• অণু গল্প

    নিয়তি

    নিয়তি
    -বিভূতি ভূষন বিশ্বাস

     

    ছোট্ট শহর, অলিগলি রাস্তা, মাঝে মধ্যে ফ্ল্যাট বাড়ি গজিয়ে উঠেছে দু’ একটা। নতুন নতুন কয়েকটা ফ্ল্যাট আশেপাশে তৈরি হচ্ছে। ভরসা নামক পাঁচতলা ফ্ল্যাটের নিচে স্কুটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কখন মেয়ের প্রাইভেট পড়া শেষ হবে, ওকে নিয়ে ঘরে ফিরবো। ওর আসার দেরী দেখে স্কুটির উপরে বসে ফেসবুক ঘাটছি। হঠাৎ এক বৃদ্ধ বয়স ষাট সত্তর হবে, একটি ব্যাগ উপুড় করে বড় ড্রেনে কি যেন ফেলে দিয়ে দ্রুত ওখান থেকে চলে গেলেন। আমি ছাড়া ওখানে আর কেউ নেই, আমি মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে আড় চোখে দেখে নিলাম। বৃদ্ধ লোকটি চলে যেতেই আমি ড্রেনের কাছে গিয়ে দেখি একটি বিড়াল ড্রেনে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। তড়িঘড়ি বিড়ালটিকে টেনে তুললাম কিন্তু বিড়ালটিকে দেখে মনে হলো ও অসুস্থ ও খুবই রোগা। ইতিমধ্যে মেয়ের পড়া শেষ ওকে নিয়ে রওনা দিয়েছি। পিছনে তাকিয়ে দেখি বিড়ালটি আমাদের পিছনে পিছনে আসতে আসতে টলে পড়ে যাচ্ছে।
    মেয়ে সব কথা শুনে বলল —– ওকে বাড়ি নিয়ে চলো বাপী ।
    অগত্যা ওকে বাড়ি নিয়ে এলাম। কিন্তু ও কিছু্ই খাচ্ছে না আর নাক দিয়ে রক্ত মতো কি সব পড়ছে। অনেক খুঁজে খুঁজে প্রাণী ডাক্তারের খোঁজ পেলাম। ডাক্তার বাবু বললেন এর ঠান্ডা লেগে এরকম হয়েছে। পর পর দু’দিন দু’টি করে ইনজেকশন দিলেন। ড্রফারে করে দুধ মুখে দিয়ে খাওয়াচ্ছিলাম এই ক’দিন, ডাক্তারের কথা মতো। কিন্তু ওর স্বাস্থ্যের কোনোও উন্নতি না হওয়াতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল। পরের দিন আমি চেয়ারে বসে আছি ও এক লাফ দিয়ে আমার কোলে এসে বসলো কিছুক্ষণ পরে দু’টো ঢেসকি দিয়ে চির বিদায় নিলো । আমার ঘরের পাসে ওকে কবর দিয়ে বললাম, তুমি চলে যাও বিড়াল জন্ম নিও না, মানব জন্ম নিয়ে আবার ফিরে এসো ।

  • অণু কবিতা

    পাপ

    পাপ
    -বিভূতি ভূষন বিশ্বাস

     

     

    পাপের কথা বলিলেই মনে হয়,
    চরিত্রের অপচয়।
    প্রাকৃত ভৌতিকবাদই হলো,
    পাপের পরিচয়।

    যেমন ম্যালেরিয়ার পরিচয়,

    মারাত্বক জ্বর।
    প্রকৃতির কবলিত ভোগবিলাসে,
    পাপিষ্ঠ সব নর।
    পুণ্য,রাজ সিংহাসনে বসলে,
    পাপ হয় তার চর।

  • অণু গল্প

    বুদ্ধি

    বুদ্ধি
    -বিভূতি ভূষন বিশ্বাস

     

     

    বাড়ির ছোটো ছেলে আদরে আদরে বাঁদর হয়ে গেছে। পড়াশুনা কপালে জোটেনি কারণ মা যে জন্ম দিয়েই স্বর্গে চলে গেছে। বড়ো ভাই সে তো বিরাট বড়ো বিজ্ঞানী আমেরিকাতে থাকে। নিজেই আধ পাগল কারোর খোঁজ খবর নেবার সময় তার নেই। মেজো ছেলে Oxford বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। মেম বিয়ে করে সেখানকার বাসিন্দা হয়ে গেছেন। মাঝে মধ্যে দু’ একটা চিঠি আসে সব ইংরেজিতে লেখা বোঝার উপায় নেই। বাবা যত্ন করে রেখে দেন আর সুযোগ পেলেই স্কুল মাস্টারকে দিয়ে পড়িয়ে নেন। চিঠিগুলো বাবার পকেটেই থাকে যেন অমূল্য সম্পদ।

    হঠাৎ এক দিন বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তার বাবু বলেছেন অপারেশন করতে হবে লাখ দুই টাকা লাগবে। দাদাদের কাছে ফোন করলে কি সব ইংরেজীতে বলে ছোটো ভাইয়ের তা সহ্য হয় না। ভাবতে ভাবতে মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। ঘরে কুড়িয়ে কাছিয়ে 13 হাজার টাকা হলো সবই 100 টাকার নোট। সব টাকা একটি বাক্সে ভরে। একটি বিজ্ঞাপন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দিলো।
    “আমি একটি বাক্স ভর্তি কিছু টাকা পেয়েছি টাকার অঙ্ক দশ থেকে কুড়ি হাজারের মধ্যে। একশত টাকা জমা দিয়ে নাম লেখাতে হবে আর দুটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারলেই সব টাকা তাঁর। প্রশ্ন দুটি হলো ১) কত টাকা? ২) কি কি নোট?

