-
গল্প- সম্পর্ক
সম্পর্ক
– দেবস্মিতা ঘোষবারান্দায় বেরোতেই সোনালি রোদ্দুর আপ্যায়ন করল অরুনিমাকে। বাতাসে হাল্কা ঠাণ্ডার আমেজ। সাড়ে নটা মত বাজে। তমালের সাথে দশটা নাগাদ দেখা করার কথা। কিন্তু অটো করে যেতে যেতে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে। তার মানে আজ আবার লেট। বারান্দার একপাশে বসে অরুনিমার দাদা আকাশ এতক্ষণ বোনের চিন্তিত মুখের দিকেই তাকিয়েছিল।
‘’এত দেরি করে ঘুম থেকে উঠলে লেট তো হবেই। বাইরের কলেজে পড়তে গিয়ে তোর অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে অরু।‘’ হাসতে হাসতে বলল আকাশ।
‘’মোটেই না, দিল্লিতে আমি প্রতিদিন সকাল সকাল উঠতাম। বাড়িতেই বরং তুই এত আদর যত্ন দিচ্ছিস যে আরামের ঘুম ভাঙতেই চাইছে না।‘’
‘’পরের মাস থেকে চাকরি শুরু তখন দেখবো এত আরাম কোথায় যায়। যাইহোক দু’ মিনিট দাড়া অজিত তোকে বাইকে ছেড়ে দিয়ে আসবে, আধ ঘণ্টায় পৌঁছে যাবি। লেট হবি না।‘’
‘’ তুই বেস্ট দাদা’’ অরুনিমার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
আকাশ ওর থেকে আট বছরের বড়। অরুনিমার যখন তেরো বছর বয়স তখন ওর মা বাবা মারা যান। দার্জিলিং থেকে ফেরার পথে ওদের গাড়ি খাদে পড়ে যায়। একুশ বছরের আকাশ কলেজের হস্টেল ছেড়ে চলে এসেছিল তার এক সপ্তাহের মধ্যে। টাকা পয়সার দিক থেকে ওদের কোনও অভাব ছিল না, আকাশের বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। মামার বাড়ির তরফ থেকেও অনেক সাহায্যের হাত এগিয়ে এসেছিল। অরুনিমার দাদু মারা যাবার আগেই আকাশকে পারিবারিক ব্যবসায় যথেষ্ট দক্ষ করে দিয়েছিলেন। কম বয়সে মা বাবা হারাবার ফলে ভাই বোনের বন্ধনটা খুবই শক্ত। বোনের পড়াশোনার সাথে কোনও আপোষ করেনি আকাশ। সর্বদা পাশে থেকেছে। স্বাধীনতা দিয়েছে। তাই অরুনিমা দিল্লির কলেজে সুযোগ পাওয়ার পর ওকে একবারও আটকায়নি। আর বোনের চাকরির খবর পেয়ে অরুনিমার থেকেও বেশি খুশি হয়েছিল ও। এই দাদা বোনের চলার পথে আকাশের ছোট বেলার বন্ধু অজিতও এক সহযাত্রী। সবসময় আকাশকে মনের জোর জুগিয়েছে। দরকারে অদরকারে অরুনিমার পাশে থেকেছে।
অজিতকে বাইক নিয়ে আসতে দেখে অরুনিমা প্রায় দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়ল।
‘’অমালের সাথে দেখা করার এত যখন তাড়া, তো দেরি করিস কেন বলত?’’ স্টার্ট দিল ও।
‘’জানি তো তোমরা কেউ একটা দিয়ে আসবে ঠিক’’ অরুনিমা উত্তর দিল।
আধ ঘণ্টার মধ্যেই নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গেল ওরা। বাইক থেকে নামতেই অজিত বলল, ’’দাঁড়া অরু, কথা আছে।‘’
অরুনিমা ঘুরে দাঁড়াল। ‘’আমি জানি অজিতদা তুমি কি বলবে’’
‘’জানারই কথা। আমি জানি না তোর দাদা তোকে কি বলেছে না বলেছে। কিন্তু আমি তোকে বলতে পারি, তোর ভালোর জন্য আমি আর আকাশ সব সহ্য করতে পারি। কিন্তু আমাদের জন্য তোকে অখুশি দেখতে পারবো না। তুই যা সিদ্ধান্ত নিবি সবসময় তোর পাশে থাকবো, সে কাছে থেকে হোক বা দুরে থেকে। সেটা বড় কথা নয়। তমালকে তুই কতটা ভালবাসিস আমি জানি। আকাশও জানে। তাই বলছি…’’ অজিত থামল।
অজিতের গম্ভীর মুখ দেখে অরুনিমা হেসে ফেললো,’’আমি যা করছি তা নিজের জন্য। তোমাদের জন্য নিজের ক্ষতি করছি এরকম ভেবো না। বাড়ি যাও। ফেরার সময় ফোন করবো চলে এস। দাদা বাড়িতে আছে। পারলে প্ল্যানগুলো করে ফেল। আমি যাই।‘’ ও এগিয়ে গেল তমালের দিকে। তমাল এতক্ষণে দেখতে পেয়েছে ওকে।
যেতেই গোলাপটা এগিয়ে দিল তমাল। পার্কের বেঞ্চে বসল দুজন। রবিবার হলেও এইসময়ে পার্কটা খালিই আছে।
‘’দিল্লি থেকে এসেছিস তো এক সপ্তাহ আগে। সবে দেখা করার সময় হলো’’ তমাল নিস্তব্ধতা ভাঙলো।
‘’বাড়িতে কিছু কাজ ছিল।‘’ অরুনিমা চুপ করে গেল। ভেবে এসেছিল অনেক কথা বলবে। কিভাবে শুরু করবে গুছিয়ে নিতে ওর একটু সময় লাগবে। অরুনিমাকে চুপচাপ বসে গোলাপ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখে তমাল মুখ খুললো,’’ তুই কি কিছু বলবি না! সারাদিন চুপ করে বসে থাকবি?”
‘’দেখ তমাল এড়িয়ে গিয়ে কোনও লাভ নেই। আজ না হোক কাল এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতেই হবে। পরের মাস থেকে আমি চাকরিতে জয়েন করছি তো তার আগেই আমি চাই ওদের বিয়েটা হয়ে যাক’’
‘’বিয়ে, অরু তুই কি পাগল হয়ে গেছিস। রুল হয়েছে, ওরা স্বাভাবিক সব মানছি কিন্তু বিয়েটা বাড়াবাড়ি নয় কি…বিয়ে না করেও তো থাকা যায়’’ তমালের গলায় অবিশ্বাসের সুর।
‘’তুই পারবি বিয়ে না করে আলাদা থেকে জীবন কাটাতে’’
‘’আমাদের ব্যাপারটা আলাদা অরুনিমা। তুই একবার আমাদের কথাটা ভাব, আমার বাড়ির লোক কখনই মেনে নেবে না ওদের ব্যাপারটা।‘’ তমাল বলল।
‘’এখানেই সমস্যা, ওরা আমাদের থেকে আলাদা নয়।:তুই আমাকে যতটা ভালবাসিস, অজিতদা আমার দাদাকেও ঠিক ততটাই ভালবাসে। ওরা কোনও অংশে কম না। আমি মানছি তোর বাড়ির ব্যাপারটা, কিন্তু তুই ভেবে দেখ ওরাই আমার পরিবার। ওদের জন্যেই আমি আজ এখানে আছি। তুই তো সবই জানিস।‘’ অরুনিমা চেষ্টা করলো নিজেকে শক্ত করতে।
‘’কিন্তু এর সমাধানও আছে, ওরা তো অন্য কোথায় চলে যেতে পারে। আমার ফ্যামিলি না জানলেই হবে। তুই নয় মাঝেমাঝে দেখা করে আসবি। ‘’ তমাল জেদের সাথে বললো।
‘’আমি পারব না তমাল। ওদের কেন পালিয়ে, লুকিয়ে বাঁচতে হবে। ওরা সম্মান নিয়ে বাঁচবে। আরও বাকি সবাইয়ের মত।‘’ অরুনিমা আপোষ করতে রাজি না।
‘’তুই জানিস আমি তোকে ভালবাসি অরু, কিন্তু আমার পরিবার কখনোই তোর দাদার ব্যপারে জানার পর তোকে মেনে নেবে না। নিয়ম হয়েছে, সমাজ আধুনিক হয়েছে সব কথাগুলো সিনেমাতেই মানায়। আসল পরিস্থিতিটা তুইও জানিস আমিও জানি। সেটাকে অস্বীকার করার প্রশ্ন আসে না।‘’ তমাল হাল ছেড়ে দিতে নারাজ।
‘’পরিবর্তন তো আর একদিনে আসে না। আমি বেশি বুঝি না। আমার খারাপ সময়ে ওরাই আমার পাশে ছিল। ওরা আমার জন্য সব করেছে তাই আজ ওরাই আমার সমাজ। আমি আর কারুর কথা ভেবে ওদের ভালবাসাকে নষ্ট হতে দেবো না। এইটাই আমার সিদ্ধান্ত। আজকের পর থেকে আমাদের আর দেখা হবে না। ক্ষমা করে দিস তমাল।‘’ গোলাপটা তমালের হাতে ধরিয়ে দিয়ে অরুনিমা উঠে এল।পার্ক থেকে বেরিয়ে ও আকাশ আর অজিত দুজনকেই দেখতে পেল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দুজনেই আন্দাজ করে নিল কি ঘটেছে। নিজের অজান্তেই অরুনিমার চোখ থেকে জল পড়তে লাগল। অজিত রুমাল এগিয়ে দিয়ে বলল, ’’এই নে, রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি করলে লোকে ভাববে আমরা তোকে কিডন্যাপ করছি’’
আকাশ বলল, ’’এসবের দরকার কি ছিল অরু। অজিত আর আমি নয় চলে যেতাম কোনও জায়গায়। আমাদের লড়াইটা পুরো সমাজের বিরুদ্ধে, এতে তোকে জড়াতে চাইনি আমি।”
‘’ না দাদা। যেদিন থেকে তুই আমাকে তোদের ভালোবাসার কথা বলেছিস সেদিন থেকেই আমি ঠিক করেছি তোরা আর সাধারণ লোকের মতই থাকবি। তোদের ভালবাসাও প্রতিষ্ঠা পাবে। আমিও থাকবো তোদের পাশে। আর এরকম ছেলে তো নিশ্চয়ই আছে যে ভালোবাসাকে মন দিয়ে যাচাই করে শরীর দিয়ে না। তাই আমার জন্য ভাবিস না।‘’ হাসি মুখে আকাশের দিকে তাকাল অরুনিমা।
‘’এবার তোরা বাড়ি চল, সামনে একটা বিয়ে বাড়ি। তোড়জোড় করতে হবে তো নাকি!’’ অজিত বললো।
‘’তোর শুধু বিয়ের জন্য তাড়া’’ আকাশ হাসতে হাসতে বাইকের দিকে এগিয়ে গেল। -
গল্প- হাত
হাত
– দেবস্মিতা ঘোষপ্লেনটা এয়ারপোর্টের মাটি ছাড়তেই একটু নিশ্চিন্ত হল তিন্নি। সপ্তাহের মাঝখানে হঠাৎ ছুটি পেতে খুব সমস্যা হত শুধু রবার্ট ছিল বলে সুযোগটা পেয়েছে। তিন্নির বন্ধু রবার্টৈর সাথে ওর বসের ভালো জানাশোনা আছে। তাই তিন্নির দরকার অনুযায়ী এক সপ্তাহ ছুটি পেতে অসুবিধা হয়নি। সিডনি থেকে কলকাতা যেতে মোটামুটি এগারো বারো ঘণ্টার বেশি লাগে না, সেই হিসাবে কাল সকাল দশটার মধ্যে পৌঁছে যাবে ও। কিন্তু তারপর কি করবে ও সেটা কল্পনা করতেই ওর মাথায় চিন্তার মেঘ ঘনিয়ে এল।
রাত তিনটে নাগাদ কলকাতা থেকে ফোন পেয়ে খুব একটা অবাক হয়নি ও। সিডনিতে আশার পর থেকেই সময়ের ব্যবধান বুঝতে তিন্নির বাড়ির লোকের একটু সময় লাগছে। ফোনের ওপারে বছর এগারোর রিমির গলা শুনে অবাক হয়েছিল তিন্নি। রিমি ওর মামার মেয়ে। তিন্নির মায়ের একটি মাত্র ভাই, ওর সুবল মামা। তার এক ছেলে অনুভব আর এক মেয়ে রিমি। রিমি কাঁদতে কাঁদতে যা বলল তার মর্মে তিন্নি শুধু এটুকু বুঝলো বছর একুশের অনুভব দু’দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি। সম্ভবত সুইসাইড করার ব্যর্থ চেষ্টা। রিমির পক্ষে পুরোটা বোঝা সম্ভব হয়নি। ওর মা বাবা ওকে দাদার সাথে দেখা করতে দেয়নি, দাদার ব্যাপারে কিছু জানায়নি। চিন্তিত রিমি তাই ওর তিন্নিদিকে লুকিয়ে ফোন করা ছাড়া কিছু ভাবতে পারেনি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরবে আশ্বাস দিয়ে তিন্নি ফোন রেখেছিল। অনুভব আর তিন্নির সাথে ওর খুব ভালো সম্পর্ক। সেই অনুভব কেন সুইসাইড করবে ভেবে পেল না ও। একটু স্পর্শকাতর হলেও তুচ্ছ কোনও কারণে ভেঙ্গে পরার মত ছেলে অনুভব নয় তা খুব ভাল করে জানে তিন্নি। ছোট বেলায় অনুভবের ব্রেন টিউমার দেখা দেয়ার জন্য বেশ কিছু ব্রেন সার্জারি করতে হয়েছিল ওকে। পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন থাকলেও অনুভবকে কখন চিন্তিত লাগেনি। সেই ছেলে কি কারণে নিজের জীবন দিতে চেয়েছিল।
কলকাতায় এসে সোজা মামারবাড়িতেই গেল ও। জানতো ওর মা বাবাও এখানে থাকবে। ওকে দেখে ওর মামিমা আর ওর নিজের মা দু’জনেই অবাক হয়ে গেল। রিমি এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। ওরা দু’জনেই বুঝতে পারলো তিন্নিকে খবর কে দিয়েছে। রিমিকে কেউ কিছু বলার আগেই তিন্নি বলল, ’’তোমরা কেউ ওকে কিছু বলবে না। ব্যাপারটা কি চলছে বলতো? আমাকে কি বাড়ির মেয়ে বলে মনে করোনা? দেশের বাইরে বলে একটা খবর দেয়ার প্রয়োজন মনে করোনা।‘’ ওর মামিমার চোখে জল দেখে চুপ করে গেল তিন্নি। তিন্নির মা বললেন, ‘’দেখ তিন্নি না জেনে বুঝে চেঁচামেচি করিস না। ঠাণ্ডা মাথায় শোন সবটা। এরকম একটা লজ্জাশীল ব্যাপার জানাজানি হলে খারাপ হবে বলেই তোকে জানানো হয়নি। আর অনুভব ভালো আছে কাল হয়ত বাড়ি চলে আসবে।‘’
