• গল্প

    গল্প- নবযৌবন

    নবযৌবন
    – লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

    তনুদি এসে গেছে বড় মামি। তনুদি এসে গেছে।এই বলে চিৎকার করতে লাগলো তনুশ্রীর পিসতুতো বোন পম্পি।পম্পির কথা শুনে বিয়ে বাড়ির আগন্তুক আত্মীয়দের অনেকেই ছুটে এলো তনুশ্রীদের বাড়ির সদর দরজায়। মন্ডল বাড়ির সবচেয়ে আদরের মেয়ে তনুশ্রী। তবে সেই আদরের কারণে যে সকলে ছুটে এলো তা ষোলআনা ঠিক নয়। সবার মনের কৌতুহল এত অল্প বয়সে ইউট্রাস রিমুভ করে কেমন আছে তনুশ্রী।

    তনুশ্রীকে দেখা মাত্রই তনুশ্রীর মেজ পিসির মেয়ে সুলতা বলে, হ্যাঁ রে তনু কেমন আছিস? শারীরিক কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? দেড়বছর হলো তো তোর অপারেশনের।

    তনুশ্রী একগাল হাসি দিয়ে বলে, না গো আমি পুরোপুরি সুস্থ আছি।

    এতক্ষনে তনুশ্রীর মা এসে হাজির সদর দরজায়।সবাইকে ধমকের সুরে বলে, কি আশ্চর্য মেয়েটা তিন ঘণ্টা জার্নি করে এলো এতটা পথ। ওকে একটু জিরিয়ে নিতে দে।

    সুলতাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে তনুশ্রীর মা তমালী দেবী বলে, তনুর অপারেশন নিয়ে ওকে বেশি কথা জিজ্ঞেস করিস না। ও পছন্দ করে না।

    সুলতা মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও মুখে বলে, ঠিক আছে মামী। আর কিছু জিজ্ঞাসা করবো না। আসলে কি বলো তো আমারও তো চার বছর আগে এই একই অপারেশন হয়েছে তাই জিজ্ঞেস করছিলাম। দেখ অপরাশেনের পরই আমি কেমন মোটা হয়ে গেলাম। তনু তো বেশ ভালোই আছে দেখছি।

    তমালী দেবী বলে, তোদের তো চল্লিশের পর ইউট্রাস বাদ গেছে আর মেয়েটার আমার বত্রিশ বছর বয়সেই শরীর থেকে এই রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে কেটে বাদ দিতে হলো। কথাগুলো বলতে বলতে তমালী দেবী কেঁদেই ফেললেন।

    কোন রকমে নিজেকে সামলে বলেন, সুলতা জামাইদের জলখাবারের দিকটা একটু খেয়াল রাখিস। মলয় একদম মুড়ি খেতে পারে না। পারলে একটু ময়দা মেখে রাঁধুনিকে দিস। ও লুচি ভেজে দেবে।
    -ঠিক আছে মামী। আমি মলয়কে বাগিয়ে গুছিয়ে জলখাবারটা দেবো। যতই হোক বড় শালী হই আমি।

    তনুশ্রী সবার সাথে একটু আধটু সৌজন্য করে নিজের ঘরে গেল। দক্ষিণ দিকের এই দশ বাই বারো রুমটার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তনুশ্রীর ঘরের ডেকরেশন অনেক খানি পরিবর্তন হয়ে গেছে এখন। বিয়ের আগে জানালার পাশে একটা স্টাডি টেবিল রাখা থাকত।

    আকবরের রাজত্ব কাল মুখস্থ করতে করতে যখন হাঁপিয়ে উঠত তখন জানালা দিয়ে বাইরের গাছপালা, ফুল, পাখি এদের দেখে বেড়াতো।
    আর মনে মনে ভাবতো, ইশ্ যদি আমি কোকিল হতাম সুরেলা কণ্ঠ দিয়ে সকলের মন জয় করতাম।

    আবার কখনো ইউক্যালিপটাস গাছটা দেখে মনে হতো, যদি আমি ইউক্যালিপটাস গাছ হতাম আকাশের কত কাছে পৌঁছে যেতাম। আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো মেঘগুলোর সাথে গল্প করতে পারতাম।

    আসলে ছোট্ট থেকে তনুশ্রী ভীষণ আবেগপ্রবণ। তনুশ্রীর রুমের উত্তর দিকের বক্স জানালাটা বেশিরভাগ দিনই বন্ধ থাকতো।
    একদিন তনুশ্রী লক্ষ্য করে এই জানালার এক কোণে একটি ঘুঘু পাখি বাসা বানিয়েছে। ডিম ফুটে ছোট্ট ছোট্ট তিনটে ঘুঘুর বাচ্চা বের হয়েছে।
    তনুশ্রী রোজ সকালে দূর থেকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতো কিভাবে মা ঘুঘুটি বাচ্চা ঘুঘু পাখিগুলোকে আদর করল। তনুশ্রী মনে মনে বলতো পাখিদেরও মাতৃত্ব এর অনুভূতি কি প্রবল। প্রতিটি বাচ্চার প্রতি সমান স্নেহ।

    প্রথম যেদিন প্রেগন্যান্ট হওয়ার মেডিক্যাল রিপোর্ট হাতে পায় তনুশ্রী সেদিন মলয়কে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আমার কিন্তু দুটো বেবি দরকার। আমার মতো সিঙ্গেল চাইল্ড আমি চাই না।

    মলয় রসিকতা করে বলে, আমার ঠাকুমার মতো গোটা পাঁচেক হলেও মন্দ হয় না। তুমি কি বলো?

    তনুশ্রী সোহাগ মাখা সুরে বলে, আমি রাজি। আমার নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি না যৌথ পরিবার ভালো লাগে।

    এই তনুশ্রীই মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে ইউট্রাস রিমুভ করতে বাধ্য হয়। পরিয়ডের অনিয়মিত ঋতুস্রাব, তলপেটের অসহ্য ব্যথা নিয়ে তনুশ্রী অস্থির থাকতো মাসের বেশিরভাগ দিন।

    মাত্রাতিরিক্ত ব্লিডিং এর কারণে বাড়ি থেকে কোথায় বের হতে চাইতো না। একবার জোর করে মলয় শপিং মলে নিয়ে যায়। কিন্তু বাড়িতে ফিরতে না ফিরতেই ওভার ফ্লো এর কারণে চুড়িদারে লেগে যায় রক্তের দাগ। কোনো রকমে ওড়না দিয়ে ঢেকে আবাসনের কৌতুহলী চোখগুলো এড়িয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল সেদিন।

    তারপর দিনই অফিস থেকে ফিরে মলয় প্রায় জোর করেই গাইনোকলজিস্ট এর কাছে নিয়ে যায়।

    উনি সব শুনে প্রথমেই দ্বিতীয় সন্তানের কথা বলেন। কিন্তু তনুশ্রী জানায় তার স্বামী দ্বিতীয় সন্তান চায় না। ডাক্তার ইউ,এস,জি করতে বলে lower abdomen এর। ইউ.এস.জি রিপোর্টে ধরা পড়ে তনুশ্রীর জরায়ুতে মাল্টি ফাইব্রয়েড হয়েছে। যেহেতু মাল্টি ফাইব্রয়েড তাই জরায়ু কেটে বাদ না দিলে পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই কথা শোনা মাত্রই মলয় বলে, যখন আমাদের দ্বিতীয় সন্তান দরকার নেই তখন বার বার শরীরকে কাটা ছেঁড়া করে লাভ কি? ডাক্তার ম্যাডাম বলে,
    জরায়ু কেটে বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে বয়স অত্যন্ত অল্প তনুশ্রীর। যদি ওষুধ দিয়ে আরো তিন চার বছর কন্ট্রোলে রাখা যায় এই অসুখটাকে তাহলে ভালো হয়।

    কিন্তু তা আর সম্ভব হয় নি। দিন দিন তনুশ্রীর হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যেতে থাকে। গায়ের রং কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে আসছে। বয়স অল্প হওয়ার দরুণ ছোট সংসারের কাজ, ছেলেকে সামলানো সবই করতো কিন্তু একবার বিছানায় পিঠ পাতলে আর উঠতে ইচ্ছে করতো না তার।

    তনুশ্রী দু’ একবার ভেবেছে দ্বিতীয় সন্তানের কথা। কিন্তু মলয়ের একদম ইচ্ছা ছিল না। মলয়ের ব্যস্ত জীবনে নতুন অতিথির জন্য অতিরিক্ত সময় একদমই ছিল না। আর তনুশ্রীর একার পক্ষে দু’টো বাচ্চাকে সামলানো সম্ভব ছিল না। সুতরাং দ্বিতীয় সন্তান এর ইচ্ছা পরিত্যাগ করে ইউটেরাস রিমুভ এর সিদ্ধান্তকেই স্বাগত জানায়।

    যখনি পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন তনুশ্রীর ইউট্রাস অপারেশন হবে এই কথা জানতে পারলো তখনই উপদেশের ঢেউ আছড়ে পড়ল তনুশ্রীর জীবনে।

    তনুশ্রীর সবথেকে নিকট প্রতিবেশী রায় জেঠিমা বলে, তনু ইউট্রাস বাদ যাওয়া মানে কিন্তু স্বামী স্ত্রীর মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হওয়া। শারীরিক সম্পর্ক ঠিক না থাকলে স্বামীদের বিপথগামী হতে বেশি সময় লাগে না।

    মলয়ের অফিসের সিনিয়র কলিগ ঘোষদার গিন্নি এসে বলে, মলয়ের আর কতই বয়স। তোর থেকে বছর তিনেকের বড়। এই বয়স থেকে তোর ইউট্রাস রিমুভ হয়ে গেলে মলয়ের তো আর তোর দিকে নজরই থাকবে না। দেখবি কেমন হঠাৎ করে মোটা হতে শুরু করবি, শরীরের গ্ল্যামার কমে যাবে। ইউট্রাস না থাকা মানে একটা মেয়ের জীবনের যৌবনটাই শেষ।

    ডাক্তার ম্যাডামও বলেছিল, তনুশ্রী ইউট্রাস রিমুভ করা মানেই কিন্তু তোমার বয়সটা দশটা বছর বাড়িয়ে দিলাম। নিজের শরীরের জন্য কিন্তু তোমাকে যত্নশীল হতে হবে। খাওয়া দাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম এইগুলো কিন্তু নিয়ম মেনে করতে হবে।

    তাই অপারেশনের একবছর পর থেকেই তনুশ্রী হালকা হালকা যোগাসন, মেডিটেশন এইসব জীবনের মূলমন্ত্র করে অকাল বার্ধক্যের সাথে লড়াই করার জন্য মনে মনে তৈরী হয়ে উঠেছে।

    তার জন্য সপ্তাহের পাঁচ দিন তনুশ্রীকে ভোর পাঁচটায় বিছানা ছাড়তেই হয়। সকালে ফ্রেশ হয়ে নিত্য আধঘণ্টা যোগ ব্যায়াম করা চাই চাই। তারপর মলয়ের অফিসে নিয়ে যাওয়ার জন্য টিফিন বানায়।

    স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির পর্ব শেষ হতে না হতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে ছিল তনুশ্রী। বিয়ের পর দুউটো বছর সকাল আটটার আগে কিছুতেই বিছানা ছাড়তো না। বড্ড ঘুম কাতুরে সে।

    মলয় রোজ মর্নিং ওয়াকে বের হতো ঘরের ইন্টার লকটা লাগিয়ে দিয়ে। বিয়ের পর পর মলয় তনুশ্রীকে বলতো মর্নিং ওয়াকের করা কথা। কিন্তু তনুশ্রী আল্লাদে গদগদ হয়ে বলতো, আমার শরীর স্বাস্থ্যের চেয়ে ঘুমটা বেশি প্রিয়।

    মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে যখন তার ইউট্রাসে মাল্টি ফাইব্রয়েড হলো তখন সে বুঝলো জীবন তার থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছে যৌবন।

    তার জীবনে পিরিয়ড শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রতি মাসে অসহ্য তলপেটের যন্ত্রনা তাকে সহ্য করতে হতো। বিয়ের আগে তো তনুশ্রী পিরিয়ডের চারটা দিন মায়ের হাতে ছাড়া খাবার খেতেই চাইতো না।

    সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতো পেটে হট ব্যাগ নিয়ে। কখনো কখনো ব্যথার ওষুধও নিতে হতো। বিয়ের পর স্বামীর ঘরে এসেও এক অশান্তি প্রতি মাসে। যদিও মলয় মাতৃ স্নেহ দিতে পারতো না তবুও অফুরান স্বামীর ভালবাসা সে দিত।

    অফিস যাওয়ার আগে ভাত, ডাল ভাতে, আলু ভাতে, ডিম ভাতে করে ডাইনিং টেবিলে রেখে যেত। হট ব্যাগে জলও ভরে দিত। এয়ার টাইট কনটেইনারে বিকালে খাওয়ার জন্য ফলও কেটে রেখে দিত।

    তনুশ্রী পিরিয়ডের যন্ত্রণা মলয়ের কাছেও ছিল অসহনীয়। তাই তনুশ্রীর শরীর থেকে ইউট্রাস রিমুভ করার ক্ষেত্রে পূর্ণ সমর্থন ছিল মলয়ের।

    অপারেশন এর পর তনুশ্রীকে সব সময় আনন্দে রাখার চেষ্টা করে মলয়। অফিস থেকে পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে সারাদিন তনুশ্রীর সঙ্গে কাটিয়েছিল। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন যখন তনুশ্রীর মনোবল ভাঙতে বদ্ধপরিকর তখন মলয় সবসময় যুক্তি দেখিয়েছে, একটা রোগকে শরীরে বাসা বাঁধতে দেওয়ার থেকে তো দূর করা ভালো।

    স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা কি শুধুই শরীর থেকে আসে! স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা, বোঝা পড়া, নির্ভরতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এইসব কিছু আসে দু’জনের অন্তর থেকে।

    আজ দেড়বছর হয়ে গেছে তনুশ্রীর ইউট্রাস কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে তনুশ্রীকে বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। বরং আগের থেকে অনেক বেশি ফিগার সচেতন হয়েছে সে। শরীরের লালিত্যও কোনো অংশে এখনও কম হয় নি।

    মেয়েদের জীবনের এই কঠিন অসুখকে শুধুমাত্র মনের জোরে অনেক খানি দূরে সরিয়ে দিতে পেরেছে তনুশ্রী। পিরিয়ডের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেয়ে মাসের প্রতিটি দিনই এখন সে এ্যাকটিভ থাকে।

    ভাইয়ের বিয়েতে তনুশ্রীকে দেখে সবাই তো হতবাক। ইউট্রাসের অপারেশন এর পরও তনুশ্রী পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে জীবনকে উপভোগ করছে। তবে তনুশ্রী সবাইকে বলে, তার এই মনের জোর কিন্তু সে মনের মানুষের কাছ থেকেই পেয়েছে।

  • গল্প

    গল্প- মিনি ম্যালিস্ট

    মিনি ম্যালিস্ট
    – লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    _ শুনছো গো, এদিকে একটু উঠে এসো। আমার একটু দরকার আছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাইরের ঘরে বসে থাকলে হবে তো? পারেও বাবা! যুবক থেকে বৃদ্ধ হয়ে গেল তবুও এই নেশা ছাড়তে পারলো না।

    – খক খক করে দুটো কাশি দিয়ে ঘরে ঢুকলেন পঁয়ষট্টি বছরের অংকের মাস্টার মশাই অমল কান্তি সিংহ। মানুষের নাম রাখার পিছনে অন্যদের দূর দৃষ্টি থাকতে পারে। কিন্তু পদবীটা লোক ভাগ্য গুনে পায়। তবে অমল কান্তি বাবুর পদবীখানা তার চরিত্রের সাথে অদ্ভুত ভাবে প্রাসঙ্গিক।

    বয়স পঁয়ষট্টি হলে হবে কি এখনও টাট্টু ঘোড়ার মতো দৌড়াতে পারে। যুবক সিংহের মতো গর্জনও করতে পারে।দেড়-দু কিলোমিটার রাস্তা যাতায়তের জন্য নিজের স্কুটার খানা ভুলেও বের করেন না। হয় কখনো সাইকেল কিংবা চরণ বাবুর ট্যাক্সি। যদিও এর জন্য পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু মহল সামনে পিছনে ওনাকে নিয়ে নানা রসিকতা করে।

    কেউ বলে, মাস্টার মশাই এত পয়সা খাবে কে? সন্তান তো একটি।
    আবার কেউ বলে, টাকায় ঘুন ধরে যাবে তো। আবার কোন শুভাকাঙ্ক্ষী বলে, অনেক তো রোজগার করলেন এবার তো একটু আরাম করুন।

    তবে অমল কান্তি বাবু গর্বের সঙ্গে ওনাদের এইসব কথার উত্তর দেন, মশাই গ্ৰাম ছেড়ে শহরে এসেছি কামাতে, কমাতে নয়। এই বয়সে ফিট আছি। তাই তো সাইকেলিং করতে পারি। আপনারা শুধু আমার পেট্রোল খরচার সাশ্রয়ের কথা ভাবছেন। আমি মনে করি, আমি ওষুধ পত্রের খরচা, ডাক্তারের খরচা বাঁচাচ্ছি।

    এইরকম মোক্ষম জবাব পেয়ে অমল কান্তি বাবুর পরিচিতরা তো একেবারে ধরাশায়ী হয়। যোগ্য জবাব যেন ওনার ঠোঁটে লেগেই থাকে। এই হেন অমল কান্তি বাবু কিন্তু আজ সাত সকালে গিন্নির বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়ে পড়ানোর ঘর থেকে ভিজে বেড়ালটির মতো ঘরে ঢুকে বলেন, কী হলো গো দিদিমণি? মুদিখানার কী জিনিস ফুরিয়েছে? বলেছি তো লিস্ট করে রেখে দেবে। আমি পড়ানো থেকে ফুরসৎ পেলেই ঠিক এনে রাখবো।

    অমল কান্তি বাবুর স্ত্রী সেফালীও দর্শনের শিক্ষিকা। তার প্রতিটি কথাতেই আছে নির্দিষ্ট যুক্তি। তিনি বলেন, মুদিখানার জিনিস ছাড়া কি এই বয়সে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে আর কোনো কথা থাকতে পারে না?

