• গল্প

    গল্প- হঠাৎ দেখা

    হঠাৎ দেখা
    -জয়তী মিত্র

     

     

    বহুবছর বাদে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে রঞ্জন। তার ছোট কাকার ছোট মেয়ে পলির বিয়ে উপলক্ষে তার গ্রামে ফেরা। বাবা, মা অনেকদিন আগেই চলে এসেছে। রঞ্জন চাকরী সূত্রে প্রবাসে থাকে। সেখান থেকে সোজা গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে শেষ গ্রাম সংলগ্ন রেল টেশনে এসে পৌঁছায়। রাত তখন প্রায় নয়টা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। একটা মাত্র অটো দাঁড়িয়ে আছে। আর কোন যানবাহন নেই। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে রাস্তা জলে ভরে গেছে। বৃষ্টির জন্য লোকজন তেমন নেই বলে সব বাড়ি চলে গেছে, একজন ছাড়া। এত বছরে চেনা জায়গাগুলো কত পরিবর্তন হয়ে গেছে।
    কিছু চেনা যাচ্ছে না। বাবার বদলির চাকরী ছিল। সেই সূত্রে তারা বহুবছর বাইরে, বাইরে কাটিয়েছে। রিটায়ার করার পর কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে সেখানেই থাকে। এর আগে জেঠুর মেয়ে, আর কাকার বড়ো মেয়ের বিয়ের সময় রঞ্জনের বাবা, মা গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল, কিন্তু রঞ্জন তখন পড়াশুনার জন্য অন্য রাজ্যে ছিল। ছুটি পায়নি বলে আসতে পারেনি। কত বছর পরে দিদিদের সাথে তার দেখা হবে। ভীষণ আনন্দ হবে।
    স্টেশন থেকে রঞ্জনদের পৈতৃক বাড়ি প্রায় পঁচিশ মিনিটের পথ। রঞ্জন ভাবলো, ভাগ্যিস একটা অটো ছিল না হলে এই বৃষ্টি মাথায় করে তাকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হতো।

    অটোর কাছে গিয়ে রঞ্জন বললো, তালবাগান যাবে? অটো চালক বললো, যাবো। আপনি কাদের বাড়ি যাবেন? রঞ্জন বললো, বিমল রায়দের বাড়ি যাবো। একথা শুনে অটোচালক বললো, আপনাকে চেনা, চেনা লাগছে। আপনি রঞ্জন? রঞ্জন বললো, হ্যাঁ, কিন্তু আপনি আমাকে কি করে চিনলেন? অটোচালক এবার আপনি থেকে সরাসরি তুই-তে নেমে এসে বললো, আরে আমি পল্টু আমাকে চিনতে পারলি না, অবশ্য না চেনারই কথা,সেই কত বছর আগের কথা। রঞ্জন এইবার ছোটবেলার বন্ধুকে চিনতে পেরে বললো, তুই সেই পল্টু! কত খেলেছি, পুকুরে সাঁতার কেটেছি, আমগাছের আম পেড়েছি, একসাথে বল? কতবছর বাদে দেখা হলো বল। কিন্তু তুই তো পড়াশুনায় ভালো ছিলি, চাকরী পাস নি নাকি রে?
    পল্টু বললো, ক্লাস টেন-এ ওঠার সময় বাবা মারা গেল। ছোট বোন আর মায়ের মুখের ভাত জোটানোর জন্য অটো চালাচ্ছি সেই থেকে। বোনের বিয়ে দিয়েছি। মা’ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি বাড়ীতে একা থাকি। বিয়ে করিনি। কথা বলতে, বলতে রঞ্জনের বাড়ি চলে এলো। ভাড়া দিতে গিয়ে বন্ধুর হাতের স্পর্শে বুক কেঁপে উঠলো রঞ্জনের, কি বরফের মত ঠান্ডা হাত। চোখ দুটো কেমন যেন লাল। পল্টু বললো, তুই আমার বন্ধু, তোর থেকে কি আমি ভাড়া নিতে পারি বল। ভাড়া লাগবে না রে। চললাম বন্ধু, আর আমাদের দেখা হবে না বলে গাড়ী ঘুরিয়ে চলে গেল পল্টু।
    আর দেখা যাচ্ছে না তো অটোটা। এই তো ছিল এর মধ্যে কোথায় চলে গেল? যাক গে বাড়ি যাই। রঞ্জনকে দেখে তার বোনেরা ছুটে এলো। কতদিন বাদে দাদার সাথে দেখা। দাদাকে এক বোন জিজ্ঞাসা করলো, এই ঝড়,জলের রাতে কিসে এলি? রঞ্জন বললো, আমার ছোটবেলার বন্ধু পল্টুর অটোতে। কি বলছিস দাদা, পল্টু তো গত বছর একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছে! এবার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে লাগলো রঞ্জনের। হাত,পা কাঁপতে লাগলো। তাহলে কি বন্ধু পল্টুর আত্মা তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেল? প্রচন্ড ভয় পেয়ে ঘামতে লাগল রঞ্জন।

  • গল্প

    গল্প- টক ঝাল মিষ্টি সম্পর্ক

    টক ঝাল মিষ্টি সম্পর্ক
    -জয়তী মিত্র

     

     

    বলি ও ছোট বৌমা ছাদ থেকে আচারের শিশিগুলো নিয়ে এসো, আজ আমার বাতের ব্যথাটা খুব বেড়েছে, আমি আনতে পারবো না। সারাদিন ফোন না হলে সিরিয়াল এই নিয়েই পড়ে থাকো কাজে একদম মন নেই। বড় বৌমা স্কুল থেকে চলে এলে আজ চা’টাও তোমাকেই করতে হবে। মুখের সামনে চা না পেলে আবার ওনার মেজাজ গরম হবে। এই বয়সে এসে এত ফাই ফরমাস আর খাটতে পারি না। সারা জীবন সংসার, দুই ছেলে মানুষ করা তারপর এখন বৌমাদের ফাইফরমাস খাটতে খাটতে জীবনটা শেষ হয়ে গেল। এই পড়ন্ত বেলায় এসেও নিজের দিকে তাকাবার সময় নেই। যে দিক না দেখবো সেইখানেই সমস্যা সৃষ্টি হবে।
    ছোট বৌমা তিথি বললো, এই নাও তোমার আচারের শিশি, তোমার জ্বালায় একটু সিরিয়াল দেখার জো নেই, এখন আবার তোমার আদরের বৌমার জন্য চা বানাতে হবে। মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে। কি আর করা যাবে,আমি তো আর চাকরী করি না, আমাকে তো কাজ করতেই হবে।

    মলিনা দেবী বললেন, এমন কেন বলছো ছোট বৌমা, আমি তো সংসারের রান্নাবান্না সবই করি, তুমি আমাকে সাহায্য করে দাও। ছেলেরা রান্নার লোক তো রাখতে বলে, এবার ভাবছি তাই করবো আর পারছি না। তিথি বললো দিদি ভাইয়ের সামনে তো চুপ করে থাকো, আমাকে যত কথা শোনাও।আমার ঘাট হয়েছে বৌমা আর আমি তোমাকে কিছু বলবো না।
    তিথি বললো, অমনি রাগ হয়ে গেল তাই না। আমি কিছু বললেই তোমার রাগ হয়, আর দিদিভাইয়ের মুখ ঝামটা খুব ভালো লাগে তাই না মা?
    তিথি আর মলিনা দেবীর মধ্যে এমন মাঝে মাঝেই চলতে থাকে, দুদিন দুজনের কথা বন্ধ তারপর নিজেরাই কেউ কারোর সাথে কথা না বলতে পেরে হাঁপিয়ে ওঠে, আবার গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে দুজনে।

