-
গল্প – যুগল বন্দি
যুগল বন্দি
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জীফালতু পয়সা নষ্ট করাটা তোমার এখন স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে দেখছি। কোনো চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজনের হিসাব নেই, হুটহাট করে অনলাইনে নিত্য জিনিস অর্ডার করা চাই। প্রচন্ড রাগে গজগজ করতে করতে কথাগুলো বলে চলেছে অনুশ্রী।
তবে অনুশ্রীর রাগের কোনো রকমের তোয়াক্কা না করেই তার বৌমা অগ্নি (অগ্নিমিত্রা ) বলে, দেখো মামনি আমায় রান্না করতে হলে এইসব utensils লাগবে। আমার স্টিলের খুন্তিতে রান্না করতে ভালো লাগে না। আমার একখানা spatula দরকার ছিল। তাই আমি অর্ডার করে ছিলাম। That’s it.
অনুশ্রী চোখগুলোকে কপালে তুলে বলে ওঠে, ওওওও, তাহলে স্টিলের খুন্তি আজকাল ব্যাকডেটেড! এই স্টিলের খুন্তি দিয়েই আমি এতকাল সুস্বাদু সব রান্না করে চলেছি আর বাড়ি সুদ্ধ লোক চেটেপুটে খেয়ে চলেছে ।সে সব ফালতু তাহলে। আর এই দুদিন রান্না ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই মেয়ের কথা শোনো, আশ্চর্য!
এবার মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে অগ্নি বলে, আমি weekend এ কিচেনে ঢুকবো এবং সেই অনুযায়ী আমার appropriate রান্নার জিনিস পত্র লাগবে। আপডেটেড জিনিস পত্র না থাকলে আমার রান্না করতে ইচ্ছা করে না।
এবার অনুশ্রী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, তোমার আর রান্না করে কাজ নেই বাছা। রাঁধবে তো কিসব ইটালিয়ান, চাইনিজ ডিশ। আমাকে আবার তোমার শ্বশুরের জন্য আলাদা করে রান্না করতে হয় প্রতি শনি, রবিবার।
অগ্নি মুখটা বেঁকিয়ে উত্তর দেয়, মামনি তুমি যদি আদিখ্যেতা করে বাপির জন্য রান্না করো। বাপি তো আমার হাতের Risotto খেতে খুব ভালো বাসে। গত রবিবার দু’ দুবার চেয়ে নিয়ে খেয়েছে।
এরপর অগ্নি একটু বিজ্ঞের মতো বলে, যাক গে মামনি। তুমি স্নান,পূজো সেরে নাও। আজ তো তোমার কিচেন থেকে ছুটি। সুতরাং এখানে দাঁড়িয়ে বকবক করে আমার ভেজা ফ্রাই করো না। রান্না করার আগে আমার আবার একটু fresh mind লাগে। ভালো রান্না করতে হলে ভালো মন দরকার। এই বলে কানে ইয়ার ফোনটা গুঁজে স্মার্ট ফোনটা হাউস কোর্টের পকেটে রেখে কাঁধ ঝাঁকিয়ে BTS এর গান শুনতে লাগলো।
এতক্ষণ শাশুড়ি-বৌমার এই তরজা চুপচাপ উপভোগ করছিল অনুশ্রীর বোন মধুশ্রী। গতকাল সে দিদির বাড়ি বেড়াতে এসেছে। কিন্তু এসে থেকেই সে শুনে চলেছে শাশুড়ি-বৌ এর কাওয়ালি। তার দিদি দু’কথা বললে বৌমা আরো চার কথা দেয় শুনিয়ে।
বড্ড আশ্চর্য লাগছে তার এইসব বাগবিতণ্ডা। মনে মনে বলে, একি ! দিদির তো দেখছি শাশুড়ি হওয়ার সামান্য সম্মানটুকুও নেই। আমরা তো ভাবতেই পারি না শাশুড়ীর সাথে উঁচু গলায় কথা বলা যায়।এ কেমন ধারার শাশুড়ি বৌ-এর সম্পর্ক কে জানে?
স্নান, পূজো সেরে অনুশ্রী ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সিঁথিতে সিঁদুর টানছিলেন। একটা কাঁচের বাটিতে বেশ কিছুটা স্পাউট মুগ কলাই খেতে খেতে ঘরে ঢুকলো মধুশ্রী।
সে তার দিদির উদ্দেশ্যে বলে, দিদি তোর তো একটা জবরদস্ত বৌমা হয়েছে রে। কি করে সহ্য করে এক ছাদের তলায় থাকছিস একসাথে। আমি হলে কবে আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে নিতাম।অনুশ্রী মুখে ময়েশ্চারাইজার ঘষতে ঘষতে বলে ওঠে, সবই আমার কপাল মধু। কেউ কি এমন সাধ্য সাধনা করে একমাত্র ছেলের জন্য জেনে শুনে এমন বৌ ঘরে আনে। তুই তো জানিস বৌমার মা আমার কলেজের বান্ধবী।
বহু বছর পর একদিন হঠাৎই হাবিবের স্যালনে দেখা হয় বৌমার মা লীনার সঙ্গে। আমি তো এতকালের পুরানো বান্ধবী পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। আর সেই দিনই লীনার মেয়েকে দেখে আমি জাস্ট মুগ্ধ হয়ে ছিলাম।আহা কি দেখতে। চোখ মুখ যেন তুলি দিয়ে আঁকা। যেমন লম্বা তেমন ফর্সা। কি অসম্ভব স্মার্ট চেহারা।
লীনার সাথে কথা বলতে বলতে বারবার আমার চোখ চলে যাচ্ছিল ওর মেয়ের দিকে। আমিও কথায় কথায় জানালাম অনিকেতের কথা। লীনা নিজেই বলেছিল, অনুশ্রী আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আত্মীয়তার সম্পর্কে রূপান্তরিত হলে মন্দ হয় না।
আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে লীনার হাত দুঊটো ধরে বলেছিলাম, তুই তো আমার মনের কথা বলে দিলি। তবে এখনকার ছেলেমেয়েরা কি বাবা-মায়ের পছন্দ করা পাত্র পাত্রীকে চোখ বন্ধ করে বিয়ে করে নেবে রে! আমাদের সব চিন্তা ভাবনাই ওদের কাছে বোরিং ,বেকডেটেড মনে হয়।
লীনা হেসে বলেছিল, দেখা যাক না কথাটা পাড়ি আগে। তারপর কি হয় দেখা যাক।
সেই মতো আমিও তোর জামাই বাবু আর অনিকেতের কাছে লীনার মেয়ের কথাটা পারলাম। তোর জামাইবাবু তো তাড়াতাড়ি আমার ফোনটা নিয়ে ফেসবুক থেকে লীনার প্রোফাইলটা বের করে এক ঝলকে অগ্নির ছবিগুলো স্টক করে এলো।
ওর মুখ থেকেও বেরিয়ে এলো, মেয়ে তো অপূর্ব সুন্দরী। তবে বড্ড বেশি আধুনিকা মনে হচ্ছে। হট প্যান্ট না শর্ট প্যান্ট কি যেন বলো সেগুলো ছাড়া বোধহয় কিছুই পরে না।
মেয়ে আল্ট্রা মডার্ন শুনেই অনিকেতও হামলে পড়লো ফোনের ওপর। কিন্তু ফটো দেখেই সে আবার মাথা চাপড়াতে লাগলো।
মধুশ্রী প্রচন্ড কৌতুহল ভরে জিজ্ঞাসা করে, মাথা চাপড়ানো কেন দিদিভাই?
-আরে অগ্নি তো অনির কলেজেই পড়তো। অনিকেত বলে, মা এ মেয়ে বড্ড বেশি স্ট্রেট ফরোয়ার্ড। মুখের ভাষাও খুব একটা ভালো না।
তখন তোর জামাই বাবু তাড়াতাড়ি অনিকে থামিয়ে কি বলেছিল জানিস?মধুশ্রী আরো কিছুটা মুগ কলাই চিবাতে চিবাতে জিজ্ঞাসা করে, কি.. কি বলেছিল জামাইবাবু?
তোর জামাইবাবু বলে, শোন অনি তোর মায়ের যুগ আর নেই। তখনকার মেয়েদের গলা দিয়ে আওয়াজ বের হতো কম। আর এখনকার মেয়েরা অবলা নয় সবলা। নিজের লড়াই নিজেই লড়তে জানে।আমি বেশ বুঝতে পারলাম কর্তারও বেশ পছন্দ লীনার মেয়েকে। শুধু অপেক্ষা অনিকেতের মতামতের।
যদিও ছেলে সঙ্গে সঙ্গে তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা কোনটাই না জানিয়ে চুপচাপ তখনকার মতো আলোচনা সভা ত্যাগ করে বুদ্ধির ঘটে ধোঁয়া দেওয়ার জন্য নিজের ঘরে গেল সেটা আমি বেশ বুঝতে পারলাম।
মধুশ্রী তাড়াতাড়ি বলে, হ্যাঁ রে দিদি অনিকেত স্মোক করে তুই কিছু বলিস না!
অনুশ্রী বলে, মা বারণ করলেই ছেলে শুনবে এমন কোনো গ্যারেন্টি আছে? আজকাল তো দেখি কর্তা গিন্নি দু’জনেই এক সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে।
দুই বোনের খোশগল্পের মাঝে অগ্নি এসে হাজির ঝড়ের মতো। যদিও কিচেন থেকেই চিৎকার করতে করতে আসছিল, মামনি আমার cleaver খানা কোথায়?
মধুশ্রী অনুশ্রীর মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানতে চায় সেটা আবার কি?
অনুশ্রী তাড়াতাড়ি করে ড্রেসিং টেবিলের টুল থেকে উঠে খাটের তলা থেকে একটা মাঝারি সাইজের ছুরি বের করে অগ্নির হাতে দেয়।
অগ্নি চলে যাওয়ার পর অনুশ্রী বলে,এই ছুরির নাম নাকি cleaver। ছুরিটার চেহারা দেখলি। মানুষ খুন করার মতো। এটা দিয়ে নাকি কাঁচা মাছ মাংস কাটা যায় সহজে। এই জিনিসটাও গত সপ্তাহে অনলাইনে কেনা হয়েছে। আমার তো ছুরিটা দেখলেই কেমন ভয় করে। তাই খাটের তলায় লুকিয়ে রেখে দিয়েছি।
তারপর মুখটা বেঁকিয়ে অনুশ্রী বলে, বঁটি দিয়ে দিব্বি মাছ মাংস কেটে নেওয়া যায়। তা নয় মহারানীর cleaver টাই লাগবে।মধুশ্রী বেশ একটু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে, দিদিভাই তোর অবস্থা কিন্তু বেশ সঙ্গিন তোর সংসারে এখন তোর কথার দাম নেই। ছেলে, স্বামী সবাই তো বৌমার পালে হাওয়া দিচ্ছে। তুই তো একেবারে একা হয়ে গেছিস দেখছি।
অনুশ্রী একটু হেসে বলে, কি যে বলিস নিজের ঘরে কখনও কেউ একঘরে হয়! এটা যেমন আমার সংসার তেমন কিন্ত বৌমারও সংসার।
মধুশ্রী একটু বিরক্ত হয়ে বলে, দেখ দিদিভাই ছেলের বৌকে মাথায় তুলে এতো নাচিস না।পরে তোকেই আফশোষ করতে হবে। আমি তো কাল থেকে এসে দেখছি তোর বৌমা তোকে একটুও ভয় পায় না। সারাক্ষণ মুখে মুখে তর্ক লেগেই আছে। উল্টে তুই কিছু বললেই তার মুখ হাঁড়ি হয়ে যাচ্ছে।
তারপর মধুশ্রী চোখে মুখে আরো খানিকটা বিজ্ঞের ভাব ফুটিয়ে বলে,শাসন করতে না জানলে ভালো শাশুড়ি হওয়া যায় না বুঝলি।
অনুশ্রী চুপ করে থাকে বোনের সুচিন্তিত অভিমত শুনে চলেছে। কিছু কথা তার ঠোঁটের ডগায় হাজির হচ্ছিল। তবু সে চুপ করে রইলো সেই মুহুর্তে।
একথা সেকথায় আরো ঘন্টাখানেক অতিবাহিত হলো। আবার শোনা গেল অগ্নির চিৎকার রান্নাঘর থেকে। মামনি ও মামনি আমার mesh skimmer টা কোথায় গেল? আরে বাবা আমার ladle টাও দেখছি ধোয়া নেই। প্লিজ মামনি তুমি তোমার বোনের সাথে এবার খোশগল্পটা বন্ধ করে আমার কাছে এসো। প্লিজ,প্লিজ, প্লিজ।
অনুশ্রী চোখে মুখে একটা প্রশান্তির হাসি দিয়ে মধুশ্রীকে বলে, দেখছিস তো আমার বৌমার আমাকে ছাড়া মোটেই চলে না। সারাক্ষণ বৌমার মুখে লেগে আছে ‘মামনি’ ডাক খানা। আমি যাই রে শিগগিরই। না হলে রেগে আগুন হয়ে যাবে।
অনুশ্রী কিচেনে আসা মাত্র অগ্নি বলে, মামনি আমার রান্না মোটামুটি রেডি। তুমি spinnerটা দিয়ে স্যালাড-এর জোগাড়টা করে নিও। আমি টেবিল সাজাতে চললাম।
অনুশ্রী স্যালাড কেটে এনে ডাইনিং টেবিলে রাখতে গিয়ে দেখে অগ্নি আজ বানিয়েছে পুরো বাঙালি খাবার। মুড়ি ঘন্ট, মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল, মাটন কষা আর টমেটোর চাটনি আবার পাঁপড়ও ভেজেছে বেশ।ইতিমধ্যে চেয়ার টেনে বসে পড়েছে অনিকেত ও অনিকেতের বাবা। মধুশ্রীও একটা চেয়ার টেনে বসে কৌতুহল ভরে। আজকের খাবারের মেনু দেখে মধুশ্রী বলে, ও বাবা আমাদের বৌমা তো বাঙালি ডিশও বানাতে জানে দেখছি।
মাসি শাশুড়ির কথায় আহ্লাদে গদগদ হয়ে অগ্নি বলে, এইসব রান্না আমি মামনির কাছে শিখেছি। তারপর অনুশ্রীকে জড়িয়ে ধরে বলে, বুঝলে মাসিমনি আমি আর মামনি কেবল ঝগড়াই করি না আমরা একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি।
তারপর গর্ব করে অগ্নি বলে, আমার মামনি আমাকে শিখিয়েছে একটা শক্ত পোক্ত সম্পর্ক গড়ে তুলতে। একসাথে থাকতে গেলে মতের অমিল হতেই পারে তা বলে মনের অমিল কখনো নয়।
অনুশ্রী এবার হালকা ধমকের সুরে বলে, অনেক হয়েছে বক্তৃতা। এবার খেতে বসো তুমি। সকাল বেলায় একটু পাস্তা খেয়েছিস মাত্র। এত রান্না সব নিজে একা হাতে করেছো। অনেক পরিশ্রম হয়েছে। পেট পুরো খালি হয়ে গেছে। তুমিও বসে পড়। আমি খাবার সার্ভ করে দিচ্ছি।
অগ্নি বলে, না মামনি আমি তোমার সঙ্গে খাবো। weekend এর এই দুটো ছুটির দিনই তো তোমার সাথে দিনের বেলায় খেতে পাই।
অনুশ্রী মধুশ্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, দেখছিস তো মধু আমার বৌমা আমাকে কেমন জ্বালাতন করে।
মধুশ্রী হঠাৎই যেন অগ্নির মুখে দেখতে পেল তার বাইশ বছরের মেয়ের ছায়া। সেও অগ্নির মতো চঞ্চলা, চপলা, মুখরা। সারাদিন তাদেরও মা মেয়ের ঝগড়া চলে। কিন্তু খাবার টেবিলে ঠিক যেন একি রকমের ভাব।
মনে মনে মধুশ্রী বলে, হয়তো একদিন না একদিন আমার মেয়েও কারোর পুত্রবধূ হবে। হে ঈশ্বর তখন আমার মেয়েও যেন ওর শাশুড়ির সঙ্গে এই রকম যুগলবন্দী তৈরি করতে পারে।
-
গল্প- খেয়ালীর মন
খেয়ালীর মন
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জীবেশি কিছুর চাহিদা ছিল না জীবনে, তবুও যা পেয়েছি তাই আমার কাছে অনেক বেশি মনে হয়।
– কি যে বলো বৌদি? তুমি আবার পেলে কি? নিজের এতো ভালো কেরিয়ার তা’ও অবহেলা করে দূরে সরিয়ে রাখলে।
-শোন ভূমি ( ভূমিকা) কেরিয়ার গড়া এতো সহজ ছিল না। আমাদের মতো ছাপোষা মধ্যবিত্তের ঘরের বউ-এর দিনরাত গান নিয়ে মেতে থাকা সম্ভব ছিল না। আর তুই তো জানিস আমার গান করা নিয়ে তোর মায়ের কত আপত্তি।
-ছাড়ো তো মায়ের কথা। তোমার কোন বিষয়টা নিয়ে আপত্তি করে না সেটা তুমি এতদিনেও কি বুঝে উঠতে পেরেছো? নিজে যেমন করে জীবন কাটিয়েছে তোমাকেও সেই ধারাতে ফেলতে চায় সারাক্ষণ।
-ছাড় না ভূমি। আর পুরানো কথার কাসুন্দি নিয়ে বসতে হবে না তোকে। আগে বল তোর নতুন ফ্ল্যাট কতদূর? হ্যাঁ রে ভূমি তোর দাদা বলছিল ওখানকার পরিবেশটা বেশ ভালো।
-এখনও প্রোমোটারদের অনেক টুকিটাকি কাজ বাকি আছে। তবে আমি বলে দিয়েছি রথের দিন পূজোটা সেরে নেবো। আমার ফ্ল্যাটটা মোটামুটি রেডি। কারেন্টের কাজও হয়ে গেছে। কাঠের মিস্ত্রিও একজন লেগেছে।
-বাঃ বেশ ভালো খবর। নিজের ফ্ল্যাট পাচ্ছিস। নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে নিস। হ্যাঁ রে তোর পেন্টিং-এর জন্য একটা কোণা কিন্তু ফাঁকা রাখিস।
-হ্যাঁ গো বৌদি তুমি কি ধারায় তৈরি বলবে একটু? আমার শখ নিয়ে কত মাথা ব্যথা।আর নিজের শখের বেলায় উদাসীন।
ভূমি অভিযোগের সুরে বলে, তোমাকে কত করে বললাম, বৌদি আমাদের কমপ্লেক্সে একটা টু বি এইচ কে বুকিং করো। কতদিন এই ঘুপচি ঘরে কাটাবে?
মুখে একটা চওড়া হাসি দিয়ে খেয়ালী বলে, সে কি রে তোর নিজের বাপের বাড়ি তোর কাছে ঘুপচি লাগছে আজকাল। আমি তো জানতাম সব মেয়েদের কাছেই তার বাপের বাড়ি রাজপ্রাসাদ মনে হয়।
-দেখো বৌদি বাস্তবজগত আর কল্পনার জগতের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তোমার ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালাটা খুলে দিলেই দেখতে পাওয়া যায় মেজু জেঠুর ঘর। সারাদিন চলছে ওদের পারিবারিক নাটক। কখনও জেঠিমা বৌদিকে গালমন্দ করছে আবার কখনও নেপালদা মদ খেয়ে এসে নিজের মা বাবার গুষ্টি উদ্ধার করছে। এই তো গেল দক্ষিণ দিকের গল্প। আর পূর্ব দিকে রেশন দোকান। সারাদিন পাঁচিলের পাশে চলছে মুত্র বিসর্জন। পশ্চিম দিকে মধূ গয়লার ঘর। গোবরের গন্ধে একেবারে গা গুলিয়ে আসে। এই জানলাটা তো কোনদিনই খোলা হয় বলে মনে হয় না। আর রইলো উত্তর দিক। যদিও এতকাল হাওয়া বাতাস আসতো এখন তো দেখছি হাবুল কাকু দোতলা তুলছে। এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আমাদের কমপ্লেক্সে একটা ফ্ল্যাট বুক করলে কি ক্ষতি হতো। বরং গলা ছেড়ে একটু গানের রেওয়াজ করতে পারতে।এই বাড়িতে বসে শুধু হারমোনিয়ামের রিডগুলোতে হাত প্র্যাকটিসটাই হয়। গলার আওয়াজ তোলার জো নেই পাঁচ জনের কথা ভেবেই।খেয়ালী রসিকতা করে বলে, বুঝলি ভূমি আমি যদি এখন গলা ছেড়ে গান গাই তাহলে মধূ গয়লার গরুগুলোও বিরক্ত হবে।
তার থেকে ভালো যেমন আছি তেমনই থাকি।-এই তো সারাক্ষণ বিজ্ঞের হাবভাব। এইজন্যই মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে তোমাকে। টুবাই-এর সাথে ফোনে কথা হয় মাঝেমধ্যেই। ও তো পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে আমাকে যে ও অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেও কলকাতার নিউটাউন, রাজারহাট এইসব অঞ্চলে ফ্ল্যাট কিনে থাকবে।
-এতো ভালো খবর দিলি আমাকে। তোরা পিসি, ভাইপো কাছাকাছি থাকবি। যাক বাবা আমার একটা বড় চিন্তা মাথা থেকে চলে গেল।টুবাই-এর থাকা নিয়ে মাঝে মধ্যেই চিন্তা হতো। মাঝে মধ্যেই তোর দাদাকে বলি দুতলা’টা বানিয়ে ফেলতে। কিন্তু তোর দাদা বলে, তোমার সাহেব ছেলে আমাদের এই গ্ৰামে এসে কোনদিনই থাকবে না। ফালতু পয়সা খরচ করে লাভ নেই।
তা এখন দেখছি তোর দাদার কথাই ঠিক। দেখছিস খোলামেলা কথাবার্তার মাধ্যমে কত সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।অনেক ক্ষণ হলো গাল গল্প। মৈনাককে চা দিতে হবে, মা কিছু খায় কিনা দেখি।
এই বলে দুজনে রান্নাঘরে ঢুকলো। রান্নাঘরে ঢুকেই ভূমি বলে ওঠে, সাবাস সাবাস, এই নতুন ব্যবস্থাটা কবে হলো গো?
