• চিঠি

    চিঠি- ভালোবাসা, তোমার উড়ো মেঘ

    ভালোবাসা, তোমার উড়ো মেঘ
    -রীণা চ্যাটার্জী

    প্রিয় ভালোবাসা,
    কেমন আছো ভালোবাসা? বদলে গেছো বুঝি এখন অনেক? চিনতে পারবে যদি দেখা হয় আবার কখনো, কোনোদিন পড়ন্ত বেলায়!
    যদি কোনোদিন তোমার চলার পথে এক ঝলক আষাঢ়ে মেঘ আসে, কি করবে? সরে যাবে তো একটু আড়াল খুঁজে নিতে? যেও না, একটু দাঁড়িয়ে যেও মেঘের নীচে। একটু না হয় ভিজলে.. একটু না হয় মাখলে অনভ্যাসের কয়েক ফোঁটা। তারপর আড়ালে সরে এসে হাতের মুঠোয় দেখো কয়েক ফোঁটা জল- আমার কান্না, মুছে নিও। কাঁধের ওপর কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে আসছে- আমার পথ চাওয়া অপেক্ষা, মুছে নিও। মাথায়-চুলে আটকে আছে আরো কয়েক ফোঁটা- আমার না-বলা কথা, মুছে নিও। মুখে-ঠোঁটে-চোখে মাখামাখি হয়ে আছে বেশ কয়েক ফোঁটার মূর্ছনা- আমার ভালোবাসা, মুছে নিও। তখন তোমার সারা শরীর জুড়ে কেবল আমি.. মুছে নিলেও ভেজা ভেজা রেশে মিশে থাকবো, তোমার অজান্তেই হয়তো- সত্যিই কি অজান্তে! বুঝবে না আমার স্পর্শ?
    আষাঢ়ে গল্প বলে এড়িয়ে যেও না- উড়ো মেঘের হাত ধরে আবার আসবো, বারবার আসবো তোমার মাঝে মিশে যেতে।

    বলো তো ভালোবাসা- তুমি কি শুধুই বসন্তের আর পলাশের? এ একচেটিয়া ভাবখানা আর ভালো লাগে না। ভালোবাসা তো আষাঢ়ের, ভালোবাসা মেঘের, ভালোবাসা জল থৈ থৈ বর্ষার। মন কেমন করা মেঘের নীচেও ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে, জানো কি?

    টুপুর টাপুর হয়ে নেমে আসে যখন-তখন তোমার হাত ধরে চলবে বলে। যূথিকা রাণী যখন সুবাস ছড়ায় রাতের বেলা, খোলা জানালা দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে ঘরের ভেতর, আকাশ জুড়ে তখন হয়তো একরাশ মেঘ তোমার সাথে কথা বলতে নেমে আসছে ঝমঝম শব্দে- ভালোবাসার বর্ষামঙ্গল।

    তখনো তুমি বড়ো উদাসীন ভালোবাসা। বুঝতেই পারবে না কিছু, ঘুম ঘুম চোখে জানালাটা বন্ধ করে দেবে। বন্ধ জানলায় শত আঘাতেও সাড়া দেবে না- বৃষ্টির সব জল ব্যর্থতার পরিচয় নিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে জমা জলের ঠিকানা হয়ে যাবে। আবার জল থেকে মেঘ, আবার নেমে আসা..একবার না হয় ভুল করেই হাত বাড়িয়ে দিও- ভুলটুকু ভেঙে দিতে, দেবে তো? অপেক্ষায় থাকবো..
    ইতি তোমার উড়ো মেঘ।

