• গল্প

    গল্প- প্রীতিভোজ

    প্রীতিভোজ
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

     

    এই ধরুন গিয়ে আপনারা যেসব মেনু চাইছেন তাতে প্লেট পিছু আটশো টাকা মিনিমাম পড়বে।
    টাকার অঙ্কটা শুনে মোহিত সন্তোষ ক্যাটারের উদ্দেশ্যে বলে, না না প্লেটের রেটটা একটু বেশি মনে হচ্ছে।
    সন্তোষ ক্যাটারার বলে- খাসীর মাংস, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, ইলিশ ভাপা আর আলু পোস্ত এইগুলোর জন্য কাঁচামালটা কিনতেই বাজেটটা বেশি পড়ে যায়। তাহলে এক কাজ করুন আলু পোস্তটা বাদ দিয়ে দিন।
    পাশেই ছিল মোহিতের ঠাকুমা বীনা দেবী। বৃদ্ধা তাড়াতাড়ি করে হাত নেড়ে বলে, ভুলেও মুখে এনো না আলু পোস্ত বাদ দেওয়ার কথাটা। আমরা হলাম গিয়ে বর্ধমানের আগুড়ি। আমাদের বাড়ির যে কোনো অনুষ্ঠানে আলু পোস্ত হবেই।
    মোহিত মুচকি হাসি দিয়ে বলে, ঠিক আছে ঠাকুমা তাই হবে। তোমার নাতির বিয়েতে তুমি আলু পোস্ত খাবে না তাই হয় না কি!
    ‌এতক্ষণ একটা প্ল্যাস্টিক চেয়ারে বসে খাতা পেন নিয়ে নিমন্ত্রিত অতিথিদের একটা লিস্ট বানাচ্ছিলেন মোহিতের বাবা প্রবীর বাবু। উনি গম্ভীর স্বরে মোহিতের ঠাকুমার উদ্দেশ্যে বললেন, মা এবার মনোযোগ দিয়ে লিস্টটা শোনো। দেখো তো কোনো আত্মীয় স্বজন বা পাড়া প্রতিবেশী বাদ পড়ে গেল নাকি।
    ‌বীনা দেবী মন দিয়ে শুনে চলেছেন ছেলের তৈরী নিমন্ত্রিত অতিথিদের নাম।লালু, ভোলা, দুলু, অয়ন, গোপাল, ভজু এইসব নাম শুনে চমকে উঠে বললেন, ওরে খোকা এরা কারা? এরা কি আমার দাদুভাই এর বন্ধুরা?
    ‌প্রবীর বাবু বললেন, তোমার নাতি যে দেড়শোটা নামের লিস্ট দিয়েছে তাদেরই নাম পড়ছি।
    ‌বীনা দেবী কৌতুহল ভরে জিজ্ঞাসা করে মোহিতকে, হ্যাঁ দাদু ভাই তোমার অফিস তো দিল্লিতে। সেখান থেকে কি দেড়শো বন্ধু বান্ধব আসছে? আমি যতদূর জানি পাড়াতে তোমার বন্ধুবান্ধব বেশি নেই।
    ‌মোহিত বলে, এই দেড়শো জন আমার ঠিক বন্ধু নয়। তবে এদেরকে খাওয়ানোর খুব ইচ্ছা আমার আছে।
    ‌প্রবীর বাবু বলে সে তো ভালো কথা। কিন্তু এদের পরিচয়গুলো আমাদেরকে একটু দাও।
    ‌মোহিত একটু আমতা আমতা করে বলে, এরা হচ্ছে সকলেই ‘আশ্রয়’ এর সদস্য।
    ‌বীনা দেবী নামটা শুনে চমকে উঠলেন। ওনার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা লম্বা বিল্ডিং এর ছবি। গত বছর পূজার সময় মোহিত আর তার মা সুনন্দা গিয়ে ছিল নতুন জামা কাপড় নিয়ে। পরেরদিন খবরের কাগজে বেরিয়েছিল খুব ছোট্ট করে এই খবরটা। বীনা দেবী কাঁচি দিয়ে কেটে রেখেছিল আশ্রয় অনাথ আশ্রমের ছবিটা।আর আঠা দিয়ে সযত্নে চিটিয়ে রেখেছে ওনার পুরানো পেপার কাটিং এর অ্যালবামে।
    ‌আজ নাতির কথা শুনে চোখের সামনে ভেসে উঠলো আশ্রয় নামক অনাথ আশ্রমের ছবিটা। বীনা দেবী তার ফোকলা দাঁতে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, এতো খুব ভালো সিদ্ধান্ত দাদু ভাই। তুমি অনাথ ছেলে মেয়েদেরকে খাওয়াতে চাও। কিন্তু আমাদের অন্যান্য আমন্ত্রিত অতিথিদের মাঝে ওদেরকে খাওয়ানো যাবে তো?
    ‌মোহিত বলে, এই জন্য আমি একটা প্ল্যান ভেবেছি। তোমরা যদি শুনতে চাও তাহলে খুলে বলতে পারি।
    ‌বীনা দেবী বলে, তুমি নির্ভয়ে ও নিশ্চিন্তে বলতে পারো। তোমার বাবা কিচ্ছুটি বলবে না।
    ‌মোহিত প্রবীর বাবুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, আমি ভাবছিলাম আমাদের পারিবারিক আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য প্যাকেটের ব্যবস্থা করা হোক।
    ‌প্রবীর বাবু ভ্রু কুঁচকে বলে, সে আবার কি কথা। আমন্ত্রিত অতিথিদের পাত পেড়ে না খাইয়ে হাতে খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দেবো। আশ্চর্য কথা!
    ‌মোহিত তার বাবার কথার উত্তর না দিয়ে উঠে যায়। এই দেখে প্রবীর বাবু আরো রেগে যান। বীনা দেবীর উদ্দেশ্যে বলে, তোমার প্রশয়ে কিন্তু ছেলেটা এমন মেজাজী হচ্ছে দিনদিন। দেখলে কেমন করে উঠে চলে গেল।
    ‌প্রবীর বাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই মোহিত ফিরে আসে। হাতে একটা পুরানো অ্যালবাম। প্রবীর বাবুর পাশে এসে বসে। তারপর বেশ কতগুলো পাতা উল্টে একটা ছবি বের করে। ছবিটাতে দেখা যায় প্রবীর বাবুর বোন, ভগ্নিপতি ও তাদের ছেলে মেয়েকে। খুব সম্ভবত ছবিটা প্রবীর বাবুর ভাইয়ের বিয়ের। ওরা চারজনে একটা টেবিলে খাচ্ছে। মাঝখানে যে নোংরা ফেলার বাটিটা আছে তা পুরোপুরি ভরে আছে খাবারে।
    ‌মোহিত ওর বাবাকে বলে, দেখছো বাবা পিসিমনিরা কিভাবে খাবার নষ্ট করছে। এই ছবিটাতে শুধু পিসিমনিদের দেখতে পাচ্ছি। এইরকম খাবার নষ্ট কিন্তু আমরা প্রতিটা টেবিলেই কম বেশি দেখতে পাই।
    ‌প্রবীর বাবু বলে, সে আর কি করা যাবে। অনুষ্ঠান বাড়িতে তো খাবার দাবার একটু নষ্ট হবেই।
    ‌মোহিত খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে, এতো খাবার কেন নষ্ট হয় জানো? আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত মেনুর ব্যবস্থা করি। একবারে বসে খুব কম মানুষ আজকাল দশ রকমের পদ খেতে পারে। কিন্তু নানা রকম পদের ব্যবস্থা থাকার কারণে সব পদগুলোর স্বাদ আস্বাদন করতে গিয়ে আমরা একটু একটু করে টেস্ট করে বাকি খাবারগুলো ফেলে দিই। একবার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো বাবা আমরা অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে কত খাবার নষ্ট করি এই দুর্মূল্যের বাজারে। কিন্তু তুমি যদি আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য সামান্য স্টার্টাড এর আয়োজন করো। তাহলে তারা গল্প করতে করতে সামান্য খাবারটুকু খেয়ে নিতে পারবে। আর তারা যখন বাড়ি ফিরে যাবে তাদের হাতে তুলে দেবো খাবারের প্যাকেট খানা। তারা বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাদের পেটের চাহিদা মতো আরাম করে বসে খাবে। এতে খাবার নষ্ট অনেকখানি কম হবে। আর অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের আমরা প্যান্ডেলে চেয়ার টেবিলে বসিয়ে পাত পেড়ে খাওয়াতে পারবো যথেষ্ট সময় ধরে।
    ‌প্রবীর বাবুর খুব একটা মন্দ লাগে না মোহিতের প্রস্তাবটা। বীনা দেবী এবং মোহিতের মা’ও বিষয়টাকে সমর্থন করে।প্রবীর বাবু সন্তোষ ক্যাটারারকে বলে, শুনলেন তো ছেলের প্রস্তাবটা।
    ‌তাহলে আপনি অতিথিদের জন্য দু’ তিন রকমের স্টার্টাড রাখুন। সঙ্গে চা, কফি, ককটেল মকটেল যা যা আছে তার ব্যবস্থা করুন। আর দুশো প্যাকেট মেন কোর্স থালির আয়োজন করুন। আর দেড়শো প্লেটের খাবার এখানে বসে খাবে তার ব্যবস্থা করুন।
    ‌সন্তোষ ক্যাটারার সব শুনে বলে, এই রকম ধরনের বিয়ে বাড়ির আয়োজন আমি প্রথম পেলাম। তবে চিন্তা ভাবনাটা কিন্তু ভীষণ যুগোপযোগী। আজকের দিনে আমাদের প্রত্যেকের খেয়াল রাখা দরকার যেন খাবার দাবার নষ্ট না হয়। আমাদের আনন্দ ফুর্তির মাঝে খানে অবশ্যই মনে করা দরকার সেই সব নিরন্ন মানুষের কথা। যারা দুবেলা পেটপুরে খেতে পায় না আজও। অনাথ শিশুদের পাশে বিভিন্ন সমাজ সেবী সংগঠনগুলো এগিয়ে এসেছে বলেই তারা দুবেলা দুমুঠো খেতে পায়। তবে মাটন, বিরিয়ানি, ইলিশ এইসব দৈবাৎ জোটে তাদের কপালে।
    ‌প্রবীর বাবুকে অনুনয়ের সুরে সন্তোষ ক্যাটারার বলে, আমারও বড় শখ হচ্ছে আপনার ছেলের মতো অনাথ শিশুদের খাওয়াতে। আসলে সৎ সঙ্গ, সৎ কর্ম এইসবও কিন্তু বেশ ছোঁয়াচে বুঝতে পারছি। আপনার ছেলের বিয়ের প্রীতিভোজের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা অনেক দিন আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরা মনে রাখবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

  • গল্প

    গল্প- বিজ্ঞাপনের বয়ান

    বিজ্ঞাপনের বয়ান
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    হঠাৎ পূর্বদিকের আকাশখানি ঢেকে গেল কালো মেঘে। ছাদে জামা কাপড় তুলতে গিয়ে পূবের পানে চেয়ে রইল স্তব্ধ নয়নে অহনা। চৈত্র মাস শেষ হতে দেরি আছে । তবুও আজকাল বিকালের দিকে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে তুমুল। এই ঝড়বৃষ্টিকে কালবৈশাখী বলছে কিনা আবহাওয়া দপ্তর তা টিভিতে কিংবা ইনটারনেট থেকে জানা হয় নি অহনার। তবে দামাল হাওয়া যেমন এলোমেলো করে দিচ্ছে বাইরের প্রকৃতিকে ঠিক তেমনি একটা ঝড় উঠেছে অহনার অন্তঃপুরে।

    প্রায় দশ বারো বছর ধরে যে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে গড়ে তুলেছিল তার প্রেম কাহিনী তা বোধহয় এবার আছড়ে পড়তে চলেছে কঠিন বাস্তবের মাটিতে। ঝড় বোধহয় উঠলো। তাই তাড়াতাড়ি কাপড় জামাগুলো জড়ো করে ছাদের লোহার কালো গেটটা দরাম করে বন্ধ করে দিয়ে নীচে নেমে এলো অহনা।

    ইতিমধ্যে অহনার মা সোমা হন্তদন্ত হয়ে এঘর ওঘর ছোটাছুটি করে জানালাগুলো বন্ধ করছে। অহনাকে দেখা মাত্রই বিরক্তির সুরে বলে, তুই কখন গিয়েছিস ছাদে জামা কাপড় তুলতে বল তো? দেখছিস ঝড় উঠেছে তাড়াতাড়ি নেমে আসবি তো।

    অহনা ঠিক কলের পুতুলটির মতো জামাকাপড়গুলো সোফায় রেখে জানালা বন্ধ করতে লাগলো। অন্যমনষ্কতার জন্য জানালর কিনারায় আঙুলটা পড়ে যাওয়ায় উঃ করে চিৎকার করে উঠলে সোমা ছুটে এসে বলে, কি যে করছিস না তুই! আরে বাবা আজকাল তো ব্রেক আপ কতজনের হচ্ছে। কিন্তু তোর মতো বোধহয় এতো উতলা কেউ হয় না। আরে বাবা কি করবি বল? অর্জুন তো নিজেই তোর শর্ত মানতে রাজি হচ্ছে না। সেখানে তোর কি কিছু করার আছে?

