-
অণু গল্প- বোন
বোন
– শক্তি পুরকাইতজানলার আড়াল থেকে সেদিন শ্রুতি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিল হাতে তালি দেওয়া। পাশের বাড়ির হরিপদ মন্ডলের ছেলেকে নাচাতে এসে সেই প্রথম দেখল ঢোল বাজিয়ে কেমন করে নাচতে হয়। গান গাইতে হয়। সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল মাসিদের রং ঢং দেখবে বলে। চোখে চোখ পড়তে ওর খবর নিয়ে যায়, ‘মেয়েটা কাদের বাড়ির!’ সে এক ছুটে ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে সারাটা রাত কেঁদেছিল। ইস্কুলে গেলে বন্ধুরাও রাগায় ‘মদ্দালি মেয়ে বলে ডাকে’। সেই থেকে ইস্কুলে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ। লজ্জায় আর ইস্কুলে গেল না। পাড়ায় বাইরে বের হলে লোকে বলে ‘মুখ দেখাস না, কাজটা শুভ হবে না..’ এখন সে হাতে তালি দিতে পারে। ঢোল বাজিয়ে নাচতে পারে। গান গাইতে পারে। কোন কিছু অসুবিধা হয় না, তার। এই কয়েক মাসে কমলামাসি, গোপামাসিদের কাছে রপ্ত করে নিয়েছে। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী সব ভাবছিল, সে কোনদিনও মা হতে পারবে না। স্বামীর সংসার করতে পারবে না। আজ ভাইফোঁটা ঘরে ঘরে বাজছে শাঁখ। বোনেরা, তাদের দাদাদের ফোঁটা দিচ্ছে ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা’ বোন হয়ে সে কোনোদিনের জন্য দাদাকে আর ফোঁটা দিতে যেতে পারবে না। কমলামাসির কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে সম্বিত ফেরে শ্রুতির। সে সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে নেয়। কমলামাসি বলে ওঠে, ‘মাগি, লোকে কী বলবে জানিস না, হিজরে হতে গেলে মাঝের মধ্যে একটু- আধটু কাপড়ও তুলতে হয়’ অরিন্দমের বোন সারাটা জীবন হিজরে হয়ে সমাজে বেঁচে থাকবে। কমলামাসি, গোপামাসিদের সঙ্গে গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে হেঁকে বলে যাবে, ‘ও দিদি তোমাদের ছেলে হল না, মেয়ে হল গো …’ !
-
অণু গল্প – মাছি
অনুগল্প -মাছি
-শক্তি পুরকাইতঘোষালদের বাড়ি আবার একটা শোকের ছায়া এসে পড়লো। গোটা বাড়ি কান্নায় ভেঙে পড়েছে। ঘোষাল বুড়োর একমাত্র ছেলের ডেড বডিটা সবে এসে নামিয়ে দিয়ে গেল শববাহী কাঁচের গাড়ি। উঠোনে শোয়ানো সদ্য মর্গ থেকে আসা ছেলে সুদীপ ঘোষালের মৃতদেহ। এতদিনের আত্ম অহংকার সব ভেঙে চুরমার করে দিল তার। ছেলেকে নিয়ে এত গর্ব করা বোধহয় ভগবানও সহ্য করতে পারেনি। পোষ্ট মর্টেমের পর গোটা মুখটা শতছিন্ন। প্ল্যাস্টিক কাগজে মোড়া ডেড বডিটা। প্রতিবেশীদেরও চোখে জল বাগ মানতে পারেনি। সবাই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে! মানিক চাঁদ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সুদীপ ঘোষাল অল্প দিনে রাজনীতিতে এত দক্ষ হয়ে উঠবে কেউ জানতে পারেনি। তার মত সুবক্তা কলেজে খুবই কম আছে। দুই দলের গোষ্ঠী সংঘর্ষে হাতাহাতি থেকে বোমা ছোঁড়াছুঁড়ি। পিছন থেকে একটা লাঠি এসে পড়ল সোজা সুদীপের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে যায়। দু’চোখে অন্ধকার নেমে আসে। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে। সুদীপকে পড়ে থাকতে দেখে কলেজের অন্যান্য বন্ধুরা ধরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়। মুখে জল দেয়। যতবার চোখ খুলতে চায় বন্ধ হয়ে আসে.. জ্ঞান আর ফেরে না। বন্ধুরা সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। ততক্ষণে কলেজ একেবারে শান্ত। পুলিশ এসেছিল। তেমন কাউকে ধরতে পারে নি। ডাক্তার সুদীপকে মৃত বলে জানিয়ে দিয়েছে। তার মৃত্যুতে কলেজের বন্ধুরাও কান্নায় ভেঙে পড়েছে। সুদীপের মৃত্যু প্রমাণ করে দিল রাজনীতি শুধু দেশকে শেষ করে দেয় না, অনেক মায়ের কোলও খালি হয়। এ ঠাকুরের কাছে মানত করে, ও ঠাকুরের কাছে মানত করে শেষে যদিও সন্তান দিল তাও কেড়ে নিল। ভগবানের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! সাদা কাপড়টা মুখ থেকে সরাতেই ঘোষাল বুড়ো ‘ও বাবা তুই চলে গেলি’ বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। তখনও গাল থেকে গড়িয়ে পড়া গাঢ় রক্তের উপর বসে সমস্ত সম্পত্তির হিসেব- নিকেষ করছে কয়েকটা মাছি আর কিছু নয়।
-
অণু গল্প- লন্ঠন
লন্ঠন
– শক্তি পুরকাইতআঃ আর পারছি না, ছেড়ে দাও! ও এসে পড়বে, ছেড়ে দাও! তখনও অন্ধকার রাতের চাঁদের আলোয় ফর্সা নিটোল স্তনের উপর মুখ দিয়ে রনজয়। এই সুযোগ আর কখনো আসবে না। একুশের যৌবনপ্রবনা শিউলিকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। বুকের একখন্ড শাড়ির আঁচল নৌকার পাঠাতনে পড়ে আছে। ঘুমন্ত শরীর বার বার রনজয়ের হাতের সমস্ত আঙুল স্পর্শ করছিল। নদীর জলে ভেসে থাকা কাঠের নৌকা দু’টি শরীরের দোলনে বার বার দুলে উঠছে। শিউলির মুখের ভিতর ঠোঁট দিয়ে আয়তন মাপছিল সে। সারা শরীর থর থর করে কেঁপে উঠছিল শিউলির। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছিল জল। কিসের জল, সে জানে না। জানতেও চায় না। রনজয়, শিউলির গলার কাছে ঠোঁট বোলায়। একের পর এক সারা শরীরে ঠোঁট রাখে। উরুতে নাভিতে পায়ের পাতায়। কী অদ্ভুত যন্ত্রণা অনুভব করে সে! মাস তিনেক রনজয়, সুকেশের নৌকায় কাজ করছে। শিউলি, সুকেশের বিবাহিত স্ত্রী। শিউলির স্বামীর প্রতি টান না থাকলেও সংসারের গন্ডিতে বাঁধা। মাঝে মাঝে তার মনে হয় এ গন্ডি পেরিয়ে চলে যেতে। কিন্তু কোথায় যাবে! এত বছর বিয়ে হলেও সুকেশ, শিউলিকে খুশি করতে পারে নি। বিয়ের পর থেকে নৌকা- নদী। শিউলির মন কেমন উদাস। এক রত্তি মেয়েটার মুখে হাসি নেই। শিউলি বার বার বলেছিল একটা সন্তানের কথা। সুকেশ উপহার দিতে পারেনি। তাই তার