-আর বলিস না তোর দাদার শখ। এই তো অক্ষয় তৃতীয়াতে জিনিসটা ঘরে ঢুকালো।
-এতদিনে একটা আমার মনের মতো কাজ করেছে দাদা। কত দাম পরলো এই ডিশ ওয়াশারটার তা কিছু জানো তুমি?
-কি জানি পঁচিশ না হলে ত্রিশ হাজার হবে মনে হয়। ফোনে টুবাইকে বলছিল শুনতে পেয়েছিলাম। এইসব কথা বলতে বলতেই তিনকাপ জল মেপে একটা বাটিতে ঢাললো।
_ কি গো এককাপ জল বেশি নিলে কেন গো? আমরা তো চারজন লোক। মা তো চা খাবে না। দু’ কাপ জল আর দু’ কাপ দুধ দিলেই তো চার জনের চা হয়ে যাবে।
-বাবা,তোর কি নজর চারিদিকে! কথা বলতে বলতে ঠিক খেয়াল রেখে চলেছিস বৌদি কি করছে। ওরে আমি চার কাপ চা বানাবো না ছয় কাপ চা করবো।
-দু’ কাপ এক্সট্রা? কেন গো দাদা কি আবার সন্ধ্যা বেলায় চা খাবে না কি?
-না না। আমাদের ঘরের কারোর জন্য নয় পাশের মুদিখানার শ্যামলদা আর ইস্ত্রি করছে যে ছেলেটা আমাদের বৈঠকখানার চাতালে। ওদের দুজনকে বিকালে দু’ কাপ চা রোজই দিই।
চোখগুলো কপালে তুলে ভূমি বলে, তুমি তো সমাজ সেবা করতে শুরু করে দিয়েছো সে কথা আমাকে বলোনি আগে।
-কি করবো বল ওরা যে বড় আপন হয়ে গেছে। তোর দাদার অফিস যাওয়ার জামা প্যান্ট শম্ভু ইস্ত্রি করে দেয় নিত্য। আর শ্যামলদা তো করোনা কালে কি ভাবে যে উপকার করছে তা বলে বোঝানো যাবে না।আলু, পেঁয়াজ-এর পাশাপাশি আদা রসুন কাঁচা লঙ্কা সবই রাখছে দোকানে। তোর দাদাকে তো মেন মাকের্টে যেতেই হয় না। এমন কি মায়ের ডায়পার তাও শ্যামলদার দোকানে পেয়ে যাচ্ছি।
-বৌদি তুমি পয়সা দিচ্ছো ওদের। কেউ জিনিস দিচ্ছে, কেউ আবার কাজ। তা বলে নিত্য চা খাওয়াতে হবে! তোমার এই কাজটা মা জানে?
খেয়ালী মুচকি হেসে বলে, আমার ঘাড়ে কটা মাথা যে শাশুড়িকে না জানিয়ে কোনো কাজ করবো। আর এখন তো বিছানায় শুয়ে শুয়েও চতুর্দিকে নজর রাখছেন।ইতিমধ্যে একটা স্টিলের মগ নিয়ে হাজির ইস্ত্রিওয়ালা শম্ভু। পূর্ব দিকে জানালা দিয়ে মগটা চালান দিল খেয়ালীকে। তারপর একটা পলিথিন জানালা দিয়ে গলিয়ে দিয়ে বলে, কাকীমা মা পাঠালো সজনে ডাঁটা।
খেয়ালী মগে দু’ কাপ চা ঢেলে দিতেই শম্ভু গুনগুন করে গান করতে করতে চলে গেল। তারপর খেয়ালী বললো, দেখলি ভূমি এদের ভালোবাসা। এই সজনে ডাঁটাগুলোর কিন্তু আমি দাম দিলাম না। বাজারে টাকা দিয়ে অনেক সজনে ডাঁটা কিনে আনা যাবে কিন্তু এই ডাঁটাগুলোর গায়ে যে ভালোবাসা লেগে আছে তা কিন্তু কোনো অর্থ মূল্যে পাওয়া সম্ভব নয়।
আমার অতি সাধারণ জায়গায় বসবাস, সাধারণ মানের ঘরদোর, অতি সাধারণ জীবন যাপন এইসব কিছুকে ছেড়ে আর এই মাঝ-বয়সে ঝাঁ চকচকে দুনিয়ায় যেতে ইচ্ছে করে না কেন জানিস ?
শুধু মাত্র আমার চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর ভালোবাসার জন্য। আর আমার গানও তো রোজ করি সন্ধ্যা বেলায় হারমোনিয়াম বাজিয়ে ঠাকুরের সামনে নিজের মতো করে। হয়তো হাততালির গুঞ্জন থাকে না তবে তাতে থাকে নিজের ভালো লাগার স্পন্দন। একদিন সন্ধ্যার সময় হারমোনিয়াম না বাজালে তোর মা’ও খবর নেয় কি গো বৌমা শরীর ঠিক আছে তো?তাই এই মাঝ বয়সে এসে যখন হিসাবের খাতা খুলে বসি তখন দেখি না পাওয়ার থেকে পাওয়ার ঘর খানির তালিকায় প্রচুর সংযোজন। সারাক্ষণ নাই নাই করলে কি ভরে উঠবে জীবন। যতটুকু জোটে ততটুককেই যত্ন আত্তি করে রক্ষা করে রাখতে হয়। আর আমি যে ভালোবাসা পাই তোদের কাছ থেকে, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর কাছ থেকে তা এক এক সময় অতিরিক্ত মনে হয় আমার কাছে। নিজের মনে বারবার প্রশ্ন জাগে এতো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য কি আমি?
-
গল্প- উপহার কেচ্ছা
উপহার কেচ্ছা
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জীবললাম চারাপোনা আনতে আর বাবু হাজির করলেন ইলিশ। আর পারি না বাপু তোমাকে নিয়ে। এত দাম দিয়ে ইলিশ খাওয়ার কোনো মানে হয়!
-গিন্নি এখন মাসের প্রথম সপ্তাহ নিঃশ্চয় খেয়াল আছে। এখন আমার পকেট বেশ গরম বুঝলে।
-তা এতই যখন পকেট গরম তাহলে আমার শাঁখা বাঁধানোটা জুয়েলার্সের কাছ থেকে নিয়ে আসি চল। সেই কবে তৈরি করতে দিয়ে এসেছি। গিয়ে নিয়ে আসা আর হয় না। ওদের দোকান থেকে প্রায়ই ফোন করছে। ওদের কে তো আর বলা যায় না এখন হাত খালি।
গিন্নির শাঁখা বাঁধানোর কথা কথাটা শুনে অশোক বাবু হঠাৎ কেঁচোর মতো গুটিয়ে গেল। একটু দুঃখী দুঃখী ভাব করে বলে, বুঝলে এই মাসে এল আই সি এর প্রিমিয়াম জমা করতে হবে। টাকার অঙ্কটাও তো বেশ বেশি। তারপর বাবলি, বুবাই এর কলেজের নিত্য নতুন খরচা লেগেই আছে। ছোট মাসির মেয়ের বিয়ে লেগেছে। সেখানেও মোটা খরচা। তাই বলছিলাম এই মাসে তোমার শাঁখা বাঁধানোটা জুয়েলার্সের কাছেই থাক। সামনের মাসের দশ তারিখের মধ্যে আমি নিজে গিয়ে তোমার গয়না আনবো।
সুলতা দেবী মুখটা বেঁকিয়ে বলে, থাক তোমাকে আর দুনিয়ার দরকারি হিসাব আমাকে শোনাতে হবে না। সবার সব কিছুতেই তুমি মুক্ত হস্ত। শুধু মাত্র আমার বেলায় তোমার পকেট গড়ের মাঠ।
এই বলে দুমদাম করে পা ফেলে ইলিশ মাছগুলো পেঁথেতে নিয়ে ধুতে চললো কলতলায়। রান্না ঘরের বেসিনে মাছ ধোওয়া একদম পছন্দ নয় সুলতা দেবীর। বেসিনে মাছ ধুলে নাকি সারা বেসিন ময় বিশ্রী গন্ধ হয়ে যায়।
বুবাই আর বাবলি ঘরে বই খাতা নিয়ে পড়তে বসলেও বাবলি কিন্তু কানখাড়া করে মা বাবার ঝগড়া শুনছিল এতক্ষণ। সে বিজ্ঞের মতো বলে, দাদাভাই এই শুরু হল রোজকার ড্রামা। উঃ পারেও বাবা এরা। কি করে যে রাতে ঝগড়া না করে ঘুমায় একসাথে কে জানে?
বুবাই বলে, রাতেও বিছানায় মা আর বাপি যুদ্ধ করে সেটা জানিস কি তুই? আরে সেদিন মা মনিকে বলছিল, বুঝলি ববি তোর অশোকদার সাথে আর এক ঘরে থাকা যাবে না।
বাবলি প্রচন্ড আগ্ৰহ ভরে বলে, তারপর, তারপর?
-মনি ওপার থেকে কি বলছিল সেটা তো শোনা যায় না। জানিস তো মা স্পিকারে দিয়ে কোনো কথা বলতে চায় না মামাবাড়ির লোকজনদের সঙ্গে। শুধু মাত্র যখন ঠাম, পিপি ফোন করে তখন তাড়াতাড়ি করে ফোনটা স্পিকারে দেয়। যাতে ওদের কথা আমরা সবাই শুনতে পারি।
বাবলি চিন্তিত মুখে বলে, তাহলে তুই জানতে পারলি না মা বাপির রাতের বেলায় অশান্তির কারণটা। জানিস দাদা, সেদিন মোবাইলে দেখছিলাম একজন ভদ্রলোক বিয়ের পঁচিশ বছর পরও অন্য মেয়ের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে।
বুবাই ধমকের সুরে বলে, তার মানে তুই কি বলতে চাইছিস ? অন্য কোনো মহিলাকে নিয়ে মা-বাপির মধ্যে অশান্তি। তুই না তোর এই বস্তা পচা সিরিয়ালগুলো দেখা বন্ধ কর এবার। যতসব base less কথাবার্তা।
বাবলি উল্টে বিরক্ত হয়ে বলে, for your kind information আমি মোবাইলে প্যানপ্যানে সিরিয়াল দেখি না। আমাদের জেনারেশন এখন ওয়েব সিরিজ দেখে। আর তুই ভাবিস না আমি বিনা কারনে বাপিকে সন্দেহ করছি।
-প্রমাণ! কি প্রমাণ শুনি?
-দুদিন আগে আমার বান্ধবী কুজ্ঞা টিউশনিতে আমায় জিজ্ঞেস করে, কি রে তোর মা বাবার marriage anniversary কেমন কাটলো? কাকু কিন্তু দারুণ একটা রোমান্টিক স্ট্যাচু গিফট করেছে কাকিমা’কে তা আমি জানি। কি সুন্দর কাঁচের বলের মধ্যে একটা ছেলে ও একটা মেয়ে পুতুল ঘুরছে। আবার কি সুন্দর একটা রোমান্টিক মিউজিকও বাজছে।
দাদাভাই তোকে কি বলবো, আমি তো কুঞ্জার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম।প্রথম কথা মা বাপির বিবাহ বার্ষিকী সেই জানুয়ারি মাসে আর কস্মিনকালেও দেখলাম না ওরা বিবাহ বার্ষিকী পালন করছে। দ্বিতীয়, বাপি মা’কে কিছু দিলে মা অবশ্যই আমাদের দেখাতো। তাহলে এখন প্রশ্ন হলো বাপি গিফটটা কার জন্য কিনলো?বুবাই সব শুনে বলে, দেখ বোন হয়তো বাপির অফিসের কোনো কলিগের বিবাহ বার্ষিকীর অনুষ্ঠান আছে তাই বাপি গিফটটা কিনেছে।
বাবলি উত্তেজিত হয়ে বলে, তোর কি মনে হয় বাপি তার বন্ধু বান্ধব দের দামী গিফট দেবে? এখনও খামে ভরে একশো এক টাকার বেশি কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে বাপি গিফট দেয় না।
তারপরই খুব দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলে, হ্যাঁ রে দাদাভাই মা জানতে পারলে কত খানি দুঃখ পাবে একবার ভেবে দেখেছিস। যদি বিষয়টা জানাজানি হয়ে যায় তাহলে আমরাই মুখ দেখাবো কি করে?
বুবাই এবার প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলে, তোকে এবার টেনে এক থাপ্পড় লাগাবো। ওয়েব সিরিজ দেখে দেখে মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। এই গিফটের বিষয় নিয়ে মাকে কিন্তু কিচ্ছুটি বলবি না একদম। তোর আবার যা পেট পাতলা স্বভাব।
আপাতত অশোক বাবুর রোমান্টিক গিফট কেনার অধ্যায়টা বন্ধ করে ভাই-বোনে। দুপুরে জমিয়ে সাদা সরষে বাটা দিয়ে ইলিশ মাছের ঝাল বাটনা খেয়ে বাড়ি সুদ্ধ লোক খুব খুশি। অশোক বাবু খেতে বারবার বলে উঠছিলেন, বাবলি, বুবাইকে কিন্তু দু’ পিস করে মাছ দিও। আমাকে এক পিস দিলেই হবে। তোমার জন্য কিন্তু বড় পিসটা আগে তুলে রাখো।
সুলতা দেবী এবার মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে, পরিবেশন যখন আমি করছি তখন আমি বুঝবো কাকে কি দিতে হবে। তুমি এতো বকবক করছো কেন? তাহলে এবার থেকে তুমিই ছেলে মেয়েকে খেতে দিও।
বাবলি খেতে খেতে বলে, মা ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুশাকটা কিন্তু বেশ ঝাল ঝাল করে রান্না করো।
সুলতা দেবী বাবলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ঠিক আছে তাই হবে। আগামীকাল তো সেকেন্ড হাফে কলেজ যাবি। তাহলে গরম গরম খেয়েও যেতে পারবি।
-না না। কলেজ যাওয়ার আগে মাছ খাবো না। মুখে কেমন একটা গন্ধ লাগে। তার থেকে ভালো রাতে আরাম করে খাবো।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া সারা হলে রান্নাঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সুলতা দেবী নিজের ঘরে এসে দেখে তার পতিদেবতাটি আজ নাক ডাকিয়ে দিবা নিদ্রা না দিয়ে মোবাইলে গান শুনছেন ইয়ার ফোনটা কানে গুঁজে।
সুলতা দেবী মৌরি চিবাতে চিবাতে বললো, কি ব্যাপার বাবুর আজকে এতো খোশমেজাজ?
অশোক বাবু তাড়াতাড়ি ইয়ার ফোনটা কান থেকে খুলে সুলতা দেবীর কানে গুঁজে দিল।’ এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার, জৈষ্ঠ্যতে হলো পরিচয়। আসছে আষাঢ় মাস মন তাই ভাবছে কি জানি কি হয়?’ এই গানটা শুনে সুলতা দেবী বলে এতো ‘বিলম্বিতলয় ‘ছবির গান সুপ্রিয়া দেবীর লিপে।
-ওগো তোমার কি মনে নেই আমাদেরও বিয়ের কথা ফাইনাল হয়েছিল আষাঢ় মাসের তেরো তারিখে।
-তা আবার মনে নেই। Unlucky thirteen -কি unlucky? ওওওও আমি বুঝি তোমার জন্য unlucky?
-বিয়ে করে যে আমার luck টাই কোথায় চলে গেল আজও টের পেলাম না।
-সে তুমি যাই বলো। তুমি কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে লাকি বস্তু।
-বাঃ বাঃ, বউ হল কি না বস্তু!
-আরে বাবা চটছো কেন? আমি তোমাকে বস্তু বলতে চাই নি।
-দেখো বাপু সকাল থেকে অনেক খাটাখাটনি হয়েছে। তুমি তোমার স্মৃতিচারণ বন্ধ করো এবার। আমাকে একটু গড়িয়ে নিতে দাও।এই বলে সুলতা দেবী পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো।অশোক বাবু সুলতা দেবীর কানের কাছে একটা মিষ্টি রোমান্টিক মিউজিক চালায়। সুলতা দেবী মুখ ঘুরিয়ে দেখে একটা কাঁচের বলের মধ্যে একটি ছেলে ও মেয়ে পুতুল হাত ধরে নাচছে। সুলতা দেবীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, কি সুন্দর গো!
তা এটা কার জন্য কিনলে গো? তোমাদের অফিসের কারোর বিবাহ বার্ষিকী আছে নাকি?
অশোক বাবু প্রেমে গদগদ হয়ে বলে, এটা তোমার গিফট। আমি তো খরচের ভয়ে সেভাবে কোনদিন বিবাহ বার্ষিকী কিংবা তোমার জন্মদিন পালন করি নি। তাই কদিন ধরে ভাবছিলাম আষাঢ় মাসের তেরো তারিখটা এলে তোমাকে একটা উপহার দেবো। কতদিন শুধু মাত্র তোমার জন্য কিছু কিনি না।
সুলতা দেবী বিছানাতে উঠে অশোক বাবুর কাঁধে মাথাটা রেখে বলে, আটাশটা বছর পেরিয়ে গেলেও সেদিনের তোমার লাজুক চাহনিটা আজও আমার মনে পড়ে। তখন এই রকম টেকো মাথাটা ছিল না। ছিল মাথা ভর্তি চুল ঠিক রাজেশ খান্নার মতো।
-তাই বুঝি, আমাকে ইয়ং বয়সে রাজেশ খান্নার মতো লাগতো। কই তুমি তো কোনোদিন সেকথা বল নি। ভাগ্যিস আজ এই রোমান্টিক স্ট্যাচুটা তোমার জন্য কিনে আনলাম। তাই তো তোমার মনের কথা জানতে পারলাম।
সুলতা দেবী মুচকি হেসে বলে, থাক অনেক হয়েছে। বুড়ো বয়সে আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। ছেলে মেয়েদের এখন প্রেম করার বয়স। আমাদের নয় গো।
-সে কি গো গিন্নি প্রেমেরও আবার বয়স আছে নাকি?