‘’কিন্তু ভাই এরকমটা করলো কেন সেটা কি কেউ বলবে আমায়? আর লজ্জাকর ব্যাপার বলতে কি বোঝাতে চাইছো একটু খুলে বলবে কি? সুইসাইড কবে থেকে লজ্জাকর ব্যাপার হয়ে গেল’’ ওর মা আর মামির এত চুপচাপ ভাব আর নিতে পারছিল না তিন্নি। ওর অবস্থা দেখে ধীরে ধীরে ওর মামিমা পুরোটা খুলে বললেন। ‘’আগের শনিবার তোর মামার বন্ধু চিরাগের বিবাহবার্ষিকীতে নিমন্ত্রণ ছিল। আমরা সবাই গেছিলাম। অন্য সব অতিথি চলে যাবার পর শুধু আমরাই ছিলাম। রিমি ঘুমিয়ে পরেছিল। আমরা গল্প করছিলাম। অনুভব চিরাগের মেয়ে প্রিয়ার সাথে পাশের ঘরে টি ভি দেখছিল। হঠাৎ প্রিয়ার চিৎকারের শব্দে আমরা সবাই ওখানে গিয়ে দেখি অনুভব এক হাত দিয়ে প্রিয়ার শার্টের বোতাম খোলার চেষ্টা করছে…’’ উনি আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। ‘’ চিরাগ গিয়ে টেনে প্রিয়াকে সরিয়ে আনেন। উনি যা তা বলেন তোর মামাকে। পুলিশে যাবার ভয় দেখান। শেষে আমরা সবাই প্রিয়ার কাছে ক্ষমা চাই। অনুভবের গায়ে হাত তোলেন, আমি আটকাতে পারিনি… কথা বন্ধ হয়ে যায় ওর সাথে। তার কিছু দিন পরই এই…।‘’ উনি চুপ করে যান। হঠাৎ রিমি বলে উঠে, ’’শুধু বাবার কথা বলছো কেন মা… তুমিও তো দাদাকে বাজে বাজে কথা বলেছিলে। কথা অবধি বলতে না ওর সাথে, আমাকেও কথা বলতে দিতে না।‘’ তিন্নির মা রিমিকে নিয়ে ঘরে চলে যান।
তিন্নির দিকে চেয়ে ওর মামিমা বলে উঠেন, ’’কি করতাম বল তো… যত বার জিজ্ঞেস করেছি কেন এমন করলি বারবার সেই একই কথা… ওর বাঁ হাত নাকি ওর আয়ত্তে ছিল না, ও নাকি ইচ্ছা করে করেনি এসব…কি করতাম আমি বল’’ তিন্নি এতক্ষণ কিছু বলেনি। ওর মাথা কাজ করছে না। ও উঠে ভিতরে চলে গেল। স্নান খাওয়া করে বিছানায় শুতেই ওর ঘুমিয়ে পরার কথা। কিন্তু অনুভবের কথা ভেবে ভেবে ওর আর ঘুম আসছিল না। রিমি এল ওর ঘরে, ’’হসপিটালে যাবার আগের দিন দাদা আমাকে বলেছিল যদি তুমি আসো তো তোমাকে এটা দিতে। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে নিয়েছিলাম। মা আমার সাথে দাদাকে কথা বলতে দিত না’’ রিমি ওর হাতে একটা ডাইরি দিয়ে চলে গেল। এমনিতেও ঘুম আসছিল না, তাই ও পড়তে আরম্ভ করল। ডাইরিটা পড়ার পর ওকে ইন্টারনেট খুলে কিছুটা সময় দিতে হল। বিকালে অনুভবকে দেখতে যাওয়ার আগে ও কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিল। অনুভবকে চিনতে ওর কোনদিন ভুল হয়নি, এই ব্যাপারটাই তিন্নিকে স্বস্তি দিয়েছিল। হাসপাতালে গিয়ে ওর মামার সাথে দেখা হয়।
‘’দিদি ফোন করে বলেছিল তুই আসবি। আমি তাহলে বাড়ি যাচ্ছি। এমনিতে এখানে থেকে তেমন কিছু করার নেই আমার। ও ভালই আছে। কাল বাড়ি নিয়ে যাব। কিন্তু কারুর সাথে কথা বলেনি সুস্থ হওয়া অবধি। ডাক্তার চেনাশোনা বলে সুইসাইড কেস হয়েও পুলিশ আসেনি। দেখ তোর সাথে কথা বলে কিনা’’
‘’ঠিক আছে মামা, তুমি যাও। আমি দেখছি’’
তিন্নিকে দেখা মাত্র অনুভব উঠে বসল।‘’ তিন্নিদি, আমি… ‘’ অনুভবকে শেষ করতে না দিয়েই তিন্নি বলল, ’’আমি জানি অনুভব। আমি সব জানি, আমাকে কিছু বোঝাতে হবে না। তুই চিন্তা করিস না । আমি সব ঠিক করে দেব।‘’ তিন্নি অনুভবের পাশে বসে ওর একটা হাত ধরলো। ‘’তুমি আসতে এত দেরি করলে কেন দিদি’’ অনুভবের চোখে জল।‘’ আমাকে কেউ জানাই নি রে, কিন্তু এত কিছু করার আগে তুই আমাকে একবার জানাস নি কেন? একবার ফোন করতে পারতিস।‘’ তিন্নিও আর নিজেকে সামলাতে পারল না।‘’ বাবা ফোন নিয়ে নিয়েছিল। কেউ বিশ্বাস করছিল না আমার কথা। আমি নিজেও জানি না কি হচ্ছে এইসব। তারপর মা বাবা… আমি আর পারছিলাম না দি।‘’। তিন্নি এবার বললো, ’’তুই আর ভাবিস না। আমি কাল তোকে নিয়ে যাব। সবাইকে সব বুঝিয়ে দেব।‘’
পরের দিন সকালে তিন্নি একা গিয়েই অনুভবকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এল। সাথে রিমিও ছিল। এতদিন পর দাদাকে দেখে ও খুব খুশি হয়েছে। বাড়ি ফিরে অনুভব রিমি আর তিন্নি ছাড়া কারুর সাথে কথা বলেনি। বিকালে তিন্নি সবাইকে এক ঘরে ডাকল। রিমি কেও। ‘’আমি সবাইকে ডেকেছি, বেশি সময় নেব না। আধ ঘণ্টা মত হলেই হবে।‘’
তিন্নির বাবা বললেন, ‘’যা বলবি তাড়াতাড়ি বল। অনুভবের এখন রেস্ট দরকার’’
‘’তার থেকেও বেশি দরকার ওর এই কথাগুলো শোনা। আমি ওকে আমার সাথে সিডনি নিয়ে যাব, ওর চিকিৎসার জন্য। এখানেও হতে পারত কিন্তু আমি ওকে আমার সাথে নিয়ে যেতে চাই। ওর কোনও আপত্তি নেই, বাকিটা তোমরা ভাবো।‘’
‘’আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। ও তো সুস্থ আবার কিসের চিকিৎসা। কি বলতে চাইছিস তুই?’’ তিন্নির মামিমা বললেন।
‘জানিনা তোমরা কতটা কি বুঝবে। সব কিছু শুনে আমি প্রথমেই খুব অবাক হয়েছিলাম। অনুভবের সাথে আবার খুব ভালো সম্পর্ক। অনুভব যে এরকম কিছু করতে পারে তা আমি কখনও মানতে পারছিলাম না। তারপর রিমি আমকে ওর ডাইরি দেয়। মামিমা তোমাকে তো ও আগেও বলে ছিল যে ওর মাঝেমাঝে মনে হয় ওর বাঁ হাত ওর কন্ট্রোলে নেই। তুমি কোনোদিন বিশ্বাস করো নি। কিন্তু সেদিন যখন দেখলে ও বাঁ হাত দিয়ে প্রিয়ার গায়ে হাত দিচ্ছে তোমার একবারও কিছু মনে হল না? নিজের ইচ্ছায় করলে ও স্বাভাবিক ভাবে ডান হাত ব্যবহার করতো। যাইহোক, তোমরা এতদিনে নিজের ছেলেকে চিনলে না। একটু তো বিশ্বাস করতে পারতে। অনুভব একটা খুবই বিরল রোগে আক্রান্ত। আমিও প্রথমে বুঝতে পারিনি। কিন্তু ওর অপরে আমার বিশ্বাস ছিল তাই ওকে ভুল বুঝিনি এক বারের জন্য। আমার অস্ট্রেলিয়ার এক ডাক্তার বন্ধু, ওকে ফোন করতে ওই ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছে। এলিয়েন হ্যান্ড সিন্ড্রোম। এতে মাঝেমাঝে কম ব্যবহৃত হাতের ওপর থেকে মাঝে মাঝে রোগীর কন্ট্রোল চলে যায়। বিশেষত বাঁ হাত। নিজের অজান্তেই রোগীর হাত নানা কাজ করতে থাকে যেমন জামার বোতাম খুলে দেওয়া, মাথায় হাত দেয়া, কোনও জিনিস ফেলে দেওয়া এইসব। রোগী চাইলেও কন্ট্রোল করতে পারে না। কখনও দশ মিনিটের জন্য কখনও আধঘণ্টার জন্য। এর আগেও অনুভবের সাথে এরকম হয়েছে। তখন কেউ ওর কথা শোনেনি। সেইদিনও এটাই হয়েছিল। ওর হাতের ওপর ওর আয়ত্ত ছিল না। আর প্রিয়াও ওর খুব কাছে বসে ছিল। ওর কোনও দোষ ছিল না। বিনা দোষে ওকে কি রকম মানসিক নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তোমরাই ভাবো। যদি সাহস করে রিমি আমাকে ফোন না করতো তাহলে কি হত বোলো। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা বিশ্বাস। ওর মা বাবা হয়ে তোমরা ওকে বিশ্বাস করো নি। যাইহোক, আমি ওকে আমার সাথে সিডনি নিয়ে যাব। সব ঠিক হয়ে যাবে অনুভব চিন্তা করিস না।‘’ ঘরের সবাইয়ের মুখে চোখ বুলিয়ে ও থামল।‘’
‘’আমাদের ভুল হয়ে গেছে, আমাকে ক্ষমা করে দে।‘’ অনুভবের মা বাবা ওর দিকে এগিয়ে গেলেন। অনুভব কিন্তু হাসি মুখে এগিয়ে এসে তিন্নির হাত তা ধরলো। -
গল্প- ঈশীর ইচ্ছা
ঈশীর ইচ্ছা
– দেবস্মিতা ঘোষনীল ডেনিম, সাদা শার্ট। কফি শপের দরজা খুলে ঢুকল মেয়েটা। মনে হচ্ছে আমার দিকেই আসছে। মুখ দেখে তো চেনা মনে হচ্ছে না। অবশ্য মুখ না দেখেও বলা যায় যে মেয়েটি আমার চেনা নয়। কারণ কলকাতাতে আমার কোনও আত্মীয় নেই।ছেলেবেলা দিল্লিতে কাটিয়েছি নিজের মায়ের সাথে। মা বাবার বিচ্ছেদের পর থেকে বাবা কলকাতায় থাকতে শুরু করেন ব্যবসার জন্য। ক্লাস ইলেভেন চলাকালীন মা মারা যান। তারপর থেকে বাবার সাথে কলকাতায়। বাবার বেশীর ভাগ সময় এখানে থাকলেও ব্যবসার কাজে প্রায়ই বাইরে যান। তাই একই শহরে থাকলেও আমি হস্টেলেই থাকতাম। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর মেস। থার্ড ইয়ার চলছে। আমি একা থাকতে ভালবাসি। কলেজ ম্যাগাজিনে আমার আঁকা ছবি বের হয় মাঝেমাঝে তাই কিছু ছেলে আছে যারা আমাকে চেনে। কিন্তু বন্ধু নেই, বান্ধবীও নেই। তাই এই রকম একটা মেয়েকে এগিয়ে আসতে দেখে অবাক হলাম।
‘’এক্সকিউজ মি, আপনি আদিত্য ত্রিপাঠী?’’ মেয়েটি বললো। তার চোখে কৌতুহল।
‘’হ্যাঁ। আমিই আদিত্য। আপনি?’’ সে আমার নাম জানে দেখে আমিও অবাক হলাম।
‘’ঈশী সেন, প্রিয়মের দিদি।‘’ হাসিমুখে নিজের পরিচয় দিল সে।
‘’ওহ, আচ্ছা’’ প্রিয়ম আমার কলেজের চেনা জানা লোকেদের মধ্যে একজন। কিন্তু ওর দিদি আমাকে কিভাবে চিনতে পারে সেটা আমার মাথায় আসছিল না। আমি কি ভাবছি সেটা মনে হয় বুঝতে পেরেছিল ঈশী।
‘’প্রিয়মের থেকে তোদের কলেজ ম্যাগাজিন দেখেছি বেশ কিছুবার। তোর আঁকা ল্যান্ডস্কেপগুলো আমার খুব ভাল লেগেছে। প্রিয়ম আমাকে তোর ছবি দেখিয়েছে তাই তো আজ চিনতে পারলাম। ইচ্ছা ছিল তোর সাথে আলাপ করে তোর হাতের আরও কাজ দেখার। তাইতো চিনতে পেরে এগিয়ে এলাম। তুই বললাম বলে খারাপ ভাবিস না, আমি বয়সে তোর থেকে তিন চার বছরের বড় হব’’ সাবলীল ভাবেই বলল ঈশী।
‘’ না না, খারাপ কেন ভাবব। আপনি প্রিয়মকে বলতে পারতেন আমাকে বলার জন্য … ওই ছবি দেখার কথাটা।‘’ যদিও প্রিয়মের সাথে বন্ধুত্ব নেই আমার তাও সেটা ওর দিদির সামনে স্বীকার করতে পারলাম না।
‘’আমি মুম্বাইতে জব করি। কলকাতা আসি খুব কম আসি। তাই আর… বলা হয়নি ’’ ওয়েটার ঈশীকে কফি দিয়ে গেল।
‘’ওহ্। অবশ্য আমি এমন কিছু ভাল ছবি আঁকিনা’’ এ কথাটা বনিয়ে বললাম না। একদম সাধারন ছবি আঁকি। কলেজ ম্যাগাজিন বলেই বের করে। ঈশী আমার কথাকে আমল দিলনা।
‘’যা আঁকিস তাই আমার বেশ ভাল লাগে। পরশু আমার মুম্বাইয়ের ফ্লাইট। কাল যদি আমরা একবার দেখা করি তোর আপত্তি আছে কি?’’ ও বলল। এবার আমি একটু ইতস্তত করলাম। বন্ধু বান্ধব না থাকার জন্য এরকম ভাবে আমি কখনো কারুর সাথে দেখা করিনি। একটু ভেবে বললাম,
‘’আমি যতদূর জানি প্রিয়মের বাড়ি মানে আপনার বাড়ি ভবানিপুরের দিকে’’