    যারা নাম লেখাতে ইচ্ছুক আগামী কাল হ্যাপি ক্লাবের মাঠে সকাল সাতটা থেকে নাম লেখানো শুরু। রেজাল্ট সন্ধ্যা ছয়টায়। পরের দিন মাঠে পৌঁছে চক্ষু চড়ক গাছ তিল ধরবার জায়গা নেই। ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে দেখি দশ লাখ জমা পড়ে গেছে। ছয়টা বাজতে বাজতে কুড়ি লাখে পৌঁছে গেলো।
    সন্ধ্যা সাতটায় রেজাল্ট বেরলো, মদন নামের এক জন পেয়েছে, মাইকে তার নাম ডাকা হচ্ছে মঞ্চে আসার জন্যে। একি ষোল সতের বছরের একটি ছেলে এসে বলল আমার নাম মদন। সবাই অবাক এই কিনা টাকার মালিক! বিশ্বাসই হচ্ছে না। সবাই চেপে ধরে বলল খোকা সত্যি করে বলো তো এই টাকা কি তোমার। এত লোক জন দেখে ও ঘাবড়ে গিয়ে সত্যি কথা বলে দিলো।  বাবু আমি হলাম পকেট মার। আচ্ছা, সে তো বুঝলাম। কিন্তু খোকা তুমি সঠিক উত্তর কি করে লিখলে? ও বলল- বাবু পকেটমারদের মধ্যে আমার রোল নম্বর তের হাজার আর আমার মালিক্, যা পকেট মারি করে নিয়ে আসি সব নিয়ে নেয়, আর আমাকে রোজ একশত টাকা করে দেয় আমি এসবই লিখেছি । মঞ্চে সবাই অবাক হয়ে গেলো ।

  • অণু গল্প

    পুনর্মিলন ২

    পুনর্মিলন ২
    বিভূতি ভূষণ বিশ্বাস

     

     

    তুমি আমার এক মাত্র পুত্র তোমার কথা শুনবো না তো কার কথা শুনবো!
    —— আসলে কি বাবা তোমার তো দিন রাত সব সমান। চোখ দুটো তো আর ভালোই হলো না তাই বলছিলাম ফ্লাটে থাকা যে কথা আর বৃদ্ধাশ্রমে থাকা একই কথা। তোমার নাতি বড় হয়েছে! রুমের অভাবে ওর পড়াশোনার খুব ক্ষতি হচ্ছে। তাই বলছিলাম আর কি!

    পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে আজ আমি বড়ই ক্লান্ত। তুমি স্বর্গে চলে গেছো ভালোই করেছ। নইলে এই কষ্ট সইতে পারতে না। তুমি জানো দেখতে না পেলে কি হবে এই বৃদ্ধাশ্রমে আমার কতো সহৃদয় বন্ধু হয়েছে। হৃদয়ের কল্পনায় সবাইকে দেখতে পাই। না না আমার কোনো দুঃখ কষ্ট নেই।

    ঐ যে ডাক্তার দিদিমণি আমার সব থেকে প্রিয় বান্ধবী। ও যত বারই আমার শরীর পরীক্ষা করে তত বারই আমার ছোট্ট বেলার কথা মনে পরে যায়। সেই খেলার মাঠ ফুট ফুটে চাঁদের মতো মেয়েটির হাত ধরে গোলা ছুট খেলা। জ্যোৎস্না রাতে লুকোচুরি খেলা সবই মনে পড়ে যায় ।

    ভালোলাগা,  ভালোবাসা হ্যাঁ আমি ওকে খুবই ভালোবাসতাম কোনো দিন বলতে পারিনি হয়তো ও আমার মনের কথা বুঝতো। হঠাৎ এক দিন ওরা ভাড়া বাড়ি ছেড়ে কোথায় যে চলে গেলো। মনে মনে খুঁজেছি কউকে বলতে পারিনি পাছে দুর্নাম রটে যায় সেই ভয়ে।

    আজ মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রণা করছে। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। তবুও সেই ছোট্ট বেলার স্মৃতিগুলো ঘুরে ফিরে চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আবছা দেখতে পাচ্ছি চারি দিকে লোক জনের ভিড়। আমাকে সবাই দেখছে। কারা এরা কউকে চিনতে পারছি না। ভিড়ের মধ্য থেকে একটি মুখ ভেসে উঠল। ফুটফুটে সেই ছোট্ট মেয়েটি। না না এতো ডাক্তার দিদিমনি। আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল। আমিই তোমার সেই ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটি “রিতা”

