-
মুক্তগদ্য- নেকুমুনুপুষু
নেকুমুনুপুষু
-শম্পা সাহা“আমার বর না একদম মেয়েদের কাজ করা পছন্দ করে না, শ্বশুর বাড়ি ও তাই!”
“তা বলে এতো ভালো চাকরিটা ছেড়ে দিবি?”
“দেখ ভালো থাকার জন্যই তো চাকরি করা, তাহলে যদি ওর রোজগারে দিব্যি সংসার চলে যায় তবে আমি আর কেন বেরোতে যাবো? আর তাছাড়া আমি বেরিয়ে গেলে সংসার কে দেখবে?”
“কেন এতোদিন যারা দেখতো! তারাই দেখবে! তাছাড়া তোর শাশুড়িও তো চাকরি করতেন!”
“সেই জন্যই বিয়ের পর চাকরি ছাড়তে হবে বলেছিল সুব্রত। আসলে ও বলে, ‘মা বাড়িতে না থাকায় ওদের দু’ ভাইকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে!’ আর তাছাড়া শাশুড়িও হাউস ওয়াইফ বৌমাই চাইতেন।”
“তাহলে উনি কেন ছাড়েন নি?”
“বাদ দে তো, এই বেশ আছি! কেন ফালতু ফালতু খাটতে যাবো? অন্য কথা বল।”
সুনীতার কথায় এষা বেশ বিরক্ত। ওর বর ব্যাঙ্কের বড় চাকুরে আর ও তার আদুরে বউ।
সুনীতা একটু দূরে যাওয়াতে, এষা মুখ ব্যাঁকায়, “হুঃ,নিজের বরের মুরোদ নেই বউকে সুখে রাখার, আর বড় বড় নারীবাদী কথা!”
পার্লারে চেয়ারে শুয়ে রীণিতা! পাশে দাঁড়িয়ে অ্যাটেন্ডেন্ট মেয়েটি কাঁচি হাতে বিরক্ত, কারণ রীণিতা তখনও সুজয়ের কাছে ডিরেকশন নিচ্ছে,
“কি কাট্ করি বলো তো? লেয়ারে মানাবে আমাকে? ও আচ্ছা! যদি না মানায়! এ বাবা, যাঃ! আমার এই পাতলা চুলে স্টেপ মানাবে? আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক তো? আচ্ছা, রাখি? “
ফোন কেটে গেল। রীণিতা গদগদ মুখে জানায়, স্টেপই করো, ও বলেছে। বলার সময় মুখ থেকে একটা আদুরে জ্যোতি বেরোচ্ছে যেন!
মেয়েটি মনে মনে ভাবছে, এই পাতলা চুলে ভদ্রমহিলাকে মোটেই স্টেপে ভালো লাগবে না! ভদ্রমহিলা তো বেশ শিক্ষিতা বলেই মনে হচ্ছে, তবু?
পার্টিতে এসে শ্বেতা এক কোণে দাঁড়িয়ে। একটা স্লিভলেস গাউন পড়ে। ওকে দেখে হৈ হৈ করে ওঠে বৈশাখী। ওর নিজের পরনে একটা দারুণ সালোয়ার। ওকে মানিয়েছেও ভীষণ।
“কি রে, এভাবে দাঁড়িয়ে কেন?” ওরা কলেজে একসাথে পড়াশোনা করতো, এখন আবার সহকর্মীদের স্ত্রী। তাই বন্ধুত্ব বেশ গাঢ়।
“দেখ না, এই বিটকেল গাউন পড়ে একটুও নড়তে পারছি না!” শ্বেতা বিরক্তি প্রকাশ করে।
“তাহলে পড়েছিস কেন?”
“দেখ না কৌশিক এতো সখ করে আনলো!”
“ঢং, তোর ভালো না লাগলে পড়লি কেন?”“না, রে ও বললো, সোনা তোমাকে খুব ভালো লাগবে!”
শ্বেতা বেশ গর্বিত। বৈশাখী অবাক, “পছন্দ না হলে সাফ জানিয়ে দিবি।”
“না রে ওকে না বলতে আমার খারাপ লাগে!” শ্বেতা বেশ একটা শ্লাঘা বোধ করে কথাগুলো বলতে।এক গা গয়না, ভারী একটা বেনারসি পরে দেবযানীও বেশ জবুথবু। কিন্তু শাশুড়ির কড়া নির্দেশ, ননদের বিয়ে, সব বউরা যেন সব গহনা লকার থেকে বের করে পরে। মুখার্জী পরিবারের ঐতিহ্য বলে কথা!
নাকে নোলক পরে দেবযানী বেশ অস্বস্থিতে, তবু বেশ ভালো লাগছে, বেশ একটা আলাদা ফিলিং, বেশ রাণী রাণী লাগছে।
ছোট জা কলেজে পড়ান বলে যা ঘ্যাম! দেখো শাশুড়ির কথাও অমান্য করে! গহনা বলতে ওই গলায় একটা পাতলা টিং টিং এ হার, আর কানে ছোট দুল! ছোট লোকের মেয়ে কি বলে সাধে! যেমন ভিখিরি বাড়ির মেয়ে তেমন চাল। কুকুরের পেটে কি ঘি সয়?
