-
গল্প- অমানুষ
অমানুষ
– প্রলয় কুমার নাথ– “মা, ভাত বেড়ে দাও…বড্ড খিদে পেয়েছে…” পাড়ার রকের ইয়ার দোস্তদের সাথে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরে এসে হাঁক পারল সঞ্জয়।
-“কই গো শুনছো, তোমার নবাবপুত্তুর রাজকার্য করে বাড়ি ফিরলো…তাকে সোনার থালা করে রাজভোগ সাজিয়ে দিতে এত দেরি হচ্ছে কেন তোমার?” ভাতের হাঁড়ি নিয়ে কাজে ব্যস্ত নীলিমা দেবীকে উদ্দেশ্য করে বিতৃষ্ণার স্বরে বলে উঠলেন সঞ্জয়ের বাবা বিনোদ বাবু।
-“ওফ আবার তোমরা বাপ ছেলে মিলে শুরু করলে…আমার আর এই সংসারে থাকতে এক দন্ডও ভালো লাগেনা বাপু…একদিন সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে চলে যাব যেদিকে দুই চোখ চায়…” ছেলের সামনে ভাত ডাল তরকারির পাত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে উঠলেন নীলিমা দেবী।
– “ছেলে!” গর্জে উঠলেন বিনোদ বাবু, “ওই অমানুষটাকে ছেলে হিসাবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে আমার…চাকরি বাকরির তো কোন চেষ্টা নেই, শুধু দিন রাত রকে বসে আড্ডা আর বাড়ি ফিরে গান্ডি পিন্ডি গেলা…এখন তো ভাবি আমার কোন সন্তান না থাকলেও কোন দুঃখ ছিল না!”
সঞ্জয়ের কাছে বাপের এই ভর্ৎসনা শোনাটা রোজকার রুটিনের মধ্যেই পরে। তাই সে এত কিছু শুনেও নির্বিকার চিত্তে ভাত খেয়ে যেতে লাগলো।
– “উফফ তুমি থামবে…সবেমাত্র ছেলেটা খেতে বসেছে আর অমনি তুমি…”, নীলিমা দেবীর কথা শেষ না হতেই আবার চেঁচিয়ে উঠলেন বিনোদ বাবু,
– “কি থামবো শুনি…তোমার এই অকর্মণ্য ছেলের চামড়াটাও হয়েছে একেবারে গন্ডারের মত…আমি যে এত কথা বলছি ওর কোন ভ্রূক্ষেপ আছে? সত্যি এমন অমানুষ আমি দুটো দেখিনি…” বলতে বলতে শোবার ঘরের দিকে পা রাখলেন বিনোদ বাবু। তিনি চলে গেলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলিমা দেবী সঞ্জয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
- “মানুষটার কথায় রাগ করিসনি বাবা…বুঝিসই তো মানুষটার বয়স হচ্ছে…তোকে নিয়ে চিন্তা করে বলেই তো…”, চোখের কোনে শাড়ির আঁচলটা ধরে সেই স্থান ত্যাগ করলেন নীলিমা দেবী।বাবার কথা তেমন গায়ে না মাখলেও মায়ের চোখের জল দেখে সঞ্জয়ের বুকের ভেতরটা যেন হুহু করে উঠল। মাথা নিচু করে ডাল দিয়ে মাখানো ভাতের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে তার মনে হল এক নিমেষের মধ্যেই তার খিদেটা যেন পেট থেকে কোথায় চলে গেল। আধ খাওয়া ভাতের থালাটা দূরে সরিয়ে রেখে হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে ঢুকে একটা বিড়ি ধরালো সে। জামাটা খুলে রেখে বুক পকেট থেকে সস্তার মোবাইল ফোনটা বার করে দেখলো কখন সেটার চার্জ চলে গিয়েছে তার খেয়ালই হয়নি। সে ফোনটা চার্জে বসিয়ে অন করতেই বেশ কয়েকটা মিসড কল এলার্ট এবং একটি মেসেজ ঢুকলো তার ফোনে। তার মানে সন্ধ্যার দিকে অপর্ণা ফোন করেছিল তাকে, একবার নয় বেশ কিছুবার। শেষে একটা মেসেজ পাঠিয়েছে সে, “তোমার সাথে খুব দরকারী কথা আছে সঞ্জুদা…কালকে বিকালে একবার পার্কে দেখা করতেই হবে। আসবে কিন্তু!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানলার বাইরে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো সঞ্জয়।
পার্কের এই বেঞ্চটা ওদের অনেক দিন ধরে চেনা। ওরা যখনই এখানে আসে এই বেঞ্চেই বসে। অপর্ণা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো ওর দিকে চেয়ে। অপর্ণার সাথে ওর সম্পর্ক সেই উচ্চ মাধ্যমিকের সময় থেকে। সঞ্জয়ের থেকে স্কুলে এক বছরের জুনিয়র ছিল অপর্ণা। তারপর দুজনেই ভর্তি হয়েছিল একই কলেজে। সঞ্জয়ের ছিল বি.কম পাস আর অপর্ণার ইংলিশ অনার্স। সেই ঘটিগরমওয়ালাটা এগিয়ে এল ওদের দিকে, কিন্তু অপর্ণা জানিয়ে দিল যে আজ কিছু খাওয়ার ইচ্ছা নেই তার।
– “কি হয়েছে বলবে তো…নাকি আরো কিছুক্ষণ বেজার মুখেই বসে থাকবে”, বললো সঞ্জয়।
-“গতকাল সন্ধ্যায় আমাকে দেখতে এসেছিল সঞ্জুদা…চন্দন দেখতে ভালো, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট পাশ করে কলকাতায় মোটা মাইনের চাকরি করে…বাড়িতে সবার ওকে খুব পছন্দ…এখন শুধু ওরা কি বলে সেই অপেক্ষা…” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে চললো অপর্ণা।
- “আর তোমারও পছন্দ তো?”
