-
গল্প – শাশুড়ি মা
শাশুড়ি মা
-প্রলয় কুমার নাথচারিদিকে উলু আর শঙ্খ ধ্বনির মাঝে সাদা কাপড়ের ওপর দুধে-আলতা মাখা পা ফেলে নববধূর বেশে ধীরে ধীরে শ্বশুরবাড়ির ভেতর প্রবেশ করছিল মঞ্জরী। পাশে তার নতুন বর পলাশ। পলাশের বাবা নেই, তার মা হিরণ্ময়ী দেবীই হলেন এই বাড়ির কর্ত্রী। অনেক পুরুষ ধরেই পলাশদের বনেদি কাঠের ব্যবসা রমরমিয়ে চলেছে। অর্থ আর প্রতিপত্তিতে ভরপুর হিরণ্ময়ী দেবীর সংসার। তাদের এই সুবৃহৎ তিনতলা বাড়িটাকে এই পাড়ার সকলেই চৌধুরী বাড়ি হিসাবে চেনে। পলাশের বাবা শশধর চৌধুরী কয়েক বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে যান। এদিকে পলাশ ততদিনে ইঞ্জিনিয়ারিং পরে সল্ট লেকের একটি বড় আই.টি কোম্পানিতে উচ্চপদে কর্মরত। তাই স্বামীর মৃত্যুর পর হিরণ্ময়ী দেবীই তাদের পারিবারিক ব্যবসার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন। মঞ্জরীর মা বিমলা দেবী ছিলেন হিরণ্ময়ীর ছেলেবেলার সই। তার মেয়ে হওয়ার পর হিরণ্ময়ী দেবী ঠিক করেই রেখেছিলেন যে ওই মেয়ের সাথে পলাশের বিয়ে দেবেন। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে মঞ্জরীর ভাগ্য খারাপ। তার বাবা মা তো অনেক আগেই মারা গিয়েছেন, এবং এতদিন সে যেন ছিল তার দুই দাদার চোখের কাঁটা। তাকে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়াতে পেরে ওর দাদারা যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। মঞ্জরীর গায়ের রঙটা একটু চাপা হলেও ছোটবেলা থেকেই তার মুখশ্রী একেবারে দেবী প্রতিমার মত। অবশ্য ছেলের বিয়ে দেওয়ার আগে পলাশের মতামতও নেন হিরণ্ময়ী দেবী, তারও মঞ্জরীকে পছন্দ হয়েছিল। তাই বলতে গেলে এক কাপড়েই মঞ্জরীকে এই বাড়ির বউ করে এনেছেন হিরণ্ময়ী দেবী। নিজের সই-এর মেয়েকে যেন নিজের মেয়ের মতই ভালোবাসেন তিনি।
বিয়ের পরে মঞ্জরীর জীবনের কয়েকটা বছর যেন স্বপ্নের মত কেটেছিল। তার ছোটবেলাটা অভাব অনটন এবং দুই দাদা বৌদির চক্ষুশূল হয়েই কেটেছে, তাই বিয়ের পর এই নতুন বাড়িতে এত প্রাচুর্যের মধ্যে এসে, এত ভালো স্বামী এবং শাশুড়ি পেয়ে সে যেন নিজের ভাগ্যকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। এই বাড়িতে তার সব থেকে আপন হল তার শাশুড়ি মা হিরণ্ময়ী দেবী। ছোটবেলাতে মাকে হারানো মেয়েটা যেন নতুন করে ফিরে পেয়েছে তার মাকে। সবই ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু তারপরই মঞ্জরীর ভাগ্যে দেখা দিল ভয়ানক বিপর্যয়। তার স্বামী পলাশ যেন কেমন বদলে যেতে লাগল। প্রথম প্রথম মঞ্জরীকে সময় কম দিতে লাগল সে। অফিস থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরতে লাগল। প্রায়দিনই বাইরে থেকে খেয়ে আসত সে। তারপর রাতে কিছুক্ষন অফিসের ল্যাপটপে মুখ গুজে বসে কি সব করে হারিয়ে যেত ঘুমের দেশে। নিজেকে বড্ড একা লাগত মঞ্জরীর, স্বামীর আদর পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে থাকত সে, কিন্তু পলাশ যেন তার দিকে ফিরেও তাকাতো না। এরপর পলাশের মঞ্জরীর প্রতি উদাসীনতা যেন ধীরে ধীরে রূঢ়তার রূপ নিতে থাকল। এখন ছোটখাটো বিষয়েই তার সাথে ঝগড়া করে পলাশ। মাঝে মাঝেই বেডরুমে রাখা সোফাতেই শুয়ে রাত কাটাতে হয় মঞ্জরীকে। এমনই সময় নিজের শরীরের মধ্যে অপর একটি প্রাণের উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারে মঞ্জরী। এখনো অবধি স্বামীর সাথে এই দূরত্বের কথা হিরণ্ময়ী দেবীকে জানায়নি মঞ্জরী, কিন্তু এর পর যা হল তাতে সে বাধ্য হল তা জানাতে।
গোপনে পলাশের মোবাইলের চ্যাট দেখে মঞ্জরী বুঝতে পারল যে তার স্বামীর পরকীয়া চলছে তার অফিসের এক মহিলা কলিগের সঙ্গে। সেই মহিলার নাম হল তৃনা। এই কথা জানাজানি হতেই পলাশের সাথে মন কষাকষি আরো বাড়ল মঞ্জরীর। পলাশ শুরু করল কথায় কথায় মঞ্জরী গায়ে হাত তোলা। মঞ্জরীর গর্ভে সন্তান আছে জেনে জোর করে পলাশ তার একজন চেনা ডাক্তার বন্ধুকে দিয়ে মঞ্জরীর গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করাল। জানা গেল যে মঞ্জরী একজন কন্যা সন্তানকে জন্ম দিতে চলেছে। তারপর থেকেই তার ওপর পলাশের শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করো বেড়ে চলল। পলাশ মঞ্জরীকে চাপ দিতে লাগল বাচ্চাটিকে এবোর্ট করতে, কিন্তু মঞ্জরী তাতে একেবারে রাজি হল না। এরপর থেকেই মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে এসে মঞ্জরীর ওপর পাশবিক অত্যাচার করতে লাগল পলাশ। তার জমায় লিপস্টিকের দাগ, মহিলা পারফিউমের গন্ধ ইত্যাদি আরো বেশি করে জানান দিত তার পরকীয়ায় লিপ্ত থাকার কথা। স্বাভাবিক ভাবেই মঞ্জরীর ওপর তার স্বামীর এই নির্যাতন চোখে পড়ল হিরণ্ময়ী দেবীর। তিনি কিন্তু অন্যান্য শাশুড়ির মত ছেলের দিকে হয়েই বৌমার প্রতি আরো অত্যাচার করতে শুরু করলেন না, বরং শক্ত হাতে পলাশের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে থাকলেন। পলাশের হাত থেকে অন্তঃসত্ত্বা মঞ্জরীকে আপ্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করতে লাগলেন।
কিন্তু একদিন প্রমাদ গুনতে হল হিরণ্ময়ী দেবীকে। সেদিন মদ্যপ পলাশ মায়ের বাধাও উপেক্ষা করে মঞ্জরীর গায়ে হাত তুলতে লাগল। চিৎকার করে বলতে লাগল,
— “আমি তোর সাথে থাকতে চাইনা বুঝলি মাগী…আমি তৃনাকে এই বাড়ির বউ করে আনতে চাই…তুই বেরো, দূর হ এই বাড়ি থেকে!”
এই বলে মায়ের সকল নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সে মঞ্জরীকে চুলের মুঠি ধরে তাকে দেওয়ালের দিকে ঠেলে দিল। মঞ্জরী আছড়ে পড়ল দেওয়ালের গায়ে, তার পেটে খুব জোরে আঘাত লাগল। তখনই তার যোনিপথ দিয়ে রক্ত ক্ষরণ হওয়া শুরু হল, যন্তনায় চিৎকার করতে করতে মেঝেতে পড়ে ছটফট করতে থাকল মঞ্জরী। নিজেকে আর সামলাতে না পেরে ছেলের গালে সটান এক থাপ্পড় কষান হিরণ্ময়ী দেবী। তখনই এম্বুলেন্স ডেকে মঞ্জরীকে হাসপাতালে পাঠান তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। মঞ্জরী প্রাণে বেঁচে গেলেও জন্মাবার আগেই চির বিদায় নিল তার গর্ভের কন্যাসন্তান। মঞ্জরীকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এসে পলাশের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে ওঠেন হিরণ্ময়ী দেবী,
— “তুই তাহলে তৃনার সাথেই নিজের ঘর বাঁধতে চাস, তাই তো? বেশ, তবে মনে রাখিস সেটা যেন এই বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে হয়! ভুলে যাস না এই বাড়ি, এই ব্যবসা সবই তোর বাবা আমার নামে করে গিয়েছেন…আজ এই সকল বিষয় সম্পত্তি থেকে তোকে আমি বঞ্চিত করলাম…তোকে ত্যাজ্য পুত্র করলাম আমি! যা বেরিয়ে যা এই বাড়ি থেকে, আজ থেকে জানব আমার কোন ছেলে নেই, শুধু একটিই সন্তান আছে আমার…আর সে হল মঞ্জরী। আমার সব বিষয় সম্পত্তি আমি তাকেই দিয়ে যাবো!”সদ্য সন্তান হারা মঞ্জরীও মেয়ের শোক ভুলে তার শাশুড়ি মায়ের এই ইস্পাত কঠিন রূপ দেখে অবাক হয়ে গেল। তার শাশুড়ি মা তাকে এতটাই স্নেহ করেন, যে তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য নিজের পেটের ছেলেকেও এত বড় শাস্তি দিতে পারেন! এমন কাজ করার সাহস আর কজন শাশুড়ি মা দেখাতে পারেন! নাহ, সত্যিই নিজের সিদ্ধান্ত থেকে অটুট থেকেছেন হিরণ্ময়ী দেবী। এই বাড়িতে থাকতে গেলে পলাশকে তৃনাকে ত্যাগ করতেই হবে। তবুও মঞ্জরীর সাথে থাকতে চাইল না পলাশ। শেষে আর কোন উপায় না দেখে এই বাড়ি, এই সমস্ত বিষয় আশয় থেকে বেরিয়ে গিয়ে তৃনার সাথে অন্যত্র সংসার পাতল সে। এই বাড়িতে শুধু রয়ে গেল এক ‘মা’ এবং তার ‘মেয়ে’। এমন ভাবেই কাটতে লাগল সপ্তাহ, মাস এবং বছর। বয়স্ক হিরণ্ময়ী দেবীর সকল দেখাশোনার ভার নিয়েছে মঞ্জরী। স্বামীকে হারিয়ে কিছুদিন চোখের জল ফেলেছিল সে, কিন্তু পরে বুঝতে শিখেছে যে যার কাছে তার নিজের কোন দাম নেই, তাকে দাম দিয়ে তার জন্য চোখের জল ফেলারও কোন দরকার নেই। এখন মঞ্জরীর সমস্ত সংসার জুড়েই আছেন হিরণ্ময়ী দেবী, মায়ের থেকেও সে যেন আরো বেশি আপন মঞ্জরীর কাছে।
তবে একটা অভাব মাঝে মাঝেই উপলব্ধি করে মঞ্জরী। এবং তা হল তার হারানো শিশুকন্যাটির অভাব। হিরণ্ময়ী দেবীও বুঝতে পারেন মঞ্জরীর মনের কথা, তাই তো এই বাড়িতেই একটা ছোটখাটো নাচের স্কুল খুলে দিয়েছেন তিনি। সেখানে নাচ শেখায় মঞ্জরী। ছোটবেলায় অভাবে অনটনে পড়াশোনা তেমন না শিখলেও, বাবা মা বেঁচে থাকতে নাচ শিখেছিল সে।
কত ছোট ছোট মেয়েরা এই স্কুলে নাচ শিখতে আসে। তাদের সকলকে পেয়ে যেন নিজের গর্ভের সন্তানটির শোক ধীরে ধরে ভুলতে শুরু করেছে মঞ্জরী। এমন সময় এই নাচের স্কুলে ভর্তি হয় টুম্পা নামের আট বছরের একটি ছোট্ট মেয়ে। তার বাবা অরুণকান্তি মজুমদার হলেন এই শহরের নাম করা ডাক্তার। দামী গাড়ি করে ওদের ড্রাইভার ওকে এই স্কুলে দিয়ে যায়, আবার সময়মত নিতে আসে। টুম্পাকে খুব সুন্দর দেখতে, যেন ছোট খাটো একটা পরী। মেয়েটাকে খুব স্নেহ করে মঞ্জরী। ওকে দেখে বারবার নিজের গর্ভের কন্যাসন্তানটার কথা মনে পড়ে তার। টুম্পা নাচে ভালোই পারদর্শী, কিন্তু মেয়েটা কেমন যেন একটু চুপচাপ। এই বয়সের অন্যান্য মেয়েদের মত এমন হাসিখুশি নয়। তার মনের খুব কাছে আসতে শুরু করে মঞ্জরী। টুম্পাও খুব ভালোবাসতে শুরু করে মঞ্জরীকে। একদিন নাচের ক্লাস হয়ে গেলে, টুম্পা কেন এত চুপচাপ এই কথা জিজ্ঞাস করাতে সে মঞ্জরীকে বলল,
— “জানো তো আন্টি, আজ এক বছর হল আমার মাম্মান নেই। কি যেন একটা রোগ হয়েছিল মাম্মানের তাই বাপি বলে মাম্মান ওই আকাশের তারা হয়ে গিয়েছে। আমার সকল বান্ধবীদের মাম্মান আছে, দেখো সবাইকে তাদের মাম্মানরা নিতে আসে, সকলে কি সুন্দর মাম্মানদের হাত ধরে বাড়ি ফেরে, কিন্তু আমি পারিনা! মাম্মানের কথা বড্ড মনে পড়ে জানো আন্টি…আমাকে খুব ভালোবাসত মাম্মান, ঠিক তোমার মত…তুমি কি আমার মাম্মান হবে আন্টি?”বলতে বলতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল টুম্পা। মঞ্জরী টুম্পার শেষের কথাগুলো শুনে একটু চমকে উঠল ঠিকই, কিন্তু পরমুহূর্তেই তাকে বুকে টেনে নিল। ঠিক সেই সময়ই নাচের ক্লাসরুমের দরজার কাছে চোখ গেল মঞ্জরীর। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং অরুনকান্তি বাবু। আজ ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে নিজেই মেয়েকে নাচের ক্লাস থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিলেন তিনি। টুম্পা এতক্ষন মঞ্জরীকে যা বলছিল তা সমস্তই শুনেছেন তিনি। তার কাছ থেকেই মঞ্জরী জানতে পারল যে অগ্নাশয়ে ক্যানসার হয়েছিল অরুণ বাবুর স্ত্রী সৌদামিনীর। যখন ধরা পড়েছিল তখন শেষ স্টেজ। তাই নিজে ডাক্তার হয়ে শত চেষ্টা করেও তিনি বাঁচাতে পারেননি নিজের স্ত্রীকে। ধীরে ধীরে অরুণ বাবুর সাথে মঞ্জরীর পরিচিতি বাড়তে থাকে। নিজের সম্বন্ধেও সমস্ত কথা সে বলে অরুণ বাবুকে। একদিন অরুণ বাবু টুম্পার মত মঞ্জরীকে বলেন,
— “টুম্পার কাছে মায়ের অভাব যেমন আছে, আপনারও তেমন জীবনে অভাব রয়েছে নিজের সন্তানের। আজ যদি আপনি আমার স্ত্রী হয়ে আমার বাড়িতে এসে টুম্পাকে নিজের সন্তানের জায়গায় বসাতে পারেন, তাহলে দুজনের অভাবই আর থাকে না। বলুন আপনি কি রাজি হবেন?”
মঞ্জরী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সুদর্শন অরুণ বাবুর দিকে। অতঃপর মাথা নত করে বলে ওঠে,
— “এত আমার পরম সৌভাগ্যের কথা অরুণ বাবু, যে আপনি আমাকে নিজের স্ত্রী মর্যাদা দিতে চাইছেন। আমিও টুম্পাকে নিজের মেয়ের মতই ভালোবাসি, আর সেও আমাকে মা হিসাবে পেতে চায়। কিন্তু এই বাড়ি ছেড়ে যে আমি যেতে পারব না অরুণ বাবু। আমার শাশুড়ি মা শুধু আমার শাশুড়ি নন, তিনি এখন আমার মা। তার সব দায়িত্ব এখন আমার। যে মানুষটা আমার মুখের দিকে চেয়ে নিজের ছেলেকে অবধি ত্যাগ করেছেন, আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে তাকে কে দেখবে বলুন?”
— “আমার ভাগ্যটা ছোটবেলা থেকেই খারাপ জানেন”, বলেছিলেন অরুণ বাবু, “বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে যেমন স্ত্রীকে হারালাম, মা বাবাকেও তেমনই হারিয়েছিলাম ছোটবেলাতেই। তাই স্ত্রীর সাথে মায়ের অভাবও যে কী, তা আমি বুঝি…তাই ভাবুন না যে টুম্পার জন্য নতুন মায়ের সাথে নিজের জন্যও নতুন এক মাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চলেছি। আজ থেকে তার সকল দায়িত্ব শুধু আপনার নয়, আমারও…অবশ্য তাতে যদি আপনাদের সকলের মত থাকে তবেই!”মঞ্জরী দেখল যে ততক্ষনে সেখানে এসে হাজির হয়েছে হিরণ্ময়ী দেবী। অরুণ বাবুর সব কথাই শুনেছেন তিনি। তার মুখে সম্মতি সূচক প্রশান্ত হাসি। অরুণ বাবু আর মঞ্জরী দুজনে মিলেই হিরণ্ময়ী দেবীর পায়ে হাত স্পর্শ করে প্রণাম করল। তাদের বুকে টেনে নিলেন হিরণ্ময়ী দেবী। মঞ্জরীকে বুক ভরা আশীর্বাদ দিয়ে তিনি বলে উঠলেন,
— “খুব সুখে থাক মা, নতুন করে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে ঘর কর। এটাই তো আমি এতদিন ধরে চাইতাম, যাতে স্বামী সন্তানের সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে তোর জীবনটা নষ্ট না হয়!”
অরুণ বাবু হিরণ্ময়ী দেবীকে বলে উঠলেন,
— “এই বয়সে আপনাকেও কিন্তু আমরা ছাড়ছি না মা। আজ থেকে আপনি আমাকে নিজের ছেলে বলেই মনে করবেন, আর আমাদের সাথেই থাকবেন। আজ থেকে আপনার সকল দায়িত্ব আমার আর মঞ্জরীর!”
তারপর একদিন শুভ দিন দেখে মঞ্জরীর সাথে অরুণ বাবুর বিবাহ হয়ে গেল। টুম্পা ফিরে পেল তার ‘মাকে’, মঞ্জরীও যেন ফিরে পেল তার ‘সন্তানকে’। আর সর্বোপরি, নিজের কন্যাসম পুত্রবধূকে নিজের গর্ভের সন্তানের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে তাকে ত্যাজ্য পুত্র করে যে একটুও ভুল সিদ্ধান্ত নেননি হিরণ্ময়ী দেবী, তা তিনি বুঝতে পারলেন। তার সেই ‘মেয়েই’ যে তাকে ফিরিয়ে দিল তার ‘ছেলে’, ‘নাতনী’ সহ গোটা পরিবারটিকে। -
গল্প- উপলব্ধি
উপলব্ধি
– প্রলয় কুমার নাথরবিবারের দুপুরের রান্নাটা নিজে হাতেই রাঁধে তিস্তা। এই দিন বাড়ির রান্নার লোকের ছুটি। আজ মাংসটা বেশ জমিয়ে রেঁধেছে তিস্তা। তার বাবা অবিনাশ বাবু নিজের ঘরেই দুপুরের খাবার খান। বাবার জন্য ভাত মাংস পাতে সাজিয়ে বাবার ঘরের দিকে নিয়ে যেতেই সে শুনতে পেল ঘরের ভেতর থেকে বাবা যেন ফোনে কার সাথে কথা বলছে। খুব ফিসফিস করে কথা বলছেন অবিনাশ বাবু, কি বলছেন তা শুনতে পেল না তিস্তা। তবে কথার মধ্যে বারবার ‘রমা’ নামটা উচ্চারণ করছেন সেটা তার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলো তিস্তা। বাবার ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর খাবারের থালাটা রাখতে যেতেই সে দেখল তাকে দেখেই সাথে সাথে ফোন কেটে দিলেন অবিনাশ বাবু। অবিনাশ বাবুর এহেন আচরণে তেমন কোন অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো না তিস্তার মুখে, সে শুধু ‘খাবারটা রাখলাম বাবা…খেয়ে নিও’ বলে মিষ্টি হেসে অবিনাশ বাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
নিজের ঘরে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে অনেক কথা ভাবতে লাগল তিস্তা। শুধু আজকে নয় প্রায় প্রতিদিনই এই ‘রমা’র সাথে বাবাকে ফোনে কথা বলতে শুনেছে সে। তার মানে এই পঞ্চান্ন বছর বয়সে কোনো ‘রমা’র প্রেমে পড়ল নাকি তার বাবা? কথাটা ভাবতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না সে, বরং একটি মুচকি হাসি খেলে গেল তার মুখে। অবশ্য এটা না হওয়ারই বা কি আছে, এই বয়সেও তার বাবা যথেষ্ট সুপুরুষ। লম্বা চওড়া তাগড়াই চেহারা, গায়ের রং যেন ফেটে পড়ছে। তার কাপড়ের দোকানের ব্যবসাটাও রমরমিয়ে চলছে। কোনো মধ্য বয়সী মহিলাই শুধু নয়, অনেক অল্প বয়সী তরুণীরাও এমন মানুষকে প্রণয়ী হিসাবে পেতে চাইবে, এমনটাই অন্তত তিস্তার বিশ্বাস। কিন্তু আজ অবধি কোনো দিন সে বাবাকে জিজ্ঞাসা করেনি, কে এই রমা? তার কারণ কারোর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানো পছন্দ করে না তিস্তা, এমনকি তার বাবার ব্যাপারেও নয়। ঠিক যেমন অবিনাশ বাবুও তার একমাত্র মেয়ের জীবনের কোনো সিদ্ধান্তের মাঝে আজ অবধি নিজের কোনো মতামত চাপিয়ে দেননি।
জীবনে কখনো মায়ের দেখা পায়নি তিস্তা। বাবার কাছ থেকে সে জেনেছে যে তাকে জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মৃদুলা দেবীর মৃত্যু হয়। তাই মায়ের কোনো স্মৃতি অন্তত তিস্তার জীবনে নেই। মাকে শুধু সে বাড়ির পুরোনো ফটো এলবামেই দেখে এসেছে, তার বাবার সাথে বিয়ের সময়ের ছবিগুলোতে। অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন মৃদুলা দেবী, অনেকটা তিস্তার মতই। বিয়ের সাজে অবিনাশ আর মৃদুলাকে খুব সুন্দর মানিয়েছিল প্রতিটা ফটোতে। মাঝে মাঝে তিস্তার মনে হয় বাপ মেয়ের এই সংসারে যদি আজ তার মাও বেঁচে থাকত তাহলে কত ভালো হত! মায়ের মৃত্যুর পর আর বিয়ে করেননি অবিনাশ বাবু। তিনিই হয়ে উঠেছিলেন তিস্তার মা বাবা দুটোই। সারা জীবন ধরে কিই বা পেল মানুষটা? তাই এই বয়সে মানুষটা যদি অপর কোনো নারীর প্রেমের স্পর্শ পেয়ে একটু বাঁচতে চায়, তাহলে তাতে তিস্তার কোন অসম্মতি নেই। এর আরেকটা কারণও আছে, তিস্তা আর এই বাড়িতে কতদিন থাকবে? অমিতাভর সাথে তার এনগেজমেন্টর দিন পরের মাসেই ফাইনাল হয়ে গিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে এই বাড়িতে অপর একজন মানুষের খুব দরকার, নাহলে বাবাকে দেখাশোনা করবে কে?
অমিতাভ…মানে ডক্টর অমিতাভ মজুমদার। এই অঞ্চলে প্রসিদ্ধ ইউরোলজিস্টদের মধ্যে এই নামটা খুবই প্রচলিত। তিস্তা যে প্রাইভেট হাসপাতালের বিলিং কাউন্টারে চাকরি করে, যেখানে কম্পিউটারের সামনে বসে ইয়া বড় বড় টাকার অঙ্কে ভরা সব বিল ধরিয়ে দেয় হতভাগ্য কাস্টমারগুলোর হাতে, সেই হাসপাতালেই সপ্তাহে তিন দিন করে বসেন অমিতাভ বাবু। আর সেইদিনগুলোতে পেশেন্টদের লম্বা লাইন লেগে যায় তিস্তার বসার জায়গার সামনে থাকা ওয়েটিং স্পেসে। সত্যিই চিকিৎসা বিজ্ঞানে খুব সফল একটি নাম এই অমিতাভ মজুমদারের। শুধু এই হাসপাতালই নয়, কলকাতার আরো কত নামী দামী মেডিকেল সেন্টার যে তার নামে চলছে তার ইয়ত্তা নেই। অর্থ, যশ আর প্রতিপত্তিতে ভরপুর বছর পঁয়তাল্লিশের এই বিপত্নীক ডাক্তার বাবুটির চোখে ধরেছিল সাতাশ বছর বয়সের সুন্দরী তিস্তা। একদিন নিজের চেম্বারে ডেকে তিনি তিস্তাকে জানিয়েছিলেন নিজের মনের কথা। বলেছিলেন যে তিনি তিস্তাকে বিয়ে করতে চান, এতে শুধু তিনি নতুন করে স্ত্রী সুখ পাবেন তাই নয়, তার একমাত্র মাতৃহারা ছেলেটারও মায়ের অভাব পূর্ণ হবে। অমিতাভ বাবুর কথা শুনে প্রথমে চমকে উঠেছিল তিস্তা। তার থেকে বয়সে প্রায় কুড়ি বছরের বড় একটি লোক তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে যে কি না আবার বিপত্নীক আর এক ছেলের বাবা, এটা ভাবতেই মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল তিস্তার। কিন্তু পরমুহূর্তেই কি যেন মনে হতে মুখের ওপর না করতে পারেনি তিস্তা। বারে বারে তার মনে হতে থাকে অমিতাভের মতো এমন অর্থ, পরিচিতি এবং স্বচ্ছলতার শিখরে কি সৌমিক কখনো পৌঁছতে পারবে? কখনো কি সে তিস্তাকে অমিতাভের মত সুখে স্বাচ্ছন্দে রাখতে পারবে? হোক না অমিতাভের বয়সটা একটু বেশি, হোক না সে বিপত্নীক, থাকুক না তার আগের পক্ষের ছেলে…তার মত তিস্তাকে সোনায় মুড়ে সৌমিক কখনো রাখতে পারবে না! তাই কিছু দিন সময় চেয়ে নিয়ে, অবশেষে কলেজ লাইফের প্রেমকে জলাঞ্জলি দিয়ে তিস্তা রাজি হয়ে গিয়েছিল অমিতাভের প্রস্তাবে।
কিছুদিনের মধ্যেই সৌমিকের সাথে দেখা করেছিল তিস্তা। সেই কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে তার প্রথম আলাপ সৌমিকের সাথে। তিস্তার ছিল ইংরেজিতে অনার্স আর সৌমিকের ফিজিক্সে। তিস্তার মতই মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে সৌমিক। তার বাবা ছিলেন সরকারি কেরানী। উচ্চ মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল সৌমিক, নাহলে ফিজিক্সের মত বিষয়ে এই কলেজের প্রথম মেধা তালিকায় স্থান পাওয়াটা চাট্টি খানি কথা নয়। অবশ্য শুধু মেধাবীই নয়, সৌমিককে দেখতেও ছিল বেশ সুন্দর। কলেজের প্রথম ফেস্টের সন্ধ্যায় তিস্তার সাথে পরিচয় হয় সৌমিকের। প্রথম দেখাতেই ওকে ভালো লেগে গিয়েছিল তিস্তার। সেদিন বিশিষ্ট আমন্ত্রিত গায়কের গানের তালে তালে একসাথে নেচেছিল ওরা দুজনে। জীবনে বাবাকে ছাড়া অপর কোন পুরুষের শরীরের এত কাছে বোধহয় এই প্রথম এসেছিল তিস্তা, তাও আবার এমন একটি ছেলের কাছে যার সাথে তার সেই দিনই পরিচয় হয়েছে। সেদিন সৌমিকের সাদা টি-শার্টের বেশিরভাগ জায়গাই তিস্তার ঠোঁটের লিপস্টিকে লাল হয়ে গিয়েছিল। সৌমিক তিস্তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ফিল্মি কায়দায় তাকে প্রপোজ করেছিল। তিস্তার যেন মনে হয়েছিল জীবনে সব কিছু পাওয়া হল। তবে আজ সে বুঝেছে সেদিন কতটা অপরিণত বুদ্ধি ছিল তার। বাঁচতে গেলে জীবনের প্রতিটি ধাপে লাগে অর্থ, মান, খ্যাতি…সেখানে এই শৈশবের মেকি প্রেম কোন কাজে আসে না। আর এই সব দিক থেকেই চুড়ান্ত রূপে পিছিয়ে আছে সৌমিক। কলেজে ঢুকেই উচ্চ মাধ্যমিকে স্টার পাওয়া ছেলেটার পড়াশোনা যেন ধীরে ধীরে অবনতির পথে এগোতে থাকলো। হয়তো এর কারণ তিস্তার সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক। অবশেষে ফার্স্ট ইয়ারেই অনার্স কেটে গেল সৌমিকের, কোনো মতে টেনে টুনে পাশ কোর্স পাশ করে কলেজ থেকে বেরোল সে। স্কুলে পড়াকালীন যে ছেলেটার স্বপ্ন ছিল ফিজিক্স নিয়ে গবেষণা করার, মাস্টার্স করার পথ আজ তার বন্ধ। ঠিক এমনই সময় একদিন হুট করে ইহকালের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন সৌমিকের বাবা। তাই বাধ্য হয়েই চাকরির চেষ্টায় হন্যে হয়ে ঘুরতে হল সৌমিককে। সরকারি চাকরি পাবার ধৈর্য্য তার আর ছিল না, তাই কিছুদিনের মধ্যেই সেলসের একটি স্বল্প মাইনের কাজে ঢুকতে হল তাকে। তাই অমিতাভের কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পেয়ে আর না করতে পারেনি তিস্তা। সৌমিকের সাথে দেখা করে তাকে জানিয়ে দিয়েছিল যে তার সাথে আর কোনূ সম্পর্ক রাখা তার পক্ষে আর সম্ভব নয়, কারণ অমিতাভের প্রতিপত্তির সাথে সৌমিকের কোন তুলনাই হয় না। সেদিন মুখ বুজে সব কথা শুনে গিয়েছিল সৌমিক, তিস্তা লক্ষ্য করেছিল শুধুমাত্র ছলছল করে উঠেছিল সৌমিকের দু’টো চোখ। কিন্তু মুখে কোন কথা বলেনি সে। অবশ্য বুকটা ভারী ভারী তিস্তারও লাগছিল, কিন্তু কিছুই যে করার নেই…তার শৈশবের প্রেমকে যে হারিয়ে দিয়েছে অমিতাভের সাথে প্রাচুর্যে ভরা নতুন জীবনের হাতছানি!
***
সেদিন ছিল তিস্তার জন্মদিন। বাবার কথামত সেদিন হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়েছিল তিস্তা। বিকালের দিকে অবিনাশ বাবু মেয়েকে বললেন তৈরি হয়ে নিতে, তিস্তাকে সারপ্রাইস দেওয়ার জন্য একটি নতুন জায়গায় নিয়ে যাবেন তিনি। তিস্তা মনে মনে ভাবলো হয়তো কোন শপিং মল বা কোন রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে চায় তার বাবা। তাই বাবার কথামত তৈরি হয়ে ওরা বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ি থেকে। রাস্তায় এসে অবিনাশ বাবু একটি ট্যাক্সি ধরলেন। ট্যাক্সির ভেতর বাবার পাশে বসে তিস্তা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো কোথায় তার বাবা তাকে নিয়ে যেতে চায় সেটা জানার জন্য। অবিনাশ বাবুর পথ নির্দেশানুসারে ট্যাক্সিটা একটি জায়গায় এসে থামল। ট্যাক্সি থেকে নেমে বেশ অবাক হয়ে গেল তিস্তা। এখানে তো কোনো মল বা রেস্টুরেন্ট নেই! রাস্তার ওপারে একটি সুবিশাল বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে যার প্রবেশ দ্বারের ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে “Healing Minds Mental Hospital” সেদিকেই এগিয়ে যেতে লাগলেন অবিনাশ বাবু। তার মানে বাবা তাকে একটি মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে এসেছে, কিন্তু কেন? অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো তিস্তা! হাসপাতালটির ভেতরে ঢুকে কাউন্টারের কিছু একটা বললেন অবিনাশ বাবু। কাউন্টারের ছেলেটার নির্দেশে একটি ওয়ার্ড বয় এগিয়ে এসে অবিনাশ বাবু আর তিস্তাকে নিয়ে গেল হাসপাতালটার তিনতলার একটি ঘরে। সেই ঘরে ঢুকে তিস্তা দেখল যে হাসপাতালের বেডে জবুথবু হয়ে বসে আছে এক মধ্য বয়সী রোগা চেহারার মহিলা। তাকে আস্তে আস্তে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে এই হাসপাতালেরই একজন তরুণী নার্স। তিস্তা ভালো করে চেয়ে দেখলো চুপ করে বসে থাকা ওই বয়স্ক মহিলাটির দিকে, এক কালে তিনি যে খুব সুন্দরী ছিলেন সেটা বোঝাই যাচ্ছে…বয়স হলেও তার মুখটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে তিস্তার! আগে কোথায় যেন দেখেছে সে এই মহিলাটিকে! অবিনাশ বাবু নার্সটির উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
— “এখন মৃদুলার অবস্থা কেমন আছে, রমা?”