    -আহা দিদিমণি, চটছো কেন? বল না কি হল? তবে যা বলবে গৌরচন্দ্রিকা একটু কম করে বলবে। নটার মধ্যে প্রথম ব্যাচটা ছেড়ে সাড়ে দশটায় দ্বিতীয় ব্যাচ নিয়ে বসতে হবে।

    – আগামীকাল মেজদার ছেলের বিয়ে। সেকথা নিঃশ্চয় মনে আছে। আর সেই জন্য আজ বড়দি, বড় জামাই বাবু ও ওদের নাতনি রিয়া আসছে এখানে। আমাদের বাড়িতেই উঠবে ওরা।

    অমল বাবু কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে, বিয়ে বাড়ি তো তোমার মেজদার বাড়িতে আমাদের বাড়িতে তো নয়। আমাদের বাড়িতে ওনাদের আগমনের হেতু?

    – তোমার মুখে কি কিছুই আটকায় না। মেজদার বাড়িতে ভীড় খুব হবে তো। তাই এখানে উঠবে।কতবছর বাদে দিদি, জামাই বাবু আসছে। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে। আমাদের নতুন বাড়িখানাও তো ওরা প্রথম দেখবে।

    – সে তো না হয় হলো। আসল কথাটা একটু ঝেড়ে কাশো তো তাড়াতাড়ি।

    – তুমি পড়িয়ে উঠে বাজারে গিয়ে বড় সাইজের কাতলা মাছের পেটির দিকটা আনবে। রাঁধুনি মাসিকে বলবো, ভালো করে ফুলকপি দিয়ে মাছের ঝোল করতে। আর আধ কিলো মতো মাটন এনো। রাতে রুটির সঙ্গে মাটনের ঝোল। একটু রসগোল্লাও নিও।

    – বাবা এতো বেশ ফর্দ দেখছি । তোমার দিদি জামাই বাবুর তো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এতো খেয়ে শরীর ঠিক থাকবে তো। তারপর বিয়ে বাড়ির খাওয়া দাওয়া।

    সেফালী দিদিমণি চোখগুলো বড় বড় করে তাকিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে ঠাকুরের বাসনগুলো মাজতে বসলেন। আর মনে মনে বলতে লাগলেন, শুধু কিপটেমি। আত্মীয় স্বজন আসবে শুনলেই খরচের চিন্তা।

    অমল বাবু সকালের ব্যাচটা ছেড়ে টিফিন পর্বটা সেরে সাইকেলটা নিয়ে ছুটলেন বাজারের দিকে।

    কাতলা মাছের কিলো ২২০টাকা। আর সেখানে রুই মাছের কিলো১৮০টাকা। তার ওপর পেটির অংশটাই কেবল নিতে বলে দিয়েছে গিন্নি। গোটার থেকে কাটা মাছের দাম সব সময় বেশি। সুতরাং রুইমাছ কেনার সিদ্ধান্তই নিলেন।

    মাটনের দোকানের সামনে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ক্যালকুলেশন করলেন। আগামীকাল তো বিয়ে বাড়ি। কনের বাড়ি বেশি দূরে নয়। মাত্র আধঘণ্টার পথ। বরযাত্রী যাওয়া যেতেই পারে। সেখানে অবশ্যই খাসি হবে। সুতরাং পরপর দুদিন মাটন খাওয়া এই বয়সে কারোর জন্যই ঠিক হবে না। তার থেকে ভালো মুরগির মাংস। সহজ পাচ্য ও সহজ লোভ্য। সুতরাং ৫০০গ্ৰাম মুরগির মাংস, ৭০০গ্ৰাম রুই মাছের পেটি ও আট টাকা দামের দশ পিস রসগোল্লা নিয়ে অমল কান্তি বাবু বাড়িতে ফিরলেন।

    বাড়ির মেন গেট অর্থাৎ বাঁশের গেটটা খুলতে খুলতেই অমল বাবুর কান বুঝতে পারলো যে তার বড় শালীরা এসে গেছে।

    বড় শালীপতি ভাই তো অমল বাবুকে দেখা মাত্রই উচ্চস্বরে বলে, আরে অমল এসো এসো।কত বছর পর দেখা হলো। তুমি তো ভায়া একি রকম আছো দেখছি।

    অমল বাবু বিনয়ের সুরে বলে, সবই আপনাদের আশীর্বাদ আর আপনার ছোট শালীর সেবা যত্ন। আপনারা গল্প টল্প করুন। আমার দ্বিতীয় ব্যাচের ছেলে মেয়েরা এসে গেছে।

    শালীপতি ভাই বলে, অনেক বছর তো টিউশনি পড়ালে। এবার একটু বিশ্রাম করো, ধর্ম কর্ম করো, বেড়াতে-টেরাতে যাও। কর্তা গিন্নি দু’জনেই পেনশন পাচ্ছো। একটি মাত্র ছেলে। সেও ভালো চাকরি করছে। আর নাই বা পড়ালে টিউশন।

    অমল বাবু বাজার থেকে এসে হাত পা ধুয়ে গামছায় মুছতে মুছতে বলেন, দাদা আপনারা শুধু আমার টিউশনি পড়িয়ে অর্থ উপার্জন টুকুই দেখলেন। এত বছর আমার হাত দিয়ে কত প্রতিভাবান ছাত্র ছাত্রী বেরিয়েছে সেটার কি পরিসংখ্যান আপনাদের কাছে আছে? একজন নিষ্ঠাবান ও অভিজ্ঞ শিক্ষক কিন্তু সমাজের সবচেয়ে বড় বন্ধু। গুরু গম্ভীর গলায় উত্তরগুলো দিয়ে গেলেন অমল কান্তি সিংহ মহাশয়।

    গম্ভীর স্বরে বললেন, আমি কিন্তু পড়াতে বসছি।এক কাপ চা পাঠিয়ে দিও।

    সেফালী দিদিমণির বড় দিদি বলে, অমল কিন্তু একি রকম আছে। আগের মতোই ঠোঁট কাটা। তা ঘরে ঢোকার সময় দেখলাম মেনগেটটা বাঁশ দিয়ে বানিয়ে রেখেছিস। কেন বাপু একখানা লোহার ছোট গেট বসিয়ে দিলেই হতো। কত আর খরচা?

    সেফালী দিদিমণি বলে- লোহার গেট লাগানোর কথা বললেই বলবেন, এই ছোট একটা লোহার গেটের জন্য আমাদের বাড়ির নিরাপত্তার কোনো অভাব হচ্ছে না। এই গেটটা বাঁশের থাক বা লোহার। উদ্দেশ্য কিন্তু আমার বাগানে যাতে গরু, ছাগল ঢুকে না পড়ে। এখনও ঘরের ভিতরে টুকিটাকি কাজ বাকি। সব সামলে তার পর পাঁচিলের লোহার গেটটার কথা ভাববো। সুতরাং আমারও আর কিছু বলার থাকে না।

    তারপর সেফালী দিদিমণি কিছুক্ষণ হেসে বলে- বড়দি তুমি তো শুধু বাঁশের গেটটা দেখলে। এই যে বাগান তা উনিই পরিষ্কার করে রাখেন। মালি করতে বললে বলবেন, মালির থেকে আমার গায়ের জোর কি কম? ফালতু মালির পিছনে পয়সা নষ্ট করা। জানো বড়দি সবজি ওয়ালাদের সঙ্গে এক টাকা, দু’টাকার জন্য এমন দর কষাকষি করবে তোমাকে কি বলবো।

    আমি বিরোধীতা করলে বলবেন, পাঁচ জায়গা থেকে এক টাকা, দু’টাকা করে কমাতে পারলেই পাঁচ-দশ টাকার সাশ্রয়। ফ্রী-তে ১০০গ্ৰাম কাঁচা লঙ্কা হয়ে যায়।

    সেফালী দিদিমণির বড় জামাই বাবু বলেন- অঙ্কের মাস্টার। তাই হিসেবে খুব পাকা। সেসব তো ঠিক আছে। তবে অমলের কিপটেমির স্বভাবটা রয়েই গেল।
    ঘরে ঢোকার সময় দেখলাম একটা নীল রঙের হাওয়াই চপ্পল পড়ে আছে উঠানে। সেটার ছেঁড়া ফিতেটাকে নাইলন দড়ি দিয়ে সেলাই করে রেখেছে বেশ। কি ভাবে করলো বলতো? এই কথা শেষ করে হো হো করে হেসে উঠল সেফালীর বড় জামাইবাবু।

    সেফালী দিদিমণিও পাল্লা দিয়ে বলে- শুধু কি হাওয়াই চপ্পলের ফিতে, বাজার করার ব্যাগের হ্যান্ডেল, পুরানো প্ল্যাসটিকের ঝুড়িগুলোতেও ওনার হাতের কেরামতি দেখতে পাওয়া যাবে।

    সেফালী দিদিমণির বড় দিদি একটু ধমকের সুরে বলে, অনেক হয়েছে শালী জামাইবাবুর মশকরা। এবার অমলকে নিয়ে চর্চা বন্ধ কর। হ্যাঁ রে সেফালী, তোরা মেজদার বৌমাকে কি দিচ্ছিস? তোদের তো দুটো ইনকাম। সোনা তো অবশ্যই দিচ্ছিস।

    সেফালী দিদিমণি খানিকটা মুখ চুন করে বলে- আমি বলে ছিলাম এক জোড়া হালকা সোনার দুল দিই। উনি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, তোমার বড়লোক দাদার বৌমা বিয়েতে অনেক গয়না পাবে। ওকে আর সোনা দিয়ে কাজ নেই। তার চেয়ে বরং একটা শ্রীরামকৃষ্ণের কথামৃত দেবো। পরবর্তী জীবনে কাজে লাগবে এবং অবশ্যই আমার বাজেটের মধ্যে।

    সেফালী দিদিমণি আরো বলে, কি জানো বড়দি দর-দাম, বাজেট এই শব্দগুলো ওনার রক্তে মিশে গেছে। স্কুল মাস্টারি চাকরির শুরুতে মাস্টারদের আর কত টাকাই মাইনে ছিল। বামফ্রন্ট আমলে মাস্টারদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটলেও ওনার মানসিকতার কোনো পরিবর্তন ঘটল না। কি আর করা যায় বলো.. নিজে ও খরচ করবে না আর আমাকে ও করতে দেবে না। কত আর অশান্তি করবো। আর কটা দিনই বাকি আছে। এইরকম ভাবেই বাকি দিন কটা কাটিয়ে দেবো।

    এমন সময় সেফালী দিদিমণির মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। ফোন ধরা মাত্রই অপর প্রান্ত থেকে ওদের কাজের মাসি বলে ওঠে, দিদিমণি আমার নাতিটা পাঁচিল থেকে পড়ে মাথা টো ফাটাইছে।সরকারি হাসপাতালে আজ ডাক্তার নেই কো। তাই ওকে প্রেরাইভেট নার্সিং হোমে নিয়ে আইলুম। এখানে বলছে ,ডাক্তার, ওষুধ সব লিয়ে হাজার টাকা লাগবেক। আমি আমার নাতনিকে পাঠাচ্ছি। আপনি উর হাতে টাকাটা দিয়ে দিবেন।

    সেফালী দিদিমণির উত্তরের অপেক্ষা না করেই কাজের মাসি ফোনটা কেটে দিল। সেফালী দিদিমণি মহা চিন্তায় পড়লেন। এই এতটাকা দিয়ে বাজার করে আনলো, বিয়ে বাড়ির গিফট্ এর খরচা তার ওপর আবার বাড়তি হাজার টাকার কথা শুনলেই কি যে করবে অমল বাবু তা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি।

    সেফালী দিদিমণির বড় দিদি তো পাশেই ছিলেন। উনি বললেন, তোর কাছে যদি টাকা থাকে তাহলে দিয়ে দে। অমলকে জানানোর দরকার নেই।

    খুব চিন্তিত মুখে সেফালী দিদিমণি বলেন- সে না হয় জানালাম না। কিন্তু মাসির নাতনি এই বাড়ীতে কেন এসেছিল জিজ্ঞাসা করলে কি বলবো? আমি বাপু অহেতুক মিথ্যা কথা কইতে পারি না। তার চেয়ে ভালো ওনাকে ডেকে মাসির বিপদের কথা জানাই। উনি কিছু তো দেবেন। বাকিটা না হয় আমি দিয়ে দেবো।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজের মাসির নাতনিকে বাঁশের গেটটা ঠেলে ভেতরে আসতে দেখে অমল বাবু নিজে থেকেই উঠে আসে অন্দরের দিকে। এসে সব শুনে কোন নার্সিং হোম, কোন ডাক্তার ইত্যাদি খুঁটি নাটি তথ্য জেনে তিনি কাজের মাসির নাতনিকে বলেন- ওরে হাজার টাকা তে হয়ে যাবে? ডাক্তারের ভিজিটই তো পাঁচশ টাকা। ঠিক আছে তুই দাঁড়া। দেখছি আমার কাছে কত আছে।

    শোয়ার ঘরের দরজার পিছনে টাঙানো হাফ শার্টের বুক পকেট থেকে একটা সাদা খাম বের করে টাকাগুলো গুনে দেখলেন। তারপর আবার খামে ভরে টাকাগুলো কাজের মাসির নাতনির হাতে দিয়ে বলে, যা লাগবে খরচ করিস। আর যদি কিছু বাঁচে ফিরত দিয়ে যাবি। ঠিক আছে।

    কাজের মাসির নাতনি চলে যেতেই সেফালী দিদিমণি বলেন- কি গো? তুমি তো আচ্ছা মানুষ! হাজার টাকা দিয়ে আবার ফেরৎ এর আশা করছো? বলিহারি বাবা।

    অমল বাবু উত্তর দেবার আগেই সেফালী দিদিমণির বড় দিদির নাতনি রিয়া বলে ওঠে- ও ম্যাডাম ঠাম্মি স্যার দাদু তো হাজার টাকা দেয় নি। বরং দু হাজার টাকা দিয়েছে কাজের মাসির নাতনিকে। আমি তো তোমাদের বেডরুমের খাটে বসে ছিলাম। বসে বসে দেখলাম স্যার দাদু জামার বুক পকেট থেকে সাদা খামটা বের করে চারটে পাঁচশ টাকার নোট গুনলো। তারপর আবার খামের মধ্যে রেখেই কাজের মাসির নাতনিকে দিল।

    রিয়ার মুখ থেকে কথাগুলো এসে সোজা বিদ্ধ করলো সেফালী দিদিমণি, বড় দিদি, বড় জামাই বাবুকে। ওনারা প্রত্যেকে বাক্যহারা। বড় দিদি মনে মনে বলতে লাগলো, ইশ্ এই মানুষটার কিপটেমিকে নিয়ে আমরা কত সমালোচনা করি, কত হাসি মজা করি। কিন্তু আমরা নিজেরাই কতটা ভুল কাজ করি।

    কিছুক্ষণ নিঃস্তব্ধতার পর সেফালী দিদিমণির বড় জামাই বাবু বলে ওঠেন, সত্যি অমল তোমাকে বাইরে থেকে দেখে তো বোঝা যায় না তোমার এত বৃহৎ হৃদয় আছে। আমাদের চোখে তোমার পাই পয়সার হিসাবটাই চোখে পড়ে, তোমার এক ঢোল এক কাঁসি জামা কাপড়, মলিন পায়ের জুতো, একেবারে সাদামাটা জীবন যাপনের অভ্যাস। পয়সার প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও তোমার simplicity-কে আমরা কিপটামি, কঞ্জুস এইসব হীন শব্দে আখ্যায়িত করি।

    কিশোরী রিয়া তার দাদুকে থামিয়ে বলে- স্যার দাদুকে আজ থেকে আর কেউ কঞ্জুস, কিপটে বলবে না। আজ থেকে স্যার দাদুকে সবাই আমরা বলবো ‘ মিনি ম্যালিস্ট’।

    সেফালী দিদিমণির বড় জামাই বাবু চশমাটা নাকের ডগায় রেখে বলেন- কি বললি মিনি ম্যালিস্ট? মানেটা ঠিক বুঝলাম না।

    রিয়া বলে- বড়দাদু মিনি ম্যালিস্ট মানে হলো, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু নিয়েই বাঁচা।