– “এটা হেঁয়ালি করবার সময় নয় সঞ্জুদা…এতদিন এম.এ করার বাহানায় আমি বিয়ের কথায় বাধা দিচ্ছিলাম…এখন তো সেটাও কমপ্লিট…এখন কি ভাবে…”
-“তুমি বিয়েটা করেই নাও অপু…এমন ভালো সম্বন্ধ পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার…”
কথাটা শুনে প্রথমে খুব হকচকিয়ে গেল অপর্ণা। তারপর সে সজোরে কষিয়ে দিল এক থাপ্পড় সঞ্জয়ের গালে। তার জামার কলার ধরে সে বলে উঠলো,
– “এটা শোনার জন্য এতদিন তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছিলাম আমি? এটা শোনার জন্য নানা টাল বাহানা করে একের পর এক ভালো সম্বন্ধগুলোকে নাকচ করেছি আমি? এটা শোনার জন্য তোমাকে এতদিন নিজের শরীরটা ইচ্ছামত দিয়ে এসেছি আমি? এটা শোনার জন্য এতদিন ধরে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি আমি…” চিৎকার করতে করতে এবার কান্নায় ভেঙে পড়ল অপর্ণা। পার্কের অন্যান্য কাপেলরা এবার উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তাদের দিকে। অপর্ণার ব্যবহারে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল সঞ্জয়। সে একবার চেষ্টা করলো অপর্ণাকে নিজের বুকে টেনে নিতে। কিন্তু উত্তেজিত অপর্ণা সজোরে ধরে ফেললো সঞ্জয়ের হাতটা, তারপর “চলো আমার সাথে…চলো…” বলে টানতে টানতে সঞ্জয়কে নিয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে গেল।পুরোনো একতলা বাড়িটার দাওয়ায় বসে নিজের একটা ছেঁড়া শাড়ি সেলাই করছিলেন নীলিমা দেবী। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে যেতে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে উঠতে যাবেন, এমন সময় সামনের দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি। তিনি দেখলেন একটি মেয়েকে নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল তার ছেলে। আরেকবার ভালো করে তাকিয়ে তিনি বুঝলেন যে সঞ্জয় নয়, বরং মেয়েটাই ধরে রয়েছে তার হাত। তার কিছু বলার আগেই অপর্ণা এগিয়ে এলো তার দিকে, তারপর কুণ্ঠা মেশান স্বরে বললো,
-“মাসীমা, আমাকে হয়তো আপনি চেনেন না। আমার নাম অপর্ণা। আপনার ছেলের সাথে একসাথেই পড়াশোনা করেছি আমি। আর আজ আপনার সামনে বলতে বাধা নেই যে আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসি, মাসীমা…”
বাড়ির বাইরে একটি অপরিচিত মেয়ের গলা শুনে বেরিয়ে এলেন বিনোদ বাবুও।
– “আহ্ অপু…কি হচ্ছে কি, বন্ধ কর এইসব…” ফিসফিসিয়ে উঠল সঞ্জয়।
– “না সঞ্জয়…আর মুখ বন্ধ করে থাকতে রাজি নই আমি…” সঞ্জয়ের উদ্দেশ্যে বলে অপর্ণা এগিয়ে গেল বিনোদ বাবুর কাছে। তারপর তাকে বললো,
-“মেসোমশাই, আজ প্রায় সাত আট বছর ধরে আপনার ছেলের সাথে আমার সম্পর্ক। ওকে ছাড়া আর অন্য কাউকে নিজের স্বামী রূপে কখনই ভাবতে পারব না আমি। তাই তো আজ ছুটে এসেছি আপনাদের কাছে…”
– “তোমার কথা তো কখনো আগে শুনিনি মা?” বিস্ময়ের স্বরে বলে উঠলেন বিনোদ বাবু।
– “তার মানে আপনার ছেলে আপনাদেরকে আমার সম্বন্ধে কোন কথাই বলেনি…এখন তো সন্দেহ হয় যে ও আমাকে সত্যিই ভালোবেসে ছিল কিনা? নাকি ইচ্ছামত শুধু আমার শরীরটা পাওয়ার জন্য…”
– “কি বলছ মা, তুমি!…কি রে, কি রে বল, ও যা বলছে তা কি সত্যি…” সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন বিনোদ বাবু। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো সঞ্জয়।
-“এক পয়সা তো ইনকাম করার মুরোদ নেই…বাপের পয়সায় বসে বসে খাস, কোনো লজ্জা নেই? তার ওপর এই সব? তোর মত অমানুষ জানোয়ার ছেলে জন্মাবার পরই কেন যে মুখে নুন দিয়ে মেরে দিলাম না আমি…”, তারস্বরে চিৎকার করে উঠলেন বিনোদ বাবু। কিন্তু সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ না করেই অপর্ণা বলে চললো,
– “আমার বাড়ি থেকে অন্য সম্বন্ধ দেখছে…কিন্তু বিশ্বাস করুন মাসীমা, মেসোমশাই…ওকে ছাড়া যে অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতেই পারি না আমি…তাই আমি চাই আজই ও আমার কপালে সিঁদুর তুলে দিক, আজ থেকেই এই বাড়ির বউ হিসেবে আমাকে স্বীকৃতি দিন আপনারা!”
