• প্রবন্ধ

    প্রবন্ধ- নবান্ন

    নবান্ন

    -ইন্দ্রনীল মজুমদার  

     

    সেই কবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “দুরন্ত আশা” কবিতায় বলে গেছেন-
    “অন্নপায়ী বঙ্গবাসী
    স্তন্যপায়ী জীব”
    অর্থাৎ বাঙালীজাতি অন্নকে এতোটাই ভালোবাসে যে এরা অন্নকে বিশেষ করে অন্নের ফ্যানকেও পান করে নেয়। ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় যখন কলকাতা শহরের রাস্তায় রাস্তায় দুর্ভিক্ষ পীড়িত অঞ্চলের অর্ধকঙ্কাল মানুষ যখন খাবারের ভিক্ষে করে ভাতও পেল না তখন ভাত থেকে বর্জিত ফ্যানটুকু চাইলেও ফ্যান দিতেও কৃপনতা করেছিল এই জাতি। হায়! এই না বলে “রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি।” কিন্তু আপাতত এইসব ‘নেতি,নেতি’ ব্যাপার বন্ধ থাক কারণ সুখের কথা বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বণ। উৎসবে ভরা আমাদের এই গোটা বঙ্গদেশ-পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ। তেমনি একটি উৎসব এই অন্নকে ঘিরেই যার নাম “নবান্ন”। “নবান্ন” শব্দটির অর্থ “নতুন অন্ন”।এই উৎসব আসলে দুই বাংলার ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব।গ্রামবাংলার কৃষক সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তাদের মধ্যে অন্যতম।

    অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে বোনা এবং রোপা হয় আমন ধান। তাই এর স্থানীয় নাম জলিধান বা পৌষধান। এই আমন ধানকেই ঘিরে নবান্ন উৎসব। আসলে নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব এই নবান্ন। তাই এই উৎসব সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর অনুষ্ঠিত হয়। আবার কোথাও কোথাও মাঘ মাসেও নবান্ন উদযাপন হয়। এই অনুষ্ঠানের রীতি হল নতুন অন্ন প্রথমে পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাক ইত্যাদি প্রাণীকে উৎসর্গ করা হয় এবং আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর কৃষি ঘরের গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড় সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন।

    এবারে আসি কাককে অন্ন উৎসর্গ করার প্রথায়। এই উৎসবের এক লৌকিক প্রথা অনুসারে নতুন আমন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী কাককে নিবেদন করা হয়। এটা আসলে এই উৎসবের একটি অঙ্গবিশেষ। “বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু তর্কে বহুদুর।” তাই লোকবিশ্বাস অনুযায়ী কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যায়। কাকের জন্য এই নৈবেদ্যকে বলে “কাকবলী”।

    নবান্ন উৎসব হিন্দুদের একটি প্রাচীন প্রথা। হিন্দুশাস্ত্রে নবান্নের উল্লেখ ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করা রয়েছে। সেই শাস্ত্র অনুসারে, নতুন ধান উৎপাদনের সময় পিতৃপুরুষ অন্ন প্রার্থনা করে থাকেন। এই কারণে হিন্দুরা পার্বণ বিধি অনুযায়ে নবান্নে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে থাকেন। শাস্ত্রমতে, নবান্ন শ্রাদ্ধ না করে নতুন অন্ন গ্রহণ করলে পাপের ভাগী হতে হয়।আবার অতীতকালে পৌষ সংক্রান্তির দিনও গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করার প্রথা ছিল।

    এবার আলোচনা করা যাক “নবান্ন” উৎসবের সামাজিক তাৎপর্য নিয়ে। একদা অত্যন্ত সাড়ম্বরে নবান্ন উৎসব পালিত হত সেখানে সকল মানুষের সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে নবান্ন উৎসব সমাদৃত ছিল। ১৯৯৮ সন থেকে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব উদ্যাপন শুরু হয়েছে। জাতীয় নবান্নোৎসব উদ্যাপন পর্ষদ প্রতিবছর পহেলা অগ্রহায়ণ তারিখে নবান্ন উৎসব উদ্যাপন করে। ইদানীং বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে আনুষ্ঠানিক নবান্ন উৎসব উদযাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমী তাদের প্রকাশিত “শিশু” পত্রিকায় নবান্নের উপর একটি পৃথক সংখ্যা বের করে।বিজন ভট্টাচার্যের লেখা একটি বাংলা নাটকের নাম “নবান্ন” যা ১৯৪৪ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রযোজনায় ও শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় এই প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল।এরপর ১৯৪৮ সালে বহুরূপী নাট্যদলের প্রযোজনায় ও কুমার রায়ের পরিচালনায় নবান্ন মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকটির বিষয় পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ যাতে বাংলার ২০ লক্ষ মানুষ অনাহার, অপুষ্টি ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল।গণনাট্য সংঘ এই নাটকটিকে ভারতের নানা জায়গায় তাদের ‘ভয়েস অফ বেঙ্গল’ উৎসবের অঙ্গ হিসেবে মঞ্চস্থ করে দুর্ভিক্ষের ত্রাণে লক্ষাধিক টাকা তুলতে সক্ষম হয়েছিল।নাটকের প্রধান চরিত্র বাংলার এক চাষি প্রধান সমাদ্দার। এই নাটকের বিষয়বস্তু হল প্রধান সমাদ্দারের পরিবার ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে অনাহারে কেমন কষ্ট পেয়েছিল তাই নিয়ে।

    এই উৎসব কালেক্রমে আরো অনুষ্ঠিত হোক এই কামনাই রইলো।

  • গল্প

    গল্প -একদিন স্কুল পালিয়ে…..