ঈশী কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে গেল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,’’দেখ তোকে সত্যিটাই বলি, মা বাবার সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না। কিছু বাক্তিগত কারণে। প্রিয়মের সাথে কোনও সমস্যা নেই। ওর জন্যই মাঝেমাঝে কলকাতা আসা। আমার এপার্টমেন্ট যাদবপুরের কাছাকাছি। কাল ওখানে আসতে পারিস। তুই চাইলে অন্য কোথাও …’’
‘’ না ঠিক আছে। আমার অসুবিধা নেই কারণ আমার মেসও ওখানেই। এবার আমাকে যেতে হবে।‘’ ঈশীর সঙ্গ আমার খারাপ লাগেনি তাই দেখা করব বলেই ঠিক করলাম। আর প্রিয়মের বাড়িতে দেখা হলে সেটা আমার পক্ষে বেশি অস্বস্তিকর হত। ঈশীর সাথে একা দেখা করলে অতটা খারাপ ব্যাপার হবে না।
‘’মেসে ফিরবি তো। তোকে ড্রপ করে দিতে পারি, আমিও বাড়ি যাব।‘’ ঈশী অল্প হাসল। হাসলে ওকে বেশ সুন্দর লাগে।
‘’না ঠিক আছে, আমার একটু অন্য কাজ আছে।‘’ বলে আমি বেরিয়ে এলাম। ঈশীকে আমার ভাল লেগেছে। যদিও আমার নিজের মনে হয় না আমার ছবিতে এমন আগ্রহ নিয়ে দেখার মতো কিছু আছে । আমি কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে ভালবাসি। রবীন্দ্র সরোবর যাব বলেই ঠিক করলাম। বন্ধু বান্ধব না থাকার এই সুবিধা নিজের সাথে অনেক সময় কাটানও যায়। একা থাকা কিছুটা নেশার মতো। একবার অভ্যাস হয়ে গেলে আর ছাড়া যায় না।
পরের দিন অনেকটা সময় কাটিয়ে ঈশীর বাড়ি থেকে যখন ফিরলাম তখন আমার মনের অনেকটাই ওর দখলে। ওর তাকানো, ওর হাসি প্রতিটা জিনিসের নিখুঁত বর্ণনা করতে পারি আমি। সবথেকে অন্যরকম ওর সোজাসাপটা কথা বলার ধরণ। নিজের মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য এতটুকু দ্বিধা নেই। এরকম মনোভাব আর একজন মহিলার মধ্যে দেখেছিলাম আমি। আজ ঈশী আমার মার কথা আমাকে সবচেয়ে বেশি মনে করিয়েছে।ঈশী আজকাল মাসে দু’ তিন বার কলকাতায় আসে। আমার সাথে দেখা করার জন্য। এর মধ্যে একদিনই অনেক সাহস করে আমি ওকে জানিয়েছিলাম আমার অনুভুতির কথা। আমার ভালবাসার কথা। ও বলেছিল ওর মনেও একই অনুভুতি আছে আমার জন্য। দু’জনের ইচ্ছায় আমরা আরও কাছাকাছি এসেছি। একে অপরকে আরও ভাল করে জেনেছি। তবে ও আমাকে অনেকবার বলেছে যে আমাদের সম্পর্কটা খুব একটা সাধারণ হবে না। অনেক দিক থেকে অনেক বাঁধাও আসতে পারে। কারণ ঈশী আমার থেকে বয়সে বড়, ও চাকরি করে। আমি যা করছি সব কিছু জেনে বুঝেই করছি । ওর বয়স নিয়ে আমার কিছু সমস্যা নেই।
ঈশীর সাথে দেখা করার পর থেকে এখন মাস ছয়েক কেটে গেছে। আমার ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট ভালই হয়েছে। ঈশী জানে। তাই ও এসেছে দেখা করার জন্য। কিন্তু ও আমার জব অফারের ব্যাপারে কিছুই জানে না। ওটা সারপ্রাইজ। সন্ধ্যায় দেখা করব আমরা। জব অফারের ব্যাপারটা ছাড়াও কিছু দরকারি কথা ছিল । ও সবুজ আর কালো ভালবাসে। অবশ্য সেটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই। ঈশী নিজে যদিও নীল ছাড়া অন্য রঙ খুব একটা বেশি পরেনা। কিন্তু আমাকে ও সবুজ আর কালোতেই পছন্দ করে।অন্য রঙ পড়লে ও রেগে যায় । তাই আমি ওর সাথে দেখা করতে গেলে সবুজই পরি। আজও তাই করলাম।‘’কংগ্রাচুলেশনস… রেজাল্ট তো ভালই হয়েছে। এই নে তোর গিফট’’ হাসিমুখে একটা ফ্রেঞ্চ পারফিউমের বোতল এগিয়ে দিল ঈশী।
‘’এটার দরকার ছিল না। যাইহোক, তোর জন্য একটা ভালো খবর আছে আর একটা খারাপ খবর। কোনটা আগে শুনবি বল’’ ঈশীকে তুই বলতে আমার প্রথমদিকে অনেক আপত্তি ছিল। তবে ওর জেদের কাছে আমাকে হার মানতে হয়েছে।
‘’খারাপটাই আগে বল’’ ঈশী একটা কফির কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল।
‘’তুই চাইছিলিস না যে আমাদের ব্যাপারটা আমাদের পরিবারের কেউ জানুক। গত সপ্তাহে প্রিয়ম আমাকে তোদের বাড়িতে নিয়ে যায়। ও শুধু আমাকে বলেছিল যে তোর বাবা মা কথা বলতে চায় আমার সাথে। আমি না গেলে ওরা মেসে আসবে। তাই আমি গেছিলাম।‘’ আমি ওর দিকে তাকালাম।
‘’কি প্রশ্ন করেছে সে আমি বুঝে গেছি। তুই কি বললি সেটা বল’’ওর মুখ দেখে বোঝা গেল না ও কি ভাবছে।
‘’ আমি কি আর বলব। বললাম তুই কলকাতায় এলে তোর সাথে ঘুরে বেড়াই আর তোর এপার্টমেন্টে রাত কাটাই তোর সাথে। শুনে কাকিমা আমকে বেরিয়ে যেতে বললেন, আমি মেসে চলে এলাম।‘’ আমি কফিতে চুমুক দিলাম।ঈশী হাসতে হাসতে আমার পিঠে চাপড় মারল। “কিন্তু এই শেষ নয়। তোর মা বাবা মনে হয় আমার বাবার সাথেও যোগাযোগ করেছিল।‘’
‘’এতটা তো আশা করিনি… তারপর?’’ এবার ও একটু চমকাল।
‘’তারপর আর কি… বাবা ফোন করেছিলো আমাকে। জানতে চাইলো আমাদের ব্যাপারে। তোর বয়স জানলো। আর জানিয়ে দিল যে পরের মাস থেকে আমার পকেটমানি বন্ধ।‘’ আমি থামলাম। ঈশীকে খুব একটা চিন্তিত মনে হল না। ও বলল, ‘’টাকার চিন্তা করিস না তুই।‘’
‘’ না টাকার চিন্তা আমি করছিও না,’’ আমি জবের কথাটা জানালাম ওকে। যতটা খুশি হবে আশা করেছিলাম ততটা খুশি কিন্তু ও হল না। অন্তত ওর মুখ দেখে আমার তাই মনে হল।
‘’খুবই ভাল ব্যাপার। কিন্তু তুই আজকাল ফোনে কিছুই জানাস না। যাইহোক তোর জন্য মুম্বাই থেকে আমিও একটা খবর এনেছি। তবে সেটা ভাল না খারাপ খবর সেটা নির্ভর করবে তোর ওপর।’’ ঈশী বলতে থাকলো। ও যা বললো তাতে আমি সত্যি ভীষণ অবাক হলাম। মুম্বাইয়ের ওর কোনও এক বন্ধু আমার কিছু ছবি ওখানকার এক আর্ট গ্যালারীতে দেখাতে চায়। ঈশীর ফোনে সে আমার আঁকা কিছু ল্যান্ডস্কেপ দেখেছে, সে চায় আমি ছবি নিয়ে মুম্বাই যাই। এখন ঈশী আমার জবের ব্যাপারে জানত না তাই ও ওর বন্ধুকে বলে এসেছে যে ও আমাকে নিয়ে যাবে। এখন ছবির জন্য মুম্বাই গেলে চাকরির জয়েনিং ডেট মিস হয়ে যাবে। চাকরিই চলে যাবে। সত্যি বলতে আমি কখনো নিজের ছবি নিয়ে এত সিরিয়াস ভাবিনি। গর্বও হচ্ছে অল্প অল্প। ঈশীর ইচ্ছাও জানতে হবে। তাই বললাম,’’তুই কি চাস বলতো?’’
‘’দেখ আদি, এটা তোর ক্যারিয়ার তুই যা করবি আমি মেনে নেব। আমার কিছু বলার নেই। তুই আমার মতামত জানতে চাইলি তাই বলছি। তুই জানিস আমি ঘুরিয়ে কথা বলতে ভালবাসি না। আমি চাই তুই মুম্বাই আয়। অনেকদিন হল এই সম্পর্কের, এবার তুই মুম্বাই আয়। আমার সাথে থাকবি। আমি মনে করি তোর দ্বারা আঁকার কাজ হবে। তুই ওখানে জায়গা পাবি, সময় পাবি সবচেয়ে বড় কথা সুযোগ পাবি। টাকা নিয়ে ভাবার কোনও দরকার নেই‘’ ঈশী থামল। ঈশীর এই সহজ ভাবে নিজের চিন্তা ভাবনা প্রকাশ করার ব্যাপারটা আমি বরাবর ভালবাসি। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা অনেকটা বেশি সিরিয়াস।
‘’আমাকে একটু ভাবার সময় দে’’ আমার মুখের হাসি উধাও হয়ে গেছে।পরের দিন সকালে ঈশী চলে গেল। আমি কখনো ওকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে যাইনা। ও পছন্দ করেনা। অতগুলো ছবি নিয়ে মুম্বাই যেতে আমার সমস্যা কম হয়নি। ঈশী মুম্বাইতে কোথায় থাকে সেটা অনেক দিন আগে ও আমাকে বলেছিল। নতুন শহরে ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছাতেও অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল। হঠাৎ দরজার ওপারে আমাকে একটা এতগুলো ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঈশীর মুখের অবস্থা যা হয়েছিল তা দেখার জন্য এতটা কষ্ট করাই যায়।
গ্রিন শার্ট, ব্ল্যাক ডেনিম, চোখে সানগ্লাস। নিজেকে আয়নায় দেখে কেমন অচেনা লাগে আমার আজকাল। এই কি সেই ক্যাজুয়াল ড্রেসে কলকাতার রাস্তায় একা একা ঘুরে বেড়ানো আদি। ঈশীর চাপে আমার আলমারিটাও সবুজ কালোতেই ভর্তি। আমার মতো ওর আলমারিটাও নীলে ভর্তি। যদিও আমার প্রিয় রঙ হলুদ । আমি বললেও ও অন্য রঙ পড়ে না। কাউকে জোর করা আমার স্বভাব না। আমার জামা কাপড় জুতো সব ঈশী কেনে। মুম্বাই আসার পর থেকে পুমা ছাড়া অন্য কোনও জুতো আমি পরিনি। আমার অনেক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনটের বেশি ট্যাটু করাতে দেয়নি ও আমাকে। সবগুলোই ওর পছন্দের। মাঝেমাঝে নিজেকে বন্দি মনে হয়। কিন্তু পরের মুহূর্তে ঈশীর ভালোবাসা আমাকে সব ভুলিয়ে দেয়। মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। আমার ছবিগুলো খুব ভাল দামে না হলেও বিক্রি হয়। তাই মোটামুটি টাকা কিছু পাই আমি। ঈশী আর ওর বন্ধুর আপত্তির জন্য আমি প্রদর্শনীতে যাইনি কখনো। অবশ্য প্রদর্শনীর জন্য খুব একটা উৎসাহী আমি কোনোদিন ছিলাম না। আমি ছবি ওকে পৌঁছে দিলে ও টাকা পাঠিয়ে দেয়, মাঝেমাঝে ওর অফিস থেকে নিয়ে আসতে হয়। আমার ইচ্ছা থাকলেও ঈশী চায় না আমি চাকরি করি। ঈশীর বিরোধিতা করতে ভাল লাগে না আমার।
আজ আমাদের লিভ ইনের একবছর পূর্তি। ছবি বিক্রির টাকা আনতে যাচ্ছিলাম। ঈশীকে গিফট দিতে হবে। রবিবার তাই অফিস বন্ধ, অগত্যা বাড়িতেই যেতে হল। ভদ্রলোকের নাম আয়ান দত্ত। বাঙালি। ওনার বাড়ির লোক আমাকে বসতে বললেন। ভদ্রলোক আসতে সময় নিচ্ছিলেন বলে আমি ঘরটা একটু ঘুরে দেখছিলাম। বেশ বড় ঘর, একপাশে ডেস্ক চেয়ার রাখা। একটা সোফাও আছে । একপাশে ছোট একটা টেবিলের উপর মনে হল কিছু ছবি একসাথে করে রাখা। কাপড় দিয়ে ঢাকা। অনাদরে ছবি পড়ে থাকতে দেখে আমার কৌতূহল হল। কাপড় সরিয়ে দেখি প্রথমটাই আমার আঁকা ছবি। দু’মাস আগে বিক্রি হয়েছিল। আয়ান আমাকে টাকাও দিয়েছে। কোনও কারণে কি ফেরৎ এসেছে! আয়ান আমাকে জানায়নি কেন। হাল্কা ধুলোর স্তর পরে গেছে। ছবিটা তুলে নিলাম ভাল করে দেখব বলে। কিন্তু নিচের ছবিটা দেখে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। গভীর অবিশ্বাসের সাথে আমি একটার পর একটা ছবি দেখতে লাগলাম। সবকটাই আমার ছবি, যেগুলো নাকি বিক্রি হয়ে গেছিল। অন্তত সেটা বলেই আয়ান আমাকে টাকা অবধি দিয়ে গেছে এই এক বছর। ঈশীর বন্ধু বলে আমি শুধু ছবিগুলো ওকে দিতাম, আর টাকা নিতাম। প্রদর্শনীতে যেতে চাইলেও নানাভাবে আমাকে আটকেছে আয়ান আর ঈশী। আয়ানকে ঘরে ঢুকতে দেখেও নড়লাম না আমি। আমার হাতে ছবিগুলো দেখেই ঘাবড়ে গেল ও । আমি যে ওর বাড়ি আসতে পারি সেটা ও ভাবেনি। ঈশীও হয়তো ভেবেছিল গিফট কিনতে যাচ্ছি, আয়ানের কাছে আসবো ভাবেনি। জানলে হয়ত ফোন করে দিত। আমি কোনও কথা না বলে আয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঠাণ্ডা গলায় বললাম,’’টাকা কে দিত?’’