-“না না এ অসম্ভব…তুমি কি দেখে ওই অকর্মণ্যটাকে বিয়ে করতে চাইছো শুনি…এমনিতেই আমাদের টানাটানির সংসার…বিয়ে করে ও কি খাওয়াবে তোমায়!”, বলে উঠলেন বিনোদ বাবু। কান্নায় ভেঙে পড়লো অপর্ণা। নীলিমা দেবী এগিয়ে গেলেন অপর্ণার দিকে, তারপর তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে তার চিবুক স্পর্শ করে বলে উঠলেন,
– “আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের ভেতর এখন কি চলছে মা। সত্যি বলতে তোমার মত এমন লক্ষীমন্ত মেয়েকে এই বাড়ির বউ হিসেবে পাওয়া আমার কাছে গর্বের বিষয়…কিন্তু তোমার একটা ভবিষ্যত আছে মা, আর আমার ছেলে তোমাকে কথনই কোন সুখ স্বচ্ছন্দ দিতে পারবে না যা যে কোন মেয়েই তার স্বামীর কাছ থেকে চায়। নিজের পেটের ছেলে, তাও বুকে পাথর চেপে বলছি…সঞ্জুকে বিয়ে করলে তোমাকে খুব পস্তাতে হবে মা…যা হয়েছে হয়েছে…এখন তোমার বাড়ির লোক যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে তাকেই বিয়ে কর মা…আর ভুলে যাও ওই হতভাগাটাকে!”, বলতে বলতে নিজেও কেঁদে ফেললেন নীলিমা দেবী। অপর্ণা ঘুরে দাঁড়াল সঞ্জয়ের দিকে, তারপর নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে কয়েকটা সস্তার সাজের জিনিস আর কিছু চিঠি টেনে বের করে সেগুলো সপাটে ছুঁড়ে মারলো সঞ্জয়ের মুখে। তারপর বললো,
– “সকলে বলত আমি তোমাকে ভালোবেসে খুব ভুল করছি, সঞ্জুদা…কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম না। স্বপ্ন দেখতাম একদিন তুমি খুব ভালো একটা চাকরি করছো, তোমার সাথে সুখে সংসার করছি আমি! কিন্তু আমি ভুল ছিলাম সঞ্জুদা…সত্যিই ভুল করেছিলাম তোমার মত একটা অমানুষকে ভালোবেসে…তোমার দেওয়া সমস্ত গিফ্ট আর প্রেমপত্র ফিরিয়ে দিলাম তোমায়, আর কোনদিন যেন তোমার মুখ দেখতে না হয় আমাকে!” এই বলে মুখ ঢেকে সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল অপর্ণা।***
পাড়ার রকে বসে আড্ডা মারতে ইচ্ছা করছিল না সঞ্জয়ের। হতাশা, লজ্জা আর আত্মগ্লানিতে তার প্রাণটা হুহু করে কাঁদছিল, শুধু চোখে কোন জল ছিল না কারণ ছেলেদের যে কাঁদতে নেই। ছোটবেলার অনেক স্মৃতি ভেসে আসছিল তার চোখের সামনে। স্কুলে পড়াকালীন পড়াশোনায় খারাপ ছিল না সে। অন্যান্য সকল বাবা মায়ের মত নীলিমা দেবী আর বিনোদ বাবুও অনেক স্বপ্ন দেখতেন তাদের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। পোস্ট অফিসের কেরানী বিনোদ বাবুর আয় ছিল অল্প, কিন্ত তিনি যতটা পারতেন ছেলের পড়াশোনা আর টিউশনের পেছনে খরচা করতেন। মাধ্যমিকে বেশ ভালোই নম্বর পেয়েছিল সঞ্জয়। তাই উচ্চ মাধ্যমিক সায়েন্স নিয়েই ভর্তি হয়েছিল সে। কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে আর কি হবে। সেই সময় থেকেই তার জীবনে এল অপর্ণা। পড়াশোনার দিকে বেশি দৃষ্টিপাত না করে সেদিনের সেই উচ্ছসিত তরুণটি সময় ব্যয় করেছিল প্রেমিকার কাছে। ফলে উচ্চ মাধ্যমিক ফল হল খুব খারাপ। কলেজে বি.কম পাশে ভর্তি হল সঞ্জয়। তখন থেকেই যেন পড়াশোনার ক্ষেত্রে নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল সে। কোনো মতে পাশ করে কলেজের গন্ডি পেরোতেই সূচনা হল তার বেকার জীবনের। আর সেদিন থেকে আজ অবধি সে সকলের চোখে অমানুষ, অকর্মণ্য। সেদিন থেকে আজ অবধি ওই ছাপোষা রেজাল্ট নিয়েই অফিসের দোরে দোরে ঘুড়েছিল সঞ্জয়, একটা চাকরির আশায়। কিন্তু কিছুই হয়নি। মাঝে পেয়েছিল একটা কাজ একটি বিমা কোম্পানিতে, কিন্তু টার্গেট না পূরণ করতে পারায় সেই চাকরিও গিয়েছে। কি মনে হতে সামনে রাখা দেশি মদের বোতলটা তুলে ঢকঢক করে এক নিমেষে পুরোটা ফাঁকা করে দিল সঞ্জয়। তারপর কাউকে কিছু না বলে ধরলো বাড়ি ফেরার পথ। সেটা দেখে তার এক সঙ্গী তাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– “কি হল গুরু…আজ এত তাড়াতাড়ি কেটে পড়ছো?”
তার কথায় পাত্তা দিল না সঞ্জয়। অমনি অপর এক সঙ্গী তাকে বললো,
– “আরে জানিস না…গুরুর আজ খুব মন খারাপ…আরে ওর ওই জানেমন, কি যেন নামটা…হ্যাঁ, অপর্ণা…ওর যে পরের মাসেই বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে চন্দন নামের এক চার্টার্ড একাউন্টেন্টএর সাথে!”নিরিবিলি রাস্তায় টলতে হাঁটছিল সঞ্জয়। আশেপাশে যাও বা এক দুইজন পথচারী ছিল, তাদের গলার আওয়াজ কানে আসছিল সঞ্জয়ের,
– “আরে এটা বিনোদ বাবুর ছেলে না? কি অবস্থা হয়েছে ওর, মুখ দিয়ে বেরোনো মালের গন্ধে টেকা দায়! সত্যিই এমন ভদ্রলোক বাবার এমন অমানুষ সন্তান…এ তো ভাবাই যায় না!”
