• গল্প

    গল্প- চর্ম অন্তরাল রহস্য

    চর্ম অন্তরাল রহস্য
    -দ্যুতিপ্রিয়া ও অর্কপ্রভ

     

    “….and by this way we solved our case of organ trafficking in Vizag..” —
    Reporting
    Mr. Anirudh Dutta
    Miss. Shibani Mittro

    “আহঃ” আহানের এই পরিতৃপ্তি মূলক শব্দ শুনেই হ্যালি বলে ওঠে “শেষ হলো তাহলে রিপোর্ট লেখাটা তাই তো?” আহান একটু হেসে সায় দিলো। ওরা দুই বন্ধু এখন এয়ার ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্সের বিজনেস ক্লাসে বসে। প্লেনটা প্রায় দু-ঘণ্টা পনেরো মিনিট হলো ছেড়ে দিয়েছে ভাইজাকের এয়ারপোর্ট থেকে। কাঁধের কাছে গুলি লাগার জায়গাটা এখনো ব্যান্ডেজ করা থাকলেও আহান গত দু’ দিনের তুলনায় আজ বেশ সুস্থ বোধই করছে। ল্যাপটপের পাশে রাখা গরম চায়ের কাপে হাল্কা করে একটা চুমুক দিয়ে বললো, “আরে পরশু অফিসে রিপোর্টটা জমা দিতে হবে না! তাই বানিয়ে নিলাম..”হ্যাঁ রে! পিংলা ও অন্যান্য লোকগুলোর কোনো খবর জানিস?” আহানের কাছ থেকে যেন এই প্রশ্নটাই আশা করছিল হ্যালি এতক্ষন ধরে, “চিকিৎসা চলছে ওদের! ওরা খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে, আমি কাল বিকালেই খবর নিয়েছি আর এই সংক্রান্ত বিষয়ে আমি ওখানকার কর্মকর্তা একজন ডাক্তারের কাছ থেকে একটা রিপোর্টও কালেক্ট করে নিয়েছি। দাঁড়া তোকে নামার পর পাঠিয়ে দেবো, তুই বরং ওই ফাইনাল রিপোর্টটার সাথে এই রিপোর্টটাও যোগ করে দিস..” হ্যালি আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তখনই পাইলটের বার্তা শোনা গেলো “আমরা আমাদের গন্তব্যে প্রায় পৌঁছে গেছি। এবার আমরা ল্যান্ড করবো। দয়া করে সবাই নিজের নিজের জায়গায় বসে, সীটবেল্ট বেঁধে নিন..নমস্কার।”

    টানা দু-ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পর ওরা যখন প্লেনের পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো তখন ভোরের আলোও ফোটে নি। দুজনের ফোনেই নোটিফিকেশন মেসেজেগুলো অনবরত ঢুকছে। তার মধ্যে একটা মেসেজ দেখেই দুজনের মন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল…” immediately report in the black suv, Numbered 5347″
    দুজনেই একে অন্যের দিকে তাকালো। এয়ারপোর্টের বাইরে গাড়িটা অনেকক্ষণ আগে থেকেই ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল।গাড়িতে ওঠা মাত্র সেটা চলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ বাদেই আরও একটি ম্যাসেজ এলো ওদের দুজনের ফোনে..”your tickets are booked, train will leave the Chitpur station at 7.10 am”.. হ্যালি সাথে সাথে ঘড়িটা দেখলো, চারটে বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট. “ব্রিফটাও একবার দেখে নিস্ বুঝলি! আমরা এবার নিজ ঘরে ফিরছি” বলেই আহান একবার চোখ মারলো। ট্রেন নির্দিষ্ট সময়েই ছাড়লো প্লাটফর্ম থেকে। সকালে প্লাটফর্মে পৌঁছে হাতে দু’ঘন্টার মতো সময় পেয়েছিলো, তখনই বিশ্রাম কক্ষের বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে স্টেশন থেকে অল্প কিছু খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিল ওরা।
    ট্রেনটা দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের দিকে।
    প্রথমে ফ্লাইট তার ওপর গাড়িতে আধ ঘন্টার কাছাকাছি জার্নি দুজনকেই বেশ কাবু করে ফেলেছে তাই আহান আর হ্যালি এখন নিজের নিজের সীটে গা এলিয়ে নিজের নিজের ফোনে ডুবে। অপারেশন স্পটটার ব্যাপারে একটু জেনে নিচ্ছে আর কি..
    “পেট্রাপোল হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত ইন্দো-বাংলাদেশ পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত চেকপয়েন্টের একটি। কলকাতা থেকে পঁচানব্বই কিলোমিটার দূরে জাতীয় সড়ক ৩৫-এর উপর অবস্থিত।”

    ট্রেনটা যখন পেট্রাপোল স্টেশনে থামলো তখন ঘড়িতে সাড়ে নয়টা ছুঁইছুঁই। আহানের পরনে এখন একটা পাজামা পাঞ্জাবি আর হ্যালির পরনে শাড়ি, কপালে সিঁদুর, হাতে নোয়া আর শাঁখা পলা। জায়গাটা সদর থেকে একটু ভেতরের একটি গ্রাম, বনগাঁ। এক্কেবারে বর্ডার লাগোয়া অঞ্চল। ওখানকার পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে এই সব পোশাকের ব্যবস্থা। স্টেশনের বাইরে একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। দুজনে নিজেদের মালপত্র নিয়ে তাতে গিয়ে বসলো।
    কুড়ি মিনিটের পথ, ট্যাক্সিটা ছুটে চলেছে যশোর রোডের ওপর দিয়ে। যখন নির্দিষ্ট গন্তব্যে ওরা দুজন পৌঁছালো তখন ঘড়িতে এগারোটা ছুঁইছুঁই। আশেপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু চাষের জমি আর মাটির বাড়ি। পাকা রাস্তা অনেক আগেই ছেড়ে এসেছে। এখন শুধু মাটির এবড়ো খেবড়ো পথ। এই সবের মধ্যে ওদের থাকার ব্যবস্থা একটা দোতলার পাকা বাড়িতে হয়েছে। ওপরওলা থেকে সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছে। এইটাই নাকি এই অঞ্চলের একমাত্র পাকা বাড়ি। বাড়ির মালিকের কাছে পরিচয় ওরা দুজন স্বামী-স্ত্রী, এখানে একটা জমি কিনতে এসেছে। জমি পছন্দ, আইনি কাজকারবার, আর জমি হস্তান্তর নিয়ে ওই মোটামুটি এক সপ্তাহ মতো থাকবে।
    ওদের পৌঁছনোর সাথে সাথেই বাড়ির মালিক শ্রীযুক্ত বনমালী বাবু বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। অমায়িক মানুষ, টাক মাথা, মোটা ঠিক না বলা গেলেও স্বাস্থ্যবান বলা যেতেই পারে। পরনে শুধু একটা ধুতি খালি গা.. ওনার পিছন পিছন ওনার স্ত্রীও বেরিয়ে এসেছেন। ভদ্র মহিলার গায়ের রং একটু চাপা, শারীরিক গড়ন বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ, শরীরে মেদের চিহ্ন মাত্র নেই। মাথায় ঘোমটার নীচে লাল রেখাটা বেশ জ্বলজ্বল করছে, এক মুখ হাসি… বনমালী বাবুই ওনার স্ত্রীর সাথে আহান আর হ্যালির পরিচয় করিয়ে দিলেন। নাম শ্রীমতি ভানুলতা দেবী‌। ভানুলতা দেবীই আহান আর হ্যালিকে ওদের দোতলায় থাকার ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে রান্না ঘরের দিকে গেলেন দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে।

    “দুপুরের খাওয়াটা বেশ হলো বল!” আহানের গলায় একটা পরিতৃপ্তির আভাস। হ্যালি এখন ঘরের ভিতরে পায়চারী করছে। “আচ্ছা আহান তুই খেয়াল করেছিস! আসার সময় মাটির এবড়ো খেবড়ো রাস্তাতে কতো গবাদি পশুর খুরের ছাপ ছিল!”
    “ওগো বঙ্গ ললনা…ভুলিও না! দেওয়ালেরও কান থাকে। নিজ স্বামীকে তাচ্ছিল্য পূর্বক সম্বোধোন করিলে সমাজ তোমারে মেনে নেবে না নারী!” কথাগুলো বলতে বলতে আহান খাটের উপর গিয়ে বসলো। ওর মুখ দেখলেই বোঝা যায় হ্যালির পিছনে লেগে ও কি হারে আনন্দ পেয়েছে। ওদিকে হ্যালি রেগে গিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আহানই ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “আরে তুই ঠিকই বলেছিস, কিন্তু এটা একটা গ্রাম না? দু’দিন থাকি সব কিছু দেখি শুনি তারপর আসল গল্প বোঝা যাবে..” আহানকে কথাগুলো শেষ করতে হলো না। বাইরে নিচের রাস্তা দিয়ে একদল গবাদি পশুর যাওয়ার আওয়াজ পেলো ওরা দুজন।দোতলায় ওদের ঘরটা ছাড়াও আরো দু’টো ঘর আছে, যদিও এখন সেগুলো খালি। এই তিনটে ঘরের সামনে দিয়ে একটা লম্বা বারান্দা। বাড়ির মালিক তাঁর পরিবারকে নিয়ে নিচের তোলায় থাকেন। অবশ্য পরিবার বলতে উনি আর ওনার বউ। নিঃসন্তান দম্পতি।
    আহান আর হ্যালি বারান্দায় চলে এসেছে। নিচে দিয়ে একটা বিশাল গবাদি পশুর দল নিয়ে পাঁচটা বাচ্ছা ছেলে যাচ্ছে। আহান ফিসফিস করে বললো, “দেখ বিকেল হয়ে গেছে, তাই ওই রাখাল বালকগুলো এই দলটাকে নিয়ে যে যার মালিকের বাড়ি ফিরছে।” ওরা এভাবে বারান্দায় যে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল নিজেরাই খেয়াল করে নি, এর মধ্যে ওরা এরকম আরো দু’টো দলকে ফিরতে দেখেছে। তার মধ্যে একটা দলের কিছুটা অংশকে নিয়ে দু’টো বাচ্ছা ছেলে বনমালী বাবুর বাড়িতেও ঢুকলো। সেটাও ওদের চোখ এড়ালো না।
    – “কি দেখছেন আপনারা!” পিছন থেকে বনমালী বাবুর গলার আওয়াজ।
    “না মানে, আমরা তো এরকম সুন্দর দৃশ্য কখনো দেখিনি তাই দেখছিলাম আর কি..” আহানই হেসে উত্তর দিলো।
    “তা তো বটেই! তা তো বটেই! আপনারা সব শহরের মানুষ.. এসব আর পাবেন কোথায়? চলুন চলুন খেয়ে নেবেন চলুন। গ্রামেগঞ্জে সবাই রাতের খাবারটা একটু তাড়াতাড়িই খেয়ে নেয় আর কি। ওদিকে আবার সকাল সকাল ওঠা। চলে আসুন…” কথাগুলো বলেই বনমালী বাবু সিঁড়ি দিয়ে নীচে যাওয়ায় জন্য অগ্রসর হলেন।

    রাতে খেয়ে আহান আর হ্যালি এখন নিজেদের ঘরে। ঘরের মধ্যে একটা নিস্তব্ধতা। দুজনেই মাটিতে দু’টো আলাদা আলাদা বিছানা করে শুয়ে আছে। দুজনের মাথাতেই একটাই চিন্তা..কোথা থেকে কাল শুরু করবে? আহান উঠে একবার বাথরুমে গেল.. হ্যালি মোবাইলে দেখলো সময় রাত এগারোটা।

    বাথরুমটা ঘরের সাথেই লাগোয়া। আহান লক্ষ্য করলো বাথরুমে দু’টো দরজা। একটা যেটা শোয়ার ঘরের সাথে যোগ আছে.. তাহলে অন্যটা কিসের? খুব সন্তর্পণে খুললো দরজাটা আহান। এটা পেঁচালো সিঁড়ি নেমে গেছে। ঠিক পাশেই একটা বড়ো কাঁঠাল গাছ। আর নীচে বনমালী বাবুর বাড়ির গোয়াল ঘরটা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা গেল না! আচ্ছা তার মানে এটা জমাদারের ব্যবহারের জন্য সিঁড়ি!

    দরজাটা বন্ধ করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে যখন ঘরে এলো তখন হ্যালি ঘুমে কাতর। আহানও গিয়ে চুপচাপ নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লো।

    হঠাৎ ঘুমের চটকাটা ভেঙে গেল নীচে গরু-বাছুরের ডাকে। উঠে বোঝার চেষ্টা করলো হ্যালি কি হচ্ছে ব্যাপারটা! ফোনের ডিজিটাল ঘড়িতে তখন প্রায় দু’টো। এতো রাতে কি ব্যাপার? কোনো চোর টোর নয়তো! নতুন জায়গা.. রিভলভারটা শাড়ির কোল আঁচলে লুকিয়ে নিয়ে খুব সন্তর্পণে ঘরের দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলো বারান্দায়। গোয়াল ঘরটা ঠিক কোনদিকে ওর জানা নেই। অচেনা অজানা জায়গায় এইভাবে হুটহাট করে নীচে যাওয়াটাও ঠিক না। আকাশ মেঘলা থাকায় চাঁদের আলো নেই বললেই চলে। হ্যালি এদিক ওদিক একটু খুঁজে দেখার চেষ্টা করলো। নাহ্ কিছুই নেই কোথাও। গরু-বাছুরের ডাকও ততক্ষণে থেমে গেছে। চারপাশে আরো একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে হ্যালি যখন ঘরে ফিরে এলো আহান তখন ভ্রূ কুঁচকে বসে কি যেন ভাবছে। “কি রে কি ভাবছিস” হ্যালির প্রশ্নে আহানের চমক ভাঙলো।
    -“না এতো রাতে হঠাৎ ওরকম শব্দ কেন হলো সেটাই অবাক করছে আর কি, তুই বাইরে কিছু দেখতে পেলি?”
    – “না রে.. যা শুয়ে পর !” বাকি রাতটা দুজনের নিরুপদ্রবে কাটলো।

    ভোরের সূর্যের সোনালী আলো যেন পুরো গ্রামটাকে সোনায় মুড়ে দিয়েছে। আহান বিভোর হয়ে গিয়েছিল সকালের এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেখতে, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে সে সচকিত হলো। বনমালী বাবু চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে উঠে এসেছেন,
    – “আমাদের এখানে সকালটা একটু তাড়াতাড়ি হয় অনিরুদ্ধ বাবু” একগাল হেসে আহনকে কথাগুলো বললেন তিনি।
    -“সে তো অবশ্যই” আহানও একটু হেসে জবাব দেয়।
    – “কাল রাতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো আপনাদের? তা আপনার স্ত্রীকে দেখছি না? উনি কি এখনো ওঠেন নি?” বনমালী বাবুর প্রশ্নে আহান এক মুহূর্ত ভাবে।পরক্ষণেই জবাব দেয়
    -“না আসলে নতুন জায়গা তো, তাই হয়তো একটু দেরি আর কি…” বনমালী বাবু হাসলেন।
    -“আচ্ছা জমির ব্যাপারটায় যদি একটু সাহায্য পাওয়া যেত মানে কোনো দালাল বা ওই জাতীয় কেউ যদি আপনার জানা থাকে” আহান থামলো।
    -“হ্যাঁ অবশ্যই, আমার পরিচিত একজন আছে নাম হরিহর। জমি নিয়ে ওর সাথে যোগাযোগ করাই সবচেয়ে ভালো। আমি ঠিকানা দিয়ে দেবো আর আমার নাম বললে তো কোনো অসুবিধাই হবে না। নিন.. আপনারা চা খেয়ে একটু ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে নিন আমি নিচে যাচ্ছি” বলে বনমালী বাবু নীচে নেমে গেলেন।
    ওদিকে আহান চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে যখন ঘরে প্রবেশ করলো তখন হ্যালি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।
    – “কালকের রাতের ঘটনাটা নিয়ে বনমালী বাবুকে কিছু জিজ্ঞাসা করলি নাকি?”
    -“একটু সবুর করো পত্নী প্রথম রাতেই এতো কৌতূহল..মালিককে জানানো ঠিক না” একটু রাশভারী গলায় কথাগুলো বলেই আহান হেসে ফেললো।

    ওরা যখন নিচে নেমে এলো ভানুলতা দেবী তখন বনমালী বাবুর সাথে কিছু কথা বলছিলেন। ওদের দেখেই হেসে বললেন, “কি শিবানী রাতে কোনো সমস্যা হয় নি তো?” হ্যালি হেসে উত্তর দেয়,
    -“না না এতো সুন্দর পরিবেশ, প্রথম দিনই উঠতে কিরকম দেরি হয়ে গেলো দেখুন” আহান ততক্ষণে হরিহরের ঠিকানা নিয়ে নিয়েছে বনমালী বাবুর কাছ থেকে।

