• প্রবন্ধ

    প্রবন্ধ- “বাংলার নিঃশব্দ আর্তনাদ”

    “বাংলার নিঃশব্দ আর্তনাদ”
    – তন্ময় সিংহ রায়

     

    সাত হাজার অতিক্রান্ত এ গ্রহের ভাষা বৈচিত্রে ব্যবহৃত ভাষা প্রায় হাজার সাড়ে ছয় মতন ও তার মধ্যে বাংলা বোধকরি একদম প্রথম সারিতে এক অকৃত্রিম রাজকীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ!
    পৃথিবীর মধুরতম ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ সমগ্র ভূপৃষ্ঠকে বেষ্টন করেছে বায়ুচাপ বলয়ের মতন বললেও নিতান্তই অযৌক্তিক কিছু বলা হবেনা। প্রকৃত বাংলা ভাষাপ্রেমী সংখ্যালঘিষ্ঠ কিছু শ্রেণীর মানুষ বোধকরি এক চরম দুশ্চিন্তায় প্রহর গুনছেন, বলাবাহুল্য এর একাধিক যুক্তিসংগত কারণও আছে বৈকি!
    সর্বোপরি রাষ্ট্রের শাসক সম্প্রদায় থেকে ফিল্মি ও খেলার দুনিয়ার সেলিব্রিটিরা সবাই আজ ইংরিজিমুখি। অপুষ্টি ও চরম অবহেলায় জীর্ণ ও শীর্ণকায় বাংলা-টা ক্রমশই হয়ে উঠছে শুধুই কথ্য ভাষা।
    বছর চার-পাঁচ এ ধরিত্রীর অক্সিজেন গ্রহণকারী নবপ্রজন্মের এক বৃহদাংশের আজ শিক্ষা শুরু ইংরিজি মিডিয়াম থেকে। শিক্ষায় জন্ম যে ছেলেটার বাংলা মিডিয়ামে, তার কদর সমাজে অপেক্ষাকৃত অনেকাংশে কম, এমনটাই একবিংশের জীবন্ত চিত্র! খুচরো হোক বা আস্ত, ইংরিজি বলে যতটা আত্ম-গর্বিত ও সোসাইটি এক কেলাস উঁচুতে উঠে গেলো বলে আমরা মনে করি, এমন অনুভবটা বাংলায় প্রায় মৃত্যুবরণ করেছে! আমদের বাহ্যিক আচরণ হয়তো বলে দেয় যে আমরা ভুলতে বসেছি, আমরা শুদ্ধ বাঙালী ও আমাদের অবিচ্ছেদ্য নাড়ির মূখ্য অপর প্রান্ত আজও বাংলা মায়ের নাড়িতে সংযুক্ত।

    এক পরিচিত দৃশ্য হলেও, আন্তরিক সাক্ষাতে মানসিক প্রতিক্রিয়া কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলো সেদিন! খুব সম্ভবত বৃহস্পতি অথবা শুক্রবার ও বেলা তখন বারোটা-টারোটা বাজবে, হঠাৎ দেখি আমার বেশ কিছুটা সামনের দিক থেকে একটা বাধাহীন গতিশীল মালভূমি দুরন্ত গতিতে এদিকেই হনহনিয়ে এগিয়ে আসছে! কাছে আসতেই দেখি চরম উত্তেজিত ও উৎফুল্ল আননের সুমন্তদা, এক নাতিদীর্ঘ কথপোকথন আবিষ্কারে সক্ষমের ফলাফল এমন যে তার একমাত্র ছেলে এবারে নামী ইংরিজি মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস থ্রি-তে দুশো ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে।
    অনুভব করলাম পুত্রের এরূপ সাফল্যে পিতার বুক গর্বে মালভূমি হওয়াটাই স্বাভাবিক, অগত্যা প্রশংসা বিনিময়ে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম!

    সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ইংরিজির দাদাগিরিতে অনেক ভাষার-ই জীবন বিপন্নপ্রায় এমনকি জাতিসংঘের কাজকর্মের ভাষাও ইংরিজি! আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অথবা একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা প্রেমের বিপুল আকস্মিক উন্মাদনা কিংবা পহেলা বৈশাখ বাংলায় দুটো-একটা স্ট্যাটাস….’আমি গর্বিত, আমি বাঙালি’ ইত্যাদি…. ব্যস! অতঃপর সারাবছর রক্ষণাবেক্ষণবিহীন বাংলা-টা মুখ থুবড়ে পড়েই থাকে রাস্তার এক কোণায়! দুদিন পরেই বাংলায় কোন মাস ও বিশেষত কত তারিখ সব অতল গভীরে তলিয়ে যায় মনের!
    চুড়ান্ত যত্নহীন ও অবিবেচক হয়ে নিজেরাই নিজেদের ভাষার ইজ্জতকে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বাজারের সস্তা পণ্য বানিয়ে নির্দ্বিধায় আফশোষবিহীনভাবে বেচে দিচ্ছি! এভাবে চলতে থাকলে…..
    আমরা সবাই এখন বুদ্ধিজীবী, হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ভিতরটা দেখাবার কোনো মানেই হয়না। এখন প্রশ্ন হল, এ বিষয়ে কপালে প্রকৃত দুশ্চিন্তার কালো মেঘের অন্ততপক্ষে সিংহভাগ বাঙালীর আবির্ভাব হবে কবে? ডুবন্ত বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে ক’জন বিশেষত বাঙালীই বা আত্মাহুতি দেবে তাতে? ও কতদিনই বা তার আয়ু??

  • কবিতা

    কবিতা- জাত

    জাত
    – তন্ময় সিংহ রায়

     

    জাত খাদ্য ভরায় না পেঠ(ব্যঙ্গাত্মক), শুধু দু’টো ভাত।

    সব জাতটাই সমান, যখন পাকস্থলীর আর্তনাদ!!

    হিমোগ্লোবিন যে জাত চেনে, সে জাত জানি মানুষ,

    জাতের বড়াই সৃষ্টি করে, মিছেই ওড়াস ফানুস।

    সৃষ্টি শুধু জরায়ু চেনে, তোরা চিনিস জাত,

    ভিন্ন জাতের নিয়ম বেঁধেও, ভিন্ন হয় না ভাত।

    অক্সিজেন’টা যে জাত চেনে, সে জাত বুঝি মানুষ,

    জাতের বড়াই সৃষ্টি করে, কেন ওড়াস ফানুস?

    মিথ্যে জাতের কারসাজিতে, রাজনীতির’ই গন্ধ!

    শিক্ষা-দীক্ষা, বিবেক, বুদ্ধি, সবই তোদের অন্ধ?

    গীতা, কোরান, যুদ্ধ চায় না, চায় যে ভালোবাসা!

    বাইবেলটাও ওঠে বলে, এক’ই আমার আশা!

    যে মা তোদের জীবন দাতা, সে জাত চেনে কই?

    সূর্যটা’ও আজ হেসে বলে, আমি হিন্দু নই।

               জলের সাথেও ধর্মবাজি, বা- রে সম্মান!

