-
প্রসঙ্গে – বসন্ত যাপন
বসন্ত যাপন
-সুমিতা দাশগুপ্তবসন্ত এসে গেছে- বাতাসে নিয়মভাঙার চোরাটান। শহরের অলিগলিতে উদাসী হাওয়ায়,ঝরে পড়া শুকনো পাতার খসখস শব্দে মনকেমনের বার্তা। কে যেন বলতে থাকে, ওরে গৃহবাসী খোলো দ্বার,চলো বেরিয়ে পড়ি, কিন্তু সংসারের জাঁতাকলে, আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে কী অতই সহজ, হুট্ বলতে বেরিয়ে পড়া! তাহলে উপায়! উতলাচিত্ত ভ্রমণপিপাসুর কি কেবল, মনখারাপই সম্বল! উঁহু,দুর্গমগিরি, কান্তারমরু পার হয়ে যাওয়া বাঙালি অত সহজে হার মানবে না। সে মনে মনে বলে-
“আমারে তুমি দাবায়ে রাখতে পারবা না”
তার কাছে বই রয়েছে না! ভ্রমণ কাহিনী!
খুব সম্প্রতি এমনই একখানা বই এসেছে আমার হাতে। ইচ্ছুক পাঠক আমার হাত ধরে বেড়িয়ে পড়তেই পারেন।
কিন্তু কোথায়? কেন, এই তো কাছেই শান্তিনিকেতনে।
কী বললেন সে জায়গা অনেকবার ঘোরা? আরে না না আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে নিয়ে যাবো এমন এক জায়গায়, দোল অথবা পৌষ উৎসব দেখে ফেরা মানুষজন যেটির হদিশ পান নি মোটেও। এই বইটি আপনাকে দেবে অচিনপুর আবিষ্কারের আনন্দ। বইটির নাম হলো
“সদা থাকো আনন্দে…শান্তিনিকেতনে”
বইটির লেখক, আদতে উত্তর কলকাতার বাসিন্দা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের
তুখোড় ছাত্র,শ্রী দীপঙ্কর রায় মহাশয় যখন বিশ্বভারতীতে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে শান্তিনিকেতনবাসী হলেন,তখন তাঁর মোটেও মন বসতো না সেখানে, সদাই নিজেকে ‘বহিরাগত’ ভেবে, নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার ভাবনা মনে চেপে বসতো,তারপর কে জানে কোন মন্ত্রবলে,প্রকৃতির ডাক পৌঁছলো, তাঁর কাছে। ছুটির দিনগুলিতে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে থাকলেন। ধীরে ধীরে একদিকে যেমন পরিচয় হতে থাকলো,ফকির বাউলদের সঙ্গে, ঠিক তেমনই প্রকৃতি তাঁর কাছে হাট করে খুলে দিল তার দুয়ারখানি। লেখক হদিশ পেয়ে গেলেন অগাধ রত্নভান্ডারের । “তাঁর কাছে খুলে যেতে থাকে,প্রকৃতির এক নতুন ও আশ্চর্য জগৎ, তিনি আবিষ্কার করেন অজস্র নতুন গাছ,সম্পূর্ণ অচেনা সব পাখি, জোনাকি পোকার মিলনোৎসব, বসন্তের গন্ধ, খোয়াই এর মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য,”- কলকাতায় বসে যার খোঁজ পাওয়া দুষ্কর।চলুন তাহলে বেরিয়েই পড়া যাক, লেখকের হাত ধরে এগিয়ে যাই অচিনপুর আবিষ্কারে।
আচ্ছা,কেউ কি কোনোদিন আপনাকে কথা দিয়েছিল, হলুদ পলাশ এনে দেবে বলে, অথচ দেয়নি! দুঃখ পাবেন না, কবি তো কবেই বলিয়াছেন,
“কেউ কথা রাখে না”- তার চাইতে নিজেই খুঁজে নিন না, সেই গাছ, চলুন বেরিয়ে পড়ি অপুর মতো “কল্পনার উড়ানে।”খেলার মাঠের গায়ে,পুকুরপাড়ের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে,লক্ষ্য রাখুন।এইখানেই কোথাও নানা গাছের ভীড়ে লুকিয়ে রয়েছে হলুদ পলাশের গাছ।না, না টানা হেঁচড়া করে ডাল ভেঙে নয়,মাটিতে ঘাসের উপরে পড়ে থাকা হলুদ পলাশক’টি সংগ্রহ করে নিন,হয়তো তারা অপেক্ষায় ছিল আপনারই জন্য।
রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলুন, সামনেই পড়বে আশ্চর্য রকম পরিচ্ছন্ন সাঁওতাল গ্রাম, কুটিরগুলির দেওয়ালে দারুণ সুন্দর সব আলপনা ,মুগ্ধ বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন তো , লেখক জানিয়ে দেবেন, এই তো কিছুদিন আগেই বাঁধনা পরবে আঁকা হয়েছিল,সুচারু চিত্রগুলি।
কোনও এক বাড়িতে ঢুকে পড়ুন, গৃহকর্তার অনুমতি নিয়ে, ছবি তুলে নিন না যতোগুলো ইচ্ছে।
চাইলে দাওয়ায় গিয়ে বসতেও পারেন, কথায় কথায় জেনে নিতে পারেন কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে,পরিযায়ী পাখিদের অস্থায়ী ঠিকানা যে ঝিল, তার পথ নির্দেশ। শাল শিমুলের জঙ্গলে নৈঃশব্দের জগতে কেবলই পাখির ডাক। পক্ষীপ্রেমিকরা হয়তো একেবারে নিরাশ হবেন না। ঘুরতে ঘুরতে সহসা নজরে পড়তে পারে জঙ্গলের ফাঁকে বিকেলের রোদ ঝলমলে রাঙা খোয়াই।
সন্ধ্যের আগে ফেরার পথ ধরুন, সেটি যদি দোলের দিন হয়, তাহলে, সঠিক দিক নির্দেশ নিয়ে পৌছে যান পথের ধারে গড়ে ওঠা ইটালিয়ান দিদির তৈরী নাট্যগ্রামে অথবা ফ্রান্সপ্রবাসী বাউলের আখড়ায়।