    ‌অহনা যে অর্জুনের ওপর রাগে ফুঁসছে তা তার ফোলা নাকের ডগা দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে। মায়ের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ফ্রিজার থেকে বরফের ট্রে-টা বের করে কয়েকটা বরফের টুকরো বের করে অনামিকাতে টিপে ধরলো। বেশ বদ রক্ত জমেছে মনে হচ্ছে।
    ‌এই ক’দিন আগে পর্যন্ত অহনা অনামিকার দিকে তাকিয়ে ভাবতো 6.5mm এর হীরের আংটিটার কথা। যেটা অর্জুন ওর জন্য কিনে রেখেছে।

    ‌কিন্তু সেই কাঙ্খিত হীরের আংটিখানা ও ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা বোধ করে নি অহনা সেদিন। তা হবে দিন চার আগের কথা। অহনাকে নিয়ে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে গিয়েছিল অর্জুন। অহনা ভীষণ রকমের এক্সসাইটেড ছিল এই প্রতীক্ষিত ডিনার নিয়ে।

    ‌এতকাল অহনা অর্জুনের সঙ্গে দেখা করেছে দামোদর ব্যারেজে বা কখনো ট্রয়োকা পার্কে। আর খুব বেশি হলে আইনক্সে গিয়েছে। আর যখন স্কুলে পড়তো তখন তো জল খাওয়া কিংবা বাথরুম যাওয়ার নাম করে টিচারদের চোখ এড়িয়ে সিঁড়ির নীচে বা কখনো পার্কিং এড়িয়াতে দেখা করতো।

    ‌অহনা আর অর্জুন এক ক্লাসের ছোট বড়। অহনা তখন সেভেন আর অর্জুন ক্লাস এইটে। সাদা জামা আর নীল স্কার্ট, পায়ে কালো নিউপোর্ট জুতো, লাল ফিতে দিয়ে লম্বা দুটো মোটা মোটা বিনুনি। মাঝে মধ্যে ঠোঁটে লিপগ্লস আর একটু পারফিউম। ক্লাস সেভেনেই বেশ ডেভলপ চেহারা ছিল অহনার। তার ওপর সুন্দর মুখশ্রী যা দেখে স্কুলের ছেলেদের প্রেম নিবেদনের লম্বা লাইন থাকতো অহনার পিছনে। তবে কিশোরী অহনা কাউকে পাত্তা দেওয়ার মেয়ে নয়।
    ‌ক্লাস সেভেনের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার পর একদিন হঠাৎ অর্জুনের সঙ্গে ধাক্কা লাগে দোতলার সিঁড়িতে ওঠার সময়। অর্জুন নীচে থেকে ওপরে উঠছিল আর অহনা ওপর থেকে নীচে নামছিল তড়িৎ বেগে। অর্জুন প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলে, দেখে চলতে পারিস না। এক থাপ্পড় মারতে হয়। অসভ্য মেয়ে কোথাকার।

    ‌অহনা তার দিঘল কালো চোখগুলোকে বিস্ফোরিত করে বলে, আমি যদি অসভ্য মেয়ে হই তুমিও একটা অসভ্য ছেলে। একেবারে যাচ্ছে তাই।

    ‌ব্যাস তখন থেকেই শুরু টেরিয়ে টেরিয়ে একে অপরকে দেখা, একে অপরের সাইকেলের চাকার হাওয়া খুলে দেওয়া, যখন তখন মুখ বেঁকানো এইসব আর কি। এইসব দুষ্টুমি করতে করতে দুটো কিশোর কিশোরী যুবক যুবতী হয়ে উঠল। তারা নিজেরাই উপলব্ধি করতে শুরু করে যে তারা একে অপরকে চোখে হারায়।
    ‌অহনা তখন ক্লাস ইলেভেনে। প্রথম প্রেমপত্র লিখলো অর্জুনকে। ভীষণ টেনশন ছিল। অর্জুন কি উত্তর দেবে এই ভেবে তো তার হৃদস্পন্দনের হার’ও বেড়ে গিয়েছিল বেশ।

    ‌না অর্জুন নিরাশ করে নি। তবে ঠিক প্রেমপত্র অর্জুন লেখে নি। লিখেছিল একটা চিরকুট ।তাও মাত্র তিনটি শব্দ ‘আমার বউ হবি?’

    ‌অহনাও সেদিন আর কোনো লিখিত জবাব দেয় নি তারপর। তবে অর্জুনকে সে দিয়েছিল তার সদ্য যৌবনে পা রাখা চঞ্চল হৃদয়। এদিক ওদিক নয় একদম অর্জুনের মনের সাথে স্টেপেল করে দিয়েছিল নিজের মনখানা।
    ‌সেই মন’ও ছিঁড়ে গেল টুকরো টুকরো হয়ে।

    নাওয়া, খাওয়া প্রায় বন্ধ। আজ দুপুরে অহনার অত্যন্ত প্রিয় খাসীর মাংস বানিয়ে ছিল সোমা। মাংসের ঝোল দিয়ে এক গ্ৰাস ভাত মুখে তুলতেই কেমন আলুনী লাগলো অহনার। অহেতুক এক খাবলা নুন মিশিয়ে মাংসের ঝোলের টেস্ট ফেরাতে গিয়ে পুরো মাংসটাই নুনে পোড়া করে দিল। ভাতের থালাতে যে দু’ ফোঁটা চোখের জলও ফেলেছিল তা লক্ষ্য করেছিল তার মা। তবে নীরবতাই শ্রেয় মনে করেছিল সোমা। সেও তো জানে কাছের মানুষের সঙ্গে বিচ্ছেদ হলে কেমন মোচড় দেয় মনটা।

    ‌তবে এখন অহনার আঙুলটা জানালায় চাপা পড়ে যাওয়ায় সোমা খুব রেগে ওঠে। আসলে মায়ের মন তো। সন্তানের ব্যথায় বড্ড ব্যথিত হয়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি করে গ্যাস ওভেনটা জ্বেলে একবাটি জল গরম করতে বসালো। তারপর স্নেহভরে বলে, শুধু বরফের সেঁক দিলে হবে না সোনা আমার। আয় এখানে আয়। একটু উষ্ণ গরম জলে আঙ্গুলটা ডুবিয়ে রাখ প্লিজ।

    ‌অহনা তার মায়ের মুখের দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো রান্নাঘরের দিকে। তারপর আঙুলটা হালকা গরম জলে ডোবাতে ডোবাতে বলে, অর্জুনকে বিয়ে করতে গিয়ে যদি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হয় তাহলে এমন বিয়ের দরকার নেই আমার।

    ‌সোমার জীবনে বেঁচে থাকার রসদ হচ্ছে তার একমাত্র মেয়ে অহনা। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে যখন বিধবা হয় তখন অনেকে তার অকাল বৈধব্য নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করে বলেছিল, আজকালকার দিনে মেয়েদের চল্লিশটা এমন কি আর বয়স। করে ফেল একটা ডিভোর্সী কিংবা বিপত্নীক কাউকে বিয়ে। তুইও সঙ্গী পাবি আরি মেয়েটাও একটা বাবা পাবে।
    ‌সোমা অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখন যে আর তৃতীয় ব্যক্তিকে নিয়ে কাজ নেই। মেয়ে মানুষ হলে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলে তার আর কোনো চিন্তা থাকবে না। তবুও আজ অহনার কথা শুনে সোমা ঠোঁটের কোণে একটু হাসি এনে বলে, বিয়ে করলে কি কেউ মাকে চিরকালের জন্য ছেড়ে চলে যায়? মাঝে মধ্যে তো আসবেই মায়ের কাছে।

    ‌অহনা ডান হাতটা নেড়ে তীব্র প্রতিবাদ করে বলে, এইখানেই তো আমার আপত্তি। কেন আমি মাঝে মধ্যে বাপের বাড়িতে আসবো? মাঝে মধ্যে শ্বশুরবাড়িতে যাবো না কেন?

    ‌সোমা মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, এটাই যে সমাজের নিয়ম সোনা। বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতেই থাকবে। বছরের পর বছর ধরে তো এই নিয়মটাই চলে আসছে।

    ‌-যে নিয়মের সঠিক যৌতিকতা নেই সেই নিয়ম বয়ে বেড়ানোর কি কোনো মানে আছে? মেয়েদের বিয়ে হলেই অন্যের ঘরে চলে যেতে হবে এ আবার কি কথা!

    – আরে বাবা, তোকে বিয়ে করে যদি অর্জুন আমাদের বাড়িতে থেকে যায় তাহলে লোকে তো ওকে ‘ঘরজামাই’ বলবে। এটা তো একটু বোঝ। ওটা কি অর্জুনের জন্য সম্মানের হবে?

    ‌অহনা গরম জলের বাটি থেকে হাতটা তুলে বলে, ঘরজামাই শব্দটা কি গালি না নোংরা কথা?
    ‌-তা এক রকম খারাপ কথা তো বটেই। ঘরজামাই শব্দটার মধ্যে লুকিয়ে থাকে যে, জামাই নিষ্কর্মা, অলস। মোট কথা সে শ্বশুরবাড়ির আশ্রিত।

    ‌-অর্জুন যে এর একটাও নয় সেটা তুমি, আমি এবং পাড়া প্রতিবেশী সকলেই ভালো করেই জানে। অর্জুন সরকারি চাকরি করে, ঘর বাড়ি ওর যথেষ্ট আছে। সুতরাং ওকে তো কোনো ভাবেই ঘরজামাই বলা যায় না। বরং আমার মাইনে এখন অর্জুনের থেকে কম।

    ‌সোমা বলে, দেখ অহনা এই ব্যাপারটাতে অর্জুনের আপত্তি সবথেকে বেশি। ও তো মানতেই রাজি হচ্ছে না বিয়ের পর আমাদের বাড়িতে এসে থাকবে।

    ‌অহনা এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আর বলে, আমার ভালোবাসার থেকে ওর কাছে সমাজটা বড় হয়ে গেল। সমাজের বস্তা পচা অনুশাসন সে মেনে নিতে পারছে বিনা বাক্যব্যয়ে আর আমার প্রস্তাবটা ওর কাছে একবারের জন্য বিবেচ্য বলে মনে হল না।

    ‌জানো মা হোটেলের মায়াবী নীল আলোয় অর্জুন যখন আমাকে ডায়মন্ডের রিং খানা পরিয়ে দিয়ে বললো, এনগেজমেন্ট কিন্তু হয়ে গেল। এবার শুধু লোক খাওয়ানোটা বাকি। সামনের আষাঢ়ে ভাবছি তোকে পার্মানেন্ট ভাবে আমাদের ঘরের মেম্বার করে নিয়ে যাবো।

    ‌তখন আমি বেশ আনন্দ করে বললাম, এই মেম্বারশিপটা একটু চেঞ্জ করে নিলে হয় না?
    ‌অর্জুন ভ্রু কুঁচকে বলে, মানে?

    ‌-এই ধরো এতো বছরের বিয়ের নিয়মের আমরা কিছু পরিবর্তন ঘটালাম। মেয়েরা বিয়ের পর বাক্স গুছিয়ে ছেলেদের বাড়িতে থাকতে রাজি হয়ে যায় পাকাপাকি ভাবে।রাজি হয়ে যায় এটা বললে ভুল হবে। অনেক মেয়ে তো বাধ্য হয়েই শ্বশুরবাড়িতে থাকে।তাই বলছিলাম আমাদের বিয়ের পর কিন্তু তুমি আমাদের বাড়িতে এসে থাকবে পাকাপাকি ভাবে। অবশ্যই নিজের বাড়ি যাবে মাঝে মধ্যে।

    ‌আসলে মা তো একা মানুষ। আমি যদি পাকাপাকি ভাবে তোমাদের বাড়িতে থাকি তাহলে মায়ের খুব অসুবিধা হবে। আর আমি ছাড়া মায়ের আর কেউ নেই এটা তুমি ভালো করেই জানো।

    ‌তারপরই ঠোঁট ফুলিয়ে অহনা কাঁদতে কাঁদতে বলে, জানো মা আমার কথাগুলো শোনা মাত্রই অর্জুন কি বললো, ‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে অহনা। বিয়ের পর কোনো ছেলে যদি পাকাপাকি ভাবে শ্বশুরবাড়িতে থাকে তাকে লোকে কি বলে জানো তো? ঘরজামাই। দেখো অহনা তোমাকে আমি ভালোবাসি ভীষণ। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমি ঘরজামাই হয়ে থাকবো। তোমার এইসব উদ্ভট প্রস্তাবে আমি মোটেই রাজি নয়। এখনো সময় আছে তুমি ভেবে দেখো আমাদের সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত যেতে পারে কিনা?’

    ‌মা অর্জুনের চোখ মুখের অভিব্যক্তি দেখে আমার একটা কথাও বলতে ইচ্ছা করে নি। শুধু হীরের আংটিটা আঙুল থেকে খুলে অর্জুনের মুখে মেরে এসে ছিলাম। আর সেই মুহুর্তে আমার মনে হয়েছিল আংটিটা অর্জুনের মুখে মারলাম না। মারলাম আমাদের ঘুনধরা সমাজের মুখে। যারা পরিবর্তন চায় না বিভিন্ন অযৌক্তিক নিয়মের। তবে এই কদিনে আমি ভেবে দেখলাম যে ছেলে তার হবু স্ত্রী’র অসুবিধার তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র নিজের ঠুনকো মান সম্মানের কথা ভাবে সেই ছেলে যতই সৎপাত্র হোক না কেন তার যে একটা উদার মন নেই তা আমি বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছি।

    ‌তারপর চোখের জল সামলে অহনা বলে, ‘মা একটা খাতা পেন আনো তো। একটা বিজ্ঞাপন লিখতে হবে।’
    ‌সোমা অবাক হয়ে বলে, ‘বিজ্ঞাপন! কিসের বিজ্ঞাপন?’

    ‌অহনা একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে, আমার বিয়ের। বয়ান টা এইরকম হবে, ‘পূঃবঃ কায়স্থ মিত্রর ৩০/৫’৭”M.A সুচাকুরে স্থায়ী ভাবে শ্বশুরবাড়িতে বসবাস করতে ইচ্ছুক পাত্র চাই।’ পাশে ফোন নাম্বার ও ঠিকানা থাকবে। ঠিক আছে না মা?

