• প্রতিবেদন

    প্রতিবেদন- নবীন রূপে সাহিত্য

    নবীন রূপে সাহিত্য
    – বিশ্বদীপ মুখার্জী

    পরিবর্তন সৃষ্টির নিয়ম। প্রায় প্রতিদিনই আমরা দেখতে পাচ্ছি কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটে যেতে। সময়ের সাথে মানিয়ে চলতে গেলে আমাদের এই পরিবর্তনকে স্বীকার করে নিতে হয়। চারিদিকে যেন পরিবর্তনের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এই বন্যা থেকে ছাড় পায়নি সাহিত্য জগতও। বইয়ের পাতায় ছাপা অক্ষর থেকে এন্ড্রয়েড ফোনের স্ক্রিনের লম্বা যাত্রা দেখেছে সাহিত্য। যদি এটা বলা হয় যে সাহিত্য নিজের সীমা বিস্তার করেছে, তাহলে কি খুব ভুল বলা হবে? শুধুমাত্র বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি সাহিত্য। আজ ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সাহিত্য এখন প্রায় ঘরে ঘরে অবস্থান করছে। নিজেকে পৌঁছে দিতে পেরেছে নিজের প্রিয়জনেদের কাছে, সাহিত্য প্রেমীদের কাছে। এই সীমাহীন সাহিত্যই তো আমরা চাই, যেখানে থাকবে না কোনও বাধা। এখনকার দিনে হাতে মোবাইল থাকলেই নিজের ইচ্ছের মত ডুবে যেতে পারা যায় সাহিত্যের বিশাল সাগরে। অনলাইন সাহিত্য এখন নিজের আকার বৃদ্ধি করছে। মুদ্রণের পাশাপাশি সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনলাইনের ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যায় না। সত্যি বলতে গেলে আজকের দিনে অনেক উঠতি কবি ও লেখকের স্বপ্নপূরণ করেছে অনলাইন সাহিত্য। কী করে? সেটারই বিস্তারিত চর্চা আমরা এবার করবো।
    সাহিত্যের বহু পুরনো রূপ হল মুদ্রণ আকার। কোনো পাঠকের দৃষ্টিকোণে হাতে বই নিয়ে পড়ার মজাই আলাদা। শোকেশে সাজানো থাকবে বড় বড় লেখকের বই। এই বই গুলো শুধু পড়ার কাজে আসে না, বরং বাড়ির সৌন্দর্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও এগুলোর অবদান অনেক। অনেককেই বলতে শুনেছি – ‘বই সবসময় প্রিন্টেড হবে। মোবাইলে বই আবার কোনো বই নাকি।’ বইয়ের মূল্য এখনও কমেনি। তাই তো প্রতি বছর বইমেলায় লাখ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়। যেকোনো লেখকের স্বপ্ন থাকে নিজের লেখাকে মুদ্রণ আকারে দেখার। সেই স্বপ্নপূরণের জন্য তারা অনেক কিছুই করতে রাজি। অনেক প্রকাশনী লেখকের মনের এই ইচ্ছেকে নিজের পকেট গরম করার সুগম পথ বানিয়ে নিয়েছে। এমন অনেক প্রকাশনীও আছে যারা লেখকের কথা চিন্তা করে, কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম বলা যেতে পারে। ‘আমার লেখা গল্প কিম্বা কবিতা অমুক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।’ এই কথাটা নিজের প্রিয়জনেদের বলার জন্য বহু লেখককে নিজের পকেট থেকে হয়তো দুশো বা তিনশো টাকাও খরচ করতে হয়। এটা বলা যেতে পারে, এ সবের মাঝে লেখকদের অনেকটাই স্বস্তি দিয়েছে অবলাইন সাহিত্য। অনলাইনই হলেও, তবুও কোনো পত্রিকাতে লেখকের লেখা তো প্রকাশিত হয়, যেটা লেখক গর্ব করে নিজের প্রিয়জনেদের দেখাতে পারে। দ্রুত গতিতে নিজের শাখা প্রশাখা বিস্তার করা অনলাইন সাহিত্য এখন লেখক ও পাঠকের মাঝে চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু উঠতি লেখক বললে ভুল বলা হবে, অনেক নামকরা লেখকও আছেন যারা নিয়মিত ভাবে অনলাইন সাহিত্যে নিজের লেখা দিয়ে অনলাইন সাহিত্যকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন।
    আজ ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের সুবাদে আমরা অনেক অজানা লেখক ও কবিদের খুঁজে পাই। তাদের লেখা পড়তেও ভালো লাগে। তাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনলাইন সাহিত্যের অবদানকে কোনো দিনই অস্বীকার করা যায় না। এটা ঠিকই যে, সাহিত্যের পুরাতন এবং আসল রূপ হল মুদ্রণ আকার। অনলাইন সাহিত্য যতই নিজের সীমা বৃদ্ধি করুক না কেন, এক লেখকের মন থেকে মুদ্রণ আকারে নিজের লেখা দেখার স্বপ্নকে কোনো দিনই মুছে দিতে পারবে না। কিন্তু এক নবীন লেখকের সাহিত্য জগতে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে অনলাইনের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- ত্রাণ

    ত্রাণ
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

    লাইনটা বেশ লম্বা। কতক্ষণে শেষ হবে তার নেই ঠিক। আকাশের রোদটাও বেশ কড়া হয়েছে ইতিমধ্যে। গত সপ্তাহের এক বিশাল ঝড়ের তাণ্ডবে নিজের প্রায় সর্বস্ব খুইয়ে দেওয়া কিছু লোকেদের ত্রাণ সামগ্রী বিলি করতে এখানে আমার আসা। কিছু বন্ধুদের সাথে এসেছি। সাহায্যের জন্য সাথে আছে লোকাল পুলিশ। আমি প্রায় দেখছি লাইনের পিছন দিকে দাঁড়ানো এক গরীব বৃদ্ধ লোক সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। তাকে বলা হচ্ছে – ‘আপনি লাইনে দাঁড়ান। আপনাকেও দেওয়া হবে। আমরা এখানে আপনাদের সাহায্য করতেই এসেছি। কেউ বাদ যাবে না।’
    কথা শুনে সেই বৃদ্ধ লোকটি আবার পিছনে চলে যায়। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই আবার সে এগিয়ে আসে। প্রায় দু’ তিনবার এমন করার পর আমার এক বন্ধু একটু চড়া কন্ঠস্বরেই তাকে বলল – ‘আপনার অসুবিধেটা কী? আপনাকে বারবার বলছি আপনি কি বুঝতে পারছেন না? যদি আবার এমন করেন তাহলে কিন্তু আপনাকে কিছু দেওয়া হবে না।’
    সেই বৃদ্ধ লোকটি শান্ত কন্ঠে বলল – ‘বাবা, আমি কিছু নিতে আসেনি, দিতে এসেছি।’
    একথা বলে সে নিজের কোমরের কাছের ভাঁজ করা ধুতি থেকে বেশ কিছু কয়েন বের করে সামনের টেবিলে রাখলো।
    ‘গুনে নিও বাবা। পুরো দেড়শো টাকা হবে। এবার চলি। তোমরা ভালো থেকো। ঈশ্বর তোমাদের আশীর্বাদ দিক।’
    লোকটি এই বলে চলে গেল। আমরা অবাক হয়ে সে দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঈশ্বরদর্শন কি এটাকেই বলে?

    *সমাপ্ত।*

  • গল্প

    গল্প- পর্ক বেঞ্জামিন

    পর্ক বেঞ্জামিন
    – বিশ্বদীপ মুখার্জী

    এমন বহু মানুষ আছেন যারা নিজের মনের কোনও না কোনও সুপ্ত ইচ্ছেকে হৃদয়ের এক কোণায় তালাবন্দি করে চিরকালের মত ইহলোক ত্যাগ করেছেন। কেউ সেই ইচ্ছেকে পূরণ করার চেষ্টা করেছেন, আবার কেউ সেই সুযোগটুকুও পাননি। এমন অগুনতি লোকেদের ভিড়ে নিজের নাম লেখাতে চাইতো না প্রহ্লাদ বিশ্বাস, যাকে আমরা ভালোবেসে পোলু বলে ডেকে থাকি। এখানে আমাদের আর পোলুর বন্ধুত্বে গল্প বলে সময় নষ্ট না করে সোজাসুজি তার মনের সুপ্ত ইচ্ছের বিষয় বলাই ভালো। আমার চাকরি পাওয়ার পর প্ৰথম ছুটি। বন্ধুদের সাথে প্ল্যান করা হলো কোথাও ঘুরতে যাওয়ার। অবশেষে জায়গা ঠিক হলো দার্জিলিং। আমরা মোট ছ’জন ছিলাম, তাদের মধ্যে একজন ছিল প্রহ্লাদ বিশ্বাস ওরফে পোলু। পোলু আমার থেকে বয়সে এক- দেড় বছরের ছোটই হবে। স্বভাবে বেশ শান্ত। কথা বেশি বলে না। বাবা মায়ের একটিমাত্র সন্তান সে। পোলুও সরকারি চাকরি খুঁজছে। পড়াশোনায় চিরকালই ভালো ছিলো সে। আমার বিশ্বাস তাকে সরকারি চাকরি পেতে বেশি বেগ পেতে হবে না।

    শিয়ালদা থেকে দার্জিলিং মেলে করে জলপাইগুড়ি স্টেশন, সেখান থেকে দার্জিলিং। আমাদের দার্জিলিং পৌঁছতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। হোটেল আগে থেকেই বুক করা ছিল। দার্জিলিং ম্যালের কাছে একটা হোটেল। ডাবল বেডের তিনটে রুম নেওয়া ছিল আমাদের। একটা রুমে আমি আর সুজল, দ্বিতীয় রুমে কল্যাণ আর পোলু এবং তৃতীয় রুমে অভিজিৎ আর শুভ্র। লাঞ্চ সেরে আমরা অল্প বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নিলাম। প্ল্যান ছিল সন্ধ্যের দিকে আশেপাশের জায়গা গুলো ঘুরতে যাবো। লাঞ্চের পর বিছানায় শরীরটা এলাতেই কেমন যেন দু’ চোখ আপনি বন্ধ হয়ে গেল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই জানি না। ঘুম ভাঙলো দরজা ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজে। আমি আর সুজল দুজনেই ধড়ফড় করে উঠলাম। বুঝতে পারলাম যে সুজলও বেশ নিদ্রার দেশেই ছিল। দরজার ওপার থেকে কল্যাণের গলার আওয়াজ পাচ্ছি।
    ‘দীপ দরজা খোল।’
    ‘কী হলো রে আবার?’ আমি বিছানা থেকে উঠে দরজা খুললাম। দেখি সামনে কল্যাণের সাথে অভিজিৎ এবং শুভ্র দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে।
    ‘কী হয়েছে?’ আমি আবার প্রশ্ন করলাম।
    একটু বিরতি নিয়ে কল্যাণ বলতে শুরু করলো – ‘লাঞ্চ করার পর আমার ঘুম পাচ্ছিল। হয়তো ট্রেনের জার্নি করার ফলে। এমনিতে দুপুরে ঘুমোবার আমার অভ্যাস নেই। কিন্তু এই ঘাটের মরা ঘুমটা আজকেই আসার ছিল।’
    ‘উফফ! এত ভূমিকা দেওয়ার কী আছে? ভূমিকা না দিয়ে কি কোনও কথা বলতে পারিস না? পরীক্ষার খাতায় যদি এত সুন্দর ভূমিকা লিখতে পারতিস তাহলে ভালো নাম্বার পেয়ে পাস করতিস। এবার ভূমিকা না দিয়ে ডাইরেক্ট সাবজেক্টে আয়।’
    কথাটা বেশ বিরক্ত হয়েই আমি বললাম। কল্যাণের এটা চিরকালের অভ্যাস। বিনা ভূমিকা দিয়ে কিছু বলা তার পক্ষে সম্ভব না।
    এবার অভিজিৎ বলল – ‘পোলুকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে হারিয়ে গেছে।’
    ‘হোয়াট! হারিয়ে গেছে? সে কি কচি বাচ্চা নাকি যে হারিয়ে যাবে?’ আমি বললাম।
    ‘সেটা তো আমিও বলছি। এই ঘাটের মরা ঘুম যদি না আসতো তাহলে হয়তো সে আমাকে বলেই যেত যে কোথায় যাচ্ছে সে। আমাকে মরার মত ঘুমোতে দেখে সে হয়তো আমায় কিছু বলেনি। ঘুম ভাঙার পর দেখি দরজা খোলা। ভাবলাম তোদের রুমে হবে। কিন্তু সে তো এখন কোথাও নেই। তার মানে এটা মেনে নেওয়া যেতেই পারে যে পোলু হারিয়ে গেছে।’
    কল্যাণের এই ব্যাখ্যাতে অল্প হলেও মাথাটা গরম হলো আমার। যথা সম্ভব মাথা ঠান্ডা করে বললাম- ‘আশেপাশে কোথাও ঘুরতে গেছে হয়তো। চলে আসবে এক্ষুনি।’
    ‘তুই বুঝবি না দীপ আমার টেনশন। রওনা হওয়ার আগে পোলুর মা আমায় বারবার বলে দিয়েছিল যে ওর বিশেষ খেয়াল রাখতে। আজকাল বড্ড অন্যমনস্ক থাকে। এবার আমি তার মাকে কী জবাব দেবো?’ কল্যাণের গলা শুনে মনে হলো সে বেশ টেনশনে আছে।
    ‘ব্যাপারটা এত হাল্কা ভাবে নিলে চলবে না দীপদা।’ আমার পিছন থেকে সুজল বললো- ‘কল্যাণদা বলছে যে পোলু নাকি আজকাল অন্যমনস্ক থাকে। তার মানে হলো সে এই জগতে কম এবং অন্য জগতে বেশি থাকে আজকাল। ক্রনিক সাইক্রিয়াটিক ডিসিস। কল্যাণদা, তুমি আগে বললে না কেন? আমরা আগে থেকে সাবধান হতে পারতাম।’
    ‘তোদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আজেবাজে কথা বলছিস কেন?’ আমার কন্ঠস্বর একটু উচ্চ হলো।
    ‘একটু আশেপাশে ভালো করে দেখে নিলে হয় না?’ একটা প্রস্তাব দিলো সুজল।
    ‘হোটেলের চারিপাশে দেখে নিয়েছি। কোত্থাও নেই সে। লাস্ট এই ঘরে এলাম।’ শুভ্র বললো।
    ‘আরও একবার দেখতে ক্ষতি কী? চলো না, গিয়ে দেখাই যাক একবার।’
    সুজলের কথায় আমরা আরও একবার তল্লাশি শুরু করলাম। হোটেলের চত্বর ঘুরে দেখে নেওয়া হলো। হোটেলের চারিপাশে সুন্দর বাগান। সুজল এবং শুভ্র বাগানের দিকে এগলো।
    ‘বাগানে দেখে কী করবি? পোলু কি ওখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে নাকি অকারণ?’ প্রায় চিৎকার করেই আমি বললাম।
    সুজলের গোয়েন্দা গল্প পড়ার খুব শখ। কোথাও রহস্যের গন্ধ পেলেই তার মস্তিষ্কে ডিটেকটিভ বুদ্ধির আলোটা জ্বলে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। বাগানে বেশ কিছু সুন্দর ডিজাইনের আলো জ্বলে গেল। সুজল ও শুভ্র নিজের নিজের মোবাইলের টর্চ অন করে এগিয়ে গেল বাগানের দিকে। গাছগাছালির ভিতর টর্চ নিয়ে তারা এমন করে খুঁজতে লাগলো যেন পোলু কোনও জলজ্যান্ত মানুষ না, সে যেন কোনও ছোট্ট বস্তুতে রূপান্তরিত হয়েছে যেটা বাগানের কোনও এক কোণায় পড়ে আছে।
    আমি আর ওদিকে তাকালাম না। কল্যাণ, অভিজিৎকে সাথে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলাম। কিছুটা হাঁটার পরেই আবছা আলোতে বেশ খুশি মনেই পোলুকে আমাদের দিকে আসতে দেখলাম। আমরাও এগিয়ে গেলাম তার দিকে।
    ‘কী রে! কোথায় চলে গিয়েছিলিস তুই?’ কল্যাণের কন্ঠে বেশ উদ্বিগ্নতার ছাপ।
    ‘একটা জিনিস খুঁজতে গিয়েছিলাম ভাই।’ বললো পোলু।
    ‘কী জিনিস?’
    ‘জিনিসটা আসলে একটা খাবার। ওটা নাকি এখানকার একটা রেস্টুরেন্টে খুব ভালো বানায়। সেটাই খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। একদিন নিয়ে যাবো তোদের সবাইকে।’
    ‘ডিশটার নাম কী?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
    ‘পর্ক বেঞ্জামিন। বেঞ্জামিন নামের কোনও এক ইংরেজ এখানে থাকতেন। তিনিই নাকি এই ডিশটা প্রথম বানিয়ে খাওয়ান। কোলকাতায় থাকতে পর্ক বেঞ্জামিন একজনের হাতে খেয়েছিলাম, কিন্তু খুব একটা ভালো লাগেনি। শুনেছিলাম দার্জিলিংয়ের এক রেস্তরাঁতে পর্ক বেঞ্জামিন নাকি খুব ভালো বানানো হয়। সেটাই খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম।’
    ‘ধুর গাধা। খোঁজ নিতে গিয়েছিলিস ভালো কথা। কিন্তু বলে যাবি তো। এটুকু আক্কেল নেই?’ বেশ বিরক্তির স্বরে বলল কল্যাণ।
    ‘ঘুমিয়ে থাকা মানুষকে ঘুম থেকে ওঠাতে নেই।’
    আমরা হোটেলে ফেরত এলাম। মুখ্য দরজার সামনে মুখ চুন করে দাঁড়িয়েছিল সুজল আর শুভ্র। পোলুকে দেখতে পেয়েই তারা এগিয়ে এলো তার দিকে। আমি সুজলের পিঠে এক চাপড় মেরে বললাম- ‘কী গোয়েন্দা? খুঁজে পেলে অপরাধীকে?’

