-
গল্প- একান্ত আপন
একান্ত আপন
-শচী দুলাল পালপৌষ মাস।মেঘলা আকাশ। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা মাঠায় রাস্তা দিয়ে আসছিলেন লতা দিদিমণি।
চিরকুমারী লতা দিদিমণি উচ্চ শিক্ষিতা, এক হাইস্কুলে ফিজিক্স টিচার থেকে হেড দিদিমণি হয়ে রিটায়ার করেছেন। ৬ ভাইবোনের সংসারের ঘানি এক হাতে টেনে তাদের সবাইকে মানুষের মতো মানুষ করে, বিশাল বাড়ি করেছেন। বাবার হাত শক্ত করতে সাহায্য করেছেন। নিজের কথা কখনো ভাবেননি। তাই তার বিয়ে করা হয়ে উঠেনি।একুবিংশ শতাব্দীর সমাজে আপনজন দ্বারা একটু ভালোবাসা ভক্তি শ্রদ্ধা ন্যুনতম শিষ্ঠতা ভদ্র আচরণ পাননি।তার বদলে পেয়েছেন ঘৃণা অবজ্ঞা লাঞ্ছনা , অপমান, নিন্দা, ভর্ৎসনা, তিরস্কার গঞ্জনা।
জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি বাধ্য হয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে। এখন চোখে গ্লুকোমা, লিভার নষ্ট, পারকিন্সনে হাতপা কাঁপে,হাড়ের ক্ষয়, অস্টোপুরোসিস,গেঁঠে বাত ইত্যাদি রোগে জর্জরিত। বৃদ্ধাশ্রম থেকে তার অতি নিকটতম এক নাতির সাথে দেখা করে ফিরছে। হঠাৎ তার নজরে এলো
রাস্তার ধারে ঘন বসতিপূর্ণ শহরের মধ্যভাগে প্রধান রাস্তার উপর দুই বিঘা বাগান ঘেরা জমির উপর বিশাল বাড়ি।বাড়ীটির ভিতর থেকে কাশি ও কাতরানির আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালেন। গেট খুলে লন পার হয়ে প্রধান দরজায় উপস্থিত হয়ে দেখলেন দরজার সামনে দুধের প্যাকেট ,খবরের কাগজের স্তুপ। দীর্ঘদিন ঘরে কেউ প্রবেশ করেনি ও কেউ বের হয়নি।দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।কলাপসিবল খোলা।
লতাদি কলিং বেল বাজালেন। সাড়াশব্দ পেলেন না। জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দিলেন। কেউ এসে দরজা খুললোনা।
চিন্তিত মনে লতাদি জোরে জোরে অনেকক্ষণ ধরে ধাক্কা দিলেন, বেল বাজালেন ও ডাকলেন। অনেকক্ষন পর দরজা খুলে টলতে টলতে বেরিয়ে আসলেন মাধব বাবু। রোগক্লিষ্ট শরীর। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। জীর্ণশীর্ণ শরীর।
প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন ভদ্র লোক। লতা দিদিমণি হাত ধরে ধীরে ধীরে ঘরে বিছানায় শুইয়ে দিতে সাহায্য করলেন। কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন
— একি! অনেক জ্বর! কবে থেকে জ্বরে ভুগছেন?
বহু কষ্টে ক্ষীণ স্বরে বললেন
— কবে থেকে তা বলতে পারবো না।তবে আমি মৃত্যু পথ যাত্রী। আমি আর বাঁঁচবো না। আপনি কে?
— সে সব পরে বলবো। এখন বলুন ওষুধ পত্র কিছু খেয়েছেন? কিছু খাবার খেয়েছেন?
— বিছানা ছেড়ে উঠে ওষুধ নেবার সামর্থ আমার নেই।আর খাবার কে খাওয়াবে?
