-
সেদিন ছিল পঁচিশে বৈশাখ
সেদিন ছিল ২৫শে বৈশাখ
-পারমিতা চ্যাটার্জী
বেশি কিছু চাইনা তোমার থেকে
শুধু একটা সুন্দর সকাল উপহার দেবে আমায়?
রোজ সকালে খবরের কাগজের পাতায় কি যে পড়ে যাও বুঝি না–
কখনও তো বলনা, ” এই চায়ের কাপটা নিয়ে একটু বোস আমার কাছে–
কখনও তো বল না তোমার গাছের ফুলগুলো বড় সুন্দর–
আমি তো এইটুকুই শুনতে চাই শুধু–
মুখ গম্ভীর করে কাগজের পাতা থেকে মুখ না তুলেই চায়ের কাপটা হাতে তুলে নাও–
তারপর শুধু বল তাড়াতাড়ি বেড়োতে হবে আমায় — অনেক কাজ পরে আছে অফিসে —
আর হ্যাঁ লাঞ্চটাও একটু বেশি দিও — আমার জিনিস গুলো সব গুছিয়ে সামনে রেখো-
শুধু হুকুমের সুরে কথা বলে যেতে তুমি ক্লান্ত হয়ে যাওনা?
আমার দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ তোমার কানে পৌঁছোয় না–
আমি প্রতিদিন একটু একটু করে হতাশায় ডুবে যাই–
— হারিয়ে যায় আমার প্রতিদিনের সকাল-
বিকেলের স্নিগ্ধ গোধূলি আসতে আসতে মিলিয়ে যায় নীল আকাশের বুকে–
নেমে আসে সন্ধ্যা, আকাশের বুকে ফুটে ওঠে অসংখ্য তারা–
আমি সেই তারার মাঝে খুঁজে চলি হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নদের —
হঠাত্ চমকে উঠি টিভিতে রাজনৈতিক নেতাদের ঝগড়ার আওয়াজে —
বুঝতে পারি তুমি এসে গেছ—-
আমায় দেখে বললে চা হয়েছে না কি?
ম্লান হেসে উত্তর দিলাম– হয়ে গেছে দিচ্ছি–।
গতবার ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের ছবিটা মালা দিয়ে সাজিয়ে ছিলাম, সামনে কাঁসার রেকাবে রেখেছিলাম একমুঠো চাঁপাফুল–
ঘরটা ফুলের গন্ধে ভরে আছে সেই সাথে ভরে আছে আমার প্রাণটাও, আজ যে আমার জীবনের পরম বন্ধুর জন্মদিন—
মনে মনে গাইলাম –“তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম”।
নিজেকেও সাজিয়েছিলাম একটু নতুন সাজে–
তুমি ঘরে ঢুকেই বললে বাহ্ সুন্দর ফুলের গন্ধে ঘরটা ভরে আছে তো?
আমি মৃদুসুরে বললাম– আজ ২৫শে বৈশাখ–
— তুমি দায়সারা ভাবে বললে, ও তা ভালো করেছ– অনেকদিন রবীন্দ্রসংগীত শোনা হয়না– আজ আমার অফিসের এক কলিগ শর্মিষ্ঠা নামে খুব সুন্দর গাইল রবীন্দ্রসংগীত মনটা যেন ভরে গেল– ও চা দেবেতো না কি–
রান্নাঘরে গিয়ে চা বানাতে বানাতে চোখদুটো নিজের অজান্তে ঝাপসা হয়ে গেল– আমার তানপুরাটায় ধূলো জমে গেছে— কার জন্য গাইব? গান শোনার লোকটাই তো বেসুরো, সে অন্য লোকের সুরে মুগ্ধ হয় আমার গান শোনার সময় হয়না–।
চায়ের কাপটা তোমার হাতে দিতে তুমি একটা চুমুক দিয়ে বললে বাহ্ খুব ভালে চা টা — কোন পাতাটার করলে গো?
আমি উদাস উত্তর দিলাম –যে পাতায় রোজ করি-
আমি আমার নিজের ঘরে ফিরে এলাম– কানে আসছিল — টিভির তীব্র শব্দ, রাজনৈতিক নেতাদের একঘেয়ে কচকচানি —
আমি দরজাটা ভিজিয়ে এলাম–
ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল— মনের দরজাটা ভেজাতে পারবি কি?
