-
গল্প-মর্নিং ওয়াক
মর্নিং ওয়াক
-সুনির্মল বসুভোরের কুয়াশায় ঢাকা নদী। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ওপারে সূর্যের প্রথম আলো। ওঁরা চারজন এপারে একসঙ্গে হাঁটছিলেন। ভোরের পাখি আকাশের প্রান্তরেখায় ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছিল। ঘাসের উপরে শিশির বিন্দু। পথের পাশে বনফুলের রং বাহার।
মর্নিং ওয়াক। ভোরের শীতল বাতাস ওদের নাকে মুখে চোখে এসে লাগছিল। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে এভাবেই ওঁরা প্রতিদিন মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে থাকেন। নদীর পাড়ে পার্কের দিকে বহু মানুষ মর্নিং ওয়াকে আসেন।
ওঁরা সবাই সারা জীবন সংসারের দায়-দায়িত্ব পালন করেছেন। ছেলে মেয়েদের মানুষ করেছেন। অবসর নেওয়ার পর নিজেদের মতো একটা অন্য জীবন কাটাচ্ছেন।
ভুবন মুখুজ্জে বলছিলেন, মানুষের মধ্যে যদি বড় হবার ইচ্ছে থাকে, তাহলে একদিন না একদিন সবকিছু হাতের মুঠোয় চলে আসে।
ত্রিদিব সিনহা বললেন, আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।
সন্তোষ দাশগুপ্ত ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ক্যান, কি হইছে?
অনল চৌধুরী বললেন, পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই, বুঝলেন ভায়া।
ত্রিদিব সিনহা বললেন, ইচ্ছাশক্তি শুধু থাকলেই হবে না, সেই সঙ্গে ভাগ্যের একটা হাত থাকা চাই।সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- খোসা ছাড়াইয়া কন।
অনল চৌধুরী দূরের কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে বললেন- চলুন, অনেকটা হেঁটেছি। গাছের ছায়ায় বসি।
ত্রিদিব সিনহা গল্প শুরু করলেন।
-ভাই, ভোরের আকাশ দেখে সারাদিনটা কেমন যাবে, আগে থেকে ভাবা যায় না। আপনাদের বাটা মোড়ের শ্রীকান্ত সরকারের কথা মনে আছে? ওর ছেলে সবুজ সরকার নঙ্গী স্কুলের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। বরাবর খানিকটা অস্থির প্রকৃতির। দু’ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসতো। বরাবর ফার্স্ট হত।
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- হ। পলাডার অনেক প্রশংসা শুনছি।
ভুবন মুখুজ্জে বললেন- সবুজ তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। সরকারি চাকরির পরীক্ষা হচ্ছিল। বয়স্ক চাকরিপ্রার্থীরা বাইরে বেরিয়ে এসে প্রশ্ন করছিলেন- ট্রাম কে আবিষ্কার করেন? বলুন না?সবুজ বাবার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। উত্তর দিল, মিঃ ট্রেন।
সবাই চমকে গিয়েছিল সেদিন।ত্রিদিব সিনহা বললেন, সেই ছেলেটি জীবনের কোন ক্ষেত্রে কোথাও আজ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা পায়নি। হারতে হারতে ওর পায়ের তলায় জমি নেই। তাই বলছিলাম, শুধু ইচ্ছা শক্তি বড় হলেই চলবে না, ভাগ্যের সহযোগিতা না থাকলে, জীবনে সাফল্যের সিঁড়ি খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
সন্তোষ দাশগুপ্ত অস্থির হয়ে পড়লেন। বললেন-হেইডা কেমন কইরা ঘটল, একটু ক্লিয়ার কইরা বলেন।
ভুবন মুখুজ্জে নিজের হাতের স্টিকের উপর মাথা রেখে বললেন- ভেরি স্যাড।
অনল চৌধুরী বললেন- ছেলেটার উপর সবার খারাপ নজর পড়ে গিয়েছিল মনে হয়।
ত্রিদিব সিনহা বললেন- মাধ্যমিক টেস্ট পরীক্ষায় সবুজ ফার্স্ট হয়েছিল। অথচ, ফাইনালে ও কোনো রকমে সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করে। গোটা স্কুল বাড়ি সেদিন ওর এই শোচনীয় পরিনাম দেখে হতাশ হয়েছিল, দুঃখ পেয়েছিল।
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- হেরপর কি হইল?
ভুবন মুখুজ্জে বললেন- অনেক পেছনে পড়ে থাকা ছেলে এইসব পরীক্ষায় ভালো ফল করে চমকে দেয়,
আবার যাদের উপর স্কুল বহু আশা করে বসে আছে, ফাইনালি তারা ওখানে গিয়ে ডোবায়।ত্রিদিব সিনহা বললেন- কলেজে গিয়ে সবুজ সরকার ইকোনমিক্সে অনার্স নেয়। ম্যাক্রো, বেনহাম নিয়ে পড়াশোনা করে। সাময়িক ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। এই সময় ওর জীবনে এষা চ্যাটার্জীর আগমন ঘটে। সেই থেকে ওর জীবনে পতন শুরু হয়।
জীবন মুখুজ্জে বলেন- একটা মেয়ে একজন পুরুষকে শূন্য থেকে উপরে ওঠাতে পারে, আবার তাকে ওপর থেকে নিচে নামিয়ে আনতে পারে।
সন্তোষ দাশগুপ্ত হেসে বললেন- আইজ কালকার পোলাপানদের পেরেম ভালোবাসার কথা আর বলবেন না, দেখছেন না, গান বানাইছে,তু তু তু তু তুতু তরা। য্যান কুত্তারে বিস্কুট দিতাসে।
অনল চৌধুরী বললেন- তাই নাকি!
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- সেদিন আমার মাইয়া শ্রাবন্তী আইছিল, আমারে একখান ফিল্ম দেখাইলো, কি নাম যেন, আমি তোমার কেডা।
জীবন মুখুজ্জে হেসে বললেন- বুঝেছি ‘হাম আপকে হ্যাঁয় কৌন’।
ত্রিদিব সিনহা কথা শুরু করলেন। বললেন- এষা মেয়েটি প্রেম-ভালোবাসার অভিনয় করে একটা সিএ ছেলেকে বিয়ে করে সল্ট লেকে ভেগে গেল।
অনল চৌধুরী বললেন, তারপর?
ত্রিদিব সিনহা বললেন- সবুজ সরকারের ক্যারিয়ার খতম। অনার্স পেল না। ভালো চাকরি পেল না। এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে পয়সা উপার্জন করছে। তাই বলছিলাম, ইচ্ছা শক্তি থাকলে, ভালো ছাত্র ছাত্রী হলেই চলবে না, ভাগ্য বলেও একটা ব্যাপার আছে। অথচ, জীবনের শুরুতে কত সম্ভাবনা জাগিয়ে ছিল ওই ছেলেটা!
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- এইসব ডেস্ট্রাক্টিভ মাইয়াগুলোর কথা আর বলবেন না।
অনল চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ত্রিদিব সিনহা বললেন- ভাগ্যিস, সব মেয়েরা এইরকম নন। ম্যান টু ম্যান, মানুষে মানুষে তফাৎ তো চিরকাল থাকেই।
অনল চৌধুরী বললেন- মেয়েরা সংসারের লক্ষ্মী। ওরা সংসারের সৌন্দর্য। ওরা না থাকলে, পৃথিবী অচল। ওদের মধ্যে ধারণী শক্তি রয়েছে।
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- আমাগো মা কাকিমা গো কথা একবার ভাইববা দ্যাখেন। আমাগো মানুষ করতে গিয়া ওঁনারা কি না করেছেন! আর এত বছর যে চাকরি বাকরি কইরা আসলাম, তাও তো অগো জন্যই।
জীবন মুখুজ্জে বললেন- সিনহাদা, আপনার কথা মানছি ভাই। সবকিছুর উপরে ভাগ্য একটা ব্যাপার।
ওরা উঠে পড়লেন।
সন্তোষ দাশগুপ্ত বললেন- রোদ্দুর উইঠা গেছে। গিন্নী চা রেডি কইরা বইসা আছে। দেরি করলে, ডালের হাতার বাড়ি মারবো আনে।
অনল চৌধুরী বললেন- দাদা, আপনি বৌদিকে ভয় পান?
সন্তোষ দাশগুপ্ত হেসে বললেন- বৌরে ভয় পায় না, কোন্ হালা?
-
দ্বিধা সীমন্তিনী
দ্বিধা সীমন্তিনী
-রীণা চ্যাটার্জীসব দ্বিধা শেষ। শুধু গল্পটা…
বিয়ের আগে অত তলিয়ে ভাবেনি- হয়তো প্রয়োজন বোধ করেনি। সবকিছু চোখের সামনে আশৈশব দেখে এলেও অভ্যস্ত চোখে নিজের জন্য আলাদা করে প্রশ্ন জাগেনি। হয়তো এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় একটা আদ্যপান্ত বাঙালি পরিবারে, পরিবেশে বড়ো হয়ে ওঠা মেয়ের জন্য এই অনুভূতি, তবুও এটাই সত্যি বিয়ের পরে তপতী প্রথম অনুভব করলো, বিবাহিত আর অবিবাহিত মেয়েদের দুই আলাদা সাজ পরিচয়ে, পরিধানে। নতুন করে বদলে যাওয়া সাজ-পোশাকে তপতীর কিন্তু খুব অস্বস্তি হতো বিয়ের পর- কেমন যেন লজ্জা করতো। ছোটোবেলা থেকে বাবা-কাকা- দাদা-মামা যাদের কোলে পিঠে বড়ো হয়েছে, কতো আব্দার, স্নেহ-খুনসুঁটির মাঝে বেড়ে উঠেছে। শ্বশুর বাড়িতে তাঁরা এলে বা শ্বশুর বাড়ির লোক তপতীর বাপের বাড়িতে এলে মাথায় আঁচল দিতে হতো- ঘোমটা টানা চলতি ভাষায়, খুব অস্বস্তি লাগতো, লজ্জা করতো, কেমন যেন পর পর মনে হতো, পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারতো না। যে পাড়ায় ছোটো থেকে ফ্রক পরে ঘুরেছে, বড়ো হয়েছে, স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করেছে, সেখানেই ঘোমটা টেনে ঢুকতে হবে সাথে ভাশুর বা খুড়শ্বশুর কেউ থাকলে। সঙ্কোচ-লজ্জা ঘিরে থাকতো ঘোমটার আড়ালে। অথচ মায়ের কড়া শিক্ষা বড়োদের সামনে ঘোমটা দিতেই হবে- না হলে না কি অপমান করা হয়। তাই আবার হয়! ঘোমটা দিলেই সম্মান করা হয়! আর ওই যে আপন-পর দ্বিধাবোধ! মন খুলে কথা বলতে না পারা, ওটাই না কি নববধূর ভূষণ- ধ্যেৎ, মনের আনন্দ তো গুলে কাদামাটি বিয়ের। তারপর সিঁদুর- বিয়ের সময় ঠিক ছিল- ফটো উঠলো বেশ কয়েকটা, ভালোই লাগলো। তবে চুলটা সেই যে লাল আর চটচটে হলো, মেজাজ বিগড়ে গেল। কিন্তু এখানেই শেষ নয়- রোজ না কি নিয়ম করে দুই বার সিঁদুর পরতে হবে, মনে থাকে না। যদিও বা মনে পড়ে, মনে হয় যেন কি এক পরাধীনতা- মাথায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কখনো মনে হতো, আছে তো লাল হয়ে সিঁথি, না হয় থাক, আসলে নিয়ম করে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর অভ্যাসটাই তো নেই ছোটোবেলা থেকে কোনোদিন। তারপর স্নান করে ভিজে চুলে সিঁদুর লাগালে জলের মতো গড়িয়ে আসতো নাক বরাবর। জোকার মনে হতো। গরমের দিন হলে তো কথাই নেই-সোনায় সোহাগা, গড়াচ্ছে ঘামের সাথে নাকে-মুখে-চোখে, জ্বালা করতো খুব। ঠিক ওখানেই হাজার কথা- এয়োস্ত্রী মানুষ… সংসারের কল্যাণ, লক্ষণ। মানিয়ে নিয়েছিল মন। আর হাতের এক গয়না, সব রঙের সাথেই সাদা- লাল! একটু তো অদ্ভুত লাগতোই। কেমন যেন “মা… মা” ধরণ। তেলে-হলুদে-শাখা-সিঁদুরে-ঘোমটায়-পরাধীনতায় অন্য এক জীবন। তার সাথে বার-ব্রত-উপোস লেগেই আছে, আর আছে এই করতে নেই, ওই করতে নেই, আমাদের বাড়ির এই নিয়ম। মাঝে মাঝে একপেট খিদের সাথে এক ঝুড়ি প্রশ্ন তোলপাড় করতো শরীর মন। প্রশ্ন থেকেই যত বিপত্তি, উত্তর খুঁজতে গিয়ে আরো বিপত্তি। সবকিছুই যেন চাপিয়ে দেওয়া এক প্রথা, পরাধীনতার প্রতীক, আর পুরুষতান্ত্রিকতার বৃথা আষ্ফালন। যদিও সারবত্তা বদলে গেছে কালের প্রবাহে, প্রতীকগুলো বেঁচে আছে লোকাচারে, যাদের ওপর চাপানো হয়েছিল তারাই তো পরম বিশ্বাসে, ভরসায় এগুলো নিয়ে বেঁচে আছে, পরাধীনতার রক্ষাকারী হয়ে যুগ যুগ ধরে। তবু বলা যাবে না এইসব কথা, অগত্যা ভরসা ডায়েরি। মনের অশান্ত প্রশ্নগুলো লিখে ক্ষতবিক্ষত হয়ে শান্ত হবার চেষ্টা করে তপতী। বলা বারণ, মনের আগলে খিল দিয়ে রাখতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল আলাদা করে- ওটাই ভদ্রতা।
বিয়ের পর পর বাবার বাড়ি (হঠাৎ করে বাড়ির নাম, সংজ্ঞাও বদলে যায়) এসেও রেহাই ছিল না, স্নান করে সাথে সাথে সিঁদুর না লাগালে কাকি-মা-বৌদি কেউ না কেউ ধ্যাবড়া করে খানিকটা লাগিয়ে দিত। সাথে সাথে প্রবচন- “এতোদিনে তো অভ্যাস হয়ে যায়, তোর কবে হবে?” হয়ে গেল, এইভাবে অভ্যাস হয়েই গেল, তৈরী হয়ে গেল সাজানো বিবাহিত মন- আর লজ্জা করতো না শাড়ির আঁচল মাথায় তুলতে, আর ভুল হতো না দু’ বেলা সিঁদুর লাগাতে, আর বেমানান লাগতো না শাঁখা-পলার সাদা, লালের সাথে যে কোনো রঙের শাড়ি। সাজসজ্জার ধারা- ধারণায় আমূল পরিবর্তন, মনের খচখচানি শীতঘুমে অচৈতন্য।
মেঘে মেঘে বেশ বেলা- তপতীও এখন এক কন্যা সন্তানের মা। মেয়ে তিয়াস বড়ো হয়েছে- স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ভার্সিটি পড়ুয়া। ছোটো থেকেই শান্ত, ধীর মেয়ে কিন্তু স্বাধীনচেতা। নিজস্ব মতামত, আর মতামতের পক্ষে যুক্তি নিয়ে আলোচনা করে তপতীর সাথে। তপতীর নিজের না বলতে পারা কথাগুলো ভাষা পায়, ভাবনাগুলো আকার পায়, প্রশ্নগুলো উত্তর খুঁজে নেয় চুপিচুপি। খুব ভালো লাগে তপতীর, বাধা দেয় না- নিজের প্রতিবিম্ব দেখে। শান্ত স্বভাবের মেয়েটা কিন্তু ভেতর ভেতর সমাজের অনেক রীতি নীতি নিয়ে বেশ প্রতিবাদী। ব্রাম্ভ্রণ্য প্রথা, সমাজের শ্রেণীভেদ, জাতিভেদ, ধর্মীয় ধ্বজা, দেশীয় লোকাচার সব কিছুতেই যুক্তি খোঁজে- পায় না। খুঁজতে থাকে শিকড়- শিকড়ে গিয়ে দেখে হাজার গড়মিল আর সুবিধাবাদ। প্রতিবাদের মেঘ ঘোর হয়ে আসে মনে, নবীন ভাবনায়। কিন্তু সবকিছু যে প্রতিবাদে মেটে না- তাই তো আরো অশান্ত হয় মন।
শরতের মেঘের মতো রোদ-বৃষ্টিতে পুড়তে থাকে, ভিজতে থাকে। অসহায় তপতী- বুঝতে পারে না, কি করবে! তার সম্পূর্ণ সমর্থন থাকলেও সাহায্য করার ক্ষমতা তো নেই!
