• কবিতা

    অনামিকা

    অনামিকা
    -পার্থসারথি ঘোষাল

     

    ফিকে হয়ে আসা অস্তালোকে তোমার রেশমী চুলের ঘ্রাণে আসে বসন্ত —-অকালবোধন।
    তোমার বক্ষলালিত্যে অতল সাগর আর কোমল সজল চাহনিতে দেখেছিলেম লক্ষ আশার ঢেউ—-থর থর কেঁপে ওঠা উরু যুগলে ছিলনা ছলনা,ছিলো শুধু অনন্ত আদর– যত্নে,অতি যত্নে রক্ষিত।জানি যুগ যুগ ধরে তুমি অভিসার পটীয়সী প্রিয়া।
    তোমার সুকোমল বাহুযুগলে আছে এক প্রশস্ত উন্মুক্ততা—ভলগার স্পর্শ পাই সেখানে যেন।
    তোমার সুঢৌল নিতম্বে দেখি অন্য কোনো অজানা গ্রহের উপস্থিতি –স্থির এবং স্পষ্ট।
    মাঝে মাঝে মনে হয় নারীর আকারে তুমি পুরুষ অপেক্ষাও শক্তিশালী ও সুন্দর।
    তাই তোমাকে লিঙ্গাতীতা বলি।
    তোমার ভাবাবেশে ষড়ঋতুর আনাগোনা–প্রকৃতির আদ্য-মধ্য-অন্তও তুমিই।
    তুমি সৃষ্টিবিলাসের স্বপ্নে যখন মোহগ্রস্তা থাকো —-তোমাকে ঘিরে থাকে তখন এক ত্রিভূবন বিজয়িনী মায়া যা তোমার প্রকৃত রূপ গোপন করে রাখে।
    তোমার চরণযুগলে অলক্তক রেখায় এক সন্দেহ জাগে–দিগন্তরেখা কি!
    তুমি মূহুর্তে পরিবর্তন করো তোমার অস্তিত্ব –শরীরী বা অশরীরী।
    চোখের সামনে দেখি তোমাকে অপরূপা–নৈসর্গিক সৌন্দর্য রাশি ঢেলে সাজানো ঈশ্বরপুত্রী—আচ্ছা তুমি কে গো? কি নাম তোমার?

  • ভৌতিক গল্প

    শাপমুক্তি

    শাপমুক্তি
    -পার্থসারথি ঘোষাল

    তথ্যমিত্র কেন্দ্রের বাইরে সেদিন রূপেনের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো। রূপেন আমাদের কলেজের সবচেয়ে সেরা ছাত্র ছিলো। বর্তমানে ও থাকে গোয়ায়, গোয়ার সেন্টজেভিয়ার্স কলেজে ফিজিক্সের অধ্যাপক। কসবায় ওর নিজস্ব ফ্ল্যাট রয়েছে যেখানে বর্তমানে ওর শালা অমলেশ সপরিবারে বাস করছে, অমলেশ একটা বেসরকারি কোম্পানির অডিট সেকশনে কাজ করে। পুজোর ছুটি কাটাতে কালীপুরে এসেছে রূপেন সস্ত্রীক। কালীপুরে ওদের সাবেকী বিশাল দোতালা বাড়ি, বৈঠকখানা, দেউড়ি ও গাড়ি বারান্দা ওদেরই কোনো এক পুর্বপুরুষ নাকি হেস্টিংস সাহেবের খুব নেক নজরে এসেছিলেন। ওদের সাতপুরুষের জমিদারী ছিলো এ তল্লাটে- এখন অবশ্য তার চিহ্নমাত্র নাই। তবুও পোষাকে আষাকে সেই জমিদারী মেজাজের রেশটুকু যেন রয়ে গেছে।চৌধুরী বংশের কুলপ্রদীপ হলো এই রূপেন।

    আমি প্রথমে রূপেনকে ঠিক চিনতে পারিনি, কারণ আজ থেকে প্রায় পাঁচবছর আগে বর্ধমানে দেখেছিলাম ওকে। তখন ওর মুখে কোনো দাড়িটাড়ি ছিলনা তাছাড়া স্বাস্থ্যও ভালো ছিলো তখন- তাই মুখটা ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম রাস্তার ওপারে মেছোবাজারের দিকে। রূপেনই এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, “কিরে বাদল, তুই আমাকে চিনতে পারলিনা মনে হচ্ছে! দেখেই অমন করে মুখটা ঘুরিয়ে নিলি কেন?”
    আমি আমতা আমতা করে বললাম,”ক-ক-ই–ই-না–না-তো!”

    রূপেন বললো, “হয় আমাকে তুই চিনতে পারিসনি, না হয় চিনেও চিনতে পারছিস্ না–কি রে? কোনটা?”

    আমি গলায় একটা দৃঢ় সুর এনে বললাম, “তোর প্রথম অনুমানটাই সত্যি, অর্থাৎ তোকে আমি ঠিক চিনতে পারিনি ভাই। এই পাঁচবছরে তোর যে এতখানি পরিবর্তন তা যেন ভাবাই য়ায় না, তোর চেহারায় একটা আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে কোথাও। তোর স্বাস্থ্যেরও অনেক অবনতি হয়েছে বন্ধু।”

    রূপেন বললো, “তুই ঠিকই ধরেছিস্ ভাই?আজ থেকে বছর তিনেক আগে একটা ঘটনার পর থেকে আমি শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রচণ্ড টেন্সড্ আছি, তারই সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছে আমার শরীরে ও মনে। যাইহোক, আমার কথা এখন থাক- তোর খবর কি? তূই এখন কি করছিস ?”

    আমি বললাম, “আমার স্টুডিও ও জোতিষীগিরি নিয়েই বেশ কেটে যাচ্ছে।পেপার খুললেই বুঝতে পারবি আমার জ্যোতিষবিদ্যার প্রসার এখন কেমন!”

    রূপেন হো হো করে হেসে উঠে বললো,”বাজারে বেশ ভালোই নাম করেছিস তাহলে! কালেজে তুই তো আমাদের “মুশকিল আসান দাদা” ছিলি- তাই এখন এহেন জ্যোতিষবিদ্যা চর্চা তারই পরিপূরক বলতে হবে! ঠিকই আছে,‌চালিয়ে যা।তবে আঁকাটা যেন ছাড়িস না। কলেজে নবীন বরণের দিন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মুরারী বসু যখন তোকে সার্টিফিকেট দিয়েছিলো তখনই তোর প্রতিভার আঁচ পেয়েছিলাম।”

    কলেজ লাইফে আমার নাম ছিলো “মুশকিল আসান দাদা” অর্থাৎ বন্ধু মহলে কারও কোনো অসুবিধা হলেই আমি বাৎলে দিতাম সমাধানের পথ।এই রূপেনেরই কত সমস্যার সমাধান করে দিয়েছি; তাই নিজের সেই অতীত ব্যতিক্রমী গুণের কথা স্মরণ করতেই একটা অবাঞ্ছিত কৌতুহল আমাকে যেন পেয়ে বসলো। আমি আবার রূপেনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি যেন একটা ঘটনার কথা বলছিলি, যার জন্য তোর শারীরিক ও মানসিক ভাবে এতখানি পরিবর্তন?”

    রূপেন বললো, “আজ এখানে বলা সম্ভব নয়, একদিন আমার বাড়িতে আয় ওখানেই সব খুলে বলবো তোকে। এই রোববারই চলে আয় না সময় করে “আমি তার কথায় সম্মতি জানিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলাম।

    একদিন রবিবার প্রায় সন্ধ্যার সময় রূপেনের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। আজকাল কালীপুরের এই বাগান পাড়ায় লোকজন খুব একটা আসেনা। তার অবশ্য একটা কারণও আছে। কারণটা হলো এ পাড়ার চৌধুরীবংশে একমাত্র রূপেন ছাড়া আর কোনো শরিক নেই, হরনাথ চৌধুরীর একমাত্র সন্তান হলো এই রূপেন। হরনাথ চৌধুরী বা তাঁর স্ত্রী কেউই আজ আর বেঁচে নেই। আর মল্লিকরা বা মজুমদাররা কেউ আর এ গ্রামে থাকে না। তারা হয় কেউ প্রবাসে কিম্বা ভারতবর্ষের অন্যান্য শহরে উচ্চ সরকারী পদে আসীন এবং সেখানেই পরিবার পরিজন নিয়ে সেটেল্ড হয়ে গেছে।তাই বাড়িগুলো জনহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবলমাত্র মাত্র বাগান পাড়ার কঙ্কালের মতো, প্রাণহীন একটা ভৌতিক অস্তিত্ব নিয়ে।

    বাড়ির গেট পেরিয়ে গাড়ি বারান্দার কাছে আসতেই চোখ পড়লো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা চকচকে নীল রঙের হাউনদাই, এটাই রূপেনের নতুন প্রাইভেট কার মনে হয়! এবার চোখ পড়লো দোতালার ব্যালকনির দিকে, মনে হলো কোনো মহিলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণা তৃতীয়ার চা়ঁদের শোভা দেখছে।কিছুক্ষণ পরেই সেখানে এক পুরুষের আভির্ভাব হলো এবং সেই পুরুষ মানুষটি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “কিরে বাদল?আয় আয় ভেতরে আয়।”

    আমি বুঝতে পারলাম যে ঐ পুরুষটি হলো রূপেন ও মহিলাটি সম্ভবতঃ তার স্ত্রী। আমি সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠতেই রূপেন এসে হাজির হলো।
    আমাকে সঙ্গে করে ভেতরে নিয়ে গেলো।একটা লম্বা একটানা বারান্দা পেরোতে পেরোতে একতালার বন্ধ কক্ষগুলো নজরে পড়ছিলো। কতদিন যে তালা বন্ধ তা অনুমান করা প্রায় অসম্ভব, কারণ তালাগুলোতে মরচে ধরেছে। সাবেকী আমলের জমিদারবাড়ি। বাড়িটার চারদিকেই বড় বড় থামওয়ালা বারান্দা। সামনের একটানা লম্বা বারন্দার শেষপ্রান্তে দোতালায় ওঠার সিঁড়ি, আমি ও রূপেন দু’জনেই কথা বলতে বলতে দোতালায় উঠে গেলাম, দোতালার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা দু’জনেই।

    ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাগান পাড়ার মোটামুটি সামগ্রিক অংশই নজর আসছে।এখানে চারদিকে একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতার অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম বাগান পাড়ায় ঢোকার পর থেকেই। তাছাড়া কৃষ্ণা তৃতীয়ার জ্যোৎস্নায় চারদিকটা যেন মূহুর্তে মুহুর্তে মোহময়ী হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ আমরা দু’জনেই নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।তারপর হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠলো রূপেন,”চল,চল ভেতরে চল। আর দেখে কি করবি! দেখার বিশেষ কিছু নেই, সেই ধ্যাড়ধেড়ে কাশীপুরের চৌধুরী পাড়া।”
    আমিও আর কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালাম ওর সঙ্গে।

    ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে সোফার উপর বসে পড়লাম, কারণ অনেকটা রাস্তা হেঁটে এসেছি।এবার আমার চোখ পড়লো ড্রয়িংরুমের চারদিকে টাঙানো নারী ও পুরুষের তৈলচিত্র গুলির উপর, রূপেন একে একে সকলেরই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলো আমার কাছে- অর্থাৎ এইসব তৈলচিত্র হলো এই বংশের পুর্বপুরুষগণের যাদের সস্ত্রীক তৈলচিত্র বানানো হয়েছিলো একসময়। এবার রূপেন সামনের একটা সোফায় আরাম করে বসে পড়ে বললো, “কি কেমন দেখলি? এটাকে আমি ড্রয়িং রুম বানিয়ে নিয়েছি। এটা আসলে ছিলো আমার পিতামহ দেবের সভাকক্ষ। সরকারী আমলা থেকে আরম্ভ করে নায়েব, গোমস্তা সবাই এখানে বসেই আলাপ আলোচনা সারতো।অর্থাৎ তাঁর সময় পর্যন্ত জমিদারীর ক্ষীণ আবেশটুকু অস্তিত্বের লড়াইয়ে কোনো রকমে টিকে ছিলো আরকি!”

    আমি গম্ভীর ভাবে বললাম,”তৈলচিত্রগুলো একদম নিখুঁত হয়ে আছে এখনো। সত্যিই তুই বিরাট অভিজাত বংশের সন্তান- তোর দেহে বইছে জমিদারী রক্ত, তা তোর কথায় বার্তায় বেশ স্পষ্ট।”

    রূপেন হো হো করে হেসে উঠলো একবার তারপর বললো,”নাম কে বাস্তে আভিজাত্যের আর কিছুমাত্র চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। এখন আমার নিজস্ব যা কিছু দেখছিস তা এক নূতন অধ্যায়ের নিদর্শন।”

    চৌধুরী বংশের অনেক ইতিহাসই শুনলাম রূপেনের মুখ থেকে। শুনে আমার খুব রহস্যময় মনে হলো। ইতিমধ্যে এক ভদ্রমহিলা চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলো, রূপেন বললো, “এর সঙ্গে তো তোর পরিচয়ই হয়নি বোধহয়, এ হচ্ছে আমার স্ত্রী রোহিনী।” এবার রোহিনীর দিকে মুখ ফিরিয়ে রূপেন বললো, “আর রোহিনী,এ হচ্ছে আমার কালেজমেট বাদল সেন, বিখ্যাত আঁকিয়ে কাম জ্যোতিষী।”

    জ্যোতিষী কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রোহিনীর চোখে মুখে কেমন যেন একটা ভ্রুকুটিকুটিল ভাব ক্রমশঃ স্পষ্ট হতে দেখলাম।
    রোহিনী দেবী একটু মুচকি হেসে বললেন,”তা বেশ তো,খারাপ কি! এখন তো জ্যোতিষীদের রমরমা বাজার- কি ঠিক বলিনি বাদল বাবু?” আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম রোহিনীদেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে। কারণ সে একজন তরুণী অথচ চোখে মুখে যেন সেই তারুণ্যের লেশমাত্র নেই, সে যেন বন্দিনী এক প্রাগৈতিহাসিক জরার অলৌকিক খাঁচায়। রোহিনীদেবীর মুখ যেন বিবর্ণ-পান্ডুর! খুব একটা স্বাভাবিক বলে আদৌ মনে হচ্ছিল না আমার। তার পায়ের মাংসল অংশের ভেতর থেকে যেন আবছা একটা কঙ্কালসার পায়ের ছবি অস্পষ্ট হলেও খুব নজর করে দেখলে বোঝা যায়। আমার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় যেন সজাগ হয়ে উঠতে চাইছে।

    রোহিনী দেবীর ঐ ধরণের অকস্মাৎ প্রশ্নে আমি আবার স্বাভাবিক হয়ে বললাম, “হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন, তবে সব জ্যোতিষী এক ক্লাসের নন গুণগত তারতম্যের কথাটাও মাথায় রাখতে হবে।” রোহিনী দেবী আবার সেই মুচকি হেসে বললেন,”ঠিক আছে, আপনারা দুইবন্ধু গল্প করুন, আমি রাঁধুনি দিদিকে একটু গাইড করবো, কারণ এ বাড়িতে আপনি আজ প্রথম এসেছেন ত্রুটি হলে তো চলবে না।” কথাটা বলেই রোহিনীদেবী দরজার দিকে পা বাড়ালেন আর ঠিক তখনই আর একটা অদ্ভুত বিষয় আমার চোখে পড়লো। দেখলাম রোহিনীদেবীর সারাগায়ে একটা অশুভছায়া যেন কুয়াশার মতো লেপটে আছে। আমি রোহিনীদেবীর গমনপথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। সারাঘরটা যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে।

    হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে রূপেন বললো, “কি রে কি দেখছিস্ অমন করে ওদিকে চেয়ে?”

    আমি বললাম, “কই কিছু না তো।” আমি সেই অদ্ভুত ব্যাপারটা একেবারেই চেপে গেলাম রূপেনের কাছে।

    রূপেন এবার বলতে লাগলো, “শোন তোকে যে জন্য এখানে ডেকেছি- আজ থেকে প্রায় বছর তিনেক আগে পুজার ছুটিতেই হবে! রোহিনী আর আমি পুজার ছুটি কাটাতে এখানে এসেছিলাম। আগেও ওকে এখানে নিয়ে এসেছি বার কয়েক, কিন্তু সেইবারেই ঘটলো সেই ভয়ংকর ঘটনাটা। এই রুমটার পাশেই অর্থাৎ বেডরুমে আমি এবং রোহিনী রাত্রে একটু লুডো খেলতে বসেছি। খেলাটা বেশ জমে উঠেছে এমন সময় বেডরুমের জানালার বাইরে রক্তচন্দনের গাছগুলোর মাথায় একটা দমকা বাতাস এসে ধাক্কা দিয়ে জানালার পাল্লা খুলে ঢুকে পড়লো ভেতরে, সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে আর বাতাসের কোনো অস্তিত্বই টের পাওয়া গেলো না, পাঁচ দশ মিনিট পর আবার রুমের লাইট জ্বলে উঠলো, অর্থাৎ কারেন্ট এলো।আমাদের খেলাও গেলো থেমে। খাওয়া দাওয়া সেরে যথারীতি শুয়ে আছি দু’জনেই। লোডশেডিং হলো এবার কিন্তু আর তাড়াতাড়ি কারেন্ট এলো না। বাধ্য হয়ে চার্জার লাইটটা জ্বালালাম, রোহিনী ততক্ষণে বেশ ঘুমিয়ে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজায় একটা আন্দোলন লক্ষ্য করলাম এবং সেই সঙ্গে একটা খস্ খস আওয়াজ।ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে আমি আবার শুয়ে পড়লাম এবং কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা বলতে পারবনা। হঠাৎ কিছু একটা লোমশ জাতীয় জিনিসের স্পর্শ অনুভব করতেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। তাছাড়া চিরদিনই ঘুমটা আমার খুব সেনসিটিভ্। ঘুম ভেঙে পাশ ফিরতেই দেখলাম রোহিনী পাশে নেই। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দেখলাম দরজাটা খোলা। মনে মনে ভাবলাম সে হয়তো বাথরুমে গেছে, তাই একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দেখলাম রোহিনী এলো না তখন বাথরুমে গেলাম; কিন্তু সেখানে রোহিনীকে দেখতে পেলাম না। তখন আমি বাইরে এসে গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে রোহিনীকে ডাকতে আরম্ভ করলাম, কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না‌। বাধ্য হয়ে টর্চ হাতে নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলাম গেটে যথারীতি তালা লাগানো রয়েছে। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার ইতিকর্তব্য ঠিক করছি, এমন সময় কানে ভেসে এলো একটা মচ্ মচ্ শব্দ, শব্দটা আসছে বাগানের দিক থেকে। শুকনো পাতার উপর কেউ যেন হেঁটে চলেছে। আমি শব্দটা অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম বাগানের দিকে, তারপর গাছের আড়াল থেকে যা দেখলাম তাতে শিড়দাঁড়া বেয়ে একটা বরফের স্রোত বয়ে যেতে লাগলো। দেখলাম- একটা ছায়ামূর্তি হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে জলের দিকে। আমি চিৎকার করে রোহিনী, রোহিনী বলে ডাকতেই সেই ছায়ামূর্তি আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালো- ও!কি ভয়ংকর! চোখদুটো থেকে একটা লালরশ্মি ঠিকরে বেরিয়ে আসছে আর মুখটা হাঁ করতেই দেখলাম দু’টো বীভৎস শ্বদন্ত। আমি যেন কিছুক্ষণ মোহাচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানেই।তারপর সেই ছায়ামূর্তি আবার মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে লাগলো এবং একসময় মিশে গেলো পুকুরের কালো জলে। কিন্তু রোহিনীর কোনো খোঁজই পেলাম না সেখানে। সেখান থেকে এলাম দেউরির কাছে রামদিনের ঘরে, রামদিনকে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলতেই রামদিন যা বললো তার মর্মার্থ হলো- ওটা নাকি প্রেতাত্মা প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবার রাতে বাগানে ঘুরে বেড়ায়, তারপর পুকুরের জলে মিলিয়ে যায়।” এই পর্যন্ত বলে রূপেন একটু থামলো।

    আমি বললাম, “তারপর রোহিনীকে পেলি কোথায়?”

    রূপেন আবার বলতে শুরু করলো, “ঐ পুকুরের পাড়ে একটা তেঁতুল গাছের নীচে অচেতন অবস্থায়। ওখান থেকে তুলে নিয়ে আসা হলো বেডরুমে মোটামুটি আধঘণ্টা শুশ্রূষার পর রোহিনীর জ্ঞান ফিরে এলো কিন্তু ও কোনো কিছুই বলতে পারল না, অর্থাৎ কেমন করে সে ঐ তেঁতুল গাছের নীচে পৌছালো তারপর কি হলো ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই থেকে রোহিনীর মধ্যে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। মাঝে মাঝে ওকে অনেক রাতে ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কথাও বলতে শুনেছি।”

    আমি বললাম, “তুই এখানে আর আছিস কতদিন?”

    রূপেন বললো, “আছি আরো দশদিন মতো, কিন্তু কেন বল তো?”

    আমি ওকে আশ্বাস দিয়ে বললাম ,”তার মানে এই দশদিনের মধ্যেই কাজ হাসিল করতে হবে।”

    “কাজ হাসিল মা–নে?ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না?” রূপেন আমার মুখের দিকে চেয়ে বললো।

    আমি বললাম, “ঐ প্রেতাত্মাকে মুক্তি দিতে হবে। তার জন্য কিছু বাস্তুযাগের গুপ্ত কাজ করতে হবে। তবে তার আগে জানতে হবে ঐ প্রেতাত্মার উৎস কোথায়? এটা জানতে হলে আমাকে এখানেই থাকতে হবে কিছুদিন।অবশ্য কাল আমি একবার আমার তন্ত্রমন্ত্রের পুঁথি ও কিছু দ্রব্য নিয়ে আসবো আমার বাড়ি থেকে, কি রাজি আছিস তো?”
    রূপেন খুশি হয়ে বললো, “একশোবার!হাজারবার!–কিন্তু তুই কাজটা উদ্ধার করতে পারবি তো ভাই?”
    আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, “দেখেই নে না এই বাদল সেন কি পারে আর কি পারে না? আর একটা কথা তোকে বলবো, ভয় পাবি না তো?”

    রূপেন বললো, “না না,বল কি বলবি।”

    আমি বললাম যে ঐ প্রেতাত্মা তার স্ত্রী রোহিনীর উপর ভর করেছে এবং সেদিন ঐ প্রেতাত্মাই রোহিনীকে সম্মোহিত করে নিয়ে গিয়েছিল বাগানের মধ্যে। সে রোহিনীকে দিয়ে তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চায়–এবং যদি ঐ প্রেতাত্মাকে মুক্তি দেওয়া না যায় তাহলে ওর স্ত্রীকে ঐ প্রেতাত্মা মেরে ফেলবে এবং গোটা বাড়িটা অধিকার করে বসবে তখন কারো সাধ্য নেই যে এ বাড়িতে একরাত বাস করে। ঘটনাটা জেনে রূপেনের চোখ একদম কপালে উঠলো।

    আমি বললাম, “রূপেন তোদের বংশের নিশ্চয় কোনো গোপন ইতিহাস আছে যা তোর পক্ষে জানা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু সেই ইতিহাস আমাকে জানতেই হবে। আচ্ছা তোদের লাইব্রেরি রুমটা কোনদিকে, ওটা একবার খুলতে হবে।”
    রূপেন বললো, “আরে, ওটা তো আজ দীর্ঘকাল ধরে তালাবন্ধ, উইপোকাতেই অর্ধেক সাবার করে দিয়েছে মনে হয়।”
    “তবুও খুলতে হবে আমার মনে হচ্ছে
    ওখানেই লুকিয়ে রয়েছে আসল রহস্য।” আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম।
    যাইহোক খাওয়া দাওয়া সেরে সেই রাতে ড্রয়িং রুমে নরম গদি আঁটা সোফায় শুয়ে দিব্যি কেটে গেলো।

    পরেরদিন বিকালে আমি আমার জ্যোতিষির থলে ও পুঁথি নিয়ে হাজির হয়ে গেলাম চৌধুরী বাড়িতে। রূপেন দেখলাম লনে পাইচারি করছে আমাকে গেট ঠেলে ঢুকতে দেখেই বলে উঠলো,”লাইব্রেরী খোলা হয়েছে, চলো এখনই একবার ঘুরে আসা যাক সেখান থেকে।”
    আমি রূপেনের কথায় রাজি হয়ে গেলাম এবং লাইব্রেরী রুমের দিকে পা বাড়ালাম দু’জনে। লাইব্রেরী রুমে ঢুকে রূপেন বললো, “দাঁড়াও, আমি একটা লাইট নিয়ে আসি।” বলেই রূপেন চলে গেলো সেখান থেকে।
    আমি ততক্ষণে আমার ব্যাগ থেকে ছোটো চার্জার টর্চটা বের করে লাইব্রেরির এদিক সেদিক দেখতে লাগলাম। তবে রূপেনের অনুমানটা সত্য নয় অর্থাৎ উইপোকার চিহ্নমাত্র পাওয়া গেলো না,পরিবর্তে দেখলাম মাকড়সার রাজ্য আর অসংখ্য টিকটিকি।হঠাৎ আমার চোখ পড়লো এক লালচামড়ায় বাঁধানো মোটা ডায়েরীর দিকে, ডায়েরীটা ধুলো ঝেড়ে ভরলাম ব্যাগের ভেতর। হঠাৎ রূপেন এসে হাজির হলো লাইট হাতে–আলোতে দেখলাম লাইব্রেরিতে দেশী বিদেশী অসংখ্য দামী বইয়ের সম্ভার। বইগুলো মোটামুটি খুলে দেখলাম তাতে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীতের সম্ভার যেমন রয়েছে, তেমনই চোখে পড়লো তন্ত্র মন্ত্রের বইয়ের সম্ভারও। একটা কোণে একটা পিতলে বাঁধানো ছড়ি চোখে পড়তেই রূপেনকে জিজ্ঞাসা করলাম,”রূপেন ঐ ছড়িটা কার?”

    রূপেন বললো,”আমাদের একজন পুর্বপুরুষের যার নাম নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরী, প্রচণ্ড অত্যাচারী ছিলেন শুনেছি বাবার মুখে।তার মৃত্যুর পর থেকেই জমিদারীর মন্দা অবস্থা দেখা দেয় আর অস্বাভাবিক সব মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে থাকে–যা তোকে আগেই বলেছি।”
    আমি এবং রূপেন লাইব্রেরি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
    রূপেন হাঁক পাড়লো,”রা—ম—দি—ন ঘর টায় তালা লাগাও।”
    রামদিন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এসে দরজায় তালা লাগিয়ে আবার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। আমরা ততক্ষণে দোতালার সিঁড়ি বেয়ে ব্যালকনিতে পৌঁছে গেছি। রূপেন ভেতরে কি যেন দরকারে ঢুকে পড়লো আর আমি আসন্ন সন্ধ্যার রহস্যময়ী রূপ উপলব্ধি করতে লাগলাম। চারদিকে যেন পরীরানীরা তাদের ইন্দ্রজাল বিস্তার করেছে। বাগানের গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলিতে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠছে। আমি মোহাবিষ্টের মতো চেয়ে রইলাম সেইদিকেই।

    সেদিন ছিলো মঙ্গলবার, রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আমি রূপেনকে বললাম, “আজ তো মঙ্গলবার, আজ রাত ১২টার পর আমি বাগানে যাবো।” রূপেন আমার কথা শুনে মনে হলো একটু আতঙ্কিত হয়েছে।
    রূপেন কি যেন একবার ভেবে নিয়ে বললো, “বাদল তুই যাস না ওটা প্রেতাত্মা, শুনেছি প্রেতাত্মারা বহুরূপী হয় তোকে যদি কোনো জন্তু হয়ে আক্রমণ করে- তখন?”
    আমি বললাম, “পারবে না ব্রাদার পারবে না, আমি এতো কাঁচা খিলাড়ী নই।” রূপেন আর কিছু বললো না। আমি রূপেনেরর সঙ্গে ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসে পড়লাম।কিছুক্ষণ পর রূপেন তার বেড রুমে চলে যেতেই আমি ব্যাগ থেকে সেই ডায়েরীখানা বের করে ঘাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ ডায়েরীর একটা পাতায় আমার চোখ দু’টো আটকে গেলো। দেখলাম একটা ধাঁধা জাতীয় কিছু লেখা রয়েছে, ধাঁধাটা এইরকম- “দামিনী চমকে ঘরের আলোকে, জাগায় তৃষ্ণা মনে পাপ।
    নিভলো দামিনী সকলই হারায়ে- রেখে গেলো এক মহাশাপ।”এটা নিছকই কোনো আবেগ তাড়িত কবিমনের প্রলাপ, না কৃত কোনো পাপের অনুশোচনার প্রকাশ! ভাবতে লাগলাম গভীরভাবে, ভাবনার মধ্যে এতটাই ডুবে ছিলাম যে বুঝতেই পারিনি রূপেন কখন এসে ঘরে প্রবেশ করেছে- “কিরে বাদল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিস নাকি?”রূপেনের কথাতেই আমি যেন সম্বিৎ ফিরে পেলাম।

    আমি বললাম, “না রে, আমি এতক্ষণ একটা গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলাম।”

    রূপেন কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,”কি ব্যাপারে বলতো?”

    আমি বললাম, “দামিনী কে? তুই জানিস এই দামিনী সম্বন্ধে কিছু?”

    রূপেন যেন আকাশ থেকে পড়লো, আমি তখন ডাইরীটা খুলে ওকে ধাঁধাটা দেখালাম।ধাঁধাটা দেখে রূপেন হো হো করে হেসে উঠে বললো, “ওটা নিছকই একটা কবিতার লাইন।”

    আমি রূপেনের হাসি থামিয়ে বললাম, “না ওটা নিছকই একটা কবিতার লাইন হতে পারেনা কারণ প্রতিটি লাইনকে লাল কালি দিয়ে আন্ডার লাইন করা আছে, এর অর্থ একটাই যে এই কয়টি লাইনের অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
    রূপেনের মুখের হাবভাব হঠাৎই যেন কেমন গম্ভীর হয়ে গেলো, সে বললো, “তাহলে ওটা কি কোনো ধাঁধা, যার উত্তর আমাদের অনুমানের বাইরে।”
    “ঠিক তাই।” আমি একটু ভেবে বললাম।

    রূপেন বললো, “তাহলে এখন কি করা যাবে?”