না সত্যি তা পারবনা–
— তবে শুধু শুধু ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজেকে আড়াল করে লাভ কি? এই তোর ঘর এই নিয়েই থাকতে হবে– যেটুকু পেলি ওইযে বলল চা টা ভালো হয়েছে, ওইটুকুই তোর পাওনা– এর চেয়ে বেশি আশা করলে নিরাশা আরও বাড়বে–
আমি তবুও একচিলতে জানলার ফাঁক দিয়ে আকাশটাকে দেখতে চেষ্টা করলাম– মনে হল আমার আকাশটা অনেক অনেক দূরে চলে গেছে–
তবু গুণগুণ করে গেয়ে উঠলাম বহুদিন পর–” যখন জমবে ধূলা তানপুরাটার তারগুলায়, তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে, তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে”। কানে এলো — কি গো খেতে দেবে না কি?
আমার সুরটা কেটে গেল–। -
আগুন জ্বালো
আগুন জ্বালো
-পারমিতা চ্যাটার্জীখেলব নাকি আগুন নিয়ে খেলব না কি একটু –
চতুর্দিকে জ্বলছে শুধু আগুন –
এ আগুন কি নিভবে শুধু জলে-?
এ আগুন নেভাতে গেলে খেলতে হবে আগুন নিয়ে–
ঘর জ্বলছে, জ্বলছে পথ, জ্বলছে প্রতি দেশের কোণ–।
হাসপাতালে শিশুর মৃত্যু ডাক্তারের লোভের আগুন–
ঘরের গৃহবধু মরছে অত্যাচার আর লাঞ্ছনার আগুন–
ঝোপের আড়ালে নারীর লজ্জা পুড়ছে কামনা আর লালসার আগুন —
মায়ের কোল খালি হচ্ছে মিথ্যা হানাহানির আগুন-
চতুর্দিকের হিংসার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে মানব চেতনা–
হিংসা আর হানাহানির আগুনে পুড়ে যাচ্ছে নিত্য প্রাণ–
কোথায় তবে শান্তির জল? কে নেভাবে এই আগুন-?
দেখিনা ভাই আগুন নিয়ে খেলে একটু — নেভে কিনা সমাজের আগুন–?
ধর্ষকদের চোখে জ্বালি না জ্বলন্ত একটা রংমশালের আগুন —
অত্যাচারী পুরুষের গায়ে দি না কেরোসিন ঢেলে–
দেখ না কেমন লাগে?
প্রাণঘাতী ওই ডাক্তার গুলোর গায়ে দি না ছুঁড়ে জ্বলন্ত দেশলাইয়ের একটি কাঠি–
তবে যদি প্রাণে বাঁচে অসহায় রোগীর –
তবে যদি কান্না থামে সন্তান হারা জননীর-
আগুন দিয়েই নেভাতে হবে সর্বত্র জ্বলন্ত আগুন –।
এই তো সেই ভারতবর্ষ – যে মাটিতে জন্মেছিলেন বীর সুভাষ আর সূর্য সেন–
এ তো সেই মাতৃভূমি যেখানে হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় দিয়েছেন ক্ষুদিরাম–
আজও তো গান গাই আমরা বন্দে মাতারম–
আজ কোথায় ক্ষুদিরাম?
কোথায় বীর সুভাষ? কোথায় সূর্য সেন?
ফাঁসির দড়ির বদলে আজ যুবক নারীর রক্ত খায়–
পরাধীন ভারতের রক্তপাত এখন স্বাধীন ভারতে হয়–
বীর সন্তানের সন্তান হারা জননীরা কাঁদতেন পুত্রের বীরত্বের গর্বে–
স্বাধীন ভারতের জননী কাঁদেন অপরাধী সন্তানের লজ্জায় —
কেন এই আগুন চতুর্দিকে?
আছে কি কোন উত্তর?
