• গল্প

    গল্প- শিখন

     শিখন
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    _কি রে ময়না কখন ফিরে আসলি মৌ দের বাড়ি থেকে?মৌ এর টেস্ট পেপার টা নিয়ে এসেছিস তো?
    আমি মুখ টা হাঁড়ির মতো করে জবাব দিয়েছিলাম, না।মৌ আমাকে ওর পুরানো টেস্ট পেপার টা দিতে পারবে না বলেছে।
    আমার মা অবাক হয়ে বলল,সে কি কথা! তুই অনেক দিন আগে থেকেই বলে রেখেছিস ওকে যে মৌ এর বোর্ডের পরীক্ষা টা শেষ হলেই ওর টেস্ট পেপার টা নিবি।
    এই প্রসঙ্গে বলে রাখি মৌ আমার থেকে বয়সে এক বছরের বড়ো ছিল।ও আমার পাড়ার বন্ধু ছিল।
    আমি একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ছিলাম,তাই তো আমি জানতাম মা।মৌ এর কাছ থেকে টেস্ট পেপার টা পেয়ে যাবো বলেই তো অন্য কোনো দাদা, দিদিকে আগে থাকতে কিচ্ছুটি বলি নি। এখন এদিকে মৌ টেস্ট পেপার টা দেবেনা বলছে। অঙ্কের স্যার তো আগামীকাল থেকেই টেস্ট পেপার নিয়ে যেতে বলেছে টিউশনি তে।
    মায়ের মুখ টা ও বেশ চিন্তিত দেখালো। কিছুক্ষণ পর মা বলেছিল, হয়তো ওর সত্যি কোনো অসুবিধা হয়েছে তোকে টেস্ট পেপার টা দিতে। তবে এরপর থেকে আর মৌ এর কাছে কোনো পুরানো বই চাইতে যাস না।
    আমি তোর বাবাকে বলছি ।উনি ওনার কোনো ছাত্র ছাত্রীর কাছ থেকে ঠিক একটা পুরাতন টেস্ট পেপার এর জোগাড় করে আনবেন।
    এরপর প্রায় মাস খানেক পরের ঘটনা। আমার মনে মৌ কে নিয়ে যেটুকু অভিমান ছিল তা একমাসে নদীর স্রোতের মতো বয়ে গেছে অনেক দূর। আমি আবার আমার বান্ধবীর সান্নিধ্য লাভের আশায় দিনরাত সময় পেলেই মৌ দের বাড়ি ছুটে যাই।মৌ ছিল আমার কাছে অনুপ্রেরণা।ওর হাতের লেখা এতো সুন্দর ছিল যে দেখে মনে হতো যেন টাইপ করে লিখেছে।খেলা ধূলা তে ও তুখোড় ছিল। প্রতি বছর স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় প্রাইজে ঘর ভরিয়ে দিতে।আর দেখতে ও ছিল ভীষন সুন্দর।
    আমি মৌ কে অনুসরন করতাম মনে প্রাণে।

    সেদিন রবিবার ছিল। আঁকার ক্লাস থেকে ফিরে এসে টিফিন করেই মৌ দের বাড়ি গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ওদের উঠানে এসেছে একজন রদ্দি ওয়ালা।মৌ ,মৌ এর দিদি,দাদা ওর মা সবাই মিলে পুরানো বই খাতা ,পেপার গুলো ভালো করে চেক করে রদ্দি ওয়ালা কে দিচ্ছিল। পূজা সংখ্যা,মাসিক পত্রিকা,নাইন,টেনের বই এর মধ্যে লাল হলুদ রঙের এ বি টি এ এর টেস্ট পেপার টা উঁকি মারছিল।আমি বই খাতার গাদার মধ্যে থেকে একরকম ঝোঁ মেরে টেস্ট পেপার টা উঠিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি সাল টা দেখেছিলাম।বড় বড় করে লেখা ১৯৯৬।
    মুহুর্তের মধ্যে চোখ টা ঝাপসা হয়ে এসেছিল।বই টা ফেলে এক ছুটে বাড়ি চলে এসেছিলাম।মৌ যদিও পিছন থেকে ডেকে ছিল। কিন্তু সেদিন আমি আর সাড়া দিই নি। আমার কিশোরী মন সেই দিন প্রথম বুঝতে পেরেছিল বেইমানি কি জিনিষ।
    মা রান্না ঘরে খাসীর মাংস রান্না করছিল। খাসীর মাংস হলেই মাকে আমি পীড়াপীড়ি করে বলতাম,মা মৌ কে একটা ছোট বাটিতে মাংস দিয়ে আসি। মৌ মাটন খেতে খুব ভালো বাসে।মৌ কে খাইয়ে আমি খুব আনন্দ পেতাম।
    আমি মায়ের পিছনে দাঁড়াতেই মা জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার আজ তাড়াতাড়ি প্রিয় বান্ধবীর বাড়ি থেকে ফিরে এলি যে?
    আমি আর সেদিন নিজেকে স্থির রাখতে পারি নি।অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল ব্রন ভরা গালে। কাঁদতে কাঁদতে মাকে খুলে বললাম মৌ দের বাড়িতে বই বিক্রির সমস্ত কথা।মৌ যে ইচ্ছা করেই আমাকে ওর পুরানো টেস্ট পেপার টা দেয় নি সেটা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না।
    কাঁদতে কাঁদতে বারবার আমি বলছিলাম,মা তুমি তো জানো আমি মৌ কে কত ভালোবাসি।বাবা ওনার স্কুল থেকে পুরানো প্রশ্ন পত্র, রেফারেন্স বই আনলেই আমি মৌ কে দিয়ে আসতাম।যাতে মৌ এর রেজাল্ট আরো ভালো হয়।মৌ যখন যেখানে যেতে বলত আমি ছুটতাম ওর সঙ্গে।মা বারণ করলে ও খুব একটা শুনতাম না।মৌ ওর জীবন বিজ্ঞানের প্র্যাকটিক্যাল খাতায় সব ছবি ও আমাকে দিয়ে আঁকিয়ে নিত। কোনোদিন না করি নি। নিজের পড়ার ক্ষতি করেও মৌ এর কাজ করে দিতাম।মৌ এর প্রতি আমার একটা টান ছিল।
    মা আমার মাথায় নিজের বাঁ হাত টা বুলিয়ে সেদিন বলেছিল,মন খারাপ করিস না ময়না। তুই কাউকে ভালো বাসিস বলেই যে সে তোকে ভালোবাসবে তার কোনো কথা নেই। বরং যে তোকে ভালোবাসে তাকে তুই অবশ্যই ভালোবাসার চেষ্টা করবি।হয়তো সে তোর মতো পড়াশোনায় ততটা ভলো নয়।হতে পারে সে গরীব,হতে পারে সে দেখতে খারাপ।মোট কথা সে হয়তো তোর সমকক্ষ কোনো দিক থেকেই নয়। তবু ও তাকে তুই ভালোবাসবি।কারন সে তোকে ভালোবাসে।যে সম্পর্ক দেওয়া নেওয়ার ভিতের ওপর গড়ে ওঠে তা কিন্তু চিরস্হায়ী হয় না কখনো।এই তো তোর জীবন শুরু।কত ঠকবি তারপর তো শিখবি। সেই শিখন আজীবন কাজে লাগবে।
    স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে সংসার জীবনে এসেও আমার বন্ধুর অভাব হয় নি কোনদিন।মৌ এর কাছ থেকে ঠকে আমি শিখে নিয়েছিলাম দেওয়া নেওয়ার সম্পর্কে বন্ধুত্ব গড়া উচিত নয়। বন্ধুত্ব গড়তে হয় কেবল মাত্র বিশ্বাস আর ভালোবাসায়।তাতে বন্ধু সংখ্যা যদি কম থাকে তাও ভালো।

  • কবিতা

    কবিতা- অপেক্ষা

    অপেক্ষা
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    অপেক্ষার একটা রং আছে
    রঙটা কালো নয়,
    তা সৈকতের মতো নীল
    কিংবা বনানীর মতো সবুজ।
    অপেক্ষার একটা ছন্দ আছে
    ধীর লয়ে, নিঃশব্দে এসে
    ছুঁয়ে যায় মনকে।
    অপেক্ষার একটা গন্ধ আছে
    যে গন্ধ মাতাল করে
    রাখে নাসারন্ধ্রকে।
    অপেক্ষার একটা মাধুর্য আছে
    সারাক্ষণ স্বপ্নের আবেশে
    মুড়িয়ে রাখে মনকে
    একটা কল্পনার মোড়কে।
    অপেক্ষার একটা টান আছে
    বিনি সুতোর টানটা,
    সেই অনুভব করতে পারে
    যে উত্তাল ঝড়ের মুখে পড়েও
    একটা খড়কুটো কে আঁকড়ে
    ধরার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে পারে।।

  • গল্প

    গল্প- সুখের বাসা

    সুখের বাসা
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    সাত সকালে সন্দীপের ঘর থেকে প্রেশার কুকারের সিটির আওয়াজ শুনে বেলা মাসিমা ওনার স্বামী মলয় বাবুর উদ্দেশ্যে বলেন, শুনতে পাচ্ছো সিটির আওয়াজ? ঠিক সাত সকালে উঠে স্বামীর জন্য রান্না বসিয়ে দিয়েছে। বেটাছেলে রোজ দিন হাত পুড়িয়ে খাবে। এটা কি ভালো দেখায়! এই জন্যই তো আমি উঠেপড়ে সন্দীপের বিয়ের ঘটকালিটা করলাম লীলার মেয়ে মামনির সাথে।
    মলয় বাবু বললেন, যাক বাবা সন্দীপকে আর হাত পুড়িয়ে খেতে হবে না। সত্যি গিন্নি তুমি ঘটকালিটা করে খুব ভালো করেছ। মা-বাবাকে ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে একা থাকে। ছেলেটা বড্ড বেশি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিল চাকরি করতে এসে।
    প্রায় তিন বছর হলো ছেলেটা আমাদের বাড়িতে ভাড়া এসেছে। তখন থেকেই দেখি রোজ রেঁধে খায়। ছোট্ট গ্যাসতেই কি সুন্দর ব্যবস্থা করে রান্নাবান্না করে কিন্তু।
    বেলা তোমার মনে আছে সন্দীপ প্রথম বার যখন আমাদেরকে চালের পায়েস করে খাইয়ে ছিল। কি সুস্বাদু হয়েছিল সেটা। আজও মুখে লেগে আছে।
    বেলা মাসিমা রসিকতা করে বলেন, দেখে তো শিখতে পারো এইটুকু ছোট ছেলেটার কাছ থেকে। আজ পর্যন্ত ঠিক করে লিকার চাটুকু করতে শিখলে না। দু’কাপ চায়ের জল দিলে তা ফুটে ফুটে এক কাপ হয়ে যায়।
    মলয় বাবু দুঃখ করে বলেন, সত্যি গিন্নি এই বুড়ো বয়সে বুঝতে পারি যে আমার রান্নাবান্নার একটু জ্ঞান থাকলে তোমার কত উপকার হতো।
    বেলা মাসিমা বলেন, আর দুঃখ প্রকাশ করে হবে কি! যখন শেখার বয়স ছিল ভুলেও রান্নাঘরের ছায়া মাড়াতে না। ছাড়ো সেইসব অতীত কথা। এখন বাজার থেকে একটু ঘুরে এসো। পুনকো শাক আর চুনো মাছ আনবে কেবল। অতিরিক্ত সবজি এনো না। গরমে বেশি রান্না করতে পারবো না। এই বলে বাজারে যাওয়ার জন্য নাইলনের ব্যাগটা মলয় বাবুর হাতে ধরিয়ে দিলেন।
    মেন গেটটা খুলে রাস্তায় পা বাড়াতে যাবেন মলয় বাবু তখনি পিছন থেকে আওয়াজ এলো, মেসোমশাই বাজারে যাচ্ছেন? দাঁড়ান আমিও আসছি।
    সন্দীপ ওর রুমের বাইরে রাখা চপ্পলটা পায়ে গলিয়ে বেশ হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো। রাস্তায় যেতে মলয় বাবু জিজ্ঞাসা করেন, কি কেমন লাগছে নতুন দাম্পত্য জীবন?
    সন্দীপ লাজুক হেসে বলে, বেশ। আগে একা ছিলাম। মাসে দুই একবার বাজারে গেলেই চলে যেত। আর এখন পারলে রোজই বাজার করে নিয়ে এসো- এটা ওটা।
    -তা যা বলেছো। আমাকেই দেখো সকাল হলেই বাজারের থলি নিয়ে রোজ বের হতেই হবে। আজ মাছ নেই তো কাল ডিম নেই। তারপর তো মুদীর দোকানে পারলে দুই বেলা ছুটতে হবে।
    তবে বিয়ে করে একটাই সুখ বুঝলে সন্দীপ। তাহলে তিন বেলা বেশ মনের মতো খাওয়া দাওয়া পাওয়া যায়। কি বল তুমি?
    সন্দীপ খানিকটা উপহাসের সুরে বলে, ভালো বললেন মনের মতো খাওয়া দাওয়া।
    মলয় বাবু গলায় খানিক উৎকণ্ঠা নিয়ে এসে বলে, কেন কেন এমন কথা বলছো তুমি?মামনি কি তোমার মনের মতো খাবার দাবার রান্না করে না?
    -মনের মতো খাবার দাবার দূরে থাক মেসোমশাই। মামনি তো রান্নাবান্নার কিছুটি জানে না। না জানে ভাতের মাড় ফেলতে, না জানে আট মাখতে, না জানে সবজি কাটতে ঠিকঠাক।
    চশমাটা নাকের ডগায় সামান্য নামিয়ে মলয় বাবু বলেন, তাহলে এই একমাস ধরে রান্নাবান্না কে করছে ?
    -কে আবার এই অধম।
    -বল কি! তোমার মাসিমা তোমার কষ্টের কথা ভেবেই তার বান্ধবীর মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের সম্বন্ধটা করেছিল। কিন্তু এখন দেখছি তোমার কষ্ট তো বিন্দুমাত্র কমে নি।
    -মেসোমশাই আগে একা থাকতাম নিজের মতো যা হোক ফুটিয়ে নিতাম। এখন তো সেটি হবার জো নেই। আমার যেসব খাবার পছন্দ মামনির তা ঠিক তেমন পছন্দ নয়।অগ্যতা দুটো পদ রান্না বেশি করতে হচ্ছে।
    এতো গেল রান্না বান্নার কথা। মামনি কাপড় জামাও কাচতে পারে না ঠিক ভাবে। একদিন আমার অফিসের প্যান্ট জামা ধুতে দিয়েই বুঝে গিয়েছি মামনি কোনদিন এইসব কাজ করে নি তেমন ভাবে। অগত্যা নিজের জামা কাপড়ও ধুচ্ছি সঙ্গে বৌয়ের’ও।
    মলয় বাবু বলেন, দেখো সন্দীপ একটা কাজ তুমি করতে পারো। তুমি ইনসটলমেনটে একটা ওয়াশিং মেশিন কিনে নাও। আমার একটা চেনা ইলেকট্রনিক্স-এর দোকান আছে। তুমি বললে ওদের একটু বলে রাখবো।
    -মেসোমশাই আমার তো আর বিরাট কিছু মাইনে নয়। এই তো বিয়ে করতে গিয়ে দুই তিন লাখ টাকার চুনা লাগলো। এর মধ্যে মামনিকে এখানে নিয়ে আসার পর থেকেই এটা ওটা সংসারের জিনিস পত্র রোজ কিনতে হচ্ছে। মোট কথা খরচা লেগেই আছে। প্রতি মাসে EMI দেওয়া একটু চাপের হয়ে যাবে। তার থেকে হাতে কেচে নেওয়াই ভালো।
    -সে তো বটেই। ব্যাচিলার যখন মানুষ থাকে তখন আর ক টাকা খরচ হয়। বিয়ে করলেই তো খরচাপাতি বাড়ে। যাক গে এখন আর কি করবে। বিয়ে যখন করেই ফেলেছো একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নাও মামনিকে। আমি তোমার মাসিমাকে বলবো যে তুমি সন্দীপের কষ্ট কম করতে গিয়ে কষ্ট তো আরো বাড়িয়ে তুলেছো।
    সন্দীপ আঁতকে উঠে বলে, না না মেসোমশাই মাসিমার কোনো দোষ নেই। মাসিমা আর কি করে জানবে মামনি গৃহকর্ম কিছুই জানে না। জানেন তো আজকাল বিয়ের আগে মেয়েদেরকে তেমন ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা মোটেই ভালো দেখায় না যে সে ঘরের কাজকর্ম কিছু জানে কিনা।
    -তা যা বলেছো সন্দীপ। আমাদের সময় তো এখন আর নেই। তখন মেয়ে দেখতে গিয়ে জেনে আসার সুযোগ থাকত পাত্রী গৃহকর্ম কিছু জানে কিনা।
    তারপর একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলয় বাবু বলেন, তোমার ভালো করতে গিয়ে তোমার ঝামেলা আমরাই বাড়িয়ে দিলাম।
    -ছিঃ ছিঃ মেসোমশাই এমন করে বলবেন না। বিয়ে করে হয়তো আমার ঘরের কাজটা এখন বেশি করতে হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আগে আপনাদের দশ বাই বারো রুমটাকে কেবল একটা ঘর বলে মনে হতো। এখন মনে হয় একটা সংসার।
    আগে অফিস থেকে ঘরে ফেরার তাড়া থাকতো না। আর এখন বিকেল চারটা বাজলেই ঘড়ি দেখতে শুরু করি। মামনি যেন একটা বিরাট চুম্বক। যার টানে অফিস থেকে প্রায় ছুটতে ছুটতে বাড়ি আসি। মামনি দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালেই অফিসের সব ক্লান্তি উধাও হয়ে যায়। তারপর যখন এক গ্লাস জল কিংবা শরবত আমার সামনে ধরে তখন মনে হয় এই শহরে কেউ তো আছে যে আমার অফিস থেকে ফেরার পথ চেয়ে বসে থাকে। তারপর যখন আমার ব্যাগ, জামা প্যান্টের পকেট হাতড়ে বেড়ায় তখন মনে হয় এতদিনে আমার চাকরি করা সার্থক হলো। নিজের জন্য রোজগার করে তেমন আনন্দ নেই। পুরুষ মানুষ তো রোজগার করে বৌ বাচ্চার জন্য, পরিবারের জন্য। আমার উপার্জিত অর্থ শুধু আমার একার নয় এখন।তার ওপর মামনিরও অধিকার আছে।
    মাঝে মধ্যে মামনি যখন মানচিত্রের ন্যায় রুটি বানায় তখন মনে হয় কেউ তো চেষ্টা করে যাচ্ছে ভালোবাসা দিয়ে রুটি গড়ার। সত্যি বলছি মেসোমশাই বিয়েটা না করলে টেরই পেতাম না দায়িত্ব বোধ কাকে বলে, কিভাবে করতে হয় কর্তব্য, কি ভাবে উজাড় করে ভালোবাসতে হয় কাউকে আর সর্বোপরি জানতেই পারতাম না কি ভাবে বাঁধতে হয় ঘর।