‘’ঈশী… দেখ আমার কোনও দোষ নেই। সবকিছু ঈশীর কথাতেই করেছি। ও চায়নি তোমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে। ঈশী আমকে প্রতি মাসে টাকা দিত। তোমার ছবিগুলোর একটাও প্রদর্শনীতে যাওয়ার মতই না। ঈশীর জন্য আমি এসব করেছি। ও তোমার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিতে চায়নি’’ আয়ান আমতা আমতা করতে থাকল। আমি আর কিছু না বলে বেড়িয়ে পড়লাম। আয়ানকে আমি কিভাবে বোঝাব, যে স্বপ্ন ভাঙ্গার কথা ও বলছে সেই স্বপ্ন আমার কোনদিন ছিলই না। সারদিন এদিক ওদিক ঘুরে মন শান্ত করে বাড়ি ফিরতে দেরি হল।
‘’হ্যাপি অ্যানিভারসারি আদি।‘’ ফিরতেই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল ঈশী। ঈশীর মুখ দেখে মনে হল আয়ান ওকে কিছু জানায়নি। সাহস পায়নি হয়তো। ভেবেছে হয়ত আমি জানাবো। দেখলাম ঈশী ওর কিছু বান্ধবীকে নিমন্ত্রণ করেছে। ও নিজেই ডিনার বানিয়েছে। আয়ানের বাড়ির ব্যাপারে আমি কিছু জানালাম না ঈশীকে। খেতে বসে হঠাৎ ওর এক বান্ধবী আমাকে বলল,’’তো আপনিও আনির মতো ছবি আঁকেন’’ আমি কিছু বলার আগেই ঈশী বলে উঠল,’’ তানিয়া তোকে আমি বারণ করেছি না আনির কথা না তুলতে’’ এইবার সেই বান্ধবী চুপ করে গেল। আনি বা আনিস নামে একজনের সাথে আমার আগে ঈশীর সম্পর্ক ছিল। আমি শুধু এইটুকুই জানি। এর বেশি ও কখনো বলেনি। আমারও বেশি আগ্রহ ছিল না। সেই মেয়েটি বিদায় নেবার সময় আমাকে আবার বলল,’’সরি। তখন আনিস মেহরার কথাটা তোলার জন্য। আসলে আপনাদের দু’জনের মধ্যে এত মিল। যাইহোক সরি’’ ঈশী কিচেনে ছিল তাই হয়তো ও আবার আনির কথা বলার সাহস পেল।
‘’আনিস মেহরাটা কে?’’ আমি থতমত খেয়ে গেলাম।
তানিয়ার মুখ দেখে মনে হল ও খুব অবাক হয়েছে। নিজের ভুল শুধরে আমি বললাম,’’আনির ভাল নাম আনিস মেহরা সেটা ভুলে গেছিলাম আরকি।‘’ তানিয়ার সামনে স্বীকার করতে পারলাম না যে আমি আনির ভাল নাম জানতাম না।
‘’শুধু কি আনিস মেহরা এখন তো ও শিল্পী আনিস মেহরা। যাইহোক আমি আসি।‘’ বলে তানিয়া চলে গেল আমাকে আরও একটা উত্তর না জানা ধাঁধাঁর মধ্যে রেখে। বিখ্যাত শিল্পী আনিস মেহরা যদি ঈশীর প্রাক্তন হয়ে থাকে তাহলে ও সেটা আমার থেকে আড়াল করল কেন? কেন জানিনা সবকিছু সোজাসুজি প্রশ্ন করে জানবার ইচ্ছা ছিল না আমার আর। আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছিল ঈশী আমাকে সত্যি বলবে না। আর তানিয়ার কথায় পুরো বিশ্বাস ছিল না তাই অনেক ভেবে অন্য উপায় বের করতে হলো। পরের দিন ঈশী অফিস যাওয়ার পর আমি খুঁজে বের করলাম ওর পুরনো ডায়েরি। ও নিজেই আমাকে বলেছিল যে ও একসময় লিখতো, এখন আর লেখে না। অথবা লিখলেও আমার আড়ালে। আমি জানতাম ঈশীর ডায়েরি কোথায় থাকে, কিন্তু আজকের আগে কখনও ওর ডায়েরি চুরি করে পড়ার প্রয়োজন পরেনি। বেশ কিছু বছরের পুরনো দুঊটো ডায়েরি পেলাম। তার একটার মধ্যে আনিস আর ঈশীর একসাথে একটা ফোটো পেলাম। ঈশীর আনি যে বিখ্যাত শিল্পী আনিস মেহরা তাতে আর সন্দেহ রইলো না। ডায়েরিগুলোতে আনির সাথে ঈশীর সম্পর্কের কথা লেখা আছে। যে সন্দেহটা কাল থেকে আমার মনে আসছে ডায়েরি পরার পর সেটা আমার বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সব কিছু না জেনে বুঝে আমি কিছু করবো না। কারণ সবকিছু বুঝলেও আমার মন ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ঈশীকে আমি সত্যি ভালবাসি। ডায়েরিটা ঠিক জায়গায় রেখে দিলাম।
‘’আদি আমার একটা অফিস ট্যুর আছে। পরশু বেরবো। এক সপ্তাহ মতো। একা থাকতে প্রবলেম হবে না তো তোর?” অফিস থেকে ফিরে বললো ও। আমার পরিকল্পনাকে কাজ করানোর জন্য এর থেকে ভাল সুযোগ আর হবে না।” না তেমন অসুবিধা হবে না’’ মনে-মনে ভাবলাম বরং সুবিধাই হবে।ঈশী চলে যাওয়ার পর আমি আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করলাম। এই মুহূর্তে তানিয়া একমাত্র মেয়ে যে আমাকে সাহায্য করতে পারে।
আমাকে যেভাবে হোক আনিস অবধি পৌঁছাতে হবে। খোঁজ নিয়ে দেখেছি সে এখন দিল্লিতে আছে। কিন্তু অত বড় শিল্পীর সাথে দেখা করা সমস্যার ব্যাপার। তানিয়ার সাথে হয়ত ওনার যোগাযোগ থাকতে পারে। ঈশী বেরোবার কিছুক্ষণের মধ্যে আমি তানিয়ার বাড়ির উদ্যেশে বেড়িয়ে পড়লাম। বাড়িতে আমার জিনিসপত্র গোছান আছে কিছুটা। তানিয়ার কাছ থেকে কতটা সাহায্য জানিনা। সাহায্য না করলেও আমি দিল্লি যাব।
হঠাৎ আমাকে সকাল সকাল ওর বাড়িতে দেখে তানিয়া একটু অবাক হল। ওর ফোন নাম্বার ছিল না আমার কাছে তবে কৌশলে ঈশীর থেকে জেনে নিয়েছিলাম ও কোথায় থাকে।
‘’আরে আদিত্য যে, ভেতরে আসো। এত সকাল সকাল কি ব্যাপার’’ তানিয়া ঘুম থেকে উঠে দরজা খুললো মনে হলো।
‘’বেশীক্ষণ সময় নষ্ট করব না, ছোট একটা দরকার ছিল’’ আমি একটু হেসে বললাম। আমি চাইনা কোনোভাবে ও আমাকে সন্দেহ করুক বা ঈশীকে কিছু জানাক।
‘’আচ্ছা বলো, দেখি যদি সাহায্য করতে পারি’’
‘’দেখো তানিয়া আমার মনে হয় তোমার সাথে আনিস মেহরার যোগাযোগ আছে এখন। আমি ওনার সাথে একটু কথা বলতে চাই, একটু যদি ব্যবস্থা করে দাও।‘’ সরাসরি দরকারি কথাই বললাম, নষ্ট করার মত সময় নেই। মনে হল ও খুবই অবাক হয়েছে। বুঝতে পারছে না কি বলবে।
‘’আমার সত্যি খুব দরকার আছে। জানোই তো আমাদের লাইনে ওনার কত দাপট। আমি শুধু আমার পেশার সুত্রে দেখা করতে চাই। ঈশীর সাথে এর কোনও সম্পর্ক নেই। ঈশী জানলে খারাপ ভাববে তাই ও না থাকাকালীন কাজটা করতে চাইছি।‘’ এই সাজানো গোছান মিথ্যেটা আমি বাড়ি থেকে ভেবে গিয়েছিলাম। কারণ সত্যি কথা বলে আমার মনের অবস্থা তানিয়াকে বোঝাতে আমি পারতাম না। তানিয়া আনিসকে ফোন করে দু’দিন পর সকাল বেলা একঘণ্টার জন্য একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করলো।
দিল্লিতে আনিসের বাড়িটা একটু ফাঁকা জায়গায়। ছোট সুন্দর সাজান বাড়ি, শিল্পীর জন্য আদর্শ। বাড়ির সামনে ছোট বাগানটাও সুন্দর করে সাজানো। ফুলগাছগুলো নিয়মিত যত্ন পায়। মাঝখানে একটি ফোয়ারা, তার একপাশে টেবিল চেয়ার রাখা। আমি ওখানে বসেই অপেক্ষা করছিলাম আনিসের। আর ভাবছিলাম কিভাবে কি বলব ওকে। যদিও আমি ঠিক করেছি আনিসকে সব সত্যি বলব, ওকে মিথ্যে বলে আমার কোনও লাভ নেই। যদিও জানিনা উনি আমার বক্তব্য বুঝবেন কিনা তবে চেষ্টা করতেই হবে। ও ভাবছে তানিয়ার কোনও ছোট পেইন্টার বন্ধু ওর সাথে দেখা করতে এসেছে। সেরকম যে নয় সেটা ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে।
এইসময় আনিস মেহরা এল। সে হঠাৎ আমাকে দেখে একটু অবাক হয়ে গেল। সেরকমটাই আশা করেছিলাম আমি। আমি ওনাকে চিনতাম তাই আমার অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। আনিসের অবাক হওয়ার কারণ আমি আর ও একই উচ্চতার, আমাদের গায়ের রঙও এক। এরকম তো অনেক মানুষই হয় যাদের উচ্চতা আর গায়ের রঙ এক হয়, তাতে সমস্যার কিছু নেই। কিন্তু আনিস যখন একটু খেয়াল করে দেখল ওর টি শার্টের রঙ, ওর পুমা সু, ওর কবজিতে থাকা ঘড়ির ব্র্যান্ডও আমার সাথে মিলে যাচ্ছে তখন ও অস্বস্তিতে পড়ে গেল। আমি জানতাম এরকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, তাই আমি আগে মুখ খুললাম, “গুড মর্নিং মিস্টার মেহরা। আমি আদিত্য ত্রিপাঠী, তানিয়ার বন্ধু।‘’
‘’গুড মর্নিং আদিত্য। আমি ভেবেছিলাম তুমি তোমার হাতের কাজ কিছু আনবে’’ ভদ্রলোক ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছেন।
‘’ না। তানিয়াকে একটু মিথ্যে বলেই আপনার সাথে দেখা করার সুযোগটা নিতে হয়েছে। তার জন্য আমি দুঃখিত। তবে আপনার সাথে আমার একটু বিশেষ দরকার আছে। তানিয়া আপনাকে আমার আসল পরিচয় গোপন করেছে। আমি ঈশীকে ভালবাসি। প্রায় একবছর হয়ে গেল আমরা একসাথে থাকি।‘’
ঈশীর নাম শুনে ভদ্রলোক সোজা হয়ে বসলেন। একটু ইতস্তত করে বললেন,’’ঈশীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেটা ভেঙ্গেও গেছে বেশ কিছু বছর আগে। আমি তো এখন শুধু এটা জানতাম যে ঈশী মুম্বাইতে থাকে। তানিয়া জানিয়েছিল, আর সত্যি বলতে ওর ব্যাপারে তেমন উৎসাহ আমার আর নেই। ওকে নিয়ে আমার সাথে কথা বলার মত কি আছে আমি বুঝলাম না।‘’
‘’সেটা আপনাকে বোঝাতেই তো আমি দিল্লি এসেছি মিস্টার মেহরা। বেশি সময় আমার লাগবেনা। তার আগে বলুন তো আমাকে প্রথম দেখে আপনার কি মনে হয়েছিল।‘’ প্রশ্ন শুনে উনি খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘’মনে হয়েছিল আমি আজ সকালে কিভাবে ড্রেস করব সেটা আপনি আগে থেকে জেনে গেছেন, তাই একই জামাকাপড় ঘড়ি, জুতো পড়ে এসেছেন।‘’ ভদ্রলোক হাসলেন ব্যাপারটার গুরুত্ব না বুঝেই। আমি গম্ভীর ভাবেই বললাম,’’শুধু তাই নয় মিস্টার মেহরা, একটু খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন আপনার পারফিউম আর আমার পারফিউমও সমান। আমি জানি আপনার শরীরে মোট তিনটে ট্যাটু আছে। পিঠে একটি ঈগল, বাঁ পায়ে রোমান হরফ আর ডান হাতের ওপরের দিকে একটি গোলাপ।‘’ ভদ্রলোকের মুখ দেখে মনে হল উনি আমাকে অশরীরী জাতীয় কিছু ভাবছেন হয়তো।
আমি থামলাম না,’’আমি জানি কারণ আমার শরীরের একই অংশে একই ট্যাটু রয়েছে। আর এই পোশাক জুতো পারফিউম ট্যাটু সবই ঈশীর ইচ্ছায়। শুধু তাই না, আমাদের পেশাও এক” এরপর আমি ওনাকে সব কিছু খুলে বললাম।
সব শুনে উনি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন,’’তোমার সাথে যা হয়েছে তার জন্য আমাকে দোষারোপ করতে তুমি আসোনি তা আমি বুঝলাম। বয়সে বড় হিসাবে আমি তোমাকে একটাই কথা বলবো তোমার কাছে এখন সবচেয়ে জরুরি নিজেকে খুঁজে পাওয়া, নিজের সাথে সময় কাটানো। তুমি কলকাতা বা মুম্বাই যেখানেই ফিরে যাও আমি ব্যবস্থা করে দেব। চলে যাওয়ার আগের কিছুদিন তুমি আমার বাড়িতে থেকে যাও, এটাই অনুরোধ।‘’
‘’আমি কলকাতা ফিরতে চাই। সেই পরিকল্পনা করেই আমি এসেছি। আপনার এখানে থাকতে দিলে সেটা আমার সৌভাগ্য।‘’ আমার কথা শুনে ভদ্রলোক হাসলেন।প্রিয় ঈশী,
প্রথমেই বলছি যে তোকে কিছু না বলে চলে আসার জন্য স্যরি। এছাড়া কোনও রাস্তাও ছিল না সেই মুহূর্তে। আমি জানতাম যেভাবে হোক তুই সব কিছু জেনে যাবি। তানিয়া না বলুক আয়ান বলবে অবশ্যই। তুই আমার সাথে অনেক ভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা সত্ত্বেও আমি দেখা করিনি তোর সাথে। আসলে তোর মুখ দেখার মানসিকতা ছিল না আমার। তুই ভাবছিস হয়তো যে এতদিন পর আমি কেন এই চিঠি লিখছি। কারণটা তুই পুরো চিঠি পড়লেই বুঝবি।
কলকাতায় তোকে প্রথম দেখেই আমার খুব ভাল লেগেছিল, তোর চলা ফেরা কথাবার্তা আমার মৃত মায়ের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। তাই জন্যেই হয়ত আমি তোর কাছাকাছি এসে ছিলাম। নয়ত বন্ধুবান্ধব আমার কোনদিনই ভাল লাগতো না। কলকাতায় আমরা কত সুখে ছিলাম। মুম্বাই যাওয়ার পর থেকেই সম্পর্কটা ভালবাসা থেকে অধিকারের দিকে চলে গেল। সত্যি বলতে আমার সব জিনিসে তোর আধিপত্য আমার ভাল না লাগলেও, মেনে নিয়েছিলাম। সমস্ত ছোট ছোট পরিবর্তন যে কখন আমাকে একটা অন্য মানুষ বানিয়ে দিয়েছিল বুঝতেই পারিনি। আয়ানের বাড়িতে যখন নিজের ছবিগুলোর আসল মর্যাদা বুঝতে পারি তখন থেকেই তোর প্রতি সন্দেহ জাগে। ছবি আঁকাকে আমি কখনই তেমন ভালবাসিনি। তাই ছবিগুলো ভালো নয়, এটা শুনে কষ্ট হয়নি। তবে সবকিছুর পিছনে তুই আছিস জেনে আমি কষ্টে সারাদিন রাস্তায় ঘুরে ছিলাম। ছবি আঁকা আমার অবসর সময়ের অভ্যাস ছিল। কিন্তু তোর জন্য সেটা বুঝতেও আমি ভুল করেছিলাম।
