-
অণুগল্প- সমর্পণ
সমর্পণ
-মানিক দাক্ষিতআমাকে নিয়ে সংসারে চরম অশান্তি। অশান্তির মূল কারণ ওর আর আমার সম্পর্ককে ঘিরে। মনে হচ্ছে সম্পর্কটাকে আর টিকিয়ে রাখা যাবে না। ইতি টানতে হবে। কিন্তু কিভাবে ইতি টানবো? ওর সাথে সম্পর্ক যে আমার বহুদিনের। ওকে ছাড়া যে আমি বাঁচতে পারবো না। উঠতে বসতে বাবার ধমক – “সামনে জয়েন্ট পরীক্ষা। ভালো চাওতো ওর সঙ্গ ছাড়ো। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোও। লক্ষ্যে পৌঁছাও।”
অনেকবার চেষ্টা করেছি ওকে ছেড়ে একা থাকার। কিন্তু পারিনি। ওর দূর্নিবার আকর্ষণ আমাকে পাগল, মাতোয়ারা করে তোলে। আমাকে নিয়ে বাবা-মায়ের গভীর প্রত্যাশা। ওরা যা হতে পারেনি, আমাকে দিয়ে সেই ইচ্ছেটাকেই পূরণ করতে চায়। মস্ত বড় ডাক্তার। আর সেটা একমাত্র সম্ভব ওর সঙ্গ ত্যাগ করে কঠোরভাবে পড়াশুনোয় মনোনিবেশে।
গতরাতে মায়ের সাথে বাবার তুমুল ঝগড়া বেধেছিল। আমাকে কেন্দ্র করেই। রাগের চোটে দেয়ালে কপাল ঠুকে মা রক্তারক্তি করেছে। রাতে জলটুকু স্পর্শ করেনি।
সকালে উঠে অপরাধীর ন্যায় মায়ের কাছে মাথা নীচু করে দাঁড়াই। আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে মা। আমার ডানহাতটাকে নিয়ে নিজের মাথায় স্পর্শ করে বলে, “ওর সঙ্গ না ছাড়লে আমার মাথার দিব্যি তুই আমার…” মুখটা চেপে ধরি মায়ের।
-ও-কথা মুখে এনো না মা। তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। কথা দিলাম। আজ থেকেই ওর সঙ্গ ছাড়বো।
জিনসের সামনের পকেট থেকে আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী স্মার্ট ফোনটা তুলে দিলাম মায়ের হাতে।
-
অণুগল্প- অমূল্য স্মৃতি
অমূল্য স্মৃতি
-অঞ্জনা গোড়িয়াসত্যিই কিছু বলার ভাষা নেই। কিছু করার ছিল না। সারাজীবন একটা আফসোস থেকে গেল। আর দেখা হলো না।
একবার আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন অথবা আমারও দেখার ইচ্ছে ছিল খুব। কিন্তু দেখা হয় নি। দেখা করতে পারি নি। বড়ো আফশোস থেকে গেল জীবনে। কেন দেখা করলাম না! কেন একবার দেখতে গেলাম না। সেই সোনা মাটির দেশে। যেখানে সুন্দর একটা স্কুল গড়েছেন। পথের মাঝে সারি সারি গাছ বসিয়েছেন। সবুজে সবুজে ভরিয়ে রেখেছেন।
সেই সুন্দর এলাকাটা আর আমার সেই প্রিয় দাদাকে আর দেখা হলো না।
শেষ বার কথা হয়েছিল যখন উনি কলকাতার টাটা হসপিটালে ভর্তি। নানান পরীক্ষা আর কেমো চলছে।
অনেক দিন থেকেই দাদার সাথে ফোনে কথা হতো। ওনার কাজকর্ম শুনে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। আমাকে একবার যেতে বলেছিলেন ওনার সুন্দর সাজানো সেই কাজরীতে। কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বড়ো আফশোস থেকে গেল।
অনেক দিন ফেসবুকে দেখতে না পেয়ে মনটা খচখচ করছিল। একদিন সকালে ফোন করেই ফেললাম। আমার সেই ফেসবুক দাদাকে। ফোনের ওপার থেকে বলে উঠলেন, আমি ওনার ছেলে বলছি। বাবা আর বেঁচে নেই। আপনি অঞ্জনাদি?