লতাদিদিমনি ড্রয়ার থেকে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট বের করে খাওয়ালেন। কপালে জলপটি দিলেন। দেখলেন ঘরে কোনো খাবার নেই।
বললেন আমি আপনার জন্য কিছু ওষুধ ও পথ্য নিয়ে আসছি। আপনি শুয়ে থাকুন। উঠবেন না।
দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বর্ষণ মুখর সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়লেন ডাক্তারের সন্ধানে।
কোনো ডাক্তার আসতে চাইলোনা। ডাক্তারকে রোগীর বিবরণ বলে ওষুধ, পথ্য পাউরুটি দুধ ফল কিনে নিয়ে আসলেন।জ্বরের ঘোরে দিন কয়েক কাটলো। যমে মানুষে টানাটানি। বিকারে ভুল বকছে। মৃতা স্ত্রীকে স্মরণ করে বলেই চলেছে। জ্যোৎস্না!আমাকে তোমার কাছে নিয়ে চলো। লতাদি অহরহ সেবা শুশ্রূষা করে গেলেন।তার সেবা শুশ্রূষায় ও ঐকান্তিক প্রার্থনায় ঈশ্বর তুষ্ট হলেন।দিন সাতেক পর মাধব বাবু চোখ মেলে চেয়ে দেখলেন তার সামনে সেবারতা এক মহিলার হাত। তার মনে হলো সাক্ষাৎ কোনো দেবি।তার সেবাযত্নে প্রাণ ফিরে পেয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ হলেন। মাধব বাবু বললেন
— আপনি কি কোনো দেবি?
আপনিই কি ঈশ্বর? কে আপনি? কি আপনার পরিচয়?
— আমি দেবি নয় স্যার।আমি এক গার্লস স্কুলের রিটায়ার্ড শিক্ষিকা। আপনার সাথে কখনো সাক্ষাৎ হয়নি।কিন্তু দরজায় নেমপ্লেট দেখে জানলাম আপনি স্কুল শিক্ষক।
আজ মাধববাবু অনেকটা সুস্থ। দিন দুয়েক জ্বর আসেনি।
গরম জলে স্নান সেরে খাওয়ার টেবিলে বসে দুজনে একসাথে খাবার খাচ্ছে। পরিপাটি করে লতাদি রান্না করেছে।
এভাবে আরও দিন কয়েক পর পুষ্টি ও বল সঞ্চার করে স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে মাধব বাবু বললেন
—আমি হাইস্কুলের অবসরপ্রাপ্ত হেডমাস্টার। এই বাড়িটি আমার বাবা করেছিলেন। আমি কিছু সংস্কার করেছি মাত্র। আমার ছেলে অয়ন খুব মেধাবী ছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে প্রথম দশজনের মধ্যে পঞ্চম হয়েছিল। কম্পুউটার সাইন্সে বি টেক। পরে এম টেক। পাড়ায় খুব নাম। আমিও গর্বিত।বিভিন্ন কোর্স করে ও বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি করে অভিজ্ঞতা অর্জন করে এক কোটি টাকার প্যাকেজ অফার নিয়ে এখন সে আমেরিকায়।আমারই বন্ধুর মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছিলাম। খুব ভালো মেয়ে। ওদের এক ছেলেও আছে। বেশ সুখেই আছে। প্রথম প্রথম ফোনে মাঝে মধ্যে কথা বলতো। পরে ধীরে ধীরে ভুলেই গেলো। আমি ফোন করলে বলতো ‘আমি ভীষণ ব্যস্ত বাবা। পরে আমিই কল ব্যাক করবো।
পরে আর তার সময়ই হতোনা। বউমাও আমাদের ভুলে গেলো। সাদের এক রত্তি আমাদের নয়নের মনি নাতিটাকেও কথা বলতে দিতনা। বলতো তার নাকি পড়াশোনার খুব প্রেসার। সেবার অয়নের মা এক কঠিন ক্রিটিকাল রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। মৃত্যুপথযাত্রী জ্যোৎস্না ( আমার স্ত্রী) কথা বলতে চেয়েছিল ছেলে বউমা আদরের নাতির সাথে কিন্তু পারেনি। তার ইচ্ছে ছিল ছেলের হাতে আগুন পেয়ে স্বর্গে যাবে। সে ইচ্ছেও তার পূরণ হয়নি।ছেলে একবার ফোন করে বলেছিল তার নাকি সামনে প্রমোশন, ছুটি সে পাবেনা। সুতরাং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সে আসতেই পারবেনা। অবশ্য কিছু টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল।
সেও আজ বছর পাঁচেক আগের কথা। ছেলে বলেছিল ওখানকার সব বিষয় সম্পত্তি বেচে দিয়ে আমেরিকায় চলে আসতে। আমি বলেছিলাম “আমি নিরুপায়”।
পৈতৃক ভিটে মাটি, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় সজন, আপন দেশ, আপনজন ছেড়ে যেতে মন চাইনি।
— আপনার জ্বরের কথা কাউকে জানিয়েছিলেন? কাউকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
— যতক্ষণ সজ্ঞানে ছিলাম ডেকেছি।কথা বলেছি। অনেক আত্মীয় বন্ধু যাদের সাথে নিত্য দেখা হয়, কথা বলে, তারা কেউ খোঁজ রাখেনি।
কেউ কথা রাখেনি।ফোন করেনি।
— বাড়িতে কাজের লোক? রান্নার লোক?