               জল হল হিন্দু আর পানি মুসলমান।

    ধর্ম হয়না বিভেদকারী, বিভেদ মোদের কর্ম,

    জাত সমুদ্রে তলিয়ে যে আজ মানবতার ধর্ম।

    লজ্জা ঢাকিস পোষাক দিয়ে, মনুষ্যত্বের বস্ত্র?

    আজও কি তা বুঝিসনা, ভালোবাসাই অস্ত্র?

     হেমলক দে হিংসাটা’কে, তবেই তোরা মানুষ।

    উড়ুক এবার বিশ্ববাসীর ভালোবাসার ফানুস!!

  • প্রবন্ধ

    প্রবন্ধ- “একবিংশের আমরা’র এক খন্ড চিত্র”

    “একবিংশের আমরা’র এক খন্ড চিত্র”
    – তন্ময় সিংহ রায়

    একবিংশের চতুর্দিকে তোমার অবস্থান প্রয়োজনাতিরিক্ত বন্ধু বলয়ের মধ্যে হলেও, সীমিতসংখ্যক বন্ধুগুলোর অবস্থান আজ লিভেনহিকের সৃষ্টির তলদেশে! নিত্য বহমান বন্ধুত্ব দু-হাজার চার সালে দুটো শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে যথা (১) প্রত্যক্ষ ও (২) পরোক্ষ(ফেসবুক)। এ যেন “জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে ঘৃতাহুতি!” অর্থাৎ একে বর্তমানে ‘সম্পর্ক’-এর সাথে ‘সু’-এর সম্পর্কের অপেক্ষাকৃত অধঃপতন তার উপরে বন্ধুত্বের পরোক্ষ ভবিষ্যত প্রভাব! অতঃপর সুফলের অস্তিত্বকে বিনা বাক্যব্যয়ে স্বীকার করলেও পরোক্ষ-র ক্রমবর্ধমান প্রভাবে ক্রমশই অধিক গুরুত্ব হারাতে শুরু করে/করছে প্রত্যক্ষ। রাজনীতি, ক্রমবর্ধমান ব্যস্ততাসহ বিভিন্ন কারণসমূহের মধ্যে এও এক উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত… ভবিষ্যত পরিণাম ঘরে ঘরে আত্মকেন্দ্রিক সন্তান আর এভাবেই নিশ্চিতভাবে গড়ে উঠবে/উঠছে আত্মকেন্দ্রিক সমাজ ক্রমে জেলা থেকে রাজ্য ও সর্বোপরি রাষ্ট্র যার চুড়ান্ত রূপ বোধকরি ‘জাতীয়তাবাদী ভাবধারা’-র জ্বলন্ত অনলে আত্মাহুতি! অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আজ রিখটার স্কেল বসানো। বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্কে ফাটল ,স্বামীর সাথে স্ত্রী-র সম্পর্কে ভাইরাস, বন্ধুর সাথে বন্ধুর সম্পর্কে ছেদ! স্বার্থটা/গুলো ত্যাগের চেয়ে ভোগটা আজ আমাদের অধিক প্রিয় হয়ে উঠেছে। ‘অল্পতে সন্তুষ্ট’ আজ আর আমাদের চিত্তাভিধানে নেই। দুই-পঞ্চমাংশের ধৈর্যশক্তি আজ আর ফোটন কণা দ্বারা উত্তেজিত হয়না। ‘শ্রদ্ধা’, ‘ভক্তি’, ‘কৃতজ্ঞতা’, ‘ভালোবাসা’, ‘আনুগত্য’, ‘মায়া’, ‘মমতা’, ‘স্নেহ’, ‘বিশ্বাস’… শব্দগুলো মানব শরীরে কেমন যেন চরম অপুষ্টির স্বীকার! শুধু ‘আমার’-কে বিপদমুক্ত, সুস্থ ও আর্থিকভাবে সু রেখো ভগবান/আল্লা/গড!… এ সমগ্র জাতি-র কল্যাণের নিঃস্বার্থ প্রার্থনার দায়িত্ব শুধুই পরম শ্রদ্ধেয় বীর নেতাজী সুভাষের জন্যেই বোধহয় ছিলো। এ গ্রহের অবহেলিত, ঘৃণিত ও উপেক্ষিত কুকুরগুলো আজ বোধকরি বেশি বজায় রেখে চলেছে তাদের ভদ্রতা ও আনুগত্য, অনেক ভালো আছে তারা। এত সমাজসেবী চারিদিকে কিলবিল করছে যে সমাজটা আজ প্রতিদিন ধর্ষিতা হতে হতে মুমুর্ষুপ্রায়! নিঃশব্দ আর্তনাদ করে সে বলছে শোনা যায়, ”ইজিপ্টোপিথেকাস অনেক শ্রেয় ছিলো, এ হেন হোমো-স্যাপিয়েন্স সন্তান-এর চেয়ে।” (ব্যতিক্রম স্বীকার্য ও ভূল ত্রুটি মার্জনীয়।)

  • প্রবন্ধ

    “বাংলার নিঃশব্দ আর্তনাদ!”

    “বাংলার নিঃশব্দ আর্তনাদ!” 

    -তন্ময় সিংহ রায়

     