  • চিঠি

    চিঠি- আমার একলা লাগে ভারি

    আমার একলা লাগে ভারি
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    ….
    আজ রবিবার। সকাল থেকেই তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। আমার বাড়ির প্রশস্ত লনের কোণে, বিশাল ওক গাছটা থেকে থেকেই প্রবল বেগে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, এই বন্দীজীবন ওর‌ আর ভালো লাগছে না বোধহয়, ওর‌ও কী আজ মনখারাপের দিন ঠিক আমার‌ই মতো!
    আশ্চর্য! কতোগুলো বছর কেটে গেল এদেশের মাটিতে, তবু এইরকম ঘনঘোর বর্ষায় আমার মন ছুটে চলে যায়, আমার ছেলেবেলার রাঙামাটির দেশে, খুব মন কেমন করে তোর জন্য, তোদের সক্কলের জন্য। রাস্তাঘাট, স্কুল বাড়ি, খেলার মাঠ, নীল গগনের সোহাগ মাখা আমার সকাল সন্ধ্যেবেলা, সব, -সব কিছু এসে ভীড় করে এসে দাঁড়ায়, আমার মনের মধ্যে। খুব ইচ্ছে করে, তোর সঙ্গে কথা বলতে, কিন্তু এখন তো তার‌ও কোন‌ও উপায় নেই, পৃথিবীর অপর গোলার্ধে এখন গভীর রাত, তোরা সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অগত্যা নিজের মনে একাএকাই সুখ দুঃখের কথা ক‌ই।
    আমার ছেলেরা তো এখন যে যার নিজের ঘরে দুয়ার এঁটে মোবাইল নিয়ে বসেছে। প্রকৃতির পানে চেয়ে দেখার অবকাশ নেই তাদের। আসলে ওরা তো কেউ রোদেপুড়ে, জলে ভিজে কাদামাটি মেখে বড়ো হয়নি আমাদের মতো, কোন‌ও দিন হাঁটে নি শীতের কুয়াশা মাখা আবছাপথে।এদেশে কেবল বৃষ্টি আর বরফ, গৃহবন্দী এইসব শিশুদের খেলাধূলাও সব গ্যাজেট নির্ভর। তাই ওদের শৈশব‌ও আমাদের মতো স্বপ্নেমোড়া নয়। ওরা কেউ কোন‌ও দিন কাগজের নৌকা ভাসানোর আনন্দটুকু পেল‌ই না। আমাদের এইসব সুখ দুঃখের গল্পের মর্ম ওরা আর কী বুঝবে বল!
    খুব ভুল যদি ভেবে না থাকি তাহলে এখন তো বোধহয় আষাঢ়ের শুরু। আমাদের রাঙামাটির দেশে বৃষ্টি নেমে গেছে। আমি মনে মনে বেশ দেখতে পাই, তুই বাদলা দিনে বারান্দায়, থামে হেলান দিয়ে, কালো পাথরের বেদীতে পা ছড়িয়ে বসে বৃষ্টি দেখছিস। বড়ো বড়ো সব গাছপালার পাতা বেয়ে জল গড়িয়ে নামছে, কাকগুলো সব ভিজে ঝুপ্পুস।
    আমাদের বাড়ির এই বারান্দাটা কিন্তু বড্ডো ভালো, বল্! বিরাট বড় বারান্দায় গোটা চারেক থাম, রেলিং এর বদলে চ‌ওড়া কালো পাথরের বেদী দেওয়া। ছুটির দিনে অনেকটা সময় আমরা ওখানেই কাটাতাম।
    দুই ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে লাল সুরকি ঢালা পথ সারা বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে, পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে বেলফুল আর রঙ্গনের গাছ। গেটের মাথায় জুঁই এর ঝোপ আজ‌ও গন্ধ ছড়ায় জানি। কুয়োতলার পাশে নীলমণি লতার মনকাড়া নীলিমা।
    এক একদিন রাতে আমরা সবাই রাতের খাওয়ার পর বারান্দায় বসে গল্প গুজব করতাম, বাবা আমাদের গান গাইতে বলতো। তুই তো চিরকাল‌ই ভালো গাইতে পারিস।তোর রিনরিনে গলার সুর ছড়িয়ে পড়তো চারপাশে। আমি ছিলাম ফাঁকিবাজ। গান গাইতে চাইতাম না, গাইলেও মাঝপথে থেমে গিয়ে বলতাম- আর জানি না।
    একবার কিন্তু, বাবা আমায় খুব জব্দ করেছিল, মনে আছে তোর? ‌ ছেলেবেলায় খুঁটিনাটি সব কিছু নিয়ে বায়না ধরা ছিল আমার স্বভাব। যেটা চাই, সেটা না পাওয়া পর্যন্ত ঘ্যানঘ্যান চলতেই থাকতো। প্রতিবছর বর্ষায় কদম ফুল ফোটা শুরু হতেই বায়না জুড়তাম, ঐ ফুল পেড়ে দিতে হবে। রোজ রোজ অতো উঁচু গাছের ফুল পাড়ে কে? একদিন মালীকাকু একখানা কদমগাছ এনে পুঁতে দিয়ে বলেছিল-
    “নাও আজ থেকে এটা তোমার গাছ। বড়ো হলে দেখবে কতো ফুল দেয়।”
    বাবা বলেছিলো-
    “না, অতো সহজে কোনো কিছু পাওয়া যায় না, পেতে নেই। যেদিন ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ গানটা ঠিকঠাক গাইতে শিখবে, সেই দিন‌ই ওটা তোমার হবে।”
    আমিও তেড়েফুঁড়ে উঠে কিছুদিনের মধ্যেই শিখে নিয়েছিলাম গানটা, আর নিজের অজান্তেই পেয়েছিলাম এক অমূল্য শিক্ষা। আকাঙ্ক্ষার বস্তু পেতে নয়, নিজের যোগ্যতায় অর্জন করতে হয়। আজ‌ও মনে রাখি সেই কথা।
    আমার পূর্ণবয়স্ক কদম গাছ সময় মতোই ফুল ফুটিয়েছে, এখন‌ও নিয়মিত অজস্র পুষ্পসম্ভার নিয়ে হাজির হয় বাদলের গান শোনাতে। তোর তোলা ছবি দেখে, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই।
    বৃষ্টিটা মনে হয় ধরে এলো। ওকের ছুঁচালো পাতার আগা থেকে বিন্দু বিন্দু জল ঝরছে, ঠিক যেমনটি আমাদের বাড়ির সামনের ইউক্যিলিপটাস গাছ থেকে ঝরতো টুপটাপ করে। মনে আছে, বৃষ্টিটা একটু ধরলেই আমরাও বেরিয়ে পড়তাম? বাগানের জল যাওয়া নালাটা তখন ঘোলা জলের খরস্রোতা নদী । সেই নদীতে আমরা দুজন কত্তোগুলো কাগজের নৌকায় নিজেদের নাম লিখে ভাসিয়ে দিতাম! দিব্যি হেলেদুলে ভেসে ভেসে চলে যেত ওরা অজানার পথে।
    জুঁই ফুলের গন্ধ ভরা রাতে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে কল্পনায় দেখতাম সেই নৌকা তখনও ভেসেই চলেছে পরীরাজ্যের ঠিকানায়। হাতের মুঠোয়, আপনি এসে ধরা দিতো স্বপ্নলোকের চাবি।
    ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে এখন। আকাশ থেকে বিলীয়মান আলোর আভা এসে পড়েছে লনের উপরে। ঠিক যেন সেই গানটা ‘ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে ,বাদল বাতাস মাতে মালতীর গন্ধে’- কিন্তু আমাদের দেশের মালতীর গন্ধ এরা পাবে কোথায়?
    চল দাদা আমরা দুজন মিলেই না হয় গাই গানটা,
    আমি গাইবো গুনগুন করে, আর তুই গাইবি আমার মনে।
    ও আর‌ও একটা কথা, এবার যখন দেশে যাবো আমরা দু’জন মিলে কাগজের নৌকা ভাসানোর খেলাটা আবার খেলবো, শুধুই আমরা দুজন, কেমন! ……