সুভাষ একদিন বলেছিলেন, ” তোমরা আমায় রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব”–
আজ আমরা গাই কবিগুরুর গান– অন্য মানে নিয়ে- ” ব্যার্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো”- -
ইন্দুর অষ্টমী
ইন্দুর অষ্টমী
-পারমিতা চ্যাটার্জীআজ এতদিন পর ইন্দুর মনে হল তার এবারের দূর্গাপুজাটা সার্থক হল। বিয়ে হয়েছে দু’বছর। স্বামী মলয় এমনিতে ভালোই, কিন্তু তার উদাসীনতা ইন্দুকে খুব কষ্ট দিত। মাইনে পেয়ে পুরো টাকাটা মা বাবার হাতে তুলে দিত।তাকে বলেছিল প্রথম রাতেই যে যা প্রয়োজন মায়ের কাছে বলতে। ইন্দু অবাক হয়েছিল এই কথা শুনে কিন্তু কোন প্রতিবাদ করেনি।
তার এই নিশ্চুপ মনোভাবে মলয় বরং আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল, তোমার কিছু বলার নেই?ইন্দু নিঃশব্দে মাথা নেড়ে বলেছিল,’ প্রথম রাতেই দেওয়া নেওয়ায় কথা বলে আমি রাতটা নষ্ট করতে চাই না।’
ও, বলে মলয় চুপ করে গিয়েছিল। তারপর রাতটা ভালোই কেটেছিল।
কিন্তু প্রতিদিন সংসারের নানারকম কাজে শাশুড়ির মন্তব্যে সে অস্থির হয়ে উঠত। তার কোন কাজেই শাশুড়ি খুশি হতে পারেন না।
সে মাসে একবার কি দুবার বাপেরবড়ি যেতে চাইলেও শাশুড়ি নানারকম ছলে তাকে আটকে দিতেন। কিন্তু তাঁর নিজের মেয়ে প্রত্যেক শনি রবি নিয়ম করে বাপেরবড়ি আসত। তখন সারাদিনের পরিশ্রমে সে ক্লান্ত হয়ে পরতো, রাতে তার তপ্ত চোখের জলে বালিশ ভিজে যায়। তার নির্লিপ্ত স্বামী বলে কেঁদে কোন কিছুর সমাধান হয় না।
অভিমানে ইন্দু কেন উত্তর দেয়না।
প্রথম পুজোয় তার ননদ প্রায় পুরো পুজোটাই বাপেরবড়ি কাটায়, ইন্দু একদিনের জন্য বাপেরবড়ি যাওয়ায় বা কোথাও ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি পায়না।এমন কি বোনাসের টাকা মলয় তার মায়ের হাতেই তুলে দেয়।ইন্দুর ভাগ্যে জোটে একটা সাধারণ মানের তাঁতের শাড়ি। তার ননদকে দেওয়া হয় কাঞ্জিভরম, শাশুড়ি নিজেও কেনেন দামী তসর। তখন থেকেই ওর মনে একটা প্রতিবাদের ঝড় উঠতে থাকে। তার বাপেরবড়ি থেকে ইন্দু এবং সবার জন্যেই তার বাবা মা নিয়ে আসে অত্যন্ত দামী সব শাড়ি নিয়ে, তার দাদা দিদিারাও দিয়ে যায় তাদের ভালো ভালো শাড়ি। সে কাউকে কিছু দিতে পারেনা, হীনমন্যতায় ভোগে।
দ্বিতীয় পুজোর অষ্টমীর সকালে ইন্দুর মা তাকে বিশেষ ভাবে আসতে বলে দেন। ওইদিন তার বাপেরবড়িতে বরাবর করুণাময়ীর কালি মন্দির থেকে ভোগ আনা হয়। অনেকেই আসেন ওই দিন ওর বাপেরবড়ি। ইন্দু সেদিন সকালবেলা বেশ জোরের সাথে সবার সামনে এসে বলে আজ আমি যাব। শাশুড়ি হুঙ্কার ছাড়েন, যাবো মানে? যাবো বললেই হল নাকি? জানোনা তোমার দিদিভাই পুজোর কটাদিন এখানে থাকে। তাছাড়া জামাই আছে, কত কাজ, আর তুমি বলছ যাবো!