— “আগের থেকে অনেক ভালো, অবিনাশ বাবু। আপনাকে তো বলেই ছিলাম যে ডাক্তার বাবু বলেছেন খুব তাড়াতাড়ি ওনাকে এখান থেকে ডিসচার্জ করতে পারবো!”, বলে উঠলো রমা নামক নার্সটি।হতভম্ব তিস্তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার মানে এই নার্সটাই হল সেই রমা যার সাথে তার বাবা ফোনে গোপনে কথা বলতো! আর এই মহিলার কি নাম বলল তার বাবা…মৃদুলা! তার মানে এই মহিলা তার মা! হ্যাঁ, এবার সে বুঝতে পারছে এই মুখেরই অল্প বয়সের ছবি বাড়ির পুরোনো এলবামে সে দেখেছে! তার মানে তার মা বেঁচে আছে! এ কী ভাবে সম্ভব? তাহলে এত দিন কি তার বাবা তাকে মিথ্যা কথা বলে এসেছে? কিন্তু কেন? অবিনাশ বাবু তিস্তার দিকে ফিরে বলতে লাগলেন,
— “আমি জানি রে মা, তোর মনে এখন অনেক প্রশ্ন। আজ তোর সব প্রশ্নের উত্তর দিতেই তো তোকে এখানে এনেছি। আমার আর মৃদুলার শৈশবের প্রেম পরিণতি পেয়েছিল আমাদের বিয়ের মাধ্যমে। তখন আমার আর্থিক অবস্থা আজকের মত ভালো ছিল না, কাপড়ের দোকানটা এত বড় ছিল না। আয় হত সামান্যই। তারপর আমাদের কোল আলো করে তুই এলি। এর পর থেকেই তোর মায়ের সাথে আমার সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরলো। তার কারণ হল আমার বন্ধু প্রফুল্ল। উচ্চবিত্ত বনেদী পরিবারের একমাত্র বংশধর ছিল সে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে দিল্লিতে মোটা মাইনের চাকরি করতো সে। আমার বিয়ের পর এক দুই বার সে এসেছিল আমার আর তোর মায়ের সাথে দেখা করতে। তখনও বুঝিনি যে ওর আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়ে পড়বে মৃদুলা, যে তোর জন্ম হবার কয়েক মাসের মধ্যেই আমাকে ছেড়ে, শৈশবের সমস্ত ভালোবাসাকে ছেড়ে সে প্রফুল্লর হাত ধরবে! আমাকে ত্যাগ করে প্রতিপত্তির নেশায় ওর সাথে দিল্লি চলে যায় মৃদুলা। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই ওর ভুল ভেঙে যায়। একাধিক নারীসঙ্গ এবং নানা বদ নেশাগ্রস্থ প্রফুল্লর আসল রূপটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে ওর সামনে। প্রতিদিনের নির্যাতন এবং লাঞ্ছনা সহ্য করতে না পেরে বাড়ি ফিরে আসে মৃদুলা। ততদিনে আমার কাছে ফিরে আসারও তার মুখ নেই। তাই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে একদিন একটি চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে মৃদুলা। ভাগ্যের ফেরে বেঁচে যায় সে, কিন্তু মাথায় চোট পেয়ে সমস্ত স্মৃতিশক্তি লোপ পায় তোর মায়ের। সাথে শুরু হয় মানসিক রোগীদের মত বিকারগ্রস্থ আচরণ। ওর বাপের বাড়িতে ওর এক দাদা বৌদি ছাড়া আর কেউ ছিল না। ওর দাদাও ছাপোষা চাকরি করতো। একদিন সেই আমাকে ডেকে সব কথা খুলে বলে, বলে যে বোনের চিকিৎসার খরচ সে আর চালাতে পারছে না। ততদিনে আমারও ব্যবসার অনেক উন্নতি হয়েছে, তাই আমাকেই অনুরোধ করে আবার মৃদুলার দায়িত্ব গ্রহণ করতে। আমি ওর কথা ফেলতে পারলাম না, মৃদুলাকে এই হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিলাম। সেদিন থেকে আজ অবধি ও এখানেই চিকিৎসাধীন। রমা ওর দেখাশোনা করে। তোকে এত কথা আগে জানাতে চাইনি, তাই তোর কাছ থেকে গোপন করে রমাকে ফোন করে তোর মায়ের খবরাখবর জিজ্ঞাসা করতাম এতদিন। কিন্তু আজ মনে হল তোকে সব কথা জানানো উচিত, তাই…”তিস্তা ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। মৃদুলা দেবীও নিজের শীর্ণকায় কম্পিত হাতগুলো রাখলেন তিস্তার পিঠে। হঠাৎ বিদ্যুতের চমকের মতো তিস্তার মনে একটি উপলব্ধি জাগল…এত বছর আগে বাবাকে ত্যাগ করে ধনসম্পদের পেছনে ছুটে তার মা যে ভুলটা করেছিল, আজ সে নিজেও তো একই ভুল করতে চলেছে সৌমিকের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে অমিতাভকে বিয়ে করে! সেও তো তার মায়ের মতই নিজের শৈশবের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে ছুটে চলেছে অর্থ আর প্রতিপত্তির দিকে! সত্যিই সৌমিককে ছেড়ে সে কী সুখে থাকতে পারবে অমিতাভের সাথে? অমিতাভের সাথে হয়তো আর্থিক নিরাপত্তা আছে, কিন্তু ভালোবাসা? সে কি কোনো দিন এক মুহূর্তের জন্যও ভালোবেসেছে অমিতাভকে? নাহ, এখনো যে তার হৃদয়ে সেই স্থান অধিকার করে আছে সৌমিক…শুধু সৌমিক! আর তার সাথেই সকল সম্পর্ক সে ছিন্ন করতে চলেছে! না, বড্ড ভুল করে ফেলেছে সে…সৌমিকের আর্থিক অবস্থা যাই হোক না কেন আজ থেকে তিস্তা আর কারোর নয়, শুধুমাত্র তার! সৌমিকের উপার্জন কম তাতে কি হয়েছে, তিস্তা নিজেও তো চাকরি করে। আজ তো সমাজে মেয়েরাও পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে সংসারের হাল ধরছে, তাহলে সে কেন তা পারবে না? মিথ্যা অর্থের প্রতি আর লোভ নেই তিস্তার মনে, সে তার ফোনটা বার করে ডায়াল করলো অমিতাভের নম্বর। তারপর ফোনটা কানে ধরে শুধু বললো,
— “আমায় ক্ষমা করবেন অমিতাভ বাবু…আমি আপনার সাথে বিয়ে করতে পারবো না।”
তারপর কোন প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোনটা কেটে দিল তিস্তা। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সে ডায়াল করল সৌমিকের নাম্বার।পড়ন্ত বিকালে গঙ্গার ধারের এই নির্জন স্থানটা বড়ই মনোরম। সৌমিকের বুকে মুখ গুঁজে এখনো কেঁদে চলেছে তিস্তা। সৌমিকের দুই হাতের আঙ্গুলের হালকা ছোঁয়া এলোমেলো ভাবে খেলা করছে তিস্তার খোলা চুলের মাঝে। আকাশে অস্তমিত সূর্যের কাছ দিয়ে নিজেদের বাসার ফিরতে ব্যস্ত পাখির ঝাঁক। ওদিকে নদীর বুকে ভাসমান কোন এক নৌকা থেকে ভেসে আসছে মাঝি ভাইয়ের অস্পষ্ট কণ্ঠে ভাটিয়ালি গানের মিঠে সুর।
(সমাপ্ত)
-
গল্প- ছপাক
ছপাক
– প্রলয় কুমার নাথ-“আমি আর পারছিনা…পারছিনা শাশ্বত!” বিছানার চাদরটা দুই হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে উন্মাদের মত মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে চিৎকার করছিল তন্বী, “বারবার…বারবার দিদি দেখা দিচ্ছে আমায়!”
সে ছুটে এসে আমার বুকের জামা খামচে ধরে পাগলের মত কাঁদতে লাগল অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে।
– “ডা: সেনগুপ্তের দেওয়া ওষুধগুলো নিশ্চয় ঠিক করে খাচ্ছ না তুমি” বলে উঠলাম আমি। তারপর এগিয়ে গেলাম বেডসাইড টেবিলের দিকে যার ওপর ওর সমস্ত ওষুধগুলো রাখা থাকে। দেখতে লাগলাম সকালের এই সময়ে ওর কোন ওষুধটা খাওয়ার কথা বলেছেন ডাক্তার বাবু। মনরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে ডা: প্রবাল সেনগুপ্তের যথেষ্ট নামডাক আছে এই অঞ্চলে। প্রচুর মানুষ তার চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছেন। আজ বেশ কিছু মাস ধরে তন্বী তার কাছে চিকিৎসাধীন। তিনি বলেছেন তন্বীর সাময়িক কিছু হ্যালুসিনেশন হচ্ছে, যা সিজোফ্রেনিয়ার পেশেন্টদের মধ্যে খুব কমন। সমস্ত ওষুধ খাওয়ানো, কাউন্সেলিংএ নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি সময়মতই করাচ্ছি আমি। তবুও কেন জানি না তন্বীর পরিস্থিতির কোন উন্নতি হচ্ছে না। ওর জন্য আমার চিন্তা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কি অপর কোন এক মৃত মানুষকে বারবার দেখতে পায়! এমন চলতে থাকলে তো ওকে মানসিক রোগের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে! তন্বী হঠাৎ ছুটে এসে টেবিল ক্লথটা ধরে এক টান দিল, ওপরে রাখা সমস্ত ওষুধপত্র ঘরের মেঝেয় যত্রতত্ৰ ছিটকে পড়লো। কান্না ভুলে এবার অদ্ভুত কণ্ঠে খিলখিল করে হাসতে লাগলো তন্বী। কি মনে হতে হাতটা তুলে ওর গালে লাগাতে গেলাম সপাটে এক চড়। কিন্তু ও আমার হাতটা ধরে ফেললো, কি আশ্চর্য পৈশাচিক শক্তি ওর গায়ে যে নিজে একজন শক্ত সামর্থ চেহারার পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও ওর মত একজন দুর্বলচিত্ত নারীর হাতের বাঁধন থেকে এক চুল নড়াতে পারলাম না নিজের হাত!
– “কাল দিদি এসে আমাকে সব বলেছে…সঅঅঅব…কেন সে বারবার আমাকে দেখা দিচ্ছে…ও আমাকে ছাড়বে না শাশ্বত…কিছুতেই ছাড়বে না!”
তন্বীর কথা শুনে একটা অপার্থিব শীতল আতঙ্কের স্রোত যেন বয়ে গেল আমার গোটা শরীর জুড়ে। বললাম,- “তোমার দিদি বহ্নি আর আর এই পৃথিবীতে নেই তন্বী! সে আর ফিরে আসতে পারে না…কিছু বলতেও পারে না…”
– “সে ফিরে এসেছে, শাশ্বত…সে বলেছে যে প্রতিশোধ নিতে চায়…প্রতিশোধ!”
কথাগুলো শুনে এই এসি ঘরের মধ্যেও যেন ঘামতে শুরু করলাম আমি। কি জানি কেন ধীরে ধীরে মনে পড়তে লাগল কয়েক মাস আগেকার সেই মর্মান্তিক ঘটনাটার কথা।***
বহ্নির সাথে আমার বিয়ের সম্বন্ধটা এনেছিলেন আমার এক দূরসম্পর্কের মামা। ভালো স্বচ্ছল পরিবার ওদের, দুই বোনের মধ্যে ওই বড়। ওদের বাবা এখনো সরকারি চাকরি করেন, কয়েক মাস পরে অবসর নেবেন। দুই বোনই সুন্দরী। তিনি বড় মেয়ে বহ্নির জন্য আমায় পছন্দ করেছিলেন। প্রথমে বহ্নি দাশগুপ্ত নামটা শুনেই কেন জানিনা আমার মনে হচ্ছিল ওকে আমার বেশ চেনা। পরে ওকে দেখতে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম। ওর সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ পেয়ে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ক্লাস নাইন অবধি ও আর আমি একই স্কুলে পড়েছি। ও ছিল আমার থেকে দুই বছরের জুনিয়র। ক্লাস নাইনের পর আমি অন্য স্কুল থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাই ব্যাঙ্গালোরে। সেখান থেকেই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেয়ে পরে ট্রান্সফার নিয়ে কলকাতায় আসি। আর বহ্নি ওই স্কুল থেকেই উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে পরে আর্টস নিয়ে গ্রাজুয়েশন করে। সেই ক্লাস নাইনে পর এত বছর পরে ওর সাথে আমার এই পরিস্থিতিতে দেখা হবে তা সত্যিই ভাবিনি! এক দেখাতেই পাকা হয়ে গিয়েছিল আমাদের বিয়ের কথা। কিন্তু বিধাতা পুরুষ বোধহয় এই বিয়ে আমাদের ভাগ্যে লিখে রাখেননি। তাই তো আমাদের বিয়ের কয়েক সপ্তাহ আগেই ঘটেছিল সেই দুর্বিষহ নির্মম ঘটনাটা যা আমাদের সকলের জীবনের গতিপথটার আমূল পরিবর্তন ঘটালো।
সেদিন দুপুর থেকেই বহ্নির মায়ের শরীরটা ভালো ছিল না, আর বোন তন্বীর সামনেই ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা তাই সে পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। এদিকে বাবাও বলেছিলেন অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরী হবে। তাই বিকালের দিকে মায়ের জন্য কয়েকটা ওষুধ কিনতে গিয়েছিল বহ্নি। স্টেশন সংলগ্ন ওষুধের দোকানটা তাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে। সেদিন দোকানে খরিদ্দারদের ভিড়ও ছিল প্রচুর। তাই সমস্ত ওষুধ কিনে দাম বুঝে নিয়ে আসতে আসতেই সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। স্টেশন থেকে ওদের বাড়িতে আসতে একটি শর্টকাট রাস্তা আছে। সেটাই ধরেছিল বহ্নি। জায়গাটা বেশ নির্জন। সন্ধ্যা নেমে বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে চারিদিকে। তার ওপরে সেই স্থানে তেমন বাড়ি ঘরও নেই, ঘন ঝোপঝাড় আর আম গাছের সারি রাস্তার দুই পাশে। হঠাৎ পাশের ঝোপের ভেতর কারোর পদশব্দ পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বহ্নি। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি তীব্র আলোর ঝলকানি এসে লাগল তার দুই চোখে। কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল বহ্নি, আর ঠিক তখনই একটি অস্ফুট শব্দ শোনা যায়…
“ছপাক…”
কোন তরল পদার্থ যেন ছিটকে এসে ছড়িয়ে পড়ল বহ্নির চোখে মুখে। নিভে গেল তার চোখের সামনে জ্বলা আলো। মুহূর্তের মধ্যে গোটা মুখে তীব্র দহনের জ্বালায় ‘মাগো’ বলে চিৎকার করে রাস্তায় পড়ে ছটফট করতে থাকল বহ্নি। রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে লাগল মায়ের জন্য সদ্য কেনা ওষুধের শিশিগুলো, আর তার সাথেই কাজ হয়েছে জেনে পাশের ঝোপের ভেতর থেকে সেই পদশব্দ দূরে সরে যেতে লাগল। মুখের তীব্র জ্বালাটা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকল, কি হল তা বোঝার আগেই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারাল বহ্নি। কোনো এক সহৃদয় পথচারী পরে বহ্নিকে স্থানীয় হাসপাতালে পৌঁছে দেন। খবর পেয়ে ছুটে আসে ওর মা, বাবা আর বোন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। জ্ঞান হবার পর থেকে মা, বাবা আর বোনকে কাঁদতে দেখে সে স্যালাইনের নল হাত থেকে খুলে ছুটে গেল হাসপাতালের ওয়াশরুমে। সেখানে থাকা আয়নায় মাঝে চেয়ে দেখল নিজের মুখের প্রতিবিম্বের দিকে। অ্যাসিডের দ্বারা বীভৎস ভাবে ঝলসে গিয়েছে তার মুখের ৯০% চামড়া। নিজের ফর্সা সুন্দর মুখটাকে যেন নিজেই চিনতে পারল না বহ্নি, অপার্থিব আক্রোশে দেওয়ালের সাথে মাথা কুটে চিৎকার করতে লাগল সে, – “না! এ হতে পারে না…কিছুতেই না!”
ওর মা, বাবা এবং বোন ছুটে এসে ওকে সামলাতে চেষ্টা করলো। হাসপাতাল থেকে কোনো মতে ওকে বাড়িতে নিয়ে গেল। কিন্তু আকস্মিক নিজের সব রূপ, সৌন্দর্য হারানোর আঘাতটা কিছুতেই সহ্য করতে পারলো না বহ্নি। পরদিনই ওর ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় ওড়নার ফাঁসের সাহায্যে ওর ঝুলন্ত শরীরটাকে প্রথম আবিষ্কার করল ওর মা! ওর হাতের মুঠোয় মধ্যে ধরা ছিল একটি দোমড়ানো মোচড়ানো কাগজ যাতে লেখা ছিল,“কে আমার এত বড় ক্ষতি করল তা আমি জানি না। এও জানিনা যে এই দেশের আইন তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারবে কি না। কিন্তু মৃত্যুর পর আমার আর কিছুই অজানা থাকবে না। তখন আমাকে আর কেউ আটকাতে পারবে না, যে এই কাজ করেছে তাকে কিছুতেই ছাড়ব না আমি। মৃত্যুর পরও নিজের ওপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়া যায়, আর সেটাই হবে আমার একমাত্র উদ্দেশ্য!”
এর পরদিনই জানতে পেরেছিলাম বহ্নির মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারাটা কার কাজ ছিল। ওই পাড়ার ছেলে অনিমেষ অনেক দিন ধরেই বহ্নির পেছনে লাগতো। রাস্তা ঘাটে দেখা হলে তাকে বারবার বিরক্ত করতো, প্রণয় নিবেদনের ব্যর্থ চেষ্টা করতো। বহুদিন ধরে এমন দৃশ্য এই পাড়ার অনেকেই দেখেছে। কিন্তু বহ্নির ওই অশিক্ষিত পাড়ার রকে বসে আড্ডা মারা বেকার ছেলেটাকে একদম পছন্দ ছিল না। প্রেম করা তো দূরের কথা সে সর্বদা ওই মস্তান গোছের ছেলেটার থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করতো। এখন যেন ওদের পাড়ার সকলের কাছেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে গেল যে বহ্নির যেহেতু আমার মত শিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ার পাত্রের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে, তাই রাগে আক্রোশে হতাশায় সেই বিয়ে পন্ড করতে অনিমেষই সেদিন সন্ধ্যায় বহ্নির মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছে। এছাড়াও আরেকটা কথা জানাজানি হয়ে গেল যে এই ঘটনার আগের দিন অনিমেষই বাথরুম পরিষ্কার করবে বলে পাড়ার একটি দোকান থেকে অ্যাসিড কিনে এসেছিল। এই কথাটা যেন আগুনে ঘিয়ের কাজ করলো। পুলিশ কিছু করার আগেই পাড়ার ছেলেরা রাগে ফেটে পড়ে চড়াও হল অনিমেষের বাড়িতে। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হিড়হিড় করে বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে এসে মারধোর করতে লাগল সকলে। অবশেষের বাড়ির লোকের ফোন পেয়ে পুলিশ যখন এসে পৌঁছলো, তখন আর অনিমেষের দেহে প্রাণ নেই!
বহ্নির শ্রাদ্ধ শান্তির পর ওদের বাড়ি থেকেই এসেছিল আমার সাথে বহ্নির বোন তন্বীর বিয়ের প্রস্তাবটা। বাড়ির বড় মেয়ের সাথে যা হল, তারপর কেই বা বিয়ে করতে চাইবে সেই পরিবারের ছোট মেয়ের সাথে। তাই ওদের পরিবারের মুখের দিকে চেয়ে আমিও আর না করতে পারিনি ওদের প্রস্তাবে। তাছাড়া আমার বাবা মার পুত্রবধূ হিসাবে তন্বীকেও অপছন্দ ছিল না। একটি শুভ দিন দেখে অত্যন্ত আড়ম্বরহীন ভাবেই আমার আর তন্বীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই শুরু হল তন্বীর নিজের মৃত দিদি বহ্নিকে দেখতে পাওয়ার এই অদ্ভুত মানসিক অসুস্থতাটা!
***
– “প্রতিশোধ!…কিসের প্রতিশোধ, তন্বী? যে তোমার দিদির মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে ছিল, সেই অনিমেষ তো আজ এই পৃথিবীতে নেই…তাহলে…”চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি।
– “না শাশ্বত, দিদির মুখে অনিমেষ অ্যাসিড ছোঁড়েনি!” বললো তন্বী।
– “এ কী বলছো তুমি! অনিমেষ অ্যাসিড ছোঁড়েনি! কিন্তু সবাই যে তাকেই অপরাধী মনে করে…তাহলে সেদিন বহ্নির মুখে কে অ্যাসিড ছুঁড়ে ছিল তন্বী?”
– “সেটা আমিও জানি না, কিন্তু শুধু এটা বলতে পারবো যে অনিমেষ অ্যাসিড ছোঁড়েনি!”
– “এই সব কি উল্টো পাল্টা কথা বলছো তুমি, তন্বী? মনে হয় তোমার মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গিয়েছে!”
– “না শাশ্বত, আমার মাথা একটুও খারাপ হয়নি…তাহলে বলছি শোনো”, হিসহিসিয়ে বলতে লাগল তন্বী, “যেদিন তুমি দিদিকে দেখতে এসেছিলে, সেদিন থেকেই তোমাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তোমার অর্থ, রূপ এইসব পাগল করে তুলেছিল আমাকে। মনে মনে পরিকল্পনা করছিলাম কি ভাবে দিদির সাথে তোমার বিয়েটা ভেস্তে দেওয়া যায়। তাই ওই ঘটনার কয়েকদিন আগে একান্তে গিয়ে দেখা করেছিলাম অনিমেষের সাথে। জানতাম যে তার মনেও আমার মত দিদির প্রতি প্রবল হিংসা এবং আক্রোশ বর্তমান। আমি শুধু উস্কে দিয়েছিলাম সেই আগুনটাকে। আমার পরিকল্পনা মতই অনিমেষ অ্যাসিড কেনে পরের দিন দিদির মুখে ছোঁড়ার জন্য। পরদিন দিদিকে বিকালে মায়ের ওষুধ কিনতে যেতে দেখে আমি অনিমেষকে ফোনে জানালাম এবার তৈরি হয়ে নিতে, আজই ধ্বংস করে দিতে হবে দিদির সব রূপ আর সৌন্দর্য! দিদি যখন দোকান থেকে ওই রাস্তা দিয়ে ফিরছিল, তখন আমি আর অনিমেষ লুকিয়ে ছিলাম পাশের ঝোপের মাঝে। কিন্তু বিশ্বাস করো…যখন আসল মুহূর্ত এলো, মনে পড়ে গেল দিদির সাথে ছেলেবেলায় কাটানো সকল মুহূর্তের কথা, কত ভালোবাসে আমাকে দিদি। কখনো সে কি স্বপ্নেও ভাবতে পারছে আমি তার বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র করেছি? তাই পারলাম না…পারলাম না শেষ মুহূর্তে আমাদের পরিকল্পনাকে বাস্তবের রূপ দিতে। আটকে নিলাম অনিমেষকে, সেও হয়তো খুব ভালোবাসতো দিদিকে। তাই আমার মতই শেষ মুহূর্তে দিদির এতবড় ক্ষতি করতে পারলো না সে। অ্যাসিডের বোতলটাকে ওখানেই ফেলে আমরা সেদিন বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। অনিমেষের কোনো কথা না শুনেই তাকে সবাই পিটিয়ে মেরে ফেলে, তাই তো এত কথা বাইরে আসেনি! সেই জন্যই দিদির আত্মা আমাকে পুরোপুরি মারছে না, শুধু তার মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার যড়যন্ত্র করার জন্য আমাকে ধীরে ধীরে মানসিক কষ্ট দিয়ে শাস্তি দিতে চাইছে!”আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম তন্বীর সব কথা। ও সব কথা বলে আস্তে আস্তে কেমন ঝিমিয়ে পড়ল। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। চোখ চলে গেল ঘড়ির দিকে। এখনই বেরোতে হবে নাহলে অফিসের জন্য দেরি হয়ে যাবে। তাহলে শেষমেষ কে ছুঁড়েছিল অ্যাসিড বহ্নির মুখে? মনে প্রশ্নের ঝড় নিয়ে কলকাতার ব্যস্ত রাস্তা ধরে গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগলাম অফিসের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে ঠান্ডা হয়ে এলো গাড়ির ভেতরটা! আমি এসি বন্ধ করে জানলার কাঁচ নামাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কাঁচগুলো নামলো না, অদ্ভুত ঠান্ডার পরিবেশটাও গেল না। আমার বাইরের চারিদিকটা এই রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল বেলাতেও কেমন যেন অন্ধকার হতে শুরু করেছে! আকাশে মেঘ করেছে নাকি? ঝড় উঠবে নাকি? ঠিক সেই সময় আমার চোখ গেল আমার সামনে রাখা গাড়ির আয়নায়! আমার গাড়ির পেছনের সিটে ওটা কে বসে আছে? বীভৎস পচা গলা মাংসে ভরা তার গোটা মুখ, ভনভন করে পোকা উড়ে বেড়াচ্ছে তার চারিপাশে! শুধু নাম মাত্র সূক্ষ্ম মণি বিশিষ্ট তার সাদা চোখগুলো যেন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বহ্নি! অপার্থিব সুরে সেই অশরীরী বলে উঠলো,
– “কেন করলে তুমি এটা? কেন আমার মুখের সাথে আমার স্বপ্নগুলোকে, আমার বাঁচার ইচ্ছাটাকে অ্যাসিডের ঝাঁঝে পুড়িয়ে শেষ করে দিলে শাশ্বত? বলো কেন?”হ্যাঁ, আমি, এই শাশ্বত মল্লিকই সেদিন অ্যাসিড ছুঁড়েছিল তার হবু স্ত্রী বহ্নি দাশগুপ্তের মুখে। কি করবো বলো, তোমাকে দেখেই যে ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো চাগাড় দিয়ে উঠলো আমার মনে। মনে পড়ে আমাদের একই স্কুলে পড়াকালীন আমার ক্লাস নাইনে ইতিহাস পরীক্ষার দিনটার কথা। স্কুলে পরীক্ষার সময় বিভিন্ন ক্লাসের ছেলেমেয়ের পাশাপাশি বসার সিট পড়েছিল, যাতে কেউ দেখাদেখি করে না লিখতে পারে। তোমার সিট পড়েছিল আমার পাশে। ইতিহাসে আমি বরাবরই কাঁচা, মানছি সেদিন আমি গার্ডের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গোপনে টুকলির কাগজ দেখে উত্তর লিখছিলাম। তুমি লক্ষ্য করেছিলে সেটা, বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ সেই কাগজটাকে আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলে গার্ডকে! খুব সৎ, খুব আদর্শবাদী সেজেছিলে সেদিন না? কিন্তু জানো তারপর আমার কি হয়েছিল? আমার গোটা পরীক্ষাটাই বাতিল করে দেওয়া হয়। ফেল করানো হয় আমাকে। গোটা স্কুলে সকলের হাসি আর উপহাসের পাত্র হয়ে উঠি আমি। তাই তো বাধ্য হয়ে ওই স্কুল ত্যাগ করে আমাকে অন্যত্র ভর্তি করান আমার বাবা। কি ভেবেছিলে তুমি? এতদিন পর সেই কথা আমার মনে থাকবে না? না, এতদিন পরে সেই সব ঘটনাগুলোকে অল্প বয়সের ছেলেখেলা ভেবে তুমি ভুলে গিয়ে আমাকে বিয়ে করার কথা ভাবলেও, তোমাকে দেখে আমার মনে একটাই শব্দ বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল…প্রতিশোধ। আর তাই তো গোপনে খোঁজ নিই তোমার সম্বন্ধে, জানতে পারি অনিমেষের কথা। ঘটনার আগের দিন রাতেই অনিমেষকে নিয়ে একটি বারে যাই আমি, ওকে মদ খাইয়ে জানতে পারি তোমার মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার পরিকল্পনার কথা। সেদিন রাতটা স্টেশনের কাছে একটি হোটেলে কাটাই আমি, কি হতে চলেছে তা নিজের চোখে দেখার ইচ্ছায়। পরদিন বিকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে অনিমেষই আমায় ফোন করে ডেকে নেয়। ওরা ওই রাস্তার পাশের ঝোপে পৌঁছনোর কিছুটা পরে আমি পৌঁছাই। দেখতে পাই যে শেষ পর্যন্ত অনিমেষ অ্যাসিডের বোতলটি নীচে ফেলে দিয়ে তন্বীকে নিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। ওরা চলে গেলে আমি রাগে ফুঁসতে থাকি, মুহূর্তের মধ্যে নিচ থেকে কুড়িয়ে নিই অ্যাসিডের বোতলটাকে, আর তারপর…
– “ক্ষমা করে দাও আমাকে, বহ্নি!…ক্ষমা করে দাও আমাকে!” আতঙ্কে চিৎকার করলাম আমি। কিন্তু বহ্নির অশরীরী কানে বোধহয় সেই কথা ঢুকলো না। সে ধীরে ধীরে নিজের হিমশীতল হাতগুলো দিয়ে আমার দুই কাঁধ স্পর্শ করল। তারপর তার বীভৎস ঝলসানো মুখটাকে নিয়ে এলো আমার মুখের খুব কাছে…তার হলদে হয়ে যাওয়া তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো নেমে এলো আমার গলার টুঁটির ওপর…তারপর একটা অসহ্য যন্ত্রণা…আমার হাতের স্টিয়ারিং কেঁপে উঠলো…আর সামনে থেকে একটা মাল বোঝাই ট্রাক এসে…একটা বিকট শব্দ…তারপর আর আমার কিছু মনে নেই!
***
রাস্তায় বেশ কিছু লোক ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল একটি এক্সিডেন্টের জায়গার চারিপাশে। একটি গাড়ির সাথে একটি মাল বোঝাই ট্রাকের ধাক্কা লাগে এই স্থানে। ট্রাক বা তার চালকের তেমন কোন ক্ষতি না হলেও ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে গাড়ি চালকের। শাশ্বত মল্লিকের রক্তাক্ত মৃতদেহটার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সকলে। কারণ, তার শরীরে এক্সিডেন্টে লাগা আঘাতের চিহ্ন থাকলেও, তার গলার টুঁটির অংশটি আশ্চর্য জনক ভাবে উধাও, যেন কোন হিংস্র শ্বাপদ প্রবল আক্রোশে খুবলে ছিঁড়ে নিয়েছে তার শরীরের ওই অংশটাকে!
(সমাপ্ত)
-
গল্প- সতীন কাঁটা
সতীন কাঁটা
-প্রলয় কুমার নাথমনতোষের ডাক শুনে দরজা খুলে সেদিন হকচকিয়ে উঠেছিল যমুনা।
— “কে এটা? কার মেয়েকে ঘরে নিয়ে এসেছো তুমি?”,মনতোষের কোলে পাঁচ বছরের শিশুকন্যটির দিকে ইঙ্গিত করে চিৎকার করে উঠেছিল যমুনা। মায়ের চিৎকার শুনে খেলা ফেলে সেখানে হাজির হয়েছিল মনোতোষ আর যমুনার আট বছরের ছেলে প্রতুলও। মনোতোষ কোন উত্তর দেয়নি স্ত্রীর প্রশ্নে, হয়তো যমুনার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে সেদিন ভয় পেয়েছিল সে। শুধু বাচ্ছা মেয়েটিকে কোল থেকে নামিয়ে প্রতুলের পাশে রেখে সে ছেলেকে বলেছিল,
— “এটা তোর একটা বোন রে খোকা…ওর নাম আভা…আজ থেকে ও আমাদের বাড়িতেই থাকবে!”
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল যমুনা। এমনিতেই টানাটানির সংসার তাদের, তার ওপর আবার কোথা থেকে এই মেয়েকে জোগাড় করে এনে বলছে সে নাকি এখন থেকে এখানেই থাকবে! স্বামীর প্রতি আবার চিৎকার করে উঠেছিল যমুনা,
— “কি গো, কে এই মেয়েটা? আর ও এখানে থাকবে কেন? কথার উত্তর দিচ্ছ না যে বড়…”
— “আভা আমারই সন্তান যমুনা…আর তাই সে আজ থেকে এখানে থাকবে!”
রাগে বিতৃষ্ণার যমুনার মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠেছিল সেই দিন। তার মানে পাড়ার এর ওর মুখে এতদিন মনতোষের সম্বন্ধে সে যা শুনেছে তা ঠিক! সে চিৎকার করে বলে ওঠে,
— “তোমার কি কোন লাজ লজ্জা নেই গো? ওই মেয়ে এই বাড়িতে কিছুতেই থাকতে পারবে না এই আমি বলে দিলুম…”
— “আভা আমার আর মালতীর একমাত্র সন্তান যমুনা…আর আজ মালতীর অবর্তমানে ওকে প্রতিপালন করা আমার দায়িত্ব। তাই ও এখানেই থাকবে। তোমার কোন অসুবিধা হলে এই বাড়ির দরজা খোলা আছে…”যমুনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। ছোট্ট মুদিখানার দোকানের মালিক মনোতোষ স্ত্রী যমুনা আর ছেলে প্রতুলকে নিয়ে এই গ্রামের অনেক বছরের বাসিন্দা। কোন মতে এক প্রকার চলে যাচ্ছিল যমুনায় সংসার, যতক্ষন না ওই ঢলানী সর্বনাশী মাগী মালতীর নজর পড়েছিল তার স্বামীর ওপর। পাশের গাঁয়ের হারান পোস্ট মাস্টারের স্ত্রী হয়ে এসেছিল গরীব ঘরের সুন্দরী বাপ মা মারা মালতী। কিন্তু বিয়ের ছয় মাসের মাথায় ঘটেছিল সেই দুর্ঘটনাটা। একদিন দুপুরে হারানের বালিশের নীচে গোল্লা পাকিয়ে ছিল ছোট আকৃতির একটি কেউটে, আগে থেকে বুঝতেই পারেনি হারান। দুপুরের খাওয়ার খেয়ে শুতে গিয়েই…কামড়ের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মারা গিয়েছিল হারান। তারপর থেকে শ্বশুর বাড়িতেই থাকত মালতী। বাচ্ছা কাচ্চা কিছু হয়নি তার, পরিবারে শয্যাশায়ী অসুস্থ শ্বাশুড়ি ছাড়া আর কেউ ছিল না। এরপর থেকেই মনতোষের সঙ্গে আস্তে আস্তে পিরিত হয় মালতীর, যার সূত্রপাত প্রথম প্রথম মাস কাবাড়ি বাজার করতে মনতোষের দোকানে আসার অছিলা। সেই টানেই মাঝে মাঝে মনোতোষও ছুটে যেত মালতীর বাড়িতে, এমনকি তার বিছানাতেও। মালতীর শয্যাশায়ী শ্বাশুড়ির কিছুই বলার ক্ষমতা ছিল না। মনোতোষ নাকি গোপনে বিয়েও করেছিল মালতীকে! সেই নষ্টামীর ফসলই কী এই বাচ্চা মেয়েটা? রাগে বিদ্বেষে ফুঁসতে থাকে যমুনা। এই সব কথা তার লোক মুখে শোনা, বহুবার মনোতোষকে জিজ্ঞাসা করলেও সে নিজমুখে কোন সন্তোষ জনক উত্তর দেয়নি যমুনাকে। তবে আজ সে বলে ওঠে,
— “গত পাঁচ দিন ধরে জ্বরে ভুগছিল মালতী…গতকাল সে মারা গিয়েছে, যমুনা! ওদের বাড়িতে আভার দেখাশোনা করার কেউ নেই, তাই আমি ঠিক করেছি আজ থেকে তুমিই হবে ওর নতুন মা!”
