• অনুবাদ

    অনুবাদ- বেগুনের গুণ (কৃষণ চন্দর)

    বেগুনের গুণ (কৃষণ চন্দর)
    বর্ণালী জানা

    বরমপুরে হাতে অনেক দিন কোনো কাজবাজ নেই। ঘরে খাবার-দাবার নেই। দুদিন ধরে পেটে কিল মেরে পড়ে রয়েছি। পকেটে শুধু পঞ্চাশটা পয়সা পড়ে রয়েছে। বউকে গিয়ে বলি… ‘হ্যাঁ গো, ঘরে দু-এক মুঠো আটাও কি নেই? আজকের দুপুরটা চালিয়ে নেওয়া যাবে না?’
    ‘যা আটা আছে তা দিয়ে মাত্র চারটে রুটি হবে’।
    ‘ঠিক আছে, চলে যাবে’?
    ‘কী করে চলবেটা শুনি?’
    পকেট থেকে পয়সাটা করে বউয়ের হাতে দিই… ‘যাও বাজারে গিয়ে বেগুন কিনে আনো। একটু বেগুন ভর্তা হলে দুপুরটা চলে যাবে’।
    ‘সে না হয় হল? তা রাতে কী খাবে শুনি? হরিমটর?’
    ‘আরে চটছো কেন? ঐ ওপরে যিনি বসে আছেন তিনি সব ইন্তেজাম করে দেবেন’।
    কথা বলতে বলতেই কাচের বাক্সটার দিকে চোখ চলে যায়। বাক্সের ভেতর প্লাস্টার অফ প্যারিসের একটা ছোট্ট তাজমহল। বিয়ের পর পর অনেক সাধ করে বউকে কিনে দিয়েছিলাম। আগ্রায় তাজমহল দেখতে গিয়ে এটা কিনেছিলাম। ভালোবাসা এক আজব কিসসা। বিশেষ করে বিয়ের ঠিক পর পর। চোখে সবকিছুই রঙিন লাগে। কুড়ি টাকার এই উপহার পেয়ে বউ তো লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠেছিল! এখন কাচের বাক্সের ভেতরের এই ঝুটা তাজমহলটাকে দেখলেই বেচে দিতে ইচ্ছে করে। দুটো পয়সা তো আসবে। কিন্তু একথা বললেই বউয়ের মুখ চুন। পরমুহূর্তেই তার মুখ ঝামটা… ‘এটা আমার সুহাগের চিহ্ন। কিন্তু এটা আমি হাতছাড়া করব না’।
    অগত্যা ইনিয়ে বিনিয়ে বউকে আবার শান্ত করতে হয়… ‘আচ্ছা আমরা এটা বেচব না। অন্য কিছু বেচব। ঐ ওপরওয়ালা নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করবেন । এখন বাজারে গিয়ে বেগুন কিনে আনো তো দেখি । খিদেয় মরে যাচ্ছি’।
    বাজারে গিয়ে বউ কয়েকটা কালো বেগুন নিয়ে ফিরল। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে কাটাকুটি করতে বসল। একটা বেগুন মাঝামাঝি কেটেই থেমে যায়…হাত থেকে চাকুটা ছিটকে পড়ে।
    আমি উঠে যাই… ‘কী হল? কী ব্যাপার?’
    ‘দেখো গো! বেগুনের ভেতর কী যেন সব লেখা!’
    বেগুনটাকে নেড়েচেড়ে দেখি। বেগুনের বীচিগুলো এমন ভাবে সাজানো মনে হচ্ছে যেন আরবিতে কেউ ‘আল্লা’ লিখে রেখেছে।
    আমি যে পূর্বিয়াঁ মহল্লায় থাকি সেখানে অর্ধেকের বেশি ঘরই আমাদের মতো হিন্দু। বাকিদের মধ্যে মুসলমানই বেশি। তবে কয়েকঘর খ্রিস্টানও রয়েছে। বেগুনের ভেতর আল্লার অধিষ্ঠানের খবর মহল্লায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আল্লার এই চমৎকারি দেখতে আমার বাড়িতে কাতারে কাতারে লোক এসে জোটে। তবে হিন্দু আর খ্রিস্টানরা মুখ বেঁকায়। তাদের এইসব অলৌকিক ব্যাপারস্যাপারে বিশ্বাস নেই। কিন্তু মুসলিমদের তো আছে! হাজি মিঁয়া আচ্চান এসে আল্লার দর্শন করে পাঁচ টাকা নজরানা দিলেন। বিড়বিড় করে কিছু মন্ত্র জপলেন।
    বেগুনটা এখন ভীষণ দামি! একে সামলেসুমলে রাখতে হবে! কাচের বাক্স থেকে ছোট তাজমহলটাক বের করে তার জায়গায় বেগুনটাকে সাজিয়ে রাখলাম। একজন ভক্ত এসে বাক্সটার নীচে একটা সবুজ চাদর বিছিয়ে দিয়ে গেল। তারপর আমাদের মুন্নান মিঁয়া এসে কোরাণ পাঠ শুরু করে দিল।
    আশেপাশের সব জায়গা…সমস্তিপুর, মেমনপুরা, বৈজওয়াড়া, কামানগড় থেকে শুরু করে সাইলান মিঁয়ার চক, মহল কোঠিয়ারান থেকে পিল পিল করে আল্লার নেক বান্দারা এই চমৎকারি দেখতে ছুটে আসে।
    একজন বলেন… ‘আমাদের ধর্মের মহিমা দেখেছ! একজন কাফেরের ঘরে আল্লা দেখা দিলেন!’
    অন্যজন বলে… ‘এটাই আমাদের আল্লার ইচ্ছা! কাফেরগুলোকে উচিত শিক্ষা দিয়েছেন’।
    লোক যত বাড়ে তত বাড়ে নজরানা। একেবারে হরির লুঠ! প্রথম পনেরো দিনেই সাত হাজার টাকা! তার মধ্যে থেকে তিনশো টাকা গাঁজাখোর সেইন করম শাহ—এর হাতে দিই। কারণ সেই তো চব্বিশ ঘণ্টা, এই অমূল্য রত্নটা পাহারা দেয়।
    দিন কুড়ি পর ভিড় পাতলা হয়ে এল। মানুষের উৎসাহ এখন কমতির দিকে। একদিন সেইন করম শাহ যখন গাঁজার নেশায় গভীর ঘুমে তখন আমি বাক্স থেকে বেগুনটাকে একটু নেড়ে নেড়ে উলটে পাল্টে বউয়ের কাছে নিয়ে আসি… ‘দেখো তো এবার কী লেখা রয়েছে?’
    দেখে তো বউয়ের চোখ ছানাবড়া। মুখ দিয়ে কথাই সরে না। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে কোনোমতে সে বলে… ‘হরে কৃষ্ণ! নিজের চোখকেও যে বিশ্বাস যায় না! কোথায় এখানে আল্লা লেখা! আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি দেবনাগরীতে ‘ওম’ লেখা রয়েছে। এ যে ঈশ্বরের অসীম কৃপা’!
    সেই রাতেই বেগুনটা নিয়ে পণ্ডিত রামদয়ালের বাড়ি গেলাম। বেগুনটাকে এবার একটু উলটিয়ে তাঁর সামনে রাখলাম।
    পণ্ডিতমশাই হতভম্ব… ‘এ যে ‘ওম’, আমাদের ‘ওম’। মুসলমানগুলো তবে এতদিন ধরে আমাদের ঠকাচ্ছিল’!
    পণ্ডিত মশাই এসে করম শাহকে ধাক্কা মেরে ঘুম থেকে তুললেন। কটমট করে তার দিয়ে চাইলেন…যেন ভস্ম করে দেবেন। তারপরই ঘাড়ধাক্কা… ‘এখান থেকে দূর হ ভতভাগা ভণ্ড পামর। আমাদের ধর্মকে তুই অপবিত্র করেছিস! আমাদের ‘ওম’-কে তুই ‘আল্লা’ বলে চালাচ্ছিস!’
    মহল্লায় হিন্দুদের মধ্যে খুশির উল্লাস। বেগুনের মধ্যে আল্লা নেই, ওম রয়েছে। পণ্ডিত রামদয়াল এবার তাঁর দায়িত্ব বুঝে নেন। শুরু হয় পূজা-পাঠ, আরতি, ভজন, সংকীর্তন। ঠাকুরের জন্য প্রণামী, দামী পট্টবস্ত্র আর রাশি রাশি অলংকার এসে জমা হয়। প্রণামীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ টাকা পণ্ডিতজির হাতে তুলে দিই। যতই হোক তিনি অনেকে খাটাখাটনি করছেন। একটু তোয়াজে তো রাখতেই হবে। আমি ন্যায্য কথার মানুষ। সমাজের গরিবগুর্বো মানুষের কথা আমার চেয়ে বেশি কেউ ভাবে না।
    বেগুনের মধ্যে আল্লা, ওম-এ রূপান্তরিত হয়েছেন। এমন অলৌকিক কাণ্ডের কথা কে কবে শুনেছে! বাড়িতে সব আচার্য, মোহান্ত আর স্বামীজিদের ঢল। তাদের মুখে ধর্মযুদ্ধ জয়ের তৃপ্তি। পানিপতের তিনটে যুদ্ধ হারার পর মুসলমানগুলোকে অবশেষে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া গেছে… মুখে একেবারে ঝামা ঘসে দেওয়া আর কি। শহরে এখন দুটো শিবির। দুই শিবিরই বলে তাদের ধর্মই সেরা। বাকিরা কাফের, বিধর্মী। আগে মহল্লার মানুষের মধ্যে কত মিলমিশ ছিল। এখন শুধু রেষারেষি। সবার চোখে সন্দেহ। সবার মনে অবিশ্বাস। একেবারে দমবন্ধ করা পরিবেশ।
    হিন্দুরা বলে… ‘ওটা আসলে আমাদের ওম’।
    মুসলমানেরা বলে… ‘হরকিজ নয়। উনিই আমাদের আল্লা রসুল’।
    -‘ওম’
    -‘আল্লা’
    -‘হরি ওম তৎসৎ’
    ‘আল্লা হো আকবর’
    পরের মাসে প্রণামী বাবদ জুটল পঁচিশ হাজার টাকা।
    তারপর ভক্তদের উন্মাদনা থিতিয়ে এল। আবার কিছু একটা খেল দেখাতে হবে। একদিন রাতে আবার হাতসাফাই করতে হল। রামদয়ালজি তখন ঘুমে অচেতন। আমি এই ফাঁকে বাক্স থেকে বেগুনটাকে বের করে আবার একটু উলটে পালটে বউয়ের সামনে ধরলাম… ‘ভালো করে দেখো তো? কী লেখা আছে এতে?’
    ‘দেখার কী আছে? ওম লেখা রয়েছে’।
    আবার বেগুনটাকে নাড়ানাড়া করে বীচিগুলোকে একটু এদিক ওদিক করে আবার বউয়ের সামনে ধরি… ‘এবার ভালো করে দেখে কী লেখা রয়েছে?’
    বউয়ের তো চক্ষু চড়কগাছ… ‘ও মা গো এ কী কাণ্ড! এ যে দেখি ক্রশ চিহ্ন। আরে খেরেস্তানদের ক্রশ গো!’
    কোনোমতে বউয়ের মুখটা চেপে ধরি। বেশি চেঁচালে সব ভণ্ডুল… ‘শোনো এখন মুখে কুলুপ এঁটে থাকো। কাল রবিবার। পাদ্রি ডুরান্ডের সঙ্গে একটু পরামর্শ করে দেখি’।
    পরের দিন পাদরি ডুরান্ড আরো এগারোজন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে পবিত্র ক্রশ সন্দর্শনে আমার কুটিরে পায়ের ধুলো দিলেন। ওম-এর ভোলবদলে তাঁরা তো একেবারে বিগলিত। তাঁরা বুকে বার বার ক্রশ আঁকেন…যীশুর বন্দনাগীত শুরু করে দেন। এবার আমার বাসায় ভক্ত খ্রিস্টানদের জমায়েত। সবাই তারা যীশুর এই মহিমা দেখতে চায়।
    শহরে এখন তিনটে শিবির। হিন্দুরা বলে- ওম। মুসলমানেরা বলে- আল্লা। আর খ্রিস্টানদের দাবি এটা তাদের পবিত্র ক্রশ।
    শহরে উত্তাপ বাড়ে। প্রথমে পাথর ছোঁড়াছুড়ি…তারপর ছুরি-তরবারি, খুনজখম। সমস্তিপুরায় দুজন হিন্দু খুন হয়ে গেল। সুর্জনপুরায় কাটা পড়ল তিনজন মুসলমান। দিনদুপরের শহরের চৌকে এখন খ্রিস্টানের বুখে ছুরি বিঁধল। পুলিশ আমায় গ্রেপ্তার করতে এল।
    তার আগেই আমি ভাগলবা। আগে থেকেই আমি সব আঁচ করতে পারছিলাম। বেগুনটাকে পাশের নর্দমার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, বাক্সপ্যাঁটরা গুটিয়ে চলে এলাম বোম্বাই। বেগুনের গুণে বেশ ভালোই রোজগার করেছিলাম। তা দিয়ে একটা ট্যাক্সি কিনে ট্যাক্সিওয়ালা বনে গেলাম।
    আমার গল্প শেষ। গল্প শেষ করে শুঁড়িখানার কাউন্টার থেকে দারুর গেলাসটা তুলে এক চুমুকে সাবাড়। হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল। কাউন্টারের ওপর গেলাসটা রাখার ফলে একটা দারুণ গোলমতো জল-ছবি তৈরি হয়েছে। পাশেই বসেছিল মহম্মদভাই। সেও আমার মতো ট্যাক্সি চালায়। মহম্মদভাইকে কানে কানে বলি জলের ছাপটকে দেখে মনে হচ্ছে ‘ওম’ লেখা রয়েছে।
    মহম্মদবাই বিজ্ঞের মতো কাউন্টারের ওপর গেলাসের ছাপটাকে দেখে, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হা হা করে হেসে ওঠে… ‘দূর শালা এটা তোর বরমপুর নয়। এটা বম্বে। এখানে কোনো ওম, আল্লা, ক্রশ নেই। এখানে আছে শুধু রোকড়া। সবকিছু এখানে টাকায় বিকোয়। ফালতু বকে লাভ নেই। রাতে গাড়িটাকে ছোটাতে পারলে পকেটে দুটো পয়সা আসবে।
    এই বলেই সে কাউন্টারের ওপর থেকে জলের ছাপটা মুছে দেয়। তারপর হাতটা ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে আমাকে বাইরে নিয়ে আসে।

  • অনুবাদ

    অনুবাদ- বর্ণালী জানা সেন

    উল্কি (হোসে বালজা )
    -বর্ণালী জানা সেন

    একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে হাজির সাংবাদিক মহাশয়। টম উলফের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা। তাঁকে আদর্শ মেনেই লেখালেখি চালিয়ে যেতে চান এই তরুণ সাংবাদিক ( বছর তিরিশ বয়স আর ইতিমধ্যেই দুটো ডিভোর্স হয়ে গেছে)। খবরের কাগজের রিপোর্টে তিনি কাব্য আনতে চান, নাটক আনতে চান, উপন্যাসের জাদু চারিয়ে দিতে চান যাতে মহোদয়ের রিপোর্টে পাঠকরা একেবারে খাঁটি সাহিত্যকর্মের স্বাদ পেতে পারেন। আসলে তিনি গল্পই তো লিখতে চান। কিন্তু মনে সবসময় চোরা আশঙ্কা…সাংবাদিকদের সহজাত প্রবৃত্তি বশত গল্পটি শেষমেশ খবরের কাগজের রিপোর্ট হয়ে যাবে না তো? এই দ্বিধাদ্বন্দ্ব মনে নিয়ে আর তাঁর আর সাহিত্যিক হয়ে ওঠা হল না…নামী এই খবরের কাগজের কলাম-লিখিয়ে হয়েই রয়ে গেলেন। এমনিতে একেবারে অমায়িক মানুষ। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অগাধ জ্ঞান। তারপর চোখে মুখে একটা কবি কবি ভাব। নাহ, ইনি সাহিত্যিক হওয়ার জন্যই জন্মেছেন। কেউ আটকাতে পারবে না।
    সকালে এই এক ঘণ্টা ধরে আমার ইন্টারভিউ নিয়ে চলেছেন…যদিও আমি বিশেষ কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছি না। আমি আমার সহকর্মীদের নিয়ে একটা অভিধান সম্পাদনা করেছি। সেটা নিয়েই এই ইন্টারভিউ। একদম পাঠকের দৈনন্দিন চাহিদার কথা মাথায় রেখেই এই অভিধান। তাঁরা যা চান তা এখানে একেবারে হাতে কাছেই মজুত রয়েছে। তবে সম্পূর্ণ অভিধান বলে কোনো কথা হয় না। সেটা একেবারে সোনার পাথরবাটি। অভিধান তাই সবসময়ই অসম্পূর্ণ। তবে আমার দলের সঙ্গীসাথীরা কাজটা করে খুব খুশি। পাঁচ বছর ধরে এমন একটা মহান কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার কৃতিত্বটা অগত্যা আমাকে নিতেই হল। সবাই যখন চাইছে! খবরের কাগজওলারা তো একেবারে হামলে পড়েছে। এই কাজের অভিনবত্ব নিয়ে ( যেখানে পুরো বর্ণানুক্রম হঠিয়ে দেওয়া হয়েছে) সাংবাদিক বন্ধুটি একেবারে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমাদের জনসংযোগ বিভাগের পক্ষ থেকে এক হপ্তা আগেই বইয়ের একটা কমপ্লিমেন্টারি কপি ওঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উনি যে তার একটা পাতাও উলটিয়ে দেখেননি তা আমি আর কী করে বুঝব! এমনভাবে প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দেন যে মনে হয় বুঝি সবজান্তা। হবে নাই বা কেন! লক্ষ লক্ষ পাঠককে সম্মোহিত করে রাখার কৌশলটা যে তাঁর নখদর্পণে।
    কাচের পার্টিশনটার ওপার থেকে দলের লোকজনরা আমাদের কথাবার্থা শুনছে…থুড়ি দেখছে। সুযোগ বুঝে আমার সেক্রেটারি কফির ট্রে নিয়ে হাজির। ভদ্রলোক নিজের ক্যাসেট, নোটবইট ব্যাগে গুছিয়ে নিচ্ছেন। নোটবইটা যদিও একবারও খোলেননি। কিন্তু উনি আর্টিকেলটা ঠিক কীভাবে লিখবেন? দু-এক সেকেন্ডের জন্য আন্দাজ করার চেষ্টা করি। উনি সত্যিই অভিধানটার কথা লিখবেন তো? এখন হলুদ সাংবাদিকতার যা বাড়বাড়ন্ত! অভিধানকে বাদ দিয়ে হয়তো আমার হাঁচির ধাত নিয়েই দুটো প্যারা লিখে দিলেন! ধন্দ তো একটা রয়েই যায়। ভদ্রলোককে দেখে মনে হয় ওঁর কোনো তাড়া নেই…হাতে অনেক সময় ( আমার দলের লোকজনেরা তো সাংবাদিক দেখেই গদগদ। তারা ধরেই নিয়েছে পরের দিন কাগজের একেবারে প্রথম পাতায় বিরাট করে খবর ছাপা হবে। কিন্তু সে খবর বেরিয়েছে পাক্কা দেড় সপ্তাহ পরে। তাও একেবারে ভেতরের পাতায়…দু-চার লাইন। ইন্টারভিউ শুরুর আগে হাসিহাসি মুখ করে যে গ্রুপ ফটো তোলা হয়েছে তা ক্যামেরাবন্দী হয়েই রয়ে গেছে। ছাপা আর হয়নি)।
    ভদ্রলোকের স্ত্রী ( বোধহয় তৃতীয় পক্ষ) নাকি আমাদের অভিধানের প্রথম খণ্ড নিয়ে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত। তারপরই ঝুলি থেকে বেড়ালটা বেরোলো। এতক্ষণ ধরে যে কথাটা বলার জন্য উশখুশ করছিলেন সেটা পেড়েই ফেললেন। সাংবাদিকের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল গল্প লিখিয়ে হতে চাওয়া এক মানুষ। উনি এখন প্রাণপনে চাইছেন ইন্টারভিউ-দাতা হয়ে উঠতে। আমি একের পর এক প্রশ্ন করে যাব। আর উনি তারিয়ে তারিয়ে জবাব দেবেন। আকারে ইঙ্গিতে যেটা বোঝাতে চেষ্টা করছেন সেটা হল উনি নাকি একটা নাটক লেখার কাজে হাত দিচ্ছেন ( এখন একটা কথা লোকে খুব খাচ্ছে… ঔপন্যাসিকেরা নাকি নাট্যকারদের চেয়েও অনেক ভালো নাটক লিখতে পারেন)। মোটামুটি প্লটটাও সাজিয়ে ফেলেছেন। একেবারে মারকাটারি প্লট। দুটো অংক থাকবে তাতে। সে দুটোতেই টানটান উত্তেজনা। প্লটে কিছুটা জল মেশাতে হতে পারে। নাটকের প্রধান চরিত্র হল উচ্ছৃংখল জীবনযাপনে অভ্যস্ত মদ আর ড্রাগে আসক্ত এক বিদেশি মহিলা। প্রথমে উনি বললেন গল্পটা নাকি ওঁর মাথা থেকেই বেরিয়েছে। তারপর দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরানোর পরই ( আরেকটু কফি পাওয়া যাবে?) একেবারে ডিগবাজি। প্লটটা নাকি তিনি পেয়েছেন প্লাজা সেন্ট্রালের এক বুটপালিশওলার-কাছ থেকে। লোকটার এখন অনেক বয়স। কিন্তু ১৯১০ সালেও নাকি সে নাকি ঠিক এখানেই কাজ করত। তখন তার কাঁচা বয়স। আর এই মানুষটার কাছ থেকে দুধর্ষ প্লটটা পেয়েছেন আমাদের সাংবাদিক বন্ধু। ঐ বুটপালিশ-ওলার ইন্টারভিউ নিতে গিয়েই ঘটনাক্রমে গল্পটা বেরিয়ে আসে।
    তা আমাদের সংবাদিক মহাশয়টি বেশ করিৎকর্মা। নিশ্চয়ই সম্পাদককে পটিয়েপাটিয়ে সোজা প্লাজা সেন্ট্রালে চলে গেছে। ওখানেই তো যত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের আড্ডা। ওখানে তাদের অনেক ঘরোয়া মেজাজে পাওয়া যায়। সেই আশাতেই বোধকরি সাংবাদিক বন্ধুটি ওখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু কবি-সাহিত্যিকদের বদলে তিনি পেলেন ঐ বুটপালিশওলাকে। এক্কেবারে নাকের বদলে নরুণ। কিন্তু এতে তাঁর লাভ বই ক্ষতি হয়নি। নিজের জুতো পালিশ হয়ে যাওয়ার পরেই তিনি লোকটার সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা গল্প করেছেন। লোকটাকে মদের লোভও দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সে বুড়ো তাতে রাজি হয়নি। কিন্তু সাঙ্ঘাতিক এক গল্প শুনিয়েছেন। গল্প নয়, একেবারে সত্যি ঘটনা। সেটা ঘটেছিল ১৯৩০-এর দশকে। গতকাল গল্পটা শোনার পর থেকেই সাংবাদিক মহাশয়ের মাথায় সেটা ঘুরঘুর করছে। কিছুতেই অন্যকাজে মন দিতে পারছেন না। গল্পটা শুনে ইস্তক সাংবাদিক বন্ধুটি দারুণ একটা গোয়েন্দা গল্প, নিদেনপক্ষে একটা নাটক লেখার প্ল্যান ভেঁজে চলেছেন।
    ঘটনাটা নিয়ে সে সময় নাকি দারুণ একটা কেচ্ছা হয়েছিল। খবরের কাগজগুলোতে মুচমুচে…রসালো খবর বেরিয়েছিল। তা সেই বুটপালিশওলার নাকি ( ১৯১০ সালে যিনি নেহাতই বালক ছিলেন, আর এখন তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন) সে সময়কার সব কাগজের হেডলাইন মনে আছে। এই অবধি বলে সাংবাদিক বন্ধু আমার দিকে জুলজুল করে চেয়ে রইলেন। বুঝতে পারছি পেট ওঁর ফুলে যাচ্ছে। সবকথা উগরে দিতে না পারলে শান্তি নেই। কিন্তু আমি ঐ ফাঁদে পা বাড়াই না। দ্বিতীয় বার কফি আসে। তারিয়ে তারিয়ে কাপে চুমুক দিই। দেখি ভদ্রলোক কখন গাত্রোত্থান করেন। তা গল্পটা সত্যিই বুটপালিশওলার কাছ থেকে শোনা নাকি ওঁর নিজের কল্পনা তা অবশ্য হলপ করে বলতে পারি না। তবে আমি যেচে কোনও প্রশ্ন করব না। ওটা আগে গল্প বা নাটকের রূপ পাক তারপর দেখা যাবে (কাচের পার্টিশনের ওপারে আকুল চোখে তাকিয়ে থাকা সহকর্মীদের জন্য একটু কষ্টও হচ্ছিল। কত আশা নিয়ে ওরা বসে আছে। সাংবাদিক মহাশয়ের কত আগ্রহ তাদের অভিধান নিয়ে! কিন্তু সাংবাদিক বন্ধুটি যে আসলে নিজের তক্কেই আছে সে আর ওরা কী করে বুঝবে?) গল্পটা শুনতে গিয়েও মাঝে মাঝে আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। একটা খুনের গল্পকে সুন্দরভাবে বুনতে গেলে যে মুন্সিয়ানার প্রয়োজন হয় সাংবাদিক বন্ধুটির তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। শুধু অনাবশ্যকভাবে খুঁটিনাটি বর্ণনা। কল্পনার জাল বুনেই চলা। বিশেষ বিশেষ শব্দ চয়ন করে তার পেছনেই ঘুরপাক খাওয়া। একেবারে তিরিশের দশকের লেখকদের মতো। শেষমেশ যা বুঝতে পারলাম গল্পটা এক ফরাসি মাফিয়ার। এই তল্লাটে একেবারে অপরিচিত একটা বন্দরে এসে এক বিদেশি মহিলার পিঠে ছুরি বসিয়ে খুন করেছে। খুনটা করেছে অদ্ভূত ভাবে। মহিলার পিঠে ঠিক চোখের মনির মতো দেখতে একটা বিউটি স্পট ছিল। ঠিক তার ওপরই লোকটা ছুরি বসিয়েছে। মেয়েটাকে দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে ঐ একই জায়গায় বার বার ছুরি চালিয়েছে লোকটা । মহিলার গায়েও শক্তি কম ছিল না। কিন্তু এই হামলা এতটাই অতর্কিতে হয়েছে যে সে আত্মরক্ষার সময়ই পায়নি।
    খুনি নিজে থেকে দোষ স্বীকার করে নিয়েছে। নিজেকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই করেনি। সে আদৌ আর ফ্রান্সে ফিরতে পারবে নাকি এই বিদেশ-বিভুঁয়ে গায়ানার জেলেই তাকে পচে মরতে হবে সে নিয়েও তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সে ছিল আশ্চর্য রকমের নিঃস্পৃহ। সে শুধু বলেছিল, সেই চল্লিশ বছর আসে যখন সে মেয়েটিকে হারিয়েছিল তখনই তো তার আসল মৃত্যু ঘটে গিয়েছিল। তারপরে এতগুলো বছর সে তো ছিল একটা জ্যান্তলাশের মতো। তাই মরতে সে ভয় পায় না। কিন্তু যে মেয়েটিকে ছাড়া সে জীবন্মৃত হয়ে ছিল তাকেই বা সে খুন করল কেন! মেয়েটিকে সে বিয়ে করতে পারেনি। বিয়েতে বাধা ছিল। তাবলে তার ভালোবাসায় কোনও কমতি ছিল না। তার ভালোবাসা ছিল ঝর্ণার মতো উদ্দাম…পাখির গানের মতো স্নিগ্ধ। মেয়েটি যখন মারা যায়…বা মারা গেছে বলে তাকে জানানো হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র সাতাশ। তারপর থেকে এই এতগুলো বছর সে একাই কাটিয়েছে। সমাজ-সংসার থেকে নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছে। মেয়েটির সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে সে পেতিত ভিলাতেই থাকত। মেয়েটিকে সে ওখানেই গোর দিয়েছে। কিন্তু মার্সেইতেই তাদের ভালোবাসা ডানা মেলেছিল। এই মার্সেই-তেই জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা সে কাটিয়েছে। বন্দরটার জীবনযাত্রাও ছিল মেয়েটির চরিত্রের মতো… অস্থির…চঞ্চলমতি…ক্ষণে ক্ষণে তার রঙ বদলে যায়। লোকটির দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে নিজের ভালোবাসা দিয়ে মেয়েটিকে একদম বদলে দেবে। ভালোবাসা দিয়েই বুনো পাখিটাকে সে পোষ মানাতে পারবে। তার ভালোবাসা ছিল সর্বগ্রাসী..যা সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দিতে পারে। কতই বা বয়স হবে তখন মেয়েটার? বড়জোর আঠেরো। আর ছেলেটির পঁচিশ। কিন্তু এই আঠেরো বছরেই জীবনের সব ওঠা-পড়া, সব ক্লেদ দেখে ফেলেছে মেয়েটি। প্রকৃত, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা সে পায়নি। আর ছেলেটি সেই অভাবই পূর্ণ করতে চায়। কিন্তু কিছুদিন পরে তারা দুজনেই বুঝে যায় দু-কূল ছাপানো যে ভালোবাসার স্বপ্ন তারা দেখছে তা অন্তত এ জীবনে আর সম্ভব নয়। মেয়টির বাবা-মা কেউ নেই, তিন কূলে কেউ নেই। ছোটবেলা থেকে শ্যাওলার মতো ভেসে বেড়িয়েছে। রোজ রাতে হাতবদল হয়েছে। তবে মাঝে তার শান্ত, স্নিগ্ধ মুখটাকে দেখলে ছেলেটির মনে হয়, ভালো সঙ্গে পড়লে মেয়েটি নিশ্চয়ই নান বা নার্সই বনে যেত। মেয়েটির কোনও মেয়েবন্ধু নেই। প্রেমিকও সেভাবে নেই। শুধু এক রাতের শরীর দেওয়া-নেওয়া। সে দুহাতে টাকা ওড়ায়, মদে চূর হয়ে থাকে। প্রতিরাতে পার্টি আর ড্রাগ। ঠিক এমন সময়েই ছেলেটির সঙ্গে তার দেখা। প্রথম প্রথম ছেলেটি ভাবে এই একটা বড় মওকা। মেয়েটিকে তো নিজের চোরা-কারবারে ব্যবহার করা যায়! মেয়েটির অনেক দোষ। বন্দরের জাহাজি আর পুলিশের সঙ্গে ঢলাঢলি করে বেড়ায়। মদ গিলে বেহেড হয়ে থাকে। কিন্তু সে কোনো নিষিদ্ধ চোরাকারবারে যুক্ত থাকতে পারে সে সন্দেহ কেউ করে না। মেয়েটা বড় বাচাল। কোনও কথা তার পেটে থাকে না। ছেলেটি ভাবে মেয়েটির এই রূপ-যৌবন ভাঙিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করে নিতে হবে। মেয়েটি মানে মারি-হোস সে অর্থে ডানা-কাটা পরী নয়। কিন্তু লাস্যে…ছলাকলায় যে কোনও পুরুষের রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। মেয়েটির উথলে ওঠা এই ভাবটাকে অনেক সময় মেকি বলে মনে ছেলেটির। কিন্তু এটাই মারি-হোসের অস্ত্র…পুরুষ বধের হাতিয়ার। মেয়েটিও ছেলেটির সঙ্গে হাত মেলায়। মাঝে মাঝে এই বন্দর থেকে পালিয়ে ছেলেটির সঙ্গে পেতিত ভিলায় আশ্রয় নেয়। তারপর আবার ফিরে আরো সব দুঃসাহসিক খেলায় নামে। পুলিশ বা বন্দর কর্তৃপক্ষকে একেবারে ঘোল খাইয়ে ব্যবসায় একেবারে ফুলেফেঁপে ওঠে তারা। গোপন আস্তানায় কাঁড়িকাঁড়ি টাকা জমাতে থাকে। এভাবেই চলছিল সব। কিন্তু এরমাঝেই মেয়েটির প্রেমে পড়ে যায় ছেলেটি। বন্দরে গিয়ে মারি-হোস আবার খালাসিগুলোর বিছানায় নিয়ে উঠবে…রাতভর পার্টিতে বেলেল্লাপনা করবে…এটা ভেবেই মনটা বিদ্রোহ করে ওঠে ছেলেটির মানে ফ্রাংকোইসের। মারিকে অন্য কারো বাহুতে দেখলেই মনে জ্বলুনি শুরু হয়ে যায় তার। কিন্তু তার হাত-পাও যে বাঁধা। ব্যবসার জন্য মারিকে কাজে লাগাতেই হবে। কিন্তু মনের জ্বালাটা তাও যায় না। মাঝে মাঝে সে মারিকে না জানিয়ে মার্সেই-তে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। মারি তাকে দেখে চোখে-চোখে গোপন শলা করে নেয়। দু-তিন দিনের মধ্যে কার্যোদ্ধার করে মারি আবার তার কাছে ফিরে আসে। সোহাগে-ভালোবাসায় একে-অপরকে ভরিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে পাখি পোষ মানে। রগরগে মেয়েটার ভেতর থেকে একটা পেলব মন বেরিয়ে আসে। চোখ-মুখ থেকে উচ্ছৃঙ্খল জীবনের ছাপ মুছে গিয়ে একটা কমনীয়তা আসে। মারিকে দেখে এখন মনে হয় যেন নিষ্পাপ…ফুলের মতো এক কিশোরী।
    কিন্তু তলে তলে যে বিপদ দানা বাঁধছে তা ফ্রাংকোইস টেরই পায়নি। তার এই রমরমা কারবার দেখে আগেকার চ্যালা চামুণ্ডাদের বা শত্রুপক্ষের মাফিয়াদের চোখ টাটিয়ে যায়। তারা কড়া নজর রাখের ফ্রাংকোইসের ওপর। জাহাজে জাহাজে কীভাবে ফ্রাংকোইস চোরা মাল চালান করে তা নিয়ে সবারই একটা সন্দেহ জাগে। এই খেলায় মারি-হোস-ই নাটের গুরু তা হাতে নাতে না ধরতে পারলেও সন্দেহ তো একটা রয়েই যায়। তাই শত্রুপক্ষের নজরদারি আরো কড়া হয়। ফ্রাংকোইস সেটা বুঝতেও পারে। এমন করেই বছর দুই কাটে। ফ্রাংকোইস ছক কষেছিল চার বছরের মধ্যে কয়েক কোটি টাকা কামিয়ে নিয়ে ধান্দা ছেড়ে দেবে। তারপর সবার চোখের আড়ালে গিয়ে মারিকে নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেবে।
    কিন্তু বিধি বাম। হঠাৎ করে মারির মৃত্যুটা তাকে একেবারে খাদের মুখে ফেলে দিল। জীবন থেকে সব রঙ মুছে গেল তার। সেই ভয়াবহ রাতটার কথা সে জীবনেও ভুলবে না। এমনিতে ফ্রাংকোইস যখন বন্দরে গিয়ে কারবার করে তখন মারি থাকে তাদের গোপন ডেরায়। সে রাতে ফ্রাংকোইস ডেরায় ফিরে দেখে সবকিছু একেবারে লণ্ডভণ্ড। পাই-পয়সা-টা পর্যন্ত চুরি হয়ে গেছে। ঘরের মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত। তারপর মর্গ থেকে ডাক আসে। লাশ সনাক্ত করতে হবে। এ নির্ঘাত কোনো শত্রুপক্ষের কাজ। কিন্তু কারা? অনেক চেষ্টা করেও কয়েক বছরেও সে কোনো কিনারা করতে পারল না। কোনো সূত্র নেই…কোনো সন্দেহভাজন নেই! এতে মনে সন্দেহ জাগাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ফ্রাংকোইসের মনে কোনও সন্দেহই জাগেনি। মারির মৃতুকে তাকে একেবারে পাথর করে দিয়েছিল।
    সেদিন রাতে সে ছুটতে ছুটতে ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছেছিল ( কিন্তু শহরে এত বড় হাসপাতাল থাকতে এই একটা ঘুপচি ক্লিনিকে কেন আহত মানুষটাকে আনা হল সে প্রশ্নও ফ্রাংকোইসের মনে জাগেনি। মাথাটা একেবারে ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল)। ক্লিনিকের লোকজনেরা অবশ্য তাকে বুলেটবিদ্ধ দেহটাকে দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রেয়সীর নিথর, ক্ষত-বিক্ষতটাকে শরীরটাকে সে দেখতে চায়নি। তার মনে মারির যে ছবিটা আঁকা হয়ে রয়েছে সেটাই নাহয় শাশ্বত হয়ে থাক। দরকারি সব কাগজ-পত্রে সে সই করে দিয়েছিল…অন্ত্যেষ্টির সব খরচ-খরচাও দিয়ে দিয়েছিল। মাসের পর মাস ছোট্ট সমাধি ক্ষেত্রটায় এসে সে চুপচাপ বসে থাকত। চোখের জলে বুক ভেসে যেত। সমাধিফলকে শুধু একটা কথাই লেখা ছিল ‘মারি-হোস’। আর কিচ্ছু না। সময় বয়ে যায়। এখন আর সে সমাধির কাছে এসে বসে থাকে না। বয়সও অনেক হল। পুরোনো ধান্দাতেই আবার জুটে গেছে। কারণ আর অন্য কিছু তো সে শেখেনি। এবার চোর, ডাকাত, খুনি যাকেই পায় তার সঙ্গে ধান্দাতেই নেমে পড়ে। কিচ্ছু বাছবিচার করে না। তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাই যখন আর নেই! এখন আর অত দাঁও মেরে কাজ নেই। নিজের দিন গুজরানের জন্য অল্প কিছু রোজগার হলেই হল। মারি যখন সঙ্গে ছিল তখন সে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখত। এখন মারিও নেই, আর সে স্বপ্নও নেই। অনেক পরিবর্তন এল তার মধ্যে। সে এখন অনেক ভদ্র, নম্র। লোকজনেরা সমীহ করে চলে।
    পাঁচ বছর আগে সেই মোক্ষম ঘটনাটা ঘটল। এক দাগি জেলখাটা অপরাধী আমেরিকা থেকে ফিরে বন্দরের বন্ধু-বান্ধবদের কথায় কথায় জানায় যে একদম মেরি-হোসের মতো এক মহিলাকে আটলান্টিকের ওপারে সে নাকি দেখে এসেছে। সেখানে এ রকম একটা বন্দরেই নাকি সেই মহিলার বাস। কথাখানা একান-ওকান হতে হতে ফ্রাংকোইসের কানেও পৌঁছয়। সে তো রীতিমতো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কিন্তু মন থেকে ব্যাপারটা কিছুতেই মুছে ফেলতে পারে না। সেদিনই বাস ধরে চলে যায় সমাধিক্ষেত্রে। তার প্রিয়তমার কবরটা শুকনো পাতায় ঢেকে গেছে। সমাধিফলকে এখনও মারি-হোস নামটা জ্বলজ্বল করছে। শুধু মারি নয় এখানে যে মাটির নীচে চাপা পড়ে রয়েছে তার সব আশা…সব স্বপ্ন। আকণ্ঠ গিলে চূর হয়ে বসে থাকে ফ্রাংকোইস।
    কয়েক মাস পরে হঠাৎ করে এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। এই বন্ধুটির কাছেই ঐ জেল ফেরত আসামী মারি-হোসের মতো দেখতে মেয়েটির গল্পটা করেছিল। ঐ আসামীর কাছ থেকেই ঐ বন্দরের কথা জেনেছিল ফ্রাংকোইসের বন্ধু। মহাসাগরের ওপারের বন্দরে যে মেয়েটা থাকে তার নাম নাকি মারি-ইনেস। একেবারেই বিগতযৌবনা। স্থানীয় ভাষায় চোস্ত হলেও কথাবার্তায় বিদেশি টান নাকি একটা রয়েই গেছে। ঐ জেলফেরত আসামী নাকি ঐ বন্দরে ফূর্তি করতে গিয়ে মারি-ইনেসের সঙ্গে এক রাতও কাটিয়েছে। সে মহিলার পিঠে নাকি অদ্ভূত একটা বিউটি স্পট রয়েছে…ঠিক চোখের মণির মতো।
    থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে ফ্রাংকোইস। এ কী নিছক সমাপতন! চোখের মণির মতো বিউটিস্পট! না না, ওটাতো একটা উল্কি। প্রথম যৌবনের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। মারিকে দেখে দেখেও তার আশ মিটত না। মারিকে সে ইচ্ছে মতো সাজাত…একেবারে পুতুলের মতো। জাহাজিগুলোর উল্কি দেখে মারি বায়না করেছিল তারও নাকি ঐ রকম একটা উল্কি চাই। মারির কথা রাখতে তার পিঠে একটা ফুলের উল্কি করে দিয়েছিল ফ্রাংকোইস। মারির জন্য সে নিজে উল্কি করা শিখেছিল। এই দায়িত্বটা সে অন্যকাউকে দিতে চায়নি। মারির যদি বেশি ব্যথা লাগে! মারির পিঠে আঁকার আগে রীতিমতো নিজের হাতে মকশো করে সে হাত পাকিয়েছিল। মারির পিঠে সূঁচটা ঠেকানোর আগে তার একবার হাত কেঁপে উঠেছিল! এত সুন্দর শরীরটাকে ক্ষত-বিক্ষত করতে মন সায় দিচ্ছিল না । কিন্তু মারির পিঠে বাহারি ফুলটা ফুটে উঠতেই সব আশঙ্কা দূর। মারিও আনন্দে আত্মহারা। দুটো আয়না দিয়ে কায়দা করে বার বার নিজের এই বিউটিস্পট দেখেই যায়।
    ফ্রাংকোইস এবার একটা নতুন খেলা শুরু করে। সত্যিটা যে তাকে জানতেই হবে। আমেরিকা থেকে জাহাজে করে যে সব পর্যটক আসে তাদের পেছনে সে ঘুরঘুর শুরু করে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারে কার কাছে গেলে সুবিধা হবে। রোদে পোড়া চামড়া, হাতের উল্কি দেখেই সে বুঝতে পারে কোন লোকটি বন্দরে থাকে। বন্দরের লোকজনেদের চোখমুখে একটা উচ্ছৃংখল জীবনের ছাপ থাকে তো! এই করতে করতেই এক ভবঘুরে ছোকরার সঙ্গে তার মোলাকাত হয়ে যায়। সে ছোকরা আবার ইউরোপীয় নয় ( এই অবধি বলে সাংবাদিক বন্ধুটি একটু জিরিয়ে নেয়… ‘তা আমি সেই বুটপালিশওলাকে জিগ্যেস করছিলাম “ এই ভেনেজুয়েলান ছোকরাটি কে? তুমি নয়তো? সে বান্দা কথাটা স্বীকারই করেনি’। আমি বলি… ‘ব্যাপারটাকে কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেদিনকার সেই দাগী আসামী হিসাবে এখন আর কেউ ওকে চিনতে পারবে না। তারওপর চল্লিশ বছর আগেকার কথা। কথাটা একেবারে লুফে নেন সাংবাদিক বন্ধুটি… ‘তা ঠিক। যে ছেলেটা সেদিন প্লাজায় বুট পালিশ করত সেই আজ বয়স কালে গল্পটা বলছে। আর তখনকার সব খবরের কাগজের হেডলাইনও মনে রেখেছে। সুতরাং, এই মানুষটিই হয়তো সেদিনকার সেই ভবঘুরে ছোকরা। ফ্রাংকোইস আর মারি-হোসের মধ্যে যোগসূত্রটা হয়তো ঐ ছোকরাই। হওয়াটা কিছু অস্বাভাবিক নয়।)
    যৌবনে যত টাকা ফ্রাংকোইস কামিয়েছিল ততটা আর কোনোদিনও রোজগার করতে পারেনি। তবে প্রাচুর্য না থাকলেও স্বাচ্ছল্য ছিল। খেয়ে পরে ভালোই কাটছিল। তাছাড়া কিছু সঞ্চয়ও ছিল। যে বিপজ্জনক খেলায় সে নেমে পড়েছে তাতে টাকা ঢালতেও তার কার্পণ্য নেই। পাগলে মতো ভালোবেসেছিল সে। এখন তার মনে শুধুই সন্দেহ আর ঘেন্না ( হয়তো বা কিছুটা জিঘাংসা)। ঐ ভবঘুরে ছোকরাকে সে বাড়িতে এনে তোলে। তার পেছনে দেদার টাকা ওড়ায়। তার জন্য বন্দর থেকে নিত্যনতুন মেয়ে এনে দেয়। কাঁড়ি কাঁড়ি মদ গেলায়। এই করে দুজনের মধ্যে অদ্ভূত একটা বোঝাপড়া গড়ে ওঠে (সে ছোকরারও অবশ্যি একটু যত্ন আত্তির প্রয়োজন ছিল)। তবে এটা বোঝাপড়া নাকি ব্ল্যাকমেইল তা বলা মুশকিল। আসলে টাকা ছড়িয়ে সেই ছোকরাকে কিনে ফেলেছিল ফ্রাংকোইস। আর উপকারীর উপকারে লাগতে ছোকরারও কোনও আপত্তি ছিল না। তাছাড়া ফ্রাংকোইস তাকে যে কাজটা দিয়েছিল সেটা তো একেবারে জলের মতো সোজা। শুধু নিজের দেশে ফিরে গিয়ে পুয়ের্তো কাবেলো-বন্দরে কিছুদিন কাটিয়ে ড্রাগ আর মদে আসক্ত এক বয়স্ক মহিলা খুঁজে বের করতে হবে। তারপর কোন একটা ছুতোয় তার সঙ্গে একটা রাত কাতিয়ে পিঠটা ভালো করে দেখতে হবে। এ আর এমন কঠিন কী কাজ! ফ্রাংকোইসের কাছ থেকে টাকাপয়সা নিয়ে সে ছোকরা দেশে ফিরে গিয়ে কাজে নেমে পড়ে।
    এর মধ্যে পুরসভার কাছ থেকে মারি-হোসের কবরটা খুঁড়ে কফিনটা খুলে দেখার অনুমতি জোগাড় করে নেয় ফ্রাংকোইস (তারজন্য পুরসভার কেষ্টবিষ্টুদের হাতে রাশি রাশি টাকাও গুঁজে দিয়েছিল)। খুব সাবধানে পা ফেলছিল সে। এক নির্জন দুপুরে কফিনটা খুলে তার চক্ষু চড়কগাছ। কফিনের ভেতর শুধু কিছু নুড়ি পাথর আর কয়েকটা জামা-কাপড়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতিগুলো তার মরে গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক মুহূর্ত থেকে এক ভয়ংকর ক্রোধে সে পাগল হয়ে ওঠে। শিরায়-ধমনীতে দামাল রক্তকণাগুলো উন্মত্তের মতো ছোটাছুটি শুরু করে। যে মনে একদিন ছিল ভালোবাসা সেখানে আজ শুধু ঘৃণা আর আক্রোশ। কম বয়সের কথা মনে পড়ে যায়। তখন সে মারির জন্য জীবনের সবকিছু উজাড় করে দিতে পারত…তার পায়ে সর্বস্ব সবকিছু বিলিয়ে দিতে পারত। কিন্তু আজ সে নিজের সবকিছু উজাড় করে দিয়ে মারিকে ধ্বংস করে দিতে চায়। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে চায় । আসলে মারির মতো মেয়েরা কাউকে ভালোবাসতে পারে না ( অন্য পুরুষদেরও সে নিশ্চয়ই এভাবেই ঠকিয়েছে)। ভালোবাসার রাতগুলোর কথা ভুলতে এই সব মেয়েদের এক মিনিটও সময় লাগে না। একেবারে থম মেরে যায় ফ্রাংকোইস। কয়েক সপ্তাহ সে নিজেকে একেবারে ঘরবন্দী করে রাখে। মারির সঙ্গে কাটানো পুরোনো দিনগুলোর কথা ভাবে। স্মৃতির সরণি বেয়ে হেঁটে চলে বেড়ায়। মারির সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত ছবির মতো ভেসে আসে তার চোখের সামনে। কিন্তু আজ সে হৃদয় খুঁড়ে দেখে যে সেখানে আর কোনো বেদনা জাগে না, জেগে ওঠে শুধু উদগ্র ঘৃণা।
    সেই ছোকরার ফিরে আসা অবধি তাকে অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু সে এখন নিশ্চিত যে মারি এখনও বেঁচেই রয়েছে। কিন্তু কেন এই ছলনা? কেন মারি তাকে এমনভাবে ঠকালো? তবে কার সঙ্গে সে পালাল? ফ্রাংকোইসের চোখের সামনে শত শত মুখ ভেসে আসে যাদের সে কখনো না কখনো পানশালায় মারির পাশে দেখেছে। ওকি কোনো নাবিকের সঙ্গে পালিয়েছে? নাকি একরাতের কোনো খদ্দেরের সঙ্গে? আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে ও এমন কারো সঙ্গে পালিয়েছে যাকে ফ্রাংকোইস কোনোদিন সন্দেহের তালিকাতেই রাখেনি।
    রাতের পর রাত সেই মুখগুলো হাতড়ে চলে ফ্রাংকোইস। কিন্তু ঠাওর করতে পারে না। মুখের সারিগুলো প্রেতাত্মার মতো চোখের সামনে আসে…আবার বাতাসে মিলিয়ে যায়। এর মধ্যে সেই ভবঘুরে ছোকরা ফিরে আসে। সে তো মহা উৎসাহে নিজের ঝাঁপি খুলে সবে ( আসলে আগেকার গল্পটাতো তার জানা ছিল না)। ছোকরার কথা শুনে ফ্রাংকোইসের মনে আর কোনো সন্দেহ থাকে না। ঐ মহিলাই মারি হোস। অন্য কেউ হতেই পারে না। জীবনের সেরা সময়টা কাটিয়ে আসার পর সে মহিলা মুখফসকে আগেকার জীবনের অনেক কথাই মাঝে সাঝে বলে ফেলেছে। ছোকরার এক সঙ্গে একরাত কাটিয়ে বকবক করতে করতে দু-একটা গোপন কথাও বলেছে। ভাঁজ পড়া চামড়ার এই বয়স্ক মহিলাকে দেখে ছোকরার প্রথমে মোটেই ভক্তিছেদ্দা জাগেনি। নেহাতই কাজের খাতিরেই তাকে খদ্দের সাজতে হয়। কিতু যৌবন না থাকলে কি হবে বিছানায় সে মহিলার ছলাকলায় ছোকরা একেবারে কুপোকাত। মহিলা ঘুমিয়ে পড়তেই সে ছোকরা কায়দা করে পিঠে আঁকা উল্কিটা দেখে নেয়। ছোট্ট একটা ফুল… বেগুনি পাপড়ি। সে মহিলা নাকি সারাদিনই মদে চূর হয়ে থাকে। মাঝে মাঝেই খুব শরীর খারাপ হয়। প্রায়ই মার্সেই-এর কথা ভাবে। একবার নাকি সে মার্সেই-তে ফিরে এসে একজনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু পারেনি। এই ক্রান্তীয় জলবায়ুর মদিরতায় একেবারে স্থবির হয়ে পড়েছিল। একবার সে একজনের মৃত্যুর খবরও পেয়েছিল। অনেক খোঁজ খবরও করেছিল। সেই মানুষটির অন্ত্যেষ্টিতে হাজির ছিল এমন একজন সাক্ষীকেও নাকি সে পেয়েছিল।
    কিন্তু এখন সে কোথায় থাকে? কার সঙ্গে থাকে? কী করে? ফ্রাংকোইসের মনে অনেক প্রশ্ন। যা খবর জোগাড় করা গেছে ছোকরা সেসবই উগরে দেয়। সে মহিলার নাকি প্রচুর টাকা। বিরাট বাড়ি। সাঙ্ঘাতিক বিলাসী। জীবনে কোনো লক্ষ্য নেই…কোনো আশা-আকাঙ্খাও নেই। শুধু প্রমোদে গা ভাসিয়ে দেওয়া। মহিলার কোনো বাঁধা খদ্দেরও নেই। যখন যাকে পায় তার সঙ্গেই গিয়ে জোটে। সাকুল্যে দুবার-কি তিনবার ছাড়া বিদেশি খদ্দেরকে সে কোঠায় তোলেনি। সে বলে, স্থানীয় পুরুষমানুষেরা নাকি অনেক আকর্ষণীয়। তাদের যা তাকত ( মহিলার সঙ্গে কয়েক রাত কাটানো ঐ কালোকোলো লোকটার মতোই। তার সঙ্গে আবার ঐ ভবঘুরে ছোকরাটার আলাপও হয়ে গিয়েছিল) বিদেশিগুলোর তার ছিটেফোঁটাও নেই।
    কিন্তু কীসের জন্য? কীসের জন্য এতটা পথ পাড়ি দেওয়া? নিজের নাম বদলানো? মারি এতসব করল কেন? কীসের আশায়? ফ্রাংকোইস কোনও জুতসই জবাব পায় না। তবে এই নতুন জায়গায় এসে মারির মন বসেনি। পুয়ের্তো কাবেলোর জীবনের স্রোতে শুধু নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে। প্রথম প্রথম ঐ ‘ভদ্দরলোক’গুলোর সতী-সাধ্বী বউয়েরা এসে শাসিয়ে যেত। কিন্তু পরে সেসব মিটেও গেছে। পরে কয়েকটা ভদ্র পরিবারের সঙ্গে তার বন্ধুও হয়ে গেছে। ছোকরা তো যা জানে সব উগরে দেয়। কিন্তু ফ্রাংকোইস-তো রয়েছে অন্যতালে। ছোকরার বর্ণনা শুনে নিজের কাহিনির শূন্যস্থানগুলো ভরাট করে নেয়। পুয়ের্তো কাবেলোর ঐ মহিলাই মারি হোস। অন্য কেউ হতেই পারে না। কিন্তু কেন সে এসব করল?
    ছোকরার পেট থেকে সব আদায় করে নিয়েই তাকে পত্রপাঠ বিদেয় করে দেয় ফ্রাংকোইস। ঘেন্না, বিদ্বেষ…প্রতিহিংসা ছাপিয়ে তার মনে এখন শুধু একটাই প্রশ্ন। কেন দরকার হল এই অভিনয়ের। সে তো মারিকে জীবনের সবকিছু উজাড় করেই দিয়েছিল তবু কেন দরকার হল এই চুরির? এত বছর কেন সে এভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকল? এই রহস্যটা ফ্রাংকোইসকে নিজেকেই ভেদ করতে হবে। কোনও গোয়েন্দা লাগিয়ে হবে না। তবে এটাও ঠিক যে ঐ মহিলাকে পেলে একটা খুনোখুনি হবেই।
    আবার নতুন করে নিজেকে গুছিয়ে নেয় ফ্রাংকোইস। তার জীবনের সবটা জুড়ে এখন মারি-হোস। মারি হোস ছাড়া তার জীবনে কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু ছিল না, কিচ্ছু থাকবেও না। তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ ঐ একটা বিন্দুতে এসেই মিলেছে। মার্সেই-তে যে অল্প কাজকর্ম বাকি ছিল সে মিটিয়ে নেয়। তারপর টাকাপয়সা যোগাড় করে নিজের এই চিরপরিচিত জায়গা, নিজের ভাষা আর নিজের বন্ধু-বান্ধবদের চিরকালের মতো বিদায় জানিয়ে জাহাজে গিয়ে ওঠে।
    এই জাহাজেই ফ্রাংকোইসের সঙ্গে আমাদের ঐ বুটপালিশওলার আলাপ যাকে আমরা সেই ভবঘুরে ছোকরা বলে ধরে নিতেই পারি। ফ্রাংকোইসের সঙ্গে সে একেবারে পুয়ের্তো-কাবেলো পর্যন্ত যায়। জাহাজে তাদের একেবারে গলায় গলায় বন্ধুত্ব। একসঙ্গে মদ খায়, গল্প-গুজব করে। তবে ফ্রাংকোইস কিন্তু ঘুণাক্ষরেও মেয়েটির কথা তোলেনা। সে এই নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়েছে তার কোনো স্পষ্ট জবাবও কাউকে দেয় না।
    যাইহোক, পুয়ের্তো কাবেলোয়-পৌঁছে ফ্রাংকোইস একেবারে দিশেহারা। এই ক্রান্তীয় অঞ্চলের চড়া রোদ, আর গরমে একেবারে কুপোকাত। সে প্রকাশ্যে খুব একটা ঘোরাফেরা করতে চায় না। এর মধ্যেই স্থানীয় এক লোকের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলে। সেই লোকের হাতে টাকাপয়সা গুঁজে দিয়ে গোপন আস্তানার ব্যবস্থাও করে নেয় । সেই লোকটা তার দোভাষীর কাজ করে দেয়। রাতের বেলা তাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোয়। কখনো পায়ে হেঁটে কখনো ট্যাক্সিতে। এই ঘোরাঘুরির একটাই উদ্দেশ্য মারিকে খুঁজে বের করা। এর মাঝেই তাকে মারি-ইনেসের বাড়ির কাছে নিয়ে আসে সেই লোক। ফ্রাংকোইস মারি-ইনেস-কে দেখে। এবার থেকে ঘাপটি মেরে থেকে মারি-ইনেসের সব গতিবিধির ওপর সে লক্ষ্য রেখে যায় । মারি ইনেস বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে…গাড়িতে উঠছে…। নাহ, এ মহিলাই তার মারি-হোস। অন্য কেউ হতেই পারে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু পৃথুলা হয়েছে…রূপের জৌলুস কমে এসেছে…সেদিনকার সেই ছটফটে অষ্টাদশীর উচ্ছ্বলতাও আজ নেই। কিন্তু মারিকে তার চিনতে ভুল হয়নি। চেহারায় বদল এলেও সেই একই হাঁটাচলার চলার ধরণ…সেই একই বাঁকা চোখের চাউনি। ভুল করার আর অবকাশই নেই।
    মহল্লার লোকজনেরা অবশ্য ফ্রাংকোইসকে দেখে কোনো সন্দেহই করেনি। বুড়ো-হাবড়া একটা লোক…সে যে খুনের মতো একটা জঘন্য কাজ করতে পারে তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। বুড়ো মানুষটা মারি-ইনেসের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় আর ফেলে আসা দিনগুলোর কথায় বুঁদ হয়ে থাকে। তিন দিন বাদে মারি-ইনেস থুড়ি মারি হোসের ছুরিকাবিদ্ধ লাশখানা মেলে। সারা দেহে কোনো ক্ষত-চিহ্ন নেই। শুধু পিঠের উল্কির জায়গাটা ক্ষতবিক্ষত। প্রবল আক্রোশে বার বার সেখানে ছুরির কোপ বসানো হয়েছে।
    এর পরের অংশটা সেই বুটপালিশওলার সত্যিকারের গল্প নাকি আমাদের সাংবাদিক বন্ধুর উর্বর মাথার সৃষ্টি তা অবশ্য বলা মুশকিল। ফ্র্যাংকোইস কি মারির কাছ থেকে কোনও জবাবদিহি চেয়েছিল? কোন উপন্যাসে বা দুই-অংকের নাটকের কি প্রধান চরিত্রের স্বীকারোক্তি কি থাকতেই হবে? বোধহয় না। বুটপালিশওয়ালা আর আমাদের সাংবাদিক বন্ধু দুজনের বক্তব্যই এখানে এক। মারি কারো কাছে কোনও জবাবদিহি করেনি। সে নিজের মর্জির মালিক। নিজের শর্তে সে জীবন-যাপন করেছে। ফ্রাংকোইস তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করত। সেই সুযোগটাই সে নিয়েছে। সে অন্য কারো সঙ্গে পালায়নি। অন্য কাউকে মন দেয়নি। এই অর্থে ফ্রাংকোইসকে সে ঠকায়নি। সে নিজের ইচ্ছেতে চলে গেছে। একাই। ফ্রাংকোইস যেদিন মর্গে কফিনটা আনতে গিয়েছিল সেদিন মারি মার্সেইতেই এক গোপন ঘাঁটিতে লুকিয়েছিল। শেষ মুহূর্তেও তার রসবোধ যায়নি। তাই বন্ধু-বান্ধবদের জুটিয়ে ভয়ংকর একটা মজা করতে চেয়েছিল। ফ্রাংকোইস যদি সেদিন কফিনটা খুলে দেখত তাহলেই সব ভুল-বোঝাবুঝি মিটে যেত। মারিও হয়তো মনে মনে সেটাই চেয়েছিল। সে ভেবেছিল কফিনটা খোলার পরই সে আবার ফ্রাংকোইসের কাছে ফিরে যাবে। এই বীভৎস মজাটার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেবে। তারপর আবার নিজেদের মধ্যে বনিবনা হয়ে যাবে। কিন্তু ফ্রাংকোইস-তো কফিনটাই খুলে দেখেনি। সে তো প্রথম থেকেই ধরে নিয়েছিল যে মারি মরে গেছে। তাই অভিমানে মারিও আর তার ভুলটা ভাঙাতে যায়নি। নিজেই সরে গেছে। অভিমানী মন যে বড় অবুঝ!
    লেখক পরিচিতি
    হোসে বালজা ( ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৯— )
    তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির সমালোচক। পড়াশোনার জন্য ভেনেজুয়েলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে আসেন রাজধানী ক্যারাকাসে। সেখানে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি লাভ করেন।
    নিজের রচনায় মূলত মানুষের মনস্তত্বের নানার পরত তিনি আবিষ্কার করে গেছেন। তাঁর মতে একই মানুষের মনে লুকিয়ে থাকে বহু সত্তা। শৈশব থেকে শুরু করে বার্ধক্য পর্যন্ত প্রতিটা মুহূর্তে আমরা নিজেরা তো বদলাচ্ছিই, সেইসঙ্গে, অন্যদের জীবনেও বদল আনছি। এই বিশেষ শৈলীই তাঁকে লাতিন আমেরিকার সাহিত্য জগতে স্বতন্ত্র করে তুলেছে। এই শৈলীকেই বলা হয় ‘সাইকোপ্যাথোলজি’।
    তাঁর রচনা ইতালিয়ান, ফরাসি, ইংরেজি, জার্মান ইত্যাদি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘Percusion’ (১৯৮২)। আর সবচেয়ে সাড়া জাগানো ছোটগল্প সংকলন ‘La mujer de Espaldas’ (১৯৯০)।
    এই সংকলনের ‘উল্কি’ গল্পটি তাঁর ‘আ উওম্যান’স ব্যাক’ গল্পের অনুবাদ। এটি তাঁর সাইকোপ্যাথলজি ঘরানারই অন্যতম সেরা দৃষ্টান্ত।

