• কবিতা

    কবিতা- এখন আমি…

    এখন আমি…
    -রীণা চ্যাটার্জী

    এখন আমি চেরাপুঞ্জি
    বুকের ভেতর মেঘের পাহাড়
    যখন তখন বৃষ্টি নেমে
    জলছবিতে আমায় সাজায়।

    ঝরতে থাকে মাটির ‘পরে
    ভেজা মাটি সাক্ষ্য রাখে,
    ক্ষয়িষ্ণু সুখ কেঁদেছে কতো-
    নীরোদের ওই অঝোর ধারায়।

    ধুয়ে দিয়ে যায় বন জ্যোৎস্না,
    ভোরের আলো তা’ও ফিকে
    হারানো মন ভিজতে থাকে
    শিকড় থেকে শাখায়-শাখায়।

    একঘেয়েমির অবাধ্য সুর
    ওদের সুরে হাজারো কথা,
    দু’ একটা বেশ অন্যরকম
    চেরাপুঞ্জির কি আসে যায়!

    ভিজতে থাকে… ভিজবে বলে
    ভিজছে শিকড়, ভিজছে সেতু
    আগল খোলা আকাশ জুড়ে
    চেরাপুঞ্জি ভিজতে যে চায়।

  • কবিতা

    কবিতা- আবেগী আবেশ

    আবেগী আবেশ
    -রীণা চ্যাটার্জী

    ইচ্ছে করে…
    সব ফেলে এক ছুটে যাই তোমার কাছে;
    পাহাড়ি ঝর্ণার সাজে, আছড়ে পড়ি
    বুকের মাঝে, অভিমানী প্রাচীরগুলো
    ভেঙে ফেলে, মৌন মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে
    নালিশ করি…
    নালিশ করি কোলাহলের প্রবল স্বরে,
    একলা থাকার দুঃখ বারি ঝরিয়ে শেষে,
    জ্যোৎস্না হাসির আহ্লাদী মন মোম
    হয়ে যাক, গলতে থাকুক সোহাগ ঝড়ে
    খড়কুটো হোক…
    খড়কুটো হোক ঝড়ের মুখে সকল বাঁধন, সকল দ্বিধা, সোহাগ ঝড়ে আমরা কেবল মনের মিতা
    বাহুডোরে থাকবো যখন, প্রশ্ন হাজার
    অবহেলার।
    ফিরবে নালিশ..
    শতেক নালিশ চোখে-চোখে, আশ্বাসী দোঁহের স্পর্শসুখে;
    চন্দ্রকথায় আর বন্দিশী মূর্ছনায় স্বপ্ন তখন
    বন্দী, মুঠোর আল্পনায়। দহন শেষের ক্লান্ত প্রহর তৃপ্তসুখে।
    সালিশ হবে..
    সালিশ হবে, ভালোবাসার ঝর্ণাধারায় ভাসিয়ে নিয়ে..
    মিটবে যখন তোমার-আমার সকল চাওয়া
    আসবো ফিরে আবার জীবন-গানের মায়ায়
    বিশ্বাসের সেই পরম পাওয়ার আবেগ নিয়ে
    তোমার মাঝে খুঁজবো শুধুই তোমার আবেশ।