    ও আমার হাত দুটো চেপে ধরলো ওর চোখ থেকে যেন ফোঁটা ফোঁটা মুক্তোর ধারা আমার বুকে পড়তে লাগলো ধীরে ধীরে সব অস্পষ্ট হয়ে আসছে।

    —– তুমিই সেই রিতা?
    — হ্যাঁ আমিই সেই রিতা।
    একটি কালো পর্দা উপর থেকে ধীরে ধীরে চোখের উপর এসে পড়লো। চারি দিক সব অন্ধকার হয়ে গেলো।

  • গল্প

    নীল তিমি 

    নীল তিমি
    -বিভূতি ভূষণ বিশ্বাস

     

     

    আর দু পিস মাংস দিই? দেন খাসির মাংস বলে কথা। এই মশাই বয়স তো কম হলো না একটু সামলে খেও!!! পাশ থেকে বৌ বললো। আসলে ও খাসির মাংস খায়না বাড়িতেও রান্না হয় না। সেইজন্য নেমন্তন্ন বাড়িতে এসে আচ্ছা করে খাই। জন্মদিনের নেমন্তন্ন খাওয়া বেশ ভালোই হলো। খাওয়া দাওয়া সেরে উঠতেই দেখি রায়বাবু। মানে শহরের নামকরা উকিল অমলেশ রায়। বললেন কেমন রান্না হয়েছে? বললাম খুবই ভালো। কিন্তু ছেলে কই? ঐ তো ঘরে। এই অভি এই দেখ তোর কাকু!! কোনো হেল দোল নেই। অগত্যা আমি ঘরে ঢুকে দেখি খুব ব্যস্ত কম্পউটার নিয়ে হাত পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কি সব করছে। বাঁ হাতে সুন্দর লাল রং এর একটি ট্যাটু  F57 লেখাl ——   কিরে অভি জন্মদিন কেমন কাটলো? কোনো উত্তর পেলাম না। আরো যেনো ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। অবশেষে বাড়ি চলে এলাম।

    বুঝলে গিন্নি খাওয়া মনে হচ্ছে একটু বেশিই হয়ে গেছে। তা হবে না, যে ভাবে খাচ্ছিলে পাশের লোক জন হাঁ করে তোমার খাওয়া দেখছিলো। আমার তো বাপু লজ্জা করছিল। আর লজ্জা! কথা বলতে বলতে ও ঘুমিয়ে পড়লো। আমার তো ঘুম আসছে না তার উপর মনে হচ্ছে পেট ফুলে দুটো হয়ে গেছে। তাকিয়ে দেখি দুটো বাজে। আস্তে আস্তে উঠে সামনের রাস্তায় গেলাম একটু হাটা চলা করলে যদি পেটটা কমে। আরে এ কি ডেডবডি নাকি রাস্তার পাশে সটান পরে আছে। ভয়ে ভয়ে আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে দেখি —- এতো অভি মরলো কি করে? নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখি নিশ্বাস চলছে। মানে মরে নি একটু ধাক্কা দিতেই অভি লাফিয়ে উঠলো আমিও লাফিয়ে উঠলাম। কিরে অভি এতো রাতে রাস্তার পাশে জঙ্গলে শুয়ে কেন? কোনো কথা না বলে হনহন করে সোজা বাড়ি চলে গেলো।

    বেশ কদিন পরে এক বিকালে খেলার মাঠের পাশে অভি দেখি চুপচাপ বসে আছে। কিরে অভি শরীর খারাপ নাকি? কাছে যেতেই দেখি ওর বাঁ হাতে লাল রং এর খুব সুন্দর তিমি মাছের ট্যাটু। কি রে এটা কোথা থেকে বানালি? ও কোনো কথা না বলে চোখ দুটি মোটা মোটা করে আমার দিকে তাকিয়ে, হন হন করে বাড়ির দিকে চলে গেলো।

    কি গো আজকের খবরের কাগজ দেখেছো—- না না দেখা হয় নি!! তাড়াতাড়ি দেখো ছেলে পুলে কি সব গেম টেম খেলে মরে যাচ্ছে। পেপারের হেডিং দেখেই আমি হতবাক “নীল তিমি পঞ্চাশ এপিসোড পার করলেই মৃত্যু।” পঞ্চাশ দিনে পঞ্চাশ এপিসোড। এই যে শোনো অভির জন্ম দিন কবে ছিলো গো আগের মাসের আগের মাসে আজ পঞ্চাশ দিন হচ্ছে। আরে বাপরে এক দৌড়ে ওদের বাড়ি চলে গেলাম।

    সন্ধ্যা হয়ে এসেছে অভিদের বাড়ি গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। বিরাট গাম্ভীর্য নিয়ে থাকতো ওর মা ইস্কুল টিচার কিনা আজই দেখলাম  কাঁদতে ওর বাবাও কাঁদছে। অভি দেখি দোতলার ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে দরজা জানলা সব ভিতর থেকে বন্ধ । অনেকে অনেক রকম ভাবে ওকে বোঝাচ্ছে কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। চোখের সামনে ঝপাত করে লাফ দিলো ব্যাস সব শেষ। সবাই হাউ হাউ করে কান্না শুরু করে দিয়েছে। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি অভির কিচ্ছু হয়নি। ওর বাবা তিনতলা করার জন্য বালি এনে রেখেছিলো অভি সেই বালির গাদার উপর পড়েছে। অভিকে বুকে জড়িয়ে ওর বাবা মা’র সে কি কান্না। অভি এদিক ওদিক তাকিয়ে কি যেন সব দেখছে আর কি সব ভাবছে।