    হরিহরের বাড়ি যখন ওরা পৌঁছালো এক যুবতী মেয়ে তখন উনুনে রান্না চাপিয়েছে ,দেখে হরিহরের বৌ বলেই মনে হলো..ওদের দেখেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো “কাকে চান বাবু ?” হরিহর বাবু ঘরে আছেন?” হ্যালি জিজ্ঞেস করে.. এমন সময় মেয়েটি রাস্তায় দেখিয়ে দিলো “ওই যে আসছেন”.. হরিহর আসতেই আহান তাকে সব খুলে বললো..শুনেই হরিহরের চোখে যেন একটা ঝিলিক খেলে গেলো..সে চটপট একটু হেসে বললো” একদম ঠিক লোকের কাছেই এসেছেন বাবু, আমি এই লাইনে অনেকদিন ধরে আছি. এমন খাসা জমি দেখাবো না যে একেবারে পছন্দ হতে বাধ্য.. এখনই যাবেন কি বাবুরা জমিটা দেখতে ??” “তা হলে তো মন্দ হতো না কি বলো গিন্নি??” আহানের প্রশ্নে হ্যালিও সম্মতি সূচক ঘাড় নাড়ালো একবার..হাঁটতে হাঁটতে হ্যালিই জিজ্ঞাসা করলো “আচ্ছা হরিহর বাবু !! এখানে সবাই কি শুধু গবাদিপশু পালন আর চাষবাসই করেন?” ” হ্যাঁ সবাই প্রায় একই কাজই করেন… গ্রাম তো বুঝতেই পারছেন তবে একটা ইস্কুল, একটা ছোট ডাকঘর আর একটা ছোট হাসপাতাল আছে, যদিও বেশিরভাগ শহুরে বাবুরাই ওখানে কাজ করেন, আর জানেন বোধহয় অল্প দূরেই ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার তাই পুলিশের পাশাপাশি আপনারা ভালো সংখ্যার মিলিটারিও দেখতে পাবেন মাঝে মাঝেই.. কথা বলতে বলতেই ওরা যে জায়গায় পৌঁছালো সেই জায়গাটা একটা ফাঁকা মাঠ..আশেপাশের জমি রয়েছে আরো.. সেগুলোতে চাষ করা রয়েছে.. কিছুটা দূরে একটা নদীর মতো বয়ে গেছে… কি শান্ত পরিবেশ.. আর তার পাড় বরাবর অনেকগুলো বড়ো বড়ো গাছের সারি… একটু দূরে একটা ছোট মাটির ঘরের মতো.. আহান সেই দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করাতে ” আরে ওটাতো পাম্প হাউস.. এই যে এত জমি দেখছেন এই সব জমিতে ওই খান থেকে জল সাপ্লাই হয়.. ওই যে জলধারাটা দেখছেন..ওটা আসলে এখানকার সাধারণ মানুষজনই ইছামতি নদী থেকে একটা খালের মতো কেটে নিয়ে এসে বানিয়েছে চাষের সুবিধার জন্য.. ওই জলেই এখানকার সব চাষবাস হয়…জানেন !! এই ইছামতি নদীটার একটা বিশেষত্ব আছে এই নদীটার একদিকে আমরা থাকি ওর অন্যদিকে বাংলাদেশ…. এখানে মিলিটারির টহল খুব একটা থাকে না.. এমনিতেই ভারত আর বাংলাদেশের সম্পর্ক খুবই ভালো তার ওপর আবার নদী.. বুঝতেই পারছেন!! হেঁ! হেঁ!” কথাগুলো নিঃশ্বাসে বলে হরিহর বাবু এখন বেশ হাঁপাচ্ছেন.. ওদিকে জমিটা আহান আর হ্যালি দুজনেরই বেশ পছন্দ হয়েছে.. এখন ওরা যাচ্ছে জমির মালিকের সাথে কথা বলতে.. জমির একদম কাছেই বাড়ি ভদ্রলোকের. নাম “বিশু”. নিতান্তই গরিব মুসলমান একজন চাষী…. লুঙ্গি পরে দাওয়ার বসে পান চিবচ্ছিলো…বেশ পেটানো শরীর.. ওদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন.. ওদিকে হরিহর বাবু বলেই চলেছেন.. “একে খরা জমি চাষবাস তেমন ভালো হয় না তার ওপর গত ক-মাস আগে ওর প্রায় পাঁচ খানা গরু-মোষ চুরি হওয়ার পর পেট চালানো দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে তাই এই শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রির চেষ্টা করছেন…” বিশু খাঁর সাথে যখন কথা বলে ওরা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলো তখন বিকাল হই হই.. দুজনেরই পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে…যানবাহনের ব্যবস্থা এখানে তেমন ভালো না.. আসার সময় একটা ভ্যান পেয়েছিল.. কিন্তু এখন দুজোড়া পা’ই সম্বল… অগত্যা ওরা বনমালী বাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো.. মাঝে একটা স্কুল বাড়ি আর একটা হাসপাতালও চোখে পড়লো ওদের.. হাসপাতালের সামনে একটা ঝুপড়িতে তখন গরম গরম কচুরি, সিঙ্গারা, চপ ভাজছে… আহান আর হ্যালি জোর কদমে এগিয়ে চললো সেই দিকে….

    খান ছয়-সাত কচুরি অবলীলায় পেটে চালান করে দুজনের মুখেই এখন একটু হাসি ফুটেছে। আশেপাশে আরো কিছু লোকজন বসে আড্ডা দিচ্ছে.. কানাঘুষো যা শোনা যাচ্ছে তাতে বেশ ভালো ভাবেই বোঝা যাচ্ছে এরা কাল রাতের গরু চুরি নিয়ে কিছু আলোচনা করছে। আহান আর হ্যালি দুজনেই আর লোভ সামলাতে পারলো না। গিয়ে একটু আলাপ করার চেষ্টা করলো। যদি কিছু জানা যায়! যা শুনলো তাতে দুজনেরই দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো। গত কয়েক মাস ধরেই নাকি কারোর না কারোর বাড়ি থেকে কখনো গরু কখনো মোষ কখনো ছাগল চুরি যায়। সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হলো.. চুরি যাওয়ার এক-দুমাসের মধ্যে নাকি আবার গবাদি পশুগুলো ফিরেও আসে নিজের নিজের মালিকের ঘরে। দু-এক সপ্তাহ পর আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। আবারো তারা ফিরেও আসে ঠিক সময়ে.. লোকাল পুলিশকে জানিয়েও কোনো কাজ হয় নি। মাঝে একবার মিলিটারিরা খানাতল্লাসি চালিয়েছিল কিন্তু কোথাও কিছু পাওয়া যায় নি। গভর্মেন্টের নাকি কোনো উদ্যোগক নেই। তাই সব যেমন চলার তেমনি চলছে।
    আহান ফিসফিস করে হ্যালিকে বললো, “এ আবার কেমন চোর রে? চুরিও করে আবার দুমাসের মধ্যে চোরাই মাল ফিরিয়েও দিয়ে যায়…উঁহু! ডালমে কুছ কালা হ্যায়!” হ্যালিও ওর সুরে সুর মিলিয়ে বললো “ঠিক বলেছিস আহান.. কেন জানি না মনে হচ্ছে এটা সোজা কেস না! দেখতে হচ্ছে তো ব্যাপারটা..”

    ১০

    ওরা যখন ঘরে ফিরলো তখন গ্রামের প্রতিটা বাড়িতেই সন্ধ্যার শঙ্খধ্বনি পড়ছে। বনমালী বাবুর বাড়ির কাজের লোক আহান আর হ্যালিকে বিকালের চা বিস্কুট দিয়ে গেল। সেগুলোকে সানন্দে গ্রহণ করে ওরা দুজন নিচের উঠানেই বসলো। বনমালী বাবু ঘরের ভিতরে কিছু একটা করছিলেন। আহান আর হ্যালিকে দেখে বেরিয়ে এলেন,”কি? পছন্দ হলো জমি?”
    একবারেই বাজিমাত..হরিহর সত্যি বোঝে খদ্দের কি চায়!” আহান বললো কথাগুলো।
    -“একদম! এত পছন্দ হয়ে গেলো যে সব ঠিকঠাক করেই এলাম একেবারে” হ্যালিও যোগ দেয়। এমন সময় ভানুদেবী গোয়াল থেকে ঘরে এলেন।ওদের দেখে সামান্য হেসে রান্নাঘরের দিকে গেলেন।
    -“আচ্ছা আসার সময় স্থানীয় মানুষদের কাছ থেকে গরু চুরি যাওয়ার কথা শুনছিলাম, আপনাদের কোনো ক্ষতি হয়নি তো?” চা খেতে খেতে হ্যালি জিজ্ঞাসা করলো।
    কথাগুলো শুনতে শুনতে বনমালী বাবু একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। আহানের হাতের স্পর্শে একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, “না না বনমালী বিশ্বাসের বাড়ি থেকে গরু সরাবে এত সাহস কার?”বলেই একটু হাসার চেষ্টা করলেন পরক্ষণে বলে উঠলেন “যাই একবার দেখেই আসি গোয়ালটা” বলে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন গোয়াল ঘরের দিকে..” আহান আর হ্যালিও একে অপরের মুখ চাওয়াচায়ি করে ওপরে চলে আসে।
    “একটু রেস্ট নিয়ে নে আজ রাতে এলার্ট থাকতেই হবে” আহান কথাগুলো বলে বাথরুমটা একবার ঢুঁ মেরে এলো।

    ১১

    রাত দু’টো
    বনমালী বাবুর বাড়ির পিছনের রাস্তা দিয়ে প্রত্যাশা মতোই কিছু গরুর পাল চলে যাচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আহান আর হ্যালি দুজনেই তৈরি ছিল। আহান বাথরুম লাগোয়া দরজাটা নিঃশব্দে খুলে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো। হ্যালি ওকে ছায়ামূর্তির মতো অনুসরণ করছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে..আহান মোবাইলে ফ্লাশ লইটটা জ্বালালো..”উমম কি দুর্গন্ধ!” হ্যালি ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে। আহান আর হ্যালি দুজনের পরনেই এখন কালো টি-শার্ট, কালো জিন্স সাথে কালো গামবুট.. হ্যালির হাতে ওর Smith & Wesson Model 500 রিভলভার অন্যদিকে আহানের Ruger Vaquero রিভলভারটা ওর পিঠের কাছে জিন্সের বেল্টের ভিতরে গোঁজা।

    ওরা বনমালী বাবুর গোয়াল ঘরটা দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে গোয়াল ঘরের পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে। সন্তর্পণে দুজনেই আশপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। আজ বিকালে বৃষ্টি হওয়ার দরুন মাটি এখনো একটু ভিজে আছে আর তাতেই গরুর খুরের ছাপ স্পষ্ট। এতো রাতে এইখানে গরুর খুরের ছাপ কেন? কোথায়ই বা যাচ্ছে এই গবাদি পশুর দলটা? কারাই বা নিয়ে যাচ্ছে? কেনই বা নিয়ে যাচ্ছে? আহান আর হ্যালি দুজনেরই চোখের দৃষ্টি তীক্ষ হয়ে উঠেছে। একটা যেন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে ওরা.. বেশি দেরি না করে ওরা গরুর খুরের ছাপগুলোকে অনুসরণ করতে লাগলো।

    দেখতে দেখতে আহান আর হ্যালি ইছামতি নদীর কাছে পৌঁছে যায়। একটু দূরে গবাদি পশুর দলটা রয়েছে একজন লোক একদম সামনে থেকে পুরো পালটাকে নিয়ে যাচ্ছে পিছনে দু’টো লোক পাহারা দেওয়ার কাজ করছে। পালটা নদীর কাছে যেতেই আরো কিছু লোক কথা থেকে এসে জড়ো হলো। একটু পরেই গরুগুলোকে ধীরে ধীরে নদীতে ছেড়ে দেওয়া হলো। হ্যালি আর আহান পাম্প হাউসের আড়ালে লুকিয়ে পুরোটাই লক্ষ্য করছে। অন্ধকারে লোকগুলোর মুখ ঠিক করে বোঝা গেল না। আকাশটা এখনো মেঘলা করে আছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তেও শুরু করে দিয়েছে। অগত্যা বাড়ি ফিরে আসা ছাড়া কোনো উপায় রইলো না।

    ১২

    -“গরু পাচার তো এখানে হামেশাই হয় কিন্তু হারানো গরু আবার ফেরত আসে কি করে? আর কেনই বা আসে” আহান ফতুয়াটা গা’য়ে দিতে দিতে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলো হ্যালির দিকে।
    ওদিকে হ্যালি এখন ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। মুখটা বেশ গম্ভীর, বোঝাই যাচ্ছে ও কিছু ভাবার চেষ্টা করছে।
    বাইরের মুষলধারে বৃষ্টিটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। রাতটা এভাবেই কেটে গেল। সকালেও বৃষ্টি কমার কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। এভাবে একটা পুরো দিন নষ্ট হবে সেটা ভেবেই আহান আর হ্যালির মুডটা একটু খিঁচড়ে আছে। দুপুরের সূর্য মাথার ওপর ওঠার সাথে সাথে বৃষ্টিটা একটু কমলো। বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে দুইমুর্তিতে বেরিয়ে পড়লো আশেপাশে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। এদিক ওদিক করতে করতে ওরা যখন হরিহর বাবুর বাড়ির সামনে এলো তখন হরিহর বাড়িতে নেই। তার বৌ যা বললো, তার অর্থ সকাল থেকে গ্রামের অনেকের গরুই পাওয়া যাচ্ছে না। এই কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টিটা ধরায় হরিহর বাবু একটু বেড়িয়েছেন। কিন্তু কোথায় গেছেন সেটা বলে যান নি।
    -“কোথায় যেতে পারে বলতো লোকটা?
    লোকটাকে কি ঠিক বিশ্বাস করা যায়? যাদের গরু চুরি গেছে তাদের সমবেদনা জানাতে গেছে না অন্য কোনো ধান্দা আছে বলতো? নেটওয়ার্কও যথেষ্ট ভালো লোকটার। এ পান্ডা নয় তো?” আহান কথাগুলো ফিসফিস করে বলে হ্যালির দিকে তাকালো।
    সন্দেহটা বেড়েই চলেছে। ফেরার পথে আবার বিশু খাঁর বাড়ি থেকে ঘুরে যাবে ঠিক হলো। লোকটার বাড়ি নদীর কাছেই প্রায় বলতে গেলে গরু চুরির কেসটা আরো একটু বিশদে জানলেও জানতে পারেন। বলেই ওরা দুজন বিশু খাঁর বাড়ির দিকে পা বাড়ালো,
    -“আজ রাতে আমাদের আগে থেকে স্পটে থাকতে হবে বুঝলি?” হ্যালিই বললো কথাগুলো। ওরা দুজনে যখন বিশু খাঁর বাড়িতে পৌঁছালো তখন সব পাখিরা যে যার বাসায় ফেরার তাড়ায়। বিশু খাঁ বাড়িতেই ছিলেন। আশানুরূপ কিছু পাওয়া গেলো না। যতদূর মনে হচ্ছে ভয় দেখিয়ে কেউ ওর মুখ বন্ধ করে রেখেছে।

    ১৩

    রাতে প্ল্যান মতো আহান একটু আগে বেরিয়ে চুপি চুপি নদীর পাড়ে একটা বড় আমগাছে উঠে বসলো। এখান থেকে চারদিকটাই বেশ ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে হ্যালি ওদের ঘরের পিছনের সিঁড়িতে কাঁঠাল গাছের আড়ালে দম বন্ধ করে লুকিয়ে রইলো। দুজনের কেউই জানে না এভাবে কতক্ষন থাকতে হবে। আদৌ আজ কিছু হবে কি না? মশার বেশ ভালো মতোই উপদ্রব রয়েছে। কামড়ে কামড়ে হাত পা পুরো ফুলিয়ে দিচ্ছে দুজনেরই। হ্যালি ওর হাতের ডিজিটাল ঘড়িটা একবার দেখে নিলো..সবে এগারোটা!
    হঠাৎ খসখস করে কি যেন একটা শব্দ হলো বনমালী বাবুর গোয়ালঘরটা থেকে। পঞ্চ ইন্দ্রিয় পুরো সজাগ হয়ে উঠলো হ্যালির। হাতে রিলভারটা তাক করে নিলো গোয়ালঘরটার দিকে। কে যেন এই দিকটাতেই এগিয়ে আসছে। হাঁটা চলার ধরণটা খুব চেনা চেনা লাগছে। বনমালী বাবু! তার মানে এই আসল কালপ্রিট? সিঁড়ি দিয়ে নিঃশব্দে নেমে এলো হ্যালি। বনমালী বাবু ঠিক ওর সামনে পিছন ফিরে সামনের দিকে হেঁটে চলেছেন, “হ্যান্ডস আপ! সব ফাঁস হয়ে গেছে বনমালী বিশ্বাস… You are under….” কথাটা শেষ করতে পারলো না, মাথায় সজোরে কেউ কিছু দিয়ে আঘাত করলো। বেশ কিছুটা রক্ত চুঁয়েচুঁয়ে কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। পিছন ফিরে দেখার চেষ্টা করলো হ্যালি…. চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কে এই ব্যক্তি?…রিলভারটা দিয়ে একটা গুলি করার চেষ্টা করলো.. পারলো কি পারলো না সেটা বোঝা গেল না। হাতের মুষ্টি আলগা হয়ে যাওয়ায় রিলভারটা কোথায় যেন পড়ে গেল। একবার কানের দুলটায় হাত দেওয়ার চেষ্টা করলো। আর জ্ঞান নেই…..