  • অনুবাদ

    অনুবাদ- কফন

    কফন (মুন্সি প্রেমচাঁদ)
    -বর্ণালী জানা সেন

    ঘরের দাওয়ায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বাপ-বেটা। চুলার আগুন নিভে এসেছে। ঘরের ভেতর বেটার বউ বুধিয়া প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে। প্রবল যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে এমন আর্তনাদ করে উঠছে যে বাপ বেটাকে বুকে হাত চেপে মনকে শান্ত করতে হচ্ছে। শীতের রাত। চারিদিক নিস্তব্ধ…শুনশান। পিচকালো অন্ধকারে ডুবে আছে সারা গ্রাম।
    ঘিসু বলে… ‘মনে হয় ও আর বাঁচবে না। সারা দিন ধরে যন্ত্রণায় আছাড়ি পিছাড়ি খাচ্ছে। গিয়ে দেখ কী হাল ওর’।
    বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে মাধবের। বিষণ্ণ গলায় সে বলে… ‘মরলে মরবে। আমি দেখে আর কী করব?’
    ‘তুই কি পাষাণ? সারা বছর ধরে ওর সঙ্গে ফূর্তি করলি আর এখন এমন বেইমানের মতো কথা বলছিস’।
    ‘ ওর এই যন্ত্রণা চোখে দেখতে পারছি না’।
    সাধারণ চামারের বাড়ি এটা। এ বাড়ির বদনাম সারা গাঁয়ে। একদিন গতর খাটিয়ে কাজ করলে পরের তিনদিন শুয়ে বসে থাকবে ঘিসু। বেটা মাধব এক আরো এক কাঠি ওপরে। কুঁড়ের হদ্দ। এক ঘণ্টা কাজ করলে আরেক ঘণ্টা সে ছিলিম টানবে। তাই ওদের আর কেউ কাজে ডাকে না। বাড়িতে একমুঠো চাল থাকলে বাপ বেটা কেউ কাজ করবে না। তার দু এক দিন উপোস গেলে ঘিসু গাছের ডালপালা কেটে আনে। আর মাধব সেটা বাজারে বেচতে যায়। হাতে যতক্ষণ টাকা থাকবে ততদিন কোনো কাজ না করে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে তারা। তারপর ক্ষিদের জ্বালা সহ্য করতে না পারলে আবার গাছের ডালপালা কাটবে…এদিক ওদিক কাজের খোঁজ করবে। গাঁয়ে কাজের কোনো অভাব নেই। চাষাভুষো মানুষেরই বাস এই গাঁয়ে। কাজ করতে চাইলে হাজারটা কাজ পাওয়া যায়। খুব বাধ্য না হলে এই বাপ-বেটাকে কেউ কাজে ডাকে না। ডেকেই বা কী হবে! দুজনে মিলে একজনেরও কাজ করবে কিনা সন্দেহ।
    তারা যদি সাধু সন্ত হত তাহলে তাদের মনের শান্তি, আর ধৈর্যের জন্য বিশেষ কিছুই করতে হত না। কারণ এটা তো তাদের স্বভাবেই রয়েছে। অদ্ভূত জীবন তাদের। দু তিনটে মাটির হাঁড়ি ছাড়া বাড়িতে আর কিচ্ছু নেই। শতচ্ছিন্ন জামাকাপড় পরে তারা লজ্জা নিবারণ করে। গলা অবধি দেনায় ডুবেও কোনো কিছুতে তাদের কোনো হেলদোল নেই। পাওনাদাররা তাদের গালাগালি করে মারধরও করে কিন্তু কিছুই তাদের গায়ে লাগে না। কোনো কিছুতেই তাদের কষ্ট হয় না। তাদের ধার দিয়ে শোধ পাওয়ার আশা করে না কেউ। তা সত্ত্বেও গাঁয়ের লোকজন এটা ওটা দিয়ে থাকে তাদের। মরশুম এলে তারা মাঠ থেকে আলু আর মটরশুঁটি তুলে এনে আগুনে পুড়িয়ে খায়। তানা হলে আখের খেত থেকে পাঁচ-দশটা আখ এনে ছিবড়ে চুষেই তারা রাত কাটিয়ে দেয়। এইভাবেই নিজের জীবনের ষাটটা বছর কাটিয়ে দিয়েছে ঘিসু। সুযোগ্য ছেলের মতো সবকিছুতে বাবাকেই অনুসরণ করছে মাধব। কোনো সময় বাপকেও সে ছাড়িয়ে যায়।
    আগুনের ধারে বসে তারা আলু পোড়াচ্ছে। কারো একটা খেত থেকে এই আলু তারা তুলে এনেছে। ঘিসুর বউ তো কবেই মরে ফৌত। গেল বছর মাধব বিয়ে করেছে। বাড়িতে বউ আসার পর তাদের ছন্নছাড়া জীবনে একটু শ্রী এসেছে। ধান ভেনে, ঘাস কেটে সে দু এক সের আটা জোগাড় করে আনে। এইভাবে নির্লজ্জ বেসরম দুটো মানুষের মুখে খাবার জুগিয়ে যায়। ঘরে বউ আসার পর বাপ-বেটা দুজনেই আরো কুঁড়ে হয়ে গেছে। এখন আর কুটিগাছটি নাড়তেও চায় না তারা। একটু নবাবি চালও এসে গেছে তাদের মধ্যে। কেউ কোনো কাজের জন্য ডাকতে এলেও তারা নড়তে চায় না। তার ওপর দুগুন মজুরি চেয়ে বসে। এখন তারা বসে আছে বউটা মরার অপেক্ষায়। ও আবাগী মরলেই তারা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে।
    চুলা থেকে একটা আলু তুলে খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ঘিসু বলে… ‘ যা বেটা, বউয়ের কী অবস্থা একটু দেখে আয়। মরলে ভূত পেত্নীর উপদ্রব সহ্য করতে হবে। এর বেশি কিছু তো আর নয়। এখানে ওঝা এলেও এক ট্যাকা চেয়ে বসবে। কোত্থেকে জোগাড় করি এই ট্যাকা!’
    ঘরের ভেতরে ঢুকতেও ইচ্ছে করে না মাধবের। সে ভেতরে গেলেই যে বাপটা সব আলু খেয়ে ফেলবে। তাই সে একটা অজুহাত দিয়ে বসে… ‘আমার ভেতরে যেতে ভয় করছে’।
    ‘ কীসের ভয় তোর। আমি তো এখানে আছি নাকি’।
    ‘তাহলে তুমি গিয়ে দেখো গে যাও’।
    ‘আমার বউয়ের যখন মর মর অবস্থা তখন আমি তিন দিন ওর পাশে ঠায় বসে থেকেছি। এক পাও নড়িনি। এখন আমি ভেতরে গেলে তোর বউ আমাকে দেখে লজ্জা পাবে না? ঘোমটার আড়ালে আমি কোনোদিনও তার মুখ দেখিনি। আজ আমি তাকে আদুল গায়ে দেখতে পারি? তা ছাড়া আমাকে দেখলে ওর শরীরেরও কষ্ট আরো বাড়বে। ও তো তখন ভালো কোৎ দিতেও পারবে না।
    ‘আমি একটা কথা ভাবছি…বাচ্চাটা যদি জন্মায় তাহলে তো শুকনো আদা, মোটা চিনি, তেল লাগবে। বাড়িতে তো কিচ্ছু নেই’।
    ‘ সব এসে যাবে। ভগবান যদি বাচ্চাটাকে আনেন তাহলে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যারা এখন আমাদের এক পয়সাও ঠেকায় না তারাই তখন ডেকে জিনিসপত্র দেবে খন। আমার নটা বাচ্চা জন্মেছে। কারো জন্মের সময়ই বাড়িতে কিছু ছিল না। কিন্তু সব ব্যবস্থা তো হয়ে গেছে’।
    গ্রামের যেসব চাষি দিনরাত এক করে খাটে তাদের অবস্থাও যে এই বাপ-বেটার চেয়ে ভালো এমন নয়, তবে পরিশ্রমী চাষিদের থেকে যে সমাজে শোষণকারীদের সম্মান বেশি, সেখানে আশ্চর্যেরই বা কী আছে! কিন্তু এটা মানতেই হবে যে, ঘিসু বুদ্ধিমান। বেকার খাটাখাটনি করে না মরে সে ভাঁওতাবাজদের দলেই নাম লিখিয়েছে, যদিও ভাঁওতাবাজদের ছল চাতুরি তার বিশেষ আসে না। ফলে তার সমাজের অন্যান্যরা যদি বা কখনো সখনো গ্রামের মুখিয়া হয়ে বসে তাকে কোনো দলই বিশেষ পাত্তা দেয় না। তবে যাইহোক একটা সান্ত্বনা আছে তার মনে। যতই খারাপ অবস্থা হোক না কেন চাষিদের মতো হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম তাকে করতে হবে না। আর তার সারল্য আর তার অসহায়তার সুযোগও কেউ নিতে পারবে না।
    চুলা থেকে গরম আলু তুলে হামলে পড়ে খেতে থাকে তারা। আলু জুড়িয়ে কখন ঠান্ডা হবে সেই তর টুকুও তাদের সয়না। আগের দিন থেকে পেটে একটা দানাও পড়েনি। গরম আলু খেতে গিয়ে দুজিনেরই জিভে ছ্যাঁকা লাগে। আলু ছাড়ানোর সময় ওপর ওপর তেমন গরম লাগেনি। কিন্তু মুখে পোরা মাত্র জিভ, গলা, টাগড়া পুড়ে যাওয়ার জোগাড়। আলুর বাইরেটা ঠান্ডা হলে কী হবে ভেতরটা তো গরমই রয়ে গেছে। এই গরম জিনিস মুখে ভরে রাখার চেয়ে জলদি পেটে চালান করে দেওয়াই ভালো। পেটে গিয়ে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে খন। তাই গপাগপ খেতে থাকে তারা। গরম আলু মুখে দিয়ে তাদের চোখে জল এসে যায়।
    ঘিসুর হঠাৎ সেই বিয়েবাড়ির কথা মনে পড়ে যায়। জমিদারবাড়ির বিয়ে বলে কথা। সেই কুড়ি বছর আগেকার ঘটনা কিন্তু সবকিছু তার স্পষ্ট মনে আছে। বিয়েবাড়িতে সে বরযাত্রী গিয়েছিল। সেদিন পেটভরে খেতে পেয়েছিল সে। এত খাবার দাবার সে জীবনে চোখে দেখেনি। আজও তার মনে পড়ে সে কথা। ছেলেকে সে বলে… ‘ বুঝলি বেটা। কী ভোজ ছিল সেদিন! অমন খাবার জীবনে চোখে দেখিনি। ভরপেট খাওয়া কাকে বলে সেদিনই আমি বুঝেছিলাম। মেয়ের বাড়ি থেকে সবাইকে পেট ভরে লুচি খাইয়েছিল। একেবারে গাওয়া ঘিয়ে ভাজা। তারপরে ছিল চাটনি, রায়তা, তিন রকমের সবজি, কীসের যেন একটা ঝোল, দই…মিষ্টি। কী আরাম করে যে সেদিন খেয়েছিলাম! যে যত পারে খাও। কেউ না বলার নেই। সবাই তো গলা অবধি খেয়েছিল সেদিন। খেয়েদেয়ে পেটে জল খাওয়ারও জায়গা নেই। পরিবেশনকারীরা আসছে। তারপর পাতে গোল গোল মিষ্টি দিয়ে যাচ্ছে। কী মিষ্টি গন্ধ! খাব না বললেও কেউ কথা শুনছে না। তারা ট্রে নিয়ে আসছে। আর পাতে খাবার দিয়ে চলে যাচ্ছে। পাত পেড়ে খেয়ে দেয়ে সবাই মুখ মোছার পরে ওরা পান দিল। অত কিছু খাওয়ার পরে আমার আর পান খাওয়ার মতো জায়গা আছে নাকি? খেয়ে দেয়ে আমি তো আর দাঁড়াতেই পারি না। কোনোরকমে টলতে টলতে কম্বলের ওপর শুয়ে পড়লাম। জমিদার মশাই বড্ড দিলদরিয়া। মনটা ছিল তার সমুদ্রের মতো বড়।
    এই ভূরিভোজের কথা শুনে মাধবেরও জিভে জল এসে যায়… ‘ ইসস,এখন যদি আবার কেঊ এমন ভোজ দিত’।
    ‘এখন অমন পাত পেড়ে কি কেউ খাওয়াবে! সে সময়ের কথাই ছিল আলাদা। এখন সবাই টাকা বাঁচানোর কথা ভাবে… ‘ এই বিয়েবাড়িতে খরচ কোরোনা, পূজাপার্বণে খরচ কোরোনা’…এই তো সবার কথা। ওদের গিয়ে জিজ্ঞেস করো তো গরিব মানুষের রক্ত জল করা পয়সা বাঁচিয়ে হবেটা কী? পয়সা বাঁচানোর বেলা সবাই আছে। শুধু খরচ করার বেলায় কেউ নেই’।
    ‘তুমি তো নিশ্চয়ই কুড়িটা লুচি খেয়েছিলে’?
    ‘কুড়িটার বেশিই খেয়েছিলাম’।
    ‘আমি হলে তো পঞ্চাশটা খেয়ে ফেলতাম’।
    ‘ আমিও পঞ্চাশটাই খেয়েছিলাম। এর কমে আমার হতই না। তখন অনেক সুস্থ সবল ছিলাম। আমি যা ছিলাম তুই তো তার ধারেকাছেও আসিস না’।
    খাওয়া দাওয়ার পরে দুজনে জল খেল। তারপর ধুতিটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে শরীরটা কুঁকড়ে গরম চুলার ধারে শুয়ে পড়ল…ওদের দেখে মনে হয় যেন বিরাট দুটো সাপ কুন্ডলী পাকিয়ে পড়ে আছে’।
    বুধিয়া তখনও আর্তনাদ করে যাচ্ছে।