মালতীর মৃত্যু সংবাদ শুনে কিঞ্চিৎ খুশি হলেও আজ থেকে এই সতীন কাঁটা নিয়ে সংসার করতে হবে এটা ভেবেই বিষিয়ে ওঠে যমুনার মন।*
এরপর কাটতে থাকে দিন, সপ্তাহ, মাস এবং বছর। একটু একটু করে বেড়ে উঠতে থাকে আভা এবং প্রতুল। তবে নিজের পেটের ছেলের প্রতি যে স্নেহ এবং ভালবাসা যমুনার মনে ছিল তার শিকি ভাগও ছিল না আভার জন্য। সব সময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মধ্যেই বড় হয়েছে আভা, দেখেছে যে তার সৎ মা প্রতুল এবং তার প্রতি কতটা ভিন্ন মনোভাবগ্রস্থ। ভালো মন্দ খাবার, পোশাক আশাক এমনকি শিক্ষা দীক্ষার ক্ষেত্রে যমুনা পক্ষপাতিত্ব করে গিয়েছে নিজের পেটের ছেলেকে। প্রথম প্রথম এই ব্যাপারে কিছুটা বাধা দিত মনোতোষ, কিন্তু পরে যমুনার সাথে ঝগড়া আর অশান্তির ভয়ে সেও মেনে নিত আভার প্রতি এই অনাচার। বাড়িতে ভালো কিছু রান্না হলে সবার আগে যমুনা পাত পেরে খাওয়াত প্রতুল ও তার স্বামীকে। তারপর তার নিজের খাওয়া হলে, অবশিষ্টাংশ যেন বাড়ির কুকুরের মত রেখে দিত আভার সামনে। এই অভাবের সংসারেও প্রতুলের জন্য পুজোয় একাধিক দামী পোশাক কেনা হত, কিন্তু আভার জন্য হয়তো কোন বার কিছু কেনা হতই না, বা হলেও সেই সস্তা সিটের ফ্রক। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো আভা, প্রতুলের মত নয় যে প্রতিটা ক্লাসেই একাধিক প্রয়াসে পাশ করতে হবে। তবুও প্রতুলের জন্য প্রতি বছর আসত নতুন বই, খাতা, ইউনিফর্ম, ব্যাগ, আর আভাকে এত ভালো রেজাল্ট করা সত্ত্বেও উঁচু ক্লাসের দাদা দিদিদের পা ধরে নিজের জন্য খুঁজে নিতে হত তাদের পুরোনো বইগুলো। প্রতুলের জন্য স্কুলের টিফিনে থাকতো লুচি, আলুর দম, মিষ্টির মত কত কি সুখাদ্য, আর আভার জন্য রোজ বরাদ্দ থাকতো শুধুমাত্র শুকনো মুড়ি। আভাকে দেখলেই যেন মালতী আর মনোতোষকে এক বিছানায় থাকার দৃশ্য ভেসে উঠত যমুনার চোখের সামনে। তাই মেয়েটাকে দুই চক্ষে দেখতে পারত না যমুনা, ওর গলার মা ডাকটা শুনলেই যেন সর্বাঙ্গে জ্বালা করে উঠত যমুনার।
শুধু তাই নয়, নিজের পেটের ছেলের থেকে ওই দুশ্চরিত্রা মালতীর গর্ভজাত সন্তান এত বেশি মেধাবী, এটাও সহ্য হত না যমুনার। তাই সংসারে খরচ বেড়ে যাওয়ার দোহাই দিয়ে সে ক্লাস নাইনের পরই আভার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিল। আভার খুব ইচ্ছা ছিল আরো পড়াশোনা করার, কিন্তু যমুনার রক্তচক্ষুর সামনে তার কিছুই মুখ ফুটে বলার উপায় রইল না। কিন্তু এত পড়াশোনার চেষ্টা সত্ত্বেও মাধ্যমিকটা কোন ভাবে পাশ করে, উচ্যমাধমিকে একাধিক বিষয়ে ব্যাক পেয়ে নিজে থেকেই পড়া ছেরে দিল প্রতুল। মনোতোষ একবার যমুনাকে বলেছিল,
— “নিজের পেটের ছেলের বিদ্যের দৌড় তো দেখলে…আমি বলি আভাকে আবার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিই! ঘরে একজন তো লেখাপড়া শিখুক!”
— “মেয়ে মানুষের অত পড়ার কোন দরকার নেই! কি হবে অত লেখাপড়া করে! দুদিন পরে সেই তো আবার অত খরচ করে বিয়ে দিতে হবে ওকে, গিয়ে তো সেই হাতা খুন্তি ঠেলবে!”
— “না তবুও…মেয়েটা যখন পড়তে চায়…”
— “না কোনদিন নয়। কি প্রমান করতে চাও তুমি, যে তোমার নিজের ছেলে পড়া লেখা শিখল না, আর ওই বেশ্যা মাগীর মেয়ে বিদ্যেধরী! খবরদার, ওকে পড়ানোর কথা বললে আমি অনর্থ বাধাবো বলে দিলাম!”
প্রথমে আভাকে এই বাড়িতে রাখা নিয়ে যতটা স্পষ্ট ভাবে যমুনার সামনে নিজের বক্তব্য রাখার ক্ষমতা ছিল মনতোষের, এখন যেন তার অনেকটাই হারিয়েছে সে। তার কারণ এই বয়সে এসে আর পারিবারিক কলহ বাড়াতে চায় না সে। তাই চুপ করে মেনে নিয়েছিল যমুনার কথা।আভা সমস্তই শুনতো তার সম্বন্ধে তার সৎ মা কি বলছে। সেই অল্প বয়স থেকে যমুনাকেই নিজের মা হিসাবে দেখত সে, আপ্রাণ চেষ্টা করত তার মন জুগিয়ে চলার। কিন্তু একটা প্রবাদ আছে না ‘যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা’, ঠিক সেভাবেই প্রতুলের জন্য যে স্নেহ ভালোবাসা যমুনার মনে ছিল তা কোন দিন গড়ে ওঠেনি আভার জন্য। মাঝে মাঝে মালতীর কথা বড্ড মনে পড়ত আভার, চোখের জলে ভিজে যেত মাথার বালিশ।
— “তোমার সাথে আমাকেও কেন নিয়ে গেলে না মা, এখানে যে অন্যের চক্ষুশূল হয়ে বেঁচে থাকতে পারছি না আমি!”
কিন্তু ঈশ্বর বোধহয় নিরুত্তর হয়ে রইতেন এই অসহায় মেয়েটির আর্তনাদ শুনে। এমনই সময়ে হঠাৎ করে এক রাত্রে স্ট্রোক হয়ে ইহলোকের মায়া ছেড়ে চলে গেল মনোতোষ। যে মানুষটা একটু হলেও সহানুভূতিশীল ছিল আভার প্রতি সেও আর রইল না। প্রতুল গিয়ে বসল বাবার দোকানে। এবার তো যমুনার দৌরাত্ব আরো বেড়ে গেল। সে উঠে পড়ে লাগল আভাকে পাকাপাকি ভাবে এই বাড়ি থেকে বার করতে। এমনই সময় পাশের গাঁয়ের মণিময় চক্রবর্তীর সাথে আভার বিয়ের সম্বন্ধটা যেন লুফে নিল যমুনা। মণিময় হলেন বেশ বড় বস্ত্র ব্যবসায়ী, কলকাতায় একটি বেশ বড় কাপড়ের দোকান আছে তার। তাই তার বাড়িতে গিয়ে খাওয়া পরার অভাব হবে না আভা জানত। তবে দোষের মধ্যে মণিমায়ের বয়সটা একটু বেশি, প্রায় পঞ্চাশের কাছে। তার প্রথম স্ত্রী সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়, বাচ্ছাটিকেও বাঁচানো যায়নি। তার পর থেকে আর বিয়ে করার ইচ্ছাই ছিল না মণিময়ের। পরে আত্মীয় স্বজনের অনেক বলাবলিতে দ্বিতীয় বিয়েতে মত দিয়েছেন মণিময়। কোন দাবি দাওয়া নেই, এক বস্ত্রেই আভাকে ঘরে তুলতে চান তিনি। এই পরিস্থিতিতে নিজের স্বপ্নগুলোকে অনেক আগেই গলা টিপে মেরে ফেলেছিল আভা। তাই এমন বেশি বয়সের দোজবর পাত্রকেই বিয়ে করতে রাজি হল সে। শুধু একবার যমুনাকে এই বিষয়ে কিছু বলতে সে বলে উঠেছিল,
—- “তাও তো ভালো যে জামাইএর আগের বউয়ের বাচ্চাটা জন্মাবার আগেই মারা গিয়েছে, তাই তোকে আর আমার মত সতীন কাঁটা নিয়ে ঘর করতে হবে না!”
সেদিন আর কিছু বলতে পারেনি আভা। সে বুঝতে পেরেছিল যমুনার মনে সৎ মেয়ের জায়গা থেকে কখনো নিজের মেয়ের জায়গায় সে পৌঁছতে পারবে না। কিছুদিনের মধ্যেই মণিময়ের সাথে বিয়ে করে সেই বাড়ি ত্যাগ করেছিল আভা।*
বেশ কয়েকটি বছর কেটে গিয়েছে। মণিময়ের পরিবারে খারাপ নেই আভা। বেশি বয়সে হলেও আভাকে সন্তান সুখ দিতে সমর্থ হয়েছে মণিময়। আর কয়েক দিন পরে নিজের একমাত্র ছেলে টুবলুর মুখে ভাতের অনুষ্ঠানটা খুব ভালো করেই আয়োজিত করতে চান ধনী ব্যবসায়ী মণিময়। সেই সূত্রেই তাদের এতবড় বাড়িটা এখন থেকেই গমগম করতে শুরু করেছে আত্মীয় স্বজনের ভিড়ে। কলকাতা থেকে এসেছে মণিময়ের এক দূরসম্পর্কের বোন, নাম শোভনা। বয়সে অনেকটা আভার মতই সে। কিন্তু আভার থেকে বিস্তর বেশি পড়াশোনা করা শিক্ষিত মেয়ে সে, এখনো বিয়ে করেনি। চাকরি করে কলকাতার একটি নামী বহু-জাতিক প্রতিষ্ঠানে। তবুও আভার সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে শোভনার। শোভনার সখ্যতা পেয়ে এবং বিশেষ করে তার শহুরে চালচলন যেন মুগ্ধ আভা। মাঝে মাঝে তার মনে হয় যদি নিজে পড়াশোনাটা কোনভাবে শেষ করতে পারত সে, তাহলে হয়তো সেও কলকাতায় গিয়ে চাকরি করতে পারত, এমন সুন্দর শহুরে আদব কায়দা শিখতে পারত। শোভনার সাথে এতটাই অন্তরিক হয়ে উঠেছিল আভা, যে তার সাজের জিনিসগুলো মাঝে মাঝে নিজেও ব্যবহার করত আভা। একদিন শোভনার কাছ থেকে একটি পারফিউমের বোতল নিয়ে নিজের গায়ে স্প্রে করতে যাচ্ছিল সে, এমন সময় সেটা দেখে হাহা করে ছুটে এল শোভনা।
— “আরে করছ কি বৌদি! ওটা কোন যে সে সেন্ট নয় গো! ওটা খবরদার নিজের গায়ে স্প্রে করো না…কারণ ওটার কাজ হল যার মুখে স্প্রে করা হয়েছে তাকে নিমেষের মধ্যে অজ্ঞান করে দেওয়া!”
— “সে কি গো! তা এমন জিনিস তোমার কাছে…”
— “কি বলি বলো বৌদি! কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে একা থাকি। প্রায়দিনই অফিস থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়! জানই তো কলকাতার রাস্তাঘাট কেমন, বদমাশ ছেলে ছোকরার অভাব নেই…তাই ওটা নিজের কাছে রাখি!”
— “ও আচ্ছা…বাহ বেশ ভালো করেছ ভাই!”
— “শোন না, তুমিও ওটা নিজের কাছে রাখো…যদি কখনো কাজে লাগে।”
— “না না, আমার ওটা আবার কি কাজে লাগবে ভাই…”
— “আরে রাখই না…আমার কাছে ওরকম আরো কয়েকটা আছে…এটা না হয় তোমাকে দিলাম!”
শোভনার পীড়াপীড়িতে ওই সেন্টের বোতলটা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিল আভা।আর একদিন পরেই টুবলুর অন্নপ্রাসন। কেমন যেন একটা দোটানায় পড়েছিল আভা। এই বাড়িতে তার স্বামীর পক্ষের এত অতিথিরা আছে, কিন্তু বাপের বাড়ির পক্ষের কেউ নেই। তার বারবার মনে হচ্ছিল একবার যমুনা আর প্রতুলকেও এই অনুষ্ঠানে ডাকলে কেমন হয়। কিন্তু বিয়ের পর থেকে ওরা আর তেমন যোগাযোগ করেনি আভার সাথে, যেন ঘাড় থেকে আভাকে নামাতে পেরে নিষ্কৃতি পেয়েছে যমুনা। তবুও আজ তাদের কথাই কেন বারবার মনে পড়ছে আভার! হোক না সৎ মায়ের পরিবার, তবুও তো জীবনের এতগুলো বছর তাদের কাছেই কাটিয়েছে সে, তাদের গলগ্রহ হয়ে জীবন কাটালেও অন্তত তাকে বিয়ের আগে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে তো দেয়নি তার সৎ মা! তারা ছাড়া আর আভার নিজের বলতে আছেই বা কে? সাত পাঁচ ভেবে টুবলুকে শোভনার কাছে রেখে একটা নেমন্তন্নের কার্ড নিয়ে পরদিন দুপুরেই যমুনার বাড়ির দিকে রওনা হয় আভা। বুকের ভেতর কেমন একটা শিরশিরানি জেগে ওঠে আভার, এত দিন পর কি জানি কেমন আছে ওরা! তাকে দেখেই বা কি বলবে যমুনা! রিকশা থেকে নেমে সেই পরিচিত এক তলা বাড়িটার দিকে এগিয়ে আসে আভা, যেখানে এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সাথে কেটেছে তার জীবনের এতগুলো বছর।
ওদের বাড়িটা লোকালয় থেকে একটু দূরে একটা ফাঁকা মাঠের শেষ প্রান্তে অবস্থিত। বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তে গিয়েও যেন থেমে যায় আভা। দেখে যে বাড়ির সদর দরজাটা ভেজানো! ভেতরে বেশ কয়েকটি মানুষের হুটপাটি এবং ছুটোছুটি করার শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই সময় তো প্রতুল দোকানে থাকে, বাড়িতে যমুনায় একার থাকার কথা! তাহলে কারা ঢুকেছে ঘরের ভেতর! আভা আলতো করে দরজাটা খুলে ভেতরের দৃশ্য দেখে আৎকে ওঠে। দেখে যে ঘরের দেওয়ালের এক পাশে যমুনা পড়ে রয়েছে। তার কপালটা অনেকটা কেটে গিয়েছে, বেশ রক্ত বেরিয়েছে সেখান থেকে! বোঝাই যাচ্ছে কেউ খুব বলপূর্বক তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে দেওয়ালের গায়ে!
— “মা…মা কী হয়েছে তোমার?”, চিৎকার করে ওঠে আভা।
আহত যমুনা মেয়ের মুখটা চেপে ধরতে চায় তারপর বিপরীত দিকের একটি ঘরের দিকে কি যেন ইশারা করে দেখাল। কিন্তু তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে আভার কোলে। মুহূর্তের মধ্যে যমুনাকে কোন রকমে টেনে তুলে সদর দরজার বাইরে এনে রাখে আভা। তখনই সে দেখতে পায় ঘরের ভেতর থেকে তিনটে ষন্ডা গোছের ছেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে। এদের একজনের হাতে যমুনার বিয়ের গহনার বাক্স এবং কিছু পয়সা কড়ি। আভা বুঝতে পারে যে তার মানে এরা লুঠপাট করতে এসেছে এই বাড়িতে। ছেলেগুলো তেড়ে আসতে লাগল আভার দিকে। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় আভার, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তার মনে পড়ে যে তার হ্যান্ড-ব্যাগের মধ্যেই রাখা আছে শোভনার কাছ থেকে পাওয়া অজ্ঞান করার স্প্রে বোতলটা! চোখের নিমেষে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের নাক মুখ চেপে ধরে সে বোতলটি খালি করে দেয় ওই তিনটি ছেলের মুখের কাছে। কি হচ্ছে সেটা বোঝার আগেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ওই তিনজন। আর একটুও দেরি না করে বাড়ির সদর দরজাটা বাইরে থেকে ভালো করে বন্ধ করে দেয় আভা। তারপর যমুনাকে কোন রকমে কোলে নিয়ে ছুটে চলে স্থানীয় রিকশা স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।যমুনার যখন জ্ঞান ফিরল, তখন সে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। মাথায় বড় একটা ব্যান্ডেজ বাধা। তার বিছানার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে আভা, শোভনা, মণিময় সহ সেই বাড়ির বেশ কিছু লোক। অপর দিকে দাঁড়িয়ে আছেন এক দল কনস্টেবল সহ স্থানীয় থানার ওসি। তাদের কাছেই হাতে হ্যান্ডকাফ পরে দাঁড়িয়ে আছে ওই তিন বদমায়েশ…কিন্তু একী! তাদের পাশে যে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রতুল! তার হাতেও যে হাতকড়া!
— “বাহ, তাহলে আপনার জ্ঞান ফিরেছে দেখছি। আপনার ভাগ্য ভালো যে সঠিক সময়ে আপনাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে গেছেন আপনার সৎ মেয়ে, আভা…নাহলে হয়তো আপনাকে বাঁচানো সম্ভব হতো না ডাক্তার বাবুদের!”, বলে উঠলেন ওসি সাহেব।
— “ওরা কারা? আর ওদের সাথে আমার প্রতুলকেও কেন এরেস্ট করেছেন আপনারা?”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল যমুনা।
— “ওরা আর যেই হোক না কেন, এইটুকু জানবেন ওদের আপনার বিবাহের গহনা এবং বাড়িতে রাখা টাকা পয়সা লুট করে আনার জন্য ভাড়া করা হয়েছিল। আর ওরা নিজে মুখে স্বীকার করেছে যে ওদের পয়সার লোভ দেখিয়ে এই কাজ করতে বলেছিল আপনারই ছেলে প্রতুল!”
যমুনার মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার পেটের ছেলে প্রতুল!…সে কিনা নিজের বাড়িতেই ডাকাতি করানোর মত ঘৃণ্য কাজ করেছে! ভাবতেই পারছে না যমুনা…কিন্তু কেন?
— “আপনার এই গুণধর পুত্র যে দোকানে বসার সাথে সাথে জুয়া খেলাও ধরেছে, সেটা নিশ্চয় আপনি জানতেন না যমুনা দেবী। তাই তার বাজারে হয়েছিল বেশ কিছু দেনা। সেটা শোধ করতেই এই অভিসন্ধি!”, বলে উঠলেন অফিসার।প্রতুল সহ ওই তিনজন শয়তানকে একে একে নিয়ে গেল পুলিশের লোকেরা। মণিময় এবং তার বাড়ির অন্যান্য লোকেরাও বেরিয়ে গেল হাসপাতালের ঘরটা থেকে। রইল শুধু যমুনা আর আভা। এতদিন ধরে যে পেটের ছেলেকে নিজের সবটুকু দিল যমুনা, তার কাছে তার মায়ের জীবনের কোন দাম নেই। সেখানে তার সতীন কাঁটা, তার সৎ মেয়ে আভা যাকে সারা জীবন সে দুই চোখে দেখতে পারেনি, এত অন্যায় অনাচার করেছে যার সাথে, সেই আভাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আজ তার প্রাণ বাঁচাল। যমুনার চোখের দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে শুরু করেছিল অনর্গল বয়ে চলা নোনতা অনুশোচনার ধারায়। অস্ফুট কণ্ঠে সে আভাকে বলে উঠল,
— “আয় মা, আয় আমার বুকে আয়!”
আভা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তার সৎ মাকে, যার সাথে আজ হয়তো নিজের গর্ভধারিনী মায়ের কোন পার্থক্য নেই। -
গল্প- শোধ বোধ
শোধ বোধ
– প্রলয় কুমার নাথআয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে সুনিপুণ হাতে সাজাচ্ছিল নিশা। ওর গায়ের রঙ বেশ পরিষ্কার, তাই গোলাপী রঙের পিওর সিল্ক শাড়িটা ওকে বেশ ভালোই মানাচ্ছে। মানানসই লিপস্টিক, আই লাইনার এবং যথাকিঞ্চিত অন্যান্য প্রসাধনীতেই কি অপরূপা লাগছে তাকে। আজ প্রসূন তার মাকে প্রথম নিয়ে আসছে এই বাড়িতে, ওর মায়ের আবার হালকা সাজই পছন্দ। তবে খোঁপায় রজনীগন্ধার মালাটা নিশার যে কোন শুভ মুহূর্ত উপলক্ষ্যে প্রিয় সাজ, তা সে বিয়ে বাড়ি হোক বা অন্য কোন অনুষ্ঠান। প্রসূনের ওকে উপহার দেওয়া সেই পারফিউমটারই সুবাস নিজের গায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার সাথে সাথে বেজে উঠল ওর বাড়ির ডোর-বেল। নিজের ঘর থেকেই নিশা শুনতে পেল ওর মাসী দরজা খুলে ওদের আপ্যায়ন করে ভেতরে ঢোকালেন। তারপর ওদের বসিয়ে কিছু কথাবার্তা বলে এক ফাঁকে নিশার কাছে এসে হাসিমুখে বলে গেলেন,
– “ওরা এসে গিয়েছেন, ঝটপট তৈরি হয়ে চলে আয়…”
নিজেকে এক ঝলক আয়নায় দেখে নিয়ে প্রসূন আর তার মায়ের কাছে চলে গেল নিশা।খুব অল্প বয়সেই মা বাবাকে হারায় নিশা। মায়ের মৃত্যু তো তার জন্মের কয়েক মুহূর্ত পরেই হয়, ওর বাবা ইহলোক ত্যাগ করেন যখন ওর চার বছর বয়স। তারপর থেকেই ওর মা বাবার ভূমিকা পালন করেছিলেন ওর মাসী আর মেসোমশাই। তাদের কাছেই সেই চার বছর বয়স থেকে মানুষ হয়েছে নিশা। গত বছর গত হয়েছেন ওর মেসোমশাই, তাই ওর পরিবারে ও ছাড়া এখন আছেন শুধু ওর মাসী। প্রসূনের সাথে নিশা একই অফিসে চাকরি করছে প্রায় দুই বছর ধরে। সেই সূত্রেই দুজনের আলাপ যা পরিণতি পেয়েছে প্রেমে। দুই পরিবারের সম্পূর্ণ মত আছে তাদের এই সম্পর্কে। ছবিতে অনেকবার দেখালেও, আজ প্রথম বার প্রসূন তার মা সুরঞ্জনা দেবীকে নিয়ে এসেছে নিশার সাথে আলাপ করাতে। হয়তো আজকেই স্থির হতে পারে প্রসূন আর নিশার বিবাহের দিনক্ষণ। বাড়ির ড্রইং রুমের ঝকঝকে কাঁচের সেন্টার টেবিলটা জুড়ে ওরা বসেছিল সবাই। মাঝে রাখা ছিল ধূমায়িত কফি, মিষ্টি, সিঙ্গারা এবং আরো নানাবিধ সুখাদ্য। হাসি ঠাট্টায় বেশ কাটছিল ওদের সময়টা। নিশা দেখল যে তার হবু শ্বাশুড়ি সুরঞ্জনা দেবী খুব খোলামেলা মনের মিশুকে মানুষ, একেবারেই সিনেমা সিরিয়ালের দজ্জাল শাশুড়িদের মতো নন। নিশা ভাল ক্লাসিকাল গায় শুনে তার খালি গলার বেশ কয়েকটা গান শুনতে চাইলেন তিনি। নিশার গলার মিষ্টি আওয়াজ যেন মুগ্ধ করল সকলকে।
কিছুক্ষণ পর একটু কুণ্ঠা মেশানো স্বরে নিশা সুরঞ্জনা দেবীকে বলে উঠলো,
– “আসলে মামণি, আমি নিজের পরিবার সম্পর্কে কোন কথাই গোপন করিনি আপনাদের কাছে। শুধু একটি কথা আমি এতদিন প্রসূনকে জানাতে চাইনি, যা আমি এখন বলতে চাই আপনাদের কাছে…”
বেশ অবাক হয়ে প্রসূন আর তার মা তাকালো নিশার দিকে।
– “কি কথা নিশা?” জিজ্ঞাসা করলো প্রসূন।
– “তোমাকে তো বলেইছি যে আমি ছোটবেলায় চার বছর বয়স অবধি দিল্লিতে কাটিয়েছিলাম। মাকে তো হারিয়েছিলাম আমার জন্মের সময়, আর বাবাকে হারালাম যখন আমার বয়স চার বছর। তবে আমার মায়ের মৃত্যুটা স্বাভাবিক হলেও, বাবার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না!”
– “কেন, কি ভাবে মারা গিয়েছিলেন তিনি?” জিজ্ঞাসা করলেন সুরঞ্জনা দেবী।
– “তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন!” প্রসূন আর তার মাকে চমকে দিয়ে বলেছিল নিশা। তারপর বেশ কিছুটা সময় ওরা সকলেই যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। অতঃপর নিশা বলতে শুরু করল,
– “দিল্লিতে একটি নামী খবরের কাগজের সংস্থায় কাজ করতেন আমার বাবা। সব কিছুই ভালো চলছিল, আমার জীবনে মায়ের অভাব থাকলেও বাবা যেন তা কখনো বুঝতে দিতেন না। কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই বাবার চাকরিটা কি কারণে চলে গেল তা আমিও জানি না। তখন থেকেই খুব মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লেন আমার বাবা। হয়তো সেই জন্যই একদিন রাত্রে ঘুমের ওষুধের গোটা শিশিটাই ফাঁকা করে দিলেন নিজের মুখে!” স্তব্ধ হল নিশা, প্রসূন দেখল পুরোনো স্মৃতিগুলো যেন অশ্রু হয়ে জমাট বেঁধেছে নিশার দুই চোখে। সে থামলে তার মাসীমা বলতে শুরু করলেন,
– “ওদের নিকট আত্মীয় বলতে এক আমারাই যা ছিলাম। তাই ওর বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে আর দেরি করিনি। কলকাতা থেকে ছুটে গিয়েছিলাম দিল্লিতে। তারপর মাতৃপিতৃহারা ওইটুকু দুধের শিশুটিকে ওখান থেকে নিয়ে এলাম কলকাতায়। আমরা নিজেরা নিঃসন্তান ছিলাম। ওকে পেয়ে মনে হয়েছিল যেন এতদিনের বঞ্চিত সন্তান সুখ আবার ফিরে পেলাম।”
– “প্রসূন…আমি তোমাকে এতদিন এই সব কথা বলতে পারিনি…কি জানি বারবার মনে হয়েছে এই কথাটা আমাদের সম্পর্কের মাঝে কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে না তো? কিন্তু আজ যখন আমাদের বিয়ের কথা চলছে…তখন আর পারলাম না এই কথা গোপন করতে! এখন তুমি যদি এটা জানার পরও আমায় বিয়ে করতে রাজি থাকো…” প্রসূনের কিছু বলার আগেই নিশার দুই হাত আঁকড়ে ধরলেন সুরঞ্জনা দেবী। তারপর স্নেহার্দ কণ্ঠে তিনি বললেন,
– “ছি ছি মা…এই ভাবে বলছ কেন? হ্যাঁ মানছি একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গিয়েছে তোমার শৈশবে, কিন্তু তার জন্য তো তুমি কোন অংশে দায়ী নও! আর আমি আমার সন্তানের মন বুঝি, তোমার মত সেও তো তার বাবাকে হারিয়েছে অনেক অল্প বয়সে, তাই আপনজনকে হারানোর ব্যাথা কি তা সেও জানে! তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, তোমার বাবার আত্মহত্যার ঘটনা কখনই তোমার আর প্রসূনের বৈবাহিক জীবনে কোন প্রভাব ফেলবে না!”
নিশা আর তার মাসীর মুখে স্বস্তির হাসি ফুটলো। ওদিকে প্রসূনও নিশার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে উঠলো।আরো কয়েকটা কথার ফাঁকে সুরঞ্জনা দেবী নিশাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
– “দিল্লির কোন সংস্থায় কাজ করতেন তোমার বাবা?”
-“দ্যা ইন্ডিয়া টাইমস…খুব নাম করা ইংরেজি খবরের কাগজ, এখনো বেরোয়!” নিশার উত্তর শুনে বেশ কৌতূহলী হয়ে আবার প্রশ্ন করলেন সুরঞ্জনা দেবী,
– “তোমার বাবার নাম কি ছিল নিশা?”
-“স্বর্গীয় শুভঙ্কর গাঙ্গুলী, মামণি” এই বলে অদূরে দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমে বাঁধানো একটি ছবির দিকে ইশারা করে সে আবার বললো,
-“ওই যে মামণি, ওই দেখুন ওটা আমার বাবা আর তার কোলে আমি…মাসীমণির কাছে শুনেছি ওটা নাকি আমার ছয় মাস বয়সের ছবি…”
সুরঞ্জনা দেবী এতোক্ষণ খেয়াল করেননি ছবিটাকে। এবার তিনি হ্যান্ড-ব্যাগ থেকে চশমাটা বার করে চোখে বসিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে।***
আজ রবিবার তাই অফিস নেই। দুপুরে বিছানায় শুয়ে প্রসূনের কথাই ভাবছিল নিশা। ভাবছিল তাদের বিয়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সম্বন্ধে যার তারিখ মাস খানেক পরেই স্থির হয়েছে। ফোন থেকে নিজের আর প্রসূনের পুরোনো ফটোগুলো দেখতে দেখতে যেন একটা স্বপ্নের রাজ্যে প্রবেশ করেছিল সে। এরই মধ্যে বাবাকে ভীষণ মিস করছিল নিশা। আজ যদি তার বাবা বেঁচে থাকতেন তাহলে একমাত্র মেয়ের বিয়ের কথা জেনে নিশ্চয় খুব খুশি হতেন তিনি। ভাবতে ভাবতে নিশা এগিয়ে গেল দেওয়ালে টাঙানো তার আর বাবার ছবিটার দিকে। ছবিতে বাবার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে সে মনে মনে বলে উঠলো,
-“কেন এমন করলে বাবা? কি এমন ঘটেছিল তোমার জীবনে যে এত বড় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হলে তুমি? ঘুমের ওষুধগুলো খাওয়ার সময় কি একবারের জন্যও তোমার আমার কথা মনে হল না? ভাবলে না তোমাকে ছাড়া আমার কি হবে? কি ভাবে বাঁচবো আমি? সেদিন যদি সাক্ষাৎ দেবদেবীর জুটির মত মাসীমণি আর মেসোমশাই ওখানে না পৌঁছতেন তাহলে…” ভাবতে ভাবতে কখন যে তার দুই চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে গেল সে নিজেও বুঝতে পারল না। এমন সময় তার হাতে ধরা মোবাইলটা বেজে উঠতেই তার ভাবনায় ছেদ পড়ল। নিশা চোখ মুছে ফোনটা রিসিভ করেই বলল,
-“হ্যাঁ প্রসূন…বলো…এতক্ষন তোমার কথাই ভাবছিলাম জানো…ভাবতে ভাবতে বাবার কথা…”
কিন্তু নিশার কথা শেষ না হতেই ফোনের ওপার থেকে উৎকণ্ঠার স্বর ভেসে এলো প্রসূনের গলা থেকে,
– “নিশা…আমাদের বাড়ির কাছে যে লাইফ-লাইন হাসপাতাল আছে, তুমি সেখানে তাড়াতাড়ি চলে এস…ইটস আর্জেন্ট!”
আর কিছু না বলেই ফোন কেটে দিল প্রসূন। হঠাৎ হাসপাতালে কেন আসতে বলছে প্রসূন? কার কি হল আবার? দুরু দুরু বুকে একবার মাসীকে বলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল নিশা। একটি ট্যাক্সি ডেকে সে ধরল লাইফ-লাইন হাসপাতালে যাওয়ার পথ।***
হাসপাতালের প্রসস্থ বারান্দায় রাখা বসার জায়গায় থমথমে মুখে মাথা নিচু করে বসেছিল প্রসূন। নিশা ব্যস্ত হয়ে তার কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
– “কি হয়েছে প্রসূন? হঠাৎ এইভাবে এখানে ডেকে পাঠালে?”
– “আজ সকালের দিকে হাতের শিরা কেটে মা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে নিশা…এখন মা এই হাসপাতালে ভর্তি। ডাক্তারবাবু বলছেন ওনার অবস্থা আশঙ্কাজনক…এখানে আনার আগেই শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বেরিয়ে গিয়েছে!”
– “কি বলছো তুমি?” নিশার মনে পড়ে যাচ্ছে তার বাবাকে হারানোর কথা, “সে কী! কিন্তু তিনি হঠাৎ করে কেন করতে গেলেন এমন কাজ?”
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল প্রসূন। ওর মুখে যেন অন্ধকার নেমে এল। তারপর পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরো বার করে নিশাকে দিয়ে বললো,
– “মা হাত কাটার আগে এটা লিখে রেখে যান। ওনার ঘর থেকেই এটা পেয়েছি। পড়ে দেখ…তোমার প্রশ্নের উত্তর এর মধ্যে আছে!”
