-
কবিতা- গোবর নিকানো হয়নি
গোবর নিকানো হয়নি
-শক্তি পুরকাইতপিঠে বানাবে বলে শিলে
চাল বাটছিল, মা।পুকুরপাড় থেকে এক আঁচল
শাপলা তুলে ভেজা কাপড়ে
দাঁড়িয়েছিল, বোন।বাবার চিৎকার শুনে ‘থ’
‘কে, কোথায় আছিস
তৈরি হয়ে নেওরা এসে পড়বে
এক্ষুনি।’ওদিকে দাউ-দাউ করে পুড়ছে
বামুন পাড়া।মা ছুটে গিয়ে গোয়ালঘরে ঢুকে
গরুগুলোকে সব ছেড়ে দিল
তুলসীতলায় জল ঢেলে
প্রণাম করেতারপর সবাই বেরিয়ে পড়লাম
নৌকায় চেপে, পদ্মা পেরিয়ে
চললাম।বাবার মাথায় ভাঙাটিনের ট্যাঙ্ক
সামান্য কিছু জামা – কাপড় নিয়ে
হাঁটতে হাঁটতে এ দেশে পৌঁছলাম।আঁচের গনগনে ধোঁয়াই
বাবার বুকে শ্বাস উঠলে বলে ‘জানিস
দেশটার জন্য কিছু করতে পারলাম না, রে
বড্ড দেরি হয়ে গেল’
দেশ ভাগের এতবছর পরও
আফশোস করে মা’কে বলতে শুনি
‘ বউমা, শেষবারের মত উঠোনটা একবার
ঝাঁট দিয়ে আসিসঘরটাতে কতদিন গোবর নিকানো হয়নি।’
-
অণু গল্প- দাহ
দাহ
-শক্তি পুরকাইতঅরিত্র ভুলতে পারছে না, যে মা নেই। অফিসে ফোনটা আসায় তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সকালে মা’কে দেখে বেরিয়েছিল। আর নেই। তার চোখ ছল ছল করে ওঠে। অরিত্র কাঁদতে চেষ্টা করে, পারে না । বুকটা খালি করতে। সে এগিয়ে যায়। একটা একটা লাশ দেখতে দেখতে। পাশে ট্রাক, আ্যম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। সামনেই চোখ পড়ে যায় মা’কে দেখে। সবুজ তুলসী পাতা দিয়ে ঢাকা চোখ। বোন অনুষ্কা মা’কে জড়িয়ে ধরে হাউ – হাউ করে কাঁদছে। প্রথম সারিতে মা। কিছুক্ষণ পরে চলে যাবে আগুনে। তাই অপেক্ষা করছে কয়েকটা মিনিট। মা’কে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অরিত্র থাকতে না পেরে চিৎকার করে ওঠে, মা- আ! তখনও বাইরে থেকে ভেসে আসছে শব্দটা — বলো হরি , হরি বোল্ …
-
অণু গল্প- কাটমানি
কাটমানি
– শক্তি পুরকাইত‘অকালে ভাতারের মাথাটা খেয়েছিস, এবার নিজের মেয়েটার মাথাটা খা, বারবার করে বললুম ওই লোকটার সাথে অত পিরিত করিস না, বুঝবি রে সময় হোক!’ উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে শাশুড়ির কথাগুলো শুনছিল মহুয়া। একবছর হল স্বামী নেই। মেয়েটা আট মাসের পেটে। সারা দিনটা মদ খেয়ে এসে মারধোর। বউ প্রতিবাদ করায় গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। সেই থেকে শাশুড়ির এত লাঞ্ছনা- গঞ্জনা শুনতে হয় মহুয়াকে। ঝাঁট দেওয়া থামিয়ে, মহুয়া শাশুড়িকে বলে- মা একটু চুপ করবে? এ সব শুনতে চাই না!