    সাত হাজার অতিক্রান্ত এ গ্রহের ভাষা বৈচিত্রে ব্যবহৃত ভাষা প্রায় হাজার সাড়ে ছয় মতন ও তার মধ্যে বাংলা বোধকরি একদম প্রথম সারিতে এক অকৃত্রিম রাজকীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ! পৃথিবীর মধুরতম ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ সমগ্র ভূপৃষ্ঠকে বেষ্টন করেছে বায়ুচাপ বলয়ের মতন বললেও নিতান্তই অযৌক্তিক কিছু বলা হবেনা। প্রকৃত বাংলা ভাষাপ্রেমী সংখ্যালঘিষ্ঠ কিছু শ্রেণীর মানুষ বোধকরি এক চরম দুশ্চিন্তায় প্রহর গুনছেন, বলাবাহুল্য এর একাধিক যুক্তিসংগত কারণও আছে বৈকি! সর্বোপরি রাষ্ট্রের শাসক সম্প্রদায় থেকে ফিল্মি ও খেলার দুনিয়ার সেলিব্রিটিরা সবাই আজ ইংরিজিমুখি। অপুষ্টি ও চরম অবহেলায় জীর্ণ ও শীর্ণকায় বাংলা-টা ক্রমশই হয়ে উঠছে শুধুই কথ্য ভাষা। বছর চার-পাঁচ এ ধরিত্রীর অক্সিজেন গ্রহণকারী নবপ্রজন্মের এক বৃহদাংশের আজ শিক্ষা শুরু ইংরিজি মিডিয়াম থেকে। শিক্ষায় জন্ম যে ছেলেটার বাংলা মিডিয়ামে, তার কদর সমাজে অপেক্ষাকৃত অনেকাংশে কম, এমনটাই একবিংশের জীবন্ত চিত্র! খুচরো হোক বা আস্ত, ‘ইংরিজি’ বলে যতটা আত্মগর্বিত ও সোসাইটি এক ক্লাস উঁচুতে উঠে গেলো বলে আমরা মনে করি, এমন অনুভবটায় বাংলা প্রায় মৃত্যুবরণ করেছে! আমদের বাহ্যিক আচরণ হয়তো বলে দেয় যে আমরা ভুলতে বসেছি, আমরা শুদ্ধ বাঙালী ও আমাদের অবিচ্ছেদ্য নাড়ির মুখ্য অপর প্রান্ত আজও বাংলা মায়ের নাড়িতে সংযুক্ত। এক পরিচিত দৃশ্য হলেও, আন্তরিক সাক্ষাতে মানসিক প্রতিক্রিয়া কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলো সেদিন! খুব সম্ভবত বৃহস্পতি অথবা শুক্রবার ও বেলা তখন বারোটা-টারোটা বাজবে, হঠাৎ দেখি আমার বেশ কিছুটা সামনের দিক থেকে একটা বাধাহীন গতিশীল মালভূমি দুরন্ত গতিতে এদিকেই হনহনিয়ে এগিয়ে আসছে! কাছে আসতেই দেখি চরম উত্তেজিত ও উৎফুল্ল আননের সুমন্তদা, এক নাতিদীর্ঘ কথপোকথন আবিষ্কারে সক্ষমের ফলাফল এমন যে তার একমাত্র ছেলে এবারে নামী ইংরিজি মিডিয়াম স্কুলে ক্লাস থ্রি-তে দুশো ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে। অনুভব করলাম পুত্রের এরূপ সাফল্যে পিতার বুক গর্বে মালভূমি হওয়াটাই স্বাভাবিক, অগত্যা প্রশংসা বিনিময়ে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম! সমগ্র বিশ্ব জুড়ে ইংরিজির দাদাগিরিতে অনেক ভাষার-ই জীবন বিপন্নপ্রায় এমনকি জাতিসংঘের কাজকর্মের ভাষাও ইংরিজি! আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস অথবা একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা প্রেমের বিপুল আকস্মিক উন্মাদনা কিংবা পহেলা বৈশাখ বাংলায় দুটো-একটা স্ট্যাটাস….’আমি গর্বিত, আমি বাঙালি’ ইত্যাদি…. ব্যস! অতঃপর সারাবছর যত্নযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণবিহীন বাংলা-টা মুখ থুবড়ে পড়েই থাকে রাস্তার এক কোণায়! দু’দিন পরেই বাংলায় কোন মাস ও বিশেষত কত তারিখ সব অতল গভীরে তলিয়ে যায় মনের। চুড়ান্ত যত্নহীন ও অবিবেচক হয়ে নিজেরাই প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বাজারের সস্তা পণ্য বানিয়ে নির্দ্বিধায় আফশোষবিহীনভাবে আমরা বেচে দিচ্ছি নিজেদের ভাষার ইজ্জতকে! এভাবে চলতে থাকলে….. আমরা সবাই এখন বুদ্ধিজীবী, হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ভিতরটা দেখাবার আজ আর কোনো মানেই হয়না। এখন প্রশ্ন হল, ললাটে প্রকৃত দুশ্চিন্তার কালো মেঘের আবির্ভাব অন্ততপক্ষে সিংহভাগ বাঙালীর, এ বিষয়ে হবে কবে? ডুবন্ত বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে ক’জন বাঙালীই বা আত্মাহুতি দেবে তাতে? ও কতদিনই বা তার আয়ু??

  • প্রবন্ধ

    “গণতন্ত্রের ষষ্ঠী পূজো “

    “গণতন্ত্রের ষষ্ঠী পূজো “

    -তন্ময় সিংহ রায়

     

     

    বীর সুভাষের নিথর দেহের ভূখন্ডটার অসহায় অবস্থান আজ বৈচিত্রময় অসংখ্য মাছি ও শকুনের ঠিক নিচে। প্রায় পচা-গলা ভূখন্ডটার ভিতর থেকে ব্যাকটেরিয়াগুলো খুবলে খুবলে অগ্ন্যাশয়, ক্ষুদ্রান্ত, বৃহদান্ত্র ও যকৃত থেকে তৃপ্তিসহকারে সংগ্রহ করছে পুষ্টিরস! জাতি ধর্ম নির্বিশেষে শুধু আমাদের অক্সিজেনকে স্বাধীন করার নিদ্রাহীন স্বপ্নে নিজের রক্তাবৃত হৃদপিন্ডটাকে হাতে নিয়ে জীবনকে পদতলে করে, অবর্ণনীয় লাঞ্ছনা, অপমান ও যন্ত্রণাকে মুহুর্মুহু সহ্য করেও বিষাক্ত রাজনীতির সি.এফ.সি’র ক্ষতিকারক প্রভাব থেকেও রেহাই পাননি তিনি! আজ বিংশ তার শেষ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করার পরেও রাজনীতি নির্গত সি.এফ.সি’র ক্রমবর্ধমান প্রভাবে বিশেষত খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলো মুমুর্ষুপ্রায়!

    ২৬/১১,পাঠানকোট ও উরির পর, ইংরিজি সাল ২০১৯, ১৪ ই ফেব্রুয়ারি….আবার এক জ্বলন্ত নিদর্শন কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার অবন্তীপুরায়। সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স-এর কনভয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী বিস্ফোরণ! বেশিরভাগই ছিলো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। হাই সিকিওর্ড জোনে খুব সাবলীলভাবেই প্রবেশ করে গেলো ৩৫০ কেজির বিস্ফোরকপূর্ণ একটা গাড়ি! …আত্মঘাতী ব্যক্তি ছাড়া বাকিরা সকলেই নির্বিঘ্নে ফিরে গেলো!…. কনভয় প্রটোকল অনুযায়ী ৩০ টার বেশি গাড়ি থাকার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা, সেখানে গাড়ির মোট সংখ্যাটা ৭৮+….আড়াই হাজার সেনা জওয়ান তবুও তারা ছিল নিরাপত্তাহীন। জানা গেছে আর.ডি.এক্স বিস্ফোরনের তীব্রতা এতটাই ছিলো যে ১০-১২ কিলোমিটার পর্যন্ত সেই শব্দ মানুষের কানে বিকটভাবে পৌঁছেছে।

