• গল্প

    গল্প- মাই বেস্ট সেল্ফি

    মাই বেস্ট সেল্ফি
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

    ‘এখন আমি ভাবি যে সত্যই আমি খুব বোকা ছিলাম এক সময়। আমাকে স্মার্ট করলো আমার ছেলে।’ চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে নীহাররঞ্জন বাবু বললেন।
    প্রতিদিন সকালে বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে গিয়ে চা পান করা তাঁর অভ্যাস। বাড়িতে তাঁর স্ত্রী চা বানিয়ে দেন ঠিকই, কিন্তু তাতে মন ভরে না তাঁর। নিজের ছোট বেলার বন্ধু দ্বারিকা প্রসাদ গাঙ্গুলীর সাথে চায়ের চুমুক ও রাজনীতির আলোচনা না হলে সারা দিনটা কেমন ঝিমিয়ে থাকে তাঁর। না, আজ চায়ের চুমুকের সাথে রাজনীতি সংক্রান্ত কোনো আলোচনা হয়নি। দু’দিন আগে নীহাররঞ্জন বাবুর ছেলে তাঁকে কিনে দিয়েছে একটা স্মার্ট ফোন। সেটাই ছিল আলোচনার বিষয়। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে নিহাররঞ্জন বাবু আবার বললেন – ‘বহু দিন আগে টি ভি তে একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম দ্বারিকা, “কার লো দুনিয়া মুট্ঠী মে।” সত্যি, পুরো দুনিয়াটা মুঠোতেই চলে এলো। এই চায়ের দোকানে বসে যে আমি বিদেশ যাত্রাও করতে পারি, সেটা কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবিনি আমি।’
    নিজের পাঞ্জাবির পকেট থেকে নতুন স্মার্ট ফোনটা বের করে তিনি নিজের বাল্যবন্ধু দ্বারিকা বাবুকে দেখালেন। স্মার্ট ফোনটা ভালো করে দেখে নীহাররঞ্জন বাবুকে সেটা ফেরত দিয়ে দ্বারিকা বাবু জিজ্ঞেস করলেন – ‘হ্যান্ডেল করতে পারিস তো?’
    ‘আর বলিস না। গত দু’দিন ধরে ছেলের কাছে সেটাই তো শিখছি। তুই জানিস তো আমার নিজের ফটো তোলাবার কতো শখ ছিল ছোট থেকেই। নিজের ফটো তোলাবার জন্য এবার কাউকে খোশামোদ করতে হবে না আমায়। নিজের ফটো এবার নিজেই তুলতে পারবো আমি।’
    কথা শেষ করেই মোবাইলের সামনের ক্যামেরা দিয়ে নিজের একটা ছবি তুলে দ্বারিকা বাবুকে দেখালেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন – ‘তুই জানিস দ্বারিকা, এটা কে কী বলে?’
    ‘না, জানি না।’ বললেন দ্বারিকা বাবু।
    ‘এটা কে বলে সেল্ফি। তুই একটু কাছে আয় আমার। আমরা দু’জনে এক সাথে একটা সেল্ফি তুলি।’

    দারূণ লাগছে, খুব সুন্দর, অপূর্ব, অনবদ্য ইত্যাদি – ইত্যাদি মন্তব্যে মনটা খুশিতে ভরে যায় নীহাররঞ্জন ভৌমিকের। নীহাররঞ্জন বাবু ব্যাবসাদার। কোলকাতার হাতিবাগান এলাকায় মস্ত বড় এক শাড়ির দোকানের মালিক তিনি। আধুনিক প্রযুক্তি থেকে এতো দিন ছিলেন বহু দূর। কিন্তু এই কিছু দিনে ছেলের দৌলতে আধুনিক প্রযুক্তিকে অনেকটাই রপ্ত করতে পেরেছেন তিনি। এখন মনে হয়, জীবনের সত্তরটা বছর যেন অন্ধকারেই কেটে গেল।
    ‘আমাদের সময় যদি এ সব হতো তাহলে তো আমি দুনিয়া কাঁপিয়ে দিতাম।’ এ কথা আজকাল প্রায় বলেন তিনি। নীহাররঞ্জন বাবু ব্যাবসাদার, তাই প্রচুর লোকের সাথে তাঁর পরিচয়। ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলতেই কিছু দিনের মধ্যেই বন্ধুর সংখ্যা হাজার ছড়িয়ে গেল। ফেসবুকে নীহাররঞ্জন বাবুর কাজ হলো রোজ নানা ভঙ্গিমায় সেল্ফি তুলে পোস্ট করা। চার শত – পাঁচ শতটা লাইক ও এক শতর ওপরে কমেন্ট দেখে তিনি লাফিয়ে ওঠেন।
    ‘তুইও একটা স্মার্ট ফোন কিনে নে দ্বারিকা। রিটায়ার করে গেছিস। সারা দিন কোনো কাজ তো নেই তোর। ফেসবুক করবি, খবর দেখবি, কতো কিছু করতে পারবি। খবর দেখার জন্য আর তোকে টি ভি খুলতে হবে না। তুই তো জানিস যে রোজ রাতে খবর দেখা আমার অভ্যাস। এই নিয়ে গিন্নির সাথে প্রায় রোজ ঝামেলা। গিন্নি সিরিয়াল দেখবে আর আমি খবর। স্মার্ট ফোন আসাতে সেই ঝামেলাটা চিরকালের মতো শেষ হয়ে গেল। এখন গিন্নি টি ভিতে সিরিয়াল দেখে আর আমি নিজের ঘরে বসে হাতে এই মোবাইলটা নিয়ে খবর দেখি।’
    দ্বারিকা বাবু চুপ থাকেন। আধুনিক প্রযুক্তির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন কি না তাতে সন্দেহ আছে তাঁর।

    দিনটা ছিল রবিবার। ঘুম থেকে ভোরে ওঠা নীহাররঞ্জন বাবুর চিরকালের অভ্যাস। সূর্যোদয়ের আগে উঠে ছাদে গিয়ে ব্যায়াম করেন তিনি। এখন ব্যায়াম করেতে যাওয়ার আগে একবার নিজের ফেসবুক এ্যাকাউন্টে চোখ বুলিয়ে নিতে ভোলেন না তিনি। ঘুম চোখেই নিজের ফেসবুক এ্যাকাউন্ট দেখতে গিয়ে একটা খবরে নজর গেল তাঁর। কাশ্মীরে জঙ্গীরা নাকি আর্মীর কোনো ক্যাম্পে মাঝ রাতে হামলা করেছে। প্রায় চল্লিশ জন জওয়ান শহীদ হয়েছে। সকালে উঠেই এহেন খবর পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল তাঁর। মন মরা হয় মোবাইলটা রাখতেই পাশের বাড়ি থেকে গলা ফাটানো কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন তিনি। নীহাররঞ্জন বাবু চমকে উঠলেন। কার বাড়ি থেকে আসছে এই বিকট কান্নার আওয়াজ? আর কেনই বা আসছে? হঠাৎ তাঁর মনে পড়লো দ্বারিকা বাবুর একটি মাত্র ছেলেই তো আর্মীতে কাজ করে। সে আছেও এখন কাশ্মীরে। কথাটা ভেবেই হৃদয় স্পন্দন তীব্র হয়ে গেল তাঁর। বুক টা ছ্যাঁৎ করে উঠল। তাহলে কি কান্নার আওয়াজটা দ্বারিকার বাড়ি থেকেই আসছে? কোনো রকমে গায়ে একটা জামা গলিয়ে ছুটলেন দ্বারিকা প্রসাদ গাঙ্গুলীর বাড়ি। দ্বারিকা বাবুর বাড়ি নীহাররঞ্জন বাবুর বাড়ির পাশেই, দু’টো বাড়ি পেরিয়ে। যেতে বেশি সময় লাগলো না। বাড়ি তে ঢুকেই নীহাররঞ্জন বাবু দেখলেন, দ্বারিকা বাবুর স্ত্রী মাটিতে বসে বুক চাপড়ে আর্তনাদ করছেন এবং ঘরের এক কোণায় দেয়ালে ঠেস দিয়ে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন দ্বারিকা গাঙ্গুলী। নীহাররঞ্জন বাবু লঘু কদমে নিজের বাল্যবন্ধুর দিকে এগিয়ে গেলেন। কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন – ‘কী হয়েছে দ্বারিকা?’
    দ্বারিকা বাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন নীহাররঞ্জন বাবুর দিতে। কাঁপা – কাঁপা গলায় বললেন – ‘কাল বিকেলেই দীপকের সাথে কথা হয়েছিল। কিছু দিন পর ছুটি পাচ্ছিল সে। কতো খুশি ছিল।’
    কথা বলতে – বলতে থেমে গেলেন দ্বারিকা বাবু। কন্ঠরোধ হয়ে গেলো তাঁর। নীহাররঞ্জন বাবু দাঁড়িয়ে রইলেন ভাবলেশহীন হয়।

    দু’ দিন পরের ঘটনা। শহরে দ্বারিকা প্রসাদ গাঙ্গুলীর একটি মাত্র পুত্র শহীদ দীপক গাঙ্গুলীর মৃত দেহ সম্মানের সাথে নিয়ে আনা হলো। কফিনের ভেতর দীপকের মৃত দেহ, যেটাকে জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। অসংখ্য মানুষ অপেক্ষা করছে নিজের দেশের জন্য শহীদ হওয়া সেই বীর সৈনিকের শেষ দর্শনের। দ্বারিকা প্রসাদ সহ প্রত্যেকের চোখেই জল। নীহাররঞ্জন বাবু নিজের চোখেও দু’ ফোঁটা জল অনুভব করলেন। আর্মীর গাড়ি থেকে যখন কফিনে বন্দী দীপকের মৃত দেহকে নামানো হলো তখন দ্বারিকা বাবু নিজেকে আর সামলাতে না পেরে ছুটে গেলেন সে দিকে। কফিনকে জড়িয়ে শুরু করলেন বিলাপ। আর্মীর লোকেরা ধরাধরি করে তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে গেল। নীহাররঞ্জন বাবু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে এ সব দৃশ্য দেখছিলেন। হঠাৎ কি একটা ভেবে এগিয়ে গেলেন কফিনের দিকে। তিনি প্রথম বার কোনো শহীদের কফিন দেখছেন। কফিনের ভেতর যার মৃত দেহ সে এখন তাঁর বাল্যবন্ধুর একটি মাত্র সন্তান নয়, সে এখন দেশের জন্য শহীদ হওয়া এক বীর সৈনিক। এ মুহূর্তে দেশের জন্য শহীদ হওয়া সৈনিকের মৃত দেহের সামনে দাঁড়ানোটা গর্বের বিষয় মনে করলেন তিনি। দু’ হাত দিয়ে কফিনে ঢাকা সেই দেহকে প্রণাম করলেন তিনি এবং নিজের প্যান্টের পকেট থেকে বের নিজের স্মার্ট ফোন।
    ‘লোকেরা অনেক সেল্ফি তোলে। সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে, খেলোয়াড়ের সাথে, সিনেমার হিরো – হিরোইনের সাথে। কিন্তু ক’ জন শহীদের সাথে সেল্ফি তোলার সুযোগ পায়? আমার সৌভাগ্য যে আমি এই সুযোগ পেলাম। এই সুযোগকে হাতছাড়া করা চলবে না। অনেক সেল্ফি তুলেছি আমি, কিন্তু এটাই হবে আমার বেস্ট সেল্ফি।’
    কথাটা ভাবা মাত্রই নিজের স্মার্ট ফোনের সামনের ক্যামেরাটা অন করলেন নীহাররঞ্জন বাবু। অসংখ্য লাইক – কমেন্টের আশার মাঝে একটা শব্দ শোনা গেল – ক্লিক।

    সে দিনটাই ছিল নীহাররঞ্জন বাবুর smartস্মার্ট ফোন ব্যবহার করার শেষ দিন। এতো লাঞ্ছনা তাঁকে আগে কোনো দিন সহ্য করতে হয়নি। ছবিতে একটাও লাইক না পড়লেও কমেন্ট পড়েছে প্রচুর। এমন কমেন্ট যেগুলো পড়ে নীহাররঞ্জন বাবুর নিজের ওপরেই ঘৃণা হয়ে গেল। দ্বারিকা বাবুর বাড়ি তে সান্ত্বনা দিতে যাওয়া তো দূরের কথা, ওনার সামনে পর্যন্ত যেতে পারেননি তিনি। সেল্ফি তোলার নেশা তাঁকে আজ প্রায় গৃহ বন্দী করে রেখে দিয়েছে। নিজের মোবাইলের দিকে তিনি আজকাল তাকিয়ে থাকেন এবং ভাবেন – ‘এই স্মার্ট ফোনটা আমার জীবনে না আসলেই ভালো হতো। আমার বেস্ট সেল্ফি আমার ওয়ারস্ট সেল্ফি হয়ে গেল।’

    সমাপ্ত।

  • অণু গল্প

    আমার মেয়ে….

    আমার মেয়ে….
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

     

    আমি নিজের মেয়ের হত্যা করিনি। আমি তো তাকে ভালবাসতাম। কাছে থাকলে কেউ ভালোবাসার মর্ম বোঝে না, বোঝে দূরে চলে গেলে। যত দিন সে আমার চোখের সামনে ছিল, চক্ষুশূল ছিল আমার। আমাদের মত লোকেদের বাড়িতে মেয়ে অভিশাপের দ্বিতীয় নাম। ভাগ্যের পরিহাস ভেবেই স্বীকার করেছিলাম মেয়েকে। আট বছর দাঁতে দাঁত চিপে তাকে মানুষ করেছি। কিন্তু আমার সদ্য জন্মানো ছেলে হয়ে গেল আমার নয়নের মণি। সেই অভিশপ্ত রাত আমার জীবনে নিয়ে এসেছিল এক রাশ অন্ধকার। মদ্যপ অবস্থায় নিজের স্ত্রীর গায়ে হাত তুলি, নিজের অপয়া মেয়ের ওপর করি সীমাহীন অত্যাচার। তাকে দূর করে দি আমি নিজের বাড়ি থেকে।
    নেশা নামবার পর বুঝতে পেরেছিলাম নিজের ভুল। মনে পড়ল নিজের ছোট্টো মেয়ের ফুটফুটে চেহারা, তার নিস্পাপ মুখশ্রী। ঘৃণা হল নিজের ওপর, নিজের পুরুষত্বের ওপর। বহু খুঁজলাম নিজের মেয়েকে পেলাম না।
    আমি রিক্সা চালাই। গরমের এক দুপুরে নিজের কুঁড়েতে খেতে এসেছিলাম। আমার নবজাত ছেলে অকারণ চিৎকার করছিল। আমার স্ত্রী আমার সাথে বার্তা বিনিময়ে পূর্নবিরাম লাগিয়েছিল। এক সংসারে থাকতে গেলে যতটুকু কথা না বললেই নয় সেটাই বলতো। হঠাৎ দরজার সামনে আমার এক সহজাত এসে দাঁড়ালো। আমায় বলল- ‘পাওয়া গেছে রে, তোর মেয়েকে পাওয়া গেছে।’
    আমি ও আমার স্ত্রী দু’জনেই উদগ্রীব হয়ে তাকালাম তার দিকে। আমাদের দৃষ্টিতে আনন্দ, উত্তেজনা মিলেমিশে একাকার।
    ‘কোথায়?’ আমি খাবার ছেড়ে উঠে গেলাম।
    ‘দু’টি ভদ্রমহিলা নিয়ে এসেছে। তারা নাকি তোর মেয়েকে কোলকাতার এক রাস্তায় পেয়েছিল। তোর মেয়ে নিজের ঠিকানা বলতে পেরেছে।’ সে বলল।
    আমার স্ত্রী ছুটে গেল রাস্তার পানে। পেছন-পেছন গেলাম আমি। রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়েছিল আমার মেয়ে। সাথে দুই ভদ্রমহিলা। আমার মেয়ে নিজের মাকে দেখে ছুটে আসছিল তার দিকে। কিন্তু নিয়তির লেখন পাল্টানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। সেই অভিশপ্ত রাতে নিজের মেয়েকে আমি বাড়ি থেকে বার করেছিলাম। আমার আত্মাভিমানী মেয়ে আর ফিরে এলো না নিজের বাপের বাড়ি। দ্রুতগামী ট্রাকটা বেরিয়ে যাওয়ার পর রাস্তায় পড়েছিল আমায় মেয়ের নিথর নিস্প্রাণ দেহ। চিরবিদায় নিয়ে চলে গেল সে। আমি কন্যাদান করলাম তার মুখাগ্নি দিয়ে।

    সমাপ্ত ।

  • অণু গল্প

    আইস ক্রিম

    আইস ক্রিম
    – বিশ্বদীপ মুখার্জি

     

     

    স্টেশান- এর বাইরে বসে আছি। রৌদ্রের প্রচন্ড তাপে সমস্ত শরীর যেন ঝলসে যাচ্ছে। মন আর শরীর কোনোটাই ভাল নেই আজ। সকাল থেকে দুপুর হয় গেল, আয় তেমন কিছুই হলো না। মানুষের কৃপণতার বিষয় চিন্তা করে হাসিও পায় এবং কান্নাও পায়। তাঁদের আর দোষ দিয়ে লাভ কী? তাঁদের টাকা। কী ভাবে, কোথায় খরচ করবে, তাঁদের ব্যাপার। খারাপ তো আমার কপাল। নাতো ভাঙ্গা একটা বাটি হাতে নিয়ে বসে থাকতে হয়?
    যাই হোক। দেখলাম, একটা ট্যাক্সি থেকে তিন জন নামলো। স্বামী, স্ত্রী এবং একটি ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে। ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে, জিনিস- পত্র নিয়ে তাঁরা আমার থেকে কিছু দূরে দাঁড়ালো। কিছু পাওয়ার আশায় আমি বাটি ঝাঁকালম।
    ‘গরীবকে কিছু দাও, বাবু।’
    স্বামী-স্ত্রী দু’ জনেই এমন ভাবে তাকালো যেন সাহায্য চেয়ে আমি বড় কোনো পাপ করে ফেলেছি। আমি বুঝে গেলাম, আশা করা বেকার। চুপচাপ বসে রইলাম। সামনে একটা আইসক্রিমের দোকান দেখে ছোট্ট মেয়েটা আইসক্রিম খাওয়ার জেদ ধরলো। মা, বাবার কাছে প্রচুর অনুরোধ করেও লাভ হল না। আমার হাসি কিম্বা কান্না পায়নি। হলো রাগ। কৃপণতার শেষ সীমা তাহলে উলঙ্ঘন করলো তাঁরা? এমন কৃপণতা কোন কাজের, যেটা নিজের সন্তানের মুখে হাসি ফোটাতে পারে না? ছিঃ , এহেন মানুষের মুখ দেখলে হয়তো সারা দিনটাই খারাপ যাবে ।
    বাচ্চা মেয়ে টার কাঁদো-কাঁদো মুখ দেখে মায়া হল আমার। উঠে গেলাম নিজের স্থান ত্যাগ করে। ভাঙ্গা বাটি থেকে দশ টাকার একটা নোট বার করে বাচ্চা মেয়েটার হাতে দিয়ে বললাম, ‘এতে যা হয় নিয়ে নাও মা। এর থেকে বেশি সামর্থ্য তো আমার নেই।’
    স্বামী-স্ত্রী দু’ জনেই হতবুদ্ধির মত তাকিয়ে রইল আমার দিকে। হয়তো কন্ঠরোধ হয় গিয়েছিল তাঁদের। সারা দিনের মন খারাপটা চকিতে ভালোলাগাতে বদলে গেল। হৃদয়ে এক অদ্ভুত শান্তি পেলাম।
    আমি ভিখারী হতে পারি, কিন্তু কৃপণ নয়।

    সমাপ্ত ।

  • গল্প

    ফিরে পাওয়া

    ফিরে পাওয়া
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

     

    একদিন ফোন করে সে আমায় বলল- ‘এই কাজটা আর ভাল লাগছে না। ইনকামের কোনো ঠিক নেই। কোনো মাসে বেশি হয় তো কোনো মাসে কিছুই হয়ে না। এ ভাবে চলা যা? তুমি কোনো এক ভাল কাজ জোগাড় করে দিতে পারবে?’

    একটু সময় চেয়েছিলাম আমি। মাঝে ব্যস্ত হয়ে পড়াতে মনে পড়েনি তার কথা। দু’দিন পর আবার তার ফোন এলো- ‘কিছু পেলে?’
    আমি খানিক চুপ থাকলাম, তারপর বললাম- ‘ভালো কিছু পাইনি রে। পেলে জানাবো।’

    দায়সারা কথা এটা, জানি। পাপিয়া যে বেশ মন খারাপ করেই ফোনটা রাখলো, বুঝতে পারলাম। আমার নিজেরও খারাপ লাগলো। মেয়েটা আশা নিয়ে ফোন করেছিল। না, কিছু একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিতেই হবে তাকে।

    পাপিয়ার সাথে আমার পরিচয়ের প্রায় ছ’বছর হল। স্নিগ্ধার মাধ্যমে পরিচয়। সে সময় আমার আর স্নিগ্ধার সম্পর্ক একেবারে শীর্ষে। পাপিয়া স্নিগ্ধার বোন। তার পিসির মেয়ে।
    স্নিগ্ধার ও আমার সম্পর্কের ইতি ঘটেছে প্রায় দু’বছর হয়ে গেছে। কারণের দিকে ফিরে না তাকানোই ভালো। পুরনো স্মৃতি ঘেঁটে লাভ নেই। স্নিগ্ধার সাথে সম্পর্ক চুকে যাওয়ার পর পাপিয়ার সাথে খুব একটা কথা হতো না। মাঝে মাঝে ফেসবুকে হাই হ্যালো হতো, ক্রমে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল।

    প্রায় দু’মাস আগেকার কথা। নিজের এক বন্ধুর বিয়েতে আমি আসানসোল যাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম সকাল সকাল রওনা দেবো, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়ে উঠল না। যে ট্রেনে আমি গেলাম সেটা হাওড়া থেকে বেলা বারোটায় ছাড়লো। ট্রেনে খুব একটা ভীড় ছিল না। জানালার পাশে একটা জায়গা দেখে আমি উপবেশন করলাম। খানিক পরেই আমার সামনের সিটে যে উপবিষ্ট হল তাকে দেখে আমি চমকে গেলাম। আমার সম্মুখে পাপিয়া। বহু দিন পর দেখা তার সাথে। পাপিয়াও যে এক নজর আমাকে দেখে বিস্মিত হয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য। তার বাড়ি দুর্গাপুরে, সেখানেই যাচ্ছিল সে। কিছু এদিক ওদিকের কথার পর পাপিয়া আমায় বললো- ‘জানো দীপদা, তোমার আর দিদির সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাওয়ার মুখ্য কারণ আমি নিজেকেই মনে করি। বহুদিন ধরে অনেক মানসিক চাপে ছিলাম। দিদির কটু কথা কম শুনিনি।’

    ‘আমাদের ব্রেকআপের মধ্যে তুই কোত্থেকে এলি?’ আমি বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম।
    ‘তুমি জানো না পুরো ঘটনাটা। জানলে হয়তো জীবনে আমার মুখ দেখবে না। ঘটনাটা আমার বাবা মারা যাওয়ার কিছু দিন পিরে ঘটে। স্নিগ্ধাদির মা, মানে আমার মামী আমার বিরুদ্ধে আমার মায়ের কাছে কান ভাঙ্গানি দেয়। আমি নাকি কোলকাতাতে থেকে প্রচুর টাকা রোজগার করেছি, কিন্তু নিজের বাবার চিকিৎসার জন্য নাকি পর্যাপ্ত টাকা দিইনি। এরকম অনেক কথা। এক সময়ে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। আমি নিজের হুঁশে ছিলাম না। আমার মামী নিজের মেয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাই মামীকে সে দিন ভুল প্রমাণ করার জন্য তোমাদের সম্পর্কের বিষয় আমি বলে দিলাম। তারপর শুরু হল কুরুক্ষেত্র। আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল আমার মামী।’

    কথা শেষ করে পাপিয়া জানালার বাইরের দিকে তাকালো।
    না, পাপিয়ার ওপর আমার রাগ হয়নি। সে সময়ে পাপিয়া যে পরিস্থিতিতে ছিল, মাথা গরম হওয়ারই কথা। 

    ‘তোর দোষ নয় পাপিয়া। দোষ পরিস্থিতির।’ আমি বললাম।

    যাত্রা পথে আরও অনেক কথা হল তার সাথে। সম্পর্কের যে মিহিন সুতোটা ছিঁড়ে গিয়েছিল, সেটা পুনরায় জুড়তে আরম্ভ করলো। প্রায় কথা হতো পাপিয়ার সাথে। মাঝে মাঝে আমরা দেখাও করতাম। এক দিন পাপিয়া আমায় জিজ্ঞেস করল- ‘তুমি বিয়ে করবে না?’
    ‘জানি না রে। এখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি বিয়ে করবো কি করবো না।’
    ‘এ আবার কেমন কথা? বিয়ে করবে কি না তাও ঠিক করোনি?’
    আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম।
    ‘হে ভগবান! কেমন বিচিত্র মানুষ বাবা।’ হতাশ হয়ে পাপিয়া বললো।
    খানিক চুপ হয়ে পাপিয়া আবার বলল- ‘সারা জীবন একলা থাকা যায় না। কারুর সঙ্গের দরকার পরে। আমি খুঁজে দেবো তোমার জন্য মেয়ে।’

    পাপিয়ার মেয়ে খোঁজা এখনও হয়েনি। উল্টে আমাকে তার জন্য একটা কাজ খুঁজে দিতে বললো। আমি ডক্যুমেন্ট্রি ফিল্ম বানাই। নানাবিধ বিষয় নিয়ে বেশ কিছু ডক্যুমেন্ট্রি ফিল্ম আছে। কিছুদিন আগে আমার ক্যামেরাম্যান কাজ ছেড়ে দেয়। বেশ বিপদে পড়েছিলাম। হঠাৎ মাথায় এলো কেননা পাপিয়াকে দিয়ে এ কাজটা করানো যাক। সেও পার্ট টাইম জব খুঁজছে, এটা মন্দ কী? পাপিয়াকে বলতে সে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু বললঝ- ‘আমি তো ক্যামেরা হ্যান্ডেল করতে পারি না।’
    ‘নো প্রোবলেম। আমার কাছে ক্যামেরা আছে। আমি শিখিয়ে দেবো।’ সমস্যার সমাধান হল।

    খুব একটা মেহনত করতে হলো না পাপিয়াকে ক্যামেরা শেখাতে। প্রায় রোজ বিকেলেই আমরা গঙ্গার কোনো ঘাটে কিম্বা কোনো পার্কে দেখা করতাম। আমার কাছে থাকতো ক্যামেরা। পাপিয়াকে ক্যামেরা শেখাতাম। সেও খুব মনোযোগ দিয়ে শিখতো। নতুন কিছু শেখার তাগিদ ছিলো তার মধ্যে।

    সে দিন হঠাৎ বিকেলে কালো মেঘ করে ঝড় উঠলো। কাল বৈশাখীর ঝড়। প্রিণ্সেপ ঘাটে ছিলাম আমরা। দু’জনেই ছুটে শেডের তলায় এলাম। ক্ষণেকের জন্য মনটা অন্যমনোস্ক হয়ে গিয়েছিল আমার। অজান্তেই কিছু পুরনো স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আমি আর স্নিগ্ধা ঘুরতে গিয়েছিলাম মাইথন ড্যাম। ঠিক এমন ভাবেই উঠেছিল ঝড় , শুরু হয়েছিল বৃষ্টি ….।

    ‘কী ভাবছো? কোথায় হারিয়ে গেলে?’ আমাকে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো পাপিয়া।
    আমি সংবিৎ ফিরে পেলাম।
    ‘ব্যাপারটা কী? কিছু পুরনো স্মৃতি মনে পড়লো নাকি?’ ঠোঁটে দুষ্টুমির হাঁসি নিয়ে পাপিয়া জিজ্ঞেস করলো।
    উত্তরে আমি শুধু মৃদু হেসে দিলাম।
    ‘এটা কিন্তু ঠিক না। সাথে যে আছে তার কথা ভাবা উচিত।’ পাপিয়া বললো, ঈষৎ বানানো অভিমান নিয়ে।
    ‘রাগ কেন করছিস? তোর কথা তো সব সময় ভাবি।’
    আমি বললাম।
    ‘ভাবো বুঝি?’ পাপিয়া গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো।
    খানিক দৃষ্টি বিনিময়ের পর আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। ঝড় আর বৃষ্টি শুরু করেছে তোলপাড়, এদিকে আমার হৃদয়েও কেমন এক তোলপাড় আরম্ভ হয়েছে। আমি কি কোনো ভুল পথে এগোচ্ছি? পাপিয়া নিজের গভীর দৃষ্টি দিয়ে কী বোঝাতে চায় আমায়?  না, আমি হয়তো ভুল বুঝেছি। পাপিয়ার দৃষ্টিতে কোনো গভীরতা নেই, রোজকার মতই সামান্য দৃষ্টি তার। নানাবিধ কথায় হৃদয়ের অন্তরে চলছিল তোলপাড়। হঠাৎ নিজের হাতে কারুর হাতের স্পর্শ পেলাম। পাপিয়ার হাত। আমার সামনে এসে দাঁড়ালো সে। চোখে চোখ রেখে বললো- ‘তুমি কি তার জায়গায় কাউকে রাখবে না ঠিক করেছ? এই দুনিয়াটা পরিবর্তনের ওপরেই টিকে আছে, দীপদা। তুমিও নিজেকে পাল্টাও। তোমার হৃদয়ে একটা স্থান এখন রিক্ত আছে, সেটাকে ভর্তি করো।’
    আমি আস্তে করে নিজের হাত তার বাহু বন্ধন থেকে মুক্ত করালাম।
    ‘কাকে বাসাবো, পাপিয়া? কাকে বাসাবো সেই স্থানে? কেউ তো নেই আর।’ অন্যত্র তাকিয়ে বললাম আমি। জানি না কেন পাপিয়ার দিকে তাকাতে সাহস হচ্ছিল না আমার।
    ‘নিজের চোখ দিয়ে না, মন দিয়ে আশেপাশে দেখবার চেষ্টা করো। ঠিক দেখতে পেয়ে যাবে।’

    বেশি কথা আর বাড়ালাম না। বেশ কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দু’জনে বসে রইলাম। ঝড় থেমে গিয়েছিল। বৃষ্টিও ধরেছিল অল্প।
    ‘আমি বাড়ি যাবো। পৌঁছে দেবে?’ পাপিয়া জিজ্ঞেস করলো।

    সেই সন্ধ্যার পর থেকে দু’দিন কথা হয়েনি পাপিয়ার সাথে। এক বিচিত্র পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। স্নিগ্ধা যেতে যেতে আমার হৃদয়ে দিয়ে গিয়েছিল একরাশ ঘৃণা। সেই ঘৃণার পর্বতকে অল্প অল্প করে ভেঙ্গেছি। বিগত দু’বছরে গভীর ভাবে কোনো মেয়ের সাথে মেলামেশা করিনি। প্রথমত সুযোগ পাইনি, এবং দ্বিতীয় মন থেকে ইচ্ছা চলে গিয়েছিলো। হঠাৎ করে পাপিয়া আমার জীবনে এলো। পাপিয়া, স্নিগ্ধার বোন। কথাটা ভেবেও কেমন যেন লাগছে। স্নিগ্ধা জানতে পারলে কী ভাববে? ছেলেটা আর কোনো মেয়ে পেল না, শেষে আমারি বোন? স্নিগ্ধা কী মনে করবে সেটা ভেবে আমার কী লাভ? সেটা আমার চিন্তার বিষয় হবে কেন? কে স্নিগ্ধা? ছিল এক সময় সম্পর্ক। এখন তো সব শেষ। সে কী ভাবছে, না ভাবছে, আমি মাথা ঘামাবো কেন? পাপিয়ার কথা ঠিক যে আছে তার কথাই চিন্তা করা উচিত।