একদিন তপতী স্নান সেরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভ্যাসবশত সিঁথিতে সিঁদুর ছোঁয়াতে যাবে তিয়াস এসে ঢোকে ঘরে।
মা’র দিকে তাকিয়ে আজ আর চুপ করে থাকতে পারে না- সিঁদুর কেন পড়ো মা রোজ? জানো না এর ইতিহাস, আর উদ্দেশ্য! তোমার ডায়েরিতে কত কিছু লিখেছো, কতো প্রশ্ন রেখেছো, উত্তর খুঁজতে চেয়েছো। তুমি তো নিজেও জানো মা, তা’ও কেন মেনে নাও এই পরাধীনতার নির্লজ্জতা, ঘৃণ্য প্রতীক। প্রয়োজন তো নেই কোনো। তুমি সিঁদুর, শাঁখা পরার সাথে সংসারের কল্যাণ- অকল্যাণ, বাবার ভালো থাকা নির্ভর করে না, তা’ও কেন রোজ এইসব নিজের ওপর চাপিয়ে নাও। নিজের সম্মান নিজে রক্ষা করতে না পারলে- তুমিও তো গতানুগতিক এক ধারায় চলবে, একই ভাবে চলতে থাকবে প্রত্যেকটা প্রজন্ম- কেন মা, কেন?
তপতী হেসে বলে- অভ্যাস হয়ে গেছে রে সোনাই। “সোনাই” তপতী এই নামে ডাকে,তিয়াসকে।
-কিসের অভ্যাস মা?
-মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস, মেনে নেওয়ার অভ্যাস।
-যে অভ্যাস তোমাকে রোজ প্রশ্নের মুখে নিয়ে আসতো, সেই অভ্যাস আরো কতদিন মা?
-এতোদিনের অভ্যাস কি পিছু ছাড়ে সোনাই এতো সহজে?
-কিছু বলার নেই… কি করে যে সব জেনেও এইভাবে নিজেকে ছোটো করতে পারো কে জানে!
-এখন এই বোধ আর কাজ করে না রে, একটা অভ্যাস শুধু। ছাড় এইসব, অন্য কিছু বল… কি করবি আজ? কখন বেরোবি?
-সবসময় কথা ঘোরানোর চেষ্টা… একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করতে করতে তিয়াস ঘর ছাড়ে। তপতী আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখে, হাসে… অতীত অন্য কিছু দাবি রাখলো, ভবিষ্যত অন্য কিছু দাবি করছে। বর্তমান! বুঝতে পারে না…সংসারের অন্য কাজে মন দেয়।
তবে একটা শৃঙ্খল থেকে মনকে আংশিক মুক্ত করতে অজুহাত সাজিয়েছে। শাঁখার ভীষণ দাম, কাজের হাত, যখন তখন বেড়ে (ভেঙে গেছে বলা না কি বারণ- বলতে নেই) যায়। ওটা তোলা সাজ করে রেখেছে, ইচ্ছে মতো, দরকার মতো গলিয়ে নেয়।
দামের কথায় সব মানিয়ে যায় সংসারে, সে যদি হয় ঘরের বৌয়ের প্রয়োজনের তালিকা তো দ্বিতীয় বার আর কেউ ভাবে না। সেই সুযোগটাই নিয়েছে তপতী। অবশ্য ওর স্বামীর এইসব ব্যাপারে কোনো মতামত নেই, বক্তব্য নেই- নির্লিপ্ত মানুষ। যদিও তাতেও অসুবিধা হাজার- যত ঝামেলা তপতীকেই সামলাতে হয়। তিনি শুনবেন না, বুঝবেন না কিন্তু “মানিয়ে নিতে” বলতে ছাড়বেন না- ওতেই না কি সব সমস্যার সমাধান। হায় রে কপাল!
দিন যেমন চলে- চলছিল। কখনো এর মন রেখে, কখনো ওর মন রেখে। নিজের মন? সে তো ঘুমিয়েছে না হারিয়েছে- সময় কোথায় ভাবার? কালের চাকায় সময় ঘুরে যায়, ঘুরতে থাকে।
কালের নিয়ম মেনে হঠাৎ করেই তপতীর বাবা একদিন চলে গেলেন এপারের মায়া কাটিয়ে। মা’কে দেখলো তপতী শেষবারের মতো- মায়ের প্রিয় সাজে। দু’বেলা পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে কাচা কাপড়, সিঁথিতে সিঁদুর, কপালে ছোট্ট সিঁদুর টিপ। নিত্যদিনের সাজ হোক বা পুজো থেকে বিয়ে বাড়ি, যে কোনো অনুষ্ঠানে মা-র ওই এক সাজ- অন্য কোনো সাজে কোনোদিন দেখেনি মা’কে। ওটাই যেন মা’র প্রতীক।
বদলে গেল এতোদিনের সাজ এক নিমিষে। চিরদিনের চুপচাপ, কম কথা বলা মানুষটা শোকটাও কেমন নিঃশব্দে পালন করলো। কপালে টিপ নেই- মায়ের এমন মুখ খুব কষ্ট দিচ্ছিল তপতীর মনে।
মুখাগ্নি, অশৌচ, শ্রাদ্ধ সব মিটলো একে একে। এ কয়দিন তপতীও সিঁদুর পরেনি- পরতে নেই না কি…এমন কথাই সবাই বলেছে- তাই পালন করেছে। নিয়মভঙ্গের দিন ব্রাম্ভ্রণের পায়ে তেল-হলুদ দিয়ে স্নান সেরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে চিরুনি নিয়ে শুনলো কাকিমা বলছে মা’কে- এবার কদিন চলুন আমাদের কাছে থেকে আসবেন। কোনোদিন তো কোথাও গেলেন না দাদার কষ্ট হবে বলে। এবার একটু ঘুরে আসবেন চলুন। ভালো লাগবে, একটু পরিবর্তন হবে।
মা বললো- আমাকে আর বেরোতে বলিস না রে, এইভাবে কারোর সামনে যেতে পারবো না। আসল সাজটাই লোকটা সাথে নিয়ে চলে গেল- খালি কপাল, খালি সিঁথি নিয়ে কোথায় যাব বল? আমি এখানেই থাকবো… বাকি কটা দিন, যে কদিন বাঁচি, বাইরে বেরোবো না।
অশৌচের পারলৌকিক আচার-বিচারে বেশ কদিন সিঁদুর না পরায় তপতীর সিঁথিও ফাঁকা। হাতে চিরুনি নিয়ে চুলে বিলি কাটতে কাটতে ভাবতে লাগলো- সাজ না পরাধীনতা, তর্ক না বিশ্বাস, ভালোলাগা না মানিয়ে নেওয়া… কোনটা আসল পথ?
মায়ের কাছে যে সাজটা পরম সম্পদ, তা নিয়ে কি তর্ক চলে! মানবিকতা তো এইসময় সেই সায় দেয় না। কিন্তু তিয়াস! ওর যুক্তি তো ফেলে দেবার নয়- ও তো আত্মসম্মানের কথা বলে…
হাজার প্রশ্ন আর দ্বিধা নিয়ে তাড়াতাড়ি সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে সরে এলো আয়নার সামনে থেকে।
পরাধীনতা না কি এয়োস্ত্রীর সাজ একরাশ দ্বিধা নিয়ে সংসারের কাজে, কর্তব্য সারতে সমাজের ভিড়ে মিশে গেল সাজানো হাসি মুখে নিয়ে দ্বিধা সীমন্তিনী।পেরিয়ে গেল বছর দুই, আড়াই- মা চলে গেলেন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। বাবার মৃত্যুর পর থেকে শেষ দিন পর্যন্ত মা সত্যিই বাড়ির বাইরে পা রাখেন নি। শান্ত মানুষের জেদ বোধ হয় এমন নীরব আর কঠিন হয়। তপতী আবার একবার প্রিয়জন হারালো, সংসার ছোট হয়ে আসছে যেন দিনে দিনে। মনের গভীরে ডুব দিয়ে দিন কাটে- শত কাজের মধ্যেও মনে হয় মা’র সাথে কথা হলো না আজ,এমনই হয় মনে হয় সবার মা,বাবা-র ছায়া জীবন থেকে সরে গেলে।
চলছিল জীবন বাঁধা গতে- হঠাৎ করেই ছন্দপতন। অফিস থেকে ফেরার পথে কথা বলেও বাড়ি এলো না। দমকা ঝড়ে নিভে গেল প্রাণপ্রদীপ- তপতী সেদিন হারিয়ে গেছিল নিজের পূর্বজীবনে যেখান থেকে একসাথে পথচলা শুরু সেইদিনে। বিশ্বাস তো দূর কথা ভাবতেও পারছিল না মানুষটা নেই। শুধু পাথরের মতো দাহকার্য, অশৌচ বিধি পালন করে গেল। অশৌচবিধি শেষে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি দিয়ে অভ্যাসমতো সিঁথির দিকে তাকিয়ে সিঁদুরে হাত দিতে গিয়ে থমকে গেল। আয়নায় নিজের মুখটা দেখতে অচেনা লাগছিল। নিজের মুখ নিজেই সহ্য করতে পারছিল না। আয়নার সঙ্গে খুব একটা সদ্ভাব কোনোদিনই তপতীর নেই। তবে যেতে আসতে চোখ পড়ে গেলে মনে হতো নেই, আর কোনো সাজ নেই। জীবনটা বদলে গেল। ডায়েরি হাতে নিল এক বছর পর। পুরোনো লেখাগুলো পড়তে পড়তে মনে উজাড় করে প্রশ্নের ভিড়… না কোনো তর্ক নেই, শুধু একটাই প্রশ্ন এইভাবে কি সত্যিই হারিয়ে যায় অভ্যাস! বদলে যায় বিশ্বাস? সব দ্বিধা কি এমনভাবেই কাঁদতে বাধ্য করে? জানা নেই- তপতীর কাছে অনেক প্রশ্ন, উত্তর দেওয়ার কেউ নেই।
-
গল্প- অ্যাই পালা, ভগবান আসছে
অ্যাই পালা, ভগবান আসছে
সুনির্মল বসুলোকটাকে সব বাচ্চারাই ভারী ভয় পেত। গায়ে নীল রঙের হাফ হাতা একটা বাঙালি শার্ট। পরনে ধুতি। বাঁ হাতে একটা ছোট বাক্স। ডান হাতে সর্বক্ষণ একটা ধূমায়মান সিগারেট। অদ্ভুত তাঁর সিগারেট টানার ভঙ্গি। ছোটখাটো চেহারা। মাথায় খাড়া খাড়া চুল। একটু মোটা গোঁফ। মাথার চুল কাঁচা পাকা হলেও, গোঁফটা একেবারে কুচকুচে কালো।
পথের মোড়ে তাঁকে দেখা গেলেই, সবাই বলতো, অ্যাই পালা, ভগবান আসছে।
সে আসলে পেশায় নাপিত নাম- নরসুন্দর ভগবান দাস। পাড়ার লক্করবাজ চ্যাংড়ারা বলতো, ভগবান দাসের ইটালিয়ান সেলুন। ইটের উপর বাচ্চাদের বসিয়ে ভগবান চুল ছেঁটে দিত। মাথার সামনের দিকে ফুলের মতো
সামান্য বড় চুল রেখে, বাকি পেছনের অংশে সবটাই সে জল দিয়ে হাতের যন্ত্রপাতির সাহায্যে সবটাই চেঁছে দিত।ভগবানের বাড়ি বালিয়াতে। ওখানে ওর বউ দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে থাকে। মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। মেয়ের নাম দুলারী। হবু জামাইয়ের খেতির কারবার আছে। বড় ছেলে জীবনলাল হাটে সবজি বিক্রি করে। ছোট ছেলে পবনলাল সিক্স ক্লাসে পড়ে। সপ্তাহে সপ্তাহে ভগবান পরিবারের জন্য বাড়িতে টাকা পাঠায়। সে বছরে দুবার বাড়িতে যায়। তখন সবার জন্য কলকাতা থেকে নতুন জামা কাপড় কিনে নিয়ে যায়। দিন পনেরো থেকে আবার এখানে কাজের জায়গায় ফিরে আসে।
যখন ছোট ছিলাম, ভগবান নির্বিচারে আমার চুল কেটে দিত। খুব মন খারাপ হতো আমার। চুল বড় থাকলে, মা বলতেন, তুই বড় চুল রাখছিস, দাঁড়া,তোর বাবাকে বলবো? বড় হবার পর,আমার নিজের বড় চুল রাখবার পেছনে আসল প্রতিবাদ ছিল সেখানেই। কিন্তু সেই ছোট্টবেলায় লোকটাকে খুব সমীহ করতাম।
দুষ্টুমি করলে, মায়েরা বলতেন, ভগবানকে ডাকবো নাকি? সঙ্গে সঙ্গে অনিচ্ছা সত্ত্বেও, বেশি বেশি ভাত খেতে হতো।মা হেসে বলতেন, এইতো সবটা খেলি। কার পেট ভরলো, আমার না তোর?