বিস্মিত নিশা কাগজটার দিকে চোখ নামিয়ে পড়তে লাগল। সুরঞ্জনা দেবী লিখেছেন:“প্রসূন,
জানিনা যখন তুই এই চিঠিতে লেখা কথাগুলো পড়বি, তখন আমি এই পৃথিবীতে থাকবো কি না। তবে এই কথাগুলো জানার দরকার তোর থেকে বেশি নিশার। তোদের খুব বেশি সময় নেব না, গৌরচন্দ্রিকা না করে আসল কথাটা বলি। তোর যখন পাঁচ বছর বয়স তখন একটি পথ দুর্ঘটনায় তোর বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেল। আমি পড়লাম অথৈ জলে। মৃত্যুর আগে তেমন কিছুই সঞ্চয় করে যেতে পারেনি তোর বাবা। কি করব, কি ভাবে সংসারের খরচ যোগাব, কি ভাবে তোর স্কুলের ফিস ভরব এই সব ভাবতে ভাবতে আমার রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল। ইংরেজি নিয়ে মাস্টার্স করা ছিল, তাই চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে লাগলাম। কলকাতার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরি পেলাম। মাইনে অল্প ছিল, তাই শুরু করলাম স্কুলের বাইরে ছাত্র ছাত্রীদের বাড়ি গিয়ে প্রাইভেট টিউশন পড়ানো। বুঝতেই পারছিস, আমি এতক্ষন ধরে বাড়ির বাইরে থাকার ফলে তোকে দেখাশোনা করার তেমন সুযোগ পেতাম না। তাই বাধ্য হয়েই তোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোকে ভর্তি করেছিলাম কলকাতার একটি আবাসিক স্কুলে। এখনো মনে পরে তোর কচি মুখের জল ভরা দুই চোখের কথা যেদিন তুই আমাকে টাটা করে ওই স্কুলে চলে গলি। এরপর আবাসিক স্কুলে থাকাকালীন তুই কিছুই জানতে পারিসনি আমি কি করেছি, কোথায় গেছি, কিভাবে অর্থ উপার্জন করেছি এবং সর্বোপরি কোন অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়েছি। এখন সেটাই বলার সময় এসেছে।তোর সাত কি আট বছর বয়স, তখন আমি দিল্লি থেকে একটি চাকরির অফার পেলাম। মাইনে যথেষ্ট ভাল, কাজও আমার পছন্দের তাই পাড়ি দিলাম দিল্লির ‘দ্যা ইন্ডিয়া টাইমস’ খবরের কাগজের অফিসে। সেই সময় সেখানেই চাকরি করতেন নিশার বাবা শুভঙ্কর বাবু। তিনিই ছিলেন আমার বস! প্রথম দেখাতেই আমি আকৃষ্ট হলাম তার প্রতি। তারপর থেকেই চেষ্টা করতে লাগলাম নানা কাজের অছিলায় ওনাকে নিজের কাছে পেতে। জানতাম ওনার স্ত্রী বেঁচে নেই, তাই আমাদের মধ্যে বাধার সৃষ্টি আর কেউ করবে না। আকারে ইঙ্গিতে ওনাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে ওনাকে আমি অন্য চোখে দেখি। ভেবেছিলাম উনি পুরুষ মানুষ, নিজেকে খুব বেশিদিন দূরে রাখতে পারবেন না আমার মত সুন্দরী মহিলার কাছ থেকে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম, ওর প্রতি আমার ভালোবাসা ছিল এক তরফা। উনি কখনো আমাকে ওনার অধীনস্ত কর্মচারী ছাড়া অন্য কোন চোখে দেখেননি। উপেক্ষার আগুনে জর্জরিত হয়ে ওনার প্রতি আমার সমস্ত ভালোবাসা যেন প্রতিহিংসার রূপ নিতে থাকল। মনে হল আমি কি এতই ফেলনা যে আমার দিকে একবার তাকাতেও নেই? একদিন যখন উনি অফিসের একটা কাজের জন্য আমায় ডেকে পাঠালেন, তখন আমি গিয়ে ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলাম ওনার কেবিনের দরজা। তারপর ওনাকে জড়িয়ে ধরে জানালাম আমার মনের কথা। কিন্তু উনি সেই মুহূর্তে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে বললেন। হেরে যাওয়ার আগে শেষ মরণ কামড়টা দিয়ে ফেললাম আমি। নিজেই খুলে ফেললাম নিজের শাড়ির এক অংশ, ছিঁড়ে দিলাম নিজের ব্লাউজের দুই দিক। ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওনার গায়ের ওপর, আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করলাম ওনার বুক, পিঠ, মুখ। সাথে তারস্বরে চিৎকার করতে লাগলাম,
– “কে আছো বাঁচাও আমায়…শুভঙ্কর স্যার আমাকে রেপ করার চেষ্টা করছেন!”
ওনার ঘরে কোন সিসিটিভি ছিল না এবং সেটাই ছিল আমার সৌভাগ্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই অফিসের বাকি স্টাফরা আমাকে ওনার হাত থেকে ‘উদ্ধার’ করলেন। আমার মত দুঃখী অবলা নারীর দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারল না কেউ। তাছাড়া ওই অফিসের বেশ কিছু উপর মহলের স্টাফদের সাথে আগে থেকেই ওনার রেষারেষি ছিল। অফিস কর্তৃপক্ষ নিজেদের সম্মান বাঁচাতে আমাকে আইনের দ্বারস্থ হতে মানা করলেন, এবং এই ‘অন্যায়ের’ শাস্তি স্বরূপ ওনাকে স্যাক করলেন। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছিস চাকরি হারিয়ে কেন মানসিক ভাবে এত ভেঙে পড়েছিলেন শুভঙ্কর বাবু যে উনি আত্মহত্যার পন্থা বেছে নিলেন!এরপর আমিও বেশিদিন আর কাজ করিনি ওই অফিসে। কলকাতায় আরেকটি ভালো অফার পেয়ে ফিরে আসি। মনে মনে নিজের করা ভুলের জন্য আফসোস হলেও সময়ের সাথে সেটা ভুলে যেতে থাকি। কখনো ভাবিনি আমার সেই কলঙ্কময় অতীতের কথা তোকে জানানোর প্রয়োজন হবে। কিন্তু সেদিন নিশাকে দেখতে গিয়ে আমার বুঝতে কিছুই বাকি রইল না, যে মেয়েটিকে আমার একমাত্র ছেলে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, আমিই হলাম সেই মেয়েটির বাবার আত্মহত্যা করার পেছনের একমাত্র কারণ। বুঝতে পারলাম যে এই সম্পর্ক হলে আমার সেই কৃতকর্মের কথা কোন না কোন দিন কোন না কোন ভাবে তোদের দুজনের সামনে প্রকাশিত হবেই। তখন কি হবে? আমার জন্য তোদের সংসারে ভাঙ্গন ধরবে না তো? অথচ তোর মুখের দিকে চেয়ে নিশাকে মেনে না নিয়েও উপায় ছিল না যে! দগ্ধে দগ্ধে মারছিলাম এত বছর আগেকার ওই পাপ কর্মের জ্বালায়! তাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম। একজন নিরাপরাধ মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়ার মত অপরাধ করে আমার নিজেরও বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই! সম্পূর্ণ স্ব-ইচ্ছায় নিজেকে শেষ করতে চলেছি আমি! হয়তো এভাবেই নিজের কৃতকর্মের শোধ বোধ করার কথা ঈশ্বর লিখে গিয়েছেন আমার কপালে। নিশাকে দিস এই চিঠিখানি, আর বলিস পারলে আমাকে ক্ষমা করতে।
ইতি,
তোর হতভাগিনী মা।”চিঠিটা পড়ে পাথর প্রতিমার মত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নিশা। ওদিকের জানলা দিয়ে আসা একটি দমকা বাতাস কখন উড়িয়ে নিয়ে গেল তার হাতে ধরা চিঠিটাকে, সে নিজেই বুঝল না। হঠাৎ একজন নার্স এগিয়ে এল তাদের কাছে, এসে বললো,
-“আপনারাই তো সুরঞ্জনা বোস-এর রিলেটিভ, রাইট? ঈশ্বরের অসীম কৃপা যে আমরা ওনাকে বাঁচাতে পেরেছি। ওনার জ্ঞান ফিরেছে!”
প্রসূন তখনই মাকে দেখার জন্য নার্সের সাথে তার কাছে ছুটতে উদ্যত হল। কিন্তু নার্সটি বলে উঠলেন,
– “এক মিনিট প্রসূন বাবু!”, বলে তিনি এগিয়ে এলেন নিশার কাছে, তারপর তাকে বললেন,
-“সুরঞ্জনা দেবী বারবার নিশা বলে একটি নাম উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। আই হোপ আপনিই নিশা দেবী, তাই তো? তাই প্রসূন বাবুর সাথে আপনিও প্লিজ আসুন ওনার সাথে দেখা করতে!”
প্রসূন আকুতির দৃষ্টিতে তাকাল নিশার দিকে। নিশার মনে হল তার পায়ের নিচের মাটিটা যেন থরথর করে কাঁপছে। তার সামনে রয়েছে তার ভালোবাসা, তার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন। ওদিকে তার পেছনে রয়েছে তার বাবাকে হারানোর যন্ত্রণা, তাকে যে এইভাবে নিজের জীবনটা শেষ করতে বাধ্য করেছে তার ওপর চরম ঘৃণা এবং প্রতিশোধস্পৃহা! কোন রাস্তাটা বেছে নেবে সে? ওর মাথা ঘুরতে লাগল…এই মুহূর্তে একটা সিদ্ধান্ত যে নিতেই হবে তাকে!হঠাৎ যেন বাবার সেই পরিচিত কণ্ঠস্বরটা বেজে উঠল তার কানে। তিনি যেন তাকে বলছেন,
– “আমার জন্য ভেবে নিজের ভালোবাসাকে হারিয়ে সারা জীবন কষ্ট পাসনি মা! যখন বেঁচে ছিলাম তখন তোর চোখের জল দেখে আমার বুক ফেটে যেত রে মা! তাই তুই কষ্টে থাকলে আমি যে মরেও শান্তি পাবে না! তুই এগিয়ে যা তোর ভালোবাসার দিকে, যে আমাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছিল সে নিজেও খুব অনুতপ্ত। নিজেও আমার রাস্তাই ধরতে চলেছিল সে! তাই সব ভুলে ক্ষমা করে দে তাকে, মনে রাখিস ক্ষমাই হল পরম ধর্ম!”
অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে নিশা ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল প্রসূনকে। যেন তার মনের সকল গ্লানি, সকল বিতৃষ্ণা ধুয়ে মুছে গেল এই পবিত্র প্রেমজ আলিঙ্গনে।
– “কই, চলুন…আমাদের নিয়ে চলুন মামণির কাছে!”, ব্যস্ত হয়ে নার্সকে বলে উঠল নিশা। তারপর সে এক বুক নিঃশ্বাস নিয়ে প্রসূনের হাত ধরে এগোতে লাগল সুরঞ্জনা দেবীর রুমের দিকে, এক ভেঙে পরা অনুতপ্ত মানুষকে ক্ষমা এবং ভালোবাসা দিয়ে পুনরায় সজীব করার অভিপ্রায়ে!(সমাপ্ত)
-
গল্প- ভুলের মাশুল
ভুলের মাশুল
– প্রলয় কুমার নাথসন্ধ্যার অন্ধরাচ্ছন্ন রাভুলেরস্তা দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছিল অরিত্রী। তার আলুথালু পোশাক, অবিন্যস্ত চুল আর শরীরের নানা স্থানে মারের কালসিটে দেখেই বোঝা যায় যে তীব্র দাম্পত্য কলহের শিকার হয়েছে অসহায় মেয়েটা। তার কপাল আর ঠোঁটের কষ গড়িয়ে আসা সরু রক্তের ধারা এখনো শুকিয়ে যায়নি। এলোমেলো পায়ে হাঁটছিল মেয়েটা, তার ছেঁড়া শাড়ির আঁচল লুটিয়ে পড়ছিল রাস্তার বুকে। সে যে কোথায় যাচ্ছে তা সে নিজেই জানে না। লোকালয় পেরিয়ে পাড়ার ইঁট ভাটার কাছটা দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ সে বুঝতে পারলো তিনটে গুন্ডা প্রকৃতির ছেলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে তার পিছু নিয়েছে। বেগতিক দেখে হাঁটার গতি বাড়াল অরিত্রী, তারপর সেটা যেন দৌড়ানোর রূপ ধারণ করলো। ছেলেগুলোও তার পিছু পিছু ছুটতে লাগলো।
একজন চিৎকার করে বলে উঠলো,”দৌড়ে আমাদের হাত থেকে পার পাবি ভেবেছিস শালী? যেখানেই যাস না কেন, আজ তোর সাথে লুডো খেলেই ছাড়ব রে ফুলটুসী!”
ওদের কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল যে ওরা আকন্ঠ মদ্যপান করে আছে। এক সময় দৌড়তে দৌড়তে পা হরকে নীচে পড়ে গেল অরিত্রী। শয়তানগুলো দাঁত বের করে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসতে লাগলো তার কাছে। অরিত্রী মাটিতে নিজের শরীরটাকে ঘষটে আরো দূরে যাওয়ার চেষ্টা করলো আর তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। কিন্তু কেউ তার কথায় কর্ণপাত করলো না। একটি ছেলে ঝটপট নিজের প্যান্টের চেন খুলে হুমড়ি খেয়ে পড়লো অরিত্রীর গায়ের ওপর। বাকিরা দুজন মজা দেখতে এবং নিজেদের সুযোগ আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ঠিক এমন সময় দূর থেকে একটি লাল আলো দেখা গেল, শোনা গেল পুলিশের গাড়ি আসার আওয়াজ। মুহূর্তের মধ্যে গাড়িটা এগিয়ে এলো তাদের কাছে, গাড়ি থেকে রিভলভার হাতে নিয়ে লাফিয়ে নেমে আসল এক লেডি পুলিশ অফিসার আর কিছু কনস্টেবল। ছেলে তিনটে সেই মুহূর্তে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালানোর জন্য ব্যস্ত হল। কনস্টেবলগুলো ছুটে গেল তাদের পেছন পেছন, কিন্তু তাদের ধরতে পারলো না। মহিলা পুলিশটি এগিয়ে এল অরিত্রীর কাছে, তারপর তাকে মাটি থেকে উঠতে সাহায্য করে বললো, “নাম কি তোমার? তোমাকে কি ওরা কোথা থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছিল?”
– “আমার নাম অরিত্রী সরকার…না আমাকে ওরা কোন জায়গা থেকে তুলে আনেনি…আমি নিজেই এই জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন ওরা আমার পিছু নেয়!”
– “স্ট্রেঞ্জ…তোমার বাড়ি কোথায়? আর তুমি এই ভর সন্ধ্যা বেলায় এই জায়গায় এসেছিলেই বা কেন?”
কোন উত্তর দিল না অরিত্রী, শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
– “তোমার বাড়ির ঠিকানাটা বল…আমরা তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আসব!”, আবার বললো পুলিশ অফিসার।
– “আমি বাড়ি যেতে চাই না, ম্যাডাম!”
শুনে অবাক হল লেডি অফিসার তথা স্থানীয় থানার ওসি সুতপা মৈত্র। কিছুক্ষণ সে তাকিয়ে দেখল অরিত্রীর দিকে। তাকে দেখেই সে বুঝতে পারলো যে মেয়েটি শুধু কিছুক্ষণ আগে একটি গণধর্ষণের শিকার হতে চলেছিল এমন নয়, সে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সেরও শিকার। আরেকটু সময় দিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হয়তো সে সব খুলে বলবে। অরিত্রীকে গাড়িতে বসিয়ে থানায় নিয়ে এল সুতপা। কিন্তু সেখানেও তেমন মুখ খুলতে চাইলো না সে। এমন মেয়েদের অনেক কেস হ্যান্ডেল করেছে সুতপা, সে জানে এমন অবস্থায় বেশ মেন্টাল ট্রমার মধ্যে থাকে মেয়েগুলো। সত্যি বলতে মেয়েটার ওপর খুব মায়া হচ্ছিল সুতপার। হয়তো আরেকটু সময় আরেকটু স্নেহের পরশ পেলেই স্বাভাবিক হতে পারবে মেয়েটা। তাই ডিউটি শেষে যখন সুতপা অরিত্রীকে বলে উঠলো, “শোনো, তুমি আমাকে নিজের বোনের মতই ভাবতে পারো, বুঝলে…চলো, কয়েকটা দিন না হয় আমার বাড়িতেই থাকবে চলো!”, তখন বিস্মিত অরিত্রীর আপত্তি করতে পারেনি তার কথায়।পুলিশের গাড়ি করে অরিত্রীর সাথে বাড়ি ফেরার পথে তাকে নিজের সম্বন্ধে অনেক কথা বলে চলেছিল সুতপা। আজ ওই ইঁট ভাটার কাছে একটি দেশি মদের ঠেকে রেড করতে গিয়েছিল তার টিম, তাই তারা বাঁচাতে পেরেছে অরিত্রীকে।
পাঁচ বছর আগে বিয়ে হয়েছে সুতপার, শ্বশুর শ্বাশুড়ি অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। তার স্বামী একটি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থায় কর্মরত ইঞ্জিনিয়ার। স্বামী এবং তিন বছরের ছোট্ট শিশুপুত্রকে নিয়ে ছোট্ট সংসার তার। বিয়ের পর সে চেয়েছিল পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিতে কিন্তু তার স্বামী তা করতে দেননি। তিনি মনে করেন মেয়েদের সবসময় স্বনির্ভর হওয়া উচিত। তাই দিনের বেশিরভাগ সময় যখন সুতপা আর তার স্বামী দুজনেই বাইরে থাকে তখন একজন আয়া দেখাশোনা করে তাদের বাচ্চাটাকে। তার সুখের সংসারের কথা শুনে অচিরেই একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল অরিত্রী। ইস, তারও যদি বৈবাহিক জীবনটা এমন হতো। তবে সুতপাকে বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল অরিত্রীর, পুলিশের মুখোশের গাম্ভীর্যের ভেতর খুব সরল হাসিখুশি মিশুকে মেয়ে সে। দেখতে দেখতে তারা পৌঁছে গেল সুতপার বাড়ি। তিনতলা সুন্দর করে সাজানো গোছানো বিশাল বাড়িটাকে দেখে যেন তাক লেগে গেল অরিত্রীর। সে বুঝতেই পারল যে স্বামীর ভালোবাসা ছাড়াও এই সংসারে আর্থিক প্রাচুর্যেরও সীমা নেই। অধিকাংশ দিনই সুতপার ফিরতে দেরি হয়ে যায়, তখন আয়া বাচ্চাটিকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যায়। তার স্বামী অবশ্য সে ফিরলে তবেই একসাথে বসে খান। ফোনে স্বামীর কাছে অরিত্রীর সম্বন্ধে সব কথা জানিয়েছিল সুতপা। তিনিও রাজি হয়ে গিয়েছিলেন অরিত্রীকে কিছুদিন এই বাড়িতে রাখার জন্য। বাড়ি ফিরে প্রথমে অরিত্রীকে নিজের একটি শাড়ি দিয়ে পরে আসতে বললো সুতপা। তারপর সে তাকে নিয়ে গেল তার স্বামীর কাছে, তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সে হাসিমুখে বললো, “এই হল হল আমার প্রিয় পতি দেবতা…শ্রী দীপঙ্কর মৈত্র!”
প্রথম দেখাতেই দীপঙ্কর আর অরিত্রী যেন অবাক হয়ে চেয়ে রইলো একে অপরের দিকে। তার কিছু পরে নমস্কার প্রতিনমস্কারের পালা মেটালো দুজনে। সুতপা একবার কৌতুকের স্বরে বললো, “কি গো, তোমরা দুজনে একে অপরকে আগে থেকেই চেন নাকি?”
উত্তরে শুধু মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলেছিল অরিত্রী।রাত তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। ঘুম আসছিল না অরিত্রীর দুই চোখে। সে নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে মৈত্র বাড়ির ছাদে এসে দাঁড়ালো। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার চারিদিকে, পশ্চিম দিক থেকে ভেসে আসছে হালকা হালকা ঠান্ডা বাতাস। আজ যদি সুতপা না থাকতো তাহলে ওই শয়তানগুলোর হাতে তার কি অবস্থা হত ভেবে শিউরে উঠছিল অরিত্রী। এমন সময় গলা খাকানির আওয়াজ শুনে পেছন ঘুরে চমকে উঠল অরিত্রী। সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে দীপঙ্কর। দীপঙ্কর মৃদু স্বরে বলে উঠলো, “আমাকে নিশ্চয় তোমার মনে আছে, অরিত্রী?”
অরিত্রী কোন উত্তর দিল না সে প্রশ্নের, এক দৃষ্টে চেয়ে রইল দীপঙ্করের দিকে। কিছুই ভোলেনি অরিত্রী, প্রতিটা স্মৃতি এখনো স্পষ্ট হয়ে ভাসছে তার চোখের সামনে। খুব ছোটবেলাতেই মাকে হারিয়েছিল অরিত্রী, এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মচারী তার বাবাকে নিয়ে ছিল তার পরিবার। কলেজের গন্ডি পেরোতেই তার বিয়ের চেষ্টায় উঠে পড়ে লাগলেন তার বাবা। তার ভাগ্য প্রসন্ন হওয়ায় অরিত্রীর জন্য এসেছিল উচ্চপদে কর্মরত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী সুদর্শন দীপঙ্করের সম্বন্ধ। দীপঙ্কর এক দেখাতেই পছন্দ করেছিল অরিত্রীকে। বিয়ের কথা পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অমোঘ নিয়তির ফেরে, বিয়ের দিনই সকলকে অবাক করে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল অরিত্রী। রাজুর সাথে কয়েক বছর একই কোচিংয়ে পড়ত অরিত্রী। সেখান থেকেই গড়ে উঠেছিল তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক। রাজু রূপ গুণ কোন অংশেই দীপঙ্করের সমতুল্য নয় জেনেও এমন আকর্ষণীয় সম্বন্ধ হাতছাড়া করে ভালোবাসার মানুষটার হাতই সেদিন আঁকড়ে ধরেছিল অরিত্রী। বেকার যুবক রাজুরও পরিবারে কেউ ছিল না, স্থানীয় একটি সাইকেল গ্যারেজে কাজ করতো সে। তার সংসারে অভাব জেনেও, তাকে বাবা কখনো বাড়ির জামাই হিসাবে মেনে নেবে না জেনেও বাবাকে লুকিয়ে তার সাথে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উদ্যেশ্যে পাড়ি দেয় অরিত্রী। তারপর প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছে বাবার সাথে আর কোন সম্পর্ক নেই অরিত্রীর। তার বাবাও আর বেঁচে নেই, এবং মৃত্যুর আগে তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি কোনো এক অনাথ আশ্রমকে দান করে যান!
– “এই ভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় যাচ্ছিলে অরিত্রী?”, প্রশ্ন করলো দীপঙ্কর।ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে অরিত্রী বললো, “মদের নেশাটা যেন রাজুকে রাক্ষস বানিয়ে তোলে। বিয়ের পর থেকেই মদ খেয়ে আমার গায়ে হাত তোলা ওর এক স্বভাব হয়ে গিয়েছিল। এখন মাঝে মাঝেই নেশাগ্রস্ত হয়ে আমাকে বাড়ি থেকে পয়সা নিয়ে আসতে বলছিল। কোন মুখে আমি বাড়ি যাই বলুন? আর না গেলেই মার…আজ অত্যাচার এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে…” লজ্জায় কুণ্ঠাবোধে কথা শেষ না করেই চুপ করলো অরিত্রী।
-“রাজুর শাস্তি হওয়া দরকার অরিত্রী…তুমি সুতপাকে ওর ব্যাপারে সব কিছু খুলে বলছো না কেন?”
– “না, আমি চাই না পুলিশ ওর কোনো ক্ষতি করুক…ও মানুষ হিসাবে খারাপ নয় দীপঙ্কর বাবু…আমি এখনো ওকে আগের মতই ভালোবাসি। জানি ওর নেশা কেটে গেলে আবার সেই আগের রাজুই হয়ে উঠবে…তাই…”
– “জানিনা তুমি কতটা সুখে আছো অরিত্রী” কথা শেষ করার আগেই দৃঢ় গলায় বলে উঠল দীপঙ্কর, “তবে আমি কিন্তু প্রথম দেখাতেই তোমায় ভালবেসে ছিলাম…সেদিন যদি তুমি রাজুকে ছেড়ে আমার হাত ধরতে তাহলে কি খুব একটা ভুল করতে অরিত্রী?”
অবাক চোখে অরিত্রী তাকিয়ে রইলো দীপঙ্করের দিকে। অতঃপর শান্ত নির্লিপ্ত গলায় সে বলে উঠলো,
– “এখন আর সেই সব ভেবে কোন লাভ নেই দীপঙ্কর বাবু…সুতপা খুব ভালো মেয়ে…ওকে সুখে রাখুন আপনি”, এই কথা বলে আর কোন দিকে না তাকিয়ে ছাদ থেকে নিচে নেমে এল অরিত্রী।পরদিন সারাটা বেলা কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে কাটালো অরিত্রী। তার শুধু মনে পড়ছিল রাজুর কথা। হয়তো গতকাল তার হাতে মার খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়াটা ঠিক হয়নি তার। এখন নেশা কেটে গিয়ে হয়তো রাজু আবার আগের মানুষ। হয়তো অরিত্রী কোথায় গেল এই ভেবে সেও খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আছে তার জন্য! বাড়ি ফিরলেই তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেবে সে, আবার চলতে থাকবে তাদের সংসার! তাই সন্ধ্যার দিকে কাউকে কিছু না জানিয়ে মৈত্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল অরিত্রী। নিজের বাড়ি ফেরার পথ ধরলো সে। টালির ছাদ দেওয়া একতলা ছোট্ট বাড়িটার কাছে আসতেই বাড়ির ভেতর থেকে রাজু আর অপর কোন এক মহিলার হাসির আওয়াজ শুনতে পেল সে। চুপি চুপি বাড়ির পেছনের খোলা জনলাটার দিকে এগিয়ে এল অরিত্রী। সে দেখলো বিছানার ওপর নগ্ন হয়ে রয়েছে এক কুৎসিত মহিলা। দেখে বাজারের যৌনকর্মী বলেই মনে হল তাকে। মদ্যপ রাজুর উলঙ্গ শরীরটা ক্রমাগত ওঠা নামা করছে সেই মহিলার দেহের ওপর। সেই মহিলাটি যৌন সুখপ্রাপ্তির আওয়াজ করতে করতে খিলখিল করে হেসে বলছে, “তোর বউ যদি জানতে পারে যে তুই তার রেখে যাওয়া গয়না বেচে আমার সাথে ফুর্তি করছিস, তাহলে কি ভাববে বল তো?”
কোমর দোলাতে ব্যস্ত মদ্যপ রাজুও বলে উঠলো, “কি আবার বলবে ওই মাগী? ওকে এই ঘরে ঢুকতে দিলে তো…”
– “সে কি রে! তুই না ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলিস…”
– “আরে রাখ তোর ভালোবাসা! ওই শালীকে পটিয়ে বিয়ে করেছিলাম যাতে ওর ব্যাঙ্ক ম্যানেজার বাবার কাছ থেকে দিনের পর দিন পয়সা হাতাতে পারি! সেটা আর হল কোথায়, শালা বুড়োটা মরার আগে পুরো সম্পত্তি কোন এক অনাথ আশ্রমের নামে লিখে দিল। আমার প্ল্যান পুরো ফেল, এখন ওই শালী ফিরে এলেও ওকে আবার লাথ মেরে বার করে দেব…হা হা”
ওরা আরো অনেক কিছুই বলে চললো, কিন্তু অরিত্রীর কানে যেন সেই সব ঢুকলোই না। সে রাজুর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। এতদিন এত অত্যাচার সহ্য করেও সে রাজুর সংসার করেছে শুধুমাত্র তাকে ভালোবাসে বলে, এখন বুঝতে পারলো সেই ভালবাসা প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছু নয়! যেন বাঁচার ইচ্ছাটাই ধীরে ধীরে চলে গেল অরিত্রীর মন থেকে। সে আবার ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো, তবে আজ তার গন্তব্য হল বাড়ির পাশের রেল লাইন, উদ্দেশ্য আত্মহত্যা। অন্ধকারের মধ্যে রেল লাইনে দাঁড়িয়ে রইলো অরিত্রী। দূর থেকে সেই লাইনেই একটি ট্রেন আসছে বুঝতে পারলো সে, দেখা যাচ্ছে তার আলো, শোনা যাচ্ছে তার হুইসেলের শব্দ। অরিত্রীর আরো কাছে এগিয়ে এল ট্রেনটা, আসন্ন মৃত্যুর দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে নিল অরিত্রী। কিন্তু হঠাৎ কি মনে হতেই লাফ মেরে রেল লাইনের এক পাশে গিয়ে পড়ল সে। ট্রেনটি সশব্দে বেরিয়ে গেল তার পাশ দিয়ে। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে অরিত্রীর মনে হল, না এত সহজে মরবে না সে। যার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আজ তার এই অবস্থা, যার প্ররোচনার জন্য দীপঙ্করের সাথে সুখে সংসার করা হল না তার, যার জন্য বাবা তাকে ত্যাগ করলেন, যার জন্য আজ তাকে পথে ধুলোয় এই ভাবে পড়ে থাকতে হচ্ছে, এত সহজে ছেড়ে দেবে তাকে? নাহ, তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে নাহলে মরেও শান্তি পাবে না সে!ধীর পায়ে অরিত্রী আবার এগিয়ে গেল বাড়ির দিকে। এখন দেখল রাজু মদের নেশায় অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে বিছানাতে। ওই বাজারের মেয়েটা হয়তো কাজ শেষে বেরিয়ে গিয়েছে বাড়ি থেকে তাই বাড়ির সদর দরজা ভেজানো। পা টিপে টিপে অরিত্রী এসে দাঁড়ালো রাজুর বিছানার কাছে। বিছানার এক পাশে এখনো পড়ে রয়েছে দেশি মদের বোতল আর আধ খাওয়া মদের গ্লাস। অরিত্রী জানত নেশা কিছুটা কাটলেই ওই গ্লাসের মদটা শেষ করবে রাজু। নিঃশব্দে রান্নাঘর থেকে এক প্যাকেট ইঁদুর মারার বিষ নিয়ে এল অরিত্রী আর তা মিশিয়ে দিল রাজুর মদের গ্লাসের মধ্যে। তারপর সে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। পেছনের জানলা দিয়ে দেখল কিছুক্ষণ পর বিছানা থেকে উঠে মদের গ্লাসটা নিঃশেষ করলো রাজু। আর সাথে সাথেই মরণ যন্ত্রণা শুরু হল তার শরীরে। মুখ দিয়ে গেজলা উঠতে উঠতে নীচে পড়ে গেল রাজু। ছটফট করতে করতে তার চোখ গেল জানলার দিকে। সে দেখলো অরিত্রী তখনো এক দৃষ্টে চেয়ে আছে তার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিথর হয়ে গেল রাজুর দেহ।
সেই রাত্রে নিজেকে অনেক বেশি হালকা আর ফুরফুরে লাগছিল অরিত্রীর। শুধু সুতপার জন্য একটা চাপা ঈর্ষা বোধ যেন লুকিয়ে ছিল তার মনের কোন অংশে। যদি রাজুর প্ররোচনায় সে পা না দিত, তাহলে হয়তো সুতপার জায়গাটা আজ তার হত। সেও দীপঙ্করের সাথে সুখে স্বাচ্ছন্দে সংসার করতে পারতো। কিন্তু এখন যে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে, আর তার জন্য সুতপার সাথে কোন অন্যায় হোক সেটা কখনই হতে দেবে না সে। সে ফিরে এল মৈত্র বাড়িতে। তারপর দীপঙ্কর আর সুতপাকে সব কথা জানিয়ে নিজের দুই হাত মুঠো করে এগিয়ে দিল সুতপার কাছে। তারপর বললো, “আমি আমার স্বামীকে খুন করেছি সুতপা…তুমি আমায় এরেস্ট করো!”
সেদিন রাতে বাড়ির ছাদে দীপঙ্করের সাথে অরিত্রীর যে কথাগুলো হয়, তা সবই গোপনে শুনেছিল সুতপা। ভাগ্যের কি পরিহাস, অরিত্রীর মতই সুতপার মনেও তার জন্য ঈর্ষা বোধ জাগছে কারণ সেই যে ছিল দীপঙ্করের প্রথম ভালোবাসা। কিন্তু সুতপা জানে যে অরিত্রী কখনই দীপঙ্করকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইবে না। সে অরিত্রীর দুই হাত ধরে মৃদু হেসে বলে উঠলো, “তার কোন দরকার নেই বোন। এক বিশ্বাসঘাতক নরাধমকে উপযুক্ত শাস্তিই দিয়েছো তুমি। আর পাড়ার সকলেই দেখেছে যে গতকাল তুমি অত্যাচারিত হয়ে রাজুর বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলে। আজ তোমাকে ওর ওখানে কেউ দেখেনি। তাই এই কেসটাকে দাম্পত্য কলহের জেরে এক লম্পট মদ্যপ মানুষের হতাশায় ভেঙে পড়ে আত্মহত্যার ঘটনা প্রমাণ করতে খুব একটা অসুবিধা হবে না আমাদের। আর শোনো, আমি তোমার থাকবার জন্য একটি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র ঠিক করেছি। আমি চাই তুমি অতীতের সব কথা ভুলে আবার জীবনটাকে নতুন করে শুরু কর, কেমন?”
অরিত্রী কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলো সুতপাকে। তার চোখ গেল পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দীপঙ্করের দিকে। তার মুখেও প্রসন্নতার হাসি ফুটেছে ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যেই কোথাও যেন মিশে আছে নিজের প্রথম প্রেমকে না পাওয়ার বেদনা। কিছু কিছু ভুলের মাশুল হয়তো মানুষকে সারা জীবনের জন্য দিয়ে যেতে হয়! -
গল্প- এক না পুরুষের কাহিনী
এক না পুরুষের কাহিনী
– প্রলয় কুমার নাথসুশীলের জন্ম হওয়ার আগে তার মা প্রভাদেবী ভগবানের কাছে বার বার মানত করতেন যেন এবার তার একটা মেয়ে হয়। বড় ছেলে কুশলের বয়স তখন আট, তাই পুত্রসন্তানের বাসনা তখন তার পূর্ণ। তিনি এবার চাইতেন তাদের পরিবারে আসুক একটি ঘর আলো করা লক্ষীমন্ত মেয়ে। অবশ্য ওনার স্বামী অতুল বাবু এই বিষয়ে কিছুই বলতেন না, তিনি যে কি চান তা বোঝাই যেত না। কিন্তু তবুও যখন প্রভাদেবীর কোলে জন্ম নিল একটি ফুটফুটে ছেলে, তখন একটু হলেও বিষণ্ণ হয়েছিলো তার মন। আত্মীয় স্বজনদের কাছে সেই দুঃখ ব্যক্ত করলে তারা পেছন থেকে মুখ বেঁকিয়ে বলতো, “মরণ দশা!…লোকে ছেলে ছেলে করে পাগল হয়ে যাচ্ছে, আর এই মাগীর কিনা মেয়ের জন্য দরদ উথলে উঠছে!…মেয়ে হলে ওর ওই কেরানী স্বামী তাকে বিয়ে দিতে পারতো শুনি?”