    পাপিয়া কী চায় সেটা কি কোনো দিন মুখ ফুটে বলবে আমায়? হয়তো না। সে ইঙ্গিত দিয়েছে। সে ইঙ্গিত যদি আমি না বুঝতে পারি তাহলে এই পৃথিবীতে আমার থেকে বড় গবেট আর কেও হবে না। পাপিয়া যদি আমায় ভালোবেসে থাকে তাহলে তার ভালোবাসাকে সম্মান দেওয়া আমার কর্তব্য। পাপিয়াকে ফোন করবো ঠিক করলাম। বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর সে ফোন তুললো- ‘হ্যালো!’
    আশেপাশে গাড়ি, বাস, ট্রাকের আওয়াজ পাচ্ছি।
    ‘কোথায় তুই?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
    ‘অটোতে।’
    ‘যাচ্ছিস কোথায়?’
    ‘বাড়ি ‘
    আমি চমকে উঠলাম।
    ‘হঠাৎ বাড়ি! সব ভাল তো?’
    ‘ভালো। এখানে ভালো লাগছিল না। তাই ভাবলাম বাড়ি যাই।’
    ‘ফিরবি কবে?’
    পাপিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো। শুনতে পেলাম।
    ‘জানি না।’
    ‘জানি না মানে? পাপিয়া, কিছু দিন পর আমাদের কাজে বেরোতে হবে। জানিস তো?’
    ‘জানি। তুমি বরং অন্য ক্যামেরাম্যান ….।’
    ‘তুই পাগল হয়ে গেছিস নাকি পাপিয়া?’ আমি প্রায় চিৎকার করেই বললাম- ‘অন্য ক্যামেরাম্যান যদি নেওয়ারই হতো তাহলে তোকে সঙ্গে নিতাম কেন?’
    ‘আমি তোমার পথে বাধা হতে চাই না, দীপদা। প্লিজ, ক্ষমা করো আমায়। আমি পারবো না নিজেকে সামলাতে। আমি জানি, এই দু’দিনে তুমি প্রচুর মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করেছো। শুধু আমার জন্য। আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে আমি স্নিগ্ধার বোন। সেই স্নিগ্ধা যাকে তুমি ঘৃণা করো। হাজার হোক, কোথাও না কোথাও গিয়ে আমাদের রক্ত তো এক। আই অ্যাম স্যরি দীপদা। ভুল করে ফেলেছিলাম আমি। আই অ্যাম ……।’ আর বলতে পারলো না পাপিয়া। কন্ঠরোধ হয়ে গিয়েছিল তার । ফোন কেটে দিল সে।
    বেশ কয়েকবার আমি চেষ্টা করলাম, ফোন বন্ধ পেলাম তার।

    দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে এসেছিল। কোনো দিনই বিকেলে গৃহবন্দী হয়ে থাকার আমার অভ্যেস নেই, কিন্তু আজ বেরোতে মন চাইলো না। মনে হচ্ছিল বুকের ওপর কেউ যেন বিশাল পাথর চাপিয়ে রেখে দিয়েছে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। পশ্চিমের জানালাটা খুলে দিলাম। ঘর ঠাণ্ডা হল। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছিলাম। এতক্ষণে হয়তো পাপিয়া বাড়ি পৌঁছে গেছে। পাশের টেবিলে রাখা ক্যামেরার দিকে তাকালাম। পাপিয়ার হাতের স্পর্শ আছে এতে। পাপিয়ার চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সে হাসছে, কথা বলছে, কিছু ভাবছে সে, নানাবিধ মুখভঙ্গি তার। পাপিয়ার শেষ চেহারা মনে পড়লো। তাকে হোস্টেল ছাড়তে গিয়েছিলাম। অল্প অল্প বৃষ্টির মধ্যে দেখেছিলাম তাকে। তার দু’চোখ কোনো উত্তরের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু আমি দিতে পারিনি উত্তর।

    ‘ঠক্ – ঠক্।’দরজায় টোকা দিল কেউ।
    ‘কে?’ জিজ্ঞেস করলাম। বেশ বিরক্ত হলাম। একান্তে থাকার ইচ্ছে ছিল। জবাব পেলাম না। পুনঃরায় টোকা। চকিতে মেজাজ গরম হয়ে গেল আমার।
    ‘কে জিজ্ঞেস করছি, কোনো জবাব নেই কেন?’ দরজা খুলতে খুলতে কথাগুলো প্রায় ঝেঁঝিয়ে বললাম। দরজা খুলে আমি থ । আমার সামনে পাপিয়া দাঁড়িয়ে। পিঠে একটা ব্যাগ, এবং বাঁ হাতে একটা ট্রলি। চোখ দু’টো ঈষৎ ফোলা। দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে তার ভেতরে ঢুকবার জায়গা বানালাম। ভেতরে ঢুকে এক কোণায় ব্যাগ গুলো রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো- ‘মাঝ পথে কাজ ফেলে আমি যাই না। যখন কথা দিয়েছি কাজে তোমার সাথে থাকবো, তখন নিজের কথা রাখবো আমি।’

    কথা শেষ করে পাপিয়া মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। অজান্তেই আমার দু’চোখ জলে ভরে এলো। শরীরে যেন এক নতুন প্রাণের সঞ্চার হলো।
    ‘তুই কোলকাতা ছাড়বি না, পাপিয়া। আমাদের এক সাথে অনেক কাজ করতে হবে। আমি একলা কি করে পারবো, আমি একলা থাকবোই বা কি করে? সারা জীবন কি একলা থাকা যায়?’
    আমার কথা শেষ হতেই পাপিয়া ঘাড় উঠিয়ে তাকালো আমার দিকে। তারও দু’চোখ ভরে এলো অশ্রুবিন্দুতে। আমি ওর কাছে গিয়ে মুছে দিলাম তার অশ্রু। সে নিজের মাথা গুঁজে দিলো আমার বুকে।

    সমাপ্ত ।

  • গল্প

    হিডেন ট্রান্সমিটার

    হিডেন ট্রান্সমিটার
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

     

    আকাশে যেমন এক রাশ মেঘ বেঁধেছিলো নিজের বাসা, ঠিক তেমনই স্বস্তিকের হৃদয়েতেও নিজের বাসা বেঁধেছিল মেঘেরা। যে কাজ আজ তাকে করতে হবে তাতে বিন্দু মাত্র ইচ্ছে ছিল না তার। নিজের শরীরে কোনো প্রকারের কাটা-ছেঁড়া স্বস্তিকের পছন্দ নয়। অথচ প্রজ্ঞা বলেছে- ‘ভয়ের কিছু নেই, স্বস্তিক। তুমি বুঝতেও পারবে না। কিছুক্ষণের ব্যাপার মাত্র।’
    প্রজ্ঞা উৎসাহিত। তাকে দুঃখ দিতে চায় না স্বস্তিক। তাই ছুটির দিনে সকালে উঠবার ইচ্ছে না থাকলেও, উঠেছে সে। দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখল, সকাল সাতটা। নিজের আশিতলা ফ্ল্যাটের বেডরুমের কাঁচের জানালার বাইরে তাকালো। আকাশে জমে আছে কালো মেঘ। প্রদূষণ মুক্ত বাতাসের জন্য তাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটা বন্ধ করে জানালা খুলে দিলো স্বস্তিক। এতো উচ্চতাতে স্বচ্ছ বাতাসের সম্ভাবনাই বেশি। তার 3 ডি মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইলে রিমাইন্ডার সেট করা ছিল আজকের দিনের। বিরক্ত হয় সে দিকে তাকালো স্বস্তিক।

    স্নান সেরে তৈরি হওয়ার সময় ফোন এলো প্রজ্ঞার। ভিডিও কল হওয়ার সময় স্বস্তিক প্রজ্ঞাকে জিজ্ঞেস করলো- ‘আচ্ছা প্রজ্ঞা, তোমাদের ওই যন্ত্রটা শরীরের কোন অঙ্গে লাগাবে?’

    খিলখিলিয়ে হাসলো প্রজ্ঞা। হাসলে তার সুন্দরতা শতগুণ বৃদ্ধি পায়।

    ‘তোমার কোমরের কাছে। আর ওই যন্ত্রটার একটা নাম আছে, স্বস্তিক। সেটা হয়তো তুমি জানো।’
    ‘জানি। হিডেন ট্রান্সমিটার।’

    দেশের জনসংখ্যা প্রায় চারশত কোটির কাছে। প্রত্যেকের শরীরে ট্রান্সমিটার লাগানো সহজ কাজ নয়। কিন্তু লাগানো অনিবার্য। বিগত দু’বছর ধরে এ কাজ চলছে। আরও কত দিন লাগবে বলা যায় না। ইন্টারনাল সিক্যুরিটির দায়িত্বে এ কাজ পড়েছে। তারা বেশ সুন্দর ভাবে গুছিয়ে এ কাজ নির্বহন করছে। কোনদিন কার শরীরে হিডেন ট্রান্সমিটার লাগানো হবে, সেটা ইন্টারনাল সিক্যুরিটির লোকেরা ঠিক করে। এক সপ্তাহ আগে সেই লোকটিকে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয় যে অমুক দিনে তার শরীরে সেই যন্ত্রটা লাগানো হবে। প্রত্যেক শহরের সরকারী হাসপাতালে কাজ শেষ করা হয়। এখানে বিশ্বাসের কথা সব থেকে আগে ওঠে। তাহলে কি সরকার দেশের নাগরিকদের ওপর বিশ্বাস করে না? এক মন্ত্রীর বক্তব্য- ‘প্রশ্ন বিশ্বাস কিম্বা অবিশ্বাসের নয়। প্রশ্ন হলো সুরক্ষার। দেশের কিম্বা আপনাদের সুরক্ষার।’

    নিজের ব্যাটারী চালিত গাড়িতে বসলো স্বস্তিক। আজকাল সব গাড়ি চলে ব্যাটারীতে। গাড়িগুলো আকারে খুব বড়ো নয়। ড্রাইভার সহ চার জন বসতে পারে এক সাথে। সকালে তাড়াহুড়ো করে বেরোবার ফলে কিছু খেতে পারেনি স্বস্তিক। কিছু দূরেই আছে এক ভালো রেস্তোরাঁ। সেখানেই প্রাতঃরাশ সেরে নেবে সে। এখনও এখানে সস্তায় ভালো খাবার পাওয়া যায়।

    সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই, কাঁচের দরজার সামনে পা রাখতেই দরজা আপনি খুলে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিক্যুরিটি। স্বস্তিকের ওপর নজর পড়তেই তাকে বাঁ দিকে তাকাবার ইশারা করলো। বাঁ দিকের দেয়ালে ছোট্টো একটা ক্যামেরা। ক্যামেরাটা স্বস্তিকের শুধু ছবিই তুললো না, সাথে তার সম্পূর্ণ শরীর স্ক্যানও করে নিলো। কিছু সেকেন্ডের কাজ। অতঃপর এগিয়ে গেল স্বস্তিক। রিক্ত টেবিল খুঁজতে একটু বেগ পেতে হলো তাকে। আজ ছুটির দিন। প্রায় প্রত্যেকেই বসে থাকে আজকের দিনের অপেক্ষায়। একটা সময় ছিল যখন সরকারী বা বেসরকারী কর্মচারীরা সপ্তাহে একদিন অন্ততঃ ছুটি পেতো। বেশিরভাগ সেটা রবিবার হতো। পরিস্থিতি গেছে পাল্টে। এখন দু‘মাস, তিন মাস টানা কাজের পর সকারের তরফ থেকে কোনো একদিন ছুটির ঘোষণা হয়। সে দিন লোকেরা পুরো সময় নিজের পরিবারকে দেয়। অনেকেই নিজের পরিবার সহ রেস্তোরাঁতে খেতে এসেছে।

    ‘সকাল দশটায় কি সবাই নিজের লাঞ্চ সেরে নেবে?’ মনে-মনে ভাবলো স্বস্তিক।

    একটা টেবিল দেখতে পেল। গোল টেবিল। চারটে চেয়ার দিয়ে ঘেরা। এক জন একটা চেয়ারে বসে আছে, তার দিকে পিঠ করে।
    ‘এখানে বসা যেতে পারে। দেরি করে লাভ নেই।’ একথা ভেবে স্বস্তিক দ্রুত কদমে এগিয়ে গেল সে দিকে।

    প্রত্যেক টেবিলে একটা করে মেনু কার্ড লাগানো আছে। নানাবিধ ব্যঞ্জনের নাম লেখা তাতে। খাবার ঠিক করে, টেবিল নাম্বার দিয়ে ‘সাবমিট’ লেখা স্থানে স্পর্শ করতে হয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসে নিজের পছন্দের খাবার।
    ‘আমি কি এখানে বসতে পারি?’ চেয়ারে বসে থাকা লোকটার পেছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো স্বস্তিক।
    সে লোকটা খাওয়া থামিয়ে, ঘাড় ঘুরিয়ে স্বস্তিকের দিকে দেখল। চমকে উঠল দু’জনেই।
    ‘আরে নির্ভয় তুই?’ সেই লোকটার পিঠে একটা চাপড় মেরে স্বস্তিক বলল।
    নির্ভয়ের সাথে স্বস্তিকের পরিচয় প্রায় ছ’বছরের। কলেজের বন্ধু তারা। স্বস্তিক সামনের টেবিলে বসলো।
    ‘তুই তো ছুটির দিনে বেলা বারোটার আগে ঘুম থেকে উঠিস না। আজ হঠাৎ এতো তাড়াতাড়ি সেজেগুজে চললি কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলো নির্ভয়।
    স্বস্তিক ইলেকট্রনিক মেনু কার্ডে খাবারের অর্ডার দিলো।
    ‘শান্তি নেই ভাই। জীবনে শান্তির খুব অভাব।‘ ঈষৎ হতাশার স্বরে স্বস্তিক বললো।

    ‘প্রজ্ঞার সাথে কোথাও ঘুরতে চললি নাকি?’
    ‘তার ছুটি কোথায়? ডক্টরদের আবার ছুটি। তার হাসপাতাল থেকেই ডাক এসেছে।’
    ‘ডাক এসেছে মানে?’ নির্ভয় জিজ্ঞেস করলো।
    ‘হিডেন ট্রান্সমিটার লাগাবে।’ স্বস্তিক উত্তর দিলো।

    পর্ব – 2
    …………………….

    ‘ওঃ! ঠিক। যা, লাগিয়ে নে।’ নির্ভয় বলল।
    ‘তুই তো বোধহয় লাগিয়ে নিয়েছিস না?’ জিজ্ঞেস করলো স্বস্তিক

    কফিতে একটা চুমুক দিয়ে নির্ভয় বলল- ‘প্রায় এক মাস হয়ে গেল। তারপর থেকে জীবনটা পাল্টে গেছে একরকম।’
    এক বেয়ারা এসে খাবার দিয়ে গেল। এক কাপ কফি আর একটা বার্গার।
    ‘জীবন পাল্টে গেছে মানে কী বলতে চাস তুই?’ বার্গারে এক কামড় দিয়ে স্বস্তিক জিজ্ঞেস করলো।
    নির্ভয়ের খাওয়া প্রায় শেষের পথে। কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে, টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে বলল- ‘যখন তোর শরীরে যন্ত্রটা ঢুকবে, তখন তুইও বুঝতে পারবি। আমরা আজ থেকে প্রায় দু’শত বছর আগে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই যে স্বাধীনতা কোথায়? চব্বিশ ঘন্টা কিছু অদৃশ্য চোখ তাকিয়ে আছে তোর দিকে। এটা কে স্বাধীনতা বলে? ডেলি রুটিনের ব্যতিক্রম যদি হয়, তোর কাছে কল চলে আসবে।” আপনি অমুক জায়গায় এতক্ষণ ধরে আছেন কেন? কতক্ষণ থাকবেন?” প্রতি পদে কৈফিয়ৎ দাও। বিরক্ত হয় গেছি আমি। কিন্তু কোনো উপায় নেই। নিষ্কৃতির কোনো পথ নেই, ভাই।’

    নির্ভয়ের শেষ কথা গুলো বিষাদে ভরা। কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল স্বস্তিক।
    ‘তোর প্রাইভেসি বলে কিছু থাকবে না আর।’ নির্ভয় স্বস্তিকের চোখে চোখ রেখে বলল- ‘তুই যদি নিজের গার্লফ্রেন্ডের সাথে সেক্সও করিস, সেটার কৈফিয়ৎও দিতে হবে ইন্টার্নাল সিক্যুরিটিকে । ‘
    কথা শেষ করে কটাক্ষের হাসি হাসলো নির্ভয়। নির্ভয়ের কথাগুলো তোলপাড় শুরু করে দিয়েছিল স্বস্তিকের হৃদয়ে। এতো গভীরে গিয়ে চিন্তা করেনি স্বস্তিক। প্রাইভেসি শব্দের মূল্য তার জীবনে অনেক বেশি।
    নির্ভয় যা কিছু বলল, তার প্রমাণ স্বস্তিক সেখানে বসেই পেয়ে গেল। কথা বলতে বলতে বেজে উঠল নির্ভয়ের মোবাইল। নিজের 3 ডি মোবাইলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো নির্ভয়। শুরু হলো ভিডিও কল

    ওপার থেকে আওয়াজ এলো- ‘আমরা দেখতে পারছি, আপনি বিগত দেড় ঘন্টা ধরে লেক টাউনের এক রেস্তোরাঁতে আছেন। কেন জানতে পারি কী?’
    ‘আমি ব্রেকফাস্ট করছি।’ নির্ভয়ের কন্ঠে বিরক্তির ভাব।
    ‘ ক্ষমা করবেন স্যার, কিন্তু ব্রেকফাস্ট করতে এতো সময় তো লাগে না।’
    ওপার থেকে যে মৃদু কন্ঠ মোবাইলে ভেসে আসছিলো, সেটা যার কন্ঠ তাকে দেখতে পাচ্ছিল না স্বস্তিক, নির্ভয়ের সামনে বসে থাকা দরুন।
    বিচিত্র এক মুখভঙ্গী করলো নির্ভয়। বললো- ‘আসলে আমার এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হয় গেল। তাই একটু গল্প করছিলাম আর কি।’
    ‘ওকে স্যার। ধন্যবাদ।’
    ফোন কেটে গেল।
    ‘দেখলি স্বস্তিক। এটাই হলো আমাদের স্বাধীনতা।’ পুনরায় কটাক্ষের হাসি হাসলো নির্ভয়।
    নির্ভয়ের চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ সেখানে বসে রইল স্বস্তিক। অর্ডার দেওয়া খাবার খেতে পারলো না সে। গভীর চিন্তায় ডুবে থাকলো। তার প্রাইভেসি নষ্ট হবে, সে কথা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না স্বস্তিক। তার জীবনে আছে কিছু প্রাইভেসি, সেটা কারুর সাথে শেয়ার করতে পারবে না সে। এমন কি প্রজ্ঞাকেও সে প্রাইভেসির কথা বলেনি স্বস্তিক। হিডেন ট্রান্সমিটার শরীরে প্রবেশ করলে সে প্রাইভেসি আর প্রাইভেসি থাকবে না। দেশের সুরক্ষার অজুহাত দিয়ে সরকার নিত্যনতুন নিয়ম বার করেছে। সে সবের প্রতি কোনো দিনই মাথা ঘামায়নি স্বস্তিক। হাসি মুখে সব মেনে নিয়েছে। কিন্তু এবার সরকারের নিয়ম মানতে দ্বিধা বোধ করছে স্বস্তিক। কিন্তু কোনো উপায় সে দেখতে পারছে না। সরকারের নিয়ম যদি না মানা হয়, তাহলে ইন্টারনাল সিক্যুরিটির হাতে পরতে হবে তাকে। ইন্টারনাল সিক্যুরিটির হাতে পরা মানে, প্রায় জীবন শেষ। দু’বার পুরো রিং হয় কেটে গেল স্বস্তিকের ফোন। প্রজ্ঞা কল করেছে। না, কোনো উপায় নেই। স্বস্তিককে যেতেই হবে হাসপাতাল, লাগাতেই হবে হিডেন ট্রান্সমিটার।

    হাসপাতাল পৌঁছবার সময় অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়ছিল। হাসপাতালের মুখ্য ফটক বেশ বড়ো। ফটকের সামনে যে সিক্যুরিটি গার্ড ছিল সে স্বস্তিকের থেকে চাইলো তার আই.ডি. কার্ড। নিজের ছোট্টো কেবিনে গিয়ে কি করলো, তার পর বেরিয়ে এলো সে। হাতে একটা গোল লোহার মেডেল। মেডেলটা স্বস্তিকের গলায় পরিয়ে, আই কার্ড ফেরত দিলো তাকে। স্বস্তিক দেখলো মেডেলে লেখা আছে – 146।
    ‘তার মানে আমার আগে 145 জন আছে।’ মনে মনে ভাবলো স্বস্তিক।
    প্রজ্ঞা অপেক্ষা করছিল স্বস্তিকের। ভেতরে ঢুকতে দেখেই এগিয়ে গেল সে। স্বস্তিকের গলায় ঝোলানো মেডেল দেখে বলল- ‘145, তার মানে দেরি আছে। এখন বিরাশি নাম্বার চলছে।’
    ‘তোমার কাজ নেই?’ জিজ্ঞেস করলো স্বস্তিক।
    ‘এতক্ষণ তো কাজই করছিলাম। এখন একটু বিরতি পেলাম। চলো, কোথাও গিয়ে একটু বসি।’
    স্বস্তিকের হাত ধরে তাকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে গেল একটা রুমে প্রজ্ঞা। রুমটা বেশ বড়ো। অনেক ডেস্ক আর চেয়ার পাতা। দেয়ালে একটা ব্ল্যাক বোর্ড দেখতে পেল স্বস্তিক। বুঝতে দেরি হলো না যে এটা ক্লাস রুম। বেশ কিছু লোক এদিক ওদিক বসে আছে। তারাও এসেছে সরকারের হুকুম পালন করতে। দুটো রিক্ত চেয়ারে গিয়ে বসলো প্রজ্ঞা আর স্বস্তিক। স্বস্তিকের ঈষৎ ফ্যাকাসে মুখ দেখে প্রজ্ঞা তাকে জিজ্ঞেস করলো- ‘তোমার শরীর খারাপ নাকি? মুখটা শুকনো লাগছে তোমার।’

    কথা শেষ করে স্বস্তিকের কপালে নিজের হাত রাখলো প্রজ্ঞা। এক ঝটকায় সেই হাত সরিয়ে দিলো স্বস্তিক।
    ‘মুখ শুকনো হলেই কি শরীর খারাপ হতে হয়? তোমারা ডক্টররা শরীর খারাপ ছাড়া কিছু বোঝো না?’
    স্বস্তিকের এহেন ব্যবহারে অবাক হলো প্রজ্ঞা। স্বস্তিক এমন ব্যবহার তো কোনো দিন করেনি তার সাথে। আজ হঠাৎ তার হলো কী? আজকের দিনে প্রেম শব্দটা লুপ্তপ্রায়। লোকেদের ধারণা যে পুরুষ ও নারীর মধ্যে একটাই সম্পর্ক হওয়া উচিত, সেটা হলো শারীরিক সম্পর্ক। বিবাহ নামের যে সামাজিক রীতিটা বহু কাল ধরে চলে এসেছে, সেটা এখনও বর্তমান, শুধু মাত্র বংশ বৃদ্ধির কারণে। অল্প লোকেরাই আছে, যারা আজও প্রেম নামের শব্দকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। অনুভূতিহীন মানুষ যান্ত্রিক রবোর্ট তুল্য। নিজেরদের রবোর্ট- এ বদলাতে চায় না স্বস্তিক আর প্রজ্ঞা। স্বস্তিকের কথায় প্রজ্ঞার খারাপ লেগেছে, তাই খারাপ লেগেছে স্বস্তিকেরও। পলকে প্রজ্ঞার হাসিমুখী চেহারাটা শুকিয়ে গেল। নিজের ভুলটা বুঝতে পারলো স্বস্তিক।
    প্রজ্ঞার হাতে নিজের হাত রেখে বলল- ‘আই এ্যাম সরি, প্রজ্ঞা।’
    ‘কী হয়েছে তোমার, স্বস্তিক?’
    খানিক চুপ থেকে স্বস্তিক প্রশ্ন করলো- ‘একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে প্রজ্ঞা? হিডেন ট্রান্সমিটার মানুষের শরীরে প্রবেশ করিয়ে সরকার কী প্রমাণ করতে চায়?’
    অদ্ভুত প্রশ্ন। এমন প্রশ্ন স্বস্তিক আগে কোনোদিন করেনি। আজ হঠাৎ এ ধরণের প্রশ্ন এলো কী করে তার মনে?
    ‘তুমি তো জানো স্বস্তিক সরকার কেন করছে এটা। এতে শুধু দেশের সুরক্ষা নয়, বরং প্রত্যেক মানুষের নিজের সুরক্ষা আছে। যদি কখনও কেউ কোনো অসুবিধেতে পড়ে, তৎক্ষনাৎ ইন্টারনাল সিক্যুরিটি তাকে উদ্ধার করতে পারবে।’ প্রজ্ঞা বললো।

    ‘আজকের লোকেরা নিজেই উন্নত। তারা নিজের সাহায্য নিজেরাই করতে পারে। আর যদি গুরুতর কিছু ঘটে, তাহলে ইন্টারনাল সিক্যুরিটি সেখানে পৌঁছাবার আগেই ঘটনা ঘটে যাবে। এখনও বিজ্ঞান এতোটা উন্নতি করেনি যে তারা টেলিপোর্ট হয় পৌঁছে যাবে। এই যুক্তি জনতাকে ঠকাবার জন্য। আমাকে এই যুক্তি দিও না।’
    প্রজ্ঞার আশ্চর্যের সীমা নিজের আকার বৃদ্ধি করছিলো।
    ‘তুমি বলতে কী চাও?’ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো প্রজ্ঞা।
    ‘কিছু সাধারণ কথা। সেগুলো হয়তো তুমিও জানো, কিম্বা না জানার অভিনয় করছো।’

    স্বস্তিকের রহস্যময় কথার রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছে প্রজ্ঞা, কিন্তু পারছে না।
    ‘প্রজ্ঞা!’ স্বস্তিক পুনরায় বলতে শুরু করলো- ‘আসলে কি জানো? আসল কথা হলো বিশ্বাসের, যেটা সরকার আমাদের ওপর করে না। যে দেশের সরকার জনতার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, সে দেশের কী দশা হয় সেটা নিশ্চয়ই তোমাকে বলে দিতে হবে না। তোমার কি মনে হয় প্রজ্ঞা, আমি কি কোনো অসৎ কাজের সাথে লিপ্ত?’
    ‘সে তো আমিও নয় স্বস্তিক। তবু্ও তো আমি এ কাজ করেছি।’
    প্রজ্ঞার কথায় মৃদু হাসলো স্বস্তিক।
    ‘সত্যটা শুনতে চাও। খারাপ লাগবে। কিন্তু শোনা দরকার। তুমি নিজের স্বাধীনতাকে সরকারের হাতে বিক্রি করে দিয়েছ। আজ তুমি যাই করো, সব খবর তাদের কাছে থাকবে। তোমার প্রাইভেসি বলে আর কিছু থাকলো না।’
    প্রজ্ঞার মুখ পুনরায় পাণ্ডুবর্ণ হয় গেল। নিজেকে সামলে সে বলল- ‘আমার এমন কোনও প্রাইভেসি নেই যার কারণে আমি সরকারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবো।’
    ‘তোমার না থাক, অন্যের তো থাকতে পারে। দেশের সুরক্ষার অজুহাত দেখিয়ে জনতার প্রাইভেসির মধ্যে হস্তক্ষেপ করার সরকারের কোনো অধিকার নেই। সরকার যদি দেশের সুরক্ষার অন্য কোনো উপায় না বার করতে পারে, তাহলে সেটা সরকারের অক্ষমতা। এটা হিডেন ট্রান্সমিটার নয় প্রজ্ঞা, এটা কুকুরের গলার চেন।’
    স্বস্তিক উত্তেজিত হলো।
    ‘শান্ত হও স্বস্তিক। এখানে হল্লা করো না।’
    স্বস্তিক শান্ত হলো। প্রজ্ঞা আর কথা বাড়াতে চায় না, তাই শান্ত কন্ঠে স্বস্তিককে বলল- ‘যাই হোক। এটা ভুল কি ঠিক সেটা ভাববার আমাদের দরকার নেই। সব জিনিসেরই দু’টো দিক থাকে। এখন আর কিছু করার নেই। কাজটা শেষ তো করতে হবে।’
    দৃঢ় কন্ঠে স্বস্তিক বলল- ‘না, আমি পারবো না।’

    পর্ব – 3
    …………………….

    স্বস্তিকের মুখে ‘না’ শুনে চমকে উঠল প্রজ্ঞা।
    ‘না মানে? তুমি প্রতিবাদ করতে চাও নাকি?’
    প্রজ্ঞার কন্ঠস্বরে আতঙ্কের আভাস পরিস্কার বোঝা গেল।
    ‘প্রতিবাদ তো এক না একজনকে করতেই হবে, প্রজ্ঞা। আমি করলে ক্ষতি কী?’
    ‘তুমি পাগল হয় গেছো? তুমি জানো এই ইন্টারনাল সিক্যুরিটির লোকেরা কত ভয়ংকর? তোমায় কি ছেড়ে দেবে তারা?’ এবার উত্তেজিত হলো প্রজ্ঞা- ‘নিয়ম ভাঙ্গার শাস্তি কী জানো তো?’
    ‘জানি, তাও আমি প্রতিবাদ করবো। আমি নিজের জীবনের কিছু প্রাইভেসি কারুর সাথে শেয়ার করতে পারবো না।’
    ‘এমন কী প্রাইভেসি আছে তোমার জীবনে, যেটা আমি জানি না? আর আমি যতটুকু জানি, তাতে এমন কিছু নেই যেটা তুমি শেয়ার করতে পারবে না।’
    স্বস্তিক চুপ রইল।
    ‘স্বস্তিক, জবাব দাও। তুমি কে, তোমার বাবা মা কে ছিলেন এটা শুধু আমি না সবাই জানে। তুমি কী করো, কোথায় থাকো, সেটাও সবাই ….।’
    ‘প্রজ্ঞা!’ প্রজ্ঞার কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিলো স্বস্তিক- ‘এমন কিছু নিশ্চয়ই আছে যেটা আমি শেয়ার করতে চাই না।’
    প্রজ্ঞা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো স্বস্তিকের দিকে।
    ‘কী সেটা?’
    স্বস্তিক আবার চুপ।
    ‘বলো স্বস্তিক। আমি জানতে চাই তুমি আমার থেকে কি লুকিয়েছো? তোমার কী এমন রহস্য আছে, যেটা আমি জানি না।’
    ‘সেটা যদি বলেই দি, তাহলে আর প্রাইভেসি কী রইলো?’
    ‘হেঁয়ালি করো না। আমার মাথা গরম হয় যাচ্ছে। যেটা জিজ্ঞেস করছি, সেটার জবাব দাও।’ ধৈর্য্য হারাচ্ছিল প্রজ্ঞা।
    ‘আমাকে ক্ষমা করো, প্রজ্ঞা। আমি বলতে পারবো না।’
    চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো স্বস্তিক।
    ‘এটা কী হচ্ছে, স্বস্তিক? তামাশা করছো কেন?’ ক্রোধে প্রজ্ঞার সমস্ত শরীর কাঁপছিল। সেও উঠে দাঁড়ালো। বলল- ‘তুমি জানো তোমার এই নাটকের জন্য আমার চাকরি যেতে পারে। অসংখ্য ক্যামেরা আমাদের ওপর নজর রেখেছে। নিজের ড্রামা বন্ধ করো।’
    ‘আমি ড্রামা করছি না, প্রজ্ঞা। আমি নিজের প্রাইভেসি বিক্রি করতে পারবো না।’
    ‘তোমার প্রাইভেসি আমার থেকে বেশি ইম্পোর্টেন্ট?’
    খানিক চুপ থেকে স্বস্তিক বলল- ‘বলতে পারো।’
    ঘর থেকে বেরিয়ে গেল স্বস্তিক।
    ‘তুমি পারবে না বেরোতে, স্বস্তিক। অকারণ ঝামেলা করো না।’ প্রায় চিৎকার করে কথাগুলো বললো প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞার কথাগুলো হয়তো স্বস্তিকের কর্ণ স্পর্শ করলো না।
    প্রজ্ঞা নিজের ডান হাতের ঘড়ির একটা বোতাম টিপলো। চারিদিকে শোনা গেল সাইরেনের আওয়াজ। স্বস্তিক দ্রুত গতিতে লিফ্টের দিকে এগোলো। কিন্তু লাভ হলো না। লিফ্ট বন্ধ হয়ে গেছে। দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেল সে। কিন্তু বিলম্ব হয় গেল। ইন্টারনাল সিক্যুরিটির লোকেরা হাতে অত্যাধুনিক বন্দুক নিয়ে ঘিরে ফেললো তাকে। ক্রোধের কারণে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো স্বস্তিক। ইন্টারনাল সিক্যুরিটির একটা গার্ড লঘু কদমে এগিয়ে এলো তার দিকে।
    ‘দু’ হাত ওপরে করুন।’ স্বস্তিককে বলল সে।
    স্বস্তিক হাত তো ওপরে করলোই না, উল্টে তার পেটে সজোরে পদাঘাত করলো। গার্ডটা আঘাত পেয়ে সেখানেই বসে পড়লো। চকিতে স্বস্তিকের মাথার পেছনে হলো বিকট যন্ত্রণা। চোখের সামনে ধীরে ধীরে ছেয়ে গেল অন্ধকার। শরীর দুর্বল মনে হলো। দু’পায়ে যেন জোর নেই। অচেতন অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়লো স্বস্তিকা।
    ঘটনাস্থলে প্রজ্ঞার সাথে ইন্টারনাল সিক্যুরিটির এক বড়ো অফিসার এলো। স্বস্তিকের মূর্ছিত দেহের দিকে তাকিয়ে প্রজ্ঞাকে বললো- ‘ডক্টর সৃঞ্জয় মজুমদারের ছেলে এমন করলো কেন, বলতে পারেন?’
    প্রজ্ঞা জবাব দিলো না। অপলক তাকিয়ে রইল স্বস্তিকের দিকে। তার দু’চোখে জল।

    পর্ব – 4
    …………………….

