• রম্য রচনা

    বাড়ি, ভাড়ার জন্য

    বাড়ি, ভাড়ার জন্য
    -অনিন্দ্য ভুক্ত

     

     

    এরে যে কেন স্ত্রীধন কয় তা আজো বুঝে উঠতে পারলেন না রামচন্দ্রবাবু।
    অবিশ্যি ধনসম্পত্তি ব্যাপারটাই এমন গোলমেলে। সেদিন নিবারণ বলছিল, ইংরেজিতে ক্রেডিট বলে একটা শব্দ আছে, তাতে নাকি দেনাও বোঝায়, পাওনাও বোঝায়। মানে ধনসম্পত্তি যোগ হলেও ক্রেডিট, বিয়োগ হলেও ক্রেডিট। সামলাও ঠেলা।

    এমন ঠেলা অবশ্য ইতিপূর্বে একবার জোর সামলে ছিলেন। সেটা ছিল পৈতৃক সম্পত্তির ঠেলা। সম্পত্তি নিয়ে যে এমন ঠেলাঠেলি হতে পারে পিতৃদেবের মৃত্যুর আগে তা টের পাননি। সে একবারে জোর ধাক্কা। ইকনমিক্সের ভাষায় ‘বিগ পুশ’।

    স্বর্গীয় দশরথ আলুর একদা আরেক বিগ পুশে তাঁকে ইকোনমিক্সটাও পড়তে হয়েছিল কিনা! তখনই বুঝেছিলেন এটা একটা সাবজেক্টের মতো সাবজেক্ট বটে। নাম শুনলেই লোকে বেশ ভক্তি ছেরাদ্দ করে। তো ধনসম্পত্তির কথা সেখানেই পড়েছিলেন। ব্যাপারটা অতএব গোলমেলে না হয়ে যায় কোথা।

    অবিশ্যি এতো পড়েও তাঁর লাভ বিশেষ হয়নি, কেবল এই ব্যাঙ্কের কেরানিগিরির চাকরিটুকু ছাড়া। নইলে স্ত্রীধন শব্দটা শুনেই তাঁর টের পাওয়া উচিত ছিল, স্ত্রী নামক বস্তুটি কেমন ভয়ঙ্কর হতে পারে। ইকনমিক্স তো ততদিনে পড়া হয়ে গেছে।

    কিন্তু টের পাবেন কি করে? পাত্রী দেখতে গিয়ে পাত্রীর একটা মুগ্ধ চোরাচাউনিতে ঘায়েল হয়ে তখন তো তিনি ছাঁদনাতলার দিকে ন্যাংচাতে শুরু করেছেন। অবিশ্যি ধন শব্দটার তো এখানেই মাহাত্ম্য। প্রথমে খেলিয়ে খেলিয়ে কাছে টানে, তারপর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পঞ্চানন বানিয়ে ছাড়ে।

    বহুক্ষণ হাঁটছেন। হাতের কাছে একটা বাড়ির রোয়াক পেয়ে ধপ করে বসে পড়লেন রামচন্দ্রবাবু। এই উত্তর কলকাতার পুরোনো বাড়িগুলো যতোদিন টিঁকে আছে, বাড়ীর রোয়াকও ততদিন টিঁকে থাকবে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ছ‍্যাকায় পৃথিবী ঝলসে যাবার আগেই কি রোয়াক সব উঠে যাবে? মনে মনে পুরোনো দিনের মানুষগুলোর বুদ্ধির তারিফ করলেন। তখনও তো এসব গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের গল্প কেউ শোনেনি। অথচ ঠিক যেন আজকের দিনটার কথা ভেবেই বউয়ে খ্যাদানো রামচন্দ্রবাবুদের কথা ভেবেই রোয়াকগুলো বানিয়েছিল সব।

    বাপস রে কি গরমখানাই পড়েছে আজ! রামচন্দ্র আলু যে রামচন্দ্র আলু, গরমে যাঁকে কেউ কখনো কাবু হতে দেখেনি, তাঁর পর্যন্ত আজ গেঞ্জী নিঙরোলে কমসে কম হাফ লিটার ঘাম বেরিয়ে যাবে। এসব নাকি গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফল।

    শব্দটা সদ্য শিখছেন রামচন্দ্রবাবু। না শিখে উপায় আছে! গরম পড়া ইস্তক কাগজওলারা তো শুধু এই এক বুলিই কপচে যাচ্ছে। অফিসের ছোকরা ছেলেগুলো পর্যন্ত একদিন একটা সেমিনার করে ফেললো। এদের ব্যাপার স্যাপার দেখে বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বাবা তাঁর সম্বন্ধে একটা শব্দ প্রায়ই ব্যবহার করতেন। উল্লুক। তার মানে কি, তখন বুঝতেন না। শুধু বুঝতেন সেটা একটা জন্তু বিশেষ। কেমন সে জন্তু আজো জানেন না, তবে ইদানিং তাঁর সব দু’পেয়েকেই উল্লুক বলে ঠাহর হচ্ছে। এক্ষুণি আলিপুর ঝড়বৃষ্টি আপিস একটা বৃষ্টির নিদান হাঁকুক, এসব সেমিনার-টেমিনার ঝটপট সব গুটিয়ে নেবে, ঠিক যেমন ফুটপাতের হকাররা পুলিশ দেখলে করে।

    ফুটপাতের হকারের কথা মাথায় আসতেই নিজেকে তাদেরই একজন মনে হলো। সবে রোববারের সকালের বাজারটা সেরে, টিফিন খেয়ে, ফ্যানের তলায় কাগজটা নিয়ে বসেছিলেন, প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে ফুটপাতে নামিয়ে দিল!