    আমি রূপেনকে বললাম, “আমার মনে হচ্ছে এই ধাঁধার অর্থের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বিরাট একটা গুপ্ত ইতিহাস, যে করেই হোক আমাদের জানতেই হবে। কিন্তু কি করে–!কি–ন–তু! পেয়েছি।”

    রূপেন বললো,”কি পেয়েছিস্ ?”
    আমি ওর কৌতূহল নিরসন করার জন্য বললাম, “এই ধাঁধার উত্তর পাওয়ার উপায়..এখন একমাত্র উপায় হচ্ছে নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীর আত্মাকে প্ল্যানচেটের মাধ্যমে আমাদের ডেকে আনতে হবে।”

    রূপেন খানিকটা অবাক হয়ে বললো, “কিন্তু নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীর আত্মাকেই কেন?অন্য কেউও তো হতে পারে!”
    আমি গম্ভীর গলায় কিন্তু জোরের সঙ্গে বললাম, “না, হতে পারে না, কারণ ঐ লাইন কয়টির নীচে যার স্বাক্ষর দেখলাম তিনি নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীই।”
    ওয়ালক্লকটা ঢং ঢং ঘন্টা বাজিয়ে জানিয়ে দিলো সন্ধ্যা সাতটা- ঠাকুরবাড়ির কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ শোনা গেলো। আমি হঠাৎ রূপেনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা রাঁধুনি দিদির বাড়ি কোথায়?”
    রূপেন বললো, “আরে পলাশের দিদিকে চিনিস না?”

    আমি বললাম, “ও পলাশের দিদি মানে ছায়াদি,তাই বল। আমি ভেবেছিলাম হয়তো কোলকাতা থেকে লোক সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছি।”

    রূপেন বললো, “ঐ তো ছায়াদি রান্নার কাজ সেড়ে বাড়ি যাচ্ছে।” বলেই হাঁক পাড়লো, “ও–ও ছা–য়া–দি এদিকে একবারটি এসো।” বলতে বলতেই ছায়াদি মানে ঘোষ পাড়ার ছায়া ঘোষ একমুখ হেসে বললো, “কি হলো গো দাদাবাবু?” তারপর আমাকে দেখেই বললো, “ও মা বাদলভাই তুমি এখানে? তা কি মনে করে?”

    আমি বললাম,”এই একটা বিশেষ কাজে এসেছি দিদি।।”

    হঠাৎ রোহিনী রূপেনকে ব্যালকনি থেকে ডাকলে রূপেন বললো, “তুই ছায়াদির সঙ্গে কথা বল আমি একটু আসি।” বলেই চলে গেলো।

    ছায়াদি রূপেনের গমনপথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ, তারপর চাপা গলায় আমাকে বললো, “বাদলভাই এ বাড়িতে ভুত আছে গো–ভুত!”

    আমি বললাম, “তুমি দেখেছো?”

    সে বললো, “দেখি নাই! তবে সে যে এ বাড়িতেই থাকে তা বেশ বুঝেছি।” এর জন্য সে যে মনে মনে শঙ্কিত তা তার চোখমুখ দেখেই বুঝলাম, তবুও পেটের দায়েই তাকে এ কাজ করতে হয়।

    ছায়াদির কাছ থেকে আরও অনেক অদ্ভুত ঘটনার কথাও জানা গেলো। আমি ছায়াদিকে বললাম, “ছায়াদি তুমি এবার এসো অনেক দেরী হয়ে গেলো তোমার।”
    ছায়াদি খানিকটা ইতস্ততঃ করেই পা বাড়ালো গেটের দিকে। আমিও ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম বারান্দার দিকে। এবং সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম দোতালার ব্যালকনিতে এবং একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।কিছুক্ষণ পর সেখানে এসে হাজির হলো রোহিনী ও রূপেন, রোহিনীর হাতে চায়ের ট্রে রূপেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমার পাশেই বসলো। রোহিনী আমাদের দু’জনের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে নিজেও একটা কাপে চুমুক দিতে দিতে একটা চেয়ারে বসলো। কিছুক্ষণ একদম নিস্তব্ধ চায়ের চুমুকের শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছিলো না কারোরই। রোহিনীই নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠলো,”আচ্ছা বাদলবাবু আপনি ভুতে বিশ্বাস করেন?”

    আমি বললাম, “বিশ্বাস করা বা না করার মধ্যে ভৌতিক অস্তিত্বের কোনো সম্পর্ক নেই।মৃত্যুর পর আত্মা যে এক অতীন্দ্রিয় জগতে প্রবেশ করে–তা আমি বিশ্বাস করি। এ জগতের সমস্ত কিছুই অলৌকিক যার লৌকিক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।”

    রূপেন বলে উঠলো, “ভুত বলে একটা কিছু আছেই।”
    রোহিনী হো হো করে হেসে উঠে বললো, “তুমিও শেষে-? ছিঃছিঃ তোমার শিক্ষা দীক্ষায় ধিক্! তুমি না বিজ্ঞানের একজন ভালো স্কলার?”
    আমি বললাম, “রোহিনী দেবী রূপেনের কথাটা ঐ ভাবে উড়িয়ে দেবেন না। রূপেন যা বলছে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।”
    রোহিনী বলে উঠলো, “আমি কোলকাতার মেয়ে আমার বাবা বিখ্যাত বোটানিস্ট ডঃ নিরোদ বরণ ঘোষ, আমরা ছোটো থেকেই একটা বৈজ্ঞানিক পরিবেশে বড় হয়েছি।আমি নিজেও কেমিস্ট্রিতে এম.এস.সি করে গোয়ার একটা অন্য কলেজে পড়াই, তাই এই সব ভুতটুত মেনে নেওয়া আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।”
    আমি বললাম, “জানেন সেদিন আপনাকে নিশিভুতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল?”
    রোহিনীর মুখে এবার যেন একটা ক্ষীণ ভয়ের আস্তরণ চোখে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে ঘড়িতে রাত্রি আটটার ঘন্টা পড়লো, দূরে কোথাও একটা শিয়াল ডেকে উঠলো- “হুক্কিহুয়া-উয়া–উয়া–উয়া!”।

    রোহিনী প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে রূপেনকে উদ্দেশ্য করে বললো,”ঘড়িতে আটটা বাজছে বাদলবাবুকে নিয়ে ডাইনিং প্লেসে এসো।”

    রাতের খাওয়া শেষ করে আমি এবং রূপেন ড্রয়িং রূমে বসে সিগারেট খেতে খেতে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম। রূপেন বললো,”রাতে যেন বাগানে যাস না ভাই এটা আমার অনুরোধ।”
    আমি আমার ভেতরের অদম্য ইচ্ছা গোপন করে বললাম,”না,না বাগানে আমি যাচ্ছি না।সে তোর কোনো চিন্তা নাই।”রূপেন আশ্বস্ত হয়ে শুভরাত্রি জানিয়ে ওর বেডরুমে চলে গেলো।
    আমিও দরজা বন্ধ করে নাইটল্যাম্পটা জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লাম সোফার উপর। রাত তখন বড়জোড় ৯টা হবে। একটা চিন্তার মেঘ আমার মনের মধ্যে ক্রমশ জমে উঠতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা বলতে পারবো না, হঠাৎ একটা অদ্ভূত শব্দে ঘুমটা আমার ভেঙে গেলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত ১টা। শব্দটার উৎস সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়লাম, আস্তে আস্তে দরজা খুলে টর্চ হাতে বেরিয়ে এলাম বারান্দায়। এখান থেকে যতদূর চোখ যায় তাতে কিছুই দেখতে পাওয়া গেলো না। এবার আমি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গাড়িবারান্দা ছাড়িয়ে এসে দাঁড়ালাম বাগানের রেলিং দেওয়া দরজার সামনে।একবার ভালো করে বুক পকেট পরীক্ষা করে দেখে নিলাম রূপোর তৈরী ভবাণীযন্ত্রমটা আছে কিনা! তারপর গেট খুলে এগিয়ে যেতে লাগলাম সেই বিতর্কিত পুকুরটির দিকে, একসময় পেছনে ফিরে দেখলাম বাড়ির দোতালার চিলেকোঠাটা শুধু দৈত্যের মাথার মতো কালো হয়ে আছে।অর্থাৎ বাগানের এই পুকুরটা বাড়িটা থেকে প্রায় দেড়শো থেকে দুশো মিটার দূরে। আজ মঙ্গলবার অতএব সেই প্রেতাত্মা নিশ্চয় আজ বেরিয়ে আসবে। এইসব যখন ভাবছি হঠাৎ একটা আওয়াজ হলো পুকুরের জলে।আমি একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর যা দেখলাম তাতে আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়ত ভিরমি খেতো।
    দেখলাম পুকুরের জলের উপর থেকে বাঁধানো ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে একটা স্যিলুয়েট্ মূর্তি। ধীরে ধীরে সেই মূর্তি ঘাটের উপর উঠে এলো। এরপর যেন মনে হলো সে এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে ভালো ভাবে দেখলো।
    তারপর আবার এগিয়ে যেতে লাগলো বাড়ির দিকে। আমিও গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম, একসময় সেই সিলুয়েট মূর্তি বাগানের গেটের কাছে পৌঁছেই পিছন ফিরে তাকাতেই চোখ পড়লো আমার দিকে তারপর যে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটলো তাতে আমার সাড়া শরীর এক অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠলো।
    হঠাৎ একটা একটানা খ্যানখ্যানে অট্টহাসিতে সমস্ত বাগানটা যেন ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলো–কোথা থেকে একটা দমকা বাতাস এসে গাছগুলোকে যেন উপড়ে ফেলতে চাইলো।যেন পৃথিবীর গভীর তলদেশে শুরু হয়েছে বিধ্বংসী কোনো এক কম্পন। চারদিকে একটা অলৌকিক মোহগ্রস্ততা। কতক্ষণ যে এমনভাবে কাটলো তা বলতে পারবো না–হঠাৎ দেখি সেই ছায়ামূর্তির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো একটা নারীমূর্তি তারপর সেটা নরকঙ্কালে পরিণত হয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসতে লাগলো আমার দিকে, আমি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গেলাম বাড়িটার দিকে কিন্তু কিসে যেন একটা হোঁচট খেয়েই পড়ে গেলাম। এবার সেই নরকঙ্কাল দেখলাম আমার প্রায় খুব কাছে হাঁটু মুড়ে বসেছে আর তার দুই হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলেছে আমার পা দু’টো।আমি বেশ বুঝতে পারলাম সে আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে পুকুরের দিকে। নিশ্চিত মৃত্যু, সে আমাকে জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলবে। মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ে গেলো ভবাণীযন্ত্রমের কথা- প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে বার করে আনলাম সেটা। দেখলাম সেই নরকঙ্কাল আমার পা দু’টো ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরে পুকুরের জলের ধারে দাঁড়িয়ে হেসে চলেছে সেই পৈশাচিক হাড়হিম করা হাসি,”হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ।”
    ভবাণীযন্ত্রম তুলে ধরতেই সেটা মিলিয়ে গেলো কালো জলে একটা বিকট শব্দ করে।
    আমার সাড়া শরীর যেন অবসন্ন হয়ে আসতে লাগলো আনিমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মতো। বুঝতে পারলাম আজ ভবাণীযন্ত্রমের জন্যই বেঁচে গেলাম। ধীরে ধীরে সবার অলক্ষ্যে আবার ফিরে এলাম ড্রয়িংরুমে কিন্তু সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারলাম না।

    পরেরদিন সকালে ব্রাশ করে ব্যালকনিতে চা খেতে খেতে রূপেন বললো,”কি রে বাগানে যাসনি তো?”
    আমি গতরাত্রির ঘটনা বেমালুম চেপে গিয়ে বললাম,”পাগল হয়েছিস, জেনে শুনে কেউ ভুতের খপ্পরে পড়তে চায়, কাল নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছি।”
    রোহিনী আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে বললো, “আ্যলজেলাম্ খেয়েছিলেন নাকি?”
    আমি মৃদু হেসে বললাম, “তার দরকার হবে না ভাবীজি, নিদ্রাদেবী আমার উপর সদাপ্রসন্না।”
    কথাটা শোনামাত্র ওদের মধ্যে একটা হালকা হাসির তরঙ্গ বয়ে গেলো যেন।
    রোহিনীর মুখটা যেন রক্তহীন ফ্যাকাশে- এ যেন আ্যনিমিক টেনডেনসি বলেই মনে হতে লাগলো আমার। রোহিনী এমনিতে যে খুব প্রাণোচ্ছল তা এই দু’দিনে বেশ বুঝতে পারলাম। ওর অজান্তে কোনো এক বিদেহী আত্মা ওর শরীর থেকে এক্টোপ্লাজমকে আশ্রয় করে সক্রিয় হয়ে উঠছে এবং একটা দুর্নিবার অশরীরী আকর্ষণ ওর শরীর থেকে রক্ত শোষণ করে চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে ওকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
    আমি কেবলমাত্র রোহিনীর কথা ভেবেই সেইদিন রাত্রেই খাওয়া দাওয়ার পর প্ল্যানচেটে বসার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করলাম। ড্রয়িং রূমের দরজা জানালা বন্ধ করে একটা তেপায়া টেবিলের সামনে মুখোমুখি বসে পড়লাম তিনজনে। ঘড়ি ঢং ঢং ঘন্টা বাজিয়ে জানিয়ে দিলো- রাত এগারটা। সমস্ত ঘরটা অন্ধকার, কেবলমাত্র টেবিলের উপর জ্বলছে একখানা মোমবাতি।আমি, রূপেন ও রোহিনী তিনজনে আঙ্গুলে আঙ্গুল ঠেকিয়ে নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীর ছবি মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম- চারদিকে জমাট নিস্তব্ধতা যেন সারা বাড়িটাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। হঠাৎ দরজাটা নড়ে উঠলো কেউ যেন নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করলো- সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করলাম রূপেনের চোখমুখ কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। চোখদু’টো টকটকে লাল আর বিকৃত মুখ দিয়ে লালা ঝরছে- হঠাৎ রুমের ভেতর গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বরে রূপেন বলে উঠলো,”আ-মা-য়—কে-ন–ডা-ক-লি–ব-ল?”
    আমি বুঝতে পারলাম রূপেনের দেহ আশ্রয় করেছে নৃসিংহ প্রসাদের আত্মা এ কন্ঠস্বর রূপেনের নয় এটা নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীর আত্মার পৈশাচিক কন্ঠস্বর- কি বীভৎস সেই কন্ঠস্বর মনে হলো যেন কোনো গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক জান্তব গর্জন।রোহিনী ভয়ে আমাকে চেপে ধরলো,আমি ইশারায় তাকে সাহস দিলাম। এবার আমি বললাম,”বলুন কে আপনি?”

    সেই আত্মা চিৎকার করে বলে উঠলো,”তু-ই—যা-কে–ডে-কে-ছি-স্—সে-ই-ই—আ-আ-মি——আ-মা-র—–খু-ব—ক-ষ্ট—হ–চ্ছে—ব-ল–কি– ব–ল–বি ব-ল?”

    আমি নির্ভয়ে বললাম, “আপনি যার দেহে এখন অবস্থান করছেন সে আপনারই বংশধর–অতএব এর জীবন ও সুখ-সমৃদ্ধি রক্ষা করতে আপনাকে আমাদের সাহায্য করতেই হবে।”

    আবার সেই আত্মা বলে উঠলো,”ব-ল—কি–প্র-য়ো-জ–নে—আ–মা–কে–ডা-ক-লি—আ-মি–বে–শী ক্ষ-ণ—থা-ক–তে—পা–র-ব–না—আ-মা-র—ক-ষ্ট—হ-চ্ছে।”

    আমি আবার বললাম, “আর একটু কষ্ট করে বসুন- আমি একটি ধাঁধা বলছি তার উত্তর আপনাকে বলে যেতে হবে- দামিনী চমকে ঘরের আলোকে, জাগায় তৃষ্ণা মনে পাপ।
    নিভলো দামিনী সকলই হারায়ে–রেখে গেলো এক মহাশাপ—–এর অর্থ কি? আজ আপনাকে বলে যেতেই হবে, তা নাহলে আপনার এই বংশধরের মহাবিপদ।”

    সঙ্গে সঙ্গে সেই আত্মা হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,”দা–মি–নী-হ-লো–এ-ক-জ-ন —বা-ই-জী।ও-র –রূ-পে —মু-গ্ধ হ-য়ে—-আ-মি—ও-কে—ভো-গ —ক-রি–এ-ব-ং—ব-দ-না-মে-র—ভ-য়ে—খু-ন— ক-রে– ফে-লি–এ-ব-ং—তা-র–লা-শ—ঐ—পু-কু-রে-র—পাঁ-কে—পুঁ-তে—ফে-লে-ছিলা-ম—-মৃ-ত্যু-র—আ-গে—সে—ব-লে-ছি-লো—এ-ই—বং-শে-র–উ-ত্তর—পুরু-ষ—সক-ল-কে—সে–মে-রে–ফে-ল-বে–মে-রে —ফেল-বে–কে-উ—বাঁচ-বে—না—ও-র—আ-ত্মা—শা-ন্তি—পা-ই নি—-শা-ন্-তি—-পা–ই–নি—–এ-বা-র—–আ–মা–য়–
    –ড়ে–দে—আ-মায়—এ-বা-র–ছে–ড়ে –দে-দে–দে।”

    আমি চিৎকার করে বললাম, “আপনি চলে যান- আপনার বংশধরের দেহ থেকে এবার আপনি চলে যান–চলে যান।”
    সঙ্গে সঙ্গে একটা দমকা বাতাসে জানালা গুলো খুলে যেতেই মনে হলো ঘর থেকে একটা ছায়া যেন বাইরের জমাট অন্ধকারে মিশিয়ে গেলো। রূপেন জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো মেঝের উপর। ওকে আমি তুলে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম বেডরুমে খাটের উপর বিছানায়। তারপর ওর চোখে মুখে মন্ত্রপুত জলের ছিটে দিতেই ও আস্তে আস্তে চোখ খুললো বটে কিন্তু কথা বলতে পারলো না।ইশারা করে জল খেতে চাইলে আমি রোহিনীকে একটু গরম দুধ আনতে বললাম।রোহিনী দুধ নিয়ে এলে ওকে একটু একটু করে দুধ দিলাম মুখে। প্রায় ঘন্টা খানেক কেটে গেলো ঐ ভাবেই, তারপর হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমার হাতটা চেপে ধরেছে। আমি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম,”কি রে কিছু বলবি।”
    ও ধীরে ধীরে বললো,”রোহিনী কোথায়?”
    রোহিনী পাশেই দাঁড়িয়েছিলো বললো, ‘এই তো আমি, কোনো ভয় নেই সব ঠিক আছে।” মনে হলো ও যেন একটু হাসার চেষ্টা করলো।রোহিনীকে আমি শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিলাম।

    পরেরদিন সকালে চায়ের আসরে রূপেন বললো, “এখন তাহলে আমাদের করণীয় কি?”
    রোহিনী বললো, “সে তোমাকে ভাবতে হবে না, বাদলবাবু সব ব্যবস্থা ভেবেরছেন।”
    আমি বললাম “চিন্তা নেই, এই শনিবার রাতেই হোম করবো ঐ পুকুরের বাঁধানো ঘাটে এবং ঐ প্রেতাত্মাকে মুক্তি দেবো তন্ত্রমতে। তার জন্য যা যা দরকার আমি লিস্ট করে রেখেছি রামদিনকে দিয়ে জিনিসগুলো আনিয়ে নিতে হবে। সেদিন ওখানে রামদিনও থাকবে আমাদের সঙ্গে।”
    রূপেন ও রোহিনীর চোখমুখ দেখে মনে হলো তারা যেন দীর্ঘদিনের একটা সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে চলেছে। রূপেন রামদিনকে ডেকে তার হাতে লিস্ট ও একটা পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললো, “আজই এই জিনিসগুলো তার বাঙলার বাজারে গণেশ ভান্ডার থেকে নিয়ে এসো।”
    রামদিন জি হুজুর বলে বিদায় নিলে রূপেন আমাকে বললো, “ভাগ্যিস সেদিন তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিলো, তা নাহলে কি যে হতো!”
    আমি বললাম, “সত্যিই তাই। আসলে কি জানিস রাখে হরি তো মারে কে–আর মারে হরি তো রাখে কে!”

    দেখতে দেখতে দু’টো দিন কেটে গেলো।আজই শনিবার। সকাল থেকেই আমরা তিনজনে মানসিক ভাবে হোমের জন্য প্রস্তুত হয়ে রইলাম। হোম শুরু হবে ঠিক রাত দশটায়- সেখানে থাকবো আমি, রূপেন, রোহিনী ও রামদিন। দিনে শুধু চা আর জল ছাড়া কিছুই খাওয়া যাবেনা, কারণ তিনজনকেই উপবাসে থাকতে হবে, এমনকি রামদিনকেও। রামদিনকে উপবাসের কথা আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি, রূপেন ও রোহিনী বাড়ির লনে পড়ন্ত রোদে চেয়ারে পিঠ এলিয়ে গল্পগুজবে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে দিলাম, তারই মাঝখানে রোহিনী আমাদের জন্য চা করে নিয়ে এলো। আমরা চা খেয়ে উঠে গেলাম বাড়ির ভেতরে।রোহিনী দেখলাম কিচেনে গেলো। মনে হয় ছায়াদিকে সাহায্য করতে, কারণ রাত্রে হোম শেষ করে নিরামিষ আহার গ্রহণই বিধেয়, তাই ছায়াদির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সে হয়তো লুচি ও নিরামিষ কোনো পদ বানিয়ে নেবে রাতের জন্য।

    রাত ঠিক সাড়ে নটায় সকলে জিনিস পত্র নিয়ে পৌঁছে গেলাম পুকুরের বাঁধানো ঘাটে।আমি মন্ত্র পড়ে সকলের গাত্রবন্ধন করলাম, আর গলায় পড়ে নিলাম রুদ্রাক্ষের মালা ও ভবাণীযন্ত্রম। দু’টো বড় চার্জার লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। আমি হোমের নিমিত্ত স্থন্ডিল প্রস্তুত করে কুশাসনে বসে পড়লাম বাকিরা অর্থাৎ রূপেন ,রোহিনী ও রামদিন বসে রইলো আমার কিছুটা পেছনে। আমি অশ্বত্থ কাঠ সাজিয়ে কুশ দ্বারা মন্ত্রপাঠ পুর্ব্বক অগ্নি সংযোগ করতেই যোগাগ্নি জ্বলে উঠলো। আমি সর্ব্বদেবদেবীকে একে একে মন্ত্রপাঠ করতে করতে ঘৃতাহুতি দিতে লাগলাম এবং যোগাগ্নিতে সমীধ যোগাতে লাগলাম কখনো সমন্ত্রক কখনবা অমন্ত্রক।একসময় পূর্ণাহুতির সময় এগিয়ে এলো আর ঠিক তখনই ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা! হঠাৎ রোহিনী চিৎকার করে খ্যানখ্যানে গলায় বলে উঠলো,”আঁমায় ছেঁড়ে দেঁ রেঁ আঁগুনেঁ পূঁড়িয়েঁ মাঁরিস নাঁ। ছেঁড়ে দেঁ, ছেঁড়ে দেঁ।” বলতে বলতে রোহিনী জলের দিকে দৌড়ে যেতে গেলে রামদিন ও রূপেন তাকে ধরে ফেললো। আর ঠিক তখনই পুকুরের মাঝখানে আভির্ভাব ঘটলো এক ছায়ামূর্তির তার অট্টহাসিতে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো- হঠাৎ একটা দমকা বাতাস সবকিছু যেন লন্ডভন্ড করে দিতে চাইলো- আমি আর দেরী না করে মন্ত্রপাঠ করে পূর্ণাহুতি দিলাম যোগাগ্নিতে- সঙ্গে সঙ্গে সব আবার আগের মতো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো- আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেলো পুকুরের মাঝখানে সেই ছায়ামূর্তিটি আগুনে পুড়তে আরম্ভ করেছে আর খ্যান খ্যানে গলায় বিকট চিৎকার করে চলেছে। দেখতে দেখতে সেই ছায়ামূর্তির মধ্যে থেকে বেড়িয়ে এলো একটা জলন্ত কঙ্কাল সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “আঁর আঁসবো নাঁ এঁখানে, আঁমাঁয় ছেঁড়ে দেঁ—ছেঁড়ে দেঁ—ছেঁড়ে দেঁ।” একসময় সেই নরকঙ্কাল পুড়ে ছাই হয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলীর সাথে মিশে গিয়ে উঠে যেতে লাগলো দূর আকাশে আর তার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে গেলো দূরদিগন্তে।
    আমি সেই দিকেই তাকিয়ে ছিলাম এতক্ষণ ।হঠাৎ রূপেনের হতাশাভরা কন্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পিছন ফিরে দেখি রোহিনী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে বাঁধানো ঘাটের উপর– জল থেকে কিছুটা দূরে।

    আমি চিৎকার করে বললাম, “আর কোনো ভয় নেই প্রেতাত্মা মুক্তি লাভ করেছে। চলো ওকে তুলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে।”

    রূপেন রোহিনীকে কোলে তুলে নিলো।রামদিন আলো হাতে আমাদের পথ দেখাতে লাগলো- আমরা অবশেষে পৌঁছে গেলাম বাড়ির বারান্দায়। রোহিনীকে সোফার উপর শোয়ানো হলো, আমি তার মুখে মন্ত্রপুত জলের ছিটে দিতেই সে চোখ খুললো। আমি, রূপেন ও রামদিন সেখানেই আরোও ঘন্টা খানেক বসে রইলাম- রূপেন রোহিনীর মাথায় হাত বোলাতে লাগলো।আমিও ভবাণীযন্ত্রম রোহিনীর মাথায় ঠেকিয়ে ভবাণীস্ত্রোত্র পাঠ করে দিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম রোহিনী ধীরে ধীরে উঠে বসেছে সোফার উপর।এখন আর চোখে মুখে সেই অশুভছায়ার প্রভাব নেই, পায়ের মাংসল অংশের ভেতরেও সেই অশরীরীর স্পর্শ কেটে গেছে। সারাগায়ে লেপ্টে থাকাসেই অশুভছায়ার কুয়াশাও উধাও–এ যেন রোহিনীর নবজন্ম। সেই রাত্রে সকলেই আমরা গরম দুধ খেয়ে কাটালাম।
    পরেরদিন যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন ৮টা। আমি ব্রাশট্রাশ করে ফ্রেস হয়ে আমার জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে রোহিনী ও রূপেনের সাথে চায়ের আড্ডায় যোগ দিলাম।গরম গরম লুচি ও আলুর দম সহযোগে প্রাতরাশ সারলাম—এবার আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে বললাম,”এবার তো আমায় ছেড়ে দিতে হবে বন্ধু।”

    রূপেন বললো,”তোর এই উপকার জীবনেও ভুলবনা ভাই।”

    রোহিনী বললো, “চলুন না একবার গোয়ায় মাসখানেক থেকে আসবেন।”

    আমি বললাম, “এবারে তা আর সম্ভব নয় ভাবীজি, নেক্সট টাইম চেষ্টা করে দেখবো।”

    আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম নীচে, তারপর ধীরে ধীরে গেটের কাছে আসতেই রামদিন আমাকে সেলাম জানালো, ওর চোখে মুখে একটা কৃতজ্ঞতা বোধ বেশ লক্ষ্য করলাম। একসময় গেট পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বড়রাস্তার উপর– সেখান থেকে ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলাম রূপেন ও রোহিনী তখনও দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে–ওরা যেন এখন শাপমুক্তির আনন্দে বিহ্বল।একসময় দেখলাম চৌধুরী বাড়ির চিলেকোঠাটাও যেন ওদের দু’জনের মতোই আকাশের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শাপমুক্তির আনন্দে শরতের রোদমেখে হালকা একটা বিমূর্ত হাসিতে মাথা দোলাচ্ছে।
    ——— সমাপ্ত——

  • ভৌতিক গল্প

    গেষ্টহাউসের সেই রাত

    গেষ্টহাউসের সেই রাত
    -পার্থসারথি 

     

     

    স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যখন নামলাম তখন সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। পশ্চিম দিগন্তে তাকিয়ে বুঝলাম সূর্যদেব অনেক আগেই বিশ্রাম নিতে চলে গেছেন তাঁর নিজের ডেরায়। মাঘমাসের শীতেমোড়া সন্ধ্যা। আমি যে জায়গায় এসে পৌছেছি তার চারপাশটা দেখে মনে হচ্ছে সবত্র যেন কয়েক শতাব্দীর প্রাচীনতা দাঁত কিড়মিড় করছে। ট্রেন থেকে নেমে শরীরের জড়তা কাটিয়ে উঠতে একটু আড়মোড়া ভাঙার মতো করে পেশীগুলোকে একটু চনমনে করে নিচ্ছি এমন সময় কে যেন পেছন থেকে ডাকলো-
    “এই যে ও মশাই? শুনছেন? ঘড়িতে এখন কটা বাজে বলুন তো?” দেখলাম প্ল্যাটফর্মের রেলিংয়ের ধারে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে একটি লোক।
    আমি বললাম,”সাতটা।”
    লোকটা বললো,”অনেক দেরী হয়ে গেল মনে হচ্ছে।”
    আমি বললাম, “আপনি?”
    “আপনি তো বলরামপুরে যাবেন?” বললো লোকটি।
    আমি খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম প্রথমে, তারপর ভাবলাম হয়তো এখানে যেসব যাত্রীরা নামে তাদের অধিকাংশের গন্তব্য বলরামপুরই হয়ে থাকে।
    “আমি জানি আপনি বলরামপুরে কোথায় উঠবেন?গেষ্টহাউসে, তাই না?” বলতে বলতে লোকটা উঠে এলো প্ল্যাটফর্মে।
    এবার কিন্তু অবাক হলাম যেন একটু বেশী। মনে মনে ভাবলাম,”এই লোকটা এতকথা জানলো কি করে?” পরমুহুর্তেই আবার ভাবলাম, “লোকটা গেষ্টহাউসের কোনো কর্মচারী টর্মচারী হবে হয়ত! যাক গে-! “আমি লোকটাকে প্ল্যাটফর্মের আলোতে দেখতে লাগলাম।
    লোকটার পরনে ছিলো একটা ময়লায় কালচে হয়ে যাওয়া কাপড়, খদ্দরের শার্ট ও সারা গায়ে একটা কালো চাদর জড়ানো, মুখটা বেরিয়ে আছে শিয়ালের মুখের মতো; চাদরের নীচে শার্টটা দেখা যাচ্ছে, তার চেহারায় লক্ষ্য করলাম যেন একটা পারলৌকিক ছলনা ছায়ার মতো ঘিরে রয়েছে, কঙ্কালসার শরীরের উপরে সৃষ্টিকর্তা যেন নিতান্ত অনীহার সঙ্গে একটা প্রকান্ড মাথা বসিয়ে দিয়েছে, চোয়াল দু’টোতে পতনোন্মুখীনতার অনিশ্চয়তা পোড়োবাড়ির ঝুলে পড়া কার্নিশের মতো, চোখগুলোতে যেন পাতালরহস্যের ইতিকথা। লোকটাকে দেখে আমার যেন কেমন একটা মনে হলো, মনের ভেতর একটা জমাট রহস্য যেন ফোঁস ফোঁস করছে। তবু আমি মনের ভাব চেপে রেখে বললাম,”তা আপনিও কি বলরামপুরে যাচ্ছেন?”

