-
গল্প- “আসা যাওয়া গ্রামের পথে”
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।
“আসা যাওয়া গ্রামের পথে”
-প্রদীপ দে— সত্যি বলছি মা –!
আমার স্কুলে যেতে একদমই ভালো লাগে না। স্কুল ছাড়িয়ে দাও না? আমি মাঠে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবো, পুকুরে সাঁতার দেবো আর ঘুড়ি ওড়াবো।— হ্যাঁ রে তোর মাথাটা কি একদম গেছে রে? একটা ক্লাস সিক্সে পড়া ছেলের মুখে এ কেমন কথা রে?
— সত্যিই বলছি মা! আমার ভাল্লাগে না!
— যা পারিস করগে! আমার অনেক কাজ আছে, মেলা তোর সঙ্গে বকবক করে লাভ নেই।
মা চলে গেল রেগে। আমি কি যে করি? কেউ আমার কথা বোঝে না। বাবা — সেতো আরো এক ভয়ানক রাগী লোক। তার সামনেই যাওয়া যায় না। একমাত্র কিছুটা বোঝে দাদু। কিন্ত মায়ের কাছে সে আবার চুপ। মা যে দাদুকেও বকে – এটা করবেন না, ওটা ধরবেন না, ওখানে যাবেন না, ওরা ভালো নয় – ইত্যাদি প্রভৃতি সব।
আমার জন্ম এই সরসীনীরে। এটা একেবারে অঁজ পাড়াগাঁ। গাছ পুকুর জঙ্গল ভরা আমার এই গ্রাম।
গাছে ফুল আছে ফল ভরে ঝুলে পড়ে, পুকুরে কত মাছ আর তাদের কি নাচানাচি – দাপাদাপি আর সত্যি কিনা জানিনা হয়তো বা মা ভয় দেখানোর জন্য একেবারে ছোটবেলা থেকে বলে আসছে ওই পুকুরের নিচে নাকি কুমির আর দৈত্য দানবেরা সব থাকে। এখন একটু বুদ্ধি হয়েছে তাও মায়ের কথায় মজা পাই আর রোমাঞ্চ হয় ,বেশ মজাই লাগে। ঠিক যেমনটা লাগে ছোটবেলায় মায়ের আর মাসির মুখে শোনা জঙ্গলে বাঘ ভালুকের কথা। আমি এখন মাঝেমধ্যে জঙ্গলে গিয়ে বাঘের অপেক্ষা করতে খুব ভালোবাসি। হ্যাঁ একটা প্রধান কথা বলতে একদম ভুলে গেছি যেখানে গেলে আমার মন ভাল হয়ে যায় – না থুড়ি মন হারিয়ে যায় সেটা এক ফালি নদী – যা আমাদের গ্রামকে ছুঁয়ে পাশের গ্রামে ঢুকে পড়েছে। বাউলেরা গান গেয়ে আর নেচে ওর পাড় ধরে চলে কি আনন্দই না পায়!— আচ্ছা দাদু, তুমি যখন ছোট ছিলে তখনও এই গ্রামটা কি এরকমই ছিল?
দাদুর বয়স বাহাত্তর। ভালো নাম ক্ষিরোদ বাড়ুর্জ্জে। দেখতে একেবারে ক্ষিরের পুতুলের মতোই। কিন্তু বেশ শক্তসামর্থ। সব কাজই করতে পারে। ভোর বেলা থেকে উঠে জপ ধ্যান করে বাগানের কাজ করে তারপর বাড়ির বাজার থেকে ফাইফরমাস – সবে একেবারে সিদ্বহস্ত! কিন্তু দাদুর একেবারে মনের কাজ হলো – সময় করে কবিতা লেখা।
দাদু আমার মাথায় হাত বুলায় আর বলে —
— দাদুভাই সময় বয়ে যায় আর সব কিছুই পাল্টায়। প্রকৃতির রূপ ক্রমাগত পরিবর্তনশীল। তবু গাছ গাছই থাকে, পাখি একইভাবে উড়ে চলে।— দাদু আজ মাকে বলেছি আমি আর স্কুলে যাবো না।
— না -না ! দাদুভাই এটা ঠিক নয়। পড়াশোনা না করলে, না শিখলে, না জ্ঞান থাকলে জগৎকে তুমি ধরতে ছুঁতে পারবে না।
আমি বুচাই চেপে যাই। দাদুকে হাত ধরে টান মারি,আমরা দুজনে পিছনের খিড়কি দোর দিয়ে আলপথ ধরি, বাবাকে এড়িয়ে, স্কুল ফাকি মেরে।
দাদু কবিতা বলে আর আমি গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে পুকুরে নেমে যাই, মুঠো করে জল তুলে আকাশের পানে ছুঁড়ে দিই -কাঁদামাটি তুলে দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ি। দাদু ও আমার পিছনে ছোঁটে আর হাঁফিয়ে ওঠে। আমরা নদীর পাড়ে গিয়ে বসে পড়ে, বুক ভরে হাওয়া গিলি!
দাদু নিঃশেষে আবৃত্তি করে —
অরন্য ঘর্মাক্ত গায়ে – আলপথ ধরে
কাশফুল হাওয়ায় পাখা মেলে ওড়ে
পাখিদের ডানা ভেজা নদী বয়ে চলে
স্নান সারে – নদীর নিংরানো জলে !যখন বাড়ি ফিরি তখন পাখিরা শেষ প্রদক্ষিণ শুরু করে দিয়েছে। একরাশ ঘন কালো অন্ধকার যেন ছুটে আসছে পুরো গ্রামটাকে গোগ্রাসে গিলে খেতে। চাঁদ বড় তাড়াতাড়ি করে সূর্য কে পাশ কাটাতে ব্যস্ত আর তারারা তখনও লুকিয়ে।
বাড়ির দরমার গেটে রেগে চোখ লাল করা যে একজন তিনিই একাধারে আমার বাপ অন্যধারে দাদুর ছেলে ………………
— বাবা, শেষ পর্যন্ত আপনি বুড়ো বয়সে যাবার সময়, আমার ছেলেটার মাথা খেয়ে যাবেন?মাও কম যায় কিসে? — লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে আর আপনি ওর দাদু হয়ে ছেলেটাকে উস্কাচ্ছেন?
অপমানিত অভুক্ত দাদু দাওয়ায় এলিয়ে বসে পড়ে। ক্রোদান্বিত কারোর নজরে আসে না, আমি দেখি দাদু বুক চেপে শুয়ে পড়ে -শেষ-শোয়া!
আমি জীবনে এই প্রথম এক মৃত্যুর আহবান অনুভব করলাম।অনেকদিন কেটে গেল। পড়াশোনা ছাড়তে পারিনি। একদিন নদীর ধারে বসে দাদুর কত কথাই ভাবি — প্রকৃতি তার নিয়মেই চলে শুধু রূপ বদলায়। গাছ পাখি নদ নদী সব আগের মতোই।
চিৎকার শুনে ঘোর কাটে।ছুটে যাই একটা দূরের কুটিরে, মহিলাদের হুল্লোড় কাটিয়ে বেড়ার জানালা দিয়ে উঁকি মারি — এক সদ্যোজাত ভুমিষ্ট সন্তানের প্রসবোত্তর জ্যান্ত ছবি আমার চোখে ধরা পড়ে।
দাদুর মৃত্যু – পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার স্বাক্ষী হয়েছিলাম আগেই। আর এখন আমি আমার জীবনে এই প্রথম পৃথিবীতে কারোর আগমন চাক্ষুষ করলাম।
-
গল্প- “ইশারা ভি কাফি”
।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
“ইশারা ভি কাফি”
-প্রদীপ দেঅল্পবয়সী মেয়ে বিয়ে করার কথা শুনলে অনেকেরই জিভে জল চলে আসে। আহাঃ কি মজা! আসলে মজার একশেষ !
সত্তর বছরের যুবক ধবলগিরি আর একা থাকতে পারলো না। বউ মারা গেছে তা প্রায় হলো গিয়ে বছর পাঁচেক। খুব কষ্টে এতদিন কাটিয়ে আর পারলো না কৃপণ ধবলগিরি। ভেবে ছিল বউ মরে গেছে ভালোই হলো, ছেলেমেয়ে কেউ নেই -কত টাকাই না বেঁচে যাবে -আহাঃ কি মজা! অনেক টাকা জমে যাবে।
ওমাঃ এ কি হলো? ধবলগিরি বউ ছাড়া আর থাকতেই পারছে না। পাঁচ বছর পর দেহ মন উদ্বেল হয়ে উঠলো — না না এভাবে আর থাকা যায় না।
ঘরে একজন মহিলা চাই -ই চাই তার!ডাক দিল। পাড়ার হারামজাদা ঘটককে। ল্যাঙড়া অবলাকান্ত ঘটক দৌড়ে এল, থলে হাতে, মাল কামাতে আর রদ্দি মজুত গোছাতে।
— দ্যাখো কান্ত আমার একটি ভালো মেয়ে দেখে দাও। টাকা পয়সার যখন অভাব নেই -তখন বিয়ে আরো একটা করেই ফেলি।
— সে তো বটেই। কোন চিন্তার কারণ নেই। ভালো একটি মেয়ে আমি খুঁজে দেখে দিচ্ছি আপনাকে।
ধবলগিরি গুনগুনিয়ে গান গেয়ে ওঠে – ‘ বসন্ত এসে গেছে ‘ —–
অবলাকান্ত বাড়ি গিয়ে ওর জাঁদরেল বউ বুলবুলির সঙ্গে কথা বলতেই বুলুবলি ওর ভাইজিকে ডেকে আনলো। ভাবলে এই সুযোগ হাত ছাড়া করে লাভ নেই। সবদিক দিয়ে ভালোই হবে। বুড়োব্যাটা কে কায়দা করতেই হবে। এত টাকা সম্পত্তি হাত ছাড়া করা মূর্খামি! খেতে না পাওয়া অল্পবয়সী বছর বিশের এই মেয়েটির নাম হল- মুখরা ।
বুড়ো মুখরা কে দেখেই গলে জল! সুযোগ আর ছাড়া যাবে না। তাই ভরা পৌষ মাসেই বিয়ে করে নিল।
বুড়ো মজে ক্ষীর। জমে গেল দ্বিতীয় বিয়ে। মুখরা গ্রামের একটি ছেলে, ফসলার সঙ্গে ভালোবাসা — ভালোবাসির সম্পর্কিত ছিল। বুলবুলি কায়দা করে ফসলাকে মুখরার ভাই বানিয়ে দিল — ছাড়পত্র আদায় হয়ে গেল মুখরার শ্বশুরবাড়ির অন্দরে, অবাদ যাতায়াতের। মুখরা সব বুঝে নিল -ইশারা ভি কাফি হ্যায়!
মুখরা লোভ দেখায় আর বুড়ো ধবলগিরি জ্বলে। কাজ সারে কাকি আর ভাইজি। বুড়ো যুবকের প্রয়োজনে আর অপ্রয়োজনে হু হু করে টাকা গলে যেতে লাগলো। প্রথমে ওটোতা না বুঝলেও ধবলগিরির মাসখানেক পর টের হলো – এই নতুন অল্পবয়সী বউ পোষার খরচ যে প্রচুর !
মুখরা গরীব ঘরের মেয়ে জীবনে কিছু পায়নি। আশ মিটিয়ে খরচ করতে লাগলো। ধবলের চক্ষু চড়কগাছ! হায়! হায়! এ কি হলো? সব সঞ্চয় যে গলে গেল। সারাজীবনের ভরা বাঁধ যে ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেল। মনে হয় মুখরার হাত দুটি বেঁধে দিই – কিন্তু তার যে উপায় নাই – হায়! হায়!
আফসোসে দিন যায়
দু চোখ যে নিদ্রাহীন
বৃদ্ধস্য যুবতী ভার্য্যা
কামহীন দেহ অর্থে খায়!অল্পদিনেই যুবক সত্তরের কৃপণ ধবল বুকে ব্যথা নিয়ে পটল তুললো।
ল্যাঙড়া ঘটক অবলাকান্তর পা চিকিৎসা পেয়ে খাড়া হয়ে উঠলো তার জাঁদরেল বউ বুলবুলির তেজ তেল পেয়ে আরো ঝাঁজিয়ে উঠলো।
অন্যদিকে মুখরা ফসলের ঘরে উঠে, বছরের পর বছর ধরে ফল ফলাতে লাগলো…
-
গল্প- বিপত্তির ভ্রমণ
অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার
বিপত্তির ভ্রমণ
– প্রদীপ দেশরীর আর মন দুই চাইছে এবার বেড়িয়ে পড়ি।
আর বলবেন না ঘরে বসে বসে একেবার বোর হয়ে গেছি। একটা গোপন সূত্রে খবর পেয়েই অনলাইনে ফ্লাইটের টিকিট বুক করে নিলাম। আর পারা যাচ্ছে না। এখন আশে পাশেও যেতে অনেক ঝামেলা, এই করোনাকালীন সময়ে। যাক টিকিট বুক হয়ে গেছে, গোছগাছ করে বেড়িয়ে পড়লাম, একেবারে ক্যাবে সোজা এয়ারপোর্ট।সেই ঝামেলা আর ঝামেলা। ঝামেলার শেষ নেই। গেটেই আটকে দিল। দেখাও ভাক্সিনাইজেশন সার্টিফিকেট না হলে যাও টেস্টে। আমিও কম যাই না তৈরি ছিলাম। মোবাইলে ডাউনলোড করা মোদীর ছবি লাগানো সার্টিফিকেট দেখিয়ে দিলাম।
সুন্দরী যুবতী আমাকে হেসে জানালো, —
— বাব্বা আপনি কি স্মার্ট! এই বয়সেও?আমিও হেসে ওয়েলকাম জানালাম।পিছনে ঘুরে যে আরো একবার ওই মহিলাটিকে দেখবো সে সুযোগ আর নিলাম না স্বেচ্ছায়, কারণ যম আছে পিছে –
মানে আমার সহধর্মিনী!যথাসময়ে প্লেন ছেড়ে দিল । হু হু করে ছুটে-মুটে আকাশ ছুঁলো। আমরা তো আকশেই যাচ্ছি বেড়াতে। কোথায় জানেন? জানেন না? ও সেটাই তো লিখিনি।
সেটা হল স্বর্গপুর!
তেরো ঘন্টা উনপঞ্চাশ মিনিট আটান্ন সেকেন্ডে আমাদের বিমান স্বর্গের পাথর ছুঁলো। সহধর্মিনী নেমেই পাথর ছুঁয়ে চারদিক ঘুরেফিরে নমস্কার সারতেই ব্যস্ত। আমি চারিধারের প্রকৃতির রূপালী ঝলমলে ঝলকানি মুগ্ধ নয়নে উপলব্ধি করে যাচ্ছি।
এয়ারপোর্টের বাইরেই ফুলে মোড়া ক্যাব দাঁড়িয়ে ছিল ইশারায় ডাকতেই উঠে পড়লাম।পাক্কা ড্রাইভার খাসা রাষ্ট্রীয় ভাষায় পুছলো — কিধার যায়েঙ্গে?