  • গল্প

    উপহার

    উপহার
    – বিভূতি ভূষন বিশ্বাস

     

     

    মায়ের হাত ধরে কাঁচা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি। একেবারে অজপাড়াগাঁ ফাঁকা রাস্তা, লোকজন নেই বললেই চলে। দুটি ছোট্ট ছেলে কাঁধে হাত দিয়ে হেঁটে আসছে। আমার থেকে ছোটো হবে। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়তাম। 1980 সালের ঘটনা যোগোযোগ ব্যবস্থা তেমন ভালো ছিলো না। ছেলে দুটি কাছে আসতেই মা জিজ্ঞাসা করল —– রাম লক্ষণ তোমরা কোথায় যাচ্ছো?
    সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো আমরা রাম লক্ষণ নই।  আমার নাম বিধান ওর নাম বিকাশ আমরা যমজ দুই ভাই। আমরা এখন কলকাতায় যাচ্ছি।
    মা বলল —- তোমাদের বাড়ি কোথায়?
    ওরা বলল —কলকাতায়।
    মা বলল —-এখানে কাদের বাড়িতে এসেছ?
    ওরা বলল —মামা বাড়ি। ওখানে ভালো লাগছে না তাই বাড়ি চলে যাচ্ছি।
    মা বলল —–কোন গ্রামে তোমার মামার বাড়ি। মামার নাম কি?
    ওরা বলল —- তা তো মনে নেই।
    মার দিকে তাকিয়ে দেখি মার চোখ মোটা মোটা হয়ে গেছে। কারণ আমাদের গ্রাম থেকে নব্বই কিলোমিটার দূরে কলকাতা। ছেলে দুটিকে মা ভুলিয়ে ভালিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলো। ওরা আমাদের গাছে পাকা আম দেখে কি আনন্দ। আমি গাছে উঠে আম পেড়ে দিলাম। আম হাতে নিয়ে আমার মতো করে গাছে উঠতে চাইলো। অনেক বার চেষ্টা করে হাঁপিয়ে গেলো তারপর কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে ঘুমিয়ে পড়ল। এখন দেখছি মা আমার থেকে ওদের বেশী খেয়াল রাখছে। দেখে আমার বড্ড হিংসা হচ্ছে। কিছু বলতে পারছি না। মা যে বলে রেখেছে আমি ওদের বড় দাদা ওদের যেন কোনরকম অসুবিধা না হয় তার খেয়াল রাখতে। দুই তিনদিন বেশ আনন্দে কেটে গেল ।

    হঠাৎ একদিন আমাদের বাড়িতে পুলিশের গাড়ি এসে হাজির। থানার বড়বাবু বাবাকে ডেকে বললেন —- থানায় খবর দিয়ে খুব ভালো কাজ করেছেন। বাচ্ছা দুটিকে দেখে শুনে রাখবেন। আমরা ওদের সম্পর্কে খবর পেলেই আবার আসবো। বাবা আর মা দুজনেই বড় বাবুর দেওয়া কাগজে সই করে দিলেন। মা লেখাপড়া বেশী জানেনা তাই বড় কষ্টে নিজের নাম “তিলোত্তমা” লিখলেন। প্রায় পনের কুড়ি দিন ভাইদের সঙ্গে আনন্দে কেটে গেল। তারপর এক দিন আবার পুলিসের গাড়ি এলো। এবার লোকজন অনেক বেশী ছিলো। গাড়ি থেকে একটি মোটা মত লোক  দুই ভাইকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলেন। বাবার হাতে একটা কাগজ দিয়ে ভাইদের নিয়ে চলে গেল। কাগজটিতে লেখা ছিল “মাতৃহারা পুত্রদের ফিরে পেয়ে অমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে যদি কখনো কিছুর প্রয়োজন হয় তাহলে এই ঠিকানায় চিঠি লিখবেন। অমি হাজির হয়ে যাবো।”

    অনেক বছর কেটে গেল মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে । গ্রামের ডাক্তারের পরামর্শে কলকাতার মেডিকেল কলেজে ভর্তি করে দিলাম। ডাক্তাররা দেখে বললেন দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। কিডনি পালটালে মা ভালো হয়ে যাবে। খরচ পড়বে পাঁচ লাখ টাকা। শুনে যেন মাথায় বাজ পড়ল। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তারা কোথায় পাবে এত টাকা। আমার এই দুর্দশার কথা শুনে একজন বুদ্ধি দিলেন। কলকাতার প্রতিটি ইস্কুল, কলেজ, ক্লাবে গিয়ে সাহায্য চাইলে চিকিৎসার টাকা উঠে আসবে। কথা মতো কাগজ পত্র তৈরি করে বেরিয়ে পড়লাম ভিক্ষা করতে। ভিক্ষা করতে করতে একটি ইস্কুলের নাম দেখে অবাক হয়ে গেলাম। “তিলোত্তমা উচ্চ বিদ্যালয়” এ তো আমার মায়ের নামে ইস্কুল। হেড মাষ্টারের কাছে গিয়ে কাগজ পত্র দেখালাম। উনি কাগজ পত্র দেখে বললেন। তোমাকে আর ভিক্ষা করতে হবে না। পাশেই তিলোত্তমা নাসিং হোম আছে ওখানে মা’কে ভর্তি করে দাও। বিনা পয়সায় চিকিৎসা হয়ে যাবে।