  • গল্প

    গল্প- নিষ্পত্তি

    নিষ্পত্তি
    লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

    -চলো না আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি।
    -পালাবো কেন? আমরা কি অন্যায় করেছি যে পালিয়ে বিয়ে করতে হবে?
    -দেখছো তো আমাদের দুজনের বাড়ি থেকেই তো মেনে নিতে চাইছে না আমাদের সম্পর্কটা।
    -তার জন্য পালাতে হবে! কোনো দিন এমন ভাবনা মাথাতেও এনো না।

    স্নিগ্ধ তৃণার হাতটা নিজের মুঠির মধ্যে নিয়ে করুণ সুরে বলে, তাহলে কি আমাদের বিয়ে হবে না কোনোদিন?

    স্নিগ্ধ’র চোখে তৃণা সেদিন দেখেছিল অসম্ভব রকমের অসহায়ত্ব। চোখের ভাষা পড়তে পারা মোটেই সহজ কাজ নয়। তবে দীর্ঘ সাতটা বছর তৃণা স্নিগ্ধর চোখে চোখ রেখে বুঝতে পেরেছে স্নিগ্ধর মনটা বড্ড নরম। একটুতেই ভেঙে পড়ে।
    তৃণা স্নিগ্ধর কাঁধে মাথা রেখে সেদিন বলেছিল, জানি না গো। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে যে ভাবে নিত্য অশান্তি লেগে থাকে। তাতে আমাদের বিয়ে হওয়া সত্যি চাপের।
    স্নিগ্ধ তৃণার হাতটা খুব শক্ত করে চেপে ধরে বলে, যদি তোমার বাড়ির লোক জোর করে তোমার বিয়ে দিয়ে দেয় অন্য কারোর সঙ্গে?
    +আমি কি ছোট বাচ্চা? যে জোর করলেই আমি ভয়ে ভয়ে বিয়ের পিঁড়িতে গিয়ে বসে পড়বো!
    স্নিগ্ধ প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, তৃণা তোমায় ছাড়া আমি কিন্তু বাঁচব না।
    তৃণার চোখটাও জলে ভরে ওঠে। কন্ঠ নালী আর্দ্র হয়ে ওঠে। তবুও নিজেকে খানিক সংযত রেখে বলে, একটা কথা তোমাকেও দিতে হবে আজ আমাকে।
    -বল কি কথা?
    -যতদিন না আমাদের দুই পরিবার রাজি হয় আমাদের বিয়েতে ততদিন কিন্তু আমরা এই রকমই থাকবো। দুজন দুজনের জন্য অপেক্ষা করবো। তুমি কিন্তু মোটেই আমাকে জোর করবে না বিয়ের জন্য।
    এবার স্নিগ্ধ খানিক রেগে উঠে বলে, দুই বাড়ির লোক যদি কোনদিন রাজি না হয় তাহলে কি আমরা এইরকম ভাবে দুজন দুজনের শুধু মুখ দেখে জীবন কাটিয়ে দেবো?
    -পারবে না তুমি?
    -অ্যাই শোনো ষাটের দশকে এই রকম ‘প্লেটোনিক লাভের’ কথা মানুষ ভাবতো। এই একুশ শতকে নয়। এই সাত বছরে আমাকে একটুও কাছে আসতে তুমি দাও নি। একটু চুমু খেতে চাইলেই হাজার নাটক শুরু করে দাও।
    বলি আমি কি পাথর! আরে বাবা আমি তো মানুষ। আমার মনেও কামনা বাসনা আছে।যাকে এত বছর ধরে পাগলের মতো ভালোবেসে আসছি তাকে একটু আদর করতে পারবো না!
    তৃণা বেশ বুঝতে পারে তার পাগল প্রেমিক ক্ষেপেছে। তাই স্নিগ্ধকে শান্ত করার জন্য সে বলে, আমি চাই আমাদের প্রথম চুম্বন হবে জাগতিক সব ভালোলাগার উর্ধ্বে। আমাদের প্রথম চুম্বনের রেশ থেকে যাবে আত্মায়। আমাদের প্রথম চুম্বন হবে ঠিক শুষ্ক ধরিত্রীর বুকে বর্ষার অবিরাম বারিধারা।
    স্নিগ্ধ একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, অনেক হয়েছে তোমার কাব্য। চলো এবার উঠি। আমার মা যদি সামান্যতম টের পায় তাহলেই শুরু হয়ে যাবে অশান্তি।
    তৃণা খানিক দুঃখ প্রকাশ করে বলে, আগে মানে আমাদের ছোটোবেলায় কিন্তু আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে যথেষ্ট সদ্ভাব ছিল। আম গাছটা বড় হতেই অশান্তি শুরু হলো।
    স্নিগ্ধ বলে, তোমাদের আম গাছের শুকনো পাতায় আমাদের ছাদ ভরে যায়। আর সেই কারণেই প্রতিদিন মাকে ছাদে ঝাড়ু দিতে হয়। সংসারের হাজার কাজের মধ্যে রোজ ছাদ ঝাড়ু দেওয়া একটা বাড়তি কাজ। তাই নিয়ে মা রাগে গজগজ করে।
    তৃণা বলে, তোমাদের ছাদে বুঝি আমাদের আম গাছের শুকনো পাতা পড়ে কেবল? একটু সামান্য ঝড় উঠলেই যে আম পড়ে তোমাদের ছাদে। তার বেলায়?
    কই আমার মা তখন তো আমগুলো তোমার মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আসে না।
    স্নিগ্ধ বলে, আমার মা তো বলে, সারা বছর আম পাতা ঝাঁট দেবো আর দুচারটে আম না বলে কুড়িয়ে নিলে অসুবিধার কিছু নেই।
    তৃণা হাসতে হাসতে বলে, সত্যিই তো অসুবিধার কারণ হওয়া উচিত নয়। আজ বাদে কাল যখন আমি তোমার বউ হবো তখন তো আমার বাপের বাড়ির আম, কাঁঠাল, জাম, পেয়ারা, বেল, কুল সবই তো তোমাদের বাড়িতে যাবে। না হয় দু’চার দিন আগে থেকেই তোমার মা ওইসব খাচ্ছেন।
    স্নিগ্ধ আর কথা না বাড়িয়ে সটান দাঁড়িয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিল তৃণার দিকে। তৃণা স্নিগ্ধর হাতটাতে ভর দিয়ে পার্কের সবুজ ঘাসের ওপর থেকে উঠে পড়ল। তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করেই পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো।
    অটোতে বসেই তৃণা বলে, আজ যা যাচ্ছেতাই রকমের গরম। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে এক দুদিনের মধ্যেই।
    অটোওয়ালা উপযাচক বলে ওঠে, শুধু বৃষ্টি নয় ম্যাডাম। মনে হচ্ছে ঝড় উঠতেও পারে।বৈশাখ পরে গেছে। এবার তো একটা আধটা কালবৈশাখী হবেই।
    অটো থেকে নেমে স্নিগ্ধ যায় টিউশন পড়াতে আর তৃণা ফেরে বাড়ি। তৃণা বাড়িতে ফেরা মাত্রই ওর মা একটা কাপড়ের মাঝারি সাইজের পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে এসে বলে, এই দেখ তোর স্নিগ্ধদার মায়ের কান্ড।
    তৃণা খানিক অবাক হয়ে পলিথিনটার মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে দেখে, প্রচুর শুকনো আম পাতা।
    চোখ গুলো কপালে তুলে সে বলে, মা এর মানে?
    তৃণার মা আরতি বলে, এত লেখাপড়া শিখেছিস আর এর অর্থ বুঝতে পারলি না। ওরে হাঁদারাম আমাদের গাছের আম পাতা যেগুলো পড়ে ওদের ছাদে। সেগুলো একসাথে জড়ো করে এই পলিথিনটাতে ভরে আমাদেরকেই দিয়ে গেছে। আর বলে গিয়েছে আমাদের বাড়ি থেকে রোজ যেন আমি কাউকে পাঠাই ওদের বাড়িতে। সে গিয়ে ছাদে ঝাড়ু লাগিয়ে আম পাতা সব কুড়িয়ে আনবে।
    কি সাংঘাতিক মহিলা তুই একবার ভেবে দেখ তৃণা। তৃণা বলে, সত্যিই তো মারাত্মক ঝগড়ুটে মহিলা। আরে বাবা গাছের পাতাই তো উড়ে পড়ে। এ তো নোংরা কিছু নয়।
    তৃণার বাবা অমিত বাবুও বিরক্ত হয়ে বলেন, সেন বৌদি যেন দিনদিন অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে।
    আরতি তো রীতিমতো কাঁদতে কাঁদতে বলে, রোজ দিন এত অপমান ভালো লাগে না। তার থেকে তুমি গাছটা কেটে দাও।
    অমিত বাবু প্রায় আঁতকে উঠলেন এই কথা শুনে। তুমি জানো এই গাছটা কতদিনের পুরানো। এটা আমার মায়ের হাতে লাগানো গাছ। আর এই গাছের আমগুলো যেন অমৃত। যেমন দেখতে তেমন স্বাদ। এই লক্ষ্মণভোগ আম গাছ কজনের বাড়িতে আছে বলতে পারো?
    আরতি বলে, বলি টাকা দিলেই বাজারে এই লক্ষ্মণভোগ পাওয়া যায়। নিজের বাড়িতেই যে রাখতে হবে অশান্তি করেও তার কি মানে আছে!
    অমিত বাবু রীতিমতো হাত নেড়ে জানিয়ে দিলেন কোনো মূল্যেই এই গাছ তিনি কাটবেন না। অগত্যা স্নিগ্ধর মায়ের সঙ্গে অশান্তি লেগেই রইল।
    দিন তিনেক পরে হঠাৎ বিকালে পশ্চিমের আকাশ জুড়ে কালো মেঘ করল। প্রথমে গাছের পাতাগুলো ও ভয়ে নড়াচড়া বন্ধ করে দিল। আস্তে আস্তে কালো মেঘ কুক্ষিগত করে নিল গোটা আকাশকে। দরজা জানালা বন্ধ করতে গিয়ে রীতিমতো কানে আসতে লাগলো হাওয়ায় শোঁ শোঁ শব্দ। তীব্র গতিতে হাওয়া এসে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে তৃণাদের বাগানের সব গাছ গুলোকে। তবে সবচেয়ে বেশি দুলে দুলে উঠছে আম গাছের ডালপালাগুলো।
    হাওয়ার সাথে এবার শুরু হলো শিলা বৃষ্টি। দরজা জানালাতে মনে হচ্ছে কেউ ক্রমাগত করাঘাত করে চলেছে। তৃণা যদিও মাঝে মধ্যেই চেষ্টা করছিল দুচারটে যততত্র পড়ে থাকা বরফ কুচি কুড়িয়ে আনতে। শিলা বৃষ্টি হলে শিল কুড়ানোর মজাই আলাদা। প্রায় কুড়ি মিনিট চললো মেঘ বৃষ্টি আর হাওয়ার লড়াই। বৃষ্টি ধীরে ধীরে কমতেই অমিত বাবু বাগানে এসে দেখে এদিক ওদিকে ভেঙে পড়েছে গাছের ডালপালা। তবে আম গাছটার দশা দেখে উনি প্রায় কেঁদে ফেললেন। চিৎকার করে উঠলেন, তৃণা তোর মাকে নিয়ে বাগানে আয় শিগগির।
    মাথায় গামছা দিয়ে হাতে টর্চ নিয়ে ছুটে আসে তৃণা ও তার মা। কি রকম অদ্ভুত ভাবে আম গাছটার গোড়াটা গেছে মুচড়ে। আরতি বলে, হ্যাঁ গো আমি গাছটাকে কেটে দিতে বলেছিলাম বলেই কি গাছটা ঝড়ে এইভাবে ভেঙে গেল।
    স্নিগ্ধদের ছাদ থেকে স্নিগ্ধর বাবা রমেন বাবু অমিত বাবুকে উদ্দেশ্য করে বলে, কালবৈশাখীতে আমাদের জলের ট্যাঙ্কের ঢাকনাটা কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল কে জানে? একটু আপনাদের বাগানে দেখবেন।শিল পড়ে সিঁড়ি ঘরের এ্যাটবেসটারটাও গেছে ফেটে। কি বিপর্যয় বলুন তো মশাই।
    তারপরই রমেন বাবু বলেন, একি আপনাদের আম গাছটা ভেঙে গেছে!
    আরতি বলে, দাদা গাছেরও তো প্রাণ আছে। দিনরাত দুই পরিবারের মধ্যে ওকে নিয়ে যে অশান্তি হতো। তা ও নিশ্চয় টের পেয়ে ছিল।ভালোই হলো আর অশান্তি হবে না।
    স্নিগ্ধর মা বাতাসী মুখ বেঁকিয়ে বলে, যা না আম ধরতো তার থেকে বেশিই পাতা ঝড়তো আমাদের ছাদে। আমি একা মানুষ কত রোজ দিন পাতা পরিষ্কার করি বল তো।
    আরতি বলে, গাছটা তো আমার শাশুড়ি মায়ের লাগানো ছিল। মায়া পড়ে গিয়েছিল খুব। তাই কাটতে মন চাইতো না তৃণার বাবার। এই কথা বলেই হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে আরতি।
    স্নিগ্ধর মা হতবাক হয়ে যায়। মনে মনে বলে, এই আম গাছটার প্রতি এদের এতো মায়া ছিল। আমি তো এই গাছটাকে কেটে দেওয়ার কথা রোজ বলেছি। তখন না জানি ওদের কত কষ্ট হয়েছে। কিন্তু তৃণার মা কোনো দিন আমাকে তেমন কটূ কথা বলে নি।
    ঝড়ের তান্ডবের নিদর্শন চতুর্দিকে। কারেন্ট চলে গেছে অনেক ক্ষণ। ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সেদিন আর অন্ধকারে রান্না বান্না না করে দিনের ভাতে জল দিয়ে নিল সঙ্গে পেঁয়াজ পোস্ত আর আলুভাতে নিয়ে স্নিগ্ধ আর রমেন বাবুকে ডাকলো বাতাসী।
    খেতে বসে রমেন বাবু বলেন,অমিত বাবুদের আম গাছটা ভেঙে গেল শেষ পর্যন্ত। আমগুলো কিন্তু যেমন দেখতে তেমনই খেতে ছিল।
    বাতাসী রমেন বাবুর কথাটা না শোনার ভান করে স্নিগ্ধর উদ্দেশ্যে বলে, হ্যাঁ রে স্নিগ্ধ তৃণার এম এ ফাইনাল পরীক্ষাটা কবে?
    স্নিগ্ধ অবাক হয়ে একটু আমতা আমতা করে বলে, কেন মা হঠাৎ তৃণার পড়াশোনা কথা জিজ্ঞেস করছো?
    বাতাসী রসিকতা করে বলে, কি ভাবছিস মা বুঝি কিছুই টের পায় না?
    লজ্জায় স্নিগ্ধ একেবারে লাল হয়ে উঠলো। তারপর বলে, মা তুমি তাহলে সব জানো?
    -ওরে আমি তোর মা হই। ছেলে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে আর মা টের পাবে না। তা কি হয়! আগামী বুধবার তোর বাবাকে নিয়ে তৃণাদের বাড়ি যাবো। আশা করি মেয়ের বিয়ের খবরে আম গাছটার শোক খানিক তাড়াতাড়ি ভুলতে পারবে তৃণার মা ও বাবা।

  • গল্প

    গল্প- সুলতার হাতপাখা

    সুলতার হাতপাখা
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

    মিঠা পাতি পানটা মুখে পুরে, তালপাতার হাত পাখাটা নাড়তে নাড়তে বেশ রসিকতা করে সুলেখা তার বড়দি সুলতাকে বলে, হ্যাঁ রে বড়দি তোদের কলকাতাতে তো ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই যথেষ্ট ভালো। তাও তোর মাথা বালিশের পাশে হাতপাখা! ওরে হাতপাখার যুগ থেকে বেরিয়ে আয় তুই এবার।
    তোর দুই ছেলেমেয়ের রুমেতেই তো এয়ার কন্ডিশন মেসিন লাগানো আছে। এবার তুইও একটা তোদের শোবার ঘরে এসি মেসিন লাগিয়ে নিস। আর কতকাল কৃচ্ছসাধন করবি।
    পাশেই বসে ছিলেন সুলেখার বড় জামাইবাবু অঘোর বাবু। উনি এবার শুরু করলেন ঠিক এইভাবে, ছোট শালি তোমার বড়দির হাতপাখা নিয়ে কিন্তু রসিকতা করো না। যদি মাথাটা ওর গরম হয়ে যায় তখন কিন্তু পাখার হাতল দিয়ে ধরিয়ে দেবে দুচার ঘা।
    সুলেখাও কম যায় না। সে বেশ কৌতুক করে বলে, জামাইবাবু মনে হচ্ছে আপনাকে শাসনে রাখতেই বড়দি আজও হাতপাখাটা মাথার গোড়াতে নিয়ে ঘুমায়?
    অঘোর বাবু মুচকি হেসে বলে, বেডরুমের কথা স্বামী স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা ভালো। এইসব কথা পাঁচ কান করতে নেই। তবে তোমার দিদির হাতপাখা কিন্তু মানুষের জীবন পর্যন্ত বাঁচিয়েছে।
    সুলেখা বিস্ময়ের সাথে বলে, বলেন কি জামাইবাবু? অ্যাই দিদি বল না একটু শুনি সেই গল্পটা।
    সুলতাও একটা মিঠা পাতি পান মুখে পুরে তার নিজস্ব স্বভাববশত ফ্যানের রেগুলেটারের স্পিডটা খানিক কমিয়ে দিয়ে খাটেতে এসে বসল। বসেই হাত বাড়িয়ে সুলেখার কাছ থেকে তালপাতার পাখাটা চেয়ে নিল।
    তারপর বলে, এটা তোদের কাছে তালপাতার একটা হাতপাখা মাত্র। কিন্তু আমার কাছে অজস্র স্মৃতির খাজানা বুঝলি। দেখ লেখা (সুলেখা) এই পাখাটার পাতার মধ্যে কত নাম লেখা আছে নিঃশ্চয় তুই দেখতে পেয়েছিস। গরমের দিনে ছাদে রিমি, বুবাইকে নিয়ে আগে যখন হ্যারিকেনের আলোয় পড়াতে বসতাম। তখন একটু ফাঁক পেলেই দুটোতে পেন দিয়ে পাখার গায়ে নাম লিখতো, মাঝে মধ্যে ছড়া’ও।
    আজ’ও এইসব আঁকিবুকি দেখলে মনটা ভরে যায়। ছেলেমেয়েগুলো বড় হয়ে গেছে ঠিকই। কিন্তু ওদের ছেলেমানুষীর সাক্ষ্য এখনও এই তালপাতার পাখাটা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। এইসব কথাগুলো বলতে বলতে, সুলতা খানিক পাখাটার গায়ে হাত বুলিয়ে নিল।
    তবে আমার হাতপাখা যে কোনো মানুষকে প্রাণে বাঁচাতে পারবে এটা আমি আগে কোনদিন ভাবতে পারি নি।
    গত বছর বাসে করে মায়াপুর যাচ্ছিলাম আমি আর তোর জামাই বাবু। বুবাই অনলাইনে থাকার ব্যবস্থা করে ছিল চৈতন্য ভবনে। আমি বারণ করে ছিলাম ছেলেকে যে এসি রুমের কোনো দরকার নেই। একটু বেশি গরম লাগলেই আমি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ফোল্ডিং হাত পাখাটা বের করে নেবো।সে তো ছেলে শুনলো না।
    যাক গে সে কথা। বাসের সামনের দিকে সিট ছিল আমাদের। ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমও তখন বেশ।বাসটাতে সব সিটই ভর্তি। বাসটা চালু হতেই বেজে উঠল হরিনাম সংকীর্তন।আমি তো জানালার ধারের সিটে বসেছিলাম। তাই বাইরের মানুষের ব্যস্ততা, কোলাহল, দোকানদারদের হাঁক ডাক, গাড়ী ঘোড়া দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম।

    ৩৪ নং জাতীয় সড়ক ধরে বাস ছুটে চলেছে ঝড়ের বেগে। হঠাৎ বাসের পিছন সিট থেকে ভেসে এলো করুণ আর্তনাদের আওয়াজ, বাস থামাও, বাস থামাও।
    গোটা বাসের যাত্রী বিস্ময়ের সাথে চেয়ে দেখে, একদম পিছন সিটে একজন বয়ষ্কা মহিলা ভীষণ ভাবে হাঁপাচ্ছে। তার পাশে বসে আছে সতেরো আঠেরো বছরের একটি মেয়ে। সে বয়ষ্কা মহিলার মাথাটা নিজের কাঁধে রেখে ব্যাকুল ভাবে সাহায্যের আবেদন করছে সকলের কাছে।

    মিনিট তিনেকের মধ্যেই ড্রাইভার বাসটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করালো। বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা ছুটে গেল বয়ষ্কা মহিলাটির কাছে। একজন ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে চোখে মুখে ছিঁটে মারতে লাগলো।
    বয়ষ্কা মহিলাটির শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। বারবার সে মুখ হাঁ করে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিল। এইসব দেখে তো ড্রাইভার তো বেশ ভয় পেয়ে যায়। সে চিৎকার করে সকলের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, আপনারা যে যার নিজের জায়গায় বসুন। একটু বাইরের হাওয়া আসতে দিন। কারোর কাছে কি হাতপাখা আছে? তাহলে সরাসরি হাওয়া করা যায় দিদিমাকে।
    এই কথা শুনে তোর জামাইবাবু তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, আমাদের কাছে হাতপাখা আছে। এক্ষুণি দিচ্ছি।
    তোর জামাই বাবুর চোখে মুখে আমি সেদিন দেখেছিলাম একজন অপরিচিত বয়ষ্কা মহিলার জন্য চরম উৎকণ্ঠা। সেদিন আমাকে বলেছিল, সুলতা তোমার হাতপাখাটা তাড়াতাড়ি দাও আমাকে। বয়ষ্কা মহিলাটির বাতাসের প্রয়োজন।
    আমি জানতাম হাতপাখা দিয়ে বেশিক্ষণ বাতাস করার অভ্যাস তোর জামাইবাবুর নেই। তাই আমি নিজেই বেতের ফোল্ডিং হাতপাখাটা নিয়ে বয়ষ্কা মহিলাটির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
    আমাকে দেখা মাত্রই সতেরো আঠেরো বছরের মেয়েটি কেঁদে উঠে বলে, আন্টি আমার ঠাকুমার হঠাৎই খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। এখন আমি কি করবো? বিনা চিকিৎসায় আমার ঠাকুমা কি মারা যাবে?
    বয়ষ্কা মহিলাটিকে দেখে আমারও পরিস্থিতি খুব একটা ভালো মনে হচ্ছিল না। তবুও বললাম তুমি এতো চিন্তা করো না। এই তো আমি হাতপাখা দিয়ে জোরে জোরে বাতাস করবো। উনি নিঃশ্চয় সুস্থ হয়ে উঠবেন। তুমি তোমার ঠাকুমার মাথাটা আমার কোলে রেখে দাও। এই বলে মেয়েটির জায়গায় আমি বসলাম আর প্রাণপণে হাতপাখাটা নেড়ে বাতাস করে চললাম।
    ড্রাইভার সকলের উদ্দেশ্যে বলে, এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটা নার্সিং হোম আছে। আমি তাড়াতাড়ি করে চেষ্টা করছি পৌঁছানোর।
    গোটা বাস একসাথে বলে উঠল, চলুন দাদা চলুন। তাড়াতাড়ি চলুন।
    প্রায় আধঘণ্টা যাওয়ার পর পেলাম সেই নার্সিং হোম। ততক্ষণে অবশ্য বয়ষ্কা মহিলার শ্বাসকষ্টটা সামান্য কমে ছিল। আমার হাতপাখা অনবরত বাতাসে বোধহয় সামান্য আরাম বোধ করেছিল।
    বাসটা থামিয়ে ড্রাইভার অনুরোধ করল, আমার সঙ্গে তিন চার জন মানুষ আসুন।রিসেপশনে কথা বলতে হবে।
    তোর জামাইবাবু আরো দুই জন ব্যক্তি গেল নার্সিং হোমের ভিতরে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই স্ট্রেচার নিয়ে দুজন ছেলে এসে বয়ষ্কা মহিলাকে নিয়ে গেল।
    ডাক্তার দেখা মাত্রই ইনজেকশন পুশ করে এবং আধঘণ্টা সকলকে অপেক্ষা করতে বলে।
    আধঘন্টার পর বয়ষ্কা মহিলাটি কথা বলার চেষ্টা করে। সে জানায় সে এখন আগের থেকে অনেকখানি সুস্থ বোধ করছে। বারবার সে বলে, আমাকে যে ভদ্রমহিলা বাতাস করছিল তাকে একবার ডেকে দিন।
    আমি তার কাছে যেতেই সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার হাতপাখার হাওয়া না পেলে আমি হয়তো বাসেই মারা যেতাম।
    -থাক না মাসিমা এইসব কথা। এখন আরাম লাগছে তো?
    চোখগুলো বুজে জানান দিয়েছিল, হ্যাঁ।
    ওনার নাতনি ইতিমধ্যে বাড়িতে ফোন করে দিয়েছে। সুতরাং আর ভয়ের কিছু নেই। ঘন্টা খানেকের মধ্যে বাড়ির লোক এসে পরবে।
    ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে ড্রাইভার বাসের স্টেয়ারিং এ এসে বসলো। ড্রাইভার সমেত পুরো বাসের যাত্রী আমাকে সেদিন বলেছিল, ভাগ্যিস আপনার হাতপাখা করার অভ্যাস আছে। তাই তো প্রায় আধঘণ্টা একনাগাড়ে বাতাস করতে পারলেন। আপনার হাতপাখার শীতল বাতাসে বয়ষ্কা মহিলাটির প্রাণটা রক্ষা পেল।
    জানিস লেখা (সুলেখা) সেদিন তোর জামাইবাবুর চোখে মুখে দেখেছিলাম প্রশান্তির ছায়া। আমার এই হাতপাখা করার অভ্যাসটার জন্য মাঝে মধ্যেই উনি আমাকে ব্যাকডেটেড বললেও সেদিন আমার এই অভ্যাসের জন্য বেশ গর্বিত হয়েছিল সেটা আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলাম।