—তারা তো জ্বর শুনে ভয়ে অনেকদিন থেকে এ মুখো হয়নি।
বাগান পরিচর্চা করার মালি! তারও পাত্তা নেই।
—— আর কোনো আপনজন?
— এতদিনে উপলব্ধি করলাম, আমার কোনো আপনজন নেই।
আপনিই ফেরেস্তা, দেবদূত, এক অতি আপনজন। আপনিই আমার প্রাণ দাত্রী।
আমি শুধু নিজের কথায় বলে যাচ্ছি। এবার আপনার কথা বলুন।
— হ্যাঁ। নিশ্চয়ই বলবো।
কিন্তু তার আগে আপনার পূজোর ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বেলে দিয়ে আসি।
বিশাল দোতলা বাড়িটির বাগানের গাছপালার আড়ালে সূর্য গেলো অস্তাচলে।পাখীদের কলতানে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। শান্ত নিস্তব্ধ মাধব বাবুর গৃহমন্দিরে বহুকাল পরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে উঠলো। নিস্তব্ধতা খান খান করে শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হলো। লতা দিদিমনি পূজার ঘর থেকে ধীর পায়ে বৈঠক খানা ঘরে যাদব বাবুর মুখোমুখি সোফায় বসলেন। আজকের সন্ধ্যায় জীবন সায়াহ্নে দুটি অচেনা প্রাণী। দুই শিক্ষক শিক্ষিকা হৃদয় – মনের কাছাকাছি।
মাধব বাবু বললেন
— এবার আপনার কথা বলুন দিদিমণি।
লতা দিদিমণি বললেন
— আমি ফিজিক্সে এম এস সি পাশ করে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেছি। চার ভাই দুবোনের সংসারে আমিই একমাত্র উপার্জনশীলা। বাবাকে সাহায্য করতাম। ও বোনরা তখন খুব ছোট। সংসারের ভার নিজের কাঁধে নিয়ে সংসার চালিয়ে সঞ্চয়ের টাকায় জমি কিনে বাড়ি করেছি।বাবার মৃত্যুর পর ভাইবোনের বিয়ে দিয়েছি।ভাইদের স্বল্প আয়। একান্নবর্তী বিরাট পরিবার।
— আপনি বিয়ে করেননি?
— সেটা আর হয়ে উঠেনি।সংসার সামলাতে গিয়ে, সংসারটাকে দাঁড় করাতে গিয়ে কখন যেন মেঘে মেঘে বেলা হয়ে গেছে। আমি অবিবাহিতা থেকে গিয়েছি। আমি এখন চিরকুমারীর মর্যাদায় গৌরবান্বিতা।
ভাইবউরা প্রথম প্রথম ঠিক ছিল। পরে তারা আমাকেই অবজ্ঞা করতে শুরু করলো। আমার কর্তৃত্ব মেনে নিত না।
ধীরে ধীরে আমার সঞ্চিত অর্থের উপর কেউ সাহায্য, কেউ অধিকার দাবি করতে লাগলো। আমি অকাতরে তাদের দিয়েই যেতে লাগলাম।
দিতে দিতে একদিন সব ফুরিয়ে আসতে লাগলো। এমনকি বোনদের বিয়েতে সোনার অলংকার দিয়েছিলাম। ভাইবউরাও দাবি করলো আমাদেরও দিতে হবে।আমি ভাবলাম এরাইতো আমার সব আমার আপনজন। দিয়েই দি।
তাস খেলায় তাসের পাতা যেমন বিতরণ করে তেমনি ভাবে সব গয়না গাঁঠি জমানো টাকা সমবন্টন করে দিলাম।
দিতে দিতে আমি হয়ে গেলাম প্রায় নিঃস্ব। যে স্বল্প আয়ের ভাইকে আমি বেশি ভালোবাসতাম যার পরিবারে নিজেকে আপন ভেবে সম্পূর্ণ সঁপে দিয়েছলাম, তাদের ছেলেমেয়েদের কোলে পিঠে মানুষ করলাম। সমবন্টনে সেই ছোট ভাই ও ভাই বউ-এর হলো রাগ।দিনরাত খোঁটা দিতে লাগলো।আমার উপর মানসিক নির্যাতন করতে শুরু করলো।অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করতে লাগলো।
অসুখে বিসুখে চেক আপ করানো ডাক্তার দেখানো কিছুই করতো না। আমি যেন তাদের কাছে গলগ্রহ। এক অবহেলিত অবস্থায় দিন কাটতে লাগলো।
— এতো অমানবিক!