  • চিঠি

    চিঠি- তোমার ফেলে আসা রক্তপলাশ

    তোমার ফেলে আসা রক্তপলাশ

    -রীণা চ্যাটার্জী

    প্রিয় ভালোবাসা,

    আজ আবার ফিরে এসেছে বসন্ত বেলা। ভালোবাসার দিন, রঙীন হবার দিন। মনে পড়ে ভালোবাসা প্রথম দেখা, প্রথম কথা, প্রথম স্পর্শ। স্পর্শের মাদকতায় বলেছিলে তুমি, আমার সাথী হবে? আজন্মের সাথী? ভীযণ ভাবে মন ছুঁয়ে গেছিল কথাগুলো। যেন..যেন যুগ যুগ ধরে শুনছি। তুমি কানে কানে বলছো, ‘ভালোবাসি.. ভালোবাসি.. ভালোবাসি..’ ভাসিয়ে দিয়েছিল খড়কুটোর মতো সেদিন তোমার ভালোবাসা। মনে হচ্ছিল, পৃথিবীটা কি সুন্দর! রঙে, বর্ণে, ছন্দে, সুরে, আশা- আকাঙ্খায় ভরা এক অপার্থিব সুখ। তবুও ভয় পেয়েছিলাম জানো, হারাবার ভয়। তুমি যে ভীষণ চঞ্চল..। যদি ভুলে ফেলে রেখে চলে যাও? ফিরে আসে আবার দহন বেলা? বা নৈঃশব্দ্যের শীতলতা! আনমনা হয়ে ভাবছিলাম, যদি..যদি সব হারিয়ে যায়, আবার বাঁচতে পারবো তো? বসন্ত যে ক্ষণিকের, ক্ষণিকের অতিথি। তখন তুমি, হ্যাঁ তুমিই তো আন্দোলিত করে বলেছিলে, কি ভাবছো? কানে কানে বলেছিলে,’মুক্তা যেমন শুক্তিরও বুকে আমার মাঝারে তুমি…’ জানো সেদিন থেকেই ওই গানটা আমার কাছে বিশ্বাসের বীজমন্ত্র হয়ে গেছে। বলেছিলে, সাজাবো তোমায় আমার রঙে। তোমার রঙে? অবাক চোখে তাকিয়েছিলাম। তুমি আমার হাতে দিয়েছিলে এক থোকা রক্তপলাশ। বলেছিলে, ভালোবাসার রঙ‌।
    তারপর চৈতালীর দমকা হাওয়ায় তুমি যেন কোথায় লুকিয়ে গেলে। দেখা দিতে মাঝে মাঝে- মন ভরতো না। অভিমানে- অনুনয়ে একটা একটা ঋতু পেরিয়ে গেল। অগ্নিবাণের দহন স্নানে, আধফোঁটা বেলিফুলের সৌরভের মাঝে খুঁজতাম, বর্ষার জুঁই-কামিনী, শরতের দুধসাদা মেঘ আর কাশের দোলায়, হিমের রজনীগন্ধায় শুধু খুঁজেছি, আর খুঁজেছি।
    আবার বসন্ত এসেছে- তুমি হয়তো আজ অন্য হাতের রক্তপলাশ। আর আমি? রোজ ভোরের অপেক্ষা আর রাতের বোবা কান্নার বাষ্প নিয়ে আষাঢ়ের প্রথম জলভরা মেঘের মতো ভেসে চলেছি ঈশান কোন বেয়ে। বসন্তেও এখন বৃষ্টি নামে জানো ভালোবাসা- ভাবি বৃষ্টি! নাকি অশ্রুকণা? চোখটা কেমন ঝাপসা লাগে। ঠিক বুঝতে পারি না। প্রথম স্পর্শে কথা দিয়েছিলাম, একসাথে চলার। আজো ভেসে চলেছি, শুধু তোমার দেওয়া মন্ত্র সম্বল করে ‘..আমার মাঝারে প্রেমের বিন্দু তুমি শুধু তুমি..’ ভালো থেকো ভালোবাসা বসন্তের হাত ধরে।
    ‌ ‌ ‌ইতি,
    তোমার ফেলে আসা রক্তপলাশ।

  • চিঠি

    চিঠি- ভালোবাসা .. তোমার অবহেলা

    ভালোবাসা .. তোমার অবহেলা
    -রীণা চ্যাটার্জী

    প্রিয় ভালোবাসা,
    অবহেলার মনখারাপে আজ আবার একবার দেখলাম- “ইতি মৃণালিনী”.. মৃণালিনীর কথায় বই নয় ছবি.. চলচ্চিত্র। দেখলাম জীবনে অস্তিত্বের সংগ্ৰাম, ভালোবাসা পাওয়ার ব্যাকুলতা। সত্যিই ভীষণ অদ্ভুত অনুভূতি ভালোবাসা তোমায় ঘিরে আবর্তিত। বারবার তুমি ধরা দাও এসে মনের দ্বারে নানা রূপে- কখনো বন্ধন মাঝে, কখনো মুক্তির আস্বাদে। কখনো মন দাবি রাখে স্বীকৃতির তো কখনো তোমায় রাখে মন গহীন কোনে- একান্তে। কখনো মন সাহসী হয়ে ভালোবাসার হাত ধরে সমাজের ভ্রুকুটি তুচ্ছ করে, কখনো আবার তাচ্ছিল্য, আর অবহেলায় অভিমানী মন‌ পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিতে চায় নিজেকে। মন, শুধু মন-ই কথা বলে ভালোবাসায়, আবেগের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হতে চায় চিরতরে।
    জানো ভালোবাসা ভালোবাসায় দেহের মরণ হয় না, মনটা মরে যায় – অবহেলায়, উপেক্ষায়, বিশ্বাসঘাতকতায়। তাই যারা ভালোবাসা না পেলে বা হারিয়ে যাওয়ার কথায় অবজ্ঞার হাসি হেসে মুখ বেঁকায়- তারা মনে বাঁচে না, দেহে বাঁচে। মন শুধু বিশ্বাস করে হাত ধরে, অঙ্গীকার করে। কিন্তু সাথীর নিষ্ঠুরতা, অবহেলায় ভালোবাসা তোমার কুসুমগুলি ফোটার আগেই ধূলায় মিশিয়ে দেয়। যেমন মৃণালিনী পড়ে ছিল- রাস্তায় অবহেলায়। প্রথমে দুই একটি মুখ উঁকি দিলো, ভিড় বাড়লো কৌতুহলের। তারপর? তারপর উৎসুক জনতা আস্তে আস্তে সরে এলো। অতৃপ্ত মৃণালিনী আর অসম্পূর্ণ ভালোবাসা ধূলো মেখে পড়ে থাকলো। মনে হচ্ছিল একরাশ ধূলোমাখা ভালোবাসা অবহেলায়, অভিমানে একলা পড়ে আছে। চোখের জল আর বাঁধ মানে নি, তখন.. অঝোরে ঝরে ছিলো। বলতে পারো কেন?
    ভালোবাসা তুমি যদি আসবেই কারো জীবনে তো অঙ্গীকার নিয়ে এসো, অবহেলা নিয়ে নয়। অপেক্ষা রইলো ভালোবাসা, এসো অঙ্গীকারের হাত ধরে।
    ইতি
    তোমার অবহেলা।

  • চিঠি

    চিঠি- আমার স্কুলে শিক্ষক দিবস

    আমার স্কুলে শিক্ষক দিবস
    – অঞ্জনা গোড়িয়া

     

     