আমি দাঁত বার করে জানালাম, — ইন্দ্রপুরী —
বাঁ হাতে বেশ জোরে চিমটি খেলাম, সন্দেহ হতেই পিছন ফিরে দেখি সহধর্মিনী কটকট করে আমার দিকে চেয়ে,–
— এখানে এক্কেবারে ভদ্র সেজে থাকবে বলে রাখলুম।ইচ্ছা ছিল প্রথমেই ইন্দ্রপুরীতে গিয়ে মেনকা অপ্সরার নাচ দেখবো। ভয়ে বাতিল করতেই হলো।
ওই চেঁচালো, — ভোলাপিতা কি পাশ লে চলো।
— ঠিক হ্যায় ভাতিজি — চলিয়ে …
আমি অবাক হয়ে ওর ভাতিজি কথা মানে খুঁজছি। ও বোধহয় বুঝতে পেরেছে। জানালো, —
— ইধার একভি মাইজি হ্যায় -একইভি!মালুম হয়ে চুপসে গেলাম। কি শৃঙ্খলা !
হিমালয়ের সিড়ির মুখে গিয়ে ক্যাব ক্যাচ-ক্যাচ করে আওয়াজ তুলে থামলে দক্ষিনা গুনে গুনে দিতে হল।
উপড়ে তাকিয়ে দেখি সিঁড়ি খাঁড়া চলে গেছে স্বর্গ ছাড়িয়ে। কি তার জৌলুস! আর নিচে তাকিয়ে দেখি মর্ত অন্ধকারে……।
চারিধার শৈল্পিক শুভ্রতা মুড়ে দিয়েছে একাধারে।
অনন্ত আলোয় ভরা চতুর্মাত্রিক। তবুও আমি অন্য কিছু চাইছিলাম। সহধর্মিণী হাত ধরে টান দিয়ে সিঁড়িতে চড়িয়ে ছাড়লো।উঠছি আর উঠছি। যেন তার শেষ নাই। আমার দম শেষ। ওর মানে সহধর্মিণীর পুরো ভরাট।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওং বং শব্দ ভেসে এল। নন্দী ভৃঙ্গি গেটে আটকালো। পুরো সংস্কৃত ভাষা আওড়ে দিল। কিছুই মালুম হলো না। হাঁ- হয়ে দুজনায় মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম।
সহধর্মিণী মুখ ভেঙচালো — খুব যে বড়াই করো পুরোনো দিনের ছাত্র -কত ভাল শিক্ষা তোমার — আর সংস্কৃত ভাষা জানো না ?
না পারলাম না কিচ্ছু।’ ভবন্তু ‘ নামক একটি শব্দই কানে এসেছে মাত্র। সহধর্মিনী একেবারে পাক্কা।
ঠিক আকার ইঙ্গিতে কি সব বোঝালো। আর ওরাই আমাদের একজন দোভাষী দিয়ে দিল -কিন্তু ভালো দাম মানে দক্ষিণা দেওয়ার শর্তে। বুঝলাম এটা এই চালাকগুলোর চালাকি!
দুনম্বরি আয়ের পাক্কা ব্যবস্থা আর কি!
আমাদের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে দিল।
সুন্দর পরিবেশ কিন্তু বাসস্থান একেবারে অপরিচ্ছন্ন নটগট!ভয়ে দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম মাইজি মানে মা দূর্গা
দশ হাত বার করে নিজের গা থেকে ময়লা বার করছে।দোভাষী বললে মা এখন খুবই রেগে আছেন। আর রেগে গেলেই উনি দশ হাত বার করেন। না হলে দুহাতেই কাজ চালান।
আমরা এখনকার রাগের কারণ জানতে চাইলাম।
— গনেশের ইচ্ছা হয়েছে মোবাইল কিনবে। শুনেছে ভারতে ডিজিটাল ইন্ডিয়া চালু হয়েছে। পুজোয় যাওয়ার আগেই মোবাইল শিখে নিতে চায়। তাহলে গিয়ে অনেক সুবিধা পাবে। টাকা পয়সার লেনদেন করতে সুবিধা অনেক। আর থলে বইতে হবে না। কার্ত্তিক মোবাইল কিনে ফেলেছে -ওর ধান্দা খারাপ।
হয়েছে কি গনেশের চার হাত। আর চার হাতেই অস্ত্র আর চার হাতে কাজ লেগেই থাকে, তাই মায়ের কাছে কেঁদে অস্থির…।
মা ভেবে চিন্তে আরো একটি হাত বানাচ্ছেন। পঞ্চম হাতেই মোবাইল ধরবেন পুত্র গনশা বাবাজীবন।
কিন্তু মায়ের গায়ে তো এখন আর তেমন ময়লাই জমে না যে — এখন সব শ্যাম্পুর যুগ না? ময়লা সব ধুয়ে জলে গলে যায় যে! মায়ের তাই দশ হাত থেকে যদি কিছু বের হয় তারই আপ্রান এই প্রয়াস!দোভাষী আমাদের সরিয়ে নিলো। আমরা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে উনি জানালেন সংস্কৃত ভাষা জেনে আসতে হবে। বুঝলাম সব চালাকি!
বাবা ভোলা অন্তর প্রান সহধর্মিণীর। দোভাষী কে পেড়াপিড়ি করলো। কাজ হলো মহিলার কথায়। সবাই ওকে যাও পাত্তা দিচ্ছে আমাকে চেয়েও দেখছে না কেউ।
মেঘের এক পাহাড়ের আড়াল থেকে দেখে অবাক।
ইনি শিব বাবা? কি দশা? হাড় লিকলিকে চেহারা? সব্বাই যে বলে শিব বিশাল মোটাসোটা ভগবান? ধুৎ! কিচ্ছু না।সহধর্মিনী চোখের জল আঁচলে মুছে নিল। ব্যাটার ছেলে দোভাষী ঠিক বুঝে গেছে, বললে, —
— মা ঠাকুরণ ওনাকে টাইট মেরে দিয়েছেন। গাঁজা খাওয়ার পর দুধ বন্ধ করে দিয়েছেন। গাঁজা সেবনের পর দুধ না পেলে শরীর ক্ষয়ে যায়! মা চান ওনার স্লিম ফিগার।মনে কষ্ট নিয়েই নামছি সিঁড়ি বেয়ে, পিছন থেকে গুরুগম্ভীর আওয়াজ এলো — হুং বুং চং —
সঙ্গে সংস্কৃত শ্লোক।দোভাষীর চোখের দিকে তাকাচ্ছি দেখি সামনে মহাদেব ত্রিশুল হাতে দন্ডায়মান। ভয়ে পিলে চমকে যাওয়ার জোগাড়। উনি নানান কথা বললেন, তার কিছুই বুঝলাম না। সহধর্মিনী ওনার পায়ে লুটিয়ে পড়লো।
দোভাষী জানালো উনি আমাদের খোঁজ নিয়েছেন। আর জানতে চাইছেন আমরা কি বর চাই।
সুযোগ কাজে লাগালাম। দোভাষীকে বললাম ,–
— ইন্দ্রের সভায় অপ্সরা মেনকা উর্বশী দের চকচকে উঠতি নাচ দেখতে চাই।মহাদেব কিছু বুঝলে না। দোভাষী অং বং কি সব বলতেই উনি ত্রিশূল ফেলে দিয়ে দুহাত তুলে জানালে —
— তথাস্তু!
এটা একেবারে বোঝা গেল!সহধর্মিণী তো রেগে লাল। এদিকে ত্রিশূল পড়ে যাওয়ায় মা দৌড়ে চলে এলেন আর কি সব বলতে থাকলেন।
দোভাষীও কিসব বললে বঝালো মাকে। মা কিছুটা শান্ত হলেন।
দোভাষী মারফত জানলাম মা কলকাতার করোনা পরিস্থিতি শেষ আপডেট জানতে চাইছেন।
আমরা দুজনে গদগদ কন্ঠে দোভাষীর মারফত সব নিবেদন করলে, মা শেষ অস্ত্রেই আমাদের ঘায়েল করে ছাড়লেন, আমরা কি ওনাদের জন্য ভ্যাক্সিন স্বর্গে পাঠিয়ছি?
নচেৎ মায়ের আসা যে অনিশ্চিত এবং ভীতির কারণ হয়ে যাবে- তাঁর পরিবারের কাছে। -
রম্য- “রাম চন্ডী’র মিত্তির”
“রাম চন্ডী’র মিত্তির”
–প্রদীপ দেআজ আর কোন চেঁচামেচি কিছু নেই। বাপরে বাপ! আজ একেবারে গিন্নিকে মেরে দিয়েছি। বাজার করে দেখিয়ে দিয়েছি বাজার কাকে বলে?
বাজার আনার ব্যাজার নেই। কিন্তু গিন্নির যা মুখ!
একেবারে মাথা খারাপ করে দেয়। একটু এদিক ওদিক হলেই রাম রাবণের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আর আমি বেচারা রাম (?) চুপ করে নেতিয়ে থাকি। গিন্নি একেবারেই ক্রোধান্বিত রাবণ ফুঁসে ওঠে আর আমি রাম চুপসে যাই। নামটাও যে স্বর্গীয় বাপ মার দেওয়া রামদুলাল মিত্তির। গিন্নি চন্ডী ওঝা থেকে চন্ডী মিত্তীর।নামেও চন্ডী কাজেও তাই একেবারে রণং দেহী।
তা আজ একেবারে চন্ডী লেজেগোবরে..
হ্যাঁ হ্যাঁ – বলছি বাবা বলছি – আমি আবার একটু ভূমিকা করে দিই নাহলে ক্যামন যেন লাগে!
আজ সকালে গিন্নিমার মুড ভাল ছিল। ঘুমচোখে আবদার করলে- কি চিংড়ি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে!আমার বুকটা ধকপক করে উঠলো। গেলো রে আজ আমার বারোটা বাজবে। কারণ আমি যাই আনবো তাই চেঁচামেচি করার অজুহাত পেয়ে যাবে গিন্নি।
ভয়ে ভয়ে বাজারে গেলাম। তারামা’কে কেবলই ডাকি- আয় মা আমায় বাঁচা।
কপাল যে আজ আমার এত ভালো জানতেম না। তাহলে আগে লটারি কাটতাম। বিরাট ঝাঁকায় এক্কেবারে এক বেগোট লম্বা বাগদা কিলবিল করছে। খুঁজছিলাম কুঁচো তা পেয়ে গেলাম এই ধেড়ে ছুঁচো! গিন্নি কি খুশিই না হবে!
-দাও ভাই, দাও দিকি এক কেজি।
বাগদাগুলি আমার ব্যাগে ঢুকে গেল। কড়কড়ে চারশো টাকা ওকে গুনে বুঝিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। প্রাণ আর মন সতেজ। বড়সাইজের বাগদা আমায় মন ভরিয়ে দিল। আরো মন ভরে গেল যখন দেখলাম আমার বাড়ির পিছনে থাকা ফ্ল্যাটের বউদি ওই বাগদাই কিনতেই ব্যস্ত। দু’ কেজি নিয়ে নিল। নিশ্চয়ই ভালো- না হলে নেবে কেন? সুযোগ এসে গেল। কথা বলার অভিপ্রায়ে প্রশ্ন করে বসলাম,
-ওহঃ বউদি যে! মাছ নিলেন দেখছি। আমিও নিলাম। ভালোই হবে কি বলেন?-হ্যাঁ হ্যাঁ একেবারে টাটকা।
-আহা। কি সুন্দর করে বললেন। আপনি যেমন সুন্দরী তেমনই আপনার কথা।
-না না আমি তেমন সুন্দরী কোথায়? আপনার গিন্নি কি কম সুন্দরী?
-আরে কি যে বলেন? চাঁদের সঙ্গে প্যাঁদের তুলনা করছেন? আপনি কত বুদ্ধিমতী।
-আপনি একটু বেশি বেশি। আপনি কি কম ভালো? আমার তো খুব ভালো লাগে বিশেষত আপনি যখন আড়াল থেকে আমায় দেখেন। আপনার চোখ দুটি কি সুন্দর! আমাকে যখন দেখেন তখন আমার বুক ভরে ওঠে। লুকিয়ে দেখেন কেন? আপনাকে তো আমার খুব ভালো লাগে। আমি যদি আপনার হতাম কি সুখের হতো! কতো রোমান্টিক আপনি.… আপনার রান্নাঘরের জানালা দিয়ে দেখবেন আমি তো রান্নাঘরেই থাকি। এখন গিয়েই তো রান্না করবো।
ওঃ তার মানে বউদিও আমায় দেখে? আর বলেই তো দিল আমাকে ওর ভালোই লাগে। সত্যি জগতে কত ভালো ভালো সুন্দর দেখতে সুন্দরী মেয়েরা রয়েছে। তারা আবার কতই না ভালোবাসতেও জানে। আর আমারটা দেখো? কি বাজে গিন্নিই না জুটেছে আমার কপালে? প্রেম ফ্রেম কিছু নাই একটা মুটকি। যাক আজ যখন আলাপ হয়েই গেল তখন আর এই সুযোগ আমি ছাড়বো না। আজই সুযোগ নিতে হবে। আমাদের রান্নাঘরের জানালা আর বউদির রান্নাঘরের জানালা একেবারে মুখোমুখি। আর একজন সুন্দরী রমণী যখন আমায় চাইছে তখন আমি পুরুষ মানুষ হয়ে একটা মুটকি গিন্নির ভয়ে সিঁটিয়ে যাবো? না না আজ আর ছাড়ছি না। এস্পার না হয় উস্পার! আর বউদির কি ফিগার! দেখলেই মন আর দেহ-আহা আহা — কি যে সুখানুভূতি হয় বারবার। ঘুরে ঘুরে দেখি। আমি ওকে আজ সব বলে দেবো। আমার সামনে আমার সেক্সি সুন্দরী। পরে কথা হবে এখন বাড়ি গিয়ে একটা কায়দা তৈরী করি আগে।
-আচ্ছা। আচ্ছা। খুব ভালো। সময় পেলেই কথা হবে। এখন বাড়ি চলি। গিন্নি আবার নজর রাখে।
-আচ্ছা আমিও আপনার অপেক্ষায় থাকবো। আপনি কত সুইট!
টা -টা করে ও হাওয়া হয়ে গেল।আমিও হাই করে বাড়ির পথ ধরলাম। কিন্তু মন ওই সুন্দরী নিয়ে চলে গেল।
বাড়ি ফিরেই একগাল হেসে গিন্নির হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিলাম। ব্যাগ খুলেই ও খুশিতে ভরে গেল- বাগদা এনেছো? আহাঃ কি যে ভালো লাগে!
যাক অনেকদিন পর তোমার ঘটে বুদ্ধি হয়েছে।
বসো বসো ঘেমে নেয়ে গেছো একেবারে -আমি জল বাতাসা নিয়ে আসছি।যাক আমি খুশি। গিন্নিকে খুশি করেছি। এবার নিজের খুশি হওয়ার পালা। গিন্নিকে আবদার করলাম- আজ বাগদাটা আমিই রান্না করি। মাছওয়ালা আমাকে একটা রেসিপি বলে দিয়েছে-খুব ভালো।
-সে কি কথা? এরকম কথা কোনোদিন শুনিনি তো? তোমার কি ভীমরতি শুরু হলো?