    কঠিন সত্যটা স্বস্তিক জেনেছিল নিজের পিতার কাছে। ডক্টর সৃঞ্জয় মজুমদার স্বস্তিকের পিতা। এক সময় দেশের নাম করা ডাক্তার ছিলেন। বেশ কিছু কঠিন রোগের ওষুধের আবিষ্কার করে বেশ সুনাম কামিয়েছিলেন। রুগী দেখা হয়ে গেলে বাকি সময়টা ওষুধ আবিষ্কারের কাজে তিনি ব্যস্ত থাকতেন। স্বস্তিক তাঁর এক মাত্র সন্তান। বহু বছর আগে তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ স্বস্তিকের মা স্বর্গ লাভ করেছেন।
    যে দিন স্বস্তিক সেই সত্যটা জানতে পায়, তার পিতা মৃত্যুশয্যায়। একদিন স্বস্তিককে ডেকে তিনি বললেন- ‘স্বস্তিক, যাওয়ার আগে একটা দায়িত্ব তোমায় দিয়ে যেতে চাই।’
    ‘কী বাবা?’
    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন- ‘তুমি হয়তো জানো না বেহালাতে আমার একটা বাড়ি আছে। বেশ পুরনো বাড়ি। আমার ঠাকুরদা সেই বাড়িটা বানিয়েছিলেন। সেই বাড়ির বিষয় আজকের দিনে তুমি কেন, কেউ জানে না। বলতে পারো ওটা আমার গোপন ঠিকানা। আমার মৃত্যুর পর তুমি সেই বাড়িতে যাবে।’
    সেই বাড়িতে কেন যেতে হবে, স্বস্তিক বুঝতে পারলো না।  জিজ্ঞাসু নেত্রে চেয়ে রইলো নিজের পিতার দিকে। খানিক বিরতির পর সৃঞ্জয় মজুমদার আবার বলতে শুরু করলেন- ‘সেই বাড়িতে একজন আছে। তোমাকে তার দায়িত্ব নিতে হবে।

    ‘কে আছে সেখানে?’
    ‘তোমার বোন।’

    চমকে উঠল স্বস্তিক। তার বোন হঠাৎ কোত্থেকে এলো? সে তো জানতো নিজের পিতার সে একটি মাত্র সন্তান। স্বস্তিক নিজের পিতার দিকে বিস্ময়ে চেয়ে রইলো।

    ‘এটাকে আমার ভুল বলতে পারো না। একজনের বিষণ্ণ মুখ আমার সহ্য হয়নি। কোনো স্ত্রীর স্বামীর মধ্যে যদি বাপ হওয়ার ক্ষমতা না থাকে, তাহলে সেই স্ত্রীর শোক দেখা যায় না। আমিও দেখতে পারিনি তোমার মাসির শোক। বিষাদে ভরা সেই মুখ আমার সহ্য হয়নি। আমি তার শূন্য কোল ভরিয়ে দিয়েছিলাম।’
    ক্রোধে, ঘৃণায় স্বস্তিকের সম্পূর্ণ শরীর জ্বলছিল। স্বস্তিক জানতো তার মেসো আত্মহত্যা করেছিল। তাহলে তার পেছনে এটাই কারণ! একটা লোক, যার সম্পূর্ণ দেশে, সম্পূর্ণ বিশ্বে নাম, ডাক আছে, তার এই কুকীর্তি?
    যে সময় সৃঞ্জয় নিজের মৃত স্ত্রীর ভগিনীর ওপর স্নেহের হাত রেখেছিলেন, সে সময় তাঁর মানসিক অবস্থা খুব ভাল ছিল না। সারা দিন নানাবিধ ওষুধের গবেষনায় তিনি ব্যস্ত থাকতেন, যার ফলে অল্প হলেও নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী কালে সুস্থ হলেও সেটার প্রভাব পড়েছিল তাঁর শিশু কন্যাটির ওপর। ছ’বছর বয়স অবধি যখন তার মানসিক বিকাশ হলো না, চিন্তায় পড়লেন সৃঞ্জয়। নিজেরই কিছুদিন পূর্বে আবিষ্কৃত এক ওষুধ প্রয়োগ করলেন নিজের কন্যার ওপর। হিতে বিপরীত হলো। তাঁর কন্যা হয়ে উঠল ভয়ানক রাগী, ভয়ানক মারমুখী।
    ‘কোনো মানুষ এতো হিংস্র হতে পারে, জানা ছিল না আগে। আমি বুঝতে পারলাম আমার এক্সপেরিমেন্ট বিফল হয়ছে। তখন আর কিছু করার ছিল না। তবে থেকে সে আমার বেহালার বাড়িতে বন্দী।’
    ‘তার বড়ো জায়গায় চিকিৎসা করাতে পারতে তো।’ বলল স্বস্তিক।
    ‘পারতাম। কিন্তু করাইনি। তার পরিচয় আমি লুকিয়ে রেখেছি। নিজের বদনমীর ভয় ছিল আমার।’
    নিজের বদনমীর ভয়ে স্বস্তিকের পিতা এক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছিলেন। যে লোক অন্যের জীবন রক্ষার জন্য সারা জীবন অফুরন্ত পরিশ্রম করে গেল, সেই নাকি নিজের মেয়ের জীবন বরবাদ করলো!
    কিছু দিন পরেই সৃঞ্জয় ইহলোক ত্যাগ করলেন। মুখাগ্নির সাথে সব কাজই স্বস্তিক করলো, কিন্তু শুধু নিয়ম রক্ষার খাতিরে। ডক্টর সৃঞ্জয় মজুমদার মৃত্যুর পূর্বেই নিজের পুত্রের কাছে নিজের সম্মান হারিয়েছিলেন।

    পর্ব – 5
    …………………

    বাড়িটা খুব ছোটো। একতলা । সামনে অল্প জায়গা ছাড়া আছে। কোনোকালে হয়তো সেখানে বাগান ছিল, এখন ঝোপ ঝাড় ভিন্ন আর কিছুই নেই। বাড়িটা যে বেশ পুরনো, সেটা এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়। চাবি দিয়ে সদর দ্বার খুলে ভেতরে ঢুকলো স্বস্তিক। বাইরে দিনের আলো, তবুও ভেতরটা অন্ধকার প্রায়। যেটুকু আলো ভেতরে প্রবেশ করছিল, তাতেই সুইচ বোর্ড খুঁজে পেল স্বস্তিক। চারিপাশে জমে আছে এক রাশ ধুলোর স্তুপ। বাড়িটা যে দীর্ঘ দিন ধরে অযত্নে আছে, সেটা দেখেই বোঝা যায়। ডাইনিং হলের মাঝে বড় এক অর্ধভগ্ন টেবিল পাতা। তার চারিপাশে চারটে চেয়ার পাতা। লাইট জ্বালাতে অল্প আলো হলো। বাড়ির অবস্থা দেখেই গা গুলিয়ে উঠল স্বস্তিকের। কোন দিকে যাবে, কী করবে কিছুই ঠাহর করতে পারছিল না সে। হঠাৎ তার নজর গেল মাটির দিকে। ধুলোর স্তুপের মধ্যে দেখতে পেল নগ্ন পায়ের ছাপ। ছাপটা কার, বুঝতে পারলো স্বস্তিক। একটা বন্ধ ঘর থেকে পায়ের ছাপটা বেরিয়ে চলে গেছে যত্র তত্র। স্বস্তিক এগোলো সেই বন্ধ ঘরের দিকে। দরজায় আওয়াজ করলো, কোনো সাড়া পেল না। পুনরায় শব্দ করলো, একই অবস্থা। একবার আরও দরজায় টোকা মারতে যাবে, দরজা খুলল। নিজের সামনে এক জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল স্বস্তিক। বুঝতে সময় নিলো না, তার সামনে যে দাঁড়িয়ে সে তার সৎ বোন। চুলগুলো ছেলেদের মত করে কাটা, চোখ দুটো বেশ বড় কিন্তু ঈষৎ রাঙ্গা। পরনে দেহের আকার থেকে বেশ বড় এক ফুল হাতা জামা ও ফুল প্যান্ট। খানিক বিস্ময়ে চেয়ে রইল স্বস্তিকের দিকে। সৃঞ্জয়কে চিনতো, স্বস্তিককে দেখলো প্রথম।
    ‘কে?’ কন্ঠে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
    ‘আমি স্বস্তিক। ডক্টর সৃঞ্জয় মজুমদারের ছেলে। তোমার নাম কি আভা?’ স্বস্তিকের গলা সহজ।
    দরজা অর্ধেক খোলা ছিল, পুরো খুলে দিলো আভা। তার আচরণ স্বাভাবিক। সৃঞ্জয় হয়তো আভাকে স্বস্তিকের বিষয় বলেছেন। দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো আভা। স্বস্তিকের ঘরে প্রবেশ করার সংকেত। ঘরে আসবাব পত্র বলতে কিছুই নেই। একটা খাট, আলমারি, আলনা এবং একটা রেফ্রিজারেটর। স্বস্তিকের হাতে বেশ বড় একটা প্যাকেট, খাবারের। কোথায় রাখবে ভাবছে।
    আভা তার হাত থেকে সেটা নিয়ে নিলো। জিজ্ঞেস করলো- ‘বাবা কোথায়?’
    মাথা হেঁট করলো স্বস্তিক। কি করে সে পিতৃ বিয়োগের সংবাদ দেবে, ভেবে পাচ্ছিল না। অনেক কষ্টে শক্তি সঞ্চয় করে বলল- ‘এবার থেকে অমিই আসবো।’
    দীর্ঘ কাল একা থাকার এবং অসুস্থতার দারুণ বেশিরভাগ মানুষই খিটখিটে হয় যায়। স্বস্তিক জানতো না যে আভার ভেতরে এমন আচরণ বৃদ্ধি পেয়েছে কিনা। আভার ক্রোধের বিষয় তার জানা আছে। এই কথাটা বলবার পর ভয়ে ভয়ে তাকালো আভার দিকে। আভার দু’চোখ বিস্ফোরিত। হাতের প্যাকেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো মাটিতে।
    ‘না। বাবা ছাড়া আমি কারুর হাতে খাবার নেবো না। তুই কে আমায় খাবার দিতে আসার? বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা এখান থেকে। চিৎকার করে বললো আভা।
    থতমত খেয়ে গেল স্বস্তিক। কিন্তু পলকে নিজেকে সামলে নিলো। উত্তেজনাতে আভার শরীর থরথর কাঁপছে। দ্রুত বেগে চলছে তার নিঃশ্বাস। ক্রোধ হলো স্বস্তিকেরও। নিজের ওপর, নিজের পিতার ওপর। সৃঞ্জয় নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত কেন নিজের পুত্রের ঘাড়ে ফেলে গেলেন? কেনই বা স্বস্তিক নিতে গেল সেই দায়িত্ব? এতো বছর পর্যন্ত যাকে চিনতো না, জানতো না, হঠাৎ করে তার দায়িত্ব তার কাঁধে চলে এলো। চকিতে তার চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন ঘটলো। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক অসহায় মেয়ে। সে নিশ্চয়ই নিজের ইচ্ছেতে এই পৃথিবীতে আসেনি । স্বস্তিকের ধমনীতে বইছে যার রক্ত, এই মেয়েটার ধমনীতেও বইছে তারই রক্ত। সৎ হলেও, আভা তার বোন। এই সত্যটা মানতে সে বাধ্য।
    আরেক কথা মনে পড়লো স্বস্তিকের। সে নিজের পিতাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তার পিতা নিজের জীবনে ভুল করে থাকুক না কেন, সে কোনো দিন ভুল করেনি, আর করবেও না।
    ‘রাগ করো না, আভা। যেটা সত্যি , সেটাকে মানতেই হবে‌। আর এটাই সত্য যে তোমার …. মানে আমাদের বাবা আর এখানে আসবে না। সে দেহ ত্যাগ করেছে।’
    শেষের কথা গুলো চাপা গলায় বলল স্বস্তিক। অল্প ভারী হয় গিয়েছিল তার কন্ঠস্বর।
    খানিক অপলক চেয়ে রইল স্বস্তিকের দিকে আভা। অতঃপর দেয়ালে পিঠ সাঁটিয়ে মাটিতে বসে পড়লো।

    পর্ব – 6
    …………………….

    অনেক কষ্টে নিজের চোখ মেললো স্বস্তিক। সংবিৎ ফিরে পেতে একটু সময় লাগলো। মাথার পেছনে অল্প যন্ত্রণা। কারণটা মনে পড়লো তার। আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো চারিদিকে। ছোট্টো একটা ঘরের মাঝে পাতা এক ট্রলিতে শুয়ে আছে সে। কতগুলো ছোটো ছোটো লাইট ঘরটাকে নিবিড় অন্ধকার থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। স্বস্তিক লক্ষ্য করলো তার গায়ে এক সবুজ রঙের চাদর । হঠাৎ তার বাঁ দিক দিয়ে শব্দ হলো একটা। দরজা খোলার শব্দ। সে দিকে দেখার চেষ্টা করলো স্বস্তিক। প্রজ্ঞা এগিয়ে আসছে তার দিকে। পাশে এসে দাঁড়ালো প্রজ্ঞা। মুখ গম্ভীর।
    ‘শরীর কেমন লাগছে এখন?’ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো প্রজ্ঞা।
    উঠে বসবার চেষ্টা করলো স্বস্তিক, প্রজ্ঞা বাধা দিলো।
    ‘উঠতে হবে না। রেস্ট নাও।’
    কোমরের কাছে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো স্বস্তিক। অজান্তেই তার হাত চলে গেল সেখানে। জামাটা একটু উঠিয়ে দেখল, বাঁ দিকের কমরে বাঁধা আছে ব্যান্ডেজ। ব্যাপারটা বুঝতে সময় নিলো না সে। তার অচেতন অবস্থাতেই এরা নিজের কাজ সেরে নিয়েছে। বিরক্তি এবং হতাশা মেশানো দৃষ্টিতে তাকালো প্রজ্ঞার দিকে।’
    পারলে তোমরা এটা করতে? ছল করে কাজ সেরে নেওয়া তোমাদের মত প্রতিষ্ঠিত লোকেদের শোভা দেয় না।’
    ‘কোনো উপায় ছিল না, স্বস্তিক। তুমি যা শুরু করেছিলে, তাতে এটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।’ শান্ত কন্ঠে বলল প্রজ্ঞা।
    এবার উঠে বসলো স্বস্তিক। প্রজ্ঞা পুনরায় বাধা দিতে চাইলো, শুনলো না স্বস্তিক।
    ‘শুয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। আমার জন্য এতো চিন্তা কিসের? প্রত্যেকেই তো এই যন্ত্র লাগিয়ে উল্টো পায়ে ফিরে যাচ্ছে। আমি তো স্পেশাল নয়।’ ঈষৎ উত্তেজনা স্বস্তিকের কন্ঠে।
    নিজের বাঁ হাত স্বস্তিকের ডান কাঁধে রাখলো প্রজ্ঞা, তাকে শান্ত করার চেষ্টা।
    ‘ আমি তো তোমায় বলেছিলাম ……। ‘
    ‘থাক প্রজ্ঞা। কথা বাড়াতে হবে না। শুধু একটা কথা বলতে চাই। তাহলেই বুঝে নাও, স্বাধীনতা কোথায়? এখন আমরা তাদের হাতের পুতুল, যাদের ভোট দিয়ে আমরাই আসনে বসিয়েছি।’
    কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো স্বস্তিক। এগোলো দরজার দিকে।
    ‘শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাও, স্বস্তিক।’ প্রজ্ঞা ট্রলির কাছে দাঁড়িয়ে স্বস্তিককে বলল ।
    ‘কী জানতে চাও?’ রুক্ষ কন্ঠে বলল স্বস্তিক।
    ‘তোমার জীবনে এমন কী রহস্য আছে, যেটা আমি জানি না?’
    চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘঃশ্বাস ফেললো স্বস্তিক। বলল- ‘আমি তো আগেই বলেছি, আমি বলতে পারবো না।’
    স্বস্তিক ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

    কেন বলতে পারবে না প্রজ্ঞাকে সে আভার বিষয়? সে তো ভুল কিছু করেনি। বরং একটা ভাল কাজ করেছে সে। এক অসহায় মেয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে। এতে তো স্বস্তিকের সম্মান বৃদ্ধি হওয়া উচিত।’ সম্মান শব্দটা খোঁচা মারলো স্বস্তিককে। নিজের সম্মান প্রত্যেকের কাছে প্রিয়। প্রিয় ছিল সৃঞ্জয়ের কাছেও। তাই তো আভার পরিচয় তিনি গোপন রেখেছিলেন চিরকাল। স্বস্তিকের পরিচয় কী? ছোটো খাটো একটা ব্যবসায়ী মাত্র। যে ফ্ল্যাটে থাকে, সেটাও তার নিজের নয়। পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে দানে পাওয়া। এখনও লোকেরা স্বস্তিককে ডক্টর সৃঞ্জয় মজুমদারের ছেলে বলেই চেনে। নিজের পিতার সামনে সে তো নগন্য। পিতার চরিত্রে সার্বজনিক ভাবে হীনতার আরোপ লাগানোর তার কোনো অধিকার নেই। না, সে নিজের পিতার সম্মান নষ্ট হতে দেবে না। কিছু একটা করতেই হবে তাকে। বেহালা যেতে পারবে না সে এবার। গোপন ঠিকানার রহস্য ভেদ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। রহস্য রহস্যই থাক, এটাই সবার পক্ষে ভালো। অন্ততঃ সৃঞ্জয় মজুমদারের পক্ষে তো বটেই। কিন্তু কী করবে মাথায় আসছে না স্বস্তিকের। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরেছে স্বস্তিক। বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। এখন দুপুর দু’টো, কিন্তু মনে হচ্ছে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। নিজের পিতার সম্মান রক্ষার উপায় সে কিছুতেই বার করতে পারছে না। বাড়ি ফিরেও সে স্থির বসতে পারছে না। মনের ছটফটানি তার সর্বাঙ্গে দেখা দিয়েছে। কখনও চেয়ারে বসছে, কখনও সোফাতে, কখনও সারা ফ্ল্যাট হাঁটছে। ইতিমধ্যেই প্রজ্ঞার বেশ কয়েক বার ফোন চলে এসেছে। কথা বললো না স্বস্তিক। ফোন বন্ধ করে রেখে দিলো। চিন্তার মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খেতে খেতে হঠাৎ এক বুদ্ধি খেললো তার মস্তিষ্কে। চকিতে ছ্যাঁৎ করে উঠল তার হৃদয়। যেটা সে ভাবলো, সেটা করতে পারবে তো? অন্য কোনো পথ তো সে আর দেখতে পারছে না। স্বস্তিক মনস্থির করলো। যেটা ভেবেছে, সেটাই করবে।

    পর্ব – 7
    …………………….

    ‘বাবা, আমি যা কিছু করছি তোমার খাতিরে। যদি ভুল করি, ক্ষমা করে দিও।’ মনে মনে বলল স্বস্তিক।
    মোবাইল অন করে আভাকে ফোন করলো। আভাকে একটা মোবাইল সে দিয়েছিল। মোবাইল আভার হাতে দিয়ে সে বলেছিল- ‘এটা রাখো। ইচ্ছে তো আছে রোজ আসবার, কিন্তু সম্ভব হবে না। ফোন থাকলে রোজ কথা তো হতে পারবে।’
    প্রথম আলাপের পর আভার সাথে সম্পর্কটা বেশ মধুর হয় উঠেছিল স্বস্তিকের। পিতৃ বিয়োগের সংবাদ পেয়ে বিষাদের গভীর সাগরে ডুবে গিয়েছিল আভা। দেয়ালে পিঠ সাঁটিয়ে মাটিতে বসে পড়েছিল। দু’পায়ের মাঝে গুঁজে দিয়েছিল নিজের মুখ। তার পাশে গিয়ে বসেছিল স্বস্তিক। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল- ‘আমাদের এটা মেনে নিতেই হবে আভা। এটাই সত্য। এবার থেকে তোমার বাবার বদলে তোমার বড়ো ভাই আসবে তোমার কাছে। তোমার কোনো আপত্তি আছে?’
    মুখ তুলে অশ্রু ভেজা চোখে আভা তাকিয়েছিল স্বস্তিকের দিকে। অশ্রু মুছে দিয়েছিল স্বস্তিক। আভা আগের থেকে অনেক সুস্থ। একদিন সে স্বস্তিককে বলেছিল- ‘তোমার কী মনে হয়? আমার মাথা খারাপ? হ্যাঁ, হঠাৎ করে মাঝে মাঝে মাথা গরম হয় যায় ঠিকই। কিন্তু এটা কি এতোই গভীর সমস্যা যে আমাকে এই বাড়ি থেকে বেরোতে দিতে নেই? বাবার চিকিৎসাতে এখন আমি তো অনেকটাই সুস্থ। তাও বাবা আমাকে কেন বেরোতে দিতো না, দাদা?’
    জবাব দিতে পারেনি স্বস্তিক। শুধু বলেছিল- ‘তুমি বাইরে যেতে চাও? ঠিক আছে, আমি নিয়ে যাবো।’
    নিয়ে গিয়েছিল স্বস্তিক । আভা যেন এক নতুন জীবন পেয়েছিল। স্বস্তিকের হৃদয়ে গভীর জায়গা দখল করে নিয়েছিল সে। ‘বোন’, এই একটা শব্দ স্বস্তিকের যেন সম্পূর্ণ জীবন পরিপূর্ণ করে দিয়েছিল।

    আভাকে ফোনে স্বস্তিক বলল- ‘তুমি বেরিয়ে চৌমাথায় এসো। আমি এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছবো।’
    চমকে উঠল আভা।
    ‘এখন! খুব বৃষ্টি পড়ছে তো।’
    ‘হ্যাঁ, এখন। হাতে সময় নেই। আমি যে কোনোদিন আর সেই বাড়িতে যেতে পারবো না।’
    ‘কেন?’ বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো আভা।
    ‘দেখা করে বলবো। তুমি চৌমাথার বাস স্টপে দাঁড়াও। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।’
    ফোন কেটে দিলো স্বস্তিক। জানালার বাইরে তাকালো। ঠিকই, বৃষ্টি বেশ প্রবল বেগে পড়ছে। পথে ঘাটে জলের প্রাচুর্য বেড়েছে নিশ্চয়ই। প্রকৃতি যেন বাধা উৎপন্ন করার চেষ্টা করছে স্বস্তিকের পথে। কিন্তু স্বস্তিকের সিদ্ধান্ত দৃঢ়। এই হিডেন ট্রান্সমিটার তার জীবনের গোপনীয়তা প্রকাশ্যে এনে দেবে। লোকেরা জানতে পেরে যাবে বেহালার গোপন ঠিকানার বিষয়। প্রশ্ন উঠবে আভার পরিচয় নিয়ে। না, আর সহ্য করতে পারছে না স্বস্তিক। মাথা কেমন দপদপ করে উঠছে তার। দ্রুত কদমে রান্না ঘরের দিকে এগোলো সে। একটা ধারালো ছুরি হাতে নিলো। সন্তর্পণে কোমরের ক্ষতস্থান থেকে ব্যান্ডেজ সরিয়ে ছুরি স্পর্শ করলো। বিকট যন্ত্রণার সাথে প্রবল রক্তপাত। দাঁতে দাঁত চিপে সহ্য করলো। খানিক পরেই তার হাতে চলে এলো ছোট্টো, চ্যাপ্টা, গোলাকৃতির এক ট্রান্সমিটার। সেটা কে পায়ের তলায় পিষে, ক্ষতস্থানে কোনোক্রমে একটা মোটা কাপড় বেঁধে দ্রুত বেগে বেরিয়ে গেল সে। স্বস্তিক জানে তার হাতে এবার সময় অল্প। ইন্টারনাল সিক্যুরিটির লোকেরা হিংস্র কুকুরের মতো খুঁজে বেড়াবে তাকে এবার। যে সিদ্ধান্ত সে নিয়েছিল, সেটার প্রথম পদক্ষেপ সে পেরিয়ে গেছে। এবার পেছনে হটবার আর কোনো উপায় নেই। কিছু হিংস্র মানুষের হাত থেকে বেঁচে যত শীঘ্র সম্ভব আভার কাছে পৌঁছতে হবে। নিজের গাড়ি বার করলো স্বস্তিক। বৃষ্টির বেগ এতো প্রবল যে শহরের কিছু রাস্তা নদীতে পরিণত হয়েছে। এই নদী পেরিয়ে আভার কাছে পৌঁছতে সময় লাগবে। খুব মন্থর গতিতে এগোচ্ছে স্বস্তিকের গাড়ি। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইন্টারনাল সিক্যুরিটি যে কোনো সময় হামলা করতে পারে তার ফ্ল্যাটে। সেখানে পাবে না স্বস্তিককে। চকিতে শহরের চারিদিকে ছড়িয়ে যাবে খবর। প্রতিটি রাস্তার মোড়ে এদের ঠিকানা। স্বস্তিকের বেহাল পৌঁছনোতে লেগে যেতে পারে প্রশ্ন চিহ্ন। বুক টিপটিপ করছে স্বস্তিকের। দু’চারটে ইন্টারনাল সিক্যুরিটির গাড়ি তার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। বুকটা ধড়াস করে উঠল তার। ভয়ে যেন তার হাত,পা অবশ হয়ে গেল। কোনোরকমে সে এগিয়ে চলল।

    পর্ব – 8
    ……………………..

    এক সময় স্বস্তিক পৌঁছল বেহালার চৌমাথায় এসে। বেশ ভালোই সময় লাগলো তার। সে দেখল কাঁচ দিয়ে ঘেরা বাস স্টপের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে আভা। রাস্তায় প্রায় হাঁটু পর্যন্ত জল। বাস স্টপের সামনে গাড়ি দাঁড় করালো স্বস্তিক। গাড়িটা চিনতো আভা। এই গাড়িতে চড়ে স্বস্তিকের সাথে সে বহু বার বেরিয়েছে। এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। দরজা খুলে স্বস্তিকের পাশে বসলো। 

    ‘ব্যাপার কী দাদা?’ উত্তেজিত কন্ঠে আভা জিজ্ঞেস করলো।
    ‘বলছি।’ গাড়ি নিয়ে স্বস্তিক এগিয়ে গেল।

    কোন দিকে যাবে জানে না সে। এই মুহূর্তে তার কোন দিকে যাওয়া উচিত, বুঝতে পারছে না। যেটা সে মনস্থির করেছে, সে কাজটা করতে হঠাৎ কিছু অজ্ঞাত কারণে দ্বিধা বোধ করছে সে। কিন্তু আর তো কোনো উপায় নেই। একবার আভার সাথে এ বিষয় আলোচনা করে নেওয়া ভালো। আভা তাকে আবার জিজ্ঞেস করলো- ‘দাদা, ব্যাপারটা কি? আমার যাচ্ছি কোথায়?’
    ‘কোথায় যাচ্ছি সেটা বলার আগে একটা কথা তোমাকে বলে দিতে চাই, আভা।’ কথা শেষ করে আভার দিকে তাকালো স্বস্তিক।
    ‘কী কথা?’ উৎকন্ঠা মেশানো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো আভা।
    ধীর কন্ঠে বলতে আরম্ভ করলো স্বস্তিক। বললো নিজের পিতার কর্ম, বলল হিডেন ট্রান্সমিটারের বৃত্তান্ত, বলল পিতার সম্মান রক্ষার কথা। অবশেষে বললো পিতার সম্মান রক্ষার এক মাত্র উপায়। দু’চোখ বন্ধ করে কথাগুলো শুনছিল আভা। স্বস্তিকের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর বলল- ‘আর যখন কোনো উপায় নেই, তখন এটাই ঠিক। তুমি যা করেছো, ঠিক করেছো, দাদা। বাবার সম্মান রক্ষার খাতিরে তুমি যাই করো, আমি তোমার সাথে থাকবো।’
    স্বস্তিক নিজের বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরলো আভার ডান হাত।
    তাদের গাড়ি এগিয়ে চললো ডায়মন্ড হার্বার রোড ধরে। অন্ধকার বেশ ঘনিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা ছ’টা বাজে, কিন্তু মনে হয় যেন রাত নেমে এসেছে। বৃষ্টির বেগ যেন বেড়েই চলেছে। হঠাৎ তারা দেখল এক সাথে অনেক গাড়ি, বাস ও ট্রাক পংক্তিবদ্ধ হয় দাঁড়িয়ে আছে। কী ব্যাপার? বুকটা পুনরায় টিপটিপ করে উঠল স্বস্তিকের। গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করলো- ‘এতো জ্যাম কেন?’