তানিয়াকে বাড়িতে আনা তোর খুব বড় ভুল হয়েছিল জানিস। হয়ত তুই জানতিস না যে মিস্টার মেহরার সাথে ওর এখন যোগাযোগ আছে, জানলে তুই নিশ্চয়ই ওকে ডাকতিস না। ওর কাছ থেকেই আমি প্রথম জানতে পারি তোর ‘’আনি’’ র আসল পরিচয়। তারপরের ঘটনাগুলো বুঝে নেওয়া কঠিন না। দিল্লিতে এসে আনিস দাদার সাথে দেখা করতে তানিয়া আমাকে সাহায্য করেছিল। হা, আনিস মেহরাকে আমি আনিস দাদাই বলি আজকাল। ভদ্রলোক সত্যি খুব ভাল। আমাকে প্রথম দেখে উনি ঘাবড়ে গেছিলেন। হঠাৎ সকাল বেলা উঠে কেউ যদি আর একজন মানুষকে দেখে যে তার মতই পোশাক পড়ে, একই ব্র্যান্ডের জুতো ঘড়ি এমনকি পারফিউম অবধি ব্যবহার করে , তার পক্ষে ঘাবড়ে যাওয়া তাই স্বাভাবিক । আমার ট্যাটুগুলোর সাথে ওনার নিজের ট্যাটু মেলানোর পড়ে উনি বুঝতে পেরেছিলেন আমার বক্তব্য। সব ঘটনা আমিই ওকে জানাই আগে। নিজের স্বার্থ না থাকলেও উনি আমকে সাহায্য করেছেন অনেক। আমার কলকাতা ফেরার ব্যাবস্থা এমনকি চাকরির ব্যবস্থা অবধি করে দিয়েছেন। এত ভাল মানুষের সাথে তুই কেন বিচ্ছেদ করেছিলিস তুই জানিস।
কলকাতা ফিরে নিজেকে গুছিয়ে নিতে অনেকটা সময় লেগেছিল। নিজেকে ফিরে পেতে অনেক সময় লেগেছিল। তবে এখানকার চেনা জানা পরিবেশে কাজটা একটু সহজ হয়েছিল। তোকে নিয়েও অনেক ভেবেছি, তুই ঠিক কি করতে চেয়েছিলিস সেসব নিয়েও ভেবেছি। আমি তোকে ভালবেসেছিলাম। তাই তোর অন্যায় অধিকারগুলো ভালবাসার অত্যাচার বলে ভুল করেছিলাম। তোর ভালবাসায় অন্ধ হয়ে গেছিলাম। তুই কোনদিনই আমাকে ভালবাসিসনি। তুই আমাকে আনিসদা বানাতে চেয়েছিলিস। আমার গায়ের রঙ আর হাইটটা ওর সমান বলে তুই সম্পর্কটা তৈরি করেছিলিস। তুই আমাকে খুঁজে পেলি কিভাবে সেটা আমার কাছে এখন রহস্য। ছবি আঁকাটা ছাড়তে না দেয়ার জন্য তুই আয়ানের সাথে মিলে প্রদর্শনীর ব্যাপারটা সাজাস। বাইরে থেকে তুই আমাকে পুরোপুরি আনিস মেহরা বানাতে চেয়েছিলিস। তাই তুই চেয়েছিলিস আমাদের পেশাটাও এক হোক। একবছরে আমি বাইরে থেকে এতটাই আনিস হয়ে গেছিলাম যে স্বয়ং আনিসদা আমাকে দেখে ঘাবড়ে গেছিল। কিন্তু এত করেও তুই শুধু আমার শরীরটা বদলাতে পেরেছিলিস, সত্তাকে নয়। কলকাতায় আসার পর আমি অনেক ভেবেছি। মাঝেমাঝে মনে হয়েছে তুই মানসিক ভাবে অসুস্থ। তুই আমাকে আনিস বানিয়ে ভালবাসতে চেয়েছিলিস। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে তুই অসুস্থ না, এত নিখুঁত পরিকল্পনা করে কাজ করা অসুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু আমার জীবনের এতগুলো দিন নষ্ট করার জন্য আমার সত্যি খারাপ লাগে। তোর ওপর রাগ হত। এখন আর হয়ই না, ক্ষমা করে দিয়েছি তোকে। শুধু এটুকু বলতে চাই এরকম আর কারুর সাথে করিস না।
যদিও আমি জানি তুই এখন একাই আছিস। তানিয়া মাঝেমাঝে বলে তোর কথা, ওর সাথে ভালো বন্ধুত্ব আছে তোর আমি জানি। আনিসদার অনুরোধে ও তোকে আমার চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছে। তোর কথা আমি আর ভাবি না। ওই একবছর আমি দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে চাই। অন্য কারুর জীবনে বাঁচার মত বন্দিদশা আর হয়না। এই চিঠি লিখে আমি তোকে আমার তরফের সব কথা জানিয়ে দিলাম। যেহেতু একসময় ভালবাসতাম তাই খারাপ কিছু আশা করতে পারবনা তোর জন্য। ভাল থাকিস। ঈশী তোর ইচ্ছার জন্য আমাকে অনেক দাম দিতে হল রে।
ইতি
‘আনি’ না হতে চাওয়া ‘আদি’ -
গল্প- দেবতার বলি
দেবতার বলি
– দেবস্মিতা ঘোষ“তুমি যদি পুরো ব্যাপারটা না জানাও তাহলে কি ভাবে সাহায্য করব বলো তো?” বললেন প্রফেসর বিশ্বাস। এতক্ষণ টেবিলে পরে থাকা খবরের কাগজটা নিয়ে মিনার দিকে এগিয়ে গেলেন। মিনা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রফেসরের কথা সে ভ্রূক্ষেপ করল না। তার দিকে খবরের কাগজটা এগিয়ে দিয়ে প্রফেসর বললেন, ”সামনের পেজটা দেখে রেখো। কয়েকটা চাকরির সম্বন্ধে ভালো লেখা আছে। আর বাজে চিন্তা ছেড়ে পড়াশোনায় মন দাও। এখন আমি আসি।” প্রফেসর বেরিয়ে গেলেন। কাগজটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো মিনা।
মিনা মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। প্রফেসর অরুণ বিশ্বাস তার কলেজেই পড়ান। বছর বিয়াল্লিশের বিবাহিত, ফর্সা লম্বা, সুপুরুষ। কলেজের পড়ান তবে স্ত্রী পুত্র কলকাতায় থাকে। ছেলের পড়াশোনার সুবিধার জন্য মনে হয় এই ব্যবস্থা। তার স্ত্রীও কলকাতার মেয়ে তাই কলকাতার সুযোগ সুবিধা ত্যাগ করে সে মেদিনীপুরে এসে থাকতে চাইনি। প্রফেসর তাই এখানে ব্যাচেলরের জীবন যাপন করছেন। তবে মিনার সাথে তার সম্পর্কের কথাটা ধরলে তাকে ঠিক ব্যাচেলর বলা চলে না। মিনার সাথে তার সম্পর্কের বয়স প্রায় দু’বছর। মিনা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মেয়ে। কলেজের কাছে মেয়েদের হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে সে। বাবা মা পরিবার এসব ব্যাপারে সে প্রফেসরকে কোনোদিনই বেশী কিছু বলেনি মিনা। প্রফেসরও অত আগ্রহী ছিলেন না। কালো, ঘন চুল, গোলগাল চোখ, একটু মোটা মিনাকে প্রফেসর প্রথম থেকেই পছন্দ করতেন। ধীরে ধীরে মিনাই ছাত্রী শিক্ষকের সম্পর্কের বাইরে গিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে ছিল। প্রফেসর আপত্তি করেননি। যদিও তাদের সম্পর্ক শুধু বন্ধুত্বে থেমে থাকেনি। ভালোবাসা থেকে শরীর আদান প্রদান সবই হয়েছে। আধুনিক মেয়েদের থেকে আলাদা একটু আনাড়ি সরল মিনাকে প্রফেসর সত্যিই ভালবাসেন। অপর দিকে মিনা প্রফেসরের বিবাহিত জীবনের ব্যাপারেও জানে। কিন্তু তাতে ওর কোনো সমস্যা নেই। ভবিষ্যতের কথা ভেবে ও বর্তমানের সুখকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে না। আর ও প্রথম থেকেই সব জানত। সব জেনে শুনেই ও প্রফেসরকে ভালবেসেছে। যদিও ওদের কলেজের কেউ বা বাইরের কেউই ওদের সম্পর্কের কথা জানেনা। দু’জনের ভালর জন্য ওরা ব্যাপারটার গোপনীয়তা বজায় রেখেছে।সামনের গরমের ছুটির পর মিনার সেমিস্টার। কিন্তু আজ সকালেই মিনার কাছে খবর এসেছে তার বাবার শেষ নিঃশ্বাস ফেলার খবর। গত সপ্তাহেই তার বাবার মৃত্যু ঘটেছে, সৎকারও হয়ে গেছে। আদিবাসি গ্রামের কেউ শহরে এসে মিনুকে খবর পর্যন্ত দেয়নি। এ কারণে ক্ষুব্ধ শোকাহত মিনা সবার আগে প্রফেসরকে জানিয়ে ছিল সবকিছু। লোক জানাজানির ভয় থাকা সত্ত্বেও প্রফেসর সকাল বেলাতেই এসেছিলেন মিনার হস্টেলে। গরমের ছুটিতে মিনাকে নিয়ে তিনি মিনার গ্রাম বটঝুরি নিয়ে যাবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি ফিরে গেলেন।
কিন্তু তাদের একসাথে যেতে দেখলে সমস্যা হতে পারে এইকথা ভেবেচিন্তে পরিকল্পনা বানালো তারা। দেখতে দেখতে গরমের ছুটি এসে গেল। প্রফেসর তার বন্ধু মহলে জানিয়ে দিলেন যে তিনি এবার নিজের গাড়ি নিয়েই লং ড্রাইভে কলকাতায় যাবেন। প্রফেসরের লং ড্রাইভে যাওয়ার অভ্যাস আছে। তাই কারুর কাছেই কিছু অস্বাভাবিক লাগলো না। অন্য দিকে মিনার বাবার মৃত্যু খবর কমবেশি সবার কাছে ছিল, তাই এত বছর পর মিনার গ্রামে যাওয়া নিয়েও খুব একটা কৌতূহল বাড়েনি। এমনিতেও আদিবাসি মিনার কথা ভাবার মত ছাত্র ছাত্রী মেডিকেল কলেজে বেশি নেই। মিনাকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাওয়ার সময় প্রফেসর নিজের মনের জিজ্ঞাসাগুলোকে আর আটকে রাখতে পারলেন না।
“গত দুবছরে তোমাকে তোমার পরিবার, গ্রাম নিয়ে কোন কথা বলতে শুনিনি। খারাপ ভেব না যে বাবার কোন খবরই তুমি রাখতে তার চলে যাওয়ার পর তুমি গ্রামে ফিরছ তোমার মা কি ভাববেন। গ্রামের বাকিরা কি ভাববে। শেষ কবে তুমি গ্রামে গেছিলে? আমাকেই বা কিভাবে পরিচয় করাবে কিছু ভেবে রেখেছ? আমারই ভুল এগুলো আগে আলোচনা করে নেওয়া ছিল।”
জানলার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মিনা বলল, “আমি গ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম যখন আমার বয়স দশ। ওই বছরই মা মারা যান। বাবা আমার আদিবাসি ছিলেন তবে মূর্খ ছিলেন না। দশ বছরের মেয়েকে ওই গ্রামে একা মানুষ করতে পারবেন না তা তিনি বুঝেছিলেন। তিনি তার এক বিশ্বস্ত শহরের বন্ধুর মাধ্যমে আমাকে একটি হস্টেলে পাঠিয়ে দিন। খরচপাতি সব ওই বন্ধুই দিতেন। তিনি আমকে দত্তক নিয়েছিলেন। উনি আর ওনার স্ত্রী বিদেশে চলে যান আমার কলেজে ভরতি হবার পর। তাও খরচ উনি পাঠান এখনও। বাবা আমার সাথে কোনও যোগাযোগ রাখেননি। তিনি চাইতেন না আমি ওনার সাথে যোগাযোগ রাখি। তাই আমিও রাখিনি। তবে রক্তের সম্পর্ক বলতে ওই বাবাই ছিলেন, তাই মনটা খুব খারাপ লাগল। যতই হোক ওটা আমার জন্মভূমি।““এগুলো তুমি আমাকে আগেও বলতে পারতে। শেয়ার করলে ভাল লাগত।“
“আমি এই ব্যাপারে কথা বলতে খুব একটা ভালবাসি না। আর হ্যাঁ, গ্রামবাসীদের বলব তুমি আমার স্যার, আদিবাসি গ্রাম ঘুরে দেখার জন্য এসেছ।“
“ তুমি রাস্তা চিনতে পারবে তো?”
“হ্যাঁ পারবো। আচ্ছা তুমি আমাকে কতটা বিশ্বাস কর?”
“এ আবার কি কথা মিনা, আমার গোপন ব্যাবসার কথা তুমি ছাড়া আর কেউ জানে না। এর পরেও তুমি বিশ্বাসের কথা বলছো”
“আচ্ছা, ছাড়ো। জানো আমাদের গ্রামের লোকেরা তেরো বছর অন্তর রিভু দেবতার পুজা করে। নরবলি হয়। শেষ যে বছর আমি গ্রাম ছেড়ে আসি সেবছর হয়েছিল। পুলিশ কেসও হয়েছিল। কোনোভাবে পুলিশ জানতে পেরেছিল। তবে বলি আটকাতে পারেনি। তবে পুরোহিতকে এরেস্ট করেছিল। গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী মোড়লের মেয়েরাই এই পুজোর পুরোহিত হয়। সেই বারের পুরোহিত ছিল ঝরনা। নিজের ঝাতে নরবলি দিয়েছিল সে, বাবার মুখে শোনা। লাশের খোঁজ না পেয়ে আর প্রমাণের অভাবে পুলিশ ঝরনাকে ছেড়ে দিতে বাধ্যহয়। তবে গ্রামে ফিরে এসে ঝরনা সুইসাইড করে। আমার গ্রাম ছেড়ে চলে আসার ঠিক আগের দিন।“ এতোক্ষণ পর চুপ করে মিনা। রাত সাড়ে আটটা বাজে। গ্রামে যেতে এখনও আধ ঘণ্টা লাগবে। মিনার এতোক্ষণের গল্প শুনে প্রফেসরের মুখে আতঙ্কের ছাপ দেখা যায়। প্রফেসরের মুখের শুকনো হাসি দেখে আর থাকতে পারল না মিনা। হো হো করে হেসে উঠল সে।
“ উফফ তুমি সত্যি বিশ্বাস করে নিলে। আমি তো তোমাকে বোকা বানাচ্ছিলাম। আর তুমি ভয় পেয়ে গেলে”
“তুমি না মিনা। সত্যি ভয় খেয়ে গেছিলাম। যাক গে বল আর কতটা বাকি”
আর মিনিট কুরি পরে জঙ্গলের মাঝখানে একটা গ্রামে এসে পৌঁছালেন প্রফেসর। চারদিকে মাটির বাড়ি, কারেন্ট নেই, মশাল জ্বলছে। তার গাড়িটাকে এই জঙ্গলের রাস্তায় আনতে অনেক কসরত করতে হয়েছে। তার গাড়ি দেখেই মশাল নিয়ে ছোট ছোট কাপড় পড়া পুরুষ মহিলারা গাড়িটাকে ঘিরে ধরল। প্রত্যন্ত গ্রামে গাড়ি নিয়ে আসলে এরকম হবে তাতে আর আশ্চর্য কি। তাকে গাড়িতে বসতে বলে মিনা নেমে গেল। নিজেদের ভাষায় কথা বলল গ্রামবাসীদের সাথে। ধীরে ধীরে সন্দেহে ভরা মুখগুলোতে কৌতূহল আর খুশি দেখা দিল। মিনার ইশারায় তিনি গাড়ি থেকে নেমে এলেন। তাদের গোল করে ঘিরে গ্রামবাসীরা একটা বাড়িতে বসতে দিল। পাতার গ্লাসে জল দিল। প্রফেসরের জলে একটা গন্ধ লাগল। আদিবাসি তো কোথাকার জল খায় কে জানে। প্রফেসর জলটুকু খেয়ে নিলেন। মাথাটা ঘুরে উঠল, হাত বাড়িয়ে মিনাকে ডাকতে গিয়ে পড়ে গেলেন তিনি।চোখ খুলে নিজেকে একটা মন্দিরে আবিস্কার করলেন তিনি। বীভৎস মূর্তিটার জন্যই এই খড়ের চালাটাকে মন্দির বলে বুঝতে পারলেন প্রফেসর। একাধিক মশালের আলোয় আদিবাসির পোশাকে মিনাকে সেই মূর্তির সামনে বসে থাকতে দেখে চমকে উঠলেন অরুণ বিশ্বাস। চারদিকে আদিবাসির পাহারা দেখে পালানোর শেষ আশাটাও শেষ বুঝলেন তিনি। সামনে থাকা হাঁড়িকাঠটাকেই অদৃষ্ট হিসাবে মেনে নিলেন তিনি। মিনা উঠে ঘুরে তাকাল তার দিকে। প্রফেসর কোনো কথা বললেন না। শুধু মনে মনে সেই নিরীহ মেয়েটির সাথে এই ভয়ঙ্কর নারীটির মিল খোঁজার চেষ্টা করতে থাকলেন।
শুধু আস্তে একবার জিজ্ঞাসা করলেন, “কেন মিনা?”