    ‌অহনার মুখের দিকে তাকিয়ে সোমা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আর মনে মনে বলে, অর্জুনের সঙ্গে এত দিনের সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটলেও মেয়েটা বাঁচতে ভুলে যায় নি এখনও। হে ঈশ্বর অহনার মনের মতো একখানা পাত্র কি আমাদের সমাজ থেকে পাওয়া যাবে? যার কাছে সমাজের থেকে মানুষ হবে প্রধান। যার কাছে লোকের কথার থেকে বেশি প্রাধান্য পাবে স্ত্রী’র আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা আর ভালোবাসা।


  • গল্প

    গল্প- অযোধ্য পাহাড়ের উপহার

    অযোধ্য পাহাড়ের উপহার
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

    -না, না আমি ঐ বউয়ের মুখ দর্শন করতে চাই না। এখুনি এই বাড়ি থেকে ওকে চলে যেতে বল তোরা।
    – চুপ কর মা প্লিজ। একটু শান্ত হও। লক্ষ্মীটি মা আমার, এই রকম করো না।
    তুমি যেমন পুত্রহারা হলে তেমনি পয়মন্তীও স্বামীহারা হলো। একবার তো ভাবো সে কথা। মাত্র একটা মাস কাছে পেলো নিজের বরকে। নিজের ঘর তৈরি করতে না করতেই খড়কুটোর মতো উড়িয়ে নিয়ে গেল নিয়তি। আমার তো পয়মন্তীর সামনে গিয়ে দুটো সান্তনা দেওয়ারও সাহস নেই।
    ওর মা আর বোনই কাছে আছে। এই কথাগুলো বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে চলেছে তৃপ্তি। পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে সে বলে, আমাদের এমন কপাল ভাইয়ের দেহটা দাহ করারও সুযোগ পেলাম না।
    প্রতিমা দেবী তার একমাত্র ছেলে প্রলয়ের ছবিটা বুকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। আর পাগলের মতো নিজের মনেই বলে চলেছে, সব শেষ করে দিল রাক্ষুসী। কত করে বারণ করেছিলাম, যাস না, যাস না তোরা পাহাড়ে হানিমুন করতে। তারপরই ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন আর বিলাপ করে বলতে লাগলেন, হে ভগবান আমি জ্ঞানত কারোর কখনো কোনো ক্ষতি করি নি। তাহলে আমার কেন এতবড় ক্ষতি হলো!
    তারপরই বলে ,জানিস তৃপ্তি আমাদের ঠাকুর ঘরের পূব দিকের জানালাটাতে একটা ঘুঘু পাখি বাসা করে মাঝে মধ্যেই। দু’ একবার বাচ্চাও ফুটিয়েছে। কিন্তু বড্ড নোংরা করে বলে এবার যে বাসাটা করেছিল তা আমি হারানকে দিয়ে ফেলা করিয়ে ছিলাম।
    হ্যাঁ রে তৃপ্তি ঘুঘু পাখির বাসা ভেঙে দিলাম বলে কি ভগবান আমার সুখের সংসার তছনছ করে দিল?
    তৃপ্তি প্রতিমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, সবই অদৃষ্ট মা। এর ওপর তো কারোর হাত নেই।
    দু’টোতে কত আনন্দ করে হানিমুন করতে গিয়েছিল। তোমার কথা মতো দূরে না গিয়ে পুরুলিয়ার অযোধ্যায় গেল। তোমার কথা মতো কোনো রির্সটে না উঠে মেজ জেঠুর বাড়িতে উঠলো। এরপরও তুমি পয়মন্তীকে রাক্ষুসী বলছো!
    এবার কটমট করে প্রতিমা দেবী তৃপ্তির দিকে তাকালো। তার দৃষ্টিতে ছিল সন্তানহারা মায়ের গভীর আক্রোশ। খুব দ্রুত চলছে যে তার হৃৎপিণ্ড তা তার বুকের শাড়িটার ওঠা নামা দেখেই বুঝতে পারা যাচ্ছে।
    প্রতিমা ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, আমি কি বলেছিলাম ওখানে পিকনিক করতে যেতে। দুজনে মিলে বেড়াতে যাচ্ছিস যা, না দলবেঁধে হুল্লোড় করতে কে বলেছিল? তারপর দল ছুট গাভীর মতো হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে আবার বিলাপ শুরু করলো।

    হঠাৎ কানে এলো পয়মন্তীর মা ডাক খানি। প্রতিমা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে তার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার ছেলের বৌ। তাকে নতুন বৌ বলা যায় না কি মৃত ভর্তৃকা বলা যায় বুঝে উঠতে পারছে না কিছুতেই। মাত্র একটা মাস প্রলয়ের বউ হয়ে সে কাটালো। এখনো শরীরের প্রতিটা অঙ্গে লেগে আছে প্রলয়ের শ্বাস প্রশ্বাস।
    পয়মন্তীর নিরাভরণ দেহ, আলুথালু একটা হাত খোঁপা, সাদা থান এইসব দেখে প্রতিমা পাগলের মতো চিৎকার করে বলে, তৃপ্তি ওকে আমার সামনে থেকে চলে যেতে বল।আমি ওর এই চেহারা দেখতে পারছি না। কত সখ করে আমার ঘরের বউ করে এনেছিলাম। মনে হতো ওর মতো মেয়ে আমার ঘর আলো করে রাখবে কিন্তু ওতো আমার ঘর অন্ধকার করে দিল।

    তৃপ্তি এবার ধমকের সুরে বলে, পাগলের প্রলাপ বন্ধ করো মা। কেন তুমি পয়মন্তীকে দোষী করেছো। গিয়েছিল তো ওর সবাই মিলে আনন্দ করতে। ভাই যদি ঝর্ণার জলে পাকামো করে হাত ধুতে গিয়ে পা স্লিপ করে পড়ে যায় পয়মন্তী কি করবে?

    দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পয়মন্তী কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার চোখের সামনে তলিয়ে গেল প্রলয়ের দেহ। আমি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম আমার স্বামীর মৃত্যু। অগ্নিকে সাক্ষী করে শপথ নিয়েছিলাম সব আপদ বিপদ দুজনে একসাথে লড়বো। কিন্তু কৈ পারলাম আমি?

    তৃপ্তি তার মায়ের কাছ থেকে উঠে এসে পয়মন্তীকে ধরে ধরে নিয়ে আসে প্রতিমার কাছে। পয়মন্তী ক্ষীণ কন্ঠে বলে, মা আমি আজই বাপের বাড়ি যেতে চাই। আপনার আপত্তি নেই তো?
    প্রতিমা হঠাৎ সব শোক ভুলে দৃঢ় কন্ঠে বললো, সেই ভালো। ওখানে থাকলে অন্তত তোর মুখ দর্শন আমাকে করতে হবে না।

    পয়মন্তী আবার লেখাপড়াটা শুরু করেছে।যদিও প্রলয়ের চাকরিটা ওরই পাবার কথা। তবুও সে মাস্টার্সটা কমপ্লিট করতে চায়। প্রলয়ের বড় ইচ্ছে ছিল পয়মন্তী যেন এম.এ.টা কমপ্লিট করে।
    দক্ষিণ দিকের জানালাটা খুলে বই খাতা নিয়ে পড়তে বসেছে পয়মন্তী। বই-এর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা ময়ূরের পালক পেল সে। বিয়ের পর প্রলয়ের ডায়েরিতে পালকটা দেখেই আবদার করে চেয়ে নিজের ইতিহাসের খাতার পাতায় রেখে দিয়েছিল বাপের বাড়িতে এসে।
    পালকটার গায়ে আলতো হাত বুলাতেই চোখগুলো তার জলে ঝাপসা হয়ে উঠলো। এমন সময় কাঁধে একটা হাতের ছোঁয়া অনুভব করলো। তাড়াতাড়ি চোখের জল সামলে মুখ ঘুরিয়ে দেখে তার শাশুড়ি মাতা দাঁড়িয়ে। চেয়ার থেকে উঠে তাড়াতাড়ি প্রণাম করে জিজ্ঞেস করে, মা আপনি হঠাৎ এলেন?
    কার সঙ্গে এসেছেন?

    প্রতিমা মৃদু হেসে বলে, তোর কথা ভীষন মনে হচ্ছিল তাই চলে এলাম। তবে একা আসি নি। নীচে চল। গিয়ে দেখ কার সাথে এলাম।

    পয়মন্তীদের নিচের তলায় বসার ঘরে বসে আছে এক সুপুরুষ যুবক। চশমার ফাঁক দিয়ে দেখা গেল চোখগুলো। অসম্ভব স্বচ্ছ চোখের মণিগুলো। পয়মন্তীর মা’ও সেখানে ছিল। উনি ব্যস্ত হয়ে বলে, আয় পয়মন্তী। এর সাথে আলাপ করিয়ে দিই।
    এর নামও প্রলয়। প্রলয় রায়। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। এখন পুরুলিয়াতে পোস্টিং।
    পয়মন্তীর ঠিক কিছুই বুঝতে পারছে না কেন হঠাৎ এই অপরিচিত যুবককে তার শাশুড়ি নিয়ে এলো তাদের বাড়ি।
    তবে পয়মন্তীর কৌতুহলের নিরসন ঘটায় তার শাশুড়ি প্রতিমা দেবী। উনি পয়মন্তীর হাতটা ধরে বলে, তোর কাছে একটা জিনিষ চাইবো দিবি ?
    পয়মন্তী বিনা সংকোচে বলে, বলুন কি চাই?
    -তুই আবার সংসার করবি কথা দে আমাকে।একটা বছর তো কেটে গেছে। এবার একটা বিয়ে কর।

    পয়মন্তী যেন আকাশ থেকে পড়ল। সে ভাবতেই পারছে না তার শাশুড়ি স্বয়ং এই কথা বলছে। আর তাছাড়া সে নিজেও বিয়ের জন্য মোটেই তৈরি নয়। এখন সে মাস্টার্স কমপ্লিট করতে চায়। তাছাড়া প্রলয়ের চাকরিতেও তাকে জয়েন করতে হবে। এরমধ্যে আবার বিয়ে থাওয়া!
    পয়মন্তী খুব শান্ত ভাবে বলে, আমি এখনও নতুন করে বিয়ের কথা ভাবি নি। এম.এ. টা কমপ্লিট করে প্রলয়ের চাকরিটাতে জয়েন করবো। এইরকম ভাবনাই মাথায় আছে।
    প্রতিমা দেবী বলে, সে তো ভালো কথা। তবে আমার অনুরোধটাও একটু ভেবে দেখ।
    পয়মন্তীর মা’ও অনুরোধের সুরে বলে, প্রলয় কিন্তু যথেষ্ট ভালো ছেলে। জীবনে চলার পথে একটা ভালো সঙ্গী কিন্তু সবার দরকার।
    কানা উঁচু থালায় ভর্তি ভর্তি জল রাখলে যেমন টলটল করে ঠিক সেই রকম টলমল করছে পয়মন্তীর মনটা। কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তখন প্রলয় রায় নিজে এগিয়ে এসে বলে, বিয়ে করতে যদি এখনি সংকোচ হয় তাহলে এখন আমরা বন্ধু তো হতে পারি? যদি কখনও মনে হয় বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বৈবাহিক সম্পর্কের জায়গা নেবে তখন নাহয় ভাবা যাবে।
    প্রতিমা দেবীও তাড়াতাড়ি প্রলয় রায়কে সমর্থন করে বলে, এটা একদম ঠিক বলেছো প্রলয়। পুরুলিয়া কেড়ে নিয়েছিল এক প্রলয়কে আবার পুরুলিয়াই ফিরিয়ে দিল আর এক প্রলয়কে। ভাগ্যিস মেজদার বাড়ি গিয়েছিলাম। তাই তো তোমার দেখা পেলাম।
    পয়মন্তী ভেবে নে অযোধ্যা পাহাড় তোর জন্য এই উপহারটা পাঠিয়েছে।
    প্রতিমা দেবীর দেওয়া উপহারটা পয়মন্তী সেদিন সংকোচ ভরে গ্ৰহণ করলেও জীবনের মাঝ তরীতে এসে বেশ বুঝতে পারছে প্রতিমা দেবীর দেওয়া উপহারের গুরুত্ব।
    প্রলয় রায় আজকাল পয়মন্তীর বিরাট একটার ভরসার জায়গা। প্রলয়ের মতো সহৃদয় স্বামীর সহযোগিতায় পয়মন্তী তার পুরানো শ্বশুর বাড়ি, বর্তমান শ্বশুরবাড়ি আর বাপের বাড়ির মধ্যে সুন্দর সামঞ্জস্য বজায় রেখে, চাকরি বজায় রেখে দিব্ব্য চলছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতেও চলবে।

  • গল্প

    গল্প- চিনি মিনির বাড়ি ফেরা

    চিনি মিনির বাড়ি ফেরা
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

    হেড স্যারের টেবিলের ল্যান্ড লাইন ফোনটা বেজেই চলেছে অনেক ক্ষণ ধরে। হেড স্যারের পাশেই বসেন বাসন্তী দেবী হাইস্কুলের বর্ষীয়ান শিক্ষিকা অনুভা ম্যাম। মনে হচ্ছে উনি ক্লাস নিতে গেছেন। হেড স্যারও এসে পৌঁছাননি। সুতরাং স্কুলের হেড ক্লার্ক অনিমেষ বাবুকে বাধ্য হয়ে ফোনটা ধরতে হয়। উনি গম্ভীর স্বরে বললেন, হ্যালো…
    -আমি তপন বাবু বলছি। অনুভা দিদিমণিকে একটু বলে দেবেন চিনি, মিনি বাড়ি ফিরে এসেছে। আর চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। এই কথাগুলো বলে ফোনটা কেটে দিলেন তপন বাবু। মানে অনুভা ম্যামের স্বামী।