-আছে মশাই আছে। প্রেমেরও বয়স আছে। তুমি যে আমাকে এত সুন্দর এই শো-পিসটা দিলে টাকা খরচা করে সেটা যদি আমি বাবলি বুবাইকে দেখাই তাহলে ওরা তো পিছনে হাসাহাসি করবেই। তোমার যখন এতই উপহার দেওয়ার ইচ্ছা করছিল আমাকে বলতে পারতে একবার। আমার অনেক দিনের একটা স্টিলের চাকি বেলনের সখ ছিল। ওটা দিলে আমার কাজেও লাগতো আর আমাকে তোমার উপহারটা লুকিয়ে রাখতে হত না।এই বলে তাড়াতাড়ি গিফটটা বক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে আলমারির লকারের একদম ভিতরের দিকে রেখে দিল।
অশোক বাবু রাগ করে বললেন, লুকিয়ে রাখার কি হয়েছে? তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি। এইজন্যই কিছু আনতে ইচ্ছে করে না ভালোবেসে। তারপর কোলবালিশটা টেনে পিছন ফিরে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লেন।
দিন পনেরো পর বাবলি কি একটা দরকারি কাগজের খোঁজে আলমারির লকারটা খোলে। সুলতা দেবী আলামারি কেনার পর থেকেই লকারেই দরকারি কাগজ পত্র রাখে।লকারে রাখার মতো গয়না তো আর তার নেই তাই মূল্যবান কাগজ দিয়েই ভরে রাখেন সেটা।
বাবলি লকারের ভিতরে একদম কোণের দিকে একটা ছোট বক্স দেখতে পায়। তাড়াতাড়ি করে সেটা টেনে বের করে খুলে দেখে তো সে হতবাক। হুবহু কুঞ্জার দেওয়া বিবরণ মিলে যাচ্ছে।
বাবলি ভাবে তাহলে কি বাবা এটা লকারের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে একদম কোণে। যাতে মায়ের নজরে না আসে। লকার তো আর মা নিত্য খোলে না। সে তাড়াতাড়ি গিফটটা যথাযথ ভাবে প্যাক করে যথাস্থানে রেখে দিয়েই ছুটলো বুবাই এর কাছে। বুবাই সেদিন ইউনিভার্সিটি যায় নি। বাবলি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে তাকে গোটা বিষয়টা জানায়। বুবাইও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। সন্তান হয়ে বাবার কেচ্ছা মাকে বলতে লজ্জা করছিল বাবলির। তাই বাবলি তার ছোট মাসি ববিতাকে ফোন করে সব জানায় এবং বিকালে ডেকে পাঠায়।
ববিতাও তড়িঘড়ি করে বিকাল পাঁচটার মধ্যে এসে হাজির। কারণ সে জানে জামাইবাবুর অফিস থেকে ফিরতে ছটা সাড়ে ছটা বেজে যায়। সুতরাং নিশ্চিন্তে দিদির সাথে কথা বলা যাবে জামাইবাবুর বিপথ গামী হওয়াকে কেন্দ্র করে।
দুই বোনে একদম দরজা বন্ধ করে আলোচনা সভা বসায়। বাবলি বুবাই বারবার দরজায় আড়ি পেতে চলেছে। কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরে আসছে।
বাবলি বুবাইকে বলে, বুঝলি দাদাভাই মা মাসিমনির কাছ থেকে উপহার কেনার বিষয়টা জানার পর আজ আর বাপিকে আস্ত রাখবে না।তা প্রায় এক ঘন্টা পর সুলতা দেবীকে দরজা খানা খুলে চুপচাপ বেরিয়ে এলেন। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলে মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকালেন। তারপর রান্না ঘরে চলে গেলেন।
বুবাই, বাবলি তার ছোট মাসিকে চেপে ধরে জানতে চাই তার মায়ের প্রতিক্রিয়ার কথা। ববিতা মুচকি হেসে বলে, তোদের বাপিকে নতুন করে প্রেম রোগেতে ধরেছে বুঝলি।
বাবলি তৎক্ষণাৎ বিজ্ঞের মতো বলে, দেখলি দাদাভাই আমার সন্দেহ খানা একদম ঠিক।
সুলতা দেবী গ্যাস ওভেনে চা-এর জল চাপাতে চাপাতে তার ছেলে মেয়ের কান্ড কারখানা ভাবছেন আর মুখ টিপে টিপে হেসে চলেছেন। নিজের মনেই বলতে থাকে, আমাদের দাম্পত্য প্রেম বোঝা কি এত সহজ ব্যাপার! সারাদিন আমরা ঝগড়া করি বলে কি আমাদের ভিতরের ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে! দম্পতিদের ভালোবাসা অনেকটা ফল্গুধারার মতো লুকিয়ে থাকে মনে।
-
গল্প- কাঁধ
কাঁধ
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জীকি গো অনেক আশা করে তোমার কাছে কথাটা পারলাম কিন্তু। আশাকরি নিরাশ করবে না। কি গো কিছু তো বলো? আর কতক্ষণ এই নীরবতা?
অভিজিৎ বাবু তার স্ত্রী অনুরিমার মুখ থেকে ‘হ্যাঁ’ এই শব্দটুকু শোনার জন্য তীর্থের কাকের মতো তার মুখের পানে চেয়ে বসে রইলো।
অনুরিমা কোন উত্তর না দিয়ে চুপচুপ রুটি সেঁকতে লাগলো। ছয়টা রুটি করে একটা সাদা কাপড়ে মুড়ে একটা স্টিলের থালায় রেখে তার ওপর আরেকটা থালা ঢাকা দিয়ে রাখল। কতবার ভেবেছে রুটি গরম রাখার জন্য একটা হটপট কিনবে। ঠিক যেমন তার বড়-জার ঘরে। কি সুন্দর দেখতে ছিল! লাল রঙের বডিটা আর তার ওপর সাদা ঢাকনা।আহা দেখলেই মন ভরে যায়।
তবে আজকাল আর অতিরিক্ত কোনো জিনিসই কিনতে ইচ্ছে করে না অনুরিমার। ওই সব ইচ্ছে হতো আজ থেকে অনেক বছর আগে। বড় জায়ের ঘরের সুন্দর সুন্দর জিনিসপত্র দেখে মন ভরানো ছাড়া তখন তার আর অন্য কোন উপায় ছিল না। বড় জায়েদের দু’ দুটো ইঞ্জিন সংসার নামক শকটখানিকে টেনে নিয়ে যায় সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও বৈভবের সাথে।
হ্যাঁ, অনুরিমার বড় জা তমালী সরকারি হসপিটালের নার্স এবং বড় ভাসুর প্রলয় পোস্ট মাস্টার। আজ থেকে সাতাশ বছর আগে অনুরিমা যখন অভিজিৎ-এর বৌ হয়ে আসে তখন কিন্তু প্রথমে ভাসুরের ঘরেই ওঠে।
আসলে অভিজিৎ-এর পৈত্রিক বাড়িখানা ছিল খুব ছোট। দুটো মাত্র ঘর। তাও আবার টালির ছাদ দেওয়া। তাই তার দাদা পৈত্রিক ভিটেতেই স্বতন্ত্র দুতলা বাড়ি বানিয়ে থাকে।
অভিজিৎ-এর বাবার দূর্গাপুর স্টেশন চত্বরে একটা ছোট গুমটি ছিল। দুই ছেলে, দুই মেয়ে, স্বামী- স্ত্রী এই ছয়টা পেট প্রতিপালন করতেই ওনার আয়ের অধিকাংশ ব্যয় হয়ে যেত।
তবে অভিজিৎ-এর বাবা ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে খুব যত্নশীল ছিলেন। ভদ্রলোক অভাব অনটন এইগুলোর সঙ্গে লড়াই করে ও চার ছেলেমেয়েকে কলেজের গন্ডী পার করিয়েছিলেন।
তার বড় ছেলে ও বড় বৌমা উভয়েই চাকুরিজীবি। তার দুই মেয়ে ও জামাইরা সু- রোজগেরে। শুধু একটু কমজোর হয়ে পড়েছে তার ছোট ছেলে অভিজিৎ। বেসিক ট্রেনিং থাকা সত্ত্বেও প্রাইমারি স্কুলের চাকরি খানা তার কপালে জোটে নি। তাই সে আজও টিউশনির টিচার।
অভিজিৎ-এর বিয়ের পর তার বড় বৌদি তাদেরকে নিজেদের বাড়ির একতলার একটা রুম ছেড়ে দিয়েছিল। অনুরিমার বিয়ের পর মাস ছয়েক বেশ তার স্বপ্নের মতো কেটেছিল। বড়জা তমালীর শিফটিং ডিউটি। তাই অনুরিমাই বেশিরভাগ সময়টা রান্না ঘরের দিকটা সামলানোর চেষ্টা করতো।বড় জা নাইট ডিউটি করে এলে অনুরিমা যথেষ্ট ভালোবেসে তার মুখের সামনে তুলে ধরতো তার অপটু হস্তের বিভিন্ন দেশের মানচিত্রের ন্যায় গড়া রুটি ও ফোড়ন আলুর তরকারি।
তমালী যদিও রুটির আকার নিয়ে অনুরিমাকে ব্যঙ্গ করলেও পরক্ষণে মুখটি বুজে খেয়ে নিত। নাইট ডিউটি করে বাড়ি ফিরে তো আর কষ্ট করে নিজেকে খাবার বানাতে হলো না। এটাই কি কম?
বড় জায়ের একমাত্র মেয়ে নিশা তখন ছিল বছর ছয়েকের। সব সময়ের জন্য কাকিমুনিকে পেয়ে সে খুব খুশি।
তবে অনুরিমা ফাঁক পেলেই তার শ্বশুরের পুরানো বাড়িতে চলে আসতো। শাশুড়ির হাতে হাতে কাজ করে দেওয়ার চেষ্টা করতো। একদিন অনুরিমার শাশুড়ি তাকে বলে, বড়লোক ভাসুরের ঘর ছেড়ে গরীব শ্বশুর শাশুড়ির কাছে এসে থাকতে কি তোমার খুব অসুবিধা হবে?
অনুরিমা যেন আকাশ থেকে পড়েছিল সেদিন। সে মনে মনে কিছুটা লজ্জিত হয়ে বলে, মা যতদূর আমি জানি আপনার ইচ্ছাতেই আমি বড়দার ঘরে থাকি। সেই রকম কথাই আমাকে বলেছিল আপনার ছেলে।অনুরিমার শাশুড়ি অভিজিৎ-এর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, ওটা তো একটা আহাম্মক। চিরকালই জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কোনোদিন স্পষ্ট কথা বলার সৎ সাহস ওর হলো না।
-আমি ঠিক বুঝলাম না মা। প্লিজ একটু খুলে বলবেন।
-তোমাকে বিয়ে করে বাবার এই ভাঙাচোরা ঘরে কিভাবে তুলবে সেই চিন্তায় অভি অস্থির ছিল। তখন আমার বড় মেয়েই প্রলয়কে বলে তোমাদের ওখানে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়।
-ওওও তাই বলুন। মা আমি কিন্তু অতি সাধারণ ঘরের মেয়ে। আমার কোনো অসুবিধা হতো না এই ছোট্ট ঘরে থাকতে।অনুরিমার শাশুড়ি স্নেহাতুর কন্ঠে বলে, ছোটো বৌমা যেদিন মন চাইবে তোমার এসে থেকো। আমি অপেক্ষায় থাকবো।
তবে অনুরিমার শাশুড়িকে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয় নি। তমালীর স্বভাবই হচ্ছে অনুরিমাকে কথায় কথায় ছোটো দেখানো। তবে সেদিনের ঘটনার পর অনুরিমা আর তার বড়লোক ভাসুরের বাড়িতে থাকতে চায় নি।
ঘটনাটা ছিল, অনুরিমার দিদি, জামাইবাবু এসেছিল তার সঙ্গে দেখা করতে। অনুরিমাও যথারীতি চা, বিস্কুট দিয়ে তাদের আপ্যায়ন করে।
তারা চলে যাওয়ার পর তমালী বলে, অনু এবার থেকে আলাদা বিস্কুটের প্যাকেট, চিনি, চা পাতা, গুঁড়ো দুধ কিনে তোর রুমে আলাদা করে রেখে দিস। আমাদের তো এখন পাঁচ জনের হিসাবে মাসকাবারি বাজার আসে। অতিরিক্ত লোক হলে তখন আবার মাসের রেশন নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।
অনুরিমা বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারে তার বড় জায়ের কথার মর্মার্থ।
সেদিন রাতে অভিজিৎ টিউশনি পড়িয়ে বাড়ি ফিরে এলে, অনুরিমা সন্ধ্যা বেলার সমস্ত কথা তাকে খুলে বলেছিল এবং অনুরিমা জানিয়েছিল, আগামীকালই সে বড় জায়ের বাড়ি পরিত্যাগ করে শ্বশুর শাশুড়ির কাছে চলে যাবে। মাসের পর মাস বড়লোক ভাসুরের বাড়িতে গলগ্ৰহ থাকা উচিত হবে না। সংসার যখন পেতেছি তখন তার ব্যয় ভার আমাদেরকেই ওঠাতে হবে।
যদিও অনুরিমার এই সিদ্ধান্তকে তমালী পূর্ণ মাত্রায় সমর্থন করে বলেছিল, চিরকাল কি অন্যের ঘাড়ে বসে খাওয়া উচিত?
অনুরিমাকে কাছে পেয়ে অভিজিৎ-এর বাবা মা খুব খুশি হয়েছিল। অনুরিমা সংসারের কাজ সামলেও তার পুরানো টিউশনিগুলো আবার শুরু করে। বড় জায়ের সংসারের মতো বৈভব না থাকলেও স্বাধীন ভাবে শ্বাস নেওয়ার আনন্দ এখানে পেয়েছিল।
ননদরাও যথেষ্ট সাহায্য করে অনুরিমা, অভিজিৎ-কে। ছুটির দিনগুলোতেই তারা সবাই মিলে একসাথে খাওয়া দাওয়া করে রাতে যে যার বাড়ি ফিরে যেতো।
শুধু ননদরা নয় ছুটির দিনগুলোতে বড়জা, বড় ভাসুর, তাদের মেয়ে সকলকেই নেমন্ত্রন্ন করতো অনুরিমা। অনুরিমার দৃষ্টি ভঙ্গিতে কোন দ্বিচারিতা ছিল না কোনোদিনই।
এইভাবে বছর দুয়েক অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংসারের শ্রী ফেরাতে উদ্যত হয়েছিল অভিজিৎ ও অনুরিমা। দু’ কামরা ঘরে খুব অসুবিধা হতো। তাই লোন নিয়ে আরো দু’টো ঘর বানায় ছাদ ঢালাই করে। এখন ননদরা বাপের বাড়িতে এলে নিশ্চিন্তে রাত কাটায়।
বছর তিনেকের পর অনুরিমা মা হয়েছিল। তাদের কোল আলো করে জন্মায় এক পুত্রসন্তান। অনুরিমা তার ছেলের নাম রাখে অরিত্র। অনুরিমার ছেলে হওয়ার পর থেকেই তার বড়জার ব্যবহারের আমূল পরিবর্তন ঘটে। তমালী সবসময় ভাবতে থাকে এবার বোধহয় তার মেয়ের আদর সব কমে গেল।তমালীর মনের গভীরে কোথাও যেন হিংসার ক্ষেত গড়ে উঠেছিল।
মাঝে মধ্যেই তমালী অনুরিমাকে হাবেভাবে বোঝাতে চাইতো, একজন সাধারণ গৃহবধূর থেকে একজন ওয়ার্কিং ওম্যানকে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়। একজন চাকুরিরতা মহিলার কাছে সময় প্রচন্ড মূল্যবান। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী নিয়ে সব সময় হৈ হৈ করার সময় থাকে না।
বাড়িতে টিউশনি পড়ালেও ছাত্র ছাত্রীদের কাজ দিয়ে নিজের কাজও কিছুটা সেরে নেওয়া যায়। এইসব নানা মনগড়া যুক্তি অনুরিমার বড়জায়ের ঠোঁটে লেগেই থাকতো।তবে অনুরিমার সহনশীলতা অনেক বেশি। সে কখনো প্রত্যুত্তর করার কথা ভাবতো না। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে তার চোখের জল সে মুছে নিত সংগোপনে।
সত্যিই তো তার বড় জা, ভাসুর আর্থিক দিক থেকে তাদের থেকে অনেক বেশি স্বাবলম্বী।এই সত্যটুকু মেনে নেওয়ার মধ্যে তো কোন লজ্জা থাকা উচিত নয়। কিন্তু তা বলে বড় জায়ের অনুরিমাকে সর্বদা দুখী ভাবার কারণ নেই। মোটা ভাত, মোটা কাপড়ের অভাবও তার নেই।
কিছু মানুষ অল্পে তুষ্ট হতে জানে। আর অনুরিমা সেই দলেই পড়ে।একে একে শ্বশুর, শাশুড়ি পরলোকগমন করেছেন। অনুরিমাই ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে অভিজিৎ-দের বাড়ির এক মজবুত স্তম্ভ। অভিজিৎ-এর বোনেরা আজও বাপের বাড়ি বলতে বড় ভাইয়ের ঘরখানি না ছোট ভাইয়ের ঘরখানিই বোঝে। অনুরিমা জানে তার শ্বশুরের ভিটেখানি তার ননদদের কাছে কত প্রিয়। মেয়েদের শৈশব থেকে মেয়েবেলার কত স্মৃতি জড়িয়ে থাকে বাপের বাড়ির প্রতিটা কোণে।
তবে অভিজিৎ-দের উঠানটা আজ দ্বি-বিভক্ত। এতকাল বাড়ি আলাদা হলেও উঠানখানি ছিল এক। এক উঠানের দুই প্রান্তে দুটো বাড়ি মনে হতো একটি পৃথিবীর দুটি প্রান্ত। কিন্তু যখন থেকে উঠানের বুক চিড়ে লম্বা, উঁচু একটা পাঁচিল উঠে গেল তখন থেকেই অনুরিমার মনে হতো সে ও তার বড় জা দুটো অনেক আলাদা জগতের মানুষ।
তবে এই পাঁচিল কিন্তু সহজে ওঠে নি। এর পিছনেও আছে একটা অধ্যায়। অভিজিৎ -এর ছেলে অরিত্র যখন থেকেই হামা টানতে শিখেছিল তখন থেকেই সে হামা দিয়েই যখন তখন বড় জেঠিমার বাড়িতে হানা দিত নিশা দিদির সান্নিধ্য লাভের আশায়।নিশাও সারাদিন ভাই ভাই করে বেড়াতো। অরিত্রকে ঠিক করে কোলে নিতে পারতো না তবুও কোনরকমে কাঁখে তুলে টলমল পায়ে গোটা উঠানময় ছুটে বেড়াত।
তমালীর অরিত্রের প্রতি নিশার এই অতিরিক্ত টানখানা মোটেই ভালো লাগতো না। নানা অছিলায় নিশাকে অরিত্রের থেকে দূরে রাখাতে চাইতো। তবুও ছোট্ট নিশাকে আটকে রাখতে পারতো না। তমালী হসপিটালে গেলেই নিশা হাজির হয়ে যেত তার কাকীমনি ও ভাইয়ের কাছে।
যখন পড়াশোনার অজুহাত, বকাবকি করেও নিশাকে আটকে রাখা যাচ্ছিল না তখন তমালী এই পাঁচিল তোলার স্বিদ্ধান্তটা নেয়। যদিও তারা স্বামী স্ত্রী সকলকে জানিয়েছিল, আমরা তো দু’জনেই কাজে বেরিয়ে যাই। মেয়ে বড় হচ্ছে। তাই ওর নিরাপত্তার কথা ভেবেই এই পাঁচিল তোলার ব্যবস্থা। তবে পাঁচিলের মাঝে অবশ্যই একটা ছোট গেট রাখা হয়। দুই বাড়ির মধ্যে যাতায়াতের জন্য।তবে এই যাতায়াতের সুবিধার জন্য লোহার গেট খানি বছর খানেকের মধ্যে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল অনুরিমার বড় জা ও ভাসুরের কাছে। তারা লোহার গেটটাতে একটা বড় তালা ঝুলিয়ে দিল।রোদে,জলে স্নাত হয়ে গেটটাতে মরচে পড়ে গেছে। লোহার গেটটার গা বেয়ে কত নাম না জানা আগাছাও জন্মে গেছে। তবে লোহার গেটটার দিকে তাকালে মনে হয় সে যেন অনেক কিছুর বোবা সাক্ষী।
পাঁচিল তোলার সময় অভিজিৎ একটু আধটু আপত্তি করলেও পরে ভাবে ভাই ভায়াদের বিবাদ তো অনিবার্য। আজ আপত্তি করলে কাল যদি আমার নিজেরই পাঁচিল তোলার দরকার পড়ে। এত বড়ো উঠানে পাঁচিল দেওয়ার খরচাও অনেক। আর সেই সঙ্গতিও তার নেই। আসলে চিরকালই দূর্বলরা সবলদের অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে আসছে। অভিজিৎ-দের দুই ভাইয়ের মধ্যেও তাই হয়েছিল।এখন অনুরিমার চুলে পাক ধরেছে, চোখে চশমা সঙ্গে হাঁটু ব্যথা। বয়স শরীরকে ঠিক জানান দিয়ে যায়। অভিজিৎও এখন বাড়িতে বাড়িতে পড়াতে যায় না। বাড়ির একটা রুমেই খুলেছে কোচিং সেন্টার। অরিত্র এখন স্থল বাহিনীর একজন সৈনিক। সারা দেশময় ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে।
এখন একখানা ঘরেই কাজ চলে যায় অনুরিমার। আরো দুখানা ঘর অতিরিক্ত লাগে তাদের।পূবের দিকের আম গাছটাতে বেশ আম ধরেছে। তারই একটা পাকা আম কেটে একটা থালায় রাখে। তার পাশে চারটে রুটি ও আলুভাজা দিয়ে অভিজিৎকে জলখাবার পরিবেশন করে অনুরিমা। তারপর নিজেও দুটো রুটি আর আলুভাজা নিয়ে প্ল্যাসটিকের ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে।
অভিজিৎ আবার জিজ্ঞেস করে, কি গো কখন তোমার কাছে আমি কথাখানা পারলাম। এখনও কিন্তু উত্তর দিলে না।
অত্যন্ত বেদনা মিশ্রিত গলায় অভিজিৎ বললো, তুমি তো জানো বড়দা চলে যাওয়ার পর বড় বৌদি কত একা হয়ে গেছে। আগে তবু হসপিটালের চাকরিটা ছিল তখন সময় কেটে যেত। কিন্তু অবসরের পর সময় কাটানো দুরহ হয়ে গেছে।
নিশাও অস্ট্রেলিয়াতে এখন। কবে দেশে ফিরবে তার কোন ঠিক নেই। বড় বৌদির শরীর আজকাল মোটেই ভালো থাকে না। রান্না মাসি আর ঠিকে মেয়েটা কাজ করে চলে যাওয়ার পর এত বড় বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। জানো তো বড় বৌদি তাই বলছিল, আবার আমরা যদি একসাথে থাকি।
এতক্ষণ বাদে অনুরিমা মুখ খুললো। সে মুখে একটু হাসি এনে বলে, আমার তো একসাথে থাকতে কোনদিনই অসুবিধা ছিল না। তবে বড়দি যদি এখন একসাথে থাকতে চায় তাহলে আমিও রাজি।
অভিজিৎ এক গ্লাস জল এক নিমেষে খেয়ে একটা স্বস্তির ঢেঁকুর তুলে বলে, আঃ বাঁচালে আমায় তুমি। বড় বৌদির করুণ মুখটা দেখে বড্ড মায়া হচ্ছিল গো। তাহলে বলো কবে তুমি বড়দার বাড়িতে আবার যেতে চাও?