    ১৪

    গতকাল রাত থেকে বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়াটা বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। আহান ওর পিঠের ব্যাগটা থেকে ব্লিচিং পাউডার বার করে চারপাশে ছড়িয়ে দিলো। হঠাৎ কানের দুলটা থেকে একটা শক খেলে গেল আহানের…. হ্যালি! হ্যালি! শুনতে পাচ্ছিস? না কোনো উত্তর নেই… ঠিক আছে তো মেয়েটা? এখন থেকে যাওয়া এখন সম্ভবও না। আহানের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে কিছু একটা হতে চলেছে। যা ভেবেছে ঠিক তাই- কোথাও থেকে বেশ কিছু মানুষের গলার আওয়াজ। পাম্প হাউসের দিক থেকে যেন পাঁচ-ছয়টা ছায়ামূর্তি ওর গাছটার দিকেই এগিয়ে আসছে। নাহ্ এখনই কিছু করা ঠিক হবে না। ব্যাগ থেকে dslr ক্যামেরাটা বার করে তাতে চোখ লাগিয়ে বসলো আহান। প্রমাণ হিসাবে সব কিছু রেকর্ড করে রাখা দরকার। তার পর যা যা ঘটলো তা চাক্ষুষ করলে যে কোনো সাধারণ মানুষেরই হাড় হিম হয়ে যাবে।
    নদীতে সাঁতার কেটে উঠে আসছে চুরি হয়ে যাওয়া গরুগুলো শুধু গরু না সাথে মোষও আছে কিছু। সব মিলিয়ে প্রায় দশ- বারোটাতো হবেই সংখ্যায়। পাড়ে উঠে এসে সব দাঁড়িয়ে পড়লো। দেখে মনে হচ্ছে সব ট্রেনিং দেওয়া। লোকগুলো ওই গবাদি পশুগুলোর থেকে কিসব যেন নিচ্ছে আর ঝোলায় পুরছে। অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আহান আর অপেক্ষা করতে পারলো না। যদি অপেক্ষা করতে গেলে বেশি দেরি হয়ে যায়! কানের দুলটায় হাত দিয়ে ফিসফিস করে কি যেন বললো- তারপর ঝপাং করে লাফ দিয়ে নেমে পড়লো গাছ থেকে।

    ১৫

    হ্যালি বুঝতে পারছে ওকে কেউ বেঁধে কোথাও একটা ফেলে রেখে গেছে। চারপাশের দুর্গন্ধটা বেশ চেনা। তার মানে ও এখনো বনমালী বাবুর গোয়াল ঘরেই আছে। রিলভারটা খুঁজে পাওয়া দরকার। এই সব বাঁধন খোলার কৌশল ওর আর আহানের জানা। ওদের স্পেশাল ট্রেনিংয়ের সময়েই এইসব শেখানো হয়েছিল। চটজলদি নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে হ্যালি অন্ধকারে এলোপাথাড়ি ভাবে রিলভারটা খুঁজতে লাগলো। হ্যাঁ এই তো পেয়েছে… খড়ের গাদায় পড়েছিল। মাথাটা এখনো ঝিম ঝিম করছে..চোখে ঝাপসা দেখছে..কানের দুলটা দুবার নিচের দিকে হালকা টেনে কিসব যেন বলার চেষ্টা করলো হ্যালি। নাহ্ আহানের সিগন্যাল নিচ্ছে না। আরো একবার দুলটা টেনে হ্যালি কাউকে যেন বললো,
    – “হ্যালো হ্যালো… হ্যালি বলছি.. We need backup.. we need backup..” কথাগুলো শেষ করেই হ্যালি বনমালী বাবুর ঘরের উদ্দেশ্যে ছুটলো। নাহ্, সব আঁটে কাটে বন্ধ। মেইন দরজার বাইরে থেকে তালা ঝুলছে। তার মানে সব এখন নদীর পারে।আর বেশি দেরি করা ঠিক হবে না আহান ওদিকে একা আছে। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো হ্যালি।
    নদীর পাড়ে যখন পৌঁছালো ততক্ষণে আহান চারটেকে কাবু করে ফেলেছে। একটার সাথে তখনও ধস্তাধস্তি চলছে। লোকটার গায়ে বেশ জোর। ওদিকে আহানের আধুনিক কৌশল, পুরো সেয়ানে সেয়ানে লড়াই। গরু মোষগুলো তখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে চাষের জমিগুলো থেকে পেট পুজো করতে ব্যস্ত। একটু দুরে ধানক্ষেতের পাতাগুলো একবার নড়ে উঠলো না? হ্যালির তীক্ষ দৃষ্টি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ব্যাপারটা..
    হ্যাঁ ঠিক তাই, একটা বন্দুকের নল আহানের দিকে তাক করা..সাথে সাথে হ্যালির দো-নলা রিভলভারটা গর্জে উঠলো।

    ১৬

    পরেরদিন সকালে লোকাল থানায় বেশ জমজমাটি ভাব। লোকাল পুলিশ মিলিটারিতে চারপাশটা পুরো গিজগিজ করছে। আহান আর হ্যালি থানায় বড়োবাবুর কেবিনে বসে। ওদের ঘিরে আরো কিছু পুলিশ আর মিলিটারি দাঁড়িয়ে আছে।
    আহানের ক্যামেরাটা প্রজেক্টরে চলছে। ওটাই একটা সব থেকে বড়ো প্রমাণ এই স্মাগলিং কেসটার। আরো কিছু পুলিশ এসে বলে গেল যে সমস্ত বেআইনি হেরোইন, কোকেন উদ্ধার করা গেছে, সব নাকি ওই গবাদি পশুগুলোর চামড়ার ওপর একটা কৃত্রিম প্লাস্টিকের চামড়া লাগিয়ে তার ভিতরে করে বাংলাদেশে পাচার করা হতো। কখনো বা একই উপায়ে বাংলাদেশ থেকে জিনিসগুলো আমদানিও করা হতো। জেলের ভিতরে তখন আসামীরা। প্ৰধান অভিযুক্ত বিশু খাঁ আহানের মারে আধমরা হয়ে আছে আর বনমালী বাবুর স্ত্রী ভানুলতা দেবী হ্যালির গুলি খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি। বনমালী বাবুকে অবশ্য গ্রেফতার করা হয় নি। উনি আসলে এসব কিছুই জানতেন না। ওনাকে ভানুলতা দেবী রোজ রাতে খাওয়ার সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিতেন। হ্যালি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। আহান ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “আরে সেদিন রাতে তুই বনমালী বাবুকে দেখেছিলিস কারণ ওনার ঘুমের মধ্যে হাঁটা চলা করার স্বভাব আছে। ঘুমের মধ্যে এ রকম হাঁটাহাঁটি করাকে বলা হয় ‘স্লিপওয়াকিং’। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘সোমনামবুলিসম’ বা ‘নকচামবুলিসম’। আরে তুই যখন ওনাকে গোয়াল ঘরে যাওয়ার সময় আসলে কালপ্রিট ভেবে ধরতে যাস তখন পিছন থেকে ভানুলতা দেবী তোকে আক্রমণ করেন।বুঝলেন ম্যাডাম?”

    আহানের কথাগুলো শেষ হতে না হতেই বাইরে থেকে একজন হাবিলদার এসে বলে গেল ওদের জন্য কলকাতা থেকে গাড়ি এসেছে। ছোট্ট কুশলীবার্তা সবার সাথে বিনিময় করে যখন আহান আর হ্যালি গাড়িতে এসে বসলো তখন দুজোড়া চোখ যেন আনন্দে আরো একবার চিকচিক করে উঠলো।

  • গল্প

    গল্প- শিখন্ডী’র অন্য পণ

    শিখন্ডী’র অন্য পণ
    – দ্যুতিপ্রিয়া বন্দোপাধ্যায়

     

     

    “আরে এই যে শুনছেন! ওইদিকে একটু সরে দাঁড়ান তো! সকাল সকাল যতসব উটকো ঝামেলা।”
    ভিড় বাসে পিছন থেকে একজন ভদ্রলোকের গলা…অবশ্য এটা নতুন কিছু না… সমাজে ওর মতো মানুষরা যে কোনো ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না সেটা ভালো করেই জানে শিখন্ডী, মানে শিখন্ডী বনলতা দত্ত. বনলতা নামটা অবশ্য শিখন্ডীর মায়ের নাম…

    তথাকথিত এক উচ্চ বংশে জন্ম শিখন্ডীর, সম্ভ্রান্ত পরিবার.. যখন তিনবারের বারও ছেলে হলো না তখন পরিবারের সবার মুখে আঁধার নেমে এলো। গুরুজনদের গলা দিয়ে ভাত নামানোর জন্য পঞ্চাশের স্বনামধন্য শ্রী দেবাশীষ দত্ত এবং ওনার বয়সের তুলনায় দশ বছরের ছোট সহধর্মিণী শ্রীমতি বনলতা দেবীর আরো একবার চেষ্টা করলেন। দেবাশীষ বাবুর বিধবা মা পাড়ার জাগ্রত মা বিপদতারিণীর কাছে মানত করলেন, “দেখো মা! এবার যেন একটা বংশ প্রদীপ পাঠিও মা.. কূলে বাতি দেওয়ার কেউ নেই মা।” যাই হোক- দশ মাস দশ দিন পর বনলতা দেবী লেবার রুমে। আগের তিনবারের তুলনায় প্রসব বেদনাটা যেন সত্যিই ভীষণ বেশি। বয়সের বাধাটা নিজে বুঝতে পারলেও বাকিদের কাছে ছিল “ছেলে হওয়াতে গেলে একটু তো কষ্ট পেতে হবে..!” টানা আধা ঘণ্টা ধরে সমস্ত কষ্টকে দাঁতে দাঁত চেপে যখন বনলতা দেবী একজন বালকের জন্ম দিলেন তখন পরিবারে খুশির বন্যা বয়ে গেলো। ঠাকুমা বড়ো শখ করে নাতির নাম রাখলেন, “দীপজ্যোতি দত্ত”

    দীপের দশ বছরের জন্মদিনটা পেরোনোর পর পরই দেবাশীষ বাবু আস্তে আস্তে বুঝতে পারলেন যে তাঁর ঘরে কোনো ছেলে না বরং চতুর্বার কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্য রকমের।
    জন্মের পর থেকেই ও একটু অন্য রকমের বলে শুধু বাবার বাড়ি না মায়ের বাড়িতেও ওকে কেউ গ্রহণ করে নি। অগত্যা নিরুপায় বনলতা দেবী বারো বছরের দীপজ্যোতিকে নিয়ে এসে পৌঁছেছিলেন দার্জিলিংয়ের এক ছোট্ট গ্রামে,”তিনচুল” সেখানেই ওর দীপজ্যোতি থেকে শিখন্ডী হয়ে ওঠা… সেখানেই ওর বুঝতে শেখা যে আর পাঁচটা মানুষের থেকে ও কতটা আলাদা…ওদের মতো মানুষদের অনেক নাম আছে, তবে ভালো ভাবে বললে ওদের মতো মানুষগুলো হলো ভগবান শিব-পার্বতীর অর্ধ-নারীশ্বর রূপের অংশবিশেষ।

    ভিড় বাসে একটু এদিক ওদিক করে কোনো রকমে পাশ কাটিয়ে এককোনায় এসে দাঁড়ালো শিখন্ডী…. পরনের শাড়ীটা ঘামে ভিজে চপচপ করছে।
    ধর্মতলার মোড়ে যখন বাসটা থামলো,হুরহুর করে বেশ কিছু মানুষ নেমে পড়লো। দূরের একটা বসার জায়গা খালি দেখে সেদিকে পা বাড়ালো শিখন্ডী। বাসের জানালা দিয়ে একটা ফুরফুরে হওয়া বারবার ওর লম্বা চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। ছয়ফুটের একটা মানুষকে শাড়ি আর লম্বা চুলে দেখতে স্বভাবতই এখনো যে কেউ খুব একটা অভ্যস্ত নয় সেটা আর বলে দিতে হয় না। মনে মনে একটু হাসে শিখন্ডী।

    “দাদা দেখি… দিনদিন একটু বার করুন…”
    “শালা 10 টাকায় কি হবে রে…? দে দে ওই 50 টাকার নোটটা দে দিকি!”
    পরিচিত সব গলার শব্দ…সাথে কান জ্বলিয়ে দেওয়া কুৎসিত হাতের তালি… অসহ্য!
    আড় চোখে ওরই গোষ্ঠীর ভাই-বোনদের একটু দেখে নিয়ে বাইরের দিকে তাকায় শিখন্ডী। আজকাল কেমন যেন জোরজুলুম হয়ে গেছে। ও ভেবে পায় না…ওর মতো মানুষদের কেন এরকম করে টাকা রোজকার করতে হয়।

    ওর এখনো মনে আছে, ছোটবেলায় ওর ব্যাপারটা লোক সমাজে জানাজানি হওয়ার পর কিছু মানুষ এসেছিল ওকে ওদের গোষ্ঠীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্ত বনলতা দেবীই একরকম জোর করে ওদের সাথে যেতে দেন নি। একবার ওই গন্ডি পেরোলে যে সেখান থেকে ফিরে আসার কোনো পথ নেই।সেই তখন থেকেই চলছে মা আর ছেলের লড়াই। স্কুলে পড়ার সময় নিজের নামের থেকে “ছক্কা” বা ” আরে ওই লেডিস” এই সম্বোধন বাণীগুলোই বেশি সরগর ছিল।

    তাই স্কুলের গন্ডির পর, কলেজের পড়াশুনা সে distance থেকেই করেছে। জুওলজিতে অনার্স, তার পর মাস্টার্স.. ইচ্ছা করেই জুওলজি নিয়েছিল জানার জন্য যে শারীরিক গঠনগত দিক ছাড়া আর কি পার্থক্য থাকে সাধারণ মানুষের থেকে। কেন ওরা স্বাভাবিক জীবন বাঁচাতে পারে না?তারপর দু’বার স্কুল সার্ভিসের পরীক্ষা দিয়েছিল। ভালো নম্বর পেয়ে পাশ করলেও চাকরিটা হয়নি তার শারীরিক গঠনগত কারণে।

    ততদিনে বনলতা দেবীও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তারপর থেকেই এই যুদ্ধটা শিখন্ডীকে একাই করতে হচ্ছে … কখনো মুখ্যমন্ত্রীর সংসদে কখনো স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে কখনো বা সুপ্রিমকোর্টের ঘোরপাকে দিন কেটে যাচ্ছে। লক্ষ্য একটাই “ওদের মতো মানুষদের সুবিচার দেওয়া”… সেই উদ্যেশ্যে আজও চলেছে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী উভয়েরই সাথে একবার দেখা করতে।

    সরকারি বাসের একটা জাঁদরেল ঝাঁকুনিতে মনের মধ্যে জমতে শুরু হওয়া ভাবনার জালে বেশ ভালোমতোই ব্যাঘাত পড়লো। “আরে দু’টো স্টপেজ পরেই তো শিবপুর মন্দিরতোলা…!” নিজের বসার জায়গাটা ছেড়ে উঠে দরজার কাছে এগিয়ে এলো। যদিও বাসে তেমন ভিড় নেই। তাও পাশে একজন দাঁড়িয়ে থাকা এক কলেজ পড়ুয়াকে বসার জায়গা করে দেয় ও।

    মিটিং সেরে বেরিয়ে আসতে আসতে মোটামুটি দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। সূর্যের তাতে মাথা পুরো ঝাঁঝাঁ করছে। কাজ মিটলে তবু না হয় কথা ছিল! শিক্ষামন্ত্রী পাশে থাকলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সেভাবে মানানো গেল না।

    যত দিন যাচ্ছে সব আশাগুলো কেমন যেন আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। পাশে নিজের বলতে কেউ নেই। চোখটা একটু ঝাপসা হয়ে এলো। দু-ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ল সবার অগোচরে।

    হাওড়া স্টেশন! হাওড়া স্টেশন!

    নাঃ আজই ফিরে যাবে তিলচুলে। কোথাও যখন কিছু হওয়ারই নেই আর যে মানুষগুলোর জন্য এত কিছু করার চেষ্টা তাদেরই যখন কোনো হেল দোল নেই তাহলে নিজের জীবনটাকে একটু নিজের মতো করে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে আর কি!
    বাসে পা-দানিতে পা’টা দিতেই যাচ্ছিলো শিখন্ডী.. হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো।

    অগত্যা বাসটা ছেড়ে দিয়ে একটু পাশে এসে ফোনটা ধরলো। তারপর বাকিটা ইতিহাস.. আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি।

    বিশ বছর পর ও এখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সমাজ সেবামূলক কাজের ডিপার্টমেন্টটা হ্যান্ডল করছে। বেশ বড় পোস্ট। বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। ওদের মতো মানুষদের পাশাপাশি এখন গরিব, দুঃস্থ, বৃদ্ধ মানুষ আর অসহায় মেয়েদের পাশে থাকাই ওদের সংগঠনের কাজ। তবে এখনো মাসের শেষে যখন মাহিনাটা ব্যাংক account এ ঢোকে তখন একটা খুশির সাথে সাথে পুরোনো জেদটা যেন আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়-
    “লড়াইটা যে এখনো অনেকটা বাকি..”

  • ধারাবাহিক

    অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-৩)

    অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-৩)
    -দ্যুতিপ্রিয়া ও অর্কপ্রভ

     

     

    (১২)

    খসখস শব্দটা বেড়েই চলেছে। যেন কোনো ভারী জিনিস টেনে নিয়ে আসছে কেউ। হিংলা সন্তর্পণে এগোচ্ছিল। পিছন থেকে এরকম একটা শব্দ শুনে ঝপ করে একটা ঝোপের ভিতর লুকিয়ে পড়লো। বেশ কিছুটা দূরে দেখলো একই রকম আরো একটা পথ ডান দিক থেকে এসে তার পথের সাথে মিশেছে। একজন মানুষ ওই পথ দিয়েই এগিয়ে আসছে। একটু কাছে আসতেই সে হতভম্ব হয়ে গেল। এ যে পিংলা! তার ভাই বেঁচে আছে? কিছুই হয়নি তার- কি সুন্দর হাঁটছে! হিংলা চিৎকার করে তাকে ডাকতে গিয়েও পারল না। সে এরপর যে দৃশ্য দেখে ফেলেছে, তাতে তার হাত পা রীতিমতো ঠান্ডা হয়ে গেল। একটা মানুষকে টেনে টেনে পিংলা নিয়ে যাচ্ছে। কি হারহিম করা দৃশ্য! কিন্তু কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কেনই বা নিয়ে যাচ্ছে? হিংলার কিছু মাথায় ঢুকলো না। সে অপেক্ষা করতে লাগলো এবং একটু তফাতে থেকে তার ভাইকে অনুসরণ করতে লাগলো। লোকটা ঘষটে ঘষটে চলেছে.. বেঁচে আছে কিনা সেটা বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। হঠাৎ হিংলার মাথাটা ঘুরে গেলো। লোকটির জামার রংটা তো..এ যে দাদাবাবু! সে আর এক মুহূর্ত ভাবতে পারলো না। মনের সমস্ত জোরকে একজায়গায় করে
    শ্বাস রুদ্ধ করে অনুসরণ করতে লাগলো। বেশিক্ষণ যেতে হলো না। একটু দূরেই একটা পুরোনো কাঠের বাড়ি দেখতে পেলো হিংলা। বেশ বড় বাড়ি। কাছাকাছি যে সমুদ্র রয়েছে সেটা হিংলা বেশ ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছে। পিংলা আহানকে নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়িটার ভিতরে ঢুকে গেল। হিংলা কাকেই বা খবর দেবে আর কিভাবেই বা খবর দেবে! ভেবেও কোনো উপায় বার করতে পারলো না। এই অবস্থাতে পিছিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। অগত্যা সে পিংলার পিছু পিছু ঘরটার ভিতরে ঢুকে পড়লো

    (১৩)