    জবাব পেল- ‘ইন্টারনাল সিক্যুরিটির তামাশা, মশায়। চেকিং চলছে। কিসের চেকিং সেটা ভগবানই জানেন।’
    বুকটা স্বস্তিকের ধড়াস করে উঠল। ভয় মেশানো দৃষ্টিতে তাকালো আভার দিকে।
    ‘কী হবে এবার?’ আভার কন্ঠেও আশঙ্কার ছাপ স্পষ্ট।
    গাড়ির ভেতর থেকেই চারিপাশে ভালো করে দেখে নিল স্বস্তিক। কিছু একটা চোখে পড়লো তার। রাস্তার বাঁ দিক দিয়ে চলে গেছে একটা লম্বা ব্রিজ। আসলে সেটা যে মেট্রো রেলের লাইন, সেটা বুঝতে পেলো স্বস্তিক। চকিতে মাথায় আরেক উপায় এলো তার। চোখের ইশারাতে আভাকে গাড়ি থেকে নামতে বলল। গাড়ি থেকে নেমে সন্তর্পণে তার মেট্রো স্টেশানের দিকে এগোতে লাগলো। অবশেষে একসময় মেট্রো স্টেশনে এসে পৌঁছলো তারা। পাঁচ মিনিটের পথ অতিক্রম করতে প্রায় আধ ঘন্টা সময় লাগলো তাদের। মেট্রো স্টেশন ছিলো পেছন দিকে। তাই সিক্যুরিটির নজরে আসার সম্ভাবনা কমে গিয়েছিল। সর্বাঙ্গ ভেজা তাদের। কিন্তু সে দিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। দু’টো টিকিট কেটে’ সুরক্ষা গন্ডী পেরিয়ে তারা প্ল্যাটফর্মে পৌঁছলো। রক্ষে যে এখানে কোথাও ইন্টারনাল সিক্যুরিটি নেই। প্ল্যাটফর্ম চারিদিকে কাঁচ দিয়ে ঘেরা। লাইনের ধারে কাঁচের বেশ কিছু দরজা আছে। মেট্রো এসে দাঁড়ালে, মেট্রোর দরজা এবং সেই কাঁচের দরজা একসাথে খোলে। অত্যাধিক বর্ষার দারুণ যাত্রীর সংখ্যা খুব বেশি ছিলো না। খানিক পরেই মাইকে ঘোষণা হলো, ধর্মতলা থেকে কাকদ্বীপ যাওয়ার মেট্রো এক নাম্বার প্ল্যাটফর্মে আসতে চলেছে। নিজের উদ্দেশ্যের দিকে আরও এক পা এগিয়ে যাওয়ার সময় চলে এলো স্বস্তিক ও আভার। দু’জনেই একে অপরের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করলো। আভার মন দুর্বল, তাও সে নিজের পিতার সম্মান রক্ষার খাতিরে নিজের দাদার মতে একমত হয়েছে। আভার গালে নিজের হাত রাখলো স্বস্তিক। চোখ দু’টো ছলছল করে উঠল আভার।
    মেট্রোতে চড়ে, নিচের দিকে তাকিয়ে দু’জনে দেখতে পেলো রাস্তায় গাড়ির সে লম্বা লাইন। ইন্টারনাল সিক্যুরিটির লোকেরা একে একে করছে সব গাড়ির তল্লাশি।

    কাকদ্বীপের সেই বৃহৎ জলাশয় আজ নিয়েছে ভয়ংকর রূপ। চারিদিকে অন্ধকার। অঝোরে পড়ছে বৃষ্টি। সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বস্তিক ও আভা। হঠাৎ যেন তারা সমুদ্রের ওপারে দেখতে পেলো নিজের পিতার প্রতিচ্ছায়া। শেষ বারের মতো আলিঙ্গনবদ্ধ হলো দুজনে। সমুদ্র এগিয়ে আসছে তাদের দিকে, তারা এগিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের দিকে। শেষ বারের মতো চোখ মেলে নিজের বোনের শূন্যে ভাসা দু’টো হাত দেখল স্বস্তিক।

    ক্রমাগত স্বস্তিকের মোবাইলে ফোন করে যাচ্ছে প্রজ্ঞা। একই কথা সে বার বার শুনতে পাচ্ছে- ‘The number you have dial is switch off right now. Please try after some time’

    সমাপ্ত ।

  • ধারাবাহিক

    ক্ষত (পর্ব- ৫/শেষ)

    ক্ষত 
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

     

    পর্ব- ৫

    ‘এটাকে এক ধরনের মানসিক ব্যাধি বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে।’ মৃত্যুঞ্জয় বলতে আরম্ভ করলো- ‘নিজের ক্ষতি করা, নিজেকে আঘাত দেওয়া এক ধরনের মানসিক রোগ। মেডিকাল সায়েন্সে এই রোগের দুটো নাম। প্রথম হলো -সেল্ফ ইনজুরি ডিসঅর্ডার, আর দ্বিতীয় নাম হলো- বি.পি.ডি. মানে বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার। এই রোগে মানুষ নিজেকে ক্ষতি করে। হয়তো সে এতে আনন্দ পায়, হয়তো নিজের শরীরের ব্যথাকে উপভোগ করে।’
    ‘তার মানে তুমি বলতে চাও যে প্রতীক সেই মানসিক রোগে আক্রান্ত?’ জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
    ‘ইয়েস মাই ডিয়ার। প্রতীক বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত। সব থেকে বড় কথা হলো সে জানে যে সে এই বীভৎস রোগের শিকার।’
    ‘কী করে বুঝলে তুমি যে সে জানে?’
    ‘তার ঘরে মেডিকালের বই দেখে। জানি না কী কারণে সেই বইগুলোকে সে পুড়িয়ে ফেলেছে। যে বইগুলো প্রতীকের ঘর থেকে আমি পাই, সেগুলো সাধারণত সাইক্রিয়াটিস্টরা পড়ে।’
    ‘আর ওই চিরকুটগুলোর মানে?’ প্রশ্নের পাহাড় জমে আছে অন্বেষার মনে।
    ‘ভালো করে ভেবে দেখো অন্বেষা। মানে তুমিও বুঝতে পারবে। প্রথম চিরকুট- এস-1, দেয়াল …. দেয়ালে রক্তের দাগ। এখানে ‘এস’ এর মনে কী?’ এস ‘মানে স্টেপ । পুরো মানে হলো স্টেপ-1, দেয়াল। শরীরে আঘাতের আরম্ভ হয়ে দেয়াল থেকে। দেয়ালে মাথা ঠুকে নিজের কপাল ফাটানো। এস-2 , মানে স্টেপ-2 হলো বেল্ট। আমার বিশ্বাস তার শরীরে বিশেষ করে পিঠে বেল্টের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যাবে। এস-3, মানে স্টেপ 3 হলো ব্লেড আর ছুরি। হাত কাটা, গাল কাটা এই সব।’
    ‘তাহলে স্টেপ- 4 রিক্ত কেন?’
    ঈষৎ গম্ভীর হয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘স্টেপ- 4 হলো চরম আঘাত। সেই চরম আঘাতটা কী সেটা এখনও হয়তো প্রতীক ঠিক করতে পারেনি। অন্বেষা, নেশা এক অদ্ভুত ফিলিংস। আমরা নেশা করি, সিগারেট, মদ ইত্যাদি। এটাকে তুমি সাধারণ ভাবে চিন্তা করে দেখো। আমরা যখন মদ খেতে শিখি, তখন একটা বা দু’টো পেগে আমাদের নেশা হয়ে যেতো। কিন্তু সেই পর্যায় নেশা করতে গেলে আমাদের এখন পাঁচ,ছয় কিম্বা সাত-আট পেগও লেগে যায়। সিগারেট আমি এক সময় দিনে দু’টো কিম্বা তিনটে খেতাম, এখন এক প্যাকেটের বেশি খাই। তার মানে ব্যাপারটা হলো নেশার পরিমান দিনে দিনে বেড়ে যায়। নিজেকে আঘাত করাটা প্রতীকের এক ধরনের নেশা। প্রথমে দেয়ালে মাথা ঠুকে চোট লাগাতো। আস্তে আস্তে তাতে তৃপ্তি কমে গেলো। তার পর শুরু হলো বেল্ট দিয়ে নিজের শরীরে প্রহার। কিছু দিন পর এতেও তার মন ভরলো না। নেক্সট হলো ব্লেড, ছুরি ইত্যাদি..’
    ভয়ার্ত কন্ঠে অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো- ‘তাহলে শেষ তৃপ্তি সে কিসে পাবে?’
    ‘ওই যে বললাম, জল। খুব সম্ভব জলের মাধ্যমে প্রতীক যে আঘাতটা পাবে, সেটা হবে তার শেষ এবং চরম তৃপ্তি।’
    ‘কিন্তু….কিন্তু প্রতীকের এই অদ্ভুত রোগটা হলো কেন?’
    ‘সেটা জানার জন্য প্রতীকের অতীতের বিষয় জানা দরকার। তবে বেশ কিছু কারণ হতে পারে সেল্ফ ইনজুরি ডিসঅর্ডারের। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, অতীতে অত্যাধিক টর্চার হওয়া, সম্পর্কের টানাপোড়ন, এই ধরেনের বেশ কিছু কারণ হতে পারে। এখন প্রতীকের এই রোগ হওয়ার মুখ্য কারণ কী, সেটা এখানে বসে বলা সম্ভব নয়। সেল্ফ ইনজুরি ডিসঅর্ডার দু’ রকমের হয়। একটা নন্ সুইসাইডাল সেল্ফ ইনজুরি ডিসঅর্ডার এবং সুইসাইডাল সেল্ফ ইনজুরি ডিসঅর্ডার। নন্ সুসাইডল সেল্ফ ইনজুরি ডিসঅর্ডার যখন নিজের সীমা লঙ্ঘন করে তখন সেটা সুসাইডালে পরিণত হয়। যেমন তোমাকে নেশা বৃদ্ধির উদাহরণ দিলাম, ঠিক তেমনই। আশা করি প্রতীকের এখনও এই রোগটা সুসাইডল পর্যন্ত যায়নি।’
    কথাটা শেষ করতেই বেজে উঠল মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইল। বিকাশ ফোন করেছে।
    ‘হ্যাঁ বলো বিকাশ।’
    ‘মৃত্যুঞ্জয়দা, প্রতীক এসেছিলো। সব দেখলো, শুনলো কিন্তু কিছু বলল না। নো রিয়্যাকশন। আমি তাকে বললাম যে পুলিশকে খবর দিতে যাচ্ছি, কিন্তু মানা করলো আমায়। নিজের ঘরে গিয়ে এদিক ওদিক দেখলো, কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো তার পর বেরিয়ে গেলো।’
    ‘কোথায়?’ উৎকন্ঠায় জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘জানি না। জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু জবাব দিলো না। এটাই তো ওর প্রবলেম, কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেয় না।’
    ‘সাথে কিছু নিয়ে বেরিয়েছে কি?’
    ‘না, কিছুই না। খালি হাতে বেরলো। তবে বেরোবার সময় তার মুখটা কেমন অদ্ভুত ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। সত্যি বলতে, এতো দিন ধরে দেখছি তাকে, কিন্তু এমন মুখ কোনো দিন দেখিনি। ভয় পেলাম, তাই ফোন করলাম তোমায়।’
    ‘বিকাশ, আমাদের বাঁচাতে হবে তাকে।’ কথাটা প্রায় চিৎকার করে বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘কিন্তু কেমন করে?’ জিজ্ঞেস করলো বিকাশ।
    ‘রাধিকা কোথায়?’
    ‘সে তো নিজের বাড়ি চলে গেছে।’
    ‘তাকে বাড়ি থেকে বেরোতে বলো। তুমি তার কোনো নিয়ারেস্ট পয়েন্টে দেখা করো তার সাথে। তারপর তোমরা গান্ধী সেতুর দিকে রওনা দাও।’
    ‘গান্ধী সেতুর দিকে!’ আশ্চর্য হলো বিকাশ।
    ‘হ্যাঁ, বেশি প্রশ্ন নয়। তাড়াতাড়ি করো। আমার মনে হয়ে সময় খুব কম আমাদের হাতে।’
    কথা শেষ করে মৃত্যুঞ্জয় ফোন রেখে অন্বেষাকে বলল- ‘অন্বেষা, নিজের স্কুটি বার করো। রাইট নাউ।’
    ‘কী হলো?’ অন্বেষার মুখও ফ্যাকাসে।
    ‘বললাম না সময় নেই। হরিআপ।’
    সূর্যাস্ত হওয়ার অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। পাটনার রাস্তাঘাট এখন স্ট্রিট লাইটে ঝলমল করছে। অফিস ফেরার সময়, তাই রাস্তায় ভিড় বেশি। স্কুটির চালক সিটে বসে আছে মৃত্যুঞ্জয় এবং তার পেছনে অন্বেষা। গান্ধী সেতুর যাওয়ার রাস্তা অন্বেষা বলে দিচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়কে। কখনও স্কুটি আশি কিলোমিটার প্রতি ঘন্টার গতি নিয়ে তীর বেগে ছুটে যাচ্ছে, তো কখনও কুড়ি কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায় নেমে আসছে তার গতি। হঠাৎ পেছন থেকে অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো- ‘তুমি কি শিওর যে প্রতীক সেখানেই গেছে?’
    ‘একটা অনুমান মাত্র। আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে। প্রতীক নেলসন হয়তো এটা আন্দাজ করতে পেরেছে যে চোর বিকাশের নয় তার ঘরেই ঢুকেছিলো। আর যে ঢুকেছিলো সে যে আদৌ চোর নয়, সেটাও হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে সে। সে হয়তো বুঝতে পেরেছে যে তার ক্ষতর সন্ধান করতেই কেউ এই কান্ড করেছে। প্রতীকের সব থেকে আগে সন্দেহ যাওয়া উচিত বিকাশের ওপরে। এবার তাকে বহু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। যেটা সে চায় না। যারা মদ্যপান করে তারা মাঝে মাঝে নিজের দুঃখ, কষ্ট ভুলবার জন্য অত্যাধিক মদ্যপানের শরণাপন্ন হয়। চরম পর্যায় নেশা, চরম পর্যায় তৃপ্তি। যতদূর মনে হয়ে এখানেও চরম পর্যায় তৃপ্তির সময় চলে এসেছে।’
    বিকাশের ফোন এলো মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইলে। মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইল অন্বেষার হাতে। অন্বেষা কল রিসিভ করলো। ওপার থেকে বিকাশ বলল- ‘আমরা মিঠাপুর বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে গেছি।’
    ‘এগিয়ে বাঁ দিকে টার্ন নাও। আমরা সেখানেই আছি।’ অন্বেষা বলল।
    স্কুটি দাঁড় করালো মৃত্যুঞ্জয়। বাইপাস রোড এটা। পাশেই বাস স্ট্যান্ড। প্রচুর বাসের যাওয়া-আসা এই রাস্তায়। গান্ধী সেতু পাটনা থেকে শুরু করে হাজীপুর পর্যন্ত চলে গেছে। গঙ্গা নদীর ওপর প্রায় ছ’কিলোমিটার লম্বা এই ব্রিজ সাউথ ও নর্থ বিহারকে এক করার মুখ্য পথ। মহাত্মা গান্ধী সেতুর থেকে আর বেশি দূর নেই তারা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বিকাশ ও রাধিকা সেখানে যথাস্থানে পৌঁছালো। সবাই মিলে একসাথে এগোলো এবার।
    ‘কী ব্যাপার মৃত্যুঞ্জয়দা? হঠাৎ আমাদের এখানে ডাকলে?’ মৃত্যুঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করলো বিকাশ।
    ‘প্রয়োজনে সাহায্য করতে পারবে তাই ডাকলাম।’ মৃত্যুঞ্জয় জবাব দিলো।
    ‘সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু এখানেই কেন?’
    ‘যদি আমার অনুমান ঠিক থাকে তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারবে।’
    বেশিক্ষণ লাগলো না তাদের মহাত্মা গান্ধী সেতু পৌঁছাতে। তীর বেগে সেতুর ওপরে উঠলো তাদের দু’ চাকা। খানিক এগোতেই তারা দেখতে পেলো ব্রিজের রেলিংএর ধারে মাথা নত করে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। পরনের জামাকাপড়ে তাকে চিনতে পারলো প্রত্যেকে। সে আস্তে আস্তে রেলিংএর গায়ে পা দিয়ে উঠবার চেষ্টা করছে।
    ‘প্রতীক….প্রতীক ….! ‘ চিৎকার করলো বিকাশ। কিন্তু গাড়ির আওয়াজে ডেবে গেলো বিকাশের চিৎকার। স্কুটির গতি অনেক কমিয়ে দিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘না, চিৎকার করে লাভ নেই।’ বিকাশকে কথাটা বলেই স্কুটির গতি আরও অল্প করলো মৃত্যুঞ্জয়। অন্বেষাকে বলল- ‘অন্বেষা , আমি স্কুটি থামতেই নেমে যাবো। স্কুটি তুমি হ্যান্ডেল করবে।’
    ‘ঠিক আছে।’ অন্বেষা একমত।
    যেমন কথা তেমন কাজ। স্কুটি থেকে নেমে হেলমেট খুলে অন্বেষার হাতে দিয়েই মৃত্যুঞ্জয় দৌড় দিলো প্রতীকের দিকে। ততক্ষণে প্রতীক রেলিংএর প্রায় অনেকটাই চড়ে গেছে। মৃত্যুঞ্জয়ের পেছন পেছন অন্বেষা, বিকাশ, রাধিকাও সে দিকে দৌড় দিলো। জলে ঝাঁপ দেওয়ার শব্দ তাদের কানে এলো। গাড়ির হর্নের শব্দের দরুণ খুব ক্ষীণ আওয়াজ এলো তাদের কানে। জলে ঝাঁপ দেওয়ার শুরুতে একটা শব্দ, কিছু সেকেন্ড পরেই তাদের কানে আরও এক শব্দ এলো।
    ‘মৃত্যুঞ্জয়দা!’ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়লো অন্বেষা।
    প্রতীকের জলে ঝাঁপ দেওয়ার কিছু সেকেন্ড পরেই ঝাঁপ দিলো মৃত্যুঞ্জয়। দৃশ্যটা এখনও চোখের সামনে ভাসছে অন্বেষার। মৃত্যুঞ্জয়ের নাম ধরে চিৎকার করে দ্রুত বেগে ছুটে গেলো সে। গঙ্গা নদী থেকে প্রায় চল্লিশ ফিটের উচ্চতা ব্রিজের। নিচে ঝাঁপ দিলে বেঁচে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই অল্প। মৃত্যুঞ্জয়কে ঝাঁপ দিতে দেখে চোখে প্রায় অন্ধকার দেখছিলো অন্বেষা। ব্রিজের ওপর থেকে অন্বেষা দেখতে পেলো, জলে পাগলের মতো হাত পা ছুঁড়ছে মৃত্যুঞ্জয়। বিকাশ বুঝতে পারলো সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। কিছু একটা শেষ চেষ্টা তাকে করতেই হবে। অন্বেষার অবস্থা যে ভালো নয় সেটা বুঝতে পেরেছিলো বিকাশ। রাধিকাকে সে বলল- ‘তোমাকেই সামলাতে হবে একে। আর এখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলে কিছু হবে না। স্কুটি আর বাইক এখানেই থাক। যা হবে দেখা যাবে। আমাদের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হবে। তাড়াতাড়ি করো, হাতে সময় খুব কম।’
    ব্রিজের মুখেই সিঁড়ি। সেটা দিয়ে নিচে নেমে এলো তারা। উর্ধশ্বাসে ছুটে চলল গঙ্গার ঘাটের দিকে। ঘাটটা বেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। যখন তারা ঘাটে পৌঁছালো দেখতে পেলো তিনটে লোক মিলে এক অচেতন ব্যক্তিকে ধরে বেঁধে ঘাটে নিয়ে আসছে। অচেতন ব্যক্তির সংখ্যা এক, বুকটা কেঁপে উঠল অন্বেষার। কে সেই অচেতন লোকটা? প্রতীক, নাকি মৃত্যুঞ্জয়? যারা তাকে ধরে বেঁধে তুলে নিয়ে আসছে, তারা নিশ্চয়ই মাঝি। হৃদস্পন্দন ক্রমে বাড়ছিল অন্বেষার। অচেতন অবস্থার লোকটা বেঁচে আছে তো? ঘাটের পাশে এক গাছের নিচে তাকে শুইয়ে দেওয়া হলো। বিকাশ ও রাধিকা লঘু কদমে সে দিকে এগিয়ে গেলো। এগোতে পারেনি অন্বেষা। আতঙ্কে তার পা যেন পাথরের ন্যায় এক জায়গায় স্থির হয়ে গিয়েছিলো। মাঝিরা নিজেদের মধ্যে কি সব কথা বলছিলো। অন্বেষার সাথে তাদের দূরত্ব খুব একটা বেশি ছিলো না, তাও অন্বেষার মনে হলো যেন তাদের কথা বহু দূর থেকে কানে ভেসে আসছে। হঠাৎ বিকাশের গলা শুতে পেলো সে।
    ‘অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। প্রচুর রক্ত বেরিয়েছে।’
    মাঝিদের মধ্যে এক জন বলল- ‘আপনাদের লোক? নিয়ে যান বাবু। আর পারি না আমরা। রোজ রোজ কেউ না কেউ জলে ঝাঁপ দেবে আর আমরা বাঁচাতে দৌড়াব। কী করবো? চুপচাপ বসে থাকতেও পারি না। মনুষ্যত্ব বলে একটা জিনিস আছে তো।’
    কথাটাটা বলে সে উল্টো দিকে চলে গেলো। অন্বেষা দেখলো, আরেকটা মাঝি তার সঙ্গ নিয়ে এগিয়ে গেলো তার সাথে। রাতের অন্ধকারের কারণে কারুর চেহারাই স্পষ্ট দেখতে পেলো না অন্বেষা। কিন্তু, মাঝি তো তিন জন ছিলো। ফিরে গেলো দু’জন। আরেক জন কোথায়? অন্বেষা দেখলো, রাধিকা এগিয়ে আসছে তার দিকে। তার কাছে এসে রাধিকা বলল- ‘বিকাশ অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করেছে।’
    ‘ক….ক….কে এটা?’ কোনো ক্রমে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
    ‘প্রতীক। মাথা নাকি ফেটে গেছে। অনেক রক্ত বেরিয়েছে। আমি কাছে গিয়ে দেখিনি, বিকাশ বলল।’
    রাধিকার জবাবে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল অন্বেষার। প্রতীককে পাওয়া গেলো, কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় কোথায়? মৃত্যুঞ্জয়কে কি পাওয়া গেলো না। গলা শুকিয়ে গেলো অন্বেষার। বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছিলো তার। হঠাৎ নিজের পেছন থেকে সেই চেনা কন্ঠস্বর শুনতে পেলো সে।
    ‘চেষ্টাটা অবশেষে সফল হলো। কি বলো, অন্বেষা।’
    পেছনে ফিরতেই আতঙ্ক আর খুশি মিশে একাকার হয়ে গেলো অন্বেষার হৃদয়ে। অনেক চেষ্টা করেও নিজের চোখের জল সে আটকে রাখতে পারলো না। ছুটে গেলো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে। অন্বেষার এহেন অবস্থা দেখে মৃদু হেসে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘তোমার কী মনে হলো, আমি গেলাম? না অন্বেষা, মৃত্যুঞ্জয় এতো সহজে যাবে না।’
    দুপুর বেলা। এক বেসরকারী হাসপাতালের আই.সি.ইউ. কেবিনের সামনে বসে আছে অন্বেষা, রাধিকা, বিকাশ ও মৃত্যুঞ্জয়। খানিক আগেই ডক্টর এসে বলে গেছেন যে প্রতীক ইজ কমপ্লিটলি আউট অফ ডেঞ্জার। কিন্তু এখনও জ্ঞান ফেরেনি তার। মাথার পেছনে লেগেছিলো অল্প আঘাত। সেই থেকে নিজের জ্ঞান হারিয়েছে সে। ব্রেন স্ক্যান করা হয়েছে। রিপোর্ট নর্মাল। ডক্টরের বিশ্বাস কিছুক্ষণের মধ্যে নিজের জ্ঞান ফিরে পাবে প্রতীক নেলসন। তা ছাড়া কপালে মোট দশটা স্টিচ লেগেছে তার। ভেঙ্গেছে ডান পা’টাও। মৃত্যুঞ্জয়ের যে আঘাত লাগেনি তা নয়। কপালে অল্প আঘাতের সাথে সাথে বাঁ হাত ভেঙ্গেছে তার।
    ‘এতো উঁচু থেকে ঝাঁপ দেওয়ার পর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা যে খুব কমে যায় সেটা আর বলে দিতে হয় না। আমার মনে হয়েছিল যে প্রতীক হয়তো সাঁতার জানে না। সাঁতার জানলে সে জলে ঝাঁপ দিতো না। মৃত্যুকে সামনে দেখে অজান্তেই তার হাত পা চলতে শুরু করতো। শেষ তৃপ্তি সে আর পেতো না। প্রতীককে বাঁচাবার আমার কাছে একটাই উপায় ছিলো। প্রতীকের সাথে সাথে জলে ঝাঁপ দেওয়া। আমি তাই করলাম। আমি যদি অল্প দেরি করতাম, তাহলে প্রতীককে জীবিত অবস্থায় ফেরত নিয়ে আসা হয়তো সম্ভব হতো না।’ হাসপাতালে বসে কথাটা বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘এমন করো না মৃত্যুঞ্জয়দা। তোমাকে ওই ভাবে ঝাঁপ দিতে দেখে আমার যে কী অবস্থা হয়েছিল, সেটা শুধু আমি জানি।’ বলল অন্বেষা।
    ‘এতো ভয় পেলে চলে না, সোনা আমার। তদন্ত করতে গেলে অনেক বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। তার জন্য প্রস্তুত থাকা দরকার।’
    হাসপাতালে পুলিশ এসেছিলো। মৃত্যুঞ্জয় কথা বললো তাদের সাথে। মৃত্যুঞ্জয় জানে পুলিশের সাথে কী ভাবে কথা বলতে হয়। পুলিশকে ম্যানেজ করতে খুব ভালো পারে সে। মৃত্যুঞ্জয়ের ফিরে আসার পর আই.সি.ইউ. এর সামনে রাখা এক বেঞ্চির দিকে এগিয়া গেলো অন্বেষা। এক বৃদ্ধপ্রায় লোক মাথা হেঁট করে সেখানে বসে আছে। তার কাঁধে হাত রেখে অন্বেষা বললো- ‘আপনি উঠুন, মিস্টার নেলসন। চলুন আমার বাড়ি। স্নান করে কিছু খেয়ে বরং রেস্ট নিন আপনি। আপনার শরীরটাও তো ভালো দেখছি না।’

    প্রতীক নেলসনের অতীত
    …………………………………………..
    সন্ধ্যে বেলায় বাড়ির ছাদে বসে আছে তারা। মৃত্যুঞ্জয়, অন্বেষা এবং প্রতীক নেলসনের বাবা জোসেফ নেলসন। রাধিকা নিজের বাড়িতে। প্রতীকের সাথে হাসপাতালে আছে বিকাশ পান্ডে। কিছুক্ষণ আগেই হাসপাতাল থেকে খবর এসেছে যে প্রতীকের জ্ঞান ফিরেছে। বিকাশকে চিনতে পেরেছে সে। এখন অনেকটাই সুস্থ প্রতীক।
    বাড়ির ছাদে তিনটে চেয়ারে বসে আছে তিন জনে। সামনে একটা ছোট্ট গোল সেন্টার টেবিল। চায়ের সরঞ্জাম তাতে। মৃত্যুঞ্জয় এবং মিস্টার নেলসনের হাতে চা দিয়ে নিজের চায়ের কাপটা উঠিয়ে নিলো অন্বেষা। মিস্টার জোসেফ নেলসনের বয়স ষাটের ওপরে। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। ছোট ছোট চোখগুলো যেন ভেতরে ঢুকে গেছে। এক মুখ খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ। মৃত্যুঞ্জয় এবং অন্বেষা সেই আধ ছেঁড়া ছবিটার সাথে সামনে বসা ভদ্রলোকের মুখশ্রী মেলাবার চেষ্টা করছে। অল্পবিস্তর মিল যে আছে সেটা বলাই বাহুল্য। চায়ে দু’ চুমুক দিয়ে মিস্টার নেলসন বলতে শুরু করলেন- ‘প্রতীকের এই অবস্থার পেছেনে দায় একমাত্র আমি। আসলে প্রতীক আমার নিজের ছেলে না, সৎ ছেলে আমার। প্রতীকের মা, মানে কান্তা মিশ্রা আমাদের স্কুলেই কাজ করতো। বিধবা। আমি তখন যাকে বলা হয় ইয়াং। কান্তা দেখতে সুন্দরী ছিলো। যা হয়ে আর কি। প্রেমে পড়লাম তার। জানতাম আমি খ্রিস্টান, সে হিন্দু। বাড়িতে ঝামেলা হবেই। সে সব ঝামেলাকে হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা ছিলো আমার মধ্যে। আসল ঝামেলার সৃষ্টি করলো কান্তা নিজে। আমাকে একদিন সে বলল যে তার নাকি দু’বছরের একটা ছেলে আছে। আমি সেটা জানতাম। কোনো আপত্তি ছিলো না আমার। কিন্তু কান্তা একটা শর্ত রাখলো। আমি যেন বিয়ের পর তার থেকে কোনো বাচ্চার আশা না রাখি। তার ভয় ছিলো যে আমার নিজের সন্তান হয়ে গেলে তার ছেলেকে আমি ভালোবাসবো না। হাজার হোক, নিজের রক্ত তো নিজের রক্তই হয়। তখন আমি কান্তাকে পাওয়ার জন্য মরিয়া। তার সব শর্ত মেনে নিলাম। ভেবেছিলাম বিয়ের পর তাকে মানিয়ে নেবো। কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করলো কান্তা। নিজের সিদ্ধান্ত থেকে এক পাও এদিক থেকে ওদিক হলো না সে। কতো দিন, আর কতো দিন সহ্য করতাম আমি? তখন রাগ হতো, নিজের ওপর, নিজের ভাগ্যের ওপর। কেন, কেন এতো মেয়ে থাকতে আমি কান্তাকেই বিয়ে করলাম। আসতে আসতে কান্তার ছেলে প্রতীক আমার ঘৃণার পত্র হয়ে গেলো। রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় রোজ রাতে মদ খেয়ে এসে মা, বেটাকে মারধর করতাম। বিয়ের চার বছর পর কান্তা চলে গেলো আমাকে আর নিজের ছেলেকে ফেলে রেখে। তখন ভেবেছিলাম প্রতীককে কোনো অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসবো। কিন্তু সমাজের ভয় সেটা করিনি। আমি আবার বিয়ে করলাম। প্রতীক প্রথমে সৎ বাপ পেয়েছিল, এবার সৎ মা পেলো। অত্যাচারের সীমা থাকলো না তার ওপর। মাঝে মাঝে মায়া যে হতো না আমার তা নয়। প্রতীকের যখন আট বছর বয়স তখন তাকে আমি বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে আসি। প্রতীকের খরচ আর সংসারের খরচ। চাপ বাড়তে থাকে আমার ওপর। স্ত্রীর সাথে রোজ অশান্তি। আমার নিজের ছেলে পিটারও বড় হচ্ছিলো। তার পেছনে খরচ করা বেশি বাঞ্ছনীয় মনে করলাম আমি।’
    খানিক থামলেন মিস্টার নেলসন। চায়ে আরও দু’ চুমুক দিয়ে বললেন- ‘ছোট থেকেই প্রতীকের মধ্যে একটা অদ্ভুত গুণ দেখেছিলাম। আমার কাছে বেধড়ক মার খাওয়ার পর নিজের ঘায়ে সে নিজেই মলম লাগাতো। কারুর সাহায্য নিতো না সে। মার খাওয়া নিজের নিয়তি ভেবে নিয়েছিল সে। প্রতীক জানতো তার মায়ের মারা যাওয়ার পর আর কেউ নেই যে তার শরীরের ঘায়ে মলম লাগবে। হঠাৎ একদিন প্রতীকের বোর্ডিং স্কুল থেকে ফোন আসে। সে নাকি নিজের শরীরে নিজেই আঘাত দেয়। আমি ছুটে গেলাম সেখানে। ডক্টর দেখানো হলো। বেশ কিছু মাস তার চিকিৎসা চললো। প্রতীককে বেশ কিছু মাস নিজের সাথে রাখলাম। নিজের স্ত্রীকে আমি বলে দিয়েছিলাম যে সে যদি প্রতীককে ভুলেও কিছু বলে তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আমার স্ত্রী রাগ করে বাড়ি ছেড়ে নিজের বাপের বাড়ি চলে গেলো, নিজের ছেলেকে নিয়ে। মৃত্যুঞ্জয় বাবু, সত্যি বলতে প্রতীক আমার কেউ না। কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই তার সাথে। মানছি যে আমি তাকে মারধর করেছি, টর্চার করেছি তাকে। কিন্তু আগলে রাখারও তো চেষ্টা করেছি। আমার বদলে অন্য কেউ হলে করতো কি? মনে তো হয় না করতো। প্রতীক সুস্থ হয়ে গিয়েছিলো। বেশ ভালোই ছিলো সে। যতোটা সম্ভব তাকে ভালোবাসা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আপনি সেটাকে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করাও বলতে পারেন। কিছু যায় আসে না আমার। হ্যাঁ, আমি ছোট্ট, নির্বোধ শিশুর ওপরে নিজের দুঃখে, আক্রোশে অত্যাচার করেছি। সেটারই প্রায়শ্চিত্ত করছিলাম আমি। প্রতীক মেডিকেল পড়তে চেয়েছিলো। পরীক্ষাতে বসলো। পাস হয়ে গেলো। পি.এম.সি.এইচ. মানে পাটনা মেডিকাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে তার অ্যাডমিশন হলো। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনাতে ভালো ছিলো। কলেজেও খুব নাম করলো। সেখানকার প্রফেসররা তার এক্সট্রা অর্ডেনরি ট্যালেন্ট দেখে আশ্চর্য হতো। আসলে ছোট বেলা থেকে নিজের চিকিৎসা নিজেই করতে শিখেছিলো সে, সেটাই মেডিকাল কলেজে কাজে এলো। কিন্তু….কিন্তু আমি আর পারলাম না, মৃত্যুঞ্জয়বাবু। আমি আর পারলাম না খরচা চালাতে। আমার নিজের ছেলের পেছনে দিনে দিনে খরচ বাড়ছিলো। প্রতীকের মেডিকেল পড়ার জন্য আমি ব্যাংক থেকে লোন নিই নি। পাছে যদি লোনের টাকা দিতে না পারি। প্রতীককে দু’বছর মেডিকাল পড়াতে পেরেছিলাম। এই দু’বছরে খুবই ভালো রেজাল্ট করেছিলো সে। তার পর থেকে আবার তার মধ্যে পরিবর্তন দেখলাম। বেশ কিছু দিন সে বাড়িতে থাকলো। সারা দিন গুম হয়ে থাকতো। কারুর সাথে কথা বলতো না। সত্যি বলতে আমাকে ঘৃণা করতো সে। হঠাৎ এক দিন আমায় বলল যে সে পাটনাতে থেকে চাকরী করতে চায়। পাটনাতেই বাড়ি ভাড়া করে থাকবে। আমি আর বাধা দিলাম না তাকে। প্রতীক চলে গেলো পাটনা। প্রায় দু’বছর হলো সে পাটনাতেই আছে। শুরু শুরুতে তার সাথে যোগাযোগ ছিলো। কিন্তু আস্তে  আস্তে সেটাও শেষ হয়ে গেলো। ফোন করলে ফোন তুলতো না সে। কালেভদ্রে যদি কোনো দিন ফোন তুলতো তো এক মিনিটের বেশি কথা বলতো না। শুনেছিলাম যে সে জব চেঞ্জ করেছে বাড়ি চেঞ্জ করেছে। তার নতুন অফিস আর বাড়ির ঠিকানা আমি জানতাম না। এক দিন তাকে ফোন করলাম, লাগলো না। বেশ কিছু দিন তাকে ফোনে পাওয়ার চেষ্টা করলাম। ব্যর্থ হলাম। বুঝে গেলাম যে সে হয়তো নিজের ফোন নম্বর চেঞ্জ করেছে। আমাকে দিতে চায় না নিজের নতুন নম্বর। রাগ হলো তার ওপর। এতো করার পরেও এই ব্যবহার? পরের সন্তান পরেরই হয়। তাকে নিজের নাম দিয়েছি, আমার কেউ ছিলো না সে, তাও সারা জীবন আগলে রেখেছি। না, এই দুর্ব্যবহার আমার সহ্য হলো না। রাগে দুঃখে আমিও তার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করলাম। সে কোথায় আছে, কী করছে, জানবার কোনো চেষ্টাই করলাম না আমি। পাটনাতে আমার অনেক পরিচিতি আছে। ইচ্ছে হলেই তার খোঁজ খবর নিতে পারতাম। কিন্তু নিলাম না। প্রায় আট মাস ধরে তার কোনো খবর নেই আমার কাছে। হঠাৎ আজ সকালে আপনি আমার বাড়িতে এসে বললেন যে প্রতীকের এই অবস্থা। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে মৃত্যুঞ্জয়বাবু, অনেক ধন্যবাদ। আপনি আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দিলেন।’ শেষ কথাটা বৃদ্ধ দু’হাত জোর করে মৃত্যুঞ্জয়কে বললেন। তাঁর দু’চোখ বেয়ে বেরিয়ে এসেছিলো অশ্রুধারা।