    আমার প্রিয় দিদিরা,
    আমি অঞ্জনা। জানি আজ হয়তো কারোর মনে নেই। আমি আপনাদের সেই অঞ্জনা। কেমন আছেন দিদিরা?
    আপনাদের সবার উদ্দেশ্যে আমার এই চিঠি।
    সবারে জানাই আমার অনেক অনেক ভালোবাসা ও শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা।
    আমি জানি না আপনারা কতটা ভালো আছেন? আজ আমি অনেক দুরে। তবে মনের থেকে দুরে কোনোদিনও নয়। এখন আমি পড়াশোনার গণ্ডি পেরিয়ে সংসারী হয়েছি। মা হয়েছি। আর হয়েছি দিদিমনি। হ্যাঁ, আমিও আজ দিদিমনি। এ আমার গর্ব। আমার ভালোবাসা আমার স্কুল। আমার ছাত্র ছাত্রীরা।
    আজ লিখছি স্কুল জীবনের শিক্ষক দিবসের কথা। দেখুন তো সবার মনে আছে কিনা? শিক্ষক দিবস—
    সকাল থেকে বৃষ্টি। একটুও বিরাম নেই।
    অথচ এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করে আছি সেই কবে থেকে।
    যেতেই হবে স্কুলে। কোনো বাধাই মানবো না। আমি যাবোই। মা রান্নাঘর থেকে হেঁকে বলে ওঠে। এত জল বৃষ্টির দিনে স্কুল কি যেতেই হবে? সেই তো ক্লাস হবে না। আজ নাকি কিসের পালনীয় দিন?
    হ্যাঁ মা। আজ শিক্ষক দিবস। আমাদের শ্রদ্ধেয় দিদিদের বরণ করার দিন। শিক্ষকদের সম্মানিত করার দিন। আজ যেতেই হবে মা।
    সেই বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম স্কুলে। তখন আমি নবম শ্রেণি। মনে দারুন আনন্দ। এ বছরই শিক্ষক দিবসের পুরো দায়িত্ব নবম শ্রেণির ওপর। নিজেদেরই মাথা খাটিয়ে অনুষ্ঠানটা সাজাতে হলো।
    প্রথম তিন পিরিয়ড ক্লাস। তারপর শুরু মূল অনুষ্ঠান।
    ক্লাস ফাইভ থেকে দেখে আসছি প্রত্যেক বছর এই দিনে উঁচু ক্লাসের দিদিরা ক্লাস নিতে আসে। ক্লাসের উপস্থিত দিদিমনিকে প্রণাম জানিয়ে শুরু করে ক্লাস।
    খুব মনে আছে মীনাদি কি সুন্দর করে ভূগোল পড়া বুঝিয়ে ছিল। ঠিক যেন ভাবি দিদিমণি। সত্যিই এখন স্কুল টিচার। আমাদের দিদিমনিরাও ওদের পড়ানোতে ভীষণ খুশি।
    এবছর আমিও নেব ক্লাস।
    কি ভীষণ উত্তেজনা মনে। দিদিদের সামনে বসিয়ে আমরা ক্লাস নেব নিচু শ্রেণীদের। এক দিকে ভয় অন্য দিকে আনন্দ।
    আমি নিয়েছিলাম পঞ্চম শ্রেনীর ইতিহাস। মুঘল সাম্রাজ্য। ইতিহাস আমার বরাবরই প্রিয়। অতীত ঘটনা জানতে ভীষণ ভালো লাগে। ইতিহাস দিদি মুকুলিকাদির পায়ে প্রণাম করলাম। দিদি আশির্বাদ করে বললেন, ভয় পেও না অঞ্জনা। আমি তো আছি।
    এই একটা কথাই মনের উদ্যম শতগুণে বাড়িয়ে দিল।
    খুব মনে পড়ছে সেই দিনটা। যখন মুঘল সামাজ্যের সম্রাটদের নাম মুখস্থ করার সহজ উপায় বলে ছিলাম ছোটোদের কাছে৷ কি খুশি তারা।
    ” বাবার হলো আবার জ্বর,সারিল ঔষধে”। বাবর, হুমায়ূন, আকবর, জাহাঙ্গীর, সাজাহান, ঔরঙ্গজেব।” সহজ পথে সহজ উপায়। মনে রাখার। মুকুলিকাদি মুচকি হেসে বলে ছিল তুমি ইতিহাস নিয়েই পড়ো। ভবিষ্যতে দিদিমণি হয়ে এভাবেই পড়িও। আমার আশির্বাদ সব সময় তোমার সাথে।
    মনের সুপ্ত ইচ্ছেটা দিদির মুখে শুনে চোখ দু’টো উজ্জ্বল হয়ে উঠে ছিল।
    সেই প্রথম ক্লাস নেওয়া। দিদিদের সম্মানার্থে।দারুণ এক অনুভূতি।
    ভবিষ্যৎ শিক্ষিকা হওয়ার প্রথম ট্রেনিং।
    তারপরই বড় একটা হল ঘরে শুরু হলো শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান।
    সমস্ত শিক্ষিকাদের বরণ করে নেওয়া হলো। আমরা প্রতি ক্লাস থেকে চাঁদা তুলে দিদিদের জন্য একটা করে উপহার তুলে দিলাম।
    এই দিনটা আসলে শিক্ষাগুরু শ্রী সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের জন্মদিন। তাই সেই মহান শিক্ষাগুরুকে মালা পরিয়ে প্রদীপ জ্বেলে সম্মান জানানো হয়। আমার ওপর দায়িত্ব ছিল শিক্ষক দিবসের গুরুত্ব সম্পর্কে বক্তৃতা দেওয়া। খবরের কাগজ পড়ে দিদিদের সাহায্যে দু’পাতার বক্তৃতা রাখলাম। হাত থরথর করে কাঁপছে। ভীষণ ভয় করছে। তবু পারতেই হবে। কি করে বলবো জানি না। দিদিমনিদের সামনে দিদিদের কথা বলার সুযোগ এই প্রথম। সত্যি বলতে জীবনের এই প্রথম ভাষণ দিলাম। তাই এটুকু বলতে পেরে ভীষণ আনন্দিত।
    তারপর স্কুলের মেয়েরা নাচ গান আবৃত্তি ছড়া নাটক সবই করলো পরপর। আনন্দ সহযোগে।আমার স্কুলটা আসলে বালিকা বিদ্যালয়। স্যার কেউ ছিল না।
    এ বছরই ছিল আমাদের প্রিয় মীরাদির বিদায়ী বছর। তাই এই আনন্দ মুহুর্তেও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন মীরাদি। আমাদের জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, তোদের ছেড়ে কি করে বিদায় নেব? এ যে বড্ড কষ্টের দিন।
    ঠিক তাই। একদিন সবাইকেই ফিরে যেতে হবে যে যার স্থানে। মেনে নিতে হয় সবই।
    নিয়মের বাইরে আমরা কেউ নই। তবু চলে যাবার দিন বড়ো কষ্ট।
    আজও শিক্ষক দিবস এলেই মনে করিয়ে দেয় সেই দিনগুলি। মনে করিয়ে দেয় কান্না হাসির মজার স্কুলের স্মৃতি। দিদিমনিদের সাথে ছিল আমাদের বন্ধুর সম্পর্ক। আজও ভুলিনি মুকুলিকাদি, শেলি দি, বড়দির হাসি খুশি মুখটা।
    আজও ভুলিনি নীলিমাদির আদর মাখা বকুনি। আজও মনে আছে করুনাদির ভালোবাসা। আল্পনাদির প্যারেড রাধাদির মিষ্টি মুখটা। তাই এই দিনটা আমার খুব স্মরণীয় একটা দিন।
    চিরকাল এভাবেই মনে রাখবো। যে যেখানেই থাকুন। খুব ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন বহু দুরে। তাদের প্রতি রইলো আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।
    আজ এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ। ছাত্রছাত্রীরা গৃহে আটকে। শিক্ষকরা নিরুপায়। আবার সব কিছু স্বাভাবিক হোক খুব শীঘ্রই। আবার দেখা হবে সবার সাথে খুব শীঘ্রই।

    ইতি —-
    তোমাদের অঞ্জনা

  • চিঠি

    চিঠি- জয় শ্রীরাম, জয় হো আল্লাহ!