ইন্দু আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকালো ।শাশুড়ি বললেন ওদিকে তাকিয়ে কোন লাভ হবেনা ও মায়ের বাধ্য ছেলে, মায়ের কথার অবাধ্য হতে ও শেখেনি।
ইন্দু হঠাৎ বলে উঠল, আমি তো আপনাদের আলোচনার সময় শুনেছিলাম জামাইবাবুর মা নাকি এবার একটা দিনের জন্য অন্তত বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। তাঁদের আত্মীয়স্বজন আসবে, দিদিভাইয়ের জেদের জন্যে উনি মায়ের কথা রাখতে পারেননি। আপনিও তার সাথে তাল দিয়ে বললেন, পুজোর সময় মেয়ে বাপেরবড়ি আসবে এটাই স্বভাবিক; তোমার মা এমন অন্যায় আব্দার করেন কি করে?
তাই আমিও ভাবছিলাম, জামাইবাবু কি করে মায়ের অবাধ্য হয়ে বউ নিয়ে চলে এলেন। উনিও তো তাহলে মায়ের খুব অবাধ্য!
আপনার ছেলে না যাক, আমি এবার যাবোই।
মলয় এতক্ষণ চুপ করে কাগজ পড়ছিল। সে কাগজটা হঠাৎ টেবিলের ওপর রেখে বলে উঠল, ‘সাবাশ ইন্দু,আমি এতদিন এই দিনটার অপেক্ষা করছিলাম কবে তুমি নিজের প্রতিবাদ নিজেই করবে। এতদিনে তুমি আমার মনের মতো কাজ করেছ। নাও তৈরী হয়ে নাও আমিই যাবো তোমাকে নিয়ে, সব অন্যায় সহ্য করে নেওয়া কোন কাজের কথা নয়। আর নিজের প্রতিবাদটা নিজেকেই করতে হয়, তোমার হয়ে আমি করলে আমার অবর্তমানে তোমার অপমান বাড়তো বই কম তো না।আর দেরী নয় চল।’
ইন্দু অবাক হয়ে তাকালো স্বামীর দিকে।অবাক হলেন তার বাবা, মা, দিদি, সবাই। শুধু জামাইবাবু মিটিমিটি হেসে বললেন,’আমিও তোমাকে সাধুবাদ জানাই ইন্দু।আর মলয় তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেল। এতদিন ভাবতাম তুমি আমার মতোই একজন মেরুদণ্ডহীন। কিন্তু আজ তুমি প্রমাণ করলে তোমার মধ্যে লুকিয়ে আছে আর একটা তুমি– যে প্রতিবাদ চায়।’
একটু পরে মলয়ের পছন্দ মতো সেজেগুজে ইন্দু মলয়ের হাত ধরে বেড়িয়ে গেল। শাশুড়ি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, তিনি হেরে গেলেন।আজ তারই আত্মজর কাছেে। জামাই বলল, ‘মা অধিকারবোধ দেখিয়ে জেতা যায়না, ভালোবাসা দিয়ে জিতে নিতে হয়। আপনি বা আপনার মেয়ে সেটা শেখেনই নি।’ মলয়ের গাড়ি নিউমার্কেটের দিকে ছুটছিল।
ইন্দু বলল,এদিকে কেন?
বাহ্ খালি হাতে যাবে নাকি? আজ তুমি প্রাণভরে কেনাকাটা কর। শুধু তোমার শাড়িটা আমি কিনব আমার পছন্দ মতো।
ইন্দু মুখ নীচু করে বলল– তুমি কিন্তু বেশ দুষ্টু আছো।
তাই বুঝি?
তাহলে আজ রাতে দুষ্টুমিটা কিন্তু একটু বেশি হবে বলে দিলাম।
-ইন্দু মলয়ের কাঁধে মাথা রেখে বলল, তোমার যা ইচ্ছে। আমার পুজোর আনন্দ আজ তুমি সার্থক করলে। দূর্গা মায়ের এই বিশাল ঘরে অনেক দূর্গারা নীরবে কেঁদে চলে। আজ অন্তত একজন দূর্গা চোখের জল মুছে হেসে উঠেছে, সে হচ্ছে আমি।। -
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন দিনে তারে বলা যায়
-পারমিতা চ্যাটার্জীএকদিন সমুদ্র সৈকতে সে আর আমি বসে ছিলাম বালিতে। একটার পর একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরে আবার ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে।
দিনের আলো ক্রমশ নিভে আসছে, দুটো গাংচিল নিজেদের মধ্যে খেলা করে চলেছে। পশ্চিম পারে সূর্যটা হঠাৎ ডুবে গেল যেন ।
একটু পরে আকাশ জুড়ে চাঁদ উঠতে লাগল– সেদিন ছিল পূর্ণিমা।
আমি তাকে বললাম — ঢেউগুলো সব ভেঙে যাচ্ছে। আবার নতুন ঢেউ এসে আছরে পড়ছে । আমাদের ভালোবাসার সমুদ্রে যদি আজকের ঢেউটা ভেঙে গিয়ে আবার নতুন ঢেউ ওঠে ?