    আশেপাশের চারিদিক ঘুরেফিরে আমরা হোটেলে ফিরলাম রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ। হোটেলে ফিরেই শুভ্র বলল – ‘কিছু খাওয়া হলো না যে। খিদে তো পেয়েছে।’
    আমরা সবাই একে অপরের দিকে তাকালাম। ঠিকই তো। আমরা কি তাহলে এবার খেতেও ভুলে যাচ্ছি? এহেন অবস্থায় কী করা যায় সেটা চিন্তা করা হলো। হোটেলে এত রাতে আর খাবার পাবো না, সুতরাং বাইরে থেকেই কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। হোটেলের পাশেই একটা ভালো রেস্তোরাঁ আছে সেটা আমি আগেই দেখেছি। আজকের ডিনারের ব্যবস্থা না হয় সেখানেই করা যাক। তবে সেখানে গিয়ে ডিনার করতে কেউ রাজি হলো না। বলতে গেলে প্রায় প্রত্যেকেই ক্লান্ত। আমি আর কল্যাণ গিয়ে সেখান থেকে ডিনার প্যাক করে নিয়ে এলাম।
    ডিনারের অর্ধেকটাও শেষ হয়নি, কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। ক্ষণেকের জন্য মনে হলো যেন আমরা হোটেলে না, কোনও দোলনায় দুলছি। এই অদ্ভুত অনুভূতি কি শুধু আমার হলো? আমি খাবার থেকে চোখ তুলে সবার দিকে তাকালাম। দেখলাম প্রত্যেকেই আমার দিকে বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
    ‘এটা কী হলো?’ প্রশ্ন করলো সুজল।
    তার প্রশ্ন করার সাথে সাথেই মাটিটা যেন আবার দুলে গেল। বেশ হইহল্লার আওয়াজ পাচ্ছিলাম বাইরে থেকে। বুঝতে দেরি হলো না যে আমরা ভূমিকম্পের সম্মুখীন হয়েছি। ভূমিকম্পটা বেশ ভালোই জোরে এসেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। ডিনার অর্ধেক ফেলে আমরা ছুটলাম বাইরের দিকে। আমাদের রুমগুলো ছিল দু’তলায়। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে গিয়ে দেখি ইতিমধ্যেই সিঁড়িতে লোকেদের প্রাচুর্য। কোনও রকমে হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা রাস্তায় এলাম। রাস্তায় লোকে লোকারণ্য। বেশ কিছু সেকেন্ড ভালো রকম ধাক্কা দেওয়ার পর ভূমির কম্পনটা এখন যেন একটু স্থির হয়েছে। আশেপাশের বেশ কিছু হোটেল, বাড়ি যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য। আমাদের হোটেলের ক্ষতির পরিমাণটা বোঝার উপায় তখন ছিল না আমাদের। এর মধ্যেই কল্যাণকে বলতে শুনলাম – ‘হে ভগবান! আমার দামি ক্যামেরাটার যেন কিছু না হয়।’
    ‘কী উন্মাদের মত বকছিস? নিজে বাঁচবো কি না তার ঠিক নেই, তোর ক্যামেরার চিন্তা।’ কল্যাণের কথা শুনে শুভ্র বলল।
    হঠাৎ পোলুর গলার আওয়াজ পেলাম। বিড়বিড় করে কিছু যেন বলছে সে। আমি ভালো করে কান লাগিয়ে শুনলাম।
    ‘এবার মনে হয় মরেই যাবো। পর্ক বেঞ্জামিন আর খাওয়া হলো না। না, ওটা আমায় খেতেই হবে। ওটা না খেয়ে আমি মরতে চাই না।’
    পোলুর কথাটা শুনেও ইগনোর করে যাওয়াটা হয়তো আমার ভুল ছিল, কারণ খানিক পরেই আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। রাস্তায় লোকেদের ভালো ভিড়। এই ভিড়ে তাকে খুঁজবো কোথায়?
    ‘পোলুটা আবার কোথায় মরে গেলে। ভালো লাগে না সত্যি। কেন যে ও মাঝে মাঝে গায়েব হয়ে যায়?’ কথাগুলো বেশ বিরক্তির সুরেই কল্যাণ বলল।
    ‘পোলু নিশ্চয়ই পর্ক বেঞ্জামিন খেতে গেছে। বিড়বিড় করে বলছিল শুনলাম।’ বললাম আমি।
    ‘তুই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি। এই অবস্থায় ও পর্ক বেঞ্জামিন খেতে যাবে?’ আমার উপর প্রায় ঝেঁঝিয়ে উঠলো অভিজিৎ।
    আমিও মাথা গরম করে চিৎকার করে ফেললাম – ‘তাহলে খোঁজ পাগলের মত এদিক ওদিক। পেয়ে গেলে আমাকে জানিয়ে দিস।’
    ‘ধুর বাবা! তোরা ঝগড়া করছিস কেন? একে তো এমন বিপত্তি আমাদের সামনে, তার উপর পোলু নেই। টেনশনের অভাব নেই। তার উপর তোরা ঝগড়া করিস না দয়া করে।’ আমাকে আর অভিজিৎকে শান্ত করার জন্য কল্যাণ বলল।
    ইতিমধ্যেই বেজে উঠলো কল্যাণের মোবাইল। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে তার চোখ দু’টো বড় বড় হয়ে গেল।
    ‘প….পোলুর ম….ম….মা ফোন করেছে। মরে গেলাম রে। কী বলি এবার?’ দু – চারটে ঢোঁক গেলার পর কল্যাণ বলল।
    ‘ফোনটা তোল। তার মাকে বল যে পোলু এখন বাথরুমে। একটু পর ফোন করতে না তো নিজের ছেলের নাম্বারে কল করতে।’ অভিজিৎ বললো।
    ‘নিশ্চই পোলুর নাম্বার লাগছে না। তবেই তো আমার নাম্বারে কল করেছে। এখন যদি বলে দিই একটু পরে কল করতে, তাহলে একটু পরে কল করলে কী বলবো তাকে? এটাই যে তার ছেলে হারিয়ে গেছে?’
    ‘উফফ! এতো ভারী সমস্যা। ফোন কাট, চল আগে পোলুকে খুঁজে বের করি।’ অভিজিৎ বললো।
    তার কথার মত ফোন ডিসকানেক্ট করে দিলো কল্যাণ।
    ‘কিন্তু তাকে খুঁজবো কোথায়?’ কল্যাণ জিজ্ঞাসা করলো।
    ‘আরে দীপদাই তো বলল যে সে হয়তো পর্ক খেতে গেছে। কোনও রেস্তরাঁতে গিয়ে খুঁজলেই হলো।’ বললো সুজল।
    ‘শুধু পর্ক নয় ভাই, ওটা পর্ক বেঞ্জামিন। এখন খুঁজতে হবে এখানে কোন হোটেলে পর্ক বেঞ্জামিন নামের ডিশ পাওয়া যায়। পোলু যদি হোটেলের নামটা বলে রাখতো তাহলে চট করে খুঁজে নেওয়া যেত তাকে।’ হতাশার স্বরে শুভ্র বলল।
    ‘আরে প্রবলেম কী? কোনও লোকাল লোককে জিজ্ঞাসা করলেই সে বলে দেবে।’ মন্তব্য করলো সুজল।
    ‘ধরে মারবে লোকেরা। ভূমিকম্পে প্রত্যেকে নিজের প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, এখন তোকে হোটেলের নাম বলতে বয়ে গেছে তাদের।’ বললো অভিজিৎ।
    খানিক এদিক ওদিক খোঁজার পর যখন কোনও লাভ হলো না, তখন অবশেষে লোকাল লোককে জিজ্ঞাসা করতেই হলো। কোনও অচেনা লোককে জিজ্ঞাসা করার থেকে ভালো নিজের হোটেলের কোনও কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করা। আমি তাই করলাম। কর্মচারী রেস্তোরাঁর নাম বলল। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম – ‘এখান থেকে কত দূর?’
    ‘খুব বেশি দূর না সাহেব। হোটেলের বাঁ দিকে দিয়ে সোজা চলে যান, সামনে একটা মোড় পাবেন। সেখান থেকে বাঁ দিকে ঘুরে একটু এগোলেই ডান হাতে পড়বে। চড়াই পথ তো, তাই প্রায় দশ মিনিট লাগবে যেতে।’ সে পথ বলে দিলো।
    আর কী! আমরা এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা সে দিকেই হাঁটা দিলাম। সারা রাস্তা অভিজিৎ গজগজ করতে লাগলো।
    ‘এ তো দেখছি একেবারে উন্মাদ। একে তো নিয়ে আসাই ভুল হয়েছে। একে যদি আজ রাতে খুঁজে পেয়েও যাই, তাও শিওর থাক যে এর জন্য আমাদের এই ট্রিপটা জলাঞ্জলি যাবে।’
    কল্যাণ এতক্ষণে নিজের মোবাইল সুইচ অফ করে দিয়েছে। বারবার পোলুর মায়ের কল কাটতে খারাপ লাগছিল তার। আমরা যখন সেই রেস্তরাঁতে পৌঁছলাম, দেখি পোলু বেশ মনোযোগ দিয়ে কিছু খেয়ে চলেছে। নিঃসন্দেহে সে পর্ক বেঞ্জামিন খাচ্ছে। আমাদের দিকে চোখ পড়তেই সে বললো- ‘ওহো! তোরা এসে গেলি? ওয়েটার, আরও পাঁচ প্লেট লাগিয়ে দাও। বসে পর তোরা। কিছু মনে করিস না। তোদের না বলেই চলে এলাম।’
    আমরা হাঁ হয়ে একে অপরের দিকে দেখলাম। কী বলবো কিছুই বুঝতে পারলাম না। পর্ক বেঞ্জামিনের প্রথম টুকরোটা মুখে দিতেই মনে হলো- ‘চুলোয় যাক ভূমিকম্প। এখন খাবারে মনোনিবেশ করা যাক।’

    সমাপ্ত।

  • গল্প

    গল্প- বেড নাম্বার 42

    বেড নাম্বার 42
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

    (1)

    টাকাটা নিজের প্যান্টের পকেটে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রাজু। টাকা গুণে নিয়েছিল সে, দু’ হাজার। ঘর থেকে বেরোবার আগে দরজার মুখের কাছে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো মধুলিকা নিজের শরীর এলিয়ে দিয়েছিল নরম বিছানার উপর। লাল রঙের নাইট বাল্বের অল্প আলোতে তাকে আবছা দেখা যাচ্ছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটা শুরু করলো রাজু। ভোর রাতে। খানিক পরেই অটো আর বাস চলতে শুরু করবে। এখনও ঠিক মত আলো ফোটেনি। কৃষ্ণর কাছে মেয়েকে রেখে এসেছে সে। কৃষ্ণ রাজুর বন্ধু। কৃষ্ণ এবং তার স্ত্রী রাজুর মেয়েকে রোজ রাতে নিজের কাছেই রাখে। কৃষ্ণ জানে না রোজ রাতে রাজু যায় কোথায়? বেশ কিছু দিন ধরে রাজুর সাথে আফতাবের মেলামেশাটা বেড়েছে, সেটা খেয়াল করেছিল কৃষ্ণ। বিশেষ করে রুপালির চলে যাওয়ার পর থেকেই। আফতাবের সাথে বসে বিড়ি-সিগারেট খাওয়া, মদ খাওয়া..রাজুর নিত্য কার্যকলাপ হয়ে উঠেছিল এগুলো। কৃষ্ণ বেশ কিছুবার রাজুকে বলেছে।
    ‘তোর আফতাবের সাথে মেলামেশাটা মোটেই ভালো লাগছে না আমার। এ পাড়ায় প্রায় সবাই জানে আফতাব ভালো ছেলে নয়। বিরাট বড়ো সুযোগসন্ধানী সে।’
    ‘না রে কৃষ্ণ। তুই ভুল বুঝছিস তাকে। আফতাব ভালো ছেলে। দেখিস না, রোজ রাতে আমাকে মদ খাওয়ায়। আজকের দিনে কে কাকে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে রোজ রোজ মদ খাওয়ায় বলতো? তুইও খাওয়াস না। এক দিন খাইয়ে পরের দিন বলিস টাকা নেই।’
    মদ্যপানে আসক্ত রাজুর সাথে বেশি তর্ক করা ঠিক মনে করলো না কৃষ্ণ।
    রাজুর পকেটে এখন দু’হাজার টাকা। বেশ অনেক টাকাই এই ক’দিনে সংগ্রহ করে নিয়েছে রাজু। তার এখন টাকার দরকার। কিন্তু সে কোন পথে টাকা রোজগার করছে? মাঝে মাঝেই তার মনে পড়ে রুপালির কথা। পাড়ার শেষে যে পুকুরটা আছে, সেখানেই পেয়েছিল রুপালির মৃত দেহ। তখন কতই বা বয়স হবে রাজুর মেয়ে রুমির? খুব জোর দু’ বছর। প্রায় একবছর হয়ে গেল ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার। কী দিন ছিল সেইগুলো। মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে রাজুর।

    (2)

    এক লোহার দোকানে কাজ করা রাজুর হঠাৎ করেই চাকরি চলে যায় দোকানের মালিক গত হওয়ার পর। অর্থ রোজগারের অন্য পথ খুঁজতে ব্যস্ত হলো সে। বেশ কয়েকটি দোকানে কাজ করলেও সেই কাজগুলোকে স্থায়ী করতে পারলো না রাজু। ফলে টাকা-পয়সার টানাটানি শুরু হলো সংসারে। অন্যের ঘরে কাজ করে দু’ পয়সা রোজগার করতে শুরু করলো রুপালি। ছোট্ট রুমিকে কাজের জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই কৃষ্ণদের বাড়িতেই রুমিকে রেখে যেত সে। হাজার হোক মায়ের মন..ছটফট তো করবেই।
    প্রায় দু’ তিনটে বাড়িতে রান্নার কাজ ধরলো রুপালি। কিছু দিনের মধ্যেই সংসারে আর্থিক সমস্যাটা অল্প হলেও দূর হলো।

    পুরনো কথাগুলো এখনও মনে পড়ে রাজুর। কৃষ্ণ চিরকাল তার পাশে দাঁড়িয়েছে। যদি কৃষ্ণর কথা সে সময়ে রাজু শুনতো তাহলে তাকে হয়তো অর্থ রোজগারের জন্য এ পথে এগোতে হতো না। মধুলিকার বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি ফেরার পথে এ সব কথাই চিন্তা করছিল সে। এই কিছু দিনে বেশ ভালোই টাকা রোজগার করে নিয়েছে রাজু। সব মিলিয়ে প্রায় চল্লিশ হাজারের উপর তো হবেই। তার টাকার প্রয়োজন। নিজের জন্য না, নিজের মেয়ের জন্য। ঠিক এই কথাটাই রুপালি একদিন বলেছিল রাজুকে। রাজুর কানে এখনও মাঝে মাঝে রুপালির সেই কথাটা ভেসে ওঠে।
    ‘টাকার দরকার সব সংসারেই হয় রাজু। আমাদের সংসারেও টাকার প্রয়োজন। আমরা এখন দু’টো নয়, তিনটে পেট..সেটা ভুলে যেও না। টাকাটা মেয়ের জন্য দরকার রাজু, আমার আর তোমার জন্য নয়।’
    রাজুর এখনও মনে পড়ে সেই দিনের কথাটা। রুপালি বাড়িতে ছিল না। রাজুও বেরিয়েছিল কাজের সন্ধানে। হঠাৎ রাস্তায় আফতাবের সাথে তার দেখা। কিছু এদিক ওদিকের কথার পর আফতাব তাকে বললো – ‘তোর বৌ দু’ তিনটে বাড়িতে রান্নার কাজ ধরেছে, এখন আর টাকার অভাব হবে না তোদের। আরও এক নতুন বাড়িতে শুনলাম কাজ ধরেছে তোর বৌ। লোকটা নাকি ব্যাংকের ম্যানেজার। একা থাকে নাকি। ভালোই টাকা রোজগার করে। তার যদি কৃপাদৃষ্টি তোদের উপরে থাকে তাহলে তোর আর কোনও কাজ না করলেও চলবে।’
    কথাটা শুনে রাজুর কান মাথা নিমেষে গরম হয়ে গেল।
    ‘কী বলতে চাস তুই?’ কড়া গলায় জিজ্ঞাসা করলো আফতাবকে।
    ‘যেটা তুই মনে করছিস, সেটাই বলতে চাই। তুই যদি চাস তাহলে লোকটার বাড়ির ঠিকানা তোকে দিতে পারি। সন্ধান নিয়ে দেখ। লোকটা মোটেই সুবিধের নয়। তোর বন্ধু আমি। তাই তোর ভালোর জন্যই বলছি। এদিক ওদিক কিছু হয়ে যাওয়ার আগে, রুপালিকে বল সেখানে না যেতে। পারলে এখনই তার বাড়ি গিয়ে রুপালিকে নিয়ে চলে আয়।’
    কোনও দিকে আর তাকালো না রাজু। বাড়ির পাঁচিল টপকে এক বন্ধ জানালার অল্প ফাঁক দিয়ে যা দেখলো সেটার কল্পনাও সে করতে পারেনি। নিজের দুঃখ, নিজের আক্রোশকে নিজের মনের মধ্যেই চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল সে। কথা বলতে ইচ্ছে করতো না রুপালির সাথে। তার মুখ দেখতেও ইচ্ছে করতো না রাজুর। রাজুর মধ্যে হঠাৎ এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে রুপালি একদিন তার কারণ জিজ্ঞাসা করলো। অনিচ্ছাকৃত রাজুকে বলতে হলো সে দিনের সব কথা। তখনই রুপালি বলেছিল টাকার কথাটা।
    ‘টাকার প্রয়োজন আমাদের সুখ-আহ্লাদের জন্য নয় রাজু। টাকার প্রয়োজন ছোট্ট মেয়েটির জন্য। সে নিজের ইচ্ছেতে এই পৃথিবীতে আসেনি। তাকে আমরা নিয়ে এসেছি। আজ যদি অর্থের দিক থেকে তুমি স্বাবলম্বী হতে, তাহলে আমাকে এই পথে যেতে হতো না। আমি নিজের ইচ্ছেতে এই পথে আসিনি। পরিস্থিতি আমাকে নিয়ে এসেছে।’
    প্রত্যুত্তরে রাজু বলেছিল- ‘তোমার মুখ দেখতে আমার ঘেন্না করছে রুপালি। এমন ভাবে রোজগার করে আনা টাকার থেকে নিজের মেয়েকে না খাইয়ে মেরে ফেলাটা হয়তো ভালো ছিলো।’

    (3)

    ধীরে ধীরে ফুটছে আলো। রাজু বেশ অনেক দূরই হেঁটে চলে এসেছে। পাশ দিয়ে দুয়েকটা বাস ও অটো পেরিয়ে গেছে। রাজু কি ইচ্ছাকৃত বাস কিম্বা অটোতে চড়লো না? নাকি সে তার নিজের দুনিয়াতেই নেই? নিজের মনে হেঁটে যাচ্ছে সে। বহু পুরনো কথা তার মস্তিষ্কে আসা যাওয়া করছে। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে নিজের মেয়েকেই সে সহ্য করতে পারেনি। অর্থ উপার্জনের কোনও পথ দেখা না গেলে নিজের জীবনই ব্যর্থ মনে হয়। সে সময়ে কারোর দায়িত্ব নেওয়ার মানসিকতা থাকে না। মেয়ে প্রায় সারা রাত চিৎকার করে খিদের জ্বালায়। মাঝে মাঝে সত্যিই খুব বিরক্ত লাগে রাজুর। মেয়েকে কষিয়ে দেয় দু’ তিন থাপ্পড়। মেয়ের চিৎকার দ্বিগুণ বেড়ে যায়। মাঝ রাতে কৃষ্ণর স্ত্রী এসে মেয়েকে নিয়ে চলে যায় গজগজ করতে করতে।
    এক দিন রাজু কৃষ্ণকে বলেছিল- ‘আমার তো মনে হয় রুপালি ঠিকই করতো রে। কিছু না হোক মেয়েটা দুবেলা খেতে তো পেতো।’

    ‘খেতে তুইও পারবি আর নিজের মেয়েকে ভালো করে খেতে দিতেও পারবি। একটা কথা মনে রাখ রাজু, এই দুনিয়াতে টাকার আগে কিচ্ছু নেই। টাকা থাকলে তোর কাছে সব আছে, যদি টাকা নেই তো কিছুই নেই।’ একটা বড় পেগ বানিয়ে রাজুর দিকে এগিয়ে দিয়ে আফতাব বলল।
    এক নিঃশ্বাসে সেটা গলাধঃকরণ করলো রাজু।
    ‘দেখ রাজু, তুই আমার ভালো বন্ধু তাই তোকে এসব কথা বলছি। সত্যি বলতে তোর দুঃখটা দেখা যাচ্ছে না রে। একে তো তোর কোনও চাকরি নেই তার উপর তোর বৌ তোর মেয়েকে তোর ঘাড়ের উপর ফেলে দিয়ে চলে গেল। তোকে আমি এক ভালো উপায় বলছি। ভালো টাকা কামাতে পারবি তুই।’
    কথা শেষ করে আরও একটা বড় পেগ বানিয়ে রাজুর হাতে দিলো আফতাব।
    ‘কী উপায়?’ জিজ্ঞাসা করলো রাজু। তার কন্ঠস্বর জড়িয়ে আসছে।
    ‘তোর একটা পার্মানেন্ট রোজগারের ব্যবস্থা করে দেবো আমি। তোকে শুধু একটা কাজ করতে হবে। নিজের মেয়েকে আমায় দিয়ে দে। ফ্রীতে নয়, ফ্রীতে একেবারে নয়। পনেরো হাজার টাকা দেবো তোকে। ভাব একবার, পনেরো হাজার টাকা! সাথে তোর একটা রোজগারের পথ খুলে যাবে।’
    ঘোলাটে চোখেই রাজু তাকালো আফতাবের দিকে। বললো – ‘শুওরের বাচ্চা, তুই কি ভাবছিস টাকার জন্য আমি নিজের মেয়েকে বিক্রি করে দেবো তোর হাতে?’
    ডাল সহজে গলবে না, এটা ভেবে তখনকার মত চুপ হয়ে গেল আফতাব।
    ‘একবার কোনও রকমে রাজুকে কাজে ঢুকিয়ে দেওয়া গেলে, তারপর তো রাজু আমার কথায় উঠবে আর বসবে। মেয়ের ব্যবস্থা না হয় তখনই করা যাবে।’ মনে মনে ভাবলো আফতাব।

    না, শুরুতে আফতাবের প্রস্তাব একেবারেই পছন্দ হয়নি রাজুর। কিন্তু পরে সে বাধ্য হলো, নিজের মেয়ের জন্য। তার মনে পড়লো রুপালির সেই কথাটা- ‘টাকাটা দরকার মেয়ের জন্য।’
    বেশ কিছুদিনের জ্বর ও অন্য উপসর্গ হওয়ার পর মেয়েকে নিয়ে যখন রাজু ডাক্তারের কাছে যায় তখন নানা পরীক্ষা করার পর ডাক্তার বলেন যে মেয়ের নাকি হার্টে ফুটো আছে। অপারেশন ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। মাথায় হাত পড়লো রাজুর। সরকারি হাসপাতালে তো বিনা খরচে অপারেশন হয়ে যাবে কিন্তু কোথাও না কোথাও ভয় থেকেই যায়। নিজের স্ত্রীকে হারিয়েছে রাজু, নিজের মেয়েকে হারাতে চায় না সে। বেশ কিছু লোকের মতামতের পর সে মেয়েকে ব্যাঙ্গালুরু নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু হাতে এখনও সময় আছে। অর্থের অভাবে দিন কাটানো রাজু শেষে শরণাপন্ন হয় আফতাবের।
    তিরিশের ঊর্ধ্বে বয়স হলেও রাজুকে দেখে কুড়ি বাইশ বছরের থেকে বেশি মনে হয় না। চেহারায় অদ্ভুত এক কচি কচি ভাব। তাই কাজটা পেতে বেশি অসুবিধে হলো না তার। মানুষের ভাগ্যের মালিক যখন অর্থ তখন আর ন্যায় অন্যায় চিন্তা করে লাভ কী? এই মানসিকতা যদি সে আগে দেখাতো তাহলে হয়তো রুপালি আজ তার পাশেই থাকতো। রুপালি এক সময় যে পথে এগিয়েছিল, আজ রাজুও সেই পথে। দুজনের উদ্দেশ্য একই.. মেয়েকে এই পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখা।