    একদিন স্কুল পালিয়ে

    -ইন্দ্রনীল মজুমদার

    ছোট্ট বন্ধুরা সবাই ভালো আছে তো? আজ এখানে তোমাদের সাথে এক বন্ধুর আলাপ করিয়ে দেব। তোমরা যেমন মাঝে মধ্যে দুষ্টুমি কর, আমাদের এই বন্ধুটিও একদিন একটু দুষ্টুমি করে ফেলেছিল আর তারপর যা ঘটলো তা গল্পটা পড়লেই বুঝতে পারবে।
    তোমাদের স্কুলে কত ক্লাস, কত চাপ থাকে। তাই না? মাঝে মধ্যে তোমরাও তো বোর হয়ে ওঠো, তাই তো? ও হোঃ দেখেছ, তোমাদের ওই বন্ধুটির নামই তো বলা হয়নি। তা ধরে নাও, ওর নাম পুপলু। সেবার এই পুপলুর সাথে কি হল, সেই ঘটনাটাই আমরা জানব। তা পুপলু স্কুলে ছিল, বেশ দিব্যি ছিল। হঠাৎ তার কি একটা মনে হল ঝট্ করে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গট্গট্ করে হাঁটতো লাগল। ভাগ্যিলস তখন টিফিন পিরিয়ড চলছিল তাই টিচার ক্লাসে ছিলেন না অতএব পুপলুকে বাঁধা দেওয়ার কেউ ছিল না। স্কুলের পেছনের পাঁচিলটার কাছে গেল এবং গিয়ে তার সামনে ব্যাগটা রাখল। পাঁচিলটা খুব উঁচু ছিল না তাই সে পাঁচিলটা টপকাতে পারলো। টপকে ওপারে গিয়ে দেখল চারপাশে জঙ্গলের মতোন। দূরে একটা পোড়ো বাড়ি আছে। পুপলু বাড়িটার দিকে এগোল। বাড়িটার দরজায় ঠোকাঠুকি করল। কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। পুপলুর মনে হল সেই বাড়ির দরজাটা যেন দরজা নয় যেন একটা পিচবোর্ড হয়ত জোরে ধাক্কা মারলেই ভেঙে যাবে। যাইহোক, সে দরজা একটু ঠেলা মারতেই সেটি একেবারে খুলে গেল। ঢুকে সে দেখলএক বিশাল ঘর যাতে অনেক রঙিন শিশি, নানা যন্ত্রপাতি, পশু ও মানুষের কঙ্কাল ইত্যাদি আরও কত কি! মনে হয় কোনোও ল্যাবরেটরি বা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাগাঢ়ে এসে পড়েছে। যাইহোক, পুপলুর কিন্তু বুটটা ছ্যাঁাত করে উঠল প্রথমে। অনেক সিনেমা, সিরিয়ালে সে এরকম ল্যাববরেটরি দেখেছে। সে চারপাশ দেখে নানা কথা ভাবছিল এমন সময় একটা টেকো, সাদা জামা পড়া একটা বেঁটে ও ফর্সা লোককে হঠাৎ দেখতে পেয়ে ভয় চেঁচিয়ে ওঠে, – “বাপরে! আপনি কে স্যার?” লোকটি এক বিকট হাসি হেসে বলে ওঠেন, “আমি চিত্তপ্রসাদ পাকড়াশি-সময়কে আমি পাকড়িয়ে রেখেছি। হাঃ হাঃ হাঃ।” ওই অদ্ভুত রকমের লোকটার কথাবার্তা শুনলে মনে হয় যে উনি পাগলারে টাইপের আছেন। এরপর তিনি বলেন, “এদিকে আয়।” এই বলে পেছনের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন সেখানে একটা অদ্ভুত রকমের যন্ত্র দেখিয়ে বললেন, “এই যন্ত্রটি দেখছিস, এর নাম DLF56C1001, এটি আমি, হ্যাঁ আমিই আবিষ্কার করেছি। বুঝলি! আমিই আবিষ্কার করেছি। হিঃ হিঃ হাঃ হাঃ হাঃ।” বলে তিনি বিকট হাসি হাসলেন। এরপর খানিকটা নরম স্বরে বললেন, “তা বাবা, এতে জানিস তো আমি যেকোনো মানুষ বা জীবকে অতীত বা ভবিষ্যতে পাঠিয়ে দিতে পারি। তবে বাপু, এরজন্যেু চাই নির্দোষ কোন মানুষকে।” এই বলে তিনি হঠাৎ পুপলুর কাছে চলে এসে তার হাত দুটো ধরে লাফাতে আরম্ভ করলেন আর বলতে লাগলেন, “ইউরেকা! পেয়েছি, পেয়েছি। তুই একটা সৎ ও নির্দোষ ছেলে। তাই, আয় বরং তোকেই আগে যন্ত্রে চাপাই। বল কোথায় যেতে চাস অতীতে না ভবিষ্যতে?
    পুপলু তাঁর কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় এবং কিছু বুঝে উঠতে না পারার আগেই বলে বসে “অতীতে”। এর অবশ্য কারণ হল পুপলুর প্রিয় বিষয় ইতিহাস যা। অতীতের কথাই বলে আর তাছাড়া অতীত নিয়ে। মানুষের কৌতূহল তো চিরন্তন। তারপর ওই বিজ্ঞানী ভদ্রলোক পুপলুকে বললেন, “আয়, চটি জোড়া পড়।” স্কুলের জুতা ছেড়ে যন্ত্রের পাশে রাখা এক অদ্ভুত রকমের চটি পায়ে দিল সে। তারপর সে যন্ত্রটার ভেতর চড়ে বসল। পুপলুর আচমকা মনে হল আরে এ তো সেই বিখ্যাত ‛টাইম মেশিন’। সে চিৎকার করে বলে উঠল, “আরে! আপনি টাইম মেশিন আবিষ্কার করেছেন কাকু। আপনাকে তো তাহলে নোবেল……”
    কথাটা শেষ হল না, লোকটা বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন, “চোপ্, ছোকরা, চুপ করে বসে থাক্।” এরপরে, ওই ভদ্রলোক কম্পিউটারে কি সব স্যু ইচ টিপলেন এবং বললেন, “তোকে ১৯৩৮ সালে পাঠাচ্ছি, বুঝলি। সাবধান! যন্ত্রর মন্ত্রর ফুস্!” তারপর তিনি এক অদ্ভুত হাসি হাসলেন।