– কেন রে মুখপুড়ি সত্যি কথা বলছি গায়ে ফোসকা পড়ছে, থাক থাক! শাশুড়ি বিড় বিড় করতে করতে ঘাটের দিকে যায়। মহুয়া ভেজা কাঠগুলো রোদে দিয়ে উনান ধরায়। পিছনে দাঁড়িয়ে আভাষপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বিজন ঠাকুর। তাকে অনেকে বিজন প্রধান বলে চেনে। গ্রামের গন্যমান্য লোক। তাই অন্যায় করলেও কেউ কিছু বলে না। সদ্য বিধবা মহুয়া পিছন ফিরে তাকাতেই দেখে দাঁড়িয়ে বিজন ঠাকুর। অঞ্চল থেকে এ বছর মহুয়াও ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘর পেয়েছে। কিছুটা ইট গাঁথলেও পুরোপুরি তুলতে পারেনি। আরও কিছু টাকার দরকার। সে প্রধানকে বলেছিল কিন্তু রাজি হয়নি। মহুয়ার যৌবনের প্রতি লোভ তার সে নিজেও জানে। আজ হঠাৎ স্বয়ং প্রধান সাহেব নিজেই হাজির। সে বসতে বলে। বিজন ঠাকুর শুধু একটা কথা বলে চলে যায় ‘রাতে আসবে কথা আছে ..’ মেয়েকে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে, মহুয়া দরজা খুলে বাইরে বের হয়। শ্রাবণের আকাশ কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি হওয়ায় পথঘাট শুনশান। সে দেখল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বিজন ঠাকুর। চাঁদের আলোয় সামান্য মুখ দেখা গেলেও পুরোপুরি নয়। মহুয়া কাছে আসতেই বিজন ঠাকুর লোভ সামলাতে না পেরে জড়িয়ে ধরে। সে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে। তাকে হুমকি দেয় এ কথা বলে দিলে প্রাণে মেরে ফেলবে। সেই জন্যে চুপ করে থাকে মহুয়া। মৃত্যুর ভয় আর মেয়েকে বাঁচানোর আকুতি। তাকে চুপ করে থাকতে হয়। বিজন ঠাকুর বিবস্ত্র মহুয়ার উপর হিংস্র বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। দূর থেকে মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পায় সে। মাটি থেকে উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই। কোনরকমে টলতে টলতে বাড়ি আসে। সকাল হলে গ্রামের মানুষের কাছে মুখ দেখাবে কী করে! ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকা দিতে না পেরে শেষে নিজের ইজ্জত দিয়ে কাটমানি দিল বিজন ঠাকুরকে। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এ মুখ আর কাউকে দেখাবে না! ঘরের দরজা খুলে মেয়েকে বুকে নিয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে অন্ধকারে ছুটে চলল, মহুয়া। -
অণু গল্প- আবাদের মাটি
আবাদের মাটি
শক্তি পুরকাইতখবরটা সুন্দরী কাকিমা’র কানে পৌঁছতে বেশীক্ষণ সময় লাগে নি। আবাদের মাটিতে আস্ত একটা কঙ্কাল পাওয়া গেছে। অমল কাকা ছ’মাস নিখোঁজ। কোথাও খোঁজ পাওয়া যায়নি। গ্রামের মানুষের ধারণা সুন্দরবনের ভেতরে কাঠ কাটতে গিয়ে হয় বাঘে খেয়েছে, নয় কুমীরে খেয়েছে। যারা এপার থেকে ওপারে যায় অনেকেই ফেরেনি। তাই এই গ্রামটা বিধবা গ্রাম বললেই চলে। গ্রামে পুরুষের তুলনায় বিধবারা বেশী। বাঘে খেলে অনেকে বলে মা বনবিবির কৃপা করেছে, তুলে নিয়েছে। কিন্তু তাদের