    কিছুক্ষণ বাদে যখন অনুভা ম্যাম হেড স্যারের রুমে এসে টেবিলে ক্লাস টেনের রেজিস্টার খানা রেখে চেয়ারটা টেনে বসলেন। হেড ক্লার্ক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে জানালেন তপন বাবু ফোন করেছিলেন আর বললেন চিন্তার কোনো কারণ নেই। চিনি আর মিনি ঘরে ফিরে এসেছে।

    এই খবরটা শোনা মাত্রই অনুভা ম্যামের চোখদুটোতে খুশি ঝলকানি দেখা দিল। ম্যাম তাড়াতাড়ি দেওয়ালে বাঁধানো পরমহংসের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে করজোড়ে প্রণাম সারলেন। তারপর বললেন, সত্যি খুব চিন্তার মধ্যে ছিলাম অনিমেষ বাবু। দু’দিন আগে সকালে একবার এসেছিল চিনি আর মিনি আমাদের ঘরে। তারপর থেকে আর দিনে রাতে একেবারের জন্য মুখটা পর্যন্ত দেখাতে আসে নি জানেন। যাক বাবা এবার ইলেভেনের ক্লাসটা মন দিয়ে করতে পারবো। ফার্স্ট পিরিয়ডটা করতেই পারলাম না ঠিক ভাবে। মন অশান্ত থাকলে কোনো কাজ হয়? নাওয়া খাওয়া সবই করছিলাম কিন্তু সারা ক্ষণ চিনি আর মিনির জন্য মনটা অস্থির হয়ে থাকতো।
    জানেন অনিমেষ বাবু ওরা দুটিতে ইলিশ মাছের খুব ভক্ত। সেই কারণে কর্তা মশাই বুধবার ইলিশ এনে বললেন, আজ তো দুজনের দুপুরের ভোজটা জমিয়ে হবে।
    আমি তো রান্না মাসীকে বললাম, দু পিস ইলিশ মাছ ভাজা তুলে রাখো আগে চিনি সোনা আর মিনি সোনার জন্য। কর্তা তো সরষে বাটা দিয়ে ঝাল ঝাল করে ইলিশ মাছ খাবে।আর চিনি, মিনি ভাজা মাছ ছাড়া একদম খেতে চায় না। আমি তো রোজই স্নান পূজো সেরে ওদের দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দুজনকে দুমুঠো ভাত খাইয়ে তবে আমি ভাত খেয়ে স্কুলে আসি।

    কি বলবো অনিমেষ বাবু, বুধবার সকালে আমি ওদের জন্য খাবার বেড়ে ওদেরকে ডাকাডাকি করেই চলেছে কিন্তু ওরা আর এলো না। এদিকে আমারও স্কুলের টাইম হয়ে আসছে। আমি ছটফট করছি। একবার এ ঘরে আরেক ও ঘরে ওদের খুঁজেই চলেছি। ছোট খাটো নরম শরীর নিয়ে মাঝে মধ্যেই খাটের তলায় ঘাপটি মেরে বসে থাকে।
    একে তো আমার হাঁটু ভাজ করা নিষেধ। তবুও ঝুঁকে দেখতে থাকি খাটের তলা, সোফার তলা । ভিতরে ভিতরে টেনশনটাও বেড়ে চলেছে। কিন্তু কি আর করবো আমাকে তো আমার চাকরিটাও রক্ষা করতে হবে। তাই বিষণ্ণতা আর উদ্বিগ্নতা নিয়ে দু মুঠো ভাত খেতে বসলাম। ভাতে ইলিশের ঝাল বাটনাটা মেখে মুখে পুড়লেও কোনো স্বাদ আস্বাদন করতে পারেনি সেদিন। বারবার দুটো ফুটফুটে কচি মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

    কোন রকমে খেয়ে উঠে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে স্কুলে চলে এসেছিলাম সেদিন। আপনি তো জানেন আমার বাড়ি স্কুলের পাশে বলে আমি রোজ প্রায় সবার শেষে বাড়ি ফিরি। কিন্তু বুধবার লাস্ট পিরিয়ডটা অফ ছিল বলে হেড স্যারকে বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছিলাম। বাড়ি ফিরে দেখি কর্তাও বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। আমি বুঝলাম ওরা এখনো বাড়ি ফেরেনি।
    হঠাৎ মনে পড়ল মুখার্জি বৌদির কথা। চিনি আর মিনি মাঝে মধ্যেই ওদের বাড়িতে যায়। তাই তাড়াতাড়ি করে বৌদিকে ফোন করে ওদের কথা শুধালাম।
    বৌদিও বললো, না দিদিমণি দুজনের কেউই আসে নি তো।
    তখন আমি হাল ছেড়ে দিয়ে ঠাকুরকে ডাকতে লাগলাম। ঠাকুর আমার চিনি আর মিনিকে রক্ষা করো। এই দুটো দিন যে আমার কি টেনশনে কেটেছে আপনাকে কি বলবো!

    অনিমেষ ভ্রু কুঁচকে বললেন, দিদিমণি আপনারা তো শিক্ষিত মানুষ। আপনারা জানেন না বাড়ি থেকে কেউ মিসিং হয়ে গেলে থানায় একটা ডায়েরি করতে হয়। সেসব না করে দুদিন ধরে ঘরে বসে ঠাকুর কে ডাকতে লাগলেন। কোন যুগে বাস করেন আপনারা!

    অনুভা ম্যাম খুব আস্তে আস্তে বললেন, অনিমেষ বাবু ইচ্ছে যে আমার হয় নি একেবারে তা নয় কিন্তু। কিন্তু কর্তা মশাই বললেন, থানায় গিয়ে বলবে কি?
    আমি বললাম- বলবো, চিনি আর মিনিকে বুধবার সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
    তারপর কর্তা বললেন, থানার ওসি যখন জিজ্ঞেস করবে ওরা দেখতে কেমন, ওদের পরণে কি পোশাক ছিল, ওদের বয়স কত? তখন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে তো?
    এইকথা শুনে আমি আর এগিয়ে যেতে পারলাম না। দেখতে কেমন বলা যাবে, বয়স কত তাও বলতে পারবো কিন্তু পোশাক?
    অনিমেষ বাবু বলেন,আপনি ওদেরকে এতো ভালোবাসেন আর খেয়ালই করেননি ওরা সকাল বেলায় কি পোশাক পরেছিল?
    -আসলে অনিমেষ বাবু ওরা তো পোশাক পরতে চায় না।
    প্রচন্ড রকম কৌতুহল নিয়ে অনিমেষ বাবু জিজ্ঞাসা করেন, মানে?
    -ওরা তো মানুষের বাচ্চা নয়। ওরা তো আমার বিড়াল বাচ্চা।

    এইকথা শোনা মাত্রই অনিমেষ বাবু হো হো করে হেসে হেড স্যারের রুম খানা কাঁপিয়ে তুললেন। সঙ্গে সঙ্গে আরো বেশ কিছু টিচার, স্টাফ এসে হাজির সেখানে। সবাই চিনি আর মিনির আসল পরিচয় পেয়ে খুব হাসতে থাকে। আর বলে, অনুভা ম্যাম বিবেকানন্দের ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ এই বাণীটির সার্থক প্রয়োগ তো আপনারা করে দেখিয়ে দিলেন।

  • গল্প

    গল্প- উপকারের পথ

    উপকারের পথ
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

    কি ব্যাপার কুহেলি তোকে কি আজকাল রেশনের লাইনেও দাঁড়াতে হচ্ছে? আমি যতদূর জানি তোর বর তো সেন্ট্রাল গভর্মেন্টে চাকরি করে। অফিসারও তো শুনেছিলাম। তবুও তুই রেশন দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে চাল, গম তুলছিস।

    কুহেলি শিল্পাকে কিছু বলতে যাবে তখনি পাশ থেকে ওদের পাড়ার শিবুদা বলে, বুঝলি তো শিল্পা কুহেলিদের বাড়বাড়ন্তের কারণটা।

    শিবুদার কথা শুনে শিল্পা খানিক উচ্চ হাসির রোল তুললো। তারপর বলে, কুহেলি রেশনের চালের ভাত খেতে পারিস? যা মোটা চাল। আমি তো বাবা সরু, লম্বা চাল ছাড়া খেতে পারি না। হয়তো তোদের মতো এতো বড়লোক নই তবুও বাবা ভাতের চাল, রুটির আটা এগুলোর কোয়ালিটির দিকে নজর রাখি। আমার কর্তা তো বলে, দুটো ভালো খাবো বলেই তো এত মেহনত করছি। আমাদেরও রেশন কার্ড আছে। কিন্তু আমরা চাল, গম তুলতে আসি না। কেরোসিন তেলটা মাঝে মধ্যেই তুলে নিয়ে যায় কর্তা।আমি বাবা রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে ভিড় ঠেলাঠেলি করতে পারি না।

    শিবুদা বলে, কুহেলি তুই না তোর বাবার ধারা পেয়েছিস একদম। দুটো পয়সায় জন্য মরে বাঁচে। কারোর ধার বাকি থাকলে তার বাড়িতে চলে যায় তাগাদা করতে।
    কুহেলি বলে, পয়সা কার দরকার নেই বলো তো?
    তাছাড়া কেউ যদি ধারে জিনিস খায় আর সময় মতো পয়সা না দেয় তাহলে তো তার কাছে তাগাদা করতে যেতেই হবে।

    তা শিবুদা তুমিও কি রেশন তুলতে এসেছো? আমিও যতদূর জানি তোমাদেরও বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো। তোমরা ভাইরা সবাই চাকরি করো।

    শিবুদা একগাল হাসি দিয়ে বলে, সরকারি জিনিস কেন ছেড়ে দিই বলতো?
    শিল্পা বলে, এটা তুমি ঠিক বলেছো। আমার উনিও তাই বলেন।
    উনি তো আমাকে কতবার বলেছেন রেশনের চাল, গম তুলে বিক্রি করে দেওয়ার কথা।কত গরীব মানুষ আছে যাদের কাছে রেশন কার্ড নেই। তাদের কাছে দশ বারো টাকা কেজি দরে চাল, গম বিক্রি করলে তারা তো লাফিয়ে নিয়ে নেয়। সরকারি বিনা পয়সার জিনিস থেকেও দু’পয়সা হাতখরচা এসে যায়। তবে হ্যাঁ সময়টা বের করে লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হবে এটাই ঝক্কি ঝামেলার।

    শিল্পা, কুহেলি আর শিবুদার গল্পের মাঝে বিরতি টেনে দেয় কালী। কালীর পরিচয় ও কাজের মেয়ে। পাঁচ ঘরে ঠিকে ঘরদোর মোছার কাজ করে আর দুই ঘরে রান্নাও করে। সে দুটো বড় বড় ব্যাগ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এসে কুহেলির উদ্দেশ্যে বলে, দিদি এখনও তো অনেক লাইন আছে গো। আমার জন্য তোমার কাজের অনেক গোলমাল হয়ে গেল।

    কুহেলি বলে, তা তো একটু হলো। তুই আমার পিছনে দাঁড়িয়ে পড়। অনেক ক্ষণ ধরে তোর লাইনটা রেখেছি।

    শিল্পা বলে কি ব্যাপার বল তো কুহেলি, তুইও কি কাজের মেয়েদের কে চাল, গম বিক্রি করতে শুরু করলি?

    কুহেলি কিছু বলার আগেই কালী বলে, তুমি তো কুহেলি দিদির বন্ধু। তবুও দিদিকে চিনতে পারোনি। দিদি অন্যের উপকার করতে পারলে আর কিছু চায় না। আমি যখন থেকে দিদির বাড়িতে কাজ করছি দিদি তখন থেকেই রেশনের চাল আর গম তুলে আমাকে ফ্রী-তে দিয়ে দেয়। এতে আমারও অনেকখানি উপকার হয়। মাসের আটা তো কিনতে হয় না বরং রেশনের চালগুলো আমিও মাঝে মধ্যে অন্যকে বিক্রি করে দিই।তাতে আমারও দু’ পয়সা আসে।

    শিল্পা অবাক হয়ে শুনছিল কালীর কথাগুলো। কুহেলি ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলে, সরকারের বরাদ্দ চাল, গম যদি আমাদের মতো সঙ্গতি সম্পন্ন লোকেরা না তুলি সেই ক্ষেত্রে লাভবান হয় রেশনের ডিলার‌। ‌ডিলারকে লাভের ভাগ না দিয়ে যদি গরীব মানুষগুলোকে একটু লাভবান করি তাহলে কিন্তু মন্দ হয় না।

    শিল্পা বলে, এটা তো কখনও ভাবি নি। সত্যি তো আমাদের রেশনের চাল, গম দরকার পড়ে না। কিন্তু আমার ভাগের চাল, গম ঠিক সরকার পাঠাচ্ছে। আমি যদি একটু কষ্ট করে তুলতে না যাই তাহলে আমার ভাগ তো রেশন ডিলারের কাছেই রয়ে যাচ্ছে। তার থেকে অনেক ভালো আমার ভাগের চাল গম তুলে গরীব মানুষদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া। এমনিতে তো তেমন ভাবে গরীব মানুষগুলোর জন্য কিছুই করে উঠতে পারি না। শুধু একটু সময় ব্যয় করে রেশনের লাইনে দাঁড়িয়ে যদি ওদের উপকার হয় তা কিন্তু মন্দ হয় না।

    সত্যি বলছি কুহেলি তোর মতো আমিও এবার থেকে রেশনের চাল-গম তুলে আমাদের কাজের মেয়েটাকে দিয়ে দেবো।

    কালী বলে, তোমাদের দুজনের মতো সবাই যদি ভাবতো তাহলে আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষগুলোর অনেক সুরাহা হতো।

  • গল্প

    গল্প- বেলেল্লাপনা

    বেলেল্লাপনা
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    সন্ধেবেলায় শাঁখটা বাজিয়ে সবে বসেছেন ঠাকুরের সামনে জপ করতে এমন সময় হাসির বিকট আওয়াজ শুনে চমকে উঠলো পুতুল কাকীমা।
    পুতুল কাকীমার পাশেই বসেছিল কাকীমার ছোট বোন বুলবুল। সে তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, বাপ রে কোন মেয়েছেলে এমন করে হাসছে তোদের বাড়িতে। একে তিন সন্ধ্যা বেলা। এইমাত্র শঙ্খধ্বনি হলো। সেইসব কোনো কিছুর মানা মানি নেই। বলিহারি মেয়েছেলে সব।

    পুতুল কাকীমা বোধহয় জপ করতে শুরু করে দিয়েছিলেন তাই তিনি হাত তুলে তার ছোট বোনকে তখনকার মতো চুপ করতে বললেন।
    কিন্তু নিজে কিছুতেই জপ করতে পারছেন না একমনে। বারবার তার মনে আসছে চল্লিশ বছর আগেকার তার শাশুড়ির একখানা কথা, ‘তুমি তো আচ্ছা বেহায়া মেয়েছেলে। শ্বশুর, ভাসুর সকলের সামনে এমন হেসে উঠলে যে বাড়িখানা কেঁপে উঠলো!’