তখন একটু বড় হচ্ছি। ক্লাস এইটে পড়ি। ইটের উপর বসে আছি। পাশে বাবা দাঁড়িয়ে ভগবানকে বলছেন, কেটে ছোট করে দাও। কানের উপর চুল, সখি সখি ভাব, আমার মোটেই পছন্দ নয়। ভগবান মনে মনে খুশি হচ্ছে। চুল ছোট করায় তাঁর বড় আনন্দ। একটু বড় হতেই, চুল কাটতে কাটতে ভগবান আমাদের অনেক নীতি শিক্ষা দিত।একদিন আমাকে বলল, বাবু, জীবনে ঘোড়ার মতো হবে, কখনো গাধা হবে না।
-কেন?
-সোসাইটিতে গাধার কোন মান সম্মান নেই। হ্যাঁ, যদি ঘোড়া হতে পারো, তাহলে লোকের কাজ থেকে রেসপেক্ট পাবে।বাংলায় কথা বলবার সময়, ভগবানের ডায়লগে মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ বেরিয়ে আসতো। তার পেছনে অবশ্য কারণ আছে। বাটা ফ্যাক্টরির ম্যানেজার মিঃ বারতোস থেকে শুরু করে মিঃ ওয়াটসন, মিস্টার চিচেক ভ্যালেন্টা, মিঃ ভেরোল, মিঃ লেডেন, মিঃ জন বেক, মিঃ ভবতোষ সেন চৌধুরী, মিঃ ভি, লিপনার, সবাই চুল, দাড়ি কাটবার জন্য ভগবানের শরণাপন্ন হতেন। ভগবান তখন সাহেবদের বাড়ি উপস্থিত হয়ে তাঁদের চুল দাড়ি কামাতেন। সেই সুবাদে মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ ভগবানের মুখে উচ্চারিত হতো। মুড ভালো থাকলে, ভগবান তাঁর ছেলেদের গল্প শোনাতো। বড় ছেলে বেশি লিখাপড়া করেনি। ছোট ছেলেকে শেষ পর্যন্ত লিখাপড়া করাবার ইচ্ছে ভগবানের।
দিন বদলে গেল। সত্তর দশক এলো। যাদের এক সময় চুল কেটেছে ভগবান, তারা বড় হয়ে গেল।
কলেজে পড়তে গেল। কেউ কেউ মস্তান হিসেবে পরিচিত হলো।হেবো মাস্তানি করে পয়সা করলো। তাঁর কোমরে দেশি পিস্তল সব সময় গোঁজা থাকে। চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে রিভলবার নাচায়। সে এখন এই অঞ্চলের ত্রাস। একলা পুলিশ তাঁর মুখোমুখি হতে চায় না। ওসি সুবর্ণ সরকার একদিন জীপ থেকে নেমে বলেছিলেন- বড্ড তেল বেড়েছে দেখছি তোর। খুব জলদি তোকে তুলে নেব।
হেবো রিভলবার নাচিয়ে বলেছে- আগের ওসিও ওই এক ডায়লগ দিয়েছিল। আমার সামনে কোনদিন খাপ খুলতে পারে নি।
একদিন হেবোর সঙ্গে মুখোমুখি ভগবানের দেখা।ভগবানের ঘাড়ে হাত রেখে হেবো বললো- কেমন আছো গুরু?
ভগবান ওর হাত সরিয়ে দিয়ে বললও-তোর বাপ আমাকে দাদা বলে ডাকে, ছোটবেলায় আমাকে দেখলে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলতিস, এখন আমাকে গুরু বলছিস? আচ্ছা, কলিকাল!দেশে অস্থিরতা শুরু হল। কোম্পানি ছোট হয়ে আসছে। কর্মীদের ছাটাই করে দেওয়া হচ্ছে। চুল দাড়ি কেটে নিজে খেয়ে বাড়িতে আর টাকা পাঠানো যায় না। খুব বিপদে পড়ে গেল ভগবান।
তারপর একদিন আমাদের মফস্বল শহর ছেড়ে নিজের দেশের বাড়িতে চলে গেল। আমরা কেউ ভগবানকে মনে রাখি নি। প্রথম প্রথম কয়েকদিন চায়ের ঠেকে ভগবানকে নিয়ে আলোচনা হতো। তারপর স্মৃতির পাতা থেকে ছোটবেলার সেই ভয় পাওয়া মানুষটাকে আমরা সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম।
বেশ কয়েক বছর পর আমি তখন ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বালিয়াতে ব্রিজ বানাবার কাজে গিয়েছি। অনেকদিন ধরে কনস্ট্রাকশন এর কাজ চলছিল। একদিন হঠাৎ দেখি, ভগবান রাস্তা ধরে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে। ওর পিঠটা কুঁজো হয়ে গেছে। পায়ে ছেঁড়া চটি। পরনে ময়লা পোশাক। মাথার সব চুল সাদা হয়ে গেছে। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
ভগবান আমাকে চিনতে পারেনি। আমি চিনতে পেরেছিলাম। সামনে গিয়ে বললাম- ভগবানদা, কেমন আছো তুমি?
-ভালো নেই। বউ মারা গেল। ছেলেরা বিয়ে করে বউ নিয়ে হাওয়া।
-আমাকে চিনতে পারছো?
-হা হা। তুমি ফোরম্যান দত্ত বাবুর ছেলে।
– তোমার সংসার কিভাবে চলে?
-হাত কাজ নাই। কাজ করবার সামর্থ্য নাই। বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি। ভগবানের কন্ঠে অসহায়তার সুর। আমার মনে পড়লো, সেই ছোট্টবেলায় আমরা সবাই এই মানুষটাকে দেখলে, ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে যেতাম।-তোমাকে কেউ দেখে না?
-মেয়ে দ্যাখে।
ছেলেরা?
-আরে না না। আমি ছেলেদের পড়ালিখার জন্য পয়সা খরচা করেছিলাম। মেয়ের জন্য কিছু করিনি। আমি চারটে পাঁচশো টাকার নোট ভগবানের হাতে গুঁজে দিলাম।ভগবান বললো- আমার কথা মনে আছে তাহলে! তুমি ঘোড়া হয়েছো, ভাগ্যিস গাধা হওনি! তারপর খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওর বাড়ির দিকে গলির প্রান্তে মিলিয়ে গেল। সেই শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একজন মানুষ আজ আমার সঙ্গে কেমন আশ্চর্যভাবে আমাকে দেখা দিয়ে গেলেন। সেদিনের ভগবানের আশ্চর্য দাপটের সঙ্গে আজকের মন ভেঙ্গে যাওয়া মানুষটার কিছু মাত্র মিল, আমি দেখতে পেলাম না।
মহুয়া গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমি জীবনের প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হলাম। সময়, কাকে যে কিভাবে জীবন যন্ত্রণার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, তা আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না।
ভগবান গলির মোড়ে মিলিয়ে যেতেই, আমি কেমন ঘোরের মধ্যে নিজের মনে বলে ফেললাম, ভালো থেকো, তুমি ভালো থেকো, ভগবানদা।তারপর মনে মনে আবার বললাম, তোমাকে ভালো থাকতেই হবে, তা না হলে, তোমরা চলে গেলে, আমার ছোটবেলার স্মৃতিগুলো সেই সঙ্গে চলে যাবে যে!
-
গল্প- একা’দশী তিথি
একা’দশী তিথি
-সুবিনয় হালদারচতুর্থ প্রহর শেষে ঊষালগ্নে উদ্ভাসিত হতে থাকে পৃথিবী।
নিশি সমাপন মুহূর্ত জানান দেয় পাখিদের সমবেত কিচিরমিচির ডাক আর আজানের আওয়াজ।
মা’ ষষ্ঠীর শঙ্খধ্বনিতে সকাল-সকাল তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে তৈরী হয়ে নেয় একা’দশী, আজ তার আর্য্য-ভূমিতে সংস্কৃতি যজ্ঞের পৌরোহিত্য করতে হবে।
সেখানে তার পরিচিত বহু মানুষজন আসবে, নমোনমো দুগ্গাদুগ্গা করে আত্মপ্রত্যয়ে বেড়িয়ে পরে একা’দশী।সেখানেই সেদিন প্রথম দেখা- তিথি ; পঞ্চমীদির সাথে ছোটবোন দ্বিতির হাত ধরে এসেছিল ওখানে।
দিদি’ই তাকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেয়-, বাক্য বিনিময় হয় সামান্য কিছু- ব্যাস এইটুকু।
তারপর ধীরেধীরে দামোদরে জোয়ার আসে! কোটালে ভেসে যায় সবকিছু কিন্তু তিথি সেটা বোঝেনি কখনোই!
তবুও আসে, জানান দেয় সে আছে !
তিথির মেজ বোন অষ্টমী খুব সুন্দরী। মনে সংগোপনে লালিতপালিত কামিনীকাঞ্চন শোভিত যা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষীত !
আসাযাওয়া গভীর হতে গভীরতর হতে থাকে। দিন যায়- বছর ঘুরে বছর আসে আর যায়- ; উত্তর থেকে দক্ষিণায়ন অতিবাহিত হয় কত কিন্তু উত্তর মেলেনি আজো !বসন্তের পরন্ত বৈকালে ঝরাপাতায় ফাগুন হাওয়ায় মর্মরধ্বনির সাথে কোকিলের ডাক শুনে নেচেছিল মন !
চেতনা পুরে প্রেরণা’ এসে জাগিয়েছিল সাদা খামে হলুদ ছোঁয়ার অনুভূতি !
তড়িঘড়ি ছুটে গিয়েছিলো- এক মায়াবী আলোর উৎস সন্ধানে ;
তার’ই জন্যে সে অপেক্ষা করছিলো- অনেকটা সময় ধরে, রাস্তার পাশে গাছের তলায় এক যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে।
পথচলতি কত মানুষ- কত ব্যস্ততা- বাস গাড়ির হর্ণ এর বিকট আওয়াজ- দুষিত আবহাওয়া- সব কিছু উপেক্ষা করে !
সমস্ত বাধা অতিক্রম করে হন্তদন্ত হয়ে ঘামে-নেয়ে একসা শরীরে একা’দশী তিথির সামনে দাঁড়ালো- ;
অন্যমনস্ক তিথি যেন রূপকথার দেশে মায়াবী পরী,
কী বলবে- ও যেন নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছিলো-না !সুন্দর পরিপাট্য বেশভূষায় বেশ লাগছে ।
একা’দশীকে এইভাবে বোকা স্ট্যাচুর মতো হাঁ-করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও উঠে দাঁড়িয়ে বললো- চলো- অনেক দেরি হয়ে গেছে ! বলে সটান রাস্তার ধার ধরে হাঁটতে থাকলো !
একা’দশী তখন ওর কাছে গিয়ে আলতো স্বরে বললো- তোমাকে-না আজ খুব সুন্দর লাগছে ।
ধ্যাৎ,মোটেই না- ; কী-যে বলো-না- আজকাল ; বলে- শরৎ মেঘের ওড়না উড়িয়ে একটু লাজুক হাসি হেসে এগিয়ে চললো-,
অগত্যা সে-ও ওর পিছু-পিছু হাঁটতে থাকলো !মোড়ের বাম দিক ঘুরে একটু এগিয়ে একটা অটোরিকশা রিজার্ভ করলো । ও কিছু জিগ্যেস করার আগেই সে বললো- ওঠো ;
একা’দশী আগে উঠে বসার পর সে তার একেবারে পাশে- গায়ে গা-ঠেকিয়ে গেটের দিকে বসলো ।অটোরিকশা চলতে থাকলো একা’দশীর নাজানা গন্তব্যে !
হাওয়ায় তিথির চুল গুলো ঠোঁট স্পর্শ করে উড়ে এসে পরছে একা’দশীর মুখে আর তিথির মেয়েলি গন্ধে তার নিশ্বাসে প্রশ্বাসে এক পারিজাতের নরম স্নিগ্ধতা ভরিয়ে দিচ্ছে !