  • সম্পাদকীয়

    তিনটি মন্ত্র

    তিনটি মন্ত্র
    -রীণা চ্যাটার্জী

    “তিনটি মন্ত্র নিয়ে যাদের জীবন… দুঃখের পৃথিবীটা তাদের কাছে এক আনন্দ আশ্রম’
    বড়ো প্রিয় আর পরিচিত গানের কলি’র তিনটি মন্ত্রই আজ মিথ্যের জাদুকাঠিতে প্রায় অস্তাচলে। অবোধ বেলার আনন্দ আশ্রমটাও কেমন রূপ বদলাচ্ছে- অচেনা লাগছে।
    আশৈশব চেনা পৃথিবীটা বদলে যাচ্ছে, বড়ো দ্রুত তার গতি। আগে বুঝতাম না?
    না কি এখন তাল মেলাতে পারছি না?
    আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছেও শুনেছি-
    কি কাল এলো বাবা! ভালো-খারাপ বুঝতাম না তখন। এখন বুঝি ভাঁজগুলো বর্তমানের মতো এতো প্রকট ছিল না। যা ছিল তা বুদ্ধির সাথে মৃদূ চিন্তা বৃদ্ধি, আক্ষেপ, আশঙ্কা- কথার ছলে বলে যাওয়া এক প্রবাদ। আর এখন ঘুমন্ত অস্তিত্বের মাঝেও শুধুই প্রবল আশঙ্কা কড়া নাড়ে।
    সত্যের জায়গায় মিথ্যার আষ্ফালন, ধর্মের নামে অসহিষ্ণু, সুন্দরকে সাজো সাজো রবে ঢেকে রাখা- এই কি অবশেষ?
    “সত্যম শিবম সুন্দরম” মন্ত্রগুলো খুঁজতে থাকে মন, একটা আনন্দ আশ্রম ফিরে পেতে চায় জীবন শান্তিছায়ায়। আর উত্তরসুরীদের জন্য একটু নিরাপদ নির্ভরতার আশ্রয়। আশঙ্কার মেঘ ছেয়ে গেছে, ভয় তো ওদের নিয়েই। ভয় পেতে পেতে মরিয়া মনটা এক একদিন চীৎকার করে বলতে চায় মিথ্যে নির্লজ্জ ভাবে আঁধার নিয়ে আসতে পারে, কিন্তু সূর্যের মতো ধ্রুব, শাশ্বত হতে পারে না। সূর্যের তেজোদীপ্ত আলোয় মিথ্যাচারের আঁধার দূরীভূত হবেই। শঠতার আষ্ফালন মুখ লুকোবে সত্যের দৃঢ়তার কাছে। সুন্দর হয়ে উঠবে পৃথিবী- শত দুঃখ সয়ে ফিরে আসবে আনন্দ আশ্রম। অপেক্ষা কখনো অন্তহীন হতে পারে না, হয় না। তাই অপেক্ষায়, আশায় বুক বেঁধে রাখা।

    সকল শুভাকাঙ্ক্ষী ও প্রিয়জনের জন্য আবীর সুবাসিত ফাগুন শুভেচ্ছা আলাপী মন-এর পক্ষ থেকে। শুভ হোক আগামী।

  • গল্প

    গল্প- অন্ত-যাম

    অন্ত-যাম
    -রীণা চ্যাটার্জী

    আজ রাতেও শোনা গেল, ‘মালাইইই বরফফফ.. মাআলাই বরফ..’ আওয়াজটা আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেলো। গান আর ঘুঙুরের শব্দ ভেসে এলো। ঘড়িতে রাত তখন বারোটা। আবার শোনা যাবে ঠিক দু’ ঘণ্টা পর। অভ্যাস হয়ে গেছে এলাকাবাসীর ঘুমের মধ্যেই এই আওয়াজটা শোনার। কিন্তু মাসের ঠিক একটা দিন ‘মালাই বরফ’ ডাকের সাথে একটা কান্নার আওয়াজ তারপর আর্ত চিৎকার ভেসে আসে দূর থেকে। বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে পড়ে, কাঁদে। বয়স্করা শুয়ে থেকেও ভারী নিঃশ্বাস ফেলে। কৈশোর উৎসাহিত হয়ে ওঠে জানার জন্য- মনের আনাচে কানাচে প্রশ্নরা ভেসে বেড়ায়। জানতে চায় মা, ঠাকুমা, দাদু, কাকার কাছে। উত্তর আসে, বড়ো হও সব জানতে পারবে।
    এইসব সেই তখনকার কথা যখন কলকাতা আজকের কলকাতা হয়ে ওঠে নি। মেট্রোরেল, মাল্টিপ্লেক্স, শপিং মল, আইনক্স খুব অজানা শব্দ। তখন ভোরবেলার প্রথম ট্রামটা হরিনাম সঙ্কীর্তনের সাথে খঞ্জনী বাজাতে বাজাতে পুণ্যার্থীদের নিয়ে দিনের প্রথম নিস্তব্ধতা ভেঙে শহরের বুকে পা ফেলে যান্ত্রিক আওয়াজে এগিয়ে যেত গঙ্গার দিকে। আওয়াজ শুনে ঘরের কোনে ঘুমখোর গৃহবাসীরা আধবোজা চোখে নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তো।
    পাড়ার মোড়ে গুমটি চায়ের দোকানের উনুনে আগুন ধরিয়ে দোকানি ময়দা মাখতো হিং-এর কচুরির। কাঠ-কয়লার কালো ধোঁয়া সাদা ভোরের গায়ে আল্পনা দিতে দিতে মিলিয়ে যেতে বাতাসে। বাড়িতে বাড়িতে দরজা খুলে সদরে জল ঢালা হলে, বেলে পাথরের সিঁড়ি আর লাল রোয়াক জল ধোয়া হয়ে ভোরের শিউলির মতো একরাশ স্নিগ্ধতা নিয়ে অপেক্ষা করতো প্রতিবেশী-পথচারীদের জন্য। ভিস্ত্রিওয়ালা চামড়ার ব্যাগে জল ভরে পিঠে নিয়ে দিতে আসতো কিছু খ্রীষ্টান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বাড়িতে। বাজারের থলি হাতে বেড়িয়ে পড়তেন বাবুরা সকালের টাটকা সব্জি-মাছ কেনার জন্য। ফ্রীজ তখন প্রায় অচ্ছুত সাবেকি বাঙালী বাড়িতে। মাসী-কাকির হাতের ঝোলে-ঝালে-অম্বলে স্বাদ বদল হতো প্রায় প্রতিদিনই দুপুরের হেঁসেলে। হরেক ফেরিওয়ালার ডাকে দুপুর থেকে সন্ধ্যা সরগরম হয়ে থাকতো।
    তখন কলকাতা- আত্মীয়ের কলকাতা, আত্মার কলকাতা, আন্তরিকতার কলকাতা।