“কখনও কখনও নিজের গোপন জিনিস কারুর সাথে ভাগ করা উচিত না, প্রফেসর। আমার বাবা সাধারণ একজন আদিবাসি ছিলেন। পেটের বাথায় কাতর হয়ে অনেক সাহস জুগিয়ে শহরের হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখানে তার দেখা হয়েছিল এক দেবতার সাথে। হ্যাঁ, তিনি দেবতাই ছিলেন, বিনা পয়সায় বাবার অপারেশনের ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন। সুস্থ হয়ে ফিরে আসা বাবা ঠিক এক সপ্তাহ পর মারা যান, চাষের কাজ করতে গিয়ে। শহরের হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলেছিল বাবার শরীর থেকে একটি কিডনি বের করে নেয়া হয়েছিল। একটা কিডনি নিয়ে ভারি কাজ করতে গিয়ে বাবার মৃত্যু হয়। এই শুনে গ্রামে ফিরে মা আত্মহত্যা করে। শহরের সেই ডাক্তার আমায় দত্তক নেন। অনেক খুঁজে জানতে পারি সেই দেবতার নাম, ডঃ অরুন বিশ্বাস। মনে আছে প্রফেসর আপনি যখন আপনার গোপন ব্যাবসার কথা বলেছিলেন আমি অবাক হইনি। কেনই বা হবো? আমি তো জানতাম আগে থেকেই। তবে আপনি নিজে থেকে জানানোর পর আমার আর কোন সন্দেহ ছিল না। সেই ডাক্তার মানে আমার দত্তক নেওয়া পিতা বিদেশে চলে গেছেন। আমার টিকিট রয়েছে কাল সকালের। আমাকে বিশ্বাস করে আপনি ভুল করেছিলেন । আমার বাবাও মোড়ল ছিলেন। সেই হিসাবে আমিও পুরোহিত। শুধু তেরো বছর শেষের অপেক্ষা ছিল। জন্মভুমির প্রতি শেষ দায়িত্ব পালন করে যাব। আজ আমি আমাদের দেবতার সামনে আমার সরল বাবার বিশ্বাসের সাথে খেলা করা দেবতার বলি দেব।“
মিনার আদেশে দু’জন আদিবাসি প্রফেসরের কপালে সিঁদুরের তিলক কেটে দিল। আর তাকে নিয়ে চলল হাঁড়িকাঠের দিকে। -
ভৌতিক গল্প- নীল শরীর
নীল শরীর
– দেবস্মিতা ঘোষ“ধুর আজ আর না বেরোলেই ভালো হতো। গাইডটার আজই জ্বর হতে হয় বল।” হালকা বিরক্তি মুখে ফুটিয়ে বলল তুতুন।
“আরে ওইরকম করে বলিস না রে, জ্বর তো হতেই পারে।” মিতালী ওকে থামাতে যায়।তুতুন আর মিতালী দু’জন বন্ধু । চেন্নাই কলেজের তৃতীয় বর্ষের সাহিত্যের মোট আট জন বন্ধু বান্ধবী মিলে কেরালা ঘুরতে এসেছে তারা। দশ দিনের পরিকল্পনা। সাত দিন অতিবাহিত। আজ সকালে ওরা মুন্নার এসেছে। সারা সকাল ঘুরেছে। বিকেলের বেড়াবার প্ল্যানটা গাইডের অসুস্থতার কারণে বাতিল হয়ে যায়। বাকিরা হোটেলেই কফি সহযোগে আড্ডায় মেতে উঠলেও তুতুন আর মিতালী বেড়াতে এসে একদিনও নষ্ট করতে রাজি নয়। স্থানীয় লোকের থেকে খবর পেয়ে তারা মাত্র দু’ কিলোমিটার দূরে থাকা “বাতিস্তা” গ্রামের উদ্দেশ্য। প্রধান আকর্ষণ একটি পোড়ো হোটেল। গ্ৰুপের বাকি বন্ধুরা অনেক চেষ্টা করে আটকানোর, কিন্তু ওদের আটকানো যায়না। ডিনারের অনেক আগে ফিরে আসবে কথা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ওরা।
বাতিস্তা পৌঁছাতে ওদের মিনিট কুড়ি লাগে। গিয়ে দেখে শুধুই একটি সাধারণ গ্রাম। গ্রাম লাগোয়া একটি আধ ভাঙা বাড়ি জঙ্গলে জড়িয়ে পড়ে আছে, লোকে বলে না দিলে জানাই যেত না যে ওটা হোটেল।
স্থাণীয় চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরালো মিতালী। তারপর দু’জন এগিয়ে গেল সেই হোটেলের দিকে। কাছে গিয়ে ভালো করে দেখল, যদিও জঙ্গলের জন্য বেশি কাছে যাওয়া যায় না।
“গাইডটার কি আজই জ্বর হতে হয় নাকি বলতো। এখানে এসে কি লাভটা হলো। কিছুই তো নেই।” বলল তুতুন।
“গাইড তো ওই 18 বছরের ছেলে, মানুষ তো রে জ্বর হতেই পারে। তবে এখানে আসার পরিকল্পনাটাও বেকার ছিল। ভেতরেই যেতে পারবো না যা জঙ্গল। আরে ওইদিকে একটা লোক বসে আছে না, জঙ্গলের মধ্যে চেয়ার নিয়ে বসে আছে কেন রে? ভূত নাকি” মিতালী হাত তুলে একটা জায়গা দেখাল।
“জঙ্গলের মধ্যে চেয়ার নিয়ে ভুত বসে থাকবে, বলিহারি তোর বুদ্ধি, চল গিয়ে দেখি”
ওরা লোকটার কাছে যায়। লোকটি মনে হয় ঝিমুচ্ছিলো, ওদের পায়ের আওয়াজে মুখ তোলে।
সাধারণ গ্রামীন পোশাক পরা বছর সত্তরের এক বৃদ্ধ। ওরা এইখানে ঘুরতে এসেছে শুনে ভেতরে যাবার কথা বলে।
“পিছনের একটা রাস্তা আছে ওখান দিয়ে ভেতরে ঢোকা যায়। আমি ভেতরেই থাকি, দেখবে চল।”তুতুন, মিতালী একটু ইতস্তত করে শেষ অবধি চলে যায়। পিছনের দিকে জঙ্গল কেটে রাস্তা করা। হোটেলের ভিতরে ঢুকে তারা বুঝতে পারে এই হোটেলটা অগ্নিদগ্ধ। কোনো এক সময় আগুনে পোড়ানো হয়েছিল। কোনার দিকে একটা ঘর পরিষ্কার করে জিনিসপত্র রাখা। মাদুর, স্টোভ, কিছু জামাকাপড়, খাদ্যসামগ্রী আরো কত কিছু যা দেখে বোঝা যায় বুড়ো সত্যিই এখানে থাকে। ওদের মাদুরে বসায়। ভালোই অন্ধকার এখানে, ইলেক্ট্রিসিটি থাকা সম্ভব নয় তা দেখেই বোঝা যায়। তুতুনকে টর্চ বন্ধ করতে বলে মোমবাতি জ্বালায় সেই বৃদ্ধটি।
“আপনি এই ভাঙা, পোড়া হোটেলে থাকেন কেন?” মিতালী জিজ্ঞাসা করে।
“আমার ঠাকুরদা এই হোটেলের দারোয়ান ছিলেন, সেইজন্য এখানেই থাকতেন। আর কোনো বাড়ি ছিল না। এই হোটেলের শেষ দিন অবধি তাই আমিও এখনে থাকব।”
“এই হোটেলটা কি ভৌতিক, আর এটার এরকম দশা হলো কিভাবে” তুতুন বলল।
“শুনতে চাও যখন বলছি তবে বিশ্বাস অবিশ্বাসের ব্যাপার তোমাদের ওপর। এই হোটেল ভৌতিক কিনা সেটাও পুরোটা শোনার পর বুঝতে পারবে।” একটু থেমে আবার শুরু করল ।
“আমার ঠাকুরদা তখন এই হোটেলের দারোয়ান। বাবা ও কর্মচারী। হোটেলের তখন জমজমাট অবস্থা। সেইরকম এক শীতকালে বেড়াতে এলো বীথি কুন্তল নামে এক দম্পতি। ঠিক চারদিন ছিল। ঠিক সেইসময় এই হোটেলে এসে উঠেছিল একটি স্কুলের দশ বারো জন ছেলে আর দু’জন শিক্ষক। সবই ঠিকঠাক ছিল। সমস্যা হল ফিরে যাওয়ার সময়। দুই দলেরই ট্রেন ছিল “কুন্তী” স্টেশন থেকে। কিন্তু ওই স্টেশনটা যে ভালো নয়, রাতের বেলা সেখানে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে সে কথা তাদের বোঝাতে পারেনি হোটেল কর্তৃপক্ষ। নীল শরীরের আক্রমণ থেকে ওদের বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছিল হোটেলের লোকেরা।”
“নীল শরীর মানে?” তুতুন বলে।
“এই গ্রামের সবচেয়ে নিকটবর্তী স্টেশন “কুন্তী”তে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এক বিশাল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল বিপ্লবীরা। মৃত সমস্ত লোক ফিরে এসেছিল যন্ত্রণায় নীল হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে। ওদের এখনো দেখা যায় ওই স্টেশনে। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে। আর কোনো মানুষ যদি ভুল করেও ওখানে যায় ট্রেন ধরতে তবে তাদেরও ওই নীল মানুষের ট্রেনে উঠতে হয়। তারাও হয়ে যায় নীল মানুষ। কেউ নীল শরীর নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। গ্রামের মানুষ সবই জানে। তাই কোনো নীল শরীর দেখলেই ওরা পিটিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলে দিত। এখন আর নীল মানুষরা ফেরে না গ্রামে। তবে ওরা এখনো আছে।
যাই হোক, বীথিদের নিরস্ত করা গেলনা। ওরা সেই ওই স্টেশনেই চলে গেল। তবে শেষ বারের মতো ওদের বলে দেওয়া হয়েছিল স্টেশন মাস্টারের অনুমতি ছাড়া কোনো ট্রেনে না উঠতে। স্টেশনমাস্টার স্থানীয় লোক, তার কোনো ক্ষতি হয়নি কখনো। বিথীদের কিছুক্ষণ পর সেই ছেলেদের দলটাও বেরোলো। ওদেরও একই কথা বলে দেওয়া হয়েছিল। বিথীদের ও ছেলেদের দলকে নিয়ে নিজে স্টেশনমাস্টার দাঁড়িয়েছিলেন প্লাটফর্মে। ধীরে ধীরে ওরা দেখে আরও মানুষের আগমন হচ্ছে। তাদের গায়ের চামড়া নীলচে। চোখ গুলি লাল। তারা সারা স্টেশন ঘুরে বেড়াচ্ছে, সংখ্যায় অগুনতি। হঠাৎ একটি ট্রেন এলো কলেজের ছেলেরা কোনো বাঁধা না মেনেই উঠে গেল, ওরা এই পরিস্থিতি আর সহ্য করতে পারছিল না। ওরা উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু নীল মানুষ ও উঠে পড়ল। আর কলেজের ছেলেদের ট্রেনে ওঠা দেখে জয়ের হাসি হাসতে লাগল তারা। হাসির দমকে কেঁপে উঠলো স্টেশন । বীথি কুন্তলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। স্টেশন মাষ্টারের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। সে ওদের ফিরে যেতে আদেশ দিল। ওদেরও আর ট্রেনে ওঠার সাহস ছিল না। ওরা সেই রাত্রে হোটেলে ফিরে এসেছিল। কিছু না খেয়েই রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল। বীথি ঘুমালে বাইরে আসে কুন্তল। রাত বারোটা নাগাদ কমন খাবার জায়গা মানে ডিনার রুমে থেকে হইহল্লা শুনে কুন্তল উঁকি মেরে দেখতে যায়। সে দেখে সেই ছেলেদের দল ওখানে বসে খাচ্ছে। ওকে দেখে তারা চমকে উঠে। হোটেলের বাকি কর্মচারীরাও ছিল ওখানে। কৈফিয়ত এর সুরে ওরা বলে পরের স্টেশনে নেমে গেছিল ওরা। সেখান থেকে এই হোটেলে চলে এসেছে। কুন্তল আবার রুমে ফিরে যায়। ও বীথিকে জাগিয়ে তোলে, সবটা বলে। বীথি বলে ওরা তো সাধারণ দেখতেই, তাহলে ওরা সত্যি বলছে। কুন্তল বলে, না সমস্যাটা হলো হোটেলের কর্মচারীদের গায়ের রং নীল লাগছে, ওরা সবাইকে নীল মানুষ করে দিয়েছে। আমি অভিনয় করছিলাম যেন আমি ওদের চিনি না। আমাদের যেভাবে হোক পালাতে হবে। বীথির মুখের রং সাদা হয়ে গেল ভয়ে। কিভাবে পালাবে কিছুই বুঝতে পারছিলনা। শেষে ওরা বাথরুমের জানলা ভেঙে পালিয়ে যায়। গ্রামের মানুষদের ডেকে আনে, আগুনে পুড়িয়ে দেয় পুরো হোটেল। আমি বাদে কেউ রক্ষা পায়নি। আমার বয়স ছিল পনের বছর।সেই থেকে আমি একাই রয়েছি।”
” আপনাকে ওরা নীল মানুষ বানায়নি কেন?” মিতালী জিজ্ঞেস করল।
“বীথি কুন্তল ছিল একমাত্র মানুষ যারা নীল শরীরের হাত থেকে বেঁচে গেছে। তবে আমি জানতাম ওরা আবার আসবে, হয়ত অন্য রূপে তবে ওদের আসতেই হবে। সেই জন্য তো এতবছর অপেক্ষা করে আছি। প্রতিশোধ চাই আমার” বিড়বিড় করতে থাকে বুড়ো।
“আপনাকে ওরা নীল মানুষ বানায়নি!” আবার জিজ্ঞেস করে মিতালী।
“কে বলেছে বানায়নি.. ” মোমবাতির আলোটা নিজের মুখের সামনে তুলে ধরে সে, তার চামড়া ধীরে ধীরে নীল হচ্ছে। চোখের রং বদলাতে শুরু করেছে, পাগলের মতো বিড়বিড় করছে সে, “আসতে তো তোদের হতই, এক রূপে না হয় অন্য রূপে.. আমার এত বছরের অপেক্ষা… নীল শরীরের নেশা বড় বিষাক্ত..তার হাত থেকে কেউ বাঁচতে পারেনা….
পরদিন সকালে বাকি বন্ধুরা গিয়ে দেখে মিতালী আর তুতুন এর মৃতদেহ। কোনার ঘরে ফাঁকা ধুলো ভর্তি মেঝেতে, কি জানি কি কারণে দুজনের গায়ের রং পুরো নীল হয়ে গেছিল।
-
অণু গল্প- স্মৃতির ধ্বংসস্তূপ
স্মৃতির ধ্বংসস্তূপ
– দেবস্মিতা ঘোষথার্ড পিরিয়ডের মাঝামাঝিই বৃষ্টি নামলো। সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। এই সতের বছরের জীবনে অগুনতি বার বৃষ্টি শুরু হতে দেখা। তাও প্রথম জলের ফোঁটাটা নামতে দেখেই মনটায় খুশির ঢেউ ওঠে। যাই হোক এই সময়টাই ভৌতবিজ্ঞান চলে নানা ফিজিক্স চলে। আমার স্কুলটি শহরের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, এখানে অনেক সতর্ক ভাবে থাকতে হয়। হঠাৎ যদি ভৌতবিজ্ঞান বা জীবনবিজ্ঞান বলে ফেলি তবে তো যাচ্ছেতাই অপ্রস্তুত হতে হবে। নাহ্, মাঝে মাঝে সত্যি মনে হয় প্রায় দু’বছর শহরে এসেও আমার আধুনিক শহুরে হওয়া হলো না বোধহয়।
কথায় কথা বাড়ে। ফিজিক্স ক্লাসে জানলার দিকে তাকিয়ে আছি দেখলে ম্যাম খুব রেগে যাবেন। আর দেখবেই বাকি জানলা দিয়ে কারখানার ধূসর শেড আর উঁচু বাড়ি ছাড়া কিছু দেখা যায় না। তবু অমাবস্যার চাঁদের মতো আকাশ দেখবো আশা করে প্রতিদিন জানলার পাশের জায়গাটার জন্য লড়াই করি। বাজে কথা ভাবা বন্ধ করে ক্লাসে মন দিলাম।
টিফিনের বেল বাজতেই বারান্দায় চলে এলাম। একটু কোনের দিকে ঘেঁষে কাঁচের জানলার সামনে দাঁড়ালাম। স্কুলের সামনের দিকটা দেখা যায়। সেই এক গাড়ি বাড়ি রাস্তা। তবু আকাশটা একটু বেশি দেখা যায় সেই ভাল।