তার শাড়ির আঁচলটা বারবার উড়ে এসে ওর মুখমণ্ডলটা ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে, ঘর্মাক্ত ক্লান্ত শরীরে কেউ যেন একটা কাশফুল দিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছে !তিথির ঘোরে আচ্ছন্ন একা’দশী শুধু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতেই থাকে ! হাল্কা লাজুক হাসি আর চোখেমুখে উজ্জ্বল আভার উপস্থিতি ভরে উঠেছে তিথি ।
কোন কথা বলছেনা দেখে সে জিগ্যেস করতে যাবে- ঠিক সেই সময় তিথি বলে উঠলো- এই দাঁড়াও- দাঁড়াও এখানে ।নেমে পড়লো দুজনে । ভাড়াটা বের করার আগেই তিথি চালকের পারিশ্রমিক মিটিয়ে দিয়ে একা’দশীর দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় বললো- চলো- সামনের ওইখানে আমরা যাবো !
দেখলো দূরে একটা বড় বিল্ডিং আর তার গেটের বাইরে ইংরেজিতে লেখা- The Asylum .
-
গল্প- আনন্দ পার্বণ
আনন্দ পার্বণ
-সুমিতা দাশগুপ্ত
ছেলেবেলা থেকেই শুনে এসেছি, বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ,পরিণত বয়সে এসে বুঝতে পারলাম, সদা পরিবর্তনশীল এই সময়ে , প্রবচনটিকে বোধহয় একটুখানি শুধরে নেওয়াই যায়।আজ বোধহয় বাঙালি নির্দ্বিধায় বলতেই পারে, উঁহু ,আর তেরো নয় , গোটাগুটি চোদ্দোটি পার্বণের গৌরবময় উপস্থিতি বাঙালির পার্বণ লিষ্টিতে। সেই সানন্দ সংযোজনটি হলো বই -পার্বণ, পৌষ পার্বণের পিছু পিছুই যার সগৌরব উপস্থিতি। আপামর বঙ্গসন্তানদের সে বড়ো প্রিয়, বড়ো আপন।
পিকনিক, হস্তশিল্পের প্রদর্শনী ইত্যাদি শীতের সাতকাহনের মাঝেই হৈ হৈ করে বইমেলার রব উঠে পড়ে।
লেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদ শিল্পী,প্রুফ রিডার, ছাপাখানা মায় বাঁধাই কর্মী, ভ্যান গাড়ি কারুরই আর দম ফেলার অবকাশ থাকে না। ওদিকে বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে হেথা হোথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বাঁশ, কাঠের তক্তা, ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে উঠতে থাকে ছোট বড়ো নানা আকারের স্টলে। কথ্যভাষায় স্টল বটে, আদতে সেগুলি বুঝি সুন্দর লাল নীল কাপড়ে মোড়া, অজস্র মণিমুক্তো ঠাসা মণিমঞ্জুষা। দেশী বিদেশী বিদগ্ধ পন্ডিতজনের মণীষায় উজ্জ্বল, নানা আকারের পুঁথিপত্তরের পাশাপাশি নব নবীন সমস্ত লেখকের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ভাস্বর কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের গৌরব এই বইমেলা। সমগ্র বিশ্বে খুব কম জায়গাতেই এমন মহাসমারোহে বই উৎসব পালিত হতে দেখা যায়।
ইতিহাসের পৃষ্ঠা একটু ওলটালেই দেখা যায় বইমেলা প্রথম শুরু হয় ফ্র্যাংকফার্টে।আজও সেটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বইমেলা বলে পরিগণিত ।আন্তর্জাতিক স্তরেও আকারে এবং চরিত্রে পৃথিবীর সমস্ত দেশকে টক্কর দেবার ক্ষমতা রাখে সেটি। সেই তুল্যমূল্য বিচারে না গিয়ে, বাঙালি যা পেয়েছে তাতেও সে অখুশি নয় মোটেই। শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত পাঠকের উপচে পড়া ভীড় তার সাক্ষ্য দেয়। ওই ক’টা দিনে সোনার কাঠির ছোঁয়ায় জীবনের যতো অভাব, দারিদ্র্য, হতাশা ,বুঝি ছায়ার মতো মিলিয়ে যায়। সম্বৎসর মনের মাঝে জমানো যতো বইয়ের নাম ছিলো, সেগুলিকে ছুঁয়ে, হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখার এই তো সুবর্ণ সুযোগ, সে পকেটে রেস্তর জোর থাকুক চাই নাই বা থাকুক। পুস্তকপ্রেমী এই সুযোগ কি ছাড়তে পারে! এবারে হয়তো কেনা হলো না, সামনের বার নিশ্চয়ই হবে, এই আশাই, আগামী দিনে পথ চলার পাথেয়। আসলে আমরা যখন বই সংগ্রহ করি তখন তো শুধু বই নয়, আমরা আনন্দও সংগ্রহ করি।
বিগত বেশ কয়েকটি বছর বইমেলা যাওয়া, হয়ে ওঠে নি, এই বছর আকস্মিকভাবে সেই সুযোগটি এসে গেল। ভিড়ের মাঝে নয়, কিঞ্চিৎ ফাঁকায় দুপুর দুপুর সেরে ফেলার সংকল্পে বেলাবেলি পৌঁছনো গেল। তখনই শুরু হয়ে গেছে নামকরা প্রকাশনার স্টলগুলোতে, আবালবৃদ্ধবনিতার লম্বা লাইন। কেনার পাশাপাশি ছুঁয়ে দেখার আগ্রহও কিছু কম নয়। শিশুদের ঝলমলে মুখ, তরুণ প্রজন্মের সদ্য প্রকাশিত বইসমূহ উল্টেপাল্টে দেখার পাশাপাশি, প্রাজ্ঞ ও বয়স্কজনের তালিকায় থাকা জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ সমন্বিত গুরুগম্ভীর পুস্তক সংগ্রহের আকাঙ্ক্ষা দেখতে দেখতে মনে হয়, বাঙালির যে দিন গেছে, তার সবটুকুই হারিয়ে যায় নি, কিছু তো আছেই,যার খবর আমরা রাখি না।
মনে রাখতে হবে এই মেলা কেবলমাত্র লেখকের নয়, বছরের পর বছর ধরে সে নবীন পাঠকও নির্মাণ করে এসেছে, আজও করে। বাবা, মা, অভিভাবকদের হাত ধরে আসা শিশু কিশোরের দল, উত্তেজনায় ভরপুর তাদের জ্বলজ্বলে মুখচ্ছবি, সেই সাক্ষ্য দেয়।
পূর্ব অভিজ্ঞতায় বিশ্বভারতীর ফাঁকা স্টল এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা ছিলো। । এই বছরে সেখানে উপচে পড়া ভীড়, চিত্তে শান্তির প্রলেপ দিলো। স্টলের নিভৃত কোণটিতে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, এরা শুধুই ঘর সাজানোর সামগ্রী সংগ্রাহকদের দলভুক্ত, না-কি হুজুগে মাতামাতি করা,”পাবলিক”!
অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত মধ্যবয়সিনী গৃহবধূ, অথবা যৌবনের প্রান্তসীমায় দন্ডায়মান, কিছু এলোমেলো পোশাকের যুবকের , হাতের লিস্টি মিলিয়ে বই সংগ্রহের ছবি ,আমায় আশ্বস্ত করলো, বুঝিয়ে দিলো আমার সে আশঙ্কা মিথ্যে করে এঁরা প্রকৃতই পাঠক শ্রেণীভুক্ত।
হেরে যাওয়াও যে কখনো সখনো এতো আনন্দদায়ক হতে পারে, তা কে কবে ভেবেছে!
এই যে নানা আলোচনায় শুনি বাঙালি আজকাল আর বই পড়ে না, সেকথা সর্বৈব সত্যি নয় তাহলে ! বাঙালির সব কিছুই হারিয়ে যায়নি একেবারে।
আমার নিজস্ব সংগ্রহের তালিকায় থাকা , এবং ভালোবাসার জনদের উপহার দেবার জন্য কিছু বই সংগ্রহ করে নিয়ে চটপট বেরিয়ে পড়ি।
সূর্য আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঢলে পড়বে। ভিড় বাড়ছে। ঠেলাঠেলি এই বয়সে আর পোষায় না।
দুপাশে স্টলের সারি, মধ্যিখানে সোজা রাস্তা। খানিকটা এগোতেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য নজরে পড়তেই, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ধুলোমাখামাখি রাস্তার ঠিক মাঝ মধ্যিখানে বসা বছর ছয়েকের একটি শিশু , অভিভাবকদের অন্যমনষ্কতার সুযোগে স্টল ছেড়ে বেরিয়ে এসে সদ্য সংগৃহীত ছড়ার বইখানি পথের মাঝে খুলে রেখে , তার উপরে উপুড় হয়ে রয়েছে। আশেপাশের ভীড়ের দিকে তার হুঁশ নেই।
স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রই।
অবধারিত রবীন্দ্রনাথের পংক্তিতে ছেয়ে যায় মন। —
“শুধায়ো না কবে কোন গান,
কাহারে করিয়াছিনু দান—
পথের ধুলার পরে
পড়ে আছে তারই তরে
যে তাহারে দিতে পারে মান।
তুমি কি শুনেছো মোর বাণী
হৃদয়ে নিয়েছ তারে টানি ?
জানি না তোমার নাম,
তোমারেই সঁপিলাম
আমার ধ্যানের ধনখানি। “ -
গল্প- কয়েকটি লাল কাঁকড়া এবং ঘর খোঁজা
কয়েকটি লাল কাঁকড়া এবং ঘর খোঁজা
-সুনির্মল বসুঝাউবন পেরিয়ে সামনে নীল সমুদ্র। রঞ্জনা বিয়ের পর এই প্রথম স্বামী অনিকেতের সঙ্গে এখানে বেড়াতে এসেছে।
সামনে ধূ ধূ বালিয়াড়ীর ওপর দিয়ে ওরা হাঁটছিল। এই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি।
অনিকেত রঞ্জনার হাত ধরেছিল। বিকেলের ঠান্ডা বাতাসে রঞ্জনার শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়ছিল।
অনিকেত কম কথা বলা মানুষ।
রঞ্জনা বলল, কি মশাই, একেবারেই চুপচাপ যে,
অনিকেত বলল, সমুদ্র দেখছি, বড়র সামনে এলে,
মুখে ভাষা আসে না।
রঞ্জনা বলল, সমুদ্র কত পুরাতন, কত নতুন,
আমাদের আগে কত মানুষ এখানে এসেছে, কত মানুষ ফিরে গিয়েছে, সমুদ্র একই রকম আছে।
অনিকেত বলল, আমরা একদিন এই পৃথিবীতে থাকবো না, সমুদ্র থাকবে।
রঞ্জনা তাকিয়ে দেখল, দূর সমুদ্রের ধারে কিছু
নুলিয়ারা একটি দাঁড়িয়ে থাকা নৌকোর পাশে ব্যস্ততার সঙ্গে নিজেদের কাজ করে চলেছে।
সমুদ্রের পাশে অস্থায়ী চায়ের দোকানে ওরা চা খেতে এলো।
তখন পেছন থেকে পরিচিত কন্ঠে একটা ডাক এলো, এই অনিকেত,
পেছন ঘুরে অনেকেত দেখল, রিমঝিমকে। সঙ্গে একজন সুদর্শন যুবক।
রিমঝিম পরিচয় করিয়ে দিল, আমার হাসবেন্ড
পার্থ, আর এ হোল, অনিকেত। আমার কলেজ লাইফের বন্ধু।
অনিকেত রঞ্জনার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল।
অনিকেতের মনে পড়ছিল, এই সেই রিমঝিম, যে একদিন ওকে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়েছিল। পরে অনিকেত জানতে পেরেছিল, বাবার মনোনীত বড়লোক পাত্র পেয়ে, তাকেই বিয়ে করেছে রিমঝিম।
ভালোবাসা আজকাল বড় সস্তা হয়ে গেছে। আর অনিকেত অংক করে ভালবাসতে শেখে নি।
সেদিন কত কথা ছিল ওদের।
কফি হাউসে, বসন্ত কেবিনে, গোলদীঘির পাড়ে প্রতিদিন দেখা হতো ওদের।
রিমঝিম বলেছিল, তোমাকে না পেলে, আমি মরে যাবো, অনিকেত।
কী মিথ্যে, কী মিথ্যে,
সেদিনের রিমঝিমের সঙ্গে আজকের এই সুখী রিমঝিমকে একটুও মেলানো যায় না।
রিমঝিম সত্যিই কি সুখী হয়েছে। নাকি, সুখে থাকার অভিনয় করছে। একটা মানুষের কত অসংখ্য মুখ থাকে।
আজকে ওই ভালোবাসাকে প্রবলভাবে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে, অনিকেতের।
রিমঝিম জিজ্ঞেস করল, কোথায় উঠেছো,
রঞ্জনা বলল, হোটেল তরঙ্গমালায়। আপনারা একদিন আসুন না।
পার্থ বলল, যাবো কাল সকালে,
অনিকেত চুপ করে ছিল। ও কিছুতেই রিমঝিমকে আর সহ্য করতে পারছিল না।
তখন আকাশে একটি দুটি তারা ফুটেছে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। পার্থ রিমঝিমকে বিদায় দিয়ে ওরা হোটেলে ফিরে এলো।
পরদিন রিমঝিম স্বামী পার্থকে সঙ্গে করে, অনিকেতের সঙ্গে দেখা করতে এলো।
রিমঝিম বলল, কবে বিয়ে করলে, জানাওনি তো,
অনিকেত বলল, চাকরি পাবার বছর তিনেক বাদে
বাবা মা বিয়েটা দিলেন।
ও, ভালো, তোমার বউ তো খুব সুন্দরী হয়েছে।
আমি একটা সুন্দর মন খুঁজেছিলাম,
পার্থ তখন টিভি চালিয়ে খেলা দেখছিল।
রঞ্জনা অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিল।
রিমঝিম বলল, আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলছো না কেন, অনিকেত। দেখছি, আমার উপর থেকে তোমার রাগ এখনো পড়েনি।
অনিকেত জবাব দিল না।
রিমঝিম বলল, কি, আমার কথার উত্তর দেবে না,
অনিকেত বলল, আমি সত্যিকার ভালোবেসে ছিলাম, আমি কাউকে ঠকাইনি। যে ভালোবাসা নিয়ে একদিন খেলেছিল, সে ঠকেছে।
রঞ্জনা ওদের মিষ্টি ও কফি পরিবেশন করলো।
বলল, ওর কাছে তোমার অনেক কথা শুনেছি, রিমঝিম।
এ কথার কোন উত্তর দিল না রিমঝিম। মনে মনে অনুভব করল, সত্যিকারের ভালোবাসা থাকলে,
একদিন সেই ভালোবাসার জন্য কাঁদতে হয়। সেদিনের জয়, আজ এত পরাজয়ের বার্তা এনে দেবে, রিমঝিম কোনো দিন সে কথা ভাবেনি।
মিষ্টি কফি খাবার পর, পার্থ একটা সিগারেট ধরিয়ে
শূন্যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী তৈরি করছিল।
একসময় ওরা বিদায় নিল। যাবার আগে, পার্থ অনিকেত আর রঞ্জনাকে ওদের লেকটাউনের বাড়িতে যাবার নেমন্তন্ন করেছিল।
গভীর রাতে, রঞ্জনা বলল, রিমঝিমের জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে,
অনিকেত বলল, একেবারে না। আমি তো তোমার কাছে কখনো কিছু গোপন করিনি।
রঞ্জনা বলল, ভালোবাসা আর ঘৃণা পাশাপাশি থাকে, দেখলে, রিমঝিম তোমাকে দেখাবার জন্য কেমন পার্থকে নিয়ে ঢলাঢলি করছিল।
অনিকেত বলল, যেখানে ভালোবাসা নেই, সেখানে ভালোবাসা দেখাবার জন্য এমন আদিখ্যেতা দেখাতে হয়।
রঞ্জনা বলল, ওদের বাড়ি লেক টাউনে একবার যাবে নাকি,
অনিকেত বলল, কক্ষনো না। রিমঝিম শুধু আমার বিশ্বাস ভাঙ্গেনি, আমার ভালোবাসাকে নিয়ে খেলা করেছে,
বিকেল বেলায় ওরা সমুদ্রের পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় মোহনার কাছে অনিকেত আর রঞ্জনা চলে এসেছিল।
বিশ্রামের জন্য ওরা একটা দেবদারু গাছের নিচে
দাঁড়ালো। রঞ্জনা দেখলো, ওদের পায়ের কাছে অনেক লাল কাঁকড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। লাল কাঁকড়া গুলো গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে, আবার গর্তে ফিরে যাচ্ছিল।
তা দেখে অনিকেত বলল, সবাই ঘর খোঁজে, ভালো ঘর, ভালোবাসার ঘর খোঁজে কজন,
রঞ্জনা বলল, যত বড়ই ঘর হোক, ভালোবাসা না থাকলে, সে আবার ঘর কিসের,
সমুদ্রের উতরোল ঢেউ এসে, ওদের দুজনের পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিল। -
গল্প- অলৌকিকতার আলো অন্ধকারে
অলৌকিকতার আলো অন্ধকারে
-সুনির্মল বসুতখন তাঁর ভয়ংকর ব্যস্ততার দিন।
সারাদিন স্কুল করবার পর, অনেক সময় খাবার সময় জোটে না, তাঁকে এ বাড়ি ও বাড়ি টিউশনি করে বেড়াতে হয়। যাতায়াতের জন্য সাইকেল একমাত্র ভরসা।
সেদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে একটা ব্যাচ পড়িয়ে সুদিন বাবু সবে দ্বিতীয় ব্যাচ পড়াতে শুরু করেছেন, গিন্নী জয়ার ফোন।
তুমি কোথায়?