আমি বললাম, হ্যাঁ। ছেলে বললো, আপনার কথা খুব বলছিলেন বাবা। একদিন নাকি দেখতে আসবেন। বাবা আর নেই। গত সপ্তাহে মারা গেছেন।ফোনটা রেখেদিলাম। কিছু বলার ভাষা নেই। চোখদুটো আবছা হয়ে আসছে। আর দেখতে পাচ্ছি না। ভেসে উঠছে সেই হাসি হাসি মুখটা।
কেন এমন হয়? চেনা মানুষগুলো এভাবে কেন হারিয়ে যায়?ফেসবুক আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তার মধ্যে এই ভালো দাদাকে পেয়েছিলাম। আমাকে প্রথম সম্ভাষণ করেছিলেন “বোন” বলে। কী যে ভালো লেগেছিল। নম্র ভদ্র রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার মশাই।
নামটা আর নাই বা বললাম। জানি না কেন আমাকে খুব পছন্দ করেছিলেন। আমার লেখা, আমার কাজ, আমার কথা নাকি দাদার খুব ভালো লাগে। একদিন পরিচয় করে আসতে চেয়েছিলেন আমার বাড়ি কিংবা আমার স্কুল।
কিন্তু আনতে পারিনি সেই দাদাকে। লোকে ‘গাছদাদু” বলে ডাকে।
গাছ পাগল এক দাদা। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জীবনের সমস্ত টাকা ব্যয় করেছেন বীরভূমের সিউড়িতে। গাছ বাঁচাও গাছ লাগাও। সিউড়ির কাজরীতে পথে পথে গাছের সারি। আর এখানকার ছোটোদের নিয়ে মেয়েদের নিয়ে গড়ে গেছেন একটা স্কুল।
নাচ গান ক্যারাটে লেখাপড়া আরও অনেক কিছু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এখানকার মানুষের জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। প্রতিদিনই একবার করে কথা হতো। মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিলাম একদিন নিশ্চয় যাবো দেখতে। কিন্তু আর যাওয়া হয় নি।
যেখানেই থাকো দাদা, ভালো থেকো। আর এই বোনটাকে ক্ষমা করো। নিশ্চয় জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কে সেই দাদা? কী তাঁর নাম?
আমার সেই “গাছদাদু” আমার ভালো দাদার নাম উজ্জ্বল রায়। একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ওখানকার আনন্দবাজার পত্রিকায় ওনার নাম বারেবারেই প্রকাশিত হয়েছে।
প্রণাম দাদা। এভাবেই ফেসবুক অনেককেই আপন করে দেয়, আবার অনেককেই নিজের অজান্তেই হারিয়ে ফেলি। তখন কেন এত কষ্ট হয়? কেন? -
অণু গল্প- রং নম্বর
রং নম্বর
-অঞ্জনা গোড়িয়াহঠাৎ একটা অজানা নম্বর থেকে কল। ফোনটা ধরতেই সেই চেনা ডাকে বলে উঠলো, প্রিয়া ভালো আছো? চমকে উঠলো। কে এ? সেই গলা, সেই বলার ধরন? কিছু জানার আগেই বললো, রং নম্বর। ফোনটা কেটে দিলো। তবু মনের মধ্যে একটা কুচিন্তা ঘুরতে লাগলো। তবে কি সে ফিরে এসেছে! নম্বরটা পেল কি ভাবে? ভীষণ ভয় করতে লাগলো প্রিয়ার।
এ দিকে ওর শরীরটাও দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার কিছুই ধরতে পারছে না।কাজে মন লাগছে না। দিব্যি ভালোই চলছিলো সুখের সংসার। কদিনের জন্য বাইরে কাজে গিয়ে জ্বর বাঁধিয়ে বাড়ি এলো। সেই থেকে চিকিৎসা করা হচ্ছে, কোনো ভালো কিছু হচ্ছে না। চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। ঠিক তখনি বেজে উঠলো ফোনটা। সেই নম্বর থকে। ভরসা করে ধরলো, কে আপনি? বারবার ফোন করছেন? চিনতে পারছো না? নাকি অচেনার ভান করছো?