মনের দুঃখ মনে রেখেই প্রভাদেবী বড়ো করে তুলতে লাগলেন তার দুই ছেলেকে। তবে ঈশ্বরের কাছে কন্যাসন্তানের জন্য তার এত প্রার্থনা যেন বিফলে গেল না…কিন্তু এই ক্ষেত্রে ভগবান যেন একটু ভুল করে ফেললেন হিসেব নিকেশ কষতে! শৈশব থেকে একটু বড় হয়ে ওঠার পরই সবার চোখে পড়লো ব্যাপারটা…সুশীলের আচার আচরণ কেমন যেন মেয়েলি ধরণের, তা আর পাঁচটা স্বাভাবিক ছেলেদের মত নয়! বিশেষ করে তার হাঁটাচলা এবং কথা বলার ধরণ এমন কি তার গলার আওয়াজটাও ভীষণ ভাবে নারীসুলভ। ওর ইচ্ছা অনিচ্ছাগুলোও কেমন যেন মেয়ে ঘেষা…কিভাবে কাউকে বোঝাবে সে, যখন ওর সমবয়সী ছেলেরা স্কুলের মাঠে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলায় মত্ত, ওর শুধু মন চলে যায় ওর সমবয়সী ছাত্রীদের রান্না-বাটি, লুকোচুরি বা কিত-কিত খেলার দিকে!
যদিও বা সুশীল পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো, প্রতিবারেই স্কুলের পরীক্ষায় ওর রেজাল্ট ক্লাসের সেরা দশজনের মধ্যেই থাকে, তবুও এই একটা বিষয়ের জন্য তার কোন গুরুত্ব নেই বন্ধুদের কাছে। সবার কাছেই সে যেন একটি হাসির পাত্র। আরেকটু উঁচু ক্লাসে উঠে সে বুঝতে পেরেছিল যে শুধুমাত্র তার বন্ধুরা নয়…তার পাড়া প্রতিবেশী, গুরুজনেরা এমনকি তার স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাছেও সে বিনোদনের একটি উৎস। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা খুব অপমান জনক লাগতো সুশীলের। সে ঘন্টার পর ঘন্টা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের অঙ্গভঙ্গীগুলো পর্যবেক্ষণ করতো, মায়ের মোবাইল ফোনে গোপনে নিজের কথা বলা রেকর্ড করে শুনতো তা কতখানি ‘মেয়েলি’ না ‘পুরুষালি’…কখনো কখনো নিজেই নিজের নারীসুলভ আচরণ উপলব্ধি করে লজ্জায় ঝাপসা হয়ে উঠতো তার চোখের দৃষ্টি…কিন্তু কিছুতেই, কিছুতেই সে বদলাতে পারতো না নিজেকে…যেন তার বন্ধুদের কথামত সত্যিই ঈশ্বর তাকে একটা ‘ডিফেক্টিভ মাল’ তৈরি করে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন! নিজের ওপর রাগে ঘৃণায় কখনো কখনো ওর মনে হত ওই যে ওদের বাড়ির পেছনে মস্ত বড় কুয়োটা আছে…তার মধ্যে ঝাঁপ দিতে! কিন্তু সেটাও যেন তার সাহসে কুলিয়ে উঠতো না!
সময়ের সাথে সকলের হাসির পাত্র হয়ে একদিন দশম শ্রেণীর উঠলো সুশীল। সামনেই মাধ্যমিক পরীক্ষা, প্রচুর পড়াশোনার চাপ…কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও রাতে বিছানায় গিয়ে কেমন যেন আনচান করে উঠতো তার শরীর। নিঃশ্বাসের গতিবেগ বেড়ে যেত, বুকের ভেতর যেন আছড়ে পড়তো উথাল পাথাল সমুদ্রের ঢেউ…আর তখনই একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিত তার শরীরের একটি ক্ষুদ্র অঙ্গে! সুশীল জীববিদ্যার বইয়ের পাতায় পড়েছে যে এই সময় যে কোন ছেলে বা মেয়ের শরীরে হরমোনাল পরিবর্তন ঘটে যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘পিউবার্টি’…এই সময়ই নাকি মানুষের মনে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণের সূচনা হয়! কিন্তু সত্যিই কি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি? কই, তার তো সবসময় পাড়ার রকে বসে আড্ডা দেওয়া সুবলদার কথা মনে পড়লেই লিঙ্গ জেগে ওঠে…হ্যাঁ, সুবলদা, মানে ওই ফর্সা সিক্স-প্যাকওয়ালা লম্বা সুদর্শন ছেলেটা যার হালকা দাড়ি এবং তরোয়াল-কাট জুলফির প্রতি পাড়ার সব মেয়েরাই পাগল! ওর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ওকে দেখেই কেমন যেন ধক করে ওঠে সুশীলের বুক…তখন যেন ওর উপেক্ষা করতে ইচ্ছা করে সুবলদারই বন্ধুদের মাঝে দূর থেকে ওর প্রতি ইঙ্গিত করে বলা মন্তব্যটি, “ওই দেখ দেখ…লেডিজ মালটা যাচ্ছে…বৌদি, ভালো আছো..ও বৌদি…”
ও যে ‘সমকামী’, সেটা বুঝতে ওর আরো বেশ কয়েক বছর লেগেছিলো!
তখন সুশীল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তারও ইচ্ছা ছিলো দাদার মত ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার, কিন্তু সেই কথা বাবাকে জানাতে তিনি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, “তোকে তো লোক সমাজে আমার ছেলে হিসাবে পরিচয় দেওয়াই দায়!…তাই তোর পেছনে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পয়সা ঢালার কোন মানে হয় কী?”
আর কথা বাড়ায়নি সুশীল, তবে একেবারও কাঁদেনি সে। সকলের কাছ থেকে এমন ভৎর্সনা শুনে তা গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে তার। কলেজের পড়ার সাথে সাথেই একটা কল-সেন্টারে পার্ট-টাইম কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলো সে। তারপর পয়সা জমিয়ে একদিন গিয়েছিলো তাদের শহরের বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: অম্লান বাগচীর চেম্বারে। অনেকদিন পর, একমাত্র সেদিনই যেন ডাক্তারবাবুর সামনে প্রাণ খুলে কেঁদেছিলো সুশীল…এক এক করে তাকে বলেছিলো সকলের কাছে হেনস্তা হওয়ার প্রতিটা যন্ত্রণাদায়ক ঘটনার কথা! তিনি সময় নিয়ে শুনেছিলেন ওর সকল বক্তব্য!
-“আমাকে ঠিক করে দিন, ডাক্তারবাবু…যেভাবেই হোক, যে ওষুধ দিয়েই হোক আমাকে অন্যান্য ছেলেদের মত স্বাভাবিক করে তুলুন!”
-“কে বললো তুমি স্বাভাবিক নও?”
ডাক্তারবাবুর এই কথা শুনে চমকে উঠেছিলো সুশীল।
-“না মানে…আমার এই মেয়েলি চালচলন…ছেলেদের দেখে আকর্ষিত হওয়া…এগুলো তো মানসিক রোগের পর্যায়েই…”
-“একেবারেই নয়…’সমকামীতা’ কোন মানসিক রোগ নয়, অন্তত চিকিৎসা শাস্ত্র তাই বলে!”
অবাক হয়ে ডাক্তারবাবুর দিকে তাকালো সুশীল। তিনি বলেই চললেন, “দেখো সুশীল, আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীই হচ্ছে এটা মেনে নেওয়া যে প্রতিটা মানুষই যেন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষিত হয়, পুরুষেরা যেন ‘পুরুষালি’ হয় আর মেয়েরা ‘মেয়েলি’…এর অন্যথা হলে সমাজ তাকে হেয় করে চলে। যেমন ধরো কারোর গায়ের রঙ কালো হলে সমাজ তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে…তার মানে কি মেনে নেবো যে কালো রঙটা চামড়ার কোন অসুখ?”
কোন উত্তর দিতে পারলো না সুশীল, শুধু মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলো ডাক্তারবাবুর কথা।
-“আমাদের সকলের ব্যবহার, যৌন চাহিদা ইত্যাদি নির্ভর করে আমাদের মস্তিষ্কের ওপর…মস্তিষ্কের কোন রোগ হলে ওষুধ দিয়ে তা সারানো সম্ভব…কিন্তু কোনো পুরুষের সুস্থ মস্তিস্ক যদি নারীর অনুরূপ ক্রিয়াকলাপ করে, তাহলে তাকে বদলানো অসম্ভব।”
-“তাহলে সত্যিই কি কোন উপায় নেই সমকামীতা থেকে মুক্তি পাওয়ার?”
-“অবশ্যই উপায় আছে সুশীল…এবং তা হল নিজেকে নিজের মতই মেনে নেওয়া…নিজেকে বোঝানো যে তুমি অসুস্থ নও, তাই আরোগ্য লাভের কোন প্রশ্নই উঠছে না…সমাজ কি বলছে তার তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছা নিজের স্বাধীনতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া!…সমাজ তাদেরকেই মনে রেখেছে যারা কোনো দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেছে, মনে রাখেনি তাদের যৌন চাহিদা পুরুষের প্রতি ছিল না নারীর প্রতি!…বি ইওরসেলফ, কারোর মতো হতে হবে না তোমাকে। সমাজে পুরুষ বা নারী নয়…শুধুমাত্র মানুষ হয়ে বাঁচো সুশীল, সেটাই যথেষ্ট বেঁচে থাকার জন্য!”এরপর কেটে গিয়েছে বেশ কিছু বছর, এর মধ্যেই যেন আমূল পরিবর্তন ঘটেছে সুশীলের মানসিকতার। সে যেন বিকশিত করতে চায় নিজের নারী সত্তাকে, সেটাকে লুকিয়ে কোনো কৃত্রিমতার আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে চায় না সে। একদিন কী মনে হতে, মায়ের একটা দামী শাড়ি আলমারি থেকে বার করে, সেটা মাথায় এবং কাঁধে জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো সে। মায়ের লিপস্টিকটা হালকা করে ঘষে নিলো ঠোঁটে, চোখের কোণে লাগালো কাজলের প্রলেপ, কপালে ছোট্ট একটা টিপ…নিজেকে দেখেই একটা অদ্ভুত মুগ্ধতায় ভরে উঠলো তার মন! নাহ, এবার থেকেই এই বেশেই সাজাবে সে নিজেকে…মনে মনে সংকল্প দৃঢ় করলো সুশীল!
কিন্তু পরিবারের লোকজনদের তার এই মতিভ্রমের কথা জানতে দেরী হল না…কলহের আগুনে তপ্ত হয়ে উঠলো ওর বাড়ির চার দেওয়াল! সেই সময় তার দাদা কুশল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি পেয়েছে কলকাতার একটি নামী সংস্থায়। নিজের সুন্দর চেহারা, এবং পুরুষালি ‘মাচো’ পার্সোনালিটির গুণে সে মন জয় করে নিয়েছে সেই কোম্পানীর মালিকের মেয়ের। কিছুদিনের মধ্যেই হাতে চাঁদ পেতে চলেছে কুশল…ধনী পরিবারের একমাত্র মেয়েটির সাথে সুসম্পন্ন হতে চলেছে তার বিবাহ!…আর এই সময় কি না ভাই-এর এই সব বেয়াদবি!
-“বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা এই বাড়ি থেকে…লোক সমাজে পরিচয় দেওয়ার অযোগ্য তুই…যা গিয়ে হিজরাদের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে তালি বাজিয়ে পয়সা ইনকাম কর গে যা…এই বাড়িতে তোর কোনো জায়গা নেই আর!” বাবা আর দাদা সমস্বরে বলে উঠেছিলো তাকে।
আগের মতই এবারও আর কথা বাড়ায়নি সুশীল, এক কাপড়ে ত্যাগ করেছিল বাড়ি। শুধু যাওয়ার পথে ঘর থেকে মায়ের ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দটা তীরের মত এসে বিঁধেছিলো ওর বুকে।এরপর কেটে গিয়েছে আরো সাতটা বছর। একটা ফ্যাশন-ডিজাইনিং এর কোর্স আগেই করা ছিলো সুশীলের, তাই আরেকটা চাকরিও সে জুটিয়ে ফেলে কলকাতার একটি নামী সংস্থায়। সেখানে কাজ করতে শুরু করে নিজের সকল হীনমন্যতা, সকল গ্লানি যেন ভুলে গিয়েছে সুশীল। সেখানে নিজের মতই আরো অনেক মানুষের সান্নিধ্যে এসে সে তৈরি করে নিয়েছে নিজের একটি আলাদা জগৎ, যেখানে সে নিজেই নিজের চোখে সেরা! ধীরে ধীরে নিজের কর্মদক্ষতার গুণে সে পৌঁছে গিয়েছে বেশ উঁচু পদে। ভাড়া বাড়ি ছেড়ে থাকতে শুরু করেছে সদ্য কেনা নতুন ফ্ল্যাটে। সে বুঝেছে যে কলকাতা শহরের সকল অপরিচিত লোকেরা এতটাই ব্যস্ত যে তার বেশভূষা বা চালচলন নিয়ে মন্তব্য করার কোন সময় তাদের নেই! এই সাত বছর ধরে তার আর কোন যোগাযোগ নেই নিজের পরিবারের সাথে।
কলকাতার যান-জট ভরা রাস্তা দিয়ে ক্যাবে করে অফিসের উদ্দেশ্যে চলেছিলো সুশীল…না সুশীল নয়, এখন নারীর মেক-আপ এবং পোষাকে আবৃত এই ‘মানুষটার’ সংক্ষিপ্ত নাম হল ‘সুশ’…এই নামেই তাকে অফিসের সকলে ডাকে। এখন তার জীবনে একটাই স্বপ্ন, মনের মত নিজের শারীরিক গঠনটিকেও নারীতে রূপান্তরিত করা! সেই খরচ সাপেক্ষ সার্জারির জন্যই প্রতিদিন একটা একটা করে পয়সা জমাচ্ছে সুশ, এই কদিনে জমিয়েও ফেলেছে কিছুটা। এমন সময় হঠাৎ চিন্তার ঘোর কেটে গেল সুশের…পাশের রাস্তায় কেমন যেন একটা জটলা বেঁধেছে, বেশ কিছু পথচারী যেন কিছু একটাকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতূহলী হলে সে ক্যাব থামিয়ে নেমে পড়লো রাস্তায়, তারপর ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখলো একটি ময়লা পোশাক পরা পাগলাটে চেহারার শীর্নকায় ব্যক্তি ওপর হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে ভিড়ের মাঝে! বোঝাই যাচ্ছে পথ চলতি কোন গাড়ি ধাক্কা মেরেছে তার মাথায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, তাকে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে, আশেপাশের লোকজন বিষয়টাকে নিয়ে নানা মন্তব্য করতে এবং মোবাইলে ফটো তুলতেই ব্যস্ত!
লোকটার বুকে আলতো হাত রেখে সুশ বুঝলো যে তার দেহে প্রাণ আছে। সে আশেপাশের সমস্ত লোকের কাছে অনুরোধ করলো, আহত লোকটিকে হাসপাতালে পৌঁছতে তাকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু এটা এক্সিডেন্টের ঘটনা, হয়তো কোন পুলিশি কেসে ফেঁসে যাবে…এই ভয়ে কেউই এগিয়ে এলো না সামনে। বিস্মিত সুশ তখন নিজেই লোকটিকে পাঁজাকোলা করে তুলে এনে রাখলো ক্যাবের ভেতর। তার নির্দেশে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ক্যাবের ড্রাইভার চলতে লাগলো নিকটবর্তী একটি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। সুশের সমস্ত গা লোকটির মাথা থেকে বেরোনো রক্তে ভেসে যাচ্ছে…সে রুমালটা বার করে লোকটির মাথায় বেঁধে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তার ঝাঁকড়া চুলের গোছাটিকে সরালো দাড়ি-গোঁফে ভর্তি মুখের ওপর থেকে…আর ঠিক তখনই যেন বিদ্যুৎপৃষ্টের মত চমকে উঠলো সুশ…এ কাকে দেখছে সে!…এ যে তার দাদা কুশল!
কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটি ঘন্টা। সুশ অপেক্ষা করছিলো অপারেশনের থিয়েটারের বাইরে। আর হতবাক হয়ে চেয়েছিলো মলিন শতছিদ্র পোষাক পরা অভাব-অনটনে জর্জরিত এক বয়স্ক মহিলার দিকে…তার গর্ভধারিণী মা, প্রভাদেবী! তিনিও যেন অবাক নয়নে চেয়েছিলেন সুশের দিকে! এমন সময় ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এলেন অপারেশনের ঘরের বাইরে, মুখে হাসি নিয়ে সুশকে বললেন, -“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আপনি যদি সঠিক সময়ে পেশেন্টকে এখানে না আনতেন, বা দরকারী সময়ে নিজের রক্ত দিয়ে সাহায্য না করতেন, তাহলে হয়তো ওকে বাঁচানো যেত না! বাট হি ইস সেফ নাও!”
এমন সময় একজন নার্স এগিয়ে এলেন সেই দিকে, তারপর প্রভাদেবীকে বললেন, -“আপনিই নিশ্চয় পেশেন্টের মা…পেশেন্টের কাছ থেকে পাওয়া মোবাইল ফোনের কল-লিস্ট থেকে নাম্বার নিয়ে আপনাকেই তো ডেকেছিলাম আমরা, তাই তো? আসুন, বিলিং কাউন্টারে আসুন…”
ঠিক সেই সময় সুশ বলে উঠলো, “পেমেন্ট আমি করবো ম্যাডাম…চলুন যাচ্ছি!”কুশলের বেডের পাশে বসে চোখের জল ফেলেছিলেন প্রভাদেবী, “তোর চলে যাওয়ার পর ধুমধাম করে বিয়ে হল তোর দাদার। এরপরই একদিন হঠাৎ আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন তোর বাবা। এদিকে আমাদের বাড়িতে মন টিকলো না তোর বৌদির, সে তোর দাদাকে বললো শ্বশুর বাড়িতে ঘর-জামাই হয়ে থাকতে…তোর দাদা রাজী হল না সেই প্রস্তাবে, আর সেখান থেকেই শুরু হল বিপত্তি! স্বামীর ওপর থেকে আশা মিটে গেল ওই ধনীর দুলালীর, তার সম্পর্ক হল পরপুরুষের সাথে। নিত্যদিন ঝগড়া অশান্তি করতে লাগলো সে তোর দাদার সাথে…একদিন আমাদের সকলকে বধূ নির্যাতনের কেসে ফাঁসিয়ে কেটে পড়লো সে!…সেই কেস চালাতে গিয়ে বাড়ি বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে উঠলাম আমরা…তোর দাদার চাকরি তো আগেই চলে গিয়েছিল…এই শোকে দুঃখে ওর কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দিলো। সারাদিন বাড়ির বাইরে বাইরে ঘুরতে লাগলো সে…কখনো ইচ্ছা হলে ফোন করতো, কখনো বা খিদের চোটে বাড়ি ফিরে আসতো… এখন আমরা একটা বস্তিতে থাকি… কোনো মতে টুকটাক সেলাই আর বাড়ি বাড়ি কাজ করে আমি…”
কান্নায় ভেঙে পড়লেন প্রভাদেবী, “আমাদের ক্ষমা করে দে, বাবা…তুই ছাড়া আজ আমাদের আর যে কেউ নেই!”
মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিলো সুশ, অস্ফুট কণ্ঠে বললো, -“জানো তো মা…আজ কেন আমি প্রথমে দাদাকে না চিনেও হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নিয়ে যেতে মনস্থির করলাম? কেন নিজের রক্ত এবং সার্জারির জন্য সঞ্চিত সমস্ত অর্থ দিয়েও সেই দাদাকে বাঁচলাম, যে একদিন আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিল? তার কারণ আমি সমাজে নারী বা পুরুষ হিসাবে নয়…শুধুমাত্র একজন মানুষ হিসাবে বাঁচতে চাই! আমার মনুষ্যত্বই আমাকে নির্দেশ দিলো একজন মুমূর্ষু মানুষের প্রাণ বাঁচাতে, যা করে দেখানোর সাহস বা ইচ্ছা ওই স্থানে উপস্থিত কোনো ‘স্বাভাবিক’ পুরুষ বা নারীর ছিলো না! আজ যদি সমাজ আমাকে মনে রাখে, তাহলে তা রাখবে দাদার প্রাণ বাঁচানোর জন্য…আমি পুরুষ হয়েও পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট তার জন্য নয়!…আর আজ তোমাদের চোখে লোক সমাজে পরিচয়ের অযোগ্য’ হয়েও, আবার আমার মনুষ্যত্ব যে আমাকে নির্দেশ দিলো তোমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে! বলো থাকবে আমার সাথে?”সুশের এক হাতের পাতায় মুখ ঢেকে কেঁদেই চললেন প্রভাদেবী, ঠিক সেই সময় জ্ঞান ফিরলো কুশলের। একদিন মানসিক ভাবে সুস্থ অবস্থায় যে ভাইকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো সে, আজ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সেই ভাইয়েরই আরেকটি হাত যেন পরম স্নেহে স্পর্শ করলো সে নিজের স্যালাইনের নল বাধা হাতের সাহায্যে!
(সমাপ্ত)
-
গল্প- আঁধারে বাঁশি বাজে
আঁধারে বাঁশি বাজে
-প্রলয় কুমার নাথ(১)
দুপুরের দিকে কেমন যেন ঝিমুনি ভাব চলে আসে গৈরিকের। রাসবিহারী মোড়ের একটি বহুতল বাড়ির তিন তলায় তার ছোট্ট অফিসে বসে গৈরিকের মনে হলো, আজ আর কোনো ক্লায়েন্ট আসবেনা বোধহয়, তাই বাড়ি গিয়ে কিছুক্ষণ ভাত ঘুম দিয়ে নিই। তার অফিসে একমাত্র কর্মচারী রঘুবীর, ওরফে রঘুদাকে সবকিছু বন্ধ করে দিতে বলে ড্রয়ার থেকে বাইকের চাবিটা বার করতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ বেজে উঠলো ল্যান্ডফোন। রিসিভার তুলে ওপার থেকে একজন পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠলো,
-“হ্যালো, এটা কি ‘সেন’স আই’ ডিটেকটিভ এজেন্সি?”
–“হ্যাঁ, বলছি!”
–“আমি কি মিস্টার গৈরিক সেনের সাথে কথা বলছি?”
–“ওফ কোর্স…”
–“নমস্কার মিস্টার সেন, আমি অরুণাভ…মানে অরুণাভ রায়চৌধুরী…মানে আপনি আমাকে ঠিক চিনবেন না…মানে আপনার অফিসের নাম্বারটা আমি নেট থেকে…”
এরপর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হলো কণ্ঠ, কয়েকবার ঢোক গেলার আওয়াজ পেলো গৈরিক। বোঝা যাচ্ছে ওপারে যে আছে, সে খুব একটা সুখে নেই।গৈরিকই ফের কথা শুরু করলো,
-“হ্যাঁ, তো অরুণাভ বাবু, বলুন আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?”
-“আসলে…মানে…আ…আমি একটু আপনার সাথে দেখা করতে চাই? আপনি কি এখন আপনার অফিসে আছেন?”
কি ভেবে গৈরিক বলল,
-“হ্যাঁ, আছি, চলে আসুন, আমার অফিসের ঠিকানা নেট থেকে দেখে নিয়েছেন তো, নাকি বলে দিতে হবে?”মোটামুটি ঘন্টা খানেক পর গৈরিক যার সাথে তার “সেন’স আই” অফিসে বসে কথা বলছিল, সে বেশ লম্বা চওড়া সুপুরুষ যুবক, নাম অরুণাভ রায়চৌধুরী, বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ। তবে তার কথা বলার ধরণ দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে যেন বেশ মানসিক চাপের মধ্যে আছে। সবে কথা বলা শুরু হয়েছিল, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো টুসু।
– “কিগো গেরোদা, হঠাৎ ফোন করে আসতে বললে, কি ব্যাপার?”
টুসু হলো গৈরিকের কাকার মেয়ে, ভালো নাম ঐন্দ্রিলা সেন। তাকে দেখে ওপর আগন্তুক একটু ইতস্তত করলে, গৈরিক বলল,
-“আপনি নিঃসন্দেহে ওর সামনে সব কথা খুলে বলতে পারেন মি: রায়চৌধুরী, ও আমার কাকাতো বোন ঐন্দ্রিলা। আমার ওয়ান এন্ড ওনলি এসিস্ট্যান্ট।”অরুণাভ বোধহয় একটু স্বস্তি পেলো এই কথা শুনে। সত্যি তো, টুসু আর তার গেরোদা মিলে শহরের কত বড়ো বড়ো রহস্যই না সলভ করেছে, তার কি কোনো ইয়ত্তা আছে?
অরুনাভ বলতে শুরু করলো,
-“আমার পূর্বপুরুষের ভিটে বীরভূম জেলার বালিজুরী গ্রামে। ওখানকার জমিদার ছিলাম আমরা এক কালে, তবে এখন ওই পোড়ো ভিটেটা ছাড়া আর কিছু নেই, থাকার কথাও নয় এই ২০১৯ সালে। তবে আমি পর্ণশ্রীতে একটি বাড়িতে ভাড়া করে থাকি মার সাথে, বাবা গত হয়েছে প্রায় তিন বছর। তারাতলার একটি কোম্পানিতে কাজ করছি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে। যাইহোক, আসল কথায় আসি। আসলে আমাদের গ্রামের বাড়ির সাথে একটা পুরোনো ঘটনা জড়িয়ে আছে…যা…যা কিনা…”একটু দম নিয়ে নিল অরুণাভ। এমনি সময় কফির ট্রে হাতে হাজির হলো রঘুদা। টুসু সবাইকে কফি অফার করে বললো,
-“হ্যাঁ, তো কোন ঘটনার কথা বলছিলেন আপনি?”
অরুণাভ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-“সে প্রায় দেড়শ বছর আগের কথা, তখন আমাদের এক পূর্বপুরুষ নরনারায়ান রায়চৌধুরী দোর্দন্ড প্রতাপে সারা জমিদারী কাঁপিয়ে বেড়াতেন। সেই সময় হঠাৎ ওই গ্রামে আগমন হলো এক জটাধারী সন্ন্যাসীর, জমিদার বাড়ির পেছনে যে জঙ্গলটা আছে, সেখানেই সবাই দেখেছিল তাকে। তবে সেই সন্ন্যাসীর চেহারা ছিল একবারে নায়কের মতো, আর তার আর একটা গুণও ছিল। রাত হলেই একটা মিষ্টি বাঁশির সুর শুনতে পেত গোটা গ্রাম, বলা বাহুল্য সেটা ওই জঙ্গলে বসে বাজাত ওই সন্ন্যাসী!”গৈরিক বলল,
-“স্ট্রেঞ্জ, সন্ন্যাসী বাঁশি বাজাত?”
-“আজ্ঞে হ্যাঁ, সে সুর গোটা গ্রামের সবাই শুনেছে।”
টুসু বলল,
-“ঠিক আছে, সে না হয় বুঝলাম, তারপর কি হলো?”
-“হয়তো ওই সন্ন্যাসীর চেহারা দেখে বা তার বাঁশির আওয়াজ শুনেই তার প্রেমে পড়ল আমাদের পরিবারেরই এক মেয়ে, শিউলি। সে প্রায় রোজ রাতে দেখা করতে যেত তার সাথে, পরে সবাই বলাবলি করতো রোজ রাত্রের ওই বাঁশির সুরই হলো সন্ন্যাসীর তরফ থেকে শিউলিকে কাছে ডাকার ইঙ্গিত। এদিকে শিউলি ছিল বালবিধবা, তার এই আচরণে যে পরিবারের মুখে চুনকালি লাগছে, তা কেউ না বললেও চলবে!”
টুসুর বেশ কৌতূহল হচ্ছিল গল্পটা শুনে, সে বলল,
–“তা ওই, কি যেন বললেন, নরনারায়ান রায়চৌধুরী…তিনি কি কখনো জানতে পেরেছিলেন শিউলির এই প্রেম কাহিনী?”
–“পারবে না, আলবাত পেরেছিল, আর সেটাই কাল হয়ে গেল আমাদের সকলের জন্য…কিছুদিন পরে ওই জঙ্গলেই সন্ন্যাসীর লাশ পাওয়া গেলো, পিটিয়ে খুন। সবাই বুঝলো এটা জমিদারের লেঠেলদের ছাড়া আর কারো কাজ নয়, আর তার দু’দিন পর গ্রামের পুকুরে পাওয়া গেলো শিউলির গলায় কলসি বাঁধা মৃতদেহ। আত্মহত্যা করেছিল সে। কিন্তু তারপর থেকে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকলো গ্রামে…কোনো কোনো দিন রাত্রে ওই একই বাঁশির সুর ভেসে আসতে থাকল জঙ্গল থেকে। আর তেমনি এক রাত্রে হৃদরোগে মৃত্যু হল নরনারায়ানের। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ল গ্রামে নাকি ওই সন্ন্যাসীর ভূতের আবির্ভাব হয়েছে! তারপর কত ওঝা তান্ত্রিক, ঝাড়-ফুঁক…”এবার গৈরিক বলল,
-“তা এ তো অনেক আগেকার গল্প, এটা নিয়ে এখন কি বিপত্তি হলো আপনার?”
অরুণাভ কফিতে শেষ চুমুম দিয়ে বলল,
-“বলছি, সেটা বলার জন্যই তো এসেছি মি: সেন। আসলে আমাদের গ্রামের বাড়িটা ফাঁকাই পড়ে থাকতো, ওখানে লোক বলতে শুধু একজন বয়স্ক কেয়ারটেকার আর তার পরিবার থাকে। আমাদের খুব পুরোনো লোক। তবে কিছুদিন ধরে ওখানে একটি মেয়ে ভাড়া থাকছিলো, নাম জাহ্নবী…জাহ্নবী গোস্বামী। আমাদের গ্রামের উচ্চমাধ্যমিক স্কুলটিতে টিচার হয়ে এসেছিল।”একটু থতমত খেয়ে চুপ করে গেল অরুণাভ।
গৈরিক ওর দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
-“কি হলো থামলেন কেন?”
-“কিছুদিন ধরেই গ্রামের লোকেরা আমাদের খবর দিয়েছিল যে ওই বাঁশির শব্দ নাকি আবার পাওয়া যাচ্ছে মাঝরাতে…আর…আর…”
-“আর?”
অরুণাভ আবার একবার ঢোক গিলে বলল,
-“তিন দিন আগের ঘটনা…জাহ্নবীর লাশ পাওয়া গেছে ওই জঙ্গলে!”চোখ বন্ধ করে কপালে হাত রাখল অরুণাভ। উত্তেজনায় টুসু বলে উঠল, “সে কী !”
(২)
অরুণাভ কিছুক্ষণ চুপ করেছিলো, তারপর বলল,
-“খুবই প্যাথেটিক কেস বুঝলেন গৈরিক বাবু!”
গৈরিক এতক্ষণ চুপ করে সবকিছু শুনছিলো, বলল,
-“কিভাবে হলো খুনটা?”
-“পুলিশ যা বলেছে তা হলো মাথায় কোনো ভারী বস্তু যেমন ইট বা পাথর…”
-“বুঝলাম, তা আপনি পুলিশকে তো খবর দিয়েছেন, তবে আমার কাছে আসলেন কেন?”
-“পুলিশের ওপর আমার খুব একটা ভরসা নেই, তা নয়, কিন্তু তারা যা বলছে আমি তা মেনে নিতে পারছি না…”
-“কি বলছে তারা?”
-“আসলে আমাদের গ্রামে মাঝে মাঝেই একটা পাগল লোক ঘুরে বেড়ায়, গায়ে কালি ঝুলি মাখা, শতছিদ্র পোশাক পরা, দাড়ি গোঁফে ভরা মুখের এই লোকটা সবসময় কি যেন আবোল তাবোল বলতে থাকে, গ্রামবাসীরা ওর কাছে এলে গালাগালি দেয়, ঢিল ছুঁড়ে পালিয়ে যায়…”কথা শেষ না করেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো অরুণাভ। অগত্যা গৈরিকই বলে উঠলো,
-“আর পুলিশ বলছে নিশ্চয়ই এটা তার কাজ, তাই তো?”
-“আজ্ঞে হ্যাঁ, কিন্তু কি জানেন, আর যাই হোক ও মানুষ খুন করবে বলে আমার মনে হয়না, তবে জাহ্নবীর খুনের পর তাকে আর কেউ দেখেনি ধারে কাছে!”
-“তাতেই হয়তো পুলিশের সন্দেহ দানা বেঁধেছে ওর প্রতি, যাই হোক, আপনার কি অন্য কারোর প্রতি কোনো সন্দেহ হয়?”
-“হ্যাঁ, সেই রকম আছে একজন, তবে…”
-“আপনি নিঃসঙ্কোচে সব কিছু বলতে পারেন, কেউ কিছু জানবে না।”
-“আমি খুব একটা সিওর নই, তবে এর পেছনে শ্যামসুন্দর ঝাঁর হাত থাকলেও থাকতে পারে। উনি আমাদের ওখানকার বড় প্রমোটার, আমাদের বেশ কিছু টাকা অফার করেছিল সে ওই বাড়িটা কেনার জন্য। তবে আমরা রাজি হয়নি…আসলে কি বলুন তো, পৈতৃক ভিটে তো, তাই কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে…”অরুণাভ আরো কয়েকটা খুঁটিনাটি কথা বলে চলে গেল, যাওয়ার আগে অনেকবার করে গৈরিককে অনুরোধ করলো কেসটা নিতে। গৈরিক বলল, ভেবে দেখবে।
“ভেবে দেখবো” কথাটা শুনে টুসুর একটু রাগই হলো গেরদার প্রতি। তার তো বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে কেসটাকে, গেরদার না একটু বেশি বেশি। তবে সেই রাগ আর বেশিদিন থাকলো না, কারণ পরের দিনই তার গেরোদা তাকে ফোনে জিজ্ঞেস করলো,
-“তোর কলেজের চাপ কেমন রে এখন, কয়েকদিন কামাই হলে কি খুব একটা প্রবলেম হবে?”
-“না তা নয়, তবে কামাই করে যাবোটা কোথায়?”
-“বীরভূমে, বালিজুরী গ্রামে…”
গেরোদা আরো কত কিছু বলছিল কিন্তু টুসুর কানে সেই সব ঢুকলে তো! সে তো ওখানে যাওয়ার কথা শুনেই আনন্দে উত্তেজনায় আত্যহারা।অরুনাভাদের বাড়িটা বিশাল বড়, আগেকার আমলে তৈরি। বড় বড় থাম, বিশাল উঁচু গেট, ঠাকুর দালান এবং বেশ বড় উঠোনের চারিপাশে দোতলা বাড়ির চওড়া বারান্দা। তবে দেখেই বোঝা যায়, আগেকার সেই শোভা আর নেই। বেশিরভাগ অংশেই চোখে পড়ে চরম দেখাশোনার অভাব। গৈরিকদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে বাড়ির দোতলায়, পুব দিকের একটা ঘরে। অরুণাভ অফিসের কি একটা কাজে আটকে গেছে তাই আসতে পারেনি, তবে ওদের আসার সমস্ত ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রেখেছিল। বাড়ির কেয়ারটেকার শঙ্করদা খুব ভালো মানুষ। প্রায় আশি বছর বয়সী এই মানুষটার পরিবারে আছে শুধুমাত্র তার ছেলে মহাদেব। মহাদেবের বয়স প্রায় সাতাশ বছর, স্বাস্থ্য ভালো, তবে কোনো রোজগারপাতি করে বলে তো মনে হয় না।
সেদিন বিকালের দিকে গৈরিকরা বাড়ির পেছনে সেই জঙ্গলটা দেখতে গিয়েছিল। সাথে এসেছিল মহাদেব। বেশ ঘন জঙ্গল, মাঝে সরু একটা আঁকা বাঁকা পথ। অনেকটা হাঁটার পর তারা পৌঁছলো একটা ভাঙা শিব মন্দিরে। একেবারে ধ্বংসাবশেষে পরিণত এই মন্দিরটি যে এককালে খুব সুন্দর ছিল তা এখনো বোঝা যায় সেটার কোন কোনো জায়গার পোড়ামাটির কারুকাজ দেখে। মহাদেব বলল,
-“এখানেই সেই সন্ন্যাসী বসে ধ্যান করতো!”