-আরে না গো না। একদিন দেখোই না কি হয়!
সহজে হবার নয়। গিন্নিকে বোঝানো বড়ই মুশকিল ব্যাপার। তারপর গিন্নি খুবই চালাক। একটা সন্দেহ হলেই সব ভেস্তে যাবে। তখনও আমি এক বোকা বুঝিনি যে আমার গিন্নি আমার বাপ!
অনেক কষ্টে গিন্নিকে ম্যানেজ করে রান্নাঘরে ঢুকলাম। গিন্নি নিজেই ছাদে গাছপালার কাজে চলে গেল। কপাল আজ আমার বড়ই প্রসন্ন। গিন্নিও ম্যানেজ হলো আর পাশের বাড়ির সুন্দরীও আমার প্রেমে পাগল হলো।
রান্নাঘরের জানালায় সুন্দরী দাঁড়িয়ে। ওকে দেখবো আর ইশারায় বাগদা রাঁধবো- এই ছিল মোর সাধ। কিছুবাদেই ও একটা ফিনফিনে নীল নাইটি পড়ে রান্নাঘরে চলে এলো। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কি সুন্দর ফিগার! এত লোভ হচ্ছে না কি বলবো মাইরি।
তাড়াতাড়ি কড়ায় তেল ঢেলে এককেজি ধোওয়া বাগদা ছেড়ে দিলাম। গনগনে আঁচে বাগদা ভাজতে থাকুক। আমিও রুপসীর আগুনে জ্বলে যাচ্ছি। ওকে ইশারা করতেই ও মুচকি হেসে চোখ মেরে দিল। আমি মোহিত হয়ে গেলাম। দুনিয়া থেকে আমি বিছিন্ন হয়ে যেতে থাকলাম।
ইশারায় কথা হচ্ছে। কত কথা। চোখ ধরে ওর রূপ আর দেহ দেখছি। ও আমার কি দেখছে তা আমার জানা নেই। শুধুমাত্র টানা চোখে আমায় মাপছে। আমার মাথার ঠিক নেই তবুও নাকে একটা বাজে পোড়া গন্ধ পাচ্ছিলাম।
এমন সময়েই তীরবেগে গিন্নি দৌড়ে চলে এল। একেবারে রণচন্ডী রূপে। কি তার গর্জন!
-ওরে মুখপোড়া মিনসে ? তাই বলি এত আদিখেত্যা কেন।? কিসের রান্না? মুখপুড়ির সঙ্গে রান্নাবাটি খেলা চলছিল আর বাগদা পুড়ে ছাই হয়ে গেলো? আমি ঠিক ছাদ দিয়ে দেখছি বুড়ো বয়সে ছুঁকড়ির ছুঁকছুঁকানি। ভাবছে আমি ভিজে মাছটি উল্টে খেতে জানিনা। আয় মিনসে তোর বাগদা রান্নার নামে বাগদী ধরা আমি বার করছি।
বলেই খুন্তি দিয়ে আমার পাছায় বার বার চপেটাঘাত করতে লাগলো। ধুতি খুলে যাওয়ার অবস্থা।ততোক্ষণে সুন্দরী কবে হাওয়া হয়ে গেছে। বিপদে পড়ে গেলাম বোকা আমিই। কি কপাল আমার? আর গিন্নিরও নজর বটে। ছাদ দিয়েই সব দেখে ফেলেছে। কি করি এবার? আমি চো চো দৌড়ে পড়িমড়ি করে পায়খানায় সেঁদিয়ে গেলাম। ভয়ে আমার সাদা ধুতির পিছন যে হলুদ হয়ে গেছিলো।
–থাক গে আর এগিয়ে লাভ নেই। যেমন কর্ম তেমন ফল……
-
গল্প- কালী ভুলো
কালী ভুলো
– প্রদীপ দেভুলোকে বাজার আনতে পাঠাচ্ছে তার বউ কালী।
– ছোটো মাছ নিয়ে আসবে, কিন্তু। সব্জি বাজার কিছু নেই। আলু আগে নেবে। সব মনে করে যাও, যা ভুলো মন তোমার! ছেলে কিন্তু স্কুলে যাবে। খেয়ে বেরোবে। তাড়াতাড়ি আসবে — মনে রেখো কিন্তু।
– না, না যাবো আর আসবো। সাইকেলে আর কত সময় লাগবে?
– দেখো আবার আড্ডায় জমে যেওনা যেন।
-আচ্ছা.. বলে প্লাস্টিকের থলে নিয়ে বিড়ি ধরিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল ভুলো। সাইকেল চড়ে পোঁ -পোঁ করে একেবারে বাজারে। মাছের বাজারে ঢোকার মূহুর্তে পকেটে হাত দিয়ে দেখে মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছে সে। অন্যথায় কি করে? ব্যাগ হাতে এদিক ওদিকে পরিচিত লোক খুঁজতে থাকে সে। বাড়ি ফিরে আনতে গেলে বউয়ের ঝাড় খেতে হবে তাকে। এই ভয়ে সে আর বাড়ির দিকে পা মাড়ায় নি।পল্টন আসছে দেখে ভুলো দৌড়ে যায়। পল্টন হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি পরেছিল।
– এই পল্টু …এই পল্টু শোন, শোন।-আরে ভুলো যে রে? কি ব্যাপার? একেবারে থলি হাতে যে রে? দেখেচিস একেই বলে সংসারী মানুষ।
আর আমাকে দেখ, কি সুন্দর সক্কাল সক্কাল খেলতে চলেছি। ব্যাচেলর একেই বলে, বুঝলি?
– আরে রাখতো তোর জ্ঞান ? যদি পারিস কিছু টাকা ধার দে। আমি টাকা আনতে ভুলে গেছি। এখন বাজার করতে হবে।
– ওঃ এই কথা? এতেই এত ঝামেলা? দেখছিস তো আমি খেলতে যাচ্ছি। টাকা নিয়ে বেরোই নি। তাতে কি হয়েছে? তোর টাকার দরকার সেটা আমি যোগাড় করে দিচ্ছি, চল আমার সঙ্গে।
– আরে তুই তো খেলতে যাচ্ছিস, আমি কোথায় যাবো?
– আরে এত বোকা কেন তুই ? ওই জন্যই না বউয়ের হাতে মার খাস?
– ফালতু কথা বলিস কেন? পারলে টাকা দে, না হলে চলি। সাইকেল ঘুরিয়ে নেয় ভুলো।
– আরে এত রাগ করিস কেন ? তুই টাকা চাইলি আর আমি দেবো না তা কখনো হতে পারে? চল আমার সঙ্গে, সাইকেল তো আছে সঙ্গে, তাহলে এত ভয় কিসের? যাবি আর আসবি , মাঠে চল, অন্য কারোর থেকে টাকা ম্যানেজ করে দেবো। যাবি আর চলে আসবি এত চিন্তা কিসের ?আইডিয়াটা খারাপ নয়। বেশ কাজে দেবে। এই ভেবে ভুলো সাইকেল নিয়ে পল্টনকে বললে- চল তাহলে তাড়াতাড়ি চল।
– হ্যাঁ, তা চল এত তাড়া কেন ভাই? যাবি আর আসবি।দু’জনে হাঁটতে লাগলো। ভুলো আর সাইকেলে চড়তে পারলো না। সময় লাগলেও কিছু করার নেই। এখন পল্টুই যে তার রক্ষাকর্তা। তাকে খুশি তো করতেই হবে। গল্পও জমে উঠলো তাদের মধ্যে।
দু’মাইল দূরে খেলার মাঠ। বেশ লোকের ভিড়। টুর্নামেন্ট চলছে। ফুটবলের খেলা। পল্টন যেতেই ওকে সবাই ডাকাডাকি শুরু করলো। ও যে বড় খেলোয়াড়। আবার গোলকীপার! আজকে ওর খুব কদর! যদি পেনাল্টি হয় তাহলে আজ ওর খুব দরকার।ওই পারবে ইজ্জত রাখতে। ভুলো ফুটবল খেলা খুব ভালোবাসে। বিয়ের দিনও ও ফুটবল খেলে বিয়ে করতে গেছিলো। তারপর কি যে হলো? বউয়ের পাল্লায় পড়ে খেলাধুলা সব ডকে চলে গেল। ভুলো আজ আবার মাঠে এসে নিজেকে সেই পুরানো দিনে হারিয়ে ফেললো। কত স্মৃতি মনে পড়ে গেল। খুব আনন্দ হলো। খেলার নিয়ম কানুন সব জানতো সে। সেও তো অনেকবার গোলে খেলেছে। চোখ বড় বড় হয়ে গিলতে থাকলো সব।
– দাঁড়া, আমি তোর টাকার ব্যবস্থা করে এখনি আসছি। বলেই ছুটে মাঠের মধ্যে হারিয়ে গেলো পল্টু।ভুলো সাইকেলটাকে বাউন্ডারির একপাশে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে একটা বিড়ি জ্বালালো। হুইসেল বেজে উঠলো। খেলা শুরু হয়ে গেলো। রোমাঞ্চিত ভুলো পান্টটা গুটিয়ে সকলের মাঝে গিয়ে বসে পড়লো। দেখতে পেলো পল্টু গোলে খেলছে। টাকা – বাজার – বউ -ছেলে -কলেজ — এসব মাথা থেকে হারিয়ে গেলো। মনে হলো সে নিজেই যেন গোলকিপার। নিজেই খেলতে থাকলো। যতবার তার গোলে বল যায় ততবারই সে কেঁপে কেঁপে ওঠে। বল তাকে আটকাতেই হবে যে! নব্বই মিনিটের খেলা গোল শূন্য ভাবে শেষ হলো। এরপর এলো এক্সট্রা টাইমের খেলা। দু’বার দশ মিনিট করে খেলেও কোনো টিমই গোল করতে পারলো না। ভুলো দু’ প্যাকেট বিড়ি শেষ করে ফেললো। এবার সেই চরম মুহূর্তে এসে হাজির সব্বাই। পেনাল্টি শট্ হবে। মাঠ থরথর করে কাঁপছে উত্তেজনায়।কি হয়! কি হয়!
বেশ বড় একটা সময়ের ব্যবধান চলছে। ভুলো সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিল। এখন প্রায় এগারোটা। ভুলোর ওসব কিছু মাথায় এলো না এখন তাকে গোল বাঁচাতেই হবে যে! সে না গোল কিপার!মাইকে নানা ঘোষণা চলছিল। চারিদিকে হকারেরা নানান মুখরোচক খাবার বিক্রি করছিল। ভুলো অমনোযোগে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখলো পকেট ফাঁকা। খাবার তৃষ্ণা সব ভুলে গেছে সে। কোনো চিন্তাই তাকে ভাবালো না।
প্রবল উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে পেনাল্টি কিক্ চললো। প্রায় বারোটা বেজে গেল খেলা মীমাংসা হতে। শেষে গোলকিপার পল্টুর টিমই জিত পেল।
এরপর শুরু হলো নাচানাচি। মাঠ প্রদক্ষিণ। পল্টনকে মালা পড়িয়ে কাঁধে তুলে ঘুরানো হচ্ছে। ভুলোও আনন্দে কোমড় দুলিয়ে নাচছে। বাড়ির কথা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছে। এরপর দেওয়া হবে প্রাইজ। হঠাৎই পল্টু দেখলো ভুলো হাত তুলে তাকে দেখিয়ে হাততালি মারছে। পল্টনের মায়া হলো। সে একেবারে ভুলে গেছে টাকা জোগাড়ের কথা।
তখন প্রায় একটা। পল্টন পঞ্চাশ টাকা এনে ভুলোর হাতে গুঁজে দিলো। তাড়াতাড়ি বাজার যা অনেক বেলা হয়ে গেছে।
ভুলোর মাথায় বাজ পড়লো। একটা ?
বারোটা বেজে গেল তার। পড়িমড়ি করে সাইকেল নিয়ে দৌড়ে গেল বাজারে।খানিকটা সাইকেল চালিয়ে ফেরার পথে একটা বাজার পেল। ভিতরে গিয়ে দেখলো প্রায় সব ফাঁকা। সব্জি মাছ কিছু নেই। সবাই ধুতে মুছতেই ব্যস্ত। ভুলো অনেক খুঁজেও কিছু পেলো না।
সাইকেল নিয়ে আরো একটা বাজারে গিয়েও একই। অভিজ্ঞতা হলো। অনেক খুঁজে এক মহিলার কাছে দুই বান্ডিল শুকনো লাউ শাক পেলো। তাড়াতাড়ি তাই নিয়ে নিল – এখন যা পাওয়া যায় – খালি হাতে তো আর বাড়ি ফেরা যাবে না! বাজারউলি সব শুনে ভুলোকে বলে দিল, সে যেন শাক গুলোয় একটু জলের ছেটা দেয়, তাহলেই তাজা হয়ে যাবে।
ভুলো মাথায় ঢুকিয়ে নিলো। ভাবলো বউকে জানানোর আগেই সে জলে ধুয়ে নেবে। কিন্তু রাস্তার কলের জলও চলে গেছিলো। সাইকেল নিয়ে ফেরার পথে একটা পুকুর দেখতে পেল সে। ব্যস মাথা খুলে গেল। সাইকেলটাকে স্ট্যান্ড করিয়ে শাকগুলো একটা সাইকেলে রাখা দড়ি দিয়ে বেঁধে জলে চুবিয়ে দিল। দড়ি ধরে আধাঘন্টা ঠায় বসে রইলো -যাতে বউ কিচ্ছুটি না বুঝতে পারে!
পাড়ার হারু বাবু দেখে চেঁচালো- ও ভুলো কি করিস?
– আরে শাকগুলোরে তাজা করছি।হারু বাবু তো হো হো করে হেসে চলে গেল..তা ভাল তা ভাল!
পাশের বাড়ির লোক ছুটে এলো, ভাবলো পুকুরের মাছ ধরছে, ছিপ ফেলেছে বুঝি বা!
ভুলো দড়ি টেনে শাক তুলে নিল। সাইকেল চালিয়ে দিল। ভীষণ বেলা হয়েছে বাড়ি ফিরতে হবে যে!
গলিতে ঢুকেই ভুলো মালুম পেলো সকলেই বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন করতে ব্যস্ত বা হয়ে গেছে। গলিতে কারোরই দেখা নেই। সাইকেলটা বাইরে রেখে বাড়ির লোহার গ্রীল ঠেলতেই বোঝা হয়ে গেল বাড়ি নিস্তব্ধ। শুনশান। ভয়ের প্রমাদ গুনলো ভুলো।
ছোট্ট বাড়ি তাও কারোর টুঁ শব্দটি নেই। ছেলে দৌড়ে এল এবার- বাবা পালিয়ে যাও, মা ক্ষেপে রয়েছে। বলেই ছেলেও হাওয়া হয়ে গেল।
গুটি গুটি পায়ে ঘরে ঢোকে ভুলো। দেখে বিছানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে হাড় লিকলিকে তার বউ কালী। যাক বাঁচোয়া! ঘুমিয়ে আছে!
