-
কবিতা- ভালোবেসেছিল কেউ
ভালোবেসেছিল কেউ
-পারমিতা চ্যাটার্জীনিস্তব্ধ নদীতীরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছি
আমরা দুজনে গোধূলির শেষ বিকেলের ছায়ায়,
নদীটা যাচ্ছে বয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি নীরবতার
সুগভীর আচ্ছাদনে।
দিনের আলো গেলো নিভে, পশ্চিম আকাশের লাল আভা মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
ক্লান্ত বলাকা ফিরছে নীড়ে
ধূসর দিগন্তের উন্মুক্ত প্রান্তর পেরিয়ে,
এ এক আশ্চর্য বিহ্বলতার আমেজ
ছড়িয়ে পড়ে নদীতীরে।
দেখে যাই শুধু নদীর পারে কপোত-কপোতীর মৃদু গুঞ্জন, হয়তো বা থেকে যাবে তাদের অলিখিত প্রেমের এক গভীর অনুভূতি।
আমরা দুজন দাঁড়িয়ে আছি নিঃশব্দে নিস্তব্ধ আধারে,
বলে যেতে চাই অনেক কথা, অনেক বিরহ ব্যাথার অনুভূতি,
পারিনা বলতে, বুকে হয়ে জমে থাকে আজকে দিনের কিছু কবিতা।
বুকে জমে আছে কবিতার কান্না, গোপন ব্যাথা,
তুমি কি শুনতে পাচ্ছ আমার এই কান্না!
তোমার এই উদাসীনতার দরজা ঠেলে আমি
যেতে পারছিনা তোমার কাছে,
পারছিনা পড়তে তোমার চোখের গভীর ভাষা।
তুমি ফিরে যাচ্ছ ধীরে ধীরে,
অমাবস্যার অন্ধকার কেটে আকাশে দেখা দিয়েছে
আধফালি চাঁদ নির্জন নদীতীরে,
আমি এখনও ভাবছি
হয়তো কেউ এসে বলবে একদিন
তোমাকে ভালবাসি,
কি আশ্চর্য দুঃসাহসিক আশা,
মনকে নিংড়ে ফেলছে যন্ত্রণায়,
একদিন হয়তো রুক্ষ শীতের ঝরাপাতার
মতন ঝরে যাবে আমার স্বপ্নের অনুভূতি,
কালের গতিতে ঝরে যাবে সবই
থেকে যাবে শুধু নির্বাক হৃদয়ের না বলা কথার গুচ্ছ।
নদীটা সেদিনও বয়ে যাবে, যেদিন আমার মন শান্ত স্তিমিত হয়ে মিলিয়ে যাবে অস্তগামী সূর্যের মতন পশ্চিমের লাল আকাশে,
সেদিন হয়তো তুমি মনে করবে কেউ আমাকে
ভালোবেসেছিল, নিঃস্বার্থ নির্মল ছিল সে ভালোবাসা, আজ আর নেই। -
অণুগল্প- কালিপূজার রাত
কালিপূজার রাত
– পারমিতা চ্যাটার্জীশব্দের আাওয়াজটা যে মাঝে মাঝে শব্দভেদী অস্ত্রে পরিণত হচ্ছে তার জ্বলন্ত প্রমাণ শ্রীময়ী আজ থেকে দশ বছর আগে পেয়েছিল। তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়, তার একমাত্র সন্তান- রাতুলকে। রাতুল ছোট্ট থেকে এই বাজির শব্দ সহ্য করতে পারতো না। কালীপুজার দিন সে ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে একটা ঘরে খাটের ওপর বসে ঠকঠক করে কাঁপত। আর শ্রীময়ীও তাকে প্রাণপণ বুকে আঁকড়ে থাকত।সেবার কালিপূজার দিন ঠিক এমনই এক শব্দভেদী বাণের ভয়ংকর শব্দে রাতুলের হার্টফেল হয়ে যায়। তার তিন দিন আগেই তারা স্বামী স্ত্রী রাতুলকে নিয়ে সবে বাড়ি ফিরে এসেছে। সাঙ্ঘাতিক ম্যালিগন্যান্ট ম্যলেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রায় দশ দিন নার্সিংহোমে ছিল। ডাক্তার ঠিক মতে ধরতে না পারায় রোগ অনেকটা বেশিমাত্রায় ছড়িয়ে গিয়েছিল। ব্রেইন অ্যাটাক করে ফেলেছিল। হার্টও খুব দূর্বল ছিল। আস্তে আস্তে সুস্থই হয়ে উঠছিল।
আচমকা কালিপূজার দিল সকালে ঘটনাটা ঘটে গেল। তার বাড়ির নীচেই কয়েকটা ছেলে, কালি পটকা ফাটাচ্ছে। রাতুল চমকে চমকে উঠছিল। কারণ তার এই শব্দের ব্যাপারে আতঙ্ক দশ বছর বয়েসেও যায়নি।শ্রী বারান্দায় গিয়ে বলে এলো ছেলেগুলোকে, বাবা তোমরা একটু দূরে গিয়ে ফাটাও..আমার বাড়িতে খুবই অসুখ পেশেন্ট আছে। সবে নার্সিহোম থেকে নিয়ে এসেছি।
ছেলেগুলো অবজ্ঞার ভঙ্গিতে তাকালো তার দিকে। সে ভালো করে দরজা বন্ধ করে রাতুলের দুধ আনতে রান্নাঘরে গেল। আর ওর স্বামী সুগত একটু বেরিয়েছিল। সেইসময় তার বাড়ির নীচেই দোদোমা নামে এক ভয়ংকর শব্দের বাজি আবার চকোলেট ব্যোম একসাথে ছেলেগুলো ফাটায়। তার মারাত্মক শব্দের আওয়াজে গোটা বাড়িটাই যেন কেঁপে ওঠে। কেঁপে ওঠে শ্রীময়ীর প্রাণ, দৌড়ে চলে আসে রাতুলের ঘরে- দেখে রাতুল চোখ দু’টো বড়ো করে খুলে কেমন করে যেন শুয়ে আছে। তার ডাকে কোনো সাড়া দিচ্ছেনা। শ্রীময়ী পাগলের মতো চিৎকার করছে, ‘রাতুল…রাতুল’ বলে, না রাতুল আর সাড়া দেয়নি। কোনোদিনই সাড়া দিল না সে মায়ের কাতর ডাকে।ডাক্তার এসে জানালেন দুর্বল হার্ট নিতে পারেনি এই শব্দ..সঙ্গে সঙ্গে হার্টফেল হয়ে গেছে। আজ থেকে দশবছর আগে ঠিক এই দিনে তার কোল খালি হয়ে গিয়েছিল। আজও তারা স্বামী স্ত্রী দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকে। এক অজানা ভয় এখনও তাদের তাড়া করে ফেরে। -
কবিতা- ওগো মেয়ে
ওগো মেয়ে
-পারমিতা চ্যাটার্জীকে তুমি একলা দাঁড়িয়ে —
নদীর পাড়ে – ওগো মেয়ে?
উড়ছে তোমার আঁচল খানি
হেমন্তে এই হিমেল হাওয়ায়–
এলোমেলো চুলে মুখ ঢেকে যায়-
কবির কলম নড়ে ওঠে তোমায় দেখে–
মনের কোণে শিল্পী আঁকেন তুলির টানে
তোমার ছবি খানি–
তুমি কি তা জানো ওগো মেয়ে?
জানিনা কি অভিমান আছে জমে
তোমার বুকের ছায়ার মাঝে–
নদীর তীরে তাই কি আজ একলা নির্জনে
এসেছ শুনতে লুকিয়ে রাখা গোপন কথা
নিজের কাছে নিজেই।
উত্তর কিছু পেলে বলে যেও তা নদীর কাছে-
ঘাটে বাঁধা নৌকা তে ওই
চাপিয়ে দিও দুঃখের বোঝা–
পা রাখ কাল নতুন ভোরের শিশির ভেজা ঘাসে।
হেমন্তের খুশীর হাওয়ায় দাওনা মনটা উড়িয়ে
যাক্ উড়ে যাক জীবন মাঝে জমে থাকা আবর্জনা।
কান্নাটাকে লুকিয়ে রেখে হাঁটো জীবন পথে
দুঃখ তোমার সাথের সাথি — সুখও কিন্তু লুকিয়ে আছে অগোচরে তোমার মনের সাথে–
খুঁজবে না কি তাকে? হৃদয় মাঝে লুকিয়ে থাকা
নতুন বেদনাকে?
বেদনার সাথে মিশে থাকে বন্ধু হয়ে সুখের তারা–
তারই হাতটা ধরে আজ দাঁড়াও নদীর পাড়ে–
নদী বলবে তোমায়-‘ দুঃখ তোর নিয়েছি আমি বয়ে যাবে শেষ মোহনাতে– ওগো মেয়ে থাকিস না আর একলা দাঁড়িয়ে,
নামছে এবার রাতের আঁধার কালো–
পথ চিনতে ভুল করবি আঁধার রাতে — কালো তোকে দেখাবে না রে সকালবেলার আলো। -
গল্প- ফেলে এসেছিস যারে
ফেলে এসেছিস যারে
-পারমিতা চ্যাটার্জীআজ অনেকদিন পর হঠাৎ মধুরা একটি মিষ্টি সুন্দর মেয়েকে দেখতে পেলো, নতুন গানের ক্লাসে ভর্তি হয়েছে নামটিও ভারি মিষ্টি হিয়া। নামটির মধ্যেও যেনো রাবীন্দ্রিক ছোঁয়া লেগে আছে।
খুব ভালো গানের গলার জন্য তাদের গানের গুরু তাকে রবীন্দ্র জয়ন্তীর জন্য বাছাই করে নিয়েছেন, আবার একক সংগীতও দিয়েছেন। মধুরার খুব ইচ্ছে হলো মেয়েটির গান শোনা । মেয়েটির সুন্দর মুখের মধ্যে অদ্ভুত এক দুঃখ মাখানো আছে। মধুরা ভাবলো যেমন করে হোক মেয়েটির সাথে ভাব জমাতে হবে ওর ভেতরে যে একটা গল্প লুকিয়ে আছে তা টেনে বার করে আনতে হবে।
মধুরার যখন বিয়ে হয় তখন সে বাসবের সাথে প্রেমে মগ্ন, বাসব তখন এম এ ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, আর সে বি এ ফাইনাল সবে দিয়েছে। হঠাৎই শুনলো তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে, মধুরা তীব্র বিদ্রোহী হয়ে উঠলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়েটাকে আটকাতে পারলোনা।
তার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর সে বাসবকে জানায় তার অসহায়তার কথা, বাসব একদম ভেঙে পড়ে বলে, আর একটা বছরও কি অপেক্ষা করা যায়না মধুরা!
মধরা বলেছিল, পারলে কি আমি করতাম না বাসব? আজও যে আমরা বড়ো অসহায় বাসব –
– পারবে আর কাউকে ভালোবাসতে?
– জানিনা বাসব, মেয়েরা সব পারে। সব পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা তাদের মধ্যে আছে ; আমার মা বলছিলেন আমাকে, যখন আমি কেঁদে ভাসাচ্ছিলাম তখন হ্যাঁ ঠিক তখনই স্মৃতির ঝাঁপি উজাড় করে দিলেন। আমায় বললেন – জানিস মা তোর মতন আমিও বিয়ের আগে একজনকে খুব ভালোবেসেছিলাম, কিন্তু বাবার রক্তচক্ষু আর মায়ের কান্নার দাম দিতে বিয়ে করলাম তোর বাবাকে। বিশ্বাস কর, তোর বাবার ভালোবাসার জোর এতটাই তীব্র ছিল যে আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল আমার পুরানো প্রেম কে। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, ” সত্যি ভুলতে পেরেছিলে! বলো না মা সত্যি কি তুমি ভুলতে পেরেছিলে!
মা আঁচলের কোণটা দিয়ে নিজের চোখ দুটো মুছে নিয়ে আমায় বললেন, হ্যাঁ রে পেরেছিলাম বইকি, তোর বাবাতো কোন দোষ করেনি, তাকে আঘাত করে দূরে সরিয়ে রাখলে তো ভালোবাসাকেই অপমান করা হয়, তাই তোর বাবার সহজ সরল ভালোবাসার বন্ধনে আমি ধরা না দিয়ে পারিনি, শুধু তাইনা তাঁকে ভালোবেসেই শ্রদ্ধার সাথেই কাছে টেনে নিয়েছিলাম। শুধু শ্রাবণের কোন বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় বা ফাগুনের কোন বসন্তের বাতাসে একান্তে ছাদে দাঁড়িয়ে রবি ঠাকুরের গান গাই, ” তুই ফেলে এসেছিস যারে মন মন রে আমার “। এটুকু আমার একান্ত গোপন একটা কোণ, থাকনা গোপনে, কারুর তো কিছু ক্ষতি তো হচ্ছেনা।
তুমি অবাক হয়ে আমার কথা শুনে ফোনটা নীরবে নামিয়ে রেখে দিলে, জানি হয়তো মেনে নিতে পারলেনা, কিন্তু বাসব কি করবো বলো, এটাই যে নিয়ম ভালোবাসলে দুঃখ পেতেই হয়।
কয়েকদিন রিহার্সাল চলতে চলতে হিয়ার সাথে বেশ ভাব জমে উঠেছে, একদিন সুযোগ মতন তাকে মধুরা বললো, ” আচ্ছা হিয়া একটা কথা বলবো কিছু মনে করবে না তো!
– না না বলো না, এ মা মনে করবো কেন!
– তোমার মুখের মধ্যে সবসময় একটা যেনো কষ্ট লুকিয়ে থাকে, হাসির মধ্যে যেন কান্না ধরা পরে যায়, আমাকে দিদি ভেবেকি কিছু বলা যেতে পারে, তাহলে হয়তো দুঃখের ভার কিছুটা লাঘব হতে পারে, যা একা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছ, তা যদি একটু অন্যের সাথে ভাগ করে নাও তবে ভার টা কিছুটা হলেও কমবে”।
ম্লান হেসে হিয়া উত্তর দিল – বলতে পারি, কিন্তু আমার দুঃখটা তো আমারই থেকে যাবে! তাও তোমাকে বলবো আমি, কারণ তুমি ঠিকই বলেছ একটু হলেও মনের ভারটা হয়তো কমবে।
এরপর একদিন রিহার্সালের পর দুজনে একটা কফি শপে বসে কথা আরম্ভ করলো। সেদিন হিয়াকে খুব ক্লান্ত আর আনমনা লাগছিল, গরম কফিতে চুমুক দিয়ে বললো – কিভাবে আরম্ভ করবো বুঝতে পারছিনা, –
– মধুরা ওকে সাহস দিয়ে বললো যে ভাবে আরম্ভ করলে তোমার সহজ মনে হয়, সেভাবেই বলো –
– হিয়া একটু দম নিয়ে আসতে আসতে বলতে আরম্ভ করলো, গান নিয়ে রবীন্দ্রভারতী থেকে মাস্টার্স দেওয়ায় পর আমার বিয়ে হয় প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক বাসব সান্যালের সাথে –
– চমকে উঠে মধুরা প্রশ্ন করলো কার সাথে!