এই সব গা সওয়া হয়ে দিয়েছে সঞ্জয়ের। উদ্ভ্রান্তের মত এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে, টলমল পায়ে পৌঁছে গিয়েছিল শহরের শেষ প্রান্তের রাস্তায়। এমন সময় হঠাৎ মুষলঝাড়ে বৃষ্টি নেমে এল। রাস্তা একেবারে জনমানবশূন্য। এমন সময় হঠাৎই সঞ্জয়ের পেছন ঝড়ের গতিতে ধেয়ে এল একটি দামী গাড়ি। গাড়ি চালক বোধহয় এত বৃষ্টির মধ্যে সঞ্জয়কে আগে থেকে দেখতে পায়নি। তাই অল্প দূরত্বে তাকে দেখে হঠাৎ ব্রেক কোষে ধরে। আর তারপরই ঘটলো বিপত্তিটা। গাড়ির আওয়াজে সচকিত হয়ে টলমল পায়ের লাফ মেরে কিঞ্চিৎ দূরে সরে গেল সঞ্জয়। রাস্তায় পড়ে গিয়ে অল্প চোট লাগল তার শরীরে। কিন্তু গাড়িটা যেন হঠাৎ ব্রেকের ঝোঁক সামলাতে না পেরে এক পাশে হেলে গিয়ে সজোরে বাড়ি খেল রাস্তার ধারে থাকা একটি গাছের সাথে। ড্রাইভারের পাশের জানলার কাঁচ ভেঙে গিয়ে গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল গাছের কিছু ডালপালা। গাড়ির ভেতর থেকে একটি মেয়ের চেনা গলার আওয়াজ শুনতে পেল সঞ্জয়, “চন্দন…চন্দন কি হল তোমার?” কিন্তু তার কিছু পরেই স্তব্ধ হয়ে গেল সেই কন্ঠ। ঘটনার আকস্মিকতায় যেন সব নেশা উবে গেল সঞ্জয়ের মস্তিস্ক থেকে। সে ছুটে গেল গাড়িটার দিকে। গাড়ির ভেতরে এক অচেনা সুদর্শন যুবক রক্তাক্ত অবস্থায় স্টিয়ারিংয়ের ওপর মাথা রেখে পড়ে আছে। আর তার পেছনের সিটেও আহত হয়ে যে মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে রয়েছে…সে আর কেউ নয়, অপর্ণা। সঞ্জয় তার নেশাতুর লাল হয়ে যাওয়া চোখের ক্রুর দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে রইলো ওদের দিকে।***
নার্সিং হোমের অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অস্থিত চিত্তে অপেক্ষা করছিল অপর্ণা এবং চন্দনের পরিবার। অবশ্য আরো একজনও সেখানকার চেয়ারে মাথা নত করে বসে ছিল, সে হল সঞ্জয়। অপর্ণার আঘাতটা তেমন গুরুতর নয়, সে আগেই সুস্থ হয়েছে। কিন্তু চন্দনের অবস্থা বেশ ক্রিটিক্যাল। মাথায় বড্ড গুরুতর জখম হয়েছে তার, হয়েছে অধিক মাত্রায় রক্তক্ষরণ। তাই তার অপারেশন চলছে এই সময়। তার মা বাবা কান্না ভেজা গলায় এক মনে ভগবানকে ডেকে যাচ্ছিলেন। বিয়ের আগে হবু স্ত্রীকে নিয়ে একটু বেরিয়েছিল চন্দন, তাতে এ কী বিপত্তি! অপর্ণার মা বাবা ক্রমাগত সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছিলেন ওদেরকে। এমন সময় নিভে গেল ও.টির লাইট। ডাক্তার বাবু বেরিয়ে এসে হাসিমুখে চন্দনের মা বাবাকে বললেন,
– “অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে! আপনার ছেলে এখন আউট অফ ডেঞ্জার! আর কয়েকটা দিন ওকে একটু অবসার্ভেশনে রেখে আশা করি আমরা রিলিজ করতে পারব!”
সকলের মুখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফুটে উঠল। ডাক্তার বাবুকে ধন্যবাদ দিতে দিতে আর ঈশ্বরের নাম করতে করতে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন চন্দনের বাবা মা। এমন সময় ওদের সকলকে অবাক করে ডাক্তার বাবু বলে উঠলেন,
-“ধন্যবাদ যদি দিতেই হয় তাহলে সঞ্জয় বাবুকেও দিন! কারণ সঠিক সময়ে যদি এম্বুলেন্স ডেকে পেশেন্ট দুজনকে উনি এখানে না আনতেন, আর চন্দন বাবুর অপারেশনের জন্য উনি নিজের রক্ত না দিতেন, তাহলে হয়তো আপনাদের ছেলেকে আমাদের পক্ষে বাঁচানো সম্ভব হত না! সত্যি মানুষের মত কাজ করেছেন সঞ্জয় বাবু…ব্রাভো ইয়ং ম্যান!”
ডাক্তার বাবুর কথা শুনে সকলে বিস্ময় তথা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে রইল সঞ্জয়ের দিকে।কয়েক দিন আগেই রিলিজ দেওয়া হয়েছে চন্দনকে। এখন সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ সে। অপর্ণা তো আগেই সুস্থ হয়ে উঠেছিল। আজ চন্দনের আহ্বানে অপর্ণা এবং তার মা বাবা এসেছেন তাদের বিশাল বড় বাড়িটাতে। ওরা সকলেই দেখলো যে অনাহুত অতিথির মত সেখানে ডাকা হয়েছে সঞ্জয়, বিনোদ বাবু আর নীলিমা দেবীকেও। সকলে একত্রিত হলে চন্দন বলে উঠলো,
– “আজ আপনাদের চোখে থাকা একটা মস্ত বড় ভুলকে আমি ভেঙে দিতে চাই। অপর্ণা আমাকে কোন কথা গোপন করেনি, সঞ্জয়ের সাথে ওর একটা সম্পর্ক ছিল জেনেও আমি ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি…এটা ভেবে যে ছেলেটা সত্যিই হয়তো অমানুষ, সে ডিসার্ভ করে না অপর্ণাকে।”
চন্দন কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল সঞ্জয়ের দিকে। জল ভরা চোখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সঞ্জয়। চন্দন গিয়ে সঞ্জয়ের দুই কাঁধ ধরে মুখে প্রসন্নতার হাসি নিয়ে বললো,