অনুরিমা যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি এনে ভ্রু কুঁচকে বলে, বড়দার বাড়িতে মানে?
অভিজিৎ একটু আমতা আমতা করে বলে, হ্যাঁ এটাইতো বড় বৌদি চাইছে যে আমরা সবাই মিলে বড় বৌদির অট্টালিকায় থাকি।বড় বৌদি বলছিল, বুঝলে ভাই লোকজন না থাকলে কি আর ঘর বাড়ি মানায়।
তাই আমিও ভাবলাম ঠিক বিয়ের পর আমরা যেমন বড়দার বাড়িতে থাকতাম সেইরকম আবার থাকবো। আর এখন তাহলে আমাদের দুটো ঘর হয়ে যাবে বলো।
অনুরিমা প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বলে, তোমার যে কবে সাংসারিক বুদ্ধি হবে কে জানে? তোমার বড় বৌদির আমাদের সাথে থাকতে ইচ্ছে হলে আমাদের এই একতলা বাড়িতে এসেই থাকতে হবে।
উনি যদি ওনার অর্থ, প্রাচুর্য, বৈভব ছেড়ে সত্যিই যদি আপনজনদের মাঝে থাকতে চান তাহলে আমাদের এই সামান্য একতলা বাড়িতে এসেই থাকতে হবে।
পরিষ্কার ও দৃঢ়তার সাথে মনের ভাবখানা প্রকাশ করে অনুরিমা এঁটো থালাগুলো নিয়ে কলতলার অভিমুখে হাঁটা দিল।
অভিজিৎ গিয়ে তার বড়বৌদি তমালীকে অনুরিমার বক্তব্য এবং অবশ্যই শর্তখানা জানায়। তমালী মনে মনে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট হয়। দুঃখী দুঃখী মুখ করে যদিও বলে, তাহলে তো আর একসাথে থাকা হল না ভাই।
অভিজিৎ চলে যাওয়ার পর তমালী নিশাকে ফোন করে অনুরিমার সব বক্তব্য জানায়। যদিও নিশা বলে, কাকীমনি কিন্তু খুব খারাপ কিছু বলে নি মা। তুমি যেমন তোমার আরাম, বৈভব এইসব ছেড়ে বের হতে চাইছো না কাকীমনিও তার আত্মসম্মান ও আত্মাভিমান এইসব ছেড়ে কেন বের হবে?
আসলে কি জানো মা, তুমি চিরকালই কাকীমনিদের হেয় প্রতিপন্ন করে এসেছো। আমাদের আর্থিক স্বচ্ছলতাকে দূরে সরিয়ে সম্পর্কগুলোকে কোনোদিনই তুমি সেইভাবে লালন করো নি। আজ আমি চাইলেও তোমার শরীর খারাপ হলেও ছুটে আসতে পারি না। আমার চাকরি আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। আমিও বাইরে, অরিত্রও বাইরে থাকে। তোমরা যদি নিজেরা মিলেমিশে থাকো তাহলে আমরাও আমাদের কাজগুলো মন দিয়ে করতে পারি।
তাই বলি মা, এখনও সময় আছে তোমার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করো। আমাদের জীবনে অর্থবল ও লোকবল দুটোই দরকার। আমরা যদি আপনজনরা একে অপরের নির্ভরযোগ্য সহায়তা লাভ করতে পারি তাহলে আকস্মিক কোনো ঝড়ে আমরা কখনো হারিয়ে যাবো না।নিশার এই তাৎপর্যপূর্ণ কথাগুলো নিয়ে প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে ভাবনা চিন্তা করলো তমালী। সত্যিই তো আজ সে স্বামীহারা, একমাত্র মেয়ে সেও দেশের বাইরে। বাপের বাড়ির লোকজনদের সাথেও তেমন ঘনিষ্ঠতা নেই। কত দিন ভাইদের বাড়ি যাওয় হয় নি। একমাত্র নিকট আত্মীয় বলতে তার ছোট দেওর ও জা। হঠাৎ যদি তার কিছু বিপদ ঘটে সবার আগে তারাই আসবে ছুটে। সুতরাং নিজের আত্ম অহংকার ভুলে যদি ছোট জা অনুরিমার শর্তখানা মেনে নিতে পারি তাহলে জীবনের শেষের দিনগুলো নিরাপত্তাহীনতা ও একাকীত্বে কাটবে না।
-
গল্প- প্রিয় সই
প্রিয় সই
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জীনারায়ণ মন্দিরে জৈষ্ঠ্য মাসের জয় মঙ্গলবারের পূজো দিতে গিয়ে তিসি তো তার বড় জেঠিমাকে দেখে অবাক। তিসির বড় জেঠিমা অর্থাৎ অতসী দেবীর পাকা শনের মতো কেশরাশি কোথায় গেল? আগের বছরও এইসময় পূজো দিতে এসে সে দেখেছে অতসী দেবীর মাথা ভর্তি সাদা চুল।
যদিও তিসি মনে মনে বলে, বাঃ জেঠিমা তাহলে চুলে কালার করছে আজকাল। কালো চুলের সঙ্গে মানুষের বয়সের জন্য একটা গভীর যোগ বড় জেঠিমার বয়স জানো বেশ কিছুটা কমে গেছে।
অনেকদিন পর বড় জেঠিমাকে দেখে প্রফুল্ল বদনে তিসি বলে, কি বড়ো জেঠিমা তোমাকে তো চেনাই যাচ্ছে না!
অতসী দেবীও বেশ বড় করে মুখ খুলে হেসে বলে, তুই কবে এসেছিস তিসি? তা জামাই, নাতি সোনা সবাই এসেছে তো?
অতসী দেবী যখন মুখ খুলে প্রাণখোলা হাসি দেয় তখন তিসি লক্ষ্য করে তার বড় জেঠিমার চোয়ার ভর্তি দাঁত। আশ্চর্য! একবছর আগে দেখা বড় জেঠিমার চেহারা আর আজকের দেখা বড় জেঠিমার চেহারার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন।
মন্দিরের চাতালে প্রচুর মেয়ে বৌ-দের ভীড়।তারা সকলেই পূজো দিতে আসলেও ঈশ্বরের আলোচনার থেকে পারিবারিক আলোচনায় মত্ত।
তিসিও অতসী দেবীকে জড়িয়ে ধরে বলে, হ্যাঁ গো জেঠিমা তোমার জামাই, নাতি সবাইকে নিয়েই এসেছি। বৃহস্পতিবার তো জামাইষষ্ঠী। তাই তোমার জামাই অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে এই কদিন।
অতসী দেবী তিসির গায়ে স্নেহের হাতখানি বুলিয়ে বলে, তোর মা কেমন আছে রে? এখন তো আর ভুলেও এমুখো হয় না। বড়দি মরলো কি বাঁচলো এই নিয়ে তোর মায়ের কোন মাথা ব্যথা নেই।
তিসি রসিকতা করে বলে, তুমি কেন মরতে যাবে জেঠিমা। মরুক তোমার শত্রু।
এইকথা শোনা মাত্রই তাড়াতাড়ি অতসী দেবী তিসির মুখখানা চেপে ধরে বলে, চুপ চুপ, এখুনি বৌমা শুনতে পেলে তোদের সবার গুষ্ঠি উদ্ধার করে দেবে।তিসি তৎক্ষণাৎ গলার স্বরটা নিচু করে বলে, মহারানীও তো শাশুড়ি হয়েছে। এখনও কি আগুনের মালসা হয়েই আছে?
অতসী দেবী চোখে মুখে হাসির ঝিলিক এনে বলে , মহারানীকে কি এত সহজে দমিয়ে রাখা যায়?
তিসি বলে, যাই বলো বড় জেঠিমা তোমার মাথাময় কালো চুল, বাঁধানো দাঁতের হাসি এইসব দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।অ্যাই জেঠিমা একটা সেল্ফি তুলবে?
এই বলেই তিসি তার বড় জেঠিমার সঙ্গে খচাখচ গোটা পাঁচেক সেল্ফি তুলে ফেললো।
সেল্ফির ছবি গুলো দেখে অতসী দেবী সামান্য নাক কুঁচকে বলে, তিসি তোর স্ন্যাপ চাট নেই? ওতে না আরো ভালো দেখায় মুখগুলো।
তিসির তো বিস্ময়ে মুখের হাঁ-টা বন্ধ হচ্ছিল না। স্ন্যাপ চাট-এর কথা কি করে জানলো তার বড়জেঠিমা এই বিষয়টা জিজ্ঞাসা করতে যাবে তখনই বড় বড় পায়ের ছায়া ফেলে পুরোহিত ঠাকুর মন্দিরে প্রবেশ করলেন।
কম্বলের আসনে বসে প্রথমে চতুর্দিকে গঙ্গা জল ছিটিয়ে দিলেন। তারপর নমঃ বিষ্ণু নমঃ বিষ্ণু করে মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন।অতসী দেবী তিসির কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে বলে, আমি ঘরে চললাম অনেক ক্ষণ এসেছি। জামাইকে নিয়ে আসিস একবার। আমার সই এর সাথে আলাপ করে যাস।
তিসি চোখের ইশারায় জানালো ঠিক আছে।সময় করে সে আসবে ক্ষণ।
অতসী দেবী চলে যাওয়ার পর তিসির মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো, এই বুড়ো বয়সে জেঠিমা কাকে আবার সই পাতালো?প্রায় ঘন্টা খানেক লেগে গেল পূজো শেষ হতে। বামুন ঠাকুর খুব সুন্দর করে মা মঙ্গলচন্ডীর ব্রত কথা খানি পাঠ করে শোনালেন। সবশেষে স্নান জল বিতরণ এবং শান্তি জলের ছিটা দিয়ে পূজা সমাপ্ত হলো।
পূজার রেকাবিটাতে কুরুশের কাজ করা ঢাকাটা দিয়ে হাওয়াই চপ্পলখানা পায়ে দিয়ে নিজেদের পৈত্রিক ভিটেখানা ছেড়ে এখন তিসি তার বর্তমান বাপের বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
রাস্তায় যেতে যেতে বারবার তিসির গতিপথ শ্লথ হচ্ছে। নারায়ণ মন্দির থেকে কিছুটা আগেই আছে একটা পাতকুয়ো। পাতকুয়োর পাশে যেতে যেতে তিসির মনে পড়তে লাগলো, কুয়োর পাড়ে বসে কত আড্ডা দিয়েছে। বিকাল পাঁচটার মধ্যে যতকাজই যার থাকুক কুয়োতলায় এসে বসা চাই।কুয়োতলায় বসে বসে রাস্তায় দিয়ে যত ছেলে ছোকরা কিংবা বুড়ো যেই যাক না কেন পাড়ার মেয়ে বৌ-দের নানারকম হাসি ঠাট্টার খোরাক তারাই হত।
কুয়ো তলা ছাড়িয়ে টুকটুক করে তিসি রেকাবি হাতে চলেছে। এবার পাশ কাটিয়ে চললো সেই কৃষ্ণচূড়া তলার পাশ দিয়ে।
গাছটার ডালপালাগুলো বোধহয় এখন প্রায়ই কর্পোরেশন থেকে কেটে দিয়ে যায়।তিসি যখন স্কুলে পড়তো তখন কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে প্রেমপত্র বিনিময় করতো অভীকের সাথে।
কিশোরী তিসির প্রথম প্রেম ছিল অভীক।বছর চারেকের বড় অভীকের সঙ্গে তিসিও দেখতো কত স্বপ্ন। বুকে বাসা বাঁধতো কথা পরিবর্তনের জোয়ার। তবে এতো সব স্বপ্ন, পরিবর্তনের আশা সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মাত্র বছর তিনেকের মধ্যেই। অভীক জাতিতে ছিল ধীবর। বামুনের মেয়ের সঙ্গে ধীবরের ছেলের বিয়ে সংগঠিত করতে গেলে আনতে হবে সামাজিক বিপ্লব। সমাজ, পরিবারের বিরুদ্ধাচরণ করার মতো এতখানি মনোবল তিসির ছিল না। তাই সে নিজের ভালোবাসার সঙ্গে সমঝোতা করে নেয়।
এই সাত আট মিনিটের রাস্তা এইসব অতীত স্মৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে কখন পেরিয়ে নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় এসে গেছে টের পাইনি তিসি।
গেটের বাইরে দাঁড় করানো নীল স্কুটারখানা দেখে সে মনে মনে বলে, খুব চেনা চেনা লাগছে স্কুটার খানা। হ্যাঁ বড়দার বিয়েতে যৌতুকে পাওয়া স্কুটার। তার মানে নিশ্চয় বড়দা এসেছে।
লোহার গেটটা খোলার আওয়াজ পাওয়া মাত্রই তিসির সাত বছরের ছেলে লাড্ডু বাড়ির ভিতর থেকে ছুটে এসে বলে, মা ও মা বড় মামু এসেছে। আমার জন্য চিপস্, চকলেট, বেবলেট, ফ্রুটি এনেছে।
তিসি রেকাবি থেকে একটা ফুল নিয়ে ছেলের মাথায় ছুঁয়ে দিল। তারপর ছেলেকে স্নেহভরে বলে, লাড্ডুর বড়মামা বলে কথা।লাড্ডুর জন্য কত কিছু আনবেই।
তিসি মা-বাবার একমাত্র সন্তান হলেও জেঠতুতো, পিসতুতো, মাসতুতো, মামাতো এইসব দাদা দিদিদের বড়দা, মেজদা, বড়দি, মেজদি এইভাবেই সম্বোধন করে। নাম ধরে ডাকার থেকে এইভাবে সম্বোধন করলে কোথায় যেন সম্পর্কের বাঁধনখানা আরো দৃঢ় হয়।
তিসি পূজার থালাটা ঠাকুর ঘরে রেখে হাত পা ধুয়ে এসে তার বড়জেঠিমার একমাত্র ছেলে তাদের বড়দাকে প্রণাম করে জিজ্ঞেস করে, কেমন আছো বড়দা? সেই তোমার ছেলের বিয়ের সময় দেখা হয়েছিল একটু খানি। হ্যাঁ গো তোমার ছেলের বৌ কেমন হয়েছে গো?অতনুও তার স্বভাব সুলভ প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বলে, আমি আর কি সার্টিফিকেট দেবো। দিবি তো তোরা। তবে এইটুকু বলতে পারি, তোর বড়বৌদি যদি যায় ডালে ডালে তাহলে আমাদের বৌমা যায় পাতায় পাতায়।
অতনুর কথা শুনে তিসির মা অমিতা তো হো হো করে হেসে উঠে বলে, এটা কিন্তু তুই একদম ঠিক বলেছিস অতনু।
তিসি ব্যাপারখানা ঠিক বুঝতে পারছে না।তাই মা, দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে কৌতুহলী চোখে।
অতনু তিসির মাথায় হাত রেখে বলে, বুঝলি কাউকে কাঁদালে কিন্তু নিজেকেও কাঁদতে হয়। যাক গে, ছোট কাকিমা এবার উঠি।বোনকে নিয়ে এসো সন্ধ্যা বেলার দিকে।
অতনু চলে যাওয়ার পর তিসি অমিতা দেবীকে বলে, ও মা বল না বড়দা কেন এই রকম কথা বলে গেল?
অমিতা দেবী মুচকি হাসি দিয়ে বলে, বলবো বলবো। আগে একটু প্রসাদ মুখে তোল। সকাল থেকে খালি পেটে আছিস। পিত্তি পড়ে যাবে তো।
স্বামী, জামাই এদের জন্য স্নানজল, প্রসাদ সব আলাদা তুলে রেখে মা মেয়ে আরো কিছুটা শশা, আম, লিচু নিয়ে ফলাহার করতে বসলো।
একটুকরো আম মুখে পুরেই তিসি বলে, মা এই আমটা তো আমাদের পুরানো বাড়ির গাছের মনে হচ্ছে। এখনও এই গাছটাতে আম হয়?