স্টেশন রোডের কাছে, পড়াচ্ছি তো!
একবার একটু এখানে আসতে পারবে?
কোথায়?
জয়দেব দার দুর্গা বাড়িতে।
কেন?
এসোই না, তখন বলবো।
ছাত্রদের টেস্ট পেপার থেকে কাজ দিয়ে সুদিন বাবু
ওখানে উপস্থিত হলেন।
সন্ধ্যেবেলায় আরতি পর্ব চলছিল। প্রচুর ভক্তদের ভিড়।
জয়া বললো, এসো।
জয়দেবদা, সুদিন বাবুর হাতটা দেখতে চাইলেন।
অনেকক্ষণ দেখার পর বললেন, আজ কিছু বলবো না। আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই,আপনি পরে একদিন আসুন।
সুদিনবাবু ফিরে গিয়ে পুনরায় ছাত্র পড়াতে বসলেন।
কদিন বাদে সময় বের করে দুর্গা বাড়ি গেলেন।
জয়দেবদা বললেন, আপনার তো এখানে জন্মাবার কথা না!
মানে?
আপনি তো বিরাট বড় বাড়ির লোক মশাই।
কি বলছেন?
আপনার তো বিরাট বাড়ি। বিরাট প্রজামহল। সবাই আপনাকে খুব মান্যতা করে।
দাদা, আমি খুব সামান্য মানুষ। দেখছেন না, সারাদিন দুটো পয়সার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছি।
আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না?
কি করে হবে?
আমি আপনাকে একটা কাজ করতে বলবো। সেটা করতে পারবেন? তাহলে আপনি নিজেই বুঝে যাবেন।তিনি কানে কানে একটা প্রক্রিয়ার কথা বললেন। বললেন, কাউকে বলা যাবে না কিন্তু! আজ রাতেই করুন। আপনি নিজেই জানতে পারবেন।
সুদিন বাবু টিউশনি পড়াতে ঢুকলেন। ছাত্র পড়াতে গিয়ে ব্যাপারটা মাথার মধ্যে নেননি কখনো।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি যখন শুতে গেলেন, তখন জয়দেব দার গোপন প্রক্রিয়াটার কথা তার মনে পড়ল।পরীক্ষার ছলে তিনি সেটি করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। একটু বাদেই ঘুম এসে গেল। সারাদিন খাটাখাটুনির পর এমন ঘটনাই স্বাভাবিক।
ঘুমের মধ্যে খানিকটা সময় বাদে জিনিস দেখলেন, তিনি যেন ওপর থেকে নিচের দিকে চাইছেন। দেখলেন, প্রচুর সবুজ গাছপালা। একটা বড় রাজপ্রাসাদের মত সাদা বাড়ি। বড় বড় জানালার উপর লাল রঙের সেড দেওয়া। বাড়ির বিশাল বড় গেট। সুদিন বাবু দৃষ্টি নামিয়ে দিলেন। দেখলেন, বড় একটি আম গাছের নিচে এক ভদ্রলোক হলুদ ক্ষেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে জমিদারী স্টাইলের পাঞ্জাবী ও ধূতি। পায়ে সাদা রঙের চটি।
সুদিন বাবু ভদ্রলোকের দিকে ভালোভাবে চাইলেন।
ওনার পাঞ্জাবিটা ঘাড় থেকে সামান্য নেমে এসেছে।
পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে সুদিন বাবু বিভিন্ন সভায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভাষণ দিতে যান।
বক্তৃতা দেবার সময় বারবার জামার কলারে হাত দিয়ে তাকে উঁচুতে উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। স্বপ্নের মধ্যে তাঁর মনে হচ্ছিল, ওনার পাঞ্জাবিটা উনি একটু তুলে দিলেই পারতেন। ভদ্রলোক শ্যাম বর্ণ। সুদিন বাবুর সঙ্গে ভদ্রলোকের চেহারায় কিছু মাত্র মিল নেই। কিন্তু ওনার চোখের দিকে তাকাতেই, সুদিন বাবু একটু আশ্চর্য হয়ে গেলেন। হুবহু ওনার নিজের চোখ। চিন্তান্বিত অবস্থায় তাঁর চোখটা এমনই দেখায়। প্রথম দিন এই পর্যন্ত।পরদিন সুদিন বাবু দুর্গাবাড়িতে গেলেন। জয়দেবদাকে বললেন, আমি আমাকে গতকাল রাতে দেখেছি।
জয়দেব দা বড় মাপের সাধক। বললেন, মাঝে মাঝে আবারো করুন। নিজেই সব দেখতে পাবেন।
সুদিন বাবুর কৌতূহল বেড়ে গেল।দুদিন বাদে তিনি আবার ওই প্রক্রিয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নে দেখলেন, আগের দিনের সেই ভদ্রলোক একটা বিরাট জলাশয়ের কাছে এসেছেন।
তাঁর চারপাশে ফতুয়া আর ধূতি পরা কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে। ভদ্রলোক জলাশয়ের দিকে আঙ্গুল উঁচু করে ওনাদের কিছু একটা দেখিয়ে কিছু একটা নির্দেশ দিচ্ছেন।পরদিন সুদিন বাবু জয়দেব দার কাছে দ্বিতীয় দিনের স্বপ্নের কথা জানালেন।
তৃতীয় দিন রাতে ওই প্রক্রিয়াটি করবার পর, সুদিন বাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। স্বপ্নের ঘরের মধ্যে দেখলেন, টানা বারান্দা দিয়ে এক দীর্ঘকায় ভদ্রমহিলা হেঁটে চলেছেন।
পরদিন তিনি দুর্গা বাড়িতে গেলেন।
দাদা, কাকে দেখলাম?
আপনার আগের জন্মের স্ত্রী।কদিন বাদে সুদিন বাবু ওই প্রক্রিয়াটি করে শুতে গেলেন। খালি বাদে স্বপ্নের মধ্যে দেখলেন, মাটির চওড়া রাস্তা। পথের দুপাশে সবুজ গাছপালা। অনেক লোক বাসের মাচায় করে দুর্গা ঠাকুর নিয়ে যাচ্ছে।
জয়দেবদা, এমন স্বপ্ন দেখার মানে কি?
আপনার বাড়িতে পূজোর জন্য দুর্গা ঠাকুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আপনি মায়ের মুখটা দেখতে পেয়েছেন?
নাতো দাদা। দেখিনি। তবে অনেক মানুষ বাসের মাচাটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, দেখেছি।কদিন পর সুদিন বাবু আবার ওই প্রক্রিয়া করলেন। তারপর শুতে গেলেন।
ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলেন। আগের দিনের সেই ভদ্রমহিলা গোল ঘোরানো সিঁড়ির দোতলায় উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। ভদ্রলোক প্রধান দরোজা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। তাঁকে ঘরের ফিরতে দেখে, ভদ্রমহিলার চোখে মুখে একটা স্বস্তির ছাপ পড়লো যেন।এর কিছুদিন পর সুদিন বাবুর বাবা বার্ধক্য জনিত কারণে পরিণত বয়সে মারা গেলেন। শ্রাদ্ধ শান্তি মিটে গেল।
সুদিন বাবু এই অশৌচ কালের মধ্যে জয়দেব দার শেখানো প্রক্রিয়াটি করলেন। কিন্তু কোনই ফল পেলেন না। বারে বারে চেষ্টা করা সত্ত্বেও, কিছুতেই আর সেই ছবিগুলো আসছিল না।
তিনি দুর্গা বাড়িতে গেলেন।
দাদা, বারবার চেষ্টা করছি। আর তো আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
পাবেন না তো!
কেন?