    এখন যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেন্ট্রাল মেট্রোরেল অফিস, সেটা তখন একটা একতলা এক বাজার। “সব পেয়েছির” ঠিকানা এলাকাবাসীর কাছে। ঠিক তার উল্টো দিকে বড়ো রাস্তা পেরিয়ে কিছু কিছু বাড়ি থেকে রাত বাড়লেই নাচ, ঘুঙুর, গানের আওয়াজ ভেসে আসতো। রাত বাড়তো, আওয়াজ বাড়তো। কৌতুহলী কৈশোর ঘুম চোখে জানলা দিয়ে চোখ বাড়াতো- মায়াবী নীল আলোয় ওড়নার আবছা প্রতিবিম্ব। বড়োদের চোখ এড়িয়ে দেখতে হতো- ওটা যে খারাপ জায়গা, এড়িয়ে চলতে হয়। সেটা বাড়িতে বাচ্চাদের আড়ে আড়ে বুঝিয়ে দেওয়া হতো আগে থেকেই বা বলা যায় জ্ঞান হওয়া থেকেই বুঝে যেত ওরা। অবশ্য কৌতুহল তাতে আরো বাড়তো- দুপুরের অবসরে আলোচনা জমে উঠতো কৈশোর মজলিসে। বয়সে একটু বড়ো মুরুব্বি দাদা, দিদিদের সংগ্ৰহে খবর একটু বেশিই থাকতো। চোখ গোল গোল করে, হাত নেড়ে, গলার স্বর খাদে নামিয়ে সেই খবর ছড়িয়ে পড়তো কানে কানে। কেউ বুঝতো, কেউ বুঝতো না- যে বুঝতো না তার জন্য বেদবাক্য, ‘তোকে বুঝতে হবে না, তোর মাথায় গোবর পোড়া.. মাথামোটা..’
    বিস্তর রাজনৈতিক চাপান-উতোর, আইনি জলঘেলা সেরে সদ্য একতলা বাজার বাড়িটা ভাঙা হয়েছে, মেট্রোরেল হবে। রাস্তার এপার- ওপার পরিস্কার দেখা যাচ্ছে এখন- তিনতলা বা ছাদে না উঠলেও।