আমার কথায় সে হেসে উঠল — কি যে বল তুমি তার কোন ঠিকানা নেই।
রাত্রি আরও ঘন হল, পূর্ণিমায় জোয়ার উছলে উঠল।
আমি বললাম– এখন পূর্ণিমা তাই এত জোয়ার । আমাদের জীবনেও এখন পূর্ণিমা চলছে তাই না ?
সে আবার হেসে উঠে বলল– আমার পাগলীর দেখছি মাথাটা একদমই গেছে ।
তারপর সে চলে গেল সাত সমুদ্র পার হয়ে বিদেশে। আর আমি পড়ে রইলাম একা । কত পূর্ণিমা আসে যায় ! না সে আর ফিরে আসেনি। অথচ যাবার সময় চোখের জল মুছিয়ে আমায় প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিল আমি তোমার কাছেই ফিরে আসব।
আমি সেই প্রতিশ্রুতি বুকে নিয়ে বসে মনে মনে সাগরের ঢেউ গুণে গেছি। তারপর একদিন খবর পেলাম সে বিয়ে করে সংসার করছে এক বিদেশিনীর সাথে – বিয়ের পর তারা কলকাতায় এসে ঘুরেও গেছে।
দিন তো আর বসে থাকেনা সে চলে যায় তার নিয়মের বন্ধনে। সেই বন্ধনের আবর্তনে আমার দিনগুলিও গড়িয়ে চলল। তারপর আমারও একদিন বিয়ে হল গৌরব নামে এক যুবকের সাথে। মনে প্রচুর দ্বন্দ নিয়ে তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাম।
গৌরব এক অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ– সে কি করে যেন আমার মনের ভাষা পড়ে ফেলল। প্রথম মিলন রাতে সে যখন আমার পাশে এসে বসল। আমি কেঁপে উঠলাম এক অজানা ভয়ে। কিন্তু গৌরব নির্বিকার ভাবে বলল– ভয়ের কিছু নেই ! ভালোবাসায় জোরও খাটেনা , যেদিন মনের এই দ্বন্দ্ব কাটিয়ে আমার কাছে আসবে আমি শুধু সেদিনের জন্য অপেক্ষায় থাকব।
আমি অবাক হয়ে ওকে বললাম– এমন মানুষ তো আমি দেখিনি কখনও যে নিজের অধিকার এমন ভাবে ছেড়ে দেয়। আমার শ্রদ্ধা হল আপনার এই কথায়।
গৌরব তেমনি নির্বিকার ভাবে বলল– অধিকার দিয়ে কি ভালোবাসা পাওয়া যায় ? আমি ভালোবাসায় বিশ্বাসী অধিকারবোধে নয়। এই বলে সে বালিশ আর চাদর নিয়ে নীচে শুতে যাচ্ছিল, আমি কাঁপা গলায় বললাম — নীচে কেন ? খাটে শুতে আপত্তি আছে?
সে বলল– তোমার অসুবিধা হবে না?
আমি খুব দৃঢ় গলায় বললাম–না ! অতটা স্বার্থপর আমি নই।
এরপর দিন চলতে লাগল ।শহর থেকে দূরে পুরুলিয়ায় তার কর্মস্থল । বিয়ের কিছুদিন পর আমরা চলে গেলাম সেই জায়গায় , সুন্দর একটা বাংলা ওকে দেওয়া হয়েছিল আমাদের থাকার জন্য। জায়গা এবং বাসস্থান দেখে আমার মুখ থেকে আপনা আপনি বেড়িয়ে এলো বাঃ কি সুন্দর !