    ওদিকে আহান আর হ্যালি ধীরে ধীরে জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। কিছুদুর এগিয়েই তারা দেখলো সামনের পথটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। কোন দিকে যাওয়া যায়! হ্যালি বললো, “তুই বাঁ দিকটা দেখ আমি ডান দিক দিয়ে এগোচ্ছি। কোনো বিপদের গন্ধ পেলেই সিগন্যাল দিয়ে দিস..” আহানও আর আপত্তি করলো না। আহান ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। সতর্ক দৃষ্টি চারদিকে বোলাচ্ছিলো সে। হঠাৎই বেশ খানিকটা দূরে লোকটিকে দেখতে পেলো। যে সাধুর সাথে কথা বলছিল আহানের দিকে পিঠ করে সামনের দিকে হেঁটে চলেছে। আহান বার দুয়েক ডাকলো লোকটাকে, কিন্তু লোকটা যেন একবারও শুনতেই পেলো না। আহান এবার তাড়াতাড়ি পা চালায়।একে যেভাবেই হোক ধরতে হবে। সে ঠিক লোকটির পিছনে এসে কাঁধে হাত দিয়ে বললো, “ও ভাইয়া,শুনাই নাহি দে রাহা হ্যায় কেয়া?”
    আহানের কথায় এবার সে পিছন ঘুরে তাকালো। কিন্তু কি অদ্ভুত! চোখগুলো অস্বাভাবিক রকমের স্থির। আহনকে দেখেও মুখোভঙ্গির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না তার। হঠাৎ করে সে জাপটে জড়িয়ে ধরে আহনকে। এরকম যে হতে পারে আহান কল্পনাও করে পারেনি। বিন্দুমাত্র গলার স্বর বের করতে পারল না। দম যেন ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে। দু’ একবার চেষ্টা করলো কানের দুলটা স্পর্শ করে হ্যালিকে সিগন্যাল পাঠানোর। পারলো না..একটা সময় লোকটি বাঁধন আলগা করে দিলো..আহান লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। লোকটি আহনকে টানতে টানতে সামনের দিকে এগিয়ে চললো।

    (১৪)

    এদিকে হ্যালি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। কিছু দূর গিয়ে সে পথের মধ্যে অদ্ভুত একটা জিনিস লক্ষ্য করলো, “আরে এ তো গাড়ির চাকার দাগ, জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি কোথা থেকে এলো?”
    এবার ও ওই দাগ ধরে এগোতে থাকলো। বেশ কিছুটা এগিয়ে সে দূরে একটা পুরনো কাঠের বাড়ি দেখতে পায়। এখন সে নিশ্চিত ! যে এখানে কোনো না কোনো গুপ্ত কাজকর্ম নিশ্চই হয়। ধীরে ধীরে হ্যালি বাড়িটার সামনে এসে হাজির হয়। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই কেন? কোনো দরজাও নেই! এটা কি পিছন দিক? সে ঠিকই ধরেছে। একটু সামনের দিকেই বড়ো দরজা দেখতে পায় হ্যালি। ওখানে বেশ কয়জন ঘোরাঘুরিও করছে। ওদের চলাফেরা কেমন যেন যন্ত্রের মতো। কাছেই দু’টো জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে। এখন হ্যালির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় পরিস্কার বলছে কিছু একটা হতে চলেছে। সে তাড়াতাড়ি কানের ঝুমকোটার হালকা নিচের দিকে টেনে কি সব যেন ফিসফিস করে বললো।
    আহানের কাছে থেকে আগে শুনেছিল এরকম কোন পরিস্থিতিতে সবকিছু ভালো করে দেখে শুনে তারপর পদক্ষেপ নিতে হয়। তাই বাড়িটার ভিতরে ঢোকার কথা ভেবেও হ্যালি থমকে দাঁড়ালো। ঠিক তো জায়গাটা আগে ভালো করে জেনে নেওয়া ভালো। ওদিকে অন্ধকারও হয়ে এসেছে। সারাদিন ধরে হাঁটাহাঁটি করে পাগুলো একটু লাগছে। তাই হ্যালি চটজলদি বাড়িটার একটু পাশে একটা বড় গাছের ওপর উঠে বসলো। এখন থেকে বাড়িটার সামনে পিছনে দুটোই ভালো করে লক্ষ্য করা যাবে। মাথায় তখন ঘুরছে.. কি হয় জঙ্গলের ভিতরে? কি আছে এই বাড়িটাতে? তাহলে কি সত্যি সেই দিন সেই ব্ল্যাকমেইল চিঠিটার চামড়াটা কোনো মানুষের ছিল? আহনকে কথাটা বলবো বলবো করে বলাই হয় নি। ভাবনায় ব্যাঘাত পড়লো যখন হঠাৎ শুনতে পেল কাছে কোথাও জাহাজের সাইরেন বাজছে।

    (১৫)

    আহানের কানের দুলটা বারবার করে আহনকে হালকা একটা ইলেক্ট্রনিক শকের মতো দিচ্ছে। একটা মেয়ের গলা “There is something wrong.. meet me near to that house in the jangal” অবশ্য এই কথাটা শুধুমাত্র আহানই শুনতে পাচ্ছে।
    আহানের ততক্ষণে হালকা হালকা জ্ঞান ফিরেছে। ভালো মতো বুঝতে পারছে ওকে একটা ঘরে রাখা হচ্ছে। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে মনে হচ্ছে কি যেন একটা পড়ে আছে। ওঠার চেষ্টা করলো, না.. হাতগুলো পিছনে মুড়িয়ে শক্ত করে বাঁধা.. পা’টাও বাঁধা.. চোখটা হালকা ধাতস্থ হয়ে গেছে অন্ধকারে। জিনিসটা কেমন নড়ে উঠলো না! কোনোরকমে নিজেকে টানতে টানতে আহান জিনিসটার কাছে এলো। আরে এ জিনিস কৈ? এত হিংলা! ও এখানে কি করে এলো? হ্যালি কোথায়? হঠাৎ কানে আবার একটা হালকা ইলেক্ট্রনিক শক সাথে সেই মেসেজটা “There is something wrong.. meet me near to that house in the jangal” যতক্ষণ না আহান কোনো উত্তর দিচ্ছে ততক্ষণ ওকে এরকম শক দিয়ে যাবে। আহান আস্তে আস্তে হিংলাকে ডাকলো, “হিংলা উঠ.. তু ইধার ক্যায়সে আয়া?” আহানের দু-তিনবার ডাকায় হিংলাও একটু নড়েচড়ে উঠলো। “দাদাবাবু! তুমি ঠিক হ্যায় না? দিদিমণি কিধার হ্যায়?” হিংলা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল হঠাৎ কাছাকাছি কোথাও একটা জাহাজের সাইরেনের শব্দ দুজনকেই বেশ আশ্চর্য করে তুললো।

    (১৬)

    জানি না এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে। ওদিকে আহানেরও কোনো উত্তর আসছে না। হ্যালি একটু বিচলিত হয়ে পড়লো। পূর্ণিমার চাঁদ ততক্ষণে মধ্য গগনে বিরাজমান। চারদিকটা বেশ ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ কোথা থেকে আরো দু’টো জিপ আসে দাঁড়ালো বাড়িটার সামনে। বাড়ির ভিতর থেকে বেশ কয়েকজন বড়ো বড়ো দুটো কাঠের কফিনের মতো কিছু গাড়িতে তুলে দিল। জিপ দু’টো যেদিক দিয়ে এসেছিল আবার সেই দিকে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো।
    হঠাৎ একটা হাল্কা ইলেক্ট্রনিক শক হ্যালিকে আবার উত্তেজিত করে তুললো। আহান reply দিয়েছে !
    “আমি আর হিংলা বাড়ির ভিতরে… বিপ বিপ…. আমি আর হিংলা বাড়ির ভিতরে.. we are trapped ” ব্যাস কেটে গেল। সিগন্যাল প্রবলেম.. আর কিছু শোনা গেল না।

    হ্যালি এবার আস্তে আস্তে গাছ থেকে নেমে এলো। বাড়ির ভিতরের সব আলোগুলো ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। খুব সন্তর্পণে হ্যালি জিপ গাড়িগুলো যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে এগিয়ে চললো। বেশিক্ষণ যেতে হলো না। আস্তে আস্তে জঙ্গলটা কেমন যেন শেষ হয়ে আসছে‌। দূরে গাছের ফাঁক দিয়ে নীল জলরাশি যেন হ্যালিকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ওই তো দূরে জিপ গাড়ি দু’টো তখন দাঁড়িয়ে আছে। কাছেই একটা বেশ বড় মতো স্টীমারও দাঁড়িয়ে। বেশ কিছু লোকজনও রয়েছে। অন্ধকারে এত দূর থেকে ভালো করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। নাহ্, আর কাছে যাওয়া যাবে না। ওদিকে সমুদ্র সৈকতে ধু ধু বালির ওপর কোথাও লোকানো যাবে না। অগত্যা এখানে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

    (১৭)

    হিংলার সাহায্যে নিজের হাতের বাঁধনটা খুলে তরিতঘড়িত হ্যালিকে সিগন্যাল পাঠালো আহান তারপর নিজের পায়ের বাঁধন সাথে হিংলাকে বাঁধনমুক্ত করে ঘর থেকে বেরোনোর উপায় খুঁজতে লাগলো। না, এরা অতটাও বোকা না। ঘরে কোনো জানালা নেই, একটাই দরজা সেটাও বাইরে থেকে বন্ধ। কেউ যেন ওদের ঘরের দিকেই আসছে। দুজনে দরজার দুই ধারে নিঃশ্বাস বন্ধ করে লুকিয়ে থাকলো। ওদের ঘরের বাইরে কেউ যেন কাউকে বলছে, “শুন আজ দো আদমি আয়ে না.. উন যে সে জো শহরকে আদমি আছে উস্কো হামলোগ ইধার রাখ দেঙ্গে। দেখ কর বহুত সেয়ানা লাগতে হ্যায়। বাদমে বাহুত কাম আয়েগা। দুসরে কো চালান কর দেঙ্গে। নাজার রাখ দোনোকে উপর। কাল শুভা শহরওলা আদমি কো লাবরেটরি মে লেকের আনা। থোড়া রিসার্চ কারনা হ্যায়…..” বলে লোকটা যে দিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে আবার চলে গেল।

    “গলার আওয়াজটা কেমন চেনা চেনা লাগলো না দাদাবাবু?” হিংলার এই কথাটা আহানের অনেক আগেই মাথায় স্ট্রাইক করেছে…”হু” বলে একটা সম্মতি জানায় আহান। কোথায় শুনেছে এই গলাটা? হঠাৎ মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে গেল “আরে এটা তো সাধুর গলা না!”
    “তার মানে সাধুটাই আসল কালপ্রিট! কিন্তু লাবরেটরি কেন? কিসের চালান? কোথায় চালান করবে হিংলাকে” এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে ভোর হয়ে গেছে আহান খেয়াল করে নি। হিংলা একটু দূরে ঘুমে কাতর। হঠাৎ কেউ একজন এসে দরজা খুলে দিলো। একজন ভিতরে প্রবেশ করলো, আরে! এটা কি সত্যি সেই সাধুটা? উহু! তা কি করে হয়? এর তো পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি। সাধুর তো পরনে ধুতি ছাড়া কিছু ছিল না! তাহলে কি এ সাধুটার যমজ ভাই? নাহ্ ব্যাপারটা দেখতেই হচ্ছে! লোকটা এখন আহানের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আহানও এক দৃষ্টে সাধুটাকে দেখছে। এ যেন এক ঠাণ্ডা লড়াই। হঠাৎ লোকটা দু’টো চেলাকে বললো, “ইসকো লে চলো, টাইম নেহি হ্যায় হামারে পাশ” কথাটা শেষ হতে না হতেই দু’টো চেলা এসে আহনকে জাপটে ধরলো। রীতিমতো ঠেলা দিতে দিতে ওকে নিয়ে এলো দোতলার একটা কোণের দিকে ঘরে। বেশ বড়ো ঘরটা- নানা রকম মেশিন, কেমিক্যাল, লাবরেটরির টুকটাক জিনিসে ভর্তি।
    আহান আসতে আসতে খেয়াল করেছে বাড়িটার আরো পাঁচ থেকে সাতটা ঘর আছে। সব ঘরই বাইরে থেকে তালা বন্ধ।আশেপাশে কম করে দশটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, যন্ত্রের মতো যে যার কাজ করছে।
    “ইধার বিঠাও উস্কো” লোকটার গম্ভীর আওয়াজে আহানের সম্বিৎ ফিরলো। দুই চেলা ততক্ষণে ওকে চেপে ধরে একটা চেয়ারের ওপর বসিয়ে দিয়েছে। একটু অদ্ভুত রকমের এই চেয়ারটা। কত ইলেক্ট্রিক তার।

    (১৮)

    সারারাত একভাবে ঠায় সমুদ্রের কিনারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ভোর হয়ে গেছে খেয়াল করে নি হ্যালি। আশেপাশেটা একবার ঝট করে দেখে নিয়ে ছুটলো জিপগুলোর দিকে। লোকগুলো সব মরার মতো ঘুমাচ্ছে। ওদিকটায় স্টীমারটাও দাঁড়িয়ে। লোকগুলোকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে, নিজের নাকে একটা রুমাল চাপা দিয়ে নিজের পিঠের ব্যাগ থেকে একটা কিছুর স্প্রে বার করে লোকগুলোর চারদিকে ছড়িয়ে দিলো- ক্লোরোফর্ম ! দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো স্টীমারটার দিকে। এই রে একটা লোক উঠে গেছে! হ্যালির দিকে পিছন ফিরে সমুদ্রের দিকে কি যেন দেখছে। হ্যালি চুপি চুপি গিয়ে লোকটার ঘারের কাছে এক রদ্দা মারলো। লোকটা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। লোকটাকে ডিঙিয়ে হ্যালি এবার স্টীমারের সব ঘরগুলো সার্চ করতে থাকলো। ওর জায়গায় আহান থাকলে ঠিক এভাবেই করতো নিশ্চয়ই। না, কোথাও আর কেউ নেই। স্টিমারের একটা জায়গার মেঝেতে পা দিতেই কেমন যেন নড়ে উঠলো সুড়ঙ্গ পথ! তারমানে গুপ্ত কক্ষ আছে স্টীমারটায়। একটু এদিক ওদিক দেখে নিয়ে নেমে পড়লো হ্যালি। পঞ্চ ইন্দ্রিয় পুরো সজাগ। একটু যেতেই হ্যালির কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগতে লাগলো। যত এগোচ্ছে ততই যেন ঠান্ডা ভাবটা বাড়ছে। একটু এগিয়েই একটা ঘর দেখতে পেলো, না ঠিক ঘর না। একটা কোল্ড রুম, কিন্তু এখানে কোল্ড রুম কেন? দু’বার না ভেবেই ঢুকে পড়ল হ্যালি। চারপাশে সব বড়ো বড়ো ডীপ ফ্রীজার। একটা ফ্রীজের ঢাকনা খুললো। তারপর আবার একটা.. এই করতে করতে প্রায় সব ফ্রীজেরই ঢাকনাগুলো খুলে ফেললো হ্যালি। রক্ত জল করে দেওয়ার দৃশ্য। এত human অর্গান! এগুলো আসে কথা থেকে? এরাই বা এগুলো পায় কথা থেকে! নাহ্, সময় নষ্ট করলে চলবে না। কানের দুলটা থেকে আবার একবার বিদ্যুৎ খেলে গেল… আহানের মেসেজ.. ” be carefull .. be carefull.. Apply Plan B “

    (১৯)

    লোকটা এবার এগিয়ে আসছে আহানের দিকে। চেলাগুলো এতক্ষণে ওকে ছেড়ে দিয়ে একটা দিকে সরে গেছে। আহান নিজের মনের সব জোরটা দিয়ে এক দৃষ্টে লোকটার দিকে চেয়ে আছে। একটু পরেই লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। যাক অপেরাশন successfull বাঁচার একটাই পথ খোলা ছিল “হিপনোটাইজ” কিন্তু যারা এই কৌশলটা আগে থেকে জানে তাদের করা একটু শক্ত ব্যাপার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কি হলো ব্যাপারটা! আহান একটু হকচকিয়ে গেল। তার মানে ও যেটা ভেবেছিলো সেটাই সত্যি, এই লোকটা ওই সাধুটার যমজ ভাই। নাহ্, হাতে একদম সময় নেই। হ্যালিকে সিগন্যাল পাঠিয়ে, আহান ছুটলো নিচে অন্য ঘর গুলোর দিকে। বাইরে বেরোনোর আগে সবটা দেখে শুনে নেওয়াই ভালো। নীচে ততক্ষণে হিংলাও দরজা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে বদ্ধ ঘরটা থেকে। লোকটাকে এভাবে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে বাকি যান্ত্রিক মানুষগুলোর মধ্যে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব… সবাই দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছোটাছুটি করছে। সব ঘরগুলোই ওই যান্ত্রিক মানুষগুলোর থাকার ঘর। কিছু নিজেদেরও জন্যও বটে। পিঠের ব্যাগটা থাকলে না হয় মাস্টার কি দিয়ে দরজাগুলো খুলে দেখা যেত। কিন্তু ব্যাগটা এরাই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। ব্যাগটাকে খোঁজার জন্য তখন আহান আকুল। হিংলা বারবার বললেও আহানের সে সাবধানবাণীতে কোনো খেয়াল নেই। হঠাৎ ওরা দুজন তুলনামূলক একটা বড়ো ঘরে ঢুকলো। অনেকটা অপারেশন থিয়েটারের মতো। এখানে অপেরাশন থিয়েটার কেন? আহানের মনে হচ্ছে সত্যি এবার ও পাগল হয়ে যাবে! খালি চারদিক থেকে কি? কেন? কেন হচ্ছে? সব যেন ওকে গিলে খেতে আসছে। ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। এতক্ষণে ওরা বাড়িটার বাইরে বেরিয়ে এসেছে। হ্যালিও হাজির ওদিক থেকে। হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে কোথা থেকে একটা গুলি হ্যালির কাঁধের ফাঁক দিয়ে এসে সোজা আহানের কলার বনে লাগলো। হ্যালি বা হিংলা কেউ কিছু বোঝার আগেই আহান মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আরো একটা গুলি চলতে যাচ্ছিল হ্যালিকে উদ্দেশ্যে করে হঠাৎ করে জঙ্গলের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। কোথা থেকে ঝাঁক ঝাঁক পুলিশ আর স্পেশাল ফোর্স এসে বন্দুকধারী ব্যক্তিটিকে ঘিরে ধরলো। আরে এত সাধুবাবা! আর তার একনিষ্ঠ চেলা পিংলা।