পরিবারদের মুখে কে অন্ন তুলে দেবে? এই বিধবাদের যৌবনে চরম ভাঁটা পড়ে। নিজেরা কী ভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এটাই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সুন্দরী কাকিমা’র ক্ষেত্রে অনেকটাই এই রকম। খবরটা কানে পৌঁচ্ছতেই আবাদের কাছেই গিয়ে দাঁড়াতেই সবাই চুপ। গ্রামের এক’শ দিনের কাজ চলছিল। খবর পেয়ে স্থানীয় থানার পুলিশ এসেছে। সুন্দরী কাকিমা সবাইকে সরিয়ে দিয়ে কঙ্কালটার কাছে এসে দাঁড়ায়। মাটি খুঁড়তেই কঙ্কালটার সাথে পাওয়া যায় এক পাটি হাওয়াই চটি ও জামার টুকরো। সুন্দরী কাকিমা’র চিনতে ভুল হয়নি, কঙ্কালটা অমলকাকার নিশ্চিত। প্রায় একবছর ধরে চলছিল পারিবারিক একটা জমি নিয়ে খুড়তোতো ভাইদের সঙ্গে চরম বিবাদ। সেই বিবাদের জেরে হয়তো অমলকাকাকে খুন করে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল। এতদিন পর তা প্রকাশ্যে বেরিয়ে এল। পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। আবাদের মাটিতে কোলে তুলে সুন্দরী কাকিমা কঙ্কালটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছ ! গ্রামের মানুষ নির্বাক দর্শকের মত সে দিকে তাকিয়ে রইল। সাদা কঙ্কালটি আসলে হারিয়ে যাওয়া একটা নিরীহ মানুষ, অমলকাকা।
-
অণুগল্প- দরজা
দরজা
– শক্তি পুরকাইত‘বাড়ি ফেরার সময় ছেলেটার জন্য দুধটা এনো?’ পাশের ঘর থেকে কমলিকার কর্কশ কন্ঠস্বর শুনতে শুনতে দয়াময়ের কান একেবারে ঝালাপালা। আগের মত যৌবনও নেই তার। পাশে শুলে কোন হুঁশ থাকে না।দয়াময় আদর করে গায়ে হাত দিলে বিরক্ত হয়ে ওঠে। যৌবন কী সব সময় মানুষের থাকে। এক সময় ভাঁটাও নামে। দয়াময় লোহা কোম্পানীতে কাজ করতে করতে কখন অল্প বয়সে বুড়ো হয়ে গেছে, সে নিজেও জানে না। দয়াময়ের যৌবনের প্রতি লালসা থাকলেও কমলিকার একেবারে নেই। যতদিন যাচ্ছে সে যেন পোড়া কাঠ হয়ে যাচ্ছে। তাই কমলিকার যে কোন কথায় বিরক্ত হয়ে ওঠে সে। দয়াময় আজকাল এ পাড়াতে ও ঢোকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলোকে দেখে মন টানে। এ মাসের মাইনে পেয়ে ভুলে গেছে যে তার বাড়িতে একটা সংসার আছে। মত্ত হয়ে ওঠে শরীরের প্রতি। ব্লাউজের হুক খুলতে গিয়ে দয়াময়ের দু’চোখে ভেসে ওঠে কমলিকার মুখ। ছেলেটার জন্যে দুধ নিয়ে গেলে তবে সে খেতে পাবে। ‘বাবা’ ডাক শুনতে পায় সে। নারী শরীর ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সে যেন একটা ভুল করে চলেছে। যে ভুলের কোন ক্ষমা নেই। বাড়িতে তার অপেক্ষা করছে একজনই মানুষ কমলিকা। সে বাড়ি ফিরলে দরজা খুলে দেবে। সে দাঁড়িয়ে দেখবে শুকিয়ে যাওয়া কমলিকার মুখ। দয়াময়ের দু’চোখ ছল ছল করে ওঠে। সে মনে মনে বলে ওঠে,’কমলিকা দরজা খুলে দাঁড়া, আমি আসছি’ কমলিকা ছাড়া এ দরজা কেউ খুলে দেবে না, তার। একটা দরজার জন্য সে চিরটাকাল অপেক্ষায় থাকবে।
-
অণুগল্প- কালি
কালি