রাত বাড়লে মাথার উপরে পূর্ণচাঁদের মায়ায় পথনির্দেশ খুঁজে নিয়ে ফিরুন নিজের আস্তানায়।
শান্তিনিকেতনে যাবেন অথচ খোয়াই দেখবেন না তা,ও কি হয়! ছেলেবেলায় যে লীলা মজুমদারের হাত ধরে অজস্রবার গিয়েছিলেন হীরের ফুল ,পক্ষীরাজ ঘোড়া আর হলদে পাখির পালক খুঁজতে, আজ সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ান তার সামনে। দেখে আসুন রূপকথার বাইরে ঢেউ খেলানো ঊষর মাটি, গ্রীষ্মের দুপুরে মনে হয় যেন তার ঝকঝকে আলোতে আগুন ধরেছে। দেখে নিন তার আদিম রূপ। জানা আছে কি, এই খোয়াই, একদা প্রস্তর যুগের মানুষের বাসভূমি ছিল! খননকার্যে পাওয়া পাথরের অস্ত্রগুলি,আজ তার প্রমাণ দেয়।
কেবল রুক্ষপ্রান্তর নয়, এই খোয়াইয়ের ঈর্ষণীয় বায়োডাইভার্সিটিও পর্যবেক্ষণের বিষয়, কারণ এই খোয়াইকে কেন্দ্র করে রয়েছে বেশ কয়েকটি ওয়েটল্যান্ড-জল বইবার খাত। এখানেই রয়েছে প্রচুর কাজুবাদাম,আকাশমণি, শিশু, পলাশ, আমলকির বন। এখানে নানা জাতের প্রজাপতি ওড়াওড়ি করে, হেমন্তে আসে হাজারে হাজারে পাখি। এইখানেই আপনি পেতে পারেন অরণ্যভ্রমণের স্বাদ।
অলমিতি বিস্তরেণ, শুধু শেষ করার আগে বলে যাই, ইচ্ছে হলে নিজের সংগ্রহে রাখতে পারেন বইটি, কারণ এই বইটি একবার পড়ে তৃপ্তি হয় না, তাছাড়া অরণ্যভ্রমণই একমাত্র বিষয়বস্তু নয়,আপনি চাইলে বাউল সংস্কৃতি, পৌষমেলা, নববর্ষ উদযাপন, বাইশে শ্রাবণ ইত্যাদি আরো অনেক অনেক বিষয়ের তথ্যমূলক এবং মনোগ্রাহী নিবন্ধ পাঠের আনন্দ পেতে পারেন।( বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ- এই লেখাটি শুধুই আমার একটি ভালো লাগা বইয়ের পাঠপ্রতিক্রিয়া)
-
প্রসঙ্গে- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে কিছুক্ষণ
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে কিছুক্ষণ
–সুনির্মল বসু(পথের পাঁচালীর রূপকারকে ঘিরে…)
এক নবমী পূজোর সকালে তাঁর বাড়ি হাজির হলাম। তাঁর শ্যালিকা ভেতর ঘরে বসতে দিলেন। সামান্য একটা চৌকি খাট, তাতেই বসলাম। এই খাটটি তাঁর। তিনি বাংলা সাহিত্যের অপরূপ রূপলোকের রূপকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্যালিকা বললেন, দেশে অনেক লেখক আছেন, তিনি অন্যরকম। হরিনাভি স্কুলে শিক্ষকতা করবার সময় মাঝে মাঝে বাড়ি আসতেন না। দিদি রমা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে খুঁজে দেখতে বললে, তিনি দেখতেন, ইছামতী নদীর পাড়ে তিনি ঘুরছেন। জিঞ্জাসা করলে, বলতে পারতেন না, এ কদিন কোথায় ছিলেন।
যে ফুল রেল লাইনের পাশে অযত্নে ফুটে থাকে, তিনি তার নাম দিতেন, যে পাখির নাম কেউ জানে না, তিনি তার নাম দিতেন। তাঁর শ্যালিকা বললেন, সাহিত্য লিখতে লিখতে তিনি ঈশ্বরমুখী হয়ে পড়েছিলেন। সারা রাত ধরে তিনি সহধর্মিণী রমা দেবীর সঙ্গে আকাশের তারা দেখেছেন।
বড় মায়াময় মানুষ তিনি। একবার ক্লাসে একটি ছাত্রকে বকেছেন, মন খারাপ। পরদিন তাঁকে ডেকে বললেন, এই গুটকে তোকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছি।
বাড়িতে অতিথি আসায় বাজার গেলেন। একটি মহিলা বেগুন বেচছিল। বিক্রি হয়নি বলে, বিভূতিভূষণ সব বেগুন কিনে পয়সা দিলেন, নিলেন দুটো মাত্র।
ক্লাসে গিয়ে বলতেন, জানালা খুলে দিতে। বলতেন, এই আকাশ,এত আলো, এই গাছপালা কত যে শেখায়। আমরা চোখ থাকতেও, দেখি না।
ঘাটশিলায় থাকার সময় বন্ধু মুকুল চক্রবর্তীকে বলতেন, কাকের ভাষা তিনি বুঝতে পারেন। একজনের মেয়ে মারা যাওয়ায়, মেয়ের বাবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তোমাদের মেয়ে কোথাও যায় নি, ও এখানেই আছে, যত দিন তোমরা ওকে মনে করবে, ও এখানেই থাকবে। যখন তোমরা ওকে ভুলে যাবে, তখন ও এইখান থেকে চলে যাবে।
বিভূতিভূষণ ভেন্ডারে উঠে স্কুল যেতেন। সবজিওয়ালাদের কাছ থেকে ফসলের খবর নিতেন।
তাঁর একমাত্র পুত্র প্রয়াত তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে বলেছিলেন, আমার স্বর্গীয় পিতৃদেব ছিলেন যুধিষ্ঠিরের তূল্য ব্যক্তিত্ব, তাঁর জীবনের রথচক্র ভূমির উপর দিয়ে যেত, পৃথিবীর কোনো মালিন্য কখনো তাঁকে স্পর্শ করে নি।