    প্রতীকের অতীতের বর্ণনা করে মিস্টার নেলসন নিচে চলে গেলেন। মৃত্যুঞ্জয় একটা সিগারেট ধরিয়ে অন্বেষাকে বলল- ‘শেষ আট মাস ধরে প্রতীক মিস্টার নেলসনের সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি। খুব সম্ভব তখন থেকেই এই রোগটা আবার তাকে আক্রমণ করেছিলো।’
    খানিক চুপ থাকার পর অন্বেষা বলল- ‘এই কাপগুলো নিচে রেখে আসি মৃত্যুঞ্জয়দা। তুমি এখানেই থেকো, যেও না কোথাও।’
    অন্বেষা চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে নিচে চলে গেলো। মৃত্যুঞ্জয় ছাদময় পায়চারি শুরু করলো। সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। আশেপাশের বাড়িগুলোতে বাতি জ্বলে গেছে সেটা দেখতে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। ছাদের দরজার ঠিক ওপরে একটা বাতি ছিলো, সেটা জ্বালিয়ে দিলো মৃত্যুঞ্জয়। অন্বেষা হাসিমুখে ছাদে ফিরে এলো। মৃত্যুঞ্জয় দেখলো তার হাতে একটা লিপিস্টিক।
    ‘হঠাৎ লিপিস্টিক কেন?’ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘কী করবো? অনেক খুঁজেও মার্কার পেলাম না যে। তাই অগত্যা এটাই আনতে হলো।’
    ‘কী করবে এখন লিপিস্টিক দিয়ে?’
    ‘বলছি। নিজের বাঁ হাতটা দাও।’
    মৃত্যুঞ্জয়ের বাঁ হাতটা নিজের বাঁ হাতের ওপর রাখলো অন্বেষা। সাদা প্লাস্টার মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে। নিজের লাল লিপিস্টিক দিয়ে সাদা প্লাস্টারের ওপর অন্বেষা লিখলো- ‘গেট ওয়েল সুন, মৃত্যুঞ্জয়দা।’
    মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল- ‘মৃত্যুঞ্জয়দা, ইউ আর জিনিয়াস।’

    =সমাপ্ত=

  • ধারাবাহিক

    ক্ষত (পর্ব – ৪)

    ক্ষত
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

     

    পর্ব- ৪

    স্কুটিটা এসে দাঁড়ালো পানের দোকানের ঠিক দশ হাত পেছনে। তখন ঘড়িতে সকাল ন’টা বেজে দশ মিনিট। রোদের তেজ ধীরে ধীরে কড়া হবে। যতক্ষণ না প্রতীক নেলসন বাড়ি থেকে বেরোয় আর বিকাশ আসে, ততক্ষণ এক এমন জায়গায় দাঁড়াতে হবে যেখানে রোদের তাপও পৌঁছবে না আর প্রতীকের চোখের আড়ালেও থাকা যাবে। কিন্তু এমন জায়গা এখানে কোথায়? গলির মুখের ঠিক উল্টো দিকে একটা সাইবার ক্যাফে। এই মাত্র সেটার শার্টার খুললো। মৃত্যুঞ্জয় ও অন্বেষা এক অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করলো। মৃত্যুঞ্জয়ের চোখের ইশারা অন্বেষা বুঝতে পেলো। দু’জনে এগিয়ে গেলো সে দিকে।
    ‘বসা যেতে পারে কি?’ দোকানিকে জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসুন না।’ দাঁত বার করে হেসে দোকানি বললো। সকালে দোকান খুলতেই যে গ্রাহক চলে আসবে, ভাবতে পারেনি সে। গ্রাহক দেখে নিজের খুশি কে সামলে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হলো না।
    একটা কম্প্যুটারের সামনে অন্বেষা বসলো। কিছু একটা করতে হবে তাই খুলে নিলো নিজের ফেসবুক প্রোফাইল।
    ‘তুমি বসবে না।’ অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়কে।
    ‘না, আমার বসলে চলবে না।’
    সাইবার ক্যাফের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল সে।
    সকাল ন’টা চল্লিশ। অন্বেষার মোবাইল বেজে উঠল।
    ‘হ্যাঁ বল….ক’টায়?….ঠিক আছে..তুই কি পৌঁছে গেছিস? ..ঠিক আছে, রাখলাম।’
    ‘রাধিকার ফোন নিশ্চয়ই?’ অন্বেষার ফোন রাখার পর তাকে জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘হ্যাঁ। রাধিকা পাটনা জংশন পৌঁছবে। শি ইজ অন দি ওয়ে। প্রতীক তাকে বলেছে যে ঠিক দশটায় সে বাড়ি থেকে বেরোবে।’ অন্বেষা বলল।
    দশটা বেজে দশ মিনিটে নিজের বাসস্থান থেকে বেরিয়ে গলির মুখে এলো প্রতীক নেলসন। নিজের বাঁ দিকে মুড়ে পানের দোকানের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলো সে। নতুন কোনো ক্ষতচিহ্ন তার শরীরে মৃত্যুঞ্জয় দেখতে পেলো না।
    ‘এখনও বিকাশ এলো না?’ কম্প্যুটার বন্ধ করে মৃত্যুঞ্জয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
    ‘যতক্ষণ না প্রতীক এই কলোনী ছাড়ছে, বিকাশ ঢুকবে না। তাকে যদি প্রতীক এক বার ভুল করেও দেখে নেয় তাহলে আমাদের পুরো প্ল্যান ভেস্তে যাবে। বিকাশ এখন কংকড়বাগ কলোনীর ঠিক বাইরে এক পিৎজা হাটে আমাদের জন্য পিৎজা কিনছে। সে নজর রেখেছে রাস্তার দিকে। যে মুহূর্তে কলোনী থেকে বেরিয়ে প্রতীক অটো ধরবে, সে দোকান থেকে বেরিয়ে চলে আসবে এ দিকে।’
    সাইবার ক্যাফের ছেলেটাকে টাকা দিয়ে দু’জনে বেরিয়ে এলো। পানের দোকানের দিকে এক বার তাকালো মৃত্যুঞ্জয়। গ্রাহক খুব একটা নেই। দু’টো বয়স্ক লোক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে জমিয়ে গল্প করছেন।
    ‘অন্বেষা, তুমি স্কুটি নিয়ে সোজা প্রতীক নেলসনের বাড়ির সামনে দাঁড়াও। আমি বরং একটা পান খেয়ে আসি।’
    ‘পান!’ চমকে উঠল অন্বেষা।
    ‘হুম, পান। তুমি এগিয়ে যাও।’
    অন্বেষা কথা না বাড়িয়ে স্কুটি নিয়ে এগিয়ে গেলো। মৃত্যুঞ্জয় গিয়ে দাঁড়ালো পানের দোকানের সামনে। দোকানি একবার দেখেই চিনতে পেলো তাকে। এক গাল হেসে বলল- ‘আপ! আইয়ে আইয়ে।’
    এক প্যাকেট সিগারেট কিনে মৃত্যুঞ্জয় তাকে বলল – ‘দরকারী কথা আছে তোমার সাথে।’
    ‘বলিয়ে না বাবু। কেয়া বাত হ্যায়?’
    মৃত্যুঞ্জয় ইশারা করে তাকে দোকান থেকে বেরিয়ে আসতে বললো। ঠিক সেই সময় বেজে উঠল মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইল। বিকাশের কল।
    কল রিসিভ করতেই ওপার থেকে বিকাশ বলল- ‘প্রতীক অটোতে বসে পড়েছে। আমার পিৎজা কেনা হয়ে গেছে। আমি আসছি।’
    ‘ঠিক আছে।’ ফোন কেটে দিলো মৃত্যুঞ্জয়।
    দোকানিকে জিজ্ঞেস করলো- ‘কিছুক্ষণ আগে হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা এক ছেলে তোমার দোকানের সামনে দিয়ে চলে গেলো। তাকে চেনো নিশ্চয়ই?’
    ‘হাঁ বাবু। এটাই তো থাকে ওই বাড়িতে।’ দোকানি বলল।
    নিজের পার্স থেকে দুশো টাকার একটা নোট বার করে দোকানির হাতে দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘যে ছেলেটা রোজ বিকেলে তোমার থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট কিনে সেই বাড়িতে যায়, তার সাথে আমি আজ যাবো সেই বাড়িতে। সে কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে। এই কথাটা যেন কেউ জানতে না পারে।’
    দোকানি স্বছন্দে টাকাটা নিয়ে নিলো। বলল- ‘বাবু, এর আগেও আপনি আমার ওপর দয়া দেখিয়েছেন। আমি আপনার কথা না তো কাউকে বলেছি, আর না কাউকে বলবো।’
    ‘ভেরি গুড।’ দোকানির পিঠে এক চোপড় মেরে বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    নিজের স্কুটি দাঁড় করিয়ে বাড়ির সামনে মৃত্যুঞ্জয়েের অপেক্ষা করছে অন্বেষা। মৃত্যুঞ্জয়কে আসতে দেখেই বলল- ‘তোমার যে পানের নেশা আছে সেটা আমি জানতাম না তো?’
    মৃত্যুঞ্জয় হেসে বলল- ‘পানের নেশা নয় সোনা আমার, কাজের নেশা। আসলে ওই দোকানিকে হাতের মুঠোয় আনা দরকার ছিলো।’
    ‘কী করে আনলে তাকে নিজের হাতের মুঠোয়?’
    ‘ভেরি সিম্পল, টাকা দিয়ে। যে দিন প্রথম আমি এখানে আসি সে দিনও তাকে টাকা দিয়েছিলাম নিজের মুখ বন্ধ রাখার জন্য। আজকেও তাই করলাম। আমরা যে এখানে এসেছিলাম সে খবর প্রতীক নেলসন পর্যন্ত যাবে না। আর হ্যাঁ, ভালো কথা, বিকাশের কল এসেছিল। প্রতীক অটোতে চড়ে গেছে। বিকাশের পিৎজা কেনা হয়ে গেছে। সে কিছুক্ষণের মধ্যে এখানে পৌঁছে যাবে।
    বিকাশের পৌঁছাতে আরও দশ মিনিট সময় লাগলো। এসেই অন্বেষাকে সে জিজ্ঞেস করলো- ‘রাধিকার কোনো ম্যাসেজ এসেছে?’
    ‘প্রতীকের রওনা হওয়ার পর কোনো ম্যাসেজ আসেনি।’ জবাব দিলো অন্বেষা।
    বাইকের ডিকি থেকে বেশ বড় রকম একটা হাতুড়ি বার করে সেটাকে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বিকাশ বলল- ‘এতে কাজ হবে তো?’
    ‘আলবৎ হবে। আচ্ছা বিকাশ, তুমি প্রতীক নেলসনের হাতে কোনো দিন মেডিকেলের বই দেখেছো?’
    ‘মেডিকেলের বই? কই, নাতো। কেন বলো তো?’
    ‘বাড়ির আশেপাশে প্রচুর বইয়ের প্রায় অর্ধেক পুড়ে যাওয়া পৃষ্ঠা পাওয়া গেছে। সেই পৃষ্ঠাগুলো মেডিকেল বইয়ের।’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    খানিক চিন্তা করে বিকাশ বলল- ‘না, মেডিকেলের বই দেখিনি। হয়তো তার ঘর থেকে পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রতীকের মেডিকলের সাথে কী সম্পর্ক হতে পারে?’
    ‘সেটাই তো প্রশ্ন বিকাশ, সেটাই তো প্রশ্ন। সব প্রশ্নের না হোক, কিছু প্রশ্নের উত্তর যে আজ পাওয়া যাবেই সেটা আমার বিশ্বাস।’
    নিজের মোবাইল ঘাঁটছিলো অন্বেষা। হঠাৎ সে বলল- ‘রাধিকার ওয়াটসঅ্যাপ করেছে। প্রতীকের সাথে তার দেখা হয়েছে। তারা গান্ধী ময়দানে কোনো এক রেস্তোরাঁতে জলখাবার খেয়ে সিনেমা দেখতে যাবে।’
    ‘গুড। ভেতরে যাওয়া যাক।’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    ফটক খুলে ভেতরে ঢুকতেই চারিপাশে চার ফুটের পাঁচিল ও আগাছা। মাঝখানে একতলা ছোট বাড়ি। ছ’ ধাপ সিঁড়ি উঠে সদর দরজা। সেটা খুলে ভেতরে ঢুকতেই অন্ধকার প্রায় বাড়িতে প্রবেশ করলো তারা। বাড়ির সব জানালা বন্ধ, একটা বাতিও জ্বলছে না। সুইচ বোর্ড কোথায় সেটা খুব ভালো করেই জানে বিকাশ পান্ডে। দু’তিনটে সুইচ পরপর টিপতেই বেশ কিছু আলো জ্বলে গেলো। তারা দাঁড়িয়ে আছে এক ছোট ডাইনিং হলে। আদ্যিকালের দুটো কাঠের আলমারি ছাড়া বেশ কিছু আবর্জনা ছড়ানো চারিদিকে। ডাইনিং হলের ডান দিকে রান্না ঘর। বলাই বাহুল্য সেটাও বন্ধ। পাশাপাশি দুটো ঘর। ডান দিকের ঘরটা বিকাশের এবং বাঁ দিকেরটা প্রতীকের। নিজের ঘরের তালা খুললো বিকাশ। তিন জনেই ভেতরে ঢুকলো। বিকাশ এগোলো ঘরের জানালা খুলতে, কিন্তু তাকে মানা করলো মৃত্যুঞ্জয়।

    ‘জানালা খুলতে হবে না। লাইট জ্বালিয়ে দাও। বাইরের কেউ যেন দেখতে না পায়ে যে এ বাড়িতে কেউ আছে।’
    অগত্যা লাইট জ্বালাতে হলো বিকাশকে । ছোট ঘর। জানালার দিকে একটা চৌকি পাতা। দুটো কাঠের টেবিল, একটা চেয়ার। টেবিলে নানা ধরনের টেস্ট টিউব। এক দিকের দেয়ালে বড় এক তাক বানানো আছে। সেই তাক জুড়েও বিভিন্ন ধরন ও আকৃতির শিশি বোতল ও টেস্ট টিউব। কোনো টেস্ট টিউবে নীল রঙ্গের জল তো কোনো টেস্ট টিউবে লাল অথবা হলুদ জল। সেগুলো যে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল সেটা বুঝতে সময় নিলো না মৃত্যুঞ্জয়। ছাদে ঝুলছে আদ্যিকালের এক সিলিং ফ্যান। সুইচ দিতেই বিকট এক শব্দ করে সেটা ঘুরতে আরম্ভ করলো। চেয়ারে বসলো অন্বেষা। টেস্ট টিউবগুলোকে ভালো করে নিরীক্ষণ করতে শুরু করলো সে। খানিক নিরীক্ষণ করার পর যখন কিছুই বুঝলো না তখন সেখান থেকে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বিকাশের হাতে একটা প্যাকেট। সেটা খুলে ভেতর থেকে তিনটে পিৎজা বার করে সে বলল- ‘মধ্যপ্রদেশে হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেছে। সেটাকে শান্ত করা দরকার।’
    প্রাতঃরাশ শেষ হওয়ার পর মৃত্যুঞ্জয় বিকাশকে জিজ্ঞেস করলো- ‘তুমি তো অনেক দিন ধরেই প্রতীককে চেনো। কোনো দিন কিছু বলেছে নিজের অতীতের বিষয় তোমাকে? কোনো দিন জিজ্ঞেস করেছো তুমি?’
    ‘জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু কোনো দিনই বিশেষ কিছু বলেনি সে। যত বার জিজ্ঞেস করেছি, ততবার কথা এড়িয়ে গেছে। তবে হ্যাঁ, রাধিকাকে বলেছে। সে কোন স্কুল, কলেজে পড়েছে সে সব। এর থেকে বেশি কিছু হাজার চেষ্টা করেও রাধিকা তার মুখ থেকে বার করতে পারেনি।’
    ‘অদ্ভুত রহস্যময় ছেলে মাইরি। অনেক ছেলের সাথেই আমার পরিচয় আছে, কিন্তু এমন বিচিত্র, এমন কমপ্লিকেটেড ছেলে কোনো দিন দেখিনি।’ বলল অন্বেষা।
    ‘হুম। তাই তো এই কেসের প্রতি রুচি দেখলাম আমি।’ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
    এদিক ওদিকের কথায় এগিয়ে চললো সময়। এক সময় ঘড়ি দুপুর একটা বাজার ইঙ্গিত দিলো। বাইরে রোদের তাপ বেশ ভালোই বেড়েছে। লোকের চলাচল যে কমেছে সেটা বলাই বাহুল্য। হাতুড়ি দিয়ে প্রতীকের তালাতে দুু’তিনটে জোরে ঘা দিলো মৃত্যুঞ্জয়। চকিতে তালার আকৃতিতে পরিবর্তন ঘটলো। ফটকের ও সদর দরজার তালারও একই অবস্থা হলো। তদন্তের খাতিরে নিজের বেশ কিছু টেস্ট টিউবকে জলাঞ্জলি দিতে হলো বিকাশকে। এটা করতে যে বুক ফেটে গেলো সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গেলো।
    ‘টেস্ট টিউব গুলোর দাম অনেক। আবার কিনতে হবে।’ বিষণ্ণতা ভরা কণ্ঠে বলল বিকাশ পান্ডে।
    অতঃপর তারা এগোলো প্রতীক নেলসনের ঘরের দিকে। হাতুড়ি মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে। তালায় চারবার সজোরে প্রহার করতে হলো তাকে। তালা ভেঙ্গে হাতে চলে এলো তার। অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালিয়ে ঘরটাকে আলোকিত করলো বিকাশ। দু’টো ঘরের আকার ও আকৃতি একই। আসবাবপত্র বলতে একটা চৌকি, একটা ছোট্ট স্টিলের আলমারি, একটা কাঠের টেবিল ও চেয়ার এবং কিছু বাসনপত্র। ঘরে যে কেউ থাকে সেটা ঘরের অবস্থা দেখে বলা সম্ভব নয়। অপরিচ্ছন্নতায় পরিপূর্ণ ঘর।
    বাসনপত্রের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘বাসন আছে অথচ গ্যাস দেখছি না। প্রতীক কি বাইরে থেকে খাবার প্যাক করিয়ে নিয়ে আসে নাকি?’
    ‘হ্যাঁ।’ জবাব দিলো বিকাশ।
    চৌকিতে পাহাড় করে রাখা জামাকাপড়। সেগুলো কে একে একে উঠিয়ে দেখলো মৃত্যুঞ্জয়। অন্বেষা ও বিকাশও ঘরের প্রতিটি কণা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখতে শুরু করলো। চৌকিতে রাখা বেশ কিছু বেল্টের ওপর নজর গেলো মৃত্যুঞ্জয়ের। ভালো করে সেগুলোকে দেখে যথাস্থানে রেখে দিলো সে। হঠাৎ তার নজর গেলো দেয়ালের দিকে। সাদা দেয়াল, তাতে অল্প অল্প রক্তের দাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সে দিকে খানিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে টেবিলের দিকে এগোলো মৃত্যুঞ্জয়। মোটা মোটা বেশ কিছু বই এবং এক ব্লুটুথ মিউসিক সিস্টেম সেখানে। কোনোটা ছেঁড়া, কোনোটা অর্ধেক পুড়ে যাওয়া। মৃত্যুঞ্জয় দেখলো সব বইগুলো মেডিকেলের। বইগুলোর শেষাংশগুলোই ভালো করে দেখলো মৃত্যুঞ্জয়।

    ‘মৃত্যুঞ্জয়দা, এদিকে এসো।’
    হঠাৎ অন্বেষার কন্ঠস্বর শুনতে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। চৌকির পেছন দিকে এক কোণায় উবু হয়ে বসে আছে অন্বেষা। তার নজর চৌকির নিচের দিকে। অন্বেষার ডাকে মৃত্যুঞ্জয় আর বিকাশ ছুটে গেলো সে দিকে।
    ‘কী হলো?’ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
    অন্বেষা ইশারা করলো চৌকির তলার দিকে।
    পুরো ঘরের তুলনায় চৌকির তালাটা বেশ পরিস্কার। বেশ বড় আকারের চৌকো কাঠের বাক্স রাখা সেখানে। সেটাকে টেনে বার করলো মৃত্যুঞ্জয়। বাক্সটাকে কাঠের সুটকেস বললে ভুল বলা হয় না। প্রায় পাঁচ ফুট বাই চার ফুটের। বাক্সটা ছিলো এক তোয়ালে দিয়ে ঢাকা। ধুলোর লেশমাত্র নেই বাক্সর গায়ে। পুরো ঘরে এই একটি মাত্র জিনিস যেন যত্ন সহকারে রাখা।

    ‘কী হতে পারে এটা?’ জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
    ‘যতদূর মনে হয়ে ফাস্ট এড বক্স। তা ছাড়া অন্য কিছু হবে বলে তো মনে হয়ে না।’
    কথা শেষ করে মৃত্যুঞ্জয় খুলল সেটাকে। চাবি দিয়ে লক করার জায়গা আছে বটে, কিন্তু লক করা ছিলো না সেটা। বক্সের ভেতরে আছে গোল করে পেঁচানো দুটো বেল্ট, বেশ কিছু ব্লেড, ছুরি, ব্যান্ডেজ, স্টিচ করার সুতো, অপারেশনে ব্যবহার করার কিছু কাঁচি। সাথে আছে চারটে কাগজের ছোট ছোট টুকরো। বাক্সটা বিকাশের হাতে দিয়ে কাগজের টুকরোগুলো বার করলো মৃত্যুঞ্জয়। প্রথম টুকরো তে লেখা আছে- এস 1, দেয়াল। দ্বিতীয় টুকরোতে লেখা আছে- এস 2, বেল্ট । তৃতীয়তে- এস 3, ব্লেড ছুরি। এবং চতুর্থ কাগজের টুকরোতে লেখা আছে- এস 4।

    ‘এটা কী হেঁয়ালি মৃত্যুঞ্জয় দা?’ বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
    অন্বেষার প্রশ্ন যেন মৃত্যুঞ্জয়ের কানেই গেলো না। ভ্রুকুটি করে এক দৃষ্টে চেয়ে রইল কাগজের সেই রহস্যময় টুকরোগুলোর দিকে।
    ‘এস 4এর পাশে কিছু লেখা নেই কেন?’ প্রশ্নটা করলো বিকাশ পান্ডে।
    মৃত্যুঞ্জয় এবারও চুপ। ঘরে খানিক নিস্তব্ধতা ছেয়ে থাকলো। কাগজের ওপর থেকে নজর সরিয়ে খানিক শূন্যের দিকে চেয়ে রইল মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘অন্বেষা, বিকাশ, দেখো ভালো করে। আরও যদি কিছু পাও।’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    চৌকিতে জামাকাপড়ের স্তুপের মধ্যে ছিলো একটা ব্যাগ। ব্যাগেও কাপড়ের পাহাড়। না, আর বিশেষ কিছুই পেলো না তারা।
    ‘ঠিক আছে। বিকাশ, এবার তুমি ফোন করো প্রতীককে। তুমি জানো তোমায় কী বলতে হবে।’
    মৃত্যুঞ্জয়ের কথা মতো বিকাশ ফোন করলো প্রতীককে । কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর প্রতীক ফোন তুলতেই কান্না মেশানো স্বরে বিকাশ বলল- ‘প্রতীক, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমি এখনই বাড়ি এসেছি। সব তোলপাড় হয়ে গেছে। জানি না চোর এসেছিল কিনা। তালা ভেঙ্গে দিয়েছে সব। তোর ঘরের, আমার ঘরের। আমার বেশ কিছু দামী টেস্ট টিউব ভেঙ্গে দিয়েছে। তুই যেখানেই আছিস, চলে আয় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
    বিকাশের ফোন রাখার পর অন্বেষা তাকে বলল- ‘বেশ ভালোই অভিনয় করতে পারো তুমি।’
    বিকাশ রয়ে গেলো সেখানে। মৃত্যুঞ্জয় আর অন্বেষা যখন বেরলো তখন বিকেল চারটে। প্রতীকের সেখানে পৌঁছবার আগেই এক রেস্তোরাঁ থেকে কিছু খাবার প্যাক করে দিয়ে গেলো মৃত্যুঞ্জয়। খিদে তাদেরও পেয়েছিল। কংকড়বাগ থেকে বেরিয়ে পাটনা জংশনের কাছে নিউ মার্কেটের একটা রেস্তোরাঁতে ঢুকলো মৃত্যুঞ্জয় আর অন্বেষা। খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর অন্বেষা মৃত্যুঞ্জয়কে বলল- ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। সেই কাগজের টুকরোগুলো কি কোনো সংকেত? যদি সংকেতই হয়, তাহলে কিসের সংকেত সেগুলো? এস 1, এস 2 এগুলো তো ট্রেনের কামরায় লেখা থাকতে দেখেছি। রিজার্ভেশন কম্পার্টমেন্টে।’

    ‘তা দেখেছো হবে। কিন্তু এটার ট্রেনের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। প্রথম কাগজে কী লেখা ছিলো?’
    ‘এস 1 আর দেয়াল।’ বলল অন্বেষা।
    ‘দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখেছো ভালো করে?’ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
    খানিক চিন্তা করে অন্বেষা বলল- ‘কিছু বিশেষ তো পাইনি।’
    ‘তার মানে তুমি লক্ষ করোনি। দেয়ালের গায়ে ছিলো রক্তের দাগ। রক্তের দাগ আমি পেলাম কাঠের বাক্সতে রাখা বেল্টেও, সাথে ব্লেড আর ছুরিতে তো ছিলোই। এবার ভালো করে চিন্তা করে দেখো। প্রথম কাগজ …. দেয়ালে রক্তের দাগ, দ্বিতীয় কাগজ …. বেল্টে রক্তের দাগ, তৃতীয় কাগজ …. ব্লেড ও ছুরিতে রক্তের দাগ। কিছু বুঝতে পেলে?’
    প্রচুর মাথা ঘামিয়েও কিছু বুঝতে পারছে না অন্বেষা। চারটে চিরকুট, তাতে কিছু সাংকেতিক শব্দ, রক্তের দাগ। না, পারছে না সে। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে তার। মাথা ধরে চুপ করে বসে রইলো অন্বেষা। খাবার চলে এসেছে। খাবার সময় হঠাৎ অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো- ‘চার নম্বর চিরকুটটা খালি কেন? তাতে দেয়াল, ব্লেড কিছুই তো লেখা নেই।’
    ‘গুড কোয়েশ্চন? তোমার কী মনে হয়, কি লেখা যেতে পারে তাতে?’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘আমি কি করে বুঝবো?’
    ‘ভেবে দেখো। সমীকরণগুলোকে এক এক করে মিলিয়ে দেখো।’
    ‘তুমি তো এমন করে বলছো যে রহস্যের সমাধান তুমি করে ফেলেছো।’
    খাবার থেকে চোখ সরিয়ে শূন্যের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বল – ‘পুরো সমাধান এখনও হয়নি। তবে কিছুটা তো অবশ্যই করে ফেলেছি।’
    ‘সমাধান করে ফেলেছো? কী বুঝলে?’ উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
    ‘বলবো।’
    বাড়ি যাওয়ার পথে আর কোনো কথা হলো না তাদের মধ্যে। বাড়ি যখন পৌঁছালো তারা তখন ঘড়িতে বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। মৃত্যুঞ্জয় সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। দরজা বন্ধ করে দিলো ভেতর থেকে। অন্বেষা নিজের ঘরে বসে নিরন্তর ভাবতে থাকে কাগজের সেই টুকরোগুলো এবং তাতে লেখা সাংকেতিক শব্দ গুলোর বিষয়। সে যা যা দেখেছে, মৃত্যুঞ্জয় তাই দেখেছে। তাহলে মৃত্যুঞ্জয় কী এমন আবিষ্কার করে ফেললো যেটা সে পারলো না। মৃত্যুঞ্জয় এই কেসে যদি অন্বেষাকে সাহায্য না করতো তাহলে কি অন্বেষা কোনো কূলকিনারা বার করতে পারতো এই রহস্যের? কথাটা ভেবে নিজের মনেই হেসে ফেললো অন্বেষা। মৃত্যুঞ্জয়দার অবজারভেশন ক্ষমতার সামনে মাথা নত করতেই হয়। কিন্তু তার অবজারভেশন কী বলে সেটা জানার জন্য মনটা ছটফট করে উঠল অন্বেষার। এখন কি মৃত্যুঞ্জয়দার ঘরে ঢোকা ঠিক হবে? সারা রাস্তা কোনো কথা বলেনি সে। বাড়িতে এসেও সোজা নিজের ঘরে ঢুকে গেলো। নিশ্চয়ই এই রহস্য নিয়ে চিন্তার গভীর সাগরে ডুবে আছে সে। তাকে কি এই সময় বিরক্ত করা ঠিক হবে? কিন্তু নিজের মনের ছটফটানিকে যে কিছুতেই কম করতে পারছে না সে। জীবনে প্রথম বার অন্বেষা কোনো রহস্যের সম্মুখীন হয়েছে। এর শেষ না দেখা পর্যন্ত তার শান্তি নেই। না, আর বসে থাকতে পারলো না সে নিজের ঘরে। বেরিয়ে পড়লো নিজের ঘর থেকে। সিঁড়ি বেয়ে মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা দিলো।
    ‘কে?’ ভেতর থেকে মৃত্যুঞ্জয়ের ব্যরিটোন আওয়াজ ভেসে এলো।
    ‘আমি অন্বেষা।’
    দরজা খুললো মৃত্যুঞ্জয়। একটা চেয়ারে বসে অন্বেষা বলল- ‘অনেক ভাববার চেষ্টা করলাম মৃত্যুঞ্জয়দা। কিন্তু কিছুই মাথায় এলো না। বিচিত্র মানুষের বিচিত্র রহস্য। যেমন বিচিত্র সে, তেমন বিচিত্র তার চালচলন। কখনও হাত কাটা, কখনও মাথা ফাটা। জানো, এক দিন রাধিকা কী বলছিলো আমায়?’
    মৃত্যুঞ্জয় খাটে বসে ঘাড় হেঁট করে নিজের মোবাইলের দিকে কি সব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। ঘাড় হেঁট করেই জিজ্ঞেস করলো- ‘কী বলছিলো রাধিকা?’
    ‘বলছিলো যে সে একদিন নাকি সোনপুর গিয়েছিলো। সেখানে তার মামার বাড়ি। ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো। গান্ধী সেতুর ওপর সন্ধ্যের আলোতে হঠাৎ সে প্রতীককে দেখতে পায়। গঙ্গার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলো সে। কৌতূহল হয়েছিল রাধিকার। সাথে তার মা-বাবা ছিলো তাই গাড়ি থামিয়ে প্রতীকের সাথে দেখা করতে পারেনি। প্রতীককে পরে সে জিজ্ঞেস করেছিলো বটে, কিন্তু চিরকালের মতো জবাব দেয়নি প্রতীক।’
    এবার মৃত্যুঞ্জয় তাকালো অন্বেষার দিকে।
    ‘কী বললে? গান্ধী সেতুতে?’
    ‘হ্যাঁ।’ অন্বেষা বলল- ‘গঙ্গার ওপর একটা ব্রিজ আছে। মহাত্মা গান্ধী সেতু নাম। প্রায় ছ’কিলোমিটার লম্বা।’
    ‘আহাঃ .. সে সব জানি। সেখানে প্রতীক দাঁড়িয়েছিলো?’
    ‘হ্যাঁ।’
    অন্বেষা দেখলো মৃত্যুঞ্জয়ের মুখটা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। নিশ্চয়ই কিছু একটা ক্লু সে পেয়েছে। কৌতূহলী দৃষ্টিতে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে চেয়ে রইল অন্বেষা।
    মৃত্যুঞ্জয় উৎসাহের সাথে বলল- ‘বুঝে গেছি। চার নম্বর চিরকুটে কী লেখা হতে পারে, সেটা বুঝে গেছি।’
    ‘কি?’ অন্বেষার কৌতূহল ক্রমে বাড়ছে।
    নিজের মোবাইলটা খাটে রেখে ঘরময় পায়চারি শুরু করলো মৃত্যুঞ্জয়।
    বলল- ‘প্রথম চিরকুটে দেয়াল, দ্বিতীয় চিরকুটে বেল্ট, তৃতীয় চিরকুটে ব্লেড, ছুরি আর চতুর্থ চিরকুটে …. ‘
    মৃত্যুঞ্জয় তাকালো অন্বেষার দিকে। অন্বেষা গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে আছে মৃত্যুঞ্জয়ের পানে। অন্বেষার চোখে চোখ রেখে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘চতুর্থ চিরকুটে জল।’
    ‘জল!’ চমকে উঠল অন্বেষা- ‘কিন্তু তুমি কী করে শিওর?’
    মৃত্যুঞ্জয় লঘু কদমে অন্বেষার দিকে এগোলো। জ্বলজ্বল করছে তার দু’টো চোখ। অন্বেষা যে চেয়ারে বসে, সে চেয়ারের দুটো হাতলে নিজের দুটো হাত রেখে, অন্বেষার দিকে ঝুঁকে এবং নিজের মুখ তার মুখের অত্যন্ত কাছে নিয়ে গিয়ে বলল- ‘তুমি হয়তো এটা জেনে অবাক হবে যে প্রতীক নেলসনের শরীরের আঘাতের একমাত্র কারণ প্রতীক নেলসন নিজে।’
    ‘মানে?’ অন্বেষার আশ্চর্য এবার নিজের সীমা লংঘন করলো।
    মৃত্যুঞ্জয় পুনরায় শুরু করলো ঘরময় পায়চারি করা।

     

     

    চলবে…………..