    কিশোরী রিয়ার মুখ থেকে এই নতুন ইংরেজি শব্দটা শুনে সেফালী দিদিমণি বলে, সত্যি রিয়া তুই আমাদের দেখার দৃষ্টি ভঙ্গিটা বদলে দিলি। আমরা নিজেদের মতো করেই অন্য কে সবসময় দেখার চেষ্টা করি। আর এইখানেই হয় বিপত্তি। আমি তোর স্যার দাদুর সঙ্গে এতবছর ঘর করেও লোকটাকে চিনেও না চেনার ভান করি মাঝে মাঝে। সত্যি রে রিয়া সোনা, তোর মনের সরলতা দিয়ে তুই কিন্তু তোর স্যার দাদুর দৃষ্টি ভঙ্গির সুন্দর বিশ্লেষণ করলি।

    অমল কান্তি সিংহ বাবু এবার একটু হেসে বলে- গিন্নি আমি সমালোচকদের মাথার ওপর রাখি বুঝলে। আরে, তোমাদের মতো সমালোচক আছে বলেই তো কোনদিন বেহিসাবি হই নি। আজ পর্যন্ত কারোর কাছে পাঁচ টাকা ধার করি নি।

    সেফালী দিদিমণি হেসে বলে- সরি সরি সরি। আমার খুব ভুল হয়ে গেছে। এবার থেকে তোমাকে আর কিপটে বলে নিন্দা করবো না বরং এবার থেকে মিনি ম্যালিস্ট বলবো। তারপর সকলে একসাথে হো হো করে হেসে ওঠে।

    অমল কান্তি সিংহ বাবু এবার একটু হুঙ্কার দিয়ে বলে, অনেক ক্ষণ আমার নামে অনেক চচ্চড়ি হলো। এবার সবার জন্য আদা দিয়ে কড়া চা করো দেখি।

    রিয়াকে কাছে ডেকে প্যান্টের পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে ওর হাতে দেয়।আর বলে, যদি প্রয়োজন হয় তবেই খরচ করবি।না হলে যত্ন করে রেখে দিও পরে কাজে লাগবে।

    রিয়া অমল কান্তি বাবুর পদস্পর্শ করে বলে- স্যার দাদু আশীর্বাদ করো আমিও যেন তোমার মতো অঙ্ক শিখতে পারি আর তোমার মতোই মিনি ম্যালিস্ট হতে পারি।

  • গল্প

    গল্প- কালী ভবন

    কালী ভবন
    – লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    কী সুন্দর তোর বাড়িখানা হয়েছে রে! তিনটে বেডরুম তাই না? হ্যাঁ রে তোর প্রতিটি রুমের সাথে অ্যাটাচ বাথরুম দেখছি। তার মানে তোর বাড়িতে তিন খানা বাথরুম। তাই তো? জল
    একগাল হাসি দিয়ে শ্রেয়াকে কথাগুলো জিজ্ঞাসা করে মনিমালা। ওরফে মনিদি।
    শ্রেয়া খানিকটা খিলখিল করে হেসে বলে- মনি দিদি তিনটে নয় গো চারটে।

    -কি করেছিস শ্রেয়া? তিন খানা মাত্র লোক তোরা। মেয়ে তো তোর অনেক ছোট। জামাই আসতে অনেক দেরি। এত বাথরুম কী ভাবে ব্যবহার করবি?

    – আসলে কি জানো, সকালের দিকটা বাথরুম নিয়ে খুব টানাটানি হয়ে যায়। আমার সাথে সাথেই প্রীতম উঠে পড়ে। আমার তো কোষ্ঠকাঠিন্যের ধাত। তাই বাথরুমে বেশ খানিকটা সময় লাগে। হিয়াকেও সকাল সাতটার মধ্যে উঠে পড়তে হয়। সাড়ে সাতটা থেকে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়ে যায় ওর। পুরানো ভাড়া বাড়িতে তো দুটো বাথরুমই মা মেয়ের দখলে চলে যেত সকাল বেলায়। বেচারা প্রীতমের খুব অসুবিধা হতো।

    তাই যখন এই জায়গাটা কিনলাম তিন বছর আগে তখনই প্রীতম বলেছিল, এবার গৃহকর্তার নিজস্ব একটা বাথরুম হবে কিন্তু। তাই তিনটে রুমের সঙ্গে তিনটে বাথরুমের প্ল্যান পাশ করালো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে।

    জায়গা তো পুরো তিন কাঠা নয়। সব দিক বজায় রাখতে গিয়ে আমার রান্না ঘর খানা ছোট হয়ে গেল, কিছুটা আক্ষেপের সুরে বললো শ্রেয়া।

    জানো তো একতলার ছাদে আবার একখানা বাথরুম এখনি বানিয়ে রেখে দিয়েছে প্রীতম। ওয়াশিং মেশিনের কাপড় কাচতে বেশ সুবিধাও হয়। ছাদেই কাচো আর মেলে দাও। কোনো টেনশন নেই।

    – শ্রেয়া চল না তোর ছাদে যাই একটু। আমার তো ফ্ল্যাট। ফার্স্ট ফ্লোরে। জি ফাইভ ব্লিল্ডিং। যদিও লিফ্ট আছে। তবুও ছাদে সেরকম ওঠা হয় না।আর করোনার চক্করে তো কতদিন মুক্ত আকাশ তলে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নিই নি।

    সকাল থেকে তোর অরুনদার অনলাইন ক্লাস, মেয়ের অনলাইন ক্লাস। হাতের কাছে চা, টিফিন দিতে দিতেই বেলা পেরিয়ে যায়।

    -শ্রেয়া বলে, মনিদি ঘরে পরার চপ্পলগুলো পরে নাও। ছাদে রোজ ঝাড়ু পড়ে না। দূর্গাপুরে যা ডাস্ট। কারখানা তো অর্ধেক বন্ধ হয়ে গেল। তবুও ডাস্ট পড়া কমলো না।

    এই বলে‌ শ্রেয়া মেন দরজাটাতে ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিয়ে ছাদের সিঁড়ির ধাপ গুনতে গুনতে ছাদে উঠতে লাগলো।

    বারো খানা সিঁড়ি ভাঙতেই পঁয়ত্রিশ বছরে বেশ হাঁটু ব্যথা শুরু হয়ে যায় শ্রেয়ার। তবে মনিদি পঁয়তাল্লিশ বছরেও কিন্তু বেশ টপাটপ উঠে পড়ল ছাদে।

    ছাদের লোহার দরজাটা খোলা মাত্রই বেশ একটা শীতল হাওয়া এসে দুজনের শরীর স্পর্শ করে দুজনকে স্বাগতম জানিয়ে গেল।

    দূর্গাপুরের ঠাণ্ডা বলে কথা। দুপুর বারোটাতেও জানান দেয়। ছাদের ওপর একটা প্ল্যাস্টিকের মাদুর বিছিয়ে দুজনে বসল। শ্রেয়া মনিদিকে একটা স্টিলের প্লেটে কমলা লেবুর কোয়া ছাড়িয়ে দিতে দিতে বলে, মনিদি তোমার কালীভবনের তলাপাত্রদের কথা মনে আছে?

    -থাকবে না আবার। দীর্ঘ কুড়িটা বছর কাটিয়েছি যে কালী ভবনে। শৈশব থেকে যৌবন বেলা। আর তলাপাত্ররা ছিল কালীভবনের সব থেকে জনপ্রিয় ভাড়াটে। প্রথম প্রথম নতুন কোনো ভাড়াটে এলেই তাদের সঙ্গে এমন ভাব জমাতো! দেখে বাপু আমার ভীষণ হিংসা হতো। শুধু হিংসা বললে ভুল হবে। আমার না খুব দুঃখও হতো। মনে মনে ভাবতাম, তলাপাত্রদের ফ্যামিলিটা কত ভালো, কত মিশুকে।

    শ্রেয়া তার চোখে মুখে কৌতুকের হাসি ফুটিয়ে বলে, তবে তলাপাত্রদের ভাব বেশিদিন স্থায়ী হতো না কারোর সঙ্গেই। সুখের পায়রার মতো অল্প দিনেই ফুরুৎ।

    -তা যা বলেছিস। বাথরুম নিয়ে তলাপাত্রদের সঙ্গে সবার কেমন ঝগড়া হতো বল।

    -আরে, আমি একদিন এই বাথরুমের জন্যই যা বকা খেয়েছিলাম বাবার কাছে তোমায় কি বলবো। শোনো তাহলে সেদিন কী হয়েছিল।

    কালীভবনে বারো ঘর ভাড়াটিয়া। আর বাথরুম বলতে মাত্র দুখানা । একটাতেও থাকতো না ছিটকিনি। কেউ ভিতরে আছে কিনা তা বুঝতে হতো বাথরুমের বাইরে রাখা জলের বালতি দেখে।

    আমার বাবা তো ভোর ভোর উঠে বাথরুম সেরে নিয়ে মা এর জন্য বাথরুমের বাইরে এক বালতি জল রেখে দিতো। মায়ের পর আমার যাবার কথা। জানো তো আমি চিরকালই একটু কুঁড়ে। সেদিন একদম ঘুম থেকে উঠতে মন চাইছিল না। সুতরাং মায়ের পর অন্য ভাড়াটিয়ারা বাথরুমে ঢুকে পড়ে।আর তারপরই তলাপাত্রদের একজন একজন করে বাথরুমে ঢুকতে থাকে লাইন দিয়ে। ওদের পরিবারের লোকও তো ছিল নাই নাই করে সাতজন।

    ইতিমধ্যে আমারও ঘুম ভেঙে গেছে। আর ঘুম ভাঙা মাত্রই প্রকৃতির ডাক। বিছানা ছেড়ে বাথরুমের সামনে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করেছি। কিন্তু কিছু করার নেই। আমার চোখের সামনে দিয়ে তলাপাত্রদের ফ্যামিলির একজন একজন করে বাথরুমে ঢুকছে। প্রায় আধঘণ্টা আমি বাথরুমের সামনে পায়চারি করি। শেষের দিকে তো কাপড়ে চোপড়ে হবার জোগাড়। কীভাবে নিজেকে সামলে ছিলাম তা আমিই জানি। কথাগুলো শেষ করে তো দুজনে মিলে খুব হাসতে লাগলো।

    এরপর মনিদি শ্রেয়াকে থামিয়ে বলে, অ্যাই শ্রেয়া তোর মনে আছে কুয়োতলার জল তোলার কথা। কত কান্ডই না ঘটতো রোজ দিন। লোহার ঘড়ঘড়ি দিয়ে তিপ্পান্ন ফুট নিচ থেকে জল তুলতে হতো। কত বার যে বালতি পড়ে গেছে কুয়োর ভিতর তার হিসাব নেই। কুয়োর ভিতর থেকে বালতি তোলার জন্য আবার কত সরঞ্জাম লাগতো।

    কর্মকার কাকুর মাকে মনে আছে? বুড়ি চোখে কম দেখতো। কুয়োতলাতে বসেই স্নান সারতো।আর প্রায়দিনই অন্যের বালতি থেকে জল নিয়ে স্নান করতো। কিছু বললেই বুড়িই উল্টে চোটপাট করতো।

    অতীতের স্মৃতির পাতাগুলো যেন ঝড়ের বেগে উল্টে চলেছে দুজনে। একটা গল্প শেষ হতে না হতেই আরেকটা। শ্রেয়া মনিদির কথার মাঝেই বলে ওঠে, বাথরুম নিয়ে বাপি দাদার কান্ডখানা কিন্তু একদম ইউনিক ছিল।

    মনিদি বলে, বাপির তো অনেক কান্ড আছে। কোনটা বলছিস বল তো?

    শ্রেয়া বলবে কী, প্রথমেই কিছুক্ষণ হেসে নিল। তারপর হাসি থামিয়ে বলে, চব্বিশ প্রহরের সময় সিনেমা দেখতে যাওয়া।
    -সিনেমার সঙ্গে বাথরুমের কি সম্পর্ক? আমার তো কিছু মনে পড়ছে না।
    – তোমরা তখন কোথাও গিয়েছিলে। বাপি দাদার বাবা বাপি দাদাকে বারণ করেছে চব্বিশ প্রহর তলায় পর্দায় সিনেমা দেখতে না যেতে।বাপি দাদা তো সিনেমার পোকা। তারপর ওর প্রিয় হিরো অমিতাভের ‘শোলে’ বইটা পর্দায় দেখাবে। বাপি দাদা তো ছটপট করছে চব্বিশ প্রহর তলায় যাবার জন্য।

    ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ বাপি দাদা বাথরুমে যায়। বাইরে লোহার জলের বালতি খানি রেখে।

    প্রায় ঘন্টাখানেক পর বাপি দাদার মায়ের খেয়াল পড়ে, বাপি তো বাথরুমে গিয়েছিল। এখনও আসে নি কেন? এই ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। নির্ঘাত পড়ার ভয়ে বাথরুমে ঢুকে বসে আছে। সামনে পরীক্ষা আর ছেলের কান্ড দেখো।

    ‌বাপি দাদার মা বাপি দাদার বাবাকে ডাকতে পাঠায় বাথরুমে। বাপি দাদার বাবা ভীষণ রাশভারী লোক ছিল। তিনি বাথরুমের সামনে গিয়ে বাপি, বাপি করে ডেকেই চলেছে। কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর আসছে না। ওনার পারদ একটু একটু করে চড়ছে। অন্যান্য ভাড়াটিয়ারাও কুয়োতলায় এসে হাজির। মিনিট দশেক হাঁক ডাক করার পর উনি রেগে গিয়ে বাথরুমের দরজায় সজোরে এক লাথি মারে। আর তারপরই আসল নাটক।
    ‌মনিদি প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে বলে, প্লিজ প্লিজ তাড়াতাড়ি বল তারপর কি হলো?
    বাথরুমের দরজাটা হাট করে খুলে গেল। বাথরুমের ভেতরে কেউ নেই। বাথরুম খালি। উপস্থিত সকলেই বিস্ময়ে তাকিয়ে একে অপরের দিকে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন,বাপি তাহলে গেল কোথায়?

    খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল। বাপি দাদার অন্যান্য ভাইরা, বাবা-মা, অন্য ভাড়াটিয়ারা সকলেই এদিক ওদিক গিয়ে বাপি দাদার খোঁজ করতে লাগলো। সবাই যখন আশাহীন হয়ে ফিরছে তখন বাপি দাদার বাবা সাইকেল নিয়ে চব্বিশ প্রহর তলার দিকে যায়।

    সেখানে গিয়ে দেখে বাপি দাদা সবার সামনে বসে খুব মন দিয়ে ‘শোলে’ সিনেমা দেখচ্ছে।বাপি দাদার বাবা পায়ের চপ্পল খানা খুলে পিছন থেকে গিয়ে ঘা কতক ধরায় বাপি দাদাকে। চব্বিশ প্রহর তলা থেকে মারতে মারতে বাপি দাদাকে ঘর নিয়ে আসে।

    বাপির কান্ড কারখানা শুনে মনিদি না হেসে বরং দুঃখ প্রকাশ করে বলে, বাপি ছেলেটা কিন্তু খুব ভালো ছিল। ওর মনটা খুব পরিষ্কার ছিল। আমাদের দুজনের জাতের অমিল না থাকলে আমি ওকেই বিয়ে করতাম।

    – কি বলো গো মনিদি! তুমি বাপি দাদাকে ভালোবাসতে?

    -মনিদি একটু লাজুক হাসি দিয়ে বলে- ও আমার প্রথম ভালোলাগা ছিল।

    শ্রেয়া মুখে একটা কমলা লেবুর কোয়া পুরে বলে- কালী ভবনে কাটানো দিনগুলো কিন্তু খুব আনন্দের ছিল বলো।

    মনিদি বলে- আমার বিয়ের পর গরম কালে ছাদে তোর অরুনদা কী কান্ড করেছিল মনে আছে?