    মলিনা দেবীর বড় বৌমা কবিতা খুব
    অহঙ্কারী। চাকরী করে বলে মাটিতে তার পা পড়ে না। পান থেকে চুন খসলেই তার মেজাজ শুরু হয়। মলিনা দেবী তাকে একটু সমীহ করে চলেন। তিথিও তার সাথে একটু দুরত্ব বজায় রেখে চলে।
    মলিনা দেবীর স্বামী অমল বাবু সরকারী চাকরী করতেন কিন্তু বড়ো সংসারে তাকেই বেশি টাকা দিতে হতো, দুই বোনের বিয়েতে মোটা টাকা খরচ করতে হয়েছে, নিজের দুই ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে নিজের জন্য কিছুই করতে পারেন নি। রিটায়ার করার পর যা পেয়েছিলেন তার অনেকটাই ওনার অসুখের পেছনে খরচ হয়ে গিয়েছিল। তাদের পৈতৃক বাড়িটাতে অনেক শরিকি ঝামেলা ছিল, তাই তিনি জমি কিনে রেখেছিলেন, পরে বাড়ি করবেন বলে। কিন্তু ওনার সে আশা পূরণ হয় নি। বাড়ি করার আগেই তিনি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যান।
    তারপর বড়ো ছেলে সুদীপ সেই জমিতে লোন নিয়ে বাড়িটা তৈরি করে। অমল বাবুর দুই ছেলেই সরকারী চাকরী করে। সুদীপ যেহেতু বাড়িটা করেছে তাই তার বউয়ের খুব দাপট ছিল সংসারে। ছোট ছেলে সুব্রত তখন নতুন চাকরী পেয়েছে।
    তারপর তিথির সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর দুই বছর ছিল সবাই একসাথে ছিল। সুব্রতর বদলির চাকরী। বদলি হবার সময় তিথিকে নিয়ে তার কর্মস্থলে চলে যায়। তবে প্রতি মাসে মায়ের জন্য টাকা পাঠাতো, তিথিও শাশুড়ি মায়ের খুব খোঁজ খবর নিত।

    একদিন সকালে সুদীপ আর বড়ো বৌমা এসে মলিনা দেবীকে বলে, তোমার জন্য একটা ভালো বৃদ্ধাশ্রম পেয়েছি, ভাবছি ওখানেই তোমাকে রেখে আসবো, আমরা দুজনেই চাকরী করি, বাড়িতে থাকি না, আর তোমার রাত দিন অসুখ লেগেই থাকে, তোমার দেখভাল করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
    ছেলের মুখে এই কথা শুনে দু’ চোখ ছাপিয়ে নোনা জল পড়তে লাগলো মলিনা দেবীর। এ তার ছেলের নয়, বৌমার কথা। বৌমা কদিন ধরে তাকে আকারে ইঙ্গিতে বাড়ি ছাড়ার কথা বলছিল। বড়ো ছেলে, আর বৌমা অফিস বেরিয়ে যেতেই ছোট ছেলেকে ফোন করে সব কথা বলে মলিনা দেবী। ছোট বৌমা তিথি স্বামীর মুখে সব শুনে বলে, মা’কে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এইখানে নিয়ে এসো। সুব্রত বললো, মাকে আমি কিছুতেই বৃদ্ধাশ্রমে যেতে দেব না, তবে তোমার সাথে তো আবার দিনরাত মায়ের ঝগড়া হয়। তুমি মায়ের সাথে আর কোন বিষয়ে ঝামেলা করবে না।
    তিথি বললো, আরে ওসব আমাদের মা, মেয়ের খুনসুটি। একটু দুজনের মন কষাকষি হয়, আবার ঠিক হয়ে যায়। মা’কে যে আমি ভালোবাসি সেটা উনি খুব ভালো বোঝেন তাই না তোমাকে ফোন করেছে।
    এই হলো টক,ঝাল,মিষ্টি সম্পর্ক। সব ভালো হলে আবার তাহলে কোনো রোমাঞ্চ থাকে না। এই ঝগড়া তো এই ভাব। উনি আমাদের কাছেই থাকবেন। আমি তো দিদিভাইকে খুব ভালো চিনি, জানতাম মা’কে উনি বেশিদিন রাখতে পারবেন না।
    তারপর ছোট ছেলের কাছে এলো মলিনা দেবী। ছেলে আর বৌমার যত্নে খুব ভালোই আছে। তিথি বলে, তোমার সাথে ঝগড়া না হলে না আমার ভালো লাগে না মা। মলিনা দেবী হেসে বলেন, পাগলী মেয়ে একটা। আমার সাথে ঝগড়া না করে এবার আমাকে একটা ছোট্ট মিষ্টি নাতনি এনে দে তার সাথে হাসি মজা করে দিন কাটাই।
    বাচ্চার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে তিথি সেখান থেকে চলে গেল।
    কয়েক মাস বাদে তিথি সন্তানসম্ভবা হলো। শাশুড়ি মা তাকে খুব যত্নে রেখেছিল। যথাসময়ে একটা কন্যা সন্তান হল তিথির।নাতনি পেয়ে ঠাকুমা খুব খুশি। তাকে নিয়ে বেশ ভালই দিন কাটছে মলিনা দেবীর।

  • গল্প

    গল্প- একাদশী

    একাদশী
    -জয়তী মিত্র

     

     

    ও বৌমা আমাকে একটু সাবু মেখে দেবে, আজ একাদশী, সাবু আর ফলমূল ছাড়া আজ আমি আর কিছু খেতে পারবো না।

    তানিয়া বললো, কেন মা, একাদশী পালন না করলে কি হবে? তোমার শরীর খারাপ হবে মা, তোমাকে কিছু পালন করতে হবে না। তোমাকে নিজের জন্য আমাদের জন্য এখনও অনেকদিন বাঁচতে হবে মা। আমি রোজকার মত মাছের ঝোল আর ডাল ভাত রান্না করেছি। তুমি আজ তাই খাবে।

    তানিয়ার শাশুড়ি মা গৌরী দেবী বললেন, তুমি কি ভুলে গেছো বৌমা, আমি বিধবা, আমাদের একাদশী পালন করতে হয়। না হলে যে তোমার বাবার আত্মা শান্তি পাবে না মা। আর সমাজ কি বলবে? বিধবা মানুষ একাদশী পালন না করে মাছ, ভাত খাচ্ছে। আত্মীয় স্বজনরা আগে কটু কথা শোনাবে বৌমা।

    তানিয়া বললো, শোনো মা, আমি ওসব আত্মীয় স্বজনদের আর সমাজের কথা তোয়াক্কা করি না। যেদিন বাবা রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময় কোন প্রতিবেশী, আর কোন আত্মীয় আমাদের পাশে ছিল বলো তো? আমি আর তোমার ছেলে যখন বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম তখন বাবা আর নেই। চিকিৎসা করাবার সুযোগটুকুও আমাদের দেয় নি। হার্ট অ্যাটাকে বাবা চলে গেলো। সেই মুহূর্তে আমাদের পাশে, তোমার ছেলের দুজন কলিগ ছাড়া আর কেউ ছিল না মা। আত্মীয়রা দু’দিন পরে তোমার সাথে দেখা করতে এলো। একটু দুঃখ প্রকাশ করলো । তারপর নানা রকম বিধি নিষেধ তোমার ওপর চাপিয়ে তারা চলে গেল। তোমার দুঃখের দিনে কজন তোমার পাশে ছিল বলো তো?
    দেখো তো মা মাছের ঝোলটা কেমন হয়েছে? তোমার মত হয়েছে? তুমি তো আমাকে রান্না করতে শিখিয়েছ। তোমার কাছে কত রকম সাবেকি রান্নার পদ শিখেছি। মাছ দিয়ে ভাত মেখে জোড় করে মায়ের মুখে তুলে দিল তানিয়া।

    -ভালো হয়েছে বৌমা। তবে আজ আমি বিরাট পাপ করলাম মা।
    -কিছু পাপ হয়নি মা। সমাজ এখন অনেক আধুনিক হয়েছে। এখন সবাই মাছ, মাংস খায়। ঠিক করে। স্ত্রী মারা গেলে কি পুরুষ মানুষরা মাছ, মাংস, ডিম খাওয়া বন্ধ করে দেয়? দেয় না, বাবাকে তুমি খুব ভালোবাসতে, আর বাবাও তোমাকে খুব ভালোবাসত। ওপর থেকে বাবা, খুশি হবেন এই দেখে যে তুমি ভালো আছো। আর তুমি সারাদিন উপোস করে সাবু খেয়ে থাকলেই বাবার আত্মা কষ্ট পাবে।
    পুরুষ মানুষদের বউ মারা গেলে সমাজ তাদের আবার বিয়ে করার বিধান দেয়, কিন্তু একজন মহিলার স্বামী মারা গেলে তাকে সাদা শাড়ি পড়ে নিরামিষ খেয়ে বিধবা সেজে থাকতে হবে কেন? আমরা মেয়ে তাই। অবশ্য মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু। আমরা মেয়েরাই মেয়েদের ওপর চিরকাল নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে এসেছি। কখনো কারোর সমস্যার সমাধান না করে সেটা নিয়ে জল ঘোলা করি।