  • ধারাবাহিক

    ক্ষত (পর্ব- ৩)

    ক্ষত
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

     

    পর্ব-৩

    কেয়ারটেকার রাতের খাবার দিয়ে যাওয়ার পর অন্বেষা মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরে ঢুকলো। তখন প্রায় রাত দশটা বাজে। টেবিলের ওপর ঢাকা খাবারের থালা দেখে অন্বেষা বলল- ‘এখনও খাওনি?’
    মৃত্যুঞ্জয় চেয়ারে বসে একাগ্রচিত্তে সিগারেটে টান দিয়ে যাচ্ছিলো। কেয়ারটেকার কখন রাত্রি আহার দিয়ে গেছে আর কখন অন্বেষা ঘরে প্রবেশ করেছে, তার হুঁশ নেই। কেয়ারটেকারটাও কথা বলে কম। মৃত্যুঞ্জয়কে চিন্তামগ্ন দেখে চুপিসারে খাবার রেখে চলে গেছে। মৃত্যুঞ্জয়ের সংবিৎ ফিরলো অন্বেষার কথায়। মৃত্যুঞ্জয়ের সামনের চেয়ারে অন্বেষা উপবেশন করলো।
    ‘কিছু চিন্তা করছো নাকি?’ জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
    ‘চিন্তার বিষয় হলে চিন্তা তো করতেই হয়। কোনো জিনিসের তদন্ত করতে গেলে নিজের চিন্তাধারাকে বহু দূর পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয়। এমন অনেক সম্ভাবনার বিষয় ভাবতে হয়ে যেটা আদতে সম্ভাবনা হতেই পারে না।’
    ‘মানে?’
    চেয়ার থেকে উঠে ঘরে পায়চারি শুরু করলো মৃত্যুঞ্জয়। বলল- ‘অনেক সম্ভাবনা। সত্যি বলতে আজ রাধিকার সাথে কথা বলার পর অনেক বিচিত্র বিচিত্র সম্ভাবনার উৎপত্তি মনের মধ্যে হলো।’
    ‘রাধিকার সাথে কথা হওয়ার পর?’ চমকে উঠল অন্বেষা।
    ‘হুম, রাধিকা। রাধিকার প্রতীকের সাথে প্রেমের সম্পর্কতে খটকা লাগছে আমার। হয়তো আমার খটকাটা নিছকই ভুল হতে পারে। পরশু রাতে তোমরা দেখতে পেয়েছিলে যে প্রতীকের বাসস্থান থেকে এক অন্য, তোমাদের অপরিচিত ছেলে বেরোয় এবং বাইকে করে চলে যায়। তার মানে এটাই হলো যে সে ছেলেটার বিষয় তোমরা আগে জানতে না। আজ রাধিকা আমায় বলল যে সে নাকি ওই অপরিচিত ছেলেটার বিষয় প্রতীককে জিজ্ঞেস করেছিল। কিন্তু কখন? কখন জিজ্ঞেস করেছিল সে? মেনে নিলাম গতকাল জিজ্ঞেস করেছিল। তাহলে কি প্রতীকের সন্দেহ হবে না? রাধিকা সেই ছেলেটার বিষয় কী করে জানলো, প্রতীক তাকে সেটা জিজ্ঞেস করবেই। তখন রাধিকা বলতে বাধ্য হবে তোমাদের রাতের অ্যাডভেঞ্চারের বিষয়। আসল খটকা তো আমার এখানেই লাগছে অন্বেষা। তাহলে কি রাধিকা বিকাশ পান্ডের বিষয় আগে থেকেই জানে? আর যদি জেনে থাকে তাহলে তোমার থেকে লুকিয়ে রাখলো কেন?’
    অন্বেষা অবাক দৃষ্টে তাকিয়েছিলো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে।
    ‘মাই গড! এ বিষয় তো আমি ভেবেই দেখিনি।’ বলল অন্বেষা।
    ‘ভেবে দেখতে হয় অন্বেষা, ভেবে দেখতে হয়। যখন তদন্ত করতে নেমেছো, তখন প্রতিটি জিনিসকে খুঁটিয়ে দেখতে হবে। কখন কোন জিনিস থেকে কী দরকারী তথ্য বেরিয়ে আসবে, বলা কঠিন।’
    পুনরায় চেয়ারে বসলো মৃত্যুঞ্জয়।
    খানিক চুপ থাকার পর মৃত্যুঞ্জয় আবার বলল- ‘বিকাশ পান্ডের বিষয় বেশ কিছু ইনফরমেশন পাওয়া গেলো। কিন্তু যা ইনফরমেশন পাওয়া গেছে সেটা যথেষ্ট নয়। আমাদের জানতে হবে বিকাশ পান্ডের সাথে প্রতীক নেলসনের লিংক।’
    ‘সেটা কী ভাবে জানতে পারবো?’ জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
    প্রায় বিড়বিড় করে মৃত্যুঞ্জয় নিজের মনেই বলল-‘পান্ডেজী’র বাড়িতে যেতে হবে একবার। দেখা যাক কেমেস্ট্রিতে এক্সট্রা অর্ডেনরি স্টুডেন্ট এখন কী করছে।’
    দুজনেই খানিক চুপ থাকলো। কিছু একটা বলবার চেষ্টা করছে অন্বেষা, কিন্তু বলতে পারছে না। খানিক পর মুখটা পান্ডুবর্ণ করে বলল- ‘একটা খারাপ খবর আছে , মৃত্যুঞ্জয়দা।’
    ‘কী?’
    ‘আগামী কাল আমি অফিস থেকে ছুটি পাইনি। ছুটি পেলে সমস্তিপুর যাওয়া যেতে পারতো।’
    একটা দীর্ঘস্বাস ফেলে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘ঠিক আছে, তাহলে কাল আমি বিকাশ পান্ডের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। একটা কথা মনে রেখো অন্বেষা, এবার থেকে আমরা যা যা করবো সেটার বিষয় যেন রাধিকা না জানতে পারে।’
    চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো অন্বেষা। যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। বলল- ‘তুমি নিশ্চিন্তি থাকতে পারো মৃত্যুঞ্জয়দা। রাধিকা এবার থেকে কিছুই জানতে পারবে না।’
    ‘আর হ্যাঁ, সগুনা মোড়, দানাপুর কী করে যাবো, সেটা বলে দাও।’
    সগুনা মোড় থেকে ডান দিকে একটা রাস্তা চলে গেছে। রাস্তা তাকে বড় গলি বললে ভালো হয়। রাস্তার দু’ধারে কোনো সময়ে খোলা মাঠ ছিলো, এখন সেখানে বড়ো বড়ো বাড়ির প্রাচুর্য। বড়ো বড়ো বাড়ি পেরিয়ে রাস্তার শেষ প্রান্তে বিকাশ পান্ডের বাড়ি খুঁজে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। ছোট এক তলা বাড়ি। গেটের পাশে লেখা আছে- বিনয় পান্ডে। মৃত্যুঞ্জয় জানে বিনয় পান্ডে বিকাশের বাবার নাম। লোহার ফটকে টোকা মারলো মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘কৌন হ্যায়?’ ভেতর থেকে এক ভারী পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো।
    ‘বিকাশ সে মিলনা থা।’ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
    লোহার ফটক খুলে গেলো। হাত কাটা গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। হিন্দীতেই বললেন- ‘বিকাশ তো অফিসে। বেলা বারোটা বাজে। এই সময় কি সে বাড়িতে থাকে?’
    ‘ফেরে কটায়?’ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘রাত দশটা কিম্বা এগারোটার মধ্যে ফিরে আসে।’ ভদ্রলোক জবাব দিলেন।
    ‘আপনি কি তার বাবা?’
    ভ্রুকুটি করে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকালেন ভদ্রলোক।
    ‘তুমি কে হে? এর আগে তো কোনো দিন দেখিনি তোমায়।’ সন্দেহের স্বরে বললেন পান্ডেজী।
    ‘আপনি আমাকে চিনবেন না। এটা জানুন যে আমি একটা কেসের ইনভেস্টিগেশনে এখানে এসেছি

    ‘ইনভেস্টিগেশন!’ ভদ্রলোক ঘাবড়ে গেলেন।
    ‘আজ্ঞে হ্যাঁ। বিকাশ কোন অফিসে কাজ করে?’
    পান্ডেজী বিকাশের অফিসের নাম ও ঠিকানা দিলেন। মৃত্যুঞ্জয় আবার জিজ্ঞেস করলো- ‘ক’টায় ছুটি হয়ে তার?’

    ‘সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা।’
    ‘সন্ধ্যে সাতটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত সে কোথায় থাকে আপনি তাকে জিজ্ঞেস করেননি?’
    আমতা আমতা করে বিনয় পান্ডে বললেন- ‘নিজের…. নিজের বন্ধুদের বাড়ি । ‘
    ‘আপনি কি জানেন আপনার ছেলে বিকাশ পান্ডে রোজ সন্ধ্যেতে কংকড়বাগ কলোনী যায়?’
    মৃত্যুঞ্জয়ের এই কথায় যেন আকাশ থেকে পড়লেন বিনয় পান্ডে।
    ‘কংকড়বাগ কলোনী! সেখানে তো শুনেছি কোনো ভাড়াটে থাকে।’
    এবার ভ্রুকুটি করে মৃত্যুঞ্জয় তাকালো।
    ‘ভাড়াটে থাকে মানে? সেখানে আপনার কোনো বাড়ি আছে নাকি?’ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘আমার বাড়ি না। আমার এক ভাইয়ের বাড়ি। অনিরুদ্ধ তিওয়ারী তার নাম। কানপুরে থাকে সে। বাড়িটা খালি পড়েছিল তাই শুনেছি ভাড়া দিয়েছে কাউকে।’
    ‘ভাড়াটেকে আপনি চেনেন?’
    ‘চিনবো কী করে? তাকে তো চোখেও দেখিনি।’
    ‘আপনার ছেলে তাকে চেনে সেটা আপনি জানেন নিশ্চয়ই?’
    ‘জানি না। তবে আমার ছেলে যদি তাকে চেনে তাতে কোনো অসুবিধে তো নেই।’
    ‘অসুবিধে আছে কি না সেটা পরে জানা যাবে পান্ডেজী। তবে একটা কথা আপনাকে বলে রাখি, সেই বাড়িতে ভাড়াটে যে, সে কিন্তু সন্দিগ্ধ। শুনেছি আপনার ছেলে নাকি পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো।’
    নিজের ছেলের প্রশংসা শুনে মুচকি হাসলেন বিনয় পান্ডে। বললেন- ‘তা তো ছিলো । আই.আই.টি. থেকে পড়ার ইচ্ছে ছিলো। আমি পুরো ব্যবস্থা করে নিয়েছিলাম। কিন্তু কি যে হলো তার কিছুই বুঝতে পারলাম না। বিকাশ বলল যে, সে পাটনাতেই থাকতে চায়। এখানেই কোনো এক কোম্পানীতে কাজ করবে সে। জেদ ধরে রইল। আমি বেশি কিছু বললাম না তাকে। এখন আফসোস হয়। যদি আই.আই.টি. থেকে পড়তো, তাহলে অনেক বেশি টাকা রোজগার করতে পারতো।’
    কথার শেষে ভদ্রলোকের মুখে বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠলো।
    ‘তার আই.আই.টি. থেকে না পড়ার পেছনে কারণ জিজ্ঞেস করলেন না?’
    ‘করেছিলাম। কিন্তু জবাব দেয়নি সে।’
    বেশিক্ষণ আর থাকলো না মৃত্যুঞ্জয় সেখানে। এবার তার গন্তব্য বিকাশের অফিস। বিকাশের অফিস ফ্রেজার রোডে। সগুনা মোড় থেকে বেশ অনেকটাই দূর। পথে অত্যাধিক ভিড়ের দরুণ সগুনা মোড় থেকে ফ্রেজার রোড পৌঁছাতে মৃত্যুঞ্জয়ের প্রায় দু’ঘন্টা সময় লাগলো। পাটনা স্টেশন থেকে নাক বরাবর সোজা রাস্তা বেরিয়ে গেছে ফ্রেজার রোড। গান্ধী ময়দান পর্যন্ত চলে যাওয়া এই পথে আকাশবাণী সহিত প্রচুর বড় – বড় সরকারী আর বেসরকারী কার্যালয় আছে। সাথে আছে বেশ কিছু শপিং মল। আকাশবাণী থেকে একটু এগিয়েই এক বহুতল অট্টালিকার সামনে অটো থেকে নামলো মৃত্যুঞ্জয়। অট্টালিকার ভেতরে ঢুকবার সময় মৃত্যুঞ্জয় দেখলো তার পাশ দিয়ে এক জন বাইকে করে বেরিয়ে গেলো। হেলমেটে ঢাকা চেহারার জন্য মৃত্যুঞ্জয় চিনতে পারলো না তাকে। কিছু একটা সন্দেহ হতে ঘাড় ঘুরিয়ে বাইকের দিকে তাকালো সে। নম্বর প্লেটের দিকে নজর গেলো। নম্বরটা চেনে । জ্যামের কারণে বিকাশ পান্ডের বাইক অত্যন্ত ধীর গতিতে পাটনা স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে। একটা অটো থামিয়ে সেটাতে বসলো মৃত্যুঞ্জয়। অটোটা বাইক থেকে প্রায় কুড়ি হাত পেছনে। মন্দ গতিতে অটো বাইকের পিছু নিচ্ছে। আফসোস হলো মৃত্যুঞ্জয়ের। এই মুহূর্তে যদি তার কাছেও বাইক থাকতো তাহলে বিকাশ পান্ডেকে নাগালে পেতে বেশি বেগ পেতে হতো না তাকে। মাঝে মাঝে বাইক আর অটোর দূরত্ব বাড়ছে। চারিপাশে বাইক, গাড়ি, অটোর ভিড়ের দরুণ চোখের আড়ালে হয়ে যাচ্ছে বিকাশ পান্ডে। অটোতে বসে ছটফট করছে মৃত্যুঞ্জয়। শেষ রক্ষা কি হবে? মৃত্যুঞ্জয় কি জানতে পারবে এই অসময় বিকাশ পান্ডে নিজের অফিস থেকে বেরিয়ে কোন গন্তব্যের পানে রওনা দিয়েছে? মৃত্যুঞ্জয় জানে পাটনা স্টেশন থেকে এক্সিবিশন রোডের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। সে ফোন করলো অন্বেষাকে।

    ‘তুমি কি কিছুক্ষণের মধ্যে পাটনা জংশনে পৌঁছাতে পারবে? আসলে তোমার স্কুটিটার খুব প্রয়োজন আমার।’ অন্বেষাকে বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘ঠিক আছে, আমি আসছি। তুমি এখন কোথায়?’   ‘ফ্রেজার রোডে। খুব ভিড়। অটোতে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে স্টেশন পৌঁছাবো। তুমি দেখে নাও এক্সিবিশন রোডে জ্যাম আছে কি না।’

    না, এক্সিবিশন রোডে জ্যাম ছিলো না। মৃত্যুঞ্জয়ের স্টেশন পৌঁছবার আগেই অন্বেষা সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলো। অন্বেষার স্টেশন পৌঁছবার ঠিক মিনিট দু’য়েক পর মৃত্যুঞ্জয়ের অটো থামলো স্টেশনের সামনে। অটো থেকে নামতেই অন্বেষাকে দেখতে পেলো সে। অন্বেষা নিজে একটা হেলমেট পরেছিলো এবং মৃত্যুঞ্জয়ের জন্য নিজের কলিগের একটা হেলমেট জোগাড় করে নিয়ে এসেছিল। চটজলদি অটোর ভাড়া মিটিয়ে অন্বেষার কাছে এসে তার হাতে থাকা হেলমেটটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে নিজে পরলো মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘ব্যাপারটা কি মৃত্যুঞ্জয় দা? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’ বলল অন্বেষা।
    ‘কোনো দিন এতো ভিড়, এতো জ্যামকে আমি মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসিনি যত আজ ভালোবাসলাম। আজ যদি রাস্তায় এতো ভিড় না হতো তাহলে হয়তো বিকাশ আমার নাগালের বাইরে চলে যেতো।’
    স্কুটি স্টার্ট করলো মৃত্যুঞ্জয়, অন্বেষা পেছনে বসলো।
    যে দিকে বিকাশ বাইক নিয়ে গিয়েছিল সে দিকে একটু এগোতেই সেই বাইককে দেখতে পেলো তারা। স্টেশনের পাশ দিয়ে একটা ফ্লাইওভারে উঠে পড়েছে দুজনের দু’ চাকা । খানিক পর বিকাশ নিজের বাহনকে ডান দিকে ঘুরিয়ে রাজেন্দ্র নগর স্টেশনের পথ ধরলো। তুলনামূলক এদিকে ভিড় কম। বিকাশের বাইক থেকে মৃত্যুঞ্জয় ও অন্বেষার স্কুটির দূরত্ব এখন মাত্র দশ হাত। ইচ্ছাকৃতই স্কুটির গতি অল্প কম করলো মৃত্যুঞ্জয়। সে চায় না বিকাশের কোনো রকমের সন্দেহ হোক। হঠাৎ মৃত্যুঞ্জয় ও অন্বেষা দেখলো রাজেন্দ্র নগর স্টেশনের কিছু আগে বিকাশ নিজের বাইক দাঁড় করলো। একজন অপেক্ষা করছিলো তার। বাইক দাঁড় করাতেই সে বসে গেলো বাইকের পেছনে। মৃত্যুঞ্জয় ও অন্বেষা দুজনেই চিনতে পারলো তাকে।
    ‘ওঃ মাই গড। এটা আমি কী দেখছি মৃত্যুঞ্জয় দা?’ বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
    ‘খুব সম্ভব আরও অনেক কিছুই দেখতে আর জানতে পাবে।’ চাপা গলায় মৃত্যুঞ্জয় বলল।
    ‘সেই কারণেই হয়তো রাধিকা আজ অফিসে আসেনি। কিন্তু এখনও আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ অন্বেষা কথা শেষ করলো।
    সামনের বাইক পুনরায় স্টার্ট হলো। রাধিকাকে পেছনে বসিয়ে এগিয়ে গেলো বিকাশ পান্ডে। মৃত্যুঞ্জয় তৎক্ষনাৎ তাদের পিছু নিলো না। খানিক দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশ্চর্য হলো অন্বেষা। বলল- ‘কী হলো? ফলো করবে না?’
    ‘করবো। একটু দূরত্ব রাখতেই হবে। আমাদের দেখে নিলে অসুবিধে আছে।’
    বিকাশ ও রাধিকার এগিয়ে যাওয়ার প্রায় কুড়ি সেকেন্ড পর মৃত্যুঞ্জয় স্কুটি স্টার্ট করলো।
    রাজেন্দ্র নগরে বেশ বড় এক জলের ট্যাঙ্কি আছে। সেই ট্যাঙ্কিকে ঘিরে ছোট বড়ো বেশ কিছু বাড়ির ভীড়। ট্যাঙ্কির গা ঘেঁসে এক সরু গলি চলে গেছে। সেই গলির শুরুতেই এক দু’তলা বাড়ি সামনে নিজের বাইক দাঁড় করালো বিকাশ পান্ডে। নিচের তলা বন্ধ। ফটক খুলতেই পাশ দিয়ে চলে গেছে দু’ তলায় যাওয়ার সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে দুজনেই উঠে গেলো দু’ তলায়। জলের ট্যাঙ্কির কাছে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যটা দেখছিল মৃত্যুঞ্জয় ও অন্বেষা। অন্বেষা বলল- ‘ মেন গেটে তো তালা লাগিয়ে দিলো। এবার আমরা ভেতরে ঢুকবো কী করে?’
    ‘রাধিকাকে কল করে মোবাইলটা আমাকে দাও।’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    মৃত্যুঞ্জয়ের কথা মতো কাজ করলো অন্বেষা। যে মুহূর্তে রাধিকার মোবাইলে রিং হলো, ফোনটা মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে ধরিয়ে দিলো সে।
    ‘হ্যাঁ বল অন্বেষা।’ ওপার থেকে রাধিকার গলা ভেসে এলো।
    ‘অন্বেষা নয়, মৃত্যুঞ্জয়। রাধিকা, কোনো জিনিসই বেশি দিন লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এক না এক দিন সত্য ঠিক সামনে চলে আসে। খুব প্রয়োজন না হলে আমি দরজা ভাঙ্গি না। তাই বলছি, আপনারা নিচে নামবেন, না আমার ওপরে উঠে দরজা ভাঙ্গবো?’
    মৃত্যুঞ্জয়ের এহেন কথায় থতমত খেয়ে গেলো রাধিকা। কী বলবে কিছু বুঝতে না পেয়ে ফোন কেটে দিলো সে। কিছুক্ষণ পর দু’তলার ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো রাধিকা। সামনের বারান্দায় এসে রাস্তার দিকে তাকালো। তার ঠিক সামনে প্রায় পনেরো হাতের তফাতে জলের ট্যাঙ্কি। মৃত্যুঞ্জয়কে খোঁজার জন্য এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল সে। হঠাৎ জলের ট্যাঙ্কির দিকে নজর গেলো তার। দেখতে পেলো মৃত্যুঞ্জয় আর অন্বেষাকে । ম্লান দৃষ্টিতে খানিক চেয়ে রইল সে দিকে, তার পর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে। মৃত্যুঞ্জয় আর অন্বেষাও বাড়ির দিকে এগোলো। ফটক খুলে তাদের ভেতরে ঢুকবার পথ করে দিলো রাধিকা। তার পান্ডুবর্ণ মুখের পানে খানিক এক দৃষ্টে চেয়ে অন্বেষা বলল- ‘তুই যে এতো বড় কথা আমার থেকে লুকিয়ে রাখবি এটা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।’
    প্রত্যুত্তর দিলো না রাধিকা। তিনজনে দু’তলায় উঠলো। ঘরে একটা চেয়ারে ঘাড় হেঁট করে বসে বিকাশ। একটা খাট পাতা, অন্বেষা ও রাধিকা বসলো তাতে। মৃত্যুঞ্জয় বসলো না।
    ‘বিকাশবাবুর সাথে কথা পরে হবে। আগে রাধিকার সাথে কিছু কথা সেরে নেওয়া যাক আগে।’ রাধিকার দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো- ‘আপনার বিকাশ পান্ডের সাথে সম্পর্কটা কি?’
    রাধিকা মাটির পানে চেয়ে বসে আসে। মুখে কথা নেই তার। রাধিকার বদলে বিকাশ বলল মৃত্যুঞ্জয়কে- ‘আমি বলছি আপনাকে। সব কথা খুলে বলছি আপনাকে।’
    ‘খুব ভালো। কিছু লুকাবেন না দয়া করে।’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘না। লুকাবো না।’ বিকাশ বলতে শুরু করলো- ‘রাধিকার সাথে আমার সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। স্কুল লাইফ থেকে। রাধিকা যে প্রতীক নেলসনের সাথে প্রেমের খেলা খেলছে সেটা আমারই প্ল্যান। প্রতীকের বিচিত্র কান্ডকারখানার বিষয় জানা দরকার।’
    ‘প্রতীকের সাথে তো আপনার রোজ দেখা হয়, জিজ্ঞেস করেননি?’
    ‘দেখা তো রোজ হয়। জিজ্ঞেসও করেছি। কিন্তু জবাব দেয়নি সে। যে বাড়িতে প্রতীক ভাড়া থাকে সেটা আমার কাকার বাড়ি। আমি প্রতীককে এটাও বলেছি যে কারণ না বললে তার এই ভয়ানক সব কার্যকলাপের খবর আমি কাকাকে বলে দেবো।’
    ‘তারপর?’ জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
    ‘আমার হাতে-পায়ে পড়লো সে। কাকাকে বলতে মানা করলো।’
    ‘সে মানা করলো আর আপনি মেনে নিলেন?’ মৃত্যুঞ্জয় বলল।
    পুনরায় ঘাড় হেঁট করলো বিকাশ।
    ‘বলুন বিকাশ বাবু, বলুন। আসল কথাটা কি সেটা বলুন। আপনাদের মধ্যে কোনো কি কোনো এগ্রিমেন্ট হয়েছিল? যেমন প্রতীক নেলসন সন্দেহজনক লোক, তেমন আপনিও কিছু কম না।’
    মৃত্যুঞ্জয়ের এই কথায় চমকে উঠল বিকাশ পান্ডে।
    ‘ আ….আমি সন্দেহজনক?’ আমতা আমতা করে বললো সে।
    ‘হ্যাঁ, আপনিও। কেমেস্ট্রিতে আপনি এক্সট্রা অর্ডিনারি স্টুডেন্ট। আই.আই.টি. থেকে পড়ার ইচ্ছেও ছিলো আপনার। দেশের যে কোনো ভালো আই.আই.টি. কলেজে আপনার অ্যাডমিশন হয়ে যেতো। হঠাৎ আপার ইচ্ছেতে পরিবর্তন ঘটল। আপনি পাটনাতেই রয়ে গেলেন। সাফল্যকে নিজের হাতে ঠেলে দিলেন আপনি। কারণটা জানতে পারি কি?’
    মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে খানিক অবাক দৃষ্টিতে তাকাবার পর বিকাশ বলল- ‘পাটনা থেকে চলে গেলে আমার গবেষনার কাজ পুরো হতো না। কেমেস্ট্রিতে আমি ভালো ছিলাম। একটা কেমিকেলের বিষয় গবেষণা করার পোকা আমার মাথায় বহু দিন আগেই ঢোকে। ক্ষমা করবেন, সেই গবেষণার বিষয় আপনাদের আমি বলতে পারবো না। ওটা কনফিডেন্সিয়াল। এটুকু কথা দিতে পারি যে আমার গবেষণা পুরো হলে ভবিষ্যতে দেশের কোনো ক্ষতি হবে না, বরং ভালোই হবে। শুরুতে নিজের কিছু জমানো টাকা দিকে গবেষণা শুরু করলাম। কাকার বাড়িটা খালি ছিলো তখন। বাড়িতে দুটো ঘর। আমার গবেষণার জন্য একটা ঘর যথেষ্ট ছিলো। অর্থের অভাবে মাঝে বহু দিন আমি নিজের রিসার্চ বন্ধ রাখি। একটা চাকরী শুরু করি। স্যালারির টাকা দিয়ে আবার শুরু করি নিজের রিসার্চ। তারপর সেই বাড়িতে প্রতীক নেলসন আসে। কাকা আমাকে ফোন করে বলে দিয়েছিল যে তাকে একটা ঘর খুলে দিতে। আমি তাই করলাম। নিজের অফিস শেষ করে আমি রোজ সেই বাড়িতে যাই। রিসার্চের কাজ চালিয়ে যাই। এখন আর টাকার অভাব হয় না।’
    ‘বুঝলাম। ব্ল্যাকমেল। নিজের কাকাকে প্রতীকের বিষয় না বলার কারণ প্রতীক থেকে টাকা নেওয়া আর নিজের গোপন রিসার্চকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাই তো?’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    খানিক চুপ থেকে বিকাশ পুনরায় বলতে শুরু করলো- ‘কিন্তু সেটা করেও আমি শান্তি পাইনি। প্রতীকের শরীরে এমন সব চোট কী করে লাগে সেটার জানার প্রবল ইচ্ছে মনের ভেতর রয়ে গেলো। তারপর একদিন রাধিকা আমায় বলে যে তার অফিসে নাকি এক অদ্ভুত ছেলে জয়েন করেছে। রাধিকার মুখে তার নাম শুনলাম। তারপরেই আমার মাথায় এই প্ল্যানটা আসে। রাধিকা যদি প্রতীককে কোনোক্রমে নিজের প্রেমের জালে ফাঁসাতে পারে, তাহলে প্রতীকের চোটের কারণ জানা যেতে পারে।’
    ইতিমধ্যে মৃত্যুঞ্জয় ঘরময় পায়চারি আরম্ভ করেছে। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পুরো ঘরটাকে দেখছে সে। হঠাৎ রাধিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো- ‘তো রাধিকা, কিছু জানতে পারলে?’
    ‘না। এখন অবধি কিছুই বলেনি সে। ওর পেট থেকে কথা বার করবার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু আফসোস, সফল হয়েনি এখনও।’ বিষন্নতা মেশানো সুরে রাধিকা বলল।
    ‘আমরা এতোজন মিলেও যদি প্রতীকের শরীরে লাগা আঘাতের কারণ খুঁজে না বার করতে পারি, তাহলে তো সেটা আমাদের ফল্ট, মৃত্যুঞ্জয়দা।’ হতাশার স্বরে কথাটা বলল অন্বেষা।

    মৃত্যুঞ্জয় যেন তার কথা শুনলোই না। সে বিকাশকে জিজ্ঞেস করলো- ‘তুমি ছাড়া সে বাড়িতে আর কে কে যায়?’
    ‘বলতে পারবো না। আমি প্রায় সন্ধ্যে সাতটায় ঢুকি আর রাত এগারোটায় বেরোই। এর মধ্যে তো কেউ আসে না। তারপরে যদি কেউ আসে, সেটা আমার জানা নেই। সারা সকাল আমি সেই বাড়িতে যাই না। কে আসছে, কে যাচ্ছে সেটা জানবো কী করে?’
    ‘এই বাড়িটা কার?’ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
    ‘এই ঘরটা আমি ভাড়া নিয়েছি। আই.আই.টি. তে অ্যাডমিশন না নেওয়ার পর থেকেই বাড়ির সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। মাসে কিছু দিন বাড়িতে থাকি, ভালো না লাগলে এখানে চলে আসি।’ বিকাশ বলল।
    ‘তুমি বললে যে তোমার কাকার বাড়িতে দুটো ঘর। একটা ঘরে তুমি রিসার্চ করো আর একটা ঘরে প্রতীক থাকে।’
    ‘হ্যাঁ।’
    ‘প্রতীকের ঘরে কোনো দিন ঢুকেছো?’
    ‘না। সে নিজের ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় না।’
    ‘হবে না। এমন করে হবে না। রহস্য ভেদ করতে গেলে তার ঘরে ঢুকতেই হবে।’
    ‘কিন্তু কী করে? চাবিও তো নেই আমার কাছে।’ বিকাশ বললো।
    খানিক শূন্যের দিকে তাকিয়ে আবার রাধিকার দিকে ফিরলো মৃত্যুঞ্জয়। তাকালো ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে। রাধিকা মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে অবাক নেত্রে চেয়ে রইলো। তার ইঙ্গিত বুঝতে পারলো না সে। এবার মৃত্যুঞ্জয়কে নিজের মুখেই কথাটা বলতে হলো। রাধিকার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বলল- ‘আর কোনো উপায় নেই রাধিকা। আমাদের প্রতীকের ঘরে ঢুকতেই হবে। আর সেটা করার জন্য তালা ভাঙ্গা অনিবার্য। প্রতীক নেলসনের সামনে সেটা করা অসম্ভব। পরশু রবিবার। সারা দিন তুমি প্রতীক নেলসনকে ব্যস্ত রাখবে। যেখানে খুশি ঘুরতে যাও তাকে নিয়ে। এই ফাঁকে আমরা দরজার তালা ভেঙ্গে তার ঘরে প্রবেশ করবো।’
    ‘কিন্তু যখন সে ফিরে এসে দেখবে যে তার ঘরের তালা ভাঙ্গা, তখন তো সন্দেহ হবে তার।’ বলল বিকাশ।
    ‘হবে বৈকি। সন্দেহ না হওয়ার কোন কারণ নেই। সেটারও একটা উপায় ভেবেছি।’
    ‘কি উপায় মৃত্যুঞ্জয়দা?’ জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
    ‘প্রতীক নেলসনের ঘরের তালা ভাঙ্গার সাথে সাথে বিকাশের ঘরের তালাও ভাঙ্গা হবে। বিকাশ নিজের ঘরের কিছু জিনিস সরিয়ে রাখবে। বিকাশ সেই ঘরে রিসার্চ করে। দরকার পড়লে দু’একটা টেস্ট টিউবও ভেঙ্গে দিতে পারে। পুরো ব্যাপারটাকে এমন করে সাজাতে হবে যাতে মনে হয়ে সেই বাড়িতে অন্য কারুর প্রবেশ ঘটেছিল। বিকাশ, তোমার গবেষণার বিষয় কি প্রতীক জানে?’
    ‘কিছু  কিছু জানে। প্রতীক এটা জানে যে আমি কিছু একটা নিয়ে রিসার্চ করছি। এ বিষয় কোনো ইন্টারেস্ট দেখায়নি সে।’ বিকাশ জবাব দিলো।
    ‘ভেরি গুড। তাহলে তো আরও সহজ হয়ে গেলো। প্রতীককে এটা বোঝাতে হবে সেই বাড়িতে এমন এক জনের প্রবেশ ঘটেছিলো যে বিকাশের গোপন গবেষণার বিষয় জানতে পেরেছিল। খালি বাড়ি পেয়ে ঘরে ঢোকে। সে জানতো না বিকাশের ঘর কোনটা। তাই দু’টো ঘরের তালাই সে ভেঙ্গে দেয়। সে হয়তো বিকাশের অজ্ঞাত প্রতিপক্ষ।’
    ‘এক্সিলেন্ট!’ উত্তেজনায় লাফিয়ে ওঠে অন্বেষা।
    মৃত্যুঞ্জয় আবার বিকাশকে বলে- ‘আমি আর অন্বেষা সেই বাড়ির আশেপাশেই থাকবো। রাধিকা প্রতীককে ফোন করে সকাল সাড়ে ন’টায় দেখা করার কথা বলবে পাটনা জংশনের সামনে। প্রতীকের বেরোতে বেরোতে হয়তো দশটা বাজবে। সময় আগে পিছেও হতে পারে। তাও আমার বিশ্বাস খুব একটা দেরি সে করবে না। প্রতীকের সাথে রাধিকার দেখা হয়ে গেলে রাধিকা অন্বেষাকে ওয়াটসঅ্যাপে একটা ম্যাসেজ করবে। সেটাই হবে আমাদের গ্রীন সিগনাল। বিকাশ ঠিক সকাল সাড়ে দশটায় আমাদের অ্যাটেন্ড করবে। সাথে নিয়ে আসবে এক বড় হাতুড়ি। আমরা তিনজনে বেলা বাড়া পর্যন্ত বিকাশের ঘরে অপেক্ষা করবো। দুপুরের দিকে যখন রাস্তায় লোক চলাচল কম হবে তখন ভাঙ্গা হবে প্রতীকের ঘরের তালা। আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেলে অন্বেষা রাধিকার ওয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ করবে। ততক্ষণ রাধিকার দায়িত্ব প্রতীক নেলসনকে ব্যস্ত রাখার। কি রাধিকা, পারবে তো?’
    কোনো এক অজানা ভয়ে রাধিকার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় শুধু ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলো যে সে একমত।

     

     

    চলবে…………….