বৃষ্টির হালকা ঝাপটা মুখে লাগতে চোখটা বন্ধ হয়ে এল। মনে পড়ে গেল পুরোনো স্কুলের কথা। বাংলা মাধ্যম। মফস্বল এলাকার একমাত্র মেয়েদের স্কুল।
বৃষ্টির সময় মনখারাপ হলে বারান্দায় দাঁড়াতাম। সামনের বিশাল মাঠ বৃষ্টির সময় ধূসর চাদরে ঢাকা পড়ত। বারান্দায় জল চলে আসত। দিদিমণিরাও আসত কাগজের নৌকা ভাসতে। কাঁঠাল গাছের পাতা থেকে টুপেটুপে জল পড়ত। সব মনে আছে, ভুলিনি কিছুই। আর মনে পড়ে রিমাকে। মনখারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম আর অপেক্ষা করতাম কখন একটা খুব নরম হাত আমার কাঁধে আলতো চাপড় মারবে আর সেই চশমা পড়া মোটু মেয়েটা এসে বলবে , “কিরে দেবু একা একা কি করছিস”হঠাৎ কাঁধে একটা হাত। স্মৃতির জাল কেটে বেরিয়ে এলাম। “what are you doing here? Go back to your class. Break time is over.” ক্লাসের মনিটর।
“Wait, r u crying?” কৌতূহল রয়েছে তার চোখে সহানুভূতি নয়।
“No it’s just rain”
“Ohh. U know what I hate rain. So much germs n mess. Ok go back to class now.”ঈশ্বরে বিশ্বাসী নই। তাও প্রার্থনা করলাম এই স্মৃতির ধ্বংসস্তুপ নিয়েই যেন বাঁচতে পারি। কোনোদিন যেন বলতে না হয় “i hate rain”. বৃষ্টির ঝাপটার সাথে মিশে যাওয়া চোখের জল মুছে ক্লাসের দিকে এগিয়ে যাই।
-
গল্প- মানুষ
মানুষ
– দেবস্মিতা ঘোষগ্যারেজ টা এখন ফাঁকা, কেউ নেই। গ্যারেজের পিছনের দরজা দিয়ে বেরোলে একটা ছোট্ট পুকুর। পানে মজে গেছে, কেউ আসে না। কেউ আসে না বললে ভুল হবে, ছোটো থেকেই এটা প্রিয় জায়গা পিন্টুর।
রাস্তায় জন্মানো ছেলের আবার ভালো লাগার জায়গা থাকে নাকি।
না থাকার কি আছে? তারাও তো মানুষ।
নিজের সাথে নিজে তর্ক করে সে। পুকুরের ধারে বসে নিজের সাথে খানিকটা বোঝাপড়া না করলে তার দিন কাটে না। হঠাৎ যদি তার এই সংকীর্ণ জীবনে ঢেউ তোলার মতো কোনো ঘটনা ঘটে তখন সে আসে এই জায়গায়। যদিও তার কুড়ি বছরের জীবনে এরকম ঘটনা খুব কমই ঘটেছে।
‘তবে কি দীপুদা সব জেনে গেছে।’
‘জেনে গেলেই বা কি আমি কি ওর পয়সায় খাই, ধুর…আমি বেশি ভাবছি।’নিজের মনকেই মানাতে পারছে না সে। তিনবছর আগের ঘটনাটা কিছুটা এইরকম।
পিন্টুর বাবা তার জন্মের আগেই মারা যান। রাস্তার ভিখারি মা তাকেও ওর মনে নেই। দু’ বছর বয়সে ওর মা মারা যান। মৃত মায়ের কোলে বছরের পিন্টুর ক্রন্দনরত মুখ মনে হয় সাধারণ মানুষের ব্যাস্ত মনকে গলাতে পারেনি তবে একটি পকেটমারের মনকে আদ্র করে দিয়েছিল। দীপক দাস ওরফে সবার দীপুদা পকেটমারদের দলের হেড ছিল। সেই পিন্টুকে মানুষ করেছে। পয়সার কমতি থাকলেও ভালোবাসার অভাব ছিল না। দলের সবাই বিশেষ করে দীপুর সদ্দবিবাহিত বউটি পিন্টুকে নিজের ছেলের আসনেই বসিয়েছিল। পিন্টু ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। দিপু ওকে পকেটমারের কাজ শিখতে দেয়নি তবে নিজের পেশাকেও ওর থেকে আড়াল করেনি। যে কাজ পিন্টুর মুখে খাবার তুলে দিয়েছে তাকে অশ্রদ্ধা করেনি কখোনো।বছর সতেরোর পিন্টু পড়াশোনা তেমন শেখেনি। তবে দিপুদার সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে সে ও দীপুর স্ত্রী একটি ছোটো খাবারের দোকান খোলে। দিন ভালোই কাটছিল। দীপুও পকেটমারের কাজে বেশি যেত না।
কিন্তু কোনো সুখই দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
শ্রাবণ মাসের দিন ছিল। সেদিন দীপু কোনো একটা কাজে বাইরে গিয়েছিল। তার স্ত্রী জ্বরে কাতর থাকায় পিন্টু একাই দোকান সামলাচ্ছিল। রাত আটটা নাগাদ বৌদির জন্য খাবার নিয়ে বাড়ি এসেছিল সে। বৃষ্টির কারণে দোকান তাড়াতাড়িই বন্ধ হয়ে গেছিল। ঘরের তালা খোলা দেখে অল্প সন্দেহ হয় কিন্তু সে আমল দেয়নি কারণ বৌদি বাড়ির ভেতরেই ছিল। কিন্তু ঘরে ঢুকে যে দৃশ্য সে দেখে তাতে তার বুদ্ধি লোপ পায়।জ্বরে প্রায় অচেতন বৌদির অশ্লীল ছবি তুলছে সমরদা। সেও দলের পকেটমার বলতে গেলে দীপুদার ডানহাত। বাড়ির একটা চাবি তার কাছেও থাকে।
পিন্টুকে দেখে থতমত খেয়ে যায় সে। রাগে জ্ঞানশূন্য হয়ে হাতে থাকা খাবারের থালা ছুঁড়ে মারে সে। ভুলবশতঃ সেই থালার আঘাতে পড়ে গিয়ে খাটের গায়ে মাথা ঢুকে যায় তার। রক্তপাত হতে থাকে।দীপু বাড়ি ফিরে শুধু দেখেছিল তার স্ত্রী অচেতন অবস্থায় গায়ের কাপড় ঠিক নেই। একদিকে পিন্টু হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে কাঁপছে, অন্য দিকে পরে রয়েছে তার বিশ্বস্ত বন্ধুর রক্তে ভেসে যাওয়া মৃতদেহ। দীপু কি বুঝেছিল সেই জানে। লাশটা বাগে ভর্তি করে স্টেশনে বসিয়ে দিয়ে এসেছিল। ঘর পরিস্কার করে, পিন্টুকে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছিল সে। কোনো প্রশ্ন করেনি।
তার পরের ঘটনা নিয়ে খুবই হইচই শুরু হয়। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। পিন্টু কয়েকদিন ঘর থেকে বেরোয়নি। কিন্তু যখনই সে শুনল দীপুদাকে পুলিশ আরেস্ট করেছে সে আর থাকতে পারেনি। সোজা পুলিশকে গিয়ে সব বলে দেয়। দীপুদার চোখে ভর্ৎসনা ফুটে উঠেছিল কিন্তু তাতে গর্বও মিশে ছিল। এইসব এর মধ্যে “অনিচ্ছাকৃত খুন” এর অপরাধে সে জেলে যায়।
আজ পিন্টু মুক্তি পেয়েছে। সে আশা করেছিল দীপুদা তাকে আনতে যাবে কিন্তু সে যায়নি। এমনকি গত তিন বছরের মধ্যে একবারও তার সাথে দেখা করতে যায়নি। ইতস্তত করে সে দীপুদার বাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু বাড়িতে তালা দেখে তার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এই পুকুর ধারে বসে সে তাই আবার আগের মতো নিজের সাথে তর্ক তর্ক খেলছে।
“তিনবছরে অনেক লম্বা হয়ে গেছিস তো।”
চেনা একটি গলার আওয়াজে মাথা ঘোরালো পিন্টু। তিনবছরে অনেকটা বুড়িয়ে গেছে দীপুদা। তবে মুখের হাসিটা একই আছে। গলার আছে আটকে থাকা কান্নাটা চেপে মুখ খুলল সে।“তুমি কিভাবে জানলে আমি এখানে থাকব”
“ছোটবেলায় তুই যখন কথা বলতে পারতিস না তখন কোনো অসুবিধা হলেই তুই কাঁদতিস তখন আমি বুঝে নিতাম তোর কি দরকার। আর এইটুকু জানব না যে দুঃখ হলে তুই কোথায় যাস”
“এতই যখন ভালোবাসো তাহলে এতদিন যাওনি কেন একবারও” আর আবেগ চেপে রাখতে পারল না পিন্টু। চোখ তার বিশ্বাসঘাতকতা করল।
“সেটা বলব বলেই এসেছি আজ। চল আমার সাথে।”
“কোথায়”
“আরে চল না”
দিপুদার পুরোনো সাইকেলটা বাইরে দাঁড় করানো ছিল। মিনিট কুড়ি পরে, একটা মাঝারি মাপের দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামল তারা। বাড়ির বাইরে একটি উবের রাখা।
পিন্টুর অবাক চাহনিকে অগ্রাহ্য করে তাকে নিয়ে ভেতরে ঢোকে দীপু। ঘরের ভিতর বছর দশ বারোর পাঁচটি শিশু। তাদের সামলাচ্ছে দিপুদার স্ত্রী। তাকে দেখে এগিয়ে এল।“তুই চলে যাবার পর আমি তোর বৌদিকে সেদিনের ব্যাপারে সব খুলে বলি। ও তখনই তোর সাথে দেখা করতে যেতে চায় কিন্তু আমি ওকে আটকাই। আমরা তোকে চমকে দিতে চাই। বিশ্বাস কর পকেটমারের জীবন থেকে আমি সরে আসি। ব্যাংকের টাকায় লোন নিয়ে উবের কিনি আর তোর বৌদি দোকানে জীবন ঢেলে দেয়। তার পর ধীরে ধীরে দু’জনের সঞ্চয় দিয়ে এই জায়গাটা গড়ে তুলি।” দিপুদা থামল।
বৌদি বলল,” পিন্টু তুই আমার ছেলে। আর আমি চাই কোনো ছেলে মেয়ে রাস্তায় পড়ে যেন কষ্ট না পায়। তাই এই পাঁচজনকে দিয়েই শুরু করলাম। আর উবেরটা এখন থেকে তোর। আমি জানি তুই গাড়ি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করিস অবসর সময়ে। তুই যা করেছিস তাতে ধন্যবাদ বলে ছোটো হবো না।”
দিপুদার কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল পিন্টু। ধরা গলায় বলল, “আমি চাইনা বড়লোকের বাড়ি জন্মাতে। প্রতিজন্মে যেন রাস্তার অনাথ হয়ে জন্মাই যাতে তোমাদের মতো মানুষদের কাছে আসতে পারি।”
হঠাৎ বাচ্চাগুলো ছুটে পিন্টুর কাছে এল। “এটাই কি আমাদের দাদা গো মনিমা, সেই যার কথা বলতে গেলে তুমি কেঁদে ফেলতে”“হ্যাঁ, আমিই তোদের সেই দাদা” বলে ওদের কোলে তুলে নিল পিন্টু।
সমাপ্ত
-
গল্প- দৃষ্টি
দৃষ্টি
-দেবস্মিতা ঘোষ
নীল শাড়িতে আর হালকা প্রসাধনীর ছোঁয়ায় অপরূপ সুন্দরী লাগছে শ্রুতিকে। এত ভিড়ের মধ্যেও বারবার শ্রুতির ওপরেই চোখ চলে যাচ্ছে অনিকের। কি সুন্দর ভাবে সমস্ত সবাইকে সামলে নিচ্ছে শ্রুতি, এটাই ভাবছে অনিক। শ্রুতি অনিকের স্ত্রী। যথার্থ ওর অর্ধাঙ্গিনী, একবছর আগে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা অন্ধ অনিক আজ এই সফলতার চূড়ায় দাঁড়াতে পেরেছে তা শুধুমাত্র শ্রুতির জন্যই।
অনিক একজন শিল্পী। ছবি আঁকা তার পেশা নেশা দুটোই।আজ তার ছবির প্রদর্শনী। সাধারণ মানুষ তো বটেই সমালোচকদের ও প্রশংসা পাচ্ছে সে আজ। অনিক হলের একটা কোনে বসেছিল একটু আর দেখছিল কি অপার দক্ষতার সাথে শ্রুতি মিডিয়ার লোক থেকে শুরু করে সমালোচক দেরও সামলাচ্ছে। মন ভরে গেল অনিকের। হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে থেকে অনিমেষ এগিয়ে এল তার দিকে।
“এইবারের তোর ছবি গুলো সত্যি দারুণ, খুব জীবন্ত। যেন আস্ত একটা মানুষের জীবন তুই ছবিগুলোর মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছিস। তোর হাতের কাজ সত্যি বলতে বরাবরই ভালো, কিন্তু এই ছবি গুলো সত্যি অন্যরকম।” বলল অনিমেষ।
অনিকের খুব কাছের বন্ধু অনিমেষ, সেও একজন চিত্রশিল্পী। বন্ধুর কথার উত্তর দিলো না অনিক শুধু হাসল। “তোর ছবির বিষয়টাই পুরো জিনিসটা বদলে দিয়েছে। আচ্ছা আমি এখন আসি রে।” বলে চলে গেল অনিমেষ। বন্ধুকে বিদায় জানিয়ে আবার চুপচাপ বসে পড়ল অনিক।সে ভাবতে লাগল। সত্যিই তো ছবির বিষয়কেই তো সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। শেষ একবছরের ঘটনা সে আবার প্রথম থেকে মনে করতে লাগল সে।
ছবি আঁকবার সরঞ্জাম কিনে ফুটপাত দিয়ে বাড়ি ফিরছিল সে।
হঠাৎই একটি দ্রুত গতিতে আসা মদ্যপ চালকের দ্বারা চালানো বাইকের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে সে। হাসপাতালে ভর্তি হয়। তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু চোখ দু’টিতে কোনোভাবে আঘাত লাগার কারণে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয় তার। কিন্তু মদ্যপ চালকটিকে বাঁচানো যায়নি, তার পরিবারের কাউকে পাওয়াও যায়নি। ছেলেটির নাম জানা গিয়েছিল, তুষার। তুষারের জীবিত অবস্থায় চক্ষুদান করার অনুমতি থাকার কথা জানা যায় তার ব্যাগ থেকে পাওয়া একটি সার্টিফিকেট থেকে। ফলে তুষারের চোখই দান করা হয় অনিককে।চিত্রশিল্পী হয়ে অন্ধ হয়ে যাবার অভিশাপ থেকে তাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অনিক কৃতজ্ঞ ছিল মনে মনে। এর পর সে তার প্রতিদিনের জীবনে ফেরার চেষ্টা শুরু করলো।
তারপর একদিন ঘটলো এক আজব ঘটনা যার ফলেই আজ অনিক এই জায়গায়। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছিল সেইদিন তার তাও সে জোর করে আঁকতে বসে। হঠাৎ তার চোখের সামনে একটি ছবি ভেসে ওঠে। মনে হলো সাদা কাগজে আগে থেকেই যেন সাদা কালিতে ছবি আঁকা এবং সেই ছবি দেখতে পাচ্ছে অনিক। দেখে দেখে সে শুধু পেনসিল বোলালো আর অদ্ভুত জীবন্ত ছবি ফুটে উঠলো। প্রথমে নিজেই বিশ্বাস করতে পারেনি অনিক। ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে বসেছিল সে। প্রথম ছবিটা ছিল একটি হামা দেয়া বাচ্চার।
এই ছিল শুরু। তখনও সে জানত না আর কিকি ঘটতে চলেছে তার সাথে। এরপর একদিন রাত্রে হটাৎ আবার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়। শুয়ে পড়বে ভেবেও কি মনে করে ক্যানভাসের সামনে গিয়ে বসে। ঠিক আগের দিনের আবারও যেন সাদা কাগজে ছবি ফুটে উঠেছে। দারুণ অবাক হয়ে শ্রুতিকে ডাকে অনিক।
“কোনো ছবি দেখতে পাচ্ছ কি!?”