    কৈশোরের কৌতুহলী চোখগুলোতে আজ উত্তেজনা ভরপুর। বাড়িতে আজ উৎসবের মেজাজ- বড়দা আজ ফিরেছে হোষ্টেল থেকে। দুপুরে ঠিক হয়েছে আজ রনি, বাচ্ছু, আমি, বড়দা একসাথে দোতলায় রাস্তার ধারের শোবো। রাতে আওয়াজ পেলে মিলি, রিমিদের ডেকে নেবে। আজ সবাই দেখবোই ওপারে কি হয়!
    ঘড়িতে রাত দুটো আবার শোনা গেল, ‘মালাইইই বরররফ, মালাইইফ বরফফফ..’
    বিছানা থেকে নিঃশব্দে উঠে জানলায় চোখ রাখলো বড়দা- আমরাও পিছু পিছু উঠে এলাম। রণি ফিসফিস করে বললো, ‘ওদের ডাকবো?’ বড়দা মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলেই আঙুল দিয়ে দেখালো দূরে.. দেখি মালাইবরফওয়ালা মাথায় লাল কাপড় চাপা দেওয়া হাঁড়ি নিয়ে ওপারের একটি বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। হঠাৎ করে ওই বাড়িতেই একটি জানলায় তখন নীল আলোর মায়াবী হাতছানি- পুরোনো বাড়ির জানলা। অনেকটাই খোলা, স্বচ্ছ পর্দার আবরণ দেওয়া। মেঝের গালিচা, কড়িকাঠে ঝাড়লন্ঠন সব দেখা যাচ্ছে- অচেনা অন্য জগৎ প্রায় অর্ধোন্মুক্ত। কৈশোরের উৎসাহের আতিশয্যে গলা আওয়াজ বেশ তুলেই বাচ্ছু বলে উঠলো, ‘এই জানলাটা তো বন্ধ থাকে! আজ খোলা?’ রণির পায়ের চাপে, বড়দার চুপ থাকার ইশারায় বাচ্ছু চুপ করে গেল। দরজায় খুট করে আওয়াজ হলো- মনে হয় রিমি, মিলি। আস্তে করে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। ওরা ঘরে ঢুকে এলো। হঠাৎ করে ওপারে গানের আওয়াজ তীব্র হয়ে উঠলো। সবার চোখ জানলায়।
    তারপর আচম্বিতে কান্নার এক তীক্ষ্ণ আওয়াজ। গান থেমে গেল, বাজনাও। তারপর একটি মেয়েলী গলার আর্তনাদ, সাথে সাথেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো মেয়েটি। ভালো করে দেখলো ওরা একটা নয় দুটি দেহ পড়ে আছে। একজনের বুকের ওপর আরো একটি দেহ। নীল আলোতেও দেখা গেল মেঝেতে রক্ত ভেসে যাচ্ছে। ঘরের আলো নিভে গেল। যেন সিনেমার পর্দা- যবনিকা পতন।
    আমাদের সবার তখন হাত-পা কাঁপছে। তাও আরো একবার তাকিয়ে দেখলাম। ওপারের জানলাটা যথারীতি বন্ধ। রিমি আমাদের ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিলো। এ-ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, সবার মুখ ফ্যাকাশে। ছোটকা উঠেছিল রাতে, এই বিশেষ রাতে এলাকার প্রায় সবার ঘুম ভেঙে যায়। ঘরে আলো জ্বলছে দেখে ছোটকা বাইরে থেকে জিজ্ঞেস করেন- কি রে এতো রাতে আলো জ্বালিয়ে রেখেছিস? ঘুমোস নি?
    ছোটকা’র গলার আওয়াজ শুনে আমরা যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। বড়দা কিছু বলার আগেই তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলো রিমি। ছোটকা বললেন- তুই এই ঘরে! বলতে বলতে ঘরে ঢুকে এলেন। এসে সবাইকে একসাথে দেখে, সবার মুখ চোখ দেখে বলে উঠলেন, ‘বুঝেছি কেন আজ একসাথে শোবার প্ল্যান তোদের? দেখা হলো সব? কৌতুহল মিটলো? অতঃপর.. এবার কি ভাবছো বাছারা?’
    আমরা সবাই চুপ। এক তো রাতবিরেতে এইসব দেখা, তারপর সামনে ছোটকা। ধরা পড়ে যাবার ভয়। তার মধ্যেই একটু সাহস নিয়ে বড়দা বললো, ‘ছোটকা সেই মালাই বরফওয়ালা ওই বাড়ির ভেতরে গেল এতো রাতে। তারপরই আওয়াজ হলো কান্নার…’ বাচ্ছু বললো, ‘ছোটকা ওই বাড়ির জানলা তো খোলে না, কিন্তু আজ দেখলাম খোলা, দুজন মেঝেতে পড়েছিল, রক্ত ছিল। কিন্তু এখন তো বন্ধ হয়ে গেছে।’
    ছোটকা বললেন, ‘ওই জানলা বন্ধ থাকে, খোলে না অনেক দিন। আজো খোলে নি..’
    বড়দা বললো, ‘আমরা যে দেখলাম আজ খোলা!’
    ছোটকা আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে আমাদের ঘরের জানলা দিয়ে ওপারে দেখলো। ‘তোদের ভীষণ কৌতুহল না রে? আজ তোদের বলবো, আমি যা শুনেছিলাম। আমাদের বলেছিলো তোদের মেজদাদু। তার আগে চা বানিয়ে নিয়ে আয় দেখি, কেমন পারিস, শুধু মুখে তো গল্প হবে না।’