– বাসব সান্যাল
– তারপর
– তারপর ফুলশয্যার দিন তিনি আমাকে বলেন,
” দেখো হিয়া বাবা মায়ের চাপাচাপিতে তোমাকে বিয়ে করে আমি তোমার প্রতি অত্যন্ত অবিচার করেছি স্বীকার করছি কিন্তু আমার কিছু করার ছিলোনা, আমি তোমার প্রতি সব কর্তব্য পালন করবো কিন্তু স্ত্রীর মর্যাদা বা ভালোবাসা দিতে পারবনা, আমার মনে আর একজন বসে আছে যাকে আমি চেষ্টা করেও ভুলতে পারিনি। এ জীবন মেনে নেওয়া কারোর পক্ষে সম্ভব নয় জানি, একটা বছর কাটাও তারপর তুমি যেদিন মুক্তি চাইবে আমি দিয়ে দেবো “।
– তুমি কি বললে -!
– আমি ফুলশয্যার রাতে এমন একটা কথা শোনার জন্য সত্যি প্রস্তুত ছিলাম না, প্রথমটা থতমত খেয়ে গেলাম তারপর আসতে আসতে বললাম, ” আমাদের সমাজে বিয়েটাও খেলা নয়, জীবনটাও খেলা নয়, এরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, ” বলে আমার বালিশ আর চাদর নিয়ে মাটিতে শুয়ে পরলাম, তিনি আমায় বললেন – মাটিতে নয় প্লিজ তুমি খাটি এসে শুয়ে পর, তা নইলে আমার নিজেকে আরও ছোট মনে হবে “।
– তারপর!
– তারপর আর কি একবছরের জায়গায় দুবছর চলে গেলো, কিন্তু পরিস্থিতির কোন বদল হয়নি, শুধু –
– শুধু!
– মাটিতে শোওয়া থেকে খাট অবধি গেছে,, সেটাও উনার জোরাজোরির জন্যে কিন্তু দুজনের মাঝে একটা অদৃশ্য প্রাচীর থাকে সেটা ভাঙতে পারিনি –
– বাসব মানে তোমার স্বামী জানে যে তুমি এতো ভালো গান কর!
– না জানার প্রয়োজন হয়নি, আমার হাতের রান্না বা চা করে এনে দিলে প্রশংসা সূচক ভাবে তাকিয়ে বলে খুব ভালো হয়েছে, কোথাও সেজেগুজে বার হলে এই কিছুদিন হল বলতে শুরু করেছে, খুব সুন্দর লাগছে, সেদিন বলল, মাথায় একটা জুঁই ফুলের মালা দিলে আরও ভালো হত, এনে দেবো?
– তুমি কি বললে!
– আমি বললাম – না, আমি ফুলের মালা কেনার কথা আমিও ভেবেছিলাম, কিন্তু কেনা হয়নি, যাবার পথে কিনে লাগিয়ে নেবো, উনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন – আমি আসছি বলে বেরিয়ে এলাম।
– এই যে দু বছর কাটালে, তারমধ্যে একদিনও কাছে আসার চেষ্টা করেনি!
– না, তবে একসপ্তাহ আগে শুতে এসে আমার হাতটা ধরেছিলেন নিজের হাতে কিছুক্ষণের জন্য তারপর আসতে আসতে ছেড়ে দিলেন। আমি বুঝতে পারছি দিদি উনি নিজের সাথে ক্রমাগত যুদ্ধ করে চলেছেন কিন্তু পারছেননা, আর আমিও যে মানুষটাকে বড়ো ভালোবেসে ফেলেছি দিদি, মানুষটা যে বড়ো ভালো তাই আমিও বেরিয়ে এসে তাকে মুক্তি দিতে পারছিনা -।
মধুরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো – কিছু মনে কোর না, তোমার অনেক ব্যাক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করে ফেললাম, দেখি আমি কিছু করতে পারি কি না!
– তুমি! তুমি কি করবে দিদি! তুমি তো তাকে চেনোই না –
– দেখি মনে হয় কিছু করতে পারবো। ঠিক আছে চল আজ ওঠা যাক, মেঘ করেছে বৃষ্টি নামলো বলে।
মধুরা বাড়ির পথ ধরলো, গাড়িতে যেতে যেতে ভাবলো, ” বাসব কি করে এতো অমানবিক হতে পারে! যা পাবার নয় তারজন্য যা পেয়েছে তাকে নিতে পারছেনা! কি করে একটা শিক্ষিত মানুষ এতোটা অবুঝ হতে পারে! নাঃ আজই বাসবকে ফোন করতে হবে, ওর পুরানো নাম্বার টা এখনও আছে নিশ্চয়ই! না থাকলে ওর কলেজে গিয়ে দেখা করবে।
ফোনে রিং হতেই তার চিন্তার তার ছিঁড়ে গেলো – প্রবাল ফোন করছে, তার স্বামী প্রবাল।
– হ্যাঁ প্রবাল বল –
– তুমি কি বাড়ি আসছ না দেরি আছে এখনও?
– না না এইতো এসে গেছি প্রায়,
– ঠিক আছে, চলে এসে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে!
– ও তাইনাকি! এখনি আসছি —-।
মধুরা তাও যাওয়ার পথে লেক মার্কেটে নেমে প্রবাহের পছন্দের একগোছা হলুদ গোলাপ আর কিছু ভালো মিষ্টি কিনে বাড়িতে ঢুকলো।
হিয়াও আজ যখন বাড়িতে ঢুকলো তখন তার শাশুড়ি মা তাকে বললো – আজ এতো দেরি হলো যে! বাসব তোর জন্য অনেকক্ষণ ঘরে অপেক্ষা করছে, তুই যা আমি তোর জন্য একটু চা খাবার নিয়ে আসি –।
তার শাশুড়ি মা প্রতিভা দেবী মানুষটা খুবই আধুনিক মনের, ছেলে বউমার মাঝে যে একটা দেওয়াল আছে তা তিনি বুঝতে পারেন, ছেলের ওপর খুব অভিমান হয়, মেয়েটাকে এভাবে অবহেলা করে, এটা কি তার প্রাপ্য ছিলো! নিজের ওপর রাগ হয়, কেনো বিয়ে দিতে গেলাম, শুধু শুধু তাদের জন্য একটা মেয়েকে বেদনার ভার বহন করে চলতে হচ্ছে — তবে ইদানিং লক্ষ করছেন ছেলে যেনো একটু একটু বদলাচ্ছে — বদলালেই ভালো –।
প্রতিভা দেবীকে তাড়াতাড়ি ধরে ফেলে বলে – না মা আজ আমার গানের ক্লাসের এক দিদির সাথে একটু কফি খেতে গিয়েছিলাম, এই নাও তোমার পছন্দের কেক এনেছি –
– কোথায় দে,
– এই যে নাও -। প্রতিভা দেবী খুব ভালোবাসেন মেয়েটিকে – বাসবের বাবা মারা যাওয়ার পর তিনি মাছ মাংস খেতেননা, ছেলেও বহুবার চেষ্টা করে বিফল হয়েছে, তার ননদরা বলেছিল, ” আদিখ্যেতা করিস না তো বাসব, হিঁদুর ঘরের বিধবা কি মাছ মাংস খেতে পারে না কি!
কিন্তু হিয়ার যুক্তির কাছে তিনি হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন, হিয়া বলেছিল, ” মা কি প্রমাণ হয় তুমি আমিষ খেলে আমায় বল তো? বাবাকে কতোটা ভালোবাসতে তা কি এই দিয়ে প্রমাণ করা যায়! আজ যদি তোমার কোন হাড়ের অসুখে তুমি শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে থাকো, তখন এরা কি তোমাকে সেবা করতে আসবে? শুধু মুখে সহানুভূতি দেখিয়ে বলে যাবে, ” আহা কি মানুষের কি অবস্থা হল “। হিয়ার বলার ধরনে প্রতিভা দেবী হেসে ফেলেন, বলেন- উফ্ তোকে নিয়ে আর পারিনা, দিস তবে কাল থেকে – সেই থেকে তার মাছ মাংস খাওয়া শুরু -। বাসবও খুব খুশি হয়েছিল সেদিন, তার চোখের মুগ্ধতা সেদিন প্রতিভা দেবীর দৃষ্টি এড়ায়নি ।
হিয়া ঘরে ঢুকতেই বাসব বলে উঠলো – কি হল এতো দেরি? আমি তো আর একটু হলে খুঁজতে বার হচ্ছিলাম,
হিয়া ম্লান হেসে উত্তর দিল – আমাকে খুঁজতে বার হবে, কেনো?
– কেনো আবার কি! বাড়িতে তো একটা খবর দিতে হয়, বাড়ির লোকগুলো চিন্তা করতে পারে, এই বোধটা থাকা উচিৎ –
– হিয়া চমকে বাসবের দিকে তাকালো, তার চোখে মুখে উদ্বেগর চিহ্ন তখনও ফুটে আছে –
হিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল – ভুল হয়ে গেছে, মাকে জানানো উচিৎ ছিলো –
– ও মা ছাড়া বাড়িতে আর কেউ থাকেনা বুঝি! আর কারুর চিন্তা হয়না বুঝি -?
– হয় বুঝি! জানতামনা তো!
– তুমি তো অনেক কিছুই জানোনা – ঠিক আছে ক্লান্ত হয়ে এসেছ এখন একটু চা টা খাও, পরে যত ইচ্ছে ঝগড়া কোর –
– ঝগড়া? ঝগড়া কেনো করবো? তোমার সাথে কি আমার ঝগড়া করার সম্পর্ক না কি?
এই বলে সে কলঘরের দিকে চলে গেলো।
বাসব নিশ্বাস ফেলে চুপ করে বসলো – পরীক্ষার খাতা এসে জমা হয়েছে, এখনও দেখে উঠতে পারেনি – মনটা খুব চঞ্চল লাগছে, কিছু ভালো লাগছেনা, এমন সময় হিয়া ঢুকলো চা আর কেক নিয়ে, সদ্যস্নাত হিয়াকে খুব সুন্দর লাগছে, বাসবের মনটা হঠাৎ ভরে উঠলো, একবার মনে হলো,হিয়া কি তাকে ভালোবেসেছে! তাই কি সে যেতে পারছেনা! আজ বাসবের মনে হল, হিয়া যদি এখন সত্যি চলে যাবার কথা বলে তাহলে তার খুব কষ্ট হবে, সে হয়তো বলবে, ” না হিয়া এখন আর তোমাকে ছাড়তে পারবনা, সেদিনের বাসব আর আজকের বাসবের মধ্যে অনেক বদল হয়ে গেছে, তুমি বুঝেও না বোঝার ভাণ করে দূরে সরে থাকো, হয়তো প্রচণ্ড অভিমানে,তোমার অভিমান আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে সব মুছে দেবো, আজ আর তোমাকে ছাড়তে পারবনা”। নিজের অজান্তে তার মনটাও হিয়ার কাছে চলে এসেছে, খুব ইচ্ছা করছিল কাছে গিয়ে ওর সুন্দর মুখটা নিজের দু’হাতের তালুতে তুলে নিতে, কাছে গিয়ে শুধু বললো, খুউব স্নিগ্ধ আর সুন্দর লাগছে তোমাকে। বাসবের কথায় হিয়া লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিয়ে শুধু বললো, চা টা ঠান্ডা হয়ে যাবে, বাসব আর কিছু না বলে ওর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে নিল।
হঠাৎ কলেজ থেকে বেরিয়ে মধুরাকে দেখে বাসব চমকে গেলো! তুমি —-?
– হ্যাঁ আমি, তোমার সাথে কথা আছে অনেক, কফিহাউসে গিয়ে বসতে পারবে একবার?
– কিছু হয়েছে? তুমি ভালো আছো তো?
– হ্যাঁ বাসব আমি খুব ভালো আছি, আজ আমি তোমার আমার জন্য তোমার কাছে আসিনি –
– তবে!
– চলো বসি তারপর বলছি -।
ওরা দুজনে কফি হাউসে বসে পুরানো দিনের মতন কফি আর কবিরাজি কাটলেট ওর্ডার দিল।
খাবার আসলে পরে বাসব বললো – উফ্ কতদিন পর আবার কবিরাজি কাটলেট খাচ্ছি, তুমি চলে যাবার পর কফি হাউসে আর ঢুকিনি – ” পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায় ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায় ” –
– কিন্তু পুরানো কে যে ভুলতে হয় বাসব, আমি কিন্তু আমার বর্তমান জীবন নিয়ে খুব সুখী, আমার স্বামী এতোটাই উদার আর প্রেমিক মানুষ যে ওকে ভালো না বেসে থাকা যায়না কিন্তু তাইবলে তোমাকে কি ভুলে গেছি! না একদম না, তুমি ঠিক মনের এককোণে আমার গোপন অন্তরে থেকে গেছো এক বন্ধু হয়ে, তুমি কেনো পারলেনা? অতীত কে আঁকড়ে ধরে বর্তমান কে অস্বীকার করে একটা নিষ্পাপ মেয়েকে কাঁদিয়ে যাচ্ছ? এ অধিকার কি তোমার আছে?
– তুমি মানে, তুমি এতো কথা জানলে কি করে!
– জানলাম কারণ আমার সাথেই হিয়া গান করে গুরু সুরঞ্জন রায়ের কাছে, তুমি জানো ওর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে উনি হিয়াকে এবারের ফাংশনে একা গানের সুযোগ দিয়েছেন, যা আমি এখনও পাইনি, কোনদিন খবর রাখো ওর এই প্রতিভার কথা?