    শ্রেয়া তো হাত পা নেড়ে উল্লাসের সাথে বলে, সে কান্ড কী কখন ও ভোলা যায়। লাইন দিয়ে একতলা ছাদের ওপর বিছানা। তখনও কালী ভবনে ইলেক্ট্রিসিটি আসে নি। সবাই গরমে ক্যাম্প খাট পেতে ছাদে শুতো। প্রত্যেকের মশারিতে আলাদা আলাদা চিহ্ন করা থাকতো।

    নতুন জামাই অর্থাৎ অরুনদার জন্যও সেই রকম ব্যবস্থা করে দিয়েছে মনিদির বাবা। মনিদির ভাই আর নতুন জামাই এর একসঙ্গে শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। মাঝরাতে অরুন দাদা বাথরুমে গেছে। পুনরায় ফিরে এসে আর সঠিক মশারি চিনতে না পেরে পাল জেঠুর মশারির ভেতর ঢুকে পড়ে। পাল জেঠু তো অরুনদাকে চেপে ধরে চোর সন্দেহে চিৎকার করতে থাকে।

    পাল জেঠুর চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গেই অন্যান্য মশারির ভেতর থেকে টর্চ লাইট জ্বলে ওঠে একসঙ্গে। অমাব্যসার রাতেও কালী ভবনের ছাদ খানি হঠাৎ আলোকময় হয়ে ওঠে।
    তারপর তো যেই অরুনদাকে পাল জেঠু চিনতে পেরেছে সেই কি লজ্জা পাল জেঠুর। লজ্জায় পাল জেঠু কি করবে আর কি বলবে বুঝতে পারছিল না। তবে অরুনদা কিন্তু খুব স্মার্টলি ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করে বলেছিল, আরে ভুল তো আমার জেঠু। মশারি চিনতে ভুল হয়ে গেছে। এতে আপনার কোন দোষ নেই।

    সেদিন অরুন জামাইবাবুর কথা শোনার পর কালী ভবনের সকলেই বলে ছিল, অরুনের মতো ছেলে হয় না। বেচারাকে শ্বশুর ঘরে এসে কী হেনস্থা হতে হলো রাত দুপুরে। তবুও জামাইয়ের মুখে হাসি।

    সত্যি রে শ্রেয়া ভাবলে এখন অবাক লাগে। বারোটা ভিন্ন পরিবার কিভাবে বছরের পর বছর এক উঠানে বসবাস করতো। আমার মেয়ের কাছে গল্প করলে বলে- ছাড় তো তোমার গল্প কথা। এইসব প্রাচীন যুগের কথা।
    আজকালকার দিনে কেউ স্বপ্নেও এইরকম পরিবেশে থাকার কথা ভাববে না।

    পঁয়তাল্লিশ বছরটা কি প্রাচীন যুগ হয়ে যায়! আমি কি এতটাই বুড়ি হয়ে গেছি। আমার মনে এই পঁয়তাল্লিশ বছরের আগের দিনগুলো তো আজও একদম সতেজ। তার আঘ্রান আজও নাকে পাই।

    জানিস শ্রেয়া আবার মাঝে মাঝে অবাক লাগে। নিজের কাছে নিজেই যেন বিস্ময় হয়ে উঠি। আমি মানুষটাই কিন্তু আমার জা, ভাসুর, দেওর এদের সাথে এক উঠানে বসবাস করতে পারলাম না। আমার শ্বশুর মশাই নিজ মুখে সকলকে পৃথক থাকার অনুমতি দেন। তোর অরুন দাদাও বলেছিল, ভাই ভাই সম্পর্ক ভালো রাখতে চাইলে নিকট ছেড়ে দূরকেই বেছে নিতে হবে।
    মহাভরতে মহামন্ত্রী বিদুর বলেছেন, সময়ের সাথে আমাদের মানসিকতা ও বদলায়। আজ যেটা সঠিক মনে হচ্ছে কালকে সেটা সঠিক মনে না-ও হতে পারে। সময়ের সাথে মানুষের চরিত্রও পাল্টাবে। তাই বোধহয় সেদিনের আমি আর আজকের আমি’র মধ্যে এতো ফারাক।

    শ্রেয়াও বলে ওঠে- মনিদি তুমি আমি মানুষটা তো একি আছি। তখন ছোট ছিলাম এখন প্রাপ্ত বয়স্ক, ম্যাচিওর। এইটুকুই তফাত। কিন্তু তখন কত অসুবিধাকে মানিয়ে আনন্দে বেঁচেছি। আর আজ সুখের সাগরে ডুবেও সারাদিন কতক্ষণ হাসি, মজা করি তা বলা মুশকিল। আমরা কেমন ধীরে ধীরে রামগরুড়ের ছানা হয়ে যাচ্ছি। সর্বদাই কৃত্রিম গাম্ভীর্যের আড়ালে নিজের আসল সত্তা ষকে লুকিয়ে রাখতে ভালোবাসি।
    একদম ঠিক বলেছিস শ্রেয়া আমাদের শিশুকাল, কিশোর বেলা, যৌবন কাল এইগুলো বড্ড ভালো ছিল। আজকালকার ছেলেমেয়েরা সত্যি অভাগা।

    আজ আমাদের ঘর, বাড়ি, বাথরুম কোনো কিছুর অভাব নেই। তবুও সবাই মিলে মিশে এক উঠানে শীতের দিনে বসে টমেটো পোড়া দিয়ে মুড়ি খাওয়া, চু কিতকিত খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো এইসবগুলো-কে খুব মিস করি রে।
    মাঝে মাঝে ভাবি যদি টাইম মেশিনে বসে আবার সত্তর আশির দশকের কালী ভবনে ফিরে যেতে পারতাম তাহলে ভারি মজা হতো।টিভি, ফোন, ইন্টারনেট কোন কিছুরই দরকার হতো না সময় কাটানোর জন্য। আনন্দ বোধহয় সাজানো ঘরে, ঝা চকচকে বাথরুমে কিংবা দামী আসবাবপত্রের মধ্যে থাকে না। আনন্দ থাকে মানুষের মাঝে।

  • গল্প

    গল্প – হাঁটুর নিচে বুদ্ধি

    হাঁটুর নিচে বুদ্ধি
    – লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    পুরীর এক অত্যাধুনিক হোটেলের লবিতে একটি সাতাশ আটাশ বছরের যুবতী তার পায়ের হাই হিল স্যান্ডেল খুলে বেদম প্রহার করছে এক ত্রিশ বত্রিশ বছরের যুবককে। এই কাণ্ড দেখতে বেশ কিছু কৌতুহলী লোকজনও জমা হয়ে গেছে। সবার জিজ্ঞাসু মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এদের মধ্যে আসল সম্পর্কটা কি?

    একজন বলে, নিঃশ্চয় ছেলেটা মেয়েটার সঙ্গে কোন অশালীন ব্যবহার করেছে।
    আবার কেউ বলে, ছেলেটা নিঃশ্চয় মেয়েটাকে ধোঁকা দিয়েছে। হ্যান্ডসাম ছেলেদের তো মেয়েদেরকে নিয়ে খেলা করাই কাজ। এইসব নানা চটপটা খবরে ভরে উঠেছে হোটেলের লবি খানা।

    তবে যে মারছে আর যে মার খাচ্ছে তাদের কিন্তু এইসব জমায়েতের দিকে কোন লক্ষ্য নেই।যুবকটি বারবার কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে মেয়েটিকে। কিন্তু মেয়েটি অবুঝের মতো বলেই চলেছে, তুই এখানে হানিমুন করতে এসেছিস না মেয়ে দেখতে?

    হোটেলের ম্যানেজার ছুটে আসে ঘটনাস্থলে। তিনি যুবতীটির সামনে হাতজোড় করে বলেন, মিসেস চ্যাটার্জী, প্লিজ এইভাবে সিনক্রিয়েট করবেন না। এতে না আপনাদের ভালো হচ্ছে না আমাদের হোটেলের।

    একজন পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রলোক একটু আগবাড়িয়ে এসে ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করে, কি ব্যাপার বলুন তো। লবির মধ্যে এইসব কি? একটা রেপুটেড হোটেলের লবিতে এইরকম ঘটনা অবাঞ্ছনীয়।

    ভদ্রলোকের কথা শেষ হতে না হতেই যুবতীটি ভদ্রলোকের ওপর সমুদ্রের বিশালাকার ঢেউএর মতো আছড়ে পড়ে বলে, দেখুন মিস্টার, ইটস আওয়ার ম্যাটার। ডোনট নিড টু ইন্টার ফেয়ার। উই আর হ্যাজব্যান্ড এ্যান্ড ওয়াইফ। ডু নট থিংক আদার ওয়াইজ।

    যুবতীটির এই শব্দগুলো উপস্থিত কৌতুহলী চোখগুলোকে নিমেষে আরাম দিল। এক মধ্য বয়ষ্কা মহিলা বলে উঠলো, ওওওও স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার। তাহলে তো কারোর কিছুই বলার বা ভাবার দরকার নেই তেমন। তবুও বলি এটা তো পাবলিক প্লেস। তোমরা হোটেলের রুমে গিয়ে বাকি ঝগড়াটা কমপ্লিট করো।

    এবার ক্রদনরত অবস্থায় যুবতীটি বলে ওঠে, আন্টি ইউ নো, আমাদের মাত্র দশদিন বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যেই আমার স্বামীর চোখে আমার থেকে অন্য মেয়েকে সুন্দরী লাগা শুরু হয়ে গেছে। আই কান্ট ইমাজিন!

    মধ্যবয়স্কা মহিলাটি যুবতীটির দুঃখে সমব্যথী হয়ে সমবেদনা পূর্ণ নিজের হাত খানি বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ইউ আর লাকি মাই চাইল্ড। তাও তো দশদিন মুগ্ধতা ছিল তোমার স্বামীর চোখে। আমার বিয়ের রিসেপশনেতেই আমার হ্যাজব্যান্ড আমাকে বাদ দিয়ে যেভাবে তার সুন্দরী সব অফিস কলিগদের সঙ্গে ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিল। আলাপ পরিচয়ের সময় উনি তার বান্ধবীদের জন্য যে যে এ্যাডজেকটিভগুলো ব্যবহার করেছিলেন তা শুনে আমার গা জ্বলে যাচ্ছিল।

    আন্টি, সর্বকালের সব পুরুষই বোধহয় একরকমের হয় তাই না। মেয়েদের ফিলিংস নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আপনি সেদিন মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছিলেন। সেটা আপনার দুর্বলতা। আমি কিন্তু মোটেই সে বান্দা নই।

    যুবকটির মুখ দেখেই মনে হচ্ছে জীবনে বোধহয় এতো অসহায় অবস্থায় সে আগে কখনও পড়ে নি। মধুচন্দ্রিমায় এসে নতুন বৌয়ের প্রখর তেজে ঝলসে যাচ্ছে তার চোখ মুখ।

    কিন্তু এই যুবকটি তো মোটেই কোনো সাধারণ, পাতি, গো বেচারা যুবক নয়। সে হচ্ছে বর্ধমান শহরের একজন নামকরা চাইল্ড স্পেশালিস্ট।এম. বি. বি. এস. পাশ করার পর বর্ধমানের একটি সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে যুক্ত হয় অনির্বাণ চ্যাটার্জী।

    ছয় ফুটের কাছাকাছি হাইট, ফেয়ার কমপ্লেকশন, মেদ হীন চেহারা, টিকালো নাক। এককথায় সুপুরুষ। অনির্বাণ যেদিন থেকে সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগদান করেছে সেই দিন থেকে রোগীর সমাগমও যথেষ্ট। শুধু কি রোগী পাত্রীর বাবা, কাকা? মেসো-রাও হাজির হয়ে যাচ্ছে সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সুন্দর মানবের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ কাজ করে। সুন্দর মানুষকে কাছে পাওয়া, একটু বার্তালাপ কে না চায়।

    অনির্বাণের প্রতি মেয়েদের যে একটা দুর্বলতা আছে এটা অনির্বাণ বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতো। ডাক্তারি পাশ করার পর থেকেই মেয়ের বাবাদের আনাগোনার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল তাদের বাড়িতে। স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষিতা সুন্দরী মেয়েদের ফটোতে ভরে উঠতো অনির্বাণের স্টাডি টেবিল।

    অনির্বাণের বিয়ের সম্বন্ধটা নিয়ে এসেছিল তার লতু মাসি। অনির্বাণের শুধুমাত্র শিক্ষিত, সুশ্রী মেয়ে হলে চলবে না পাত্রীর পরিবারকেও উচ্চশিক্ষিত হতে হবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এই রকম পাত্রী ও পরিবার পাওয়া গিয়েছে। লতু মাসির ননদের বড় জায়ের ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে লাজবন্তী। নামের সাথে যদিও কামের কোন মিল নেই। তবুও বিয়ের আসরে লাজবন্তীকে দেখে অনির্বাণের লাজুক লতাই মনে হয়েছিল।

    লম্বা, ফর্সা, ডাগর চোখ দুটি দেখে অনির্বাণ নিমেষে হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকে। একে সুন্দরী, দুই উচ্চ শিক্ষিতা। তবে শিক্ষিত এই বিষয়টিতে অনির্বাণের বদ্ধমূল ধারণা ছিল- এ্যাকাডেমিক কেরিয়ার ভালো হতেই হবে।

    কিন্তু স্কুল কলেজের জীবনে ভালো নাম্বার পেয়ে পাশ করা আর গার্হস্থ্য জীবনে পাশ দেওয়ার মধ্যে যে বিরাট ফারাক আছে তা বোধহয় ডাক্তার অনির্বাণ চ্যাটার্জী জানতেন না। চিরকালই নিজের গর্ভধারিনীকে দেখেছেন হাসিমুখে শত অসুবিধাকে মানিয়ে নিতে। তাই অনির্বাণের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বোধহয় মেয়েদেরই সহজাত। ছোট থেকে অনির্বাণ তার বাবার মুখে শুনে আসছে মেয়েদের বুদ্ধি হাঁটুর নিচে থাকে। এই কথাটার মধ্যে পরিষ্কার লুকিয়ে রাখা হয়েছে মেয়েদের অবমাননার এক অধ্যায়।

    লাজবন্তী অনির্বাণকে প্রথম দর্শনেই বুঝেছিল, এই ছেলে অহংকারে পরিপূর্ণ। অনির্বাণ পাত্র হিসেবে বিয়ের বাজারে ভীষণ দামী তা তার হাবে ভাবে ফুটে ওঠে সব সময়।

    লাজবন্তীও সাদা কালো বাংলা ছবির নায়িকা সুলভ আচরণে কখনো নিজেকে জড়িয়ে রাখে নি। স্পষ্ট কথা শুনতে ও বলতে লাজবন্তীর কোন সংকোচ নেই।

    ফুলশয্যার রাতে অনির্বাণ লাজবন্তীর অনামিকায় পড়িয়ে দেয় একটি হীরের আংটি। আংটিটা আঙ্গুলে পড়ে কয়েকবার বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে দেখে লাজবন্তী বলে উঠেছিল, হীরেই যখন কিনলে তখন সাইজটা একটু বড় কেনা গেল না।

    নতুন বৌয়ের মুখে এই রকম কথা শুনে অনির্বাণ প্রথমে একটু চমকে ওঠে। অনির্বাণ কিছু বলার আগেই লাজবন্তী আরো বলে, যদি বাজেট কমই ছিল তা হলে শুধু সোনার আংটি দিলেই চলে যেত। কমসে কম সেটা একটু বড় হতো।

    ফুলশয্যার রাতেই অনির্বাণ লাজবন্তীর কথার রাশ খানা টেনে ধরার চেষ্টা করেছিল। গুরুগম্ভীর আওয়াজে অনির্বাণ বলেছিল, তোমার পছন্দ হয়নি এটা বললেই চলতো। এত
    ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বললেই হতো।

    লাজবন্তী একটু মৃদু হাসি দিয়ে বলেছিল, স্পষ্ট কথা বলা সহজ কিন্তু স্পষ্ট কথা হজম করা কঠিন। আজকের ঘটনায় হোটেলের লবিতে বসে অনির্বাণ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছে লাজবন্তীর সেদিনের কথাখানি। স্পষ্ট কথা যে মাঝে মাঝে চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে তা সে যথেষ্ট বুঝতে পারছে।

    মন তো মনই হয়। নারী কিংবা পুরুষ যারই হোক না কেন। সদ্য বিবাহিত বউ-এর কাছে অন্য মেয়ের রূপের প্রশংসা করতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে ডাক্তার অনির্বাণ চ্যাটার্জী। মেয়েদের বুদ্ধি হাঁটুর নিচে নয় সেটা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। মেয়েদের বুদ্ধি পুরুষদের কাঁধ স্পর্শ করেছে।

    নারীদের বাস্তব বুদ্ধি, সাংসারিক বুদ্ধি পুরুষদের থেকে কোন অংশে কম নয় বরং বেশি বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। স্বামীর সংসার, সংসারের প্রতিটি মানুষকে অবলীলায় আপন করে তুলতে পারেন নারী। হাঁটুর নিচে বুদ্ধি এই প্রবাদটিকে যদি সদর্থক ভাবে দেখা যায়, তাহলে বলতে হয় নারী তার ইগো, নারী তার আমিত্ব, নারী তার অহংকার, নারী তার হিংসা লালসা এই সব ধ্বংসাত্মক প্রবৃত্তিগুলোকে কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয় না। সর্বদায় হাঁটুর নিচে রাখার চেষ্টা করে।

    হোটেলের লবিতে লাজবন্তী কাছে বেদম মার খেয়ে অনির্বাণ তার বাকি জীবনে বাকসংযমকে জীবনের মূলমন্ত্র করবে ভেবে নিয়েছে। আর ভুলেও কখনো সংযম হীনতার কথা সে বলবে না।

    হঠাৎই অনির্বাণের গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছিল একটু জলের জন্য। একটু জলের জন্যই এদিক ওদিক ঘুরে দেখেতেই সে দেখে সে তো হোটেলের লবিতে নেই সে তো তার হোটেলের রুমের বিছানায় শুয়ে আছে। পাশে লাজবন্তী।
    অনির্বাণ সোজা হয়ে বিছানার উপর উঠে বসে। একি এতক্ষণ তাহলে সে স্বপ্ন দেখছিল! স্বপ্নের মধ্যে তাহলে লাজবন্তী সবার সামনে তাকে বেদম মারছিল। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, যাক বাবা। সবটাই স্বপ্ন ছিল তাহলে।

    অনির্বাণকে উসখুস করতে দেখে আলস্য জড়ানো গলায় অনির্বাণের কোমরে হাত রেখে লাজবন্তী বলে, হোয়াট হ্যাপেন হানি? এনিথিং রং?