জায়েরা- বড়, মেজো, সেজ, ছোট বৌকে তাদের দল থেকে বাদ দিয়ে নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত ছোট বৌ এর নিন্দা করতে।
এই চিত্রও আমাদের বেশ পরিচিত। আমরা যতই নারী স্বাধীনতা নিয়ে চিৎকার করি, যতই বলি পুরষরা আমাদের দমিয়ে রাখতে চায়, আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান করে না, মূল্য দেয় না, আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দ্বারা নিপীড়িত, সত্যি কি সব ক্ষেত্রে তাই? আমাদের এই বশংবদ হয়ে থাকার ইচ্ছেও কিছুটা দায়ী নয়?
আমি এক উচ্চ শিক্ষিতা মহিলাকে বেশ সুরেলা গলায়, ন্যাকা ন্যাকা সুরে বলতে শুনেছি, “আমার ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট, এ টি এম কার্ড, স্যালারি অ্যাকাউন্ট নাম্বার সব ও জানে, আমি ওসব কিছুই বুঝি না?” এই কথা বলতে বলতে তিনি যেভাবে চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে সবার প্রতিক্রিয়া দেখছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল যেন তিনি বিশ্ব জয় করেছেন! বলতে ভুলে গেছি, তিনি একজন শিক্ষিকা!
আমাদের সামাজিক অবস্থান নিয়ে কে দায়ী? কেন এ দেশে এখনো আমরা সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন, এ জন্য কারা প্রকৃত দায়ী এবং কতোটা, তা নিয়ে কি এখনো সন্দেহ আছে?
আমরা দোষারোপ না করে, পারি না কি নিজেদের মানসিক অবস্থাকে সুদৃঢ় করতে? এক দিনে হবে না জানি, কিন্তু চেষ্টা তো করাই যায়?
-
অণু গল্প- সংগ্ৰাম
সংগ্ৰাম
-শম্পা সাহা“ধ্যাৎ ভাল্লাগে না। রোজ রোজ মাম্মাম এক খাবার দেয়। ধুর্!’
ব্যাপ্তি ওর টিফিন বক্সটা বাড়ি ঢোকার আগে যে মোড়টা পরে সেই মোড়ের রাস্তায় রাখা ডাস্টবিনে উপুড় করে। তার আগে অবশ্য এদিক ওদিক দেখে। কেউ দেখছে না তো?
ডাস্টবিনটা এমনিতেই উপচে পড়ছে। কিছু পড়লো ভেতরে। কয়েকটা আঙুর, আর একটা স্যান্ড উইচ গড়িয়ে গিয়ে পড়লো একটু দূরে।
আসলে আজ অভিলাষার জন্মদিন উপলক্ষে সবাইকে চিকেন মোমোর প্যাকেট, কেক আর চকলেট দিয়েছে। ওর পাপা ইয়া বড় গাড়ি করে সব ড্রাইভারের হাতে পাঠিয়েছে। এটাই ওদের স্কুলের রীতি। সবাই যে যার জন্মদিনে ট্রীট দেয়। ব্যাপ্তিও দিয়েছিল।
ওকে বাসটা মোড়ে নামিয়ে দিয়ে যাবার পর প্রায় দিনই এভাবে ও টিফিন বক্স উপুড় করে। আসলে ওর পাপা আর মাম্মাম দুজনেই ডাক্তার। তাই বিজি। ওকে বাসেই আসতে হয়। আর বাড়ি ঢুকেই সুরূপাদি ওকে খাওয়াতে বসবে। ও না খেলে সুরূপাদিকে মাম্মাম খুব বকে। তাছাড়া তিনমাস অন্তর অন্তর পাপা নিজে ওর ওয়েট চেক করে। তাই স্কুলে ফ্রেন্ডদের থেকে কিছু খেলে আর পেটে টিফিন খাবার জায়গাই থাকে না!
ও কিছুদূর এগিয়ে যেতে দুটো নেড়ি কুকুর আর একটা মানুষের মধ্যে লড়াই শুরু হল। মানুষটা শুধু দেহাবয়বে মানুষের মত। এগিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো স্যান্ড উইচের ওপর। বাঁ হাতে একটা ঢিল ছুঁড়ে দিল কালো কুকুরটার দিকে! মোক্ষম জায়গায় লেগেছে! বেশ বড় ঢিল! কেঁউ কেঁউ করে কালোটা পালাতে ঘেয়োটাও ওর পেছন পেছন দৌড় দিল। ওরা বুঝে গেছে এই অসম লড়াইয়ে ওদের জেতবার সম্ভাবনা নেই।
চোখ বুজে, দাঁড়িগোঁফের জঙ্গলে ভরা মুখটা হাঁ করে একটা বিরাট কামড় মেরে চিবোতে থাকে মহার্ঘ্য খাবার আর অন্য হাত মাছি তাড়ায়।
ব্যাপ্তি ততক্ষণে বাড়িতে পৌঁছে ফ্ল্যাটের বেল টিপেছে। ওর পেছনের সংগ্ৰাম ওর অজানাই!
