-
গল্প- মহুলের মা
মহুলের মা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী
সুবলা দেবী বেশ বিরক্তি সহকারে বলল, হ্যাঁ রে অভয় তুই যে এতো বড় স্ত্রৈণ হয়ে গিয়েছিস তা আজ টের পেলাম।
মলি, মলয় বলতো বটে, মা বড়দা আর আগের মতো নেই। সবসময় বৌদির কথাতেই সায় দেয়। সেদিন বরং আমিই বকে ছিলাম ওদের দুজনকে। এখন তো দেখছি ওরাই ঠিক চিনেছে বড় বৌকে।
অভয়ের অফিস যাওয়ার তাড়া আছে। তবুও সে শান্ত স্বরে বলল- মা মহুল যেমন তোমার নাতনি ঠিক তেমনি আমার আর হৈমন্তীর মেয়ে। তাই মহুলের জীবনের ব্যাপারে হৈমন্তীর মতামত খুব দামী অন্ততঃ আমার কাছে।
সুবলা দেবীর রাগের আগুনে খানিকটা ঘি-এর মতো যোগ হলো অভয়ের কথাগুলো। দাউ দাউ করে যজ্ঞের শিখার মতো জ্বলে উঠে বললেন, তুমি তো বাবা অফিস আর ঘর করো। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন নিয়ে আমাকে থাকতে হয়।
এর মধ্যেই তোমার বউ-এর কীর্তি পাড়াতে বেশ আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।
হৈমন্তী কিচেনে খাবার রেডি করার জন্য দোতলা থেকে নেমে আসতেই সুবলা দেবীর মুখে এমন কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো।
হাসি থামিয়ে বলল- মা আপনার তো তাহলে খুব নিন্দা মন্দ হচ্ছে পাড়াতে। তাহলে কিন্তু আজ থেকে আর পাড়া বেড়ানোটা বন্ধ করুন।
সুবলা দেবী মুখটা গম্ভীর করে বলল- তোমার মতো মুর্খ মেয়েমানুষ আমি তো এই প্রথম দেখলাম। নিজে সাধ করে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনো। তুমি আবার এম এ পাশ দিয়েছো!
সুবলা দেবীর এই একটা অস্ত্র আছে। যখন নিজে আর যুক্তি তর্কে পেরে ওঠে না তখন হৈমন্তীকে ধরাশায়ী করতে হৈমন্তীর শিক্ষা, বংশ এইসব নিয়ে টানাটানি করতে শুরু করে।
হৈমন্তী ও তার ক্ষুরধার বুদ্ধির প্রয়োগ করে খুব মিষ্টি ও সংযত ভাবে।
-মা ভাগ্যিস ইউনিভার্সিটির চৌকাঠ পেরিয়ে ছিলাম। তাই তো উচ্চ শিক্ষার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হন আপনারা। না হলে আমাকে কি আর মানুষ ভাবতেন? আপনাদের উচ্চ বনেদী বংশ। আপনারা ছিলেন গাঁয়ের বড়লোক। আর সেখানে আমার বাবা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মাত্র। আপনাদের উদার মানসিকতা। তাই তো আপনার স্বামী আমাকে আপনাদের ঘরের বউ করে এনেছিলেন। মনে আছে মা উনি আমাকে কি দিয়ে মুখ দেখেছিলেন? উনি ওনার বই আলমারির চাবিটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, বড় বৌমা এখন মরেও সুখ আমার। এতকাল শুধু ভাবতাম আমি মরে গেলে আমার বইগুলোর কি হবে? আমার সহধর্মিণী পুরানো খাতা-বই বিক্রির দোকানে গিয়ে হাফ দামে বিক্রি করে টাকাগুলো বগলদাবা করে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরে এসে বই-এর খালি আলমারিটার মধ্যে ওনার মহামূল্য শাড়ি কাপড় রাখতে রাখতে বলবেন, কতবার বলেছিলাম একটা আলমারিতে আমার আর হচ্ছে না। আরেকটা আলমারি কিনে দাও। সে তো দিলে না। অগত্যা তোমার সাধের বই আলমারিটাই আমাকে বুদ্ধি করে কাজে লাগাতে হলো।
শ্বশুর মশাই এর এমন বুদ্ধি দীপ্ত রসিকতা শুনে সেদিন নতুন বউ এর ‘বউ বউ’ লজ্জা ভুলে বেশ হা হা আওয়াজ তুলে হেসেছিল হৈমন্তী।
হৈমন্তীর বিয়ের বছর দশেক পর মারা গিয়েছিলেন সুবলা দেবীর স্বামী। স্বামীর বিয়োগে সুবলা দেবী যত না ভেঙে পড়ে ছিলে তার থেকে অনেক বেশি ভিতর ভিতর ভেঙে গিয়েছিল হৈমন্তী।
নতুন এই ঠিকানায় তার তো একমাত্র মনের সঙ্গী ছিল তার শ্বশুর মশাই। বিকাল বেলা হলেই অভয়ের বাবা গল্পের বই বের করে হৈমন্তীকে ডাক দিতেন। বলতেন, বৌমা আমার চোখের জোড় তো আগের মতো নেই। তাই টানা অনেকক্ষণ ধরে বই পড়তে পারি না। তার চেয়ে ভালো এখন থেকে তুমি বই পড়বে আর আমি শুনবো।
এমন প্রস্তাবে হৈমন্তী যেন মনে মনে ধেই ধেই করে নেচে উঠেছিল সেদিন। তারপর দীর্ঘ দশটা বছরের ছয়টা মাস বাদ দিলে একশো চোদ্দো মাস বিকাল বেলার এই গল্পের আসর বসেছে হৈমন্তীর শ্বশুরবাড়িতে। শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে স্মরণজীৎ চক্রবর্তী, আশাপূর্না দেবী থেকে বানী বসু এমন নতুন পুরাতন লেখক লেখিকা কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টির ঝড় বয়ে যেতো সুবলা দেবীর তিনতলা বাড়িতে।
তবে সুবলা দেবী সাধারণত এড়িয়ে চলতো এই গল্পের আসরকে। মাঝে মাঝে স্বামীর অনুরোধে এসে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেন নি। কারণ পাড়ার মহিলাদের মুখরোচক টাটকা গল্পের আসর থেকে ডাক আসতে থাকে বারংবার।
এইসব পুরানো কথা উঠলে কিছুতেই হৈমন্তী নিজের আবেগকে সংযত রাখতে পারে না। আসলে একটা চাপা যন্ত্রণা বড্ড টনটন করে ওঠে বুকের ভিতরটা। তার বড় ইচ্ছে ছিল নিজের লেখাপড়াটাকে কোনো সামাজিক কাজে লাগানোর। তাই সে ভেবেছিল গাঁয়ের নীচু পাড়াতে গিয়ে একটা অবৈতনিক নাইট স্কুল খোলার। স্বামী শ্বশুরকে পাশে পেলেও শাশুড়ি, ননদ, দেওর কাউকেই পাশে পায় নি। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা সম্ভব নয়। তাই সে পিছু হঠতে বাধ্য হয়ে ছিল।
তাই হয়তো এই কারণেই মহুলের পাকা কথার দিন ভরা সভাতে ছেলের বাড়ির পাকা মাথাদের সামনে হৈমন্তী বলে ওঠে- আমি মেয়ের মা হয়ে একটা কথা স্পষ্ট ভাবে বলতে চাই আপনাদের কাছে। আমার মেয়ে সরকারি অফিসের একটি দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন। এই চাকরিটা পাওয়ার জন্য দিন রাত এক করে মেহনত করেছে সে। পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম জানে কেবলমাত্র চালিয়ে নেওয়ার জন্য। বিয়ের পরও এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে আশা করি না আমি। আর তখন যদি আপনারা ঘরের কাজকর্মের জন্য বাড়িতে অশান্তির পরিবেশ তৈরি করেন তাহলে কিন্তু সমস্ত চাপটা এসে পড়বে আমার মেয়ের ওপর। তাই জানতে চাইছিলাম আপনাদের ছেলে কি দৈনন্দিন জীবনের জরুরী কাজ কর্মগুলো যেমন ধরুন রান্না করা, বাসন ধোয়া, ঘর মোছা জানে তো?
হৈমন্তীর এই প্রশ্নে পাত্রের ঠাকুমা, মা, কাকীমা, দাদু, বাবা, কাকা সবাই একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো মাত্র।
পাত্রের দাদু গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন- আমার পরিবারে মেয়েদের গৃহকাজে সাহায্য করার জন্য কাজের লোক রেখে দিয়েছি। আমাদের পরিবারের পুরুষরা বাইরের কাজেই পারদর্শী বেশি। তবে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি অভয় বাবু, আপনার সহধর্মিণী কিন্তু ভীষণ স্ট্রেট ফরওয়ার্ড। আমাদের পরিবারের মেয়ে বউরা কিন্তু অনেক ভদ্র ও লাজুক। আজ আমরা আসি। বাড়িতে গিয়ে অর্ক দাদুভাই-এর সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো আমরা। তারপর জানাবো।
এরপর কেটে গেছে আরো দু তিনটে মাস। ভ্যাপসা গরমের জায়গা নিয়েছে ঠান্ডা আমেজ। আশ্বিন শেষ করে কার্তিক আগত। দু’ দুটো মল মাস পেরিয়ে অগ্রহায়ণ আসবে। সুবলা দেবীর খুব ইচ্ছা ছিল মহুলের বিয়েটা এই অগ্রহায়ণে হবে। কিন্তু হৈমন্তীর অদ্ভুত সব জিজ্ঞাসাবাদের দৌলতে মহুলের বিয়েটাই ঝুলে গেল। পাত্রপক্ষ চুপচাপ দেখেই চলে গেল। সুবলা দেবী এইসব কথা ভাবে আর আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে হৈমন্তীর সেই দিনের বক্তব্যগুলো যত দিন যাচ্ছে চানাচুর তেলেভাজা সহযোগে পরিবেশন করতে থাকে।
অনেকেই অবশ্যই সুবলা দেবীকে উদ্দেশ্য করে বলে, আপনার নাতনির বিয়ের জন্য পাত্রের অভাব হবে না। এমন মোটা টাকার মাইনের চাকরি যার।
আবার অনেকই বলে তাই বলে পাত্রকে ঘর-গৃহস্থালির কাজকর্ম জানতে হবে তবেই মা বিয়ে দেবে। এমন আবদার থাকলে পাত্র পেতে তো বেগ পেতেই হবে। যতই হোক আজও আমাদের সমাজ পুরুষ তন্ত্রের অনুশাসন মেনে চলে।
দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেল। একদিন ডিনার টেবিলে অভয় বলে- হৈমন্তী তোমার ঐ অসম্ভব জেদটা এবার ছাড়ো। আমি আমাদের মুখার্জী ঘটককে আসতে বলেছি আগামী কাল।
হৈমন্তীও গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- হ্যাঁ গো আমাদের সমাজের মেয়েদের মানসিকতার পরিবর্তন হলেও পুরুষরা কিন্তু এখনও মধ্য যুগেই পড়ে আছে। নারী তুমি যতই বিদূষী হও, যত বড় পদেই আসীন হও না কেন বাড়ি ফিরে ক্লান্তি ভুলে খুন্তি তুলে নিতেই হবে পরিশ্রান্ত হাতে।
রাতে শুয়ে শুয়েও এই বিষয় নিয়ে স্বামী স্ত্রীর আলাপচারিতার মধ্যে অভয়ের মোবাইলটা বেজে উঠল। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, কেমন আছেন অভয় বাবু? আমি অর্কর দাদু বলছি।
অভয় তাড়াতাড়ি বালিশ ছেড়ে সোজা হয়ে বিছানায় উঠে বসে। হৈমন্তী চোখের ইশারায় ফোনটা স্পিকারে দিতে বলে।
অর্কের দাদু বলেন, আমাদের বাড়ির মেয়ে, বৌমারা অর্ককে একটা বছর ধরে ঘষে মেজে প্রাত্যহিক ঘরোয়া কাজকর্ম শিখিয়ে ফেলেছে মোটামুটি। এখন আমার দাদুভাই ডাক্তারির পাশাপাশি ভাত, ডাল রান্না করতে শিখে গেছে। সত্যি বলছি অভয় বাবু, সেদিন আপনার মিসেস এর কথা আমার প্রথমে একদমই পছন্দ হয়নি। কিন্তু বাড়ি ফিরে গিয়ে আমাদের বাড়ির মেয়ে বৌমারা বোঝালো যে পুরুষ মানুষ টুকটাক রান্না বান্না ঘরের কাজ না জানলে তাদের কি কি অসুবিধা হয়। সেদিন বুঝলাম আপনার মিসেস এর কথাগুলো ওর একার কথা নয়। আজকালকার বেশিরভাগ মেয়েদেরই কথা।
তাদের অসুবিধার লিস্ট শুনে তো আমরা পুরুষরা খুবই লজ্জিত হয়ে পড়ি। কিন্তু আমার পক্ষে তো আর এই বয়সে এসে রান্নাবান্না শেখা সম্ভব নয়। তাই অর্কর বাবা আর অর্ককে বললাম, তোদের তো এখনও শেখার বয়স আছে। তোরা ই না হয় রান্না শিখে দেখিয়ে দে পুরুষ মানুষও বাইরে ও ঘর দুটোই সামলে নিতে পারে। কথাগুলো শেষ করে হো হো করে হাসি দিয়ে মোবাইলটা ভরিয়ে তুললেন।
হাসি থামিয়ে বললেন- তাহলে আপনারা কবে আসছেন আমাদের বাড়িতে মহুল ও অর্কর বিয়ের দিনটা ঠিক করতে?