কথাগুলো ভাবতে সময় হলো না। একেবারে আস্ত ঝাঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো কালী- আজ তোরই একদিন না আমারই একদিন! হয় তুই থাকবি নয় আমি থাকবো।
ঝাঁটা পেটা খেতে লাগলো ভুলো আর চেঁচিয়ে আত্মরক্ষার্থে চিৎকার করে বলতে লাগলো- দেখো কেমন তাজা লাউ শাক জমি থেকে কেটে এনেছি। তুমি খেতে কি ভালোবাসো! একবারটি দেখো আমার লক্ষ্মীসোনা! গ্রামে গেছিলাম না? তাইতো একটু দেড়ি হলো এই আর কি? আমি কিন্তু ভুলে যায়নি, তাহলে অযথা মারধোর কেন করছো? মাথা ঠাণ্ডা করে একটু দেখোই না?
-
গল্প- রহস্যা
রহস্যা
– প্রদীপ দেগ্রামে যেতে ভালো লাগে
কি অপরুপ তার ছবি
নদী পথঘাট চলে এঁকেবেঁকে
সাতরঙ ঢেলে দেয় তায় রবি !অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাই বর্তমান গ্রামের এই ব্যাহিক সুন্দরতার পিছনে আছে কিছু না পাওয়ার হাহাকার। গ্রামের প্রায় ছোটো বড় সবাই কর্ম্মের আশায় ভিনদেশে পাড়ি জমায়। মায়েরা, স্ত্রীরা দিন গুজরান করে ওদের উপার্জনের অর্থে, আর সজল নয়নে পথ চেয়ে থাকে তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায়.. গ্রাম-ঘর যে ফাঁকা হয়ে গেছে।
গ্রামটার নাম আনন্দী। উলুবেড়িয়া থেক বেশ ভিতরে এক অজপাড়াগাঁ। আনন্দী নামটা গ্রামের লোকেরা ভালবেসেই ডাকে- খাতা কলমে কি আছে তা আমার জানা নেই। দু’দিনের জন্য ঘুরতে এসেছি। এক বন্ধুর আমন্ত্রণে- এইটুকুই জানি, বেশি জেনে লাভ কি?
না গ্রামটার প্রেমে পড়ে গেছি। নিঃসন্দেহে বলতে পারি আমার মতো বেকার বাউন্ডুলের কাছে এত সুন্দর সাজানো ছবির মতোনই এই গ্রামকে মনের মণিকোঠায় গেঁথে ফেলেছি।
মুলতঃ তিনটি জিনিস আমাকে এখানে দু’দিন আটকে রেখে দিল। প্রথম সুন্দর রূপী এই গ্রাম, দ্বিতীয় অনলের বৌদির সখ্যতা আর তিন নম্বর হলো রহস্যাবৃতা এক নারী।
গ্রামের একপ্রান্তে একটি পুকুরের পাড়ে একটা বড় ঝুড়িওলা বটগাছের নীচে ছিল এই ভাংগাচোরা খড়ের চালাটি। অনলের বৌদি প্রথম দিনের সখ্যতা বেশ মাখামাখা হলে, দ্বিতীয় দিনের দুপুরবেলা আমাকে তার মোহময়ী রূপ যৌবনের একটা আকর্ষণে এখানে টেনে আনলো। আমি বত্রিশ বছরের এক অবিবাহিত যুবক অন্য এক যুবতী বৌদির সান্নিধ্য লাভের জন্যই এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে পারলাম না। আমার বন্ধু অনল কিছুই জানলো না। ওকে কিছুই জানালো হলো না। ও তখন ভাত-ঘুমে ব্যস্ত ছিল। ও আসলে দু’দিন এখানে বিশ্রাম নিতেই এসেছিল, আর আমি ঘুরতে।
ঘরটা আগোছোলা ছিল। একটা বাঁশ দিয়ে বানানো তক্তা পাতা ছিল। গাছের শুকনো পাতায় আর শিকড়ে আবর্জিত অবস্থা। বৌদি তাড়াতাড়ি একটা খেজুরের পাতা দিয়ে পরিস্কার করতে লাগলো। আমি প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাথে এক নারীর লাস্যময়ী ব্যবহার তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে লাগলাম। যদিও আমার আদর্শে আমি কামনার বশবর্তী ছিলাম না তবে বাহ্যিকভাবে তার দৃশ্যতা আমাকে মোহমুগ্ধ করে রাখতো।
আমরা তক্তায় বসে দু’জনে পাশাপাশি। বিকেল পড়ন্ত প্রায়। বৌদি খুবই মিশুকে। একটা কামনার ভাব ওর শরীরে মাখামাখি করে অবস্থান করছে, কিন্তু এতক্ষণে বুঝে ফেলেছি – তা মোটেই ক্ষতিকারক নয় – বরং বেশ উপাদেয় আমাদের একঘেয়েমি দুঃখের জীবনে। গল্প আড্ডা চলছে আমি জিঞ্জাসা করলাম- আর কতোক্ষণ, অন্ধকার যে হয়ে এলো..এবার?
বৌদি বেশ চোখ নাচিয়ে জানালো- সব ব্যবস্থা আছে। আসছে। সে আসছে।
– দাদা কবে ফিরবেন?
– কি করে বলি। মাস ছয়েকের আগে তো নয়ই।
– এত দিন পরে আসে?
– ওখানে যে সেরেস্তার ম্যানেজার। ছুটি নেই।
– ওটা কি সুরাটে?
– হ্যাঁ গো, বৌদি কথাটা শেষ করতে পারলো না, ভাঙা দরজায় ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে যে ঘরে ঢুকলো সে একজন বছর কুড়ির নারী। যার হাতে একটা কেটলি আর কয়েকটা ভাঁড়।
ওই তো কন্যে এসে গেছেন — বৌদি হাসলো।
‘কন্যে’ কথাটা আমার বুকে বেশ বাজলো। ভাবার অবকাশ নেই। একটি সুন্দরী নারী আটপৌরে তাঁতের শাড়িতে যতোই আঁটকে রাখুক নিজেকে, তার প্রাকৃতিক রুপ সত্যিই অনস্বীকার্য। আমি দেখছি।
বৌদি আমার পরিচয় দিয়ে আলাপ করিয়ে দিলেন। ওর নাম বললো না। শুধু ধাক্কা মেরে বললো- নাম জেনে কি লাভ? প্রয়োজনে পরে জানবে। এখন শুধু পছন্দ কিনা তাই বলো।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। অনুমান করার চেষ্টা করলাম। বাইরে তাকিয়ে মেলাবার প্রয়াস করলাম, সত্যি কি এখন গোধুলী লগ্ন!
– আমি সোজা কথায় তোমায় কতকগুলি কথা বলতে চাই। বলবো?
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুধু না বুঝে, ঘাড় নাড়লাম।
– মেয়টি গর্ভবতী। ওর প্রেমিক এই গ্রামেরই ছেলে। আয়ের জন্য মুম্বাই পাড়ি দিয়েছে। রুপার কাজ করে। মুম্বাইয়ে এই ব্যবসার ভাল কদর। প্রথম দু’মাস যোগাযোগ রেখেছিল। যখন শুনেছে ও গর্ভবতী তখন থেকে আর কোনো খবর নেই। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। একবারে গায়েব।
– সে কি? ওর বাড়িতে যোগাযোগ করো নি কেন? আমার অবাক হওয়ার পালা।
– কে বলেছে করিনি? ওর দাদা বৌদি কোনো দায়িত্ব নিতে চায়নি। ওদের কি দোষ?
– এ যে বড় বিপদ? এখন কি হবে?
– ওই জন্যই তোমাকে বলা। আমি একা মহিলা, যে সব জানি। দাদাও এখানে নেই কাউকে বলতে পারছি না। তার উপর মেয়েটির পাঁচ মাস চলছে। এমতাবস্থায় আমি একা কি করতে পারি। তোমাকে পেয়ে একজনকে পেলাম। অন্ততঃ তোমাকে জানাতে পারলাম। বৌদি বলে গেল।
– আমি কিভাবে সাহায্য করবো?
– দেখো, না যদি কেউ রাজী থাকে। অথবা নিজেও যদি রাজী হও এই বেচারী মেয়েটার জন্যে। দেখো না একটু ভেবে.. কাতর অনুরোধের গলা।
আমি হতচকিত। প্রস্তুত ছিলাম না এই পরিস্থিতির জন্যে। আনন্দ করতে এসে কি বিপদে জড়ালাম!
ভাবছি আর মেয়েটিকে মুখ তুলে দেখছি। মেয়েটি লজ্জায় অভিমানে কাঁদছে।মেয়েটি তার কাঁপা হাতে ভাঁড়ে চা ঢেলে দিল। ভাঁড় হাতে ধরে রইলাম। চা মুখে উঠলেও গলাধঃকরণ হল না।
অন্ধকার হয়ে এলো। আনন্দ কিছু না থাকায় ওখানে আমাদের এই তিনজনের কাছেই পরিবেশ পরিস্থিতি খুব সুখকর ছিল না। ভাবার বিষয়, ভাবার অছিলায় আমি… দেখছি.. বলে বেড়িয়ে এলাম।
অনলকে কিছু বলিনি। পরের দিন ভোরেই আমরা দু’জন গ্রাম ছেড়ে শহরের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম। ফেরার সময় বৌদির চাহনিতে আমার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আকুতি, আমার অসস্তির কারণ অতি অবশ্যই হয়েছিল, যা অন্য কেউ টের পায়নি।
এই কথা কি বাড়িতে আলোচনা করা যায়? নিজেও তেমন প্রতিষ্ঠিত হই নি, যে অন্যজনের সহায়তা করবো। মন দিয়ে মানতে পারলেও ভবিষ্যত কিন্তু অন্য কথা বলবে। সাত পাঁচ ভেবে, ঝুটঝামেলা এড়াতে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডায় নিজেকে ডুবিয়ে দিলাম। আপনি বাঁচলে বাপের নাম! এই যুগে কেউ যেচে অন্যর ফেলে দেওয়া ঝামেলা ঘরে তোলে- এই সব বলে, সহজ মনকে জটিল করে তুললাম।
মাস তিনেক বাদে একটা নিউ ইয়ারস গ্রীটিংস কার্ড পেলাম- অনলের হাত দিয়ে। বললে বৌদি তোকে দিতে বলেছে। আমার অস্বস্তি বেড়ে গেল। অনল জানালো বৌদি তোকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছে।
নববর্ষের কার্ড খুলে অবাক! – এ কি এটার ভিতরে তো কোন শুভেচ্ছা লেখা কার্ড নেই, বদলে আছে মেয়েলী হাতে লেখা দু’টি চিঠি।
প্রথম চিঠি
—————-
সুধী,
পারলে ক্ষমা করবেন। আমি আপনাকে জড়াতে চাইনি। আমি নিরুপায় ছিলাম তাই!
এখন পথ খুঁজে নিলাম
আমি – রহস্যা।
——————————————-দ্বিতীয় চিঠিঃ
—————–প্রানের ভাই ,
ভাল থেকো। ভুল বুঝো না। আমিও নিরুপায় ছিলাম। ওকে ভালবেসে, বাঁচাতে চেয়েছিলাম, পারলাম না। ও এখন বহুদূরে, ওর নিজের খোঁজা ঠিকানায়। যাওয়ার আগে এই চিঠিটা ও লিখে রেখেছিল, যেটা আমি পরে ওর ঘর থেকে পাই। ওর শেষ ইচ্ছায়, আমি তোমাকে চিঠিটা পাঠালাম।ইতি- তোমার বৌদি।
-
অণুগল্প- মেঘলা আকাশ
মেঘলা আকাশ
– প্রদীপ দেআমি আর আকাশ আজ চুটিয়ে রঙ খেললাম ওদের ছাদে। কালো বেগুনী রঙ যে তেল দিয়ে মাখালে এত বীভৎস দেখতে লাগে -আগে আমি কোনদিন দেখিনি। আকাশকে চেনাই যাচ্ছিল না।
ওকে নিয়ে আমি মজা করে হেসে উঠেছিলাম। হো হো.. দ্যাখ এবার কেমন লাগে?আকাশ তাড়াতাড়ি করে মোবাইলে ওর মুখটা দেখার চেষ্টা চালাচ্ছিল। আর আমি তারিয়ে তারিয়ে মজা উপভোগ করছিলাম, হাসিটা দেখিয়ে, আবার লুকিয়ে।
আচমকা আমি এক নারী কন্ঠে হা..হা শব্দে অনাবিল এক ব্যাঙ্গাত্মক হাসির আওয়াজে চমকে উঠলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি এক কিশোরী চকিতে পাশের বাড়ির ছাদ থেকে নিজেকে লুকিয়ে ফেললো। এক চকিতে সে আমার কাছে তার নীল পরিধানে এক অপরুপা লাস্যময়ী হয়ে ধরা পড়েও হারিয়ে গেল।
আকাশ ততোক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। তরুনীর হাসি তাকে উদ্দেশ্য করেই এটা সে বুঝে ফেলেছে । কিন্তু কিছু করার নেই দেখে মানে মানে সেই যাত্রায় তার হার মেনে নিয়েছে।
আমি আর থাকতে পারলাম না- কে রে ওই ফাজিলটা?
– ও মেঘা, মানে মেঘলা।
-তা এমন করে হাসলো কেন? তোকে কি ভালোবাসে?
– না, ও আমায় বাসে না। আমি বাসি।
আমি একটা ধাক্কা খেয়ে চুপ করে গেলাম। কি উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ক্ষেত্রে কি উত্তর হওয়া উচিৎ তাই ভাবছিলাম। হঠাৎই কেন জানিনা মনের কোণে যেন সূর্য দেব একটু উঁকি দিয়ে গেল।কিশোরীর লাস্যময়ী হাসিমাখা মুখ আমার হৃদয়ের কোমল পদ্মে যেন এক মধুর রাগিণী হয়ে গুমরিয়ে উঠলো। মাথায় দুষ্টুমি খেলা করলো।
– চল চল, অনেকে হয়েছে, এবার বাড়ি যাই।
বলেই তড়তড়িয়ে সিড়ি দিয়ে নেমে চলে এলাম।খাওয়া দাওয়া সেরে বিশ্রাম নেওয়া আর হলো না। ওই নীলাম্বরী আমাকে যেন বারবার ডাকছিলো। বিকালের আগেই বেড়িয়ে পড়লাম। সে কিশোর বয়সে, অন্য এক কিশোরীর খোঁজে।
মাথায় কথাটা ঘুরছিল- ও আমায় বাসে না। তাহলে কাজটা খুবই সহজ হবে। হয়তো বিধাতা ওকে আমার জন্যই বানিয়েছে। দৌড়ে গিয়ে আকাশের পাশের বাড়ির আশে পাশে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। যদি একবার তার দেখা পাই। আর তো তর সইছে না। একঘন্টা ঘুরে প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছি। এমনই সময় দরাম করে দোতলার জানালা খুলে গেল। আমি চকিতে মাথা তুলে দেখি আমার চাওয়া.. মেঘ।
তখন আর মাথার ঠিক রাখতে পারলাম না। ইশারায় ওকে ডাকলাম। অবাক কান্ড !