-
গল্প- বাগান
বাগান
-শম্পা সাহাশ্বাশ্বতী রায় জীবনটা শুরু করেছিলেন আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতই। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, তারপর বাংলা অনার্স আর তারপর ভালো চাকুরে দেখে বিয়ে।
সাধারণ চেহারার মধ্যেও শ্বাশ্বতীর কোথাও যেন বিশেষ একটা কিছু ছিল ওই যাকে বলে এক্স ফ্যাক্টর। তাই শ্যামলা শ্বাশ্বতী যখন চওড়া পাড় তাঁত আর একটা বিরাট এলোখোঁপা করে তাতে ফুল গুঁজতো আর কপালে বেশ চাঁদের মত ভেলভেটের টিপ, চোখ ফেরানো মুশকিল ছিল আট থেকে আশির।
আর একটা বিশেষত্ব ছিল ওর সাজগোজের।ও বেশ ধ্যাবড়া করে কাজল পড়তো ওই যাকে আজকালকার ঘষামাজা ভাষায় বলে স্মাজ! আসলে ওর চোখ যেন একটু ছোট পানপাতা মুখের তুলনায়। মা বলতো হাতির চোখ, বোন বলতো, কুতকুতে। সেটা ঢাকতেই এই স্টাইলটা বেশ ক্র্যাক করে যায়।
অফিস টফিসে শ্বাশ্বতীর বর বেশ ঠ্যালাও খায়,”কি রায়দা বৌদি কেমন আছে? সত্যি দাদা ভাগ্য করে বৌ পেয়েছ!” বা,”বৌদি কি দেখে যে তোমায় বিয়ে করলো?” ঢং ..যেন জানে না, আমাদের দেশে এখনো ছেলেরা বিয়ে করে আর মেয়েদের হয়, তাই বৌদির বিয়ে করার প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে?আজকাল হলেও না হয় কথা ছিল! এ নব্বইয়ের দশক। না এসব রায়বাবু কিছুই বলেন না।
বাড়িতে এসে দেখেন বৌদি একঢাল চুলে লম্বা একটা বেনী করে, সাধারণ সুতির শাড়ি আর কপালে সিঁদুরের লাল টিপ। ভেলভেট পড়লে নাকি আঠায় কপাল কুটকুট করে।আগে এসব দেখে রায়দার বেশ একটু ইয়ে মতন হতো। মাঝে মাঝে মনে হত চকাস করে একটা চুমু খাই, বা নিদেন একটু আঁচল টেনে গদগদ স্বরে বলি, “এই একটু এদিকে এসো না!” কিন্তু তখন তো সন্ধ্যা হতেই মা টিভির ঘরে, রাজ্যের খাজা বাংলা সিরিয়াল নিয়ে।তবে এতো না হলেও হাবিজাবি অনেক কিছুই ছিল। আর আসতো মায়ের আড্ডার বন্ধুরা। মানে পাশের বাড়ির কাকিমা, ওপাড়ার জ্যেঠিমা, সামনে বাড়ির বৌদি।আর শ্বাশ্বতী লাজুক মুখে চা সাপ্লাই দিয়ে যেত। এককাপ অবশ্য রায়দার-ও জুটতো।
তারপর বয়স বাড়লে বসতো ভগবতের আসর। ঠাকুরের নাম, মালা জপা। আর শ্বাশ্বতীও সেই চায়ের দায়িত্বে। সঙ্গে ততদিনে দুই ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, তাদের টিফিন করে দেওয়া।
কিন্তু সব সময় শ্বাশ্বতী একই রকম। যদিও এখন ছেলে মেয়ে বড় হওয়ায়, বয়সের কারণে শরীর ভারী হয়েছে কিন্তু ওই যে কি যেন আছে ওর মধ্যে।
এই তো মাস খানেক আগে অফিসের গেট টুগেদারে, ফিচকে ছোঁড়া অতনু তো বলেই বসলো,”যাই বলো রায়দা তোমাকে বৌদির পাশে পুরো কাকু মনে হয়।” এমনকি এই কথা শুনে শ্রাবন্তী পর্যন্ত হেসে কুটিপাটি।শ্রাবন্তী নতুন জয়েন করেছে, ঘষামাজা সুন্দরী। রায়দার ওকে বেশ লাগে।
“ওরা কি বুঝবে? সংসার তো চালাতে হয় এই শর্মাকেই। ওদের বৌদিকে তো আর দশটা পাঁচটা অফিস করতে হয় না বাস ঠেঙিয়ে। তাহলে ওই এক্স ফ্যাক্টর কবেই ওয়াই জেড হয়ে যেত!”
কিন্তু সবই মনে মনে। ভদ্রলোকের শতেক জ্বালা, চাইলেও কিছু বলা যায় না।শুধু বাড়ি ফিরে বৌকে বলেছিল, “এই বয়সে অত মাথায় ফুল লাগাবার কি দরকার!” মাথায় ফুল লাগানোটা শ্বাশ্বতীর নেশা।কোনো অনুষ্ঠানে গেলে মাথায় ফুলটা ওর মাস্ট। তাই বাড়ির বাগানেই হাজার ফুলের মেলা। কিনতেও হয় না। তাই মাথায় ফুল লাগানোর কোনো খরচ নেই, এমনকি বাড়ির পুজোর ফুলের খরচটাও বেঁচে যায়!