    মিলি বললো, ‘এক্ষুণি আনছি ছোটকা.., কিন্তু আমি আসার আগে তুমি ওদের কিছু বলবে না।’ অগত্যা..
    মিলি খুব তাড়াতাড়ি চা বানিয়ে নিয়ে এসেই বললো, ‘এবার শুরু করো ছোটকা..’
    ছোটকা শুরু করলেন, ‘তোরা যে জানলা আজ এখান থেকে দেখলি। তখন তো এখান থেকে দেখা যেত না, আমরা দেখেছিলাম ছাদ থেকে লুকিয়ে। খোলা ছাদে উন্মুক্ত আকাশের নিচে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শিউরে উঠেছিলাম। তোদের মতো আমরাও খুব ভয় পেয়েছিলাম রে সেদিন। তোদের মেজদাদুও আমাদের ধাওয়া করে ছাদ অব্দি উঠেছিল। সেদিন ছাদে বসেই শুনেছিলাম- একটা হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার গল্প। যার কান্নার আওয়াজ শুনিস, সিতারা ওর নাম। বড়ো অসহায় মেয়ে। বিহারের এক গ্ৰামে থাকতো, জ্ঞাতি কাকার কাছে। বাবা-মা কেউ ছিলো না। অপূর্ব সুন্দরী, গান শেখে নি, কিন্তু চমৎকার গানের গলা। সেই জ্ঞাতি কাকার ছেলে বলবন্ত ওকে গ্ৰাম থেকে এনে জোর করে দালালদের হাতে বিক্রি করে দেয়। গ্ৰামে বদনাম রটিয়ে দেয় সিতারা বেজাতের লোকের সাথে পালিয়ে গেছে, খারাপ পাড়ায় বাসা নিয়েছে। চরিত্র নষ্ট করে রোজগার করছে- এইসব নানান গল্প ফেঁদে যাতে সিতারা আর কোনোদিন গ্ৰামে ফিরতে না পারে- সেইজন্য সিতারার নাচের ছবি গ্ৰামে গিয়ে দেখায়। বেচারা সিতারা অনেক অত্যাচার সহ্য করে বাঈজী পেশায় নামতে বাধ্য হয়। অসহায় সিতারা মেনে নিয়েছিল নিজের এই জীবন- নাচ, গান, বাবুদের মনোরঞ্জন। কিন্তু দুঃখ যেন সিতারা কপালে লিখে নিয়ে জন্ম নিয়েছিল। বাবুদের মজলিসে মালাই বরফ বেচতে আসতো কেতন। সেও বিহারের অধিবাসী। গভীর রাত ছাড়াও সন্ধ্যা রাতেও মালাই বেচতে আসতো। তখনই সিতারার সাথে আলাপ জমে। ভাষা এক হওয়ায় মনের মিল হয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। দুঃখিনী মেয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে কেতনের সাথে। দুজনের চোখে ঘর বাঁধার স্বপ্ন- বলবন্ত দালাল মারফত জানতে পারে সব কথা। সোনার ডিম দেওয়া হাঁস কে হাতছাড়া করতে চায়? তাই ষড়যন্ত্র করে একদিন রাতে মালাই বরফ কেনার অছিলায় ডেকে পাঠায় কেতনকে। তারপর দরজা বন্ধ করে চলে নির্মম অত্যাচার। সিতারা কাঁদতে থাকে, হাতে পায়ে ধরে ছেড়ে দেবার জন্য। কিন্তু কোনো কথাই শোনে না ওরা- অকথ্য অত্যাচারের পরিণামে কেতন লুটিয়ে পড়ে রক্তাক্ত অবস্থায় নিথর হয়ে। সিতারা আর্তনাদ করে ওঠে, উপুড় হয়ে জড়িয়ে ধরে নিথর কেতনকে। তারপর সিতারার আর জ্ঞান ফেরে না। বলবন্তকে বেশ কিছুদিন পর ওই বাড়ির সিঁড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তখন লোকে বলতো ওকে সিতারার আত্মা খুন করেছে। এসবের সত্যতা বলতে পারবো না, শোনা কথা- মুখে মুখে প্রচলিত। কিন্তু মনে হয় সিতারা- কেতন আজো ঘুরে বেড়ায়। তাই তো ওই আওয়াজ ভেসে আসে…’ ছোটকা যখন শেষ করলো সিতারার কাহিনী তখন ভোরের প্রথম ট্রামটা রাস্তার বুক চিরে এগিয়ে চলেছে পুণ্যার্থী নিয়ে।
    ছোটকা বললেন, ‘চল আজ ভোরের কলকাতা দেখিয়ে আনি। তৈরী হয়ে নে চটপট সবাই।’
    রাস্তায় বেরিয়ে ওই বাড়ি আর ওই বন্ধ জানালার দিকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছিলো। গা শিরশির করে উঠছিলো। ফিরেছিলাম সবাই ভোরের গরম গরম কচুরি, জিলিপি খেয়ে।
    আজ বহু দিন পর বাড়িতে আসা। এ বাড়িও বিক্রি হবে- তার মিটিং। ফেরার পথে সেন্ট্রাল এভিনিউ ক্রশিং-এ গাড়িতে বসে মুখ বাড়ালাম। নেই সেই বন্ধ জানলা, পুরোনো বাড়ি। নতুন ঝাঁ চকচকে বিল্ডিং সেখানে। সিতারা হারিয়ে গেছে, কেতন মুছে গেছে, ভালোবাসা হারিয়ে গেছে। অবুঝ মন প্রশ্ন করলো- সিতারার কান্না! কান্নাও হারিয়ে গেছে?
    সম্বিত ফিরলো দেখি গাড়িটা আমার শৈশব, বাল্য স্মৃতি, সিতারাকে হারিয়ে অনেক দূর চলে এসেছে।
    এ কলকাতা নতুন কলকাতা- অনলাইন কলকাতা, কেতাদুরস্ত কলকাতা। সব অচেনা।