ও আমাকে ওর সুন্দর টানা চোখ দিয়ে ইশারা করলো যেন, দাঁড়াও।পাশের সরু গলির মধ্যে চলে গেলাম। মেঘলা ওই নীল লম্বা জামাটা পড়েই খালি পায়ে চলে এল – কি তাড়াতাড়ি বলো ?
ওর চোখের চাওনিতে এক নেশা মাখানো আগুন।আমি জানতে চাইলাম – তুমি কি আকাশকে?
কথা শেষ করতে দিল না। চোখ নামিয়ে নিল। অন্য কিছু বলবে?
আমি বুঝে গেলাম। সব জানা হয়ে গেছে। আমি তো এটাই চাইছিলাম। আকাশকে আমারও ভাল লাগে না। মেঘলাকে আমার চাই।
— আমি তোমায় কি বলবো..আমতা আমতা করছি।
নীলাম্বরী মেঘ মুক্তোর দাঁতে হাসলো- বাব্বা! এত কষ্ট?
লাজলজ্জার গুলি মেরে আমি বলে ফেললাম- আমি যদি ভালোবাসি?
– যদি? বলেই হি-হি করে তার কি হাসি!
আমি সাহস পেয়ে গেলাম। বুঝলাম মেঘলা খুব সাহসী। আমি সত্যি কত বোকা। মেয়েরা কি ছেলেদের থেকে বেশী সাহসী হয়?
এইসব ভাবছি। দেখলাম মেঘ আমার কাছে চলে এসেছে। আমি দু’হাত দিয়ে ওকে কাছে টেনে নিলাম। ওর ওষ্ঠ কাঁপছে। আমারও। এত সহজে ওকে পাবো ভাবিনি। ও বোধহয় আগে থেকেই আমাকেই চেয়েছিল। আকাশকে আমার জন্যই কায়দা করছিলো। আমি খুব খুশি। আকাশ মরুক। ও আমার শুধু বন্ধু, আর মেঘ আমার জীবন। আমরা দু’জনে দু’জনের খুব কাছে। দুহাতের নাগালে। অন্ধকার হয়ে এসেছে। সরু গলিটা নির্জন। হঠাৎ মাথার পিছনে বিরাট কিছুর প্রহারে আমি কাতরে উঠলাম। এক বেগুনে রঙের শয়তান যেন দ্রুত গতিতে সরে গেল। কিছু বোঝার আগেই চোখে অন্ধকার দেখে ধপাস করে পড়ে গেলাম।
এরপর একমাস পরে হসপিটাল থেকে বাড়ি এলাম। বাবা মা কি বুঝেছিলো জানি না। বাড়িতে আসার পর বিছানায় ছিলাম। একদিন মা জানালো আকাশ দেখতে আসছে। আমি বিছানায় উঠে বসলাম। চোখ কচলে দেখলাম আকাশ ঘরে ঢুকলো সঙ্গে মেঘ। মেঘলার সিঁথি লাল।
মা জানালো- তুই যখন হসপিটালে তখনই ওদের বাবা মা ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়। আকাশ নাকি তোর ফেরার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ওদের পরিবার তাড়াতাড়ি করে ওদের বিয়েটা দিয়ে দেয়।
আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। দেখলাম অন্ধকারে আকাশ মেঘলা!
-
অণুগল্প- ফলন
ফলন
– প্রদীপ দেআকাশের মুখটা ভার। আবার বারিপাতও নেই। নামতা পড়ার মত মিডিয়ায় আবহাওয়া দপ্তরের ঘোষণা ঘোষিত হয়েই চলেছে – সাবধান ওই বুঝি প্রলয় আসে! রোদ্দুর সকলেই চায়, কিন্তু সেও তো চায় নিস্তারিতে। নিয়মের ঘানি টেনে চলেন এক অশরীরী হর্তাকর্তা যাকে কেউ কোথাও কোনদিন দেখেনি।
চাষা আবদুলেরও মুখ ভার। অকালের বারি তার ক্ষেতের দৈত্য! মাটির ভিতর থাকা তার চাষের আলুর অকাল প্রয়াণ প্রায়! ক্রোড়ের সন্তান মাতৃসম! হারিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুজরায়।
মানত করে তার বিবি। দরগায় ছোটে, যদি হাওয়ারে ঘুরায়ে দেন তার প্রাণের আল্লা!এরকমই তো ঘটেছে এবার। বিবির তলার শরীর ভারী হলো। বিয়ের প্রায় দশবছর বাদ। অনেক মানতের পর দূর্যোগ প্রায় কেটে গেল। সবার কথা অমান্য করি আল্লা বুঝিবা তার বিবির শরীরে সেঁধিয়ে গেল। অসম্ভবকে সম্ভব করে বিবির পেট ভরে উঠলো, গরীবি ঘরের এক ছোট্ট কামনাকে স্বাগত জানাতে।
আট মাস কেটেছে। স্বাস্থ্যকেন্দ্র বারবার সাবধান বাণী কানের গোড়ায় শুনিয়ে ছেড়েছে – দেখো বাপু একটু বুঝে শুনে চলো, প্রেথম পোয়াতি, একটু নজর দিও। নষ্ট যেন না হয়!
আবদুল তার বিবি জাহানারার প্রতি ভালোই নজর দিত। নিজস্ব চাহিদাগুলোকে বিসর্জন পর্যন্ত দিয়ে দিল। ভয়ে স্ত্রীর সঙ্গে যৌনতার ইচ্ছে ভুলে যেত। তার একটিই মনোস্কামনা তাকে তাড়িত করতো তা হলো ঘরে বাইরে ক্ষেতের ফসল যেন ঘরে উঠে আসে।
এইরকম পরিস্থিতিতে বারবার ঘোষণা, ঝড় -জলের আগাম পূর্বাভাস তার অশান্ত মনকে বড়ই বিচলিত করে তুললো। বাইরের ক্ষেত নিয়ে যখন দূর্যোগ তাকে পীড়ন করছে ঠিক তখনই ভিতরে বিপদ তাকে ছোবল বসালো।
জাহানারা বিবি বাথরুমে পড়ে গেল। রক্তপাতের দরুণ গর্ভপাতের সম্ভাবনা প্রবল ভাবে দেখা দিল। হাকিম এলো, পরীক্ষণের পর দাওয়াই দিল। কিন্তু আশঙ্কা তীব্রতর হলো, যখন গর্ভস্থ শিশুর অস্তিত্ব নিরুপণ করা কষ্টকর হয়ে পড়লো। মহিলা প্রতিবেশীরা সকলেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল, জান দিয়ে পারলে, সন্তানটিকে বাঁচাতে সচেষ্ট হলো।
এদিকে কালোমেঘে আকাশ ছেয়ে গেল। প্রচন্ডভাবে প্রকৃতি তার বায়ু ছোটাতে শুরু করলো – যার নাম ঝড়। বড় বড় গাছগুলো তাদের প্রচন্ড শক্তিতে সেই ঝড়ের সংগে লড়তে থাকলো। আবদুল এ অবধি ঠিক লড়াই চালাচ্ছিলো নিজের সঙ্গে, কিন্তু একেবারেই ভেঙ্গে পড়লো যখন তীব্র বায়ুর সঙ্গে বৃষ্টির সূচনা সূচিত হলো।
বাইরে প্রকৃতি তার ধংস্বাত্মক লীলা খেলায় ব্যস্ত। ঝড় -জলে মাটি ধুয়ে গেল, আর আবদুলের বুকের পাঁজর যেন ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যেতে থাকলো – ফসলের আলু তার আর ঘরে উঠবে না -এই আশঙ্কায়।
ভিতরে তখন হাকিম আর মাসিদের আরো এক লড়াই চলতে থাকলো আবদুলের ফসলকে বাঁচানোর জন্য। আবদুল এতটাই অসহায় হয়ে পড়লো যে আল্লাহর কাছে মানত করার কথা মনেও এলো না।
-
গল্প- আমার আলেয়া
‘আমার আলেয়া’
– প্রদীপ দেপর্ব – ১
ট্রেনটা ছেড়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণের একটানা আওয়াজ ছড়িয়ে পড়লো চারিধারে। তারপর আবার নিস্তব্ধতা গ্রাস করলো স্টেশন চত্বরে। আমি ছাড়া আর দু’জন নেমেছিল তারা বেড়িয়ে গেছে। আমি এখন একা এই পাহাড়ি স্টেশনে। সিমেন্টের চেয়ারে বসে পড়লাম। ঠান্ডা আছে তবে সহ্য করতে পারছি কারণ শরীরে যথেষ্ট পরিমান শীতবস্ত্র ছিল। কেন যে এখানে নামলাম জানিনা। ট্রেনে এক ব্যক্তির মুখে শুনে এখানকার ইতিহাস জানার একটা তাগিদ অনুভব করলাম, যা শেষ পর্যন্ত আমাকে এখানে টেনে আনলো। কিন্তু এখন আমি এই পাহাড়ি এলাকায় কোথায় থাকার ঘর খুঁজতে যাব? অন্ধকারে কিছু দেখাও যাচ্ছে না ভালো করে। একটা সিগারেট ধরালাম মাথাটাকে কাজ করানোর জন্য। চারবার টানার পর বেশ শরীর মাথা চাঙ্গা মনে হল।
কে যেন পিছন থেকে আমার নাম ধরে ডেকে উঠলো। চমকিয়ে গেলাম – এক পরিচিত মহিলার কন্ঠস্বর! মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম পিছনে দাঁড়িয়ে আমার ছোটবেলার বন্ধু আলেয়া। একসঙ্গে পড়াশুনা, বড়ো হয়ে ওঠা, তারপরে বিয়ে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি। ব্যাস ছাড়াছাড়ি।
আমি ওকে অবাক চোখে দেখছি।
আলেয়াই সহজ করে দিলো – আরে তুই এখানে?
আমি হতবুদ্ধি।
ওই হেসে ফেললো – আরে আমি আলেয়া!
এখানেই তো আমার শ্বশুরবাড়ি।পর্ব – ২
আমি ভাবতেই পারছি না এই পাহাড়ি জনমানব শূন্য স্টেশনে আলেয়ার দেখা পাবো। আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে ওকেই দেখছি। ও যেন খুব ফর্সা হয়ে গেছে। কেমন সাদাটে লাগছে। ও তো ছিল শ্যামবর্ণ। পাহাড়ি এলাকায় এতো পরিস্কার হয়ে গেছে? আর চোখ দু’টো ও যেন কেমন লাগছে। অথচ মুখে হাসি সেই আগের মতোই। আমি এইসবই ভাবছি। আর ও হেসেই চলেছে। হো – হো -হো। মিষ্টি সুরে পাহাড়ে হাসি ধাক্কা খেয়ে আবার বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।— কি তুই ভাবছিস আমি এখানে তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম? আরে নারে না। আমার কর্তাকে ছাড়তে এসেছিলাম। ও তো তোর ট্রেনেই জলন্ধর গেলো। ফিরছি, দেখি তুই বসে। তুই যেমন অবাক হয়েছিস, আমিও তেমনই।
আমি এবার বুঝলাম – ও তাই বল। তোরা এখানে থাকিস?
– হ্যাঁ রে। আমার শ্বশুর এখানকার পুরোনো আমলের জমিদার।কর্তা হলেন সৈন্যবাহিনীর একজন মেজর।
– ওরে বাব্বা! – যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
— তা তুই এখানে কি ভাবে? আগে তাই বল?
– আরে যাচ্ছিলাম জলন্ধরেই। হঠাৎ ট্রেনে এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে আলাপ হলো। লেখালিখি করি জানতে পেরে আমাকে এখানে একবার নামতে বললেন। এখানে নাকি পুরানো আমলের অনেক ইতিহাস লুকিয়ে আছে। আমাকে অনুরোধই করলো একবার যদি ঘুরে যাই। তাহলে নাকি অনেকেরই সুবিধা হবে। অনেক খবর নাকি অপ্রকাশিত হয়ে রয়ে গেছে।
দেখলাম ফাজিল আলেয়া মুচকি মুচকি হাসছে
– তুই নিজেকে কি ভাবিস? একজন বড় লেখক না কি?আমি বেশ লজ্জা পেলাম, যদিও ও আমার বন্ধু। কিন্তু কথাতো ঠিকই বলেছে।
আলেয়া আক্ষেপ করলো — তুই যদি এতই বুঝতিস তাহলে কি আর এতসব ঘটতো?
বুঝলাম ও আমার অসহয়াতার কথাই বলছে। সত্যি আমি ওকে সেদিন গ্রহণ না করে হয়তো আমি ওকে অমর্যাদা করেছিলাম এটা ঠিকই, কিন্তু আমার তো কোনো ক্ষমতাই ছিল না। ওই দিন না করেছিলাম বলেই না, আজ ও এই জমিদার ঘরের এক বৌমণি।
ও তাও হাসছে। ‘তা বলি ওই বয়স্ক লোকটিকে দেখতে কেমন?’
– একেবারে সুন্দর শুভ্রকেশী এক সদাশয় ব্যক্তি।
– নে নে খুব হয়েছে। এবার ওঠ। চল আমার সঙ্গে।
আমার না বলার উপায় নেই। ও ছাড়বেও না তা আমি ভালই জানি। কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লাম, ‘যাব কি ভাবে?’
আলেয়া কাপড় গুছিয়ে চোখ নাচালো, গাড়ি আছে।
আমি কি বোকা? কিসব বলছি?স্টেশনের বাইরে আসতেই সামনে ঝকঝকে আম্বাসাডার সাদা রঙ্গের গাড়িতে চোখ গেল।
ড্রাইভার খুঁজছি। আবার বোকা বনে গেলাম।আলেয়া ব্যাপারটা বুঝে হেসে লুটোপুটি খেল। খুব ভাল লাগলো ওকে।
– আরে আমিই ড্রাইভ করি। তুই না একটা পুরানো গরুই রয়েছিস!
লজ্জায় কথা বাড়ালাম না গাড়িতে উঠে বসলাম। আলেয়া গাড়ি স্ট্রাট দিয়ে দিল।একটা শীতল বাতাস ছুটে এলো। গাড়ি প্রচন্ড জোরে চালাচ্ছিল ও। আমি এই পাহাড়ি এলাকায় নির্জন স্থান এক ভীতু মানুষ আলেয়ার সাহসে সাহসী হলাম।
পর্ব- ৩
মাঝরাত। অন্ধকার। নির্জন। কালোমেঘে আকাশ যেন মুড়ে রয়েছে। একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ।
আলেয়া গাড়ি নিয়ে যেখান থামলো, সেখান জমাট বাঁধা অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। চোখ কচলে গাড়ি থেলে নামলাম আলেয়ার সঙ্গে। ভাল করে তাকিয়ে অবাক বিষ্ময়ে দেখলাম আমি এক বিরাট রাজপ্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে। আলেয়া বুঝতে পেরে সেই রাজহাসি হাসলো – কি দেখছিস?– বিরাট ব্যাপার! ভাবতে অবাক লাগছে। তার মানে তুই এই রাজপ্রাসাদের মালকিন? কিন্তু আলো নেই কেন?