মনে যন্ত্রণা বাসা বেঁধে আছে। পোয়াতি মেয়েদের দেখলে শিউলির হিংসে মা হবার। ভগবান, তার কথা কোনদিন শুনতে পায় না। যে দিন থেকে রনজয়, শিউলিদের নৌকায় কাজ করতে এল, সে দরজার আড়াল থেকে একপলক দেখেছিল সুঠাম শরীর কারগরি কৌশল। সে দিন রনজয়ের চোখের ভাষা পড়ে নিতে শিউলির এতটুকু অসুবিধে হয়নি। এতদিন হয়তো সেই ভাষা পড়ার জন্য অপেক্ষায় ছিল শিউলি। সেই জন্যেই তো ভগবান পাঠিয়েছেন এমন সুপুরুষকে। সবই কপাল! শিউলি রোজ রান্না করে সুকেশ, রনজয়ের জন্যে ভাত নিয়ে যায়। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে রনজয়ের নদীর জলে ভেজা শরীর । মেয়েরা শুধু ভালবাসে নয়, দেখে গোপনে পুরুষের ভেজা শরীরও। সে গোপনে কখন রনজয়কে ভালবেসে ফেলেছিল নিজেও জানে না। আজ এই সুযোগেই দুইজন মিলিত হয়েছে। চাঁদের আলোয় জ্যোৎস্নায় ঘামে ভেজা শিউলির নগ্ন শরীরের ভাষা রনজয় পড়ে নিয়েছে। নৌকার পাঠাতন দুলছে দু’টি শরীরের দোলনে। সাথে সাথে নৌকায় বাঁধা লন্ঠনটাও দুলছে। শ্রাবণের মেঘঘন আকাশ চেয়ে দেখছে পরকীয়া। শিউলি যেন অন্যায় করেছে। সে রনজয়কে বোঝাতে চেষ্টা করে, এ পাপ! ঝিঁ ঝিঁ ডাকা অন্ধকারে সুকেশের কন্ঠস্বর ভেসে আসে। শি – উ – লি! কন্ঠস্বর কানে আসতেই সে ধড়ফড় করে উঠে পড়ে। শাড়ি ঠিক করে নেয়। ভয় জড়ানো চোখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নৌকায় দুলে ওঠা লন্ঠনের দিকে। যেন দু’টো শরীরের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়ে লন্ঠনটা।
-
অনুগল্প- ডাক
ডাক
-শক্তি পুরকাইতবিপ্লবী অমূল্য প্রামানিকের ফাঁসি হয়ে গেছে। দেবজিতের চোখে তার মুখটা বার বার ভেসে উঠছে।জেলের ভিতর সে ঘুমোতে পারে না। উস্ পাশ করে। এক- এক করে সব কয়েদিরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ইস্কুল পড়া ছাত্র সে দিন পিস্তল হাতে নিয়ে ছুটে ছিল ইংরেজ সাহেবকে মারবে বলে। টার্গেট গুলি করা।
প্রথম গুলির শব্দ শুনেছিল সে। তারপর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল সে ধরা পড়েছে। ব্রিটিশ পুলিশ তাকে টানতে টানতে নিয়ে এসে ছিল। দেবজিৎ জেলের ভিতর থাকতে থাকতে কখন সবার আপনজন হয়ে উঠেছিল, সে নিজেও জানে না। জেলার থেকে কারারক্ষী ওকে খুব ভালবাসে। চারিদিকে ভেসে আসছে দেশ মুক্তির গান। সে চিৎকার করে ওঠে, ব-ন্দে-মা-ত-র-ম্! তার চিৎকার শুনে কারারক্ষী ছুটে আসে। বুঝতে পারে, বিপ্লবীদের সঙ্গে আবার মারপিট বেঁধেছে! দেখে দেবজিতের স্থির চোখ দু’টো জেলের অন্ধকারে মিট মিট করছে। দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল। জেলার কাল ওর ছুটি ঘোষণা করে গেছে। দীর্ঘ কয়েক বছর পর কারাবাস থেকে মুক্তি। দেখতে দেখতে কখন সকাল হয়ে গেছে সে জানতে পারেনি। আজ যে তার ছুটি। তাই ছুটির আনন্দটা অন্যরকম। তার সহযোদ্ধারা জিজ্ঞাসা