    বৌমার কথাগুলো শুনতে শুনতে কখন যে ভাতের থালা শেষ হয়ে গেছে সেটা বুঝতেও পারেনি গৌরী দেবী। বৌমার জিন্স কুর্তি পড়ায় আপত্তি থাকলেও কোনোদিন মুখে কিছু বলেন নি। আজ গৌরী দেবী বুঝলেন, বৌমা শুধু পোশাকে নয়, মানসিকতায়ও আধুনিক।
    ঠিকই সমাজে নিয়মের বেড়াজাল থেকে আমরা মেয়েরাই মেয়েদের মুক্ত করে তাদের ডানা মেলে ওড়ার সাহস জোগাতে পারি। তানিয়ার মত মেয়েরা আমাদের সমাজের সম্পদ। এই নতুন প্রজন্মের মেয়েরাই সমাজের কুসংস্কারগুলো সরিয়ে সকলকে আশার আলো দেখাতে পারবে।

  • গল্প

    গল্প- সেয়ানে সেয়ানে

    সেয়ানে-সেয়ানে
    -জয়তী মিত্র

    সকালে ঘুম থেকে উঠেই সুমিতা দেবী শুরু করে দেন পরচর্চা। এই কাজে তিনি একেবারে সিদ্ধহস্ত। কাজের মাসি মালতীর সাথে চায়ের কাপ নিয়ে বসে পড়েন পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে খোশগল্পে।পরচর্চা না করলে নাকি তার ভাত হজম হয় না।

    শপিং মলে সেদিন দেখা তার প্রতিবেশী গৌরী দেবীর সাথে। দেখা হতেই একগাল হেসে সুমিতা দেবী জিজ্ঞাসা করেন, ও দিদি তোমার ছেলে বৌমা কি সমুদ্রে বেড়াতে গেছে?

    আমার বৌমা বললো- তোমার বৌমা হট প্যান্ট পড়ে সমুদ্রে স্নানের ছবি দিয়েছে।

    গৌরী দেবী বলেন, ঠিক বলেছে তোমার বৌমা। আমার ছেলে সুদীপ আর বৌমা রিমি দুজনেই মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করে। একদম ছুটি পায় না, তাই দুজনের কোথাও যাবার সময় হয় না। তাই কদিনের ছুটি পেতেই দুজনে বেড়াতে গেছে, আমি জোর করে পাঠিয়েছি। আর সমুদ্রে তো কেউ শাড়ি পড়ে স্নান করে না, তাই হট প্যান্ট কিনে নিয়ে গেছে বৌমা। খুব মিষ্টি লাগছে বৌমাকে হট প্যান্ট পড়ে। ওদের অল্প বয়স, এখনই তো আনন্দ করবে। এর পর বাচ্চা হলে তো আর কথাই নেই, তখন কোথাও যাবার সময় পাবে না। তোমার বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?
    গৌরী দেবীর কথা শুনে সুমিতা দেবী বলেন, আমরা খুব ভালো আছি, আর থাকবো না’ই বা কেন? আমার বৌমা কত যত্ন করে আমাদের কর্তা গিন্নি দুজনকে। ঘরের কাজ, রান্না বান্না এক কথায় জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ সব বৌমা’ই করে। আমি বৌভাতের পরদিনই বৌমাকে বলেছিলাম, সংসার এখন তোমার, আমি কোনো কাজ করতে পারবো না। সবকিছু তোমাকে বুঝে নিতে হবে। আমার এখন ছুটি, আমি পায়ের ওপর পা তুলে খাব। আমার বৌমা অক্ষরে অক্ষরে আমার কথা মেনে চলে। খুব ভয়ও পায় আমাকে। শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাক পড়ে না। যা বলি তাই শোনে। তারপর আজকাল আবার আমার খুব বাতের ব্যথা হয়। তখন তো রাতদিন আমার সেবা করে। আমি খুব খুশি এমন বৌমা পেয়ে। ওই রাতদিন বাইরে বেরিয়ে চাকরী করবে এইসব আমার একদম পছন্দ নয়। চাকরী করা মেয়েরা খুব একটা সুবিধার হয় না। তাছাড়া সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকলে সংসার করবে কখন! আর আমিই শুধু সারাজীবন সংসারের ঘানি টানবো না’কি বলো?

    গৌরী দেবী সব শুনে বলেন,”বাহ! তোমার বৌমা তো খুব ভালো হয়েছে। আসলে আমি বাড়ীতে আমার একটা মেয়ে এনেছি, কোনো কাজের লোক আনিনি, আর যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমি তার স্বাবলম্বী হবার পথেও বাধা দেইনি আর বেড়াতে গিয়ে ছোট পোশাক অনেকেই পড়ে। বাড়ীতে তো আর পড়ে না। আমার বৌমা বলে-আমি ওর আধুনিকা শাশুড়ি। বৌমা আমার একজন খুব ভালো বন্ধু। আমরা দুজন একে অপরের সুখ দুঃখের সাথী, একে অপরের পরিপূরক।

    গৌরী দেবীর এইসব কথা হজম হলো না সুমিতা দেবীর। তার তখন জোঁকের মুখে নুন পড়ার মত অবস্থা। আর এক সেকেন্ড সেখানে না দাঁড়িয়ে,”আজ আসি” বলে সেখান থেকে বিদায় নিল সুমিতা দেবী।

  • গল্প

    গল্প- অমানবিক

    অমানবিক
    -জয়তী মিত্র

     

     

    “বলি এই যে নবাব নন্দিনী আর কতো ঘুমোবে, এবার দয়া করে উঠে রান্নাঘরে যাও, বাবাইয়ের অফিসের ভাতটা রাঁধো গিয়ে সাতটা বেজে গেল। আর আমাকে এককাপ চা দিয়ে যাও।

    শাশুড়ি মায়ের আওয়াজ শুনে ঝিমলি উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো, “এক্ষুনি আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি মা, কাল রাতে শরীরটা খুব খারাপ হয়েছিল তাই একটু উঠতে দেরি হয়ে গেছে।”

