• কবিতা

    লহ প্রণাম

    লহ প্রণাম
    -রুদ্র প্রসাদ

     

    সমুজ্জ্বল স্মৃতির অতল তলে,
    উদ্ভাসিত – প্রস্ফুটিত শতদলে,
    বিকশিত – সুবাসিত, তোমারই সম্ভার,
    কাব্য, গীত তুমিময় — তুমি একাকার ।
    সৃষ্টিশীলতায় মগ্ন মনের ভাবনা যত,
    আপন খেয়ালে লিখে গেছ অবিরত,
    সুখ – দুঃখ – উত্থানের নব-নীতি-রঙ্গ,
    তোমার রচনা, ঠিক যেন মুক্ত – বিহঙ্গ ।
    সংস্কারের বেড়াজাল আর জাত-পাত,
    অমানবিকতার সমূলে করেছ আঘাত ।
    “নাইট হুড” – উপাধি প্রত্যাখ্যাত,
    মনিকোঠায় আছে যে সবার জ্ঞাত,
    মানবিক বেদনায় কেঁদেছে ও প্রাণ,
    “নোবেল” ও প্রতিভার সামান্য সম্মান ।
    বিজ্ঞানের অভিশাপ, সেই ‘হিরোশিমা’,
    অথবা মিষ্টি প্রেমের সুপ্ত মধুরিমা
    আকুল সব দেশাত্মবোধের গানে,
    বানভাসি জোয়ার এনেছ যে প্রাণে,
    মুসলমান ভাইকে পরালে মিলনের রাখী,
    অখণ্ড দেশের ছবি তাইতো মোরা আঁকি ।
    শত – সহস্রাধিক বৎসরের ও পরে,
    উচ্চকিতে উচ্চারিবে একই সুরে,
    হৃদয় মাঝে, বিশ্ব মাঝে একটি শুধু নাম,
    “কবিগুরু”, লহ তুমি, সামান্যের প্রণাম ।।

  • ধারাবাহিক

    অপ্রত্যাশিত চিঠি – পর্ব ৮/৮

    অপ্রত্যাশিত চিঠি
    -রুদ্র প্রসাদ

     

     

    সপ্তম পর্বের পর …

    ( ২৮ )

    সন্ধ্যায় ড্রেসিংয়ের পর একা একা বসে পুরো ব্যাপারটা ভাবছিলাম, একটু তলিয়ে ভাবতেই কয়েকটা জিনিস পরিষ্কার হল, প্রথমতঃ আমি প্রথম দিন থেকেই পুলিশ আর চোরা-কারবারী, উভয়পক্ষের নজরে ছিলাম । দ্বিতীয়তঃ এখনকার প্রথম সাক্ষাতে পরিচয় পেয়েই চেনার ভান করলেও সেনগুপ্ত সাহেব আমার উপস্থিতির কথা আগে থেকেই জানতেন, নিজের অথবা ঘোষ ম্যাডামের সোর্স থেকে । তাছাড়া আমি না থাকলেও পুরো ঘটনাটা স্বাভাবিকভাবেই ঘটত, কারণ পুলিশ – এনসিবি ক্রমশই তাদের জাল গুটিয়ে আনছিল । মাঝখান থেকে আমি ঢুকে জড়িয়ে পড়েছি ।
    ভাইকে ফোন করলাম । পুরো ঘটনাটা গুছিয়ে বলতে একটু সময় লাগল । ফোন রাখার পর মনে হতে লাগল, ‘দাদু প্যাকেটটা নিয়ে কি করলেন’, ভাবতে ভাবতেই চিঠিতে লেখা কথাগুলো মনে পড়ল । হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মাথায় এলো, সেনগুপ্ত সাহেবকে ফোন করতে গিয়েও করলাম না । আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার । কয়েকটা ফোন সেরে, কালকের মতোই খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম । খেয়াল করলাম, বাম কাঁধের ব্যথা ছাড়া আপাতত আর কোনো অসুবিধা নেই ।

    ( ২৯ )

    আজ শুক্রবার । গতকালই ফিরে যাওয়ার প্ল্যান ছিল, কিন্তু হল না । সব ফর্মালিটি সেরে উঠতে দশটা বেজে গেল । দাদু অনেকটাই সুস্থ । হরিদাদুকেও অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছুটা শান্ত করা গেছে । সেনগুপ্ত সাহেবই গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন । সঙ্গে ডাক্তার, কম্পাউণ্ডার, রাঁধুনী আর পুলিশ, মোট চারজন সঙ্গী হল । সেনগুপ্ত সাহেব আশ্বাস দিলেন যে সন্ধ্যার আগেই সমীরের বডি পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন, তার মধ্যেই পোষ্ট-মর্টেম হয়ে যাবে । গাড়িতে আসার পথে বিশেষ কোনো কথা হল না । তাজপুর পৌঁছে নতুন রাঁধুনীকে আর রান্না করার দরকার হল না । সকলের জন্য লাঞ্চ-প্যাকেট আনা হয়েছিল, সে গুলো দিয়েই আহার পর্ব সমাধা হল ।
    ওপরের ঘরে এসে আর্মস্লিং থেকে হাতটা বের করতেই যন্ত্রণা বেশ ভালো টের পাওয়া গেল । একটু সময় বিশ্রাম নিয়েই নিচে নেমে এলাম । কম্পাউণ্ডারের নাম শুভঙ্কর বাবু, তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, দাদু আর হরিদাদু ল্যাবের দিকে গেছেন, ডাক্তার জ্যোতির্ময় বাবু ও পুলিশ প্রদ্যোৎ বাবু সঙ্গে আছেন । রাঁধুনী শঙ্করদাকে দেখলাম জলখাবারের ব্যবস্থায় ব্যস্ত । আপাতত সেই প্যাকেটটার খোঁজ করার জন্য দাদুর ঘরে গেলাম । খুব বেশি মেহনত করতে হল না । আমার আন্দাজ সঠিক ছিল । ঠিক যেখানে ভেবেছিলাম, প্যাকেটটা সেখানেই আছে । এবার পুলিশ এলে শুধু বলে দিলেই চলবে । ঘর থেকে খুশি মনেই বেরিয়ে এলাম ।
    বসার ঘরে বসে অলসভাবে একটা পত্রিকা নাড়া-চাড়া করছিলাম, এমন সময় পুলিশ এলো । একটু পরে সকলে মিলে গেলাম স্থানীয় শ্মশানে । চিতায় সমীরের বডিটা তোলা হতেই হরিদাদু কান্নায় ভেঙে পড়ল । দাহকার্য সম্পন্ন করে উঠতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেল ।

    ( ৩০ )

    বাড়ি ফিরে দেখি সেনগুপ্ত সাহেব এসেছেন, দাদুর বয়ান নেবেন । শ্মশান থেকে ফিরেছি বলে আর দাঁড়ালাম না । স্নান সেরে, জামাকাপড় পাল্টে নিচে এসে চা নিয়ে বসতে বসতে দেখি বয়ান নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে । দাদু বলছিলেন আর একজন পুলিশের লোক সেটা খাতায় লিখে নিচ্ছিলেন । এক জায়গায় এসে সেনগুপ্ত সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, “প্যাকেটটা এখন কোথায় ?” দাদু কিছু বলার আগেই আমি বললাম, “ওটা দাদুর বিছানার বালিশের ভেতরে আছে”। দাদু কোনো কথা না বলে, শুধু সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়লেন ।
    সেনগুপ্ত সাহেবের দৃষ্টি আমার দিকে দেখেই বললাম, “দাদু চিঠিতে ‘পুনশ্চঃ’ বলে লিখেছিলেন, ‘যেখানেই দেখিবে ছাই …’। আমি প্রথমে ধরতে পারি নি । অসমাপ্ত লাইনের বাকি কথাগুলো ভেবে, শুরুতে রতনকেই মূল টার্গেট ভেবেছিলাম, কিন্তু পরে বুঝেছি রতনকে অন্য কেউ পরিচালনা করছে । তাই কথাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল । পরে পেছনের দিকে পুকুর পাড়ে ছাইয়ের গাদায় শিমূল তুলা পড়ে থাকতে দেখেছিলাম । দাদুর ঘরে ঢুকেও মনে হয়েছিল যে ঘরটা বেশ কয়েকদিন ব্যবহার হয় নি । পুরো ধারণাটা দানা বাঁধতে সময় লেগেছে । আজ এসে দুয়ে দুয়ে চার করে সব মিলিয়ে দেখার পর নিশ্চিত হয়েছি । আসলে আমি একটা সময়ে দাদুকেই সন্দেহ করেছিলাম । এমনটা ভেবেছিলাম, হয়তো কোনোভাবে দুষ্ট চক্রের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন, এখন ওদের হাত থেকে নিষ্কৃতি চাইছেন বলেই আমাকে ডেকেছেন । কিন্তু যখন দেখলাম, চিঠির লেখা আর ল্যাবের ক্লিপবোর্ডের নোটশিটের লেখা, দুটো একেবারে আলাদা হস্তাক্ষর, তখন দাদুর ব্যাপারটা খানিকটা আঁচ করেছিলাম । তবে ঐ ইমপস্টারকে ওখানে দেখে সত্যি সত্যিই চমকে গিয়েছিলাম”।
    এতোক্ষণ চুপ করে থাকার পর দাদু মুখ খুললেন, “ওরা কি কম ক্ষতি করেছে ? কতো প্রাণ অবহেলার বলী হয়েছে ! দিনের পর দিন চারাগুলোকে বিনা পরিচর্যায় ফেলে রেখেছে । কতো সবুজের হত্যা করেছে, তার ইয়ত্তা নেই …”, বলতে বলতেই তাঁর গলা ধরে এল । ইতিমধ্যে সেনগুপ্ত সাহেব নির্দেশে পুলিশ প্যাকেটটা নিয়ে এসেছে, দেখলাম প্যাকেটটা একটা ন্যাকড়া জড়িয়ে বালিশের ভেতর রাখা ছিল । সেই জন্যই ছোট্ট প্যাকেটটা লুকোতে একটু বেশিই তুলা বের করতে হয়েছে ।
    যখন সেনগুপ্ত সাহেব বাকিদের নিয়ে দাদুর বয়ান আর মাদকের প্যাকেট গুছিয়ে উঠতে যাবেন, এমন হরিদাদু এসে বলল, “সাহেব, আমি খুনী, আমার শাস্তি হওয়াই উচিত”। শুনে সেনগুপ্ত সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আপনি যা করেছেন তার জন্য সাজা নয়, আপনার পুরস্কার পাওয়া উচিত । কিন্তু বিভাগীয় গোপনীয়তার জন্যই কোনো কিছু প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না”। একটু থেমে, “তবে আপনাদের মতো কতিপয় আদর্শবাদী মানুষের জন্যই মনুষ্যত্ব আজও টিকে আছে”, বলেই পুলিশী কায়দায় বুট ঠুকে স্যালুট্ করলেন ।

    ( ৩১ )

    ডাক্তারী পরিচর্যা আর নতুন রাঁধুনীর রান্না খেয়ে ওপরে এসে কয়েকটা ফোন সেরে নিলাম । ক্লান্তির জন্য ঘুমও পেয়েছে দেখে আজ আর ফেসবুকে ঢুকলাম না । মনে হল, ব্যথাটা বেশ কম, তবে সারতে সময় লাগবে । সমীরের ব্যাপারটা ছাড়া বাকি সব কিছু মোটামুটি ভালোভাবে মিটেছে বলে ভালোই লাগছিল । আলো নিভিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম ।
    সকালে দাদুর সাথে ল্যাবে গিয়ে দেখি একেবারে লণ্ডভণ্ড অবস্থা ! দাদুকে অস্ফুটে বলতে শুনলাম, “সব শেষ করে দিয়েছে”, কথাগুলো হাহাকারের মতো শোনাল । কাছে গিয়ে বললাম, “শেষ থেকে আবার শুরু কর, নতুন করে সাজিয়ে তোলো তোমার সবুজবীথি”। চারপাশটা দেখতে দেখতে অনুচ্চস্বরে দাদু বললেন, “হুঁ, করতে তো হবেই । সবুজ না থাকলে যে সব কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে” ।
    হরিদাদুকে দেখলাম কিছুটা সামলেছে । কথা বলে জানতে পারলাম, প্রথমদিন এসে যখন আমি ওপরের ঘরে ফোনে কথা বলছিলাম, তখন হরিদাদুই গিয়েছিল আমাকে সব কিছু জানিয়ে সাবধান করার জন্য । কিন্তু আমার কাছে পৌঁছানোর আগেই তাকে রতন ধরে ফেলে । তারপর থেকেই বেসমেন্টে বন্দী থাকার জন্য আমি আর দেখতে পাই নি ।
    দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর দাদুর ঘরে বসে গল্প করছিলাম, এমন সময় হরিদাদু এসে বলল, “দাদুভাই, আমার একটা কাজ করে দেবে ?” “কি কাজ ?” জানতে চাইলাম । “সমুর অস্থিটা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে ? আমি পরে সময়মতো গয়ায় তার পিণ্ডদানের ব্যবস্থা করব । শত খারাপ হলেও সে আমার …”, বলতে বলতেই আবার তার দুচোখ জলে ভরে গেল । সম্মতি দিতে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে একটা লাল শালুতে মুখ বাঁধা ভাঁড় দিলো ।

    ( ৩২ )

    সন্ধ্যায় ডাক্তারের সাথে কথা বলে একটা মেডিকেল সার্টিফিকেট করিয়ে নিলাম । মনে মনে ভাবলাম, ‘আরও সাতদিন বিশ্রামের বন্দোবস্ত হল বটে, তবে কাল বিকেলে মা-বাবার ফিরে আসার আগেই বাড়ি পৌঁছাতে হবে । না হলে কপালে অশেষ দুঃখ আছে । এখন এই অবস্থায় যাওয়ার কথা কি করে বলা যায়’, ভাবতে ভাবতে দাদুর কাছে গেলাম । দেখি দাদু এর মধ্যেই কয়েকজন লোক ঠিক করে ফেলেছেন, তারা কাল থেকে ল্যাবে কাজ করবে । আমি সময় করে বললাম, “দাদু, এবার তো আমাকেও যেতে হবে । তবে পরে আসব আর নিয়মিত যোগাযোগ রাখব – কথা দিচ্ছি”। দাদু নীরবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন । রাতের খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম ।
    সকালে যখন ঘুম ভাঙল, তখন সূর্য ওঠেনি । তৈরী হয়ে নিচে নেমে এসে দেখি দাদু, হরিদাদু – সবাই আমার অপেক্ষায় রয়েছেন । দাদু একটা গাড়িও ঠিক করে দিয়েছেন আমার যাওয়ার জন্য । প্রাতঃরাশ সেরে বিদায় নিতে যেতে দুজনেই জড়িয়ে ধরলেন । আগামী বড়দিনের ছুটিতে সবাইকে নিয়ে আসব’, প্রতিশ্রুতি দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম । জানালা দিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে, দুই বৃদ্ধের ওপর যে ঝড় বয়ে গেল গত কয়েকদিন ধরে, সেটাই ভাবছিলাম । নির্বান্ধব দুটি মানুষের কথা মনে হতেই একটু খারাপ লাগল । গাড়ির ব্যাকসিটে বসে গা এলিয়ে দিতে দিতে খেয়াল হল নিজের অজান্তেই চোখের কোণদুটো ভিজে গেছে । মনে মনে বললাম, খুব তাড়াতাড়িই আবার আসব … ভালো থেক তোমরা’।।

    ।। সমাপ্ত ।

  • ধারাবাহিক

    অপ্রত্যাশিত চিঠি – পর্ব ৭/৮

    অপ্রত্যাশিত চিঠি
    -রুদ্র প্রসাদ

     

     

    ষষ্ঠ পর্বের পর…….