    অনির্বাণ লাজবন্তী দিকে ঘুরে বলে, এভরিথিং ইজ অলরাইট বেবি। বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখা গ্লাস ভর্তি জলটা নিমেষে শেষ করে। তারপর লাজবন্তীকে জড়িয়ে ধরে চুপটি করে শুয়ে পড়ে।

    ভোররাতের এই উদ্ভট স্বপ্ন থেকে অনির্বাণ যে বিশেষ শিক্ষা লাভ করেছে তার কথা লাজবন্তীর কাছে একদম চেপে গেল। অনির্বাণ শুনেছে ভোরের স্বপ্ন দেখে যদি ঘুম ভেঙে যায় আর তারপর যদি আর ঘুম না আসে তাহলে সেই স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। তাই অনির্বাণ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে এইরকম ভোরের স্বপ্ন কোনদিন সে সত্যি হতে দেবে না। তার বাবার যুগ আর নেই। মেয়েদের বুদ্ধি হাঁটুর নিচে মোটেই নয়। বরং মেয়েদের বুদ্ধির তল পাওয়াই মুশকিল।

  • গল্প

    গল্প- ভাঙা নয় গড়া

    ভাঙা নয় গড়া
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    হালকা ঠান্ডা পড়তে না পড়তেই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যাচ্ছে মিনাক্ষীর আজকাল। শুধু ঠিক ঠান্ডা তা নয় এইবারের শীতকালটাও মিনাক্ষীর কাছে খুব স্পেশাল। খুব আদরের।

    এতবছর ধরে শীত কিংবা গ্ৰীষ্ম সকাল ছয়টাতে স্নান সারতে হতোই তাকে। স্নান সেরে পূজা করতে না করতেই রান্নার মাসি এসে যেত সাতটার মধ্যে।কোন রকমে নাকে মুখে ভাত, ডাল গুঁজে সাড়ে আটটার মধ্যে বাসস্টপে হাজির হতেই হত। যেদিন কপাল গুনে বসার সিট পেত সেদিন ভাবতো, ইশ্ যদি গরুর মতো জাবর কাটার ক্ষমতা ভগবান তাকে দিতো কি ভালোই হতো। সিটে বসে গরম ভাতের সঙ্গে খাওয়া খাবারগুলোর স্বাদ উপভোগ করতে পারতো।

    ৩১শে অক্টোবর মিনাক্ষীর লাস্ট ওয়ার্কিং ডে ছিল। তারপর একদিন খুব ঘটা করে ফেয়ারওয়েল দিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের সাথে মিনাক্ষীর যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল। তবে ফেয়ারওয়েলের দিনে আবেগে গদগদ হয়ে মিনাক্ষীর চোখে জলটল তেমন আসে নি।

    আজ বেলা সাড়ে সাতটায় ঘুম থেকে উঠে গ্যাসের চুলায় চায়ের কেটলিতে দু’কাপ জল দিয়ে বসায়। আঁচটা সিমে করে দক্ষিণ দিকের বারান্দায় হালকা রোদটাতে এসে দাঁড়ায়। ছোট ছোট টবে বেশ কিছু সিজেন ফ্লাওয়ার লাগিয়েছে সে।

    মিনাক্ষীর স্বামী অরুন বাবু ও দু’বছর আগে অবসর গ্রহণ করেছেন। অবসরের আগে রোজই প্রাতঃভ্রমণ করতে বের হতেন। কিন্তু আজকাল আর রোজ বের হয় না। কারণ রিটারমেন্টের আগে রাস্তাঘাটে, বন্ধুবান্ধবের কাছে ব্যাঙ্ক ম্যানেজার হিসাবে একটা সম্মান ছিল তার। কিন্তু অবসর গ্রহণের পর বন্ধু মহল আগের মতো আর তাকে অতখানি কদর করে না। তারা হাবে ভাবে বুঝিয়ে দেয় অবসরের পর মুড়ি মুড়কির এক দর। এখন তাই বেশিরভাগ দিন ছাদে গিয়ে হালকা একটু ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে নেন তারপর নেমে এসে মিসেস এর হাতের পরম যত্নে তৈরি ব্ল্যাক টি খান।

    মিনাক্ষী গাঁদা গাছগুলোতে হালকা একটু জল স্প্রে করে এসে চা-টা নামায়। একটা ট্রেতে দুখানা সুদৃশ্য কাঁচের কাপে চা ঢেলে বারান্দায় রাখা ছোট টেবিলটার উপর রাখে। চেয়ারে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাবে এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। সকালে মোবাইল বাজলেই মিনাক্ষীর টেনশন হয় এই বুঝি কাজের মেয়েটা আসতে ‘পারব না’ বলে ফোন করছে।

    মোবাইলের স্ক্রিনে নামটা দেখে সব ফালতু টেনশন ঝেড়ে ফেলে বেশ গদগদ সুরে বলে, বেবু আজ সকাল সকাল মা-কে মনে পড়লো? মিনাক্ষী তার মেয়ে অম্বিকাকে আদর করে আজও বেবু বলে ডাকে।
    অপর প্রান্ত থেকে অম্বিকা বলে, মম আমি মাসখানেক তোমাদের ওখানে গিয়ে থাকতে পারি?
    অম্বিকার গলার সুরটা কেমন যেন অন্যরকম ঠেকলো মিনাক্ষীর কানে। তবুও নিজের উৎকণ্ঠাকে উপেক্ষা করে সে বলে, তোমার বাড়ি। তুমি যতদিন খুশি থাকতে পারো।
    ওকে মম। আমি আজ ডিরেক্ট স্কুল থেকে তোমার কাছে আসছি। আর অন্য কোন কথা না বলেই ফোনটা কেটে দিল অম্বিকা।

    অরুণ বাবু চুপচাপ সব শুনছিলেন। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বলতে থাকেন, যেমন একগুঁয়ে মা তেমনি তার একটা জেদি মেয়ে। মায়ের আস্কারাতেই তো মেয়ের এতো তেজ। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে উনিও জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার তোমার মেয়ে সাত সকালে কি বললো?

    ফোনটা পাশে রেখে চায়ের কাপের চা-টা প্রায় এক বারেই শেষ করে ফেলে মিনাক্ষী। তারপর আস্তে আস্তে বলে, বেবু বিকালে আসছে। বেশ কিছুদিন থাকবে বলছে। জানো তো গলাটা কেমন যেন শোনালো ওর। কি জানি বাপু আবার কি হলো!

    অরুণ বাবু বলে, আমি তো তোমাকে প্রথমেই বলেছিলাম মিনু। ওদের বিয়ে খুব একটা সুখের হবে না। দুজনেই সমযোগ্যতা সম্পন্ন। ব্যক্তিত্বের সংঘাত তো হবেই। তার ওপর সৌরভ একদমই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছে। অম্বিকা আর সৌরভের মানসিকতা কখনো মিলতে পারে!

    মিনাক্ষী বলে, দেখি বিকালে এসে কি বলে শুনি। আগে থেকে এতো সিদ্ধান্ত না টানাই ভালো।

    অরুণ বাবু আবারও মনে মনে বিরক্তি প্রকাশ করে ও বিড়বিড় করে বলে, তোমার এই বিজ্ঞভাবের জন্যই মেয়েটার জীবনে এতো অশান্তি। কোনোদিন কোনো ব্যাপারে মেয়েকে শাসন করলো না। বেশি শাসন করলে না কি ছেলে মেয়েরা বিগড়ে যায়। নাও এবার ভোগান্তির জন্য তৈরি হোও।

    সারাটা দিন কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা মিনাক্ষীকে ছুঁয়ে রইলো। স্নান, খাওয়া সবই করছে ঠিকই কিন্তু মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে।

    অম্বিকা তাদের একমাত্র সন্তান। কত না কষ্ট করে মেয়েটাকে বড়ো করেছে, নিজের পায়ে দাঁড় করিয়েছে মিনাক্ষী। অরুণ বাবুর তো বদলির চাকরি ছিল। কখনও পুরুলিয়া, কখনও বাঁকুড়া, কখনো আবার আসাম। এমন করেই তো চাকরি জীবনটা অতিবাহিত করেছেন উনি। শুধুমাত্র রিটায়ারমেন্টের আগে দু’বছর কলকাতাতে থাকতে পেরেছিলেন।

    মিনাক্ষী একা হাতে মেয়ে, ঘর সংসার, নিজের চাকরি সব কিছু সামলেছে। একটা মাসের জন্য না বাপের বাড়ির কিংবা শ্বশুর বাড়ি থেকে কারোর কোনো সহযোগিতা সে পায় নি। এই নিয়ে বিশেষ কোনো আক্ষেপও সে করে না। মানসিকতার দিক থেকে সে বরাবরই খুব মজবুত।

    অরুণ বাবুকে বিয়ে করে মিনাক্ষী যখন বাঁকুড়ার এক অজ পাড়াগাঁয়ে তার শ্বশুর বাড়িতে এসে পৌঁছায় তখন তার বাপের বাড়ির সকলে বলেছিল, এবার মিনু টের পাবে কত ধানে কত চাল। কলকাতা শহরের মেয়ে হলেও মিনাক্ষীকে কিন্তু একবেলার জন্য বেমানান লাগে নি তার শ্বশুর বাড়িতে।

    সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যেই অম্বিকা স্কুল থেকে সোজা দমদমের বাড়িতে এলো। চোখ, মুখটা একদম বসে গেছে।
    মিনাক্ষী বলে, কিরে এত রোগা দেখাচ্ছে কেন?
    অম্বিকা বলে, ও তোমার চোখের ভুল। ৭০ কেজিই আছি। জিম জয়েন করেও এখনও পর্যন্ত এক কিলো ওজন কমলো না। তবে মনটা ভালো নেই তো তাই মুখটা শুকনো লাগছে। একটু ভালো করে আদা দিয়ে কড়ক চা বানাও সাথে ডিমের ওমলেট প্লিজ।
    মিনাক্ষী হেসে বলে, ঠিক আছে। তুই ফ্রেশ হয়ে নে। আমি সব রেডি করছি।

    ওয়াশ রুমের দিকে যেতে যেতে অম্বিকা পিছন ঘুরে জিজ্ঞাসা করে, বাবা কোথায়? যদি বাড়িতে থাকে প্লিজ একটু বাজারে পাঠাও না। বাবা থাকলে তোমার সঙ্গে স্বচ্ছন্দে কথা বলতে পারি না।
    মিনাক্ষী বলে, বাবা বাড়িতে নেই এই মুহূর্তে। তবে জানি না কখন আবার এসে পড়ে। একটু রিলায়েন্স ফ্রেশে পাঠিয়েছি।

    অম্বিকা আর বাথরুমে না গিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারখানা টেনে মিনাক্ষীকে চেপে বসায় ও নিজেও বসে। তারপর শুরু করে, মা, বাবা একটা কথা কিন্তু ঠিক বলে যে সম্পর্ক সমানে সমানে করা উচিত।
    মিনাক্ষী বলে, সৌরভের সাথে মানিয়ে চলতে তোর অসুবিধা হচ্ছে?
    -শুধু কি অসুবিধা, দিন দিন নিজেদের মধ্যে এতো তিক্ততার সৃষ্টি হচ্ছে তোমায় কি বলবো। ছোটো খাটো বিষয় নিয়ে তুলকালাম কান্ড বেঁধে যাচ্ছে।স্কুল থেকে আমিও ক্লান্ত হয়ে ফিরি মা। আমারও রেস্ট দরকার। তার মধ্যে মাঝেমধ্যেই শ্বশুর, শাশুড়ি এসে থাকেন লম্বা। তাদের সামনে সৌরভকে কিছু কাজ করতে বললেই শাশুড়ি মায়ের গাল ফুলে যাচ্ছে।

    আমি সৌরভকে বললাম, যতদিন তোমার মা বাবা থাকে ততদিন একটা রাঁধুনি রেখে দিই। সৌরভ বলে, রাঁধুনি রাখা মানে তো মাসে তিন হাজার টাকা বাড়তি একটা ফালতু খরচা। প্রতিমাসে বাড়ি, গাড়ির EMI বাবদ দিতে হচ্ছে ত্রিশ হাজার টাকা। তার ওপর মা বাবার ওষুধ পত্র বাবদ যথেষ্ট খরচা হয়। এতো খরচ চালানো সম্ভব নয়।

    মা আমি তো চাকরি করি। আমার স্যালারি আমি কি নিজের প্রয়োজনে খরচা করতে পারি না! একটু আরাম করে থাকবো বলেই তো এত কষ্ট করে পড়াশোনা করে চাকরি জুটিয়েছি। কিন্তু বিয়ে করে একি ঝামেলায় পড়লাম।

    মিনাক্ষী এতক্ষণে খুব ভালো করে বুঝতে পারছে অম্বিকা ও সৌরভের মনোমালিন্যের সুত্রপাত কোথা থেকে হয়েছে। মিনাক্ষী বলে, মোটামুটি হয়ে গেছে তোর কথা? এবার ফ্রেশ হতে যা। আমি চা রেডি করছি।

    অম্বিকা বাথরুমের দরজা বন্ধ করা মাত্রই মিনাক্ষী সৌরভকে ফোন করে তাড়াতাড়ি এবং বলে রাইটার্স থেকে সোজা যেন সে দমদম চলে আসে। আরো বলে, অম্বিকাও এসেছে একটু আগে।সৌরভ আন্দাজ করে অম্বিকা নিঃশ্চয় রাগ করেই বাপের বাড়ি গেছে।

    ফ্রেশ হয়ে একেবারে নাইট স্যুটটা পরেই ডাইনিং টেবিলে এসে বসলো অম্বিকা। আগের থেকে অনেক খানি ঝরঝরে লাগছে। এসেই মাকে সব কথা বলে এবং গরম গরম ডবল ডিমের ওমলেট ও আদা দিয়ে কড়া চা খেয়ে তারও মনটা অনেকটা ভালো হয়ে উঠেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে, সৌরভও ডবল ডিমের ওমলেট খুব পছন্দ করে।

    মিনাক্ষী বলে, ও আসলেই বানিয়ে দেবো।
    অম্বিকা বলে, মানে?
    মিনাক্ষী হেসে বলে, সৌরভও অফিস থেকে সোজা এখানে আসছে।
    অম্বিকা বলে, মম কোনো মানে হয়। তোমাকে তো মনের কোনো কথাই আর খুলে বলা যাবে না দেখছি।
    মিনাক্ষী বলে, তাই যদি মনে হয় বলিস না এবার থেকে। কিন্তু আমি তো তোর মা। কিভাবে মেয়ের সংসার ভাঙার ইন্ধন জুগিয়ে যাই। দেখ, অবিবাহিত ও বিবাহিত জীবনের মধ্যে অনেক তফাত। তুই নিঃশ্চয় জানিস সংস্কৃত ভাষায় বিবাহ শব্দের অর্থ- বিশেষ রূপে বহন করা। সেই বহনটা কিন্তু স্বামী স্ত্রী দুজনকেই করতে হবে। একে অপরের দোষ যতই খুঁজবি ততই অশান্তির সাগরে ডুববি। সৌরভ রাঁধুনি রাখতে বারণ করলো আর তা নিয়ে তুই মনকষাকষি শুরু করে দিলি! এতো ঠিক নয়।

    তুই একটা শিক্ষিতা, চাকুরিরতা বিবাহিত মহিলা।তোর নিজস্ব মেরুদণ্ড থাকা দরকার। তোর প্রয়োজন তুই তোর স্বামীকে জানিয়েছিস। মানা না মানা সেটা তার ব্যাপার। তার জন্য তো প্রয়োজনটা বাতিল করা যাবে না। সংসার করতে গেলে কিছু সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে শিখতে হবে। সামান্য অশান্তি হলে হবে। তা বলে পালিয়ে বাঁচবি না কি?