– শক্তি পুরকাইতকালো পিস্তলটা কপালের এক কোনে এমন ভাবে ধরেছে কোন উত্তর করতে পারেনি, স্বাধীনতা সংগ্রামী অখিল জানা। দেশ স্বাধীনের পর আজও এই ভাবে বেঁচে থাকতে হবে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ বছর তা নিজের চোখে দেখল। অনেকবার শাসিয়েও গেছে ‘শালা বুড়ো যদি ও পথে পা বাড়াস, তোর মৃত্যু নিশ্চিত’ এ কথাগুলো বলে চলে গেছে পাড়ার নেতা। এই জন্যে কী ব্রিটিশদের হাতে এত মার খেতে হয়েছে, এত জেল খাটতে হয়েছে! সে লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকে। স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশন থেকে যেটুকু টাকা পায় নিজের সংসারটা কোনরকমে চলে। আজীবন সে অবিবাহিত অর্থাৎ বিয়ে করে নি। গ্রামের কোনো মানুষের বিপদ পড়লে সে এগিয়ে গিয়ে সবার আগে দাঁড়ায়। তাকে চেনে না, এমন কেউ নেই। সে একরকম গ্রামের ভগবান বললে চলে। সবাই তার কথা মানে। আগের মত শরীরে জোরও নেই। শরীরের জোর না থাকলেও প্রতিবাদ করতে ছাড়ে না। প্রতিবছর সে ভোটের লাইনে দাঁড়ায়। কিন্তু এ বছর তার সে আধিকারও নেই। সদানন্দ প্রাইমারী ইস্কুলে ভোটের লাইন পড়েছে। সে জানলা খুলে দেখে সবাই ভোট দিতে চলেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামী অখিল জানার মত অনেকে যেতে পারবে না। এ কোন দেশ! সে জানতে চায়? বার বার নিজের আঙুলের দিকে তাকায়। এ বছর প্রথম তার আঙুলে কালি লাগে নি। যে কালিতে দাঁড়িয়ে আছে একটা দেশ, একটা মানচিত্র।
-
অণুগল্প- কলাবউ
কলাবউ
– শক্তি পুরকাইতআয়নার সামনে দাঁড়ায় তাপসী। নিজেকে দেখে বার বার। শাড়ি পরতে ওকে বেশ মানাচ্ছে। নিজেকে যেন ‘কলাবউ – কলাবউ’ লাগে। সে শাড়িটা কোন রকমে পরে নেয়। ওর জন্য অপেক্ষা করছে গ্রামের অন্য মেয়েরা। সপ্তমীর সকালে ‘কলাবউ’ স্নান করানো দেখবে সে। প্রতি বছর ওর বাবা শহরের কোলাহল থেকে মুক্তি পাবার জন্য গ্রামের এই শান্ত পরিবেশে তার নিজের বাড়িতে এসে পুজো ক’টা দিন কাটায়। আজ নয় বহু দিন ধরে পুজো মানে গ্রামে কাটানো। শহর থেকে গ্রামে পুজো কাটানোর মজাটাই অন্যরকম। কতদিন পর দেখা মানুষের সঙ্গে ভাব বিনিময়। তাপসীর বাবা এটা বেশ করতে পারে। সে শাড়িটা পরে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে ‘কলাবউ’ স্নান করানো দেখতে যায়। তাপসী পিছন ফিরে দেখেনি, যে তার পিছু নিয়েছে ক’য়েকটা বোখাটে ছেলে। সে মেয়েদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টা করতে করতে চলে আসে। ওর সাথের মেয়েগুলোকে লক্ষ্য করে হেঁটে গেলেও সামন্য আড়াল হতে, কে যেন মুখে হাত চাপা দিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। সে চিৎকার করতে পাচ্ছে না। এই গ্রামের সবাইকে সে চেনে না। শহরে থাকতে থাকতে গ্রামের সংস্কৃতি তার অজানা। তাপসীকে মুখে গামছা বেঁধে ধান জমির ভেতর নিয়ে আসে। একটা একটা বস্ত্র করে খুলে নগ্ন করে। তাপসী বলতে চেষ্টা করে, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও’ তার কথা যেন কেউ শুনতে চায় না। বরং হুমকি দেয় চিৎকার করলে