    আজকাল রত্নাকে দেখলেই তাঁর কেমন ভয় ভয় করে। আজ‌ও যখন মেঝেয় ছড়ানো কাগজটার উপর দশাসই একটা ছায়া এসে পড়েছিল, বুকটা কেঁপে উঠেছিল। মুখ তুলে দেখেছিলেন ভদ্রমহিলার মুখে যেন বর্ষার মতো মেঘ এসে ভিড় করেছে। এই একটা ব্যাপারে রত্না যেন আরো পটু হয়ে উঠেছে। আগে তন্বী যুবতীর শরীরের খাঁজে খাঁজে ইঙ্গিত খেলা করতো। এখন পৃথুলা রমনীর মাংসের তালগুলো ইঙ্গিত পরিবহনে অক্ষম হয়ে পড়ায় মুখখানাই শেষ অস্ত্র হয়ে উঠেছে।

    রামচন্দ্রবাবু তখনই প্রমাদ গুনেছিলেন। ধপ করে বরের পাশে বসে পড়ে বর্বরের মতো তার গলা জড়িয়ে নিজের অপমানিত হওয়ার গল্প শুনিয়েছিল রত্না। বাড়িউলি তাকে নাকি যৎপরোনাস্তি অপমান করেছে। তার কোনো দোষ নেই। ছাদে বাড়িউলির তারটা ফাঁকা ছিল বলে সে নাকি কেবল একটাই লুঙ্গি রোদে দিয়েছিল।

    বাকি গল্পটা রামচন্দ্রবাবুর মোটামুটি জানা ছিল। ফি বছরই তাঁকে এটা শুনতে হয় কিনা! প্রথমে গল্পটা বলতে বলতে ফোঁসফাঁস, তারপর তিনি বোঝানোর চেষ্টা করলে বজ্রহুঙ্কার, আর শেষে রাজী না হলে অনশন ধর্মঘট। ছকটা চেনা হয়ে গেছে বলে আজকাল আর প্রথম ধাপের পর এগোতে চান না। কিন্তু আজ এই গরমের ভয়ে একটু কুঁইকাঁই করেছিলেন। ব্যস, ঝট করে নাটক দ্বিতীয় অংকে পৌঁছে গেল। গত এক বছরে তিনি যে আরেকটু পুরোনো হয়ে গেছেন, খেয়াল ছিল না রামচন্দ্রবাবুর। হুঙ্কার সহযোগে এবারে একেবারে মেঝে থেকে গেঞ্জী ধরে টেনে তুললো!

    সেই থেকে ঘুরছেন। আজকাল বাড়িভাড়া পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা নাকি? এক তো খালি বাড়ি পাওয়া যায় না, তারপর যদি বা পাওয়া গেল, শুরু হবে প্রশ্নমালা। কি পরিচয়, রাবণের গুষ্টি নাকি টোনাটুনি, কেন পাল্টাচ্ছেন বাড়ি? এই শেষ প্রশ্নটা এলেই সিঁটকে যান রামচন্দ্রবাবু। দিনকে দিন যা নাম করে ফেলছে রত্না, এবার গোটা কোলকাতা শহরে বাড়ি মিললে হয়!

    গরমের ঝোঁকটা একটু কাটলেও, উঠতে আর ইচ্ছে করছিল না। বসে বসে শেষ প্রশ্নের উত্তরটা মকসো করছিলেন। এমন সময়ই চোখ গেল দড়িতে ঝোলানো কাগজের বোর্ডটার দিকে, ‘টু লেট’। যে বাড়ির রোয়াকে বসে আছেন, তার ঠিক উল্টো দিকের বাড়িতে। আরে, এতোক্ষণ চোখে পড়েনি! গরমে কি চোখে সর্ষে ফুল দেখছিলেন নাকি?

    তড়াক করে উঠে গিয়ে দরজার কড়া নাড়লেন।
    ‘কে-এ-এ’ বলে যিনি এসে দরজা খুললেন তাঁকে দেখেই রত্নার কথা মনে পড়ে গেল।
    – কি চাই?
    – আজ্ঞে, ভাড়া।
    –ভাড়া! বাড়ি তো ভাড়া হয়ে গেছে হপ্তাখানেক হলো।
    গরমটা যে এখনো শরীর থেকে নামেনি সেটা টের পেলেন রামচন্দ্রবাবু। ঝট করে দরজার বাইরে গিয়ে ঝোলানো বোর্ডটা টেনে এনে ভদ্রমহিলার চোখের সামনে রীতিমতো নাচাতে শুরু করে দিলেন,
    – তাহলে এটা কি, বলি তাহলে এটা কি?
    – য়্যাঁ!
    ধপ করে বসে পড়লেন ভদ্রমহিলা। বসেই চীৎকার ছাড়লেন, ‘ঝিল্লি-ই-ই’।
    ঝিল্লি বোধহয় পাশের ঘরেই ছিল। হয়তো কথাবার্তা শুনেও থাকবে। সে যখন ঘরে ঢুকলো, ভদ্রমহিলাকে বাগে পাওয়া গেছে ভেবে রামচন্দ্রবাবু তখন‌ও প্রবল পরাক্রমে বোর্ডটা নেড়ে যাচ্ছেন।
    – এটা কি, এটার মানে তাহলে কি?
    ঘরে ঢুকে পরিস্থিতি বুঝতে ঝিল্লি ঠিক দশ সেকেন্ড সময় নিল। তারপর ঝিলিক করে বোর্ডটা রামচন্দ্রবাবুর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে সেটা উল্টো করে ধরে, ভেংচি কেটে বললো,
    –এটার মানে ‘টু লেট নয় স্যার, এটার মানে ‘টু-উ-উ লেট’। আপনি বড্ডো দেরী করে ফেলেছেন।
    রামচন্দ্রবাবুর মনে হলো রত্না আবার তাঁর গেঞ্জী ধরে খ্যাঁচকা টান মারলো।

  • গল্প

    সেই বাসটা

    সেই বাসটা

    – অনিন্দ্য ভুক্ত

    বাসটাকে ভালো করে চোখে পড়েনি সুকুমারের। অথচ এই রুটে তার ভালোই যাতায়াত।কাজেকম্মে কলকাতায় আসতে হলে , বলতে গেলে প্রায় ফি হপ্তাতেই যেটা করতে হয়, রাতটা অশোকের বাড়ি কাটিয়ে যায়। কাজের বড়ো সুবিধা হয় তাতে। অনেক রাত অবধি কলকাতার কাজগুলো সারতে পারে। তারপর টুক করে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা নাগাদ ঢুকে পড়ে অশোকের বাড়ীতে। আগে থেকে বলাই থাকে। তাই অশোকের বৌ রান্না করে, বিছানা পেতে রাখে। খেয়েদেয়ে, দুই বন্ধুতে খানিকক্ষণ আড্ডা মেরে একবার. মশারির মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলেই হলো।