চুপ করে রইলো প্রিয়া। সেই বললো, ভয় পেও না। নম্বরটা তোমার বরই দিয়েছে। দুটো নম্বর দিয়েছিল। মনে হয় ওরটা সুইচ অফ। ফোনটা ওকে দাও। ভয়ে ভয়ে বললো প্রিয়া, “কি বলার আমাকে বলো?”
হা হা হা হেসে উঠলো। এখনো সেই ভীতুটা আছো। বিছানা থেকে বলে উঠলো স্বামী, “কার ফোন?” হাতে দিলাম ফোনটা। অট্টহাসিতে ঘরটা ভরে গেল, “কাল আসছে আমার এক বন্ধু। দেখবে তোমার ভালো লাগবে।”
জানতে চাইলাম, কে আসছে?
হাসি মুখে বললো, গাড়িতে কাল এক ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ হলো। আমাকে চেনে মনে হয়। নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। তোমাকেও চেনে।
আমার অসুখের কথা শুনে আসতে চাইছে। ঠিকানা দিয়েছিলাম সঙ্গে ফোন নম্বর। দেখি, কি বলে একবার?
ও জানেই না এই সেইজন। যাকে কথা দিয়েছিল, বিদেশ থেকে ফিরলে বিয়ে করবে প্রিয়া। কি উত্তর দেবে প্রিয়া? কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।
ও কি প্রতিশোধ নিতে আসছে? পুরানো কিছু চিঠি আজও ওর কাছে। সব কি জানিয়ে দেবে ও? ভাবতে ভাবতেই বেলটা বেজে উঠলো। শাড়িটা একটু পড়িপাটি করে পড়লো। মাথার অগোছালো চুলটা সুন্দর করে ছেনে খুলে দিল কাঁধের নীচে।
জানি না কেন একটু সাজতে ইচ্ছা করছে। এখন ও কি ওর জন্য সেই টানটা- না না এসব কি ভাবছে?
আস্তে আস্তে গেটটা খুলে দিল। চেয়ে দেখে, একজন সেবক। এ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে দাঁড়িয়ে।
কাছে এসে বললো, স্যার পাঠিয়েছেন রোগীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। স্যারের নিজস্ব হসপিটালে। ওখানেই চিকিৎসা করবেন স্যার। প্রচন্ড রোগীর চাপ। তাই আসতে পারেননি। তার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। প্রিয়া মনে মনে বললো, তুমি ঠিক আগের মতই আছো । -
অণুগল্প- প্রকৃত বন্ধু
প্রকৃত বন্ধু
–বিভূতি ভূষন বিশ্বাসলেটার বক্স খুলে দেখি কল্পনার চিঠি পোষ্ট কার্ডে লেখা,
শ্রী শ্রী ভগবান,
আমার মা খুব অসুস্থ মা’কে সুস্থ করে দিও।
ইতি তোমার বন্ধু
কল্পনা।
ঠিকানা আর কিছুই লেখা নেই, এই চিঠি আমি কাকে বিলি করি। প্রতি মাসের প্রথম দিন কল্পনার চিঠি পাই।
আগত্যা নিজের আফিসের ড্রয়ারে রেখে দিই। ড্রয়ার প্রায় ভর্তি হয়ে এসেছে। আজ তেমন কাজ নেই তাই কল্পনার চিঠিগুলি পড়তে বসেছি- একটি চিঠিতে লেখা,
“কথা দিলাম লিখবো।”কল্পনার জীবনের সুখ দুঃখের সব কথাই চিঠিতে লেখা আছে। কল্পনা ভগবানকে বন্ধু মনে করে তাতে সন্দেহ নেই। একটি চিঠি দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। চিঠিতে লেখা,
শ্রী শ্রী ভগবান,
আজ কথা রাখলাম তোমার নাম লাল কালি দিয়ে এক কোটি বার লিখলাম।
ইতি তোমার বন্ধু
কল্পনা
চিঠি পড়তেই রানাঘাট ষ্টেশনের নাম মনে পরে গেল। তড়িঘড়ি ষ্টেশনে গিয়ে দেখি সেই বৃদ্ধ মহিলা কৃষ্ণ নাম লেখায় ব্যস্ত। আমি কল্পনাদি বলে ডাক দিলাম। উনি মাথা উঁচু করে বললেন, কালের স্রোতে কল্পনা হারিয়ে গেছে বাবা। -
অণুগল্প- সাদা কালো
সাদা কালো
-সুমিতা দাশগুপ্ত“একি বুবুসোনা, তুমি এখনও কেঁদেই চলেছো? অনেকক্ষণ কেঁদেছো, নাও এবারে কান্নাকাটি থামাও।”
“কী করবো মা, আমার যে খুব কান্না পাচ্ছে। ঐ দুষ্টু লোকেরা মিলে মিছিমিছি ভালো দাদুটাকে মারলো কেন?