    (২০)

    যখন জ্ঞান ফিরলো, আহান তখন হসপিটালের বেডে শুয়ে। হ্যালি ওর পাশেই বসে। পিছনে হিংলা দাঁড়িয়ে, ডক্টর এসে সব checkup করে গেল। হিংলার মুখ দেখে এবার আহান হেসেই ফেললো। রীতিমত ছানার বড়ার মতো বড়ো বড়ো চোখ করে হিংলা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। আহানই শুরু করলো কিভাবে ও আর হ্যালি একে অপরকে সাথে যোগাযোক করে এবং কি ভাবে ওরা প্ল্যান B apply করে পুলিশকেও সিগন্যাল পাঠায়। কিভাবে দুই যমজ ভাই একে অপরের পরিপূরক হয়ে পঞ্চাশ বছরের পুরোনো এক কথাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করে, দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে যান্ত্রিক মানুষ আর মানুষের অঙ্গ বেচার কাজ সুনিপুণ ভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল। কিভাবে দুই ভাইয়ের একজন অতিপরিচিত তান্ত্রিক সাধু হয়ে উঠেছিল জনসমক্ষে আর অপরজন সুদক্ষ বিজ্ঞানী সাথে সুনিপুণ শল্য চিকিৎসক। কিভাবে বিভিন্ন হোটেল আর রিসর্টের মালিকদের কখনো টাকা কখনো বা ভয় দেখিয়ে নিজেদের হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছিলো। কিভাবে মানুষের রক্ত খেকো বাদুড়দের কাজে লাগিয়ে পর্যটক বা নিরীহ মানুষকে ভুতের ভয় দেখাতো। কিভাবে শক থেরাপি সাথে কিছু ওষুধের মাধ্যমে মানুষদের যন্ত্র মানবে পরিণত করতো। কিভাবে স্টিমারে গুপ্ত কক্ষে লুকিয়ে আন্তর্জাতিক সমুদ্রের দ্বারা অঙ্গ বিক্রির কাজ চলতো। কথার রেশ কাটলো যখন ডাক্তার এসে বলে গেল যে পিংলা সহ বাকি যান্ত্রিক মানুষদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে ট্রেটমেন্টের জন্য। হিংলা চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলো নিজের ভাইকে একবার দেখার জন্য।

    (২১)

    হসপিটালের কেবিনের মধ্যে এখন এক ঠান্ডা নিস্তব্ধতা।
    নিস্তব্ধতা কাটলো যখন লোকাল থানার ও.সি সহ একটা পাঁচ-সাত জনের পুলিশ ফোর্স এসে স্যালুট করে “স্যার” এবং “ম্যাডাম” বলে দাঁড়ালেন। ওদিকে যান্ত্রিক মানুষগুলোর এরপর কি হবে, কালপিট দুটোরই বা কি হবে সাথে আরো হাজারো প্রশ্ন……সবকিছু কাটিয়ে আবার যে নিজের নিজের দৈনিক জীবনে ফেরার বিষন্নতা ওদের দুজনের মাথাকেই হ্যাং করে দিচ্ছে বারবার।
    নিজের নিজের ফোনের টিং টিং শব্দে ওদের দুজনেরই সম্বিৎ ফিরলো…

    ” Your flight ticket has successfully booked, Have a happy trip.”

    সবার অজান্তেই ওদের দুজোড়া চোখ আবার একবার চিকচিক কৰে উঠলো।

    -সমাপ্ত-

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-২)

    অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-২)
    -দ্যুতিপ্রিয়া ও অর্কপ্রভ

     

    (৫)

    ওরা এখন তিনজনে মিলে মন্দিরের পাশে জলাশয়ের বাঁধানো ঘাটে এসে বসেছে। ঠান্ডা হওয়া ওদের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে বারবার। মন্দিরের পিছনে জঙ্গলটাকে কেন্দ্র করে নিরীক্ষণে ব্যস্ত হ্যালির কৌতূহলী চোখগুলো হঠাৎ দূরের ঘাট’টায় একটা লোককে দেখে আটকে যায়। হ্যাঁচকা টান মেরে আহনকে ইশারা করলো হ্যালি। লোকটা তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। ঠিক লোক বলা যায় না অনেকটা সাধু গোছের।
    সাদা চুল সাদা গোঁফ, পরনের লাল থান। হাতে কি যেন একটা রয়েছে ঠিক বোঝা গেল না। কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেল। দুই দলের চোখ যেন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে সবটুকু নিরীক্ষণ করে নিচ্ছে। এর মধ্যেই বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ বেশ ভক্তিভরে সাধুটিকে যে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে কিছু কথাবার্তা বলে গেলো সেটা আহান বা হ্যালি কারোরই চোখ এড়ালো না। ওদিকে দুপুরের সূর্যি মামা মাথার ওপর উঠে পড়েছে। আর বেশিক্ষণ বসে থাকা গেলো না। হিংলার ডাকে ওদের উঠে পড়তে হলো। দু’জোড়া পা গাড়ির দিকে অগ্রসর হলেও ওদের মন বা নজর পরে রইলো সাধুটির দিকে। কিছুক্ষন পর সাধুটিও ভায়ামাতাভির ঘন জঙ্গলে মিলিয়ে গেলো।

    (৬)

    “বাঁচা আমাকে হ্যালি!” কাতর কণ্ঠে আহান বলে ওঠে, কিন্তু কোথায় হ্যালি? এ যে হিংলা! ও এরকম অদ্ভুত ভাবে হাসতে হাসতে আহানের দিকে এগিয়ে আসছে কেন? ওর হাতেই বা ওটা কিসের মেশিন? একদম কাছে চলে এসেছে হিংলা.. আহান ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পালাতে পারছে না.. পাগুলো পুরো অবশ.. কেউ যেন ওকে পুরো নিয়ন্ত্রণে করে ফেলেছে! না না.. আহান লাফিয়ে উঠে পড়ে সোফা থেকে। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে, পুরো কপাল ঘামে চপ চপ করছে। “কি ভয়ানক স্বপ্ন! বাপরে বাপ..” নিজের মনেই বলে ওঠে আহান। সন্ধ্যা অনেক আগেই হয়ে গেছে। ওর মনে আছে, বিকালের দিকেই ওরা ফিরে এসেছিল। তারপর ও ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমের সোফায় এসে বসে কিসব যেন ভাবছিল। কখন যে দু’চোখের পাতা এক হয়ে গেছে খেয়াল নেই। হুস ফিরলো, হ্যালির ডাকে। ততক্ষণে হ্যালি ফ্রেশ হয়ে দু’প্লেট লুচি তরকারি নিয়ে হাজির। “কি এত ভাবছিস বলতো? কাল থেকেই দেখছি..কাল বিকেলে কি যেন একটা বলতেও যাচ্ছিলিস। তারপর যা যা সব ঘটলো!” কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলতে বলতেই হ্যালি আহানের পাশে এসে বসলো। ততক্ষণে আহান ওর হাত থেকে এক প্লেট লুচি তরকারি ছোঁ মেরে নিয়ে নিয়েছে। দু’টি লুচি গলাধঃকরণ করে আহান একটু আরাম করে শুরু করলো সকালে বাইনোকুলারে দেখা সেই অদ্ভুত মানুষটার কথা, “তাও শুধু আজ নয় আগের দিন বিকেলেও আমি লক্ষ্য করেছি ওরকম একজন লোককে…” বলে বাঁ হাতে করে ক্যামেরাটা এগিয়ে দিল হ্যালির দিকে।
    “কিন্তু আমি ভাবছি সাধুটাকে নিয়ে, কিভাবে দেখছিল আমাদের দেখিস নি? চাহনিটা আমার একদম ভালো লাগে নি” একদমে কথাগুলো বলে ফেললো হ্যালি। সাথে দুজনেরই মাথায় ঘুরছে নিখোঁজ মানুষগুলোর কথা‌।
    কি হয় জঙ্গলের মধ্যে? কেন মানুষগুলো ফিরে আসেনা? কোনো জন্তু জানোয়ার নেই তো? না সত্যি কোনো অশরীরি কিছু আছে সেখানে? এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেলো। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার‌। “এখানে তো generator বা inverter থাকার কথা” হ্যালির কথাটা শেষ হতে না হতেই আহান উঠে পড়লো। “দাঁড়া তো একবার ম্যানাজারের সাথে কথা বলে আসি। এখানে যে কারেন্ট নেই সেটা মনে হয় ওরা জানেই না।” এমনিতে হ্যালির কোনো ভয়ডর নেই। কিন্তু আজ আহান বেরিয়ে যেতে না যেতেই হ্যালির গা’টা কেমন ছমছম করে উঠলো। ঘরের জানলা দরজা সব বন্ধ, কিন্তু কোথা থেকে যেন একটা বরফের মতো ঠান্ডা হওয়া হ্যালিকে স্পর্শ করে যাচ্ছে বারবার, হ্যালি পুরো কেঁপে উঠলো যখন হঠাৎই ঘরের সমস্ত বন্ধ দরজা জানালাগুলো সজোরে খুলে গেল। মনের সমস্ত সাহসকে একজায়গায় করে হ্যালি উঠে বারান্দার দিকে যেতে গেল। কিন্তু এক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। দু’টো লাল চোখ যেন ওকে বশীভূত করে ফেলেছে। পাগুলো পুরো অসাড়, ওর শরীরের সমস্ত রক্ত যেন কেউ শুষে নিচ্ছে…
    ওদিকে আহান তখনও বেশিদূর যায়নি, পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তায় অন্ধকারে হাঁটার অসুবিধা হচ্ছে। হঠাৎ পিছনে হ্যালির রক্তজল করা চিৎকার যেন এক নিমেষে পাহাড়ের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিলো। পড়ি কি মরি করে ছুটলো আহান রিসোর্টের দিকে। ঘরের দরজা খুলে যখন ড্রয়িং রুমে ঢুকলো তখন অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তিকে আহান স্পষ্ট বারান্দার পাশ দিয়ে যেতে দেখলো। চট করে মোবাইলের ফ্লাশ লাইটটা জ্বালিয়ে দৌড়ে গেল বারান্দার দিকে। কিন্তু তখন চারদিকে কেউ নেই। জলের পাইপ বেয়ে পাহাড়ের খাদ ধরে নিচে নামবে কিনা ভাবছে, হঠাৎ খেয়াল পড়লো হ্যালির কথা। ওর ওই রক্ত জলকরা চিৎকারটার কথা….
    “হ্যালি.. হ্যালি” কোনো সাড়া শব্দ নেই। আহানের গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। হাতের মোবাইলে চার্জ কম থাকায় ফ্লাশ লাইটটা অনেকক্ষণ আগেই নিভে গেছে। অন্ধকারে এলোপাতাড়ি ভাবে আহান খুঁজতে লাগলো হ্যালিকে। হঠাৎই বেখেয়ালে কিছুতে যেন ধাক্কা খেয়ে আহান পড়ে গেল মাটিতে। সাথে সাথে কারেন্টটাও চলে এলো।
    “হ্যালি..” আহানের গলা দিয়ে তখন আর আওয়াজ বেরোচ্ছে না।
    ড্রইং রুমের মেঝেতে হ্যালি পড়ে আছে। ঘাড়ের কাছে এক খাবলা রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। দু’ মিনিট সময় লাগলো আহানের নিজেকে শক্ত করতে। তারপর চটজলদি হিংলাকে ফোন করলো হ্যালির ফোন থেকে। নাহ্ এই সময় ভেঙে পড়লে চলবে না। পাঁজাকোলা করে হ্যালিকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওর ঘরের বিছানায় শুয়ে দিলো আহান। হিংলাও পাশের সার্ভেন্ট কোয়াটার থেকে ততক্ষণে হাজির।

    (৭)

    “কোনো কিছু রক্ত খেকো প্রাণী বেশ খানিকক্ষণ ধরে রক্ত খেয়েছে। কিন্তু এখানে ওরকম কোনো প্রাণী নেই। এমন কি ভায়ামাতাভি জঙ্গলেও নেই, সুতরাং এ কোন অশরীরির কাজ। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখন থেকে নাকি ওদের ফিরে যাওয়াই ভালো।” কথাগুলো বলে ডাক্তার বাবু ফিরে গেছেন প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হলো। হ্যালির তখনও জ্ঞান ফেরেনি। আহান ওর মাথার পাশে বসে। হিংলা গেছে ওষুধপত্রগুলো আনতে।

    আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারল না আহান, চোখের কোন থেকে দু’ ফোঁটা জল হ্যালির কপালের ওপর পড়লো- ছিঃ ছিঃ! দিনদিন ও যেন কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে। তখন ওই সব না দেখে হ্যালিকে কোথায় দেখবে তা না! নিজের guilty feelটা যেন কিছুতেই কম হচ্ছে না আহানের।
    “তুই আবার কাঁদিস ও নাকি!” হ্যালির ক্ষীণ শব্দ, আহান ততক্ষণে ওর ভেজা চোখগুলোকে মুছে নিয়েছে।
    এতদিনের বন্ধুকে এভাবে কাঁদতে দেখে হ্যালি একটু হাসার চেষ্টা করলো। আহানের সাহায্যে ও এখন একটু উঠে বসতে পেরেছে। যদিও এখনো যে ভালোমতো দুর্বলতা আছে, সেটা ভালো ভেবেই বুঝতে পারছে।
    আহান বারবার করে কথা বলতে বারণ করলেও সন্ধ্যেবেলার পুরো ঘটনাটা বললো। আহানও বললো কি কি হয়েছে ওর ঘরে আসার পর থেকে।

    সব কিছু শুনে হ্যালির মনে জেদ চেপে গেল কালই নাকি ও ওই জঙ্গলে যাবে।
    “না দিদিমণি ইয়ে নেহি হো সাক্তে..” হিংলার গলা। ওষুধ নিয়ে ফিরে এসেছে…
    “ম্যায় সব কুছ শুনে নিয়েছি দরওয়াজেকে পিছেসে দাদাবাবু, দিদিমণি.. মুঝে মাফ করে দেবেন। কিন্তু কাল হি আপ লোগ নিজের গাঁওমে ওপাশ জাওগে, ব্যস।”

    দূরের কোনো ঘড়িতে রাত দশটার ঘন্টা পড়লো।
    ঘরের মধ্যে এক অদ্ভূত নিস্তব্ধতা। আহান ভালো করেই জানে হ্যালির জেদের কথা। একবার যখন কিছু ভেবেছে তখন সেটা করেই ছাড়বে। আহানও এর শেষ দেখতে চায় চিন্তা শুধু হ্যালিকে নিয়ে। ওদিকে হিংলাও আজ রাতে দাদাবাবু দিদিমনিকে একা ছাড়তে নারাজ।

    (৮)

    রিসর্টের সব জানালা দরজাই এখন বন্ধ। তিনজন এখন ঘরের মধ্যে গোল করে বসে। একটা গভীর নিস্তব্ধতা। দেওয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটা চলার শব্দ আর প্রত্যেকের স্বাসপ্রশ্বাস যেন প্রতিমুহূর্তে নিস্তব্ধতাটাকে বারবার ভেঙে চুরচুর করে দিচ্ছে।
    রাতে ম্যানেজারের রুমে ফোনটা ঝনঝন করে উঠলো। “হ্যালো.. Mr. Ahan বলছি… বলছি, কাল ভোরেই আমরা রুম ছেড়ে দিচ্ছি… আমার বন্ধুর শরীরটা ঠিক নেই, তাই আমরা ফিরে যাচ্ছি… সকাল সাতটায় যদি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করা যেত তাহলে খুব ভালো হতো.. আচ্ছা নমস্কার…” ঘড়িতে রাত দেড়টার ঘন্টাটা বাজার সাথে সাথে ফোনটাও কেটে গেল।
    রাতে ঘরের মধ্যে যে কি হলো সেটা বাইরের কেউই জানতে পারলো না। হ্যালিকে নিজের ঘরে শান্তিতে ঘুমাতে দেখে আহানও নিজের ঘরে এলো ওদিকে হিংলা দিদিমনিকে পাহারা দেওয়ার জন্য ডাইনিং-এ থেকে গেলো সেই রাতের মতো। সকাল সাতটা, রিসর্ট থেকে দুইমূর্তি হিংলাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। গাড়ি বলা ছিল। হোটেলের সব কাগজের কাজ শেষ করে ম্যানাজারের সাথে ছোট কুশলী বার্তা সেরে তিনজনেই গাড়িতে উঠে পড়লো। পথে সেরকম কেউই কথা বললো না। হ্যালির শরীর খুবই খারাপ। সে এখন আহানের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। আগের রাতের ঘটনা যে তিনজনের মনেই গভীর দাগ কেটেছে সেটা বাইরে থেকে বোঝা গেল না। এমন কি হিংলাও কেমন একটা গুম মেরে রয়েছে। গাড়িটা এসে যখন বিশাখাপত্তনম স্টেশনে থামলো তখন ঘড়িতে দশটা ছুঁইছুঁই। গাড়িটাকে ছেড়ে দিয়ে তিনজনে এখন স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে। ট্রেন আসবে। সেই বারোটায়।
    বারোটার ট্রেনটা যখন বিশাখাপত্তনম স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেল তখন হিংলার পিছন পিছন যে আরো একজন ভায়ামাতাভি যাওয়ার উদ্দেশে স্টেশন থেকে বেরোলো সেটা কারোরই চোখে পড়লো না।

    (৯)