-তোমার পছন্দ?
– আমি বললাম খুব পছন্দ হয়েছে।শুধু বলতে পারলাম না আমার সেই শ্রদ্ধার মানুষটি কখন যেন আমার অজান্তে আমার মনটাকে দখল করে বসে আছে।
গৌরবের আসতে একদিন দেরী হচ্ছিল । আমি ঘর বার করছিলাম কি যেন এক চঞ্চলতায় আমায় পেয়ে বসেছিল -কেন এত দেরী করছে? জানেনা কি আমি এসময়টা ওর জন্য অপেক্ষা করি!আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গৌরবের অফিসের গাড়ী এসে থামল আমাদের বাংলোর গেটে । গৌরব নামতেই আমার গলায় যেন একরাশ অভিমান ঝরে পড়ল – এত দেরী? আমি কখন থেকে তোমার জন্য ঘরবার করছি। নিজের অজান্তে কখন যে আপনিটা তুমি হয়ে গেছে জানিনা! বোধহয় সেইদিন প্রথম ওকে তুমি বললাম। ওই যে আগে বলেছিলাম — গৌরব মনের ভাষা পড়তে পারে! খুব সুন্দর একটা স্নিগ্ধ হাসি মুখে ছড়িয়ে দিয়ে বলল– তুমি অপেক্ষা করছিলে? আমি এখনি ফ্রেস হয়ে আসছি।
আমি বললাম -আজ বগানে চা খাবে ?
ও তেমনি মিষ্টি অথচ সংযত হাসি মুখে লাগিয়ে বলল– মন্দ কি?
আমি বাগানের চেয়ারে সুন্দর করে চায়ের পট সাজিয়ে আনলাম তার সাথে নিজের বানানো কেক্ ।
একটু পরে গৌরব কেকের টুকরোটা মুখে দিয়ে বলল- বাহ্ কি অপূর্ব কেক কোথায় পেলে?
আমি তেমনি অভিমানী গলায় বললাম – কোথায় আবার পাবো আমি বানিয়েছি।
ও উচ্ছসিত হয়ে বলল- সেইজন্যেই এত সুন্দর , তোমার হাতের ছোঁয়া আছে যে।
এই প্রথম ওর মুখে নিজের প্রশংসা শুনে আমারও মুখটা আনন্দে কেঁপে উঠল।
তখন শ্রাবণ মাস এসে গেছে। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি ঝরে পড়ছে , আমি ভুলে গেছি অতীতের সেই প্রতিশ্রুতিহীন ভালোবাসাকে। এখন আমি অপেক্ষায় থাকি গৌরবের কখন সে ফিরবে অফিস থেকে। আমি নিত্যনতুন জলখাবার বানিয়ে রাখি তার জন্য। গৌরবের মুখে প্রতিদিনের প্রশংসায় যেন ভালোবাসাকে খুঁজে পেতে লাগলাম। মনে মনে বললাম — সবই তো বুঝতে পারো তবু কেন কাছে আসো না?
একদিন কি খেয়াল হল শ্রাবণের বর্ষায় বাগানে দাঁড়িয়ে খুব ভিজলাম , বিকেল থেকে এলো আমার তুমুল জ্বর কোন জ্ঞান নেই , যখন জ্ঞান ফিরল তখন দেখি উৎকণ্ঠিত মুখে গৌরব আমার কপালে জলপটি দিয়ে যাচ্ছে। আমাকে চোখ মেলতে দেখে বলল– কি করে বাঁধালে এমন জ্বর ? ডাক্তার এসে ইনজেকশন দিয়ে গেল তাও কোন হুস নেই ? ভয়ে তো আমার বুক শুকিয়ে গিয়েছিল। আমি ওর দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হেসে বললাম- যমের সাধ্য কি এমন স্বামীর কাছ থেকে আমায় ছিনিয়ে নেবে।তারপর এতদিনের সংযম ভেঙে কোনরকমে উঠে বসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললাম–” এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘন ঘোর বরিষায়। এমন দিনে মন খোলা যায়– বাইরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি, যেন থামার কোন লক্ষণ নেই– আর ভেতরে আমি গৌরবের গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ।