ধানবাদ ষ্টেশন থেকে 57 কিলোমিটার দূরে Parasnath Mandir (পারাস নাথ মন্দির ) এই তো সেদিন ঘুরে এলাম বিরাট বড় পাহাড়ের উপর মন্দির। পায়ে হেঁটেই উঠতে হয়। মাঝে মাঝে ছোট ছোট দোকান পাঠ আছে একটু বিশ্রাম করে নিতে পারেন। কৌতূহলের বিষয় হলো ওখানে জৈন ধর্মের মানুষ বসবাস করেন। পুরুষেরা সবসময় নগ্ন থাকেন আর মেয়েরা সাদা থান কাপড় পরেন। নগ্নতা আমাদের সমাজে যেমন ভয়ঙ্কর ওদের সমাজে তেমনি সহজ সরল। নগ্নতার অর্থ এখানে সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। মন্দিরে যাবার পথে একটি দোকানে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে পরলাম।
হঠাৎ একটি বাচ্চা মেয়ে এসে কিছু পয়সা চাইল । দেখে মনে হলো খুবই গরীব। পর্যটকদের কাছ থেকে কিছু আদায় করা ওদের পেশা বলা যায়। ভিক্ষা শব্দটা এখানে না বলাই ভালো। কারণ ভিক্ষা শব্দের মানে ওরা বোঝে কিনা সন্দেহ আছে। আমি একটু মজা করেই মানি ব্যাগ থেকে 2000 টাকার একটি নোট বের করে, বাচ্চা মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিলাম। নোটটি দেখে মেয়েটি যেন কারেন্টে শট খাবার মত পিছিয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা শুকনো হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ও যেন বলতে চাইছে বাবু আমাদের দারিদ্রতা নিয়ে ব্যঙ্গ করো না॥
তৎক্ষনাৎ আমি ওর সামনে 5,10,20,50,100, 500 এবং 2000 টাকার নোট দু হাতে করে ওর সামনে ধরে বললাম যেটা পছন্দ হয় নিয়ে নাও। ও আবার হেসে ফেলল । এ বারের হাসিটা যেন আমার প্রান জুড়িয়ে দিল। তারপর পাঁচ টাকার নোটটি নিয়ে নিল। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম 2000 টাকার নোটটি না নিয়ে,পাঁচ টাকার নোটটি নিলে কেন ?
ও বলল —— বাবু ওটা নিয়ে ভাঙ্গাতে গেলেই সবাই ভাববে আমি চুরি করেছি।
সত্যি তো এমন কথা এক বারও ভাবিনিতো। আমরাই তো সেই সভ্য সমাজের মানুষ যারা এই সব কথা ভেবে থাকি। দোকানদারকে সাক্ষী রেখে দু হাজার টাকার নোটটি ওকে দিয়ে দিলাম। ও একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, সঙ্গে মুচকি হাসি দিয়ে এক দৌড়ে পালিয়ে গেল।
উগ্রপন্থী কার্যকলাপে সাহায্য করার জন্য আজ দুদিন হলো আমি লকাপে বন্দী আছি। নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি। তবে এখনো আমার গায় হাত তোলেনি। তার কারণ আমার মোবাইল, যেটা ওরা বাজেয়াপ্ত করে ঘেঁটে ঘুঁটে দেখেছে কিছু্ই নেই আছে শুধু কবিতা,গল্প,আর নিজের তোলা পশু, পাখি, কীট পতঙ্গের ছবি । হয়তো তার জন্যই গায় হাত তোলেনি। আজ বিকালে আমার স্ত্রী একটা চিঠি থানার বড় বাবুকে দিয়েছে। চিঠিটি আজই আমার নামে এসেছে। আর পাঠিয়েছে সেই কল্পনা। হ্যাঁ ও আমাদের পাড়ার ভাড়াটিয়া। প্রায় এক বছর ধরে আছে। ও আমার ভালো বন্ধু ফোনে প্রায়ই কথা হয় লেখালেখি নিয়ে। ও আমার লেখার খূবই ভক্ত। চিঠিটি বড় বাবু পড়ে আমাকে পড়তে দিয়ে বললেন। কাল রবিবার হলি চাইল্ডের ম্যডাম আর সেই BSF জাওয়ান আসছে ওনাদের জবানই আপনাকে মুক্ত করতে পারবে ।
কল্পনার লেখা চিঠি আমাকে —–
প্রিয় বিভূতি বাবু ।
এটাকে চিঠি না বলে আমার জীবন কাহিনী বলতে পারেন । আমি তখন খুবই ছোট ছিলাম । আমার মা লক্ষ্মী পূজা করতেন আর আমাদের ইস্কুলে “জন গণ মন” গান গাওয়া হতো এই দুটি কথাই মনে আছে। একদিন ইস্কুল থেকে ফেরার পথে রতন কাকার সঙ্গে দেখা। উনি বললেন আমার বাবা’ মা অসুস্থ আমাকে ওখানে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ওনার গাড়িতে উঠে চললাম বাবা মাকে দেখতে। গাড়ির ভিতরে দুই তিন জন লোক ছিল তাদের লম্বা লম্বা দাড়ি। চোখগুলো দেখলে ভয় ভয় করে। একটি ফাঁকা যায়গাতে এসে গাড়ি দাঁড়াল। আশে পাশের অনেক লোকজনের ভিড়। ভিতরে গিয়ে দেখি চার পাঁচজনের দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়ে আছে । ওরা মৃত দেহ দেখিয়ে বলল এটা তোমার বাবা এটা তোমার মা ওটা দাদা । তোমাকে ছাড়া সবাইকে ভারতের সেনাবাহিনী গুলী করে মেরে ফেলেছে।আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। তখন একটা দাড়িওয়ালা লোক এসে বলল তুমি আমার কাছে থেকে পড়াশুনা করে মানুষের মতো মানুষ হবে ।
প্লেনে করে কোথায় যে নিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। বিরাট বড়ো ইস্কুলের মতো। আমার মতো অনেক ছেলে মেয়ে আছে। ছোট থেকে বড় সব রকম। দু একদিন বসে বসে ঘুরে ঘুরেই কাটালাম। তার পর থেকে ক্লাস শুরু হলো। লম্বা লম্বা দাড়িওয়ালা লোকগুলো এসে ক্লাস নিত। ক্লাসের শুরুতেই বলতো তোমাদের সব আত্মীয় স্বজনদের ভারতীয় সেনারা গুলি করে মেরেছে। তার চরম প্রতিশোধ নিতে হবে। তোমরা তৈরি। সবাই তারস্বরে বলতো হ্যাঁ আমরা তৈরি প্রতিশোধ নেবার জন্য । তার পর শুরু হতো ক্লাস । পড়া শুনার সাথেসাথে প্রাকটিক্যাল করতে হতো, সাঁতার কটা, জাম্প দিয়ে দেয়াল পার হওয়া বছর দুই পর থেকে ড্রাইভিং শেখা , বন্ধুক চালানো ইত্যদি । শেষের বছর আমাকে ট্রেনিং দেওয়া হলো মানব বোমার। ট্রেনিং শেষে আমাকে পাঠানো হলো ভারতে “অপারেশন পেগনেন্ট” সফল করার জন্য। ভারতীয় সেনাবহিনীর উপর আক্রমণ করতে হবে। তাই আজ গর্ভবতী মহিলা সেজে চললাম ব্যারাকপুর সেনা ছাউনিতে। পরের জন্মে আমি ভারতবর্ষে জন্মাতে চাই। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন।
ইতি আপনার বন্ধু কল্পনা ।
পরের দিন BSF জাওয়ান ও হলি চাইল্ডের ম্যডাম এসে হাজির । আমদের তিনজনকে একটা ঘরে নিয়ে বসালো । ম্যডামকে ঘটনার বিবরণ দিতে বললেন —–
উনি বললেন গুটি কয় ছাত্র ছাত্রী আর আমি আটকে পড়েছিলাম হঠাৎ বাস হরতাল হয়ে যাবার জন্যে। তাই সেনাবাহিনীর গাড়ি যাচ্ছ দেখে সাহায্য চেয়ে ওদের গাড়িতে উঠে পড়ি । বাগমোড়ে আসতেই এক গর্ভবতী মহিলা সাহায্য চাইল হসপিটালে যাবার জন্য। মহিলা গাড়িতে উঠতেই আমি যায়গা ছেড়ে দিলাম বসার জন্য। ওর পাশেই দুজন বাচ্ছা এক ছিঁটে বসে ছিল। একজন আপন মনে গুণ গুণ করে গান করছে “জন গণ মন অধিনায়কও জয়ও হে” অন্য বাচ্চাটি মহিলাকে বলছে আন্টি কাল আমাদের বাড়িতে লক্ষ্মী পূজা তুমি প্রসাদ খেতে এসো। মহিলাটি যেন শক্ত কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। আমি ভাবলাম ওর বোধ হয় সময় হয়ে গেছে। ড্রাইভারকে জোড়ে গাড়ি চালাতে বললাম। হঠাৎ মহিলাটি চিৎকার করে বলল এটা তো আমার দেশ এটা তো আমার দেশ বলেই দরজা খুলে নিচে ঝাঁপ দিলো। বিকট শব্দে আমাদের গাড়িটি কেঁপে উঠল। কিছুদূর গিয়ে গাড়িটি থেমে গেলো। আমরা অল্প বিস্তর অনেকেই আঘাত পেয়েছি। ঘটনাস্থলে এসে দেখি মহিলা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।
সমস্ত কথাগুলি রেকর্ড করা হলো এবং সাদা কাগজে লিখে আমরা তিনজনে সই করলাম। কাল কোর্টে উঠবে কেস। আজ সোমবার দুপুর একটায় রায় বেরোল আমি বেকসুর খালাস পেলাম।
বুঝলে বিপিনের মা এবার নিজের চেহারার দিকে একটু খেয়াল দাও দিন দিন যা মোটা হয়ে চলেছ যদি এক বার বিছানায় পড়ো বিপিন তো দূরের কথা দশ জনেও তোমাকে নাড়াতে পারবে নাl তাও বা যদি বিপিনের বাবা বেঁচে থাকতো।
দুই বান্ধবী রান্না ঘরে বসে গল্প গুজব হাঁসি ঠাট্টা করছে । হঠাৎ হৈ হট্টগোলে দুজনের গল্প থেমে গেলো । মনে হচ্ছে যেন দাঙ্গা বেঁধে গেছে লোক জন ছুটা ছুটি করছে কেউ কারোর কথা শোনার সময় পর্যন্ত নেই ।
ছুটছে তো ছুটছে কারো হাতে ব্যাগ কারো হাতে গরু,ছাগল,মুরগী যে যা পারছে নিয়ে ছুটছে । ছেলে মেয়ে বৌ বাচ্চা সবাই ছুটছে । গ্রামের কেউ আর ছুটতে বাকি নেই । আরে এতো রবিন পাগল টিয়া পাখির খাঁচা নিয়ে ছুটছে । সবাই ঠিকই বলে “টিয়া পাগলা” টিয়া পাখী ছাড়া ও আর কিছুই বোঝে না ।
ঐ তো বিপিন হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে । —— কি হলো বাবা বিপিন ? মা এখন কিছু বলার সময় নেই সব কিছু গোছ গাছ করে নাও । এই দেশ ছেড়ে পালাতে হবে । সে কি বাবা এই বুড়ো বয়সে কোথায় যাবো ? কেন হিন্দুস্থান। এই দেশ আর আমাদের নেই এটা পূর্ব পাকিস্থান হয়ে গেছে । মোড়ল মহাশয়ের আদেশ “যত শীঘ্র সম্ভব গ্রামের সবাইকে হিন্দুস্থানে যেতে হবে”। কিন্তু বাবা আমি যাবো কি করে? কেনো সবাই যে ভাবে যাচ্ছে হেঁটে হেঁটে । মা,যানবাহন বলতে পালকি আমরা কোথায় পাবো। ও সব তো জমিদারদের জন্য। তা ছাড়া আমাদের অতো সামর্থ আছে নাকি !
আচ্ছা বাবা সংসারের জিনিসপত্রের কি হবে ?—- মা তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও ! তোমার ধবলির গলা থেকে চিরতরের মত দড়ি খুলে দিলাম বাচ্চাকে (বাছুর) নিয়ে ধবলি স্বাধীন ভাবে বাঁচবে। ওকে হিন্দুস্থানে নেবার ক্ষমতা আমার নেই । মা,– তাড়াতাড়ি মুরগির খাঁচার দরজাটা খুলে সবাইকে মুক্ত করে দাও। সব ছাগলের গলা থেকে দড়িগুলো আমি খুলে দিচ্ছি। হে আমার প্রিয় জীব জড়ো সবাই ভালো থেকো। আমি আর মা চল্লাম হিন্দুস্থান।
চলো মা ———আচ্ছা চল বাবা —– রাস্তা দিয়ে হাঁটার জো নেই কাতারে কাতারে লোকজন হেঁটে চলেছে গন্তব্য একটাই হিন্দুস্থান । সবার হাতে কিছু না কিছু আছে । রিম ঝিম করে বৃষ্টি তার উপর কাঁচা রাস্তায় এক হাঁটু কাঁদা । মা ভালো হাঁটতে পারে না প্রায় সবার পেছনে আমরা।
হঠাৎ মা চেঁচিয়ে বললো খোকা ঐ দেখ মনে হচ্ছে রবিনের টিয়া পাখী ফেলে দিয়ে চলে গেছে বেচারী খাঁচার মধ্যে ছট্ ফট করছে ওকে ছেড়ে দে। দরজাটা খুলে দিতেই ফুরুত করে উড়ে পালালো। মনে হলো ও যেন স্বাধীনতা পেয়ে গেছে। খোলা আকাশে প্রাণ ভরে উড়তে লাগলো।
হালদার পাড়ায় ঢুকতেই কান্নার শব্দ। মা কান্নার শব্দ অনুসরণ করে একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন আমিও পিছনে পিছনে ঢুকলাম । একি রে বাবা এতো তপন হালদারের মা। বিছানায় শুয়েই থাকে বাঁ দিকটা সম্পূর্ণ পড়ে গেছে। পাশেই হাতের কাছে জল,মুড়ি কিছু ফল রাখা আছে । বুঝতে অসুবিধা হলো না সবাই ওনাকে ফেলে রেখে চলে গেছে । মা কাঁদতে কাঁদতে ওনার কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন । কিছু একটা বলতে চাইছে বলতে পারছে না। মুখটা তো বেঁকে গেছে । কোনো রকমে মাকে ধরে নিয়ে ওখান থেকে আবার হাঁটা শুরু করলাম ।
যত এগিয়ে চলছি ততই দেখছি রাস্তার দুধারে সব সাংসারিক জিনিসপত্র পরে আছে । কারোর ব্যাগ,বাসন পত্র,আরো কত কি ! রাত হয়ে এসেছে মা আর চলতে পারছে না । সামনেই একটা খোলা মাঠ সবাই ওখানে বিশ্রাম নিচ্ছে । আমরাও ওখানে ভিড়ে গেলাম কিছু চেনা,কিছু অচেনা মুখের ভিড়ে বিশ্রাম নিতে শুরু করলাম।
ভোর হতে না হতেই মাঠ প্রায় ফাঁকা যে যার মত উঠে চলে গেছে। মাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। মায়ের পা দুটো ফুলতে শুরু করেছে মা আর হাঁটতে পারছে না মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে মায়ের কষ্ট হচ্ছে। কোনো মতে হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা হয়ে এলো সামনে পিছনে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।
সামনে একটি বটবৃক্ষের গাছের তলায় আমরা আশ্রয় নিলাম রাত কাটাবার জন্য সঙ্গী সাথী বলতে ভোলা কুকুরটা এখনো আমাদের সাথে আছে। মা যে ওকে ভীষণ ভালোবাসে । ভোর হতেই মাকে উঠিয়ে দিলাম। একি মা তোমার গায়ে তো জ্বর। পা দুটো প্রচণ্ড ফুলে গেছে।
বাবা আমি আর যেতে পারবো না আমাকে রেখে তুই চলে যা। আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে কোনো এক 15 August তোর ঘরে ছেলে রূপে জন্ম নেবো তুই যা চলে যা। তা হয় না মা। তোমাকে ছেড়ে কি করে যাই! দুই এক জন লোক পাশ দিয়ে যাচ্ছে না দেখার ভান করে। সাহায্য চাইলেই মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে। রাস্তার পাশের খানা খন্দের জল আর জঙ্গলের ফল মূল দিয়ে দুই তিন দিন চললো।