– “কিন্তু জীবনে বড় হওয়ার পরীক্ষায় পাশ না করলেও, সব চেয়ে বড় মনুষ্যত্বের লড়াইয়ে যে জিতে গিয়েছে সঞ্জয়। অপর্ণাকে ও ভালোবেসেছিল, কিন্তু তার বদলে লাঞ্ছনা আর অপমান ছাড়া ওর ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। অপর্ণার সাথে তার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল, কিন্তু তাতে তো অপর্ণারও মত ছিল! তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই ওর আমাকে এখন ঈর্ষা করা উচিত কারণ আমিই যে কেড়ে নিতে চলেছি ওর প্রেমিকাকে। তাই সেদিন গাড়ি এক্সিডেন্টের পর ওর কাছে সুযোগ ছিল আমাকে আর অপর্ণাকে ওই স্থানেই মরণের মুখে ফেলে কেটে পরার। কিন্তু ও সেটা করেনি, নিজের সমস্ত মান অভিমান ভুলে আমাদের নার্সিং হোমে পৌঁছে দিল সে, এমনকি নিজের রক্ত দিয়ে আমার জীবন পর্যন্ত বাঁচালো সে! হয়তো সে ভেবেছিল অপর্ণা সত্যিই সুখে থাকবে আমার কাছে! সত্যিকারের মনুষত্ব আর অপর্ণার প্রতি গভীর ভালোবাসার এর থেকে বেশি কোন প্রমাণের দরকার হয়না। তাই আমি ঠিক করেছি, অপর্ণার সাথে আমার নয়, বিয়ে হবে সঞ্জয়ের। তাছাড়া আমার অফিসে আমাকে এসিস্ট করার জন্য একজন কর্মচারীকে নিয়োগ করার কথা চলছে, সেই পজিশনে আমি সঞ্জয়কে নিযুক্ত করব। আমার বিশ্বাস আমি ওকে ঠিক গড়ে পিটে তুলতে পারব যাতে ও জীবনে আমার মতই সাফল্য অর্জন করে। কি অপর্ণা, এবার খুশি তো?”অপর্ণা চোখের জল মুছে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি দিয়ে দেখতে লাগল চন্দনের দিকে। সকলে অবাক হয়ে দেখলো চন্দন অপর্ণার হাতটা গুঁজে দিল সঞ্জয়ের হাতের মধ্যে। দুজনেই বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো একে অপরের দিকে। চন্দন যেন মনে মনে বলে উঠলো,
– “শুধু মনুষত্বের পরীক্ষায় তুমি একা পাশ করবে আর আমি হেরে যাব, তা কি করে হয় সঞ্জয়? তাই এত কিছু হওয়ার পর অপর্ণাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আমিও জিতে গেলাম নিজের বিবেকের কাছে…প্রমাণিত হল যে তোমার মত আমিও অমানুষ নই!”(সমাপ্ত)
-
গল্প- সারপ্রাইজ
সারপ্রাইজ
– প্রলয় কুমার নাথশাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরল অর্ণা। একে অসহ্য গরম, তারপর ফিরতি পথে অসম্ভব ভিড় বাসে লেডিস সিটেও বসার জায়গা পায়নি সে। বাথরুম থেকে বেরোতেই তার বিধবা শাশুড়ি প্রভাদেবী এসে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
– “আমার পুজোর জিনিসপত্রগুলো এনেছো তো বৌমা? কই কোথাও দেখছি না তো…”
অর্ণা জিভ কেটে বললো,
– “এই যাহ্, একেবারে ভুলে গিয়েছি মা…আসলে আজ ফিরতি পথে তাড়াহুড়ো করে ব্যাংকে গিয়ে মামের স্কুল ফিসটা দিতে হল যে, আজই যে এই মাসের লাস্ট ডেট ছিল ফিস জমা দেওয়া…তাই…”
ঠিক এই সময় মায়ের পিছু পিছু সেখানে হাজির হল অর্ণার অবিবাহিত ননদ সোহিনী, ওদিকে প্রভাদেবী মুখ ভেঙচে বলে উঠলেন,
-“বাহ্ মামের স্কুলের মাইনের জন্য আমার পুজোর কথা তোমায় মনেই রইলো না…কাল বাদে পরশু পুজো, এখন এই শরীরে আমি নিজে হাতে কি করে…”
অর্ণা প্রভাদেবীকে যথাসাধ্য বোঝাবার চেষ্টা করে বললো,
– “ছি মা, এ কি বলছেন…আপনার পুজো তো পরশু দিন, তাই না? আমি কালই সব পুজোর জিনিস অফিস ফিরতি পথে কিনে এনে বাড়ি ঢুকবো…”
এই কথা শুনে প্রভাদেবী কতটা প্রসন্ন হলেন জানি না, হয়তো তিনি আরো কিছু বলতে চলেছিলেন, কিন্তু তার আগেই মায়ের পিছন থেকে সোহিনী ফুট কেটে বললো,
– “থাক মা থাক…আসলে বুঝতে পারছো না, মেয়ের থেকে কি আর তুমি আমি বৌদির কাছে আপন হতে পারবো কোনোদিন? চল এখান থেকে, আর ওর সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই…”
অর্ণা ওদের বাধা দিয়ে কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ওরা সেখান থেকে চলে গেল। অর্ণা শুনতে পেল যে যেতে যেতে প্রভাদেবী শাড়ির আঁচলে চোখ ঢেকে বলছেন,
– “সাধে কি আর লোকে বলে বাড়ির বউ যদি বাইরে বেরিয়ে পয়সা রোজগার করে তাহলে ধরাকে সরা জ্ঞান করে…ও কেন মনে রাখবে আমার পুজোর কথা…এ যদি আমার সমু আজ অফিসে যেতে পারতো, অর্থ উপার্জন করতে পারতো, তাহলে কি কখনো মা কিছু চাইলে তা ভুলে যেতে পারতো?”কথাগুলো যেন সূঁচের মত বিধল অর্ণার কানে। সত্যিই কি মেয়েরা অর্থোপার্জন করলে স্বার্থপর হয়ে ওঠে? কি জানি, তবে সে অন্তত তেমন নয়। আজ প্রায় বছর খানেক হল অর্ণার উপার্জনে এই সংসার চলছে। কখনো কি ভেবেছিল সে যে এমন দিনও তাকে দেখতে হবে? কত আশা নিয়ে, চোখে কত স্বপ্নের জলছবি এঁকে সে এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছিল। স্বামী সৌমেন্দ্র পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, একটি সুবিশাল মাল্টি-ন্যাশনাল ফার্মে উচ্চ-পদে কর্মরত। নিতান্ত সময় কাটানোর জন্যই একটি প্রাইভেট ফার্মে রিসেপশনিস্টের চাকরিটা নিয়েছিল অর্ণা। বিয়ের পরপর এই বাড়ির সকলে তাকে কত স্নেহ করত, সবকিছু যেন স্বপ্নের মতই মনে হচ্ছিল তার। বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই তাদের কোল আলো করে এল মাম। সেদিন থেকেই তার ওপরে কেমন যেন বিষিয়ে উঠতে থাকলেন প্রভাদেবী, তার যে ছিল নাতির মুখ দেখার খুব সাধ। তবে অর্ণার স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিবর্তিত হতে লেগেছিল আরো বেশ কিছু বছর…যেদিন ঘটলো সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটা! ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের কাজ দেখানোর সময় অসাবধানতাবশত একটি উঁচু জায়গা থেকে পড়ে গিয়েছিল সৌমেন্দ্র। এতে তার জীবনহানি না হলেও সারা জীবনের জন্য অকেজো হয়ে গেল তার দুটি পা! তারপর আর কি, প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি, তারা তো আর বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দিয়ে যাবে না। কিছু দিন একটু মায়া দয়া দেখিয়েছিল তারা সৌমেন্দ্রকে, অবশেষে তার জায়গায় নতুন লোক দেখতে শুরু করল!