সাধারণ দিনেও রাতে একটা ফুল বা মালা গেঁথে মাথার কাছের টেবিলে রাখে শ্বাশ্বতী।যে সময় যে ফুল হয়। মরশুমি গাঁদা থেকে রজনীগন্ধা, বেলি, গ্লাডিওলার, ডালিয়া এমনকি কামিনী গোছাও।
সারাদিন কাজ শেষে, সবাইকে রেডি করে শ্বাশ্বতী লাগে ফুলের পরিচর্যায়। মাটি খুঁড়ে, তাতে সার দিয়ে, পাকা পাতা ফেলে, জল দিয়ে, নোংরা পরিষ্কার করে একেবারে ঝকঝকে তকতকে। ফুলের বাগান তো নয় যেন নিজের সন্তান। গাছগুলোর চারিপাশ আবার নিজে হাতে নিকিয়ে দেয়। কিছু বললে বলে,”আমার তো ওই একটা মাত্র শখ, ওতে আর বারণ কোরো না !” রায়দা বারণও করেন না।
এমনিতেই প্রাইভেট ফার্মের চাকরি, বৌকে তেমন সময় দিতেই বা কোথায় পারেন? কিন্তু আজকাল যেন শ্বাশ্বতীর এই ফুল ফুল বাতিকটা অসহ্য লাগে। রায়দার বয়স প্রায় পঞ্চান্ন, গায়ের রং টকটকে ফর্সা, মনে হয় টোকা দিলে রক্ত বেরোবে। মাথা জোড়া মস্ত টাক, পিছনে অবশ্য কয়েকগোছা চুল আছে কিন্তু তা যতই টেনে সামনে ঢাকার চেষ্টা হোক, সবই ব্যর্থ। অথচ শ্বাশ্বতী! সেই একই রকম চুলের গোছা।
মাঝে মাঝে রাগ হয় রায়দার। ওনার বয়স বাড়ে তাহলে বৌয়ের কেন বাড়বে না।? এই নিয়েও লোকের গা ঠ্যালা কথার শেষ নেই।মোটে তো দশ বছরের বড় কিন্তু লোকে এমন করে বলে যেন শ্বাশ্বতীর ও বাবার বয়সী।আর তার ওপরে ফুল। আজকাল তো অফিসে দুয়েকজন ঠাট্টা করে ওনাকে ফুলকুমার বলে। কি? না বৌদি ফুলকুমারী তাই আপনি ফুলকুমার। আর সহ্য হয় না!
এইবার রায়দা ঠিক করেছেন বাড়ির সামনের ওই বাগানটায় একটা দোকানঘর করবেন। রিটায়ারমেন্ট এর আর বেশিদিন নেই। তাই ওটা ভাড়া দিলে বেশ কিছু ক্যাশ আসবে।
শ্বাশ্বতী বরাবরই চুপচাপ, খুব বেশি কথা বলা ধাতে নেই। ও যেন কোনো কিছুকেই গায়ে মাখে না! না ভালোবাসা না রাগ। তবু দুয়েকবার বলে,
“বাবুর তো চাকরি হয়ে গেছে। সামনে দোকান না করলেই কি নয়। বাগানটা না হয় থাক। পুজোর ফুলটাতো আসে!”
“পুজোর ফুল না তোমার খোঁপার ফুল?”পরদিন মিস্ত্রী লেগে যায় কাজে। অনেক বেলা হলো, চা পায় নি কেউ। প্রায় নটা বাজে। বাবু এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি।রায়দাকে আবার না ডাকলে ঘুম ভাঙে না।মিস্ত্রীদের আগের দিনই সব দেখিয়েদুখিয়ে দিয়েছিলেন। ওরা সকাল সকাল এসেই কাজে লেগে গেছে।
ঠুকঠাক আওয়াজে রায়দার ঘুম ভাঙে। বৌদি কই? এ ঘর ও ঘর খোঁজেন,
“মা, বাবুর মা কই গো?”
শাশুড়ি মালা জপতে জপতে ইশারা করেন যে তিনি জানেন না। ঘরে এসে শ্বাশ্বতীর ফোনটা খোঁজেন রায়দা, বাইরে গেলে তো ফোন নিয়ে যাবে।হঠাৎই নিজের ফোন থেকে শ্বাশ্বতীকে একটা ফোন করবেন বলে ফোনটা তুলতেই একটা মেসেজ চোখে পড়ে হোয়াটস অ্যাপ এ।
“যে বাড়িতে আমার জন্য সামান্য একফালি বাগান থাকে না, সে বাড়িতে আদৌ আমার কোনো জায়গা আছে বলে আমার সন্দেহ।আমি দেশের বাড়িতে গেলাম। ওখানে থেকেই বাগান করবো। আমাকে নিতে আসলে শুধু লোকই হাসবে, তাই সে চেষ্টা কোরো না!”ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়লেন রায়দা। ততক্ষণে বাগানের গাছগুলো তছনছ হয়ে গেছে দোকানঘর হবে বলে।
-
গল্প- লোকে শুনলে বলবে কি
লোকে শুনলে বলবে কি
-শম্পা সাহা“আমি কালই বাপের বাড়ি চলে যাবো! এই লোকের সঙ্গে থাকবো না, থাকবো না, থাকবো না! এই শুনছোওওওওওও…”
“ঘর ঘর ঘর ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ ঘ্যাঁ..”
“বজ্জাৎ লোক, হতচ্ছাড়া নাক ডাকছে দেখো। নাক না মেশিনগান! ধুস্, সংসারে ক্যাতায় আগুন।”
বালিশ নিয়ে ঈষৎ পৃথুলা নিমকি রানী মানে নিভৃতবাসিনী গিয়ে শুলো ড্রয়িং রুমের সোফায়। তার আগে অবশ্য দুই চারক্ষেপ বালিশ চালিয়ে এসেছেন গন্ডার, হিপোপটেমাস, উষ্টুম ধুষ্টুম ঘন্টুর বাবার ভুঁড়ির উপর।
সে কুম্ভকর্ণ তো এখন গায়ের ওপর দিয়ে হাতি চলে গেলেও টের পাবে না, সেখানে বালিশ তো পালক!
বেচারা ঘন্টু, মা বাবার এই রোজকার লড়াই দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে সেঁধিয়েছে দোতলার খুপড়ি মত ঘরটায়। বেজায় গরম কিন্তু মাঝরাতের ধুন্ধুমার যুদ্ধ শুনে তো আর ঘুম চটকে যায় না!