জানো মা,রোজ সকালে মোবাইলের ইস্কুল শেষ হয়ে গেলে,’বাই বাই ম্যাম্’ বলে আমি যখন দোতলার এই বারান্দাটায় বসে বসে রাস্তা দেখি তখনই রোজই দেখতে পাই রায়দাদুর বাচ্চা নাতিটাকে নিয়ে ওদের আয়ামাসি রাস্তা পেরিয়ে ঐ পার্কে বেড়াতে নিয়ে যায়, আর সেখানে গিয়েই বাচ্চাটাকে একা ছেড়ে দিয়ে বেঞ্চিতে বসে, অন্য আয়ামাসিদের সঙ্গে গল্প করে। বেবিটা একা একাই টলমল করে এদিকে ওদিকে হেঁটে বেড়ায়। কখনো হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েও যায়। আয়ামাসি দেখলেও ওকে তুলে দেয় না, শুধু গল্প করেই যায়। আজ ওরা যখন নিজেরা গল্প করছিল, তখন বেবিটা যে আপনমনে একা একা গেটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সেটা দেখতেই পায় নি। বেবিটা আপনমনে একা একা ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস ঐ রাস্তায় চা ফিরি করা চা’ওয়ালা দাদুটা দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলো! না হলে আর একটু হলেই রাস্তায় নেমে গেলে কী সাংঘাতিক কান্ড হতো বলো! কোথায় দাদুটাকে সবাই থ্যাঙ্ক ইউ বলবে তা না ঐ আয়ামাসিরা সবাই ছুটে এসে ওকে ছেলেধরা বলে লোকজন জুটিয়ে কতো মারলো। আমি এখান থেকে কত চেঁচালাম, বললাম ওকে মেরো না, ও ভালো লোক, কেউ শুনতেই পেল না। ভাগ্যিস ট্রাফিক পুলিশকাকুটা, দাদুটাকে চিনতে পেরে এসে বাঁচালো! জানো মা দাদুটার কপাল কেটে রক্ত পড়ছিলো। কেন মা ওরা ভালো দাদুটার সঙ্গে ঐ রকম করলো?”
” কী আর বলি বলো। আসলে নিজেদের গাফিলতি আর অন্যায়, চাপা দিতেই ওরা এমনটা করেছে। মানুষের স্বভাবটাই যে এইরকম, নিজের অপরাধের দায় সবসময় অন্যের উপরে চাপিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চায়।”
” কেন মা? নিজে দোষ করলে অন্যকে কেন শাস্তি পাওয়াবে? আমাদের ইস্কুলে তো এইরকম হয় না। বড়ো হলেই কী মানুষই এইরকম হয়ে যায়?”
“না সোনা সবাই এইরকম হবে কেন? চারপাশে দেখো না, এই দুঃসময়েও নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কত মানুষ নীরবে কত ভালো কাজ করে যাচ্ছেন।
নাও এখন মনখারাপ না করে একটা ছবি এঁকে আমাকে দেখাও তো দেখি।”
“কীসের ছবি আঁকবো?”