    জয় শ্রীরাম, জয় হো আল্লাহ!
    -রীণা চ্যাটার্জী

    শ্রদ্ধেয় মাননীয়রা,

    একটি অভিজ্ঞতা ও পরবর্তী অনুভব ভারতের রাজধানী, নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে উপযুক্ত একটি বাহনের অপেক্ষা করছি। এক গেরুয়া বেশধারী, কপালে তিলক সুঠাম ভিক্ষুক সামনে এসে নানান আশীর্বাদ বর্ষিত করে হাত বাড়িয়ে দিল ভিক্ষার।
    অবশ্যই তার বক্তব্য ছিল তার ভিক্ষা পাত্রে কিছু দক্ষিণা দিলেই ঈশ্বর আমার, আমার পরিবারের, আমার সন্তানের শীঘ্র, এবং অবশ্যই মঙ্গল করবে।
    আমি আবার এই একটি ব্যাপারে বড়ো কৃপণ, আমার নিজের ভাষায় ‘আমি এই ব্যাপারে বিচক্ষণ মানুষ, দায়িত্বশীল নাগরিক’। পরিস্থিতি একান্ত অসহায় হলে আমার দিতে আপত্তি নেই। কিন্তু সুস্থ মানুষ, ভবিষ্যত প্রজন্ম আর ধর্মের নামে বাড়ানো হাতে আমার মুঠো খোলে না। ভিক্ষা দিয়ে পুণ্য লোভীদের দলে নাম লেখাতে চাই না। মনে হয় ভিক্ষা সমাজকে হয়তো কর্মবিমুখ করে তোলে, আগামী প্রজন্মের মূল্যবোধ নষ্ট করে দেয়। (অবশ্যই ব্যক্তিগত মতামত। কারণ কে কোন অবস্থায় ভিক্ষা বৃত্তি বেছে নিয়েছে, সঠিক কারণ জানা সম্ভব নয়। তাই কোনো শ্রেণীকে আঘাত করা উদ্দেশ্য নয়, অজান্তে হলে ক্ষমা প্রার্থী) তাই কৃপণ, নিষ্ঠুর, অমানবিক বদনাম নিতে সানন্দে রাজী, তাতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা, আপত্তি নেই।
    যাই হোক আসল কথায় আসি। অতি আশীর্বাদ বৃষ্টিতে অতিষ্ঠ হয়ে বর্তমানে রাজধানীর রাজনৈতিক অবস্থান জেনেও আমি বলে উঠলাম, “হাম আল্লা বালে হ্যায়…” উদ্দেশ্য অবশ্যই এটা বুঝিয়ে দেওয়া যে আমি ভিন্নধর্মী, তাই ভিন্নধর্মীকে ভিক্ষা দেওয়া যাবে না ( ধর্ম নিয়ে কট্টর অবস্থানটা… যাচিয়ে নেওয়া আর কি!)। আমাকে ততোধিক অবাক করে দিয়ে গেরুয়াধারী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো “জয় আল্লা, জয় হো আল্লাহ” যথারীতি হাতটা সামনে এগিয়ে।
    একা ছিলাম তাই প্রথমেই হেসে উঠলাম আপন মনে, মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে। ভাবলাম ধর্ম, ধর্মবোধ কতো সহজ এদের কাছে!
    পরমুহূর্তেই কেমন লজ্জা লাগলো নিজের হাসির উপর। পৌরহিত্য যদি একটি পেশা হয়, তাহলে ভিক্ষা বৃত্তিও ধরে নিলাম এক শ্রেণীর পেশা। তিনি না হয় স্বাধীন ধর্মব্যবসায়ী। কোনো পেশায় ধর্ম তো প্রতিবন্ধক হতে পারে না, গোঁড়ামি সাজে না। নমনীয়তা তো উত্তরণের চাবিকাঠি। আমার এ ভাবনার মাঝেই অবশ্য সেই ব্যক্তি সরে গিয়ে অন্য স্থানে আশার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, এ যে জীবিকার তাগিদ। তারপরেই ভাবলাম আমাদের দেশের তাবড় তাবড় নেতারা, বিদগ্ধ জনেরা যেখানে ধর্মের নামে অসহনশীল হয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করতে পারেন নিমেষে। ধর্মীয় রক্ষাকবচ পড়ে দেশ উন্নয়নের, সমাজ উদ্ধারের মিথ্যা অমৃত বাণী শোনান। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাঠগড়ায় তোলেন নিজেদের (ভোট) পাওয়ার হিসেব ঠিক রাখতে। সেইখানে উদরপূর্তির কারণে, যা জীবনের নূন্যতম চাহিদা- ভেদাভেদ মিটিয়ে দিয়ে এক কন্ঠে ‘রাম-রহিম’ উচ্চারিত হয়ে যায় অবলীলায়, ধর্ম ভেদাভেদের প্রাচীর তুলতে পারে না সেই নূন্যতম চাহিদার কাছে। সত্যিই, পেটের দায় বড়ো দায়- আমাদের নেতা, বিদগ্ধ জনেদেরও যদি এই জ্বালা থাকতো! ধর্ম মনে হয় আর মঞ্চে ফেরি হতো না, আদালতে হাজিরার দিন গুনতো না। ভীষণ দরকার ছিল তথাকথিত মাননীয়দের এই জ্বালার, ক্ষুধার জ্বালা উপলব্ধি করার। তাহলে বাড়িয়ে দেওয়া ভিক্ষার হাত সমাজ থেকে হয়তো মুছে যেত চিরতরে।

    সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার- কর্তব্য, সাম্যবাদ রণনীতির অনেক নাম, অনেক কৌশল তো শুনলাম বিগত বেশ কয়েক দশক ধরে। সবকিছুর বুনিয়াদ বোধ হয় মিথ্যের অবগুণ্ঠন পড়ে আছে। সব নীতি সরিয়ে দিয়ে ভিক্ষা দিয়ে নিজের কর্তব্য সারা হয়ে গেছে না ভেবে, ভিক্ষাবৃত্তির অতীত- বর্তমান-ভবিষ্যত একবার তলিয়ে ভাবা যায় না কি?
    সাম্যবাদী, শান্তিকামী, শ্রেণী শোষনের বিরুদ্ধে যাঁরা, ধর্মের কাণ্ডারী নেতারা সবাই মিলে ভাববেন না কি একবারও? শুদ্ধিকরণ হোক একবার?