    পুপলুর কিরকম যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল এবং তার মনে হল যে এই জগৎ থেকে তার মনটা অন্য এক জগতে চলে যাচ্ছে, সে ভয় পেয়ে এট চিৎকার করে উঠল। হঠাৎ দেখল যে সে অন্য এক জগতে বা বলাবাহুল্য অন্য এক সময় চলে এসেছে। চারিদিকে বিশাল বড়ো বড়ো বাড়ি যাকে বলে অট্টালিকা তবে চারিদিকে সবুজ সমারোহে পরিপূর্ণ। পুপলুর মনে হল হয়ত পুরনো কলকাতা তার কাছে ফিরে এসেছে যেখানকার গাড়িগুলো একেবারে অন্যরকম একেবারে পুরনো দিনের মতো। এখানে ভারতীয়দের সাথে সাহেব-মেমরা নিজেদের মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশগুলো যেন অন্যরকম। পুলিশের মধ্যে যারা ভারতীয় তাদের পাগড়ী পরা আছে আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল এরা ভারতীয় হয়েও বিদেশী সরকারের দাসত্বের দরুন ঐরা দেশীয় বিপ্লবীদের উপরেই অত্যাচার চালায়। তার এখন ‛দ্যে লেজেন্ড অব ভগৎ সিং’, ‛শহীদঃ ২৩শে মার্চ, ১৯৩১’, ‛ আবার আসিব ফিরে’, ‛গান্ধী মাই ফাদার’, ‛চিটাগং’, ‛বোস-দ্য১ ফরগটেন হিরো’ ইত্যােদি সিনেমার কথা মনে পড়ল। কিন্তু এটা সিনেমা নয় বরং বাস্তব। অতীত এখন তার কাছে বর্তমান। এখানকার লোকেরা জিন্সের প্যান্ট সহ আধুনিক জামা কাপড় পড়তে জানে না। তারা পুড়ে গেছে স্বদেশী যুগের জামা,ধুতি-পাঞ্জাবি ও শাড়ি। এখনকার মহিলারা অনেক উন্নত তারাও ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে পোশাকে যেমন আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে তেমনি কর্মক্ষেত্রেও তাদের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু এখানকার মেয়েরা কেমন যেন লাজুক কোনো একটা সংস্কার তাদের উপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানকার বেশিরভাগ লোকেরা পুরনো দিনের স্বদেশী পোশাক পরিধান করেছে। তবে ব্যতিক্রমী হিসেবে দেখা গেল শিক্ষিত ও অভিজাত বংশের অফিস বাবুদের। তারা গায়ে কোট-প্যা ন্ট পড়ে ও মাথায় টুপি পড়ে যেন সাহেব সেজে চলেছেন। পুপলুর একটা জিনিস মনে হল যেটা তোমাদেরও মনে হয়ত হত আর তা হল এই অতীতের লোকেরা বেশ মন খোলা রেখে রাস্তায় পরিচিত লোকেদের সাথে কথা বলছে, কুশল বিনিময় করছে ইত্যাদি তবে তারা মোবাইল নামক যন্ত্রটায় মাথা নত করে দেয় নি। আসলে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল তো দূর অস্ত টেলিফোনেরই দেখা মেলা ভার। টি.ভি.-ই তো কোন দূর অস্ত। এইসব লোকেদের তথ্য পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে রয়েছে রেডিও, খবরের কাগজ ও বই। এখানে উল্লেখ্য এই যে, এই অতীতের কলকাতায় বেশ ফাঁকা ফাঁকা জায়গা আছে। আর প্রচুর গাছপালা,মাঠ, পুকুর রয়েছে। বেশিরভাগ বাড়িগুলি বিশাল এবং সবই একান্নবর্তী পরিবারে ঠাঁসা। এখানকার জেলগুলো যেখানে শ্রদ্ধেয় বিপ্লবীরা বন্দি রয়েছেন সেগুলোও নিশ্চয়ই পুরনো দিনের মতোন।
    যাইহোক, পুপলু কিছুদুর হেঁটে একটা মাঠ দেখতে পেল। সেখানে সবাই সাদা পাঞ্জাবি ও ধুতি পড়ে রয়েছে আর দূরে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন লাঠিধারী এক রোগা, ছোটখাটো এক টেকো মতো লোক। লোকটা কি যেন বলছে আর সবাই চেঁচিয়ে উঠছে। লোকটার পাশে রয়েছে চরকা। পুপলু ভাবল লোকটা সমবেত দর্শককে হয়ত ‛লাঠি দিয়ে মারার’ কথা বলছে। কিন্তু পরক্ষণেই পুপলুর ভুল ভাঙল। না, ইনি আর যাই বলুন অন্তত ‛লাঠি নিয়ে মারার’ কথা বলবেন না কারণ ইনি সত্য ও অহিংসার পূজারী স্বয়ং ‛মহাত্মা গান্ধী’- আমাদের সবার প্রিয় ‛বাপু’। তা গান্ধীজী বক্তৃতা শেষ করার পর যখন মানুষের মাঝখান দিয়ে আসছিলেন তখন পুপলু উত্তেজিত হয়ে সামনে ‛জাতির জনক’-এর কাছে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে বলল, “নমস্কার বাপু।” তা গান্ধীজী পুপলুর মাথায় হাত রেখে শান্তভাবে ও হাসিমুখে বললেন, “সত্য ও অহিংসা কা পাথমে চালো বেটা। সত্য ও প্যাায়ার হামকো আংরেজসে মুক্তি কারেঙ্গে। ” গান্ধীদর্শনের পর পুপলু হাঁটতে হাঁটতে এক বিশাল বাড়ি বা বলা যায় অট্টালিকার সামনে এলো। পুপলু বাড়িটি চিনতে পারার সাথে সাথেই উত্তেজিতভাবে নিজের মনেই বলে উঠল, “আরে! এ যে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ি!” তা সেখানে ঢুকে উঠোনে এক ধবধবধবে ফরসা, ইয়া-লম্বা ও প্রায় পেট পর্যন্ত সাদা দাঁড়িওয়ালা এক বয়স্ক ভদ্রলোক ইজি-চেয়ারে বসে আছেন। তাঁকে ঘিরে থাকা কয়েকজন ছোট-বড়ো সবার সাথেই তিনি গল্প করছেন। স্বয়ং কবিগুরুকে দেখে পুপলু মুগ্ধ হয়ে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করল। কবিগুরুও হাসিমুখে স্নেহার্শীবাদ করলেন তাঁকে। পুপলুকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “তোমার নাম কি? কোন ক্লাসে পড়?