-
ধারাবাহিক- নীলচে সুখ ( চতুর্থ ভাগ )
নীলচে সুখ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়পর্ব- ৯
সিকিমের পাহাড়গুলো বড়োই ভঙ্গুর। যখন তখন, যেখানে সেখানে ধ্বস নামে। মানগাং তাদের অন্যতম। সম্ভবত সেই কারণেই এখানে জনবসতি কম। জনবসতি কম বলেই, এখানকার সৌন্দর্যে ভাটা পড়েনি। প্রকৃতি এখানে নিষ্কলুষ। মন এখানে প্রজাপতি হতে চায়। সৌন্দর্যের মধু নিতে চায় উড়ে উড়ে, আরও আরও আরও দাও প্রাণ।
গতকাল যেখানে ধ্বস নেমেছিল সেই জায়গা এখনো পরিস্কার করার কাজ চলছে। বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মীরাও অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন।
এখানের ধ্বসে, পাথরের ছোট বড়ো টুকরোর সাথে প্রচুর মাটিও ওপর থেকে নেমে আসে।
বড়ো বড়ো পাথরের চাঁইগুলোকে সরিয়ে দেওয়া গেছে, কিন্তু ছোট ছোট টুকরোগুলো, বৃষ্টি ভেজা মাটির সঙ্গে লেপটে আছে। কাদা প্রায় হাঁটুর সমান। তারই নিচে ডুবে থাকা পাথরগুলো দেখা যায় না। অন্তত পঞ্চাশ মিটার এলাকা এইরকম ভয়ঙ্কর ভাবে রয়েছে।
দপ্তরের কর্মীরা পুলিশের সহায়তায়, একটি একটি করে গাড়ি অতি সাবধানে এই রাস্তাটুকু পার করিয়ে দিচ্ছেন।
দইগোলার মতো কাদার ওপর দিয়ে কোনও রকমে একটি একটি করে গাড়ি ঐ ভয়ঙ্কর রাস্তাটুকু পার হয়ে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচচ্ছে।
বাঁ দিকে গভীর খাদ। সেখানে গিয়ে পড়লে, সোজা কল্পিত স্বর্গলাভ নিশ্চিত।কয়েকটি গাড়ি মোটামুটি নির্বিঘ্নেই চলে গেল। কিন্তু বিপদ হলো ওদের গাড়ির বেলাতেই।
কাদার নিচে ডুবে থাকা একটা পাথরে ধাক্কা লেগে গাড়ির চাকা গেল ঘুরে। তখনই সকলকে হতবিহ্বল করে গাড়ি চলে এলো একেবারে গভীর খাদের কিনারায়।
গাড়ির সামনের দিকের অংশ খাদের দিকে ঝুলে গেল। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলতে হবে। অথবা আয়ুর জোর । পিছনের দিকের একটা চাকা, বেশ বড়ো একটা পাথরে আটকে গেল। তাই গাড়িটা যাত্রী সমেত খাদে গড়িয়ে যেতে গিয়েও, শেষ অবধি থমকে থেমে গেল।
গাড়ির মধ্যে নয়টি প্রাণী আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে কাঠের পুতুলের মতো নিথর হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর প্রতিক্ষা করছে।
কিছু পরেই তারা অনুমান করলো, এ যাত্রা তারা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে, কিন্তু বিপদ কাটেনি। সামান্য নড়াচড়া তাদের বিপদে ফেলতে পারে। নীল মৃদু স্বরে বললো, ‘কেউ নড়াচড়া করবে না। যে যেখানে যেমন আছো, তেমনই থাকো।’
ড্রাইভার, নীলের কথায় সমর্থন জানিয়ে, ভাঙা বাংলায় বললো, ‘রাইট স্যার। একদম হিলবেন না। গাড়ি হিলিয়ে গেলে, নিচে চলে যাবে। জান কা খতড়া আছে বাবু।’
ততক্ষণে বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের কর্মীরা এসে গেছে। গাড়ির পিছনে ক্রেনের হুক লাগিয়ে টেনে তুলছে গাড়ি। খুবই সন্তর্পণে, ধীরে ধীরে গাড়ি আবার সেই রাস্তায় ফিরে এলো।
বিপদ কেটে গেছে। মানালি মায়ের কোলে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে। মিসেস রায় প্রফেসরকে প্রবল বিক্রমে জাপটে ধরে আছেন। প্রফেসরের চোখ বন্ধ, কিন্তু
ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে, নাকি
মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করছেন, তা তিনিই বলতে পারবেন।
গাড়ি রাস্তায় উঠে আসার পরেই, আবার চলতে শুরু করেছে। প্রফেসর এবার চোখ মেলে তাকালেন। ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে অত্যন্ত বিনয়ী কন্ঠে ধীরে ধীরে বললেন,
‘সামাল কে ভাইয়া, জান কা মামলা হ্যায়।’
ড্রাইভার হেসে বললো, ‘পাহাড় মেঁ এয়সা হোতি হ্যায় সাব। ঘাবড়াইয়ে নেহি । সামনে অর ভি খতরনাক জায়গা মিলেগি। ভরোসা রাখিয়ে। কুছ নেহি হোগা। ম্যয় হুঁ না।’আপাতত বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু মিসেস রায়ের মনে ভীষণ ভয় ঢুকে গেছে। ওই যে ড্রাইভার বললো, সামনে নাকি আরও বিপদ আছে? ড্রাইভারের ওই, ম্যায় হুঁ না, কথায় কারো বিশ্বাস নেই। এইমাত্র যে কান্ড ঘটিয়েছো, তারপরে তোমাকে ভরসা করার কোনও মানেই হয় না। অথচ অনন্যোপায়, তাকেই নির্ভর করতে হবে, আগামী বেশ কয়েকদিন।
এর চাইতে অসহায় অবস্থা আর কি-ই বা হতে পারে?
মানালি মায়ের কোল থেকে মুখ তুলে হালকা স্বরে বললো, ‘গাড়িটা একটু দাঁড় করাও না, একটু নেমে জল খাবো।’
সম্ভবত জল খাওয়া উদ্দেশ্য নয়। সে তো গাড়িতে বসেই খাওয়া যায়।
আসলে মাটির মানুষ। মাটিতেই ভরসা, নির্ভরতা। সাক্ষাৎ মৃত্যুকে এত সামনে থেকে দেখে, সেই মাটির প্রতি টান গভীর হয়ে উঠেছে। একবার এখনই তাকে না স্পর্শ করলেই নয়।
মাটি। মানুষের জীবন ধারণের এক প্রধান উপাদান। মাটি, তুমি ছাড়া হ’লেই হৃদয় কম্পমান। মাটি, তোমাকে শতকোটি প্রণাম।
কথাটা বোধহয় সকলের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো, শুধু মুখ ফুটে বলছিলো না।
নীল তৎক্ষনাৎ হুকুমের সুরে বললো, ‘এই ড্রাইভার, গাড়ি থামাও। আমরা একটু নামবো।’
ড্রাইভার আরও মিনিট কয়েক পরে একজায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলো।
পাহাড়ের কোলে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান। প্রকৃতি এখানে আরও উদার। চারপাশ, যেদিকে চোখ যায়, পাহাড় পাহাড় আর পাহাড়। একটি ঝর্ণা, এলোচুল চঞ্চলা কিশোরীর মতন হেলেদুলে নাচতে নাচতে ওই দূরের পাহাড় থেকে নিচে নেমে আসছে। তার ঝরঝর শব্দ, সরোদের ঝংকার তুলে ধ্যানমৌন পাহাড়ের ঘুম ভাঙাতে নিরলস চেষ্টায় নিমগ্ন।
পাইন কাঠের ছোট্ট বেঞ্চি। প্রফেসর আর মিসেস রায়, তাতে বসে পড়লেন। বুক ভরে নিলেন বিশুদ্ধ বাতাস। এখনো কেউই স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারেননি। জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেলো সবাই। দারুণ ঠান্ডা জল। আবারও মেঘ ঘনিয়ে আসছে। কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইছে।
চা দোকানী- একটি পাহাড়ি স্ত্রী লোক, তার পিঠে কাপড় দিয়ে বাঁধা একটি বাচ্চা।
চলমান জীবন যুদ্ধের জলজ্যান্ত ছবি। এভাবেও বাঁচে জীবন। বুকে লড়াই আর স্নেহ মমতাকে পিঠে বেঁধে, সুখ অসুখের সীমানা পেরিয়ে, মৌন গম্ভীর ধূসর জীবনযাপন।
আরও পথ। সামনে আরও পথ। অজানা অচেনা। আস্থাহীন সারথি’র হাত ধরে, সুখের খোঁজে পথ চলা। কেবলই পথ চলা।পর্ব-১০
পাহাড়ি পথে গাড়ি চাপলেই সমতলের মানুষ কিঞ্চিৎ ভীতু হয়ে যান। পাকদণ্ডী পথে পাক খেতে খেতে গাড়ি যতই ওপর দিকে উঠতে থাকে। নিচের দিকে তাকালে, বুক কেঁপে ওঠে।
মৃত্যু ভয়, প্রতি মুহূর্তে জানান দেয়, জীবন কত মধুর, কত সুন্দর।
একে হারাতে চাই না। থাকো, থাকো, ওগো প্রাণ। শরীরের খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকো দীর্ঘ সময়। আনন্দময় সুখী হয়ে।
যান্ত্রিক বিপর্যয়ের ভয় তো আছেই। বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা দুরন্ত গাড়িগুলো, যতক্ষণ না পাশ দিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যাচ্ছে, আতঙ্ক কাটে না। বিশেষ করে গাড়ি যদি, খাদের দিকে থাকে।
আর, স্টিয়ারিং হাতে লোকটির প্রতি আস্থা যদি তলানিতে গিয়ে থাকে। তবে আতঙ্কের মাত্রা কোথায় পৌঁছাতে পারে, তা ভুক্তভোগী মাত্রই নির্ঘাত ভাবে উপলব্ধি করতে পারেন।
এদের ক্ষেত্রেও সেই একই অনুভূতি। তাই, পথে যেতে যেতে প্রকৃতির আশ্চর্য সুন্দর রূপ-সুধা তেমন করে আকন্ঠ মুগ্ধতায় পান করা হয়ে উঠলো না। একটা ভয়ার্ত, দমবন্ধ ভাবনা থেকে কিছুতেই নিস্তার পাওয়া গেল না।ড্রাইভার হঠাৎ হিন্দিতে বললো। যার বাংলা তর্জমা করলে যা হবে, ‘ডান দিকের জানালার কাঁচগুলো বন্ধ করে দিন। নইলে, ঝর্ণার জলে ভিজে যাবেন। এখনই আমরা ঝর্ণার ভেতর দিয়ে যাবো। ভীষণ ঠান্ডা জল। বরফের মতো। এই ঠান্ডায় ভিজে গেলে, খুবই কষ্ট পাবেন।’
এর পরের কথাটি সত্যিই আতঙ্কিত হবার মতো।
‘ঝর্ণার জলে ওখানকার রাস্তায় হাল খুবই খারাপ। গাড়ি দুলবে। ভয় পাবেন না। সবাই শক্ত করে ধরে চুপচাপ বসে থাকবেন। নড়াচড়া করবেন না। কারণ রাস্তা শুধু ভাঙাই নয়, পিচ্ছিলও বটে।’
সকলেই বাক্যহারা। সকলেই সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিলো।
কিছুক্ষণ আগেই ঘটে যাওয়া সেই ভয়ানক ঘটনা এখনো মনের মধ্যে দগদগে হয়ে আছে। এরপর আবারও যদি…
মিসেস রায় মনে মনে এই অনাবশ্যক ঝুঁকি পূর্ণ ভ্রমণে আসার জন্য আক্ষেপ করছেন। আনমনে হাত ব্যাগের মধ্যে থেকে একটা ছোট্ট রুমাল বের করে আনলেন। পুঁটুলির মতো করে বাঁধা।
সেটি চোখ বুঁজিয়ে কপালে ছোঁয়ালেন। ওটা মানালির দেওয়া সেই প্রসাদী ফুল।
দুর্গামাঈ কী জয়। বিপদ আপদে তার কথাই বড্ড বেশি মনে পড়ে।
প্রফেসর বিস্ফোরিত চোখে বললেন, ‘একেবারে ঝর্ণার মাঝখান দিয়ে?’
ড্রাইভার বললো, ‘ইয়েস স্যার। বো ঝোরা পাহাড়কে উপর সে সিধা রাস্তে পে গিড়তা।তেজ জাদা নেহি, লেকিন পানি কে কারণ দিক্কত হোতি হ্যায়। ডড় নেহি।’
আর একটু এগিয়েই ড্রাইভার বললো,
‘ওয়ো দেখিয়ে দূর সে বহৎ আচ্ছি লাগতি। ম্যায় ইঁহা গাড়ি রোক দেতা হুঁ। ফোটো খিঁচ লিজিয়ে।’
নীল বসে ছিল সেই জানালার ধারেই। দরজা খুলে সেই প্রথম নেমে গেল। অস্ফুটস্বরে বললো, ‘রিয়েলি ওয়ান্ডারফুল। নাইস।’
একে একে সবাই নেমে এলো গাড়ি থেকে। সেই আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্যের মনোহরণ রূপে, মোহিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এমন সৌন্দর্য উপভোগ করতে সহস্রবার জীবনের ঝুঁকি নেওয়া যায়। এ-ই তো জীবন। এখানেই তো জীবন আর মরণের তফাৎ।
দূর থেকে যে নৃত্যরতা কিশোরী ঝর্ণটি দেখা যাচ্ছিলো এতক্ষণ। এ-ই সেই স্বর্গীয় নর্তকী। পাহাড়ের কোল থেকে নেমে এলোমেলো অশান্ত দুরন্ত পায়ে সে ছুটে যেতে যায় কোন অজানার দেশে। অজস্র অজস্র জলকণা ধোঁয়ার মতো ছেয়ে ফেলেছে চারদিক। সাদা ফ্যানার স্রোত হু হু করে নেমে যাচ্ছে পাশের খাদে জলতরঙ্গ বাজাতে বাজাতে।
মুভি মুডে ছবি ধরা রইলো সকলের ক্যামেরায়। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। কিন্তু ছবি তো শুধুই ছবি। প্রাণসঞ্চার হলো কী তাতে? না। তাকে ধরা যায় না। সে থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মনের অন্দরমহলে প্রবেশাধিকার পেয়েছে যে, তাকে বন্দী করবে, এমন সাধ্য কার?গাড়ি এগিয়ে চললো। চিরকিশোরী রৌপ্যবর্ণা মাধুরিকে প্রেম চুম্বন দিয়ে, দূরে, আরও অনেকটা পথ বাকি। পৌঁছাতে হবে সন্ধ্যার আঁধার নামার আগেই। এই পথে পাহাড়ি ভাল্লুকের উপদ্রব আছে।
এখন পাহাড় যেন চারপাশ থেকে জাপটে ধরতে আসছে। কালচে পাহাড়গুলো এক-একটা বিশালাকার দৈত্যের মতন খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।
এতো রূপ এরা পেলো কোথায়। কোন সে রূপকার, কেমন করে এমন হৃদয় হরণ সাজে সাজালো এদের?
হে প্রকৃতি। হে প্রকৃত দেবতা, তুমি তোমার অনির্বচনীয় সুখানুভূতি রংতুলির প্রলেপ বুলিয়ে দাও প্রতিটি মানুষের অন্তরে। ঘুচে যাক অমানিশার করাল ছায়া। প্রতিষ্ঠিত হোক প্রেমময় আলোকবর্তিকা। হয়ে উঠুক বিশাল আর সুন্দর।গাড়ি আরও কিছুদূর গিয়ে আচমকাই তার গতি কমিয়ে দিলো। ওরা সবাই গাড়ির সামনের কাঁচ দিয়ে দেখতে পেল, একটা পাহাড়ি ভাল্লুক দুলকি চালে রাস্তার একপাশ দিয়ে চলছে।
ড্রাইভার বললো, ‘দেখিয়ে, ভালু আ গিয়া।’
তন্ময় অস্থির হয়ে বললো,’আরে ভাই, পাশ কাটিয়ে চলো না, ভাল্লুক আবার দেখার কী হলো?’
ব্রজেশ বললো, ‘এই শোন, তুই কখনো দেখেছিস, রাস্তা দিয়ে ভাল্লুক দুলকি চালে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে?’
তন্ময় চুপসে গেল। তবুও বললো, ‘না মানে, দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাই..’
প্রফেসর বললেন, ‘আরে, যদি পাশ কাটিয়ে যাওয়া উচিৎ হতো, তাহলে ড্রাইভার তাই করতো।’
-‘রাইট স্যার। বো কভী ভি এট্যাক কর সকতা হ্যায়। বো আবভী জঙ্গল কা রাস্তা পরড় লেগা। সামনে যানা খতরনাক হো সকতী হ্যায়। ইয়ে বহৎ ডেঞ্জারাস জানবার সাব।’
সত্যিই তাই। ভাল্লুকটা বাঁদিকের পাহাড়ের বাঁকে জঙ্গলে ঢুকে গেল। এই সময়ের অপেক্ষাতেই ছিল ড্রাইভার। জোরে গাড়ি চালিয়ে দিলো।
এখন আর কোথাও কালক্ষয় নয়। গাড়ি ছুটে চললো লাচেনের উদ্দেশ্যে ।পর্ব-১১
জীবন থেমে থাকে না, পরিবর্তন আনে। কালের নিয়মে। ফেলে আসা সময়, পিছুটান রেখে যায় স্মৃতির এলবাম।
কর্মময় ব্যস্ত জীবনে মায়ার বাঁধন। সঙ্গে আছে দায়দায়িত্ব, কর্তব্য আর অধিকার অনধিকারের বিচিত্র টানাপোড়েন।
তারই মাঝে খুঁজে ফেরে, হাতড়ে বেড়ায় মন, একটুকরো সুখের অঙ্গন। কে জানে সেই সুখের কী রঙ।চার বন্ধুর ইদানীং বিশেষ দেখাসাক্ষাৎ হয় না। জীবন জীবিকার তাগিদে সবাই ব্যস্ত।
ফোন আসে কখনো সখনো। কথা হয়।
কথা হয় ঠিকই, তবে সেই কথায় আগের মাত্রাহীন উচ্ছ্বলার উত্তাপ নেই। মাপকষা গতানুগতিক বাঁধাছকের নিয়মমাফিক কথপোকথন ।
তারুণ্য বড়ো ক্ষণস্থায়ী।
যতক্ষণ থাকে, তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না।
হারিয়ে যাবার পর যা থাকে, তা শুধুই গল্প।মানালি আর নীলের মাঝে একটা অন্য রকম সম্পর্ক হয়তো এসেছিল। তবে তা ভালোলাগা।
তার বেশি কিছু নয়। হয়তো।
ভালোবাসা পরিনতি খোঁজে। পরিনতি চেয়ে থাকে ভবিষ্যতের দিকে।
জীবন তো গানিতিক নিয়মের দাসত্ব করে না। সে চলে তার নিজস্বতায়। তাইতো সব জীবন একই রকম নয়।মানালি এখন কানাডায়। ওর স্বামী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। চাকরির সূত্রে আপাতত সেখানেই সেটেল্ড। কাজেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে।
ব্রজেশ গায়ক হতে চেয়েছিল। হয়নি। বাবা হঠাৎই মারা যাবার পর, পারিবারিক ব্যবসা সামলাতে ব্যস্ত। একমাত্র সন্তান কি না।
তন্ময় শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখতো। এখন নিজেই কোচিং সেন্টার খুলে, সেই স্বপ্ন পুরণের চেষ্টা চালাচ্ছে।
দীপেন হারিয়ে গেল। মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিল। কেউ বলে প্রেমের আঘাত, কেউ বলে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা। হতাশা।
প্রত্যাশা কিংবা নিজস্ব যোগ্যতার প্রতি প্রবল বিশ্বাস, সে-ও তো প্রেম।নীল টিভি সিরিয়ালে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করে। আশায় বুক বেঁধে আছে, একদিন নায়ক হবে। হয়তো হবে।
সুখের স্বপ্ন উড়ান, আর সুখের ঘরে বাস কিছুতেই এককথা নয়।রাত তখন কত জানা নেই। নীলের জানবার ইচ্ছেও নেই। নীলচে সুখ রিসর্ট ঘুমিয়ে পরেছে। কেবল বারান্দার কয়েকটি আলো, জ্বালা আছে।
জ্বালা আছে ‘নীলচে সুখ’ লেখা গ্লো-সাইনবোর্ড। বাকি সব অন্ধকার।
লনের চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল নীল।রুমার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।
-‘একি, এখানেই এইভাবে সারারাত বসে থাকবে না কি! চলো, ঘরে চলো। উঠে এসো। চলো।’
রুমা, নীলের হাত ধরে টেন , তাকে তোলবার চেষ্টা করলো। পারলো না।
নীল, রুমার হাতটা চেপে ধরলো, অনুনয়ের সুরে বললো, ‘একটু বসবে, আমার কাছে। একটু সময়.. প্লিজ.. বসবে?’
রুমা হাই তুলে হালকা গলায় বললো, ‘ছেলেটা ঘরে একা ঘুমিয়ে রয়েছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে কাউকে দেখতে না পেলে কান্নাকাটি করবে, ভয় পাবে। প্লিজ, ঘরে চলো। তোমার সব কথা শুনবো, কাল সকালে। এখন শোবে চলো।’
নীল, রুমার চোখের দিকে তাকিয়ে, ওর মন বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর সামান্য আওয়াজ করে হাসলো।
রুমা, নীলের মুখের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে সামনের চেয়ারে ধপাস করে বসেই বললো, ‘হাসলে যে, কী বোঝাতে চাইছো তুমি, আমি তোমায় এভয়েড করছি?’
– ‘তাই, বললাম কী?’
-‘ সব কথা উচ্চারণ করতে হয় না। অন্যভাবেও বুঝিয়ে দেওয়া যায়। যাক গে, কী বলবে বলো।’
নীল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘নাহ্ থাক,..’ -‘কেন! থাকবে কেন? বলোই না শুনি, নতুন করে প্রেম নিবেদন করবে নাকি? দেখো বাবা। কেন যে শুধু শুধু এইসব মাল ফাল খেতে গেলে, জানি না।’
নীল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ঘরে চলো। ছেলেটা একা আছে।’কখনো কখনও মেনে নেওয়া কিংবা মানিয়ে নেওয়াও সুখ। এডজাস্টমেন্ট।
স্বপ্ন আর বাস্তব কিছুতেই মেলে না।
দুস্তর দূরত্ব এই দুয়ের মাঝে। দুরত্বের মাঝেই যন্ত্রণার ঘর। দিগন্তের স্পর্শ পাওয়া অবাস্তব। সে কেবলই দুরত্বের নির্মম মায়াজাল।মানালিকে নিয়ে ও যে কল্পনার আল্পনা আঁকেনি, এমন বললে নিতান্তই তঞ্চকতা করা হবে।
মানালির মনের কথা ওর জানা নেই। তবে আন্দাজ করতে পারে। হয়তো সেও, মনে মনে, নির্জন বৃষ্টি ভেজা মায়াবী চাঁদনী রাতের পাহাড়ি পথে, তার হাতের ছোঁয়া সুখস্মৃতি, এখনো যে অমলিন।স্মৃতি পিছুটান। তার হাত থেকে বোধকরি কারোরই রেহাই পাবার যো নেই।
মুশকিল সেখানেই, যখন অতীত, বর্তমানের ঘরে উঁকি দেয়, কিন্তু ধরা দেয় না। তার পালিয়ে বেড়াতেই সুখ। ধরা ছোঁয়ার অনেক বাইরে। আলতো পায়ে তার কেবলই নিঃশব্দ যাওয়া আসা। মনের আঙ্গিনায় আলোছায়ায় লুকোচুরি।
বাতাসে ফিসফিস করে কে যেন বলে,
‘আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকবো..’
মনের অতলান্ত গভীরে, নিভৃত একান্তে।
বড়ো জানতে ইচ্ছে করে।
ওগো সুখ, তোমার কী রঙ?
শেষ নাহি রে, শেষ কথা কে বলবে?।। সমাপ্ত।।
-
ধারাবাহিক- নীলচে সুখ ( তৃতীয় ভাগ)
নীলচে সুখ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়পর্ব-৭
নীল আর মানালি চাঁদের আলোয় হেঁটে চলেছে পাহাড়ি রাস্তায়। একটা বাঁক ঘুরতেই তারা দেখলো, পাহাড়ের কোলে একটা মন্দির। মন্দিরের চারপাশ বেশ আলো সাজানো। জেনারেটর ব্যবহার করা হয়েছে। আরও এগিয়ে গেল মন্দিরের কাছে। বেশ কিছু মানুষের ভীড়। সবাই স্থানীয়। সেখানেই হচ্ছে সেই ভজন গান। যা দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল। কাছে গিয়ে মূর্তির দর্শন করলো। দুর্গা মূর্তি। পার্বতী। পর্বতেই যায় আবাস। প্রণাম সেরে ঘুরে দাঁড়াল। এবার ফিরতে হবে। লজ থেকে অন্তত মাইল খানেক দূরে চলে এসেছে ওরা। সবাই নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। অচেনা অজানা জায়গা। কাউকে তেমন করে কিছু বলে আসা হয়নি। মানালির বাবা মা দুশ্চিন্তা করবেন, তাতে আশ্চর্যের কী! ঠান্ডাও এখানে অনেক বেশি।
ঠিক তখনই একজন সাধু গোছের লোক, তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সাদা দাড়ি গোঁফ। মাথায় সাদা লম্বা চুল। সাদা ধুতি আর গায়ে একটা সাদা শাল। অনেকটাই বয়স হয়েছে। হাতে একটা পিতলের থালা, তাতে কিছু পাহাড়ি ফুল আর খেজুর কিসমিস। মৃদু হেসে বললেন, ‘দুর্গামাঈ আপকা ভালা করে। লিজিয়ে, পরসাদ লিজিয়ে।’
ওরা অযাচিত এই আহ্বানে একটু কুন্ঠিত বোধ করলো। তারপর আড়চোখে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে নির্বাক সম্মতিতে, বাড়িয়ে ধরা থালা থেকে ইতস্তত ভাবে যৎসামান্য প্রসাদ তুলে নিলো।
লোকটি অত্যন্ত প্রসন্ন চিত্তে দুজনের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে বললেন,
‘দুর্গামাঈ আপ দোনো কো সুখী রাখে, কুশল মঙ্গল রাখে। জয় দুর্গামাঈ।’
লোকটি ভীড়ের ভেতর চলে গেলেন।
ওরা ফেরার পথ ধরলো।
মন্দির চত্তরের বাইরে এসে, নীল বললো,
‘মানালি, তোমার কাছে রুমাল আছে?
মানালি অবাক হয়ে বললো, ‘হ্যাঁ আছে, কেন?’
নীল দাঁড়িয়ে গেল। বললো,’গুড,দাও।’
মানালি হাতের ছোট ব্যাগের ভেতর থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিলো। নীল রুমালটা নিয়ে বললো, ‘এবার তোমার হাতের প্রসাদ আর ফুলগুলো এর মধ্যে রাখো।’ মানালি যন্ত্রচালিতের মতো তাই করলো।
নীল নিজেও তার হাতে ধরে রাখা ফুল, প্রসাদ রুমালের মধ্যে রেখে ভালো করে বেঁধে, মানালির হাতে ফেরৎ দিয়ে বললো,
‘নাও, যত্ন করে রাখো। এটা এখন আমাদের কৈফিয়ত কিংবা সাক্ষী যা খুশি বলতে পারো।’
মানালি কপাল কুঁচকে অবাক হয়ে বললো,
‘তার মানে?’