    নগণ্য নাগরিক

  • চিঠি

    চিঠি- খোলা চিঠি

    খোলা চিঠি
    -পারমিতা ভট্টাচার্য

     

     

    শ্রীচরণেষু
    মা,

    অনেক দিন হলো তোমাদের কোনও খবর পাইনি। আশা করি ঈশ্বরের কৃপায় তোমাদের সব খবরই কুশল। বাবার বুকের ব্যথাটা কেমন আছে মা? পরান বাবু দাদার চাকরিটা করে দিয়েছে? মিলি এখন কত বড় হয়েছে মা? কত দিন হয়ে গেল তোমাদের দেখিনি। জানো মা, শহরে যখন তুমুল বৃষ্টি নামে আমি জানালার ধারে বসে তখন ছোট বেলার বৃষ্টি ভেজার দিনগুলোর কথা মনে করি। শ্রাবণের ধারা তখন গড়িয়ে পড়ে আমারও গাল বেয়ে। মনে আছে মা, বৃষ্টিতে ভেজার পর তুমি তোমার আঁচল দিয়ে আমার গা, মাথা মুছিয়ে দিতে। জ্বর হলে সারা রাত মাথার কাছে জলপট্টি আর পাখা নিয়ে বসে থাকতে জেগে। তোমার গায়ের গন্ধ কত দিন পাইনি মা। খুব লোভ হয় জানো সেই গন্ধটার। তাই কালীপুর যাওয়ার সাহস না হলেও স্টেশনে গিয়ে বসে থাকি। তখন দূর থেকে দেখি দাদা স্টেশনে বাপি, ছটুদের সাথে তাস খেলছে, মদ খাচ্ছে, খিস্তি দিচ্ছে মুখে। আমি একদিন কিছু টাকা তোমাকে দিতে গিয়েছিলাম মা। কিন্তু দাদা কিছুতেই আমায় বাড়ি যেতে দিলো না। বলল, ‘নষ্টা মেয়ে! তুই গেলে আমাদের বাড়ির মান সম্মান সব মাটিতে মিশে যাবে।’ কিন্তু টাকাটা ছিনিয়ে নিলো আমার হাত থেকে। আমি নষ্টা মেয়ে আর আমার রোজগারের টাকাটা খুব প্রয়োজনীয়…. তাই না? আমি প্রতি মাসে আমার গতর বেচে তোমাদের যে টাকা পাঠাই, তা দিয়ে তোমাদের মুখে অন্ন জোটে। এক বারও ভেবে দেখো ওই টাকাতে কতটা চোখের জল, হৃদয় নিংড়ানো কষ্ট মিশে আছে?

    মাত্র ওই কটা টাকার জন্য তোমার সনাতন বাবুর মত পিশাচের হাতে আমায় তুলে দিয়েছিলে। আর পিশাচটা লোক দেখানো আমায় বিয়ে করে এনে তোলে এই বেশ্যাখানায়। আমাকে বেচে দেয় মোটা টাকার বিনিময়। আমাকে বেচা টাকাতে তোমরা কোঠা দালান বাড়ি তুলেছিলে। সাজিয়ে ছিলে নিজেদের সংসার। আমি জানি মা, আমার মত সমত্ত মেয়ের বাড়িতে থাকার জ্বালা। প্রতিবেশীদের, আত্মীয় স্বজনের নজর এড়াতে তাই আমায় বাড়ি থেকে একেবারেই নিকেশ করে দিলে। জানো মা, আমার আজ আর কোনও দুঃখ নেই। কোনও অভিযোগও নেই তোমাদের বিরুদ্ধে। এখন আমি আর কাঁদি না। শরীরে – ব্যথা – যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমি এটা বুঝি যে আমি তোমাদের গলায় কাঁটার মত আটকে ছিলাম। আর আমার মত উঠতি বয়সের মেয়েকে খাওয়ানো পরানো অনেক ঝামেলার ব্যাপার। মা, আমার মত অতি সাধারণ একটা মেয়েকে বেচে দালান কোঠা তোলায় কোনও অপরাধ নেই। কিন্তু ওই মেয়েটা সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তার ছায়া মাড়ালেও অপবিত্র হতে হয়। পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মুখ দেখাতেও লজ্জাবোধ হয় তোমাদের।

    তোমায় তো মা বলে ডাকার আরও কেউ আছে, মা। কিন্তু আমি কাকে মা বলে ডাকি বলো দেখি? মা তো একটাই হয়, তাই না? তোমরা কি পারতে না একটা গরীবের ছেলে দেখে আমার বিয়ে দিতে, সংসার করে দিতে? আমি ভালো আছি মা এখানে। রোজ খাটে শুই। ভালো ভালো খাবার খাই, সুন্দর সাজগোজ করি। আমার কোনও কিছুর অভাব নেই মা। অভাব শুধু তোমাদের, অভাব একটা সংসারের, অভাব একটা নিজের মনের মানুষের। একটা অনুরোধ রাখবে মা আমার? আর কখনও কোনও অনুরোধ তোমার কাছে করবো না। তোমরা মিলির একটা বিয়ে দিও। গরীব ঘরের ছেলে হলেও দেখে ওর একটা সংসার করে দিও। ওর একটা সংসার হোক, মনের মানুষ হোক, মা বলে ডাকার কেউ থাকুক ওকে। আর যদি একান্তই বিয়ে দিতে না পারো তাহলে ওকে তোমরা ওর ভালোবাসার মানুষের কাছে চলে যেতে দিও। ও তার সাথে সংসার করুক। আমাকে তোমরা কৌশিকদা’র সাথে যেতে দাওনি। কারণ ও নিচ জাতের ছিলো। আমিও সে দিন তোমাদের কথা অমান্য করতে পারিনি। তার ফল আমাকে জীবন দিয়ে চোকাতে হচ্ছে মা। এতটা ভালো আমার নাও করতে পারতে তোমরা। তোমাদের মতই না হয় আমিও খুদ কুঁড়োর অভাবের সংসার করতাম। তবুও তো বাঁচতাম। এখন যে প্রতিনিয়ত মরি আমি। মিলির বিয়ের জন্য টাকা জমিয়ে আমিও রাখছি। তোমায় পাঠাবো। আজকাল তোমাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে। এ জীবনে কি সেটা আর সম্ভব হবে? আজ এই পর্যন্তই থাক। তোমরা সবাই খুব ভালো থেকো। তুমি, বাবা ও দাদা আমার প্রণাম নিও। মিলিকে আমার ভালোবাসা দিও। আর মনে মনে ভেবো তোমার বড় মেয়ে মরে গেছে তোমাদের জীবন থেকে।

    ইতি,
    তোমার একান্ত অভাগী

  • চিঠি

    চিঠি- উন্নাসিক

    উন্নাসিক
    -অমিতাভ সরকার

     