    বেবু, সৌরভকে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটা সম্পূর্ণ তোমার নিজের ছিল। সেদিন কিন্তু তোমার বাবা আপত্তি করলেও আমি কিন্তু কোনো আপত্তি করি নি। বরং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম তুমি যেন তোমার সিদ্ধান্তকে সম্মান ও মর্যাদা দিতে পারো।

    অম্বিকা মিনাক্ষীকে জড়িয়ে ধরে বলে, মম, you are the best mom। ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া আমার জীবনের সেরা উপহার হলে তুমি। প্লিজ মা, তোমার ঈশ্বরের কাছে আমার জন্য একটু প্রার্থনা করো আমি ও যেন তোমার মতো ব্যক্তিত্বময়ী হয়ে উঠতে পারি।

  • গল্প

    গল্প -এক চিলতে ঘর

    এক চিলতে ঘর
    -লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    কন্যাকুমারীতে দক্ষিণ ভারতের শেষ প্রান্তে তিন সাগর বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর আর আরবসাগর মিলিত হয়েছে কিন্তু তাদের মিলনস্থলে তাদের জলের রঙের প্রভেদ বুঝিয়ে দেয় তারা একে অপরের থেকে স্বতন্ত্র। সেইরকমই নীলিমা, মিনতি ও বিষ্ণুপ্রিয়া মিলিত হয়েছে মায়াপুর ইসকন মন্দিরে।

    তারা তিনজনই তিনটি পৃথক জীবনযাত্রার মহিলা। কলেজে ও তারা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা অনার্সের ছাত্রী ছিল। তবুও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল অটুট।
    কিন্তু কলেজ ছাড়ার পরে যে যার কর্মজীবনে, সাংসারিক জীবনে প্রবেশ করায় সেই বন্ধুত্বের ভাটা পড়ে গিয়েছিল। এবার দীপাবলিতে হঠাৎই সেই বন্ধুত্বের জোয়ার এনে দেয় ফেসবুক।

    নীলিমা মিনতিকে বলে, কি রে ভেবেছিলি সংসার স্বামী, সন্তান, নাতি সব নিয়ে ব্যস্ত থাকবি আর আমাদেরকে ভুলে যাবি। কিন্তু দেখ ফেসবুকের হাত ধরে আবার আমরা কেমন এক হলাম।
    মিনতিও বলে, সত্যিরে বিয়াল্লিশটা বছর পর আবার আমাদের তিন বন্ধুর দেখা। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। ভেবেছিলাম আমাদের বন্ধুত্ব স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে বোধহয়। সত্যি নীলিমা তোকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

    নীলিমা বলে ওঠে, দেখবি টেনে এক চড় কসাবো। কি মনে করেছিস বয়স হয়ে গেছে বলে আমি আর আগের মত মারকুটে নেই।

    নীলিমার কথা শুনে মিনতি আর বিষ্ণুপ্রিয়া তো হো হো করে হেসে ওঠে। কলেজে পড়ার সময় নীলিমাকে কলেজের ছেলেরাও ভয় পেত। কথায় কথায় হাত চালানোটা ওর স্বভাব।

    বিষ্ণুপ্রিয়া একটা রেকাবিতে তিন কাপ চা আর কিছু ড্রাইভ ফুডস নিয়ে হাজির হল। হাসিমুখে বলে দুপুরে কটার সময় লাঞ্চ করবি? নীলিমা ও মিনতি জানায় আমাদের কোনো তাড়া নেই যখন সবাই করবে তখন আমরা করবো।
    বিষ্ণুপ্রিয়া ওদের সাথে বসে চা খেতে খেতে বলে, আমরা বুড়ি হয়ে গেলাম বল। কলেজে যখন পড়তাম তখন মিনতির কি চুল ছিল। একখানা লম্বা বেণী সবাইকে মুগ্ধ করত।
    মিনতি বলে, সত্যি রে সেইসব দিনগুলো হারিয়ে গেছে আসলে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
    নীলিমা কিছুটা ঝাঁজিয়ে বলে মিনতিকে, ম্যাডাম আপনি তো বিন্দাস আছেন। গার্লস স্কুলের কড়া দিদিমণি। অধ্যাপক স্বামী, ডাক্তার ছেলে ও বৌমা, মেয়ে -জামাই নাতি -নাতনি সব নিয়ে একদম পরিপূর্ণ পরিবার।
    মিনতি বলে, ওরে সংসারকে পরিপূর্ণ করতে গিয়ে আমি যে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। সেই পঁচিশ বছর থেকে কর্মজীবন আর সংসার জীবন এর বাইরে আর কিছু জানলাম না। স্বামী সন্তান শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, জা নিয়ে একেবারে হুলুস্থুল কাণ্ড।
    আমার হাতে সকালের ব্ল্যাক টি ছাড়া কর্তার পটি হবে না। চেম্বারে বেরোবার আগে ছেলে বৌমাকে টিফিন বক্সটা সাজিয়ে রোজ আমাকেই দিতে হবে। রাধুনী মাসি কি রান্না করবে রোজদিন আমাকেই বলতে হবে।

    আর এতসব করার পরেও শুনতে হয় এখন তো অবসর সময় তুমি একটু গৃহকর্মের দিকে মন দাও। ভাবতে পারছিস যে মানুষটা যৌবন কাল থেকে সংসার করছে তাকে বার্ধক্যে এসে সংসারে মন দেওয়ার কথা বলছে সেইসব মানুষ যারা এক গ্লাস জল পর্যন্ত গড়িয়ে খেতে চায় না।
    নীলিমা তুই কিন্তু অনেক ভালো আছিস। নিজে চাকরি করেছিস, পেনশন পাচ্ছিস এখন। কারোর কোনো দায়-দায়িত্ব মাথায় নেওয়ার দরকার নেই।পয়সা ফেলো তামাশা দেখো। ভাই ভাইয়ের বউরা মাথায় করে রেখেছে। তোর মত একটা সোনার ডিম পারা হাঁসকে তারা তো যত্নআত্তি করবেই।

    নীলিমা তখন হেসে বলে, দূর থেকে সরষে খেত ঘনই লাগে। জানিস যখন ভাইয়ের বউয়ের বিরক্তিকর মুখটা দেখি তখন খুব কষ্ট হয়। এই যেমন ধর বাড়িসুদ্ধ লোক নেমন্তন্ন বাড়ি খেতে যাচ্ছে। আমার আবার ভোজবাড়ি খাবার সহ্য হয় না। সুতরাং আমার জন্য কিছু না কিছু রান্না করতেই হবে ভাইয়ের বউকে। আর তখনই তার মুখ হয়ে যায় ভার।
    আর যদি আমি বলি আমি নিজে করে নেব তাহলে তার মনে হয় আমি তাকে পরে খোঁটা দেব। সুতরাং শত ব্যস্ততার মধ্যেও শত অনিচ্ছার মধ্যেও আমার জন্য রান্না তাকে করতে হয় আর সেই রান্না আমাকে খেয়ে হজম করতে হয়।
    বিশ্বাস কর তখন মনে হয় এটা যদি আমার নিজের সংসার হতো তাহলে আমি স্বচ্ছন্দে রান্না ঘরে ঢুকতে পারতাম নিজের ইচ্ছামত কিছু একটা বানিয়ে নিতে পারতাম। এই বুড়ি বয়সে এসে বুঝি রে নিজের সংসারটা কত দরকার ছিল।
    নীলিমা ও মিনতির কথোপকথন খুব মন দিয়ে শুনছিল বিষ্ণুপ্রিয়া যদিও তার তো কিছু বলার নেই। সে তো এই পার্থিব সংসারের বাইরে বিরাজ করে।
    সে হাসিমুখে বলে তোরা তোদের সুখ দুঃখের গল্প কর আমি একটু মন্দির থেকে আসছি। প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেল বিষ্ণুপ্রিয়া ওদের দুজনকে ছেড়ে মন্দিরে এসেছে সেখানে ঠাকুরের বাসনগুলো যত্ন করে মেজে ধুয়ে তুলে রাখছে। ঠাকুর ঘরের আরো বাকি সব জিনিসপত্র সব গোছগাছ করে কৃষ্ণের পদতলে চুপচাপ বসে রইলো।
    কিছু চাওয়ার নেই, কিছু পাওয়ার নেই শুধু আছে ভক্তি, প্রেম ও ভালোবাসা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি।
    বারোটা বাজছে। খাবার সময় হয়েছে। বিষ্ণুপ্রিয়া নীলিমা ও মিনতিকে ডেকে আনে খাবার কক্ষে। অত্যন্ত সাধারণ নিরামিষ খাবার-দাবার পরম তৃপ্তি করে খেলো নীলিমা ও মিনতি দুজনই।
    নীলিমা বিষ্ণুপ্রিয়াকে বলে, বিষ্ণু আমাদের তো কত দুঃখ, কত অভিমান। তোর মনে কি এসব কিছুই নেই?
    বিষ্ণুপ্রিয়া বলে, ওইগুলো বিসর্জন দিয়েছি বলেই তো আজ প্রভু চরণে ঠাঁই পেয়েছি রে। তোদের জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার গল্পগুলো শুনতে আমার বেশ ভালই লাগছিল। ভাবছিলাম তোদের দুজনের দু’টো জীবনের যে কোনো একটাকে বেছে নিতে পারতাম তাহলে হয়তো আমিও এই সব গল্পই তোদেরকে করতাম।
    কিন্তু আমিও যে জীবন বেছে নিয়েছি সেখানে জাগতিক হিসাব-নিকাশ, দেনা-পাওনা কোনো কিছুই পরোয়া করে না। সেখানে শুধু আছে ভালোবাসা প্রেম।
    আমার কথাগুলো তোরা ঠিক বুঝতে পারবি না রে কারণ ঈশ্বরের চরণে সমর্পণ করা এত সহজ ব্যাপার নয়। যাগ্গে, তোরা কদিন থাকছিস তো?

    এমন সময় মিনতির ফোনটা বেজে উঠলো। রাঁধুনী মাসি ওপাশ থেকে বলে, দিদিমণি আমি কিন্তু রাতে আসতে পারবো না এই বিকেল বিকালে রুটি করে চলে যাব বলে দিও। আবার কিছুক্ষণ বাদে লন্ড্রীবালা ফোন করে, দিদিমণি আপনি কি বাড়িতে নেই কখন থেকে ডোর বেল বাজাচ্ছি কেউ খোলে না। আজকে কাপড় জামা দেওয়ার নেই?এরপর দুধবালা, ফুলবালা। একের পর এক ফোন।কী আশ্চর্য ব্যাপার। একটা দিন ঘরটাকে সামাল দেওয়ার লোক নেই। এই বলে বিরক্ত হয়ে ফোনটা সুইজ অফ করে দিল মিনতি।

    সন্ধ্যা বেলায় মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি, ভজন এইসব শুনে মিনতি ও নীলিমার মন খানি প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। সকল ভক্তবৃন্দের সাথে তারাও কৃষ্ণ নামে মাতোয়ারা হয়ে যায়। প্রায় ঘন্টা চারেক ফোনটা সুইচ অফ ছিল। রুমে ফিরে এসে ফোনটা সুইচ অন করেই দেখে শ খানেক মিসড কল। মিনতির পতিদেবতা, ছেলে, বৌমা, মেয়ে,জামাই, নাতি সবাই নিজের নিজের ফোন থেকে ফোন করেছে।
    মিনতি নীলিমাকে বলে, এদের কান্ড দেখ। দেখছিস যখন আমি ফোন তুলছি না তখন এতো বার ফোন করার কোন মানে হয়। নীলিমা বলে, ওরে তুই তো ভাগ্যবতী যে এই রকম একটা ভালোবাসার সংসার গড়তে পেরেছিস।

    আর আমাকে দেখ, কখন এসেছি কেউ একটা ফোন করেছে? আসলে সবাই নিজের নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সেখানে আমিই বাইরের লোক।আগাছা।
    বিষ্ণুপ্রিয়া রাতে শুতে এলে নীলিমা বলে, আমি কি তোদের আশ্রমে পাকাপাকি ভাবে থেকে যেতে পারি?
    বিষ্ণুপ্রিয়া বলে, কিন্তু তোর পরিবার?
    নীলিমা বলে, ওরাও বেঁচে যাবে। প্রতিমাসে আমি পেনশনের কিছু টাকা পাঠিয়ে দেবো। তাহলেই হবে।
    আসলে আজকে আমার মনে হলো বেঁচে থাকতে গেলে নিজের হাতে তৈরী একটা পরিবার থাকা দরকার না হলে প্রভুর পরিবারে থাকা দরকার। সম্মান আর ভালোবাসা দুটোই যে বড় দরকার।

  • গল্প

    গল্প- গুপ্তধন

    গুপ্তধন
    – লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    বাবা রে ছোট বোনকে নিয়ে তো দাদাদের অহংকারের শেষ নেই। তাদের বিদ্যাধরি, বড়লোক বোন তারও বাবার সম্পত্তির ভাগ চাই!

    এই কৃতজ্ঞতা বোধ! দুই ভাই মিলে কী আদিখ্যেতা করতো মহারানীকে নিয়ে। বড় বৌ নীলিমাকে পূর্ণ মাত্রায় সমর্থন করে ছোট বউ রঞ্জিমা।
    বুঝলে বড়দি যতই লেখাপড়া শেখো শরীরের লোভ লালসা ত্যাগ করা এত সহজ নয়। শুধু বড় বড় বুলি কপচালেই হবে, কাজের বেলায় লবডঙ্কা।

    দ্যাখ ছোট, বুড়িকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দাদারা যে কত কষ্ট করে ওকে ইজ্ঞিনিয়ারিং পড়িয়েছে তা ওকে কেউ কোনদিন বুঝতে দিয়েছে। বছরে একবার বোন বাপের বাড়ি আসবে তার জন্য জেনারেটর ভাড়া করা চাই। কি না লোডশেডিং হলে বোনের কষ্ট হবে। যতসব, বেশি বেশি।

    আরে বাবা সে ও তো সবার আগে এবাড়ির মেয়ে। তারপর তো কোনো কোম্পানির এ্যাডভাইজার।

    কী বলবো বড়দি, আমাদের না হয় বিদ্যা বুদ্ধি কম। তা বলে বাবা দাদার অবস্থা বুঝবো না এমন অবুঝ আমরা নই।

    দুই জা মিলে তাদের একমাত্র ননদের নামে ভালোই গুন কীর্তন শুরু করেছে সকাল বেলায়। আসলে এটাই সঠিক সময়। কমল ও অমলের সামনে তো কোনো কথা বলা যাবে না তাদের বোনের নামে। আর শাশুড়ি মাতা উত্তমার সামনে তো ভুলেও না।

    উত্তমা দেবী স্বামী বিয়োগের পর থেকেই গুরু বাড়িতে মাসের বেশিরভাগ দিন কাটিয়ে আসেন। সংসারের মায়া ত্যাগ করতে চান তাই এই ব্যবস্থা। তবে গতকাল উনি ফোন করে জানালেন বুড়ি আসছে আমেরিকা থেকে। তাই তিনিও পরশু দিন ফিরছেন। প্রায় তিন বছর পর এবার বুড়ি আসছে। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েও আসতে পারে নি সে।

    ‌উত্তমা দেবী সম্পত্তির হিসাব নিকাশ এবার পাকাপোক্ত করে নিতে চান। কারণ তাঁরও বয়স হয়েছে। আজ আছে কাল নেই। এখন ভাই ভাই ভাব আছে কালকে যে অশান্তি হবে না তার কী গ্যারেন্টি। উত্তমা দেবীর স্বামী হঠাৎই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাই সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করে যেতে পারেন নি। এবার সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে উত্তমা দেবীকে।

    ‌বুধবার সকাল দশটার মধ্যে কমল উত্তমা দেবীকে নিয়ে চলে আসেন গুরুদেবের আশ্রম থেকে। বাড়িতে পা রেখে থেকেই তো উত্তমা দেবীর খুঁতখুঁত করা শুরু হয়েছে। নীলিমা ও রঞ্জিমা তো রাগে ফোঁস ফাঁস করলেও একটি কথা বলার সাহস নেই। শ্বশুর মশাই-এর সব সম্পত্তির মালিক কিন্তু উত্তমা দেবীই। তাই তাকে চটানের সাহস কারোর নেই।

    ‌দুপুরে খেতে বসে উত্তমা দেবী সকলকে জানালেন, ‘শুক্রবার যখন বুড়ি আসছে তখন ভাইদেরই উচিত এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠানো’।কমল ও অমল ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেই নীলিমা ও রঞ্জিমা মুখ বেঁকিয়ে বলে ‘আবার পাঁচ হাজার টাকার চুনা।’ উত্তমা দেবী বৌদের দিকে কটমট করে তাকাতেই তারা মুখ নিচু করে।

    ‌যথারীতি শুক্রবার বুড়ি (মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী)
    তার একমাত্র ছেলে মেঘদূতকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলো তার বাপের বাড়ি বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে। কলকাতা থেকে এতটা রাস্তা আসতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মেঘদূত। গাড়ির আওয়াজ পাওয়া মাত্রই ছুটে আসে দুই বউ। নীলিমা মেঘদূতকে কোলে তোলার চেষ্টা করলে সে বলে ‘ডোন্ট, আমি কোলে চড়ি না’।
    মেঘদূতের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলেও বুড়ি ধমকের সুরে বলে ‘বড় মামীমনি হয়। এইরকম বলে না। ভালোবাসাকে সম্মান জানাতে হয়।’

    রঞ্জিমা তাড়াতাড়ি করে বুড়ির হাত থেকে একটা ছোট ব্যাগ নেওয়ার চেষ্টা করে। বুড়ি হেসে বলে ‘তুমি এই হালকাটা নাও ছোট বৌদি। কেমন আছো সব তোমরা। বাড়ির ছেলে মেয়েরা কোথায় গেল?’
    রঞ্জিমা বলে ‘সব টিউশনি গেছে চলে আসবে একটু পরেই।’
    ইতিমধ্যে উত্তমা দেবীও পা টেনে টেনে সদর দরজায় হাজির হয়ে গেছে।

    ‌মুহুর্তের মধ্যে পুরো পরিবারটাতে কেমন একটা খুশির বাতাবরণ তৈরি হয়ে গেল। কে বলবে গতকাল পর্যন্ত বুড়ির দুই বৌদি বুড়িকে তুলোধোনা করছিল। উত্তমা দেবী বলে জামাই বাবাজীবন সঙ্গে এলে কত ভালো হতো।
    ‌বুড়ি বলে, ‘সোম আসবে মাস তিনেক পরে। আমাকে নিতে।’
    ‌এইকথা শোনা মাত্রই রঞ্জিমা বলে ওঠে, ‘সেকি গো তুমি তিনমাস থাকবে?’
    ‌বুড়ি খানিক হেসে বলে, ‘আমার বাড়ি, আমি যতদিন খুশি থাকবো। তবে তোমরা ভয় পেও না তোমাদের কোনো অসুবিধা আমি করবো না।’
    ‌নীলিমা রঞ্জিমার কথাটাকে আড়াল করে তাড়াতাড়ি বলে ‘বুড়ি তুই কিন্তু তোর ছোট বৌদির কথার অন্য মানে করিস না। জানিস তো ওর মুখ পাতলা। এবার বলতো কী টিফিন খাবি? আমি কিন্তু আজকাল নুডুলস, স্প্যাগেটি, পিৎজা সব বানাতে শিখে গেছি।’
    ‌বুড়ি বলে, ‘ আমায় আলুভাজা দিয়ে মুড়ি দাও। সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা। দাদাদেরও তো কিছু খাওয়া হয় নি। সবাই একসাথে বসে খাবো।’

    ‌আজ আর ডাইনিং টেবিলে জলখাবারের ব্যবস্থা হলো না। মেঝেতে আসন বিছিয়ে সকলে বসলো। হঠাৎ করে অমল খেয়াল করে মেঘদূত গেল কোথায়? বড় মামুর গলার আওয়াজ শুনে ছোট্ট মেঘদূত চিৎকার করে বলে ‘আমি এইখানে।’
    ‌সবাই তাকিয়ে দেখে মেঘদূত পুরানো ঢেঁকিতে চড়ে বসে আছে পরম সুখে।

    ‌টিফিন খেতে খেতে বুড়ি বলে, ‘দাদা আমি দেশের বাড়িতে একবার যেতে চাই। তার একটা ব্যবস্থা করো।’
    ‌কমল বলে, ‘খুব ভালো হবে বোন। অনেক বছর আমরা ও যায় নি। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে যাতায়াত একদম বন্ধ হয়ে গেছে। কবে যাবি ভাবছিস?’
    ‌বুড়ি বলে, ‘একটা রবিবার দেখে প্রোগ্রাম করো। ভাইপো ভাইঝি বৌদিরা সকলে মিলে যাবো।’
    ‌অমল বলে, ‘তাহলে সামনের শনিবার চল। পুরোদিন থেকে রবিবার বিকালের দিকে ফিরে আসবো।’

    দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর উত্তমার ঘরে বাড়ির সব সদস্যদের ডেকে পাঠায় বুড়ি। আমেরিকা থেকে সে দুই ট্রলি ব্যাগ ভর্তি জিনিস এনেছে। কত রকমের কসমেটিকস! দুই বৌ তো হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বড় বৌয়ের মেয়ে রুমি তো মা কাকীমাকে ধমক দিয়ে বলে, ‘অদ্ভুত আচরণ।পিসিমনি সবার জন্যই যখন গিফট এনেছে তখন হুড়োহুড়ি করার কোনো মানে হয়।’
    বড় বৌ নীলিমা মেয়ের ধমক খেয়ে চুপচাপ পাশে বসে রইলো।

    ‌বুড়ি প্রথমে বাড়ির ছোট থেকে শুরু করে জিনিস দিতে। কী যত্ন সহকারে প্যাকিং করে এনেছে। প্যাকেটগুলো হাতে দিতে দিতে বলে কেউ কিন্তু এখানে খুলবে না। রঞ্জিমা তো তার প্যাকেটখানি হাতে পেয়ে এক মিনিট সময় নষ্ট না করে নিজের ঘরে এসে তাড়াতাড়ি কাঁচি বের করে প্যাকেটটা কেটে গিফট-টা টেনে বের করে আনে। ‘ও মা! কত লিপস্টিক,কী দারুণ শেডগুলো!’