    ( ২৪ )

    কিছুটা আসার পর রাস্তার মোড় ঘুরতেই কালচে গাড়িটা দৃষ্টিগোচর হল । পুলিশের সাইরেন শুনে পালাবার চেষ্টা না করে, রাস্তার একপাশে থেমে গেল গাড়িটা । পুরো ব্যাপারটা একটু গোলমেলে লাগল ! কিন্তু ঘোর কাটতে সময় লাগল না । গতি কমিয়ে পুলিশের গাড়িটা আর একটু কাছাকাছি হতেই আমাদের লক্ষ্য করে একঝাঁক বুলেট ছুটে এলো । সেনগুপ্ত সাহেব আর দুই কনস্টেবল জবাবে এক রাউণ্ড করে গুলি চালাতেই বললাম, “ওদের সঙ্গে দাদু আছেন, বি কেয়ারফুল” । “হুঁ”, বলেই সেনগুপ্ত সাহেব চাপা গলায় বললেন, “স্টপ ফায়ারিং”। তারপর নির্দেশ দিতেই ড্রাইভার গাড়িটাকে আড়াআড়িভাবে রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিল । দুটো গাড়ির মাঝে ব্যবধান প্রায় পঁচিশ গজ মতো হবে ।
    এরপর বেশ কিছু সময় চুপচাপ কাটল । এক একটা মুহূর্ত যেন এক একটা প্রহরের সমান বলে মতো হচ্ছিল । এমন সময় আমদের সামনের দিক থেকে আরও একটা পুলিশের সাইরেন শোনা গেল । সেনগুপ্ত সাহেবকে অস্ফুটে বলতে শুনলাম, “এবার ? পালাবি কোথায় ? যা দেখি, কেমন করে পারিস”। সামনের গাড়িটা থেকে আবার গুলি চলল, এবার উল্টোদিকে । তারপর আবার বিরতি । একটু পরে সামনে গাড়ির একটা দরজা খুলে গেল । আগে দাদুকে ঠেলে নামিয়ে দিয়ে পেছন পেছন নামল পালের গোদা লোকটা । নেমেই দাদুর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হেঁকে বলে উঠল, “আমাদেরকে যেতে না দিলে এই বুড়োর পরিনতির জন্য আমরা দায়ী থাকব না”। আমাদের গাড়ির হেডলাইটের আলোয় লোকটাকে ভালো করে দেখতেই বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ে গেল, “আরে ! এ যে …”, নিজের অজান্তেই গলা থেকে কথা গুলো বেরিয়ে এলো । এ তো সেই লোকটা, যে প্রথমদিন টোটোতে করে আসার সময় আমার সঙ্গেই ছিল ! দাদুর বাড়ি যাওয়ার পথও বাতলে দিয়েছিল ! এই জন্যই একে এতো চেনা চেনা লাগছিল । অবশ্য এখনকার মতো চোখে-মুখে হিংস্রতা আর শয়তানি ক্রূরতা সেদিন দেখি নি ।

    ( ২৫ )

    কি করা যায় ভাবছি, এমন সময়, হঠাৎ দেখি উল্টোদিকের দরজা খুলে আরও একজন নেমে পড়েছে । কিন্তু এ কি ! একে যে অবিকল দাদুর মতোই দেখতে ! চোখে ভুল দেখছি বলে মনে হল । একটু চোখ রগড়ে দেখলাম, নাহ্, দেখার ভুল নয় । সেনগুপ্ত সাহেবও কম অবাক হন নি । দুজনকেই একেবারে এক রকম দেখতে ! কে আসল আর কে নকল, বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম । হঠাৎ দেখি সেনগুপ্ত সাহেব দরজা খুলে গাড়ি থেকে নামলেন, নেমে গলা তুলে বললেন, “পালাবার কোনো পথ নেই । বাঁচতে চাইলে সারেণ্ডার কর”। দেখে আমিও অন্যপাশ দিয়ে এই ফাঁকে নেমে পড়েছি । বেশ বুঝতে পারছি, তৃতীয় ব্যক্তি গাড়ি থেকে নামার ফলে বন্দুকধারী কিছুটা হলেও বেকায়দায় পড়েছে । সুযোগটা কাজে লাগানোর তাল খুঁজছি, এমন সময় হঠাৎ দেখি তৃতীয় ব্যক্তি আমাদের দিকে দৌড়তে আরম্ভ করেছে । আমিও এই সুযোগ দেখে, রাস্তা থেকে একটা বড় পাথরের টুকরো কুড়িয়ে, সজোরে ছুঁড়ে মারলাম বন্দুকধারীর মাথা লক্ষ্য করে । এবার আর কোনো ভুল-চুক হয়নি, ঠিক লেগেছে ডান চোখের পাশে । লোকটাকে একপাশে পড়ে যেতে দেখলাম, ঠিক তখনই হঠাৎ একটা গুলির আওয়াজ হল । দেখলাম, আমাদের দিকে দৌড়ে আসা লোকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে আর সামনের গাড়ির ভেতর থেকে একটা রিভলবারের নল দেখা যাচ্ছে । এবার গর্জে উঠল সেনগুপ্ত সাহেবের পুলিশ স্পেশাল, অব্যর্থ নিশানা । কোথায় লাগল বুঝতে পারলাম না বটে, তবে একজনকে ওপাশের দরজা খুলে, মাটিতে পড়ে যেতে দেখলাম । এই সব দেখতে দেখতে, উত্তেজনার বশে কখন যে গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছি, খেয়াল নেই । হঠাৎ আবার একটা গুলির শব্দ আর সাথে সাথে এক প্রচণ্ড ধাক্কায়, রাস্তার ওপর ছিটকে পড়লাম । বামদিকে তীব্র যন্ত্রণার সাথে সাথে মনে হল, সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে, চোখে নেমে আসছে জমাট অন্ধকার ।

    ( ২৬ )

    চোখ খুলে বুঝতে পারলাম না কোথায়, কি অবস্থায় আছি । নড়াচড়া করতে গিয়ে বুঝলাম সারা শরীরে অসম্ভব ব্যথা । গায়ে যেন একটুও জোর নেই । কোথায় এলাম ভাবতে ভাবতেই দেখি, সামনে একজন দশাসই মহিলা, পরনের পোশাক দেখে নার্স বলে মনে হল । আমাকে নড়তে দেখেই খসখসে গলায় হুকুম জারি করল, “জ্ঞান ফিরেছে বলেই বেশি নড়াচড়া করবেন না । একটু পরেই ডাক্তারবাবু আসবেন । এখন চুপচাপ শুয়ে থাকুন”। অগত্যা শুয়ে শুয়েই চারপাশে চোখ বোলাতে লাগলাম, সব দেখে জায়গাটাকে কোনো হাসপাতালের কেবিন বলে মনে হল । ঘরের ভেতর একটা টিউবলাইট জ্বলছে, কিন্তু ঘড়ি না থাকায় সময় বোঝা গেল না । নার্সের তুরীয় মেজাজ দেখে প্রশ্ন করতেও ভরসা হল না । শুয়ে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবছিলাম ।
    একটু পরে একজন বয়স্ক অমায়িক ভদ্রলোক এলেন, গলায় স্টেথোস্কোপ আর গায়ে অ্যাপ্রন দেখে বুঝলাম ইনিই ডাক্তারবাবু । মৃদু হেসে বললেন, “গুড ইভিনিং ইয়ংম্যান, এখন কেমন …”। বললাম, “মোটামুটি ঠিকই আছি, তবে ভীষণ দুর্বল আর গায়ে খুব ব্যথা”। শুনে উনি বললেন, “চিন্তার কিছু নেই, গুলিটা কাঁধ ছুঁয়ে চলে গেছে । এখানে আনতে দেরী হয়েছে । অতিরিক্ত ব্লিডিংয়ের জন্যই এতো দুর্বল লাগছে । ডোন্ট ওয়্যারি, ও দু-দিনেই ঠিক হয়ে যাবে”। বিশ্রাম নিতে বলে ডাক্তারবাবু চলে গেলেন ।
    একটু পরে আর একজন কমবয়সী ডাক্তার এসে ড্রেসিং করে নতুন ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিলেন । জিজ্ঞাসা করে জানলাম তাঁর নাম নীলোৎপল বাবু, প্রায় আমার মতোই বয়স হবে বলে মনে হল । তাঁকে বলে নিজের মোবাইল দুটো ফেরত পেলাম, একটা চার্জারও জোগাড় হল । ফোন অন করতেই দেখি একগাদা মিসড্ কল, শুধু মায়েরই সাতাশটা । বুঝলাম, অবধারিতভাবে কপালে ফুল-চন্দন অপেক্ষা করছে । মনে মনে একটা গল্প বানিয়ে, একটু ভয়ে ভয়েই মাকে ফোন করলাম । আওয়াজ শুনেই বোঝা গেল, মেজাজ সপ্তমে, কিন্তু সব খুলে বলার তো উপায় নেই, কি আর করা যাবে ! একঝুড়ি মিথ্যা বলে এ যাত্রায় আপাতত রেহাই জুটল । আরও কিছু ফোন আর মেসেজ করে ফেসবুকে ঢুকতে যাব, এমন সময় সেই নার্স রাতের খাবার নিয়ে হাজির হল । স্বাদ-গন্ধহীন খাওয়ারগুলো কোনোক্রমে গলাধঃকরণ করার পর গুচ্ছের ঔষধ গিলে তবে ছাড়া পাওয়া গেল ।
    খাওয়া-দাওয়ার পর, হঠাৎ করে রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে যেতেই একরাশ দুশ্চিন্তা এসে মাথায় ভীড় করে এলো । এতো সময় যে কেন মনে পড়েনি, ভেবেই আশ্চর্য হলাম । খানিকক্ষণ পর নীলোৎপল বাবু রাউণ্ডে এলেন । তাড়াতাড়ি করে “দাদু, হরিদাদু, রাই – এরা সব কোথায় ? সবাই কেমন আছে ? কি হল, শেষ পর্যন্ত …”, ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করতেই হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “সবাই মোটামুটি ভালো আছেন । কোনোরকম বিপদের আশঙ্কা নেই । তবে আপনার চোটটাই গুরুতর, শরীর এখনও বেশ দুর্বল । আর জেগে না থেকে, ঘুমিয়ে পড়ুন । বিশ্রাম নিলে দ্রুত সেরে উঠবেন । আর কালকে, সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত সাহেব আসবেন, এলো আপনি কথা বলে নেবেন । ঠিক আছে ? গুড নাইট”, বলেই চলে গেলেন । পুরো ঘটনাগুলো ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়লাম ।

    ( ২৭ )

    সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর একপ্রস্থ ড্রেসিং আর জলখাবার সহযোগে অনেকগুলো ঔষধ গেলার পর মোবাইলটা নাড়া-চাড়া করছিলাম,এমন সময় সেই বয়স্ক ডাক্তারবাবু এলেন, সাথে সেনগুপ্ত সাহেব আর রাই । রাইকে পুরোদস্তুর ফর্মাল ড্রেসে একদম স্বাভাবিকভাবে আসতে দেখে একটু অবাক লাগল । অভিব্যক্তি যেন গম্ভীর বলেও মনে হল । সেনগুপ্ত সাহেব একটু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “কি …, এখন কেমন আছ ?” প্রত্তুত্তরে হেসে বললাম, “আগের চেয়ে অনেকটা ভালো । তবে বেশ কিছু প্রশ্ন আছে”। কথার মাঝেই থামিয়ে দিয়ে, রাইকে দেখিয়ে বললেন, “এঁর সাথে আলাপ করিয়ে দেই । ইনি মিস্ ঋষাণী ঘোষ, স্পেশাল অফিসার, এন.সি.বি.”। কিছু না বলে তাকিয়ে থাকতে দেখে শান্তভাবে, “রাই আমার ডাকনাম, আন্ডার-কভার অপারেশনের জন্যই নাম, ডেজিংনেশন ইত্যাদি বলা সম্ভব হয় নি”, বললেন নবরূপে সদ্যচেনা ঋষাণী ম্যাডাম । সামলে নিয়ে বললাম, “ইটস্ ওকে, কোয়াইট আন্ডারস্ট্যান্ডেবল্, তবে তার মানে, ঐ বাড়িতে ঢোকার পর থেকে সন্দেহভাজনদের তালিকায় আমিও ছিলাম”। উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসলেন ঘোষ ম্যাডাম । এবার ডাক্তারবাবু বললেন, “আপনারা কথা বলুন, আমি রাউন্ড দিয়ে আসছি”।
    ডাক্তারবাবু চলে যাওয়ার পর সেনগুপ্ত সাহেব বলতে শুরু করলেন, আমিও মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে জেনে নিচ্ছিলাম । জানা গেল, পুরোটাই পুলিশ – এন.সি.বি. জয়েন্ট অপারেশন ছিল । এখানকার মোটামুটি সকলেই ধরা পড়েছে, আরও কেউ জড়িত আছে কি না জানার জন্য তল্লাশি চলছে ।
    পুরো ঘটনায় দাদু খুব শক পেয়েছেন, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকার জন্য তাঁর বয়ান এখনও নেওয়া সম্ভব হয়নি ।
    আমি যাদের মেরেছিলাম, তাদের একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, তাকে কোলকাতা পাঠানো হয়েছে ।
    দাদুর মতো দেখতে যে লোকটার গুলি লেগেছিল, সে একজন সখের অভিনেতা । তার নাম শশধর, যাত্রাপালায় অভিনয় করত । অতিরিক্ত পয়সার লোভে এদের সঙ্গে এসে জুড়ে গিয়েছিল । বাইরের কোনো লোকের সামনে সে দাদু সেজে অভিনয় করত । হুবহু এক রকম দেখতে না হলেও মেকআপ করে ম্যানেজ করে নিতে পারত । এখন আপাতত পুরো ঘটনার রাজসাক্ষী হতে সম্মত হয়েছে ।
    আর যে লোকটা প্রথমদিন হিতৈষী সেজে আমাকে দাদুর বাড়ি যাওয়ার পথ বাতলে দিয়েছিল, তাকেই আপাতত এখানকার দলের মাথা বলে মনে করা হচ্ছে । তবে তার ওপরেও কেউ আছে কি না, সে ব্যাপারে তল্লাশি জারি রয়েছে । লোকটার সঠিক পরিচয় এখনও জানা যায় নি । নাম ভাঁড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় বলে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে পরিচিত । তবে যা প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে জানা যায় লোকটা এক আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানকারী দলের সঙ্গে যুক্ত । আগে খিদিরপুর অঞ্চলে এই সব কুকাজই করে বেড়াত, ইদানীং পুলিশের তাড়া খেয়ে ওখান থেকে পালিয়ে এসে বোধহয় এখানে আস্তানা গেড়েছিল । এরা চারাগাছের টব আর প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটের আড়ালে মাদক পাচার করত । জলপথে এদের সরবরাহ আসত, আর এখান থেকেই বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ত ।
    দাদুকে অন্ধকারে রেখে শুরু করলেও, দাদু ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিলেন । এদের কার্যকলাপের প্রমাণ হিসেবে এদের কনসাইনমেন্টের একটা প্যাকেট সরিয়েও ফেলেছিলেন । ঘোষ ম্যাডাম জানালেন যে প্যাকেটটা দেখতে ছোটোখাটো হলেও বাজারে ওর দাম কয়েক কোটি টাকা । কিন্তু দাদুর এই কাজটা ওদের নজরে আসতেই ওরা দাদুকে বন্দী করে । দাদুকে চাপ দিয়ে প্যাকেটটা হাতিয়ে নিয়ে দাদুকেই মেরে ফেলার প্ল্যান ছিল ওদের ।
    রতন একটা ভাড়াটে খুনে গুণ্ডা, ওর নামে পুলিশের খাতায় বেশ কয়েকটা কেস রয়েছে । দাদুকে ভয় দেখানো, গা-জোয়ারী আর জুলুমবাজির কাজটা সেই করত ।
    আবীর হিসেব রাখার কাজ করত । কোথায় কোথায় কত পরিমাণ সাপ্লাই দেওয়া হল, কোথা থেকে কত অর্ডার এলো ইত্যাদি ।
    আর হরিদাদুর কাটারীর কোপে যে কমবয়সী ছেলেটা মারা গেছে, তার নাম সমীর । হরিদাদুর নাতি । অল্পবয়সেই বখে গিয়েছিল । কিন্তু পড়াশোনায় জলাঞ্জলী দিয়ে কিভাবে এদের দলে ভিড়ল, তা এখনও জানা যায় নি । তবে এর হাত ধরেই এখানকার আড্ডা গড়ে উঠেছিল । সমুদ্রতটের লাগোয়া, নির্জন আর বর্ডার কাছে হওয়ার জন্যই এই জায়গাটা বেছে ওরা ঘাঁটি গেড়ে বসার প্ল্যান করছিল । পরে এরা দুজন বয়স্ক মানুষকে সরিয়ে দিয়ে পুরো জায়গা দখলের চিন্তাও করেছিল । প্রথমে সমীরকে সামনে রেখে ব্ল্যাকমেল করে, পরে ভয় দেখিয়ে এরা এখানে জাঁকিয়ে বসার ধান্দায় ছিল । কিন্তু মাঝখান থেকে আমি এসে পড়ায় এদের সব পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেছে ।
    এই এক নাতি ছাড়া, হরিদাদুর তিনকুলে কেউ নেই । স্ত্রী বিয়োগের পর ছেলে-বৌমাকেও হারাতে হয়েছে । এখন নাতির এই করুণ পরিণতিতে তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত থাকার জন্য গত রাতে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল । এখন আপাতত কাউন্সেলিং চলছে ।
    বেশ কিছু সময় ধরেই ঘোষ ম্যাডাম এই দলটার ওপর নজর রাখছিলেন । পর্যটক সেজে ওদের সকলের গতিবিধি লক্ষ্য করছিলেন । কিন্তু খদ্দের সেজে পিছু নিতে গিয়েই ধরা পড়ে গিয়েছিলেন তিনি । যদিও তাঁর পরিচয় ওরা জানত না । ওরা তাঁকে আর পাঁচটা সাধারণ বড়লোক বাপের বিগড়ে যাওয়া মেয়ের মতো ভেবেই কিডন্যাপ করেছিল, পরে হয়তো মুক্তিপণ চাইতো বা বেচে দেওয়ার চেষ্টা করত । আমাকে বাজিয়ে দেখার জন্যই সেদিন টোটোতে সহযাত্রী হয়ে আলাপ জমিয়েছিলেন ।
    কথা বলতে বলতে অনেক বেলা হয়ে গেল । সেই বয়স্ক ডাক্তারবাবু ফিরে এলেন, জানলাম তাঁর নাম ডাঃ সত্য রঞ্জন পাল । আমাকে একবার চেক-আপ করে বললেন, “মোটামুটি সব ঠিকই আছে, তবে আজকের দিনটা অবজারভেশনে রাখা ভাল । কাল সকালে আপনাদের রিলিজ করে দেব”। ডাঃ পালের সঙ্গে সঙ্গে সেনগুপ্ত সাহেব আর ঘোষ ম্যাডামও উঠে পড়লেন ।
    যাওয়ার আগে ঘোষ ম্যাডাম বললেন, “ইউ ক্যান কল মি ঋষাণী”, একটু থেমে আবার “গেট ওয়েল সুন, সি ইউ ল্যাটার …”, বলে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন । করমর্দনের আছিলায় আমার হাতে একটা ছোট্ট চিরকুট গুঁজে দিতে একটু অবাকই হলাম । মুখ তুলে তাকাতেই একটা ফিচেল হাসি দিয়ে, চোখ টিপে, হাতের ইশারায় বললেন, ‘কল মি’ । সামনে এগিয়ে যাওয়ার দরুন সেনগুপ্ত সাহেব বা ডাঃ পাল, কারোর নজরেই এলো না ব্যাপারটা । আমিও কিছু না বলে ডান হাতে থাম্বস-আপ দেখালাম । সবাই চলে যাওয়ার পর দেখি চিরকুটে নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, ই-মেল আই.ডি., সব লেখা আছে । নিজের মোবাইলে সেভ করতে করতে ভাবলাম, ‘কথায় বলে, পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা, এন.সি.বি. ছুঁলে ???’ – কথাটা মনে হতেই নিজের মনে একটু হেসে নিলাম ।

    to be continued…

    Chapter 8 (Coming soon, 27th April, 18)

  • ধারাবাহিক

    অপ্রত্যাশিত চিঠি – পর্ব ৬/৮

    অপ্রত্যাশিত চিঠি
    -রুদ্র প্রসাদ

     

     

    পঞ্চম পর্বের পর…..