মৃত্যুর আগেই তিনি যাবার সংকেত পেয়েছিলেন। তিনি স্কুল থেকে ফিরছেন, একটি মৃতদেহ শ্মশানমুখী হয়েছে।
-কে মারা গেল গো?
-মাষ্টারমশাই,আপনি চিনবেন না,পাশের গাঁয়ের।
-একটু দেখাবে।
-ওরা দেখালেন।
বিভূতিভূষণ দেখলেন, অন্য মানুষ, মুখটা হুবহু তাঁর মতো। পরদিন তিনি চলে গেলেন।
বিভূতিভূষণের মৃত্যুও ঘটেছিল, মুঘল সম্রাট বাবরের প্রার্থনার মতো। ছোট তারাদাসের তখন রক্ত বমি হচ্ছিল। ঈশ্বরগত বিভূতিভূষণ নিজের প্রাণের বদলে, ছেলের প্রাণ চাইলেন।
মারা যাবার আগে বলেছিলেন, তোমরা কাঁদছো কেন? আমি কোথাও যাচ্ছি না।কেবল এ ঘর আর ও ঘর। যখন যখন তোমরা ঝর্নার কাছে যাবে, সবুজ ঘাসে সোনালী আলোয় হাঁটবে, তখন জানবে, আমিও তোমাদের সঙ্গে আছি। -
প্রসঙ্গে- কবি জীবনানন্দ দাশ, সাহিত্যের আঙিনায় আমি যেভাবে তাঁকে পেয়েছি
কবি জীবনানন্দ দাশ, সাহিত্যের আঙিনায়
আমি যেভাবে তাঁকে পেয়েছি
-সুনির্মল বসুআমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল,
নাটোরের বনলতা সেন।তিনি বলেছিলেন, সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।
১৮৯৯ সালের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম, পূর্ববাংলার বরিশাল জেলায়।
পিতা সর্বানন্দ দাশগুপ্ত এবং জননী মহিলা কবি কুসুমকুমারী দাশ। কুসুমকুমারী দাশ কবি হিসেবে তাঁর সমকালে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি কবিতা লিখেছিলেন,
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি জীবনানন্দ দাশ। শৈশবে পড়াশোনা করেছেন ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে, পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্স নিয়ে বি.এ পাস করেন। এবং পরবর্তীকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ পাস করেন।
চাকরি জীবনে বিভিন্ন পেশায় কাজ করেছেন। দুই বাংলার বিভিন্ন কলেজে স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু কোথাও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি।জীবনানন্দ দাশের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ, ঝরা পালক। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, বনলতা সেন। এই গ্রন্থটি সিগনেট প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল। গ্রন্থটির প্রচ্ছদপট এঁকেছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়। বনলতা সেন একটি কাল্পনিক নারী চরিত্র। হয়তো এই চরিত্রের মধ্যে কিছু বাস্তবতা থাকতে পারে। কারণ, জীবনানন্দ দাশের জীবনে এক সময় প্রেম এসেছিল। কবি এই কবিতায় লিখেছিলেন,
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, রূপ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য, অতিদূর সমুদ্রের পারে যে নাবিক হারায়েছে দিশা, দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর, তেমনি দেখেছি তারে, অন্ধকারে, বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন, পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”জীবনানন্দ দাশ বিবাহ করেছিলেন লাবণ্য গুপ্তকে। তাদের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। কারণ, সংসারের আর্থিক অনটন। দূর অতীতে এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়া শোভনার সঙ্গে অতীতে কবির একটা ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
পরবর্তীকালে জীবনানন্দ দাশ লেখেন, বেলা অবেলা কালবেলা, মহাপৃথিবী, রূপসী বাংলা, সাতটি তারার তিমির এবং ধূসর পান্ডুলিপি কাব্যগ্রন্থ।তিনি ছিলেন বরাবরই প্রচারবিমুখ মানুষ। উপন্যাস লিখেছেন, মাল্যবান, সতীর্থ ও কারুবাসনা।
তাঁর লেখাগুলো অধিকাংশই প্রকাশিত হতো, প্রগতি, কল্লোল ও কালি কলম পত্রিকায়।
এছাড়া, বেশকিছু প্রবন্ধগ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন। কেন লিখি, লিটারারি নোটস, প্রভৃতি লেখা প্রবন্ধ গ্রন্থ।অনেকে তাঁকে বলেছেন, তিমির হননের কবি। কেউ কেউ বলেছেন, নির্জনতার কবি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, চিত্র ধর্মী কবি।
তিনি লিখেছিলেন, “হাজার বছর ধরে আমি হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,”