    বাজারের সস্তা পণ্যে পরিণত হয়েছে গরীব খেটে খাওয়া মানুষগুলোর স্বল্পদামী জীবন। যে গর্ভধারিণী মা-টা তার সোনার টুকরো বীর সন্তানকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখলো, সেই হতভাগিনী মা-টাই শুধু অনুভব করেছেন তাঁর বুকফাটা যন্ত্রণার মাত্রাটা! অনুভূতিহীন ফুলের মতন যে শিশুটা সারাজীবন তার বাবাকে চোখের সামনে অন্ধকারের অতল গভীরে তলিয়ে যেতে দেখলো, সেই স্নেহ মাখা পিতৃপ্রেমের পরম স্পর্শ সারাটাজীবন দেবে কোন রাজনৈতিক দল? নাকি টাকা দিয়ে কেনা যায় সেই স্পর্শ? যে অভাগিনী স্ত্রী-টার কপালের এক চিলতে লাল রঙটার মৃত্যু হল নিমেষেই, তিনি জানেন যন্ত্রণার পরিমাণটা! এ সিঁদুরটাই বা তাকে ফিরিয়ে দেবেন কোন নেতা? কোনো দুর্ঘটনা যদি বাস্তবে তার রূপকে দান করে তখনই আমরা হয়ে পড়ি উত্তেজিত ও আবেগপ্রবণ! আর বিশেষত ঠিক সেই মুহুর্তেই জন্ম নেয় শ-এ শ-এ কৌটিল্য। হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা, এটা করা উচিৎ, ওটা কেনো হয়নি?… রিখটার স্কেলে, কু-ঘটনার তীব্র নিন্দা করা প্রতিবাদীদের কম্পনের মাত্রাটা দুদিন পরেই হয়ে যায় সুইচড অফ্। টাটকা মৃত’র পরিবারগুলো তৎক্ষণাৎ ভেসে যায় প্রতিশ্রুতি, সমবেদনা ও সহানুভূতির অবিশ্রান্ত জলধারায়। দু’দিন পরেই ঝাপসা হয়ে যায় জীবন্ত স্মৃতিসহ সব রাজনীতি প্রদত্ত ভোট মার্কেটিং-এর প্রতিশ্রুতিগুলো, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে থাকে সাময়িক সহ+অনুভূতিগুলো। বেদনাকে শুধু মৃতদের পরিবারের জন্যে ফেলে রেখে চিরকালের মতন সান্নিধ্য ত্যাগ করে ‘সম’-গুলো।….. কিছুদিন স্বাভাবিক, আবার ভয়াবহ দুর্ঘটনা! আবার উত্তেজনা, দু’টো মোমবাতি, এক চিলতে আবেগ! আবার ঝাপসা! এভাবেই চলছে জলচক্র। দেশাভ্যন্তরেই ফরাসী বিপ্লবটা আগে প্রয়োজন, কারণ…’সর্ষের মধ্যে ভূত’-টাও আজ ভাবনার জানালায় বড় বেশি উঁকিঝুঁকি মারে!……শেষাগত দেশের সংকটময় মুহুর্তগুলোতেও ইগোকে সপাটে জড়িয়ে ধরে বসে আছে প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোই, পরিণাম…. একতায় ৯ মাত্রার ভূমিকম্প! সন্ত্রাসবাদ দমন তো পরে আগে রাজনৈতিক দুর্গন্ধমুক্ত ও একতাযুক্ত একটা দেশ আবিষ্কার প্রয়োজন। (ভূল ত্রুটি মার্জনীয় ও ব্যতিক্রম স্বীকার্য।)

  • অণু গল্প

    “বুড়িটা বোঝেনি সে কথাগুলো”

    “বুড়িটা বোঝেনি সে কথাগুলো” 
    -তন্ময় সিংহ রায়

     

     

    এ গ্রহের উদ্ভিদ বড়োজোর আর ক’টা দিন তাকে অক্সিজেন দেবে! বিভিন্ন প্রসাধনীতে যে ত্বক একদিন ধরে রাখতো তার লাবণ্য, বেশ কয়েক বছর হোলো শেষ নিঃশ্বাসটাও ত্যাগ করেছে সেটা! অসংখ্য ভাঁজে সে হারিয়েছে তার স্বাভাবিক রুপ! শিরা ধমনীগুলো প্রতি মুহুর্তে উপেক্ষা করে তাকে(ত্বক)। যে স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে ছিলো পরম মমতার কোমল স্পর্শ, সে ঝাপসা দৃষ্টি আজ চরম অনাদরে ও অবহেলায় ভাসে নোনাজলে!
    আজ প্রায় বছর দেড়েক হোলো, প্রতিদিন বিকেল চারটে বাজলেই বুড়িটা জানালাটার লোহার রডগুলোকে ধরে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দূরে ওই মাঠটার দিকে! কৌতুহলদীপ্ত জনা-তিনেক বৃদ্ধা মনের জানার প্রবল ইচ্ছাকে দমন করতে না পেরে অবশেষে একদিন বুড়িটা বলে বসে, তার একমাত্র আদরের সোনার টুকরো জীবন, তার ছোট্ট ছেলেটা নাকি ভীষণ চঞ্চল! কোথায় খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়ে বিষম চোট পায়, রক্ত বেরোয় কেটে গিয়ে, কি করে বসে!… তাই প্রতিদিন খেলার সময়ে তিনি তাকে অস্পষ্ট নিষ্পলক দৃষ্টিতেও দুর্বল রেটিনায় বসিয়ে নাকি নজরবন্দী করে রাখেন।…….পরম মমতার এরূপ মর্মান্তিক প্রতিফলনে বিষ্ময়ে হতবাক চশমাবৃত ছ’টা দুর্বল চোখের অশ্রুগ্রন্থি নিঃসৃত করেছিলো কিছু সুপরিচিত বেদনাশ্রু!….বোঝানোর সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম সত্বেও সে বুড়ি বোঝেনি যে তাঁর সোনার টুকরো ছেলে আজ প্রাপ্তবয়স্ক, এ পৃথিবীর অনেক কিছুই এখন সে বোঝে, একটা বউ এনেছে ঘরে…. আর বউয়ের অপছন্দটা ছেলের কাছে আজ তাঁর (বুড়ির) চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান।……মূল্যটাকে হীন করে অব্যবহৃত প্রাণহীন আসবাবপত্রের মতন তাঁকে(বুড়িকে ফেলে রেখে গেছে এই ঘরেই…. তাঁদের (অন্যান্য বৃদ্ধাদের) সাথে। তার শেষ জীবনের ছোট্ট ছোট্ট চাওয়া-পাওয়া, আশা, স্বপ্ন, ভরসা সবই তাচ্ছিল্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেছে এই আবদ্ধ ইঁটের খাঁচায়। বুড়িটা বোঝেনি যে, আজ আর তার সোনার টুকরো ছেলেটা রাতে দুধের জন্যে ডুকরে কেঁদে ওঠেনা, তাকে আজ আর পরাতে হয়না যত্ন করে কাজল টিপ!… ছোট্ট আঙুলটা ধরে অতি যত্নে গুটি গুটি পায়ে সে আর মায়ের সাথে হাঁটেনা…..স্কুল থেকে এসেই ঝপাস করে ব্যাগটা ফেলে অভুক্ত মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে আজ আর বলেনা….”মা খিদে পেয়েছে, ভাতটা মেখে খাইয়ে দাও”…… বুড়িটা বোঝেনি সে বোঝানো কথাগুলো।

    একদিন গহীন রাতে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে বুড়িটা চিৎকার করে বলে উঠলো “সোনা আমার, ওদিকে যাসনা বাবা… ওদিকে পুকুর আছে !”