কোন স্কুলে? কোথা থেকে এসেছ?” ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলেন। বলাবাহুল্য, স্কুলের নাম শুনে কবিগুরু হয়ত ধরতে পারেননি। পুপলুর মনে হল “এই রে! ব্যাগটা আনতেই তো ভুলে গেছি। নয়ত সেখান থেকে পাঠ্যবই ‛কথা ও কাহিনী’ বের করে অটোগ্রাফ নেওয়া যেত। স্বয়ং কবিগুরুর অটোগ্রাফ বলে কথা! কিন্তু পরক্ষনেই পুপলুর মনে হল “আরে! আমার পকেটে তো কাগজ রয়েছে, সেটা দেব কি?” আর তা সঙ্কোচের সাথে রবি ঠাকুরের কাছে তা বাড়িয়ে দিল। রবি ঠাকুর কিন্তু হাসিমুখে তাতে সই করে দিলেন। কবিগুরুকে নমস্কার জানিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এলো পুপলু।
    এরপর বেশ কিছুদূর এগিয়ে পুপলু দেখল বেশ বড়ো বড়ো বাড়ি বোধহয় সরকারি কোয়ার্টার। তার সামনে বাগান, সেখানে ইংরেজ শিশুরা খেলা করছে ও তাদের বাবা-মায়েরা নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। মেন গেটের সামনে ইয়া বড়ো গোঁফওয়ালা দারোয়ান যার হাতে আবার বন্দুক। পুপলু তাকে দেখেই ভয় পেয়ে গেল। ওখানে বোধহয় আম- ভারতীয়দের প্রবেশের অনুমতি নেই। আসলে তখন অর্থাৎ পরাধীনতার যুগে অনেক হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্লাব ইত্যাদি জায়গায় কেবলমাত্র ইংরেজদের প্রবেশাধিকার ছিল, সাধারণ ভারতীয়দের সেখানে ঢোকার অনুমতি থাকত না। ওই গোরা শিশুগুলো পুপলুকে দেখে হাত নেড়ে ডাকল, “কাম, কাম হিয়ার।” কিন্তু পুপলু ভয় সেখানে আর থাকল না পাছে বন্দুকবাজ লোকটা গুলি করে বসে। সেখান থেকে অন্যান্য জায়গা দেখার জন্য হাঁটা লাগাল।
    রাস্তায় অনেকেই পুপলুকে দেখে হয়ত কৌতুহলবশত নানা কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় পুপলুর ঠিকানা,স্কুল ইত্যাদি শুনে কেউই কিছু বুঝতে পারছে না।
    যাইহোক, কেউই কিছু না বুঝলেও, পুপলু কিন্তু এটা ভালোভাবেই বুঝতে পেরে গেছে যে সে অতীতে অর্থাৎ আশি বছর আগের পরাধীন ভারতে পৌঁছে গেছে। তার হঠাৎ পুরনো দিনের জাদুঘর, চিড়িয়াখানা দেখার ইচ্ছে হল। “সেখানে যাব কি করে?”- এটা ভাবতেই পরক্ষণেই তার ড. মেঘনাথ সাহা,আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, যদুনাথ সরকার, ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ইদ্যাদি গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে দেখা করার ইচ্ছে হল। তাঁদের কোথায় পাওয়া যাবে? তার আরও অনেক কিছুই দেখার ইচ্ছে জাগল?আচ্ছা, ওই দূরের মাঠে এত ভিড় কেন? পুপলু সেখানে গিয়ে দেখে সাদা পাঞ্জাবি, ধুতি ও টুপি পড়া এক দেবতুল্য ব্যক্তি বক্তৃতা দিচ্ছেন। আরে! সেই ব্যক্তিটা তো আর কেউই নন স্বয়ং ‘নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু’। তিনি হয়ত দেশে্র স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য অভয় বাণী দিচ্ছেন। পুপলু তা শোনার জন্য সামনের দিকে এগোতে যাচ্ছে, এমন সময় পেছন থেকে “পুপলু,পুপলু” বলে কে বেশ যেন ডেকে উঠল। আর ঠিক তখনই কে বেশ যেন জোরে ঝাঁকুনি দিল যার ফলে আচমকাই তার ঘুম ভেঙে গেল। সে দেখল সামনে অনেক বন্ধু-বান্ধব আর তার পাশে আরতি ম্যাডাম জলের বোতল হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ও জল ছেটাচ্ছেন। পুপলু হঠাৎ বলে উঠল, “স্কুল থেকে পালিয়ে….”। তবে তার কথা শেষ হল না, স্কুলের ঘন্টা পড়ে গেল যে!
    ছোট্ট বন্ধুরা, নিশ্চয়ই এবার বুঝতে পেরেছ যে পুপলু স্বপ্ন দেখছিল।কিন্তু সেই স্বল্প সময়ের মধ্যেই সে গান্ধীজি, কবিগুরু, নেতাজীর সাক্ষাৎ লাভ করেছে বা বলাবাহুল্য, সে ইংরেজ আমলের কলকাতাই দেখে ফেলেছে, ভাবা যায়! কিন্তু হঠাৎ তার পকেটে হাত চলে গেল আর সেখানেই খুঁজে পেল একটা কাগজ যাতে রয়েছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অটোগ্রাফ। ব্যাপারটা ভারী রহস্যময়, তাই না?