ঝকঝকে দাঁত দেখা গেল আলেয়ার।
– কে বললে আলো নেই? তুই পাহাড়ি অঞ্চলের খবরাখবর রাখিস না তাই জানিস না। পাহাড়ি অঞ্চলে অধিকাংশ সময়ে বিদ্যুৎ থাকে না।আমি এখন পুরোদম পেয়ে গেছি। আর নিজেকে বোকা ভাবতে পারছি না। লড়ে গেলাম — দ্যাখ আলেয়া তুই সব ব্যাপারে মাতব্বরি করবি না। তুই বড়লোকের বউ বলে কি সব জেনে গেছিস? কে বলেছে সব পাহাড়ি অঞ্চলে সবসময় আলো থাকে না?
আমি বড় লোহার গেটে দাঁড়িয়ে। আলেয়া আমার হাত ধরে এক হ্যাচকা টান মারলো এমন ভাবে যে আমি ওর বুকে গিয়ে পড়লাম। অনেকদিন বাদ ওর শরীরের স্বাদ যেন আমায় রোমাঞ্চিত করলো। খুব দামী মনে হলো নিজেকে আলেয়ার সান্নিধ্যে এই বিশাল রাজবাড়ির এক অতিথি হয়ে।
আলেয়া আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে এলো, ‘অনেক জেনে গেছিস না? আমি বলছি এখানে বিদ্যুৎ প্রায়ই থাকে না আর তুই চালাকি মারছিস? চল ভিতরে চল।
আমি খুশি হলাম, তাই বল।
ওর হাত ধরে আমি অন্ধকারেও হাঁটতে পারি। আগে কত হেঁটেছি। হঠাৎ যে কি সব হলো। একটা ভালো চাকরি যদি জোতাতে পারতাম তাহলে আলেয়াকে হারাতে হত না। তা যাকগে। ভগবান যা করে মঙ্গলের জন্যই করে। না হলে কি এইদিনটা কে এইরকম ভাবে পেতাম।
বাগান পেড়িয়ে, উঠোন ডিঙিয়ে, যখন রাজ মহলে প্রবেশ করলাম, তখন আলেয়া একটা ঘরে নিয়ে গেলো। দেখলাম ঘরটায় বেশ আলো হয়ে রয়েছে।
আমি অবাক হয়ে দেখছি।আলেয়া মুখ খুললো, এটা ইমার্জেন্সি আলো।
আমি কিন্তু আলোর বাতি খুঁজে পেলাম না। চকিতে আলেয়া আমাকে ঠেলে বাথরুমে চালান করে দিল। ও নিজেও অন্য বাথরুমে সেঁধোলো।
বিরিয়ানি সহ বেশ কয়েকটি ভাল ভাল পদ ও ড্রাইনিং টেবিলে সাজালো। আমাকে ডাকলো, আয় আগে দু’জনে খাওয়াটা সেরে ফেলি তারপর কথা হবে।
আমি সব কিছু খুঁজি। কাউকে দেখতে না পেয়ে মনটা উশখুশ করছিল। আলেয়া ঠিক বুঝে নিল। ও আমার সব বোঝে।
-দেখলি তো স্বামী বাইরে চলে গেল। শ্বশুর কাজে বাইরে। কাজের সব লোককে রাতে বাড়ি পাঠিয়ে দিই।আমি বুঝলাম। হাসলাম। ও মুখ ভেংচি কাটলো।
চোখ দিয়ে ইশারা করলো যার মানে, ও যদি অবিবাহিত হত এবং আমার প্রেমিকা এখনও থাকতো, আমি সে সুযোগ নিতাম।খাওয়া দাওয়া সেরে ও কয়েকটা ঘর আমাকে ঘুরে দেখালো। ইমার্জেন্সি আলোয়। শ্বশুরের ঘরে নিয়ে গেল না। জানালা দিয়ে আমি ভিতরটা দেখার চেষ্টা করলাম। একপলকে ঘরের টাঙানো বিশাল ছবিটা আমার নজরে এলো। কি রকম যেন মনে হল আমি জানালা দিয়ে আবার দেখবার চেষ্টা করলাম। ট্রেনে এই ভদ্রলোকই তো আমায় এখানে নামতে বলেছিল। আমি ভাল করে দেখছি।
আলেয়া ওর সরু সরু আঙুলগুলো আমার চোখের সামনে নাড়ালো।
– কি দেখছিস উনি আমার শ্বশুর মশাই।– আমি তো তাই দেখছি। উনিই তো আমার ট্রেনে ছিলেন। ওনার কথামতোই আমি এই পাহাড়ি স্টেশনে ইতিহাস জানতে নেমে পড়ি।
– তাই নাকি? ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাঃ বেশ। বেশ! তাহলে তো কাল ওনার সংগে তোর দেখা হয়ে যাবে।
আলেয়া হাসছে। আমি ওর খুব কাছে। ইচ্ছা হচ্ছে ওকে ভাল করে দেখি। কথা বলি। পারলে পুরানো আদর ফিরিয়ে দিই।
শেষ রাত। আলেয়া আমায় একটা ঘরে বিশ্রাম নিতে বললো, তুই এই ঘরে শো। আমি পাশের ঘরে আছি। কাল সব ঘুরে দেখাবো।রাতে দরকার হলে ডাকিস।
আমি মুচকি হাসলাম, আর দরকার! শুভ রাত্রি।
একটু তন্দ্রা এসেছে। এমন সময়ে দরজা খোলার আওয়াজ হলো। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি আলেয়া দাঁড়িয়ে।
– কিরে তুই ঘুমাচ্ছিস? আমি ঘুমোতে পারছি না আর তুই দিব্যি ঘুমাচ্ছিস? এতদিন পর দেখা?
– কি করবো বল তুই তো আর এখন আমার নয়, অন্যের।
ও এক ঝটকায় আমাকে জাপটে ধরলো, বিছানায় উঠে, ‘কে বলেছে আমি তোর নয়? আমি তোরই! মন অন্য কাউকে দেওয়া যায়? মেয়েরা বারাবার প্রেম করতে পারে না, একবারই করে।
আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। অসহায় ভাবে আলেয়াকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলাম। অনেকদিনের বাকি থাকা ভালোবাসা আদরে আদরে ভরিয়ে দিলাম। যৌবনে এরকম বহুবার ওকে ভালোবেসেছি। আজ আবার নতুন করে বাঁধ ভাঙা ঢেউয়ে ওকে ভাসিয়ে দিলাম। দেহসুখে আমারা দু’জনে তখন দুই বিহঙ্গ এক হয়ে গেছি। আলেয়া যে এখনো আমায় ভোলেনি এবং ওর চাওয়া পাওয়া অনেক বাকি তাই বোঝাতে লাগলো। আমি এই মূহুর্তে শুধুই আমার পুরানো অক্ষমতার গ্লানি থেকে বাঁচতে, ওকে উজাড় করে ভালোবাসা দিতে থাকলাম।
পর্ব – ৪
মধুর এক তৃপ্তি নিয়ে চোখ বুঁজে আছি, হঠাৎই গুলির আওয়াজে রাজপ্রাসাদ কেঁপে উঠলো।
আমি সবে বোঝবার চেষ্টা করছি, তখন আলেয়া আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ‘তুই আমাকে তোর বুকে লুকিয়ে রাখ। না হলে ওরা আমায় মেরেই ফেলবে।’আমি হতবুদ্ধি। সেটা আবার কি?
ততক্ষণে পুরো রাজপ্রাসাদ জুড়ে বোমা গুলির আওয়াজে ভরে গেছে। তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেলাম। গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতই সে আওয়াজ। অনেক কালো কালো ছায়া শরীরের দৌড়াদৌড়ি দেখতে পেলাম। আমি এমনিতেই ভীতু। আরো ভয় পেয়ে শক্ত হয়ে গেলাম। আলেয়াকে সর্বশক্তি দিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা চালালাম। আমার ঘরের মধ্যেও ওদের হানা শুরু হলো। কি করবো বুঝতে পারলাম না। কথা বলতেও পারছি না। আলেয়ার শরীর যেন ভয়ে শক্ত হয়ে গেছে। মিনিট দু’য়েকের পরেই। দেখলাম আলেয়া আমার বুকে নেই। আমি চমকে উঠে বসে পড়লাম। সারাঘরে ওকে খুঁজতে লাগলাম অন্ধকারে। না ও কোথাও নেই। কোথায় গেল আলেয়া। ততক্ষণে আওয়াজ অনেকটাই কমে গেছে। শুধু কারা যেন চুপিচুপি কিছু কাজে ব্যস্ত। সময় নষ্ট না করে সাহস করে দরজা খুলে উঁকি মারতেই চক্ষু চড়কগাছ! দেখি উঠোনে আলেয়াকে দু’জনে ধরে রেখেছে, অন্যজন রিভলভার তাক করে।
আলেয়া চিৎকার করে চলেছে..আমাকে মেরো না তোমার পায়ে পড়ি। আমায় ছেড়ে দাও। প্লীজ আমায় দয়া করো।
এক আগুন্তককে বলতে শুনলাম- ক্ষমা আমি তোকে করতে পারবো না। তুই একটা পাপী। কুলটা। মিথ্যাবাদী।
– তুমি কি বলছো? তুমি যে আমার স্বামী। তুমি আমাকে কেন অবিশ্বাস করো? আমাকে বিশ্বাস করো, আমি তোমারই। তোমার বিয়ে করা স্ত্রী।
আলেয়া নিজেকে বাঁচানোর জন্য আকুল প্রার্থনা জানাচ্ছিল। নিজেকে সৎ প্রমাণ করার প্রয়াসে আছড়ে তার দুইচোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগলো।
অন্ধকারেও যেন আমার দু’চোখ আলোতে ভরে গেল। আলেয়ার করুণ আকুতি তার স্বামীকে ছড়িয়ে দিল।তার স্বামী কিন্তু তার রুদ্র মুর্ত্তিতে হো হো হো করে হাসিতে ভরিয়ে দিল সেই রাজপ্রাসাদ। আবার বোমা গুলির আওয়াজ হলো। মাঝরাতে কাক পাখি ডেকে উঠলো। একটা বড় পেঁচা কর্কশ শব্দে আলোড়িত করলো কালো রাত্রিকে।
আর সময় দেওয়া ঠিক হবে না ভেবে প্রচণ্ড সাহসের সঙ্গে চিৎকার করে উঠলাম। গুলি ছুটে গেল অনেকগুলো। আর আমার পিছন থেকে প্রবল জোরে মাথায় আঘাত পেলাম। মাথা ঘুরে গেল -সব কিছু কালো অন্ধকারে হারিয়ে গেলাম।
চোখ খুলেও খুলতে পারছিলাম না। একটা ঘোরে ছিলাম। আরও সময় লাগলো। যখন একটু ঘোর কাটলো তখন দেখলাম আমি একটা বেডে শুয়ে আছি। মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা। হাত দু’টো বাঁধা বেডের সঙ্গে। কেউ কিছু বলছেও না দেখছেও না।
সময় এরকম করে এগোচ্ছে আর আমার যেন অনেক কথাই মনে পড়ছে। আরো মনে করার চেষ্টা করতে থাকলাম। পারলাম না মাথায় অসহ্য যন্ত্রনায় কাতর হলাম।পর্ব – ৫
কত দিন পরে আমার মাথা হালকা হলো বলতে পারবো না তবে যখন আগের কথাগুলো মনে হলো তখন যেন কেমন স্বপ্ন বলেই মনে হতে লাগলো।
কি ভাবে কি হলো বোঝবার জন্য আমি এক নার্সের সঙ্গে ভাব জমালাম। নার্স বেশি কিছু জানতোও না। শুধু জানালো, এটা একটা পাহাড়ি অঞ্চলের স্বাস্থ্যকেন্দ্র মাত্র। আপনি স্টেশনে রাতে ঠান্ডায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। অঞ্জান হয়ে পড়েন। পাহাড়ি আদিবাসীরা আপনাকে উদ্বার করে এখানে নিয়ে আসেন। অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কবলে আপনি নিউমোনিয়া আক্রান্ত হন।
আমি আরো কিছু জানতে চাইছিলাম, কিন্তু পেলাম না। বুঝলাম এরা কেউ জানে না। তবুও বুদ্ধি করে প্রশ্ন করলাম- তাহলে আমার মাথায় কিসের আঘাত লেগেছিল?
– আপনি বসার সিট থেকে উল্টে পড়ে যান। পিছনের মাথায় ধাক্কা লাগে এক বড় প্রস্তরখন্ডে।
তাতেই এই বিপত্তি।বৃথা চেষ্টা! আমি চুপ করে গেলাম।
– কবে ছুটি হবে?ডাক্তার বাবু আপনার ছুটি দিয়ে রেখেছেন। আপনি ইচ্ছা করলে বাড়ি যেতে পারেন।
ধন্যবাদ — জানিয়ে নার্সকে বিদায় জানালাম।
হসপিটাল থাকে বেড়িয়ে পড়লাম। প্রথমেই স্টেশনের দিকে পা বাড়ালাম।
তন্য তন্য করে স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চল খুঁজলাম।
কিছু বুঝতে পারলাম না।পর্ব – ৬
দিন দশেক বিশ্রাম নিয়েছি। এখন অনেকটাই ভালো লাগছে। মনের জোর নিয়ে ঠিক করলাম আমায় এই ঘটে যাওয়া ঘটনার রহস্য উন্মোচন করতেই হবে। এটা স্বপ্ন বলে মানতে পারছি না। উদ্যোমের সঙ্গে প্রথমেই ওই রাজপ্রাসাদের খোঁজ করতে হবে। পথে নামলাম। শীতকাল দুপুর বারোটা, বেশ আমেজ ছিল। হাঁটতে শুরু করলাম। দেখলাম পাহাড়ি রাস্তা এবড়ো খেবড়ো হয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে। সুন্দর প্রকৃতির প্রকাশ। কোনদিকে যাবো, কাউকে দেখতে পেলে খুব ভাল হত। খানিকটা হাঁটার পর একটা ঝুপড়ি চোখে এল। এক বয়স্ক ব্যক্তি চা তৈরি করছিল। সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
দোকানে কোন খরিদ্দার ছিল না। দেখে মনে হল উনি এখানেই থাকেন। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করলো।আমিই জানতে চাইলাম- চায়ে মিলেগা?
লোকটি কোন উত্তর দিল না। আমি বারবার জানতে চাইলেও কোন উত্তর এলো না। আমার মূল উদ্দেশ্য কাজে লাগলো না। কিছু সাহায্য পাওয়ার আশা ত্যাগ করে এগিয়ে চললাম।
আরো কিছুটা এগিয়েছি, সামনে একটা বাজার পেলাম। বাজার মানে পাহাড়ের কোলে বেশ কয়েকজন সব্জি বিক্রি করছে। ভালো লাগলো। আশা করে এগিয়ে গেলাম। এক মহিলা সব্জিবিক্রেতার সঙ্গে কথা চালালাম। ভদ্রমহিলা কেন জানিনা কথা বললো এবং অবাক হলাম ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় কথা বললো। প্রথমে এখানকার বিষয় নিয়ে কথা বললাম। পকেট থেকে একটা একশো টাকার একটা নোট ওকে বাঙালি বলে উপহার দিলাম। গরীবলোক কিছুটা লোভে পড়ে গেল। ভাবলো আমি বোধহয় কোন সরকারি লোক, কিছু খবর দিলে কিছু পাওয়া যাবে। যদিও মুখে একটু লাজ দেখালো। কাজ হবে ভেবে খুশি হলাম। ও সব্জি গুটিয়ে নিয়ে, আমাকে ইঙ্গিত করলো যাতে আমি ওর সঙ্গে যাই। বাজারে ও কোন কথা বলতে চাইছিলো না।
— চলো আমার সনে।
— তাই চলো।
দশমিনিট হেঁটে ওর কুঁড়েঘরে গিয়ে উঠলাম।
দৈন্যদশা কাকে বলে? মহিলা একটা ভাঙ্গা
টুলে বসতে দিল। বললে – চা আনি।
আমি বাইরে বসে আর উনি ভিতরে চা বানাতে গেলেন। চারিদিকে ছোট ছোটো পাহাড়। বেশ মনোরম পরিবেশ।চা খেতে খেতে জানতে চাইলাম- এখানে রাজবাড়ি কিছু আছে?
-কেনে বাবু?
– না একটু ঘুরে দেখতাম।
ও কোনো উত্তর দিল না। নিজের বাজার গোছাতে ব্যস্ত রইলো। দ্বিতীয় বার প্রশ্ন শুনে জানালো — আগে ছিল এখন আর নেই।
– কেন, কোথায় গেল?
— না, বাড়ি আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
— সে কি? কেমন করে হল এসব?
আমি ওকে আরো একশো টাকার একটা নোট এগিয়ে ধরলাম। ও নিল। খানিকটা সময় চুপ করে রইলো। তারপর মুখ খুললো।
— আমি মান্ডি ওই বাড়িতেই কাজ করতেম।উখানে কর্ত্তা, গিন্নি আর উদের বাপটা থাকতো। এ থানের অনেকেই কাম করত উনাদের বাড়ি। একদিন রাতে সব শেষ হয়ে গেল।
মান্ডি সময় নিল। আমি ধৈর্যের বাঁধ ছাড়াচ্ছি।
— কি হয়েছিল সে রাতে?
স্বামী -স্ত্রী ঝামালা ছিল। মন অমিল। আমারা জানতেম। এক অমাবস্যায় রাতে স্বামী সকলকে মাইরা সব খতম করে দিল।
আমি কাঁপছিলাম ভিতরে ভিতরে।প্রকাশ করলাম না।
ওই বললে — সবাই শেষ।
আমি হঠাৎ কি মনে করে জানতে চাইলাম,
সকলের বডি পাওয়া গেছিল?-হ্যাঁ। না, তবে গিন্নিমার বডি মেলে নি।
তারপর কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় মান্ডি জানালো, ও বাড়িতে আর কেউ যেতে পারতেম না, ডর লাগতো। একবার বিতেন গেছিল ও বোবা হয়ে গিয়েছে।
– সে এখন কোথায়?
– একটু আগেই ওর ঘর আছে। চা বানায়।
এবার আমি ফেলে আসা বয়স্ক লোকটির কথা মনে করলাম। বুঝলাম তাই ও উত্তর দেয়নি। অনেক কথা জেনে মান্ডির ঘর ছাড়লাম। ভাবতে লাগলাম এবার কি করি?
গুটিগুটি পায়ে রাজবাড়ির পথ ধরলাম। বিকেল গড়িয়ে পাহাড়ে অন্ধকার নামছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। কিন্তু আমার মন অন্যখানে অন্য কোথাও।
মান্ডির কথাটা মাথায় গেঁথে বসে গেছে – ‘গিন্নিমার বডি মেলে নি।’পর্ব – ৭
ভারাক্রান্ত মনে হাঁটছি আর ভাবছি কি হতে পারে?
ভৌতিক? প্রথমে মনে হলেও এখন মন বলছে অন্য কিছু ঘটনা এর পিছনে লুকিয়ে আছে। সেটা আমায় জানতে হবে। আলেয়ার শ্বশুর আমায় কিছু খুঁজতে বলেছে নিশ্চয়ই। হয়তো ওনার অতৃপ্ত আত্মা এটা চেয়েছে। আর আলেয়া? সে যদি একটা মৃত ছায়া হয়ে খেলা করে তবে সে কি বোঝাতে চাইছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। তবে ওর স্বামী যে আসল কালপিট তা বোঝা হয়ে গেছে।
সবার ডেডবডি যদি পাওয়া যায়, তাহলে আলেয়ার বডি কোথায় গেল?চোখ তুলে দেখি আমার স্বপ্নে দেখা ভগ্নপ্রায় রাজবাড়ি আমার সামনে। অনেকটাই অন্ধকার নেমেছে। পাহাড় এখানে বাঁক নিয়েছে। আমি কিছু সময় নির্বোধের মত দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রকান্ড লোহার গেট যেন আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
লোভ সামলাতে পারলাম না। দ্রুতগতিতে ভিতরে প্রবেশ করলাম। প্রচন্ড গতিতে একটা ঝনঝনানি আওয়াজ তুলে গেট বন্ধ হয়ে গেল। নিস্তব্ধতার মধ্যে একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ। গা ছমছম করা ভাব। আমি সাহস করে ভিতরে চললাম- যেন স্বপ্নের মত আগের ঘোরে আলেয়ার সঙ্গেই।উঠোন পেরোতেই পিলে চমকে গেল। দেখলাম জমাট বাঁধা অন্ধকারে কালো কালো ছায়া মূর্তি সরে সরে যাচ্ছে। আমি ভুত বলে মানতেও পারছি না, আবার ভয়ে সিঁটিয়েও গেলাম। কি করবো বুঝতে পারলাম না। এগোবো, না কি পালাবো? পালানোই বুদ্ধিমানের কাজ। শুনলাম এখানে এসে অনেকেই বোবা হয়ে গেছে, ভয় পেয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই ট্রেনে আলেয়ার শ্বশুরের আকুতিও মনে পড়ে গেল। এখন আমি কি করবো? কি করা উচিৎ? মনে হয় আলেয়া বিপদেই পড়েছিল তাহলে আমি এত ভীতু হব কেন? আর ম়ৃত আত্মার ইচ্ছা যখন, তখন একবার সাহস করে ঢুকেই দেখি কি আছে কপালে?
ভিতরে আওয়াজ হচ্ছে। নানারকম। ভুতুড়ে কিনা জানিনা। তবে পরিবেশ ভয়ার্ত রূপ নিচ্ছে। মাকড়সা যেন জাল বিস্তার করে রেখেছে।উঠোন পেরিয়ে ঘর। সব লন্ডভন্ড হয়ে। ধাক্কা খেলাম টেবিলে। খুব জোরে। ব্যথা সামলাতে যাবো, কোথা থেকে এক মহিলার কান্নার শব্দ পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুটলো.. আবার চিৎকার। আবার বোমা- গুলি এবার এক পুরুষ মানুষের আর্তনাদে, কিছু হুড়মুড় করে পড়ার আওয়াজ হলো।আমি দিশেহারা হয়ে অন্ধকারে পথ খুঁজতে লাগলাম।
সামনে সিঁড়ি মনে হল। সময় নষ্ট না করে উঠে গেলাম। মনে হলো কেউ যেন আমার পাশ দিয়ে চলে গেল। তারপর ফিসফিস শব্দ শুনতে পেলাম। কারা যেন কথা বলছে।
আর আমি ভয় পাবো না। কারণ আমার আর বেরোনোর উপায় নেই। সিংহের গুহায় যখন ঢূকেই পড়েছি তখন মৃত্যু অবধারিত। মরণই হয়তো আমাকে এখানে টেনে এনেছে। সুতরাং মরার আগে অন্তত একবার সাহস করে আলেয়ার জন্য কিছু করি। এই সাহসে ভর করেই আমি আলেয়ার শ্বশুরের ঘরে উঁকি মারলাম।
উরি বাবাঃ। দেখে পিলে চমকে গেল। ঘর ভর্তি অশরীরী কালো কালো ছায়া মূর্তি কিছ যেন করছে। ধোঁয়া ভরে রয়েছে। কটু গন্ধ। তবে গন্ধটা যেন বেশ চেনা। জানালাটা আরো একট ভাল করে খুলতে গিয়েই বিপত্তি ঘটিয়ে দিলাম। ভিতরে ছায়ামুর্তিরা লাফালাফি করে উঠলো। দুমদাম আওয়াজ হলো। কান্না হাসির রোল উঠলো। দমকা বাতাসের শব্দ। ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম। বুঝলাম আমি ওদের নজরে। সবাই আমাকে ঘিরে ফেলেছে। সবার হাতে অস্ত্র। পালাতে গিয়ে পড়ে গেলাম। চারদিকে ভৌতিক পরিবেশ আমাক খেতে এলো।
হঠাৎই। একটা তীব্র আলোর রোশনাই ছিটকে এলো। চোখের মধ্যে আলোটা ঠিকরে পরছে। আমি জ্ঞান হারালাম।
পর্ব – ৮
চেতনা ফিরে পেয়ে চোখ মেলে তাকালাম। এ আমি কোথায়? চারদিকে উর্দ্দিধারী পুলিশ। আমি একটা চেয়ারে বসে। চোখে মুখে জলধারার অবশিষ্টাংশ। আমাকে একজন ধরে রয়েছে পিছু থেকে। আবার সব মনে করার চেষ্টা করলাম। মনে পড়তে সময় লাগলো না। আমি ভুতের গুহায় ছিলাম – কি করে যে এখানে এলাম বুঝতে পারছি না।বোঝার চেষ্টা করছি। তার মানে আমাকে পুলিশে ধরে রেখেছে।
আমি কি কিছু অন্যায় করে ফেলেছি? এই সব ভেবে ভীতু এক লেখক হাত পা পেটের মধ্যে নিয়ে ফেলেছি।সামনে ওসি বসে। আমাকে দেখে হাসছে। আরো ভয় পেয়ে গেলাম এবার বুঝি আমায় কোর্টে চালান দেবে। চারপাশে অনেক আদিবাসী লোক দাঁড়িয়ে ভিড় করে রয়েছে।সকলেই মজা দেখছে যে এক বাইরের লোক এসে এখানে ঝামেলা করেছে।
আমি সকলের মুখগুলি দেখছি। হঠাৎই চোখে এল মান্ডিকে আর সঙ্গে সেই বোবা চা ওয়ালাকে। আমি আরো ঘাবড়ে গেলাম।ওসি আমার দিকে চেয়ে মুচকি -মুচকি হাসছে। বোঝাচ্ছে দ্যাখ বেশি পাকাপোনা করার ফল কেমন পাস।
হঠাৎ ওসি একেবারে শুদ্ধ বাংলায় বললে- কি খুব ভয় পেয়েছেন? আপনি তো বেশ সাহসীই!
আমি একটু অবাক হলাম। বুঝলাম উনি একজন বাঙালী।
– না না ভয়ের কিছু নেই। আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আপনার চেষ্টায় আজ একটা বিরাট অভিযানে আমরা সফল হয়েছি।
আমি কি শুনছি? বুঝতে না পেরে বোকার মত চেয়ে রইলাম।
ওসি সাহেব বললেন- আপনার সাহসের জন্য আজ বহুদিন বাদে একটা ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হল। জানেন আপনি কতবড় কাজ করেছেন?
আমি ভুত ছাড়া কিছুই জানিনা। তাই উত্তর দিতে পারলাম না। চুপ করে জানতে চাইলাম।
ওসি বললো- একটা স্মাগলিং গ্রুপ আজ ধরা পড়লো। যারা বছর তিনেক ধরে ওই ভগ্নপ্রায় রাজবাড়িতে ভুত সেজে কারবার চালাচ্ছিল। আমাদেরও বোকা বানিয়ে রেখেছিল। এখান কার সব আদিবাসীও ভয়ে তাই বুঝতে পারেনি।
আমি মান্ডির মুখের দিকে চাইলাম। ওসি দেখলো। ‘হ্যাঁ, ঠিকই এই মান্ডির জন্য আপনিও বাঁচলেন। আমরাও রাস্তা পেলাম। ওই এসে খবর দিয়েছিল যে আপনি রাজবাড়ি যাচ্ছেন।’
এবার আমি জানতে চাইলাম- কিন্তু মান্ডিকে তো আমি কিছু বলিনি?
–না ও জানতো আপনি সেই কাজেই খবর সংগ্রহ করছেন।
আমি অবাক। আরো অবাক হলাম যখন ওসি আরও ভেঙে বললেন।
— আর ওই চা ওয়ালা হারুণ আদৌ হাবাবোবা নয়। ও রাজবাড়ির সব ব্যাপারটা জানতো। সব ধরে ফেলেছিল। তাই ওকে প্রাণে মেরে দিতেও গেছিল। ও ওদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল ও সারাজীবন বোবা সেজেই থাকবে। কাউকে কিছু বলবে না। এটা যদিও সহজে হয়নি আপনার ওই আলেয়ার স্বামী রাজকিশোর বাবুই ওকে মাফ করে দিয়েছিলেন। কারণ ও ছিল ওদের বংশেরই ওরসজাত এক পুর্বপুরুষ। হারুণ যদি আমাদের এই কথা আগে জানাতো তাহলে আমরা কাজটা সহজেই করতে পারতাম। আজ আপনার বিপদ দেখে মান্ডিটই ওকে এখানে নিয়ে আসে। আর এই সুযোগে আমরা আপনার পিছনে ধাওয়া করি আপনাকে বুঝতে না দিয়ে- তাই কাজটা সহজ হলো।
আমি বোকার মত চেয়ে- তাহলে ভুতেরা? আর অতো শব্দেরা?
– ওগুলো সব সাজানো। লোককে বোকা বানাতে। আমরা তো ভুত না মানলেও ওই বাড়ি নিয়ে মাথাই ঘামাই নি। রাজকিশোর জমিদার আন্তর্জাতিক চোরাকারবারের একজন হর্তাকর্তা।
আজ সবাই ধরা পরে গেল।আমি আশস্ত হলাম। আসল প্রশ্নের উত্তর খুজঁতে ওসির মুখে তাকালাম।
– না। সরি ওদের বাঁচাতে পারিনি। ওরা অনেক আগেই ওর শিকার হয়ে গেছিল।
– কিন্তু কেন?
– আলেয়ার শ্বশুর মানে রাজকিশোরের বাবা এটা মানেনি। প্রতিবাদ করেছিলেন। বৌমাকে নিয়ে পরিকল্পনা করছিলেন কি করা যায়। আলেয়াও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। রাজকিশোর বুঝতে পেরে সেই রাতেই ওদের শেষ করে দেয়।
– ওদের কি ডেডবডি পেয়েছিলেন?