    …সেই জানালাটা তেমনি আছে, আছে দিগন্ত বিস্তৃত সেই খোলা মাঠটাও, কিন্তু শুষ্ক ত্বকের মমতা মাখানো দু’টো হাত বিকেল চারটে-তে আর কোনোদিনও ধরেনি লোহার রডগুলোকে সেদিন রাতের পর।।

  • প্রবন্ধ

    “উলঙ্গ মনুষ্যত্ব “

    “উলঙ্গ মনুষ্যত্ব “
    -তন্ময় সিংহ রায়

     

     

    ব্যতিক্রম স্বীকার করেই বিশ্লেষণ… কয়েনগুলোর ভরের যোগফল পাঁচশো-আশি গ্রাম। পাঁচশো-আশি গ্রামের বাজারি পাল্লাটার ঠিক নিচে মাধ্যাকর্ষণ টান’টা আজ মাত্রাতিরিক্ত! অপর পাল্লায় দু-কিলো মনুষ্যত্ব, গ্যাস বেলুনের ভূমিকায়। খোলা বাজারে দু’আঁটি মনুষ্যত্ব আর লাল শাক আজ দাম প্রায় একই । জিলেটিনের প্রলেপযুক্ত কাগজের টুকরোটার বিনিময়ে নিঃস্তব্ধ রাতের অন্ধকারে ও দিনে বিক্রি হতে দেখেছি কত-শত টাটকা মনুষ্যত্ব!.. তা সে বাধ্য হয়েই হোক বা অর্থলালসায়। মনুষ্যত্বহীনতা একবিংশেই ধারণ করেছে সংক্রামক মহামারী আকার, দ্বা’বিংশে এই সংক্রামণ পৌঁছাবে বিভিন্ন গাছ-গাছালি ও অনুজীবেদের দেহে। পোষাকি বৈচিত্রে ঢাকা যায় একটা সম্পূর্ণ শরীরের লজ্জাকে কিন্তু মনুষ্যত্বহীনতার লজ্জাকে ঢাকার পোষাক আজও অনাবিষ্কৃত।… ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায়না’- জনপ্রিয় প্রবাদ বাক্যটার অক্সিজেনদাতা আমরাই ও মনুষ্যত্বহীনদের একপ্রকার উলঙ্গ বলাটাই যুক্তিসংগত অর্থাৎ ‘উলঙ্গ মনুষ্যত্ব।’ মনুষ্যত্ববিহীন সমাজটা আজ পিতৃহারা যন্ত্রণায় কাতর আর্তনাদ করছে… ‘বাঁচাও বাঁচাও, আমায় মেরে ফেলো না, আমি বাঁচতে চাই তোমাদেরই নিয়ে’..সে আর্তনাদ আমাদের অভিনয়ী কর্ণকুহরে আর উঁকিও মারেনা, প্রবেশ তো দূর! আত্মকেন্দ্রিকতায় ডুবে আমরা আজ অতি যত্নে বিস্তার করে চলেছি নিজেদের আত্মকেন্দ্রিক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, তবুও আমরা সামাজিক সর্বশ্রেষ্ঠ জীব!….আসলেই আমরা সবাই অবচেতনভাবে পরিণত হয়েছি বুদ্ধিজীবী মূর্খতে। নিজেদের আখেরটা গোছাতেই আমরা আজ ব্যস্ত… সমাজ-টমাজ?… ওসব নিয়ে ভাবে আবেগিরা…(যেমন ছিলেন:- রাজা রামমোহন রায়, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর) অথবা নিজেদের পাওনাগণ্ডা গোছাতে হবো কৃত্রিম সামাজিক আবেগি….. বি প্র‍্যাক্টিকাল! আবেগের এখন কোনো জায়গাই নেই… অধিকাংশের মুখ্য মন্ত্র আজ ভালো খাওয়া, ভালো পরা, নিজেদের ও পরবর্তী বংশধারকদের সুখের জন্যে একনিষ্ঠ মনে অর্থকে(যথাসাধ্য)ফুলের মালা ও চন্দনের ফোটায় বরণ করে ঘরে আমন্ত্রণ জানিয়ে অত্যাধিক খাতির যত্ন করা …. ব্যাস! চুলে ক্লোরোফিলের অভাবে ষাটে পদার্পণ করেই জীবনের সব দায়িত্বে দাঁড়ি টানা, আর সমাজ সচেতনতার জন্যে প্রয়োজনে বোধকরি আছে সরকার…তাতে আমাদের কি দরকার? আমরা শুধু বিশেষ বিশেষ দিনে একটু আদর্শের গন্ধ-টন্ধ ছড়িয়ে ভাষণ-টাষন দিয়ে সামাজিক দায়িত্ব পূর্ণ করে মহানুভবতার জীবাশ্মের নিদর্শন রাখবো/বুদ্ধিদীপ্ত চিৎকার করে গলায় গীটারের ঘুমন্ত তারগুলোকে জাগিয়ে বলবো “জয় হিন্দ! “, “বন্দেমাতরম!” অথবা “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি!”….শেষে আত্মতুষ্টিতে ভুগবো…
    মনে জীবন্ত হয়ে ওঠে সেই পরিচিত অর্থপূর্ণ শব্দগুচ্ছের সমষ্টি …….. “সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!” (ভূল ত্রুটি মার্জনীয়)

  • গল্প

    “ন কাঠা”

    “ন কাঠা” 
    -তন্ময় সিংহ রায়

     

     