  • কবিতা

    কবিতা- অন্তরায়

    অন্তরায়
    -রীণা চ্যাটার্জী

    একটা স্বপ্ন মিলিয়ে যাওয়ার আগে
    কোলাকুলি করে আর এক তার ফাঁকে,
    মাঝে কিছু শ্বাস, কিছুটা দীর্ঘশ্বাস
    ভিড় করে আসে স্বপ্নেরা একরাশ।
    খানিক ঘোরে বাঁচার কানাঘুষোয়
    পথ হারায় কখনো মিথ্যার আশ্রয়ে
    ঘুমের গলিতে কোষেদের আস্তানায়,
    অলক্ষ্যে জাগে, অলক্ষ্যে মৃতপ্রায়।
    মুহুর্তের আঁচলে বেঁধে রাখার গিঁট
    ওদের পিঠেও নাছোড়বান্দা জিদ-
    চোখের তারায় বাস্তুচ্যুতের রাগ-এ
    রাতের শিশির দুরন্ত শোকে জাগে।
    নতুনের ভারে পুরাতন ঘোলা জলে
    হৃতোদ্যমে ফের চোরা ঘুর্ণন তোলে।
    ভেসে ওঠে ক্ষীণ বুদবুদের আশ্বাস-
    স্থির-অস্থির জলছবি দেয় ফাঁস।
    ক্লিষ্ট ভোরের হাতছানি ভাসা ভাসা
    ভাবনার আঁশে জাল কাটে তমসা।
    দাপুটে চলনে কায়াহীনের আবছা ছায়া,
    খোলা চোখে চোখ রাখে না সে বেহায়া।
    আশা-সংঘাতে, সৃষ্টি-ধ্বংসের আনাগোনায়
    স্বপ্নেরা দূর থেকে একে অপরের অন্তরায়।

  • কবিতা

    কবিতা- অমলকান্তি আগুন হবে?

    অমলকান্তি আগুন হবে?
    -রীণা চ্যাটার্জী

    আগুন লাগবে, দাউদাউ জ্বলা আগুন,
    পচন ধরা সমাজটাকে জ্বালিয়ে দিতে
    দলে দলে আসবে জানি তাজা রক্তের বান, তুমিও এসো, কুটো জ্বালাও অমলকান্তি-
    আগুন লাগবে আগুন, শুদ্ধিকরণ যজ্ঞ হবে।
    ক্ষান্তবর্ষণে লাজুক রোদ্দুরের‌ স্বপ্ন তোমার?
    স্বপ্ন তোমার অলীক ছিল- অবাস্তব দোষে দুষ্ট,
    জানতে না বুঝি? বলেনি কেউ কোনোদিন!
    আকাশে বারুদের মুষ্টিযোগে
    রোদ্দুর এখন বিষফোঁড়া রোগে
    বিষাক্ত বিষে ছাড়খার হয়ে গেছে।
    স্বপ্ন যাদের স্বার্থে ঘেরা, আগ্ৰাসন মন্ত্র তাদের।
    ন্যায়-নীতিতে শক্ত কথা, সফল হওয়ার গল্প ওদের।
    তোমার চাওয়া তো রোদ্দুর নরম-
    নরম মাটি আঁচড়ে সুখ- এই রীতিতে চলছে জগৎ।
    আবার একটা স্বপ্ন দেখো তেজী চোখের
    দৃপ্ত শপথে- আগুন হবার স্বপ্ন দেখো।
    অমলকান্তি জ্বলন্ত এক আগুন হবে?
    তোমার স্বপ্ন ভাঙতে এলে, কিনতে এলে
    জ্বালিয়ে দেবে, পুড়িয়ে দেবে।
    অদম্য সাহসী তকমা নিয়ে… হবে আগুন?