    আমি যেন আশার আলো খুজে পেলাম। ওনার কথা মতো তিলোত্তমা নার্সিং হোমে মা’কে ভর্তি করে দিলাম। দশ পনের দিনের মধ্যে মা সুস্থ হয়ে উঠল। এক নার্স বলল মার দুটো কিডনি পাল্টে দিয়েছে। খুব আনন্দ হচ্ছে আবার ভয়ও করছে। কত টাকা পয়সা দিতে হয় কে জানে। মা’কে আজ ছেড়ে দিল। কাউন্টার থেকে একটি বিল আমাকে দিল তাতে লেখা আছে মোট খরচ পাঁচ লক্ষ টাকা। আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। কে যেন আমার হাত ধরে টেনে তুলল। তাকিয়ে দেখি হেড মাষ্টর মহাশয় আর পাশে দাঁড়িয়ে ডাক্তার বাবু। ওনারা বললেন নিচে পড়ে দেখো দাদা । দাদা বলতেই অমি চমকে উঠলাম। আমার তো কোনো ভাই নেই। রসিদের নিচে পড়ে দেখি পেইড লেখা পাশে নাম রাম লক্ষণ। পরে ভাইরা বলল আমরাই সেই মায়ের রাম লক্ষণ। বাবা মরার সময় তোমাদের কথা বলে গিয়েছিল। বাবার ইচ্ছাতেই ইস্কুল ও নার্সিং হোমের নাম রাখা হয়েছে। আর বাবা তার অঙ্গ সংরক্ষণ করেছিলেন। বাবার কিডনি দুটি মাকে লাগিয়ে দিলাম। দুই ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।

  • অণু গল্প

    মায়ের আঁচল

    মায়ের আঁচল
    – বিভূতি ভূষণ বিশ্বাস

    আরে বাপরে ১০ টা বেজে গেছে,সর্বনাশ করেছে ১০ টা থেকেই তো ডিউটি । তারা হুড়ো করে বেরিয়ে পড়লাম । কি আর করবো সব কাজই তো আমাকে করতে হয় । যাবার সময় মা ঠিকই বলে গিয়েছিলেন ” বাবা তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিস” । কিন্তু মা মনের মতো মেয়ে তো পাইনা । কি করবো বলো । এই সব ভাবতে ভাবতে অফিসে রওনা দিলাম । ১০ মিনিট পায়ে হেঁটে স্টেশনে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য । ওহ এখন তো গঙ্গা সাগরের মেলা চলছে । মনেই নেই কি করে মনে থাকবে আমরা যে স্টেশন মাস্টার দিনরাত সপ্তাহের নামও ভুলে যাই । শুধু ডিউটি আর ডিউটি ছাড়া কিছু বুঝিনা ।

    লক্ষ্মীকান্ত পুরই তো গঙ্গাসাগরে যাবার মেইন স্টেশন । এই মাস দুই হলো আমার পোস্টিং হয়েছে । সিঁড়ি দিয়ে অফিসে উঠতেই দেখি এক ভদ্রমহিলা বসে আছে সিঁড়ির উপর । বয়স ৫০/৫৫ হবে । আমি জিজ্ঞাসা করলাম আপনি এখানে বসে কেন ? উনি যে কি ভাষায় কথা বল্লেন বুঝতেই পারলাম না । অগত্যা পাশ কাটিয়ে দু’তলায় আমার অফিসে চলে গেলাম । রাত আটটায় আমার ছুটি হলো তখনো দেখি উনি ওখানে ঠাঁই বসে আছেন আর ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন । জিজ্ঞাসা করলাম বাড়ি কোথায় ? কি যে বল্ল বুজতেই পারলাম না অগত্যা পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম নিজের রেল- কোয়াটারে ।

    অস্থির অস্থির লাগছে ঘুম আসছে না শুধু ঐ মহিলার কথা মনে পড়ছে অগত্যা স্টেশনে গিয়ে দেখি উনি এখনো ওখানেই বসে আছেন । জিজ্ঞাসা করলাম কিছু খাওয়া দাওয়া হয়েছে ? উনি হা করে চেয়ে রইলেন । অগত্যা ইশারা করে খাবার কথা জিজ্ঞাসা করলাম । এবার হাত নাড়িয়ে উত্তর দিলেন — ‘না’ । ইশারা করে আমি বললাম আমার সঙ্গে যেতে । উনি উঠে পড়লেন আমি একটা হাত ধরে আমার রেল-কোয়াটারে নিয়ে গেলাম ।