-‘তার মানে লজে ফিরে গেলেই বুঝবে। কতরকম প্রশ্নের মুখে পরবে জানো? কোথায় ছিলি, কোথায় গেলি, এতো দেরি কেন? উরিব্বাস!
সব প্রশ্নের মুশকিল আসান, এই দুর্গা মা’য়ের প্রসাদ। কী? কিছু ঢুকলো মাথায়?’
মানালি হি হি করে হেসে বললো, ‘যাঃ খালি ফাজলামো।’
নীল বললো, ‘তোমার কোন কলেজ যেন?’ -‘রামমোহন, কেন?’
-‘ওই তো, সেই জন্যেই, পড়তে আমার মতো প্রেসিডেন্সিতে, দু-দিনেই বোলচাল, মগজ সব অন্যরকম গল্প হয়ে যেতো।’
-‘আরে রাখো তোমার প্রেসিডেন্সি। ওখানে কি-হয় না হয় সবাই জানে। আমার বোলচাল মগজ ঠিক জায়গাতেই আছে।’
-‘আরে আমারই সামনে, আমার কলেজের কুৎসা! না না এ অসহ্য।’
-‘ঠিক আছে, তুমি তোমার অসহ্যতা নিয়ে সারারাত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। আমি চললাম।’
মানালি সত্যিই গটগট করে অন্ধকারে মধ্যে হাঁটতে শুরু করলো। নীল থতমত হয়ে পিছন থেকে বললো, ‘আরে, কী মুশকিল। আমি আসছি তো।’ মানালি সে কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে তার চলার গতি আরও বাড়িয়ে দিলো। নীল পিছন থেকে প্রায় ছুটে এসে মানালির হাত ধরে ফেললো।
মানালি একটুও সেই হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলো না। শুধু মুখে কৃত্রিম বিরক্তি ভাব এনে বললো, ‘প্রেসিডেন্সি..’
মানালির নরম হাত, নীলের শক্ত মুঠোয় ধরা। সেটা কী মানালির নিরাপত্তার কারণে, সাবধানতা! নাকি আবেগ দূর্বলতা ! কারণ যাই হোক, এক আশ্চর্য সুন্দর সুখানুভূতি স্নিগ্ধ ঝর্ণার মতো বয়ে যাচ্ছিলো, দুজনের মনের গহীনে, যা অব্যক্ত।
নীল, হালকা ধমকের সুরে বললো,’অন্ধকারে ঐভাবে কেউ দৌড়োয়! আছাড় খেলে বুঝতে মজা।’
মানালি একটু সময় চুপ করে থেকে বললো,
‘অন্ধকার পাথুরে রাস্তায় চলতে আমরা ভয় পাই। আঘাত লাগার ভয়। কিন্তু এটাও তো সত্যি, এই পথ আমাদের শিক্ষাও দেয়। জীবনের চলার পথ আলোকিত মসৃণ নয়। অনেক বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে চলতে চলতে আলোর দিশা পেতে হয়। তাই না?’
রাস্তায় মাঝে মধ্যেই বড়ো বড়ো ভাঙা গর্ত। বৃষ্টির জলে টইটম্বুর। আকাশের ভাঙা চাঁদের প্রতিবিম্ব সেই জলে এসে পড়েছে। যেন এই মায়াময় নির্জনতায় ওদের দুজনকে দেখবে বলে, জলের নিচে ঘাপটি দিয়ে বসে আছে। তিরতির করে বহে যাওয়া ঠান্ডা হাওয়ায় সেই জল কেঁপে কেঁপে উঠছে, কাঁপছে প্রতিবিম্ব।
নীল, সেই কম্পমান চাঁদের দিকে তাকিয়ে হালকা গলায় বললো, ‘তোমার সাবজেক্ট যেন কী?’
মানালি কপাল কুঁচকে বললো, ‘ফিলোসোফি কেন?’
নীল হাসতে হাসতে বললো, ‘না, এমনিই..:
মানালি ততক্ষণে বুঝতে পেরেছে, এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে, নীলের পিঠে চটাস করে একটা চাপড় মেরে বললো, ‘ইয়ার্কি হচ্ছে না, অসভ্য ছেলে।’
নীল এইবারে হো হো করে হেসে বললো,
‘মাফ করো, জুলজির মাথায় ফিলোসোফি ঢুকবে না। হা হা হা।’
নীলের অমন প্রাণখোলা হাসি দেখে, মানালিও স্থির থাকতে পারলো না। সেই হাসিতে সেও যোগ দিলো। হা হা হা…
তাদের সেই সম্মিলিত নির্মল হাসি, প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো রাত সুন্দরী পাহাড়ের নিঝুম কোলে কোলে।
সুন্দরী সিকিম, নব যৌবনের উচ্ছ্বলতায় আরও সুন্দরী হয়ে উঠলো।কিন্তু, লজে অপেক্ষারতা মাতা সুন্দরী কী করেন সেটাই এখন দেখার।
পর্ব-৮
এখন রাত আটটা। ছোট্ট এই প্রায় জনমানবহীন পাহাড়ি গ্রামে মধ্যরাতের নিঃস্তব্ধতা। মিসেস রায় একা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেয়ের আকুল প্রতীক্ষায়।
ছেলেগুলোকে জোর করেই পাঠিয়েছেন একটু এগিয়ে গিয়ে, যদি ওদের কোনও হদিস করা যায়, এই আশায়। একেই বলে উদ্বেগ। স্বাভাবিক।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেরা ফিরে এলো। ওদের দেখা পায়নি। তবে অন্য খবর এনেছে। রাস্তা পরিস্কারের কাজ চলছে। আন্দাজ মতো কাল সকল নটার পরেই রাস্তা চালু হয়ে যাবে। যদি না আবারও নতুন করে ধ্বস নামে।
মিসেস রায় কথাগুলো শুনলেন বটে, কিন্তু বিশেষ উৎসাহ পেলেন বলে মনে হলো না।
শুধু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে চলে গেলেন।
প্রফেসর চোখ বুঁজে শুয়ে একটু বিশ্রাম নেবার চেষ্টা করছিলেন। মিসেস রায়ের কথায় সে চেষ্টায় জল ঢেলে উঠে বসলেন। চাপা গলায় বললেন, ‘আরে..এতো মহা মুশকিল। আমি কী করলাম?’
মিসেস রায়ও একইভাবে বললেন,
‘তুমিই তো ওদের জোটালে। গায়ে পড়ে।’ -‘কেন? তুমিও সামনেই ছিলে। তুমি ওদের অফার, আই মিন প্রপোজাল দাওনি?
তাছাড়া এসব কথা উঠছে কেন? কোথায় কী রামায়ণ মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে?’
-‘তুমি চুপচাপ ঘরে বসে আছো কেমন করে? এতখানি রাত হলো, এই ভয়ঙ্কর জায়গায় মেয়েটা একটা সামান্য পরিচিত ছেলের সঙ্গে, ওফ্ফ.. কী কুক্ষণে এখানে এসেছিলাম। আসা থেকে দুর্ভোগ পিছু নিয়েছে। যাক, তুমি একবার বাইরে বেরিয়ে দেখবে, নাকি আমিই যাবো?’
-‘কেন? ওরা গেলো তো..’
-‘ওরা ফিরে এসেছে। দেখা পায়নি। রাস্তা সারাইয়ের খবর এনেছে।’
-‘তাই নাকি, বেশ ভালো। সারাইয়ের কাজ কী হয়ে গেছে?’
-‘তোমার যাবতীয় মুখোরোচক প্রশ্নের পছন্দের উত্তর পাশের ঘরে গেলেই পেয়ে যাবে। যাও পাশের ঘরে যাও। জমিয়ে বসে সবকিছু ঠিকঠাক জেনে এসো, যাও।’
-‘তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? একটা কথা ব’লে রাখছি শোনো- আমি দীর্ঘদিন যাবৎ এইরকম তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে শিক্ষকতা করে কাটিয়েছি। আমি চিনতে ভুল করি না। তুমি যা কল্পনা করছো, তা একেবারেই ভুল। নতুন জায়গায় একটু ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। বেড়াতেই তো এসেছে। ঘরে শুয়ে বসে থাকার জন্য তো আসেনি। এটাই স্বাভাবিক। আমার সেই বয়স থাকলে, আমিও এইরকম গ্যাঁট হয়ে ঘরে বসে অকারণ বকবক করে সময় নষ্ট করতাম না। সে অভিজ্ঞতা তোমার যথেষ্টই আছে।’
মিসেস রায় বুঝলেন, এইভাবে বলা তার উচিৎ হয়নি। মানুষটা মনে মনে দুঃখ পেয়েছেন।পায়ে পায়ে খোলা জনলার ধারে এসে দাঁড়ালেন। অন্ধকারে বেশি দূর দেখা যায় না। মনের মধ্যেও একরাশ দুশ্চিন্তার অন্ধকার। মায়ের মন, সন্তানের জন্য ব্যাকুল হবেই। অনিচ্ছা সত্বেও দু’একটা অবান্তর অপ্রিয় কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবেই। উচাটন বাগ মানে না।
প্রফেসর আড় চোখে মিসেস রায়ের দিকে তাকিয়ে, পায়ে চটিটা গলিয়ে, বাইরে বেরুতে যাবেন ঠিক তখনই পাশের ঘর থেকে একটা সমবেত কোলাহল ভেসে এলো।
-‘ এই এসে গেছে। কোথায় গিয়েছিলি এতক্ষণ? বলে যাবি তো।’
প্রসেসর বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন,
‘মানালি তুমি মায়ের কাছে যাও। উনি তোমার জন্য খুবই চিন্তা করছিলেন। যাও।’
মানালি বাবার পাশ দিয়ে ঘরে চলে গেল। মিসেস রায় তখনও একইভাবে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে, বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন।
মানালি কাছে গেল না। সামান্য দূর থেকে আদুরে গলায় বললো, ‘মা, তুমি রাগ করেছো?’
মা তখনও একটুও নড়লেন না। শুধু নির্বাক নিশ্চলভাবে এক আশ্চর্য রকম চোখে মানালির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সেই দৃষ্টিতে রাগ, স্নেহ, অভিমান আর স্বস্তির নিবিড় বন্ধন ছিল একাকার হয়ে। ছলছল চোখে বললেন, ‘মানালি এমন করিস কেন বল তো! কী পাস, আমাকে এমন করে কষ্ট দিয়ে।’
মানালি ছুট্টে গিয়ে মাকে জাপটে ধরে বললো, ‘আর কখনও হবে না মা। প্লিজ..’ কথা শেষ হলো না, গলা বুঁজে এলো।
বোধকরি এটুকুই যথেষ্ট ছিল। মমতার কাছে নত হওয়াই জগতের নিয়ম।
মা তার সন্তানকে সজোরে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে, অশ্রুসজল চোখে বললেন, ‘আমি যে বড়ো ভয় পাই মানালি, আমি যে বড্ড ভীতু।’ মানালি মা’য়ের বুকে মাথা রেখে বললো, ‘মা আমার ওপর তোমার বিশ্বাস নেই! বিশ্বাস নেই মা?’
মা আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। ডুকরে কেঁদে উঠলেন। বুকের মাঝে জমে থাকা পাথরগুলো যেন বুলডোজার দিয়ে ধাক্কা মেরে কেউ সরিয়ে দিলো, আর সেই সরে যাওয়া পাথরের ফাঁক গলে পবিত্র ঝর্ণার ধারা কুলকুল শব্দে নদীর পানে ছুটে গেল।
মায়ের অশ্রু ভেজা গাল নেমে এলো, মেয়ের মাথায়। মানালির ডাগর দুটি চোখেও টলমল করছে জল।
পাইন গাছের পাতায় লেগে থাকা বৃষ্টির জল, তখনও গড়িয়ে গড়িয়ে ঝরছে ভিজে পাহাড়ের গায়ে, টপটপ, টপটপ।
পাশের ঘরে ব্রজেশ ভরাট উদাত্ত গলায় গান ধরেছে,
“এ তুমি কেমন তুমি
চোখের তারায় আয়না ধরো,
এ কেমন কান্না তুমি
আমায় যখন আদর করো..”পরদিন সবাই খুব সকালে উঠে পরেছে। ড্রাইভারের সঙ্গী এসে জানিয়ে গেছে। রাস্তা খুলে গেছে। ব্রেকফাস্ট করেই রওনা দেওয়া হবে, লাচুন লাচেন-এর পথে।
নীল আর তার বন্ধুরা একটু আগেই সেই ধ্বসের জায়গা দেখে এসেছে। প্রফেসর ওদের সঙ্গে লজের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাদের কাছে ধ্বসের খুঁটিনাটি বিবরণ জানছেন।
এতক্ষণে জানা গেল, এই জায়গার নাম মানগাং। মনে রাখবার মতো জায়গা।মানালি আর মিসেস রায়ও রাস্তায় নেমে এলেন। এখন সবাই যাবার জন্য তৈরি। গাড়িটা পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ মানালি তার মাকে শিশুসুলভ সরলতায় বললো, ‘মা, একবার হাঁ করো।
মিসেস রায় কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন?’
-‘আহঃ, যা বলছি করো না। হাঁ করো।’
মিসেস রায় খানিকটা অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে মেয়ের আদেশ পালন করতে, হাঁ করলেন।
মানালি সেই হাঁ-এর মধ্যে একটা কিশমিশ টুক করে ফেলে দিলো।
মিসেস রায় সেটাকে বারদুই চিবিয়ে নিয়ে, অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘কী এটা?’
মানালি রুমালে বাঁধা গতরাতের দুর্গামাঈ-এর প্রসাদ মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘পাহাড় পার্বতীর প্রসাদ। সবাইকে দাও। বাবাকেও।’
মিসেস রায় তেমন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। তবুও রুমাল শুদ্ধ প্রসাদ কপালে ঠেকিয়ে নিয়ে, ছেলেদের দিকে এগিয়ে গেলেন।
তন্ময় বললো, ‘কাকীমা কালরাতে ওরা তো ওই মন্দিরেই গিয়েছিল। তারই প্রসাদ।’
প্রফেসর হেসে বললেন, ‘বাব্বা, এই পাহাড়ি জঙ্গলে মন্দিরও খুঁজে বের করে ফেললি তোরা।এ তো দস্তুরমত একটা আবিষ্কার বলা যেতেই পারে। নাঃ মানতেই হচ্ছে, তোদের ক্যালি আছে।’
মিসেস রায় প্রফেসরের মুখে একটা কিশমিশ দিয়ে দিলেন। প্রফেসর মুখে প্রসাদ নিয়ে, বালককের মতো মুঠো বদ্ধ হাত আকাশ পানে ছুঁড়ে চিৎকার করে বললেন, ‘দুর্গামাঈ কী জয়।’
সবাই হৈ হৈ করে হেসে উঠলো।
মানালি আর নীল দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে, সেই হাসিতে যোগ দিয়ে, প্রফেসরকে নকল করে চিৎকার করে বললো, ‘দুর্গামাঈ কী জয়।’
ড্রাইভার বললো, ‘সবাই গাড়িতে বসুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
সবাই গাড়িতে বসতেই, চলতে শুরু করলো গাড়ি। জানালা দিয়ে সবাই শেষ বারের মতো, প্রাণ ভরে দেখছিল, অখ্যাত আশ্চর্য সুন্দরী মানগাং-কে।
বিদায় রুপসী মানগাং। একটি মাত্র রাত। তাও অযাচিত আকস্মিক ঘটনায় অসহায় ভাবে তোমার ছোট্ট কোলে আশ্রয় নেওয়া। তোমার কাছে যা পেলাম, সারাজীবন মনের মনিকোঠায় উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে থাকবে।গাড়ি মাত্র মিনিট পনেরো গড়িয়েছে। তখনই ঘটে গেল একেবারে ভয়াবহ ঘটনা। যার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। থাকার কথাও নয়।
চলবে……..
-
ধারাবাহিক- নীলচে সুখ ( দ্বিতীয় ভাগ)
নীলচে সুখ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়পর্ব- ৪
সকালে ডেকে ঘুম ভাঙাতে হলো না। প্রবল বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ার দাপাদাপিতে ঘুম এমনিই ভেঙে গেল।
নীল ঘরের বাইরে এলো। পাহাড়ি বৃষ্টিকে আরও কাছ থেকে দেখবে বলে। বারান্দায় এসে দেখলো মানালি, একা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে এক মনে তাকিয়ে আছে, পাহাড়ের গায়ে ঝরে পরা মুক্তোগুলোর দিকে। এলোমেলো হাওয়ায় উড়ে আসা জলের কণায় ভিজে যাচ্ছিল ওর এলো চুল, শান্ত মুখ। মানালি যেন আশ্রয় দিচ্ছিল, প্রশ্রয় দিচ্ছিল অপরূপ প্রকৃতির ভালোবাসাকে। লালন করছিলো তাদের সর্বাঙ্গে।
-‘একি! মানালি!’
নীলের আচমকা ডাকে সামান্য চমকে উঠে পিছন ফিরে বললো, ‘ও, তুমিও উঠে পরেছো। দ্যাখো, কী সুন্দর বৃষ্টি। জানো, আমি জানতামই না বৃষ্টি এমন আশ্চর্য রকম সুন্দর। সিনেমায় দেখেছি, গল্পে পড়েছি। কিন্তু বাস্তবে এই প্রথম। সেগুলোর সঙ্গে এর কোনও মিলই নেই।’ বলেই চট করে ঘুরে, নীলের চোখের দিকে তাকিয়ে শিশুর মতো জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার ভালো লাগছে না?’
সেই সময় মানালির হাত দু’টো মুঠো করে বুকের কাছে জড়ো করা ছিল। আর কাঁপছিল থরথর করে, ভিজে যাওয়া পাখির মতো।
নীল কিচ্ছু বললো না। শুধু তাকিয়ে রইলো। এমন অপরূপ ক্ষণে সম্ভবত কথারা নির্বাসনে যায়। শুধু কথা বলে মন, সে কথারা ভেসে যায়, মন থেকে মনে, চোখ থেকে চোখে। সাক্ষী থাকে সময়, শুধুই সময়।
-‘কী ব্যাপার রে তোদের? ভোরবেলা এই ঠান্ডার মধ্যে বৃষ্টির জল গায়ে লাগাচ্ছিস। অসুখে পরবি যে। মিসেস রায়ের উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর। তৈরি হয়ে নে। গাড়ি এসে যাবে তো! বাবা নীল, তোমরাও যাও। রেডি হয়ে নাও। ওফ্ফ, হঠাৎ কিরকম বৃষ্টি আরম্ভ হলো বলো দেখি, সময় মতো বেরোতে পারলে হয়। দুর ছাই ভালোলাগে না।’
আওয়াজ শুনে তন্ময় বেরিয়ে এসেছে। পাশের ঘর থেকে প্রফেসরের ফরমায়েশ ভেসে এলো, ‘একটু চা পাওয়া যায় কিনা দ্যাখো না। ইন্টারকম কাজ করছে না।’
তন্ময়, করিডর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। চায়ের তদারকি করতে।সবাই রেডি। ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে। গাড়ি এলো ন’টায়। দেরির কারণ জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। অকাট্য যুক্তির সাজানো বাহানা তৈরিই আছে। সুতরাং সময় নষ্ট করার কোনও মানেই হয় না। এখন বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে আকাশের যা অবস্থা , ভরসা করা যায় না। ব্যাগ গুছিয়ে সবাই বসতেই গাড়ি রওনা দিলো, লাচেন লাচুনের পথে।
যে ভয় ছিল, তাই হলো। বেশ কিছুদূর যাবার পরেই আবার বৃষ্টি এলো ঝমঝমিয়ে। সেই বৃষ্টির মধ্যেই গাড়ি চললো। তবে খুবই ধীরগতিতে। দিনের বেলাতেও হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু ওদের মনের মধ্যে ভয় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এইভাবে রিস্ক নেওয়া বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। কেন না, বিপদটা তাহলেও একই থেকে যাচ্ছে। উপায় নেই। এগিয়েই যেতে হবে। জানালার কাঁচ সব বন্ধ। কাঁচগুলো সাদাটে হয়ে গেছে। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আশ্চর্য ভয়ার্ত নীরবতা বিরাজ করছে গাড়ির ভেতর। আরও কিছুক্ষণ এইভাবে যাবার পর। হঠাৎ গাড়ি থেমে গেল। ড্রাইভার আর তার সঙ্গী, দুজনেই নেমে গেল নিঃশব্দে।
মিনিট খানেক অপেক্ষা করে, ব্রজেশ আর দীপেন নেমে গেল। প্রায় তক্ষুনি ফিরে এসে খবর দিলো। গাড়ি আর যাবে না। সামনের রাস্তায় বিরাট ধ্বস নেমেছে। রাস্তা বন্ধ।
মিসেস রায়, হতচকিত হয়ে বললেন, ‘তাহলে, কী হবে এখন। এই পাহাড়ি রাস্তায় জঙ্গলে রাত কাটাতে হবে নাকি, সর্বনাশ..’
বড়ো বড়ো চোখ ভয়ে আরও বড়ো হয়ে গেল। প্রফেসর চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলেছেন। কারণ, মনে হয় উনি বুঝতে পেরেছেন চশমা চোখে খুঁজেও, এই বেমক্কা বিপদ থেকে বেরুনোর পথ পাওয়া দুষ্কর। অসহায় ভাবে নীলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নীল, কিছু একটা ব্যবস্থা কী করা যায়, মানে এই ঝড়বৃষ্টিতে পাহাড়ি জঙ্গলে..’
নীল হঠাৎ লক্ষ্য করলো মানালি তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে না জানি কী ছিল। নীল একলাফে গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে গেল। তার সঙ্গ নিলো বাকি তিনজন। ওদের চলার ভঙ্গিতে দৃঢ়তার চিহ্ন স্পষ্ট।
পাহাড়ের বাঁক ঘুরতেই, ওরা চলে গেল দৃষ্টির বাইরে। এখন একটানা ঝিঁঝি পোকার কান্না ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। বৃষ্টি থেমে গেছে। আলো কমে আসছে। সন্ধ্যা নামছে।পর্ব-৫
মিনিট দশেক এভাবেই কেটে গেল। সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছে। গাড়িতে এভাবে কতক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকা যায়। ড্রাইভারটা গেল কোথায়? একেবারে নিপাত্তা। কিছু বলেওনি। নাকি বলবার প্রয়োজন বোধ করেনি? সে বিচার পরে করা যাবে।
আপাতত এই অবস্থা থেকে রেহাই পেলে হয়। ভাগ্যিস ছেলেগুলো সঙ্গে আছে। তবু খানিকটা ভরসা। খানিকটা কেন? এই মুহূর্তে ওরাই একমাত্র ভরসা।
ড্রাইভার সিটের দরজাটা খুলে গেল। একটা মুখ উঁকি দিলো। এটা ড্রাইভারের সঙ্গীটা। হিন্দি ভাষায় যা বললো, তার তর্জমা করলে যা দাঁড়ায় সে খবর নতুন কিছু নয়। তবে একটা স্বস্তির কথা শোনালো। ওরা একটা লজে রাতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে।
যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। মিসেস রায়, স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন, ‘ওফ্ফ। বাঁচালে বাবা। কিন্তু সেটা কতদূরে?’
-‘সামনেই নেমে আসুন। ব্যাগপত্র সব আমরা নিয়ে আসছি। আপনারা ওই লোকটার সঙ্গে যান।’ এটা তন্ময়ের গলা। বাকি ছেলেগুলোর গলাও পাওয়া যাচ্ছে।
বোঝা গেল ছেলেগুলো সব কিছু দেখেশুনেই এসেছে।একটা ছোট্ট দোতলা বাড়ি। রাস্তা থেকেই সরু খাড়াই সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। পরপর পাশাপাশি দু’টো ঘর। ঘরের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইল ফোনের টর্চ জ্বেলে ঘরে ঢুকলেন প্রফেসর। আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলেন।
ঘরে একটা চওড়া চৌকি, তার ওপর একটা অতি নোংরা বিছানা পাতা। একটা কাঠের টেবিলের মাঝখানে বিয়ারের খালি বোতল। বোতলের মুখে একটা লম্বা মোমবাতি গোঁজা। বিদ্যুৎ নেই। রাত্রি যাপনের নিরুপায় আশ্রয়।
প্রফেসর পকেট থেকে লাইটার বের করে মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দিলেন। আলোছায়ার ভূতুড়ে পরিবেশ।
ঘরের মধ্যে একটা বিশ্রী ভ্যাপসা গন্ধ। একটা জানালা আছে, কিন্তু সেটা বন্ধ। বেশ বোঝা যাচ্ছে, এ ঘরে অনেকদিন কেউ প্রবেশ করেনি। ঘরের মেঝেতে ধুলো ভর্তি। নিয়মিত ঝাড়ু দেওয়াও হয় না।
মানালি জানালাটা হাট করে খুলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ বৃষ্টি ভেজা বিশুদ্ধ বাতাস, সরলবর্গীয় বৃক্ষের মনমাতানো গন্ধ নিয়ে হুহু করে ঘরে ঢুকে, সমস্ত মলিনতা ধুইয়ে দিলো।
প্রফেসর দেওয়ালের গায়ে আরও একটা দরজা দেখতে পেলেন। হাতল ধরে টান দিতেই খুলে গেল। প্রফেসরের ঠোঁটে হালকা খুশির ঝিলিক। ওটা বাথরুম।
যাক নিশ্চিন্ত। রাতেরবেলা বাথরুম সারতে অন্তত বাইরে যেতে হবে না। সত্যি বলতে কী ওরা এতকিছু আশাই করেনি। এই অচেনা অজানা অন্ধকার পাহাড়ের রাস্তায় রাত্রিবাস করতে হচ্ছেনা, এটাই সবচাইতে বড় পাওয়া। আর ওদের দৃঢ় বিশ্বাস, এইসব কিছুই পাওয়া সম্ভব হতো না, যদি এই ছেলেগুলো না থাকতো।ছেলেগুলো ব্যাগগুলো নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকে পরেছে। সম্মিলিত গলার আওয়াজ বুঝিয়ে দিচ্ছে, ওরা এই আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনায় বেশ মজা পেয়েছে। নির্ধারিত সিলেবাসের বাইরে, বাড়তি পাওয়া রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এটা বয়সের ধর্ম। অথচ, একই ঘটনায়, রায় দম্পতি দিশাহারা।
ড্রাইভারের সঙ্গী আবার এসে জানিয়ে গেল ।
কাল সকালে রাস্তা ঠিকঠাক হলে আবারও রওনা দেওয়া হবে। ততক্ষণ এখানেই থাকতে হবে।বৃষ্টি অনেকক্ষণ থেমে গেছে। আকাশ একেবারে পরিস্কার। আপাতত বৃষ্টির সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আকাশ ময় ঝলমলে তারাদের ভীড়। আর এই সদ্য স্নান সেরে ওঠা পাহাড় সুন্দরী, আরও রূপবতী রাজকন্যা হয়ে সেজে উঠেছে, চাঁদের রুপোলী আলোর ঝর্ণা ধারায়।
দূর থেকে একটা গান ভেসে আসছিল। মেয়েদের গলা।
নীল ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিলো।
মানালি দেখতে পেয়ে পিছন থেকে ডাক দিলো, ‘নীল, কোথায় যাচ্ছো?’
নীল, মানালির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কোথাও না, এমনিই এই সামনে একটু..’