    “হ্যাঁ ওখানেই যেতে হবে” চাপাগলায় লোকটা বললো।
    বললাম, “তাহলে তো ভালোই হলো, একজন সঙ্গী পেলুম!- চলুন এখন একটু চা খাওয়া যাক। পরে রওনা হওয়া যাবে”
    “আজ্ঞে, আমি চা খাই না।আপনি চাইলে খেতে পারেন,আমি এখানেই রয়েছি –আপনি খেয়ে আসুন।”
    মনে মনে ভাবলাম,”কলিযুগের অবতার নাকি অপরের দয়া গ্রহণ করেন না।যাক্ গে—“ততক্ষণে ঠান্ডাও বেশ জাঁকিয়ে পুরো এলাকাটাকে কবজা করেছে,ইতিমধ্যে সময়ও গড়িয়ে গেছে অনেকখানি। চারদিকে যেন একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা ,আমার সঙ্গে যে দুচারজন যাত্রী নেমেছিল এখানে তারা অনেক আগেই যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিয়েছে। মাঘমাস উত্তুরে ঠান্ডা হাওয়া পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন বরফ ঢেলে চলেছে।শুক্লাচতুর্থীর ফ্যাকাশে জ্যোৎস্নায় চারদিক যেন মোহময়ী হয়ে উঠেছে।
    আমি পায়ে পায়ে স্টেশন চত্বরে একটা টি স্টলের দিকে এগিয়ে গেলাম।বেঞ্চে বসে চায়ের অর্ডার করতেই একটা ছেলে আমার হাতে মাটির ভাঁড় ধরিয়ে দিলো।চায়ে চুমুক দিতে দিতে লক্ষ্য করছিলাম আমার জন্য প্রতীক্ষিত লোকটি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে,মনে হচ্ছে তার মনের গভীরে যেন একটা কুটিল ইচ্ছা ক্রমশঃ জমাট বাঁধছে–অবশ্য এটা আমার বোঝার ভুলও হতে পারে।
    প্ল্যাটফর্মের পেছনে দেখলাম তখনও একজন রিক্সাওয়ালা চাদরমুড়ি দিয়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে,যাইহোক তারসঙ্গে কথাবার্তা বলে আমি এবং প্ল্যাটফর্মে দেখা হওয়া লোকটি আরও আধঘন্টার মধ্যে ঐ ভ্যান রিক্সায় চড়ে স্টেশন ছাড়িয়ে বলরামপুর অভিমুখে রওনা হয়ে গেলাম। দুধারে সোনাঝুড়ির জঙ্গল–চারদিকে একটা রহস্যময়তা যেন থাবা পেতে বসে আছে,তার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছে যেন আমার সঙ্গের এই লোকটির পান্ডুর ভাবলেশহীন নিরবতা—-যাইহোক এখানে বলে রাখা ভালো আমার বলরাম পুরে আগমনের কারণটা–আমি কোলকাতায় একটি অডিট আফিসে চাকরি করি বলরামপুর যাচ্ছি অডিটের কাজে ওখানে একটা ইউকো ব্যাঙ্ক আছে সেখানেই আগামী পরশু থেকে অডিটের কাজ শুরু করতে হবে।ওখানকার ব্যাঙ্কের ম্যানেজার কৌশিক রায় আমার থাকার ব্যবস্থা ওখানেই করেছেন অবশ্য কালকে আমার আর একজন সহকারীও এসে পৌঁছে যাবে।কৌশিক বাবুর নির্দেশ মতোই হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে নেমেছি এই জনমানব শুন্য স্টেশনে।

    রিক্সা ভ্যান একটা একটানা ক্যাঁচড়,ক্যাঁচড় শব্দ তুলে চলছে তো চলছেই অবশেষে ঘন্টাখানেক পর আমরা আমাদের গন্তব্যের কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম অর্থাৎ ভ্যান ওয়ালার পুর্ব কথা মতো– নন্দীপুরের আমবাগান। এখান থেকে বড়রাস্তার ডানদিকে আমবাগানের ভেতর হয়ে আরও ঘন্টাখানেকের হাঁটা পথে আমাদের অভীষ্ট সেই গেষ্টহাউস-এ পৌঁছে যেতে পারবো।
    ভ্যান ওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে আমি এবং স্টেশনের সেই লোকটি হাঁটা লাগালাম বাগানের ভেতরে রুক্ষ মাটির রাস্তা ধরে।আমার ডানহাতে ছিলো একটা অ্যাটার্চিকেশ ও কাঁধে লম্বা হাতলওয়ালা চামড়ার ব্যাগ।
    চারদিকে শুধু ঝিঁঝিঁ র ডাক আর নিশাচর পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছেনা।কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমিই নিস্তব্ধতা ভেঙে লোকটিকে প্রশ্ন করলাম,”আপনার বাড়ি কি বলরামপুরেই ,না?–“
    সে বললো,”না”।আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম,”তবে?”লোকটা আর কোনো উত্তর দিলো না।
    ঐটুকুই যা কথা হলো তার সঙ্গে ।আবার একটা জমাট নিস্তব্ধতা।আমি হাঁটছিলাম লোকটার পিছু পিছু কারণ লোকটাকে কেমন যেন আমার একটু একটু সন্দেহ হয়েছে প্রথম থেকেই তাই তার পেছনে পেছনে হ়াঁটাই সমীচীন বলে মনে হয়েছিল আমার।
    এবার লোকটাই হঠাৎ আমাকে বললো ,” আপনিতো ঐ গেষ্টহাউস এ থাকবেন?নাকি?
    আমি বললাম,”হ্যাঁ ওখানেই তো থাকার ব্যবস্থা হয়েছে,কেন বলুন তো?’মনে মনে ভাবলাম,”লোকটার আবার কোনো কুমতলব টতলব নেইতো!”
    লোকটি বললো,”জায়গাটা খুব একটা ভালো নয়,আপনার মতো অনেক সাহেব ও বাড়িতে এর আগে উঠেছিলেন কিন্তু একরাতের বেশী টিকতে পারেনি।”মনে মনে ভাবলাম ,”কৌশিক বাবুর কাছেতো তেমন কিছুই শুনিনি–গেষ্টহাউসের যে এমন একটা বদনাম আছে!—-অবশ্য কৌশিকবাবু তো মাসখানেক হলো বদলি হয়ে এখানে এসেছেন তারপক্ষে এতো ঘটনা জানাও বোধহয় সম্ভব নয়।”
    যাইহোক আমি একটা সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম একটু, ততক্ষণে দেখি লোকটা বাঁদিকে ঝোপের মধ্যে নেমে যাচ্ছে, আমিতো রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম এবং চিৎকার করে বলে উঠলাম,”ও মশাই!করছেন কি?ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন?ওদিকে তো কোনো রাস্তা নেই,তবে?”
    লোকটা চাপা গলায় বললো,”এখান থেকে একটু আগেই গেষ্টহাউস পেয়ে যাবেন, চিন্তা নেই,চলে যান!আমি এ পর্যন্তই -তার বেশী যাওয়ার আমার উপায় নেই।”
    তারপর যা ঘটলো তা মোটেই কোনো প্রাকৃত ঘটনা নয়,দেখলাম ঐ ঝোপের মধ্যে একটা গাছের খ্যাংড়া ডালে একটা কাপড় মৃদু বাতাসে দুলছে।ব্যাগ থেকে টর্চটা বের করে একটু এগিয়ে গিয়ে ঝোপের উপর ফেলতেই যা দেখলাম তাতে আমার ভেতরটা যেন একটা অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠলো– দেখলাম যে কাপড়টা দুলছে ওটা ঐ লোকটার আর মাটিতে যে শার্ট ও কালো চাদরটা পড়ে আছে সেগুলোও তারই ,কিন্তু লোকটা কোথায়?কৌতূহল বশে ঝোপের এদিক ওদিক টর্চ নিয়ে দেখতেই যা দেখলাম তাতে আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে যেতে লাগলো।দেখলাম একটা মরার মাথার খুলি ও তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কতকগুলো হাড় ।ব্যাপারটা এতক্ষণে আমার মাথায় ঢুকলো আমি সেখানে আর একটুও অপেক্ষা না করে হনহন করে এগিয়ে গেলাম গেষ্টহাউসের দিকে। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম একদম গেষ্টহাউসের গেটে।
    গেটের এপার থেকে একবার হাঁক পারলাম,”ভে-ত-রে কে-উ আ-ছেন?আ-মি অ-ডি-ট-বা–বু!”
    দেখলাম ভেতরবাড়ির দরজা খুলে বেশ হৃষ্টপুষ্ট একটা লোক –এই গেষ্টহাউসের কেয়ারটেকারই হবে বোধহয়! হ্যারিকেন হাতে এগিয়ে আসছে। গেটের কাছে এসে ডানহাতটা কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানিয়ে বললো,”আসুন সার্।”বলে গেটের তালা খুলে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল।
    বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখলাম ভেতরটা বেশ সাজানো তবে আলোর অভাব ।একটা হ্যাজাক জ্বলছে বটে, তবে এই পেল্লাই সাইজের রুমের পক্ষে যথেষ্ট নয় ।সামনেই সোফার উপর বসে চারদিকটা বেশ ভালো করে লক্ষ্য করতে লাগলাম।ঘরের মধ্যে আসবাব পত্রের প্রাচুর্য চোখে পড়ার মতো।সামনে একটা ছোট টি-টেবিলের উপর আমার ব্যাগ ও অ্যাটার্চিকেশটা নামিয়ে রাখলাম।একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বাইরে বেরিয়ে এলাম,পুরো গেষ্টহাউসটা ভালো করে একনজর দেখে নিলাম।গ্রাউন্ড ফ্লোরে এই মাঝের বড় রুমটা ছাড়াও রয়েছে আরও পাঁচ পাঁচটা রুম, সবগুলোই তালাবন্ধ, লম্বা একটানা বারান্দা,বারান্দার দেওয়াল প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু তার উপর দুফুট আন্দাজ ব্যবধানে লোহার গ্রিল বসানো।একদম মাঝখানে প্রধান দরজা,তারসামনে গাড়ি বারান্দা। কিছুক্ষণ পর আবার ভেতরে এসে সোফাটায় বসলাম এবং লক্ষ্য করলাম এই বড় রুমটার একপাশে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির গ্রিলের দরজা।সবকিছুই ঠিকঠাক, একটা জিনিস চোখে পড়তেই একটু আশ্চর্য হলাম,দেখলাম সমগ্র বাড়িটায় ইলেক্ট্রিফিকেশনের সব ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও তার ফল থেকে বাড়িটা যেন বঞ্চিত–গেটের বাইড়েও দেখলাম বৈদ্যুতিক তারের পোল তবে এ বাড়িতে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে না।মনে মনে একটা সদুত্তর পাবার চেষ্টা করছি এমন সময় দেখি এই গেষ্টহাউসের কেয়ারটেকার এসে হাজির।তাকে দেখেই আমি জিজ্ঞাসা করলাম,”আচ্ছা এখানে বৈদ্যুতিক আলো জ্বালানো হয়না?সবই তো ব্যবস্থা রয়েছে দেখছি, তাহলে?”
    কেয়ারটেকার বললো,”এখানে দীর্ঘদিন ধরে কোনো সংযোগ নেই বাবু, তার চুরি গেছে বহু এলাকায় তাই।”
    বললাম ,”এরজন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ?”
    সে বললো,”বহুবার সংযোগ ঠিক করা সত্ত্বেও কোনো সুরাহা হয়নি বাবু,তার-চোরেরা বার বার তার চুরি করে নিয়ে চলে যায়।”
    কথায় কথায় জানতে পারলাম লোকটির নাম দ্বিজেন দাস, পাশের গ্রাম বিষ্ণুপুরে তার বাড়ি, আজ দশ পনেরো বছর সে এখানে কেয়ারটেকার গিরি করছে।বললাম,”দ্বিজেন একটু চায়ের ব্যবস্থা করতে পারবে?”
    সে তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানিয়ে বাইরে চলে গেলো।আমি ততক্ষণে আমার অ্যাটার্চিকেশ থেকে ট্র্যাকস্যুট ,সাবান,হ্যান্ডওয়াশ ও টাওয়েল বার করে সামনের টি-টেবিলের উপর রাখলাম ।এটা অবশ্য আমার থাকবার রুম নয়,এটা সভাকক্ষ অর্থাৎ অনেকটা বৈঠক খানার মতো,বাইরে থেকে সরকারী আমলারা এলে এখানেই তাদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। ঘরটা বেশ বড় ।মাঝখানে বড়মাপের একটা গোলাকার দামীকাঠের টেবিল তার চারপাশে খান পঁচিশ গদিআঁটা চেয়ার সুন্দর ভাবে সাজানো,তাছাড়াও রয়েছে দেওয়াল ঘেঁষে একটা বড় সোফা ও ছোট ছোটো দুটো টি-টেবিল।

    একটু পরেই দেখলাম দ্বিজেন চায়ের ট্রেতে চা ও কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে এসে হাজির হলো।
    চা টা খেয়ে টেবিলের উপর জিনিসপত্র তুলে নিয়ে আমি দোতলায় স়িঁড়ি বেয়ে উঠে দেখলাম ডানদিকের একেবারে শেষ রুমটার আগের রুমটা আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছে।দোতালার ঝোলাবারান্দায় দামীকাচের বড় বড় চার পাঁচটা জানালা।এককথায় গেষ্টহাউসের পুরো বিল্ডিংটা খুব সফিস্টিকেটেড্ ।আমার জন্য বরাদ্দ রুমটায় ঢুকে চারদিক বেশ ভালো করে দেখে নিলাম এবং জিনিস গুলি যথাস্থানে গুছিয়ে রাখলাম। দশ বাই দশ রুম ।রুমের পেছনে দুটো মাঝারি সাইজের জানালা তাতেও দামীকাচ লাগানো পাল্লা এবং ঝোলাবারান্দার দিকটায় একটা দামী কাঠের কারুকার্য করা দরজা, এই দরজা হয়েই সিঁড়ি বেয়ে একটু আগে ঢুকেছি আমার রুমে।দোতালায় ওঠার সিঁড়ির দরজা ঝোলাবারান্দার ঠিক মাঝের অংশে উন্মুক্ত। ঝোলাবারান্দার এই অংশটি বাইরের দিকে আরও একটু প্রশস্ত হয়ে একেবারে ঠিক গাড়িবারান্দার মাথায় চূড়ার মতো শোভা পাচ্ছে।আরও একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম দোতলায় ঝোলাবারান্দার দুইপ্রান্তে অত্যাধুনিক কারিগরীবিদ্যার দৌলতে তৈরীকৃত দুটি টয়লেট।
    আমার জন্য বরাদ্দ রুমটির একধারে একটা লোহার খাট,পূর্ব থেকে পশ্চিমে সাজানো ,একটা আলমারী ও খান কতক ফাইবারের চেয়ার এবং ঘরের এককোনে একটা ছোটো টেবিল।এবং ঘরের দরজার ডান দিকের কোণে একটা কারুকার্য ক‍রা পাথরের কুঁজো।
    সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো যে জিনিসটা তা হলো ঘরটার নিট্ অ্যান্ড ক্লিন এমবিয়েন্স মানে একেবারে ঝকঝকে চেহারা।যে কোনো লোকের কাছেই ব্যাপারটা চোখে ধরার মতো।হঠাৎ দ্বিজেন ঘরে ঢুকে জানালো সে নন্দীপুরের বাসস্ট্যান্ড থেকে আমার রাতের খাবার নিয়ে এসেছে সাতটার সময়।
    আমি দ্বিজেনকে কাছে ডেকে স্টেশন থেকে আসার সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে জানাতেই দ্বিজেনের চোখে মুখে দেখলাম একটা ভয়ের আস্তরণ।
    একটু আসস্ত হয়ে দ্বিজেন বলতে লাগলো,”তবে শুনুন ঘটনাটা খুলেই বলি আপনাকে।আজ থেকে প্রায় ষোলো সতেরো বছর আগে এখানে এক ভদ্রলোক শহর থেকে জরিপের কাজে এসেছিলেন এই বলরামপুর অঞ্চলে এবং তিনি এই গেষ্টহাউসেই আস্তানা গেড়েছিলেন প্রায় দিন দশেকের জন্যে তার সঙ্গে আরও দুজন তার সহকর্মীও ছিলো। তারাও তার সঙ্গে এই গেষ্টহাউসেই থাকতো ।সারাদিন ধরে এ অঞ্চলের এখানে ওখানে জরিপের কাজ শেষে সন্ধ্যাবেলা ফিরে আসতেন এখানে।এইভাবেই বেশ কয়েকটাদিন পার হলে তার সঙ্গের সহকর্মী দুজন কি একটা জরুরী কাজে কোলকাতা ফিরে গিয়েছিল।এবং দিন দুয়েকের মধ্যে তারা আবার যখন এখানে ফিরে আসে দেখে সেই ভদ্রলোক উধাও—তারা তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার কোনো হদিশ পায়নি।”
    আমি মাঝে দ্বিজেনকে থামিয়ে বললাম ,”পুলিশে খবর দেওয়া হয়নি?”
    “পুলিশ কে খবর দেওয়া হয়েছিল এবং তারা সেই ঘটনার প্রায় দিনকুড়ি পড়ে ঐ ভদ্রলোকের ধূতি ,চাদর ও শার্ট অক্ষত অবস্থায় আবিস্কার করে নন্দী পুরের আমবাগানের একটি ঝোপের ধার থেকে এবং তার কিছুটা দূরেই পাওয়া গিয়েছিল তার পচাগলা লাশ ,পুলিশি তদন্তে জানা যায় তার মৃত্যু হয়েছে কোনো বন্যজন্তুর আক্রমনে।সেই থেকে রাতের বেলা আপনার মতো সাহেব সুবো লোক এই গেষ্টহাউসে যারাই এসেছে তারা ঐ একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে।”
    ঘটনাটা শুনে ভয় যে পেলাম না তা ঠিক নয় কিন্তু ভেতরে ভেতরে যেন একটা রহস্যের গন্ধ পেয়ে মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো।
    ভদ্রলোকের মৃত্যু যে বন্যজন্তুর আক্রমনে ঘটেনি সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত কারণ বন্য জন্তু আক্রমন করলে তার জামা ,কাপড় ও চাদর অক্ষত অবস্থায় থাকতো না ।পুলিশ মনে হয় ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশী ঘাঁটাতে চাইনি।আর তাছাড়া আজ থেকে ষোলো সতেরো বছর আগে পুলিশি তদন্তের ধরণ-ধারণও আজকের মতো এতটা কমপ্যাক্ট ছিলো না। তবে?তবে কি–!!
    যাহোক দ্বিজেন বললো ,”বাবু খাওয়া দাওয়া সেরে ভালো ভাবে দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে পড়ুন ,অনেকটা রাস্তা জার্ণি করে এসেছেন। আমি কাল সকাল ছটাতেই এসে হাজির হবো কোনো ভয় নেই।” আমি দ্বিজেনকে জিজ্ঞাসা করলাম ,”আচ্ছা দ্বিজেন এখান থেকে মাইল টেকের মধ্যে কোনো জনবসতি নেই?”দ্বিজেন বললো এই গেষ্টহাউসের পূর্বদিকে একটা কুমোরপাড়া রয়েছে, ব্যাপারটা জেনে একটু আস্বস্ত হয়ে আবার বললাম,”তুমি এতো রাত্রে বিষ্ণুপুর যাবে?তোমার ভয় করবে না ?’
    দ্বিজেন জানালো যে সে আজ আর বিষ্ণুপুর যাবে না বলরামপুরেই থাকবে তবে এখানে নয় দাস পাড়ায় সেখানে তার শ্বশুর বাড়ি।তার স্ত্রী নাকি আসন্ন প্রসবা কখন যে পেন উঠবে বলা যায়! তাই তাকে সেখানে থাকতেই হবে।আমি দ্বিজেনকে বাইরের গেটে তালা লাগিয়ে দিয়ে যেতে বললাম।যাইহোক দ্বিজেন আমার কথামতো যথারীতি গেটে তালা লাগিয়ে তার সাইকেলের বেল বাজাতে বাজাতে রওনা হয়ে গেলো তার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে।আমি ও গেষ্টহাউসের অভ্যন্তর ভাগের প্রধান দরজায় তালা লাগিয়ে আমার রুমে ফিরে এলাম এবং রুমের দরজা ভালো ভাবে বন্ধ করলাম।বলরামপুর গ্রামটা বেশ বড় গ্রাম এখান থেকে বর্দ্ধমান নাকি বেশ কাছেই কৌশিকবাবু ফোনে সেই রকমই জানিয়েছিলেন।
    রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারটা ,আমি যথারীতি খাওয়া দাওয়া শেষ করে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে উপভোগ করতে লাগলাম নিশীথিনীর সেই রহস্যময় রূপ।
    চারদিকে একটা জমাট নিস্তব্ধতা যেন নিশ্বাস ফেলছে। সমগ্র প্রকৃতি যেন হয়ে উঠেছে রূপকথার সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের কোনো অজানা অচেনা দেশ।সিগারেট খাওয়া শেষ করে বোতল থেকে একটু জল খেয়ে নিলাম।ঘুমানোর আগে আমার একটু গল্পবই পড়া অভ্যাস ,তাই একখানা বড় মোমবাতি জ্বালিয়ে টেবিলের উপরে রেখে বইটা পড়তে লাগলাম।কিছুক্ষণ পড়ার পর ঘুমে জড়িয়ে আসতে লাগলো দুচোখ তাই আর জেগে থাকতে পারলাম না শুয়ে পড়লাম খাটে লেপমুড়ি দিয়ে।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই হঠাৎ একটাশব্দে ঘুমটা ভেঙে যেতেই শুনতে পেলাম একটা চাপা গর্জনের মতো কিছু শব্দ।ধরমরিয়ে উঠে বসলাম বিছানার উপরে ভালোভাবে শুনতে লাগলাম এবং অনুধাবন করতে লাগলাম শব্দটার প্রকৃতি।শব্দের মাত্রা যেন ক্রমশঃ বাড়ছে।শব্দটা আর যাইহোক কোনো মানুষের বা বন্যজন্তুর হতে পারেনা।এ শব্দ যে করছে সে মানুষ বা জন্তুর মতো নয়,কারণ শব্দের মধ্যে একটা অতিপ্রাকৃতিক প্রভাব রয়েছে মনে হলো একসঙ্গে অনেক গুলো সিংহ ও হায়েনা চিৎকার করলে যেমন শব্দ হবে শব্দটা ঠিক তেমনই।এই অঞ্চলে সিংহ বা হায়েনার বাস যে থাকতে পারেনা তা দেখলেই বোঝা যায়।তাহলে এটা কোন জন্তুর গর্জন–আরো ভালো করে শুনতে লাগলাম এবং একসময় যা শুনলাম তাতে আমি শুধু অবাকই হলাম না ,ভয় ও পেয়ে গেলাম কিছুটা।আমি পরিস্কার শুনতে পেলাম ঐ গর্জনের মধ্যে জেগে উঠছে একটি নারীকন্ঠস্বর।কি ভয়ংকর সেই কন্ঠস্বর! সে যেন বলছে ,”বি-বি-বি-ব-ব-ব-স-স-স-ন-ন-ন হ-হ-হ আ-মি-শো-ষ-ণ-কা-রি-ণী-পি-শা-চি-নী।”
    যার মর্মার্থ হলো–“বিবসন হ আমি শোষণকারিণী পিশাচিনী।”এবার ঐ জরিপের কাজে এখানে আশ্রয় নেওয়া ভদ্রলোকের মৃত্যুর কারণ আমর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল।
    আরো ঘন্টা খানেক কেটে যেতেই আর কোনো শব্দ শুনতে পেলাম না,চারদিকে নরকের নিস্তব্ধতা।চাঁদ ডূবে গেছে প্রথম প্রহরেই; তাই চারদিকে প্রকৃতি যেন জমাট অন্ধকারে ডুবে আছে।জানালাটা একটু ফাঁক করতেই বাড়ির পেছনের ঝোপঝাড়ে মধ্যে লক্ষ্য করলাম একটা মস্ মস্ আওয়াজ কেউ যেন হেঁটে চলেছে ভারী ভারী পা ফেলে–কতকগুলো কুকুর হঠাৎ ডেকে উঠেই আবার চুপ করে গেলো।ব্যাপারটা কি আরো ভালোভাবে জানতেই টর্চটা হাতে নিয়ে আমার রুমের দরজাটা খুলে বাইরে এলাম এবং অবশেষে পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে এসে দাঁড়ালাম একেবারে বারান্দার প্রধান দরজার সামনে।এবং সেখানে কান পেতে রইলাম।হঠাৎ গেট খোলার শব্দে সত্যিই আমি ভয় পেয়ে গেলাম।তারপর শুনলাম গেষ্টহাউসের খোলা লনে কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে।প্রথমটায় দরজা খোলার আমার সাহস হলনা।বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম এখন আমার কর্তব্য কি?মানুষের মন বলে ষষ্ঠ জ্ঞানেন্দ্রিয়টি বড় অদ্ভুত যখন সে অবশ্যম্ভাবী কোনোকিছুর টের পায় তখন মরিয়া হয়ে ওঠে–আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হলোনা।টর্চ হাতে দরজাটা খুলেই সোজা গেটের বাইরে চলে এলাম,আবার যখন টর্চ জ্বালানোর চেষ্টা করছি– দেখলাম টর্চটা আর জ্বলছে না।টর্চটা জ্যাকেটের পকেটে ভরে ক্ষীণ নক্ষত্রালোকে যা দেখলাম তা অত্যন্ত ভয়ংকর,দেখলাম একটা উলঙ্গ নারীমূর্তি একটা কুকুরের শরীর দাঁতে চেপে ধরে আছে তখনও কুকুরটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে।আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না মনে মনে ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করতেই মনের ভেতর জেগে উঠলো একটা অসীম সাহস আর সেই সাহসের বলেই আমি বাঘের মতো চিৎকার করে উঠলাম,”কে তুই?”
    উলঙ্গ ঐ নারীমূর্তি ভয়ংকর এক নাকিসুরে বলে উঠলো,”হুঁ—আঁ—আঁ আ-মি-শোষণকারি পিশাচিনী ,আমাকে সৃষ্টি করেছে এক তান্ত্রিক ,পালা এখান থেকে।”
    আমার গলায় ছিলো মক্ষম মৃত্যুঞ্জয় কবচ ,আমি জানি এ কবচ যতক্ষণ আমার গলায় থাকবে ভুত-প্রেত-দানা-দৈত্য-পিশাচ আমার কুশপ্রমাণ বিঘ্নও ঘটাতে পারবে না।
    দেখলাম কি ভয়ংকর সেই পিশাচিনীর মূর্তি
    চুলগুলো সাপের মতো,সুতীক্ষ্ম স্তনবৃন্ত ,হাতের নখ গুলো যেন এক একটা ধারালো ছুরি আর মুখটা শিয়ালের মুখের মতো তাতে লকলক করছে একহাত প্রমাণ একটা জিভ আর দাঁত গুলো বেরিয়ে আছে তীরের ফলার মতো।চোখগুলো যেন আগুনের ভাঁটা।চারদিকে একটা পচা মাংসের গন্ধে বিষিয়ে উঠেছে সেখানকার বাতাস।আমি সাহস সঞ্চয় করে বললাম ,”কে সেই তান্ত্রিক যে তোকে সৃষ্টি করেছে?কি নাম তার?”
    পিশাচিনী হুংকার ছেড়ে বললো,”ধনানন্দ তান্ত্রিক।কিন্তু সে আর বেঁচে নেই ,হা-হা–হা–আমিই তার রক্ত শুষে মেরে ফেলেছি হা-হা–হা”
    কি ভয়ংকর সেই অট্টহাসি শুনলেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে ওঠে।
    আমি আবার বললাম ,”কেন তুই এভাবে এই অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়িয়ে বেড়াচ্ছিস আর নিরীহ জীব হত্যা করে নিজের রক্তপিপাসা মেটাচ্ছিস।তুই কি কোনো দিনই মুক্তি পাবিনা?”
    এবার সে আমার উপর আক্রমণ করতে উদ্যত হতেই আমি গলার মৃত্যুঞ্জয় কবচ খানা ছিঁড়ে হাতের মুঠোতে পুরে সামনে ধরতেই পিশাচিনী ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলো।আমি যত এগোতে থাকি পিশাচিনী ততই পিছতে থাকে এভাবে কতটা পথ যে অতিক্রম করেছি মনে নেই একসময় দেখলাম একটা সূড়ঙ্গের মুখে দাঁড়িয়ে আছে ঐ পিশাচিনী আর আমি তার সামনে। আমি আরও এগিয়ে গেলাম তার দিকে সেও ঐ মৃত্যুঞ্জয় কবচকে ভয় পেয়ে ঢুকে পড়লো সূড়ঙ্গের ভেতরে ,সঙ্গে সঙ্গে যেন দৈববাণীর মতো কিছূ একটা শুনলাম এবং বুঝতে পারলাম সুরঙ্গের মুখে পাশের ঐ বড় পাথরখানা চাপা দিয়ে তার সামনে একটা ত্রিশূল মাটিতে পুঁতে দিলে ঐ পিশাচিনী আর কোনোদিনই বেরিয়ে আসতে পারবে না। দেখলাম সত্যি সত্যিই একখানা বড় পাথর রয়েছে সুড়ঙ্গের ঠিক ডানদিকে এবং পাথরের নীচেই পড়ে রয়েছে একখানা মরচে ধরা ত্রিশূল।আমি দৈববাণীর নির্দেশমতো পাথরটা অত্যন্ত কষ্ট করে সুড়ঙ্গের মুখে চাপা দিয়ে তার ঠিক সামনে ত্রিশূলটা মাটিতে পুঁতে ফেললাম।