আপনার এখন অশৌচ কাল।সুদিন বাবু নানান ব্যস্ততার কারণে পরবর্তীকালে আর কখনো ওই চেষ্টাটা করেননি।
কারণ, তাঁর মনে হয়েছিল, এইসব অলৌকিক ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাঁটি করা ঠিক নয়। বর্তমান সংসারের প্রতি মায়াটান কমে যায়।
জয়দেবদা বললেন, আগামী জন্মে আপনি ও বাড়িতেই জন্মাবেন। আগের জন্মে কালী মন্দিরটা অসম্পূর্ণ রেখে আপনি মারা গিয়েছিলেন। আগামী জন্মে ওখানে জন্মে আপনাকে সেই অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হবে।
-
গল্প- সিনেমার আড্ডাটা
সিনেমার আড্ডাটা
–অঞ্জনা গোড়িয়া (সাউ)“ঠিক ১২ টাই আমতলায় চৌরাস্তার মোড়ে।
মনে থাকবে যেন।মিস করিস না একদম।”
কথা মতো দাঁড়িয়ে থাকতাম আমতলার মোড়ে।
নামটা শুনলেই মন ছুটে যায় সেই দিন গুলোর স্মৃতি পাতায়।২-৫টা। ৫টা -৮ টা।এগুলো হয়তো কারোর মনে নেই।
হাউসফুল, ব্লাকে টিকিট কাটা। ফাস্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস,ব্যাল্কনি শব্দ গুলোর সাথে একালের ছেলেমেয়েরা খুব একটা পরিচিত নয়।আমাদের সময়ে সিনেমা হলে গিয়ে, সিনেমা দেখার স্মৃতি কথা ।
আমার এলাকার প্রতিটি সিনেমা হল আমার চেনা।
দিনে তিন টাইম সিনেমা হতো।এখনো বেশ কিছু দামী সিনেমা হল খোলা আছে ঠিকই কিন্তু মানুষের তেমন ঢ্ল দেখা যায় না। সিনেমা পাগল দর্শক যারা আছেন,তারা হয় মোবাইলে ডাউনলোর্ড করে নিচ্ছে নয় তো টিভিতে, নেটে বা অন্য কোনো ভাবে দেখে নিচ্ছে।
হলে বসে তিন ঘন্টা টানা সিনেমা দেখার সময় কারোর নেই।
আর কেউ খবরই রাখি না।
আশেপাশের অনেক হল বন্ধ হয়ে গেছে। হাতে গোনা যে কটি সিনেমা হল আছে তাও স্কুল কলেজ পালানো ছেলেমেয়েদের কাছে। অজানা অথবা গুরুত্বহীন। এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে একটা স্মার্টফোন থাকলেই সব স্বপ্ন পূর্ণ। ফোনে সারা বিশ্ব দর্শন। সিনেমা দেখা হয়ে যায়। সিনেমা হলে যেতে লাগে না খুব একটা।আমাদের সময়ে নতুন কোনো সিনেমা মুক্তি পেলেই কোন হলে সিনেমাটা আসছে? কত সপ্তাহ থাকবে একেবারে মুখস্থ রাখত রোহিত, সুব্রত ঝুমা, কাকলি আমরা সবাই। উঃ কি রোমাঞ্চকর ছিল সেই দিন গুলি।
যেদিন স্কুলে গিয়ে শুনি আজ ছাত্র ধর্মঘট । ব্যস ক্লাস বন্ধ। আন্দোলন করে ক্লাস বয়কট। কিন্তু কিসের জন্য কেন ধর্মঘট? ওসব জানার সময় ও নেই আর ইচ্ছে ও নেই। স্কুল বন্ধ মানেই সিনেমা দেখা। চারজনে মিলে দৌড় সিনেমা হলে। তখন পাঁচ দশ মিনিট বাকি। যার কাছে যা টাকা আছে টিফিন খাওয়ার কিংবা খাতা কলম কেনার। সব একত্রিত করে টিকিট কাটতে লাইন। রোহিত তো রীতিমতো ঝগড়া লাইনে দাঁড়িয়ে। কেন হাফ টিকিট দেওয়া হবে না? সব জায়গায় স্কুল ছাত্রের হাফ টিকিট বাসে অটোতে। আর সিনেমা দেখার বেলা ফুল। আসলে কিছু টাকা কম পড়ছিল। যদি একটু ম্যানেজ করা যায় আর কি।
ঝুমা ও কম নয়। হলের কাউন্টারে গিয়ে কাউন্টারের সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে যদি বাকি টাকাটা না দিতে হয়। কাউন্টার কাকুও বুঝল স্কুল পালানো ছেলে মেয়ে এদের চটিয়ে লাভ নেই। বরং একটু কমিয়ে দিই। হলের সিটগুলো তো ভর্তি হবে।
ঝুমা অবশ্য বলে আসত কাকুকে। আমার ভালো কাকু। সামনের দিন এলে সব মিটিয়ে দেব কেমন? তবে ব্যাল্কনিতে দিতে হবে সিট। হাজার হোক তোমার পাশের স্কুলের ছাত্র ছাত্রী আমরা। হলের বিপদ হলে আমরাই তো ছুটে আসব।
দিব্যি বাড়ি না গিয়ে নতুন জুটির প্রসেনজিৎ জুহির “অমর প্রেম” সিনেমাটা দেখা হয়ে গেল। স্কুল জীবনে সিনেমা দেখা ছিল দারুন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
শারুখ খান কাজলের নতুন সিনেমা রিলিজ হলেই আর রক্ষে নেই। কতক্ষণ দেখব সিনেমাটা। আশেপাশের হলে ব্যাগের ভেতরে অন্যএকটা বাড়ির জামা লুকিয়ে আনতাম। তারপর সবাই একসাথে কোথাও দেখা করে স্কুলড্রেস গুলো বদলে নিতাম। চললাম মহানন্দে হলের দিকে। টিকিট কেটে একেবারে ব্যাল্কনির সিট। একটু আরামদায়ক নিরিবিলি। কিছুক্ষণ পরেই বাদাম ওয়ালা ঠোকায় ঠোকায় বাদাম বিক্রি করছে। ঝাল নজেন্স,ভুট্টা ভাজার প্যাকেট কিনে মুখে পুরে দিলাম। একটা করে বাদাম মুখে দিয়ে হইহই করতে করতে সিনেমার পর্দার দিকে তাকিয়ে। রাহুল আর ঝুমার মধ্যে একটু খুনসুটি চলছিল,কারোর আর বুঝতে বাকি রইল না দুজনার অমরপ্রেমকাহিনীর কথা । সারা স্কুলের সেরা জুটি রাহুল ঝুমা।
রোহিত সবার চেয়ে একটু বেশি ই দুষ্টু। ওদের একসাথে সিট দিত ইচ্ছে করে ই। দুজনার প্রেমের সুযোগ করে দিত।
শেষ হওয়ার একটু আগেই বেরিয়ে আসতাম। দিনের আলোয় যাতে কেউ চিনতে না পারে। সবার চক্ষুর আড়ালে জনতার ভীড়ে নিজেরা লুকিয়ে ফেলতাম নিজেদের।
সিনেমার আড্ডাটা আর নেই। হারিয়ে গেছে দিনগুলি। তবু বারে বারে মনে আসে সিনেমার আড্ডার স্মৃতি। মনে আসে ঝুমা রাহুলের প্রেম কাহিনি। বি এ পাশ করে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দেখা সাক্ষাৎ বন্ধুত্ব সব অতীতের আড্ডা টুকু কেমন ধোঁয়াসে হয়ে যায় কর্মের ব্যস্ততায়। দীর্ঘ দশ বছর পর রাহুলের সাথে দেখা। সেই হাসি খুশি ছেলেটা কেমন বুড়িয়ে গেছে। পাথরের মতো স্থির কঠিন হয়ে গেছে। ঝুমার কথা উঠতেই এড়িয়ে গেল অন্য প্রসঙ্গে।
শুনেছিলাম ওদের বিয়েটা হয় নি। রাহুল যে তখনো বেকার। এখনো বেকার বলা চলে। খবরের কাগজের দপ্তরের খবর সাপ্লাই দেয়। এমন ছেলের সাথে কে ই বা বিয়ে দেবে?
ঝুমার গ্যাজুয়েশান শেষ করেই বিয়ে হয়ে গেল বিখ্যাত ব্যারিস্টারের সাথে। ঝুমা পারে নি রাজি করাতে বাবাকে।
সিনেমা হলেই শেষ হয়ে গেল দুজনের অমর প্রেম।
দিন গুলো বড্ড পিছু টানে।
সেদিন হঠাৎ রোহিতের সাথে দেখা। আজও আগের মতোই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সেই চাহনি সেই উজ্জ্বল দুটো চোখের ভাষায় কোথাও কোনো ভুল নেই। তবু স্বহাস্যে বুঝিয়ে দিল দিব্যি আছে খোশমেজাজে।
যাবার সময় শুধু একবার প্রশ্ন করল, কিছুই কি মনে নেই?
আমিও একগাল হেসে বুঝিয়ে দিলাম, রবি ঠাকুরের কথায়,রাতের সব তারারাই আছে দিনের আলোর অন্ধকারে।
চলে গেল একমুখ তৃপ্তির হাসি হেসে।
সিনেমার আড্ডাটা আজ আর নেই।
আজ শুধুই স্মৃতির পাতায়। -
গল্প- নীলাঞ্জনা, শুধু তোমার জন্য
নীলাঞ্জনা, শুধু তোমার জন্য
-সুনির্মল বসুনীলাঞ্জনার সঙ্গে দেখা বিশ বছর বাদে। আসলে, দুর্গাপুর থার্মাল প্রজেক্টের একটা কাজ দেখতে এখানে আসা।
চীফ ইঞ্জিনিয়ার অনুতোষ চৌধুরীর
অনুরোধে তাঁর বাড়িতে আসতে হল নিরুপমকে। নীলাঞ্জনা যে অনুতোষ চৌধুরীর স্ত্রী, এটা জানা ছিল না ওর।স্মৃতিতে ধাক্কা।
সেই নীলাঞ্জনা, নিরুপমের অতীত।
পরিচয়পর্ব সারা হল। নীলাঞ্জনার মধ্যে কোনো জড়তা নেই। নিরুপম স্বাভাবিক হতে পারছে না।স্মৃতি পিছু টানছে।
ভার্সিটিতে এক সঙ্গে পড়তো ওরা। সাহিত্য সভায় গল্প পড়তো নিরুপম। নীলাঞ্জনার বাবা কোম্পানির ডিরেক্টর। প্রতিদিন এম্বাসেডর চেপে আসতো ও।
নীলাঞ্জনা যথেষ্ট সুন্দরী। ছেলেদের পাত্তা দিত না। সেই মেয়ে একদিন যেচে আলাপ করতে এসেছিল নিরুপমের সঙ্গে।
আমিতো বন্ধন রায়ের প্রেমে পড়ে গেছি।
বন্ধন রায় নিরুপমের গল্পের নায়ক। সেই প্রথম আলাপ।
তারপর রাখালদের ক্যান্টিনে, কফি হাউসে, বসন্ত কেবিনে কতবার কথা হয়েছে, কত অসংখ্য বার। রাতে গোল দীঘির পাড়ে বসে চাঁদের আলোয় জ্যোৎসনায় ভিজেছে দুজন, কতদিন।এক বিকেলে কফি হাউসে গিয়ে দু কাপ কফির অর্ডার দিতেই, নীলাঞ্জনা হঠাৎ বলেছিল, ওই দ্যাখো, অভিনেতা সৌমিত্র চ্যাটার্জি এসেছেন!
ওনার পাশের ভদ্রলোককে চেনো?
নাতো। ঠিক বলতে পারছি না!
উনি হলেন এক্ষণ পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য।
তাই বুঝি! আমি রেগুলার ওই পত্রিকা পড়ি।
আমি ইবসেনের নাটকের উপর ওনার পত্রিকায় একটা লেখা পাঠিয়েছি।
কফিটা ঠান্ডা হচ্ছে। খেতে হবে তো!
হু।
বাংলা ভাষায় তোমার প্রিয় কবি কে?
শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
দুজনই আমার প্রিয় কবি। সেই সঙ্গে আমি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নাম যোগ করছি।
ঠিক বলেছো। ওনার নাম বাদ দিলে, সেটা বিরাট অন্যায় হয়ে যেত।
এবার উঠতে হবে। লাইব্রেরীতে যাবো। কাল ভার্সিটিতে আসছো তো?
আসবো তো অবশ্যই। ইদানিং আমার বিয়ে নিয়ে বাবা-মা খুব উঠে পড়ে লেগেছেন।
আমাদের ভালবাসার কি হবে?
তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করো না?
আমি মোটেই সে কথা বলিনি।আরেকদিন সন্ধ্যায় বসুশ্রী হলে সিনেমা দেখে বেরিয়ে নীলাঞ্জনা বলেছিল, গত দুদিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি, আমার বুকের মধ্যে যে কি কষ্ট হচ্ছিল,
তা তোমাকে বোঝাতে পারবো না।
ভালোবাসা মানে একটা ঝড়, বুকের মধ্যে সব সময় থমকে থামা ঝড়ের ইশারা।
তোমার কষ্ট হয় না, আমাকে না দেখলে?
হয় তো বটেই। কাছে না পেলে, মনে মনে তোমাকে কত অসংখ্যবার পেতে চেষ্টা করি।
মানে?
মানে, আমার চারদিকে তখন নীলাঞ্জনা ছায়াছবির মতো ঘুরে বেড়ায়। বলে, কষ্ট পেয়ো না, এইতো আমি তোমার কাছেই আছি। আমাকে ছুঁয়ে দ্যাখো!
অ্যাই, সব সময় ঠাট্টা ইয়ার্কি না?
নিরুপম হো হো করে হেসে ফেলে।কত কত দিন কেটে গেছে এভাবেই। সেইসব সোনালী বিকেলগুলো, মনোরম সন্ধ্যা গুলো চার জোড়া চোখে কত যে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল। স্বপ্নের মিনার, স্বপ্নের গম্বুজ, স্বপ্ন দিয়ে গড়া ভালবাসার রাজপ্রাসাদ।
অথচ, তারপর একদিন এলো, সব স্বপ্নের ইমারত ভেঙেচুরে খানখান। আজ সে সব অতীত।
কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে?
নিরুপম অতীত খুঁড়ে দেখতে চায় নি কখনো।নীলাঞ্জনাও স্বামীর সামনে অতীত পরিচয়ের কথা তোলেনি, নিরুপম উদাস থেকেছে।
এক সময় কফি মিষ্টি খেয়ে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।বিকেলে পার্টিতে আবার দেখা।
অনুতোষ রিসেপশনে ব্যস্ত।নীলাঞ্জনা কাছে এলো নিরুপমের।
আবার দেখা হলো,
তাইতো,
কুড়িটা বছর পার,
জীবন তো রাজধানী এক্সপ্রেস,
হুম,
সেসব দিন মনে পড়ে?
পড়ে, না পড়াই ভালো,
কেন?
শুধু শুধু পুরনো ক্ষতে হাত,
দোষটা কার?
কারো নয়,
মানে?
দোষটা ভাগ্যের,
বিয়ে করেছো?
প্রেমহীন বিয়েতে আমার বিশ্বাস নেই, তাছাড়া সময় পাই নি,
নিজেকে কষ্ট দাও কেন?
জানিনা, বলতে পারব না,
আমি কিন্তু অপেক্ষা করেছিলাম!
জানি, আমার পায়ের তলায় তখন জমি ছিল না,
আমার বাড়ি থেকে বিয়ের চেষ্টা চলছিল, হয়ে গেল,
আর, সেই রাতে আমি কলকাতা থেকে পালিয়ে সোজা ধানবাদ,
খুব কষ্ট হয়েছিল, তাই না?
পুরুষের অক্ষমতা তুমি বুঝবে না,
জানি, আন্দাজ করতে পারি,
ভালো হয়েছে, কেউ নেই, তাই কারো জন্য ভাবনার ঢেউ নেই,
তাই নাকি?
তুমি সুখী হয়েছো তো?
দেখে কি মনে হয়?
দেখে বোঝা যায় নাকি?