করে, তুই আমাদের ছেড়ে চলে যাবি, তোর সাথে আর কোনদিন দেখা হবে না রে …! সে বলে আগে দেশকে মুক্ত করি, তারপর দেখা হবে ঠিক! সহযোদ্ধাদের চোখে জল দেখে সেও কেঁদে ওঠে। কারারক্ষী গেট খুলে দেয়। জেল থেকে ওর সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে বাইরে আসে। প্রথমে এসে তার নিজের জন্মভূমি গ্রামের মাটিতে পা রাখে। দেখে তার বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। কাকারা তাদের সব সম্পত্তি লিখে নিয়েছে। সে কার কাছে গিয়ে উঠবে। ভেবে পায় না। একজন পড়শি বলে ওঠে, ওরে স্বদেশী ডাকাত এসেছে, গ্রাম থেকে তাড়া ওকে! সে বুঝতে পারে বিপ্লবী মানে একজন স্বদেশী ডাকাত। তাই গ্রামের মানুষের কাছে সন্দেহ! বিপ্লবীদের ডাকের অপেক্ষা না করে আবার সে নেমে পড়ে দেশের কাজে।সে উপেক্ষিত মানুষের কাছে স্বদেশী ডাকাত নামে। জোরে একটা গুলির শব্দ শোনা যায়। অন্ধকারে গা ঢাকা দেয় দেবজিৎ। বিপ্লবী নয়, পালিয়ে যাওয়া একটা স্বদেশী ডাকাত। -
অনুগল্প- ভাত
ভাত
– শক্তি পুরকাইতদাদা শুনছ, একটু বাইরে আসবে প্রধান সাহেব ডেকেছে! দরজার বাইরে চেনা কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ভাতের থালা থেকে খেতে খেতে উঠে পড়ে আকাশ। মাখানো ভাতের থালা ঢাকা দিয়ে দরজা খোলে। রহিম, মেঘনাথ, সুরেশ দাঁড়িয়ে। সে জিজ্ঞাসা করে, এতরাতে প্রধানসাহেব কেন ডাকল? তারা বলল, কিছুই জানি না!
আকাশের মনের ভিতর একটা সংশয় বাসা বাঁধতে থাকে। তবে কী পুরানো হিসেব- নিকেশ মিটিয়ে নিতে চায়! ওদের দাঁড়াতে বলে, আকাশ ঘরে ঢুকে বউ সঙ্গীতাকে বলে, দরজাটা ভেজিয়ে দিও আসতে রাত হবে। ছোট মেয়েটা কখন কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে। একরত্তি মেয়েটাকে দেখলে মায়া হয়। সঙ্গীতা একা থাকে। কতবার বারণ করেছিল, বলেছিল রাজনীতি ছেড়ে দিতে। কে কার কথা শোনে! সঙ্গীতাও আর কিছু বলে না। শুধু স্বামীর ঘরে ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকে। আকাশ চলে যাওয়ায় সঙ্গীতা দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়ে। সারারাত সঙ্গীতার দু’চোখের পাতা এক হয়নি। ভোরের আলো আধো আধো সবে ফুটেছে। সঙ্গীতার দু’চোখের পাতা জলে ভরা। সে মন খুলে কাঁদতে পারে না। স্বামীর না ফেরাই ভয় আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সে বিছানা থেকে উঠে বাড়ির উঠোন ঝাঁট দেয়। তারপর এঁটো বাসনগুলো বাইরে রেখে দেয়। আকাশের না খাওয়া ভাতগুলো থালায় যেমন ছিল, তেমনই আছে। শুধু মানুষটা নেই। দূরে পড়শিদের গুঞ্জন শোনা যায়। বড় রাস্তার ধারে কার একটা লাশ পাওয়া গেছে। শুনে সঙ্গীতার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে কী করবে জানে না। মনকে ঠিক রাখতে পারে না। তবে কী আকাশের কিছু হয়েছে! এতক্ষণে সে বুঝল আকাশ আর