    ঝিমলির কথা শুনে শাশুড়ি মা রমলা দেবী বললেন, “বাচ্চা হবার সময় সবারই কম বেশি শরীর খারাপ হয় তাই বলে হেঁসেল কি বন্ধ থাকে? আমাদেরও বাচ্চা হয়েছে, আমরা ভরা মাসেও সংসারের যাবতীয় কাজ করেছি। এই তোমাদের মত এত ন্যাকামি করে বেলা অবধি শুয়ে থাকতে পারিনি। তোমার তো সবে পাঁচ মাস, এই সময় আমি তো প্রচুর কাজ করতাম। তোমার দেখছি আজ কাল কাজে মন নেই, রান্নাটাও বাপের বাড়ি থেকে ঠিক মতো শেখোনি। তোমার মা তো কিছুই শেখায় নি তোমাকে। খালি মুখে মুখে তর্ক করা শিখিয়েছে।”
    ঝিমলি বললো,”আপনি যা বলার আমাকে বলুন, আমার মায়ের কি দোষ? বাপের বাড়িতে সব মেয়েরাই আদরে থাকে, শ্বশুর বাড়ি এসে সবাই আস্তে আস্তে কাজ শিখে নেয়।”
    -“তুমি হাসালে বৌমা, তুমি বাপের বাড়ি ছিলে আদরে? তোমার বাপের বাড়ির যা অবস্থা- নুন আনতে পান্তা ফুরোয়..তুমি আর কথা বলো না। বাবাইকে কত বড়ো ঘরে বিয়ে দেবো ঠিক করেছিলাম। বাবার বিরাট কাপড়ের ব্যবসা। কত জমি জায়গার মালিক। এক মাত্র মেয়ে ছিল। আমার বাবাই ভবিষ্যতে সব সম্পত্তির মালিক হতো। বাবাইটা একটা বোকা, না হলে তোমার মতো একটা গরীবের ঘরের মেয়েকে বিয়ে করে আনে। সে তোমাকে ভালোবাসে, তাই তোমাকে ছেড়ে আর কাউকে বিয়ে করতে রাজি হলো না। পাগলেও নিজেরটা বোঝে আর ও বুঝলো না। সবই আমার কপাল কি আর করা যাবে, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিলাম। কিন্তু তুমি এতটাই অযোগ্য যে কোনো কাজই ঠিক মতো করতে পারো না। নাও এখন রান্নাবান্না সেরে বাসনগুলো মেজে রেখো, আজ মানোদা কাজে আসবে না।”
    রমলা দেবীর এক মেয়ে আর এক ছেলে। মেয়ে মিতার বিয়ে হয়েছে চার বছর হলো। আর একমাত্র ছেলে বাবাই মিতার থেকে দুই বছরের ছোট। দুই বছরের একটি পুত্র সন্তান আছে মিতার। মিতা যখন চার মাসের গর্ভবতী তখন মিতাকে শ্বশুর বাড়ি থেকে নিজের কাছে নিয়ে আসে রমলা দেবী। সব সময় মেয়ের যত্ন নিতেন। সারাক্ষণ মেয়ে কি খাবে? কতক্ষন বিশ্রাম নেবে? এইসব নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকতেন। তারপর নাতি হলে তাকেও যত্ন করে চার মাস নিজের কাছে রেখে একটু বড়ো করে মেয়েকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়েছেন। মেয়েকে চোখে হারান রমলা দেবী।
    আর ছেলের বউ-এর বেলায় রমলা দেবীর অন্য চেহারা দেখে ওনার এক দূর সম্পর্কের বোন একদিন বেড়াতে এসে বলেই ফেললো, “দিদি, নিজের মেয়েকে তো এই সময় কত যত্ন করতে আর ঝিমলির বেলায় অন্য রকম ব্যবহার কেন করছো? ও তো তোমার বাড়ির বউ।”
    -“দেখো মিতা আমার মেয়ে আর ঝিমলি আমার বৌমা। দুজনের মধ্যে অনেক ফারাক। মেয়ে আর বৌমা কখনও এক হয় না। নিজের তো বিয়ে হয়নি তাই এইসব বুঝবে না।”
    রমলা দেবীর বোন বললো, “আমার বোঝার দরকার নেই। তোমাদের মত শাশুড়ি থাকলে সংসারে কোনোদিন শান্তি আসবে না। কেন যে তোমরা বৌমাকে মেয়ে ভাবতে পারো না কে জানে? ভালোবাসা দিয়েই ভালোবাসা অর্জন করতে হয়। তুমি যদি বৌমাকে ভালোবাসো সেও তোমাকে সম্মান করবে, এটা যে কবে বুঝবে কে জানে? তবে সবাই যে খারাপ নয়, ব্যতিক্রমও আছে আমাদের সমাজে, তবে সেটা সংখ্যায় কম। তুমিও যে একদিন বাড়ির বউ ছিল সেটা বোধ হয় ভুলেই গেছ। তোমার শাশুড়ি মা তো তোমাকে কতো ভালোবাসতেন, তোমার দোষ ত্রুটি আড়াল করে রাখতেন, তাই তো তুমি এত সুন্দর একটা সংসার গড়তে পেরেছো। বৌমাকে কাছে টেনে নাও। দেখবে ঝিমলিও তোমাকে ভালোবাসবে, সম্মান করবে। অমানবিক না হয়ে একটু মানবিক হও। তাহলে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠবে দুজনের মধ্যে।”

  • গল্প

    গল্প- হীরের টুকরো

    হীরের টুকরো
    -জয়তী মিত্র

    ও বৌমা অর্পণ ঘরে আছে?

    -হ্যাঁ কাকিমা আছে, কিছু দরকার আছে?

    -তোমার কাকুর কিছু ওষুধ আনতে দিতাম। আমার রাজ্যের কাজ পড়ে আছে তাই যদি অর্পণ ওষুধগুলো এনে দিত খুব ভালো হতো।

    রুমি বললো, এনে দেবে কাকিমা চিন্তা করবেন না।
    রায় গিন্নি বললেন, রুমি তোমাদের মত ভাড়াটে পেয়ে আমরা খুব খুশি, তোমরা কত দেখভাল করো আমাদের। তোমার জন্য আমার খুব খারাপ লাগে। কত বড়োলোকের মেয়ে তুমি, আর বিয়ে করলে শেষে একটা বেকার ছেলেকে তাও আবার অনাথ। শুনেছি কত বড়োলোকের ছেলের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আজ তুমি রাজরানী হয়ে থাকতে। সেটা না করে বেকার বর নিয়ে ঘর করছ। তাও তুমি শিক্ষিকার চাকরীটা করতে তাই দুজনের চলে যাচ্ছে, না হলে তো খুব খারাপ অবস্থা হতো তোমাদের।
    রুমি রেগে গিয়ে বললো, বেকার তো ও নয়, চাকরী হয় তো করে না কিন্তু টিউশনি করে তো ভালই আয় করে, আর অনেক চাকরীর পরীক্ষা দিচ্ছে, একদিন ঠিক পাবে, আমি আগে পেয়েছি এই যা, আর আমরা দুজন দুজনকে ভালবেসে বিয়ে করে তো বেশ সুখে আছি তাই না কাকিমা, আর অর্পন ঘরে আছে বলেই না ওকে দিয়ে আপনার কাজটা করিয়ে নিতে পারছেন।
    রায় গিন্নি কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।

    রুমির সাথে অর্পণের দেখা এক বিয়েবাড়িতে। অর্পণের এক বন্ধুর দাদার বিয়েতে কন্যাযাত্রী হয়ে এসেছিল রুমি। সেখানেই পরিচয়। দুজনেই তখন কলেজে পড়ে। তারপর ফোন নম্বর আদান প্রদান থেকে বন্ধুত্ব, সেই বন্ধুত্ব পরিণতি পায় ভালোবাসায়। রুমি প্রথম ভালোবাসার প্রস্তাব দেয় অর্পণকে। অর্পণ রুমিকে ভালোবাসলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি।
    ছোট বেলায় অর্পণের বাবা, মা মারা যায়, মামার বাড়িতে অনাথের মত মানুষ হয়। মাধ্যমিক পাশ করার পর মামা আর পড়াতে চায় নি অর্পণকে। কিন্তু নিজের চেষ্টায় পড়াশুনা চালিয়ে গেছে অর্পণ। বাচ্চাদের পড়িয়ে টাকা উপার্জন করে নিজের পড়ার খরচ চালিয়েছে, পড়াশুনায় ভালো ছিল বলে মাস্টার মহাশয়রাও তাকে সাহায্য করেছে। এইভাবেই কোনরকমে চলছিল অর্পণের জীবনযাত্রা। মামার বাড়িতে কোনোদিন ভালোবাসা পায়নি অর্পণ। মাঝে মাঝে মা-বাবার কথা ভেবে চোখের জল ফেলত।
    রুমির ভালোবাসায় নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে অর্পণ। রুমি ছিল বড়লোক বাবার মেয়ে। তার একটা ভাইও ছিল। বাবার ছিল বিরাট কাপড়ের ব্যবসা। শহরের বুকে দু’টো বিরাট কাপড়ের শোরুম ছিল।
    রুমির এই প্রেম তার বাবা, মা মেনে নেয় নি। স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু মেয়েকে কিছুতেই বিয়েতে রাজি করাতে পারেননি। রুমি ততদিনে সরকারী চাকরীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরী পেয়ে গেছে। অর্পণও চাকরীর চেষ্টা করছিল কিন্তু তখনও সে চাকরী পায় নি। অর্পণকে ডেকে একদিন রুমির বাবা, মা খুব অপমান করে, সহ্য করতে না পেরে সেইদিনই অর্পণের হাত ধরে রুমি ঘর ছাড়ে। তারপর কিছু বন্ধুর সাহায্য নিয়ে রেজিস্ট্রি বিয়ে করে রায় বাড়ীতে ভাড়া আসে। রুমির বাবা, মা আর খোঁজ নেন নি মেয়ের।
    স্বামী, স্ত্রীর সুখেই দিন কাটছিল। একদিন টিউশনি পড়িয়ে ফেরার পথে এক জায়গায় জটলা দেখে এগিয়ে যায় অর্পণ। দেখে এক দুর্ঘটনায় এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক আক্রান্ত হয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সবাই দেখছে কিন্তু কেউ এগোচ্ছে না। চমকে উঠল অর্পণ। আরে এ যে রুমির বাবা। এমনিতেই কারো কিছু হলেই সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া অর্পণের স্বভাব। তৎক্ষণাৎ একজনের সাহায্য নিয়ে অর্পণ নিকটবর্তী হাসপাতালে রুমির বাবাকে ভর্তি করলো। খবর পেয়ে ছুটে এলো রুমির ভাই, মা আর রুমি। ডাক্তার বললেন, ঠিক সময়ে না আনলে ওনাকে বাঁচানো যেত না।
    তারপর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে রুমির বাবা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। সেই সময় অর্পণের চাকরীর সুখবর আসে। রুমির খুব আনন্দ, তার স্বামী চাকরী পেয়েছে। এতদিনে অর্পণের মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বপ্ন সফল হয়েছে। রুমিকে আর কেউ অর্পণের বেকারত্ব নিয়ে খোঁচা দেবার সাহস পাবে না। অর্পণকে জড়িয়ে ধরে রুমি বলে, আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী আমি।