    ট্রেনটা যখন পালাসা স্টেশনে থামলো তখন ঘড়িতে বিকাল সাড়ে তিনটে বাজছে। স্টেশনের বাইরে একটা কালো রঙের গাড়ি অপেক্ষা করছে। ট্রেন থেকে নেমে আহান আর হ্যালি গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলো।
    টানা পাঁচ ঘন্টা গাড়ি জার্নির পর যখন আহান আর হ্যালি ভায়ামাতাভির মাতাজির মন্দিরের সামনে এসে পৌঁছালো ততক্ষণে পথের ক্লান্তি ভ্যানিশ হয়ে গেছে। মন্দিরকে একবার প্রণাম করে দুজনে মিলে তালাবের ঘাটে উপস্থিত হলো। একটা নৌকো বাঁধা রয়েছে। নৌকার মালিক যখন আহান আর হ্যালির সামনে এসে দাঁড়ালো। তখন ওদের দুজনেরই চোখগুলো আনন্দে চিকচিক করে উঠলো,হিংলা! তালাবের জলটা এতটাই পরিস্কার যে ঘন অন্ধকারেও নিজেদের অবয়ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হ্যালি বার দুয়েক জলে হাত ডোবালো। জঙ্গলটা যতই কাছে এগিয়ে আসছে ততই কিরকম গা’টা ছমছম করতে লাগলো ওদের।
    “কি অদ্ভুত রকমের শান্ত তাই না?” আহান ফিসফিস করে বললো।
    “একটা ঝিঁঝি পোকাও অব্দি ডাকছে না দেখেছিস?” আহানের সুরে হ্যালিও সুর মেলালো।
    “ইতনা বড় জঙ্গল মে কিসি চিজ কো
    ঢুঁননে যায়ে তো বহুত দিন লাগ যায়গা” হিংলার গলা। ও যে বেশ উত্তেজিত সেটা বোঝাই গেলো ওর গলা শুনে। হ্যালি আহানকে বললো, “ঠিকই বলেছে হিংলা, এভাবে হবে না, আলাদা হতেই হবে” আহান সাথে সাথে বাধা দিয়ে বলে, “কখনোই না, তোকে আমি অন্ততঃ একা ছাড়ছি না।” হিংলা বলে, “আপ দিদিমনিকে সাথ যাও, ম্যায় একেলা হি সামহাল লুঙ্গা, মেরে চিন্তা করবেন না।” কোনো সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লে আমরা অন্যজনকে জানিয়ে দেবো- কথাগুলো বলতে বলতেই আহানদের নৌকোটা একটা পরিষ্কার জায়গায় দাঁড় করালো হিংলা। ঝুপ ঝুপ করে সব নেমে পড়লো। তারপর তিনজনে মিলে নৌকোটাকে দুটো বড়ো গাছের আড়ালে লুকিয়ে ফেললো পাছে কেউ না দেখে ফেলে। আহান ওর ব্যাগ থেকে একটা ধারালো ছুরি করে আশপাশ থেকে কিছু ডালপালা কেটে সেগুলো দিয়ে নৌকোটাকে ভালো করে আড়াল করে দিলো। তিনজনে মিলে ঘাপটি মেরে বসে রইলো ভোর হওয়ার অপেক্ষায়। কতক্ষণ যে এভাবে বসে ছিল, মাঝখানে ওরা পালা বদল করে ঘুমিয়েও নিয়েছে একটু। পরের দিন যখন আহান আর হ্যালি ডান দিকে আর হিংলা বাঁ দিকের রাস্তাটা দিয়ে চলতে শুরু করলো তখন ভোরের আলো সবে ফুটছে।

    (১০)

    হিংলা পুরো ভাইজাকটা চোষে ফেললেও এই জঙ্গলে আগে কখনো আসে নি। সে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ধীর পায়ে এগোতে লাগলো। সারি সারি গাছ শুধু কিন্তু কোনো জন্তু জানোয়ার নেই। ভারী অবাক হলো। দূর দূর পর্যন্ত নতুন কিছু চোখে পড়লো না। জঙ্গলটা এতটাই ঘন যে মানুষ রাস্তা গুলিয়ে ফেলতে বাধ্য। হয়তো সেই জন্যই মানুষ একবার ঢুকলে আর ফিরে আসে না। মনে মনে চিন্তা করে সে, হঠাৎ ভাইয়ের কথা মাথায় এলো। সে কি এখনো বেঁচে আছে? জঙ্গলের কত ভিতরে সে পৌঁছে গেছে, কি অবস্থা আছে, কিছুই জানে না। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ একটা জিনিস দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে হিংলা।ঘন জঙ্গলে একই পথ যদি কেউ বারবার ব্যবহার করে তাহলে ঘাস পাতা একটু ফিকে হয়ে যায় হিংলা সেরকমই দু’টো পথ আবিষ্কার করে ফেলেছে, একটা ডান দিকে চলে গেছে অন্যটা বাঁ দিকে। এ জঙ্গলে কোনো জন্তু তার এখনো অব্দি চোখে পড়েনি। তাহলে কি কোনো মানুষ? তার ভাই? এই পথেই কি সে বারবার ঘুরছে? এসব চিন্তা তাকে মুহূর্তে উত্তেজিত করে তুললো। কিন্তু সে যাবে কোন দিকে রাস্তার ডান দিক দিয়ে নাকি বাম দিক দিয়ে? একটু ভেবে বাম দিকের পথই নিলো। মনে কোথাও যেন একটু একটু আশার আলো দেখা দিচ্ছে। অমনি একটা খসখস শব্দ তার সব ইন্দ্রিয়কে সতর্ক করে দেয়। হিংলা থেমে যায়। বোঝার চেষ্টা করে শব্দটা কথা থেকে আসছে।

    (১১)

    এদিকে আহান আর হ্যালি এই জঙ্গলে প্রথম এলেও তাদের জঙ্গলে আসার অভিজ্ঞতা আগেও আছে। দুজনেই সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে এগোতে লাগলো। অল্প একটু এগিয়েই আহান থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। গলায় একটা চাপা উত্তেজনা, “এটাই তো খুঁজছিলাম!”
    প্রথমে হ্যালি বুঝে উঠতে পারে না। আহান তাকে পথের মতো একটা রাস্তা দেখিয়ে দেয়। “এ পথ দিয়ে নিশ্চয়ই কেউ যাতায়াত করে” হ্যালি বলে উঠে, একটু এদিক ওদিক দেখে নিয়ে ওরা ওই রাস্তাটাকে অনুসরণ করতে থাকে। এখন তারা জঙ্গলের একটু ঝোপের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। ওদের একটু পাশ দিয়েই রাস্তাটা গেছে। যাতে হুট করে ওই লোক চলাচলের রাস্তায় কেউ ওদের ধরে না ফেলে সেই জন্য।
    অল্প কিছু দুর যেতেই একটা বড়ো গাছ দেখতে পায় ওরা দুজন, “সেই সাধুটা না!” হ্যালি উত্তেজিত হয়ে আহানের হাত খামচে ধরেছে. এদিকে সাধুটিও একটা বড়ো গাছের তলায় বসে একজনের সাথে কথা বলছিলেন, দেখে চাকর বলেই মনে হলো ওদের। জঙ্গলের ভিতরে একটা খসখস শব্দ শুনে সাধুটি লোকটাকে চলে যেতে বললেন। লোকটা চলে যেতেই একটা গম্ভীর গলার আওয়াজ আহান আর হ্যালির হৃদপিন্ডকে মনে হলো যেন ওদের কলজে থেকে বার করে নিয়ে আসছে…”কোন হ্যায় উধার?”
    আর উপায় নেই, আহান বেরিয়ে এলো গাছের ফাঁক থেকে, “ও ভাই যারা এধার শুননা” আহান চিৎকার করে লোকটাকে ডাকলো। কিন্তু সে যেন কিছু শুনতেই পেলো না। কেমন যান্ত্রিক ভাবে চলতে চলতে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো। সাধুর কাছে আসতেই তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “ইহা পার ক্যা কার রাহে হয় তুম? ইয়ে জায়গাকে বারে ম্যায় কুচ নাহি শুনা ক্যা? টুরিস্ট লোগো কাভি ইহা মানা হ্যয়।” আহান একটু ভয়ের সাথেই বললো, “ও আদমি কোন থা? আপ ইধার রেহেতে হো ক্যা?” এবার গর্জে বলে উঠলেন তিনি, “হাঁ, ম্যায় ইহা পার আপনা ধ্যান করতা হ্যায়। আগার ভালা চাহতে হোয় তো জলদি নিকাল যাও..” আহান আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো কিন্তু তিনি পাত্তাই দিলেন না। চোখ বড়ো বড়ো করে এক দৃষ্টে আহানের দিকে চেয়ে আছেন আর সাথে বিড়বিড় করতে লাগলেন, যেন মন্ত্র পড়ছেন। গাছের পিছন থেকে হ্যালি খেয়াল করলো আহান যেন কেমন যন্ত্রের মতো অন্য দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। “এইরে লোকটা আহনকে হিপনোটাইজ করে ফেলেছে!” হ্যালি জঙ্গলের ভিতর দিয়েই যতটা সম্ভব নিজেকে লুকিয়ে আহানের পিছন নিলো। সাধুর নজর থেকে বেশ কিছুটা দূরে যেতেই হ্যালি পিছন থেকে আহানকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো যাতে ওর ঘোরটা কেটে যায় আর হলোও তাই, “কিরে এভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলি কেন?” আহানের গলায় একটু রাগের আভাস। হ্যালি গাছের পিছন থেকে যা যা দেখেছে পুরোটা বললো।
    সবটা শুনে আহানের গলায় তখন উৎকন্ঠার রেখা, “শোন আমার মনে হয় এখানে কিছু একটা আছে, নাহলে সাধুটিই বা আমাকে ওরকম হিপনোটাইজ করে এখান থেকে পাঠাতে কেন চাইছে! আর কে ওই চাকরটা? এতবার করে ডাকলাম একবারও ঘুরেও তাকালো না! শোন ওই চাকরটাকে খুঁজে বার করতে হবে..” হ্যালিও সায় দিলো।

     

    চলবে…………..

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-১)

    অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-১)

    -দ্যুতিপ্রিয়া ও অর্কপ্রভ

     

    (১)

    ট্রেনটা যখন বিশাখাপত্তনম স্টেশনে থামলো তখন ভোর হয় হয়… অনিরুদ্ধর ঠেলাতে ঘুম ভাঙল শিবানীর। দু’ মিনিটের মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দেবে তাই দুজনে ঝটপট করে নেমে পড়লো ট্রেন থেকে। দুজনের কাঁধেই দু’টো ব্যাগ, হাতে একটা করে ট্রলি।
    শিবানী ওরফে হ্যালি, পেশায় একজন ভূতত্ত্ববিদ্। আঠাশ বছরের রোগা, বব কাট চুল, জিন্স ছাড়া আপনি যদি একে অন্য কিছু পোশাকে কখনো দেখেছেন তাহলে ধরে নিতে হয় আপনার সেদিন লটারি কাটা উচিত। এর পিঠে যে কলেজ ব্যাগটা থাকে তার ভিতরটাকে আপনি ছোট খাটো একটি ল্যাবরেটরি বলতে পারেন।
    অন্যদিকে অনিরুদ্ধ ওরফে আহান.. পেশায় সাংবাদিক‌। আঠাশ বছরের চশমা পরিহিত, লম্বা, গায়ের রং এক কালে বেশ ফর্সা ছিল কিন্তু এখন রোদে জলে পুড়ে কালোতে পরিণত হয়েছে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কাঁধে যে ব্যাগটা থাকে সেখানে খুঁজলে হিরে থেকে জিরে অব্দি সব পাওয়া যাবে.. হাতে একটা  ডি.এস .এল. আর ক্যামেরা।

    আসলে ওরা দুই বন্ধু মিলে এসেছে বিশাখাপত্তনমের পাহাড় আর সমুদ্রের মেলবন্ধনকে চাক্ষুষ করবে বলে। প্রতি বছর ওরা দুই বন্ধু মিলে এরকম কয়েকটা ট্রিপ করে। তবে একটাই নিয়ম, এই সব ছুটিতে ওরা নিজস্ব পরিচয় ব্যবহার করে না। তখন ওরা শুধু আহান আর হ্যালি। দুজন পর্যটক, যাদের পৃথিবীর কোনা কোনা দেখার ইচ্ছা। এভাবে পরিচয় লুকিয়ে ভ্রমণের কারণ- একটাই.. এটা একটা খেলা, যে শেষ অব্দি নিজের পরিচয় সাথে বন্ধুর পরিচয় লোকাতে সক্ষম হবে সে জিতবে, অন্যজন হারবে, পানিশমেন্ট! যে হারবে, পরেরবার তাকেই দুজনকার ঘুরতে আসার সব খরচ দিতে হবে।

    যাইহোক, তল্পিতল্পা গুটিয়ে যখন দুজনে স্টেশনের বাইরে এলো তখন পাখিদের কিচিরমিচির বেশ ভালো মতোই শুরু হয়ে গেছে। কোথাও থেকে অনবরত এক ঠাণ্ডা শীতল হওয়া ওদের মাথার চুলগুলোকে খালি এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। খিদেয় দুজনের পেটেই ততক্ষণে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে।হ্যালির মনের ভাবটা বুঝতে পেরে আহানই সামনের কচুরির দোকানে যাওয়ার প্রস্তাব দিলো। একটা তৃপ্তির হাসি হেসে হ্যালিও চললো তার সাথে। এবারের প্ল্যানটা হ্যালি করেছিল, ওর সমুদ্র পছন্দ হলেও আহানের আবার পাহাড় একটু বেশি কাছের। তাই বিশাখাপত্তনমে এসে এক ঢিলে দুই পাখি মেরে দেয় সে।
    “জায়গাটা কিন্তু চমৎকার”- স্টেশনে পেট পুজোটা ভালো করে সেরে, গাড়িতে করে হোটেলের দিকে যাওয়ার পথে আহানই মন্তব্যটা করলো। উপরি পাওনা হিসাবে, আগে থেকে সব কিছু বুকিং থাকায় কোনো চিন্তা নেই। ” আইডিয়াটা কার সেটা দেখতে হবে তো…” সম্পূর্ণ credit সানন্দে নিজের কাঁধে নিজেই নিয়ে নেয় হ্যালি। অন্যদিকে আহানের সেসব দিকে খেয়াল নেই। এখন সে দু’চোখ ভোরে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করতে ব্যস্ত। অবশেষে হোটেলে পৌঁছে check in সেরে রুমে পৌঁছাতে এক ঘন্টা লেগে গেলো ওদের। রুমটা ভারী অদ্ভুত- আসল হোটেল থেকে একটু দূরে, একটা বড়ো ঘরের ভিতরে দু’টো আলাদা আলাদা ঘর, একটা বাথরুম, মাঝখানে একটা ড্রইং হল,আর পিছনের দিকে একটা বারান্দা। এরকম আরো দু’টো তিনটে রিসর্ট আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হ্যালি বাথরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার জন্য। ঘড়িতে সবে সকাল চারটে- ওদিকে আহান দরজাটা খুলে বারান্দায় আসে দাঁড়ালো। এই জায়গাটা ভারী সুন্দর‌। পুরো পাহাড়ের কোলে, মোটামুটি এক হাত দূর থেকেই গভীর খাদ, ওদিকে দূরে সারিসারি পাহাড় চূড়া… ছুটে গিয়ে ঘর থেকে dslr আর বাইনোকুলারটা নিয়ে এলো আহান। এই অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য বেশ ভালোভাবে ক্যামেরাবন্দি করে বাইনাকুলারে চোখ লাগলো আহান। পাহাড়ের কোলে দূরে একটা ঘন জঙ্গলের মতো দেখা যাচ্ছে। পুরো কুয়াশায় মোড়া… উফফফ দেখেই লোভ হয়ে যায়।
    ফ্রেশ হয়ে দুজনেই হালকা কিছু খেয়ে একটু জিরিয়ে নিলো। শারীরিক বিশ্রামটাও দরকার। ঘন্টা খানেক পর, মৌনতা ভঙ্গ করে আহানই প্রথম বেরোনোর তাগাদা দেয়। যেহেতু সকালটা প্রায় শেষ আর পুরোটাই অচেনা অজানা একটা জায়গা তাই আজ দুজনে আশেপাশেটা ঘুরে একটা গাইড ঠিক করে রিসর্টে ফিরবে ঠিক হলো।
    জায়গাটা সত্যিই অনবদ্য, একদিকে সমুদ্রের হওয়া শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে আর অন্য দিকে পাহাড়ের নৈসর্গ মনটাকে যেন প্রতিমুহূর্তে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। দুই বন্ধুর মধ্যে হ্যালি একটু বেশি চটপটে। ওর রেডি হতে বেশি সময় লাগে না। আহান রেডি হতে নিজের ঘরে গেল। হাতে বেশ খানিকটা সময় আছে দেখে হ্যালি বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। দূরের ওই জঙ্গলটার মধ্যে মানুষকে টানার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। পুরো মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছে হ্যালিকে। চোখ যেন ফেরাতেই পারছে না ওই জঙ্গলটা থেকে। সম্বিৎ ফিরলো,আহানের গলার আওয়াজে। dslr হ্যালিকে ধরিয়ে দিয়ে বললো, “স্নাপগুলো একবার দেখ- বারান্দা থেকে যা zoom ভিউ পেয়েছি না…অসাধারন! দুজনে একে অন্যের দিকে একবার তাকিয়েই বুঝে গেল কি চলছে দুজনের মাথায়। “কাল তবে ওখান থেকেই শুরু হোক, কি বলিস?” হ্যালির প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না আহান, শুধু হালকা হেসে সম্মতি জানালো। আশেপাশে খুব বেশি মানুষ নেই। ভাইজাগের মতো একটা প্রসিদ্ধ tourist destination যে এরকম নিরিবিলি আর মন্ত্রমুগ্ধকর হতে পারে সেটা এখানে না আসলে বিশ্বাসই হতো না ওদের। হাঁটতে হাঁটতে একটা ক্যামেরার দোকানের ওপর চোখ যায় আহানের। dslr-টার এক দিকের স্ট্রাপটার অবস্থা শোচনীয় তাই কিনে নেওয়াই ভালো। দোকানদার বেশ মিশুকে, হিন্দিতেই জিজ্ঞাসা করলো কবে ওরা এসেছে, কোথায় থাকছে, এরপর আর কোথায় কোথায় যাবে এই সব। হ্যালিও দু-এক কথার পর পাহাড়ের কোলে জঙ্গলটা দেখিয়ে ওটার ব্যাপারে জানতে চাইলো।
    “উস জায়গাকা নাম হ্যায় ভায়ামাতাভি, “ডাৱকা জঙ্গল”, দূর সে বহুত হি খুব সুরাত হ্যয় লেকিন পাস কোই নাহি যা সকতা” এই বর্ণনায় ওদের দুজনেরই যাওয়ার ইচ্ছাটা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেলো “আচ্ছা আপনার কোনো চেনাশোনা ভালো গাইড আছে? মানে যে একটু আশপাশটা ঘোরাতে পারবে বিশেষ করে ওই ভায়ামাতাভি জায়গাটা”-আহানের এই প্রশ্ন শুনে দোকানদার কেন জানি না অবাক হয়ে তাকালো ওদের দিকে, বললো “সাহাব মেরে ঘর জানে কে ওয়াক্ত হো গয়া হ্যায়। মুঝে অভি দোকান বন্ধ কারনা হোগা, আপকো কুছ ঔর চাইয়ে তো কাল শুভা লে লেনা… “
    “কেমন যেন এড়িয়ে গেল না পুরো ব্যাপারটা!” হ্যালি আহনকে উদ্যেশ্য করে ফিসফিস করে বললো। আহানও ভ্রু দু’টো কুঁচকে বললো, “exactly” ওদিকে দোকানদার দোকান বন্ধ করে কোথায় যেন সরে পড়েছে। আকাশটাও অন্ধকার অন্ধকার করে এসেছে। ওরা আশেপাশের চায়ের গুমটিগুলোতে খোঁজ নেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনো ফলই পেলো না। সবাই কেমন এড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা। একটু ভেঙে পড়লো ওরা। কিন্তু পরক্ষণেই আহান বললো “রিসর্টে চ তাড়াতাড়ি আমাদেরই যা ব্যবস্থা করার করতে হবে, কুছ পরোয়া নেই, যখন একবার ভেবে নিয়েছি তখন যাবই।” রাতে খাবারটা হ্যালি একটু আগেই অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। এখন দু’জনে মিলে ড্রইং রুমে বসে। হ্যালি মন দিয়ে ডাইরিতে কি সব যেন লিখছে আর মাঝেমাঝেই মোবাইলে কি সব দেখছে। ওদিকে আহানের চোখ ক্যামেরাতে আটকে। সকাল থেকে বিকালে ঘরে ঢোকার আগে পর্যন্ত যত ছবি তুলেছে সেগুলোই দেখতে ব্যস্ত। হঠাৎ হ্যালিই বলে ওঠে “একটু রিসার্চ করলাম বুঝলি জায়গাটা নিয়ে, তেলেগু ভাষায় “ভায়াম” হলো ভয় আর “আতাভি” মানে জঙ্গল। জায়গাটা এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার মতো দূরে। যাওয়ার রাস্তা একটাই যদিও সেটা খুব একটা খারাপ না। কিন্তু সাধারণ মানুষ সবাই ঐদিকটায় যাওয়াটা একটু এড়িয়ে যায়। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর তো ওদিকে যারা যারা গেছে তাদের নাকি আর কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। কথিত আছে একশো বছর আগে নাকি ওখানে একটা গ্রাম ছিল। একবার পাহাড় থেকে ধস নেমে পুরো গ্রামটাই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তার পর থেকে নাকি ওখানে অনেক অতৃপ্ত অশরীরিদের বিচরণ” কথাগুলো মন দিয়ে শুনে আহান ওর ক্যামেরা থেকে হ্যালিকে কিছু একটা দেখাতে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা ঝনঝন শব্দে দুজনেই কেঁপে উঠলো।”