— হ্যাঁ। আমি এক অশনি সংকেত উপলব্ধি করলাম।
— তখন কি করলেন?
— আমি ঠিক করলাম আমি আর সংসারে থাকবোনা। আমি নিজের উপার্জনের টাকায় কেনা জমি, নিজ আয়ের তৈরি বাড়ি ত্যাগ করে এক বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিলাম।
— আপনিতো পেনশন হোল্ডার?
— পেনশনের টাকা যাকে যতো দিতাম তাকে ততটাই এখনো ফোন পে তে পেমেন্ট করে দিই।
— এখনো তাদের টাকা দেন?
— না দিয়ে পারি! তারা যে আমার আপনজন।
এখন কোথা থেকে আসছিলেন?
আপনার এই পাড়ায় অনেকটা দূরে আমার এক বোনের মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তার একটা ছেলে আছে ক্লাস ফোরে পড়ে। তাকে খুব ভালোবাসি।
গতকাল রাতে গিয়েছিলাম। দিনকয়েক থাকবো বলে।বোনঝি লতামাসি লতামাসি বলে খুব খাতির করলে। নাতিটাকে একটা বড়ো দামি খেলনা দিলাম। সে খুব খুশি। তার আনন্দে তার সাথে খেলা করে আমিও কিছুটা সময় কাটালাম।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে একটা ঘরে শুয়ে ছিলাম। পাশের ঘরে বোনের মেয়ে ও তার হাসবেন্ড এর কথা শুনে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো।তাদের কথাগুলি বুকের মধ্যে হাতুড়ির আঘাত দিতে লাগলো।
‘ লতা মাসি এসে আমাদের বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা সব মাটি করে দিল। এখন কতদিন থাকবে? কবে যে বিদেয় হবে বুড়িটা? মরন হয়না। নাতির সঙ্গে ভালোবাসার নাম করে শেষ বেলায় আমাদেরই ঘাড় মটকাবে নাতো? ‘
ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে আমি শাড়ি ছেড়ে বোনঝিকে ডাকলাম। হাতে একটা ভারি প্যাকেট দিয়ে বললাম এটা তোমাদের জন্য। যাও দিন কয়েকের জন্য কোথাও বেড়িয়ে এসো। বোনঝি প্যাকেট খুলে দেখলো অনেক টাকা। লক্ষাধিক। দেখে একদম ‘থ’ হয়ে গেলো।
আমি বললাম। বৃদ্ধাশ্রমে আমার পাশের বিছানায় যে মেয়েটি থাকে সেই মেয়েটির কাল থেকে শরীর খুব খারাপ। আমাকে এখুনি চলে যেতে হবে। আমি ধীর পায়ে ঘর থেকে বের হলাম। বোনঝি নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। আমি আস্তে আস্তে ঘর থেকে বের হয়ে যখন রাস্তায়, তখন পৌসমাসের বৃষ্টি,
আর আমার দুচোখে জলের ধারা মিলেমিশে একাকার। তারপরই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনার রোগ, যন্ত্রণার আওয়াজ পেয়ে আপনার সাথে সাক্ষাৎ।
কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থেকে উভয়ে উভয়ের কথা শুনে তাদের আপনজনদের কথা অনুভব করলেন। খাওয়া দাওয়া শেষে দুজনে দুই আলাদা রুমে থেকে রাত্রিবাস করলেন। সারারাত ভাবলেন। লতা দিদিমণি ঘরদোর সব গুছিয়ে রান্নাবান্না করে ঢেকে রেখে বললেন
— স্যার। আমার কাজ শেষ। আমি আজ চলে যাবো ।এই আমার ফোন নং।
প্রয়োজন পড়লে আমায় ডেকে পাঠাবেন।
— আপনি চলে যাবেন?