এ প্রায় রোজকার ঘটনা। সেই লাস্ট কবে ঘন্টুর বাবা এট্টু সেন্টু হয়ে রোমান্টিক হয়েছিল! তারপর থেকে তো ব্যাঙের মাথা, নিজেই ফুলতে ফুলতে একটা মস্ত কোলা ব্যাঙ!
নিমকি রানীও যে খুব দুবলিপাতলি এমন নয়! তা মোটা বলে কি একটু ভাব ভালোবাসা থাকতে নেই? এই তো শ্যামার বর নিখিল, কৃষ্ণার বিয়ে হয়ে গেল, তাও কেমন পেছনে রোমান্টিক মিউজিক বাজিয়ে ভেজা ভেজা বক্ষ ভেদ করা চোখে চায়। এমনকি শ্যামার শাশুড়ি শ্বশুরেও কত ভাব ভালোবাসা! সে তুলনায় ঘন্টুর তো বিয়েই হয়নি। এতো তাড়াতাড়ি কি জীবন ফুরিয়ে গিয়ে করুণাধারায় আসতে হবে? নো নেভার! রস কস সিঙ্গারা বুলবুলি কিছুই এতো তাড়াতাড়ি ফুরোতে দিলে চলবে না। কালই একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে!
সোফায় শুয়ে নিমকি রানী উসখুস করতে থাকে। মরণ! ব্যাটাচ্ছেলে! কুঁড়ের হদ্দ! এট্টু ইয়ে করতেও যেন গা গতরে ব্যথা! হুঃ! ফুঁসতে থাকে নিমকি।
“নিমকি!”
গা জ্বলে যায়। ঘন্টুর বাবাই তো ভালোবেসে এই নামটা দিয়ে ছিল বিয়ের পর পর।বলেছিল, “নিভৃতবাসিনী, তুমি যেমন মুচমুচে তেমন সুস্বাদু, আর আমার সব থেকে প্রিয়।তাই তুমি আমার নিমকি রানী” মরণ! বয়স পঞ্চাশ হতে এখনো ঢের দেরি আর এর মধ্যেই নিমকি যেন জিভেগজা! ওনার নোনতা মুখে আর রোচেনা!সাপ্তাহিক নারীবাদী পত্রিকা পড়ে পড়ে কত রকম প্যাঁয়তারা অ্যাপ্লাই করেছে সে, বগল কাটা নাইটি থেকে, হংকংয়ের তেল কিছুই বাদ যায়নি! কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি!মেশিন পত্রে যেন জং। ব্যাটা মেশিনগানের যেন গাদা বন্দুকে ট্রান্সফরমেশন। সব প্যাঁচ পয়জার ফেল।
বিছানায় পড়লে যেন নাকের ভেতর ঘূর্ণিঝড় ঢুকে পড়ে, আর সে ঝড়ে বেচারা নিভৃতবাসিনীর রোমান্টিক বিবাহিত মধ্য জীবনের তেইশ ঠান্ডা। কভি নেহি! কাল এসপার কি ওসপার! এই পড়ন্ত যৌবন কিছুতেই এভাবে বিফলে যেতে দেবে না, আরে বাবা, খাবার পর হাত না চাটলে কি ঠিকঠাক পেট ভরে না তৃপ্তি হয়?
“কালই কথা বলবো, হয় জাগো নয় ভাগো থুড়ি আমিই বাপের বাড়ি ভাগবো” এই পণ করে চোখ বোজে নিভৃতবাসিনী!সকাল থেকেই বাড়ি থমথমে। ঘন্টু বুঝেছে আবার যশ-এর মেঘ জমেছে ঈশাণ কোণে।ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস টের পেয়ে সে কোনো রকমে সকালের খাবার খেয়েই মানে মানে ওদের তেলকলের দেখভালে কেটে পড়ে। কি জানি বাবা কখন ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে?আর টার্গেট মিস করলে তার আর রক্ষা নেই!
“নিমু, নিমু” কোমরের কষি আলগা করে বেঁধে, লুঙ্গি হাঁটুর ওপর তুলে সোফায় বসে ঘন্টুর বাবা অরণ্যেরোদন খাসনবিশ মিহি গলায় ডাক ছাড়ে,”নিমকি রানী আমার চা টা দাও!”
যদিও বিছানায় পড়ারর পরের কোনো ঘটনাই অরণ্যেরোদনের অবগত নয়, তবু রান্নাঘরের ধুপুর ধাপুর শুনে বোঝে,”কুছ গড়বড় তো হ্যায় দয়া! “কিন্তু কি? সেটাই আবিষ্কার করতে এই মধু মাখা হরিনাম মানে গিন্নীর নাম!
ধুপ করে টেবিলের ওপর প্লেট এসে পড়ে, আর রাখার তোড়ে কাপ চলকে চা, প্লেট আর প্লেটে রাখা নোনতা বিস্কুটদুটো ভেজায়।ছেলে নেই তাই সুরেলা গলায় অরণ্যেরোদন ব্যাপারটা বুঝতে চায়,”কি হলো নিমু ,রেগে আছো যেন? কি হয়েছে?”এই সুযোগটাই তো খুঁজছিল নিমকি। সঙ্গে সঙ্গে সামনের সোফায় ধমাস করে বসে, জানে কি হবে আর কত সময় লাগবে, তাই আগে থেকেই রান্নাঘরে গ্যাস বন্ধ করে এসেছে।
“বলছি তোমার মেশিনগান কি একেবারেই জং পড়ে গেছে?”
“মেশিনগান?”
এ শব্দব্রহ্মে বেশ ভেবড়ে অরণ্যেরোদন চমকে ওঠেন,
“মানে, সে কি?”