    হঠাৎ একটা ঝড়ের সোঁ সোঁ আওয়াজ আমার কানে আসতে লাগলো। আমি সামনের একটা কি যেন গাছের দিকে তাকাতেই স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম সত্যিই এক তান্ত্রিকের আবক্ষ মূর্তি যেন জ্বলজ্বল করছে।হঠাৎ ঐ তান্ত্রিকের জলদগম্ভীর কন্ঠস্বর শুনতে পেলুম –“আ–জ–থে–কে–স–ব–শা–ন্–তি,আ–র–ঐ–পি–শা–চি–নী–কা–র—ও–কো–নো–ক্ষ–তি–ক–র–তে–পা–র–বে–না–না–না।”কথাগুলো ঐ উন্মুক্ত বনপ্রান্তরে বার বার প্রতিধ্বনিত হতে হতে অবশেষে মিলিয়ে গেলো দূরদিগন্তে।তারপর আবার সেই জমাট অন্ধকার আর অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা।কতক্ষণ যে সেখানে স্থানুর মতো দাঁড়িয়েছিলাম বলতে পারবো না,হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলাম একটা পাখির একটানা কর্কশ আওয়াজে।চারদিক ভালোকরে আর একবার চেয়ে দেখলাম–আঃ কি প্রশান্তি! বুকভরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম বারবার।দেখতে দেখতে ভোর হয়ে এলো,আমি ক্লান্ত পায়ে ফিরে এলাম গেষ্টহাউসে।এসে দেখি গেট যথারীতি তালাবন্ধ, এবার বুঝতে আমার একটুও অসুবিধা হল না যে–কাল রাত্রে আমি কোনো এক অতিপ্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে সম্মোহিত অবস্থায় গেট পেরিয়েছি বিনা বাধায়। অতএব বাধ্য হয়ে গেট পেরলাম ডিঙিয়ে এবং গেষ্টহাউসের ভেতরে প্রবেশ করলাম। এবং বুঝতে পারলাম কাল রাত্রে প্রায় মাইল চারেক পথ হেঁটে পিশাচিনী কে চিরবন্দিনী করে এসেছি।
    চারদিক একদম ফরসা হয়ে গেলো সকাল ছটার সময় দ্বিজেন যথারীতি এসে পৌছালো এবং বললো ,”রাত্রে ভয়টয় করেনিতো বাবু?ঘুম হয়েছিলো তো ঠিক?”
    আমি গতরাত্রির সমস্ত ঘটনা চিরদিনের জন্য হৃদয়বন্দী করে রেখে বললাম,”খুব ভালো ঘুম হয়েছিলো।”
    ———সমাপ্ত————
    বি.দ্র.:-গল্পে বর্ণিত স্থানাদি সম্পূর্ণ রূপে কাল্পনিক, একটা আপাত বাস্তবতা সৃষ্টির চেষ্টা মাত্র।

  • ভৌতিক গল্প

    জন্মান্তর

    জন্মান্তর
    -পার্থসারথি ঘোষাল

     

     

    [বিঃদ্রঃ-এই গল্পের সমস্ত চরিত্র ও ঘটনাবলী সম্পূর্ণভাবে কাল্পনিক।বাস্তবের সঙ্গে যদি কোনো যোগ থেকে থাকে তা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত ও সম্পূর্ণ রূপে কাকতালীয়।]

    মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি অজানাকে জানা, এই প্রবৃত্তি মানুষকে অনেক সময় নেশার মতো পেয়ে বসে।ইন্দ্রজিৎ বাবুরও প্রায় সেই রকম অবস্থাই হয়েছিল।ইন্দ্রজিৎ বাবু –মানে ডঃ ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ী। ভদ্রলোক কোলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজের জীববিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন। দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনে অনেক নিগূঢ় অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল। অবসর গ্রহণের পর তিনি চলে এসেছিলেন মেদিনীপুরে তাঁর পৈতৃক ভিটে পালপাড়ায়। তিনি বিপত্নীক, অবশ্য তাঁর দুই ছেলে আছে, তারা দু’জনেই উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী–যে যার ফ্যামিলি নিয়ে ভিনরাজ্যে বাস করে। মাঝে সাঝে অবশ্য তারা যে বাবার খবর নিতে গ্রামের বাড়িতে আসে না –তা কিন্তু নয়; তবে তা খুবই বিরল। ইন্দ্রজিৎ বাবুর বয়স প্রায় সত্তর বছর; কিন্তু তাই বলে স্বাস্থ্য সেই অনুপাতে ভেঙে যায় নি। এ বয়সেও তিনি রীতিমতো ড্রিঙ্ক করেন তবে সবই বিদেশী জিনিস। আজকাল তাঁকে বাইরেও খুব একটা দেখা যায় না। এখানে ত়াঁর সঙ্গী বলতে রাঁধুনি হরি, আর ফাইফরমাস খাটার জন্য এই গ্রামেরই ছেলে–গজা এবং তাঁর অতি আদরের স্যামসন্(ডোবারমেন্ট)। বাড়িটা একটা বহুকক্ষবিশিষ্ট দোতালা বাড়ি। গ্রাউন্ডফ্লোরে ঠিক মাঝখানে চৌকো বারান্দা এবং তার চারপাশে কিচেন ও ভাঁড়ারের জন্য ব্যবহৃত দু’টি রুম, তাছাড়াও রয়েছে অ‍্যাটাচ্ বাথ দু’টি টয়লেট। একটা ঘর রাঁধুনি হরির জন্য বরাদ্দ, এবং আরও গোটা তিনেক ঘর যেগুলো সবই বর্তমানে আন্ডার লক্ অ্যান্ড্ কি। দোতালার যে ঘরে ইন্দ্রজিৎ বাবু থাকেন তার গায়েই বাথরুম ও টয়লেট। তাছাড়াও রয়েছে বারান্দা ও বারান্দার চারপাশে লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরি রুম, এবং আরোও গোটা তিনেক ঘর ও একটা মাঝারি সাইজের বাথরুম কাম টয়লেট যেগুলো তালা বন্ধই থাকে প্রায়। গ্রাউন্ডফ্লোরে যাওয়ার সিঁড়ির দরজা বারান্দার একদিকে তাতে দামী ভেলভেটের পর্দা ঝুলছে। বাড়ির চারধারে প্রায় আটফুট উঁচু সারাউন্ডিং ওয়াল। প্রায় বিঘে তিনেক জায়গার উপর এই বাড়ি ও বাড়ি সংলগ্ন একটা বাগান যেখানে দেশী বিদেশী সব গাছই চোখে পড়বে। বাগানটা অবশ্য বাড়ির পেছনে, গ্রাউন্ডফ্লোরের একটা মাঝারি গেট দিয়ে ঐ বাগানে যাওয়া আসা করা যায়। অবশ্য, অন্য আর একটা পথও রয়েছে বাগানে যাবার– সেটা হলো বাড়ির ডানপাশে যে লম্বা পার্টিশন্ ওয়াল, বাগান এবং বাড়ির সম্মুখস্থ লন ও ফুলের বাগিচাকে পৃথক করেছে–তার গায়ে একটা ছোটো দরজা আছে। বাড়ির বামদিকে আরও একটা পার্টিশন্ ওয়াল রয়েছে তবে তা নাতিদীর্ঘ। অর্থাৎ বাড়িটা পুরো জায়গাটার মোটামুটি মাঝে। বাড়ির সামনে একদম ফটক পর্যন্ত প্রশস্ত লন, তার দু’পাশে গার্ড ওয়াল দিয়ে তৈরী ফুলের বাগিচা, কারণ ইন্দ্রজিৎ বাবু ফুল খুব ভালোবাসেন।বাড়ির কিচেন রুম সংলগ্ন একটা ইঁদারা, তাতে দামী পাম্পবসানো। দোতালার ছাদে একটা জাহাজ মার্কা জলের ট্যাঙ্ক। মোটকথা আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত হাউসিং পরিকাঠামোর প্রসাদ থেকে এ বাড়ির পরিবেশ যে বঞ্চিত নয়, তা সহজেই অনুমেয়। একটা দারোয়ান এবং দামী গাড়ির বোধহয় প্রয়োজন ছিল তবে কি কারণে যে এ দু’টি অনুপস্থিত তা বোঝা বড় শক্ত।

    আজ থেকে পাঁচ/ছয় বছর আগে ইন্দ্রজিৎ বাবুর কথায়-বার্তায় একটা প্রাণবন্ত মিশুকে ভাব লক্ষ্য করা যেত। বর্তমানে কি যেন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি যেন একটু অস্বাভাবিক মাত্রায় চুপচাপ; কারণ ছাড়া কথা বলেন না –এই আর কি! খুব ভোরে একবার দোতালা থেকে লনে একটু যা পাইচারি করেন, বাদবাকি দিনের অধিকাংশ সময়েই তিনি লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরিতে কি যেন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে–তাঁর কাছে মাঝে মাঝে কোলকাতা থেকে এক ভদ্রলোক আসেন। একদিন থেকে, তারপরের দিনই আবার ফিরে যান। ভদ্রলোকের নাম রমেন পুরকায়স্থ, জানা যায় উনিও নাকি ঐ সুরেন্দ্রনাথ কলেজেই ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করতেন। তিনিও রিটায়ার করেছেন আজ বছর ছয়েক হলো।
    একদিন ল্যাবরেটরি রুমের সামনে ইন্দ্রজিৎ বাবুকে খুব চিন্তিত মনে হলো, হঠাৎ তিনি লাইব্রেরী রুমে ঢুকে টেলিফোনে কাকে যেন রিং করে  বললেন, “হ্যালো, বিভাস আমি স্যার বলছি। আমার একটা বিষয় তোমার কাছে জানার ছিলো–হ্যাঁ, আরে না না–আজকাল আর চিন্তা শক্তিকে কাজে লাগাতে পারছি না।” টেলিফোনের ওপারে যিনি রয়েছেন অর্থাৎ বিভাস নামে লোকটি ব্যাপারটা মনে হয় জানতে চাইলো।ইন্দ্রজিৎ বাবু তখন তাকে যা বললেন তার মর্মার্থ হলো —-মানুষ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কি কোনো অতীন্দ্রিয় জগতে প্রবেশ করে, এবং সেখান থেকে একটা নৈসর্গিক শক্তি মাধ্যমে ইহজগতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে আবার পুনর্জন্ম লাভ করতে সমর্থ হয়? কিছুক্ষণ ধরে তিনি রিসিভারে কান রেখে খুব অভিনিবেশ সহকারে ঐ বিভাস নামে লোকটির কথা শুনলেন এবং অবশেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। তাঁর চোখ মুখের ভাব দেখে মনে হলো তিনি যেন তাঁর কাঙ্খিত জবাব পেলেন না। রুম থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলেন নীচে ,সঙ্গে তার একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু স্যামসন্। হরির তাঁর উপর চোখ পড়তেই বললো, “বাবু,আপনি এইসময় নীচে? কি মনে করে?” ইন্দ্রজিৎ বাবু যেন কথাটা শুনতেই পেলেন না মনে হলো। ঘড়িতে তখন প্রায় বিকাল সাড়ে পাঁচটা। স্যামসন প্রাচীরে হনুমানের মতো কি একটা দেখে বাঘের মতো গর্জন করতে লাগলো, ইন্দ্রজিৎ বাবু তাকে শান্ত করলেন। হরি খানিকটা দ্রুত ওদিকে এগিয়ে গিয়ে হাত উঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,”হেই-হেই–যা-যা-যা-হুস্-হুস্-যা-যা।”প্রাচীরে বসে থাকা প্রাণীটি হরির ঐ অদ্ভুত আওয়াজে ভয় পেয়ে, সেখান থেকে বোধহয় পালিয়েই গেলো। ইন্দ্রজিৎবাবু স্যামসনকে মুখে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করে হাত ইশারা করা মাত্র সে সোজা সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো একেবারে দোতালায়।

    এবার হরির দিকে মুখ ফিরিয়ে ইন্দ্রজিৎ বাবু বললেন,”আচ্ছা হরি ,মানুষ মরলে কোথায় যায় জানিস্?” হরি মুখটা একবার আকাশের দিকে তুলে কি যেন ভেবে নিয়ে বললো,”সে তো জানিনা বাবু,তবে বাপ ঠাকুরদার মুখে শুনেছি ভাল কর্ম করলে স্বর্গ লাভ হয় আর কুকর্ম করলে নরকে পচে মরতে হয়।”
    ইন্দ্রজিৎ বাবু বুঝতে পারলেন যে হরির লেখাপড়া যা একটু আছে সেইটুকুই যথাসম্ভব কাজে লাগিয়ে সে একটা তার মতো করে জবাব দিয়েছে ,এর বেশী আশা করা বোধহয় বাতুলতা; তাই কি যেন ভেবে একটু মৃদু হেসে চলে গেলেন ফুলের বাগিচার কাছে এবং ফুলের গাছগুলো পরীক্ষা করতে করতে হাঁক পাড়লেন,”গ-জা-জা-জা,এই গ-জা— কোথায় গেলি রে বদমাইশ?”
    হরি জানালো, “বাবু ,গজা আজ খেয়ে দেয়ে বিদেয় নিয়েছে। আজ পাশের গ্রামে পঞ্চরস দেখতে যাবে।আজ আর ও আসবে না, আবার কাল সেই সকাল আটটা না নটা! তার ঠিক ঠাহর নাই।”
    ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”কাল গজা এলে গাছগুলোতে জল দিতে বলবি, জলের অভাব হয়েছে মনে হচ্ছে।”
    হরি সম্মতি সূচক ঘাড়টা একবার ডানদিকে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি এঙ্গেলে নুইয়ে দ্রুত চলে গেলো পেছনের বাগানে। ইন্দ্রজিৎ বাবুও ততক্ষণে পায়ে পায়ে উঠে এলেন দোতালার লাইব্রেরী রুমে। টেবিলের উপর তখনও একটা বই খোলা অবস্থায় পড়ে আছে–বইটা আসলে হেনরী গ্রে’র লেখা– একটা হিউম্যান অ্যানাটমির বই। সেই বইটার একটা পাতার কতকগুলো লাইনকে ইন্দ্রজিৎ বাবু লাল কালি দিয়ে ভালোভাবে আন্ডার লাইন করে মনে হয় আবার পরবর্তী অংশে মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর বই থেকে মুখ তুলে চেয়ারে শরীর এলিয়ে লাইব্রেরী রুমের চারদিকে একবার চোখ বোলাতে লাগলেন।

    লাইব্রেরী রুমের চারটে কাঠের আলমারীতে দেশী বিদেশী অসংখ্য দামী দামী বই। ঘরের মাঝখানে একটা সেক্রেটারিয়েট গোছের টেবিল। টেবিলের একপাশে দরজার দিকে মুখ করে একখানা দামী রিভলভিং চেয়ার ও আর একপাশে খানচারেক কাঠের বার্ণিশ করা চেয়ার। ঘরটার একদিকে অর্থাৎ বাগানের দিকটায় দু’টো বেশ বড় মাপের জানালা, তাতে দামী সবুজ কাঁচ লাগানো। ঘরটায় আপদকালীন অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাও রয়েছে।এই লাইব্রেরি রুমেই ইন্দ্রজিৎ বাবু অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন।
    এবার একটু ল্যাবেরেটরি রুমে উঁকি মারা যাক–দুটো স্টিলের বড় সাইজের আলমারী–তালা বন্ধ মনে হয়।
    এককোণে একটা নরকঙ্কাল—আসল না নকল তা দুর থেকে কিছুই বোঝা যায়না। তিনটে টেবিল পর পর সাজানো —তাতে দু’ তিনটে মাইক্রোস্কোপ বেশ দামী বলেই মনে হয়। একটা ট্রেতে কিছু ছুরি ও কাঁচি। একটা কোণে একটা ডাস্টবিন; তাছাড়াও দেওয়ালের চারদিকে নানা ধরণের গাছ গাছালি ও বিভিন্ন জীবজন্তুর লেমিনেটেড করা ছবি, সেখানে মানব দেহের ছবিও রয়েছে বেশ কয়েকটি। আলমারীর মাথায় রয়েছে ফাইলের পাহাড় কতদিনকার যে পুরনো তা বাইরে থেকে দেখে আন্দাজ করে ওঠা মুশকিল।কিন্তু একটা জিনিস দেখে একটু অবাকই হতে হয়, আর তা হলো দেওয়ালের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে টাঙানো একটা বড় পঞ্চকোণের ছবি। অবশ্য এই রকম আর একটা ছবিও চোখে পড়বে লাইব্রেরি রুমের দেওয়ালে রিভলভিং চেয়াটার সামনাসামনি দরজার ঠিক উপরের দেওয়ালে—এতক্ষণে ইন্দ্রজিৎ বাবুর চিন্তা বিহ্বল মানসিকতার মোটামুটি একটা হিসেব পাওয়া যাচ্ছে—-আজকাল তিনি বিজ্ঞানের চর্চা থেকে খানিকটা সরে এসে তারই পরিপূরক হিসাবে হয়ত আর একটা বিষয়েও চর্চা ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন আর তা হলো নেক্রোমেন্সি(কালাজাদু)ও ব্ল্যাকমাস(ডাকিনীবিদ্যা) নিয়ে খুব গভীর পড়াশোনা এবং হাতেকলমে এই গুপ্তবিদ্যার সত্যতা যাচাই করে নেওয়া। এবং মোটামুটি আন্দাজ করা যায় যে হয়ত এই কারণেই কোনো কোনোদিন গভীর রাত্রে ল্যাবেরেটরির দরজা বন্ধ করে কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তবে ব্যাপারটা যে কি তা কারও পক্ষেই জানা বোধহয় সম্ভব নয়, একমাত্র হরি ছাড়া-তবে হরিকে দেখেও মনে হয়না যে, সে ঘটনাটা সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গও জানে!

    ল্যাবেরেটরি রুমে ঢুকলেই একটা পচা গন্ধের অস্তিত্ব একটু গভীর ভাবে নিঃশ্বাস নিলেই টের পাওয়া যায়।এর থেকে মোটামুটি এমনটাই অনুমান করা যেতে পারে যে ইন্দ্রজিৎ বাবু এখানে জীবিত অথবা সদ্যমৃত জীবজন্তুর দেহ কাটাছেঁড়া করেন এবং এইজন্যই টেবিলের উপর ট্রেতে দেখা গেল ছুরি কাঁচির উপস্থিতি–এবং সেইসব মৃতদেহের রক্ত ও মেদের অবশিষ্টাংশ পরিস্কার করে কোণের ঐ ডাস্টবিনে ফেলা হয়। হতে পারে এ গন্ধের উৎস সেখানেই। তবে সেইসব মৃতদেহ গুলি যে কোথায় ফেলা হয় তা অজ্ঞাত। হঠাৎ শোনা গেল কার যেন পায়ের শব্দ, চারদিকে তখন রীতিমতো অন্ধকার নেমেছে। দেখা গেলো ইন্দ্রজিৎ বাবু ল্যাবরেটরি রুমে সন্তর্পণে ঢুকলেন এবং দরজা বন্ধ করে একটা মৃদু আলো জ্বালালেন, মৃদু নীলচে আলোয় ঘরটার চারদিক একটা অতিপ্রাকৃত অবয়ব গ্রহণ করলো–ইন্দ্রজিৎবাবু দেওয়ালের ঐ পঞ্চকোণের (কালাজাদুর প্রতীক) ছবিটাকে একটা টৈবিলের উপর রাখলেন ও তারপর আলমারী খুলে কালো কাপড়ে জড়ানো মূর্তি জাতীয় কিছু একটা জিনিস বার করে আনলেন। এখন দেখা যাচ্ছে তিনি ঐ মূর্তিটা কোলে নিয়ে বসলেন ছবির সামনে চেয়ারে। তাঁর ঠোঁট দুটোর মধ্যে খুব মৃদু আন্দোলন।এই অবস্থায় তিনি চোখ বুঝে প্রায় ঘন্টা দেড়েক ধ্যানস্থ হয়ে রইলেন, কিন্তু তাঁর ধ্যানে হঠাৎ ব্যাঘাত ঘটালো বাইরে স্যামসনের একটানা গম্ভীর –হাউ–হাউ চিৎকার। ইন্দ্রজিৎ বাবু বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলেন যে স্যামসন বাগানের দিকে কি যেন একটা দেখে তখনও চিৎকার করেই চলেছে। সাবেকী আমলের ওয়ালক্লক ঢং-ঢং আওয়াজ তুলে জানিয়ে দিলো রাত্রি আটটা। ইন্দ্রজিৎ বাবু স্যামসনকে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করলেন; কিন্তু স্যামসন যেন আজ একটু বেশী মাত্রায় সন্দেহতাড়িত হয়ে হিংস্র হয়ে উঠতে চাইছে। ইন্দ্রজিৎ বাবুর চোখে মুখে একটা কুটিল চিন্তা যেন পিঙ্গল বর্ণ ধারণ করেছে, তিনি একটা বিশেষ কৌশলে স্যামসনের মুখের সামনে হস্তসঞ্চালন করতেই স্যামসন যেন শান্ত হয়ে গেলো।দেখে মনে হলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর সেই বিশেষ কৌশলে হস্তসঞ্চালনার মধ্যে একটা অলৌকিক অথচ নিগুঢ় রহস্যময়তা বিরাজ করছে। আজ থেকে বছর দুয়েক আগে ইন্দ্রজিৎ বাবু প্রায় প্রতিদিন একটা শ্মশানেও নাকি যাতায়াত করতেন,তবে কি জন্য যে তিনি শ্মশানে যেতেন সে কারণ জানা সম্ভব নয়। এখন অবশ্য বেশ কিছুদিন হলো সেই অভ্যাস থেকে তিনি বিরত রয়েছেন। যাইহোক স্যামসনের ঐ ধরণের আচরণে ইন্দজিৎবাবুর চেহারাতেও যেন একটা অস্বাভাবিক শক্তির প্রভাব ক্রমশঃ প্রকট হয়ে উঠছে–যা লক্ষ্য করার মতো।ইন্দ্রজিৎ বাবুর হাবভাব দেখে মনে হলো বাগানের ঐ অন্ধকারেই যেন তাঁর চির আকাঙ্খিত কোনো কিছু তিনি খুঁজে চলেছেন মানসবিহারের মধ্য দিয়ে। হঠাৎ সিঁড়িতে কার যেন পায়ের শব্দ শুনে ইন্দ্রজিৎ বাবু নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। হরিই এতক্ষণ সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠছিলো। ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে দেখে বললেন,”ও! তুই? কিরে কিছু বলবি?”
    হরিকে দেখে মনে হলো সে যেন অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখেছে, একটা আতঙ্ক মাখা চোখে চেয়ে রইলো ইন্দ্রজিৎবাবুর মুখের দিকে। ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে জিজ্ঞাসা করলেন “কিরে হরি? কি হলো? আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে কি দেখছিস?”
    হরি এবার ঢোক গিলে বললো,”বা-বু, বা-গা-নে সে-ই বি-দে-শী ফু-লগাছ-টার নী-চে?”
    “হ্যাঁ, কি হলো সেখানে?”ইন্দ্রজিৎ বাবু জানতে চাইলেন।
    হরি বললো,”এক-টা মুর্তি পা থেকে মা-থা প-র্যন্ত মেম-সাহেব-দের মত কালো বোর-খা পরা, হাতে এক-টা জ্ব-লন্ত লো-হার শিকের মত কিছু ছিলো, যার লাল রঙের আ-ভায় দেখ-লাম ঐ মুর্তির মুখটা– কি ভয়ংকর! চোখ ,মুখ,নাক কিচ্ছু নেই যেন একটা এবড়ো খেবড়ো পাথরের বড় টুকরো”
    ইন্দজিৎবাবু কৌতূহলী হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলেন,”তুই ঠিক দেখেছিস?”
    হরি আরও জোর দিয়ে বললো,”মা কালীর দিব্যি বলছি বাবু! আমি যা দেখেছি একদম সত্যি, একটুও বাড়িয়ে বলছি না আপনাকে।” ইন্দ্রজিৎ বাবু কথাটা শুনে ভেতরে ভেতরে যেন খুব উৎসাহ পেলেন এবং মনে মনে ভাবতে লাগলেন,”হুঁ-হুঁ বাবা,এতদিনের সাধনা, না এসে যাবে কোথায়!” এবার হরির পিঠে হাত রেখে বললেন,”বোকা কোথাকার! কি দেখতে কি দেখেছে কে জানে!–ভয় নেই !ভয় নেই! ওসব কিচ্ছু না –তোর চোখের ভুল।”
    হরি বললো,”না বাবু চোখের ভুল নয় আমি দেখেছি–আমার খুব ভয় করছে বাবু।”
    ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে নিয়ে নিজের বেড রুমে প্রবেশ করলেন। তারপর হরিকে একটা চেয়ারে বসতে বললেন। তিনি নিজে হরির সামনে দাঁড়ানো অবস্থাতেই কাগজে মোড়া কি যেন একটা জিনিষ ড্রয়ার থেকে বের করে হরির আপাদমস্তক কয়েকবার বুলিয়ে তারই কিছুটা অংশ একটা লাল কাপড়ে বেঁধে হরির ডান হাতে বেঁধে দিয়ে বললেন,”যা রে ক্ষ্যাপা তোর আর কোনো ভয় নেই,এই লালকাপড় যতক্ষণ তোর হাতে বাঁধা থাকবে দুনিয়ার কোনো অশুভ শক্তিই তোর চুল স্পর্শ করতে পারবে না। দেখবি এই লাল কাপড় যেন কখনো,কোনো অবস্থাতেই খুলে না যায়?”
    হরির মাথাতে বিন্দু বিসর্গ কিছূই ঢুকলো না, শুধু মাথা নেড়ে সেখান থেকে বিদায় নিলো।

    তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে এখন হরির আর তেমন ভয় টয় করে না। হরি মনে মনে একটা বিরাট সাহস পেয়েছে–ঐ যে হাতে তার মন্ত্রপুত লালকাপড়ের টুকরো! হরি সারাদিনে কতবার যে ডানহাতের কনুইয়ের উপর বাঁধা ঐ লাল কাপড়ের টুকরোটি যত্ন সহকারে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখে কে জানে! ওটিই যেন এখন তার প্রাণভমরা। তবে হরির মনে একটা ব্যাপার খুব খচ্ খচ্ করতে লাগলো; আর তা হলো তার মালিক অর্থাৎ ইন্দ্রজিৎ বাবুর উপচিকিৎসাবিদ্যার উপর বিশ্বাস ও তা করায়ত্ত করার রহস্য। কারণ আজ প্রায় ছয়-সাত বছর হলো সে এখানে রাঁধুনির কাজ করে আসছে। বাবুর এ হেন গুণের পরিচয় সে ঘুণাক্ষরেও কোনোদিন টের পায়নি,আর সেদিনকার মতো অমন অদ্ভুত ঘটনাও ঘটেনি এর আগে কোনোদিন-এতক্ষণ কুয়োর ধারে সুপারি গাছটায় হেলান দিয়ে এইসব কত কি যে সে ভাবতে লাগলো মনে মনে তার ইয়ত্তা নেই। ততক্ষণে গজা যে পা টিপে টিপে তার পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে তা সে টেরও পায়নি।
    হঠাৎ গজা বলে উঠলো,”কি গো হরিকা কি ভাবতেছ?কাকীমার কথা বুঝি?”
    হরি খেঁকিয়ে উঠে বললো,”দুর হ এখান থেকে!দুর হ! হতভাগা কোথাকার। কথার কেমন ছিরি দেখো?”
    গজা চোখ বড় বড় করে বললো,”কাকা, বাগানের বাঁধানো আমগাছে ভুত আছে গো!ভু–ত!”
    হরি একবার চারদিক দেখে নিয়ে বললো,”তুই দেখেছিস?”