বাসব অবাক হয়ে বললো তাই! আমি তো কোনদিন ওকে বাড়িতে গান গাইতে শুনিনি, মায়ের কাছে শুনেছিলাম ও গান শিখতে যায় এই পর্যন্ত ব্যাস আর কিছু তো জানিনা –
– জানার চেষ্টা কর নি তাই জানোনা, তুমি জানোনা ও তোমাকে কতোটা ভালোবাসে! ওর দুঃখ ভরা চোখ দুটো দেখে কেনো জানিনা আমার মনে হত ওর ভেতর অনেক জমা ব্যাথা আছে, প্রেম পর্যায়ের গান করার সময় এতো তন্ময় হয়ে গায় যে ওর দুচোখ দিয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পরে।
আমি ওর সাথে ভাব করে ওর অনেক কাছের একজন হয়ে যাই, ও আমাকে দিদি বলে ডাকে, সেদিন ওকে কফি খাওয়ানোর নাম করে ডেকে নিয়ে গিয়ে অনেক ভুলিয়ে ওর মনের কথা জানি, ওর মুখে জানতে পারি তুমি ওর সেই হতভাগ্য স্বামী যে এমন ভালোবাসার মর্যাদা দিতেই পারেনি। খুব রাগ হল তোমার ওপর, তুমি যে এতোটাই মেরুদণ্ডহীন কোনদিন ভাবিনি।
বাসব নিঃশব্দে ওর সব কথা শুনে গেলো, শুধু বললো আমার খুব উপকার করলে, একেই বলে সত্যিকারের বন্ধু, যে ভাঙেনা বরং গড়তে সাহায্য করে, তুমি দেখো আমি সব ঠিক করে নেবো। যেদিন হিয়াকে আমি আমার কথা বলেছিলাম, সেদিনের আমি আর আজকের আমি এক নই মধু, আমিও ওকে ভালোবাসি খুব ভালোবাসি, কিন্তু বলতে চেয়েও অনেকবার বলতে পারিনি তবে আজ আমি বলবোই।বাড়ির পথে যেতে যেতে মধুরার মনটা বেশ হালকা লাগছিল, সেদিন প্রবাল ডেকেছিল ওকে সারপ্রাইজ আছে বলে, গিয়ে দেখে একটা বড়ো সুন্দর কেকের ওপর অনেক মোম জ্বালিয়ে আর হলুদ সবুজ গোলাপের ফোয়ারায় এক মোহময় পরিবেশে ঘর সাজিয়েছে ও নিজে আর দুই ছেলেমেয়ে তিতিল আর তাতার মিলে, ঘরে ঢুকতেই কুচো দুটো ওকে জড়িয়ে ধরে চিত্কার করে উঠলো, ” হ্যাপি বার্থডে মাম্মা “। ও সত্যি তো আজ তো ওর জন্মদিন, রিহার্সালের চাপে নিজের জন্মদিন টা নিজেই ভুলে গিয়েছিল, কিন্তু যার মনে রাখার সে ঠিক মনে রেখেছে, বাচ্চাদের আদর করে প্রবালের দিকে তাকালো, প্রবাল সলজ্জ মুখে এগিয়ে এসে ওর গায়ে লাল সাদা কাজ করা সুন্দর ঢাকাই শাড়ি এনে গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলল– শুভ জন্মদিন। সেদিন এক ভিষণ আবেগে প্রবালকে জড়িয়ে ধরে মধুরা বলে উঠেছিল, ” তোমার মতন স্বামী যেনো মেয়েরা জন্ম জন্ম ধরে পায়,”। প্রবাল ওর মুখটা তুলে ধরে বলেছিল, চল কেকটা কাটি, বাচ্চারা তো অপেক্ষা করছে কখন থেকে কেক খাবে বলে।
সে কথাটা যেতে যেতে আজ মনে হলো, স্মৃতি আঁকড়ে যদি সে পড়ে থাকতো তবে প্রবালের প্রতি এক নিদারুণ অবিচার হতো, এখন সত্যি বলতে কি প্রবাল তার জীবনের প্রতি মুহূর্তের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গেছে, সেখানে বাসব আছে ফেলে আসা এক স্মৃতির মাঝে, যে হঠাৎ জীবনে উঁকি দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। গুণ গুণ করে গান গাইতে গাইতে মধুরা বাড়ির দিকে যেতে লাগলো,” ” তুই ফেলে এসেছিস যারে মন মন রে আমার, “।
আর দুদিন পর ফাংশন, প্রতিভা দেবী হিয়াকে বললেন, হ্যাঁ রে আজ তোর রিহার্সাল নেই?
– না মা, কাল একেবারে স্টেজ রিহার্সাল
– ও তুই তাহলে নিজেই একটু প্র্যাকটিস কর, আমি কমলাকে বলছি তোকে একটু আদা দিয়ে চা করে দিয়ে যাবে, গলাটা ঠিক থাকবে।
প্রতিভা দেবী যাবার জন্য পা বাড়িয়েছেন হঠাৎ হিয়ার মা ডাকে চমকে ফিরে তাকালেন, দেখলেন হিয়া সজল চোখে তার দিকে চেয়ে আছে, কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কি রে! কিছু বলবি!
– মা আমার জন্য তুমি খুব ভাবো না? যাবে তো আমার ফাংশনের দিন?
– নিশ্চয়ই যাবো মা, আমার মেয়েটা গান গাইবে আর আমি যাবো না! তা কি হয়?
হঠাৎ আবেগে শাশুড়ীমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে
আকুল কান্নায় ভেঙে পরে হিয়া।
হিয়ার পিঠে নীরবে স্নেহের হাত বুলিয়ে ওর চোখ মুছিয়ে দিলেন, তারপর বললেন দাঁড়া – আমি আসছি।
একটু পরে ঘরে ঢুকে রবীন্দ্রনাথের ছবি ওর টেবিলে রেখে তার সামনে একটা ছোট কাঁসার রেকাবে কিছু জুঁই ফুল রেখে দিলেন, তারপর হিয়ার মুখটা নিজের আঁচল দিয়ে ভালো করে মুছিয়ে একটু পাউডারের প্রলেপ দিয়ে একটা বড়ো লাল টিপ কপালে লাগিয়ে দিলেন। ওর এলোমেলো চুলগুলোকে গুছিয়ে একটা হাত খোঁপা বেঁধে দিয়ে বললেন, এবার গান কর, দেখ তোর মনটা অনেক ভালো লাগবে, হিয়া সজল চোখে শাশুড়ী মায়ের দিকে তাকালো, প্রতিভা দেবী কড়া সুরে বললেন, না আর একদম কান্না নায়, কাল স্টেজ রিহার্সাল না! গানে মন দে, আমি চা নিয়ে আসছি।
আজ হিয়ার মনটা সত্যি খুব খারাপ লাগছে, এই শ্রাবণেই তাদের বিয়ে হয়েছিল, এখন আবার সেই শ্রাবণ, বাইরে তাকিয়ে দেখলো শ্রাবণের আকাশ মেঘে মেঘে ভার, সে গান আরম্ভ করলো, ” আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে, কি এনেছিস! “।
মধুরা চলে যাবার পর বাসব একাই বসেছিল কফি হাউসে, আকাশের মুখ ভার এখুনি হয়তো বৃষ্টি নামবে, নামুক আজ অনেক বৃষ্টি নামুক, আজ হিয়ার কাছে যেতে সত্যি খুব ইচ্ছে করছে, মধুরার কাছ থেকে শোনার পর যে হিয়া তাকে বলেছে সে বাসবকে ভালোবেসে ফেলেছে, তাই বাসবকে ছেড়ে যেতে পারছেনা অথচ বাসব একটা আহাম্মক সে কিছুই বুঝতে পারেনা।
মনে মনে একটা ছবি আঁকতে লাগলো কি ভাবে আজ হিয়ার কাছে নিজেকে প্রকাশ করবে।
আর এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল।আগে কলেজে পড়ার সময় নিজে গান লিখে তাতে সুর দিয়ে গাওয়া খুব অভ্যাস ছিল, তার এই গান শুনেই মধুরা তার কাছে আসে, আজও হয়তো থেকে যাবে মনের এককোণে, হয়তো পুরোপুরি ভুলতে পারবেনা কিন্তু আজ সে হিয়াকে খুব ভালোবাসে এবং প্রতিদিন একটু একটু করে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা সে অন্তর দিয়ে অনুভব করে।
সেই পুরানো গান লেখার অভ্যাস নিয়ে হিয়াকে আজ শোনাবে বলে একটা গান লিখতে চেষ্টা করল, আর আশ্চর্য এতদিন আগের অভ্যাস একটা লাইন লিখতেই পরপর লাইন গুলো যেনো মনের দরজা খুলে হু হু করে ঢুকে পড়লো। কফি আর সিগারেট ধ্বংস করতে করতে গানের সুরটাও দিয়ে ফেললো। মনে মনে ঠিক করলো আজ হিয়াকে ডেকে পাশে বসিয়ে এই গানটা শুনিয়ে বলবে, গানটা শুধু তোমার জন্যেই লিখেছি শুধু তোমার জন্যে।
তোমার আমার স্বপ্নের বালুচরে
বারে বারে আমি তোমাকে ফিরেছি খুঁজে,
বুঝতে পারিনি জানলার কোণে
নীরবে কখন ছায়া ফেলে গেছ তুমি।
পেয়েও কেনো যে যেতে পারিনি কাছে
অপরাধী মন ছায়ায় ছিলো যে ঢাকা,
তাই পাইনি দেখতে তোমার চোখে আমার ভালোবাসা।
বিরহের ভারে হয়েছি ক্লান্ত তুমি আমি দুজনে
ভালোবাসি তোমায় তবুও পারিনি বলতে
অকারণ রাত কেটে গেছে বেদনায়,
তবুও পারিনি কাছে ডাকতে।
আজ হঠাৎ এমন বাদল সন্ধ্যায়
সব বাধা ঠেলে নিলাম তোমায়
আমার ভালোবাসা বন্ধনে,
সব অভিমান তোমার
আমি ভেঙে দেব আজ
এই শ্রাবণ সন্ধ্যায়
আজ এই শ্রাবণ সন্ধ্যায়,
তুমি আর ঠেলে দিয়োনা
আমায় দূরে,
সব পথ ভুলে আমি এসেছি
চলে,
শুধু তোমারই কাছে, শুধু তোমারই কাছে।।
গান লেখার পর সে তাড়াতাড়ি বাড়ির পথ ধরলো, যেতে যেতে তার প্রিয় ফুলের দোকান থেকে একগোছা লাল টুকটুকে গোলাপ কিনলো।
বাড়িতে ঢুকতেই হিয়ার গান ভেসে এলো কানে, ” আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে ” কি অপূর্ব গলা, সমস্ত প্রাণ নিংড়ে যেনো গানটা গাইছে হিয়া, বাসবের মনে পড়লো এরকমই এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় হিয়া তার জীবনে এসেছিল, তাই কি আজ হিয়া এই গানটা গাইছে! সে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চুপ করে গানটা শুনতে লাগলো। প্রতিভা দেবী চা নিয়ে আসতে গিয়ে দেখলেন বাসব তন্ময় হয়ে গান শুনছে তিনি আসতে আসতে সেখান থেকে চলে গেলেন, ঠাকুরের কাছে গিয়ে প্রার্থনা জানালেন, ” আজ যেনো এই মেয়েটার নীরব ভালোবাসাকে আমার অবুঝ ছেলেটা বুঝতে পারে “।
গান শেষ হবার পর দরজা ঠেলে বাসব আসতে আসতে দরজা খুলে ঢুকে দেখলো হিয়া হারমোনিয়াম ছেড়ে উঠে আসতে আসতে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, আকাশের জমা মেঘগুলো এখন বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে। সে পেছন থেকে গিয়ে হিয়াকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে ফেরালো, দেখলো হিয়ার দুচোখে জলের ধারা, সে নিজের হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো, আর কতদিন আমায় দূরে সরিয়ে রাখবে, আমি যে আরও পারছিনা হিয়া –
– আমি তো তোমাকে দূর সরিয়ে রাখতে চাইনি—
– বাসব হিয়ার ঠোঁটে নিজের আঙুল টা চেপে বলল, জানি সবই আমার মূঢ়তা, তবে সেদিন বাসবের যে মন ছিল আজ সেই বাসবের মনে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, সেদিনের বাসব আর আজকের বাসবের মধ্যে অনেক তফাৎ। আজ আমি তোমার জন্য একটা গান লিখে এনেছি শুনবে?
– হিয়া নীরবে ঘাড় নাড়লো।
বাসব আরম্ভ করলো তার আজকের লেখা গান গাইতে, ” তোমার আমার স্বপ্নের বালুচরে, বারে বারে আমি তোমাকে ফিরেছি খুঁজে, “
বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি, জানলা দিয়ে ছাঁট আসছে ওরা ভিজে যাচ্ছে দুজনে দুজনের ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে। প্রতিভা দেবী চা দিতে এসে ওদের দেখে আসতে আসতে ফিরে গেলেন, ঠাকুরের কাছে গিয়ে বললেন, ” তুমি শুনেছ ঠাকুর, আমার প্রার্থনা বিফল যায়নি, আজ আমার অবুঝ ছেলেটা, আমার মেয়েটাকে তার ভালোবাসার মর্যাদা ফিরিয়ে দিচ্ছে, এর চেয়ে আনন্দ আর কি হতে পারে ! এইভাবেই ওদের রেখো ঠাকুর এইভাবেই ওদের রেখো।
হ্যাঁ ঠাকুর প্রতিভা দেবীর কথা শুনেছেন, একবছরের মাথায় হিয়ার কোল আলো করে একটি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হেসে ওঠে। কালিপুজার দিন জন্মেছে বলে বাসব ওর নাম রাখে দীপালিকা। অন্নপ্রাশনের দিন হিয়ার কোলে দিয়াকে দিয়ে (দীপালিকার বাড়ির নাম) ছবি তুলবার সময় হিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বাসব বলে, যাই বল দিয়া কিন্তু আমার হিয়ার মতন ফুটফুটে সুন্দর হয়নি ” ও কিছুটা ওর বাবার মতন হয়েছে,
হিয়া হেসে বলে, বাবা বুঝি শুনতে চাইছে যে বাবা কত সুন্দর!
বাসব হেসে বলে, খুব কথা শিখেছ দেখছি আজকাল, দাঁড়াও হচ্ছে তোমার।
প্রতিভা দেবী নাতনী কোলে নিয়ে এক মুখ হেসে ছবি তোলেন, বলেন আমার মা লক্ষ্মী এসেছে।
মধুরা চোখে আনন্দ অশ্রু নিয়ে ওদের দেখছিল, আজ ওর সাথে প্রবাল আর তিতিল, তাতারও এসেছিল, হিয়া এগিয়ে গিয়ে মধুরার হাত ধরে টেনে এনে ওর কোলে বাচ্চা দিয়ে দুপাশে বাসব আর ও নিজে দাঁড়িয়ে ছবি তুললো। হিয়া মধুরাকে বললো, তোমার জন্যে সব হল দিদি –
– না রে বাসবের মনে ভালোবাসায় ভরে গিয়েছিল তোর জন্যে কিন্তু তোর ভেতরের কথাটা জানতে পারছিলনা বলে এগিয়ে আসতে পারছিলোনা শুধু কষ্ট পেয়ে যাচ্ছিল, আমি শুধু তোর মনের কথাটা ওকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, ব্যাস আর কিছু নয়।
বাসব একটু আড়ালে মধুরাকে ডেকে বললো, এ কথাটা আজ আমি স্বীকার করলাম মধু যে সত্যিকারের বন্ধু ভাঙেনা বরং গড়তে শেখায়।
বাড়ি ফেরার সময় মধুরা জানলার দিকে চেয়ে নিজের মনেই আবার সেই রবীন্দ্রনাথের গানটা গুণগুণ করতে লাগলো, ” তুই ফেলে এসেছিস যারে, মন মন রে আমার, “।। -
গল্প- অন্তবিহীন পথ
অন্তবিহীন পথ
-পারমিতা চ্যাটার্জী
প্রতিবারের মতো এবারেও অতনু এক তোড়া গোলাপের গুচ্ছ নিয়ে এসে এণার হাতে দিয়ে, ওর কপালে একটা চুম্বন দিয়ে বলল,” হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে ডিয়ার।”
এণা জানে অতনু তার কর্তব্য সেরে দিল, এবার কত রাতে ভ্যালেন্টাইন্স ডের পার্টি সেরে ফিরবে তার কোন ঠিকানা নেই।
এণা সব জেনেও ইচ্ছা করে বলল, যাবে নাকি আজ রাতে ডিনার খেতে পার্কস্ট্রিটের রেস্তোরাঁয়? অনেকদিন যাইনি।
– তাচ্ছিল্য সুরে অতনু বলল, তোমার আবার এসব শখ কবে থেকে জাগলো?
– মানুষ কি বদলায় না?