    ‘আ…মোলো-যা, মরন দশা! মড়ার কাকগুলো ভর দুপুরে এরম বাড়ির ওপর ঘুরে ঘুরে কা কা করচে কেনো বলতো! হইই হুস্ হুস্… যাঃ! যাঃ!’ এদিকে, প্রতিদিনের আদর্শমিশ্রিত কর্তব্যকে পালনের নির্ভেজাল ইচ্ছায় সেদিনও পাশের বাড়ির পুঁটি’র বুড়ি ঠাকুমাটা হাতে এঁটো থালাটা নিয়ে ডাক ছাড়লো ‘আ তু…আঃ! আঃ!’ আকাশগঙ্গার কেন্দ্র থেকে আনুমানিক সাতাশ হাজার দুশো আলোকবর্ষ গড় দুরত্বে অবস্থিত জ্বলন্ত গ্যাসীয় পিন্ডটা সেদিন যেন বেশ রেগেই ছিলো। তার উপরে হলুদ প্রকৃতির স্বাধীনতা অর্জনকারী বাতাসটা যেন চুড়ান্ত অভিমান করে সেদিন এদিক পানে আসেইনি এমনটাই মনে হচ্ছিল। দুরে…মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল ও স্বাস্থ্যবান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে বিশালাকৃতির নগ্ন বটগাছটা তাকিয়ে কেমন যেন অশুভ একটা ঈঙ্গিত করছে বলে হঠাৎ-ই মনে হোলো, নাঃ চোখের ভূল!… তখনও পর্যন্ত তিন ছেলের ক্লাস ফোর পাশ গ্রাম্য মা-টা জানতোই না যে কাকগুলো তাদের ধ্বনির মাধ্যমে কি ভয়াবহ ঈঙ্গিত বহন করছে। মা-টার ছয় বছরের বড়ো ছেলে অপু ভর্তি হয়েছে গ্রামের এক সদ্যজাত ইস্কুলে। ইস্কুল গর্ভে জনা তিনেক মাষ্টার ও বিশ পঁচিশ ছাত্র-ছাত্রী, পড়াশুনা ভালোই। মেজোটা ভোলা আর নামবিহীন ছোটোটা ঘুমাচ্ছে ঘরে। আবার বিকট কা! কা! শব্দে হঠাৎ ছোটো ছেলেটা যেনো ডুকরে উঠলো কেঁদে! কেমন যেনো অজানা আতঙ্কে আচমকা এবারে ছ্যাঁত করে উঠলো মা-টার বুকের ভেতরটা। ছুটে ঘরে ঢুকেই ছোটো ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ব্লাউজের হুকটা আলগা করতে যাবে এমন সময়ে…. “অপুর মা… ও অপুর মা, সর্বনাশ হয়ে গেছে গো! সর্বনাশ হয়ে গেছে!”.. বলতে বলতে জনা সাতেক লোক ও বউ দীর্ঘনিঃশ্বাসযুক্ত কয়েকটা ব্যস্ত মনসহ আস্ত শরীর নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত হোলো বাড়িতে। ক্রমবর্ধমান হৃদস্পন্দনকে সঙ্গী করে চোখে মুখে অববর্ণনীয় ভয়, চরম উদ্বেগ ও মুহুর্তের তীব্র দুশ্চিন্তাকে সারা চোখ-মুখ ও মনে মেখে হুড়মুড়িয়ে মা-টা বাইরে বেরোতেই এক জমকালো সংবাদ যেনো মুহুর্তেই ধরে উপরে নিলো তার রক্তাবৃত হৃদপিন্ডটাকে! যেনো ছিনিয়ে নিলো তার অস্বচ্ছল সংসারের সুখ, শান্তি, স্বপ্ন ও তার শিশুগুলোর ভবিষ্যৎ, যেনো কেড়ে নিলো টুকটুকে লাল এক চিলতে সিঁদুরটার অধিকার চিরকালের মতন।…… ”পরাণদা গলায় দড়ি দিয়েছে।” দুশ্চিন্তাজর্জরিত বিস্ফোরিত চক্ষুদুটোর একটা নিথর ঝুলন্ত দেহকে দেখতে সেদিন একটা প্রায় আস্ত গ্রাম হাজির হয়েছিলো পাশের পাড়ার পুরানো তেঁতুল গাছটাকে ঘিরে। দুশ্চিন্তাহীন রাখতে ঋণাক্রান্ত পরাণদা তার একমাত্র বউটাকেও সেসব বিষয়ে কোনোদিন কিছু জানায়নি ও শেষ সম্বল হিসেবে কাঠা ন’য়েক ভিটেটাকে বাঁচাতেই নাকি তার এই অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুকে নিঃশব্দে বরণ বলে বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু দিনেশ।…..অনুভূতি ও প্রায় অনুভূতিহীন তিনটে শিশু মন, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলো মায়ের শাড়ির রঙের পরিবর্তন। দেখলো মায়ের কপালে লাল রঙের মৃত্যু ও বাবার চিতার শেষ আগুনটা। অবশেষে অমানুষিক পরিশ্রম ও অকল্পনীয় কষ্টে, একটা জীর্ণ শীর্ণ শরীরের পুষ্টি দুগ্ধে, সাধারণ মানের খাবার ও পোষাকে পরম স্নেহ-মমতায় বেড়ে উঠলো তিন ছেলে। দুর্ভাগ্যবশতঃ পড়াশুনাটা তিনজনের কারো জীবনেই পেলোনা পূর্ণতা!  আজ সাতাশটা বছর কেটে গেছে তবুও মা-টা আজও যেনো স্পষ্ট শুনতে পায়, “অপুর মা… ও অপুর মা, সর্বনাশ হয়ে গেছে গো! সর্বনাশ হয়ে গেছে!”…. আতঙ্কিত চিত্তে হঠাৎ-ই কেমন যেনো সে করে ওঠে! তিন বছরের এক কন্যা শিশুর অর্ধদায়িত্ববান মদখোর বাবা অপুটা আজ কাঁচা সব্জীর দু-দুটো দোকানের মালিক। ভোলাটা নিজে নিজেই বিয়ে করে নিয়েছে। প্রায় অনেককেই বলতে শোনা যায়, একটু দেখতে সুন্দর বলে ভোলার বউটা নাকি প্রায় সময়ে মহাকাশচারীর ভূমিকায় তার অস্তিত্বের নিদর্শন রেখে চলে। একটা অটো রিক্সা কিনে বেশ ভালোই আয় করে সে, আর সেই নামবিহীন দেবুটা আজ তো রঙের কাজে বেশ রঙিন করেছে তার নাম, একটা আলাদা তিন কাঠাও নাকি কিনেছে সে।

    বেশ বছর দুই হোলো, প্রায় সময়েই তিন ভাইয়ের মধ্যে ন-কাঠা নিয়ে অশান্তিটা ছাড়িয়েছে তার মাত্রাটা। কানাঘুষোয় শোনা যায়, যত দিন নাকি বউদুটো আসেনি এ সংসার বজায় রেখেছিলো তার স্বাভাবিক ধর্ম। সারাজীবনের চুড়ান্ত মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত ও নিঃস্বার্থ কর্তব্যপরায়ণা পরম মমতাময়ী বিধবা বুড়ি মা-টার শেষ জীবনের এ পরিণতি পুরো গ্রামটাকে পর্যন্ত কাঁদিয়েছিলো এমনটাই শোনা যায়। একদিন ভোলার মাধ্যমিক পাশ সুন্দরী বউটা ধাক্কা মেরে তার শাশুড়িকে ঘর থেকে বর্জ্য পদার্থের মতন ফেলে দিয়ে রক্তচক্ষু দৃষ্টি নিক্ষেপিত স্ব-শরীরে মন্তব্য করে ‘বুড়িটা মরেও না, ছেলেগুলোর ন-কাঠা ভাগ করে দিতে পারিসনি? সারাজীবন করলিটা কি?….স্বামীটাকে খেলি আর নিজে বসে শুয়ে গিলেছিস!’….একটা ঝামা ইঁটে মাথাটা লেগে ফেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়েছিলো গলগল করে অনেকটাই আর কোমরে হাতে ও পায়ে লেগেছিলো বিষম চোট!.. ঝামা ইঁটটা তার রুপ পরিবর্তনে ধারণ করেছিলো খয়েরি বর্ণ। বুকফাটা চাপা কষ্টে, জলভরা দুচোখে এ যন্ত্রণা ও অপমানের কারণটা সে (মা-টা) জানতে চেয়েছিলো পরম করুণাময়ের কাছে, উত্তর সে পায়নি। খুঁজেছিলো এক টুকরো নিঃস্বার্থ সহানুভূতি, তাও সে পায়নি। দিনটার সেই মুহুর্তটার সাক্ষী ছিলো কিছু প্রতিবাদহীন ও হীনা প্রতিবেশী ও প্রতিবেশিনী। যারা প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলো, চরম অপমানের বোঝা ও যন্ত্রণা কাঁধে তারা ফিরেছিলো বাড়িতে।’তোমরা আমাদের সংসারে নাক গলাতে আসো কেনো হে? আমরা তো যাইনি, এটা আমাদের সংসারের ব্যাপার, যাও যাও এখান থেকে!’ একদিন নির্দ্বিধায় খুব স্বাভাবিকভাবেই ছোটো ছেলেটা তো বলেই বসলো, ‘মা তুমি মরলে তোমার ভাগটা কিন্তু আমায় দেবে।’ কারণ হিসাবে বিশ্লেষণের প্রকৃতি এমন যে সেবারে মায়ের চোখের ছানি কাটাতে অনেক বেশি টাকা তার বেরিয়ে গেছে তার উপরে টুকটাক হাতে টাকাকড়ি দেওয়া। টানা দুবছর অবেলায়, দুপুরে দুমুঠো ডাল-ভাত খাওয়ানোয় বড় বউটা একটা বৃহৎ অধিকারের ডালাকে সুসজ্জিত করে তো সমানে বলেই চলেছে মা, ‘তোমার রুপোর চেনদুটো ও কাঠের ওই আলমারিটা কিন্তু আমায় দিও, তোমার নাতনীর বিয়েতে চেনটা ভাঙিয়ে কিছু গড়িয়ে দেবো, তোমারই তো বড়ো নাতনী বলো? আর তোমার ছেলে বলছিলো, পুব দিকটার ওই এক কাঠায় তো ও চার পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন সব্জী চাষ করে আসছে তাই ওটা যদি ওকে লিখে দাও তো…! মৃত্যুর পরে এটা ওটা নিয়ম পালন, লোক খাওয়ানো! সে অনেক খরচ!’ নির্বাক ও হতবাক অসহায়া বুড়ি মা-টা শেষ কয়েকটা দিন প্রতি রাতে অযত্নে নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকারে একান্তে শুয়ে হাতদুটো জড়ো করে তার স্বামীকে প্রণাম করে বলতো-”ওগো তুমি একটাবার দুচোখ মেলে দেখো তোমার তুলতুলে শিশুরা কত বড়ো হয়ে গেছে! ওরা আর আমার দুধ চায় না, তুমি ওদের বুকভরা আশির্বাদ কোরো, ওরা যেনো সুখী হয় এই তোমার দেওয়া ন’কাঠায়।”