    অর্পণ বলে, তোমাকে পেয়ে আমার জীবন ধন্য, একটা অনাথ বেকার ছেলেকে তুমি ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছো। আর আমার চাওয়া, পাওয়ার কিছু নেই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেন আমরা একে অপরের পরিপূরক হয়ে বাঁচতে পারি।
    একদিন বিকালে রুমির মা, আর বাবা আসলেন মেয়ে জামাইকে নিজের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। রুমির বাবা বিনয় বাবু বললেন, রুমি তুই ঠিক মানুষকে জীবন সঙ্গী বেছেছিস মা, আমি হীরে ফেলে কাঁচের পিছনে ছুটেছিলাম। যেখানে তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম সেই ছেলেটি ভালো নয়। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম। অর্পণ আমার হীরের টুকরো জামাই যার কাছে তুই সুখে আছিস। আমাকে ক্ষমা করে দিস মা, টাকাপয়সা দিয়ে সব সময় সব কিছুর বিচার হয় না, সেদিন আমি অর্পণকে অপমান করে খুব ভুল করেছি। আজ তার প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছি। অর্পণ না থাকলে আমি আজ এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতাম না। জামাইয়ের হাত ধরে বিনয় বাবু বলেন, আজ থেকে আর ভাড়া বাড়িতে নয়, আমার বাড়ীতে আমার বড়ো ছেলে হয়ে থাকবে।

    অর্পণ বললো, আমি চাকরী পেয়ে গেছি এইবার আমরা একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট কিনে দুজনে থাকবো।

    রুমির মা বললেন, সে পরে হবে… যতদিন ফ্ল্যাট না কেনা হচ্ছে ততদিন আমাদের কাছে থাকবে, চলো। তুমি আমাদের এইভাবে ফিরিয়ে দিও না।
    মা’কে অর্পণের মনে পড়ে না। সেই কোন ছোটবেলাতে মা, বাবা তাকে ছেড়ে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। মায়ের কথা মনে পড়লেই বুকটা কষ্টে ভরে যেত অর্পণের। আজ আর এক মা তাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে এসেছেন সেই ডাক উপেক্ষা করা সম্ভব হলো না অর্পণের। নতুন মা’কে পেয়ে নিজের মাকে হারানোর কষ্টটা আজ অনেকটা লাঘব হল অর্পণের।
    বাড়িওয়ালী রায় গিন্নি রুমির মাকে বললেন অর্পণ সত্যি হীরের টুকরো ছেলে। ওর মতো ভদ্র, পরোপকারী ছেলে আজকের দিনে বিরল। অনেক ভাগ্য করে এমন জামাই পেয়েছেন।
    চলে যাবার দিন অর্পণ রায় গিন্নিকে বলে, আসি কাকিমা, ভালো থাকবেন, প্রয়োজনে ফোন করবেন খুব তো বেশি দুর নয় আমি ঠিক চলে আসবো।
    রায় গিন্নি বললেন, তোমার যখন খুশি এসো বাবা, আমিও তো তোমার মায়ের মতই। এই কয়েক মাসে তোমরা আমার নিজের সন্তানের মতই হয়ে গিয়েছিলে, যদি কখনও আমার কোনও কথাতে কষ্ট পেয়ে থাকো আমাকে ক্ষমা করে দিও।
    অর্পণ বললো, কাকিমা ছেলের কাছে বুঝি কেউ ক্ষমা চায়? এমন কথা একদম বলবেন না। তারপর রুমিকে আদর করে রায় গিন্নি বলেন, আবার আসিস মা, কাকিমাকে ভুলে যাস না।
    রুমি বললো, না কাকিমা তোমাকে কি করে ভুলে যাবো। এই কয়েক মাস তোমরাই তো আমাদের অভিভাবক ছিলে,আমাদের কত কিছু রান্না করে খাওয়াতে, একদম নিজের মায়ের মত। তোমার কথা আমার সব সময় মনে পড়বে। ভালো মন্দ রান্না করলে খবর দেবে এসে খেয়ে যাবো।
    আর তোমাদের একটা খাওয়া পাওনা আছে, অর্পণ বললো। আমার চাকরীর পাওয়ার খাওয়াটা একদিন খাওয়াবো কাকিমা।
    রায় গিন্নি বললেন, আমি খুব খুশি হয়েছি, যে তুমি একটা ভালো চাকরী পেয়েছো। তোমরা জীবনে সুখী হও এই কামনা করি।

    তারপর রুমি আর অর্পণ কাকিমাকে প্রণাম করে বাপের বাড়ির পথে রওনা দেয়।

  • গল্প

    গল্প- জীবনের জলছবি

    জীবনের জলছবি
    জয়তী মিত্র

     

     