    সমস্যাটা হয় সকালে, বাড়ী ফেরার সময়। সেকেন্ড হুগলী ব্রীজ থেকে যে রাস্তাটা সিধে নেমে এসে সাঁতরাগাছি স্টেশনে ঢুকেছে, কোণা এক্সপ্রেস হয়ে , সেই রাস্তাতেই বাসটা ধরতে হয় ওকে। আগে এই সময়টায় বেশ কিছু বাস ছিল। এখন তার বেশীর ভাগই হয় বন্ধ, নৈলে রোজ চলে না, এমনকি কবে চলবে আর কবে নয়, তার কোনো ঠিক ঠিকানা থাকে না। সরকার বাসভাড়া বাড়াচ্ছে না বলে বাস মালিকেরা বাস তুলে নিচ্ছে। মধ্যিখান থেকে ভোগান্তিটা পোহাতে হচ্ছে প্যাসেঞ্জারদের। ঠিক যেন সেই ,রাজায়-রাজায় যুদ্ধ হয উলুখাগড়ার প্রাণ যায়, সেই গল্প।

    বাসের সময় অসময় বলে কিছু নেই বলে নিজে হাতে বাড়তি সময় নিয়ে বেড়িয়েছিল সুকুমার। কাল বাবাকে ডাক্তার-টাক্তার দেখিয়ে মেজকাকার সঙ্গে দেশের বাড়ীতে পাঠিয়ে কাজ সারতে শুরু করেছিল। অশোকের বাড়ী ঢুকতে যথারীতি রাত এগারোটা। কথা আছে আজ সকালে বাবা চন্ডীতলা চলে আসবে, সেখান থেকে দু’জনে একসঙ্গে বাড়ী ফিরবে। বাবাকে টাইম দেওয়া আছে আটটা। সরাসরি বাস পেলে এখান থেকে চন্ডীতলা আধ ঘন্টার রাস্তা।সেটা পাবে না ধরে নিয়েই ছ’টার সময় স্ট্যান্ডে হাজির হয়ে গিয়েছিল।

    তারপর থেকে হা-পিত্যেশ।ঝাড়া আধঘন্টা অপেক্ষার পরও যখন কোন বাস এলো না, তখন আর ওয়েট করার ভরসা পেল না। এখান থেকে শলপ মিনিট পনেরো। সেখানে কিছু না পেলে পদব্রজে কোণা চৌমাথা। মানে আরো প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট। সেখান থেকে বাসে চন্ডীতলা আধঘন্টা। অতঃপর শলপ যাবার প্রথম যে বাসটা আসবে সেটাতেই উঠবে ঠিক করে নিয়েই হাতটা তুলেছিল,বাসটাও ঠিক তার পায়ের সামনে এসে দাঁড়ায়,যে বাসের ও এখন সওয়ারী।

    বাসটা যাবে জঙ্গীপাড়া। শলপ থেকে বাঁদিকে ঘুরে যায়। শলপে নামবে ভেবেই বাসটায় উঠেছিল সুকুমার। বাসে উঠে কি মনে হলো, কন্ডাক্টরকে জিজ্ঞাসা করলো,’চন্ডীতলা যাবে?’ ওকে অবাক করে অম্লান বদনে ঘাড় নেড়ে দিলো কন্ডাক্টর,’যাবে।’

    জঙ্গীপাড়া যাবার বিকল্প রাস্তা আছে একটা চন্ডীতলা দিয়ে। মনে একটা চোরা আশা নিয়েই তাই প্রশ্নটা করেছিল। তার যে এমন উত্তর পাবে ভাবেনি সুকুমার। উত্তর শুনে হাতে যেন চাঁদ পেল। তাড়াতাড়ি একটা জানলার ধার দখল করে বসে পড়ল।

    তাড়াহুড়ো করার অবশ্য বিশেষ দরকার ছিল না। গোটা বাসটা প্রায় ফাঁকা। সাকুল্যে পাঁচ-ছ’ জন হবে যাত্রী।সবাই এক একটা জানলার ধার দখল করে বসে পড়েছে। ব্যতিক্রম বলতে একজন। ভদ্রলোক কন্ডাক্টরের পাশে বসে জমিয়ে আড্ডা মারছেন।

    এখন শ্রাবণের শেষ। কাল রাত্রে প্রায় সারারাত ঝেঁপে বৃষ্টি হয়েছে। বাতাস তাই বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা,মনোরম। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেলেও এখনো রোদ ওঠেনি। আচমকাই একটা মেজাজ এসে গেল সুকুমারের। জমিদারী মেজাজ। যেন নিজের গাড়ী বের করে সকালে হাওয়া খেতে বেরিয়েছে। “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে….”।
    আচমকা হেঁড়ে গলায় সাত সকালে জ্যোৎস্না রাতের গান শুনে চমকে সবাই তার দিকে তাকালো। সুকুমার তখন চোখ বুঁজে গানের ভেলায় প্রমোদ ভ্রমণ করছে। গান শেষ হতে চোখ খুলে সুকুমার দেখলো তার পাশে স্বয়ং কন্ডাক্টর সাহেব বসে আছেন। “বাহ্ দাদা ভারী মিষ্টি গলা তো আপনার। কোথায় থাকা হয় তাহলে দাদার?”