– “মা, ওই পাখি দিয়ে গুলটি মারার গেমটা চালিয়ে দাও না…”
ছোট্ট মামের কচি গলার আওয়াজ পেয়ে বেডরুমে এগিয়ে গেল অর্ণা। বিছানার উপর বসে মাম প্রতিদিনের মতই তার ফোন নিয়ে ঘাঁটছে। আর প্রতিদিনের মতই পুব দিকের জানলা দিয়ে আকাশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে হুইলচেয়ারের ওপর চুপ করে বসে আছে সৌমেন্দ্র। একটা সৌখিন হাসি খুশি মানুষের জীবনে কতটা বিপর্যয় ঘটলে তার মধ্যে এমন আমুল পরিবর্তন আসতে পারে তা সৌমেদ্রকে না দেখলে বোঝা যাবে না। এখন কারোর সাথে কথা বলা তো দূর, পাঁচবার ডাকলে যেন তবে একবার সাড়া দেয় সে। নিজের দুই পায়ের মত নিজেকেও এই সংসারে নিতান্ত অকেজো একটি জঞ্জাল ছাড়া যেন কিছুই ভাবতে পারে না সে। অর্ণা হাসিমুখে মেয়ের কাছে এসে ফোনটা নিয়ে আনলক করে ‘Angry Birds’ গেমটা চালাতে যাবে এমন সময় দেখলো আবার তার অফিসের বস রজত পাল তাকে বেশ কয়েকটা ‘Whatsapp’ মেসেজ পাঠিয়েছেন। সেই একই কথা বারবার…’কি হল? আর কত সময় নেবে? ভেবে দেখলে আমার প্রস্তাবটার ব্যাপারে?’ হাসিমুখটা গম্ভীর হয়ে গেল অর্ণার, সে কোন রিপ্লাই না করে গেমটা চালিয়ে ফোনটা এগিয়ে দিল মামের কাছে।মুহূর্তের মধ্যে রজত পাল নামক এক বছর পঞ্চাশের কামুক ব্যক্তির মাথা ভর্তি টাক আর মসৃণ করে কমানো ওই ধূর্ত মুখটার ছবি ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। লোকটার স্ত্রী এবং দুই ছেলে বর্তমান, তবুও এখনো অল্প-বয়সী মেয়ে দেখলে নোলা সরসর করে। এই নিয়ে গোটা অফিসে তার বদনাম কিন্তু উচ্চপদ এবং কোম্পানির মালিকের নিকট আত্মীয় হওয়ার সুবাদে তিনি সেই সব কথা কখনো নিজের গায়েই মাখেন না। সৌমেন্দ্রর পঙ্গু হয়ে যাওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই তার কুদৃষ্টি পড়েছে অর্ণার ওপর। বারে বারে নানা দিন নানা অছিলায় নিজের কেবিনে ডেকে সেই একই প্রস্তাব তিনি তাকে দিয়ে চলেছেন…অর্ণা যেন তার পঙ্গু স্বামীকে ডিভোর্স করে তার সাথে তার বাংলোয় এসে ওঠে! তার ওই পঙ্গু স্বামী কি দিতে পারবে তাকে? আর্থিক স্বচ্ছলতার কথা না হয় বাদই দিলাম…শারীরিক সুখ, সেই চাহিদাও কি এই অবস্থায় ঠিক মত মেটাতে পারছে সে? তাই অর্ণা যেন তার কাছে এসে থাকে, তার মত সুন্দরীকে সোনায় মুড়িয়ে একেবারে রাজরানী করে রাখবেন রজত…ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথম প্রথম এইসব শুনে হকচকিয়ে উঠত অর্ণা, কিন্তু পরে যেন এইসব গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। তবে সে এইটুকু বুঝেছে যে এই মানুষটাকে চটালে তাকে এই অফিস থেকে পাততাড়ি গোটাতে হবে, আর এমন হলে তার সংসারের হাড়ি চড়বে কি ভাবে? তাই সে রজতবাবুর সকল বেয়াদবি মুখ বুজে সহ্য করছে, ভাবার জন্য সময় চেয়ে নিচ্ছে…কিন্তু এইভাবে আর কতদিন চালাতে পারবে সে?
এত ক্লান্ত হয়ে ফিরেও যেন রাতে দুইচোখের পাতা এক করতে পারছে না অর্ণা। কাল অফিসে গেলে আবার ওই রজত পালের কুপ্রস্তাব সহ্য করতে হবে, বাড়ি ফিরলে মা বা ননদের সকল ফরমাশ পূরণ করলেও কোন না কোন ভাবে ওরা তাকে অপদস্থ করবেই…এই যেন তার নিত্যদিনের রুটিন। মাঝে মাঝে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা করে অর্ণার। কিন্তু পারে না শুধু তার কথা ভেবে যে এখন বিছানায় তার আর সৌমেন্দ্রর মাঝে শুয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোচ্ছে…তার ছোট্ট সোনা, মাম…তার নয়নের মণি…তাকে বড় করার জন্য, মানুষের মত মানুষ করার জন্য হাজার লাঞ্ছনাও সহ্য করে নেবে অর্ণা! অদূরে দেওয়াল ঘড়িতে ঢং করে রাত বারোটা বেজে উঠল। ঠিক এমন সময় অর্ণাকে অবাক করে হঠাৎ সৌমেদ্র বলে উঠলো,
— “অনু…আজ কত তারিখ বলো তো?”
এই সময় এমন বিচিত্র প্রশ্ন শুনে বিস্মিত স্বরে অর্ণা বললো,
– “কেন ওই এগারো…না, এখন তো বারোটা বেজে গেল…তাহলে আজ ওই বারোই জুন…হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”
– “সেটা নিজেকেই একবার জিজ্ঞাসা করে দেখ, উত্তর পাবে!”