কে জানে কেন, মানালি বললো, ‘আমিও যাবো।’
ওর এই বলার ভঙ্গিতে কেমন যেন একটা আবদার লুকিয়ে ছিল।
কিছু না ভেবেই নীল বললো, ‘এসো।’
মানালি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চিৎকার করে তার মায়ের উদ্দেশ্যে বললো, ‘মা আমি এক্ষুনি আসছি।’
মিসেস রায় ঘর থেকে সেই আওয়াজ পেয়ে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’
মানালি সে কথার কোনও উত্তর দিলো না। সিঁড়ি বেয়ে একেবারে রাস্তায় চলে এলো। ভিজে রাস্তার ওপর চাঁদের আলো। চারিদিক জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। উঁচু নিচু পাকদণ্ডী পথে দুটি তরুণ তরুণী। এগিয়ে চলেছে সেই দূর থেকে ভেসে আসা গান অনুসরণ করে।
সঙ্গে আছে ঝিঁঝি পোকার তান আর একরাশ উচ্ছ্বাস ভাললাগা।পর্ব- ৬
মিসেস রায় প্রায় ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলেন। দেখলেন, মানালি আর নীল, অন্ধকার পাহাড়ি পথে হেঁটে হেঁটে চলেছে। একবার মনে হলো চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে, কোথায় যাচ্ছিস, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন। কোথায় আর যাবে। এইতো এতটুকু জায়গা। সামনের রাস্তাটা যেটা দিয়ে ওরা এসেছে এখানে সেটাই একমাত্র চলাচলের পথ। ডানদিকে কিছুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। বাকিটা অন্ধকারে ঢাকা। সেই দিকেই গেছে মানালিরা।
বামদিকে একটু গিয়েই পথ বাঁক নিয়েছে। তাই বেশি দূর দেখা যায় না। চোখ বাধা পায় পাহাড়ের গায়ে। ওই দিকেই লাচুন লাচেনের পথ। ধ্বস নেমেছে। কাল কী হবে কে জানে।
তন্ময় বাইরে এসে মিসেস রায়কে দেখে বললো, ‘এ কি কাকিমা, একা দাঁড়িয়ে কেন?’
-‘আর বলো কেন? মেয়েটা এই অন্ধকারে কোথায় গেল বলোতো? কোনও মানে হয়?’
তন্ময় আস্বস্ত করে বললো, ‘আহা, কাকিমা কেন চিন্তা করছেন? সঙ্গে নীল আছে। নো টেনশন। আসুন তো আমাদের ঘরে আসুন। স্যারকে ডাকুন।’ বলেই, নিজেই ডাকতে শুরু করে দিলো, ‘স্যার.. স্যার। প্লিজ বাইরে আসুন। কী একলা ঘরের মধ্যে বসে আছেন। আসুন আমাদের ঘরে। কাকিমাকে নিয়ে গেলাম।’
তন্ময় মিসেস রায়কে নিয়ে তাদের ঘরে এলো। দীপেন, ব্রজেশ প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলো, ‘এই তো কাকিমা আসুন আসুন। জমিয়ে গল্প করা যাক।’
ইতিমধ্যে প্রফেসরও এসে পরলেন। ওরা তালি দিয়ে হৈহৈ করে উঠলো।
এইবারে আসর জমবে। প্রফেসর বললেন, ‘না না, শুধু মুখে আসর জমে না। কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা যায়, সঙ্গে একটু কফি?’
ব্রজেশ সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘এটা কোনও কথা হলো স্যার। এক্ষুনি ব্যবস্থা করছি।’
মিসেস রায় অবাক হয়ে বললেন, ‘এখানে এই জঙ্গলে কীভাবে কী ব্যবস্থা করবে!’
ব্রজেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো, ‘দেখুন তো কীভাবে কী করি।’ বলেই হুস করে বেরিয়ে গেল। ভাবখানা এমন, যেন নিউমার্কেট। চাইলে বাঘের দুধও মিলবে।
মিসেস রায় হতাশ গলায় বললেন, ‘দ্যাখো দেখি ছেলের কান্ড..’
প্রফেসর হাসতে হাসতে বললেন, ‘আহা, তুমি ওমন করছো কেন? ওরা একটু আনন্দ ক’রে যা করে করুক।’
কিন্তু মা’য়ের মন। সদাই খিচখিচ করে। বললেন, ‘নীল আর মানালিটা থাকলে ভালো হতো। কেন যে হঠাৎ বাইরে গেল! কী জানি বাবা, বুঝি না।’
তারপরেই জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘এ কি, জানালা খোলো নি কেন? খুলে দাও ওটা। বাইরের হাওয়া বাতাস আসুক।’
দীপেন ঝটপট জানালা খুলে দিলো। নির্মল ঠান্ডা হাওয়ায় ঘর ভরে উঠলো।
ঠিক তখনই ব্রজেশ হৈহৈ করে ফিরে এসে বললো, ‘আসছে.. হাতে গরম চিকেন চাউমিন, আর কফি।’
প্রফেসর আনন্দ মেশানো অবাক গলায় বললেন, ‘সেকি! পেলে কোথায়? এখানে এইসবের দোকান আছে নাকি, আশ্চর্য!’
ব্রজেশ ভ্রু নাচিয়ে বললো, ‘আছে স্যার, সব আছে। এই বাড়ির নিচের তলায় দুটো দোকান আছে। একটা মুদিখানা, আর একটা ছোট্ট রেষ্টুরেন্ট।’
প্রফেসর প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, ‘রেষ্টুরেন্ট?’
ব্রজেশ খানিকটা ভুল শুধরে নেবার মতো করে বললো, ‘না মানে, অর্ডার দিলে বানিয়ে দেয় আর কি। তাই রাতের খাবারের কথাও একেবারে বলে এলাম। চিকেন কারী আর রুটি।’
মিসেস রায় একটু কুন্ঠিত ভাবে বললেন, ‘আমাদের জন্যেও তাহলে..’
ব্রজেশ আস্বস্ত করে বললো, ‘বলে দিয়েছি। সকলের একই মেনু। যদিও আপনাদের জিজ্ঞেস না করেই..’
প্রফেসর ব্রজেশের পিঠে স্নেহের চাপড় মেরে বললেন, ‘ওয়েল ডান মাই বয়। মেনি মেনি থ্যাংকস টু অল অফ ইউ। তোমরা সঙ্গে না থাকলে যে কী হাল হতো, তা বেশ হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছি। কী বলো মিসেস রায়। ভুল বলেছি?’
মিসেস রায় সলজ্জ ভঙ্গিতে বললেন, ‘নিশ্চয়ই। একশোবার। ছেলেগুলোর তুলনা হয় না। অন্তত আজকের যুগে।’
প্রফেসর একটু বিরক্ত স্বরে বললেন, ‘থামো তো। এমন একটা সুন্দর পরিবেশে, অকারণ যুগ যুগান্তরের কথা ভালো লাগে। এখন এখানে যে কদিন বেড়ানো চলবে, চুটিয়ে আনন্দ করো। টিভি, খবরের কাগজ একদম বন্ধ। খালি দূর্নীতি, ধান্দাবাজী, জঘন্য পলিটিক্স ওফ্ফ, অসহ্য। সেসব থেকে এক্কেবারে শতহস্ত দূর।
তখনই একটি ছোট ছেলে। চাউমিনের প্যাকেটগুলো নিয়ে এলো।
ব্রজেশ সেগুলো টেবিলে রাখতে বলে আরও গোটাকয়েক মোমবাতি নিয়ে আসার জন্য বললো। ছেলেটা নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে চলে গেল।
নাও, সবাই গরম গরম খেয়ে নাও। দ্যাখো আবার কেমন বানিয়েছে। মিসেস রায় সকলের হাতে একটা করে প্যাকেট তুলে দিলেন।
ঘরে হোক কিংবা বাইরে। খাবারের তদারকি করা থেকে পরিবেশন করার অলিখিত দায়িত্ব মেয়েদের হাতেই থাকে। সেটা শুধুই মানানসই নয়, খাদ্যের স্বাদও যেন বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেয়।
দেবী অন্নপূর্ণার কাছে, দেবাদিদেবকেও হাত পেতে দাঁড়াতে হয়।
ছেলে মেয়ে দু’টোর জন্যে, থাক.. যখন আসবে খাবে। ঠান্ডা হয়ে যাবে। ভালো লাগবে খেতে তখন?
এই হলো মায়ের মন। খেয়ে নয়। সকলকে খাইয়ে তৃপ্তি। সকলের ভালো লাগাই তার ভালো লাগা। তার অপরিসীম আনন্দ বোধ। এখানেই সে জয়ী। অপরাজেয়। ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। হে মাতৃরূপা প্রকৃতি, তোমাকে শতকোটি প্রণাম।খাওয়া পর্ব শেষ। এখন কফি পর্ব চলছে। কফির কাপ হাতে নিয়ে তন্ময় খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে, -‘আরিব্বাস কী দারুণ রে। এদিকে এতক্ষণ চোখ যায়নি কেন রে? এই দীপেন, ব্রজেশ এদিকে আয় একবার তাকিয়ে দ্যাখ। ফাটাফাটি।’
দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার বরফ ঢাকা সাদা চূড়ায় চাঁদের আলো লুটোপুটি খেলছে। রুপোর মুকুটে সেজে উঠেছে পর্বত রাণী।
প্রফেসর বিভোর হয়ে উদাস কন্ঠে বললেন,
‘অপূর্ব..অনির্বচনীয়.. সুন্দর।’
দীপেন মোহিত হয়ে, হঠাৎ উদাত্ত গলায় গান ধরলো,
“আলোকের এই ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দাও,
আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধূলার ঢাকা..
ধুইয়ে দাওও..”
সেই গানে সকলেই গলা মিলিয়ে দিলো। তৈরি হলো সত্যিই এক স্বর্গের পরিবেশ।
বিদ্বেষ বিহীন শান্তিময় এমন স্বর্গীয় পৃথিবীতে অনন্ত কাল বেঁচে থাকা যায়।কিন্তু অশান্তি পিছু ছাড়ে না। ছেলে মেয়ে দু’টো এখনো ফিরলো না। দুজনেই মোবাইল ফোন লজে ফেলে গেছে। যোগাযোগ অসম্ভব।
চলবে…..
-
ধারাবাহিক- নীলচে সুখ (প্রথম ভাগ)
নীলচে সুখ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়পর্ব-১
এখন মধ্যরাত। গ্যাংটকের `নীলচে সুখ’ রিসর্টের বাগান ঘেরা সবুজ ঘাসে ঢাকা লনের চেয়ারে বসে শরতের মেঘমুক্ত নীলাকাশ দেখছিল নীল।
তারাগুলো যেন একটু বড়ো লাগছে, এখান থেকে। হালকা হালকা ঠান্ডা।
দূরের পাহাড়গুলোর গাঢ় অন্ধকার কালো গায়ে দীপাবলির মতো ঝিকমিক করছে মন উদাস করা সুন্দরী আলোক সজ্জা।
অনেকটাই হুইস্কি খেয়েছে নীল। অনেকদিন পরে মদ খেলো নীল। কেন কে জানে হঠাৎই ইচ্ছে করলো।
সঙ্গে স্ত্রী রুমা, ছ’বছরের পাপুকে নিয়ে এখন ঘরে ঘুমে অচেতন। গাংটকে আসার পরিকল্পনা বা ইচ্ছে রুমারই। নীল বাধা দেয়নি। তবে এখানে আসতে নীলের মন চায় না। ভয় করে। স্মৃতি উসকে ওঠে। মানালি।মানালিকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। নীলের মনে, মগজে, শরীরের প্রতিটি রোমকূপে সে আছে একাকার হয়ে। ওই দূরে মায়াবী অকাল দীপাবলির মতো। ধরা ছোঁয়ার বাইরে, আশ্চর্য আকর্ষণে মোহিত করে। মানালি।
এখানেই প্রথম দেখা। গ্যাংটক।
নীল তখন বি.এস.সি. ফাইনাল ইয়ার। সদ্য পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ওরা চার বন্ধু প্ল্যান করলো কাছাকাছি কোথাও কয়েকদিনের জন্যে ঘুরে এলে মন্দ হয় না। অনেক ঘেঁটেঘুঁটে পরীক্ষানিরীক্ষা তর্কাতর্কি শেষে সাব্যস্ত হলো গ্যাংটক। পাহাড় নদী ঝর্ণা, মানে এককথায়, কম বাজেটে স্বর্গের শোভা দর্শন। ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে বাসে গ্যাংটক। এই রকমই ঠিক ছিল, কিন্তু জলপাইগুড়ি এসেই আচমকা প্ল্যানটা বদলে গেল।
বাসস্ট্যান্ডে, একজন প্রায় মধ্য বয়সী ভদ্রলোক সামনে এসে বললেন-‘ভাই, আপনারা কী গ্যাংটক যাবেন?’
পোশাক পরিচ্ছদ বা উচ্চারণ শুনে বোঝাই যাচ্ছিল, ইনি গাড়ির বা কোনও হোটেলের দালাল নন। দালালদের স্বার্থপর হিসেবি চোখ আর চোয়াল, দেখলেই বোঝা যায়। দালাল। দালালি, এক অদ্ভুত জীবন জীবিকার পোশাকি নাম।
দীপেন সবসময়ই খুব সাবধানী। সে ভদ্রলোকের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘কেন বলুন তো?’
ভদ্রলোক বিনয়ের ভঙ্গিতে বললেন,
‘মানে, আমরা ঐখানেই যাচ্ছি কিনা..’
দীপেন তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘আপনারা যাচ্ছেন যান, আমাদের যাওয়া..’
ভদ্রলোক হাত তুলে দীপেনকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আহা, কী মুশকিল, আমার কথাটা আগে একটু দয়া করে শুনুন।’
ব্রজেশ চোখের ইশারায় দীপেনকে চুপ করিয়ে দিয়ে বললো,’ না না, ঠিক আছে, বলুন কী বলবেন?’
ভদ্রলোক তার কথা শুরু করার মাঝেই তার পিছনে আরও দুজন এসে দাঁড়াল। একজন ভদ্রমহিলা, প্রায় ঐ ভদ্রলোকের মতই হবেন বয়সে। আর একটি কিশোরী বলা যায়! নাকি যুবতী? যে কিনা এদেরই বয়সী।
তিনজনকে একত্রে এক্কেবারে অন্যরকম লাগছে। বেশ একটা সুখী পরিবার যেমন হয়ে থাকে আর কি, তেমনই।
এবার ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমি বলছি।
ব্যাপারটা হলো, আপনারা যদি গ্যাংটক যান তাহলে আমরা শেয়ারিং করে একটা গাড়ি ভাড়া করতে পারি। আপনারা চারজন, আমরা তিনজন। টাকাও কম লাগবে আর যাওয়াও নির্বিঘ্নে হবে। নইলে বাসের জার্নি, জানেনই তো। তাছাড়া সময়ও একটা ফ্যাক্টর। বাসে অনেক সময় নেবে। এবার আপনারা ভেবে দেখুন। অবিশ্যি, আপনাদের আপত্তি থাকলে আমাদের কিছু করার নেই। সত্যি কথা বলতে কী, আপনারা ইয়াং ম্যান।বাঙালি। সঙ্গে থাকলে, যতই হোক বিদেশ বিভুঁইয়ে, একটু বাড়তি সাহস যোগায়।
দেখুন ভেবে। তবে, আমাদের কিন্তু গাড়ি নিতেই হবে, কেননা আমার এই মেয়ে, বেশিক্ষণ বাসে চাপতে পারে না। বমি করে।’
কিশোরী লজ্জা পেলো শুধু নয়, একটু অপ্রসন্ন অপ্রস্তুত হয়ে মায়ের কনুইতে সকলের নজর এড়িয়ে একটা মৃদু চিমটি কেটে দিলো। মুখে বললো, ‘মা, যা করবার তাড়াতাড়ি করো। এই রোদ্দুরে আর ভালো লাগছে না।’
কেউ লক্ষ্যই করেনি, নীল এতক্ষণ ওই মেয়েটির দিকেই তাকিয়ে ছিল।
হালকা চাপা গায়ের রঙের সাথে মানানসই চাঁপাফুল রঙের শালওয়ার আর সাদা কামিজ। হালকা ঢেউ খেলানো এলোমেলো অবিন্যস্ত চুল। সারারাতের ট্রেন জার্নির ধকলে কৃত্রিম সাজ মুছে যাওয়া মুখ, যেন ওকে আরও সুন্দরী করে তুলেছে।
কম বয়স, সবসময়ই সুন্দরতার আধার। স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে তা আরও বিশেষ করে দাবী রাখে নিশ্চয়ই। এ প্রকৃতির খেলা।
নীলের মনের মধ্যে কে যেন বলে উঠলো, না না, ওর কোনও কষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। সেটা হবে চরম অমানবিকতা।
এমন মনে হবার কারণ জিজ্ঞেস করা নিতান্তই নিরর্থক। কেন না, ভালোলাগা কখন কীভাবে কোথা দিয়ে লখিন্দরের লৌহ কক্ষের ফাঁক খুঁজে ঢুকে পড়ে তা বোধকরি ঈশ্বরেরও অজানা।
‘ঠিক আছে, চলুন। একসঙ্গেই যাওয়া যাক।’ বলেই সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘চল, যাওয়া নিয়ে কথা। অসুবিধের কী আছে। এ বরং ভালোই হলো, কী বলিস?’
বাকিদের মুখে কোনও কথা নেই। কেবল চোখে কিঞ্চিৎ অবাক চিহ্ন প্রকাশ পেলো।পর্ব-২
পাহাড়ি পথে গাড়ি ছুটে চলেছে। পাকাপোক্ত ড্রাইভার। এই রাস্তার প্রতিটি ইঞ্চি তার নখদর্পণে। তবুও নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই নিরাপদে গাড়ি চালানোর নিয়ম এই পাহাড়ি পাকদণ্ডী পথে। ডানদিকে খাড়াই পাহাড়। বামদিকে বিপদজনক খাদ। সামান্য একটু ভুলে, অনেক বড়ো মাশুল দিতে হতে পারে।
চারপাশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলা। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেই তো এখানে আসা।
ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচার সাময়িক বন্ধন মুক্তি। ছুটি। কবির সেই লাইনটা মনে পড়ছে।
কাজের একপিঠে যেমন কেবলই ছোটা আর এক পিঠে তেমন কেবলই ছুটি।
পাহাড়ি ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা কান্না আর গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়া, আর কোনও শব্দ নেই। এমন পরিবেশে চুপ করে প্রকৃতির নির্বাক মৌনতায় মজে থাকতেই মন চায়।
কথা নয়, কথা নয়। এসো নিঃশব্দতায় যাপন করি, যেটুকু আছে সময়।
এটা নীলের লেখা কবিতার লাইন। নীল বেশ ভালো কবিতা লেখে। ফেসবুক বন্ধুরা তো ওর নামের সঙ্গে ‘কবি’ পদবী জুড়ে দিয়েছে। নীলের হাসি পায়। তবে বাধা দেয়না। বুঝে নিয়েছে, ওটা অভ্যাস বশতঃ উচ্চারিত কথা। গুরুত্ব দেওয়া বৃথা।
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আপনারা কী হোটেল বুকিং করে এসেছেন?’
তন্ময় বললো, ‘না না। খুঁজেখাঁজে একটা সস্তার হোটেল দেখে নেবো। আমাদের যাহোক একটা মাথা গোঁজার জায়গা হলেই চলে যাবে।’
ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে বললেন, ‘তা ঠিক। তোমরা ছেলেছোকড়ার দল। তোমাদের আর অসুবিধে কীসের।’ তারপরেই হঠাৎ কুন্ঠিত গলায় বললেন, ‘তোমাদের তুমি বলে ফেললাম, কিছু মনে করলে?’
অসীম বললো, ‘না না কাকীমা। একদমই না। আমরা তো আপনার ছেলেরই মতো।’
-‘আমার ছেলে নেই, এই একটিই মেয়ে। এই বেড়াতে আসার দু’টো কারণ। এক তো আমার মেয়ের বায়না। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। বেড়াতে যাবো। তাই বেড়িয়ে পরা।
দ্বিতীয় কারণটা তুমিই বলো না..’কর্তার উদ্দেশ্যে বললেন কথা গুলো।
-‘হ্যাঁ, ঠিকই। সেটাও একটা কারণ নিশ্চয়। ব্যাপার হচ্ছে আমার এক বন্ধু এই বছরখানেক আগে আপার গ্যাংটকে একটা রিসর্ট লিজ নিয়েছে। প্রায়ই আসতে বলে। নানান কারণে হয়ে ওঠেনি। এই ফাঁকে সেটাও সেরে নেওয়া হবে। ওই জায়গাটা নাকি বেশ নিরিবিলি। মানে, ঘিঞ্জি নয়।
বেড়াতে এসে ঘিঞ্জি চ্যাঁচামেচি ভীড়, একদম ভালো লাগে না। তোমরা কী বলো? বেড়ানো মানে তো শুধু মনের আরাম নয়। চোখ কান নাকের আরামও তো চাই নাকি? বলেই হা হা করে হেসে উঠলেন।’ ভদ্রমহিলা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘ওফফ, এখানেও তোমার মাষ্টারি শুরু করলে?’
বোঝা গেল ভদ্রলোক শিক্ষকতা করেন।
তিনি হাসি থামিয়ে হালকা গলায় বললেন,
‘ওহ্, আই এম স্যরি। ‘
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তোমরাও ইচ্ছে করলে সেখানেই উঠতে পারো।’
ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। ভদ্রমহিলা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললেন, ‘চিন্তার কিছু নেই। তোমাদের বাজেটের মধ্যেই হবে। সেটুকু অবশ্যই বলতে পারি। তবুও তোমরা ভেবে দ্যাখো।’
গাড়ি একটা খাবারের হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। ড্রাইভারের পরিচিত হোটেল। এখানেই দুপুরের খাওয়া সেরে নিতে হবে।
গ্যাংটক পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়ে যাবে।খেতে খেতে খুব বেশি কথাবার্তা হলো না ওদের মধ্যে। শুধুমাত্র এইটুকু জানা গেল। মেয়েটির নাম মানালি। বি.এস.সি. ফাইনাল ইয়ার। পরীক্ষা শেষ। এখন এরা আপাতত একই পথের যাত্রী।
পর্ব-৩
তখন বেলা গড়িয়েছে। মেঘলা আকাশ। এখানে যখন তখন বৃষ্টি নামে। অচেনা ভিনদেশী হাওয়ায় পাহাড়ের সোঁদাগন্ধ। দিন রাতের বালাই নেই, ঝিঁঝি পোকার অন্তহীন ক্রদন অব্যাহত। মিউজিক্যাল অর্কেস্ট্রা। একটা যাদুকরী প্রশান্তি ছড়িয়ে মনকে মাতাল করে তুলছে। চড়াই উৎরাই, পাহাড়ের ইইউ টার্ন । ভয়াবহ অথচ অপরূপা সৌন্দর্যের রাণীকে মনপ্রাণ ভরে দেখতে দেখতে চলে এলো গ্যাংটক।
গাড়ি থামলো সেই রিসর্টের সামনে। সুন্দর নিখুঁত একটি ডাকবাংলো। দুধসাদা রঙের বাড়ি। চারপাশ নানান রঙের ফুল দিয়ে সাজানো বাগান। সবুজ লন। বিরাট ছাতার নিচে পালিশকরা কাঠের চেয়ার টেবিল সাজানো। কারুকাজ করা বিশাল রেলিং গেট। ড্রাইভার গাড়ির হর্ন বাজাতেই ছুটে এলো একজন। দরজা খুলে গেল। বাংলোর মাথায় বিরাট গ্লোসাইনবোর্ড। তাতে নীল রঙের মোটা অক্ষরে লেখা ‘নীলচে সুখ’।ওদের একটা ফোর বেডের রুম। বেশ বড়ো এবং সাজানো। ওরা ব্যাগ খুলে সঙ্গে আনা জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে রাখতে রাখতে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল।
তন্ময় বললো,’নীলচে সুখ। হায় হায়। এ সুখ টিঁকলে হয়!
দীপেন বললো, যা বলেছিস। লম্বা একখানা বিল ধরিয়ে দিলেই চিত্তির। বাজেট, জেড প্লেন হয়ে উড়ে যাবে। নীলচে সুখ, হুঁ.. হ্যাঁ রে নীল, সুখের কী কোনও রঙ হয়। নীলচে, লালচে?
নীল বললো, ‘হয় বৈকি। সুখ কী একরকম? নানান সুখের নানান রঙ। কারোর পেয়ে সুখ, কারোর পাইয়ে দিয়ে সুখ।’
তন্ময় বললো, ‘ও, তাই বুঝি। তাহলে হারিয়ে সুখ? তার কী রঙ ভাই, কালচে?’
সবাই হৈ হৈ করে হেসে উঠলো। নীল হাসতে হাসতে বললো, ‘না রে ভাই, কালচের ওপর দুঃখের একচেটিয়া অধিকার। সেখানে সুখের প্রবেশ নিষেধ।আজ বিশ্রাম। কাল সকালে লাচুন লাচেন যাওয়া। সিকিমের সবচেয়ে সুন্দর জায়গার মধ্যে এই দু’টি নাম সবার আগে। সকাল সাতটার মধ্যে রেডি হয়ে বেরুতে হবে। তাছাড়া শরীর বেশ ক্লান্ত। রাতের খাবার খেয়ে ওরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পরার তোড়জোর করছে। এমন সময় দরজায় টোকা।
তন্ময় দরজা খুলে দিলো। বাইরে দাঁড়িয়ে প্রফেসর প্রকাশ রায়। ওরা ঠিক পাশের রুমেই আছেন।
-‘আসতে পারি? মানে, একটু কথা ছিল,’
তন্ময় বললো, ‘নিশ্চয়, আসুন স্যার।’
প্রফেসর রায় কোনও অকারণ ভনিতা না ক’রে বললেন, ‘তোমাদের কালকের প্রোগ্রাম কিছু ঠিক করেছো?’
তন্ময় বললো, ‘হ্যাঁ স্যার, আমরা কালকে লাচেন লাচুন যাবো ঠিক করেছি।’
স্যারের মুখ যেন খুশিতে ঝকমক করে উঠলো, বললেন, ‘ওয়ান্ডারফুল। কিন্তু তার জন্য তো গাড়ি দরকার। আগেই বুকিং করতে হয়। তক্ষুনি পাওয়া খুবই মুশকিল। দু’রাত তিনদিনের ব্যাপার। ওরা চুক্তিতে যায়। তোমরা তেমন কিছু ব্যবস্থা করেছো কী? শুধু তাই নয়, ওগুলো তো একেবারে পাহাড়ের কোলে ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম। তাই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এরা, এই সমস্ত কিছুর দায়িত্ব নেয়। তাই বলছিলাম, সেইসব ব্যবস্থা করেছো কী?’
কথাগুলো শুনে ওদের এক্সপ্রেশন একেবারে হাঁদারাম মার্কা হয়ে গেল।
দীপেন হতাশ গলায় বললো, ‘সর্বনাশ। আমরা তো এসব কিছুই জানিনা। কোনও ব্যবস্থাই করিনি। আমরা তো ভেবেছিলাম, একটা গাড়ি ধরবো, চলে যাবো। কিন্তু আপনি যা শোনালেন স্যার, এরপরে তো, কিরে কী করবি?’
তন্ময় বললো, ‘কী আর করা যায়। প্রোগ্রাম ক্যানশেল।’
সবাই হতাশ হয়ে বিছানায় ধপধপ করে বসে পরলো।
প্রফেসর রায় ওদের সকলের মুখগুলো দেখে নিয়ে বললেন, ‘এতো আপসেট হবার কিছু নেই। উপায় আছে। যদি তোমরা রাজি থাকো।’
নীল ঘরের বন্ধ জানালাটা খুলে দিতে দিতে বললো, ‘আপনারা কাল ঐ দিকেই যাচ্ছেন তো?’