গৈরিক চারপাশটা ভালো করে দেখতে থাকলো, টুসু বলল,
-“আর বাঁশির শব্দও বুঝি এখান থেকেই আসতো? আর ওই শিউলির বুঝি এখানেই…”
কথা শেষ না হতেই গৈরিক তাকে চোখের ইশারায় চুপ করতে বলল। পেছনে একটা ঘন বনতুলসী ঝোপের পেছনে কেমন যেন একটা খস খস আওয়াজ হচ্ছে!হঠাৎ মহাদেব সেদিকে ছুটে গেল আর ছেঁড়া জামার কলার ধরে হিরহির করে টেনে অনলো এমন একজনকে, যে কিনা এই হত্যা মামলায় প্রধান অভিযুক্ত। মহাদেব চিৎকার করে পাগলটার মুখে একটা ঘুসি লাগাতে যায় আর কি, টুসু আর গৈরিক তাকে কোনক্রমে থামালো। পাগলটা চিৎকার করতে থাকলো,
-“পারবি না…পারবি না…তোরা কোনোদিন পারবি নয়…কোনোদিন গুপ্তধন খুঁজে পাবি না…পাবি না!”
গৈরিক অবাক হয়ে বলে উঠলো,
-“বাবা, আবার গুপ্তধন এলো কোথা থেকে এর মধ্যে?”
মহাদেব পাগলটার দিকে মারমুখী হয়ে বলল,
-“চোপ শালা পাগলা…শালা সবসময় ভুলভাল কথা মুখে, ওই মাস্টারনীকে খুন করে এখন বড় বড় কথা…তোকে পুলিশ খুঁজছে না? চল শালা, চল পুলিশের কাছে…”
মহাদেব আবার তেড়ে মারতে গেল পাগলটাকে।
এবার গৈরিক শক্ত করে ধরে ফেলল মহাদেবের হাত, তারপর তাকে বললো,
-“ওকে ছেড়ে দাও, আমার ওকে কিছু জিজ্ঞাস করার আছে।
কিন্তু পাগলটা ছাড়া পেয়ে আর দাঁড়ালো না, পড়িমরি করে দূরে জঙ্গলের মধ্যে অদ্দৃশ্য হয়ে গেল।
মহাদেব গৈরিকের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বলল,
-“ওকে আপনি ছেড়ে দিলেন, ও তো খুনি, ওকে পুলিশ…”
গৈরিক তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
-“কে খুনি আর কে খুনি নয়, তা শুধু বলবে সময়!”সেদিন রাতটা মোটামুটি নির্ঝঞ্ঝাট হয়েই কাটলো। সকালে হঠাৎ পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শুনে টুসুর ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি ঘরের বাইরে গিয়ে দেখল তার গেরোদা আগেই নীচে দাঁড়িয়ে কথা বলছে পুলিশের সাথে। দর্শনধারী চেহারার পুলিশ অফিসারটি বলছে,
-“এ তো মহা ফ্যাসাদে পড়া গেল মশাই, খুনিই শেষ পর্যন্ত খুন!”
আশ্চর্য হয়ে টুসু পেছন থেকে সটান জিজ্ঞাসা করে বসল,
-“আবার কে খুন হলো গেরোদা?”
গৈরিক উদাস মুখে আকাশের দিকে চেয়ে বলল,
-“কাল রাতে ওই পাগলটা খুন হয়েছে…পুলিশ বলছে ইটস এ কেস অফ স্ট্র্যাংগুলেশন!”
সর্বনাশ, একি বলছে গেরোদা, আবার আর একটা খুন!…টুসু ভাবলো, কেসটা যেন গেরোদার হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ!(৩)
গৈরিক এবার ওই পাগলের প্রসঙ্গে না গিয়ে অন্য কথা বলল,
-“আচ্ছা, এই যে রাত্রে ওই বাঁশির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে, এটা কতদিন আগে থেকে শুরু হয়েছে?”
পুলিশ অফিসার তার পুরুষ্ঠ গোঁফে একবার আঙ্গুল বুলিয়ে বলল,
-“তাও প্রায় তিন-চার মাস আগে থেকে।”
-“আপনারা কি এ বিষয়ে কোনো খোঁজ খবর নিয়েছিলেন?”
-“না, তেমন কিছু নয়, আসলে বুঝতেই পারছেন, গ্রামের লোকের ধারণা যে ওটা ওই সন্ন্যাসীর অশরীরি আত্মা করছে…তা ভূতের এগেনস্টে আর কেই বা থানায় কমপ্লেন করতে আসবে বলুন?”
-“বাহ, আর আপনারাও ওই ভূতের গল্পে বিশ্বাস করে নিলেন?”
-“না ঠিক তা নয়, তবে ওই জাহ্নবী ম্যাডামের আগে তো আর কোনো খুন খারাপি হয় নি…তাই আর খামোকা…”
-“তা এখন তো আর ওই পাগলকে খুনির তকমা দেয়া যাবে না সাহেব, এবার কেসটা কিভাবে সাজাবেন ভাবছেন?”পুলিশ অফিসারটি দাঁত বার করে হেসে বলল,
-“সেই তো, এখন তো মাথায় যে আর কিছু আসছে না।”
গৈরিক একটি মৃদু হেসে বললেন,
-“মি: রায়চৌধুরীর কাছ থেকে শুনেছিলাম জাহ্নবী ওর স্কুলের চাকরিটা নিয়ে এখানে এসেছিল প্রায় পাঁচ-ছ মাস আগে, তাহলে বুঝছেন তো ওর আসার এক মাসের মধ্যেই ওই বংশীধারী ভূতের মর্তে আগমন…এবার মাথায় আসলো কিছু?”
পুলিশ অফিসারটি হাঁ করে চেয়ে রইলো গৈরিকের দিকে, ফের গৈরিকই আবার বলল,
-“আমার কার্ডটা রাখুন, জাহ্নবীর পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টটা এলে জানাবেন, এখন একটু কাজ আছে, চলি।”পুলিশের গাড়িটা চলে যাওয়ার পর গৈরিক আর টুসু বাড়ির ভেতর ঢুকতে গিয়েও থেমে গেলো, দেখলো আরেকটা নীল ইটিওস ওদের দিকেই ধুলো উড়িয়ে আসছে। কাছে আসতেই গাড়ি থেকে নামলেন ছাই রঙের সাফারি সুট আর নানা রকমের সোনার গহনা পড়া এক গাট্টা-গোট্টা ভদ্রলোক। সে নিজেই কথা বলা শুরু করল,
-“হামার আদমিলোগ সহি খবর দিয়েছিল…উ রায়চৌধুরী কা লউন্ডা ডিটেক্টিভ হায়ার করেছে…”
বলে নিজেই হো হো করে হাসতে লাগল।
গৈরিক কঠোর স্বরে বলল,
-“ভালোই হলো আপনি নিজেই এখানে এলেন, আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল মিস্টার শ্যামসুন্দর ঝাঁ, কি নামটা ঠিক বললাম তো?”
-“হাঁ, বহুত খুব বহুত খুব, অভি দেখিয়ে না, হামি ইতনা সারা রূপিয়া অফার করলাম মিস্টার রায়চৌধুরীকে এই বাড়িটার জন্য, লেকিন ও…”শ্যামসুন্দরকে থামিয়ে দিয়ে গৈরিক বলল,
-“কেন কিনতে চান এই পোড়ো বাড়িটাকে আপনি?”
-“হামি ইখানে ফাইভ ইস্টার হোটেল বানাবো, কাছে বহ জঙ্গল আছে না, তারপর নদী আছে, মন্দির আছে, ইখানে হামি ট্যুরিস্ট-স্পট বানাতে চাই!”
-“তার মানে এখানে যদি কারোর খুন হয় বা ভূতের বাঁশি শোনা যায়, তাহলে তো আপনার ভালোই হয় তাইনা, অরুনাভ বেশ ভয়ে ভয়ে আপনাকে বাড়ি বিক্রি করে পালাবে!”
এইবার শ্যামসুন্দর রক্তচক্ষু বার করে স্পষ্ট বাংলায় বলল,
-“কি বলতে চান কি আপনি? এই সব আমি করছি? শুনুন মিস্টার ডিটেক্টিভ, ভালো চান তো এখুনি কেটে পড়ুন এখান থেকে নাহলে…”এতক্ষণ টুসু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনে যাচ্ছিল, হঠাৎ চিৎকার করে বলল,
-“নাহলে….নাহলে কি করবেন আপনি? দেশে কি থানা পুলিশ নেই, এভাবে ওপেনলি থ্রেট করছেন?”
-“আরে ওই থানা আর পুলিশ আমার দু’ হাতের মুঠোয় বুঝলে দিদিমণি, তাই আমার লেজে পা দিতে এসো না, ফল ভালো হবে না।”
টুসু ব্যঙ্গের সুরে বলল,
-“রামায়নে তো পড়েছি হনুমান লেজে আগুন লাগিয়ে গোটা লঙ্কা জ্বালিয়ে ছিল, তবে তা তো অনেক কঠিন কাজ…আমি ভাবছি আপনি কি লেজ দিয়ে ওই বাঁশীটা ধরে বাজাতে পারবেন?”
-“কেয়া? আগার বানসি বাজানা হোতা তো হাত সে হি পাকারতা না…”
-“কিন্তু সেটা কি করে হতো? ওই যে বললেন না আপনার এক হাতের মুঠোয় থানা আর অন্য হাতের মুঠোয় পুলিশ, বাঁশি ধরার আর জায়গা কোথায় থাকলো?”
এবার গৈরিকও আর হাসি চেপে রাখতে পারল না।একটু দুপুর গড়াতেই অরুণাভ এসে হাজির। স্নান সেরে একসাথে খেতে বসল সবাই। আজ বোধহয় সে এসেছে বলেই দুপুরের মেনুতে স্পেশাল কিছু খাবার তৈরি হয়েছে এই বাড়িতে…চিংড়ি মাছ দিয়ে এঁচোর, ঝুরি আলুভাজা, কষা মটন, মুগডাল আর আমসত্বের চাটনি। খেতে খেতেই অরুণাভ বলল,
-“কিছু মনে করবেন না মিস্টার সেন, আসলে অফিসে একটা মস্ত বড় অডিট চলছিল তাই আপনাদের সঙ্গে একসাথে আসা হলো না।”
গৈরিক একটা এঁচোরের টুকরো মুখে পুরে বলল,
–“না না ঠিক আছে, কোনো অসুবিধা হয়নি আমাদের, আচ্ছা একটা কথা বলুন…এই যে মহিলা ভাড়া থাকতো আপনার বাড়িতে, তার ব্যাকগ্রাউন্ড কিছু চেক করেছিলেন আপনি?”
-“হ্যাঁ, যা জেনেছিলাম তা হলো ও আমাদের গ্রামের স্কুলটিতে অর্থনীতির টিচার হয়ে এসেছিল, আমি স্কুলেও খোঁজ নিয়েছিলাম। বিয়ে-থা তো করেনি। বয়স ছিল ওই পঁচিশ চব্বিশ মতো।”
-“আর বাড়ির ঠিকানা বা আত্মীয় পরিজন?”
-“ওর বাড়িটা কোথায় যেন…দাঁড়ান মনে করে দেখি…ও হ্যাঁ…বার্ধমানের গুস্কারায়…ঠিকানাটা আছে আমার কাছে।”
-“গুড, আমি কালকেই ওখান থেকে একবার ঘুরে আসতে চাই!”দুপুরের ওই ভাত ঘুমের নেশাটা বোধহয় আর যাবে না গৈরিকের। সবে মাত্র একটু তন্দ্রা এসেছে এমন সময় বেজে উঠলো মোবাইল।
-“হ্যালো…”
-“হ্যাঁ বলছি…”
-“দ্যাটস গুড, তা কি বেরোলো রিপোর্টে?”
-“আচ্ছা, বুঝলাম।”
টুসু দেখলো একটা গভীর কালো মেঘ যেন গ্রাস করছে তার গেরোদার পুরো মুখমন্ডল। আর না থাকতে পেরে সে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি গো? কে ফোন করেছিল? কি বললো?”
বেশ উদ্বেগ মেশানো স্বরে গৈরিক বললো,
-“থানা থেকে ফোনে করেছিল রে, ওরা জাহ্নবীর পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টটা পেয়েছে, একটা পাথর খুব কাছ থেকে তার মাথায় আছড়ে মারা হয়েছে…স্কাল্প ভেঙে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু…আরেকটা খবরও দিলো পুলিশ…ওই রক্ত মাখানো পাথরের টুকরোটাও খুঁজে পেয়েছে ওরা!”-“বাহ, এত খুব ভালো কথা, এমনটাই তো আমরা এক্সপেক্ট করেছিলাম।”
-“কিন্তু যেটা এক্সপেক্ট করিনি সেটা হল মৃত্যুর সময় জাহ্নবী ছিল দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা!”
এই কথাটা শুনেই চমকে উঠলো টুসু…এ কি ভাবে সম্ভব? অরুণাভ তো বলল যে জাহ্নবী বিয়েই করেনি, তাহলে সে অন্তঃসত্ত্বা হলো কিভাবে…এ কথা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলো না টুসু।
সত্যি, কেসটা কোন দিকে ঘুরছে তা কেই বা জানে!(৪)
যদিও বা এখন শীতকাল নয়, তবুও মাঝরাতে জঙ্গলের আঁকা-বাঁকা পথ দিয়ে যেতে যেতে বেশ একটা শিহরণ লাগছিলো টুসুর। যত তারা ওই পোড়ো মন্দিরটার দিকে এগোচ্ছে, বাঁশির সুরটা তত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। টুসু ভাবলো, গেরোদা সবকিছু আগে থেকে কিভাবে বুঝে যায় কে জানে, কারণ সন্ধ্যে হলেই সে তাকে বলেছিল,
-“আজ কিন্তু হাঁ করে ঘুমিয়ে পরিসনা, বুঝলি, মনে হচ্ছে আজ ওই বংশীধারীর খোঁজে রাতে হয়তো আমাদের বেরোতে হতে পারে।”
না, ঘুমিয়ে টুসু একেবারেই পড়েনি, বরং অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল যে মাঝরাতে ওই মধুর বাঁশির ধ্বনি পাওয়া যায় কিনা। এবং সঠিক সময়ে তা তাদের কানে পৌঁছেও গেছিল, তাই এখন তারা বেরিয়েছে এই নৈশ অভিযানে।এখন দূর থেকে মন্দিরটা দেখা যাচ্ছে…চারিদিকের ঘন অন্ধকারে ভরা বোনঝোপের মাঝে যেন ছোট্ট একটা দৈত্যপুরী, দাঁত বের করে আছে তাদের গিলবে বলে। টুসু ভূতে বিশ্বাস করে না, কিন্তু তবু যেন আজ ওর গা ছমছম করতে লাগলো। কে আছে ওর ভেতরে যে এত রাতে বাঁশি বাজাচ্ছে? কে ! গৈরিক ফিসফিস করে বলল,
-“শোন, আমরা মন্দিরের পেছনে গিয়ে দাঁড়াব, ওখানে একটা ছোট জানলা আছে, ওখান দিয়েই দেখা যাবে ভেতরে কে আছে। আর কোনো শব্দ করবি না বুঝলি?”
ওরা ঠিক জায়গায় পা টিপে টিপে এসে দাঁড়িয়ে যখন চোখ রাখলো মন্দিরের ভেতরে, তখন টুসুর মনে হচ্ছিল যেন ওর হৃৎপিন্ডটা বোধহয় এইবেলা বুক ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে ওরা দেখলো তাদের দিকে পেছন ফিরে শিবলিঙ্গের পাশে বসে আসে একটা পুরুষের মূর্তি, বেশ স্বাস্থ্যবান চেহারা, মাথায় এবং কাঁধে চাদর জড়ানো। লোকটি একমনে একটা বাঁশি নিয়ে বাজিয়ে চলেছে।হঠাৎ টুসু “মাগো…” বলে চিৎকার করে উঠতেই গৈরিক দেখলো ওর পাশ দিয়ে কি যেন একটা কিলবিল করতে করতে মন্দিরের একটা ফাটলে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটু পরেই টুসু হুঁশ ফিরে পেয়ে বলল, –“কিছু হয়নি আমার…কামড়ায়নি”।
কিন্তু এতক্ষণে বাঁশি বাদক সতর্ক হয়ে উঠেছে, সে কোনো রকমে চাদরটা আরো টাইট করে মুখে জড়িয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল মন্দির থেকে। গৈরিক ছুটে গিয়ে ওর কাঁধটা ধরতেই ও ঘুরে গিয়ে জোরে একটা ঘুষি মারলো গৈরিকের মুখে। গৈরিককে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে টুসু ক্ষিপ্ত বেগে ছুটে গেল লোকটির কাছে, খামচে টেনে ধরলো তার বুকের চাদর। কিন্তু লোকটার গায়ে যেন অসুরের বল, সে এক ধাক্কায় টুসুকে দূরে ঠেলে দিয়ে দৌড়ে মিশে গেল দূরের গাছপালার মাঝে অন্ধকারে।কিছুক্ষণ পর গৈরিক টুসুর কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কি রে ঠিক আছিস তো?”
টুসু এখনো লোকটার প্রতি রাগে আর উত্তেজনায় একেবারে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“আমি ঠিক আছি গেরোদা, কিন্তু ও ঠিক থাকবেনা, আমার হাতের নখ অনেকটাই দাগ রেখে দেবে ওর বুকের চামড়ায়…”
গৈরিক প্রসঙ্গটাকে একটু হালকা করার জন্য বলল,
-“ও.কে কাম ডাউন…আচ্ছা আমাদের পাড়ায় সবাই তো বলে আমায় কলির কেষ্ট ঠাকুরের মতো দেখতে, এবার দেখে বলতো সত্যি আমায় তেমন লাগছে কিনা…”
এই বলে সে ওই লোকটার বাঁশিটা ঠোঁটের সামনে ধরে একেবারে শ্রীকৃষ্ণের পোসে দাঁড়িয়ে পড়ল। টুসু দেখে অবাক হয়ে বলল,
-“মাই গুডনেস, ওটা তুমি কোথায় পেলে!”পরের দিনটা একা একা কাটাতে বিরক্তি লাগছিলো টুসুর। তার গেরোদা অবশ্য বলেছিল সবাইকে চোখে চোখে রাখতে, তবে টুসুর তো কাউকে খুব একটা সন্দেহজনক মনে হচ্ছিল না। গেরোদা আজ বর্ধমানের গুস্কারায় গিয়েছে, জাহ্নবীর পরিবারের লোকজনদের সাথে কথা বলার জন্য। সেই ভোরে বেরিয়েছে, বলেছে যে আসতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে। অগত্যা টুসু একটা ইংরেজি থ্রিলার খুলে বসেছে। কে বলবে যে এক মাস পরেই ওর সেকেন্ড ইয়ারের পরীক্ষা। বিকালের দিকে ফিরে এলো গেরোদা, কেমন যেন গম্ভীর হয়ে থাকছে সারাক্ষণ। বাড়ির প্রায় সবাইকেই আলাদা করে কি সব কথা জিজ্ঞেস করলো সে। টুসু জানে যে এই রকম সময় গেরোদা একাই থাকতে পছন্দ করে, তাই আর তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি সে। তবে সবচেয়ে বেশি সময় গৈরিক কথা বলল কেয়ারটেকার শঙ্করবাবুর সাথে। তাহলে কি এই বয়স্ক মানুষটাকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছেন গেরোদা? টুসুর মনে হলো তার জেঠতুতো দাদার মনে কখন কি চলছে, তা বোঝা খুব কঠিন। সন্ধ্যার পর গৈরিক টুসুকে বলল,
-“বাড়ির সবাইকে ডেকে দে, কাউকে বাদ দিবিনা, বুঝলি…”
-“সেকি? তুমি কি আজই কেসটা সল্ভ করে ফেলবে নাকি?”
গৈরিক কোনো উত্তর দিলো না, শুধু একটু মুচকি হেসে মোবাইলে একটা নম্বর ডায়াল করে ফোন কানে রেখে বলল, “হ্যালো, পুলিশ স্টেশন…”নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে উপস্থিত হলো সবাই; অরুণাভ, শঙ্করবাবু, মহাদেব আর সেই পুলিশ অফিসার, তার সাথে দু’জন কনস্টেবলও এসেছে। এমনকি সবাইকে অবাক করে শ্যমসুন্দরও ঢুকলো ঘরে। টুসু অপেক্ষা করছিল কখন গেরোদা ঘরে ঢুকবে। গৈরিক ঘরে ঢুকে সবাইকে নমস্কার জানিয়ে, অরুনাভর দিকে চেয়ে বলল,
-“তা অরুনাভবাবু, আপনি আপনার এই পৈতৃক ভিটেটা বেচতে চাননি কেন?”
-“বলেছিলাম তো এই বাড়ির প্রতি আমার একটা টান…”
ওকে শেষ করতে না দিয়েই গৈরিক বলল,
-“তো আপনার এই বাড়ির প্রতি টানটা কি জাহ্নবী আসার পর কিঞ্চিৎ বেড়ে গিয়েছিল?”
অরুণাভ অবাক হয়ে গেল এ কথা শুনে, বলল,
-“মানে?”
-“মানেটা খুব সিম্পল, আগে তো আপনি এই বাড়িতে ন’মাসে ছ’মাসে একবার আসতেন, কিন্তু জাহ্নবী আসার পর আপনি প্রতি সপ্তাহেই এক দু’ দিন করে…”
এবার অরুণাভ গৈরিককে থামিয়ে বলল,
-“কারণ আমি বাড়িটাকে রিপেয়ার করার কথা ভাবছিলাম আবার নতুন করে…”টুসু দেখল যে কেউ যেন কাউকে কথা শেষ করতে দিচ্ছে না, গৈরিক চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
-“জাহ্নবীর থেকে কিন্তু বাড়ির প্রতি আপনার খুব একটা বেশি টান ছিলনা, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনি যে জাহ্নবীর সাথে কতটা ঘনিষ্ট হয়েছিলেন তার সাক্ষী এ বাড়ির সবাই…আর মনে পড়ে, সেই এক ঝড় জলে ভরা রাতের কথা, সেদিন আপনি জাহ্নবীর সাথে…কি শঙ্কর বাবু? তেমনি তো দেখেছিলেন আপনি?”
শঙ্কর বাবু হঠাৎ হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল,
-“আমায় ক্ষমা করুন দাদাবাবু, উনি আমায় এমন ভাবে জেরা করতে লাগলেন যে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল ও কথা, ক্ষমা করুন আমায়, ক্ষমা করুন…”
অরুণাভ এবার মুখ নিচু করে বসে পড়ল সোফায়, গৈরিক বলল,
-“মি: রায়চৌধুরী এখনো কি অস্বীকার করবেন যে জাহ্নবীর গর্ভের সন্তান আপনার নয়…তাহলে কিন্তু আমায় আপনার আর তার সমস্ত কথোপকথনের রেকর্ড বার করতে হবে আপনাদের মোবাইল কোম্পানিগুলো থেকে।”অরুণাভ মুখ তুলে বলল,
-“তার কোনো দরকার হবে না মিস্টার সেন, আমি মানছি যে ও আমার সন্তানের মা হতে চলেছিল…ও কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না বাচ্চাটাকে এবোর্ট করতে, আমায় ওকে বিয়ে করতে বলছিল…”
-“তাহলে তো এটাও মানতে হয় যে জাহ্নবীর খুনের সময় নিজে কলকাতায় থাকলেও নিজের নাম থেকে কলঙ্ক মুছতে পয়সা দিয়ে লোক লাগিয়ে আপনিই খুন করিয়েছেন ওকে।”
অরুণাভ এবার আতঙ্ক ভরা মুখে বলল,
-“না, না গৈরিক বাবু, আমি মানছি ওর সাথে আমার একটা শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল…তবে আমি ওকে খুন করিনি গৈরিক বাবু, খুন করিনি…আমিও ওকে ভালোবাসতাম, শুধু কিছু ফিন্যান্সিয়াল ইস্যুর জন্য বিয়ে করতে পারছিলাম না, বিশ্বাস করুন আমায়, আবার বলছি, আমি ওকে খুন করিনি।”
টুসুর যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল সব কিছু দেখে শুনে, শেষ পর্যন্ত অরুণাভ, এ তো সে ভাবতেই পারেনি কখনো!(৫)
গৈরিক এবার হঠাৎ নরম হয়ে গিয়ে বলল,
-“শান্ত হন অরুণাভবাবু, আমি জানি আপনি খুনি নন, আমি শুধু চাইছিলাম যে আপনি যেন জাহ্নবীর গর্ভের সন্তানের পিতৃত্ব নিজের মুখে স্বীকার করেন। তাই এভাবে আপনাকে উত্ত্যক্ত করলাম, মার্জনা করবেন।”
তারপর সে অন্যদের দিকে ঘুরে গিয়ে বলল,
-“যাকগে, কিছুক্ষণ না হয় জাহ্নবীর কথা ছেড়ে, আমি শিউলির প্রসঙ্গে আসি। সে এই বাড়িরই মেয়ে ছিল কিন্তু আপনারা ওর সম্বন্ধে এখনো অনেক কিছুই জানেন না, যা আমি বলতে চলেছি। মাত্র আট বছর বয়সে শিউলিবালার বিবাহ হয়েছিল বাংলাদেশের সাতখিরার এক জমিদারপুত্রের সঙ্গে, নাম নন্দদুলাল সিংহ। বিবাহের সময় নন্দদুলালের বয়স ছিল মাত্র চোদ্দ বছর। মা বাপ মরা মেয়েটির সুখের সংসার কিন্তু বেশিদিন টিকল না। নন্দদুলাল বিপ্লবী দলে যোগ দিয়েছিল, তাই বাড়িতে খুব কম সময়ই থাকতো। একদিন ইংরেজ সেপাইরা সাতখিরায় নিয়ে এলো একটি তরুনের লাশ যার কপালে আর গালের চারপাশে চারটে গুলি লেগেছিল, ফলে তার মুখ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। সবাই তার চেহারা দেখে ভাবল যে সেই হল নন্দদুলাল আর তখনকার প্রথা মেনে হতভাগিনী শিউলিবালাকে বালবিধবার বেশে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল!”টুসু বলল,
-“বাপরে, তুমি তো পুরো উইকিপিডিয়া হয়ে গেছো গো, এত ইমফো কোথায় পেলে?”
গৈরিক বলল,
-“দাঁড়া, পিকচার তো অভি বাকি হায়…পরে সব বলছি…শিউলি ছিল জমিদার নরনারায়ান রায়চৌধুরীর দাদার মেয়ে। তার মা বাবা তার জন্মের কিছু পরেই গত হয়েছিল। অনাথ মেয়েটির মা বাবা দু’জনের ভূমিকাই পালন করত জমিদারবাড়ির ধাই, কিরণবালা। এই ধাইমা শিউলিকে নিজের মেয়ের মতই ভালোবাসত, শিউলি তার সমস্ত মনের কথা কিরনবালাকেই সবার আগে বলত যেমন বলেছিল তার বিধবা হওয়ার করুন কাহিনীটি। যেদিন শিউলির ওই সন্ন্যাসীর সাথে শেষ দেখা হয়, সেদিন রাতে সন্ন্যাসীর কাছে যাওয়ার আগে সে কিরণবালাকে বলে যে ওই সন্ন্যাসীই হলো তার হারিয়ে যাওয়া স্বামী নন্দদুলাল! এত বছর পর সে সন্ন্যাসী হয়ে ফিরেছে, মন্দিরে নতুন শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছে। এখন তাকে আর কেউ চিনতে পারুক না পারুক, কিন্তু একজন স্ত্রীর কখনো তার স্বামীকে চিনতে কোনো ভুল হবে না। ইংরেজ সেপাইদের আনা লাশটি ছিল অন্য কোনো যুবকের। এই মুহূর্তে খুব অর্থকষ্টে আছে তার স্বামী, তাই সেদিন রাতেই শিউলি তার গহনার বাক্স নিয়ে পাড়ি দেয় ওই সন্ন্যাসী, থুড়ি তার স্বামী নন্দদুলালের কাছে!”টুসুর আর মুখ দিয়ে কোনো কথা বার হচ্ছিল না, অরুণাভ বলল,
-“কিন্তু ওই গহনার বাক্সের কথা তো আমরা কোনো দিন শুনিনি!”
গৈরিক আবার বলতে লাগল,
-“কারণ জমিদারের লেঠেলদের হাতে ধরা পড়ার আগেই ওই মন্দিরের কোনো একটা জায়গায় সেটা লুকিয়ে রেখেছিল ওরা দু’জনে।”
কিছুক্ষণ পর শ্যামসুন্দর মুখ খুলল,
-“পর আপকো ইতনা সব ক্যাইসে মালুম হুয়া?”
গৈরিক শুরু করল,
-“এইবার আসি এই প্রশ্নের উত্তরে। জাহ্নবীর বাড়ি গিয়ে ওর পরিবারের সাথে কথা বলে আমি জানতে পারি যে এই কিরণবলা হলো ওদের বংশেরই এক নারী। কিরণবালা নিজেও বাঁশি বাজাতে জানত, আর এটাও জানত যে নরনারায়ান একজন হার্টের রুগী। তাহলে এবার আর বলার দরকার নেই যে ওই সন্ন্যাসীর মৃত্যুর পর কিরণবালাই ভূত সেজে মাঝরাতে বাঁশি বাজাত ওই জঙ্গলে। সে চেয়েছিল, নরনারায়ান যে অন্যায় কাজ করেছেন তার কন্যাসম শিউলির প্রতি, তার প্রতিশোধ নিতে। আর সফলও হল সে, ভূতের ভয়ে দুর্বল হৃদয়ের নরনারায়ান বেঘোরে প্রাণ হারালেন। এরপর কিরণবালা ওই গ্রাম ছেড়ে তার নিজের বাড়ি বর্ধমানে চলে যায়। আর তার বংশের সকলেই বংশপরাক্রমে শিউলি সম্পর্কিত সমস্ত ঘটনা জানতে পারে তার কাছ থেকে, আর এই ভাবেই ওই গহনার বাক্সের কথা জানতে পারে জাহ্নবী। কিন্তু হায়, এই জানাটাই তার জীবনের কাল হয়ে গেল।”অরুণাভ চেঁচিয়ে উঠলো,
-“আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না মিস্টার সেন, আপনি বলুন কে খুন করেছে জাহ্নবীকে, বলুন, আপনি বলুন প্লিজ…”
গৈরিক বলেই চলল,
-“জাহ্নবীর এই বাড়িতে আসার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল ওই গহনার বাক্সটা হাতানো, কিন্তু এরই মধ্যে সে অরুণাভর প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে। সে ভাবে যে গহনাগুলো পেলে অরুণাভর সাথে ভালো ভাবে জীবন শুরু করতে পারবে, তাই তো সে তার গর্ভের সন্তানকে এবোর্ট করেনি। তবে ওই গভীর জঙ্গলে গিয়ে রাত বিরেতে গহনার বাক্স খোঁজা, তাও আবার একা একা, সেটা একটা মেয়ের পক্ষে সত্যি কঠিন। এদিকে অরুণাভ তো কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকে, তাই সে সাহায্য চেয়েছিল এমন একজন জোয়ান পুরুষমানুষের কাছ থেকে যে সর্বক্ষণ এই বাড়িতেই থাকে। বলেছিল যে ওটা পাওয়া গেলে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে।”আর কারোর বুঝতে বাকি রইল না যে গৈরিক কার কথা বলছে। সকলের ক্রুর দৃষ্টি নিজের দিকে আঁচ করে আছে বুঝতে পেরেই মহাদেব চেঁচিয়ে বলে উঠল,
-“না, আ…আমি কিছু জানি না, আমি কিছু করিনি…”
এতক্ষণ পর টুসু মৃদু হেসে বলল,
-“আমি কিন্তু কাল রাতে নখ দিয়ে খামচে অপরাধীর বুকের ছালচামড়া তুলে নিয়েছি!”
কথা শেষ না হতেই অরুণাভ ছুটে গেল মহাদেবের দিকে, আর এক টানে ওর জামার সব কটা বোতাম ছিঁড়ে ফেলল। সবাই দেখল যে তার বুকে টুসুর নখের ক্ষত এখনো জ্বলজ্বল করছে!গৈরিক বলল,
-“কথায় আছে না অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। জাহ্নবীর সাথে মহাদেব কয়েকমাস ধরে খোঁজাখুজির পর মন্দির থেকে বার করে ফেলে গহনার বাক্স। এই কয়েকমাসে জাহ্নবীরই কথামতো মাঝরাতে মন্দিরে এসে বাঁশি বাজাতে থাকে মহাদেব, আর জাহ্নবী খোঁজ চালিয়ে যায় গহনার বাক্সের। ওরা জানত যে এতে গ্রামের সকলে ভাববে যে আবার বোধহয় ওই সন্ন্যাসীর ভূতের আবির্ভাব হয়েছে, ফলে ভুলেও কেউ জঙ্গলের কাছে সেইসময় আসবে না। ও ভেবেছিল আমরাও বোধহয় কাল রাতে ওর বাঁশি বাজানো শুনে ভয়ে আজ সকালেই মানে মানে কেটে পরব। ছোটবেলায় মহাদেব স্কুল পালিয়ে মাউথ-অর্গান বাজিয়ে বেড়াতো, এ কথা তার বাবা আমাকে বলেছে, তাই তার পক্ষে বাঁশি বাজানো খুব একটা কঠিন নয়…এছাড়া ওই বাঁশিটা ও গ্রামের যে দোকান থেকে কিনেছে, সেই দোকানদার ওর চেহারার বর্ণনা আমার কাছ থেকে শুনে ওকে চিনতে পেরেছে। যেদিন ওরা গহনার বাক্সের খোঁজ পেয়ে যায়, সে দিন মহাদেবের মনে সমস্ত গহনা একাই আত্মসাৎ করার ফন্দি আসে, আর তাই সে জাহ্নবীর মাথায় পাথর ছুঁড়ে…”গৈরিকের কথা শেষ না হতেই অরুণাভ মহাদেবের কলার চেপে ধরে তাকে এক থাপ্পড় মারতে উদ্যত হলো, কিন্তু পুলিশ কনস্টেবলরা ছুটে এসে ওদের থামিয়ে দিল। মহাদেব আর কোনো কথা বলল না, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকল তার বৃদ্ধ বাবা শঙ্কর।
টুসু বলে উঠল,
-“এবার বুঝেছি…ওই পাগলটা হয়তো ওদের মন্দিরে কিছু খোঁজাখুঁজি করতে দেখে ফেলেছিল, তাই সেদিন বলছিল তোরা গুপ্তধন পাবিনা। আর এই কথা বুঝে মহাদেব ওকেও রাস্তা থেকে সরিয়ে দিল গলা টিপে খুন করে, যাতে ও কাউকে কিছু বলতে না পারে!”