– জানিনা, তবে আজ আমার সময় হবেনা। যদি একান্তই যেতে চাও তো কাল দেখবো।
মনে মনে এণা ভাবলো আমার বসন্তের বাগানে অনেকদিন টাটকা ফুল ফোটেনি, আজ যদি সেই আগের মতো এক টুকরো বসন্তের স্মৃতি খুঁজতে রাঙামাটির পুরনো পথে যাই, সে কি আমায় ফিরিয়ে দেবে? দেয় দেবে, কি আর করা যাবে, আজ পায়ের শিকলটা খুলে বেরিয়ে পড়ি ফেলে আসা দিনগুলিতে নতুন গন্ধ নিতে।
মাত্র দুু’ বছর তার বিয়ে হয়েছে, এর মধ্যে অতনুর সুর কেটে গেছে। অবশ্য কোনদিনই সে তার মনের মতন হয়ে উঠতে পারেনি, এই কথা অতনু উঠতে বসতে অনেকবার শুনিয়েছে যে তাকে মানুষ করতে পারেনি। সে তথাকথিত লাস্যময়ী হয়ে উঠতে পারেনি এই আক্ষেপ সে প্রায়শই করে থাকে।
টেবিলে বসে গুছিয়ে একটি চিঠি লিখলো,
“তোমার মনের মতন হয়ে উঠতে পারলামনা, আমায় ক্ষমা করো। আমি ফিরে যাচ্ছি আমার বাবা মায়ের কাছে, তোমায় মুক্তি দিয়ে গেলাম, এবার মনের মতন বউ ঘরে নিয়ে এসো। ভয় নেই কোন খোরপোষ দাবি করবো না। যেদিন ডিভোর্স পেপার পাঠাবে সই করে দেবো।
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন রইলো তোমার ভবিষ্যত জীবনের জন্য।”
চিঠিটা ভাঁজ করে টেবিলের ওপর রেখে সুটকেস গুছিয়ে পাশের ফ্ল্যাটে চাবি দিয়ে বেরিয়ে পড়লো ট্যাক্সির খোঁজে।
প্রায় মাঝরাতে বাড়ি ফিরে অতনু বেল বাজিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কেউ দরজা খুলছেনা, বন্ধ দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে সে দরদর করে ঘামছে; স্মিতার সাথে কথা বলতে গিয়ে তার খেয়ালও নেই যে এতোটা রাত হয়ে গেছে। স্মিতাও হয়েছে তেমনি মদ পেলে আকণ্ঠ পান না করলে তার আশ মেটেনা তাও আবার পরের পয়সায়, সত্যি আজ মেজাজটা একদম বিগড়ে গেছে, এণা কখনও কিছু চায়না, ভেবেছিল তাড়াতাড়ি ফিরে এসে তাকে সারপ্রাইজ দেবে কিন্তু স্মিতার পরেরপর ফোন করে করে তাকে সেই পাবে নিয়ে গিয়ে তবে ছাড়লো। মদ্যপ মহিলাকে তো একা রাস্তায় ছেড়ে দেওয়াও যায়না, কোথায় অ্যাক্সিডেন্ট করে বসবে তখন সব দায় তার এসে পড়বে। তাকে তাই নিউআলিপুরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে আসতে হল।
এণা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে, ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকলো।
দরজার বেল শুনে এণার মা অর্পিতা দেবী তো মেয়েকে দেখে অবাক! কি রে তুই!
– এণা ম্লান হেসে বললো, কেন আসতে নেই?
– না না তা কেন? বোস বোস, একা একা চলে এলি না বলে, তাই বলছি সব ঠিক আছে তো?
– হ্যাঁ মা চলে এলাম, পারলাম না আর থাকতে।
– সে কি রে! কি বলছিস তুই? চলে এলাম মানে?
– চলে এলাম মানে চলে এলাম- ভয় নেই বেশিদিন তোমার বাড়িতে থাকব না, কিছু একটা ব্যাবস্থা করে তাড়াতাড়ি চলে যাবো।
– আমি কি তাই বললাম? আমি বলতে চাইছি, সংসারে থাকতে হলে মেয়েদের একটু মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হয়, তুই বা ও যা চাইতো তা করতিস না কেন?
– মা তুমি বুঝতে পারছনা কেন?
মৃদুলা ঢুকলো ঘরে হাতে সরবতের গ্লাস নিয়ে, মৃদুলা এণার বউদি- শাশুড়ীকে উদ্দেশ্য করে বললো – মা ও অনেকটা পথ ক্লান্ত হয়ে এসেছে, আগে একটু বসতে দিন, জল খেতে দিন। তারপর না হয় জেরা করবেন।
– আমি জেরা করছি বলে তোমার মনে হয়?
– করছেনই তো; একটা মেয়ে কতোটা অপারগ হলে ঘর ছেড়ে চলে আসে – আপনি তো বুঝবেন মা – আর সব কিছু কেন ওকে মানিয়ে নিতে হবে? আর একজন কেন ওকে একটুও মানাবেনা? ও তো জলে পড়়ে নেই, ও শিক্ষিতা, যথেষ্ট গুণের, সেই গুণ যদি কেউ সমানে পায়ে দলে যায়, কেন ও অপমানিত লাঞ্ছিত হয়ে একটা জীবন কাটিয়ে দেবে, আমায় বলতে পারেন?
এণা অবাক হয়ে বউদির মুখের দিকে চেয়েছিল।বউদির সাথে তার পরিচয় বেশি নেই, ওর বিয়ের কয়েকমাস পরে বউদি এ বাড়িতে বউ হয়ে আসে, এবারও বাপের বাড়ি খুব একটা আসা হয়নি, তাই বউদি মানুষটাকে তার ভালো করে জানাই হয়নি। আজ উঠে গিয়ে বউদিকে জড়িয়ে ধরে বলল, তবু তোমার একটু সহানুভূতি পেলাম।
মৃদুলা বলল- “আমি সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলি, সে যেই হোক, আর তুমি তো আমার অতি কাছের মানুষ, তোমার কষ্টটা বুঝবোনা? খুব ভালো করেছো চলে এসে। যে অপমান করে আর যে সহ্য করে দু’জনেই সমান অপরাধী। তুমি যে মনের জোর করে বেরিয়ে আসতে পেরেছ, এতে তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো।অতনু দরজা খুলে ঘরে ঢুকে কোথাও খুঁজে পেলো না এণাকে। হঠাৎ খুব চিন্তা হলো, কি হলো কোথায় গেল? ও চিৎকার করে ডাকলো, “এণা তুমি কোথায়? তুমি কি ওয়াশরুমে?
না শূন্য ঘর থেকে কোনো মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠস্বর ভেসে এলোনা। হতাশ হয়ে ও বসে পড়লো খাটে, হঠাৎ টেবিলের ওপর রাখা চিঠিটার দিকে চোখ গেলো, তাড়াতাড়ি চিঠিটা খুলে পড়তে বসলো।চিঠি পড়ে মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো, এতদূর! কি করে এতো সাহস হলো? আমায় পরীক্ষা করছে, ভাবছে আমি ওকে পায়ে ধরে সেধে আনতে যাবো! থাক ও ওখানে যতদিন পারে, আমি মোটেও ওকে আনতে যাবোনা। দেখি, কতদিন ও না এসে থাকতে পারে!
কিন্তু দিন চলে যায়, মাস গড়িয়ে যায়, বছরও শেষ হতে চললো কিন্তু এণা আর ফিরে এলোনা।
প্রথম দু’বছর অতনু কাটালো ব্যস্ত জীবন নিয়ে, অফিস, তারপর ক্লাব পার্টি এসবে মেতে থাকলো। একসময় সে ক্লান্ত হয়ে পরে, দিনের শেষে নিজের খালি বাড়িতে ঢুকে যখন দেখে কেউ তার জন্য অপেক্ষায় নেই, তখন এণার শান্ত মিষ্টি মুখটা সামনে ভেসে ওঠে।
এতো অভিমান যে ওই শান্ত মেয়েটার বুকে লুকিয়ে ছিলো, তা সে অনুভব করার চেষ্টা করেনি।
স্মিতার মধ্যে সে ভালোবাসা খুঁজে পায় না। শুধুই উচ্ছাস আর হাল্কা মনের চাহিদা, তা দিয়ে সত্যি কোন জীবনকে এগিয়ে নিয়ে চলা যায় না।
মনে মনে ভাবে এণা যদি একবার ফিরে আসে তবে আর তাকে চলে যেতে দেবে না কিছুতেই; কিন্তু এণা আর ফিরে এলোনা।
এণা এখনও তার বিবাহিতা স্ত্রী, সে এভাবে দিনের পর দিন তাকে ছেড়ে থাকতে পারেনা। কিন্তু নিজের দাবি নিয়ে তার সামনে দাঁড়াতেও পারেনা।
স্মিতা তাকে প্রায় বলে, “চলো ডিয়ার, এবার বিয়েটা করে ফেলি” অতনু নিশ্চুপ হয়ে থাকে, স্মিতাকে সে এ বাড়ির মালকিন হিসেবে ভাবতেই পারেনা। কিছু না হতেই যা কর্তৃত্ব ফলায়, মালকিন হলে তো তাকে হাতের দাস বানিয়ে ছাড়বে । এণার জন্য যে এতো আকুলতা বুকের ভেতর লুকিয়ে ছিল তা সে আগে কেন বুঝতে পারেনি! কেন তাকে বারবার অপমান আর তাচ্ছিল্য দেখিয়ে দূরে সরিয়ে রাখতো।
অতনু নিজেকে একদম বদলে ফেললো, বুঝলো এসব হৈ-হুল্লোড় একটা বয়স অবধি ঠিক আছে, তারপর মানুষ চায় দিন শেষে একটা শান্ত ভালোবাসার নীড়, যে নীড়ে স্বপ্ন গাঁথা আছে, কল্পনা আছে, ভালোবাসা আছে আর টুকটাক মান অভিমান, এবং তা মিষ্টি ভালোবাসায় সেই অভিমানকে ভাঙিয়ে আবার কাছে টেনে নেওয়ার এক বাসনা।
স্মিতার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল অফিস শেষে একা ঘরে তন্ময় হয়ে শুনতো রবীন্দ্রসংগীত; একদিন এই গানের জন্য এণাকে কতো না ছোটো করেছে সবার সামনে— আজ সেই গানই তার জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ালো। গলা মিলিয়ে নিজেও গাইতো, “এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে..” এই গানটা এণা খুব গাইতো, এক একদিন সে নিজেও খুব তন্ময় হয়ে শুনতো, কিন্তু যেই এণা তাকে দেখে গান থামিয়ে দিতো তখন তার অভিমান বিদ্বেষের রূপ নিতো।
আজ রবীন্দ্রসংগীতের কিছু নতুন সিডি কিনতে গিয়ে দেখে, এণাক্ষ্মী ভট্টাচার্যের সিডি। অবাক হয়ে তুলে নিল হাতে সিডিটা। দোকানদার বললো ইনি এখন বেশ নাম করে গেছেন, শান্তিনিকেতনের মানুষ, এখন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবে বেশ প্রতিষ্ঠিত, ওঁর ডেট পাওয়া যায়না।
এবার বসন্ত উৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্র সদনে প্রোগ্রাম করতে আসছেন, টিকিট চাই আপনার?
– হ্যাঁ আছে আপনার কাছে?
– সব শেষ হয়ে গেছে আর দু’টোই আছে পড়ে।
– দিন তাহলে একটা।
অতনু টিকিট নিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে নিজের মনেই বলতে লাগলো, “তুমি তো জিতে গেলে এণা, নিজেকে প্রমাণ করেছো, আমার অপমান বিদ্রুপের উপযুক্ত জবাব দিয়ে দিয়েছ, কিন্তু জানো এই পরাজয়তে আমার কোনো গ্লানি বোধ হচ্ছেনা বরং এক নির্মল আনন্দে ভেতরটা ভরে উঠছে! অভিনন্দন এণা, অনেক অনেক অভিনন্দন।”
প্রোগ্রামের দিন অনেক আগেই অতনু চলে গেলো, যাতে প্রথমে বসার সুযোগ পায়। স্মিতা তাকে ফোন করে বসন্ত উৎসব সেলিব্রেট করার জন্য ফোন করেছিল, কিন্তু সে বলে দিয়েছে আজ তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়, হয়তো আর কোনদিনই যাবেনা, এসব ক্ষণিকের আনন্দে তার আর রুচি নেই। স্মিতা অবাক হয়ে বলেছিল, “তুমি দেখছি বউয়ের শোকে বিবাগী হয়ে যাচ্ছ!”অতনু নির্লিপ্ত জবাব দিয়েছিল, “কি হচ্ছি জানিনা, তবে আমাকে আমার মতন থাকতে দিলে আমি খুশি হবো”।
স্মিতা বলেছিল, “আমার সাথে কি সম্পর্ক রাখতে চাওনা আর?”
– “তুমি তো বিবাহিতা?”
– “হ্যাঁ বিবাহিতা জেনেই তো এগিয়েছিলে!”
– “ভুল করেছিলাম, ভীষণ ভুল, আমি দুঃখিত স্মিতা, তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য, পারলে ক্ষমা করে দিও।”
– “বউকে যদি এতো ভালোই বাসতে তবে আমার দিকে এগোলো কেন?”
– “তুমি বলো তো তুমি কি আমায় সত্যি ভালোবাসতে না আমার সঙ্গটাই শুধু উপভোগ করতে?”