“যা ইচ্ছে হয়। এই তো তোমার আশেপাশেই তো কতো কিছু আছে।”
“কিন্তু মা আমার রঙপেন্সিলের বাক্সটা যে কাল রান্না মাসির ছেলেটাকে দিয়ে দিলাম।রঙ তো করা যাবে না। ”
“ঠিক আছে, সাদা কালো ছবিই আঁকো না হয়।”
চারপাশে চেয়ে বুবুর নীচের বাগানে ফোটা গন্ধরাজ ফুলগুলো মনে ধরে গেল, কিন্তু একটাই সমস্যা। সাদা কাগজে সাদা ফুল ফুটিয়ে তোলা যাবে কী করে! অতঃপর সে সাদা কাগজে গন্ধরাজ ফুল এঁকে, ফুলগুলোর চারপাশটা কালো রঙ দিয়ে ঢেকে দিচ্ছিলো, দিতেই থাকলো, যতক্ষণ না সেগুলি রাতের আকাশে তারার মতো ফুটে ওঠে। এছাড়া আর কী-ই বা সে করতে পারতো এই সাদা কালোর দুনিয়ায়! -
অণুগল্প- শেষ পাতা
শেষ পাতা
-সুনির্মল বসুকবে আছি, কবে নেই, এই কথা ভাবতে ভাবতে ভদ্রলোক জীবন কাহিনী লেখা শুরু করলেন, জীবন কথা লেখা খুব শক্ত কাজ, আসল জীবন থেকে লিখিত জীবন অন্য কথা বলে।অথচ, নিজের জীবন নিয়ে মিথ্যার বেসাতি করা ভদ্রলোকের মন পছন্দ নয়, রাত জেগে তিনি স্মৃতির বন্ধ দরজা খুলে দেন, স্মৃতির সিন্দুকে কত কষ্ট দুঃখের মণিমাণিক্য, কত চোখের জল ভৌতিক অন্ধকারে লুকিয়ে আছে, সুখ খুঁজতে গিয়ে কত অসুখের সালতামামি রয়েছে,
ভাবনার পথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি কতদূর দুরান্তরে চলে যান, কত নদী বন্দর কত আরণ্যক পৃথিবী পেরিয়ে আলোকবর্ষ অতিক্রম করে, চালচুলোহীন তিনি দিকশূন্যপুরের দিকে এগিয়ে চলেন,
স্মৃতিগুলো কিছুতেই তাঁর পিছু ছাড়ে না,
সুখের দিনগুলো একদিন স্বপ্ন দেখাতো, দুঃখের দিনগুলো আজকাল তাঁকে ঠাট্টা করে চলে, স্মৃতির সরণিতে কত উন্মনা মুখ হেঁটে যায়।
যে প্রাক্তন প্রেমিকা মুখের উপর অতীতে একদিন দরজা বন্ধ করে দিয়ে অন্য পুরুষের হাত ধরেছিল, জীবনের প্রান্তসীমায় এসে তার জন্য মনে করুণা জাগে, অথচ একদিন কত স্বপ্ন জেগেছিল জীবনের প্রথমভাগে,
মধ্যরাতে মগ্ন চৈতন্যে জেগে থেকে ভদ্রলোক জীবন লিপির খেরোর খাতা ভরিয়ে তোলেন,
যারা তাঁকে একদিন সত্যিকারের ভালোবাসা দিতে চেয়েছিল, তিনি তাদের অগ্রাহ্য করে যান, তিনি যাদের ভালোবেসে ছিলেন, তাঁরা নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নিতে এসেছিল তাঁর কাছে, কাজ গুছিয়ে পগার পার।
জীবন কাহিনীর শেষ পাতায় ভদ্রলোক লিখলেন, জীবনটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না, বহু কষ্ট করে আমি যে জীবন কাহিনী লিখে গেলাম, তার কোন প্রয়োজন ছিল না, আমার নিরর্থক জীবন ভারবাহী জন্তুর মতো, এই জীবন কাহিনী কারো পাঠযোগ্য হতে পারে না, আমার বাতিল জীবনের মতো, আমার বাতিল জীবন কাহিনী আপনারা কেউ দয়া করে পড়বেন না। -
অণুগল্প- ওরা তিন জন
ওরা তিন জন
-রুনু মন্ডলওরা তিন জন প্রৌঢ়া মহিলারা ঘন্টা খানেক আগেও কেউ কাউকে চিনতো না। এখন একেবারে গলাগলি। ওরা কে? কারা?
কোথায় থাকে? চলুন ওদের কাছে গিয়ে জানা যাক..