    এখন উনি মায়ের মতো সব কাজ করেন কিন্তু দু জনের মধ্যে ইশারাতে কথা হয় । যেন দু জনাই বোবা । আমাকে আর কষ্ট করে রান্না করতে হয় না । মাস খানেক পর এক দিন ভোরে কলিং বেল বেজে উঠলো দরজা খুলে দেখি পুলিশ ও দু জন অচেনা লোক । পুলিশ জিজ্ঞাসা করলেন ——- আপনি কি Mr.B.B.Biswas.
    ——- আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’।
    পুলিস বললেন ——- আপনার ম্যাসেজ আমরা পেয়েছি । এনারা এনাদের মা কে হারিয়েছেন তাই দেখতে এসেছেন । এদিকে ভদ্রলোক মহিলাকে দেখে মা মা বলে কেঁদে ফেলে জড়িয়ে ধরলেন । ওনারা বললেন মা শুধু তামিল ভাষাই বোঝেন । খুবই কষ্ট হয়েছিল সে দিন উনাকে বিদায় দিতে ।

  • ভ্রমণ কাহিনী

    ভূ-স্বর্গ 

    ভূ-স্বর্গ
    -বিভূতি ভূষন বিশ্বাস

     

     

    ভ্রমণ করতে কে না ভালোবাসে কিন্তু ভ্রমণ করাই মানে আনন্দ করা কোন মতেই যেন নিরানন্দ না আসে। সেই দিকটা খুবই খেয়াল রাখতে হবে। চলুন ঘুরে আসা যাক ভূ-স্বর্গ থেকে। ভূ-স্বর্গকে দু’টি ভাগে ভাগ করতে হবে। ১) কাশ্মীর ২) লে। দু’টি ভাগ দুই সময়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে দুই জায়গা ভ্রমণ করলে দু’টির মজা পাবেন না। কোন ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে যাবেন কখনোই নিজেরা যাবেন না। সঙ্গে ভোটার কার্ড ও আঁধার কার্ড ও কয়েক কপি জেরক্স নিতে ভুলবেন না। ATM কার্ড সঙ্গে রাখবেন ক্যাস টাকা না দিয়ে পারলে দেবেন না। ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ নেবেন সঙ্গে।  “Diamox 250mg” দিনে দুবার খাবার পর খাবেন তিন দিন পাহাড়ে ঢোকার ঠিক আগে। এই ঔষধটি দেহে অক্সিজেন নিতে সাহায্য করে।” —-কথা গুলি বলেছেন লে’র সরকারি হসপিটালের ডাক্তার।
    কাশ্মীর সাধারনতঃ বরফের সময় যেতে হয় তা হলে বেশ মজা পাবেন। আগষ্ট নভেম্বর থেকে মার্চ এপ্রিল। তবে সারা বছরই যাওয়া যায়। জম্মু ষ্টেশনে নেমে ছোট ছোট বাস আছে তাতে করে শ্রীনগর (298 Km)। আর উচ্চতা 1530 মিটার সমুদ্র তল থেকে। শ্রীনগর শহর ঝিলম নদীর তীরে অবস্থিত। নদীর কিনারাতে ব্যাট তৈরির কারখানা দেখতে পাবেন। শ্রীনগরে আট নয় দিন থাকলে প্রথমে ডাল লেকে ঘুরে নেবেন। এখানে খুবই বার্গেনীং হয়। শিকারায়  ছয় জন হলে 600 বা 300 টাকায় ফিট হয়ে যাবে। কাশ্মিরী মেয়ে বৌ ও বর সেজে ছবি তুলতে পারবেন। কেনা কাটায় সাবধান থাকবেন। হাউসবোটে রাত কাটাতে পারেন তবে অনেক টাকা খরচ হবে। এই ডাললেকে অনেক ছবির সুটিং হয়েছে।
    লাদাখ শব্দের অর্থ গিরিবর্ত্মের দেশ। এটি একটি জেলা। লাদাখের সদর শহর লে।  এর উচ্চতা 3505 মিটার। শ্রীনগর থেকে লের দূরত্ব 434 কিলোমিটার। মাঝে কারগিলে এক রাত থাকতে হয়। 900 বছরের প্রাচীন বুদ্ধ মূর্তি যাবার সময় পথে দেখে নেবেন। লে থেকে ণুব্রা উপত্যকা যাবেন এটা হিমালয়ের মরুভূমি বলে। এখানে দুই কুঁজ উট দেখতে পাবেন। এক রাত তাঁবুতে থাকতে হয়।
    পরের দিন চলে যান প্যাংগং লেকে।”লে” শহর থেকে 222 কিলোমিটার দূরে। এখানে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ গাড়ি চলার রাস্তা চাংলা পাস পাবেন এর উচ্চতা 17350 ফুট। 14000 ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই সরোবরের দৈর্ঘ্য 130 কিলোমিটার যার 40 কিলোমিটার ভারতের বাকি 90 কিলোমিটার চীন দখল করে নিয়েছে 1962 সালের যুদ্ধের পর থেকে। এই সরোবরটি এশিয়ার বৃহত্তম নোনা জলের লেক। এখানে রংয়ের বৈচিত্র খুবই সুন্দর জল সাতটি রংয়ের হয়। ব্রাক্ষ্মনী হাঁস ও সিগালের দল দেখতে পাবেন। এক রাত অবশ্যই এখানে থাকবেন তাঁবুতে।
    পরের দিন চলে যান সো-মোরিরি লেক লে শহর থেকে 225 কিলোমিটার দূরে সিন্ধু নদ এর পাস দিয়ে চলে যাবেন। পথে একটু দাঁড়িয়ে মারমট (খরগোসের মতো দেখতে) দেখে নিন । এই সরোবরের জলের রং নীল। হাঁস পাখি দেখতে পাবেন। এখানেও এক রাত তাঁবুতে থাকতে হয়। মনে রাখবেন জুলাই, আগষ্টে বর্ষা হলেও লাদাখের আবহাওয়া খুবই ভালো থাকে।
    শ্রীনগর থেকে লে যাবার পথে আর্যগ্রাম দেখে নিতে পারেন খুব সহজেই। আর্য গ্রাম প্রধানত পাঁচটি গ্রাম নিয়ে গঠিত ১) দা ২) বিমা ৩) হানু ৪) দারচিক ও ৫) গারকুন। তবে মনে রাখবেন কোন মতেই দারচিক ও গারকুনে যাবার অনুমতি নেই। প্রথম তিনটি গ্রাম ঘুরে দেখলে প্রান আনন্দে ভরে যাবে। এরা “দর্দ” জাতি বহু শতাব্দী পার হয়ে গেলেও এরা কিন্তু একদম পাল্টায়নি। নিজেদের মধ্যেই বিবাহ হয়। তবে মেয়েরা একটু অন্য রকম। বিদেশীদের বেশি ভালোবাসে তবে তা গোপনে। মনে রাখবেন ওখানকার খাবার না খাওয়াই ভালো যে সব টুরিষ্টরা নিজেরা রান্না করে খাওয়ায় তাদের সঙ্গে যাবেন। এক মাত্র পোষ্ট-পেইড মোবাইল কাজ করে। স্থানীয় প্রিপেইড সিম তুলে নিতে পারেন। নেট ভালো কাজ করে না।  লে থেকে মানালী তারপর  চণ্ডীগর হয়ে ফিরে আসুন ।