    ( ২০ )

    কয়েকটা ধাপ নামতেই একটা ক্ষীণ আলোর রেখা চোখে পড়ল । আরও একটু নামতেই দেখি একটা বড়-সড় আন্ডারগ্রাউন্ড ঘর । অগোছালো ঘরের ভেতর দুটো কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে, আলোকিত করার পক্ষে যথেষ্ট না হলেও মোটামুটি ভেতরটা বেশ দেখা যাচ্ছে । যদিও দেওয়ালে রঙ না থাকায়, দেওয়াল গুলোকে কালচে মনে হচ্ছিল, ভালো করে দেখে বুঝলাম, প্লাস্টার করা আছে ঠিকই, তবে অযত্নের ফলে বেহাল দশা । দেওয়ালে কয়েক জায়গায় জলের ছাপও চোখে পড়ল । ঘরটা বড়ই স্যাঁতসেঁতে । ঘরের ভেতর কয়েকটা এক মানুষ সমান উঁচু, প্রমাণ সাইজের সেল্ফ আর একপ্রান্তে দুটো বড় টেবিল রয়েছে, যেখানে ল্যাবে দেখা সেই তিনজন ষণ্ডামার্কা লোক কি যেন কাজে ব্যস্ত । ঘরের অপরপ্রান্তে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম । একটা লোক আঙ্গুল উঁচিয়ে, ধমকে চলেছে আর সামনে তিনটে চেয়ারে তিনজনকে বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে ! ভালো করে দেখতেই তিনজনকে চিনতে পারলাম । বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখি দাদু, হরিদাদু আর সদ্য পরিচিতা রাই !!!
    পকেট থেকে দ্বিতীয় মোবাইলটা বের করে ঘরের ভেতরের অবস্থার ফটো আর ভিডিও তুলে সেনগুপ্ত সাহেবকে পাঠাতে গিয়ে, খেয়াল করলাম নেটওয়ার্ক নেই । একবার মনে হল, ওপরে গিয়ে মেসেজগুলো পাঠিয়ে দিয়ে আবার ফিরে আসব । কিন্তু ঠিক সেই সময়, সামনে দাঁড়ানো লোকটা একটা চড় মারল দাদুকে । দেখে নিজের অজান্তেই চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেল । স্থির করলাম, আর দেরী করা ঠিক হবে না । এমার্জেন্সী কিট থেকে পাঞ্চার দুটো বের করে দুহাতের আঙ্গুলে গলিয়ে নিলাম । কমাণ্ডো নাইফটা কোমরের হোল্ডস্টারে ঝুলিয়ে শাবলটাকে ডানহাতে নিলাম । সেল্ফের আড়ালে লুকিয়ে এগোতে এগোতে সকলের অবস্থান লক্ষ্য করছিলাম । দেখলাম ষণ্ডামার্কা লোক তিনটে নিবিষ্ট মনে কাজে ব্যস্ত । আরও একটু এগোতে দেখলাম, রতন আর সেই কমবয়সী ছেলেটা এমনি দাঁড়িয়ে আছে আর আবীর মেঝেতে বসে খৈণী ডলছে, সেল্ফের আড়াল ছিল বলে প্রথমে এদের দেখতে পাইনি । তবে যে লোকটা দাদুর সামনে দাঁড়িয়ে হম্বি-তম্বি করছে, একপাশ থেকে তার মুখটা দেখে চেনা চেনা লাগলেও আগে কোথায় দেখেছি, মনে পড়ল না । কিন্তু সেই লোকটাই যে পালের গোদা, সে বিষয়ে কোনো সংশয় রইল না । আপাতত কারোর কাছেই কোনো হাতিয়ার চোখে পড়ল না । ওদের সবচেয়ে কাছের সেল্ফটার পেছনে দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবলাম, ‘আচমকা আক্রমণে এরা নিশ্চয়ই হক্-চকিয়ে যাবে, আর সেই অবস্থার সুযোগটা আমাকে কাজে লাগাতেই হবে’ ।

    ( ২১ )

    শরীরটা টানটান করে একটা লম্বা শ্বাস নিলাম । ডানহাতের শাবলটা লাঠির মতো করে ধরে মনে মনে প্রস্তুত হলাম । তারপর নিয়মিত চর্চা করা ক্যারাটের শিক্ষা আর মনের সাহস সম্বল করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম । প্রথমে রতনের মাথার পেছনে সজোরে শাবলের বাড়ি মেরেই সামনের লোকটাকে একটা জোরালো সাইড-কিকে ছিটকে দিলাম । কমবয়সী ছেলেটা কিছু করে ওঠার আগেই তার চোয়াল লক্ষ্য করে একটা ঘুসি চালিয়ে দিলাম । এবার দেখি, আবীর একটা কাটারী হাতে উঠে দাঁড়িয়েছে । দেরী না করে পাশের সেল্ফটা তার ওপর উল্টে দিলাম । এবার বামহাতে ছুরিটা নিয়ে তিনজনের বাঁধন কেটে দিলাম । দেখলাম, বাকি তিনটে লোক এদিকে এগিয়ে আসছে । একসাথে তিনজনকে দেখে, চট করে বামদিকে সরে গিয়ে সামনের লোকটার ডানহাঁটুর নিচে একটা শাবলের ঘা লাগাতেই লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ল । আর আমিও সুযোগ বুঝে তার মাথায় আর এক ঘা লাগানোর সাথে সাথে বাঁহাতে ধরা কমাণ্ডো নাইফটা পাশের লোকটার পেট লক্ষ্য করে চালিয়ে দিলাম । দুজনকে একসাথে ধরাশায়ী হতে দেখে তৃতীয় লোকটা থমকে গিয়ে অন্যদিকে সরে গেল । তার দিকে এগোতে গিয়ে খেয়াল করলাম পালের গোদা লোকটা উঠে বসে, পকেট থেকে কিছু একটা বের করছে । অনুজ্জ্বল আলোতেও কালো চকচকে জার্মান মাউজারটা চিনতে কষ্ট হল না । দুপাশে বাল্বের আলো থাকলেও ঘরের মাঝখানে বেশ অন্ধকার । আমি সেই সুযোগে চট করে লাফিয়ে একটা সেল্ফের আড়ালে সরে যেতে যেতে শব্দে বুঝলাম, দুটো গুলি পর পর এদিকেই ছুটে এলো । তবে আলো-আঁধারির জন্যই বোধহয় নিশানা ঠিক করে উঠতে পারে নি । দেরি না করে, আড়াল থেকে বেরিয়েই শাবলটাকে লোকটার হাত লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারলাম । হাতে না লেগে কাঁধে লাগতেই লোকটা আবার পড়ে গেল । কাঁধে ঝোলানো কুড়ুলটা বের করে ওপাশের লোকটার এগোতে যাব এমন সময় হঠাৎ একটা ছুরি এসে সেল্ফটার গায়ে লাগল । সচকিত হয়ে দেখি, এ সেই কমবয়সী ছেলেটার কাজ ! বামহাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখের রক্ত মুছে, আবার একটা ছুরি ছোঁড়ার জন্য তৈরী হচ্ছে । কিন্তু ছুরিটা ছুঁড়তে পারল না । আবীরের হাত থেকে ছিটকে কাটারীটা মনে হয় হাতের কাছাকাছি পড়েছিল, সেটা দিয়েই এক কোপে সেই ছেলেটাকে ধরাশায়ী করল হরিদাদু ! বাকি ওপাশের লোকটাকে দেখে মনে হল ভয় পেয়েছে, সেল্ফের ওপাশ থেকে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে । আমার দিকে নজর নেই দেখেই ঘুরে তার পেছনে চলে এলাম । কুড়ুলের উল্টো দিকটা দিয়ে মাথায় মারতে যেতেই বোধহয় বুঝতে পেরে একটু সরে গেল । ঘা টা মাথায় না লেগে পিঠের ওপরের দিকে লাগায়, লোকটা সেল্ফটার সাথে ধাক্কা খেয়ে এদিকে ঘুরল । সঙ্গে-সঙ্গে আমার একটা রাউণ্ড-হাউস কিক সপাটে তার কানের গোড়ায় পড়তেই লোকটা কাটা কলা গাছের মত, ধপ করে মাটি নিল ।
    এবার সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেই লোকটা দাদুকে টেনে-হিঁচড়ে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আর আবীরও সেল্ফ ঠেলে বেরিয়ে এসে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে । দৌড়ে গিয়ে কাঁধের এক জোরালো ধাক্কায় আবীরকে পেড়ে ফেললাম বটে, কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দেরী হয়ে গেছে । সেই লোকটা দাদুকে টানতে টানতে নিয়ে সিঁড়ির অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে ।

    ( ২২ )

    কিছুটা সামলে পিছু নিয়ে সিঁড়ির কাছে পৌঁছাতেই ওপর থেকে আরও দুটো গুলি ছুটে এলো । তারপর আবার সব চুপচাপ । একটু অপেক্ষা করে সতর্কভাবে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলাম । টর্চ জ্বালিয়ে স্টোররুমটা ভালো করে দেখলাম, পাখি উড়ে গেছে । কেউ কোথাও নেই । এগিয়ে দেখলাম বাইরে বেরোনোর দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ । পরীক্ষা করে বুঝলাম, এই মজবুত দরজা ভাঙা, আমার একার পক্ষে সম্ভব নয় । সুতরাং সেই ফোকর গলেই বেরোতে হবে । দুজনকে সাথে নিয়ে কাজটা যথেষ্ট কষ্টকর হবে । কিভাবে করব, ভাবতে ভাবতে নিচে গেলাম । দেখি, সেই কমবয়সী ছেলেটার রক্তে চারপাশ ভেসে যাচ্ছে আর হরিদাদু চেয়ারে বসে শূন্যদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, কাটারীটা তখনও হাতে ধরা ! আর রাই তখনও অচৈতন্য …!!!
    কাছে গিয়ে হাত থেকে অস্ত্রটা সরিয়ে দিয়ে, কয়েক বার ডেকেও কোনো সাড়া পেলাম না । কাঁধে হাত দিয়ে একটু নাড়া দিতে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে আমাকে সামনে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ল । দেরী হয়ে যাচ্ছে দেখেই একটু কড়া ভাবে বললাম, “এখন কান্নাকাটি করার সময় নয় । আরও অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে” । চারপাশে চোখ চালিয়ে দেখলাম একেবারে লণ্ডভণ্ড অবস্থা । দেখি আবীর আর সেই ছুরিতে জখম লোকটা নড়ে-চড়ে উঠে বসার চেষ্টা করছে বটে, তবে বিশেষ কিছু করার অবস্থায় আছে বলে মনে হল না । তবুও কোনোরকম ঝুঁকি না নিয়ে, ঘুসি আর লাথি সহযোগে, দুটোকেই আবার শুইয়ে দিলাম । তারপর আমার নাইলনের দড়িটা থেকে কয়েকটা ছোট ছোট টুকরো করে সবকটাকে পিছমোড়া করে বেঁধে, মুখে গামছা ছিঁড়ে গুঁজে দিলাম । পরে আবার মনে হতে সবার পাগুলোও বেঁধে দিলাম । দড়িটা বেশ ছোট হয়ে গেলেও বাইরে যাওয়ার সময় যদি দরকার পড়ে, তার জন্য এখনও পর্যাপ্ত রয়েছে দেখে ভালো লাগল । ভাবলাম, ‘ভাগ্যিস দড়িটা বড় করে কিনেছিলাম’ ।
    এবার রাইকে ধরাধরি করে হরিদাদুর সঙ্গে ওপরে উঠে এলাম । কাঠের প্যাকিং বাক্সগুলোকে সিঁড়ির মতো করে সাজিয়ে ফোকরের কাছে যাওয়ার রাস্তা করে উঠতে বেশ কিছুটা সময় লাগল । প্রথমে নিজে বেরিয়ে এসে দড়ির একটা প্রান্ত গাছে ভালো করে বেঁধে দিয়ে আবার ফিরে এলাম । হরিদাদুকে ঠেলে-ঠুলে ফোকর দিয়ে ওপাশে পাঠানোর পর রাইকে কাঁধে তুলে বাইরে বের করে আনতে যথেষ্ট বেগ পেতে হল ।

    ( ২৩ )

    বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়েই চলেছে । চোখে-মুখে জলের স্পর্শ পেয়ে রাইয়ের জ্ঞান ফিরলেও আচ্ছন্নভাবটা কাটলো না । আমার কাঁধে ভর করে কোনোক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে, টলতে টলতে চলতে লাগল । বাড়ির কাছে পৌঁছেছি এমন সময়, বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে পুলিশের সাইরেন কানে এলো । একটু পরেই রাতের অন্ধকার ভেদ করে গাড়ির আলো দেখতে পেলাম । দেখতে দেখতেই পুলিশ এসে পড়ল, সামনেই সেনগুপ্ত সাহেব স্বয়ং ! কাছে আসতেই আমি তাড়াতাড়ি করে বললাম, “অনেক দেরী হয়ে গেছে, ওরা দাদুকে ধরে নিয়ে গেছে । ওদিকের গ্লাসহাউসের পেছন দিকটায় একটা স্টোররুম আছে, সেই স্টোররুমের নিচের বেসমেন্টে একটা লাশ পড়ে আছে । আর বাকি পাঁচজন লোক জখম হয়েছে, তাদের বেঁধে রেখে এসেছি” ।
    সেনগুপ্ত সাহেব অধস্তন অফিসারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে, হরিদাদু আর রাইকে পুলিশের জিম্মায় চিকিৎসার জন্য পাঠানো কথা বলে এদিকে আসতেই আমি আবার বললাম, “ওদের বেশি দূরে যেতে দেওয়া যাবে না, তাড়াতাড়ি চলুন”। বাইরে এসে দেখি সেই পিক-আপ ভ্যানটা তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে । মনে মনে ভাবলাম, ‘ভালোই হল, একটা গাড়ি খুঁজে বের করতে পারলেই কেল্লা ফতে’, ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল, উত্তেজনার বশে আমার কীর্তির কথা কাউকে বলা হয়নি । পুলিশের গাড়ির দিকে যেতে যেতেই সেনগুপ্ত সাহেবকে অন্য গাড়িটার মোটামুটি বর্ণনাসহ চাকার হাওয়া বের করে দেওয়া, ফুয়েল পাইপে ফুটো করা আর মোবাইল রেখে দেওয়ার করার কথাগুলো বলতেই অ্যাডিশনাল এস.পি. সাহেব “ওয়েল ডান”, বলে আলতোভাবে আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন । চলতে চলতেই ফোন করে আমার মোবাইল নম্বর আর গাড়ির কথা জানিয়ে দিয়ে অবিলম্বে নম্বরটা ট্র্যাক করার নির্দেশ দিলেন ।
    সঙ্কীর্ণ রাস্তা বলেই পুলিশের গাড়িটা ব্যাক-গিয়ারে পিছিয়ে আনতে হল বালিসাই-তাজপুর সি-বীচ রোড পর্যন্ত । গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া দুজন কনস্টেবল, সেনগুপ্ত সাহেব আর আমি । সেনগুপ্ত সাহেবের কাছে একটা পুলিশ স্পেশাল ০.৩৮ বোরের কোল্ট রিভলবার থাকলেও বাকি দুজনের কাছে আদ্যিকালের ০.৩০৩ ব্রিটিশ লী-এনফিল্ড রাইফেল দেখে খুব একটা ভরসা হল না । ওদের কাছে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারে ভেবেই, দাদুর জন্য দুশ্চিন্তা হতে লাগল । ইতিমধ্যে একটা ফোন আসায় সেনগুপ্ত সাহেব কথা বলতে লাগলেন ।
    ফোন রেখে ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে, আমাকে উৎকণ্ঠিতভাবে বসে থাকতে দেখে সেনগুপ্ত সাহেব বললেন, “ডোন্ট ওয়ারি, এখান থেকে বেরনোর সব রাস্তা বন্ধ, পেট্রলিং টীমকে বলা হয়েছে, এছাড়া কোস্টাল গার্ডের টীমকেও ইনফর্ম করা আছে, প্রয়োজনে সাহায্য পাওয়া যাবে । তাছাড়া লোকেশান ট্র্যাক হয়েছে, আমাদের থেকে তিন-চার কিলোমিটার সামনে আছে । আমরা সঠিক রাস্তায় যাচ্ছি । একটু পরেই ধরে ফেলব, পালানোর কোনো জায়গা নেই”। একটু থেমে আবার বললেন, “তোমার দাদুর কোনো ক্ষতি হতে দেব না, টেক মাই ওয়ার্ড”। বলেই একটা ট্যাবলেটে ম্যাপটা দেখালেন । জিপিএস সিস্টেম অনুযায়ী আমার মোবাইল লোকেশান সামনেই, তবে খুব আস্তে আস্তে যাচ্ছে । নির্দেশ মতোই তবে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তার জন্য গাড়ি চলল লাফিয়ে লাফিয়ে । বাইরে বৃষ্টিটাও তখন ধরে এসেছে ।

    to be continued…

    Chapter 7 (Coming soon, 26th April, 18)

  • ধারাবাহিক

    অপ্রত্যাশিত চিঠি – পর্ব ৫/৮

    অপ্রত্যাশিত চিঠি
    -রুদ্র প্রসাদ

     

     

    চতুর্থ পর্বের পর…….

    ( ১৫ )

    উত্তেজনার কারনেই বোধহয় বিশেষ ঘুমোতে পারলাম না । যদিও প্রথম দিনের মতো দেরী করেই নিচে এলাম । চুপচাপ চা-জলখাবার খেয়ে, ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । পুকুরের অন্য পাড় দিয়ে যেতে যেতে ছবি তুললাম এলোমেলোভাবে । উত্তর দিকে, প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেখি, একটা বেশ বড়সড় জঞ্জালের স্তূপ । সেখানে ছাইয়ের পরিমাণই বেশি, এছাড়াও সারের খালি প্যাকেট, কৌটো, শিশি-বোতল, কাটা ঘাস, আগাছা, লতাপাতা আর প্রচুর শুকিয়ে যাওয়া চারাগাছ চোখে পড়ল । মনে মনে ‘ছাই-গাদা’ বলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছি, এমন সময় হঠাতই দাদুর লেখা চিঠির শেষ অসমাপ্ত লাইনটা মনে পড়ে গেল । আবার ছাই গাদাটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতেই চোখে পড়ল, বেশ খানিকটা শিমূল তুলা ! বৃষ্টির জলে ছাইয়ের সাথে প্রায় মিশে গেলেও আলাদাভাবে চেনা যাচ্ছিল । একটা গাছের ভাঙা ডাল কাজে লাগিয়ে যতটা সম্ভব দেখলাম । কিন্তু পুরো ছাই গাদাটা মোটামুটি নাড়া-চাড়া করেও বিশেষ কিছু পেলাম না, সবই বাতিল জিনিসপত্র । এর চেয়ে বেশি দেখতে চাইলে কোদাল বা শাবল জাতীয় কিছু লাগবে, ভেবেই উঠে পড়লাম । ‘শিমূল গাছটাও এখান থেকে অনেকটা দূরে, তাছাড়া এখন তুলার সময়ও নয়, তাহলে এখানে এতো তুলা এলো কি করে ? একসাথে এতো চারাগাছ শুকিয়েই বা গেল কি করে’ ইত্যাদি ভাবতে ভাবতেই এসে পৌঁছালাম সেই বকুল গাছটার কাছে । চারপাশটা ভালো করে লক্ষ্য করার সাথে সাথে বিভিন্নভাবে ল্যাবের পেছনের দিকের বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম ।
    তারপর এদিক-ওদিক ঘুরে, ছবি তুলতে তুলতে, চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে এসে ঢুকলাম ল্যাবে । আগের দিনের মতোই সব চুপচাপ, শুধু মনে হল আজকের ব্যস্ততা যেন একটু বেশি । এদিক-ওদিক দেখছিলাম বটে, মনে মনে চিঠিটার কথাই ভাবছিলাম । যদি আমার ধারণা ঠিক হয়, তবে দাদু বলতে চেয়েছেন, ‘যেখানেই দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন’, ভাবতে ভাবতেই রতনের দিকে চোখ পড়ল । ‘এ কি কোনও সংযোগসূত্র হতে পারে ? না ছাইয়ের গাদায় কিছু সূত্র পাওয়া যেতে পারে ? না রতনই সব রহস্যের চাবিকাঠি ? না রতনের থেকে সাবধান হওয়ার কথা বলেছেন দাদু’ – কিছুই মাথায় এলো না । সবই যেন কেমন ধোঁয়াটে আর জটপাকানো ! এদের সবার হাবভাবই কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হল । সবাই যেন মুখে কুলুপ এঁটে থাকার প্রতিযোগিতায় নেমেছে !
    ল্যাবের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে পেছনের দিকে এসে একটা স্টোররুম দেখতে পেলাম । স্টোররুমের দরজাটা বেশ শক্তপোক্ত । খোলা দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, ভেতরে বেশ কিছু বস্তা আর ছোট-বড় কৌটো সাজিয়ে রাখা আছে । ঘরের ভেতরের দিকে রঙহীন প্লাস্টার করা দেওয়াল দেখে বুঝলাম, এই ঘরের দেওয়ালটাই বাইরে থেকে দেখেছি । আরও কিছু দেখার ইচ্ছে থাকলেও হল না, আমাকে এদিকে আসতে দেখেই রতন ঠিক পেছন পেছন এসেছে । আমি অন্যদিকে ঘুরতেই ঘরের ভেতরে গিয়ে একটা খালি বালতি বের করে এনে, দরজাটা বন্ধ করে দিল । আমিও ইতি-উতি দেখতে দেখতে কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলাম ।

    ( ১৬ )

    রাতে ঘুম না হওয়ার জন্য চোখ জ্বালা করতে লাগল । আর কোথায় না গিয়ে, ঘরে ফিরে এলাম । বসে বসে ভাবছিলাম, এখন কি করা যায়, এমন সময় সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত সাহেবের মেসেজ পেলাম, লিখেছেন, ‘পুলিশ ব্যাপারটা তল্লাশি করে দেখবে’ । ভাইকে অনলাইন দেখে, ওর সাথে চ্যাট করে আজ রাতের একটা পরিকল্পনা স্থির করলাম । তারপর কি করে সঠিকভাবে রাতের কাজটা করা যায়, ভাবতে ভাবতে নিচে নেমে এলাম । নিচের তলায় আবীর আর বাইরের রান্নাঘরে রান্নার লোক ছাড়া, আর কাউকে দেখতে পেলাম না ।
    বসার ঘরে বসে খবরের কাগজ দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম, আবীর বেরিয়ে ল্যাবের দিকে যাচ্ছে । কাগজটা রেখে দিয়ে, চারপাশ একবার সতর্কভাবে দেখে নিলাম । উল্টোদিকের ঘরটাতে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এলো । ঘরে একটা বিশাল বুকসেল্ফ আর কম্পিউটার দেখে মনে হল, সেটা দাদুর ঘর । বিছানাটা বেশ পরিপাটি হলেও বইপত্র আর কম্পিউটারের ওপর বেশ ধুলো জমেছে দেখে কি রকম একটা খটকা লাগল । পাশের দুটো ঘরও তথৈবচ ।
    রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়েই সিঁড়ির তলার জায়গাটা চোখে পড়তে দেখতে পেলাম, কোদাল, কুড়ুল, বেলচা, শাবল, কাস্তে, কাটারি, ঝুড়ি, বালতি ইত্যাদি রাখা আছে । প্রতিটা জিনিসই বিভিন্ন মাপের দু-তিনটে করে । রান্নাঘরে রাঁধুনীকে ব্যস্ত দেখে, চারপাশটা আর একবার সতর্কভাবে দেখে নিয়ে, সবচেয়ে ছোট শাবল আর কুড়ুলটা হাতিয়ে নিয়ে, ওপরের ঘরে ফিরে এলাম । ছোটখাট জিনিস দু্টো দিব্যি হাতিয়ার হিসাবে দারুণ কাজে লাগানো যাবে । ভাইয়ের সাথে আরও একদফা শলা-পরামর্শ সেরে, স্নান সেরে খেতে এলাম । দাদুর সাথে হালকা কথাবার্তার সাথে সাথে খাওয়ার কাজ সেরে, ওপরে এসে সটান শুয়ে পড়লাম । ক্লান্তির জন্য ঘুম আসতে দেরী হল না ।

    ( ১৭ )

    সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে ব্যাগের জিনিসপত্র নাড়া-চাড়া করছিলাম, এমন সময় রতন এলো । ব্যাগ গোছাচ্ছি দেখেই বোধহয় আর কিছু বলল না । রতন নিচে যাওয়ার একটু পরেই আমি জলখাবার খেতে নামলাম । খাওয়ার পর বললাম, “রাতে একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ব, কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে”।
    দাদু একটু উদাসভাবে বললেন, “ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেল তাহলে ?” আমি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে, ওপরে চলে এলাম । ল্যাপটপে তোলা ছবিগুলো সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর পরিকল্পনামতো সেনগুপ্ত সাহেবকে মেসেজ করলাম । একটু পরেই রিপ্লাই এলো, ‘আমার পক্ষে পুরো ব্যাপারটা খুব ঝুঁকির হয়ে যাবে, প্রাণ সংশয়ও হতে পারে, আমার এই সব ঝামেলায় জড়ানো উচিত নয়, যা করার পুলিশ করবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি । কয়েকটা ফোন সেরে নিচে এলাম । দাদুর সাথে গল্প করতে করতে রাতের খাওয়া শেষ করলাম । “সকাল সকাল বেরব”, বলে ওপরে এসে, চুপচাপ শুয়ে পড়লাম । বেশ কিছু সময় পর ঘরের দরজার বাইরে হালকা পায়ের শব্দ কানে আসতে বুঝলাম, রতনের নজরদারি চলছে । শব্দ না করে আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম । বারোটা বাজতেই উঠে তৈরী হতে লাগলাম । প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে, বেরুবার আগে, একই মেসেজ, ভাই আর সেনগুপ্ত সাহেব, দুজনকেই পাঠিয়ে দিলাম — “ইট’স শো-টাইম”।

    ( ১৮ )

    আগের দিনের মতোই, বেরনোর আগে নিচের তলাটা একবার চট করে ঘুরে এলাম । গতরাতের মতোই পুরো বাড়িতে আমি একা । আর দেরী না করে ছাদে উঠে এলাম । কালকের তুলনায় আজ বৃষ্টির বেগটা একটু বেশিই মনে হল । ছাদের কোণায়, নিমগাছের কাছে পৌঁছেই দেখতে পেলাম, গেটের দিক থেকে টর্চ জ্বেলে কয়েকজন এদিকেই আসছে । হাতঘড়ির স্টপওয়াচটা চালু করে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম । লোকগুলো বাড়ির সামনে দিয়ে ল্যাবের দিকে এগিয়ে যেতেই, নিচে নেমে এলাম । যতটা সম্ভব গাছ-গাছালির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে, দ্রুতপায়ে এলাম গেটের কাছে । কালকের মতোই দুটো গাড়ি । হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ি দুটোর কাছে গিয়ে, ভালো করে লক্ষ্য করে বুঝলাম, আজ গাড়ি দুটোতে কেউ নেই । পরিস্থিতি আমার অনুকূল দেখে একটু খুশিই হলাম ।
    এবার এমার্জেন্সী কিট থেকে আমার প্রিয় একফুট লম্বা আর একদিকে খাঁজকাটা, ধারালো কমাণ্ডো নাইফটা বের করে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম । দুটো গাড়ির চাকার হাওয়া বের করে ফুয়েল পাইপটা কাটতে কাটতে মনে হচ্ছিল, সময় যেন অতিদ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে । কার্য সমাধা করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝলাম, এই ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টিভেজা ঠাণ্ডা রাতেও প্রচণ্ড উত্তেজনায় ভেতরে ভেতরে বেশ ঘেমে গেছি । যেভাবে তেল পড়ছিল, সেটা দেখে মনে মনে আন্দাজ করলাম, ‘ট্যাঙ্ক যদি ফুল থাকে তো খালি হতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে । কালকের মতো সময় নিলে ভালো, এখানেই আটকে যাবে । না হলেও বেশি দূরে যেতে পারবে না । এখন পুলিশ সময়মতো এলে হয়’। পেছনের ফোর্ড এণ্ডেভার গাড়িটার নিচে নিজের একটা মোবাইল, চালু করে, জায়গা মতো স্টিকিং-প্লাস্টার দিয়ে আটকে দিলাম । পুরো কাজটা করে উঠতে অনেকটা সময় লাগল মনে হলেও ঘড়িতে আট মিনিটের সামান্য বেশি হয়েছে দেখে একটু আশ্বস্ত হলাম । যাই হোক, ‘দ্রুত পলায়নের রাস্তাটা কিছুটা হলেও বন্ধ করতে পেরেছি, আর যদি পালিয়েও যায়, তবে মোবাইল লোকেশান ট্র্যাক করে ধরে ফেলতে অসুবিধা হবে না’, এই ভেবে খুশি মনেই তৈরী হলাম ল্যাব অভিযানের জন্য ।

    ( ১৯ )

    ঘুরপথে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গিয়ে পৌঁছালাম ল্যাবের পেছনের দিকের বকুল গাছটার কাছে । চারপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে চড়ে বসলাম গাছে । ফোকরটা দিয়ে মাথা গলাতেই মাকড়সার ফাঁদ আর নোংরা, সারা মুখে জড়িয়ে গেল । ভেতরে জমাট অন্ধকার । কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কিছু ঠাহর হল না । কিছুটা অধৈর্য হয়েই দেওয়াল আঁকড়ে ঝুলে পড়লাম ভেতরে । মাটি থেকে ফোকরের উচ্চতা আন্দাজ করে মনে হল, মেঝে বেশ নিচুতে । যতটা সম্ভব নিঃশব্দে কপাল ঠুকে লাফিয়ে নামলাম । ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল । হাতড়ে হাতড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে হল, স্টোররুমটা আমার আন্দাজের তুলনায় বেশ বড় । চারপাশে অনেক ছোট-বড় বস্তা, প্যাকেট, কৌটো ইত্যাদি রাখা আছে । পা টিপে টিপে কিছুটা এগোনোর পর দরজাটা পেলাম । ভেজানো দরজাটা ঠেলে ল্যাবে ঢুকতেই অ্যালকোহলের ঝাঁঝালো গন্ধের সাথে আরও একটা কটু গন্ধ নাকে এলো, যে গন্ধটা সচরাচর শিব মন্দিরের আশেপাশে পাওয়া যায়, গাঁজার গন্ধ । বুঝলাম মৌতাত চলছে । হঠাৎ একটা চাপা শব্দ কানে আসতেই সতর্ক হয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালাম । কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না । মনে হল, যেদিক থেকে এলাম, সেই দিক থেকেই শব্দটা এলো । কিন্তু দেওয়াল পর্যন্ত গিয়েও কিছু দেখতে পেলাম না । বামদিকে যাওয়ার জায়গা নেই বলে এবার ডানদিকে চললাম । অন্ধকারে আবার হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে যেতে যেতে, কিছুটা গিয়ে পায়ে শক্ত বাক্সের মতো কিছু ঠেকল । হাত বুলিয়ে মনে হল কাঠের প্যাকিং বাক্সজাতীয় কিছু হবে । সেগুলোকে একপাশে রেখে সরে আসতেই হঠাৎ আবার একটা শব্দ পেলাম । যেন শব্দটা বাক্সগুলোর ওপাশ থেকেই আসছে । বাক্সগুলোর পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতেই একটা সিঁড়ি পেলাম, নিচের দিকে নেমে গেছে ! অদম্য কৌতুহল নিয়ে নামতে লাগলাম, শব্দের উৎসের খোঁজে ।

    to be continued…

    Chapter 6 (Coming soon, 25th April, 18)