    “চাঁপাডাঙ্গা”। একটু গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল সুকুমার। বাড়ীতে একটু গলা খুললেই বৌ বলে, “ওই শুরু হলো ষাঁড়ের বাজনা;কানের পোকা সামলাও এবার।” সেই গান শুনে কেউ উঠে এসে অভিনন্দন জানালে একটা কেউকেটা ভাব আপনিই চলে আসে।

    কন্ডাক্টর অবশ্য সুকুমারের গাম্ভীর্যকে বিশেষ পাত্তা দিল না। উল্টে খোসগল্প জুড়ে দিল তার সঙ্গে। লোকটা গপ্পোবাজ, বোঝাই যাচ্ছে। সুকুমারের জমিদারী মেজাজ যাচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিলো বেরিয়ে ফিরে সে বাড়ির বৈঠকখানায় আড্ডা জুড়েছে। আড্ডা মারতে মারতেই সে জেনে নিল ভায়া চন্ডীতলা জঙ্গীপাড়া যাবার বাস এই একটিই। দিনে দু’টো ট্রিপ। সকাল সাড়ে ছ’টায় একবার, বিকেল সাড়ে পাঁচটায় একবার।

    গল্প করতে করতেই বাস চন্ডীতলায় হাজির। স্টপেজ টপকে ঠিক যেখানে প্রয়োজন সুকুমারের, সেখানেই তাকে নামিয়ে দিল। বাস থেকে নেমে কৃতজ্ঞতাবশত কন্ডাক্টরের দিকে হাত নাড়তে গিয়ে সুকুমারের মনে হল তাকে নামিয়ে দিয়ে বাসটা যেন অনাবশ্যক দ্রুত গতিতে চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেল। কেমন যেন একটা খটকা লাগলো। তারপরই মনে পড়লো, এই রে বাসের ভাড়াটাই তো দেওয়া হয়নি! কিন্তু তার না হয় ভুল হলো, কন্ডাক্টর সাহেবও তো একবারও ভাড়া চাইলেন না! ভাবতে ভাবতেই মনে হলো,আচ্ছা বাসটা কি মাঝে কোথাও থেমেছিল? লোকজন কি কিছু ওঠানামা করেছিল?

    সুকুমারের ভাবনাগুলো কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। তবে পুরো জট পাকানোর আগেই একটা নীল রঙের মারুতি ভ্যান হর্ণ দিয়ে ক্যাঁচ করে ব্রেক কষে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। বাবা চলে এসেছে, বিনয়ের ভ্যান গাড়ীতে। দেশ থেকে ফেরার সময় বিনয়ের এই ঝরঝরে গাড়িটাই প্রতিবার ভাড়া করা চাই বাবার।

    বন্ধু হলেও অশোকের সঙ্গে একটা আত্মীয়তাও আছে সুকুমারের। আত্মীয়তা অবশ্য পোস্ট- ম্যারিটাল, মানে বিয়ের পর গড়ে উঠেছে। দুই বন্ধুতে দুই বোনকে বিয়ে করেছিলো। মীনা অশোকের বৌ, ঝুমা সুকুমারের। ছেলে মেয়ে বৌকে নিয়েও তাই মাঝে মাঝেই অশোকের বাড়ী যায় সুকুমার। আর ফেরার সময় এখন প্রতিবারই এক ঝামেলা। বাসের টাইম ধরে বাসস্ট্যান্ডে এসেও বেশির ভাগ দিনই বাস মেলে না। দূরপাল্লার বাস সব, কোনদিন যে কোনটা বসে যাচ্ছে।

    যাক এবারে অন্তত নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সুকুমার। বাস নিয়ে ঝামেলাটা মিটলো। ছোটো রুটে চলে এই বাসটা। রেগুলার পাওয়া যাবে। একবার চন্ডীতলা পর্যন্ত চলে আসতে পারলে বাসের ভাবনাটা আর থাকবে না।

    বাড়ী ফিরেই তাই বাসের গল্পটা ঝুমাকে করেছিল। এই রুটটা আসলে ঝুমারই আবিষ্কার। নৈলে বৌ-বোঁচকা নিয়ে আগে তারকেশ্বর পর্যন্ত ট্রেনেই ফিরতো। তাতে সময়টা লেগে যেত বেশী। আর ঝুমাকে গল্প বলতেই সে বায়না ধরেছিল,”চলো একবার ঘুরে আসি, অনেকদিন যাইনি।”

    রাজী হয়ে গেল সুকুমার। রবি-সোম দু’ দিন মেয়ের টিউশন পড়তে যাওয়া থাকে না। রবিবারের ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই তাই বেরিয়ে পড়েছিল।
    আজ মঙ্গলবার । বিকেলে মেয়ের টিউশন আছে। তাছাড়া সকালে ফিরতে পারলে দোকানটাও বন্ধ যায় না। ভোরবেলা থেকে বৌকে তাড়া মেরে বেরোতে বেরোতে ছ’টা। তা হোক, মনে মনে হিসেব করে নিয়েছে অশোক, সাড়ে ছ’টার জঙ্গীপাড়া ধরে চন্ডীতলা, সেখান থেকে হয় কোনো এক্সপ্রেস, না পেলে ছাব্বিশ নম্বর ধরে চাঁপাডাঙ্গা।

    কিন্তু কোথায় সেই বাস? ঘড়ির কাঁটা ছ’টা বত্রিশ পেরোতেই উদ্বিগ্ন হতে শুরু করলো সুকুমার। এক্ষুনি ছোট ছেলে বায়না ধরলো বলে। ও বাসে যেতে চায় না। গত কয়েক বার বাসের গন্ডগোল হয়েছিল বলে এবারে আরো বেঁকে বসেছিল। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে এনেছে। ছ’টা পঁয়ত্রিশ হতেই ঝুমা কনুইয়ের গুঁতো মারলো,”কই গো?”

    সুকুমারের মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল।স্পষ্ট মনে পড়ছিলো সেদিন বাসটা কোথাও দাঁড়ায়নি, কোথাও কোনো প্যাসেঞ্জার ওঠানামা করেনি, কন্ডাক্টর কারো টিকিট কাটেনি। শুধু সুকুমারকে চরম বিপদ থেকে উদ্ধার করে, গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে রকেটের গতিতে চোখের সামনে থেকে ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল।

  • রম্য রচনা

    বেগুনের গুণ

    বেগুনের গুণ
    – অনিন্দ্য ভুক্ত

     

     