– “আমি অতো জানিনা -“
– “আমি জানি, আমরা কেউ কাউকে ভালোবাসিনি। শুধু সঙ্গটাই উপভোগ করে এসেছি, নতুন সঙ্গী এলে তোমার আমাকে ভুলে যেতে দু’দিনও সময় লাগবে না।”
স্মিতা আর কিছু না বলে ফোন কেটে দিলো আর অতনু নিশ্চিন্ত হলো।
আজ এণার প্রোগ্রাম, সকাল থেকেই অতনু খুব উত্তেজিত, বিকেলে পড়ে যাবার জন্য এণার পছন্দ করে আনা একটা পাজামা পাঞ্জাবীীর সেট বার করলো। দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে খুব যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে এণা এটা কিনে এনে হরিণ চোখ দু’টো তুলে অতনুর মুখের দিকে চেয়েছিল, অতনু অবহেলায় সেটা বিছানায় রেখে, বম্বে থেকে আনা একটা বহুমূল্য সিফন শাড়ি ওর দিকে ফেলে দিয়ে বলেছিল, “এটা তোমার গিফট।”
এণার মনটা পড়ার চেষ্টা করেনি কখনও। অতনু তো এণাকে কখনও বারতি টাকা দেয়নি, ও ওর গানের টিউশনির টাকা থেকে সাধ্য মতোন কিনে এনেছিল।
সেদিন সন্ধ্যায় স্মিতার দেওয়া ভালো ব্র্যান্ডের দামী সার্ট পরে স্মিতার সাথে মদের গ্লাস নিয়ে চিয়ার্স বলে সন্ধ্যা কাটিয়েছিল আর স্মিতাও সেদিন পরেছিল তারই এনে দেওয়া এণার চেয়েও অনেক দামী শাড়ি।
এণাকে দেখিয়ে স্মিতা বলেছিল, “এটা অতনু আমায় এনে দিয়েছে।”
এণা চোখের জলকে গোপন করে ঢোঁক গিলে সব অপমান হজম করেছিল।
এবার তার পালা, তবে এই পরাজয়কে সে জয়ের মালা হিসেবেই নিয়েছে। তার বাবা মা ভুল করেনি, ঠিকই করেছিলেন এণার মতন মেয়েকে তার জীবন সঙ্গী হিসেবে বেছে দিয়ে, বিশেষ করে মা।
সেদিন সে এণাকে বুঝতে পারেনি, খুব সাদামাটা একটা শান্ত সাংসারিক মেয়ে হিসেবেই ভেবে এসেছে। এণার শান্ত স্নিগ্ধ রূপের মধ্য উন্মাদনা না থাকলেও সৌন্দর্য ছিল অসীম, সে সৌন্দর্যের মর্যাদা সে সেদিন দেয়নি।
প্রথম জীবনে তার মা’ও একই ভাবে বাবার কাছে অসম্মানিত হয়েছিলেন, তার বাবাও তার ভুল বুঝতে পেরে মাকে সম্মানের মালা পরিয়ে সংসারে ফিরিয়ে এনেছিলেন। বাবা তাকে বলেও ছিলেন, “বাবু যে ভুল আমি করেছি তা তুই করিস না। চকচক করলেই হীরে হয় না, তোর মায়ের প্রতি আমিও অবিচার করেছিলাম চরম, তাকে ফিরিয়ে এনেছি ঠিকই, কিন্তু তার মায়ের মনে যে কঠিন অভিমানের প্রাচীর তৈরি হয়ে গেছে তা আমি অনেক চেষ্টা করেও ভাঙতে পারিনি।”
সেও হয়তো পারবে না এণার মনের অভিমান আর
অবহেলার প্রাচীরটা ভেঙে ফেলতে! জানেনা সে পারবে কি না! তবু চেষ্টার ত্রুটি করবে না।
দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেলো অতনু নিজেকে সাজিয়ে নিয়ে চললো অনুষ্ঠানে, এণার দেওয়া সেই সাজে, যে সাজ সে একদিন চরম অবহেলায় ফেলে রেখেছিল আজ সেই সাজেই নিজেকে সাজালো। এণার হয়তো মনে নেই কিন্তু আজ অষাঢ় মাসের সেই দিন, যে দিনে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। মাত্র দু’বছরে সেই বন্ধন কাটিয়ে এণা চলে গিয়েছে।মাঝখানে চলে গিয়েছে আরও পাঁচটা বছর।
অনুষ্ঠান আরম্ভ হল সমবেত সঙ্গীত দিয়ে তারপর সভাপতির ভাষণ। অতনু অস্থির হয়ে উঠছিলো কখন তার এণা আসবে।
এণার নাম ঘোষণার সাথে সাথেই অতনু সোজা হয়ে বসলো, সে সামনের দিকে সিটেই বসেছিল, অনেক আগে এসে গিয়েছিল তাই সামনের দিকে সিট পেয়ে গিয়েছিল।
এণা ঢুকলো সাদার ওপর হাল্কা পিঙ্ক রঙের গোলাপি ও সোনালি রঙ দিয়ে কাজ করা শাড়ি, তার গায়ের রঙের সাথে মিশে গিয়েছে। অদ্ভুত স্নিগ্ধ আর সুন্দর লাগছিল তাকে দেখতে।
একের পর এক গান গেয়ে যেতে লাগলো এণা। প্রত্যেকটা গান অতনুর হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করছিল। এখন সেও যে রবীন্দ্রসংগীত শিখছে, আজ অনেকদিন হয়ে গেলো কলকাতার একজন নামকরা রবীন্দ্রসংগীত গায়কের কাছে শিক্ষা নিচ্ছে মন প্রাণ ঢেলে।
সবই বিরহের গান গাইছ এণা, তার মানে এণার মধ্যেও প্রবল বিরহ যন্ত্রণা।
শেষ গানটি গাইল, “যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে…”
মনে হল সমস্ত হৃদয় নিংড়ে যেন গানটি পরিবেশন করছে। অতনু পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে ওর বড়ো বড়ো কালো চোখ দু’টো জলে ভরে আসছে। গান শেষ হবার পর হাততালিতে হল ফেটে পড়ছে, এণা বেরিয়ে যাচ্ছে বিজয়িনীর ভঙ্গিতে।
এণা বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তায়, ওর সঙ্গের ছেলেটি বলছে, “দিদি ট্যাক্সি ডেকে দি?”
এণা উত্তর দেবার আগেই অতনু এগিয়ে এলো হাতে নানান রঙ দিয়ে সাজানো গোলাপের গুচ্ছ নিয়ে, এণা নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে আছে।
-অতনু ওর হাতে গোলাপ গুচ্ছটি তুলে দিয়ে বললো, “তুমি জিতে গেছো এণা আর আমি হেরে গেছি, কিন্তু বিশ্বাস কর এণা, এ হার যেন আমাকে নতুন করে দিল, তোমার দেওয়া আঘাতেই আমার জয়ের মালা, আমি নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেয়েছি।”
– এণা ফুল হাতে নিয়ে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো অতনুর চোখে এক অদ্ভুত আকুতি। অতনু বলল, “অসাধারণ গান শুনলাম আজ, হয়তো আগেও শুনতে পারতাম কিন্তু তখন শোনার বা বোঝার মতন মন বা অনুভূতি কোনটাই আমার ছিলো না।
এণা মাটিতে চোখটা নামিয়ে নিয়ে বললো, “আজ হয়েছে?”
“হ্যাঁ, এণা এখন আমিও যে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা করে তার রস গ্রহণ করতে পেরেছি।”
– “তুমি রবীন্দ্রসংগীত!”
এণার অবাক প্রশ্নের উত্তরে অতনু বললো, “হ্যাঁ, আমি, আমি এখন তোমার গানই গাই আর তোমার মনের মতন করে তোমার ফেলে আসা ঘরটা সাজিয়ে রাখি।” একবার ফিরবে কি সেই ফেলে আসা পরিত্যক্ত ঘরটায়? শুধু দেখে যাও সে ঘরের পরিবর্তনটা।
চল এণা একবার চল, শুধু ঘরটা দেখতে, আমার এতদিনের অপেক্ষা ছিলো শুধু এই যে, আমি আমার বদলে যাওয়া নতুন আমিটাকে তোমার সামনে তুলে ধরবো বলে আমার এই অপেক্ষার পূর্ণতাটুুুকু অন্তত দাও!”
হঠাৎ কোথা থেকে দমকা ঝড় উঠলো, বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। অতনু এবার হাত ধরে টেনে বললো “চলো গাড়িতে উঠি, ভিজে যাবে যে,”
এণার বলতে ইচ্ছে করছিল, “জীবনে প্রথম যেন বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তোমাকে আর আমাকে ..”
কিন্তু মনের কথাটা মনেই থেকে গেলো বলতে পারলো না, শুধু যন্ত্রচালিতর মতন অতনুর হাতটা ধরে বলল, চলো।
বহুদিন পর অতনুর সাথে গাড়িতে ছুটে চলেছে এণা।
অতনু গান চালিয়ে দিয়েছে,” মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ, আসিতে তোমার কাছে..”
বাইরে তখন প্রবল ঝড় আর তার সাথে তুমুল বৃষ্টি,
আর গাড়ির ভেতরে চলছে গান, আজ গানের সাথে দু’জনেই গলা মিলিয়ে গাইছে, “মনে হল, যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ… “ -
গল্প- আবার বৃষ্টি পরবে
আবার বৃষ্টি পরবে
– পারমিতা চ্যাটার্জীকতদিনের পর আবার এসে দাঁড়িয়েছি রাঙামাটির পথে।
তোমার মনে আছে অনু?
আমরা যখন রাঙামাটির পথে পা মিলিয়ে হাঁটতাম, তুমি আমার হাতটা তখন গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে বলতে- “এই মাটিতে কবির পায়ের গন্ধ মিশে আছে।
-আমি তাকিয়ে থাকতাম টলটলে দিঘীর মতন তোমার শান্ত দীঘল চোখ দু’টিতে।
– মনে হত যেন মিশে গেছি ওই চোখের তারায়।
মনে আছে তোমার আচমকা মেঘের গর্জনে তুমি ভয় পেয়ে আমায় জড়িয়ে ধরেছিলে।তারপর হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে ছেড়ে দিলে। তেমার সেই লজ্জারাঙা চোখ দু’টি আজও আমার মনের ক্যানভাসে আঁকা আছে।
দোল পূর্ণিমায় পলাশ গাছের গোধূলি ছায়ায় মাখিয়ে দিতাম তোমায় আমার মনের আবীর।
খোয়াইয়ের ধারে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ আব্দার করলে, রতন কাকার দোকানে চা খেতে যাবে?
– আমি বললাম তোমার আব্দার রাখবনা, এমন সাধ্য কি আমার আছে?
তুমি কি তখনও বোঝনি অনু আমার মনের কথাটা?
হঠাৎ একদিন মেঘ করে এলো। দেখতে দেখতে পূবের আকাশটা কালো হয়ে গেল।
তুমি বললে, অয়ন মেঘ করেছে, এখুনি বৃষ্টি আসবে। ভিজে যাবো যে..
আমি আস্তে আস্তে বললাম, আমি তো তোমার মন থেকে ঝরে পরা বৃষ্টির জলে রোজই ভিজে যাই অনু। তুমি না বুঝেই আমার দিকে তাকিয়ে রইলে। তোমার মায়াবী চোখ দু’টি আমায় প্রবল আকর্ষণে তোমায় কাছে টানতে লাগল। কিন্তু আমি জয় করলাম আমার নিজেকে, নিজের মনের দুর্বলতাকে। মুখে বললাম, একদিন না হয় একটু ভিজলাম কি আসে যায় তাতে?
বলতে বলতে মুষল ধারে বৃষ্টি নামল। তুমি একেবারে ভিজে গেলে। ভিজলাম আমিও কিন্তু আমার চোখ দু’টো ছিল তোমার ভেজা হলদে শাড়িটার ওপরে যা লেপ্টে রয়েছে তোমার শরীরের প্রতিটি কোণায়। তেমার ভেজা চুলগুলো লেপ্টে গেছে তোমার চোখে মুখে। আমি হাত দিয়ে তোমার চোখের ওপরের চুলগুলো সরিয়ে দিলাম।
আমার শিল্পী মনের প্রতিটি কোণায় কোণায় তোমার এই ভেজা শরীরটা তোমার অজান্তে আঁকা হয়ে থাকল। আমার আঁকার সব ছবিই তোমার মনে দাগ কাটে। শুধুু জানিনা আমি মানুষটা তেমার মনে কতটা দাগ কাটতে পেরেছি। তোমায় নিয়ে কত ছবি এঁকেছি তাও তুমি জানোনা। কিন্তু আজকের এই ছবিটা বোধহয় জীবনের সেরা ছবি হবে।
হ্যাঁ, ওই ছবিটা আমার জীবনে কিছু দিয়েও অনেকটা কেড়ে নিল।
ওই ছবিটার জন্য আমি পেলাম আন্তর্জাতিক পুরস্কার আর তোমার কাছে চরম তিরস্কার। সে তিরস্কারের ভাষা ছিল যেমন সত্য তেমনি নির্মম।
তুমি সেদিন যখন বলেছিলে, ছিঃ আমাকে একেবারে সবার সামনে নামিয়ে আনলে– সামান্য পুরস্কারের লোভে?
তখন আমার চোখ ফুটল, সত্যি তো এ আমি কি করলাম? যাকে ভালোবাসি, তার সিক্ত যৌবনের ছবি কি করে আমি সবার সামনে মেলে ধরলাম?
তোমার ক্ষমা আমি পেলাম না। তুমি বললে, আমি ক্ষমার অযোগ্য।
আমি নীরবে এ তিরস্কার মাথা পেতে নিলাম।
নিজেকে হারিয়ে ফেললাম অনেক দূরে, যাযাবরের মতন ঘুরে বেড়াতাম। কখনও আধপেটা খেয়ে কখনও না খেয়ে। শেষকালে ফিরলাম। কলকাতায় মায়ের চোখের জলের মূল্য দিতে। চাকরি নিলাম রবীন্দ্রভারতীতে অঙ্কন শিক্ষক হয়ে। ফিরতে পারিনি আর আমার প্রিয় সেই রাঙামাটির দেশে।
প্রায় কুড়িবছর পর কিসের এক অমোঘ টানে এলাম আবার পৌষমাসের মেলার প্রাঙ্গণে।
হঠাৎ দেখলাম তোমায়, আর্ট গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে কি যেন খুঁজে যাচ্ছো তন্ময় হয়ে।আমি আস্তে আস্তে তোমার পাশে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলাম- কি খুঁজছ?
তুমি চমকে তাকালে আমার দিকে। তারপর হতাশ গলায় প্রশ্ন করলে, পালিয়ে গেলে কেন?
আমি বললাম, কি করে থাকব একই শহরে তেমার ঘৃণা নিয়ে?
শুধু ঘৃণাটাই দেখলে?
না আরও কিছু দেখতে চেয়েছিলাম।
– কি?
-ৎভালেবাসা?
– পাওনি?
– হয়তো পেয়েছিলাম, কিন্তু নিজেই হারিয়ে ফেলেছিলাম।
– আজ আমার একটা ছবি আঁকবে? এ ছবি কোন প্রদর্শনীতে যাবে না। থাকবে শুধু তোমার আমার মাঝে।
– আমি আকুল হয়ে তোমার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললাম,অ..নু..
তুমি তেমনি ভাবে বললে, বললে না তো আঁকবে কি না?
আমি শুধু নিজের এতদিনের না ঝরা অশ্রুকে সংযত করে তোমার দু’টো হাত তেমনি ভাবে জড়িয়ে রেখে বললাম আঁকব।
তুমি হেসে আমার হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললে, আবার বৃষ্টি পরবে। -
গল্প- জীবন যুদ্ধ
জীবন যুদ্ধ
– পারমিতা চ্যাটার্জীচলতে চলতে পা দু’টো বড় ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে,
মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে একদম ভিজে যাচ্ছি, ঝড়ে বাতাসে ছাতাটাও ওলোটপালোট খাচ্ছে। সামনে একটা বাঁশের সাঁকো আছে, ইদানীং বড় খুব পিচ্ছল হয়ে যচ্ছে, পার হতে গিয়ে পড়ে না যাই।অন্ধকারে অনুভব করলাম কে যেন এসে আমার হাতটা ধরল, চমকে তাকালাম
দেখলাম অল্প বয়সী একটি ছেলে, হাত ধরে আমায় সাঁকোটা পার করে দিচ্ছে, বলল চলুন ভয় নেই, পড়বেন না।রাস্তায় নেমে সে অন্যদিকে চলে গেল, আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, ভাবলাম বৃষ্টিটা একটু কমে এলে বাড়ীর পথ ধরব…তারমধ্যে যদি একটা অটো বা রিক্সা পাই নিয়ে নেব। রাস্তার আলোগুলো টিমটিম করে জ্বলছে,
ভালো করে দেখতে পাচ্ছিনা।
হঠাৎ একটা দামী গাড়ী এসে সামনে প্রায় গা ঘেসে দাঁড়াল, মুখ তুলে বকতে যাচ্ছিলাম,
কিন্তু গাড়ী থেকে যে নামল তাকে দেখব আশা করিনি, একজন সুসজ্জিত ভদ্রলোক, অনেক দিনের চেনা, এই বৃষ্টিতে একা কোথায়? উঠে এসো নামিয়ে দিচ্ছি।মনে তখন কত প্রশ্নের ভীড় গাদাগাদি করছে, গাড়ীতে উঠব কি?
মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললাম-তুমি? গাড়ীর ভেতর একজন সুসজ্জিতা মহিলা। বলল- হ্যাঁ, আমি বছর দুই হল এসেছি।
ভেতরের মহিলাকে দেখিয়ে বলল আমার স্ত্রী সুধা। আর এ আমার এক পুরানো বন্ধু।বৃষ্টির জলে এমনি চোখটা ঝাপসা হয়েছিল, এখন আবার কোথা থেকে রাশি রাশি চোখের জল আসতে লাগল। কোনরকমে টাল খেতে খেতে আমাদরর এঁদো গলিটা পার হয়ে যেন এক ঘোরের মধ্যে বাড়ী ফিরলাম।
ছেলেটা তখনও ফেরেনি, মা এসে বলল কিরে কাপড়টা ছাড়, বিছানায় এমন করে বসে পড়লি যে…
-মা বাবুন কোথায়?
বাবুন তো সোনাইকে নিয়ে বেড়াতে গেল, এসে যাবে এখন, তুই কাপড়টা ছেড়ে একটু চা খা আগে, বলি এই বৃষ্টির মধ্যে বার হসনা, আজকাল তো চোখের পাওয়ারটা এতে বেড়েছে। মুখ ঝামটেই জবাব দিলাম খেটে খেতে হয় মা। বাবুন এলে বল তো নেট দেখে আজ রাতেই শান্তিনিকেতন যাবার টিকিটটা যেন কেটে দেয়, ওখানকার চাকরিতে এ মাসেই জয়েন করতে বলেছিল। মা বললো, তোর সবেতেই জেদ, কাল সকালে গেলে কি হয়? এতো রাতে আমি একলা যেতে দেব না।
পরদিন সকালে চলে গেলাম শান্তিনিকেতন।
আঃ কি শান্তি!
আসার সময় মা ভাইদের খুব মন খারাপ হল, কিন্তু কি করা যাবে, একাই যখন বাঁচতে হবে তখন লড়াই আরম্ভ করে দেওয়াই ভালো।পরদিন সকালে ঘরের কিছু জিনিস কিনতে যাব বলে তৈরী হচ্ছি, এমন সময়ে অজয়দা ঘরদোরের যাবতীয় জিনিস নিয়ে এসে, লোক দিয়ে নিজের হাতে সব সাজিয়ে দিয়ে গেল।
–তুমি?
কি করে খবর পেলে আমি এসেছি…
অজয়দা কোন উত্তর না দিয়ে কাজ সারতে লাগল।
–বলল, এখন যাচ্ছি। বাস্কেটের মধ্যে চা, দুধ চিনি, রুটি, মাখন, ডিম কলা আছে। এখনকার মতন হয়ে য়াবে, সঙ্গে একজন মাসীকেও এনেছে।
আবার বলল রান্নাঘরে চাল, ডাল তেল নুন সব আছে এখনকার মতন হয়ে যাবে।
আমার দু’ চোখ দিয়ে হু হু করে জল পড়তে লাগল। সেই কবে থেকে অজয়দা আমায় ভালোবাসত, সেই ভালোবাসা এখনও অম্লান। সেই একই পোষাক, চেক্ চেক্ লুঙ্গি, খালি গা বুক ভর্তি লোম, যা দেখে সেদিন দেমাক করে বলেছিলাম, কোথাকার একটা চাষা ভুসা, সাহস কত…আমায় ভালোবাসতে এসেছে..
ভগবান বোধহয় অলক্ষ্যে হেসেছিলেন…
আজ সেই চাষার দয়ায় জীবনটা হয়তো বাঁচবে…। -
গল্প-খোয়াইয়ের ধারে
খোয়াইয়ের ধারে
– পারমিতা চ্যাটার্জীখোয়াইয়ের ধারে আজও শনিবারে হাট বসে।
দূর দূর গ্রাম থেকে পসারিরা আসে পসার সাজিয়ে, আবার দিনশেষে, যে যার পসরা গুটিয়ে যাত্রা করে ঘরের দিকে।
খোয়াইয়ের হাট যেখানে বসে, তার একটু আগে একটা রাঙা মাটির পথ নীচের দিকে নেমে গেছে, সেখানেই আমাদের বাড়ী।
সেবার দোল বসন্ত উৎসবের পরের দিন শনিবার ছিল, আর তুমি এসেছিলে হাটে, তোমার সাথে ছিল তোমার কলকাতার বন্ধুরা।
তোমরা বেড়াতে বেড়াতে আমাদের বাড়ীর সামনে চলে এসেছিলে, তখনও আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ছিল, জোৎস্না খেলছিল আমাদের ছোট্ট বাগানটায়।
আমার দু’একজন বন্ধু মিলে, খোলা আকাশের তলায় জোৎস্না মেখে গাইছিলাম গান…
‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলো
ও রজনীগন্ধা, তোমার গন্ধসুধা ঢালো’
গান শুনতে তোমরা দাঁড়িয়ে গেলে,
আর তুমি?
মন্ত্রমুগ্ধের মতন চেয়ে রইলে আমার দিকে,
শুধু আমার দিকে….
– কি যেন এক যাদু ছিল তোমার দৃষ্টিতে, তারপর দিন আবার এলে, তারপরে আবার….
কি তাড়াতাড়ি ভালোবেসে ফেললাম তোমায়,
তখন কি বুঝেছিলাম…
– তুমি শহরের বড়লোক আধুনিক পরিবারের শিক্ষিত ছেলে…
আর আমি…? আধা গ্রাম আধা গঞ্জের নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে।হ্যাঁ, তবে আমিও অশিক্ষিত ছিলাম না। আর গান গাইতে পারতাম, শহুরে আধুনিকতা মোটেই ছিলনা। কিন্তু ওই ছোট্ট জায়গায় অনেকেই বলত,-রবীন্দ্রনাথ নাকি আমাকে দেখেই তাঁর গল্পের নায়িকাদের চেহারা আঁকতেন…সে সব ঠাট্টার কথা…
ওই বয়েসে মনে একটু দোলা যে লাগতো না তা বলতে পারি না…
-তোমার বন্ধুরা চলে গেল, তুমি থেকে গেলে।
এসে গেল আর একটি হাটবার। সকাল থেকেই শুরু হল পসারিদের আনাগোণা।একজন বাউল তার ডুগডুগি
বাজিয়ে গাইছিল,
‘গোলেমালে গোলেমালে পিড়িত কইরোনা,
পিড়িতি কাঁঠালের আঠা লাগলে পড়ে ছাড়বেনা…’
তুমি আমায় ঠেলা দিয়ে বললে,
-বুঝলে এ আঠা লাগলে পড়ে ছাড়বেনা…
সত্যি আমার এখনও ছাড়েনি…পরদিন গাড়ী করে তোমার বাবা মা এসে তোমায় নিয়ে গেলেন। যাবার সময় তোমার চোখে ছিল জল, তাও আমার চোখের জল মুছে দিয়ে বলেছিলে,
-দু’টো বছর অপেক্ষা করো, আমি ঠিক আসব।
আজ বারো বছর হয়ে গেল এখনও অপেক্ষার জানলায় বসে আছি, তুমি আর আসোনি। আমিই বা কি বোকা ছিলাম, সাধারণ বাপমায়ের সাধারণ মেয়ে হয়ে বড়লোকের ছেলের ভালোবাসায় গা ভাসিয়ে দিলাম।
এখনও শনিবারের হাটে এসে খুঁজে বেড়াই, আমার সেই ক্ষণিক পাওয়া ভালোবাসাকে।
মাঝে মাঝে মনে হয় ওইতো!
ছুটে যাই কাছে, গিয়ে দেখি অচেনা অতিথি…।
এইভাবেই একদিন অচেনার মাঝে বহুদিন প্রতিক্ষিত সেই চেনা মানুষটাকে পেয়েছিলাম, কিন্তু সে আমায় চিনতে পারেনি, তার সাথে ছিল তার বাবা, মা, মনে হল স্ত্রী আর মেয়ে।
আমার আকুল চোখের দিকে তাকিয়ে সে মুখ ঘুরিয়ে নিল, এটাই তে স্বাভাবিক, দু’দিনের দেখা একটা আধা শহুরে মেয়ের কাছে কথা রাখতে কেউ আসে?
আমি রাঙা মাটির পথ ধরে বাড়ীর দিকে এগিয়ে গেলাম, বাবা আছেন আমার অপেক্ষায় তাকে খাবার দিতে হবে। -
গল্প- ঘর ছাড়া বাউল
ঘর ছাড়া বাউল
-পারমিতা চ্যাটার্জীসেদিন খুব বৃষ্টি পড়েছিল,
শ্রাবণের ঘন আকাশ,
মেঘে থমথম করছে..
মন চাইছিল জানো?
তোমার কাছে যেতে,
কিন্তু- একটা কিন্তু ভাব থেকে
গিয়েছিল মনের কোণে,
আমি তো জানিনা–
তোমার মনে আমার জন্য কি আছে?
আমি তো এক গান পাগল কবিতা পাগল
ছন্নছাড়া ছেলে–
তবুতো প্রাণে ভালেবাসা আছে
আষাঢ়ের নিঝুম সন্ধ্যায়
ভাঙা বাড়ীর গাড়ী বারন্দাটার তলায় তুমি বৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য আশ্রয় নিয়েছিলে– তোমার গোলাপি ওড়নাটা মাথায় দিয়ে বৃথা চেষ্টা করছিলে বৃষ্টি থেকে বাঁচবার। তোমার সমস্ত শরীর বেয়ে বৃষ্টির জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল।
আমি শিল্পী নই,তবু মনে হচ্ছিল হাতে একটা রঙ তুলি আর সাদা ক্যানভাস থাকলে তোমার এই অপরূপ বৃষ্টিস্নাত ছবিটা ফুটিয়ে তুলতাম। কিন্তু আমার মন ক্যানভাসে সে ছবিটা তোমার ছবিটা চিরকালের জন্য আঁকা হয়ে থাকল, তুমি জানতে পারলেনা।ঠিক সময় তুমি চলে গেলে আর একটা ঠিক এরকম ভরা শ্রাবণে স্বামীর ঘরে ঘর করতে, সত্যি তো আমার মতন এই ঘরছাড়া বাউলকে কেউ পাত্র হিসাবে ভাবতে পারে?
তাই আমি কোনদিন যাইনি তোমার কাছে ভালোবাসার আবেদন নিয়ে। না পাওয়ার দুঃখ সইতে পারব কিন্তু প্রত্যাখানের বেদনা সইতে পারবনা। তাই নিজেকে আড়ালেই রেখেছিলাম। হয়তো চিরকালই আড়ালেই রাখতাম, সামনে আসতাম না।কিন্তু জানো তোমার বিয়ের ঠিক একমাসের মাথায়
আমাদের পাড়ার বাবলিটা, তুমি হয়তো চেনোনা। সে এসে আমায় খবর দিল-
দাদা সর্বনাশ হয়ে গেছে!
আমি বললাম কি হয়েছে রে বল?
আমাদের তিন্নি..অনেকদিন পর তোমার নাম শুনে বুকের রক্তটা চলকে উঠল–
তবুও বললম- হ্যাঁ তিন্নির কি হয়েছে?
সে বলল- ও আর স্বামী নিকোপার্কে গিয়েছিল
ওখানে কয়েকজন গুণ্ডা তুলে নিয়ে ওকে,আমি হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললাম– থাক আর বলতে হবেনা। তিন্নি এখন কোন হসপিটালে আছে? বাইপাসের ধারে, ওর শরীর দিয়ে প্রচুর রক্ত বেড়িয়ে গেছে। এখনি ওকে রক্ত দিতে হবে না হলে বাঁচানো যাবেনা। আমার মনে এক এমুহূর্ত তোমার মুখটা ভেসে উঠল। তারপর সার্টটা গলিয়ে নিয়ে বাবলুকে বললাম চল।
তোমাদের বাড়ী গিয়ে তোমার মাকে তুলে নিলাম
অসহায় মহিলার আর্তনাদ কন্না অনেকদিন আগের এক ঘটনা মনে পরিয়ে দিচ্ছিল। আমার দিদিও কলেজ থেকে ফেরার পথে এরকম একদল ঘাতকের হাতে পরে প্রাণ হারিয়েছিল। মায়ের সেই কান্না এখনও আমার কানে বেজে খানখান হয়ে ভেঙে ঝরে পড়ে। দিদিকে আমরা চিকিৎসা করানোর কোন সুযোগ পাইনি। তার আগেই সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেছিল।আজ আমি তিন্নিকে কিছুতেই মরতে দেবোনা। ওকে বাঁচাতেই হবে।
ক দিন আগে এখানে রক্তদানের ক্যাম্প হয়েছিল আমি রক্ত দিয়েছিলাম। ব্লাডগ্রুপটা তাই জানাছিল- ও পসিটিভ।যাবার পথে মাসীমাকে একটা কথাই শুধু জানতে চাইলাম ওর ব্লাড গ্রুপটা কি? উনি বললেন- ও পসিটিভ.. কি আশ্চর্য ভাবে মিলে গেল।
আমি মনে মনে ভাবলাম কত তাড়াতাড়ি ওখানে পৌঁছানো যায়।
ওখানে পৌঁছে দেখলাম, তোমার বাবা কপালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে আছেন।তোমার মাকে দেখে অসহায় প্রশ্ন করলেন- তুমি কি করে এলে?তোমার মা আমাদের দেখিয়ে দিলেন- তোমার মা কাতর হয়ে বললেন শ্বশুরবাড়ী থেকে কেউ আসেনি? না দেখতেই তো পাচ্ছ..
জামাই কোথায়? সে ও চলে গেছে তার বাবা মায়ের সাথে — ধর্ষিতা মেয়ের কোনো দায় ওরা নেবেনা। এখন ওসব কথা থাক এখন আমার মেয়েকে বাঁচাতে যে রক্তের প্রয়োজন ও পসিটিভ..
আমায় নিয়ে চলুন কাকু কোথায় রক্ত দিতে হবে?
তুমি? তেমার ব্লাড..
– ও পসিটিভ–
চল বাবা চল কি উপকার যে করলে-আমি মনে মনে ভাবলাম আমি কারও উপকার করিনি, যা করেছি আমার ভালোবাসার জন্য করেছি।
দু তিন দিনের মাথায় তুমি বাড়ী এলে- আমি আর যাইনি তোমার কাছে। দলে দলে লোক এসে তোমায় সান্ত্বনা বাক্য আর সহানুভূতিতে তোমরা অস্থির হয়ে উঠছিলে। আর তুমি? যেন সব কিছু হারিয়ে ফেলে এক সত্ত্বাহীন অস্তিত্বে পরিণত হয়েছিলে। সাহস করে কাকুকে গিয়ে বললাম এত সহানুভূতিতে তো আরও অসুস্থ হয়ে পরছে। ওকে একজন সাইকোলজিস্ট দেখানো দরকার। ভালোই ছিলে ওষুধপাতি খেয়ে কিন্তু যেদিন তোমার শ্বশুরঘর থেকে তোমার কাছ থেকে ডিভোর্স নিতে এলো, সেদিন তুমি একদম ভেঙে পরলে। আমায় বললে- একদিন অসহায় চোখে চেয়ে আমায় বাঁচালেন কেন? এতো অপমানের চেয়ে তো মৃত্যুও ভালো ছিল।
আমি এই প্রথম তোমার এলোমেলো মাথাটা ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বললাম আমি তো আছি অত চিন্তা করেনা। তুমি আমার হাত দু’টো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে কেঁদে বললে আমায় কেনদিন ঘেন্না করবে না তো? ঘেন্না তোমায় কেন করব? তুমি মাথা উচু করে বাঁচার মতন করে বাঁচবে। ঘেন্না তো নিজেদের ওপর হয়, এই অসামাজিক সমাজ ব্যবস্থায় একটা মেয়ের লজ্জা রক্ষা করতে পারলাম না। এর আগেও পারিনি এবারও পারলাম না।
তোমরা বল তো মেয়েটার কি দোষ? ওর বর ওকে বেড়াতে নিয়ে,গেছে সেখানে এই ঘটনা ঘটেছে ওর চোখের সামনে। অথচ বাধা দেবার চেষ্টা করেনি কেন? তাতে ওর প্রণটা শুধু যেত নাকি? আরে বাবা আড়ালে দাঁড়িয়ে একটা পুলিশ কল তো করতে পারতিস? তা নয় মেয়েটাকে ওভাবে ফেলে রেখে পালিয়ে চলে এলো- এ কেমন স্বামী?