  • গল্প

    গল্প- রাক্ষুসী মাসি

    রাক্ষুসী মাসি
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    -বলি ও ছোট বৌমা তুমি কোন আক্কেলে ঠিক করলে যে আমার সোহম দাদুভাই তোমার বড়দিদির কাছে থেকে মানুষ হবে? মানছি আমার ছোট ছেলেটার রোজগার একটু কম। তাই বলে নিজের পেটের সন্তানকে তুমি অন্যের ঘরে রাখতে চাও! বলি তুমি কেমন ধারার মা গো?
    শর্মিলা অনেক ক্ষণ ধরে সহ্য করে চলেছে তার সত্তরোর্ধ্ব শাশুড়ি বিমলা দেবীর গঞ্জনা। এবার আর চুপ থাকতে না পেরে সে বিরক্ত হয়ে বলে, আপনাদের এই রাবণের গুষ্টিতে ছেলে মানুষ করা খুব মুশকিল। সারাদিন শুধু হৈ চৈ। লেখাপড়ার কোনো নাম গন্ধ নেই। যার মন চাইছে সে পড়ছে আবার যার মন চাইছে না সে পড়ছে না। তার ওপর আপনার নাতিদেরকে তো কেউ কিচ্ছুটি বলতে পারবে না। কিছু বলতে গেলেই আপনি রে রে করে তেড়ে আসবেন।
    তাই আমি আপনার ছেলের সঙ্গে পরামর্শ করেই ঠিক করেছি সোহম আমার বড় দিদির কাছে থেকেই লেখাপড়াটা করবে।
    বিমলা দেবী খানিক নিজের কপাল চাপড়ে বলে, বলি ও ছোট বৌমা, তুমি তো একটু আধটু লেখাপড়া জানো। ও দিয়ে কি এইটুকু ছেলেটাকে মানুষ করা যায় না। পাঁচ বছরের ছেলেকে এখন থেকে নিজের কোল ছাড়া করলে তার কি আর তোমার প্রতি টান থাকবে?
    শর্মিলা ঠোঁটের কোণে সামান্য একটু হাসি এনে বলে, সোহম আমার নাড়ী ছেঁড়া ধন।এই নাড়ীর টান ছিন্ন করা যায় কি কখনও?
    তাই বলছি এবার অন্তত দয়া করে আপনি বিলাপটা বন্ধ করুন। বড়দি, জামাই বাবু দোতলার ঘরে আছে। কখন ওদের কানে পড়ে যায় এইসব কথা কে বলতে পারে।
    ঠিক তাই। শর্মিলার বড় দিদি মনিমালা দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছিল।আর তখনই বিমলা দেবীর কথাগুলো শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সিঁড়িতে।
    মনে মনে সে ও নিজেকে প্রশ্ন করছিল, কাজটা কি আমি ঠিক করছি? আমি নিঃসন্তান বলেই তো সোহমকে নিজের কাছে রেখে লেখাপড়াটা শেখাতে চাইছি। শুধু যে সোহমের ভবিষ্যতের কথা ভাবছি তা নয়। আমার মনের কোণে লুকানো রয়েছে যে সন্তান সুখের চাহিদা সেটাও তো আমি চরিতার্থ করতে চাইছি। তাহলে কি আমি অন্যায় করছি? আমার বুকের অতৃপ্ত মাতৃত্বের ধারাকে তৃপ্ত করতে গিয়ে আমি আমার নিজের ছোট বোনকে বঞ্চিত করছি না তো?
    এমন সময় দোতলার বারান্দায় কারোর পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে মনিমালা আর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে না থেকে পুনরায় ওপরে উঠে আসে।
    শর্মিলার খাটে শুয়ে শুয়ে গল্প করছে মনিমালার স্বামী অখিলেশ আর শর্মিলা স্বামী বিদ্যুৎ। দুই ভায়রা ভাই আলোচনা করছে সোহমের স্কুলের ভর্তির বিষয় নিয়ে।
    বিদ্যুতের কথায় বারবার উঠে আসছে তাদের বাড়ির পরিবেশ আর গ্রামের পরিবেশের কথা। বিদ্যুতের কথাবার্তার মধ্যে শর্মিলার ভাবনা চিন্তার প্রতিচ্ছায়াও দেখতে পেয়েছিল সেদিন মনিমালা।
    নিজের মনকে তখন সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, আমি তো আর জোর করে সোহমকে নিয়ে যেতে আসিনি। ওর মা বাবার অনুরোধে এসেছি। তাছাড়া দুটো ছেলে নিয়ে শর্মিলা তো অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বড়টা আমার কাছে থেকে মানুষ হলে ওরও একটু সুরাহা হবে।
    বিদ্যুৎ ঘরের দরজার দিকে মুখ ঘোরাতেই দেখে মনিমালা দাঁড়িয়ে আছে। সে বলে বড়দি আপনার বোন কই? ওকে ডাকতে তো নিচে গিয়েছিলেন। মনিমালা বলে এখন ও কাজে খুব ব্যস্ত। একটু পরে আসবে।
    দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়েই মনিমালা শর্মিলার উদ্দেশ্যে বলে, কই রে সোহমের কয়েকটা জামাকাপড় আমার ব্যাগে দিয়ে দে আর বইখাতার জন্য একটা আলাদা ব্যাগ গুছিয়ে দে। বেলা তো প্রায় শেষের মুখে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সন্ধে নামবে তাই আর বেশি দেরি করতে চাইছি না। 5:10 এর লোকালটা পেয়ে গেলে সাড়ে ছটার মধ্যে ভালোভাবে বাড়ি পৌঁছে যাব।গিয়ে সন্ধ্যাটাও দিতে পারব।
    শর্মিলা সেইমতো সোহমের বইয়ের ব্যাগটা গুছিয়ে দিল। আর কয়েকটা জামা কাপড় ওর বড়দির ব্যাগে ভরে দিল। সোহমকে জামা প্যান্ট পরিয়ে কাছে টেনে নিয়ে শর্মিলা বলে, একদম শান্ত হয়ে থাকবে কিন্তু বড় মাসীমণির কাছে। মাসীমণি, মেসোমশাই যা বলবে তাই শুনবে, কেমন। এই কথাগুলো বলতে বলতে যদিও শর্মিলার গলাটা কেঁপে উঠেছিল। তবুও তৎক্ষনাৎ নিজেকে সংযত করে বলে, চল ঠাকুমাকে প্রণাম করবি চল। বাড়ির বড়দের সবাইকে প্রণাম করে তারপর রওনা দিবি।
    বিদ্যুৎ ইতিমধ্যে একটা রিক্সা ডেকে এনেছে। সবার সাথে সৌজন্য বিনিময় করে মনিমালা সোহমকে নিয়ে রিক্সায় উঠেছিল।
    তারপর দেখতে দেখতে ছোট্ট সোহম প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে উঠে পড়েছে। পড়াশোনাতে ভীষণ মনোযোগী সে। প্রতিবছর ক্লাসে প্রথম হয় আর স্বভাবের দিক থেকেও ভীষণ ধীর স্থির।
    প্রায় প্রতি মাসেই সোহমের মা বাবা ভাই আসে ওর সঙ্গে দেখা করতে। তবে সোহমের যে ওদের জন্য খুব একটা মন খারাপ করে তা সে কোনদিন বলেনি তার মাসীমণিকে।
    সোহমের কখনো সামান্যতম শরীর খারাপ হলেই অখিলেশ বাবু আগে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে এসে তারপর শালি ও শালিপতি ভাইকে খবর দিতেন। আর তখন বিদ্যুৎ এসে এমন হাবভাব করত যা দেখে মনিমালার মনে হতো তারা যেন বড্ড বেশি অনাদরে রেখেছে সোহমকে। এই কথাটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইছে সোহমের বাবা বিদ্যুৎ।
    সেবার মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে সোহমের ভাইরাল ফিভার হয়। সেই খবর পাওয়া মাত্রই শর্মিলাকে নিয়ে বিদ্যুৎ ছুটে আসে। সে অখিলেশ বাবুর উদ্দেশ্যে রীতিমতো রাগান্বিত হয়ে বলে, সোহমের দায়িত্ব যখন ঠিকমতো নিতে পারছেন না তখন ওকে আমি এখানে রাখবো না। আজকেই আমি ওকে চিত্তরঞ্জন নিয়ে যাব।
    শর্মিলা তখন শশব্যস্ত হয়ে অখিলেশ বাবুর হাত দুটো ধরে বলেছিলো, জামাইবাবু ওর কথায় রাগ করবেন না। জানেন তো একটুতেই মাথা গরম করা ওর স্বভাব।
    সেদিন শুধু অখিলেশ বাবু মনিমালার কথা ভেবে চুপ করে ছিলেন। এই কয়েকটা বছরে মনিমালা যে মনেপ্রাণে সোহমের যশোদা মা হয়ে উঠেছে। তা বেশ বুঝতে পারে অখিলেশ বাবু। রোজ সকালে উঠেই মনিমালা সবার আগে ভাবতে বসে সোহমকে কি খেতে দেবে আজ। সোহমের পছন্দটা সবার আগে। আর সোহমও মাসীমণি ছাড়া চোখ যেন অন্ধকার দেখে।
    মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক দুটো পরীক্ষাতেই দুর্দান্ত রেজাল্ট করে, জয়েন এন্ট্রান্স ভালো ফলাফল করে, কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে এখন আসানসোলের হেলথ সেন্টারে যোগদান করেছে সোহম।
    এবার তাই সোহমের বাবা তার ডাক্তার ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে শুরু করে দিয়েছে। বিদ্যুৎ বাবুর এখন চালচলন পাল্টে গেছে। বন্ধুবান্ধবদের মহলে তার খাতির বেড়ে গেছে। যতই হোক ডাক্তার ছেলের বাবা বলে কথা।
    দুর্গাপুরের বি জনের একটি মেয়েকে বেশ পছন্দ হয় বিদ্যুৎ বাবুর। মোটা টাকার পণও দিতে চাইছে মেয়ের বাবা। আর সেই খবরটা দিতে এই দিন কয়েক আগে বিদ্যুৎ এসেছিল তার বড় শালিকা মনিমালার বাড়ি।
    কিন্তু সেখানে এসে সে যা শুনলো তাতে রীতিমতো অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে। রীতিমতো আস্ফালন করে মনিমালার উদ্দেশ্যে বলে, সোহমের লেখাপড়া দায়িত্ব আপনাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। ওর বিয়ের দায়িত্ব নয়। কোন সাহসে, কোন অধিকারের জোরে সোহমের মা-বাবা বেঁচে থাকতে সোহমের বিয়ের সিদ্ধান্ত আপনারা নিচ্ছেন?
    বছরের পর বছর ধরে বিদ্যুৎ বাবুর ঔদ্ধত্য সহ্য করতে করতে সেদিন অসহ্য হয়ে মনিমালা বলে, সোহম আমার ঔরসজাত নয় ঠিকই। ও আমার মানসজাত সন্তান। আমার মনের মত করে ওকে আমি বড় করেছি। আজ ও ডাক্তার হয়েছে আর সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হয়েছে।
    বিদ্যুৎ বাবু অসভ্যের মত দাঁত বের করে হো হো করে হেসে উঠলো এই কথা শুনে। তারপর হাততালি দিয়ে বলে আপনি কি আজকাল নাটক নভেল লিখছেন নাকি বড়দি। ভালো বললেন তো। সোহম আপনার মানসজাত সন্তান।
    তারপর ক্রুর হাসি দিয়ে বলল, তা এত বছরেও সোহম কোনদিন কি আপনাকে মা বলে ডেকেছে বড়দি?
    বিদ্যুৎ বাবু ভেবেছিল সে একেবারে মোক্ষম জায়গায় আঘাত করেছে মনিমালার।
    কিন্তু মনিমালা খুব শান্ত গলায় সেদিন বলেছিল, কাউকে মা বলে ডাকলেই কি তার সন্তান হওয়া যায়? শর্মিলা তো তোমাদের বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকেই তোমার মাকে মা বলে সম্বোধন করে। কিন্তু সে কোনোদিন আমাদের মায়ের জায়গায় তার শাশুড়িকে বসাতে পারেনি। এই যে তুমি তোমার শ্বশুর-শাশুড়িকে মা বাবা বলে সম্বোধন করো। কিন্তু কোনদিন ভেবেছো, কোনদিন চেষ্টা করেছো তাদের ছেলে হয়ে ওঠার।
    কিন্তু সোহম আমাকে মাসীমণি বলে ডাকলেও ওর অন্তরে আমার প্রতি যে শ্রদ্ধা ভক্তি ও ভালোবাসা আমি দেখেছি তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই যে ও আমাকে মায়ের আসনই বসিয়ে রেখেছে।
    আমার সামান্য শরীর খারাপ হলেই সেই ছোট্ট থেকে আমি ওকে দেখেছি অস্থির হয়ে উঠতে আর এখন তো তোমরাও দেখতে পাচ্ছো ছুটি পেলেও চিত্তরঞ্জন যায় না আমাদের দুর্গাপুরে চলে আসে।
    শর্মিলা নিজে আমায় বহুবার বলেছে দিদি সোহম আমাকে মা বলে ডাকে ঠিকই কিন্তু মা হিসাবে মান্য কিন্তু তোকেই করে ও।
    আমি বরঞ্চ বলেছি তা আবার হয় নাকি।নাড়িছেঁড়া ধন তোর। নাড়ির টান সে যে আলাদা জিনিস। আমি তো এ জন্মে সেই টান কেমন হয় তা বুঝতে পারলাম না।
    মনিমালার শান্ত গলাটা কখন যে কান্নায় চাপা পড়ে গিয়েছিল সে নিজেও বুঝতে পারেনি। একতলার স্টাডি রুম থেকে দোতলায় উঠে এসেছে সোহম। আজ তার রবিবারের ছুটি।
    মনিমালাকে কাঁদতে দেখে সে রীতিমতো অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। বিদ্যুৎ বাবুকে উদ্দেশ্য করে বলে, বাবা তুমি কি এই বাড়িতে আসো মাসীমণিকে শুধু কাঁদাবে বলে? ছোট্ট থেকে দেখে আসছি তোমার উল্টোপাল্টা কথার জন্য মাসিমনি কষ্ট পায়।
    ছেলের মুখে এমন ধারা কথা শুনে বিদ্যুৎ বাবু আরো রেগে ওঠে। তারপর বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে, বাঃ বাঃ। দারুন ট্রেনিং পেয়েছিস তো তুই তোর মাসির কাছ থেকে। জানিস তো বাংলায় একটা কথা আছে মায়ের থেকে যে মাসীর দরদ বেশি তাকে নাকি বলে রাক্ষুসী মাসি।
    এই কথাটা শোনা মাত্রই সোহম প্রচন্ড রকম উত্তেজিত হয়ে বলে এরপর আর একটা নোংরা কথা বললে আমি ভুলে যাব তুমি আমার বাবা। তাই বলছি আমাকে আর রাগিও না কিন্তু।
    একটা কথা যে বিয়ে নিয়ে তুমি অশান্তি করছো মাসিমনির সঙ্গে। সেটা জেনে রাখো আমার সিদ্ধান্ত। তিতলিকে ভালোবাসি আমি বহুদিন থেকে আর আমি ওকে বিয়ে করবো।
    আর একটা কথা এবার থেকে মাসিমনির বাড়িতে যখন আসবে তখন ভদ্র ব্যবহার সঙ্গে করে আনবে। মনে রাখবে আজ আমি যা কিছু তা সম্পূর্ণ অবদান মাসীমণি আর মেসোমশাই এর।
    বিদ্যুৎ বেশ বুঝতে পারছে তার শান্ত শিক্ষিত ছেলে বেশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। তাই সে তৎক্ষণাৎ গলার সুরটা বদলে ফেলে বলে, তোর মা তোকে নয় মাস পেটে ধরে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে। তার কথাও তুই ভুলে গেলি!
    রীতিমতো হাত তুলে সোহম বলে থাক থাক বাবা মায়ের কথা অন্তত তুমি বলতে এসো না। সে আমাকে পেটে ধরেছে বলেই তোমাদের পরিবার থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে রেখে মানুষ করতে চেয়েছিল। এই যে ভাইকে নিজের কাছে রেখে রীতিমত গুন্ডা তৈরী করেছ। এই বয়স থেকে তোলাবাজি করতে শিখে গেছে।
    বুঝলে বাবা মা বুঝতে পেরেছিল তোমার দৌড় কতটা। তুমি যে শুধু ফাঁকা আস্ফালন করতে পারো সেটা মা বেশ টের পেয়েছিল। যৌথ পরিবারে থেকে তুমি শুধু গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেরিয়েছো।
    মনিমালা দেখছে পরিস্থিতি ভীষণ রকম অপ্রীতিকর হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। তাই সে বাধ্য হয়েই বলে, সোহম চুপ কর।
    ব্যাস এই তিনটি শব্দে একেবারে চুপ হয়ে গেল ডাক্তার সোহম সেন। মাসিমনির যে কোনো কথা ওর কাছে মাতৃ আজ্ঞা স্বরূপ।
    একটা শব্দ খরচ না করে দ্রুতপায়ে সোহম আবার স্টাডি রুমে ফিরে গেল।
    বিদ্যুৎ দেখল সোহম কতখানি শ্রদ্ধা করে তার মাসীমণিকে। সোহম তার বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারে কিন্তু মাসিমনির মুখের ওপর নয়। তাই বিদ্যুৎ বাবু যতই মনিমালাকে রাক্ষসী মাসি বলুক না কেন সোহম কিন্তু মনিমালাকে বসিয়ে রেখেছে তার মায়ের আসনে।