    -“পারলে আমায় ক্ষমা কোরো অপুর মা। সুখ, শান্তি ও ভালো খাওয়া-পরা, আমি কিছুই তোমায় দিতে পারিনি। তোমার বুকে তিলে তিলে গড়ে ওঠা পরিবেশ, এমন নরকে পরিণত হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি কোনোদিন, বিশ্বাস করো তুমি আমায়। যোগ্য স্বামীর পরিচয় আমি দিতে পারিনি, বিশ্বাসঘাতক স্বামীটাকে তুমি ক্ষমা কোরো। নিজে মুক্তি নিয়ে তোমায় পারিনি দিতে মুক্তি..অপুর মা! এ ঋণ পরিশোধযোগ্য নয় জেনেও, যদি অন্য কোনো জীবনে তোমায় স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়, চেষ্টা করবো তোমার এ ঋণ শোধ করার। শুধু একটা বার ক্ষমা কোরো আমায়।”

    এ স্বপ্ন গভীর ঘুমে জীবন্ত হলেও, সেদিন ভোর বেলায়…অপমানিত, লাঞ্ছিতা ও অবহেলিতা কর্তব্যপরায়ণা বিধবা মা-টা আর কোনোদিন ও একটা নতুন দিন আর দেখতে পায়নি।।

  • প্রবন্ধ

    পশু কারা??

    পশু কারা??
    -তন্ময় সিংহ রায়

     

     

    একটা সম্পূর্ণ/আধাসম্পূর্ণ জীবনে অক্সিজেনের যথার্ত ভাগ তো পায় সকলেই কিন্তু সঠিকভাবে বাঁচাটা অসম্ভব বলে ভূল করলেও যথেষ্ট কঠিন বলাটাই বোধকরি নির্ভুল। একটা পশু সারাজীবন বাঁচে তার পশুত্ব বজায় রেখে কিন্তু একটা মানুষ বারে বারে হারিয়েছে বা হারাচ্ছে তার মনুষ্যত্ব। কিছু ক্ষেত্রে, আত্মসম্মানহীনের নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে হৃদয় তাচ্ছিল্যে পূর্ণ করে আমরা স্মরণ করি কুকুর নামক এমন একটা প্রাণীকে যে কখনই হারায়নি তার পশুত্ব। কুকুর বিশ্বাসঘাতক, স্বাভাবিক জ্ঞানে এ কথাটা বলার ক্ষমতা আজও পর্যন্ত কারো হয়েছে কিনা তা আমার সম্পূর্ণ অজানা কিন্তু মানুষ বিশ্বাসঘাতক, এটা আজ একটা কুকুরেরও বোধ করি জানা। বুদ্ধিবিহীন কোনো কর্মের স্রষ্টাকে আমরা অনেক ক্ষেত্রে উদাহরণ দিই গরু বলে। একটা গরুও কখনও তার পশুত্ব হারিয়েছে কিনা তাও আমার জানার বাইরে। যদি যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা/বিশ্লেষণধর্মী উত্তর চাওয়া হয় কারো কাছে যে একটা গরু কি সত্যিই প্রকৃত অর্থে নির্বোধ? যদি উত্তর হ্যাঁ হয় তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্নের আবশ্যিক দাবী রাখে, কেন/কিভাবে? অথবা বুদ্ধিহীনতার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসাবে গরু নামক প্রাণীটি কতটা যথার্থ তা যুক্তিসহ বিশ্লেষণ/ব্যাখ্যা করো। যদি উত্তর না হয় তাহলে কেনো তাকে মিথ্যে দোষারোপ ও অপমান? পশু বলে? জানিনা ক’জন এক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুচ্ছের যুক্তিসংগত উত্তর দিতে অক্ষমতার পরিচয় বহন করবেন না! অকারণে নির্বিচারে ও নির্দ্বিধায় অগুনিতবার দেখেছি কুকুরকে অত্যাচার করতে, দেখেছি অমানবিক ও আফসোসহীনভাবে মেরে ফেলতে কিন্তু অকারণে একটা মানুষকে কামড়াতে, আঁচড়াতে বা সিং উঁচিয়ে তেড়ে আসতে সাধারণত কোনো কুকুর বা গরুকে আমি দেখিনি। একজন মানুষ আ-মৃত্যু এই পৃথিবীর যতটুকুই ক্ষতিসাধন করে একটা কুকুর তা করে কি-না আমার ঠিক জানা নেই আর বিশ্ব উষ্ণায়ন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণ কোনো কুকুর, গরু/গাছ বোধ হয় নয়। জিরো ডিগ্রী না হলেও মস্তিষ্কের ভিতরের তাপমাত্রা পাঁচ থেকে দশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড করলেই বোঝা যায় যে আমাদের ভাগ্যটা কতটা পরিমাণে সৌ যে কুকুর,গরু, গাছ প্রভৃতিরা বাকশক্তিহীন। আমরা বারে বারে হিটলার হয়ে কৃতিত্ব অর্জন করেছি নিরীহ প্রাণী ও উদ্ভিদগুলোর উপরে আর দুর্নীতির গন্ধ পেলেই নিজেদের প্রমাণিত করেছি সাপে তাড়া লেংটি ইঁদুর/গোলাপের সুবাসরুপে গভীর নিঃশ্বাসে নিস্তব্ধে সংযোজন করেছি সেই দুর্নীতির গন্ধ। আমরা গরুকে নিয়ে রাজনীতি করেছি কিন্তু একটা গরু তা করেনি। আমরা কচ্ছপ ও হরিণকে লুপ্তপ্রায় করতে চলেছি আর গর্বে ভরা বুক উঁচিয়ে বলছি ‘আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ জীব।’ আমরা লোভী, ওরা প্রয়োজনটুকু মেটায়, আমরা স্বার্থপর, ওরা আমাদের স্বার্থে কাজে লাগে। ক্ষমতার অপব্যবহারে আমরা প্রায় অধিকাংশই সারাজীবনে আমিষ ভক্ষণকারীর ধর্ম পালনের তাগিদ ছাড়াই কত নিরীহ জীব হত্যা করেছি তা হিসাব বহির্ভূত, শুধু হত্যা করতে পারিনি নিজের ভিতরে থাকা মনুষ্যত্বহীনতাকে। এ জীবেরা সংঘবদ্ধ হতে শেখেনি তাই আমাদের এ যাত্রায় রক্ষে! প্রশ্নের তিক্ষ্ণ ফলায় এরা হিমোগ্লোবিনপূর্ণ তরল নিঃসরণ করেনি তাই ভাগ্য আমাদের প্রসন্ন যে ‘এ সুন্দর পৃথিবীতে সুষ্ঠ, সাবলীল ও পূর্ণ মর্যাদার সহিত বাঁচার অধিকার সবার। এ পৃথিবী আমাদের (গাছ, কুকুর ইত্যাদি) বাসযোগ্য গৃহ, তাকে তিলে তিলে যীশুখৃষ্টের ন্যায় (তোমাদের খৃষ্টান ধর্মানুযায়ী) শেষ করার অধিকার তোমাদের কে দিয়েছে?? কেন শেষ করে ছাড়লে এ পৃথিবীর স্বাভাবিকত্ব?? কেন নির্দ্বিধায় ও নির্বিচারে হত্যা করো আমাদের?? কতটা পরিমাণ অনুভব করো আমাদের অব্যক্ত, অসহনীয় যন্ত্রণা?? কতটাই বা সমব্যাথী হও/আদৌ হও কিনা!’ (ব্যতিক্রম অবশ্যই স্বীকার্য।)