    “দেখেছি মানে! ভুতের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেছি –ভুত আমাকে বলেছে ভর সন্ধ্যাবেলা তার কাছে গেলে সে এমনকি এই ফাগুনমাসেই পাকা আম খাওয়াবে।” কথাটা বলেই গজা হি-হি করে বিচ্ছিরি একটা হাসি হাসতে হাসতে এক ছুটে ফটকের বাইরে চলে গেলো।হরিরও যে হাসি পাইনি তা নয়, তবে হাসতে গিয়েই মুখ ফিরিয়ে দেখলো দোতালার জানালায় ইন্দ্রজিৎ বাবু–তাকেই যেন ইশারা করে ডাকছেন। হরি তৎক্ষণাৎ দোতালায় ল্যাবেরেটরি রুমে ঢুকে দেখলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর হাতে একটা একহাত প্রমাণ কাঁচের পুতুল। পুতুলটা দেখেই হরির ভেতরে যেন একটা রহস্যের স্রোত বয়ে যেতে লাগলো, সে মনে মনে ভাবলো, আরে! এ তো কয়েকদিন আগে অন্ধকারে বাগানের মধ্যে দেখা সেই ছায়ামূর্তিটারই অবিকল মূর্ত্ত প্রতীক–একদম হুবহু মিল। হরিকে দেখে ইন্দ্রজিৎ বাবু পুতুলটা একটা কালো কাপড়ে জড়িয়ে রেখে দিলেন আলমারীর ভেতরে। পুতুলটা দেখে হরির যে কোনোপ্রকার ভাবান্তর হতে পারে–তা একবারও মনে হলো না ইন্দ্রজিৎ বাবুর। তারপর হরির দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,”হরি, আজ সন্ধ্যা বেলা রমেনবাবু আসবে,বুঝলি?” কথাগুলো শুনে মনে হলো আজ রমেন বাবুর এখানে আসার যেন একটা বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে।
    হরি কিছু একটা জিজ্ঞাসা করবে ভাবছিলো কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারলো না।মনে মনে একটা আতঙ্ক মিশ্রিত উদ্বেগ নিয়েই সে ধীরে ধীরে নীচে নেমে এলো।

    সন্ধ্যাবেলা যথারীতি রমেন বাবু এসে হাজির হলেন। ঘড়িতে তখন সাতটা ছুঁই ছুঁই। রমেন বাবুর কাঁধে দেখা গেল একটা শান্তিনিকেতন মার্কা সাইডব্যাগ আর ডান হাতে একটা চটের বড়থলে। থলেটার মধ্যে যে ভারী কোনো জিনিস আছে, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। গেট থেকে একটু দূরে রিক্সা থেকে নেমে এতক্ষণ হেঁটে হেঁটে আসছিলেন। গেটের দরজায় এসে কড়া নাড়লেন —-হরি তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে তাকে সসম্মানে ভেতরে নিয়ে এলো। রমেনবাবু বারান্দায় পা দিয়েই মনে হয় ইন্দ্রজিৎ বাবুর খোঁজ নিলেন, হরি হাত তুলে রমেন বাবুকে দোতালায় উঠে যাবার ইশারা করলো। রমেনবাবুও আর কোনো কথা না বলে সিঁড়ি বেয়ে সোজা উঠে গেলেন দোতালার বারান্দায়। ইন্দ্রজিৎ বাবু যেন এতক্ষণ তাঁরই অপেক্ষা করছিলেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। রমেনবাবুকে সঙ্গে নিয়ে সোজা ঢুকে গেলেন তাঁর বেডরুমে। তারপর সশব্দে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। ঘরের ভেতর থেকে দু’জনেরই চাপা গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।
    নিশ্চয় এমন কোনো গোপন আলোচনা, যা সাবধানতা অবলম্বন না করে আলোচনা করা যায় না।
    মোটামুটি ঘন্টা দুয়েকপর ইন্দ্রজিৎ বাবুকে দেখা গেল দরজা খুলে বাইরে আসতে। তিনি সিঁড়ি বেয়ে একদম হরির ঘরে এসে প্রবেশ করলেন। হরি তখন সবেমাত্র রান্নার কাজ শেষ করে –কার যেন একটা চিঠি পড়তে আরম্ভ করেছে। ইন্দ্রজিৎ বাবুকে ঢুকতে দেখেই হরি তক্তাপোষ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সসম্ভ্রমে বললো,”আসুন বাবু আসুন।” বলেই সে চিঠি খানা বিছানার নীচে গুঁজে রাখলো। ইন্দ্রজিৎ বাবু বললেন,”কিরে কি পড়ছিলি?চিঠি নাকি? কার চিঠি?”
    হরি ঘাড় নাড়িয়ে যা বললো, তা অনেকটা এইরকম যে– তার স্ত্রী তাকে চিঠিতে একবার গ্রামের বাড়িতে দিন চারেকের জন্য যেতে লিখেছে। এভাবেই মাঝে মাঝে হরির চিঠি আসতো, আর চিঠি এলেই হরির কমসে কম দু/তিন দিনের ছুটি মঞ্জুর হতো। কারণ মাঝে মাঝে হরির অনুপস্থিতিটা ইন্দরজিৎবাবুর বড় কাজে লেগে যেত। ইন্দ্রজিৎবাবু এবারও তাই হরির যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে দিলেন এবং উপরের ঘরে রাতের খাবার পৌঁছে দেওয়ার বরাত দিয়ে ধীরে ধীরে হরির ঘর থেকে বেড়িয়ে উঠে গেলেন দোতালায়।
    যাই হোক রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে রমেনবাবুকে বন্ধ তিনটে ঘরের একটা খুলে দেওয়া হলো। এখানে এলে এই ঘরেই তিনি প্রত্যেকবার রাত কাটান। অতএব, তিনি কোনো অস্বস্তি বোধ করলেন না। এবার বলি রমেন পুরকায়স্থের এ বাড়িতে মাঝে মাঝে আসার কারণটা—ভদ্রলোক প্রচণ্ড বিষয়ী তাই পেনশন ছাড়াও দু’পয়সা উপরি কামাতে তিনি অনেক কিছুরই দালালী করে থাকেন। প্রয়োজনে কাস্টমারের বাড়িতেও অর্ডার মতো মাল পৌঁছে দেন। এমনকি তিনি কাজের লোকও মফস্বল বা গ্রাম থেকে জোগাড় করে দিতে পারেন।ইন্দ্রজিৎ বাবুকে তিনি মাঝে মাঝেই ব্যাঙ, সাপ, গিরগিটি, গিনিপিগ, খরগোশ ইত্যাদি প্রাণী কাঁচের জারে পুরে এনে দিতেন, তাছাড়া দামী দামী দেশী বিদেশী গ্রন্থ তো আছেই। সবচেয়ে ভয়ংকর যে জিনিসটি তিনি অত্যন্ত গোপনে গভীর রাতে গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসতেন–তা হলো বাচ্চা ছেলে বা মেয়ের লাশ।এরজন্য অবশ্য মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন ইন্দ্রজিৎ বাবুর কাছ থেকে। এই কারণেই এবাড়িতে রমেন বাবুর এতো খাতির যত্ন। রমেন বাবু লোকটা যে একটা বাস্তুঘুঘু তা তার হাবভাবেই বোঝা যায়।

    যাইহোক, রমেনবাবু দরজা বন্ধ করে রুমের নাইটল্যাম্পটা জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লেন। অনেকটা রাস্তা জার্ণি করে এসেছেন। শুয়ে শুয়ে কি যেন ভাবছেন।ঘড়ির ঘন্টা জানান দিলো রাত এগারটা। কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি ঘুমিয়ে পড়লেন। চারদিকে একটা জমাট নিস্তব্ধতা বাড়িটাকে যেন চেপে ধরে আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন প্রেতপুরী,বাগানের ঘন অন্ধকারে যেন অসংখ্য অশরীরী এসে দাঁড়িয়েছে, তাদের নিঃশ্বাসের শব্দে সাড়া বাড়িটা যেন দুলছে। হঠাৎ কিসের যেন একটা আওয়াজে রমেন বাবুর ঘুম ভেঙে গেলো। জলের বোতল থেকে একটু জল খেয়ে তিনি ভাবতে লাগলেন শব্দটা কিসের?এর আগেও এ বাড়িতে তিনি রাত্রিবাস করেছেন। রাতে অনেক অস্বাভাবিক শব্দই তার কানে এসেছে; তবে আজকের শব্দটা যেন একটু আলাদা—তিনি কান খাড়া করে শুনতে লাগলেন।মনে হলো কেউ যেন সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে ভারী ভারী পা ফেলে। এবার তিনি উঠে দরজার পাল্লাদুটো একটু ফাঁক করে যা দেখলেন —তাতে তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা বরফের মতো ঠান্ডা স্রোত বয়ে যেতে লাগলো—তিনি দেখলেন একটা আপাদমস্তক বোরখা পরা ছায়ামূর্তি বারান্দার অন্ধকার পেরিয়ে ল্যাবেরেটরি রুমের দরজায় এসে দাঁড়ালো। তিনি চিৎকার করতে যেতেই বুঝলেন তাঁর গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। তবুও তিনি চোখ সরালেন না। অবশেষে দেখলেন সেই ছায়ামূর্তি যেন দরজায় মিলিয়ে গেলো। তারপর সারারাত তিনি দুইচোখের পাতা এক করতে পারলেন না,অর্থাৎ সারারাত একরকম না ঘুমিয়েই কাটালেন।পরদিন সকাল বেলা চা খেতে খেতে ইন্দ্রজিৎ বাবুকে ঘটনাটা জানালেন–ইন্দ্রজিৎ বাবু ঘটনাটা রমেনবাবুর হেলুসিনেশন্ বলে উড়িয়ে দিলেও তিনি নিজে জানেন এ ঘটনার সূত্রপাত কোথায়? রমেন বাবুও নিজের মনকে সান্ত্বনা দিলেন ইন্দ্রজিৎ বাবুর রাস্তা ধরেই। একটু পর দেখা গেলো রমেন বাবু বাড়ির ফটক পেরিয়ে তাঁর গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন।
    এই ঘটনার প্রায় সাতদিন পর ইন্দ্রজিৎ বাবু হরিকে চারদিনের জন্য ছুটিতে তার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। গজা এই চারদিন হোটেল থেকে তাঁর জন্য দিনে ও রাতে খাবার নিয়ে আসবে, তেমন কথা হয়েছে গজার সঙ্গে হরির।
    পরের দিন গজা রাতের খাবার পৌঁছে দেওয়ার পর ইন্দ্রজিৎ বাবু যেন কোনো এক আগন্তুকের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন। রাতের খাবার পর্ব যেন-তেন প্রকারে সমাধা করলেন। রাত যখন বেশ গভীর হয়ে এলো –ওয়াল ক্লক আরও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলো রাত একটা, তখন গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো একটা অ্যাম্বাস্যাডার–ইন্দ্রজিৎ বাবু গাড়ির শব্দ শুনেই গেটের দরজা খুলে দিলেন। ভেতরে ঢুকলো রমেন পুরকায়স্থ সঙ্গে ছোট্ট একটা চার পাঁচ বছরের মেয়ে। মেয়েটির গায়ে শতছিন্ন একটা ময়লা ফ্রক ও পায়জামা গোছের কিছু একটা। তাকে প্রচণ্ড ভয় দেখিয়ে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে –তা বোঝা গেল তার চোখে মূখে একটা আতঙ্কের আস্তরণ অনুভব করে। গাড়িটা গেটের বাইরে অপেক্ষা করছে।মেয়েটাকে নিয়ে রমেন ও ইন্দ্রজিৎ বাবু একদম দোতালায় ল্যাবেরেটরি রুমে ঢুকে গেলো। ল্যাবেরেটরির দরজা বন্ধ হলো।ইন্দ্রজিৎ বাবু মেয়েটার ডানহাতে কোকেন জাতীয় চেতনা নাশক কোনো ইঞ্জেকশন্ প্রয়োগ করে মেয়েটিকে টেবিলের উপর শুইয়ে দিলেন।আবার দরজা খুলে গেল, ততক্ষণে রমেন পুরকায়স্থ তার পাওনা বুঝে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে যেতে লাগলো সঙ্গে ইন্দ্রজিৎ বাবু। তাদের দু’জনের চোখেই দেখা যাচ্ছিল হিংস্রতা। রমেন বাবু গাড়িতে চাপলেন ও ইন্দ্রজিৎ বাবুকে হাত ইশারা করলেন, ইন্দ্রজিৎ বাবু তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতেই গাড়িটা চোখের নিমেষে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো।ইন্দ্রজিৎ বাবু গেটটা ভালো ভাবে বন্ধ করে উঠে এলেন বারান্দায়। তারপর গ্রাউন্ডফ্লোরর দরজায় তালা লাগিয়ে উঠে গেলেন দোতালায়। ল্যাবেরেটরি রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। দেখলেন মেয়েটা টেবিলের উপর ততক্ষণে সম্পূর্ণ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। এবার এগিয়ে গেলেন আলমারীর দিকে, কালোকাপড়ে মোড়া সেই পুতুলটা বার করে নিয়ে এলেন এবং সেই পঞ্চকোণের ছবিটা। তারপর ওই দুটোকে সাজিয়ে রাখলেন টেবিলের উপর। হুইস্কির বোতল খুলে সমস্তটায় ঢেলে নিলেন গলায়—সারাঘর অন্ধকার কেবলমাত্র একটা মোমবাতি জ্বলছে টিমটিম করে, সারাঘরে কারা যেন ফিসফিস করে কথা কয়ছে—হঠাৎ পঞ্চকোণটা রক্তের মতো লাল হয়ে উঠলো–পুতূলের পেছনে এসে দাঁড়ালো আর এক ছায়া মূর্তি তার হাতে জলন্ত লৌহশলাকা। গোটা বাড়িটা এখন প্রেতলোকের চাদর জড়িয়ে যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে–ইন্দ্রজিৎ বাবু টলতে টলতে হাতে তুলে নিলেন শাণিত ছুরি তারপর টেবিলের উপর শায়িত উলঙ্গ অচৈতন্য ছোট্ট মেয়েটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। হঠাৎ এক সময় হিংস্র শ্বাপদের মতো বুক চিরে বার করে নিয়ে এলেন একটা মাংসপিন্ড—আবছা আলোয় দেখা গেলো মাংসপিণ্ডটা নড়ছে –ওটা হৎপিন্ড তখনও ঝলকে ঝলকে রক্ত বেরিয়ে আসছে ওটা থেকে।মেয়েটার বুক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে আর সেই রক্তপান করে চলেছে সেই ছায়ামূর্তির সঙ্গে আরো অসংখ্য ছায়া মূর্তি। আজ এ বাড়িতে যেন শুরু হয়েছে প্রেতপার্বণ। অবশেষে হৃৎপিণ্ডটাও ইন্দ্রজিৎ বাবু তুলে দিলেন ঐ ছায়ামূর্তির হাতে। ছায়ামূর্তি সেই হৃৎপিণ্ড যেন লুকিয়ে নিলো নিজের ছায়াশরীরে। ঠিক তখনই বাইরে শোনা গেল প্রচণ্ড ঝড় ও বজ্রপাতের আওয়াজ। ঝড়ের দাপটে জানালার একটা পাল্লা খুলে যেতেই বিদ্যূতের একটা ঝলকানি জানালা দিয়ে ঢুকে মিলিয়ে গেলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর বুকে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন মেঝের উপর। সময় ততক্ষণে গড়িয়ে গেছে অনেকটাই। হঠাৎ ইন্দ্রজিৎ বাবুর জ্ঞান ফিরতেই তিনি দেখলেন সেই ঘরে পঞ্চকোণের ছবি এবং সেই পুতুলটা উধাও হয়ে গেছে। প‍রিবর্তে সেখানে পড়ে রয়েছে ইংরাজীর ওয়াই আকৃতির একটা রুপোর দণ্ড এবং একটা কালো চামড়ায় মোড়া বই। তিনি সমস্ত ব্যাপারটাই বুঝতে পারলেন। রুপোর দন্ড ও চামড়ায় মোড়া বইটা তুলে রাখলেন আলমারীর ভেতরে গোপন একটা জায়গায়। হঠাৎ তার নজরে পড়লো মেয়েটার লাশ। লাশটা দু’হাতে তুলে নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন একদম গ্রাউন্ডফ্লোরে তখনও চলছে ঝড় ও জলের তান্ডব। ইন্দ্রজিৎ বাবু অনেক কষ্টে বাগানের এক কোণে গর্ত খুঁড়ে নরম মাটির একদম গভীরে পুঁতে ফেললেন লাশটাকে। তারপর সেখান থেকে অতি দ্রুত উঠে এলেন ল্যাবরেটরি রুমে। এসে দেখলেন কোথাও এক ফোঁটা রক্তের চিহ্নমাত্র নেই। চারদিক একদম আগের মতোই পরিস্কার। পরেরদিন সকালে ইন্দ্রজিৎ বাবু টের পেলেন যে তাঁর শরীরে যেন কি একটা অলৌকিক শক্তি এসে বাসা বেঁধেছে। আরও একটা ঘটনা তিনি সেদিনের পর থেকে লক্ষ্য করতে লাগলেন আর তা হলো স্যামসনকে নিয়ে। ইন্দ্রজিৎ বাবু প্রায়ই লক্ষ্য করতেন স্যামসন বাগানের সেই বিতর্কিত কোণটির এক পাশে চুপ করে বসে আছে আর কেউ যেন অদৃশ্য থেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।তারপর স্যামসনকে অধিকাংশ সময়েই চেন দিয়ে বেঁধে রাখা হতো দোতালার বারান্দায়–ইন্দ্রজিৎ বাবু লক্ষ্য করলেন ধীরে ধীরে স্যামসনের মধ্যে যেন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই ফুরিয়ে আসছে।

    দু’দিন পরেই হরি ফিরে এসে দেখলো তার মালিকের বয়সটা যেন হঠাৎই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে অনেকটা কমে গিয়েছে- চোখ দু’টোতে একটা নীলচে আভা। হরি মনে মনে ভাবলো এমন চেহারা সে আগেতো কোনো দিন দেখেনি–হরির ঘটনাটা রহস্যময় বলেই মনে হতে লাগলো।

    তারপর প্রায় একমাস কেটে গেছে এখন অবশ্য ল্যাবেরেটরি রুমটা তালা বন্ধই থাকে। ইন্দ্রজিৎ বাবু আর নীচে নামেন না বললেই চলে। ইন্দ্রজিৎ বাবু তাঁর সেই অলৌকিক ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সমস্ত প্রকার ইন্দ্রিয়জ সুখ উপভোগ করতে লাগলেন নিশুতি রাতের নির্জনতাকে কাজে লাগিয়ে। কিন্তু সেদিন রাত্রে ঘটলো একটা আশ্চর্য ঘটনা—ইন্দ্রজিৎ বাবু খাওয়া দাওয়া সেরে তার বিছানায় চোখ মুজে শুয়ে আছেন, হরি আছে তার নিজের ঘরে–রাত তখন বারোটার বেশী হবে না বোধহয়! এখন প্রায়ই গভীর রাত পর্যন্ত ইন্দ্রজিৎ বাবুর ঘুম আসেনা। উনি ঘুমের ঔষধ ব্যবহার করেন মদের সঙ্গে তবুও অনেকক্ষণ জেগে থাকেন—জেগে থাকেন বললে ভুল হবে, কে যেন তাকে জোড় করে জাগিয়ে রাখে। ইন্দ্রজিৎ বাবুকে একটা কৌতূহল পেয়ে বসলো–তিনি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে গেলেন ল্যাবরেটরি রুমের দরজায়। পকেট থেকে চাবি বার করে খুলে ফেললেন দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা সেই ল্যাবেরেটরি রুমটা। রুমটা খুলতেই তার নাকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ এসে ভেতরটা গুলিয়ে দিলো। তারপর তিনি সেই অন্ধকারে যা দেখলেন তা অত্যন্ত ভয়ংকর, তিনি দেখলেন সেই মেয়েটি শুয়ে আছে টেবিলের উপর —ইন্দ্রজিৎ বাবু কিছুক্ষণ সেখানেই স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ দ্রুত বাইরে বেরিয়ে সশব্দে দরজা বন্ধ করেই তালাটা লাগিয়ে দিলেন। নিজের ঘরে দ্রুত ফিরে এসে দরজা বন্ধ করলেন। হঠাৎ তার চোখ পড়লো ঘরের এককোণে রাখা টেবিলের দিকে দেখলেন সেখানেও দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই মেয়েটি, বুকটা একবারে হাঁ হয়ে আছে আর ফিং দিয়ে রক্ত ছুটছে, তিনি বেশীক্ষণ আর সেই দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না –একটা বিকট চিৎকার করে জ্ঞান হারালেন।
    এদিকে হরি মনে হয় তাঁর চিৎকার শুনতে পেয়েছিলো–সে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে ইন্দ্রজিৎ বাবুর ঘরে ঢুকতেই দেখলো তার মালিক ইন্দ্রজিৎ বাবু মেঝের উপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না হরি। একটু পর সে জলের বোতল থেকে জল নিয়ে ইন্দ্রজিৎ বাবুর চোখে মুখে ছেটাতেই মনে হলো তাঁর ঠোঁটগুলো যেন একটু একটু নড়ছে।তারপর আরও একঘন্টা কেটে গেলো–এবার যেন ইন্দ্রজিৎ বাবুর চোখদুটো একটু খুললো। সে রাতটা ঐ ভাবেই কাটলো। পরের দিন ইন্দ্রজিৎ বাবু একটু বেলার দিকে যথারীতি সুস্থ হয়ে উঠলেও ঘুণাক্ষরেেও কাল রাতের ঘটনা হরিকে জানালো না। হরিকে তিনি তার ঐ অবস্থার কারণ স্বরূপ একটা আদত মিথ্যা কথা বললেন। সেইদিনই দুপুরে টেলিফোনে ইন্দ্রজিৎ বাবু একটা সুসংবাদ পেলেন–তাঁর ছোটো ছেলের স্ত্রী দীর্ঘদিন পর সন্তানসম্ভবা হয়েছেন। ইন্দ্রজিৎ বাবুর আনন্দ আর ধরে না। এ সংবাদ বহু প্রতীক্ষিত।
    আনন্দে বিহ্বল হয়ে ইন্দ্রজিৎ বাবু সেদিন বাইরে বেড়াতে গেলেন হরিকে সঙ্গে নিয়ে –শ্মশান ছাড়িয়ে খোলামাঠে দু’জনে অনেকক্ষণ গল্পগুজবে এত মশগুল রইলেন যে –কখন যে গুটি গুটি পায়ে সন্ধ্যা নেমেছে তা টেরই পেলেননা।হঠাৎ হরি বললো ,”বাবু, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলুন, ঐ দেখুন!মেঘ করেছে! এখুনি হয়তো ঝড় উঠবে।”
    তারা বাড়ির দিকে হনহন করে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু বেশীদুর এগোতে পারলো না। শ্মশানের কাছাকাছি একটা পোড়ো বাড়ি ছিলো। অগত্যা তারা দু’জনে আশ্রয় নিলো ঐ বাড়িটার মধ্যে। চারদিকে ততক্ষণে শুরু হয়েছে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি ও ঝড়–থেকে থেকে বজ্রপাতের চোখরাঙানি। হরি তো ভয়ে একেবারে আধখানা হয়ে গেছে। কাছেই কোথাও একটা বাজ পড়ার শব্দে চমকে উঠলো দু’জনেই। হঠাৎ বিদ্যুতের আলোয় ইন্দ্রজিৎ বাবু দেখলেন সেই পোড়ো বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে যেন একটা ছোট্ট মেয়ে, ইন্দ্রজিৎ বাবু আবার ভালোভাবে নজর করে দেখতেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো সেই ছায়াশরীর। তিনি ঘটনাটা ততক্ষণে বুঝে গেছেন। হরি কিন্তু কিছুই দেখতে পেলনা। সেদিন প্রায় অনেকটা রাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছিলো ইন্দ্রজিৎ বাবু ও হরিকে। ইন্দ্রজিৎ বাবুর মনে শান্তি নেই।দিনের পর দিন তার সেই অলৌকিক শক্তির অপব্যবহারের ফলে কোনো এক বিপ‍রীত শক্তি তার শরীরকে যেন ক্রমশ দুর্বল করে তুলছে—এটা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছিলেন। তাই চোখে মুখে একটা আতঙ্ক তাকে যেন গ্রাস করতে চাইছে।
    একদিন সন্ধ্যা বেলা হরি কি যেন একটা কাজে বাগানে যেতেই চোখ পড়লো বাগানের এককোণে। দেখলো একটা ছোট্ট মেয়ে যেন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে একটু এগিয়ে যেতেই যা দেখলো তাতে হরির প্রাণপাখি উড়ে যাবার জোগাড়। দেখলো দু’হাত মতো একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে বড় আমগাছের নীচে আর তাকে সেই লিকলিকে হাড়ের আঙ্গুল নাড়িয়ে ডাকছে। হরি ভয়ে পিছতে পিছতে শুনতে পেলো একটা হাড়হিম করা চাপা হাসি। সে প্রায় ছুটেই সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলো সেদিন।

    তারপর কেটে গেছে সাত সাতটা বছর। এখন আর এবাড়িতে রমেন বাবুও আসেন না। একদিন খবরের কাগজে একটা সংবাদ পাওয়া গেলো–সংবাদটা এইরকম যে গঙ্গা বক্ষে চলন্ত স্টীমার থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে এক ভদ্রলোক, পুলিশ অবশেষে তার দেহটি খুঁজে পায় ও তার পরিচয় ও জানতে পারে–ভদ্রলোক সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ল্যাবরেটরি আসিস্ট্যান্ট ছিলেন, পুলিশ আরও জানিয়েছে যে ঐ ভদ্রলোক দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন, ভদ্রলোকের নাম–রমেন পুরকায়স্থ। এখন হরিও আর এ বাড়িতে রাধুঁনির কাজ করে না। সে চরম ভয় পেয়ে কাজে ইস্তফা দিয়ে পালিয়েছে কাউকে কিছু না বলে।গ্রামের ছেলে গজাও কোথায় ভিনরাজ্যে ভালো বেতনের লোভে পাড়ি দিয়েছে ।আর স্যামসন?—একদিন রাতে স্যামসনের লাশ পাওয়া গেলো বাগানেরই একটা কোণে। স্যামসনের শরীর বেশ কিছুদিন ধরে খারাপ যাচ্ছিল। সে নাকি প্রতিদিন রাত্রে বাগানের দিকে চেয়ে থাকতো আর দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তো। ইন্দ্রজিৎ বাবু এখন একদম একা, একটা চরম পরিণতির জন্য যেন অপেক্ষা করে আছেন। তাঁর কাছে এখন থাকে একজন বিহারী রাঁধুনি সেই-ই সব দেখাশোনা করে।ইন্দ্রজিৎ বাবুর ছোটো ছেলে অরিজিৎ-ই একদিন ফোন মারফৎ সবকিছু অবগত হয়ে ঐ বিহারী যুবকটির হাতে তার বাবার সমস্ত দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলো। সেও আজ প্রায় সাত বছর আগের কথা।
    একদিন একটা বুলেরো গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাড়িটার গেটে। গাড়ি থেকে নামলো একটা ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা মেয়ে তারই হাত ধরে নামলো একটি সুন্দরী যুবতী ও সৌম্যদর্শন এক যুবক। ঐ যুবকটি হলো অরিজিৎ, ইন্দ্রজিৎ বাবুর ছোটো ছেলে আর ঐ যুবতী হলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর ছোটো পুত্রবধূ ইশিতা। ঐ যে ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটি! ও হলো অরিজিৎ-এর একমাত্র কন্যা–“তৃষা”, অর্থাৎ ইন্দ্রজিৎ বাবুর নাতনি।ছেলে, বৌ আর নাতনিকে কয়েক দিনের জন্য কাছে পেয়ে –ইন্দ্রজিৎ বাবুর বাঁচার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠলো–কি আনন্দ! কি আনন্দ!

    কিন্তু দুর্ঘটনাটা ঘটলো সেদিন বিকালে। অরিজিৎ ও ঈশিতা যখন ফুলের বাগিচার ধারে দাঁড়িয়ে গল্পগুজবে ও ঠাট্টা তামাশায় একবারে মশগুল। ততক্ষণে তৃষা গ্রাউন্ডফ্লোরর বারান্দার বাগানের দিকের গেটটা খুলে পৌঁছে গেছে বাগানের সেই কোনাটায়।
    এদিকে অনেকক্ষণ তৃষার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ঈশিতার মনে সন্দেহের উদ্রেক হতেই ব্যাপারটা অরিজিৎকে জানালো। তৃষার নাম ধ‍রে জোরে জোরে ওরা দু’জনেই ডাকতে লাগলো, কিন্তু কোনো সাড়া পেলনা। ইশিতা তো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে রীতিমতো। অরিজিৎ ও সেই বিহারী রাঁধুনি রামলাল ততক্ষণে তৃষার খোঁজ আরম্ভ ক‍রে দিয়েছে। খুঁজতে খুঁজতে দেখলো তৃষা পড়ে রয়েছে বাগানের একটা আমগাছের নীচে। সেখান থেকে অরিজিৎই কোলে করে নিয়ে আসে তৃষার অচৈতন্য দেহ। অরিজিৎ সঙ্গে সঙ্গে ডাঃ চৌধুরীকে ফোন করলো। আধঘন্টার ভেতরে ডাঃ চৌধুরী এসে তৃষাকে পরীক্ষা করে জানালো ভয়ের কিছু নেই। তৃষা বাগানে কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে। একটু সাবধানে রাখলেই হবে এবং যাবার আগে ডাঃ চৌধুরী বললেন, “ওকে কোনো ভাবেই বাগানে যেতে দেবেন না যেন, কারণ ভয়ের উৎস ওখানেই কোনো জায়গায় লুকিয়ে রয়েছে।”
    সেদিন রাত্রে অরিজিৎ ও ঈশিতা দু’জনেই দুই চোখের পাতা এক করেনি। পরেরদিন সকাল থেকেই অবশ্য তৃষা বেশ আগের মতোই চনমনে হয়ে উঠলো। হঠাৎ ছুটে সে ইন্দ্রজিৎ বাবুর ঘরে গিয়ে হাজির হলো ইন্দ্রজিৎ বাবু অবাক হয়ে তৃষাকে দেখতে লাগলেন, আর মনে মনে বিড় বিড় করে বলতে লাগলেন,”হ্যাঁ এই তো সেই! -এই তো সেই! –এসেছে!– আবার ফিরে এসেছে।” ইন্দ্রজিৎ বাবু ইশারায় তৃষাকে কাছে ডেকে তৃষার বুক খুলে দেখলেন বুকের উপর একটা লম্বালম্বি কালো দাগ–কেউ যেন বহুদিন আগে ছুড়ি দিয়ে কেটেছিলো জায়গটা। ইন্দ্রজিৎ বাবু নিজের ভবিতব্য বুঝতে পারলেন।তিনি একটা সাদা কাগজে কি যেন লিখে বালিশের নীচে লুকিয়ে রাখলেন।
    আর সেই অবিশ্বাস্য অলৌকিক ঘটনাটাও ঘটলো সেদিন সন্ধ্যাতেই। অরিজিৎ ও ঈশিতা যখন কিচেনে ঐ বিহারী রাঁধুনিটিকে কি যেন বিদেশী রান্না শেখাচ্ছিলো। হঠাৎ তাদের কানে একটা চাপা গোঙানির শব্দ এসে পৌছালো–তারা সকলেই ছুটে দোতালায় ইন্দ্রজিৎ বাবুর ঘরে ঢুকেই দেখলো সেই ভয়ংকর দৃশ্য–দেখলো তৃষা প্রচণ্ড প্রতিহিংসায় দুই হাত দিয়ে চেপে ধরেছে ইন্দ্রজিৎ বাবুর গলা, তৃষার সে কি ভয়ংকর মূর্তি মনে হচ্ছে এ যেন তৃষা নয় ওর দেহে প্রবেশ করেছে কোনো অশরীরী শক্তি চোখগুলো মণিহীন–তাদের পা যেন সেই সিমেন্টের মেঝেতে আটকে গেছে, তারা অসহায়ের মতো দেখতে লাগলো ইন্দ্রজিৎ বাবুর মৃত্যু যন্ত্রণা– দুই কান,নাক আর কষ বেয়ে বেরিয়ে আসছে রক্ত। কিছুক্ষণ পর ইন্দ্রজিৎ বাবুর দেহটা নিথর হয়ে গেলো। তৃষার দেহ থেকে একটা নীলচে আলো হঠাৎ বেরিয়ে এসে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেলো তীরের ফলার মতো তারপর মিলিয়ে গেলো বাগানের অন্ধকারে। তারা দেখলো তৃষা ইন্দ্রজিৎ বাবুর বুকের উপর পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে।ঈশিতা তৃষাকে সঙ্গে সঙ্গে কোলে তুলে নিয়ে চোখে মুখে জলের ছিটে দিতেই তার জ্ঞান ফিরে এলো।অরিজিৎ কান্নায় ভেঙে পড়লো। হঠাৎ বালিশের নীচ থেকে ইন্দ্রজিৎ বাবুর লেখা চিঠিটা খুঁজে পেলো অরিজিৎ।অরিজিৎ চিঠিটা খুলে দেখলো তাতে লেখা রয়েছে–“পরীক্ষিত সত্য! জন্মান্তরে প্রতিহিংসা শরীর ধারণ করে। আমার মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই এ চিঠি লিখছি। এরপরে এ বাড়িতে তোমরা আর কেউ থেকো না। এ বাড়ি একটা জলন্ত অভিশাপ।—ইতি আশীর্বাদক,তোমাদের হতভাগ্য পিতা।”
    সমস্ত ঘটনা গোপন করে ইন্দ্রজিৎ বাবুর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এ বাড়িতেই। তবে এই অনুষ্ঠানে ইন্দ্রজিৎ বাবুর বড়ছেলে শুভজিৎ অংশগ্রহণ করেনি, যদিও তার স্ত্রী, একছেলে ও দুইমেয়ে উপস্থিত ছিলো শেষপর্যন্ত।

    তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। এখন এই অভিশপ্ত বাড়িতে কোনো মানুষের আনাগোনা নেই।মহাকাল ধীরে ধীরে গ্রাস করে চলেছে এ বাড়ির অস্তিত্ব।অন্ধকার নামলেই শোনা যায় কালপেঁচা আর ঝিঁঝিঁর একটানা তীক্ষ্ণ ডাকের সঙ্গে অশরীরীদের হা হুতাশ।

  • কবিতা

    স্বপ্নবেচার সওদাগর

    স্বপ্নবেচার সওদাগর
    -পার্থসারথি

     

     

    ওরা স্বপ্নবেচার সওদাগর -স্বপ্নগুলো স্বার্থের পাল্লায় ওজন করে অল্পদামে কিনে নিয়ে রপ্তানি করে।

    কোথায় যে রপ্তানি করে! –সে কথাতো তোমার আমার জানার কথা নয়।

    কখ্খনো যেন এমন কৌতূহলের বশবর্তী হয়ো না!