রমা রায়- স্বামী হারা বিধবা। সৎ ছেলে বৌমার সংসারে থাকা খাওয়া। ছেলের সামনে তবু কিছু খাবার জোটে। আড়ালে বৌমা যা খেতে দেয়, তাতে পেট ভরে না। পেটে খিদে নিয়ে রমাদির রাতে ঘুম আসে না। তার ওপর কোনো কারণে যদি কোনো অসুখ বিসুখ বাত বা জ্বর জ্বালার কথা বলে ছেলে, বৌমা এই মারে তো সেই মারে। বাঁচার ইচ্ছে কবে চলে গেছে। মনের দুঃখে কালি ঘাটে গিয়ে বসে আছেন।
সীমা সেন- স্বামী মারা যাবার পর পেনশন পান তবু শান্তি নেই। নিজের টাকা নিজে খরচ করতে পান না। বৌমা চাকরি করে। ছেলের কারখানা বন্ধ। তাই মায়ের পুরো টাকাটাই হাতিয়ে নিয়ে সংসারের পুরো কাজকর্মের ভার মায়ের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে দিব্যি আছে। উলটে পান থেকে চুন খসলেই মায়ের হেনস্থার শেষ নেই। হুকুম করা কাকে বলে সীমা সেনের ছেলে বৌমার কাছে শিখতে হয়। বাঁচতে ইচ্ছে করে না তাই।
উমা দাস- নিজে চাকরি করতেন, ডিভোর্সি। এখন পেনশন পান। রাঁধেন-বাড়েন খান, যখন না রাঁধতে ইচ্ছে করে খাবার অর্ডার করে আনান। এর অন্য ব্যাপার। একাকীত্ব। বাঁচার আনন্দ নেই।তিন জনের কাকতালীয় ভাবে একই দিনের কিছু আগে পরে কালিঘাটে চত্বরে দেখা।
সবার কথা শোনা জানার পর ওরা ঠিক করে উমা দাসের বাড়িতে ওরা থাকা শুরু করবে। যেমন কথা তেমন কাজ। আপন জনের সান্নিধ্য ছেড়ে তিন বন্ধুতে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। উমা দাস সব দায়িত্ব নিয়েছে। নতুন সংসারে তিন বন্ধুর ভালোই কাটছে। নতুন এক সুন্দর সংসার গড়ে উঠেছে। -
অণু গল্প- শিক্ষক
শিক্ষক
-সুমিতা দাশগুপ্ত-মা জানো, কাল তো শিক্ষক দিবস। আমাদের ম্যামদের জন্য কী চমৎকার সব গিফট কেনা হয়েছে, উঁচু ক্লাসের দিদিরা সব গিফট সুন্দর করে প্যাকও করে ফেলেছে।কাল দেওয়া হবে। সব রেডি।
-আমার গিফটও রেডি।
-তোমার গিফট? কার জন্য মা? তোমার ম্যামের? কোথায় থাকেন তিনি? কোথায় খুঁজে পেলে তাঁকে?
-এইখানেই, শুধু চোখ মেলে দেখি নি এতোদিন।
-কে মা?
-কমলামাসি। এই যে এতো রেলিশ করে কাঁকড়ার ঝাল আর তালক্ষীর খাও, সব তো ওঁর কাছেই শেখা। আগে এইধরনের রান্না কোনও দিন বানানো দূরে থাক চেখেও দেখি নি।
-ও, কিন্তু তাই বলে উনি তোমার টিচার!