    সবে মাত্র মাস চারেকের নতুন বৌ তখন পুতুল কাকীমা। বয়স হবে আঠারো প্লাস।কলেজে ওঠা মাত্রই মাস্টার পাত্র পেয়ে যেতেই কাকীমার বাবা বিয়েটা দিয়ে কন্যাদায় থেকে মুক্ত করে ছিলেন নিজেকে।

    পুতুল কাকীমারা চার বোন। আর পুতুল কাকীমাই ছিল বড়। সুতরাং তার বিয়ের চিন্তাই ছিল সবচেয়ে বেশি তার পরিবারে।

    পুতুল কাকীমা পড়াশোনা ও খেলাধূলাতে ছিল তুখোড়। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে লাল লাঠি কিংবা ঝুলন ঝাঁপ সবেতেই নাম্বার ওয়ান। স্কুলের বাৎসরিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে তার সাফল্যের হার থাকতো সবার থেকে বেশি।

    কিশোরী বয়সে স্বপ্ন দেখতো তার বাবার মতো পুলিশ হবে সে। কিন্তু যৌবনের দোড়গোড়ায় পা রাখা মাত্রই তার ঠাকুমা ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন বড় নাতনিকে পরগ্ৰোত্র করার জন্য।

    পুতুল কাকীমার বাবা তাই ইস্কুল মাস্টার জামাই পেয়ে একদম দেরি না করে মেয়ের বিয়েটা সেরে ফেলেছিলেন। চঞ্চল, চপলা, ডাকাবুকো মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে কিভাবে মানিয়ে নেবে এই চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকতো শুধু পুতুল কাকীমার মা।
    শ্বশুরবাড়িতে এসে দেওর, ননদের সাথে তার বেশ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই দিনটা ছিল দোল পূর্ণিমা। দুপুরে দেওর, ননদের সঙ্গে আবীর আর বাঁদর রং মেখে বেশ একটু আধটু হুল্লোড় করেছিল সে। কিন্তু সন্ধ্যা বেলায় চায়ের আসরে ঘটেছিল বিপত্তি।

    পুতুল কাকীমার ছোট ননদ সুলতা চা খেতে খেতে বলে, ‘বৌদি মেজদা আর সেজদাকে কিন্তু রং মেখে পুরোই বাঁদর মনে হচ্ছিল। ওদের পিছনে খড় দিয়ে একটা লেজ করে দিলে ভালো লাগতো। মনে হতো ঠিক মুখ পোড়া বীর হনুমান।’
    এই কথাটা শোনা মাত্রই পুতুল কাকীমা আর নিজের হাসি চেপে রাখতে না পেরে উচ্চস্বরে হো হো করে হেসে ওঠে। সুলতা যদিও পুতুল কাকীমার হাসি থামানোর জন্য নিজের চোখ টিপে ইশারা করতে থাকে। কিন্তু পুতুল কাকীমা কিছুতেই নিজের হাসি আর বন্ধ করতে পারছিল না।
    আর যখন হাসি বন্ধ হলো তখন পুতুল কাকীমার দু’চোখ জলে ভরে উঠেছিল। দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘরের দরজা দিয়েছিল। সেদিন তার অভিমান ভাঙাতে কেউ আসে নি। রাতে তার স্বামী অনুপ বাবু ঘরে এসে গম্ভীর স্বরে বলে ছিলেন,’স্থান, কাল, পাত্রের জ্ঞান তোমার কি একেবারেই নেই? বাবা, জেঠু, দাদাদের সামনে এমন বেলেল্লাপনা করার আগে একবার ভাবলে না তুমি!’
    পুতুল কাকীমার চোখ কাঁদতে কাঁদতে ফুলে উঠেছিল। আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে স্বামীর চোখে চোখ রেখে গর্জে উঠেছিল তরুনী পুতুল। ‘আমার হাসিটা তোমাদের কাছে বেলেল্লাপনা? তাহলে তো খুব মুশকিল তোমাদের এই বাড়িতে আমার থাকা। এটা তো একটা বাড়ি। এখানে মানুষ বাস করে।তারা আনন্দ করতে পারবে না, ফুর্তি করতে পারবে না এমনকি একটু প্রাণ খুলে হাসতে ও পারবে না? এই রকম বাড়িতে থাকার চেয়ে জেলের গরাদে থাকা অনেক ভালো।
    অনুপ বাবু সেদিন পুতুল কাকীমার কষ্টটা সামান্য হলেও বুঝতে পেরেছিলেন তবুও স্বামী সুলভ আচরণ প্রকাশ করে বলেছিলেন, বিয়ের পর মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে এসে কিছু বিধি নিষেধ মানতে হয়। না হলে লোকে তো খারাপ বলবে।

    সেদিন রাতে অভুক্ত অবস্থাতেই শুয়ে পড়েছিল পুতুল কাকীমা। যদিও রাতে ছেলেদের খাওয়া দাওয়া শেষে শাশুড়ি এসে একবার ডাক দিয়ে গিয়েছিল খাওয়ার জন্য। কিন্তু পুতুল কাকীমা সেদিন না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল।

    পরের দিন সকালে ভোর থাকতে উঠে বাসি কাপড় ছেড়ে গম্ভীর মুখে রান্নাঘরে ঢুকে ছিল। সুলতা ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই বৌদির সাথে কথা বলতে চাইলে পুতুল কাকীমা গম্ভীর স্বরে বলেছিল, সুলতা তুমি এই বাড়ির মেয়ে আর আমি এই বাড়ির বৌ।এটা কিন্তু ভুলে যেও না কখনও।

    তারপর ধীরে ধীরে কখন যে সদা হাস্য, প্রাণোচ্ছ্বল মেয়েটা পাল বাড়ির রাশভারি ন বৌ হয়ে গেল তা কেউই লক্ষ্য করে নি।

    মিনিট দশেক জপের আসনে বসে থাকার পর পুতুল কাকীমা হাত তুলে ঠাকুরকে নমস্কার পর্বটা শেষ করে বললেন, বুলবুল একবার ছেলে মেয়েগুলো আর অবশ্যই বৌমাকে ডেকে আনতো আমার কাছে।

    বুলবুলকে আসতে দেখে পুতুল কাকীমার মেয়ে মৌলি শুচিস্মিতাকে বলে, বৌদি ছোটো মাসী আসছে আমাদের ঘরের দিকে। মনে হচ্ছে মা পাঠিয়েছে। একটু আগেই যা জোরে আমরা হাসির রোল তুলেছিলাম। নির্ঘাৎ মা রেগে গেছে।
    শুচিস্মিতা আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করে, তোমাদের বাড়িতে জোরে হাসতে নেই বুঝি?

    মৌলি কিছু উত্তর দিতে যাবে তখনি বুলবুল এসে বলে, তোদের সকলকে দিদি ডাকছে ঠাকুর ঘরে। তিন সন্ধ্যা বেলাতেও হাসি, মশকরা তোদের বন্ধ হয় না। আর মৌলি, শিউলি তোরা তো মেয়েছেলে। আজ না হয় কাল পরের ঘরের বউ হয়ে যাবি। তখনও কি এই রকম পাড়া মাতানো হাসি হাসবি? কি আওয়াজ রে বাবা! ঘরদোর একেবারে কেঁপে উঠলো।

    বুলবুল মাসি চলে যাওয়ার পর ছেলেমেয়েগুলো সব কিছুক্ষণ চুপ রইলো। অর্ক একটু ধমকের সুরে শুচিস্মিতাকে বলে, তোমার এতো জোর হাসির জন্য আজ বোনেরাও বকা খাচ্ছে। সত্যি তো মেয়েদের গলার আওয়াজ, হাসির আওয়াজ এইগুলো একটু কম হওয়া উচিত।

    শুচিস্মিতা অর্কের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে, পাঁচ বছর ধরে যখন প্রেম করেছো তখন নিঃশ্চয় আমার হাসির আওয়াজ বহুবার শুনেছো। কই কখনও তো কানে লাগছে একথা বলো নি। আর আমি একদমই মুখ টিপে হাসতে পারি না। হাসতে যদি হয় প্রাণখুলেই হাসবো।

    অর্ক একটু বিরক্ত হয়ে বলে, দেখো শুচিস্মিতা তুমি কিন্তু মায়ের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে কোনো তর্ক করতে যাবে না। মা যেটা বলবে চুপচাপ শুনে নেবে। মেয়েদের হাঁটা, চলা, বলা এইসবের মধ্যে শালীনতা থাকা দরকার। শান্ত,ধীর স্থির মেয়ে না হলে পদে পদে বিপদ।

    অর্কের কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে শুচিস্মিতা মৌলি, শিউলির সঙ্গে পুতুল কাকীমার ঠাকুর ঘরে ঢুকলো। মৌলি আর শিউলির মুখ শুকিয়ে চুন। শুচিস্মিতাও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক, হর্ষ, নিপেন ওরাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। যাকে বলে pin drop silence.

    এই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হলো পুতুল কাকীমার গলার আওয়াজে। পুতুল কাকীমা জিজ্ঞাসা করে ওদেরকে, কার হাসির আওয়াজ এতো বিকট ছিল?

    শিউলি আমতা আমতা করে বলে, মাসিমনি আসলে নিপেন দাদার ফুটবল ম্যাচের মজার গল্প শুনে হাসি পেয়ে গিয়েছিল খুব জোরে। আর নতুন বৌদির গলার হাসির আওয়াজটা ছিল খুব তীব্র। ওটাই বোধহয় তোমার কানে লেগেছে।

    শুচিস্মিতার দিকে তাকিয়ে পুতুল কাকীমা জিজ্ঞেস করে, তুমি খুব জোরে জোরে হাসতে ভালোবাসো?
    শুচিস্মিতা কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
    পুতুল কাকীমা গম্ভীর স্বরে বলে, তা বেশ। নিজেদের ঘরের মধ্যেই প্রাণখুলে হাসতে পারলে আর লাফিং ক্লাবে ছুটতে হবে না।

    তারপর গলাটা একটু নরম করে বলে, কখনো মাথায় আনবে না তুমি এই বাড়ির বউ বলে তোমার জোরে হাসা হাসি করা চলবে না। শুধু এইটুকু খেয়াল রাখবে তোমার হাসির আওয়াজে কারোর অসুবিধা যেন না হয়।

    ছেলেমেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে অনুপ বাবু ঘরে ঢুকে বলেন, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ওদেরকে খুব বকাবকি করবে। বিশেষ করে বৌমাকে।

    পুতুল কাকীমা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বৌমা শ্বশুরবাড়িতে থাকতে এসেছে জেলখানায় নয়।

    অনুপ বাবুরও মনে পড়ে যায় চল্লিশ বছর আগেকার দোল পূর্ণিমার ঘটনার কথা। আর মনে মনে এখন অনুতাপের আগুন পুড়তে থাকেন। কেন সেইদিন তিনি পুতুল কাকীমার পাশে দাঁড়ানোর সৎ সাহস দেখাতে পারেন নি।

  • গল্প

    গল্প- গোপালের মা

    গোপালের মা
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    -কি গো বোস দিদা কেমন আছো তুমি? মায়ের কাছে শুনলাম তুমি নাকি একাই থাকো এই বয়সে।
    -না না একা তো আমি থাকি না। সঙ্গে আমার গোপাল থাকে।
    -গোপালটা আবার কে গো? তোমার কোনো নিকট আত্মীয়?
    বোস দিদা খিলখিল করে হেসে বলে, নিকট বলে নিকট। গোপাল হচ্ছে পরম আত্মীয় আমার। শুধু আমার কেন গোপাল সবার নিকট আত্মীয়।
    -ও দিদা হেঁয়ালি করা বন্ধ করে বলো না কোন গোপালের কথা বলছো।
    বোস দিদা আমার হাত দু’টো ধরে বলে, আমার গোপাল হচ্ছে তোদের শ্রীকৃষ্ণ।
    -ওওওও, তুমি কৃষ্ণ ঠাকুরের কথা বলছো!
    হ্যা৬ গো দিদা তোমার তো চারটে ছেলে তাই না? সবার তো বিয়ে থাওয়া হয়ে গেছে। তারা তোমার খোঁজ খবর নিতে আসে না?