  • গল্প

    গল্প- ছল চাতুরী

    ছল চাতুরী
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    ঋদ্ধিমার বাসর ঘরটা বেশ জমে উঠেছিল গান, বাজনা আর হাসি ঠাট্টায়। ঋদ্ধিমার বান্ধবী অলি তার কানে কানে বলে, দারুণ একটা হ্যান্ডসাম বর তো জুটে গেছে। এবার আরো ভালো ভালো রোম্যান্টিক কবিতা লিখিস।
    লাজুক হেসে ঋদ্ধিমা বলেছিল, ধ্যাত কি যে বলিস। কিন্তু মনে মনে ঋদ্ধিমাও তৈরী প্রেমের সাগরে ডুবে দিতে। সারাক্ষণ আড়চোখে দেখে চলেছে সে অতীনকে।
    অতীনের গায়ের রং শ্যামলা হলেও অদ্ভুত আকর্ষণীয় চেহারা। উচ্চতার সঙ্গে মানানসই দেহের ওজন। আর চোখে চশমা থাকলেও তার ভিতর দিয়েই স্বচ্ছ চোখের চাহনিতে বারবার তির বিদ্ধ হচ্ছে ঋদ্ধিমা।
    শুভ দৃষ্টির সময় অতীনের চাহনিটা ঋদ্ধিমার হৃদয়ে একেবারে গেঁথে গেছে। আর সেই চাহনির সঙ্গে ছিল একটা মিষ্টি হাসি। যে হাসির মধ্যে ছিল আস্থা আর বিশ্বাসের আশ্বাস।
    ছেলেদের দল আর মেয়েদের দল মিলে শুরু করেছিল গানের লড়াই খেলা। এমন সময় বেজে উঠলো রিংটোন ‘মা গো আমার মা আমি তোমারি খোকা’। এই রিং টোন বেজে ওঠা মাত্রই অতীনের মামাতো ভাই তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফোনটা বের করে ধরে বলে, হ্যাঁ পিসিমণি বলো?
    অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, বিয়ের সব পর্ব কখন শেষ হলো?
    -ও তো অনেক ক্ষণ মিটে গেছে। আমরা সবাই এখন বাসর ঘরে।
    -তা বেশ। ফোনটা অতীনকে একবার দে তো।
    অতীনের মামাতো ভাই ফোনটা স্পিকারে দিয়ে অতীনকে দিলো। অতীন ফোনটা ধরে বলে, হ্যাঁ মা বলো?
    -কি রে চব্বিশ ঘণ্টা এখনো হয় নি এর মধ্যেই বউকে পেয়ে মা’কে ভুলে বসে আছিস?
    অতীন আমতা আমতা করে বলে, মা এতো ব্যস্ত ছিলাম যে ফোন করতে সময় পাই নি।
    এবার বেশ ধমকের সুরে অতীনের মা সবিতা দেবী বলে, অনেক হয়েছে সাফাই দেওয়া। সকাল হলেই বৌ নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বি। আমি এখন রাখলাম।
    সবিতা দেবীর প্রতিটা কথা ঋদ্ধিমার কানে বিঁধে ছিল কাঁটার মতো। বাইশ বছরের তরুণী, যার চোখে বিবাহিত জীবনকে ঘিরে অজস্র রঙিন স্বপ্ন। সে হঠাৎ কেমন গুটিয়ে গেল অজানা ভয়ে। মনে মনে সে বিস্ময়ে ভাবে, অতীন ওর মা’কে এতো ভয় পায়! বত্রিশ বছরের যুবক, যে সরকারি উচ্চ পদে আসীন, যার ব্যক্তিত্ব বেশ প্রকাশ পায় তার উজ্জ্বল মুখাবয়বে। সে কিনা তার মায়ের কাছে এখনও দুগ্ধ পোষ্য বাচ্চার মতো বকা খাচ্ছে!

    তারপরই ভেবেছিল, সন্তান যতই বড় হয়ে যাক না কেন সে তো তার মা বাবার কাছে ছোটটি থাকে চিরকাল। তাই হয়তো অতীনের মা এমন করে বকাবকি করলো।
    বাসর ঘরে সবাই ঘুমে ঢুলে পড়েছে। অতীনের পাশে কখন যে ঋদ্ধিমাও ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায় নি নিজেও। দূরে কোনো মসজিদের আজানের ধ্বনি শুনে ঘুম ভেঙে যায় ঋদ্ধিমার। ঘুম ভাঙতেই লক্ষ্য করে অতীনের হাতের ওপর মাথা রাখা আছে তার। অদ্ভুত এক ভালোলাগার আবেশে ঘাড় ঘুরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো অতীনের দিকে।
    নববধূকে নিয়ে অতীন বেলা এগারোটার মধ্যে পৌঁছে গেল। গড়িয়া থেকে বারাসাত।এই ঘন্টা খানেক পথটা এসেছিল ঋদ্ধিমা অতীনের কাঁধে মাথা রেখে। অতীনের কাঁধটা ঋদ্ধিমার মনে হয়েছিল একটা নরম বালিশ।যে কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া যায়।
    বর বধূকে বরণ করার জন্য বরণডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবিতা দেবী। লাল চওড়া পাড়ের গরদের শাড়ি, কপালে বড় সিঁদুরের টিপ, গলায় বেশ মোটা একটা বলবিছা চেন, হাতে মোটা মোটা শাঁখা পলা সঙ্গে মানতাসা।
    এই প্রথম ঋদ্ধিমা ওর শাশুড়িকে দেখলো। দেখাশোনার সময় একটি বারের জন্য উনি আসেন নি ঋদ্ধিমাকে দেখতে। বরং উনি বলে পাঠিয়েছিলেন, অতীনের পছন্দই আমার পছন্দ। এই কথাটা শুনে ঋদ্ধিমার ধারণা ছিল তার শাশুড়ি বেশ উদারমনষ্ক হবে।
    বরণ করার পর সবিতা দেবী নিজের গলা থেকে বলবিছা চেনটা খুলে ঋদ্ধিমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিল। তারপর মুখটা বেজার করে বলেছিলেন, আমার বরণ পর্ব শেষ। এরপর যা যা স্ত্রী আচার আছে তোমরা করে নিও। অতীন এদিকের পর্ব মিটলে আমার ঘরে আসিস। আমার খুব মাথাটা ধরেছে।আমি আমার ঘরে চললাম।

    সবিতা দেবীর কথাবার্তার মধ্যে বেশ একটা একনায়কতন্ত্রের ভাব ছিল। হাবে ভাবে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন তিনিই এই পরিবারের সর্বেসর্বা।
    তবে একথা বোঝানোর তো কিছু নেই। সবিতা দেবী নিজের সংসারে নিজেই সর্বময় কত্রী হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। ঋদ্ধিমা সদ্য এসেছে একটা নতুন পরিবারে। সে এখন অতীনদের পরিবারে ছোট্ট চারাগাছ।তার ডালপালা বিস্তার করতে এখনও ঢের দেরি।
    ঋদ্ধিমার ছোট ননদ অনুশ্রী তাকে নিয়ে গেল দোতলার একটা বড়সড় ঘরে। এই ঘরটার সব আসবাবপত্র দেখেই ঋদ্ধিমা বুঝতে পারে এটা অতীন আর ওর ঘর।
    -কি গো বৌদি পছন্দ হয়েছে তোমার ঘরটা?
    -খুউব পছন্দ হয়েছে। এই ঘরটাতে আগে তোমার দাদা থাকতো নিশ্চয়?
    -না গো এটা একদম নতুন তোমার ঘর। এই ঘরে প্রথম তুমিই থাকবে।
    -তাহলে তোমার দাদার ঘর কোনটা ছিল আগে?
    -দাদা তো মায়ের কাছে থাকে।
    ঋদ্ধিমা মনে মনে বলে, সে আবার কি কথা? এতবড় ছেলে এখন ও মায়ের কাছে ঘুমায়! শাশুড়ি মনে হচ্ছে ছেলেমেয়েকে একটু বেশিই ভালোবাসে।
    তারপর বলে, তোমাদের খুব মজা বলো। এখনো পর্যন্ত মা বাবার কোল ঘেঁষে ঘুমাও।
    অনুশ্রী মুখ বেঁকিয়ে বলে, আমার তো আলাদা রুম আছে। দাদা একা ঘুমাতে পারে না। তাই ও মায়ের কাছে ঘুমায়।
    তারপর খাটের গদিটা হালকা তুলে একটা চাবির গোছা বের করে বলে, এই নাও। ধর তোমার আলমারির চাবি। আমি এখন আসি বৌদি।
    আগের দিন বিয়ের ধকলে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ঋদ্ধিমা। স্নান সেরে খোলা চুলে সিলিং ফ্যানের হাওয়াতে চোখটা বুঁজে এসেছিল। দুপুর দুটো নাগাদ অনুশ্রীর ডাকে ঘুম ভেঙেছিল।
    দুপুরে খেতে বসলো বাড়ির অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে। শ্বশুর বাড়িতে আসার পর থেকে একবারের জন্য কাছে পায়নি সে অতীনকে। শুধু দূর থেকে দেখছিল তার নতুন বরকে।

    পরের দিন বৌভাতের আয়োজনে ভীষণ ব্যস্ত ছিল অতীন। সকালে চা খাওয়ার সময় একটিবার কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, রাতে ঘুম হয়েছিল তো? কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
    ঋদ্ধিমা ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিল, তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ব্যাস সেই কথা।
    সন্ধ্যা বেলায় রিসেপশনের অনুষ্ঠানে ঋদ্ধিমাকে দেখে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না।অতীনের এক তুতো বৌদি তো রসিকতা করে বলেই ফেলেছিল, আজ বুঝতে পারছি কেন অতীন বিয়ে না করার সংকল্প ত্যাগ করলো। এমন রূপে লাট্টু তো হতেই হবে অতীনকে।
    পাশেই ছিল সবিতা দেবী। উনি ঋদ্ধিমার রূপের প্রশংসায় খানিক বিরক্ত হয়ে বলে উঠেছিলেন, রূপ তো দুদিনের। শুধু রূপ দিয়ে কি স্বামীকে বশে রাখা যায়?
    দু’ একবার ঋদ্ধিমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল অতীন কেবলমাত্র ছবি তোলার জন্য। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে অতীন যখন ফুলশয্যার ঘরে ঢোকে তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত একটা।
    থেমে গেছে সানাইয়ের সুর, মানুষজনের হৈ চৈ। সন্ধ্যার বিরাট কর্মযজ্ঞ হয়েছে সমাধা।তবে মাঝে মধ্যেই কুকুরগুলো রব তুলছে। ওদের ভোজ পর্ব এখনও মেটেনি।
    অতীন ক্লান্ত শরীরটা কে এলিয়ে দিলো ফুলের বিছানায়। তারপর বলে, বিয়ে করা বেশ ধকলের। তোমারও তো খুব ধকল যাচ্ছে বলো?
    ঋদ্ধিমা বলে, সে তো যাচ্ছে। তবে এখন মনে হয় সব ধকলের অবসান ঘটবে।
    অতীন ঋদ্ধিমার অনামিকাতে পরিয়ে দিল এ লেখা আংটিটা। তারপর হাত পেতে বলে, আমার উপহার কই?
    ঋদ্ধিমা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে মাথার বালিশের নিচে থেকে বের করে একটা রুপোর পেন। পেনটা অতীনের হাতে দিয়ে বলে, আমি শুনেছিলাম তুমি খুব ভালো কবিতা লিখতে পারো। তাই আমার মনে হলো, আমাদের ফুলশয্যার রাতে এই পেনটার থেকে আর ভালো উপহার হয় না। কিগো পছন্দ হয়েছে তো?
    অতীন ঋদ্ধিমার দিকে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। তারপর মুখটা একদম কাছে নিয়ে এসে বলে, ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আজকের রাতের সমস্ত সুখ স্মৃতি লিখবো এই পেনটা দিয়ে।
    তৃষিত চাতকের মতো চেয়ে রইলো ওরা একে অপরের দিকে। ভালোবাসার উত্তাল ঢেউ বারবার আছড়ে পড়ছে দুজনের হৃদয়ে। মনের স্বাভাবিক দ্বিধা দূরে সরিয়ে অতীন স্পর্শ করে ছিল ঋদ্ধিমার ওষ্ঠ যুগল। আরো কিছুটা ঘনিষ্ঠ হতে যাবে এমন সময় দরজার পরে টোকা। অনুশ্রী ডাকছে, অ্যাই দাদা তাড়াতাড়ি নিচে আয়। মায়ের শরীরটা খুব খারাপ লাগছে।

    এই কথা শোনা মাত্রই অতীন ছুটে এসে দরজা খুলেছিল। তারপর দৌড়ে নিচে নেমে আসে। ঋদ্ধিমা মনে মনে বলে, সারা সন্ধ্যাবেলায় আমন্ত্রিত অতিথিদেরকে বেশ ঘটা করে আপ্যায়ন করলেন উনি। একবারের জন্য মনে হয় নি যে উনি অসুস্থ।তাহলে এখন আবার কি হলো?
    গুটি গুটি পায়ে ঋদ্ধিমা দোতলা থেকে নিচে নেমে এলো। সবিতা দেবীর ঘর থেকে বেশ গুঞ্জন ভেসে আসছে। ঋদ্ধিমা ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ালো সবিতা দেবীর ঘরে।
    সবিতা দেবী বিছানায় শুয়ে। মাথার গোড়ায় বসে আছে অতীন। সিলিং ফ্যানটা ফুল স্পীডে ঘুরলেও অনুশ্রী হাত পাখাটা নেড়ে চলেছে। অতীনের বাবা ডাক্তার ডাকার কথা বললে, সবিতা দেবী হাত নেড়ে আস্তে আস্তে বলে, এত রাতে ডাক্তার বদ্যি ডাকতে হবে না। একা ঘুমানোর অভ্যাসটা একদম নেই তো তাই অন্ধকারে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এখন ঠিক আছি। তোমরা সবাই যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো।
    অতীনের বাবা বলে, গিন্নি তাহলে আজ আমি এই ঘরেই শুয়ে পড়ছি কেমন?
    -না একদম না। তুমি ভীষণ নাক ডাকো।আমি একটুও ঘুমাতে পারি না। তুমি তোমার ঘরেই শুয়ে পড়ো।
    ঋদ্ধিমা এইসব শুনে বলে, অনুশ্রী তুমি তাহলে আজ মায়ের কাছে শুয়ে যাও।
    অনুশ্রী মুখ বেঁকিয়ে বলে, তাহলে তো সমস্যার সমাধান হয়েই যেত বৌদি। আমি নাকি ঘুমের ঘোরে ভুল বকি। তাই মা আমাকে শুতে নিতে চায় না।
    ঋদ্ধিমা মনে মনে বলে, এতো বেশ ঝামেলার শাশুড়ি। ছেলের বিয়ে দিয়েছেন অথচ ছেলে ছাড়া ঘুমাতে পারবেন না রাতে! অনেক রকম শাশুড়ির কথা শুনেছি। কিন্তু নিজের বেলায় এমন আজব শাশুড়ি এসে জুটবে কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবে নি। বেশ আজব ব্যাপার তো।
    অতীন সবিতা দেবীর ঘরের দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দুটো বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। শরীর আর তার সাথ দিচ্ছে না। সে ঋদ্ধিমাকে বলে, তুমি ওপরে চলে যাও। অনুশ্রী বরং তোমার সঙ্গে শুয়ে পড়ুক আজ। আমি মায়ের খাটেই শুয়ে পড়ছি।
    ঋদ্ধিমার বিস্ময়ের পালা যেন শেষ হচ্ছে না। ছেলের ফুলশয্যার রাতেও ছেলেকে কাছছাড়া করতে চায় না। মনে মনে বলে, তাহলে এমন ধেড়ে খোকার বিয়ে দেওয়ার কি দরকার ছিল?
    অনুশ্রী অতীনের কথা শুনে বলে, দাদাভাই আমি কারোর সঙ্গে শুতে পারবো না। একা না শুলে ঘুম আসবে না।
    কান্নায় ভিজে আসছে ঋদ্ধিমার গলাটা। কোনো রকমে সে বলে, আমার একা ঘুমানোর অভ্যাস আছে। এই কথাটা শেষ করেই প্রায় ছুটে পালিয়ে আসে নিজের ঘরে। দরজায় ছিটকিনিটা তুলে আছড়ে পড়ে বিছানায়। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল কে জানে।