  • অণু গল্প

    নিষ্ঠুর সমাজ

    নিষ্ঠুর সমাজ
    -বিভূতি ভূষণ বিশ্বাস

     

     

    সেদিন বিকালে ফুটবল খেলার মাঠে আমরা পাঁচ ভাই বোন খেলা করছিলাম,আর মা পাশে শুয়ে ছিলো হঠাৎ একটি লোক ট্যাক্সি থকে নেমে আমাকে কোলে নিয়ে চম্পট। আমি তো কথা বলতে পারিনা তাই অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম ভাই বোন আর মা’র দিকে,আস্তে আস্তে সব অস্পষ্ট হয়ে গেলো। দুই চার দিন খুব কান্না করেছি। এখন দেখছি এখানেই ভালো আছি। সময় মতো খাওয়া দাওয়া সব কিছুই পাই, তবে সব থেকে ভালো লাগে প্রভুর এক মাত্র মেয়েকে ও সব সময় আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

    যাই হোক ধীরে ধীরে শিশু কাল কৈশোর যৌবন সবই কেটে গেলো এখন শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, মাথা ঝিম ঝিম করে দাঁত শির শির করে প্রভুকে ছাড়া কাউকে আর চিনতে পারি না। হঠাৎ এক দিন মাথা খুব যন্ত্রণা করছিল বাড়ির মায়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম নিরুদ্দেশের পথে । এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম।

    আমাকে দেখে দোকানদার গরম জল ছুঁড়ে মারলো। আমি আর ধৈর্য্য ধরতে পারলাম না ওকে কামড়ে দিলাম । সবাই হই হই করে পাগলা কুকুর পাগলা কুকুর বলে তাড়া করলো। কতো দূর আর পালাবো। বড় বড় লোহার রড নিয়ে সবাই আমাকে ঘিরে ফেললো এক জন মাথায় সজোরে মারলো। ভাগ্য ভালো মাথায় না লেগে সামনের ডান পায়ে লাগলো ।

    তিন পা দিয়ে দৌড়ানোর বৃথা চেষ্টা করলাম। সপাটে আর একটা মারলো, সামনের বাঁ পাটাও গেলো । পিছনের দু’পাই ভরসা,মানুষ হলে দৌড়াতে পারতাম । ব্যকুল দৃষ্টিতে চেয়ে আছি কখন মাথায় শেষ আঘাতটা পড়বে। ভাবতে ভাবতে সজোরে মাথায় শেষ আঘাতটা পড়লো। ধীরে ধীরে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। হঠাৎ কে যেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে দেখার চেষ্টা করলাম। আবছা দেখলাম এতো আমার প্রভু। প্রভুর কোলে মাথা রেখে নিষ্ঠুর সমাজ থেকে চিরতরে বিদায় নিলাম।