    তাহলে ঐ কৌতূহলই তোমাকে চিরতরে কালের চোরাবালিতে হাপিস্ করে দেবে-

    তোমার স্থান হবে তখন নিরুদ্দিষ্টের তালিকায়।
    নাছোড়বান্দা যত সওদাগরের দল ঘুরঘুর করে তোমার আমার দুর্বল মুহূর্তের আনাচে কানাচে-

    সুযোগ পেলেই রবাহুতের মতো ঢুকে পড়ে বিশ্বাসের বালাখানায়।

    দরদস্তুর করে তোমার আমার স্বপ্নের দাম ঠিক হয় –

    যদি মেনে নিতে পারো নিজস্বতা খুইয়ে, তো ভাল কথা!

    আর যদি গররাজি হও, তাহলে ওদের হিংস্রতার বলি হয়ে পড়ে থাকবে কোনো জলাজংলায় বেওয়ারিশ লাশ হয়ে।
    ওরা! ঐ যে সওদাগরের দল!! চেনো ওদের ?

    ওরা আমাদেরই বা তোমাদেরই পড়শী ছিল একদিন।

    আজ ওরা অচেনার ভীড়ে ভিড়েছে-সওদাগরী ব্যবসায় মেতে উঠেছে এক্কাদোক্কা করে…

    ধনকুবের হবে বলে! গাড়ি-বাড়ি-ব্যাঙ্কব্যালেন্সের ইঁদুরদৌড়ে সামিল হতে গিয়ে,

    ওরা তাই ভূলে যায় ছোটবেলার আম জাম কুড়ানোর বন্ধু, খেলার সাথী,রাম-রহিমদের কথা।

    যে হাতে হাতধরে একদিন লুকোচুরি খেলেছিলো,

    আজ সেই হাতই রাঙিয়ে নেয় শৈশবের স্বপ্নকে খুন করে ঐ রাম-রহিমদের রক্তে—

    আসলে ওরা যে আজ আর মানুষ নেই, ওরা আজ স্বপ্নবেচার সওদাগর!!

  • কবিতা

    সৌন্দর্য্য! সে তো তুমি

    সৌন্দর্য্য! সে তো তুমি
    -পার্থসারথি

     

     

    অসতর্ক মুহূর্তে তোমার উষ্ণতা অনুভব করতেই

    আবিষ্কার করে ফেলেছি নিজের ব্যক্তিত্ব-মোক্ষনের সূক্ষ্ম স্নায়ুজালকে।
    তোমার বেআব‍রু শারীরিক ভৌগলিকতায় খুঁজে পেয়েছি

    পৌরুষকে–নূতন করে,গহীন প্রেম পারাবারে।
    তোমার সৃজনস্নিগ্ধ রন্ধ্রপথে সৌরভ মুখরতা,

    সৃষ্টি সুখের উল্লাস আনে পরিমিত আমাতে।
    উষর উর্বরা বক্ষের অমৃতধারা সৃষ্টিকারী কোমল উৎসমুখ চুম্বন করে তৃপ্ত

    তাই লক্ষ বছর অতৃপ্ত আবিলতা।
    চন্দ্রমুখী তুমি পূর্ণিমার পূর্ণত্ব তোমাতেই অতলান্তিক ব্যঞ্জনায় বারে বারে বসন্ত আনে মনে—

    পলাশরাঙা তপ্ত কামনাকক্ষে।
    গহীন আঁধার পথে যৌবন-উপবনে প্রতিদিন সাঙ্গ করি তাই ঈপ্সিত অভিসার।
    প্রলম্বিত পললগতি তোমার স্খলিত বসন শায়িত দেহ-তটিনী প্লাবিত হয়

    আমারই তৃষিত উৎকণ্ঠার গঙ্গোত্রীর ধারায়—-

    তুমি যে দূর্লভ–মূর্ত্তিমতী সৌন্দর্য্য–স্বর্গ থেকে আরও উচ্চে রাখি তাই আমার অভিমানিনীকে।

  • কবিতা

    মরিচিকা তোমাকে

    মরিচিকা তোমাকে
    -পার্থসারথি

     

     

    “বেলা শেষের গানে তোমার প্রসঙ্গ আনতেই গানটা বেহাগের কাছে গচ্ছিত রেখেছি,তু

    মিতো জানই আমি চিরদিন বাউন্ডুলে চণ্ডীচরণ—এই নামেই ডাকতে আমাকে;

    জানিনা সেই ডাকের মধ্যে কোনো আন্তরিকতা ছিল কিনা!
    তুমি হয়তো ভাববে আজ এতো বছর পরে শুধুমাত্র একটা নামের খেই ধরে-

    এতটা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কি খুব প্রয়োজন ছিলো।
    উত্তরটা খুব সহজ- রাত্রি।
    একটা দীর্ঘশ্বাস ভরা– ‘না’।

    প্রতিহিংসা চরিতার্থতার গোপন ইচ্ছা যদি ভাবো—-তাও নয়।”
    “তবে?”
    “যেভাবে শুরু হয়েছিলো একটা সম্পর্ক তা কেবলমাত্র ঝোঁকের বশে এভাবে শেষ করা যায়

    তার ব্যাকরণের প্রথম পাঠ তোমার কাছেই বুকে পাথর চাপা দিয়ে শিখে নিয়েছি—-

    তাই এখন আর হারাবার ভয় নেই।

    তুমি রাত্রি আজ কোন অতিথির গোপন কক্ষে অনাবিল আনন্দে উজার করেছো নিজেকে

    তাও জানতে চাইবো না—তবে তোমার কাছে একটা জিনিষ চাইবো অবশ্য যদি রাজি থাকো ।”
    “কি?”
    “একবার ওই গানটা গাও না রাত্রি ,আর হয়তো তোমার সাথে আমার দেখা হবেনা কোনোদিনও।”
    “কোন গানটা?”
    “ওই যে–‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে——-!”

  • কবিতা

    ভূল

    ভূল
    -পার্থসারথি

     

     

    যদি আপন ভেবেই ডাকলে কাছে—কেন মিথ্যে অভিমান?
    আমিতো চাইনি স্বপ্ন দেখতে — ছলনার ছদ্মনাম!
    ভাঙার গানেই তুষ্ট যে মন
    কেন তাকে ভোলাও,
    নিরানন্দে হাসে যে হৃদয়, তাকে কেন দোলাও?
    মিথ্যা আশার কুহেলীতে থাকো যে মুখ ঢেকে
    কেমন করে গড়বে হৃদয়–
    প্রেমের অভিষেকে!
    পথের পাশে ফুটে থাকা রঙবেরঙের ফুল,
    তাদের দিয়ে সাজাও আশার ফুলদানি বিলকুল।
    যখন সে ফুল শুকিয়ে যাবে সময়ের অভিশাপে,
    ফেলবে জানি আবার পথে
    পুড়ে মনস্তাপে।
    মুখের হাসির অজানা দেশে মিথ্যার পথ গড়ে—
    ভোলাও কেন অতিথিকে ,সে যে এসেছে ও দেশ ঘুরে।
    মায়ার কাজল কুটিল চোখে, বাড়ায় কেবল মায়া!
    নাই যে আশা, ভালবাসা সবই শুধু ছায়া।
    ক্ষণিকের ভূল স্বপ্ন সমান,
    তা দিয়ে সৃষ্টি চলেনা।
    লোভের মরু ,কণ্টকতরু তাতে সুফল ফলেনা।
    দূর থেকে দেখা পাহাড়শোভা– নানারঙের বাহারে—!!
    কাছেতে গেলেই সব মিথ্যা , দৃষ্টি তবু ভূল করে হায়! কেমনে বোঝাই! আহাঃ রে!

  • গল্প

    চরৈবেতি

    চরৈবেতি
    -পার্থসারথি

     

     

    একটা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মাল্টিন্যাশানাল্ কোম্পানীতে কাজ করে রুদ্রাণী –মানে রুদ্রাণী দত্তগুপ্ত।আগে ছিলো রুদ্রাণী পালৌধি –এরকম পদবী চেঞ্জেরও একটা ছোটো অথচ গুরত্ববহ প্রেক্ষাপট রয়েছে।
    যাওয়া আসার জন্য তাকে কোম্পানী দামী এক্সেল প্রেসেন্ট করেছে-এমডি বলে কথা।ধ্রুপদী চাল চলনের সঙ্গে মানানসই গাড়ী ওকে নিতে আসে ঠিক সওয়া আটটায়।উর্দিধারী ড্রাইভার সিক্সথ্ ফ্লোরে ফরেস্ট অ্যামবিয়েন্স-কলিংবেল বাজিয়ে জানান দেয় তার আগমন বার্ত্তা।রুদ্রাণী তখন তার রূপচর্চায় ব্যস্ত—ভেনেস্তাকাঠের সাবেকী আমলের ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে লাস্ট টাচ্!শৃঙ্খলিত জীবনের মানে খুঁজে পেতে চায় সে।বেডরুমের দরজায় অভ্যস্ত টোকা -মেডসার্ভেন্ট—
    ম্যাডাম গাড়ি রেডী—-!
    আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রুদ্রাণীর হাত আরও সুইপ্ট্–মেডসার্ভেন্ট কে চটজলদি সদর্থক উত্তর–ঠিক আছে আমি আসছি—
    ফাইনাল চেকআপ–হেড টু ফুট!যেন গোটা শরীরটা জরিপ করে নিচ্ছে ও।ও বেশি মেকআপের ফ্যান নয়।মুখে-হাতে-গলায় ক্লাস এপার্ট দামী কোম্পানীর বডিলোশন্,আইলাইনারে সেনসিটিভ টান, অধরাঞ্জনীর সপ্রতিভ উল্লাস—মোডিফায়েড লুক আনতে–সালোয়ার কামিজ্–সাথে ছোট্ট অথচ আকর্ষণীয় একটা টিপ।জিনস বা ফরম্যাল প্যান্ট-শার্ট হলে ওটা মাইনাস্ ।ফ্রেঞ্চ পারফিউমের সৌরভে চারদিকে গন্ধ তুলে সানগ্লাস চোখে নেমে এলো রুদ্রাণী।পৌরুষোচিত সংযমের ঘেরাটোপ ভাঙানো চমকানো ঝাঁ চকচকে ওয়াইল্ড লুক।
    কোনো রকম ইতস্তত নাকরে স্বভাবজাত রাজসিক ভঙ্গিমায় উঠে বসলো এ-সি গাড়ীতে।ড্রাইভার পেছনের গেট খুলে সসঙ্কোচে ম্যাডামের সাচ্ছ্যন্দের বিষয়ে সন্দিহান।নিজের হাতে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ড্রাইভার-সীটে বসে ক্লাসিক স্টার্ট–চোখের নিমেষে বেরিয়ে গেলো গাড়িটা।ঘড়ির কাঁটা তখন আটটা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই।

    এই অ্যাপার্টমেন্টের অন্যসব বাসিন্দাদের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি এসে পড়ে তার উপর অর্থাৎ রুদ্রাণী দত্তগুপ্ত যেন এক আশ্চর্য !!–সকলের দৃষ্টির চক্রব্যূহ ভেদ করার ক্ষমতাও রাখে ,মিড ফোর্টির ওই উগ্রাধূনিকা যুবতীটি।পৌরষের বাঁধভাঙানো- লোভ জাগানো- যৌবনের উপবনে তার দোসর মেলা ভার ;তাই পুরুষের লোভ আর নারীজনোচিত ঈর্ষাতে ইন্ধন যোগায় রুদ্রাণীর রুদ্র-যৌবন।সমগ্র নারীজাতির মনে আক্ষেপ আনা লুক তার –তাকে দেখা মাত্র একজন যুবতীর রুদ্রাণী হবার বাসনা অত্যন্ত প্রবল হয়ে পড়ে–তখন তাকে একটা অপূরিত পিপাসা তাড়া দেয়—ইস্!আমি যদি রুদ্রাণী হতাম!

    সবার রুদ্রাণী হওয়ার বাসনা–কি কাজের মেয়ে!কি সংসারের নিয়মসিদ্ধ গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে আসা গৃহকর্ত্রী— housewife! রুদ্রাণী সবই বোঝে বোধের জায়গায় no compromise ।বোধ-পারাবারে গোধুলি বেলায় একসময় বোঝা ও জানার মধ্যে একটা আত্মসন্তুষ্টির রঙছড়ানো আবিলতা মিশে থাকতো এখন সেটা আর নেই।চোখে রঙিন চশমায় তা মসৃণভাবে ঢেকে দিতে চায় রুদ্রাণী।বুকের মধ্যে চিনচিন করে ওঠে একটা ব্যথা—নিজের অজান্তেই যেন ও বলে ওঠে –তোমরা আর আমার সম্বন্ধে কতটুকু জানো—-
    তাই লোভকাতর আর ঈর্ষাকাতর চোখগুলো আটকে যায় সুঠাম শরীরের যৌবনসিক্ত আধুনিকার শারীরিক ম্যাপে।রুদ্রাণী সুঅঙ্গনা বটে—সুন্দর আবেদনময়ীর রিক্ত বিলাস যেন —একাকীত্বের অভিসার!প্রকৃত অর্থে এখনো এই মধ্যচল্লিশে ষোড়শ বর্ষীয়াদের সঙ্গেও তুড়ি মেরে প্রতিযোগিতা লড়তে পারে ও।ওই যে বলেছিলাম আগে ছিল পালৌধি।কয়েক বছরের ব্যবধানমাত্র এখন সে বিচ্ছিন্না—আবার সেই দত্তগুপ্ত অর্থাৎ পৈতৃক পদবীটাকেই আকড়ে বাঁচা।
    কলেজ লাইফ—প্রশান্ত পালৌধির সাথে চুটিয়ে প্রেম ,বাড়ির সকলের অমতে হুয়িমসিকেল্ ডিশিসন্!অতএব প্রশান্তঘরণী ।
    তারপর ভালবাসার চাঁদে লাগলো গ্রহণ—ধীরে ধীরে শুরু হলো psychologically mental errosion সব ফুরিয়ে গেল একসময়।নিঃস্বা, রিক্তা রুদ্রাণী।মিউচুয়াল সেপারেশন্ই একমাত্র পথ।রুদ্রাণীর জীবন থেকে ভালবাসার প্রশান্তসাগর শুকিয়ে গেল।প্রশান্ত যে আবার বিয়ে করেছে সেখবরও সে পেয়েছে;তবু যেন কোনো হেলদোল নেই অন্ততঃ বাইরে থেকে তাই মনে হয়।
    ইদানীং প্রায়শঃ হুরমুর করে ভাবনার বন্যা ধেয়ে এসে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়।কিন্তু না পারেনা ও মানসিকতার জোরে নিজেকে উদ্ধার করে আর আবিস্কার করে—মাল্টিন্যাশানাল্ কোম্পানীর এমডি–এম এস রুদ্রাণীকে।
    এখন মিস্ বা মিসেস্ out of date সুবিধার্থে এই অভিযোজন–কি ?ভালোইতো!কিন্ত সকলেই সন্দিহান —রুদ্রাণীর রহস্যময়তার কাচেরঘরে ফাটল!সকলেই যেন সুন্দরী ডির্ভোসীর যৌবননিঃসৃত কস্তুরীর ঘ্রাণ পেয়েছে।সস্তার রূপ-মার্কেটে তরতাজা সুস্বাদু নারীমাংস!গন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে!
    সওদা হয়ে যায় give & take policy’র আদলে।দেওয়া নেওয়ার অলঙ্ঘ্য উলঙ্গ চুক্তির সেনসিটিভিটি!
    একবিংশ শতাব্দী!নাকি মধ্যযুগ চিনতে হচ্ছে কি ভূল! কিজানি!
    রুদ্রাণী দত্তগুপ্ত গড্ডালিকা প্রবাহে গাভাসিয়ে দিয়ে আপোসের রাস্তা খুজে নেয়।হঠাৎ বিবেক জিঙ্গাসা করে রুদ্রাণী তুমিও শেষে—-?
    পালৌধি থাকার সময়ে এই সমস্যা ফেস্ করতে হয়নি তাকে।তখন পুরুষালি দৃষ্টির কামাতুর আবেদন উপভোগ করতে ভাললাগতো ওর।কিন্তু দত্তগুপ্ততে ফিরে আসার পর,দশবছর থেকে শারীরিক-সালিশীর বেপর্দা চুক্তিতে সাইন করতে হয়েছে
    তাকে।না তার জন্য ওর মধ্যে কোনো মেনিয়াক্ টেনডেনসি লক্ষ্য করেনি কেউ বরং স্বাভাবিক পূর্বাপেক্ষা আরও স্ট্যাটিস্টিক্যাল্।

    এই ব্যাপারে রুদ্রাণীর নিজের উপর ছিলো একটা কড়া শাসন–শরীর আর মনের মাঝখানে একটা সেপারেশন্ ওয়াল তৈরী করে ফেলেছিল যেন স্বয়ংক্রিয় ভাবেই।প্রায় দশ বার বছর আগে তখন সে সদ্যবিবাহিতা–শরীর জুড়ে যৌবনের ঢেউ,রূপের তটে ছলকে উঠছে।এখনও বা কম কিসে–এখনও তার শরীরে পুরুষালি ধৈর্য্যের বাঁধভাঙ্গাযৌবন —ভাটা পড়েনি একটুও।চারদিকে তাই পুরুষ পতঙ্গের ভীর সে একা অমানিশায় রূপবহ্নি।কাকে চাইবে ,কাকে নাচাইবে–ওখানে রুদ্রাণীর সূক্ষ হিসাব–ভূল হবার জো নেই।

    সেই গাণিতিক হিসাবেই দশ দশটা বছর ধরে একটির পর একটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে এসেছে–আজ সে শুধুমাত্র নিজের ক্যালিতে গ্রীন ওয়ার্ল্ড মাল্টি ন্যাশানাল কোম্পানীর এমডি।আজ তার ভোগের লিস্টে কি নেই –গাড়ি,ফ্ল্যাট,ফ্যাট স্যালারী প্যাকেজ,ইনসেনটিভ পার্কস যাবতীয় হীরে থেকে জীরে।তাহলে রুদ্রাণী অবশ্যই সুখী?–না–তবু যেন কোথায় একটা গরমিল!!
    একটা নৈরাশ্যের কনকনে হাওয়া তার সারা শরীর কাঁপিয়ে তোলে।বিশেষ করে অবসর সময়ে–একা নিজের সঙ্গে নিজের মোকাবিলার সংবেদনশীল মুহূর্ত্তে।তবে এহেন মুহূর্ত্তের সম্মুখীন হওয়ার ফুরসৎ খুব কমই পায় ও।
    ও তখন লাসভেগাসে –উপলক্ষ্যটা ছিল ইন্টারন্যাশানাল ট্রেড ফেয়ার–রুদ্রাণী সেখানে রিপ্রেজেন্ট করছিল ওর কোম্পানীকে সঙ্গে ছিল মাইকেল ক্রুক -চিফৃএক্সিকিউটিভ্ মার্কেটিং।বোর্ড অফ ডিরেক্টরসে এমনটায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো।
    মাইকেলকে নিয়ে তারা উঠেছিল সেখানে সাততারা হোটেল-ফিনিক্সে-রয়্যাল রিলেস্ক!রাজসিক বিলাসে মেলে ধরেছিলো সেদিন রুদ্রাণী নিজেকে।বিলাসী শয্যায় রাজসিক তন্ময়তার সমুদ্রমন্থন।মাইকেল কামার্ত, আপাদমস্তক একটা আস্ত নারী—ইচ্ছাপূরণের সেকি কুৎসিত রূপ !বাতাসও যেন থমকে যায় ওদের নগ্নতার উন্মত্তায়।নগ্নিকার শরীরে আলতো আবেশ সারাশরীর জুড়ে শিহরণ। হঠাৎ রুদ্রাণী জেগে ওঠে –বাধার প্রাচীর খাড়া হয় ওর আর মাইকেলের মাঝখানে—অপূরিত বাসনার পূনর্মোক্ষণ;মাইকেল কৈফিয়তের সুরে বলে ওঠে–What’s wrong with you?Are you well or don’t like to get it eagerly?
    রুদ্রাণী যেন নিজের কাছেই নিজে হেরে যাচ্ছিল- ডানাভাঙা পাখির বার বার ওড়ার ব্যর্থ চেষ্টা যেন ।এইরকম অপ্রত্যাশিত যে তার জীবনে কখন ঘটতে পারে ,সে ভাবতেই পারেনি।ঘটনাচক্রে ঘটলো কিন্তু তাই –বিবেকের দ্বন্দ্ব শুরু হলো কোনো ভাবেই নিজেকে ভেজাতে পারছে না।
    অভিজ্ঞ পৌরুষ,পরিমিত স্পর্শ তবু তার মন সায় দিচ্ছেনা।রুদ্রাণী এ ব্যাপারে যথেষ্ট অভিজ্ঞা –একজন পিএইচডি স্কলারের যেমনটা হওয়া প্রয়োজন।এতদিনের অভিজ্ঞতাই বলে দিচ্ছে তাকে–প্রকৃত পুরুষ এতটা ফোরপ্লে বা কামকেলির আশ্রয় নেয়না।কয়েকমিনিটের যৌনস্তুতি ব্যস্! তার পরেই চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে যাওয়া।নারী তখন আর তার প্রকৃত সঙ্গিনী থাকে না ,হয়ে ওঠে ভোগ্য–চরমভাবেই ভোগের সামগ্রী।এবং এই ওয়ান সাইডেড্ সেক্সুয়্যালিটির কথা ভেবেই রুদ্রাণী পৌরুষ-সান্নিধ্য পেতে চেয়েছে।লড়াকু পৌরুষও ওর এই সেক্সুয়্যাল স্ট্যামিনারের কাছে কতবার নম্রফণী হয়েছে।
    প্রতিপক্ষ কে তৃপ্ত করার অনায়াসলব্ধ কৌশল তার মতো আর কেউ জানে বলে মনে হয় না। সে যেন কলিক্রোড়সঞ্জাতা রতি–কোনো পুরুষই তার সাথে পেরে উঠতনা,অবশেষে পরিশ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়তো রোদে পোড়া গাছের মতো।ঘুমে ঢলে পড়া সেই অর্ধাচেতন পুরুষের নাসিকা গর্জনের শব্দে সে নিজেকে triumphant ভাবত আর মনে মনে বলতো–“Totally defeated! তবুও তো এমন কিছুই এগোয়নি! এইটুকুতেই একেবারে—-রক্তলাল তুলতুলে পুরন্ত ঠোঁটে চুম্বনেই দিশাহারা!ভাবছে কত যেন বীর-কত যেন আদায় করলো।আসলে নিলামতো আমি!একেবারে নিঙরে,শুষে নিলাম অনায়াসে।এখনো বাকি -অনেক বাকি।সমস্ত কিছু জীবন -যৌবন -সম্পদ সব! সব!”
    সেই আত্মবিশ্বাস ও আত্মরতিরও পদস্খলন ঘটেছিল মধ্যচল্লিশের পূর্ণযুবতীর শারীরিক ব্যর্থতায়।হাল ছেড়ে হাহুতাশী!!-না কখ্খনো না –কোনো অবস্থাতেই হাল ছেড়ে দেবার পাত্রী রুদ্রাণী দত্তগুপ্ত নয়!তাই primary blowটা সামলে উঠে মাইকেলের সুঠাম দেহটাকে সে দখল করেছিল।দেহটা কার? মাইকেলের না গ্রীন ওয়ার্ল্ড মাল্টি ন্যাশানাল কোম্পানীর চিফ্এক্সিকিউটিভের?তা না হলে কিসের জন্য রুদ্রাণী!কিসের জন্য এই এতো কিছু -থিওরি মেকিং!মন যেন তার গেয়ে উঠতে চায়-“আমারও পরাণ যাহা চায় তুমি তাই ,তুমি তাই গো—”
    ফোর প্লে বা কামকেলির কৌশলী প্রয়োগে একেবারে উন্মাদ করে তুলেছিল মাইকেলকে।আর তারপর just a recess—“জাস্ট এ মিনিট,ডার্লিং—-জাস্ট এ মিনিট–আই এম কামিং দেন আই মাস্ট গিভ্ ইউ মোর–মোর এন্ড মোর ওকে!” বলতে বলতে প্রায় ছুটে ঢুকে পড়ল টয়লেটে।পরিবর্ত্তন চায়! পরিবর্ত্তন–নিজস্ব শুষ্ক গোপনীয়তায় কৃত্রিম সুগন্ধী ক্রীমের প্রলেপ।তারপর কৃত্রিমতার জাল বিস্তার করে মাইকেল কে টেনে নিয়েছিল কৃত্রিম পিচ্ছিল ঐ রন্ধ্রপথে ।
    সে রাত কেটেছিল বিনিদ্র।চোখে ছিলনা রুদ্রাণীর ঘুমের লেশ্,পরিবর্ত্তে ছিলো চকচকে শানিত দুটো লোভরিপু চরিতার্থতার ছলনামাখা চোখ –ও চোখে ঘুম আসতে নেই।এক সময় মাইকেল ক্লান্ত হয়ে অর্ধনগ্ন অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লে- পা টিপে টিপে শিকারী চিতার মতো রুদ্রাণী ঢুকে পড়লো আবার টয়লেটে।আরশির সামনে এসে উদ্বেল যৌবনের রণক্ষেত্র তার শরীরটা খুটিয়ে খুটিয়ে পরীক্ষা করছে।পরীক্ষা করছে নিজের নগ্ন শরীরটাকে।আয়নায় স্বপ্রতিবিম্বে যেন বিবেক এসে দাঁড়ালো এবং জিজ্ঞাসা করল–“রুদ্রাণী তুমি ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গিয়েছ; তা নাহলে কিসের জন্য ঐ আর্টিফিসিয়াল লুব্রিকেশন্?বলতে পারো?”রুদ্রাণী চমকে পিছু হটলো কয়েক পা–তবে কি!তবে কি রুদ্রাণী দত্তগুপ্ত ফুরিয়ে আসছে?সেদিনই রুদ্রাণী টের পেয়েছিলো যৌবনযমুনায় এবার ভাটা পড়ে আসছে।

    সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুরই পরিবর্ত্তন হয়–এটাইতো স্বাভাবিক। এইরকম কতো কথায়না মনে পড়তে লাগলো রুদ্রাণীর–একেবারে মেনিয়ার মতো পেয়ে বসলো তাকে। এইরকম মনবিকলনের শিকার আগে কখনো হয়নি সে ।হঠাৎ মাইকেল জেগে উঠলো চোখে মুখে একটা জৈবিক-পিপাসা।সে রুদ্রণীর অনুকম্পা পেতে বললো- ও!ডার্লিং ইউ আর দ্য বেস্ট -এন্ড ইভেন স্টিল —–স্টিল আপডেটেড্–স্টিল!
    কথাগুলো শুনে রুদ্রাণীর ভেতরে একটা আশঙ্কার কালমেঘ জমে উঠলো।মাইকেলের ঐ একটা শব্দ-“স্টিল”বার বার যেন রুদ্রাণীর কানে অনুরণিত হতে লাগলো।যৌবনের রাজপ্রাসাদে তাহলে এখনো সে রাণী সাহেবাই আছে–কিন্তু এরপর?আর্টিফিশিয়াল লুব্রিকেশনের কৃত্রিম মসৃণতার ঘোর কেটে গেলে?তারও পরে!অনেক পরে—-??
    একটা অনিবার্য অনিশ্চয়তা যেন তাকে তাড়া করে বেড়াতে লাগলো—আর এর থেকে অব্যাহতি পেতে রুদ্রাণী নিজেকে নিজের গোপনতম স্বস্তির ঈশান কোনে স্থাপন করলো।আর ঠিক তখনই–লাসভেগাসের বিলাসবহুল হোটেলের আরামশয্যা ভেদ করে উঠে এলো পনের বছর পুর্বের এক আবেগতাড়িত স্মৃতি।একটি বিদেশী সিনেমার নায়িকার সংলাপ-I am Novatna.People call me by my nick name with love– what about you——–রুদ্রাণী চমকে উঠেছিলো আর কান চেপে ধরেছিল।with love! —-আর কিছুই সে শোনেনি।আচ্ছা এমনি ভালবেসে তাকেও কি কেউ কোনো দিন কিছু বলেনি।বলেছে-বলেছে!কিন্তু কি বলেছে?কি?–কি?
    গাড়িটা হঠাৎ ব্রেক কষে থেমে যেতেই –ড্রাইভার শুনলো তার ম্যাডাম চিৎকার করে উঠলো—কি ?কি?
    সে আশ্চর্য হয়ে রুদ্রাণীকে জিজ্ঞাসা করলো-কি হলো ম্যাডাম?
    রুদ্রাণীর স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছে।সানগ্লাসটায় চোখ ঢাকতে ঢাকতে এবং সেই সঙ্গে নিজেকে আবৃত করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে রুদ্রাণী দত্তগুপ্ত,গ্রীণওয়ার্ল্ড মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানীর এমডি আদ্যন্ত প্রফেশনাল্ হয়ে তার বিরক্তি উদ্গার করল–কি হলো থামলে কেন?রাস্তার মাঝে?রাবিশ্! –‘চলো! চলো!
    যাইহোক অধস্তন কর্মচারীর মালিক বা মালকিনকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করাটা out of courtesy–।যতক্ষণ না তাঁরা কিছু বলছেন টুঁ টি নয়।কিচ্ছু জিজ্ঞাসা করা যাবেনা—এমনকি অপ্রস্তুত মুহূর্ত্তে কিছু দেখে ফেললেও না দেখার ভান করতে হবে—–নিশব্দে হুকুম পালন।কিঁউ কি হুকুমৎ উনকি এক্তিয়ার মে!
    রুদ্রাণী!—–রুদ্রাণী মাই ডার্লিং !আদর করে ডাকতো একজনই আর সে হলো প্রশান্ত পালৌধি,রুদ্রাণীর এক্স হাস্বেন্ড।বাঙলা
    উচ্চারণে নয় রীতিমতো কেতাদুরস্ত অ্যাঙ্গলিসাইসড্ সম্বোধন—“রুড্রাণী”।তখন কৃষ্ণচূড়ারতলে আশা ছিল ,ভাল ভালবাসাও ছিল মানে সবকিছুতেই with love থিওরি আর কি!ভালবাসা কিন্তু ঐ “রুড্রাণী “ডাকের দৌলতেই ঘরে পা রেখেছিল।’পিয়া অব তো আ যা’–আজান দিতে হয়নি তাকে অর্থাৎ প্রশান্ত পালৌধিকে।তার অনেক আগেই দ্বাবিংশতির যৌবনোপবনে লেগেছিল প্রেমের দখিনাবাতাস।তাজমহল মাফিক বাদশাহী অট্টালিকার দাপুটে ব্যক্তিত্ব-অ্যাটর্নি জেনারেল মিঃ রাজেন্দ্র দত্তগুপ্তের একমাত্র মেয়ে রুদ্রাণী।সে তখন শ্রীরাধা আর প্রশান্ত যেন শ্যামরায়।

    রুদ্রাণী ধনী বাপের একমাত্র মেয়ে।একসময় কনভেন্টের মেরিটরিয়াস্ স্টুডেন্ট সেে।ছোটবড় সমস্ত রকম হ্যান্ডসে সে সিদ্ধহস্তা—ভি বাল সারার খুব প্রিয় ছাত্রী ছিল সে।ফরমাল পার্টি থেকে রাজকীয় ডিনার—মোটকথা সাহেবী আদবকায়দা।প্রেসগিল্ড থেকে টেনিস ক্লাব সর্বত্র ওদের অবাধ বিচরণ।রুদ্রাণীর বাবা ,অ্যাটর্নিজেনারেল মিঃ রাজেন্দ্র দত্তগুপ্ত জাঁদরেল ব্যক্তিত্ব—একসময় বাঘে বলদে জল খেত যার ইশারায়।হাই-সোসাইটি কালচার।পুরদস্তুর বাদশাহী জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত ছিল রুদ্রাণী।কেতাদূরস্ত সাহেবীয়ানায় বেড়ে উঠেছে সে।অধিকন্তু লাস্যময়ী-পুর্ণযুবতী অঙ্গে প্রত্যঙ্গে ঝাঁ চকচকে রাজসিকতা—যৌবনতরঙ্গহিল্লোলে শোভমান রূপসাগরের স্বপ্নপরী।পুরন্ত আদুরে ঠোঁট,টানা টানা চোখের অতল গভীরে কতকালের ইতিহাস যেন লুকানো।ক্লাসিক ব্যাকগ্রাউন্ড।রুদ্রাণী প্রকৃতঅর্থেই রুদ্রাণী; নামের সার্থকতা তার চাল চলনে প্রতিমুহূর্ত্তে ব্যঞ্জিত।অতএব প্রশান্ত পালৌধির মতো মিডিলক্লাস ফ্যামিলির ছেলের সাথে এনগেজমেন্টতো দূরাস্ত—পরিচয় হওয়ারই কথা নয়।

    কথায় বলেনা বাস্তব আর কল্পনা কালে কবুসে মিতালী পাতায়—রুদ্রাণীর জীবনেও ঘটেছিল ঠিক তাই।সময়ের সাথে সাথে গড়িয়ে ছিল ওদের সম্পর্ক।একসময় তা পর্যবসিত হয়েছিল দুরন্ত প্রেমে।

    রুদ্রাণীর বয়স তখন বড়জোর চব্বিশ—যৌবনযমুনায় উজানের টান।অতএব দত্তগুপ্ত থেকে পালৌধি।কেবলমাত্র ক্ষণিকের মোহে—হাই কালচারের মুখে ছাই দিয়ে যেন পথ ভূলে প্রশান্তের ঘরে অর্থাৎ প্রশান্ত ঘরণী।সংসারের সঙ মাত্র সার করে ন’টা বছর!—-প্রশান্তসাগরের তীরে রুদ্রাণী ঢেউয়ের উছলে পড়া।তারপর বিলম্বিত প্রত্যারর্ত্তনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সার্থক রূপায়ণ—–একসময় একশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে ফুটন্ত প্রেমরস উষ্ণতা হারিয়ে মাইনাস স্কেলে।আদালতের নির্দেশ মেনে দুটো বছর মিউচুয়াল সেপারেশনে থাকা —-তারপর !আরকি ?সোজাসুজি ডিভোর্স কমিট্– নো নিগোশিয়েশন্!
    রুদ্রাণী কিন্তু স্বমহিমায় উজ্জ্বল,শত জটিলতার মধ্যেও সে অত্যন্ত স্মার্ট।একসময় হাইকালচারের যে মানসিকতার দাপটে উঁচুতলা থেকে হাত বাড়িয়ে প্রশান্তের মতো একটা ছন্নছাড়া ছেলেকে আস্তাকুড় থেকে তুলে এনে ঠাঁই দিয়েছিল সে রাজপ্রাসাদে ,সেই রুদ্রাণীই আবার তাকে স্বপ্রয়োজনে বর্জ্জনও করেছে ঐ একই মানসিকতার দাপটে।সে যেন নিজের অস্তিত্ব নিয়েই এক্সপেরিমেন্ট করতে চেয়েছে।তাই বলে সম্পূর্ণ প্রসেসটাতেই ভাঁউতা ছিলনা।প্রশান্তের রূপে সে সত্যিই আকৃষ্টা হয়েছিল একদিন।

    এসি গাড়ির শীতল বিলাসিতায়,কালকাচের চৌকস্ নিরাপত্তায় শরীর এলিয়ে ব্যাকসিটেড্ রুদ্রাণী দত্তগুপ্ত,নামকরা মাল্টি ন্যাশানাল কোম্পানীর এমডি নিজের অজান্তে–তন্দ্রার ঘোরে ঘোষণা করে বসে তার স্বীকারোক্তি—“Only for sexual attraction—–nothing but being desirous fatally!!
    আসলে প্রেম এই বিমূর্ত্ত বিশেষ্যপদটির আড়ালে লুকিয়ে ছিল দূর্বোধ্য এক জৈবিক অনুভূতির ভয়ঙ্কর যৌনতা।হঠাৎ স্মৃতির পুনর্মোক্ষণ—-যেন কোনো রোম্যান্টিক সিনেমার প্লে-ব্যাক্।

    শহরজীবন তখনও এতটা সস্তার উমেদারী করেনি।জীবন এতটা মেকি আধুনিকতার পাঠ নিতে শেখেনি।আধুনিকতার সংজ্ঞায় ফ্ল্যাক্সিবল্ কোনো তকমা জুড়ে দেওয়া হয়নি।যৌবন তখন ঘরোয়া শাসনের চোখরাঙানিকে মূল্য দিত।আজ থেকে বাইশ বছর আগে– প্রশান্ত যখন ছিল একটা বেমানান গোছের মূর্ত্তিমান ছন্নছাড়া।

    তারিখটা ছিল একত্রিশে ডিসেম্বর ,সময় বিকাল চারটে–টেনিস কোর্টে শর্টস পরিহিতা রুদ্রাণী দত্তগুপ্ত– আভিজাত্যের প্রতীক যেন।এই রুদ্রাণীকে দেখে প্রশান্তের সেদিন মেনিয়াক টেনডেনসি দেখা দিয়েছিল।সফিস্টিকেটেড্ ক্লাবকালচারের সমস্ত নিয়মনীতি ভেঙে ফেলেছিল সেদিন ও।রকবাজী কায়দায় –হুইসেলিং!রুদ্রাণীর রুদ্রত্বকেই যেন চ্যালেঞ্জ থ্রো করল প্রশান্ত–বেলাল্লাপনার আর্টিস্টিক কৌশলে।মধ্যত্রিংশতির উল্লাসময়ী রুদ্রাণী –আপাদমস্তক উগ্র আধুনিকা ;সে জানে তাকে দেখে ছেলেরা মরে বাঁচে।আচ্ছাসা মর্দানাভি উনপে মরতে হ্যায়!
    সাহসী স্মার্ট যুবক সে পছন্দ করে ;তাই বলে ওভার স্মার্ট –নো নো– নেভার টু বি টলারেটেড্ অ্যান্ড অ্যাট এনি কস্ট।প্রশান্তের এতটা দুঃসাহস যে ও আদৌ পছন্দ করছেনা ,সেটা প্রশান্তের বন্ধুরা ভাল করেই জানে।
    প্রশান্তের ঐ হেন বেপরোয়া ভাব রুদ্রাণীর চ্যালেঞ্জ বলেই মনে হয়েছে।অতত্রব দেখে নিতে হবে ঐ ছেলেটার কতটা দম!তাই সে হঠাৎ ওদের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল।প্রশান্ত তখন তার এক বন্ধুর কোলে মাথা রেখে নির্লজ্জভঙ্গিমায় শুয়ে আছে।তার বন্ধুরা তাকে ধমকের সুরে বলে ওঠে –আঃ প্রশান্ত ইয়ারকির একটা সীমা আছে?সব জায়গাতেই তুই একরকম।তোর কি একটুও কমনসেন্স থাকতে নেই?তুই কার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিস্?জানিস উনি অ্যাটর্নিজেনারেল মিঃ রাজেন্দ্র দত্তগুপ্তের একমাত্র মেয়ে—মিস রুদ্রাণী!
    কথাগুলো যেন বাতাসে উড়েগেল –প্রশান্তের কোনো হেলদোলই নেই।সে আরও বেপরোয়া জোরগলায় গান ধরল–হাম্ তুম্ এক কামরেমে বন্দ হো অউর চাবি খো যা—-

    প্রচণ্ড অপ্রতিভ হয়ে পড়েছিল টেবিলের বাকি সকলে।নিজস্ব রাজকীয় ভঙ্গিতে এসে দাঁড়াল রুদ্রাণী।হাতের টেনিস রাকেটটা দিয়ে প্রশান্তকে টার্গেট করে বাকিদের উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল–হু ইজূ দ্যাট মাঙ্কি?হুজ গেস্ট ?

    আই অ্যাম প্রশান্ত পালৌধি নিড নো সুপারভিশন্,চটজলদি উত্তর দিল প্রশান্ত।—
    ——!!
    আচমকা বুমেরাং এবং জবরদস্ত।রুদ্রাণী যেন খানিকটা হকচিয়ে গেল।এ যেন অ্যালোপ্যাথি–like cures like theory–
    রুদ্রাণী গর্জ্জন করে উঠলো–হোয়াট!!
    প্রশান্ত এবার রীতিমত স্বপ্রতিভভাবে অ্যাঙ্গিলিসাইস্ড্ উচ্চারণে জানাল—ম্যাডাম আই অ্যাম দ্য গেস্ট অব মাই ওন।অ্যান্ড ইউ আর সারটেনলি অন বিহাভ্ অব আওয়ার দ্যাট এনসেস্টরস্—” এপ্” বাই নেম।
    রুদ্রাণীর ঠোঁটদুটো রাগে কাঁপতে আরম্ভ করলো।তার তাকে মাঙ্কি বলার জবাব এইভাবে –তাও আবার ভাষার চাতুর্য্যে !এতটা ঔদ্ধত্য ঐ ছেলেটার!সেকি জানেনা রুদ্রাণী দত্তগুপ্তের একচুয়াল হোয়্যারঅ্যাবাউটস?তাকে সে এপের প্রতিনিধি বলার সাহস পেল কোথ্থেকে!——
    অতএব এ যার সুপারভিশনে এখানে ঢুকেছে তাকে ডাঁটবে।অসহ্য! রুদ্রাণী দত্তগুপ্ত এই প্রথম কারও কাছে ধাক্কা খেল ।না হজম করে বসে থাকার মেয়ে সে নয় –ফিরিয়ে দেবে এই ইনসাল্ট শতগুণে।হঠাৎ তার মনে হল–উঁহু!–সামথিং স্পেশাল ইজ দেয়ার ইন হিম।রাগটাও যেন এক অজ্ঞাত কারণে স্তিমিত হতে লাগল।
    রাগের আবরণে সত্যখোঁজার তত্ত্ব পুরে ছুঁড়ে মারল আবার প্রশ্ন–হুজ গেস্ট ?হুজ গেস্ট ইজ হি? অ্যান্ড আই ডু ওয়ান্ট টু নো দিস্।

    জবাবটা দিলো প্রশান্ত খুব ঠাণ্ডা মাথায়–সারটেনলি ইউ আর ডিফ্।

    হোয়াট,চিৎকার করে উঠলো রুদ্রাণী।

    ইয়েস ইট ইজ্;বিকজ্ আই হ্যাভ্ মেনসানড্ বিফোর।
    চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো প্রশান্ত।কলারওয়ালা লাল রঙের শার্টে দারুণ মানিয়েছে ওকে তারউপর আবার বুকের বোতাম দুটো খোলা—-তার এই ড্রেসিং স্টাইলটা যেন” against the dresscode”বলে মনে হয়েছে রুদ্রাণীর।এই মুহুর্তে ওকে শুধুমাত্র এই কারণ দেখিয়েই ক্লাব থেকে বের করে দিয়ে ওর ঔদ্ধত্যের উপযুক্ত জবাব দেওয়া যায়!মনে মনে এমনটা যখন ভাবছে তখন হঠাৎ তার চোখ পড়লো প্রশান্তের প্রশস্ত লোমশ বুকের দিকে—যেন সতেজ সবুজ ঘাসের প্রশস্ত লন যেখানে অনায়াসে ক্লান্তিহর বিনোদনে দুদণ্ড আরামতো করাই যায়।হঠাৎ রুদ্রাণীর গোপনতম ইচ্ছার চুল্লীতে কেযেন ইন্ধন যোগাতে লাগলো ;আগুনের নীল শিখায় ক্রমশঃ পুড়ে যেতে লাগলো তার প্রতিশোধস্পৃহার শালকাঠ।

    হাইসোসাইটি কালচারে নারীস্বাধীনতা সো করার একটা প্রথা ছিলো– মেয়েদের গা খোলা চালচলন।বিপরীতপক্ষে পুরুষদের ছিল ঠিক উল্টোটা অর্থাৎ পোষাকে-আষাকে একটা রাখঢাক ভাব।তাই প্রশান্তের ঐহেন ড্রেসকালচার যেন এক অনিবার্য্য ব্যতিক্রম—–স্বর্গোদ্যানে শয়তান নির্দেশিত নিষিদ্ধ জ্ঞানফল!—-রুদ্রাণীকে পেয়ে বসলো যেন এক অমোঘ মোহ।প্রশান্তনামক চুম্বকের দুর্বার আকর্ষণ রুদ্রাণীনামক কাঁচা লৌহ খণ্ডটিকে একঝটকায় কাছে টেনে নিল।প্রশান্তের চোখে চোখ রাখল রুদ্রাণী—মানে হাইসোসাইটি কালচারে অভ্যস্তা রুদ্রাণী দত্তগুপ্ত।রুদ্রাণীর প্রেমের পানসি এখন প্রশান্তসাগরের মোহনায় দিকভ্রান্ত–ন যযৌ ন তস্থৌ ।

    প্রশান্তের চোখ যেন ক্রমশঃ গ্রাস করতে লাগল রুদ্রাণীর মনকে।ওর চোখের মণিতে রুদ্রাণী দেখতে পেল এক অতলান্তিক প্রেম যেন বাঙ্ময় হয়ে আছে।রুদ্রাণী আর নিছক কালচারের আবরণে নিজেকে ঢেকে রাখতে পারলনা।প্রশান্তের দৃষ্টি ওর সর্ব্বাঙ্গ দখল করে ফেলেছে।ওর দিকে এগিয়ে আসছে এক কালপুরুষ চোখে যার যুগসঞ্চিত বুভূক্ষা– সংহারী মূর্ত্তিতে!!সবকিছু তছনছ করে দিতে—-
    exceptional!—-piercing!——full of sexual appeals!!
    ঐ কালপুরুষ যেন রুদ্রাণীকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আর বলছে–come on darling! come on! wouldn’t you once try me?

    হঠাৎ প্রশান্ত হাতটা বাড়িয়ে দিল রুদ্রাণীর দিকে–সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যেতে লাগল রুদ্রাণীর।শর্টসপরা রুদ্রাণী সারা শরীরে যেন একটা তিরতিরে কাঁপন অনুভব করতে লাগলো; সারা শরীর কামনায় জর্জরিত –একসময় সমস্ত বিচার বুদ্ধির বেড়া টপকে রুদ্রাণীও হাত মেলালো।অজগর এবার শিকার ধরেছে।রুদ্রাণী মনে মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল –yes! yes youngman I just want you—- ।

    সকলে অবাক বিস্ময়ে দেখছিল,সমস্তদিক থেকে মূর্তিমান বাউণ্ডুলে ঐ প্রশান্ত পালৌধির প্রেমে বিবশ হয়ে ,অ্যাটর্নিজেনারেল রাজেন্দ্র দত্তগুপ্তের একমাত্র মেয়ে তাকে নিয়ে একেবারে নিভৃত এককোনায় গিয়ে টেবিলের নির্জনতায়, তাও আবার নিজের গেস্ট হিসাবে সমাদর করে বসাচ্ছে।নিজেও বসেছে গা ঘেঁসাঘেসি করে—মুখোমুখি নয় কারণ সেখানেও হয়তো একটা দূরত্ববোধের মনস্তত্ব কাজ করতে পারে।
    কিছুক্ষণ দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে থাকল কোনো এক অজানা ভাবের রাসায়নিক বিক্রিয়াজনিত আকর্ষণে—হঠাৎ নীরবতা ভেঙে প্রশান্ত বলে উঠলো–রুদ্রাণী ইউ আর দ্য বেস্ট।
    ——ইউ আর নাথিং বাট এ ক্রিয়েশান ওয়ান অ্যান্ড ইউনিক্—-ইউ আর লাইক আ ওয়েসিস্ —–এভরিবডি ক্যান কোয়েন্চ্ হিস্ থার্স্ট কামিং নেয়ার ইউ —–ইউ আর ডেনরাজাসলি ফেয়ার ওয়ান।
    ইউ আর এভার লাস্টিং ইউথ্ —-হে দেবী তোমার যেন আদি নেই ,অন্ত নেই।
    বিছানায় শুয়ে রুদ্রাণীকে সোহাগের কায়দায় বলতো এসব প্রশান্ত।বলত বহুত পেয়ার সে –with love।রুদ্রাণীকে টানা অনেকটা সময় ধরেই প্রশান্ত ভালবেসেছিল। তার একেবারে নিজস্ব রীতিতে— পারফেক্টলি ইন হিস্ ওন ওয়াইল্ড স্টাইল।অপরপক্ষে রুদ্রাণী !অমোঘ এক জৈবিক আকর্ষণে কাটিয়ে দিয়েছিল অনেকগুলো দিন—-অনেক গুলো মাস—-অনেকগুলো বছর।একটা নস্ট্যালজিয়া তাকে পেয়ে বসেছিল।তার দৈহিক সুষমার খ্যাতি ,প্রশান্তের মুখ থেকে শুনে শুনে ওর মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাসের প্রাবল্য দেখা দিয়েছিল। ও বিশ্বাস করতো তার এই শরীরী ভান্ডার চিরদিনই যেন যৌবন মদিরায় “হরদম হ্যায় হরদম ভরপুর মদ!”থাকবে” because she is the very gift of cupid”—কামদেবের আশীর্ব্বাদধন্যা। কামদেবের প্রসাদে যৌনতার জীবন্ত প্রতীক ,রতিক্রীড়া নিপুনা স্বর্গবারাঙ্গনা।সে স্থূল শরীরে অনায়াসে রচনা করতে পারতো উত্তেজনার দাবানল যে আগুনে পৌরষোচিত বর্বরতা পুড়ে ছাই হয়ে যেত —আর রুদ্রাণী হয়ে উঠত আরও উগ্রযৌবনময়ী ,রতিক্রীড়াপটীয়সী—–এ শক্তি যেন তার স্বয়ংক্রিয় শক্তি।
    একসময় স্ত্রীর এহেন গুপ্তরহস্যের পরিচয় পেয়ে প্রশান্ত যারপরনাই কিছুটা আশ্চর্য হয়েছিল বইকি!প্রথম সেই ফুলশয্যার রাতেই এটা টের পেয়ে প্রশান্ত বলেছিল–you are all but like this –virgin class apart —virgin!—still a dangerous attraction!

    রুদ্রাণী যেন পিনড্রপ-সাইলেন্স্ –আসলে ওর মুখে কথা বলার কোনো প্রয়োজন ছিলনা ;কারণ রুদ্রাণী থিওরিতে বিশ্বাস করেনা ও বিশ্বাস করে প্র্যাকটিকাল্।প্রশান্তের মন্তব্যকে দারুণভাবে সমর্থন জানিয়েছিল সেদিন ওর যৌবনোদ্দাম শরীর দিয়ে —-প্রশান্তের সামনে তুলে ধরেছিল ভোগের নৈবেদ্য তার নিজের শরীর।সেদিনই প্রশান্ত ঐ ভোগ্যবস্তুটিকে সার্টিফাই করেছিল,বলেছিল-you are nothing but a ——cupid made you in his leisure time and with no faults.

    কিন্তু এতোকিছু সত্বেও মন যেন রুদ্রাণীকে সায় দিচ্ছিলনা।মনে মনে একটা যুদ্ধক্ষেত্র তৈরী হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে থেকেই।যাযাবর জীবনে অভ্যস্ত জংলী মানসিকতার ঝাঁঝালো পৌরুষের সান্নিধ্য পাওয়ার নেশা একদিন পেয়ে বসেছিল তাকে।আর তারজন্য সে তার জাত -মান-সংস্কার সবকিছুকে দুহাতে সরিয়ে রাস্তা তৈরী করে নিয়েছিল–ধীরে ধীরে সেই রাস্তা হয়ে উঠছিল কন্টকময়—জঞ্জালে পরিপুর্ণ চলার অযোগ্য। সেদিন সে ঝোঁকের মাথায় প্রশান্তকে মেনে নিয়েছিল—-কারণ সে ভেবেছিল সময়ের স্টিয়ারিংটা নিজের হাতে শক্তকরে ধরে প্রশান্তনামক জীবনগাড়িটার গতিমুখ ঘোরাবে —-সফিস্টিকেশনের দিকে। কিন্তু না!সেটা সে পারেনি—-হাইসোসাইটিকালচারের ড্রেসিংরুমে প্রশান্ত যে একেবারেই বেমানান সেটা বুঝতে পেরেছিল–পরীক্ষিত সত্যরূপে। আভিজাত্যের কোনোপাঠকেই প্রশান্তের বন্যস্বভাব ফলপ্রসু হতে দেয়নি। প্রশান্তের আদিমতা বারবার রুদ্রাণীকে মনে করিয়ে দিয়েছে -হি কান্ট বিলং টু আওয়ার ওন কালচার। প্রশান্ত যেন বার বার বলতে চেয়েছে–“আমি মুক্ত বিহঙ্গ নীলআকাশেই আমাকে মানায় ;আভিজাত্যের সোনার খাঁচায় নয়।”

    সে বার বার তাকে সফিস্টিকেটেড করে তোলার সেনসিটিভ্ প্রসেসিং-এ একটা করে wild-error প্ল্যান্ট করে দিয়েছে—নিজস্ব সপ্রতিভ পৌরুষ আর শিক্ষাদীক্ষাকে একটা মাত্রা দিতে ; কিন্তু রুদ্রাণী সেটাকে তার ফল্ট ভেবে ভূল করতে থেকেছে। রুদ্রাণীকে বার বার সে বোঝাতে চেষ্টাকরেছে তার একান্ত নিজস্বতার কথা।কখনও সে উন্মাদের মতো প্রমান করতে চেয়েছে রুদ্রাণীর মেকি সাহেবী কায়দার অসাড়ত্ব।
    প্রশান্ত পালৌধি অল অ্যালং ব্রিলিয়ান্ট স্কলার -বর্তমানে সে রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটির ইংরাজী সাহিত্যের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট —টেনিসে আন্তর্জাতিক স্তরে বেশ কয়েকবার খেতাব জয়—তার খামতি কোথায়। তাই পরিস্থিতির সীমাবদ্ধতার বাইরে সে হাঁটতে শিখেছে সেই ছোটবেলা থেকেই আর তাই তাকে আপাতদৃষ্টিতে যাযাবর বলেই মনে হতে পারে! কারণ সে মিডিলক্লাস ফ্যামিলি থেকে লড়াই করে উঠে এসেছে— জীবন দর্শন তার নখদর্পণে।এখানটাতেই রুদ্রাণীর সঙ্গে তার ইগোর লড়াই তবুও প্রশান্ত পালৌধিকে নস্যাৎ করার কোনো সূত্রই খুঁজে পায়নি রুদ্রাণী তাদের হাইসোসাইটিকালচারের ম্যানুয়ালে। অতএব শুরূ হল একটা মানসিক ভূমিকম্প উভয়দিক থেকেই —ক্রমশঃ সম্পর্কের ফাটল বাড়তে লাগলো।যার প্রভাব পড়লো প্রশান্তের পিতৃত্বের অধিকার অর্জনের প্রয়াসের উপর—রুদ্রাণীই সেখানে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ালো।তাদের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশঃ বাড়তে লাগলো ,বাড়তে লাগলো উভয়ের অনীহা উভয়ের প্রতি।বন্যহস্তীর মতো খেপে উঠলো প্রশান্ত, রুদ্রাণীনামক হস্তিনীকে থেঁতলে দিতে চাইলো তার উন্মত্ততা।যেন দুই বন্যহস্তী আর হস্তিনীর প্রাণঘাতী লড়াই।একসময় রুদ্রাণীকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইলো সে।

    তাদের দুজনের মধ্যে শুরু হয়ে গেল এক ইগোর লড়াই–যেখানে নিগোশিয়েশনের প্রবেশ নিষেধ।এইভাবে কেটে গিয়েছিল অনেকগুলো বছর।চব্বিশ থেকে পঁয়ত্রিশ—তখনও ওদের শারীরিক সম্পর্কের অমোঘ টানে ভাটা পড়েনি।অকপট শরীরীসখ্যতায় উভয়ের মধ্যে ছিল অকৃত্রিম –আদিম —ছটফট করা উদগ্র কামনার শরীর নিঙরে নেওয়া চৌম্বকতা;কারণ প্রশান্তের কাছে রুদ্রাণী ছিল বরাবরুই —very gift of the cupid।রুদ্রাণী এই শক্তির প্রসাদেই মধ্যচল্লিশে পৌঁছেও নিরুদ্বিগ্ন।শারীরিক সৌন্দর্যের ভান্ডারে তার তাই প্রাচুর্যের আবিলতা—একি কম কথা! সে যেন কামদেব ঔরস-সঞ্জাতা উর্ব্বসী–স্বর্গবারাঙ্গনা।

    তারপর—-!!!!বর্তমানের পাথুরে পথের শেষে—-!!
    gift of the cupid!—-রুদ্রাণীর মানসিকতা?
    ভূমিকম্পপররর্তী ধ্বংসাবশেষ যেন।অসহ্য ক্ষোভে আর হতাশায় ফেটে পড়লো সে—–এখন এই মধ্যচল্লিশে তার কানে কানে কে যেন বলে —Rudrani you have already been finihed .Nothing is left in you ,the gift of the cupid.
    ঠাণ্ডা এসি গাড়িতে ঐ কথাগুলোই যেন তার মানসিক অস্বস্তির গোপন গুহায় প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো—কুলকুল করে ঘামতে লাগলো রুদ্রাণী দত্তগুপ্ত—তার ভেতরের নারীসত্তা ঢুকরে কেঁদে উঠতে চাইছিলো।ওর বিবেক ওকে বারবার কঠিন থেকে কঠিনতর প্রশ্নের সম্মুখীন করে তুলতে লাগলো।বিবেক ওকে যেন বললো–“রুদ্রাণী তুমি আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো হতে পারলেনা কেন? যারা বিয়ে করে অনেক অমিল সত্ত্বেও সন্তান-সন্ততির মা হয়ে অবিচ্ছিনা থেকে গিয়েছে স্বামী–সন্তান–সংসারের নিরাপদতম গণ্ডির ভেতরে।আর তুমি? আজ না ঘরকা না ঘাটকা ছিঃ!রুদ্রাণী ছিঃ!ছিঃ–ছিঃ!”—-রুদ্রাণী হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো–শীট্–শীট্–শীট্!
    কিহলো ম্যাডাম?বলে ড্রাইভার হঠাৎ এমার্জেন্সি ব্রেক কষলো।