হ্যাঁ, একটু ভেবেই উত্তর পেল অর্ণা। আসলে সবসময় পরিবারের অন্যদের সম্বন্ধে ভেবে ভেবে কখন যেন নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভুলেই গিয়েছে সে। তার মনেই ছিল না যে আজ হল তার জন্মদিন। এবার অর্ণাকে আরো অবাক করে হঠাৎ সৌমেন্দ্র আঁকড়ে ধরল অর্ণার ডান হাতটা, তারপর মৃদু স্বরে বললো,
– “কি ভাবছো হ্যাঁ? তোমার স্বামী হাঁটতে পারে না, কোন উপার্জন তার নেই, তাই বলে কি সে তার স্ত্রীকে জন্মদিনে কোন সারপ্রাইস গিফ্টও দিতে পারে না?”
– “ম…মানে? তুমি আমার জন্য স…সারপ্রাই গিফ্ট কিনেছো?”, অপার অবিশ্বাস অর্ণার গলায়।
-“ওঠো…ঘরের আলো জ্বালাও…আলমারিটা খুলে নিচের দিক থেকে ডান দিকের দুই নম্বর তাকে দেখো!”
অর্ণা তখনই উঠে ঘরের আলো জ্বালিয়ে আলমারি খুললো। নির্দিষ্ট তাকে দেখল উপহার দেওয়ার রঙিন মোড়কে বাধা রয়েছে কোন পাতলা বস্তু…কি এটা? এতক্ষন অর্ণা ভাবছিল যে হয়তো কোন সস্তার শাড়ি বা অন্য কিছু সৌমেন্দ্র তার জন্য কিনে রেখেছে…এখন তো মনে হচ্ছে এটা তাও নয়! হয়তো কোন বার্থডে উইশ লেখা কার্ড এটা…তবুও অর্ণা হাসিমুখে ঝলমলে মোড়কটা খুলতে শুরু করলো।***
পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে পৌঁছে সোজা রজত পালের চেম্বারে ঢুকল অর্ণা। রজতবাবু অপর এক ম্যানেজারের সাথে সেই সময় কথাবার্তা বলতে ব্যস্ত ছিলেন। অর্ণাকে নিজের ইচ্ছায় তার কেবিনে আসতে দেখে তিনি মুখে এমন অভিব্যক্তি করলেন যেন দেখে মনে হল ‘এ তো মেঘ না চাইতেই জল!’ তিনি তখনই অপর ব্যক্তিটির কাছ থেকে সাময়িক বিরতি চেয়ে নিলেন। তিনি চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলে হাসিমুখে অর্ণা এগিয়ে গিয়ে বসল রজত বাবুর ঠিক সম্মুখে। তারপর রজতের চোখে চোখ রেখে সে বললো,
– “আমি অনেক ভেবে দেখলাম আপনার প্রস্তাবটার সম্বন্ধে, স্যার…হ্যাঁ, সত্যি আপনি একেবারে হক কথা বলেছেন…ওই পরিবারে ওই পঙ্গু স্বামীর কাছে থেকে আমি জীবনে কোন সুখই পাবো না, উপরন্তু আমাকেই ওদের চোদ্দ গুষ্টির পেটে ভাত যোগাতে হবে!…তবে আমি একটু জানতে চাই আপনি আমার জন্য ঠিক কি কি করতে পারবেন?”
অর্ণার গলায় এই সুর শুনে গেল রজতবাবুর চিত্ত গদগদ হয়ে উঠল। তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন,
– “আরে তুমি বলো না কি করতে হবে? সোনা দানা যা চাও সব! তোমার মেয়েরও দায়িত্ব নেব আমি। এই শহরে আমার চারটে বাংলো আছে তার মধ্যে একটা পুরো তোমার নামে করে দেব…গাড়িও আছে তিনটে, তার মধ্যেও একটা…”
তার কথা শেষ না হতেই অর্ণা বললো,
– “দাঁড়ান মিস্টার পাল, আমি কি চাই জানেন? ঠিক যেমন আমি সৌমেন্দ্রকে ডিভোর্স করে ওই পরিবারের সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে আপনার কাছে আসব, আমাকে পেতে গেলে আপনাকেও আপনার স্ত্রীকে ডিভোর্স করে পরিবারের সাথে সকল সম্পর্ক শেষ করে আমার কাছে আসতে হবে…বলুন আপনি রাজি?”
মুহূর্তের মধ্যেই পাংশুবর্ণ ধারণ করলো রজতবাবুর মুখ।
– “সে কি! এ কি বলছ তুমি…ওর সাথে সম্পর্ক শেষ করব কি করে আমি? আইনত সে আমার স্ত্রী, আমার দুই সন্তানের মা!”
– “তাহলে আমি আপনার কে হতে চলেছি, মিস্টার পাল?” তারস্বরে চিৎকার করে উঠল অর্ণা, “রক্ষিতা?”