    সকালে ঘুম থেকে উঠে নিচে নেমে এসে দেখেছিল, তার শাশুড়ি দিব্বি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। টকাটক কথাও বলছে। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে উৎসুক নয়নে অতীনকে খোঁজে ঋদ্ধিমা।
    সবিতা দেবী ঋদ্ধিমার উৎকণ্ঠা বুঝতে পেরে বলেছিল, বৌমা অতীন এখনও ঘুমাচ্ছে।আজও তো অফিসের ছুটি। কদিন যা ধকল গেল ছেলেটার ওপর দিয়ে। ওকে যেন ঘুম থেকে তুলতে যেও না। ওর ইচ্ছা মতো ও ঠিক উঠে পড়বে।
    তুমি বরং স্নান করে পুজোর ঘরে এসো। আমি একটু দেখিয়ে দেবো সব কিছু। পূজোর ঘরটাতে কাজের মাসিকে আর ঢুকতে দিই না। আগে নিজেই মুছে নিতাম। এখন হাঁটু মুড়ে বসা একদম বারণ। তাই আর পারি না। ঘর মোছার লাঠি দিয়ে কোনোরকমে মুছে নিই। এবার থেকে তুমি আমার এই কাজটা করে দিও কেমন মা?
    ঋদ্ধিমা স্নান সেরে বের হতে না হতেই সবিতা দেবী বলে, ঋদ্ধিমা তোমার কাচা জামা কাপড় ছাদে মেলবে। নীচের উঠানে কেবল আমি জামা কাপড় শুকাতে দিই। আসলে আমি তো মাছ মাংস খাই না। আর তোমরা সবাই আমিষ খাও। তাই বললাম আর কি।কিছু মনে করো না মা।
    ঋদ্ধিমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, কাচা জামা কাপড়তে কোনো দোষ হওয়ার কথা নয়। তারপরই মনে পড়ে যায় তার মায়ের কথা। ঋদ্ধিমাকে ওর মা বলেছিল, শ্বশুরবাড়ি তে গিয়ে প্রথম থেকেই নিজে বেশি কথা বলবি না। মানুষগুলোকে আগে ভালো করে বুঝতে হয়।
    ঋদ্ধিমা তাই একটু একটু করে বোঝার চেষ্টা করে চলেছে তার শাশুড়িকে, স্বামীকে, ননদকে, শ্বশুর মশাইকে। আর এই বোঝাপড়া আজও চলছে সতেরো বছরটা ধরে।
    তবে আজকাল আর সে চুপচাপ সব কথা হজম করে না। তার মতো শান্ত স্বভাবের মেয়েও বেশ সরব হয় মাঝে মধ্যেই।
    যেদিন প্রথম ঋদ্ধিমা ওর বিয়ের আলমারিতে অতীনের প্যান্ট জামা গুছিয়ে তুলে রাখতে চেয়েছিল সেদিনও সবিতা দেবী বলেছিলেন, কেন বৌমা অতীনের প্যান্ট জামা আমার আলমারিতে থাকলে তোমার কি খুব অসুবিধা হচ্ছে?
    ঋদ্ধিমা সেদিনও আকাশ থেকে পড়েছিল। স্বামীর জামা প্যান্ট স্ত্রী গুছিয়ে বাগিয়ে নিজেদের আলমারিতে তুলে রাখবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এখানেও সবিতা দেবীর আপত্তি।
    সেদিন ঋদ্ধিমা মনে মনে খুব কষ্ট পেলেও এখন কিন্তু রসিকতা করে সে অতীনকে বলে, তোমার মা সেদিন আমার যে কি উপকার করে ছিল তা কি বলবো। তোমার প্যান্ট জামা মেশিনে পরিষ্কার করতে দিয়েই আমি মুক্ত। বাকিটা কিন্তু এতকাল তোমার মা সামলে এসেছেন।
    অতীন এই মাঝ বয়সে এসে বেশ বুঝতে পারে মায়ের প্রতি অতিরিক্ত ভক্তি দেখাতে গিয়ে সে ঋদ্ধিমার প্রতি অনেক অবিচার করেছে। মাঝেমধ্যেই অতীন ঋদ্ধিমাকে বলে, তোমার আমার ওপর খুব রাগ হয় তাই না?
    ঋদ্ধিমা ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি নিয়ে এসে বলে, হতো খুব রাগ হতো। কতবার ভেবেছি সব ছেড়ে ছুড়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে থাকবো। বিয়ের পর টানা একটা সপ্তাহ তুমি আমার সঙ্গে রাতে এক ঘরে কাটাও নি। তোমার মায়ের বেশিরভাগ দিনই কিছু না কিছু অসুবিধা হতো। কিন্তু যেদিন উপলব্ধি করলাম মা হতে চলেছি আমি। সেদিন আমার সব মনোযোগ তোমার কাছ থেকে সরিয়ে আমাদের সন্তানের দিকে দিতে লাগলাম।
    তারপর যখন রুচিরা এলো কোলে তখন দেখতাম তুমিও অফিস থেকে ফিরে আগে তোমার মায়ের ঘরে না গিয়ে মেয়েকে দেখার জন্য আমার ঘরে ছুটে আসতে। তোমাদের বাবা মেয়ের ভালোবাসা দেখে আমার মনটা ভরে উঠতো। সন্ধ্যা হলেই এইটুকু মেয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতো তোমার জন্য।
    তখন ভাবতাম যদি আমি তোমাদের ঘর ছেড়ে চলে যেতাম তাহলে রুচি কি তোমাকে এতটা কাছে পেত। বাবার ভালোবাসা, বাবার আদর থেকে ওকে হয়তো আমি বঞ্চিত করতাম।
    তারপর যখন রুচি ক্লাস টু-তে তোমার হার্টের অসুখটা ধরা পড়লো। তোমাকে নিয়ে আমি চেন্নাই এলাম ট্রিটমেন্ট করতে। আর এই তিনটে মাস তোমাকে আমি নতুন করে চিনলাম, জানলাম আর সর্বোপরি বুঝলাম। বুঝলাম যে তুমি মানুষটা মায়ের প্রতি বড্ড বেশি অনুগত। নিজে কষ্ট পেলেও মায়ের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারো নি কোনদিন।
    অতীনের চোখগুলো জলে ভরে ওঠে। ঋদ্ধিমা আমাকে ক্ষমা করে দিও। যৌবন কাল হচ্ছে মানুষের জীবনের সোনালী অধ্যায়। আর তোমার জীবনের সেই দিনগুলো আমি নষ্ট করে দিয়েছি। এই অনুতাপ যে আমাকে কুরে কুরে খায় অবিরত।
    ঋদ্ধিমা বলে, পুরানো কথা ভেবে কষ্ট পেও না। জানো যেদিন প্রথম তোমার হার্টের ব্লকটা ধরা পড়লো সেদিন খুব কেঁদেছিলাম ঠাকুরের কাছে। তবে আজকে আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই। ভাগ্যিস তোমার হার্টের অসুখটা হলো। তাই তোমার সঙ্গে একান্তে তিনটা মাস কাটাতে পেরেছি।
    নাইবা তুমি আমাকে দিতে পারলে শারীরিক সুখ। তুমি তো আমাকে মানসিক শান্তি দিতে পেরেছো এখন। জীবনে একটা প্রকৃত বন্ধু তো আমি পেলাম অবশেষে। যার কাছে নির্দ্বিধায় মনের সব কথা উজাড় করে দেওয়া যায়। শত চেষ্টা করেও কিন্তু তোমার মা আমাদের মনের মিলন আটকে রাখতে পারেন নি।
    এমন সময় সবিতা দেবীর আয়া মিঠু এসে বলে, বৌদি একবার চলো মাসীমার ঘরে।উনি আমার হাতে খাবেন না বলছেন।
    সবিতা দেবী মাস খানেক আগে বাথরুমে পড়ে গিয়ে কোমড় ভেঙেছেন। এখন পুরোপুরি শয্যাশায়ী। এছাড়াও বার্ধক্য জনিত নানান অসুখ ওনার শরীরে দানা বেঁধেছে।
    ঋদ্ধিমা মুচকি হাসি দিয়ে অতীনকে বলে, নিশ্চয় তোমার মা টের পেয়ে গেছে আমরা বসে বসে গল্প করছি। তাই আর সহ্য হচ্ছে না। তাই আমাকে ব্যস্ত রাখার জন্য নতুন কৌশল।
    অতীন বলে, সত্যি বাবা! মা পারেও। বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই এখন। তবুও শুয়ে শুয়ে ভেলকিবাজি দেখাতে ছাড়ে না।
    ঋদ্ধিমা সবিতা দেবীর ঘরে ঢুকে টুলটা টেনে বসলো খাবারের বাটিটা হাতে নিয়ে। তারপর এক চামচ খিচুড়ি মুখে পুরে দিয়ে বলে, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। ওষুধ খেয়ে সুস্থ হতে হবে তো আপনাকে। আপনি অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে আপনার ছেলে তো খুব কষ্ট পায়।
    সবিতা দেবী ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ ঋদ্ধিমার মুখে দিকে তাকিয়ে থাকে। ওনার চোখের কোণেও জল টলমল করছে। ধীরে ধীরে বলেন, আমার মতো বজ্জাত শাশুড়ি পেয়েও তুমি টিকে রইলে এই বাড়িতে। কত ছল চাতুরী করেছি অতীনের থেকে তোমাকে দূরে রাখার জন্য। অসম্ভব তোমার সহ্য ক্ষমতা বৌমা। তুমি যদি অতীনকে ছেড়ে চলে যেতে তাহলে আমাদের মা বেটাকে এই দুর্দিনেকে বুকে করে আগলে রাখতো বৌমা?
    ঋদ্ধিমার চোখের সামনে ভেসে উঠল সারদা মায়ের বাণী ‘যে সয় সে রয়, যে নাশ হয় সে বিনাশ হয়।’ প্রত্যেকের জীবনে পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে নিয়ে আলাদা আলাদা সমস্যা থাকে। আর সেই সমস্যা থেকে কেউ পালিয়ে গিয়ে মুক্তি খোঁজে। কেউ আবার দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যায় শেষ টুকু দেখার জন্য। ঋদ্ধিমা হচ্ছে এই দ্বিতীয় প্রকৃতির মানুষ ।

  • গল্প

    গল্প- সাধের বাগান

    সাধের বাগান
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

    -এ বাবা সকাল সাতটা বেজে গেল। আর তুমি এখনো মেন গেটের তালাটা খোলো নি।
    -আজ থেকে ঠিক করেছি নটা পর্যন্ত মেন গেটটা তালা বন্ধ রাখবো।
    -সে আবার কি কথা গো? প্রতিমা আসবে না কাজ করতে?
    -প্রতিমা তো রোজ নটার পরই কাজে আসে। সুতরাং নয়টায় মেন গেটের তালা খুললে কারোর অসুবিধা হবে না।
    -হ্যাঁ গো গেরস্থ ঘরে বেলা নটা পর্যন্ত মেন গেটে তালা ঝুলিয়ে রাখা কি ভালো কথা! কত লোকের টুকিটাকি দরকার পড়ে বলতো।
    -কার কার টুকিটাকি দরকার পড়ে বলতে পারবো না। তবে ঘোষ বৌদির তে রোজ এক ঝুড়ি করে ফুলের দরকার পড়ে তা আমি বলতে পারি।
    -ধ্যাৎ, কি যে ফালতু বকছো‌। ঘোষ বৌদি কবে আবার এক ঝুড়ি ফুল তুলে নিয়ে গেল?
    -গিন্নি তুমি যদি সংসারের চতুর্দিকে খেয়াল রাখতে তাহলে আমাকে আজ নয়টা পর্যন্ত মেন গেটে তালা মেরে রাখতে হতো না।
    তপতী চোখগুলো গোল গোল করে বলে, বাঃ বাঃ খুব ভালো বললে তো তুমি। আমি ঘরে থেকে সংসারের চতুর্দিকে খেয়াল রাখি না আর তুমি অফিসে বসে বসে সংসারের খুঁটিনাটি সমস্ত জিনিসের খেয়াল রাখো।
    এই যে গত রোববার মিউনিসিপ্যালিটির মজদুরগুলো আমাদের ত্রিশ ধামা বালি নিয়ে সরকারি ড্রেন বানানোর কাজে লাগিয়ে দিল।তা তো আমি খেয়াল করলাম বলেই তুমি বসে একথা জানতে পারলে।
    -আহা গিন্নি চটছো কেন? আমি তো তোমার ভালোর জন্যই এখনও পর্যন্ত মেন গেটটা তালা চাবি দিয়ে রেখেছি।
    তপতী বিষ্ময়ের সাথে বলে, আমার ভালো? সকাল নটা পর্যন্ত মেন গেট বন্ধ রাখলে আমার কি ভালো হবে একটু বুঝিয়ে বলবে?
    সুকান্ত বাবু বেশ বিজ্ঞের মতো বললেন, এই যে আজ এখনও পর্যন্ত গেট বন্ধ আছে। আর সেই কারণেই তুমি দুই ঝুড়ি ফুল তুলতে পারলে বাগান থেকে।
    তপতী এতক্ষণে বুঝতে পারলো কেন তার পতি দেবতা সকাল নয়টা পর্যন্ত আজ গেট বন্ধ রেখেছে।
    আসলে তপতীদের বাগানটা বড় সুন্দর।লাল, সাদা, হলুদ, গেরুয়া, গোলাপী রঙের জবা গাছের সমাহার বাগান জুড়ে। তাছাড়াও আছে ঠিকরে টগর, চাপ টগর, সাদা নয়নতারা, গোলাপী নয়নতারা, অপরাজিতা এইসব ফুল ফোটে কম বেশি সারা বছর ধরে। আর শীতের দিনে দুই তিন রকমের গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া এইসব দিয়ে দারুণ সুন্দর করে বাগানটাকে সাজিয়ে তোলে সুকান্ত বাবু।
    মাঝেমধ্যে আবার বেগুন, ঢেঁড়স, শশা, লঙ্কা, গাজর, টমেটো, ধনেপাতা এইসবও চাষ করেন বেশ। তাছাড়া আছে পেয়ারা গাছ, পেঁপে গাছ, কারিপাতার গাছ, আম গাছ।
    সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যে মেন গেট খুলে দিলেই পাড়া প্রতিবেশীরা ফুল তুলতে হাজির হয়ে যায়। পলিথিন ব্যাগ ভর্তি করে ফুল তো তুলবেই তার সঙ্গে টমেটো, বেগুন, কাঁচা লঙ্কা এইসবও টপাটপ তুলে ব্যাগে ভরে নেয়।
    সুকান্ত বাবু তো পাড়া প্রতিবেশীদের এইসব কান্ডকারখানা দেখে রেগে যান ভীষণ। রাগে গজগজ করতে করতে ওদের পিছনে বলতে থাকেন, আমি কষ্ট করে বাগান করবো আর পাড়া সুদ্ধ লোক এসে কানমুলে ফুল, সবজি সব তুলে নিয়ে যাবে।
    তপতী তখন বুঝিয়ে বলে, আহা রাগ করো কেন এতো? গাছে তো অনেক ফুল ফোটে।তাই তো ওরা তুলতে আসে। আমি যেমন ঈশ্বরের পায়ে ফুল দিয়ে থাকি ওরাই তো তাই করে। ব্যাপারটা কিন্তু একই।
    -এইসব কথা শুনে সুকান্ত বাবু আরো রেগে যেতেন। তপতীকে উদ্দেশ্য করে বলতেন, এতো ভালো মানুষি ভালো না। তোমার আশকারা পেয়েই তো ঘোষ বৌদি গেট খোলা মাত্রই ঢুকে পড়বে বাগানে। আমার তো মনে হয় ভোর থেকেই ও অপেক্ষা করে আমি কখন গেটটা খুলবো।
    এই তো গতকাল দেখি জবা ফুটেছে খুব কম। তোমার ঠাকুরের জন্য ভাবলাম আমি আগে গিয়ে ফুলগুলো তুলে রাখি। সাজিটা নিতে ঠাকুর ঘরে ঢুকেছি মাত্র তার মধ্যেই গেট খুলে ঘোষ বৌদি সোজা পৌঁছে গেছে।দশটা জবার তিনটি রেখেছে তোমার জন্য।বল কষ্ট হয় কিনা? ফুল তোলার আগে তো আমাদের কাছে একবার পারমিশন নেওয়া উচিত। কোনো ভদ্রতা বোধ নেই।
    তপতী বুঝতে পারে তার পতি দেবতা ঘোষ বৌদির ওপর চটেছে বেজায়। তবু সে বলে, হ্যাঁ গো ঘোষ বৌদির ঘরের ঠাকুর আর আমাদের ঘরের ঠাকুর সে তো এক। তাহলে অহেতুক আমরা বিভেদ কেন সৃষ্টি করছি।
    তাছাড়া ঘোষদা মানুষটা কিন্তু খুব উপকারী। মনে আছে তো আমাদের রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষার সময় উনি কত সাহায্য করেছিলেন। ওনারাও রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিত আমিও। এক হিসাবে আমরা কিন্তু গুরু ভাইবোন। আমাদের নিজেদের মধ্যে মন কষাকষি করা একদম উচিত নয়।
    সুকান্ত বাবুর যদিও তার গিন্নির উপদেশগুলো মোটেই শুনতে ভালো লাগছিল না। তবুও তিনি বললেন, গিন্নি এই বাগানটা আমার সাধের। কেউ যখন ফুল তুলতে এসে কুঁড়িগুলো কিংবা গাছের কচি ডালগুলো ভেঙে ফেলে তখন আমার খুব কষ্ট হয় সত্যি বলছি গো।
    তপতী বলে, বুঝতে পারি গো। তুমি গাছপালাগুলোকে সন্তান স্নেহে বড়ো করো। এবার থেকে তুমি নয়টার সময় মেন গেটের তালা খুলো। আমার কোনো অসুবিধা নেই।