    সকালে উঠে মাধব কুঁড়ের ভিতর ঢুকে দেখে তার বউয়ের শরীর একদম ঠান্ডা। তার মুখের ওপর মাছি ভনভন করছে। পাথরের মতো চোখ উলটে রয়েছে। তার সারা গা ধুলোয় ভর্তি। বাচ্চাটা পেটেই মরেছে।
    মাধব দৌড়ে বাপের কাছে খবর দিতে আসে। তারপর দুজনেই বুক চাপড়ে চাপড়ে বিলাপ শুরু করে। তাদের কান্না শুনে পাড়াপড়শিরা সব ছুটে আসে। এই শোকার্ত মানুষদুটোকে সবাই সান্ত্বনা দেয়। এই সময় মানুষ আর কীইবা করবে। কিন্তু এখন ওত কান্নাকাটি আর বিলাপ করলে চলবে না। মৃতদেহ দেহ ঢাকা দেওয়ার জন্য কাপড় (কফন) লাগবে…কাঠ লাগবে। তাদের তো হাঁড়ির হাল। শিকারি পাখির যেমন বাসায় মাংস সঞ্চয় করে রাখতে হয় না, তেমনই এই বাপ বেটার ঘরেও এক পয়সাও তো জমা নেই।
    বাপ-বেটা কাঁদতে কাঁদতে গেল গ্রামের জমিদারের কাছে। এই দুটো মানুষের মুখদর্শন করতে চান না জমিদার। এরা চুরি করেছে…সময়মতো কাজে আসেনি। তখন তিনি এদের মারধোরও করেছেন। ঘিসুকে দেখে জমিদার জিগ্যেস করেন…’ কী ঘিসুয়া কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন? এখন তোর দেখাই পাওয়া যায়না। ভাবলাম এ গাঁয়ের পাট বোধহয় উঠিয়েছিস’।
    জমিদারের কথা শুনেই ঘিসু তো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কান্না আর থামে না তার… ‘ কী যে সমস্যায় পড়েছি! কাল রাতে মাধবের বউ মরেছে। সারা দিন যে যন্ত্রণায় ছটফট করেছে। হুজুর মাঝরাত অবধি তার মাথার কাছে বসেছিললাম আমরা। যতখানি সম্ভব ওষুধপত্রও দিয়েছি। কিন্তু ওকে আর আটকাতে পারলাম না। এখন আমাদের কে দেখাশোনা করবে হুজুর। আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেল…আমাদের ঘরটা শ্মশান হয়ে গেল। হুজুর আমি আপনার চাকর। আপনি ছাড়া ওর শেষকৃত্যের দায়িত্ব কে নেবে? ঘরে যা পয়সা ছিল ওষুধেই সব খরচ হয়ে গেছে। এখন হুজুর যদি দয়া করেন তবেই ওর শেষ কাজটা ঠিকমতো হয় আর কি। আপনি থাকতে আমি কার কাছে আর কাছেই বা আর হাত পাতব?’
    জমিদার মানুষটা এমনিতে ভালো। মনে দয়ামায়া আছে। কিন্তু ঘিসুকে দয়া দেখানো মানেই কালো চাদরকে রঙ করতে যাওয়ার সামিল। জমিদারের একটু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করে… ‘ দূর হয়ে যা এখান থেকে। ঘরেই লাশটা রেখে দে। ওখানেই ওটা পচুক গে। যখন কাজের জন্য ডেকে পাঠাই তখন তো পাত্তা পাওয়া যায় না। আর এখন নিজের যখন গরজ পড়েছে তখন এসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা হচ্ছে। হতভাগা বেজন্মা কোথাকার। বেইমান’। কিন্তু এখন রাগ দেখানোর সময় নয়। প্রতিশোধ নেওয়ারও সময় এটা নয়। কিছুটা দোনোমনা করে দুটো টাকা বের করে ঘিসুর দিকে ছুঁড়ে দিলেন তিনি। কিন্তু সমবেদনার একটা শব্দও উচ্চারণ করলেন না। ঘিসুর দিকেও তাকালেন না। শুধু কর্তব্য পালনের জন্যই টাকাটা তিনি ছুঁড়ে দিলেন।
    জমিদার যখন দুটাকা দিয়েছেন তখন গাঁয়ের ব্যাপারী আর মহাজন কী আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? জমিদারের নামে কেমন ঢাক পেটাতে হয় সেটা ঘিসু ভালোমতই জানে। জমিদারের কথা শুনে কেউ দু পয়সা দিল, কেউবা চার পয়সা। এক ঘণ্টার মধ্যে দেখতে দেখতে পাঁচ টাকা চলে এল তাদের হাতে। কেউ আবার চাল দিল, কেউ কাঠ। বিকেলের দিকে ঘিসু আর মাধব বাজারে গেল কফন কিনতে। এদিকে লোকজন গেল বাঁশ কাটতে ।
    বুধিয়াকে শেষ দেখা দেখার জন্য গাঁয়ের বউ ঝিরা এল। বুধিয়াকে এই অবস্থায় দেখে তারা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরল।
    ৩।
    বাপ-বেটায় বাজারে এল। ছেলেকে ঘিসু বলে… ‘ওকে পোড়ানোর জন্য অনেক কাঠ আছে। তাই নারে মাধব?’
    মাধব উত্তর দেয়… ‘হ্যাঁ অনেক কাঠ রয়েছে। এবার শুধু একটা কফন লাগবে’।
    ‘ঠিক আছে পাতলা …জ্যালজ্যালে দেখে একটা কফন কিনে নিই’।
    ‘ বটে বটে… লাশ নিয়ে যেতে যেতে তো রাত হয়ে যাবে। তখন কে আর দেখবে?’
    ‘সমাজের কী অদ্ভূত নিয়ম! বেঁচে থাকতে আব্রু রক্ষার জন্য যে একটা ছেঁড়া কাপড়ও পেল না। মরার পর তার জন্যই আবার নতুন কফন চাই’।
    ‘ শরীরের সঙ্গে সঙ্গে তো কফনও পুড়ে ছাই হয়ে যাবে’।
    ‘হ্যাঁ এটা তো আর কোনো কাজেই লাগবে না। এই পাঁচ টাকা যদি আমাদের হাতে আগে থাকত, তাহলে ওকে কিছু ওষুধপত্র দিতে পারতাম’।
    একজন কী ভাবছে অন্যজন তা ঠিক আঁচ করতে পারে। বাজারে গিয়ে তারা এদিক, ওদিক ঘুরতেই থাকে। ওদিকে সন্ধ্যা নেমে আসে। একটার পর একটা কাপড় দোকানে তারা পাক খেয়েই যায়। নানান রকম কাপড় তারা দেখে…রেশম, তাঁত। কিন্তু কোনোটাই তাদের পছন্দ হয় না। ঘুরতে ঘুরতে নিজেদের অজান্তেই একটা ভাটিখানার সামনে চলে আসে তারা। তারপর ভাটিখানার ভেতরে ঢোকে…যেন আগে থেকেই ঠিক করা ছিল সব। ভেতরে ঢুকে প্রথমটা হতভম্ব হয়ে পড়ে তারা। তারপর ঘিসু দোকানির কাছে গিয়ে বলে ‘আমাদেরও একটা বোতল দিন’। ঘিসু মদ নিয়ে আসে। সেইসঙ্গে কিছু তিলের নাড়ু। এবার মদের সঙ্গে চাটও আসে। আসে মাছভাজা । দোকানের বারান্দায় নিশ্চিন্ত মনে বসে তারা ঢুক ঢুক গিলেই যায়। কয়েক পাত্তর গেলার পর মনটা বেশ ফুরফুরে লাগে। ঘিসু বলে… ‘ওকে কফন দিয়ে ঢাকার কী দরকার। ওটা তো ওর সঙ্গেই পুড়ে যাবে। ও তো আর সঙ্গে করে কিছু নিয়ে যাবে না’।
    মাধব আকাশের দিকে তাকায়…সে যে নিরপরাধ, তার যে কোনো দোষ নেই সেটাই যেন আকাশের দেবদূতদের কাছে ঘোষণা করতে চায় সে… ‘এটাই তো জগতের নিয়ম। তা নাহলে বামুনদের হাজার হাজার টাকা দেয় কেন লোকে? এসবের ফল সগ্‌গে পৌঁছোয় কিনা তা কে বলতে পারে!’
    ‘বড়লোকের প্রচুর টাকা আছে। তারা সেই টাকা উড়িয়ে পুড়িয়ে দিক গে। কিন্তু আমরা কেন টাকার অপচয় করতে যাব?’
    ‘কিন্তু তুমি গাঁয়ের লোকেদের কী বোঝাবে? ওরা জিগ্যেস করবে না যে কফন কোথায়?’
    ঘিসু তো হেসেই খুন… ‘তাদের বলে দিস যে আমার কোঁচড় থেকে টাকাগুলো পড়ে গেছে। আমরা অনেক খুঁজেছি। পাইনি। লোকজন হয়তো আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তারা আবার টাকা দেবে’।
    এইভাবে নিয়তিক জয় করার আনন্দে মাধবও হেসে ফেলে… ‘বড় ভালো ছিল বউটা। বেচারি! মরে গিয়েও সে আমাদের ভরপেট খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল’।
    বোতল এখন অর্ধেকেরও বেশি খালি। ভাটিখানার পাশেই খাবার দাবারের দোকান। দোকানিকে দু সের লুচি, মাংশের ঝোল, মেটের তরকারি আর মাছভাজা দিতে বলে ঘিসু। মাধব ছুটে দিয়ে পাতায় মুড়ে খাবার নিয়ে আসে। এখানেই দেড় টাকা খরচ হয়ে গেল। আর মাত্র কয়েক পয়সা পড়ে আছে।
    ক্ষুধার্ত বাঘ যেমন শিকার দেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমনি বাপ-বেটাও গোগ্রাসে লুচি গিলতে থাকে। লোকলজ্জা, লোকনিন্দার ভয় তারা করে না। লজ্জা, শরমের মাথা তারা কবেই খেয়ে বসে আছে। এবার
    দার্শনিকের মতো কথা বলে ঘিসু… ‘আমার প্রাণটা একটু ঠান্ডা হলে বউটারও একটু পুণ্যি হয়, সগগে যায় তাই না? ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেয় মাধব… ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাবে। ভগবান তুমি তো সবার মন পড়তে পারো… ওকে স্বর্গেই নিয়ে যেয়ো। আমরা দুজনে ওকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করছি। আজ পেটপুরে যা খেলাম…সারা জীবনে অমন খাইনি’।
    খানিক্ষণ পরে ধন্দ জাগে মাধবের মন। বাপকে সে জিগ্যেস করে… ‘ সগ্‌গটা কেমন? আমরাও তো একদিন সেখানে যাব তাইনা?’
    ঘিসু কোনো জবাব দেয় না। এই ছেলেমানুষের মতো কথার কীইবা জবাব দেবে। মনে মনে সে ছেলেকে তিরস্কার করতে চায়। সগ্‌গের কথা ভেবে এখনকার আনন্দকে মাটি করতে চায় না সে’।
    ‘সগ্‌গে ও যদি আমাদের জিজ্ঞেস করে আমরা ওকে কফন দেইনি কেন? তখন তুমি কী জবাব দেবে শুনি?’
    ‘ ওহ। এবার চুপ কর’।
    ‘ ও নিশ্চয়ই আমাদের জিজ্ঞেস করবে’।
    ‘ ওকে কফন দেওয়া হবে না কে বলল। আমাকে কি অত গাধা পেয়েছ নাকি? তিন কুড়ি বয়স হল আমার। আমার চুলটা কি রোদে পেকেছে। ওকে কফন দেওয়া হবে। খুব ভালো কফন। আমরা যা দিয়ে পারতাম তার চেয়ে অনেক ভালো’।
    মাধবের ঠিক বিশ্বাস যায় না। তার মনে এখনও ধন্দ… ‘ তাহলে কে দেবে কফন? সব পয়সা তো উড়িয়ে দিলে। সগ্‌গে গিয়ে আমাকেই তো জবাবদিহি করতে হবে। আমিই যে ওর সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়েছিলাম’।
    বড় বিরক্ত লাগে ঘিসুর… ‘আমি তো বলছি ও কফন পাবে। আমার কথায় বিশ্বাস যাচ্ছে না’।
    ‘ কিন্তু কে টাকা দেবে? আমাকে সব খুলে বলছ না কেন?’
    ‘যারা এখন আমাদের পয়সা দিয়েছিল তারাই দেবে। ওরা আমাদের হাতে পয়সা দেবে না। যদি কেউ দিয়ে ফেলে তাহলে তো আমরা এখানে বসে মদ খেয়েই সব ফুটিয়ে দেব। তারপর ওরাই একটা কফন কিনে দিয়ে দেবে’।
    অন্ধকার নামে। আকাশের গায়ে এক ঝুড়ি তারা জ্বলজ্বল করে আগুনের ফুলকির মতো। ভাটিখানায় এখন তুমুল হইহল্লা। একজন গান গেয়ে ওঠে…আরেকজন বকবক করে যায়, কেউ আবার সঙ্গীকে জাপটে ধরে, কেউ বন্ধুর মুখে গেলাস চেপে ধরে। আজ আকাশে বাতাসে শুধুই আনন্দ…শুধুই ফূর্তি। বাতাসেরও যেন আজ নেশা লেগেছে। কত লোক গেলাস হাতে মাতলামি করে যাচ্ছে। নিজেদের ভুলে থাকার সুখটুকু পেতেই এখানে এত মানুষের ভিড়। মন নয় এখানকার বাতাসই তাদের মাতাল করে দিয়েছে। জীবনে একের পর এক দুর্যোগ…দুর্বিপাক তাদের এখানে টেনে এনেছে। তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে না আধমরা হয়ে রয়েছে তাও ঠাওর করতে পারে না।
    বাপ-বেটা এখনও গিলে যাচ্ছে। তাদের দিকেই সবার চোখ। সবাই ভাবছে ঐ বাপ-বেটার কী ভাগ্য! দুজনে মিলে পুরো এক বোতল সাবাড় করে ফেলল!’
    খাওয়া দাওয়া শেষ করে। যেটুকু লুচি পাতায় পড়ে আছে সেটা এক ভিখারিকে দিয়ে দেয় মাধব। ভিখারিটা অনেক্ষণ ধরে ক্ষুধার্ত চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। দেওয়ার মধ্যে যে কত সুখ, কত তৃপ্তি তা জীবনে এই প্রথমবার অনুভব করল মাধব।
    এবার ভিখারিটাকে ঘিসু বলে… ‘এই নে পেটপুরে খা। যার পয়ে আজ তুই খাচ্ছিস সে মরেছে। কিন্তু তোর আশীর্বাদ নিশ্চয়ই তার কাছে পৌঁছবে। মন প্রাণ দিয়ে আশীর্বাদ কর ওকে। কত খাটাখাটনি করে এইটুকু জুটিয়েছে ও।
    মাধব আবার আকাশের দিকে চায়… ‘ও সগ্‌গে যাবে। ও সগ্‌গের রানি হবে’।
    টলতে টলতে ঘিসু উঠে দাঁড়ায়। সে যেন কোন আনন্দের সাগরে ভাসছে। ছেলেকে সে বলে… ‘হ্যাঁ বেটা ও নিশ্চয়ই সগ্‌গে যাবে। সে কাউকে কোনোদিনও কষ্ট দেয়নি…কাউকে কটু কথা বলেনি। এমনকী মরেও সে আমাদের হাতে কতগুলো ট্যাকা তুলে দিয়েছে। সে সগ্‌গে যাবে না তো আর কে যাবে? যারা গরিবদের রক্ত চুষে খায় আর তারপর গঙ্গায় ডুব দিয়ে আর মন্দিরে গঙ্গাজল ছিটিয়ে নিজেদের সব পাপ ধুয়ে ফেলতে চায় সেই চশমখোর বড়লোকগুলো কি তবে সগ্‌গে যাবে?’
    এখন আর ওই সগ্‌গ আর ভগবানের কথা ভালো লাগে না তাদের। নেশা করলে মনে কখন যে কী ভাব আসে সে আর কে বলতে পারে? এবার তাদের শোকতাপ হয়। যন্ত্রণায় ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। মাধব বলে… ‘বেচারি অনেক কষ্ট পেয়েছে। আর কষ্টেই মরল’। হাত দিয়ে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মাধব।
    ছেলেকে শান্ত করার চেষ্টা করে ঘিসু… ‘ এত কাঁদছিস কেন বেটা। এই মায়ার সংসার থেকে সে মুক্তি পেয়েছে এটা ভেবেই একটু হাস। ও তো ভাগ্যবতী! দেখ কত তাড়াতাড়ি সে এই মায়ার জাল কেটে চলে যেতে পারল’!
    এবার বাপ-বেটা দুজনে দাঁড়িয়ে হেঁড়ে গলায় গান ধরে… ‘ও ছলনাময়ী, তোমার চোখে কেন আগুন। ছলনাময়ী’।
    ভাটিখানায় যত লোক ছিল তারা সব তাজ্জব হয়ে বাপ-বেটার কাণ্ড দেখে। মদে চূর হয়ে গান করে যায় দুজনে। তারপর আবার নাচ শুরু করে । তারা লাফায়, ঝাঁপায়… টলে মাটিতে পড়ে যায়… গড়াগড়ি খায়, নানা রকম অঙ্গভংগি করে যায়। তারপর একসময় নেশার ঘোরে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে।

  • অনুবাদ

    অনুবাদ- ছায়া-ছবি

    ছায়া-ছবি
    ( আদা নেগ্রি )
    -বর্ণালী জানা সেন

     

     

     

    সওদাগরি অফিসের সামান্য টাইপিস্ট সে। বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই। তার মতো খেটে খাওয়া মেয়েরা যেমন হয় তেমনটা চালাকচতুর সে নয়। একটু কুঁজো হয়ে সে হাঁটে। পোশাক আশাকেরও কোনো চাকচিক্য নেই। সেই একঘেঁয়ে ছাইরঙা নয়তো গাঢ় বাদামি রঙের জামা। মাথায় ফেল্টের টুপি। টুপিটাকে টেনে টেনে সে মুখের ওপর নিয়ে আসে বার বার। তার চোখ, পাতলা আঁখিপল্লব একেবারে ঢেকে যায় টুপির আড়ালে। আর সব মহিলার মতো সেও চুলটাকে বব করে একটু কেতাদুরস্ত হতে চায়। কিন্তু চুলের এই ফ্যাশন তাকে মানায় না। পাতলা কয়েক গাছি চুল মাথাতেই লেপটে থাকে। আবার চুলটা বিনুনি করে একটা খোঁপা বাঁধতে চাইলেও আরেক বিপত্তি। হেয়ারপিন দিয়ে আটকানো যায় না তার পাতলা চুল। তার আলতো খোঁপা ঘাড়ের ওপর এলিয়ে পড়ে না স্বপ্নপরীদের মতো। এই চুল নিয়ে তার বড্ড অস্বস্তি। ছোটখাটো খোলামেলা পোশাকেও একেবারে মানায় না তাকে। বকের মতো ঢ্যাঙা পা দুটোকে তো ঢেকে রাখতে হবে। তার ওপর নাইলনের মোজা তার গোড়ালির ওপর উঠেই কেমন কুঁচকে যায়। উফফ অসহ্য! মোজা এমন হলে মেয়েদের সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে যায়। কেমন যেন ঘরকুনো গিন্নিবান্নি লাগে।
    একা মানুষ সে। বাবা-মা সেই কবেই মরে ফৌত। তার শুকনো আপেলের মতো অসংখ্য ভাঁজ পড়া রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখের দিকে কোনো পুরুষ চেয়েও দেখেনি। বলিরেখাময় মুখের দিকে মাঝে মাঝে চেয়ে মনে হয় বুঝিবা জন্ম থেকেই সে বুঝি এমন পারা…এমন বুড়োটে। অফিসটাও তার তেমনি। ঢুকলেই মন খারাপ করে আসে। শহরের একেবারে মাঝখানে ঘুপচি অফিসে জানালা দিয়ে আলোও ঢোকে না ভালো করে। জানালা দিয়ে শুধু দেখা যায় ঘিঞ্জি গলি। দিনের বেলাতেও অফিসে জ্বলে বিজলি বাতি। অফিসজুড়ে শুধু নতুন, পুরোনো কাগজ…কপি করার কালির গন্ধ…টাইপরাইটারের ঘটাং ঘটাং…আর ভাগ্যের জাঁতাকলে পড়া কিছু অসহায় মানুষ। মাসের সাতাশ তারিখ বেতনের দিকে তাকিয়ে যাদের দিনগত পাপক্ষয়। তাছাড়া এই ছোট অফিসে লোকই বা আর কত? যারা আছে তাদের আবার নজর ওই ঢলঢলে মেয়েটার দিকে। সেও টাইপিস্ট। কচি মুখ। তারও চুল বব করা। তবে তার লিপস্টিক ভেজা ঠোঁট আর চোখের গাঢ় মাস্কারাতেই যেন আটকে রয়েছে তার বয়স। জামা কাপড় দেখলে মনে হয় অফিস তো নয় যেন সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে এসেছেন তিনি। কোনো জামাই তার হাঁটু অবধি পৌঁছয় না। জামাগুলো তার এমন ভাবে তার শরীরে লেপ্টে থাকে যে খালি চোখেই শরীরের সব উঁচু, নীচু…কোমরের বিপজ্জনক সব ভাঁজ ঠাওর করা যায়।
    আমাদের এই কেরানি শুকনো আপেলের মতো মুখ নিয়ে বৃহস্পতি কি শনিবার বিকেলে যায় সিনেমা দেখতে। কখনো সখনো রবিবারও। আর সপ্তাহের বাকি দিনগুলো শুধু ভাবে…সিনেমার নানান দৃশ্যের কথা। আর পরের সিনেমাটা কবে দেখা হবে তারই অধীর আগ্রহে বসে থাকে সে।
    সিনেমায় সে একাই যায়। কোনো বান্ধবী জোটেনা । আসলে তার কোনো বন্ধুই নেই এ পৃথিবীতে। সে অবশ্য কারো সঙ্গে বন্ধুত্ত্বও করতেও যায়নি। শুধু আজ বলে আজ নয় সেই স্কুলের দিনগুলোতে যখন যে এই এতটুকুনি তখন থেকেই সে একা…নির্বান্ধব। এমনিতেই সে একটু মুখচোরা…লাজুক। আর একটু হীনমন্যতাও আছে ভেতরে। লোকের সঙ্গে সে মিশতে পারেনা। সে এমনই…জন্ম থেকেই। নিজের কথা কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারে না । কাউকে বিশ্বাস করে উঠতে পারে না। কারো কাছে কিছু চাইতে পারে না নিজের জন্য। এ সংসারে কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের দেখলেই লোকের বিরক্তি আসে। আবার কিছু লোক আছে যাদের চারপাশে সারাক্ষণ মাছির মতো ভনভন করে গুণমুগ্ধের দল। অনেকে আবার আছে যারা কোনো দলেই পড়ে না। পৃথিবীতে তারাই দুঃখ পায় সবচেয়ে বেশি। জীবনে তারা একাই থেকে যায়। নিজের নামটা শুনলেও বিরক্তি লাগে তার। কী একখানা নাম! বিজিয়া। আসলে লুইজিয়া। লোম্বার্ডির কথ্য ভাষায় অপভ্রংশ হতে হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজিয়া। এই নামটা শুনলেই যেন চোখের সামনে ভেসে আসে ঘন কুয়াশা…গোধূলির মরা আলো…আর ঝম ঝম বৃষ্টি।
    বেছে বেছে সবচেয়ে ভালো সিনেমা হলেই সে যায় যেখানে দেখানো হয় দুর্দান্ত সব ছবি। এই করে মাসমাইনের অর্ধেকটাও খসে যায়। তাতে কী! এমন মানস ভ্রমণের সুযোগ আর কোথায়ই বা পাবে সে! ছায়া ও ছবির এই দুনিয়ায় ভেসে ভেসে সারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ায় সে। এই ভ্রমণে তার সবসময় ফার্স্ট ক্লাসের টিকিটই চাই… ফার্স্ট ক্লাসের সব আরাম…সব বিলাসিতা চাই। সিনেমা হলেই ঢুকতে না ঢুকতেই শুরু হয়ে যায় তার যাত্রা। গেটে পা দিয়েই নিজের কল্পনায় বুঁদ হয়ে যায় সে। তারপর সে আসে লবিতে…হলের প্রশস্ত লবিতে সব মোটা মোটা সব থাম…সেখানে সব চোখ-ঝলসানো ঝাড়বাতি…কত সুন্দর সুন্দর সব মূর্তি! দেওয়ালে রঙিন জ্বলজ্বলে সিনেমার পোস্টার। সেখানে বড় বড় করে লেখা সিনেমার নাম…নীচে চটুল রগরগে সব ছবি। সে যখন হলে ঢোকে ততক্ষণে সিনেমা শুরু হয়ে গেছে। পিচ কালো অন্ধকারে মনে হয় সব আসনই যেন খালি…নিশ্চয়ই কোনো এক চমক লুকিয়ে রয়েছে তার জন্য…বুক ঢিপ ঢিপ করে তার। অন্ধকারে নিজের সিটে বসে নিজের অজান্তেই ছোঁয়া লেগে যায় পাশে বসা মানুষটার গায়ে। প্রতিবারই শিহরণ খেলে যায় তার শরীর জুড়ে। সে নিজেও জানে না পাশের মানুষটা পুরুষ না নারী। তবে যাই হোক না কেন রক্তমাংসের মানুষ তো বটে। পাশে বসা মানুষটার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস সে অনুভব করে। মানুষটার মুখ সে দেখতে পায় না। আর তার মুখও দেখতে পায় না কেউ। এ নিয়ে অবশ্য তার কোনো অপরাধবোধ নেই। বিরতির সময় হঠাৎ করে আলো জ্বলে উঠলে সে দেখতে পায় পাশে বসা মানুষটার মুখ। সে মানুষ কখনো পুরুষ কখনো বা নারী। কিন্তু একবার আলো জ্বলে উঠলে মানুষটাকে নিয়ে তার আর কোনো আগ্রহ থাকে না। কারো দিকে চেয়ে থাকলে সে মানুষটাও তো তাকে নজর করে দেখবে। আর এটাই সে চায় না। নিজেকে সে জানে। সে যে বড়ই সাদামাটা…আলুথালু। আহা এমনটা যদি হত…এমনটা যদি হত যে কেউ কারো মুখ না দেখেই সারা জীবন এমন করেই একে ওপরের গা ঘেঁসে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যেত!
    সিনেমার মধ্যে চড়া দাগের রোম্যান্সই তার পছন্দ যেখানে অবাস্তব সব ঘটনা ঘুরে ফিরে আসে…প্রেমে উথালপাথাল হয় মানুষ। এই কল্পনার আশ্রয় তার যে বড় দরকার। নাহলে এই দমবন্ধ করা নিঃসঙ্গ জীবন থেকে মুক্তি পাবে কী করে! তার যদি অনেক পড়াশোনা আর টাকাপয়সা থাকত তাহলে সে তো পটের বিবি সেজে নাটকে…থিয়েটারে যেতে পারত। তবে নাটক বা অপেরার মাপা হাসি মাপা কথা তার ভালোলাগে না একেবারেই। তার মতো মোটা দাগের রুচির মানুষের ওসব পোষায় না। তার চাই রুপোলি পর্দার রগরগে আমোদ…একবারে এলোমেলো, পাগল করে দেওয়া বিষাক্ত আনন্দ। একেবারে প্রথম দৃশ্য থেকে সে পর্দার মানুষগুলোর সঙ্গে একেবারে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। পর্দার নায়িকার সঙ্গে নিজেকে এক করে ফেলে। নায়িকার সঙ্গে সঙ্গে সেও হাসে, কাঁদে, ভালোবাসে…ঘৃণা করে…কষ্ট দেয়…কষ্ট পায়…প্রেমের জন্য জীবন বাজি রেখে বসে…তারপর শেষপর্যন্ত সে জিতে যায়। সিনেমা হলের ওই দু-তিন ঘণ্টার মধ্যে কখনো সে মারী পিকফোর্ডের মতো মিষ্টি…সুন্দরী, আবার কখনো মে মুরের মতো… একরাশ বাদামি চুল আর স্পষ্ট তেকোনা নাসারন্ধ্র নিয়ে লাস্যময়ী। সেই তো গ্রেটা গার্বো। পেলব বেতের মতো শরীর…জাদুমাখা নীল চোখে অনন্যা। কখনো সে পলা নেগ্রি…কখনো বা বেবে ড্যানিয়েলস। নায়িকাদের আসল জীবনের কথা সে ভাবে না। পর্দায় নায়িকারা যে চরিত্র ফুটিয়ে তোলেন তারই সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে ফেলে সে।
    এই দু-তিন ঘণ্টা ধরে সে ভেসে বেড়ায় স্বপ্নের দেশে। সে দেশে সে কোনোদিন যায়নি আর যাবেও না। তবু দেখামাত্রই চিনে ফেলে। অদ্ভূত আরাম পায়। মনে হয় যেন কতজন্ম ধরে ওদেশেই রয়েছে সে। দামি দামি গাড়ি…কখনো উল্কার গতিতে ধেয়ে আসা ট্রেনে চড়ে ঘুরে বেড়ায় সে। প্লেনে করে আকাশে উড়ে যায়। ঝাঁ চকচকে…প্রাসাদের মতো হোটেলে থাকে সে…যেখানে শুধু রাজারানিদেরই মানায়। মহার্ঘ্য জিনিসপত্রে সাজানো বসার ঘরে কত রইস, খানদানি মানুষজনের সঙ্গে মোলাকাত করে। গয়নায় মোড়া থাকে তার সারা শরীর…ঠিক যেন কোনো দেবীপ্রতিমা। কখনো আবার সে সাহসী…টানটান। আমেরিকার পশ্চিমে প্রেইরি তৃণভূমিতে কোনো রংচটা, ভাঙাচোরা সরাইখানার মালকিন হয়ে বসে ভাগ্যের সন্ধানে…সোনার সন্ধানে আসা মানুষজন, জেলফেরত আসামী আরো কতশত লোককে অভ্যর্থনা জানায় সে। পরনে তার লো-কাট জামা, গলায় ডোরাকাটা স্কার্ফ, মাথায় বাহারি ফুল। এই দুনিয়ায় কত বিচিত্র ঘটনা ঘটে…মানুষের লোভ, ষড়যন্ত্র দেখে সে ভয়ে কেঁপে ওঠে, কষ্ট পায়। কতবার তার জীবন বিপন্ন হয়, কিন্তু ভাগ্যের জোরে বার বার বেঁচে যায় সে। সে বার বার জীবন খোয়াতে বসে…আবার বার বার ফিরেও আসে। যে মানুষ মানুষটাকে ভালোবাসে সে মোটেই ফেয়ারব্যাংকের মতো চাষাভুষো নয়। আবার ঘিওনেও মতো গুণ্ডাগিরি সে করে না। তার ভালোবাসার মানুষ ভদ্র, নম্র, পরিশিলীত। তার দাঁড়ি- গোঁফ পরিষ্কার করে কামানো। প্রাণখুলে সে হাসতে পারে। সে যাই করুক না কেন একটা মৃদু হাসি সবসময় লেগে থাকে তার ঠোঁটের কোণে। তাকে অবশ্য হতে হবে অ্যাংলো-আমেরিকান। মাঝেমাঝেই এই মানুষটার মধ্যে তার অফিসের বসের আবছা আদল খুঁজে পায় বিজিয়া। তার তরুণ, ঝকঝকে, স্মার্ট বস। দূর তা আবার হয় নাকি। অফিসে তার বসের টেবিল তার টাইপরাইটার টেবিলের মধ্যেকার কয়েক হাতের ব্যবধান বাস্তবে যেন শত সহস্র যোজন হয়ে দাঁড়ায়। এই দূরত্ব সে অতিক্রম করতে পারে না। করার সাধ্যি নেই তার। কিন্তু সিনেমার পর্দার মানুষটাকে সে ছুঁতে পারে…তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করতে পারে। সে মানুষটার সঙ্গে পক্ষীরাজে সওয়ার হয়ে সে এই পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে চলে যেতে পারে। এক নিমেষে সে চলে যায় দূর সমুদ্রের তীরে…যেখানে সে যাওয়ার কথাও ভাবতে পারেনি কোনোদিন। সে যে সমুদ্রই দেখেনি কোনোদিন। যা দেখেছে তা ওই ছায়া আর ছবিতে। তাও সে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পায়…সে কান পেতে শোনে পাড়ে ঢেউ ভাঙ্গার শব্দ…ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল। সমুদ্রের লোনা স্বাদ সে অনুভব করে। উচ্ছল সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে নিজেকে বাঁধনহীন মুক্ত মানুষ বলে মনে হয়। তবে প্রবল গর্জনে একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। সমুদ্র কি এমনই উত্তাল থাকে সবসময়। সে কি শান্ত হয়না কখনো? নাকি শান্ত হয়েও সে এমনই বাঁধভাঙ্গা দুরন্ত! পর্দার ওপারে সব ঘটনা এমন চোখের নিমেষে ঘটে যায় যে মাঝে মাঝে সে তাল রাখতে পারে না। পর্দার মানুষগুলো নানান অঙ্গভঙ্গি, তাদের আসা-যাওয়া, হাঁটা- চলা, হাসি-কান্না, আদর-ভালোবাসা…এমনকী তাদের কুকর্মগুলোও কেমন যেন চোখের পলক ফেলতেই সব ঘটে যায়। তারপর আসে ক্ল্যাইম্যাক্স। সিনেমা হলে যদি একটুও আলো থাকে তবে সে ব্যালকনির সিটের দিকে একবার চেয়ে দেখে। সে দেখে রুদ্ধশ্বাস মুখের সারি…দমবন্ধ করে বসে রয়েছে সব…বিস্ফারিত চোখ…উত্তেজনায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখ। চোখের সামনে যদি একখানা আয়না থাকত তাহলে সে দেখতে এত তার চোখ মুখের দশাও ঠিক তেমনি।
    ইসস জীবনটা যদি সত্যিই এই রুপোলি পর্দার মতো হত! চোখের সামনে দরজাগুলো কেমন আপনা থেকেই খুলে যেত! দরজার ঠিক ওপারেই রূপকথার রাজ্য। সেখানে পথ, ঘাট আলো হাওয়া সব স্বপ্নের মতো। সেখানে বিপদে পড়লে ঠিক কেউ না কেউ এসে উদ্ধার করে। সেখানে কোনো নিষেধের বেড়ি নেই। মনের সব ইচ্ছেরা ডানা মেলে ওড়ে সেখানে। মনের সব সাধ পূরণ হয়।
    কিন্তু এসব কিছুই তো মিথ্যে। সব কল্পনা। কল্পনার এই জগতে ভেসে বেড়ানো কি মানুষের উচিত? বিজিয়ার মা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তো মেয়ের এই ব্যাপার স্যাপার শুনে তিনি রীতিমতো ভিরমি খেতেন। তিনি হয়তো বলেই বসতেন… ‘নিজের কী ছিরি একবার তাকিয়ে দেখেছিস?’ তবে এখনকার ছুঁড়িরা অবশ্য মায়ের কোথায় পাত্তা দেয় না। তাদের সাফ কথা… ‘নিজে রোজগার করছি…যা মন চাইবে তাই করব’। বিজিয়ার মা ইহজগতে আর নেই…সেটাই যা রক্ষে। শুধু মা কেন এই দুনিয়ায় কেউ নেই বিজিয়ার…কেউ কোনোদিন হবেও না। শরীরের মধ্যে শুধু ধিকিধিকি একটা আগুন জ্বলে যায়। সে অবশ্য নিজে এটা মানতে চায় না। বাইরে তার কোনো লক্ষণও দেখায় না। কিন্তু ছায়াছবির পর্দার কল্পনার ঘোরে মিশে তার এই বুকের আগুন একটু নেভে। তার মনের উত্তেজনা হাজার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সে নিজে একটু শান্ত হয়। এখন একটা মহা সমস্যা হয়েছে তার। মাঝেমাঝেই তার এই দুটো সমান্তরাল জীবন একে অন্যের ঘাড়ে এসে পড়ছে। দুটো জীবনে আটকে পড়া তার দুটো সত্তা একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত হচ্ছে। এখন সিনেমা হল থেকে বাড়ি ফিরে গনগনে তাতে পুড়ে যায় সমস্ত শরীর। নাড়ির গতি চঞ্চল হয়। চোখে ঘুম আসে না তার। মনের বিকারে সিনেমায় দেখা দৃশ্য জীবন্ত হয়ে বার বার চোখের সামনে ফিরে ফিরে আসে। কল্পনায় সে নানা ছবি দেখে । বিছানায় ছটফট করতে করতে ভোরের দিকে চোখটা একটু লেগে আসে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নেরা মায়াজাল বোনে। ঘুঁটেকুড়ুনি থেকে সে হয়ে যায় কোনো ডাচেস বা বিশাল কোটিপতির কন্যা। ভালোবাসার মানুষের জন্য প্রাসাদের সব আরাম সব বিলাসিতা ছেড়ে সে বেরিয়ে আসে পথে। নয়তো বা সে হয়ে যায় সেই রোবট-নারী…যার ছলাকলার কাছে হার মানে রক্ত মাংসের মানবী। তার রূপের আগুণে পতঙ্গের মতো ঝাঁপ দেয় শত শত পুরুষ।
    ঘুম থেকে আর উঠতে ইচ্ছে করে না। তার জিভ ভারী হয়ে আসে। সে কিছু মনে করতে পারে না। মাথার মধ্যে সব জট পাকিয়ে যায়। অফিসেও কোনো কাজে মন বসে না। সবসময় অন্যমনস্ক। টাইপরাইটারের সামনে বসে দিবাস্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে। কাজে ভুল হয়ে যায় বিস্তর। যেখানকার সংখ্যা সেখানে বসে না। কলাম ঠিকঠাক থাকে না। নিজেকে সে একেবারে হারিয়ে ফেলে। অফিসের বস ভাবেন… ‘উনি বোধহয় অসুস্থ’। তাই আর তাকে ছাঁটাই করাও হয় না।
    সেদিন শনিবার। রাত এগারোটা। হেলিও সিনেমা হল থেকে সবে ছবিটা দেখে বেরিয়েছে সে। চোখের সামনে সবকিছু কেমন ঘোলাটে। কানে একটা ভোঁ ভোঁ শব্দ। শুকনো আপেলের মতো মুখে হঠাৎ যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। একটা নতুন ভাবনা এসেছে মনে। রাস্তার চৌমাথা উপচে পড়ে ভিড়ে। নাইটক্লাবগুলো থেকে পিল পিল করে মানুষ বেরিয়ে আসে। ভিড়ে একজনের গায়ে ঘাড়ে আরেকজন এসে পড়ে। গাড়ি বিকট হর্নে কানে তালা ধরে আসে। রাস্তার চারপাশে হোর্ডিং আর সাইনবোর্ড…সাদা, বেগুনি, ঘননীল। কোনোটায় ঝুলছে লম্বা ফিতে, আবার কোনোটায় ঝালর। গাড়ির হেডলাইটে ভিজে রাস্তা ঝকমকিয়ে ওঠে। মাথার ওপরে আলো, নীচে আলো। মাথাটা ঘুরিয়ে যায় তার। সে বুঝে উঠতে পারে না কোথায় রয়েছে সে। কে সে? নিজেই মনে করতে পারে না। নিজেকে সে ভুলে যায়। এই একটু আগে পর্দায় সে র‍্যোমান্টিক কাহিনিতে বুঁদ হয়েছিল কিছুতেই তার রেশ কাটে না। চোখের সামনে ভেসে একের পর ঘটনা। না, সে ওই সওদাগরি অফিসের সামান্য কেরানি বিজিয়া নয়। সে জিনার্ভা। সবে কুড়িতে পড়েছে। প্রেমে পাগল। প্রেমের জন্য সবকিছু করতে পারে সে। স…ব কিছু। সে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্যারিসের রাস্তায়। একটু পরেই তার প্রেমিক গাড়ি নিয়ে আসবে। তখন সে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়বে গাড়ির সামনে। এ জীবন আর রাখবে না সে। প্রেমিক আর তাকে ভালোবাসে না, তাকে বিশ্বাস করে না। তার প্রেমিক! তার একজন প্রেমিক আছে ভেবেই যে কী রোমাঞ্চ, কী আনন্দ, মন জুড়ে কী উথালপাতাল কাকে বোঝাবে সে! ভালোবাসার জন্য কাঁদা, ভালোবাসার জন্য কষ্ট পাওয়ার যে কী সুখ!… ‘ এবার আমি তার জন্য জীবন দিয়ে দেব’ নিজের মনেই বলে সে। কিন্তু সে কি আর সত্যিকারের মরবে? কিছুতেই না। একেবারে শেষ মুহূর্তে ঠিক তার প্রেমিক তাকে বাঁচিয়ে দেবে…তাকে বুকে তুলে নেবে। সে আবার তার প্রেমিকের ভালোবাসা ফিরে পাবে। প্রেমিক আবার তাকে বিশ্বাস করবে। সিনেমার নায়িকারা আবার কখনো মরে নাকি? কক্ষনো নয়।
    ওই পর্দায় যেমন হয় তেমনই চোখের সামনে নিমেষের মধ্যে ঘটে যায় সব ঘটনা। রাস্তায় ব্যস্তসমস্ত হয়ে সব লোক হেঁটে যায়। সবার ভীষণ তাড়া। কেউ তার দিকে ফিরেও তাকায় না। চারদিকে চোখ ধাঁধানো আলো। শোঁওও শোঁওও করে এক একটা গাড়ি ছুটে যায়। বিজিয়া-জিনার্ভা জানে সে সুন্দরী, তার আলাদা একটা আভিজাত্য রয়েছে। রাশিয়ান ফারের কোটের মধ্যে থাকা পোর্সিলিনের মূর্তিটার মতোই সুন্দর, পেলব সে। তার পায়ে নরম জালিকাটা মোজা। এই কাদাভেজা রাস্তায় তার দামি মুক্তোরঙা জুতোজোড়া বড় বেমানান। মাথায় তার টুপি নেই। একরাশ ঘন কোঁকড়ানো সোনালি চুল পিঠের ওপর লুটিয়ে পড়েছে। কোথা থেকে সে যে এমন সোনালি চুল পেল কেজানে! নিজেকে একবার আয়নার দেখতে খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু তারসঙ্গে তো কমপ্যাক্টের বক্স নেই। তাই আয়নাও নেই। রাস্তার দোকানগুলোও সব বন্ধ হয়ে গেছে। তাই কাচের জানলায় মুখটা দেখারও কোনো সুযোগও নেই।
    একটা কথা সে জানে…সে সুন্দরী…তন্বী…লাস্যময়ী…সে অভিজাত। প্রেমে সে উন্মাদ। প্রেমের জন্য তার জীবন বাজি।
    রাস্তার ওদিক থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসে গাড়ি। গাড়িটা ব্রেকও কষে। কিন্তু মরতে যে এত মরিয়া তাকে আর বাঁচাবে কে? চট করে কিছু বুঝে ওঠা যায় না। শুধু শোনা যায় তীব্র আর্তনাদ। পুলিশ ছুটে আসে। রাস্তা থেকে পাঁজাকোলা করে তাঁরা তুলে আনেন মহিলার দেহ। তার ছোট বাদামি জামাটা প্রায় কাঁধের ওপর উঠে গেছে। একেবারে আলুথালু অবস্থা। অনাবৃত দেহে স্পষ্ট দেখা যায় সব আঘাতের চিহ্ন। পা দুটো ভেঙে গেছে। যে গাড়ি তাকে ধাক্কা মেরেছে সেই গাড়িতে করেই তাকে হাসপাতালে আনা হয়। কৌতুহলী মানুষ সব ভিড় করে তাকে দেখতে। তারপর একসময় যে যার মতো চলে যায়। কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে… ‘বেচারি’! কেউ আবার বলে ওঠে ‘উনি কে?’
    কেউ নয়। সত্যিই কেউ নয়। সওদাগরি অফিসের সামান্য এক কেরানি। একা মানুষ। জীবনে একটাই নেশা ছিল তার…সিনেমা।

    অনুবাদ—বর্ণালী জানা সেন
    রচনা সম্পর্কে–
    ইতালিতে মুসোলিনির ( ২৮ অক্টোবর ১৯২২- ২৫ জুলাই ১৯৪৩) শাসনকালের দমবন্ধ করা দিনগুলিতে প্রায় সকলের চোখের আড়ালে একটা বড়সড় বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন সেদেশের লেখিকারা। ফ্যাসিবাদী শাসকের চাপিয়ে দেওয়া কঠোর পুরুষতান্ত্রিক রীতি নীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তাঁদের কলম। তাঁরা নিজস্ব ভঙ্গিতে, নিজেদের মতো করে জানিয়েছিলেন তাঁদের চাওয়া-পাওয়া, প্রতিবাদের কথা। গত কুড়ি বা তিরিশের দশকে ইতালিতে যত লেখিকা পুরোভাগে এগিয়েছিলেন তেমনটা আর কখনো হয়নি। রচনার ধরন, বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে পাঠকদের মন জয় করার পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচকদের সমীহও আদায় করে নিয়েছিলেন তাঁরা। সে যুগেরই এক অন্যতম প্রতিনিধি আদা নেগ্রি। জন্ম ১৮৭০ এ। কবিতা লিখতে শুরু করেছিলন ১৮ বছর থেকেই। কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখে গেছেন সমানে। মূলত সমাজের যারা নীচু তলার মানুষ তাদের জীবন সংগ্রাম, আবেগ, অনূভূতি ফুটে উঠেছে তাঁর রচনায়। ফ্যাসিস্ত জমানায় ১৯২৬ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে তিনি ছোটগল্প লিখেছেন প্রায় আশিটি। ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনী Stella Mattutina ( Morning Star). তাঁর এই আত্মজীবনী ভীষণ ভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রকাশের সময় থেকে তাঁর আই বই বিক্রি হয়েছে প্রায় ৬০,০০০ কপি। তাছাড়া corriere Della Sera নামে যে সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর বেশিরভাগ ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে তার পাঠক সংখ্যাও ছিল ৬ লক্ষের কাছাকাছি। তাঁর কাব্যগ্রন্থ Maternita (Motherhood) প্রকাশিত হয় ১৯০৪ সালে। তাঁর দুই কন্যার জন্ম ও তাদের বড় করার কাহিনি নিয়েই এই কাব্যগ্রন্থ। তাঁর ছোট মেয়েটি শৈশবেই মারা যায়। খেটে খাওয়া মেয়েদের হয়ে তিনি কলম ধরেছেন বার বার। তাদের জন্য লড়াইও করেছেন। সামাজের এই প্রান্তিক খেটেখাওয়া মেয়েদের কথাই তিনি লিখেছেন ‘Le Solitarie’ ( Solitary Women) গ্রন্থে। ১৯৩১ সালে অ্যাকাডেমি অফ ইতালি-র দেওয়া মুসোলিনি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। পরে এই অ্যাকাডেমির সদস্য মনোনীত হন তিনি। তিনিই এই অ্যাকাডেমির প্রথম মহিলা সদস্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন মিলানে ১৯৪৫ সালের ১১ জানুয়ারি তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
    ছায়া-ছবি ( The Movies) গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় corriere Della Sera পত্রিকায়। প্রকাশকাল ১৯২৮ সালের ২৭ নভেম্বর।