অভয় কিছুক্ষণের জন্য একদম চুপ হয়ে যায়। হৈমন্তীর ঠেলা খেয়ে স্তম্ভিত ফিরে আসে। শান্ত ভাবে বলে, মায়ের সাথে আলোচনা করে আপনাকে দিনটা জানাচ্ছি।
ফোনটা কেটে দেওয়ার পরই অভয় হৈমন্তীর হাত দুটো নিজের কোলের কাছে টেনে এনে বলে, প্রথাগত আচার আচরণের বাইরে যাওয়ার জন্য অনেক সাহস লাগে। আমার তো সে সাহস কোনোদিন হলো না। কিন্তু তুমি চার দেওয়ালের মধ্যে থেকেও সেই সাহসটুকু দেখিয়ে নিজের মেয়ের ভবিষ্যত জীবনটা কিছুটা হলেও সুনিশ্চিত ও শান্তি পূর্ণ করে তুলতে পেরেছো।
হৈমন্তী জিতে যাওয়ার আনন্দে প্রায় কেঁদেই ফেলে। চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, আমরা গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসিয়ে চলি বলেই তো সমাজের চলার পথে এতো আবর্জনা জমে যাচ্ছে। নারীদের উন্নতি চাইছি কিন্তু উন্নতির জন্য যে পরিবেশ দরকার তা আমরা তৈরি করতে রাজি নই। যাক গে সমগ্র সমাজ পাল্টানোর ক্ষমতা তো আমার নেই। কিন্তু আমি আমার মেয়ের জীবনে তো পরিবর্তনের হাওয়া আনতে পেরেছি।
এখন শুয়ে পড়ো। কাল সকালে মা’কে জানিও অর্কের দাদুর কথাগুলো। অভয় এল.ই.ডি. টিউবটা বন্ধ করে নাইট ল্যাম্পটা জ্বেলে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অভয় নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও হৈমন্তী সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। মনের মধ্যে উঠে আসতে লাগল মহুলের মা হওয়ার পর থেকেই মেয়ের জন্য আজ অবধি কত লড়াই না সে করেছে। -
গল্প- পার্সেল রহস্য
পার্সেল রহস্য
লোপামুদ্রা ব্যানার্জীমহালয়ার সকাল টা এমন করে শুরু হবে আমাদের এপার্টমেন্টে তা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের অঞ্চলের পৌরমাতার উদ্দ্যোগে ভোর সাড়ে চারটা থেকে ই বিছানায় শুয়ে শুয়ে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়ার স্তোত্র পাঠ শুনছি।আহা কী অপূর্ব লাগে! নাকে যেন সোজা ধূপ ধুনোর আঘ্রাণ ঢুকে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছেলেবেলার শিউলি ফুল কুড়ানোর দিন গুলো। আরো একটা জিনিষ বড্ড মনে শিউলি ফুল দিয়ে হাতে মেহেন্দি করার শখ টা। তাই সকল আলস্য ছেড়ে ফেলে বিছানা ত্যাগ করে সোজা ওয়াশরুমে চলে যাই।গঙ্গা বাড়ির পাশে হলেও স্নান করতে যাই না আমি কোনোদিনই।আসলে গঙ্গা স্নান করার পরে ভিজে কাপড় ছাড়ার পদ্ধতি গুলো আমার কাছে ভীষণ অস্বস্তি কর। কিন্তু আমাদের এপার্টমেন্টের তলাপাত্র জেঠিমা প্রতিবছর মহালয়ার দিন গঙ্গা স্নানে ছোটেন নিজের স্বামীকে নিয়ে।জেঠু গিয়ে পূর্বপুরুষ দের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে আর জেঠিমা গঙ্গা স্নান।
কিন্তু আজ সকালে মাইকের মহালয়া কানে আসার আগেই তলপাত্র জেঠিমা বাজখাঁই গলা আমার কানে এলো। আমার ফ্ল্যাট ফার্স্ট ফ্লোরে।তাই গ্ৰাউন্ড ফ্লোরের কথা বার্তা বেশ স্পষ্ট কানে আসে।
জেঠিমা বলছেন , দাঁড়াও দাঁড়াও একদম না। একদম হাত লাগাবে না।কিসের না কিসের প্যাকেট কে জানে?
জেঠু বিরক্ত হয়ে বলছেন,ধ্যাত একটা পবিত্র কাজে বের হচ্ছি। এখন এইসব ফালতু ঝামেলা।
_ সে কথা বললে তো হবে না কর্তা মশাই।বাড়ি যখন প্রোমোটারের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তখন ভাবা উচিত ছিল। হাজার লোকের বাস হবে।তার সঙ্গে ফ্রী তে আসবে হাজার উৎপাত।
_ধূর বাপু তুমি চুপ করো না। স্কুটার টা কি করে বের করবো সেই কথা টা পারলে একটু ভাবো।
_ ও আজ তোমার স্কুটার বের করা যাবে না এখন।এমন ভাবে প্যাকেট টা পড়ে আছে সামনের চাকার নিচে যে গাড়ির স্ট্যান্ড খুললেই চাকা টা প্যাকেটের উপর উঠে পড়বে।প্যাকেটের ওপর চাকা পড়লেই প্যাকেট টা ফাটবে।আর ফাটলেই ওর ভিতর থেকে কিসব বেরিয়ে আসবে কে জানে?
_ তলাপাত্র জেঠু একটু ঝুঁকে পলিথিনে মোড়ানো প্যাকেট টা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর বললেন ,বুঝলে গিন্নী প্যাকেট টা কিন্তু বেশ পরিস্কার দেখছি। হাত দিয়ে ই সরিয়ে দিই ।
_রীতিমতো চিৎকার করে উঠে জেঠিমা বলে, খবরদার না। দিনকাল একদম ভালো না।তার থেকে বরং তুমি আমাদের সেক্রেটারি দিবাকর বাবু একটা ফোন করো।বলো নীচে নেমে আসতে একবার।
অগ্যতা তলাপাত্র জেঠু বাধ্য স্বামীর মতো সেক্রেটারি দিবাকর বাবু কে ফোন লাগালেন। ইতিমধ্যে মাইকে মহালয়া শুরু হয়ে গেছে।প্রতিটা ফ্ল্যাটে ই আলো জ্বলে উঠেছে।বার দুয়েক চেষ্টা করার পর দিবাকর বাবুর সঙ্গে তলাপাত্র জেঠু যোগাযোগ করতে পারলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই দিবাকর বাবু এপার্টমেন্টের ক্যাশিয়ার ও প্রেসিডেন্ট কে সঙ্গে নিয়ে গ্ৰাউন্ড ফ্লোরে এলেন।ক্যাশিয়ার তমাল কুন্ডু এসেই বললেন,এই সব ফালতু ঝামেলার জন্য ই আমি মেনগেটে তালা চাবির বদলে সিকিউরিটি রাখার কথা বলে আসছি এতবছর ধরে। কিন্তু তলাপাত্র জেঠুর আপত্তি ই সবচেয়ে বেশি। এবার বুঝুন ঠেলা।
রজত বাবু বললেন,আহা তমাল এখন থাক ঐ সব বিষয়। তার চেয়ে ভালো নয় কি প্যাকেট টা কোথা থেকে এলো,কে এমন করে সিঁড়ির নিচে গাড়ি, সাইকেলের মাঝে ফেলে গেল তা নিয়ে ভাবা দরকার।
তলাপাত্র জেঠিমা হঠাৎ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন,দেখো তমাল তুমি রাগ করো না। তোমরা ইয়ং ছেলেদের দেখনদারি টা বড্ড বেশি। তোমাদের এখন রোজগার পাতি ভালো। কিন্তু তোমার জেঠু তো রিটায়ার্ড লোক। আমাদের কলসীর জল গড়িয়ে খেতে হয়। তাই আমাদের কাছে সিকিউরিটি রাখাটা কিছুটা বিলাসিতা মনে হয়। তুমি যখন তখন তোমার জেঠু কে আক্রমণ করো সিকিউরিটি র ব্যাপার নিয়ে।এ আমার একদম ভালো লাগে না।
তমাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু প্রেসিডেন্ট রজত বাবু চোখ টিপে ব্যাপার টা ক্লোজ করার রিকোয়েস্ট করে।আসলে এমন পুন্য ভোর বেলায় ঝগড়া অশান্তি সমীচীন নয়।
রজত বাবু এগিয়ে গিয়ে প্যাকেট টা দেখলেন।প্যাকেট টা যশোদা বস্ত্রালয়ের । মুখ টা বেশ টিপে রাবার ব্যান্ড দিয়ে আঁটা।বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ভয়ের কিছু বলে মনে হচ্ছে না।আর তাছাড়া আমাদের এপার্টমেন্টের লোকজন সবাই ছাপোষা ভদ্রলোক। এখানে বিষ্ফোরক টোরক আসার তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। তাই আমি বলছিলাম, আপনারা তো সবাই উপস্থিত আছেন।তাই আমি সবার সামনেই প্যাকেট টা খুলতে চাই।কারোর কোনো অবজেকশন নেই তো?
তমাল বলে, দাঁড়ান দাঁড়ান রজত দা।আমি মোবাইল এ ভিডিও টা চালু করি।পরে বিল্ডিং এর সকলের সামনে স্বচ্ছতা বজায় রাখা যাবে।
ধীরে ধীরে প্যাকেট টা তলাপাত্র জেঠুর সামনের চাকার মুখ থেকে হাতে তুললেন রজত বাবু। হালকা নাচিয়ে বললেন ওজন এক কিলোর নীচেই হবে মনে হচ্ছে।
দিবাকর বাবু বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন,রজত দা আর দেরি করো না।মা দুর্গার নাম নিয়ে খুলে ফেলুন।
রজত বাবু প্যাকেটের মুখের রাবার ব্যান্ড টা খুলে ফেললেন। তারপর দেখলেন ভিতরে একটা কাগজের প্যাকেট। তাতে লেখা আছে অন লাইন শপিং ব্যান্ডের নাম। কিন্তু নাম, ঠিকানার জায়গা টা নীল রঙের কালি দিয়ে কেটে দেওয়া আছে। কিছুতেই পড়ে উদ্ধার করা যাচ্ছে না।
তলাপাত্র জেঠিমা চোখ গুলো বড় বড় করে বলেন,এ আবার কি কান্ড!কেউ নতুন জিনিস এমন করে সিঁড়ির নিচে গাড়ি ঘোড়ার মাঝে ফেলে রাখে?