-অবশ্যই। হাতে ধরে স্টেপ বাই স্টেপ তো উনিই আমাকে শিখিয়েছেন।
মনে রেখো, জীবনে যখনই কারো কাছে কিছু শিখবে, তিনিই তোমার শিক্ষক, তাঁর সামাজিক অবস্থান যেমনই হোক না কেন, তিনি তোমার গুরু। -
অণু গল্প- ট্রাডিশন যখন যেমন
ট্রাডিশন যখন যেমন
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়সকাল সাতটা। মেঝেতে বাবু হয়ে বসে, জানালার গরাদেতে হাত আয়না ঠেসান দিয়ে দাঁড় করিয়ে, গালে সাবান ঘষে ব্লেড লাগানো রেজার দিয়ে দাড়ি কামান নন্দুবাবু। তারপর বাজার।
সকাল আটটায় রান্নাঘরের সামনে ধরাস করে ফুট দেড়েক সাইজের কাৎলা কিংবা রুই ফেলে দিয়ে কলতলায় চলে যান চান সেরে নিতে।
ইতিমধ্যে স্ত্রী কমলা, সেই মাছের ঝোল আর ভাত, তরকারি, ভাজা ইত্যাদি রান্না করে, অপেক্ষায় আছেন।
কত্তা চান সেরে দেওয়ালে টাঙানো যাবতীয় ঠাকুর দেবতাদের প্রণাম ঠুকেই খেতে বসবেন। আপিস আছে। ভীষণ চাপ। ট্রামের মান্থলি টিকিট করা আছে। বাদুড়ঝোলা নিত্যকার জীবনের যন্ত্রণা।সন্ধ্যে ছটা। নন্দুবাবু। বাড়ি ফিরে, কলতলায় হাতমুখ ধুয়ে ধুতি পড়ে চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়বেন। স্ত্রী কমলা একটু মুড়ি চানাচুর, কিংবা দুটো গরম রুটি একটু হালুয়া, সঙ্গে এককাপ চা। কত্তার টিফিন। সন্ধ্যে সাতটায় রেডিওতে বাংলা সংবাদ। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন পল্লীমঙ্গল অনুষ্ঠান চলছে। কত্তার কান, চোখ, মুখ সব একসঙ্গে চলছে।
গিন্নির ফুরসৎ নেই। রাতের খাবার বানাতে হবে। ছেলে মেয়েরা পড়ছে। শাশুড়ির জ্বর এসেছে। রাতে কত্তা ঘুমিয়ে না পড়লে, বলতে হবে, শ্বশুরের কাশির ওষুধটা ফুরিয়ে গেছে। ইলেকট্রিক বিল জমা দেবার কালই শেষ তারিখ।
সেদিন গিয়েছে কালের অতলে। এখন, নন্দুবাবুর উত্তরাধিকারী মিঃ কুন্তল ব্যানার্জি। অটো সেভারে মসৃণ করে দাড়ি কামিয়ে, সেলফোন তুলে বাপিকে মাছের অর্ডার দিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। ফ্রিজে রাখা মাছ সব্জি ইত্যাদি বের করে নিয়ে গিয়েছে মানুদি। রান্না করার লোক।
মিসেস ব্যানার্জি এখনো শুয়ে আছেন। গতকালের নাইট পার্টির ধকল। হ্যাংওভার।
ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে, ওয়াড্রব থেকে স্যুট বের করে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বেঁধে নিয়ে চলে এলো ডাইনিং টেবিলে। ব্রেকফাস্ট সাজানো আছে। ঝটপট খেয়ে সোজা ড্রাইভিং সিট। হর্ন দিয়ে চলে গেল। তাড়া আছে। আজকের ডিরেক্টরস মিটিংটা খুবই ইম্পর্ট্যান্ট।রাত নটা। দু’ পেগ হুইস্কির সাথে চিকেন পকোড়া কিংবা হ্যাম স্যান্ডউইচ। টিভিতে নিউজ বুলেটিন। মিসেস ব্যানার্জির পলিটিক্যাল মিটিং আছে। মানুদি খবরটা জানিয়ে দিয়ে, আজকের মতো চলে গেল।ওর ডিউটি আবার কাল শুরু হবে।
পেরেন্টসের দায়িত্ব যথাযথ মর্যাদায় দেওয়া আছে ওল্ডএজ হোমে। ছেলে দেরাদুন স্কুলে। উইন্টার ভ্যাকেশনে আপার্টমেন্টে আসে কিছু দিনের জন্য।
সব ব্যবস্থা এবশোলিউটলি ও কে। নো প্রবলেম। শুধু একাকীত্ব বোধ মাঝেমধ্যে,
নইলে নাথিং, নো প্রবলেম, নো.. -
অণুগল্প- এই মেঘ, এই রোদ্দুর
এই মেঘ, এই রোদ্দুর
-সুনির্মল বসুতিনি এইসবে ক্লাস টুয়েলভে নাটক পড়িয়ে এলেন, সবে এসে স্টাফ রুমে বসেছেন, তখন ছাত্রটি এলো,
আমাকে বাংলা পড়াবেন, স্যার?
-কোথায় বাড়ি?