-হয় নিশ্চয়। এই তো অতনু দিয়ে গেল।আমগুলোর সাইজ ছোট হলেও মিষ্টি খুব।
আরো দুচার’টা শশা কুঁচি মুখে পুরে তিসি বলে, ও মা এবার তো বল বড়দা কেন বললো অন্যকে কাঁদালে নিজেকেও কাঁদতে হয়।
অমিতা দেবী কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সে সব অনেক কথা। সব কথা বলতে গেলে দুপুরে আর জামাইকে ভাত দেওয়া যাবে না সময় মতো।
তিসি নাছোড়বান্দা। সে বলে, ঠিক আছে। ভাবসম্প্রসারণ না করে তুমি সারসংক্ষেপ করে বলো।
অমিতা দেবী বলে, তোর অতনুদার বৌ তোদের শিউলি বৌদি নতুন বৌ হয়ে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনোদিন তোর বড়জেঠিমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে নি। সবসময় বাপের বাড়ির পয়সার দেমাক।তোর অতনুদাকে বিয়েতে যে স্কুটারখানা দিয়েছিল যৌতুকে। তার চাবিকাঠিটাও শিউলি নিজের কাছে রাখে। অতনু ছাড়া আজ পর্যন্ত সেই স্কুটারখানা চালানোর অনুমতি কারোর মেলে নি।
তোর তিন দিদিদেরকেও একদম সহ্য করতে পারতো না শিউলি। বড় জেঠিমার মেয়েরা যখন বাপের বাড়ি আসতো তখন ব্যাগ ভর্তি করে খাবার দাবার আনতো। সেই সব জিনিসের ছিঁটে ফোঁটাও তোর জেঠু জেঠিমাকে দিতে তার মন চাইতো না।
আসলে কি জানিস আমার মনে হয় বড়দির সব থেকে বড় ভুল ছিল শিউলি বউ হয়ে আসা মাত্রই সংসারের চাবির গোছা, সকল দায় দায়িত্ব সব কিছু শিউলির কাঁধে তুলে দেওয়া।তুই তো দেখেছিস, আমরা এক সংসারে থাকতেও বড়দি তেমন কাজকর্ম করতে চাইতো না। আসলে বড়দি চিরকালই একটু অলস প্রকৃতির। সংসারের কাজকর্মের থেকে আমোদ ফুর্তিই তার বেশি প্রিয়। তাই বড়দির কাছে পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের আসা যাওয়ার মাত্রা ছিল বেশি।এটাতেই শিউলির আপত্তি। বাড়িতে সবসময় লোকজন আসা যাওয়া করলে বাড়ির প্রাইভেসি বলে কিছু থাকে না।
তোর বড়জেঠু যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন তাও তোর বড়জেঠিমা আনন্দেই ছিল। শিউলির সাথে নিত্য অশান্তি হলেও কখনো কারোর কাছে কিচ্ছুটি বলতো না ভয়ে। পাছে শিউলির কানে উঠলে অশান্তির মাত্রা আরো দ্বিগুণ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে অতনুর বোনেরা বাপের বাড়িতে এসে আর রাত কাটাতো না। পাড়া প্রতিবেশীরাও আর আগের মতো হৈ হৈ করতে আসতো না। বড়দির আত্মীয় স্বজনেরাও আসা যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
কিন্তু তোর বড়জেঠুর মৃত্যুর পর তোর বড়জেঠিমার দূর্দশার অন্ত নেই। একাদশীর দিনটা গোটা উপোস হয়ে যেত বড়দির। সুগারের রোগী। তাই মিষ্টি, আপেল, খেজুর এইসব খাওয়া বারণ। ফল বলতে শুধু শশা। সুতরাং শশা চিবানো ছাড়া গতি নেই। আর শিউলি রুটি, পরোটা কোনটাই দিতে চাইতো না। তার বক্তব্য ভাতের রান্নার ঝামেলা, রুটির ঝামেলা এতো আমি পারবো না।আজ থেকে বছর দুই আগে, বারটা ঠিক মনে পড়ছে না আমি গিয়েছিলাম নারায়ণ মন্দিরে পূজা দিতে। পূজো হয়ে যেতে ভাবলাম একটু ফলপ্রসাদ দিয়ে আসি অতনুদের। সদর দরজাটা খুলে দেখি নতুন যে দু’তলাটা বানিয়েছে অতনু তার মেন গেটে তালা। আর পুরানো একতলার ঘরের দরজাটা ভেজানো। আমি তো বড়দি, ও বড়দি করে হাঁক পারি। কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না।
এমন সময় দেখি একটা হুলো বিড়াল ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে বীরের মতো।আমি তাই দেখে ভেজানো দরজাটা দিলাম জোর করে ঠেলে। তারপর গুটি গুটি পায়ে ভিতরে ঢুকে দেখি কোণের ঘরটাতে টিভি চলছে আর তোর বড়জেঠিমা চুপচাপ জানালার গ্ৰিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।আমি ঘরে ঢুকে যখন বড়দি, ও বড়দি বলে রীতিমত চিৎকার করি তখন তোর বড় জেঠিমার স্তম্ভিত ফিরে আসে। উদাস চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, শিউলি তো নেই। বাপের বাড়ি গেছে।
তিসি অবাক বিস্ময়ে শুনে চলেছে তার বড়জেঠিমার জীবন কথা। অমিতা দেবী এক ঢোঁক জল খেয়ে আবার বলে, আমি বললাম, ও বড়দি আমি তো তোমার কাছে এসেছি গো। আমি গো আমি। আমি তোমাদের ছোট বউ। অমিতা গো অমিতা। আমাকে চিনতে পারছো না?
এত পরিচয় দেওয়ার পর কাঁপা কাঁপা হাতগুলো দিয়ে আমাকে ধরে বলে, আমাকে নিয়ে চল না এখান থেকে। তোর বাড়ির এককোণে পড়ে থাকবো। দুবেলা দুমুঠো ভাত দিস আর আমার সাথে একটু করে গল্প করিস। জানিস আমি কতদিন কথা কই নি প্রাণ খুলে। কথাগুলো বলতে বলতে বড়দির দুই চোখ দিয়ে নেমে আসছে অঝোরে অশ্রুধারা। আমি তাড়াতাড়ি করে বড়দির চোখের জল মুছতে উদ্যত হলাম। যেই চোখের জলখানি স্পর্শ করেছি অনুভব করি কি সাংঘাতিক উত্তাপ। আমার হাতে লাগলো গরম ছ্যাঁকা।
মনে হল তোর বড়জেঠিমার মনের সকল জমা কষ্ট যেন আগ্নেয়গিরির নিভে যাওয়া লাভা স্রোত যেন বড়দির চোখের জলের ন্যায় প্রবাহিত হচ্ছে। আমারও দু’চোখ জলে ঝাপসা হয়ে উঠলো। কিছুক্ষণ বড়দির কাছে বসে বসে বেশ কিছু অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনলাম বড়দির মুখে।
বাড়ি ফিরে এসেই তোর বাবাকে তোর বড় জেঠিমার মূহ্যমান মানসিক অবস্থার কথা বলি। তোর বাবাও সঙ্গে সঙ্গে অতনুকে ফোন করে বলে, তুই শীঘ্র বড়বৌদিকে ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখা। এইরকম দীর্ঘদিন চলতে থাকলে বড় বৌদি একদিন অ্যালজাইমার পেশেন্ট হতে বাধ্য হবে।
দেখ অতনু তুই ছেলে হয়ে মায়ের প্রতি এত খানি উদাসীন হয়ে উঠলি কি করে?এত তোর কাজের ব্যস্ততা। যে দিনান্তে মিনিট দশেকের জন্য মায়ের কাছে বসতে, দুটো কথা কইতে ইচ্ছে করে না! ছিঃ অতনু ছিঃ। তোর বউয়ের ছায়া যে তোর ওপর এত খানি পড়েছে তা সত্যি আমরা ভাবতে পারি নি।
ছোট কাকুর কাছ থেকে নিজের মায়ের এই মানসিক অসুস্থতার কথা জেনে অতনু মনে মনে অনুতপ্ত হয়। বড্ড আক্ষেপের সুরে বলে, আমার খুব অন্যায় হয়ে গেছে ছোট কাকু। আজই আমি শ্বশুর বাড়ি থেকে ফিরে মায়ের জন্য একজন অভিজ্ঞ সাইক্রিয়াটিস্ট-এর ব্যবস্থা করছি।
এতসব কথা বলতে বলতে অমিতা দেবীরও চোখের কোণে জল জমেছে। যে সন্তানের জন্য মা তার সমগ্র পৃথিবীকে ভুলে যেতে পারে সেই সন্তান নিজের স্ত্রী, সন্তান পেয়ে গর্ভধারিনী মাকে ভুলে যায়। কি অদ্ভুত মায়ার খেলা।
অমিতা দেবীর মুখে বড় জেঠিমার জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার কথা শুনে তিসির মনটাও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সাময়িক নিস্তব্ধতা। তারপরই তিসি বলে, তাহলে আজকে যে বড় জেঠিমাকে দেখলাম এই এক বছরের মধ্যে তার আমূল পরিবর্তন হলো কি ভাবে গো?
অমিতা দেবী চোখের কোণের জলখানা মুছে বলে, তোর বড় জেঠিমার পরিবর্তনের সব কৃতিত্ব কিন্তু সই-এর।
তিসি এবার প্রচন্ড মাত্রায় কৌতুহলী হয়ে বলে, দূর বাপু তোমাদের এই সই’টা কে একটু খুলে বলবে?
অমিতা দেবী আরো বলে, বুঝলি তিসি সই আসার পর থেকে অতনুর বৌ শিউলিও বেশ কিছুটা টাইট হয়ে গেছে।
তিসি এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, প্লিজ মা আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছি না। প্লিজ বলো, সই কে?
-ওরে সই হলো অতনুর আর শিউলির বৌমা মিত্রা। বড্ড বুদ্ধিমতী ও মিষ্টভাষী মেয়ে। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে। এই টুকু ছোট মেয়ে শিউলির মতো তেজী মেয়েকে একেবারে এককোণে করে দিয়েছে।
বিয়ের পর থেকেই ঠাকুমা শাশুড়ির অত্যন্ত প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠেছে। তোর বড় জেঠিমার দেখাশোনার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়।
-মা শিউলি বৌদি তাহলে নিজের বৌ’টির ওপর সাংঘাতিক চটে আছে।
-আর চটে থেকে লাভ কি। মিত্রা তো অতনুর ছেলের বলে বলীয়ান। সেদিন বাজারে শিউলির সাথে দেখা হতে সে তো বলেই ফেললো, ছোট কাকিমা কি যে দেখে শুনে বউ আনলাম আমি। নিজের শাশুড়ির থেকে শাশুড়ির শাশুড়ি প্রিয় হয়ে গেল।
শিউলি ওর স্বভাব সুলভ কথা বলার ভঙ্গিমায় সামনের দাঁতগুলো চেপে আরো বলে, আজকাল কলেজ থেকে ফেরার পথে নাতবৌ ঠাকুমার জন্য ফুচকা, চপ, সিঙাড়া নিয়ে আসবে। তারপর দুজনে মিলে চা, মুড়ি দিয়ে এইসব খাওয়ার কি ঘটা। দুজন দুজনকে আদিখ্যেতা করে ‘সই’ বলে ডাকবে আবার।
শিউলি মনে মনে প্রচন্ড জ্বলছে ঠিকই তবুও মুখটি বন্ধ করে থাকে এই ভয়ে বৌ’কে কিছু বললে যদি একমাত্র ছেলে হাতছাড়া হয়ে যায়।
তিসি বলে, মা সুখ কিংবা দুঃখ দুটোই কিন্তু চাকার মতো ঘুরে আসে আমাদের জীবনে তাই না। এই চিরন্তন সত্যটা জেনেও তো আমরা অহংকারে মদমত্ত হয়ে থাকি।
জানি না সন্ধ্যা বেলায় জেঠিমার সই-এর সঙ্গে আলাপ করতে যেতে পারবো কিনা। তাই দূর থেকেই ওর জন্য জানাই অনেক শুভ কামনা। প্রতিটি ঠাকুমা, দিদিমা যদি মিত্ররা মতো সই পায় তাহলে স্মৃতি ভ্রংশ বা অ্যালজাইমারের মতো কঠিন মানসিক অসুখ থেকে অনেক বৃদ্ধ, বৃদ্ধারা বেঁচে থাকার নতুন আলো দেখতে পাবে। -
গল্প- ঠিক আছে
ঠিক আছে
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জীদীপালি জলযোগের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল মিতালী। দীপালি জলযোগের সুস্বাদু সিঙ্গাড়গুলো দেখে মনটা কেমন আনচান করতে শুরু করলো আজ।
দুই বছর আগে প্রায়ই সন্ধ্যা বেলায় দীপালি জলযোগ থেকে আসতো গরম গরম সিঙ্গাড়া। ছোট চায়ের কাপে চা খেয়ে ঠিক পোষায় না মিতালীর। তাই বড় কফি মগে ভর্তি ভর্তি চা নিয়ে সিঙ্গাড়া দিয়ে মুড়ি মেখে কি জমিয়ে আড্ডা মারতো বুলা কাকিমার সঙ্গে।বুলা কাকিমার সঙ্গে মিতালীর বয়সের তফাত যথেষ্ট। তবুও সেই প্রথম দর্শনের দিন থেকেই বেশ ভাব হয়েছিল দুজনের।
মিতালী তার পতি পরমেশ্বর আলোককে নিয়ে ফ্ল্যাট দেখতে এসেছিল এয়ারপোর্ট চত্বরে ।আলোক তো মুখটা’কে বাংলার পাঁচের মতো করেই এসেছিল সেদিন। আসলে আলোকের ফ্ল্যাট বাড়ি মোটেই পছন্দ নয়। পায়রার খোপের মতো অবস্থা।এদিক ওদিক চড়ে বেরিয়ে সময় হলে নির্দিষ্ট খোপে ঢুকে পড়া ।আর অন্য কারোর সঙ্গে মুখ দেখাদেখি নেই।
তার ওপর কার্পেট এড়িয়াটুকুই নিজের। নিজের ফ্ল্যাটের সামনে নিজের জুতো জোড়া রাখতে গেলেও ওপরের সুবিধা অসুবিধার কথা ভাবতে হবে। এক কথায় এক কাঁড়ি পয়সা খরচ করে আজীবন ঝুটঝামেলা মাথায় নেওয়া।যদিও আলোকের এই সব মনগড়া অপ্রাসঙ্গিক যুক্তিকে মোটেই আমল দিতে রাজি নয় মিতালী। কলকাতার বাজারে একফালি শক্ত পোক্ত কংক্রিটের ছাদ তো পাওয়া যাবে। সমাজ সংসারে টিকে থাকতে গেলে মানিয়ে চলতে তো হবেই। সে তুমি নিজের বাড়ি বানিয়ে থাকো কিংবা ফ্ল্যাট বাড়ি কিনে থাকো।
তবে মিতালীর ফ্ল্যাট বুকিং করতে এসেই বুলা কাকিমার সঙ্গে আলাপ হয়ে বড় ভালো লেগেছিল।
বুলা কাকিমার স্বামী সুনীল কাকু সবে মাত্র রিটায়ারমেন্ট নিয়েছে PWD এর অফিস থেকে। স্থুলকায় চেহারার মানুষটাকেও বেশ লেগেছিল মিতালীর। প্রতিটি কথার শেষে উনি কেন ‘ঠিক আছে’ শব্দটার ব্যবহার করেন তা বুঝতে মিতালীর সময় লেগেছিল বেশ।বুলা কাকিমা প্রথম আলাপেই মিতালীকে জিজ্ঞেস করে, তোমাদের সন্তান কয় টি গো?
মিতালী বলেছিল, আমার একটি মেয়ে কাকিমা। এই ক্লাস ফোরে পড়ে।
বুলা কাকিমা একগাল হাসি দিয়ে বলে, এখনও সময় আছে আরেকটা ইস্যু নিয়ে নাও। আমাদের কোলে পিঠে বড় হয়ে যাবে। আমার ছেলের তো বিয়ে দেওয়ার বয়স হয়ে গেল। এখনও সেই রকম কোনো পার্মানেন্ট কাজ জোটাতে পারে নি বলে বিয়েটা দিচ্ছি না।
পাশেই ছিলেন বুলা কাকিমার স্বামী সুনীল কাকু উনি বললেন, যা চাকরি বাকরির অবস্থা ছেলের বিয়ে থাওয়া আর দিতে হবে না। এই কথাটা শেষ করেই উনি ওনার স্বভাব সিদ্ধ বাক্য ‘ঠি…ক আছে’,’ঠিক আছে’ উচ্চারণ করলেন।
মিতালী অবাক হয়ে সুনীল কাকুর মুখের দিকে চেয়ে রইলো। আজীবন ছেলে আইবুড়ো থেকে যাবে। আর উনি বলছেন ঠিক আছে। আশ্চর্য! কিছুতেই মিতালীর মাথায় ঢুকলো না কেন সুনীল কাকু ঠিক আছে কথাটা বললেন।ফ্ল্যাট বুক করার দেড় বছরের মধ্যে প্রমোটার রেডি ফ্ল্যাট হ্যান্ডওভার করলেন। কাকতালীয় ভাবে মিতালী ও বুলা কাকিমা তাদের গৃহপ্রবেশের দিন একদিনেই স্থির করেছিল।
পাশাপাশি ফ্ল্যাট হওয়ার সুবাদে এটা ওটার প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে আসা যাওয়ার মাত্রাও ছিল বেশি।
মিতালীর মেয়ে তুলতুলি ফাঁক পেলেই বুলা কাকিমার ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হতো। দুই তিন মাসের মধ্যে এই দুই পরিবারের মধ্যে এমন ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠল যে গোটা এ্যাপার্টমেন্টের সকলের কাছে ঈর্ষার বিষয় ছিল।
তবে একটা চিরসত্য বোধহয় মিতালী ভুলে গিয়েছিল, যেখানেই অতি সেখানেই ক্ষতি। আসলে মিতালী একদম নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির মেয়ে হলেও লোকজন তার বড্ড প্রিয়। মিলেমিশে থাকার যে সুপ্ত বাসনা তার মধ্যে ছিল সেটা বুলা কাকিমাদের পেয়ে বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হয়।
বেশ কাটছিল দিনগুলো। বুলা কাকিমা কচুশাক, কচুলতি, লইটে মাছ, শুঁটকি মাছ এইসব বানিয়ে একেবারে গরম গরম নিয়ে ছুটে আসতো আলোকের জন্য।
মিতালীরা এদেশীয়। আলু পোস্ত, মাছের ঝোল খেতে ও রান্না করতেই ভালোবাসে।বুলা কাকিমার হাতের বাঙাল রান্না খেয়ে আলোক যে ভাবে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতো তা দেখে বাধ্য হয়ে মিতালীকে লইটে মাছ, কচুশাক, কচুলতি সবই শিখতে হয়েছিল।
সেবার তো মিতালী বাপের বাড়ি গিয়ে ওর ভাই, বাবা সকলকে লইটে মাছ রান্না করে খাইয়ে বিশাল সুনাম কুড়িয়ে ছিল। মিতালী কিন্তু মুখে ও মনে মনে সবসময় বুলা কাকিমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতো তাকে এই সব রান্না শিখিয়ে দেওয়ার জন্য।কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই সামান্য ‘ঠিক আছে’ বাক্যকে কেন্দ্র করে বুলা কাকিমদের সঙ্গে মনকষাকষি শুরু হলো মিতালীর। আসলে বিষয়টা ছিল অতি সামান্য।
তুলতুলি খেলতে খেলতে পা পিছলে পড়ে যায় সিঁড়ি থেকে। মাথা ফেটে রক্ত গঙ্গা বইতে শুরু করে। সিকিউরিটির হাঁকডাকে ছুটে আসে সুনীল কাকুও। মিতালী কিছু বরফের টুকরোকে একটা কাপড়ে বেঁধে তুলতুলিরর কপালে রাখার চেষ্টা করছে।
যন্ত্রণায় কাতর তুলতুলি বারবার হাত দিয়ে বরফের পুঁটলিটা সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। মিতালী তুলতুলিকে বকতে গেলে বুলা কাকিমা বলে, ছোট ছেলে এইরকম তো করবেই। তুমি জোর করে বরফের সেঁকটা দাও। তোমার কাকুকে আমি রিকশা ডেকে আনতে বলছি।
সুনীল কাকু কিছুক্ষণের মধ্যেই রিকশা ডেকে নিয়ে আসে। মিতালীর সাথে বুলা কাকিমাও ডাক্তারের কাছে যায়। তুলতুলির কপালে তিনখানা স্টিচ পড়ে। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়েছে তুলতুলি।
ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে এসে বুলা কাকিমার মুখে সুনীল কাকু সব শুনে বলে, মেয়ে যে খুব দূরন্ত। সারাদিন ছুটে বেরানো চাই। এখন দেখো কি রকম বিপত্তি ঘটলো। ঠি…কি আছে, ঠিক আছে। এই’ ঠিক আছে’ শব্দটা শুনে মিতালী খুব কষ্ট পায়। ওর মেয়ে পড়ে গিয়ে কপাল ফাটিয়ে ফেললো, স্টিচ পড়লো। এইসব কথা জানা সত্ত্বেও উনি কিভাবে ঠিক আছে বললেন! আসলে ‘ঠিক আছে’ শব্দটা সুনীল কাকুর মুদ্রাদোষ এটা জানা সত্ত্বেও সেই মুহুর্তে মিতালীর মাথায় অন্য চিন্তা ভাবনা ঢুকলো। মিতালীর মনে হল, সুনীল কাকু ওনার মেয়ের কষ্ট দেখে মনে মনে আনন্দই পেয়েছেন।
আর এই ভুল ভাবনার ওপর ভর করে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। একটু একটু করে কথাবার্তা, আসাযাওয়া, দেওয়া-নেওয়া কমতে থাকে।
দেখতে দেখতে দু’টো বছর হয়ে গেল মিতালীদের সাথে কথা বন্ধ বুলা কাকিমাদের। কখনো সখনো সামনা সামনি হয়ে গেলে মিতালীই চোখ নামিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তুলতুলির শিশু মনও বুঝে গেছে যে ওদের বাড়ি যেতে নেই। যদিও আলোক প্রয়োজন পড়লে কথা বলে।
এই দুই বছরে মিতালীর মনের অভিমানের পাথরখানি অনেক খানি ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে। সুনীল কাকুর ‘ঠিক আছে’ শব্দটা কেবলমাত্র কথার কথা। এই ঠিক আছে শব্দটাকে সর্বক্ষেত্রে মেনে নেওয়া উচিত এটা মিতালী বুঝতে পেরেছে।
তাই আজ পয়লা বৈশাখের দিন দীপালি জলযোগের পাশ দিয়ে যেতে যেতে মিতালীর মনে হলো অনেক দিন তো হলো বুলা কাকিমদের সঙ্গে মান অভিমানের পালা। এই নতুন বছরে মান অভিমানের পালা বন্ধ করে আবার দুই প্রতিবেশী এক হয়ে গেলে মন্দ হয় না।
সুনীল কাকু দীপালি জলযোগের সিঙাড়া খেতে বড় ভালোবাসেন ।তাই কিন্তু কিন্তু করে মনের দ্বিধাকে দূরে সরিয়ে দশ পিস সিঙাড়া ও দশ পিস রসগোল্লা কিনে তুলতুলির হাত ধরে আবাসনে ফিরে এল। লিফ্টের দরজাটা খুলতে খুলতে ভেবে চলেছে, কি বলবে সে বুলা কাকিমার ঘরে গিয়ে।
যথারীতি লিফ্ট এসে দাঁড়ালো থার্ড ফ্লোরে। লিফ্ট থেকে নেমে তুলতুলির হাতে রসগোল্লার প্যাকেটখানা দিয়ে বুলা কাকিমার ডোর বেলটা টিপলো মিতালী। বুকটা তার ধরাস ধরাস করছে। মনে হলো হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে প্রচন্ড মাত্রায়। যদি বুলা কাকিমারা সেভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার না করে। তাহলে সেধে অপমানিত হতে হবে।
এইরকম সাত পাঁচ ভাবনা যখন মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তখনই দরজা খুলে সামনে দাঁড়ায় বুলা কাকিমা।
একগাল হাসি দিয়ে বলে, এসো এসো। ভিতরে এসো। তোমাদের কথাই হচ্ছিলো। ভাবছিলাম তোমাদেরকে ডেকে পাঠাবো।তার মধ্যেই তোমরা এসে হাজির।
মিতালীর কি রকম স্বপ্নের মতো লাগছে। আস্তে আস্তে বলে, আপনি কাকিমা আমার কথা ভাবছিলেন। আশ্চর্য!