    এরপর থেকে প্রতিদিনই তপতী লক্ষ্য করে ঘোষ বৌদিসহ আরো অনেকেই সকাল ছয়টা থেকে গেটের পাশে ঘোরাঘুরি করে কিছুক্ষণ তারপর চলে যায়। তপতীর খুব খারাপ লাগে বিষয়টা। তবু সে তার স্বামীর কথা ভেবেই গেটের তালাটা খোলো না। ঠাকুরের কাছে করজোড়ে বলে, প্রভু আমাদের ক্ষমা করো।পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে এমন ছল চাতুরী করতে হবে কোনোদিন ভাবি নি।

    সপ্তাহ খানেক পর একদিন ঘোষদা ও বৌদি এলো সন্ধ্যার দিকে তপতীদের বাড়ি। সুকান্ত বাবু সাত তাড়াতাড়ি করে গেট খুলে আন্তরিক আপ্যায়ন করলেন। তপতী চা পরিবেশন করলো পকোড়া সহ যোগে। ঘোষদা চা খেতে খেতে বললেন, একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি কিন্তু আজ আমরা।
    সুকান্ত বাবু তপতীর দিকে একটু তাকিয়ে নিল চট করে। তারপর বলে, কি অনুরোধ ঘোষদা?
    -সামনের বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন আমাদের এলাকার রামকৃষ্ণ সংঘ-তে বাঁকুড়ার প্রধান মঠের মহারাজ আসছেন সন্ধ্যার দিকে। ধরুন আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত্রি হয়ে যাবে। তাই সংঘের তরফ থেকে আমাদের সকলের মিলিত অনুরোধ যদি আপনার দোতলায় ওনার থাকার ব্যবস্থা করা যায়।
    তপতী তো প্রস্তাবটা শোনা মাত্রই ভাবে গদগদ হয়ে বলে, এতো আমাদের পরম সৌভাগ্য। মহারাজ ওনার পায়ের ধুলো আমাদের বাড়িতে দেবেন। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। আমি মহারাজের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখবো।
    যথারীতি বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন রাত আটটা নাগাদ মহারাজ সুকান্ত বাবুর দোতলায় এলেন। রাত্রি সাড়ে নটার মধ্যে রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে উনি শুয়ে পড়লেন। পরের দিন ভোর ছয়টার মধ্যে আবার উঠে পড়লেন। আসলে মঠ মিশনের মহারাজরা বেশ অনুশাসন প্রিয় হয়। ওনারা জানেন জীবন সুস্থ থাকতে গেলে নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে সবার আগে।
    যেহেতু বাড়িতে মহারাজ আছেন তাই সুকান্ত বাবু সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যেই মেন গেটের তালা খুলে দেন। তালা খোলার মিনিট পনেরোর মধ্যেই ঘোষ বৌদি ফুল তুলতে চলে আসে বাগানে। বহুদিন বাদে ফুল তুলতে এসে টপাটপ ফুল ছিঁড়ে ব্যাগ ভর্তি করতে থাকে। মনের আনন্দে ফুল তোলার পর ঘোষ বৌদি গেল দোতলায়। মহারাজকে প্রণাম করতে।
    মহারাজ খাটে বসে বসে বাগানটা দেখছিলেন আর গুনগুন করে গান গাইছিলেন, ‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে উঠ না ফুটে মন’।
    ঘোষ বৌদি দরজার পাশে যে টেবিলটা ছিল তার ওপর ফুলের ব্যাগটা রেখে মহারাজের ঘরে ঢুকলো। মহারাজকে ভক্তি ভরে প্রণাম করে ওনার পদতলে বিছানো সতরঞ্জিতে বসলো। তপতী তখন দোতলাতে ছিল।মহারাজের জন্য চা তৈরি করছিল।
    মহারাজ ঘোষ বৌদিকে উদ্দেশ্য করে বলে, মা তুমি ফুল দিয়ে ঠাকুরকে সাজাতে খুব ভালোবাসো, না?
    ঘোষ বৌদি ভক্তিতে গদগদ হয়ে বলে, হ্যাঁ মহারাজ। ঠাকুরের সিংহাসনটা ফুলে ভর্তি না হলে মনটা ভালো লাগে না।
    মহারাজ এই কথাটা শোনার পর সামান্য হেসে বলে, কিন্তু অন্যের পরিশ্রমের ফুল দিয়ে ঠাকুরের সিংহাসন সাজানো তো ঠিক কথা নয়। এতো ফাঁকিবাজি কাজ। তুমি কতটুকু পরিশ্রম করেছো ঈশ্বরের পায়ে ফুল দেওয়ার জন্য ঈশ্বর তো সেটা দেখতে পাচ্ছে। বাড়িতে যদি বাগান করার জায়গা না থাকে টবে গাছ লাগিয়ে ফুল ফোটাও। তারপর সেই ফুল ভক্তি ভরে ঈশ্বরের পায়ে নিবেদন করো। নাই বা হলো ব্যাগ ভর্তি ফুল। মেহনতের দুচারটে ফুলেই ঈশ্বর খুশি হয়ে তোমাকে অনেক আশীর্বাদ করবেন।

    মহারাজের এই কথাগুলো শুনে তপতী মনে মনে বলে, কর্তা রেগে গিয়ে এইসব কথা কতবার বলতে চেয়েছে ঘোষ বৌদিকে। আমিই বারণ করেছি সবসময়। যে সামান্য ফুল তোলা নিয়ে পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে লাভ নেই। কিন্তু ঈশ্বরের কি লীলা মহারাজের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিলেন সেসব কথা।
    তারপর থেকে ঘোষ বৌদি আর তেমন ভাবে ফুল তুলতে আসতো না তপতীদের বাগানে।যদি কখনও একান্তই দরকার পড়তো বেলার দিকে এসে তপতীদের ঘর থেকে ফুল চেয়ে নিয়ে যেত।
    মহারাজের পায়ের ধুলোতে তপতীদের বাড়িটা যেমন ধন্য হয়ে গেল ঠিক তেমন ভাবেই তপতীর পতিদেবতার সাধের বাগানটা বেঁচে গেল। এখন আর যত্রতত্র ফুলের কুঁড়ি, কচি ডাল পালা এইসব ভেঙে পড়ে থাকতে দেখা যায় না।

  • গল্প

    গল্প- বেড রেস্ট

    বেড রেস্ট
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    গরম দুধের গ্লাসটা হাতে ধরে চুপচাপ বসে রইল দিতি। বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে তার শাশুড়ি মা অপর্ণা দেবীর বাক্যবানগুলো।
    খুব সম্ভবত দিনটা ছিল রবিবার। সারাদিন রাজীব বাড়িতে আছে। সকালে একবার বাজারে যাওয়া ছাড়া আর বিশেষ কোনো কাজ সে করে নি। আর রবিবার মানেই সকালের জলখাবার থেকে শুরু করে রাতের ডিনার অবধি কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া। দিতি সকাল সাড়ে ছয়টাতে রান্নাঘরে ঢুকেছে তো ঢুকেছে। একটার পর একটা কাজ করে দুপুরে খাওয়ার টেবিলে খেতে বসে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।
    স্বামী ও শ্বশুর মশাই-এর খাওয়া দাওয়া শেষ হলে দিতি ও তার শাশুড়ি মা খেতে বসেছিল।দিতি খুব স্বাভাবিক ভাবেই রাজীবকে বলে, শুনছো তুমি বাবার আর তোমার এঁটো থালা বাটিটা তুলে নিয়ে গিয়ে গামলাতে রেখে দাও।
    দিতির এই কথা শুনে অপর্ণা দেবী বাজখাঁই গলায় বলে উঠেছিল, খবরদার না। রাজীব তুই কোনো এঁটো বাসন তুলতে যাবি না। আমাদের বাড়ির পুরুষ মানুষেরা খাবার খেয়ে থালা বাসন তোলে না।
    তোমার বাবার বাড়িতে ছেলেদের এঁটো থালা বাসন তোলার রীতি থাকতে পারে। কিন্তু আমার বাড়িতে এইসব নিয়ম কানুন লাগু করতে এসো না। ভুলে যেও না সংসারটা এখনও আমার।
    দিতি তো হতবাক তার শাশুড়ির এমন ধারার কথা শুনে। তার অতি সাধারণ কথার কি সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া। আর সব থেকে বেশি অবাক হয়েছিল সেদিন রাজীবকে দেখে। মুখ দিয়ে একটি বাক্য খরচ না করে চুপচাপ ডাইনিং রুম থেকে সোজা বেডরুমে চলে গিয়েছিল। তবে সেদিন দিতির শ্বশুর মশাই বরঞ্চ মৃদু স্বরে মিউমিউ করে বলে ছিল, থাক না গিন্নি। মেয়েটা সারাদিনের খাটাখাটনির পর খেতে বসেছে। এত কড়া কড়া কথা না বললেই চলে।

    অপর্ণা দেবী সেদিন এমন কটমট করে রাজীবের বাবা দুলাল বাবুর দিকে তাকিয়েছিল। মনে হচ্ছিল পারলে কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়ে নেয় তাকে। শুধু তাচ্ছিল্য ভরে বলেছিল, বৌমাকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে সংসারটা চালাতে হবে। আমার সংসার কিভাবে সুষ্ঠভাবে চালাবো আমি তা তোমাকে বলে দিতে হবে না। খাওয়া দাওয়া যখন হয়ে গেছে এখানে বসে না থেকে ঘরে গিয়ে পিঠ পেতে আরাম করো।

    সেদিন দিতি চোখের জল মুছতে মুছতে কোনো রকমে ভাত খেয়েছিল। খাসির মাংসটাও আলুনি লাগছিল। রান্নাঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে যখন ঘরে এসেছিল তখন দেখে রাজীব পাশবালিশে পা তুলে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। দু’চার কথা শোনাবে ভেবেছিল। কিন্তু আর বলা হয় নি তার অভিমানের কথা।

    দিতির বিয়ের বছর খানেক পর রাজীব পেয়েছিল স্কুলের চাকরিটা। ঠিক বিবাহ বার্ষিকীর দিনেই নিয়োগ পত্রখানি হাতে পেয়েছিল রাজীব। সেদিন সবাই বলেছিল, দিতির পয়ে তেই রাজীব চাকরিটা পেল।দিতির বাপের বাড়ি থেকে ওর বাবা, মা, দাদা বৌদি সবাই এসেছিল ঐদিন। দিতির বাবা এই খুশির খবরটা শুনে বলেছিল, বেয়াই মশাই রাজীবের স্কুলটা কিন্তু আপনাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে হয়ে গেল। রোজ আসা যাওয়া করলে রাজীবেরই কষ্ট হবে বেশি। তার চেয়ে ভালো রাজীব স্কুলের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া করুক।
    অপর্ণা দেবী ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলেছিল, বেয়াই মশাই আপনাকে এত ভাবতে হবে না আমার ছেলেকে নিয়ে। আমার ছেলের ভাবনা একান্তই আমাদের।
    দিতির বাবা সেই দিন অবাক হয়ে গিয়েছিল অপর্ণা দেবীর এইরকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা শুনে। আর সেই দিনের পর থেকে দিতির বাবা দিতি ও রাজীবের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতো না। দিতির শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় উনি বলেছিলেন, মা রে তোদের ভালো মন্দ ভাবার অধিকার টুকুও রইলো না আমার।
    দিতির চোখ দিয়ে গড়িয়ে এসেছিল তপ্ত অশ্রু ধারা। অশ্রু ভারাক্রান্ত গলায় বলেছিল, বাবা সবই আমার কপাল। এমন ঘর, বর তোমরা আমার জন্য ঠিক করলে যে আমাকে সারা জীবন মাথা নিচু করে থাকতে হবে। শুধু শ্বশুর, শাশুড়ি খারাপ হলেও স্বামীর ভালোবাসা পেয়ে সব কিছু ভুলে যাওয়া যায়। কিন্তু তোমাদের জামাই-এর কাছে তার মা বাবা দেবতূল্য। মায়ের কোনো অন্যায় ওর চোখে পড়ে না।

    এইসব কথা ভাবতে ভাবতে আবার চোখটা ভিজে উঠলো। চোখের জলটা না মুছেই দিতি ওর পেটে হাত বুলাতে লাগলো আস্তে আস্তে। এখন সে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। নানা রকমের কম্প্লিকেশন থাকার জন্য দু’ দুবার মিস ক্যারেজও হয়ে গেছে।
    এইবার ডাক্তার বলেছেন, সম্পূর্ণ বেড রেস্ট দরকার দিতির। বিছানা থেকে ওঠা একদম নিষেধ। কোনো রকমে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে স্নানটা করছে সে। তাও নিজে নয়। রাজীব স্কুলে বের হবার আগে দিতিকে স্নান করিয়ে দিয়ে যায় রোজ। তারপর নিজে হাতে টিফিন খাইয়ে নটার মধ্যে স্কুলে বেরিয়ে পড়ে। দুপুরে বিছানায় কোনো রকমে বসে ভাতটা খায়। অপর্ণা দেবীই দুপুরের খাবারটা খাইয়ে দেন। তারপর একটা ছোট বালতিতে মুখ হাত ধুইয়ে দেন দিতির। প্রথম দিন দিতি কিছুতেই পারছিল না মুখের কুলকুচির জল বালতিতে ফেলতে। অপর্ণা দেবীই বলেছিলেন, বৌমা কোনো অসুবিধা নেই আমার। তুমি নিশ্চিন্তে কুলকুচি করতে পারো। তোমাকে এখন ডাক্তারের কথা মতো চলতে হবে যে।

    এইসব পুরানো কথা ভাবতে ভাবতে দুধের গ্লাসটার কথা ভুলেই গিয়েছে দিতি। তার মায়ের গলার আওয়াজে স্তম্ভিত ফিরে এলো, কি রে এখনও দুধ টা শেষ করিস নি?