একদিকে প্রকৃতি চেতনা, অন্যদিকে ইতিহাস চেতনা, আবার স্বাদেশিক চেতনা, বারবার তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে।
চিত্রকল্প ব্যবহার করতে গিয়েও, তাঁর প্রতিভার অনন্যতা বারেবারে প্রমাণিত হয়েছে।ব্যক্তিগত জীবনে আর্থিক ক্ষেত্রে অসফল মানুষ তিনি। অথচ, কবিতায় বারবার জীবনের মহৎ চালচিত্র অনুপম সুন্দর ভঙ্গিতে তুলে ধরতে পেরেছেন।
হৃদয়ের গাঢ় অনুভূতি মিশিয়ে কি সুন্দর ভাষায় লিখেছেন,
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার, নাটোরের বনলতা সেন।১৯৫৪ সালের ২২ শে অক্টোবর কোলকাতার শম্ভুনাথ পন্ডিত হাসপাতালে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
ইতিপূর্বে ল্যান্সডাউন রোডে তিনি ট্রাম দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ছিলেন। মারা যাবার আগে, কবি জীবনানন্দ দাশের শেষ সংলাপ ছিল, ধূসর পান্ডুলিপি সারা আকাশ জুড়ে।
তাঁর মৃত্যুর শেষদিকে স্ত্রী লাবণ্য দেবী হাসপাতালে আসতেন না। কবির মৃত্যুর পর বলেছিলেন, বাংলা সাহিত্যকে তিনি অনেক কিছু দিয়ে গেছেন, আমাকে কি দিয়ে গেলেন?
যে ট্রামের ধাক্কায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন কবি, সেই ট্রাম চালকের সেদিন ছিল চাকরির শেষ দিন। বাড়িতে অশান্তি ছিল, ছেলেকে নিয়ে। ছেলে বি,কম পড়ে। পড়ার বই ছেড়ে, জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে। ভদ্রলোক ছেলেকে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের পর এদেশে আর কোনো কবি আছেন নাকি। ছেলে জীবনানন্দ দাশের কবিতার বই দেখিয়েছিল।
সেদিন বারবার ঘন্টি বাজানো সত্বেও, যে ভদ্রলোক ট্রাম লাইন থেকে সরে যাননি, এবং ট্রামের ধাক্কায় পাঁজরে আঘাত পেয়েছেন, তিনি যে বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশ, এই সংবাদটি পরে জানতে পেরেছিলেন তিনি।
শ্মশানে কবির মরদেহ এলে, তিনি মালা কিনে ছেলের হাতে দিয়ে বলেন, তুই মালাটা ওনার গলায় পরিয়ে দে। এখানে এত মানুষ, ওনাকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন, আমি ভুল বলেছিলাম বাবা, রবীন্দ্রনাথের পর, উনি এদেশের অনেক বড় কবি।কবি ভাবনার স্বাতন্ত্র্যে, প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে, ধূসর পৃথিবীর চিত্র অঙ্কনে, অতীত ইতিহাসের মানচিত্রে হেঁটে চলা একজন অতিশয় সংবেদনশীল মরমী কবি ছিলেন জীবনানন্দ দাশ।
রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা সাহিত্যে যে পরিবর্তনের বাঁক এলো, তা এসেছিল, কবি জীবনানন্দ দাশের হাত ধরে।
তাঁর লেখা বিখ্যাত কতগুলি কবিতা হলো, রূপসী বাংলা, অদ্ভুত আঁধার এক, আট বছর আগের একদিন, মুহূর্ত, শ্যামলী, কমলালেবু, আকাশলীনা, তিমির হননের গান, সময়ের কাছে প্রভৃতি।জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থের জন্য তিনি সম্মানিত হয়েছিলেন। তাঁর কবিতা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশেষ করে, ফরাসি ভাষায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা খুবই সমাদৃত হয়েছিল। তাঁর রচিত কাব্য উপন্যাস ও প্রবন্ধ নিয়ে বিভিন্ন রকমের গবেষণা চলেছে।
ব্যক্তিগত ও সাংসারিক জীবনের ব্যর্থতা ছিল তাঁর নিজস্ব, অথচ, কবিতায়, উপন্যাসে ও প্রবন্ধে তিনি হাজার তারার আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন।এক জীবনে বহু জীবনের কাজ করে গিয়েছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। মনে প্রানে একজন হৃদয়বান কবি তিনি। বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন,
সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।কবি জীবনানন্দ দাশ কিন্তু সেদিনের পৃথিবীতে ইতিহাসের সরণি ধরে হাজার বছর ধরে এই পৃথিবীর সড়কপথে একাকী নিঃসঙ্গ হেঁটে গিয়েছিলেন।
-
প্রসঙ্গে- লেখনী চর্চা, জীবন ও সাহিত্য ভাবনায় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
লেখনী চর্চা, জীবন ও সাহিত্য ভাবনায়
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