  • অনুবাদ

    অনুবাদ- উপহার

    উপহার
    -সাদাত হাসান মান্টো
    অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন

     

     

    দিল্লিতে থিতু হয়ে বসার আগে সুলতানার রাজ্যপাট ছিল আম্বালা ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে তার বাঁধা বাবুদের মধ্যে জনা কয় গোরাও ছিল। তাদের কাছ থেকে গোটাকয় ইংরেজি লব্জও শিখেছিল সে। এমনিতে ইংরেজি শব্দ সে বিশেষ বলেনা। কিন্তু বিপাকে পড়লে আপনা থেকেই তার ইংরেজি বুলি বেরিয়ে আসে। নতুন শহরে সে এসে দেখে বাজারের হাল খুব খারাপ। আর তার যে ব্যবসা সেটার তো কোনও দরই নেই। একদিন ব্যাজার মুখে পাশের কোঠার তামাঞ্চা জান-কে সে এসে বলে… ‘বুঝলে…দিস লেইফ ভেরি ব্যাড’। হাতে কোন কাজ নেই…পরের বেলার খাবার কোত্থেকে জুটবে তার কোনও ঠিক নেই…এমন অবস্থায় পড়লের মুখ থেকে তো এমন দার্শনিক বুলিই বেরোবে!
    আম্বালা ক্যান্টনমেন্টে জীবনটা ছিল একদম ফুরফুরে। ব্যবসার এত রমরমা ছিল যে একা হাতে সে সামলে উঠতে পারত না। গোরা, ব্রিটিশ টমিরা সব গলা অবধি গিলে সন্ধে বেলা ভিড় জমাত তার কোঠায়। তার সুলতানাও তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে সব কাজ শেষ করে তাদের পকেট ফাঁকা করে দিতবিদেয় করে । দেশি বাবুরা মাঝে মাঝে তার কাছে আসত ঠিকই কিন্তু গোরাগুলোকেই সুলতানার বেশি পছন্দ ছিল। গোরাগুলোর ভাষা সে বুঝত না বটে কিন্তু এটা তার কাছে শাপে বরই হয়েছিল। কেউ যদি কোঠায় এসে বেশি দরদাম করত তাহলে সে এমন ভান করত যেন সে কিছুই বুঝছে না। মাথা ঝাঁকিয়ে সে তার নিজের ভাষাতেই বলে যেত… ‘আপনে ক্যা কাঁহা মালিক…ঠিক সে সমঝা নেহি’। আবার তারা যদি বেশি বাড়াবাড়ি করত তাহলে সুলতানাও গালাগাল দিয়ে তাদের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে দিত। সুলতানার ভাষা বুঝতে না পেরে তারা বুরবকের মতো চেয়ে থাকত…খানিকটা হতভম্বও হয়ে পড়ত। কিন্তু সুলতানাকে থামায় কে?… ‘সাহাব তু তো একদম কামিনা নিকলা…উল্লুকে পাঠঠে…হারামজাদা কঁহিকা’। মজার কথা ভেবে গোরাগুলো হে হে করে হেসে গড়িয়ে পড়ত আর মুচকি হাসত সুলতানা।
    কিন্তু দিল্লিতে আসার পর তিন মাস হয়ে গেল। এখনও একজনও গোরা এলনা তার কাছে। আম্বালায় থাকতে থাকতে এই বড় শহরের কথা সে কত শুনেছে। এখানে নাকি টাকা উড়ে বেড়ায়…শুধু খপ করে ধরে নিতে পারলেই হল। এখন তো দেখা যাচ্ছে সব বকোয়াস। এখানকার সব বড় বড় লাটসাহেবরা কোথায় গেল? সুলতানা শুনেছে তেনারা নাকি সব সিমলায় পাড়ি দিয়েছেন। ওখানেই গরমকালটা কাটিয়ে আসবেন। এই তিনমাসে ছজন খদ্দের। এই তার ব্যবসাপাতির হাল। হ্যাঁ মাত্র ছজন! এই ছজনের মুখেও আবার সেই বাঁধা বুলি…দিল্লির রইস আদমিরা নাকি এখন সব সিমলার পাহাড়ে। এই তিনমাসে ছজন খদ্দেরের কাছ থেকে সুলতানার রোজগার হয়েছে মাত্র আঠেরো টাকা আট আনা। সবকটা আবার হাড় কঞ্জুস। তিনটাকার বেশি এক পয়সা কেউ বের করবে না। এখানে তিনটাকার বেশি কেউ দেয়ও না। প্রথম পাঁচ জনের কাছ থেকে সুলতানা দশ টাকা চেয়েছিল। সেটা দরাদরি করে নেমেছিল তিনে।
    কেন যে বেছে বেছে ওরা তার কাছেই এসেছিল তা সুলতানা বলতে পারবে না, তবে ছ নম্বর লোকটা যখন এল তখন সুলতানা গম্ভীর মুখে আগেভাগেই শুনিয়ে দেয়… ‘আমি তিন টাকা নিই। এর এক পয়সা কম নয়। পোষালে আসুন নাহলে কেটে পড়ুন’। লোকটা কী ভাবল কে জানে তবে সে সুলতানার ঘরে গিয়েই ঢুকল। লোকটা যখন জ্যাকেটটা খুলছে তখন আদুরে গলায় সুলতানা বলে… ‘আর একটা টাকা বেশি দিতে হবে’। এক টাকার বদলে সুলতানা পেল আট আনার চকচকে একটা কয়েন…তার ওপর আবার রাজার মুখ খোদাই করা। সুলতানা আর কী করে! নাই মামার চেয়ে কানা মামাও তো ভালো।
    এই শহরে এসে হিসেবে গোলমাল হয়ে গেছে সুলতানার। তিন মাসে মাত্র আঠেরো টাকা আট আনা। আর ওদিকে খরচের তো মা-বাপ নেই। কোঠার ভাড়া মাসে কুড়ি টাকা। কোঠা তো নয়…পিঁজরাপোল একটা! বাড়িওয়ালা আবার একেই কেতা দেখিয়ে বলে ফ্ল্যাট। এই ফ্ল্যাটে আবার ওয়েস্টার্ন টয়লেট। তাতে আবার চেন লাগানো। এমন জিনিস তো বাপের জম্মে দেখেনি সুলতানা…ব্যবহার করা তো দূর অস্ত। সে ভেবেছে ঐ চেন ধরে বুঝি উঠতে হয়। সেদিন কোমরটা খুব টনটন করছিল। উঠে দাঁড়াতেও কষ্ট। তা সুলতানা ঐ চেন ধরে উঠে দাঁড়াতে গেছে অমনি গোটা বাথরুম জুড়ে একেবারে জলপ্রপাত। ভয় পেয়ে চেঁচয়ে ওঠে সে।
    পাশের ঘরেই নিজের ফোটোগ্রাফির জিনিসপত্রগুলো একটু গোছগাছ করছিল খুদা বক্স। সুলতানার চিৎকারে সে তো পড়ি কি মরি করে ছুটে আসে… ‘সুলতানা তুই?’
    ভয়ে তখনও বুক কাঁপছিল সুলতানার… ‘এটা কি বাথরুম নাকি রেল স্টেশন? মনে হচ্ছিল প্রাণটা বুঝি বেরিয়েই যাবে’।
    খুদা বক্স তো হেসেই খুন… ‘বোকা মেয়ে…এটা হচ্ছে বড় শহরের বিলাইতি বাথরুম। বুঝলি?’
    বিধাতা যে কী ভাবে এই দুজনকে মিলিয়ে দিলেন! খুদাবক্স রাওয়ালপিন্ডির ছেলে। হাইস্কুল পাশ করার পর একটা সে বনে যায় লরি ড্রাইভার। পরে কাজ নেয় একটা বাস কোম্পানিতে। রাওয়ালপিন্ডি আর কাশ্মীরের মধ্যে সেই কোম্পানির বাস চলত। কাশ্মীরে এক মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়। সে তার সঙ্গে পালিয়ে আসে লাহোর। সেখানে হাতে কোনও কাজ নেই। দুর্দশার একশেষ। যে মেয়ে একদিন তার হাত ধরে পালিয়ে এসেছিল পেটের দায়ে সেই মেয়েকেই পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসায় নামিয়ে দেয় খুদা বক্স। এমনি করেই বছর দুয়েক কেটে গেল। তারপর সে চিড়িয়া অন্য আরেকজনের সঙ্গে ফুড়ুৎ। কেউ কেউ বলে তাকে নাকি আম্বালায় দেখা গেছে। সে ছোকরিকেই খুঁজতে খুদা বক্সের আম্বালায় আসা। এখানে এসে সে ছোকরি তো মিলল না কিন্তু মিলে গেল সুলতানা। প্রথম দেখাতেই খুদা বক্সকে মনে ধরে যায় সুলতানার।
    খুদা বক্স আসার পরই সুলতানার ভাগ্যের চাকাটা ঘুরতে শুরু করে। ব্যবসাপাতি বেশ ভালোই জমে ওঠে। সুলতানার মনে অনেক সংস্কার। সে ভাবে এত রোজগারপাতি সবই বুঝি খুদা বক্সের জন্য।
    ওদিকে খুদা বক্স নিজেও খুব পরিশ্রমী। এক মুহূর্তও চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। ওখানে রেলস্টেশনের ধারে একজন ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় খুদা বক্সের। কিছুদিনের মধ্যে ভাবও জমিয়ে ফেলে। সে চালাক-চতুর মানুষ। সেই ফটোগ্রাফারের কাছ থকে কিছু দিনের মধ্যেই ছবি তোলার কায়দা-কানুন শিখে ফেলেসে। নিজের ব্যবসা শুরু করার জন্য সুলতানা তাকে ষাট টাকা দেয়। সেই টাকায় একটা পুরোনো ক্যামেরা, একটা পর্দা, গোটাকয় চেয়ার আর কিছু প্রয়োজনীয় রাসায়নিক কিনে ব্যবসা ফেঁদে বসে খুদা বক্স। একদিন সে সুলতানাকে এসে বলে এবার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় যেতে হবে…সেখানে নাকি ব্যবসার অবস্থা অনেক ভালো। সেখানে এসে ভালো বাসাও মিলে গেল। খুদা বক্সের কাছে যে গোরারা ছবি তোলাতে আসত তাদের অনেকেই সুলতানার কোঠাতেও যাতায়াত শুরু করল।
    বেশ কিছু টাকা জমিয়ে ফেলল সুলতানা। সে টাকা দিয়ে এক জোড়া রুপোর কানের দুল আর আটটা বালাও কিনে ফেলল। তার তোরঙ্গে এখন পনেরোখানা দামি শাড়ি। ঘর সাজানোর জন্য কয়েকটা আসবাবও কেনা হল। সবকিছু ভালোমতোই চলছিল। হঠাৎ একদিন উঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ের মতো খুদা বক্স এসে বলে এবার তাদের দিল্লিতে যেতে হবে। সুলতানা তো এককথায় রাজি। খুদা বক্সের জন্যই আজ তার কপাল ফিরেছে।
    নতুন শহরে একটা ব্যবসা জমে উঠতে যে কিছুদিন সময় লাগবে সেটা সুলতানা আগে থেকেই জানত। প্রথম মাসে কোনও খদ্দের জোটেনি। তা যাকগে…তাতে অত চিন্তার কিছু নেই। দ্বিতীয় মাসের শেষের দিকে এবার সত্যিই তার কপালে ভাঁজ পড়ে। এতদিনে একজনও এই কোঠার পা মাড়াল না। একদিন সে খুদাবক্সকে বলেই ফেলে… ‘ কী হচ্ছে বলতো? দুমাস হয়ে গেল এখনও এই চত্বরে কারো দেখা নেই! জানি এখন বাজারের অবস্থা খারাপ, তাবলে এতটা খারাপ?’
    খুদা বক্স মুখফুটে সুলতানাকে কিছু বলেনা বটে কিন্তু তারও চিন্তা হয়… ‘আমিও ভেবেছি। কিন্তু বুঝলি সবকিছু এই কমবয়াক্ত যুদ্ধের জন্য। এই যুদ্ধের জন্যই এসব পাড়ায় আর লোকজন আসছে না…আবার এমনটাও হতে পারে যে…’ কথা শেষ হওয়ার আগেই দরজায় টোকা। লাফিয়ে উঠে দরজাটা খুলে দেয় খুদা বক্স। নতুন শহরে সুলতানার প্রথম খদ্দের। আয় হল তিন টাকা। অন্য পাঁচজনেরও কাছেও ঐ একই দাম মেলে।
    কপালে এবার সত্যিই ভোগান্তি আছে। কোঠার ভাড়াই তো মাসে কুড়ি টাকা। তারওপর জল আর ইলেক্ট্রিসিটির বিল আছে। খাইখরচা আছে। তারপর জামাকাপড়…এটা সেটার খরচ তো লেগেই আছে। এই আঠেরো টাকা আর আট আনায় কীইবা হয়? আম্বালায় থাকতে সে আটটা সোনার বালা সুলতানা গড়িয়েছিল একে একে সব গেল। শেষ বালাটা বিক্রি করার সময় সে খুদাবক্সকে বলেই ফেলে… ‘চলো আমরা আম্বালাতেই ফিরে যাই। এই শহরে আমরা আর করে-কম্মে খেতে পারব না। এই শহর আমাদের কিচ্ছু দেবে না। আমাদের যা গেছে তা গেছে…ভাবব কোন গরিব মানুষকে দান করে দিয়েছি। যাও এই চুড়িটা বিক্রি করে এসো। আমি ততক্ষণে মালপত্রগুলো গুছিয়ে নিই। আজ রাতের ট্রেনেই আমরা আম্বালা ফিরে যাব’।
    খুদাবক্স চুড়িটা নিয়ে নিল বটে কিন্তু এ শহর ছেড়ে তার যাওয়ার মন নেই… ‘ না, সোনা আমরা আম্বালা যাব ন। এই শহরেই থাকব। এখানেই অনেক পয়সা কামাবো। তোর সোনার চুড়ি আবার হবে। শুধু আল্লার ওপর ভরসা রাখ। তিনিই আমাদের পথ দেখাবেন’। সুলতানা আর কথা বাড়ায় না। কিন্তু নিরাভরণ হাত দুটো দেখে তার কান্না পেয়ে যায়।
    দুমাস কেটে যায়। যা আয় হয়েছে তা দিয়ে সিকিভাগও খরচ ওঠে না। সুলতানা জানে না এবার সে কী করবে। খুদাবক্স তো সারাদিনই বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। তাই আরো নিঃসঙ্গ লাগে সুলতানার। প্রথম প্রথম আশেপাশের কোঠাওয়ালিদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করে সময় কাটিয়ে দিত। কিন্তু এখন আর সেসব ভালোলাগে না। বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎও তাই বন্ধ হয়ে গেল। এখন সারাদিন বাড়িতে বসে সে পান সাজে, সুপুরি কাটে…পুরোনো জামাকাপড়গুলোকে সেলাই করে। মাঝে মাঝে সে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। সামনে সে রেল-ইয়ার্ডটা রয়েছে সেদিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সারাদিন ধরে ইঞ্জিন খোলা, জোড়া হচ্ছে। মালপত্র নিয়ে সব ওয়াগন আসছে।
    রেল-ইয়ার্ডের মাঝেই রেলের গুদাম। সেখানে একটা বিশাল টিনের ছাউনির নীচে হাজার, হাজার বাক্স, গাঁটরি পড়ে রয়েছে। গুদামের বাঁ দিকে খোলা জায়গা। সেখান দিয়ে সাপের মতো এঁকে বেঁকে চলে গেছে রেল লাইন। রেললাইনগুলো এইদুপুর রোদে খোলা তরোয়ালের মতো ঝলসে উঠছে। তা দেখে নিজের হাতের দিকে নজর চলে যায় সুলতানার। তার হাতের নীল শিরাগুলোও চামড়া ভেদ করে যেন উঠে আসছে। পাশের ঐ রেলইয়ার্ড সারাক্ষণই কর্মমুখর। কিছু না কিছু চলছেই সেখানে। ইঞ্জিন আসছে। মালগাড়ি আসছে ধুঁকতে ধুঁকতে। মালপত্র খালাস হচ্ছে। আবার সে গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে।
    হুইসল দিয়ে ইঞ্জিন আসছে। তারপর ঝিক ঝিক করতে করতে চলে যাচ্ছে দৃষ্টিপথের বাইরে। সকালে সুলতানা যখন ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় তখন প্রতিদিন একই দৃশ্য সে দেখে। ভোরের আলোআঁধারিতে সে দেখে একটা ইঞ্জিন ধোঁয়াউগরাচ্ছে। আকাশের দিকে তাকালেও সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী। মাঝে মাঝে সে দেখে রেলের বগি থেকে ইঞ্জিন খোলা হচ্ছে। সেই ইঞ্জিনই আবার ঝিক ঝিক করতে করতে চল যাবে অন্য কোথাও। ইঞ্জিনটাকে দেখে নিজের কথাই মনে পড়ে সুলতানার। তাকেও কি জীবনের রেলপথে টেনে ফেলা হয়নি? ইচ্ছে-অনিচ্ছের পরোয়া না করে সেও তো চলছে ধুঁকতে ধুঁকতে। তার কলকবজাগুলো রয়েছে অন্যের হাতে। চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে একদিন হয়তো ইঞ্জিনের সঙ্গে তার সব যোগ তার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কোনও অজানা জায়গায় এসে হয়তো থেমে যাবে তার চলা। আর কখনো সে ঘুরে দাঁড়াবে না।
    এখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রেলপথের দিকে তাকিয়েই তার বেশিরভাগ সময় কেটে যায়। চারদিকের নৈঃশব্দকে খান খান করে বেজে ওঠে কোনও ট্রেনের হুইসল। নানা চিন্তা ঘুরপাক খায় তার মাথায়। আম্বালাতেও তার বাসার কাছেই ছিল রেলস্টেশন। সে তখন কোনও ট্রেন দেখেনি…ইঞ্জিন দেখেনি। মাঝে মাঝে তার মনে হত এই রেলস্টেশনই বুঝি ঘিনঘিনেধোঁয়াটে বিশাল একটা বেশ্যাখানা। আর ট্রেনের পেটমোটা সব ইঞ্জিনগুলো বড়লোক, রইস সব খদ্দের যারা মাঝে মাঝে তাকে দর্শন দিয়ে যেত।
    আবার কখনো কোনও ইঞ্জিন ওয়াগনগুলোকে টানতে টানতে ইয়ার্ডে নিয়ে আসত। সুলতানার মনে হত ওগুলো যেন সব নামি দামি খদ্দের। প্রতিটা জানালার ধারে তার মতো মেয়েমানুষদের দেখে জল মাপতে মাপতে এগোচ্ছে। এসব কথা ভাবলেই মনটা বড় চঞ্চল হয়ে ওঠে সুলতানার। তাই সে ব্যালকনিতে যাওয়াই বন্ধ করে দেয়।
    একবার নয়, দুবার নয় বারবার সে খুদাবক্সকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে… ‘আমার ওপর রেহম কর খুদাবক্স। এই ঘরে সারাদিন আমার কীভাবে কাটে তা কি ভেবে দেখেছ? সকাল থেকে রাত অবধি শয্যাশায়ী রুগির মতো ঘরবন্দি হয়ে কাটিয়ে দিই’। কিন্তু প্রতিবার নানা অছিলায় কথাখানা এড়িয়ে যায় খুদাবক্স… ‘জানেমন, আমি তো চেষ্টা করছি। আল্লা মুখ তুলে চাইলে সব একদিন ঠিক হয়ে যাবে। শুধু একটু ধৈর্য ধর’। পাঁচ মাস ধৈর্য ধরেছে সুলতানা। এবার ধৈর্যের সীমা বাঁধ ভাঙছে। খুদা বক্স এখনও সারাদিন বাইরেই কাটায়। আর খাঁচায় বন্দী পাখির মতো সুলতানা গুমরে মরে। কয়েকদিন পরেই মুহরমের মাস। এই মাসে সুলতানা সব ধর্মীয় আচার নিষ্ঠাভরে মেনে চলে। কারাবালারমরু প্রান্তরেচোদ্দশো বছর আগেপয়গম্বরের পৌত্র হাসান আর তাঁর সঙ্গীরা মৃত্যু বরণ করেছিল! শোকের এই ঘটনাকে চোখের জলে স্মরণ করে সুলতানা। এই মাসে সে কালো কাপড় ছাড়া পরে না।
    কিন্তু এ বছর তার কী হবে? নতুন কাপড় কেনার মতো হাতে পয়সা নেই। রাস্তার ওপারের কোঠাওয়ালি মুখতার কী সুন্দর একখানা লেডি হ্যামিলটন মার্কা দামি কাপড়ের কুর্তা বানিয়েছে! তার হাতাদুটো আবার জর্জেটের। কী মানিয়েছে ওকে! কুর্তার সঙ্গে মানানসই কালো সালওয়ার ও সে বানিয়েছে! কাপড়টা কী চকচকে! আর আনোয়ারি তো একটা জর্জেটের শাড়িও কিনে ফেলেছে। সুলতানাকে সে বলেছে এবার একটা সাদা সিল্কের পেটিকোটও কিনবে। এটা এই শাড়ির সঙ্গে খুলবে দারুণ। আনোয়ারি আবার কালো ভেলভেটের নরম তুলতুলে জুতোও কিনেছে। বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে সুলতান। নিজেকে এতটা অসহায় তার কোনোদিনও মনে হয়নি। মুহরমে পরার মতো তার কাছে আজ কিচ্ছু নেই।
    মুখতার আর আনোয়ারির সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরে সে একেবারে ভূমিশয্যা নিল। মেঝেতে শুধু মোটা কাপড়ের একখানা চাদর পাতা। বুকের ভেতরটা যদি দেখানো যেত তাহলে সে দেখিয়ে দিত কত দগদগে ঘা রয়েছে সেখানে। ঘর ফাঁকা। খুদা বক্স যথারীতি বাইরে। মোটা বালিশে মাথা গুঁজে অনেকক্ষণ চুপচাপ পড়ে রইল সে। তারপর ভূতে পাওয়া মানুষের মতো ব্যালকনির দিকে ছুট লাগাল। আসলে সে গেলনা…কে যেন তাকে চালিয়ে নিয়ে গেল।
    তার বুকের মতো রেল ইয়ার্ডও খাঁ খাঁ করছে। কোথাও কোনও প্রাণের সাড়া নেই। কোনও ইঞ্জিন নেই। শুধু কয়েকটা বগি দাঁড়িয়ে আছে। রোজকার মতো আজও সন্ধেতে ভিস্তিওয়ালারা রাস্তায় জল ছিটিয়ে গেছে। তাই বাতাসে আর তত ধুলোর দাপট নেই। রাস্তায় জনাকয় লোক হেঁটে যাছে। এই সব কটা মিনসে একদম একই রকম। কোঠার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েগুলোকে হাঁ করে গিলবে, তারপর বাড়ি গিয়ে বউয়ের আঁচলের তলায় মুখ লুকোবে। ওদের মধ্যেই একজন সুলতানার দিকে তাকাল। সুলতানা তাকে দেখে একটু হেসে আবার মুখ সরিয়ে নেয়। সব ফালতু আদমি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই সুলতানা টের পায় লোকটা এখনও যায়নি। সে এখনও তার মুখের দিকে এখনও তাকিয়ে আছে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছে সুলতানা। সুলতানা লোকটাকে ইশারা করে ওপরে ডাকে। ওপরে আসার সিঁড়িটাও দেখিয়ে দেয়।
    একটু পরেই লাজুক লাজুক মুখ করে লোকটা উঠে আসে। তাকে দেখেই সুলতানা জিগ্যেস করে… ‘তোমার কি এখানে আসতে ভয় করছিল’। লোকটাও সটান জবাব দেয়… ‘কেন এমন মনে হচ্ছে তোমার?’
    ‘না, দেখছিলাম তো এই জায়গাতেই অনেকক্ষণ ধরে ঘুরপাক খাচ্ছ। বোধহয় ভাবছিলে এগোবো কি এগোবো না!’
    লোকটা আবার হেসে ফেলে… ‘আরে না না। আমি তো তোমার ওপরের ফ্ল্যাটের মেয়েটাকে দেখছিলাম। সে ছুঁড়ি কত ছলাকলা করে রাস্তার ওপারের ফ্ল্যাটের লোকটাকে পটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারপরেই দেখলাম তোমার ঘরের সবুজ আলো জ্বলে উঠল…আর তুমি বারান্দায় বেরিয়ে এলে। সবুজ রং আমার খুব প্রিয়। চোখের খুব আরাম হয়’। এই বলেই লোকটা ঘরের ইতি উতি কী যেন খুঁজতে শুরু করে দেয়’।
    গলা খাঁকরে সুলতানা জিগ্যেস করে… ‘কী ব্যাপার? উঠছ নাকি?’
    ‘না না। আমি একটু বাড়িটা ঘুরে দেখতে চাই। তুমি আমাকে একটু ঘুরিয়ে দেখাবে?’
    ঘরে তো মাত্র তিনটে ছোট ছোট কুঠুরি। তাই-ই সে ঘুরিয়ে দেখালো লোকটাকে। তারপর তারা মেঝের ওপর তাকিয়া পাতা বড় ঘরে ফিরে এল।
    ‘আমার নাম শংকর’…নিজে থেকেই কথা শুরু করে শংকর।
    এই প্রথম লোকটার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখল সুলতানা। দোহারা চেহারা। দেখতেও অতি সাধারণ। কিন্তু চোখদুটো অসাধারণ…আলোয় ভরা। রগের কাছে চুলে অল্প পাক ধরেছে। একটা বেইজ রঙের প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে আছে লোকটা। সে জামার কলারটা আবারতোলা। মাটিতে পাতা মোটা চাদরের ওপর আরাম করে বসে লোকটা। দেখে মনে হচ্ছে সে বাড়ির মালিক আর সুলতানা একজন পাতি খদ্দের। এভাবে বসে থাকতে না পেরে অনেকক্ষণ পরে মুখ খোলে সুলতানা… ‘বলো, আমি কী করতে পারি তোমার জন্য?’ মেঝের ওপর আরো জমিয়ে বসে লোকটা… ‘আমি আর কী বলি বলো? সবকিছু তোমার ওপরই ছেড়ে দিচ্ছি’। সুলতানা কোনও রা কাড়ে না। লোকটা উঠে পড়ে… ‘তুমি যখন এত করে জানতে চাইছ তখন বলেই দিই…আসলে তুমি আমাকে যা ভাবছ আমি তা নই। আমি কিন্তু পয়সা খরচ করতে তোমার কাছে আসিনি। আমি আমি না আসলে ডাক্তার। আমাকে সবাই ফি দেয়। আমাকে যারা ডাকে তারাই উলটে আমায় টাকা দেয়’।
    সুলতানা তো হেসেই খুব… ‘তা কী কাজকম্ম করো তুমি?’
    ‘তুমি যা কর ঠিক তাই’।
    ‘ইয়ে আমি…মানে আমি কিছু করি না’।
    ‘তাহলে আমিও কিছু করিনা’।
    ‘ফালতু বকওয়াস মত করো। কিছু না কিছু তো কর’?
    হিমশীতল গলায় শংকর জবাব দেয়… ‘তাহলে তুমিও তো কিছু না কিছু করো’
    ‘ আমি এটা সেটা করে সময় কাটিয়ে দিই’।
    ‘আমিও তাই’।
    ‘তাহলে চল আজ একসঙ্গেই এটা সেটা করা যাক’।
    ‘আমি রাজি। কিন্তু একটা শর্তে…আমি কিন্তু কোনও পয়সা দেবো না’।
    ‘মাথাটা কি একদম গেছে? এটা কোনও ধর্মশালা নয়’।
    ‘আর আমিও কোনও স্বেচ্ছাসেবী নই’।
    ‘স্বেচ্ছাসেবী কী জিনিস?’…অবাক হয়ে জিগ্যেস করে সুলতানা’।
    ‘স্বেচ্ছাসেবী…ঐ যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়। একেবারে গর্দভ’।
    ‘আমি কিন্তু গর্দভ নই’।
    ‘তুমি না হলে কী হবে তোমার ঐ ঘরের মানুষ…ঐ যে খুদা বক্স সে একটা আস্ত একটা গর্দভ’।
    ‘কেন? সে কী করেছে?’
    ‘ কয়েক সপ্তাহ ধরে দেখছি তো…ভাগ্য ফেরানোর আশায় এক ভণ্ড বাবাজির পায়ে হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছে। আরে যার নিজের কপালই ফুটো…সে অন্যের কপাল কীকরে ফেরাবে!’
    ‘বাজে বোকোনা তো। তুমি তো হিন্দু তাই আমাদের ফকিরদের কেরামতির কথা তুমি জানো না। তোমরা তো মুসলিম ফকির দেখলেই হাসি-ঠাট্টা শুরু করে দাও’।
    ‘আরে এটা হিন্দু-মুসলমানের ব্যাপারই নয়’।
    ‘তোমাদের সব চালাকি আমি বুঝি’… ‘আচ্ছা তুমি কি…
    ‘হতে পারে। কিন্তু আমার শর্তে’।
    এবার সুলতানা উঠে দাঁড়ায়… ‘তাহলে আমিও আপনাকে দরজাটা দেখিয়ে দিই’।
    শংকর উঠে দাঁড়ায়। পকেটে হাতটা পুরে বিজ্ঞের মতো বলে… ‘আমি এই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করি। দরকার পড়লে আমায় ডেকো। আমি কিন্তু কাজের মানুষ’।
    শংকর চলে যায়। কালো জামার কথা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে যায় সুলতানা। কী অদ্ভুত না লোকটা! লোকটার কথা ভাবতে তার বেশ ভালোই লাগছে। সুলতানা ভাবে, এই মানুষটাই যদি তার আম্বালার কোঠায় আসত তাহলে সে তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিত। কিন্তু এটা তো দিল্লি। এখানে সবই অন্য রকম। শংকর চলে যাওয়ার পরে তার খুব একা লাগছে। লোকটার কথাবার্তা, চালচলন…সবই যেন কেমন পারা!
    সন্ধের সময় খুদা বক্স ঘরে ফেরে। তাকে রীতিমতো জেরা শুরু করে দেয় সুলতানা… ‘কোন চুলোয় ছিলে সারাদিন?’ খুদা বক্সকে দেখে মনে হয় সে একেবারে বিধ্বস্ত… ‘আরে আমি তো পুরানা কিলার ওখানে ছিলাম। ওখানেই কয়েকদিন আগে এক ফকির বাবার সঙ্গে দেখা। আমি তো নিত্যদিন তাঁরই সেবায় লেগে আছি…যদি আমাদের ভাগ্যটা ফেরে’।
    ‘তা বাবাজি কিছু বলেছেন?’
    ‘না এখনও কিছু বলেননি। আসলে তিনি এতদিন আমার দিকে নজরই দিতে পারেননি। তবে সুলতানা আমিও বলে দিলাম আমার এত ভক্তি…সেবা কিছুই বিফলে যাবে না। আল্লার কৃপায় কপাল আমাদের ফিরবেই’।
    সুলতানার আবার মুহরমের কথা মনে পড়ে যায়। কান্নাবোজা গলায় সে বলে… ‘তুমি তো সারাদিন বাইরে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছ। আমার যে কীভাবে এই বদ্ধ খাঁচায় দিন কাটে! আমি কোথাও বেরোতে পারি না। কয়েকদিন পরেই মুহরম। আমার যে একটা কালো জামা দরকার সে কথা কি তোমার খেয়াল আছে? আমার হাতে একটা পয়সা নেই। শেষ বালাটাও বেচে দিয়েছি। এবার আমাদের কী হবে ভেবে দেখেছ? তুমি তো সারাদিন যত ভিখিরি আর ভন্ড বাবাজি আছে তাদের পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছ। আমাদের কিসমতই ফুটা। দিল্লিতে আল্লাও আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তুমি রাস্তায় রাস্তায় আবার ফটো তুলতে পার না? তাতে দুটো পয়সা তো অন্তত হাতে আসবে’।
    খুদা বক্স মাটিতে শুয়ে পড়ে… ‘কিন্তু তার জন্যও তো আমার কিছু মূলধন লাগবে। আমাদের হয়তো আম্বালা ছেড়ে আসা উচিত হয়নি। কিন্তু কী করব বল! সব আল্লার মর্জি! কে জানে যা হচ্ছে তা হয়তো ভালোর জন্যই হচ্ছে! এই কঠিন সময়ে ফেলে আল্লা হয়তো আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন…’। মাঝ পথেই তাকে থামিয়ে দেয় সুলতানা… ‘তোমার কাছে হাতজোড় করছি যেখান থেকে হোক আমার জন্য সালওয়ারের কালো কাপড় এনে দাও। আমার কাছে সাটিনের সাদা কুর্তা আছে। সেটা নাহয় কালো রং করিয়ে নেওয়া যাবে। আম্বালায় থাকতে দিওয়ালির সময় তুমি একটা সাদা শিফনের দুপাট্টাও এনে দিয়েছিল। সেটাও রং করে নেব। কিন্তু কালো সালওয়ার পাই কোথা থেকে? আমি জানি না, তুমি চুরি কর, ডাকাতি কর কিন্তু যেভাবেই হোক আমায় কালো সালওয়ারটা এনে দাও। আমি মাথার দিব্যি দিচ্ছি তুমি যদি ওটা এনে না দাও তাহলে কিন্তু আমার মরা মুখ দেখবে’।
    খুদা বক্স উঠে পড়ে… ‘তোর ঐ বকওয়াস বন্ধ কর তো। আমিই বা কোত্থেকে টাকা পাব? আমার হাতেও ফুটোকড়ি নেই’।
    সুলতানা তার সাফ কথা জানিয়ে দেব… ‘আমি কিচ্ছু জানি না। আমার কালো সাটিনের সাড়ে চার গজ কাপড় লাগবে। এই আমার শেষ কথা’।
    ‘আল্লার কাছে দোয়া কর…আজ রাতে যেন তিন-চারজন খদ্দের পাঠিয়ে দেন’।
    ‘কেন তোমার মুরোদ নেই? তুমি নিজে কিছু করতে পারো না? তুমি যদি মন দিয়ে চেষ্টা করতে তাহলে ঐ চার গজ কাপড় কেনার জন্য পয়সা রোজগার করতেই পারতে। যুদ্ধের আগে এক গজ কাপড়ের দাম ছিল বারো থেকে চোদ্দ পয়সা। এখন আর কত হবে? এক টাকা…দেড় টাকা…এর বেশি তো আর নয়! সাড়ে চার গজ কাপড়ের জন্য কত আর টাকা লাগবে তাহলে?’
    ‘তুই যখন এত করে বলছিস তখন দেখি কী করতে পারি। এখন কিছু খাওয়া দরকার। তুই একটু বস। আমি নীচের দোকান থেকে কিছু খাবার নিয়ে আসি’।
    তার চুপচাপ বাজারের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ে। সকাল হতে না হতেই খুদাবক্স আবার হাওয়া। সুলতানা সেই একাই পড়ে থাকে। একবার শোয়, একবার ওঠে। সময় কাটাতে কিছুক্ষণ ঘরে পায়চারি করে। দুপুরে কোনও রকমে একটু কিছু মুখে তুলে তোরঙ্গ থেকে সেই সাদা দুপাট্টা আর সাটিনের কুর্তাটা বের করে। তারপর সেগুলোকে রং করাতে লন্ড্রিতে নিয়ে যায়। বাড়ি ফিরে এসে পুরোনো হলদেটে হয়ে আসা ফিল্মি পত্রিকায় একটু চোখ বোলায়। এই সব পত্রিকায় তার সব প্রিয় সিনেমার সংলাপ আর গানগুলো রয়েছে যে! পড়তে পড়তেই ঝিমুনি আসে। ঘুম ভেঙে উঠে দেখে চারটে বেজে গেছে। স্নানটান করে কাচা জামা কাপড় পরে গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সেখানে দাঁড়িয়েই ঘণ্টা খানেক কেটে যায়। সন্ধে নামছে। নীচে রাস্তায় লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে। বাতাসে কেমন যেন একটা শীত শীত ভাব। হঠাৎ করে শংকরকে চোখে পড়ে যায় তার।শংকরও তার দিকে চেয়ে হাসে। কিছু না ভেবেই শংকরকে সে ডেকে বসে।
    শংকর আসতে তার একটু বাধো বাধো লাগে। কী বলবে সে বুঝে পায় না। কিন্তু শংকরের ওসব বালাই নেই। তাকিয়ায় হেলান দিয়ে এমন ভাবে বসে পড়েছে যেন এটা তার নিজের বাড়ি। সুলতানা কোনও কথা বলার আগে শংকরই বলে বসে… ‘দেখো কোন লজ্জার ব্যাপার নেই। তুমি আমায় হাজারবার ডাকতে পারো। আবার হাজারবার তাড়িয়েও দিতে পারো। আমি কিছু মনে করব না’।
    ‘তোমাকে কেউ চলে যেতে বলছে না’।
    ‘তাহলে আমার শর্তে রাজি তো?’…শংকরের মুখে দুষ্টু হাসি।
    সুলতানাও হেসে খুন… ‘কীসের শর্ত? তুমি কি আমায় শাদি করবে নাকি?’
    ‘শাদি? ছিঃ। ওসব কথা কেউ মুখে আনে? যতদিন বাঁচব ততদিন ঐ চক্করে তো পড়বই না। ঐ বিয়েশাদি আমাদের জন্য নয়’।
    ‘বাজে কথা বন্ধ করো ত…কামকাজের কথা বল’…ঝাঁঝিয়ে ওঠে সুলতানা।
    ‘আমি কী বললে তুমি খুশি হবে? দেখো তুমি একজন মহিলা। তুমিই এমন একটা কিছু বল যাতে আমাদের দুজনেরই সময়টা ভালো কাটে। এইসব বাজে গুলতানি মারার চেয়ে জীবনে আরো অনেক কিছু করার আছে’।
    ‘তুমি কী চাও বলতো?’
    ‘সব পুরুষ মানুষ যা চায়’…শংকরের সাফ জবাব।
    ‘তাহলে সব পুরুষের সঙ্গে তোমার তফাতটা কীসে?’
    ‘ দেখো তোমার আর আমার মধ্যে কোনও তফাত নেই। কিন্তু অন্য পুরুষদের চেয়ে আমার আকাশ-পাতাল তফাত। দেখো সব কিছুতে কোনও প্রশ্ন হয় না। নিজেকে বুঝে নিতে হয়’।
    দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুলতানা… ‘বুঝেছি’।
    ‘ তাহলে কী করা যায়?’
    ‘ ঠিক আছে, তুমিই জিতে গেলে। এরকম কোনও ব্যাপার হয় বলে বাপের জম্মে শুনিনি’।
    ‘তুমি তো অনেককিছুই শোননি। তোমার আসেপাশে যে হাজার হাজার পরিবার থাকে তারা কি ভাবতে পারে যে কোনও মেয়ে তার শরীর ভাঙিয়ে খাবে? কিন্তু তোমার কাছে তো এটা জলভাত। শুধু তুমি কেন? এই শহরে আরো হাজার হাজার মেয়ের কাছে এটাই বেঁচে থাকার উপায়। তোমার নাম তো সুলতানা। তাই না?’
    ‘হ্যাঁ তাই’।
    ‘আমি শংকর…এই সব নামে কী এসে যায়? তার চেয়ে চলো আমরা পাশের ঘরে যাই’।
    পাশের ঘর থেকে যখন তারা বেরিয়ে এল তখন দুজনের মুখেই আর হাসি ধরে না। শংকর যেই বেরোতে যাবে অমনি সুলতানা এসে তাকে ধরে… ‘আমার একটা উপকার করতে পারবে?’
    ‘কী আগে শুনি?’
    একটু দোনামনা করে সুলতানা… ‘ না মানে…তুমি হয়তো ভাববে যে এক্ষুনি যা হল তার বিনিময়ে আমি দাবি করছি?’
    ‘আরে বলেই ফেলো’।
    বুকে একটু বল আনে সুলতানা… ‘না মানে…সামনেই তো মুহরম। একটা নতুন কালো সালওয়ার বানানোর জন্য আমার কাছে পয়সা নেই। আমি কী বলি বল? আমার আছে দুপাট্টা আর কুর্তা আছে…সেগুলো রং করতে দিয়েছি। কিন্তু সালোয়ারটাই নেই’।
    ‘তুমি সালওয়ার কেনার জন্য আমার কাছে পয়সা চাও?’
    ‘আমি মোটেও তা বলিনি। আমি বলেছি তুমি কি আমার জন্য একটা কালো সালওয়ার যোগাড় করে এনে দিতে পারবে?’
    শংকরের মুখে এক চিলতে হাসি খেলে যায়… ‘দেখো আমার হাতেও পয়সাকড়ি বিশেষ থাকে না। তবে আমি কথা দিচ্ছি মুহরমের প্রথম দিনেই তুমি তোমার কালো সালওয়ার পেয়ে যাবে। এবার একটু হাসোতো দেখি!’…কথায় কথায় সুলতানার কানের দুলের দিকে নজর যায় শংকরের… ‘আমাকে এই দুল জোড়া দিতে পারবে?’
    সুলতানা তো থ… ‘ এটা দিয়ে তুমি কী করবে? পাতি রুপোর। পাঁচ টাকার বেশি দামও হবে না’।
    ‘তোমাকে আমি এর দাম জিগ্যেস করিনি। শুধু আমি ওটা চেয়েছি’।
    ‘তাহলে নাও’…কান থেকে দুলজোড়া খুলে দেয় সুলতানা। শংকর চলে যাওয়ার পরে নিজের ভুলটা বুঝতে পারে সুলতানা। এখন হাত কামড়ানো ছাড়া উপায় কী? চিরদিনের মতো দুলজোড়া তার চলে গেল।
    সুলতানা ভালোমতোই জানে যে শংকর আর এমুখো হবে না।
    মুহরমের প্রথমদিনই সক্কাল সক্কাল দরজায় টোকা। দরজার খুলে সুলতানা তো অবাক। ওপাশে শংকর। তার হাতে একটা খবরের কাগজের মোড়ক… ‘এই নাও তোমার কালো সাটিনের সালওয়ার। একটু বড় হতে পারে। দেখে নিও। এখন চলি’।
    শংকরকে বড্ড আলুথালু দেখাচ্ছে। যেন এইমাত্র বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা এখানে চলে এসেছে। তাদের আর কোনও কথা হল না সেদিন।
    শংকর চলে যাওয়ার পরে সুলতানা প্যাকেটটা খুলে দেখে এ যে কালো সিল্কের সালওয়ার ঠিক যেমনটা সে মুখতারের কাছে দেখেছিল। কানের দুলের দুঃখ সে ভুলে গেল।
    বিকেলের দিকে সে কুর্তা আর দুপাট্টা আনতে লন্ড্রিতে গেল। তারপর নতুন জামাকাপড় পড়ে ফিটফাট হয়ে সে সবে বসেছে তখন আবার দরজায় টোকা। মুখতার। সুলতানাকে ভালোকরে মেপে নেয় মুখতার… ‘তা সুলতানা খবর কী? কুর্তা আর দুপাট্টা দেখে তো মনে হচ্ছে রং করা। কিন্তু সালোয়ারটা তো একদম নতুন। তুমি এটা বানিয়েছ বুঝি?’
    ‘হ্যাঁ আজই। সকালেই দর্জি এসে দিয়ে গেল। বেমালুম মিথ্যে বলে দেয় সুলতানা। হঠাৎকরে মুখতারের কানের দিকে নজর যায় সুলতানার… ‘এই দুলজোড়া কবে কিনেছ?’
    মুখতার হেসে বলে… ‘আজই সকালে’।
    অনেকক্ষণ তাদের মুখে আর কোনও কথা যোগায় না!