    সুজাতা হাঁ হাঁ করে ওঠার আগেই রমাপদ ধপ করে বসে পড়েছেন। তাও কিনা পোকা বেগুনের কারণে! একদিন বাজার করতে এসে সুজাতার যা চোখে পড়ে গেল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই, নিত্য বাজারে অভ্যস্ত মানুষটাকে তার জন্য বসে পড়তে হলো! রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন সুজাতা। কি কুক্ষণেই না ইচ্ছে হয়েছিল আজ একসঙ্গে বাজার করতে আসার। একসঙ্গে আসবেন বলে ট্রাঙ্ক খুলে পাটভাঙ্গা ধুতি পাঞ্জাবী বের করে ছিলেন, আর তাই পরেই কিনা..এই প্যাচপ্যাচে জলকাদার মধ্যে! এই পোকাধরা বেগুনের ঝাঁকির সামনে! রোজ বাজার থেকে ফেরার পর পাঞ্জাবীর পেছন দিকটায় কাদার ছিঁটে কোত্থেকে আসে, সে রহস্য সুজাতার কাছে আস্তে আস্তে পরিস্কার হচ্ছিল। যত পরিস্কার হচ্ছিল, তত ক্রোধ বাড়ছিলো তার। বাড়তে বাড়তে… দুই পাটি দাঁত তাঁর সশব্দে কড়মড় করে উঠলো।
    চমকে উঠে পাল্লা হেলিয়ে ফেলল নিবারণ। রমাপদর সযত্নে বাছাই করা বেগুনগুলো গড়িয়ে পড়ে মিশে গেল ঝাঁকির বেগুনের মধ্যে। দু’হাত দিয়ে সেই পতন আটকাতে গিয়ে উবু হয়ে বসা রমাপদ কাত হয়ে উল্টে গেলেন কাদার মধ্যে।
    তুলে ধরবেন কি, বিস্মিত সুজাতা হতভম্বের মতো যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনই রইলেন,আর তার প্রৌঢ় স্বামী পাটভাঙা ধুতি -পাঞ্জাবী পরে বাজারের কাদার মধ্যে লুটোপাটি খেতে লাগলেন।