অর্ণার কন্ঠস্বর যেন বন্ধ কেবিনের বাইরেও এসে পৌঁছলো বাকি সকল কর্মচারীদের কানে। রাগে লাল হয়ে উঠল রজতবাবুর মুখ। তিনি লাজলজ্জা ভুলে উদ্ধত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন,
– “তোমার মত পঙ্গু স্বামীর সুন্দরী অভাগিনী স্ত্রী আর হতেও বা কি পারে বলো? কোন বড়লোকের রক্ষিতা ছাড়া?”খিলখিল করে হেসে উঠল অর্ণা। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সে বলতে শুরু করলো,
—– “কাল রাতে আমার জন্মদিন উপলক্ষে আমার ওই পঙ্গু স্বামী আমাকে একটি সারপ্রাইস গিফ্ট দিয়েছে…কোন দামী শাড়ি বা গহনার থেকে আমার কাছে যার মহত্ব আরো অনেক বেশি…এই দেখুন সেটা কি…”
এই বলে অর্ণা তার হাতে ধরা একটি চ্যানেল ফাইল এগিয়ে দিল রজত পালের কাছে। বিস্মিত মুখে রজত বাবু ফাইলটা উল্টে পাল্টে দেখতে থাকলেন, ওদিকে অর্ণা বলেই চললো,
– “হ্যাঁ, এই কথা সত্য যে আজ এক বছর আমার স্বামী পঙ্গু। কিন্তু আমি তার চিকিৎসার কোন খামতি রাখিনি। নিজের স্বল্প উপার্জনের অর্ধেকটাই খরচা করেছি ওর চিকিৎসার ওপর। ডাক্তার, ও নিজে এবং ওর বাড়ির লোকেরা হাল ছেড়ে দিলেও আমি ছাড়িনি। গত সপ্তাহে ওর কয়েকটি টেস্ট করানো হয়েছিল, সেই টেস্টের রিপোর্ট কাল পৌঁছেছে ওর কাছে। খুব আশ্চর্যজনক ভাবে হঠাৎ করেই ওর খোঁড়া দুই পায়ের অবস্থার দ্রুত উন্নতি হতে শুরু করেছে। সেই রিপোর্ট ও মেল করেছিল অর্থোপেডিক ডাক্তার বাবুকে যার কাছে ও চিকিৎসারত। তিনিও যারপরনাই বিস্মিত হয়েছেন এই রিপোর্ট দেখে, বলেছেন এটা ভগবানের আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছু নয়। এখন তিনি নিশ্চিত আর দুই তিন মাসের মধ্যেই সৌমেন্দ্র আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।”
– “কি বলছ তুমি!” রজতবাবু গলায় বিস্ময়ের সুর।
– “শুধু তাই নয়…এই কথা সৌমেন্দ্র ওর পুরোনো অফিসেও জানিয়েছে। ওখানে সে বরাবরই খুব সুনামের সাথে কাজ করে এসেছে, তাই তারাও ওর কথা ভেবে ওকে লিখিত ভাবে জানিয়েছে যে নির্দিষ্ট সময়ে সুস্থ হয়ে উঠলে ও আবার কাজে যোগদান করতে পারবে। ওর চাকরি বজায় থাকবে!”নতমুখে ফাইলের পাতা উল্টে চলেছিলেন রজতবাবু। কিছুক্ষণ পর আবার বলতে শুরু করল অর্ণা,
– “এবার শেষ সুখবরটাও দিয়ে ফেলি আপনাকে। কয়েকমাস আগে একটি টিভি চ্যানেল তার লাইভ শো-এর অ্যঙ্কর চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল…আমি গিয়েছিলাম অডিশনে। তবে সেখানকার বিপুল সংখ্যক চাকরিপ্রার্থী দেখে এক কথায় ছেড়েই দিয়েছিলাম ওখানে চাকরি পাওয়ার কোনো আশা…কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস দেখুন, আমার ভাগ্যেই জুটে গেল চাকরিটা! সেখানকার অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটাও কালকেই এসে পৌঁছেছে আমার বাড়িতে। তাই নিজের ডাক্তারি রিপোর্টের সাথে এটাকেও সৌমেন্দ্র রেখেছিল আমার সারপ্রাইজের মোড়কের ভেতর। আর একমাস পরই ওখানে আমার জয়নিং। তাই বুঝতেই পারছেন আমার মত পঙ্গু স্বামীর সুন্দরী অভাগী স্ত্রী কোন বড়লোকের রক্ষিতা ছাড়াও আর কি হতে পারে!”
এই বলে এক ঝটকায় ফাইলটা রজতবাবুর হাত থেকে কেড়ে নিল অর্ণা। তারপর ফাইলের শেষ পাতাটা বার করে ছুঁড়ে মারল তার মুখের ওপর। শান্ত নিরুদ্বিগ্ন কন্ঠস্বরে অর্ণা বলে উঠল,
– “এটা কিন্তু ছিল না ওই মোড়কের ভেতর। এটা আমার নিজের হাতে লেখা, যা দিয়ে আমি আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চাই মিস্টার পাল…এটা আমার রেসিগনেশন লেটার!”
রজতবাবু বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলেন অর্ণার দিকে।***
বাড়ির ডোরবেল বাজাতে প্রভাদেবী এসে দরজা খুললেন। ক্লান্ত বিধ্বস্ত অর্ণা বাড়ির ভেতরে ঢুকতে গিয়েও হঠাৎ প্রভাদেবীকে দেখে জিভ কেটে বলে উঠল,
-“এই যাহ্…আজকেও ভুলে গেলাম আপনার পুজোর জিনিসগুলো আনতে, মা!…আচ্ছা, আমি এখুনি সামনের বাজারটা থেকে…”
অর্ণার কথা শেষ না হতেই প্রভাদেবী হাসিমুখে তার হাত ধরে তাকে ঘরে টেনে এনে বললেন,
– “তার আর কোন দরকার নেই, মা! আমাদের পরিবারের মা লক্ষী যে আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে…তাকে পুজো করতে ফুল, ফল, মিষ্টি লাগে না…লাগে শুধু একটু মেয়ের প্রতি মায়ের আদর আর ভালোবাসা.. আমার এমনই পোড়া কপাল, যে তা থেকে আমি এতদিন তাকে বঞ্চিত করে এসেছি!”
– “এ কি বলছেন মা!” অর্ণার কণ্ঠে বিস্ময়।
সেই সময় সোহিনী পাশ থেকে এসে বললো,
– “মা, ঠিকই বলছে বৌদি। দাদার এক্সিডেন্টের পর তুমিই এই সংসারের কান্ডারী হয়েছ, আমাদের এতগুলো পেটে অন্ন জুগিয়ে এসেছ। আর আমরা কিনা তোমাকেই কথায় কথায় অপমান করেছি, ছোট করেছি। দাদার সাথে আমাদের রক্তের সম্পর্ক থাকলেও আমরা ওর ব্যাপারে হাল ছেড়েই দিয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আশা ছাড়োনি। নিজের উপার্জনের অর্ধেকেরও বেশি অংশ দিয়ে তার চিকিৎসা করিয়ে গিয়েছো। তাই হয়তো তোমার এই অসাধারণ জেদ, সহনশীলতা এবং একাগ্রতার ফলেই ভগবান খুশি হয়ে দাদাকে সুস্থ করতে চলেছেন। তাই আমাদের কাছে তোমার স্থান ভগবানের কাছেই বৌদি…পারলে আমাদের ক্ষমা করো।”
অর্ণা “ধুর পাগলী!” বলে সোহিনীকে বুকে টেনে নিল। প্রভাদেবী প্রসন্ন চিত্তে শাড়ির আঁচলে নিজের চোখ মুছলেন। অর্ণা দেখলো যে, বেডরুম থেকে মামও ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। হুইলচেয়ারের হাতল ঘুরিয়ে বেরিয়ে এল সৌমেন্দ্রও। নিজের সহধর্মিণীর প্রতি অগাধ ভরসা, বিশ্বাস এবং ভালোবাসা যেন ঝলকে উঠছে তার দুই জল ভরা চোখে।(সমাপ্ত)