    (“অমলকান্তি” একটি প্রতীক নাম রূপে ব্যবহৃত। অমলকান্তি- কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতার অনুকরণের কোন স্পর্ধিত প্রকাশ নয়। অনিচ্ছায়, অজান্তে কোনো ত্রুটি হলে ক্ষমাপ্রার্থী)

  • কবিতা

    কবিতা- প্রচ্ছদ

    প্রচ্ছদ
    -রীণা চ্যাটার্জী

    চলো একটা প্রচ্ছদ আঁকি
    রঙচঙে- লাল, হলুদ, নীল
    বা অন্য কোনো রঙ-
    না হয় সব রঙের মিশেল
    ক্যানভ্যাসে দুর্বোধ্য কিছু ছবি..
    হোক বেমানান, কোনো ক্ষতি নেই
    শুধু প্রচ্ছদের চমক লাগবে-
    রঙের আতিশয্যে চোখ ধাঁধানো,
    বাহারী বিজ্ঞাপনের মতো মন মাতানো,
    ভেতরটা হোক হাবিজাবির সমাহার,
    শব্দের আধপোড়া ঘ্রাণের গন্ধটা
    নির্লজ্জতার আড়ালে কাঁদবে,
    ভুলের চোরাবালিতে তলিয়ে যাবে-
    ঢেকে দেবে, ঢেকে যাবে সব,
    গর্বিত অহঙ্কারের মিথ্যের কোষে কোষে-
    অন্তরের খবর কে আর নিয়েছে কবে?
    শুধু প্রচ্ছদ চাই..
    ওটা রঙচঙে হলেই হবে।

  • সম্পাদকীয়

    প্রয়াণ… লহ প্রণাম

    প্রয়াণ… লহ প্রণাম
    -রীণা চ্যাটার্জী

    সুধী,
    সুন্দর, শাশ্বত, সমাহিত, পবিত্র- এই শব্দগুলো বারবার ভেসে উঠেছে মানসপটে গত কয়েকদিন ধরে। সত্য তো বটেই- কিন্তু কজন পায় এমন সমাহিত প্রয়াণ মুহূর্ত।
    মৃত্যুকে ছুঁয়ে নতুন করে যেন মূর্ত হয়ে উঠলেন আরো আপনজন হয়ে গেলেন আত্মার। এ আত্মিক বন্ধন তো কোনোদিন আলগা হবার নয়। আসমুদ্র হিমাচল যেদিন এক সাথে অশ্রুসাগরে ভাসলো- সেদিন দূরে সরে গেল মনের সকল কলুষতা, ভেদাভেদ, জাতি, ধর্ম। প্রকৃত শিল্পীর কোনো জাতির নয়, কোনো বিশেষ ধর্ম, বর্ণের অধীন নয়, একটাই পরিচয় তাঁকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় তাঁর শিল্পসত্তা।
    রাজনীতি ছুঁতে পারলো না তাঁকে- জীবনেও না, মরণেও না। ক’জন পারেন এমন জীবনাদর্শ তৈরী করে যেতে? স্বর্গীয় অমলিন হাসির ছবিটা যেন শিখিয়ে দেয়- জীবনের ছন্দ, বারবার দেখেও আশ মেটে না। না, তিনি আর ফিরে আসতে চান না, যদিও আসেন আবার “লতা মঙ্গেশকর” হতে চান না। তাঁর নিজের কণ্ঠেই এইরকম শোনা গেছে সাক্ষাৎকারে। তাহলে যদি পুর্নজন্ম বলে কিছু থাকে- তিনি হয়তো হবেন তাঁর নিজের কণ্ঠের অনুরাগী। আনমনে অবসরে শুনবেন তাঁর পূর্বজন্মের কণ্ঠস্বর। মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়ে হয়তো ভাববেন- “ইসস আমিও যদি এইরকম গাইতে পারতাম” যেমন আমরা সবাই এখন ভাবি। হয় না সবকিছুর পুনরাবৃত্তি হয় না- তাহলে মহিমা খন্ডিত হয়ে যায়। তিনি থাকুন একাধিপত্য নিয়ে সুরের জগতে স্বমহিমায় যতদিন পৃথিবীতে সুর থাকবে, থাকবে তাঁর গান।