-সুনির্মল বসুসাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যখন তাঁর রচিত সাহিত্যে সামাজিক নিয়মকানুনকে প্রাধান্য দিচ্ছিলেন, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের রচিত সাহিত্যে ভাবালুতা প্রাধান্য পাচ্ছিল, তখন শরৎচন্দ্র মাটির কাছাকাছি মানুষের ছবি সাহিত্যে তুলে ধরেছিলেন।
তিনি বলতেন- এই দেশে, এই সমাজে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, তাই এই সমাজকে আমি মানি। কিন্তু তাই বলে দেবতা বলে নয়।
শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং জননীর নাম ভুবন মোহিনী দেবী।
লেখকের শৈশব কেটেছে কিছুদিন ভাগলপুরে। ছোটবেলায় পড়াশোনা করেছেন, প্যারী পন্ডিতের পাঠশালায়। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন, দুর্গাচরণ বিদ্যাপীঠ এবং দেব নারায়ন জুবিলী হাই স্কুলে।দারিদ্র্যের কারণে উচ্চশিক্ষায় বেশি দূর এগোতে পারেননি। জীবনের পাঠশালায় তাঁর যথার্থ শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছিল।
নিজেই বলেছেন, “মাত্র ষোলোটা টাকার অভাবে এফ.এ. পরীক্ষাটা দিতে পারিনি, তখন বামুন কায়েতদের বাড়ি গিয়েছি, তাঁরা সব দূর দূর করে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছে, তখন কাহার, বাগদি, দুলে, এদের কাছে গিয়েছি। এরা আমাকে পরম আদরে কাছে টেনে নিয়েছে, এদের কাছেও আমার ঋণ কি কম?”
বেনামে মামা সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নামে “মন্দির” গল্প লিখে, তিনি কুন্তলীন পুরস্কার পান। এরপর একে একে লেখেন, বড়দিদি, মেজদিদি, বিপ্রদাস, দেবদাস, দত্তা, গৃহদাহ, বিরাজ বৌ, চন্দ্রনাথ, পরিণীতা, পল্লীসমাজ, বামুনের মেয়ে, প্রভৃতি উপন্যাস। একমাত্র রাজনৈতিক উপন্যাস লেখেন, পথের দাবী। ইংরেজ পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগারড বইটি বাজেয়াপ্ত করেন এবং শরৎচন্দ্রের রিভলবার সীজ করেন।
এইসময় শরৎচন্দ্র উত্তর হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নিকট সম্পর্কে এসেছিলেন।
নিজের লেখা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, সংসারে যারা শুধু দিলে, পেলে না কিছুই, যারা উৎপীড়িত, নিপীড়িত মানুষ হয়েও মানুষ যাদের চোখের জলের কোনো হিসাব নিলে না, এদের বেদনাই দিলে আমার মুখ খুলে, এরাই আমাকে পাঠালে, মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতে।
অসহায় মানুষের প্রতি নিবিড় সহানুভূতি বোধ, প্রবল পর্যবেক্ষণশক্তি এবং গভীর জীবনবোধ তাঁকে জনগণমন-অধিনায়ক লেখকে পরিণত করেছিল।
তিনি সাহিত্যে দেখাতে চেয়েছিলেন, পাঁকের মধ্যেও পদ্ম জন্মায়। প্রশ্ন তুলেছিলেন, সতীত্ব কোথায় থাকে, দেহে না মনে। তাঁর জবাব ছিল, সতীত্ব মনে থাকে, শরীরে নয়। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, সতীত্ব বড়, না নারীত্ব বড়। নিজেই সারাজীবন নিজের লেখায় উত্তর দিয়েছেন, সতীত্বের চেয়ে নারীত্ব অনেক বড়।রবীন্দ্রনাথ একটা কবিতায় লিখেছিলেন, “জীবনে জীবন যোগ করা, না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।” শরৎচন্দ্র সাধারন মানুষের সঙ্গে জীবন যোগ করতে পেরেছিলেন।
চারটি পর্বে দীর্ঘ আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখেছিলেন, শ্রীকান্ত। পঞ্চম পর্ব লিখে যেতে পারেননি। সেটি লিখেছিলেন, লেখক প্রমথনাথ বিশী।
গৃহদাহ উপন্যাসে ত্রিভুজ প্রেমের দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন। পল্লীসমাজ উপন্যাসে গ্রামীন রাজনীতি ও মানুষের স্বার্থপরতার পাশাপাশি, গঠনশীল জীবনযাত্রা বর্ণনা রয়েছে।
ডাক্তার অমর চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা পার্বতীকে তিনি ভালোবেসে ছিলেন। সেই সূত্রে লেখেন, দেবদাস, উপন্যাসটি। লেখক হিসেবে তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর এই ব্যক্তিগত উপন্যাসটি যেন ছাপা না হয়। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি ছাপা হয়েছিল। অসম্ভব জনপ্রিয়তার কারণে এটি বারবার চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে।
রেঙ্গুনে একাউন্ট অফিসে চাকরি করবার সময় তিনি সেখানকার বেঙ্গলি ক্লাবে গান গাইতেন। শরৎচন্দ্র গায়ক হতে গিয়ে, লেখক হয়েছিলেন।