    (২)

    “আওয়াজটা তোর ঘর থেকে এলো না” বলেই আহান ছুটলো হ্যালির ঘরের দিকে। একটা বেশ বড় সাইজের পাথর পড়ে আছে, তার গায়ে মানুষের মাথায় এক গুচ্ছ চুল দিয়ে বাঁধা একটা ব্রাউন রঙের কাগজ। সারা ঘর কাঁচের টুকরোয় ভরে গেছে। আহান দরজা খুলে বাইরে গিয়ে একবার দেখলো। কিন্তু কিছুই তো নেই কোথাও! আসলে হ্যালির রুমটা লোকালয়ের দিকে আর আহানেরটা বারান্দার পাশে।

    হ্যালি কাঁচের টুকরোগুলোকে পাশ কাটিয়ে পাথরের টুকরোটার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেই আহান এসে বাধা দিল.. “দাঁড়া আমি দেখছি।”

    কোনোরকমে পাথরে বাঁধা ব্রাউন কাগজটা তুলে নিয়ে ড্রইং রুমে এলো দুই বন্ধু। যা দেখলো, তাতে যে কোনো সাধারণ মানুষের রক্ত জল হয়ে যাবে। এতক্ষণ ওরা যেটাকে ব্রাউন রঙের কাগজ বলে মনে করেছিল ওটা আসলে শুকনো চামড়ার অংশ বিশেষ। কোনো মানুষ বা পশুর চামড়া কেটে সেটাকে রোদে শুকিয়ে বানানো হয়েছে। ভিতরে রক্ত দিয়ে লেখা,
    “জিন্দা রেহেনা চাহতা হ্যায় তো ভাগ যা…”

    ওদের দুজনেরই নার্ভ বেশ শক্ত। পালানো তো দূরের কথা দুজনেরই মাথায় জেদ চেপে গেল। শেষ না দেখে কিছুতেই নড়বে না এখান থেকে।
    হ্যালিকে একটু অস্থির দেখে আহান বললো, “তুই বরং একটা কাজ কর, তুই আমার ঘরটা ব্যবহার কর‌ আমি আজ এখানেই থেকে যাচ্ছি‌।”
    টেবিলের ওপর রাখা খাবারগুলো ততক্ষণে ঠাণ্ডা জল হয়ে গেছে। সেগুলোকেই গলাধঃকরণ করে যে যার জায়গায় শোবার তোড়জোড় করতে লাগলো। মিনিট দশেক পর আহান আড়চোখে দেখলো হ্যালি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আলোও বন্ধ। একটা গভীর দম ছেড়ে নিজের পিঠের ব্যাগটা কাছে টেনে নিল আহান। ছবিগুলো আরো একবার দেখা দরকার। সন্ধে বেলায় ফটোগুলোতে ও একটা জিনিস খেয়াল করেছে.. কি সেটা? সেটা নিজে ভালো করে না বুঝে হ্যালিকে কি বোঝাবে? ওদিকে হ্যালি ঘুমানোর চেষ্টা করলো বেশ খানিকক্ষণ ধরে। না মাথার মধ্যে দু’টো প্রশ্ন খালি ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে,
    এক কিসের বা কার রক্ত…
    দুই কিসের বা কার চামড়া…
    নাহ্, এভাবে ঘুম আসবে না.. খুব সন্তর্পণে খাট থেকে উঠে ঘরের মধ্যে টেবিল লাম্পটা জ্বালিয়ে বসলো। ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বের করে নিয়ে এখন ও বসেছে পরীক্ষা করতে। এমনিতে ও পেশাগত দিক দিয়ে ভূতত্ববিদ হলেও,কাজের সূত্রে
    প্রত্নতাত্বিক, জুওলজি, বোটানি,পদার্থ কিংবা রসায়নবিদ্যা সব বিষয়গুলোর ওপরই কম বেশি চর্চা থেকে যায়।

    (৩)

    কাজ করতে করতে কখন যে ভোর হয়ে গেছে দুজনের কেউই খেয়াল করেনি। হুস ফিরলো কলিং বেলের আওয়াজে। আহানই গিয়ে দরজাটা খুললো। ততক্ষণে হ্যালিও বেরিয়ে আসছে ঘর থেকে। হোটেল থেকে লোক এসেছে ওদের জাগানোর জন্য। কারণ পাহাড়ের কোলে ভোরের সূর্যোদয় একটা আলাদাই আকর্ষণ। আগের দিনের রাতের জানালায় কাঁচ ভেঙে যাওয়ার ঘটনাটুকু ছাড়া বাকি ঘটনাটা দুজনেই চেপে গেল। জানাজানি হলে হয়তো হোটেল কর্তৃপক্ষই এখানে ওদের থাকতে দেবে না।
    একটা স্বর্গীয় সূর্যোদয় উপভোগ করতে না করতেই হোটেলের একজন কর্মচারী ওদের জলখাবারটা দিয়ে গেল। ব্রেকফাস্ট যেহেতু হোটেল বুকিং-এর সাথে কমপ্লিমেন্টারি তাই ওটা আর আলাদা করে order দিতে হয়না। যাই হোক আজ ওরা হোটেলে বলে রেখেছে, ওদের একটা ভালো গাইডের ব্যবস্থা করে রাখার জন্য। জলখাবার খেয়েই ওরা বেরিয়ে পড়লো। গাইডটা একটা বাচ্চা ছেলে, ওই বাইশ কি তেইশ বছর বয়স। নাম হিংলা। ভাইজাকের ব্যাপারে ওর মতো জ্ঞানী আর সাহসী চটপটে ছেলে নাকি আর নেই।

    দুজনের মুখেই আগের রাতের ঘটনা একটা চিন্তার ছাপ ফেলেছে, কিন্তু বাইরের পরিবেশ দুজনেরই মনকেই ভালো করে দিলো। হিংলা ছেলেটা খুবই চটপটে। গাড়ির সাথে কথা বলাই ছিল। ওরা গাড়ির কাছাকাছি আসতেই হিংলা দরজা খুলে দিয়ে বললো ” উঠে পড়ুন দাদাবাবু দিদিমনি, আজ আপনাদের মাতাজির মন্দিরমে লেকে যাউজ্ঞা, বহুত জাগ্রত ও মন্দির”..হিংলার মুখে এরম বাংলা শুনে হ্যালি স্বভাবতই কৌতূহলী হয়ে ওঠে..গাড়িতে উঠে আহান জিজ্ঞাসা করায় হিংলাই বললো যে তার ছোটোবেলা কেটেছে গ্যাংটকে তারপর কাজের খোঁজে ও আর ওর ভাই ভাইজাকে চলে আসে। আহান আর হ্যালিকে বাংলায় কথা বলতে দেখে বুঝে যায় বাঙালি গেস্ট তাই ও বাংলাটাই জারি রাখে। হিংলা যদিও হেসে হেসেই কথা বলছে কিন্তু তার চোখে মুখে কোথাও যেন একটা দুঃখের ছাপ আছে সেটা এড়ালো না আহানের চোখ থেকে। হাজার হোক, সাংবাদিকের চোখ বলে কথা। গাড়ি একটা কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে মাঝারি গতিতে। মন্দির ছাড়া কাছেপিঠে আর কি কি দেখার আছে জানতে চাওয়ায় হিংলা বলে, “মন্দিরকে পাসমে এক তালাব হ্যায় দাদাবাবু, আর মন্দিরকা পিছেই ওই ভায়ামাতাভি জাঙ্গালটা” জঙ্গলের কথা শুনেই দুজনের চোখ চিকচিক করে উঠলো। হ্যালি যেন এরই প্রতীক্ষা করছিল। স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞাসা করে “আচ্ছা হিংলা, জঙ্গলটার ব্যাপারে একটু বলো তো। বাইরে থেকে এতো সুন্দর লাগে কিন্তু শুনেছি এখানকার মানুষ নাকি ভয় পায় ওই জঙ্গলে যেতে।” হ্যালির কাছ থেকে এই প্রশ্ন আসতে পারে, সেটা আশাই করেনি হিংলা। সে একটু সময় নিয়ে বলে, “ঠিক হি শুনেছেন দাদাবাবু-দিদিমণি, উস জঙ্গলমে কই জানা নেহি চাহতা। লোগ ডরতে হ্যায়”
    “কিন্তু কেন? কি আছে ওখানে?” আহান আর চুপ না থাকতে পেরে হিংলাকে কথাগুলো জিজ্ঞাসা করেই ফেললো। হিংলা একটু ইতস্তত করছিল। তখন হ্যালি ওকে বলে “লুকানোর কিছু নেই হিংলা! তুমি আমায় দিদিমণি বলেছো না! বলো কি আছে ওখানে? আমরাও শুনতে চাই”
    “দাদাবাবু দিদিমণি, আসালমে বাত হ্যায় কি..ওখানে মানুষ গেলে লটকে নেহি আতা। এখনো অব্দি আমাদের এই ভায়ামাতাভি থেকে চারজন লাপাতা… বাকি আশপাশ সে বহুত সারে মানুষ ভি উধারসে লটকে নেহি আয়ে। উনমে সে মেরে ভাইভি থা দিদিমনি!” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামে হিংলা। ওর চোখগুলো এখন ঘোলাটে হয়ে এসেছে, সাথে গলাটাও কেঁপে কেঁপে উঠছে।
    “কি বলছো হিংলা, মানুষ লাপাতা? তোমার ভাই ও? তুমি পুলিশের কাছে যাওনি? তারা কি বলছে?” এতগুলো প্রশ্ন একসাথে করে আহান হাঁপাতে লাগলো। এতক্ষণে ও বুঝেছে হিংলার মুখে কেন কষ্টের ছাপ দেখেছিল প্রথমে।
    হ্যাঁ, দাদাবাবু আমি বারণ করেছিলাম ওকে যেতে। লেকিন ও মেরা বাত নাহি মানা। অর এটা ভি শুনা যাতা হ্যায় কি পুলিশের কাছে গেলে জাঙ্গালকা কালা সায়া ঘরকে বাকি সবকে উপারভি পারতা হ্যায়।” হিংলার এই উত্তর শুনে আহান আর হ্যালি দুজনেই হতভম্ব হয়ে যায়। গাড়িটাও ইতিমধ্যে মন্দিরের সামনে চলে এসেছে। পাহাড় কেটে বানানো মন্দিরটা, সত্যি অসাধারণ হাতের কাজ কারিগরদের। দেখেই ওরা মুগ্ধ হয়ে গেলো। আহান তো dslr-এ চোখ গুঁজে রইলো। একটা মুহূর্তও যেন মিস করতে চায়না। এদিকে হিংলা সেখানকার ইতিহাস নিয়ে বলে চলেছে- মন্দিরটা নাকি ওই গ্রামটা ধ্বংস হয়ে যাবার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর পাহাড় দেবীকে তুষ্ট করার জন্য তখনকার মানুষজনরা বানায়। মন্দিরটা বানাতে কমসে-কম দশ থেকে বারো বছর সময় লেগেছিল। মন্দিরের পিছনে হঠাৎ কি যেন একটা নড়ে উঠল না! নিজের অজান্তেই তড়িঘড়ি আহান বাইনোকুলারটা চোখে লাগলো। হ্যাঁ, ঠিক দেখছে সে, একটা মানুষ মন্দিরের পিছনে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে, মন্দিরের ঠিক পিছন থেকেই ভায়ামাতাভির জঙ্গলটা শুরু হয়েছে। জঙ্গলে ঢোকার মুখে পিছন ফিরে মন্দিরটাকে একবার প্রণাম করলো সে। আহান ভালো ভাবে লক্ষ্য করলো তাকে, সাধারণ আর পাঁচটা মানুষের মতোই কিন্তু চোখ দু’টো অস্বাভাবিক রকমের স্থির, হাঁটা চলার মধ্যেও একটা যান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট। যেন মনে হচ্ছে ওকে দিয়ে কেউ কিছু
    করিয়ে নিচ্ছে। এইরকম একজনকেই কাল সন্ধ্যাবেলায় ওর ক্যামেরাতে তোলা ছবিগুলোতে দেখেছিল না?
    “কিরে এত মন দিয়ে কি দেখছিস” হ্যালির প্রশ্নে আহানের সম্বিৎ ফেরে। আসল ব্যাপারটা লুকিয়ে গিয়ে হালকা হেসে বলে, “আরে না না, আসলে এত সুন্দর জায়গাটা কখন যে হারিয়ে গেছিলাম।”

     

    চলবে…………

  • গল্প

    গল্প- আপতন…….. স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখা

    আপতন…….. স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখা
    – দ্যুতিপ্রিয়া বন্দোপাধ্যায়

     

     

    (১)
    ঘড়িতে রাত বারোটার ঘন্টা পড়লো। না আর পারা যাচ্ছে না.. মাথা পুরো ঝিম ঝিম করছে। চশমার ফাঁক থেকে ল্যাপটপের লেখাগুলো অনেকক্ষণ আগে থেকেই ঝাপসা হতে শুরু করে দিয়েছে। কোনো রকমে নোট প্যাডটা সেভ করে ল্যাপটপটা বন্ধ করতে গিয়ে তানৌকা খেয়াল করলো মেইলটা খোলা থাকায় ল্যাপটপটা বন্ধ হচ্ছে না, Screen এ তখনও কম্পোজ new mail optionটা খোলা, সেখানে জ্বলজ্বল করছে একটা নতুন আনকোড়া মেইল, প্রকাশকের মেইল আইডি আর ওর শেষ না হওয়া একটা গল্প, প্রকাশককে পাঠাবে বলে মেলেতেই ‘সেভ’ করছিল আর কি। আসলে শেষ না হওয়ার কারণটা অন্য। ও ভেবেছিল আরো একটু ভেবে, অন্যরকম করে গল্পটা শেষ করবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেইলটা ডিলিট করতে গেলো, যাঃ!! কারেন্ট চলে গেল! মানে আজ যে কার মুখ দেখে সকালে উঠেছিল, কে জানে! এবার তানৌকার মাথা গরমটা কারেন্টের থেকে ঘুরে গিয়ে, নিজের ল্যাপটপটার ওপর পড়লো। বিরক্তিকর, যত পুরোনো হচ্ছে তত নিত্য নতুন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। আগে তো ছিলই ল্যাপটপের নিজস্ব জায়গায় কিছু ‘সেভ’ করা যেতো না। ইদানীং হয়েছে, পাওয়ার ব্যাক আপের পুরো ষষ্ঠী পুজো হয়ে গেছে। কার্রেন্ট না থাকলে দু’ সেকেন্ড যে এক্সট্রা চলবে তার উপায় নেই। একরাশ বিরক্তি নিয়ে চেয়ার থেকে উঠতে গিয়ে তানৌকা বেশ বুঝতে পারলো পায়ের বুড়ো আঙুল অব্দি পুরো অসাড়, অগত্যা চেয়ারের ওপর অকাল কুষ্মাণ্ডর মতো বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
    ঘাড়ে যন্ত্রণাও করছে। অবশ্য হওয়ারই কথা- সেই সকালে প্রাতঃরাশ সেরে বসেছে তানৌকা। একটা গল্প লেখার ইচ্ছায়। না, ইচ্ছা বলাটা এখানে ঠিক না.. বরং বলা ভালো প্রকাশকের চাপে পড়ে। লেখা জমা দেওয়ার অন্তিম সময় যে আজ রাত সাড়ে বারোটা। তা রাত বারোটা বাজার ঘন্টাটা যেন তানৌকাকে ফাইনাল ওয়ার্নিং দিয়ে দিয়েছে ‘অলরেডি..’  এর মধ্যে নাকি একটা নতুন গল্পো তানৌকাকে জমা দিতে হবে। তা না হলে শহরের নাম করা পত্রিকার, পুজো সংখ্যাতে এবারের মতো তানৌকার লেখা আর যে জায়গা পাবে না সেটা গতকালই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে প্রকাশক মহাশয়।