তলাপাত্র জেঠু বিরক্ত সহকারে বললেন,পয়সা বেশি হলে নতুন জিনিস ও মাটিতে গড়াগড়ি খায় দেখছি।যাক গে, ক্ষতিকারক যখন কিছু নেই তখন ভয়ের কিছু নেই।
বুঝলে দিবাকর তাহলে আমরা আর দেরি করবো না। তোমরা প্যাকেট টা খুলে দেখো।আমি আর গিন্নী বরং রওনা দিলাম।
তলাপাত্র জেঠু ওনার আমলের বাজাজ চৈতক কে স্টার্ট দিয়ে জেঠিমা কে পিছনে বসিয়ে গঙ্গা স্নানে ছুটলেন।
আমি আমার ফ্ল্যাটের ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ ধরে থেকে পুরো ব্যাপার টা লক্ষ্য করছিলাম। এবার মনে হলো একেবারে স্পটে যাই।হাউস কোর্ট টা গলিয়ে সিঁড়ির নিচে যেতেই তমাল আমাকে দেখে বলল,এই যে মৌমিতা দি এসে গেছে।ও দিদি প্যাকেট টা তুমি খুলে দেখ। মহিলাদের জিনিস যদি হয়।তাই আমরা কিন্তু কিন্তু করছিলাম।
আমি প্যাকেট টা হাত বাড়িয়ে নিলাম। তারপর হাত দিয়ে ছেঁড়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। তাই কাঁচির জন্য ওদের কে নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে এলাম। কাঁচি দিয়ে প্যাকেট টা কাটতেই বেরিয়ে এলো একটা দারুন দেখতে একটা ড্রেস। ব্লাক আর গ্ৰীন এর কম্বিনেশনে র ফ্লোরাল প্রিন্ট।
দিবাকর বাবু হেসে বললেন, ওওওও এতো মেয়েদের পোশাক।
রজত বাবু বললেন, কেউ নিঃশ্চয় সিঁড়ি নীচে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল।বিড়াল কিংবা ছুঁচো তে টানাটানি করে এমন রহস্য সৃষ্টি করলো মহালয়ার সকালে।আরে বাবা অন লাইন শপিং তো কোনো অন্যায় কাজ নয়।এই নিয়ে তো লুকোচুরির কিছু নেই।
তমাল বিজ্ঞের মতো বলল,সাধে কি আর বলে মেয়েছেলের বুদ্ধি।কথা টা বলেই ও বুঝতে পারে মুখ ফস্কে একটা বাজে কথা বলে ফেলেছে। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই ও বলে ওঠে, মৌমিতা দি আমি আমাদের হুয়াটস গ্ৰুপে এই ড্রেস টার একটা ছবি দিয়ে দিচ্ছি।আর লিখে দিচ্ছি,এই জিনিসটা যার তিনি যেন তোমার কাছ থেকে নিয়ে যায়।প্লিজ দিদি না করো না।
অগ্যতা আমি মালিক হীন পোশাক টা বাইরের ঘরের বুক সেলফের ওপর রেখে দিয়ে কিচেনে গেলাম। গ্যাসে লিকার চা বসিয়ে রাতের বেলায় ধুয়ে রাখা বাসন পত্র গুলো মুছে বাসন রাখার সেলফে তুলে রাখতে লাগলাম।
তারপর একটা কাঁচের গ্লাসে লিকার চা টা ঢেলে দুটো বিস্কুট নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলাম। আর পার্সেল টা কার হতে পারে এই ভাবনা টা দেওয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো দোলা দিতে লাগলো আমার মনে।
মিনিট পনেরো পর ডোর বেল টা বেজে উঠলো।আমি দরজা খুলে দেখি তলাপাত্র জেঠিমার বৌমা রুচি।
মিষ্টি হাসি দিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে পড়ল। তারপর কোনো রকমের ভনিতা ছাড়াই বললো,দিদি ওই পার্সেল টা আমার। গতকাল দুপুরে ডেলিভারি বয় দিয়ে গিয়েছিল।এই বলেই ফোন টা খুলে ওর অর্ডার লিস্ট টা দেখলো।
আমার আর কোনো সন্দেহ রইল না যে ড্রেস টা রুচির। কিন্তু ওর ড্রেস টা কিভাবে সিঁড়ি ঘরে এলো সেটা বুঝতে পারছিলাম না।
রুচি এই প্রথম বার আমার ফ্ল্যাটে এলো।তাই আমি ওর ডান হাত টা ধরে বললাম, প্রথমবার তুমি আমাদের ফ্ল্যাটে আসলে।আগে তো সোফায় বসো। তারপর পার্সেল নিয়ে কথা বলছি।
রুচি হালকা হাসি দিয়ে সোফায় বসলো। তারপর বললো,কি আর করবো বলো দি। আমার শাশুড়ি কারোর ফ্ল্যাটে আসা যাওয়া খুব একটা পছন্দ করে না।
তারপর একটু বিরতি নিয়ে বললো, ওনার ধারনা অন্যদের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করলে আমি নাকি বিগড়ে যাবো।ভাবো একবার! আমি কি দুধ খাওয়ার বাচ্চা।
আসলে আমি তো গ্ৰামের মেয়ে। শাশুড়ি মা সবসময় বলে,যত কম শহরের হাওয়া গায়ে লাগাবে।ততই সব দিক থেকে ভালো থাকবে। শহরের আদব কায়দা শিখলেই বিপত্তি।খরচ বেড়ে যাবে আকাশ ছোঁয়া। ওনার শুধু সাশ্রয় এর চিন্তা।আমি আসার পর তো ঠিকে কাজের মেয়েটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছে জানো। আমাকে বলা হল,বৌমা আমি তো এখন ও শক্ত সামর্থ আছি।তাই দুজনে মিলে মিশে সংসারের সব কাজ করে নেবো কেমন। কিন্তু দিদি মাস খানেক ও মিলেমিশে কাজ করতে পারলাম না আমরা। আমার শাশুড়ি মা সপ্তাহের ওয়ার্কিং দিন গুলোতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।যেমন ধরো মাথা ধরা কিংবা পেটে ব্যথায় ভুগবেন।
আমি বেশ বুঝতে পারছি তলাপাত্র জেঠিমা পাকা মাথার বুদ্ধি ধরেন সবসময়। কিন্তু রুচি ও যে খুব একটা বোকা মেয়ে তা কিন্তু নয়।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার পার্সেল টা তুমি সিঁড়ি ঘরে রেখেছিলে কেন রুচি?
রুচি বলে দিদি আমার কপাল টাই খারাপ যাচ্ছে আজকাল।না হলে কি এমন বিপত্তি ঘটত।
মানে?
আমার শাশুড়ি মাকে লুকিয়ে অনলাইনে এটা ওটা আমি কিনি মাঝে মধ্যে ই। ডেলিভারি বয়ের থেকে জিনিস নিয়ে সিঁড়ি ঘরের যে বড় লেটার বক্স টা আছে তার মাথায় তুলে রাখি।সময় সুযোগ বুঝে আমি অথবা বর যে কেউ এসে টুক করে পার্সেল টা নিয়ে চলে যাই।
আমি চোখ গুলো কপালে তুলে বললাম, ওওওওও,ব্যাপারটা নতুন নয় তাহলে। ঠিক আছে নিয়ে যাও পার্সেল টা তাড়াতাড়ি। তোমার শাশুড়ি যে কোনো মুহুর্তে চলে আসতে পারে।
পার্সেল টা হাতে নিয়ে চলে যাওয়ার সময় রুচি আমার হাত টা ধরে বলে, প্লিজ মৌমিতা দি এই পার্সেল রহস্য এর কথা খুব বেশি কাউকে বলো না।
আমি রুচির হাতের ওপর হাত রেখে বললাম, নিশ্চিন্তে থাকতে পারিস। কমিটির তিন চার জন ছাড়া এই পার্সেল কার ছিল কেউ জানবে না।তবে এরপর থেকে সিঁড়ি ঘরে পার্সেল না রেখে সোজা নিজেদের ঘরে নিয়ে যাবি। শাশুড়ি কিছু বললে বুদ্ধি দিয়ে উত্তর দিবি। লুকোচুরির পথের চেয়ে লড়াই এর পথ ভালো।লড়াই এর একটা পরিনতি থাকে। লুকোচুরি তে থাকে কেবলমাত্র ধোঁকা। ধোঁকার হাত ধরে যেমন ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না ঠিক তেমনি জীবনটা ও বিষময় হয়ে যায়।। -
গল্প- কুটুম্ব
কুটুম্ব
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জীতনিমা দেবী খুব যত্ন করে তার বেয়াই আর বেয়ানে -এর জন্য দুপুরের খাবারের আয়োজন করছেন। তনিমা দেবীর মেয়ে তৃপ্তির বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক হয়ে গেল। কিন্তু এই প্রথম তৃপ্তির শ্বশুর, শাশুড়ি আসছে তৃপ্তির বাপের বাড়িতে।
আসলে তৃপ্তির বিয়ের দেখাশোনা, পাকা কথা সবই হয়েছিল ওর পিসতুতো বোন রাজন্যার বাড়ি কলকাতা থেকেই। তৃপ্তির শ্বশুর শাশুড়ির মনে হয়েছিল গোপাল মাঠ বড্ড দূরে। যদিও রাজন্যা বারবার বলেছিল, আন্টি কলকাতা থেকে দূর্গাপুর মাত্র তিন ঘন্টার রাস্তা। সিটি সেন্টার থেকে আধ ঘন্টাও লাগবে না গোপাল মাঠ পৌঁছাতে।
আপনি আর আঙ্কেল নিজে গিয়ে একবার দেখে আসুন তৃপ্তি কেমন ঘরের মেয়ে।
রাজন্যার কথা শুনে তৃপ্তির শাশুড়ি লীনা দেবী বলেছিলেন, তোমার মুখে তো শুনেছি তোমার মামার তেমন অবস্থা নয়। আর সত্যি কথা বলতে কি তৃপ্তিকে আমাদের সবার ভীষণ পছন্দ। এটাই বড় কথা। তৃপ্তির বাবার কি আছে তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। তাছাড়া অমিতের বাবাকে তো জানোই তুমি। উনি হচ্ছেন একজন জন দরদি কাউন্সিলর। গরিব মানুষের প্রতি ওনার একটা আলাদা অনুভুতি কাজ করে সবসময়।
রাজন্যার মুখ থেকে লীনা দেবীর এই কথাগুলো শুনে তৃপ্তি ও তার মা বাবা এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিল যে তৃপ্তির শ্বশুর বাড়ির লোকজন অত্যন্ত ভদ্র ও নিরহংকারী।
তৃপ্তির বিয়েতে ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে আসা গায়ে হলুদের তত্ব দেখে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের একেবারে চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। তৃপ্তির পিসি মানে রাজন্যার মা বলেছিল, ভাগ্যিস তৃপ্তি আমাদের রাজুর বাড়িতে থেকে রবীন্দ্র ভারতীতে ক্লাস করতে যেত। তাই তো এমন বড়লোক, শিক্ষিত, রুচিশীল শ্বশুরবাড়ি পেল।
তৃপ্তির বর অমিত পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। বেশ নম্র ভদ্র ও দায়িত্ববান ছেলে। তৃপ্তির সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এর দিকে সজাগ দৃষ্টি। এই পাঁচ বছরে নিজে হয়তো খুব বেশি শ্বশুর বাড়িতে রাত কাটায়নি। কিন্তু তৃপ্তি যখনই গোপাল মাঠ আসতে চেয়েছে তখনই গাড়ী করে পৌঁছে দিয়ে গেছে।
বিয়ের পর কনসিভ করতে তৃপ্তির বেশ সমস্যা হচ্ছিল। অনেক গাইনোকলজিস্ট দেখানোর পর সে বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় অন্তঃস্বত্তা হয়। তৃপ্তির বাবা মা-এর একান্ত অনুরোধে অমিত ও তার মা বাবা তৃপ্তিকে রাখতে এসেছে গোপাল মাঠে।
শক্তিগড়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটা ভদ্রস্থ মাপের রেস্টুরেন্টে সকালের টিফিনটা সেরে নিয়েছে ওরা। তৃপ্তি যদিও একবার ওর শাশুড়িকে বলেছিল, মা এখন তো সবে আটটা। আর দু’ ঘন্টা র মধ্যে তো বাড়ি পৌঁছে যাব। বাড়িতে গিয়ে না হয় মায়ের হাতে লুচি তরকারি খাব।
লীনা দেবী মিষ্টি হাসি দিয়ে মিষ্টি করে বলেছিল, জানো তো তোমার বাপি নটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে নেয়। গোপাল মাঠে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে গেলে বেশি দেরি হয়ে যাবে। তাই এখানেই খেয়ে নেওয়া ভালো।
প্রাতঃরাশ খেয়ে হালকা মিউজিক চালিয়ে গাড়ি চালাতে লাগল অমিত। দশ মিনিটের রাস্তা অতিক্রম করার পরই চোখে পড়ল একটা ডাবওয়ালা। অমিতের বাবা চন্দ্রশেখর বাবু গাড়ী থেকে নেমে চারজনের জন্য চারটা ডাব কিনে আনলেন।
ডাবটা হাতে নিয়েই তৃপ্তির চোখের সামনে ভেসে উঠল ওর বাবার মুখটা। ডাবের জল খেতে বড্ড ভালোবাসে। তবুও দাম দিয়ে ডাব কিনে খেতে চায় না। গরমে ক্লান্ত হয়ে সবজি বাজার থেকে ফিরে এসে নুন চিনির শরবত খাবে রোজ দিন। তবু টাকা খরচ করে ডাব কিনবে না।
তৃপ্তি এক চুমুক ডাবের জল খেয়ে অমিতের উদ্দেশ্যে বলে, অ্যাই আরো দু’টো ডাব কিনে নাও না বাড়ির জন্য। এখানে তা’ও চল্লিশ টাকা করে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের গোপাল মাঠে আরো দাম।
লীনা দেবী তাড়াতাড়ি বলে, তাই বুঝি। তোমার বাপের বাড়ির ওদিকে ডাবের খুব দাম। এই অমিত দুটো বড় দেখে ডাব কিনে নে তোর শ্বশুর শাশুড়ির জন্য।
জাতীয় সড়ক-এর বুকে ছুটে চলেছে অমিতের দামী চার চাকা। স্বামীর পাশে বসে হালকা মিউজিক শুনতে শুনতে তৃপ্তি ভাবে, সত্যি সে ভীষন লাকি। অমিতের মতো দায়িত্ববান স্বামী, মামনি আর বাপির মতো উদারমনষ্ক শ্বশুর, শাশুড়ি পেয়ে। কত সহজে ওনারা আমার অত্যন্ত ছাপোষা মা- বাবাকে আপন করে নিয়েছেন। আমার বাবা যে একটা সামান্য গুমটি দোকান আছে। তার জন্য কিন্তু ওনাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। পাঁচ বছরে কখনো শুনিনি কোনো অসম্মান জনক বাক্য। বরং প্রতি বছর পুজোতে মামনি নিজে গিয়ে আমার মা বাবার জন্য দামি জামা কাপড় কিনে উপহার হিসেবে পাঠায়। প্যাকেটের উপর সুন্দর করে লিখে দেন, ‘আমার দাদা দিদির জন্য ছোট্ট উপহার এই বোনের বাড়ির তরফ থেকে।’
এইসব আন্তরিক কথাবার্তা ভাবতে ভাবতে কখন যে নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছি তৃপ্তি যেন টের পায় নি।
অমিতের গলার স্বর শুনে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো তৃপ্তি।
কি গো এসে গিয়েছি তো? এবার তো নামো।
লাজুক হাসি দিয়ে তৃপ্তি নামল খুব সাবধানে। লীনা দেবী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, দেখো বৌমা সাবধানে। বাপের বাড়ি এসে বেশি ছোটাছুটি করতে যেও না যেন।
তনিমা দেবী তাড়াতাড়ি দুটো চেয়ার এনে উঠানে পেতে দিল। চেয়ারের উপর বিছিয়ে দিয়েছে পুরানো শাড়ির পাড় থেকে তোলা সুতো দিয়ে নিজের হাতে বোনা আসন।একটা নড়বড়ে টুলের ওপর এনে রাখল শরবতের গেলাসগুলো।
লীনা দেবী হাত নেড়ে বলল, দিদি ব্যস্ত হবেন না। তিন চার ঘন্টা তো বসেই এলাম। এখন বরং একটু দাঁড়িয়ে থাকি। পা টা ছাড়ুক একটু।
তৃপ্তির বাবা তার সারল্য মাখা হাসি দিয়ে বলল, সেই ভালো দিদি। চলুন আমরা বরং একটু হেঁটে স্কুল বাড়ির দিকটা দিয়ে। জানেন তো ওখানে গাছ গাছালি প্রচুর। গরমের দিনে ওই জায়গাটা ছেড়ে ঘরে আসতেই মন চায় না।
চন্দ্রশেখর বাবু বললেন, সেই ভালো। এই তো প্রথমবার এলাম। তল্লাটটা বরং ঘুরে দেখি।
তৃপ্তির বাবা বেয়ান, বেয়াই, জামাই সবাইকে নিয়ে এলাকা পরিদর্শন করাতে গেলেন। নড়বড়ে টুলটার ওপর পরে রইলো শরবত-এর গেলাসগুলো।অতিথিদের কাছে শরবত-এর গেলাসগুলো কোনো সমাদরই পেল না।
তৃপ্তি বরং ওর মায়ের হাতে ডাব দুটো দিয়ে বলল, মা তোমার আর বাবার জন্য নিয়ে এসেছে তোমার জামাই। খুব টেস্টি জলটা। আমরা সবাই তো খেলাম।
ওওওও তাই বোধহয় আর কেউ শরবত এর গেলাসগুলো ছুঁয়ে দেখল না। এতক্ষণে বিষয়টা পরিষ্কার হলো আমার কাছে।
যাক গে। ও তৃপ্তি তুই আমার সঙ্গে একবার রান্নাঘরে আয় মা। দেখ তো সব জোগাড় ঠিকঠাক আছে কিনা।
রান্না ঘরে ঢুকে তৃপ্তি তো অবাক হয়ে যায়। দেরাদুন রাইসের গন্ধে ভরে উঠেছে টালির ছোট্ট রান্নাঘরটা। একে একে তনিমা ঢাকা খুলে দেখাতে লাগল কি কি সে বানিয়েছে দুপুরে খাওয়ার জন্য।
তৃপ্তি বলে, ও মা এত কেন রান্না করতে গিয়েছ। মাটনটাই তো ঠিক ছিল। আবার গলদা চিংড়ি করার কি খুব দরকার ছিল।
হ্যাঁ গো মা বাবার তো পকেটের খুব চাপ হয়ে গেছে। যে মানুষটা নিজেদের জন্য সচারাচর গলদা চিংড়ি কেনে না শুধু মাত্র দামের জন্য।সেই মানুষ একসঙ্গে খাসী আর গলদা কিনে এনেছে।
দেখ তৃপ্তি যতই হোক তোর শ্বশুরবাড়ির লোকরা বড়লোক। বড়লোকদের পাতে কি কুচো চিংড়ি দেওয়া যায়? না ওনাদের পাতে রেশনের চালের মোটা ভাত দেওয়া যায়?যারা যেমন মানুষ তাদের কে তো তেমন আপ্যায়ন করতে হবে তাই না।
তৃপ্তি ওর মোবাইলটা অন করে দেখলো বেলা একটা বাজতে চলেছে। তনিমার উদ্দেশ্যে বলে, মা বাপির দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ওরা এখনই এসে পড়বে। চল আমরা পাকা ঘরের বারান্দায় জল, জায়গা করে ফেলি।
মিনিট দশেকের মধ্যেই তৃপ্তির বাবা অমিতের মা বাবাকে না ফিরে এল। এসেই বললেন- তনিমা বেয়াই বেয়ানরা একটু দূর্গাপুর ব্যারেজ দেখতে যাবে বলছেন। তাই বলছি এখন আর খাবার বেড়ে কাজ নেই।
লীনা দেবী মিষ্টি হেসে বললেন, যেতে আসতে যেটুকু সময় লাগবে। চিন্তা করবেন না। আমরা দূর্গাপুর থেকে ফিরে এসে কব্জি ডুবিয়ে খাব দিদির হাতের টেস্টি সব রান্না।আর হ্যাঁ, তৃপ্তির সঙ্গে আপনারও খেয়ে নিন কিন্তু। না হলে কিন্তু সবার খেতেই দেরি হয়ে যাবে। তখন আবার হজমের সমস্যা হবে।
তৃপ্তি বলে, মামনি বাপি তো একটার মধ্যে খাবার খান বাড়িতে। দেরি হলে বাপির তো কষ্ট হবে।
তৃপ্তির কথাটা জাস্ট হাওয়াতে উড়িয়ে দিয়ে লীনা দেবী বললেন, একদিন অনিয়ম করলে তোমার বাপির কিছু হবে না। তাছাড়া তো ঘন্টা খানেক-এর তো মামলা।
অমিতরা চলে যাওয়ার পর তৃপ্তির মা বলল, তৃপ্তি চল আমরা সবাই এক মুঠো করে খেয়ে নিই। তোর তো এইসময় অনিয়ম করা উচিত হবে না।
তৃপ্তির বাবা বলল, বুঝলে তৃপ্তির মা আগে জামাই বাবাজীবন, বেয়াই আর বেয়ানের পাতে মাংস, চিংড়ি পড়ুক। ওনারা খাওয়ার পর যদি কিছু বেঁচে থাকে তখন না হয় রাতে আমরা খাব। এই বেলা ডাল, আলু চচ্চড়ি দিয়ে খেয়ে নিই আমরা।
খাওয়া দাওয়ার সেরে বিছানায় শুয়ে বারবার তৃপ্তি জানালার দিকে উঁকি মারতে লাগল।বেলা গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল। ঘড়িতে যখন সাড়ে তিনটে তখন অমিতদের গাড়িটা এসে থামলো তৃপ্তিদের বাড়ির সামনের রাস্তায়।
তনিমা, তৃপ্তির বাবা হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। লীনা দেবী মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, সরি সরি খুব দেরি হয়ে গেল আমাদের ফিরতে।
তনিমা বলে ,হ্যাঁ দিদি বড্ড অবেলা হয়ে গেল যে। চলুন একটু করে খেয়ে নেবেন কিছু।
লীনা দেবী তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, না না দিদি আপনাদেরকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমরা সিটি সেন্টার থেকে লাঞ্চ করেই ফিরছি। আধ ঘন্টার মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়বো। বুঝতেই তো পারছেন বেশি দেরি করা যাবে না। অমিত নিজেই তো ড্রাইভ করবে।
লীনা দেবী কিছুক্ষণ তৃপ্তিকে এটা ওটা প্রেগন্যান্সি সংক্রান্ত জ্ঞান দিয়ে তারপর রওনা দিলেন। অমিত যাওয়ার সময় তৃপ্তিকে একটা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে গেল। তৃপ্তির হাতের ওপর আলতো নিজের হাতটা ছুঁইয়ে চোখ বন্ধ করে জানান দিল ওর আবেগকে।
অমিতরা চলে যাওয়ার পর তৃপ্তির মা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, হ্যাঁ রে তৃপ্তি তোর শ্বশুর, শাশুড়ি আমাদের ঘরের এক গ্লাস জল পযর্ন্ত মুখে তুলল না।
তৃপ্তি একটা তিতো হাসি দিয়ে বলল, ছাড় না মা। ওনারা তো মাটন, চিংড়ি রোজ খাচ্ছে। বরং আজ আমরা তিনজনে জমিয়ে রাতে খাওয়া দাওয়া করব।
তনিমা দেবী হালকা ধমকের সুরে বলল, একি অসভ্যের মতো কথা তৃপ্তি। ওনাদের জন্য খাবারের আয়োজন করলাম। আর ওনারাই কিছু না খেয়ে চলে গেলেন।
তৃপ্তি বলে, মা গরিব ঘরের মেয়েকে বড়লোকরা নিজেদের পুত্রবধূ করে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু পুত্রবধূর মা বাবাকে নিজেদের সম গোত্রীয় ভাবতে পারে না কিছুতেই। দোষ কি কখনও বড়লোকদের হয় না। দোষ তো আমাদের মতো গরীবদের।যারা বড়লোকদের সঙ্গে কুটুম্বিতা করতে ছুটি। এই জন্যই তো বলে আত্মীয়তা করতে সমানে সমানে।
তনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তৃপ্তি কতবড় কঠিন কথাটা তুই কি অবলীলায় বললি রে মা। গরিবরা চিরকালই বড়লোকদের দয়ার পাত্র হতে পারে। কিন্তু প্রকৃত বন্ধু হতে পারে না। -
গল্প- জিজীবিষা
জিজীবিষা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জীতিন টে দিন কেটে গেল তবু রুমকির একটা খবর পেলাম না।যখনই ফোন করছি তখন ই ফোন সুইচ অফ বলছে। অগত্যা দুশ্চিন্তা ছাড়া আমার হাতে আর কিছু রইল না।
আমার পতিদেব বরুন কে বললাম,হ্যাঁ গো তুমি আমাকে একবার রুমকির জেঠুর বাড়িতে নিয়ে যাবে।
বরুন বলল, রুমকির জেঠুর বাড়িতে কেন যাবে তুমি?
_ ও মা তোমাকে তো বলাই হয় নি যে রুমকি ওর বাবা মায়ের কাছে থাকে না। থাকে না বললে ভুল বলা হবে। বরং বলতে পারো ওর মা মানে ওর সৎ মা থাকতে দেয় না।
জানো রুমকি বলছিল ওর সৎ মা প্রতি মাসে ওর থেকে পাঁচ ঘরে কাজ করে যা পায় ।সেই টাকা টুকু ও কেড়ে নিয়ে নেয়। তার ওপর ঠিকঠাক করে খেতে পর্যন্ত দেয় না।
তবে রুমকির জেঠিমা টা ভালো। সকালের টিফিন,ভাত তো এর ওর ঘর থেকে খেয়ে নেয়। শুধু রাতের খাবার টুকু আর শোওয়ার জায়গা টুকুর জন্য জেঠিমার কাছে কাছে রুমকি।
বরুন বলে,কত আর মেয়েটার বয়স হবে।এই বয়স থেকে কত সংগ্ৰাম করে বাঁচছে। তবে ওদের এই ধরনের জীবন সংগ্ৰাম গুলো ওদের কে বড্ড তাড়াতাড়ি স্বাবলম্বী হতে শেখায়।
তা যা বলেছো।রুমকি গত মাসে আঠারো তে পা দিয়েছে। সেদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল,বীথি দিদি পোস্ট অফিসে বই খুলতে গেলে কি করতে হয় গো?
তাই নাকি? বাঃ রুমকি তো চালাক চতুর ও আছে।
আমি মুখ টিপে হেসে বললাম,চালাক বলে চালাক।ওর জেঠু তুতো দিদির দেওরের সঙ্গে প্রেম ও করছে।যদিও বাড়িতে কেউ কিচ্ছুটি জানে না।
বল কি গো! তবে আর রুমকি কে নিয়ে চিন্তা করো না। রসিকতা করে বলল বরুন।মানে ভ্রু জোড়া বেঁকিয়ে বললাম,মানে?
মানে অতি সোজা।রুমকি বিয়ে টিয়ে করে বসে নি তো?
আমি রীতিমতো লাফিয়ে উঠে বললাম,এই রে বাবা। তাহলে আমি এখন কি করব? তিন দিন তো হয়েই গেল।আর কদিন রুমকির পথ চেয়ে বসে থাকবো।প্লিজ লক্ষ্মী টি। আমাকে আজ সন্ধ্যা বেলায় একবার নিয়ে চলো ওর জেঠিমার বাড়ি। ইচ্ছে তো করছে তুমি অফিস বের হলেই আমি বেরিয়ে পড়ি ওর জেঠুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমি তো কোনদিন ও নীচু পাড়ায় যাই নি।ওর জেঠুর বাড়ি টাও চিনি না।
ঠিক আছে ঠিক আছে।এত উতলা হয়ে লাভ নেই।আমি অফিস থেকে ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে যাবো ক্ষণ।
বরুন অফিসে বের হয়ে গেলে আমি আবার রুমকির নাম্বার টা ডায়েল করলাম। অপর প্রান্ত থেকে রিং আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমার হৃদ যন্ত্রটা যেন লাফাতে শুরু করলো।
কিন্তু আমার আনন্দ নিমেষে নিরানন্দে পরিনত হল। রিং হয়ে হয়ে ফোন টা থেমে গেল।যেমন অন্ধকারে ছিলাম ঠিক তেমনি অন্ধকারে রইলাম।
ঘর দোর পরিষ্কার করে স্নান সেরে পূজায় বসলাম।ফুল দিয়ে ঠাকুর কে সাজাতে সাজাতে আবার মনে পড়ল রুমকির কথা।এর ওর বাড়ি থেকে আমার জন্য পলিথিন ভরে শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনতো।আর বলত,দিদি আমার তো নিজের ঘর নেই যে ঠাকুরের আসন পারবো। আমার হয়ে তুমি ই ফুল গুলো ঠাকুর কে দিয়ে দিও।
আমি বেশ বুঝতে পারতাম রুমকির একটা নিজস্ব ঘরের লোভ আছে। ছোট থেকেই আশ্রিতা হয়ে কাটছে যে ওর জীবন। আশ্রিতা দের জীবনে ভালোবাসা কম অনুকম্পা থাকে বেশি।
পূজো সেরে সোফায় বসে একটা মাসিক ম্যাগাজিন পড়ছিলাম। হঠাৎ আমার মোবাইল টা বেজে উঠলো।স্ক্রীনে ফুটে উঠল রুমকির ছবি ও নাম।
তাড়াতাড়ি পত্রিকা টা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মোবাইল টা হাতে তুলে নিয়ে বললাম,হ্যালো
অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, দিদি আমি রুমকি বলছি।
হ্যাঁ রে রুমকি তোর ব্যাপার কি? শরীর ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ দিদি শরীর ঠিক আছে।
তাহলে তিন দিন ধরে কাজে এলে নি না কেন?