সাহিত্যচর্চার প্রথমদিকে তাঁর সঙ্গে একইসঙ্গে লিখতেন লেখিকা অনুরূপা দেবী।
একটি বৃষ্টির দিনে কবি নরেন্দ্র দেব পত্নী রাধারানী দেবী শরৎচন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, শরৎদা আপনি হঠাৎ কলকাতা ছেড়ে রেঙ্গুনে চলে গেলেন কেন? উত্তরে শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, সে যে বললো, আপনি এই শহরে থাকলে, আমার অশান্তি, আমি চাই না, আপনি এই শহরে থাকুন। তারপরে, এক লাফে একেবারে পগারপার।শরৎচন্দ্র বিয়ে করেছিলেন, প্রথমে শান্তি দেবীকে, পরে হিরণ্ময়ী দেবীকে।
তাঁর লেখা বিখ্যাত ছোট গল্পগুলি হল, হরিলক্ষ্মী, দেওঘরের স্মৃতি, অভাগীর স্বর্গ ও মহেশ।
মহেশ, তাঁর লেখা পৃথিবী কাঁপানো গল্পের একটি। গল্পের শুরুতে তিনি লিখেছিলেন, “গ্রামের নাম কাশিপুর। গ্রাম ছোট, জমিদার আরো ছোট। কিন্তু দাপটে তাহার গ্রামের লোকেরা টু শব্দটি পর্যন্ত করিতে পারেনা, এমনই প্রতাপ।
এই গ্রামে পথের পাশে পিটুলি গাছের ছায়ায় গফুর জোলার বাড়ি। মা মরা মেয়ে আমিনা এবং অবলা জীব মহেশকে নিয়ে তাঁর ঘর গৃহস্থালী। সে তাঁকে পেটপুরে খেতে দিতে পারে না। তাই কন্যা আমিনার সঙ্গে তাঁকে মিথ্যে অভিনয় করতে হয়।
গল্পের পরিসমাপ্তিতে গফুর মহেশকে খুন করেছে।নক্ষত্রখচিত রাতে বাবলা গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে গফুর। কন্যা আমিনার হাত ধরে পথে নেমে, শূন্যে দু হাত তুলে প্রচলিত বিশ্ব বিধানের উদ্দেশ্যে হাহাকার করে বলে উঠেছে,
আল্লাহ, আমায় যত খুশি সাজা দিও, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে, তার চরে বেড়াবার মত এতোটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া পুকুরের জল আমার মহেশকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি কখনো মাফ করো না।”চরিত্রহীন উপন্যাস লিখে, শরৎচন্দ্র খুব টেনশনে ছিলেন। কাজের লোকের সঙ্গে প্রেম, মানুষ কিভাবে গ্রহণ করবে। বাজে শিবপুরের বাড়িতে এক দুপুর বেলায় তিনি যখন শরৎচন্দ্র শেঠের দোকানে বসে আছেন, তখন কলকাতা থেকে এক সম্ভ্রান্ত মহিলা তাঁর খোঁজ করলেন। শরৎচন্দ্র বুঝলেন, যা আশঙ্কা করেছিলেন, সেই বিপদ সামনে এসে গেছে। তিনি সামনে এগিয়ে গেলেন, বললেন, আমিই শরৎচন্দ্র।
ভদ্রমহিলা বললেন, আমি আপনাকে প্রণাম করতে এসেছি। আমি আপনার চরিত্রহীন উপন্যাস পড়েছি। আপনার চরিত্রহীন উপন্যাস আমার চরিত্র রক্ষা করেছে।এই কথায় সেদিন অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে খুব স্নেহ করতেন। শরৎচন্দ্র কবিকে অশেষ শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু মাঝে মাঝে মন কষাকষি করে বাড়ি ফিরে, আবার তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে যেতেন।
একদিন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে গিয়ে জুতো খুঁজে পাননি বলে, পরদিন জুতো পেপারে মুড়ে বগলে করে এলেন। রবীন্দ্রনাথ রসিকতা করে বললেন, কি হে শরৎচন্দ্র, আজ কি উপন্যাস পড়বে, পাদুকা পুরান নাকি।
মানুষ থাকে না। আদর্শ থেকে যায়। শরৎচন্দ্র নেই, শরৎ সাহিত্য রয়েছে।
কে বড় লেখক, রবীন্দ্রনাথ, না শরৎচন্দ্র।
রবীন্দ্রনাথ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, আমি তো কবি।
অর্থাৎ লেখক হিসেবে শরৎচন্দ্রকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
যে মেয়েকে পাত্রপক্ষের কাছে বিবাহের আগে বারবার হেনস্থা হতে হয়, তাঁকে জীবনে নয়, সাহিত্যে জেতাতে পারতেন একজনই। তিনি শরৎচন্দ্র।তাঁর প্রথম আবির্ভাবের দিনে রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎবাণী ছিল, বাংলা সাহিত্যে শরতের চাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে, ও বিশাল ক্ষমতা নিয়ে এসেছে, ওকে দেখো।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র অকাল মৃত্যুর খবর এলে, অতিশয় বিমর্ষ রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
“যাহার অমর স্থান প্রেমের বাঁধনে,
ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে।” -
প্রসঙ্গে- হায় আধুনিকতা!