এইবারে প্রফেসর চেয়ারে বসলেন। এতক্ষণ দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন। বললেন, ‘আমি ব্যাপারটা কোলকাতা থেকেই সেরে এসেছি। ওখানে এজেন্ট আছে কিনা। আমার খুবই পরিচিত। আমি তিন জনের জন্য বুকিং করেছি। এখন তোমরা যদি বলো, তাহলে এখনই ওকে ফোন করে, চারটে সিট বাড়িয়ে নিতে পারি।’
তন্ময় অবিশ্বাসের সুরে বললো, ‘এখন কী আর হবে?’
প্রফেসর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘আরে বাবা সে দায়িত্ব আমার। আগে তোমরা বলো রাজি কিনা?’
নীল খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ রেখে বললো, ‘রাজি, আপনি ব্যবস্থা করুন স্যার। ওখানে যাবো বলেই এখানে আসা। কোনও কিন্তু নেই। আপনি ব্যবস্থা করুন স্যার, প্লিজ।’
প্রফেসর বিনয়ের সাথে বললেন, ‘না না, ওভাবে বলোনা প্লিজ। তোমাদের ভালো লেগেছে বলেই না, তাছাড়া মাঝরাস্তা থেকে একসঙ্গে এলাম, একই জায়গায় আছি, একসাথে সবাই বেড়াতে যাবো, এ তো মহা আনন্দের কথা, তাই না?’ প্রফেসর চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘ওকে, তাহলে এই কথাই রইলো। কাল ভোর পাঁচটায় ডেকে দেবো। ঠিক সাতটায় গাড়ি আসবে। গুডনাইট অল অফ ইউ।’
তন্ময়, দরজা বন্ধ করতে করতে বললো,
‘থ্যাংকস স্যার। গুডনাইট।’
দীপেন ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে বললো,
এখন আর কোনও কথা নয়। প্রবলেম সলভড। কাল ভোর পাঁচটায় ওঠা। গুডনাইট।’
ব্রজেশ এতক্ষণ শ্রোতার ভুমিকায় ছিল। এখন শোবার সময় গায়ে কম্বল টেনে নিতে নিতে হালকা স্বরে উচ্চারণ করলো, ‘নীলচে সুখ।’
এই ছোট্ট একটি কথায় কেউ মুচকি হাসলো কিনা অন্ধকার ঘরে তা টের পাওয়া গেল না।চলবে……………..
-
অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-৩)
অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-৩)
-দ্যুতিপ্রিয়া ও অর্কপ্রভ(১২)
খসখস শব্দটা বেড়েই চলেছে। যেন কোনো ভারী জিনিস টেনে নিয়ে আসছে কেউ। হিংলা সন্তর্পণে এগোচ্ছিল। পিছন থেকে এরকম একটা শব্দ শুনে ঝপ করে একটা ঝোপের ভিতর লুকিয়ে পড়লো। বেশ কিছুটা দূরে দেখলো একই রকম আরো একটা পথ ডান দিক থেকে এসে তার পথের সাথে মিশেছে। একজন মানুষ ওই পথ দিয়েই এগিয়ে আসছে। একটু কাছে আসতেই সে হতভম্ব হয়ে গেল। এ যে পিংলা! তার ভাই বেঁচে আছে? কিছুই হয়নি তার- কি সুন্দর হাঁটছে! হিংলা চিৎকার করে তাকে ডাকতে গিয়েও পারল না। সে এরপর যে দৃশ্য দেখে ফেলেছে, তাতে তার হাত পা রীতিমতো ঠান্ডা হয়ে গেল। একটা মানুষকে টেনে টেনে পিংলা নিয়ে যাচ্ছে। কি হারহিম করা দৃশ্য! কিন্তু কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কেনই বা নিয়ে যাচ্ছে? হিংলার কিছু মাথায় ঢুকলো না। সে অপেক্ষা করতে লাগলো এবং একটু তফাতে থেকে তার ভাইকে অনুসরণ করতে লাগলো। লোকটা ঘষটে ঘষটে চলেছে.. বেঁচে আছে কিনা সেটা বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। হঠাৎ হিংলার মাথাটা ঘুরে গেলো। লোকটির জামার রংটা তো..এ যে দাদাবাবু! সে আর এক মুহূর্ত ভাবতে পারলো না। মনের সমস্ত জোরকে একজায়গায় করে
শ্বাস রুদ্ধ করে অনুসরণ করতে লাগলো। বেশিক্ষণ যেতে হলো না। একটু দূরেই একটা পুরোনো কাঠের বাড়ি দেখতে পেলো হিংলা। বেশ বড় বাড়ি। কাছাকাছি যে সমুদ্র রয়েছে সেটা হিংলা বেশ ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছে। পিংলা আহানকে নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়িটার ভিতরে ঢুকে গেল। হিংলা কাকেই বা খবর দেবে আর কিভাবেই বা খবর দেবে! ভেবেও কোনো উপায় বার করতে পারলো না। এই অবস্থাতে পিছিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। অগত্যা সে পিংলার পিছু পিছু ঘরটার ভিতরে ঢুকে পড়লো(১৩)
ওদিকে আহান আর হ্যালি ধীরে ধীরে জঙ্গলের ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। কিছুদুর এগিয়েই তারা দেখলো সামনের পথটি দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। কোন দিকে যাওয়া যায়! হ্যালি বললো, “তুই বাঁ দিকটা দেখ আমি ডান দিক দিয়ে এগোচ্ছি। কোনো বিপদের গন্ধ পেলেই সিগন্যাল দিয়ে দিস..” আহানও আর আপত্তি করলো না। আহান ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। সতর্ক দৃষ্টি চারদিকে বোলাচ্ছিলো সে। হঠাৎই বেশ খানিকটা দূরে লোকটিকে দেখতে পেলো। যে সাধুর সাথে কথা বলছিল আহানের দিকে পিঠ করে সামনের দিকে হেঁটে চলেছে। আহান বার দুয়েক ডাকলো লোকটাকে, কিন্তু লোকটা যেন একবারও শুনতেই পেলো না। আহান এবার তাড়াতাড়ি পা চালায়।একে যেভাবেই হোক ধরতে হবে। সে ঠিক লোকটির পিছনে এসে কাঁধে হাত দিয়ে বললো, “ও ভাইয়া,শুনাই নাহি দে রাহা হ্যায় কেয়া?”
আহানের কথায় এবার সে পিছন ঘুরে তাকালো। কিন্তু কি অদ্ভুত! চোখগুলো অস্বাভাবিক রকমের স্থির। আহনকে দেখেও মুখোভঙ্গির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলো না তার। হঠাৎ করে সে জাপটে জড়িয়ে ধরে আহনকে। এরকম যে হতে পারে আহান কল্পনাও করে পারেনি। বিন্দুমাত্র গলার স্বর বের করতে পারল না। দম যেন ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে। দু’ একবার চেষ্টা করলো কানের দুলটা স্পর্শ করে হ্যালিকে সিগন্যাল পাঠানোর। পারলো না..একটা সময় লোকটি বাঁধন আলগা করে দিলো..আহান লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। লোকটি আহনকে টানতে টানতে সামনের দিকে এগিয়ে চললো।(১৪)
এদিকে হ্যালি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। কিছু দূর গিয়ে সে পথের মধ্যে অদ্ভুত একটা জিনিস লক্ষ্য করলো, “আরে এ তো গাড়ির চাকার দাগ, জঙ্গলের মধ্যে গাড়ি কোথা থেকে এলো?”
এবার ও ওই দাগ ধরে এগোতে থাকলো। বেশ কিছুটা এগিয়ে সে দূরে একটা পুরনো কাঠের বাড়ি দেখতে পায়। এখন সে নিশ্চিত ! যে এখানে কোনো না কোনো গুপ্ত কাজকর্ম নিশ্চই হয়। ধীরে ধীরে হ্যালি বাড়িটার সামনে এসে হাজির হয়। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই কেন? কোনো দরজাও নেই! এটা কি পিছন দিক? সে ঠিকই ধরেছে। একটু সামনের দিকেই বড়ো দরজা দেখতে পায় হ্যালি। ওখানে বেশ কয়জন ঘোরাঘুরিও করছে। ওদের চলাফেরা কেমন যেন যন্ত্রের মতো। কাছেই দু’টো জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে। এখন হ্যালির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় পরিস্কার বলছে কিছু একটা হতে চলেছে। সে তাড়াতাড়ি কানের ঝুমকোটার হালকা নিচের দিকে টেনে কি সব যেন ফিসফিস করে বললো।
আহানের কাছে থেকে আগে শুনেছিল এরকম কোন পরিস্থিতিতে সবকিছু ভালো করে দেখে শুনে তারপর পদক্ষেপ নিতে হয়। তাই বাড়িটার ভিতরে ঢোকার কথা ভেবেও হ্যালি থমকে দাঁড়ালো। ঠিক তো জায়গাটা আগে ভালো করে জেনে নেওয়া ভালো। ওদিকে অন্ধকারও হয়ে এসেছে। সারাদিন ধরে হাঁটাহাঁটি করে পাগুলো একটু লাগছে। তাই হ্যালি চটজলদি বাড়িটার একটু পাশে একটা বড় গাছের ওপর উঠে বসলো। এখন থেকে বাড়িটার সামনে পিছনে দুটোই ভালো করে লক্ষ্য করা যাবে। মাথায় তখন ঘুরছে.. কি হয় জঙ্গলের ভিতরে? কি আছে এই বাড়িটাতে? তাহলে কি সত্যি সেই দিন সেই ব্ল্যাকমেইল চিঠিটার চামড়াটা কোনো মানুষের ছিল? আহনকে কথাটা বলবো বলবো করে বলাই হয় নি। ভাবনায় ব্যাঘাত পড়লো যখন হঠাৎ শুনতে পেল কাছে কোথাও জাহাজের সাইরেন বাজছে।(১৫)
আহানের কানের দুলটা বারবার করে আহনকে হালকা একটা ইলেক্ট্রনিক শকের মতো দিচ্ছে। একটা মেয়ের গলা “There is something wrong.. meet me near to that house in the jangal” অবশ্য এই কথাটা শুধুমাত্র আহানই শুনতে পাচ্ছে।
আহানের ততক্ষণে হালকা হালকা জ্ঞান ফিরেছে। ভালো মতো বুঝতে পারছে ওকে একটা ঘরে রাখা হচ্ছে। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে মনে হচ্ছে কি যেন একটা পড়ে আছে। ওঠার চেষ্টা করলো, না.. হাতগুলো পিছনে মুড়িয়ে শক্ত করে বাঁধা.. পা’টাও বাঁধা.. চোখটা হালকা ধাতস্থ হয়ে গেছে অন্ধকারে। জিনিসটা কেমন নড়ে উঠলো না! কোনোরকমে নিজেকে টানতে টানতে আহান জিনিসটার কাছে এলো। আরে এ জিনিস কৈ? এত হিংলা! ও এখানে কি করে এলো? হ্যালি কোথায়? হঠাৎ কানে আবার একটা হালকা ইলেক্ট্রনিক শক সাথে সেই মেসেজটা “There is something wrong.. meet me near to that house in the jangal” যতক্ষণ না আহান কোনো উত্তর দিচ্ছে ততক্ষণ ওকে এরকম শক দিয়ে যাবে। আহান আস্তে আস্তে হিংলাকে ডাকলো, “হিংলা উঠ.. তু ইধার ক্যায়সে আয়া?” আহানের দু-তিনবার ডাকায় হিংলাও একটু নড়েচড়ে উঠলো। “দাদাবাবু! তুমি ঠিক হ্যায় না? দিদিমণি কিধার হ্যায়?” হিংলা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল হঠাৎ কাছাকাছি কোথাও একটা জাহাজের সাইরেনের শব্দ দুজনকেই বেশ আশ্চর্য করে তুললো।(১৬)
জানি না এভাবে আর কতক্ষণ বসে থাকতে হবে। ওদিকে আহানেরও কোনো উত্তর আসছে না। হ্যালি একটু বিচলিত হয়ে পড়লো। পূর্ণিমার চাঁদ ততক্ষণে মধ্য গগনে বিরাজমান। চারদিকটা বেশ ভালো ভাবেই দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ কোথা থেকে আরো দু’টো জিপ আসে দাঁড়ালো বাড়িটার সামনে। বাড়ির ভিতর থেকে বেশ কয়েকজন বড়ো বড়ো দুটো কাঠের কফিনের মতো কিছু গাড়িতে তুলে দিল। জিপ দু’টো যেদিক দিয়ে এসেছিল আবার সেই দিকে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো।
হঠাৎ একটা হাল্কা ইলেক্ট্রনিক শক হ্যালিকে আবার উত্তেজিত করে তুললো। আহান reply দিয়েছে !
“আমি আর হিংলা বাড়ির ভিতরে… বিপ বিপ…. আমি আর হিংলা বাড়ির ভিতরে.. we are trapped ” ব্যাস কেটে গেল। সিগন্যাল প্রবলেম.. আর কিছু শোনা গেল না।হ্যালি এবার আস্তে আস্তে গাছ থেকে নেমে এলো। বাড়ির ভিতরের সব আলোগুলো ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। খুব সন্তর্পণে হ্যালি জিপ গাড়িগুলো যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে এগিয়ে চললো। বেশিক্ষণ যেতে হলো না। আস্তে আস্তে জঙ্গলটা কেমন যেন শেষ হয়ে আসছে। দূরে গাছের ফাঁক দিয়ে নীল জলরাশি যেন হ্যালিকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ওই তো দূরে জিপ গাড়ি দু’টো তখন দাঁড়িয়ে আছে। কাছেই একটা বেশ বড় মতো স্টীমারও দাঁড়িয়ে। বেশ কিছু লোকজনও রয়েছে। অন্ধকারে এত দূর থেকে ভালো করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। নাহ্, আর কাছে যাওয়া যাবে না। ওদিকে সমুদ্র সৈকতে ধু ধু বালির ওপর কোথাও লোকানো যাবে না। অগত্যা এখানে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
(১৭)
হিংলার সাহায্যে নিজের হাতের বাঁধনটা খুলে তরিতঘড়িত হ্যালিকে সিগন্যাল পাঠালো আহান তারপর নিজের পায়ের বাঁধন সাথে হিংলাকে বাঁধনমুক্ত করে ঘর থেকে বেরোনোর উপায় খুঁজতে লাগলো। না, এরা অতটাও বোকা না। ঘরে কোনো জানালা নেই, একটাই দরজা সেটাও বাইরে থেকে বন্ধ। কেউ যেন ওদের ঘরের দিকেই আসছে। দুজনে দরজার দুই ধারে নিঃশ্বাস বন্ধ করে লুকিয়ে থাকলো। ওদের ঘরের বাইরে কেউ যেন কাউকে বলছে, “শুন আজ দো আদমি আয়ে না.. উন যে সে জো শহরকে আদমি আছে উস্কো হামলোগ ইধার রাখ দেঙ্গে। দেখ কর বহুত সেয়ানা লাগতে হ্যায়। বাদমে বাহুত কাম আয়েগা। দুসরে কো চালান কর দেঙ্গে। নাজার রাখ দোনোকে উপর। কাল শুভা শহরওলা আদমি কো লাবরেটরি মে লেকের আনা। থোড়া রিসার্চ কারনা হ্যায়…..” বলে লোকটা যে দিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে আবার চলে গেল।
“গলার আওয়াজটা কেমন চেনা চেনা লাগলো না দাদাবাবু?” হিংলার এই কথাটা আহানের অনেক আগেই মাথায় স্ট্রাইক করেছে…”হু” বলে একটা সম্মতি জানায় আহান। কোথায় শুনেছে এই গলাটা? হঠাৎ মাথায় বিদ্যুতের মতো খেলে গেল “আরে এটা তো সাধুর গলা না!”
“তার মানে সাধুটাই আসল কালপ্রিট! কিন্তু লাবরেটরি কেন? কিসের চালান? কোথায় চালান করবে হিংলাকে” এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে ভোর হয়ে গেছে আহান খেয়াল করে নি। হিংলা একটু দূরে ঘুমে কাতর। হঠাৎ কেউ একজন এসে দরজা খুলে দিলো। একজন ভিতরে প্রবেশ করলো, আরে! এটা কি সত্যি সেই সাধুটা? উহু! তা কি করে হয়? এর তো পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি। সাধুর তো পরনে ধুতি ছাড়া কিছু ছিল না! তাহলে কি এ সাধুটার যমজ ভাই? নাহ্ ব্যাপারটা দেখতেই হচ্ছে! লোকটা এখন আহানের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। আহানও এক দৃষ্টে সাধুটাকে দেখছে। এ যেন এক ঠাণ্ডা লড়াই। হঠাৎ লোকটা দু’টো চেলাকে বললো, “ইসকো লে চলো, টাইম নেহি হ্যায় হামারে পাশ” কথাটা শেষ হতে না হতেই দু’টো চেলা এসে আহনকে জাপটে ধরলো। রীতিমতো ঠেলা দিতে দিতে ওকে নিয়ে এলো দোতলার একটা কোণের দিকে ঘরে। বেশ বড়ো ঘরটা- নানা রকম মেশিন, কেমিক্যাল, লাবরেটরির টুকটাক জিনিসে ভর্তি।
আহান আসতে আসতে খেয়াল করেছে বাড়িটার আরো পাঁচ থেকে সাতটা ঘর আছে। সব ঘরই বাইরে থেকে তালা বন্ধ।আশেপাশে কম করে দশটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, যন্ত্রের মতো যে যার কাজ করছে।
“ইধার বিঠাও উস্কো” লোকটার গম্ভীর আওয়াজে আহানের সম্বিৎ ফিরলো। দুই চেলা ততক্ষণে ওকে চেপে ধরে একটা চেয়ারের ওপর বসিয়ে দিয়েছে। একটু অদ্ভুত রকমের এই চেয়ারটা। কত ইলেক্ট্রিক তার।(১৮)
সারারাত একভাবে ঠায় সমুদ্রের কিনারার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ভোর হয়ে গেছে খেয়াল করে নি হ্যালি। আশেপাশেটা একবার ঝট করে দেখে নিয়ে ছুটলো জিপগুলোর দিকে। লোকগুলো সব মরার মতো ঘুমাচ্ছে। ওদিকটায় স্টীমারটাও দাঁড়িয়ে। লোকগুলোকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে, নিজের নাকে একটা রুমাল চাপা দিয়ে নিজের পিঠের ব্যাগ থেকে একটা কিছুর স্প্রে বার করে লোকগুলোর চারদিকে ছড়িয়ে দিলো- ক্লোরোফর্ম ! দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললো স্টীমারটার দিকে। এই রে একটা লোক উঠে গেছে! হ্যালির দিকে পিছন ফিরে সমুদ্রের দিকে কি যেন দেখছে। হ্যালি চুপি চুপি গিয়ে লোকটার ঘারের কাছে এক রদ্দা মারলো। লোকটা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। লোকটাকে ডিঙিয়ে হ্যালি এবার স্টীমারের সব ঘরগুলো সার্চ করতে থাকলো। ওর জায়গায় আহান থাকলে ঠিক এভাবেই করতো নিশ্চয়ই। না, কোথাও আর কেউ নেই। স্টিমারের একটা জায়গার মেঝেতে পা দিতেই কেমন যেন নড়ে উঠলো সুড়ঙ্গ পথ! তারমানে গুপ্ত কক্ষ আছে স্টীমারটায়। একটু এদিক ওদিক দেখে নিয়ে নেমে পড়লো হ্যালি। পঞ্চ ইন্দ্রিয় পুরো সজাগ। একটু যেতেই হ্যালির কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগতে লাগলো। যত এগোচ্ছে ততই যেন ঠান্ডা ভাবটা বাড়ছে। একটু এগিয়েই একটা ঘর দেখতে পেলো, না ঠিক ঘর না। একটা কোল্ড রুম, কিন্তু এখানে কোল্ড রুম কেন? দু’বার না ভেবেই ঢুকে পড়ল হ্যালি। চারপাশে সব বড়ো বড়ো ডীপ ফ্রীজার। একটা ফ্রীজের ঢাকনা খুললো। তারপর আবার একটা.. এই করতে করতে প্রায় সব ফ্রীজেরই ঢাকনাগুলো খুলে ফেললো হ্যালি। রক্ত জল করে দেওয়ার দৃশ্য। এত human অর্গান! এগুলো আসে কথা থেকে? এরাই বা এগুলো পায় কথা থেকে! নাহ্, সময় নষ্ট করলে চলবে না। কানের দুলটা থেকে আবার একবার বিদ্যুৎ খেলে গেল… আহানের মেসেজ.. ” be carefull .. be carefull.. Apply Plan B “
(১৯)
লোকটা এবার এগিয়ে আসছে আহানের দিকে। চেলাগুলো এতক্ষণে ওকে ছেড়ে দিয়ে একটা দিকে সরে গেছে। আহান নিজের মনের সব জোরটা দিয়ে এক দৃষ্টে লোকটার দিকে চেয়ে আছে। একটু পরেই লোকটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। যাক অপেরাশন successfull বাঁচার একটাই পথ খোলা ছিল “হিপনোটাইজ” কিন্তু যারা এই কৌশলটা আগে থেকে জানে তাদের করা একটু শক্ত ব্যাপার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কি হলো ব্যাপারটা! আহান একটু হকচকিয়ে গেল। তার মানে ও যেটা ভেবেছিলো সেটাই সত্যি, এই লোকটা ওই সাধুটার যমজ ভাই। নাহ্, হাতে একদম সময় নেই। হ্যালিকে সিগন্যাল পাঠিয়ে, আহান ছুটলো নিচে অন্য ঘর গুলোর দিকে। বাইরে বেরোনোর আগে সবটা দেখে শুনে নেওয়াই ভালো। নীচে ততক্ষণে হিংলাও দরজা ভেঙে বেরিয়ে এসেছে বদ্ধ ঘরটা থেকে। লোকটাকে এভাবে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে বাকি যান্ত্রিক মানুষগুলোর মধ্যে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব… সবাই দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে ছোটাছুটি করছে। সব ঘরগুলোই ওই যান্ত্রিক মানুষগুলোর থাকার ঘর। কিছু নিজেদেরও জন্যও বটে। পিঠের ব্যাগটা থাকলে না হয় মাস্টার কি দিয়ে দরজাগুলো খুলে দেখা যেত। কিন্তু ব্যাগটা এরাই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। ব্যাগটাকে খোঁজার জন্য তখন আহান আকুল। হিংলা বারবার বললেও আহানের সে সাবধানবাণীতে কোনো খেয়াল নেই। হঠাৎ ওরা দুজন তুলনামূলক একটা বড়ো ঘরে ঢুকলো। অনেকটা অপারেশন থিয়েটারের মতো। এখানে অপেরাশন থিয়েটার কেন? আহানের মনে হচ্ছে সত্যি এবার ও পাগল হয়ে যাবে! খালি চারদিক থেকে কি? কেন? কেন হচ্ছে? সব যেন ওকে গিলে খেতে আসছে। ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। এতক্ষণে ওরা বাড়িটার বাইরে বেরিয়ে এসেছে। হ্যালিও হাজির ওদিক থেকে। হঠাৎ জঙ্গলের মধ্যে কোথা থেকে একটা গুলি হ্যালির কাঁধের ফাঁক দিয়ে এসে সোজা আহানের কলার বনে লাগলো। হ্যালি বা হিংলা কেউ কিছু বোঝার আগেই আহান মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আরো একটা গুলি চলতে যাচ্ছিল হ্যালিকে উদ্দেশ্যে করে হঠাৎ করে জঙ্গলের ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। কোথা থেকে ঝাঁক ঝাঁক পুলিশ আর স্পেশাল ফোর্স এসে বন্দুকধারী ব্যক্তিটিকে ঘিরে ধরলো। আরে এত সাধুবাবা! আর তার একনিষ্ঠ চেলা পিংলা।
(২০)
যখন জ্ঞান ফিরলো, আহান তখন হসপিটালের বেডে শুয়ে। হ্যালি ওর পাশেই বসে। পিছনে হিংলা দাঁড়িয়ে, ডক্টর এসে সব checkup করে গেল। হিংলার মুখ দেখে এবার আহান হেসেই ফেললো। রীতিমত ছানার বড়ার মতো বড়ো বড়ো চোখ করে হিংলা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। আহানই শুরু করলো কিভাবে ও আর হ্যালি একে অপরকে সাথে যোগাযোক করে এবং কি ভাবে ওরা প্ল্যান B apply করে পুলিশকেও সিগন্যাল পাঠায়। কিভাবে দুই যমজ ভাই একে অপরের পরিপূরক হয়ে পঞ্চাশ বছরের পুরোনো এক কথাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করে, দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে যান্ত্রিক মানুষ আর মানুষের অঙ্গ বেচার কাজ সুনিপুণ ভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল। কিভাবে দুই ভাইয়ের একজন অতিপরিচিত তান্ত্রিক সাধু হয়ে উঠেছিল জনসমক্ষে আর অপরজন সুদক্ষ বিজ্ঞানী সাথে সুনিপুণ শল্য চিকিৎসক। কিভাবে বিভিন্ন হোটেল আর রিসর্টের মালিকদের কখনো টাকা কখনো বা ভয় দেখিয়ে নিজেদের হাতের পুতুল বানিয়ে রেখেছিলো। কিভাবে মানুষের রক্ত খেকো বাদুড়দের কাজে লাগিয়ে পর্যটক বা নিরীহ মানুষকে ভুতের ভয় দেখাতো। কিভাবে শক থেরাপি সাথে কিছু ওষুধের মাধ্যমে মানুষদের যন্ত্র মানবে পরিণত করতো। কিভাবে স্টিমারে গুপ্ত কক্ষে লুকিয়ে আন্তর্জাতিক সমুদ্রের দ্বারা অঙ্গ বিক্রির কাজ চলতো। কথার রেশ কাটলো যখন ডাক্তার এসে বলে গেল যে পিংলা সহ বাকি যান্ত্রিক মানুষদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে ট্রেটমেন্টের জন্য। হিংলা চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলো নিজের ভাইকে একবার দেখার জন্য।
(২১)
হসপিটালের কেবিনের মধ্যে এখন এক ঠান্ডা নিস্তব্ধতা।
নিস্তব্ধতা কাটলো যখন লোকাল থানার ও.সি সহ একটা পাঁচ-সাত জনের পুলিশ ফোর্স এসে স্যালুট করে “স্যার” এবং “ম্যাডাম” বলে দাঁড়ালেন। ওদিকে যান্ত্রিক মানুষগুলোর এরপর কি হবে, কালপিট দুটোরই বা কি হবে সাথে আরো হাজারো প্রশ্ন……সবকিছু কাটিয়ে আবার যে নিজের নিজের দৈনিক জীবনে ফেরার বিষন্নতা ওদের দুজনের মাথাকেই হ্যাং করে দিচ্ছে বারবার।
নিজের নিজের ফোনের টিং টিং শব্দে ওদের দুজনেরই সম্বিৎ ফিরলো…” Your flight ticket has successfully booked, Have a happy trip.”