আমি তখন অসীম সাহসে ভর করে বলেই ফেললাম যে আপনাদের কোনো অমত না থাকলে আমি ওর হাত ধরতে চাই। তুমি দু’হাতে মুখ ঢেকে বললে আমি মরতে চাই কারুর দয়া নিয়ে বেঁচে থাকতে চাইনা।এই প্রথম তোমার কাছে এসে বললাম- যদি বলি ভালোবাসা- বিশ্বাস করবে?
আজ থেকে পাঁচবছর আগে থেকেই তেমায় ভালোবেসে গেছি শুধু। বিনিময়ে কিছু চাইনি কিন্তু আজ আমি একটা ভালো চাকরি পেয়েছি মানে এবার আর আমি সেই ঘরছড়া বাউল নই, দেখে চিনতে পারেনা?
সবই কি বলতে হবে? কিছুুই কি বুঝে নেওয়া যায়না?
হ্যাঁ যা বোঝার বুঝেছি।
– তুমি বললে এমন মানুষ আজও আছে?
– আমি বললাম, সবই কি আর অন্ধকার থাকে! কোথাও কোথাও আলো নিশ্চয়ই জ্বলে- সেই আলোর রেখাটুকু ধরেই তো পথটা পার হই আমরা।। -
গল্প- বনলতা
বনলতা
-পারমিতা চ্যাটার্জীহসপিটালে যাবে বলে সবে অরিত্র ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে একটা টোস্টে কামড় বসিয়েছে, এমন সময় মা হঠাৎ রণচণ্ডী মূর্তি ধারণ করে সামনে এসে দাঁড়ালেন।
মায়ের ওরকম অগ্নিমূর্তির দিকে চেয়ে, অরিত্র বলল,”কি হয়েছে মা! প্রেশারটা আবার বাড়লো না কি! কিরকম যেন লাগছে তোমাকে?”
মা সেরকমই ঝাঁঝের সাথে উত্তর দিলেন, “এক সপ্তাহ কেটে গেলো, আমরা মেয়েটাকে দেখে এলাম, এখনও তোমার কোনো সদুত্তর পেলামনা, প্রেশারের আর দোষ কি! আজও ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলেন আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না, উনি বললেন, ওঁর মেয়ে খুব অপমানিত বোধ করছে, বারবার আমি ফোন করছি বলি, আসলে আমাদের আপনাদের পরিবারটাকে খুব ভালো লেগেছে তাই মেয়ে বেরিয়ে যেতে ফোন করলাম, একটা কিছু বলে দিন, আমি বলেছি, আমি অত্যন্ত দুঃখিত দিদি, আমি আজই আপনাকে জানিয়ে দেবো, অন্তত মেয়েটার সাথে একবার কথা বলে তো দেখ।”
অরিত্র বুঝতে পারলো, যে কোনো মেয়ের পক্ষেই এটা খুব অসম্মানের, তাছাড়া যে মেয়েটিকে তারা দেখে এসেছে সে ইতিহাস নিয়ে মাস্টার্স কমপ্লিট করে এম.ফিল করছে, দেখতেও অত্যন্ত সুশ্রী কিন্তু সে যা খুঁজছে তাতো নেই, তা কোনদিনও পাওয়া সম্ভব নয়, তাহলে? একটু সময় নিয়ে বললো, “ঠিক আছে ওঁদের মেয়েকে বলে দাও একটা সময় দিতে, আমরা একটু কথা বলে নিতে চাই, যেদিন যেখানে বলবে আমি সেইমতন সময় অ্যডজাস্ট করে নেবো।”
উফ্ এই কথাটা বলতে তুই একসপ্তাহ লাগিয়ে দিলি! নে খেয়ে নে এবার।
অরিত্র দেখলো মুহূর্তে তার মায়ের গলার স্বর একদম বদলে গেলো, মনে মনে হাসিও পেলো।
খেয়ে নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবলো, কি যেন মেয়েটার নাম ছিলো! ও মনে পড়েছে, ওর নাম ছিলো তিস্তা, হ্যাঁ তিস্তার মতই চঞ্চল সে, খুব সপ্রতিভ কিন্তু তার মন যে দখল করে বসে আছে সেই শান্ত স্নিগ্ধ কালো চোখের মেয়েটি, যার নাম বনলতা, ঠিক যেন জীবনান্দ দাসের বনলতা।
বনলতা তার পেশেন্ট হয়ে এসেছিল, তার স্বামী তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতো, তার চিকিৎসা করতে করতে অজান্তে কখন যে তার মনটাকে সাথে করে নিয়ে গেছে সে বুঝতে পারেনি। সে জানেও না বনলতা এখন কেমন আছে! তার আর কোনো সন্তান হলো কি না! কিছুই জানেনা।
বনলতার প্রথম সন্তান জন্ম দেবার সময় থেকেই সে ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল,
কারণ তার স্বামী তখন আমেরিকায় চলে গিয়েছিল তার কোনো এক কলিগকে সাথে নিয়ে।
বনলতা সন্তানসম্ভবা খবর পেয়েও সে কোনরকম খোঁজ খবর করেনি, এসেছিল একদম শেষ মুহূর্তে, বনলতার তখন জ্ঞান ছিলো না। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছিলেন, তারপর বনলতার স্বামীকে জিজ্ঞেস করে আপনাকে একটা সই করতে হবে, সে কারণ জানতে চাইলে তারা বলে, বনলতার প্রেশার খুব হাই এবং ই.সি.জি. রিপোর্ট বলছে হার্টের কন্ডিশন ও ভালো নয়। এমত অবস্থায় দু’জনকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব, তবু্ও আমরা চেষ্টা করবো।
বনলতার স্বামী মৃগাঙ্ক বলেছিল, “ডাক্তার আপনারা দেখবেন আমার স্ত্রীর যেন কোন ক্ষতি না হয়, ওর জীবনটা যেন বাঁচে।”
বনলতা একটা একটা করে দিন গুণ ছিল সন্তানের মুখ দেখবে বলে, সে যখন জানতে পারলো যে তার সন্তানকে বাঁচানো যায়নি তখন সে পুরোপুরি ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিল। খাওয়া পুরো বন্ধ করে দিল, কারুর সাথে কথা বলতো না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো শুধু। স্বামী বহু চেষ্টা করেও তাকে এক চামচ স্যুপ খাওয়াতে পারেনি, তখন তার ওপর ভার পরে বনলতকে সুস্থ করে তোলার।
তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল, বনলতা সুস্থ হয়ে যেদিন স্বামীর হাত ধরে বাড়ি চলে যাচ্ছিল সে সেদিন তার চেম্বারের জানলা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো, হঠাৎ দেখলো বনলতা পেছন ফিরে তাকিয়ে তার দিকে চলে যাচ্ছে আসতে আসতে কম্পাউন্ড পার হয়ে। যতদূর দেখা যায় দু’জন দু’জনের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিলো।
বনলতার সেই দৃষ্টির ভাষা সেদিন সে পড়তে পেরেছিল।
মনে মনে একটা গোপন আশাও পোষণ করে রেখেছিল হয়তো কখনও কোন একদিন সে আসবে! না বনলতা আর আসেনি। সে হয়তে সুখেই আছে তার কথা ভেবে এখন সে বর্তমানকে নষ্ট করতে পারেনা।
যে আসছে তার জীবনে, সে বনলতা নয়, সে তিস্তা , তিস্তাকে তিস্তার মতো করেই গ্রহণ করতে হবে, তারমধ্যে বনলতাকে খুঁজলে চলবে না।
দু’ একদিনের মধ্যে অরিত্রর মোবাইলে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো, অরিত্র কোনো পেশেন্টের ফোন ভেবে বেশ ভারিক্কি চালে ফোনটা ধরে উত্তর দিল, “ইয়েস ডাঃ অরিত্র ইজ স্পিকিং”
ওপার থেকে কলকল করে মহিলা শব্দের হাসির শব্দ ভেসে এলো, তারপর হাসি সামলে বললো, “আপনি তো আচ্ছা মশাই, ফোন করতে বললেন, আর চিনতেই পারছেন না! “
মুহূর্তের মধ্যে অরিত্রর শরীরের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেলো, বুঝতে পারার পর সেও সহাস্যে উত্তর দিল, “ও বুঝেছি, মনে হচ্ছে তিস্তা নদী, কিন্তু নদী তো খুব শান্ত হয়, কিন্তু আপনি যেভাবে নির্ঝরিণী ঝর্ণার মতন হাসি ছড়ালেন, তাতে আপনার নাম কোনো ঝর্ণার নামে হওয়া উচিৎ ছিলো”
ওপার থেকে আবার সেই কলকল শব্দ বেজে উঠলো, “আপনি তো খুব সুন্দর কথা বলতে পারেন! আমার তো ধারণা ছিলো ডাক্তাররা নীরস প্রকৃতির হয়।”
ডাক্তাররা নীরস প্রকৃতির হয় এ অভিযোগ কিন্তু সত্য নয়, অনেক ডাক্তার সাহিত্য ও সংগীত চর্চাও করে থাকেন। তাছাড়া আমি কিন্তু মনের ডাক্তার, “দেখবেন আমি কিন্তু আপনার পেশেন্ট নই, আমার আবার মনের চিকিৎসা করতে যাবেন না যেন, আমি একদম সুস্থ মনের মেয়ে”
“হুম, সে তো বুঝতেই পারছি, তা বলুন কবে মহাশয়ার দেখা পাবো?”
“দেখা পাবার জন্য খুব উদগ্রীব বুঝি?”
“খুব না হলেও একটু উদগ্রীব তো বটেই”
“তাহলে তো আপনার নিজের মনের চিকিৎসাটা আগে করতে হয়”
“মানে!”
“মানে যাকে দেখার জন্য উদগ্রীব তাকে এই কথাটা বলার জন্য একসপ্তাহ সময় নিয়ে নিলেন”
‘না, এতোদিন ঠিক উদগ্রীব ছিলাম না। তবে আপনার সাথে কথা বলার পর হলাম”
“ও তাই বুঝি?”
“হ্যাঁ, ঠিক তাই, এবার বলুন কোথায় কবে দর্শন পাবো?”
“খুব তাড়া মনে হচ্ছে?”
“আরে বাইরে পেশেন্টরা ওয়েট করে আছে..”
“ও সরি সরি, কোথায় করা যায় বলুন তো?”
“আপনি যখন তিস্তা তখন গঙ্গার ধারে দেখা করাই ভালো, মানে আউটরমঘাট”
“গ্রেট আইডিয়া, তাহলে এই রবিবার আউটরমে এই সন্ধ্যা ছটা নাগাদ, আপনার অসুবিধা নেই তো?
“না না ঠিক আছে, রবিবার তো অফ ডে” “একদম ঠিক আছে, তাহলে এবার রাখি?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন, টা টা”
“হ্যাঁ টা টা”
ফোনটা রেখে দিয়ে অরিত্রর মনে একটা শিহরণ বয়ে গেলো, না মেয়েটা খুব সপ্রতিভ, দেখি কথা বলে, বিয়ে তো করতেই হবে। যাকে সে মনের মধ্যে সাজিয়ে রেখেছে, সে তো কোনদিনই তার হবেনা, তাই এই বন্ধন থেকে তাকেও মুক্ত হয়ে আসতে হবে।বনলতা এখন নিজের সংসার নিয়ে ব্যাস্ত, মৃগাঙ্ক অফিস যাবে তার খাবার দাবার গোছাতে রান্নাঘরে তাড়াতাড়ি মাছের ঝোলটা বানাচ্ছে, টিফিনের জন্য ফল কাটছে, স্যান্ডউইচ তৈরি করছে, এই তাড়াহুড়োর সময় আবার মৃগাঙ্কর ডাক দিলো তাকে ঘরে, সবই তো হাতের কাছে গুছিয়ে রেখে এসেছে, আবার ডাকছে কেন কে জানে! সে আবার মা হতে চলেছে, মৃগাঙ্কর আদর ও যত্নে মাঝে মাঝে সে যেন
হাঁপিয়ে ওঠে। সবই করে যায় কিন্তু মনের কোণে প্রথম জীবনের সেই অপমানটা থেকেই গেছে। মৃগাঙ্ক হাজার চেষ্টা করেও তাকে ভাঙতে পারেনি।
ঘরে ঢুকতেই মৃগাঙ্ক তাকে কাছে টেনে নিলো, বনলতা অস্বস্তিতে পরে গেলো, “আরে কি করছো? রান্নাঘরে রান্নার মাসি আছেনা? “
“থাক তাতে আমার কি! সারাদিনের জন্য অফিস যাচ্ছি, এইসময়টা একটু কাছে থাকতে পারোনা?”
“তোমার রান্না টিফিন এগুলো তো সব দেখে দিতে হবে”
“হ্যাঁ, নিজের খাবারটা খেয়েছো তো?”
“হ্যাঁ, খেয়েছি”
“কি খেলে? দু’টো টোস্ট তাই না? চল আমার সাথে বসে এখন একটা ডিম সিদ্ধ খাবে”
“ওরে বাবা এখন আমি পারব না”
“পারব না বললে হবে? তুমি তো জানো এখন তোমার খাওয়ার কত প্রয়োজন? জানি আমি তোমার মনে জায়গা করতে এখনও পারিনি, হয়তো একদিন পারবো, আমি সেদিনের অপেক্ষায় আছি কিন্তু যে আসছে তার কথা ভেবে একটু খাও।’
বনলতার কোমল মনে মৃগাঙ্কর কথাগুলো খুব করুণ শোনালো, সে এগিয়ে এসে স্বামীর বুকে মাথা রেখে বললো, “কে বললো জায়গা করতে পারোনি?”