  • গল্প

    গল্প- বাংরেজবাবু

    বাংরেজবাবু

    -ইন্দ্রনীল মজুমদার

    সে অনেকদিন আগের কথা, প্রায় একশ বছরের বা তারও বেশি হবে। আমরা তখন পরাধীন। গল্পটা এইরকমঃ-

    ইংরেজ আমলে এক সাহেবদের স্কুলে কেরানির কাজ করতেন নকল সেন। তিনি বাঙালি হয়েও তাঁর মন পড়ে থাকত সাহেবি আদব-কায়দার দিকে৷ তা একদিন তাঁর মাথায় এক চিন্তার উদয় ঘটল, তিনি ভাবলেন যে তিনি ইংরেজ হবেন। ইংরেজরা অনেক নিয়ম-কানুন মানেন, তাঁরা অনেক ভদ্র। হাজার হোক আমাদের দেশটাকে তো চালাচ্ছেন। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। নকলবাবু ভাবলেন প্রথমে ভাষাটা বদলাতে হবে কারণ তাঁর মাতৃভাষা অতি জঘন্য। তাঁর জাতভাইরা অভদ্র, বদমাইস৷ বাঙালিদের মধ্যে ভালো কিছু কি আছে? এরা ‘বাপ-ঠাকুরদা’ করে মরে, পায়ের উপর পা তুলে ‘পরনিন্দা-পরচর্চা’ করে- এটা কি কোনো জাত হল? এইসব ভাবনা-চিন্তা করতে করতে নকলবাবু সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁকে ইংরেজি আদব-কায়দা নকল করতে হবে। তা যাই হোক না কেন, একদিন এক মজার কাণ্ড ঘটল। সকালে প্রার্থনা করার সময় তিনি ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন-“stoodo up on the line”। তাঁর এই ইংরেজি শুনে ছেলেরা বেশ হাসাহাসি করল৷ হেডস্যার মিঃ এলিয়ট সাহেব চোখ রাঙিয়ে একবার তাকালেন নকলের দিকে। নকল ভাবলেন, এইতো ছেলেরা আমার ইংরেজি শুনে খুশি হল আর ইংরেজ সাহেব বুঝি আমার উপর হিংসা করল। অতএব পথ চলা শুরু হল, তিনি যেভাবেই হোক না কেন ইংরেজ হয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন। ধুতি-পাঞ্জাবির বদলে কোর্ট-প্যান্ট পরলেন, মাথার মাঝখানে টাক তাই আশেপাশের চুলগুলিকে এমন করে আঁচড়ালেন যেন সাহেব দেখতে লাগে। সাহেবদের মতোন হ্যাট পরতেন এবং মাঝে মধ্যেই ইংরেজি বলেন।
    অতএব তিনি এখন পুরোদস্তুর একজন ইংরেজ। বেঁটে ও মোটা চেহারায় ইংরেজ হিসেবে তাঁকে মানিয়েছে ভাল। আর হেঁটে স্কুলে যান না, যান ঘোড়ার গাড়ি করে। বাঙালিদের সাথে আর আড্ডা মারেন না তার বদলে তাঁর ইংরেজ বন্ধুদের সাথে মদ,উইস্কি খান এবং তাঁদের সাথে প্রতি শনিবার আনন্দ-ফুর্তি করেন। এত কিছু করে টাকা খরচা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তিনি পু্রো ইংরেজ হয়ে উঠছেন যে! নকলবাবুর আরও গুণ দেখা দিল যেমন তিনি দেষজ জিনিস গ্রহণ করতেন না। বিলিতি জিনিস তাঁর অতিপ্রিয়। দেশের বিপ্লবীদের ও তাঁদের কাজকর্মকে অপছন্দ করতেন। তাঁর মতে, “দেশ স্বাধীন হওয়া উচিৎ নয়। ইংরেজরা অনেক ভালো ও ইংরেজি ভাষা অনেক ভালো।” তখন প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, জগদীশ বোস গাছে প্রান খুঁজে পেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখালেখি করছেন, বাংলায় স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়েছে, দেশ ও দশের লোকে বাংলার গুণগান করছে। কিন্তু নকলবাবুর কাছে “এগুলো Rubbish-all are rubbish।” তাঁর মতে -ওখানকার লেখকরা যেমন Shakespeare, Dickens অনেক বড়ো লেখক এবং ইংরেজরা অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাঙালিদের থেকে অনেক এগিযে। ইংল্যান্ডবাসীর কাছে বাঙালি কিছুই নয়। তা তিনি ইংরেজদের তৈলমর্দন করতেন, নিজেও ইংরেজ হয়ে তো উঠতেনই। তাঁর আচরণে তাঁর মাইনে বেড়েছে কিন্তু সম্মান বাড়েনি। তাঁর মতে তিনি একজন ইংরেজ এবং তাঁর মতো ইংরেজি কেউ জানে না। তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে ছেলেরা গেলে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত “এই জানিস ওখানে একজন ইংরেজ থাকেন আগে বাঙালি ছিল এখন ইংরেজ হযেছেন।” পাড়ার বউরা যারা তখনকার রীতি অনুযায়ী কম লেখাপড়া জানত তারাও বলাবলি করত, “এই জানিস ওই ভদ্রলোকের বাংলাটা এখন আর ঠিক আসে না। উনি আগে বাংলা বলতেন কিন্তু এখন সাহেবদের মতোন ইংরেজিতেই কথা বলেন। কারুর সাথে আর মেশেন না।” -এই বলে তারা দুহাত তুলে নকল-সাহেবের বাড়ির উদ্দেশে প্রণাম ঠুকত এই ভেবে যে তিনি ইংরেজ হয়ে উঠেছেন। তবে এসবে নকলসাহেবের কোনও মাথাব্যাথা নেই কারণ তাঁর মতে ‘বিবর্তন’-এর নিয়মে তিনি এখন ইংরেজ আগে হয়ত বাঙালি ছিলেন। তাঁর ইংরেজি আসল-সাহেবদের লজ্জা পাইয়ে দেয়। তা কোথা থেকে তিনি দুটো শব্দ শিখলেন ‘government’ ও ‘aided’। তিনি নিজের নাম রাখলেন ‘gov-aid’ তবে তিনি উচ্চারণ করতেন ‘গবেট’ (আসলে ইংরেজিটা তিনি বেশিই জানতেন)। তা এই ভাবেই কাটতে লাগল,একদিন এক কাণ্ড ঘটে বসল৷ স্কুলে আসলেন মিসেস হ্যামিলটন বলে এক উচ্চপদস্থ মহিলা, তিনি মিঃ এলিয়ট এর সাথে দেখা করতে চান স্কুলের ব্যাপারে কিছু কথা বলতে। তাঁর সঙ্গে দেখা হল নকলবাবুর সাথে, মেম বললেন- “Hi babu,Can you please tell me where the office of Mr.Elliot is?”

    নকলবাবু নীচে দেখিয়ে বলেন বললেন, “You go to Hell.”(আসলে নকলবাবুর কাছে Hell-এর অন্য মানে আছে কারণ তিনি ইংরেজিটা ভালোই জানেন)
    -What? Who are you?
    -গবেট।
    -Yes, I see.
    – ট্যাংকে গু(আসলে Thank you)৷
    -I see, let me complain against you……..

    -শুয়োরলি(আসলে surely)।
    (ইংরেজিটা ভালো জানার জন্যে তিনি সেদিন অনেক ঝামেলা ভোগ করেছিলেন। তাঁর চাকরি চলে গিয়েছিল ভালো ইংরেজি বলার জন্যে(অত্যন্ত তাঁর মতে)। কিন্তু শুনেছিলাম যে তিনি হাল ছাড়েননি, তিনি ইংরেজ হয়েই ছিলেন। বলাবাহুল্য তিনি হয়েছিলেন একজন ‘বাংরেজ’-অধিক ইংরেজি জানা বাঙালি৷ আমরা যেন সৌভাগ্যক্রমে তাঁর মতো যেন না হয়ে উঠি সবসময় যেন মনে রাখি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যে অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন। ইংরেজি শেখা ভালো কিন্তু বাংলা আমাদের মাতৃভাষা সেটা ভালোভাবে শেথা আগে দরকার।
    “মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা৷”

    জীবনে উন্নতি করতে গেলে মাতৃভাষাকে ভালোবাসা খুবই দরকার।)

  • গল্প

    গল্প- ধূর্জটিবাবুর পাগলামি

    ধূর্জটিবাবুর পাগলামি
    – ইন্দ্রনীল মজুমদার

     

    (গত ৬ ও ৯ আগস্ট যথাক্রমে হিরোসিমা দিবস ও নাগাসাকি দিবস স্মরণ করে এই গল্পটি লেখা।)

    ৬ই আগস্ট। সকালে বৃষ্টির ধারা ধরণীকে বইয়ে দিল। বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেলাম। এমন সময় কলিং বেলের ঘন্টা। দরজা খুলতেই এক গাল হাসি নিয়ে তিনি হাজির। তিনি আর কেউ নন আমাদের সবার প্রিয় পাঞ্জাবি প্রতিবেশী সিংজী ওরফে রাম কিরণ সিং। ছাতাটা মেঝেতে মেলে রেখে সোফায় বসলেন। এরই মধ্যে চা ও সিঙারা হাজির। যাক ভালোই হল খেতে খেতে এই বাদলা দিনে বেশ জম্পেশ গল্প করা যাবে।

    সিংজী প্রথমে একটা প্রশ্ন করে বসলেন, “ আপনি ধূর্জটিবাবুর কাহিনী শুনেছেন?”

    আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম, “না। কে তিনি?”

    – সে অনেক বছর আগেকার কথা। দেশ স্বাধীনতার দু-বছর আগের অর্থাৎ ১৯৪৫ সালের ঘটনা। ধূর্জটিবাবু বলছি ঠিকই কিন্তু তাঁর পুরো নাম হল ড.ধূর্জটিপ্রসাদ পাকড়াশী। তা তিনি…….

    আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, “দাঁড়ান দাঁড়ান। উনি কি বিজ্ঞানী ছিলেন? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক কি?”

    সিংজী উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, “এক্স্যাক্টলি! একদম ঠিক ধরেছেন।”

    -এইবার মনে পড়েছে। পদার্থবিজ্ঞানী ধূর্জটিবাবু বোধ করি ‘Radioactivity’, ‘Einstein’s concept of the Universe’, ‘The future world’ ইত্যাদি নামকরা ইংরেজি বিজ্ঞান বইগুলির লেখক। আমি শেষ দুটো বই অনেকদিন আগে পড়েছিলাম। তাঁর বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলি জার্মানি,আমেরিকা,ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশগুলোর নামকরা জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। নানা দেশের নানা বৈজ্ঞানিক সভায় বক্তৃতা দিয়েছেন। ইংল্যান্ডের এক বৈজ্ঞানিক যাঁর নামটা ঠিক মনে পড়ছে না তিনি বলেছিলেন- “Mr.Dhurjati Prasad Pakrashi’s written papers are gold mines. They are like treasures to all of us.” কিন্তু হাজার 945 সালের পর তিনি কি একটা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পাগল হয়ে যান অধ্যাপনা ছেড়ে দেন কেন যে তিনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন তাও আমার অজানা।”

    সিংজী বললেন, “তিনি কেন পাগল হয়ে গিয়েছিলেন সেটা আমি জানতে পেরেছিলাম যখন এই কলকাতায় প্রথম আসি। তিনি পাগল যখন হয়েছিলেন তখন থেকেই এমনকি মৃত্যুশয্যাতেও খালি বলে যেতেন,- “Man is the killer of himself-মানুষ নিজেরাই নিজেদের ঘাতক।” মাঝে মাঝে তিনি চিৎকার করে বলতেন,- “Oh God, save these illeterate persons. These modern human aka Homo sapiens don’t understand the concept of Humanism. Humanism shall live.Humanism-where are you? Save us God,save us, save the world.”

    আসলে যে ঘটনাটি তার মনে দাগ ফেলে দিয়েছিল, যার জন্য তিনি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন, সেই ঘটনায় আসি। ১৯৪০ সালের ধূর্জটিবাবু দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকা, নানা বইপত্র ঘেঁটে, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নাল পড়ে এবং মারি ক্যুরি, পিয়ের ক্যুরি, রাদারফোর্ড, বেকরেল ইত্যাদি
    বিশ্ববিখ্যাতদের লেখা পড়ে বহুকষ্টে ‘Radioactivity’ নামক একটি বই লেখেন। এই বইটি সারা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত লাভ করে। এর ভাষা এতোটাই সাবলীল ছিল যে একজন উচ্চ শ্রেণির স্কুল ছাত্রও বুঝতে পারবে এই বইয়ের বিষয়বস্তু। আসলে ধূর্জটিবাবু অধ্যাপক হিসেবেও দুর্দান্ত ছিলেন। এখনকার অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাই হয়তো তারঁ মতোন নয়। তিনি পদার্থবিজ্ঞানের জটিল সমস্যাগুলি সুন্দর করে ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে মেলে ধরতেন আর তার সাথে জটিল গাণিতিক ব্যাপারগুলিও সহজভাবে বোঝাতেন। এবার আসল ঘটনায় প্রবেশ করা যাক। এক ঐতিহাসিক ঘটনা যা সবার জানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন বিশ্বজুড়ে চলছে, তখন ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৪১-এ আমেরিকার পার্ল হার্বারে জাপান আক্রমণ চালায় যাতে আহত হন বহু। কিন্তু এই ঘটনা ধূর্জটিবাবুর মনে দাগ কাটেনি। এই পার্ল হার্বারের বদলা আমেরিকা এমনভাবে নেয় তা বিজ্ঞানের মাধ্যমে হলেও চিরকালের জন্য বিজ্ঞানের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন শেষ হবার মুখে। পৃথিবী বিশ্বযুদ্ধের দাপাদাপিতে যখন হাঁফ ছেড়ে উঠেছে ঠিক তখনই ৬ই আগস্ট,১৯৪৫ সালে হিরোশিমার বুকে সকাল ৮ টা ১৫-এ পড়ে ‘লিটিল বয়’ নামক অ্যাটম বোম যা কেড়ে নেয় ৯০,০০০ থেকে ১,৬৬,০০০ জনের প্রাণ। বলা যায়, শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষের প্রাণ চলে যায়। এই মর্মান্তিক ঘটনা শুনে ধূর্জটিবাবু প্রায় অর্ধ-উন্মাদ হয়ে ওঠে। ধূর্জটিবাবুর পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে গেলেন মাত্র তিনদিনে যখন রেডিওতে শুনলেন যে ৯ই আগস্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ফ্যাট ম্যান’ নামক আরেকটা অ্যাটম বোমা জাপানের নাগাসাকিতে বেলা ১১ টা বেজে ২ মিনিটে নিক্ষেপ করে দিয়ে যা কেড়ে নেয় ৬০,০০০-৮০,০০০ মানুষের প্রাণ এবং শেষ করে দেয় শহরের অর্ধেক বাসিন্দাদের। জাপান এই ঘটনার ছ-দিনের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে আর সেইসঙ্গে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ধূর্জটিবাবু যখন শুনলেন যে ঘটনাটির দু- চার মাস পরে ওই দুটি অভিশপ্ত শহরে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এবং ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব মানুষের জীনে ঢুকে তার ক্ষতি করে চলেছে তখন বিজ্ঞানের এই অভিশাপ তাঁর মনে এমন এক গভীর চাপ ফেলে দায় যে তাঁকে আর মানসিক অসুস্থতার থেকে বা বদ্ধ পাগলের দশা থেকে সুস্থ করা আর কোনোদিনও যায়নি। বলাবাহুল্য, ওই তেজস্ক্রিয়তার ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেখানে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিয়েছে। তাঁর মতে বোধহয় তাঁর ‘Radioactivity’ বইটি এসবের মূল কারণ। সেই বই তিনি সাধ্যমতো বাজার থেকে তুলে নিলেও পরে তাঁর সেই বই বিক্রিও হয় তবে সেটি নিঃশেষিত হয়ে গেলে আর তা পুনঃপ্রকাশ করতে দেননি। অধ্যাপনা তো ছেড়েই দেন। বাড়িতেই থাকতেন আর মনে মনে কি সব বিড়বিড় করতেন। তবে ১৯৫৬ সালে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে সবসময় এমনকি ঘুমের ঘোরেও বলতেন, “Oh God,save this world,save people,save Humanism.” সত্যিই আজ পৃথিবীতে মানবিকতা কমে গেছে, মনুষ্যত্ব আজ অনেকটাই লোপ পেয়েছে।