     

    ভীষণ কৃপণ শব্দ দিয়ে তোমাকে চিঠি লিখব ভেবেছিলাম কিন্তু হল কই?
    স্বমহিমায় সেই মথিত কথাগুলোই তো বারবার আসতে শুরু করেছে। সুচরিতাসু কেন তুমি বারবার আমার স্বপ্নের মাঝে এসে আমাকে অনুপ্রাণিত করো তোমার দুটি নয়নের দিকে তাকিয়ে থাকার জন্য। আমি দেখি আর অনুভব করি, তুমি কি লাজুক তাইনা?
    আমি বসে থাকি বাতায়নে তোমার অপেক্ষায়, অনেক অপেক্ষায়। তুমি পথ ধরে সোজা চলে যাও, তুমি মুখ তুলো না একটিবারের জন্য। আমি চাই, হ্যাঁ আমি চাই তুমি একটু মুখ তুলে আমার দিকে চাইবে। তোমার এটা উন্নাসিকতা কিনা জানিনা তবে তোমার এই ভাবনাটা তোমাকে আরও কাছে পাওয়ার চাহিদা বাড়িয়ে দেয়।

    মাঝে মাঝে ভাবি এই ভাবেই তো কবিতার জন্ম হয়। তুমিতো কবিতা আমার প্রথম ভালোবাসা, আমার প্রথম প্রেম তুমি, দ্বিধা নাই বলতে। আমি নিবেদিত তুমি কি গ্রহণ করবে না? না অবক্ত হয়ে আমার হৃদয় মন্দির আলোকিত রাখবে জীবনের প্রথম ভালোবাসা হয়ে। এই জীবনের অনাস্বাদিত সম্পদ হয়ে।একি স্বপ্নের মায়াজালে আমি আবদ্ধ!

    না না আমি আকন্দ ফুল হয়ে সারা জীবন থেকে যাব।আমার সোহাগ তোমার শ্রী চরণে গিয়ে তোমাকে আপ্লুত করবেই করবে। তুমি আমাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হবেই এই বিশ্বাসই আমার ভালোবাসা ,আমার প্রথম প্রেম। একটা দিনও তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। তোমার উন্নাসিকতার এটাই হবে শাস্তি।

  • চিঠি

    চিঠি- ঈশ্বরের চিঠি

    ঈশ্বরের চিঠি
    – তমালী বন্দ্যোপাধ্যায়

    স্নেহের মানুষ,

    তোরাই তো সেই মানুষ…? অধম, অর্বাচীন, হিংস্র, নিন্দুক, স্বার্থপর, পিশাচ? তোরাই তো সবসময় মুখে ধম্ম ধম্ম করে চেঁচাস…অথচ হেলায় নিজের মানব ধর্ম বিসর্জন দিয়েছিস…একবার চারদিকে তাকিয়ে দ্যাখ আমার সৃষ্ট সকল উদ্ভিদকুল, প্রাণীকুল তাদের নিজ নিজ ধর্ম বজায় রেখে বেঁচে আছে। তোদের আমি সবচেয়ে বুদ্ধিমান করে বানালাম আর তোরাই কি’না পৃথিবীর সবচেয়ে নির্বোধ প্রাণী হলি!!

    মুখে তোদের ঈশ্বরের জয়গান–অথচ হিংসা দিয়ে, ঈর্ষা দিয়ে, লোভ দিয়ে, ঘৃণা দিয়ে আমাকে প্রতিমুহূর্তে ব্যথিত করিস। তোদের অস্ত্রের প্রতিটি খোঁচায় আমি রক্তাক্ত হই…চোখ বন্ধ করি ভয়ে, অন্ধ হতে চাই।

    তোরাই তো সেই মানুষ যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাকে ছুঁতে চাস মন্দিরে, মসজিদে, গীর্জায়? কিন্তু তোরা কি জানিস না…আমি সেখানে থাকিই না… আমি জলে, আকাশে, বাতাসে,গাছে লতায়, সমগ্র প্রাণীকুলে মিশে আছি…আছি তোদের প্রাণের ভিতর।

    তোদের মন্ত্রোচ্চারণ, আজান,প্রার্থনা আমার কানে পৌঁছায় না কারণ তোদের স্বার্থপর, অহংকার, নিন্দা, বিবাদ বাক্য শুনে শুনে আমি ক্লান্ত…আমি বধির হতে চাই।

    তোদের ব্যবহার, তোদের মুখোশ পরা মুখ দেখে আমি নির্বাক। তোদের প্রতিটি দুষ্কর্ম আমায় লজ্জা দেয়, ব্যথিত করে আমায়.. আমি খুশী হইনা মোটেও।

    আর শোন, তোরা ধর্মের নামে হানাহানি বন্ধ কর।আর ওই যে তোরা ধর্মগ্রন্থ মানিস…ওটাও আমি বানাইনি…বানিয়েছিস তোরা…নিজেদের প্রয়োজনে। সেই অতীত যুগের নিয়মকানুন তোরা আধুনিক,উত্তর আধুনিক যুগেও চালাতে চাস নিজের প্রয়োজনে…আমার কোন প্রয়োজন নেই এসবে।আমি শুধু বলি তোরা সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চল…আধুনিক হ’ ..পুরোন ধ্যানধারণা আঁকড়ে বাঁচিসনি…মনে জ্ঞানের আলো জ্বাল আর পিছনে না ছুটে সামনে এগো…নতুন কিছু করে দেখা।

    আমি প্রতিদিন দেখি ধর্ম মানতে গিয়ে তোরা অধর্ম করিস আর ধার্মিক হতে গিয়ে অধার্মিক হোস। প্রতিদিনের জীবন সুন্দর ভাবে অতিবাহিত করাই আসল ধর্ম পালন।আমি চাই আমার নাম নিয়ে তোরা শুদ্ধ হ’,সৎ হ’,জ্ঞানী হ’, ভালোমানুষ হ’, মানবিক হ’…সব অজ্ঞানতা থেকে বেরিয়ে এসে জ্ঞানের আলো জ্বাল নিজেদের মনে…খুশী থাক, ভালো থাক আর অন্যকেও ভালো রাখ রে মানুষ।

    আর শোন স্বর্গ, নরক বলে কিছু নেই। একমাত্র এই গ্রহ পৃথিবী যেখানে তোরা আছিস, সেটাই আছে…তোরাই ভালোবেসে সেটাকে স্বর্গ বানাস আবার দলাদলি, মারামারি, হানাহানি করে সেটাকেই নরক বানাস।

    তবে এটা সত্যি যে পাপ-পুণ্য আছে আর আছে কর্মফল। একটু খেয়াল করে দেখিস তোরা অন্যায় করলে,আঘাত দিলে সেটা তোদের জীবনে ঠিক ফিরে আসে অভিশাপ হয়ে… আজ নয়তো কাল…এটাই কর্মফল…বুঝলি অজ্ঞান মানুষ?