    না এবার পা’টা একটু ছেড়েছে। চেয়ার থেকে উঠে বাথরুমের দিকে গেল তানৌকা। চোখে মুখে একটু জলের ঝাপটা দিয়ে এসে খাটে বসলো। মাথার মধ্যে তখনও একই জোট ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে। লেখাটার কি হবে! ঘড়িতে সোয়া বারোটা… আদতে ও এমন একটা রক্ষণশীল পরিবারের অংশ যেখানে মেয়েদের সামান্য স্নাতক হওয়াটাই বিশাল বড় ব্যাপার, সেখানে ওর ইচ্ছা, সমাজকে দেখার ভঙ্গিমাটা যেন একটু অন্যরকম তাই গত তিন বছর ধরে একজন লেখিকা হবার স্বপ্ন দু’চোখে নিয়ে শহরের হেন কোনো সম্পাদক বা প্রকাশক নেই যে যার দরজায় ঘোরেনি তানৌকা। লেখালেখিটা যে খুব খারাপ করে তা না, আসলে পিছনে একটা আর্থিক আর মানসিক সমর্থন থাকলে ব্যাপারগুলো অনেক সহজ হয়ে যায় আর কি, সে যাকগে!! এতদিন বাদে গিয়ে যে শহরের অন্যতম পত্রিকা, “অনুরাগ”এর জাঁদরেল প্রকাশক শ্রী বিশ্বনাথ মজুমদার মহাশয়কে নিমরাজি করনো গেছিলো সেটাও যে গেল হাত থেকে সেটা বোঝার বাকি রইলো না তানৌকার।
    সব কিছুকে প্রথম থেকে শুরু করার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হয়ে বিছানায় গা’টা এলিয়ে দিলো ও। চোখটা বন্ধ করে মনে মনে ভাবলো, “দুর্ছাই, এভাবে ধরে বেঁধে গল্প লেখা হয় নাকি! অমুক বিষয়ের ওপর একটা গল্প লিখে অমুকদিনে জমা দিতে হবে, তারপর সম্পাদক, প্রকাশক সবাই ‘এপ্রুভ’ করবে, কি সংশ্লিষ্ট লেখাটি ছাপা হবে কি না, তবে গিয়ে একটা লেখা প্রকাশ পাবে। দূর.. দূর এ;যেন প্রতিবারই মহাভারতের যুদ্ধ
    ঘড়ির কাঁটা দুটো তখন একটা বারোটায় আর একটা  পাঁচটার ঘরে জ্বলজ্বল করেছে। নাঃ এভাবে ঘুম হবে না। তাই ঘড়িটার দিকে পিঠ করে শুলো তানৌকা। কাল থেকে আবার নতুন যুদ্ধ শুরু।

    (2)
    মোবাইল ফোনটা সেই কখন থেকে ‘ভাইব্রেট’ করছে, মাথার ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে আড় চোখে ঘড়িটার দিকে তাকালো তানৌকা, ধ্যাৎ! সবে সকাল সাড়ে আটটা।
    এতো সকালে আবার কে ফোন করছে? একটু বিরক্ত হয়েই হাত বাড়িয়ে মাথার বালিশের তলা থেকে ফোনটা বের করে আনলো। একটা অচেনা নম্বর… ‘অলরেডি’ পাঁচটা ‘মিস কল্‌’.. অগত্যা ধরতেই হয়।
    “হ্যালো, আমি শ্রী বিশ্বনাথ মজুমদার, ‘অনুরাগ’ পত্রিকা থেকে। আপনার লেখাটা..”
    এইরে এইভাবে উনি ফোন করে তানৌকাকে লেখাটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করবেন, সেটা তানৌকা ভাবতে পারেনি। দু’বার ঢোক গিলে, তানৌকা বলার চেষ্টা করলো, “না, মানে, আসলে, আমি অনেক লেখার চেষ্টা করলাম”
    কথাটা শেষ করতে পারলো না ও, উল্টোদিকের গুরুগম্ভীর আওয়াজটা ওকে চুপ করিয়ে দিলো।
    “কি মানে মানে করছেন বলুন তো, ‘জাস্ট লিসেন টু মি ফার্স্ট’ , কাল একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে আপনার মেইলটা পেলাম আমরা, ওই বারোটা পাঁচ কি বারোটা দশ নাগাদ রাত, লেখাটা বেশ ভালো, ছাপা হবে এবারে পুজো সংখ্যাতে। কিন্তু আপনি কি বেয়াক্কেলে মানুষ! আর শুনুন এরপরের বার থেকে এইরকম করলে কিন্তু আপনার আয়ের দশ শতাংশ কেটে নেওয়া হবে।”
    বলেই ফোনটা কেটে দিলেন প্রকাশক শ্রী বিশ্বনাথ মজুমদার মহাশয়।

    ফোনটা কেটে দেওয়ার পর দশ মিনিট কেটে গেছে। এখনো ঘুমের ঘোর আর আকস্মিক শকটা মিলিয়ে কেমন একটা আফিমের নেশার মতো লাগছে তানৌকার। ঘোর কাটলো ফোনে টুং টুং করে দু’বার আওয়াজে, শ্রী বিশ্বনাথ মজুমদারের, লেখাটা ‘এপ্রুভাল’ এর একটা ‘অফিসিয়াল কনফার্মেশান এস .এম এস… সাথে আজ একবার দেখা করতে বলেছেন। হঠাৎ মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা চলে উঠলো, সেই কাল রাতের পর আজ এতক্ষণে কারেন্ট এলো। যথারীতি ল্যাপটপটাও চালু হয়ে গেছে। ওখানে তখনো একটা নোটিফিকেশন ‘শো’ করছে,

    “Your mail has successfully sent”……

  • গল্প

    গল্প- পর্দার আড়ালে অভিমন্যু

    পর্দার আড়ালে অভিমন্যু
    – দ্যুতিপ্রিয়া বন্দোপাধ্যায়

     

     

    অফিস থেকে আজ মেইল এসেছে- “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” এ আজকের বিষয় “কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিস”… সব কর্মচারীদের আজ কিছু না কিছু করে তার ভিডিও কোম্পানির নিজস্ব ‘সাইটে’ এ ‘আপলোড’ করতে হবে। মেইলটা দেখে দু’মিনিটের জন্য হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেলো না প্রিয়ংবদা ওরফে প্রিয়ংবদা দাসগুপ্ত। পেশাগত দিক দিয়ে গত পাঁচ বছর ধরে একটা মাল্টিনেশানাল কোম্পানিতে তে পরিবহন ডিপার্টমেন্টে আছে। চাকরি জীবনের ৮টা  থেকে ১০টা সময়টা বাদ দিলে তার পরিচয় দাঁড়ায় দাশগুপ্ত বাড়ির মেজো বৌমা, মি. দাশগুপ্তর বৌ। অবশ্য ওই বৌ কথাটা প্রিয়ংবদার নিতান্তই খেলো মনে হয়। তার থেকে বিনা মাইনের ‘পার্মানেন্ট’ কাজের লোক শব্দটা অনেক ভালো।’অ্যাটলিস্ট’  লোক দেখানো তো কিছু নেই! ও হ্যাঁ এখানেই শেষ না… বছর দু’য়েকের একটা ছেলেও আছে বটে, নাম প্রিয়াংশু… ওর আর ওর বর, অংশুর নামের মিলিয়ে রাখা। এখন এটাই নাকি ট্রেন্ড চলছে কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ঠোঁটের কোনে একটা অবজ্ঞার হাসি ফুটে উঠলো প্রিয়ংবদার। উঠে গিয়ে আলমারিটা খুললো। তার ভিতরে লকারটাও, খুব সাবধানে বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া গয়নার বাক্সটা বার করে আনলো। কলকাতার গড়িয়া হাটের মতো জায়গায় একটা তিনতলা সাবিকি আমলের শ্বশুর বাড়ী। নয় নয় করে বাড়িতে বারো জন লোক। যত দূর যা জানে বরের নামে সম্পত্তির পরিমাণও কম না। তাও বিয়ের তিন বছর পরেও যেন ওর কোনো কিছুতেই কোনো অধিকার নেই। নিজের ছেলের ওপরও সেই অধিকার নেই যতটা একজন মায়ের থাকে। অংশুর মতে ছেলেকে ওর হাতে দিয়ে ‘আনকালচার্ড’ মানুষ বানাতে পারবে না। এই ফাঁকে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকটা একবার দেখে নেয় প্রিয়ংবদা- কেউ আসছে না তো..!! খুব সন্তর্পণে গয়নার বাক্সটা খোলে ও- ভিতরে বাবার দেওয়া কিছু গয়না আর বেশ পুরোনো রং উঠে যাওয়া একটা ভাঙা মাউথ অর্গান। প্রাণ ভরে দেখে মাউথ অর্গানটাকে। কত বছর বাজায় নি। চোখ দু’টো ছলছল করে ওঠে। বিয়ের আগে ওর নিত্য সঙ্গী ছিল এই মাউথ অর্গানটা। রাগ, দুঃখ, কষ্ট কিংবা আনন্দ সবেতেই ঢেউ তুলতো তার এই নিত্য সঙ্গীর সাথে। ছাদে একা একা, মনের অজান্তেই টপ টপ করে দু’ ফোঁটা জল পড়লো তার পুরোনো সঙ্গীর গায়ে। কোথাও যেন প্রিয়ংবদাও বুঝতে পারে তার সঙ্গীও তার বিরহে ব্যাকুল। নাহ্, এভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না।কেউ জানতে পারলে আর রক্ষা থাকবে না। ঝটপট করে সব গুছিয়ে রাখে ঠিক আগের মত করে। গিয়ে বসে ল্যাপটপের সামনে, কি করবে এই বিষয়টার ভেবে পায় না। ওদিকে অফিসের ব্যাগে থাকা নতুন মাউথ অর্গানটা যেন ওকে হাত ছানি দিয়ে ডাকছে। যেদিন থেকে অফিসে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ হলো ঠিক তার আগের দিন সেই মাসের মাইনে থেকে কিনেছিলো অফিসের কাছে একটা নাম করা দোকান থেকে। যদিও জানতো সেটা কোনো দিন বাজাতে পারবে না, তাও। অফিসের সবার একরকম চাপে পড়েই কেনে সেদিন মাউথ অর্গানটা। অফিস ছুটি হওয়ার পর সবাইকার বারবার অনুরোধে বহু বছর বাদে দু-একটা গানের দু-এক কলি শোনানোর চেষ্টা করেছিল। আগের মতো না পারলেও, যা শুনিয়েছিল তাতেই অফিসের সবাই ওর ফ্যান হয়ে যায়। আজ কি একবার ট্রাই করবে? নাহ্ সে উপায় নেই। বাপের বাড়িতে বাবা ঠাকুমার ইচ্ছাতেই পাঁচ বছরের জন্মদিনে হাতে পায় তার প্রাণের সঙ্গীকে। সেখানে কোথাও কোনো বাধ্যবাধকতা ছিলো না। বিংশ শতাব্দীর যুগে ছেলে মেয়ে সব সমান সেরকমই মানসিকতার লোকজন সব সেখানে। বিয়ের আগে অবশ্য দাশগুপ্ত বাড়িতে এই সব নিয়ে কেউ কোনো আপত্তি তোলেনি। বরং শাশুড়িমা তো ওর মাউথ অর্গানের সুর শুনে মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন। বিয়ের পর অষ্টমঙ্গলা শেষ করে যখন শ্বশুর বাড়ি যায় সেবার খুব শখ করে বাপের বাড়ি থেকে তার প্রাণের সঙ্গীকেও নিয়ে গেছিল প্রথমবার। সেদিন সন্ধ্যে বেলায় নিতান্তই অভ্যাসবশত শ্বশুর বাড়ীর তেতলা ছাদে বসে সুর তুলেছিল। সেদিন ছিল জোৎস্না রাত। সারা পাড়া যেন সেই মুহূর্তে থমকে গিয়েছিলো। হঠাৎই সব কিছু ছারখার হয়ে যায়, যখন শ্বশুর মশাই এসে ওর হাত থেকে মাউথ অর্গানটা নিয়ে ছুঁড়ে মাটিতে মেরে ভেঙে দেন। কিছু বুঝে ওঠার অবকাশ পায়নি সেদিন প্রিয়ংবদা। মাথা নিচু করে সব শুনেছিলো সব, দেখেও ছিলো। যে দাসগুপ্ত বাড়ির বৌরা নাকি এই সব বাজারু কাজ করে না। শ্বশুর বাড়ীর একটা মানসম্মান- সম্ভ্রম আছে। নাহ্ তারপরের কথাগুলো আর শুনতে পারেনি প্রিয়ংবদা। অজ্ঞান হয়ে গেছিলো। তবে জ্ঞান ফেরার পর তার মনে ছিল কিভাবে বাড়ির একজন সদস্যও তার পক্ষ নেয়নি। নিজের স্বামী অংশুর দিকে শুধু তাকিয়েছিলো একবার, ভেবেছিলো সেই গাছের আড়ালে দাঁড়ালে হয়তো এই ঝড় থেকে রেহাই পাবে। নাহ্ সেদিন সেই আশাটাও ভেঙে চুরচুর হয়ে গেছিলো।
    বুঝেছিলো অংশুর কাছে শারীরিক সম্বন্ধটাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ- মনের মিল থেকে। পরে শাশুড়িমাকে এই নিয়ে জিজ্ঞাসা করতে গেলে শুনতে হয়েছিল, “শোনো মা, ওই সব বাউন্ডুলেপোনা এবার ছাড়তে হবে। যা বাপের বাড়িতে করতে, করতে‌..তাছাড়া আমরা তো আর তোমাকে তোমার ওই সব ছাইপাশ শুনে বিয়ে দিয়ে নিয়ে আসিনি। তোমার মোটা অঙ্কের মাইনেটা যাতে অন্য কোনো সংসারে পড়ে বেহাত না হয় সেজন্য নিয়ে আসা। নইলে কি আছে তোমার?”

    সেদিনের পর থেকে প্রিয়ংবদা বুঝে গেছিলো ওর আসলে জায়গাটা কি এই স্বনামধন্য দাশগুপ্ত পরিবারে। “কই গো এদিকে একবার শুনবে…” বর অংশুর গলা। কি একটা ভিডিও বানাবে, “হাউ টু বিকাম বেস্ট হাসবেন্ড ” বিষয়ের ওপর। তারপর ইউটিউবে এ দেবে। সেখানের ওর অনেক ফ্যান ফলোওয়ার। ভেজা চোখগুলো মুছে রান্না ঘরের দিকে এগোলো প্রিয়ংবদা! তাকেও যে প্রমাণ দিতে হবে…” দে আর  ভেরি হ্যাপিলি ম্যারিড কাপল্‌…!!”

    গত চব্বিশ দিন আগে- দীর্ঘ ছয় মাস চেষ্টার পর প্রিয়ংবদার আবার ওয়ার্ক ফর্ম অফিস হয়েছে। আজকাল একটু দেরি করেই ফেরে।কি হবে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে! সেদিন রাতে খাবার টেবিলে শাশুড়িমা এই নিয়ে ওকে প্রশ্ন করতে, শাশুড়িমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে সে মোটা মাইনের বৌ ঘরে নিয়ে এলে তার ওপর অফিসের কাজের চাপ অনেক থাকে। তাই এই সব নিয়ে কোনো অবাঞ্ছিত প্রশ্ন তাকে না করাই ভালো। মাস গেলে সংসারে টাকাও আগের থেকে অনেক বেশি দেয়। তাই কেউ কিছু বলতেও পারে না। অবশ্য সবারই চোখে মুখে সব কিছুই প্রকাশ পায়।সেদিকে দৃষ্টিপাত না করে, রাতের খাবারটা কোনোরকমে গলাধঃকরণ করে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো প্রিয়ংবদা। কাল সকালে আবার অফিসে বেরোনো আছে। অবাঞ্ছিত কথায় কথা বাড়িয়ে যে নিজের শক্তি ক্ষয় ছাড়া আর কিছু হয় না সেটা এতদিনে ও বুঝে গেছে। হঠাৎ পিছন থেকে কানে এলো শ্বশুর মশাই ওর ভাসুরের দশ বছরের ছেলে রেহানকে বলছে, “দাদুভাই, গান শিখতে হলে কিন্তু তোমাকে এই অভিমন্যুর মতো মাউথ অর্গান বাজানো শিখতে হবে। আহা কি সুন্দর বজায় ছেলেটা। বাংলার নতুন আওয়াজ কে বলবে! এই কদিন হলো রেডিওতে বাজাচ্ছে কিন্তু শুনলে পুরো বোঝা যায় যে পোক্ত হাত।এতদিন যে এই সব প্রতিভা কোথায় লুকিয়ে ছিল কে জানে! দাদুভাই তুমি, পারবে তো আমার মুখ উজ্জ্বল করতে?”

    কোনো কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় প্রিয়ংবদা। মুখে একটা জয়ের হাসি। আড়চোখে দেখে নেয় দাশগুপ্ত পরিবারের সম্ভ্রমশীলতার চক্রবুহ‍্যকে…

    পিছনে তখন রেডিওতে অভিমন্যু ঝড় তুলেছে তার সঙ্গীর সাথে…
    “কারার ঐ লৌহকপাট,
    ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট,
    রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
    ওরে ও তরুণ ঈশান,
    বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
    ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি….”

You cannot copy content of this page