    অনেকক্ষণ সিংজী বলার পর আমি বলে উঠলাম, “We want Humanism. We want such a person who will work for the betterment of the world not by killing people. He/she must save the world from all kinds of dangers.আমরা মানুষের মতো মানুষ চাই, পশুর মত মানুষ নয়, কৃত্রিম মানবিকতার মানুষ নয়। ডিগ্রিধারী রোবট নয় বরং কাজের মানুষ চাই। বিজ্ঞান হোক আশীর্বাদ, অভিশাপ নয়। বিজ্ঞান হোক বিজ্ঞানের অভিশাপের বিরুদ্ধে পরম অস্ত্র। প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্কট, পরিবেশ দূষণ কমুক। এই আমাদের রইলো আশা।”

    সিংজী হাসলেন।

  • প্রবন্ধ

    প্রবন্ধ- এ যেন এক নতুন ইতিহাস

    এ যেন এক নতুন ইতিহাস

    ইন্দ্রনীল মজুমদার 

     

    আমাদের দেশ প্রাচীন দেশগুলির মধ্যে অন্যতম।বহু ইতিহাস ঘিরে রয়েছে এই দেশ। ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখা যাবে চমক দেওয়া সব ঘটনাগুলির সাক্ষী আমাদের দেশও।

    আমাদের দেশে যেরকম সাহিত্যচর্চা,বিজ্ঞানচর্চা ও ইত্যাদি চর্চার সাথে যাদুচর্চাও কিন্তু আছে। সবকিছু জিনিসই কোনো না কোনো ঘটনা বা ভাবনা থেকে সৃষ্টি হয়েছে, অদ্ভুতভাবে কিছু সৃষ্টি হয়নি। পাশ্চাত্য পুলিশের সাথে আমাদের পার্থক্য অনেক।জ্ঞানী ব্যক্তিদের সংখ্যা আমাদের দেশে থাকলেও পাশ্চাত্য দেশে আছে অনেক।আমাদের দেশ কুসংস্কারের মতো ঘন অন্ধকার জিনিস থেকে এখনো মুক্তি পায়নি, তার ছাপ আজও অনেক গ্রামে-গঞ্জে এমনকি শহরেও লেগে রয়েছে।বলাবাহুল্য, আজও কিছু মানুষ কাউকে জেতানোর জন্য হোম-যজ্ঞ করে, বৃষ্টি না পড়লে দেবদেবীর পূজো আরম্ভ করে, রোগ থেকে নিরোগ হওয়ার বা পরীক্ষায় সাফল্য বা কোনো কর্মে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য নানান তন্ত্র-তুকতাক ইত্যাদি অপকর্ম আরম্ভ করে। এরজন্য মানুষ নানান অ-মানুষের পাল্লায় পড়েছে যা্রা কেউই নয় শ্রেফ ঠকবাজ বা ভণ্ড এবং তাদের উদ্দেশ্য সাধারণ,সরল মানুষকে ধর্মের নামে ঠকিয়ে পকেট ফাঁক করে মুখ লুকানো।এর কাছে ঠকে যাওয়া লোকেদের দেখেছি, এদের দেখলে মনে হয় এরা নিজেদের পরম ভুল বুঝতে পেরেছে এবং এদের করুণ মুখ ‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে’-এই বিখ্যাত প্রবাদটির অর্থ-র সত্য প্রতিফলিত করে।নানান বিজ্ঞান ও ধর্মীয় অজুহাত দিয়ে এই ভন্ডগুলো টাকা সংগ্রহ করছে, এরা সভ্যতার অগ্রগতির বাঁধা সৃষ্টি করে এবং সমাজে অন্যায় করা ব্যক্তি বা অপরাধী হিসেবে গণ্য হয়।যেসব রাজনীতিবিদ বা প্রভাবশালী ব্যক্তি এইসব ভণ্ডদের মদত দেয় তারাও সমান দোষে দুষ্ট সেটা খেয়াল রাখতে হবে।