এক দিন ভোরে মার কপালে হাত দিয়ে দেখি,কপাল বরফ হয়ে গেছে। হাত পা শক্ত নাড়ানো যাচ্ছে না। সত্যি মা আমাকে ছেড়ে হিন্দুস্থান চলে গেলো। মাকে টেনে নাড়াতে না পেরে কিছু ডাল পালা দিয়ে ঢেকে দিলাম। আর ভোলাকে বললাম চল ভোলা আমরা যাই । আমি হাঁটা শুরু করলাম ভোলা আমার পিছনে পিছনে হাঁটা শুরু করলো। কিছু দূর আসার পর ভোলা এক দৌড়ে মার কাছে চলে গেলো। অনেক ডাকলাম ও শুধু তাকিয়ে রইল এলো না।
সন্ধ্যা হবো হবো একটি গ্রামে এসে পড়লাম সবাই অচেনা । জিঞ্জাসা করলাম এটা কোথায় ? এক জন বললো এটা ভারতবর্ষ মানে হিন্দুস্থান। স্বাধীন ভারত বুঝলে ভাই। মনটা আমার ব্যাথায় ভরে গেলো।
অনেক দিন পর আবার পূর্ব পাকিস্থানে গিয়ে মার দেহাবশেষ খোঁজ করে ছিলাম কিছুই পাইনি।খুঁজতে খুঁজতে একটি মানুষের মাথার খুলি আর একটি কুকুরের মাথার খুলি পেয়ে ছিলাম। মা আর ভাই মনে করে নিয়ে এসে সৎকার করেছি।
খুবই স্পষ্ট মনে আছে বাবার কাঁধে চড়ে ইস্কুলে যেতাম । পথে যেতে যেতে কত লোকে কত কথা বলতো বাবাকে । সব আর মনে নেই শুধু মনে আছে ওরা বলতো ওই লম্বু পাগল … ওই লম্বু পাগল … বলেই দৌড়ে পালিয়ে যেতো । মাঝে মধ্যে ঢিলও ছুঁড়তো । বাবা অবশ্য কিছুই বলতো না । কিন্তু ওদের এই ব্যবহারে আমার খুব কষ্ট হতো । ইস্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাবা আমার দু গালে চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত । কিছুদিন পর বাবা হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল । বাবার উপস্থিতি আর কোন দিন দেখতে পাইনি । মাকে অনেক বার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করেছি । কিন্তু তেমন কোন সদুত্তর পাইনি । মা শুধু কান্না করতেন আর বলতেন বাবা দেশান্তরী হয়ে গেছেন । বড় হবার পর বাবার স্মৃতি প্রায় ভুলেই গেছি বলা চলে ।
রেলে চাকরি পাবার পর অজপাড়াগাঁয়ের গ্রাম ছেড়ে চলে যেত হলো নাগপুর ষ্টেশনে । ওখানেই যে প্রথম পোষ্টিং । বেশ কিছুদিন পরে জানতে পারলাম দুলালদা রেলে চাকরি করে না । দিনরাত প্লাটফর্মেই থাকে । আর রেলের বড় বাবুদের ফাইফরমাশ খাটে । দুলালদা দেখতে বেশ লম্বা । মাথা ভরা ঝাঁকড়া সাদা চুল । বয়স মনে হয় ৬৫/৭০ হবে । যে কোন কাজ বললেই ওনার না নেই । রেলের কাজ এত সুন্দর করেন মনেই হয়না যে উনি রেলর কর্মীই নন ।
ভ্রমণ করা আমার খুবই ভালো লাগে । মাঝে মধ্যে এক দুদিন ছুটি পেলে আশেপাশের ছোট ছোট জায়গাগুলি দেখতে বেরিয়ে পড়ি দুলালদা কে সঙ্গে নিয়ে । দুলালদাও আমার সঙ্গে বেশ মিশে গেছে । কবে থেকে যে দুলালদা আমার রেল কোয়াটারে থাকতে শুরু করেছেন মনেই করতে পারছিনা না । অবশ্য রান্নার কাজটা দুলালদা দক্ষ হাতে করে আমাকে রান্না ঘরের ধারে ঘেষতেই দেন না ।
এক বার বাড়ি থেকে খবর এলো বোনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । দুলালদাকে অনেক করে বললাম কিছুতেই আমার সঙ্গে যেতে রাজি না হওয়ায় অগত্যা আমি একা চলে গেলাম । বোনের বিয়ে দিয়ে । ফাঁকা ঘরে মাকে কি করে রেখে আসি । তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলাম নাগপুরে । ষ্টেশনে নামতেই বড় বাবু বলল বিশ্বাস ভয় নেই অমিতাভ রান্না বান্না করে রেখেছে ।
মা জিজ্ঞাসা করলেন অমিতাভ কে ? আমি বললাম আমার ঘরে একজন বয়স্ক লোক থাকেন উনার আসল নাম কেউ জানে না । আমি দুলালদা বলে ডাকি । বড় বাবু অমিতাভ বলে ডাকে । আবার কেউ কেউ লম্বু বলেও ডাকে । উনি কিন্তু সবার ডাকেই সাড়া দেন । কথা বলতে বলতে মা আর আমি রেল কোয়াটারে পৌঁছে গেলাম । কলিং বেল টিপতেই দুলালদা বেরিয়ে এল । মা উনাকে দেখে চমেক উঠল । মুহূর্তের মধ্যে মা কেঁদে ফেলল আর বলল খোকা এই তোর বাবা । মুহূর্তের জন্য আমি যেন হারিয়ে গেলাম আর আমার দু চোখ দিয়ে যেন পুষ্প বৃষ্টি ঝরতে লাগলো ।