— আলেয়ার পাওয়া যায়নি। এটা রহস্যই রয়ে গেছে।
আমি চুপ। এবার আমি কি করবো? আমার কাজতো শেষ হলো না। আলেয়া কোথায় হাওয়া হয়ে গেল। ও যে আমার বড়ই প্রাণের। ওই তো আমায় টেনে এনেছে এখানে। আমি শেষ দেখতে চাই!
– যাক। আপনার নাম আমরা প্রধান দপ্তরে পাঠিয়েছি একজন সাহসী লেখক হিসাবে। আপনি এখন কি করতে চান?
আমার মাথায় আর কিছু কথা ঢুকলো না।আমি ওদের ধন্যবাদ জানিয়ে থানা থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। মান্ডি আর হারুণ আমার সঙ্গে এলো।
আমার হাত ধরে নিল- সাব আমাদের কোঠিমে চলিয়ে।পর্ব – ৯
মান্ডি আর হারুণের হাত ধরে মান্ডির ঘরে চলে এলাম। মান্ডি বেশ খাতির করছে। হয়তো ওদের মালকিনকে ওরা ভালবাসতো তাই। আমাকেও পারলে একটু খুশি করে, এমনই ভাবখানা।
মান্ডি খাবার বনাতে থাকলো। আমি আমার ব্যাগ ঘোছাতে ব্যস্ত রইলাম।মান্ডি জানতে চাইলো- কেয়া বাত সাব?
আমি চাইছি কিছু কথা আলোচনা চালাতে। ওদের জানাতে চাইছি আমার মনের দদ্দ্বটা।
ওরা বুঝতে পারলো। কিছু খাবার খাওয়ার পর আমরা তিনজনে বসে পড়লাম।
– সব রহস্য রয়ে গেছে। আমাকে আলেয়াই সমস্ত ঘটনা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল। সম্ভবত ওর আত্মাই এই কাজ করে থাকবে। তা হলে ধরে নিতে হয় ও মারা গিয়েছিল।
হারুন আর কথা বলতে দিল না- সাব আপকা থোরাসা গলতি হোতা হ্যায়। উসিকা শ্বশুর জি আপকো এহি সব বাতায়া, দেখায়াভি।
মান্ডি সব কথা শুনে হারুনকে বললে- এক কাম কিজিয়ে দা ‘সাব গুনিনজিকি পাশ চলিয়ে। সব সাচ মিল যায়েগা।
হারুন লাফিয়ে উঠলো- এহি একদম আচ্ছা হোগা।
আমি চুপ করেই ছিলাম। আমি এইসব বিশ্বাস করিনা।
হারুন সব বুঝে গেল। দেখিয়ে সাব আভি দুসরা কহি রাস্তা নেহি। এ গুনিন বহুৎ পুরানা আদমি হ্যায় ইধারকা। একবার যানেসে মালুম হো জায়েগা। আউর রাস্তা ভি মিলেগা।
মান্ডিও রাজী। আমার এখন ছটফটানি মন। মানতেও পারলাম না ফেলতেও পারলাম না। একপ্রকার রাজী হয়েই গেলাম।
গ্রামের শেষে শশ্মান। আর তার বাম পাশে যে পাহাড়টা ঢালু হয়ে নেমে এসেছে তার পাশেই পর্ণকুটির।
মান্ডি আর হারুন ঢুকে কথা বলে এলো।আমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই গুনিনটি চিৎকার জুড়ে দিল – এ কৌন আছে? ইসিকা সাথ বিশ্বওয়াস না আছে।ব্যাটা বুঝতে পেরেছে আমার কাছ দিয়ে ওর আমদানি ভাল হবে না।
মান্ডি আর হারুন ও সব কিছু শুনেও শুনলো না। ওনাকে সমস্ত ঘটনা বিস্তারিত বললো। গুনিনজী সব ধৈর্য্য ধরে শুনলো- গুনানে পড়েগা।
গোনা – গুনির কাজ করতে থাকলো। মান্ডি আর হারুন হাত জোড় করে বসে। আর আমি মজা দেখতে থাকলাম। অনেক সময় চলে গেল।
গুনীনিজি গুনে গুনে অস্থির হয়ে উঠলেন। সঙ্গে ছিল মড়ার খুলি, বড় বড় কড়ি আর তামার পয়সা।
হাঁক দিয়ে জানালে- নেহি নেহি ও আভিতোক জিন্দা হ্যায়।আমি তড়াক করে উঠলাম। মনের মত কথা। কিন্তু ব্যাটার ছেলে ভন্ড কায়দা মারছে এই ভেবে চুপসে গেলাম। চক দিয়ে এঁকে বললেন – ভাগবান কা দিক মে দেখাতা হ্যায়।
আমি লেখক হওয়ার কারণে ওর হেয়ালি সহজেই বুঝে গেলাম- মানে উত্তর দিকের কথা বলছে।
মান্ডি আর হারুন না বুঝে অনেক প্রশ্ন করে চলেছে। অনেক কিছু জানতে চাইছে আর ভন্ড সব উত্তর দিয়ে দিচ্ছে।
একটা কথা আমার কানে এল- উসিকা শ্বশুর জী কা প্রেত মেই এয়সা কুছভি কিয়া থা।
উসকা শান্তি হুয়া নেহি। আলেয়া কা রূপ
সে ওহি দেখা দিয়া। হামারা হিসাব নিকলায়া আলেয়া আভিতোক জিন্দা হ্যায়। কথাগুলো ও বেশ জোরের সঙ্গেই বললো।অনেক কিছু জানার পর আমারা তিনজন ওখান থেকে ফিরে এলাম।
সুযোগ খুঁজছিলাম। মধ্যরাতে সকলে ঘুমালে আমি অতি সন্তর্পণে ঘর ছাড়লাম।
পথ খুঁজে আবার স্টেশনেই চলে এলাম।জানতাম, যে ট্রেনটায় আমি এখানে নেমেছিলাম, সেই ট্রেনটা এখনি এখান দিয়ে পাশ করবে। টিকিট কাটার কথা মনে এলো না। শুধু একটা কথাই মনে বসে গেছে- উত্তর দিক। বারবার জলন্ধর নামটা চলে এসেছিল। তার মানে কি বোঝাতে চাইছিল সবাই?
যদি ভুতের কথাই মানি অথবা ভগবানের কথাই মানি- তাহলে উত্তর দিক মানে জলন্ধর কেই বোঝায়। সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না আর সবাইকে নিয়েও কাজ করা যাবে না। তাই লুকিয়ে চলে এলাম ।ট্রেন এসে গেল। জলন্ধর এক্সপ্রেস। তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম। কোনকিছু না দেখে না বুঝে। উঠেই বিপদ! এ আবার অন্য ফ্যাসাদে পড়লাম। চক্ষু চড়কগাছ। একেবারে ধরা পড়ে গেলাম।
অন্তিম পর্ব
ট্রেনে উঠেই দেখি একেবারে কালোকোর্ট পড়ে চেকার সাহেব যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছে।
টিকিট নেই তার উপর ফার্স্ট ক্লাস। অল্প টাকা ছিল, ম্যানেজ হলো না। তার উপর চেকারের দাবি ওনাকে রসিদ কাটতেই হবে। নাহলে অসুবিধা, ওনাকে ডেলি কিছু কেস নাকি দিতেই হয়। আমাকে নিয়ে জলন্ধর স্টেশনে নিয়ে অফিসারের কাছে তুলে দেবে। উনি মাফ করলে মাফ। আমার অসুবিধা হওয়ার কথা নয় দিব্যি দাঁড়িয়ে রইলাম। ভোর বেলায় তো নেমেই যাব।অনেক টিকিটবিহীন যাত্রী ছিল ট্রেনে। সবাইকে নিয়ে জি আর এফ স্টেশনের একটা ঘরে তুললো।
আমি নিরুপায়। উপায় পাচ্ছি না।ভুতের বোধহয় বিশেষ কৃপা আমার উপর। না হলে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসি। তাই হল, থানার বাঙালী ওসি আমাকে দেখে দৌড়ে এলেন- আরে আপনি?
সব জানলেন। একমিনিট লাগলো না, আমি ছাড়া পেয়ে গেলাম। উনি খাতির করে আমায় জীপ গাড়িতে তুললেন — দেখেছেন কি কান্ড? কাল রাতে আমি জীপ নিয়ে জলন্ধর এসেছিলাম। এখন ফিরতি পথে আপনাকে এই অবস্থায় দেখে ফেললাম। যাক কোথায় যাবেন? নিশ্চয়ই কোন অভিযানে।
হেসে ফেললাম। সত্যি উনি একজন সজ্জন ব্যক্তি। উনি আমার জীবনদাতা। ওনাকে সব খুলে বললাম আমার মনের ইচ্ছা। গুনিনের কথাও জানালাম।
উনি এক মিনিট চুপ করে থেকে বললেন- আমার কাজ হয়ে গেছে। ফিরছিলাম। তা আপনার কাজে আমায় নিতে পারেন। আমারও খুব ইচ্ছা হচ্ছে। যদি সঙ্গে যেতে পারমিশন দেন?
আমি লজ্জায় মরে গেলাম- আরে এ আপনি কি যে বলেন? আমি পারমিশন দেব? আরে আপনি সঙ্গে থাকলে আমার কাজ সার্থক হবে এব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
– তা হলে কাজটা আমায় করতে দিন। মানে আমিই অপারেশনটা করবো। আর আপনি শুধু সঙ্গে থাকবেন। আমি এখানকার সব চিনি এবং আমাকেও সবাই চেনে।
আমি খুব খুশি হলাম। হাত বাড়িয়ে দিলাম- একদম। উনিও হাত মেলালেন- ডান।
জীপ ছুটে চললো। পাহাড়ি এলাকায় ধুলো উড়ছে – মুখ চোখ কালো হয়ে যাচ্ছে। এক দুর্নিবার আকর্ষণ আমাদের রোমাঞ্চিত করতে থাকলো।
বুঝলাম উনি অভিঞ্জ। উনি পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছেন। চুপচাপ ওনাকে ফলো করতে থাকলাম।
অনেক পথ পার হলাম। জীপ এসে থামলো একটা বড় গেটের সামনে। ভিতরে গাছ, ফুলের বাগান। ইংরেজিতে লেখা ” মিশন”। ব্যাপারটা বুঝলাম। উনি আমাকে নিয়ে ভেতরে গেলেন। একটা অফিস গোছের ঘরে দেখলাম দুইজন মহিলা বসে আছেন।
বাঙালী ওসি ভদ্রলোক ওনার পরিচয় দিলেন। এতক্ষণে ওনার নাম জানতে পারলাম- পরিমল ভট্টাচার্য। আগে নামটা জানা হয়ে ওঠেনি।পরিমল ওসি সব বুঝিয়ে বললেন। ওনাদের হেল্প চাইলেন। দুই মহিলা বেশ শিক্ষিতা ও রুচিশীলা বলেই মনে হল। রেজিস্টার খুলে দেখলেন কি সব।
দু’ তিনবার ফোনে কথা বললেন। বুঝলাম বছর দুই বা তিন আগের আগত মহিলাদের খবরাখবর সংগ্রহ করতে চাইছেন উনি। দু’টি আশ্রমের নাম লিখে দিলেন। আমরা বেড়িয়ে পড়লাম সন্ধানে।পরের আশ্রমে এসে ওসি অনেক খবর নিলেন। ভিতরে গিয়ে খোঁজ ও করলেন। সুবিধা হলো না।
গাড়ি ছুটেই চললো সারাদিন। অনেক ঘোরাঘুরি করে অসফল হয়ে পড়েছি। যাবার সময় শেষ একটা আশ্রমে পৌঁছুলাম। বিকেল হয়ে গেছে।সূর্য ডুবুডুবু। পাহড়ি এলাকা রক্তিম আলোয় ঢেকে গেছে। ম্যানেজার চেষ্টা করছিলেন। আমরা ঘরে বসে। সামনে বড় লোহার রডের জানালা। সমস্ত আশ্রমের মহিলারা বাগান ছুঁয়ে প্রার্থনা স্থলে যাচ্ছেন, আমি সেই দৃশ্য দেখছি। হঠাৎই চমকে উঠলাম, আলেয়া যেন চলে গেল মনে হল। হয়তো আমার মনের ভুল, আমি চকিতে জানালার সামনে চলে গেলাম। ও কি আমায় দেখেছে? জানিনা। তবে ওসি পরিমল বাবু ঠিক দেখে নিয়েছে। সত্যি স্বীকার করছি একজন ওসি হিসাবে উনি একদম নিখুঁত। নিখুঁত ওনার চাল। উনি সবেগে ভিতরে চলে গেলেন।
আমি বাইরে ছটফট করছি। আধাঘন্টা কেটে গেল। কোনো খবর নেই। পরিমল বাবু শেষে বেড়িয়ে আমায় একটান মেরে বাগানের দিকে নিয়ে গেলেন। আমি জানতে চাইলাম। উনি হাসলেন — ইউ আর গ্রেট!
দুরে একটা বেঞ্চে বসেছিল আলেয়া। আমি দেখে অবাক। দেখি ও আমাকেই দেখছে। পরিমলবাবু অল্পকরে বললেন- বদমাশদের একজন ওনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন..ম়ৃত বলে।
আমি শুধুই আলেয়াকে দেখছি। কিছু জানার প্রয়োজন নেই। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। ওটা ওসির কাজ উনিই করুক। আলেয়ার পাশে গিয়ে বসলাম। ওর হাতটা ধরলাম। আলেয়ার চোখে জল — বাবা মার লোভ আজ আমাকে এখানে এনে ফেলেছে।
আমি ওর হাতটা চেপে ধরলাম। ও করুণ ভাবে অনুরোধ করলো- তুই আমাকে যেতে বলিস না। আমি শেষ জীবনটা এখানেই থাকতে চাই।
আমার সব পাওয়া হয়ে গেছে। তাই মেনে নিলাম।
পরিমল বাবু অফিসিয়াল কাজে ওকে নিয়ে আশ্রমের অফিসে হানা দিল।আমি বাইরে দাঁড়িয়ে। কিছু বাদে ওসি পরিমলবাবু জীপ থেকে আমায় ডাক দিলেন – লেখক বাবু চলে আসুন, আমার কাজ হয়ে গেছে, এবার ফিরতে হবে। আমি একবার আশ্রমটাকে ভাল করে দেখে নিলাম যদি আর একবার আলেয়ার দেখা পাই। না আর দেখা হল না।
এগিয়ে জীপের সামনের সীটে বসতে যাবো, পরিমল বাবু ইশারা করে পিছনে বসতে বললেন, খারাপ লাগলো উনি বোধহয় আমাকে আর কাছে বসাতে চাইছেন না। পিছনে উঠে বসেই অবাক। এ কাকে দেখছি?
আলেয়া আমার হাতটা ধরে টেনে নিল। আমি একেবারে ওর কাছে চলে গেলাম। ও আমার কাছে আরো সরে এল। আমি পারলাম না, তোকে ফেরাতে.. বলেই হুহু করে কেঁদে উঠলো।
সামনে বসে স্ট্রিয়ারিং হাতে পরিমলবাবু হেসে উঠলো- আমি থাকতে তা আর কি করে হতে দিই?
জীপগাড়ি ছুটে চললো।
সমাপ্ত।
–