ভিতরে ড্রয়িং রুম থেকে সুনীল কাকু বলে, এসো এসো মিতালী। দীপালি জলযোগের সিঙাড়া ঠান্ডা হয়ে গেল, ঠিক আছে।
মনের সব জড়তা কাটিয়ে মিতালী ড্রয়িং রুমে ঢুকে অবাক। একি কাকে দেখছে! সুনীল কাকুর পাশে বসে আলোক টমেটো সস দিয়ে দিব্য গরম গরম সিঙ্গাড়া খেয়ে চলেছে।
মিতালীকে দেখে আলোক মুচকি হেসে বলে, কি গো তোমার হাতেও কি সিঙাড়ার প্যাকেট?
বুলা কাকিমা বলে, এতো সিঙাড়া একসাথে খাওয়া ঠিক হবে না কিন্তু।সুনীল কাকু বলে, দাও তো আজ মন খুলে সিঙাড়া খেতে, ঠিক আছে। দরকার পরলে ওষুধ খেয়ে নেওয়া যাবে, ঠিক আছে। কতদিন বাদে আমরা আবার একসাথে বসে সিঙাড়া খাচ্ছি বলো তো, ঠিক আছে। হোই না আজ একটু লাগাম ছাড়া, ঠিক আছে..
আজ সবাই সুনীল কাকুর মুদ্রাদোষ ঠিক আছে কে আপন করে নিয়ে প্লুতস্বরে বলে ওঠে, একদম ঠিক আছে…………
-
গল্প- গেঁড়ি গুগলি
গেঁড়ি গুগলি
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জীখবরদার বলছি এক পা আর এগিয়ে আসবি না। এইখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি যতক্ষণ না আমি এক বালতি জল আনছি।
-ও ঠাকুমা প্লিজ আজকের মতো মাপ করো দাও না। সত্যি বলছি আর এ ভুল হবে না।
কাঁদো কাঁদো গলায় এই অনুরোধ বাক্যগুলো অযথা খরচা করে চলেছে আট বছরের মিঠি।মিঠির অনুনয় বিনয়কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বেতো পা নিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কলতলার দিকে হনহন করে চলল মিঠির ঠাকুমা গীতা দেবী।
মিঠির মা ইন্টু রান্না ঘরের জানালা দিয়ে এতক্ষণ ধরে ঠাকুমা আর নাতনির কান্ড কারখানা চুপচাপ দেখছিল। মেয়েকে শাশুড়ি বকছে দেখে ইন্টুর কষ্ট হলেও মুখ বন্ধ করে থাকে। শাশুড়ি কিংবা মেয়ে দুইজনের চরিত্রই তো তার জানা।
মিঠির মুখে সারাদিন খই ফুটছে। একটা কথা বললে দশটা উত্তর দিয়ে দেয় ইন্টুকে। ইন্টু মিঠিকে শাসন করতে গেলেই ঢাল হয়ে মিঠিকে সবসময় রক্ষা করে তার ঠাকুমা গীতা দেবী।
মেজাজ দেখিয়ে উঁচু গলায় গীতা দেবী উল্টে ইন্টুকেই তর্জনী তুলে শাসায়, দেখ বৌমা মুখার্জি বাড়ির মেয়েকে শাসন করতে এসো না। এত বছর তো বিয়ে হয়ে এসেছো এই মুখার্জি বাড়ির ছেলে মেয়ে কারোর মুখে জোরে আওয়াজ শুনেছো। খোকার সঙ্গে ঝগড়া হলে তোমার কথাই বাপু আমার কানে আসে। আজ পর্যন্ত খোকাকে একটা উঁচু গলায় কথা বলতে দেখি নি, বৌ-এর সঙ্গে কিংবা বড়দের সঙ্গে।
সুতরাং তুমি মা জননী নিশ্চিন্তে থাকো আমার মিঠাই দিদিভাই মোটেই মুখরা হবে না। এখন ছোট তাই একটু আধটু বদমাইশি করে। এই আর কি।
সেই ঠাকুমা আজ নিজ হস্তে তার পেয়ারের নাতনিকে দুপুরের কাঠফাটা রোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আজ আর নাতনির সোনার অঙ্গ তামা হয়ে যাবে বলে ঠাকুমা মাথা ব্যথা করছে না। ইন্টুর মাথাতে কিছুই ঠুকছে না ব্যাপারটা হলো কি?
রান্না ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এল ইন্টু।
মা’কে দেখে মিঠাই এবার কেঁদে ফেলেছে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, তুমি কি কিছু দেখতে পাচ্ছো না ঠাকুমা আমার সাথে কি ব্যবহার করছে?
– দেখতে পাচ্ছি বলেই তো রান্না ঘরের মেলা কাজ ফেলে ছুটে এলাম। তোর ঠাকুমা যখন তোকে বকছে তখন অন্যায়ের পরিমাণ নিঃশ্চয় বিশাল।ইন্টুর কথাগুলো শেষ হতে না হতেই গীতা দেবী একটা লোহার বালতি করে প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ করে জল নিয়ে এসে হাজির।
ইন্টুকে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, দেখো দেখো বৌমা। এই বজ্জাতটাকে ছুঁয়ে ফেলো না যেন। আগে ভালো করে স্নান করাই তারপর অন্য কথা। তুমি যাও বাছা তোমার নিজের কাজে যাও। একটার মধ্যে ছেলেরা সব খেতে বসে পড়বে।
ইন্টুও ব্রিটিশ আমলের দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে পৌনে বারোটা বাজছে। তার শ্বশুর মশাই সবসময় ঘড়ির কাঁটা সাথে চলে।
সত্তর বছর বয়সেও রোজ সকালে তাদের মিষ্টির দোকানের শাটারখানি তিনিই তোলেন। জলের ছিটে, ঝাড়ু সব কিছু নিজের হাতে করেন।মিঠাই-এর বাবা জলখাবার খেয়ে নটার মধ্যে দোকানে পৌঁছালে তবেই ইন্টুর শ্বশুর মশাই বাড়িতে ফিরে আসেন।মুড়ি, আলুভাজা সহযোগে জলখাবারটা সেরে জমিতে কাজ দেখতে বের হন।
মিঠাই-এর স্কুল না থাকলে মিঠাইও দাদুর সঙ্গী হয়। দাদুর ছাতার তলায় টুকটুক করে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ায় জমির আল ধরে।কখনো কখনো ক্ষেত মজুরদের হাত ধরে তাদের বাড়িতে গিয়েও হাজির হয়। মুখার্জিদের বাড়িতে, জমিতে, খামারে তিন পুরুষ ধরে কাজ করছে জীবন দলুইরা। জীবন দলুই-এর বৌ, মেয়ে সময়ে অসময়ে ছুটে ছুটে আসে মুখার্জি বাড়িতে।
মিঠির ঠাকুমাও সেই ছোট্ট থেকে মিঠিকে কোলে নিয়ে পাড়া বেড়াতে বের হলে একবার গিয়ে দাঁড়াবেই জীবন দলুই-এর ঘরের সামনে।
ছোট্ট মিঠিকে কোলে নেওয়ার জন্য জীবন দলুই-এর মেয়ে অনিমা হাত বাড়িয়ে থাকতো স্নেহের দৃষ্টিতে। মিঠিও ছোটো থেকেই অনিমাকে খুব পছন্দ করে। পেয়ারা, বাতাবি লেবু, খেজুর, আম কখনও বা কলকে ফুল, গন্ধরাজ ফুল কিংবা মাধবীলতা গাছ থেকে পড়ে দেওয়ার আবদারে অনিমাকে অস্থির করে তুলতো। আর অনিমাও নিজের সব কাজ ফেলে ছোট্ট মিঠির বায়না মেটাতো।যেই না মিঠির ঠাকুমা বালতিটা তুলে হরহর করে জল ঢালা শুরু করেছে তেমনি মিঠি কান্না জুড়ে দিয়েছে। কাঁদতে কাঁদতে ঠাকুমাকে বলে, আমি কি এমন অন্যায় করেছি যে তুমি আমার স্কুল ড্রেসটাও ভিজিয়ে দিলে? আমি তো স্কুল থেকে ফেরার পথে রোজই জীবন জেঠুদের বাড়িতে যাই। কৈ তুমি তো এইরকম করে আমাকে স্নান করাও না।
মিঠির ঠাকুমা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, অন্য দিন তো এমন করে পাত পেড়ে খেয়ে আসো না। ছিঃ ছিঃ! এইসব অখাদ্য কুখাদ্য কি করে তুই বামুন ঘরের মেয়ে হয়ে খেয়ে আসলি? আবার খাওয়ার কি ধূম। অনিমার সাথে একথালাতেই চেটে পুটে খাচ্ছে গেড়ি গুগলির ঝাল।
এতক্ষণে ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো ইন্টুর কাছে। মিঠি স্কুল থেকে ফেরার পথে জীবন দলুই-এর ঘরে পান্তা ভাত, কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচা লঙ্কা সহযোগে গেড়ি গুগলির ঝাল খেয়ে এসেছে।
ইন্টুর শাশুড়ি মাতা বোধহয় পাড়াতে কারোর বাড়ি গিয়েছিল। ফেরার পথে জীবন দলুই-এর বেরা’বিহীন মাটির খড়ের ছাউনি দেওয়া বাড়ির দিকে তাকাতেই লক্ষ্য পড়ে উঠানে খোলা রয়েছে মিঠির স্কুলের জুতো। মিঠির ঠাকুমা গীতা দেবী পা টিপে টিপে অনিমাদের উঠানে গিয়ে দাঁড়ায়।
অনিমার মা লক্ষ্য করলেও অনিমা আর মিঠি আপন মনে পান্তা ভাত গুগলীর ঝাল দিয়ে খেয়েই চলেছে। গীতা দেবী তো রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, মিঠি তাড়াতাড়ি খাবার ফেলে উঠে আয়। স্কুল থেকে সোজা ঘর যেতে কষ্ট হয়।আজ তুই বাড়ি চল। তারপর তোর একদিন কি আমার একদিন। এই বলে মিঠির হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে এসে মাঝ উঠানে প্রখর রোদের মধ্যে মিঠিকে দাঁড় করিয়ে রাখে।
ইন্টু সাধারণত কখনো তার শাশুড়ি মায়ের বিরোধীতা প্রকাশ্যে করে না।আজ কিন্তু এই সমস্ত ঘটনা জানার পর চুপচাপ গা বাঁচিয়ে রান্না ঘরে চলে গেল না।
ইন্টু তাড়াতাড়ি একটা গামছা নিয়ে এসে মিঠির গা মুছতে শুরু করে। মাথায় চুল রাখার বড্ড শখ মিঠির। রোজ বিকালে অনিমা লাল ফিতে দিয়ে কলা বিনুনি করে দেয় মিঠিকে। সকালে এই বিনুনি বেঁধেই মিঠি স্কুলে চলে যায়। তাড়াতাড়ি বিনুনিটা খুলে শুকনো গামছা দিয়ে ভালো করে জড়িয়ে দিল চুলটা। মিঠি ইন্টুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলেছে। ইন্টুরও চোখের কোণে অশ্রু ধারা জমাট বাঁধছে।
গীতা দেবী হুংকার দিয়ে বলে, দেখ বৌমা মেয়েকে নিয়ে আদিখ্যেতা না করে ওকে শেখাও যার তার ঘরে খেতে নেই। আমরা ব্রাম্ভ্রণ। সমাজের শ্রেষ্ঠ। আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা বাউরি, বাগদি, হাড়ি, মুচি, ডোম এদের ছায়া পর্যন্ত মারায় না। আর ওদের ঘরে গিয়ে একথালাতে পান্তা ভাত খাচ্ছে তোমার মেয়ে। আমার তো ভাবলেই গা গুলিয়ে উঠছে।
ইন্টু এবার আর চুপ থাকতে না পেরে শাশুড়ির চোখে চোখ রেখে বলে, মা আপনি আপনার নাতনিকে প্রচন্ড ভালোবাসেন জানি এটা। কিন্তু তাই বলে ওকে সব সময় ভুল পথে পরিচালিত করবেন এটা মা হয়ে কিভাবে সহ্য করি।
মিঠির নিষ্পাপ মনে আপনি জাতপাত, অস্পৃশ্যতার বীজ বপন করে চলেছেন। মা আমরা আজ যথেষ্ট সভ্য। উন্নত প্রযুক্তির হাওয়া ঘরে বাইরে সর্বত্র। কিন্তু আমাদের মনের জানালাতে আজও আমরা প্রকৃত মানবিকতার হাওয়াকে ঢুকতে দিতে চাই না। করজোড়ে ইন্টু বলে, মা দয়া করে আপনার মনের ভ্রান্ত ধারণাগুলো বর্জন করুন। না হলে কিন্তু আপনি নিজের অজান্তেই মিঠির ফুলের মতো মনটাকে প্রস্ফুটিত না করে সংকুচিত করে ফেলবেন। -
গল্প- অঙ্কুরে বিনাশ
অঙ্কুরে বিনাশ
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জীপ্রতিদিন সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম ভেঙে যায় প্রতিমা দেবীর। ঊষার কিরণে যখন পূর্বের আকাশ লাল তখনই বাসি কাপড় ছেড়ে ধূপ ধুনো সহযোগে দিনটা শুরু করেন প্রতিমা দেবী।
একমাত্র ছেলে দিল্লিতে থাকে তার পরিবার নিয়ে। বছরে একবার আসে পূজার সময়। তাও শ্বশুরবাড়িতে থাকে বেশি দিন। পুত্রবধূ একমাত্র মেয়ে। সুতরাং তার বাপের বাড়িতে জোর বেশী। যদিও এইসব নিয়ে আজকাল আর কোনো আক্ষেপ করেন না প্রতিমা দেবী।
সকাল আটটার মধ্যে রাঁধুনি রেবা এসে যায়। বেলা নটার মধ্যে ঠিকে ঝি কালুর মা। ওদের সবাইকে নিয়ে বেশ শরগোলে কাটে সকালটা।
রাঁধুনি রেবা রোজ যত না রান্না করে তার বেশি এপাড়া ওপাড়ার খবর শোনায় বেশি।আজ সকালে রেবা ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই শুরু করে, কাকীমা কাল রাতে পাল পাড়ায় কি কান্ড হয়েছিল কিছু শুনেছো?
– না, আমি কি করে জানবো এপাড়া ওপাড়ার খবর। ওসবের ঠেকা তো তোর।
– রায় মাস্টারকে চেনো তো? ছিঃ ছিঃ এই বুড়ো বয়সে কি কান্ড।
প্রতিমা দেবী বলে, রায় মাস্টার মানে মধুসূদন রায়? ওনাকে তো চিনি। আমার ছেলেকে তো ইংলিশ পড়াতে আসতেন। তা উনি আবার কি করলেন?
– ও কাকীমা, এই সব কথা মুখে আনতেও লজ্জা।কাল রাতে তো পাল পাড়ায় কাউন্সিলর, পুলিশ সবাই এসেছিল। পাড়ার ছেলেগুলো মাস্টারকে মেরেছেও খুব। পুলিশ এসেই তো উদ্ধার করলো।
– দেখ রেবা, গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে আসল ঘটনাটা বলবি কি তুই? আমার এমনিতেই উচ্চ রক্তচাপ। তুই আর সেটাকে বাড়িয়ে দিস না।
প্রতিমা দেবী ও রেবার কথোপকথনের মাঝে এসে পড়েন গৃহকর্তা সুনীল বাবু। উনি রোজ মর্ণিং ওয়াকে যান বাজারের থলি হাতে নিয়ে। শরীরের খেয়াল রাখার সাথে সাথে সুনীল বাবু জিহ্বার খেয়ালও রাখতে ভালোবাসেন। কাঁচা কলা, মোচা, থোড় এইসব আয়রন জাতীয় খাবার তার খুব প্রিয়। যদিও রেবা মনে মনে খুব অসন্তুষ্ট হয়। কতবার হাবে ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, বাজারে একটা মোটা করে মাসি আছে। যার কাছে মোচা, থোড়, ইচোর, কচুশাক, কচুলতি সব কাটা পাওয়া যায় কাকু। দামও বেশি নেয় না।সেখান থেকেই তো আনতে পারো কাকু।
তবে আজ মর্ণিং ওয়াক থেকে ফিরলেন সুনীল বাবু একটু গম্ভীর মুখে। বাজারের ব্যাগে আজ কাঁচা লঙ্কা ছাড়া কিছুই নেই। হাত পা ধুয়ে বললেন, গিন্নি একটু লিকার চা নিয়ে এসো তো ড্রয়িং রুমে।
প্রতিমা দেবী ড্রয়িং রুমে আসতেই সুনীল বাবু বলেন, আজ হাঁটতে গিয়ে একটা খবর শুনলাম। আমার তো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। রবীন বাবু বললো, খবরটা কিন্তু পুরোপুরি মিথ্যা নয়। এর আগেও ওনাকে নিয়ে এইরকম কথা শোনা গেছে।
প্রতিমা দেবী বলেন, তুমি কি রায় মাস্টারমশাই এর কথা বলছো?
সুনীল বাবু ভ্রু কুঁচকে বলেন, তুমি জানলে কি করে গো এত সকালে?
– না গো আমি এখনও পুরো বিষয়টা সম্পর্কে জেনে উঠতে পারি নি। আমি শুধু মাত্র আন্দাজ করে নামটুকু বললাম। আসলে রেবা এসে থেকে রায় মাস্টারের নামে নিন্দা করে চলেছে।
-গিন্নি বুড়ো বয়সে সত্যি বোধহয় রায় মাস্টারের মতিভ্রম ঘটেছে। নাতনির বয়সী মেয়ের সঙ্গে কেউ এইরকম আচরণ করে।
– কার সঙ্গে উনি কি করেছেন গো? আমি যতদূর জানি উনি খুব অভিজ্ঞ শিক্ষক।
– সেইখানেই তো অবাক লাগছে। একজন শিক্ষক হয়ে ছাত্রীর সঙ্গে এইরকম অশোভন আচরণ করলেন কিভাবে?
– দূর বাপু তুমি খুলে বল না কার সঙ্গে কি করেছেন উনি ?
একটু দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সুনীল বাবু বলেন, হরিপদ বাবুর নাতনি রাই ওনার কাছে ইংরেজি পড়তে যায় সন্ধ্যা বেলায়। ব্যাচেই পড়ে। কিন্তু গতকাল ওরা মাত্র দুজন ছিল। একজন একটু তাড়াতাড়ি চলেও যায়। সেই সুযোগে রায় মাস্টারমশাই হরিপদ বাবুর নাতনির বক্ষদেশে হাত দেয়। সেই মেয়ে টিউশন থেকে ফিরে এসে তার মাকে রায় মাস্টারের কার্য কলাপ বলে।হরিপদ বাবুর বৌমা সঙ্গে সঙ্গে হরিপদ বাবুর ছেলেকে সব কথা বলে। হরিপদ বাবুর ছেলে পাড়ার বেশ কয়েক জন ছেলেকে নিয়ে গিয়ে হাজির হয় রায় মাস্টারের বাড়ি।
প্রথমে বাগবিতণ্ডা তারপর তারা মাস্টার মশাইয়ের গায়ে পর্যন্ত হাত তোলে। শেষ পর্যন্ত কাউন্সিলর পুলিশ নিয়ে এসে মাস্টার মশাইকে জনতার রোষানলের হাত থেকে রক্ষা করে।
-হ্যাঁ গো তোমার কি মনে হয় মাস্টার মশাই এই নোংরামীটা করতে পারেন?