    (4)

    ধীরে ধীরে বেলা বাড়ছে। না, আর ওসব কথা চিন্তা করে লাভ নেই। আজ মধুলিকা তো কাল মৃন্ময়ী তো কোনও দিন মৃত্তিকা। বহু মহিলার সংসর্গে এসেছে সে। বেশ ভালো অর্থ রোজগারও করেছে। আজ সে ঠিক ভুলের চিন্তা করে না। যে হাতে পরস্ত্রীর নগ্ন দেহ স্পর্শ করে সে, পর দিন সেই হাতেই নিজের মেয়েকে ধরে আদরে ভরিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে দ্বিধায় পড়ে যায় রাজু। এই নোংরা হাতে কি নিজের মেয়েকে স্পর্শ করবে? ক্ষতি কোথায়? যদি নোংরাই বলা হয়, তাহলে তো তার সম্পুর্ণ শরীর নোংরা, তার আত্মা নোংরা। কোনটাকে বাদ দেবে সে? আফসোস শুধু একটাই রয়ে গেল। অর্থ উপার্জনের পথ যদি এটাই হওয়ার ছিল তাহলে রুপালিকে হারাবার কোনও মানে ছিল না। আজ মেয়েকে নিয়ে সে ব্যাঙ্গালুরু যাবে। সকালেই ট্রেন। তাই তাড়াতাড়ি পা চালাতে হবে তাকে। মোবাইলটা অন করে কৃষ্ণকে ফোন করলো রাজু। রোজ সকালে বাড়ি ফেরার পথে ফোন করে কৃষ্ণকে। মেয়ের খোঁজ নেয়। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোন তুলে ওপার থেকে কৃষ্ণ বললো- ‘কোথায় আছিস তুই? রাত থেকে তোকে ফোন করছি।’
    ‘কাজে ছিলাম তো। কেন? কী হয়েছে?’
    ‘তুই তাড়াতাড়ি পাড়ার হাসপাতালে আয়। তোর মেয়ের শরীর ভালো না।’
    প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে হাসপাতালের গেটের কাছেই রাজুর দেখা হয়ে গেল কৃষ্ণর সাথে। কৃষ্ণর বিষণ্ণ মুখ দেখে তার বুক ছ্যাঁৎ করে উঠলো।
    ‘কাল রাত থেকে স্বাস কষ্ট বেড়ে গিয়েছিল। যা ওষুধ ছিল সেগুলো দিয়েছিলাম। কিন্তু লাভ হলো না কিছুই। শেষে হাসপাতাল আনতে হলো রাতেই।’ কৃষ্ণ বললো।
    ‘এখন কেমন আছে মেয়ে?’ প্রশ্ন করলো রাজু।
    ঘাড় হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল কৃষ্ণ।
    কৃষ্ণর থেকে বেড নাম্বার নিয়ে রাজু ছুটে গেল সে দিকে। ওয়ার্ডে ঢুকে দেখলো বেড নাম্বার 42-এর উপর আপাদমস্তক সবুজ চাদর ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছে তার ছোট্ট মেয়ে। মুখ থেকে চাদর সরিয়ে রাজু দেখতে পেল দু’ চোখ বন্ধ করা তার মেয়ে যেন এখনও মুচকি মুচকি হাসছে। যেন সে রাজুকে প্রশ্ন করছে – ‘বাবা, এই টাকায় সুস্থ হওয়ার থেকে চলে যাওয়া কি ভালো না?’

  • গল্প

    গল্প- নাইটমেয়ার

    নাইটমেয়ার
    – বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

     

    ‘মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা?’ সায়ন্তিকা’র দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো অর্ণব।
    সায়ন্তিকা তাকিয়ে আছে শূন্যের দিকে। অর্ণবের কথায় যেন তন্দ্রাভঙ্গ হলো তার।
    খানিক ভাবলেশহীন ভাবে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে সে বললো- ‘না অর্ণব। ভুলে গেছি। নাইটমেয়ার মানে বোঝো?’
    ‘সে দিনগুলো এখন তোমার কাছে নাইটমেয়ার হয়ে গেছে? বাহ্, বেশ ভালো লাগলো শুনে।’
    অর্ণবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সায়ন্তিকা।
    ‘সে দিনগুলোর কথা না বলাই ভালো অর্ণব। কিছু স্মৃতি এমন থাকে যেগুলো না মনে করাই বাঞ্ছনীয়।’

    দুজনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ নীরবতার পর সায়ন্তিকা বললো – ‘সত্যি বলতে ভাবতে পারিনি যে এত দিনপর তোমার সাথে আবার দেখা হবে।’
    ‘হুম। চার বছর, দু’ মাস। ঠিক চার বছর, দু’ মাস আগে তোমার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল, হোয়াটসঅ্যাপে। তারপর তুমি আমায় ব্লক করে দিয়েছিলে। এখনও লাস্ট কনভারসেশনের রেকর্ডটা রয়েই গেছে মোবাইলে।’
    অর্ণবের কথায় আবারও হাসলো সায়ন্তিকা। বলল – ‘তাই নাকি? তুমি কি গত চার বছর ধরে একই মোবাইল ইউজ করছো নাকি?’
    ‘হ্যাঁ সায়ন্তিকা। কিছু কিছু জিনিসকে চট করে ফেলে দেওয়া যায় না। যেমন মানুষের সাথে স্মৃতি জুড়ে থাকে, তেমনই স্মৃতি জুড়ে থাকে জিনিসের সাথেও। প্রচুর লোকের সাথে প্রথম আলাপ হয়েছিল এই মোবাইলের মাধ্যমেই। কিছু লোকের সাথে যোগাযোগ এখনও আছে, আর কিছু লোকেরা ছেড়ে চলে গেছে।’
    বিষাদের স্পষ্ট রেখা অর্ণবের মুখে ফুটে উঠলো। সায়ন্তিকার মুখটাও গম্ভীর হলো।
    ‘তোমাকে ব্লক করতে চাইনি অর্ণব। কিন্তু বাধ্য হয়েছিলাম ব্লক করতে। কিচ্ছু করার ছিল না আমার। নিজের অবহেলা আর সহ্য হচ্ছিলো না আমার দ্বারা।’ বললো সায়ন্তিকা।
    ‘কে তোমায় অবহেলা করছিল সায়ন্তিকা? আমি? কিছু ভুল ধারণাকে মনে পুষে রেখে একটা ভালো সম্পর্ককে নিমেষে শেষ করে দিলে তুমি। কে তোমাকে অধিকার দিয়েছিল? আমি তোমায় কথা দিয়েছিলাম যে নিজের শেষ নিঃশ্বাস অবধি তোমার সঙ্গ ছাড়বো না। আমাকে আমার কথাটাও রাখতে দিলে না। আমাকে আমার সামনেই মিথ্যুক প্রমাণিত করে দিলে তুমি।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে অল্প উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল অর্ণব।
    সায়ন্তিকা একটুও উত্তেজিত হয়নি। ঠাণ্ডা মাথায় সে বললো- ‘অর্ণব, তোমার মধ্যে অনেক গুণ আছে। তুমি ভালো ছেলে, কেয়ারিং, মিশুকে.. আরও অনেক গুণ। কিন্তু একটা দোষও আছে তোমার মধ্যে। তুমি মানুষের মন বুঝতে পারো না। কারোর ফিলিংস বোঝার ক্ষমতা তোমার মধ্যে নেই অর্ণব।’
    অর্ণব ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সায়ন্তিকার দিকে। একটা জায়গায় তারা থেমেছে এখন। এখান থেকে সামনের দৃশ্যটা অপূর্ব। নিচে প্রায় অনেকটা খাই, ওপারে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল পর্বতমালা।
    ‘পাহাড় আমার চিরকালই বড্ড প্রিয়।’ বললো সায়ন্তিকা।
    ‘জানি। খুব ভালো করেই জানি।’
    ‘দার্জিলিং বহুবার গেছি। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে পাহাড়ের মধ্যে।’
    সায়ন্তিকার কথাগুলো অর্ণবের কাছে নতুন কিছু না। সে বহুবার সায়ন্তিকার মুখে এমন কথা শুনেছে। ঠাণ্ডা হওয়া বইছে। গায়ের চাদরটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিলো সায়ন্তিকা।
    ‘কান ঢেকে নাও সায়ন্তিকা। তোমার তো অল্পতেই ঠাণ্ডা লাগে।’ বললো অর্ণব।
    ‘তোমার মনে আছে বুঝি?’ অর্ণবের দিকে তাকিয়ে সায়ন্তিকা প্রশ্ন করলো।
    ‘মনে আছে। কারণ পুরনো স্মৃতি আমার কাছে নাইটমেয়ার নয়।’
    ‘হ্যাঁ অর্ণব। আমার কাছে সেই স্মৃতিগুলো নাইটমেয়ার। ভালোবেসে কারোর হাত ধরার পর সেই হাত ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্ট তুমি বুঝবে না অর্ণব। কারণ সেই কষ্ট তুমি পাওনি। সেই কষ্ট পেয়েছি আমি। আমি ছিলাম মন্থকুপে ফেঁসে। সেখান থেকে উদ্ধার করে এনেছিলে তুমি আমায়। কিছু একটা আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম আমি। তুমি নিজের দু’হাত বাড়িয়ে দিলে আমার দিকে। সেই দু’হাত ধরেই আমি আবার থেকে বাঁচতে শিখলাম। আঁকড়ে ধরতে চাইলাম তোমাকে। কী ভুল করেছিলাম আমি। দীর্ঘদিনের সাংসারিক জীবনে যা কিছু হারিয়েছিলাম, সেগুলো তুমি আমায় ফেরত দিলে। হারিয়ে গিয়েছিল আমার লেখা, হারিয়ে গিয়েছিল আমার কল্পনা শক্তি। সেগুলো তুমি ফেরত দিলে আমায়। তোমার হাত ধরেই পুনরায় আমার লেখা শুরু হলো। আমি এক নতুন জীবন, নতুন জগৎ পেলাম। দীর্ঘদিন ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম আমি। তুমি সুস্থ করলে আমায়। এত কিছু করলে আমার জন্য, তবুও আমার ফিলিংসটা বুঝতে পারলে না? এটা বুঝতে পারলে না যে আমি তোমার কাঁধে মাথা রেখে শান্তি পাই? তোমার ওই কাঁধটা আমার বড় প্রিয় ছিল অর্ণব। আর তুমি নাকি সেই কাঁধটা অন্য কাউকে দিয়ে দিলে?’
    সায়ন্তিকার কথাগুলো একাগ্রচিত্তে শুনছিলো অর্ণব। সায়ন্তিকার কথা শেষ হওয়ার পর সে বললো – ‘মানুষের মনে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা স্থান হয় সায়ন্তিকা। সে তোমার স্থান কোনও দিন নিতে পারবে না, আর তুমি ওর স্থান কোনও দিন নিতে পারবে না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে একটা সময় ছিল যখন তোমার জীবন জুড়ে শুধু আমি ছিলাম। তুমি আমার অজান্তেই আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলে। তখনও কি তুমি নিজের জীবনে আমায় সেই স্থানটা দিতে পেরেছিলে, যে স্থানটা ঘিরে তোমার স্বামী আছে?’
    ঘাড় নিচে করলো সায়ন্তিকা। জবাব নেই তার কাছে।
    ‘সায়ন্তিকা, আমি চিরকাল তো তোমার পাশে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমায় চিরকালের মত নিজের চোখেই অপরাধী বানিয়ে দিলে। এখন কী মনে হয় জানো? হয়তো আমি তোমার সাথে বিরাট বড় কোনও অন্যায় করে ফেলেছি। হয়তো উচিত ছিলো না তোমার পাশে দাঁড়ানো। আমার এটা বোঝা উচিত ছিলো যে অথৈ জলে ডুবতে থাকা মানুষ যেটা হাতের নাগালে পায় সেটাকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় সে। সায়ন্তিকা, আমিও হাড় মাংসের একটা প্রাণী। অন্যদের মত আমারও কিছু ইচ্ছে হয়, কিছু আহ্লাদ হয়। নিজের একটা পরিবার হোক, সংসার হোক সেটা কে না চায় সায়ন্তিকা? আমিও চেয়েছিলাম। পল্লবীকে দেখে মনে হয়েছিল যে এর সাথে আমি নিজের সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। আমরা যখন রিলেশনে এলাম, তখন সেই খবরটা খুশি মনে তোমাকে দিতে গেলাম ফোন করে। তুমি তখন আমার মুখের উপর ফোন কেটে দিলে। তোমাকে আমি নিজের ভাবতাম সায়ন্তিকা। ভেবেছিলাম তোমার থেকে সাংসারিক জীবনের অনেক টিপস নেবো। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠলো না। আস্তে আস্তে তুমি দূরে চলে গেলে আমার থেকে। পুরনো ঘটনাগুলো সব স্মৃতি হয়ে জমা রয়ে গেল মনের এক কোণায়। না সায়ন্তিকা, আমার জন্য পুরনো স্মৃতি কোনও নাইটমেয়ার নয়। সেগুলো সযত্নে রাখা আছে আমার কাছে। চিরকাল সেগুলো আমার কাছেই থাকবে, আমার আপন হয়ে।’
    সায়ন্তিকা গভীর দৃষ্টিতে তাকালো অর্ণবের দিকে।
    ‘আমি আবার ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম অর্ণব। অনেক কষ্টে আবার আমাকে সুস্থ করা হয়েছে। আমার লেখা বহুকাল আগেই মরে গিয়েছিল। তুমি সেটাকে পুনর্জীবিত করেছিলে। তোমাকে হারানোর পর ভাবতে পারিনি যে আবার কোনও দিন লিখতে পারবো।’ সায়ন্তিকা বলল।
    ‘কিন্তু এখন লিখেছ তুমি। আমি আজও পড়ি তোমার লেখা। পড়াই পল্লবীকে। আজ পর্যন্ত তোমার যটা বই বেড়িয়েছে, সবগুলো আমি পড়েছি। এমন করেই লিখে যাও সায়ন্তিকা।’
    ‘প্রতি বছর কোনও না কোনও পাহাড়ে ঘুরতে আসি আমি। এবার এখানে আসার আগে ভাবতেও পারিনি যে তোমার সাথে দেখা হবে।’
    সায়ন্তিকার দিকে তাকিয়ে অর্ণব বললো- ‘যে কারণেই হোক আবার আমাদের দেখা হলো। এটাই হওয়ার ছিলো সায়ন্তিকা। সায়ন্তিকা, আমায় ভুল বুঝো না। আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি.. I am always with u. আর এটাই সত্যি।’
    কথা বলতে বলতে তারা হোটেলে ফিরে এলো। সায়ন্তিকা দেখলো, হোটেলের পার্কে এক মহিলা কোলে বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মহিলাটির নজর গেল অর্ণবের দিকে। অর্ণবের দিকে এগিয়ে এসে সে বললো- ‘কিছুতেই ঘুমোচ্ছে না। জ্বালিয়ে মারে ছেলেটা।’
    হঠাৎ তার নজর গেল সায়ন্তিকার দিকে।
    ‘পল্লবী, একে চিনতে পারছো? ছবি দেখেছ অনেকবার।’ বললো অর্ণব।
    পল্লবী অবাক হয়ে বলল – ‘সায়ন্তিকাদি না?’
    সায়ন্তিকা ছোট্ট বাচ্চাটাকে পল্লবীর কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে বললঝ- ‘একে আমাকে দাও। আমিও ঘুম পাড়িয়ে দেবো জুনিযার অর্ণবকে।’

     

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- দি এম্পটি আর্থ (শেষাংশ)

    দি এম্পটি আর্থ (শেষাংশ)
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     


    ……………..
    পর্ব – ১৭
    …………….

    ‘ননসেন্স! কে বলেছে এটা ওর আইডিয়া ছিলো? এই যে, মিস্টার এন এস ডব্ল্যূ, তুমি যে বারবার বলছো যে আমি নাকি ডাঃ ব্যানার্জীর আইডিয়া চুরি করেছি, তার পিছনে কোনও ভিত্তি আছে? কোনও প্রমাণ আছে তোমার কাছে? যখন প্রমাণ নেই তখন কারোর উপরে দোষারোপ করবে না। আগে সলিড প্রমাণ নিয়ে এসো। তারপর কথা হবে তোমার সাথে। আমি যদি বলি, আইডিয়া চুরি আমি না ডাঃ অনুপম ব্যানার্জী করেছে। তুমি সেটা বিশ্বাস করবে তো? পপুলেশন কন্ট্রোলের কথা বলেছে ডাঃ ব্যানার্জী? কে দিয়েছিল সেই আইডিয়াটা তার মগজে? আজ যদি ডাঃ ব্যানার্জী জীবিত থাকতো তাহলে ওকে সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতাম আমি।’
    ‘তার মানে আপনি জানেন যে ডাঃ অনুপম ব্যানার্জী জীবিত নেই।’
    অর্চিষ্মানের এই কথায় হকচকিয়ে গেলেন ডাঃ চৌধুরী। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বললেন – ‘আমি কেন? এটা তো সবাই জানে যে ডাঃ অনুপম ব্যানার্জী আর বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে এত দিনেও কি সে সামনে আসতো না?’
    ‘পুলিশ কিন্তু তার ডেড বডি পায়নি। নিরুদ্দেশ হওয়ার বারো বছর পর ফাইল বন্ধ করে দেওয়া হয়। শুধু ডাঃ ব্যানার্জী নয়, তার স্ত্রী এবং পুত্রকেও পরবর্তী কালে খুঁজে পাওয়া যায়নি। যার ডেড বডি পাওয়া যায় না, তার মৃত হওয়ায় অল্প হলেও সন্দেহ থেকেই যায়। তাই তো আমরা আবার সেই বন্ধ ফাইলকে রিওপেন করেছি ডাঃ চৌধুরী। সে সব কথা পরে হবে। আপনি বললেন যে ডাঃ ব্যানার্জী নাকি আপনার আইডিয়া চুরি করেছেন।’ অর্চিষ্মান বলল।
    ‘হ্যাঁ, আমার আইডিয়া। আমার আইডিয়া চুরি করে গবেষণা করছিল সে। আমি গোপন ভাবে সেটা জানতে পারি। তাকে বলেওছিলাম যে সে গবেষণা করছে, করুক। আমার তাতে কোনও আপত্তি নেই। আমার ডিমান্ড শুধু এটুকুই ছিলো যে গবেষণার শেষে যেন ক্রেডিটে আমার নামটা দেয়। কিন্তু রাজি হয়নি সে।’
    ‘কী ছিলো আপনার আইডিয়া?’ জিজ্ঞাসা করলো অর্চিষ্মান।
    খানিক চুপ থেকে ডাঃ চৌধুরী বললেন – ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের এক অন্যতম পদ্ধতি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেক ওষুধ বা ইনজেকশন বাজারে এসেছে। কিন্তু তাতে কোনও দিন কোনও কাজ হয়নি। সেই সময় আমি এক ধরনের ওষুধের ফর্মুলা বের করেছিলাম। তখনও ওষুধটা আমি আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি।’
    ‘কী ধরনের ওষুধ?’ জিজ্ঞাসা করলো অর্চিষ্মান।
    ‘সেটা একটা ব্যাকটেরিয়ার মত। একটা ছোট্ট ক্যাপসুল। সেই ওষুধটা নিয়ে আমার অনেক প্ল্যান ছিল। ভেবেছিলাম নিজের গবেষণা আর প্ল্যানের বিষয় ভারত সরকারের সাথে কথা বলবো। কিন্তু সেটা হয়ে উঠলো না। আমার সব থেকে বড় ভুল কী ছিলো জানেন অফিসার? আমার সব থেকে বড় ভুল ছিলো নিজের প্ল্যানের বিষয় অনুপমের সাথে আলোচনা করা। তার মনের মধ্যে যে বিষ আছে সেটা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি। আমার প্ল্যান ছিলো প্রত্যেক সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে সেই ওষুধটা যেন পাওয়া যায়। এবং সেই ওষুধটা ডক্টরের দেওয়া আর পেশেন্টের নেওয়া যেন বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। কোনও মহিলার প্রথম ডেলিভারির পর অপারেশন টেবিলেই সেই ক্যাপসুলটা মহিলাকে দিয়ে দেওয়া হলে আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে অনেকটা নিয়ন্ত্রণ পেতে পারতাম। সেই ক্যাপসুলটা মহিলার শরীরে প্রবেশ করার পর যদি কোনও পুরুষ তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে তাহলে সেই পুরুষের শুক্রাণু হ্রাস হবে আর পরবর্তী কালে সে বাপ হতে পারবে না। তার মানে এটা নয় যে তার মধ্যে শারীরিক মিলনের ক্ষমতা কমে যাবে। সে আগের মতই শারীরিক মিলন করতে পারবে, কিন্তু তার বীর্যে শুক্রাণু থাকবে না। কোনও পুরুষকে জোর জবরদস্তি ওষুধ খাওয়ানো বা ইনজেকশন দেওয়ানোর থেকে এই উপায়টা আমার নজরে খুব সহজ ছিলো। যে কথাগুলো আমি তোমাদের বললাম সেগুলো অনুপমকেও বলেছিলাম। বলে না- সাদা মনে কাদা নেই। সেই অবস্থা ছিলো আমার। নিজের ফর্মুলার বিষয়েও আমি তাকে অনেকটা বলেছিলাম। সে যে বেইমানি করবে সেটা কে জানতো? হঠাৎ এক দিন জানতে পারলাম অনুপম কোনও বিষয় রিসার্চ করছে। নিজের স্পাই লাগিয়ে তার রিসার্চের বিষয়টা জানতে পারলাম। তখনই মাথা ঘুরে গেল আমার। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করেছিলাম। তাকে বলেওছিলাম যে সে করুক রিসার্চ, কিন্তু অবশেষে ক্রেডিটে যেন আমার নামটা দেয়। সে পুরোপুরি অস্বীকার করলো। এবার তুমি নিজেই বলো অফিসার, আমার বদলে তুমি হলে কী করতে?’
    ‘রিভেঞ্জ নিতাম।’ গম্ভীর গলায় অর্চিষ্মান বলল। অর্চিষ্মানের কথায় চমকে গেল স্বপ্নীল। কিন্তু ডাঃ চৌধুরী চমকালেন না। উত্তেজিত হয়ে বললেন – ‘একদম ঠিক বলেছো। রিভেঞ্জ। এদেরকে ক্ষমা করা যায় না। এদেরকে ক্ষমা করলে ঈশ্বর কোনও দিন ক্ষমা করবে না। এদের থেকে রিভেঞ্জ নিতে হয়। আমিও তাই করলাম। আমিও রিভেঞ্জ নিলাম অফিসার, আমিও রিভেঞ্জ নিলাম।’
    এবার অর্চিষ্মান উঠে দাঁড়ালো।
    ‘খুব ভালো করলেন ডাঃ চৌধুরী, খুবই ভালো করলেন। এবার আমাদের অফিসে গিয়ে বলবেন যে আপনি রিভেঞ্জটা কী ভাবে নিলেন। স্বপ্নীল, আমি ভুল করিনি ডাঃ ব্যানার্জীর ফাইলটা রিওপেন করে।’
    ডাঃ চৌধুরী কিছুক্ষণের জন্য কিছুই বুঝতে পারলেন না যে কী হলো। যখন বুঝতে পারলেন তখন তার আর করার কিছুই নেই। কী বলবেন ভেবে পেলেন না। অবশেষে মুখ খুললেন ডাঃ চৌধুরী। বললেন – ‘তোমরা কী ভাবছ, এখান থেকে তোমরা বেরিয়ে যেতে পারবে? চারিদিকে আমার গার্ড আর সিকিউরিটি আছে। ক্যামেরাতে যা যা রেকর্ড করা আছে সবগুলোকে ডিলিট করো আমার সামনে। না তো এখান থেকে বেরোনো তোমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।’
    মুচকি হাসলো অর্চিষ্মান।
    ‘ডাঃ চৌধুরী, যখন থেকে আমরা দু’জন এখানে বসে আছি, তখন থেকে আমাদের কমান্ডো এই ফার্ম হাউসকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। আমরা কাঁচা খেলা খেলি না ডাঃ চৌধুরী। চিন্তা করবেন না, আপনাকে আমাদের অফিসে খুব ভালো করেই ওয়েলকাম জানানো হবে।”

    পর্ব – ১৮
    ……………..

    ‘আর কোনও উপায় নেই। এর থেকে বেশি আমরা আর কিছুই করতে পারবো না।’ হতাশার সুরে কথাগুলো বলল অর্চিষ্মান।
    তার সামনে ন্যাশনাল সিকিউরিটি উইংএর বড়বড় অফিসাররা দাঁড়িয়ে আছে। সাথে আছেন আবির্ভাব গাঙ্গুলীও।
    ‘তোমাকে এমনি হতাশ হতে এর আগে কোনও দিন দেখিনি অর্চিষ্মান।’ আবির্ভাব গাঙ্গুলী বললেন।
    ‘আর আমরা করতেই বা কী পারবো স্যার? এটা বাইলজিক্যাল ওয়েপানের মত চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে। যেটা ছড়িয়ে গেছে সেটাকে আটকানো সম্ভব নয়। খুব বেশি আমরা নতুন ওয়েপান তৈরি বন্ধ করতে পারি। আর আমি সেটাই করতে যাচ্ছি। একটা মেঘমিত্রাকে আমরা পেয়েছি। এমন অসংখ্য মেঘমিত্রা দেশের চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদেরকে খুঁজে বের করা জাস্ট ইম্পসিবল। আমরা চেষ্টা করতে পারি যাতে নতুন মেঘমিত্রা আর তৈরি না হোক। স্যার, আমার ফোর্স দরকার। সেখানকার পরিস্থিতি আমার জানা নেই।’

    ‘লাইফ লাইন ড্রাগস্’ ডাঃ দিবাকর চৌধুরীর ওষুধের কোম্পানি। কোলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে বেশ কিছুটা দূরে এই কোম্পানির ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরিতেই তৈরি হয় এমন ওষুধ যেগুলো স্বল্প মূল্যে বহু লোকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এবং এই ফ্যাক্টরি থেকেই তৈরি হয় অর্চিষ্মানের কথায় ‘বাইলজিক্যাল ওয়েপান’। দেশের বেশ কিছু বড়বড় শহরে ডাঃ দিবাকর চৌধুরীর কোম্পানির ফ্যাক্টরি আছে। যে যে শহরের ডাঃ চৌধুরীর কোম্পানির ফ্যাক্টরি আছে, সেই রাজ্যের ন্যাশনাল সিকিউরিটি উইংএর ব্রাঞ্চকে খবর পাঠানো হয়ে গেছে। একটা বিশেষ ক্যাপসুল যেন তৈরি না হয়।
    পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র ফ্যাক্টরি কোলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে। অর্চিষ্মান কিছু ফোর্স নিয়ে রওনা হলো সে দিকে। ফ্যাক্টরিটা বানানো বেশ অনেকটা জায়গা ঘিরে। চারিদিকে সিকিউরিটিতে ভরা। ফ্যাক্টরির গেটের সামনে একটা গাড়ি এবং দু’টো ফোর্সে ভরা ভ্যান এসে থামলো। ফ্যাক্টরির সিকিউরিটি ইনচার্জের চেহারা বেশ লম্বা চওড়া। অর্চিষ্মানের গাড়ি থেকে নামতেই সে এগিয়ে এলো। অর্চিষ্মান তাকে নিজের আই ডি কার্ড দেখিয়ে বলল – ‘আপনি হয়তো খবর পাননি এখন যে এই ফ্যাক্টরির, এই কোম্পানির মালিক এখন আমাদের আন্ডারে। আমার কাছে অর্ডার ছিলো ফ্যাক্টরি সিল করে দেওয়ার। কিন্তু আমি সেটা করবো না। এই ফ্যাক্টরিতে অনেক ওষুধ তৈরি হয় যেটা সাধারণ মানুষের উপকার করে। তাই আমরা শুধু একটা বিশেষ ওষুধের ম্যানুফ্যাকচারিং বন্ধ করতে এসেছি।’
    সিকিউরিটি ইনচার্জ ভালো করে অর্চিষ্মানকে দেখে বলল – ‘আমার বস ডাঃ দিবাকর চৌধুরী নয়। আমার বস হলো এই সিকিউরিটি এজেন্সির মালিক। দিবাকর চৌধুরীকে আপনারা গ্রেপ্তার করুন বা মেরে ফেলুন, যতক্ষণ না নিজের বস থেকে আমি অর্ডার পাবো নিজের ডিউটি আমি বন্ধ করবো না। বাইরের কোনও লোকের ভিতরে প্রবেশ নিষেধ।’
    ‘তার মানে আপনি ভিতরে ঢুকতে দেবেন না। তাই তো?’
    ‘না।’
    সিকিউরিটি ইনচার্জের না বলার সাথে সাথে দু’টো ভ্যান থেকে যে ফোর্স নেমেছিল তারা নিজের হাতে নিমেষের মধ্যে বন্দুক উঠিয়ে নিলো। সিকিউরিটি গার্ড ফ্যাক্টরিতেও প্রচুর ছিলো। তাদের বন্দুকও গুলি চালাবার জন্য প্রস্তুত হলো। ফ্যাক্টরির সিকিউরিটি ইনচার্জ অর্চিষ্মানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল – ‘বন্দুক এদিকেও আছে অফিসার।’
    ‘অদ্ভুত ব্যাপার। আজকাল প্রাইভেট সিকিউরিটি এজেন্সির কর্মীদের দেখছি সাহস অনেক বেড়ে গেছে। তারা নাকি আমাদের উপর কথা বলে, তারা নাকি আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে। কোথা থেকে পাও হে এত সাহস?’
    কথাটা বলার পর অর্চিষ্মান আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করলো না। নিজের কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে সোজা সিকিউরিটি ইনচার্জের কপালে ঠেকিয়ে বলল – ‘ট্রিগারটা টিপলেই গল্প শেষ।’

    কোলকাতা সহ দেশ জুড়ে ডাঃ দিবাকর ব্যানার্জীর কোম্পানির যত ফ্যাক্টরি আছে সবগুলোতে আপাতত তালা লাগিয়ে দেওয়া হলো। অর্চিষ্মান যখন ফ্যাক্টরিতে ঢোকে তখন তার কাছে আবির্ভাব গাঙ্গুলীর ফোন আসে। তিনি ফোনে বলেন – ‘ফ্যাক্টরি আপাতত সিল করে দাও অর্চিষ্মান। দিল্লী হেডকোয়ার্টার থেকে সেটাই অর্ডার এসেছে। ডাঃ চৌধুরীকে আজ রাতে স্পেশাল ফ্লাইটে দিল্লী নিয়ে যাওয়া হবে। সাথে তুমিও থাকবে।’
    আবির্ভাব গাঙ্গুলীর কথার মতই কাজ হলো। শুধু ফ্যাক্টরি সিল করা হলো না, যত প্রাইভেট সিকিউরিটির গার্ড ছিলো প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করা হলো।
    ন্যাশনাল সিকিউরিটি উইংএর কিছু কমান্ডোর সাথে সেই রাতেই অর্চিষ্মান ডাঃ দিবাকর চৌধুরীকে নিয়ে দিল্লীর জন্য রওনা হলো।

    পর্ব – ১৯
    ……………….
    দু’দিন পর….
    …………………..

    নিজের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে অর্চিষ্মান। সন্ধ্যার সময়। সামনে সূর্যাস্ত হচ্ছে। পিছন থেকে অনন্যা দু’ হাতে দুটো কফির কাপ হাতে নিয়ে এলো। একটা অর্চিষ্মানকে দিলো। কফিতে এক চুমুক দিয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে অর্চিষ্মান বলল – ‘আমি পারলাম না অনন্যা। পারলাম না এই দেশকে রক্ষা করতে।’
    নিজের এক হাত অর্চিষ্মানের কাঁধে রাখলো অনন্যা। বলল – ‘তোমার যা করার সেটা তুমি করেছো। এর থেকে বেশি তোমার কিছু করার ছিলো না। তুমি তো নিজেও জানো যে এটাকে আটকানো অসম্ভব।’
    ‘প্রতিশোধের আগুন চারিদিক ছারখার করে দেয়। প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকা মানুষ নিজেও পুড়ে যায় এবং আশেপাশের বহু মানুষকে পুড়িয়ে দেয়। এটাই হলো ডাঃ দিবাকর চৌধুরীর সাথে। তিনটে গুমখুন, যার লাশ পাওয়া গেলো না। এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের নামে এমন সর্বনাশ। এক দিকে কম দামে ওষুধ বাজারে ছেড়ে গরীব বাঁচানোর ঢং, অন্য দিকে মানুষের জন্মের উপর লাগাম লাগিয়ে দেওয়া। সব ঠিক থাকতো অনন্যা, সব ঠিক থাকতো যদি ডাঃ চোধুরী নিজের বানানো ফর্মুলা নিয়েই এগোতেন। কিন্তু তিনি সেটা করলেন না। তিনি ওষুধটাকে আরও কড়া বানালেন। শেষে ওষুধটা এমন কড়া হলো যে পুরুষরা চিরকালের মত শারীরিক মিলনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো। ডাঃ ব্যানার্জীর প্ৰতি আক্রোশ তাকে এই পর্যায় নিয়ে গিয়েছিল যে তিনি এটা দেখতে পারলেন না যে তিনি পুরো দেশকে মারাত্মক সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ডাঃ চৌধুরীর ফার্ম হাউস থেকে কিছু পুরনো কাগজ পাওয়া গেছে। কাগজগুলো অনেক পুরনো। ওষুধের ফর্মুলা লেখা আছে তাতে। হাতের লেখা যে ডাঃ চৌধুরীর নয় সেটা দেখেই বোঝা যায়। খুব মারাত্মক প্ল্যান করেছিলেন তিনি। ডাঃ ব্যানার্জী এবং তার পরিবারকে মারার পরেও তিনি শান্তি পাননি। ডাঃ ব্যানার্জীকে পুরো দেশ ও দুনিয়ার নজরে বদনাম করা ছিল তার আসল উদ্দেশ্য। দূরদর্শিতায় ভরা ডাঃ চৌধুরী এটা অনুমান লাগিয়েছিলেন যে কোনও না কোনও দিন গভর্মেন্টের নজর পড়বেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি অনুপাতের উপর। হয়তো তদন্তও হতে পারে। তখন তিনি ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর ফর্মুলাটা সবার সামনে আনবেন। ডাঃ ব্যানার্জী নিরুদ্দেশ হওয়ার আগেই সেই ভয়ানক ওষুধটা বাজারে ছেড়ে দিয়েছিলেন। জানি না এটা ডাঃ চৌধুরী কী ভাবে করতেন, কিন্তু তার প্ল্যান এটাই ছিলো। আজকের দিনে দেশের বহু মহিলার শরীরের সেই ক্যাপসুল প্রবেশ করে গেছে। তারা বহু অল্প বয়সী ছেলের সাথে সম্পর্ক করে তাদের নপুংসক বানিয়ে দিচ্ছে। এই কারণেই চারিদিকে লেসবিয়ানের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। টাকা দিয়ে কী না করা যায় অনন্যা। বলতে গেলে ডাঃ চৌধুরী নিজের ইনকামের অর্ধেক থেকে বেশি অর্থ খরচ করেছেন এই র্যােকেটের পিছেনে। জানি না এই অগুনতি মহিলারা আর কত ছেলের জীবন নষ্ট করবে। শায়ক আর প্লুটোর মত হয়তো অসংখ্য পুরুষ ও অল্প বয়সী ছেলে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তাদের দেখতে পারছি না, তাদের চিনতে পারছি না। এটাই হয়তো আমাদের দুর্ভাগ্য। ডাঃ চৌধুরী দেশের ভিতরেই ভয়ানক বাইলজিক্যাল ওয়ার লাগিয়ে দিলেন। জানি না অনন্যা, ডাঃ চৌধুরীর এই বাইলজিক্যাল ওয়েপান পরবর্তী কালে মনুষ্য জাতির আর কত ক্ষতি করবে।’
    অস্তের দিকে যাওয়া সূর্যের দিকে খানিক তাকিয়ে নিজের দু’ চোখ বন্ধ করলো অর্চিষ্মান। অনন্যা তার হাত নিজের হাতে চেপে ধরলো।

    *সমাপ্ত।*

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- দি এম্পটি আর্থ (চতুর্থ অংশ)

    দি এম্পটি আর্থ (চতুর্থ অংশ)
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     


    ……………
    পর্ব – ১৬
    ………………

    পরদিন সকালেই স্বপ্নীলের ফোন এসেছিল অর্চিষ্মানের কাছে। ফোন করে সে বলল – ‘ডাঃ চৌধুরী ইন্টরভিউয়ের জন্য রাজি হয়ে গেছে। আজ বিকেলে সময় সময় দিয়েছে সে। রেডি থাকিস। ঠিক বিকেল পাঁচটা।’

    ডাঃ দিবাকর চৌধুরীর ফার্ম হাউস ডায়মন্ড হারবার রোডে। মাত্র দু’জনের আসার অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল। সেটা স্বপ্নীল আর অর্চিষ্মান দু’জনেই জানতো। সময় দেওয়া হয়েছিল মাত্র তিরিশ মিনিট।
    ‘আমাদের হাতে সময় কিন্তু খুব কম। তিরিশ মিনিটের মধ্যে আমাদের কাজ সেরে ফেলতে হবে।’ রওনা দেওয়ার আগে স্বপ্নীল বলল অর্চিষ্মানকে।
    অর্চিষ্মান এক নতুন রূপ ধারণ করেছে। লম্বা লম্বা চুল, পিছনে পনিটেল। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে কালো ফ্রেমের সানগ্লাস।
    ‘তিরিশ মিনিট অনেক আমার জন্য। বেশি প্ৰশ্ন করা আমার স্বভাব নয় স্বপ্নীল। দু’ চারটে প্রশ্নতেই আসল তথ্যটা বের করে আনার চেষ্টা করি আমি। আজও সেই চেষ্টাটাই করবো।’ নিজের কথা শেষ করলো অর্চিষ্মান।
    নিউজ চ্যানেলের গাড়ি করেই তারা গেল। বেশি জিনিস তাদের কাছে ছিল না। একটা ক্যামেরা আর একটা মাইক। নিউজ চ্যানেলের একটা আই ডি কার্ড অর্চিষ্মানের নামে বানিয়ে দিয়েছিল স্বপ্নীল। ঠিক বিকেল পাঁচটায় তাদের গাড়ি ডাঃ দিবাকর চৌধুরীর ফার্ম হাউসের মুখ্য ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালো। ফটকের কাছেই দু’টো বন্দুকধারী গার্ড দাঁড়িয়ে। অর্চিষ্মান, স্বপ্নীল এবং গাড়ির চালকের আই কার্ড দেখলো তারা। তিনজনকেই গাড়ি থেকে বের করে মুখ্য ফটক সংলগ্ন একটা ছোট্ট ঘরে নিয়ে গেল। ছোট্ট একটা ক্যামেরা দিয়ে তিনজনেরই ছবি তোলা হলো। জমা নিয়ে নেওয়া হলো তাদের মোবাইল ফোন। ফার্ম হাউসের ভিতর শুধু দু’জনের যাওয়ার অনুমতি আছে। ড্রাইভারকে গাড়িতে বসেই অপেক্ষা করতে হবে। দু’টো গার্ড ছাড়া সেখানে এক তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব হলো। সে অর্চিষ্মান ও স্বপ্নীলকে ফার্ম হাউসের ভিতর নিয়ে গেল। একটা বেশ বড় ড্রইং রুমে তাদের বসতে দিয়ে সেই লোকটা বলল – ‘আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন। ডক্টর বাবু একটু পরেই আসবেন।’
    নিজের কথা শেষ করে সেই লোকটা উধাও হয়ে গেল।
    ড্রইং রুমের দেয়ালে বেশ কিছু পেন্টিংস সাজানো। দু’ দিকের দেয়ালে দু’টো এ সি। প্লাস্টার অফ পেরিসের চারটে স্ট্যাচু ঘরের চার কোণে দাঁড়িয়ে আছে। মেঝেতে পাতা দামী কার্পেট। ঘরের মাঝখানে গোল করে ঘেরা সোফা সেট। তার মাঝে সেন্টার টেবিল। দু’জনে সোফাতে বসে অপেক্ষা করছে ডাঃ দিবাকর চৌধুরীর। প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হলো তাদের। দশ মিনিট পর অর্চিষ্মান প্রথমবার সামনে থেকে দেখলো বিখ্যাত ডক্টর এবং গবেষক দিবাকর চৌধুরীকে। দিবাকর চৌধুরীর শেষ সাংবাদিক সম্মেলনে স্বপ্নীল দেখেছিল তাকে। অর্চিষ্মান তাকে সামনাসামনি এই প্রথম দেখলো। উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির মত। গায়ের রঙ ফর্সা, মাথায় ব্যাক ব্রাশ করা সাদা চুল, মুখে দাড়ি – গোঁফের চিহ্নমাত্র নেই। চেহারায় যে আভিজাত্যের ছাপ আছে সেটা বলাই বাহুল্য। ডাঃ চৌধুরীর ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই অর্চিষ্মান ও স্বপ্নীল উঠে দাঁড়ালো। ডাঃ চৌধুরী দু’জনকে বসার ইশারা করে নিজেও সোফাতে বসলেন। স্বপ্নীল নিজের পরিচয় দিলো এবং অর্চিষ্মানের পরিচয় করালো ডাঃ চৌধুরীর সাথে। অর্চিষ্মানের নাম এখন দেবব্রত অধিকারী।
    ‘কী জানতে চাও তোমরা?’ ডাঃ চৌধুরী স্বপ্নীলকে জিজ্ঞাসা করলেন।
    ‘আপনার নতুন প্রজেক্টের বিষয়।’ জবাব দিলো স্বপ্নীল।
    ‘প্রজেক্ট বলতে অর্গ্যান ব্যাংক, তাই তো?’
    ‘ইয়েস স্যার।’
    ‘অর্গ্যান ব্যাংকের বিষয় তো সে দিন আমি প্রেস কনফারেন্সে সব কিছুই বলেছি। নতুন কিছু বলার মত আছে বলে তো মনে পড়ছে না।’ ডাঃ চৌধুরী বললেন।
    ‘বলার মত আছে ডাঃ চৌধুরী। অনেক কিছুই বলার মত আছে।’ এবার অর্চিষ্মান বলল। অর্চিষ্মান ততক্ষণে ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়েছে।
    ডাঃ দিবাকর চৌধুরী ভ্রুকুটি করে তাকালেন অর্চিষ্মানের দিকে।
    ‘কী এমন বলার মত আছে যেটা আমি সে দিন প্রেস কনফারেন্সে বলিনি?’
    অর্চিষ্মান ও স্বপ্নীল এক অপরের দিকে একবার তাকালো।
    ‘আপনার ইতিহাস জানতে চাই ডাঃ চৌধুরী। জানতে চাই আপনার অতীত। পশ্চিমবঙ্গের এক ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করা থেকে শুরু করে বিশ্ব বিখ্যাত ডক্টর এবং গবেষক হওয়ার সম্পূর্ণ যাত্রাটা আমরা জানতে চাই এবং সকলকে জানাতে চাই।’ কথাটা প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলল অর্চিষ্মান।
    খানিক চুপ থেকে অর্চিষ্মানের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ডাঃ চৌধুরী। অর্চিষ্মান ক্যামেরা অন করলো। স্বপ্নীল মাইক এগিয়ে দিলো ডাঃ চৌধুরীর দিকে।
    ‘পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলাতে আপনার জন্ম। সেখানেই লেখাপড়া আপনার। সেখান থেকে আজ বিশ্ব বিখ্যাত ডক্টর এবং গবেষক।’ স্বপ্নীল বলল।
    ডাঃ চৌধুরী বলতে শুরু করলেন – ‘ডক্টর হওয়ার ইচ্ছে আমার ছোট থেকেই। আমার নিজের কাকা ডক্টর ছিলেন। তাকে দেখেই আমার মনে ইচ্ছে জন্মায় যে আমি ডক্টর হবো। ডাক্তারিকে আমি কোনও দিন নিজের পেশা হিসেবে দেখিনি। চেষ্টা করে গেছি লোকেদের সেবা করার। ঈশ্বরের কৃপায় নিজের চেষ্টায় অনেকটাই সফল হতে পেরেছি। নাম, যশ এগুলো ক্ষণিকের। আজ আছে তো কাল নেই। আমি চিরকাল চেয়েছি লোকেদের হৃদয়ে নিজের স্থান তৈরি করার। বিশেষ করে গরীবদের হৃদয়ে। আজ যুগ অনেক এগিয়ে গেছে, তাও আজও বহু গরীব মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। তাদের কাছে টাকা থাকে না ওষুধ কিনবার। এ সব জিনিস আমার কোনও দিনই সহ্য হতো না। আমি কিছু করতে চাইতাম তাদের জন্য। করেছি, সফল হয়েছি নিজের কাজে। আমার ওষুধের কোম্পানি থেকে অনেক কম দামের ওষুধ তৈরি করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই.. বহু লোকের কাছে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া। আজ আকাশ ছোঁয়া মূল্য বৃদ্ধিতেও আমরা খুবই অল্প দামে ওষুধ দিই, যাতে গরীবরা বাঁচতে পারে। এখনও মনে আছে, তখন আমি ক্লাস টেন-এ পড়ি। আমার পাশের বাড়ির কাকিমা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। খুব ভালোবাসতেন আমায়। গরীব ছিলেন। তাও কাকু বহু দিন কষ্ট করে কাকিমার চিকিৎসা চালালেন। দিনে দিনে ওষুধের দাম আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। শেষে আর পারলেন না তিনি। ঘটনাটা ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছিল আমায়। আমার চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটেছে। চোখের আড়ালে তো আরও অনেক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যেটার বিষয় আমরা জানতেই পারছি না। কাকিমার মত তো বহু লোক প্রাণ হারাচ্ছে। ছোট বেলায় ভাবতাম যে ডক্টর হয়ে বিনা মূল্যে গরীবদের চিকিৎসা করবো। কিন্তু যখন আস্তে আস্তে বড় হলাম, চিন্তা ধারায় পরিবর্তন ঘটলো। গরীবদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা করে তাদের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব না। আমি তো ফ্রীতে তাদের দেখবো। কিন্তু তারা ওষুধ কিনবে কোথা থেকে? তখন থেকেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে যেমন করে হোক ওষুধের দাম কম করার ব্যবস্থা করতেই হবে। না তো বহু প্রাণ অকালেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে নেবে।’
    ‘একটা ছোট প্রশ্ন আছে।’ কথাটা অর্চিষ্মান বলল ক্যামেরার পিছন থেকে।
    আবার অদ্ভুত দৃষ্টিতে ডাঃ দিবাকর চৌধুরী তাকালেন অর্চিষ্মানের দিকে।
    ‘কী প্রশ্ন?’ জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
    ‘ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর সাথে আপনার সম্পর্ক তো খুব ভালো ছিলো। তাই না?’ অর্চিষ্মান প্রশ্ন করলো।
    ডাঃ চৌধুরীর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। এমন প্রশ্ন হয়তো তিনি আশা করেননি। তার কপালে অল্প অল্প ঘামের বিন্দু দেখতে পেলো অর্চিষ্মান। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন ডাঃ চৌধুরী। বললেন – ‘হুম। ভালো সম্পর্ক ছিল আমাদের। খুব ভালো ডক্টর ছিল সে। কী যে হয়ে গেল, কোথায় যে চলে গেল ভগবান জানে।’
    ‘তাকে শেষ বারের মত আপনার সাথেই দেখা গিয়েছিল।’ বলল অর্চিষ্মান।
    ‘হুম, জানি। তার বাড়ি গিয়েছিলাম। সেই ডেকে পাঠিয়েছিল।’
    ‘কেন ডেকে পাঠিয়েছিল সেটা কি জানতে পারি?’
    এবার শুধু দৃষ্টি নয়, গলার আওয়াজটাও বেশ কড়া হলো ডাঃ চৌধুরীর।
    ‘আপনারা এখানে ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন না তদন্ত করতে এসেছেন?’
    অর্চিষ্মান ক্যামেরার পিছন থেকে সরে গিয়ে ডাঃ চৌধুরীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল – ‘প্ৰশ্নগুলোকে ইন্টারভিউযের অংশ মনে করুন ডাঃ চৌধুরী। হঠাৎ ডাঃ ব্যানার্জী আপনাকে নিজের বাড়িতে কেন ডেকে পাঠিয়েছিলেন?’
    ‘বহু বছর আগেকার কথা। ওতো মনে রাখা সম্ভব নয়।’
    ‘সেটাও ঠিক। তবে একটা কথা আপনাকে না বলে থাকতে পারছি না ডক্টর চৌধুরী।’ অর্চিষ্মান স্বপ্নীলের পাশে বসে বলল – ‘এটা সেই সালেরই কথা যে সালে ডাঃ ব্যানার্জী অন্তর্ধান হয়েছিলেন। মানে 2036 সালের কথা। আপনার সাথে শেষ দেখা হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তার আগে তিনি একটা বক্তৃতা দেন। সেই বক্তৃতাটা এখনও ইন্টারনেটে আছে। আপনি যে কথাগুলো বলছেন সে কথাগুলো অনেক আগেই তিনি বলে গেছেন।’
    ‘কী বলতে চাও তুমি?’ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন ডাঃ চৌধুরী।
    ‘ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে পর্যন্ত আপনি গবেষণার ক্ষেত্রে বেশি দূর এগোতে পারেননি। গবেষণার ক্ষেত্রে তখন ডক্টর ব্যানার্জীর নাম আপনার থেকে অনেক এগিয়ে। হঠাৎ করে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তারপর থেকে শুরু হয় আপনার যাত্রা। কম মূল্যের ওষুধের বিষয় ডাঃ ব্যানার্জী নিজের বক্তৃতাতে বলেছিলেন। পরবর্তী কালে আপনি সেই কাজে হাত দিলেন এবং সফল হলেন। এটা কি শুধু কাকতলীয়? কাকতলীয় মেনে নেওয়া যেতো যদি আপনার সাথে ডক্টর ব্যানার্জীর ভালো সম্পর্ক না থেকে থাকতো।’
    অর্চিষ্মানের কথায় মাথা গরম হলো ডাঃ চৌধুরীর। উচ্চ কন্ঠে তিনি বললেন – ‘হোয়াট ননসেন্স। তুমি কি বলতে চাও আমি ডক্টর ব্যানার্জীর আইডিয়া চুরি করেছি?’
    ‘আমি তো কিছুই বলছি না ডাঃ চৌধুরী। শুধু অনুমানের কথা বলছি।’ শান্ত কন্ঠে অর্চিষ্মান বলল।
    ‘নিজের অনুমান নিজের কাছে রাখো। এটা ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছে না আমার উপর এলিগেশন লাগানো হচ্ছে। এখানে তোমরা তামাশা করতে এসেছ? তোমরা হয়তো জানো না যে আমার সময় কত দামী। আমি চাইলে এক্ষুণি তোমাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারি। তোমাদের নিউজ চ্যানেলে ফোন করে যদি তোমাদের নামে কমপ্লেন করি তাহলে তোমাদের চাকরি চলে যাবে সেটা জানো কি?’
    মুচকি হেসে অর্চিষ্মান বলল – ‘জানি। সাথে এটাও জানি যে আপনি এটা করবেন না। আপনাকে দু’টো কথা বলা হয়নি। ওই দু’টো কথা শুনলে আপনি হয়তো একটু শান্ত হবেন। প্রথম কথা হলো ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর নিরুদ্দেশের ফাইলটা রিওপেন হয়েছে। আর দ্বিতীয় কথা হলো আপনার সামনে যে দু’জন বসে আছে তাদের মধ্যে একজন মানে আমি এন এস ডব্ল্যূ’র অফিসার।’
    অর্চিষ্মান ও স্বপ্নীল লক্ষ্য করলো হঠাৎ করে ডক্টর চৌধুরীর মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
    ‘অনেক ঘটনা ঘটে গেছে ডাঃ চৌধুরী। জল অনেক গড়িয়ে গেছে। ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে আবার থেকে। কোনও পুরনো ফাইল রিওপেন হওয়া মানে আপনি জানেন নিশ্চই। আগে যা যা হয়নি, এখন সেগুলো হবে। ডক্টর অনুপম ব্যানার্জীর নিরুদ্দেশের মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক রহস্য। আপনি তার কাছের বন্ধু ছিলেন। কিছু তো আপনি নিশ্চই জানেন। পরবর্তী কালে আপনি সে পথেই হেঁটেছেন যে পথ ডাঃ ব্যানার্জী দেখিয়ে গিয়েছিলেন।’
    ‘তুমি ভুল করছো অফিসার। ডাঃ ব্যানার্জীর নিরুদ্দেশের বিষয় আমি কিছুই জানি না। তূমি বারবার বলছো যে তার দেখানো পথে আমি হেঁটেছি। তাতে ভুল কী করেছি? ডাঃ ব্যানার্জীর স্বপ্ন ছিলো যে ওষুধের মূল্য এতই কম হোক যে সেটা সাধারণ গরিব জনতার কাছে পৌঁছতে পারে। তার নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণে তার সেই স্বপ্নটা পুরো হতে পারেনি। আমি তার কাছের বন্ধু ছিলাম। তাই আমার কর্তব্য ছিলো নিজের বন্ধুর স্বপ্নটা পুরো করার। আমি তার স্বপ্নকে পুরো করে তার আত্মাকে শান্তি দিয়েছি। আমার তো মনে হয় না যে আমি কোনও ভুল কাজ করেছি। কারোর স্বপ্নকে পুরো করা যদি অন্যায়, তাহলে আমি অন্যায় করেছি। তোমার নজরে যদি সেটা অন্যায় মনে হয় তাহলে তুমি গ্রেপ্তার করতে পারো আমায়।’ কথাগুলো দৃঢ় কন্ঠে বললেন ডাঃ চৌধুরী।
    ‘জেনে খুশি হলাম ডাঃ চৌধুরী যে আপনি নিজের বন্ধুর অপূর্ণ স্বপ্নকে পূর্ণ করেছেন। তাহলে তো বলতে হয় আপনার বন্ধুর আরও একটা অপূর্ণ স্বপ্ন ছিলো। আপনি নিশ্চয়ই সেটাও পূর্ণ করার চেষ্টায় লেগে আছেন।’
    ‘কোন স্বপ্নের কথা বলছো তুমি?’
    অর্চিষ্মান এবার মুখে কিছু বলল না। নিজের মোবাইল বের করে ডাঃ ব্যানার্জীর সেই বক্তৃতার ভিডিওটা চালিয়ে ডাঃ চৌধুরীর সামনে রেখে দিলো।
    ‘ভিডিওটা ভালো করে দেখুন ডাঃ চৌধুরী। বিশেষ করে শেষ অংশটা।’
    অর্চিষ্মানের দিকে একবার রক্তবর্ণ চোখে তাকিয়ে ভিডিও দেখতে শুরু করলেন ডাঃ চৌধুরী।

    চলবে…

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- দি এম্পটি আর্থ (তৃতীয় অংশ)

    দি এম্পটি আর্থ (তৃতীয় অংশ)
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

     


    …………….
    পর্ব – ১১
    ……………….

    প্লুটো তাকে ফ্ল্যাট নম্বর বলেছে। সেখানে গিয়ে অর্চিষ্মান দেখলো ফ্ল্যাট বন্ধ। চৌকিদারকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল – ‘মেঘমিত্রা ম্যাডামেরই ফ্ল্যাট এটা। তিনি মাঝে মাঝে আসেন। যখনই তিনি আসেন নিজের সাথে কোনও না কোনও অল্প বয়সী ছেলেকে নিয়ে আসেন। সব থেকে অদ্ভুত ব্যাপার হলো ছেলে বদলের মাঝের সময়টা তিনি গায়েব থাকেন।’
    ‘কী করেন তিনি?’ জিজ্ঞাসা করলো অর্চিষ্মান।
    ‘জানি না স্যার। কী কাজ করেন সেটা বলতে পারবো না।’
    ‘তোমার কি কোনও আন্দাজ আছে যে এখন পর্যন্ত কটা ছেলেকে সে এই ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছে?’
    খানিক চিন্তা করে চৌকিদার বলল – ‘ঠিক মত বলতে পারবো না স্যার। তাও কম করে দশ – বারোটা ছেলেকে তো সে নিয়েই এসেছে।’

    নিজের ফ্ল্যাটে ফেরার পথে অর্চিষ্মান ফোন করলো সপ্তর্ষিকে। বলল – ‘তোর বন্ধু শায়কের নিজের শিক্ষিকার প্রেমে পড়ার ঘটনাটা প্রায় বাইশ বছর পুরনো না?’
    ‘হ্যাঁ, তা হবে।’
    ‘তখনকার একটা ঘটনা মনে কর সপ্তর্ষি। বেশ কিছু দিন ধরে ঘটনাটার জের ছিল। নিউজ চ্যানেল, নিউজ পেপার তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল।’
    ‘কী ঘটনা বলতো।’
    ‘অদ্ভুত। তুই ভুলে গেলি? ভুলে অবশ্য আমিও গিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ করে মনে পড়লো। দেশ জুড়ে বেশ কিছু মহিলাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তারা নাকি অল্প বয়সী ছেলেদের নিজের প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে সেক্স করতো, আর না তো তাদের ধর্ষণ করতো। বহু মাত্রায় অল্প বয়সী ছেলেদের ধর্ষণ। ভাবতে পারিস? পুলিশ তাদের মুখ থেকে কিছুই বের করতে পারেনি। তাদের কাছে নাকি পটাশিয়াম সায়ানাইড ছিল। মনে পড়েছে?’
    ‘হ্যাঁ, পরিস্কার মনে পড়েছে।’ বলল সপ্তর্ষি।
    ‘আমার যত দূর মনে হয় তোর শায়কের প্রেমিকাও তাদেরই দলের।’
    ‘কিন্তু তাদের কিছু তো উদ্দেশ্য হবে?’ সপ্তর্ষি প্রশ্ন করলো।
    ‘উদ্দেশ্যই তো জানা যায়নি ভাই। উদ্দেশ্য জানা গেলে অনেক তথ্যই সামনে এসে যেতো। কিন্তু কিছুটা উদ্দেশ্য আমি হয়তো বুঝতে পেরেছি।’
    ‘কী?’
    ‘এখন নয়। আগামী কাল বলবো। একটা ছোট্ট পরীক্ষা করা এখনও বাকি আছে।’

    ‘তোমার কি মাথাটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে অর্চিষ্মান?’
    রাতে শুতে যাওয়ার আগে অর্চিষ্মান নিজের প্ল্যানটা বলেছিল অনন্যাকে। শুনে খানিক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে অর্চিষ্মানের দিকে তাকিয়ে রইল অনন্যা।
    ‘আমার প্রমাণ চাই অনন্যা। আমি চোখ বন্ধ করে হাওয়াতে ঢিল ছুঁড়তে নারাজ। যে সন্দেহটা আমি করছি সেটা যদি সঠিক হয়, তাহলে এটা ভেবে নাও যে এই কেসের অনেকটা কাছে আমি পৌঁছে গেছি। শুধু কিছু প্রশ্ন করতে চাই ডাঃ চৌধুরীকে।’
    ‘তুমি যার উপর আঙ্গুল তুলছ সে কিন্তু সমাজের এক বিশিষ্ট ব্যক্তি। এটা মনে রেখো।’ অনন্যা বলল।
    ‘অনন্যা, তুমি ভুল করছো। আমি কারোর উপর আঙ্গুল তুলছি না। বিনা প্রমাণে কারোর উপর আঙ্গুল তোলা আমার স্বভাব বিরুদ্ধে। যেহেতু কোনও এক সময় ডাঃ চৌধুরীর সাথে ডাঃ ব্যানার্জীর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, তাই ডাঃ ব্যানার্জীর নিরুদ্দেশ সম্পর্কে তিনি কিছু আলোকপাত করতে পারেন।’
    ‘বহু বছর হয়ে গেছে ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর নিরুদ্দেশ হওয়া। বারো বছর পর্যন্ত যদি কোনও নিরুদ্দেশ ব্যক্তির সন্ধান না পাওয়া যায় তাহলে তাকে মৃত বলে মেনে নেওয়া হয়। শুধু ডাঃ ব্যানার্জী নয়, তার স্ত্রী এবং সন্তানকেও মৃত বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। তাদের ফাইল বহুদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।’
    অর্চিষ্মান বলল – ‘সেটা আমি জানি সুইট হার্ট। কিন্তু তুমি হয়তো এটা ভুলে যাচ্ছ যে এন এস ডব্ল্যূ’র কাছে এই ক্ষমতাটা আছে যে সন্দেহবশত তারা বন্ধ ফাইলকেও রি ওপেন করতে পারে। আমি তাই করবো। ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর বন্ধ ফাইলকে রি ওপেন করবো। আপাতত আগামী কালের কাজটা সেরে নিই।’
    ‘আগামী কাল যেটা তুমি করতে যাচ্ছ সেটা কি ঠিক করছো? প্লুটোর বয়সই বা কত? তার সাথে এমন করো না।’ অনন্যা বলল।
    ‘আমি তো তার কোনও ক্ষতি করছি না অনন্যা। এটা শুধু একটা পরীক্ষা মাত্র। সে জানতেও পারবে না। প্রথমে তাকে এক সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যাবো। সাইক্রিয়াটিস্ট তাকে দু- চারটে প্রশ্ন করে তাকে অজ্ঞান করবে। তার অচেতন অবস্থাতেই তার পরীক্ষা হবে।’
    ‘পরীক্ষা করাটা কি খুব দরকার?’ অনন্যা প্রশ্ন করলো।
    ‘তোমাকে বললাম না অনন্যা, এই পরীক্ষার ফল যেটা আমি ভেবেছি যদি তাই হয়, তাহলে আমি এক শক্ত প্রমাণ পেয়ে যাবো। এই প্রমাণটাই আমার দরকার।’

    পর্ব – ১৩
    ……………….

    ছোট থেকেই প্লুটোর কাজ করার ইচ্ছে এন এস ডব্ল্যূ তে। তারা নাকি অদ্ভুত অদ্ভুত তদন্ত করে, অনেক রহস্যউদঘাটন করে। তাদের কাজটা অ্যাডভেঞ্চারে ভরা। প্লুটোর অ্যাডভেঞ্চার বেশ ভালো লাগে, তাই ভালো লাগে এন এস ডব্ল্যূও। হঠাৎ অর্চিষ্মান তাকে এন এস ডব্ল্যূ’র অফিসে ডেকে পাঠিয়েছে শুনে বেশ আশ্চর্য হয়েছিল সে। যেহেতু অফিসটা এন এস ডব্ল্যূ’র, তাই আর দু’বার চিন্তা করলো না সে। এন এস ডব্ল্যূ’র বহুতল বিল্ডিংএর নিচেই অর্চিষ্মান অপেক্ষা করছিল প্লুটোর।
    ‘আমাকে হঠাৎ এখানে ডেকে পাঠালে?’ অর্চিষ্মানকে দেখেই প্লুটো জিজ্ঞাসা করলো।
    ‘তোমার এখানে কাজ করার ইচ্ছে আছে। তাই না? তাই ভাবলাম একবার তোমায় ঘুরিয়ে দিই। তোমার মনটাও ভালো হয়ে যাবে।’
    কথা শেষ করে অর্চিষ্মান ভিতরে নিয়ে গেল প্লুটোকে। এন এস ডব্ল্যূ’র অফিস তাকে ঘোরালো, পরিচয় করালো কিছু অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাথে। বেশ খুশি মনে সেগুলোকে দেখলো প্লুটো। নিজের দুঃখ যেন ভুলেই গেল সে। সুযোগ দেখে অর্চিষ্মান প্লুটোকে বলল – ‘তোমাকে একটা দরকারি কথা বলতে চাই প্লুটো। যেহেতু তুমি পরবর্তী কালে এখানেই কাজ করতে চাও, তাই তোমাকে এ কথাগুলো বলা উচিত বলে মনে করি।’
    ‘কী কথা?’ প্লুটো জিজ্ঞাসা করলো।
    এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্চিষ্মান বলল – ‘প্লুটো, ঘটনাটা তোমার সাথে রিলেটেড। তোমার আর মেঘমিত্রার সাথে।’
    মেঘমিত্রার নাম শুনে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল প্লুটোর।
    ‘দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই প্লুটো। মেঘমিত্রা একা নয়, আর একা নয় প্লুটোও। অসংখ্য মেঘমিত্রা ও অসংখ্য প্লুটো আজ চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেঘমিত্রাদের কাজ প্লুটোদের নিজের জালে ফাঁসিয়ে নেওয়া। বহু বছর আগে থেকে মেঘমিত্রাদের আবির্ভাব হয়। তবে থেকে তারা অসংখ্য প্লুটোদের নিজের জালে ফাঁসিয়ে তাদের দিয়ে কিছু ভুল কাজ করিয়ে যাচ্ছে। এমন কাজ যেটা সমাজের আর এন এস ডব্ল্যূ’র নজরে ক্রাইম। এই মনে করো আজ তোমায় ছেড়ে চলে গেল মেঘমিত্রা। তুমি তার দুঃখে অবসাদে ভুগছো। কিছু দিন পর হঠাৎ করে সে ফিরে এলো। এই অপ্রত্যাশিত খুশি তুমি নিতে পারলে না। ছুটে গেলে তার দিকে। ব্যাস, এখানেই বাজিমাত করে নিলো সে। এবার সে যা বলবে, তুমি তাই করবে। প্লুটো, এদের দল অনেক বড়। কত দূর পর্যন্ত তারা ছড়িয়ে আছে সেটা এখনও আমরা জানি না। জানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এখনও। আজ তুমি আমাদের সাহায্য করবে প্লুটো। এন এস ডব্ল্যূ’র তোমার সাহায্যের প্রয়োজন।’
    এন এস ডব্ল্যূ-কে সাহায্য করার সুযোগ পাবে কোনও দিন ভাবেনি প্লুটো। এটা তার জন্য আশাতীত। মনটা আনন্দে ভরে গেল তার।
    ‘কী করে আমি এন এস ডব্ল্যূ’র কাজে আসবো?’ প্লুটো জিজ্ঞাসা করলো অর্চিষ্মানকে।
    ‘এন এস ডব্ল্যূ’র একটা অফিসারের কাছে আমি তোমায় নিয়ে যাবো। সে তোমায় কিছু প্রশ্ন করবে মেঘমিত্রার বিষয়ে। তুমি তার বিষয়ে যা যা জানো সেগুলো বলো। আমাকে যা বলেছো, তার থেকেও বেশি কিছু জানলে সেই অফিসারকে বলো। ঠিক আছে?’
    প্লুটো ঘাড় নেড়ে সহমত দিলো।

    এন এস ডব্ল্যূ’র আন্ডার গ্রাউন্ডে অর্চিষ্মান নিয়ে গেল প্লুটোকে। হল ঘরের মত এক বড় ঘরে ঢুকলো তারা। ঘরের একদিক সবুজ পর্দা দিয়ে ঢাকা। পর্দার ওপারে কী আছে সেটা দেখা মুশকিল। অন্য দিকে এক রিভলবিং চেয়ারে বসে আছেন মাঝ বয়সী এক ভদ্রলোক। তার সামনে একটা বড় টেবিল ও টেবিলের ওপারে দু’টো চেয়ার। ভদ্রলোকের নাম ডক্টর শত্রুঘ্ন বিশ্বাস। তিনি সাইক্রিয়াটিস্ট। ভালো করে একবার প্লুটোকে দেখে তিনি অর্চিষ্মানকে বললেন – ‘চিন্তা নেই অফিসার। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে যেতে পারো। আমি ঠিক নিজের কাজ করে নেবো।’

    পর্ব – ১৪
    ………………

    ‘যদি তোমার ডাউট ঠিক হয় তাহলে এটাকে আটকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।’ বললেন আবির্ভাব গাঙ্গুলী।
    প্লুটোকে ডাঃ শত্রুঘ্ন বিশ্বাসের কাছে ছেড়ে অর্চিষ্মান দেখা করতে গেল আবির্ভাব গাঙ্গুলীর সাথে। প্লুটোর উপর কোনও মেডিক্যাল পরীক্ষা করাতে তিনিও আগে অনুমতি দেননি। কিন্তু পরে অর্চিষ্মানের তর্কে তিনি হার মেনে গেলেন। প্রতিটি সমীকরণ একে একে মিলিয়ে তাকে বুঝিয়েছিল অর্চিষ্মান। শুধু শেষ প্রমাণের অপেক্ষা। খুব সম্ভব সেটাও আজ পেয়ে যাবে।
    আবির্ভাব গাঙ্গুলীর কথায় অর্চিষ্মান বলল – ‘এখনই আমি কিছু ফাইনাল বলতে চাই না স্যার। শেষ প্রমাণটা আগে পেয়ে যাই। 2022 সালে প্রফুল্ল গুহ নামের এক প্রফেসার ‘দি এম্পটি আর্থ’ নামের এক বই লিখেছিলেন। মনুষ্য জাতি লুপ্ত হওয়ার অনেক কারণের ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। মুখ্য কারণ দিয়েছিলেন বিষাক্ত রেডিয়েশন। কারণ আলাদা যাই হোক না কেন, মনুষ্য জাতি কিন্তু বিলুপ্তের দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমিও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে তদন্তটা শুরু করবো কোথা থেকে। ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে ডাঃ ব্যানার্জীর বক্তৃতা চোখে পড়লো। ভাবলাম, এখান থেকেই শুরু করা যাক।’
    ‘ডাঃ চৌধুরীর ইন্টারভিউয়ের কী ব্যবস্থা করলে?’ প্রশ্ন করলেন আবির্ভাব গাঙ্গুলী।
    ‘সেটাও দিন দুয়েক-এ হয়ে যাবে স্যার।’
    খানিক বিরতি নিয়ে আবির্ভাব গাঙ্গুলী বললেন – ‘তোমার ধারনা এদের বড় গ্যাং কাজ করছে। কোনও বড় র্যাভকেটের সাথে যুক্ত তারা। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য জানা যায়নি এখনও। তারা যে এমন করছে তার পিছনে কোনও তো কারণ হবে?’
    ‘স্যার, ডাঃ অনুপম ব্যানার্জীর এক অসমাপ্ত গবেষণা বারবার খোঁচা মেরেছে আমায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর নিয়ন্ত্রণ আনার কথা তিনি বলেছিলেন। বলেছিলেন এক নতুন পদ্ধতির কথা। কিন্তু সে পদ্ধতি কারোর সামনে আর এলো না।’
    ‘তোমার কী মনে হয়? এরা ওই অজানা পদ্ধতির ভিত্তিতে এমন কাজ করছে? যে গবেষণা কোনও দিন পুরো হয়নি, সেটার ভিত্তিতে কাজ করা তো অসম্ভব।’
    ‘উত্তরের খোঁজে তো আমিও আছি স্যার।’
    দরজায় টোকা মেরে ঘরে ঢুকলো ডাঃ শত্রুঘ্ন বিশ্বাস। তাকে দেখেই অর্চিষ্মান জিজ্ঞাসা করলো – মেডিক্যাল টেস্ট হলো?’
    ‘হ্যাঁ, হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জ্ঞান ফিরে আসবে। আমার টিম তার সাথেই আছে। প্লুটোর জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই তার মস্তিষ্কে এটা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে যে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল সে। মেঘমিত্রা এবং তাদের মত মেয়েদের প্রতি ঘৃণার কারণে হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছিল তার। অবশেষে নিজের নার্ভে কন্ট্রোল না রাখতে পেরে সেন্স লেস হয়ে যায় সে।’
    ‘ভেরি গুড। তার মেডিক্যাল রিপোর্ট কী বলছে?’ অর্চিষ্মান জিজ্ঞাসা করলো।
    ডাঃ বিশ্বাস একবার আবির্ভাব গাঙ্গুলীর দিকে তাকালো, তারপর অর্চিষ্মানের দিকে তাকিয়ে বলল – ‘তোমার ধারনা ঠিক ছিল অর্চিষ্মান। প্লুটো নিজের পুরুষত্ব হারিয়ে ফেলেছে।’

    পর্ব – ১৫

    রাত প্রায় দু’টো। এন এস ডব্ল্যূ’র অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অর্চিষ্মান। তার সাথে আছে হাতে অস্ত্র নিয়ে এন এস ডব্ল্যূ’র কিছু কমান্ডো ও অফিসার।
    অর্চিষ্মান তাদের বলছে – ‘সালটা 2048 থেকে 2050এর মধ্যে। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট দেশ জুড়ে এমন অনেক মহিলাদের গ্রেপ্তার করেছিল যারা অল্প বয়সী ছেলেদের ধর্ষণ করতো। সেই মহিলাদের গ্যাং এখনও সক্রিয়। এখন তারা প্রতক্ষ্যভাবে না হোক অপ্রতক্ষ্যভাবে অল্প বয়সী ছেলেদের ধর্ষণ করছে। তাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। পুলিশ যদি আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এ কাজটা করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারবো না? আমরা যদি না পারি তাহলে এ দেশে এন এস ডব্ল্যূ’র প্রয়োজন কী? আমাদের এই কাজটা করতেই হবে। তবে হ্যাঁ, সতর্কতা অবলম্বন করে। আমরা কী করছি তার খবর যেন বাইরের কেউ না জানতে পারে। এখন আমরা বালিগঞ্জ যাবো। আমাদের প্রথম শিকারের নাম মেঘমিত্রা। খুব সম্ভব তাকে আমরা সেখানে পাবো না। তার ফ্ল্যাট সার্চ করবো আমরা। দেখা যাক, সেখান থেকে কী পাওয়া যায়।’

    বালিগঞ্জের সেই অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে যখন এন এস ডব্ল্যূ’র দল পৌঁছলো তখন প্রায় রাত তিনটে। অর্চিষ্মান সহ মোট ছ জন বন্দুকধারী অফিসার ছিল। চৌকিদারকে আগেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেঘমিত্রার ফ্ল্যাট বারো তলায়। ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে দেখা গেল দরজা বন্ধ। দরজা খোলার চাবি অর্চিষ্মানের কাছে ছিল। অন্ধকার ফ্ল্যাটে ঢুকেই নিজের হাতের ছোট্ট টর্চটা জ্বালালো অর্চিষ্মান। টর্চটা ছোট, কিন্তু তার আলোর জোর প্রচন্ড। একটা ড্রইং রুম, বেশ বড়। সুইচ বোর্ড খুঁজে আলো জ্বালানো হলো। পুরো ড্রইং রুমের মেঝেতে পাতা আছে দামী কার্পেট। দেয়ালে ঝুলছে দামী এক টি ভি। ভিতরের বেড রুমে ঢুকলো এন এস ডব্ল্যূ’র দল। বিছানার চাদর এলোমেলো। বিছানায় রাখা আছে একটা ল্যাপটপ।
    ‘আজ হয়তো এখানে এসেছিল মেঘমিত্রা।’ প্রায় ফিসফিস করে অর্চিষ্মান বলল।
    খাটে বসে ল্যাপটপ খোলার চেষ্টা করলো সে। স্ক্রিনে কৃত্তিম রোবোটিক মুখ ভেসে এলো। ল্যাপটপ থেকে আওয়াজ এলো – ‘Welcome to your world. Please give your eyes.’
    ল্যাপটপের ঠিক মাথার কাছ থেকে হালকা আলোর রেখা বেরিয়ে এলো। অর্চিষ্মানের চোখে এসে পড়লো সেই আলোর রেখাটা। অর্চিষ্মান বুঝতে পারলো যে ল্যাপটপ তার চোখের রেটিনা স্ক্যান করতে চাইছে। ল্যাপটপের সামনে বসে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। বাকি লোকেরা তন্নতন্ন করে পুরো ফ্ল্যাট সার্চ করছে। হঠাৎ দরজায় কোনও শব্দ পেলো তারা। দরজা খোলার শব্দ। অর্চিষ্মান এক লাফে বেড রুম থেকে ড্রইং রুমে এলো। দরজা খুলতেই তারা সামনে একা রমণীকে দেখলো। অর্চিষ্মান তাকে আগেও দেখেছে, প্লুটোর সাথে। এই রমণীর নামই, মেঘমিত্রা। অর্চিষ্মানের নজর গেল সব থেকে আগে মেঘমিত্রার গলার কাছে। সে আগের ঘটনা জানে। এদের গলায় নাকি পটাশিয়াম সায়নায়েড ঝোলানো থাকে লকেটের মত। অনেকে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে এবং অনেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর পটাশিয়াম সায়নায়েড খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। মেঘমিত্রার গলায় পাতলা একা সোনার হার ঝুলছে। সাথে আছে গোল মত ছোট্ট এক লকেট। সেটাও সোনা দিয়ে বাঁধানো। এই ছোট্ট লকেটের মধ্যেই হয়তো আছে সেই বিষাক্ত জিনিসটা, যেটা একবার জিভে স্পর্শ করালে নিমেষের মধ্যে চিরকালের মতো ইহলোক ত্যাগ করে দিতে হয়। মেঘমিত্রা অবাক দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে রইল তাদের দিকে। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞাসা করলো – ‘কে আপনারা? এখানে কী করছেন?’
    অর্চিষ্মান ধীর গতিতে এগিয়ে গেল তার দিকে। বলল – ‘আমরা কিছু জানতে এসেছি এখানে।’
    ‘কী জানতে এসেছেন?’
    ‘এটাই যে আপনারা কার হয়ে কাজ করছেন?’
    মেঘমিত্রা ভ্রুকুটি করে তাকালো অর্চিষ্মানের দিকে। হালকা রুক্ষ স্বরে বলল – ‘কার হয়ে কাজ করছি মানে? কী কাজ? আর আপনারা আমার অনুমতি ছাড়া আমার ফ্ল্যাটে ঢুকেছেন কী করে?’
    ‘প্লুটোকে চেনেন?’
    অর্চিষ্মানের এই প্রশ্নে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল মেঘমিত্রার।
    অর্চিষ্মান আরও কাছে এলো তার।
    ‘আপনি জানেন হয়তো প্লুটোর সাথে যে নোংরা খেলাটা আপনি খেলেছেন তাতে তার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। আপনাদের উদ্দেশ্যটা কী এবং আপনারা কার হয়ে কাজ করছেন এটা জানা আমাদের জন্য খুব দরকার। আপনি একা নন। আপনাদের মত বহু মহিলা এ কাজে লিপ্ত। আজ থেকে নয়, বহু বছর থেকে।’
    কথা শেষ করে অর্চিষ্মানের ডান হাতটা ঝড়ের বেগে এগোলে মেঘমিত্রার গলার দিকে। মেঘমিত্রা কিছু বোঝার আগেই, তার সোনার হার আর লকেট অর্চিষ্মানের হাতে চলে এলো।
    ‘এর মধ্যেই না লুকিয়ে আছে, আপনাদের সহজ মুক্তির রহস্য? অফিসার, অ্যারেস্ট করেও নাও। ভয়ের কিছু নেই, এর মুক্তির রাস্তা বন্ধ। নিয়ে যাও একে এন এস ডব্ল্যূ’র অফিসে।’

    চলবে……

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- দি এম্পটি আর্থ (দ্বিতীয় অংশ)

    দি এম্পটি আর্থ (দ্বিতীয় অংশ)
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     


    ………………
    পর্ব – ৬
    …………….

    ডক্টর দিবাকর চৌধুরী বহুদিন পর দেশে ফিরেছেন। আজকাল তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস খুব একটা করেন না। নানা গবেষণার কাজেই ব্যস্ত থাকেন তিনি। মেডিক্যাল সাইন্সের জগতে বেশ বড় রকম ক্রান্তি যে তিনি নিয়ে এসেছেন সেটা বলাই যেতে পারে। বেশ কিছু মারণ রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছেন তিনি। বিগত বেশ কিছু বছর তিনি অ্যামেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন নিজের নতুন গবেষণার কারণে। কোলকাতার এক বড় হোটেলে আজ তার সাংবাদিক সম্মেলন। সম্মেলনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ঘরে ঢুকলো তার সেক্রেটারি আদিত্য বর্মন।
    ‘আপনি কি রেডি স্যার?’
    ডক্টর দিবাকর চৌধুরী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিলেন। পিছনে ফিরে তাকিয়ে বললেন – ‘আদিত্য, এসো এসো। হ্যাঁ, আমি রেডি। এখান থেকে গাড়ি করে গেলে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছতে পনেরো মিনিটও লাগবে না। এখনও হাতে অনেক সময় আছে।’
    ডক্টর চৌধুরীর দিকে এগিয়ে এলো আদিত্য। বলল – ‘জানেন স্যার। কেমন অদ্ভুত লাগছে আমার। এমন একটা জিনিস এর আগে তো কোনও দিন হয়নি। ব্লাড ব্যাংক জানা ছিল। এবার অরগ্যান ব্যাংকও খুলে গেল।’
    অট্টহাস্য করে ডক্টর চৌধুরী বললেন – ‘এখনও খোলেনি আদিত্য, খুলবে। জীবনের সত্তরটা বছর এমনি কাটিয়ে দিইনি আমি। মাথার চুল এমনি সাদা হয়ে যায়নি আমার। চিরকাল চেষ্টা করেছি মনুষ্য জাতির জন্য কিছু করে যাওয়ার। আদিত্য, পরবর্তী কালে মনুষ্য জাতির ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল নয়। প্রত্যেক মানুষকে একে অপরের সাহায্যে আসতে হবে। তবেই হয়তো আমরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবো। মনুষ্য জাতির কাছে আমার একটাই অনুরোধ। যদি তারা বেঁচে থাকতে একে অপরের সাহায্যে না আসতে পারে, তাহলে অন্তত মৃত্যুর পর অপরের সাহায্যে আসুক। কথাটা শুনতে অদ্ভুত লাগলেও কিন্তু এটা ঠিক কথা। আমার নতুন আবিষ্কার মানুষকে মৃত্যুর পরেও অন্যের উপকারের ক্ষেত্রে অনেক সাহায্যে আসবে। ভাবো আদিত্য, একবার ভেবে দেখো…. মৃত্যুর দশ মিনিটের মধ্যে সেই ইনজেকশনটা দিয়ে দিলেই বহু মানুষের উপকার হতে পারে। মৃত মানুষের বহু অঙ্গ.. যেমন কিডনি, লিভার, ফুসফুস আরও অনেক অঙ্গ বহু দিন পর্যন্ত ভালো থাকবে। অরগ্যান ব্যাংক খুলে সেখানে শরীরের সেই অঙ্গগুলোকে স্টোর করে রেখে দেওয়া যাবে। সেগুলো অনেক দিন পরেও অন্যের কাজে তো আসতে পারবে। কোলকাতাতেই খোলা হবে দেশের প্রথম অরগ্যান ব্যাংক। বেশ কিছু হিউম্যান অর্গ্যানের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আপাতত সেগুলো দিয়েই কাজ শুরু করা যাক।’

    পর্ব – ৭
    ……………….

    প্রায় বিকেল পাঁচটা বাজে। কোনও একটা কাজে নিজের অফিস থেকে বেরোলো অর্চিষ্মান। গাড়ি করে যেতে গিয়ে হঠাৎ রাস্তার এক ধারে দেখতে পেল প্লুটোকে। প্লুটো তাদের ফ্ল্যাটের পাশেই থাকে। বয়স আন্দাজ পনেরো বছর। ছেলেটা লেখাপড়ায় ভালো, সুন্দর ক্রিকেটও খেলতে পারে। সুন্দর চেহারা তার। অর্চিষ্মানের সাথে প্লুটোর বেশ বন্ধুত্ব। প্লুটো প্রায়ই অর্চিষ্মানকে বলে – ‘আমি তোমার মত তুখোড় অফিসার হতে চাই। কাজ করতে চাই এন এস ডব্ল্যূ’তে।’
    অট্টহাস্য করে অর্চিষ্মান তখন বলে – ‘কিন্তু তুমি তো ভালো ক্রিকেট খেলো। ভালো খেলোয়ার হবে তুমি।’
    ‘না গো। আসলে কি জানো? নিজের বডি ফিট রাখার জন্য খেলাধুলো খুব দরকার। তাই খেলি।’

    ‘ছেলেটা একা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে করছেটা কী? স্কুল তো অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেছে হবে।’ মনে মনে ভাবলো অর্চিষ্মান।
    নিজের গাড়ি নিয়ে এগোতে গেল সেই দিকে। প্লুটো স্কুল ড্রেসেই আছে। মানে স্কুল শেষে নিজের বাড়ি যায়নি সে। হঠাৎ অর্চিষ্মান দেখলো প্লুটোর সামনে সাদা রঙের এক বড় গাড়ি এসে থামলো। এই গাড়িকে চেনে না সে। প্লুটোর বাবার নিজের গাড়ি আছে। কিন্তু এটা সেই গাড়ি না। গাড়ির চালকের পাশের দরজাটা খুলে গেল। প্লুটো গাড়ির ভিতরে ঢুকলো। গাড়ির ভিতরে প্লুটো ছাড়া আর কে আছে, সেটা দেখতে পেলো না অর্চিষ্মান। প্লুটো গাড়িতে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিলো। এক অজানা গাড়িতে প্লুটোকে যেতে দেখে কিছু একটা সন্দেহ হলো অর্চিষ্মানের। অর্চিষ্মান পিছু নিলো সেই গাড়ির। বেশ খানিক এদিক ওদিক ঘোরার পর সেই সাদা গাড়িটা বালিগঞ্জের এক বড় অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে থামলো। অর্চিষ্মান নিজের গাড়ি বেশ কিছুটা দূরে দাঁড় করিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়েছিল সে দিকে। সে দেখলো গাড়ি থেকে প্লুটো নামার সাথে সাথে চালকের আসন থেকে এক মহিলা নামলো। প্লুটোর দিকে বেশ হাসি মুখে এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে নিজের একটা হাত রেখে তাকে ভিতরে নিয়ে গেল। মহিলাকে চেনে না অর্চিষ্মান। একবার ইচ্ছে হলো ভিতরে গিয়ে দেখার, কিন্তু গেল না সে।

    পর্ব – ৮
    ……………

    বেশ গভীর রাত। অনেকক্ষণ হয়েছে অনন্যা ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম নেই অর্চিষ্মানের চোখে। নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে সে। একাগ্রচিত্তে কিছু দেখে যাচ্ছে সে। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গলো অনন্যার। অর্চিষ্মানকে জেগে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো – ‘এখনও জেগে তুমি? কী ব্যাপার?’
    মোবাইলের দিকে তাকিয়েই অর্চিষ্মান বলল – ‘আজ দু’দিন হলো অনন্যা, আমি নিজের তদন্ত শুরু করতে পারলাম না। তোমার রেফারেন্স হিসেবে দেওয়া প্রফেসার গুহ’র বইয়ের বিষয় অনেক পড়লাম। অনেক তথ্য জানতে পারলাম। তথ্যগুলো সঠিক হলেও জানি না কেন সেগুলো আমি মানতে পারলাম না। মনুষ্য জাতির বিলুপ্তের সম্ভাবনা তিনি দিয়েছিলেন প্রায় একশো বছর। বইটা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল। তাহলে বেশিরভাগ মানুষই আজ বিষাক্ত রেডিয়েশনের ফলে নিজের পুরুষত্ব হারিয়ে ফেলতো। খুব সম্ভব আমিও তার সাইড ইফেক্ট থেকে রক্ষা পেতাম না।’
    ‘কিন্তু এমনটা হচ্ছে অর্চিষ্মান। তুমি সার্ভে রিপোর্ট দেখো। আগের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে মহিলারা পুরুষের সঙ্গ ত্যাগ করছে। তাদের মধ্যে লেসবিয়ানের প্রবণতা অনেক বেশি মাত্রায় সজাগ হয়ে উঠেছে। এর পিছনে কোনও তো কারণ হবে।’
    লেসবিয়ানের কথাটা বলতেই অর্চিষ্মানের মনে পড়ে গেল সপ্তর্ষির বাল্য বন্ধুর কথা। সে এখনও হাসপাতালে ভর্তি। অনন্যাকে সব কথাটা বলল সে। সব শুনে অনন্যা বলল – ‘তাহলে আমি ভুলটা কী বললাম তোমায়? অধিকাংশ বিবাহিত মহিলারা আস্তে আস্তে যদি লেসবিয়ান হয়ে যায় তাহলে দেশের জনসংখ্যা বাড়বে কী করে?’
    ‘সে সব তো ঠিক আছে অনন্যা। কিন্তু আমার একটাই প্রশ্ন। এই বিষাক্ত রেডিয়েশন কি শুধুমাত্র ইন্ডিয়াতেই আছে? রেডিয়েশন তো চারিদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। বিদেশে তো বিজ্ঞান আমাদের দেশের থেকে অনেক বেশি উন্নত মানের। রেডিয়েশনের কুপ্রভাব তো বিদেশে আরও বেশি হওয়া উচিত। তাহলে সেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে হ্রাস দেখা দিচ্ছে না কেন?’
    বেশ ভালো প্রশ্ন তুলেছে অর্চিষ্মান। অর্চিষ্মানের প্রশ্নে চুপ থাকলো অনন্যা। নিজের মোবাইলটা অনন্যার হাতে দিয়ে অর্চিষ্মান বলল – ‘এই ভিডিওটা ভালো করে দেখো অনন্যা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতের হ্রাসের বিষয় সার্চ করতে গিয়ে এই ভিডিওটা পেলাম। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পুরনো ভিডিও।’
    অনন্যা ভালো করে ভিডিওটা দেখলো। একটা মঞ্চ, কেউ একজন মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছে। মঞ্চের সামনে চেয়ারে বসে আছে বহু লোক। প্রায় কুড়ি মিনিটের ভিডিওটা মন দিয়ে দেখলো অনন্যা। সব শেষে বলল – ‘ভদ্রলোকটি কে?’
    ‘চিনতে পারলে না? একসময় বেশ ভালোই বিখ্যাত ছিলেন ইনি। তারপর হঠাৎ করে একদিন উধাও হয়ে গেলেন। এই বক্তৃতাটা দেওয়ার প্রায় পনেরো দিনের পর থেকে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। পুলিশে মিসিং রিপোর্ট লেখানো হয়, কিন্তু কিছুই করতে পারে না পুলিশ। বাড়িতে ছিল তার স্ত্রী এবং দু’ বছরের ছেলে। পরবর্তী কালে তার স্ত্রী এবং পুত্র কোথায় চলে যায়, কেউ জানে না।’
    ‘স্ত্রী এবং পুত্রও মিসিং?’ প্রশ্ন করলো অনন্যা।
    ‘হুম। তারাও মিসিং। অদ্ভুত রহস্যময় কেস ছিল। ভদ্রলোকের নাম ডক্টর অনুপম ব্যানার্জী। শেষ বারের মত তাকে দেখা গিয়েছিল ডক্টর দিবাকর চৌধুরীর সাথে।’
    ‘ডক্টর দিবাকর চৌধুরী!’
    ‘ইয়েস ম্যাম। ডক্টর দিবাকর চৌধুরী.. যিনি আজকের দিনে মেডিক্যাল সাইন্স জগতে বিখ্যাত নাম। তিনি নাকি খুব ভালো বন্ধু ছিলেন অনুপম ব্যানার্জীর। এই ভিডিওটা ভালো করে দেখো অনন্যা। ডক্টর ব্যানার্জী একটা কথায় বিশেষ জোর দিয়েছেন। ওষুধের আসল কাজ হলো মানুষকে সুস্থ করা এবং মানুষের জীবন রক্ষার। মূল্য বৃদ্ধির কারণে ওষুধের দাম দিনে দিনে আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। যে কারণে অধিকাংশ মানুষের কাছে লাইফ সেভিং ড্রাগ পৌঁছতে পারছে না। মেডিক্যাল সাইন্স যদি অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তুলতে না পারে তাহলে সেটা মেডিক্যাল সাইন্সের জন্য বিরাট পরাজয়। ওষুধের দাম কমাতে হবে। ওষুধের এমন দাম রাখতে হবে যাতে বহু গরীব মানুষের কাছে সে ওষুধ পৌঁছতে পারে। এটা হলো ডক্টর ব্যানার্জীর বক্তৃতার প্রথম বিষয়। এবার তার বক্তৃতার দ্বিতীয় বিষয় দেখা যাক। মূল্য বৃদ্ধির কারণ। এটা আমরা প্রত্যেকেই জানি যে আকাশ ছোঁয়া মূল্য বৃদ্ধির মুখ্য কারণ হলো অপ্রত্যাশিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর নিয়ন্ত্রণ আনা খুবই দরকার। যদি আমরা চুপচাপ বসে থাকি তাহলে কিছুতেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব না। তার জন্য কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। এক নতুন ধরনের ওষুধের গবেষণার কথা বলেছিলেন তিনি। কী ওষুধ সেটা জানা যায়নি। কারণ তার গবেষণা পুরো হয়নি।’
    অর্চিষ্মানের মোবাইলটা এতক্ষণে খাটে রেখে দিয়েছে অনন্যা।
    ‘যখন গবেষণা পুরো হয়নি তখন এটা নিয়ে চিন্তা করে কী লাভ?’ অনন্যা জিজ্ঞাসা করলো।
    ‘একটু ভাবো অনন্যা। ডক্টর ব্যানার্জীর ভালো বন্ধু ছিলেন ডক্টর চৌধুরী। ডাঃ ব্যানার্জীকে শেষবারের মত তার সাথেই দেখা যায়। ডাঃ ব্যানার্জী কম মূল্যে ওষুধের কথা বলেছিলেন। পরবর্তী কালে ডাঃ চৌধুরী বহু মারণ রোগের ওষুধের আবিষ্কার করেছেন। প্রত্যেকটি ওষুধের মূল্যই কিন্তু কম। আজও ডাঃ চৌধুরী স্বল্প দামে গরীবের মধ্যে ওষুধ পৌঁছনোর কথা বলেন। কিছু তো একটা আছে অনন্যা যেটা আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে। একবার ডাঃ ব্যানার্জীকে ঝাঁকিয়ে দেখলে কেমন হয়?’

    ‘না, একেবারেই না। বলতে গেলে অসম্ভব।’ কথাটা উচ্চ কন্ঠে বললেন আবির্ভাব গাঙ্গুলী।
    আবির্ভাব গাঙ্গুলীর কেবিনে বসে আছে অর্চিষ্মান।
    ‘কিন্তু কেন স্যার? প্রবলেমটা কোথায়?’
    ‘অদ্ভুত ব্যাপার তো? কোথায় প্রবলেম সেটা তুমি বুঝতে পারছো না? অর্চিষ্মান, আজকের দিনে ডক্টর দিবাকর চৌধুরী শুধুমাত্র ডক্টর কিম্বা গবেষক নন। তিনি একজন সেলিব্রেটি লেভেলের মানুষ। আজ যদি তার কাছে এন এস ডব্ল্যূ’র কোনও অফিসার জিজ্ঞাসাবাদ করতে পৌঁছে যায় তাহলে খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে যাবে। তার পর যদি কোনও সঠিক প্রমাণ না থাকে আমাদের কাছে তাহলে মিডিয়ার অসংখ্য প্রশ্নের বাণ কিন্তু আমাদের দিকেই ধেয়ে আসবে। তখন সামলাতে পারবে তো মিডিয়ার সেই তীক্ষ্ণ প্রশ্নগুলোকে? তুমি যা যা তথ্য আমায় দিলে, সেগুলো যদি আমি মেনেও নিই তাও তোমাকে ডক্টর চৌধুরীর থেকে কোনও প্রকারের জিজ্ঞাসাবাদ করতে আমি বারণই করবো।’
    খানিক চুপ থেকে অর্চিষ্মান বলল – ‘ব্যাপারটা খুব গুরুতর স্যার। আমরা এটা পরিস্কার বুঝতে পারছি, এক সময় ডাঃ অনুপম ব্যানার্জী যে পদ্ধতিতে কাজ করার কথা বলেছিলেন সেই পদ্ধতিতেই পরবর্তী কালে ডাঃ দিবাকর চৌধুরী কাজ করতে শুরু করেন। এক সময় দু’জনের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্বও ছিল। স্যার, আমার বিশ্বাস ডাঃ ব্যানার্জীর অন্তর্ধানের কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে ডাঃ চৌধুরীর কাছে। সবটাই কাকতালীয় হতে পারে না। আর ডাঃ ব্যানার্জীর অন্তর্ধানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অনুপাতে হ্রাস হওয়ার রহস্যটাও। স্যার, আমার এক বন্ধু কাজ করে এক নামী নিউজ চ্যানেলে। আমি তার মাধ্যমে ডাঃ ব্যানার্জীর এক ইন্টারভিউ’এর ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে পারি। যদি তিনি রাজি হোন, তাহলে কেল্লা ফতেহ। আমি না হয় তার ক্যামেরা ম্যান হয়েই ভিতরে প্রবেশ করবো।’

    পর্ব – ১০
    …………….

    অনেক্ষণ হলো সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। কোলকাতার রাস্তা ঘাট এখন আলোয় ঝলমল করছে। একটু আগেই একটা রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়েছে অর্চিষ্মান আর স্বপ্নীল বর্মন। সে কাজ করে এক বিখ্যাত নিউজ চ্যানেলে। আবির্ভাব গাঙ্গুলী থেকে অনুমতি পেয়ে গেছে অর্চিষ্মান। কিন্তু তিনি বলে দিয়েছেন – ‘খুব সামলে অর্চিষ্মান। একটুও যেন এদিক ওদিক না হয়। তাহলে আর ডিপার্টমেন্টের মান সম্মান থাকবে না।’
    অনুমতি পাওয়ার পরেই অর্চিষ্মান ফোন করেছিল নিজের বন্ধুকে।
    ‘এক এমন খবর যা দুনিয়া কাঁপিয়ে দিতে পারে। আজ সন্ধ্যায় দেখা কর, তোকে সব বলবো।’
    রেস্তোরাঁতে বসে অর্চিষ্মানের মুখে সব কথা শুনে স্বপ্নীল বলল – ‘তথ্যটা যদি এক পার্শেন্টও ঠিক হয় তাহলে সত্যি এ খবর দুনিয়া কাঁপাবে। কিন্তু ডাঃ চৌধুরী ক্যামেরার সামনে সব কথা বলবে কেন?’
    ‘সে কখনই ক্যামেরার সামনে সব কথা বলবে না। প্রশ্ন আমি করবো। আমাকে নিজের আসল পরিচয় দিতেই হবে। যাদের জানার তারা এটাই জানবে যে মিডিয়ার লোক এসেছে ইন্টারভিউ নিতে। ঘরের ভিতরে যে এন এস ডব্ল্যূ’র এক অফিসারও আছে, সেটা কেউ জানবে না। আমি জানি আমাকে ছদ্মবেশ নিতে হবে। তার জন্য আমি প্রস্তুত।’
    ‘ঠিক আছে। আমি ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করছি।’

    রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে দু’জনেই নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেল। বেশ কিছু দূর এগোবার পর রাস্তার এক মোড়ে অর্চিষ্মান কাউকে ঘাড় হেঁট করে বসে থাকতে দেখলো। অর্চিষ্মানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকে চিনতে দেরি করলো না। গাড়ি দাঁড় করিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল অর্চিষ্মান।
    ‘তুমি এত রাতে এখানে কী করছো?’
    প্লুটো ঘাড় উঠিয়ে অর্চিষ্মানের দিকে তাকালো। তার চোখ দু’টো কেমন ফুলে গেছে।
    ‘কী হয়েছে প্লুটো?’ অর্চিষ্মান তার পাশে বসলো। প্লুটো আবার ঘাড় হেঁট করলো।
    ‘তোমার যদি কোনও সমস্যা থাকে তাহলে আমায় বলতে পারো। আমি চেষ্টা করবো সাহায্য করার।’
    এবার প্লুটো নিজের মুখ খুলল। বলল – ‘আমার সাহায্য কেউ করতে পারবে না। তুমিও না।’
    ‘চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? বলো।’ প্লুটোর মাথায় হাত রেখে অর্চিষ্মান বলল।
    মাথায় হাত রাখতেই প্লুটোর দু’ চোখ বেয়ে জল বেরিয়ে এলো। কাঁদতে কাঁদতে প্লুটো যা বলল তার সারমর্ম হলো, প্লুটো এক মহিলাকে ভালোবাসতো। মহিলাটির সাথে হঠাৎই একদিন তার আলাপ হয় এক বাস স্ট্যান্ডে। মহিলাটির নাম মেঘমিত্রা। প্লুটোর মিশুকে স্বভাব। খুব তাড়াতাড়ি মহিলাটির সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলল সে। প্লুটোর স্কুল শেষ হলে তারা প্রায় দেখা করতো। বহুবার মেঘমিত্রা প্লুটোকে বালিগঞ্জে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে গেছে। মেঘমিত্রা সেই ফ্ল্যাটে একাই থাকতো। মেঘমিত্রাকে দেখতে সুন্দর। সে প্রায়ই প্লুটোর সামনে নিজের বস্ত্র পরিবর্তন করতো। বয়ঃসন্ধিতে পা রাখা প্লুটো ড্যাবড্যাব করতে তাকিয়ে থাকতো মেঘমিত্রার মসৃণ দেহর দিকে। প্লুটোর কথায়, তাদের মধ্যে প্রথম শারীরিক সম্পর্ক হয় গতকাল। কিন্তু তার পর থেকে মেঘমিত্রার কোনও পাত্তা নেই। প্লুটো বহুবার তাকে ফোন করেছে, কিন্তু বন্ধ পেয়েছে তার ফোন। তার ফ্ল্যাটে গেছে, কিন্তু বন্ধ পেয়েছে তার ফ্ল্যাট। প্লুটো মেঘমিত্রাকে ভালোবেসে ফেলেছে, তাই নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না।
    অর্চিষ্মানের মনে পড়ে গেল সপ্তর্ষির বন্ধু শায়কের কথা। শায়ক আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে। বিয়ের পর কোনও দিনই সে নিজের স্ত্রীকে শারীরিক সুখ দিতে পারেনি। তাই তার স্ত্রী আজ লেসবিয়ান। তার মানে কি শায়ক চিরকালই এমন ছিল? যদি শায়কের কথায় বিশ্বাস করা যায় তাহলে নিজের বয়ঃসন্ধি কালে সে নিজের এক শিক্ষিকার প্রেমে পড়েছিল। তার সাথে একবার শারীরিক সম্পর্কও হয়েছিল শায়কের। সেই শিক্ষিকাকে যে সে সেই বয়সে তৃপ্তি দিতে পেরেছিল সেটা এখনও স্বীকার করে শায়ক। তাহলে হঠাৎ করে তার শরীরে এমন ভয়ংকর পরিবর্তন ঘটল কেন? শায়ক খুব একটা নেশা করে না যার ফলে তার শারীরিক ক্ষমতার পতন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তাহলে কারণটা কী? হঠাৎ একটা কথা মনে পড়লো অর্চিষ্মানের। সপ্তর্ষি তাকে বলেছিল যে শায়কের সেই শিক্ষিকা তার পর কোথাও উধাও হয়ে গিয়েছিল। শায়ক পরে জানতে পেরেছিল যে, সে চরিত্রহীন ছিল। শায়কের একাধিক বন্ধুর সাথে নাকি তার গোপন সম্পর্ক ছিল। কোনও মহিলা কি শুধুমাত্র নিজের শারীরিক খিদে মেটানোর জন্য এমন কাজ করবে? তাহলে তো সে শায়কের সাথে একাধিকবার মিলিত হতে পারতো। খেলা করতে পারতো সে শায়কের সাথে। শায়কের ঘটনাটা প্রায় বাইশ বছর আগেকার। এতদিন পর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। শুধুই কি শায়ক আর প্লুটো? শায়কের বন্ধুরাও তো আছে। আছে হয়তো আরও অসংখ্য ছেলে। একটা ট্যাক্সিতে বসিয়ে প্লুটোকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় অর্চিষ্মান। নিজে এগিয়ে যায় বালিগঞ্জের দিকে।

    চলবে….

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- দি এম্পটি আর্থ (প্রথম অংশ)

    দি এম্পটি আর্থ (প্রথম অংশ)
    – বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

     

    পর্ব – ১
    …………….
    সাল – 2022
    …………………

    এক সাংবাদিক প্রফেসার প্রফুল্ল গুহকে প্রশ্ন করলো – ‘এটা কি শুধু আপনার অনুমান মাত্র?’
    প্রফুল্ল গুহ তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে জবাব দিলেন – ‘বইটা ভালো করে আগে পড়ুন আপনি। জবাব পেয়ে যাবেন। আমাদের পূর্বপুরুষদের নাম বলতে গেলে দু’বার ঢোঁক গিলতে হয়। এক পুরুষ, দু’পুরুষ, তিন পুরুষ…ব্যাস, এখানেই শেষ। এরপর আর মনে থাকে না। কে মনে রাখবে চোদ্দ পুরুষের নাম? মনে রাখা তো দূরের কথা, আমরা জানিই না তাদের নাম কী ছিল। বলতে গেলে পূর্বপুরুষদের বিশাল লিস্ট। কিন্তু আমাদের আগামী প্রজন্মের ক্ষেত্রে কি লিস্টটা বিশাল হবে? আমার নাতি, তার নাতি, তার নাতি…. এরা কি আদৌ জন্ম গ্রহণ করবে কি না একটা সন্দেহ থেকেই যায়। কিছু বছর আগে আমরা যে পাখিদের দেখতাম, অধিকাংশই তারা বিলুপ্ত প্রায়। যে পোকামাকড়কে দেখতাম তারাও বেশিরভাগ বিলুপ্তের পথে। যে পরিমাণে আমাদের আশেপাশে বিষাক্ত রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়ছে, তার দৌলতে বেশি দিন নেই যে মনুষ্য জাতিও বিলুপ্তের পথে এগিয়ে যাবে। বেশি দিন না, খুব বেশি হলে একশো বছর। তার পর মানুষের অবশেষ থেকে যাবে মাত্র এই পৃথিবীতে। আমি নিজের বই ‘দি এম্পটি আর্থ’এ বোঝাবারই চেষ্টা করেছি। আরও অনেক তথ্য আছে, আরও অনেক কারণের ব্যাখ্যা করা আছে এই বইয়ে। পড়লে বুঝতে পারবেন।’
    নিজের কথা শেষ করলেন প্রফেসার প্রফুল্ল গুহ।

    পর্ব – ২
    ………………
    সাল – 2036
    ……………………

    ডক্টর অনুপম ব্যানার্জী একটা বক্তৃতা দিয়ে বাড়ি ফিরছেন। তার থ্রী ডি মোবাইলে রিং হলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠল ডক্টর দিবাকর চৌধুরীর মুখ।
    ‘হ্যালো।’
    ‘কনগ্রাচুলেশন ডক্টর ব্যানার্জী। আপনার বক্তৃতা শুনলাম। জাস্ট ফ্যান্টাস্টিক। এক দিকে আপনি ডক্টর আর অন্য দিকে এক সফল গবেষক। আপনার সাকসেস দেখে সমস্ত ডক্টর জাতির বুক ফুলে উঠবে।’
    ‘থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর চৌধুরী।’
    ‘নো ডক্টর নো। শুধু থ্যাঙ্ক ইউ দিয়ে কাজ হবে না। চলে আসুন, দেখা করা যাক। সেলিব্রেট করা যাক। আজ রাত আটটায় ড্রিম ল্যান্ড বারে চলে আসুন। আপনার অপেক্ষা করবো আমি।’

    মুখোমুখি বসে আছেন দুই বিখ্যাত ডক্টর…. ডক্টর অনুপম ব্যানার্জী আর ডক্টর দিবাকর চৌধুরী। তাদের সামনের টেবিলে কিছু খাবার আর দু’টো গ্লাসে দামী বিলেতি মদ। গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে ডক্টর ব্যানার্জী বললেন – ‘আজকের দিনে আমরা দু’ জনেই কিছুটা হলেও বিখ্যাত হয়েছি। নিজেদের কঠিন পরিশ্রমের ফলে। কিন্তু ব্যাপারটা কী জানেন ডক্টর চৌধুরী? আমাদের চিন্তাধারা অনেকটা এক হলেও আমাদের কাজ করার পদ্ধতিতে বিস্তর তফাৎ। আপনাকে সাথে নিয়ে আমি একটা গবেষণাতে হাত দিয়েছিলাম। পরিণাম আপনার জানা আছে। কাজের মাঝে যদি ইগো প্রবলেম চলে আসে তাহলে সেই কাজ কোনও দিন সাকসেস হয় না।’
    ‘কিন্তু আমাদের লক্ষ্য যে এক সেটা তো আপনি জানেন? এ বিষয়ে প্রথম আমিই আপনাকে বলেছিলাম। আপনি আমার থেকে পুরো ব্যাপারটা শুনে নিজে গবেষণা করতে শুরু করলেন। আমাকে জানাবার প্রয়োজন বোধ করলেন না একবারও। স্পাই লাগিয়ে আমি সেটা জানতে পারি। দেখুন ডক্টর ব্যানার্জী, আপনি গবেষণা চালিয়ে যান, আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি শুধু এটা চাই যে গবেষণার শেষে ক্রেডিটে যেন আমার নামটাও থাকে।’ বললেন ডক্টর চৌধুরী।
    একটা কটাক্ষের হাসি হাসলেন ডক্টর অনুপম ব্যানার্জী। বললেন – ‘আপনি যদি এটা মনে করছেন যে আমি আপনার আইডিয়া চুরি করেছি, তাহলে সেটা ভুল ভাবছেন আপনি। এই আইডিয়াটা বহু দিন আগেই আমার মাথায় এসেছিল। আর যত দূর ক্রেডিটের কথা বলছেন, আমি অকারণ কাউকে ক্রেডিট দিই না।’

    পর্ব – ৩
    …………..
    সাল – 2048
    ……………………

    শায়কের খুব ভালোলাগে তৃষাকে। তৃষা তার থেকে বয়সে বড়, তার স্কুলের শিক্ষিকা। কিন্তু ভালোবাসা কি বয়স মানে? হয়তো না। শায়কের বয়স কম…. চোদ্দ, পনেরো বছর। বলা হয় নাকি এই সময়টা খুব খারাপ। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ খুবই বেশি থাকে এই বয়সে। হয়তো বিপরীত লিঙ্গের বিষয় জানার প্রবল ইচ্ছের কারণে। তৃষার বয়স তিরিশের ঊর্ধ্বে। বেশ খোলামেলা সে। শুধু পোষাকেই নয়, স্বভাবেও। শায়কের প্রতি যেন একটু বেশিই খোলামেলা হয়ে যায় তৃষা। তার এই খোলামেলা স্বভাবই শায়ককে আকৃষ্ট করে তার দিকে। কারণে অকারণে শায়কের গালে, হাতে, উরুতে হাত দেওয়া যেন নিজের স্বভাব বানিয়ে নিয়েছে তৃষা। শুরুতে শায়কের অস্বস্তি হতো, পরে সেটা অভ্যাস হয়ে গেল তার। তৃষার দেখাদেখি শায়কও সেই কাজ করতে শুরু করলো। তৃষা কোনও বাধা দিলো না। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে তৃষা একদিন শায়ককে বলল – ‘শায়ক, কাল স্পেশাল দিন।’
    ‘কেন ম্যাম?’ প্রশ্ন করলো শায়ক।
    ‘উফ্ফ! কতবার তোমাকে বারণ করেছি যে আমায় ম্যাম বলবে না। বাকি স্টুডেন্টের সামনে ম্যাম বলো সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আড়ালে তো আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারো। আমারও ভালো লাগবে। হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম। কাল স্পেশাল দিন। কারণ, কাল আমার বার্থ ডে। আর কেমন কোইনসিডেন্স ভাবো, কাল আবার ছুটির দিন। কাল তুমি আমার ফ্ল্যাটে আসবে। আমরা দু’জনে মিলে সেলিব্রেট করবো।’
    ‘কিন্তু আমি বাড়িতে কী বলে বেরবো?’
    ‘উফ্ফ শায়ক। যুগ কত এগিয়ে গেছে। আর তুমি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পুরনো কথা বলছো?’

    বাড়িতে কিছু একটা বলে বেরিয়ে পড়েছিল শায়ক। সে জানে তৃষার ফ্ল্যাটে তৃষা ছাড়া আর কেউ থাকে না। তৃষা কোনও দিন এমন প্রস্তাব দিতে পারে সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি শায়ক। তার মনটা বারবার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছিল তৃষাকে কাছ থেকে পাবে বলে। পনেরো বছরের শায়ক সে দিন প্রথমবার শারীরিক সম্পর্কের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল। মদের নেশায় উন্মাদ হয়ে ছিঁড়ে খেতে চেয়েছিল তৃষার নগ্ন দেহকে। যখন ঘুম ভাঙ্গে শায়কের তখন নিজেকে পায় তৃষার বিছানায়। পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে তৃষা। মৃদু হাসছে শায়কের দিকে তাকিয়ে।
    শায়কের হৃদয় চুড়মাড় হয়ে গেল সে দিন, যে দিন সে নিজের বেশ কিছু বন্ধুর থেকে জানতে পারে যে তৃষা নাকি তাদের সাথেও শারীরিক সম্পর্ক করেছে। তৃষাকে আর স্কুলে দেখা গেল না। সে কোথায় চলে গেল কেউ জানে না।

    প্রায় বছর দেড়েক পর পুলিশ দেশের বেশ কিছু জায়গা থেকে বহুসংখ্যক মহিলাদের গ্রেপ্তার করে। অভিযোগ, তারা নাকি জোর করে অল্প বয়সী ছেলেদের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। বলতে গেলে অল্প বয়সী ছেলেদের ধর্ষণ করে তারা। ছেলেদের আগে নিজের প্রেমে ফাঁসানোর চেষ্টা করে। চেষ্টায় সফল হলে ভালো, না তো সোজা ধর্ষণ। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, প্রত্যেক মহিলারাই হয়তো গ্রেপ্তারের আগে কিম্বা পরে আত্মহত্যা করে। তাদের কাছে নাকি পটাশিয়াম সায়ানাইড ছিল।

    পর্ব – ৪
    ………………
    সাল – 2070
    ……………………

    কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে অর্চিষ্মান বলল – ‘ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। না ভেবে উপায় নেই।’
    সামনে বসে আছেন তার সিনিয়ার আবির্ভাব গাঙ্গুলী। তিনি বললেন – ‘তাই তো তোমায় বলছি। ভালো করে চিন্তা করে দেখো। এর কূলকিনারা আমাদের বের করতেই হবে।’
    ‘রেশিও টা সাংঘাতিক। শেষ কুড়ি পঁচিশ বছরের মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। সাল 2050এ আমাদের দেশের পপুলেশন ছিল প্রায় একশো ষাট কোটির মত, যেটা কুড়ি বছর পর এখন মাত্র একশো চৌষট্টি কোটি। কুড়ি বছরে মাত্র চার কোটি।’ বলল অর্চিষ্মান।
    ‘চিন্তার বিষয় তো এটাই অর্চিষ্মান। মৃত্যুর অনুপাতও যে বেড়েছে তাও নয়। হঠাৎ করে মানুষের জন্ম কমে গেল কেন? এমনও তো নয় যে লোকেরা বিয়ে করছে না। বিয়েও করছে, সংসারও করছে, তাদের সন্তানও জন্মাচ্ছে। তাহলে মানুষ জন্ম অনুপাতে এত পতনের কারণ কী?’
    খানিক চিন্তা করে আভির্ভাব গাঙ্গুলী আবার বললেন – ‘কোথাও গন্ডগোল আছে অর্চিষ্মান। আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। এই দায়িত্বটা আমি তোমার উপর দিলাম। আমাদের ডিপার্টমেন্টে তুমি সব থেকে সাকসেস অফিসার। তাই সব থেকে আগে তোমার নামটাই আমার মাথায় এলো। কাজে লেগে পড়ো।’

    ভারত সরকারের এক নতুন ডিপার্টমেন্ট – এন এস ডব্ল্যু ( ন্যাশনাল সিক্যুরিটি উইং )। যেমন যেমন দিন এগিয়েছে, অরাজকতা ছড়িয়েছে চারিদিকে। কিছু বছর আগে পর্যন্তও দেশের ভিতরের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল পুলিশের হাতে। কিন্তু বহুক্ষেত্রেই পুলিশের অসফলতা ভাবতে বাধ্য করে সরকারকে। আগে পুলিশ অথবা সরকারি গোয়েন্দা এজেন্সি থেকে উচ্চ মানের অফিসারদের নিয়ে শুরু হয়েছিল এন এস ডব্ল্যু। আস্তে আস্তে এন এস ডব্ল্যু’তে কর্মচারীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রয়োজন হলো। শুরু হলো সম্পূর্ণ আলাদা পদ্ধতিতে এই নতুন ডিপার্টমেন্টে কর্মচারী নির্বাচন।
    এন এস ডব্ল্যু দেশ জুড়ে পেল বেশ কিছু তুখোড় অফিসার। তাদেরই মধ্যে একজন অর্চিষ্মান অধিকারী। অর্চিষ্মানের স্ত্রী অনন্যা অধিকারী নিজেও কাজ করে এন এস ডব্ল্যু’তে। চাকরি সূত্রেই পরিচয়, বন্ধুত্ব, অবশেষে বিয়ে। তাদের বিয়ে হয়েছে প্রায় ছ মাস হলো।
    নিজের সিনিয়ার আভির্ভাব গাঙ্গুলীর সাথে মিটিং করে অর্চিষ্মান যখন নিজের ফ্ল্যাটে ফিরলো তখন রাত প্রায় ন’টা বাজে। ডিনার টেবিলে অনন্যাকে সব কথা বলল অর্চিষ্মান।
    ‘এটা তো এক না এক দিন হওয়ারই ছিল।’ সব কথা শুনে বলল অনন্যা।
    ‘মানে? কী বলতে চাও তুমি?’
    ‘আমি এটা বলতে চাই যে মানুষ নিজের শত্রু নিজেই। মানুষের থেকে বড় শত্রু মানুষের নেই। মানুষ নিজের চিতা নিজেই বানায় আর নিজের কবর নিজেই খোঁড়ে।’
    ‘হেঁয়ালি করো না অনন্যা। কী বলতে চাও সেটা পরিস্কার করে বলো।’ বলল অর্চিষ্মান।
    ‘তোমার ইনভেস্টিগেশনের ক্ষেত্রে একটা ক্লু তোমায় দিতে পারি অর্চিষ্মান। জানি না সেই ক্লু’টা তোমার কত কাজে আসবে।’
    ‘কী ক্লু?’
    তাদের ডিনার শেষ। খাবারের প্লেটগুলো রান্না ঘরে রেখে সোফাতে অর্চিষ্মানের পাশে বসে অনন্যা বলল – ‘তুমি তো জানো যে আমার চিরকালই বই পড়ার খুব শখ। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে.. বছর কম বেশি হতেও পারে, প্রফুল্ল গুহ নামের এক প্রফেসরের একটা বই বেরিয়েছিল। বইটার নাম ছিল – দি এম্পটি আর্থ। বইটা খুব যে বিখ্যাত তা নয়, কিন্তু বইটাতে অনেক কিছু দেওয়া আছে। আজ যে সমস্যার কথা তুমি বলছো, সেটার বিষয় প্রফুল্ল গুহ বহুদিন আগেই লিখে গেছেন।’
    ‘তুমি কি বইটা পড়েছ?’ জিজ্ঞাসা করলো অর্চিষ্মান।
    ‘না, বইটা পড়িনি আমি। তবে বইটার রিভিউ পড়েছি। অর্চিষ্মান, আমরা আজকের দিনে চারিদিক দিয়ে ঘিরে আছি অসংখ্য বিষাক্ত রেডিয়েশনে। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে রেডিয়েশন তত বিষাক্ত হচ্ছে। বিষাক্ত রেডিয়েশনের ফলে আজ থেকে পঞ্চাশ, ষাট বছর আগে থেকেই পাখি ও পোকামাকড়ের বহু প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেই বইয়ে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে বিজ্ঞানের উন্নতির সীমা থাকা উচিত। বিজ্ঞান যত উন্নতি করবে, মানুষ তত তাড়াতাড়ি ধ্বংসের দিকে এগোবে।’
    ‘তার মানে তুমি এটা বলতে চাও যে মনুষ্য জাতি বিলুপ্তের পথে এগোচ্ছে?’ প্রশ্ন করলো অর্চিষ্মান।
    ‘হতেও পারে। বিষাক্ত সব রেডিয়েশনের ফলে মানুষের মধ্যে প্রজনন ক্ষমতার যে হ্রাস হবে সেটা তো জানা কথা। যখন মানুষের মধ্যে প্রজনন ক্ষমতা থাকবে না তখন পপুলেশন বাড়ার রেশিওতেও যে হ্রাস ঘটবে সেটা আর বলে দিতে হবে না।’
    ঘাড় হেঁট করে অনন্যার কথা গুলো শুনছিল অর্চিষ্মান। কথাগুলো ঠিকই বলছে সে, কিন্তু তাও এসব কথা মেনে নিতে মন চাইছে না অর্চিষ্মানের। অনেক রাত পর্যন্ত ইন্টারনেট ঘাঁটলো সে। ‘দি এম্পটি আর্থ’এর বিষয় অনেক তথ্য সংগ্রহ করলো। শুধুমাত্র বিষাক্ত রেডিয়েশনের জন্য দেশের এমন অবস্থা, এটা মেনে নিতে মন চাইছে না তার। মন কেন চাইছে না, সেটার উত্তর সে নিজেও জানে না।

    পর্ব– ৫

    লাঞ্চ টাইম। অফিসের ক্যান্টিনে চুপচাপ বসে আছে অর্চিষ্মান। কোথায় থেকে তদন্ত শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না সে। প্রফেসার প্রফুল্ল গুহ’র যুক্তি দিয়ে কেসের ফাইলটা বন্ধ করে দেওয়াও ঠিক মনে করছে না সে। কেমন যেন দায়সারা কাজ হবে সেটা। এর মূলে সত্যিই যদি কোনও গভীর রহস্য থাকে তাহলে সেটা চিরকালের মত রহস্যই থেকে যাবে। কিন্তু সে তদন্ত শুরু করবেই বা কোথা থেকে? কাল অনেক রাত পর্যন্ত জন্মবৃদ্ধি অনুপাতের হ্রাসের বিষয় ইন্টারনেট ঘেঁটে তথ্য জোগাড় করেছে সে, নানা ওয়েবসাইট থেকে। বিষাক্ত রেডিয়েশনের বিষয় অনেক ওয়েবসাইটেই লেখা আছে। আর লেখা আছে বেশ কিছু মেডিক্যাল কারণ। পুরুষের শরীরে শুক্রাণু হ্রাসের অনেক মেডিক্যাল কারণ খুঁজে পেল সে। কিন্তু কোনও তথ্যতেই সন্তুষ্ট হতে পারলো না অর্চিষ্মান। চিন্তায় মগ্ন ছিল সে। তার সামনের চেয়ারে কখন সপ্তর্ষি এসে বসেছে, সে খেয়াল করেনি। সপ্তর্ষি ভৌমিক, অর্চিষ্মানের কলিগ।
    ‘ধ্যানমগ্ন দেখছি।’
    সপ্তর্ষির কথায় সংবিৎ ফিরে পেল অর্চিষ্মান।
    ‘সকাল থেকে তোকে দেখিনি অফিসে।’ অর্চিষ্মান বলল।
    ‘ছিলাম না রে। গিয়েছিলাম হসপিটাল।’
    ‘হঠাৎ হসপিটাল? এনি প্রবলেম?’
    ‘প্রবলেমটা আমার নয়। আমার এক বন্ধুর। আমার ছোট বেলার বন্ধু। বলতে গেলে তার জীবনে ঝড় উঠেছে। সুসাইড অ্যাটেম্পট করেছে সে।’
    ‘ব্যাপারটা কী?’ প্রশ্ন করলো অর্চিষ্মান।
    খানিক চুপ থেকে সপ্তর্ষি বলল – ‘পারিবারিক সমস্যা আর কি। ছেলেটা চিরকালই খুব ভালো, আমার খুব কাছের বন্ধু। সব কথাই আমার সাথে শেয়ার করে সে। প্রায় এক বছর হয়েছে তার বিয়ের। বর, বৌ দু’জনেই ভালো চাকরি করে। হঠাৎ তার বৌ অন্য একজনের প্রেমে পড়ে। অদ্ভুত ব্যাপার দেখ, যার প্রেমে পড়ে সে আবার একটা মহিলা। বলতে গেলে তারা লেসবিয়ান।’
    কথাটা শুনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল অর্চিষ্মান। বলল – ‘এমন ঘটনা আজ চারিদিকে। এতে নতুনত্ব কিছু নেই।’
    ‘ঠিকই বলেছিস। এটা যেন একটা ট্রেন্ড হয়ে যাচ্ছে, একটা ফ্যাশান হয়ে যাচ্ছে।’
    ‘সব জিনিসের পিছনেই কিছু না কিছু কারণ থাকে সপ্তর্ষি। হঠাৎ করে কেউ নিজেকে পরিবর্তন করে না। মনে কর তোর বন্ধুর বৌ যদি বাই সেক্সুয়াল হত তাহলে খুব সম্ভব বিয়ের আগেও তার কোনও না কোনও নারীর সাথে সম্পর্ক থাকতো। বিয়ের এত দিন পর হঠাৎ করে সে কোনও নারীর প্রেমে পড়তো না।’
    খানিক চুপ থেকে এদিক ওদিক তাকিয়ে সপ্তর্ষি বলল – ‘সব কথা এখানে বলা যাবে না অর্চিষ্মান। শোনার অনেক লোক আছে এখানে। সবার সামনে কারোর পারসোনাল লাইফ ডিসকাস করে সেই লোককে ছোট করতে চাই না আমি। আর সব থেকে বড় কথা সে যখন আমার বন্ধু। বাইরে চল, তোকে বলছি সব।’

    চলবে…

You cannot copy content of this page