“সাদা কাগজে আবার ছবি কিভাবে দেখব, কি সব বলছ তুমি!! বেশি চিন্তার ফলে ভুলভ্রান্তি হচ্ছে তোমার, যাও গিয়ে শুয়ে পড়।” শ্রুতি চলে গেল।
অনিক পরেও নানা কৌশলে অনেককে জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু কেউ দেখতে পায় না। সাদা কাগজের ছবি শুধু অনিকের চোখেই ধরা পড়ে।
সে যখন সেই ছবির ওপর পেনসিল বুলিয়ে তাকে দৃশ্যমান করে তোলে তখন সবাই অনিকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যায়।অনিকের মন কিন্তু অন্য জায়গায়। তার বারবার মনে হয় এই ছবিগুলো কাকতলীয় নয়। পরস্পর সামঞ্জস্য রেখে এগুলি তাকে দিয়ে কেউ যেন আঁকিয়ে নিচ্ছে। যেমন প্রথম ছবিটি একটি বাচ্চার। দ্বিতীয়টিতে সেই বাচ্চাকে একটি মহিলা অন্য একটি পুরুষের কোলে দিচ্ছে। তৃতীয় ছবিতে অন্য একটি বাচ্চা বয়সে বড় কিশোর বলা যেতে পারে, একা বসে মাউথ অর্গান বাজাচ্ছে। এরকম প্রায় দশটা ছবি আঁকার পর অনিকের মনে হয় যে সে একটি মানুষেরই জীবন কাহিনীর টুকরো টুকরো ছবি আঁকছে। বলা যেতে পারে তাকে দিয়ে আঁকানো হচ্ছে। এই ছবির নেশায় পাগল হয়ে উঠে সে। সব কটা ছবি শেষ না করলে গল্পটা যেন সে পুরো জানতে পারবে না।
সে এটুকু বুঝতে পারে যে একটি ছেলের জীবনের ছবি সে আঁকছে। ছেলেটি কখনও মাউথ অর্গান বজায় কখনও বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারে। ছবির মাধ্যমে অনিক জানতে পারে ছেলেটির বাকি তিনটে বন্ধুও গান বাজনা নিয়ে মত্ত। এক একটি ছবি টুকরো টুকরো কথা হয়ে ধরা দেয় অনিকের কাছে। একটি ছবিতে দেখা যায় এক মহিলার অত্যাচার ছেলেটি নীরবে সহ্য করছে, গায়ে তার কালসিটের দাগ। আবার দেখা ছেলেটি বড় হয়ে গেছে, বাইশ তেইশ বছর। সেই পুরোনো বন্ধুদের সাথেই গান বাজনা প্র্যাক্টিস করছে। এরপর হঠাৎ ছেলেটাকে নেশা করতে দেখা যায়। বন্ধুদের সাথে বচসাও। এতটা ঘটনা জানার জন্য এখন অব্দি অনিক সাতাশটি ছবি এঁকেছে। শেষ ছবিটি আঁকার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল অনিক যদিও সে জানত না ওটাই তার শেষ অদ্ভুত ছবি হবে।
অবশেষে আঠাশ নং ছবিটি শেষ হল। এটি একটি বাইক সংঘর্ষ এর ছবি। সেই ছেলেটি বাইক নিয়ে গিয়ে একজনকে ধাক্কা মেরেছে। কিন্তু আহত ব্যাক্তির মুখ বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেটিকেও মৃত মনে হচ্ছে। অনিক বুঝল তার এবার ছুটি ছেলেটির জীবন এখানেই অবসান।
কিন্তু ছেলেটিকে আর কেনই বা অনিক এইসব আঁকছিল!?এতদিন ছবির নেশায় ছিল সে। আঁকার ঘোর কেটে গেছে তার। জাগতিক সবকিছু থেকে যেন কিছু দিনের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল সে। তখনি সে শ্রুতিকে ঘরে ডেকে এনে প্রতিটা ছবি দেখাল।
শিল্পী স্বামীর পাগলামির সাথে যথেষ্ট পরিচিত শ্রুতি । কিন্তু প্রতিটা ছবি দেখে খুব অবাক হলো সে।
“এত জীবন্ত ছবি, ছবি তো নয় যেন গল্প।”কিন্তু কিন্তু ভাব করেও প্রথম থেকে সব খুলে বলল অনিক। ছবিগুলো দেখতে দেখতে ই পুরো ঘটনাটা শুনল শ্রুতি। সে বলল,”অন্য সময় হলে হয়ত তোমাকে অবিশ্বাস করতাম তবে শেষ ছবিটা দেখার পর আর নয়। ভালো করে দেখ এটা সেই রাস্তা যেখানে তোমার এক্সিডেন্ট হয়।” তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এ ছেলে আর কেউ নয় সেই বাইক আরোহী, তার চোখেই তুমি এইসব দেখছ।”
শ্রুতির কথা শুনে পুরোটা জলের মতো সোজা হয়ে যায়। কিন্তু কৌতুহল কমে না অনিকের। ছেলেটির জীবন সম্মন্ধে আরও জানার ইচ্ছে হয় তার। নানা কষ্টে সে আর শ্রুতি শেষ অবধি তুষারের ব্যাপারে খবর জোগাড় করে। তুষারের ছবি পোস্টারে দেখে সেই তিন বন্ধু যাদের কথা ছবির মাধ্যমে অনিক জানত, তারা যোগাযোগ করে। তাদের থেকেই তুষারের সমগ্র জীবন কাহিনী শোনে সে।
খুব ছোটবেলায় নিজের মা’ই নাকি তুষারকে বিক্রি করে দেয় এক নিঃসন্তান দম্পতির কাছে। তুষার তাদের কাছে আসার কিছুদিনের মধ্যেই তাদের সন্তান হয়। ফলে তুষারের আদর জোটেনি। অত্যাচার সহ্য করেও সে ছিল, দু’মুঠো খাবারের আশ্রয় ত্যাগ করতে চায়নি। অনেক কষ্ট হলে সে চুপচাপ মাউথ অর্গান বাজাত। ছোটবেলা থেকেই তারা চারবন্ধু খুব কাছাকাছি ছিল। গরিব সকলেই তবে তুষারের অবস্থার জন্য সবাই ওকে একটি বেশি ভালোবাস। ছেলেটি ভালোবাসার যোগ্য ছিল, সবার বিপদে আপদে এগিয়ে যেত। সমস্ত কষ্ট সহ্য করেও হাসিমুখ বজায় রাখত। সেই তুষার হঠাৎ বদলে যেতে শুরু করে। তার নকল বাবা তাকে টাকার লোভ দেখিয়ে অসামাজিক কাজে লিপ্ত করেন। নেশার মধ্যে ডুবে যেতে থাকে সে। বন্ধুরা আটকাবার চেষ্টা করেছিল। লাভ হয়নি, দুরত্ব বেড়েছিল শুধু। স্বপ্ন ছিল চারবন্ধুর ব্যান্ড হবে, শেষ অবধি তুষার আলাদা হয়ে গেল। ও কারুর খবরই রাখত না। তারপর এই একসিডেন্ট। তুষারের মৃত্যুর ঠিকঠাক খবরও বন্ধুরা পাইনি। এত কিছু বলে সমিক, অগ্নি আর রিসভ চলে গেল।
হঠাৎ ভিড় থেকে সামনে এগিয়ে এল শ্রুতি। অতীতের ভাবনা ছেড়ে বাস্তবে এসে পড়ল অনিক। শ্রুতির পরিকল্পনা অনুযায়ী ছবিগুলো দিয়ে প্রদর্শনী করছে অনিক। “সমীকরা তোমার অপেক্ষায় রয়েছে। আর অনেক রাত হয়েছে, প্রধান অতিথিরাও চলে গেছে। এবার তুমি আসো, বাকিটা দলের লোকজন সামলে নেবে।” শ্রুতি বলল।
অনিক ধীর পায়ে শ্রুতির পিছু নিল। আজকের এই প্রদর্শনী অনিকের ক্যারিয়ারের এক চূড়ান্ত সাফল্য। তার স্থান চিত্রশিল্পী হিসাবে অনেক উঁচু হল। সমিক অগ্নিদের দিকে এগিয়ে গেল সে। আজকের ছবিগুলো বিক্রি হওয়ার ফলে পাওয়া সমস্ত টাকার অর্ধেক ওদের হাতে তুলে দিয়ে সে বলল, “ব্যান্ড বানানোর স্বপ্নটা সফল করার চেষ্টা করো। ওটাই তুষারের শেষ ইচ্ছা ছিল বলে ধরে নাও।”অনিকের বুকটা ফাঁকা ফাঁকা মনে হল। সে জানে এত ভালো ছবি সে দ্বিতীয়বার আর আঁকতে পারবে না । তার সুখ্যাতি ও কমে যাবে কিছুদিন পর। তাও আজ সে খুব সুখী। আজ রাতে ঘুমানোর সময় কোথা থেকে একটা মাউথ অর্গানের সুর তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। বড়োই বিষণ্ন সে সুর তবুও শান্তি মেশানো..
-
গল্প- চিরকুট
চিরকুট
–দেবস্মিতা ঘোষঘরের নীল আলোটা জ্বেলে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। মন জুড়ে ভালো খারাপ মিশ্র অনুভূতি। অনেক আশা নিয়ে বসে আছি শেষ চিরকুট-এর জন্য। সবাই ভাবছে আজ আমার জয়ের দিন। কিন্তু সত্যি হলো আমি এই জয়ের একটি অংশ মাত্র। প্রকৃত বিজয়ী আজ আর এই জগতের বাসিন্দা নয়। সমস্ত ঘটনা লিপিবদ্ধ করার সময় এসেছে।
আমি শতদল বসু। পেশায় একজন নাম ডাক হীন উকিল অন্তত দুই মাস আগে অবধি তাই ছিলাম। আমার ভাগ্য একটি দিক থেকে খুবই প্রসন্ন ছিল, কারণ আমি পেয়েছিলাম অরূপ স্যারকে। বিখ্যাত উকিল অরূপরতন রায়ের এসিস্ট্যান্ট হতে পেরেছিলাম। আমার স্যার এর সুখ্যাতি সমন্ধে নতুন করে আর কিছু বলার নেই। তার সমবয়সী অথচ তাকে ঈর্ষা করেনা এরকম লোক কমই ছিল। স্যারকে অনেক কাছ থেকে দেখে তার প্রতি ভক্তি দ্বিগুণ হয়ে যেত। খুব কম সংখ্যক কেস উনি হাতে নিতেন তবে শেষ ছয় সাত বছরে উনি কটা কেস হেরেছেন সেটাও বলা যায় না।
আজ থেকে ঠিক দুই মাস আগে আমার স্যার মারা যান। খুন হন।
মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ আগে তিনি একটি কেস হাতে নেন। স্থানীয় একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষকের সতেরো বছরের মেয়ের ধর্ষণের কেস। অভিযোগ ছিল বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের অধিনায়কের ছেলের বিরুদ্ধে। অনেক পরিশ্রম এর পরেও কোনো প্রমাণ হাতে আসছিল না। উল্টোদিকে একের পর এক প্রাণে মারার হুমকি। পুলিশি প্রোটেকশন এর জন্য রাজি করাতে পারিনি স্যারকে। মানুষটা চিরদিনই নিজের ব্যাপারে কম ভাবত।
দিনটা ছিল শনিবার। ঝড় বৃষ্টির রাতে হঠাৎ স্যারের ফোন পাই। উৎফুল্ল গলায় স্যার বলেছিলেন যে প্রমাণ পেয়ে গেছেন। কি প্রমাণ কিভাবে পেলেন বলার আগেই ফোন কেটে গিয়েছিল। আরও দু’বার ট্রাই করেও পাইনি। আমি পুলিশকে জানাই তৎক্ষণাৎ। তবে স্যার অবধি পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেছিল। স্যার শুয়েছিলেন তার বাড়ি থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে একটি রাস্তার ধারে, মৃত অবস্থায়। রোড এক্সিডেন্ট প্রমাণ করতে অসুবিধা হয়নি। তবে ভেতরে ভেতরে উপলব্ধি করেছিলাম যে স্যারের প্রতিপক্ষ এবার একটু বেশি শক্তিশালী ছিল স্যার বুঝে উঠতে পারেননি। ফোনে উল্লিখিত প্রমাণের ব্যাপারটা আমি কাউকে বলিনি কারণ মৃতদেহের সাথে কোনো জিনিস পাওয়া যায়নি। নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কিভাবে দিন কেটে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি।
স্যার চলে যাওয়ার তিন দিন পর রাত বারোটা নাগাদ আমার বাড়ির দরজায় হঠাৎ ঠকঠক আওয়াজ। দরজা খুলে দেখি কেউ কোথাও নেই। নীচের দিকে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেলাম। একটি চিরকুট। কিন্তু এত কম সময়ের মধ্যে চিরকুট রেখে কেউ পালাবে কিভাবে। চিরকুটটা তুলে নিলাম। সাদা কাগজের ওপর কালো কালি দিয়ে লেখা। লেখা পড়ার আগেই আমার মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল। লেখার প্রথমেই লেখা “শত” আর হাতের লেখাটাও স্যারের। “শত” বলেও শুধু এক জনই ডাকত আমায়। চিরকুট এর বাকি লেখাটা পড়তে গেলাম আমি…
চিরকুটের মধ্যে আমার ডাকনামের নীচে শুধু একটা বাড়ির ঠিকানা দেওয়া। আর লেখা “কাল সকালেই একবার চলে যাস। আর ফিরতি পথে রমার থেকে গীতাবিতানটা নিয়ে আসিস।” এই হাতের লেখা আমি ভালো ভাবে চিনি। ভুল হবার কোন জায়গা নেই তাও চিরকুটটা ঘরে এনে আমার একটি পুরোনো খাতায় থাকা স্যারের লেখার সাথে মিলিয়ে দেখলাম। হুবহু এক।
ঘরে বসে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু চিন্তায় চিন্তায় রাত কেটে গেল কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। সকাল হতেই আর থাকতে না পেরে ঠিকানা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়িটার সামনে এসে বুঝতে পারলাম যে এটা তো মাস্টারমশায়ের বাড়ি। আগে না আসলেও ঘটনাটি ঘটার পর থেকে এই এলাকার নাম টিভির পর্দায় প্রায় আসছে। অথচ আমি কিনা কাল থেকে বোকার মতো ভেবে চলেছি। যাই হোক, ভিতরে গিয়ে মাস্টারমশায়ের সাথে কথা বলে বোঝা গেল যে স্যার মারা যাওয়ার পর কেস এর ভবিষ্যৎ সমন্ধে তিনি আর কোনো আশা রাখছেন না। আর কোনো উকিল রাজিও নন এই কেসের দায়িত্ব নিতে। বড় অংকের টাকা দিলেও নয়। মনে মনে ভাবলাম জীবনের দাম টাকার থেকে বড় সেটা ওরা বুঝে গিয়েছে। এবার উপলব্ধি করলাম এই ঠিকানায় আমাকে পাঠানোর মানে।
আমি ওনার মেয়ের কেসের দায়িত্ব নেব শুনে স্বাভাবিক ভাবেই উনি অবাক হলেন। মুখে শুধু বললেন ”আমার মেয়ে যেন সুবিচার পায় বাবা। আর তুমি সাবধানে থেকো।” আমি ওনাকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম। আরও একটা কাজ বাকি। সোজা চলে গেলাম স্যারের বাড়ি। কলিং বেলের শব্দে দরজা খুললেন রোমিতা কাকিমা। ইনিই হলেন স্যারের রমা। “জানতাম তুই আসবি” বলেই একটি চাবি এগিয়ে দিলেন। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। কাকিমা বিষণ্ণ মুখে স্মিত হেসে বললেন “পুরো বইটা নিয়ে যেতে তোরই বেশি কষ্ট।” আর কিছু না বলে চুপচাপ চাবিটা নিয়ে চলে এলাম। স্যারের বা কাকিমার আত্মীয় স্বজন বলতে কেউ ছিল না। তাই স্যারের মৃত্যুর পর কাকিমাকে এরকম ভাবে একা থাকতে দেখে ভীষণ খারাপ লাগল।
কিন্তু চাবিটা কিসের!? উত্তরটা পেলাম পরবর্তী চিরকুটে। শুধু 15D লেখা ছিল তাতে। যথারীতি স্যারের অফিসের 15D লেখা কাগজের বাক্স থেকে স্যারের হাতে লেখা ডায়রি উদ্ধার করলাম পরদিন গিয়ে। তাতে শুধু এই কেস সম্পর্কে তথ্য ছিল।
প্রথম চিরকুট পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে কেস আবার চালু হলো। আমার কেসের দায়িত্ব নেয়া যে চূড়ান্ত বোকামির কাজ সে সম্বন্ধে এলাকার সমস্ত মানুষ বোধকরি নিশ্চিত ছিলেন। উপদেশ পেয়েছিলাম “আবেগের বশে” বা “নামকেনার” জন্য এসব যেন না করি। তবে চিরকুট আসা কিন্তু বন্ধ হয়নি। ওই চিরকুটের বলে দেওয়া সূত্র ধরেই ধীরে ধীরে কেসোটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু স্যারের বলে দেওয়া শেষ প্রমাণটার কোনো হদিস নেই। এরকম ভাবে দেড় মাস কেটে যায়। জামিন পেয়ে বাইরে আসে রিতম, এই কেসের আসামী। রিতম বাইরে আসার পরের দিন আসা চিরকুটে লেখা ঠিকানাটা আমার খুব চেনা লাগছিল। ঠিকানার নীচে লেখা ছিল “এই মুহূর্তে চলে আয়। দেরী করিস না। একা আসিস”
চিরকুটে বলা জায়গাতে গিয়ে যা দেখেছিলাম তা আজও মনে থাকবে। স্যার এর মৃতদেহ যেখানে পাওয়া গিয়েছিল সেই জায়গাতেই পরে আছে অন্য একটি ছেলের মৃতদেহ, তার হাতে ধরা একটি রেকর্ডার। আমি চুপচাপ রেকর্ডারটা নিয়ে বাগে ঢোকালাম তারপর পুলিশকে জানালাম “বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পাওয়া” মৃতদেহের কথা।পুলিশি ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে দেরি হলো। ভিডিও রেকর্ডারটা দেখতেই সমস্ত ক্লান্তি উধাও হয়ে গেল। পুরো ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। স্যারের মৃত্যুর আগে স্যার কোনোভাবে রিতমের কোনো বন্ধুর সাথে আলাপ জমান। তারপর তার সাহায্যে কোনোভাবে মাতাল রিতমের থেকে সমস্ত সত্য ঘটনা জানেন এবং ভিডিও রেকর্ডারে রেকর্ড করেন। তখনও রিতম জামিনে ছিল। এই রেকর্ডার এ শুধু আসামীর বলা ঘটনাটুকুই আছে। কেস এর ফয়সালার জন্য যদিও ওটাই যথেষ্ট ছিল।
এর পরের ঘটনা বিশেষ কিছু না। রেকর্ডার কোর্টে পেশ করার পর রিতমের শাস্তি হয়। জেরার মুখে সে স্বীকারও করে যে রেকর্ডিংয়ের কথা জানতে পেরে সেই লোক দিয়ে স্যারকে খুন করায়। ধর্ষণের দোষ তো প্রমাণিত হয়েই গেছে। দ্বিতীয় বার জামিন পাওয়ার পর সে তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে বলে যে রেকর্ডারটা তাকে দিয়ে যেতে। যাওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। তার কাছ থেকেই রেকর্ডার উদ্ধার হয়। আজ রিতমের শাস্তি ঘোষণা হয়।
তাই এখন আমি বসে আছি শেষ চিরকুটের আশায়। গত দু’মাস প্রতিদিন পেয়েছি যা। কোনোদিন আমি দেখার চেষ্টাও করিনি যে কে দিয়ে যায় ওই চিরকুট। আর করবই বা কেন! আমি তো জানি ওটা কে পাঠায়। কিভাবে পাঠায় সেটা নয় অজানাই থাকলো…..
হটাৎ দরজার ঠকঠক। চিরকুটটা নিয়ে দরজা বন্ধ করলাম। ভিতরে লেখা “এই জগতে আমার কাজ শেষ এবার আমাকে যেতে হবে। সাবধানে থাকিস শত, রমার খেয়াল রাখিস”…