  • ধারাবাহিক

    অপ্রত্যাশিত চিঠি – পর্ব ৪/৮

    অপ্রত্যাশিত চিঠি
    -রুদ্র প্রসাদ

     

     

    তৃতীয় পর্বের পর………

    ( ১০ )

    বিকেলে তাজপুরে নেমে একটা খালি টোটোতে উঠে বসে জানতে পারলাম, আরও দু-তিনজন যাত্রী না পাওয়া পর্যন্ত যাবে না । অগত্যা বসে বসে গান শুনছিলাম, এমন সময় দেখি সেই সৈকত সুন্দরী, এসে আমার সামনের খালি জায়গায় বসল ! কিছুক্ষণ আমাকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করে স্বগোতক্তি করল, “আমি পরে এসেছি, তার মানে আমার পিছু ধাওয়া করছেন না, … হুঁ ।” কোনো মন্তব্য না করে অন্যদিকে মুখ ফেরালাম । একটু পরে দেখি খুব স্মার্টভাবে ডানহাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “হাই, আমি রাই ।” হাতটা দেখে একটু আশ্চর্য লাগলেও করমর্দন না করেই মুখে “হ্যালো” ছাড়া আর কিছু বললাম না । আমার আচরণ বোধহয় তার ঠিক পছন্দ হ’ল না, এবার দেখি নিজেই আমার ডানহাতটা ধরে একটু ঝাঁকিয়ে নিল । ইতিমধ্যে আরও একজন যাত্রী পেয়ে টোটো চলতে শুরু করেছে । মৃদু আলাপচারিতার পর আমি রাস্তার পাশে মৎস্য দপ্তরের বিশাল জলাশয় ছাড়াও ছোট-বড় অনেক পুকুর দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম, মেয়েটা অনর্গল বকেই চলেছে । মনে মনে ভাবলাম, ‘এতো এনার্জি পায় কোত্থেকে কে জানে’ ! আমার গন্তব্যে পৌঁছে বিদায় জানাতে রাই বলল, “আবার দেখা হবে নিশ্চয়ই” । সম্মতিসূচকভাবে মাথা নেড়ে হাঁটতে শুরু করলাম ।
    বাড়ি ফিরে দাদুকে কোথাও দেখতে পেলাম না । রতন আর আবীর লালকে দেখতে পেলেও বিশেষ কিছু না বলে ওপরের ঘরে এলাম । হাত-মুখ ধুয়ে ক্যামেরাটা নিয়ে ছাদে যেতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির মুখে দরজাটা এমনি আটকানো, কোনো তালা-চাবির বালাই নেই । দরজা ঠেলে ছাদে গিয়ে দেখি, সেখানেও গাছপালার কমতি নেই । সারি সারি টবে প্রচুর গাছ লাগানো, পাতাবাহার আর ক্যাক্টাসই বেশি । ছাদে দাঁড়িয়ে গাছপালার ফাঁকে সূর্যাস্ত ক্যামেরাবন্দী করার সময়, ছাদ থেকে বাড়ির চারপাশটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলাম । নিম গাছটা নিচ থেকে দেখেছিলাম, এবার ছাদ থেকেও ভালো করে দেখে নিলাম । যতগুলো সম্ভব ছবি তুলে সূর্য ডোবার পর নিচে নেমে আসতে গিয়ে দেখি সিঁড়ির মুখেই রতন দাঁড়িয়ে । জিজ্ঞেস করে জানলাম, দাদু তখনও ফেরেন নি ।
    ঘরে এসে ল্যাপটপে বাড়ির চারপাশের ছবিগুলো দেখছিলাম, এমন সময় মায়ের ফোন । কথাবার্তা সেরে নিচে এসে জলখাবার খেয়ে আবার ঘরে গিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম । বিভিন্ন দিক থেকে, বাড়ির চারপাশের যত ছবি তুলেছি, আর ল্যাবের ভেতরের ভিডিওটেপটা বারবার করে দেখলাম । মনে মনে আর একবার পুরো পরিকল্পনাটা ভেবে নিয়ে ভাইকে মেসেজ করলাম, একটু পরে রিপ্লাই এলো, ‘সাবধানে’ ।
    ভেতরে ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে খেতে গেলাম । তখনও দাদুকে দেখতে না পেয়ে বেশ আশ্চর্য হ’লাম । জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ‘দাদু একটু আগেই ফিরেছেন । কোথাও গিয়েছিলেন, যেখানে অবেলায় খাওয়া হয়েছে । তাই রাতে আর কিছু খাবেন না । আজ একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছেন’ ।
    আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলাম । প্রতিটা খাওয়ারকেই সন্দেহ করার জন্য ঠিকমত খেতেও পারলাম না । যাই হ’ক, নামমাত্র খেয়ে উঠে পড়লাম । বিশেষ কিছু না বলে ওপরের ঘরে এসে টানটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম । বেশ কিছু সময় পর হঠাৎ মনে হ’ল ঘরের বাইরে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে । আমি চুপচাপ শুয়ে শুয়ে সময় কাটিয়ে যাচ্ছি । একসময় মনে হ’ল এখন আর কেউ নেই । রাত বাড়তে লাগল ।

    ( ১১ )

    বাইরে তখন হালকা বৃষ্টি পড়ছে । হাতঘড়িতে বারোটা বাজতেই উঠে পড়লাম । সদ্য কেনা গামছাগুলো দুটো করে জুতোর ওপর বেঁধে নিলাম, যাতে চলাফেরার সময় জুতোর ছাপ না পড়ে । নাইলনের দড়ির গোছাটা কাঁধে পেঁচিয়ে, এমার্জেন্সী কিটটা নিয়ে, উইন্ডচিটারটা গলিয়ে বেরিয়ে এলাম । চারপাশটা দেখতে গিয়ে বেশ অবাক হয়ে গেলাম । ওপরের তলায় আমি ছাড়া কেউ থাকে না – এটা আগের দিনই দেখেছিলাম । এখন দেখছি নিচের ঘরেও কেউ নেই ! ঘরগুলোর দরজা সব বাইরে থেকে বন্ধ !!!
    আর সময় নষ্ট না করে ছাদে এলাম । ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই নিম গাছ বেয়ে নিচে নামলাম । চলার পথের দুপাশেই বড় বড় ঘাস থাকায় মোটামুটি নিঃশব্দেই চললাম ল্যাবের দিকে । কিন্তু কিছুটা যাওয়ার পর দাঁড়াতে হ’ল । বাইরে গেটের কাছে একটা গাড়ি থামার আওয়াজ পেলাম । একটু পরেই শুনতে পেলাম কয়েকটা পায়ের শব্দ এদিকেই এগিয়ে আসছে । আর ঠিক তখনই খেয়াল করলাম, ল্যাবের দিক থেকেও এই দিকে কয়েকজন সশব্দে এগিয়ে আসছে । আমি ঠিক মাঝখানে ।

    ( ১২ )

    টর্চের আলোর সাথে সাথে পায়ের শব্দগুলো ক্রমশই এগিয়ে আসছে । স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে ছিলাম, হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি করে পাশের ভুঁই-চাঁপার ঝোপের আড়ালে গিয়ে এবড়ো-খেবড়ো জমিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম । অন্ধকারে কিছুটা চোখ সয়ে গিয়েছিল, ওদের টর্চের আলো আরও কিছুটা সুবিধা করে দিল, দেখলাম পেছনের দিক থেকে তিনটে লোক আসছে । তাদের মধ্যে দুজন একটা বস্তার মতো কিছু, ধরাধরি করে নিয়ে আসছে । সামনের দিক থেকে আরও দুজন লোক আসছে । দুপক্ষ এসে দাঁড়াল একেবারে আমার সামনে । বড় জোর কয়েক হাতের ব্যবধান । হাতের টর্চটা ঘুরিয়ে আলো ফেললেই চিত্তির – ভাবতেই শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল । কপাল ভালো বলতে হবে, সামনা-সামনি হতে উভয়পক্ষই টর্চের আলো নিভিয়ে ফেলল ।
    ল্যাবের দিক থেকে আসা দুজনের একজন নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করল, “সাহেব, আজ এতো দেরি ? রাস্তায় সমস্যা হয় নি তো ?” গলার আওয়াজে চিনলাম, এ সেই খিটকেল আবীর লাল মিশ্র ।
    ওদিক থেকে আসা সামনের লোকটাও চাপা গলায় উত্তর দিল, “সব ঠিক আছে” । আর কিছু না বলে, ওরা পাঁচজন ল্যাবের দিকে এগোল । আমিও কিছুটা দূরত্ব রেখে ওদের অনুসরণ করতে লাগলাম । ওরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল, কিন্তু দূরে থাকার জন্য কথাগুলো ঠিকমতো শুনতে পারছিলাম না ।
    ওরা ল্যাবের ভেতর ঢোকার পর, বাইরে থেকে দেখার চেষ্টা করে কোনও লাভ হল না । ভেতরে কোনো আলো না থাকায়, কিছুই বুঝতে পারলাম না । ল্যাবের চারপাশটা ঘুরেও কিছু উদ্ধার করতে পারলাম না, ওরা যেন জমাট অন্ধকারে কোথাও হারিয়ে গেল । হাল ছেড়ে দিয়ে, একটা আমগাছের আড়ালে থেকে, ল্যাবের দরজার দিকে নজর রেখে, অপেক্ষা করতে লাগলাম । সময় গড়িয়ে চলল ।

    ( ১৩ )

    বেশ কিছু সময় পর, ল্যাব থেকে চারজন বেরিয়ে এলো । বাইরের দিকে চলতে শুরু করল দেখে বুঝলাম, এরা ফিরে যাচ্ছে । আগের বারের মতো নয়, এবার দূরত্ব কমিয়ে, প্রায় ওদের পেছন পেছন চলতে লাগলাম । ঘরের সামনে এসে দলটা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, একটু আগে শোনা সেই সাহেব গলাটা নামিয়ে বলে উঠল, “সেই ছেলেটার কি খবর ? লালু, আজ আবার ওষুধ দিস নি তো ?”
    “না, আজ আর দেই নি”, আবীরও তেমনি উত্তর দিল, “খেয়ে-দেয়ে ঘুমোচ্ছে, রতন দেখে এসেছে । ওকে নিয়ে চিন্তা করবেন না সাহেব”।
    “আমি তো বললাম, চিন্তার কিছু নেই । তা ও তোরা শুনলি না, পেছন পেছন গেলি । আরে বাবা, এখানে বেড়াতে এসে একটা ছেলের কিছু হয়ে গেলে, পুলিশ এসে হাঙ্গামা বাধাবে না ? অত ঝামেলার কি দরকার ? তাছাড়া, কাল বাদে পরশু যখন চলেই যাবে, ফালতু ঘাঁটিয়ে লাভ কি ? খালি নজরে রাখিস । আমি না বললে, আগ বাড়িয়ে, নিজে থেকে কিছু করতে যাস না । বুজেছিস ?” বলে সেই সাহেব একটু থামল । তারপর আবার বলল, “চুপচাপ নিজের কাজ করে যা । আর বুড়োর খেয়াল রাখিস”। বলেই চলতে শুরু করল ।
    এই সাহেবের গলাটা আমার খুব চেনা লাগলেও ঠিক কার গলা আর কোথায় শুনেছি, কিছুতেই মনে করতে পারলাম । ভাবতে ভাবতেই ওদের অনুসরণ করতে লাগলাম । ওরা যখন গেটের কাছে পৌঁছাল, আমিও ততক্ষণে গাছের আড়ালে, ঝোপঝাড় ঠেঙিয়ে, কাঁটাতারের বেড়ার কাছে পৌঁছে গেছি । দেখলাম, একটা নয়, দুটো গাড়ি । মাঝারি উচ্চতার সেই সাহেব আর আবীর ছাড়া বাকি দুজন সামনের গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল । সামনেরটা ঠিক বুঝতে না পারলেও ওদের টর্চের আলোতে পেছনের কালচে গাড়িটা যে হাল আমলের ফোর্ড এণ্ডেভার, সেটা চিনতে অসুবিধা হল না । তবে নম্বরটা দেখা গেল না । সাহেবকে পেছনের গাড়িতে উঠতে দেখে বুঝলাম, গাড়িতে অন্তত একজন ড্রাইভার, আগে থেকেই আছে । গাড়ির ব্যাকসিটে বসে সাহেব বলল, “আজকের মালটা সাবধানে রাখিস । কোনোরকম ঝামেলার আভাস পেলেই আমাকে খবর দিবি”। গাড়ির ইঞ্জিন চালু হতেই আবীর ফিরতে উদ্যত হল । পেছনের গাড়িটা হেডলাইট জ্বালাতেই চমকে উঠলাম । সামনের নম্বরপ্লেট বিহীন পিক-আপ ভ্যানটার পেছনে, বামদিকে তিনকোনা রিফ্লেক্টরটা আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে !

    ( ১৪ )

    গাড়ি দুটো এগিয়ে গেল তাজপুর-বালিসাই সি-বিচ রোডের দিকে । আবীরকে ফিরে আসতে দেখে, কিছুটা পেছন পেছন আসার পর, যখন দেখলাম সে আবার ল্যাবের দিকে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ করে একটা কথা মনে হতেই অনুসরণ না করে উল্টোপথ ধরলাম । এবার গেট দিয়েই বাইরে এলাম । এসে বুঝতে পারলাম, আমার অনুমান সঠিক । সামনের ঐ অপরিসর রাস্তাতে এস-ইউ-ভি কেন, ছোট গাড়িও ঘোরানো অসম্ভব । তার মানে, গাড়ি দুটো উল্টো দিক থেকেই এসেছে । রাস্তাটা কোথায় গেছে, ওদিকে কি আছে কৌতূহল কিছুতেই দমন করতে পারলাম না । রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে । উত্তেজনার বশে খেয়ালই হল না কখন বৃষ্টির বেগটা বেশ বেড়েছে । কিছু দূর যেতেই সমুদ্রের গর্জন আর ঢেউ ভাঙার জোরালো আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পেলাম । আরও এগিয়ে দেখি, সমুদ্রের ধারেই পৌঁছে গেছি ! বিদ্যুতের ঝলকানিতে চোখে পড়ল, কয়েকটা নৌকা সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । তল্লাটে জন-মানবের কোনও চিহ্নই নেই । বৃষ্টিতে ভিজে শীত শীত করায়, আর দাঁড়িয়ে না থেকে, ফিরে চললাম ।
    ফিরে এসে ল্যাবের দিকে যাব বলে এগিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম । এভাবে সামনে দিয়ে যাওয়াটা বড় বেশি ঝুঁকিবহুল হয়ে যাবে, ভেবেই পুকুরের পাড় দিয়ে ঘুরে ল্যাবের পেছনের দিকে গিয়ে পৌঁছালাম । আন্দাজে বকুল গাছটার কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না । আলো জ্বালার সাহস হল না । আপশোস হতে লাগল, কেন যে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে রাখি নি । মনে মনে নিজের ওপর বিরক্ত হলেও, করার কিছু ছিল না । এমনি এমনি দাঁড়িয়ে থেকে, আর সময় নষ্ট না করে ফিরে চললাম ।
    এসে নিমগাছে চড়তে গিয়ে টের পেলাম, নেমে আসা যতটা সহজ কাজ ছিল, ওপরে ওঠা তার চাইতে ঢের বেশি কঠিন, বিশেষতঃ এই ভেজা গাছে । রীতিমতো পরিশ্রম করে, বেশ কিছু সময় ব্যয় করে, শেষ পর্যন্ত ছাদে উঠতে পারলাম । ছাদে উঠে বুঝতে পারলাম, বৃষ্টিটা বেশ ধরে এসেছে । দরজার কাছে এসে উইন্ডচিটার, জুতো, জামাকাপড় – সব খুলে, হাতে করে নিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে নেমে এলাম । ঘরে এসে, শুকনো জামাকাপড় পরার পর মোটামুটি বিস্তারিতভাবে সবকিছু ভাইকে মেসেজ করে যখন শুতে যাচ্ছি, তখন পূর্বদিক প্রায় ফরসা হয়ে এসেছে । শুরু হচ্ছে আরও একটা নতুন দিন ।

    to be continued…

    Chapter 5 (Coming soon, 24th April, 18)

  • ধারাবাহিক

    অপ্রত্যাশিত চিঠি -পর্ব ৩/৮

    অপ্রত্যাশিত চিঠি
    -রুদ্র প্রসাদ

     

     

    দ্বিতীয় পর্বের পর…..