একটু একটু আমতা আমতা করে রুমকি বলল,দিদি আমি বিয়ে করে ফেলেছি।
বলিস কি রে!তা কাকে বিয়ে করলি?
তোমাকে বলেছিলাম না আগে। আমার জেঠ তুতো দিদির দেওরের কথা।ওকেই বিয়ে করলাম।
এ তো খুব আনন্দের খবর রে।
না দিদি আনন্দ করে তো আর বিয়ে টা করতে পারলাম না।
মানে?
আসলে আমরা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে মন্দিরে চুপিচুপি বিয়ে টা করলাম।
কেন রে? তোর জেঠুর মেয়ে তো সব জানতো তোদের ব্যাপারে।
দিদি আর কি করবে? দিদি ওর শাশুড়ি কে বলেছিল আমাদের সম্পর্কের কথা। তাই শুনে বুড়ি বলল, আমার ছোট ছেলের বিয়ে তে আমার পঞ্চাশ হাজার টাকা বর পণ চাই। তবেই তোমার খুড়তুতো বোন কে আমি ঘরে তুলব।
তারপর?
তারপর আর কি। আমার বাবা তো থেকে ও নেই।জেঠু ও বললো , আমার পক্ষে এতগুলো টাকা বর পণ দেওয়া সম্ভব নয়। তখন আমার বর অজিত একটা উপায় বের করল।
কি উপায়? অবাক হয়ে বললাম আমি?
অজিত বলল,রুমকি চল আমরা ঘর ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি। তাহলে তো আর বর পণ দিতে হবে না।তারপর কোথায় ঘর ভাড়া করে থাকবো।
আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, আমার মতো অভাগী কে বিয়ে করার জন্য কোনো ছেলে নিজের ঘর ও ছাড়তে রাজি ! সেদিন রাতে জেঠিমার ঘরের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আমার করনীয় কি? আকাশ পাতাল ভাববার পর ঠিক করলাম, আমার আবার জেঠুর ঘর ছাড়তে ভয় কিসের? নিজের সব খরচ নিজেই করি। শুধু রাত টুকু জেঠুর বাড়িতে ঠাঁই নিই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,রুমকি এখন কোথায় আছিস তাহলে?
দিদি দূর্গাপুর ইসটেশনের কাছে যে বস্তি আছে সেখানে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি।
তা বেশ।তাহলে আগামীকাল একবার আয় বর কে নিয়ে।দেখা করে যাস একবার।
পরেরদিন অজিতের সাইকেলের সামনে বসে রুমকি এলো আমাদের বাড়িতে। সিঁথি তে মোটা সিঁদুর,হাতে শাঁখা পলা পরে কি সুন্দর দেখাচ্ছে যেন রুমকি কে।
রুমকি একগাল হেসে আমাকে বলল,দিদি আমাকে বউ এর সাজে কেমন দেখাচ্ছে?
আমি ও রসিকতা করে বললাম,তোর বর এখন ও বলে নি মনে হচ্ছে।
রুমকি মুচকি হেসে বললো,ওর তো দুচোখে এক প্রেম ঝরছে।না হলে আমার মতো মেয়েকে বিয়ে করতো।
অজিত লাজুক হাসি দিয়ে বললো,দিদি তোমার বোন টার মন টা পরিষ্কার নয়। কেবল ফালতু কথা বলে।
আমি অজিত কে বললাম, রুমকি কিন্তু তোমার প্রেমে হাবুডুবু খেয়েই নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে।ও এখন আর কারোর আশ্রিতা নয়।ও এখন তোমার ঘরের ঘরনী। মেয়েটাকে তোমার প্রেম দিয়ে সারাজীবন আগলে রেখ ভাই। -
গল্প- সাদা বেনারসি
সাদা বেনারসি
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জীএকি কাণ্ড গো! নিজের বিয়ে তে কেউ সাদা বেনারসি পরে? বেশি বয়সে বিয়ে হওয়ার জন্য ছোট পিসি মনির মাথাটা বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে।
হীরা পিসির মুখ থেকে এমন ব্যঙ্গাত্মক কথা শুনে আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। আমি হীরা পিসিকে বললাম, কারোর সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করার আগে একবার ভাবা উচিত নয় কি পিসি মনি?
হীরা পিসি ভ্রু কুঁচকে বলল,মানে কি বলতে চাইছিস তুই বুলা? আমি কি এমন ভুল বললাম? বাঙালি ঘরের বিয়ের কনে সাদা বেনারসি পরে কি বিয়ের পিঁড়িতে বসছে কোনোদিন? আমি তো বাবা এই প্রথম দেখলাম এমন দৃশ্য তাও আমাদের মতো যৌথ পরিবারে।
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি বললাম, হীরা পিসি ছোট পিসির সাদা বেনারসি পরার পিছনে একটা ইতিহাস আছে ।যেটা বোধহয় তোমার কান পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায় নি এতদিনে ও। ঘটনা টা তাহলে শোনো তুমি , তোমার বিয়ের বৌভাতের দিন আমি দেখি ছোট পিসি ঠাম্মা প্রায় পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এলো বাইরে থেকে। কি ব্যাপার তা দেখতে আমি ছোট পিসির ঘরে গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি ভিতর থেকে দরজায় খিল এঁটে দিয়েছে ছোট পিসি ঠাম্মা।আমি যদিও ঠাম্মা শব্দ টা ব্যবহার করি না।আমি শুধু ছোট পিসি বলি।
খিল এঁটে দেওয়া র এই কথা টা শুনে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে মেজ পিসি ঠাম্মা বিশাখা বলে উঠেছিল,সে কি কথা রে! এমন অসময়ে দরজায় খিল এঁটে দেওয়া কি কথা!
চল তো বুলা আমার সঙ্গে তোর ছোট পিসি মনির ঘরে একবার। হঠাৎ মেয়েটার কি হলো একবার জিজ্ঞেস করে আসি।
এই তো সন্ধ্যা বেলায় লাল বেনারসি পরে , খোঁপায় বেল ফুলের মালা জড়িয়ে কি সুন্দর করে সাজলো।কি মিষ্টি দেখতে লাগছিল আমার ছোট বোন টাকে।
আমার দাদুরা পাঁচ বোন এবং ছয় ভাই।বড় পিসি ঠাম্মা ফাল্গুনীর মেয়ে হীরা এবং বড় দাদু মানে আমার দাদুর বড় ছেলে মানিক এবং অরুন্ধতী এরা তিনজনে সমবয়সী। আর আমি হলাম সেই মানিকের মেয়ে বুলা।
বড় পিসি ঠাম্মার মেয়ে হীরা এবং ছোট পিসি ঠাম্মা অরুন্ধতী একসাথে পড়াশোনা করেছে একি স্কুল থেকে।মাসী বোন ঝি এর মধ্যে ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনা নিয়ে বেশ কম্পিটিশন লেগেই থাকত।
তবে কলেজে ওঠার পর হঠাৎ করেই হীরা পিসির বিয়ে হয়ে যায় এক অধ্যাপক পাত্রের সঙ্গে।আসলে হীরা পিসির রূপের ছটা ও দেখার মতো।যেমন ফর্সা তেমন চোখ মুখ।
সেদিনটা ছিল হীরা পিসির বৌভাত। তাই ছোট পিসি অরুন্ধতী ঠিক করেছিল বেনারসি শাড়ি পরে বৌভাত খেতে যাবে। তাই সে তার মেজ দি বিশাখার বিয়ের লাল বেনারসি টা পরেছিল। কিন্তু হঠাৎ বাইরে থেকে কাঁদতে কাঁদতে এসে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল এঁটে দিয়েছিল।
মেজ পিসি ঠাম্মা বারবার দরজায় ধাক্কা মারার পর থমথমে মুখে ছোট পিসি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল। বেনারসি র ভারি আঁচল লুটোপুটি খাচ্ছে মেঝেতে। খোঁপার বেল ফুলের মালা টাও যেন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে শতরঞ্জি র ওপর। চোখের কাজল,আই লাইনার গেছে একেবারে থেবড়ে।
অরুন্ধতীর এমন আলুথালু বেশ দেখে বিশাখা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর মৃদু স্বরে বলেছিল,বোন তোর সাজগোজ এর একি অবস্থা করেছিস? সেই সন্ধ্যা বেলা থেকে রেডি হচ্ছিস।আর এখন সব নিজের হাতে ভন্ডুল করে দিলি?
অরুন্ধতীর বক্ষদেশ এর দ্রুত ওঠানামা দেখে বেশ যাচ্ছে সে ভীষন রকমের রেগে আছে।রাগে,অভিমানে কাঁদতে কাঁদতে চোখ গুলো জবা ফুলের মতো লাল করে ও ফেলেছিল।
বিশাখার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষন। তারপর বলেছিল,মেজ দি আমার কি অপরাধ বলতে পারিস কেন আমি হীরার ছোট মাসী হলাম?
অস্ফুট স্বরে বিশাখা বলে,মানে?
আমি রেডি হয়ে কনে যাত্রীর গাড়িতে বসে ছিলাম।কোথা থেকে মানিক এসে বলে, ছোট পিসি তোমার কি এমন লাল টুকটুকে বেনারসি, খোঁপায় বেল ফুলের মালা এইসব দিয়ে সাজা চলে? হীরার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলবে কি!যতই হোক তুমি তো এখন মাসী শাশুড়ি হয়ে গেছো। শাশুড়ির সাজ কি এমন হয়?
মানিকের কথা শুনে ওখানে আরো যারা ছিল তারা ও বলে উঠল,সব সাজগোজ এর একটা নির্দিষ্ট সীমা থাকে।বয়স যাইহোক অরুন্ধতী তুই যে এখন মাসী শাশুড়ি হিসাবে হীরার শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিস সেটা ভুলে গেলে চলবে না।
পাশ থেকে মানিক দার বৌ বলল, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো র চেষ্টা করছে গো আমাদের অরুন্ধতী।ওর যে আদৌ কোন দিন বিয়ে হবে কিনা কে জানে? তাই বোধহয় এমন সাজগোজ করেছে আজ।
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে ছোট পিসি মনি আবার কেঁদে ফেলেছিল।আর সেই থেকেই ছোট পিসি মনি ডিপ কালারের শাড়ি পরা ও ছেড়ে দিয়েছিল।
তাই বলে নিজের বিয়েতে ও এমন সাদা বেনারসি পরে বসে কেউ? দুঃখ মেশানো গলায় বলল হীরা পিসি।
আমি বললাম, এখন বুঝতে পারি পারিবারিক সম্পর্কের গন্ডীর মধ্যে আমাদের সাজ পোশাক ও জড়িয়ে আছে যেন তাই না হীরা পিসি? অনেক পরিবারে এখন যদিও পরিবর্তন এর আলো ঢুকে পড়েছে। সেখানে শাশুড়ি,বৌমা একসাথে নাইটি, চুড়িদার পরে ।
কিন্তু আমাদের পরিবারে এখন ও গুমোট হাওয়া। এখন ও আমরা যৌথ পরিবারের সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ততটা খুঁজি না।যতটা নিষ্ঠা খুঁজি সম্পর্কের বাহ্যিক আচার আচরণের মধ্যে।
আমার কথা গুলো শুনে হীরা পিসি বলে,সে কি রে এত সব কান্ড হয়েছিল আমার বিয়ের সময়। বৌভাতের দিন ছোট মাসীর শরীর খারাপ হয়েছিল এটাই আমাকে বলেছিল সবাই। এত বছর পর বুঝতে পারলাম এর পিছনে অন্য গল্প ছিল।
কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকার পর হীরা পিসি ছোট পিসির ঘরে গেল।গিয়েই ছোট পিসিকে জড়িয়ে ধরে বলল,আজ তোমার নিজের বিয়ে তে ও সাদা বেনারসি পরবে ছোট মাসী?
ছোট পিসি লাজুক হাসি দিয়ে বলল,একে তো চল্লিশ বছরে বিয়ের পিঁড়িতে বসছি ,তার ওপর তোর বর মানে আমার জামাই ও এসেছে । সেখানে কি ভালো দেখায় শাশুড়ি হয়ে লাল বেনারসি পরে ঘুরে বেড়াতে।
হীরা পিসি বিরক্ত হয়ে বলে,শোনো ছোট মাসী যৌথ পরিবারের এই জগা খিচুড়ি মার্কা সম্পর্কের জেরে কি নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হবে নাকি।আমি শুধু মাত্র তোমার বোন ঝি হই তা নয় কিন্তু।আমি তোমার বান্ধবী ও হই।আর সেই বন্ধুত্বের জোরে বলছি,যতই তুমি সম্পর্কের দিক থেকে শাশুড়ি হয়ে যাও না কেন সাদা বেনারসি পরে নয়,লাল বেনারসি পরে ই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে আজ।
মনের সব দ্বন্দ্ব দ্বিধা কে দূরে সরিয়ে দিয়ে এবং হীরার মতো উদার মনষ্কা বোন ঝি কে পাশে পেয়ে অরুন্ধতী কুড়ি বছর পর আবার পরল মেজ দি বিশাখার সেই লাল বেনারসি টা।যৌথ পরিবারের জটিল সম্পর্কের সীমানা কে অতিক্রম করে অরুন্ধতী আজ ফুরফুরে মেজাজে শুরু করল তার বৈবাহিক জীবন। -
গল্প- পুরুষ সিংহ
পুরুষ সিংহ
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী-মৈনাককে এই পারমিশনটা দেওয়ার আগে তোমার কি একবারের জন্য মনে হল না আমার সঙ্গে একবার পরামর্শ করা উচিত।
-মিথ্যা বলব না। মনে যে একদমই হয়নি তা কিন্তু নয়। আর মনে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। এই চল্লিশ বছরে আমি নিজের সিদ্ধান্তে কোন কাজটা করেছি বল তো?