    দিতি ওর মায়ের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে বলে, মা একটা কথা সবসময় মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুতেই সঠিক উত্তরটা পাচ্ছি না।
    দিতির মা অনুভা বলে, কি কথা রে?
    -এই যে আমার স্বামী, শাশুড়ি সবাই এতো খেয়াল রাখছে আমার আজকাল। এর তো একটাই কারণ আমি ওদেরকে বংশধর দেবো ।তাই না?
    অনুভা মোটা দাঁড়ার চিরুনি দিয়ে দিতির চুলটা আঁচড়ে দিতে দিতে বলে, সব কিছুর পিছনে রহস্য খুঁজতে যাস না দিতি। রাজীব আজ তোর যে খেয়াল রাখছে তা শুধুই কি কর্তব্য এর মধ্যে ভালোবাসা নেই বলতে চাইছিস?
    একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিতি বলে, সেটাই তো বোঝার চেষ্টা করছি মা। রাজীব আজ পর্যন্ত কোনদিন শব্দে প্রকাশ করে নি ওর ভালোবাসা।
    -যতদিন যাবে ঠিক বুঝতে পারবি তুই। রাজীবের ভালোবাসার ধরণটা হয়তো তোর সাথে মেলে না। তাই বলে সে ভালোবাসতে জানে না সে কথা বলা উচিত নয়। রাজীব যে ভাবে তোকে বুকে আগলে রেখেছে তা আমার কল্পনার অতীত।
    চাইলেই রাজীব এবং তোর শাশুড়ি কিন্তু তোকে আমাদের ওখানে পাঠাতে পারতো।আমি তো অনেক বার অনুরোধ করে বলেছিলাম, দিতিকে আমরা নিয়ে যাই। তখন তোর শাশুড়ি বলেছে, না বেয়ান। সেটি হবার জো নেই। রাজীব বলে দিয়েছে, আমার বউ আমাদের কাছেই থাকবে। আর এইখানেই ডেলিভারি হবে। যা সেবা শুশ্রূষা করার দরকার পড়বে আমরাই করবো।
    একটু থেমে অনুভা বলে, এরপরও তুই বলবি রাজীব তোকে ভালোবাসে কিনা তুই ঠিক বুঝতে পারছিস না?
    দিতি ওর মায়ের কথাগুলো শুনে, ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। তারপর বালিশে মাথাটা দিয়ে তার মাকে বলে, বাবাকে বলো আমার জন্য তার আর দুঃশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই।

  • গল্প

    গল্প- ঘোর কলিকাল

    ঘোর কলিকাল
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

    প্রভাত মাস্টারিটা পাওয়ার পর থেকেই তার স্কুল, ছাত্রছাত্রী এইসব হয়েছে ধ্যান জ্ঞান। একেবারে সঠিক সময়ে প্রার্থনা বসার আগেই সে হাজির হয়ে যায় স্কুলে। যদিও তার জন্য তাকে সকাল আটটার মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে হয়।
    প্রভাতের মা রমা দেবীকে তাই ভোরে উঠেই রান্না চড়াতে হয়। যদিও রমা দেবীর এতে কোনো অসুবিধা হয় না। ভোর ভোর রান্না করার অভ্যাসটা তার গড়ে উঠেছে বিয়ের পর থেকেই। প্রভাতের বাবা বিমল বাবুও ছিলেন অঙ্কের শিক্ষক। ওনার’ও স্কুল তাদের বাড়ি থেকে অনেকখানি দূরত্বে ছিল।
    ছোট থেকেই প্রভাত শুনে আসছে স্কুলের খাতা দেখার নিয়ম কানুন, কেউ নকল করলে তার কি শাস্তি হয় এইসব।
    রমা দেবীও সবসময় ছেলেদের শেখাতেন ‘অন্যায় যে করে, অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে।’
    রীতিমত একটা সৎ ও আদর্শ পরিবারে বড়ো হয়ে উঠেছে প্রভাত। যদিও তার চাকরির সময়কালে পারিপার্শিক আদর্শ, সততা এইসব চারিত্রিক গুণাবলীগুলো অনেক কমে গিয়েছে। তবুও প্রভাত নিজের মতো করে সৎ থাকার চেষ্টা করে এবং একজন সুশিক্ষকের আদর্শ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তুলে ধরার চেষ্টা করে।

    কিন্তু দুই তিন দিন আগে হঠাৎ জনা দশেক বিক্ষুব্ধ গার্জেন দলগত ভাবে স্কুলে এসে হাজির। প্রধান শিক্ষক মহাশয় চেয়ার ছেড়ে ছুটে আসতে বাধ্য হন গার্জেনদেরকে শান্ত করার জন্য। কিন্তু গার্জেনদের একটাই বুলি, ‘প্রভাত স্যারের বদলী চাই।’

    প্রভাত তখন নাইনের পরীক্ষার রুমে গার্ড দিচ্ছিল। বেয়ারা সুনীল হাঁপাতে হাঁপাতে এসে প্রভাতের কানে কানে বলে, স্যার খুব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন কিন্তু। গার্জেনরা একদম মার মুখী হয়ে রয়েছে। হেড স্যার ব্যাপারটা সামলানোর চেষ্টা করছেন। জানি না কতদূর কি করতে পারবেন। আপনি কিন্তু ভুলেও নীচে নামবেন না এখন।
    প্রভাতও অবাক। সে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না তার অন্যায়টা কি? সুনীল চলে যাওয়ার পর প্রভাত পুনরায় নাইনের ক্লাসরুমে ঢুকে চেয়ারটা টেনে খুব ধীরে ধীরে বসলো।

    নীচে থেকে ক্ষুব্ধ অভিভাবকদের চিৎকার চেঁচামেচির মাত্রা লাগাম ছাড়া হলে প্রধান শিক্ষক মহাশয় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য লোকাল থানায় ফোন করে। মিনিট কুড়ির মধ্যে একজন অফিসার আর দুজন কনস্টেবল এসে হাজির বড়বেলুন হাইস্কুল প্রাঙ্গনে।

    পুলিশকে দেখা মাত্রই গার্জেনরা অভিযোগের সুরে বলে, প্রভাত স্যারের যোগ্য শাস্তি চাই।বদলী চাই।
    পুলিশ অফিসার রীতিমত ধমকের সুরে বলে, আমি সকলের অভিযোগ শুনবো কিন্তু একে একে। দয়াকরে আপনারা চিৎকার চেঁচামেচি বন্ধ করুন আগে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন আজও পরীক্ষা চলছে ছাত্রছাত্রীদের। এরমধ্যে আপনারা যে হট্টগোল করছেন তার জন্য কিন্তু আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

    পুলিশ অফিসারের কাছে ধমক খেয়ে উত্তেজিত গার্জেনরা কিছুটা সংযত হলো। পুলিশ অফিসার বলেন, কি কারণে প্রভাত স্যারের বদলী চাইছেন তা আমাকে একজন বলবেন বিস্তারিত ভাবে।

    একজন গার্জেন কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো, স্যার এই প্রভাত মাস্টারের জন্য আমার মেয়েটা সুইসাইড করতে গিয়েছিল।
    চমকে উঠলেন অফিসার এবং প্রধান শিক্ষক মহাশয়। অফিসার রাশভারি গলায় বলেন, কেন?
    -গতকাল আমার মেয়ের পরীক্ষার খাতা কেড়ে নিয়েছে প্রভাত স্যার।

    প্রধান শিক্ষক মহাশয় তাড়াতাড়ি বলেন, ওওওও ইলেভেন বি- এর কেসটা।

    অফিসার প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে থামিয়ে দিয়ে বলে, স্যার আগে ওনার কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা শুনে নিই। তারপর আপনার কাছে আসছি।
    -তা প্রভাত স্যার কেন আপনার মেয়ের পরীক্ষার খাতা কেড়ে নিয়েছিল?
    অভিভাবকটি বলে ওঠেন, স্যার সে কথা কিছু মেয়ে লিখে রাখে নি চিঠিতে। এই বলে পকেট থেকে সুইসাইড নোটটা বের করে পুলিশ অফিসারকে দেখালো।

    সুইসাইড নোটে লেখা আছে, প্রভাত স্যারের জন্য আমি স্কুলে কারোর কাছে মুখ দেখাতে পারবো না। খাতাটা কেড়ে নিয়ে স্যার আমার চরম ক্ষতি করলেন। তাই আমি ধানের কীটনাশক খেতে বাধ্য হচ্ছি।

    পুলিশ অফিসার চিঠিটা একজন কনস্টেবলের হাতে দিয়ে প্রধান শিক্ষক মহাশয়কে বললেন, আমি প্রভাত স্যারের সাথে কথা বলতে চাই। উনি কি আজ স্কুলে উপস্থিত আছেন?

    বেয়ারা সুনীল ছুটতে ছুটতে গিয়ে ডেকে আনে প্রভাতকে। প্রভাত অন্য একজন শিক্ষকের দায়িত্বে ছেড়ে আসে নাইন ক্লাসের পরীক্ষাটা।

    প্রভাতকে দেখা মাত্রই অভিভাবকরা মারমুখী হয়ে ওঠে। যদিও পুলিশ অফিসারের রক্ত চক্ষু দেখে তারা চুপ হয়ে যায়।

    অফিসার প্রভাত স্যারের উদ্দেশ্যে বলে, স্যার আপনি আমাকে বলুন তো গতকাল সুলতা নামের মেয়েটি ঠিক কি কান্ড করেছিল পরীক্ষার হলে।
    প্রভাত বলে, আমি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলাম সুলতা ওর শাড়ির আঁচলটা বারবার ওলোটপালট করছে। আমি কাছে এলেই শান্ত হয়ে যাচ্ছে। আমিও ওঁত পেতে ছিলাম ।যখনি টুকলিটা বের করবে আমি ঝপ করে ধরবো।

    একদম পরীক্ষা তখন শেষের দিকে সুলতা যেই টুকলিটা আঁচলের নিচে থেকে বের করে দেখে লিখতে শুরু করে আমি গিয়ে চেপে ধরি ওর খাতাটা। ও তো ভয় পেয়ে যায় প্রথমে। টুকলিটা আমার কাছে জমা করার কথা বলা মাত্রই সুলতা ওর টুকলিটা ব্লাউজের ভেতর চালান করে দেয়। আমি তখন বাধ্য হয়ে নমিতা ম্যাডামকে তল্লাশি করতে বলি। ম্যাডাম বাথরুমে নিয়ে গিয়ে টুকলিটা বের করে।
    তারপর হেড স্যারের কাছে সুলতাকে নিয়ে যাই আমরা। হেড স্যার সুলতার ইতিহাস পরীক্ষার খাতা বাতিল করে দেয়।

    পুলিশ অফিসার সব শুনে সুলতার বাবার উদ্দেশ্যে বললেন, কি মশাই আপনার মেয়ের সুইসাইড করার আসল কারণটা জানতে পারলেন তো।

    সুলতার বাবা কাঁদতে কাঁদতে পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলে, স্যার মেয়েটা হসপিটালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে শুধু মাত্র এই প্রভাত স্যারের জন্য। স্যার এতটা কঠোর ব্যবস্থা না নিলেও পারতেন। এখন যদি আমার মেয়েটার কিছু হয়ে যায় তখন আমি কি করবো স্যার?

    অন্য অভিভাবকরা বলে ওঠে, এমন কড়া টিচার আমাদের গ্ৰামের স্কুলে দরকার নেই। আমরা সবাই খেটে খাওয়া মানুষ। চিকিৎসার পিছনে এতো পয়সা খরচা করতে পারবো না। তার থেকে প্রভাত বাবুকে আমাদের স্কুল থেকে বদলী করিয়ে দেওয়া হোক।

    প্রধান শিক্ষক ও পুলিশ অফিসার বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ফিরে এলেন গার্জেনদের মধ্যে। প্রধান শিক্ষক মহাশয় সুলতার বাবার উদ্দেশ্যে বললেন, আপনার মেয়ের হসপিটালে চিকিৎসা বাবদ যা খরচ হয়েছে তার সবটাই দেবে প্রভাত স্যার এবং যত দিন না আপনার মেয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে ততদিন বিকালের ভিজিটিং ওয়ারে আপনার মেয়েকে দেখতে যাবেন প্রভাত স্যার।
    দেখুন প্রভাত বাবুর মতো শিক্ষক অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গেলে আমাদের স্কুলেরই ক্ষতি হবে।
    অহেতুক আপনারা আর ঝুট ঝামেলা না বাড়িয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিন।

    সমবেত অভিভাবকের দল নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে জানায়, পুলিশ অফিসার আর প্রধান শিক্ষকের জন্যই তারা প্রভাত স্যারকে ক্ষমা করে দিল।
    অভিভাবকের দল চলে গেলে, প্রধান শিক্ষক মহাশয় প্রভাতের কাঁধে হাত রেখে বলে, এ ঘোর কলি বৎস। এখানে জীবন আদর্শের অন্য পাঠ চলে। যেখানে দেখিবে অন্যায়, মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া উপায় আর নাই।
    প্রভাত বাড়িতে ফিরে তার মা বাবাকে সুলতার টুকলি সংক্রান্ত সমস্ত ঘটনা খুলে বলে। বিমল বাবু সব শুনে বলে, কিছু বোধ বুদ্ধিহীন অভিভাবকদের জন্য আজ শিক্ষা ব্যবস্থার এই অধঃপতন। টুকলি করলে শাস্তি দেওয়া যাবে না, ক্লাস রুমে লাঠির ব্যবহার নিষিদ্ধ। এখন না আছে গুরুর শাসন না আছে আগেকার মতো গুরুদের ভালোবাসা। শিক্ষক আর ছাত্রের মধ্যেও এখন give and take policy. এই কঠিন সময়ে তুই যখন শিক্ষকতার পেশাটাই বেছে নিয়েছিস তখন তোকে একটা কথাই বলবো, ‘যেমন কলি তেমন চলি’ এই প্রবাদকে নীতিবাক্য হিসাবে মেনে নিতে শেখ বাবা। না হলেই আরো অনেক সুলতার মতো অপ্রীতিকর ঘটনার সাক্ষী তোকে হতে হবে।

You cannot copy content of this page