  • অনুবাদ

    অনুবাদ- শকুন

    শকুন
    জুলিও রামোন রিবেইরো
    অনুবাদ- বর্ণালী জানা

    সকাল ছটা। শীতের মিহি কুয়াশার ওড়না সরিয়ে আড়মোড়া ভাঙছে শহরের। কুয়াশায় ঢাকা শহরটাকে দেখতে কেমন যেন অপার্থিব…ভূতুড়ে লাগে।ধর্মপ্রাণ মহিলারা দল বেঁধে চলেছে গির্জার দিকে। রাতের ভবঘুরেরা অন্ধকার গায়ে মেখে বিষণ্ণ মুখে বাড়ির পথ ধরেছে। পেদ্রো অ্যাভিনিউতে কাগজকুড়ুনিদের ভিড়। হাতে তাদের ঝাঁটা, বালতি। কলকারখানার শ্রমিকরা হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটছে গাড়ি ধরার জন্য। কাগজওয়ালারা ঠান্ডায় জমে নীল। বাড়ির কাজের মেয়েরা বালতিভর্তি যত জঞ্জাল রেখে যাচ্ছে রাস্তার ধারে। স্যানিটারি বিভাগের গাড়ি এসে ওগুলো নিয়ে যাবে। ঠিক এই সময়ই শহরে জুটে যায় যত রাজ্যের শকুন…তাদের গায়ে কোন পালক নেই…একেবারে কুচ্ছিত, কদাকার।
    এই ব্রাহ্ম মুহূর্তেই প্রতিদিন ঘুম ভাঙে ডন সান্তোসের। কাঠের পা-টা ভালো করে বেঁধে ষাড়ের মতো তর্জন-গর্জন শুরু করে দেয়… ‘এই হতচ্ছাড়া এফ্রিন…এনরিকে…জলদি ওঠ!’
    চোখ কচলাতে কচলাতে দুই ভাই ছোটে কোরালের* পাশের ডোবায়। ঠান্ডায় ডোবার জল জমে বরফ। কাচের মতো বরফের নীচে আগাছাগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। মুখ-হাত ধুয়ে দুই ভাই টিন নিয়ে ছুট লাগায় রাস্তায়। আর এদিকে ডন সান্তোস ঢোকে খোঁয়াড়ে। শুয়োরটাকে ময়লা খেতে দেখে বুড়ো মারে এক লাঠির বাড়ি… ‘রাস্কেল কোথাকার! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন’!
    ওদিকে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে দুই ভাই। গাছে উঠে কুল পেড়ে খায়। গাছে উঠতে না পারলে নীচ থেকে পাথর ছুঁড়ে কুল পাড়ে। খুঁজে খুঁজে যত ছূঁচলো পাথর ওদের বের করা চাই। তা দিয়ে লক্ষ্যভেদ হয় অনেক ভালো। ভোরের এই অপার্থিব মুহূর্তকে সাক্ষী রেখে ওরা ছুটে যায় ঐ রাস্তার দিকে। ঐ রাস্তাটা সোজা খাঁড়ির দিকে চলে গেছে। রাস্তার ধারে সার দিয়ে সুদৃশ্য সব বাড়ি।
    এ রাস্তায় ওরা একা নয়। ওদের মতো আরো অনেকে আছে। অন্য শহরতলির কোরালগুলোতে ওরা থাকে। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওরাও রাস্তায় জুটে যায়। কারো হাতে বালতি, টিন, আবার কারও হাতে কার্ডবোর্ডের বাক্স, কখনও বা শুধুই পুরোনো একটা খবরের কাগজ। ওরা কাউকে চেনে না…মনে হয় শহরের কোন গুপ্ত সংগঠনে নাম লিখিয়েছে…গোপনে, লুকিয়ে-চুরিয়ে যে যার মতো কাজ হাসিল করে যায়। কেউ কেউ বড় বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে…কেউবা পার্কে…আবার কেউ ময়লার গাদার সামনে। খেতে না পাওয়া দড়ি পাকানো কুকুরগুলোও এসে জোটে।
    একটু বিশ্রাম নিয়েই কাজে নেমে পড়ে এফ্রিন আর এনরিকে। রাস্তার এক এক ধারে একেক জনের কাজ । বড় বড় বাড়িগুলোর দরজার সামনে ময়লার ঝুড়ি। ময়লার ঝুড়ি উপুড় করে তারা হাতড়ে হাতড়ে খোঁজে অমূল্য রতন। তা মিলেও যায়…সার্ডিনের টিন, পুরোনো জুতো, পাউরুটির টুকরো, মরা টিয়াপাখি, নোংরা তুলো। এফ্রিন আর এনরিকে শুধু ফেলে দেওয়া খাবার-দাবার খুঁজে বেড়ায়। পাস্কুয়ালের খিদে মেটাতে হবে যে! পাস্কুয়াল যা পায় তার ওপরই হামলে পড়ে। তবে আধ পচা শাক-সবজিই ওর বেশি পছন্দের। পচা টমেটো, চর্বি, আর দারুন দারুণ সব সালসা মিলে যায় ময়লার গাদায়…রান্নার বইতেও এমন সালসার কথা লেখা থাকে না। এই দিয়েই নিজেদের টিন ভর্তি করে দুই ভাই। ভাগ্য ভালো থাকলে কোন কোন দিন অনেক মহার্ঘ জিনিসও তারা পেয়ে যায়। এফ্রিন একদিন ময়লার ঝুড়িতে প্যান্টের একটা বকলস পেয়েছিল। সেটা দিয়ে একটা গুলতি বানিয়েছিল। একদিন একটা আস্ত আপেল পেয়ে এফ্রিনের আনন্দ আর ধরে না। খাবার-দাবারে অতটা আগ্রহ নেই এনরিকের। ওষুধের বাক্স, রঙিন বোতল, ফেলে দেওয়া টুথব্রাশ…এগুলোর দিকেই তার নজর।
    আঁতিপাতি করে ময়লা হাতড়ানোর পর জঞ্জালগুলো আবার ঝুড়িতে রেখে এবার তারা যায় অন্য বাড়ি। রাস্তায় শত্রুরা সবসময় ওঁত পেতে থাকে। মাঝে মাঝে বাড়ির কাজের মেয়েগুলো তাদের হাতেনাতে ধরে টিন কেড়ে নেয়। মাঝে মাঝে যমদূতের মতো আসে স্যানিটারি ডিপার্টমেন্টের লোক। তাদের এত পরিশ্রম সব মাটি!
    আস্তে আস্তে সূর্যটা মাথার ওপরে ওঠে। সকাল গড়ায়। চড়া রোদে কুয়াশার চাদরটা কোথায় যে মিলিয়ে যায়! প্রার্থনা সেরে গির্জা থেকে কলকল করে বেরিয়ে আসে মহিলারা। রাতের ভবঘুরেররা এখন গভীর ঘুমে। বাড়ি বাড়ি কাগজ বিলি করে ফিরে যায় কাগজওয়ালারা। আরেকটা অপার্থিব ভোর শেষ হয়। পালক ওঠা, ন্যাড়া শকুনদুটো বাসায় ফেরে।
    এদিকে কফি বানিয়ে নাতিদের ফেরার অপেক্ষা করে ডন সান্তোস। নাতিরা ফিরলেই আবার শুরু হয় আরেক প্রস্থ তর্জন-গর্জন… ‘কফিটা গিলে আমায় ধন্য করো। হতচ্ছাড়ার দল আজ কী এনেছিস দেখি’?
    লোলুপ দৃষ্টিতে টিনগুলো হাতড়ায় বুড়ো। যেদিন টিন উপচে পড়ে সেদিন বুড়ো মহাখুশি… ‘আজ মনে হচ্ছে পাস্কুয়ালের ভোজটা ভালোই জমবে। তবে বেশিরভাগ দিনই বুড়োর মেজাজ সপ্তমে চড়ে থাকে… “টিন খালি কেনরে হতভাগা। আজ নিশ্চয়ই কোন কাজ করিসনি…খালি আড্ডা দিয়ে বেড়িয়েছিস! ছোটলোক! পাস্কুয়াল কি তবে না খেয়ে মরবে?’
    দুইভাই ছুটে আঙুর খেতের দিকে চলে যায়। দাদুর থাপ্পড়ের চোটে কানদুটো এখন ঝাঁ ঝাঁ করছে। ওদিকে পা টেনে টেনে বুড়ো যায় খোঁয়াড়ের দিকে। বুড়োর হাতে খাবার দেখেই শুয়োরটা ঘোঁতঘোঁত করে ছুটে আসে… ‘বেচারা পাস্কুয়াল। আজ তোর ভাগ্যে বিশেষ কিছু জুটবে নারে? ছোঁড়াগুলো আজ কিছুই আনেনি। ওরা তো তোকে আমার মতো ভালবাসেনা! সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না…আচ্ছা করে কড়কে দিতে হবে ওদের’।
    শীতের শুরুতেই দৈত্যের মতো চেহারা হয়ে গেল শুয়োরটার। সঙ্গে রাক্ষুসে খিদে। ভালমতো খাবার না পেলেই শুরু হয়ে যায় তার দাপাদাপি। বুড়োর সব রাগ গিয়ে পড়ে নাতিদের ওপর। বুড়ো ভোর বেলা তাদের তুলে দিয়ে বলে ‘এবার অন্য জায়গায় যা…যেখানে কেউ যায় না…একদম সমুদ্রের ধারে চলে যা। ওখানেই তো সব ময়লা ফেলা হয়। অনেক কিছু জুটে যাবে ওখানে’।
    এক রবিবার দুই ভাই হাজির হয় সমুদ্রের ধারে। স্যানিটেশন ডিপার্টমেন্টের লোকরা ঠেলাগাড়ি ভর্তি করে জঞ্জাল ফেলে যাচ্ছে। দূর থেকে দেখে মনে ছোট একটা পাহাড়…যতসব কুকুর আর শকুনের মেলা বসেছে সেখানে। দূর থেকে পাথর ছুঁড়ে ওগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করে দুই ভাই। ওরা যে তাদের গ্রাসে ভাগ বসাচ্ছে। ঢিলের বাড়ি খেয়ে কঁকিয়ে ওঠে একটা কুকুর। ময়লার গাদার কাছে এসে দুর্গন্ধে নাড়িভুঁড়ি পর্যন্ত গুলিয়ে ওঠে দুই ভাইয়ের। শকুনের পালক, বিষ্ঠা আর নোংরায় পা ডুবে যায়। সেদিকে খেয়াল করার সমাই নেই তাদের…ময়লার গাদার হাত ডুবিয়ে তন্ন তন্ন করে চলে তাদের খোঁজ। ভাগ্য ভালো থাকলে হলদেটে কাগজে মোড়া আধখাওয়া মাংশ উঠে আসে হাতে। ওদিকের আরেকটা ময়লার ঢিবিতে বসে লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শকুনগুলো । কেউ কেউ আবার এ পাথর থেকে ও পাথরে লাফিয়ে ছেলেরগুলোর হাত থেকে খাবার কেড়ে নিতে যায়। ওদের ভয় দেখাতে চেঁচিয়ে ওঠে এফ্রিন…তার চিৎকার খাদের মধ্যে ধাক্কা খেয়ে ফেরে… দু-একটা পাথর গড়িয়ে পড়ে সমুদ্রে। টিন ভর্তি করে দু ভাই ফিরে আসে কোরালে।
    ডন সান্তোসের হাসি আর ধরে না… ‘সাবাশ বেটা…এবার হপ্তায় দু-তিন যেতে হবে ওখানে’।
    এবার থেকে রবি আর বুধবার করে চলে যায় তাদের রত্নখনিতে। সমুদ্রের ধারে যত পশু-পাখি আর শকুন থাকে তাদের সব চিনে ফেলে দুই ভাই। শকুনগুলোও এখন দুই ভাইকে দেখে তেড়ে আসে না। এখন তাদের মধ্যে বেশ ভাব। ছেলেগুলোর পাশাপাশি বসেই নোংরা ঘাঁটে তারা। শুধু কি তাই? নিজেদের হলুদ ঠোঁট দিয়ে ময়লা খুঁটে খুঁটে ছেলে্গুলোর পরিশ্রম অনেক কমিয়ে দেয়।
    এই বিরাট অভিযান সেরে একদিন বাড়ি ফেরার পর এফ্রিন দেখে পায়ের তলায় একটা ঘা-মতো হয়েছে। কাচের একটা টুকরো ফুটেছে। পরেরদিন সকালে পা ফুলে ঢোল। সেই নিয়েই কাজে যায়। বাড়ি ফেরার সময় সে আর কিছুতেই হাঁটতে পারে না। বাড়ি ফিরে দেখে দাদুর সঙ্গে হোঁৎকা মতো এক লোক দেখা করতে এসেছে। লোকটার হাতে রক্ত। দাদু লোকটাকে নিয়ে গেছে খোঁয়াড়ে… ‘ডন সান্তোস…আমি কুড়ি…তিরিশ দিন পরে আসব। ততদিনে ওটা নিশ্চয়ই আরো নাদুস-নুদুস হয়ে যাবে’।
    লোকটা চলে যেতেই দুই ভাই দেখে দাদুর চোখ চকচক করছে। ঘরে ঢুকেই দুজনকে আবার তাড়া দেয় দাদু… ‘এই যে নবাব পুত্তুরেরা, বসে থাকলে চলবে না। কাজে যা। এখন থেকে পাস্কুয়ালকে আরো বেশি করে খাবার দিতে হবে। এই সুযোগটা হারালে চলবে না’।
    পরের দিন পরে দুই নাতিকে ডেকে দেয় ডন সান্তোস। ফোলা পা নিয়ে এফ্রিন কিছুতেই উঠতে পারে না।
    ভাইয়ের হয়ে মুখ খোলে এনরিকে… ‘ওর পায়ে ব্যথা। হাঁটতে পারবে না। পায়ে কাচ ফুটেছে’।
    নাতির পা-টা দেখে শিউরে ওঠে ডন সান্তোস। এ যে গভীর ক্ষত! কিন্তু মুখে বলে ঠিক অন্য কথা… ‘কিচ্ছু হয়নি। সামান্য একটু কেটেছে তার জন্য এত কুলোপানা চক্কর! যা দিয়ে ডোবায় পা ধুয়ে একটা ন্যাকড়া জড়িয়ে নে’।
    এবারও ভাইকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে এনরিকে… ‘ওর পায়ে যে ভীষণ ব্যথা। ও হাঁটতে পারছে না’।
    চুপ করে এক মুহূর্ত ভাবে দাদু। তারপর খোঁয়াড়ে পাস্কুয়ালের গর্জন শুনে আর মাথা ঠিক রাখতে পারে না… ‘তাহলে আমার কী হবে? আমার এই কাঠের পায়ে ব্যথা লাগে না? সত্তর বছর বয়স হয়ে গেল এখনও গাধার মতো খাটছি…একদম ঘ্যানঘ্যান করবিনা বলছি’।
    দাদুর মুখঝামটা শুনে টিনটা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে রাস্তায় বেরোয় এফ্রিন। পা যেন আর চলে না! ভাইয়ের কাঁধে ভর দিয়ে সে কোনোমতে খুঁড়িয়ে হাঁটে। আর না পেরে আধ ঘণ্টা পরেই দু-ভাই ফিরে আসেনি। টিন প্রায় খালি।
    ‘দাদু, এফ্রিন পা-একদম গেছে। ও দাঁড়াতেই পারছে না’।
    আগুন চোখে নাতিদের দিকে তাকায় ডন সান্তোস…পারলে এক্ষুনি ওদের ভস্ম করে দেবে।
    ‘বটে?’ পাতলা দাড়িতে একটু হাত বুলিয়ে এফ্রিনের ঘেঁটিটা ধরে ঘরের মধ্যে ধাক্কা মেরে সে ফেলে দেয়… ‘যা বিছানায় শুয়ে শুয়ে মরগে যা। ওখানেই পচে মর। এনরিকে, তোকে ভাইয়ের সব কাজ করতে হবে। এবার আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা’।
    দুপুরের দিকে টিন ভর্তি করে কোরালে ফেরে এনরিকে। তার পেছন পেছন নতুন এক অতিথি এসেছে বাড়িতে…ঐ রাস্তার ঘেয়ো একটা নেড়ি কুত্তা। সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করে এনরিকে… ‘এটাকে আস্তাকুড়ে পেয়েছি। সেই যে আমার পিছু নিয়েছে আর ছাড়ছেই না!’
    লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে ডন সান্তোস… ‘তা ঐ ব্যাটাকে কে খাওয়াবে?’
    এনরিকে ছুটে এসে কুকুরটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে… ‘দাদু ওকে মেরো না। আমি আমার খাবার থেকেই ওকে ভাগ দেব’।
    ডন সান্তোস আবার তেড়ে আসে নাতির দিকে…কাঠের পা-টা তার কাদায় দেবে যায়… ‘এখানে কোনও কুকুরের থাকা হবে না। একা রামে রক্ষে নেই আবার সুগ্রিব দোসর!’
    দরজাটা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে যেতে চায় এনরিকে… ‘ও না থাকলে এ বাড়িতে আমিও থাকব না’।
    একটু দমে যায় ডন সান্তোস। এই সেদিনের ছোঁড়াও তবে ঝোপ বুঝে কোপ মারছে! ওকে ছাড়া তো এখন কোনও গতিও নেই। এনরিকে জেদ ধরে বসেই থাকে… ‘ও তেমন কিছু খায় না দাদু। কেমন হাড় জিরজিরে চেহারা তো দেখতেই পাচ্ছ। এফ্রিন এখন বেরোতে পারছে না। কুকুরটা থাকলে আমার কাজে অনেক সুবিধা হবে। ও আস্তাকুড়গুলো খুব ভালো চেনে। ও শুঁকেই বলে দেবে কোথায় কী আছে’।
    হাল ছেড়ে দিয়ে ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে ডন সান্তোস। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। কোন কথা না বলে টিনটা নিয়ে খোঁয়াড়ের দিকে হাঁটা দেয়। দাদুকে হারতে দেখে আনন্দে কুকুরটাকে বুকে জড়িয়ে ভাইয়ের কাছে ছুটে যায় এনরিকে।
    ওদিকে খোঁয়াড় থেকে ভেসে আসে দাদুর গর্জন… ‘পাস্কুয়াল…পাস্কুয়াল…পাস্কুয়ালিতো।
    কুকুরটাকে ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দেয় এনরিকে… ‘বুঝলি ভাই, এটার নাম দেব পেদ্রো’। ভাইয়ের অবস্থা দেখে মুখটা তার শুকিয়ে যায়। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে এফ্রিন। ঘামে জবজব করছে সারা শরীর। পা-টা এই গোদা হয়ে ফুলে রয়েছে। আঙুলগুলো যন্ত্রণায় বেঁকে গেছে… ‘ভাই তোর জন্য এটাকে এনেছি। পেদ্রো এখন থেকে তোর সঙ্গেই থাকবে। আমি যখন কাজে যাব তখন তুই ওর সঙ্গে খেলতে পারবি। ও তোকে পাথর কুড়িয়ে এনে দেবে’।
    ‘আর দাদু? দাদু তো মেরে শেষ করে দেবে তোকে’।
    দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে এনরিকে… ‘নাহ, দাদু কিছু বলবে না’।
    দরজার বাইরে তাকায় দুইভাই। বৃষ্টি পড়েই চলছে। খোঁয়াড় থেকে শোনা যাচ্ছে দাদুর কাতর ডাক… ‘পাস্কুয়াল…পাস্কুয়াল…পাস্কুয়ালিতো’।
    আজ পূর্ণিমা। এ কথা মনে করেই ভয়ে কাঠ হয়ে যায় ছেলেগুলো। পূর্নিমার রাতগুলোকে দাদুকে সামলে রাখা যায় না। আজ বিকেল থেকেই সারা কোরাল জুড়ে দাদু উন্মত্তের মতো চক্কর কেটে চলেছে। নিজের মনেই কী যেন বিড়বিড়িয়ে বলছে। মাঝে মাঝে লাঠিটা নিয়ে আঙুর লতার ওপর দুম দুম করে ঘা মারছে। মাঝে মাঝেই দরজায় উঁকিয়ে দিয়ে ভয়ে গুটিয়ে যাওয়া নাতি দুটোকে দেখে ঘেন্নায় থুতু ছেটায়। পেদ্রোও ভয়ে গুটিসুটি মেরে যায়।
    চাঁদের দিকে চেয়ে সারা রাত চেঁচিয়ে যায় বুড়ো… ‘রাবিশ, রাবিশ…সব রাবিশ’!
    পরের দিন সকালে কাঁপতে কাঁপতে ওঠে এনরিকে। সারা রাত ধরেছে ছেলেটা কেশেছে। দাদু সব শুনেও রা কাড়েনি। ভেতরে ভেতরে প্রমাদ গুনেছে বুড়ো। এনরিকে শয্যা নিলে পাস্কুয়ালের কী হবে? গায়ে যত চর্বি জমছে তত যেন হিংস্র হয়ে উঠছে জানোয়ারটা। তার এখন সর্বগ্রাসী খিদে। আজ সারা বিকেল ধরে কাদায় নাক ঘসতে ঘসতে গর্জন করে গেছে। এ নিয়ে পাশের বাড়ির নেমেসিও পর্যন্ত এসে নালিশ জানিয়ে গেছে।
    যে ভয়টা বুড়ো পাচ্ছিল সেটাই সত্যি হল পরের দিন। এনরিকে বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। রাত রাত ধরে হি হি করে কেঁপেছে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।
    ‘এবার তুই-ও’? পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যায় বুড়োর।
    এনরিকে নিজের বুকটা দেখিয়ে দেয়। সর্দি জমে একেবারে ঘড় ঘড় করছে। বুড়ো ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আবার পাঁচ মিনিট পরে ফিরে আসে… ‘সব তোদের শয়তানি! আমি কি বুঝি না? আমি হাঁটতে পারিনা…তাই তোরা সবাই মিলে আমাকে হেনস্থা করছিস। আমার সামর্থ্য থাকলে তোদের দুটোকে দূর করে নিজেই পাস্কুয়ালের দেখাশোনা করতাম’।
    এফ্রিন যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে। এনরিকে কাশতে কাশতে হাঁপিয়ে ওঠে’।
    ‘জাহান্নামে যা তোরা। আমি নিজেই পাস্কুয়ালের দেখভাল করব। সব অপগোণ্ড…ভাগাড়ের শকুন কোথাকার! দেখ এবার আমি কী করি! এ বুড়ো হাড়ে এখনও অনেক জোর রয়েছে। তবে একটা কথা জেনে রাখ আজ তোদের খাওয়া বন্ধ…যতদিন না কাজে যাবি যতদিন উপোস দিয়ে মরবি’।
    বুড়ো টলতে টলতে টিনটা নিয়ে রাস্তায় নামে। আধ ঘণ্টা পর বুড়ো খালি হাতে বাড়ি ফেরে। নাতিদের মতো সে ছুটতে পারে না। সে যাওয়ার আগেই স্যানিটেশনের লোকজনেরা সব ময়লা সাফা করে দিয়ে গেছে। তারপর রাস্তার এক খেঁকি কুত্তা তাকে কামড়াতেও গিয়েছিল।
    ‘নরকের কীট! যতদিন না কাজে যাবি খাওয়ার জুটবে না বলে দিচ্ছি’।
    পরের দিন টিন হাতে বুড়ো আবার বেরোয়। কিন্তু বিশেষ সুবিধা করতে পারে না। গলা পিচের রাস্তায় কাঠের পা বসে যায়। আবার ফুটপাথের শক্ত পাথরে পা ফেলতে গেলে কুঁচকিটা ব্যথায় টনটন করে ওঠে। তৃতীয় দিনের অপার্থিব ভোরে বুড়ো হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় নেতিয়ে পড়ে। আর সেইসঙ্গে মুখ দিয়ে গালাগালির বন্যা ছোটে… ‘পাস্কুয়াল যদি না খেয়ে মরে…তার দায় কিন্তু তোদের’!
    তাদের দুর্দশার দিন শুরু হয়। বাড়ির তিনজনই বিছানাবন্দী। গোটা দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযাগবিচ্ছিন্ন। এফ্রিন যন্ত্রণায় কাতরায়। কাশতে কাশতে গলায় রক্ত উঠে আসে এনরিকের। পেদ্রো কোরালের এদিক-ওদিক ছুটে নুড়ি-পাথর কুড়িয়ে এনে মনিবের হাতে তুলে দেয়। ডন সান্তোস বিছনায় বসে কাঠের পায়ে হাত বোলায় আর নাতিদুটোকে শাপশাপান্ত করে যায়। কোরালের একদিকে কিছু সবজি হয়েছে। বুড়ো তাই দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দুপুরের খাবার সারে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একটা লেটুস পাতা বা গাজর নিয়ে নাতিদুটোকে লোভ দেখায়। হ্যাঁ, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না…ওদের লোভ দেখাতে হবে…পেটভর্তি খাবারের লোভ! তবে যদি ব্যাটারা বাগে আসে।
    কথা বলার ক্ষমতা নেই এফ্রিনের। আর দাদুর ঘোলাটে চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে যায় এনরিকে। এ চোখের চাউনি সে চিনতে পারে না। এ যে মানুষ নয়, হায়নার দৃষ্টি! রাতে আবার চাঁদ ওঠে। পেদ্রোকে বুকে টেনের নিয়ে খুব আদর করে এনরিকে। আদর পেয়ে আনন্দে কুঁই কুঁই করে ওঠে পেদ্রো। রাত বাড়ে। খোঁয়াড় থেকে থেকে শোনা যায় জান্তব গর্জন। বুড়ো অস্থির হয়ে ওঠে। অসহায় হয়ে বুড়োও কাতরায়…যেন তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হচ্ছে। কাঠের পা-টা শক্ত করে বেঁধে মাঝে মাঝে কোরালের বাইরে বেরিয়ে যায়। চাঁদের আলোয় এনরিকে দেখে বুড়ো একবার খোঁয়াড়ে যাচ্ছে, একবার বাগানে। হাতে শক্ত মুঠি পাকিয়ে সব কিছু যেন ভেঙে চূরমার করে দিতে চাইছে। শেষমেশ ঘরে ঢুকে ছেলে দুটোর ওপর লাভা উগরে দিতে চায়…যেন পাস্কুয়ালের এই রাক্ষুসে খিদের জন্য তারাই দায়ী।
    আজ শুক্লপক্ষের শেষ রাত। পাস্কুয়ালের বিকট গর্জন আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এনরিকে শুনেছে খিদে পেলে শূয়োররা নাকি উন্মাদ হয়ে যায়…ঠিক মানুষের মতো। দাদুর কানে সব যাচ্ছে, কিন্তু আজ আর তার কোন উচ্চবাচ্য নেই। গালাগালের বন্যাও নেই। বিছানায় শুয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে দরজার দিকে। মনে মনে রাগ দানা বাঁধছে…তাও দাদু চুপ… একসময় প্রবল বহ্বাস্ফোটে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। দূরের পাহাড়গুলো রুপোলি আলোয় ভেসে যায়। বুড়ো তাকিয়ে থাকে হাঁ করে। নাতিদের দিকে তাকিয়ে ভেতরের রাগটা আবার দলা পাকিয়ে ওঠে। ‘ওঠ ওঠ বলছি শয়তানের দল’। এলোপাথাড়ি কিল, চড়, ঘুসির বন্যা বইয়ে দেয় বুড়ো… ‘ওঠ বলছি…শালা আলসে কুঁড়ের দল। এইভাবে আর কতদিন চলবে? উঠে দাঁড়া বলছি’।
    ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে এফ্রিন। তার যে উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তি নেই। দেওয়ালটা ধরে কোনোমতে উঠে দাঁড়ায় এনরিকে। দাদুর চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা শুকিয়ে যায়। হাত-পা অবশ হয়ে আসে। দাদুর লাঠির বাড়ি নেমে আসে মাথায়। সে কোনও ব্যথা পায় না। ব্যথার বোধটাই তার আর নেই। শেষমেশ দুটো কথা বলে উঠতে পারে সে… ‘এফ্রিন থাক। ওর কোন দোষ নেই। আমি যাচ্ছি। হ্যাঁ হ্যাঁ আমি যাব’।
    বুড়ো পিছিয়ে আসে। রাগে…উত্তেজনায় বুকটা তার হাপরের মতো ওঠানামা করে। নিজেকে সামলাতে একটু সময় লাগে বুড়োর… ‘এক্ষুনি যা না …দু টিন ভর্তি করে আনবি…না না চার টিন…
    টিনগুলো নিয়ে এনরিকে ছুট লাগায়। ওষুধ নেই, পথ্য নেই। পেটে একদানা খাবার নেই। সোজা হয়ে সে দাঁড়াতে পারে না। খালি হোঁচট খেয়ে পড়ে। কোরালের দরজা খুলতে গিয়ে সে দেখে পেছনে পেদ্রো।
    ‘তুই আসিস না বাবা…বাড়িতে থাক। এফ্রিনের দেখভাল কর’।
    এনরিকে রাস্তায় নামে। প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়। খিদেতে গা গুলিয়ে আসে। কিছু না পেয়ে খানিকটা ঘাস খেয়ে ফেলে। মাটি খাওয়ারও ইচ্ছে হয়। তার চোখের সামনে কুয়াশার ওড়নায় ঢালা এক মায়াবি জগত। নিজেকে পেঁজা তুলোর মতো হালকা মনে হচ্ছে। সে যেন মুক্ত বিহঙ্গ…শুধু ভেসেই চলেছে। আস্তাকুড়ে পৌঁছে দেখে দলে একটা নতুন শকুন। নিজের টিনগুলো ভর্তি করে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। ধর্মপ্রাণ মহিলা…রাতের ভবঘুরে…কাগজওয়ালা… ভোরের সব নিঃসৃত রস ছড়িয়ে পড়ছে শহরজুড়ে। ভোরের মায়াবি আলোর ভেতর দিয়ে জিনপরীর হাত ধরে হাঁটতে থাকে এনরিকে।
    বাড়িতে ঢোকার মুখে দেখে দমবন্ধ করা এক গুমোট হাওয়া। থমকে দাঁড়ায় সে। মনে হয় এই দরজায় কাছে এসেই তার জগতটা শেষ হয়ে গেছে। ওপারে অন্য এক জগত…সেখানে শুধু পাঁক আর জান্তব গোঙানি। কোরাল জুড়ে এক ভূতুড়ে নৈঃশব্দ…এ যেন প্রবল এক ঝড়ের পূর্বাভাষ। কোন বিপর্যয়ের অশনি সংকেত। খোঁয়াড়ের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে দাদু। দৃষ্টি তার আকাশের দিকে। দাদুকে দেখে মনে হয় যেন ঝুরি নামা প্রাচীন কোন বটগাছ। যুগ যুগ ধরে ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে…নিথর…নিশ্চল। এনরিকে এসে জোরে জোরে দাদুকে ডাকে। কোন সাড়া নেই।
    ‘এই যে টিন ভর্তি জিনিস এনেছি’।
    দাদুর তাও কোন সাড়াই নেই। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। কী হয়েছে টা কী? মনটা এবার কু ডাকে এনরিকের। ছুটে যায় ঘরের ভেতর। দাদাকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠে এফ্রিন… ‘পেদ্রো…পেদ্রো…
    ‘হ্যাঁ, কী হয়েছে পেদ্রোর?’
    ‘পেদ্রো দাদুকে কামড়েছে…দাদু লাঠি নিয়ে নিয়ে তেড়ে গেছে…তারপর একবার শুধু কুকুরটার চিৎকার শুনেছি। আর কিছু জানি না আমি’।
    ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এনরিকে… ‘পেদ্রো…পেদ্রো…গেলি কোথায়?’
    পেদ্রোর কোনও সাড়া নেই। দাদু এখনও স্থির হয়ে মাটির দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মাথাটা গরম হয়ে যায় এনরিকের। বমি এসে যায়। লাফিয়ে গিয়ে সে দাদুর সামনে দাঁড়ায়… ‘পেদ্রো কোথায়? উত্তর দাও বলছি’!
    তারপর এনরিকের চোখ যায় খোঁয়াড়ের দিকে। শুয়োরটা তার রাক্ষুসে খিদে নিয়ে ঘোঁতঘোঁত কী যেন গিলছে। খাবারটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে…শুধু কুকুরের লেজ আর পাগুলো পড়ে রয়েছে।
    নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না এনরিকের। আহত পশুর মতো আর্তনাদ করে ওঠে… ‘না…এ কিছুতেই হতে পারে না। ঝাপসা চোখে সে শুধু দাদুর মুখটা খোঁজে। বুড়ো লোকটার মুখে কুলুপ। নাতির ঐ ভয়ংকর দৃষ্টি এড়াতে এখন মৌনতাই তার ভরসা। বুড়োর চারপাশে ভূতের মতো নাচতে শুরু করে এনরিকে। বুড়োর শার্ট ধরে ছিঁড়ে দেয়, একবার লাথি মারে। সে জবাব চায়…সোজা-সাপটা জবাব… ‘তুমি এটা কেন করলে? কেন? কেন?’
    প্রথমটা বুড়ো চুপ করে থাকে। তারপর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতেই ছেলেটাকে ঠাসিয়ে মারে এক থাপ্পড়। মার খেয়ে গোত্তা খেয়ে মাটিতে পড়ে এনরিকে। ওদিকে দৈত্যের মতো বিশাল বপু নিয়ে পাস্কুয়ালের মহাভোজ তারিয়ে তারিয়ে দেখে বুড়ো। চুপিসাড়ে বুড়োর রক্ত মাখা লাঠিটা তুলে নেয় এনরিকে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুড়োর ওপর… ‘পেছন ফেরো…ফেরো বলছি’।
    বুড়ো পেছন ফিরে দেখে লাঠিটা দুলতে দুলতে সপাৎ করে তার পিঠে এসে পড়ল। ‘শিক্ষা হয়েছে? না আরো দিতে হবে’…চিল চিৎকার করে ওঠে এনরিকে। আবার এক থাপ্পড় মারতে গিয়েও থেমে যায়। এতক্ষণ মাথা ঠিক ছিল না তার। এ কী করছিল সে! লাঠিটা ফেলে দেয় সে। তার চোখে অনুশোচনা। কিন্তু বুড়ো খুব ভয় পেয়ে গেছে। ভয়ের চোটে এক পা, একপা করে পিছোতে, পিছোতে মাটিতে পা পিছলে খোঁয়াড়ের মধ্যে গিয়ে পড়ে।
    ভয়ে পিছিয়ে আসে এনরিকে। কানখাড়া করে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করে। শুনতে না পেয়ে আরো দু-পা এগোয়। দাদু এখনও মাটিতে পড়ে রয়েছে। সারা গায়ে কাদা। কাঠের পা-টাও ভেঙে গেছে। মুখটা হাঁ করে অধীর হয়ে পাস্কুয়ালকে খুঁজে চলেছে। খোঁয়াড়ের এক কোণে দাঁড়িয়ে মাটিতে কী যেন একটা গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করছে পাস্কুয়াল…রক্তের গন্ধ।
    চুপিচুপি যেমন এসেছিল, তেমনই পা টিপে টিপে ঘরে চলে যায় এনরিকে। দাদু তাকে বোধহয় দেখতে পায়নি! কিন্তু এনরিকে মনে কে যেন কাতর ভাবে তার নাম ধরে ডাকছে…এমন অসহায় ডাক সে আগে কখনও শোনেনি… ‘এনরিকে…দাদুভাই…ফিরে আয়…
    এক ছুটে ঘরে গিয়ে ভাইকে ডেকে তোলে সে… ‘ভাই জলদি। বুড়োটা খোঁয়াড়ে পড়ে কাতরাচ্ছে। চল এই সুযোগে আমরা পালাই’।
    ‘কিন্তু দাদা কোথায় যাব?’
    ‘আস্তাকুড়ে। ঐ যেখানে শকুনগুলো ভিড় করে…কিছু না কিছু খাবার ওখানে মিলে যাবে’।
    ‘কিন্তু দাদা আমি যে উঠে দাঁড়াতেই পারছি না’।
    দুহাত দিয়ে ভাইকে টেনে তুলে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে এনরিকে। এত শক্ত করে ভাইকে সে জড়িয়ে ধরেছে যে দুজনকে আর আলাদা করা যায় না। দু-ভাই একই সত্তায় বিলীন হয়ে গেছে। কোরালের দরজা খুলে রাস্তায় বেরিয়ে দু-ভাই দেখে অলৌকিক ভোরের কুয়াশা সরিয়ে দিনের কর্মব্যস্ততায় জেগে উঠেছে শহর। বিরাট এই শহরটা তাদের দুই ভাইকে দৈত্যের মতো হাঁ করে গিলে খেতে আসছে।
    ওদিকে খোঁয়াড় থেকে শোনা যায় প্রবল ধ্বস্তাধ্বস্তির আওয়াজ।
    বিঃদ্রঃ- পেরুতে বস্তির এক-কামরাওয়ালা ঘরকেই বলা হয় কোরাল।