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃরাশ সেরে মাধববাবু বললেন
— শুনেছি বন্যার সময় গাছের ডালে একসাথে সাপ ও মানুষ বাস করছে। দুজনেই একই সমস্যার সম্মুখীন।
আমরাও দুজনেই নিরাশ্রয়। এই বিশাল পৃথিবীতে আপনজন খুঁজে পাইনি। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলি।
লতাদি চোখ নামিয়ে বললো —বলুন।
আপনার সাহচর্যে সেবায় যত্নে আমি মুগ্ধ। অভিভূত। ঈশ্বর এতদিন বাদে এক প্রকৃত আপনজন পাঠিয়ে দিয়েছেন।
এবার আমাকে আপনার আপনজন ভাবার সুযোগ করে দিন।
লতাদি মাথা নিচু করে রইলো। কি উত্তর দেবে?
মাধব বাবু বললো
—আমাকে আপনার কোমল হৃদয়ে স্থান দিন।
লতা দিদিমণি চোখে চোখ রেখে বললেন -বেশ
— শুধু বেশই যথেষ্ট নয়। আসুন আমরা আমাদের একাকীত্ব দূর করি। একজন আর একজনকে চিরসাথী করি।
— সমাজ কি বলবে? নিন্দে করবে যে।
— আমরা লিভ টুগেদার হয়ে জীবন যাপন করতে চাই।
— এ এক গভীর সমস্যা।
— ঠিক আছে। তাহলে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা যদি দিই।
— সারাজীবন অবিবাহিতা থেকে এই শেষ বেলায় বিয়ে!!! অসম্ভব। লোকে কি বলবে?
— লোকে আবার কি বলবে? তাছাড়া আমরা তো এই বয়সে দেহের টানে বিয়ে করছি না।
লতাদি মাথা উঁচু করে বললো
—-আপনজন খুঁজতে গিয়ে যা দেখলাম। সমাজ সংস্কার তো আমাদের কথা ভাবেনি। আমাদের দিকে তাকাইনি। এখন আমাদের নিষ্কাম ভালোবাসার স্বীকৃতি দিক বা না দিক আমরা ঘর বাঁধবো।
— আমরা ভাববো এই বয়সে শরীর নয়। চাই আপনজন।
— আমি ভাবছি এই বিশাল সম্পত্তি ও বাড়ি কোনো মিশনের স্কুলকে দান করে দেব। সেখানে আমাদের জীবিত অবস্থাতে স্কুল হবে। ছাত্র ছাত্রীরা শিক্ষালাভ করবে। তারাও হবে আমাদের প্রকৃত আপনজন।
— আমি আপনার পরিকল্পনায় সহমত। এই বিশাল সম্পত্তির উপর দুটি মাত্র রুম নিয়ে আপনি আমি প্রকৃত আপনজন ভেবে জীবনের শেষ কটা দিন কালাতিপাত করবো।
—– এই বিশাল সম্পত্তির সিংহদ্বারে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে “একান্ত আপন”।
— আর আমাদের দুজনের হৃদয় মন্দিরেও লেখা থাকবে । -
গল্প- নিরঞ্জন
নিরঞ্জন
-শচী দুলাল পালবিজয়া দশমীর রাত্রি,বিসর্জনের পথে মা দূর্গা। আবালবৃদ্ধবনিতার শোভাযাত্রা চলেছে শহরের প্রধান রাস্তা দিয়ে গঙ্গার ঘাটে। ব্যান্ড পার্টি, আলোক সজ্জায় ধুনুচি হাতে যুবক যুবতীরা নৃত্য করছে। কেউ ভাং, কেউবা কোল্ড ড্রিংকস এর সাথে মদ মিশ্রিত পানীয় খেয়েছে। রাস্তার দুপাশে জনতার সারি। ঘরদোর ছেড়ে সবাই আজ রাস্তায়। অর্ঘ্য নামে একটি মেধাবী ছেলে সেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে শোভাযাত্রার আনন্দ উপভোগ করছিলো। হঠাৎ নাচের দল থেকে কয়েকজন বন্ধু অর্ঘ্যকে হাত ধরে টেনে নাচের দলে ঢুকিয়ে নিলো। সে নাচ জানেনা, অনিচ্ছাকৃত ভাবে তাদের সাথে পা মিলাতে লাগলো।