    বোস দিদা একটু মুচকি হেসে বলে, আসে তো ছেলে, বৌমা, নাতি নাতনি সকলেই আসে। যখন আমি খাওয়া দাওয়ার নেমন্তন্ন করি।
    সকলে মিলে এসে কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে যায়।ব্যাস তারপর আর মায়ের কোনো খোঁজ খবর রাখে না।

    -সেকি গো দিদা! তোমার ছেলেগুলো তো মোটেই সুবিধার নয়।

    – সে কথা আর বলতে। সারাদিন সবাই আমার মৃত্যুর দিন গুনছে। আমি চোখ বুজলেই বাড়িটা বিক্রি করে টাকাগুলো চার ভাগে করে নেবে। এই আশাতেই বসে আছে কুলাঙ্গারগুলো।

    আমি কৌতুহল ভরে জিজ্ঞাসা করি, দিদা তোমার তো আশির কাছাকাছি বয়স। এই বয়সে নিজে রেঁধে খাচ্ছো কি ভাবে? তোমার বাজার হাট, ওষুধ পত্র কে এনে দেয়?

    বোস দিদা বলে, সবই গোপাল ব্যবস্থা করে দেয়।
    আমার দুচার জন গুরু ভাই বোন আছে তারাই দোকান, বাজার, ওষুধ পত্র সবের জোগাড় করে দেয়। আর আমি দু’মুঠো ফুটিয়ে নিই ।

    -এটা তোমার একটা সুরাহা হয়েছে বেশ। কিন্তু এই বয়সে পেনশন তুলতে যেতে পারো একা একা?

    -ওরে আমার তনু সোনা বয়স যতই বাড়ুক যদি কারোর মনের জোর আর টাকার জোর থাকে তাহলে তাকে ছেলে মেয়েদের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হয় না।

    আমি যেদিন পেনশন তুলতে যাই অটো ওয়ালা সমুকে ডেকে পাঠাই। ও যত্ন করে আমাকে অটোতে তোলে আবার নামিয়েও দেয়। তারপর আমাকে ধরে ধরে পেনশন অফিসে নিয়ে যায়। আমার কাজ মিটে গেলে আবার যত্ন করে অটোতে বসিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
    আমিও ওকে ওর অটোর যা ভাড়া তার থেকে আরো বেশি কিছু টাকা দিয়ে দিই। সত্যি বলছি দিদিভাই সমু গরীব হতে পারে কিন্তু লোভী নয়। বরং ভাড়ার অতিরিক্ত যে টাকা দিই তা নিতে চায় না মোটেই। আমিই বলি, তোর বউ-এর হাতে দিবি। বলবি বোস দিদা পাঠিয়েছে।

    এইসব কথা শুনে আমি শুধাই, তোমার ছেলেরা পেনশনের টাকা দাবি করে না?

    দিদা খানিক চুপ থাকে তারপর বলে, সেও এক লড়াই বুঝলি। তোর বোস দাদু প্রথমে আর্মিতে চাকরি করতো। ওখান থেকে রিটায়ারমেন্ট নেওয়ার পর ডিভিসিতে আবার চাকরি করে। তাই তোর দাদুর দু’টো পেনশন ছিল। তোর দাদু মারা যাওয়ার পর হাফ করে এই দুটো পেনশনের টাকাই আমি পাই।
    এই নিয়ে একদিন ছেলেরা আলোচনা সভা বসালো। বড় ছেলে স্কুলের কেরানি সে হিসেবে কষে বললো, মা তুমি যে টাকা পেনশন পাবে তাতে তুমি চার ভাইয়ের ঘরে ঘুরে পায়ের ওপর পা তুলে খেতে পারবে। তোমার থাকা খাওয়ার জন্য কাউকে কোনো টাকা দিতে হবে না। তবে আমাদের ছেলে মেয়েগুলোর লেখাপড়া, শখ আহ্লাদের দায়িত্বটা তুমি নিও।

    আমি তো মনে মনে খুব খুশি হলাম। নাতি নাতনিগুলোকে কাছে পাবো। আর ভাবলাম লেখা পড়াতে আর কটা খরচা হয়। আসলে আমার তো জ্ঞানই ছিল না ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মাইনে হয় হাজার হাজার টাকা। তারপর নাতি নাতনিদের নিত্য মোটা মোটা চাহিদা। আমার পেনশন তো প্রায় পুরোটাই শেষ হয়ে যেত।

    তারপর আমার গোপাল সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে। আমি কাঁসর বাজিয়ে গোপালকে ঘুম থেকে তুলি। এইসব করলে ওদের ঘুমের ব্যঘাত ঘটতো খুব। তাই নিয়ে বৌমা, ছেলে বিরক্তি প্রকাশ করতো।

    তাছাড়া আরো একটা বড় ঝামেলা হচ্ছে আমার খাওয়া দাওয়া। আমি নিরামিষ খাই আর চারবেলা গোপালকে ভোগ নিবেদন করি। ছেলেদের বাড়িতে এইসব কাজের খুব অসুবিধা হতে লাগলো।

    তখন আমি স্থির করলাম ছেলেদের সংসারে না থেকে নিজের বাড়িতেই ফিরে যাওয়া ভালো। একটা বছর চার ছেলের ঘরে ভাগের মা হিসাবে থেকে অবশেষে গোপালের মা হয়ে নিজের বাড়িতে আমার পাকা পোক্ত অবস্থান।

    আমার শরীর টরীর খারাপ হলে গুরু ভাই বোন রা এসে রাতে থাকে। আর মাঝে মধ্যে আশ্রমের লোকেদের সঙ্গে তীর্থ করতে বেরিয়ে পড়ি।
    তনু তোকে কি বলবো কি যত্ন করে আশ্রমের লোকজন বেড়াতে নিয়ে যায়। সঙ্গে একজন ডাক্তারও থাকে।

    আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম আশি বছরের বয়ষ্কা এই মহিলাটার কথা। যার চার চারটে ছেলে। কিন্তু সে কারোর মুখাপেক্ষি নয়। সে কি সুন্দর নিজের মনের জোরে আজও ঈশ্বরের সাধনায় মগ্ন হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে দিন।

    অনেক ক্ষণ গল্প করার পর বোস দিদার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় বলি, তোমার মতো করে তুমি বর্তমানকে নিয়ে আনন্দ করে কাটিয়ে দাও দিদা। আজকের বর্তমান সমাজে বেশিরভাগ মানুষের যে নৈতিক অবক্ষয় তাতে সন্তানদের অবহেলাকে তুচ্ছ জ্ঞান করার বোস দিদার মতো শক্ত মনোবল যেসব মায়েদের থাকবে তারা জীবনের শেষ মুহূর্তটাও সুখে কাটিয়ে দিতে পারবে।

  • গল্প,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    গল্প- দীশার মতিগতি

    ।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    দীশার মতিগতি
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    বিয়ের পর থেকেই দীশা লক্ষ্য করে আসছে তার বড় ভাসুর সমীর তার প্রতি একটু বেশিই খেয়াল রাখে।

    সমীর একজন সরকারি স্কুলের শিক্ষক ও অকৃতদার।দীশার মনে বারবার প্রশ্ন আসে যে, তার সরকারি চাকুরিওয়ালা ভাসুর ঠাকুরের বউ জুটলো না কেন?

    প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সমীর গরম গরম তেলেভাজা নিয়ে আসে দীশার নাম করে।

    দীশার শাশুড়ি মঞ্জু দেবী ঠেস দিয়ে প্রায়ই বলে, কপাল করে একখানা ভাসুর পেয়েছো তুমি বৌমা।বরের থেকে ভাসুর খেয়াল রাখে বেশি।

    দীশার বর অরুন সি আর পি এফ এর একজন জোয়ান।এখন অরুনাচলে থাকে।মাত্র একমাস হয়েছে তাদের বিয়ে। এখন ও কোয়াটার পায় নি বলে সে দীশাকে বাড়িতে ই রেখে গেছে।

    অরুনদের পরিবার খানা বেশ ছোট।বিধবা মা, আইবুড়ো দাদা, অরুন আর দীশা।

    অরুণ যেহেতু বাড়িতে থাকে না সেই হেতু সমীর ই এখন দীশার লোকাল গার্জেন। অরুনের সাথে কথা বলে দীশা তার ভাসুর কে জানায় সে সপ্তাহের দুটো দিন যুব কেন্দ্র থেকে কম্পিউটার শিখতে যাবে।

    সমীর খুব খুশি হয়ে বলে, ভালোই হলো।এই সুযোগে ঘর থেকে বের হতে পারবে।

    দীশা প্রথমদিনেই ক্লাস শেষ করে যুব কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে দেখে তার ভাসুর ঠাকুর তার পুরানো আমলের স্কুটার খানা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একেবারে হাসি হাসি মুখ করে।দেখেই দীশার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। তবুও নিজেকে সংযত রেখে বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভাসুরের স্কুটারে ওঠে একপ্রকার বাধ্য হয়ে।

    ও মা তার ভাসুর ঠাকুর বাড়ি না গিয়ে একটা পার্কে সামনে এসে দাঁড়াল।হাসি মুখে বলে, এই তো সবে বিকাল বেলা।তাই আর বাড়ি ফিরলাম না।চল দুজনে পার্কে গিয়ে একটু বসি।

    দীশা আর করে কি।সে ও রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে গুটি গুটি পায়ে পার্কে ঢোকে।

    কি সুন্দর পার্ক টা! গাছ গুলো কি সুন্দর করে কেটে আকার দেওয়া হয়েছে জিরাফের, নারী পুরুষের। দেখে মন খানা ভরে গেল দীশার।

    সমীর ও দীশা এক বেঞ্চিতে বসে আছে তবে দুপ্রান্তে। হঠাৎ করে সমীর দীশার অনেক খানি কাছে এসে বসল। কেমন ঢিপ ঢিপ করে উঠলো দীশার বুকটা।মনটা কেমন কু গাইতে শুরু করলো। কদিন ই বা চেনে সে সমীরকে। কেমন তার স্বভাব চরিত্র কে জানে? তার ওপর অবিবাহিত ।ভাই থাকে না বলে সুযোগ নেবে না তো সে?
    মনে মনে দীশা বলে,যদি কোনো রকম বেচাল দেখি তাহলে চালিয়ে দেবো টাইকন্ডুর একটা পোজ। তারপর যা হবে দেখা যাবে।

    সে একাকী নারী বলে যদি তার ইজ্জতে কোনরকম হাত দিতে আসে তার ভাসুর সে কিন্তু ছেড়ে দেবে না।
    ওদিকে ধীরে ধীরে সমীর ও দীশার খুব কাছে এসে যায়।সমীরের গরম শ্বাস পড়ছে দীশার গায়ে।সমীর হঠাৎ দীশার ওড়না টা এক ঝটকায় টান মেরে খুলে ফেলে দেয়।

    দীশা হাতের মুঠো শক্ত করে একটা ঘুঁষি বাগিয়ে মারতে যাবে সমীরের মুখে ঠিক তখনই সমীর বলে ওঠে, কি বিপদ ঘটত বলতো দীশা যদি শুয়োপোকা টা তোমার ঘাড়ে বুলে যেত।

    শুয়োপোকার কথা শুনে দীশা বেশ ভয় পেয়ে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ। ততক্ষনে সমীর একটা শক্ত কাঠি দিয়ে ওড়না থেকে শুয়োপোকা টা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।দীশা মনে মনে বলে, ছিঃ কি সাংঘাতিক ভুল বুঝেছিলাম মানুষ টা কে। পুরুষ মানে যে সুবিধাবাদী এই কথাটা ষোলো আনা সঠিক নয়। কিছু স্বার্থান্বেষী পুরুষের জন্য সমগ্র পুরুষ জাতিকে সন্দেহ করা উচিত নয় সেটা সেদিন বুঝে ছিল দীশা।

    চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে সে এগিয়ে আসে তার ভাসুরের কাছে।তার পর দুই হাত দিয়ে ওড়নাটা টাইট করে ধরে আর সমীর অতি সাবধানে কাঠির ডগাটা দিয়ে শুয়োপোকা টা ধীরে ধীরে তুলে দূরের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসে।

    তারপর হাত ধুয়ে পাশের কফি স্টল থেকে দুকাপ কফি আর সিঙারা এনে হাজির ।
    আজ সিঙারা টা কেন তার ভাসুর আনলো তা নিয়ে অনর্থক মস্তিষ্ক চালান না করে পরম আনন্দে গরম সিঙ্গাড়া আর কফির স্বাদ আস্বাদন করল দীশা।

  • গল্প,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    গল্প- শাশুড়ির মৃত্যুর পর

    ।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    শাশুড়ির মৃত্যুর পর
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    চুড়ির রিনিরিনি সেই শব্দটা বারবার কেন শুনতে পাই আমি? নিঃশব্দে শাশুড়ি অমলা বালার ছবির সামনে কাঁদতে কাঁদতে কথা টা বলে চলেছে অনুশ্রী।

    আজ তার শাশুড়ির বাৎসরিক শ্রাদ্ধ শান্তির ক্রিয়া কর্ম।অমলা বালার আকস্মিক মৃত্যু টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না অনুশ্রী।