গৈরিক বলল,
-“দ্যাটস রাইট টুসু, আর যদি আমাদের পুলিশ বাবুরা এখন ওই রক্তমাখা পাথর বা ওই পাগলটার গলার স্কিনে একটু খুঁজে দেখেন, তাহলে মহাদেবের ফিঙ্গারপ্রিন্ট অবশ্যই পাবেন!”সেই দীর্ঘদেহী পুলিশ অফিসার এবার বলে উঠল,
-“হ্যাটস অফ টু ইউ, গৈরিকবাবু, আপনি তো ফাটিয়ে দিলেন মশাই। তবে ওই গহনার বাক্স…”
-“ওটা মন্দিরেই রাখা আছে…পাছে কিছু জানাজানি হয়ে যায় তাই মহাদেব ওটাকে আর ঘরে আনেনি, সুযোগ পেলে ওখান থেকেই ওটা নিয়ে সোজা কলকাতা চলে যেত বেচার তাগিদে। এখন প্রশ্ন মন্দিরে কোথায় আছে ওটা? তাইতো?”
সবাই প্রায় একসাথেই বলে উঠল, “হ্যাঁ।”
গৈরিক বলতে লাগল,
-“মনে আছে আমি বলেছিলাম যে শিউলি কিরণবালাকে বলেছিল যে ওই সন্ন্যাসীই মন্দিরে নতুন শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছে…আমার বিশ্বাস ওই শিবলিঙ্গটা ফাঁপা…ওর মধ্যেই লুকোনো আছে গহনার বক্সটি, কি মহাদেব বাবু, আমি ঠিক বলেছি তো?”
মহাদেব মুখ নিচু করেই মাথা দুলিয়ে একটা সম্মতিসূচক ঈঙ্গিত করল।সেই রাত্রেই মহাদেবকে এরেস্ট করে নিয়ে গেল পুলিশ আর মন্দির থেকে গহনার বাক্সে যা সোনা পাওয়া গেলো, তার এখনকার মুল্য আনুমানিক কুড়ি লাখ টাকা!
গেরোদার এত বড় সাফল্যের পরও টুসুর মন কেমন করছিল শিউলি আর জাহ্নবীর কথা ভেবে। কত মিল এদের দু’জনের মধ্যে। এই দু’জন নারীই তাদের ভালোবাসার মানুষদের সাথে সংসার করতে চেয়েছিল, চেয়েছিল যেভাবেই হোক তাদের আর্থিক সাহায্য করতে। কিন্তু দু’জনের ভাগ্যে মৃত্যু ছাড়া আর কিছু জুটল না। সত্যিই তো, সেই যুগ থেকে এইযুগ অবধি মেয়েরা কত অসহায় সমাজের হাতে। টুসু নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল, কবে যে মেয়েরা উপযুক্ত মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারবে, কবে যে তারা পুরুষের চোখে চোখ রেখে বলতে পারবে, আমিও তোমার মতই মানুষ ! কবে?
-
গল্প- টেক্কা
টেক্কা
– প্রলয় কুমার নাথ“বৌ-বাচ্চাকে খাওয়ানো পরানোর যখন মুরোদ নেই, তখন বিয়ে করতে গিয়েছিলে কেন শুনি?”
আজকাল পরমার এই ধরণের মন্তব্য শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওঠে অনিন্দ্য। তার ভাবতেও অবাক লাগে, যে এ কি সেই পরমা! কলকাতার অন্যতম ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের একমাত্র মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও একদিন এই পরমাই আঁকড়ে ধরেছিলো নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে অনিন্দ্যর হাত! সেই কলেজের সময় থেকে দু’জনের প্রেম, অনিন্দ্য পিছপা হতে চাইলেও তাকে হার মানতে হয়েছে পরমার জেদের কাছে। একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে সাধারণ চাকরি জোটায় অনিন্দ্য, এই কথা জেনেও তার জন্য এক কাপড়ে নিজের পরিবারের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে পরমা। এই সব অনেক পুরোনো কথা, বর্তমানে শিয়ালদার একটি ভাড়া বাড়িতে স্ত্রী এবং আট বছরের মেয়ে মলিকে নিয়ে ছোট্ট সংসার অনিন্দ্যর।অনিন্দ্য পরমাকে বহুবার বোঝাতে চেষ্টা করেছে নিজেদের আর্থিক অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে, কিন্তু প্রতিবারই বিফল হয়েছে। নিজের বন্ধু-বান্ধব এবং চারপাশের আর পাঁচটা স্বচ্ছল পরিবারকে টেক্কা দেওয়ার জেদ চেপে গিয়েছে পরমার। একদিন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না অনিন্দ্য, সে পরমার চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে,
“আমি কিন্তু তোমাকে তুলে এনে বিয়ে করিনি, পরমা…তুমি নিজের ইচ্ছায় আমার জন্য বাড়ি ছেড়েছিলে। তোমার যদি মনে হয় আমার কাছে তুমি উপযুক্ত সুখ-স্বচ্ছন্দ পাচ্ছো না, তাহলে তোমার জন্য এই বাড়ির দরজা খোলা আছে…”
এই কথার কোনো জবাব দেয় না পরমা, শুধু তার সুন্দর চোখদু’টি ক্রোধের আগুনে জ্বলে ওঠে। সেই রাত্রে অনিন্দ্যর বিছানা ত্যাগ করে পরমা, এবং পরদিন সকাল থেকেই তার আর কোনো খোঁজ পায়না অনিন্দ্য।এরপর কেটে গিয়েছে বেশ কয়েকটি মাস। স্ত্রীকে হারিয়ে এবং মেয়েকে নিরন্তর মায়ের জন্য কৈফিয়ত দিতে দিতে হতাশ অনিন্দ্য একদিন জানতে পারে যে তাদের অফিসে নিযুক্ত হয়েছেন এক নতুন এইচ.আর ম্যানেজার। তিনি নাকি একে একে স্যাক করেছেন এমন কর্মচারীদের, যাদের গতবছরের পারফরম্যান্স খারাপ। এক সময় ডাক আসে অনিন্দ্যর! তাকেও বাধ্য করা হয় নিজে থেকে পদত্যাগ করতে। নিজের রেজিগনেশন লেটারটা এইচ.আর ম্যানেজারের হাতে দিতে গিয়ে বিস্ময়ে থরথর করে কেঁপে ওঠে অনিন্দ্য, কারণ সেই নব নিযুক্ত এইচ.আর ম্যানেজার আর কেউ নয়…তার স্ত্রী পরমা। তাচ্ছিল্যের সাথে বলে ওঠে পরমা, “তোমাকে বলেছিলাম না, একদিন আমি সকলকে টেক্কা দেবই!…যাই হোক, কিছুদিনের মধ্যেই ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে দেবো তোমার কাছে, আর আইন নিশ্চয় চাইবে না যে এমন চালচুলোহীন পিতার কাছে থেকে মলির ভবিষ্যৎ নষ্ট হোক…”
কেটে গিয়েছে আরো বেশ কয়েকটা বছর। পরমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সাথেই অনিন্দ্যকে হারাতে হয়েছে মলিকেও। আইন অনিন্দ্যর কর্মজীবনের বিফলতাকে ভর্ৎসনা করে, তার একমাত্র সন্তানের দায়িত্ব তুলে দিয়েছে তার থেকে অধিক রোজগেরে পরমার হাতে। চাকরি এবং পরিবারকে হারিয়ে সর্বশান্ত অনিন্দ্য ভুগতে থাকে ডিপ্রেশনে। সে ঠিক করে শেষ করে দেবে নিজেকে। সেদিন রাত্রে একমুঠো ঘুমের ওষুধ মুখে পোরার ঠিক আগের মুহূর্তে বেজে ওঠে তার মোবাইল ফোন। থানা থেকে ফোন করা হয়েছে তাকে। অনিন্দ্য চমকে ওঠে, যখন সে শোনে যে গতকাল রাত্রেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে পরমা! সে ছুটে যায় থানায়, সেখানে পুলিশ তাকে বলে যে মৃত্যুর আগে পরমা কিছু কাগজপত্র দিয়ে যেতে চেয়েছিলো অনিন্দ্যকে। প্রথম কাগজটি হল একটি সম্পত্তির উইল, এবং দ্বিতীয়টি হল অনিন্দ্যর উদ্দেশ্যে পরমার লেখা একটি চিঠি, যাতে সে লিখেছে:
“অনিন্দ্য,
পারলে আমায় ক্ষমা করো। আমি বুঝতে পারিনি, যে সকলকে টেক্কা দেওয়ার জন্য সফলতার শিখরে উঠে যখন নিচের দিকে চাইবো, তখন কাউকেই দেখতে পাবো না। তার কারণ হল, এই আর্থিক স্বচ্ছলতা পাওয়ার জন্য সমাজের নানা মানুষের কাছে আমাকে ক্রমাগত বিকিয়ে দিতে হয়েছে শরীরের সাথে নিজের আত্মমর্যাদাকেও! যে মলিকে নিজের কাছে পেয়ে আমি মনে করেছিলাম যে এক বিরাট বড় যুদ্ধজয় করলাম, একদিন সেই আমাকে দেখে ফেললো এক পরপুরুষের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হওয়া অবস্থায়।তার কান্না মাখা কচি গলার কথাগুলো যে এখনো আমার কানে বাজে, ‘তুমি খুব খারাপ, মামণি…এবার আমি বুঝতে পারলাম তুমি কেন বাপির সাথে থাকো না! আমি তোমার কাছে থাকবো না…কখনো না…আমি বাপির কাছে যাবো!’
সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তোমার সাথে প্রতিপত্তির যুদ্ধে জিতেও মনুষ্যত্বের যুদ্ধে হেরে গিয়েছি আমি। এমনই সময় আমার হাতে এসে পৌঁছলো বাবার বিপুল সম্পত্তির উইলটা, হয়তো শেষ সময়ে তিনি ক্ষমা করেছিলেন আমাকে। কিন্তু এত ধনসম্পত্তির মালিক হলেও, আমার সবচেয়ে প্রিয় বুকের ধন…আমার মলিই যে থাকতে চায় না আমার কাছে। তার এক জেদ, সে তোমার কাছে থাকবে! কিন্তু আমার যে তোমার কাছে ফিরে যাওয়ার আর কোনো মুখ নেই।
তাই বাধ্য হয়েই স্বেচ্ছায় এই সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে মৃত্যুর আগে আমার সমস্ত পৈতৃক সম্পত্তি তোমার নামে লিখে দিলাম। সুখে থেকো অনিন্দ্য, মলিকে সুখে রেখো।
ইতি,
পরমা।”***
আরো বেশ কয়েকটি বছর অতিবাহিত হয়েছে। মলি এখন কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। পরমার পৈতৃক সম্পত্তির মালিক অনিন্দ্য এখন প্রবেশ করেছে বার্ধক্যে। আর্থিক প্রাচুর্যে ভরা তার সংসার। এমনই একদিন এক সৌম্যদর্শন যুবকের হাত ধরে তার কাছে এগিয়ে এলো মলি। তারপর সে নতমুখে অস্ফুট স্বরে অনিন্দ্যকে বললো,
“আমি আর অসীম একে অপরকে খুব ভালোবাসি, বাবা…অসীম একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ চাকরিজীবী ছেলে হওয়া সত্বেও আমি ওকেই বিয়ে করতে চাই…আশা করি এতে তোমার কোনো অমত নেই!”মুহূর্তের মধ্যে সচকিত হয়ে উঠলো অনিন্দ্য। মলির মধ্যে কত বছর আগেকার সেই কলেজ পড়ুয়া পরমাকে যেন দেখতে পাচ্ছে সে, আর অসীম নামক ওই যুবকের মধ্যে নিজেকে! টেক্কা দেওয়ার এই খেলার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায় আবার যেন কেঁপে উঠলো প্রৌঢ় অনিন্দ্যর বুক!
(সমাপ্ত)
-
গল্প- আয়নার ইঙ্গিত
আয়নার ইঙ্গিত
-প্রলয় কুমার নাথপর্ব-১
নেতাজী সুভাষ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেই মৈনাক আরেকবার স্পর্শ করল তার ফোনের স্ক্রিনে থাকা স্বাগতার নাম্বার। কিন্তু কিছুক্ষণ ফোনটা কানে রেখেই, বিরক্ত হয়ে লাইনটা কেটে দিল মৈনাক। এবারও সেই এক ব্যাপার, সেই এক যান্ত্রিক আওয়াজ এল কানে,
–“দা নাম্বার ইউ আর ডায়ালিং ইস কারেন্টলি সুইচড অফ, প্লীজ ট্রাই আফটার সাম টাইম…” আর কোন কিছু না ভেবে মৈনাক এয়ারপোর্টের সামনে থেকে একটা ট্যাক্সি ধরল। তারপর গাড়ির চালককে নিজের বাড়ির অবস্থান বুঝিয়ে দিয়ে ঢুকে পরল ট্যাক্সির ভেতর। চালক স্টার্ট দিল গাড়িতে, আর সেই সঙ্গেই সকল উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তা ভিড় করে এল মৈনাকের মস্তিষ্কে। কি যে হল স্বাগতার? কালকের গোটা দিনটা, আর আজকের এই দুপুরটা অবধি ওর ফোন বন্ধ…এমন তো কখনো হয়নি আগে!মৈনাক আর স্বাগতার বিবাহ হয়েছে প্রায় তিন বছর আগে। আরেঞ্জড ম্যারেজ হলেও বিয়ের পর তা “লাভ”-এই পরিণত হয়েছিল প্রথম প্রথম। কলকাতার একটি নামী মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে মার্কেটিং ম্যানেজার পদে কর্মরত মৈনাককে কর্মসূত্রে প্রায় যেতে হয় কলকাতার বাইরে। এই যেমন সে এক সপ্তাহ ধরে তার কোম্পানির ব্যাঙ্গালোর ব্রাঞ্চে বসেছিল, আজ দুপুরেই সে সেখানকার কাজ মিটিয়ে ফ্লাইটে করে কলকাতায় ফিরল। স্বাগতার সাথে বিবাহের এক বছরের মধ্যেই একটি পথ দুর্ঘটনায় মারা যান মৈনাকের মা এবং বাবা। তাই মৈনাকের অনুপস্থিতিতে, স্বাগতাকে একাই থাকতে হয় এই এত বড় বাড়িতে। বিয়ের দুই বছরের মধ্যেই একবার সন্তান-সম্ভবা হয়েও মিসক্যারেজ হয়ে যায় স্বাগতার, তাই তার সেই দুঃখ এবং মৈনাকের মা বাবাকে হারানোর শোক যেন ক্রমশ ওদের দু’জনকে আলাদা করে দিচ্ছিল। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও, প্রতিদিন কম করেও পাঁচ থেকে ছয় বার ফোনে কথা হয় মৈনাকের স্বাগতার সাথে।
শুধু বিপত্তি বাঁধল গত দিন থেকে…স্বাগতাকে কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না ফোনে! যখনই মৈনাক তাকে ফোন করছে, তখনই সেই এক কথা শোনা যাচ্ছে! আতঙ্কে আর উত্তেজনায় বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিল মৈনাক…হঠাৎ করে কি হল স্বাগতার? কেনই বা বন্ধ করে রেখেছে সে তার ফোন? কোন যান্ত্রিক গোলযোগ হলেও তা এতোক্ষণ ধরে চলার কথা নয়…তাহলে কোন বিপদ হল না তো স্বাগতার!
ওদের বাড়িটা একটা ফাঁকা জায়গায় অবস্থিত, যানজটে ভরা জনবসতি থেকে একটু দূরে। বাড়ির সামনে একটি ফাঁকা মাঠ, অন্য দুই ধারে বাগান আর বাড়ির পেছনে আছে একটি দিগন্ত বিস্তৃত জঙ্গলাকীর্ণ জমি। মৈনাকের ট্যাক্সিটা ওর বাড়ির সামনে পৌঁছলে সে চালকের ভাড়া মিটিয়ে, দুরু দুরু বুকে ছুটে গেল বাড়ির কাছে। সে জোরে জোরে চিৎকার করে স্বাগতার নাম ধরে ডাকতে লাগল, কিন্তু কোন উত্তর এল না বাড়ির ভেতরে থেকে। মৈনাক বাড়ির সদর দরজার কাছে ছুটে এসে দেখল, যে দরজাটা শুধুমাত্র বাইরে থেকে আটকানো…তবে কোন তালা দেওয়া নেই তাতে। এটা দেখে ধক করে উঠল মৈনাকের হৃদয়…তার মানে কি স্বাগতাকে কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছে এই বাড়ি থেকে? আর সেজন্যই সে বুঝি ফোন ধরতে পারছে না!
আর দেরি না করে মৈনাক এক ঝটকায় দরজা খুলে ছুটে গেল বাড়ির ভেতর। সে সারা বাড়িময় স্বাগতার নাম ধরে ডাকতে লাগল, তাকে খুঁজতে লাগল এই ঘর থেকে সেই ঘর…কিন্ত প্রতিটা ঘরের সব কিছু ঠিক আগের মত একই জায়গায় থাকলেও নেই শুধু স্বাগতা! কিছুক্ষণ তাকে খোঁজার পর, ড্রয়িং রুমে সোফায় ক্লান্ত হয়ে বসে, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মৈনাক,
–“কি হল তোমার স্বাগতা…কোথায় গেলে তুমি আমায় ছেড়ে…কোথায়!”একটু পরেই বেজে উঠল মৈনাকের ফোন, ও নিজের হুঁশ ফিরে পেয়ে ফোনের স্ক্রিনে দেখতে পেল সূর্যর নাম্বার। সূর্য ওর অফিস কলিগ এবং বিশিষ্ট বন্ধু। ওরা একসাথেই কোম্পানির কাজে ব্যাঙ্গালোরে গিয়েছিল, তারপর আজকে দু’জনে একই ফ্লাইটে ফিরেছে। সূর্য থাকে দমদম এয়ারপোর্টের কাছেই, ওকে ওর স্ত্রী আজ এয়ারপোর্টে রিসিভও করতে এসেছিল। এবং মৈনাকের এই স্বাগতার ফোন না পাওয়ার ঘটনার কথা সূর্য মৈনাকের সাথে ব্যাঙ্গালোরে কাটানোর শেষ দিনই জানতে পেরেছে। মৈনাক ওর ফোনটা রিসিভ করতেই, বেশ উদ্বেগের সাথে বলে উঠল সূর্য,
–“কি রে, বাড়ি পৌঁছেছিস? খোঁজ খবর পেলি কিছু বৌদির?”
মৈনাক উদভ্রান্তের মত কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে উঠল,
–“না রে সূর্য…স্বাগতাকে কোথাও পাচ্ছি না…কোথাও না…বাড়ির সদর দরজাটা বাইরে থেকে তালা না দিয়েই বন্ধ করা ছিল…সারা বাড়ি খুঁজলাম, কোথাও নেই সে!”
ফোনের ওপার থেকে সূর্য বলে উঠল,
–“সে কি! তুই আত্মীয় স্বজনদের কাছে গিয়ে খোঁজ নিয়েছিস, সে তাদের কারোর কাছে আছে কি না?”
মৈনাক অধৈর্য হয়ে বলে উঠল,
–“সে তো ব্যাঙ্গালোরে থাকতে তোর সামনেই চেনা জানা সবাইকেই ফোন করে দেখলাম, ভাই…কেউ তো কিছুই বলতে পারল না ওর সম্বন্ধে!”কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল সূর্যর কন্ঠ, তারপর সে দৃঢ় গলায় বলে উঠল,
–“মৈনাক, আমার মনে হয় আর দেরি করা ঠিক হবে না…আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি তোর কাছে…তারপর আমাদের দুজনকে একবার থানায় যেতে হবে…বৌদিকে যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এই ব্যাপারে তাদেরকে জানাতে হবে…শোন, তুই টেনশন নিস না বেশি…আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি তোর ওখানে…রাখছি!”
সূর্যর সাথে কথা বলা হয়ে গেলে, দুশ্চিন্তায় কাঁপা কাঁপা হাতে আবার ফোনটা নিজের পকেটে ভরে রাখল মৈনাক!সূর্যর দমদম থেকে হাওড়ায় আসতে প্রায় এক দেড় ঘণ্টা সময় লাগবে, এই কথা মৈনাক জানে। এই সময়টুকু এই বাড়িতে এই ভাবে একা বসে থাকতে খুব অসহায় লাগছিল তার। সন্ধ্যার অন্ধকার অনেক আগেই নেমে এসেছে পৃথিবীর বুকে…স্বাগতাকে ছাড়া পুরো বাড়িটাই যেন কোন প্রেত পুরীর মত খাখা করছে মৈনাকের চোখের সামনে। রোজকার সন্ধ্যা বেলার সাথে আজকের এই সময়টার এই বাড়ির চেহারায় কত পার্থক্য! আজ এই বাড়ির কোন ঘরে কোন আলো জ্বলে ওঠেনি, শোনা যায়নি কোন শঙ্খের ধ্বনি, আসছে না এই সময় টিভিতে অনুষ্ঠিত হওয়া কোনো মেগা সিরিয়ালের আওয়াজও! কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে মৈনাক বুঝতে পারল যে এখনও অবধি সে ফ্লাইটে পরে আসা পোশাকই পরে রয়েছে!
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সোফা থেকে উঠে পড়ল মৈনাক। তারপর নিজের বেডরুমে গিয়ে অন্য পোশাক খোঁজার উদ্দেশ্যে সুইচ অন করল সেই ঘরের লাইট। কিন্তু ঘরের লাইট জ্বলল না। সে আরো এক দুই বার চেষ্টা করল সুইচ অন-অফ করে, কিন্তু তাও জ্বলল না লাইট। হয়তো এখন কারেন্ট নেই, লোড শেডিং চলছে, ভাবল মৈনাক। সে এই অন্ধকার ঘরের মধ্যে কোনরকমে তার বিছানার পাশের একটি টেবিলের ড্রয়ার থেকে বার করল একটি মোমবাতি আর দেশলাই। তারপর মোমবাতিটাকে জ্বালিয়ে, টেবিলে দাঁড় করিয়ে, সেই আলোতেই অসুবিধাজনক ভাবে বদলে নিল নিজের পোশাক।
ওদের বিছানার সামনেই দেওয়ালে লাগান রয়েছে একটি বিশাল বড় আয়না। বিয়ের পর পরই মৈনাক নিজেই কিনে এনেছিল সেটাকে, মূলত স্বাগতার সাজ গোজ করার জন্যই। মোমবাতির আলোটা সেই আয়নার সামনে আসছিল না বলে, সেটাকে হাতে করেই, মৈনাক এসে দাঁড়াল আয়নাটার সামনে, শুধুমাত্র চুলটা একটু আঁচড়ানোর অভিপ্রায়ে।
কিন্তু এতদিনের পরিচিত এই আয়নাটার সামনে আসতেই কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল মৈনাকের। সে যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে যে আয়নাটার ভেতর থেকে কার একটা নিঃশ্বাস নেওয়ার আওয়াজ ভেসে আসছে। সে আয়নাটার আর একটু কাছে আসতেই, সেই মোমবাতির আলোতে দেখতে পেল যে আয়নার মাঝে তার নিজের চেহারাটা কেমন যেন ঝাপসা হয়ে এল!…ঠিক যেন কারোর নিঃশ্বাস ত্যাগের বাষ্পতে ভরে উঠেছে গোটা কাঁচটাই! মৈনাক অবাক হয়ে চেয়ে রইল সেই দিকে…দেখতে দেখতে, সেই কাঁচে জমা বাষ্প যেন একটি পুরুষের মূর্তি ধারণ করল…সেই অশরীরি পুরুষ যেন আয়নার ভেতর থেকে বড় বড় চোখ মেলে চেয়ে আছে মৈনাকের দিকে! মৈনাক আতঙ্কে শিউরে উঠে ছুটে দুই পা পিছিয়ে এল সেই আয়নার কাছ থেকে…ওর কম্পিত হাত থেকে মোমবাতিটা ঘরের মেঝের ওপর পড়ে গিয়ে দপ করে গেল নিভে!
পর্ব-২
মৈনাক রুদ্ধশ্বাসে সেই ঘর থেকে ছুটে বেরোতে গেল, কিন্তু দরজার সামনে আসতেই হঠাৎ দরজার দু’টো পাল্লা সজোরে এসে বন্ধ হয়ে গেল ওর মুখের সামনে! সে আছড়ে পড়ল বন্ধ দরজার গায়ে, নিজের সর্বশক্তি দিয়ে টেনেও আলাদা করতে পারল না দরজার দু’টি পাল্লা। সে আর্তচিৎকার করে দুই হাত দিয়ে বাড়ি মারতে থাকল দরজার গায়ে! তীব্র শব্দে কেঁপে উঠতে থাকল দরজা তথা তার পুরো বেডরুমটাই সেই আঘাতের চোটে, কিন্তু সেই দরজা খুলতে পারে কার সাধ্য! মোমবাতির আলো নিভে যাওয়ার পর পুরো ঘর জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজমান, শুধু পেছনের জানলা থেকে এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে সেই অভিশপ্ত আয়নার বুকে। অবশেষে, দরজা খোলার বৃথা প্রচেষ্টা ছেড়ে দিয়ে, মৈনাক কোন মতে হাঁপাতে হাঁপাতে দরজার গায়ে পেছন দিয়ে সেঁটে দাঁড়িয়ে আবার তার ভয়ার্ত দৃষ্টি রাখল সেই আয়নার প্রতি। সে এবারও স্পষ্ট দেখতে পেল, সেই ছায়ামূর্তিটা যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে আয়নার ভেতর থেকে। এবার সে যেন হেলান দিয়ে দাঁড়াল, তার দুই হাত দিয়ে আয়নাটার কাঁচের বিপরীত পৃষ্ঠতলে স্পর্শ করে! এই হালকা চাঁদের আলোয়, মৈনাক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সেই অশরীরির দুই হাতের পাঁচটি করে আঙুলের ছাপ!
মৈনাক চাইল চিৎকার করতে, কিন্তু কোনো আওয়াজই সৃষ্টি করতে পারল না তার কণ্ঠের স্বরযন্ত্র। ঠিক এমন সময় ঘরের বাইরে, দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ আসতে লাগল! সে শুনতে পেল তার বন্ধু সূর্যর পরিচিত কণ্ঠস্বর,
–“মৈনাক…এই মৈনাক…তুই কি বৌদিকে খুঁজে না পেয়ে পাগল হয়ে গেছিস! বাড়ির সদর দরজা হাট করে খুলে রেখে এখন বেডরুমের দরজা বন্ধ করে ভেতরে বসে আছিস!”
ঠিক তখনই অদৃশ্য হয়ে গেল আয়নার মধ্যে থাকা সেই ছায়ামূর্তি! আবার আয়নার মধ্যে নিজের স্বাভাবিক প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল মৈনাক…আর সূর্যর ধাক্কায়, এক ঝটকায় খুলে গেল ঘরের দরজাটা।মৈনাক ছুটে গিয়ে আতঙ্কে খামচে ধরল সূর্যর জামার কলার, তারপর সে হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে বলে উঠল,
–“সূ…সূর্য…এই ঘরে…এই আয়নাটার মধ্যে কেউ আছে সূর্য…কেউ একটা আছে!”
সূর্যর বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল মৈনাকের কথাটা বুঝতে, তারপর সে অবিশ্বাস ভরা কণ্ঠস্বরে বলল,
–“হয়, হয়…এই রকম পরিস্থিতিতে মানুষ একটু ভুল ভাল দেখেই ফেলে!”
মৈনাক তীব্র প্রতিবাদের সুরে চিৎকার করে বলে উঠল,
–“তোর কি মনে হচ্ছে, আমি ভুল ভাল দেখছি? আমি তোকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলছি?…না সূর্য, না…আমি সত্যিই এই আয়নার মধ্যে একটা ছায়া মূর্তিকে দেখেছি!”
সূর্য আবার বিরক্তি মেশান গলায় বলল,
–“আর সে তোর স্ত্রী স্বাগতা, তাই তো?”এবার সূর্যকে অবাক করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মৈনাক, সে চিৎকার করে বলল,
–“তুই এখনো কেন বিশ্বাস করছিস না আমার কথা? ওটা একজন পুরুষের চেহারা ছিল, কোন মহিলার নয়!…আমি তোকে মিথ্যা কথা বলছি না রে, সূর্য!”
সূর্য এবার বেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বলল,
–“ঠিক আছে, বুঝলাম…তবে এই কথাই পরে আসছি…আগে যে কাজে তোর কাছে এসেছি, সেই কাজ মেটাতে হবে। শোন তোর মোবাইলে বৌদির ছবি আছে নিশ্চয়? ব্যাস, আর দেরি না করে এখনই আমাদের একবার থানায় যেতে হবে…তুই কিছুক্ষণের জন্য এই সব ভাবা বন্ধ কর, নাহলে পুলিশের লোকেদের সামনে এই সব বলে ফেললে কিন্তু ওরা তোকে পাগল ভাববে, আর আমাদের সমস্যায় দৃষ্টিপাতই করবে না!”
মৈনাক কিছুক্ষন ধাতস্থ হলে, ওরা দু’জনেই ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল থানার উদ্দেশ্যে।থানাতে গিয়ে বিশেষ কোন উল্লেখ্য ঘটনা ঘটল না। সেখানকার দীর্ঘদেহী একজন অফিসার তাদের কাছে আসা হাজারো এমন নিরুদ্দেশের ঘটনা লেখা একটি খাতার প্রায় শেষের দিকের পাতায় লিপিবদ্ধ করলেন মৈনাকের স্বাগতাকে না পাওয়ার আকুল অভিযোগ। ফটো নিয়ে তার সম্পর্কে হাজারো কথা জিজ্ঞাস করে, নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেই তিনি বললেন,
–“ঠিক আছে, আমরা আপনার স্ত্রীর কোন খোঁজ খবর পেলে অবশ্যই জানাব…এখন তাহলে আসুন।”
প্রতিনমস্কার করে বেশ নিরাশ চিত্তেই থানা থেকে বেরিয়ে এসেছিল মৈনাক আর সূর্য। ওরা আবার ফিরে এসেছিল মৈনাকের বাড়িতে।মৈনাকের বেড রুমে ওরা এক সাথে কথা বার্তা বলছিল। সূর্য মৈনাককে জিজ্ঞাসা করল,
–“এই আয়নাটাতো এতদিন ধরে তোদের বেডরুমে আছে, এর আগে কি তোর এটাকে নিয়ে এমন কোন ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে?”
মৈনাক উদাসীন স্বরে বলল,
–“কই, না তো!”
এবার সূর্য বেশ গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
–“তুই যদি আমাকে সত্যি কথাই বলে থাকিস যে তুই ওই আয়নাটার মধ্যে কোন অতি প্রাকৃত-শক্তিকে উপলব্ধি করেছিস, তাহলে তোকে একটা কথা বলি…শুধু আমাদের ভারতবর্ষেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই আয়নাকে অশরীরি শক্তির বাসস্থান বলে মনে করা হয়! এর পেছনে কিন্তু কারণ আছে…বিভিন্ন প্যারানর্মাল বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যে আত্মা হল আলোর মতই একটি শক্তি…আলো যেভাবে আয়নার ভেতরে ঢুকে তার পৃষ্ঠতল থেকে প্রতিফলিত হয়, ঠিক সেভাবেই এই বিদেহী আত্মাদেরও আয়নার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ থাকে। সেই জন্য মনে করা হয়, যে ঘরে কোন মুমূর্ষ রোগী আছে বা কেউ মারা যাচ্ছে, সেই ঘরে আয়না রাখা উচিত নয়, আর তা রাখলেও সেটাকে যেন দেওয়ালের দিকে ঘুরিয়ে রাখা হয়…নাহলে সেই রোগীর বা যার মৃত্যু হচ্ছে, তাদের আত্মার বিশাল সম্ভাবনা এই আয়নার ভেতর প্রবেশ করে তার মধ্যেই বাস করার! এছাড়াও, কেউ কেউ তো আয়নাকে “পোর্টাল”-ও মনে করেন, অর্থাৎ অশরীরি শক্তিদের তাদের দুনিয়া থেকে আমাদের দুনিয়ায় যাওয়া আসার সংযোগস্থল!”এতক্ষন মৈনাক স্তব্ধ হয়ে শুনছিল সূর্যর কথা, এবার সে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,
–“তার মানে বুঝতে হবে যে এই আয়নার মধ্যেও কারোর প্রেতাত্মা লুকিয়ে আছে!…কিন্তু এতদিন তো সে কোন ভাবে আমাদেরকে দেখা দেওয়ার চেষ্টা করেনি!”
ওর কথা শেষ না হতেই সূর্য অধৈর্য স্বরে বলে উঠল,
–“তার কারণ এতদিন এই আত্মার তোর সাথে যোগাযোগ করার কোন প্রয়োজন হয়নি…কিন্তু এখন হয়েছে! কিন্তু কেন? কেন সে চাইছে তোর সাথে কথা বলতে? কি এমন ঘটনা ঘটেছে এখন যে…”
ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মৈনাক বলে উঠল,
–“ঘটনা তো ঘটেছেই, সূর্য…এই যে স্বাগতা নিখোঁজ হয়েছে!”ব্যাপারটাকে আন্দাজ করে সূর্যও হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মৈনাকের দিকে। তারপর দৃঢ় স্বরে তাকে বলে উঠল,
–“তার মানে…হোক না হোক….এই আত্মার বৌদির নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সাথে কোন সম্পর্ক আছে….হয়ত সেই ব্যাপারেই সে কোন কথা তোকে বলতে চেয়েছিল!”