সবার অজান্তেই ওদের দুজোড়া চোখ আবার একবার চিকচিক কৰে উঠলো।
-সমাপ্ত-
-
ধারাবাহিক- অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-২)
অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-২)
-দ্যুতিপ্রিয়া ও অর্কপ্রভ(৫)
ওরা এখন তিনজনে মিলে মন্দিরের পাশে জলাশয়ের বাঁধানো ঘাটে এসে বসেছে। ঠান্ডা হওয়া ওদের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে বারবার। মন্দিরের পিছনে জঙ্গলটাকে কেন্দ্র করে নিরীক্ষণে ব্যস্ত হ্যালির কৌতূহলী চোখগুলো হঠাৎ দূরের ঘাট’টায় একটা লোককে দেখে আটকে যায়। হ্যাঁচকা টান মেরে আহনকে ইশারা করলো হ্যালি। লোকটা তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। ঠিক লোক বলা যায় না অনেকটা সাধু গোছের।
সাদা চুল সাদা গোঁফ, পরনের লাল থান। হাতে কি যেন একটা রয়েছে ঠিক বোঝা গেল না। কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে গেল। দুই দলের চোখ যেন একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঝাঁঝরা করে দিয়ে সবটুকু নিরীক্ষণ করে নিচ্ছে। এর মধ্যেই বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ বেশ ভক্তিভরে সাধুটিকে যে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে কিছু কথাবার্তা বলে গেলো সেটা আহান বা হ্যালি কারোরই চোখ এড়ালো না। ওদিকে দুপুরের সূর্যি মামা মাথার ওপর উঠে পড়েছে। আর বেশিক্ষণ বসে থাকা গেলো না। হিংলার ডাকে ওদের উঠে পড়তে হলো। দু’জোড়া পা গাড়ির দিকে অগ্রসর হলেও ওদের মন বা নজর পরে রইলো সাধুটির দিকে। কিছুক্ষন পর সাধুটিও ভায়ামাতাভির ঘন জঙ্গলে মিলিয়ে গেলো।(৬)
“বাঁচা আমাকে হ্যালি!” কাতর কণ্ঠে আহান বলে ওঠে, কিন্তু কোথায় হ্যালি? এ যে হিংলা! ও এরকম অদ্ভুত ভাবে হাসতে হাসতে আহানের দিকে এগিয়ে আসছে কেন? ওর হাতেই বা ওটা কিসের মেশিন? একদম কাছে চলে এসেছে হিংলা.. আহান ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পালাতে পারছে না.. পাগুলো পুরো অবশ.. কেউ যেন ওকে পুরো নিয়ন্ত্রণে করে ফেলেছে! না না.. আহান লাফিয়ে উঠে পড়ে সোফা থেকে। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে, পুরো কপাল ঘামে চপ চপ করছে। “কি ভয়ানক স্বপ্ন! বাপরে বাপ..” নিজের মনেই বলে ওঠে আহান। সন্ধ্যা অনেক আগেই হয়ে গেছে। ওর মনে আছে, বিকালের দিকেই ওরা ফিরে এসেছিল। তারপর ও ফ্রেশ হয়ে ড্রইংরুমের সোফায় এসে বসে কিসব যেন ভাবছিল। কখন যে দু’চোখের পাতা এক হয়ে গেছে খেয়াল নেই। হুস ফিরলো, হ্যালির ডাকে। ততক্ষণে হ্যালি ফ্রেশ হয়ে দু’প্লেট লুচি তরকারি নিয়ে হাজির। “কি এত ভাবছিস বলতো? কাল থেকেই দেখছি..কাল বিকেলে কি যেন একটা বলতেও যাচ্ছিলিস। তারপর যা যা সব ঘটলো!” কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলতে বলতেই হ্যালি আহানের পাশে এসে বসলো। ততক্ষণে আহান ওর হাত থেকে এক প্লেট লুচি তরকারি ছোঁ মেরে নিয়ে নিয়েছে। দু’টি লুচি গলাধঃকরণ করে আহান একটু আরাম করে শুরু করলো সকালে বাইনোকুলারে দেখা সেই অদ্ভুত মানুষটার কথা, “তাও শুধু আজ নয় আগের দিন বিকেলেও আমি লক্ষ্য করেছি ওরকম একজন লোককে…” বলে বাঁ হাতে করে ক্যামেরাটা এগিয়ে দিল হ্যালির দিকে।
“কিন্তু আমি ভাবছি সাধুটাকে নিয়ে, কিভাবে দেখছিল আমাদের দেখিস নি? চাহনিটা আমার একদম ভালো লাগে নি” একদমে কথাগুলো বলে ফেললো হ্যালি। সাথে দুজনেরই মাথায় ঘুরছে নিখোঁজ মানুষগুলোর কথা।
কি হয় জঙ্গলের মধ্যে? কেন মানুষগুলো ফিরে আসেনা? কোনো জন্তু জানোয়ার নেই তো? না সত্যি কোনো অশরীরি কিছু আছে সেখানে? এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেলো। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। “এখানে তো generator বা inverter থাকার কথা” হ্যালির কথাটা শেষ হতে না হতেই আহান উঠে পড়লো। “দাঁড়া তো একবার ম্যানাজারের সাথে কথা বলে আসি। এখানে যে কারেন্ট নেই সেটা মনে হয় ওরা জানেই না।” এমনিতে হ্যালির কোনো ভয়ডর নেই। কিন্তু আজ আহান বেরিয়ে যেতে না যেতেই হ্যালির গা’টা কেমন ছমছম করে উঠলো। ঘরের জানলা দরজা সব বন্ধ, কিন্তু কোথা থেকে যেন একটা বরফের মতো ঠান্ডা হওয়া হ্যালিকে স্পর্শ করে যাচ্ছে বারবার, হ্যালি পুরো কেঁপে উঠলো যখন হঠাৎই ঘরের সমস্ত বন্ধ দরজা জানালাগুলো সজোরে খুলে গেল। মনের সমস্ত সাহসকে একজায়গায় করে হ্যালি উঠে বারান্দার দিকে যেতে গেল। কিন্তু এক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। দু’টো লাল চোখ যেন ওকে বশীভূত করে ফেলেছে। পাগুলো পুরো অসাড়, ওর শরীরের সমস্ত রক্ত যেন কেউ শুষে নিচ্ছে…
ওদিকে আহান তখনও বেশিদূর যায়নি, পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তায় অন্ধকারে হাঁটার অসুবিধা হচ্ছে। হঠাৎ পিছনে হ্যালির রক্তজল করা চিৎকার যেন এক নিমেষে পাহাড়ের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিলো। পড়ি কি মরি করে ছুটলো আহান রিসোর্টের দিকে। ঘরের দরজা খুলে যখন ড্রয়িং রুমে ঢুকলো তখন অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তিকে আহান স্পষ্ট বারান্দার পাশ দিয়ে যেতে দেখলো। চট করে মোবাইলের ফ্লাশ লাইটটা জ্বালিয়ে দৌড়ে গেল বারান্দার দিকে। কিন্তু তখন চারদিকে কেউ নেই। জলের পাইপ বেয়ে পাহাড়ের খাদ ধরে নিচে নামবে কিনা ভাবছে, হঠাৎ খেয়াল পড়লো হ্যালির কথা। ওর ওই রক্ত জলকরা চিৎকারটার কথা….
“হ্যালি.. হ্যালি” কোনো সাড়া শব্দ নেই। আহানের গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। হাতের মোবাইলে চার্জ কম থাকায় ফ্লাশ লাইটটা অনেকক্ষণ আগেই নিভে গেছে। অন্ধকারে এলোপাতাড়ি ভাবে আহান খুঁজতে লাগলো হ্যালিকে। হঠাৎই বেখেয়ালে কিছুতে যেন ধাক্কা খেয়ে আহান পড়ে গেল মাটিতে। সাথে সাথে কারেন্টটাও চলে এলো।
“হ্যালি..” আহানের গলা দিয়ে তখন আর আওয়াজ বেরোচ্ছে না।
ড্রইং রুমের মেঝেতে হ্যালি পড়ে আছে। ঘাড়ের কাছে এক খাবলা রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। দু’ মিনিট সময় লাগলো আহানের নিজেকে শক্ত করতে। তারপর চটজলদি হিংলাকে ফোন করলো হ্যালির ফোন থেকে। নাহ্ এই সময় ভেঙে পড়লে চলবে না। পাঁজাকোলা করে হ্যালিকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওর ঘরের বিছানায় শুয়ে দিলো আহান। হিংলাও পাশের সার্ভেন্ট কোয়াটার থেকে ততক্ষণে হাজির।(৭)
“কোনো কিছু রক্ত খেকো প্রাণী বেশ খানিকক্ষণ ধরে রক্ত খেয়েছে। কিন্তু এখানে ওরকম কোনো প্রাণী নেই। এমন কি ভায়ামাতাভি জঙ্গলেও নেই, সুতরাং এ কোন অশরীরির কাজ। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখন থেকে নাকি ওদের ফিরে যাওয়াই ভালো।” কথাগুলো বলে ডাক্তার বাবু ফিরে গেছেন প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হলো। হ্যালির তখনও জ্ঞান ফেরেনি। আহান ওর মাথার পাশে বসে। হিংলা গেছে ওষুধপত্রগুলো আনতে।
আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারল না আহান, চোখের কোন থেকে দু’ ফোঁটা জল হ্যালির কপালের ওপর পড়লো- ছিঃ ছিঃ! দিনদিন ও যেন কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে। তখন ওই সব না দেখে হ্যালিকে কোথায় দেখবে তা না! নিজের guilty feelটা যেন কিছুতেই কম হচ্ছে না আহানের।
“তুই আবার কাঁদিস ও নাকি!” হ্যালির ক্ষীণ শব্দ, আহান ততক্ষণে ওর ভেজা চোখগুলোকে মুছে নিয়েছে।
এতদিনের বন্ধুকে এভাবে কাঁদতে দেখে হ্যালি একটু হাসার চেষ্টা করলো। আহানের সাহায্যে ও এখন একটু উঠে বসতে পেরেছে। যদিও এখনো যে ভালোমতো দুর্বলতা আছে, সেটা ভালো ভেবেই বুঝতে পারছে।
আহান বারবার করে কথা বলতে বারণ করলেও সন্ধ্যেবেলার পুরো ঘটনাটা বললো। আহানও বললো কি কি হয়েছে ওর ঘরে আসার পর থেকে।সব কিছু শুনে হ্যালির মনে জেদ চেপে গেল কালই নাকি ও ওই জঙ্গলে যাবে।
“না দিদিমণি ইয়ে নেহি হো সাক্তে..” হিংলার গলা। ওষুধ নিয়ে ফিরে এসেছে…
“ম্যায় সব কুছ শুনে নিয়েছি দরওয়াজেকে পিছেসে দাদাবাবু, দিদিমণি.. মুঝে মাফ করে দেবেন। কিন্তু কাল হি আপ লোগ নিজের গাঁওমে ওপাশ জাওগে, ব্যস।”দূরের কোনো ঘড়িতে রাত দশটার ঘন্টা পড়লো।
ঘরের মধ্যে এক অদ্ভূত নিস্তব্ধতা। আহান ভালো করেই জানে হ্যালির জেদের কথা। একবার যখন কিছু ভেবেছে তখন সেটা করেই ছাড়বে। আহানও এর শেষ দেখতে চায় চিন্তা শুধু হ্যালিকে নিয়ে। ওদিকে হিংলাও আজ রাতে দাদাবাবু দিদিমনিকে একা ছাড়তে নারাজ।(৮)
রিসর্টের সব জানালা দরজাই এখন বন্ধ। তিনজন এখন ঘরের মধ্যে গোল করে বসে। একটা গভীর নিস্তব্ধতা। দেওয়াল ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটা চলার শব্দ আর প্রত্যেকের স্বাসপ্রশ্বাস যেন প্রতিমুহূর্তে নিস্তব্ধতাটাকে বারবার ভেঙে চুরচুর করে দিচ্ছে।
রাতে ম্যানেজারের রুমে ফোনটা ঝনঝন করে উঠলো। “হ্যালো.. Mr. Ahan বলছি… বলছি, কাল ভোরেই আমরা রুম ছেড়ে দিচ্ছি… আমার বন্ধুর শরীরটা ঠিক নেই, তাই আমরা ফিরে যাচ্ছি… সকাল সাতটায় যদি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করা যেত তাহলে খুব ভালো হতো.. আচ্ছা নমস্কার…” ঘড়িতে রাত দেড়টার ঘন্টাটা বাজার সাথে সাথে ফোনটাও কেটে গেল।
রাতে ঘরের মধ্যে যে কি হলো সেটা বাইরের কেউই জানতে পারলো না। হ্যালিকে নিজের ঘরে শান্তিতে ঘুমাতে দেখে আহানও নিজের ঘরে এলো ওদিকে হিংলা দিদিমনিকে পাহারা দেওয়ার জন্য ডাইনিং-এ থেকে গেলো সেই রাতের মতো। সকাল সাতটা, রিসর্ট থেকে দুইমূর্তি হিংলাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। গাড়ি বলা ছিল। হোটেলের সব কাগজের কাজ শেষ করে ম্যানাজারের সাথে ছোট কুশলী বার্তা সেরে তিনজনেই গাড়িতে উঠে পড়লো। পথে সেরকম কেউই কথা বললো না। হ্যালির শরীর খুবই খারাপ। সে এখন আহানের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। আগের রাতের ঘটনা যে তিনজনের মনেই গভীর দাগ কেটেছে সেটা বাইরে থেকে বোঝা গেল না। এমন কি হিংলাও কেমন একটা গুম মেরে রয়েছে। গাড়িটা এসে যখন বিশাখাপত্তনম স্টেশনে থামলো তখন ঘড়িতে দশটা ছুঁইছুঁই। গাড়িটাকে ছেড়ে দিয়ে তিনজনে এখন স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে। ট্রেন আসবে। সেই বারোটায়।
বারোটার ট্রেনটা যখন বিশাখাপত্তনম স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেল তখন হিংলার পিছন পিছন যে আরো একজন ভায়ামাতাভি যাওয়ার উদ্দেশে স্টেশন থেকে বেরোলো সেটা কারোরই চোখে পড়লো না।(৯)
ট্রেনটা যখন পালাসা স্টেশনে থামলো তখন ঘড়িতে বিকাল সাড়ে তিনটে বাজছে। স্টেশনের বাইরে একটা কালো রঙের গাড়ি অপেক্ষা করছে। ট্রেন থেকে নেমে আহান আর হ্যালি গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলো।
টানা পাঁচ ঘন্টা গাড়ি জার্নির পর যখন আহান আর হ্যালি ভায়ামাতাভির মাতাজির মন্দিরের সামনে এসে পৌঁছালো ততক্ষণে পথের ক্লান্তি ভ্যানিশ হয়ে গেছে। মন্দিরকে একবার প্রণাম করে দুজনে মিলে তালাবের ঘাটে উপস্থিত হলো। একটা নৌকো বাঁধা রয়েছে। নৌকার মালিক যখন আহান আর হ্যালির সামনে এসে দাঁড়ালো। তখন ওদের দুজনেরই চোখগুলো আনন্দে চিকচিক করে উঠলো,হিংলা! তালাবের জলটা এতটাই পরিস্কার যে ঘন অন্ধকারেও নিজেদের অবয়ব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হ্যালি বার দুয়েক জলে হাত ডোবালো। জঙ্গলটা যতই কাছে এগিয়ে আসছে ততই কিরকম গা’টা ছমছম করতে লাগলো ওদের।
“কি অদ্ভুত রকমের শান্ত তাই না?” আহান ফিসফিস করে বললো।
“একটা ঝিঁঝি পোকাও অব্দি ডাকছে না দেখেছিস?” আহানের সুরে হ্যালিও সুর মেলালো।
“ইতনা বড় জঙ্গল মে কিসি চিজ কো
ঢুঁননে যায়ে তো বহুত দিন লাগ যায়গা” হিংলার গলা। ও যে বেশ উত্তেজিত সেটা বোঝাই গেলো ওর গলা শুনে। হ্যালি আহানকে বললো, “ঠিকই বলেছে হিংলা, এভাবে হবে না, আলাদা হতেই হবে” আহান সাথে সাথে বাধা দিয়ে বলে, “কখনোই না, তোকে আমি অন্ততঃ একা ছাড়ছি না।” হিংলা বলে, “আপ দিদিমনিকে সাথ যাও, ম্যায় একেলা হি সামহাল লুঙ্গা, মেরে চিন্তা করবেন না।” কোনো সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লে আমরা অন্যজনকে জানিয়ে দেবো- কথাগুলো বলতে বলতেই আহানদের নৌকোটা একটা পরিষ্কার জায়গায় দাঁড় করালো হিংলা। ঝুপ ঝুপ করে সব নেমে পড়লো। তারপর তিনজনে মিলে নৌকোটাকে দুটো বড়ো গাছের আড়ালে লুকিয়ে ফেললো পাছে কেউ না দেখে ফেলে। আহান ওর ব্যাগ থেকে একটা ধারালো ছুরি করে আশপাশ থেকে কিছু ডালপালা কেটে সেগুলো দিয়ে নৌকোটাকে ভালো করে আড়াল করে দিলো। তিনজনে মিলে ঘাপটি মেরে বসে রইলো ভোর হওয়ার অপেক্ষায়। কতক্ষণ যে এভাবে বসে ছিল, মাঝখানে ওরা পালা বদল করে ঘুমিয়েও নিয়েছে একটু। পরের দিন যখন আহান আর হ্যালি ডান দিকে আর হিংলা বাঁ দিকের রাস্তাটা দিয়ে চলতে শুরু করলো তখন ভোরের আলো সবে ফুটছে।(১০)
হিংলা পুরো ভাইজাকটা চোষে ফেললেও এই জঙ্গলে আগে কখনো আসে নি। সে সতর্ক দৃষ্টি রেখে ধীর পায়ে এগোতে লাগলো। সারি সারি গাছ শুধু কিন্তু কোনো জন্তু জানোয়ার নেই। ভারী অবাক হলো। দূর দূর পর্যন্ত নতুন কিছু চোখে পড়লো না। জঙ্গলটা এতটাই ঘন যে মানুষ রাস্তা গুলিয়ে ফেলতে বাধ্য। হয়তো সেই জন্যই মানুষ একবার ঢুকলে আর ফিরে আসে না। মনে মনে চিন্তা করে সে, হঠাৎ ভাইয়ের কথা মাথায় এলো। সে কি এখনো বেঁচে আছে? জঙ্গলের কত ভিতরে সে পৌঁছে গেছে, কি অবস্থা আছে, কিছুই জানে না। একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ একটা জিনিস দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে হিংলা।ঘন জঙ্গলে একই পথ যদি কেউ বারবার ব্যবহার করে তাহলে ঘাস পাতা একটু ফিকে হয়ে যায় হিংলা সেরকমই দু’টো পথ আবিষ্কার করে ফেলেছে, একটা ডান দিকে চলে গেছে অন্যটা বাঁ দিকে। এ জঙ্গলে কোনো জন্তু তার এখনো অব্দি চোখে পড়েনি। তাহলে কি কোনো মানুষ? তার ভাই? এই পথেই কি সে বারবার ঘুরছে? এসব চিন্তা তাকে মুহূর্তে উত্তেজিত করে তুললো। কিন্তু সে যাবে কোন দিকে রাস্তার ডান দিক দিয়ে নাকি বাম দিক দিয়ে? একটু ভেবে বাম দিকের পথই নিলো। মনে কোথাও যেন একটু একটু আশার আলো দেখা দিচ্ছে। অমনি একটা খসখস শব্দ তার সব ইন্দ্রিয়কে সতর্ক করে দেয়। হিংলা থেমে যায়। বোঝার চেষ্টা করে শব্দটা কথা থেকে আসছে।
(১১)
এদিকে আহান আর হ্যালি এই জঙ্গলে প্রথম এলেও তাদের জঙ্গলে আসার অভিজ্ঞতা আগেও আছে। দুজনেই সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে এগোতে লাগলো। অল্প একটু এগিয়েই আহান থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। গলায় একটা চাপা উত্তেজনা, “এটাই তো খুঁজছিলাম!”
প্রথমে হ্যালি বুঝে উঠতে পারে না। আহান তাকে পথের মতো একটা রাস্তা দেখিয়ে দেয়। “এ পথ দিয়ে নিশ্চয়ই কেউ যাতায়াত করে” হ্যালি বলে উঠে, একটু এদিক ওদিক দেখে নিয়ে ওরা ওই রাস্তাটাকে অনুসরণ করতে থাকে। এখন তারা জঙ্গলের একটু ঝোপের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। ওদের একটু পাশ দিয়েই রাস্তাটা গেছে। যাতে হুট করে ওই লোক চলাচলের রাস্তায় কেউ ওদের ধরে না ফেলে সেই জন্য।
অল্প কিছু দুর যেতেই একটা বড়ো গাছ দেখতে পায় ওরা দুজন, “সেই সাধুটা না!” হ্যালি উত্তেজিত হয়ে আহানের হাত খামচে ধরেছে. এদিকে সাধুটিও একটা বড়ো গাছের তলায় বসে একজনের সাথে কথা বলছিলেন, দেখে চাকর বলেই মনে হলো ওদের। জঙ্গলের ভিতরে একটা খসখস শব্দ শুনে সাধুটি লোকটাকে চলে যেতে বললেন। লোকটা চলে যেতেই একটা গম্ভীর গলার আওয়াজ আহান আর হ্যালির হৃদপিন্ডকে মনে হলো যেন ওদের কলজে থেকে বার করে নিয়ে আসছে…”কোন হ্যায় উধার?”
আর উপায় নেই, আহান বেরিয়ে এলো গাছের ফাঁক থেকে, “ও ভাই যারা এধার শুননা” আহান চিৎকার করে লোকটাকে ডাকলো। কিন্তু সে যেন কিছু শুনতেই পেলো না। কেমন যান্ত্রিক ভাবে চলতে চলতে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো। সাধুর কাছে আসতেই তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “ইহা পার ক্যা কার রাহে হয় তুম? ইয়ে জায়গাকে বারে ম্যায় কুচ নাহি শুনা ক্যা? টুরিস্ট লোগো কাভি ইহা মানা হ্যয়।” আহান একটু ভয়ের সাথেই বললো, “ও আদমি কোন থা? আপ ইধার রেহেতে হো ক্যা?” এবার গর্জে বলে উঠলেন তিনি, “হাঁ, ম্যায় ইহা পার আপনা ধ্যান করতা হ্যায়। আগার ভালা চাহতে হোয় তো জলদি নিকাল যাও..” আহান আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো কিন্তু তিনি পাত্তাই দিলেন না। চোখ বড়ো বড়ো করে এক দৃষ্টে আহানের দিকে চেয়ে আছেন আর সাথে বিড়বিড় করতে লাগলেন, যেন মন্ত্র পড়ছেন। গাছের পিছন থেকে হ্যালি খেয়াল করলো আহান যেন কেমন যন্ত্রের মতো অন্য দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। “এইরে লোকটা আহনকে হিপনোটাইজ করে ফেলেছে!” হ্যালি জঙ্গলের ভিতর দিয়েই যতটা সম্ভব নিজেকে লুকিয়ে আহানের পিছন নিলো। সাধুর নজর থেকে বেশ কিছুটা দূরে যেতেই হ্যালি পিছন থেকে আহানকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো যাতে ওর ঘোরটা কেটে যায় আর হলোও তাই, “কিরে এভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলি কেন?” আহানের গলায় একটু রাগের আভাস। হ্যালি গাছের পিছন থেকে যা যা দেখেছে পুরোটা বললো।
সবটা শুনে আহানের গলায় তখন উৎকন্ঠার রেখা, “শোন আমার মনে হয় এখানে কিছু একটা আছে, নাহলে সাধুটিই বা আমাকে ওরকম হিপনোটাইজ করে এখান থেকে পাঠাতে কেন চাইছে! আর কে ওই চাকরটা? এতবার করে ডাকলাম একবারও ঘুরেও তাকালো না! শোন ওই চাকরটাকে খুঁজে বার করতে হবে..” হ্যালিও সায় দিলো।চলবে…………..