    শিমূল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার রঙে নিজেকে রাঙিয়ে, কোকিলের কুহু সুরে মুখরিত হয়ে বসন্ত এসেছে। বারান্দার পলাশ গাছটা লালে লাল হয়ে গেছে। পাশে আমের গাছটার মুকুলের একটা মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতির এই শোভা দেখেতে দেখতে রঞ্জনার মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল।
    অসীম চলে গেছে আজ বছর তিন হলো। রঞ্জনার জীবনের সব রঙ নিয়ে সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। রঞ্জনা আজ একা। একমাত্র ছেলে অর্ণব প্রবাসে চাকরী করে। মাঝে মাঝে আসে। রঞ্জনাও ছেলের কাছে গিয়ে থাকে। কিন্তু সেখানে তার মন টেকে না। আসলে নিজের ঘর, বাড়ি ছেড়ে বেশিদিন অন্য কোথাও থাকতে ভালো লাগে না। আবার বাড়ীতেও একা থাকা যায় না। তাই একজন চব্বিশ ঘণ্টার মহিলাকে রেখেছে রঞ্জনা। মালতীরও কোনো পিছু টান নেই। সে রঞ্জনার সাথে বেশ আনন্দেই আছে। মালতীর সাথে গল্প করতে করতে রঞ্জনার মন চলে যায় সেই কিশোরী বেলার দিনগুলোতে।
    বসন্তের এক বিকালে স্কুল থেকে ফেরার পথে পরিচয় অসীমের সাথে। পাশাপাশি দুটো পাড়ায় থাকত তারা। একই পথ দিয়ে যাতায়াত করতে করতে পরিচয়, তারপর ভালোলাগা। সেটা যে কখন ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে নিজেরাও বোঝে নি। রঞ্জনা তখন একাদশ শ্রেণীতে পড়ে, আর অসীম সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। দীর্ঘ পাঁচ বছর চলে তাদের প্রেমপর্ব। দুজনেই খুব রঙ খেলতে ভালোবাসত। তাদের ভালোবাসার একমাত্র সাক্ষী ছিল যাতায়াতের পথের ধারের কৃষ্ণচূড়া গাছটা। বসন্ত এলে কৃষ্ণচূড়া গাছটা নিজেকে লাল রঙে রাঙিয়ে নিত। গাছের তলায় দোলের দিন দুজনে খুব রঙ খেলতো।
    তারপর অসীম কলেজ জীবন শেষ করে চাকরী জীবনে প্রবেশ করে। দুজনেই ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান। তাছাড়া অসীম সুদর্শন, সরকারী চাকুরে, তাই রঞ্জনার বাবা-মা তাদের বিয়েতে বাধা দেন নি।
    রঞ্জনা ও সুন্দরী, শিক্ষিতা, গান জানে তাকে পুত্রবধূ করতে অসীমের বাবা-মায়েরও কোনো আপত্তি ছিল না। দুই বাড়ির সম্মতিতেই তাদের শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হলো।
    রঞ্জনা বউ হয়ে এলো সেনগুপ্ত পরিবারে।অসীমরা দুই ভাই। ছোট ভাই সুমিত বছর তিনের ছোট অসীমের থেকে। শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী, দেওরকে নিয়ে সাজানো সংসার রঞ্জনার। বেশ সুখেই দিন কাটতে লাগলো তাদের। শাশুড়ি মায়ের কাছে রান্না, ঘরের যাবতীয় কাজ শিখে নিল রঞ্জনা। তার সুমধুর ব্যবহারে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রঞ্জনা সবার প্রিয় হয়ে উঠলো। শ্বশুর বাড়িতে এসে তার গানের চর্চা শুরু হল। শ্বশুর মশাই তাকে গানের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। শাশুড়ি মা তাকে গানের স্কুলে নিয়ে যেত। রঞ্জনা একেক সময় ভাবত সে অনেক ভাগ্যবতী, তাই এমন শ্বশুর বাড়ি পেয়েছে।
    তারপর বিয়ের তিন বছরের মাথায় এলো তাদের পুত্র সন্তান। বাড়ীতে খুশির বন্যা বয়ে গেল। ছেলের নাম রাখা হলো অর্ণব। ঠাকুমা আর দাদু ডাকতেন রিভু বলে। মায়ের আর বাবার কাছে বাবাই। কাকাও আদর করে সোনা বলে ডাকতো। বাড়ির সকলের নয়নের মনি ছিল অর্ণব।
    ছোট বেলা থেকে অর্ণব ওরফে রিভু’ও খুব দোল খেলতে ভালোবাসত। দোলের দিন ঠাকুমা-দাদুর পায়ে আবীর দিয়ে বাবা-মা, কাকার সাথে রঙ খেলতো। বালতিতে রঙ গুলে পিচকারি দিয়ে সবাইকে রঙ দিত। অসীম আর রঞ্জনা চলে যেত বারান্দার পাশের সেই পলাশ গাছটার নিচে। দুজনে লাল আবীর দিয়ে নিজেদের রাঙিয়ে নিত, ঠিক লাল পলাশের মত।
    তারপর দেওর চাকরী জীবনে প্রবেশ করলো। দেওরের বিয়ে হলো দেখাশুনা করে। ছোট জা’কে নিজের বোনের মতো ভালোবাসত রঞ্জনা। শাশুড়ি মাও দুই বৌমার হাতে সংসারের ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন। এইবার ঠিক করলেন দুই বুড়ো-বুড়ি তীর্থে যাবেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। একদিন সকালে হাঁটতে বেরিয়ে এক গাড়ীর ধাক্কায় প্রাণ হারান অসীমের বাবা। পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। শাশুড়ি মা শোক সহ্য করতে না পেরে কিছুদিন বাদে তিনিও চলে গেলেন। দুই ছেলে আর বৌমাদের তখন দিশেহারা অবস্থা। ক্রমে আস্তে আস্তে সেই শোক তারা কাটিয়ে উঠলো। এদিকে অর্ণবও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে প্রবাসে চলে গেল। রঞ্জনার হাতে সংসারের যাবতীয় ভার এসে পড়লো।
    দেওরের ছিল বদলির চাকরী। সে তার পরিবার নিয়ে তার চাকরী স্থলে চলে গেল। আরো একা হয়ে গেল রঞ্জনা। অসীম সেই সকালে অফিস যেত আর সন্ধ্যায় ফিরতো। এত বড় বাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করতো। সময় কাটানোর জন্য আবার গানের রেওয়াজ শুরু করলো রঞ্জনা। অসীমের খুব বাগানের শখ ছিল। সেই বাগানের গাছগুলো নিয়ে অনেকটা সময় কাটাতো রঞ্জনা।
    অসীমের রিটায়ার করার সময় এল। পড়াশুনা শেষ করে ছেলেও প্রবাসেই চাকরী পেলো।
    একদিন অফিস থেকে খবর আসে অসীম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে তার মৃত্যু হয় হার্টঅ্যাটাকে।
    এক লহমায় রঞ্জনার জীবনটা ছারখার হয়ে যায়। শোকে পাথর হয়ে যায় রঞ্জনা। ছেলে এসে কাজকর্ম সব করে মাকে নিয়ে নিজের কাছে নিয়ে যায়। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্টটা বুকে চেপে রাখে রঞ্জনা। কিন্তু স্বামী হারানোর কষ্ট কি সহজে ভোলা যায়? ত্রিশ বছরের সংসার তাদের। একটু একটু করে সাজিয়েছিল। নিজের হাতে বাগান করেছিল স্বামী-স্ত্রী মিলে। কত রঙ, বেরঙের ফুল ফুটতো শীতকালে। বর্ষায় বেল ফুলের গন্ধে সারা বাড়ি ম ম করত। অসীম খুব প্রকৃতি প্রেমিক ছিল। তার সাজানো বাগানে প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধের সাথে একাত্ম হয়ে যেত তার মন। গ্রীষ্ম,বর্ষা, শরৎ, বসন্ত ইত্যাদি নানা ঋতুতে নানা রকমের ফুল গাছ লাগতো অসীম। বাড়িতে একটা নার্সারির মত বানিয়েছিল।
    বসন্ত এলে আমগাছের ডালে কোকিলের কুহু সুরে বাড়ি মেতে থাকতো।
    অসীম চলে যাবার পর ছেলের কাছে কিছুদিন কাটিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল রঞ্জনা গাছগুলোর টানে। বাগানটাতে গেলেই সে অসীমের স্পর্শ অনুভব করতো। গাছগুলোর মধ্যেই যে অসীম বেঁচে রয়েছে। প্রতিদিন সকাল, সন্ধ্যা গাছগুলোর পরিচর্যা করতো রঞ্জনা। গাছেদের সাথে খুব ভালো সময় কাটত রঞ্জনার। তার সাথে সঙ্গী ছিল রঞ্জনার কাজের মাসি মালতী।

    অসীম চলে যাবার পর দোলের দিনটা মালতীর সাথে বাগানের ফুল গাছগুলো নিয়ে সময় কাটাত রঞ্জনা। মনে হতো এই বাগানেই অসীম তার জন্য রঙ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে নানা রঙে সাজিয়ে দেবার জন্য।