-এ তো তোমার অভিমানের কথা হয়ে গেল সেজ বউ।
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখার্জি বাড়ির সেজ বউ নিরুপমা বলল, এই বয়সে আবার অভিমান! হতো এককালে খুব অভিমান হতো তোমার ওপর। যখন তুমি তোমাদের পরিবারে সমানাধিকারের তত্ব প্রয়োগ করতে ব্যস্ত ছিলে। তোমার রোজগার ছিল সবচেয়ে বেশি। আর তোমার আদর্শও ছিল ঝুড়ি ঝুড়ি। তাই তো সমান দৃষ্টিতে সকলকে দেখার জন্য নিজের স্ত্রী, সন্তানদের সবসময় ভালো কিছু থেকে বঞ্চিত করে এসেছো।
গেরস্তে সবাই একই খাবার, একই জামা কাপড় পরলেও অন্দরে চলত অন্য খেলা। তোমার তিন ভাই সবাই হরলিক্স, বিস্কুট, ফল আলাদা করে এনে তাদের ছেলেমেয়েদের খাওয়াতো। আর আমার মৈনাক, মিঠি এরা শুধু শশা চিবিয়ে বড় হয়ে গেল। আর আমি যেহেতু বড়লোক ঘরের মেয়ে ছিলাম তাই তো তোমার ধারনা ছিল, বড়লোকের মেয়ে মানেই হিংসুটে।
ভাগ্যিস আমার বাবা একরকম জোর করেই মৈনাক আর মিঠিকে নিয়ে চলে গিয়েছিল ওনার কাছে। তাই ওরা এই রকম নামকরা স্কুল থেকে পড়াশোনা করে আজ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে।
হিমাংশু বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, তাহলে বাবা হিসাবে আমার কোনো অবদানই নেই দেখছি।
পুনরায় মুখ ঝামটা দিয়ে নিরুপমা বলল, অবদান আবার নেই। ওরা জীবনে যেটুকু অভাব কষ্ট পেয়েছে সে তো তোমার দৌলতেই পেয়েছে।
-আমি কি শুধু ওদের কে কষ্টই দিয়েছি সেজ বউ?
নিরুপমা আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, থাক না আর মনে করিও না সেইসব পুরানো দিনের কথা। তার চেয়ে বরং বাজারে যাও। ছেলেমেয়েগুলোর জন্য ভালো মন্দ বাজার করে নিয়ে এসো। আজ আমাদের কতবড় আনন্দের দিন বলো। আমাদের মৈনাক এম এস এ চান্স পেয়েছে।
হিমাংশু বাবু বললেন, আনন্দের সঙ্গে দুঃখটাও তো পেছন পেছন এলো।
দেখো তুমি যেটাকে দুঃখ ভাবছো সেটা কিন্তু আমার কাছে মোটেই দুঃখের নয়। স্বামীর পড়াশোনাতে স্ত্রী পয়সা খরচ করবে এতে লজ্জিত হওয়ার তো কিছু নেই!
মৈনাকের সমস্ত লেখাপড়ার খরচ তো আমার বাবা চালিয়ে এসেছে এতদিন। কৈ তখন তো তোমার খারাপ লাগেনি ? তাহলে আজ হঠাৎ শোক করছ কেন?
-দেখ দাদুর টাকায় পড়াশোনা করা আর বউ এর টাকায় পড়াশোনা করার মধ্যে যথেষ্ট তফাৎ আছে।
-একদম ঠিক বলেছো তুমি। তফাৎ আছে দুটো ভাবনার মধ্যে। শ্বশুরের পয়সার ওপর কেমন যেন একটা জোর থাকে বেশিরভাগ পুরুষ মানুষের। কিন্তু পুত্রবধূর পয়সার ওপর সেই জোর নেই। বরং তোমার মনে হচ্ছে তুমি অপারগ বলেই তোমার বৌমার কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিতে হচ্ছে। এম বি বি এস পাশ করেই তো ছেলেটা আর্মিতে জয়েন করেছিল। যা উপার্জন করেছিল তা তোমাদের মুখার্জি পরিবার আলাদা হওয়ার পর ধারদেনা মেটাতেই শেষ করে ফেলল। ভবিষ্যতের জন্য কিছুটি সঞ্চয় করেনি মৈনাক।
তারপর এম এস এ চান্স পেতেই রীতিমতো চিন্তা পড়ে গিয়েছিল মৈনাক। কোথা থেকে জোগাড় হবে পড়াশোনার খরচ। দাদুর কাছ থেকে আর নতুন করে কোনো টাকা নিতে চাইছিল না ও। আমি তখন বলেছিলাম আমার যে কুড়ি ভরি গয়না বেঁচে আছে তা বিক্রি করে কিংবা বন্দক দিতে। তখন তিথি বলল, মা এত কেন ভাবছেন? আমি আছি তো? আমি যা পেমেন্ট পাই তাতে কষ্টশিষ্ট করে আপনার ছেলেকে আমি ঠিক পড়াতে পারব।
দেখলাম মৈনাকও রাজি হয়ে গেল। ওদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যখন সুন্দর সমঝোতা আছে তখন আমরা শ্বশুর শাশুড়ি হয়ে আপত্তি করতে যাবো কেন? দেখ মৈনাক যেমন আমাদের সন্তান। ঠিক তেমনি তিথির স্বামী। স্বামীর জীবনে স্ত্রীর অবদান কি শুধু হেঁশেল ঠেলা তে? স্ত্রীরা যেমন রেঁধে বেড়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের খাওয়াতে পারে ঠিক তেমনি বিপদে অর্থ সাহায্যও দিতে পারে।
হিমাংশু বাবু আবার বলেন, তুমি ঠান্ডা মাথায় একবার ভেবে দেখো বৌমার কাছে আমি কতটা ছোট হয়ে গেলাম?
রাখ তো তোমার ঠুনকো মান সম্মান। তিথি সব জানে। মৈনাক ওকে সব বলেছে। যৌথ পরিবারটা ধরে রাখতে গিয়ে তুমি যে আজ নিঃস্ব সেটা তিথির অজানা নয়।
আর শোনো তোমার সেকালের ভাব ধারনা এবার ত্যাগ করো। স্ত্রী দিবারাত্রি সংসারের জন্য পরিশ্রম করে যাবে তার বেলায় তোমাদের মতো পুরুষ মানুষের তেমন একটা খারাপ লাগে না। কিন্তু স্ত্রী পরিশ্রম করে টাকা এনে সংসারের হাল ফেরালে তখন মান সম্মানে লাগে খুব!
হিমাংশু বাবু বেশ বুঝতে পারছেন বিষয়টা এবার নিরুপমার দিকে ঘুরে যাচ্ছে। নিরুপমা বিয়ের পর হিমাংশু বাবুদের গ্ৰামের স্কুলে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল। তখন কিন্তু হিমাংশু বাবুর মা বাবা চরম আপত্তি করেছিলেন। ওনাদের যুক্তি ছিল বউ এর রোজগারের টাকায় খাওয়ার থেকে উপোস থাকা ভালো। আর হিমাংশু বাবুও চুপচাপ তার মা বাবা কেই সমর্থন করেছিলেন।
সেই পুরোনো ঘা থেকে রক্তক্ষরণ হওয়ার আগেই চুপচাপ বাজারে চলে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলেন হিমাংশু বাবু।
হিমাংশু বাবু বাজারে বেরিয়ে গেলে তিথি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, মা তুমি বাবাকে এত কড়া কথা শোনালে তবুও বাবা কিন্তু সব কিছু চুপচাপ সহ্য করে গেল। আমি তো ভাবতেই পারছি না বাবার মতো রাশভারী মানুষ একান্তে তোমার কাছে যেন কত অসহায়!
নিরুপমা বলল, বৌমা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটাই হচ্ছে বোঝাপড়া বা সমঝোতার ভিতের ওপর তৈরি। যৌবনে পুরুষ মানুষের থাকে অন্য উদ্দীপনা। নিজেকে পুরুষ সিংহ মনে করে। কিন্তু চামড়ার শিথিলতা আসার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে যৌবনের ভুলগুলো। বুঝতে পারে, মা বাবা, ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন সবাইকে ছাপিয়ে বার্ধক্যে সবচেয়ে বেশি দরকার পড়ে স্ত্রী’কে। তাই তখন বুড়ো সিংহের মতো মাঝে মধ্যে হুংকার ছাড়লেও আস্ফালন করার ক্ষমতা থাকে না। চুপচাপ স্ত্রীর বাক্য শিরোধার্য করা ছাড়া উপায় থাকে না আর। -
গল্প- আলাদা খাট
আলাদা খাট
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জীসবে মাত্র রাতের অন্ধকার ঠেলে দূর থেকে দিবাকর উঁকি মারছে পুবের আকাশে। দূর থেকে কানে ভেসে এলো আজানের ধ্বনি। মামাবাড়ির বিছানায় ঘুমটা বেশ পাতলা হচ্ছিল সারারাত। তাই আজানের ধ্বনি কানে আসতেই ভাবলাম আজ ভোরের সূর্য দেখবো দুই বোনে। কতকাল সূর্য ওঠা দেখিনি।
আগে কিশোরী বেলায় আমি আর নিপা দিদি কালী পূজার এক সপ্তাহ আগে থাকতেই মামাবাড়িতে চলে আসতাম। দিনের আলো ফোটার আগেই মামাদের কালী তলায় গিয়ে গোবর দিয়ে মাড়ুলি দিয়ে আসতাম। তারপর ফ্রকের কোঁচড় ভরে শিউলি ফুল কুড়িয়ে মাড়ুলিটা সাজাতাম খুব সুন্দর করে। কি অনাবিল আনন্দ ছিল তখন!
তাই ভাবলাম আজ ভোরে নিপা দিদিকে তুলে নিয়ে যাবো মামাদের কালী তলায়। কিন্তু পাশ ফিরে দেখি দিদি নেই। মনে মনে ভাবলাম, দিদি কি তাহলে আমার আগেই উঠে চলে গিয়েছে কালী তলায়।
কালকে রাতে শুয়ে শুয়ে দিদি বলছিল, কতদিন শিউলি ফুল কুড়িয়ে ঠাকুরকে দিইনি। আর শিউলি ফুল দিয়ে হাতে কেমন মেহেন্দি করতাম। মনে আছে বোন তোর?
আমিও আর বিছানায় পড়ে না থেকে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে মেঝেতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মশারির খুঁটগুলো খুলতে লাগলাম। এমন সময় দেখি নিপাদি ঘরে ঢুকছে। গায়ে রয়েছে রাতের আকাশী রঙের সুতির নাইটিটা। হাউস কোট বা ওড়না কিছুই নেই।
আমি বললাম, কি রে দিভাই কোথায় গিয়েছিলি এতো ভোরে? আমি তো ভাবলাম তুই কালী তলায় গিয়েছিস। নিপাদি আমার থেকে তিনেকের বড় হলেও তুই তুকারি করেই ডাকি ছোট থেকে।
নিপাদি বলল, থাক তোকে আর মশারি খুলতে হবে না। এখনও বেশ মশা আছে।বলেই ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
আমিও পুনরায় মশারির খুঁটগুলো লাগিয়ে দিলাম যথারীতি। তারপর কাঠের চেয়ারটা ঘরের কোণ থেকে টেনে এনে বিছানার পাশটিতে বসে আবার জিজ্ঞাসা করলাম কি রে কোথায় গিয়েছিলি বললি না তো?
– কোথায় আবার যাবো! গিয়ে ছিলাম রিমি আর তিসির ঘরে সেই মাঝরাতে।
– কেন রে?
– আসলে কি জানিস তো। আমার তিসিকে ছাড়া একদম ঘুম আসতে চায় না।
-ওওওও তাই বল। হ্যাঁ রে দিভাই তুই যে তিসিকে নিয়ে আলাদা ঘুমাস তাতে জামাইবাবু আপত্তি করে না? মানে আমি বলতে চাইছি তোর আর জামাইবাবুর বয়স তো এখন চল্লিশের কোঠায়। এই বয়স থেকেই স্বামী স্ত্রী আলাদা আলাদা জায়গায় তোরা রাতে ঘুমাচ্ছিস?
নিপাদি হাত নেড়ে বলল, না না তোর কি মাথা খারাপ? এই বয়স থেকে আমি স্বামীসঙ্গ ত্যাগ করবো! আমার বিয়ের ডবল বেডে আমরা তিনজনই শুয়ে পড়ি।
– আমি প্রশ্ন করলাম, মানে তুই, জামাইবাবু আর তিসি এক বিছানায় ঘুমাস রাতে। তাই তো?
– হ্যাঁ তাই তো। কেন তুই তোর মেয়েকে রাতে তোদের কাছে নিয়ে ঘুমাস না?