    রুদ্রাণী প্রচণ্ড চিৎকার করে বলে উঠলো–কিহলো থামলে কেন?এভাবে থামার কোনো মানে হয়?কোনোভাবেই থামা চলবেনা।চলতেই হবে যে করে হোক।চলো!চলো!চলো!
    =সমাপ্ত=

  • গল্প

    তখন অনেক রাত

    তখন অনেক রাত
    -পার্থসারথি

     

    বদ্যিপাড়ার যেদিকটায় ঝোপঝাড় ওইদিকে থাকে তিনুমাসি-একাই থাকে সে ,তিনকুলে তার কেউ নেই।রাত তখন দেড়টা-দুটো তিনু মাসির দরজায় আঘাত-ঠক,ঠক,ঠক-ঠক———?
    তিনু মাসির এমনেই রাতে ঘুম আসে না।

    যদিবা চোখ একটু লেগেছিল তাও গেল চুলোই ওই ঠক্-ঠক্ আওয়াজের দৌলতে।কে-কে-এতো রাতে ?কে দরজায় ধাক্কা দেয়?
    গলা চড়িয়ে বলে উঠলো তিনু মাসি।
    মাসি ,আমি ঘ্যানা শিগ্গির দরজাটা খোলো।
    কেন কি হয়েছে রে?
    বলছি-বলছি,আগে দরজাটা খোোলোতো।
    তিনু মাসি দরজা খুলে দিতেই ঘ্যানা ঢুকে পড়লো হন্তদন্ত হয়ে ,বললো-মাসি দরজাটা বন্ধকরো তাড়াতাড়ি।
    কেন?
    আঃ কথা বারিওনা যা বলছি তা শোনো।
    তিনুমাসি ঘ্যানার কথা মতো দরজাটা লাগিয়ে দিলো।
    এবার বলতো ঘ্যানা কি হয়েছে?
    বলবো-বলবো সব বলবো;আগে একগ্লাস জল দাও দেখি?গলাটা শুকিয়ে একে বারে কাঠ হয়ে গেছে।
    তিনু মাসি কলসী থেকে জল গড়িয়ে ঘ্যানার হাতে দিলো।জলটা এক নিশ্বাসে ঢক্ ঢকিয়ে খেয়ে ঘ্যানা বললো,আঃ,এতক্ষণে জীবনটা এলো মাসি তুমি কোনো জন্মে আমার মাই ছিলে।
    এবার বলতো ঘ্যানা এতরাতে তুই এখানে কেন এলি?।
    পুলিশ!
    পুলিশ!কেন কি-কি হ-হয়েছে?তিনুমাসির গলা একটা অজানা ভয় যেন চেপে ধরলো।
    ঘ্যানা বললো,পুলিশে আমাকে তাড়া করেছে।সেই স্টেশান মোড় থেকে ছুটতে ছুটতে আসছি।আর একটু হলেই ধরা পড়ে গিয়েছিলুম আর কি।
    কেন পুলিশ তোকে তাড়া করলো কেন?তুই কি করেছিস্?
    জাননা সেদিন সাহেবরা আমাদের মালবোঝাই গাড়ি বাজারে ঢুকতে দেয়নি।সেই নিয়ে প্রথমে বচসা পরে হাতাহাতি–শেষে-বোমবাজি।ওরা আমাদের চন্দনের গায়ে বোম মেরেছে-সে এখন হাসপাতালে ভর্ত্তি।উল্টে শালা আমাদের নামেই থানায় ডাইরি করেছে?
    ও মা সেকি !ওরা মেরে আবার ওরাই ডাইরী করেছে?পুলিশ ডাইরী নিলো কেন?
    নেবেনা?ওরা যে শালা জনার্দন ওঝার লোক গোটা দুনিয়াটা শালারা যেন কিনে রেখেছে?
    ওরা কিন্তু খুব ভয়ঙ্কর ঘ্যানা?সাবধানে চলাফেরা করিস্।এইতো সেদিন বাউরী রণাটা আর বাড়ি ফিরলোনা একদম বেপাত্তা।
    হবেনা রণা যে সাহেবের বাউরী পাড়া ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছিলো।
    হঠাৎ দরজায় আবার শব্দ-ঠক্-ঠক্-ঠক্—–তিনুমাসি ঘ্যানাকে বললো ঘ্যানা তুই মাচানের উপর লুকিয়ে পর ,মনে হচ্ছে পুলিশ।
    কি হলো দরজা খোলো,না খুললে দরজা লাথি মেরে ভেঙে ফেলবো,বাইরে কারা যেন চিৎকার করে উঠলো।

    তিনু মাসি ঘুম-জড়ানো গলা নকল করে বললো ,কে ?এতরাতে?এখানে ?
    পুলিশ!-উত্তর এলো বাইরে থেকে।ততক্ষণে অবশ্য ঘ্যানা লুকিয়ে পড়েছে মাচানের উপরে।
    পুলিশ?তা এখানে কেন?
    দরজাটা খুলবে,না ভেঙে ফেলবো।
    তার দরকার হবে না।খুলছি ,খুলছি।এই বলে তিনুমাসি দরজাটা খুলে দিলো;দরজা খোলার সাথে সাথেএকদল পুলিশ ও সাহেব ঘরের মধ্যে হুরমুরিয়ে ঢুকে পড়লো।
    সাহেব লাল চোখে তিনুমাসিকে বললো,ঘ্যানা কোথা?
    তিনূ মাসি মুখে কাপড় চাপা দিলো কারণ সাহেবের মুখ থেকে ভক্ ভকিয়ে মদের গন্ধ বেরুচ্ছিলো।
    কিহলো ?ঘ্যানা কোথা?সাহেব ঝাঁঝালো গলায় চিৎকার করে উঠলো।
    চিৎকার করবি না সাহেব!এটা ভদ্রলোকের পাড়া।
    ওঃ ভদ্দর পাড়া!কি আমার সতিলক্ষীরে!
    থানার বড়বাবু নিরঞ্জন সমাদ্দার সাহেবকে
    থামিয়ে তিনুমাসিকে বললো-আপনিতো ঘ্যানার দূরসম্পর্কীয়া মাসি ,কি?
    হ্যাঁ,তাতে কি হয়েছে?
    কিছু হয়নি,ঘ্যানা ছুটতে ছুটতে এদিকেই এসেছে।
    তাই আমাদের সন্দেহ হলো সে হয়তো এখানে-মানে আপনার বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারে!হাজার হোক মাসি তো?
    ভদ্রভাবে কথা বলো অফিসার ?আমার ছেলে বেঁচে থাকলে আজ তোমার বয়সেরই হতো।
    সাহেব হঠাৎ ফোড়ং কাটলো-স্যার এশালা বিধবা বুড়ি এযুগের মাতঙ্গিনী।-কথাটা শুনে দলের অন্য কনস্টেবলেরা হো -হো -হা -হা -হি -হি-করে হেসে উঠলো।
    আঃ কি হচ্ছে কি?চুপ!সবাই আবার চুপ।যেন একটা আলপিন পড়লেও শোনা যাবে।
    বড়বাবু এবার কনস্টেবলদের ঘরটা সার্চ করার নির্দেশ দিলেন।
    তিনু মাসি বললো ,এটা কি?বলা নেই, কওয়া নেই আমার বাড়ি সার্চ?তার আগে তোমার সাথের ওই গুণ্ডাটাকে গ্রেফ্তার করা উচিত অফিসার?
    আপনি কিন্তু আপনার ঔকাৎ ভুলে যাচ্ছেন তিনুদেবী?পুলিশের কাজে বাধা দিয়ে আইন হাতে নেবেন না।
    আইন!হাঃ-হাঃ-হাঃ,যারা আইনের দোহাইদিয়ে মুঠো মুঠো টাকা আত্মসাৎ করে,তাদের মুখে আর যাইহোক আইনের কথা মানায়না।
    কি মানায় আর না মানায় ,একটু পড়ে টের পাবেন।-বলে বড়বাবু এক কনস্টেবলের কাছে জানতে চাইলেন-কি কোনো ক্লু পেলে সমীর?
    না স্যার।
    মাচানের উপরে কি আছে তিনুদেবী?বড়বাবু জানতে চাইলেন
    তিনুমাসি বললো ,ওখানে কিচ্ছুনেই।বড়বাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন-
    বেশ!তাহলে চলো হে সব,মনে হচ্ছে মালটা এখানে আসেনি।
    বড়বাবুর কথাটা শেষ হতে না হতেই মাচানের উপর রিঙটোনের আওয়াজ ভেসে এলো।
    একটা কনস্টেবল চেঁচিয়ে উঠলো -স্যার মোবাইল!মাচানের উপর!
    ঘ্যানা ওর মোবাইলের সুইচ অফ্ করতে ভূলে গিয়েছিলো।আর ওটাই ওর কাল হয়ে দাঁড়ালো।
    বড়বাবু মাচানের উপরটা সার্চ করার নির্দেশ দিলেন।
    সঙ্গে সঙ্গে দুজন কনস্টেবল্ মাচানের উপর চেপে ঘ্যানাকে নামিয়ে নিয়ে এলো।
    বড়বাবু ঘ্যানার উদ্দ্যেশ্যে বললেন-এবার বাছাধন !চলো থানায় বেশ করে ধোলাই দিয়ে,বেছে বেছে জাঁদরেল ধারা দিয়ে তোমাকে কোর্টে চালান করবো।তবেই আমার নাম নিরঞ্জন সমাদ্দার।এই কে আছো? ব্যাটাকে গাড়িতে তোলো।
    তিনুমাসি প্রথমটায় বাধা দেবার চেষ্টা করলে -সাহেব তার পেটে একগুঁতো মারলো,তিনু মাসি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
    ঘ্যানা নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলো না চিৎকার করে উঠলো-সা—-হে—-ব!হাত দুটো নেহাৎই আমার বাঁধা তানাহলে মাসির পেটে গুঁতো মারার ফল তুই হাড়ে হাড়ে টের পেতিস্।
    ততক্ষণে তিনুমাসি কোনোরকমে উঠে বসেছে।
    বড়বাবু বললেন ,আঃসাহেব আইন হাতে নিও না।ফলাখারপ হবে।
    তিনুমাসি সাহেবকে বললো-সাহেব তুই কাজটা ভাল করলিনা।এরজন্য তোকে ভুগতে হবে।
    বড়বাবু কনস্টেবলদের বললেন-এই দাঁড়িয়ে দেখছো কি?গাড়িতে তোলো ব্যাটাকে।থানায় নিয়ে গিয়ে ব্যাটার দপ্ দপানি আমি আজই ঠাণ্ডা করে দিচ্ছি।
    ঘ্যানাকে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে থাকা পুলিশ ভ্যানে তুলে-ভ্যানটা সোজা উত্তর মুখে বেরিয়ে গেল।
    তিনুমাসি ওদের উদ্দ্যেশ্যে চিৎকার করে বলতে লাগলো-তোদের দিন এবার ফুরিয়ে এসেছে রে পশুরদল!সবাই জেগে উঠছে -এবার তোদের বিনাশ হবে -বিনাশ হবেই হবে।

    তিনুমাসিও শক্ত মায়ের বাছা।অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করা তার অভিধানে নেই।কোনো রকমে উঠে দরজায় শেকল দিয়ে পাটি পাটি করে রওনা দিলো বাউরী-পাড়ার দিকে।মঞ্জা বাউরীর ভাঙা দেওয়ালের কাছে এসে ডাক দিলো,-ম–ন—-জজাএই-ম–ন–জা।
    মঞ্জা মনে হয় জেগেই ছিলো বললো,ক্যা ক্যা গ-এত রাইতে?—–

    আমি ,আমিরে তোদের তিনুমাসি।
    ওহ!মাসি?তাই বুলো,তা ঘরবাগে আস কেনে মাসি?
    বিপদ হয়েছে রে মঞ্জা।
    তা আবার কি বিইপদ হ্যল গ?
    কিছুক্ষণ আগে সাহেব পুলিশ নিয়ে এসে ঘ্যানাকে ধরে নিয়ে গেলো।
    আমার পেটেও ঘুসি মেরেছে ওই হারাম- জাদাটা।

    উঃ শালা সাহেবের খুইব বার ব্যাড়েইছে।উর ববস্থাট আমাদেরক্যাই ক্যরতে হ্যবে।

    শোন কালই আমরা সকলে সকাল ৯টার সময় থানা ঘেরাও করবো।
    তুই সনাতন,ফকির,রণার ভাই গনা ,জগদীশ এদের সবাইকে জানিয়ে দিস্।

    হ্যাঁ-হ্যাঁ সিট তুমাকে চিন্তা ক্যরতে হ্যবে না আমরা সব্বাই তৈয়ার থাইকব,ঘ্যানা আমাদের মাবাপ ব্যটটে।উর জ্যন্যে জান বাজী রাইখব গো মাসি -জান বাজী রাইখব।

    তিনুমাসি আবার মনে করিয়ে দিলো,মনে রাখিস্ কাল সকাল ৯টা?
    হ্যাঁ-হ্যাঁ ত্যুমি নিচ্তিন্তি ঘ্যর ষাও।

    থানায় বড়বাবুর রুমে জনার্দ্দন ওঝা রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,ঘ্যানার পিঠে লাল দাগ গুলো কিসের ববড়বাবু?এতো মার মেরে ছেন এখনো পর্যন্ত বেহুঁশ-যদি কিছু হয়ে যায় আপনার চাকরিটা তো থাকবে না-ই,সেই সঙ্গে মিডিয়ার দৌলতে গোটা ব্যাপারটা আর ছড়াতে বাকি থাকবে?যতসব গর্দভকান্তের দল।

    বড়বাবু মাথা নিচু করে বললো,সরি স্যার্!

    আর সরি স্যার যা গোবর গোলার তাতো গুলে
    ফেলেছেন।
    এবার সাহেবের দিকে আঙুল তুলে জনার্দনবাবু সরোষে বললো,নিজেকে তুই কি মনে করিস্ সাহেব?তোর ওই গুণ্ডা গর্দ্দি দল মেনে নেবে?যদি কিছু দূর্ঘটনা ঘটে যায় তার জন্য দায়ী থাকবি তুই আর ওই তিনদিনের বড়বাবু।

    সাহেব জনার্দনের পা জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো ,আমাকে বাঁচাও জনুদা এবারের মতো মাপ করে দাও।

    এইভাবে একটার পর একটা ভূল !দলের কাছে আমার ভাবমূর্ত্তির কথাটা একবার ভাবলি না?নেক্সট্ ইলেকশনে দল আমাকে টিকিট দেবে ভেবেছিস্?

    হঠাৎ একজন কনস্টেবল দৌড়ে এসে বড়বাবুকে বললো,স্যার-স্যার প্রায় শ-পাঁচেক লোক হাতে লাঠি ,ঝাঁটা,কুড়াল নিয়ে থানা ঘেরাও করতে এগিয়ে আসছে এইমাত্র বিবির পুকুরের পাড়ে দেখে এলাম!

    জনার্দন ওঝার চোখমুখ লাল হয়ে উঠলো,বড়বাবুকে সে বললো-এখন কি করে সামলাবে অফিসার?

    বড়বাবু নিরঞ্জন সমাদ্দার বললেন,জনার্দ্দন বাবু আপনি পেছনের গেট দিয়ে বেড়িয়ে যান।সাহেবকেও সঙ্গে নিয়ে যান।
    জনার্দ্দন ওঝা যাবার আগে আবার বড়বাবুকে মনে করিয়ে দিলো-দেখবেন দ্বিতীয় ভূল যেন আর নাহয়?

    না না সে আপনার চিন্তা নাই ,আমি ব্যাপারটা ঠিক ট্র্যাকেল করে নেবো।নফরগঞ্জে আসার পর থেকে অনেক এক্সপিরিয়েন্স হয়েছে -তাছাড়া অনেক গুলো প্রোবলেমইতো সল্ভ করলাম।

    তাই নাকি!বেশ আসছি ,কি ঘটে না ঘটে পরে ফোনে——–!সাহেব! চল আমরা বেড়িয়ে যাই।জনার্দ্দন ওঝা সাহেবকে নিয়ে থানার পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।ওদের গাড়িটা বাজারের মোড় ক্রস করতে না করতেই মিছিলের মুখে পড়লো।বাইরে থেকে ওদেরকে দেখা যাচ্ছিল না;কারণ গাড়ির গেটের কাচগুলো কালো।গাড়ির ভেতর থেকে জনার্দ্দন ওঝা লক্ষ্য করলো মিছিলের পুরোভাগে রয়েছে বিরোধী শিবিরের নেতা সাকিল ও ভীম নস্কর এবং সঙ্গে সেই সবার পরিচিত তিনুমাসি ও বাউরী পাড়ার লোকজন ।তিনুমাসি আজই সকালে সাকিলদের আঞ্চলিক অফিসে গিয়ে সব খোলসা করে বলে এসেছিলো।
    জনার্দ্দন ওঝা সাহেবের উদ্দ্যেশ্যে বললো,সাহেব জল যে অনেক দূর গড়িয়েছে রে—-।বড়বাবুকে একবার কল করতো।

    এই যে করি—–,
    বলে সাহেব ওর মোবাইল থেকে বড়বাবুকে ফোন করলো।
    ফোনে বড়বাবুর গলা-হ্যালো !কে?

    সাহেব বললো -ধরুন জনার্দ্দন দা কথা বলবেন—–,
    বলে ফোনটা জনার্দ্দন ওঝার হাতে ধরিয়ে দিলো।
    হ্যাঁ!বড়বাবু আমি সভাপতি সাহেব বলছি।আমি যা বলছি তা মন দিয়ে শুনুন।লোকজন অনেক -আপনি এখনই ডি-এস-পি কে ফোন করে কিছু এডিশনাল্ ফোর্সের ব্যবস্থা করুন।নইলে সামাল দিতে পারবেন না।ক্যুইক্ এখনই—-
    বলেই ফোনটা কেটে দিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি বার করে নিয়ে যাওয়ার ইশারা করলো জনার্দ্দন ওঝা।
    গাড়িটা চোখের নিমেষে বেরিয়ে গেল।
    এদিকে থানার বড়বাবু জনার্দ্দন ওঝার কথা মতো ডি-এস-পি সাহেবের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে এডিশনাল ফোর্সের ব্যবস্থা পাকা করে ফেললেন।মোটামুটি আধঘন্টার মধ্যে ফোর্স পৌঁছে যাবে।

    মিছিল বাজার ছাড়িয়ে বাসস্ট্যান্ডের মুখে।”থানার বড়বাবু মুর্দাাবাদ।”—“সাহেবকে অবিলম্বে গ্রেফতার করতে হবে।”–
    “জনার্দ্দন ওঝা তুমি নিপাৎ যাও।”—“ঘ্যানাকে অবিলম্বে ছেড়ে দিতে হবে।”ইত্যাদি ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে মিছিলটা একসময় থানার গেটে গিয়ে পৌঁছালো।ভিতর থেকে গেট বন্ধ।

    সবার আগে তিনু মাসি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো-কই রে কাপুরুষের দল কোথায় লুকালি সাহস থাকেতো বেরিয়ে আয় ।মিছিলের অন্য লোকজনও খুব হম্বিতম্বি করতে লাগলো।

    কেউ কেউ ইটপাটকেল ছূঁড়তেও দ্বিধা করলো না।পরিস্থিতি যখন খুব জটিল বলে মনে হলো বড়বাবুর ,তখন হ্যান্ডমাইকের মাধ্যমে ঘোষণা করলেন-
    আপনারা কেউ কিন্তু আইন নিজের হাতে নেবেন না।ঢিল ছূঁড়ে থানার জানলার একটা কাচ যদি ভাঙে তাহলে সরকারী সম্পত্তি নষ্টের দায়ে সবাইকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হবো।

    মিছিলের সকলে একসঙ্গে চিৎকার করে বলে উঠলো-সব নষ্ট করে ফেলবো দেখি আমাদের গ্রেফতার কর।

    তারা থানার গেট টপকানোর চেষ্টা করতে লাগলো এবং রীতিমতো ইটপাটকেল ছূঁড়তে লাগলো।
    সাকিল ও ভীম নস্কর সকলকে শান্ত হতে বললো এবং বড়বাবুর পারমিশন বলে তিনুমাসি ,সনাতন,গনা,জগদীশ ও মঞ্জাকে নিয়ে থানার ভেতরে ঢুকলো।অবশিষ্ট লোকজন বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলো।
    এদিকে এডিশনাল ফোর্সনিয়ে একটা পুলিশভ্যান থানার গেটে এসে হাজির হলো।

    বড়বাবুর পার্সোনাল্ রুমে ওরা সবাই ঢুকলো এবং অফিসিয়াল এটিকেট্ যথাসম্ভব বজায় রেখে সবার আগে সাকিল বড়বাবুকে বললো -কোন অপরাধে ঘ্যানা ওরফে ঘনশ্যাম দাশগুপ্তকে গ্রেফতার করা হয়েছে?জানতে পারিকি?
    বড়বাবু তাচ্ছিল্যের সুরে বললো-আপনি কে?
    ভীম নস্কর গলা চড়িয়ে বলে উঠলো,চেনেন না মনে হচ্ছে?খুব বাড়াবাড়ি করছেন আপনি।
    সাকিল ভীমের কথাটা কেড়ে নিয়ে বললো,কতটা মাল খাইয়েছে ওই জনার্দ্দন ওঝা?

    হোয়াট্!আপনার সাহসতো কম নয় ?থানায় ঢুকে থানারই বড়বাবুর aginstএ আনঅফিসিয়াল এলিগেশন্?

    সাহসের এখনই দেখলেন কি?এরচেয়েও বেশী সাহস দেখাতে পারি।

    তাইনাকি?কিন্তু এটা থানা -কথাটা ভূলে যাবেন না।বড়বাবু বললো।

    ভীম নস্কর ও তিনুমাসি একযোগে বলে উঠলো-এডিশনাল ফোর্স কেন ?লাঠিচার্জ করবেন নাকি?
    তা আপনারা যদি অশান্তি করেন তখন তাই করতে হবে,বড়বাবু জানালো।

    বাইরে যারা ছিলো তাদের মধ্যে অনেকেই পুলিশ ব্যারিকেড্ ভেঙে থানার ভেতরে ঢুকতে চাইলে পুলিশের সঙ্গে তাদের একপ্রস্থ খণ্ডযুদ্ধ বেধে গেলে বড়বাবু বললেন,ভীমবাবু আপনার লোকেদের শান্ত হতে বলুন;নইলে পরিণাম কিন্তু খুব ভয়ঙ্কর হবে?

    ভীমনস্কর বাইরের সকলকে শান্ত হতে বললে তারা তার কথামতো ভেতরে ঢোকা থেকে বিরত হলো।
    হঠাৎ তিনুমাসি বড়বাবুকে বললো,ঘ্যানাকে কোর্টে চালান করা হয়নি কেন এখনো?
    সে কৈফিয়ৎ আপনাকে দিতে আমি বাধ্য নই।

    সাকিল রাগে ফেটে পড়লো–কি ভেবেছেন কি আপনি?খাঁকি পোশাকটা গায়ে আছে বলে কি ধরাকে সরা জ্ঞান করবেন?
    আমরা চাই ইমিডিয়েট আপনি ঘ্যানাকে কোর্টে প্রডিউস্ করুন।
    নইলে—-

    নইলে! কি করবেন কি?
    আমরা মানবাধিকার কমিশনের দারস্থ হবো!ভীমনস্কর জানালেন।

    তা যাননা যেখানে যাবেন। এখানে কেন এতো উপদ্রব?আমাদের করণীয় যা -তা করার পরই ঘ্যানাকে কোর্টে প্রডিউস্ করা হবে।
    ভীমনস্কর বলে বসলো,এটা কি আপনার বাপের জমিদারী?যে যখন যা খুশি তাই করবেন।সাকিল !ডি-এস-পিকে ফোনে ধরোতো দেখি?

    সাকিল ডি-এস-পিকে ফোনে সমস্ত ব্যাপারটা ইন ডিটেল্ জানালো।
    ডি-এস-পিও আশ্বাস দিলো তাদের।অতএব আজকের থানা ঘেরাও-এর উদ্দ্যেশ্য সফল।তারা আবার সদলবলে মিছিল করে বড়বাবুর কুৎসা-মেশানো স্লোগান দিতে দিতে ফিরে এলো আঞ্চলিক অফিসে।
    সাময়িক একটা আলোচনা সভার কাজ সাঙ্গ করে সেদিনকার মতো সকলেই বিদায় নিলো।

    গাজনের মেলা ছিলো সেদিন ।সাহেব তার নিজের মোটরবাইকে করে বাড়ি ফিরছিলো। পীরস্থানের কাছে আসতেই কারা যেন তার পথ আটকে দাঁড়ালো।সকলের মুখ কাল কাপড়ে মোড়া।তাদের মধ্যে একজন বললো ,কোথায় যাবিরে শালা?আজ তোর হিসাবটা চুকিয়ে দিতেই আমরা দাঁড়িয়ে আছি এখানে।

    সাহেব মোটর বাইক নিয়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করলো কিন্তু পেছন থেকে আচমকা তার মাথায় পড়লো রডের বারি—-আঃ !আঃ——আঃ করতে করতে—-

    মাটিতে ছিটকে পড়লো সাহেব।সঙ্গে সঙ্গে মুখোশ ধারীর দল এলোপাথাড়ি রডের বারিতে সাহেবকে আধমরা করে -ফেলে রেখে পালালো সেখান থেকে।সাহেব গোঙাতে লাগলো,গায়ের জামাটা রক্তে ভিজে গেছে।
    বেশকিছুক্ষণ কেটে গেলো এমনি ভাবেই।
    হঠাৎ দৃরে একটা গাড়ির লাইটের ছটা দেখা
    গেলো ।গাড়িটা কাছে আসতেই দেখা গেল-ওটা একটা লরি ,ড্রাইভার লরি’র আলোতে দেখতে পেল সাহেবকে।
    লরি থেকে নেমে সাহেবকে কোলে করে লরিতে তুললো।সোজা হাসপাতালের দিকে ছুটে চললো লরিটা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে—

    রাত তখন প্রায় দুটো হবে–সাহেবকে স্যালাইন দিতে না দিতেই হার্টফেল করলো।অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণই যার একমাত্র কারণ।
    সাহেবের মোবাইলের কললিস্ট থেকে জনার্দন ওঝার ফোনে হাসপাতাল থেকে ঘটনাটা জানানো হলো।ঘন্টাদুয়েকের মধ্যেই জনার্দন ওঝা ,বড়বাবু নিরঞ্জন সমাদ্দার ও দলীয় কিছু হোমরাচোমরা গোছের যুবক এসে হাজির হলো হাসপাতাল চত্বরে।
    ব্যস আর যায় কোথা–শুরু হয়ে গেল সাবেকী চাল অর্থাৎ যেমনটা হয় আরকি? ভাঙচুর,ডাক্তার নার্সদের মারধর,শ্লীলতাহানি ইত্যাদি ইত্যাদি।হাসপাতাল চত্বর একেবারে রণক্ষেত্র হয়ে উঠলো।
    যাইহোক নিয়মমাফিক পুলিশি হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রনে এলে–হাসপাতালের ইতিকর্তব্যানুসারে লাস পাঠানো হলো পোস্টমর্টেমের জন্য।সেখানেও দলীয় হোমরা-চোমরাদের দাপাদাপি—শেষমেষ লাশ তুলে দেওয়া হোলো দলীয়সদস্যবৃন্দের হাতে।

    পরের দিন সকাল হতে না হতেই সারা নফরগঞ্জ হয়ে উঠলো যেন কুরুক্ষেত্র।বোমাবাজি,মিছিল ,বিরোধীদের ঘরে আগুন ,গ্রেফতার–নফরগঞ্জ শুনশান—বিরোধী দলের একটা লোক নেই –কেউ মারখেয়ে হাসপাতালে ,তো কেউ জেলে,কেউবা আবার প্রাণের ভয়ে গ্রাম ছেড়েছে।

    দিনরাত পুলিশি টহল -১৪৪ধারা জারি—–

    দুপুর বারোটা নাগাদ বড়বাবু জনার্দন ওঝা কে জানালো-স্যার!কেস্ কিচাইন্!

    কি হয়েছে বড়বাবু?অ্যাঁ আরে বলছেন কি ?এতো কাস্টোডিয়াল ডেথ্?
    স্যার,আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। প্লিজ্ আপনি একবার থানায় আসুন।

    ঠিক আছে আপনি ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করুন আমি এস পি সাহেবের বাঙলো থেকে একটা আলোচনা সেরেই আপনার ওখানে পৌঁছুবো—খেয়াল রাখবেন কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়?
    ঠিক আছে স্যার।

    এদিকে তিনুমাসি ও বাউরীপাড়ার বেশ কয়েকজন ফেরার।সারা বাউরী পাড়াটা যেন শ্মশানে পরিণত হয়েছে।বাউরী পাড়াতে পুলিশ পিকেট্ বসানো হয়েছে।বাইরে থেকে অচেনা লোক এলাকায় এলেই থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে জেরা করা হচ্ছে।বড়বাবু সেই নিয়েই ঘন্টাতিনেক হলো খুব ব্যস্ত।

    হঠাৎ জনার্দন ওঝার ফোন–বড়বাবু ওটাকে বস্তায় ভরে সোজা চলে আসুন ডিহির জঙ্গলে ওখানেই ওটার শেষকৃত্য হবে।

    বড়বাবু একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো-বাঁচালেন স্যার!

    পরেরদিন প্রতিটি খবরের কাগজে বড় বড় অক্ষরে যে ক্যাপশন্ টা নফরগঞ্জ এলাকার মানুষ কে ভাবিয়ে তুলছিল তাহলো—“আসামী ঘনশ্যাম দাশগুপ্ত ফেরার।”
    বাউরীপাড়ার ফেরারী আসামীদের খোঁজ চালাচ্ছে পুলিশ।জনার্দন ওঝা সেই খবর জানতেই ফোনে বড়বাবুকে জিজ্ঞাসা করলো,কি বড়বাবু আসামীদের খোঁজ মিললো?
    বড়বাবু উলটে জানতে চাইলো,স্যার ওদের খোঁজকি আদৌ মিলবে?
    জনার্দন ওঝা ফোনটা কেটে দিলো।ঘড়িতে তখন রাত ১-৩০মিনিট।
    ——–সমাপ্ত———

You cannot copy content of this page