  • অনুবাদ

    অনুবাদ- বড়দিনের ভোজ

    বড়দিনের ভোজ
    -মারিও দে আন্দ্রেদ

    অনুবাদ-  বর্ণালী জানা সেন 

     

     

    বাবা মারা যাওয়ার পরে প্রথম বড়দিন। বাবা চলে গেছেন পাঁচ মাস আগে। ঘরের আনাচে-কানাচে এখনও তাঁর কত স্মৃতি! তিনি চলে যাওয়ার পরে আমাদের সব সুখ, শান্তি চলে গেছে। তথাকথিত সুখী পরিবার বলতে যা বোঝায় আমরা তা কোনোদিন ছিলাম না। এমনিতে সবাই ভালো মানুষ, কেউ চুরি-ডাকাতি করেনি, নিজেদের মধ্যে কোনো ঝগড়া বিবাদ নেই, টাকাকড়ির টান নেই…তাও আমরা পুরোপুরি সুখী ছিলাম না । তার অন্যতম কারণ বাবা। নেহাতই ছাপোষা অতিসাধারণ, একটা মানুষ। কোন রসকষ নেই। কোনো মহৎ চিন্তা নেই। চাল, ডাল, তেল, নুনের বাইরে বড় কিছু তিনি ভাবতেই পারলেন না সারাজীবন। বাবার জন্যই জীবনটাকে আমরা কোনোদিন পুরোপুরি উপভোগই করতে পারিনি। আমরা কনোদিন কোন ঝাঁ-চকচকে রিসর্টে বেড়াতে যাইনি। ভালো মদের স্বাদ পাইনি। কাজের সুবিধার জন্য রেফ্রিজারেটর বা হেনা তেনা যা থাকা দরকার মা তার কোনটাই পাননি। বাবার সব চিন্তাভাবনাই যে কী উদ্ভট ছিল! নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করতে বাবার জুড়ি ছিল না।
    বাবা চলে গেছেন। সবার মন ভারী। বড়দিন চলে এল। তাও মুখে কারো হাসি নেই। আমিও মানুষটার কথা ভুলতে পারছি না। খাওয়ার টেবিলে…সংসারের তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাজেকর্মে অবধারিতভাবে বাবার কথা উঠবে। এটা একদম রুটিন হয়ে গেছে আমাদের জীবনে। একদিন সিনেমায় যাওয়ার কথা বলতেই মা এমন আঁতকে উঠল যেন ভীষণ একটা পাপ করে ফেলেছি আমি! এই শোকের সময়ে অর্বাচীনের মতো এমন একখানা কথা বললাম কী করে! শোকটা যেন সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতে হবে! সব ছেলেদের মতো আমিও বাবাকে ভালোবাসতাম। তবে সে ভালোবাসার মধ্যে কর্তব্য ছিল বেশি, মনের টান ছিল কম। পরিবারের সুখের মুহূর্তগুলোকে বাবার স্মৃতি এমনভাবে গ্রাস করে নিয়েছে যে মনে মনে লোকটাকে গালাগাল দিতে ইচ্ছে করছে। মরেও কাউকে দু দণ্ড শান্তি দিচ্ছে না।
    এবারে যা করার আমাকেই করতে হবে। একটু পাগলামি করতে হলে হবে। ছোটবেলা থেকেই সবাই আমাকে বলে পাগল। তবে এই পাগলামির দোহাই দিয়ে কত অপকম্ম করেও আমি ছাড় পেয়ে গেছি। ছোটবেলায় স্কুলে যখন প্রতি ক্লাশে গাড্ডু মারতাম তখনও কেউ কিছু বলেনি। দশ বছর বয়সে এক খুড়তুতো বোনকে লুকিয়ে চুমু খাওয়ার সময় আমার ঐ ভয়ানক পিসি ভেলহার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েও দিব্যি পার পেয়ে গেছি। তারপর কোন কাজের মেয়ে বা তুতো বোনদের কাছে এমন কিছু একটা বলেছিলাম যাতে সব আত্মীয়-স্বজন হাঁ হাঁ বাড়িতে চলে এসেছিল। ‘ছেলেটা তো দেখছি একদম পাগল’! এসব কথা শুনতে কোন বাবা-মার ভালো লাগে! ওরা শুধু বলেন… ‘আহা, পাগল একখানা, ওর কথা কি ধরতে আছে?’ আত্মীয়-স্বজনদের চোখে মুখে প্রচ্ছন্ন গর্ব…‘যাক, বাবা বাঁচা গেছে…আমাদের ছেলেপিলেরা তো আর ওর মতো হয়নি’! তবে আর যাইহোক…ওরা যাকে পাগলামি বলে তার মধ্যেই ছিল আমার মুক্তি। আমার যা ইচ্ছে তাই করতাম। তবে যা করতাম খুব মন দিয়ে করতাম। আমায় কেউ কিছু বলতে আসত না। পাগল বলে কেউ ধর্তব্যের মধ্যেও আনত না। তাই বাঁচার আনন্দকে একেবারে চেটে পুটে নিয়েছি। আমার মধ্যে কোন হীনমন্যতা আসেনি। জীবন সম্বন্ধে আমার কোন অভিযোগও নেই।
    প্রতি বছর আমাদের ক্রিসমাস ডিনার হত। প্রার্থনার পর সবাই একসঙ্গে খেতে বসতাম। তবে এলাহী কোন আয়োজন হতনা…যতটা সস্তায় সারা যার আরকি…ঐ কিসমিস, আখরোট, কাজু এইসব। থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়(আমারা বাচ্চারা অবশ্য এক বাদাম নিয়েই কাড়াকাড়ি করতাম) । ফি বছর সেই একঘেয়ে রুটিন…একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া…তারপর কোলাকুলি করে শুতে যাওয়া। এইসব কথা মনে পড়তেই মনটা বিদ্রোহ করে উঠল। না এবার একটা পাগলামি করতেই হবে… ‘এবার বড়দিনে টার্কি হবে’। আমার কথা শুনে সবার তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। বড়দিনে টার্কি! অসম্ভব! আমার পিসি তো সাফ জানিয়ে দিলেন এই শোকের সময়ে কাউকে নেমন্তন্ন করা যাবে না।
    ‘কে বলেছে নেমন্তন্ন করতে? তোমাদের স্বভাব আর গেল না…বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান ছাড়া আর কবে টার্কি হয়েছে আমাদের বাড়িতে? আর যখনই হয়েছে ঐ যতসব হ্যাংলা আত্মীয়স্বজন এসে জুটে গেছে…’
    ‘এমন করে বলে না বাবা’।
    ‘ আমি এমন করেই বলি। মাথায় ঢুকেছে সবার?’
    আমাদের রাবনের গুষ্টির ওপর আমার যত রাগ সব উগরে দিই । সাধুপুরুষ সব! আমি ওদের থোড়াই কেয়ার করি! যা পাগলামি করার আমাকে এখনই করতে হবে। এ সুযোগ হাতছাড়া করলে চলবে না। মা তো রয়েইছে। আমার পিসি আর বোনও আমার কাছে মায়েরই মতো। এই তিন মায়ের প্রশ্রয়েই তো আমার জীবনটা এত সুন্দর! বাড়িতে কারো জন্মদিনের পার্টি হলে তবেই টার্কি রান্না হয়। আর টার্কি হলেই পঙ্গপালের মতো যত আত্মীয় জুটে যায়। পার্টির তিন দিন আগে থেকেই আমার তিন মা-কে কাজে লেগে পড়তে হয়। খাবার বানাতে হয়…কেক, পেস্ট্রি, মিষ্টি। আমার তিন-মা সারা জীবন খেটেই গেল। আর কোনোদিকে তাকানোর ফুরসৎ পেলনা। তারপর পার্টির দিন আত্মীয় স্বজনেরা আসবে…রাক্ষসের মতো গিলবে… ছেলেমেয়ের জন্য ছাঁদা বেঁধে বাড়িতে নিয়ে যাবে। এঁটো-কাঁটা যা পড়ে থাকবে পরেরদিন মায়েদের ভাগে তাই জুটবে। সবাই খেয়ে চলে গেলে তবে মা ছোট্ট এক টুকরো মাংশ পাবে…এতই ছোট যে সাদা ভাতের থালায় সেটা চোখেই পড়বে না। মা-ই সবসময় আমাদের খাবার পরিবেশন করে। ছেলে বুড়ো সবাইকে দিয়ে থুয়ে যেটুকু পড়ে থাকে তাই খেয়েই মা খুশি। টার্কির স্বাদ কেমন মায়েরা কেউ জানে না। লোকজন খাওয়ার পর যে হাড়গোড় বেঁচে থাকে সেটা দিয়েই ওরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায়।
    না, এবার আর কোন আত্মীয় স্বজন থাকবেনা। টার্কি রান্না হবে শুধু আমাদের জন্য…আমাদের পাঁচজনের জন্য। টার্কি থাকবে…তারসঙ্গে কাসাভা আলুর দু-রকম স্টাফিং থাকবে। একটা হবে তুলতুলে…তাতে থাকবে টার্কির চর্বি আর মেটে। আরেকটা হবে একটু শক্ত… প্রচুর মাখন থাকবে তাতে। আমার কিন্তু মেটেটাই চাই। আমি কিসমিস আর আখরোট দিয়ে খাব। ও…আর সঙ্গে আমার শেরিও চাই। এই রেসিপিটা আমি রোজের কাছ থেকে শিখেছি যদি বাড়িতে ওর নামটা উহ্যই রাখি। আমরা যে প্রায়ই একসঙ্গে ঘুরতে বেরই… বাড়িতে কেউ জানে না। তবে ওরা কিছু একটা সন্দেহ তো করেই। আমার কথা শুনে কেউ রা কাড়ে না। সবাই গম্ভীর মুখে বসে থাকে…যেন সব শয়তানেরই কীর্তি। এত খাবার-দাবারের লোভ দেখিয়ে শয়তান সেন তাঁদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে! ‘আর সঙ্গে বরফ ঠান্ডা বিয়ারও থাকবে’…কারো দিকে না তাকিয়েই ঘোষণা করে দিই আমি। বাড়ির বাইরে থেকে আমি অনেক নতুন নতুন জিনিস খাওয়া শিখেছি। আমার পছন্দ খাঁটি ফরাসি ওয়াইন। কিন্তু মা-যে বিয়ার খেতে খুব ভালোবাসে!
    আমাদের বড়দিনের ভোজের বিস্তারিত প্ল্যান, প্রোগ্রাম হল। সবার মুখে, চোখে চাপা উত্তেজনা। সবাইকেই এখন পাগলামিতে পেয়ে বসেছে। তবে সবাই কিন্তু আমার কোর্টেই বল ঠেলে দিয়েছে। আমার পাগলামিতেই যেন সবকিছু হচ্ছে। এতে তাদের অপরাধবোধ একটু কমে। সবাই এ ওর দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। শেষ পর্যন্ত আমার বোনই সবার মনের কথাটা ঘোষণা করে দেয়… ‘দাদা না এক্কেবারে পাগল!’
    টার্কি কেনা হল। রান্না হল। মাঝরাতে প্রার্থনা সেরে আমরা এলাম খাবার টেবিলে। আমাদের বড় সাধের দিন! বড় আনন্দের দিন! একটা খুশিয়াল হাওয়া। আমারও ভারি মজা লাগছে। মা-কে শেষ পর্যন্ত টার্কি খাওয়াতে পারব। মায়ের জন্য এতদিন কিছুই করতে পারিনি। মনের সবটুকু আবেগ দিয়ে মায়ের কথা ভেবেছি। আমাদের জন্য শুধু প্রাণপাত করে গেল মানুষটা। ভাই, বোনের মুখও আনন্দে ঝলমল। সব এই টার্কির জন্য। এই টার্কির জন্যই আমরা সুখের মর্ম বুঝেছি। মা ছুরি দিয়ে টার্কির পুরো ব্রেস্ট পিসটা কাটতে গিয়ে কাটতে পারল না। ব্রেস্ট পিস থেকে ছোট একটা ফালি কেটে নিল। কৃচ্ছ্রসাধনের অভ্যাসটা এখনও গেল না দেখছি!
    ‘না মা, আমায় পুরো পিসটাই দাও। আমি পুরোটাই খাব’।
    ডাহা মিথ্যে। আমার মনে তখন আনন্দে উপচে পড়ছে। আজ আমার কিচ্ছু না খেলেও চলবে। বাকিরা যদি পেটপুরে খায় তবে আমি উপোস দিতেও রাজি। বাকি সবাইও মনে মনে ঠিক একইকথা ভাবছে। প্রতিদিন শুধু কর্তব্যের মজা নদীতে যে আনন্দ, যে ভালোবাসা আটকে পড়েছিল আজ তা আবার প্লাবন নামিয়েছে। মায়ের ভালোবাসা, সন্তানের ভালোবাসা…কী স্বর্গীয় এই অনুভূতি ! আমার হঠাৎ যীশুর কথা পড়ল। যীশুর আবির্ভাবের দিব্য মুহূর্তকে আমাদের মতো একটা মধ্যবিত্ত পরিবার আর কত ভালোভাবে উদযাপন করতে পারে! টার্কির ব্রেস্ট পিসটা চওড়া, চওড়া টুকরোয় কাটা হল।
    ‘মা, আমি আজ পরিবেশন করব’।
    ‘পাগল একটা’! মায়ের কাজে আমি ভাগ বসাতে চাই কোন সাহসে! যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমার কথা মেনে নিয়ে প্লেটগুলো সব আমার দিকে এগিয়ে দেয় মা। আমি খাবার ভাগ করতে বসি। ভাইকে বলি গেলাসে বিয়ার ঢালতে। নরম তুলতুলে একটা চর্বির টুকরো দেখে আমি প্লেটে তুললাম। তারপর কয়েক টুকরো সাদা মাংস। সবার চোখ এই মাংশের দিকেই। হাঁ হাঁ করে উঠল মা… ‘একা সব খেয়ে নিস না জুকা। ভাই-বোনের জন্যও কিছু রাখ’।
    মাকে বললাম ‘এটা তোমার’। চোখ ছলছল করে উঠল মায়ের। আমার বেচারি মা! সারা জীবন শুধু কষ্টই দিয়েছি মাকে। রোজের কথা জেনে…আমার সব কুকীর্তির জেনেও কোনদিন কিছু বলেনি আমায়।
    ‘না, মা এটা তোমায় খেতেই হবে…অন্য কাউকে দিতে পারবে না’।
    আর থাকতে না পেরে ডুকরে কেঁদে উঠল মা। মায়ের দেখাদেখি পিসিও ফোঁপাতে শুরু করল। কারণ এর পরের প্লেটটাই যাবে তাঁর হাতে। বোনের কথা আর কী বলব! ওর চোখে তো কল লাগানোই আছে। খুললেই জল। মা কাঁদে, পিসি কাঁদে, বোন কাঁদে। এই ছোঁয়াচে রোগ যাতে আমাকে না ধরে সেইজন্য আগদুম-বাগডুম বকতে শুরু করলাম। আমার এখন মাত্র উনিশ। যাচ্ছেতাই সব ব্যাপার। সবার মাথাই দেখছি গেছে। নাহলে টার্কির মাংশ দেখে বাড়িসুদ্ধ কেউ কেঁদে ভাসায়! সবাই একটু হাসার চেষ্টা করে বটে…এই পরিবেশে আর হাসি ফোটে না। এখন যে হাসা অসম্ভব! কাঁদতে কাঁদতেই অবধারিত ভাবেই বাবার কথা মনে পড়ে গেল সবার। বাবার ঐ বিষণ্ণ মুখের লম্বা ছায়াটা বড়দিনের সব আনন্দ মাটি করে দিচ্ছে। ঐ মৃত মানুষটার ওপর খুব রাগ হল আমার।
    আমরা খাওয়া শুরু করলাম। কারো মুখে কোন কথা নেই। অতীতের স্মৃতি এসে ভিড় করছে মনে। তবে রান্নাটা কিন্তু হয়েছে খাসা। কী নরম মাংশ…মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। তার ওপর হ্যামের স্টাফিং! কিসমিস আর আখরোটের নরম আদর! উহহ এই স্বাদ একেবারে জিভে…টাগরায় লেগে থাকে। কিন্তু এর মাঝেও বাবার সেই লম্বা ছায়া। ফোটোফ্রেমের মধ্যে বাবার ঐ ছবিটা যেন আমাদের তিরস্কার করছে… ব্যঙ্গ করছে। টার্কির স্বাদ জিভে মেখে মায়ের শেষ পর্যন্ত বোধোদয় হল…ভগবানের আবির্ভাবকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য টার্কির মতো আর কিছু হয় না।
    অতীতের স্মৃতি নাকি বর্তমানের এক টুকরো আনন্দ। একদিকে বাবা আরেক দিকে এই টার্কি। দুজনের দড়ি টানাটানিতে কে জিতবে! আমি ভাবলাম যুদ্ধে টার্কির পক্ষ নেব। আমি শুধু টার্কিরই গুণগান গাইব। কিন্তু মৃত মানুষের ক্ষমতা অনেক বেশি। মনের কোনো সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে অতর্কিতে আবির্ভাব হয়ে শত্রুপক্ষকে একেবারে মাত দিয়ে দেয়। আমি টার্কির কথা শুরু করতেই মা ফুঁপিয়ে উঠল…. ‘আজ যদি তোর বাবা বেঁচে থাকতেন’! বাবাই জিতে গেলেন।
    এত সুস্বাদু খাবার আর আমার মুখে রুচছে না। বাবা নাকি টার্কি? দুই মৃত প্রানীর এই লড়াই দেখে মনটা আমার তিতকুটে হয়ে গেছে। লোকটার ওপর ঘেন্না হচ্ছে আমার। কিন্তু আজকের দিনের আনন্দটা আমি মাটি হতে দেবনা। কিছুতেই না। তার জন্য একটু অভিনয় করতে হলে হবে। জানিনা কীকরে মাথায় এমন দুষ্টূবুদ্ধি গজালো! আমি এবার বাবার পক্ষ নিলাম। করুণ স্বরে বললাম… ‘মা তুমি ঠিকই বলছ…বাবা তো আমাদের খুব ভালোবাসতেন…আমাদের জন্য প্রাণপাত করেছেন। এখন স্বর্গে গিয়ে উনি নিশ্চয়ই সুখে আছেন! (একটু দোনামনা করলেও টার্কির নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করলাম না)…আজ আমাদের সবাইকে একসঙ্গে দেখে বাবাও নিশ্চয়ই খুব আনন্দ পাচ্ছেন’!
    বাঁধের মুখ খুলে গেল। এখন সবাই বাবার কথা বলছে। তারপর বাবার ছায়াটা ছোট হতে হতে আকাশের তারা হয়ে গেল। এখন সবাই চেটেপুটে খাচ্ছে। কারণ বাবার কোনও তুলনা হয় না। আমাদের জন্য বাবা শুধুই আত্মত্যাগ করেছেন। বাবা রাতারাতি সাধু-মহাত্মা বনে গেছেন। মা বলে… ‘দেখো বাবা, তোমরা আজ যা হয়েছ সবই কিন্তু বাবার জন্য। বাবার ঋণ কোনোদিনও শোধ করতে পারবে না’। বাবা আজ আকাশের তারা। বাবার সঙ্গে কাটানো ভালো মুহূর্তগুলোই শুধু আজ সবার মনে পড়ছে। কারো মনে কোনও তিক্ততা নেই। বাবা আজ আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাবা আর কাউকে কষ্ট দিতে পারবে না। শুধু সুখস্মৃতি হয়েই রয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত তাহলে মরা টার্কিরই জয় হল।
    মা, পিসি… আনন্দে উপচে পড়ছে সবাই। এটা কি তাহলে ‘রসনা তৃপ্তির আনন্দ’! না না শুধু রসনা নয়। এটাই বোধহয় প্রকৃত সুখ। আলগা হয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলো আবার জোড়া লাগছে। দৈনন্দিন তুচ্ছতার স্রোতে যারা একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল…তারা আজ আবার কাছাকাছি চলে এসেছে। আমি জানি এর একমাত্র কারণ টার্কি। এই টার্কিই আজ আমাদের ভালোবাসার নতুন বাঁধনে বেঁধে দিল। এ ভালোবাসা অক্ষয়…এ ভালোবাসা চিরন্তন। এই মুহূর্তটাকে আমি চিরকাল মনের মধ্যে বাঁধিয়ে রাখতে চাই। আমাদের মতো এত সুখী আর কি কেউ এই জগতে আছে!
    মা পেটপুরে খেল। মায়ের খাওয়া দেখে মাঝে তো আমার ভয়ই হচ্ছিল…মায়ের না আবার পেটে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। তারপর ভাবলাম যা হয় হোক…মা মরলে মরুক। কিন্তু তার আগে আসল টার্কির স্বাদটা নিয়ে যাক। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের ওপর উঠতে পেরে আমিও আজ খুব খুশি! আত্মত্যাগের যে কত সুখ!
    টার্কির পর শেষপাতে আমরা আঙুর আর একটু কুকিজ খেলাম। এই কুকিজকে আমাদের দেশে বেম-কাসাডোস বলে। মানে হল সুখী বিবাহিত জীবন। মুহূর্তের জন্য বাবার মুখটা মনে পড়ে গেল। টার্কি আজ বাবাকে মাহাত্ম্য দিয়েছে…আমাদের মনে তাঁকে অমর করে দিয়েছে। বাবা আজ ভগবানের আসনে।
    খাওয়া শেষ। এবার ওঠার পালা। দু-বোতল বিয়ার গিলে সবার পা টলছে। আমরা যে যার ঘরে শুতে চলে গেলাম। আজ আর ঘুম আসবে না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করাই সার হবে। তবে এই নিদ্রাহীন রাতেরও আনন্দ আলাদা। সারা রাত জেগে থাকাও যে কত আনন্দের! কিন্তু রোজ যে আমায় দেখা করতে বলেছিল। ও গোঁড়া ক্যাথলিক। ও বলেছে শ্যাম্পেন সাজিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমাকে তো যেতেই হয়। মাকে আবার মিথ্যে বললাম… ‘বন্ধুর বাড়ি পার্টিতে যাচ্ছি’। মাকে কপালে চুমু দিতে দিতে চোখ টিপে একটু মুচকি হাসলাম। মায়ের আর বুঝতে বাকি রইল না যে ছেলে কোথায় যাচ্ছে। যাক, একটু নাহয় কষ্টই পাক। পিসি আর বোনকে চুমু দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ‘রোজ আমি তোমার কাছে আসছি!’

  • অনুবাদ

    অনুবাদ- সাদা হেরন

    সাদা হেরন
    -সারা ওর্ন জুয়েট
    অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন

     

     