সেই নাচের দলে ছিল ভীরা নামে একটি ছেলে- তার সহপাঠী। ভীরা হিংসুটে ও দুষ্টু প্রকৃতির ছিল। অর্ঘের উন্নতিতে তার জ্বলন হতো। গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে যথারীতি মা’কে বিসর্জনের জন্য প্রতিমার জলে ভাসানের উদ্যোগ চলছে । অর্ঘ্য তীরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে দেখছে। হঠাৎ দেখলো পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ভীরা। ভীরা তাকে এক ধাক্কা দিতেই জলে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলো। ভীরা তাকে বাঁচাবার ছল করে কিছু একটা দিয়ে তাকে আঘাত করলো। কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। সবাই চোখের সামনে দেখলো একটা ছেলে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে । কিছুক্ষণ পর সে জ্ঞান হারালো। বিসর্জনের যাত্রীরা কেউ তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গেলো না। কে নিজের জীবন বিপন্ন করে ডুবন্তকে বাঁচাতে যাবে? তারা সবাই ধরে নিলো বিসর্জনের রাতে অর্ঘ্য ভেসে গিয়ে মরে গেছে।
জলের স্রোতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ভাসতে ভাসতে সবার চোখের আড়ালে চলে গেলো দূরে, বহূদুরে। শহরের এ প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে দ্রুতগতিতে সংবাদ সম্প্রচারিত হলো। অর্ঘ্য নামে একটি যুবক প্রতিমা বিসর্জন করতে গিয়ে ভেসে গেছে। অর্ঘ্যের মা-বাবা ও পরিবারের বুক ফাটা আর্তনাদে গঙ্গার ঘাটে ঘাটে হাহাকার ছড়িয়ে পড়লো।
কোনো এক গঙ্গা তীরে বড়ো বড়ো বট অশ্বত্থ গাছের সমারোহ। বেশ ছায়া সুশীতল গাছ গাছালীতে ভরা এই স্থানটি। গঙ্গাধারে পর্ণকুটিরে জোনাই নামে একটি বছর পনেরোর কিশোরী তার মা বাবার সাথে থাকে। অন্যদিন বেশ বেলায় ঘুম থেকে ওঠে। আজ অজানা কারণে সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেছে। পুব আকাশে সূর্য উদয় হচ্ছে। তার রক্তিম রশ্মিতে জল লালে লাল। গঙ্গা তীরে গিয়ে নির্মল বাতাসে জলের দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ দেখলো প্রতিমার কাঠের কাঠামোর টুকরোর উপর কি একটা ভেসে আসছে। রক্তাক্ত দেহ। ভাসতে ভাসতে দেহটি এক্কেবারে তার সামনে এসে থামলো। দূর থেকে মৃতদেহ মনে হলেও সামনে এলে সে অনুভব করলো দেহ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, ছটফট করছে। জোনাই দেখলো বিসর্জিত দূর্গাকাঠামোর টুকরোর উপর ভাসমান যুবকটির প্রাণ আছে। সে যুবকটিকে জল থেকে তুলে নিজের যথাশক্তি দিয়ে ডাঙ্গায় তুললো। পেটে চাপ দিয়ে জল বার করলো।ধীরে ধীরে ছেলেটি প্রাণ ফিরে পেলো। অবসন্ন শরীর। কথা বলার ক্ষমতা নেই। জলে সাঁতার, মাছ ধরা, নিজের এক টুকরো বাগানে কাজ করা শক্তিশালী জোনাই নিজের শরীরে ভর নিয়ে যুবকটিকে ধীরে ধীরে নিজের কুটিরে নিয়ে এলো। গরম দুধ খেতে দিলো। সেবা পথ্য দিয়ে শরীরে প্রাণসঞ্চার করলো। যুবকটি চোখ মেলে চেয়ে দেখলো সেবারতা এক কিশোরীর হাত তার কপালে। ধড়ফড় করে উঠে বসতে গিয়ে অবসন্ন দূর্বল শরীরে অক্ষম হয়ে পড়ে গেলো। জোনাই যুবকটিকে বলল- তুমি দূর্বল। মাথায় চোট লেগে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে। তোমাকে এখুনি হাসপাতালে ভর্তি করা প্রয়োজন। তোমার নাম কি? বাড়ি কোথায়? তোমাকে এক দেবীপ্রতিমার কাঠের কাঠামোর টুকরোর উপর গঙ্গা জল থেকে উদ্ধার করেছি।
ছেলেটি তার স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়েছে। কিছুই মনে করতে পারছে না। বলল- আমি কিছু মনে করতে পারছি না?