    আর ধর্ম ধর্ম করে বিপুল অর্থব্যয় বন্ধ কর।আমার কিছুর অভাব নেই…তাই ঘুষ দিয়ে পুজো উপচারে আমাকে খুশী করতে আসিসনা…তাতে আমি রুষ্টই হবো।আর প্রচুর অর্থ খরচ করে উৎসব অনুষ্ঠান আর ধর্মস্থান…মন্দির,মসজিদ,গীর্জা না বানিয়ে সেই টাকা গরীবদের দান কর…আমি তাতে খুশীই হবো।

    ভালো করে মনে রাখিস আমার সব কথা।
    তোরা শুদ্ধ হ’…তাহলে তোদের বিশ্বাস আমি দু’হাত পেতে নেবো…তোদের সমর্পণে আমি খুশী হবো। নয়তো চিরকাল আমি অন্ধ-বোবা-কালা পাষাণ হয়েই থাকবো।

    আমি চাই সমগ্র উদ্ভিদকুল আর প্রাণীকুলকে তোরা রক্ষা করবি..প্রকৃতিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবি..নিজেদের বিপদ নিজেরা ডেকে আনবি না। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে ভালো থাকিস।
    ইতি
    তোদের এক এবং একমাত্র ঈশ্বর

  • চিঠি

    চিঠি- স্ত্রীর চিঠি

    স্ত্রীর চিঠি
    – শচীদুলাল পাল

     

    প্রিয়তম শরৎ
    অনেকদিন হলো তোমার চিঠি পাইনি।বছর ঘুরে আবার আশ্বিন এলো।দুর্গাপূজাও এসে গেলো। সেই যে গেলে কোন দেশে চাকরি করতে। বছর ঘুরে গেল, তুমি এলে না।আবার এক বছর বাদে তুমি আসবে।আশায় রয়েছি।রাতে ঘুম আসছেনা, রাত জেগে চিঠি লিখছি।এখন ভরা শরৎ। মেঘে ঢাকা আকাশ।রিমঝিম বৃষ্টি হচ্ছে।উঠানে শিউলির ডালে কুঁড়িতে ভরে গেছে। কাশ ফুলে ফুলে চারিদিক সাদা।মালতি লতায় জল পড়ে অবিরাম। চারিদিকে ব্যাঙের ডাক।পুঁই লতাটা কত বড় হয়ে গাছ বেয়ে উঠছে।
    টগর গাছে কত ফুল ফুটে আছে।সকালে উঠে দেখতেই তোমার কথা মনে পড়ে।সামনে একফালি খেতে সবুজের সমারোহ। কত করেলা ঢেড়শ কচু শশা হয়েছে।লতায় পাতায় ভরে গেছে। পেয়ারা গাছটা থেকে কত পাকা পেয়ারা মাটিতে পড়ে।জল টইটম্বুর ডোবাটায় অসংখ্য মাছগুলি মনের আনন্দে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। হাঁস গুলি জল কেলি তে মত্ত জোড়ায় জোড়ায়।দূরে ধানের খেতে রৌদ্র ছায়া।
    মাঝে মাঝে দেখি   নীল আকাশেসাদা মেঘ রাশি রাশি।শরতের সৌন্দর্য প্রকৃতি রূপময়। গাছপালার পত্রপল্লবে গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার ফিকে হয়ে আসতেই পাখপাখালির দল মহাকলরবে ডানা মেলে উড়ে যায় নীল আকাশে।আকাশের উজ্জ্বল নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে মালার মত উড়ে যায় পাখির ঝাঁক। বিলের জলে শালুক শাপলা আলোকিত প্রস্ফুটিত।
    পুকুরপাড়ে আমগাছের ডালে মাছরাঙা ধ্যান করে।স্বচ্ছ জলে পুঁটি,চান্দা বা খলসে মাছের রূপালি শরীর ভেসে উঠলে সে ছোঁ মেরে তুলে নেবে তার লম্বা ঠোঁটে।নদীর চরে চখাচখি ,পানকৌড়ি, বালিহাঁস বা খঞ্জনা পাখির ডাক।কলসি কাঁখে মেঠো পথে হেঁটে চলে গাঁয়ের বধূ।
    তোমার আসার আশায় আছি। রিয়া তোমার কথা সব সময় বলে। বাবা কবে আসবে। ওকে অনেক স্বান্তনা দি।কিন্তু আমি আর পারছিনা। গভীর রাতে কত  ঘুম ভেঙে গেছে। মনে হয়েছে তুমি এসেছো।আমার পাশেই আছো।বিরহ জ্বালায় জ্বলে মরি।ভরা ভাদ্রের মতো চোখে জলে ভরে যায়। তবু তোমার দেখা নাই। মনে অনেক আশঙ্কা।একদিন পুকুরে স্নান সেরে ফিরছি পাড়ার একটা বউ বলেই দিল “

    তোর সোয়ামী কবে আসবেক।দেখগা অন্য মেয়া নিয়ে ফুর্তি করছে। তুর কুথা কি আর মনে আছে।”
    আমি মনকে বুঝাই, না না এমন কি করে হবে।আমি ত তোমাকে কত ভালবাসি। তুমি এমনি করতেই পারোনা।
    মাঝে মাঝে যখন বৃষ্টি পড়েনা।আকাশ পরিস্কার থাকে তখন শরতের চাঁদের আলোয় ঘর ভরে যায়।আমিও আনমনা হয়ে যায়। ভরা ভাদরের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। তোমার আমার মিলনের কথা বেশি করে মনে পড়ে। সামনে পূজা। এবার আমার জন্য দামি শাড়ি নিয়ে এসো তিনটা। রিয়ার জন্য, বাড়ির সবার জন্য দামি দামি জামা কাপড় এনো। আমরা এবার শহরে যাব ঠাকুর দেখতে। পুজা প্যান্ডেলে ঘুরব। অনেক আশা নিয়ে রইলাম। তুমি না থাকলে আমার সাজতে ভালো লাগেনা।তুমি যেদিন আসবে সেদিন থেকে শাড়িগুলো বের করে পরবো। অনেক সাজব।এমনভাবে তোমাকে বেঁধে রাখব তুমি আর আমাকে ছাড়া অন্য কারোর কথা ভাবতেই পারবেনা।রাত প্রায় শেষ হলো। দূরে কোথাও পাখীদের কিচির মিচির। রাত শেষে ভোর হচ্ছে। আমার ও রাত শেষ হবে। তুমি আসবে। আবার আঁধার শেষে আমার জীবনেও সূর্য উঠবে।
    ইতি
    তোমার স্ত্রী
    টগর

You cannot copy content of this page