-
ধারাবাহিক- অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-১)
অরণ্যের অন্ধকারে (পর্ব-১)
-দ্যুতিপ্রিয়া ও অর্কপ্রভ
(১)
ট্রেনটা যখন বিশাখাপত্তনম স্টেশনে থামলো তখন ভোর হয় হয়… অনিরুদ্ধর ঠেলাতে ঘুম ভাঙল শিবানীর। দু’ মিনিটের মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দেবে তাই দুজনে ঝটপট করে নেমে পড়লো ট্রেন থেকে। দুজনের কাঁধেই দু’টো ব্যাগ, হাতে একটা করে ট্রলি।
শিবানী ওরফে হ্যালি, পেশায় একজন ভূতত্ত্ববিদ্। আঠাশ বছরের রোগা, বব কাট চুল, জিন্স ছাড়া আপনি যদি একে অন্য কিছু পোশাকে কখনো দেখেছেন তাহলে ধরে নিতে হয় আপনার সেদিন লটারি কাটা উচিত। এর পিঠে যে কলেজ ব্যাগটা থাকে তার ভিতরটাকে আপনি ছোট খাটো একটি ল্যাবরেটরি বলতে পারেন।
অন্যদিকে অনিরুদ্ধ ওরফে আহান.. পেশায় সাংবাদিক। আঠাশ বছরের চশমা পরিহিত, লম্বা, গায়ের রং এক কালে বেশ ফর্সা ছিল কিন্তু এখন রোদে জলে পুড়ে কালোতে পরিণত হয়েছে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, কাঁধে যে ব্যাগটা থাকে সেখানে খুঁজলে হিরে থেকে জিরে অব্দি সব পাওয়া যাবে.. হাতে একটা ডি.এস .এল. আর ক্যামেরা।আসলে ওরা দুই বন্ধু মিলে এসেছে বিশাখাপত্তনমের পাহাড় আর সমুদ্রের মেলবন্ধনকে চাক্ষুষ করবে বলে। প্রতি বছর ওরা দুই বন্ধু মিলে এরকম কয়েকটা ট্রিপ করে। তবে একটাই নিয়ম, এই সব ছুটিতে ওরা নিজস্ব পরিচয় ব্যবহার করে না। তখন ওরা শুধু আহান আর হ্যালি। দুজন পর্যটক, যাদের পৃথিবীর কোনা কোনা দেখার ইচ্ছা। এভাবে পরিচয় লুকিয়ে ভ্রমণের কারণ- একটাই.. এটা একটা খেলা, যে শেষ অব্দি নিজের পরিচয় সাথে বন্ধুর পরিচয় লোকাতে সক্ষম হবে সে জিতবে, অন্যজন হারবে, পানিশমেন্ট! যে হারবে, পরেরবার তাকেই দুজনকার ঘুরতে আসার সব খরচ দিতে হবে।
যাইহোক, তল্পিতল্পা গুটিয়ে যখন দুজনে স্টেশনের বাইরে এলো তখন পাখিদের কিচিরমিচির বেশ ভালো মতোই শুরু হয়ে গেছে। কোথাও থেকে অনবরত এক ঠাণ্ডা শীতল হওয়া ওদের মাথার চুলগুলোকে খালি এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে। খিদেয় দুজনের পেটেই ততক্ষণে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে।হ্যালির মনের ভাবটা বুঝতে পেরে আহানই সামনের কচুরির দোকানে যাওয়ার প্রস্তাব দিলো। একটা তৃপ্তির হাসি হেসে হ্যালিও চললো তার সাথে। এবারের প্ল্যানটা হ্যালি করেছিল, ওর সমুদ্র পছন্দ হলেও আহানের আবার পাহাড় একটু বেশি কাছের। তাই বিশাখাপত্তনমে এসে এক ঢিলে দুই পাখি মেরে দেয় সে।
“জায়গাটা কিন্তু চমৎকার”- স্টেশনে পেট পুজোটা ভালো করে সেরে, গাড়িতে করে হোটেলের দিকে যাওয়ার পথে আহানই মন্তব্যটা করলো। উপরি পাওনা হিসাবে, আগে থেকে সব কিছু বুকিং থাকায় কোনো চিন্তা নেই। ” আইডিয়াটা কার সেটা দেখতে হবে তো…” সম্পূর্ণ credit সানন্দে নিজের কাঁধে নিজেই নিয়ে নেয় হ্যালি। অন্যদিকে আহানের সেসব দিকে খেয়াল নেই। এখন সে দু’চোখ ভোরে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করতে ব্যস্ত। অবশেষে হোটেলে পৌঁছে check in সেরে রুমে পৌঁছাতে এক ঘন্টা লেগে গেলো ওদের। রুমটা ভারী অদ্ভুত- আসল হোটেল থেকে একটু দূরে, একটা বড়ো ঘরের ভিতরে দু’টো আলাদা আলাদা ঘর, একটা বাথরুম, মাঝখানে একটা ড্রইং হল,আর পিছনের দিকে একটা বারান্দা। এরকম আরো দু’টো তিনটে রিসর্ট আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হ্যালি বাথরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হয়ে নেওয়ার জন্য। ঘড়িতে সবে সকাল চারটে- ওদিকে আহান দরজাটা খুলে বারান্দায় আসে দাঁড়ালো। এই জায়গাটা ভারী সুন্দর। পুরো পাহাড়ের কোলে, মোটামুটি এক হাত দূর থেকেই গভীর খাদ, ওদিকে দূরে সারিসারি পাহাড় চূড়া… ছুটে গিয়ে ঘর থেকে dslr আর বাইনোকুলারটা নিয়ে এলো আহান। এই অপরূপ নৈসর্গিক দৃশ্য বেশ ভালোভাবে ক্যামেরাবন্দি করে বাইনাকুলারে চোখ লাগলো আহান। পাহাড়ের কোলে দূরে একটা ঘন জঙ্গলের মতো দেখা যাচ্ছে। পুরো কুয়াশায় মোড়া… উফফফ দেখেই লোভ হয়ে যায়।
ফ্রেশ হয়ে দুজনেই হালকা কিছু খেয়ে একটু জিরিয়ে নিলো। শারীরিক বিশ্রামটাও দরকার। ঘন্টা খানেক পর, মৌনতা ভঙ্গ করে আহানই প্রথম বেরোনোর তাগাদা দেয়। যেহেতু সকালটা প্রায় শেষ আর পুরোটাই অচেনা অজানা একটা জায়গা তাই আজ দুজনে আশেপাশেটা ঘুরে একটা গাইড ঠিক করে রিসর্টে ফিরবে ঠিক হলো।
জায়গাটা সত্যিই অনবদ্য, একদিকে সমুদ্রের হওয়া শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে আর অন্য দিকে পাহাড়ের নৈসর্গ মনটাকে যেন প্রতিমুহূর্তে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। দুই বন্ধুর মধ্যে হ্যালি একটু বেশি চটপটে। ওর রেডি হতে বেশি সময় লাগে না। আহান রেডি হতে নিজের ঘরে গেল। হাতে বেশ খানিকটা সময় আছে দেখে হ্যালি বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। দূরের ওই জঙ্গলটার মধ্যে মানুষকে টানার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। পুরো মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছে হ্যালিকে। চোখ যেন ফেরাতেই পারছে না ওই জঙ্গলটা থেকে। সম্বিৎ ফিরলো,আহানের গলার আওয়াজে। dslr হ্যালিকে ধরিয়ে দিয়ে বললো, “স্নাপগুলো একবার দেখ- বারান্দা থেকে যা zoom ভিউ পেয়েছি না…অসাধারন! দুজনে একে অন্যের দিকে একবার তাকিয়েই বুঝে গেল কি চলছে দুজনের মাথায়। “কাল তবে ওখান থেকেই শুরু হোক, কি বলিস?” হ্যালির প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না আহান, শুধু হালকা হেসে সম্মতি জানালো। আশেপাশে খুব বেশি মানুষ নেই। ভাইজাগের মতো একটা প্রসিদ্ধ tourist destination যে এরকম নিরিবিলি আর মন্ত্রমুগ্ধকর হতে পারে সেটা এখানে না আসলে বিশ্বাসই হতো না ওদের। হাঁটতে হাঁটতে একটা ক্যামেরার দোকানের ওপর চোখ যায় আহানের। dslr-টার এক দিকের স্ট্রাপটার অবস্থা শোচনীয় তাই কিনে নেওয়াই ভালো। দোকানদার বেশ মিশুকে, হিন্দিতেই জিজ্ঞাসা করলো কবে ওরা এসেছে, কোথায় থাকছে, এরপর আর কোথায় কোথায় যাবে এই সব। হ্যালিও দু-এক কথার পর পাহাড়ের কোলে জঙ্গলটা দেখিয়ে ওটার ব্যাপারে জানতে চাইলো।
“উস জায়গাকা নাম হ্যায় ভায়ামাতাভি, “ডাৱকা জঙ্গল”, দূর সে বহুত হি খুব সুরাত হ্যয় লেকিন পাস কোই নাহি যা সকতা” এই বর্ণনায় ওদের দুজনেরই যাওয়ার ইচ্ছাটা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেলো “আচ্ছা আপনার কোনো চেনাশোনা ভালো গাইড আছে? মানে যে একটু আশপাশটা ঘোরাতে পারবে বিশেষ করে ওই ভায়ামাতাভি জায়গাটা”-আহানের এই প্রশ্ন শুনে দোকানদার কেন জানি না অবাক হয়ে তাকালো ওদের দিকে, বললো “সাহাব মেরে ঘর জানে কে ওয়াক্ত হো গয়া হ্যায়। মুঝে অভি দোকান বন্ধ কারনা হোগা, আপকো কুছ ঔর চাইয়ে তো কাল শুভা লে লেনা… “
“কেমন যেন এড়িয়ে গেল না পুরো ব্যাপারটা!” হ্যালি আহনকে উদ্যেশ্য করে ফিসফিস করে বললো। আহানও ভ্রু দু’টো কুঁচকে বললো, “exactly” ওদিকে দোকানদার দোকান বন্ধ করে কোথায় যেন সরে পড়েছে। আকাশটাও অন্ধকার অন্ধকার করে এসেছে। ওরা আশেপাশের চায়ের গুমটিগুলোতে খোঁজ নেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনো ফলই পেলো না। সবাই কেমন এড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা। একটু ভেঙে পড়লো ওরা। কিন্তু পরক্ষণেই আহান বললো “রিসর্টে চ তাড়াতাড়ি আমাদেরই যা ব্যবস্থা করার করতে হবে, কুছ পরোয়া নেই, যখন একবার ভেবে নিয়েছি তখন যাবই।” রাতে খাবারটা হ্যালি একটু আগেই অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। এখন দু’জনে মিলে ড্রইং রুমে বসে। হ্যালি মন দিয়ে ডাইরিতে কি সব যেন লিখছে আর মাঝেমাঝেই মোবাইলে কি সব দেখছে। ওদিকে আহানের চোখ ক্যামেরাতে আটকে। সকাল থেকে বিকালে ঘরে ঢোকার আগে পর্যন্ত যত ছবি তুলেছে সেগুলোই দেখতে ব্যস্ত। হঠাৎ হ্যালিই বলে ওঠে “একটু রিসার্চ করলাম বুঝলি জায়গাটা নিয়ে, তেলেগু ভাষায় “ভায়াম” হলো ভয় আর “আতাভি” মানে জঙ্গল। জায়গাটা এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার মতো দূরে। যাওয়ার রাস্তা একটাই যদিও সেটা খুব একটা খারাপ না। কিন্তু সাধারণ মানুষ সবাই ঐদিকটায় যাওয়াটা একটু এড়িয়ে যায়। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর তো ওদিকে যারা যারা গেছে তাদের নাকি আর কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। কথিত আছে একশো বছর আগে নাকি ওখানে একটা গ্রাম ছিল। একবার পাহাড় থেকে ধস নেমে পুরো গ্রামটাই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তার পর থেকে নাকি ওখানে অনেক অতৃপ্ত অশরীরিদের বিচরণ” কথাগুলো মন দিয়ে শুনে আহান ওর ক্যামেরা থেকে হ্যালিকে কিছু একটা দেখাতে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা ঝনঝন শব্দে দুজনেই কেঁপে উঠলো।”(২)
“আওয়াজটা তোর ঘর থেকে এলো না” বলেই আহান ছুটলো হ্যালির ঘরের দিকে। একটা বেশ বড় সাইজের পাথর পড়ে আছে, তার গায়ে মানুষের মাথায় এক গুচ্ছ চুল দিয়ে বাঁধা একটা ব্রাউন রঙের কাগজ। সারা ঘর কাঁচের টুকরোয় ভরে গেছে। আহান দরজা খুলে বাইরে গিয়ে একবার দেখলো। কিন্তু কিছুই তো নেই কোথাও! আসলে হ্যালির রুমটা লোকালয়ের দিকে আর আহানেরটা বারান্দার পাশে।
হ্যালি কাঁচের টুকরোগুলোকে পাশ কাটিয়ে পাথরের টুকরোটার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেই আহান এসে বাধা দিল.. “দাঁড়া আমি দেখছি।”
কোনোরকমে পাথরে বাঁধা ব্রাউন কাগজটা তুলে নিয়ে ড্রইং রুমে এলো দুই বন্ধু। যা দেখলো, তাতে যে কোনো সাধারণ মানুষের রক্ত জল হয়ে যাবে। এতক্ষণ ওরা যেটাকে ব্রাউন রঙের কাগজ বলে মনে করেছিল ওটা আসলে শুকনো চামড়ার অংশ বিশেষ। কোনো মানুষ বা পশুর চামড়া কেটে সেটাকে রোদে শুকিয়ে বানানো হয়েছে। ভিতরে রক্ত দিয়ে লেখা,
“জিন্দা রেহেনা চাহতা হ্যায় তো ভাগ যা…”ওদের দুজনেরই নার্ভ বেশ শক্ত। পালানো তো দূরের কথা দুজনেরই মাথায় জেদ চেপে গেল। শেষ না দেখে কিছুতেই নড়বে না এখান থেকে।
হ্যালিকে একটু অস্থির দেখে আহান বললো, “তুই বরং একটা কাজ কর, তুই আমার ঘরটা ব্যবহার কর আমি আজ এখানেই থেকে যাচ্ছি।”
টেবিলের ওপর রাখা খাবারগুলো ততক্ষণে ঠাণ্ডা জল হয়ে গেছে। সেগুলোকেই গলাধঃকরণ করে যে যার জায়গায় শোবার তোড়জোড় করতে লাগলো। মিনিট দশেক পর আহান আড়চোখে দেখলো হ্যালি ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আলোও বন্ধ। একটা গভীর দম ছেড়ে নিজের পিঠের ব্যাগটা কাছে টেনে নিল আহান। ছবিগুলো আরো একবার দেখা দরকার। সন্ধে বেলায় ফটোগুলোতে ও একটা জিনিস খেয়াল করেছে.. কি সেটা? সেটা নিজে ভালো করে না বুঝে হ্যালিকে কি বোঝাবে? ওদিকে হ্যালি ঘুমানোর চেষ্টা করলো বেশ খানিকক্ষণ ধরে। না মাথার মধ্যে দু’টো প্রশ্ন খালি ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে,
এক কিসের বা কার রক্ত…
দুই কিসের বা কার চামড়া…
নাহ্, এভাবে ঘুম আসবে না.. খুব সন্তর্পণে খাট থেকে উঠে ঘরের মধ্যে টেবিল লাম্পটা জ্বালিয়ে বসলো। ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বের করে নিয়ে এখন ও বসেছে পরীক্ষা করতে। এমনিতে ও পেশাগত দিক দিয়ে ভূতত্ববিদ হলেও,কাজের সূত্রে
প্রত্নতাত্বিক, জুওলজি, বোটানি,পদার্থ কিংবা রসায়নবিদ্যা সব বিষয়গুলোর ওপরই কম বেশি চর্চা থেকে যায়।(৩)
কাজ করতে করতে কখন যে ভোর হয়ে গেছে দুজনের কেউই খেয়াল করেনি। হুস ফিরলো কলিং বেলের আওয়াজে। আহানই গিয়ে দরজাটা খুললো। ততক্ষণে হ্যালিও বেরিয়ে আসছে ঘর থেকে। হোটেল থেকে লোক এসেছে ওদের জাগানোর জন্য। কারণ পাহাড়ের কোলে ভোরের সূর্যোদয় একটা আলাদাই আকর্ষণ। আগের দিনের রাতের জানালায় কাঁচ ভেঙে যাওয়ার ঘটনাটুকু ছাড়া বাকি ঘটনাটা দুজনেই চেপে গেল। জানাজানি হলে হয়তো হোটেল কর্তৃপক্ষই এখানে ওদের থাকতে দেবে না।
একটা স্বর্গীয় সূর্যোদয় উপভোগ করতে না করতেই হোটেলের একজন কর্মচারী ওদের জলখাবারটা দিয়ে গেল। ব্রেকফাস্ট যেহেতু হোটেল বুকিং-এর সাথে কমপ্লিমেন্টারি তাই ওটা আর আলাদা করে order দিতে হয়না। যাই হোক আজ ওরা হোটেলে বলে রেখেছে, ওদের একটা ভালো গাইডের ব্যবস্থা করে রাখার জন্য। জলখাবার খেয়েই ওরা বেরিয়ে পড়লো। গাইডটা একটা বাচ্চা ছেলে, ওই বাইশ কি তেইশ বছর বয়স। নাম হিংলা। ভাইজাকের ব্যাপারে ওর মতো জ্ঞানী আর সাহসী চটপটে ছেলে নাকি আর নেই।দুজনের মুখেই আগের রাতের ঘটনা একটা চিন্তার ছাপ ফেলেছে, কিন্তু বাইরের পরিবেশ দুজনেরই মনকেই ভালো করে দিলো। হিংলা ছেলেটা খুবই চটপটে। গাড়ির সাথে কথা বলাই ছিল। ওরা গাড়ির কাছাকাছি আসতেই হিংলা দরজা খুলে দিয়ে বললো ” উঠে পড়ুন দাদাবাবু দিদিমনি, আজ আপনাদের মাতাজির মন্দিরমে লেকে যাউজ্ঞা, বহুত জাগ্রত ও মন্দির”..হিংলার মুখে এরম বাংলা শুনে হ্যালি স্বভাবতই কৌতূহলী হয়ে ওঠে..গাড়িতে উঠে আহান জিজ্ঞাসা করায় হিংলাই বললো যে তার ছোটোবেলা কেটেছে গ্যাংটকে তারপর কাজের খোঁজে ও আর ওর ভাই ভাইজাকে চলে আসে। আহান আর হ্যালিকে বাংলায় কথা বলতে দেখে বুঝে যায় বাঙালি গেস্ট তাই ও বাংলাটাই জারি রাখে। হিংলা যদিও হেসে হেসেই কথা বলছে কিন্তু তার চোখে মুখে কোথাও যেন একটা দুঃখের ছাপ আছে সেটা এড়ালো না আহানের চোখ থেকে। হাজার হোক, সাংবাদিকের চোখ বলে কথা। গাড়ি একটা কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে মাঝারি গতিতে। মন্দির ছাড়া কাছেপিঠে আর কি কি দেখার আছে জানতে চাওয়ায় হিংলা বলে, “মন্দিরকে পাসমে এক তালাব হ্যায় দাদাবাবু, আর মন্দিরকা পিছেই ওই ভায়ামাতাভি জাঙ্গালটা” জঙ্গলের কথা শুনেই দুজনের চোখ চিকচিক করে উঠলো। হ্যালি যেন এরই প্রতীক্ষা করছিল। স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞাসা করে “আচ্ছা হিংলা, জঙ্গলটার ব্যাপারে একটু বলো তো। বাইরে থেকে এতো সুন্দর লাগে কিন্তু শুনেছি এখানকার মানুষ নাকি ভয় পায় ওই জঙ্গলে যেতে।” হ্যালির কাছ থেকে এই প্রশ্ন আসতে পারে, সেটা আশাই করেনি হিংলা। সে একটু সময় নিয়ে বলে, “ঠিক হি শুনেছেন দাদাবাবু-দিদিমণি, উস জঙ্গলমে কই জানা নেহি চাহতা। লোগ ডরতে হ্যায়”
“কিন্তু কেন? কি আছে ওখানে?” আহান আর চুপ না থাকতে পেরে হিংলাকে কথাগুলো জিজ্ঞাসা করেই ফেললো। হিংলা একটু ইতস্তত করছিল। তখন হ্যালি ওকে বলে “লুকানোর কিছু নেই হিংলা! তুমি আমায় দিদিমণি বলেছো না! বলো কি আছে ওখানে? আমরাও শুনতে চাই”
“দাদাবাবু দিদিমণি, আসালমে বাত হ্যায় কি..ওখানে মানুষ গেলে লটকে নেহি আতা। এখনো অব্দি আমাদের এই ভায়ামাতাভি থেকে চারজন লাপাতা… বাকি আশপাশ সে বহুত সারে মানুষ ভি উধারসে লটকে নেহি আয়ে। উনমে সে মেরে ভাইভি থা দিদিমনি!” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামে হিংলা। ওর চোখগুলো এখন ঘোলাটে হয়ে এসেছে, সাথে গলাটাও কেঁপে কেঁপে উঠছে।
“কি বলছো হিংলা, মানুষ লাপাতা? তোমার ভাই ও? তুমি পুলিশের কাছে যাওনি? তারা কি বলছে?” এতগুলো প্রশ্ন একসাথে করে আহান হাঁপাতে লাগলো। এতক্ষণে ও বুঝেছে হিংলার মুখে কেন কষ্টের ছাপ দেখেছিল প্রথমে।
হ্যাঁ, দাদাবাবু আমি বারণ করেছিলাম ওকে যেতে। লেকিন ও মেরা বাত নাহি মানা। অর এটা ভি শুনা যাতা হ্যায় কি পুলিশের কাছে গেলে জাঙ্গালকা কালা সায়া ঘরকে বাকি সবকে উপারভি পারতা হ্যায়।” হিংলার এই উত্তর শুনে আহান আর হ্যালি দুজনেই হতভম্ব হয়ে যায়। গাড়িটাও ইতিমধ্যে মন্দিরের সামনে চলে এসেছে। পাহাড় কেটে বানানো মন্দিরটা, সত্যি অসাধারণ হাতের কাজ কারিগরদের। দেখেই ওরা মুগ্ধ হয়ে গেলো। আহান তো dslr-এ চোখ গুঁজে রইলো। একটা মুহূর্তও যেন মিস করতে চায়না। এদিকে হিংলা সেখানকার ইতিহাস নিয়ে বলে চলেছে- মন্দিরটা নাকি ওই গ্রামটা ধ্বংস হয়ে যাবার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর পাহাড় দেবীকে তুষ্ট করার জন্য তখনকার মানুষজনরা বানায়। মন্দিরটা বানাতে কমসে-কম দশ থেকে বারো বছর সময় লেগেছিল। মন্দিরের পিছনে হঠাৎ কি যেন একটা নড়ে উঠল না! নিজের অজান্তেই তড়িঘড়ি আহান বাইনোকুলারটা চোখে লাগলো। হ্যাঁ, ঠিক দেখছে সে, একটা মানুষ মন্দিরের পিছনে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে, মন্দিরের ঠিক পিছন থেকেই ভায়ামাতাভির জঙ্গলটা শুরু হয়েছে। জঙ্গলে ঢোকার মুখে পিছন ফিরে মন্দিরটাকে একবার প্রণাম করলো সে। আহান ভালো ভাবে লক্ষ্য করলো তাকে, সাধারণ আর পাঁচটা মানুষের মতোই কিন্তু চোখ দু’টো অস্বাভাবিক রকমের স্থির, হাঁটা চলার মধ্যেও একটা যান্ত্রিকতার ছাপ স্পষ্ট। যেন মনে হচ্ছে ওকে দিয়ে কেউ কিছু
করিয়ে নিচ্ছে। এইরকম একজনকেই কাল সন্ধ্যাবেলায় ওর ক্যামেরাতে তোলা ছবিগুলোতে দেখেছিল না?
“কিরে এত মন দিয়ে কি দেখছিস” হ্যালির প্রশ্নে আহানের সম্বিৎ ফেরে। আসল ব্যাপারটা লুকিয়ে গিয়ে হালকা হেসে বলে, “আরে না না, আসলে এত সুন্দর জায়গাটা কখন যে হারিয়ে গেছিলাম।”চলবে…………
-
ধারাবাহিক- দি এম্পটি আর্থ (শেষাংশ)
দি এম্পটি আর্থ (শেষাংশ)
-বিশ্বদীপ মুখার্জী
……………..
পর্ব – ১৭
…………….‘ননসেন্স! কে বলেছে এটা ওর আইডিয়া ছিলো? এই যে, মিস্টার এন এস ডব্ল্যূ, তুমি যে বারবার বলছো যে আমি নাকি ডাঃ ব্যানার্জীর আইডিয়া চুরি করেছি, তার পিছনে কোনও ভিত্তি আছে? কোনও প্রমাণ আছে তোমার কাছে? যখন প্রমাণ নেই তখন কারোর উপরে দোষারোপ করবে না। আগে সলিড প্রমাণ নিয়ে এসো। তারপর কথা হবে তোমার সাথে। আমি যদি বলি, আইডিয়া চুরি আমি না ডাঃ অনুপম ব্যানার্জী করেছে। তুমি সেটা বিশ্বাস করবে তো? পপুলেশন কন্ট্রোলের কথা বলেছে ডাঃ ব্যানার্জী? কে দিয়েছিল সেই আইডিয়াটা তার মগজে? আজ যদি ডাঃ ব্যানার্জী জীবিত থাকতো তাহলে ওকে সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতাম আমি।’
‘তার মানে আপনি জানেন যে ডাঃ অনুপম ব্যানার্জী জীবিত নেই।’
অর্চিষ্মানের এই কথায় হকচকিয়ে গেলেন ডাঃ চৌধুরী। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বললেন – ‘আমি কেন? এটা তো সবাই জানে যে ডাঃ অনুপম ব্যানার্জী আর বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে এত দিনেও কি সে সামনে আসতো না?’
‘পুলিশ কিন্তু তার ডেড বডি পায়নি। নিরুদ্দেশ হওয়ার বারো বছর পর ফাইল বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু ডাঃ ব্যানার্জী নয়, তার স্ত্রী এবং পুত্রকেও পরবর্তী কালে খুঁজে পাওয়া যায়নি। যার ডেড বডি পাওয়া যায় না, তার মৃত হওয়ায় অল্প হলেও সন্দেহ থেকেই যায়। তাই তো আমরা আবার সেই বন্ধ ফাইলকে রিওপেন করেছি ডাঃ চৌধুরী। সে সব কথা পরে হবে। আপনি বললেন যে ডাঃ ব্যানার্জী নাকি আপনার আইডিয়া চুরি করেছেন।’ অর্চিষ্মান বলল।
‘হ্যাঁ, আমার আইডিয়া। আমার আইডিয়া চুরি করে গবেষণা করছিল সে। আমি গোপন ভাবে সেটা জানতে পারি। তাকে বলেওছিলাম যে সে গবেষণা করছে, করুক। আমার তাতে কোনও আপত্তি নেই। আমার ডিমান্ড শুধু এটুকুই ছিলো যে গবেষণার শেষে যেন ক্রেডিটে আমার নামটা দেয়। কিন্তু রাজি হয়নি সে।’
‘কী ছিলো আপনার আইডিয়া?’ জিজ্ঞাসা করলো অর্চিষ্মান।
খানিক চুপ থেকে ডাঃ চৌধুরী বললেন – ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের এক অন্যতম পদ্ধতি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক ওষুধ বা ইনজেকশন বাজারে এসেছে। কিন্তু তাতে কোনও দিন কোনও কাজ হয়নি। সেই সময় আমি এক ধরনের ওষুধের ফর্মুলা বের করেছিলাম। তখনও ওষুধটা আমি আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি।’
‘কী ধরনের ওষুধ?’ জিজ্ঞাসা করলো অর্চিষ্মান।
‘সেটা একটা ব্যাকটেরিয়ার মত। একটা ছোট্ট ক্যাপসুল। সেই ওষুধটা নিয়ে আমার অনেক প্ল্যান ছিল। ভেবেছিলাম নিজের গবেষণা আর প্ল্যানের বিষয় ভারত সরকারের সাথে কথা বলবো। কিন্তু সেটা হয়ে উঠলো না। আমার সব থেকে বড় ভুল কী ছিলো জানেন অফিসার? আমার সব থেকে বড় ভুল ছিলো নিজের প্ল্যানের বিষয় অনুপমের সাথে আলোচনা করা। তার মনের মধ্যে যে বিষ আছে সেটা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি। আমার প্ল্যান ছিলো প্রত্যেক সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে সেই ওষুধটা যেন পাওয়া যায়। এবং সেই ওষুধটা ডক্টরের দেওয়া আর পেশেন্টের নেওয়া যেন বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। কোনও মহিলার প্রথম ডেলিভারির পর অপারেশন টেবিলেই সেই ক্যাপসুলটা মহিলাকে দিয়ে দেওয়া হলে আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ পেতে পারতাম। সেই ক্যাপসুলটা মহিলার শরীরে প্রবেশ করার পর যদি কোনও পুরুষ তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে তাহলে সেই পুরুষের শুক্রাণু হ্রাস হবে আর পরবর্তী কালে সে বাপ হতে পারবে না। তার মানে এটা নয় যে তার মধ্যে শারীরিক মিলনের ক্ষমতা কমে যাবে। সে আগের মতই শারীরিক মিলন করতে পারবে, কিন্তু তার বীর্যে শুক্রাণু থাকবে না। কোনও পুরুষকে জোর জবরদস্তি ওষুধ খাওয়ানো বা ইনজেকশন দেওয়ানোর থেকে এই উপায়টা আমার নজরে খুব সহজ ছিলো। যে কথাগুলো আমি তোমাদের বললাম সেগুলো অনুপমকেও বলেছিলাম। বলে না- সাদা মনে কাদা নেই। সেই অবস্থা ছিলো আমার। নিজের ফর্মুলার বিষয়েও আমি তাকে অনেকটা বলেছিলাম। সে যে বেইমানি করবে সেটা কে জানতো? হঠাৎ এক দিন জানতে পারলাম অনুপম কোনও বিষয় রিসার্চ করছে। নিজের স্পাই লাগিয়ে তার রিসার্চের বিষয়টা জানতে পারলাম। তখনই মাথা ঘুরে গেল আমার। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করেছিলাম। তাকে বলেওছিলাম যে সে করুক রিসার্চ, কিন্তু অবশেষে ক্রেডিটে যেন আমার নামটা দেয়। সে পুরোপুরি অস্বীকার করলো। এবার তুমি নিজেই বলো অফিসার, আমার বদলে তুমি হলে কী করতে?’