হাসপাতালে দিন কয়েক থেকে যুবকটি সুস্থ হলে জোনাই তাকে ঘরে নিয়ে এলো। জোনাই-এর বাপ দিনমজুর। সবদিন কাজ থাকে না। চুল্লু খেয়ে ঘুমায়। মা অন্যের বাড়িতে বাসন মাজে। ঝিয়ের কাজ করে।
গরীবের সংসার। বাপটা একদিন চুল্লু খেয়ে মেয়ের উপর চড়াও হলো- আর কতদিন গলগ্রহটাকে পুষবি? ওর মাথার ঠিক নেই। নিজের নাম ঠিকানা বলতে পারছে না।-না পারুক। একদিন না একদিন সে নিজেকে চিনতে পারবে।
-তাতে তোর কি লাভ?
-লাভ ক্ষতি আমি কিছু বুঝিনা। একজন মুমূর্ষুকে প্রাণ ফিরে পেতে সাহায্য করেছি তাই নিজেকে ধন্য বলে মনে করছি। আমি ওকে আমাদের ঘরেই রাখবো। ওকে এখনি ছেড়ে দিলে ক্ষিদে তৃষ্ণায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে।
-আমরাই বা কোথা থেকে যোগাবো তার ভরণপোষণ?-আমার খাবারের আর্ধেক আমি ছেলেটিকে খাওয়াবো।
-তার মানে তুই ছেলেটিকে এখানেই রাখবি? সেটা আমি কিছুতেই হতে দেব না। লোকে কি বলবে?
-যে যাই বলুক আমার কিছু যায় আসে না। যতদিন না তার পূর্বস্মৃতি মনে করতে পারছে ততদিন আমি তাকে দেখবো। সংসার চালাতে তোমাদের যদি কষ্ট হয় আমি কাজ করব। উপার্জন করব।
মা রান্না করতে করতে এসে বললো- তোদের বাপ বেটির সব কথা শুনেছি। ঠিক আছে কাল থেকে তুই কাজে লাগ। সামনের উর্বর জমিটায় সবজি লাগা। গতর খেটে উপার্জন কর।
সবজি বেচে দু’ টাকা আয়ও হবে। আমিও না হয় দু’বাড়ি বেশি ঠিকে ঝির কাজ করব।
এভাবেই থাকতে লাগলো ছেলেটি। তারা নাম দিল দূর্গাপদ।
কয়েক বছর এভাবে কাটলো। জোনাই এখন অষ্টাদশী। দূর্গাপদ শহরে এক প্রোমোটারের অধীনে নির্মিয়মান ফ্ল্যাটে কর্মীর কাজ করে। জোনাইএর মা’কে সে মা বলে। বেতনের সব টাকা মায়ের হাতে দিয়ে দেয়। একদিন তাদের অবস্থা সচ্ছল হলো। কাজকর্মে নিষ্টা, সততা, সরলতা দেখে প্রমোটার তাকে সুপারভাইজার পদে প্রমোশন দিলেন। দূর্গাপদ এখন উচ্চ আয়ের প্রমোটারের শ্রেষ্ঠ সেবক হলো। বেতনের টাকায় পাকা বাড়ি তৈরি করে দিল।
জোনাই, দূর্গাপদ একে অপরকে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় পরিণত হলো। তারা দিনান্তে প্রায়ই গঙ্গাতীরে শানবাঁধানো ঘাটে বসে গঙ্গার অপূর্ব শোভার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা দুজনে নিজেদের ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে।কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না।
একদিন খবরের কাগজের চপ ভাজা সহযোগে ঠোঙায় ঝালমুড়ি খাচ্ছে। বহুবছর আগে এক ছবি সহ বিজ্ঞাপন দেখে জোনাই চমকে উঠলো। “অর্ঘ্য নামে এক যুবক দূর্গা বিসর্জনের রাতে হুগলির ঘাট থেকে জলে ভেসে গেছে। তার মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া যায়নি। কোনো সহৃদয় ব্যাক্তি সন্ধান পেলে নীচের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে বাধিত হবো।”