-জানি না গিন্নি। মানুষের মন না মতি। এই বৃদ্ধ বয়সে এসে এইরকম বিকৃত রুচি কিভাবে জন্মালো ওনার।
– তবে কি জানো ওনার চরিত্র সম্বন্ধে কথা আমিও এর আগে শুনেছি। উনি নাকি বোঝাতে বোঝাতে ছাত্রীদের পিঠে,থাই-এ হাত বুলান। তবে এই নিয়ে এতকাল কোনো ছাত্রী মুখ খোলে নি।তাই হয়তো ওনার এইধরনের অশোভন কাজ করার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল।– হ্যাঁ গো হরিপদ বাবুর নাতনি রাই-এর সাহস আছে বলতে হবে।
সুনীল বাবু বলেন, লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েরা অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা মুখ বুজে সহ্য করে নেয়। এই দূর্বলতাকেই অনেক পুরুষ ব্যবহার করে নিজেদের কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্য।প্রতিমা দেবী বলেন, দেখলে তো এখনকার মেয়েদর সাহস। ঠুকনো মান সম্মানের ভয়ে অন্যায়কে মুখ বুজে সহ্য করে নি। মেয়েদের শরীর মানেই কি ভোগ্য বস্তু! এই ধারণার পরিবর্তন আসবেই একদিন ধীরে ধীরে। এই কথাগুলো বলতে বলতে প্রতিমা দেবীর চোখে মুখে ফুটে উঠলো প্রতিবাদের ভাষা।
-
গল্প- মনোরথ
মনোরথ
– লোপামুদ্রা ব্যানার্জী-হ্যাঁ গো বৌমা, তুমি কি মেয়েছেলে গো? স্বামী রাগ করে না খেয়ে শুয়ে পড়লো আর তুমি দিব্যি বসে বসে মুরগির ঠ্যাং চিবোচ্ছো!
সবে মাত্র লেগ পিসটাতে কামড়টা বসিয়েছিল শ্রাবন্তী। একটু বিরক্ত হয়েই বলে, আপনার ছেলে যদি রাগের হোল সেল মার্কেট হয় তাহলে আমি কি করবো মা?
-দেখো বৌমা, পুরুষ মানুষের অমন একটু আধটু যখন তখন রাগ হয়। তা বলে তুমি স্ত্রী হয়ে অভুক্ত স্বামীর আগে খেয়ে নিলে?শ্রাবন্তীর এগারো বছরের মেয়ে শ্রীমন্তী বলে ওঠে, ঠাকুমা স্ত্রীরা যদি অভুক্ত স্বামীর আগে খেয়ে নেয় তাহলে কি হয়?
শ্রীমন্তীর ঠাকুমা মৃদুলা দেবী চোখগুলো গোল গোল করে বলে, পাপ হয় পাপ, মহাপাপ।
শ্রীমন্তী আবার জিজ্ঞাসা করে, ঠাকুমা পাপ কি ? আর মহাপাপ কি পাপের বাবা?
শ্রাবন্তী আর না হেসে থাকতে পারলো না। মাথাটা নিচু করে চোখ, মুখ বন্ধ করে নিঃশব্দে হেসে চলেছে।
মৃদুলা দেবী শ্রীমন্তীকে বলে পাপ করলে নরকে যেতে হয় আর পূর্ণ করলে স্বর্গে।
শ্রীমন্তী খেতে খেতে বলে, ঠাম্মা নরক আর স্বর্গের মধ্যে কি তফাৎ?
-নরকে গরম তেলের কড়াই-এ মানুষকে ঢুবানো হয় আর স্বর্গে সুখই সুখ। কত আরাম।
শ্রীমন্তী বলে, কবে আমি স্বর্গে যাবো?
-বালাই ষাট! তুই কেন এইসব জায়গায় যাবি! এই তো তোর কচি বয়স।
-তুমি তো ঠাকুমা বুড়ি হয়ে গেছো। তাহলে কি এবার তুমি স্বর্গে বা নরকে যাবে?
কিছুটা বিরক্তির সুরে মৃদুলা দেবী বলে, ওরে আগে মরি। তারপর তো যাবো এইসব জায়গায়।
শ্রীমন্তী আবার বলে, মৃতদেহের শরীরে তো কোন অনুভূতি থাকে না। তাহলে তো তাকে গরম তেলে ফেলা হলেও তার তো কোন অনুভূতি থাকবে না। সুতরাং সে কোন কষ্ট ও পাবে না।;তাই না ঠাকুমা?এবার মৃদুলা দেবী রেগে গিয়ে বলে, মাংসের হাড় চিবোচ্ছো, চিবোতে থাকো। খেতে খেতে এতো কথা কেউ বলে না।
ঠাকুমার কাছে ধমক খেয়ে শ্রী ( শ্রীমন্তী) চুপচাপ খাবারের থালাতে মনোনিবেশ করে।
শ্রাবন্তী শ্রী-কে জিজ্ঞাসা করে, কি রে একটা লেগ পিস দিই তোকে?
শ্রী তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে বলে, থাক মা । বাবাকে দিও। বাবা তো লেগ পিস খেতে পছন্দ করে।মৃদুলা দেবী শ্রীর কথা শুনে বলে, মেয়ের তো বাপের ওপর টান হবেই। দেখো এইটুকু মেয়ে কেমন বাবার কথা ভাবছে! হ্যাঁ গো বৌমা, তোমাদের তো ভাবের বিয়ে। এ কেমন তর ভাব তোমাদের। হৃদয় বলে কি তোমার কিছুই নেই?
শ্রাবন্তী আঙ্গুলগুলো ভালো করে চেটে বলে, ছিল বারো বছর আগে হৃদয় নামক একটা বস্তু আমার। এখন আর সত্যি আমার কাছে নেই। ওটা তো আপনার ছেলেকে দিয়ে দিয়েছি। আর আপনার যদি এতই অসুবিধা হচ্ছে যান না আপনার ছেলের কাছে। ডেকে নিয়ে আসুন তাকে খাবার টেবিলে। তাহলে বুঝবো আপনার ছেলে কেমন আপনাকে মান্য করে।
মৃদুলা দেবী বলে, বৌমা চ্যালেঞ্জ করো না। আমার খোকা সেই ছেলেই নয় যে মায়ের কথা অমান্য করবে।
শ্রাবন্তী মুচকি হেসে বলে, খুব আশ্বস্ত হলাম মা। আমি রান্নাঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে শুতে যাচ্ছি। আপনি আপনার ছেলেকে খাবার বেড়ে দেবেন।
এই বলে শ্রাবন্তী কিচেনের কাজগুলো গুছিয়ে বাথরুমে যায় ফ্রেশ হতে। এই কদিন বেশ ভ্যাপসা গরম পড়েছে। জলে ভালো করে ওডি-কোলন দিয়ে বেশটি করে স্নান করল সে। তারপর স্লিভলেস সাদা সুতীর নাইটটা পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো।আজও কিন্তু শ্রাবন্তী বেশ সুন্দরীই আছে। তলপেটে মেদ জমলেও অতিরিক্ত নয়। রোজ সকালে উঠে নিয়ম করে ব্যায়াম করে। প্রথম প্রথম আকাশকে পীড়াপীড়ি করতো একটু ব্যায়াম করার জন্য। আকাশের চূড়ান্ত অনীহা দেখে আজকাল আর কিছুই বলে না সে।
শ্রাবন্তী, আকাশের প্রেম কলেজ লাইফ থেকে। আকাশের প্রেমে হাবুডুবু খেতো শ্রাবন্তীই বেশি। আকাশ কলেজ পাশ করার বছর তিনেকের মধ্যেই যেমনি সরকারি চাকরিটা পেয়ে গেল তেমনি শ্রাবন্তী বিয়েটা ছটপট সেরে নিতে চাইলো।
নিজের কেরিয়ার নিয়ে তেমন ভাবে নি কিছুই শ্রাবন্তী। আসলে তখন তার বড্ড বিয়ে পেয়েছিল। স্বপ্নে, জাগরণে সে মগ্ন আকাশের প্রেমে। তবে সেই মগ্নতার রেশ খুব বেশি দীর্ঘ হয় নি। অষ্টমঙ্গলার পর থেকেই শুরু হয়েছিল হৃদয়ের ভগ্নতা।ছোট্ট ছোট্ট কথা আমাদের মনকে অসীম আনন্দে ভরিয়ে তোলে আর ছোট্ট ছোট্ট মনান্তর আমাদের মনকে ভেঙে খানখান করে দেয়। শ্রাবন্তীর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। শ্রাবন্তী ও আকাশ দুটো সম্পূর্ণ আলাদা পরিবেশ থেকে বড় হওয়া দুটো মানুষ।
শ্রাবন্তী ছোটবেলা থেকেই গান করতে খুব ভালোবাসে। স্কুলের, পাড়ার যে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সে গান গাইতে স্টেজে উঠবেই।
শ্রাবন্তীর অষ্টমঙ্গলার পর পর-ই রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠিত হয়েছিল আকাশদের পাড়ায়।
শোনা মাত্রই শ্রাবন্তী আনন্দে, উৎফুল্ল হয়ে আকাশকে বলে, আমি একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইবো তোমাদের পাড়ার অনুষ্ঠানে।পাশে বসেই ছিলেন মৃদুলা দেবী। উনি বললেন, সে কি গো বৌমা! এই তো কদিন বিয়ে হয়ে এলে। আগে পাড়ার লোকজনদেরকে ভালো করে চেনো, জানো। তারপর তো ওদের সাথে অনুষ্ঠান করবে।
আকাশও একটু বাঁকা হাসি দিয়ে বলে, সে না হয় বলে দিতে পারি কিন্তু তুমি এতো পাবলিসিটি প্রিয় তা তো আগে জানতাম না।
শ্রাবন্তী যেন আকাশ থেকে পড়লো। রবীন্দ্র জয়ন্তীতে একটা গান গাইবে তার জন্য তার পাবলিসিটি নিয়ে ওদের মাথা ব্যথা হয়ে গেল।
আকাশের ওপর রাগ করেই শ্রাবন্তী সেবার আর রবীন্দ্রজয়ন্তীতে গান গাইতে গেল না। কিন্তু চোখের জলে ভিজিয়ে ছিল বালিশ। তবে আকাশ কিন্তু একটি বারের জন্যও স্নেহমাখা হাত দিয়ে শ্রাবন্তীর চোখের জল মুছিয়ে দেয় নি। হয়তো টের পায়নি কখন শ্রাবন্তী নিঃশব্দে কেঁদে ছিল।
বিয়ের পরের বছরই কোল আলো করে এলো শ্রীমন্তী। যখন নার্স এসে জানালো তার মেয়ে হয়েছে তখন খুব আনন্দ হয়েছিল শ্রাবন্তীর। মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল মেয়েকে তার মনের মতো করে বড় করবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি।
শ্রীমন্তী বছর চারেক এর হতে না হতেই তাকে ড্রয়িং, ডান্স স্কুলে ভর্তি করে দিল।
শ্রী ড্রয়িং করতে ভালোবাসলে ও নাচতে মোটেই আগ্ৰহী ছিল না। তাও বছর তিনেক টেনে টেনে নাচের স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল শ্রাবন্তী। তারপর শ্রাবন্তী নিজেই হাল ছেড়ে দিয়েছিল। শ্রাবন্তী ভাবলো পড়াশোনাটাই করুক মন দিয়ে।
শ্রী নাচ ছেড়ে দেওয়ায় খুশি মনে আকাশ বলেছিল, আমি তো আগেই বলেছিলাম ওসব নাচ টাচ শিখিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে ড্রয়িং-টা শিখুক। লেখাপড়াতেও কাজে লাগবে। ধীরে ধীরে শ্রাবন্তী বেশ বুঝতে পারছিল আকাশের ভাবনার জগত আর তার ভাবনার জগতের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। কিন্তু তা বলে কি শ্রাবন্তী তার সাংস্কৃতিক দিক থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবে? না, শ্রাবন্তী এই বারো বছরে নিজের মনকে নতুন করে ঠেলে সাজিয়ে নিয়েছে। সময় পেলেই সে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পড়ে। রবীন্দ্র সংগীতের জন্যই যেন তার গলাখানি তৈরী। অপূর্ব লাগে তার গলায় শুনতে, ‘আমি তোমার প্রেমে হবো সবার কলঙ্ক ভাগি’, ‘ যেদিন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ অথবা ‘ জাগরণে যায় বিভাবরী.. ‘
আকাশদের পাড়ায় এখন মোটামুটি সকলেই জেনে গেছে আকাশের বউ খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। আর সেই কারণেই আজ তাদের পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা সন্ধ্যা বেলায় এসেছিল আকাশদের বাড়ি।
তারা শ্রাবন্তীকে অনুরোধ করে দূর্গা পূজার সপ্তমীর দিন সন্ধ্যায় যেন শ্রাবন্তী এক দেড় ঘন্টা তাদের পূজা মন্ডপে গান গায়। আর এই কাজের জন্য ক্লাব কমিটি শ্রাবন্তকে পাঁচ হাজার টাকা পারিশ্রমিক হিসেবে দিয়ে যায়। আর এইখানেই আকাশের আপত্তি।
আকাশের যুক্তি, ওদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া মানে কিন্তু ওদের হাতে চলে যাওয়া। এবার থেকে যখন তখন শ্রাবন্তীকে পাড়ার ছেলেরা ডাকবে গান গাইতে। আর আজকাল ক্লাবগুলোতে বারোমাসে চব্বিশ পার্বণ লেগেই আছে।
শ্রাবন্তী রসিকতা করে আকাশকে বলেছিল, তাহলে তোমার বউ-এর পাবলিসিটি বেড়েছে বলো। গান গাওয়ার জন্য লোকে পয়সা দিতে চাইছে। ভালোই হলো বুঝলে। এবার থেকে গানটাকে আমার জীবিকা করে নেবো।
আকাশ বিদ্রুপের সুরে বলে, বাড়ির নিরাপত্তা ভালো লাগছে না আর? তাই বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। এই শেষ কথাটার মধ্যে যথেষ্ট কু ইঙ্গিত ছিল।
শ্রাবন্তী এই কথাটা শোনা মাত্রই প্রতিবাদী কন্ঠে বলে ওঠে, নিজের মানসিকতা দিয়ে অন্তত আমার মনকে বুঝতে এসো না।
আকাশ হঠাৎই চিৎকার করে বলে উঠে ছিল, আমার মানসিকতা খারাপ! তুমি এতদিনে আমাকে এই চিনলে? আমার উচিত’ই হয় নি তোমার পাড়ায় গান গাওয়া নিয়ে কোনো কথা বলা। তোমার যা ইচ্ছা তাই করো।
এই বলে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ড্রয়িং রুম ছেড়ে বেড রুমে চলে যায়। ঘরে ঢুকে ফ্যানটা ফুল স্পিডে চালিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে শ্রাবন্তী ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে রাত্রিকালীন রূপচর্চা করতে। গোলাপ জল,নাইট ক্রিম, পাউডার এইসবের সুগন্ধি নাকে ভুরভুর করে ঢুকছে আকাশের। রূপচর্চা শেষ করে শ্রাবন্তী খাটের ওপর এলিয়ে দেয় তার সতেজ শরীরটা।
আজ আর আকাশের অভিমানে শ্রাবন্তীর চোখে জল আসছে না। বরং মন থেকে কোথাও যেন জোর পাচ্ছে সে। আজ আর রাতের খাবার আকাশ খেলো না বলে তাকে পীড়াপীড়ি করলো না। বরং মনে মনে সে বললো, পেটের জ্বালা ধরলে বাপ বাপ করে খাবে। তাছাড়া তার শাশুড়ি মা তো ছেলের খাবারের দায়িত্ব নিয়েছেন। সুতরাং শান্তিতে এবার নিদ্রা যাওয়া যায়।
চোখটা সবে লেগেছে হঠাৎ শ্রাবন্তী বুঝতে পারে তার কোমরে আকাশ হাত রাখলো। শ্রাবন্তীর কাঁধের কাছে মুখ নিয়ে এসে আকাশ বলে, আমি খুব খারাপ না? তোমাকে খুব কষ্ট দিই।
শ্রাবন্তী তো অবাক হয়ে যায়। এতবছর আকাশের কথায় ব্যথা পেয়ে যখন কেঁদে কেঁদে চোখ জবা ফুলের মতো লাল করে ফেলেতো, যখন অধীর আগ্রহে আশা করে বসে থাকতো আকাশের কাছ থেকে একটু সান্ত্বনা বাক্য শোনার জন্য তখন অবজ্ঞা ছাড়া কিছুই জোটে নি।
আর আজ যখন নিত্য অশান্তিতে পুড়ে মনটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে তখন আকাশ সহানুভূতির হাত বাড়াচ্ছে। কি অদ্ভুত !নিজের মনেই মৃদু হেসে চলেছে শ্রাবন্তী। আকাশের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে বলে, যদি রাগ কমে গিয়ে থাকে তাহলে যাও গিয়ে খেয়ে নাও। তোমার মাকে বলবে খাবার বেড়ে দেবে।
আকাশ তাড়াতাড়ি বলে, মা কেন? তুমি খাবার বেড়ে দেবে না আমায়।
-না ,আজ আর আমি দিতে পারবো না। এইমাত্র ফ্রেশ হয়ে শুলাম।
– শ্রাবন্তী তুমি কি আমার ওপর এখনো রেগে আছো। প্লিজ লক্ষ্মীটি আর রাগ করো না। তুমি ক্লাবের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে চাইছো, গাও না। কোনো আপত্তি নেই আমার। তবে ওদের কাছ থেকে টাকা পয়সা না নেওয়াই ভালো। বুঝলে।
শ্রাবন্তী কিছুতেই বুঝতে পারছে না টাকা পয়সা নিলে আকাশের অসুবিধাটা কোথায়? একবার ভাবলো আকাশের কথাটাই শুনবে সে। ক্লাব কমিটিকে টাকাগুলো ফিরিয়ে দেবে।
কিন্তু পরমুহুর্তেই শ্রাবন্তীর মনে হলো, এতগুলো টাকা ছেড়ে দেবো। জীবনে এই প্রথম তার যোগ্যতার দাম কেউ দিচ্ছে। তাছাড়া তো মাঝে মধ্যে তো শুনতে হয় শাশুড়ি, বর এদের কাছ থেকে যে, রোজগার করলে বুঝতে টাকার দাম কত। ঈশ্বর যখন সেই সুযোগ শ্রাবন্তীকে দিচ্ছে তখন সেই সুযোগ হাতছাড়া করার কোন মানেই হয় না।
শ্রাবন্তীর উত্তরের অপেক্ষায় তৃষিত চাতকের মতো শ্রাবন্তীর মুখের দিকে চেয়ে আছে আকাশ। শ্রাবন্তী ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে, রোজগারের স্বাদ যখন পেতে চলেছি তখন তাকে আমি গ্ৰহণ করবোই।
তোমার চিন্তা নেই তোমাদের কারোর খাওয়া দাওয়ার কোন অসুবিধা হবে না। যাও গিয়ে খেয়ে এসো। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। আর হ্যাঁ, তোমার জন্য লেগ পিস আছে রাখা। খেয়ে নিও।
আকাশ বুঝতে পারছে শ্রাবন্তী খুব শক্ত মুডে আছে। বেশি বাগবিতণ্ডা না বাড়িয়ে একটু কষ্ট করে হাসি এনে বলে, তুমি তো লেগ পিস খেতে ভালোবাসো। তুমিই খেতে পারতে। আমিই তো সবসময় খাই।
শ্রাবন্তী এবার মাথা বালিশের উপর হাত দিয়ে নিজের মাথাটা তুলে বলে, আমি আজ লেগ পিস খেয়েছি। শ্রী খায় নি। তোমার জন্য রেখে দিয়েছে।
আকাশের বিস্ময় আর শেষ হচ্ছে না। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে নিজেই টেবিলের ওপর রাখা খাবারগুলো একটা প্লেটে নিয়ে খেতে লাগলো।
শ্রাবন্তীর আজ মনে মনে খুব আনন্দ হচ্ছে।
আত্মতৃপ্তিতে মন খানিক ভরে উঠেছে। সংসার ধর্ম পালন করার নামে নারীই শুধু বঞ্চিত হয়ে আসছে দিনের পর দিন। মেয়েদের গায়ে জোর করে যেন ত্যাগীর লেবেল এঁটে দেওয়া হয়েছে। মন না চাইলেও সমাজের ভয়ে, লোকলজ্জার ভয়ে অনেক ত্যাগই মেয়েরা স্বীকার করে পরিস্থিতির চাপে।
তবে শ্রাবন্তী আজ পেরেছে, শুধু মনের কথা শুনতে। মনটাকে আজ আর ভারি লাগছে না তার। বরং বেশ হালকা, ফুরফুরে মনে হচ্ছে।শ্রাবন্তী নিজের মনেই বলে, এবার থেকে নিজের মতো করে বাঁচবো। আর মেয়েকেও শেখাবো স্বাধীন দৃষ্টি ভঙ্গি ও মানসিকতা নিয়ে বাঁচতে। বেশ ঘুম আসছে দু’চোখ জুড়ে। আজ আকাশের জন্য অপেক্ষা করলো না শ্রাবন্তী। নাইট ল্যাম্পটা জ্বেলে মনোরথে চেপে ঘুমের দেশে পাড়ি দিল শ্রাবন্তী।
-
গল্প- সৌরভ
সৌরভ
-লোপামুদ্রা ব্যানার্জীস্কুল পাড়ার মোড়ে নাড়ুর চায়ের দোকানে রোজ দুবেলা বসে আলোচনা সভা।আলোচ্য বিষয় পাড়া থেকে দিল্লি। পাড়ার মধু দালাল থেকে প্রধানমন্ত্রী মোদী সকলের সমালোচনাতে মুখরিত হয় আলোচনা সভা খানি।বক্তারাও এক একজন দিকপাল।
বঙ্কুবিহারী পালের বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। দীর্ঘদিন জেলা কোর্টের মুহুরীর কাজ করে এসেছেন। উকিলদের সংস্পর্শে থাকতে থাকতে সেও অবলীলায় সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দিতে পটু।
আর আছে গোবর্ধন হাঁসদা। বড়জোরা গ্ৰামের সরকারি স্কুলের পিওন ছিলেন। হাবে ভাবে তাকে তো স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলে মনে হয়। এলাকার লোকজন ছেলে মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করার সময় সবার আগে হাঁসদা বাবুর কাছেই ছোটে।
এছাড়া আরো একজন গুরুত্বপূর্ণ বক্তা হলেন কোয়াক ডাক্তার দীর্ঘাঙ্গী চট্টোপাধ্যায়। যেমনি দীর্ঘ তার কলেবর তেমনি লম্বা তার কথা। তার নাকি খুব হাত যশ। পাশ করা ডাক্তাররাও তার কাছে পরামর্শ করতে আসেন।
আজ রবিবারের সকালে নাড়ুদার চায়ের দোকানের আসন্ন নির্বাচনের দলবদলের হিরিক নিয়ে আলোচনাটা জমেছিল দারুণ কিন্তু হঠাৎই সেই আলোচনার গতিপথ হারিয়ে অন্য আলোচনা শুরু হয়ে গেল।
নাড়ুর চায়ের দোকানে রোজ সকালে আলুর চপ বিক্রি হয়।অতি অল্প আলুর পুর দিয়ে কিভাবে অতি উৎকৃষ্ট আলুর চপ নাড়ুদা বানায় তা বেশ আশ্চর্যজনক।
তবে আজকের নাড়ুদার দোকানের সামনে একটা লাল রঙের স্পোর্টস কার এসে দাঁড়াতেই আলোচনা সভার বক্তাগণ অতীব আশ্চর্য হয়ে উঠলো। তাদের আশ্চর্যের মাত্রা আরো বাড়লো যখন গাড়ি থেকে নেমে এল নুপুর বৌদি।
হালকা পিঙ্ক কালারের শাড়ি, এয়ারহোসটেস থ্রি কোয়ার্টার ব্লাউজ পরিহিতা, কানে সামান্য ছোট্ট দু’টি সোনার দুল, কপালে কালো টিপ ও ডানহাতে একটা দামি রিস্ট ওয়াচ, পায়ে সামান্য হিলের জুতো। গাড়ি থেকে নেমে নাড়ুদার কাছে এসে অতি ক্ষীণ কন্ঠে বলে, আমায় পাঁচটা আলুর চপ দাও তো নাড়ুদা।
নাড়ুদা কোনপ্রকার বাক্যব্যয় না করে একটা কাগজের ঠোঙ্গার মধ্যে পাঁচটা আলুর চপ দিয়ে বলে, বৌদি পঁচিশ টাকা দাও।
নুপুর বৌদি ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টাকা বের করার আগেই স্পোর্টস কার থেকে নেমে এলো একজন সুদর্শন মাঝবয়সী পুরুষ। এগিয়ে এসে ত্রিশ টাকা দিল নাড়ুদাকে।
নাড়ুদা হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিতে নিতে ভদ্রলোকের আপাদমস্তক গভীর ভাবে নিরীক্ষণ করে নেয়। নুপুর বৌদি গাড়ি করে চলে যাওয়ার পর শুরু হয় গভীর আলোচনা।
গোবর্ধন হাঁসদা বলে, আরে এতো মিত্র মাস্টারের ছেলের বউ না?