    অন্যদিনের চেয়ে দৃশ্যটা আজ একটু অন্যরকম হলো। অন্যদিন বাইরে বেরোলে রমাপদ যান আগে আগে।টান টান শরীর,দৃপ্ত পদক্ষেপ। পেছন পেছন সুজাতা। একটু শ্লথগতি। হাঁটার ভঙ্গীতে একটু থপথপে ভাব। এই নিয়ে প্রতিবারই অনুযোগ করেন সুজাতা, ‘কি সবসময় ঘোড়ার মতো লাফাও?’ স্ত্রীর মনোগত ইচ্ছা রমাপদ জানেন। তাই গতি মন্থর করেন। চেষ্টা করেন পায়ে পা মিলিয়ে চলতে। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই ফিরে আসে অভ্যাস, স্মৃতি যায় বিস্মরণে। আবার সামনে রমাপদ, পিছনে সুজাতা। সুজাতার ভ্রু কুঁচকে ওঠে। অগ্ৰগামী রমাপদর চোখে পড়ে না সে দৃশ্য। আজ পরিস্থিতি একেবারে বিপরীত। সামনে সুজাতা হাঁটছেন দৃপ্ত দ্রুত পদক্ষেপে। পিছনে, বেশ কয়েক কদম তফাতে রমাপদ হাঁটছেন, যেন কোনোক্রমে টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন শরীরটাকে। ঝুলে গেছে চোয়াল,চোখ রক্তশূন্য, চিবুক বক্ষলগ্ন হয়ে ঝুলে পড়ে আছে। চারপাশে এখনও লোকজন আছে, মাথার ওপর ক্যাটক্যাট করছে সূর্য, সাহস তাই ধরে রাখতে পারছেন রমাপদ। টেনে হিঁচড়ে হলেও শরীর তাই এগোচ্ছে। এরই মধ্যে অবশ্য দু’বার ভেবে ফেলেছেন, বাড়ী ফিরে কি হবে, কি হতে পারে। দু’বারই তলপেট মোচড় দিয়ে উঠেছে। নির্বিবাদে বাড়ী পর্যন্ত ফেরার জন্য তাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে অশুভ চিন্তা ভাবনা মন থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা চালাতে চালাতেই পা চালাচ্ছেন। কবিদের তিনি দু’চক্ষে দেখতে না পেলেও এখন বারবার কবিকেই স্মরণ করছেন। ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’। তবে কবি তো আর ভগবান নন, তাই শেষ পর্যন্ত ভক্তের ভরসা হলেন না তিনি। দূরপাল্লার দৌড়ের ক্ষেত্রে যেমন শেষ বাঁকে এসে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে অনেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়,রমাপদর হলোও তাই। সুজাতার পেছন পেছনই হাঁটছিলেন তিনি, বাড়ীর সামনে এসে সূজাতা যখন সদর দরজার তালা খুলছেন, ধুতিতে পা জড়িয়ে তিনি পড়ে গেলেন।
    ধরণী দ্বিধা হও– এটুকু উচ্চারণেরও সময় হলো না রমাপদর। সুজাতার দরজা তখন খোলা হয়ে গিয়েছিল। শব্দ পাওয়া মাত্র তিনি বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়ালেন। ব্যাপারটা বুঝতে তাঁর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। বিপদের কিছু নয় বুঝতে পেরে তিনি এগিয়ে এলেন। তারপর রমাপদকে কিছু বুঝতে না দিয়ে, সামান্য নীচু হয়ে খপ করে চেপে ধরলেন তাঁর পাঞ্জাবীর করার। হিড়হিড় করে টানতে শুরু করলেন প্রৌঢ় স্বামীকে। তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে এনে ডাষ্টবিনে ময়লা ফেলার ভঙ্গীতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন সোফার উপর। টানা- হ্যাঁচড়ায় ততক্ষণে পাঞ্জাবী ছিঁড়ে গেছে রমাপদর, ধুতি খুলে যাবার উপক্রম।
    এতো দ্রুত সব ঘটনাগুলো ঘটে গেল রমাপদ থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন। সুজাতার এই মুর্তির সঙ্গে, পঁচিশ বছর ঘর করার পরও তাঁর কখনো পরিচয় হয়নি। নিজেকে সামলে সুমলে সোফার উপর যখন উঠে বসলেন, ভেতর থেকে তখনো সুজাতার চাপা গর্জন ভেসে আসছে।এটা অবশ্য রমাপদর চেনা অস্ত্র। চাপা গর্জন আর দাঁত কিড়মিড়। বর্তমানে যদিও রমাপদর কোনো অস্ত্র নেই, তথাপি যৌবনে ছিল, পিলে চমকে দেওয়া হুঙ্কার। তখন খুব কার্যকর মনে হতো এই অস্ত্রকে, এখন খুব ভোঁতা মনে হয়। স্বল্প পাল্লার ঝগড়ায় তিনি জিতলেও দূর পাল্লায় সুজাতার অস্ত্র দু’টি যে অনেক বেশী কার্যকর তা স্বীকার করতে অন্তত রমাপদর কোনো দ্বিধা নেই।
    খানিকক্ষণ থম মেরে সোফায় বসে থাকার পর রমাপদ উঠে পড়লেন ভয়ঙ্কর হতাশ লাগছে, বিষণ্ণও। সেকেণ্ড রাউন্ড চা’টাও যে আর পাওয়া যাবে না, বেশ বুঝতে পারছিলেন। এখনও গেলে দ্বিজেনের ঘরে সবাইকে পাওয়া যাবে। দ্বিজেনের বউয়ের কৃপা হলে হয়তো বা এক কাপ চা’ও। উঠে পড়ে বাইরে পা বাড়াতে যাবেন, চাপা হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে ঘরে ঢুকে এলেন সুজাতা, ‘ তা যাবে না, এই পোশাকে না গেলে বন্ধুদের কাছে বউয়ের পিণ্ডি চটকানো যাবে কি করে!’
    মনে হচ্ছিল ঝট করে পিছন ফিরে একটা সজোরে পাঞ্চ, মুখের জিওগ্রাফিটাই পাল্টে দেবেন। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলেন রমাপদ। এই শর্ট-র্টার্ম মিস্ট্রিগুলোর পিছনে ছুটতে গিয়েই লং-র্টার্মে আজ তাঁর এই হাল। রমাপদ তাই পিছনে ফিরলেন, হাত চালালেন না। বদলে সুড়সুড় করে ঢুকে গেলেন বাথরুমে।
    বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবী পরে বেরিয়ে পড়লেন। লুঙ্গিটা ইচ্ছে করে পড়লেন। লুঙ্গি পড়ে বাইরে বেরোনো সুজাতা পচ্ছন্দ করেন না। তবে বাইরে বেরিয়ে এবারেও গতি বাড়লো না। যে তেজে লুঙ্গি পড়েছেন, বাইরে বেরিয়ে সেই তেজ কেমন নেতিয়ে পড়লো। রমাপদ মাথা তুলে হাঁটতে পারছিলেন না। সুজাতার হাতে নেংটি ইঁদুরের মতো ঝুলতে ঝুলতে গৃহপ্রবেশের দৃশ্যটা আশেপাশে কে দেখেছে কে জানে!
    তবে কিছুদূর এগোনোর পরেও যখন কোথাও কোনো আওয়াজ উঠলো না, খানিক স্বস্তি ফিরে এলো রমাপদর মনে। তাহলে বোধহয় এ যাত্রায় পার পাওয়া গেছে।কারো চোখে পড়েনি। ভাবনাটা মাথায় আসায় স্বস্তির সঙ্গে গতিও ফিরে এসেছিল পায়ে।
    কিন্তু রমাপদর অঙ্কে গোলমাল ছিল সেটা বোঝা গেল দ্বিজেনের ঘরে ঢুকতেই। প্রাত্যহিক বৈঠকীতে কেউ কাউকে অভ্যর্থনা জানায় না। আজ সবাই হৈ হৈ করে উঠলো রমাপদ ঘরে ঢুকতেই। মুখ ফের আষাঢ়ের কালো মেঘে ভরে উঠলো। রমাপদ গিয়ে ঘরের এক কোণে বসে পড়লেন। বসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আজ চা’ও এসে গেল। অন্যদিন বাড়ীর কাজের মেয়েটি চা দিয়ে যায়,আজ দ্বিজেনের বউ নিজে এলো। চা নিতে গিয়ে রমাপদ দেখলেন দ্বিজেনের বউয়ের মুখে মুচকি ফিচেল হাসি।
    টি-টোয়েন্টিতে ব্যাট করতে নেমে যে লোকটার হাত হঠাৎ আটকে যায়, গ্যালারির ব্যারাকিং হজম করতে করতে সে ভেতরে ভেতরে ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকে, তারপর একসময় ঝেড়ে চালিয়ে দেয়। হয় ছক্কা,নয় ফক্কা। রমাপদর অবস্থা সেই দিকেই এগোচ্ছিল। আগুনে ঘি ঢালার কাজটা করলেন বিশ্বনাথ।
    বিশ্বনাথ ঘোষ রমাপদর নিকটতম প্রতীবেশী। রমাপদর প্রথম থেকেই সন্দেহ হছিল খবরটা ঠেকের দোরগোড়া পর্যন্ত টেনে এনেছে বিশ্বনাথই। তাছাড়া পোকা বেগুন কেনার আইডিয়াটা বিশ্বনাথেরই মস্তিষ্ক প্রসূত। দিন কয়েক আগে বাজারে দুজনের দেখা, রমাপদ তখন একটা বেগুন হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছেন,
    -‘কি রমাদা কি দেখছেন অত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে?’
    ঘাড় ঘুরিয়ে বিশ্বনাথকে দেখে রমাপদ বলেছিলেন,
    -‘আরে ভাই বলো কেন, একটা পোকা দেখলে সে বেগুন আর ঘরে ঢুকবে না’।
    – ‘বলেন কি দাদা, পোকাই তো বেগুনের গুণ।,’
    এবার রমাপদ পর্যন্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলেন,’মানে?’;
    -‘আরে রমাদা, বেগুনে পোকা মানে কি বলুন তো, জমিতে পেষ্টিসাইড পড়েনি। পোকা আর ক’টা দাদা, কেটে ফেলে দেবেন। ইন এক্সচেঞ্জ কি পাচ্ছেন ভাবুন।’