চোখ নাচায় নিমকি, “জানো তোমার নামে ডাইভোর্স কেস করলে এক্ষুণি ডাইভোর্স পেয়ে যাবো!” চায়ের কাপে হাত বাড়াতে গিয়েও হাত পেছিয়ে আসে,”কিন্তু তুমি খামোখা আমায় ডাইভোর্সই বা দেবে কেন?আমি আবার কি করলাম?”
পুরো বোল্ড আউট অরণ্যে রোদন।
“কিছু করো না, তুমি কিচ্ছু করোনা। আর সেই জন্যেই আমার ডাইভোর্স চাই!”
“কেন, আমার অতবড় তেলকল”,
“ধুত্তোর তেলকল!” মাঝপথেই থামায় নিভৃতবাসিনী,
“যদি নিজের মেশিনপত্তরেই না তেল দিতে পারো ও তেল কলের কি দরকার? একটু শখ আল্লাদ নেই, ভাব ভালোবাসা নেই, রোমান্টিক হবার নাম নেই, রাত্তিরে বিছানায় পড়ে যেন তেলকল চালাচ্ছে,ঘরঘর ফরফর!”
কথার মাঝখানে নিজের অধুরা যৌবনের দুঃখে ফ্যাঁচ করে কেঁদে ওঠে নিভৃতবাসিনী!“আহাহা, এতে কাঁদছো কেন? আসলে বোঝোই তো, সারাদিনের খাটাখাটনি, আর বয়সও তো হয়েছে!”,
“তা কে বলেছিল, হাঁটুর বয়সী মেয়ে বিয়ে করতে। তোমার জন্য আমার জীবনটাই বরবাদ হয়ে গেল। দিদির দেওর ঘনশ্যামকে বিয়ে করলেই ভালো হতো!”
এই বলে অজানা ঘনশ্যামের হয়েও হলোনা অনতীত, চিরস্থির অনাস্বাদিত অপ্রাপ্ত প্রেম কল্পনা করে কেঁদে ভাসায় নিভৃতবাসিনী!অরণ্যে রোদন অনেক বুঝিয়েবাঝিয়ে, বেশ কথাটথা দিয়ে কাজে বের হলো। আজ সন্ধ্যা থেকেই বেশ খুশি খুশি ভাব। আজ আর নিভৃতবাসিনী নামটা মনে আনতেও ইচ্ছে করছে না, আজ নিমকি রানী পুরো মুচমুচে খাস্তা মেজাজে।
ঘন্টু ভয়ে ভয়ে ফোন করে জানালো আজ বন্ধুর বাড়ি ফিস্টি। অন্যদিন হলে নিভৃতবাসিনী নানান তদন্ত করেন, “কে, কার বাড়ি, কোথায়, কখন ফিরবি?” আজ সেসব কিছুই না করাতে ঘন্টুও অবাক,
“যাচ্ছলে! এই সকালে মেঘ, আর এই রোদ্দুর। বাব্বা! মেয়েদের মেজাজ, কে বুঝতে পারবে? শিবের বাবাই ফেল তো ঘন্টু!”
ঘন্টু আরো একবার প্রতিজ্ঞা করে এ জীবনে সে কোনোদিন বেলতলা থুড়ি ছাদনাতলায় যাবে না। সারাদিন বাড়িতে বাবা যা হ্যাটা হয়! তার বৌ-ও দেখে দেখে ঠিক এসব শিখবে।তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া শেষ। নিমকি রানীর বুক বহুদিন পর ফুলশয্যার রাতের মত দুরুদুরু। ওদিকে অরণ্যে রোদন বেশ একটা হলুদ গেঞ্জি আর লালকালো ছাপছাপ লুঙ্গিতে রেডি! ভুঁড়িটা বেঢপ। যাক! ওদিকে তাকাবে না নিমকি।
বেশ এগিয়ে গিয়ে পাশে বসে অরণ্যে রোদনের। অরণ্যে রোদন ভাব বুঝে দুই হাত বাড়িয়ে মুখটা এগিয়ে নিয়ে যায় নিমকি রানীর কাছে, আহা কি অপূর্ব মুহূর্ত! এই ঠোঁটে ঠোঁট মিলতে যাবে, নিমকি রানীর বুকে হাঁপড় পড়ছে, মুখে বেশ লাজুক লাজুক ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে যথাসাধ্য, কতদিন পর বলে কথা! এই এই সবে ঠোঁটে ঠোঁট লেগেছে,
“হ্যাঁচ্ছো..”প্রবল এক হাঁচিতে নাকের থেকে বেশ কিছুটা তরল কণা উড়ে গিয়ে পড়লো নিমকির চোখেমুখে। ছিটকে অনেক দূরে সরে গিয়ে দেখে, অরণ্যে রোদন নাক লুঙ্গি দিয়ে চেপে হেঁচেই যাচ্ছে, হেঁচেই যাচ্ছে, হেঁচেই যাচ্ছে!
অত্যন্ত রাগে, বিরক্তিতে নিমকি জিজ্ঞাসা করে “হঠাৎ হাঁচছো যে? ইচ্ছে করে,বলো?”
এক ক্রূর জিঘাংসা ফুটে ওঠে নিভৃতবাসিনীর চোখেমুখে।
“এ ঠকানো, এ প্রতিশোধ, মানসিক অত্যাচার, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ!”