বঙ্কুবিহারী বলে, বা বা এতো একদম ভোল পাল্টে ফেলেছে। আগের থেকে গায়ের রং টা ফর্সা হয়ে গেছে দেখছি। শরীর স্বাস্থ্যও ফিরেছে বেশ।দীর্ঘাঙ্গী বাবু বলে, মিত্র মাস্টারের ছেলে টুবাইটা অকালে চলে গেল। কত আর বয়স হয়েছিল। জোয়ান তরতাজা যুবক। সাতচল্লিশ আটচল্লিশ হবে। ঐ লম্বা চওড়া ছেলেটার হার্টের রোগ থাকতে পারে দেখে বোঝা সম্ভব ছিল না।
গোবর্ধন বাবু বলে, বেশি না, বেশি না। মাত্র দু’টো বছর ভুগলো ছেলেটা। চোখের সামনে কেমন একটা তরতাজা ছেলে চলে গেল।
বঙ্কুবিহারী বাবু, চায়ের ভাঁড়ে একটু চমুক দিয়ে বলে, টুবাই-এর এক ছেলে এক মেয়ে না? টুবাই যখন মারা যায় তখন তো ওরা বেশ ছোট ছিল।
দীর্ঘাঙ্গী বাবু বলে, ছেলেটার বারো আর মেয়েটার পনেরো।জ্বর, সর্দি হলে টুবাই তো সবার আগে আমার কাছেই নিয়ে আসতো।
একটু থেমে জিজাসু সুরে বলে, হ্যাঁ রে নাড়ু টুবাইয়ের বাড়ি তো তোদের পাড়ায়। ওদের এত ঠাঁটবাট চলে কি করে রে? দুবছরেই তো টুবাইয়ের বউ ভোল পাল্টে ফেলেছে।
নাড়ু লোহার কড়াইয়ের গরম তেলে গোটা পাঁচেক আলুর চপ ছেড়ে ছানতা দিয়ে হালকা নেড়ে মুখটা বেঁকিয়ে বলে, বুঝলেন ডাক্তার বাবু এই জগতে কেউ কারোর নয়।টুবাই ওর বউ কে কি কম ভালোবাসাতো! এই বউকে পাবার জন্য টুবাই সুইসাইড করতে গিয়েছিল।
গোবর্ধন বাবু ভ্রু কুঁচকে বলে, সুইসাইড? আগে তো কোনদিন শুনি নি টুবাই সুইসাইড করতে গিয়েছিল। তা ব্যাপারটা কি নাড়ু একটু খুলে বল তো।
নাড়ু গরম তেল থেকে চপগুলো তুলে ঝাঁঝড়িতে রেখে গ্যাসটা বন্ধ করতে করতে বলে, ও কাকা এইসব কথা কি আর রাষ্ট্র করতে আছে। আমরা এক পাড়ার লোক তাই জানি।
টুবাইকে তো ওর বউ প্রথমে কিছুতেই বিয়ে করতে চায় নি।টুবাইও নাছোড়বান্দা । একদিন নুপুরের নামে একটা সুসাইড নোট লিখে হাতের শিঁড়া কেটে আত্মঘাতী হয়। হসপিটালের বেডে শুয়ে সেলাইনের বোতলকে সাক্ষী রেখে টুবাই ও নুপুরের বিয়ে হয়।
গোবর্ধন বাবু চোখে মুখে একেবারে প্রফুল্ল এনে বলে, এতো একেবারে অঞ্জন চৌধুরীর সিনেমার মতো। তা এখন দেখছি টুবাইয়ের বউ বিধবা হয়েও নতুন সিনেমা করছে মনে হচ্ছে।
চায়ের দোকানে উপস্থিত সকলেই হো হো করে হাসির রোল তুলে চৌমাথা খানি কাঁপিয়ে তোলে।
হঠাৎই বঙ্কুবিহারী বাবু বলে, চুপ, চুপ। টুবাইয়ের মেয়ে আসছে এদিকে।
নিমেষে হাসি বন্ধ করে সকলে চা পানে মনোনিবেশ করলো।
টুবাই ও নুপুর বৌদির মেয়ে পায়েল সাইকেল থেকে নেমে সাইকেলটা নাড়ুদার দোকানের সামনেই স্ট্যান্ড করে গটগট করে হেঁটে এসে বলে, নাড়ু কাকু পাঁচটা আলুর চপ দাও তো তাড়াতাড়ি।নাড়ু একটু আগেই ভেজে রাখার আলুর চপগুলো তুলে কাগজের ঠোঙ্গার মধ্যে রাখতে গেলে পায়েল বলে, আরে না না। ঠান্ডা চপ নেবো না। তুমি আমায় গরম গরম ছেঁকে দাও।
পায়েলের কথা শুনে নাড়ু একটু মনোক্ষুণ্ণ হয়ে বলে, তা হলে একটু দাঁড়াতে হবে কিন্তু।চপ ভাজতে সময় লাগে।
পায়েল সেইমতো দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে স্মার্ট ফোনখানা ঘাঁটতে লাগলো।
গোবর্ধন বাবু একটু গলা খাকারি দিয়ে বলে, তুই টুবাইয়ের মেয়ে না?
পায়েল ফোন থেকে চোখ না সরিয়ে বলে, হ্যাঁ।
গোবর্ধন বাবু আবার বলে, ইংলিশ মিডিয়ামেই পড়ছিস তো?
পায়েল এবারও মুখ নিচু করে বলে, হ্যাঁ।দীর্ঘাঙ্গী বাবু বলে, তা দিদিভাই তোমার দাদু কেমন আছে এখন? অনেক দিন তোমার দাদুর সাথে দেখা হয় নি। এখন বোধহয় ঘর থেকে তেমন বের হয় না। আমি তোমার দাদুর বন্ধু হই। দু’একবার তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম যখন তোমার বাবা অসুস্থ ছিল। তখন দেখে থাকবে হয়তো তুমি।
পায়েল এবার মোবাইল থেকে মুখটা তুলে দীর্ঘাঙ্গী বাবুর দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ আপনি তো হরলিকস নিয়ে দেখতে এসেছিলেন পাপাকে। দাদুর শরীর খুব একটা ভালো নয়।বড্ড পায়ে ব্যথা।
দীর্ঘাঙ্গী বাবু শশব্যস্ত হয়ে বলে, সেকি কথা। তোমার দাদুকে সুস্থ থাকতেই হবে এখন দীর্ঘদিন তোমাদের জন্য।
বঙ্কুবিহারী বাবু চশমাটা নাকের ডগায় এনে বলে, তোদের নীচের তলাটাতে ভাড়াটে খুঁজছিল তোর দাদু।পেয়েছিস?এ্যগরিমেন্ট করে নিয়েছে তো তোর দাদু?
এত ফালতু আলাপ চারিতায় পায়েল মনে মনে চরম বিরক্ত হলেও মুখে বলে, নতুন ভাড়াটে এসেছে। তবে এ্যগরিমেন্টের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।
এতক্ষণে নাড়ু পাঁচটা আলুর চপ ঠোঙায় দিতে দিতে বলে, তোর মা তো একটু আগেই পাঁচটা চপ নিয়ে গেল। কম পড়ে গেল?
পায়েল বলে, সৌরভ মামার তোমার আলুর চপ খুব ভালো লেগেছে। তাই আবার নিয়ে যাচ্ছি।
গোবর্ধন বাবু বলে, ওওওও, ঐ ভদ্রলোক তোর মামা হয় বুঝি? তা আমরা তো জানতাম তোর মায়ের ভাই বোন কেউ নেই। এটা কি সম্পর্কের মামা তোর?
পায়েল চপের ঠোঙাটা হাতে নিয়ে দাম মিটিয়ে চলে যাওয়ার সময় বলে, আমার মায়ের অফিসের বস হন উনি।
এই কথাটা বলে, সাইকেলে চেপে দ্রুতগতিতে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
বাড়িতে ফিরে এসেই পায়েল নুপুরকে বলে, আমাকে আর কখনো নাড়ুদার দোকানে পাঠাবে না বলে দিলাম।
নুপুর ক্ষীণ কন্ঠে বলে, কেন? কি হলো তোর আবার?
-জানো নাড়ু কাকার দোকানে গিয়ে আমাকে হাজার জনের হাজার কথার উত্তর দিতে হচ্ছিল। নাড়ু কাকা আবার জিজ্ঞাসা করে,এই যে তোর মা পাঁচটা আলুর চপ নিয়ে গেল তা বোধহয় কম পড়ে গেল নাকি?আমি যেমনি বলেছি সৌরভ মামার তোমার দোকানের আলুর চপ ভালো লেগেছে তাই আবার নিতে এলাম। তেমনি গোবর্ধন দাদু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, তোর মায়ের তো ভাই বোন নেই জানতাম। এটা তবে কেমন মামা? তুমি বলো মা ওদের এত পঞ্চায়েতের কি আছে?
আমি যেমনি বললাম সৌরভ মামা মায়ের অফিসের বস।শুনেই ওদের মুখগুলো কেমন যেন হয়ে গেল।
আর একটা কথা মা, তুমি সৌরভ মামাকে আমাদের বাড়িতে এবার থেকে কম আনবে। সেদিন রায় দিদু জিজ্ঞাসা করছিল, কে রে ওই ভদ্রলোক? আজকাল প্রায়ই তোদের বাড়িতে আসতে দেখি।
তাছাড়া সেদিন খেলার মাঠের ঘটনাটা ভাই তোমাকে বলে নি। স্কুল মাঠে ক্রিকেট খেলতে খেলতে প্রিন্সের সাথে ভাইয়ের ঝগড়া হয় ক্যাম্বিস বল হারানো নিয়ে। জানো প্রিন্সের কত বড় সাহস বলে কিনা তোর আবার পয়সার চিন্তা। তোর নতুন বাবার কাছে চেয়ে নিস।এবার নুপুর কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে, চুপ কর পায়েল। কে কি বললো আর তা নিয়ে তুই সংসারে অশান্তি ডেকে আনছিস।
-দেখো মা অশান্তি আমারও ভালো লাগে না। কিন্তু পাঁচজনের বাঁকা বাঁকা কথাগুলো আমাদেরকেই শুনে বেড়াতে হয়।মা-মেয়ের কথপোকথনের সুর ধীরে ধীরে উঁচুর দিকে যাচ্ছে। পাশের ঘর থেকে সৌরভও উঠে এসেছে দুজনের বাক বিতন্ডার মধ্যে।
সৌরভ নুপুরকে কিছুটা ধমকের সুরে বলে, কি হচ্ছে কি নুপুর? তুমি চুপ করো না। পায়েলের এখন বয়স কম।ওর পক্ষে কি সব সম্পর্কের গভীরতা বোঝা সম্ভব। তুমি ম্যাচিওর আর ও ইমম্যাচিওর।নুপুর কিছু একটা বলতে যাবে হঠাৎ লক্ষ্য করে তার শ্বশুর মশাই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে।তার নড়বড়ে মেরুদন্ডের শরীরটাকে কোনক্রমে লাঠির ওপর ভর দিয়ে টেনে টেনে সেখানে উপস্থিত হয়েছে।
তিনি কিছুটা গম্ভীর স্বরে পায়েলকে প্রশ্ন করেন, সৌরভ এই বাড়িতে এলে তোকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। এটা তোর খারাপ লাগে। কিন্তু সৌরভ যখন তোর স্কুলের মোটা টাকা মাইনে প্রতি মাসে দেয়, টিউশনির টাকা, নেটের রিচার্জ আরো কত নিত্য নতুন আবদার তোর মেটায় তখন তো ওর কাছে হাত পেতে নিতে খারাপ লাগে না।
টুবাই চলে যাওয়ার পর আমরা সকলেই অথৈ জলে পড়ে ছিলাম। আমার পেনশেনের সামান্য কটা টাকায় তোদের দুই ভাই বোনকে নামী স্কুলে পড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
আর তোর মা এল.আই.সি. অফিসে ঢুকেছিল সদ্য। সেই সময় সৌরভ যদি তোর মায়ের দিকে সাহায্যের, সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে না দিত তাহলে আজকে যে বড় বড় কথাগুলো বলছিস সেগুলো আর তোর বলা হতো না।কিছুটা দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন নুপুরের শ্বশুর মশাই। বুঝলে বৌমা, অকৃতজ্ঞ। হাত পেতে উপকার নিতে লজ্জা করে না আবার সমালোচনা করতেও পিছপা হয় না। পাড়া প্রতিবেশী তো আছেই নিন্দে মন্দ করার জন্য। টুবাইয়ের চিকিৎসার পিছনেই জলের মতো পয়সা বেরিয়ে গেছে। তোমার যা গয়না ছিল সবই বিক্রি করতে হয়েছে। আমাদের দুর্দিনে একটি বারের জন্য পাড়ার কেউ এগিয়ে এসেছিল সাহায্যের হাত নিয়ে।
বলতে বলতে নুপুরের শ্বশুর মশাই এর গলা আদ্র হয়ে উঠেছে। তবুও তিনি বলেই চলেছেন। বুঝলে বৌমা পাড়ার লোকরা ভেবেছিল টুবাই চলে যাওয়ার পর তুমি ওদের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করবে। কিন্তু তা তো তুমি করলে না। আর এইখানেই পাড়ার হিতৈষীদের মনোকষ্ট শুরু হলো।
আমরা নিজেদের আত্মসম্মান বজায় রেখে শাক ভাত, নুন ভাত খেয়ে দিন কাটিয়েছি। একটু মাছ মাংসের জন্য পায়েল, পাপাই বায়না করলে তুমি ওদেরকে বকতে আর আড়ালে চোখের জল ফেলতে। বৌমা আমি সব দেখতাম আর চুপ থাকতাম। আমিও যে অসহায়।
দেখ পায়েল দিদিভাই তুই তো বড়ো হচ্ছিস। পাঁচজনের পাঁচ কথায় কান না দিয়ে মায়ের দুঃখটা বোঝার চেষ্টা কর।
আর দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ভালোবাসা মানেই কি স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক? না দিদিভাই তা কখনও হয় না। তোমারও তো অনেক ছেলে বন্ধু আছে সবার সাথেই কি তোমার প্রণয়ের সম্পর্ক?দাদুর আবেগ তাড়িত কথাগুলো শুনে পায়েল এবার কেঁদে ফেলে। নুপুরকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা আমাকে ক্ষমা করে দিও। সৌরভ মামাকে নিয়ে আমার মনে সামান্যতম নোংরা সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
বাড়ীর এই গুমোট পরিবেশকে হাল্কা করার জন্য সৌরভ বলে, অনেক হলো কান্নাকাটি। আলুর চপগুলো একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল যে। আবার নাড়ুদার দোকানে গেলে কিন্তু নাড়ুদা এবার রেগে যাবে। সৌরভের এইরকম রসিকতায় সকলেই হেসে ওঠে।
সৌরভ বলে, নুপুর চপগুলো একটু গরম করার ব্যবস্থা করো। আজ আর আমাকে আলাদা করে মুড়ি দিও না।আজ আমি, পায়েল, পাপাই আর তুমি একসাথে এক গামলাতে মুড়ি খাবো।
নুপুরের শ্বশুর মশাই হাসতে হাসতে বলেন, নাড়ুর আলুর চপের গন্ধকে ছাড়িয়ে নিখাদ এক ভালোবাসার গন্ধে ভরে উঠলো আমার এই বাড়ি খানা।