    সেদিন আর বেগুন কেনা হয়নি। বিশ্বনাথের কথায় যুক্তি আছে। আবার উল্টোদিকে আছে সুজাতার ভ্রুকুটি। দোটানায় পড়ে সেদিন আর বেগুনই কেনেন নি। আজ সুজাতাকে সঙ্গে পেয়ে ভেবেছিলেন এক্সপিরিয়েন্সটা হাতে নাতে হয়ে যাবে। তারপর তো এই কীর্তি।

    ঠেকে এসে বিশ্বানাথকে দেখার পর থেকেই তাই পারদ চড়িয়ে। অথচ বিশ্বনাথ মুখ এমন গম্ভীর করে বসে ছিল যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। কিন্তু ঠেকে এসে কাঁহাতকই বা আর এমন ভেটকি মাছের মতো মুখ করে বসে থাকা যায়? বিশেষ করে চারদিকে যখন এমন হাসি-ঠাট্টার ফোয়ারা চলছে। শেষ পর্যন্ত সে বলেই ফেলল,
    – ‘যাই বলুন দাদা, বৌদির রাগটা কিন্তু রুগি বেগুনের জন্য নয়।’
    – কথাটা কানে ঢুকতে যেটুকু সময় লাগলো,রক্তটা চড়াৎ করে মাথায় উঠতে সেটুকু সময় লাগলো না। দাঁতে দাঁত চেপে, হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন রমাপদ। ঠিক ততটা দ্রুততায় উঠেছিলেন, ততটা দ্রুততার সঙ্গেই আবার নিজেকে সামলেও নিলেন। তারপর মাথা নিচু করে, মন্থর পদক্ষেপে বেরিয়ে গেলেন বাইরে, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই।
    বাড়ী ফিরে অন্যদিন আগে একটু পাখার তলায় বসেন, তারপর বাথরুম যান। আজ সোজা গিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। শাওয়ারের প্যাঁচটা ডানদিকে পুরো ঘুরিয়ে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রক্তটা মাথা থেকে নেমে এলো। স্নান করে বেরিয়ে এসে রমাপদ দেখলেন সুজাতা পাজামা-পাঞ্জাবী হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে। এমনটা তো হয়না! কোনোদিন কপাল ভালো থাকলে পাট করা জামা কাপড় বিছানার উপর পান। অবাক হলেও আজ তার চুপ করে থাকার দিন। স্ত্রীর হাত থেকে নিঃশব্দে পরিধেয়গুলি নিলেন। নিঃশব্দেই তৈরী হয়ে নিয়ে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলেন। মাথা নীচু করে চুপচাপ খেয়ে নিয়ে রমাপদ গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
    ঘুম আসছিল না। ঘুমোবার জন্য তো শোননি। চোখ বুজে কেবল ভেবে যাচ্ছিলেন। নির্দিষ্ট কোনো ভাবনা নয়। নির্দিষ্ট কিছু ভাবার মতো মনের অবস্থাও তো নয়। হঠাৎই কপালে একটা ভিজে ভিজে নরম স্পর্শ অনুভব করলেন রমাপদ। কিসের স্পর্শ, বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয। কিন্তু ইতিপূর্বে এমন ঘটনা কবে ঘটেছে স্মরণে আসছিলো না তাঁর। যেটুকু আসছিলো সেটাকে পূর্ব জন্মের স্মৃতি বলেই মনে হচ্ছিল। রমাপদর শরীর শক্ত কাঠের মতো হয়ে গেল।
    সুজাতা এরকমই কিছু প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করেছিলেন। তাই পরের কাজটাও ভেবে রেখেছিলেন। সিঙ্গল খাট, স্বামীকে একটু টেনে নিয়ে পাশেই শুয়ে পড়লেন। তারপর ধীরে ধীরে স্বামীর চুলে বিলি কাটতে শুরু করলেন। রমাপদর চোখ খুললো না। খানিকক্ষণ বিলি কাটার পর গলায় আদুরে সুর এনে সুজাতা বললেন,
    – ‘বেগুনগুলো জানো, দারুণ টেস্টি। বিশ্বনাথদা ঠিকই বলেছেন। কোনো কেমিক্যাল নেই তো।’
    ফটাস করে দু’চোখের পাতা খুলে গেল রমাপদর। বিষ্ফোরিত হয়ে উঠলো দৃষ্টি। সেদিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন সুজাতা।

  • গল্প

    আলোর হাতছানি

    আলোর হাতছানি
    -অনিন্দ্য ভুক্ত

     