আই পি সির কড়া কড়া ধারা যেই হানতে যাবে, ভাঙা গলায় অরণ্যে রোদনের স্বীকারোক্তি,
“বল্টা, আমাদের দোকানের, ওর জ্বর, কাশি, আর হাঁচিও ছিল। এতোবার করে বাড়ি যেতে বললাম, কিছুতেই গেলো না! সেই দুপুর থেকে আমারও শুরু হয়েছে!হ্যাঁচ্ছো,হ্যাঁচ্ছো…”,আবার শুরু হাঁচির মনোরেল!এখন ঘন্টু যথারীতি ওপরের ঘরে, আর অরণ্যেরোদন নিভৃতবাসে! সে ব্যবস্থা অবশ্য নিভৃতবাসিনী স্বেচ্ছায়ই করেছে।
“পুরুষ মানুষগুলো কি রকম দেখেছো, বৌ কুড়ি কি বুড়ি! কিছুতেই মুখে রোচে না! তার জন্য করোনা পর্যন্ত হওয়াতে পারে! পামর, নরাধম, ইতর, ইল্লত”, ইত্যাদি গালাগাল অরণ্যে রোদনকে দিতেই থাকে মনে মনে নিভৃতবাসিনী! কি আর করবে? এ অবস্থায় তো আর জোরে জোরে স্বামীকে গাল দেওয়া যায় না! লোকে শুনলে বলবে কি?
-
কবিতা- আকাল
আকাল
-শম্পা সাহাকারোর জন্য একটা কবিতা বা গল্প লেখা কি এতই কঠিন?
নাকি তোমার কল্পনার ঘোড়া ছুটতে শেখেনি
খাইয়েছো ছোলা, করেছো কত না আবদার
তবু তার চলবার ছুটবার ক্ষমতায় বড়ই অলস ভাব ফুটে ওঠে
জুঁই ফুলকড়িদের গন্ধে যেমন হাল্কা বিরাগ থাকে
থাকে বৃষ্টি ধোওয়া বিকেলের বিষণ্ণতা তেমনি বিষাদগ্ৰস্ত
তোমার কল্পনার ঘোড়ারা ঘাস খায় বাঁধা থাকে
ডাক পাড়ে মিহি সুরে
তুলতে পারেনা বিদ্রোহের সুর বিপ্লবের শ্লোগান
তুমি কি এতোই নিঃস্ব এতই কাঙাল!
চারিদিকে যে এত প্রেম দেখি
ভালোবাসার আজ তবু বড়ই আকাল! -
গল্প- ভাালোবাসো তো?
ভালোবাসো তো?
-শম্পা সাহা“সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান কোরো না তো !ওই এক কথা শুনতে শুনতে আমার কান পচে গেছেে! অন্য কোনো কথা থাকলে বলো!’
রাহুলের ধরা হাতখানা যেন নিজে থেকেই শিথিল হয়ে আসে! যে আবেগে সোমা রাহুলকে ডেকেছিল সে আবেগটাতো গেলোই সঙ্গে দিয়ে গেল একরাশ বাড়তি মনখারাপ!
সোমার এই এক দোষ। পড়াশোনায় ভালো, দেখতে শুনতে ভালো, ওকে রাহুল নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। সবই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু সোমা যেন বাস্তবের বদলে কল্পনার জগতেই থাকে বেশি।
বছর পাঁচেক হলেও এখনো রাহুল বাচ্চা নিতে রাজি নয়। “এই তো সবে কেরিয়ারের শুরু এখনই ওসব ঝামেলা আমার দরকার নেই বাবা, আগে একটু সেটল হই!”
এই বক্তব্যে সোমার মত বা অমত কোনোটাই নেই। আসলে ও বরাবরই এরকম গা ছাড়া! সংসার যে করে তাতেও যেন নিজেকে জড়ায় না কোনোভাবেই। ও কোনোদিকে তাকিয়ে থাকলেও আসলে যেন দেখে না কিছুই। ওর চোখ দুটো যেন নাগালের সব কিছু পার করে অন্য কোনো কিছু খুঁজে বেড়ায়!কিন্তু কি? সেটা হয়তো ও নিজেও জানে না!
রাহুলের নিজের ব্যস্ততা কাটিয়ে যেটুকু সময় পায় তাতে সোমাকে খুশি রাখবার চেষ্টা করে। বেড়াতে নিয়ে যায় উইক এন্ডে বা শনিবার সন্ধ্যায় কোনো রেস্তোরাঁয়! সোমা যায় কিন্তু যেন ও ওখানে থেকেও নেই। আসলে ভীষণ এক শূণ্যতা, যেটা ওকে ধীরে ধীরে গ্ৰাস করছে! তা ও ভালোই বোঝে!
বিয়ের পর পর চাকরিটা ও ছাড়তে চায় নি। কিন্তু শাশুড়ির মা বয়স হয়েছে একা সংসার সামলাতে পারবেন না এবং “কটা টাকাই বা মাইনে পাও?” এ অজুহাতে সেটা ছেড়ে একেবারেই বাড়িতে বসে।
বাবা মা এক ধাক্বায় দুজনেই যখন এক দিনের তফাতে মারা গেলেন, মাত্র দুদিনের জ্বরে তখন এ চাকরিটাই ওকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আর পাশে ছিল বড় মামা মামী। তাই ওনাদের আনা সম্বন্ধ ও ফেলতে পারে নি, রাজি হয়েছিল বিয়েতে!