ঝালমুড়ি খাওয়া হয়ে গেলে জোনাই ঠোঙাটি সযত্নে লুকিয়ে রেখে দিল।
সে ভাবতে লাগলো এ তো সাধারণ ছেলে নয়। যদি সে এখনই তার পরিবারের হাতে তুলে দেয় দূর্গাপদকে তাহলে সে হাতছাড়া হয়ে যাবে। আশংকায় তার দিন কাটতে লাগলো।
সারারাত তার ঘুম আসে না। একদিন মধ্যরাতে জোনাই দূর্গাপদর রুমে গিয়ে
ইতস্তত করতে করতে দূর্গাপদর কপালে এক গভীর চুম্বন করলো। দূর্গাপদ প্রথম নারী স্পর্শ পেয়ে ধড়ফড় করে ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে দেখলো জোনাই তার সামনে দাঁড়িয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
-এ কি!জোনাই তুমি কাঁদছো কেন?
কি হয়েছে?
জোনাই দূর্গাপদকে জড়িয়ে ধরে বললো- আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।
-সে তো আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। কথাটা এতদিন মুখফুটে বলতে পারিনি।-কথা দাও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না!
-তিন সত্যি করে বলছি আমি তোমায় ভালোবাসি। তোমাকে আমি বিয়ে করবো। আমার হৃদয়ের মনিকোঠায় তোমায় স্থান দিয়েছি। সে স্থান চিরস্থায়ী থাকবে।
একে অপরকে জড়িয়ে ধরে রাত্রি অবসান হলো দূরে কোথাও ভোরের পূজার ঘন্টা ও শঙ্খ ধ্বনি হলো।
আজ বিজয়া দশমী। গঙ্গার ঘাটে ঘাটে বিসর্জনের বাদ্যি বাজছে। গঙ্গাতীরে উপচে পড়া ভীড়।
দূর্গাপদ – জোনাই সুন্দর পোশাকে বিসর্জন দেখতে গেছে। তারা দুজনে হাত ধরাধরি করে একপাশে দাঁড়িয়ে দূর্গা মায়ের বিসর্জন দেখছে। হঠাৎ পা পিছলে দুজনেই মায়ের কাঠামোর উপর পড়ে গেলো। শক্ত কাঠামোয় দূর্গাপদর কপাল ফেটে রক্ত ঝরতে লাগলো। কে বা কারা যেন তাদের ডাঙায় নিয়ে এলো। জোনাই বললো- তোমার নাম “অর্ঘ্য”।
সাথে সাথে দুর্গাপদর পূর্বস্মৃতি মনে পড়তে লাগলো।
হ্যাঁ। আমি অর্ঘ্য। আমিই দূর্গাপদ। তুমি আমার বাকদত্তা স্ত্রী।
এসো বিসর্জনের এই পুণ্য লগ্নে তোমাকে বরণ করি। অর্ঘ্য তার রক্তাক্ত কপালের রক্ত দিয়ে সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিলো।
ঢাক ঢোল কাঁসরঘণ্টা শঙ্খ ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত হলো।
জোনাই মোবাইলে সেভ করা ফোন নম্বরটিতে ফোন কল করে বললো- এই নাও তোমার নিজের মা বাবার সাথে কথা বলো।
অপর প্রান্ত থেকে নারী কন্ঠ ভেসে আসলো।-মা! আমি তোমার ছেলে অর্ঘ্য বলছি। আমি বেঁচে আছি মা। আজ রাতেই আমি আমার সদ্য পরিণীতা নববধূকে সাথে নিয়ে বাড়ি আসছি। তোমরা বরণডালা সাজিয়ে রেখো।