‘রিভেঞ্জ নিতাম।’ গম্ভীর গলায় অর্চিষ্মান বলল। অর্চিষ্মানের কথায় চমকে গেল স্বপ্নীল। কিন্তু ডাঃ চৌধুরী চমকালেন না। উত্তেজিত হয়ে বললেন – ‘একদম ঠিক বলেছো। রিভেঞ্জ। এদেরকে ক্ষমা করা যায় না। এদেরকে ক্ষমা করলে ঈশ্বর কোনও দিন ক্ষমা করবে না। এদের থেকে রিভেঞ্জ নিতে হয়। আমিও তাই করলাম। আমিও রিভেঞ্জ নিলাম অফিসার, আমিও রিভেঞ্জ নিলাম।’
এবার অর্চিষ্মান উঠে দাঁড়ালো।
‘খুব ভালো করলেন ডাঃ চৌধুরী, খুবই ভালো করলেন। এবার আমাদের অফিসে গিয়ে বলবেন যে আপনি রিভেঞ্জটা কী ভাবে নিলেন। স্বপ্নীল, আমি ভুল করিনি ডাঃ ব্যানার্জীর ফাইলটা রিওপেন করে।’
ডাঃ চৌধুরী কিছুক্ষণের জন্য কিছুই বুঝতে পারলেন না যে কী হলো। যখন বুঝতে পারলেন তখন তার আর করার কিছুই নেই। কী বলবেন ভেবে পেলেন না। অবশেষে মুখ খুললেন ডাঃ চৌধুরী। বললেন – ‘তোমরা কী ভাবছ, এখান থেকে তোমরা বেরিয়ে যেতে পারবে? চারিদিকে আমার গার্ড আর সিকিউরিটি আছে। ক্যামেরাতে যা যা রেকর্ড করা আছে সবগুলোকে ডিলিট করো আমার সামনে। না তো এখান থেকে বেরোনো তোমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।’
মুচকি হাসলো অর্চিষ্মান।
‘ডাঃ চৌধুরী, যখন থেকে আমরা দু’জন এখানে বসে আছি, তখন থেকে আমাদের কমান্ডো এই ফার্ম হাউসকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। আমরা কাঁচা খেলা খেলি না ডাঃ চৌধুরী। চিন্তা করবেন না, আপনাকে আমাদের অফিসে খুব ভালো করেই ওয়েলকাম জানানো হবে।”পর্ব – ১৮
……………..‘আর কোনও উপায় নেই। এর থেকে বেশি আমরা আর কিছুই করতে পারবো না।’ হতাশার সুরে কথাগুলো বলল অর্চিষ্মান।
তার সামনে ন্যাশনাল সিকিউরিটি উইংএর বড়বড় অফিসাররা দাঁড়িয়ে আছে। সাথে আছেন আবির্ভাব গাঙ্গুলীও।
‘তোমাকে এমনি হতাশ হতে এর আগে কোনও দিন দেখিনি অর্চিষ্মান।’ আবির্ভাব গাঙ্গুলী বললেন।
‘আর আমরা করতেই বা কী পারবো স্যার? এটা বাইলজিক্যাল ওয়েপানের মত চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে। যেটা ছড়িয়ে গেছে সেটাকে আটকানো সম্ভব নয়। খুব বেশি আমরা নতুন ওয়েপান তৈরি বন্ধ করতে পারি। আর আমি সেটাই করতে যাচ্ছি। একটা মেঘমিত্রাকে আমরা পেয়েছি। এমন অসংখ্য মেঘমিত্রা দেশের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদেরকে খুঁজে বের করা জাস্ট ইম্পসিবল। আমরা চেষ্টা করতে পারি যাতে নতুন মেঘমিত্রা আর তৈরি না হোক। স্যার, আমার ফোর্স দরকার। সেখানকার পরিস্থিতি আমার জানা নেই।’‘লাইফ লাইন ড্রাগস্’ ডাঃ দিবাকর চৌধুরীর ওষুধের কোম্পানি। কোলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে বেশ কিছুটা দূরে এই কোম্পানির ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরিতেই তৈরি হয় এমন ওষুধ যেগুলো স্বল্প মূল্যে বহু লোকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এবং এই ফ্যাক্টরি থেকেই তৈরি হয় অর্চিষ্মানের কথায় ‘বাইলজিক্যাল ওয়েপান’। দেশের বেশ কিছু বড়বড় শহরে ডাঃ দিবাকর চৌধুরীর কোম্পানির ফ্যাক্টরি আছে। যে যে শহরের ডাঃ চৌধুরীর কোম্পানির ফ্যাক্টরি আছে, সেই রাজ্যের ন্যাশনাল সিকিউরিটি উইংএর ব্রাঞ্চকে খবর পাঠানো হয়ে গেছে। একটা বিশেষ ক্যাপসুল যেন তৈরি না হয়।
পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র ফ্যাক্টরি কোলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে। অর্চিষ্মান কিছু ফোর্স নিয়ে রওনা হলো সে দিকে। ফ্যাক্টরিটা বানানো বেশ অনেকটা জায়গা ঘিরে। চারিদিকে সিকিউরিটিতে ভরা। ফ্যাক্টরির গেটের সামনে একটা গাড়ি এবং দু’টো ফোর্সে ভরা ভ্যান এসে থামলো। ফ্যাক্টরির সিকিউরিটি ইনচার্জের চেহারা বেশ লম্বা চওড়া। অর্চিষ্মানের গাড়ি থেকে নামতেই সে এগিয়ে এলো। অর্চিষ্মান তাকে নিজের আই ডি কার্ড দেখিয়ে বলল – ‘আপনি হয়তো খবর পাননি এখন যে এই ফ্যাক্টরির, এই কোম্পানির মালিক এখন আমাদের আন্ডারে। আমার কাছে অর্ডার ছিলো ফ্যাক্টরি সিল করে দেওয়ার। কিন্তু আমি সেটা করবো না। এই ফ্যাক্টরিতে অনেক ওষুধ তৈরি হয় যেটা সাধারণ মানুষের উপকার করে। তাই আমরা শুধু একটা বিশেষ ওষুধের ম্যানুফ্যাকচারিং বন্ধ করতে এসেছি।’
সিকিউরিটি ইনচার্জ ভালো করে অর্চিষ্মানকে দেখে বলল – ‘আমার বস ডাঃ দিবাকর চৌধুরী নয়। আমার বস হলো এই সিকিউরিটি এজেন্সির মালিক। দিবাকর চৌধুরীকে আপনারা গ্রেপ্তার করুন বা মেরে ফেলুন, যতক্ষণ না নিজের বস থেকে আমি অর্ডার পাবো নিজের ডিউটি আমি বন্ধ করবো না। বাইরের কোনও লোকের ভিতরে প্রবেশ নিষেধ।’
‘তার মানে আপনি ভিতরে ঢুকতে দেবেন না। তাই তো?’
‘না।’
সিকিউরিটি ইনচার্জের না বলার সাথে সাথে দু’টো ভ্যান থেকে যে ফোর্স নেমেছিল তারা নিজের হাতে নিমেষের মধ্যে বন্দুক উঠিয়ে নিলো। সিকিউরিটি গার্ড ফ্যাক্টরিতেও প্রচুর ছিলো। তাদের বন্দুকও গুলি চালাবার জন্য প্রস্তুত হলো। ফ্যাক্টরির সিকিউরিটি ইনচার্জ অর্চিষ্মানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল – ‘বন্দুক এদিকেও আছে অফিসার।’
‘অদ্ভুত ব্যাপার। আজকাল প্রাইভেট সিকিউরিটি এজেন্সির কর্মীদের দেখছি সাহস অনেক বেড়ে গেছে। তারা নাকি আমাদের উপর কথা বলে, তারা নাকি আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে। কোথা থেকে পাও হে এত সাহস?’
কথাটা বলার পর অর্চিষ্মান আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করলো না। নিজের কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে সোজা সিকিউরিটি ইনচার্জের কপালে ঠেকিয়ে বলল – ‘ট্রিগারটা টিপলেই গল্প শেষ।’কোলকাতা সহ দেশ জুড়ে ডাঃ দিবাকর ব্যানার্জীর কোম্পানির যত ফ্যাক্টরি আছে সবগুলোতে আপাতত তালা লাগিয়ে দেওয়া হলো। অর্চিষ্মান যখন ফ্যাক্টরিতে ঢোকে তখন তার কাছে আবির্ভাব গাঙ্গুলীর ফোন আসে। তিনি ফোনে বলেন – ‘ফ্যাক্টরি আপাতত সিল করে দাও অর্চিষ্মান। দিল্লী হেডকোয়ার্টার থেকে সেটাই অর্ডার এসেছে। ডাঃ চৌধুরীকে আজ রাতে স্পেশাল ফ্লাইটে দিল্লী নিয়ে যাওয়া হবে। সাথে তুমিও থাকবে।’
আবির্ভাব গাঙ্গুলীর কথার মতই কাজ হলো। শুধু ফ্যাক্টরি সিল করা হলো না, যত প্রাইভেট সিকিউরিটির গার্ড ছিলো প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করা হলো।
ন্যাশনাল সিকিউরিটি উইংএর কিছু কমান্ডোর সাথে সেই রাতেই অর্চিষ্মান ডাঃ দিবাকর চৌধুরীকে নিয়ে দিল্লীর জন্য রওনা হলো।পর্ব – ১৯
……………….
দু’দিন পর….
…………………..নিজের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে অর্চিষ্মান। সন্ধ্যার সময়। সামনে সূর্যাস্ত হচ্ছে। পিছন থেকে অনন্যা দু’ হাতে দুটো কফির কাপ হাতে নিয়ে এলো। একটা অর্চিষ্মানকে দিলো। কফিতে এক চুমুক দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে অর্চিষ্মান বলল – ‘আমি পারলাম না অনন্যা। পারলাম না এই দেশকে রক্ষা করতে।’
নিজের এক হাত অর্চিষ্মানের কাঁধে রাখলো অনন্যা। বলল – ‘তোমার যা করার সেটা তুমি করেছো। এর থেকে বেশি তোমার কিছু করার ছিলো না। তুমি তো নিজেও জানো যে এটাকে আটকানো অসম্ভব।’
‘প্রতিশোধের আগুন চারিদিক ছারখার করে দেয়। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকা মানুষ নিজেও পুড়ে যায় এবং আশেপাশের বহু মানুষকে পুড়িয়ে দেয়। এটাই হলো ডাঃ দিবাকর চৌধুরীর সাথে। তিনটে গুমখুন, যার লাশ পাওয়া গেলো না। এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে এমন সর্বনাশ। এক দিকে কম দামে ওষুধ বাজারে ছেড়ে গরীব বাঁচানোর ঢং, অন্য দিকে মানুষের জন্মের উপর লাগাম লাগিয়ে দেওয়া। সব ঠিক থাকতো অনন্যা, সব ঠিক থাকতো যদি ডাঃ চোধুরী নিজের বানানো ফর্মুলা নিয়েই এগোতেন। কিন্তু তিনি সেটা করলেন না। তিনি ওষুধটাকে আরও কড়া বানালেন। শেষে ওষুধটা এমন কড়া হলো যে পুরুষরা চিরকালের মত শারীরিক মিলনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো। ডাঃ ব্যানার্জীর প্ৰতি আক্রোশ তাকে এই পর্যায় নিয়ে গিয়েছিল যে তিনি এটা দেখতে পারলেন না যে তিনি পুরো দেশকে মারাত্মক সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ডাঃ চৌধুরীর ফার্ম হাউস থেকে কিছু পুরনো কাগজ পাওয়া গেছে। কাগজগুলো অনেক পুরনো। ওষুধের ফর্মুলা লেখা আছে তাতে। হাতের লেখা যে ডাঃ চৌধুরীর নয় সেটা দেখেই বোঝা যায়। খুব মারাত্মক প্ল্যান করেছিলেন তিনি। ডাঃ ব্যানার্জী এবং তার পরিবারকে মারার পরেও তিনি শান্তি পাননি। ডাঃ ব্যানার্জীকে পুরো দেশ ও দুনিয়ার নজরে বদনাম করা ছিল তার আসল উদ্দেশ্য। দূরদর্শিতায় ভরা ডাঃ চৌধুরী এটা অনুমান লাগিয়েছিলেন যে কোনও না কোনও দিন গভর্মেন্টের নজর পড়বেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি অনুপাতের উপর। হয়তো তদন্তও হতে পারে। তখন তিনি ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর ফর্মুলাটা সবার সামনে আনবেন। ডাঃ ব্যানার্জী নিরুদ্দেশ হওয়ার আগেই সেই ভয়ানক ওষুধটা বাজারে ছেড়ে দিয়েছিলেন। জানি না এটা ডাঃ চৌধুরী কী ভাবে করতেন, কিন্তু তার প্ল্যান এটাই ছিলো। আজকের দিনে দেশের বহু মহিলার শরীরের সেই ক্যাপসুল প্রবেশ করে গেছে। তারা বহু অল্প বয়সী ছেলের সাথে সম্পর্ক করে তাদের নপুংসক বানিয়ে দিচ্ছে। এই কারণেই চারিদিকে লেসবিয়ানের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। টাকা দিয়ে কী না করা যায় অনন্যা। বলতে গেলে ডাঃ চৌধুরী নিজের ইনকামের অর্ধেক থেকে বেশি অর্থ খরচ করেছেন এই র্যােকেটের পিছেনে। জানি না এই অগুনতি মহিলারা আর কত ছেলের জীবন নষ্ট করবে। শায়ক আর প্লুটোর মত হয়তো অসংখ্য পুরুষ ও অল্প বয়সী ছেলে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তাদের দেখতে পারছি না, তাদের চিনতে পারছি না। এটাই হয়তো আমাদের দুর্ভাগ্য। ডাঃ চৌধুরী দেশের ভিতরেই ভয়ানক বাইলজিক্যাল ওয়ার লাগিয়ে দিলেন। জানি না অনন্যা, ডাঃ চৌধুরীর এই বাইলজিক্যাল ওয়েপান পরবর্তী কালে মনুষ্য জাতির আর কত ক্ষতি করবে।’
অস্তের দিকে যাওয়া সূর্যের দিকে খানিক তাকিয়ে নিজের দু’ চোখ বন্ধ করলো অর্চিষ্মান। অনন্যা তার হাত নিজের হাতে চেপে ধরলো।*সমাপ্ত।*
-
ধারাবাহিক- দি এম্পটি আর্থ (চতুর্থ অংশ)
দি এম্পটি আর্থ (চতুর্থ অংশ)
-বিশ্বদীপ মুখার্জী
……………
পর্ব – ১৬
………………পরদিন সকালেই স্বপ্নীলের ফোন এসেছিল অর্চিষ্মানের কাছে। ফোন করে সে বলল – ‘ডাঃ চৌধুরী ইন্টরভিউয়ের জন্য রাজি হয়ে গেছে। আজ বিকেলে সময় সময় দিয়েছে সে। রেডি থাকিস। ঠিক বিকেল পাঁচটা।’
ডাঃ দিবাকর চৌধুরীর ফার্ম হাউস ডায়মন্ড হারবার রোডে। মাত্র দু’জনের আসার অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল। সেটা স্বপ্নীল আর অর্চিষ্মান দু’জনেই জানতো। সময় দেওয়া হয়েছিল মাত্র তিরিশ মিনিট।
‘আমাদের হাতে সময় কিন্তু খুব কম। তিরিশ মিনিটের মধ্যে আমাদের কাজ সেরে ফেলতে হবে।’ রওনা দেওয়ার আগে স্বপ্নীল বলল অর্চিষ্মানকে।
অর্চিষ্মান এক নতুন রূপ ধারণ করেছে। লম্বা লম্বা চুল, পিছনে পনিটেল। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের সানগ্লাস।
‘তিরিশ মিনিট অনেক আমার জন্য। বেশি প্ৰশ্ন করা আমার স্বভাব নয় স্বপ্নীল। দু’ চারটে প্রশ্নতেই আসল তথ্যটা বের করে আনার চেষ্টা করি আমি। আজও সেই চেষ্টাটাই করবো।’ নিজের কথা শেষ করলো অর্চিষ্মান।
নিউজ চ্যানেলের গাড়ি করেই তারা গেল। বেশি জিনিস তাদের কাছে ছিল না। একটা ক্যামেরা আর একটা মাইক। নিউজ চ্যানেলের একটা আই ডি কার্ড অর্চিষ্মানের নামে বানিয়ে দিয়েছিল স্বপ্নীল। ঠিক বিকেল পাঁচটায় তাদের গাড়ি ডাঃ দিবাকর চৌধুরীর ফার্ম হাউসের মুখ্য ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো। ফটকের কাছেই দু’টো বন্দুকধারী গার্ড দাঁড়িয়ে। অর্চিষ্মান, স্বপ্নীল এবং গাড়ির চালকের আই কার্ড দেখলো তারা। তিনজনকেই গাড়ি থেকে বের করে মুখ্য ফটক সংলগ্ন একটা ছোট্ট ঘরে নিয়ে গেল। ছোট্ট একটা ক্যামেরা দিয়ে তিনজনেরই ছবি তোলা হলো। জমা নিয়ে নেওয়া হলো তাদের মোবাইল ফোন। ফার্ম হাউসের ভিতর শুধু দু’জনের যাওয়ার অনুমতি আছে। ড্রাইভারকে গাড়িতে বসেই অপেক্ষা করতে হবে। দু’টো গার্ড ছাড়া সেখানে এক তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব হলো। সে অর্চিষ্মান ও স্বপ্নীলকে ফার্ম হাউসের ভিতর নিয়ে গেল। একটা বেশ বড় ড্রইং রুমে তাদের বসতে দিয়ে সেই লোকটা বলল – ‘আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন। ডক্টর বাবু একটু পরেই আসবেন।’
নিজের কথা শেষ করে সেই লোকটা উধাও হয়ে গেল।
ড্রইং রুমের দেয়ালে বেশ কিছু পেন্টিংস সাজানো। দু’ দিকের দেয়ালে দু’টো এ সি। প্লাস্টার অফ পেরিসের চারটে স্ট্যাচু ঘরের চার কোণে দাঁড়িয়ে আছে। মেঝেতে পাতা দামী কার্পেট। ঘরের মাঝখানে গোল করে ঘেরা সোফা সেট। তার মাঝে সেন্টার টেবিল। দু’জনে সোফাতে বসে অপেক্ষা করছে ডাঃ দিবাকর চৌধুরীর। প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হলো তাদের। দশ মিনিট পর অর্চিষ্মান প্রথমবার সামনে থেকে দেখলো বিখ্যাত ডক্টর এবং গবেষক দিবাকর চৌধুরীকে। দিবাকর চৌধুরীর শেষ সাংবাদিক সম্মেলনে স্বপ্নীল দেখেছিল তাকে। অর্চিষ্মান তাকে সামনাসামনি এই প্রথম দেখলো। উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির মত। গায়ের রঙ ফর্সা, মাথায় ব্যাক ব্রাশ করা সাদা চুল, মুখে দাড়ি – গোঁফের চিহ্নমাত্র নেই। চেহারায় যে আভিজাত্যের ছাপ আছে সেটা বলাই বাহুল্য। ডাঃ চৌধুরীর ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই অর্চিষ্মান ও স্বপ্নীল উঠে দাঁড়ালো। ডাঃ চৌধুরী দু’জনকে বসার ইশারা করে নিজেও সোফাতে বসলেন। স্বপ্নীল নিজের পরিচয় দিলো এবং অর্চিষ্মানের পরিচয় করালো ডাঃ চৌধুরীর সাথে। অর্চিষ্মানের নাম এখন দেবব্রত অধিকারী।
‘কী জানতে চাও তোমরা?’ ডাঃ চৌধুরী স্বপ্নীলকে জিজ্ঞাসা করলেন।
‘আপনার নতুন প্রজেক্টের বিষয়।’ জবাব দিলো স্বপ্নীল।
‘প্রজেক্ট বলতে অর্গ্যান ব্যাংক, তাই তো?’
‘ইয়েস স্যার।’
‘অর্গ্যান ব্যাংকের বিষয় তো সে দিন আমি প্রেস কনফারেন্সে সব কিছুই বলেছি। নতুন কিছু বলার মত আছে বলে তো মনে পড়ছে না।’ ডাঃ চৌধুরী বললেন।
‘বলার মত আছে ডাঃ চৌধুরী। অনেক কিছুই বলার মত আছে।’ এবার অর্চিষ্মান বলল। অর্চিষ্মান ততক্ষণে ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়েছে।
ডাঃ দিবাকর চৌধুরী ভ্রুকুটি করে তাকালেন অর্চিষ্মানের দিকে।
‘কী এমন বলার মত আছে যেটা আমি সে দিন প্রেস কনফারেন্সে বলিনি?’
অর্চিষ্মান ও স্বপ্নীল এক অপরের দিকে একবার তাকালো।
‘আপনার ইতিহাস জানতে চাই ডাঃ চৌধুরী। জানতে চাই আপনার অতীত। পশ্চিমবঙ্গের এক ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করা থেকে শুরু করে বিশ্ব বিখ্যাত ডক্টর এবং গবেষক হওয়ার সম্পূর্ণ যাত্রাটা আমরা জানতে চাই এবং সকলকে জানাতে চাই।’ কথাটা প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলল অর্চিষ্মান।
খানিক চুপ থেকে অর্চিষ্মানের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ডাঃ চৌধুরী। অর্চিষ্মান ক্যামেরা অন করলো। স্বপ্নীল মাইক এগিয়ে দিলো ডাঃ চৌধুরীর দিকে।
‘পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলাতে আপনার জন্ম। সেখানেই লেখাপড়া আপনার। সেখান থেকে আজ বিশ্ব বিখ্যাত ডক্টর এবং গবেষক।’ স্বপ্নীল বলল।
ডাঃ চৌধুরী বলতে শুরু করলেন – ‘ডক্টর হওয়ার ইচ্ছে আমার ছোট থেকেই। আমার নিজের কাকা ডক্টর ছিলেন। তাকে দেখেই আমার মনে ইচ্ছে জন্মায় যে আমি ডক্টর হবো। ডাক্তারিকে আমি কোনও দিন নিজের পেশা হিসেবে দেখিনি। চেষ্টা করে গেছি লোকেদের সেবা করার। ঈশ্বরের কৃপায় নিজের চেষ্টায় অনেকটাই সফল হতে পেরেছি। নাম, যশ এগুলো ক্ষণিকের। আজ আছে তো কাল নেই। আমি চিরকাল চেয়েছি লোকেদের হৃদয়ে নিজের স্থান তৈরি করার। বিশেষ করে গরীবদের হৃদয়ে। আজ যুগ অনেক এগিয়ে গেছে, তাও আজও বহু গরীব মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। তাদের কাছে টাকা থাকে না ওষুধ কিনবার। এ সব জিনিস আমার কোনও দিনই সহ্য হতো না। আমি কিছু করতে চাইতাম তাদের জন্য। করেছি, সফল হয়েছি নিজের কাজে। আমার ওষুধের কোম্পানি থেকে অনেক কম দামের ওষুধ তৈরি করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই.. বহু লোকের কাছে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া। আজ আকাশ ছোঁয়া মূল্য বৃদ্ধিতেও আমরা খুবই অল্প দামে ওষুধ দিই, যাতে গরীবরা বাঁচতে পারে। এখনও মনে আছে, তখন আমি ক্লাস টেন-এ পড়ি। আমার পাশের বাড়ির কাকিমা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। খুব ভালোবাসতেন আমায়। গরীব ছিলেন। তাও কাকু বহু দিন কষ্ট করে কাকিমার চিকিৎসা চালালেন। দিনে দিনে ওষুধের দাম আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। শেষে আর পারলেন না তিনি। ঘটনাটা ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল আমায়। আমার চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটেছে। চোখের আড়ালে তো আরও অনেক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যেটার বিষয় আমরা জানতেই পারছি না। কাকিমার মত তো বহু লোক প্রাণ হারাচ্ছে। ছোট বেলায় ভাবতাম যে ডক্টর হয়ে বিনা মূল্যে গরীবদের চিকিৎসা করবো। কিন্তু যখন আস্তে আস্তে বড় হলাম, চিন্তা ধারায় পরিবর্তন ঘটলো। গরীবদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা করে তাদের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব না। আমি তো ফ্রীতে তাদের দেখবো। কিন্তু তারা ওষুধ কিনবে কোথা থেকে? তখন থেকেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে যেমন করে হোক ওষুধের দাম কম করার ব্যবস্থা করতেই হবে। না তো বহু প্রাণ অকালেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে নেবে।’
‘একটা ছোট প্রশ্ন আছে।’ কথাটা অর্চিষ্মান বলল ক্যামেরার পিছন থেকে।
আবার অদ্ভুত দৃষ্টিতে ডাঃ দিবাকর চৌধুরী তাকালেন অর্চিষ্মানের দিকে।
‘কী প্রশ্ন?’ জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
‘ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর সাথে আপনার সম্পর্ক তো খুব ভালো ছিলো। তাই না?’ অর্চিষ্মান প্রশ্ন করলো।
ডাঃ চৌধুরীর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। এমন প্রশ্ন হয়তো তিনি আশা করেননি। তার কপালে অল্প অল্প ঘামের বিন্দু দেখতে পেলো অর্চিষ্মান। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন ডাঃ চৌধুরী। বললেন – ‘হুম। ভালো সম্পর্ক ছিল আমাদের। খুব ভালো ডক্টর ছিল সে। কী যে হয়ে গেল, কোথায় যে চলে গেল ভগবান জানে।’
‘তাকে শেষ বারের মত আপনার সাথেই দেখা গিয়েছিল।’ বলল অর্চিষ্মান।
‘হুম, জানি। তার বাড়ি গিয়েছিলাম। সেই ডেকে পাঠিয়েছিল।’
‘কেন ডেকে পাঠিয়েছিল সেটা কি জানতে পারি?’
এবার শুধু দৃষ্টি নয়, গলার আওয়াজটাও বেশ কড়া হলো ডাঃ চৌধুরীর।
‘আপনারা এখানে ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন না তদন্ত করতে এসেছেন?’
অর্চিষ্মান ক্যামেরার পিছন থেকে সরে গিয়ে ডাঃ চৌধুরীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল – ‘প্ৰশ্নগুলোকে ইন্টারভিউযের অংশ মনে করুন ডাঃ চৌধুরী। হঠাৎ ডাঃ ব্যানার্জী আপনাকে নিজের বাড়িতে কেন ডেকে পাঠিয়েছিলেন?’
‘বহু বছর আগেকার কথা। ওতো মনে রাখা সম্ভব নয়।’
‘সেটাও ঠিক। তবে একটা কথা আপনাকে না বলে থাকতে পারছি না ডক্টর চৌধুরী।’ অর্চিষ্মান স্বপ্নীলের পাশে বসে বলল – ‘এটা সেই সালেরই কথা যে সালে ডাঃ ব্যানার্জী অন্তর্ধান হয়েছিলেন। মানে 2036 সালের কথা। আপনার সাথে শেষ দেখা হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তার আগে তিনি একটা বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতাটা এখনও ইন্টারনেটে আছে। আপনি যে কথাগুলো বলছেন সে কথাগুলো অনেক আগেই তিনি বলে গেছেন।’
‘কী বলতে চাও তুমি?’ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন ডাঃ চৌধুরী।
‘ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে পর্যন্ত আপনি গবেষণার ক্ষেত্রে বেশি দূর এগোতে পারেননি। গবেষণার ক্ষেত্রে তখন ডক্টর ব্যানার্জীর নাম আপনার থেকে অনেক এগিয়ে। হঠাৎ করে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তারপর থেকে শুরু হয় আপনার যাত্রা। কম মূল্যের ওষুধের বিষয় ডাঃ ব্যানার্জী নিজের বক্তৃতাতে বলেছিলেন। পরবর্তী কালে আপনি সেই কাজে হাত দিলেন এবং সফল হলেন। এটা কি শুধু কাকতলীয়? কাকতলীয় মেনে নেওয়া যেতো যদি আপনার সাথে ডক্টর ব্যানার্জীর ভালো সম্পর্ক না থেকে থাকতো।’
অর্চিষ্মানের কথায় মাথা গরম হলো ডাঃ চৌধুরীর। উচ্চ কন্ঠে তিনি বললেন – ‘হোয়াট ননসেন্স। তুমি কি বলতে চাও আমি ডক্টর ব্যানার্জীর আইডিয়া চুরি করেছি?’
‘আমি তো কিছুই বলছি না ডাঃ চৌধুরী। শুধু অনুমানের কথা বলছি।’ শান্ত কন্ঠে অর্চিষ্মান বলল।
‘নিজের অনুমান নিজের কাছে রাখো। এটা ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে না আমার উপর এলিগেশন লাগানো হচ্ছে। এখানে তোমরা তামাশা করতে এসেছ? তোমরা হয়তো জানো না যে আমার সময় কত দামী। আমি চাইলে এক্ষুণি তোমাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারি। তোমাদের নিউজ চ্যানেলে ফোন করে যদি তোমাদের নামে কমপ্লেন করি তাহলে তোমাদের চাকরি চলে যাবে সেটা জানো কি?’