– না রে দিভাই। রিমি পাঁচ বছর বয়স থেকেই আলাদা ঘরে শোয়।
রীতিমতো আঁতকে উঠে নিপাদি বলল, সে কি কথা। এইটুকু ছোট মেয়ে রাতে একা একা ঘুমায় কি করে।
কিছুটা ধমকের সুরে বলল, হ্যাঁ রে নিশা তোর কি কান্ডজ্ঞান নেই। রাত্রি বেলায় মেয়েটা যদি ভয় টয় পেয়ে বসে।
-ভয় পেলে আমি ছুটে যাই তো পাশের রুম থেকে। সেদিন হয়তো ওর কাছেই সারারাত শুয়ে রইলাম।
– ঠোঁট বেঁকিয়ে নিপাদি বলল, বাপু এতো নাটকের কি আছে। দশ বছরের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তোরা স্বামী স্ত্রীতে বড় খাটে আরাম করে ঘুমাতেই পারিস।
– সে হয়তো পারি। কিন্তু আমার মন সায় দেয় না। মা বাবার ঘনিষ্ঠতা ওর কিশোরী মনে প্রভাব ফেলুক এটা আমরা চাই না।
– ওরে ছোট মেয়ে ওরা, ঘুমিয়ে পড়লে ওদের কোনো জ্ঞান থাকে না। বেশ বিরক্ত হয়ে বলল নিপাদি।
– দেখ দিভাই তুই যাই বলিস না কেন আমি তোর যুক্তি মানতে পারলাম না। কিশোর বয়স থেকেই ধীরে ধীরে যৌবনের দিকে যায় মানব শরীর। এই সময় ওদের মনে নানা রকমের কৌতুহল জেগে ওঠে। আর বিদেশে তো আঠেরো মাস বয়স থেকেই বাচ্চার জন্য আলাদা বিছানার ব্যবস্থা করা হয়। একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সব বাচ্চা ছোট থেকে আলাদা ঘুমায় তাদের রাতে ঘুমের পরিমাণও যথেষ্ট ভালো হয়। ফলে তারা সারাদিন অনেক বেশি চনমনে থাকে।
আমার শেষ কথাগুলো নিপা দি খুব মন দিয়ে শুনছিল লক্ষ্য করলাম। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, এটা কিন্তু তুই ঠিক বলেছিস। বিছানায় কেউ বারবার পাশ ফিরলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। সেখানে বিছানার মধ্যে …না রে নিশা আমি এবার বাড়ি গিয়েই তিসির জন্য আলাদা ঘরে একটা খাটের ব্যবস্থা করব। ওকে রাতে একা শোয়াবো। দেরী যা হওয়ার হয়ে গেছে আর নয়। আমি না হয় মাঝে মধ্যেই তিসির রুমে গিয়ে শোবো। সুঅভ্যাস এর বিকল্প নেই।
আমি মনে মনে বললাম, যাক বাবা। শেষ পর্যন্ত বড় দিদি হয়ে যে ছোট বোনের কথা শুনল এটাই আমার সৌভাগ্য। আগে যৌথ পরিবারের বিধবা ঠাকুমারা নাতি নাতনীদের নিয়ে শুতো। কিন্তু এখনকার পরমাণু পরিবারগুলোতে সেই সুবিধা নেই। তাই বলে কি থেমে যাবে এতদিনের সায়েন্টিফিক পন্থা।না কখনো না। আমরা অভিভাবকরাই পারি আমাদের সন্তানদের জন্য একটা সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে নিজের বাড়ি থেকেই। শুধু আবেগ নয় সন্তানকে বড় করতে হবে বিবেক বুদ্ধি দিয়ে। -
গল্প- মিসক্যারেজ
মিসক্যারেজ
–লোপামুদ্রা ব্যানার্জীআরে বাবা আমার তো দেরি হয়ে যাচ্ছে। ব্যাঙ্ক থেকে বলে ছিল ফার্স্ট আওয়ারে আসতে। বাড়িতেই সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।
ওগো শুনছো, তাড়াতাড়ি একবার এসে আমার আধার কার্ডটা দিয়ে যাও।
রান্নাঘর থেকে উচ্চ স্বরে আওয়াজ এলো, আমার হাত জোড়া। খাটের গদির নিচে আলমারির চাবির গোছাটা আছে। তুমি আমার আলমারিটা খুললেই দেখতে পাবে একটা টিনের চকোলেটের বাক্স আছে। ওর মধ্যেই রাখা আছে তোমার আমার আধার কার্ডগুলো।
শম্ভু বাবু অগত্যা গদির নিচ থেকে চাবির গোছাটা বের করে সহধর্মিনীর আলামারিটা খুলল। খুলেই তো অবাক। ফিসফিস করে বলে উঠল, এতো শাড়ি! এরাই যা গাদাগাদি ঠেসাঠেসি করে রয়েছে সেখানে কি আর আমার প্যান্ট জামারা জায়গা পায়!
দুজনের দু’টো আলাদা আলমারি না হলে কি চলে সুরভীর। যাক গে এবার দেখি চকলেটের বাক্স কোথায়?
একটু এদিক ওদিক উঁকি মারতেই একদম নীচের থাকে দেখতে পেল বাক্সটা। এটা তো ভ্রমরের পাঁচ বছরের জন্মদিনের চকলেটের বাক্স। কোনো জিনিসটা ফেলতে মন চায় না সুরভীর। নিজের মনেই হাসতে হাসতে বলল কথাগুলো শম্ভু বাবু।
বাক্সটা খুলতেই দেখে বেশ কিছু পুরানো পোস্ট কার্ড, এনভেলব, ইনল্যান্ড লেটার রয়েছে। তারই মধ্যে উঁকি মারছে আধার কার্ডগুলো। নিজের আধার কার্ডটা পকেটে পুরে বাক্সটা বন্ধ করতে যাবে হঠাৎ একটা চেনা হাতের লেখা কাগজ দেখতে পেয়ে থমকে গেল।
বাক্সের একদম নিচের দিকে রয়েছে ভাঁজ করা কাগজটা। কাগজটা হাতে নিয়ে কৌতুহলবশত ভাঁজগুলো খুলে ফেলল।
বেশ বড় বড় হরফে স্পট হাতের লেখায় লিখেছিল চিঠিটা মৃদুলা। মৃদুলা হচ্ছে শম্ভু বাবুর একমাত্র বোন।
সম্বোধন করেছিল এইভাবে,
প্রিয় বৌদি,
জানি না তুমি বেঁচে ফিরে আসবে কিনা? কিন্তু সত্যি বলছি তোমাকে ছাড়া আমি অচল। যেদিন শাঁখা পলা খুইয়ে সাদা শাড়ি পরে আবার ফিরে এলাম বাপের বাড়িতে। সেদিন তুমি অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে মা’কে বলেছিল, মা মৃদুলাকে রঙিন শাড়িটা পরতে দিই। ওর এই বিবর্ণ চেহারা যে আমি সহ্য করতে পারছি না।
মা বরং বিরক্ত হয়ে বলেছিল, তোমার যত অনাসৃষ্টি কথাবার্তা বৌমা। এই সদ্য বিধবা হয়েছে মৃদুলা। এর মধ্যেই রঙিন শাড়ির কথা ভাবছো! বলি সমাজ সংসারের কথা তো একটু ভাববে। ওর শ্বশুর বাড়িতে জানতে পারলে কি ভাববে!
সেদিন তুমি বলেছিলে, মৃদুলা আর শ্বশুরবাড়ি ফিরবে না। যে মানুষটার জন্য শ্বশুরবাড়িতে থাকতে যাওয়া। সেই মানুষটাই যখন রইল না তখন কিসের আশায় ওমন শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকা।
মা দাঁত খিঁচিয়ে বলে ছিল, মৃদুলার মেয়ে তো আর বানের জলে ভেসে আসে নি। বারোমাস মামা বাড়িতে থাকলে ঠাকুমা দাদুর কাছ থেকে আর কিছু পাবে ভ্রমর দিদিভাই?
তখন দাদা যদিও বলেছিল, মৃদুলার শ্বশুরবাড়ির অবস্থা খুব যে স্বচ্ছল তা তো নয়। রোজগার তো করতো আমাদের জামাই তুফান। সেই যখন রইল না তখন আর ওখানে পড়ে থেকে কাজ নেই বোনের।
দাদার কথা মায়ের পছন্দ না হলেও মুখে আর কিচ্ছুটি বলে নি সেদিন। আমার ভ্রমরের সব দায়িত্ব তোমরা নিজেদের কাঁধে তুলে নিলে।
স্বামী শোকে কাতর হয়ে আমি প্রায় বিছানা নিয়েছিলাম। আমার যে একটা দু’ বছরের ছোট্ট মেয়ে আছে তা প্রায় ভুলতেই বসে ছিলাম।
তুমি আমার মেয়েকে স্নেহ আর যত্ন দিয়ে আগলে রাখতে সারাক্ষণ। কিন্তু সেই আমিই আজ তোমার চরম ক্ষতি করে দিলাম।
সত্যি বলছি বৌদি তোমার প্রাণনাশের চেষ্টা আমি বিন্দুমাত্র করিনি। আমি শুধু চেয়েছিলাম তোমার পেটের সন্তানটা যেন না থাকে। কি সাংঘাতিক স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম সেই মুহূর্তে। নিজের সুখের প্রতি এত লোভ আমার। ছিঃ ছিঃ। এই রকম একটা নীচ কাজ আমি করে ফেললাম। আমার যে নরকেও স্থান হবে না। ভগবান যে আমাকেও দগ্ধে দগ্ধে মারবেন।
চিঠিটা পড়তে পড়তে শম্ভু বাবু রাগে কাঁপতে শুরু করেছেন। মাথার মধ্যে যেন আগুন জ্বলে উঠছে। মনে হচ্ছে এখুনি ছুটে গিয়ে মৃদুলাকে ঘর থেকে টেনে বের করে দেওয়া উচিত। নিজের মনে মনে বলে উঠলেন, দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষলাম শেষ পর্যন্ত।
চিঠিটা এখনও শেষ হয় নি। রয়েছে আরো কয়েকটা লাইন। কিন্তু বাকি লাইন কটা পড়ার মতো ধৈর্য আর শম্ভু বাবুর নেই। উনি চিৎকার করে ডাকলেন সুরভীকে।
স্বামীর হঠাৎ এমন তীব্র চেঁচানি শুনে সুরভী তো বেশ ভয় পেয়ে গেল। হাতের কাজ ফেলে, কোনো রকমে রান্নাঘরটা ভেজিয়ে পড়ি কি মরি করে ছুটে এলো নিজেদের রুমে।
সুরভীকে আসতে দেখেই শম্ভু বাবু চিঠিটা দেখিয়ে বলে, এটা কি গিন্নি?
চিঠিটা দেখে সুরভীর গলা প্রায় শুকিয়ে এসেছে। মনে মনে বলে, সর্বনাশ। আমার এত বছরের লুকিয়ে রাখা চিঠিটা ওর হাতেই পড়ল। হে ভগবান এখন কি করে মানুষটাকে সামাল দেবো আমি।
সুরভীকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আবার ধমকে উঠলেন শম্ভু বাবু, চিঠিটা নাচিয়ে বললেন, এটার মানে কি?
সুরভী ছুটে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এলো। তারপর অনুনয়ের সুরে বলে, প্লিজ লক্ষ্মীটি একটু কম চিৎকার চেঁচামেচি করো। ঠাকুরঝি পূজোতে বসেছে।
-খুনী, আসামী, ভন্ডদের পূজো ভগবান গ্ৰহন করে না। এটা নিঃশ্চয় তুমি জানো।
সুরভী শম্ভ বাবুর হাত থেকে খপ করে চিঠিটা কেড়ে নিয়ে বলে, এই চিঠিতে ঠাকুরঝি যা লিখেছে তা কিন্তু ষোলো বছর আগের ওর স্বীকারোক্তি। ও তো ওর নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত।সেই অনুতাপ থেকেই চিঠিটা লিখেছিল সেদিন ও ভগবানের কাছে।
-তোমাকে কি চিঠিটা মৃদুলা নিজ হাতে দিয়েছিল?