    এইবার দোলের দিন রাধাকৃষ্ণের পূজো দিয়ে অসীমের ফটোতে একটু লাল আবীর ছোঁয়ালো রঞ্জনা। তারপর বাগানের পলাশ গাছটার দিকে তাকিয়ে পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগল। ঠিক সেই সময় দুই হাত ভর্তি রঙ দিয়ে পেছন থেকে মালতী রঞ্জনার দুই গাল রাঙিয়ে দিল।
    রঞ্জনা বললো, “একি করছো মালতী, আমি যে বিধবা। আমার যে রঙ খেলতে নেই গো। রঙ ধুতে ঘরে এসে রঞ্জনা অসীমের ছবির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অসীমের মুখটা আজ কি উজ্জ্বল লাগছে। মনে হল অসীম বলছে,”আমি তো মালতীর হাত দিয়ে তোমাকে আবীর দিলাম, কে বললো তুমি বিধবা? আমি তো তোমার সাথেই আছি সব সময়। দেখ তোমায় রঙ মাখতে দেখে পলাশ ফুল ও তার পাপড়ি মেলে ধরেছে।”

    রঞ্জনা অসীমের ফটোটা নিয়ে ছুটে গিয়ে পলাশ গাছের নিচে রেখে টলাল আবীর দিয়ে ভরিয়ে দিল। আজ রঞ্জনার মনে হল সত্যিই আবার তাদের সেই হারানো বসন্ত ফিরে এসেছে। মনটা আনন্দে ভরে গেলো রঞ্জনার।

  • গল্প

    গল্প- বঙ্গে চৈত্র সেল

    বঙ্গে চৈত্র সেল
    – জয়তী মিত্র

     

     

    চৈত্র মাস এলেই তিথির মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। কেনাকাটা করতে তিথি খুব ভালোবাসে। এই সময় তার শয়নে, স্বপনে, জাগরণে শুধু সেল, সেল আর সেল। সারাক্ষণ সেলের জিনিসপত্রগুলো মাথায় ঘুরতে থাকে।
    কত সস্তায় কত জিনিস চারিদিকে। শাড়িতে পঞ্চাশ শতাংশ ছাড়। সালোয়ার, কুর্তি, নাইটি, ঘর সাজানোর জিনিস, শৌখিন জিনিস এমন কি বাসনপত্রেও ছাড়। উফ্ কি মজা। মনের মধ্যে লাড্ডু ফুটতে লাগলো তিথির।
    ছাড়, ছাড়,ছাড়…
    মনে মনে গান গাইতে লাগলো। অফিস থেকে ফিরতেই স্বামী রাহুল হাত, মুখ ধোবার সাথে সাথে চা, খাবার সব মুখের কাছে ধরল তিথি। অন্য দিন চা চাইলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। তিথির স্বামী রাহুল ভাবলো নিশ্চয়ই ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। কিছু চাইবে মনে হয়, তাই এত খাতির।
    চায়ে চুমুক দিয়ে রাহুল বললো, আজ কি চাহিদা আছে বলে ফেলো, চাহিদা থাকলেই তো এই আদর,অ্যাপায়নটা বেশি পরিমাণে জোটে..
    তিথি কোনো ভনিতা না করেই বললো, চৈত্র সেল শুরু হয়ে গেছে নিয়ে যাবে? রাহুল একটু বেরসিক, কোনো কিছুতেই তার কোনো উচ্ছ্বাস নেই। রাহুল বললো, এতক্ষণে বোধগম্য হলো এত আদরের কারণ কি?
    তিথি বললো, চলো না, কটা নাইটি, কুর্তি, তোমার গেঞ্জি, বারমুডা, জিন্স আর বিছানার চাদর কিনে আনি। আমার এক বান্ধবী কাল কত বাজার করে এনেছে, খুব সস্তায় পেয়েছে সব।
    রাহুল লাফ দিয়ে উঠে বললো, না, না আমি ওইসব পড়বো না, আর তোমার সাথে যাবো ও না। এক ধোয়াতেই জিন্স হাফ প্যান্ট হয়ে যাবে, গেঞ্জি পেটের ওপর উঠবে আর বারমুডার কথা বলতেই লজ্জা লাগছে। এই ব্যাপারে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। তুমি তোমার বান্ধবীর সাথে যাও। যা খুশি কেনো, দেখো পরে যেন পস্তাতে না হয়।
    তিথি রাগ করে বললো, তাই যাব, তোমার মত বেরসিক লোকের সাথে সেলের জিনিস কিনতে গেলে আমার কেনাকাটা মাটি হয়ে যাবে।

    রাহুল বললো, জিনিস কিনবে সবসময় ভালো দোকান থেকে, আর দাম দিয়ে কিনলে বহুদিন পরতে পারবে। না হলে সস্তার তিন অবস্থা হবে।
    তিথি রাহুলের কথাতে পাত্তা না দিয়ে পরদিন বান্ধবী সুস্মিতাকে সাথে নিয়ে সন্ধ্যা বেলায় গেল সেল থেকে জিনিস কিনতে।
    ওখানে গিয়ে দুই বান্ধবী আনন্দে আত্নহারা। নাইটি, কুর্তিতে পঞ্চাশ শতাংশ ছাড়। শুধু এক দিনের জন্য।
    আনন্দে চারটে নাইটি, চারটে কুর্তি নিল তিথি। তিথির বান্ধবীও কোনো কিছু বাদ দিলো না। সব কিছুই অল্প বিস্তর কিনলো। তারপর ফুচকার দোকানেও একটা করে ফাউ পেল। খুশিতে ডগমগ হয়ে দুই বান্ধবী যে যার বাড়ি ফিরে গেল।
    তারপর দিন তিনেক পোশাকগুলো নিয়ে খুব নাড়াচাড়া করলো। খুব পছন্দ হয়েছে সবগুলো। একটা নীল প্রিন্টেড নাইটি স্নান করে উঠে পড়ল। মনে খুব ফুর্তি। এত কমদামে পেয়েছে ভাবতেই ভালো লাগছে তিথির।
    পরদিন নাইটি ধুতে গিয়েই তিথির চোখ জলে ভরে গেল। নাইটির কাঁচা রঙ সব ধুয়ে গেছে। তারপর মনের দুঃখে সেটা পড়তে যাবে, দেখে সেটা ফ্রকে পরিনত হয়েছে। দুটো কুর্টিতে ফুটো বেরিয়েছে। রাতের অন্ধকারে ভিড়ের মধ্যে ভালো করে দেখতে পায়নি বেচারী।
    সাথে সাথে বান্ধবীর অবস্থা জানার জন্য ফোন করলো। ওপাশ থেকে সুস্মিতা কাঁদো গলায় বললো, তারও একই অবস্থা।
    দুজনে মিলে দিন দুয়েক পর আবার সেই ফুটপাথে গেল দোকানদারকে নালিশ জানাতে। গিয়ে দেখল সে পগার পার। ফুটপাথের স্থায়ী দোকানদার সে নয়। একদিনের জন্য খুব সস্তায় সব বেচে চলে গেছে। আরো কান্না পেল দুজনের। তিথি বললো, বরের কথা না শোনার ফল তাকে এখন ভুগতে হচ্ছে।
    বাড়ি আসার পর সব শুনে রাহুলের হাসি আর থামতেই চায় না। তিথিকে বললো, ঠিক হয়েছে, দেখো কেমন লাগে, বারণ করেছিলাম তখন আমার কথা ভাল লাগছিল না। খুব ভালো শিক্ষা হয়েছে। আর এই জীবনে সেলের জিনিস কিনতে যাবে না। আবার হাসতে শুরু করলো রাহুল আর টিপ্পনী কেটে বললো, নাইটি, থুড়ি ফ্রকটা পরো তো দেখি কেমন লাগছে? তিথির দুচোখ বেয়ে তখন নোনা জলের ধারা বইছে।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- আত্মজা

    আত্মজা
    – জয়তী মিত্র

     

     

    আজ রবিবার, তিন্নির কলেজ ছুটি। এমনিতেই ছুটির দিনগুলোতে ঘুম থেকে একটু দেরি করেই ওঠে। কিন্তু আজ রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা লুচি আর আলুর দমের গন্ধে আর বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে না পেরে মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। বেশির ভাগ রবিবারগুলো তিন্নির পছন্দের জলখাবারই বানাতে হয় তিন্নির মা সুমিতা দেবীকে। তিন্নি মা’কে আদর করে বললো, “আজ আমার লুচি খেতেই ইচ্ছা করছিল মা। তুমি কি করে জানলে আমার মনের কথা?