    যখন লিখছিলাম, তখনো জানতে পারিনি গীতশ্রীও অমৃতলোকে। সুরের সন্ধ্যা অস্তমিত! গানে গানে আবার ফিরে পাওয়ার, অনুভব করার আপ্রাণ চেষ্টা…কৈশোর, যৌবনে সুরে সুরে হারিয়ে যাওয়ার সন্ধ্যা বেলা- “কিছুক্ষণ আরো না হয় রহিতে কাছে..” শোকার্ত বাঙলা আর বাঙালীর একটাই আর্তি আজ আকাশে বাতাসে।

    সকালে আবার- বাপী লাহিড়ী না ফেরার দেশে… জীবনকে সচল রাখার, ছন্দে বেঁধে রাখার, সুরে সুরে মাতোয়ারা করে দেওয়া শ্রদ্ধেয় প্রিয় মানুষগুলো মুহূর্তের ব্যবধানে স্বর্গীয় হয়ে গেলেন।
    জীবনের জৈবিক যন্ত্রণা থেকে দূরে, যান্ত্রিক পরাধীনতা ছিন্ন করে পরপারে। মৃত্যু শান্তি এনে দিয়ে গেল হয়তো। কিন্তু আমরা.. একসাথে এতো বিষাদ! কিভাবে দিতে পারি হৃদয়ের অঞ্জলী? বড়ো বেসুরো যে আজকের সকাল। সুর কতো দূরে.. “ইয়াদ আ রাহা হ্যায়…”

  • কবিতা

    কবিতা- পাশায় পাষাণ

    পাশায় পাষাণ
    -রীণা চ্যাটার্জী

    সুখ, অ-সুখের দন্ডি পেরিয়ে,
    সীমন্তনীর সীমিত সম্ভারে
    ইচ্ছেরা যেন অচ্ছুত হয়ে যায়..
    অসহায় ভাবনার ডানা ছাঁটা হয়
    দর্পের দন্ডিত শাসনভারে…
    তোমার কোলে অভিশাপ ঘুমোয়
    শত শতাব্দীর অন্ধকারে…
    আরোপিত কলঙ্কের তিলক এঁকে
    পাদস্পর্শের শর্তে মুক্তির প্রতীক্ষায়-
    ত্রিলোকসুন্দরী অভিশপ্ত প্রস্তর বন্দিনী
    তুমি, স্তব্ধ নীরবতা ঘেরা অলিন্দে।
    কেন চেয়েছিলে মুক্তির ভিক্ষা?
    ক্ষমা প্রার্থনা করজোরে!
    তাই বা কেন? কেন অহল্যা?
    পেয়েছিলে কি কাঙ্খিত মুক্তি?
    একরাশ অপমানের কালো ধূমে
    বোঝোনি অহল্যারা জন্মলগ্নের
    পাশার ছকে পাষাণ হয়ে যায়,
    অহল্যাদের পাষাণ হতে হয়…

  • কবিতা

    কবিতা- সংলাপ

    সংলাপ
    -রীণা চ্যাটার্জী

    এপার থেকেই শুরু হোক আবার কথা,
    ওপারে যাওয়া তো হলো না আজো সারা-
    প্রলয় লেগেছে প্রকৃতিতে অচেনা রূপে,
    অনুজীবের কবলে ধুঁকছে এখন ধরা।
    অনুঘটকের বেসামাল প্রসাধনী
    বারবার তুলছে বেয়াদব সব ঝড়,
    কিছু দেহ মাটি চাপা, খানিক ফুলেছে জলে
    জ্বলেছে আগুন মুছে নিয়ে যেতে শব।
    তবুও মৃতের মিছিলে নেমে-
    নশ্বর দেহ দাপটে দেখায় ক্ষোভ।
    বন্ধ কপাটের শার্সি চোঁয়ানো রোদ-
    দূর থেকে ছুঁয়ে যায় মন হারানো কায়া,
    নিভৃতের নিভৃতবাস ক্লান্তিতে নেয় শ্বাস।
    সূর্য ডুবলে আলো আঁধারের কোলে-
    বেঁচে থাকা আশে, ঝিমানো কাশের কাঁধে
    জীবন আলগোছে গোনে বন্ধকী, আর সুদ।
    চিতাকে দিয়ে ফাঁকি- নিভু নিভু জ্বালে
    সেঁকে নিয়ে কিছু শ্বাস হয়তো রয়েছে বাকি।
    যায় না তো গোনা- পেন্ডুলামের স্বর
    মৃদু স্বরে সময় বলে গেছে “সংলাপ”
    ওপারে যাওয়া তো হলো না আজো সারা-
    এপার থেকেই শুরু হোক আবার কথা…

<p>You cannot copy content of this page</p>