-না গো না। আমি নার্সিংহোম থেকে ফিরে আসার মাস খানেক পর কিছুটা সুস্থ হয়ে যখন ঠাকুর ঘরে যাই। তখন ঠাকুরের সিংহাসনের কাপড়টা পাল্টাবো ভেবে ওটা তুলতে গিয়ে দেখি হলুদ কাপড়ের নিচে রয়েছে একটা ভাঁজ করা কাগজ। চিঠিটা পড়ে সেদিন আমিও চমকে উঠে ছিলাম।
আর সব থেকে আশ্চর্য হয়ে ছিলাম যে মৃদুলা ইচ্ছে করে বাথরুমে সাবান জল ফেলে রেখেছিল। যাতে আমি পা পিছলে পড়ে যেতে পারি।
শম্ভু বাবু একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আজও চোখের সামনে তোমার অসহায় মুখটা ফুটে ওঠে আমার মাঝে মধ্যেই। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলে তুমি তখন। বাথরুমের মধ্যে এমন ভাবে পড়ে গিয়েছিল যে দেওয়ালের কিনারায় লেগে কপালটা ফেটে গিয়েছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল বাথরুমের সাদা মার্বেলগুলো । হসপিটালে নিয়ে যেতে যেতেই তুমি পথেই জ্ঞান হারালে। আমি সমানে তোমার চোখে মুখে জলের ছিটা মারছিলাম। কিন্তু তোমার জ্ঞান ফিরে আসেনি তখন। নার্সিংহোম-এ পৌঁছানো মাত্রই ডাক্তার তোমাকে ও.টি-তে নিয়ে যেতে বলল। ঘন্টা দেড়েক পরে ডাক্তার বাবু বিষন্ন মুখে জানালেন, ‘মা কে বাঁচাতে পারলেও বেবিকে পারলাম না এবং পরবর্তীতে ম্যাডাম প্রেগন্যান্ট হতে গেলে বেশ কিছু কমপ্লিকেশন দেখাও দিতে পারে। আই মিন মিস ক্যারেজ হতেও পারে ।’
সেদিন আমার মতো শক্ত পুরুষ মানুষের চোখও জলে ভরে উঠেছিল।মাও খবরটা শুনে দুঃখ পেয়েছিল খুব। তবুও মা সেদিন তোমাকেই দুষে ছিল।মা আক্ষেপ করে বলেছিল, বৌমার তো সবেতেই অনাসৃষ্টি কান্ড কারখানা। মৃদুলাকে সাদা শাড়ি পরতে দিল না কোনোদিন। একাদশী করতে দিল না একদিনও। মাছ মাংস ডিম সব খাওয়ানো চাই বিধবা ননদকে। এত অনাচার করলে কি আর ধর্মে সয়। ভগবান একদম টের পাইয়ে দিল। মিসক্যারেজ হয়ে গেল।
শম্ভু বাবু সুরভীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যখন এই চিঠিটা পেলে তখন আমাকে কিচ্ছুটি কেন জানালে না?
একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরভী বলল, যাকে ভগবান সব দিক থেকে মেরে রেখেছে। তাকে আর নতুন করে কি শাস্তি দেবে মানুষ। যে ছোট্ট শিশুটা পৃথিবীর আলো দেখতেই পেল না। তার জন্য দুঃখ করে মনের কষ্ট বাড়িয়ে কি লাভ হতো। বরং ভগবান যখন ভ্রমরের মতো একটা ফুটফুটে মেয়ের দায়িত্ব আমাদেরকে দিয়েছে তখন ওকেই মন প্রাণ দিয়ে লালন পালন করা ভালো নয় কি?
চিঠির শেষ লাইনগুলো নিঃশ্চয় তুমি পড়োনি। পড়লে আর ঠাকুরঝির শাস্তির কথা ভাবতে না।
ঠাকুরঝি লিখেছিল, বৌদি আমি যখন শুনলাম তুমি মা হতে চলেছো তখন আমার মনে একটা ভয় তৈরি হলো। এই ভয়টা ছিল আমার মেয়ে ভ্রমরকে নিয়ে। দুবছর বয়সে বাবাকে হারিয়ে মামা বাড়িতে আশ্রয় পাওয়ার পর থেকেই ও তোমাদের চোখের মণি হয়ে উঠেছে। দাদা তো অফিস থেকে ফেরার পথে ভ্রমরের জন্য কিছু না কিছু আনবেই রোজ। আর তুমি তো ভ্রমরের যশোদা মা। আমার থেকে বেশি ও তোমার কাছে আবদার করে।
সেইখানে আর একটা বাচ্চা এলে আমার মেয়ের আদর যে কমে যাবে। তোমাদের ভালোবাসাও কমে যাবে ধীরে ধীরে। এইসব ফালতু কথা ভাবতে ভাবতে আমার বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়। আর এই কান্ড জ্ঞানহীন, অনৈতিক কাজটা করে ফেলেছি বৌদি তোমার সাথে। প্লিজ ভগবান আমাকে ক্ষমা করে দিও। বৌদির সামনে গিয়ে এইসব কথাগুলো বলার সৎ সাহস আমার নেই। তাই তোমাকেই লিখে জানালাম সব কথা।
শম্ভু বাবুও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমি ভাবতেই পারছি না আমার নিজের বোন আমাদের সঙ্গে এমন কাজ করল!
সুরভী শম্ভু বাবুর গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, মন খারাপ করো না। আমাদের নিজেদের সন্তান না হলেও ভ্রমর কিন্তু আমাদের সন্তানেরও বেশি।এতো বাধ্য, বিনয়ী মেয়ে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না।
নাও আর দেরি করো না। ভ্রমর টিউশনি থেকে সোজা ব্যাঙ্কে চলে যাবে বলেছে। মেয়েটার আজ প্রথম ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হবে। খুব আনন্দ ওর।
পর মুহূর্তেই শম্ভু বাবুকে অনুরোধের স্বরে সুরভী বলে, প্লীজ ঠাকুরঝি’র এই স্বীকারোক্তির কথা তুমি আমি ছাড়া দ্বিতীয় ব্যাক্তি কেউ না জানে। এত বছরের পুরানো কথা আর খুঁচিয়ে ঘা করার দরকার নেই।
শম্ভু বাবু হালকা দু’চোখ বন্ধ করে স্ত্রীকে বুঝিয়ে দিলেন, ঠিক আছে। তাই হবে। ক্ষমার চেয়ে বড় ধর্ম আর কিছু নেই যে সংসারে। -
গল্প- শিখন
শিখন
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জী_কি রে ময়না কখন ফিরে আসলি মৌ দের বাড়ি থেকে?মৌ এর টেস্ট পেপার টা নিয়ে এসেছিস তো?
আমি মুখ টা হাঁড়ির মতো করে জবাব দিয়েছিলাম, না।মৌ আমাকে ওর পুরানো টেস্ট পেপার টা দিতে পারবে না বলেছে।
আমার মা অবাক হয়ে বলল,সে কি কথা! তুই অনেক দিন আগে থেকেই বলে রেখেছিস ওকে যে মৌ এর বোর্ডের পরীক্ষা টা শেষ হলেই ওর টেস্ট পেপার টা নিবি।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি মৌ আমার থেকে বয়সে এক বছরের বড়ো ছিল।ও আমার পাড়ার বন্ধু ছিল।
আমি একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ছিলাম,তাই তো আমি জানতাম মা।মৌ এর কাছ থেকে টেস্ট পেপার টা পেয়ে যাবো বলেই তো অন্য কোনো দাদা, দিদিকে আগে থাকতে কিচ্ছুটি বলি নি। এখন এদিকে মৌ টেস্ট পেপার টা দেবেনা বলছে। অঙ্কের স্যার তো আগামীকাল থেকেই টেস্ট পেপার নিয়ে যেতে বলেছে টিউশনি তে।
মায়ের মুখ টা ও বেশ চিন্তিত দেখালো। কিছুক্ষণ পর মা বলেছিল, হয়তো ওর সত্যি কোনো অসুবিধা হয়েছে তোকে টেস্ট পেপার টা দিতে। তবে এরপর থেকে আর মৌ এর কাছে কোনো পুরানো বই চাইতে যাস না।
আমি তোর বাবাকে বলছি ।উনি ওনার কোনো ছাত্র ছাত্রীর কাছ থেকে ঠিক একটা পুরাতন টেস্ট পেপার এর জোগাড় করে আনবেন।
এরপর প্রায় মাস খানেক পরের ঘটনা। আমার মনে মৌ কে নিয়ে যেটুকু অভিমান ছিল তা একমাসে নদীর স্রোতের মতো বয়ে গেছে অনেক দূর। আমি আবার আমার বান্ধবীর সান্নিধ্য লাভের আশায় দিনরাত সময় পেলেই মৌ দের বাড়ি ছুটে যাই।মৌ ছিল আমার কাছে অনুপ্রেরণা।ওর হাতের লেখা এতো সুন্দর ছিল যে দেখে মনে হতো যেন টাইপ করে লিখেছে।খেলা ধূলা তে ও তুখোড় ছিল। প্রতি বছর স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় প্রাইজে ঘর ভরিয়ে দিতে।আর দেখতে ও ছিল ভীষন সুন্দর।
আমি মৌ কে অনুসরন করতাম মনে প্রাণে।সেদিন রবিবার ছিল। আঁকার ক্লাস থেকে ফিরে এসে টিফিন করেই মৌ দের বাড়ি গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ওদের উঠানে এসেছে একজন রদ্দি ওয়ালা।মৌ ,মৌ এর দিদি,দাদা ওর মা সবাই মিলে পুরানো বই খাতা ,পেপার গুলো ভালো করে চেক করে রদ্দি ওয়ালা কে দিচ্ছিল। পূজা সংখ্যা,মাসিক পত্রিকা,নাইন,টেনের বই এর মধ্যে লাল হলুদ রঙের এ বি টি এ এর টেস্ট পেপার টা উঁকি মারছিল।আমি বই খাতার গাদার মধ্যে থেকে একরকম ঝোঁ মেরে টেস্ট পেপার টা উঠিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি সাল টা দেখেছিলাম।বড় বড় করে লেখা ১৯৯৬।
মুহুর্তের মধ্যে চোখ টা ঝাপসা হয়ে এসেছিল।বই টা ফেলে এক ছুটে বাড়ি চলে এসেছিলাম।মৌ যদিও পিছন থেকে ডেকে ছিল। কিন্তু সেদিন আমি আর সাড়া দিই নি। আমার কিশোরী মন সেই দিন প্রথম বুঝতে পেরেছিল বেইমানি কি জিনিষ।
মা রান্না ঘরে খাসীর মাংস রান্না করছিল। খাসীর মাংস হলেই মাকে আমি পীড়াপীড়ি করে বলতাম,মা মৌ কে একটা ছোট বাটিতে মাংস দিয়ে আসি। মৌ মাটন খেতে খুব ভালো বাসে।মৌ কে খাইয়ে আমি খুব আনন্দ পেতাম।
আমি মায়ের পিছনে দাঁড়াতেই মা জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার আজ তাড়াতাড়ি প্রিয় বান্ধবীর বাড়ি থেকে ফিরে এলি যে?
আমি আর সেদিন নিজেকে স্থির রাখতে পারি নি।অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল ব্রন ভরা গালে। কাঁদতে কাঁদতে মাকে খুলে বললাম মৌ দের বাড়িতে বই বিক্রির সমস্ত কথা।মৌ যে ইচ্ছা করেই আমাকে ওর পুরানো টেস্ট পেপার টা দেয় নি সেটা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না।
কাঁদতে কাঁদতে বারবার আমি বলছিলাম,মা তুমি তো জানো আমি মৌ কে কত ভালোবাসি।বাবা ওনার স্কুল থেকে পুরানো প্রশ্ন পত্র, রেফারেন্স বই আনলেই আমি মৌ কে দিয়ে আসতাম।যাতে মৌ এর রেজাল্ট আরো ভালো হয়।মৌ যখন যেখানে যেতে বলত আমি ছুটতাম ওর সঙ্গে।মা বারণ করলে ও খুব একটা শুনতাম না।মৌ ওর জীবন বিজ্ঞানের প্র্যাকটিক্যাল খাতায় সব ছবি ও আমাকে দিয়ে আঁকিয়ে নিত। কোনোদিন না করি নি। নিজের পড়ার ক্ষতি করেও মৌ এর কাজ করে দিতাম।মৌ এর প্রতি আমার একটা টান ছিল।
মা আমার মাথায় নিজের বাঁ হাত টা বুলিয়ে সেদিন বলেছিল,মন খারাপ করিস না ময়না। তুই কাউকে ভালো বাসিস বলেই যে সে তোকে ভালোবাসবে তার কোনো কথা নেই। বরং যে তোকে ভালোবাসে তাকে তুই অবশ্যই ভালোবাসার চেষ্টা করবি।হয়তো সে তোর মতো পড়াশোনায় ততটা ভলো নয়।হতে পারে সে গরীব,হতে পারে সে দেখতে খারাপ।মোট কথা সে হয়তো তোর সমকক্ষ কোনো দিক থেকেই নয়। তবু ও তাকে তুই ভালোবাসবি।কারন সে তোকে ভালোবাসে।যে সম্পর্ক দেওয়া নেওয়ার ভিতের ওপর গড়ে ওঠে তা কিন্তু চিরস্হায়ী হয় না কখনো।এই তো তোর জীবন শুরু।কত ঠকবি তারপর তো শিখবি। সেই শিখন আজীবন কাজে লাগবে।
স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে সংসার জীবনে এসেও আমার বন্ধুর অভাব হয় নি কোনদিন।মৌ এর কাছ থেকে ঠকে আমি শিখে নিয়েছিলাম দেওয়া নেওয়ার সম্পর্কে বন্ধুত্ব গড়া উচিত নয়। বন্ধুত্ব গড়তে হয় কেবল মাত্র বিশ্বাস আর ভালোবাসায়।তাতে বন্ধু সংখ্যা যদি কম থাকে তাও ভালো। -
কবিতা- অপেক্ষা
অপেক্ষা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জীঅপেক্ষার একটা রং আছে
রঙটা কালো নয়,
তা সৈকতের মতো নীল
কিংবা বনানীর মতো সবুজ।
অপেক্ষার একটা ছন্দ আছে
ধীর লয়ে, নিঃশব্দে এসে
ছুঁয়ে যায় মনকে।
অপেক্ষার একটা গন্ধ আছে
যে গন্ধ মাতাল করে
রাখে নাসারন্ধ্রকে।
অপেক্ষার একটা মাধুর্য আছে
সারাক্ষণ স্বপ্নের আবেশে
মুড়িয়ে রাখে মনকে
একটা কল্পনার মোড়কে।
অপেক্ষার একটা টান আছে
বিনি সুতোর টানটা,
সেই অনুভব করতে পারে
যে উত্তাল ঝড়ের মুখে পড়েও
একটা খড়কুটো কে আঁকড়ে
ধরার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে পারে।।