  • ধারাবাহিক

    ক্ষত (পর্ব-২)

    ক্ষত 
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

     

    পর্ব- ২

    বাড়িটা ছোট, আশেপাশে বলতে গেলে জংগল। কোনো সময় হয়তো বাগান ছিলো, কিন্তু এখন সেটা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। সদর দরজায় তালার দরুণ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ সম্ভব নয়। বাইরে থেকেই মৃত্যুঞ্জয় বুঝতে পারলো যে বাড়িতে খুব বেশি হলে দুটো ঘর। একটা ঘর বাড়ির পেছন দিকে। বেরোবার জন্য একটা দরজাও আছে। সন্তর্পণে বাড়িটার চারিপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছে মৃত্যুঞ্জয়। বাড়িটা বেশ পুরনো, তায় আবার যত্নহীন। বেশ কিছু কাঠের জানালা অল্প অল্প ভাঙ্গা। জানালাগুলো বেশ উঁচুতে, তাই ছিদ্র দিয়ে কিছু দেখা সম্ভব হলো না মৃত্যুঞ্জয়ের জন্য। এবার মাটির দিকে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সে। দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে। কিছুক্ষণ আগেই হয়ে গেছে সূর্যাস্ত। পাঁচিল টপকে প্রবেশ করার প্রায় চল্লিশ মিনিটের বেশি হয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ের। দিনের আলো থাকতেই নিজের কাজ শেষ করতে হবে তাকে। মাটির দিকে তাকাতেই খানিক পর কিছু রক্ত মাখা ব্যান্ডেজ ও তুলো পেলো সে।  স্টিচের কিছু সুতো তার হাতে এলো। প্রায় অর্ধেকটা পুড়ে যাওয়া বইয়ের একটা পৃষ্টা দেখতে পেলো মৃত্যুঞ্জয়। তৎক্ষনাৎ সেটা তুলে নিলো। আধ পোড়া কাগজটা ভালো করে দেখলো। সাথে সাথে মাটিতে ছড়ানো প্রায় একই প্রকারের বেশ কিছু কাগজের টুকরো তার চোখে পড়লো। কোনোটা প্রায় নব্বই শতাংশ পুড়ে যাওয়া তো কোনোটা পঞ্চাশ শতাংশ। একে একে সবগুলোকে উঠিয়ে নিরীক্ষণ করলো মৃত্যুঞ্জয়। সবগুলো পৃষ্ঠাই মেডিকেল বইয়ের। সবগুলোকে এক সাথে দলাপাকিয়ে নিজের প্যান্টের পকেটে পুড়লো সে। আরও কিছু পাওয়ার আশায় ঘাড় হেঁট করে মাটির দিকে তাকিয়ে মৃত্যুঞ্জয় এগোতে থাকে। মাটিতে ওটা কী পরে আছে? উবু হয়ে বসে সে জিনিসটা তুললো মৃত্যুঞ্জয়। একটা ছবিকে যেন দু’টুকরো করা হয়েছে, তারই একটা অংশ এখন মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে। এক পুরুষের ছবি। ব্যাক ব্রাশ করা চুল, চোখে চশমা, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, পরনে সুট-টাই। ছবিটা সাদা-কালো, বলাই বাহুল্য যে বেশ পুরনো ছবি। সেই ছবিটাও নিজের প্যান্টের পকেটে চালান করলো মৃত্যুঞ্জয়। চারিপাশে বেশ অন্ধকার নেমে এসেছে। হাতঘড়িতে সময় দেখলো সে, সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা। আর বেশি সময় নেই হাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রতীক নেলসন চলে আসবে। ঘাসের ওপর আরও কি কি আছে অন্ধকারের দরুণ দেখা সম্ভব নয়। পাঁচিল টপকে বাইরে বেরোবার প্রস্তুতি নেবে ঠিক সে সময় লোহার ফটক খোলার শব্দ পেলো সে। তৎক্ষনাৎ বাড়ির পেছন দিকের দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো মৃত্যুঞ্জয়। আলোআঁধরির মধ্যে দেখতে পেলো কেউ ফটক খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। মাঝারি উচ্চতা, বাঁ হাতের চেটোতে মোটা করে ব্যান্ডেজ বাঁধা, পিঠে একটা ব্যাগ। সদর দরজা খোলার আওয়াজ কানে এলো মৃত্যুঞ্জয়ের। খানিক পরেই বাড়ির পেছন দিকের ঘরের বাতি জ্বলে গেলো। মৃত্যুঞ্জয়ের বুঝতে দেরি হলো না যে, এই ছেলেটাই প্রতীক নেলসন। না, আর এখানে থাকা ঠিক না। অতি সন্তর্পণে পাঁচিল টপকে বেরিয়ে গেলো মৃত্যুঞ্জয়।

    পানের দোকানে গিয়ে একটা সিগারেট ধারালো সে। আরও কিছুক্ষণ এখানে থাকলে কেমন হয়ে? খুব সম্ভব দ্বিতীয় ছেলেটাও খানিক পরেই চলে আসবে। দোকানি বারবার মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে তাকাচ্ছিল। দোকানে গ্রাহকের প্রাচুর্যের কারণে কিছু বলতে পারছিল না। সে বুঝতে পেরেছিল যে মৃত্যুঞ্জয় দ্বিতীয় ছেলেটার অপেক্ষাই করছে। অল্প একটু সুযোগ পেয়েই দোকানি মৃত্যুঞ্জয়কে বলল- ‘আমি আপনাকে জানিয়ে দিতাম বাবু। আপনার সময় নষ্ট করার দরকার ছিলো না।’

    মৃত্যুঞ্জয় একটা আরও সিগারেট ধরিয়ে বলল- ‘এতক্ষণ যখন থেকেই গেলাম, তখন কাজটা শেষ করে যাওয়াই ভালো।’

    দোকানির মুখটা শুকিয়ে গেলো। সে হয়তো ভাবলো মৃত্যুঞ্জয় নিজেই কাজটা সম্পন্ন করে তার থেকে সেই একশো টাকাটা ফেরত চেয়ে নেবে।
    সিগারেটে দু’টো টান দিতেই পেছন থেকে এক বাইকের আওয়াজ পেলো মৃত্যুঞ্জয়। বাইকটা দাঁড়ালো দোকানের সামনে এসে। দোকানের পাশের দিকে আড়াল করে মৃত্যুঞ্জয় দাঁড়িয়েছিল। বাইকে যে বসে ছিলো সে যখন নিজের হেলমেটটা খুলল, তখন তাকে পরিস্কার দেখতে পেলো সে। দোকানি ঠিকই বর্ণনা করেছিলো। এতক্ষণে বাইকের নম্বরটা মৃত্যুঞ্জয় নিজের মোবাইলে নোট করে নিয়েছে । এক প্যাকেট সিগারেট কিনে যখন বাইকে বসে থাকা ছেলেটা পার্স বার করে টাকা দিতে যাবে, ঠিক তখনই মৃত্যুঞ্জয় দেখতে পেলো পার্সে এক জনের ভিজিটিং কার্ড। কার্ডে লেখা ছিলো- ‘পঙ্কজ চৌধরী, এডুকেশন ফর অল ইনস্টিটিউট, ১৬/বি, বোরিং রোড, পাটনা – ৮০০০০১।’
    বলাই বাহুল্য মৃত্যুঞ্জয় পুরো ঠিকানাটা নিজের মোবাইলে টুকে নিলো।
    সে ছেলেটা সিগারেটের মূল্য দিয়ে বাইক স্টার্ট করে চলে গেলো নিজের গন্তব্যের দিকে। তার চলে যাওয়ার পর মৃত্যুঞ্জয় দোকানিকে আবার একশো টাকা দিয়ে বলল- ‘আমি যে তার বাইকের নম্বর নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম সে খবর যেন ঘুণাক্ষরেও তার কানে না যায়।’
    দাঁত বার করে দোকানি টাকা নিয়ে বলল- ‘কিসি কো নাহি বোলেংগে বাবু। কিসি কো নাহি।’
    মৃত্যুঞ্জয় বাড়ি ফিরলো তখন রাত সাড়ে আটটা। ঘরে ঢুকেই ফোন করলো সুপ্রতীক অধিকারীকে। বলল- ‘তোর পৈতৃক বাড়ি এটা। তুই বহু বছর থেকেছিস এখানে। তাই না?’
    ‘হ্যাঁ।’ সুপ্রতীক জবাব দিলো।
    ‘পাটনাতে কোনো পুলিশ অফিসারের সাথে তোর পরিচয় আছে?’
    ‘হঠাৎ তোর পাটনাতে পুলিশের কি দরকার পড়লো?’
    ‘দরকার আছে বস, দরকার আছে। আর.টি.ও. থেকে একটা বাইক নম্বরের ডিটেলস নিতে হবে। বাইকটা কার এবং তার বাড়ির ঠিকানা। পারবি?’
    ‘কোনো গন্ডোগোল বেঁধেছে কি?’
    ‘না। চিন্তা করিস না। গন্ডোগোল বাঁধলেও মৃত্যুঞ্জয় আছে এখানে।’
    ‘জানি তুই গন্ডোগোল বাঁধতে দিবি না। দে, নম্বরটা দে। কালকের মধ্যে ডিটেলস পেয়ে যাবি।’
    ‘গুড।’
    মৃত্যুঞ্জয়ের নম্বর দিয়ে ফোন রাখতেই ঘরে ঢুকলো অন্বেষা।
    ‘কোথায় ছিলে তুমি মৃত্যুঞ্জয়দা? প্রায় দু’ঘন্টা ধরে তোমার অপেক্ষা করছি।’ কথাটা বলে একটা চেয়ারে বসলো অন্বেষা।
    ‘কাজে গিয়েছিলাম। অত্যন্ত দরকারী কাজে।’ একটা সিগারেট ধরিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল। চলে গেলো খোলা জানালার কাছে।
    ‘গতকাল রাতে প্রতীকের হাতে চোট লেগেছে।’ অন্বেষা বলল।
    ‘জানি। হাতের পাতায়। মোটা করে ব্যান্ডেজ বেঁধে আছে সেখানে।’ সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল।
    অবাক কন্ঠে অন্বেষা জিজ্ঞেস করলো- ‘তুমি কী করে বুঝলে? দেখেছো নাকি তাকে?’
    ‘হুম। তার বাড়ির কাছেই ছিলাম। তোমাকে যা খোঁজ নিতে বলেছিলাম নিয়েছ?’
    ‘নিয়েছি।’ অন্বেষা বলল- ‘প্রতীক নেলসনের বাড়ি সমস্তিপুরে সেটা তোমাকে আগেই বলেছি। বাড়িতে থাকেন তার বাবা জোসেফ নেলসন। মা নেই, হয়তো মারা গেছেন। এক সরকারী স্কুলের টিচার ছিলেন তার বাবা। রিটায়ার করে এখন বাড়িতেই থাকেন। এই নাও বাড়ির ঠিকানা।’ একটা কাগজ অন্বেষা এগিয়ে দিলো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে।
    কাগজটা হাতে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘জোসেফ নেলসন কোন স্কুলে কাজ করতেন সেটা নিশ্চই জানতে পারোনি?’
    মাথা নেড়ে না বলল অন্বেষা।
    এক সাথে সিগারেটের তিন চারটে লম্বা টান দিয়ে সেটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো মৃত্যুঞ্জয়। এগিয়ে এলো অন্বেষার পাশে রাখা কাঠের টেবিলের দিকে। প্যান্টের পকেট থেকে কাগজের টুকরোগুলো এবং আধ ছেঁড়া ছবিটা বার করে টেবিলে রেখে বলল- ‘এগুলো পেলাম প্রতীকের বাসস্থানের জঙ্গল থেকে।’
    ঘাড় হেঁট করে সেগুলোর দিকে তাকালো অন্বেষা। আধ পোড়া কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল- ‘এগুলো তো মেডিকেলের বই মনে হয়ে।’
    পরক্ষণেই তার নজর গেলো ছেঁড়া ছবিটার দিকে।
    ‘এই ছবিটা কি প্রতীকের বাবার?’ মৃত্যুঞ্জয়কে জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
    ‘জানি না। নো আইডিয়া। হয়তো প্রতীকের বাবার, হয়তো তার সাথে যে থাকে তার বাবার। ছবিটা দেখে মনে হয়ে ভদ্রলোকের বিয়ের সময়ের ছবি। ছবির নিচেটা ভালো করে দেখো অন্বেষা। তারিখ লেখা ছিলো। ছবিটা ছেঁড়ার ফলে তারিখ বাদ পড়ে গেছে। কিন্তু সাল এখনও স্পষ্ট, ১৯৮৬।’
    ‘ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি দেখে তো খ্রিস্টান বলেই মনে হয়। কিন্তু প্রতীকের সাথে মুখের আদলের কোনো মিল দেখছি না।’ ছবিটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখলো অন্বেষা।

    ‘সব সময় এটা সম্ভব না যে ছেলের মুখের আদল বাবার সাথে মিলেই যাবে। প্রতীককে হয়তো নিজের মায়ের মতো দেখতে। কিম্বা কারুর মতো না।’ কথা শেষ করে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করলো মৃত্যুঞ্জয়।

    ‘বেশ কিছু প্রশ্ন মনে খটকা দিচ্ছে অন্বেষা। প্রথমত, মেডিকলের বই সেখানে কী করছে? বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কেন? নিজের শরীরের চোটের চিকিৎসা কি প্রতীক নিজেই করে? তাহলে যখন তার মাথা ফাটে তখন স্টিচ করে কে? গত রাতেই বা পরিপাটি করে তার হাতে ব্যান্ডেজ কে বেঁধে দিলো? তোমাদের অফিসে ছেলেদের সংখ্যা নিশ্চই কম নয়। তাহলে রাধিকা প্রতীককেই কেন ভালোবাসলো? দ্বিতীয় ছেলেটাই বা কে? অবশ্য সেই ছেলেটার বিষয় আগামী কাল ইনফরমেশন পেয়ে যাবো।
    অনেক প্রশ্ন অন্বেষা, অনেক প্রশ্ন।’
    হঠাৎ অন্বেষার দিকে ফিরে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো- ‘তোমাদের অফিসের লাঞ্চ টাইম কখন হয়?’
    ‘দু’টো।’ জবাব দিলো অন্বেষা।
    ‘ঠিক আছে। কাল লাঞ্চ টাইমে তোমাদের অফিস যাবো। প্রতীকের সাথে কথা হলে ভালো, নাতো রাধিকার সাথে কথা বলবো। রাধিকাকে একবার ঝাঁকিয়ে দেখা যাক, যদি কিছু বেরিয়ে আসে।’
    অন্বেষার অফিস এক্সিবিশন রোডে। এক বহুতল অট্টালিকার ছ’তলায় তাদের অফিস। দুপুর দুটোর আগেই মৃত্যুঞ্জয় সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল। ঠিক দুটোয় অন্বেষার ফোন এলো মৃত্যুঞ্জয়ের মোবাইলে।
    ‘অফিসে চলে এসো মৃত্যুঞ্জয়দা। ক্যান্টিন আছে। এখানেই খেয়ে নেবো।’
    ক্যান্টিনে অন্বেষা মৃত্যুঞ্জয়ের আলাপ করালো রাধিকার সাথে। অন্বেষার বয়সী রাধিকা। উচ্চতা অন্বেষার থেকে অল্প কম হলেও মুখশ্রী খুব সুন্দর। গায়ের রং বেশ ফরসা। খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর মৃত্যুঞ্জয় রাধিকাকে বলল- ‘দেখুন, আমি আপনাকে আগেই বলে দিতে চাই যে কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন আপনাকে জিজ্ঞেস করবো। আমার যত দূর মনে হয়, যে ব্যাপারে তদন্ত করতে আপনি এবং অন্বেষা এগিয়েছেন সেটা খুবই গুরুতর এবং জটিল । একটা মানুষের শরীর চোটের কারণে যদি দিনে দিনে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়, তাহলে সেটার শেষ পরিণাম ভয়ংকর হতে পারে। যদি সত্যি প্রতীক কোনো বিপদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাহলে সেই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করা আমাদের কর্তব্য। আর সেই কারণেই আপনাকে যে প্রশ্নগুলো করবো তাতে কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্নও হতে পারে । আশা করি আপনি আপত্তি করবেন না।’

    এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে গেলো মৃত্যুঞ্জয়। রাধিকা যে একটু ঘাবড়ে গেলো সেটা বলাই বাহুল্য। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো অন্বেষার দিকে। অন্বেষা বলল- ‘নির্দ্বিধায় উত্তর দে রাধিকা। প্রতীককে তুইও বাঁচাতে চাস আর আমরাও।’
    সামনে রাখা জলের গেলাস থেকে দু’ঢোঁক জল পান করে মৃত্যুঞ্জয়কে রাধিকা বলল- ‘বলুন।’
    ‘কত দিনের পরিচয় আপনার প্রতীকের সাথে?’
    ‘প্রায় চার মাস। ছ’মাস আগে সে অফিসে জয়েন করেছে। তখন বেশি কথা হতো না তার সাথে। তারপর আস্তে  আস্তে বন্ধুত্ব হয়।’ রাধিকা বলল।
    ‘যত দূর জানি প্রতীক মিশুকে নয়। আপনার সাথে তার ঘনিষ্টতার বিশেষ কারণ?’
    ‘আমাদের একে অপরের সঙ্গ ভালো লাগে।’
    ‘তাহলে তো অনেক কথাই সে আপনাকে বলেছে নিশ্চয়ই। যেমন নিজের শরীরে চোটের কারণের বিষয় আপনাকে বলে থাকতে পারে।’
    মৃত্যুঞ্জয়ের এই কথায় মাথা গরম হলো রাধিকার। বিরক্তির স্বরে বলল- ‘যদি কারণটা আমি জানতাম তাহলে রাতে এতো রিস্ক নিয়ে তার বাড়ির পেছনে লুকিয়ে থাকতাম না।’
    ‘তাও ঠিক। আচ্ছা, এতো ছেলে আপনাদের অফিসে আছে, আপনার প্রতীককেই কেন পছন্দ হলো? মানে …. প্রতীক তো সাধারণ ছেলেদের মতো না।’
    মৃত্যুঞ্জয় যে এ ধরনের কোনো প্রশ্ন করবে সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি রাধিকা। অবাক দৃষ্টিতে তাকালো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে। বিস্ময়ের দারুণ কন্ঠরোধ হয়ে গিয়েছিল তার। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল- ‘ভালোবাসার পেছনে কোনো যুক্তি থাকে না। যেখানে যুক্তি থাকে সেখানে ভালোবাসা থাকে না ।’
    ‘ভেরি গুড। আচ্ছা, আপনাদের দুর্বল মুহূর্তেও কিছু উল্লেখ করেনি প্রতীক?’
    এবার আর থাকতে পারলো না রাধিকা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। প্রায় চিৎকার করে বলল- ‘কি ভেবেছেন আপনি নিজেকে? একটা মেয়ের অপমান করতে আপনার লজ্জা করে না? আমি আপনাকে চিনি না, জানি না, এ সব বাজে প্রশ্নের উত্তর দেবো কেন আপনাকে?’
    ‘রিল্যাক্স ম্যাডাম, রিল্যাক্স। প্লিজ বসুন। এটা আপনিও জানেন যে এ প্রশ্ন গুলো অত্যন্ত দরকারী। আপনি জানেন যে আমরা কেউ প্রতীকের খারাপ চাই না। তাই প্লিজ, মাথা গরম করবেন না।’ শান্ত কণ্ঠে মৃত্যুঞ্জয় বলল।
    অন্বেষা বোঝালো রাধিকাকে- ‘শান্ত হো রাধিকা। এ সব জানা খুব দরকার ছিলো মৃত্যুঞ্জয়দা’র জন্য। যখন সে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে, তখন তাকে কোঅপারেট করা কি আমাদের উচিত নয়?’
    চেয়ারে বসলো রাধিকা। অর্ডার দেওয়া খাবার চলে এসেছে। তিনজনেই খেতে শুরু করলো। খাবার মাঝেই মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো- ‘প্রতীকের বাড়িতে যে ছেলেটা আসা যাওয়া করে তাকে কোনোদিন ভালো করে দেখেছেন?’

    ‘না।’ সংক্ষিপ্তে উত্তর দেয় রাধিকা।
    ‘আপনি কোনোদিন জিজ্ঞেস করেননি তার বিষয়?’
    ‘করেছিলাম। প্রতীক বলেছিলো যে তার পুরনো বন্ধু।’
    ‘আপনার বাড়ি কোথায়?’
    ‘পাটলিপুত্র কলোনীতে।’
    আর বিশেষ কিছু প্রশ্ন করলো না মৃত্যুঞ্জয়। লাঞ্চ শেষ হলো তাদের। হঠাৎ মৃত্যুঞ্জয় দেখলো যে ক্যান্টিনের গেটে এসে হাজির হলো প্রতীক নেলসন। রাধিকার দিকে তাকিয়ে বলল- ‘ভেবেছিলাম তোমার তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। কিন্তু দেখলাম পুরো লাঞ্চ আওয়ারটাই নিয়ে নিলে।’
    গত সন্ধ্যের আলো আঁধারির মধ্যে প্রতীক নেলসনকে ভালো করে দেখতে পারেনি মৃত্যুঞ্জয়। আজ ভালো করে দেখার সুয়োগ পেলো তাকে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া মাথার চুল, ক্লিন শেভ, কপালে ও দু’গালে অসংখ্য কাটা ও স্টিচের দাগ, বাঁ হাতের পাতায় এখনও পরিপাটি করে বাঁধা ব্যান্ডেজ। চেহারায় বিশেষত্ব বলতে এর থেকে বেশি উল্লেখ্যযোগ্য কিছু নেই।

    ‘নো ডিয়ার, আসলে অন্বেষার এক দাদা এসেছে। তাই দেরি হয়ে গেলো আর কি।’ রাধিকা এগিয়ে গেলো প্রতীকের দিকে। দুজনে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেলো।
    লিফ্ট দিয়ে নীচে নামবার সময় মৃত্যুঞ্জয় অন্বেষাকে বলল- ‘তোমাকে এক দিনের ছুটি নিতে হবে অন্বেষা।’
    ‘কেন বলো তো?’
    ‘প্রতীকের অতীতের বিষয় জানা দরকার। সেটা জানতে পারবে যেখানে সে নিজের ছোট বেলা কাটিয়েছে সেখানে। মানে, সমস্তিপুরে। তোমাকে সমস্তিপুর যেতে হবে। প্রতীকের বাবার সাথে দেখা করতে হবে। তদন্ত যদি চালিয়ে যেতে চাও, তাহলে ছুটি নাও অফিস থেকে।’
    ঈষৎ পান্ডুবর্ণ হয়ে গেলো অন্বেষার মুখ। নিচু গলায় বলল- ‘সে না হয়ে ছুটি নিলাম। কিন্তু …. কিন্তু আমাকে কি সমস্তিপুর একলা যেতে হবে?’
    লিফ্ট থেকে বাইরে এলো তারা।
    ‘একজনকে সাথে লাগবে। তাই না?’ মৃদু হেসে মৃত্যুঞ্জয় বলল।
    ‘শুধু তোমাকে। তুমি যখন এগিয়ে এসেছো, তখন থাকতে তো হবেই আমার সাথে।’ প্রতিউত্তর দিলো অন্বেষা।
    ‘হ্যাঁ ভালো কথা। সেই ছেলেটার নাম আর ঠিকানা জানা হয়ে গেছে।’
    মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় চমকে উঠলো অন্বেষা।
    ‘তাই নাকি? দারুণ তো। কী নাম তার, কী করে সে?’
    ‘কী করে সেটা তো এখনও জানা যায়নি, তার নাম হলো বিকাশ পান্ডে। তুমি অফিসে যাও অন্বেষা। তোমার লাঞ্চ টাইম শেষ।’
    বিকেল পাঁচটা বাজে যখন মৃত্যুঞ্জয় বোরিং রোডে ‘এডুকেশন ফর অল ইনস্টিটিউটে’ পৌঁছালো। চার তলা এক বাড়ির সম্পূর্ণ দু’তলাটা ইনস্টিটিউট। নীচে সারিসারি সাইকেল রাখা। বেশ কিছু অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা দু’তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলো। নিজের নিজের সাইকেলের দিকে এগোলো প্রত্যেকে। একটা ছেলেকে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো- ‘পঙ্কজ চৌধুুুরীকে কোথায় পাবো?’
    ‘স্যার ক্লাসেই আছেন। জাস্ট একটা ব্যাচ শেষ হলো। এখনই শুরু হবে একটা।’ জবাব দিয়ে ছেলেটা নিজের সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
    দু’তলায় উঠল মৃত্যুঞ্জয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই বাঁ দিকে একটা বড় হল ঘর, বেশ বড়। টেবিল চেয়ার পাতা ঘরময়। সামনের দেয়ালে ব্ল্যাক বোর্ড। মৃত্যুঞ্জয় দেখলো ছাত্ররা নিজের নিজের স্থান গ্রহণ করছে। ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে পাতা চেয়ারে হাতে এক মোটা বই নিয়ে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। তিনি হয়তো পঙ্কজ চৌধুরী। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ ঊর্ধে, এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, অর্ধেক থেকে বেশি সাদা। মাঝারি উচ্চতা, রোগা ছিপছিপে চেহারা এবং গায়ের রংটা একটু কালোর দিকে। মৃত্যুঞ্জয় এগিয়ে গেলো তার দিকে। নমস্কার করে জিজ্ঞেস করলো- ‘আপনি কি পঙ্কজ চৌধুরী?’
    ভদ্রলোক খানিক হাঁ করে তাকালেন মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে।
    ‘হ্যাঁ, আমি।’ চাপা কন্ঠে বললেন তিনি।
    ‘আপনাকে ডিস্টার্ব করার জন্য ক্ষমা চাইছি, অত্যন্ত প্রয়োজনে আপনার কাছে এসেছি। দয়া করে একটু বাইরে আসবেন? দরকারী কথা আছে।’
    ছাত্রদের অপেক্ষা করতে বলে পঙ্কজ চৌধুরী বেরিয়ে এলেন মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে। সিঁড়ির মুখের কাছে দাঁড়িয়ে কথা হলো তাদের।
    মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘জানি আপনার সময় অনেক মূল্যবান, তাই বেশি সময় নেবো না আমি। আমি শুধু এক জনের বিষয় জানতে আপনার কাছে এসেছি।’
    ‘কার বিষয়?’ পঙ্কজ জিজ্ঞেস করলেন।
    ‘আপনি বিকাশ পান্ডেকে চেনেন?’
    ‘বি….কা…শ পান্ডে!’ মনে করার চেষ্টা করলেন পঙ্কজ চৌধুরী।
    ‘হ্যাঁ, বিকাশ পান্ডে। বাড়ি দানাপুর, সগুনা মোড়। প্লিজ মনে করুন।’
    ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আসলে বিকাশ পান্ডে নামের এক আরও ছাত্র ছিলো আমার । তাই গুলিয়ে ফেলছিলাম আর কি।’
    ‘কী জানেন তার বিষয়?’
    ‘বিকাশ ওয়াস এ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। আপনি তো বুঝতেই পারছেন যে আমি সায়েন্স পড়াই। কেমেস্ট্রিতে খুব ভালো ছিলো সে। খুব ভালো বলতে এক্সট্রা অর্ডিনারি ব্রিলিয়ান্ট। অনার্সে 80%এর ওপর নম্বর পেয়েছিল। তাতেও সে খুশি হয়নি। আমাকে বলেছিল সে নাকি আরও বেশি আশা করেছিল।’ উৎসাহিত হয়ে বললেন পঙ্কজ চৌধুরী।
    ‘সে এখন কী করছে?’ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘জানি না। দু’ হাজার বারোর ব্যাচ ছিলো। তার পর দুু’ এক বার দেখা হয়েছে ঠিকই কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে আর দেখা নেই।’
    ‘আচ্ছা, তাদের বাড়িতে কে কে আছে জানেন কী?’
    ‘না। তা জানি না।’
    ‘বাড়ির আর্থিক অবস্থার বিষয় কোনো ধারনা?’
    খানিক ভেবে পঙ্কজ চৌধুরী বললেন- ‘আমার অনুমান আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। ইনস্টিটিউটের ফি জমা করতে প্রায় দেরি করতো। ভালো ছাত্র ছিলো, তাই আমি কনসিডার করতাম।’
    ‘তার বাবা কী করেন জানেন কী?’
    ‘না মশাই। বলতে পারবো না।’
    ‘একটা শেষ প্রশ্ন। প্রতীক নেলসনের নাম শুনেছেন কী?’
    ভদ্রলোক আবার চিন্তা করলেন।
    ‘না। শুনিনি।’
    এক দীর্ঘস্বাস ফেলে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘থ্যাংক ইউ স্যার। আপনি আমার অনেক হেল্প করলেন।’
    পঙ্কজ চৌধরী আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন- ‘বিকাশ কোনো প্রবলেমে নেই তো?’
    ‘এখন পর্যন্ত না। ধন্যবাদ, আসি।’ মৃত্যুঞ্জয় চলে গেলো সেখান থেকে।

     

    চলবে……………

  • ধারাবাহিক

    ক্ষত (পর্ব – ১)

    ক্ষত
    -বিশ্বদীপ মুখার্জী

     

     