এ পৃথিবীতে নেই। প্রধান-সাহেবের দলবল গতকাল রাতে ডেকে নিয়ে গিয়ে আকাশকে খুন করেছে। সঙ্গীতা ঘরের বাঁশের খুঁটি ধরে বসে বসে কাঁদতে থাকে। সকালের সদ্য রোদে আকাশের মাখানো এঁটো ভাতগুলো খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে, কা -কা করে ডেকে যাওয়া এক ঝাঁক কাক। সঙ্গীতা দেখল কাক নয়, যেন হাসি মুখে আকাশ দাঁড়িয়ে। আর হাতের সরু সরু আঙুল থেকে ঝরে পড়ছে অজস্র সাদা সাদা ভাত। -
অণুগল্প- ঘুংঘুর নদীর পানি
ঘুংঘুর নদীর পানি
– শক্তি পুরকাইতবর্ষা শেষ হতে চলল, আকাশে এক ফোঁটাও বৃষ্টি নেই। ঘুংঘুর নদী শুকিয়ে কাঠ। মাটি হাঁ হয়ে আছে। প্রতিবেশীদের চোখে জল। একফোঁটা বৃষ্টির জন্য মানুষের এমন হয়, সওকত মিঞা এ বছর তা সাক্ষী । প্রতিবেশীদের বিপদ পড়লে সে পাশে গিয়ে দাঁড়ায়, এটা নতুন নয়। আগা গোড়াই সে করে আসে। গ্রামে কেউ মারা গেলে একাই মাটি খোঁড়ে। আবার নিজেই মাটি দেয়। সওকত মিঞা ঘর থেকে বাইরে বের হয়। তারপর আকাশের দিকে তাকায় কোথাও এতটুকু মেঘ নেই। বৃষ্টি তো অনেক দূরে। গ্রামের যে কোন বিচার বা সালিশি সভায় ডাক পড়ে তার। ব্রহ্মপুত্র নদীর জলে পলি মাটি বয়ে আনতে আনতে আজ মানচিত্র থেকে ঘুংঘুর নদী নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। ঘুংঘুর নদী আর ঘুংঘুর নদী নেই। তবুও প্রতিবছর ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি নামলে প্রতিবেশীরা দেখত ঘুংঘুর নদীর আসল চেহারা। খড় কুটো পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু এ বছর তা সম্ভবনা খুবই কম। সওকত মিঞার অন্তর কেঁদে ওঠে। গ্রামের মানুষ গরমে হাঁস ফাঁস করছে। এই ভাবে গরম থাকলে গ্রাম উজার হয়ে যাবে। বাগানের শাক সবজি সব শুকিয়ে গেছে।মানুষ খাবে কী! সে যেন এ গ্রামের প্রাণপুরুষ। সকল দায় -দায়িত্ব সব তার। সেই জন্যে তার জন্ম। সওকত মিঞা, আগুন ঝরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, ‘আল্লা এক পসলা পানি দিলি না, মানুষগুলা বাঁচবে কেমনে …’! বলতে বলতে তার মুখের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে যায়। কিছু বলতে চেষ্টা করে। পারে না। দু’চোখে অন্ধকার নেমে আসে। শেষ নিঃশ্বাস পড়ে। প্রতিবেশীরা এসে দেখে সওকত মিঞা মারা গেছে। শেষ বিকেলে ঘুংঘুর নদীর চরে কবর খোঁড়া হয় তার। সওকত মিঞাকে কবরে তুলতেই গ্রামের মানুষ দেখল, আকাশ ভেঙে মুষলধারে বৃষ্টি। এ বছর প্রথম বৃষ্টি। বৃষ্টি নামতেই ঘর থেকে ছেলে-বুড়ো সবাই বেরিয়ে আসে। বৃষ্টি ভেজার আনন্দ উপভোগ করে। আর ঘুংঘুর নদীও হাঁ হয়ে থাকা মাটিতে প্রাণ ফিরে পায়। ঘুংঘুর নদীর পানিতে বইতে থাকে গোটা গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখ । গ্রামের অন্তরালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেন সওকত মিঞা এ সব দেখছে …!