“সত্যি পেরেছি? মৃগাঙ্ক ওকে সবলে বুকে জড়িয়ে নিয়ে অজস্র আদরের চিহ্ন দিয়ে গেলো ওর কপালে, বুকে, গলায় চিবুকে, নিজের অজান্তেই যেনো বনলতা স্বামীর আদরে আজ শিহরিত হল,
খুব ভালো লাগলো তার, হাত ধরে বলল-“চল খাবে চল।”
পরিকল্পনা অনুযায়ী রবিবার আউটরমে তিস্তা আর অরিত্র একটা খুব আনন্দময় সন্ধ্যা কাটালো। দু’জনেই দু’জনের সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগলো আর সিদ্ধান্ত নিলো তারা একসাথে পথ চলতে পারবে।
তিস্তা সত্যি একটা আনন্দের গতি সে মানুষকে বিস্বাদ থেকে নিমেষেই খুশিতে ভরিয়ে দিতে পারে।
বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেলো, একমাস বাকি।
এরমধ্যে দু’জনে মাঝেমধ্যে দেখা সাক্ষাৎ করতে লাগলো আর ফোনে তো রোজ রাতে প্রায় একঘন্টা ধরে কথা বলে যায়। প্রধান বক্তা তিস্তাই তার ঝরঝরে ঝর্ণার মতন অজস্র কথা অরিত্রর মনকে কোথায় যেন ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
শুধু মনের মধ্যে রাখা সেই ছবিটা যখন মাঝেমধ্যে জেগে ওঠে, অরিত্র নিজেই নিজেকে বলে, “কেন ভুলতে পারিনা তোমায়, কেন তোমার শান্ত দিঘির মতন চোখের দৃষ্টি মনের আয়নায় ভেসে ওঠে, মনটাকে এলোমেলো করে দেয়, যেখানেই থাকো, শুধু ভালে থেকো, তোমায় না ভুলেই আর একজনকে ডেকে এনেছি মনে, তাকেও ভালোবেসেছি, শুধু তুমি থেকে যাবে আমার নিভৃত মনের এককোণে একটা ছোট্ট জায়গা দখল করে, তাই থাকো আর কিছু তো করার নেই আমার”
মৃগাঙ্ক অফিস বেরিয়ে যাবার পর ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করে, বনলতা আনমনা হয়ে জানলা ধরে দাঁড়ায়, আজ মৃগাঙ্কর আদর তার মনকে স্পর্শ করেছে, মানুষ তো ভুল করেই, সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত তো সে আপ্রাণ করছে, তার এই প্রচেষ্টােকে সে সম্মান জানাবে। মৃগাঙ্কর সন্তানের সে মা হতে চলেছে, আগের সন্তান ছেলে ছিলো, যাকে সে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। এবার মৃগাঙ্ক বলেছে, “আমি তোমার মতন শান্ত স্নিগ্ধ মিষ্টি একটা বনলতা চাই।” জানলার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার চলে আসার সময় অরিত্রর নির্নিমেষ দৃষ্টি, যে দৃষ্টিতে ছিলো অনেক না বলা কথা, তারও তো ছিলো অনেক কথা, কেউ কাউকে কিছু বলতে পারেনি, শুধু নীরব সুন্দর একটা অনুভূতি তার মনে এসে বারবার মনটাকে দখল করে বসে। হয়তো অরিত্র এতদিনে বিয়ে করে নিজস্ব সংসার নিয়ে ব্যাস্ত, এরকম কত পেশেন্টই তো তার কাছে যাওয়া আসা করে, কে আর মনে রাখে বনলতা নামে কোন এক বিশেষ পেশেন্টের মনের না বলা অনুভূতির কথা!
তিস্তা আর অরিত্রর বিয়ের দেখতে দেখতে চার বছর কেটে গেলো। সুখী দম্পতি বলতে যা বোঝায় ওরা তাই। ওদের মাঝখানে এখন এক ছোট্ট অরিত্র এসেছে, যার নাম তিস্তা দিয়েছে অভিজয়।
তবু মাঝেমধ্যে যখন রিমঝিম বৃষ্টিতে অরিত্রর ঘুম ভেঙে যায়, মনের কোণে ভেসে ওঠে সেই স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি, নিজের মনেই কবিতা বলে, “যেতে যেতে কেন তাকালে ফিরে, কি বলতে চেয়েছিলে সেদিন, না বলেই গেলে চলে।”
তিস্তার স্পর্শে তার চেতনা ভাঙে, নিজের মনের ভাবনাকে দূরে ঠেলে দিয়ে তিস্তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলে, “কাজের ভিড়ে তোমাদের তেমন করে সময় দিতে পারিনা, চল একটু পাহাড়ের দিকে বেড়িয়ে আসি।”
তিস্তা তো এককথায় রাজি, বলে “তুমি ব্যাবস্থা কর আমি সব গুছিয়ে নিচ্ছি।”
মৃগাঙ্ক সেদিন অফিস থেকে ফিরে বনলতাকে কাছে টেনে বলে, “আজ তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে, বনলতার অবাক মুখের দিকে চেয়ে অরিত্র বলে, বেড়াতে যাবো আমরা সিকিমের দিকে, তোমার পছন্দ তো?” ছেলে মানুষের মতন ঘাড় দুলিয়ে তিস্তা বলে, “হ্যাঁ, খুব পছন্দ, কবে যাবো?”
“সামনের রোববার রওনা হব। তোমাদের গরমজামা সব ঠিকঠাক আছে তো? না হলে চল তোমার আর কথার কিছু গরমজামা কিনে নিই”
“না আমার সব আছে, কথার জন্য কিছু নিতে হবে।” কথা ওদের সন্তান, চার বছরের ফুটফুটে মেয়ে, পুরো নাম কথাকলি।
বেরিয়ে পরে ওরা সিকিমের উদ্দেশ্যে।
সিকিমে খুব আনন্দ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৃগাঙ্ক, বনলতা আর ছোট্ট কথাকলি। অনর্গল কথা বলে যায় বলে ওর নাম দেওয়া হয়েছে কথাকলি। ওর মিষ্টি মিষ্টি কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে ওর বাবা মা।
মৃগাঙ্ক অনেকদিন পর বনলতাকে এতো হাসতে দেখে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, “তোমার ভালো লাগছে তো বনো? “
বনলতা চোখ বুৃৃঁজে উত্তর দিল, “ভীষণ ভালো লাগছে”
“তাহলে, একটা…”
“এই মেয়ে আছে না!”
“ও তো এগিয়ে গেছে,” এই বলে আর দেরি না করে মৃগাঙ্ক একটা গাঢ় চুম্বন দেয় বনলতার ঠোঁটে।
যথারীতি কথা দেখে ফেলে আর বলে, “এ বাবা তুমি আমার মতন মাম্মাকেও কিসি দাও?”
অপ্রস্তুত মৃগাঙ্ক তাড়াতাড়ি বলে, “না না তোমার মাম্মার ঠেঁটটা একটু লেগেছিল তাই দেখছিলাম “
বনলতা কপট রাগ দেখিয়ে বলে, “দেখলে তো?”
“তা কি করবো বলো, এমন রোমান্টিক জায়গায় একটু রোমান্স করবনা! তা কি হয়?”
অরিত্র ছেলেকে নিয়ে পাহাড়ের কোলে সূর্য ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখছে, আকাশটা পুরো হলুদ আর কমলা রঙে মেশানো এক অদ্ভুত সুন্দর রূপ নিয়েছে। পাহাড়ের কোল বেয়ে নেমে আসছে তিরতির করে এক নাম না চঞ্চল ঝর্ণা। তিস্তা সেদিন হলুদ আর কমলা মেশানো এক সুন্দর পোশাক পড়েছে, ভারি সুন্দর লাগছে ওকে দেখতে।
অরিত্র একহাতে তিস্তাকে গভীর আবেগে কাছে টেনে নিয়ে বললো, “আকাশটাও আজ তোমার রঙে সেজেছ” তিস্তা বললো, “তুমি একটু ভুল বললে, আমি আকাশের রঙে সেজেছি “।
অরিত্র বললো “আর ঝর্ণাটাকে দেখো তোমার মতন চঞ্চল গতিতে তিরতির করে নেমে আসছে,” তিস্তা হেসে অরিত্রকেও তার হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
দূর থেকে মৃগাঙ্ক দেখলো তাদের মতন এক দম্পতি সূর্যাস্তের সৌন্দর্যে মগ্ন হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে একদৃষ্টিতে সেই অপরূপ দৃশ্যের রস গ্রহণ করছে।
মৃগাঙ্ক বনলতাকে বললো, দেখতো ওরা কেমন ছেলে নিয়েও দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে আছে”
বনলতা বললো, “ওদের ছেলেটা আর একটু ছোটো, আর তোমার মেয়ের মতন হয়তো বিশ্বপাকা নয়”
“তা বলে এমন রোমান্টিক জায়গায় তোমাকে একটু আদর করবো না! আর তুমি তো কখনোই ওর মতন আমাকে জড়িয়ে ধরবেনা !”
বনলতা এগিয়ে এসে মৃগাঙ্কর কোমর জড়িয়ে ধরলো, “মৃগাঙ্ক অভিমান করে বললো, থাক জোর করে করতে হবে না”
বনলতা মৃগাঙ্ককে বললো, “তোমার কানটা একটু আমার কাছে নামিয়ে আনো”
“কেন কান ধরবে না কি?”
“আরে একটু নামাও না”
মৃগাঙ্ক কান নামিয়ে আনতেই বনলতা ওর কানে একটা কুটুস করে কামড় দিয়ে বলল, “রাত এখনও অনেক বাকি “
এবার মৃগাঙ্কর মুখ হাসিতে ভরে গিয়ে বনলতাকে প্রায় কোলে তুলে নিয়ে বললো, “না আমার বউটা দেখছি সত্যি খুব রোমান্টিক।”
হাঁটতে হাঁটতে ওরা প্রায় যখন ওদের কাছে এসে পড়েছে তখন মৃগাঙ্ক বলল, ” আরে দাঁড়াও দাঁড়াও এতো দেখছি ডাঃ অরিত্র সেন, যার চিকিৎসায় তুমি ভালো হয়েছিলে”
বনলতা একমুহূর্ত থমকে দাঁড়ালো, তারপর বললো, “থাক ওদের আর বিরক্ত করো না, ওরা এখন নিজেদের মধ্যে একটু আনন্দ করছে, ছেড়ে দাও”
“কেন বনো, কতদিন পর দেখা হলো একবার কথা বলবেনা? আমি জানি চিকিৎসার সময় তোমরা দু’জন দু’জনের প্রতি দুর্বল হয়েছিলে, হয়তো কেউ কাউকে কিছু বলতে পারোনি, কিন্তু তোমার মনের কোণে এখনও ওর জন্য একটু জায়গা আছে তা আমি বুঝতে পারি, কথা বলো না একবার, কি এমন ক্ষতি হবে তাতে? আমি জানি তুমি এখন আমাকেই ভালোবাসো, তবু কারুর জন্যে যদি একটু জায়গা থাকে, তাতে তো কোন অপরাধ নেই’
বনলতা আরও কাছে এসে স্বামীকে সব ভুলে গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বললো, “তুমি এতো উদার, আজ আমি এক নতুন তোমাকে আবিস্কার করলাম, এতদিন হয়তো ছিলো, কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তা মিলিয়ে গেলো।”
মৃগাঙ্ক অরিত্রর কাছে এসে বললো, “একটু বিরক্ত করলাম,”
অরিত্র ঘুরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো, ওর চোখ চলে নিজের অজান্তেই বনলতার দিকে!
মৃগাঙ্ক আবারও বললো,”চিনতে পারছেন? আমার স্ত্রী বনলতা দীর্ঘদিন আপনার চিকিৎসায় থেকে সুস্থ হয়েছে, তাই আপনার কাছে আমি আজও কৃতজ্ঞ।”
হেসে অরিত্র বলল, “না না এতে কৃতজ্ঞতার কিছু নেই, এতো আমার কাজ – আলাপ করিয়ে দিই – আমার স্ত্রী তিস্তা আর আমাদের ছেলে অভিজয়।”
পরস্পর ভদ্রতা বিনিময়ের পরে মৃগাঙ্কই বললো, “চলুন না এতোকাল পর যখন দেখাই হলো তখন একটু বসে চা খাওয়া যাক..”
তিস্তা তাড়াতাড়ি বলে উঠলো – “হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, অনেকক্ষণ থেকেই মনটা চা চা করছিল, চলুন যাওয়া যাক।” তারপর কথার দিকে চেয়ে বললো – “এই বুঝি আপনাদের মেয়ে! কি নাম তোমার ?”
কথা তরতর করে বলে গেলো, “আমি তো ভীষণ কথা বলি তাই মা আমার নাম কথাকলি রেখেছে”।
কিছু দূর এগিয়ে একটা গুমটি মতন চা খাওয়ার স্টল সাথে সিঙারাও ভাজা হচ্ছে, আবার মোমো আছে।
ওরা সবাই চা সিঙারা খেতে খেতে গল্পে মশগুল হয়ে গেলো, বাচ্চাদের মোমো দেওয়া হলো।
চা খাওয়ার শেষে মৃগাঙ্ক তিস্তার সাথে কথা বলতে বলতে বাচ্চাদের নিয়ে যেন ইচ্ছে করেই একটু এগিয়ে গেলো, পেছনে আসতে আসতে হাঁটতে লাগলো অরিত্র আর বনলতা।
ভেবে পারছিলনা কি কথা বলবে- শেষে অরিত্র বললো- “এখন সব ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ, এখন ঠিক আছে, তবে অনেকদিন পর্যন্ত সব পাওয়ার মধ্যে একটা নীরব দৃষ্টি আমার মনে ভেসে উঠতো, যে দৃষ্টি যেন কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু বলতে পারেনি।
আর আপনার?”
“আমারও একটা শান্ত স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি মনের আয়নায় উঁকি দিতো, যে যাবার সময় ফিরে তাকালো কিন্তু কিছু না বলেই চলে গেলো।
এখন তো আমরা দু’জনেই খুশি সংসারের আবর্তনে! কি তাইতো?”
“হ্যাঁ, মৃগাঙ্কর উদারতা আর অকৃত্রিম প্রেম আমায় ভরিয়ে দিয়েছে তবু মনের একটা ছোট্ট জায়গা একজনের দৃষ্টিটা রয়ে গেছে, থাকনা যেমন আছে, জোর করে তাকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করিনা বরং সযত্নে রেখে দিই।”
অরিত্র পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে বনলতার দিকে তাকালো, তারপর বললো- তিস্তার খরস্রোতা ভালোবাসায় আমিও ভেসে যাই। তবু আমারও মাঝে মাঝে শ্রাবণের অঝোরে বৃষ্টি ধারার সাথে ফিরে আসে সেই শান্ত স্নিগ্ধ মুখটা যাকে চেষ্টা করেও ভোলা যায়না। আমারও মনে হয়, থাকনা মনের স্মৃতি কোঠায় একটা ছোট্ট স্মৃতি।”
আসতে আসতে সন্ধ্যা নেমে এলো। যে যার পথে চলে গেলো অতীতকে পিছনে ফেলে বর্তমানের হাত ধরে।
সে রাতে অনেকক্ষণ অরিত্র যেন ইচ্ছে করেই তিস্তার সাথে রোমান্টিক মুহূর্ত কাটালো, হয়তো কিছু ভোলার জন্য, কিন্তু একথাও স্বীকার না করে পারলোনা যে তিস্তাকে সে খুউব ভালোবাসে।
মৃগাঙ্কর বাহুবন্ধনে বনলতাও আজ নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে ছেড়ে দিল, সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে উপভোগ করতে লাগলো মৃগাঙ্কর ভালোবাসা। আজ তারও মনে হলো একদিন মৃগাঙ্ক যত ভুলই করুক না কেন আজ সে বনলতাকে নিজের সবটুকু উজাড় করে দেয়।
তিস্তা আর অভিজয় ঘুমিয়ে পড়ার পর অরিত্র একটা সিগারেট ধরিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো- একটু পরে ঘরে গিয়ে নিজের একান্ত ব্যাক্তিগত ডায়েরিটা নিয়ে এসে একটা কবিতা লিখলো–
“তোমার আমার পথ গেছে বেঁকে
ভালোবাসা তবুও গেছে থেকে
জীবনের কোনো এক অজানা অদৃশ্য বাঁকে।
যেতে যেতে ফিরে একবার তাকালে,
কিছু না বলেই গেলে চলে।”