    ( ০৬ )

    ওপরের ঘরে এসে, দরজার দিকে মুখ করে বসে, হ্যান্ডিক্যামের রেকর্ডিংটা ল্যাপটপে দেখতে লাগলাম । দেখতে দেখতে কয়েকটা জায়গায় খটকা লাগল । একটু ভেবে দেখলাম, যেভাবে আমাকে চোখে চোখে রাখা হয়েছে, তাতে করে ফোনে এসব আলোচনা করার ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো । হোয়াটস্অ্যাপে চ্যাটের মাধ্যমে ভাইকে মোটামুটি বিশদে সব বললাম । আর এ ও বললাম যে ‘চিঠিতে লেখা কথার সাথে দাদুর এখনকার হাবভাব ঠিক মিলছে না’ । সব শুনে ভাই বলল সতর্ক হয়ে সাবধানে থাকতে । আরও কিছু শলা-পরামর্শের পর চারটের দিকে উঠে পড়লাম ।
    ভাবলাম তাজপুর সৈকতে কিছু সময় ঘুরে আসি । নিচে নেমে আসতেই সেই খিটকেল মাঝবয়সী লোকটাকে সামনে পেলাম । জিজ্ঞেস করে জানলাম, তার নাম আবীর লাল মিশ্র, বাড়ি উড়িষ্যার নয়াগড়ে, সে আবার না কি দাদুর ম্যানেজার । যাই হ’ক, তাকে ‘একটু ঘুরে আসি’, বলে বেরিয়ে পড়লাম ।
    বালিসাই-তাজপুর সি-বীচ রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে, রাস্তার ধারে ফুটে থাকা একটা অচেনা জংলা ফুল দেখে ছবি তোলার সাধ জাগল । সাইড ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বের করতে গিয়ে হঠাৎ অজানা বিপদের আভাস পেয়ে, আন্দাজ করেই পেছনে ফিরলাম । দেখি, একটা গাঢ় নীল রঙের পিক-আপ ভ্যান প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছে । প্রায় শেষ মুহূর্তে বামদিকে ঝাঁপ দিয়ে কোনোক্রমে রক্ষা পেলাম । উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই ভ্যানটা অনেকটা এগিয়ে গেছে । নম্বর প্লেটটা দেখতে পেলেও নম্বরটা পড়তে পারলাম না । তবে ভ্যানটার পেছনে, বামপাশে একটা লাল রঙের তিনকোনা রিফ্লেক্টর দেখতে পেলাম, বিকেলের আলো পড়ে চকচক করছে । উঠে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে খেয়াল করলাম, অপ্রস্তুতভাবে পড়লেও বিশেষ চোট লাগেনি । পুরো ব্যাপারটা কোনো আনাড়ি ড্রাইভারের কেরামতি ভেবে ভুলতে চাইলেও মনের খচ্-খচানিটা গেল না । ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি নিয়েই প্রায় শুনশান রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছালাম সমুদ্রের কাছে । দেখলাম, তুলনামূলকভাবে প্রচার কম বলেই হয়ত এখানে ভিড়টা অনেক কম । ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকটা দোকান, মূলতঃ রেস্টুরেন্ট, একটা অস্থায়ী ওয়াচ টাওয়ারের সাথে এলোমেলো গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের সারিতে সাজানো, বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সাগর সৈকতটাকে এই পড়ন্ত বেলায় বেশ মোহময়ী লাগছিল । চমৎকার হাওয়াতে মনটাও বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠতেও বিশেষ সময় লাগল না । কয়েক জোড়া চোখের দৃষ্টি আমার ওপর নিবদ্ধ দেখে একটু অস্বস্তি হলেও খুব একটা আমল না দিয়ে, একটু এগিয়ে গেলাম, তারপর বালির ওপর বসে লাল কাঁকড়ার দৌড় আর ঢেউয়ের আনাগোনা দেখতে মন্দ লাগছিল না । লোকজনও বেশ কম । বেশ সময় কাটছিল । হঠাৎ চোখে পড়ল, সামনে এক সুন্দরী তন্ময়ভাবে ঝিনুক কুড়িয়ে চলেছে । আশেপাশে কোনো সঙ্গী-সাথী দেখলাম না । আর যারা আছে সব যে যার মত করে সূর্যাস্ত উপভোগে ব্যস্ত । বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেও বয়সের সঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না, তবে পঁচিশের আশেপাশেই হবে । তার দিকেই তাকিয়ে আছি – বুঝতে পেরেই বোধহয় ভ্রূ কুঁচকে একবার তাকালো, চোখাচোখি হতে আমি অন্যদিকে মুখ ঘোরালাম । এদিক-ওদিক তাকাতে খেয়াল করলাম, সেই কয়েকজোড়া চোখের দৃষ্টি, তখনও আমার ওপরই রয়েছে । খানিকটা বিরক্ত হয়েই উঠে পড়লাম ।
    সন্ধ্যা হয়ে আসছে । ইতস্ততঃ ঘুরতে ঘুরতে ফেরার পথ ধরলাম । হঠাৎ বিদ্যুতের ঝলকানিতে বুঝলাম, মেঘ ভালোই জমেছে । তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ফিরতে ফিরতেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । বাতাসের বেগ বাড়তে লাগল ।

    ( ০৭ )

    ফিরে এসে দেখি, যথারীতি লোডশেডিং আর দাদু চিন্তিতভাবে বারান্দায় পায়চারি করছেন । আমাকে দেখেই বললেন, “যাক, ফিরেছ ভালোই হয়েছে । বৃষ্টি আসতে চিন্তায় পড়ে গেছিলাম” । আমি “বিশেষ ভিজিনি”, বলে পাশ কাটিয়ে ওপরের ঘরে এসে, ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বার করে, যখন দেখলাম সব ঠিক আছে, একটু স্বস্তি পেলাম । জামাকাপড় পাল্টে নিচে এসে দেখি, দাদু নেই । রতনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, দাদু ল্যাবে গিয়েছেন । আর কথা না বাড়িয়ে চা-জলখাবার খেয়ে ওপরে এলাম ।
    ঘরে এসে কয়েকটা ফোন সেরে সারাদিনের কথা ভাবছিলাম, এমন সময় হোয়াটস্অ্যাপে ভাইয়ের দুটো মেসেজ এলো । প্রথমটা পড়ে আশাহত হলাম – ‘ঘুমের ঔষধের কোনো অ্যান্টিডোট নেই’ । অন্যটা পড়ে কিছুটা যেন আশা জাগল । ওর এক বন্ধুর জামাইবাবুর বন্ধু, সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত, পুলিশ অফিসার – বর্তমানে তিনি এখন অ্যাডিশনাল এসপি হিসাবে কাঁথিতে রয়েছেন, প্রয়োজনে সাহায্য করতে পারেন । মনে পড়ল, ভদ্রলোকের সাথে একবার ব্যক্তিগতভাবে আলাপ হয়েছিল । এখন মনে রেখেছেন কি না, কে জানে । এরপর ফেসবুক ঘাঁটাঘাটি করে সময় কাটানোর চেষ্টা করলেও মাথায় কালকের একটা পরিকল্পনা করছিলাম ।
    বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে । রাতে খাওয়ার সময়ও দেখলাম হরিদাদু নেই । জিজ্ঞেস করাতে দাদু বললেন, “ও একটু দেশের বাড়ি গেছে । চার-পাঁচদিন পর ফিরবে ।” খেতে বসে লক্ষ্য করলাম, আমাকে যা যা খেতে দেওয়া হয়েছে, দাদুকেও তাই দেওয়া হয়েছে – শুধু একটা পদ ছাড়া । দাদু সেটাকেই দেখিয়ে বললেন, “এটা আজকের স্পেশাল, সামুদ্রিক মাছের স্পাইসী কারি” । যখন দেখলাম সব খাওয়ারই এক জায়গা থেকেই দুজনকে পরিবেশন করা হচ্ছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হ’ল না যে ঐ স্পেশাল আইটেমটাই যত নষ্টের গোড়া । কিছু মেশানো থাকলে ওটাতেই থাকবে । বাকি সব খাওয়ার পর ওটাকে নামমাত্র মুখে ছুঁইয়ে উঠে পড়লাম ।
    বাইরে বৃষ্টির বেগ আরও বেড়েছে । ওপরে এসেই সতর্কতামূলকভাবে গলায় আঙুল দিয়ে বমি করার চেষ্টা করে দেখলাম, ব্যাপারটা মোটেই সহজ নয় । বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় কিছুটা সফল হলাম বটে, কিন্তু নিঃসংশয় হতে পারলাম না । গতরাতের মতো না হলেও একটা হালকা ঝিমুনি আজও এলো, তবে অনেক দেরিতে । মনে মনে কাল সারাদিনের কর্মসূচিটা ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়লাম ।

    ( ০৮ )

    গতকালের তুলনায়, আজ বেশ সকালেই ঘুম ভাঙল । উঠে পড়ে বেরোতে গিয়েও বেরোলাম না । ঘরে বসেই মনে মনে সারাদিনের কর্মসূচির একটা খসড়া করে ফেললাম । কিছু সময় পর, গতকালের মতই নিচে এলাম । আজও দাদুকে দেখতে পেলাম না । জলখাবার খেয়ে বাড়ির চারপাশে ঘুরে দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল, পূর্বদিকে বাড়ির একেবারে গা-ঘেঁসে একটা ঝাঁকড়া নিম গাছ । দেখে মনে মনে ভাবলাম, গাছটা প্রয়োজনে খুব কাজে আসতে পারে । আরও একটু এগিয়ে যেতে চোখে পড়ল একটা বড়-সড় পুকুর, বাঁধানো ঘাটও রয়েছে একটা । কিন্তু চারপাশে আম-জাম-পেয়ারা-শিমুল-শীরিষ-নারকেল ইত্যাদি গাছ এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে, বাড়ি থেকে পুকুরটা প্রায় দেখাই যায় না ।
    পুকুরের পাড় বরাবর ঘুরে পৌঁছালাম ল্যাবের পেছনের দিকে । দেখি ল্যাবের সেদিকের দেওয়ালটা ইঁটের । দেওয়ালের ওপরের দিকে একটা বড় গর্ত, যেটা পাশের একটা বকুল গাছে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে । ‘হয়ত এক্সস্ট ফ্যান লাগানোর জন্য করা হয়েছিল, পরে আর লাগানো হয় নি’, পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে হ’ল । একটু এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল একটা বিশাল মাচা বাঁধা হয়ে আছে । জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন লতানে গাছ লাগানো আর মাচা থেকে ঝুলে আছে ঝিঙে, চিচিঙ্গে, উচ্ছে, চাল-কুমড়ো, কুমড়ো আরও কত কি ! তার একপাশে সারিবদ্ধভাবে লাগানো ঢ্যাঁড়শ গাছও দেখলাম । ফল ধরে থাকায় গাছগুলো চিনতে অসুবিধা হ’ল না । সামনে একটা বিরাট চালতা গাছ দেখে এগিয়ে দেখি, পাতাসহ একটা চালতার ওপর ফড়িং বসেছে । ছবিটা তুলতে তুলতেই পেছন থেকে আওয়াজ এলো, “কি … কেমন দেখছ ?”
    ভিউ ফাইন্ডার থেকে চোখ না সরিয়েই জবাব দিলাম, “দারুণ !” ছবি তোলার পর দাদুকে বললাম, “কালকের বৃষ্টির জন্য ক্যামেরার লেন্সে জলীয় বাষ্প জমে গেছে । পরিষ্কার না করালে লেন্সটার ক্ষতি হতে পারে । তোমার কোনো চেনাশোনা দোকান আছে ? কাছাকাছি কোথাও । তাছাড়া কিছু কেনাকাটাও করার ছিল” ।
    দাদু একটু ভেবে বললেন, “এখানে কেনাকাটা করার মতো কি আর আছে । তুমি বরং কাঁথি চলে যাও । ওখানে কয়েকটা বড় দোকান আছে । তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পেলেও পেতে পার” । মনে মনে ভাবছিলাম, কি করে কাঁথি যাওয়ার বাহানা করব, এখন নিজে থেকে বলায় সুবিধাই হ’ল । দেরি না করে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম কাঁথির উদ্দেশ্যে ।

    ( ০৯ )

    কাঁথি সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে জিপিএস থাকলেও আশেপাশে জিজ্ঞেস করতে করতে চললাম । কিছুটা এগিয়ে এসে পড়লাম কাঁথি সুপার মার্কেটে । ভেতরে ঢুকে দেখি, নামেই সুপার মার্কেট ! আদতে একটা বড় বাজারই বলা চলে । এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে এগোচ্ছিলাম, এক জায়গায় চোখে পড়ল ছোট ছোট গামছা বিক্রী হচ্ছে । নেড়ে-চেড়ে বুঝলাম, এগুলো বেসিনের পাশে রাখা তোয়ালের বদলে বা ঘরদোর মোছার কাজে লাগতে পারে । একটা মতলব মাথায় আসতেই বেশ কয়েকটা কিনে নিলাম । বেশ সস্তাই বটে । আর একটা দোকান থেকে কিনলাম শক্ত অথচ হালকা নাইলনের দড়ি । আর বেশি দেরি না করে পা চালালাম গন্তব্যের দিকে ।
    ভাগ্য ভালো বলতে হয়, পৌঁছে সিদ্ধার্থ সেনগুপ্তকে তাঁর অফিসেই পাওয়া গেল । দেখা পেতেও বিশেষ অপেক্ষা করতে হ’ল না । ভদ্রলোকের স্মৃতিশক্তি বেশ প্রখর, পরিচয় দিতেই চিনতে পারলেন – ব্যাপারটা দেখে একটু অবাক হ’লেও মুখে কিছু বললাম না । সাদরে বসিয়ে মন দিয়ে আদ্যোপান্ত শুনলেন । আমার কথার মাঝে প্রশ্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জেনে নিলেন, যদিও যতটা সম্ভব রেখে-ঢেকেই বললাম । সবশেষে আমাকে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন । ওনার বদান্যতায়, সৌভাগ্যক্রমে জুটে গেল স্থানীয় রামকৃষ্ণ মিশনের জন্মাষ্টমীর ভোগ । ওখানে বসেই নানাবিধ কথাবার্তা সেরে, প্রয়োজনে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি নিয়ে তখনকার মতো বিদায় নিলাম ।
    বাইরে এসে ভাইকে ফোনে সব কথা বলে নিজের পরিকল্পনার কথাও বললাম, সব শুনে ভাই বলল, “যাই করিস সাবধানে আর দেখেশুনে, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা আর কি” । কথা শেষ করে আবার ফিরে চললাম তাজপুর ।

    to be continued…

    Chapter 4 (Coming soon, 23rd April, 18)

  • ধারাবাহিক

    অপ্রত্যাশিত চিঠি -পর্ব ২/৮

    অপ্রত্যাশিত চিঠি
    -রুদ্র প্রসাদ
    প্রথম পর্বের পর…

    ( ০৪ )