-পাশেই আদর্শ পল্লী,
-ছুটির পর নিয়ে যেয়ো।
এই স্কুলে শুধু নয়, এই অঞ্চলে শিক্ষক হিসেবে অবিনাশবাবুর খুব নামডাক।একসময় তিনি এখানকারই ছাত্র ছিলেন। ভালো পড়ান, ভালো বলেন, ভালো লেখেন। কাগজে লেখা ছাপা হয়।
ছুটির পর তিনি দেখলেন, সেই ছাত্রটি বাইরে তার জন্য অপেক্ষায়। তিনি পড়ান অনেক, তবু, আরো পড়াতে চান। ভেবেছেন, সাহিত্যটাকে ভালোবাসতে শেখাবেন সবাইকে।
ও বাড়িতে যেতেই, ছাত্রের মা এগিয়ে এলেন,
আসুন স্যার, আপনার নাম শুনি খুব, আপনি পড়ালে, নিশ্চিন্ত হতে পারি। কাগজে আপনার লেখা পড়েছি,
অবিনাশবাবু কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারছেন না, তিনি ভদ্রমহিলার দিকে তাকাতে পারছেন না।
-আপনার জন্য চা আনছি। তিনি রান্নাঘরে গেলেন।
অবিনাশবাবু ততক্ষণে অতীতে ফিরে গেছেন। বর্ষা কাল। প্রবল বৃষ্টিতে জল থৈ থৈ। পাশের গার্লস স্কুলের মেয়েরা নীল শাড়ি পরে স্কুলে যাচ্ছিল। সমীর বললো, জল ছেটাতে পারবি?
অতি উৎসাহে সেদিনের ক্লাস টেনের অবিনাশ জল ছিটিয়েছিল, যা একটি মেয়ের শাড়িতে লেগে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি স্কুলের হেড মাষ্টারের ঘরে।
অসিত চ্যাটার্জী কড়া মানুষ। এক সপ্তাহ সাসপেন্ড,গারজিয়ান কল।
আজ এত বছর বাদে, সেখানেই পড়াতে আসা।
তিনি চা মিষ্টি দিলেন, তাঁর কবিতা ভদ্রমহিলা নিয়মিত পড়েন, ভালো লাগে, জানালেন।
অবিনাশবাবুর মনে হলো, অতীতের ছোট ছোট চুল কাটা অবিনাশের সঙ্গে উনি বর্তমানের অবিনাশকে মেলাতে পারেন নি। তিনি শিক্ষক অবিনাশে মুগ্ধ।
সুমিতকে পড়াচ্ছেন মাস তিনেক হলো।
পড়ার পর কবিতা নিয়ে কথা হয়, ভদ্রমহিলা সুনীল গাঙ্গুলীর কবিতার ভক্ত। বুদ্ধদেব গুহ তাঁর প্রিয় লেখক।
বেশ আলাপী, পড়াশুনা আছে ওনার। অবিনাশবাবু রোজ ভাবেন, আজই বলবেন, বলা হয়না।
অবশেষে একদিন বলেই ফেললেন, জানেন, আপনার জন্য আমি একদিন হেডস্যারের কাছে শাস্তি পেয়েছিলাম।
-কি ব্যাপার বলুন তো? ভদ্রমহিলা বেমালুম ভুলে গেছেন, অথচ, অবিনাশ বাবু এতটুকু ভোলেন নি।
অবিনাশবাবু ঘটনাটা বললেন, ভদ্রমহিলা হো হো করে হেসে উঠলেন।
সেদিন ওভাবে পাগলের মতো আপনাদের স্কুলে গিয়ে হেড স্যারের কাছে নালিশ করাটা আমার একেবারেই উচিত হয় নি। সত্যি কি ছেলেমানুষ ছিলাম, তখন আমরা।
যাক, এতদিনের জমে থাকা মেঘ সরে গেছে, আকাশে এত আলো, এত রোদ্দুর।
সুমিতকে ভালো করে সাহিত্য পড়াতে হবে, সাহিত্যকে ছড়িয়ে দিতে হবে, সবার মধ্যে, অবিনাশ বাবু ভাবলেন। আর কোনো উদ্বেগ নেই, খোলা আকাশ আর আলোর নীচে অবিনাশবাবু হেঁটে চললেন।
ভদ্রমহিলার কথা কানে বাজছিল,
সত্যি কি ছেলেমানুষ ছিলাম তখন আমরা।