    বেলা পড়ে আসছে। তবে গ্রীষ্মের শেষ বিকেলের এই মরা আলোয়এখনও বনের গাছ-গাছালি, লতা-পাতা রাঙা হয়ে রয়েছে। নয় নয় করে আটটা বাজতে চলল। ছোট্ট ঐ মেয়েটা বনের পথ ধরে চলেছে। সঙ্গে একটা গরু। গরুটাকে সে হ্যাট হুট করতে করতে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। গরুটা চলে দুলকি চালে, একবার একবার এখানে দাঁড়ায়, একবার ওখানে। গরুর সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে মেয়েটাও পিছিয়ে পড়ে। তবে সে রাগ করেনা মোটেও। গরুটা যে তার সঙ্গী। সূর্যাস্তের আলো গায়ে মেখে তারা গভীর জঙ্গলে ঢোকে। তাদের কোনও ভয়ডর নেই। এ পথ যে তাদের হাতের তালুর মতো চেনা। চোখ বন্ধ করেও তারা দিব্যি চলে যেতে পারে।
    গরমের এই দিনগুলোতে গরুটার দস্যিপনা বাড়ে। যে মাঠে মেয়েটা তাকে চরতে দিয়ে আসে সেখান থেকে পালিয়ে ঝোপ-ঝাড়ের আড়া্লে লুকিয়ে থাকে। মেয়েটা তাকে খুঁজতে গিয়ে গলদঘর্ম হয়। গলায় একটা ঘন্টি আছে বটে গরুটার। কিন্তু সে যদি দুষ্টুমি করে এক জায়গায় গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তবে কি ঘণ্টি বাজবে! না কেউ নাগাল পাবে! তাই তাকে খুঁজতে গিয়ে সিলভিয়া একেবারে নাস্তানাবুদ। বাচ্চা মেয়ে সে। কাঁহাতক কতক্ষণ আর ধৈর্য থাকে। নেহাত গরুটা মনিবদের রসে বশে রাখে…গামলা ভর্তি দুধ দেয়! নাহলে ওর কপালে দুঃখ ছিল। সিলভিয়ার হাতে অবশ্য প্রচুর সময়। কী করবে না করবে সে নিজেও বুঝে পায় না। তবে যেদিন আকাশ পরিষ্কার থাকে…আবহাওয়া ভালো থাকে সেদিন অবলা এই প্রাণীটার সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে ভালোই লাগে। ও ছাড়া তার খেলার সঙ্গীই বা আর কে আছে! খেলতে খেলতে গরুটা নিজেই হাঁপিয়ে পরে ধরা দিয়ে দেয়। তার আবার কত গালভরা নাম মিস্ট্রেস মলি। গরুর সাড়া পেয়ে মুচকি হাসে সিলভিয়া। বাছাধন পথে এসো এবার! বিলের ধার থেকে মলি-কে ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় সিলভিয়া। যেতে যেতে আদর করে গরুটার মুখে খানিকটা ঘাস-পাতা গুঁজে দেয়। মলি এবার আর আর দুষ্টুমি করে না। সুবোধ বালিকার মতো হেঁটে চলে। এবার সে বাড়ি যাবে। গামলা উপচে দুধ দেবে। সিলভিয়ার ভয় তো দিদিমা-কে। বাড়ি ফিরলেই তো সে বুড়ি খ্যাঁক করে এসে ধরবে… ‘এত দেরি যে! তা ছুঁড়ির কোথায় বেড়ানো হচ্ছিল?’ ঘর থেকে সে বেরিয়েছে সাড়ে পাঁচটায়। এই দস্যি গরুটাকে খুঁজে খুঁজে বাড়ি আনা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়! মিসেস টিলিরও এই অভিজ্ঞতা আছে। সিলভিয়া আসার আগে তাঁকেই তো গরু খুঁজতে যেতে হত। সে যে কী ঝামেলার! এই ছোট্ট মেয়েটাকে দোষ দিয়ে আর লাভ কী! সিলভিয়া আসার পর তাঁর ঝামেলাঅনেক কমেছে। তবে এমন পাড়াবেড়ানি মেয়েও তিনি জীবনে দেখেননি। সারাক্ষণ শুধু বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাড়াপড়শিরা বলে… ‘আহারে কচি মেয়ে! জন্ম ইস্তক নোংরা ঐ ঘিঞ্জি শহরে বন্দী হয়ে কাটিয়েছে! এই আট বছর বয়সে এই খোলামেলা জায়গায় এসে একটু হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে’। সে যে ছিন্নমূলের মতো এখানে এসে পড়েছে সিলভিয়ার তা মনেই হয়না…যেন জন্মজন্মান্তর ধরে তার এখানেই বাস। ঘিঞ্জি ঐ শহরটার কথা মনে পড়ে গেলে তার ঐ শুকনো জেরানিয়াম ফুলের ছবিটাই ভেসে ওঠে। কত অযত্নে…অনাদরে পাশের বাড়ির টবে নেতিয়ে পড়েছিল গাছটা।
    মিসেস টিলি মনে মনে বলেন… ‘মেয়েটা লোকজনকে খুব ভয় পায়’। তাই তো মেয়ের বাড়িতে একপাল ছেলেমেয়ের মধ্যে সিলভিয়াকেই এনে নিজের কাছে রেখেছেন। মেয়ের কাছ থেকে বাড়ি ফেরার সময় তিনি ভাবেন… ‘ওরা বলে মেয়েটা নাকি বাইরের লোককে খুব ভয় পায়। তা আমার ওখানেই ও ভালো থাকবে’। নাতনি নিয়ে দিদা যখন বাড়ি ফিরে তালাটা খোলেন তখন কোত্থেকে একটা বেড়াল এসে মিঁউ মিঁঊ ডাক জুড়ে দেয়। আদুরে মেয়ের মতো দিদার গায়ে মাথা ঘসে। সব ভয় কেটে যায় নাতনির। সে ভাবে… ‘এত সুন্দর জায়গা তো পৃথিবীতে আর একটাও নেই’। আর কক্ষনো ঐ ঘিঞ্জি নোংরা শহরটায় সে আর ফিরবে না।
    মলিকে নিয়ে ছায়াঘেরা বনপথে হেঁটে যায় বাচ্চা মেয়েটা। গরুটা বার বার পিছিয়ে পড়ে। তাড়াতাড়ি পা চালায় সিলভিয়া। জল খাবে বলে গরুটা আবার একটা জলার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। সিলভিয়াও দাঁড়িয়ে পড়ে। ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে দেয়। তা গা ঘেঁসে কত প্রজাপতি উড়ে যায়। গরুটাকে নিয়ে আবার সে হাঁটা সেয়। পাখিরা সব বাসার ফিরছে। তাদের কলকাকলি এক সুরেলা রেশ রেখে যায় তার মনে। গাছেদের ডালপালাগুলো হাওয়ায় দোলে। পশু-পাখিরা যে যার ঘরে ফিরছে…ফিরতে ফিরতে তারা একে-অপরকে যেন বলছে… ‘বন্ধুগণ শুভরাত্রি’। হাঁটতে হাটঁতে সিলভিয়ারো বড় ঘুম পায়। আর বেশি দূর নয়, কাছেই বাড়ি। বুনো ফুলের গন্ধে বাতাস আজ মাতাল হয়েছে। আজ বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে। এতক্ষণ সে কখনও বাইরে থাকেনি। এই ঘন জঙ্গল…এখানকার গাছ-গাছালি, পশু-পাখির সঙ্গে সে একাত্ম হয়ে গেছে। সে এই মাটিরই কন্যা। এক বছর হল সে দিদার বাড়ি চলে এসেছে। আচ্ছা ঐ ঘিঞ্জি শহরটায় সবকিছু কি আগের মতোই চলছে! ঐ লালমুখো ছেলেটাকি এখনও সবাইকে বিরক্ত করে বেড়াচ্ছে! ছেলেটাকে দেখলেই ভয়ে কুঁকড়ে যেত সে। কী পাজি ছেলে! সবসময় তাকে ভয় দেখাত! ছেলেটার কথা মনে পড়তেই সে প্রায় দৌড় লাগায়। এখানেও সে এসে পড়বে না তো!
    বনের নীরবতা চিরে হঠাৎ করে এক শিসের আওয়াজ! কে হতে পারে! ভয়ে সাদা হয়ে যায় মেয়েটা। এ তো কোনও পাখির ডাক নয়। এখানকার সব পাখি তার চেনা। তাদের ডাক অনেক পেলব…আদুরে। এ যেন কোনও বখাটে ছোঁড়ার শিস মনে হচ্ছে। গরুটার যা হয় হোক…সে এখন একটা ঝোপের আড়ালে লুকোতে পারলে বাঁচে। কিন্তু লুকোতে যে তার একটু দেরি হয়ে যায়! তার আগেই শত্রু এসে তাকে পাকড়াও করে। একগাল হেসে শত্রু বলে… ‘ও খুকি বড় রাস্তাটা আর কতদূর’। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সিলভিয়া জবাব দেয়… ‘অনেকটা দূর’। কিন্তু তার ঐ মিনমিন গলা আগন্তুকের কানে গেল কিনা কে জানে!
    আগন্তুকের চেহারা লম্বা-চওড়া। কাঁধে একটা বন্দুক। সেদিকে না তাকিয়ে ঝোপ থেকে বেরিয়ে গরুটাকে নিয়ে হেঁটে চলে সিলভিয়া। অবাক হয়ে দেখে সে লোকটিও চলেছে তার পাশে পাশে। লোকটাই প্রথম আলাপ জমায়… ‘বুঝলে খুকি আমি এখানে পাখি শিকারে এসেছিলাম। তারপর বনের মধ্যে ঢুকে পথ হারিয়ে ফেলেছি। আমার এখন একজন বন্ধু খুব দরকার। না না, আমাকে ভয় পেয়োনা…তোমার নাম কী? আমি কি তোমাদের বাড়িতে আজ রাতটা কাটাতে পারি। কাল সকালেই আবার শিকারে বেরিয়ে পড়ব’।
    ভয়ে বুক দুরুদুরু করে সিলভিয়ার। দিদা তো আর কিছু বুঝবে না…শুধু তাকেই দোষ দেবে। এমনটা যে ঘটবে সে কি আগে থেকে জানত নাকি? তার কোনও দোষ নেই। আগন্তুক আবার তার নাম জিগ্যেস করে। কাটা গাছের মতো মাথাটা হেলিয়ে সে কোনওরকমে বলে ‘সিলভি’।
    ওদিকে বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তিন মূর্তিকে দেখতে পান মিসেস টিলি। গরুটা তাঁকে দেখেই হাম্বা করে ডেকে ওঠে। দিদা একেবারে রেগে লাল… ‘এবার কী বাহানা আছে শুনি তোর? এবারও কি গরুটা তোকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে নাকি?’ সিলভিয়া চুপ। সে যে কত বিপদে পড়েছিল দিদাকে কিছুতেই বোঝানো যাবে না। লোকটাকে দেখে দিদা নিশ্চয়ই ভেবেছে এখানকার চাষি-বাসির ছেলে হয়তো জুটেছে তার সঙ্গে!
    লোকটা এবার তার বন্দুকটাকে দরজার পাশে রেখে কাঁধ থেকে মস্ত বোঝটা নামায়। তারপর মিসেস টিলির কাছে গিয়ে তার পথ হারিয়ে ফেলার কাহিনি শোনায়… ‘আজ রাতের জন্য কি এখানে আশ্রয় নিতে পারি? না না আমার জন্য চিন্তা করবেন না। যেখানে থাকতে দেবেন সেখানেই থাকব। কাল ভোরেই বেরিয়ে পড়ব। এখন খুব খিদে পেয়েছে। যদি এক গেলাস দুধ দিতে পারেন…
    ‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই’… নতুন লোককে পেয়ে অতিথি বৎসল মনটা আবার জেগে উঠেছে মিসেস টিলির… ‘তা বাবা বড় রাস্তায় গিয়ে পড়লে তুমি হয়তো অনেক ভালো জিনিস পেতে। তা মাইল খানেক হবে। তবে তুমি এখানেও স্বচ্ছন্দে থাকতে পারো। আমরা যা খাই তাই কষ্ট করে তাই নাহয় খেয়ো। তুমি আরাম করে বসো। আমি এক্ষুনি দুধ দোয়াব। তুমি খড়ের বিছানাতে শুতে পারো আবার পালকের বিছানাতেও পারো। তোমার যা ইচ্ছে’। অতিথিকে এত আদর যত্ন করে পেরে তিনি খুব খুশি… ‘হাঁসগুলোকে নিজের হাতেই পেলেছি। ঐ যে জলায় হাঁসগুলো চরে বেড়ায়। সিলভি এবার অতিথির জন্য খাবার বাড়ো’। সিলভিয়া এক পায়ে খাড়া। দিদার কাজে লাগতে পেরে খুব খুশি। তাছাড়া তারও যে খুব খিদে পেয়েছে!
    নিউ-ইংল্যান্ডের এই গভীর জঙ্গলে এমন একটা ঝকঝকে তকতকে বাড়ি পাওয়া যাবে আগন্তুক তা স্বপ্নেও ভাবেনি। এখানকার বাড়িগুলো যে কতটা নোংরা…অগোছালো সে ভালো করেই থাকে। এখানে হাঁস-মুরগির সঙ্গে গাদাগাদি করে মানুষ থাকে। কিন্তু এই বাড়িটা একদম অন্য রকম। একটু ছোট এই যা। সে মন দিয়ে বুড়ির বকবক শোনে…সিলভিয়ার ডাগর বাদামি চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আগ্রহের আতিশয্যে সে বলেই বসে এমন ভালো খাবার নাকি তার গত একমাসে জোটেনি। খাওয়া-দাওয়ার পর তারা দাওয়ায় এসে বসে। রুপোর থালার মতো চাঁদ ওঠে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে রুপোলি আলো। মিসেস টিলি তাঁর ঘরকন্নার গল্প শুরু করেন। এই তো বেরি তোলার সময় হয়ে এল। সিলভি আছে বলেই রক্ষে। গরুটা ভালোই দুধ দেয় বটে কিন্তু বড্ড জ্বালায়। বুড়ির গল্প আর ফুরোয় না… ‘বুঝলে বাবা নিজের হাতে চার ছেলেমেয়েকে গোর দিয়েছি। এখন পড়ে রয়েছে শুধু দুজন। সিলভির মা আর এক ছেলে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে তার খবরও অনেক দিন পাইনি। বেঁচে আছে কিনা কেজানে! আমার ছেলে ড্যান…সে খুব ভালো বন্দুক চালাতে পারত। কী টিপ ছিল হাতে! যত রাজ্যের টিয়া পাখি, কাঠবেড়ালি শিকার করে আনত। খুব রাগ করতাম আমি। তাও শুনতো না। কত দূরে যে চলে গেল! আমার মনে হয় চিঠিপত্র লেখার ইচ্ছেও ওর হয় না। আমি অবশ্য ওকে দোষ দিই না। দুনিয়াটাকে অনেক দেখলাম তো!’
    একটু থেমে আবার শুরু করে বুড়ি… ‘বুঝলে বাবা, সিলভিয়াকে দেখতে একদম মামার মতো। পাগলি মেয়ে একটা! সারাক্ষণ বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বনের পশু-পাখিরা সব ওর বন্ধু। বন থেকে কাঠবেড়ালি ধরে আনে…নিজের হাতে খাওয়ায়। আর পাখিদের যে কী ভালোবাসে! গত শীতে কয়েকটা নীলকণ্ঠ পাখি এসেছিল এখানে…আমি যদি নজর না রাখতাম তাহলে সিলভি যে কী করত! নিজে না খেয়ে বোধহয় সব খাবার পাখিদের খাইয়ে দিত! আমি কাক ছাড়া আর সবাইকে সহ্য করতে পারি। ড্যান তাও একটা কাক এনে পুষেছিল। ও চলে যাওয়ার পরেও কাকটা এখানে অনেকদিন রয়ে গিয়েছিল। ড্যানের সঙ্গে তার বাপের একদম বনত না। তাও ছেলে চলে যাওয়ার পর সে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল’।
    পরিবারের এই দুঃখের কিস্‌সা আর শুনতে ভালো লাগছিল না অতিথির। তার মন এখন অন্যদিকে। বুড়ির একটা কথাই তার মনে একেবারে গেঁথে গেছে… ‘তাহলে সিলভি নিশ্চয়ই এখানকার সব পাখি চেনে’! চাঁদের নরম আলোয় ছোট্ট মেয়েটা ঘুমে ঢুলছে।
    ‘আসলে পাখিদের একটা মিউজিয়াম করছি আমি। ছোটবেলা থেকেই পাখি শিকারের খুব সখ… দু-একটা খুব বিরল গোছের পাখি আমি এখনও ধরতে পারিনি। পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এই পাখিগুলোকে পাওয়ার জন্য আমি সব কিছু করতে পারি’।
    নিজেকে আর সামলাতে পারেন না মিসেস টিলি… ‘ তা বাবা তুমি কি পাখিগুলোকে খাঁচায় ভরে রাখো?’
    না না ওগুলোকে মেয়ে তার ভেতর খড় ঢুকিয়ে সাজিয়ে রাখি। ঐ মিউজিয়ামের মতো। শত শত পাখি আছে আমার সংগ্রহে। সবকটা আমিই শিকার করেছি। গত শনিবার এখান থেকে প্রায় মাইল তিনেক দূর থেকে একটা সাদা হেরন দেখেছি। সেটা খুঁজতে খুঁজতেই এখানে এসে পড়েছি। এমনিতে এসব জায়গায় তো সাদা হেরনের দেখা মেলে না…কী সুন্দর ছোট্ট সাদা হেরন…এই বলে সে চায় সিলভিয়ার দিকে। এ মেয়ে তো এ তল্লাটের নাড়ি-নক্ষত্র জানে…ও কি পারবে দিতে ঐ পাখির খোঁজ!
    কোনও কথাই কানে ঢুকছে না সিলিভিয়ার। পাশের সরু গলিতে একটা ব্যাঙ লাফাতে লাফাতে চলেছে। সিলভিয়ার চোখ এখন সেদিকে।
    ‘ কি খুকি! দেখলে নিশ্চয়ই তুমি হেরনকে চিনতে পারবে তাই না? ঐ যে লম্বা মতো সাদা পাখি…তুলোর মতো নরম পালক…ঢ্যাঙ্গা দুটো পা…কোনো উঁচু গাছের মগডালে ওরা বাসা বাঁধে… খড়কুটো দিয়ে তৈরি বাসা…একদম বাজ পাখির মতো…
    বুকের ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে সিলভিয়ার। লম্বামতো সাদা পাখিটাকে সেদিন তো সে দেখেছে। জঙ্গলের ঠিক অন্য প্রান্তে একটা জলার পাশে সবুজ ঘাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল পাখিটা। ভারি অদ্ভুত জায়গাটা। সেখানে হলদে রোদ এসে তার উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে যায়। ইতি উতি ঘন নলখাগড়ার বন। দিদা তাকে বার বার সাবধান করে করে দিয়েছ… ‘ওরে ওদিকে যাসনি। চোরাবালি আছে। একদম তলিয়ে যাবি…কেউ আর খুঁজে পাবে না’। জলাভূমি ছাড়িয়ে ঐ অনেক দূরে সমুদ্র। সমুদ্র সে নিজের চোখে দেখেনি…তাও সে সমুদ্রের স্বপ্ন দেখে। ঝড়-ঝঞ্ঝার রাতে বাতাসে সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসে…শিউরে ওঠে সে।
    আগন্তুক এখনও তার পাখির গল্পেই মশগুল… ‘ঐ পাখির বাসাটা খুঁজে পাওয়ার জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি। যে এর সন্ধান দিতে পারবে তাকেই আমি দশ ডলার দেব…দরকার হলে সারা ছুটিটাই জঙ্গল চষে বেড়াব। পাখিটা হয়তো এমনিই এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে…আবার এমনটাও হতে পারে কোনও শিকারি পাখির ভয়ে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
    সব শুনে একেবারে অবাক হয়ে যান মিসেস টিলি। কিন্তু সিলভিয়া এখনও একদৃষ্টিতে ব্যাঙটাকেই দেখে চলেছে। অন্য সময় হলে একমনে সে কতকিছু ভাবত! আজ তার মনেও একটা উত্তেজনা। ব্যাঙটা দরজার পাশে গর্তটায় ঢোকার চেষ্টা করছে…কিন্তু এই এত রাতে ঘরের দাওয়ায় লোকজনকে দেখে সে মনে হয় একটু ঘাবড়ে গেছে। সেদিন রাতে ছোট্ট মেয়েটার চোখে ঘুম আসে না। দশ ডলার! এ দিয়ে যে রাজার সম্পত্তিও কিনে নেওয়া যায়।
    পরের দিন সকালে উঠেই জঙ্গলে বেরিয়ে পড়ে আগন্তুক। সঙ্গী সিলভিয়া। নতুন লোকটাকে এখন আর ভয় লাগছে না তার। লোকটা খুব ভালো। কেমন সুন্দর সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারে। পাখিদের নিয়ে কত মজার মজার গল্প বলে লোকটা…কোন পাখি কোথায় থাকে…কী খায়…কোথায় ডিম পাড়ে…
    লোকটা তাকে একটা নানচাকু দেয়। সে তো আনন্দে একেবারে ডগমগ। লোকটা একবারও তাকে বিরক্ত করেনি…তাকে ভয় দেখায়নি। কিন্তু লোকটা যখন অকারণে এক এক করে পাখি মারছিল তখন সিলভিয়ার খুব কান্না পাচ্ছিল। লোকটার কাঁধে যদি ঐ বন্দুকটা না থাকত তবে কত ভালো হত! লোকটা যদি পাখিদের এতই ভালোবাসে তবে সে তাদের মারে কেন! নিজের সরল বুদ্ধিতে বুঝতে পারে না সিলভিয়া। বেলা গড়ায়। সিলভিয়া অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আগন্তুকের দিকে। এত সুন্দর…এত দিলদরিয়া মানুষ সে আগে কখনও দেখেনি। হতে পারে সে ছোট…কিন্তু তার মধ্যেও তো এক নারীমন লুকিয়ে রয়েছে যে শুধু ভালোবাসা চায়। পা টিপে টিপে তারা জঙ্গলে হাঁটে। জঙ্গলের রহস্য…জঙ্গলের বিশালত্ব তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। মাঝে মাঝে তারা থমকে দাঁড়ায়। জিরোতে জিরোতে পাখির গান শোনে। তারপর ঝোপ ঝাড় ঠেলে আবার হাঁটে। কেউ কথা বলেনা। মাঝে মধ্যে ফিসফিসিয়ে শুধু ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’। অতিথি চলে আগে আগে…তার পেছনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁতে সিলভিয়া। উত্তেজনায় বাদামি চোখদুটো তার চকচক করে ওঠে।
    এখনও পর্যন্ত সাদা হেরনের কোনও চিহ্ন পর্যন্ত নেই। অতিথির কথা ভেবে একটু খারাপ লাগে সিলভিয়ার। তবুও সে পথ দেখাতে এগিয়ে যায়না…পিছে পিছেই চলে। আর কথা বলার তো প্রশ্নই নেই। এই নিঝুম পুরীতে যেন সে নিজের গলা শুনলেও চমকে যাবে! কথার যখন কোনও প্রয়োজন নেই তখন শুধু শুধু বলে লাভ কী! গুটি গুটি পায়ে সন্ধে নামে চরাচর জুড়ে। তারা একসঙ্গে গরুটাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। হাঁটতে হাঁটতে তারা ঠিক সেই জায়গায় চলে আসে যেখানে ঠিক আগের দিন আগন্তুকের শিস শুনে ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল সিলভিয়া।
    ২।
    জঙ্গলের ঐ শেষ প্রান্তে যেখানে জমিটা যেখানে খাড়াই হয়ে উঠে গেছে সেখানেই রয়েছে ঐ পাইন গাছটা। বাড়ি থেকে প্রায় আধ মাইলের পথ তো হবেই। বুড়ো, প্রাচীন এই পাইন গাছটা দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজার মতো। তার বয়সি আর একটাও গাছ নেই এ তল্লাটে। কাঠুরেরা কেন যে গাছটাকে ছেড়ে দিয়েছিল তা কেউ জানে না… হতে পারে বনের সীমানার একটা গণ্ডি কেটে দেওয়ার জন্য। কাঠুরের দল এ মুলুক ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বন আবার ভরে উঠল বনস্পতিতে। নতুন নতুন পাইন, ওকে, মেপল গাছ গজালো। কিন্তু কেউ আর ঐ পাইন গাছের মাথা ছুঁতে পারল না। বন আর ঐ দূরের সমুদ্রের মধ্যে যেন প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গাছটা। সিলভিয়া সব জানে। সে ভাবে, এই গাছটার মাথায় উঠতে পারলেই বুঝি সমুদ্র দেখা যাবে। কতদিন সে গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গাছটার গুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে সমুদ্রের স্বপ্ন দেখেছে। আজ তার আবার গাছটার কথা মনে পড়ল। যে গাছের মাথা থেকে সমুদ্র দেখা যায় সেখান থেকে কি হেরনের দেখা মিলবে না ! দিনের আলো ফোটার আগেই সে যদি গাছটায় উঠে পড়তে পারে তাহলে পাখির বাসাটারও খোঁজ পেয়ে যেতে পারে। রোমাঞ্চে তার গা শির শির করে ওঠে। একবার হেরনের বাসাটা দেখে সে যখন বাড়িতে এসে খবর দেবে তখন অতিথি যে তাকে কীভাবে ধন্য ধন্য করবে সেকথা ভেবেই এখন থেকেই মনে আনন্দের বান ডাকে। এই ছোট্ট মেয়েটা অত আনন্দের ভার কি বইতে পারবে!
    রাতভর ঘুম এলনা চোখে। ঘরের দরজাটা খোলা। কোথা থেকে একদল রাতচরা পাখি কিঁচিরমিঁচির জুড়ে দিল। সিলভিয়া প্রহর গোনে। নতুন অতিথি…দিদা…সব তো ঘুমেই কাদা। আনন্দে…উত্তেজনায় তার দু-চোখের পাতা এক হয় না। কখন যে ভোর হবে। গ্রীষ্মের এই রাতটা যেন শীতের লম্বা রাতের মতো হয়ে গেছে…ফুরোতেই চায় না। একসময় রাতচরা পাখিদের ডাক থামে। এই ভোর হল বলে! আবার ভোর হতেই মনে হয় রাতটা কি বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল? পা টিপে টিপে ঘরের বাইরে বেরোয় সিলভিয়া। দিদা জানতে পারলে সব মাটি। ঘর থেকে বেরিয়েই সে লাগায় একছুট। তাকে এখন বনের ঐ প্রান্তে ফাঁকা জায়গাটায় যেতে হবে। ঘাস…লতা-পাতা মাড়িয়ে সে ছোটে। পাখিদেরও ঘুম ভাঙছে। পাখিদের অস্ফুট কলতানকে সঙ্গী করে সে ছুটেই যায়। বাইরের দুনিয়ার মানুষের ছোঁয়া লেগে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা…মাটির গন্ধ মাখা মেয়েটা কি বদলে যাবে তবে!
    আকাশের তখনও জেগে রয়েছে চাঁদ। চাঁদের মরা আলোয় বিশাল গাছটা দাঁড়িয়ে রয়েছে অশরীরীর মতো। এই গাছের চূড়ায় উঠতে হবে তাকে। শিহরণ খেলে যায় তার শরীরে। শিরার ভেতরের রক্তকণারা দামাল হয়ে ওঠে। গাছের এই শক্ত গুঁড়ি বেয়ে উঠে আকাশটা ছুঁতে হবে। কিন্তু এত উঁচু গাছে সে উঠবে কীভাবে! যদি আগে পাশের ওক গাছটায় ওঠা যায় তাহলে কেমন হবে! ঐ ওক আর পাইন গাছটার ডালপালা উপরে গিয়ে সব একসঙ্গে মিশেছে। সে প্রথমে ওক গাছে উঠবে… তারপর ডাল বেয়ে পাইন গাছটায় উঠে পড়বে। বুদ্ধিটা ভালোই। ওক গাছে সে আগেও চড়েছে। ওক গাছের ঘন ডালপালার মাঝে সে অদৃশ্য হয়ে যায়…পাতা থেকে টুপটাপ শিশির ঝরে পড়ে…তার আওয়াজ পেয়ে পাখিগুলো ডানা ঝাপটে উড়ে যায়। একটা লালমুখো কাঠবেড়ালি বেরিয়ে আসে…এত ভোরে ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য সে যেন নালিশ জানাতে চায়। এইবার পাইনের ডালগুলোর নাগাল সে পেয়েছে। এবার এই ডাল ধরে এক লাফে ঐ পাইন গাছে যেতে হবে।
    শেষ পর্যন্ত বিপজ্জনক কাজটা সে করেই ফেলে। কাজটা সে যতটা কঠিন মনে করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। একটু অন্যমনস্ক হলে শরীরের আর একটা হাড়ও আস্ত থাকত না। এবার পাইনের ডাল বেয়ে সে ওঠে। তাকে একেবারে মগডালে যেতে হবে। কাঁটায় সারা গা ছড়ে যায়…হাতদুটো জ্বালা করে। ভোরের আলো ফুটছে। বনের চড়াই…রবিন…সব কলতান জোড়ে। আরো যে কতটা উঠতে হবে! গাছ বেয়ে সিলভিয়া যত ওপরে ওঠে গাছটা তত লম্বা হয়ে যায়। সে জানে তাকে যত তাড়াতাড়ি কাজ হাসিল করে ফিরে যেতে হবে। তানাহলে সব পরিশ্রম বৃথা।
    গাছটা যে এত লম্বা আগে সে বুঝতেই পারেনি। নিজের রাজকীয় চেহারা নিয়ে গাছটা যেন ছোট্ট মেয়েটার মনের জোর পরীক্ষা করতে চাইছে। কিন্তু শেষে এসে কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল সিলভিয়ার। গাছের ডালপালাগুলো যেন তাকেই সাহায্য করার জন্য হাতে এসে যেন ধরা দেয়। বুড়ো গাছটাও বোধহয় ছোট্ট মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছে। বনের যত বাজপাখি, বাদুড়, মথ আর এমনকি মিষ্টি গলার কোকিলগুলোর চেয়েও অনেক বেশি সাহস ধরে বাদামি ডাগর চোখের এই ছোট্ট মেয়েটা। গাছটা দাঁড়িয়ে থাকে নিথর নিশ্চল। এমনকি মেয়েটার কথা ভেবে সে যেন এই গ্রীষ্মের সকালের পূবালি দামাল বাতাসকেও ঠেকিয়ে রাখে।
    সিলভিয়ার চোখমুখ যেন নিভে যাওয়া তারার মত…ফ্যাকাশে হলেও…একটা একটা দীপ্তি রয়েছে আলাদা। কাঁটায় ভরা ডাল-পালার শেষ বাধা টপকে সে এখন গাছের মগডালে। এত পরিশ্রমে একটু ক্লান্ত হলেও তার উৎসাহ বিন্দুমাত্র কমেনি। ঐ দূরের সমুদ্রটা ভোরের রাঙা আলোয় মাখামাখি। দুটো বাজপাখি ভোরের নরম আলো গায়ে মেখে উড়ে যায় পুবপানে।তাদের পালকগুলো কী নরম! একেবারে প্রজাপতির ডানার মতো। এতদিন সে এদের দেখছে নীচ থেকে…আজ যেন সে হাত বাড়ালেই তাদের ধরতে পারে। এদের সঙ্গে সেও মেঘেদের রাজ্যে উড়ে বেড়াতে পারে। কেমন যেন একটা ঘোর লেগে যায় তার মনে। পশ্চিম দিকে চাইলে মাইলের পর মাইল জুড়ে শুধু বন আর বাদা জমি। গ্রামগুলোকে সব সাদা দেখায়…মাঝে মাঝে দু-একটা গির্জার চূড়া চোখে পড়ে।
    পাখিরা এবার গলা ছেড়ে গান ধরে। সকাল আসে। নরম রোদ ছড়িয়ে পড়ে বনে-বনান্তরে। ঐ যে সমুদ্রের বুকে দেখা যায় পালতোলা নৌকা। আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘে কত রং ধরেছে…বেগুনি, গোলাপি…হলুদ। সবুজের এই সমুদ্রে সাদা হেরনের বাসাটা তাহলে কোথায়? সে কি খুঁজে পাবে? নাকি বনের এই অপূর্ব শোভা দেখেই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে! সিলভিয়া হাল ছেড়োনা। একবার নীচে তাকাও তো দেখি…ঐ যেখানে আলো ঝলমল বার্চ আর ছায়াঘেরা হেমলক গাছগুলো মিশেছে…ঐ যে ঐ যেখানে সে সবুজ জলাটা রয়েছে…সেদিকে একবার ভালো করে তাকাও…ওখানেই তো তুমি সেদিন ঐ লম্বা-সাদা পাখিটাকে দেখেছিলে। ওখানে তুমি আবার ওকে দেখতে পাবে। ঐ দেখো… মরা কালো হেমলক গাছগুলোর পাশে একটা সাদা বিন্দু…বিন্দুটা বড় হতে হতে একটা পাখি হয়ে এই দেখো পাইন গাছটার কাছেই কেমন চলে এসেছে। ঐ সেই পাখি। লম্বা…সরু গলা। নরম সাদা পালক। ও খুকি এখন একটুও নড়োনা…তোমার বাদামি চোখের আলোর তিরটা ওর গায়ে বিঁধিয়ে দিয়োনা। ঐ দেখো…ও তোমার ঐ পাইন গাছের ডালে গিয়েই বসেছে। তোমার একেবারে হাতের নাগালে। ওখানেই ওর বাসা। সকালের আলো গায়ে মেখে ওখান থেকেই ও নতুন এই দিনটা শুরু করবে।
    সিলভিয়ার চোখে ঘোর। মন অবশ। একটু পরেই…কতগুলো দাঁড়কাকের কর্কশ ডাকে স্বপ্নের ঘোর কেটে যায়। ঝগড়াটে পাখিগুলোর ক্যাঁচক্যাঁচানিতে বিরক্ত হয়ে আবার উড়ে যায় সেই আলোর পাখি…সোনালি ডানার হেরন। পাখিটা আবার ফিরে যায় নিচের সবুজ দুনিয়ায়…সেই জলাজমিটার পাশে। সিলভিয়া জেনে ফেলেছে এ পাখির সব রহস্য। এবার তাকে ফিরতে হবে। যেমন ভাবে সে উঠেছিল তেমনি বিপজ্জনক ভাবেই সে এবার নীচে নামতে থাকে। হাত-পা কেটে রক্ত পড়ে। জামা ছিঁড়ে যায়…পা-টা হড়কে যায়। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে সিলভিয়ার। আবার মনে একটা চোরা আনন্দও উঁকি দিয়ে যায়। সে যখন বাড়ি গিয়ে পুরো ঘটনাটা বলবে তখন অতিথির চোখ-মুখ কি আলোয় ভেসে যাবে!
    বাড়িতে দিদার ঘুম ভেঙ্গেছে। উঠে ইস্তকই চেঁচিয়ে যাচ্ছেন… ‘সিলভি, সিলভি’। কোনও সাড়া নেই। ঘরে খড়ের বিছানাটাও তো খালি। এত সকালে মেয়েটা গেল কোথায়? অতিথিরও ঘুম ভেঙে যায়। আজ নিশ্চয়ই তার সব মনস্কামনা পূর্ণ হবে! চটপট করে সে তৈরি হয়ে নেয়। পুঁচকি মেয়েটার চোখ মুখ দেখেই কাল সে যা বোঝার বুঝে গেছে। মেয়েটার কাছে নিশ্চয়ই ঐ পাখির খোঁজ রয়েছে। এবার একটু বাবা-বাছা করে পেট থেকে কথাটা বের করে নিতে হবে। ঐ তো ফিরে এসেছে মেয়েটা। মুখখানা একেবারে ফ্যাকাশে। জামা কাপড় ছেঁড়া…গায়ে পাইন আঠার গন্ধ। হাঁ হাঁ করে ছুটে আসে দিদা। দিদা আর অতিথি মিলে একে একে প্রশ্নবান ছুঁড়ে যায়। হ্যাঁ এটাই সময়, এখনই তাকে সবটা খুলে বলতে হবে।
    সে বলতে চায়, কিন্তু গলা দিয়ে কোনও স্বর বেরোয় না। গলার মধ্যে কী যেন একটা দলা আটকে আসে। দিদা বকাবকি করে। অতিথি সোজা তাকিয়ে আছে তার চোখের দিকে। তার ঐ দৃষ্টিতে অনুনয়। হ্যাঁ এই লোকটা তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এই লোকটা তাদের রাতারাতি বড়লোক করে দিতে পারে। একে তো সবটা খুলে বলতেই হবে।
    তারআর কথা ফোটেনা… যেন জন্ম-জমান্তর এমন বোবা হয়েই ছিল সে। এই কুয়োর ব্যাং হয়েই জীবনের ন’টা বছর কাটিয়ে দিয়েছে সে। আজ যখন তার কাছে মহাসাগরের ডাক এল তখন একটা পাখির জন্য সে কি তা ফিরিয়ে দেবে? তার কানে ভেসে আসছে পাইন পাতার শনশন। তারপর চোখের সামনে সেই আলোমাখা…সোনালি ডানার পাখি। এই অলৌকিক সকালটা সেই ঐ পাখির সঙ্গে কাটিয়েছে…একসঙ্গে তারা সমুদ্র দেখেছে। কী করে এমন এক সঙ্গীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়! না, সে কিছুতেই মুখ খুলবে না।
    নিরাশ হয়ে ফিরে যায় শিকারি। সিলভিয়ার বুকে যেন একটা তীর এসে বেঁধে। কুকুর যেমন তার মনিবকে ভালোবাসে তেমনিভাবে সেও তো লোকটাকে ভালবাসতে পারত! গরু নিয়ে ঘরে ফেরার সময় কতদিন সিলভিয়া ঐ শিস শুনে চঞ্চল হয়েছে। পর মুহূর্তেই ভুল ভেঙ্গেছে। লোকটার গুলিতে ছোট ছোট পাখিগুলোকে রক্তাক্ত হয়ে তার মন একদিন কেঁদে উঠেছিল। সে কষ্টও আজ ফিকে হয়ে এসেছে। লোকটা তো তার ভালো বন্ধু হতে পারত। কিন্তু এই পাখিরা কি তার চেয়েও ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে পারবে! মেয়েটা অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছে…হে বনদেবী তুমি তোমার অপার সৌন্দর্যের মায়া-কাজল সাথীহারা এই সরল মেয়েটার চোখে পরিয়ে দিয়ো।

  • অনুবাদ

    অনুবাদ- এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজার বড়দিন

    এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজার বড়দিন
    -জুয়ান বস্‌চ

    অনুবাদ- বর্ণালী জানা সেন

     

    ঐ দূরে একটা গাছের আবছা অবয়ব দেখা যায়যেন! ঐ তো ঐ বিশ হাত দূরে। রাত তবে ভোর হয়ে আসছে।অনুমানে কোন ভুল ছিল না, কিন্তু এই এই অনুমানের ওপর নিজের ভাগ্যটাকে ছেড়ে দিয়ে বড় ভুল করে ফেলেছিল এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজা। দিনের আলো ফুটছে। এবার তো একটা গা ঢাকা দেওয়ার জায়গা না হলেই নয়। ফেরার অপরাধী সে। কিন্তু কোথায় লুকোবে? রাস্তার ডানদিকে ওই পাহাড়গুলোর কোনও একটার গুহায় নাকি বাঁ দিকে আখের খেতে? আখের খেতই ভালো। ওখানে লোকের নজর পড়বে কম! আর এই সিদ্ধান্তটাই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াল মেন্ডোজার। আজ ২৪ ডিসেম্বর। কাল বড়দিন। আকাশে-বাতাসে খুশির সুর। সকালের মিঠে রোদের আদর গায়ে মেখে আখের খেতে আয়েস করে শুয়ে পড়ে সে।
    সকাল সাতটা। মেন্ডোজার প্ল্যান মাফিকই সব এগোচ্ছে। এদিকের রাস্তায় এখনও কেউ আসেনি। ঠান্ডা বাতাসে একটা জোলো ভাব। বোধহয় বৃষ্টি হবে আজ। তবে এ আর নতুন কী! প্রতিবার বড়দিনের আগেই তো এখানে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টিও না হলেও বা কী! মানুষের ফুর্তিতে আজ আর কোনও লাগাম পড়বে না। যত রাজ্যের লোক কোম্পানির দোকানে গিয়ে জুটবে। পাঁইট পাঁইট মদ গিয়ে সকাল থেকে হল্লা মাচাবে। আজকে যে সবাইকে আনন্দ করতে করতে হবে। এটাই যে দস্তুর। কিন্তু সে যদি পাহাড়ের দিকে যেত তাহলে একটা না বিপদ হতই। কথায় বলে না সাবধানের মার নেই। পাহাড়ের দিকটাকে সে হাতের তালুর মতো চেনে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে কুঁড়ে বানিয়ে অনেক মানুষ থাকে সেখানে। তারা ওখানে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করে, ভুট্টা-শাক-সব্জি বোনে। এরা তাদের জিনিসপত্র নিয়ে চিনিকলের দোকানে বেচতে যায়। আর সে যদি এদেরই কোন একজনের নজরে পড়ে যায়! আর রক্ষে নেই তাহলে। কথা পাঁচ কান হতে সময় লাগবে না। বাতাসের মতো হু হু করে খবর ছড়িয়ে পড়বে। এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজার ওপর হুলিয়া রয়েছে। এখানে কেউ তাকে লুকিয়ে রাখার সাহস করবে না। যে রাখবে সেও প্রাণে মরবে। এখানে সবাইকে পাখি পড়া করে একটা কথা শেখানো হয়েছে…মেন্ডোজার কোনও খবর পেলেই কোতোয়ালিতে জানাতে হবে।
    সকালের নরম রোদে…ঠান্ডা বাতাসে মেন্ডোজার মনটাও একটু শান্ত হয়। দিনের বেলায় এখানেই সে সবচেয়ে নিরাপদ! এখানে কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। ভাগ্যদেবী একটু মুচকি হাসেন।
    ঠিক এইসময় মান্দিতোর মা-ও ঠিক একই কথা ভাবছিল। দোকানে ঐ মোদো-মাতালগুলো ভিড় জমানোর আগেই যদি পা চালিয়ে মান্দিতো সক্কাল সক্কাল সেখানে পৌঁছে যেতে পারে! লোকের বাড়ি কাপড় কেচে…মুরগি চরিয়ে কয়েক পয়সা জমিয়েছে মান্দিতোর মা। মুরগি চরাতে ঐ পশ্চিমে কতদূর যেতে হয় তাকে! প্রায় আধ বেলার হাঁটা পথ। বড়দিনের জন্য কত কষ্ট করে পয়সা কটা সে জমিয়েছে! আজ সে মান্দিতো-কে দিয়ে দোকান থেকে একটু ময়দা, কড মাছের একটা টুকরো আর একটু চর্বি আনাবে সে। সে গরিব হতে পারে কিন্তু আজ এই আনন্দের দিনে বাচ্চাগুলোকে কি সে উপোসী রাখতে পারে? আর কিছু না হোক একটু কড মাছ খেয়েই নাহয় তারা বড়দিন পালন করবে।
    তাদের ছোট্ট গ্রামটা পাহাড়ের দিকে। গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। রাস্তার একদিকে আখের খেত…আর অন্যদিকে ধূসর বন্ধ্যা জমি। গ্রামে সবমিলে প্রায় চোদ্দ, পনেরোটা মতো বাড়ি। বাড়ির ছাদগুলো তালপাতা দিয়ে ছাওয়া। মেন্দিতো পয়সা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় একটু দাঁড়ায়। চিনি তৈরির মরশুমে এ রাস্তায় গাড়ির ভিড় লেগেই থাকে। গাড়ি ভর্তি আখ যায় চিনিকলের দিকে। আকাশটা আজ ঝক ঝক করছে। সবুজ আখের খেতে নরম রোদ ঠিকরে পড়ছে। সকালের মৃদুমন্দ বাতাসে মনে যেন ঘোর লেগে যায়। কিন্তু দোকানটা সেই কতদূর! সে কি এতটা রাস্তা একা একা যাবে নাকি? এতটা পথ সে একা একা যায় কী করে? কিন্তু সঙ্গীই বা সে পায় কোথা থেকে? যেমন ভাবা অমনি কাজ। একছুটে সে চলে যায় এক পড়শির বাড়ি। ছয় সপ্তাহ আগে ওদের একটা কালো কুকুর ছটা বাচ্চা দিয়েছে। তার মধ্যে পাঁচটাকে বাড়ির মালিক একে ওকে দিয়ে দিয়েছে। এখন রয়েছে মাত্র একটা। জীবনে স্নেহ-ভালোবাসা বিশেষ পায়নি মান্দিতো। কিন্তু নিজের যত আবেগ…যত ভালোবাসা সব এই কুকুরছানাটার ওপরই সে উজাড় করে দিয়েছে। ন বছর মাত্র বয়স। কিন্তু জীবন তাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে। তার ছোট মাথার বুদ্ধিতে সে জানে কুকুরছানাটা কিছুতেই অতদূর হাঁটতে পারবে না। কোলে নিয়েই যেতে হবে। কিন্তু ছানাটাকে সে নেবেই। আগুপিছু না ভেবেই সে ছুটে যায় ওফেলিয়াদের বাড়ি… ‘মিস ওফেলিয়া আমি আজাবাখ-কে একটু নিয়ে যাচ্ছি’। এই বলেই সে কুকুর নিয়ে ছুট। কুকুরের মালিক কী বলল না বলল তা আর শোনার ধৈর্য নেই। সে অনুমতি চেয়েছে। ব্যস। কুকুরটাকে কোলে নিয়ে ছুটতে ছুটতে একসময় চোখের আড়ালে চলে যায়। আর তখন থেকেই শুরু হয় এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজার ভাগ্যের খেলা।
    সকাল নটা। মান্দিতো যে রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছে সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে মেন্ডোজা। এমন সময় মান্দিতোর কোল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আখের খেতের দিকে ছুটে যায় কুকুরছানাটা। ছোট্ট তুলতুলে একটা শরীর। এতটা দূর আসতে নিশ্চয়ই হাঁপিয়ে পড়েছে। তাই আখের খেতে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে চায়। আর নাহলে এদিক-ওদিক ছুটে ছুটে একটু খেলতে চায়। একটা বাচ্চার গলা কানে আসে মেন্ডোজার। বাচ্চাটা একতা কুকুরের নাম ধরে ডাকছে… ‘আজাবাখ…কোথায় যাচ্ছিস? দাঁড়া…দাঁড়া বলছি’। শিরদাঁড়া দিয়ে হিমশীতল শ্রোত বয়ে যায় মেন্ডোজার। এই বাচ্চাটা পুলিশের কোন চর-টর নয়তো? আকাশটা পরিষ্কার। আখের ঘন জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে যতটা দেখা সম্ভব তা দেখার চেষ্টা করে। নাহ, বাচ্চাটাকে তো দেখা যাচ্ছে না। মেন্ডোসা বোকা-হাবা নয়। মাথায় সে যথেষ্ট বুদ্ধি ধরে। বাচ্চাটা যদি দেখে ফেলে যে সে এখানে লুকিয়ে রয়েছে তাহলে বিপদ। তার চেয়ে এখানে পিছন ফিরে শুয়ে মটকা মেরে পড়ে থাকবে। আর টুপি দিয়ে মুখটা আড়াল করে নিলে আর কোনও চিন্তা নেই।
    আখের ক্ষেতে তিড়িং, বিড়িং করে ছুটছে কুকুরছানাটা। খেতের মাঝে আস্ত একটা মানুষকে শুয়ে থাকতে দেখে কুকুরছানাটা ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। তার পেছনে ছুটতে ছুটতে মান্দিতোও চলে আসে। কিন্তু সেখানে এসেই তার চক্ষু চড়কগাছ! ঐ লোকটা খেতে ওভাবে শুয়ে আছে কেন? কোন নড়া চড়া নেই! লোকটা কি তবে মরে গেছে। ওটা তাহলে লাশ! ভয়ে কুঁকড়ে যায় মান্দিতো। ভূতে ধরার আগেই তাকে এখান থেকে ছুটে পালাতে হবে। কিন্তু আজাবাখকে তো ফেলে যাওয়া যাবে না। ওটার ঘেউ ঘেউ-তে বিরক্ত হয়ে ভূতটা হয়তো ওর গলাই টিপে দেবে। আজবাখ-কে ছাড়া সে যে পালাতেও পারছে না। এখানে আর মুহূর্ত দাঁড়ালে সে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তার শরীরে আর নড়ার মতো শক্তি নেই। ভূতগ্রস্থের মতো সে তাকিয়ে থাকে মরা লোকটার দিকে। কুকুরটা লোকটার পাশে বসে ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছে। লাশটা যেকোনো মুহূর্তে উঠে দাঁড়িয়ে তার টুঁটি চেপে ধরবে। মনে সাহস এনে লাশটার দিকে এগিয়ে কুকুরটাকে একহাতে তুলে পড়ি-কি-মরি করে ছুট লাগায় মান্দিতো। আখের ধারালো পাতায় হাত-পা-মুখ ছড়ে যায়। কিন্তু সেদিকে তার কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রাণভয়ে সে ছোটে। ছুটতে ছুটতে সে একেবারে দোকানে এসে থামে। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত শরীর…মনে চোরা আতংক…মান্দিতো ভাবে এক্ষুনি বুঝি সে মাথা ঘুরে পড়বে। আঙুলটা দেখিয়ে ভাঙা গলায় একটাই কথা সে বলে উঠতে পারে… ‘ঐ যে ওখানে আদেলা-তে একটা লাশ পড়ে রয়েছে’?
    ‘কী? এ ছোঁড়া বলে কী!’…পেছন থেকে এই বাজখাঁই গলা শুনে মান্দিতোর-তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া। হবে নাই বা কেন? চিনিকলের স্টেশন চিফ সার্জেন্ট রেই-এর হাব, ভাব, হাঁটা, চলা দেখলে যেকোনো মানুষের বুক-ই ভয়ে দুরু দুরু করে। দোকানে জড়ো হওয়া মানুষগুলোর কৌতূহল বাড়ে। বাচ্চা ছেলেটা যা বলেছে তা কি সত্যি!
    বড়দিনের আগে আজ তো লাশের সুরতহালের জন্য লা-রোমানার জাজ-কেও পাওয়া যাবে না। গলা অবধি গিলে কোথায় সে আজ ফুর্তি করে বেড়াচ্ছ! তবে সার্জেন্ট পিছু হঠার পাত্র নন। বাচ্চাটার কথাটাকে তিনি পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারছেন না। পনেরো মিনিটের মধ্যেই দুজন পুলিশকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি। লাশটা যেখানে পড়ে রয়েছে সেখানেই যেতে হবে তাঁকে। ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখতে হবে। দু-পয়সার মজা লুটতে দশ-বারোজন লোকও তাঁর পিছু নেয়। ভাগ্য যে তার এমনভাবে বিরূপ হবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজা।
    ভাগ্যদেবীর কাছে সে তো বেশি কিছু চায়নি। বউ-বাচ্চার সঙ্গে সে বড়দিনের আগের রাতটা কাটাতে চেয়েছে। কতদিন সে ওদের দেখে না! ঐ দূরে সেইবো প্রদেশে পাহাড়ের গোপন ঘাঁটি থেকে পায়ে হেঁটে এতটা দূর এসেছে সে। দিনের বেলায় সে গা-ঢাকা দিয়ে থেকেছে…আর সারা রাত ধরে হেঁটেছে। এই ভাবে কেটে গেছে দিনের পর দিন…রাতের পর রাত। কোনও ঘরবাড়ি, খেতখামারের ধারে কাছে ঘেঁসেনি সে। কখন কে দেখে ফেলে! এ তল্লাটের সবাই জানে সে একজন ফেরারি আসামী। কর্পোরাল পমারেস-কে সে খুন করেছে। কেউ তাকে দেখে ফেললে অনর্থ হয়ে যাবে। একমাত্র নিনাকে আর বাচ্চাগুলোকেই সে দেখা দেবে। বড়জোর দু-এক ঘণ্টা। এর বেশি সে নিনার কাছেও থাকতে পারবে না। তবু তার কাছে ওইটুকুই যথেষ্ট। তার জন্য সে সব কষ্ট সইতে পারে। আজ ছ’মাস হল তাড়া খাওয়া পশুর মতো সে ছুটে বেড়াচ্ছে। আজ এখানে, কাল ওখানে। সেন্ট জনস-ডে তেই তো কান্ডটা ঘটল। তার হাতে বেমালুম খুন হয়ে গেল কর্পোরাল পমেরেস। সেই থেকেই তার ফেরার জীবন।
    আজ তাকে নীনার কাছে…বাচ্চাদের কাছে যেতেই হবে। যে করেই হোক। কোনও এক অদৃশ্য…আদিম শক্তি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে যাকে ঠেকানোর ক্ষমতা তার নেই। বউকে বুকে জড়িয়ে ধরা…বাচ্চাদের গল্প শোনানোর মধ্যে যে আনন্দ তা কিন্তু অবিমিশ্র নয়। মেন্দোজা জানে তার মধ্যে একটু ঈর্ষাও রয়েছে। একবার সে তার সুখের নীড়টাকে দেখতে চায়। ফেলে আসা দিনগুলোকে আর একবারের জন্য ফিরে পেতে চায়। এই তো যেন সেদিনের কথা। সারাদিন খাটুনির পর সন্ধে বেলা সে খেত থেকে ফিরত। কুপির টিমটিমে আলোয় বাচ্চারা তাকে ঘিরে বসত। তার মজার মজার গল্প শুনে বাচ্চারা সব হেসে গড়িয়ে পড়ত। সে জানে ঐ দিনগুলো…ঐ হাসিকান্নার দিনগুলো আর ফিরে আসবে না তার জীবনে। ধুলোমাখা রাস্তা দিয়ে সে শরীরটাকে কোনোমতে ঠেলে নিয়ে যায়। বর্ষা এলেই এই পথ পুরো খানা-খন্দে ভরে যাবে। পদে পদে মৃত্যু আজ ওঁত পেতে রয়েছে। সব বাধা পেরিয়ে আজ তাকে যেতেই হবে বাড়ি।
    এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজা এক কথার মানুষ। কোনও মন্দ স্বভাব তার নেই। তবে তার আত্মসম্মান বোধ প্রবল। তাই সেন্ট জন্‌স-ডেতে কর্পোরাল পমেরেস যেখন যখন তাকে অকারণেই এসে ঠাসিয়ে থাপ্পড় মেরেছিল তখন সে চুপ থাকতে পারেনি। তার আত্মসম্মানবোধ তাকে চুপ থাকতে দেয়নি। তারও হাত উঠে গিয়েছিল। আজ সে এক ফোঁটাও মদ ছোঁয়নি। কিন্তু তাও সে টলছে। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছে সে। বাড়ি ফেরার প্রবল ইচ্ছেটাই আজ তাকে চালিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আজ স্বয়ং ভগবানও তাকে আটকাতে পারবেনা। বড়দিনের আগের এই রাতটা সেবাড়িতেই কাটাবে… বউ বাচ্চাদের সঙ্গে। নিনা আর বাচ্চাগুলো কত কষ্টের মধ্যে রয়েছে। আজ এই আনন্দের দিন তাদের হাতে এক পয়সাওনেই! বাচ্চাগুলো হয়তো বাবার জন্য কান্নাকাটি করছে। ভাবতেই বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায় মেন্ডোজার।
    কিন্তু তার সব পরিকল্পনা আজ ঘেঁটে গেল। বাচ্চাটা গিয়ে কীকরবে তার ওপরই এখন সবকিছু নির্ভর করছে। ভাগ্যতার এখন সুতোর ওপর ঝুলছে। বাচ্চাটা কিমুখ বন্ধ রাখবেনা কিসব কিছু ফাঁস করে দেবে। বাচ্চাটার পায়ের ধুপ ধাপ শুনে মনে হয়েছে সেছুটতে ছুটতে পালিয়েছে। ভেবেছে হয়তো খেতের কোন মুনিষ কাজ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। তবু সাবধানের মার নেই। এই খেত থেকে পালিয়ে অন্য একটাতে আশ্রয় নেওয়াই বুদ্ধিমানের। কিন্তু সে কাজেও তো বিপদ কম নেই। এর মধ্যে কেউ যদি আসা-যাওয়ার পথে তাকে অন্য খেতে ঢুকতে দেখে ফেলে! তাহলেই তো খেল খতম! না না…তাড়াহুড়ো করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। এই মুহূর্তে সে এখানেই নিরাপদ। রাত নটায় সে এখান থেকে বেরোবে। পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগারোটা…সওয়া এগারোটা নাগাদ সে বাড়ি পৌঁছে যাবে। এর পর কী করতে হবে সে জানে। জানালা দিয়ে ফিসফিস করে সে বউকে ডাকবে… ‘শুনছ, দরজাটা শিগগির খোল…এই যে আমি এসেছি’। চোখের সামনেই সে যেন এখন নিনাকে দেখতে পাচ্ছে…আলুথালু বেশ…চুলে তেল নেই…চিরুনি পড়েনি। শুধু কালো চোখদুটো তার চকচক করছে। আজ তাকে বাড়ি যেতে হবে। এটাই এখন তার বেঁচে থাকার একমাত্র উদ্দেশ্য। তার আগে নিজেকে কিছুতেই ধরা দেবে না মেন্ডোজা। এখন বরং একটু ঘুমিয়েই নেওয়া যাক।
    কতগুলো ভারি বুটের শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। শোনা যায় একটা বাচ্চার গলা… ‘এই যে সার্জেন্ট এখানে…এখানেই লাশটা পড়ে ছিল’।
    ‘কিন্তু কোন খেতে? এটাতে নাকি অন্যটায়?’
    ‘না না এখানেই’…আশ্বাস দেয় বাচ্চাটা।
    বাচ্চাটার শেষ কথাটা নিয়ে তো ভাবতে হয়ে। ‘এখানে’ বলতে সে কী বুঝিয়েছে? এনকারনেশিয়ন যেখানে লুকিয়ে আছে সেটা? নাকি পাশেরটা? নাকি সামনেরটা? গলা শুনে মনে হয় সার্জেন্ট আর বাচ্চাটা একটু দূরেই আছে…মনে হয়ে দুটো খেতের মাঝের রাস্তাটায়। বাচ্চাটা কোন খেত দেখিয়েছে তার ওপরই নির্ভর করছে সবকিছু। তাকে ধরার জন্য লোকজনেরা সব কাছাকাছিই চলে এসেছে। এখন আর বসে বসে ভাবলে চলবে না, কিছু একটা করতেই হবে…জলদি। খুব সাবধানে বুকে ভর দিয়ে অন্য খেতে যাওয়ার চেষ্টা করে সে…খুব সাবধান থাকতে হবে। যেন কোনও শব্দ না হয়। হলেও লোকেরা যেন ভাবে… ‘এ কিছু না…এতো পাতার শনশন’। তাকে এক্ষুনি এখান থেকে সরে যেতে হবে। ওদিকে শোনা যায় সার্জেন্টের কর্কশ গলা… ‘নেমেসিও তুমি ওইদিকে যাও…আর আমি যাচ্ছি ঐ পাশে…সলিতো তুমি এখানেই থাকো’।
    লোকগুলো এখন রাগে গজগজ করছে। বেড়ালের মতো নিঃশব্দে হামাগুড়ি দিয়ে মেন্ডোজা অন্য খেতের দিকে এগোতে থাকে। লোকগুলোর কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারে যে তাকে ধরার জন্য বেশ অনেকজনই এখানে এসেছে। ব্যাপারটা তো ভালো হচ্ছে না। তার জন্যও নয়…আর বাচ্চাটার জন্যও না…তা সে যেই হোক না। সার্জেন্ট রেই আর তার শাকরেদ নেমেসিও আরোয়ো আখের খেত তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেলে। তাদের ভারি বুটের তলায় কচি আখের চারাগুলো একেবারে পিষে যায়। তাদের হাত-পা ছড়ে। এত খোঁজাখুঁজির পরেও কোনও লাশ মেলে না। তবে কি সব ভুয়ো খবর!
    ‘এই বাচ্চা এদিকে শোন…লাশটা কি এখানেই ছিল? তুই ঠিক দেখেছিস?’
    ভয়ার্ত গলায় মান্দিতো বলে… ‘হ্যাঁ, এখানেই তো ছিল।
    এইসব বাচ্চা-কাচ্চাদের কথায় ভরসা নেই নেমেসিওর… ‘স্যার, ছেড়ে দিন। ছেলেমানুষ। কী বলতে কী দেখেছে। আমি বলছি এখানে কিচ্ছু পাওয়া যাবে না’।
    সার্জেন্ট কটমট করে তাকাতেই বুকের ভেতরটা ভয়ে শুকিয়ে যায় মান্দিতোর… ‘না স্যার। আমি আজাবাখকে নিয়ে এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। তা কুকুরছানাটা আমার কোল থেকে নেমে ছুটতে শুরু করে’…এই বলে কোল থেকে কুকুরটাকে নামিয়ে রাখে মান্দিতো… ‘তারপর হল টা কী…ও ব্যাটা ছুটতে ছুটতে ওদিকে চলে যায়…
    বাচ্চাটাকে ধমকে থামিয়ে দেয় সার্জেন্টের আরেক শাকরেদ সলিতো রুইজ। ওত বক বক শোনার আর ধৈর্য নেই তার… ‘এই ছোঁড়া, লোকটাকে দেখতে কেমন’।
    ভয়ে কেঁপেই যাচ্ছে মান্দিতো… ‘আমি ওর মুখ দেখিনি। শুধু জামা-কাপড় দেখেছি। মুখটা টুপি দিয়ে ঢাকা ছিল। এই যে এই ভাবে পাশ ফিরে শুয়েছিল লোকটা’।
    ‘কী রঙের প্যান্ট পরেছিল?’
    ‘নীল…আর হলদে জামা। মাথায় কালো টুপি…
    ভয়ে গলা দিয়ে আর আওয়াজ বেরোয় না মান্দিতোর। পা কাঁপে। বুক দুর দুর। কান্না পেয়ে যায়। এ নিয্যশ ভূতের কাণ্ড। ভূতেরা চাইলে সব করতে পারে। ভূতটা ইচ্ছে করেই এখান থেকে সটকে পড়েছে যাতে মান্দিতো সবার কাছে মিথ্যুক হয়ে যায়। এই ভূত সুযোগ পেলেই তার ঘাড় মটকাবে।
    মান্দিতো যা ভাবে ভাবুক, কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল এত খোঁজাখুঁজির পরও লাশের কোন চিহ্ন মেলে না। অন্তত এই খেতে। অস্বাভাবিক ক্ষিপ্রতায় এখেত থেকে ওখেতে গিয়ে লুকোয় মেন্ডোজা। অন্য খেতে গিয়েই আবার বিপদ আসে। ঠিক ঐ পথ দিয়েই কুকুরটাকে কোলে নিয়ে আসছিল বাচ্চাটা। লাশ খুঁজে না পেয়ে বাচ্চাটকে এক রকম ভাগিয়েই দিয়েছিলেন সার্জেন্ট। এবার বাড়ি ফেরার পথে সে দেখে লাশটা নিজেই নিজেই অন্য একটা খেতের মধ্যে গিয়ে ঢুকছে। হ্যাঁ হ্যাঁ এটা তো সেই লাশ! জামা কাপড় সব তো এক!
    ‘এই তো সার্জেন্ট এখানে…এই তো এদিকে গেল’…এই বলে জায়গাটা দেখিয়ে দেয় মান্দিতো।
    ভয়ে আর কোনও কথা বলতে পারে না সে। সার্জেন্টকে জায়গাটা দেখিয়েই দে ছুট…একেবারে বাড়িতে এসে সে থামে। কী উটকো ঝঞ্ঝাটে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল সে! ওদিকে বাচ্চাটার গলা শুনে সার্জেন্ট তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের নিয়ে ছুটে আসেন।
    নেমেসিও এখনও সেই একই কথা বলে যায়… ‘ছেলেমানুষের কথা কিছু ধরবেন না স্যার’।
    কিন্তু সার্জেন্ট ঘাঘু লোক। ডাল মে কুছ কালা তো জরুর হ্যায়… ‘দেখো কিছু না কিছু তো আছে বটেই। সবাই মিলে খেত ঘিরে ফেলো’।
    শুরু হল চিরুনি তল্লাশি। অথচ শিকারিরা এটাও জানে না যে কীসের শিকারে চলেছে তারা। সকাল গড়িয়ে এখন মাঝ দুপুর। তল্লাশির জন্য ছোট ছোট দল তৈরি হয়। প্রতিটা দলে একজন সৈন্য আর জনাকয়েক মুনিষ। দলগুলো এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে খোঁজ শুরু করে। বড়দিনের আগে সবার পেটেই দু-এক পাত্তর পড়েছে। তাই সবার উত্তেজনাটাও একটু যেন বেশি-ই। ওদিকে ঈশান কমে জমে ওঠে মেঘপুঞ্জ। সারা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে জলভরা কালো মেঘ। এই বৃষ্টি নামল বলে! এখন চারদিক থেকে লোকজন ঘিরে ফেলেছে মেন্ডোজাকে। সার্জেন্টের দলবল নাহয় জানে না তারা কীসের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মেন্ডোজা তো জানে! তাকে ধরার জন্যই এতসব আয়োজন। সেন্ট জন্‌স-ডে তে যা ঘটেছিল তারই প্রতিশোধ নিতে এসেছে এরা।
    সৈন্যরা সব কোথায় রয়েছে এখান থেকে বুঝতে পারে না সে। শুধু জানে তাকে পালাতে হবে…যে করেই হোক। সৈন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে সে এখেত ওখেত ছুটে বেড়ায়। হ্যাঁ এবার সে অনেকটা দূরে চলে এসেছে। এখানে সে যদি চুপচাপ ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে তাহলে কেউ তাকে ধরতে পারবে না। তারপর সে অনায়াসে ন’টা নাগাদ বেরিয়ে যাবে। কিন্তু মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি রয়েছে। কেউ যেন তার কানে কানে এসে বলে যায়… ‘পালাও, পালাও’। সে খেতের মধ্যে ছোটাছুটি করতেই থাকে। আর এই করতে গিয়েই ধরা পড়ে। দূর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে ওঠে… ‘ঐ যে ও পালাচ্ছে। ধর্‌ ধর্‌। ওকে দেখতে পুরো এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজার মতো’।
    মেন্ডোজার নাম শুনে সবাই মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়। তবে এই সেই খুনি…যে এতদিন সবার চোখে ধুলো দিয়ে বেড়াচ্ছে!’
    ‘সবাই ওদিকে চল’…গর্জন করে ওঠেন সার্জেন্ট। যেদিকে আসামীকে দেখা গিয়েছিল সেই দিক লক্ষ্য করে রিভলভার হাতে সার্জেন্ট ছুটে যান।
    কালোমেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। কেমন যেন বিশ্রী দমবন্ধ করা, গুমোট পরিবেশ। তবে শিকারিদের সেদিকে লক্ষ্য নেই। তারা এখন শিকারের গন্ধ পেয়েছে। আখের খেত দুমড়ে-মুচড়ে, পায়ে মাড়িয়ে তারা ছুটছে। আসামীকে হাতেনাতে ধরা চাই। ঐ দূর থেকে আবার মেন্ডোজার চেহারাটা দেখা যায়। ঝড়ের বেগে সে ছুটছে। তার দিকে ভালো করে বন্দুকটা তাকও করতে পারল না সলিতো রুইজ।
    সার্জেন্ট চেঁচিয়ে নির্দেশ দেন… ‘যাও…তুরন্ত চিনি কলে যাও। আরো কয়েকজন সেনাকে পাঠাতে বলো’।
    শিকারিরা এলোপাথাড়ি ছোটে। ঠিক কোন দিকে যাবে ঠাহর করে উঠতে পারে না। সব গুলিয়ে যায়। একবার খেতে ঢুকতে যায়…পরের মুহূর্তেই পিছিয়ে আসে।
    দুপুর গড়িয়ে বিকেল। চিনিকল থেকে আরো তিনজন সেনা আসে। সঙ্গে ন, দশজন মুনিষ। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তারা নানান দিকে ছড়িয়ে পড়ে। দূরে একজন সেনা আর জনাকয় মুনিষকে দেখা যায়। তারা গুলি চালাতেও পারে না…যদি কোনও নিরীহ পথচারী মারা পড়ে! চিনিকল থেকে পিল পিল করে লোকজন বেরিয়ে আসে। মেয়েরাও বাদ যায় না। আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারে নাতারা । যাকে সামনে পায় তাকেই জিগ্যেস করে… ‘এখনও কি ধরা পড়েনি?’
    এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজা অত সহজে দমার পাত্র নয়। মরার আগে সে কিছুতেই মরবে না। আখের খেত আর পাহাড়ের মাঝবরাবর যে রাস্তাটা চলে গেছে বেলা তিনটে নাগাদ সেখানে ওঠে মেন্ডোজা। রাস্তা থেকে ঝাঁপ দিয়ে সে পাহাড়ে উঠতে যাবে এমন সময় পিঠে তীব্র যন্ত্রণা। বুলেটটা সোজা এসে বিঁধেছে তার শিরদাঁড়ায়। পলক ফেলতে না ফেলতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে। একটা নয়, দুটো নয় পরপর চোদ্দটা বুলেট এসে বেঁধে মানুষটার শরীরে। কথার বলে না শয়তানের শেষ রাখতে নেই। সেনারা গুলি চালিয়েই যায়। এর মধ্যে বৃষ্টি নামে। সকাল থেকে আকাশজুড়ে যে মেঘের সাজ শুরু হয়েছিল তাই এখন সহস্রধারায় ছড়িয়ে পড়ে মাটির বুকে।
    এনকারনেশিয়ন মেন্ডোজা মরে কাঠ। তার মুখে কোনও গুলির দাগ নেই…কোন বিকৃতি নেই। কিন্তু মাউজারের গুলিতে দাঁতগুলো সব বিচ্ছিরিভাবে ভেঙে গেছে। কাল বড়দিন। এই হতভাগ্য লোকটা এতটা পথ উজিয়ে শুধু বাড়িতে ফিরতে চেয়েছিল… জীবিত বা মৃত। বৃষ্টি থামার লক্ষ্মণ নেই। সার্জেন্ট রেই মনে মনে কিছু একটা ছক কষেন। লাশটাকে নিয়ে এখন কী করা যায়! লাশটাকে যদি পশ্চিমে বড় রাস্তায় নিয়ে যায় তাহলে দিনের দিনই মারকোইস-এ পৌঁছনো যাবে। তাহলে আজই ক্যাপ্টেনের হাতে বড়দিনের উপহারটা তুলে দিতে পারবেন তিনি। আর তা যদি না হয় তাহলে এটাকে বয়ে বয়ে নিয়ে যেতে হবে চিনিকলে। সেখানে আবার কোম্পানির ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ট্রেন আবার বেশিরভাগ সময়তেই লেট।সময়মতো আর মারকোইসে পৌঁছনো যাবেনা। কিন্তু বড় রাস্তায় গেলে অনেক গাড়িঘোড়া পাওয়া যাবে। যেকোনও একটা গাড়ি বালরি থামিয়ে যাত্রীদের ধমকে নামিয়ে লাশটা নিয়ে উঠে পড়তে পারলেই হল।
    ‘ঘোড়ালাও…জলদি…এই লোফারটাকে বড় রাস্তায় নিয়ে যেতে হবে’…হাঁকদে্ন সার্জেন্ট।
    ঘোড়া পাওয়া যায়না। আসে একটা দুবলাগাধা। মুষলধারে বৃষ্টি…কোনো বিরামনেই। কচি আখের পাতায় ঝরে পড়ে জলের দানা। আর সময় নষ্ট করতে চাননা সার্জেন্ট। বড্ড তাড়া। কয়েক জন মুনিষ মিলে লাশটাকে গাধার পিঠে যতটা সম্ভব ততটা শক্ত করে বাঁধে। গাধাটাকে নিয়ে রওনা দেন সার্জেন্ট। পেছন পেছন দু-জন সেনা আর দু-তিনজনলোক। সার্জেন্ট বলে্ন এইবৃষ্টি-বাদলা রমধ্যেই সবাই কে যেতে হবে। থামলে চলবেনা।
    বৃষ্টিতে রাস্তা ঘাট পিছল। রাস্তা জোড়াগর্ত। গাধাটার পাহড় কেযায়… জল কাদার মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এরমধ্যে তিন-তিনবার লাশটা ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যায়। সৈন্যসামন্তরা প্রথমে প্রথমে টুপি দিয়েই মাথা বাঁচানোর চেষ্টা করে… তারপর তালপাতা কেটে, গাছের ছালকেটে মাথাঢাকে। বৃষ্টির বেগবাড়লে কিছুক্ষণের জন্য সবাই আখের খেতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। জলের তোড় আর থামেই না। এর মধ্যেই আবার চলা শুরু। কারোমুখে কোন কথা নেই। মাঝে মাঝে নৈশব্দ চিরে ভেসে আসে দু-একজন সেনার গলা…‘ বেজম্মাটাকে দেখ একবার’… ‘এতদিনের কর্পোরালপ মেরে সের আত্মা শান্তি পেল’।
    চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝড়-জলের জন্য আজকের সন্ধেটা যেন ঝুপ করে নেমে এসেছে। অন্ধকারে এখন পথ চলা দায়। কোথাও জল জমে রয়েছে… কোথা ও বড়গাড্ডা। পা-টিপে টিপে সবাই এগোয়। সন্ধে সাতটা নাগাদ বৃষ্টিটা অনেক ধরে আসে। হঠাৎ-ই একজন মুনিষ চেঁচিয়ে অঠে… ‘ওই যে ঐ দূরে একটা আলো দেখতে পাচ্ছি’।
    ‘হ্যাঁ ঐ গ্রাম থেকে’…এই কথা বলেই মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায় সার্জেন্টের। এই প্ল্যানটা ভেঁজে তার কলিজাটা একটু ঠান্ডা। ব্যাটা মরেছে তো কী হয়েছে। যে পাপ সে করেছে তাতে আরো কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। মিনিট পনেরো পর অবশেষে একটা কুঁড়ে ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় সৈন্য-সামন্তের দল। কর্কশ গলায় আবার চেঁচিয়ে ওঠেন সার্জেন্ট… ‘লাশটার বাঁধন খোলো…আর ওটাকে ঐ ঘরের ভেতর ছুঁড়ে ফেলে দাও। কতক্ষণ আর ভিজব’! এখন গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি পড়ছে। একটু পরেই হয়তো থেমে যাবে। সার্জেন্ট দেখে তার লোক-লস্কর অনেক কসরত করে বাঁধনটা খুলেছে। ঠিক এই সময় কুঁড়ের দরজায় গিয়ে টোকা দেন সার্জেন্ট। মহিলা দরজা খুলতেই তার পায়ের ওপর লাশটাকে ছুঁড়ে দিয়েই তারা পালায়। মহিলা তো হতবাক। কিছু একটা ভারী জিনিস এসে পড়ল মনে হয়! আরে এতো একটা লাশ! মেন্ডোজার লাশ! জলে-কাদায়-রক্তে মাখামাখি। দাঁতগুলো কী বিচ্ছিরিভাবে ভেঙেছে! মানুষটাকে আর চেনাই যায় না! এ যেন মেন্ডোজার প্রেতাত্মা! পায়ের কাছে পড়ে থাকে নিথর মাংসপিন্ডটার দিয়ে সে তাকিয়ে থাকে ভাবলেশহীন। অনেকক্ষণ পর পুরো ব্যাপারটা মাথায় ঢোকে তার…বেরিয়ে আসে বুকফাটা আর্তনাদ… ‘ওরা ওকে মেরে ফেলেছে…এনকারনেশিয়নকে মেরে ফেলেছে ওরা…আমার বাচ্চারা যে অনাথ হয়ে গেল!’
    মায়ের কান্না শুনে বাচ্চারা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মাকে জড়িয়ে ধরে তারাও কাঁদে। শুধু ছোট ছেলেটা ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপে… ‘মাম্মা…মাম্মা…ওই লোকটা… ঐ লাশটাকেই তো আমি সকালে আখের খেতে দেখেছি’!