    পর্ব – ১

    বেশ কিছু দিন হলো পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বিহারে ঠাঁই নিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়। নিজের প্রায় বারো বছরের কর্মজীবনে বলতে গেলে কোনো দিনই মানসিক শান্তি পায়নি সে। চারিদিকে রহস্য নিজের ডালপালা গজিয়ে রাখলে শান্তি জুটবেই বা কোত্থেকে? চব্বিশ বছর বয়স ছিলো মৃত্যুঞ্জয়ের যখন সে আই.পি.এস.-এর চাকরীটা পায়। তার পর থেকে শুধু আর শুধু কাজ। এক বিয়ের বাড়িতে প্রভার সাথে তার আলাপ, তার পর বন্ধুত্ব…. প্রেম, অবশেষে বিয়ে। তাদের সাংসারিক জীবন মাত্র দু ‘ বছরের । প্রভা ছেড়ে চলে যায় তাকে । বহু দূরে , এতো দূরে যেখান থেকে ফিরে আসা আর সম্ভব হয়ে না । তার পর চাকরী থেকে ত্যাগপত্র দেওয়া , কোলকাতা ছেড়ে মৃত্যুঞ্জয়ের চলে যাওয়া , সে অনেক ঘটনা । এখন সে পছন্দ করে একাকীত্ব । সে থাকতে চায় রহস্যের জটিল দুনিয়া থেকে বহু দূর । কিন্তু যেটা সে চায় , সেটা পায়ে না । মৃত্যুঞ্জয় খুব ভালোই বুঝতে পেরেছিল যে পশ্চিমবঙ্গে থাকলে সে মানসিক শান্তি পাবে না । তাই আপাতত কিছু দিনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিদায় নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। সুপ্রতীক অধিকারী মৃত্যুঞ্জয়ের ব্যাচমেট। এখনও সে সি.আই.ডি. তে কার্যরত। মৃত্যুঞ্জয় জানে সুপ্রতীকের পৈতৃক ভিটে বিহারে। সেখানে কিছু দিন গিয়ে থাকলে কেমন হয়? সেখানে সর্বক্ষণ তাকে রহস্য তো আর তাড়া করে বেড়াবে না। সেখানে মৃত্যুঞ্জয়কে কেউ চেনে না। থাকা যাবে বেশ কিছুদিন নিশ্চিন্তে। সুপ্রতীককে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে সে বলল- ‘যত দিন খুশি সেখানে থাক। কিন্তু নিরিবিলি পাবি না।’
    ‘কেন?’ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘আসলে সেই বাড়িতে কেয়ারটেকার ছাড়া ভাড়াটেও থাকে। দু’টো পরিবার। এক পরিবার অবাঙালী আর এক পরিবার বাঙালী।’
    ‘অসুবিধে হবে না।’
    ‘ঠিক আছে। কেয়ারটেকারকে আমার ঘরটা পরিস্কার করে দিতে বলছি।’
    দশ দিনের ওপর হয়ে গেলো মৃত্যুঞ্জয় পাটনাতে আছে, সুপ্রতীকের পৈতৃক বাড়িতে। বাড়িটা যেখানে, সেখানে বাঙালীদের সংখ্যা বেশ ভালোই। বাড়ি থেকে অল্প দূরেই মা কালীর এক প্রাচীন বড় মন্দির, যেটা ইয়ারপুর কালী বাড়ির নামে বিখ্যাত। মন্দির থেকে একটু এগিয়ে গেলেই এক বড় পুকুর, কচ্চি তালাব নামে লোকেরা সেই পুকুরকে চেনে। আশেপাশে বাজারে ভরা। বলতে গেলে বাড়িটা খুব ভালো জায়গায় অবস্থিত।
    বাড়ি টা দু’তলা । নীচের তলায় ভাড়াটে থাকে এবং ওপরতলায় বেশ অনেকগুলো ঘরের মধ্যে একটা ঘরে মৃত্যুঞ্জয়, বাকি ঘরগুলো তালা দেওয়া। পুরনো আমলের বাড়ি, কিন্তু যত্নে আছে সেটা দেখেই মনে হয়। নীচের ভাড়াটের মধ্যে এক শ্রীবাস্তব পরিবার এবং এক সান্যাল পরিবার। শ্রীবাস্তব পরিবারে স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের পাঁচ বছরের এক ছেলে। আলোক শ্রীবাস্তব পাটনাতেই এক ব্যাংকে কাজ করে। বলতে গেলে মিশুকে নয় তারা। মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে যেচে পরিচয় করেছিলেন সন্দীপ সান্যাল। সান্যাল পরিবারে সন্দীপ সান্যাল ছাড়া সদস্য আরও দু’জন, তাঁর স্ত্রী মালতী সান্যাল এবং চব্বিশ, পঁচিশ বছরের তাঁদের কন্যা অন্বেষা সান্যাল। বেশ হাসিখুশি মিশুকে পরিবার। সন্দীপ সান্যাল কাজ করেন পাটনার জেনারেল পোস্ট অফিসে। অবসরের এখনও দু’বছর আছে। ছুটির দিনে প্রায় মৃত্যুঞ্জয়ের ঘরে এসে জমিয়ে আড্ডা দেন। আলোচনা হয় বিহারের পুরাতন ইতিহাস নিয়ে। মৃত্যুঞ্জয় নিজের পরিচয় দিয়েছিল এক রিসার্চ স্কলার বলে। সে বিহারে এসেছে বিহারের প্রাচীন ইতিহাসের বিষয় রিসার্চ করতে। মৃত্যুঞ্জয় বুঝতে পেরেছিল সান্যালবাবুর প্রাচীন ইতিহাসের বিষয় জ্ঞান অনেক।
    রবিবার। আজ দুপুরে মৃত্যুঞ্জয়ের নেমন্তন্ন। অন্বেষার জন্মদিন আজ। সান্যাল বাবু গতকালই মৃত্যুঞ্জয়কে নিমন্ত্রণ করে গিয়েছিলেন। এতো দিনে মৃত্যুঞ্জয় একটা জিনিস লক্ষ করেছিল যে অন্বেষার ডিটেকটিভ গল্প পড়ার খুব শখ। তাই সন্ধ্যেবেলায় বেরিয়ে অনেক খুঁজে অন্বেষাকে দেওয়ার জন্য শার্লক হোমসের এক রচনা সমগ্র কিনে এনেছিল। বইটা অন্বেষাকে দিতেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো সে।
    ‘থ্যাংক ইউ মৃত্যুঞ্জয়দা। থ্যাংক ইউ সো মাচ। আসলে জানো, আমার কাছে অনেক বই আছে, কিন্তু শার্লক হোমসের স্টোরি কালেকশন নেই। আজ সেটাও হয়ে গেলো।’ আনন্দের স্বরে অন্বেষা বলল।
    ‘জানি, লক্ষ্য করেছিলাম। তোমার বুক সেল্ফে অনেক বই দেখেছি, শুধু এটাই দেখিনি।’ বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘বাঃ, তোমার দৃষ্টি তো প্রখর। জাস্ট লাইক এ ডিটেকটিভ।’
    অন্বেষার কথায় অট্টহাস্য করলো মৃত্যুঞ্জয়।
    দুপুরের খাওয়া শেষ হওয়ার পর অন্বেষা মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে গেলো নিজের ঘরে। অন্বেষাকে দেখতে সুন্দর, স্মার্ট এবং এক বেসরকারী কোম্পানীতে কাজ করে সে। অসুবিধে এটাই হলো যে, সে কথা বলে একটু বেশি। খাবার টেবিলে বসেও রহস্য গল্পের বিষয় মৃত্যুঞ্জয়ের সাথে অনেক আলোচনা হলো। তারপর নিজের বই দেখাতে মৃত্যুঞ্জয়কে নিয়ে গেলো নিজের ঘরে। বইগুলো দেখতে দেখতে মৃত্যুঞ্জয় তাকে জিজ্ঞেস করলো- ‘তোমার দেখছি খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি অনেক টান আছে?’
    অন্বেষা খাটে বসে মৃত্যুঞ্জয়ের দেওয়া শার্লক হোমসের বইটা ঘেঁটে দেখছিল। মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে চোখ তুলে বলল- ‘বলতে পারো টানটা ইদানীং হয়েছে।’
    বইটা খাটে রেখে মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে এসে বলল- ‘আসলে বলতে পারো জানার আগ্রহ। একটা বিশেষ জিনিস জানার আগ্রহ।’
    ‘কী সেটা?’
    ‘স্টিগমাটা।’
    ‘স্টিগমাটা! হঠাৎ!’ চমকে উঠল মৃত্যুঞ্জয়। তার হাতে খ্রিস্টান ধর্ম বিষয়ক একটা বই।
    দু’জনেই খাটে এসে বসলো। আচমকাই অন্বেষার মুখটা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলো।
    ‘ব্যাপার কী অন্বেষা?’ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
    ‘আসলে বেশ কিছু দিন ধরে স্টিগমাটার বিষয় জানার ইচ্ছে হয়েছে। আগে স্টিগমাটার নাম শুনেছিলাম, কিন্তু ডিটেলস জানতাম না। জানার ইচ্ছেটা হলো আমাদের অফিসের এক ছেলের কারণে।’
    ‘কোন ছেলে?’
    ‘প্রায় ছ’মাস হলো ছেলেটা আমাদের অফিসে জয়েন করেছে। নাম প্রতীক নেলসন। খ্রিস্টান। চুপচাপ থাকে বেশিরভাগ। নিজের কাজের সাথে মতলব রাখে। কিন্তু ছেলেটা বাকি পাঁচটা ছেলের মতো সাধারণ নয়। ছেলেটার মুখে, হাতে কাটা-ছেঁড়ার অজস্র দাগ। প্রায় রোজ দেখি কখনও তার হাতে ব্যান্ডেজ কিম্বা কপালে স্টিচ। অফিসে এটা নিয়ে খুব আলোচনা হয়। তাকে বহু বার এমন স্টীচের কারণ জিজ্ঞেস করা হয়েছে। কিন্তু সে একটি কথা বলে যে এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ঠিক যেন মনে হয়ে তাকে রোজ কেউ মারধর করে। আমাদের বস বলেছে যে কারণ না বললে তাকে চাকরীতে রাখা মুশকিল হবে। কিন্তু সে তাও কিছু বলেনি। বস তাকে রাখতে বাধ্য, কেন কি সে কাজ ভালো করে। তার শরীরের আঘাতের দাগগুলো সত্যি রহস্যময়।’
    মৃত্যুঞ্জয় ভ্রুকুটি করে কথাগুলো শুনছিলো। খানিক বিরতি নিয়ে অন্বেষা আবার বলতে শুরু করলো- ‘আমি একবার শুনেছিলাম যে কিছু কিছু খ্রিস্টানদের শরীরে আপনি আঘাত লাগে। শরীরে অনেক জায়গায় নাকি কেটে যায়, রক্তক্ষয় হয়। সেটাকেই নাকি স্টিগমাটা বলে। ডিটেলস জানতাম না। তাই ডিটেলস জানার জন্য কিছু বই কিনলাম। কিন্তু এখনও পড়বার সুযোগ করতে পারিনি।’
    এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘এখনো পর্যন্ত স্টিগমাটাকে একটা মিথ বলেই মানা হয়। এর বিষয় যা কিছু তথ্য পাওয়া গেছে সেটার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে যে স্টিগমাটা সাধারণ লোকের হয় না। যারা প্রিস্ট অথবা যীশুর পরম ভক্ত হয়, তাদের শরীরে নাকি স্টিগমাটা দেখা দিয়েছে। স্টিগমাটার ঘায়ের এক রকম বিশেষত্ব থাকে। যীশুকে ক্রুুশিফাই করার সময় তাঁর সর্বাঙ্গে যেমন প্রকারের ঘা দেওয়া হয়েছিল, ঠিক তেমনই ঘা স্টিগমাটাইজ লোকেদের আসে। যেমন দু’টো হাতের এবং দু’টো পায়ের চেটোতে পেরেক ঠুকবার দাগ। আসলে এখানেও একটা ভুল ধারণা আছে। হাতের চেটোতে পেরেক ঠুকে কাউকে ক্রুসে ঝোলানো সম্ভব না। পেরেকের আঘাত দেওয়া হয়েছিল যীশুর দুই রিস্টে। স্টিগমাটাটা আসলে রিস্টে আসে। তার পর পিঠে চাবুকের ঘায়ের দাগ, মাথায় কাঁটার মুকুট পরানোর ঘায়ের দাগ। স্টিগমাটার বিষয় একটা কথা সবসময় মনে রাখবে অন্বেষা, শেষ স্টিগমাটা যীশুর কোনো ভক্তের অথবা প্রিস্টের আসে না।’
    ‘শেষ স্টিগমাটা মানে?’ জিজ্ঞেস করলো অন্বেষা।
    ‘মানে, যীশুর শরীরের শেষ আঘাত। যে আঘাত তাঁর পেটের কাছে দেওয়া হয়েছিল, বল্লম দিয়ে। যে আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়। বলা হয়ে নাকি সেই স্টিগমাটা প্রভু নিজের ভক্তদের দেন না। সেটা দিলে ভক্তের প্রাণ চলে যেতে পারে।’
    খানিক কি সব চিন্তা করে অন্বেষা বলল- ‘না, প্রতীক নেলসনের ঘায়ে কোনো বিশেষত্ব আছে বলে তো মনে হয় না। সাধারণ মাথা ফাটা, হাত কাটা, গাল কাটা যেমন হয়ে থাকে, তেমনই। তাহলে সেটা স্টিগমাটা নয়?’
    মাথা নেড়ে না বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘তাহলে কি কেউ তার ওপরে কন্টিনিউ টর্চার করছে? কিন্তু সে সেটাকে এক নাগাড়ে সহ্য করবেই বা কেন? না মৃত্যুঞ্জয়দা, কিছু একটা রহস্য তো আছেই এর ভেতর।’
    এখানেও রহস্য! অন্বেষার কথায় মৃত্যুঞ্জয় শুধু মৃদু হাসলো, বলল না কিছু।
    ‘না মৃত্যুঞ্জয়দা, এই ব্যাপারটাকে এমনভাবে ফেলে দেওয়া চলে না।’ বলল অন্বেষা।
    ‘কী করতে চাও তুমি?’ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘জানি না আমি কী করতে পারবো। কিন্তু প্রতীককে সেই অজানা লোকের টর্চারের হাত থেকে বাঁচানো উচিত। কম করে মনুষত্বের খাতিরেও। আর, তোমার কী মনে হয়ে মৃত্যুঞ্জয়দা, সেই অজানা লোকটার শাস্তি হওয়া উচিত নয়? দিনের পর দিন এক জনের ওপর সে টর্চার করে যাচ্ছে।’
    ‘সে সব তো ঠিক আছে অন্বেষা, কিন্তু সব থেকে আগে প্রতীক নেলসনের আঘাতের কারণ জানতে হবে। টর্চার ছাড়া অন্য কারণও তো হতে পারে?’
    ‘অন্য কারণ?’ অবাক হলো অন্বেষা- ‘কী অন্য কারণ হতে পারে?’
    ‘সেটা এখানে বসে বলা সম্ভব নয়। তুমি যদি প্রতীকের জন্য কিছু করতে চাও তাহলে সব থেকে আগে তার শরীরে আঘাতের কারণ জানার চেষ্টা করো। তুমি যেটা বলছো সেটা হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে।’
    গম্ভীর মুখ করে বসে রইল অন্বেষা। যেন কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। কোনো এক অজানা কারণে তার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে মৃদু হাসছে মৃত্যুঞ্জয়। হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করলো- ‘অন্বেষা, তুমি কি এই ব্যাপারে তদন্ত করতে চাও নাকি?’
    মৃত্যুঞ্জয়ের এহেন প্রশ্ন শুনে চমকে উঠল অন্বেষা। কি বলবে ভেবে পেলো না। আবার কিছু চিন্তা করে বলল- ‘ভালো বলেছো তুমি এটা মৃত্যুঞ্জয়দা। এ বিষয় যদি আমি তদন্ত করি তাহলে মন্দ হয়ে না।’
    ‘একেবারে মিসেস মার্পল কিম্বা ন্যান্সি ড্রিউ।’
    দুটো বিখ্যাত ডিটেকটিভের সাথে নিজের তুলনা শুনে ঈষৎ লজ্জা পেলো অন্বেষা।
    ‘ধ্যাৎ, কী যাতা বলো না তুমি।’
    ‘লেগে পড়ো। কিন্তু সাবধান, তদন্তের পথে কিন্তু কাঁটার অভাব নেই।’
    রাত প্রায় সাড়ে দশটা। মৃত্যুঞ্জয় নিজের ঘরে পায়চারি করছে এবং দ্রুত সিগারেটে টান দিয়ে যাচ্ছে। মনটা চঞ্চল তার। এমন ভাবে অন্বেষাকে তদন্তের জন্য উস্কে দেওয়াটা ঠিক হয়েনি। সে জানে যে কোনো রহস্যের তদন্ত করতে গেলে বহু প্রকারের বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। অন্বেষার অল্প বয়স, রক্ত গরম, সে হয়তো বিপত্তির কথা চিন্তাই করবে না। না, খুব ভুল করে ফেলল মৃত্যুঞ্জয়। হঠাৎ সে স্কুটির আওয়াজ শুনতে পেলো। এ আওয়াজ সে চেনে। অন্বেষার স্কুটি। এতো রাতে অন্বেষা যাচ্ছে কোথায়? ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলো মৃত্যুঞ্জয়। দেখলো, অন্বেষা নিজের স্কুটিতে বসে কোথাও বেরিয়ে গেলো। কোথায় গেলো সে। মৃত্যুঞ্জয়ের মুখে চিন্তার ছায়া স্পষ্ট। সে দ্রুত কদমে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে সান্যালবাবুর ঘরের বন্ধ দরজায় টোকা দিলো। সান্যালবাবু দরজা খুলতে তাঁকে মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো- ‘এতো রাতে অন্বেষা কোথায় গেলো?’

    ঈষৎ ঘাবড়ে গেলেন সান্যালবাবু । বললেন – ‘ওর এক বান্ধবীর নাকি খুব শরীর খারাপ। সেখানেই গেলো।’
    অন্বেষা সত্যি বলেছে তো? নাকি, বান্ধবীর শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে তদন্ত করতে?

    সান্যালবাবু ঘাবড়ে গেলেন।
    ‘কেন, কিছু হয়েছে?’
    নিজের মনের সন্দেহটা সান্যাল বাবুর সম্মুখে প্রকাশ করতে পারলো না মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘না, কুছু নয়। এতো রাতে বেরলো তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি। রাতে কি ফিরবে অন্বেষা?’ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
    ‘না বাবা। রাতে আর ফিরবে না। যার বাড়ি গেছে, তার বাড়িতেই রয়ে যাবে।’
    ‘ঠিক আছে। আপনি শুয়ে পড়ুন।’
    মৃত্যুঞ্জয় নিজের ঘরে ফিরে এলো। মনের সন্দেহটা ক্রমে প্রবল হয়ে যাচ্ছে তার। অন্বেষাকে এক বার ফোন করা কি উচিত? ফোন করলেও অন্বেষা মৃত্যুঞ্জয়কে সেই কথাই বলবে যে সে নিজের বাবাকে বলেছে। যে বান্ধবীর বাড়ি যাওয়ার কথা অন্বেষা নিজের পিতাকে বলেছে, তার ঠিকানা পেতে পারতো মৃত্যুঞ্জয়। তার বাড়ি গিয়ে জানতে পারতো অন্বেষার এতো রাতে বাড়ি থেকে বেরোবার উদ্দেশ্য কী। কিন্তু সান্যালবাবুর কাছ থেকে ঠিকানা চাওয়া উচিত মনে করলো না মৃত্যুঞ্জয়। ভদ্রলোক চিন্তায় পড়ে যাবেন। প্রতীক নেলসনের ঠিকানাও জিজ্ঞেস করা হয়েনি। নাতো মৃত্যুঞ্জয় সোজা সেখানেই চলে যেতো। কী করবে কিছু ভেবে না পেয়ে মৃত্যুঞ্জয় নিজের মোবাইল উঠিয়ে কল করলো অন্বেষাকে। বেশ কিছু বার রিং হলো, কিন্তু অন্বেষা ফোন তুললো না। মৃত্যুঞ্জয়ের চিন্তা বৃদ্ধির জন্য অন্বেষার ফোন রিসিভ না করাটা যথেষ্ট ছিলো। না, আজ রাতে আর ঘুম হবে না মৃত্যুঞ্জয়ের। জানালা খুলে অন্ধকার রাত্রে আকাশের চাঁদ ও তারা দেখেই তার সম্পূর্ণ রাত কাটবে। আজকের রাত যেন একটু বেশি লম্বা। মাঝে মাঝে নিজের মোবাইলে সময় দেখে নিচ্ছে মৃত্যুঞ্জয়। সময় যেন এগোতেই চায় না। গভীর রাত যখন নিজের পা বাড়িয়ে ভোরের পানে অগ্রসর হতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই মোবাইল বেজে উঠল মৃত্যুঞ্জয়ের। সে দেখলো অন্বেষার ফোন।
    ‘হ্যালো!’
    ‘তুমি জেগে আছো? আসলে দেখলাম তোমার ফোন এসেছিল। তখন বিজি ছিলাম তাই রিসিভ করতে পারিনি। এখন ফ্রি হয়েছি, তাই ভাবলাম তোমায় কলব্যাক করে দেখি।’  কথাগুলো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো অন্বেষা।
    তুমি আছো কোথায় এখন?’ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়। 

    ‘আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে। তার শরীর খারাপ ছিলো তাই এসেছি।’
    মৃত্যুঞ্জয় ঠিকই ভেবেছিলো, অন্বেষা যে কথা নিজের বাবাকে বলেছে সে কথাই মৃত্যুঞ্জয়কে বলল

    ‘ঠিক তাই তো? নাকি অন্য কোনো ব্যাপার?’
    মৃত্যুঞ্জয়ের মুখে আচমকা এহেন প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেলো অন্বেষা। খানিক চুপ থাকলো সে। তাকে চুপ থাকতে দেখে মৃত্যুঞ্জয় বলল- ‘তার মানে আমার ধারণাটা ঠিক। গতকাল দুপুরে আমাদের কথোপকথন আর রাতে তোমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়াতেই আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। আর ইউ অল রাইট নাও?’

    হ্যাঁ, মৃত্যুঞ্জয়দা। আমি ঠিক আছি। এখন বান্ধবীর বাড়িতেই আছি। সেও ছিলো আমার সাথে। সকালে ফিরছি। ফিরে সব বলছি তোমায়।’ চাপা গলায় বললো অন্বেষা।

    সকাল প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ অন্বেষা এলো মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে। একটা চেয়ারে বসতেই মৃত্যুঞ্জয় তাকে বলল- ‘ভুলটা আমারই হয়েছিল। তোমাকে এমন ভাবে তদন্তের বিষয় বলাটা ঠিক হয়েনি।’
    ‘এতে ভুলের কী আছে মৃত্যুঞ্জয়দা? সত্যি বলতে এই বিষয়টার প্রতি আমার ইন্টারেস্ট আগে থেকেই ছিলো। নাতো আমি স্টিগমাটার বিষয় জানার জন্য খ্রিস্টান ধর্মের বই গুলো কিনতাম কেন? আর একটা কথা তো বলতেই হয়ে মৃত্যুঞ্জয়দা, তোমার অবজার্ভেশন পাওয়ারটা দুর্দান্ত। রাতে আমাকে বাইরে বেরোতে দেখে এটা আন্দাজ করে নেওয়া যে আমি প্রতীক নেলসনের আঘাতের বিষয় ইনভেস্টিগেশন করতে যাচ্ছি, জাস্ট ওসাম। তোমার রিসার্চ স্কলার না হয়ে ডিটেকটিভ হওয়া উচিত ছিলো।’
    নিজের প্রশংসা শুনতে ভালো লাগে না মৃত্যুঞ্জয়ের। কিন্তু অন্বেষার সাহসের তারিফ নিজের মনে না করে সে থাকতে পারলো না। সত্যি, মেয়েটার সাহস আছে।
    অন্বেষার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসলো মৃত্যুঞ্জয়। তাকে জিজ্ঞেস করলো- ‘কিছু জানতে পারলে?’
    অন্বেষা উৎসাহ নিয়ে বলতে আরম্ভ করলো- ‘তোমাকে শুরু থেকে বলি। আমাদের অফিসেই একটা মেয়ে আছে, নাম রাধিকা মেহেতা। সে আবার কোনো অজ্ঞাত কারণে প্রতীককে নিজের মন দিয়ে বসেছে। প্রতীকের শরীরে এমন আঘাতের কারণে সেও চিন্তায় থাকে। অফিসে প্রতীক কারুর সাথে যদি দু’চারটে কথা বলে তো সে একমাত্র রাধিকা। কিন্তু সে রাধিকাকেও নিজের আঘাতের কারণ জানায়নি। গত কাল তোমার সাথে কথা হওয়ার পর রাধিকার সাথে এই বিষয় ডিটেল্সে কথা হলো আমার। নিজের শরীরে আঘাতের কারণ প্রতীক এমনিতে বলবে না সেটা বুঝতে আর বাকি ছিলো না। তাই আমরা প্ল্যান করলাম যে রাতের নিরিবিলিতে প্রতীকের বাড়ির আশেপাশে থেকে তার শরীরে আঘাতের কারণ জানবো । কাজে রিস্ক ছিলো আর সাথে ছিলো এক অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চার । তাই আর দু’বার ভাবলাম না। বেরিয়ে পড়লাম রাতে স্কুটি নিয়ে।’
    ‘প্রতীকের বাড়ি কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলো মৃত্যুঞ্জয়।
    ‘এখান থেকে একটু দূর। জায়গাটার নাম, কংকড়বাগ কলোনী। কলোনীর এক গলিতে শেষ বাড়ি। এক তলা ছোট বাড়ি। প্রতীক ভাড়াটে। বাড়িওয়ালা থাকে না। বাড়ি ঘেরা পাঁচিলটা প্রায় চার ফুটের। আমরা নিঃশব্দে আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। বাড়ির সামনে একটা বাইক দাঁড়িয়ে আছে সেটা আগেই লক্ষ করেছিলাম। বাড়ির ভেতর থেকে আবছা আবছা গলার আওয়াজ ভেসে আসছিল। এক নয়, দু’জনের। সিওর হয়ে গেলাম যে বাড়ির ভেতর প্রতীক ছাড়া আরও এক জন কেউ আছে। তারা কী বলছিল সেটা ঠিক শুনতে পেলাম না। কিছুক্ষণ পর বাড়ি থেকে কেউ বেরলো। অন্ধকারে তাকে চিনতে পেলাম না। বাইকে বসে আমাদের ঠিক উল্টো দিকে চলে গেলো।’
    ‘বাইকের নম্বরটা নোট করেছো?’
    দাঁত দিয়ে নিজের জিভ কাটলো অন্বেষা।
    ‘ইশ…. নোট করা হয়েনি।’
    ‘ঠিক আছে। তার পর?’
    ‘পুরো বাড়িতে একটি ঘরে লাইট জ্বলছিলো। জানালা বন্ধ ছিলো। জানালার ঠিক ওপরে একটা ভেন্টিলেটর আছে। সেই ভেন্টিলেটরের কারণেই বোঝা যাচ্ছিলো যে ঘরে লাইট জ্বলছে। খানিক পর ঘর থেকে হঠাৎ গানের শব্দ পেলাম। মিউজিক সিস্টম চালানো হলো। কিন্তু সেই গানের আওয়াজের মধ্যেও কারুর গলার শব্দ আমি পাচ্ছিলাম। সেটা এক জনের কি দু’জনের বলা শক্ত। মশার কামড়ে বেশ অনেকক্ষণ আমাদের সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। তারপর গানের আওয়াজের মধ্যেই কানে এলো বাসনের আওয়াজ। কিছু বাসন যেন মাটিতে পড়লো। তার কিছুক্ষণ পরেই চিৎকার। এক প্রকারের চাপা আর্তনাদ। ঠিক মনে হলো যেন কেউ তাকে জখম করছে। যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে সে। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে সেই শব্দ আমরা শুনতে পেলাম। রাধিকা আর সহ্য করতে পারছিলো না। ছুটে সে বাড়ির ভেতর যেতে চাইলো। আমি বাধা দিলাম। চাপা আর্তনাদের শব্দ বন্ধ হওয়ার প্রায় ঘন্টা খানেক পর ঘরের লাইট নিভে গেলো। তার পর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমরা আরও প্রায় এক ঘন্টা অপেক্ষা করলাম। যদি আরও কিছু জানতে পারি, এই আশায়। কিন্তু কিছুই হলো না আর। অগত্যা ফিরে এলাম আমরা। আমার সন্দেহ যেই লোকটা বেরিয়ে গেলো সে সব জানে, এবং তার বেরিয়ে যাওয়ার পরেও বাড়িতে প্রতীক ছাড়া আরও এক জন ছিলো । নাতো প্রতীক কথা বলতো কার সাথে? গানের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পেলাম, মৃত্যুঞ্জয়দা।’

    মৃত্যুঞ্জয় এতক্ষণ ঘাড় হেঁট করে অন্বেষার কথা শুনছিলো। এবার চেয়ার থেকে উঠে খোলা জানালার কাছে গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল- ‘গানটা বাজানো হয়েছিল আঘাত আর চাপা যন্ত্রণার শব্দকে দাবিয়ে রাখার জন্য। ঘরের ভেতর কী হচ্ছে সেটা যেন আশেপাশের লোকেরা যেন বুঝতে না পারে। প্রতীকের বাড়ি কোথায়?’
    একটু চিন্তা করে অন্বেষা বলল- ‘যত দূর মনে হয়ে সমস্তিপুরে। এখান থেকে বাসে করে গেলে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা।’
    ‘তোমার আজ অফিসে গিয়ে দুটো কাজ আছে। প্রথম, প্রতীকের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করো, আর দ্বিতীয়, ওর বাড়িতে কে কে আছে তার খোঁজ নাও।’
    ‘ঠিক আছে। আরও কিছু?’
    ‘রাধিকাকে মানা করে দিও গত রাতের কথা ভুলেও যেন প্রতীককে না বলে। আপাতত এই কাজগুলো তুমি করো, তার পর দেখছি আমি কী করতে পারি ।’
    কথা শেষ করে প্রায় অর্ধেক সিগারেটটা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো মৃত্যুঞ্জয়। জানালাটা বাড়ির পেছন দিকে। সেখানে গাছগাছালি ছাড়া এখন কিছুই নেই।
    ‘তুমি কি সাহায্য করবে মৃত্যুঞ্জয়দা?’ প্রায় লাফিয়ে উঠলো অন্বেষা।
    ‘হুম, করবো।’ গম্ভীর গলায় বলল মৃত্যুঞ্জয়।
    বিকেল প্রায় চারটে বাজে। কংকড়বাগ কলোনীর সেই গলিটার সামনে একটা পানের দোকানে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছে মৃত্যুঞ্জয়। দোকানে মৃত্যুঞ্জয় ভিন্ন আর অন্য কোনো গ্রাহক নেই। এই ফাঁকে দোকানিকে মৃত্যুঞ্জয় হিন্দীতে জিজ্ঞেস করলো- ‘তিওয়ারী সাহেবের বাড়িতে কে থাকে?’
    দুপুর একটা থেকে বিকেল চারটে। তিন ঘন্টা হয়ে গেলো মৃত্যুঞ্জয়ের এখানে আসা। সে জেনেছে, যে বাড়িতে প্রতীক নেলসন ভাড়া থাকে সেই বাড়ির মালিকের নাম, অনিরুদ্ধ তিওয়ারী। ভদ্রলোক স্বপরিবার উত্তরপ্রদেশের কানপুরে থাকেন। সেখানেই নাকি চাকরী করেন তিনি। পাটনার এই বাড়িটা তিওয়ারীজী’র বাবা বানিয়েছিলেন। বাড়িটা দীর্ঘদিন খালি পড়ে ছিলো। প্রায় দু’বছর। দু’বছর পর এক ছেলে এখানে এসে থাকতে শুরু করে। তার থাকতে আসার পর থেকেই শুরু হয়ে বিচিত্র কিছু ঘটনা। প্রত্যেক রাতে কেমন যেন অদ্ভুত শব্দ সেই বাড়ি থেকে বেরোয়। ছেলেটার সর্বাঙ্গে ক্ষতচিহ্ন দেখা যায়। আশেপাশের লোকেরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ হয়েনি। ভেবেছিল পুলিশে খবর দেবে, কিন্তু গাফিলতির দরুণ সেটা করা হয়েনি।
    পানের দোকানিটা বলল- ‘বাবু, আমি দোকান বন্ধ করি রোজ রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার ভেতর। ছেলেটা অফিস থেকে সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ফেরে। ঠিক তার কিছুক্ষণ পর একটা আরও ছেলে আসে।’
    ‘বাইকে করে?’ মৃত্যুঞ্জয় জিজ্ঞেস করলো।
    ‘হ্যাঁ বাবু, বাইকে। সেও হয়তো এক সাথেই থাকে।’
    ‘তার বিষয় কিছু বলতে পারবে তুমি?’
    খানিক চিন্তা করে দোকানি বলল- ‘বাড়ি ঢুকবার আগে আমার দোকান থেকে রোজ এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিয়ে যায়। তার চেহারা আমি দেখেছি। বয়স তিরিশের কাছাকাছি, রোগা চেহারা, মুখটা লম্বা, চাপচাপ দাড়ি আছে, আর হ্যাঁ, গলার আওয়াজটা কেমন যেন খ্যাসখ্যাসে।’
    ‘বাইকের নম্বরটা কোনোদিন লক্ষ করেছো?’
    ‘না বাবু।’
    মৃত্যুঞ্জয় দোকানির হাতে একশো টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে বলল- সে যখন রোজ আসে, আজকেও আসবে। তার বাইকের নম্বর নোট করে নেবে।’
    ‘জী বাবু। বহুত আচ্ছা।’ দোকানি খুশি খুশি সে টাকা নিয়ে নিলো।
    আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো মৃত্যুঞ্জয়। সূর্যের তাপ যখন কমে আসছে, তখন সে পা বাড়ালো প্রতীক নেলসনের বাসস্থানের দিকে। চার ফুটের পাঁচিল, ছ’ফুটের মৃত্যুঞ্জয়ের জন্য সেটা টপকে ভেতরে ঢুকতে বিশেষে অসুবিধে হবে না।

     

     

    চলবে…………..

<p>You cannot copy content of this page</p>