হায় আধুনিকতা!
-রাণা চ্যাটার্জীযত বেশি স্বাধীনতা তত দেখছি এর অপব্যবহার। চায়ের দোকানে এঁটো বাসন মাজা ছেলেটার বাড়িতে ভাত ফুটানোর জোগাড় আছে কিনা ঠিক নেই, হকার দাদাটার কাল কি করে চলবে চিন্তায় নেই কপালে ভাঁজ কিন্তু পকেটে এন্ড্রয়েড মোবাইল আর ডেলি ফ্রি ডাটা মজুত। হোক আটা দামি বয়েই গেল, নেট দুনিয়ায় রগরগে ভিডিওর প্রতুলতা বুঁদ করে রেখেছে শিক্ষিত অশিক্ষিত ছোট বড় সকলকে। প্রকাশ্যে ঘুরছে যৌন উস্কানি ভিডিও রমরমা।অশ্লীলতার মোড়কে পণ্য জাত হচ্ছে নারী শরীর। এ যেন মগের মুলুক স্বাধীনতা, যখন যাকে খুশি যা খুশি ভাবে করায়ত্ত করার প্রচেষ্টা আর বাধা পেলেই নোংরা তকমায় বিদ্ধ।
কি দেখতে হয় আর কি দেখার বয়স হয় নি এই লক্ষণ গন্ডি ধুয়ে মুছে সাফ। পরশু খবরে পড়লাম মফস্বল ছোট শহরে এক মধ্য বয়স্ক ঠান্ডা মাথায় প্রতিদিন বিভিন্ন বাড়ি ঢুকে মহিলাদের খুন করতেন আবার স্বাভাবিক জীবন যাপন। শিশুদের মধ্যেও বাড়ছে ভয়ঙ্কর অপরাধ প্রবণতা। স্কুল বাচ্চা প্রায়শই ধর্ষণের শিকার, সদ্যজাত ঝলসে উঠছে লালসার আগুনে, বৃদ্ধা হোক মধ্যবয়সী সে হোক নান কিংবা ভিখারি সবাই টার্গেট এই নর পিশাচ আবহাওয়ায়। তবে কি কোথাও নিরাপদ নয় আমরা, আমাদের মহিলা, শিশু কন্যা মহল?