  • কবিতা

    আর একটা ফরাসি বিপ্লব

    আর একটা ফরাসি বিপ্লব
    -তন্ময় সিংহ রায়

     

     

    বিনা বাক্যব্যয়ে ব্যাতিক্রম স্বীকার করেই একরাশ প্রকৃত ঘৃণা বর্ষণ ও আন্তরিক ধিক্কার জানাই সেই সমস্ত হৃদপিন্ডধারণকারী কঠিন বর্জ্য পদার্থদের, যারা পোষাকি বৈচিত্র্যতায় ঢেকে রেখেছে তাদের মানসিকতার দুর্গন্ধকে!…. স্বপ্ন শুধু, মনুষ্যত্বকে অদৃশ্যভাবে বিক্রয়যোগ্য করে ধনী হওয়ার। একজন শিক্ষিত অথবা উচ্চশিক্ষিত মানুষের স্বভাব ও চিন্তাধারার প্রতিফলনে যে একটা পশুও চরম লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়বেনা এমন বলাটা যুক্তিবিদ্যার চরম অপমান , অনুরূপ একজন অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত যে মাদার টেরিজা বা স্বামী বিবেকানন্দ হবেনা এমন ভাবাটাও চরম মূর্খতার পরিচয় বহন করে। তবে যে শিক্ষায় একজনের অন্তর আজও ইজিপ্টোপিথেকাস , যে শিক্ষিত-এর গভীরে আজ ও খুঁজে পাওয়া যায় ইনটেনডেন্ট, সে শিক্ষা অর্জন অপেক্ষা মূর্খতাই শ্রেয়। একজন সাধারণ চোর চুরির দায়ে যায় নিস্তব্ধ অন্ধকার ঘরটাতে কিন্তু একজন অর্থবান শিক্ষিত চোর পায় দিগন্ত বিস্তৃত খোলা আকাশ আর উদ্ভিদের পর্যাপ্ত প্রশ্বাস। বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো’র ভূবনজয়ী মহাগুরু দার্শনিক সক্রেটিস-এর “যার টাকা আছে তার কাছে আইন খোলা আকাশের মত, আর যার টাকা নেই তার কাছে আইন মাকড়ষার জালের মত!” আজও সতেজ ও প্রাণবন্ত! এদিকে ভগবান আজ শয়তানের ভূমিকায়ও বিত্তবান। জিরো ডিগ্রী মস্তিষ্কের তৈমুর লং-এর ভূমিকায়ও একটা দরিদ্র মানুষের বৃক্ক ও যকৃত নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে করা হয় রক্তাক্ত গবেষণা! পরে ঘোষিত হয় মৃত বলে। সম্প্রতি ভারতের কর্নাটক ও মহারাষ্ট্রে গ্রামে স্ত্রীরোগে আক্রান্ত বেশ কিছু হতদরিদ্র মহিলাদের যথেষ্ট মেডিক্যাল যৌক্তিকতা ছাড়াই তড়িঘড়ি অপারেশনে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে জরায়ু ৷ হাব-ভাবে বিধান চন্দ্র রায়ে-রা সামান্য হাঁচি-কাশিতেই নির্দেশ জারী করছে সাত-আট রকমের টেস্ট, এক্সট্রা প্রাপ্তি বলতে হাল্কা একটু কমিশন হজম। এক্ষেত্রে হজমটা বদ কখনই হয়না অর্থাৎ পরিপাক ক্রিয়ার কোনো যান্ত্রিক গোলোযোগ সম্পন্ন হয়না। উকিলের সততা আটকে থাকে অর্থবান প্রকৃত আসামীটার বুক পকেটে! একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের বুক ভরা আদর্শে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে প্রাণ যায় অসংখ্য তরতাজা প্রাণগুলো! একজন বিবেকবান শিক্ষক চুরি করে বাচ্চাদের মিড-ডে মিলের উপকরণ অথবা অনুপোযুক্ত শিক্ষাদানেও প্রাপ্তিযোগ হয় কুড়ি অথবা চল্লিশ। একজন চোর পুঁথিগত /মানসিক শিক্ষিত হলে সমাজ তার বুকে পায় শান্তি কিন্তু একজন শিক্ষিত যদি হয় চোর তবে সমাজটা হয় এখনের মতন। এখন প্রশ্ন হলো আর একটা ফরাসি বিপ্লব কি আজও নিষ্প্রয়োজন?

You cannot copy content of this page