    যাত্রাপথে পেরিয়ে এলাম অনেক ছোট-বড় জনপদ । গঙ্গা পেরিয়ে দামোদর আর রূপনারায়ন ছাড়াও বেশ কয়েকটা নাম না জানা নদ-নদী পড়ল । নদীর বুকে জায়গায় জায়গায় জেগে ওঠা চড়া আর প্রায় বুজে আসা নদীগর্ভে ক্ষীণ জলধারার জন্য তাদের নদীসুলভ না দেখালেও পারাপারের সেতুর বিস্তার দেখে তাদের অতীতের প্রকৃত ব্যাপ্তি অনুমান করতে কষ্ট হয় না । দু-তিনটে স্বল্প বিরতি ছাড়া মোটামুটি দ্রুতই এলাম । প্রায় চার ঘন্টার বাসযাত্রা শেষে নামলাম, জায়গাটার নাম তাজপুর মোড়, বালিসাই । আশেপাশে জিজ্ঞেস করে জানলাম তাজপুর সৈকতে যাওয়ার জন্য ট্রেকার আর টোটো চলে, আমাকেও ঐ পথেই যেতে হবে । একটা শেয়ারের টোটোতে উঠে ঠিকানা বলতেই পাশে বসা এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক বললেন, “সঙ্গে আসুন, আমিও ওদিকেই যাচ্ছি । আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে দেব ।” বালিসাই-তাজপুর সি-বিচ রোড ধরে যাওয়ার সময় নজরে পড়ল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কয়েকটা বাড়ি-ঘর, বেশ কিছু ফিশারী আর ফাঁকা জমি । রাস্তায় কিছু ট্যুরিস্টদের গাড়ি, সাইকেল আর মোটরসাইকেল ছাড়া লোকজনের বিশেষ আনা-গোনা চোখে পড়ল না । কিছুটা আসার পর টোটো থামিয়ে দিয়ে সেই ভদ্রলোক বললেন, “এখানে নেমে ঐ বাঁদিকের রাস্তাটা ধরে চলে যান । একটু এগিয়ে মোড় ঘুরলেই কাঁটাতারের বেড়া দেখতে পাবেন । ওটাই ভৌমিকবাবুর বাড়ি” । বিদায়ী নমস্কার জানিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম ।
    পৌঁছে দেখি, গাছ-গাছালির ভেতরে যে একটা বাড়ি আছে, বোঝার উপায় নেই । সামনের নুড়ি বিছানো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, ‘সবুজায়ন’ কথাটা যেন চাক্ষুষ করলাম । শুনশান বাড়ির চারপাশে, গোধূলি বেলার আলো-আঁধারিতে যতদূর দৃষ্টি যায়, শুধুই সবুজের সমারোহ । ডোরবেল বাজিয়ে কোনও কাজ হ’ল না । বেশ কয়েক বার ডাকা-ডাকি করার পর একজন মধ্য চল্লিশের লোক এসে দরজা খুলে বাইরে এল । কাকে চাই, কোথা থেকে আসছি, কেন এসেছি ইত্যাদি জেরায় রীতিমত জেরবার করে, শেষ পর্যন্ত দাদুর লেখা চিঠি দেখাতে তবে, ভেতরে যেতে দিল । জিজ্ঞেস করলাম, “দাদু, হরিদাদু – এরা সব কোথায় ?” লোকটা উত্তর না দিয়ে, ইশারায় বসতে বলে চলে গেল । বুঝতে পারলাম, লোডশেডিং, ঘরে যে অনুজ্জ্বল আলোটা জ্বলছে, সেটা সম্ভবত সোলারের আলো । চোখ বুলিয়ে দেখলাম, ঘরে একটা জলচৌকি, একটা টেবিল, তিনটে চেয়ার আর একটা পেল্লায় বই বোঝাই শো-কেস । বেশির বই উদ্ভিদবিদ্যা সংক্রান্ত হলেও সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা ছাড়া, বেশ কিছু গল্পের বইও আছে । বেশ খানিকক্ষণ দাদু এলেন, সঙ্গে হরিদাদু, বললেন, “যাক, এসেছ তাহলে, ভেবেছিলাম আসবেই না” । প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই জড়িয়ে ধরলেন, বুঝলাম এখনও যথেষ্ট শক্তি ধরেন । শুধু হরিদাদুকে দেখে মনে হল কেমন যেন শুকিয়ে গিয়েছেন । ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসার পর বললেন, “অনেকদূর থেকে এসেছ, হাত-মুখ ধুয়ে নাও । চা খেতে খেতে কথা বলা যাবে” । বলেই হাঁক দিলেন, “রতন …”। এক বছর তিরিশের স্বাস্থ্যবান যুবক আসতে তাকে বললেন, “দাদাকে ওপরের ঘরে নিয়ে যা” । রতনের পেছনে অপরিসর সিঁড়ি ভেঙে উঠার সময় খেয়াল হ’ল, বাইরে জমাট অন্ধকার । দোতলার পশ্চিম দিকের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে যখন ঘরের আলোটা জ্বালালো, তার গেঞ্জির তলা দিয়ে বেরিয়ে আসা পেশিবহুল হাতটা দেখে মনে মনে তারিফ করতে করতে ভাবলাম, ‘নিয়মিত শরীরচর্চা করে নিশ্চয়ই’ ।
    আমাকে ঘর দেখিয়ে রতন চলে যাবার পর দেখলাম, ঘরটা বেশ বড় হলেও একটা বড় বিছানা, টেবিল-চেয়ার আর আলনা ছাড়া, আর কিছু নেই । একসাথে না হলেও ঘরের পাশেই বাথরূম । জামাকাপড় ছেড়ে মাকে ফোন করে নির্বিঘ্নে পৌঁছানোর আর এখানকার খবরাখবর দিলাম । ফোনে কথা বলার সময় মনে হ’ল, দরজার বাইরে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে । কিন্তু বেরিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না, এমনকি, পুরো দোতলায় আমি ছাড়া, আর কেউ নেই !
    নিচে নেমে যেতে দাদু বললেন, “তুমি চা-টা খাও । আমাকে একটু যেতে হবে । পরে কথাবার্তা হবে” । চা-জলখাবার খেয়ে ওপরে এসে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বের করছি, এমন সময় কারেন্ট এলো । উজ্জ্বল আলোয় লক্ষ্য করলাম, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হলেও ঘরটা ভীষণ স্যাঁতসেঁতে, চারপাশে এত গাছপালা থাকার কারণেই মনে হয় । ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, মোবাইল, পাওয়ার ব্যাঙ্ক – সব চার্জে বসিয়ে, কি মনে করে এমার্জেন্সী কিটটা নিজের কাছে রেখে দিলাম । হঠাৎ খেয়াল হ’ল, পুরো বাড়িটা কেমন আশ্চর্য রকম নিঃস্তব্ধ, যেন কোনও জনপ্রাণীই নেই ।
    এরপর বেশ কিছু সময় ফেসবুকে মগ্ন ছিলাম । রতনের ডাকে বুঝলাম, খাওয়ার সময় হয়েছে । ল্যাপটপটা বন্ধ করে নিচে এসে দেখি, আয়োজন বিস্তর ! দাদু বললেন, “তোমাকে রোজ রাতে একটা করে স্থানীয় বিশেষ পদ রান্না করে খাওয়াব । আজ সামুদ্রিক কাঁকড়া । খেয়ে দেখ, এমনটা তোমাদের শহরে কোথাও পাবে না” । যদিও কাঁকড়া খুব একটা পছন্দ করি না, তাও জোরাজুরিতে শেষ পাতে খানিকটা খেতে হল । খাওয়ার পর দাদু বললেন, “ক্লান্ত আছ, এখন বিশ্রাম নাও” ।
    ওপরের ঘরে এসে ফোনে কথা বলতে বলতে খেয়াল করলাম, মাথাটা ঝিম্-ঝিম্ করছে । ফোনটা রেখে শুয়ে পড়ার জন্য মশারিটা ঠিক করতে করতে বুঝতে পারলাম অস্বস্তি বাড়ছে । হাত-পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে । বাথরূম সেরে কোনোমতে টলতে টলতে ফিরে এসে বিছানায় গড়িয়ে পড়তে পড়তে বুঝতে পারলাম চোখ জড়িয়ে আসছে …!!!

    ( ০৫ )

    সকালে ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে । অস্বস্তি নিয়ে উঠে বসে কালকের কথা ভাবছিলাম । এলোমেলো চিন্তা-ভাবনা করতে করতে প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে ঘরে এসে জামাকাপড় বের করতে গিয়ে বুঝলাম, কেউ আমার ব্যাগ হাতড়েছে ! আপাতদৃষ্টিতে সব ঠিকঠাক মনে হলেও দেখলাম, অন্যকিছুই খোয়া যায়নি, শুধু দাদুর চিঠিটা নেই ! খালি খামটাই রয়েছে …!!!
    মনের খচ্-খচানিটা চেপে নিচে নেমে এসে জানলাম, আমার জন্য দাদু অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু দেরী দেখে একটু আগেই প্রাতরাশ সেরে কোথাও বেরিয়েছেন । হরিদাদুকেও কোথাও দেখতে পেলাম না ।
    জলখাবার খেয়ে ক্যামেরা আর হ্যান্ডিক্যামটা নিয়ে বাড়ির চারপাশটা দেখব বলে বেরিয়ে, ঘুরতে ঘুরতে বুঝতে পারলাম, জায়গাটা আমার অনুমানের চেয়ে ঢের বড় আর অজস্র গাছ-পালাতে ভর্ত্তি । বাড়ির ভেতরে-বাইরে সবুজ রঙ আর নামটাও ‘সবুজ বীথি’ দেখে মনে মনে হেসে ফেললাম ।
    পূর্বদিকে, বাড়ির পেছনের দিকটায় একটু এগোতেই দেখি আরও একটা ঘর, তবে কাচ দিয়ে ঘেরা । কাছে গিয়ে দেখি, বৃহৎ কর্মকাণ্ড ! ঘর না বলে কাচ দিয়ে ঘেরা একটা বড়-সড় জায়গা বললে অত্যুক্তি হয় না । দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড় ! আন্দাজে মনে হ’ল, এই একটা ঘরের ভেতর, প্রমাণ সাইজের স্কোয়াশ কোর্ট, কমপক্ষে গোটা কুড়ি, অনায়াসে ঢুকে যাবে । ভেতরে ঢুকতেই আগে চোখে পড়ল হরেকরকমের ছোট-বড় চারাগাছ – কোনোটা টবে, কোনোটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে, কোনোটা আবার মেঝেতে তৈরি করা কৃত্রিম শয্যায় ….। এক একটির এক একরকম রূপ । কয়েকটাতে আবার কিছু রঙ-বেরঙের নাম না জানা ফুল ফুটে রয়েছে ।
    এই সবই দেখতে দেখতে এগোচ্ছিলাম, হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হ’ল – সামনে দাদু ! অ্যাপ্রন আর গ্লাভস পরে, আমার দিকে পেছন ফিরে, সাথের তিনটে ষণ্ডামার্কা লোককে অনুচ্চস্বরে কিছু বলছিলেন । আমার আসাটা খেয়াল করেন নি ।
    পেছনে হঠাৎ করোর উপস্থিতি টের পেয়ে পেছন ফিরে দেখি, রতন । গলা খাঁকরি দিয়ে, যেন প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি জোরেই বলল, “দাদা এখানে ! আর আমি ওদিকে খুঁজছিলাম” । আওয়াজ পেয়ে দাদু এগিয়ে এসে বললেন, “এসেছ ভালো, সবকিছু ঘুরে দেখ । তবে, কোনও কিছুতে হাত দিও না । কিছুক্ষণ আগেই বিষাক্ত ঔষধ দেওয়া হয়েছে” । হাবভাবে মনে হ’ল না যে, আমি এখানে এসেছি বলে খুশি হয়েছেন, বরং একটু বিরক্তই মনে হ’ল ।
    মাথা নেড়ে, “আচ্ছা”, বলে চারদিকটা ঘুরে দেখতে দেখতে একটা খুব সুন্দর ফুল দেখে ক্যামেরাবন্দী করতে যাব, এমন সময় একটা ক্রুদ্ধ আর ঘড়ঘড়ে আওয়াজে তাকিয়ে দেখি, কাল সন্ধ্যায় জেরা করা সেই মাঝবয়সী লোকটা, ছবি তুলতে বারণ করছে ! দাদু দেখে, একটু হেসে, বললেন, “এখানে ছবি-টবি তুলবে না । এই ঘরের ভেতর যত চারাগাছ দেখছ, সব গুলোই আর কিছুদিন পর বাইরে যাবে । এখনও পর্যন্ত ওগুলো খোলা আলো-বাতাস পায়নি । বাইরে যাওয়ার আগে ছবি তোলা নিষেধ, নজর লেগে যাবে । এদের যতসব কুসংস্কার আর কি” ।
    “ঠিক আছে”, বলে ক্যামেরার লেন্স খুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে ভাবছিলাম, ‘একজন আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হয়েও দাদু এই সমস্ত ফালতু কুসংস্কার প্রশ্রয় দিচ্ছেন কি করে ! ছবি তোলার জন্য ডেকে এনে এখন নিজেই বারণ করছেন !’ অবাক হয়ে এই সব ভাবতে ভাবতেই ফুলটার দিকে চোখ পড়ল, সত্যিই খুব সুন্দর । ছবি তোলার লোভ সামলাতে না পেরে, ক্যামেরাটা ব্যাগে ঢোকানোর আছিলায় হ্যান্ডিক্যামটা অন করে দিলাম । ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মোটামুটি ল্যাবের ভেতরের হাল-হকিকৎ যতটা সম্ভব রেকর্ড করতে করতে ভান করলাম যেন, ব্যাগে ঢুকছে না বলে বাধ্য হয়েই হ্যান্ডিক্যামটা হাতে রাখতে হয়েছে । মনে মনে ভাবলাম, ‘ভাগ্যিস, বড় ব্যাগটা সঙ্গে আনি নি, না হ’লে হয়ত এটাকেও ব্যাগে ঢোকাতে বলত’ ।
    সতর্কভাবে চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে লক্ষ্য করলাম, দাদু, রতন, মাঝবয়সী লোকটা ছাড়াও তিনটে লোক আর একটা কমবয়সী ছেলে রয়েছে । দাদু চারাগাছগুলোর কাছে গিয়ে একটা ক্লিপবোর্ডে আটকানো কাগজে কিছু নোটস্ নিয়ে রাখছেন । কিন্তু দেখে মনে হ’ল, লেখা নয়, যেন এমনি আঁকিবুকি কাটছেন ! বাকিরাও কিছু-না-কিছু কাজ করছে বটে, তবে দেখে মনে হ’ল না তারা কেউই এধরনের কাজে অভ্যস্ত ! শুধু রতনকে দেখলাম, কিছু না করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে, আর মাঝে মাঝে আড়চোখে আমাকে দেখছে । বুঝলাম, আমাকে নজরে রাখাই ওর কাজ । কিছু সময় ল্যাবে কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম ।
    ঘরে এসে কয়েকটা ফোন সেরে, ভাইকে হোয়াটস্অ্যাপে মেসেজ করলাম, ‘বেশ কিছু সন্দেহজনক ঘটনা দেখছি, আলোচনা করব’ । একটু পরে রিপ্লাই এলো, ‘লাঞ্চের পর’ ।
    দুপুরে খেতে এসে দেখি, দাদু একটু যেন গম্ভীর হয়ে আছেন । ‘কি হয়েছে ?’, জিজ্ঞেস করাতে খানিকটা উষ্মা নিয়েই বললেন, “এমনিতে তো কোনো খোঁজ-খবর রাখোই না, নেহাত চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠালাম বলেই এলে । ব্যস্ততার মাঝে ভালো করে দুটো কথাও বলা হ’ল না আর এদিকে তোমার ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেল ! তুমি তো বিকেলেই চলে যাচ্ছ ?”
    হেসে বললাম, “এই কথা ? কিন্তু আজ বিকেলে তো যাচ্ছি না । আরও দুদিন থাকব । জন্মাষ্টমী আর স্বাধীনতা দিবসের ছুটি কাটিয়ে তবেই ফিরব । এবার খুশি তো ?”
    “সত্যি বলছ !” – জিজ্ঞেস করলেন বটে, তবে অভিব্যক্তিতে মনে হ’ল না খুব একটা প্রসন্ন হয়েছেন ! কিছু না বলে, মাথা নেড়ে সায় দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম । মোটামুটি চুপচাপ খাওয়া শেষ হ’ল । লক্ষ্য করলাম, এখানেও হরিদাদু অনুপস্থিত ।

    to be continued…

    Chapter 3 (Coming soon, 22nd April, 18)

  • ধারাবাহিক

    অপ্রত্যাশিত চিঠি -পর্ব ১/৮

    অপ্রত্যাশিত চিঠি
    -রুদ্র প্রসাদ 

     

     