    ‌সবাই যে যার মনের মতন গিফট্ পেয়ে খুব খুশি। আসলে বুড়ি হচ্ছে এমন একটি মানুষ যে সকলের দিকে খেয়াল রাখতে পারে। শনিবার সকালে দুই খানি টাটা সুমো ভাড়া করা হয় গ্ৰামের বাড়ি যাবে বলে।

    ‌ঘন্টা খানেকের মধ্যে তারা পৌঁছেও গেল।গাছ গাছালি ভরা মাটির দুতলা বাড়িটা অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে আছে ভিটে জুড়ে। টেপা কলটাতে চাপ দিতেই বেশ গদগদ করে জল পড়লো। টিব ওয়ালটা দেখে মেঘদূতের খুব মজা লাগে। সে শুধু ঘুরতে ফিরতে এসে চাপ দিয়ে জল বের করছে।

    ‌বুড়ি ধীরে ধীরে মাটির সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠে। মাকড়সার জালগুলো একটা ছাড়ু দিয়ে সরাতে সরাতে পৌঁছায় তার ঠাকুমার ঘরটিতে। কাঠের দরজায় প্রথমে হাত বুলায়। তারপর শিকলটা খুলে ভিতরে পা রাখতেই একটা ইঁদুর ছুটে বেরিয়ে গেল। বড্ড ধুলোয় ভরা ঘরটা। বুড়ি ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালাটা খুলে দিতেই একটা হাওয়া এসে বুড়ির শরীরকে স্পর্শ করে গেল।

    ‌এদিকে দুই বৌ এদিক সেদিক ঘুরে বুড়িকে খুঁজতে খুঁজতে মাটির দোতলায় উঠে আসে। কোনের দিকের ঠাকুমা শাশুড়ির ঘরটা খোলা দেখে তারা সেদিকেই পা বাড়ায়। হঠাৎ একটা ভারী কিছু পড়বার আওয়াজ শুনে প্রথমে তারা থমকে দাঁড়ায় তারপর পা টিপে টিপে এসে উঁকি মারে ঘরটার দিকে।

    ‌দেখে, মুখে ওড়নাটাকে টাইট করে বেঁধে ঠাকুমার চৌকির নিচে থেকে বেশ কসরত করে একটা লোহার বাক্স বের করে আনছে বুড়ি। সঙ্গে সঙ্গে দুই জা চোখাচোখি বার্তালাপ খানি সেরে ফেলে। এবার তারা দুজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে বাক্স খানির ভিতর থেকে কী বের হয় তা দেখার জন্য।

    ‌বুড়ি হাঁটু গেঁড়ে বসে বেশ কিছুটা ঝুঁকে কি সব ঘাঁটতে থাকে। অবশেষে কিছু একটা জিনিষ পেয়ে খুব খুশি হয়ে ওঠে। মুখ থেকে তার আওয়াজ বের হয়’ ইয়াহু’। বেশ কিছু পুরাতন কাগজ পত্র একটা কাপড়ের পলিথিন ব্যাগের মধ্যে রাখা আছে খুব সযত্নে। বুড়ি পলিথিনের ব্যাগটাকে বের করে লোহার বক্সটাকে আবার যথা স্থানে ঠিলে রাখে। উঠে দক্ষিণ দিকের জানালাটা বন্ধ করে দেয়। ততক্ষণে বুড়ির দুই বৌদি পা টিপে টিপে দোতলা থেকে নেমে আসে।

    ‌তারা দুজনেই অপেক্ষা করতে থাকে কখন বুড়ি তাদেরকে এই পলিথিন ব্যাগের সম্বন্ধে বলবে। কিন্তু বুড়ি নিচে নেমে এসে পলিথিনের ব্যাগখানির কথা কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ তার ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখে।

    ‌তারপর যথারীতি হই হুল্লোড় করে গ্ৰামের বাড়ি থেকে রবিবার সকলে মিলে সন্ধ্যায় বেলিয়াতোড়ে ফিরে আসে। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে নীলিমা ও রঞ্জিমা দুজনেই অমল ও কমলকে জানায় পলিথিন ব্যাগের কথাটা। যদিও দু’ভাই বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দেয় না।

    এরপর মাস খানেক পর দলিল সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য উকিল বাবুকে ডেকে পাঠানো হয়। গ্ৰামের ভিটে মাটি, চাষ জমি, দুই খানা পুকুরের চোদ্দ আনা ভাগ, গোটা ত্রিশেক তালগাছ, চারটা আম গাছ, দুটো শেগুন ও মেহগনি আর বেলিয়াতোড়ে দুতলা দালান, দু’টো হার্ডওয়্যারের দোকান । আরো আছে উত্তমা দেবীর ভরি চল্লিশের সোনার গহনা। এইসব কিছু সমান তিন ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উত্তমা দেবী। দুই বৌ একটু অসন্তুষ্ট হলেও বুড়ির দুই দাদার কোনো আপত্তি নেই।
    কিন্তু সকলকে চমকে দিয়ে বুড়ি বলে, ‘আমার এইসব প্রপার্টি কিছু লাগবে না। সব কিছু দাদাদেরই থাক। তবে সব কিছু মায়ের নামে জীবন সত্ত করে দেওয়া হোক। মায়ের অবর্তমানে দাদারা তার হকদার।’

    বুড়ির কথা শেষ হতে না হতেই ছোট বউ রঞ্জিমা বলে ‘তুমি গ্ৰামের বাড়ি গিয়েছিলে তো গুপ্তধনের সন্ধানে তাই না। সেটা তো ঠাকুমার লোহার বাক্স থেকে পেয়েও গেছো। তাই তোমার আর এইসব অল্প মূল্যের জিনিস আর লাগবে না।’

    রঞ্জিমার হঠাৎ আক্রমণে বুড়ি কিছুটা ধরাশায়ী হলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বলে, ‘বাঃ, গোয়েন্দা গিরি তো ভালোই করতে পারো বৌদি।তা আমি কি জিনিষ ঠাকুমার লোহার বাক্স থেকে পেয়েছি সেটাও নিশ্চয়ই দেখেছো।’
    রঞ্জিমা এবার কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘দেখেছি একটা পলিথিনের ব্যাগ তুমি বের করেছো এবং উত্তোজিত হয়ে “ইয়াহু” বলেও উঠেছিলে। আর ব্যাগখানা চুপিচুপি এনে নিজের ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিলে। ঠিক বলছি তো আমি। আজ পর্যন্ত সেই ব্যাগের কথা কাউকে তুমি বলো নি।’

    উপস্থিত সকলের মুখ মুহূর্তের মধ্যে বিবর্ণ হয়ে যায়। অমল, কমল চরম অস্বস্তি র মধ্যে পড়ে। উত্তমা দেবীও ভাবতে থাকেন কী জিনিস এমন যা বুড়ি নিয়ে এলো যে তাঁকেও কিছু বললো না। এইরকম অশান্তির মধ্যে উকিল বাবু আর বসে থাকতে চাইলেন না। তিনি বিদায় নিলেন।

    উকিল বাবু চলে যাওয়ার পর উত্তমা দেবী বলেন, ‘বুড়ি আমাকেও কী কিছু বলা যায় না।’
    বুড়ি বলে ‘সকলকেই বলা যায়। তবে আমি ঠিক সবার সামনে বিষয়টা আনতে চাই নি। তবে তোমাদের মনে যখন এতো সন্দেহ তখন তার নিরসন হওয়া দরকার। একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি।’

    কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই গুপ্তধনের ব্যাগটা নিয়ে বুড়ি আসে। সবার সামনে উপুর করে ঢেলে ফেলে। বেশ কিছু কাগজ, চকলেটের প্যাকেট, ভাঙা স্কেলের টুকরো, কিছু কাঁচের চুড়ি আর একটা ফটো। উত্তমা দেবী চমকে উঠলেন ভাঙা স্কেলটা দেখে। এই স্কেল তো তিনিই ভেঙে ছিলেন বুড়ির পিঠে। কাঁচের চুড়িগুলো দেখে কমল বলে ওঠে ‘এটা তো আমি চড়কের মেলা থেকে কিনে ছিলাম। তবে তোর জন্য নয়। বড় জেঠুর মেয়ে শীলা দিদির জন্য। তুই পেলি কি করে?’
    বুড়ি বলে ‘চুরি করে। এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম ও শেষ চুরি। আমি তখন ক্লাস টুয়ে পড়ি। দাদা আমার থেকে তখন শীলা দিদিকে বেশি ভালোবাসতো। সারাক্ষণ শীলা আর শীলা। শীলা দিদি কাঁচের চুড়িগুলো খুলে পুকুরে স্নান করতে গিয়েছিল আর আমি তখন এক ডজন চুড়ির মধ্যে এই চারটে চুড়ি লুকিয়ে নিয়ে নিয়েছিলাম।’

    নীলিমা বলে ‘তা বলে খাওয়া চকলেটের প্যাকেটটা কেন রেখে দিয়েছিলে? ‘
    ‘এই ক্যাডবেরির প্যাকেটটা আমার কাছে ভীষণ ভীষণ দামী। বাবা শুধুমাত্র আমার জন্য কিনে এনেছিলেন। সেদিন প্রথম আমি উপলব্ধি করি বাবা আমাকে সবার থেকে বেশি ভালোবাসে।’
    এতসব কথার মাঝে কখন মেঘদূত এসে পুরানো ফটোটা নিয়ে দেখতে বসে পড়েছে। শুধু মেঘদূত নয় বাড়ির অন্যান্য ছেলে মেয়েরাও। বড় বৌয়ের মেয়ে রুমি তো কাউকে চিনতে পারছে না। সে বলে ওঠে, ‘ও পিসিমনি, এরা কারা?’
    বুড়ি ফটোটা হাতে নিয়ে বাঁ দিক থেকে শুরু করে, ‘আমার বড়মা, দিদা, মা, বড় পিসি মনি, মেজ পিসিমনি, বড় জেঠিমা, ছোট কাকিমা,শীলা দিদি, মিঠু দিদি আর আমি।
    এই ফটোটা তুলে ছিল বড়ো জেঠু। স্টুডিও থেকে ফটোগ্ৰাফার এনে। আমার তো জায়গা হচ্ছিল না কিছুতেই। তখন ঠাকুমা বললো যে সে ফটো তুলবে না। তার চেয়ে বুড়িকে নেওয়া হোক। আজ হয়তো আমি মুহু মুহু ফটো তুলে বেড়াই। তবে সেদিনের সেই অনুভূতিগুলো আমার কাছে অমূল্য, জীবন্ত। আমি আমার সমস্ত নিজস্ব ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ছোট থেকেই ঠাকুমার লোহার বাক্সে রাখতাম। আর এই কারণেই আমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ও আবেগগুলো কারোর সাথে শেয়ার করতে চাই নি।
    ছোট বৌদি বোঝা গেল তো আমার গুপ্তধনের রহস্য। এবার নিঃশ্চয় তোমার মনের দ্বন্দ দ্বিধা দূর হলো। আশাকরি আমার প্রাপ্ত গুপ্তধনের তোমার কোনো দরকার নেই। এগুলো আমি নিঃশ্চয় আমেরিকার নিয়ে যেতে পারবো।’



  • গল্প

    গল্প- ভিক্ষা নয় ভালোবাসা

    ভিক্ষা নয় ভালোবাসা
    – লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    বিয়ের পর এই প্রথম বার মামাবাড়িতে বিজয়া প্রণাম করতে এলো রিমি। একসময় দিনের পর দিন এই মামাবাড়িতে পরে থাকতো সে। আসলে তখন মামাবাড়িটা তার যৌথ পরিবার ছিল। মা বাবার একমাত্র সন্তান হলেও লোকজন রিমির খুব পছন্দ। কাজিনদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া, ঘুমানো, পুকুরে স্নান করতে যাওয়া, বিকাল হলেই ধান ক্ষেতে বসে আড্ডা এই সব ছেড়ে কিছুতেই কলকাতা ফিরে আসতে মন চায় না রিমির। তবে বিয়ের দশ বছরেও এর আগে বিজয়া দশমী করতে সময় পায় নি রিমি।
    আজ মহা সপ্তমী। করোনার আতঙ্কে দিন কাটলেও দেবীর আরাধনা বন্ধ হয় নি। তাই আর মনখারাপ নয়। একটু আনন্দ হয়ে যাক এবার তাই রনজয়কে নিয়ে দশমীর দিন সকালেই রিমি এসে হাজির আরামবাগের তিরোল গ্ৰামে। আগের দিন মেজ মামাকে ফোন করে জানিয়ে ছিল সে। আসলে পাঁচ মামা-ই আলাদা। আগের মতো এতো বড় হাঁড়ি নেই যে যখন খুশি বাড়তি লোক আসুক কোনো অসুবিধা নেই। এই দশ বছরে গ্ৰামটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ধান জমিতে গড়ে উঠেছে বড় বড় পাকা বাড়ি। রিমির মনে হলো গ্ৰামগুলো যেন কোথাও তার লালিত্য হারাচ্ছে। হঠাৎ সে চিৎকার করে ওঠে ‘গাড়ি থামাও,গাড়ি থামাও।’

    রনজয় গাড়ি থামাতেই প্রায় লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ছুটতে শুরু করে আল রাস্তা ধরে রিমি। রনজয় তো অবাক! রিমি ছুটে গিয়ে একটা বৃদ্ধ মহিলাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। মহিলা ভুরু কুঁচকে বলে ‘সেজ পিসিমার মেয়ে রিমি দিদিমনি না। কত বছর পর তোমাকে দেখলুম। কার সঙ্গে এইচো দিদিমনি?’
    রিমি বলে, ‘আমার বরের সঙ্গে। চলো তুমি গাড়িতে ওঠো। এখন কোথায় যাবে?’
    বৃদ্ধ মহিলাটি বললো, ‘তোমার মেজ মামার ঘরই যাবো। এখন শুধু ওদের বাড়িতেই কাজ করি।’

    বৃদ্ধ মহিলাটির নাম চাঁপা। সবাই তাকে চাঁপাদি বলেই ডাকে। বহু বছর ধরে রিমির মামাবাড়িতে কাজ করে সে। রিমি যখন আগে মামাবাড়ি আসতো রিমির জামা কাপড় ধুয়ে দিতে। রিমি পুকুরে স্নান করতে নামলে সে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো। রিমির চপ্পলে কাদা লাগলে পরিষ্কার করে দিতো। আরো কত কি।
    বিনিময়ে রিমির মায়ের কাছ থেকে পুরানো শাড়ি, পুরানো জুতো, পুরানো ব্যাগ এইসব আবদার করতো।

    গাড়িতে যেতে যেতে চাঁপাদি জিজ্ঞাসা করে রিমি কদিন থাকবে। রিমি বলে আগামীকাল সকালেই চলে যাবে। চাঁপাদি বলে, ‘জানো এখন অনেক টাকার ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু প্রতিমাসে টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারি না। তুমি আমায় যাওয়ার সময় কিছু টাকা দিয়ে যেও।’
    রিমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো।