মৈনাক আতঙ্কে শিউরে উঠে একবার তাকাল সেই আয়নাটার দিকে। কিন্তু এখন তার মধ্যে যেন অস্বাভাবিকতার লেশ মাত্র নেই। এবার সূর্য মৈনাককে ঝাঁকিয়ে ধরে চিৎকার করে বলে উঠল,
–“শোন মৈনাক, শোন…আমাদের সকলের আগে জানতে হবে, যে এই আয়নাটার মধ্যে কার প্রেতাত্মা বাস করছে…তারপরই আমরা বুঝতে পারব যে তার কি সম্পর্ক আছে বৌদির নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার সাথে!…আর জন্য তোকে বলতে হবে তুই কোথা থেকে এই আয়নাটা কিনেছিলিস…ভালো করে ভেবে বল, মৈনাক…আমাদের হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই!”মৈনাক তার মস্তিষ্কে জোর দিয়ে ভাবতে লাগল এই প্রশ্নের উত্তর…
পর্ব-৩
মৈনাকের কিছুক্ষণ ভেবেই মনে পড়ে গেল এই আয়নাটা কেনার ঘটনার কথা। সে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠল,
–“বিয়ের পরেই একবার আমি আর স্বাগতা বড়বাজারের একটা মার্কেটে গিয়েছিলাম কিছু কেনাকাটা করার উদ্দেশ্যে। সেখানেই একটি কিউরিও-র দোকানে এই আয়নাটাকে দেখে খুব পছন্দ হয় স্বাগতার, সে ওটা কেনার কথা বলে। আমি গিয়ে দোকানদারের সাথে কথা বলে জানতে পারি, স্থানীয় কোন এক সাহা বাড়ি থেকে নিলামে এই আয়নাটা কিনেছে সে! আমি খুব একটা রাজি চিলাম না এটা কিনতে, স্বাগতাকে বলেছিলাম যে যদি বাড়িতে আয়নার দরকারই হয়, তাহলে নতুন আয়না কিনে দিচ্ছি…এরকম একটা ব্যবহার করা, নিলামে বিক্রি হওয়া আয়না কিনে কি লাভ? কিন্তু স্বাগতা নাছোড়বান্দা, তার নাকি এই সব এন্টিক জিনিসই বেশি পছন্দের! তাই সেদিন বাধ্য হয়ে এই আয়নাটা কিনে এনেছিলাম। পরে বাড়িতে মিস্ত্রি ডেকে এটা আমাদের বেডরুমের দেওয়ালের সাথে আটকে নিয়েছিলাম।”সূর্য ওকে থামিয়ে উত্তেজিত স্বরে চিৎকার করে বলে উঠল,
–“এক মিনিট মৈনাক, সেই দোকানদার তোকে কি বলেছিল, সে এই আয়নাটাকে যেন কোথা থেকে কিনেছে?”
মৈনাক বিরক্ত হয়ে বলে উঠল,
–“ওফ বললাম তো, বড়বাজারের কোন এক সাহা বাড়ি থেকে…ও হ্যাঁ, দোকানদার এই কথাও বলেছিল যে ওটা নাকি সেই অঞ্ছলের এক বিখ্যাত বনেদি বাড়ি, বেশ বড় পারিবারিক ব্যাবসা ছিল ওদের আগে সেই ব্রিটিশদের সময় থেকে…কিন্তু এখন ওদের ওই বাড়িটা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। ব্যাবসা তো অনেক আগেই উঠে গিয়েছে এবং এখন খুব খারাপ আর্থিক অবস্থা ওই পরিবারের, তাই তো তারা বাধ্য হয়েছে বাড়ির পুরনো এন্টিক জিনিসগুলোকে পয়সার জন্য এভাবে নিলামে বিক্রি করে দিতে!”মৈনাকের এই কথাগুলি বলার সাথে সাথেই হঠাৎ যেন একবার কেঁপে উঠল আয়নাটা! ওরা দু’জনেই চমকে উঠে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল সেটার দিকে…আর ঠিক তেমনই সময় সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল সেই ঘরের সমস্ত জানালা দরজা। ওরা শিহরিত হয়ে দেখল, যে আয়ানার কাঁপুনি যেন ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে চলেছে… মনে হচ্ছে যেন এখনই সেটা দেওয়াল থেকে খুলে নিচে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে!…তবে তা কিন্তু হল না। হঠাৎ কোনো এক ক্ষুব্ধ অশরীরি পুরুষ কণ্ঠের গুরুগম্ভীর আর্তচিৎকারে পুরো বাড়িটাই যেন কেঁপে উঠল। আবারও আয়নার কাঁচটা ঝাপ্সা হয়ে এল, কিন্তু এবার আর কোন পুরুষের মূর্তি তার মধ্যে দেখা গেল না। সূর্য ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল,
–“কে আছে আয়নার মধ্যে…কে?”
কিন্তু সেই প্রশ্নের কোন উত্তর এল না, তার পরিবর্তে, সেই অদৃশ্য অশরীরির পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেল,
–“স্বাগতাআআআআ…”
এই নাম শুনে, আর উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না মৈনাক, সে ধপ করে বসে পড়ল ঘরের মেঝের ওপর। কিন্তু সূর্য যেন এখনও বেশ শক্ত হয়ে আছে, সে আবার সেই কম্পিত আয়নাটার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠল,
–“কি হয়েছে স্বাগতা বউদির? বল কি হয়েছে তার? কোথায় চলে গিয়েছে সে?. ..বল… আমার কথার জবাব দাও…”কিন্তু এবারও তার প্রশ্নের কোন জবাব এল না, তার পরিবর্তে আবার গর্জে উঠল সেই ভৌতিক আয়ানা,
–“সুনীতিইইইই…”
এবার বেশ অবাক হয়ে গেল ওরা দু’জনেই! “সুনীতি” বলে তো ওরা কাউকে চেনে না, তাহলে এ কার কথা বলছে এই আয়নার ভেতর বসবাসকারী ওই প্রেতাত্মা! সূর্য আবার কিছু বলতে চলেছিল, কিন্তু তার আগেই, এবার তৃতীয় বার শোনা গেল সেই অশরীরির হাড় হিম করা কণ্ঠস্বর,
–“অবিনাশশশশশ…”
এবার আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে থাকার চেয়ে আর কোন উপায় ছিল না ওদের দু’জনেরই, কারণ, যথারীতি এই “অবিনাশ” বলেও কাউকে ওরা চেনে না! কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঁপা বন্ধ হয়ে গেল সেই আয়ানাটার, স্বাভাবিক হয়ে গেল তার কাঁচের প্রতিফলন ক্ষমতা, আর খুলে গেল সেই ঘরের সমস্ত জানলা দরজা। কিন্তু মৈনাক আর সূর্যর বিহ্বল ভাবটা কাটিয়ে স্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় ফিরে আসতে আরো বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল।কিছুক্ষণ পর সূর্য বলে উঠল,
–“শোন মৈনাক, ওই ‘আয়না’ কিন্তু আমাদের যথেষ্ট ‘ইঙ্গিত’ করে দিয়েছে, তবুও আমরা এখনও জানি না যে বৌদির সাথে আর কাদের দু’জনের নাম এই প্রেতাত্মা আমাদের বলতে চাইল, আর বৌদির নিখোঁজ হওয়ার সাথে এদের দু’জনের কি সম্পর্ক আছে… তবে এখানে এভাবে বসে থাকলে কিন্তু আমরা আমাদের কোন প্রশ্নেরই উত্তর পাব না!”
ওর কথা শেষ না হতেই মৈনাক অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,
–“তাহলে কে বলবে আমাদের এই কথাগুলো…কোথায় গেলে পাব আমরা আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর?”
সূর্য এক নিঃশ্বাসে বলে উঠল,
–“যেখান থেকে এই আয়নাটা নিলামে বিক্রি করা হয়েছিল…আমাদের যেতে হবে সেই বড়বাজারের সাহা বাড়িতে!”ওরা সেই রাতটা কোন রকমে কাটিয়ে পরের দিন সকালেই রওনা হল সেই সাহা বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওদের ভাগ্য ভালো ছিল, বড়বাজারের সেই কিউরিওর দোকানটা তখনও সেখানে খোলাই ছিল। সেই দোকানের মালিককে জিজ্ঞাসা করতেই ওরা পেয়ে গেল সাহা বাড়িতে যাওয়ার পথ নির্দেশ। ওরা সেখান থেকে আন্দাজ দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিল সেই বাড়ির সামনে। এক কালে যে এই পরিবারের বেশ ভালো আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল, তা এখনও এই ভাঙ্গা চোরা সুবৃহৎ পুরনো আমলের তৈরি বাড়িটাকে দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু এখন যে তাদের সুখের দিন শেষ হয়েছে তা প্রমাণ করে দিচ্ছে এই এত বড় সম্পত্তির নিদারুন দেখাশোনার অভাব। ওরা আর বাড়িটাকে বাইরে থেকে দেখে বেশি সময় নষ্ট না করে সোজা গিয়ে বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়ল। একটু পরেই সাধারন লুঙ্গি আর ফতুয়া পরিহিত, একজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক ওদের সামনে দরজা খুলে দাঁড়াল। দেখেই বোঝা যায় যে তিনি একসময় বেশ সুদর্শন চেহারার অধিকারী ছিলেন, কিন্ত এখন ক্রমাগত অভাব অনটনে বেশ ভেঙ্গে পড়েছে তার স্বাস্থ্য। তাছাড়া, মৈনাক আর সূর্যর মত তাকেও বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লাগছে দেখে।
ওদের কিছু বলার আগে, স্বয়ং সেই ভদ্রলোকই যেন বেশ উদ্বেগের সাথে বলে উঠলেন,
–“আপনারা কি আজকের খবরের কাগজটা পড়ে তারপর এখানে এসেছেন?”
ওরা দু’জনেই অবাক হয়ে গেল এই কথা শুনে। মৈনাক বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল,
–“মানে?”
সেই ভদ্রলোক ওদেরকে অবাক করে দিয়ে অধৈর্য গলায় বলে উঠলেন,
–“আজকের খবরের কাগজেই তো বেরিয়েছে খবরটা…গত পরশু দিন থেকে আমার দাদার মেয়ে সুনীতিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! পুলিশকে জানানোর সাথে সাথে আমি খবরের কাগজেও এই নিরুদ্দেশের কথাটা জানিয়েছিলাম…আপনারা কি সুনীতির কোন খোঁজ খবর পেয়ে আমাকে জানাতে এসেছেন? বলুন…দয়া করে বলুন…আপনারা কি দেখেতে পেয়েছেন মেয়েটাকে কোথাও?”ওরা দু’জনেই অবাক হয়ে পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল সেখানে, বিস্ময়ে ওদের বাকশক্তি যেন লোপ পেয়েছে! এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন সেই ভদ্রলোক, তার পর হতাশা ভরা কণ্ঠে বলতে লাগলেন,
–“হায় ঈশ্বর, কত বার করে আমি মেয়েটাকে বলেছিলাম, ওই অবিনাশ ছেলেটার সাথে না মিশতে! ও মটেই ভালো ছেলে নয়… প্রেমের নাটক করছে সে ওর সাথে! কিন্তু মেয়ে শুনলে তো আমার কথা…কে জানে, ছেলেটা যে ওকে কোথায় নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে! সুনীতির মতই অবিনাশকেও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না ওই একই দিন থেকে!”এবার যেন আরো বড় ঝটকা খেল ওরা দু’জনে…স্বাগতা, সুনীতি আর অবিনাশ…এই তিন জনেরই নাম নিয়েছিল মৈনাকের বাড়ির আয়নায় থাকা সেই প্রেতাত্মা! আর এখন ওরা জানতে পারল যে এই তিনজনেই নিখোঁজ হয়েছে! এ কোন রহস্যের গোলোকধাঁধায় ফেঁসে গেল ওরা, এই কথা ভেবে যেন ওদের মাথা ঘুরতে লাগল!
পর্ব-৪
সেই ভদ্রলোক আপন মনে কত কি বলে চললেন, কিন্তু সে সব আর মৈনাক আর সূর্যর কানেই ঢুকল না। পরমুহূর্তেই কথার ঘোর কেটে গেল ভদ্রলোকের, এবার তিনি বেশ সন্দিগ্ধ গলায় বলে উঠলেন,
–“সুনীতির কোন খবর যখন আপনাদের কাছে নেই, তাহলে আপনারা কারা? আর আমার কাছে আপনাদের কি দরকার?”
কিছুক্ষণ তো ওরা দু’জনে ভেবেই পেল না, যে কোথা থেকে শুরু করবে! সবার প্রথমে সূর্যই মুখ খুলল, সে তার আর মৈনাকের পরিচয় সেই ভদ্রলোককে দিয়ে বলল,
–“কি ভাবে যে আপনাকে সব কিছু বলব, তা বুঝে উঠতে পারছি না…শুধু এইটুকু জেনে রাখুন, আপনি যেমন সুনীতি আর অবিনাশের খোঁজ পাচ্ছেন না, ঠিক তেমনই…এই যে আমার বন্ধু মৈনাক..সে তার স্ত্রী স্বাগতাকেও খুঁজে পাচ্ছে না!…আর আশ্চর্যজনক ভাবে, এই তিনজনই কিন্তু নিখোঁজ হয়েছে একই দিন থেকে!”ভদ্রলোক কিছুক্ষণ বিহ্বল চোখে চেয়ে রইলেন ওদের দিকে। যেন বিশ্বাসই করতে পারলেন না ওদের কথা। তারপর এতক্ষণ পর ওদেরকে নমস্কার জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
–“নমস্কার, আমার নাম অম্লান সাহা…বুঝলাম আপনাদের কথা, কিন্তু আপনারা এখানে কি মনে করে আসছেন?”
মৈনাক বেশ দৃঢ় গলায় বলে উঠল,
–“শুধু একটা কথা জানার জন্য, আপনারা কি এই বাড়ির কোন আয়না কখনো নিলামে বিক্রি করেছিলেন?”
অম্লান বাবু বেশ বিরক্ত হলেন এই কথা শুনে, তিনি বলে উঠলেন,
–“এই সব কথা জানার কি আপনারা আর সময় পেলেন না মশাই, বাড়ির একটা মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে…আর আপনারা পড়ে আছেন কোন এক আয়না নিয়ে!”
তার কথা শেষ না হতেই সূর্য চিৎকার করে বলে উঠল,
–“সম্পর্ক আছে, অম্লান বাবু!…ওই আয়নার এই তিনটি মানুষের নিখোঁজ হওয়ার সাথে সম্পর্ক আছে…আর এই কথা আপনাকে বিশ্বাস করতেই হবে, কারণ আজ ওই “আয়নার ইঙ্গিত”-কে অনুসরণ করেই আমরা এখানে আসতে পেরেছি!”
এই বলে বিস্ময়ে হতবাক অম্লান বাবুর কাছে ওরা বলে গেল সেই আয়নাকে কেন্দ্র করে ওদের একটার পর একটা ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা!অম্লান বাবু এই কথাগুলো সম্পূর্ণ রূপে বিশ্বাস করলেন কিনা কে জানে, কিন্তু সমস্ত ঘটনা শোনার পর, তিনি বেশ আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন,
–“আ…আমার মনে পড়েছে….ওই আয়নাটা এই এই বাড়িতেই আমার দাদার ঘরের দেওয়ালে আটকানো ছিল!”
তার কথা শেষ না হতেই মৈনাক বলে উঠল,
–“বেশ, তাহলে হঠাৎ ওটা নিলামে বেচতে গেলেন কেন?”
অম্লান বাবু বেশ করুণ কণ্ঠে বললেন,
–“আসলে সেই সময় পয়সার বেশ টানাটানি যাচ্ছিল তাই ভাবলাম যে…আর তাছাড়া দাদার মৃত্যুর পর তো ওই আয়নাটা আর কেউ ব্যবহারও করত না!”
সূর্য এবার তীক্ষ্ণ স্বরে তাকে জিজ্ঞাসা করল,
–“আপনার দাদা কি ভাবে মারা গিয়েছিল, অম্লান বাবু?”
একটা দীর্ঘনিঃস্বাস ফেলে অম্লান বাবু বলতে লাগলেন,
–“দাদার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছিল…আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম তাকে বাঁচানোর, কিন্তু পারলাম না…হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে আনার পর এই বাড়িতেই তার ঘরে তার জীবনের শেষ মুহূর্ত কাটে, এখানেই মৃত্যু হয় দাদার!…কিন্তু জানেন, দাদা এত তাড়াতাড়ি মরতে চায়নি…সে আরো কিছুদিন বাঁচতে চেয়েছিল…বাঁচতে চেয়েছিল!”এই বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন অম্লান বাবু। সূর্য তার মানসিক অবস্থার দিকে কোন দৃষ্টিপাত না করেই আবার তাকে প্রশ্ন করে উঠল,
–“ভালো করে ভেবে বলুন, অম্লান বাবু…যে সময় আপনার দাদার এই বাড়িতে মৃত্যু হয়, সেই সময় কি সেই ঘরের দেওয়ালে ওই আয়নাটা লাগানো ছিল?…বলুন অম্লান বাবু…”
অম্লান বাবু হঠাৎ কান্না থামিয়ে তাদের দিকে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে, অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন,
–“হ্যাঁ…হ্যাঁ ছিল!”
মৈনাক আর সূর্যর মনে হল, ওদের মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হল! ওদের আর বুঝতে বাকি রইল না, যে ওই আয়নার ভেতর বসবাসকারী প্রেতাত্মা আর কেউ নয়…সে হল এই অম্লান বাবুর দাদা তথা সুনীতির বাবা!ওরা আর এক মিনিটও সেখানে অপেক্ষা না করে ফিরে এল মৈনাকের বাড়িতে। এখন নিজের বাড়ির, এই অতি পরিচিত ঘরে ঢুকতেই কেমন যেন গা ছমছম করতে লাগল মৈনাকের। সে ভেবেই শিউরে উঠতে লাগল, যে এতদিন সে আর স্বাগতা একজন তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতির মাঝেই এই ঘরে এক সাথে রাত্রিবাস করেছে! কিন্তু এখন এই সব কথা ভেবে কোনো লাভ নেই, কারণ এখনো অবধি তারা শুধু এইটুকু বুঝতে পেরেছে, যে একজন পিতার আত্মা তার মেয়ে এবং মেয়ের প্রেমিকের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে থাকা কোন কারণের কথা তাদের বলতে চেয়েছে…কিন্তু স্বাগতা! স্বাগতার নামও কেন নিল সেই প্রেতাত্মা? তার মানে কি স্বাগতারও এই সুনীতি আর অবিনাশের নিখোঁজ হওয়ার সাথে কোন সম্পর্ক আছে?
মৈনাকের চিন্তার ঘোর কেটে গেল সূর্যর তীব্র গলার আওয়াজে,
–“শোন মৈনাক, এবার এই সমস্ত রহস্যের জট খোলার একেবারে শেষ চেষ্টা করতে হবে আমাদের!”
মৈনাক আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল সূর্যর দিকে, সে বলেই চলল,
–“যেভাবেই হোক, এই আত্মাকে ডেকে পাঠাতে হবে আমাদের আবার…তাকে বার করতে হবে এই আয়নার কারাগার থেকে!…তারপর যা করার সেই করবে…সেই হবে আমাদের এই রহস্য ভেদ করার পথ নির্দেশক!”
মৈনাক অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,
–“কিন্তু কি ভাবে তাকে বার করব আয়না থেকে?”
সূর্য দৃঢ় গলায় বলে উঠল,
–“তাকে ওই আয়না থেকে বার করতে গেলে লাগবে একজন “মিডিয়াম”…আয়না থেকে বেরিয়ে যার শরীরের ভেতর সে প্রবেশ করে তার কর্তব্য পালন করবে…আর আমিই হব সেই মাধ্যম!”
মৈনাক প্রতিবাদী কণ্ঠে বলে উঠল,
–“না ভাই সূর্য, তুই এমনিতেই আমার জন্য অনেক করেছিস…আর তোকে আমি বিপদের মধ্যে ফেলতে পারব না! ওই মিডিয়াম হব আমি…যা হবার আমার হবে!”
অনেক চেষ্টা করেও এই ব্যাপারে মৈনাককে রাজি না করতে পেরে, অগত্যা সূর্য শুরু করল তার পরবর্তী কাজ!সেই ঘরের সমস্ত জানলা দরজা বন্ধ করে আলো নিভিয়ে দেওয়া হল। তারপর একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে, সূর্যর কথামত মৈনাক সেটাকে হাতে করে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সেই আয়নাটার সামনে। সেই আয়না আর মৈনাকের চারিপাশে সূর্য ছড়িয়ে দিল নুনের ছিটে! তারপর, শুধুমাত্র একটি মোমবাতির দ্বারা আলোকিত সেই অন্ধকার ঘরের ভয়াবহ পরিবেশের মধ্যে ওরা কিছুক্ষণ আয়নাটার দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর আবার সূর্যর কথামত, মৈনাক একটা ধারালো চাকু দিয়ে তার ডান হাতের এক অংশে হালকা চির লাগিয়ে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা রক্তের ফোঁটাগুলিকে ছিটিয়ে দিল সেই আয়নার গায়ে!
আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না তাদের!…আবার কেঁপে উঠল সেই আয়না…ঝাপসা হয়ে এল তার কাঁচ…আবার একটা বিকট আর্তচিৎকার করে আয়নার কাঁচের বিপরীত পৃষ্টতলে নিজের দুই হাত ঠেকিয়ে দৃশ্যমান হল সেই ছায়ামূর্তি! সূর্যর কথামত মৈনাকও তার কম্পিত হাত দু’টিকে নিয়ে গেল আয়নার কাছে…খুব কাছে…সে তার দুই হাতের পাঁচটি করে আঙ্গুল রাখল আয়নার ঠিক সেই জায়গায়, যার অপর দিকে হাত রেখেছে সেই প্রেতাত্মা!…সূর্য স্পষ্ট চেয়ে দেখল, আয়নার ভেতরের সেই ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে এক ঝটকায় ঢুকে গেল মৈনাকর দেহে!…একটা তীব্র চিৎকার করে আয়না থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে তার দিকে পেছন ফিরে ঘুরে গেল মৈনাক…তার চোখ দু:টি হয়ে উঠেছে রক্তের মত লাল! মৈনাক উন্মাদের ভঙ্গিতে এক ছুটে সেই ঘরের দরজা খুলে অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরের পথে!
শেষ পর্ব
সোনাগাছির নিষিদ্ধ পল্লীর একটি ছোট ঘুপচি ঘরে দুই দিন ধরে আটকে রাখা হয়েছিল মেয়েটাকে। শুধু দু’বেলা করে দু’টো শুকনো রুটি আর আলু চচ্চড়ির থালা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল তার সামনে, ঘরের দরজাটাকে অল্প ফাঁক করে। তারপর আবার বাইরে থেকে সজোরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সেই ঘরের দরজা। চোখের জল যেন শুকিয়ে গিয়েছিল মেয়েটার, চিৎকার করে গলাও গিয়েছিল বসে, বার বার বন্ধ দরজায় বারি মেরে তার দুই হাতও করছিল টনটন। সে কোনো মতে পড়ে ছিল সেই ঘরে রাখা ময়লা চাদরে আবৃত ছোট একটা খাটিয়ার ওপর। নিজের করা ভুলের জন্য আফসোসে তার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু এই ঘরে না তো আছে কোন দড়ি, না এক শিশি বিষ, না এক টুকরো ধারালো কাঁচ!
ঠিক সেই সময় হঠাৎ খুলে গেল ঘরের দরজা…সেই ঘরে প্রবেশ করল উগ্র সাজ পোশাকে বেষ্টিত মুর্তিমতী দানবীর মত চেহারার এক মাঝ বয়সী মহিলা। আর তার পেছনে পেছনে এল, সেই অসহায় মেয়েটির দিকে কামোত্তেজিত দৃষ্টিতে চেয়ে, অগুন্তি সোনার হার আর আংটি পড়া এক মদ্যপ ধনীর দুলাল! মেয়েটি ছুটে গেল সেই মহিলার কাছে, তারপর তার দুই পা জড়িয়ে ধরে আকুল কণ্ঠে বলল,
–“আ…আমায় ছেড়ে দাও মাসী…যেতে দাও আমায়…তুমি তো আমার মায়ের মত…আমার এতবড় সর্বনাশটা করো না, মাসী…করো না!”
সেই নিষ্ঠুর মহিলা এবার চুলের মুঠি ধরে সেই মেয়েটিকে তুলে তাকে আবার বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
–“আয় হায়, জানিস এই বাবু তোর সাথে এক রাত বিতানোর জন্য, হামাকে কত রূপিয়া দিয়েছে…বিশ হাজার!…আর তু বোল রহি হে কি তুই চলে যাবি, হ্যাঁ? কভি নেহি!”
তারপর সে সেই মদ্যপ যুবকের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল,
–“যান বাবু যান, পুরো ফ্রেশ মাল আছে…অভি তক নত ভি উতড়ি নেহি!…আপনা সুহাগ রাত মানিয়ে নিন!”মেয়েটা আরো একবার চিৎকার করে কিছু একটা বলতে চাইল, কিন্ত সেইদিকে কোন দৃষ্টিপাতই করল না সেই “মাসী”, সে তাড়াতাড়ি সেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল। এবার সেই মদ্যপ যুবক এক মুহূর্তের মধ্যে খুলে ফেলল তার পরনের পোশাক…অর্ধনগ্ন অবস্থায় সে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটির গায়ের উপর…একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে উঠল অসহায় মেয়েটি!
এমন সময় হঠাৎ সেই ঘরের বন্ধ দরজার দুই পাল্লা সশব্দে ভেঙে পড়ল ঘরের মেঝের ওপর। আর সেই ঘরে রক্তের মত রাঙা চোখ নিয়ে প্রবেশ করল আরেকজন পুরুষ…সে আর কেউ নয়, মৈনাকের দেহে ভর করা সেই আয়নার অশরীরি আত্মা!…এক ঝটকায় মৈনাক ঘাড় ধরে তুলে নিল ওই ধর্ষণ ক্রিয়ায় মত্ত মদ্যপ যুবকটিকে সেই মেয়েটির শরীরের ওপর থেকে…তারপর সে ছুঁড়ে মারল ছেলেটির শরীরটাকে সেই ঘরের দেওয়ালে থাকা টিউব লাইটের দিকে…সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের দাপটে জ্বলন্ত মুখ ঢেকে একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে, ঘরের মেঝের ওপর পড়ে গেল সেই অর্ধনগ্ন মদ্যপ যুবকের দেহ। এর পর দুই জন গুন্ডা গোছের ছেলেকে সেই ঘরে নিয়ে প্রবেশ করল সেই “মাসী”…মৈনাক এবার ছুটে গেল সেই মহিলার দিকে, তারপর সেই মুহূর্তে একটা কষিয়ে চড় লাগাল তার গালে…নাক মুখ দিকে রক্ত বেরিয়ে তখনই একটা চিৎকার করে ঘরের মেঝের ওপর পড়ে গেল সেই মহিলা!…এবার বাকি ছেলে দু’টো তেড়ে আসল মৈনাকের দিকে…মৈনাক যেন তাদের পাত্তাই দিল না…সে দুই হাত দিয়ে দু’জনের গলা চেপে ধরে তাদের কিছুক্ষণ শূন্যে ঝুলিয়ে রেখে তারপর তাচ্ছিল্যের সাথে তাদের দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল!
এতক্ষণ ধরে আতঙ্কে স্তম্ভিত হয়ে অসহায় মেয়েটি পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছিল এই সমস্ত ঘটনা। এবার মৈনাক রুপী সেই প্রেতাত্মা তার কাছে এল ধীরে ধীরে…তারপর মৈনাকের গলা থেকে কোন এক অজানা কণ্ঠস্বরে সেই অশরীরি তাকে বলে উঠল,
–“সুনীতি!…সুনীতি, মা আমার….আমি তোকে এই নরক থেকে উদ্ধার করতে এসেছি মা…চল আমার সাথে…”
কিন্তু মেয়েটি ঠিক চিনতে পারল সেই কন্ঠস্বর, সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলে উঠল,
–“বাবা…বাবা তুমি!…তুমি এসেছ বাবা!”এর কয়েক ঘন্টা পর স্থানীয় থানায় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল! কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ সেই থানার ওসির চেম্বারে তার সামনে সুনীতির হাত ধরে প্রবেশ করল মৈনাক…এই দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেল থানার সকলেই! কিন্তু কারোর কিছু বলার আগেই, একবার নিজের লাল চোখের করুণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে দেখল সেই প্রেতাত্মা সুনীতির দিকে, তারপর একবার সেই বিস্ময়ে স্তব্ধ মেয়েটির মাথায় আলতো হাতের স্পর্শ করে হঠাৎ কেঁপে উঠল মৈনাকের শরীর। একটা তীব্র আর্তচিৎকার করে মৈনাকের শরীরটা লাফিয়ে উঠে গেল শূন্যে…সুনীতির যেন মনে হল যেন একটা উজ্জ্বল আলোর গোলক…কোন একটা অস্বাভাবিক তেজস্বী শক্তি যেন বেরিয়ে গেল মৈনাকের শরীর থেকে….তারপর সে তার একমাত্র মেয়েকে সারা জীবনের জন্য বিদায় জানিয়ে উঠে গেল ওপরে…আরো ওপরে…ওই দূর আকাশের বুকের মাঝে! এই দৃশ্য কিন্তু থানার আর কোনো লোক দেখতে পেল না, তারা শুধু বুঝল, যে মৈনাক অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল নিচে! চিৎকার করে বললেন সেই থানার ওসি,
–“এই, কেউ জল নিয়ে আসো…তাড়াতাড়ি!”মৈনাকের জ্ঞান ফিরল পরের দিন অনেক বেলার দিকে। সে চোখ মেলে চেয়ে দেখল, সে নিজের বেডরুমের বিছানার ওপর শুয়ে আছে। তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে সূর্য, সে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে.. এছাড়াও ঘরে উপস্থিত অম্লান বাবু, যিনি বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছেন সুনীতিকে…তার একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন পুরো টিম সহ থানার ওসি…কিন্তু তারা হাতে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে যাদের ধরে রেখেছেন, তাদের দেখে চমকে উঠল মৈনাক!…তাদের মধ্যে একজন অচেনা সুদর্শন যুবক, এবং আরেকজন হল স্বয়ং মৈনাকের হারিয়ে যাওয়া স্ত্রী, স্বাগতা!
মৈনাকের কিছু বলার আগেই বলে উঠলেন ওসি সাহেব,
–“আপনি তো কামাল করে দিলেন, মৈনাক বাবু!…আজ আপনার জন্য বেঁচে গেল সুনীতির ইজ্জত, এবং আমরা ধরতে সক্ষম হলাম একটি বড় নারী পাচার এবং মধুচক্রের কেন্দ্রবিন্দুকে!”
তারপর তিনি গ্রেফতার হওয়া স্বাগতা আর সেই অচেনা যুবকটির দিকে চেয়ে বললেন,
–“কি স্বাগতা দেবী…কি অবিনাশ বাবু…একবার আপনাদের কুকর্মের কথাগুলো বলুন মৈনাক বাবুকে!”
ওরা দু’জনেই মাথা নিচু করে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।অগত্যা, ওসি সাহেবই বলে চললেন,
–“মৈনাক বাবু, আপনার স্ত্রী স্বাগতার পিরিত ছিল অবিনাশের সঙ্গে, ওরা দু’জনে এক সাথে পালিয়ে গিয়ে সংসার পাততে চেয়েছিল…কিন্তু তার জন্য লাগত অনেক পয়সা। তাই ওরা দু’জনে একটা প্ল্যান করল…অবিনাশের প্রতি সুনীতির একটা দুর্বলতা আগে থেকেই ছিল। সেটাকে কাজে লাগিয়ে, মিথ্যা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার অছিলায়, অবিনাশ সুনীতিকে এই বাড়িতেই তুলেছিল যখন আপনি ছিলেন ব্যাঙ্গালোরে!…ও সুনীতিকে মিথ্যা করে বলেছিল যে এটা তার এক বান্ধবীর বাড়ি, এখানে একটা রাত কাটিয়ে ওরা পরের দিনই কলকাতার বাইরে রওনা দেবে…সেই রাতেই স্বাগতা আর অবিনাশ সুনীতিকে এই বেডরুমেই প্রথমে ফ্রুট জুসের মধ্যে ঘুমের ওষুধ খায়িয়ে অজ্ঞান করে, তারপর আগে থেকেই বলে রাখা, সোনাগাছির এক নিষিদ্ধ পল্লীর দালালের গাড়িতে তার অজ্ঞান দেহটা তুলে দেয়…আর এর জন্য ওরা সেই দালালের কাছ থেকে পায় দুই লক্ষ টাকা!”–“অবিনাশ পারলে লোক দিয়ে সুনীতিকে রাস্তা ঘাট থেকেই কিডন্যাপ করাতে পারত, কিন্তু সেখানে আছে মেয়েটার চিৎকার চেঁচামেচিতে লোক জানা জানি হওয়ার ভয়, যা আপনার এই বাড়িতে একটুও নেই!…এরপর সেই টাকা নিয়ে আর নিজেদের মোবাইলে অন্য সিম কার্ড পুরে গা ঢাকা দিল স্বাগতা আর অবিনাশ…কিন্তু ওরা ভুলে গিয়েছিল, যে ওদের মোবাইলের আই.এম.ই.আই নাম্বার ট্র্যাক করে আমরা ইচ্ছা করলেই ওদের ধরতে পারি, যা আমরা পেরেছি কয়েক ঘন্টা আগে! ওরা হয়তো কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল, কিন্তু তার আগেই হাওড়া স্টেশন চত্বর থেকে ওদেরকে আমরা এরেস্ট করি!…তবে মৈনাক বাবু, একটা কথা বলুন…আপনি কি ভাবে জানলেন, যে ওরা সুনীতিকে সেই নিষিদ্ধ পল্লীর ওই ঘরটাতেই রেখেছে?”
মৈনাক এতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুনছিল ওসির সমস্ত কথা। যে স্বাগতাকে এতক্ষণ ধরে হন্যে হয়ে সে খুঁজে চলেছিল, তার প্রতি বিতৃষ্ণায় ভোরে উঠলো তার মন। সে নিজের নজর ফিরিয়ে নিল স্বাগতা আর অবিনাশের দিক থেকে, তারপর আরেকবার তাকাল তার ঘরের দেওয়ালে আটকান সেই আয়নাটার প্রতি। সে জানে যে আর সেটা কোনো দিন কেঁপে উঠবে না, তার কাঁচটা ঝাপসা হয়ে গিয়ে তার মধ্যে কোন ছায়ামূর্তিকেও কখনো দেখা যাবে না আর…সে বুঝেছে, সেই আয়নার ভেতর থেকে সুনীতির বাবার প্রেতাত্মা পুরোটাই দেখেছিল যে এই ঘরের ভেতরই তার একমাত্র মেয়ের সাথে কি অন্যায় কাজ করা হচ্ছে, তাই তাকে বাঁচানোর জন্যই সে এইভাবে ক্রমাগত ইঙ্গিত করে গিয়েছে মৈনাক আর সূর্যকে!…ওসি সাহেবকে বলতে হবে সব কথা, তিনি বিশ্বাস করুন বা না করুন।
(সমাপ্ত)