     ( ০১ )
       কয়েক দিন হল, একটানা বৃষ্টি হয়ে চলেছে । আজও সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার । সারারাত এক নাগাড়ে ঝরার পরও বিরাম নেই । এখনও টিপ্-টিপ্ করে পড়ে চলেছে । আর এই রকম আবহাওয়ার সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে চলছে লোডশেডিং । সোলার এনার্জির আর কতটুকু ক্ষমতা !
       এমন একটা মনোরম সকালকেও উপভোগ করতে পারছিলেন না প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি । পঁচাত্তর পেরিয়েছেন বেশ কিছুদিন হল, কিন্তু মাঝারি উচ্চতার নির্মেদ শরীরে এখনও সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি সময় । কাজ নিয়েই মেতে আছেন নিজের খেয়ালে । বয়সের ভারে পাতলা হয়ে আসা ব্যাকব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুল আর পরিচ্ছন্ন – পরিপাটি পোশাকে সদা প্রাণোচ্ছল মানুষটার আজ হঠাৎ হল টা কি !!! দুদিন হল দাড়ি কামাতে ভুলে গেছেন । খাওয়া – দাওয়া সারছেন অন্যমনস্কভাবে । নিজের প্রিয় আরাম কেদারাটায় বসেও ভেতরে ভেতরে ছটপট করছিলেন তিনি । সুন্দর সকালের আপাত শান্ত প্রকৃতির বৃষ্টিভেজা অনুপম রূপ, বা সাউণ্ড সিস্টেমে বাজতে থাকা পছন্দের রবীন্দ্রসঙ্গীত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল …’ –  কোনও কিছুই কাঙ্ক্ষিত মানসিক শান্তি দিতে পারছিল না । মাঝেমাঝেই উঠে ঘরময় পায়চারি করছিলেন অস্থিরভাবে আর সময়ে সময়ে শক্ত হয়ে উঠছিল বয়সের সাথে চারটে দাঁত হারানো চোয়াল দুটো । কখনও নিষ্ফল আক্রোশে মুঠো করছেন আঙুল । কোনওভাবেই অস্বস্তিটা ভুলতে পারছেন না । বেশ কিছু সময় একভাবে বসে থাকার পর উঠলেন, মনস্থির করে গলা তুলে ডাক দিলেন, “হরি, এই হরি” ।
       মিউজিক সিস্টেমটা বন্ধ করতে করতেই হাজির হরি । দেখে আশ্বস্ত হলেন, সেই কর্মজীবনে প্রায় সমবয়সী সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন একে, এই অবসরোত্তর জীবনে এখনও একমাত্র বিশ্বস্ত ও অনুগত সহচর, মেদিনীপুরের এই রাখহরি মন্ডল – আজও টিকে আছে । বললেন, ‘জলখাবার আর চা টা ঠান্ডা হয়ে গেছে, গরম করে নিয়ে আয় ।”
       হরি চলে যাবার পর নিজের বন্ধ কম্পিউটারটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে হেসে ফেললেন, আসলে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেও আজকালের সোশ্যাল মিডিয়াতে অভ্যস্ত নন তিনি, বড়জোর ই-মেলটুকু করতে পারেন । বেশি কিছু করতে ইচ্ছে তাঁর করে না, নাহলে হয়ত আজকের দিনে যোগাযোগ অনেক সুবিধাজনক হত । ভদ্রলোক এবার গিয়ে বসলেন নিজের লেখার জায়গায়, না চাইতেই কিছু ব্যক্তিবিশেষ বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সাহায্যপ্রার্থী হতে হয় বলে চিঠিপত্র নিয়মিত লিখতে হয় তাঁকে, লিখতে বসে নিজের ভাবনায় ডুবে গেলেন ভদ্রলোক, আবারও জুড়িয়ে গেল হরির গরম করে দিয়ে যাওয়া চা – জলখাবার । সময় গড়িয়ে চলল ।
       এক সময় লেখা শেষ করে খাম বন্ধ করতে করতে হরিকে ডাকলেন । হরি এলে বললেন, “এগুলো খুব জরুরী চিঠি । তাড়াতাড়ি যা, আজকের ডাকে দেওয়া চাই । দুটোর মধ্যে রেজিস্ট্রি করে দিবি, বুঝেছিস ।”
       চিঠিপত্র নিয়ে হরির চলে যাওয়ার পথে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আনমনে ভাবতে লাগলেন, ‘চিঠিটা সময়মতো পৌঁছাবে তো ? আবেদন কার্যকর ঠিক সময়মতো হবে তো ? অতিবিলম্ব না হয়ে যায় ।’
       অন্যমনস্কভাবে দৈনন্দিন কাজকর্ম শেষ করে রাতে শুতে গিয়েও মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল ভাবনাগুলো, ‘চিঠিটা সময়মতো পৌঁছাবে তো ? সাহায্য আসবে তো ? না এলে কি করণীয় …..’। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন । হঠাৎ অস্পষ্ট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তাঁর, আবছায়ায় বুঝতে পারলেন ঘরের ভেতর দু-তিনজন লোক কিছু যেন খুঁজে চলেছে । ধড়ফড় করে উঠে বসতে গিয়ে শুনতে পেলেন, “উঠে পড়েছেন দেখছি । ভালোই হল, এবার বলে ফেলুন জিনিসটা কোথায় রেখেছেন । তাহলে আর কষ্ট করে খুঁজতে হয় না” । বিছানা হাতড়ে বুঝলেন টর্চলাইটটা বিছানায় নেই । ঠিক সেই মুহূর্তে কেউ ঘরের মধ্যেকার সোলারের আলোটা জ্বালালো । আলোয় সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখতে পেয়ে সবিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এ কি ! তুই ! এখন এখানে ….!!!!”
       ( ০২ )
       সদাই কর্মচঞ্চল লবনহ্রদের অফিসে দিনের শেষবেলায় হাতের কাজ মোটামুটি শেষ করে নিজের ডেস্কে বসেই মোবাইলে গেম খেলছিলাম । ওদিকে আমাদের গ্রুপ লিডার অপূর্বদা লিস্ট বানাচ্ছিলেন । আগামী বুধবার অফিসেরই এক সহকর্মীর ( ডিপার্টমেন্ট আলাদা হলেও সখ্যতা আছে ) বিয়ে, কে কে যাবেন, কি উপহার দেওয়া হবে ইত্যাদি আলোচনা হচ্ছিল । হঠাৎ পাশের ডেস্ক থেকে পৌষালী বলল, “রুদ্র, তুই কি পরবি ? শেরওয়ানী পরিস, তোকে বেশ মানাবে ।”
       মোবাইল থেকে মুখ তুলে বললাম, “ক্ষেপেছিস ! আমার যা চেহারা, তাতে ওসব পরলে পুরো কাকতাড়ুয়া লাগবে ।” দেখলাম কথাটা শুনে কৃষ্ণাদি তাঁর সেই বিখ্যাত হাসিটা দিয়ে নিজের ডেস্কের দিকে হাঁটা দিলেন । অন্যদিকে দেখি, গোলাপ না অর্কিড – কিসের তোড়া ভালো হবে, সেই নিয়ে শিব শঙ্করদা আর ভূষণদার ভেতর চাপান-উতোর চলছে । একটু সুখটানের আশায় অমল, অশোক আর প্রদীপদার সাথে বেরতেই যাব, এমন সময়ই পেছনে ধনঞ্জয়দার বিখ্যাত গলা, “এই যে, পটলডাঙার চারমূর্তি, বলি সব চললেন কোথায় ?”
       অশোক বলল, “দাদা, আপনারা প্ল্যানিংটা করুন, আমরা এই দু-মিনিটে আসছি ।”
       ধনঞ্জয়দা গম্ভীর হয়ে বললেন, “এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে । আপনাদের মুখাগ্নি পরে করলেও চলবে ।” কি আর করা যায়, বিরস বদনে ফিরে এলাম । দেখি পৌষালী মুখ টিপে টিপে হাসছে ।
       যাই হ’ক, শেষ পর্যন্ত ঠিক হ’ল, কেনাকাটার দায়িত্ব কৃষ্ণাদি আর পৌষালীর, খরচ যা হবে পরে হিসাব করে সকলে সমান ভাগে ভাগ করে নিলেই চলবে, বাকিদের সময়ে পৌঁছে গেলেই হবে ।
       মনে মনে একটা মতলব ভেঁজে ডিপার্টমেন্টাল হেড সুধাংশু স্যারের কেবিনে গিয়ে কথাটা বলতে, স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে বললেন, “বিয়েবাড়িতে যেতে চাইছ না ? … হুঁ … ঠিক আছে । তবে শুক্রবার যেন ডুব মেরো না ।” ঘাড় নেড়ে বাইরে এলাম । শেষে যখন সকলে বেরতে যাবে এমন সময় অপূর্বদা গলা তুলে বললেন, “সবাই ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবেন আশা করছি ।”
       আমার পাশ থেকে অমল ফুট কাটল, “না হলে ফ্লাইটটা মিস হয়ে যাবে !”
       পাশ থেকে প্রদীপদা অস্ফুটে শুধু, “হুঁ” – বলে থেমে গেলেন । হাসি-ঠাট্টা করতে করতে আমরা অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম ।
       ( ০৩ )
       পার্কিং থেকে বাইকটা নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ভাবছিলাম, অযাচিতভাবে বেশ কয়েকদিন ছুটি পাওয়া গেল, শনি-রবি এমনিতে ছুটি, সোমবার – জন্মাষ্টমী, মঙ্গলবার – স্বাধীনতা দিবস, বুধবার – বিয়েবাড়ি, বৃহস্পতিবার – বৌভাত — সব মিলিয়ে ছ-দিন । বাড়িতে আমি একা, মা-বাবা বোনের বাড়িতে, ভাইও বাইরে – কি করা যায় …।
       ফেরার পথে সাবওয়ে থেকে বাটার নান আর চিলি চিকেন নিয়ে নিলাম । রাতে খেতে বসে মনে হ’ল, কোথাও একটা ঘুরে আসতে পারলে মন্দ হত না । ভাবতে ভাবতেই গত সপ্তাহে আসা একটা চিঠির কথা মনে পড়ল, ছিলাম না বলে নিচে সিকিওরিটির লোকেরা নিয়ে রেখেছিল, পরে পেয়েছিলাম বটে, তবে দেখা হয়নি । তারপর কাজের চাপে বেমালুম ভুলে গিয়েছি । খাওয়ার পর বেশ কিছু সময় খোঁজার পর চিঠিটা পেলাম, দেখি প্রেরক – শ্রী শুভ্রাংশু শেখর ভৌমিক । মনে পড়ে গেল এক উচ্ছল চিরতরুণ মানুষের কথা । বোটানিস্ট ভদ্রলোক আমার স্বর্গীয় দাদুর বন্ধু । অকৃতদার মানুষটির সাথে দীর্ঘকাল যোগাযোগ করা হয়নি ভেবেই লজ্জিত হলাম । এতদিন পর কি মনে করে চিঠি লিখলেন, ভাবতে ভাবতে চিঠিটা খাম থেকে বের করলাম । মনে মনে বয়স হিসেব করে হাতের লেখার তারিফ না করে পারলাম না, লিখেছেন …,
    “স্নেহাস্পদেষু বড় দাদুভাই,
       আশা করি পরম মঙ্গলময়ের অশেষ কৃপায় সপরিবারে কুশলে রয়েছ । দীর্ঘদিনের নীরবতার কারণ হিসাবে বলি, পারিপার্শ্বিক নানাবিধ কারণবশতঃ যোগাযোগ হয়নি । অভিমান কিছুটা আছে বটে, তবে অভিযোগ নেই । আমি আর হরি বহাল তবিয়তে, কোনোক্রমে এখনও টিকে আছি ।
       গত কয়েকদিন যাবত তোমার কথা খুব মনে পড়ছে । একবার এসে ঘুরে যাও । আমার পক্ষে এদের সান্নিধ্য ছেড়ে বেরোনো মুশকিল । বয়সও হয়েছে, আজ আছি – কাল নেই । জরুরী অনেক কিছু আছে, জনান্তিকে বলার মতো । তোমার ছবি তোলা আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশা যদি এখনও আগের মতো থাকে, চলে এসো, মস্তিষ্কের পুষ্টি হবে ।
       ঈশ্বরের কাছে তোমার মঙ্গল ও সার্বিক উন্নতি প্রার্থনা করি । তোমার মা-বাবা-ভাই-বোন — সকলকে আমার শুভেচ্ছা দিও ।
       সত্ত্বর সাক্ষাৎ হবে, বৃদ্ধকে নিরাশ করবে না, এই আশা করি ।
    আশীর্বাদান্তে,
                                                           ইতি,
                                              তোমার গাছ দাদু,
                                     শুভ্রাংশু শেখর ভৌমিক ।
                                              ৬ই আগস্ট ২০১৭
    পুনশ্চঃ যেখানেই দেখিবে ……”
       চিঠিটা পড়ে আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম, সম্বিত ফিরল মোবাইলের আওয়াজে । মায়ের ফোন – কি করছি, কি খেয়েছি ইত্যাদি হাজারো প্রশ্নবাণ সামলে চিঠির কথা বললাম । এ ও বললাম যে, কাল যাব । দেখলাম সম্মতি সহজেই পাওয়া গেল । মায়ের সাথে কথা বলে ঘুমোতে গিয়েও পুরোনো কথাই ভাবছিলাম । অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে দাদুর সাথে ।
       সকাল থেকে উঠেই একটা অদ্ভুত উত্তেজনা অনুভব করছিলাম, অনেকদিন পর আবার একা একা কোথাও যাচ্ছি । প্রাতরাশ সেরে ব্যাগ গোছাতে শুরু করলাম । ফার্স্ট এড আর এমার্জেন্সী কিটটা পরীক্ষা করে দেখলাম ঠিকই আছে । কাজ গুছিয়ে সাড়ে এগারটার দিকে বেরিয়ে পড়লাম । প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে বাইকটা পরিচিত সার্ভিস সেন্টারে জমা করে দিলাম । চায়না টাউনে দুপুরের খাওয়া সেরে দুটোর সময় বাসে উঠলাম, ধর্মতলা থেকে । গন্তব্য – তাজপুর । জানালার ধারে বসার পেয়ে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মাথায় চিঠির কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছিল ।



    to be continued…

    Chapter 2  (Coming soon, 21st April, 18)
  • কবিতা

    লেখলিপি

    লেখলিপি 
    -রুদ্র প্রসাদ

     

    ধীর পদসঞ্চারে সময়ের অমোঘ লয়সারণী বেয়ে,
    দিনপঞ্জির পাতা উল্টে সবকিছু চলছে এগিয়ে ।
    কালক্ষয় প্রতি পদে পদে, বন্ধুর পথ যে অচেনা,
    কত কিছুই রহস্যে ঘেরা, রয়ে গেছে অজানা ।
    সন্ত্রস্ত, আচ্ছন্ন সবই অশান্ত আবহের অনুপনে,
    ঘনঘোর তমসাচ্ছন্ন নিশীথ আবৃত অতিগোপনে ।
    জাত-ধর্ম-সাম্যের নেশায় ধ্বস্ত মনের বিকাশ,
    সম্ভ্রম বিকিয়েই কুলীন, শালীনতার বহিঃপ্রকাশ !
    ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর, ক্রমান্বয়ে ক্ষয়িষ্ণু আয়ু,
    জর্জরিত দূষিত হলাহলে নিষ্পেষিত শ্বাস বায়ু ।
    চাহিদা প্রবল, স্বকীয়তা যে সব হারানোর সাজে,
    স্তুপীকৃত জঞ্জালে আজ ফেরা কিসের খোঁজে !
    অস্তিত্ব বিরাজে দেখ সুদূর পরাহত কষ্টকল্পসুখে,
    বিগত স্মৃতিপট ভারাক্রান্ত ক্লান্তিতে আর দুঃখে ।
    দুর্বার অশনি সদম্ভে গরজে মেঘের বাঁকে বাঁকে,
    আপন প্রতারিত হয়ে চলে মিথ্যা ছলনার ফাঁকে ।
    রিপুর আদিম তাড়নায় কিছু স্পৃহা অবদমিত ;
    দিশাহারা অবরুদ্ধ পাখি সংকটে ভীত, শঙ্কিত ।
    সুপ্ত বিবেক সংযমহীন লোলুপ লালসার ফাঁদে,
    দলিত-মথিত গলিত ভ্রষ্ট আবেগ ডুকরে কাঁদে ।
    তবুও ঔৎসুক্য চরমে, অসার অপেক্ষায় উন্মুখ;
    মানসপটে যতনে লালিত স্নিগ্ধ প্রিয়জনের মুখ ।
    উষ্ণতাহীন নগ্ন উগ্রতার তীব্রতায় দেহ মন ক্লান্ত,
    স্নেহ-ভালবাসার শীতল সুহৃদ পরশে হবে শান্ত ।
    সময়ের চাকা ঘোরে, চলবে সদাই আপন গতিতে,
    কিছু কথা, কিছু ব্যথা, ভাস্বর অমলিন স্মৃতিতে ।
    ছোট থেকে বড় হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া,
    মিলিয়ে-মিলে হিসাবনিকাশ যত চাওয়া-পাওয়া ।
    খুঁজে ফেরা সঠিক পথে একটু আলোর নিশানা,
    সত্তা হারিয়ে উজান বেয়ে দেখা আপন ঠিকানা ।
    নূতনের আগমনে আশা, মিটে যাবে আঁধারখানি,
    ঘুচে যাবে যত দূরত্ব, বৈরিতা, স্ব-দ্বেষ আর গ্লানি ।
    সাফল্য-ব্যর্থতার ভেদাভেদ ভুলে মেলাব সবারে,
    সৌহার্দ্যের আলোক শিখা জ্বলবে হৃদমাঝারে ।
    নূতনের সূচনা দিগন্তে সোনালি আভা সহকারে,
    নূতন পাতায় লেখা হবে আচারে আর ব্যবহারে ।
    আগামীর চিরন্তন আশায় উড়িয়ে নিজ ধ্বজা…,
    নবারুণচ্ছ্বটায় আলোকিত, উদ্ভাসিত হবে শ্রীজা ।
    উদিত ভানু জাগতিক রীতে হবে অস্তগামী সাঁঝে,
    প্রেম-প্রীতির বইবে জোয়ার সবার মনের ভাঁজে ।
    দোলাচলহীন, শুভ হবে সবার, এই হোক প্রার্থনা,
    জীবনের খাতায় হল আরও একটি সনের সূচনা ।
    সুখ-শান্তি-প্রগতি সাথে মিলেমিশে হোক কথা বলা,
    সৌভ্রাতৃত্বের অঙ্গীকারে সুমধুর হোক সকলের পথচলা ।।

You cannot copy content of this page