    তার শাশুড়ি মাতা রোজ ভোর বেলায় উঠে বাগানে ফুল তোলা টা সেরে ফেলতো। তারপর বৃদ্ধা তাদের কুলমন্দির গিয়ে মন্দির চত্বরে জল ছিটানো, গোবরের ছড়া দেওয়া, মন্দিরের ভিতরের লাল মেছে টা জল দিয়ে শুকনো করে মুছে দেওয়া, নিত্য পূজার কাঁসার বাসন গুলো তেঁতুল দিয়ে ঘসে ঘসে পরিষ্কার করা এইসব কাজ করতো।
    তার এই রুটিনের কোনোদিন অন্যথা দেখেনি এই পনেরো বছরে অনুশ্রী।

    মন্দিরের পর্ব সেরে এসে অমলা বালা নিজের বাড়ির পূজার ঘরটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ধুনো জ্বালাতো। তারপর গোটা বাড়ির উপর নিচে ঘুড়ে ঘুড়ে ধুনো দেখাতো।আর তখন অমলা বালার চুড়ির রিনিরিনি শব্দ টা বেশ কানে আসতো অনুশ্রীর।

    অমলা বালার হাতে থাকতো মোটামোটা শাঁখা পলা আর চার গাছা চার গাছা করে মোট আটা গাছা চুড়ি। আওয়াজ টা তাই মন্দ হতো না।অনুশ্রী তাড়াতাড়ি করে গায়ের চাদরটা দিয়ে কানটা বন্ধ করার চেষ্টা করতো।আর অমলা বালা ছেলে অরুনের তো কোনো অসুবিধা হতো না চুড়ির রিনিরিনি শব্দে।কারণ ছোট থেকেই তার কান দুটো ভোরবেলায় এই আওয়াজ শুনতে অভ্যস্ত।

    ধুনো দেখানোর পর্ব সারা হলে অমলা বালা অনুশ্রীর ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে বৌমা কে ঘুম থেকে ওঠাতো।

    যদিও অমলা বালার মেয়ে ছবি বহুবার তাকে বারন করেছে এই কান্ড কারখানা টা না করতে।

    তখন অমলা বালা হেসে মেয়েকে উত্তর দিতো, দেখ ছবি তুই অফিস যাস না কিন্তু বৌমা তো অফিসে যায়। নটার মধ্যে ঘর থেকে না বেরোলে কি করে অফিস পৌঁছাবে দশটায়।

    ছবি তখন মুখ বেঁকিয়ে বলতো যার অফিস তার হুশ নেই ।মহারানী বেলা সাতটা পর্যন্ত পড়ে পড়ে নিদ্রা সারবেন আর তুমি তার জন্য চিন্তা করে মরবে!

    _কি করবি বল দেখছিস তো এতগুলো বছর হয়ে গেল তবু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারল না। তবে সকালে ঘুম থেকে ওঠে না ঠিকই কিন্তু রাতে তো সবার শেষে ঘুমাতে যায় বৌমা।

    আর অফিস যাওয়ার সময় আমি তো সেদ্ধ ভাত ছাড়া কিছুই রেঁধে দিতে পারি না। সাতটার সময় ঘুম থেকে উঠেই বৌমা হাঁকুপাঁকু করে মেয়েকে স্কুলে পাঠাবার জন্য। আর রিম্পাকে তো চিনিস ।সে তো আরো ঘুমকাতুরে। আটটার মধ্যে মেয়েকে স্কুল ভ্যানে তুলে তারপর বৌমা কোনরকমে একটু লেবু দিয়ে লিকার চা দুটো বিস্কুট খেয়ে ছোটে স্নানঘরে। তুই বল কখন সে রাঁধবে?

    আমি তো বাপু বেশ শক্ত পোক্ত আছি এখনো। তাই ভাতে ভাতটা বসিয়ে দিই। তা বলে যে বৌমা রান্না করতে জানেনা একথা তার চরম শত্রু কেউ বলতে পারবে না। বৌমার হাতের বিরিয়ানী, চিকেন চাপ, ডিমের চপ ওই যে কি বলিস ফিশ বল সেইসব তো তুমিও চেটেপুটে খাও মা।

    থাক থাক আর করো না মা তোমার বৌমার রান্নার সুখ্যাতি। অরন্ধন এর সময় দু চারটে লোক বলতেও তোমরা আর পারো না আজকাল। আমার শ্বশুরবাড়ির সবাই কত ভালোবাসতো আমাদের বাড়ির অরন্ধন এ আসতে। সে সবে উঠেই গেছে তোমার বৌমা আসার পর থেকে।

    শাশুড়ির পালন করা নিয়ম আচার-অনুষ্ঠান এইসব বৌমারাই আগে নিয়ে যায়। দেখো না আমাকে শাশুড়ীর পালন করা বার ,ব্রত, আচার অনুষ্ঠান এখন আমিই করি সব।

    অমলা বালা মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে বলতো, খুব ভালো করো মা। সংসারটা সংসারের মতই করা উচিত। বৌমা তো আর শুধু সংসার করে নাও তাকে অফিস টাও করতে হয়। তাই তাকে আমি কোনদিন জোর করে তার ওপর সংসারের নিয়ম, রীতিনীতি কিছু চাপিয়ে দিইনি।

    এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অনুশ্রীকে কাঁদতে দেখে ছবি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার স্বর্গীয় মায়ের এইসব কথা মনে করছিল।

    এবার সে একটু বিরক্ত হয়েই অনুশ্রী কে আওয়াজ দিল, অনেক হয়েছে কান্নাকাটি। জ্যান্ত থাকতে তো আর মানুষটার সেবা যত্ন করলে না। কোন ভোর থেকে উঠে বৃদ্ধ বয়সেও সংসারের হাল মা ধরেছিল এতদিন। এবার টের পাবে। কে তোমাকে অফিস যাওয়ার আগে মুখের সামনে ভাতের থালা তুলে দেয় এবার দেখবো?

    অনুশ্রী তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে বলে, সত্যি ছবি আমার জীবনের চরম ক্ষতি হয়ে গেছে এখন বেশ বুঝতে পারছি।

    _ এখন আর বুঝে কি হবে বৌদি? মায়ের শরীরটা নিশ্চয়ই ভিতরে ভিতরে তখন খারাপ ছিল। সঠিক সময়ে ডাক্তার দেখালে হয়তো এইভাবে মা চলে যেত না একবছর আগে।

    _কিন্তু ডাক্তার তো বলছে মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। এটা তো আগে থেকে টের পাওয়া যায় না তেমন ছবি।

    ছবি ঠেস মেরে বলে, দেখো আমি বাপু তোমার মতো এত অফিস কাছারি করি না, তোমার মতো বাইরে বাইরে ঘুরি না, আমি বাপু ঘরেই থাকি তাই আমার জ্ঞান তোমার থেকে আশাকরি কম হবে। তবু এটা জানি নিশ্চয়ই মায়ের বুকে কষ্ট হচ্ছিল কদিন আগে থেকেই।

    ওদের দুজনের কথোপকথনের মধ্যে অনুশ্রীর মেয়ে রিম্পা এসে জানায় পুরোহিত ঠাকুর এসে গেছে। বারোটা বাজলেই কিন্তু শ্রাদ্ধ তে বসবেন উনি।

    শ্রাদ্ধশান্তির কাজ সারতে সারতে বেলা প্রায় তিনটে। মোটামুটি নির্বিঘ্নে অমলা বালা বাৎসরিক শ্রাদ্ধশান্তির সমস্ত ক্রিয়াকর্ম নিয়ম মেনে আচার মেনে সুসম্পন্ন করল তার ছেলে ও বৌমা।

    শ্রাদ্ধশান্তি কাজ মিটে যাওয়ার পর ছবি শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় তার দাদার দুখানা হাত ধরে বলে, তোরা মাঝে মাঝে আমার শ্বশুর বাড়ি যাস দাদা। বৌদির তো অফিস আছে। আমার হয়তো সেরকম করে আর বাপের বাড়ি এসে থাকা চলবে না কথাটা পুরো শেষ না করেই হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো ছবি।

    পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনুশ্রী তার ননদের ব্যথা যন্ত্রণা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছিল। সে বলে, কেন ছবি তোমার বাপের বাড়ি আসা কেন চলবে না? আমি নাইবা থাকলাম ঘরে সকালের দিকটায়, সন্ধ্যার পর থেকে তো ঘরেই থাকবো। তখন তোমার আর কোন অসুবিধা হবে না।

    ছবি এবার কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, দেখো বৌদি বাপের বাড়ি এসেও আমি হাত পুড়িয়ে খেতে পারব না। তোমার যেদিন ছুটিছাটা থাকবে সেদিন বল এক বেলার জন্য আসবো আনন্দ করবো তারপর চলে যাব। শ্বশুর বাড়িতেও খাটাখাটনি বাপের বাড়িতে ও খাটাখাটনি এতো আমি পারবো না বৌদি।

    অনুশ্রী আর কথা না বাড়িয়ে ননদকে বিদায় জানিয়ে ফিরে আসে।

    সন্ধ্যের দিকে অরুণ যে বৃদ্ধা মহিলাকে তাদের কুল মন্দিরের কাজকর্ম করার জন্য রেখেছিল সেই মহিলাটি আসে। তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল অনুশ্রী।সে এলে তার হাতে নতুন দুখানা শাড়ি আর হাজার টাকা দিয়ে অনুশ্রী বলে, আমাদের কালাশৌচ শেষ হয়ে গেল।আর তোমাকে কুল মন্দিরের কাজকর্ম করতে হবে না।

    পাশেই ছিল অরুন।সে লাফিয়ে উঠে বলে, সেকি বন্ধ কেন করছো? এ আমাদের কুল মন্দির।দুই জেঠু বাইরে থাকে তাই সারা বছর আমাদের পালা থাকে। আর আমরা না পালন করলে এত দিনের মন্দির রক্ষা পাবে কি করে?

    অনুশ্রী মৃদু হেসে বলে, চিন্তা করো না তোমাদের মন্দিরের কাজকর্ম বন্ধ হবে না আমি বেঁচে থাকতে। এবার থেকে মন্দিরের কাজকর্ম আমরা করবো।

    _ সে কি করে সম্ভব!

    _ সকালের নিত্য পূজার সমস্ত জোগাড় করেই আমি অফিস যাবো।আর সন্ধ্যা টা রিম্পা দেখিয়ে দেবে। আমাদের মন্দির যখন তার দায় ভার ও আমাদের।

    আর এবার থেকে মা যে আচার অনুষ্ঠান গুলো করতেন তা আমি ও করবো।সামনেই তো ভাদ্র মাসের মনসা পূজা।আর আমাদের অরন্ধনের দিন।তাই আমি এইসময় দুটো দিন অফিস থেকে ছুটি নেবো।ছবির শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের এবার নেমন্ত্রন করবো।

    রিম্পা আর অরুন একসাথে বলে ওঠে , তুমি একা হাতে পারবে এসব?

    অনুশ্রী হেসে বলে,একা কোথায়! তোমরা তো থাকছো আমার সাথে। তুমি কিন্তু একটা দিন অফিস থেকে ছুটি নিও প্লিজ।

    রিম্পা বলে ওঠে, আমার কিন্তু স্কুল থাকবে।
    আমি কামাই করবো না।

    অনুশ্রী ধমকের সুরে বলে, একদিন স্কুল কামাই করলে তেমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।
    বাৎসরিক শ্রাদ্ধ শান্তির পর্ব মিটে গেল মানে এই নয় যে ঠাকুমা ফ্রেম বন্দী হয়ে গেল।তুই তো ঠাকুমাকে খুব ভালোবাসিস তাই না।তাই আমাদের উচিত আমরা যাকে ভালোবাসি তার চিন্তা ধারা, তার কর্ম জীবন এই গুলোকে আমাদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখা। তবেই তার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়।

    এই একটা বছর ধরে অনুশ্রী কানে চুড়ির রিনিরিনি যে শব্দটা শুনতে পেতো তা আজকাল আরো তীব্র শোনায় যখন সে কুল মন্দিরের কাজকর্ম করে, বাড়িতে ধুনো দেখায় তখন। চুড়ির রিনিরিনি শব্দটা শুনতে পেলে আগে সে ভয় পেত কিন্তু এখন সে আর ভয় পায় না। বরং বেশ সাহস পায় তে তার শাশুড়ি সবার অলক্ষ্যে সমস্ত সাংসারিক কর্মের সঙ্গে আছে।

  • গল্প,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    গল্প- আরো একবার

    ।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    আরো একবার
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    একখানা চার চাকা প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়ালো বিভার।বিভাও তৎক্ষণাৎ চোখ পাকিয়ে তাকালো গাড়িটার দিকে। গাড়ীর জানালার কাঁচ টা নামিয়ে একজন ভদ্রমহিলা বলে, অ্যাই বিভু উঠে আয় গাড়িতে।

    চমকে উঠেছিল সেদিন ডানকুনি র কোএডুকেশন স্কুলের শিক্ষিকা বিভাবরী রায়। বিভু নামটা ধরে তো তার কলেজের বান্ধবী সুদক্ষিনা ছাড়া আর কেউ কোনদিন ডাকে নি।

    কিন্তু সেই সুদক্ষিনা তো ভীষন গরীব ঘরের মেয়ে ছিল। কতবার বিভাবরী নিজের পকেট মানি দিয়েছিল সুদক্ষিনা কে। শুধুমাত্র তার অসুস্থ মাকে ফল কিনে দেওয়ার জন্য।

    বিভাবরী ছাতাটা বন্ধ করে ভালো করে গাড়ীর ভিতরের মহিলাটিকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে ছিল। মহিলা টি আবার ও বলে ওঠে, কি রে বিভু চিনতে পারছিস না? অ্যাই আমি সুদক্ষিনা মজুমদার। দূর্গাপুর গরমেনট কলেজের ২০০১ এর ইতিহাসের ব্যাচ।

    এইবার বিভা উচ্ছসিত হয়ে ওঠে। সংকোচের সমস্ত বাঁধন ভেঙ্গে বলে ওঠে, সুদু তুই! তোকে আমি চিনতে পারি নি।