    রোজ বিকেলে এখানেই আড্ডা বসে ওদের। পাঁচটা থেকে সাতটা।আজ আসতে একটু দেরীতে হয়ে গেল অলোকের। এসে দেখে কেউ কোথাও নেই। গেল কোথায সব, ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল টী-টোয়েন্টির ম্যাচ চলছে। আজ আর অতোএব কারো টিকিটি পাওয়া যাবে না।
    মনটা তিতকুটে হয়ে গেল। এই এক ঝামেলা হয়েছে। আরে বাবা, খেলতে পারলে নিজে খেলো না। তা নয় পরের খেলা দেখে সময় নষ্ট।গলাও নষ্ট, চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে। বসে বসে খেলা দেখার চেয়ে আড্ডা মারা বোধহয় ঢের গুণ ভালো।
    খানিকক্ষণ গুম হয়ে মাঠের ধারে বসে রইলো অলোক। একা একা করবেটাই বা কি? কারো বাড়ী যাবে, সেখানেও তো সব হাঁ করে টিভি গিলছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে উঠে পড়লো। আজ জঙ্গলে ঢুকবে। অন্যদিন কথাটা উঠলেই সবাই হাঁ হাঁ করে ওঠে। আজ নিশ্চিন্তে ঢোকা যাবে।
    কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখল অলোক।চারটে বাজে সন্ধে গড়াতে তার মানে এখনো ঘন্টা আড়াই। বেশীদূর না ঢুকলেই হলো, বেলাবলি ফিরে আসা যাবে। খেলা দেখে রতনরাও হয়তো ততক্ষণে মাঠে এসে যাবে।
    গ্ৰামের শেষ প্রান্তে এই মাঠ। আর মাঠ যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই শুরু জঙ্গলের। লম্বায় চওড়ায় প্রকান্ড এক জঙ্গল। যেমন পেল্লায় তেমনি ঘন। ওরা বলে পাগলাঝোরার জঙ্গল।কেন বলে সে অবশ্য কেউ জানে না। ঘন জঙ্গল বলেই হয়তো বা দিনের বেলাতেই আলো ঢোকে খুব কম। তবে সেটা জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা ঢুকলে তারপর। দিনদুপুরে সামনাসামনি সবাই ঢোকে, ওরাও কতবার ঢুকেছে, কিন্তু বেলা পড়লে কেউ আর জঙ্গলের পথ মাড়াতে চায় না। অলোকের বহু দিনের ইচ্ছে ও জঙ্গলের গভীরে ঢুকবে, তাও আবার বিকেলের দিকে। ও দেখতে চায় কি আছে বিকেলের জঙ্গলে, কিন্তু বন্ধুরা ঢুকতে দিলে তবে তো।
    বেশী ভাবনা না বাড়িয়ে চট করে ঢুকে পড়লো অলোক। সামনের দিকে চেনা অংশটুকু পেরিয়েও এলো দ্রুত।আর চেনা অংশটা পেরিয়ে আসতে আসতেই মুগ্ধতা বাড়ছিলো। কত নাম না জানা গাছ, কত অচেনা ফুল,কত অজস্র পাখির কিচিরমিচির। আরো খানিকটা ঢুকে আসতে বিস্ময় বেড়ে গেল অলোকের।আলো আসছে।জঙ্গল এখানে যেন একটু পাতলা। বিকেলের পড়ন্ত লালচে আলোয় মনে হচ্ছে যেন জঙ্গলে আগুন লেগেছে। দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু দাঁড়ালে চলবে না। ভেতরে আরো কত কি দেখবার আছে কে জানে! অলোকের নেশা ধরে যাচ্ছিলো।
    আরো একটু ভেতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল ও। কি বিশাল দীঘি! পদ্মদীঘি। নিজের মনেই নাম দিয়ে ফেললো।আর এগোতে ইচ্ছে করছিলো না। পা দুটো কেউ যেন মাটির সঙ্গে আটকে দিয়েছে। হঠাৎই অলোক দেখলো দীঘির একপাশের জলে যেন কালো ছায়া পড়লো। প্রথমটায় চমকে উঠলেও অলোক বূঝতে পারলো গাছের আড়ালে সূর্য নেমে যাচ্ছে।
    সর্বনাশ বুঝে ওঠার আগেই ঝপ করে অন্ধকার নেমে এলো। নিকষ কালো অন্ধকার। যতই সাহসী হোক,এই অবস্থায় ভীতু আর সাহসীর মধ্যে কোনো প্রভেদ থাকে না। অলোকের মনে হচ্ছিল ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। কষ্ট করে মনের জোর ফিরিয়ে ও পিছূ ফিরে হাঁটা লাগাল। জঙ্গলে অন্ধকার নামে আগেই। ঘড়ির কাঁটা বলছে এখন ছটা। তার মানে বাইরে এখনো আলো আছে। তাড়াতাড়ি পা চালালে এখন ফেরা যাবে।
    কিন্তু চালাবো বললেই তো আর চলে না। অন্ধকারে আন্দাজে আন্দাজে এগোনো। হাতড়ে হাতড়ে এগোতে এগোতেই হঠাৎ দূরে একটা আলোর রেখা চোখে পড়লো। মনে একটু ভরসা এলো যেন। কেন যে আলো ভয় কাটিয়ে দেয় কে জানে! অলোকের গতিবেগ দ্রুত হলো আলোর বিন্দুর দিকে চেয়ে।
    কয়েক মিনিট হাঁটার পর খেয়াল হল ও আলোর কাছাকাছি পৌঁছতে পারছে না,বরং আলো যেন আরো দূরে সরে যাচ্ছে। আরো জোরে পা ফেলতে হবে। হঠাৎ ই আলোর বিন্দু দুটো হলো। কিন্তু দুটো আলো তো পাশাপাশি নয়। অলোক বিভ্রান্ত বোধ করলো। কোন দিকে যাবে? ঠিক করে ওঠার আগেই আবার একটা আলোর বিন্দু ফুটে উঠল চোখের সামনে,ঠিক যেমন আকাশে তারা ফুটে ওঠে, সেভাবেই যেন।
    দেখতে দেখতে আলোর মালার মধ্যে যেন আটকে গেল অলোক। অমাবস্যার রাতের মত যেন এক তারায় ভরা আকাশ। অলোকের মনের থেকে ভয় চলে গেল। ও মুগ্ধ হয়ে আলোর মালা দেখছিলো। আস্তে আস্তে আলোর বিন্দুগুলো নাচতে শুরু করল ওর চোখের সামনে। কেউ যেন মন্ত্রের মতো অবশ করে দিচ্ছিল অলোককে।। হঠাৎ ই অলোক আবিস্কার করল ও সেই পদ্মদীঘির সামনে দাঁড়িয়ে। এতোক্ষণ কি তাহলে ও এই দীঘির চারপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো!
    ভালো করে দীঘির দিকে তাকিয়েই আঁতকে উঠল সে। একটা হাত। হাতটা ডুবে যেতে যেতে যেন ভেসে উঠছে। বুঝতে দেরী হল না অলোকের। কতবার যে এমন ডুবন্ত মানুষকে বাঁচিয়েছে ও! কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, কেন দাঁড়িয়ে আছে,সব ভুলে ঝাঁপ মারলো অলোক।
    পরদিন সকালে অলোককে খুঁজতে খুঁজতে গ্ৰামের লোক পাগলঝোরার জঙ্গলের সেই ভেতরে ঢুকে এলো, যেখানে এর আগে কখনো আসেনি তারা। এসে দেখলো দীঘির পাড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে অলোক।তার ডান হাতটা সামনে বাড়ানো, ঠিক যে ভঙ্গীতে তাকে গ্ৰামের পুকুরপাড়ে আগেও অনেকবার দেখেছে সবাই।

<p>You cannot copy content of this page</p>