কিসের আমাদের বড়াই তবে? রুচি সংস্কৃতির দোহাই। দেওয়াল জুড়ে মনীষীদের বাণী নিভৃতে কাঁদে। সদা জাগ্রত প্রশাসন কি করবে মনের মধ্যে যদি অপরাধ প্রবণতার বিষাক্ত লেলিহান আষ্টেপৃষ্টে বাঁধে আমাদের। সম্প্রতি ফুলের মতো একরত্তি শিশু তিন বছরের টুইঙ্কেলকে যেভাবে নৃশংসতার সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় খুন করে ফেলে দিয়ে যাওয়া হলো শিহরণ বয়ে গেল ঠান্ডা রক্ত স্রোতের।দেখ কেমন লাগে আর কত ভয়ঙ্কর হতে পারি আমরা এই বার্তা প্রকাশ্যে খুল্লম খুল্লা ছোবল মারছে। “দেশ বাঁচাও বেটি বাঁচাও স্লোগানের ছত্রছায়ায় মা বাবার স্নেহ ভালোবাসায় হাসি খুশিতে বড়ো হওয়া শিশু কন্যার এমন ভয়ঙ্কর পরিণতি কিসের পূর্বাভাস সত্যিই জানা নেই। কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফোঁপরা করে দেশকে ছিবড়ে করা আর সামান্য ধার করে ফেলে তাগাদাকারীর হুঙ্কার, বীভৎসতার নমুনা দেখে বড় গা সওয়া এ আধুনিক জীবন।
-
প্রসঙ্গে- আজ আট- নেই আস্বাদ
আজ আট- নেই আস্বাদ
-রীণা চ্যাটার্জীস্বামীর মঙ্গল কামনায় স্ত্রী-র উপবাস। উল্টোটা কোনো দিন ভাবা হলো না- আজ নারীদিবস।
ঘরোয়া শিক্ষার অঙ্গ, স্বামীর সংসারে গিয়ে সব মানিয়ে, মেনে চলতে হবে। উল্টোটা শেখানোর প্রয়োজন নেই, কারণ নারীর ঠিকানার ঠিক নেই- আজ নারীদিবস।
ঋতুকালীন যন্ত্রণার দিনেও নারীকে সকাল থেকে রাত হেঁশেল থেকে অফিস সব সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে হবে। না হলেই ঘরে বাইরে সমালোচনার আঙুল। উল্টোটা? ওটা তো সম্ভবই নয়- তবুও আজ নারীদিবস।
সন্তান জন্মের প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করেও নারীকেই মা হওয়ার শিক্ষা নিতে হয়- উল্টোটা? ওটা তো তান্ত্রিকতার অধিকার- আজ নারীদিবস।
বিধি, আচার-আচরণ, নিয়ম-কানুন সব শিখে নিতে হবে নারীকে- উল্টোটা? ছিঃ তাই আবার কখনো হয়! আজ নারীদিবস।
কি আর করলে সারাদিন? এই প্রশ্নটা একতরফা। উল্টোটা ভাবতে শেখানোর শিক্ষক কোথায়? আজ নারীদিবস।
পুত্র সন্তানের মা জানেন, তাঁর সন্তানের তো ঠিকানা আছে। আলাদা করে সামাজিকতা, গার্হস্থ্য শিক্ষার দায় থেকে তার রেহাই। কন্যা সন্তানের মা’কে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয় তাঁর মতো যে তাঁর কন্যার ঠিকানা বদলের পালা আসবে একদিন- গার্হস্থ্য শিক্ষার মান কম থাকলেই বংশের তুলোধোনা- আজ নারীদিবস।
উদাহরণ যত, বিতর্ক তত। বিপক্ষে ধ্বজা ধরার জন্য ভিড় লেগে যাবে- তাতে অবশ্যই অনেক নারীমুখ দেখা যাবে। আসলে ওনাদের রক্তে, মজ্জায় মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে নারীজন্মের তথাকথিত অর্থ- মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া। কন্যাসন্তানকে শিখিয়ে নেওয়া, পুত্রবধূকে সংসার ধর্মে শিক্ষিত করে তোলা- ওনারা নিজেদের একনিষ্ঠ ধর্ম বলে মনে করেন। জীবন শেষে যা পাওয়া যায়- একটু ঠুনকো কর্তৃত্ব, কয়েকটি চাবি, সবার দাবি মিটিয়ে-মেটাতে ভগ্ন বা আধভগ্ন শরীরে হাসি-হাসি মুখ, সুখী-সুখী ভাব। মূল্যায়ন- সে আবার কি? আমার ‘আমি’কে বিসর্জন দিয়ে এই তো সংসার- সব পেয়েছির আসর।
বদল আসছে চিন্তাধারায়, আগামী প্রজন্ম ভাবছে- ভাবতে শিখছে নতুন করে। সমবেদনা নয় মূল্যায়নের দাবীতে প্রশ্ন তুলছে। প্রয়োজন একটু সাথ দেবার- ওদের কথাগুলো শুনতে আমাদের শিখতে হবে।
হ্যাঁ, শিখতে হবে- কারণ এখন সোস্যাল মিডিয়ার দৌলতে আপডেট মূলক অভিনন্দন বার্তার প্লাবনে একটি প্রতীক দিবস- নারী দিবস। শ্রমের সমমূল্য নির্ধারণ ও মানবিকতার তাগিদে দিনটি সূচনার হাত ধরলেও শ্রমের মূল্য তো দূরে থাক- প্রকৃতভাবে নারীর মূল্যায়ন এখনো হয় নি, আর ভাবনাতেও নেই। নারীদিবস তাই স্বাদে আসে নি, আপডেটের আহ্লাদে, কবিতার সুগন্ধি মেখে ঘুমিয়ে আছে। জাগাতে হবে, বাঁচাতে হবে, সাধে-আস্বাদে।
আর সেই অনাস্বাদিত স্বাদের ঘ্রাণটুকু হয়তো আসবে আগামী প্রজন্মের হাত ধরে, সেই ঘ্রাণের ভাগ নিতে হাত ধরতে হবে ওদের- যারা সমবেদনা নয়- সম্মানের প্রশ্নে ঝড় তুলেছে।
সাজিয়ে রাখা হাসি মুখগুলোও সেদিন বুঝে নিতে চাইবে নারীর প্রকৃত মূল্যায়ন। সবাই হাত ধরলে একটা বিশেষ দিন বলতে হবে না- ‘আজ নারীদিবস’
বলবো আবার-“ইচ্ছে, সুখে হোক না নারী দামী..”