চলে যাচ্ছে বেশ,
মিস্টার চৌধুরী তো যথেষ্ট সফিস্টিকেটেড মানুষ।
তা ঠিক, তবে কি জানো, বিয়ে একটা অভ্যাস, একটা দায়বদ্ধতা, এই নিয়ে বেঁচে থাকা।আমার মনে হয়, তোমাকে পাইনি বলে, তুমি রোজ আমার কাছে আসো, যখন তোমাকে দেখি না, তখন তোমাকে আরো বেশি করে দেখি,
কাজের সূত্রে আসো না এখানে,
না, ভাগ্য যে দেয়নি, তাকে ঘুরপথে পেতে চাইনা,
তুমি বদলে গেছো নিরুপম,
হবে হয়তো,
আমার তো সব মনে পড়ে,
কি?
সেই সব পুরনো দিনের স্মৃতি, সেইসব মায়াবী রাত, গড়িয়াহাটে সন্ধ্যেটা কাটানো, ঝিলের পাশে পাশাপাশি হাঁটা, আলেয়া সিনেমাতে উত্তম সুচিত্রার ছবি দেখা, সব সব,
আমি জানলে, এখানে আসতাম না,
আমি তো ভুলে থাকতে চাই, তুমি এসে আবার সব কিছু মনে করিয়ে দিলে,
নীলাঞ্জনা, এই ভালো। সেই সব দিনগুলো আমার জীবনের ওয়েসিস, স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা যায় বেশ,
তুমি পারো, আমি পারিনা,
তুমিও পারবে,
কিভাবে?
ঝরা ফুলের গন্ধ কেমন জানো, দেখবে তার মধ্যেও ভালোবাসার সুগন্ধ লুকিয়ে থাকে। আমাকে ভুলে যেও, আমাকে মনে রেখো না, স্বামী সংসার নিয়ে সুখে থাকো!ততক্ষনে পার্টিতে ঘোষণা শোনা গেল, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস চৌধুরী, প্লীজ্ কাম অন স্টেজ।
নিরুপম দেখলো, নীলাঞ্জনা আর ওর স্বামী মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল। ভালো লাগছে, ওদের দুজনকে।
ভালো থাকো তোমরা। সুখের বৃষ্টি আসুক তোমাদের জীবনে। সেই সব দিন রাত্রি গুলো আমার কাছে স্মৃতির সংগ্রহশালা হয়ে থাক, নিরুপম মনে মনে বললো।
ভালো থেকো নীলাঞ্জনা। সুখী হও।
নীলাঞ্জনা, আমি আর আসবো না। যেটুকু পেলাম, সেটুকুই আমার স্বর্ণ কমল সঞ্চয়, যা পেলাম না, তা হয়তো আমার ছিল না।
আমার নিঃসঙ্গ জীবনে সেদিনের স্মৃতি গুলো গভীর মমতায় আগলে রাখবো আমি, নিজেকে বোঝাবো,
কিছু হারায় নি আমি। ভালোবাসা হারায় না কখনো।জীবনের বিভিন্ন মোড়ে বারবার শুধু তার অর্থ পরিবর্তন হয়। ঝরা ফুলের সুগন্ধ নিতে কজন জানে।
যে জানে, সে জানে।
তার কাছে বেঁচে থাকাটা প্রতি মুহূর্তে সানাইয়ের সুরের মতো বেজে বেজে যায়।
কজন সেই সুরের মাহাত্ম্য শুনতে পায়, যে শুনতে পায়, তার বেঁচে থাকাটা অন্য মাত্রা পায়।
নিরুপম নিজেকে বোঝালো, নীলাঞ্জনাকে পেলে,
প্রতিদিনের ধূলিমলিনতায় হয়তো এই ভালবাসার
মর্যাদা নষ্ট হতো, অথচ, ওকে পায় নি বলে, আশ্চর্যজনকভাবে আজ ওদের সেদিনের ভালোবাসা চিরকালের ভালোবাসা হয়ে রইলো, এই পবিত্র ভালোবাসা স্মরণ করলে, এক জীবন পার করে দেওয়া মোটেই শক্ত নয়, নিরুপমের এরকমই মনে হল।ততক্ষনে স্যান্ট্রো গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রেখে ও দ্রুত গতিতে শহরের হাইওয়ের দিকে ছুটে চললো।
-
গল্প- রুম নাম্বার ২০৫
রুম নাম্বার ২০৫
– মুনমুন রাহাঅন্ধকারের বুক চিড়ে ট্রেন চলেছে ঝিকঝিক শব্দে । কামরার বেশির ভাগ মানুষই নিদ্রা দেবীকে আহ্বান জানিয়েছেন। ঘুম নেই কেবল মিতুলের চোখে। মনটা কেমন ভারি ভারি লাগছে । বিশেষ করে বন্ধুদের সাথে কথা বলার পর থেকে। মিতুলের সেই কবেকার ইচ্ছে হানিমুনে সুইজারল্যান্ড যাবে । বিয়ের আগে হবু বর অরিত্রকে সে নিজের ইচ্ছা জানিয়েছিল , অরিত্র তখন সম্মতি ও দিয়েছিল। কিন্তু গোল বাধল বিয়ের পর । এক তো অরিত্র অফিস থেকে ছুটি পাচ্ছে না। আর দুই নম্বর হল অরিত্রর মা। তিনি ছেলের বিয়ের জন্য জগন্নাথ দেবের কাছে মানত করে বলে এসেছেন একটা ভালো মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে হলে ছেলে বৌ আগে জগন্নাথের শ্রী চরণে মাথা ঠেকিয়ে আসবে। আর কি করার মিতুলরা তাই সুইজারল্যান্ড বাদ দিয়ে পুরী চলছে হানিমুনে। বন্ধুদের এই নিয়ে খিল্লির শেষ নেই। এই তো কালকেই পৌষালি বলছিল ,
“মিতুরে, তুই ও শেষে দীপুদার প্রেমে পড়লি? দীপুদা অর্থাত বাঙালির প্রিয় তিনটি জায়গা, দীঘা , পুরী , দার্জিলিং।”
যদিও অরিত্র বলেছে খুব তাড়াতাড়ি তারা সুইজারল্যান্ড যাবে। তবু যেন সুইজারল্যান্ডে হানিমুনে না যাওয়ার দুঃখটা কিছুতেই মিতুলের পিছু ছাড়ছে না।পুরী তে পা দিয়ে মিতুলের মনটা আস্তে আস্তে ভালো হতে থাকে। পুরীতে মিতুল আগেও এসেছে তবে অরিত্রর সাথে জগন্নাথ দর্শন , সি বিচে হাতে হাত রেখে হাঁটা , বিশাল সমুদ্রতে অরিত্রর সাথে হারিয়ে যাওয়া , বড় কোন ঢেউ আসলে অরিত্রর মিতুল কে আগলে রাখা এসব কিছুই মিতুলের কাছে চেনা পুরীকে অচেনা স্বপ্ন নগর করে তুলেছে । কেবল হোটেল রুমে মিতুলের কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। হোটেলটা এমনিতে বেশ সুন্দর। সমুদ্রের বেশ কাছে। পাঁচ তারা হোটেলটার সুইমিং পুল , বার , রেস্টুরেন্ট সব কিছুই বেশ বিলাস বহুল। মিতুলরা রুমটাও পেয়েছে সি ফেসিং। হোটেলটা পুরো ভর্তি তারপরও এত কম নোটিশে মিতুলরা যে এমন একটা ঘর পাবে তা আশা করে নি মিতুল। তাই প্রথম দিন রুম টা দেখে বেশ খুশি খুশি লাগছিল মনটা। কিন্তু কিছুক্ষন পর থেকেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হতে থাকে মিতুলের। মনে হয় কেউ যেন আছে যাকে দেখা যাচ্ছে না কিন্তু অনুভব করা যাচ্ছে। সবসময় কেউ যেন তার সাথে সাথে সর্বক্ষন ঘুরছে। বিশেষ করে অরিত্র আর মিতুলের একান্ত হওয়ার মূহুর্ত গুলোতে যেন বেশি বেশি করে অচেনা অস্তিত্ব টের পাচ্ছে মিতুল।
প্রথম দিন রাতে অরিত্র নব বিবাহিতা স্ত্রী মিতুল কে কাছে টেনে নেয় । মিতুলও অরিত্রর স্পর্শে নিজেকে উজাড় করে দিতে চায়। অরিত্র মিতুলের উন্মুক্ত পিঠে , কোমরে , গলায় নিজের ঠোঁট দিয়ে আদর করতে লাগে । মিতুলও অরিত্রর আদরের উষ্ণতায় ক্রমে বিগলিত হয়ে পড়ে। কিন্তু তখনই মিতুলের মনে হয় তার গায়ে একটা গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। চোখ বন্ধ থাকায় প্রথমে মনে হয় অরিত্রর নিঃশ্বাস হয়তো। কিন্তু একটু পরেই খেয়াল হয় অরিত্রর মুখ মিতুলের কোমোর বেয়ে নীচে নামছে তবে তো অরিত্রর নিঃশ্বাস মিতুলের ঘাড়ে পরা সম্ভব নয়! ভয় পেয়ে যায় মিতুল ছিটকে ওঠে অরিত্রর কাছ থেকে। অরিত্র অবাক হয় মিতুলের ব্যাবহারে। মিতুল অরিত্রকে তার অসস্তির কথা বললে অরিত্র বিশ্বাস করে না। বলে এ নিশ্চয়ই মিতুলের মনের ভুল। তেমন কিছু হলে অরিত্রও নিশ্চয়ই অনুভব করত। সে রাতে অরিত্র মিতুলর মিলন পর্ব অসমাপ্ত রয়ে যায়। ভীত মিতুল কে বুকে টেনে নিয়ে অরিত্র ঘুমিয়ে পড়ে। মিতুল কিন্তু অরিত্রর বুকের মাঝে চোখ বন্ধ করেও বুঝতে পারে কেউ যেন তাদের খাটের চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এই অনুভূতি কেন অরিত্রর হচ্ছে না কে জানে? কেটে গেল আরও দুটো দিন। এই অনুভূতি পিছু ছাড়ল না মিতুলের।
খুব ভোরে মিতুলের ঘুম ভেঙে যায়। ভোরের আধ ফোটা আলোয় রাতের ভীবিষিকা ম্লান হয়ে আসে। মিতুল মনকে বোঝায় অরিত্র ঠিকই বলেছে , এসব অবাস্তব অনুভূতি মিতুলের মনের ভুল ছাড়া কিছুই নয়।
সান রাইস দেখতে ভারি ইচ্ছে হয় । মিতুল দেখে অরিত্র অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মিতুল আর তাকে ডাকে না। ঠিক করে একই যাবে সান রাইস দেখতে। বাথরুমে ফ্রেশ হতে গেলে মিতুলের মনের অলৌকিক অনুভূতি গুলো আবার মাথা চাড়া দেয়। মনে হতে থাকে যেন দুটো অদৃশ্য চোখ তার উপর দৃষ্টিপাত করে চলেছে অনবরত। মিতুল কোন রকমে রেডি হয়ে নীচে নেমে আসে। সে প্রথমে যায় হোটেলের রিসেপশনে। সেখানে খুব বেশি লোক ছিল না। একজন বয়স্ক লোক আর দুজন স্টাফ। মিতুল বয়স্ক লোকটির কাছে এগিয়ে যায়। তারপর তাকে জানায় মিতুল রুম চেঞ্জ করতে চায়। এবং সেটা আজই দরকার হলে এখনই । মিতুলের গলার স্বরে এতটাই উত্কন্ঠা ছিল যে বয়স্ক লোকটি মাথা তুলে মিতুলের দিকে তাকিয়ে বলে ,
“কেন ম্যাডাম এত তাড়া কিসের? রুমে কিছু অসুবিধা হলে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো সমাধান করার। ”
মিতুল বলতে গিয়েও থেমে যায় যদি অরিত্রর মতো এই লোকটিও অবিশ্বাস করে ! মিতুল বলে,
” আমি বললাম তো আমি ঐ রুমে থাকব না । আমাকে রুম পাল্টে দিতেই হবে। ”
মিতুলের আচরণে ভদ্রলোক খানিকটা অবাকই হলেন। তারপর কি যেন ভেবে বলেন,
” কোন রুম ?”