    পরেরদিন রিমিরা বের হবে ঠিক সেই সময় এসে হাজির চাঁপাদি। মেজ মামি আগেই বলে দিয়েছে, ‘রিমি কুড়ি টাকার বেশি একদম দিবি না। ওদের ভীষণ চাওয়া বাতিক।’
    ‌রিমি ওর পার্স থেকে প্রথমে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে দিতে যাবে হঠাৎ তার মনে হলো সে কি ভিক্ষা দিচ্ছে চাঁপাদিকে। না একদমই না। সে তো চাঁপাদিকে যথেষ্ট ভালোবাসে। তাহলে করুণা নয় ভালোবাসা দেওয়া উচিত। রিমি একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে চাঁপাদির হাতে দিয়ে বলে, ‘চাঁপাদি এইটা রাখো। ওষুধের পাশাপাশি একটা হরলিক্স কিনে খেও।’

    চাঁপাদি হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। রিমির হাত দু’টো ধরে চুমু খেতে শুরু করে। আর বলে ‘আবার কবে আসবে তুমি রিমি দিদি। ততদিনে আমি হয়তো মরেই যাবো।’
    রিমিরও চোখের কোণে জল এসে যায়। জলটুকু লুকিয়ে বলে, ‘এবার আসি আমরা। আবার দেখা হবে।’

  • গল্প

    গল্প- শঙ্খধ্বনি সেদিন দিও

    শঙ্খধ্বনি সেদিন দিও
    – লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    কাল সারাদিন অসহ্য প্রসব যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি হতে হতে প্রায় রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। ডাক্তার জানালেন সিজার করার দরকার নেই নরম্যাল ডেলিভারি সম্ভব। মিতাকে প্রসূতি কক্ষে নিয়ে যাওয়ার পর অতনু একটা ফোন করলো বাড়িতে। রমা দেবীও চিন্তায় অস্থির। ফোন পাওয়া মাত্র তিনি তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করেন,’কী রে কী হলো?’
    অতনু বললো, ‘মা, ডাক্তার বাবু বলেছেন এখনও দেরী আছে। তুমি চিন্তা করো না আমি ঠিক সময় মতো তোমাকে ফোন করবো। অলি এসে গেছে?’
    রমা দেবী জানালেন ‘হ্যাঁ রে এই মাত্র দীপক নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। তোর ছোট মেয়ে তো অলির ছেলের সঙ্গে খেলতে ব্যস্ত। ঠিক আছে বাবা, তুই রাখ এখন।’
    রমা দেবী ফোনটা রেখে হাতজোড় করে মা দূর্গার ফটোর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন, ‘মা গো এবার মুখ তুলে তাকিও। দুই মেয়ের কোলে এবার যেন ছেলে হয় বৌমার। আমি ছেলে হলে নবমীতে জোড়া পাঁঠা বলি দেবো মা।’
    রমা দেবী খেয়াল করেন নি কখন তার পিছনে অলি এসে দাঁড়িয়েছে। পিছন ফিরতেই তাকিয়ে দেখে অলি গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, ‘চল এবার দু’টো রুটি খেয়ে নিবি চল। এসে থেকে তো কিছুই মুখে তুলিস নি। দাদুভাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’
    অলি বলে, ‘হ্যাঁ, আমি ওদের তিনজনকে বিছানা করে দিয়ে এলাম। তোমার বড় নাতনি এখনও পড়ছে আর বাকি দুজন মনে হয় এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। মা তোমাকে একটা কথা বলছি প্লিজ কিছু মনে করো না। তুমি মা দূর্গার কাছে দাদার ছেলে প্রার্থনা না করে মেয়ে প্রার্থনা করতে পারতে।দেখছো তো আজকাল ছেলেদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কত খানি বেড়ে গেছে। আগে মারপিট গুন্ডা বদমাইশি করে বেড়াতো কিন্তু এখন মেয়েদের সঙ্গে অমানবিক কাজ করতেও দ্বিধা বোধ করে না ছেলেরা। যদিও সেই ধরনের ছেলেদের সংখ্যা আজও কম । তবু ভয় হয় আমার বাড়ির ছেলেটা যদি এই রকম কু-সঙ্গে পড়ে যায়। মা গো মেয়েকে যেমন বড়ো হলে আমরা শাসন করি, তার সামনে ভালো মন্দ দিকগুলো তুলে ধরি ঠিক ছেলেদেরকেও সমান ভাবে সেই শিক্ষা দিতে হবে আমাদের। যৌনতা সম্পর্কে আমাদের অপ্রয়োজনীয় গোপনীয়তাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সামনে সংকট হয়ে উঠেছে। যেকোনো বিষয়ে অজ্ঞানতাই অন্ধকার নিয়ে আসে।’
    রমা দেবী এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিলেন। তিনি বিরক্তির সাথে বলেন, ‘তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুই তোর ছেলের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক নিয়ে কথা বলবি? দেখ অলি আমাদের সমাজে এইসব বিষয় গোপন করেই রাখা হয়। এইগুলো প্রকাশ্যে এলে সমাজ ধ্বংস হয়ে যাবে।’
    অলি এবার গলার স্বরকে আরো নিচু করে বলে, ‘কোন সমাজের কথা বলছো মা? যে সমাজ তোমার আমার বাড়ির মেয়ে বউদের সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগায়? একা একটু রাত হলেই বের হতে ভয় লাগে। বাড়ির কোনো পুরুষ মানুষ সঙ্গে না থাকলে বের হতেও পারি না। মা আমরা তো বন জঙ্গলে বাস করি না। আমরা সভ্য সুসজ্জিত আলোয় ঝলমলে শহরে বাস করি। যত না চোর ডাকাতের ভয় পাই তার চেয়ে বেশী ভয় পাই ধর্ষকদের কথা ভেবে। কোথায় কীভাবে ঘাপটি মেরে বসে আছে যার টের পাওয়া মুশকিল। এই ধর্ষকরা তো কারোর না কারোর বাড়ির পুরুষ।’
    এতগুলো কথা বলতে বলতে অলির গলা ভারি হয়ে উঠেছে তার চোখের কোণে তীব্র যন্ত্রণার চিহ্ন স্বরূপ জলও এসে পড়েছে। তবু সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, ‘তোমাদেরকে এসব কথা বলার কোনো মানেই হয় না। চল, চল সামান্য কিছু খেয়ে শুয়ে পড়বে চলো। রাত অনেক হয়েছে। সকালের মধ্যে বৌদির একটা খবর এসে পড়বে।’
    রমা দেবী একবাটি শুকনো মুড়ি দুধে ভিজিয়ে খেয়ে নিজের ঘরে শুতে চলে গেলেন চুপচাপ। অলি কিচেনটা পরিষ্কার করে এঁটো বাসনগুলো একটা গামলায় জল দিয়ে ভিজিয়ে রেখে দিল।

    সকালে ঠিকে কাজের মাসি এসেই জিজ্ঞাসা করে ‘ কী গো বৌদি মনির এবার ছেলে হলো তো?’
    রমা দেবী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, ‘তুই তোর কাজ কর। ছেলে মেয়ে যা হবে ঠিক খবর পেয়ে যাবি।’
    দোতলা থেকে অলির গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কার সাথে যেন কথা বলছে। রমা দেবী চুপচাপ মালা জপে যাচ্ছেন। একটু পরেই অলি নিচে নেমে এসে জানায় ‘মা দাদার একটা সুস্থ বাচ্চা হয়েছে। বৌদির ছেলে হয়েছে মা।’
    ঠিকে কাজের মাসি তো একগাল হেসে বলে ‘শাঁখ বাজাও গো শাঁখ।’
    অলি ঠাকুর ঘরের দিকে রওনা দিলে রমা দেবী বলেন, ‘ আজ থাক। যেদিন এই ছেলে একটি বিপদগ্ৰস্ত মেয়ের সম্মান রক্ষা করতে পারবে সেদিন শঙ্খধ্বনি করিস। আজ নয়।’
    অলি ছুটে এসে রমা দেবীকে জড়িয়ে বলে, ‘মা তুমি যে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তৈরী ভুলে ভরা সংস্কার থেকে  নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছো তা ভেবে আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে কী বলবো। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তোমার মতো জ্ঞান চক্ষুর উন্মোচন সকলের হোক।’

  • গল্প

    গল্প- অবশেষে

    অবশেষে
    – লোপামুদ্রা ব্যানার্জী

     

     

    দেখতে দশটা বছর পার হয়ে গেল। সুজয়ের জন্য একটা মনের মতো পাত্রী জুটল না। সেই কবে এম এ পাশ করা মাত্রই স্কুলের মাস্টারির চাকরিটা জুটিয়ে ফেলেছিল সুজয়। তবুও সে অবিবাহিত। পাত্রীর বাবা দাদারা আজও এসে চলেছে সম্বন্ধ নিয়ে। সুজয়ের মা, বাবা, দিদি, ভগ্নিপতি রবিবার হলেই বেরিয়ে পড়েন পাত্রী দেখতে। তারা তো ইতিমধ্যে গোটা দশেক পাত্রীকে ফাইনাল করে এসেছিলেন। কিন্তু সুজয় দেখতে গিয়ে একান্তে পাত্রীর সঙ্গে কথা বলার পরই পরিস্থিতি যায় পাল্টে। কখনো পাত্রী সুজয়কে নাকচ করে আবার কখনো সুজয় পাত্রীকে।

    হঠাৎই এক সম্বন্ধ এসে জুটেছে সুজয়ের। পাত্রীর বয়স আটাশ। দর্শন নিয়ে পড়াশোনা। উচ্চতা পাঁচ ফুটের কম। স্থূলকায় চেহারা। গায়ের রং শ্যামবর্ণ। গান টান জানে অল্পবিস্তর। মুখশ্রী আহামরি না হলেও মন্দ নয়। সদা হাসিমাখা মুখ। দুইবেলা টিউশনি পড়ায়। মোটামুটিভাবে পরিশ্রমী মেয়ে।
    সুজয়েরও বয়স যথেষ্ট হয়েছে। মাথায় হালকা টাক উঁকি ঝুঁকি মারছে। আত্মীয় স্বজনের কথা এবার খুঁত খুঁত করাটা বন্ধ করে সুজয়ের উচিত বিয়ের জন্য যোগ্য পাত্রী নির্বাচন করা। সুজয়ের বন্ধু বান্ধবরা তো সামনা সামনি সুজয়কে নিয়ে মশকরা করে।
    সবার মনে একটাই প্রশ্ন পাত্রীর সাথে একান্তে সুজয় কী এমন কথা বলে যে তারপর বিয়ে নাকচ হয়ে যায়।

    এবার তাই আর পরিবারের লোকজন আগে পাত্রী দেখতে না গিয়ে সুজয়কেই পাঠালো পাত্রী দেখতে। সুজয় তার ছেলেবেলার বন্ধু মিলনকে নিয়ে পাত্রী শোভাকে দেখতে যায় কোনো এক রবিবারে।
    দোতলার বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে ক্লাস ইলেভেনের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীদের দর্শনের ফেলাসি চ্যাপ্টারটা খুব মন দিয়ে পড়াচ্ছিলো শোভা। হঠাৎ পায়ের আওয়াজ শুনে মুখ তুলে দেখে দুটি অপিরিচীত যুবককে নিয়ে শোভার বাবা দাঁড়িয়ে। শোভার বাবা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে ‘ আমি এনাদের নিচে ড্রইং রুমে বসতে বলেছিলাম। কিন্তু সুজয় বাবাজীবন তোর পড়ানোটা শুনতে চাইছিল।তাই অগ্যতা….’

    শোভা মনে মনে বিরক্ত হলেও ঠোঁটের কোণে হাসি এনে বলে, ‘ভালোই করেছেন। এবার আপনারা দয়া করে ড্রইং রুমে গিয়ে বসুন আমি আসছি এদের ছেড়ে দিয়ে।’ কিছুক্ষনের মধ্যে ড্রইং রুমে এলো শোভা। কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই বলে ‘ আপনাদের যা জিজ্ঞাসা আছে তাড়াতাড়ি করুন। আমার আর একটা ব্যাচ আসবে এখুনি।’
    সুজয়ও সময় নষ্ট না করে বলে, ‘আজকের দিনে টিউশনিটা বন্ধ রাখলে কি খুব অসুবিধা হতো?’
    শোভা বলে, ‘দেখুন এটা আমার পঞ্চান্নতম দেখা শোনা। বিয়ে হবে কিনা এবারও তার ঠিক নেই। টিউশনি পড়িয়ে আমি নিজের হাতখরচাটুকু উঠিয়ে নিই। সেখানে আমি কোনো কম্প্রোমাইজ করতে চাই না।’
    সুজয় বলে, ‘আমি একান্তে একটু কথা বলতে চাই আপনার সঙ্গে। যদি আপনার আপত্তি না থাকে?’
    শোভা কোনো রকম সংকোচ না করে বলে, ‘আসুন। আমার বেডরুমে চলুন।’
    মিলনকে বসিয়ে রেখে শোভার পিছন পিছন সুজয় গিয়ে ঢুকলো শোভার বেডরুমে। সুন্দর ঝিমঝাম গোছানো। খাটের পাশে রাখা চেয়ারটা এগিয়ে দিল শোভা। সে নিজে খাটের ওপর বসলো। হালকা পা দোলাতে দোলাতে বললো, ‘শুরু করুন। আপনার প্রাইভেট কথা।’
    সুজয় শোভার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ দু’টো স্থির করে বললো, ‘আপনার তো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আপনি নিঃশ্চয় প্রেম করেছেন।’
    শোভা তো হতভম্ব! কি বলছে এ! নিজেকে একটু সামলে একটু মুচকি হেসে শোভা বললো, ‘জীবনে বসন্ত তো অনেক এসেছে। দেখতে আমি সুন্দরী নই বলে বিয়ের পিঁড়িতে বসা হয় নি এখনো। তবে প্রেমে পড়েছি বার কয়েক।’
    সুজয় তো হতবাক! এতবছর ধরে সে মেয়ে দেখে বেরাচ্ছে আর এই প্রশ্নটা করা মাত্রই পাত্রী একদম গুটিয়ে পড়তো। আর এই মেয়ে কি অবলীলায় জীবনের সত্যি খানা তুলে ধরলো।

    সুজয় বাড়িতে এসে জানিয়ে দিল শোভাকেই সে বিয়ে করবে। বাড়ির লোকের খুব একটা পচ্ছন্দ ছিল না শোভাকে। তবু সবদিক বিবেচনা করে তারাও বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। সুজয়ের মা তো সবাইকে বলতে লাগলো ‘ নিঃশ্চয় এই মেয়ে অনন্যা। পনেরো বছর ধরে দেখাশোনার পর সুজয়ের এই প্রথম কোনো পাত্রীকে মনে ধরলো।’
    অবশেষে সুজয়ের বউ পাওয়া গেল। শোভার বাড়ির লোকজনও তো হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
    দুই পরিবারই খু্ব খুশি। তবে সুজয়ের বাড়ির সবার মনে একটা প্রশ্ন উঁকি মারতে লাগলো এত বছর একান্তে সুজয় পাত্রীকে কী এমন কথা বলতো যে পাকাদেখাতে এসেই বিয়ের কথা ভেঙে যেতো। কিন্তু এবার শোভা কী এমন উত্তর দিলো যে সুজয় পুরো ক্লিন বোল্ট। শোভাকে পীড়াপীড়ি করতে শোভা তার ননদদের জানায়, ‘তোমার দাদা ভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমি প্রেম করেছি কিনা। আমি বলে ছিলাম হ্যাঁ।’ সুজয়ের দিদি বোন সকলে তো হেসে অস্থির। তাদের কাছে এই কথাটাতে স্পষ্ট হলো রে এতদিনে সুজয় একান্তে পাত্রীকে কি জিজ্ঞাসা করতো। অনেক পাত্রী তো সুজয়কে পাগলও বলে ছিল।

    তবে সুজয় বড়ো খুশি শোভার মতো জীবনসঙ্গী পেয়ে। যার অন্ততঃ সত্যি কথা বলার মতো সৎ সাহস আছে। প্রেম ভালোবাসা কি খারাপ বস্তু যে একে লুকিয়ে বেড়াতে হবে। প্রেমে পড়লেই যে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে বিয়ের পর পরকীয়াতে সুজয়ের যথেষ্ট আপত্তি। সুজয়ের মুখে এই সব কথা ফুলশয্যার রাতে শুনতে বেশ লাগছিল শোভার। শোভা একটু লাজুক অবনত মুখে বললো, ‘তা তুমি কটা প্রেম করেছিলে শুনি।’
    জানলার পাশ থেকে আওয়াজ এলো, ‘ধূস দাদার একটাও প্রেম টেম হয় নি। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেই জানে না। ও করবে প্রেম!’

    তাড়াতাড়ি দরজা খুলে সুজয় দেখে তার তুতো ভাইবোনরা, বৌদিরা সবাই রীতিমত জানলায় কান পেতে বসে আছে। সুজয়ের দরজা খোলা দেখে যে যার মতো দৌড় লাগালো। পড়ে রইলো কেবল মিনু বৌদি। সে কিন্তু না পালিয়ে সোজা ফুলশয্যার খাটে গিয়ে বসলো আর হাসতে হাসতে শোভাকে বললো, ‘সব পুরুষ মানুষ যদি ঠাকুরপোর মতো হতো তাহলে বেশ হতো।’

You cannot copy content of this page