মুচকি হেসে অর্চিষ্মান বলল – ‘জানি। সাথে এটাও জানি যে আপনি এটা করবেন না। আপনাকে দু’টো কথা বলা হয়নি। ওই দু’টো কথা শুনলে আপনি হয়তো একটু শান্ত হবেন। প্রথম কথা হলো ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর নিরুদ্দেশের ফাইলটা রিওপেন হয়েছে। আর দ্বিতীয় কথা হলো আপনার সামনে যে দু’জন বসে আছে তাদের মধ্যে একজন মানে আমি এন এস ডব্ল্যূ’র অফিসার।’
অর্চিষ্মান ও স্বপ্নীল লক্ষ্য করলো হঠাৎ করে ডক্টর চৌধুরীর মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
‘অনেক ঘটনা ঘটে গেছে ডাঃ চৌধুরী। জল অনেক গড়িয়ে গেছে। ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে আবার থেকে। কোনও পুরনো ফাইল রিওপেন হওয়া মানে আপনি জানেন নিশ্চই। আগে যা যা হয়নি, এখন সেগুলো হবে। ডক্টর অনুপম ব্যানার্জীর নিরুদ্দেশের মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। আপনি তার কাছের বন্ধু ছিলেন। কিছু তো আপনি নিশ্চই জানেন। পরবর্তী কালে আপনি সে পথেই হেঁটেছেন যে পথ ডাঃ ব্যানার্জী দেখিয়ে গিয়েছিলেন।’
‘তুমি ভুল করছো অফিসার। ডাঃ ব্যানার্জীর নিরুদ্দেশের বিষয় আমি কিছুই জানি না। তূমি বারবার বলছো যে তার দেখানো পথে আমি হেঁটেছি। তাতে ভুল কী করেছি? ডাঃ ব্যানার্জীর স্বপ্ন ছিলো যে ওষুধের মূল্য এতই কম হোক যে সেটা সাধারণ গরিব জনতার কাছে পৌঁছতে পারে। তার নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণে তার সেই স্বপ্নটা পুরো হতে পারেনি। আমি তার কাছের বন্ধু ছিলাম। তাই আমার কর্তব্য ছিলো নিজের বন্ধুর স্বপ্নটা পুরো করার। আমি তার স্বপ্নকে পুরো করে তার আত্মাকে শান্তি দিয়েছি। আমার তো মনে হয় না যে আমি কোনও ভুল কাজ করেছি। কারোর স্বপ্নকে পুরো করা যদি অন্যায়, তাহলে আমি অন্যায় করেছি। তোমার নজরে যদি সেটা অন্যায় মনে হয় তাহলে তুমি গ্রেপ্তার করতে পারো আমায়।’ কথাগুলো দৃঢ় কন্ঠে বললেন ডাঃ চৌধুরী।
‘জেনে খুশি হলাম ডাঃ চৌধুরী যে আপনি নিজের বন্ধুর অপূর্ণ স্বপ্নকে পূর্ণ করেছেন। তাহলে তো বলতে হয় আপনার বন্ধুর আরও একটা অপূর্ণ স্বপ্ন ছিলো। আপনি নিশ্চয়ই সেটাও পূর্ণ করার চেষ্টায় লেগে আছেন।’
‘কোন স্বপ্নের কথা বলছো তুমি?’
অর্চিষ্মান এবার মুখে কিছু বলল না। নিজের মোবাইল বের করে ডাঃ ব্যানার্জীর সেই বক্তৃতার ভিডিওটা চালিয়ে ডাঃ চৌধুরীর সামনে রেখে দিলো।
‘ভিডিওটা ভালো করে দেখুন ডাঃ চৌধুরী। বিশেষ করে শেষ অংশটা।’
অর্চিষ্মানের দিকে একবার রক্তবর্ণ চোখে তাকিয়ে ভিডিও দেখতে শুরু করলেন ডাঃ চৌধুরী।চলবে…
-
ধারাবাহিক- দি এম্পটি আর্থ (তৃতীয় অংশ)
দি এম্পটি আর্থ (তৃতীয় অংশ)
-বিশ্বদীপ মুখার্জী
…………….
পর্ব – ১১
……………….প্লুটো তাকে ফ্ল্যাট নম্বর বলেছে। সেখানে গিয়ে অর্চিষ্মান দেখলো ফ্ল্যাট বন্ধ। চৌকিদারকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল – ‘মেঘমিত্রা ম্যাডামেরই ফ্ল্যাট এটা। তিনি মাঝে মাঝে আসেন। যখনই তিনি আসেন নিজের সাথে কোনও না কোনও অল্প বয়সী ছেলেকে নিয়ে আসেন। সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হলো ছেলে বদলের মাঝের সময়টা তিনি গায়েব থাকেন।’
‘কী করেন তিনি?’ জিজ্ঞাসা করলো অর্চিষ্মান।
‘জানি না স্যার। কী কাজ করেন সেটা বলতে পারবো না।’
‘তোমার কি কোনও আন্দাজ আছে যে এখন পর্যন্ত কটা ছেলেকে সে এই ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছে?’
খানিক চিন্তা করে চৌকিদার বলল – ‘ঠিক মত বলতে পারবো না স্যার। তাও কম করে দশ – বারোটা ছেলেকে তো সে নিয়েই এসেছে।’নিজের ফ্ল্যাটে ফেরার পথে অর্চিষ্মান ফোন করলো সপ্তর্ষিকে। বলল – ‘তোর বন্ধু শায়কের নিজের শিক্ষিকার প্রেমে পড়ার ঘটনাটা প্রায় বাইশ বছর পুরনো না?’
‘হ্যাঁ, তা হবে।’
‘তখনকার একটা ঘটনা মনে কর সপ্তর্ষি। বেশ কিছু দিন ধরে ঘটনাটার জের ছিল। নিউজ চ্যানেল, নিউজ পেপার তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল।’
‘কী ঘটনা বলতো।’
‘অদ্ভুত। তুই ভুলে গেলি? ভুলে অবশ্য আমিও গিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ করে মনে পড়লো। দেশ জুড়ে বেশ কিছু মহিলাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তারা নাকি অল্প বয়সী ছেলেদের নিজের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে সেক্স করতো, আর না তো তাদের ধর্ষণ করতো। বহু মাত্রায় অল্প বয়সী ছেলেদের ধর্ষণ। ভাবতে পারিস? পুলিশ তাদের মুখ থেকে কিছুই বের করতে পারেনি। তাদের কাছে নাকি পটাশিয়াম সায়ানাইড ছিল। মনে পড়েছে?’
‘হ্যাঁ, পরিস্কার মনে পড়েছে।’ বলল সপ্তর্ষি।
‘আমার যত দূর মনে হয় তোর শায়কের প্রেমিকাও তাদেরই দলের।’
‘কিন্তু তাদের কিছু তো উদ্দেশ্য হবে?’ সপ্তর্ষি প্রশ্ন করলো।
‘উদ্দেশ্যই তো জানা যায়নি ভাই। উদ্দেশ্য জানা গেলে অনেক তথ্যই সামনে এসে যেতো। কিন্তু কিছুটা উদ্দেশ্য আমি হয়তো বুঝতে পেরেছি।’
‘কী?’
‘এখন নয়। আগামী কাল বলবো। একটা ছোট্ট পরীক্ষা করা এখনও বাকি আছে।’‘তোমার কি মাথাটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে অর্চিষ্মান?’
রাতে শুতে যাওয়ার আগে অর্চিষ্মান নিজের প্ল্যানটা বলেছিল অনন্যাকে। শুনে খানিক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে অর্চিষ্মানের দিকে তাকিয়ে রইল অনন্যা।
‘আমার প্রমাণ চাই অনন্যা। আমি চোখ বন্ধ করে হাওয়াতে ঢিল ছুঁড়তে নারাজ। যে সন্দেহটা আমি করছি সেটা যদি সঠিক হয়, তাহলে এটা ভেবে নাও যে এই কেসের অনেকটা কাছে আমি পৌঁছে গেছি। শুধু কিছু প্রশ্ন করতে চাই ডাঃ চৌধুরীকে।’
‘তুমি যার উপর আঙ্গুল তুলছ সে কিন্তু সমাজের এক বিশিষ্ট ব্যক্তি। এটা মনে রেখো।’ অনন্যা বলল।
‘অনন্যা, তুমি ভুল করছো। আমি কারোর উপর আঙ্গুল তুলছি না। বিনা প্রমাণে কারোর উপর আঙ্গুল তোলা আমার স্বভাব বিরুদ্ধে। যেহেতু কোনও এক সময় ডাঃ চৌধুরীর সাথে ডাঃ ব্যানার্জীর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, তাই ডাঃ ব্যানার্জীর নিরুদ্দেশ সম্পর্কে তিনি কিছু আলোকপাত করতে পারেন।’
‘বহু বছর হয়ে গেছে ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর নিরুদ্দেশ হওয়া। বারো বছর পর্যন্ত যদি কোনও নিরুদ্দেশ ব্যক্তির সন্ধান না পাওয়া যায় তাহলে তাকে মৃত বলে মেনে নেওয়া হয়। শুধু ডাঃ ব্যানার্জী নয়, তার স্ত্রী এবং সন্তানকেও মৃত বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। তাদের ফাইল বহুদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।’
অর্চিষ্মান বলল – ‘সেটা আমি জানি সুইট হার্ট। কিন্তু তুমি হয়তো এটা ভুলে যাচ্ছ যে এন এস ডব্ল্যূ’র কাছে এই ক্ষমতাটা আছে যে সন্দেহবশত তারা বন্ধ ফাইলকেও রি ওপেন করতে পারে। আমি তাই করবো। ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর বন্ধ ফাইলকে রি ওপেন করবো। আপাতত আগামী কালের কাজটা সেরে নিই।’
‘আগামী কাল যেটা তুমি করতে যাচ্ছ সেটা কি ঠিক করছো? প্লুটোর বয়সই বা কত? তার সাথে এমন করো না।’ অনন্যা বলল।
‘আমি তো তার কোনও ক্ষতি করছি না অনন্যা। এটা শুধু একটা পরীক্ষা মাত্র। সে জানতেও পারবে না। প্রথমে তাকে এক সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যাবো। সাইক্রিয়াটিস্ট তাকে দু- চারটে প্রশ্ন করে তাকে অজ্ঞান করবে। তার অচেতন অবস্থাতেই তার পরীক্ষা হবে।’
‘পরীক্ষা করাটা কি খুব দরকার?’ অনন্যা প্রশ্ন করলো।
‘তোমাকে বললাম না অনন্যা, এই পরীক্ষার ফল যেটা আমি ভেবেছি যদি তাই হয়, তাহলে আমি এক শক্ত প্রমাণ পেয়ে যাবো। এই প্রমাণটাই আমার দরকার।’পর্ব – ১৩
……………….ছোট থেকেই প্লুটোর কাজ করার ইচ্ছে এন এস ডব্ল্যূ তে। তারা নাকি অদ্ভুত অদ্ভুত তদন্ত করে, অনেক রহস্যউদঘাটন করে। তাদের কাজটা অ্যাডভেঞ্চারে ভরা। প্লুটোর অ্যাডভেঞ্চার বেশ ভালো লাগে, তাই ভালো লাগে এন এস ডব্ল্যূও। হঠাৎ অর্চিষ্মান তাকে এন এস ডব্ল্যূ’র অফিসে ডেকে পাঠিয়েছে শুনে বেশ আশ্চর্য হয়েছিল সে। যেহেতু অফিসটা এন এস ডব্ল্যূ’র, তাই আর দু’বার চিন্তা করলো না সে। এন এস ডব্ল্যূ’র বহুতল বিল্ডিংএর নিচেই অর্চিষ্মান অপেক্ষা করছিল প্লুটোর।
‘আমাকে হঠাৎ এখানে ডেকে পাঠালে?’ অর্চিষ্মানকে দেখেই প্লুটো জিজ্ঞাসা করলো।
‘তোমার এখানে কাজ করার ইচ্ছে আছে। তাই না? তাই ভাবলাম একবার তোমায় ঘুরিয়ে দিই। তোমার মনটাও ভালো হয়ে যাবে।’
কথা শেষ করে অর্চিষ্মান ভিতরে নিয়ে গেল প্লুটোকে। এন এস ডব্ল্যূ’র অফিস তাকে ঘোরালো, পরিচয় করালো কিছু অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাথে। বেশ খুশি মনে সেগুলোকে দেখলো প্লুটো। নিজের দুঃখ যেন ভুলেই গেল সে। সুযোগ দেখে অর্চিষ্মান প্লুটোকে বলল – ‘তোমাকে একটা দরকারি কথা বলতে চাই প্লুটো। যেহেতু তুমি পরবর্তী কালে এখানেই কাজ করতে চাও, তাই তোমাকে এ কথাগুলো বলা উচিত বলে মনে করি।’
‘কী কথা?’ প্লুটো জিজ্ঞাসা করলো।
এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্চিষ্মান বলল – ‘প্লুটো, ঘটনাটা তোমার সাথে রিলেটেড। তোমার আর মেঘমিত্রার সাথে।’
মেঘমিত্রার নাম শুনে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল প্লুটোর।
‘দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই প্লুটো। মেঘমিত্রা একা নয়, আর একা নয় প্লুটোও। অসংখ্য মেঘমিত্রা ও অসংখ্য প্লুটো আজ চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেঘমিত্রাদের কাজ প্লুটোদের নিজের জালে ফাঁসিয়ে নেওয়া। বহু বছর আগে থেকে মেঘমিত্রাদের আবির্ভাব হয়। তবে থেকে তারা অসংখ্য প্লুটোদের নিজের জালে ফাঁসিয়ে তাদের দিয়ে কিছু ভুল কাজ করিয়ে যাচ্ছে। এমন কাজ যেটা সমাজের আর এন এস ডব্ল্যূ’র নজরে ক্রাইম। এই মনে করো আজ তোমায় ছেড়ে চলে গেল মেঘমিত্রা। তুমি তার দুঃখে অবসাদে ভুগছো। কিছু দিন পর হঠাৎ করে সে ফিরে এলো। এই অপ্রত্যাশিত খুশি তুমি নিতে পারলে না। ছুটে গেলে তার দিকে। ব্যাস, এখানেই বাজিমাত করে নিলো সে। এবার সে যা বলবে, তুমি তাই করবে। প্লুটো, এদের দল অনেক বড়। কত দূর পর্যন্ত তারা ছড়িয়ে আছে সেটা এখনও আমরা জানি না। জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এখনও। আজ তুমি আমাদের সাহায্য করবে প্লুটো। এন এস ডব্ল্যূ’র তোমার সাহায্যের প্রয়োজন।’
এন এস ডব্ল্যূ-কে সাহায্য করার সুযোগ পাবে কোনও দিন ভাবেনি প্লুটো। এটা তার জন্য আশাতীত। মনটা আনন্দে ভরে গেল তার।
‘কী করে আমি এন এস ডব্ল্যূ’র কাজে আসবো?’ প্লুটো জিজ্ঞাসা করলো অর্চিষ্মানকে।
‘এন এস ডব্ল্যূ’র একটা অফিসারের কাছে আমি তোমায় নিয়ে যাবো। সে তোমায় কিছু প্রশ্ন করবে মেঘমিত্রার বিষয়ে। তুমি তার বিষয়ে যা যা জানো সেগুলো বলো। আমাকে যা বলেছো, তার থেকেও বেশি কিছু জানলে সেই অফিসারকে বলো। ঠিক আছে?’
প্লুটো ঘাড় নেড়ে সহমত দিলো।এন এস ডব্ল্যূ’র আন্ডার গ্রাউন্ডে অর্চিষ্মান নিয়ে গেল প্লুটোকে। হল ঘরের মত এক বড় ঘরে ঢুকলো তারা। ঘরের একদিক সবুজ পর্দা দিয়ে ঢাকা। পর্দার ওপারে কী আছে সেটা দেখা মুশকিল। অন্য দিকে এক রিভলবিং চেয়ারে বসে আছেন মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক। তার সামনে একটা বড় টেবিল ও টেবিলের ওপারে দু’টো চেয়ার। ভদ্রলোকের নাম ডক্টর শত্রুঘ্ন বিশ্বাস। তিনি সাইক্রিয়াটিস্ট। ভালো করে একবার প্লুটোকে দেখে তিনি অর্চিষ্মানকে বললেন – ‘চিন্তা নেই অফিসার। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে যেতে পারো। আমি ঠিক নিজের কাজ করে নেবো।’
পর্ব – ১৪
………………‘যদি তোমার ডাউট ঠিক হয় তাহলে এটাকে আটকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।’ বললেন আবির্ভাব গাঙ্গুলী।
প্লুটোকে ডাঃ শত্রুঘ্ন বিশ্বাসের কাছে ছেড়ে অর্চিষ্মান দেখা করতে গেল আবির্ভাব গাঙ্গুলীর সাথে। প্লুটোর উপর কোনও মেডিক্যাল পরীক্ষা করাতে তিনিও আগে অনুমতি দেননি। কিন্তু পরে অর্চিষ্মানের তর্কে তিনি হার মেনে গেলেন। প্রতিটি সমীকরণ একে একে মিলিয়ে তাকে বুঝিয়েছিল অর্চিষ্মান। শুধু শেষ প্রমাণের অপেক্ষা। খুব সম্ভব সেটাও আজ পেয়ে যাবে।
আবির্ভাব গাঙ্গুলীর কথায় অর্চিষ্মান বলল – ‘এখনই আমি কিছু ফাইনাল বলতে চাই না স্যার। শেষ প্রমাণটা আগে পেয়ে যাই। 2022 সালে প্রফুল্ল গুহ নামের এক প্রফেসার ‘দি এম্পটি আর্থ’ নামের এক বই লিখেছিলেন। মনুষ্য জাতি লুপ্ত হওয়ার অনেক কারণের ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। মুখ্য কারণ দিয়েছিলেন বিষাক্ত রেডিয়েশন। কারণ আলাদা যাই হোক না কেন, মনুষ্য জাতি কিন্তু বিলুপ্তের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমিও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে তদন্তটা শুরু করবো কোথা থেকে। ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে ডাঃ ব্যানার্জীর বক্তৃতা চোখে পড়লো। ভাবলাম, এখান থেকেই শুরু করা যাক।’
‘ডাঃ চৌধুরীর ইন্টারভিউয়ের কী ব্যবস্থা করলে?’ প্রশ্ন করলেন আবির্ভাব গাঙ্গুলী।
‘সেটাও দিন দুয়েক-এ হয়ে যাবে স্যার।’
খানিক বিরতি নিয়ে আবির্ভাব গাঙ্গুলী বললেন – ‘তোমার ধারনা এদের বড় গ্যাং কাজ করছে। কোনও বড় র্যাভকেটের সাথে যুক্ত তারা। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য জানা যায়নি এখনও। তারা যে এমন করছে তার পিছনে কোনও তো কারণ হবে?’
‘স্যার, ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর এক অসমাপ্ত গবেষণা বারবার খোঁচা মেরেছে আমায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর নিয়ন্ত্রণ আনার কথা তিনি বলেছিলেন। বলেছিলেন এক নতুন পদ্ধতির কথা। কিন্তু সে পদ্ধতি কারোর সামনে আর এলো না।’
‘তোমার কী মনে হয়? এরা ওই অজানা পদ্ধতির ভিত্তিতে এমন কাজ করছে? যে গবেষণা কোনও দিন পুরো হয়নি, সেটার ভিত্তিতে কাজ করা তো অসম্ভব।’
‘উত্তরের খোঁজে তো আমিও আছি স্যার।’
দরজায় টোকা মেরে ঘরে ঢুকলো ডাঃ শত্রুঘ্ন বিশ্বাস। তাকে দেখেই অর্চিষ্মান জিজ্ঞাসা করলো – মেডিক্যাল টেস্ট হলো?’
‘হ্যাঁ, হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জ্ঞান ফিরে আসবে। আমার টিম তার সাথেই আছে। প্লুটোর জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই তার মস্তিষ্কে এটা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে যে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল সে। মেঘমিত্রা এবং তাদের মত মেয়েদের প্রতি ঘৃণার কারণে হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছিল তার। অবশেষে নিজের নার্ভে কন্ট্রোল না রাখতে পেরে সেন্স লেস হয়ে যায় সে।’
‘ভেরি গুড। তার মেডিক্যাল রিপোর্ট কী বলছে?’ অর্চিষ্মান জিজ্ঞাসা করলো।
ডাঃ বিশ্বাস একবার আবির্ভাব গাঙ্গুলীর দিকে তাকালো, তারপর অর্চিষ্মানের দিকে তাকিয়ে বলল – ‘তোমার ধারনা ঠিক ছিল অর্চিষ্মান। প্লুটো নিজের পুরুষত্ব হারিয়ে ফেলেছে।’পর্ব – ১৫
রাত প্রায় দু’টো। এন এস ডব্ল্যূ’র অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অর্চিষ্মান। তার সাথে আছে হাতে অস্ত্র নিয়ে এন এস ডব্ল্যূ’র কিছু কমান্ডো ও অফিসার।
অর্চিষ্মান তাদের বলছে – ‘সালটা 2048 থেকে 2050এর মধ্যে। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট দেশ জুড়ে এমন অনেক মহিলাদের গ্রেপ্তার করেছিল যারা অল্প বয়সী ছেলেদের ধর্ষণ করতো। সেই মহিলাদের গ্যাং এখনও সক্রিয়। এখন তারা প্রতক্ষ্যভাবে না হোক অপ্রতক্ষ্যভাবে অল্প বয়সী ছেলেদের ধর্ষণ করছে। তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। পুলিশ যদি আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এ কাজটা করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারবো না? আমরা যদি না পারি তাহলে এ দেশে এন এস ডব্ল্যূ’র প্রয়োজন কী? আমাদের এই কাজটা করতেই হবে। তবে হ্যাঁ, সতর্কতা অবলম্বন করে। আমরা কী করছি তার খবর যেন বাইরের কেউ না জানতে পারে। এখন আমরা বালিগঞ্জ যাবো। আমাদের প্রথম শিকারের নাম মেঘমিত্রা। খুব সম্ভব তাকে আমরা সেখানে পাবো না। তার ফ্ল্যাট সার্চ করবো আমরা। দেখা যাক, সেখান থেকে কী পাওয়া যায়।’বালিগঞ্জের সেই অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে যখন এন এস ডব্ল্যূ’র দল পৌঁছলো তখন প্রায় রাত তিনটে। অর্চিষ্মান সহ মোট ছ জন বন্দুকধারী অফিসার ছিল। চৌকিদারকে আগেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেঘমিত্রার ফ্ল্যাট বারো তলায়। ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে দেখা গেল দরজা বন্ধ। দরজা খোলার চাবি অর্চিষ্মানের কাছে ছিল। অন্ধকার ফ্ল্যাটে ঢুকেই নিজের হাতের ছোট্ট টর্চটা জ্বালালো অর্চিষ্মান। টর্চটা ছোট, কিন্তু তার আলোর জোর প্রচন্ড। একটা ড্রইং রুম, বেশ বড়। সুইচ বোর্ড খুঁজে আলো জ্বালানো হলো। পুরো ড্রইং রুমের মেঝেতে পাতা আছে দামী কার্পেট। দেয়ালে ঝুলছে দামী এক টি ভি। ভিতরের বেড রুমে ঢুকলো এন এস ডব্ল্যূ’র দল। বিছানার চাদর এলোমেলো। বিছানায় রাখা আছে একটা ল্যাপটপ।
‘আজ হয়তো এখানে এসেছিল মেঘমিত্রা।’ প্রায় ফিসফিস করে অর্চিষ্মান বলল।
খাটে বসে ল্যাপটপ খোলার চেষ্টা করলো সে। স্ক্রিনে কৃত্তিম রোবোটিক মুখ ভেসে এলো। ল্যাপটপ থেকে আওয়াজ এলো – ‘Welcome to your world. Please give your eyes.’
ল্যাপটপের ঠিক মাথার কাছ থেকে হালকা আলোর রেখা বেরিয়ে এলো। অর্চিষ্মানের চোখে এসে পড়লো সেই আলোর রেখাটা। অর্চিষ্মান বুঝতে পারলো যে ল্যাপটপ তার চোখের রেটিনা স্ক্যান করতে চাইছে। ল্যাপটপের সামনে বসে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। বাকি লোকেরা তন্নতন্ন করে পুরো ফ্ল্যাট সার্চ করছে। হঠাৎ দরজায় কোনও শব্দ পেলো তারা। দরজা খোলার শব্দ। অর্চিষ্মান এক লাফে বেড রুম থেকে ড্রইং রুমে এলো। দরজা খুলতেই তারা সামনে একা রমণীকে দেখলো। অর্চিষ্মান তাকে আগেও দেখেছে, প্লুটোর সাথে। এই রমণীর নামই, মেঘমিত্রা। অর্চিষ্মানের নজর গেল সব থেকে আগে মেঘমিত্রার গলার কাছে। সে আগের ঘটনা জানে। এদের গলায় নাকি পটাশিয়াম সায়নায়েড ঝোলানো থাকে লকেটের মত। অনেকে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে এবং অনেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর পটাশিয়াম সায়নায়েড খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। মেঘমিত্রার গলায় পাতলা একা সোনার হার ঝুলছে। সাথে আছে গোল মত ছোট্ট এক লকেট। সেটাও সোনা দিয়ে বাঁধানো। এই ছোট্ট লকেটের মধ্যেই হয়তো আছে সেই বিষাক্ত জিনিসটা, যেটা একবার জিভে স্পর্শ করালে নিমেষের মধ্যে চিরকালের মতো ইহলোক ত্যাগ করে দিতে হয়। মেঘমিত্রা অবাক দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞাসা করলো – ‘কে আপনারা? এখানে কী করছেন?’
অর্চিষ্মান ধীর গতিতে এগিয়ে গেল তার দিকে। বলল – ‘আমরা কিছু জানতে এসেছি এখানে।’
‘কী জানতে এসেছেন?’
‘এটাই যে আপনারা কার হয়ে কাজ করছেন?’
মেঘমিত্রা ভ্রুকুটি করে তাকালো অর্চিষ্মানের দিকে। হালকা রুক্ষ স্বরে বলল – ‘কার হয়ে কাজ করছি মানে? কী কাজ? আর আপনারা আমার অনুমতি ছাড়া আমার ফ্ল্যাটে ঢুকেছেন কী করে?’
‘প্লুটোকে চেনেন?’
অর্চিষ্মানের এই প্রশ্নে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল মেঘমিত্রার।
অর্চিষ্মান আরও কাছে এলো তার।
‘আপনি জানেন হয়তো প্লুটোর সাথে যে নোংরা খেলাটা আপনি খেলেছেন তাতে তার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। আপনাদের উদ্দেশ্যটা কী এবং আপনারা কার হয়ে কাজ করছেন এটা জানা আমাদের জন্য খুব দরকার। আপনি একা নন। আপনাদের মত বহু মহিলা এ কাজে লিপ্ত। আজ থেকে নয়, বহু বছর থেকে।’
কথা শেষ করে অর্চিষ্মানের ডান হাতটা ঝড়ের বেগে এগোলে মেঘমিত্রার গলার দিকে। মেঘমিত্রা কিছু বোঝার আগেই, তার সোনার হার আর লকেট অর্চিষ্মানের হাতে চলে এলো।
‘এর মধ্যেই না লুকিয়ে আছে, আপনাদের সহজ মুক্তির রহস্য? অফিসার, অ্যারেস্ট করেও নাও। ভয়ের কিছু নেই, এর মুক্তির রাস্তা বন্ধ। নিয়ে যাও একে এন এস ডব্ল্যূ’র অফিসে।’চলবে……