-
অণুগল্প- ছায়া
ছায়া
– শক্তি পুরকাইত‘অকালে মায়ের মাথাটা খেয়ে, আমার হয়েছে যত জ্বালা! বিশ্বরূপকে বার বার বলেছিলুম, এই মা মরা মেয়েটার মুখ চেয়ে একটা বিয়ে কর। আমার তো বয়েস হচ্ছে, ওকে কে দেখবে, কে মানুষ করবে!’ জানলার ফাঁক দিয়ে এতক্ষণ ঠাকুমার কথাগুলো বার বার মনে করছিল, লীনা। ঠাকুমা ওকে বলতো তোকে বিয়ে দিয়েই তবে আমি দু’চোখের পাতা এক করবো। নইলে মরে গিয়ে শান্তি পাবো না, একবিন্দু। সকল সময় তোর সাথে সাথে ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়াবো! ঠাকুমা, মারা গেছে মাস খেনেক আগে। তবু লীনার মনটা কেঁদে ওঠে, ঠাকুমার জন্যে। কিছুই তার ভাল লাগে না। উঠোনে পা রাখতে সে দেখতে পায়, ঠাকুমা এঁটো বাসনগুলো মাজছে। নিম গাছের শীতল হাওয়ার সাথে মিশে যাচ্ছে, সাদা থানটা। ঠাকুমা ডাকছে- লীনা, এই লীনা! সে ছুটে গিয়ে, ঠাকুমাকে ছুঁতে চেষ্টা করে। পারে না। মূহুর্তে সে বুঝতে পারল, তিনি এ পৃথিবীতে নেই। লীনা ‘ঠাকুমা’ বলে কেঁদে উঠল আর এক বার ।
-
অনুগল্প- বাঁক
বাঁক
– শক্তি পুরকাইতবাঁশের তৈরি লম্বা একটা বাঁক। সহজেই বেঁকে যায় বলে নাম বাঁক। তার নিচে ঝুলতে থাকে দু-একটা মাটির ভাঁড়। ভাঁড়ে বাবা মহাদেবের মাথায় ঢালার জন্য নদী থেকে তুলে আনা জল। মধুশ্রী বাঁক কাঁধে নিয়ে হাঁটতে থাকে। ‘বোম্ – বোম্ – বোম্’ বলতে বলতে। সজিত নাসিংহোমে ভর্তি, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। মুখে মধুশ্রী… মধুশ্রী নাম! মধুশ্রী হাঁটতে পারে না। তবুও কোনরকমে হাঁটছে সজিতের বাঁচার জন্য। অনেকটা পথ পেরিয়ে আসে মধুশ্রী। দূর থেকে দেখা যায় বাবা মহাদেবের ঐতিহ্যবাহী সাবেকী মন্দির। মন্দিরের গা বেয়ে নেমে গেছে ছোট ছোট বটের ঝুরি। সারা মন্দিরের পলেস্তরা খসে খসে পড়ছে। মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে মধুশ্রী। কাঁধ থেকে ভারি বাঁকটা নামিয়ে রাখে। বাঁক থেকে খুলে আনে মাটির ভাঁড়, ভাঁড়ে জল । মন্দিরের পুরানো দরজাটা কোনরকমে খোলে সে। পিয়ালী ছুটতে ছুটতে খবর আনে, সজিত মারা গেছে! তখনও মন্দিরের বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে একটাই শব্দ বোম্– বোম্–তারকবোম্!
-
অনুগল্প- আন্দোলন
আন্দোলন
-শক্তি পুরকাইতনাম- রেহেনা বিবি, বয়স- সাতাশ বছর। দ্বিতীয় লাশটার মুখ থেকে কাপড় সরায় সুতনু রায়। হরিদেব পুর থানায় মাস দু’য়েক আগে এসেছে। লাশটা দেখে চমকে ওঠে। বাচ্চাটা যে ভাবে পুড়েছে, তা ভাবা যায় না। চোখের সামনে দাউ -দাউ করে জ্বলছে গোটা বস্তি। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে কেউ বাদ যায়নি। এ-ও ছুটেছে। কেউ সন্তান হারার শোকে কাতর। কেউ স্বজন হারানোর কান্নায় ভেঙে পড়ছে। চারিদিকে শুধু মৃত্যুর ছায়া। এক-এক করে সাজানো কুড়িটা লাশ। মেহের আলিও খুঁজছে তার বউ-বাচ্চাকে। একদিন নতুন ঘর বাঁধার স্বপ্নে সরকারের বিরুদ্ধে পা মিলিয়েছিল। কিন্তু তার বিনিময়ে এই পরিণাম। সে বুঝতে পারে নি, কে বা কারা এ কাজ করতে পারে! এ বছর ঈদে দেওয়া শাড়িটা দেখে চিনতে পারে বউটাকে। পাশে শোয়ানো ছোট মেয়েটা। পুড়ে যাওয়া মা ও মেয়ের নিথর দেহ। সারা শরীর আন্দোলন হতে থাকে তার। সে চিৎকার করে ওঠে, রে – হে – না! পুলিশ টানতে টানতে নিয়ে যায়, মেহের আলিকে।
-
অনুগল্প- ইছামতির কান্না
ইছামতির কান্না
-শক্তি পুরকাইত‘কানাই, এ কানাই..’