    বিজ্ঞান বরাবরই কুসংস্কারের পরম শত্রু। যেখানে কুসংস্কার সেখানে বিজ্ঞানের আলো ফেললে দেখা যাবে সব যাকে বলে ‘Nonsense’। তাই বিজ্ঞান হয়ে উঠছে এত শক্তিশালী এবং সভ্যতার পরম বন্ধু।বিজ্ঞানের ইতিহাসের পাতা খুললেই দেখা যাবে কোন জিনিসের মূলে কোন ঘটনা আর তখনই বোঝা যাবে যে এই ভূত-প্রেত, জীববলি ইত্যাদি কুসংস্কারগুলি কিছুই নয় শ্রেফ গাঁজা। তো এবার, আমরা চলে আসি মূল বক্তব্যের দিকে। ‘জ্ঞান’ একটি মহা মূল্যবান জিনিস।কথায় আছে, ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করি’।আমাদের দেশে জ্ঞানী বা পণ্ডিত ব্যক্তিদের অলৌকিক শক্তির অধিকারী এবং তাঁদের জ্ঞানকে ‘অলৌকিক বস্তু’ বলে মনে করা হত। পাশ্চাত্য দেশ মধ্যযুগে ‘জ্ঞান’-কে বা জ্ঞানী ব্যক্তিকে ধর্মবিরোধী বলে গণ্য করা হত এবং চার্চের পোপ তাঁদের নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি দিতেন।গ্যালিলিও, ব্রুনো, কপারনিকাস ইত্যাদি বিজ্ঞানী ব্যক্তিদের যে কিভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তা ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বলভাবে লেখা আছে।৩৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্রো-ম্যাগনন মানুষ পাথর ঘষে আগুন সৃষ্টি করেছিল এবং এই কৌতূহল থেকেই সৃষ্টি হল বিজ্ঞান।আমাদের দেশের কথায় এবার ফিরে আসা যাক।আমাদের দেশে বহু প্রাচীন কাল থেকেই বিজ্ঞানচর্চা করা হত।বলাবাহুল্য, আমাদের দেশ প্রাচীন আয়ুর্বেদ,বেদ ও ইত্যাদি নানান শাস্ত্রের উৎসস্থল।আমাদের দেশে আগে অনেক ঋষি,মুণিদের স্থান ছিল।সেসব ঋষি,মুণিরা জঙ্গলে পাহাড়-পর্বতে ইত্যাদি স্থানে যোগ সাধনা করতেন।তাঁরা ছিলেন জ্ঞানী-গুনী মানুষ।তো, এঁরা নানান গাছ-গাছরার উপর পর্যবেক্ষণ করে সৃষ্টি করলেন এদের ভেষজ গুনাবলী যেসব গুন আজও আমাদের চমকে দেয়। তাঁরা নানান যোগ, মুদ্রা, প্রাণায়াম ইত্যাদি নিয়ে চর্চা করতে লাগলেন এবং তাঁদের চর্চিত জিনিস নানান শাস্ত্রে লিখে রাখতেন।এই বিভিন্ন গাছ-গাছরার, লতা-পাতার, শাকসবজি, মৎস্য ও তৈল-এগুলোর ভেষজগুন হল বর্তমান ঔষধ ঔষধি বা রোগ সারানোর প্রথম পর্ব।কবিরাজেরা এই ভেষজগুণ দিয়ে নানা ওষুধ তৈরি করতেন। আধুনিক ঔষধের মত ভেজাল বা স্টেরয়ড যুক্ত না হয়ে খাঁটি ওষুধ ছিল। শোনা কথা, আগেকার কবিরাজেরা নাড়ি টিপে বলে দিতে পারতেন কারা আয়ু কবে শেষ হয়ে যেতে পারে।এইগুলো এখন কোন বিস্মৃতির জলে তলিয়ে গেছে তার ঠিক নেই। আমাদের দেশে ইংরেজরা আসার পর তারা নানান শাস্ত্র নয় লুট করে চলে গেছে, নয় জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছে যার ফলে এই আয়ু মাপার পদ্ধতি আমাদের মন থেকে লোপ পেয়ে গেছে।

    আমাদের দেশে আগে বিজ্ঞানীরা বা বলাবাহুল্য দার্শনিকেরা কি করতেন? তাঁরা আকাশের মানচিত্র গঠন করেছিলেন।তাঁরা রাজসভায় সমাদর পেতেন।শোনা যায়, প্রাচীন কালে এই সব বিজ্ঞানীদের কিছু কুসংস্কারী মানুষ ‘তান্ত্রিক’ বলে আখ্যা করেছিলেন তাঁরা নানারকম জিনিস নিয়ে ভাবতেন এবং নানানরকম কাজ করতেন যা সাধারন কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের ভাবনার বাইরে।তাঁরা রাজসভায় রাজার কাছে থেকে কোনো মৃতদেহ নিয়ে জলে ডুবিয়ে রাখতেন।তার দু-তিনদিন পর যখন শবটি নরম হয়ে যায় তখন তাকে তুলে তার শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন-মানব দেহ কি দিয়ে তৈরি? দেহের মধ্যে কি কি আছে? কোনটার কি কাজ? ইত্যাদি। এটাই হচ্ছে হাল আমলের ‘Anatomy’-র প্রথম ধাপ। ভাবা যায়! অথচ শোনা কথা দেশ নাকি ‘Anatomy’ এসেছে ইংরেজদের হাত ধরে।

    আমাদের আগে এবং এখনও পাওয়া যায় অনেক মাদারী।এরা রাস্তাঘাটে এবং রাজসভায় নানা মায়াজালের খেল দেখাতেন। মানুষকে শূন্যে ভাসানো, একটা দড়িকে খাড়া করে দেওয়া ও তারউপর মানুষকে শোয়ানো,শূন্য থেকে জিনিস আনা-কোনো কিছুকে অদৃশ্য করে দেওয়া ইত্যাদি কত কি।অথচ বিদেশীরা এসব খেলা তাদের দেশের বলে যুগ যুগ ধরে প্রচার করে এসেছে।বিজ্ঞান নাকি তাদের,আমাদের দেশ কুসংস্কারী- মানতে বাধ্য নই। বহু যুগ আগে আর্যভট্ট নানান পরীক্ষা করে বলেছিলেন, ‘সূর্য স্থির এবং পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে’। তাই আমরা সূর্যকে পূর্ব দিকে উদিত হতে দেখি এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যেতে দেখি।‘শূন্য’-র ধারণা তাঁর থেকেই আসে।এই শূন্য ছাড়া গণিত এগোত না,কম্পিউটার আবিস্কার হত না, দুনিয়াটাই ফ্যাকাশে হয়ে যেত।ইউরোপীয়দের কয়েক হাজার বছর আগে, কণাদ মুনি বলেছিলেন কোনো বস্তুকে খন্ডিত করতে করতে এমন একটা জায়গায় আসবে যখন সেটাকে আর খন্ডন করা সম্ভব হবে না, সেই অবস্থাটির নাম দিয়েছিলেন ‘পরমাণু’।নাগার্জুনকে ‘আপেক্ষিক তত্ত্ব’-র আদিপিতা বলা যায় কারন তিনি আপেক্ষিকতার ধারণাটি বলেছিলেন। শ্রীধর আচার্য,লীলাবতী,ব্রহ্মগুপ্ত ইত্যাদি সবাই প্রাচীনকালের নামকরা গণিতজ্ঞ ছিলেন।স্থাপত্যে এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কুতুব মিনার, যেখানের লোহায় এতো হাজার বছরেও মরচে ধরেনি।জন্তর মন্তর জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।এগুলি সারা বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানীদের কৌতুহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শোনা যায়, পিথাগোরাসও নাকি ভারতে এসেছিলেন-কে জানি সত্যি না মিথ্যা।সে যাই হোক, বিজ্ঞানের জগতে, আমাদের অবদান ছিল,আছে এবং থাকবে।হাল আমলের ভারতীয় বিজ্ঞানের ইতিহাস সবাই জানেন,আমি শুধু প্রাচীনকালের ভারতীয় বিজ্ঞানের কথা অল্প কথায় শোনালাম।

    মেহেরগড় সভ্যতা থেকেই আমাদের সভ্যতার সেইসাথে বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু এবং আমরা বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, কুসংস্কার নই,বুঝেছেন।কুসংস্কার যব জাতির মধ্যেই কম-বেশি আছে বিজ্ঞানের আলো যতোই বেশী ছড়াবে ততোই কুসংস্কার উবে যাবে।

You cannot copy content of this page