    তিন্নির মা সুমিতা দেবী বললেন,”মায়েরা সন্তানের সব কিছু বোঝে। যেদিন তুই মা হবি সেদিন তুইও বুঝবি।”
    তিন্নিকে বুকে জড়িয়ে সুমিতা দেবী বললেন,”আজ তোকে তোর জীবনের একটা চরম সত্য কথা জানাবো মা, আজ তোর সব কিছু জানা দরকার। অনেকবার তোকে সব কথা জানাবার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। ভয় পেয়েছিলাম, যদি তোকে হারিয়ে ফেলি, তাই তোকে নিয়ে তোদের বাড়ি ছেড়ে অনেকদূরে চলে এসেছিলাম আমি আর তোর বাবা। যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না।”

    তিন্নি কিছু বুঝতে না পেরে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
    সুমিতা দেবী বলতে শুরু করলেন,”আজ থেকে কুড়ি বছর আগে তোর জন্ম এক বনেদী পরিবারে। তোর মা তোকে জন্ম দিয়েই মারা যান। তোর ঠাকুমা আর তোর বাবা তোকে নিতে অস্বীকার করে। তোর ঠাকুমা বললেন, একে তো হয়েছে মেয়ে তার ওপর জন্মেই মা’কে খেয়েছে এ মেয়েকে কে মানুষ করবে! তার থেকে ওকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে আয়। তারপর তোকে তারা অনাথ আশ্রমে পাঠাবার কথা ভাবে। আমি তখন তোদের বাড়ীতে ভাড়া থাকতাম।
    দশ বছর আমার বিয়ে হয়ে গেলেও আমাদের কোনো সন্তান হয় নি। সমাজের কত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সহ্য করেছি। বাঁজা অপবাদ শুনতে শুনতে আমার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল। তাই ভগবান হয়তো আমার কষ্টের কথা শুনেছিল। একটা সন্তান লাভের জন্য কত দেবতার কাছে যে মানত করছি সেটা বলাই বাহুল্য। তাই যখন দেখলাম তোকে আশ্রমে পাঠানোর তোড়জোড় চলছে ঠিক তখন আমি আর তোর এই বাবা তোকে আইনি পদ্ধতিতে দত্তক নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, কি বিচিত্র এই পৃথিবী, কেউ কত সাধনা করেও একটা সন্তান পায় না আর যারা সন্তান পায় তারা অবহেলায় তাকে দূরে সরিয়ে দেয়।।আমার মাতৃত্ব পূর্ণতা লাভ করলো। তোকে পেয়ে আজ আমি সত্য ধন্য রে। তুই আমার জীবনের মূল্যবান সম্পদ। তুই শুধু আমার, আমার আত্মজা।” মায়ের মুখে তার জীবনের কাহিনী শুনে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেললো তিন্নি। সুমিতা দেবীও তখন অঝোরে কাঁদছেন।
    তিন্নি বললো,”তুমি আমার মা, আমি আর কিছু শুনতে চাই না। তুমি ছিলে তাই আমার জীবনটা এতো সুন্দর হয়েছে। না হলে আজ আমি কোথায় হারিয়ে যেতাম। আমার একটাই পরিচয় আমি তোমাদের মেয়ে, আর তোমরা আমার মা,বাবা। যারা আমাকে জন্মের পর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল তাদের কথা নাই বা শুনলাম। তোমাদের মত মা, বাবা আছে বলে আজও পৃথিবীটা সুন্দর আছে।”
    -চল মা এবার তুই খাবি চল, তোর বাবা পাড়ার মোড়ের মাথা থেকে গরম জিলিপি এনেছে, তুই যে খুব ভালবাসিস জিলিপি খেতে।
    চোখের জল মুছিয়ে মেয়েকে তখন খাওয়াতে লাগলেন সুমিতা দেবী।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- গোপালের ভোগ

    গোপালের ভোগ
    – জয়তী মিত্র

    আজ মাঘী পূর্ণিমা। খুব ভোরে উঠে স্নান সেরে সুমনা দেবী গোপালের ভোগ রান্নায় ব্যস্ত। খিচুড়ি, পাঁচ রকমের ভাজা, লাবড়া, চাটনি, পায়েস সব রান্না করে আজ তিনি তার আরাধ্য দেবতা গোপালের চরণে নিবেদন করবেন। তারই প্রস্তুতি চলছে সকাল থেকে। এত কাজ সব একা হাতে সামলান তিনি। ঠাকুরের কাজ একাই করতে পছন্দ করেন তিনি। আর তাছাড়া এই সময়ে তার একমাত্র ছেলে শুভ অফিসে যায়। নাতি স্কুলে যায়। বৌমা তাদের নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে। শাশুড়ি মা’কে সাহায্য করার মতো সময় তার হাতে থাকে না। সুমনা দেবীর তাতে কোন আক্ষেপ নেই।

    সারাদিনের বেশির ভাগ সময় তার ঠাকুর ঘরেই কাটে। তিনবেলা গোপালকে খাবার দেওয়া, তারপর বড়ো আসন জুড়ে তার অনেক ঠাকুর। তাদের নিত্য পূজো দিতেই দিনের অনেকটা সময় তার কেটে যায়। সংসারের দিকে তিনি নাক গলান না। ওটা বৌমার দায়িত্ব। আর তাতে বৌমা খুব খুশি। তার ওপরে খবরদারি করার কেউ নেই। তাই শাশুড়ি মায়ের সাথে তার সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই।
    কিন্তু সুমনা দেবী মানুষটা খুব কৃপণ টাইপের। হাত দিয়ে তার সহজে কিছু গলে না। তার বৌমা আবার খুব দরাজ মনের। বাড়ীতে কাজের লোক থেকে ভিখিরি পর্যন্ত কেউ তার কাছে কিছু চেয়ে খালি হাতে ফেরত যায় না। কাজের মাসি তো বৌদিমনি অন্ত প্রাণ।
    এই তো সেদিন কাজের মাসীর মেয়ের জন্মদিন গেল। বৌদি রুমি একটা বড়ো কেক আর চকলেট কিনে মাসীর মেয়ের জন্য পাঠালো। মাসী তো আনন্দে কেঁদে ফেললো তারপর রুমিকে অনেক আশীর্বাদ করলো।

    গোপালের ভোগ দিয়ে সুমিতা দেবী এক কাপ চা নিয়ে সবে বসেছে। বৌমা রুমি একটু কাজে বেড়িয়ে ছিল। ঠিক তখন দুটো বাচ্চা ছেলে গেটের সামনে এসে খাবার চাইলো। সুমনা দেবী ধমক দিয়ে ছেলে দুটোকে তাড়িয়ে দিয়ে বললো, “যা, কাজ করে খা গে, এখানে কোনো খাবার নেই। টাকা কি গাছে ফলে নাকি, বিদায় হ। একটু শান্তিতে চা খাব তার উপায় নেই। যত সব ভিখিরির দল। ছেলে দু’টো শুকনো মুখে চলে গেল।

    তারপর ঠাকুর ঘরে গিয়ে দেখেন আসনে তার গোপাল নেই, সুমনা দেবী তো কাঁদতে লাগলেন, তার গোপাল কোথায় গেল? গোপাল তো কিছুই খেল না।
    সুমনা দেবীর কান্না শুনে কাজের মাসী মলিনা বললো, “তোমার গোপাল তো তোমার কাছে খাবার চাইতে এসেছিল, তুমি তো তাড়িয়ে দিলে, তাই গোপাল তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ভগবান বিরাজ করে। ওই বাচ্চাদের মধ্যেই গোপাল ছিল, তুমি তাদের নাগাল পাওনি মাসিমা। গরীবের সেবা করলেই ভগবানের সেবা হয়। তোমার গোপাল আজ তোমাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়ে গেল। এবার থেকে পারলে গরীব মানুষের জন্য কিছু করো, তাতেই তোমার গোপাল খুশি হবে।”
    মলিনার কথা কতদূর কানে গেল কে জানে? সুমনা দেবী গোপালকে আসনে না দেখে তখনো কেঁদেই চলেছে। গোপাল কি তাহলে ভোগ গ্রহণ করলো না? এই প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে লাগলো সুমনা দেবীর মনে।

You cannot copy content of this page