  • অনুবাদ

    অনুবাদ- নিষ্কৃতি

    নিষ্কৃতি
    -রোমুলো গ্যালোগোজ 

    অনুবাদে- বর্ণালী জানা সেন 

     

     

     

    ঐ দূরে যে পাহাড়টা খাড়া উঠে গেছে তার পাশেই গভীর অতলান্ত খাদ। অসংখ্য বুনোলতা পাহাড়টাকে সাপের মতো পেঁচিয়ে রয়েছে। খাদের ঠিক গা-ঘেঁসে কাঁটা গাছের ঝোপ। পাহাড়ের ঠিক গায়েই সেই বাড়িটা। বাড়ি বলা ভুল…ভাঙাচোরা একটা কামরা। সে ঘরের চিমনি দিয়ে বহুকাল কোনও ধোঁয়া ওঠেনি। ঘরের ঠিক দোরগোড়ায় উদাস মুখে বসে আছে চিররুগ্ন ছেলেটা। মানুষ তো নয় যেন একটা কংকাল…কুচ্ছিত…কদাকার। ঝাঁটার কাঠির মতো চেহারায় বিশাল একটা মাথা। মাথায় কয়েকগুছি চুলও নোংরা…জট পাকানো। কতকাল যে তেল, সাবান, চিরুনি পড়ে না! পেটটা ফুলে ঢোল। হাড্ডিসার দুটো পায়ে যত রাজ্যের খোসপাঁচড়া। হাঁটু আর পায়ের দুটো পাতায় জল জমেছে। মুখের চামড়া রুক্ষ খসখসে। হাড়ের ওপর শুধু চামড়ার একটা পরত। মুলোর মতো দাঁতগুলো মুখের বাইরেই বেরিয়ে থাকে সারাক্ষণ। কোটরে ঢোকা চোখদুটো অস্বাভাবিক হলুদ। ঐ চোখ দিয়েই সে যেন কিছু বলতে চায়। ঐ ঘোলাটে চোখের ভাষায় তীব্র এক যন্ত্রণা…মুখে যা প্রকাশ করা যায় না।
    সারাদিন পাথরের মতো দরজায় সামনে সে বসে থাকে। আর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দূরের সবুজ পাহাড়গুলোর দিকে। যেদিকেই চোখ যায় শুধু পাহাড় আর খাদ। সাগরের ঢেউয়ের মতো ঐ ঢেউ খেলানো পাহাড়্গুলোও সব নীল দিগন্ত রেখায় গিয়ে মিশে গেছে। ছেলেটার মনে উথাল-পাথাল। কেন যে তার মনে এত বিষ! সামনে যা পায় তার ওপরই বিষ উগরে দিতে চায়। এই সৃষ্টিশুদ্ধকে সে ভেঙে তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে। দিন রাত রাগে সেগুমরে গুমরে মরে । মাঝে মাঝে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু গলার কাছে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে আসে। এই মরা চোখে জলও আসে না! রাগলে সে আর মানুষ থাকেনা। সহস্র দানবের শক্তি যেন ভর করে তার শরীরে। দাঁতে দাঁতকপাটি লেগে যায়। হাতের সামনে যা পায় ছিঁড়ে খুঁড়ে একসা করে মনে একটু শান্ত পায়। প্রচন্ড ঝড়ের পর প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়ে যায় তেমনই প্রলয়ংকর তাণ্ডব চালিয়ে সেও আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ে। একতাল মাংসের মতো পড়ে থাকে মাটিতে। অন্য সময় সে চুপচাপ বসে কী যেন ভাবে। আকাশের মেঘপুঞ্জে সে অশনি সংকেত দেখতে পায়। যেন সাংঘাতিক কিছু ঘটে যাবে এই মূহূর্তে। চিত্রার্পিতের মতো বসে থাকেসে । ঘন বিষাদের এই মুহূর্তগুলোতে সব কিছু গুলিয়ে যার তার। নিজেকেও সে ভুলে যায় । প্রথমে গোড়ালিটা শিরশির করে ওঠে…তারপর সেই শিরশিরানি ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। ভেতরটা জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়। একেই কি মরে যাওয়া বলে? রাতের অন্ধকারে এই খাড়াই পাহাড়টা ফুলতে ফুলতে যেমন একটা বিশাল দৈত্যের মতো হয়ে যায় তেমনই তার পেটটাও ফুলতে ফুলতে প্রায় ফেটে পড়ার জোগাড় হয়। সে হাঁসফাঁস করে…নিঃশ্বাস নিতে পারে না। মাথায় ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করে ওঠে। কানের পাশে হাজার হাজার ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। চোখের সামনে ভেসে ওঠে শত শত তারা। অদ্ভূত এক নীরবতা নেমে আসে চরাচর জুড়ে…অসীম…অনন্ত এই নীরবতা। ঠিক এমন সময়ই সে ভয়ংকর দৃশ্যটা দেখতে পায় সে। ঘিনঘিনে ঐ কয়লা খাদানের লোকটা তার মাকে জাপটে ধরে আছে। আর সে ঘরের কোণে বসে ঠকঠক করে কাঁপছে। জ্বর আসার আগে এই কাঁপুনি তার খুব চেনা।
    বাবা মারা যাওয়ার ঠিক পর পরই এই দৃশ্যটা প্রথম দেখে ফিলিপ। তারপর বার বার ঘুরে ফিরে আসে দৃশ্যটা। কেন যে এমনটা হয় সে নিজেও জানে না…বুঝতে পারে না। দৃশ্যটা কল্পনা করলেই খ্যাপা হাতির মতো ছটফট করে ওঠে সে। মায়ের ওপর তার ভীষণ ঘেন্না। মায়ের দিকে মুখ তুলে কথা বলতে গেই এই প্রচণ্ড ঘেন্নাটা বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে আসে। শুধু মায়ের দিকে চাইলেই চোখের সামনে ভেসে আসে দৃশ্যটা। ঐ বীভৎস লোকটার বিরাট কালো হাতটা মাকে পেঁচিয়ে রয়েছে!
    মায়ের জন্য আজ তার ছোট্ট বুকে শুধুই ঘেন্না। ছেলেটা কোনও কথা বলে না। নিজের তৈরি একটা খোলসের মধ্যে দিনরাত নিজেকে গুটিয়ে রাকে। সারাদিন কী যে ভাবে! ছেলের মুখ খোলানোর অনেক চেষ্টা করেছে মা। কোনও ফল হয়নি। আসলে মাও তো কোনোদিন ছেলেকে একটু ভালো কথা…একটু মিষ্টি কথা বলেনি। মা শুধু মেরেছে…ধরেছে…গালাগাল দিয়েছে। আর মায়ের মার খেয়ে ছেলের জেদ আরো বেড়ে গেছে। মায়ের প্রতি ঘেন্নায় পাগলের মধ্যে সে আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়েছে। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে মূর্ছা গেছে। প্রথম প্রথম মা তাকে খুব মারত…কিল, চড়, লাথি, ঘুসি। কিন্তু তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটাও জল বেরোয়নি। তাড়া খাওয়া জন্তুর মতো সে শুধু গর্জন করত আর মাটিতে গড়াগড়ি খেত। তারপর সব তেজ হারিয়ে মড়ার মতো মাটিতে পড়ে থেকেছে…ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এরপর মা অন্য কৌশল নিয়েছে। মার থামিয়ে ছেলের হাতটা পিছমোড়া করে বেঁধে পিন ফুটিয়ে গেছে। নিজের বিষের জ্বালায় নিজেই জ্বলতে জ্বলতে মাটিতে পড়ে গেছে ছেলে। অচৈতন্য ছেলেকে এবার ছেড়ে দিয়ে মা সরে গেছে… ‘হে মা রক্ষে করো’!
    মা বাড়িতে থাকে খুব কম। বাইরে লোকের খেতে খেতে ঘুরেই বেশির ভাগ সময় কেটে যায়। খেতে সে কাঠ কুড়োয়, সুযোগ পেলে একটু ভুট্টা চুরি করে পাশের শহরে গিয়ে বেচে আসে। একটু-আধটু যে পয়সা হাতে আসে তা দিয়ে মোটা কাসাভা রুটি…বা কখনও সখনো দু-একটা নোনা মাছ কিনে সে রাতে বাড়ি ফেরে। খাবার দেখলেই হামলে পড়ে ছেলে। তার পেটের খিদের আগুন কখনও নেভে না। মার হাত থেকে খাবার কেড়েকুড়ে গপগপ করে গিলতে থাকে। দিনে…রাতে সে শুধু খাওয়ার কথাই ভাবে…খাওয়ারই স্বপ্ন দেখে।
    একদিন ফিলিপের এক বন্ধু এসে জুটল। সেদিন সকাল থেকেই কুকুরটার ঘেউ ঘেউ শুনছিল ফিলিপ। কুকুরটা মনে হয় তার মনিবকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সারাদিন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বিকেলের দিকে ফিলিপের কাছে এসে থামে। ফিলিপকে দেখেই কুকুরটা গদগদ হয়ে লেজ নাড়াতে থাকে। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে ফিলিপের পায়ের কাছে শুয়েই পড়ে। রুগ্ন ছেলেটার হতকুচ্ছিত চেহারা দেখেও কুকুরটার একটুও ভয় নেই। ফিলিপও অনেকক্ষণ ধরে জরিপ করে কুকুরটাকে। কুকুরটাকে দেখে সে একটুও অবাক হয়নি ফিলিপ…যেন অনেকদিনের হারানো বন্ধু আবার ফিরে এসেছে। কুকুরটাকে সে একটাও কথা বলে না…একটু পিঠ চাপড়েও দেয় না। এত আদিখ্যেতা দেখানোরই বা কী আছে! কুকুরটা তার কাছে এসেছে…ব্যস মিটে গেছে। এটা হওয়ারই তো কথা ছিল। সেই কুকুরটার মনিব। সারাদিন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে কুকুরটা তাকেই খুঁজেছে। সে জানে এই কুকুর তাকে কোনোদিনও ছেড়ে যাবে না। কিছুক্ষণ পর তার শান্ত মনে আবার ঝড় ওঠে। আজব সব ভাবনা আসে মনে…যা দেখা যায় না, কাউকে বলা যায় না। মাঝে মাঝে তার মনে হয় একটা অদৃশ্য হাত তার গলা টিপে ধরতে চাইছে। তার মনে হয় কুকুরটা যেন কোনও অজানা দেশ থেকে এসে জুটেছে। সেই দেশ রয়েছে আকাশের অনেক ওপরে যা কেউ দেখতে পায় না। শুধু বিশাল ঐ কাকটা যখন বিকট চিৎকার করে ডানা ঝাপটে আকাশে উড়ে যায় তখন সেই শুধু এই রহস্যে ঘেরা ছায়াময় জগতটা দেখতে পায়। ফিলিপের কেন জানিনা মনে হয় কুকুরটা শুধু শুধু উড়ে এসে জুড়ে এসে জুড়ে বসেনি। কুকুরটা এসে যেন তাকে কোনও বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করতে এসেছে।
    অনেকক্ষণ পর মুখ খোলে ফিলিপ… ‘সকাল থেকে জঙ্গলে তোর ডাক শুনছি। আমি জানি তুই আমাকেই খুঁজতে এসেছিস’। কুকুরটা আবার গদ গদ হয়ে কুঁই কুঁই করে যায়। হঠাৎ করে এই আদরের ডাক থামিয়ে কুকুরটা তীব্র গর্জন করে ওঠে… সে যেন কোনও বিপদের গন্ধ পেয়েছে। ঐ ঝোপের আড়াল থেকে ফিলিপও কারো একটা পায়ের আওয়াজ শুনেছে। এই আওয়াজ তার চেনা… ‘ওরে থাম থাম…মাম্মা এসেছে’।
    বাড়ির সামনে উটকো এই জানোয়ারটাকে দেখে মাথাটা গরম হয়ে যায় প্লাসিদার। কুকুরটাকে সে তাড়ানোর অনেক চেষ্টা করে…কিন্তু সে বান্দা নড়েনা। ফিলিপের পায়ের কাছে শুয়েই থাকে আর চেঁচিয়ে যায়। কুকুরটা কি তাকে ভয় দেখাতে চায়! তাহলে অমন আগুন-চোখ নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে কেন? ভয় পেয়ে যায় প্লাসিদা। তখনকার মতো সে ওখান থেকে সরে যায় ঠিকই কিন্তু মন থেকে তার অস্বস্তিটা যায় না।
    ঘরে ঢুকে সন্ধের খাওয়ার আয়োজন করে প্লাসিদা। খাওয়া বলতে আর কি…দু-এক টুকরো মোটা রুটি বইতো নয়। খাবারটা সে ঘরে লুকিয়ে রাখে যাতে ফিলিপ নাগাল না পায়। তারপর এক টুকরো রুটি নিয়ে চলে আসে পাহাড়ের ধারে। এখানেই লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে খেয়ে নিতে হবে। কিন্তু ও ছেলের চোখকে ফাঁকি দেওয়া খুব মুশকিল। সে ঠিক মাকে দেখতে পেয়ে যায়। খাবারটা ছিনিয়ে নিতে তীরের মতো সে মায়ের দিকে ছুটে যায়। এক টুকরো রুটি মাটিতে ছুঁড়ে দিয়ে মা সরে যায়। রুটির টুকরোটা গিয়ে পড়ে ঝোপের ধারে। ফিলিপ রুটিটা কুড়িয়ে নিয়ে বুভুক্ষুর মতো খায়। কুকুরটা লেজ নাড়িয়েই যায়। রুটির এক টুকরো ছুঁড়ে ফিলিপ কুকুরটা দিতে যায়। কিন্তু সে কুকুর মুখ সরিয়ে নেয়। তারপর মাটিতে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। মুখটা তার ঐ মহিলার দিকে।
    ওদিকে ছেলের দিক থেকে মুখ সরাতে পারে না প্লাসিদা। ছেলেটা যখন চিবিয়ে চিবিয়ে রুটিটা খাচ্ছিল তখন ওকে যে কী কদাকার লাগছিল! ঘা ঘিনঘিন করছিল প্লাসিদার। ছেলেটা আগে অতটা কুচ্ছিত ছিল না বোধহয়। যত ভাবে প্লাসিদার তত ঘেন্না লাগে ছেলেটাকে। একটা নরকের কীট। মরতে বসেছে…তাও বাঁচার কী চেষ্টা। ছি। ঐ ছেলেটার জন্যই তো তা জীবনে এত যন্ত্রণা। কোথাও সে কাজ পায় না। শহরে বাবুদের বাড়ি কাজ চাইতে গেলে তারা ছেলেটাকে দেখে নাক শিঁটকোয়… ‘না বাপু, তুমি কাজ কর ঠিক আছে…কিন্তু তোমার ঐ ছেলেটাকে এখানে রাখা যাবেনা’। ছেলেটার জন্য ক্রিসান্টোকেও সে কাছে পাচ্ছে না। কয়লা খাদানে কাজ করে ক্রিসান্তো। হাতে টাকাকড়ি আছে। তার সঙ্গে আশনাইটাও বেশ ভালোই জমেছিল…কিন্তু তাদের মাঝখানেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই হতচ্ছাড়া ছেলেটা। সেদিন তো ক্রিসান্তো একেবারে সাফ সাফ জানিয়েই দিল… ‘ছেলেটাই তো তোর যত নষ্টের গোড়া। নাহলে তোর এত কষ্টই হত না। আমার ঘর আছে…ভরপেট খাবার-দাবার আছে। তুই একদম রানি হয়ে থাকতে পারতিস। আর তোকে লোকের খেতে খেতে কাঠ চুরি করতে হত না। কিন্তু তোর ঐ ছেলেটাকে নেবনা…ওকে সোনা দিয়ে মুড়ে দিলেও নয়। ব্যাটার চোখের দিকে চেয়ে দেখেছিস! একেবারে হায়নার চোখ। দেখে তোর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাবে। ওর সারা শরীরে শয়তানির ছাপ। একেবারে পাক্কা শয়তানের বাচ্চা। কে বলবে ও ছেলেমানুষ! চেহারাখানা দেখেছিস! অত শয়তানি বুদ্ধি বাচ্চাদের থাকে না। আমার দিকে এমন করে চায় যেন ছিঁড়ে খুবলে খেয়ে নেবে। ওকে যদি অন্ধকারে পাহাড়ের ধারে পেতাম তাহলে আমি কিন্তু একেবারে…হ্যাঁ একেবারে শেষ…শালা শয়তান! আমি যদি তোর জায়গায় থাকতাম তাহলে…
    ক্রিসান্তোর কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝোপের ধার থেকে কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে ডেকে ওঠে। চমকে ওঠে প্লাসিদা। এই কুকুরটাই তো তাদের ঘরে ঘাঁটি গেড়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা ফিলিপের পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে! কুকুরটা যেন তার মনিবকে খুঁজে চলেছে। প্লাসিদার পায়ের কাছে এসে কিছু একটা শুঁকে আবার গর্জন ওঠে।
    প্লাসিদা ঠিক তখনই ক্রিসান্তোকে বলছিল… ‘কিন্তু ধরা পড়ে যাই’।
    ‘ না না কেউ ধরতে পারবে না। যে ছেলে দু-পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে না সে যদি পাহাড় থেকে পড়ে যায়…
    এখন ছেলের ঐ বিচ্ছিরি…পোকায় খাওয়া চেহারাটা দেখে ক্রিস্তানোর ইঙ্গিতটা মনে পড়ে তার প্লাসিদার… ‘নাহ্‌, কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারবে না’।
    চারপাশটা ভালো করে দেখে নেয় প্লাসিদা। চারিদিকে ভূতুড়ে নৈঃশব্দ। জনমনিষ্যি নেই। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। ঐ অনেক নীচে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দু-চারটে বাড়ি আছে অবশ্য…চাষাভূসোদের বাড়ি। অত দূর থেকে কেউ কিচ্ছু টের পাবে না। বাড়িগুলোর চিমনি থেকে হালকা নীল ধোঁয়া মাঝে মাঝে চোখে পড়ে।
    চারদিকটা ভালো করে জরিপ করার পর প্লাসিদার কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগে। গলার কাছে একটা দলা আটকে রয়েছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আকাশে কালো মেঘে ছেয়ে গেছে…মেঘের নীল ছায়া পড়েছে নীচের উপত্যকায়। দূরে ঐ দিগন্ত রেখার কাছে শেষ পাহাড়টার ওপর থেকে বৃষ্টি ধেয়ে আসছে। একের পর এক বাজের শব্দে রাত্রির নৈঃশব্দ ভেঙে খান খান। মেঘের গুরু গুরু ডাকে কি অশুভ সংকেত লুকিয়ে রয়েছে? স্বয়ং শয়তান এখন ভর করেছে প্লাসিদার মনে…কোনও অন্ধকার সুড়ঙ্গে সে তলিয়েই যাচ্ছে।
    ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তোর ঐ ছেলেটা মানুষ নয়। একটা দৈত্য। দেখ দেখ শয়তানটা কীভাবে তাকিয়ে আছে দেখ! যেন এক্ষুনি গিলে খেয়ে নেবে! হে মা রক্ষে করো! চোখদুটো ভাটার মতো জ্বলছে…দাঁতগুলো কিড় মিড় করছে! হা ভগবান! একটা জড় পদার্থের মতো বেঁচে ও পাবেটা কী! পেটে গিজগিজে পোকাগুলো তো আস্তে আস্তে ওর জীবনীশক্তি শুষেই নিচ্ছে! জ্বর আসার আগে কেমন পাগলের মতো কাঁপে দেখিস না…মনে হয় যেন জিনে পেয়েছে। হা ভগবান… এভাবে আমি কিছুতেই বাঁচতাম না…তার চেয়ে মরণ ভালো’।
    কুকুরটা আবার চেঁচিয়ে ওঠে। ক্রিসান্তো চমকে ওঠে… ‘দেখ, কোত্থেকে আবার একটা কুকুর জুটিয়েছে! জীবনে কত কী যে ঘটে সব কি আর বোঝা যায়?’
    গ্রোগ্রাসে রুটিটা গিলে আবার মায়ের দিকে হাত বাড়ায় ফিলিপ… ‘দে আরো দে…আমার খিদে পেয়েছে’।
    ছেলেকে দেখে বুকটা কেঁপে ওঠে প্লাসিদার। ছেলেটাকে এত অচেনা মনে হচ্ছে কেন? ও কি মানুষ নাকি প্রেতাত্মা! ছেলেটাকে বড় রহস্যময় মনে হচ্ছে। ঐ চোখের মধ্যে যেন কোনও অশুভ ইঙ্গিত। ছেলেটার বড্ড জেদ। দিন আনি দিন খাই সংসারে এত খাবার সে কোত্থেকে জোটাবে? মনের মধ্যে আবার সেই ভাবনাটা খেলে যায় প্লাসিদার। সে একটা রুটির একটা টুকরো ছিঁড়ে ঝোপের দিকে ছুঁড়ে দেয়। সেটা গিয়ে আটকে যায় ঝোপের একটা ডালে। নীচে অতলান্ত খাদ।
    ফিলিপ উঠে দাঁডায়। চোখের কোণে বিদ্যুৎ খেলে যায়। জ্বলন্ত চোখে সে মায়ের দিকে চায়। সে সব বুঝে গেছে। মা কি চায় সে বুঝে গেছে। তার জন্য মরণফাঁদ বিছিয়ে রেখেছে মা। সে যদি রুটিটা আনতে যায় তাহলে নিশ্চিত মৃত্যু। কাঁটা গাছের ডালটা তার ভার নিতে পারবে না। কিন্তু মা যখন চাইছে তখন তাই হোক। অনেক কষ্টে মনকে বুঝিয়ে সে ঝোপের দিকে এগোয়।
    কিন্তু এই সময়ই বিদ্যুৎ বেগে ছুটে আসে কুকুরটা। এক লাফে সে ঝোপের ওপর গিয়ে লাফায়। কিন্তু তার ভারে ছোট গাছটার ডাল নুয়ে পড়ে। কুকুরটা সোজা গভীর খাদে। আর কোনও চিহ্ন দেখা যায় না তার।
    সে এক ভয়াবহ রাত। মুষলধারে বৃষ্টি। কালো আকাশের বুক চিরে ঝলছে উঠছে আলো। বাজের শব্দে বুক কেঁপে ওঠে। এ কোন প্রলয় আসতে চলেছে আজ! খড়ের চালের ফুটো দিয়ে জলে ভেসে যাচ্ছে ঘর। পথে ঘাটে যেন সহস্র নদী সাপের মতো ফুঁসছে। অনেকক্ষণ ধরে খাদের নীচ থেকে কুকুরটার কাতর ডাক শোনা গেছে। কিন্তু এখন সব চুপ।
    মা-ছেলে শুয়ে আছে ঘরে। কারো মুখে কোনও কথা নেই। বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে। সেই আলোয় ছেলের চোখটা দেখে পায়ের তলার মাটি সরে যায় প্লাসিদার। ও যে পাক্কা শয়তানের চোখ…ধূর্ত, নিষ্ঠুর। প্লাসিদার ঘুম আসে না। ছেলেকে তার ভয় হচ্ছে। ছেলের ভেতরের শয়তান জেগে উঠে তার গলাটা টিপে দেবে না তো?
    ওদিকে ছেলে মাঝে মাঝেই বিড় বিড় করে কী যেন বলছে। ভালো করে শুনে মাথাটা ঘুরে যায় প্লাসিদার।
    ‘মাম্মা, মাম্মা তুমি কেন আমাকে মারতে চাও’?

You cannot copy content of this page