  • গল্প

    চোর

    চোর
    -বিভূতি ভূষন বিশ্বাস

     

     

    সবে ডিউটি থেকে রানাঘাট CRE রেল কোয়ার্টারে ফিরছি পাশেই রাজীব পল্লীতে অনেক লোকজনের ভিড়। দুটি পুলিস ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে,দেখেই বুঝে গেলাম ব্যপারটা কি। আসলে ওরা চোর ধরতে এসেছে। রাজীব পল্লী হলো একটি বস্তির নাম আর ওখানে বেশ কয়েক জন কিশোর থাকে বয়স পনের থেকে পঁচিশের মধ্যে হবে। কারুরই বাবা মা নেই সবাই উটকো। একটি বাড়িতে ওরা থাকে। আর রাত্রে চুরি টুরি করে যা পায় বড়িওয়ালাকে দিয়ে দেয় বদলে সারাদিনে দুবেলা খাবার পায়। ওদেরকে সবাই “ড্রেনডাইট” বলে ডাকে। আসলে ওরা ডেনড্রাইট রুমালে নিয়ে তার গন্ধ শুঁকে নেশা করে । আসল নাম কি ? বা নাম আছে কিনা সন্দেহ । তিনটি ছেলেকে ধরে পেটাতে পেটাতে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল। অমি পাশ কাটিয়ে চলে আসছি। ওদের মধ্যে একজনকে অমি ভূতো বলে ডাকি। ও করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল।

    দশ পনের দিন পরে পাড়ার দোকানের মোড়ে দেখি ভূতো বসে আছে।
    অমি বললাম ——– কবে ছাড়া পেলি ?
    ও বলল —–এইতো এখুনি।
    অমি বললাম —— চুরি টুরি ছেড়ে কিছু একটা কর যা টাকা পয়সা লাগে অমি দেবো।
    ও মাথা নিচু করে কনো কথা বলল না।
    অমি বললাম —— ভূতো কাল কিন্তু স্বাধীনতা দিবস। কাল কিন্তু চুরি টুরি করিস না । যদি টাকা পয়সা লাগে তো বলিস অমি দিয়ে দেবো।
    ও বলল —– ও কাল স্বধীনতা দিবস !
    মানে আমদের মালিকের বকনা গরুটা সেদিন ছুটে গেছিল সারাদিন কেউ ধরতে পারেনি । মানে ওই দিন গরুটি স্বাধীন হয়ে গেছিল। একেইতো স্বাধীনতা বলে?
    আমি অবাক হয়ে ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে, —— হ্যাঁ, বলে চলে গেলাম।

    বিকাল হলে পালচৌধুরীদের মাঠে বসে সবাই আড্ডা মারে ছোটরা খেলা করে। আমিও গুটি গুটি পায়ে শহরের মধ্যে দিয়ে মাঠে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি আগেকার জমিদার এখনকার প্রথম সারির নেতা ও ধনী ব্যক্তি পালচৌধুরীদের বাড়ীর সামনে অনেক মানুষের জটলা ও কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখি ল্যাম্প পোষ্টের সঙ্গে ভূতো বাঁধা আর দু’চার জন ওকে মেরেই যাচ্ছে। আমি ঠেকাতে যেই গেছি আমাকেও ওরা চোর বানিয়ে বসেছে । ব্যপারটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝে সঙ্গে সংগে থানায় ফোন করে সব খুলে বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিস ভ্যান এসে হাজির । যে বেশি মারছিল সে বলল স্যার এই ছেলেটি আমাদের বাড়ি থেকে সব সোনার গয়না চুরি করেছে। এর এই বস্তার মধ্যেই আছে। থানার বড় বাবুর আদেশে বস্তা খুলে মাটিতে ঢালা হলো। একি এতো সব ভারতের জাতীয় পতাকা । কাল স্বাধীনতা দিবস ছিল আজ শহরের পথেঘাটে যত পতাকা পড়ে ছিল সব ভূতো গুছিয়ে বস্তায় ভরেছে। থানার বড় বাবুর বুঝতে অসুবিধা হয়নি ব্যাপারটা কি। অমি, ভূতো আর যে ছেলেটি মারছিল তাকে গাড়িতে করে থানায় নিয়ে গিয়ে ছেলেটিকে লকাপে পুরে দিল। ভূতোর জামিনদার হয়ে আমি সই করলাম।

    থানার বড় বাবুর আদেশে একটি ভ্যান রিক্সা কিনে ভূতোকে দেওয়া হলো। আর থানার পাশে একটি ভাঙ্গা ঘর ছিল ওখানে ভূতোর থাকার ব্যবস্থা করা হলো। আজ এক বছর পূর্ণ হলো ভূতোকে ফোনে ডেকে বললাম ষ্টেশনে যাবো চলে এসো। ভূতোর রিক্সায় যেতে যেতে অনেক কথা হলো তবে ওর একটা কথা আমার খুবই ভালো লাগলো। ও বলল — আজ এক বছর হলো আমি স্বাধীন হয়েছি। মনটা খুশিতে ভরে গেল।

You cannot copy content of this page