    একটু ঠাট্টার ছলে,তা কেন পারবি? উঠে আয় গাড়িতে। এই বলে গাড়ীর দরজাটা খুলে দিল সুদক্ষিনা।

    বিভাবরী গাড়ীতে উঠে বসতেই গাড়িটা চলতে শুরু করল। ভাদ্রমাসের ভ্যাপসা গরমে ছাতা মাথায় বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রীতিমত ঘর্মাক্ত বিভা।

    গাড়ীতে বসেই এসির হাওয়াতে শরীরটা বেশ আরাম বোধ করল। ইতিমধ্যে সুদক্ষিনা ড্রাইভার কে বলে শক্তিগড়ের কোনো ভালো রেস্তোরার সামনে যেন গাড়ি দাঁড় করায়।

    বিভাবরী বারবার আড় চোখে দেখে চলেছে সুদক্ষিনাকে।কি সাংঘাতিক পরিবর্তন। কলেজের সেই সাদা মাটা মেয়েটা এখন কি স্মার্ট দেখতে হয়েছে।

    বিভা মনে মনে বলে, পড়াশোনা তে তার থেকে কোনদিনই ভালো ছিল না সুদক্ষিনা। তাহলে নিঃশ্চয় বড়লোকের বউ এখন।লেয়ার কাট চুলের বাঁকা সিঁথি তে আবছা একটু সিন্দুর দেখতে পেয়ে নিশ্চিত হলো সুদক্ষিনা বিবাহিত।

    সুদক্ষিনা বেশ কতগুলো ফোন কল সেরে ফোনটা ব্যাগে রাখতে রাখতে বলে ছিল, আজ কিন্তু তোকে সহজে ছাড়ছিনা।আঠেরো বছর পর আবার দেখা। এখন সাড়ে এগারোটা। লম্বা টাইম আমাদের হাতে।

    কি রে এমন ফ্যাল ফ্যাল করে কি দেখছিস বলতো? ভাবছিস গরীব,বেচারী সুদক্ষিনা কি লটারি পেয়েছে?

    বিভা ঠোঁটের কোণে একটু হাসি এনে বলে, তা তো একটু ভাবছি।অ্যাই সুদু তুই কবে বিয়ে করেছিস?

    বিয়ের কথা শোনা মাত্রই সুদক্ষিনা কেমন একটা মুচকি হাসি দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল।
    তারপর বলল, বিভু তুই কি এখন ও দূর্গাপুর এ থাকিস? আর এখানে এসেছিলি কোথায়?

    _ আমি ডানকুনির একটা স্কুলে চাকরি করছি ইতিহাসের টিচার হিসাবে। আর আমি এখন ও দূর্গাপুরে থাকি সেই পুরনো কোয়ার্টারে। যদিও কোয়ার্টার খানা এখন আমাদের নিজেদের হয়ে গেছে।
    বাবার রিটায়ারমেন্ট এর আগে থেকেই স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া কোয়াটার গুলো লীজে দিতে শুরু করেছিল।আমি ই তখন বাবার কোয়াটার খানা লীজে কিনে ফেলি।

    _ বিভু আশাকরি তোর সাথে সমরেশ দার বিয়ে হয়েছে। কেমন আছে রে সমরেশ দা?

    ইতিমধ্যে শক্তিগড়ের একটা সুন্দর রেস্টুরেন্ট এর সামনে ড্রাইভার গাড়ি টা থামালো।গাড়ি থেকে নেমেই সুদক্ষিনা বিভাবরীর হাত দুটো ধরে বলে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি কোনো দিন তোর সাথে আবার দেখা হবে। কতগুলো বছর হয়ে গেল বলতো। আমাদের মধ্যে সামান্যতম যোগাযোগ টুকু ও ছিল না। আসলে কলেজ ছাড়ার পর যে যার মতো জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েছিলাম সবাই।

    বিভু তোর মনে আছে আমাদের কলেজের পাশে জেরক্স দোকানের সুনীল দার কথা।যার দোকান থেকে ছেলে গুলো সব পরীক্ষার সময় মাইক্রো জেরক্স করে আনতো।

    _ তা আবার মনে থাকবে না।যত রকমের দু নাম্বারি কার্য কলাপের আখড়া ছিল এই দোকান টা।সুদু তোর সাথে আমাদের ব্যাচের অন্য কারোর সঙ্গে যোগাযোগ আছে না কি?
    _ আছে একজনের।
    _ কে রে?
    _ পার্থ প্রতিমের সাথে।
    পার্থ প্রতিমের নাম শুনেই বিভাবরী যেন আকাশ থেকে পড়ল। চোখ গুলো কপালে তুলে বলে, পার্থ এর সাথে তুই যোগাযোগ রেখেছিস! কি করে সম্ভব? তুই তো ওকে দুচোখে সহ্য করতে পারতিস না।

    মনে আছে সেবার সরস্বতী পূজার সময় কি সাংঘাতিক ঝামেলা হয়েছিল তোদের দুজনের মধ্যে। সমরেশ দা অনেক কষ্টে তোদের দুজনকে শান্ত করেছিল।

    _ দেখ বিভু কেউ যদি তোকে স্বার্থপর বলে তাহলে তুই রাগ করবি না?
    আমাকে মাঝে মধ্যে পার্থ ওর ইতিহাসের নোট দিত। । জানিস তো আমার কোচিং নেওয়ার মতো সামর্থ্য ছিল না।তাই মাঝে মধ্যেই এর ওর কাছ থেকে নোট ম্যানেজ করতে হতো।

    সেবার সরস্বতী পূজার ফুল, বেলপাতা, দূর্বা, সব কিছু ধুয়ে পরিষ্কার করে ঝুড়িতে বেছে রাখছি।এমন সময় পার্থ এসে বলে, সুদক্ষিনা আমাকে একটা ছোট গাঁদা ফুলের মালা দে। আমার গার্লফ্রেন্ড খোঁপায় জড়াবে।

    আমি তখন বলেছিলাম মালা সব হিসাব করে আনা হয়েছে।মালা কম পড়লে ম্যাম আমাকে বকবেন।
    আর আমার এই কথা শুনে পার্থ আমাকে বললো, ও যখন আমার কাছ থেকে নোট চাস তখন তো আমি না বলি না।নোট গুলো আমাকেও পয়সা দিয়ে কিনতে হয়।
    তারপর তো আমাকে স্বার্থপর, হিংসুটি,লোভী আরো কত কিছু বলেছিল। আসলে গরীব ছিলাম তো তাই বোধহয় আমাকে অপমান করতে কেউ দ্বিধা বোধ করতো না।

    _থাক না সুদু ঐ সব কথা। এতদিন বাদে তোর সাথে আমার যে দেখা হলো তা যে কত আনন্দের তা বলে বোঝাতে পারবো না।

    ইতিমধ্যে ওয়েটার এসে দু প্লেট মশালা ধোসা দিয়ে গেল। সাথে কফি।

    খেতে খেতে সুদক্ষিনা ও লক্ষ্য করে চলেছে বিভাবরী কে।সাজ পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে সে সধবা না বিধবা।সে তো আজকাল বাঙালি বিবাহিত মেয়েদের কে দেখে বোঝা যায় না অবিবাহিত না বিবাহিত না বিধবা। তাছাড়া সুদক্ষিনা নিজেও শাঁখা, সিঁদুর কিছুই পরে না।

    তাই সুদক্ষিনা আবার সমরেশ দার প্রসঙ্গ টা টেনে আনলো।
    কি রে সমরেশ দার কথা কিছু বল। বিয়ে করে নিঃশ্চয় খুব সুখে আছিস তোরা?

    বিভাবরী মাথা টা কিছুক্ষন নিচু করে রাখে। তারপর বলে, বছর পাঁচেক হলো

    সুদক্ষিনা তাড়াতাড়ি বিভাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, থাক থাক আর বলতে হবে না তোকে। তারপর বলে, আমি ভাবতেই পারছি না সমরেশ দার মতো মানুষ এত তাড়াতাড়ি চলে গেল। ঈশ্বরের কাছে ওর আত্মার শান্তি কামনা করি।

    বিভাবরী এবার বিরক্ত হয়ে বলে, ধূর বাপু। তোর না আগে আগে ভেবে নেওয়ার অভ্যাস টা এখনও যায় নি দেখছি। ওরে তোর সমরেশ দা মারা যায় নি। বহাল তবিয়তে আছে।

    সুদক্ষিনা কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, তাহলে বছর পাঁচেক আগে কি হয়েছিল রে?

    বিভা বলে, ডির্ভোস। তোর সমরেশ দার সঙ্গে আমার ডির্ভোস হয়েছে বছর পাঁচেক হলো ,বুঝলি পাগলি।
    _ সে কি রে! সমরেশ দার মতো বুঝদার মানুষের সাথে তুই ঘর করতে পারলি না।আর আমাকে দেখ , কেমন ফালতু, হিংসুটে,রগ চটা ছেলেটার সাথে ঘর করছি।
    _কার কথা বলছিস সুদু?
    _ কার আবার, পার্থ প্রতিম বাবুর কথা বলছি।

    এবার তো রীতিমতো ভিমরি খাওয়ার জোগাড় বিভার।সে দুচোখে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, তুই পার্থ কে বিয়ে করেছিস? কবে করলি বিয়েটা? হ্যা রে পার্থ এখন কি করে?

    _ পার্থ আর আমি দুইজনেই এখন রাজ্য পুলিশের আধিকারিক। আসানসোলে পোস্টেড।বিয়ে করেছি দশ বছর হলো।সাত বছরের একটা ছেলে আমাদের।

    তবে বিয়েটা যে কিভাবে ঘটল তা আমি ও বুঝে উঠতে পারি না। যেহেতু আমাদের দুজনের বাড়ি এক পাড়াতে। সেই হেতু পার্থ এর মা আমাকে আসতে যেতে দেখতো।

    আমি চাকরি পাওয়ার পর উনি নিজেই এসেছিলেন বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আমাদের বাড়িতে। এসে আমার মাকে বলেছিলেন, ‘আমার মেজাজী ছেলের জন্য একটা শক্ত, সামর্থ্য,তেজী মেয়ে খুঁজছিলাম। আপনার মেয়ের মধ্যে আমি সেই সব গুন গুলো দেখতে পাই।তাই আমি চাই আপনার মেয়েকে বউ করে নিয়ে যেতে।’
    ব্যাস,চার পাঁচ মাসের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল।

    তবে জানিস বিভু, পার্থ কিন্তু এখন অনেক বেশি ম্যাচিওর।রগ চটা স্বভাব টা একদমই চলে গেছে। বরং ওর মধ্যে আমি অনেক বেশি সহনশীলতা দেখতে পাই।

    _ তাই হয় বোধহয়।বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বোধশক্তি, বিচক্ষণতাও বাড়ে। কিন্তু সমরেশের ক্ষেত্রে তা আমার উল্টো মনে হয়।

    এম এ করার পর অনেক চেষ্টা করেও যখন কোনো সরকারি চাকরি জোগাড় করতে পারলো না তখন ও একটা বেসরকারি স্কুলে যোগদান করে।স্কুল টাইমিং এর পর ও বাড়িতে কোচিং ক্লাস করতো। তবুও কোথায় যেন হীনমন্যতায় ভুগতো সারাক্ষণ।কথায় কথায় টেনে আনতো আমার মাইনের কথা, চাকরির নিরাপত্তার কথা। সাত টা বছর তাও জোড়াতালি দিয়ে চেষ্টা করেছি সুসম্পর্ক রাখার। তারপর আর পারলাম না।

    সুদক্ষিনা হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে দুটো ।দুজনে রওনা দেয় দূর্গাপুরের উদ্দেশ্যে।সিটি সেন্টারে ঢোকা মাত্রই পার্থ এর সাথে দেখা।সুদক্ষিনা ফোন করে পার্থ কে আগেই আসতে বলেছিল। তারপর বিকালে সারলো দুপুরের লাঞ্চ। লাঞ্চ করতে করতে কলেজের আরো ও কিছু মজার ঘটনা ওরা স্মৃতিচারণ করলো।

    বাড়ি ফিরে এসে সুদক্ষিনা ও পার্থ প্ল্যান করে কিভাবে তাদের সমরেশ দা ও বিভাবরী কে আবার মিলিয়ে দেওয়া যায়।

    পার্থ বিভাবরীর কাছ থেকে সমরেশ দার ফোন নাম্বার নেয়। মাঝে মধ্যেই সৌজন্য মূলক বার্তালাপ করে। যে সম্পর্কের বাঁধন গুলো আলগা হয়ে গিয়েছিল সেগুলো আবার মজবুত বাঁধনে বাঁধা পড়তে লাগলো।

    সুদক্ষিনা ও পার্থ তাদের একাদশতম বিবাহ বার্ষিকীতে সমরেশ ও বিভাবরী কে নিমন্ত্রণ করলো।প্রথম দিকটায় সমরেশ ও বিভাবরীর একটু আড়ষ্ঠতা থাকলেও কলেজের পুরানো কথার ভীড়ে কখন যে আবার বন্ধুত্বের সারল্যে এক হয়ে উঠেছে তা নিজেরাই টের পায় নি।

    রাতে বাড়ি ফেরার সময় হলে পার্থ বিভাবরী কে পৌঁছে দিতে চাইলে সমরেশ বারণ করে বলে, আমি আছি তো। তোকে আর দূর্গাপুর যেতে হবে না।
    সেদিন সুদক্ষিনা দেখেছিল, তাদের সমরেশ দার চোখে সেই কলেজের দিনগুলোর গভীর ভালোবাসা বিভুর জন্য।

You cannot copy content of this page