গলা টিপে মেরে ফেলবে.. কাদা ধানজমির ভেতর তাপসীর নগ্ন বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দূর থেকে ভেসে আসে ঢাকের ঢ্যাম -কুড়া – কুড় আওয়াজ। মাইকে শোনা যাচ্ছে চণ্ডীপাঠ ‘ইয়া দেবী সর্বভুতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ। তাপসী কাদাজমি থেকে ওঠার চেষ্টা করে, পারে না। এতক্ষণে সবাই পালিয়েছে। সামান্য সামান্য এখনো নিশ্বাস পড়ছে। পায়ের আলতা ধুয়ে গিয়ে লাল হয়ে গেছে জল। সে ‘কলাবউ’ স্নান করানো দেখতে এসে নিজেই ‘কলাবউ’ হয়ে গেল।
-
অণুগল্প- ভাসানের শেষ পদধ্বনি
ভাসানের শেষ পদধ্বনি
– শক্তি পুরকাইতদূর থেকে ভেসে আসছে ঢ্যাম – কুড়া- কুড় ঢাকের বাদ্যি। ঝিঁ ঝিঁ ডাকা অন্ধকারের ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে দুগ্গা মাঈ কী জয়! সুমনাও পাড়ার মেয়ে-ঝিদের সঙ্গে রঙ খেলেছে আজ।
শুভ বিজয়ার শুভেচ্ছা জানিয়ে তাকেও মুখে রঙ দিয়েছে। এত আনন্দের মধ্যেও সুমনা শুনতে পাচ্ছে, একটা বিষন্নতার সুর! একে- একে মঞ্চ থেকে প্রতিমা নামানো হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ পর জলে পড়বে। আবার আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে একবছর পর। সুমনার মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। বেশ কিছুদিন ধরে অমলের সঙ্গে অশান্তি চলছিল। সেই অশান্তিটা আরো জোরালো হয়ে উঠল মেয়েটা হওয়ার পর। অমল কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। ‘কন্যা সন্তান’ যেন অমলের কাছে একটা বড়ো বোঝা। সেই বোঝা যেন শেষ করে দিতে চায়! সুমনা, মা দুর্গাকে বিজয়ার প্রণাম করে, এক ছুটে ঘরে আসে। এক মাসের মেয়েটা ঘুমোচ্ছে। দরজাটা কোনো রকমে খুলে সে বুকে করে নিয়ে অন্ধকারের ভিতর একা ছুটে চললো। এতক্ষণ প্রতিমা জলে ভাসছে। মাটির গা থেকে গলে পড়ছে মাটি। তবুও মুখটা বার বার ভেসে উঠছে সুমনার। সে আজ শুনতে পাচ্ছে ভাসানের শেষ পদধ্বনি। পায়ের শব্দগুলো যেন অন্ধকারে মিশে যাচ্ছে। ফাঁকা রেল লাইনের ধারে এসে দাঁড়ালো। তারপর এক ঝটকায় ঝোপের উপর নিজের কন্যাসন্তানকে ছুঁড়ে দিল। আর্তনাদ করে মেয়েটা কেঁদে উঠল মৃত্যুর কান্না। পিছনে না তাকিয়ে সুমনা ঘরের দিকে রওনা হল। জলভরা চোখে নিজের দুর্গাকে নিজের হাতে বিসর্জন দিল সে! -
অণুগল্প- তালাক
তালাক
– শক্তি পুরকাইতসেই কবে ঘুম ঘোরে আব্দুল, বউ আনজুকে মুখের উপর বলে ফেলেছিল তালাক, তালাক, তালাক …! সে বুঝতে পারেনি রাগের মাথায় এমনটা হবে। বেশ কয়েকদিন সময়টা ভাল যাচ্ছিল না। পারিবারিক একটা অশান্তির মধ্যে ছিল। ‘তালাক’ শব্দটা ওভাবে মুখ ফসকে বেরিয়ে যাবে কে জানতো! সকাল হতে বউ আনজু, ছেলে তানজিরকে নিয়ে সোজা বাপের বাড়ি উঠেছিল। কতবার আব্দুল, আনজুকে আনতে গিয়েছিল সে আসে নি। বরং মুখের উপর বলেছিল ‘তালাক দেবার সময় হুঁশ ছিল না!’ অনেকবার গ্রামে ওদের নিয়ে সালিশি সভা বসেছিল। কিন্তু ফল হল না। আনজু আর ওই সংসারে ফিরতে চায় না। যে মানুষটার মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে ঘুমাতো না। ভাত মাখিয়ে গালে না দিলে খেত না। সে মানুষটা এমন দূরে সরে যাবে আনজু ভাবতে পারেনি। মাঝে মাঝে খবর আসে সে ঠিকঠাক বাড়ি ফেরে না। ফিরলেও মদ খেয়ে টলতে টলতে বাড়ি আসে। সে কোর্টে তার বিরুদ্ধে কেস করেছে। গ্রামের কেউ আনজুর পাশে এসে দাঁড়ল না। সে শরিয়ত বিরোধী কাজ করেছে। আজ সরকারের তিন তালাক বিল পাশ হওয়ায় সবার মুখে হাসি। সে আনন্দের মধ্যেও শুনতে পেল বেদনার সুর। ‘তালাক’ শুধু একটি মেয়ের জীবন নষ্ট করে না। একটি ফুলের মত সংসারও নষ্ট হয়। আনজু, ছেলে তানজিরকে কোলে নিয়ে কোর্টের সামনে এসে দাঁড়াল। ছল ছল চোখে আব্দুলের পথের দিকে চেয়ে থাকল সে।
-
অণুগল্প- রেসের ঘোড়া
রেসের ঘোড়া
-শক্তি পুরকাইতআগের মত আতাউল মোল্লার শরীরটাও ভাল নেই। ঘোড়া দৌড়ের কেরামতি তেমন দেখাতেও পারে না। তবুও প্রতিবছর ডাক পড়ে, মিলনীপুর ছাউনির মাঠে ঈদের মেলাতে। আতাউল মানে দর্শকদের উল্লাস। ছেলে-মেয়েরা ওই একটা দিন অপেক্ষা করে থাকে, তার খেলা দেখবে বলে। ঈদ কমিটির উদ্দ্যোক্তাদের বিশেষ অনুরোধে আবার সে ঘোড়াদৌড়ে অংশ নেবে। তাই সকাল থেকে ঘোড়াকে পরির্চ্চাতে ব্যস্ত। ঘোড়াকে স্নান করানো, ঘোড়ার গা মুছিয়ে দেওয়া। তারপর ভিন্ গাঁ পেরিয়ে প্রতিযোগীতার মাঠে। আতাউলের আজ সব কিছু স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। এর আগে কোনদিনও ঘটেনি। বুড়ো বয়সে সে কী আগের মত প্রথম হতে পারবে। প্রথম হলেই নগদ কুড়ি হাজার টাকা মিলবে। আল্লার কাছে সে কসম করে, হাসপাতালে ভর্তি ছেলেটাকে যেন সুস্থ করতে পারে । ঘোড়া নিয়ে মিলনীপুর ছাউনির মাঠে এসে দাঁড়ায়। সকালের রোদে সাদা ঘোড়ার গা যেন রুপোর ঝালরের মত চক চক করছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, এ বছরও পুরস্কার সে নেবে। খেলার মাঠে যে-যার ঘোড়া নিয়ে দাঁড়ায়। আতাউল ঘোড়া দৌড়ের জন্যে প্রস্তুত হয়। বাঁশি বেজে ওঠে। বাঁশির শব্দ তার বুকের ভিতর কন্ কন্ করে ওঠে। একে একে ঘোড়া ছুটেছে, তির বেগে। আতাউল সবার আগে আগে ছুটেছে। সে দেখতে পেল ধুলোর মত কি যেন সামনে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। আতাউল কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ঘোড়া পা দু’টো মুড়ে ধীরে ধীরে বসে পড়ল। মাঠের দর্শকের চিৎকার ভেসে আসছে। এতোক্ষণে সে বুঝতে পারল আর কোনদিনও প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পারবে না। ঈদ কমিটির লোকেরা ছুটে গিয়ে ঘোড়ার মুখে জল দিল। ঘোড়ার ঘোলাটে চোখ তাকিয়ে থাকল খোলা আকাশের দিকে। মুহুর্তে শেষ নিঃশ্বাস পড়ল মাটিতে। আতাউল চিৎকার করে উঠল, রু-ক-সো -না! তুই চলে গেলি! আমি রেসের মাঠে কাকে নিয়ে ছুটবো? দূরে আতাউল শুনতে পেল, একমাত্র ছেলের কন্ঠস্বর ‘আব্বা আমি আগের মত হাঁটতে পারব তো। আগের মত রেসের মাঠে ছুটবো..’ তার দু’চোখ বেয়ে নেমে এল জল নয়, শেষ বিজয়ের অকৃত্রিম ইচ্ছা ।