” ২০৫ ”
কথাটা শুনে ভদ্রলোক কেমন যেন চুপ হয়ে যায়। তারপর বলে,
” ঠিক আছে ম্যাডাম আমি দেখছি কি করা যায়। তবে যদি এখানে অন্য রুম না পান তবে অন্য কোন হোটেলের ব্যবস্থা করুন।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই হোটেলের মালিক এসে উপস্থিত হলো। মিতুল আর ভদ্রলোকের কথা কানে যেতেই রীতিমতো ঝাঁঝিয়ে উঠলো সে। ভদ্রলোককে চিৎকার করে বলল,
” কি যা তা বলেছেন অমল বাবু? আর ম্যাডাম আপনাকে পরিস্কার করে জানিয়ে দি আমাদের পক্ষে এখন অন্য ঘরের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। হোটেল ভর্তি। আপনারা চাইলে অন্য হোটেলে যেতেই পারেন তবে আপনাদের পাঁচ দিনের অ্যডভান্স কিন্তু ফেরত পাবেন না।”
মিতুল আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ চলে এলো সমুদ্রের ধারে। সূর্য দেব ততক্ষণে আকাশে উঁকি দিয়েছেন। মিতুলের আর সান রাইস দেখা হলো না । তবু সে হোটেলে ফিরল না। সকালের নরম আলোটা বেশ ভালো লাগছে। মনে অনেক গুলো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে পড়ছে বয়স্ক ভদ্রলোকের ২০৫ রুম নাম্বার শুনে আঁতকে ওঠার কথা। ম্যানেজারের কথা চাপা দেওয়ার প্রয়াস। মিতুল এখন নিশ্চিত এই অনুভূতি তার মনের ভুল নয় কিছু নিশ্চয়ই আছে ঐ রুমে। কিন্তু কি আছে রুম নাম্বার ২০৫ এ !” কি রে , খুব চিন্তায় আছিস মনে হচ্ছে? ”
হঠাৎ একটা গুরুগম্ভীর আওয়াজে কানে যেতে মিতুল মুখ তুলে তাকায়। দেখতে পায় এক জটাজুটো ধারীকে যার পরনে কেবল কৌপিন, গলায় রকমারি পাথরের মালা চোখ গুলো টকটকে লাল, কপালে বড় একটা সিঁদুরের টিপ। তিনি আবার বললেন,
” ভেবে কিছু হবে না। জানতে হবে ! তোকেই জানতে হবে কি চায় সে ! আমি তোকে শুধু সাহায্য করতে পারি।”
মিতুলের বুঝতে বাকি রইলো না সাধু কি সম্পর্কে কথা বলছেন। মিতুল হাত জোড় করে বলল,
” দয়া করুন বাবা । আমি আর এইসব সইতে পারছি না অজানা আতঙ্কের সাথে অজানা অস্তিত্বের সাথে যুদ্ধ করে আমি ক্লান্ত । আমার এই অস্বস্তি এই অনুভূতি আমি কাউকে বোঝাতেও পারছি না। বললে কেউ বিশ্বাস করছে না। এমন কি আমার স্বামী ও নয়। ”
” কেউ বিশ্বাস করবে না রে । যে জীবন দিয়ে অনুভব করে বিশ্বাস কেবল তার জন্মায়। এবার আমার কথা মন দিয়ে শোন। তোকে আমি একটা তাবিজ দিচ্ছি এটা গলায় পরবি আর একটা পাথরের মালা দেব সেটা হাতে নিবি। তারপর সেই অশরীরীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করবি। তবে মনে রাখিস তখন যেন আর কেউ না থাকে তোর সাথে। তাকে রাত বারোটার পরেই ডাকা ভালো। ভয় পাবি না । আমার বিশ্বাস সে তোর সাথে কথা বলার জন্যেই তোর পিছু ধরেছে। ক্ষতি করার হলে এতদিন করে দিত। ”
এই বলে সাধু মালা আর তাবিজ মিতুলের হাতে দিয়ে যেযন হঠাৎ এসেছিল তেমন হঠাৎই চলে গেল। ভোরের নরম আলো কেটে উজ্জ্বল রোদ উঠছে আস্তে আস্তে। মিতুল ধীর পায়ে হোটেলের উদ্দেশ্য রওনা হল । হাতের মুঠোয় লুকিয়ে নিল সাধুর দেওয়া সেই তাবিজ আর মালা।রাত বারোটা। মিতুল দেখল অরিত্র ঘুমিয়ে পড়েছে। এই কদিন মিতুল কিছুতেই অরিত্রর ভালোবাসার ডাকে সাড়া দিতে পারে নি। যতবার মিতুল অরিত্রর কাছে আসার চেষ্টা করেছে কোন এক অদৃশ্য শক্তি নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে মিতুলর কাছে আর মিতুলও ছিটকে সরে এসেছে অরিত্রর কাছ থেকে। মিতুল আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। ঘড়িতে ১২-৩০ । মিতুল উঠে বসল। অদৃশ্য অশরীরীর সাথে বোঝাপড়া করার সময় এসে গেছে। সে যে ঘরেই আছে তা মিতুল জানে তার অনুভূতি দিয়ে। মিতুল হাতে সাধুর দেওয়া মালাটা নিল আর গলায় পড়ল তাবিজটা তারপর চলে গেল বারান্দায়। চোখ বন্ধ করে ধীর গলায় বলতে লাগলো ,
” তুমি কে আমি জানি না। কিন্তু জানতে চাই। জানতে চাই কেন আমার ছায়া সঙ্গী হয়ে ঘুরছো তুমি? ”
একবার , দুবার কোন উত্তর নেই। মিতুল আবার বলল তার কথা গুলো। তিনবারের বার সাড়া পেল মিতুল। সামনের চেয়ারে কেউ এসে বসলো। মিতুল চোখ খুলে দেখল একটা আবছা ছায়া। যেন কোন মানুষ কে সে অনেক গুলো কুয়াশার পর্দার ভিতর থেকে দেখছে। তারপর শোনা গেল তার রক্ত হিম করা ফ্যাঁসফ্যাঁসে এক গলার আওয়াজ। যেন অনেক দূর থেকে কথা গুলো আসছে।
” আমি এসেছি তোমার ডাকে। তুমি ঠিক বলেছ আমি তোমার ছায়া সঙ্গী হয়ে আছি। তবে তার উদ্দেশ্য তোমার ক্ষতি নয়। আমার মুক্তি। ”
মিতুলর ভয়ে জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে তবু সে নিজের মনে সাহস সঞ্চয় করে। বলে,
” বেশ, বল আমি কিভাবে তোমাকে সাহায্য করবো?”
” আমি নীলা। ছয় মাস আগেও এই হোটেলের রিসেপশনিস্ট ছিলাম। নতুন কাজ ভালোই লাগছিলো আমার। মন দিয়ে নিজের কাজ করতাম। কত নতুন মানুষর সাথে পরিচয় হতো রোজ। বেশ কাটছিল দিন গুলো। তবে দিন গুলো আরও রঙিন হয়ে উঠল আকাশের সাথে সম্পর্ক তৈরী হওয়ার পর। আকাশ এই হোটেলের ম্যানেজার। আমাদের ভালোবাসা আর বিশ্বাস ক্রমে মজবুত হল । অন্তত আমার কাছে । আকাশ আমাকে আরও কাছে পেতে চাইল। আমি আপত্তি করিনি। কয়েকদিন পরেই যার সাথে বিয়ে তাকে আপন করে নিতে আমার দ্বিধা বোধ কাজ করে নি। আকাশ আর আমি মাঝেমাঝে মিলিত হতে লাগলাম। বিয়ে তে আকাশ আপত্তি করে নি কিন্তু দেরি করছিল। আমি তাড়া দিতে লাগলাম। আমার আর এই ভাবে মেলামেশা ভালো লাগছিল না। আমি সংসার বাঁধতে চাইছিলাম। একদিন আমি জানতাম পারলাম আমি মা হতে চলেছি। ছুটলাম আকাশের কাছে। বললাম আর দেরি নয় আমাদের ভালোবাসার ফসল হিসেবে যে আসছে তার জন্য আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা করে নেওয়া দরকার। আমাকে অবাক করে আকাশ বলল ,
” বাচ্চা? কিসের বাচ্চা? এ বাচ্চা যে আমার তার প্রমাণ কি? আমি মানি না। আর তুমি ভাবলে কি ভাবে যে আমি তোমাকে বিয়ে করব? তোমার মতো ক্যারেকটার লেস মেয়ে কে আমি কখনও বিয়ে করব না। যে মেয়ে আমার সাথে শুতে পারে সে তো অন্য পুরুষের সাথে ও শুতে পারে! ” তারপর বিচ্ছিরি ভাবে হেসে আকাশ বলল,
” তাই ভালো কথা বলছি এইসব বাচ্চার ঝামেলা হটাও। কালই ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করো। তারপর আমাদের সম্পর্ক যেমন চলছিল চলবে। আর ঢাক ঢাক গুর গুর নয় সোজাসুজি সওদা। তুমি আমাকে শরীর দেবে বদলে আমি তোমাকে কর্ম ক্ষেত্রে উপরে উঠতে সাহায্য করবো। ”
আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। কিন্তু আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমার সন্তানকে কিছুতেই মারব না। ঠিক করলাম আকাশ কে এর উচিত শিক্ষা দেব। দুদিন পর আকাশকে ফোন করে বললাম তাকে আমি সাতদিন সময় দিলাম। সে যদি আমাকে অস্বীকার করে তবে আমি মালিক পক্ষের সাথে এই নিয়ে কথা বলব। বলব কিভাবে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আকাশ আমাকে ব্যবহার করেছে । আরও বললাম দরকার হলে পুলিশের কাছেও যাব। বাচ্চা হওয়ার পর ডি এন এ টেষ্ট করলেই পুলিশ বুঝতে পারবে আমি ঠিক কথা বলছি কি না। কেটে গেল দুটো দিন। আমি কদিন হোটেল থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। আকাশের সাথেও তাই আর দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। এদিকে আমার বাড়িতে সব কিছু জানতে পেরে যায়। সমাজের ভয়ে বাড়ির লোক আমাকে চাপ দিতে থাকে বাচ্চা নষ্ট করতে। আমিও আমার প্রতিজ্ঞায় অনড়। তাই অশান্তি তখন আমার নিত্য সঙ্গী। আমি সমাজ সহ পরিবারের সাথে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত । চার দিনের দিন ফোনটা এল আকাশের কাছ থেকে। বলল নিজের ভুল সে বুঝতে পেরেছে। তবে তার বিয়ে নিয়ে কিছু শর্ত আছে আর সেই ব্যাপারেই কথা বলার জন্য আমাকে একান্তে ডাকল সে। আকাশের কথা মতো রাত আটায় আমি গেলাম হোটেলে। আকাশ আমাকে প্রথমে নিজের রুমে নিয়ে গেল। আমাকে চেয়ারে বসতে দিল তারপর আমাকে কিছু একটা ড্রিঙ্ক দিল। সেটাতে নিশ্চয়ই কিছু মেশানো ছিল। আমার কেমন যেন একটা ঘোর ঘোর লাগছিল।
তারপর আকাশ বলল ,
” আমাকে ফাঁসাবি না ? এই বাচ্চা দিয়ে ফাঁসাবি তো ! দেখ এবার না থাকবি তুই আর না থাকবে তোর বাচ্চা। ”
একটা লোহার রড সে আগেই জোগাড় করে রেখেছিল। সেটা দিয়ে মারতে লাগলো। আমার পেটে , মাথায়, মুখে। আমি ককিয়ে উঠছিলাম কিন্তু বাধা দিতে পারছিলাম না। এক সময় আমার দেহটা নিথর হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে। আকাশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আমার লাশকে সামনে রেখে সে একটা সিগারেট ধরাল । হোটেলে তখন কিছু রুমের কাজ চলছে। আকাশ বোধ হয় কিছু মিস্ত্রীকে আগে থেকেই টাকা খাইয়ে রেখেছিল। তাদের সাহায্যে আমর লাশটা নিয়ে আসা হলো এই ২০৫ রুমে। এই ঘরে মেরামতের কাজ চলার জন্য ওদের বেশি বেগ পেতে হলো না আমার লাশ লুকাতে। মেঝেতে পুঁতে দেওয়া হলো আমার লাশ ও আমার ব্যাগ যা আমি সাথে এনেছিলাম। তারপর মিস্ত্রীরা সুন্দর করে ইট বালি সিমেন্টের প্রলেম ঢেলে দিলো তাতে। মুছে দিল আমার হত্যার সকল প্রমাণ। আমার পরিবারের কাছে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে রইলাম। কিন্তু আমার আত্মা মুক্তি পেল না । ছেলেরা বড় নিষ্ঠুর বড় অমানবিক হয় মিতুল । তাই তো আমি তোমাকে তোমার স্বামীর সাথে মিলিত হতে দিইনি। আমি মুক্তি চাই। আকাশের শাস্তি চাই। ”এতক্ষন কথা বলার পর এবার একটু থামলো নীলা। মিতুলের আর এই ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলা ভয় করছে না বরং কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য। মিতুল বলল,
” না নীলা সব ছেলেরা এক রকম হয় না। আমার স্বামী অরিত্র খুব ভালো মানুষ। তবে তোমাকে আমি মুক্তি দিতে চাই। শাস্তিও দিতে চাই আকাশ কে। কিন্তু কি করে হবে ! আমার কাছে তো কোন প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ ছাড়া পুলিশ কেন মানবে আমার কথা ? ”
” প্রমাণ আছে। প্রমাণ আমার ব্যাগে আছে। আমি এখানে আসার দিন ব্যাগে স্পাই ক্যামেরা ফিট করে এসেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল আকাশ যদি বিয়ে নিয়ে কোন বাহানা করে অথবা আমাকে নোংরা প্রস্তাব দেয় তবে সেই ভিডিও আমি পুলিশ কে দেখাব। আমার ব্যাগের স্পাই ক্যামেরাতে আমার মার্ডার হওয়ার ভিডিওটা পেয়ে যাবে। ”
এই বলে আবাছা ছায়াটা মিলিয়ে গেল বাতাসে।মিতুল কে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি আকাশ কে পুলিশের হাতে তুলে দিতে। নীলা ঠিকই বলেছিল তার ব্যাগের স্পাই ক্যামেরাতে সব কিছু রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল। কেবল মিতুল কিভাবে এই হত্যার কথা জানল সেই উত্তরটা পুলিশ কে দিতে পারেনি মিতুল। অরিত্র প্রথমে মিতুলের পুলিশ ডাকা নিয়ে খুব আপত্তি করেছিল। কিন্তু মিতুলর কথা মতো সব প্রমাণ পাওয়া গেলে বেশ অবাক হয়ে যায় সে। তারপর মিতুলের মুখ থেকে নীলার সব কথা জেনে মিতুলের কাছে ক্ষমা চায় সে মিতুল কে অবিশ্বাস করার জন্য। নীলার সৎকারের ব্যবস্থা নীলার পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে মিতুলরা আজ বেরিয়ে পড়ল কোলকাতার উদ্দেশ্যে।
গাড়ি তে যেতে যেতে অরিত্র বলে
“এই হানিমুনটাতো মাটি হলো এবার গিয়েই সুইজারল্যান্ডের ব্যবস্থা করব । ”
মিতুল বলে ,
” একটাই শর্ত, হোটেল সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ করে নেবে। ”
” সে আর বলতে ! এবারে না হয় জগন্নাথের কৃপা ছিল। আর ভুল করি !”
অরিত্রর বলার ধরন দেখে হেসে ওঠে মিতুল। এতদিন পরে মিতুলর মুখে প্রাণ খোলা হাসি দেখে হাসি খেলে যায় অরিত্রর ঠোঁটেও।