চেনা কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে কানাই নৌকা বাইতে বাইতে ঘাটে আসে। সবুজ রঙের শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে পার্বতী। মাথার দু’পাশে চুল লাল ফিতে দিয়ে বিনুনি। কানাই নৌকা বেঁধে দিয়ে উপরে ওঠে। সোজা গিয়ে পার্বতীর পিছনে এসে দাঁড়ায়।
-‘বল,কী হয়েছে, অমন চিৎকার করছিস কেন? চল না, আজ নৌকা নিয়ে ঘুরতে যাই। না, আজ যাব না! মাছ ধরতে যাব। ঘরে একটা টাকা-পয়সা নেই। মাছ না ধরলে খাব কি?’
পার্বতী একটু চুপ থাকে। তারপর বলে,
‘তোর কবে সময় হবে? আমি মরে গেলে!’
-‘না রে পার্বতী, অন্য একদিন যাবো।’
-‘তুই তো রোজ বলিস, অন্য একদিন! চল না … ! যাচ্ছি বাবা, যাচ্ছি! জানিস পার্বতী তোকে না আজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ঠিক যেন আমার বউ।’
-‘সত্যি বলছিস, কানাই। আর একবার বল। ঠিক তোর বউ।’
পার্বতীর কথায় কেমন যেন হয়ে ওঠে সে। ভাবতে থাকে পার্বতীকে বিয়ে করলে কি করে খাওয়াবে। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে কোন দিন আর বাস্তবে মিলবে না। কানাই সামান্য একজন মাঝি। কোনো রকমে মা’কে নিয়ে সংসার চালায়। তাকে এসব বিয়ে-টিয়ে মানায় না। পার্বতী গা ঠেলা দেয়।
-‘কী রে অমন করে কি দেখছিস?’
– ‘না কিছু,না।’
কানাই নৌকাটা খুলে পার্বতীকে ডাকে,
-‘আয়! নৌকাতে বস। পার্বতী কানাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। দেখতে থাকে কানাইয়ের পুরুষালি শরীর। কুঁকড়ানো চুল। কানাইকে যত দেখে পার্বতী বিভোর হয়ে যায়।
-‘কি রে পার্বতী তোর বাড়ির লোক কিছু বলবে না? আমার সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছিস! বললে কী যায় আসে।সে আমি বুঝে নেবো। তোর কিছু হবে না।’
-‘কানাই, এ কানাই তুই কোনদিন কাউকে ভালবেসেছিস?’
-‘হ্যাঁ, কেন আমার মাকে, আমার গ্রামকে, নদীকে। ধ্যাৎ, ও ভালবাসা নয়।’
-‘তবে কোন ভালবাসা?’
-‘ধর, আমি তোকে ভালবাসি, তুই আমাকে।এই ভালবাসা। আচ্ছা কানাই, আমাকে কেমন লাগে?’
কানাই উত্তর দেয় -‘খুব, খুব ভাল।’
ইছামতির নৌকা বাইতে বাইতে বেলা পড়ে আসে। নদীর বুক চিরে ডুবে যাচ্ছে সূর্য। শুধু শোনা যায় জলের মধ্যে দাঁড় টানার শব্দ। ধীরে ধীরে কানাইয়ের নৌকা ঘরমুখো হয়। নদীর পাড়ে টিম টিম করে আলো জ্বলছে, কানাই নৌকা বাঁধে ঘাটে। পার্বতী চুপ করে থাকে।
-‘ কি রে নৌকা থেকে নামবি না। আয়! নামতে ভয় করছে? আয়, আমার হাতে হাত রাখ।’
পার্বতী নৌকা থেকে এক পা না-এক পা ফেলতে সোজা এসে পড়ে কানাইয়ের বুকে। তার নরম ছোঁয়ায় কানাইয়ের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। কানাই জীবনের প্রথম নারী স্পর্শ অনুভব করে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, দু’জন-দু’জনে।
-‘ওঠ পার্বতী, কি করছিস!’ শাড়িটা ঠিক করে নে!পার্বতী উঠে দাঁড়ায়।
দূরে গ্রামের লোকের হো হো শব্দ ভেসে আসে। ভয়ে সে জড়িয়ে ধরে কানাইকে। অন্ধকারে একটা লাঠি এসে পড়ে কানাইয়ের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। রক্তে ভিজে যায়, শরীর। পার্বতীকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। ইছামতির জলে তখনও ভাসছে কানাইয়ের শরীর।