ওকে নিয়ে রাহুলের এমনি কোনো সমস্যা নেই কারণ যে স্ত্রীর চাহিদা নেই সে তো হাতে চাঁদ পাওয়ার মত। কিন্তু ওর এতোটা নির্লিপ্ততাও ভালো লাগে না। ভালো কোনো গিফট দিলে, ভালো কোনো জায়গায় বেড়াতে নিয়ে গেলেও ওর অভিব্যক্তি একই রকম থাকে। ও খুশি হয়েছে,, না ওর খারাপ লাগছে তা মোটেই বোঝা যায় না!
প্রথম প্রথম রাহুল ভাবতো সোমার বোধহয় ওকে পছন্দ নয় বা অন্য কাউকে ও ভালোবাসে। কিন্তু না- গত পাঁচ বছরে যে মেয়ে একা কোথাও যেতে চায় না, তার আবার প্রেম ট্রেম কি? বরং সে দিক থেকে রাহুল অনেক বেশি অ্যাক্টিভ। ওর এখনো বেশ কয়েকজন বান্ধবী রয়েছে। যারা প্রত্যেকে জানে ও বিবাহিত! সব জেনেও ওরা ডেটিং এ যায়, দেখা করে! সে অবশ্য সোমাকে না জানিয়ে। যদিও জানলেই যে সোমা আপত্তি করবে বা রাহুল তাতে খুব একটা বিচলিত হবে এমন নয়! কিন্তু তবু, সব খোলামেলা হলে মজা কোথায়? তা ছাড়া একটু আধটু মাইন্ড ফ্রেশ রাখারও তো দরকার।
“সোমার তো কোনো অভাব রাখিনি”, রাহুল নিজেকে ক্লিন চীট দেয়।শুধু সোমা মাঝে মাঝে ওই বিরক্তিকর প্রশ্নটা করে? “তুমি আমায় ভালোবাসো?” গত পাঁচ বছরে প্রায় প্রতিদিন একবার হলেও সোমা এই প্রশ্নটা করে!
“কেন বাসবো না?” বা,” না, অন্য কাউকে ভালোবাসি”, এইসব বলে রাহুল বেশ মজার ছলেই উত্তর দিতো।কিন্তু আজকাল আর ভালো লাগে না। একঘেয়ে প্রশ্ন কেন করে ও? পাগল নাকি? মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, মেয়েটার মাথার গন্ডগোল নেই তো ?কিন্তু এই এক প্রশ্ন বাদে সোমা পারফেক্ট বৌ। একেবারে শো পিস। কোনো ট্যা ফোঁ নেই, সুন্দর, প্রেসেন্টেবল! কিন্তু কেন যে ও এই এক প্রশ্ন বার বার করে?
যখন অদ্ভূত চাহনিতে ওর দিকে তাকিয়ে মেয়েটা প্রশ্নটা করে,মনে হয় যেন বুকের ভেতরটা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে রাহুলের। ওর ভীষণ রাগ হয় আজকাল! রেগে যায়, চিৎকার করে, “এক প্রশ্ন বার বার করো কেন?”,
“তুমি যে নিজে থেকে কোনোদিন বলো না!” ওই একঘেয়ে সুরে বলে ওই এক্সরের মত দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটা। রাগে মাথার ভেতরটা দপদপ করে রাহুলের, ছিটকে চলে যায় সামনে থেকে।
কিন্তু না, কোনো রাগ নেই, ঝাল নেই, অভিমান নেই! কদিন বাদেই মেয়েটা ওই একই প্রশ্ন করে আবারও! কেন? কেন? কেন? “এই প্রশ্ন করার জন্য কি ডিভোর্স চাওয়া যায়?” ভাবে রাহুল!
গভীর রাত! ঘরে একটা হাল্কা নীল আলো ,বোঝা যায় মোবাইল স্ক্রিনের আলো! এক নারীমুর্তি চেয়ে আছে মোবাইলের স্ত্রিনে। নির্লিপ্ত চোখে দেখছে নানা ভালোবাসার স্বীকৃতি, ভালোবাসার প্রকাশ নানা ভাবে, নানা শব্দে, নানা ঠিকানায়! পাশে এক পুরুষ গভীর ঘুমে আছন্ন!
-
কবিতা- আমার কবিতারা
আমার কবিতারা
– শম্পা সাহাযদি কোনোদিন কবি হই
যদি কোনোদিন কোনো খবরের কাগজে আমার নাম প্রথম পাতায় ছবি সহ
মঞ্চ আলো করে আমি আর আমার উপাস্যরা
যদি কোনোদিন আমার নাম লোকে কবি হিসেবে উচ্চারণ করে
তারপর আর শব্দ নিয়ে ভাববো না
ভাব নিয়ে ভাবনাদের তখন বেজায় ছুটি
ভালোবাসার তখন বড্ড মন খারাপ
তখন সামান্য কলম ছুঁইয়ে ছাইপাশ
তাতেই বইবে বাহা বাহার বন্যা
প্লাবিত হব মুহুর্মূহ প্রশংসা বাক্যে
অনুরাগী আর স্তাবকের দিকে ছুঁড়ে দেব দুয়েকটা রুটি
কাড়াকাড়ি মারামারি পড়ে যাবে তা সংগ্ৰহে
কবিতার বাজারীকরণে আমি তখন বিরাট ব্যবসায়ী
কোনো কবিতাই আর বিনামূল্যে দৃষ্টিগোচর নয়
ফরমায়েশি কবিতারা তখন গায়ে রং চড়িয়ে মুজরা করবে
নোট উড়বে দিকবিদিক ছেয়ে
কবিতারা কাঁদবে ছটফট করবে
বনসাই কবিতারা স্বাদ গন্ধহীন সংকর প্রজাতি
তবু বিকোবে চড়া দরেনা এসব নিছকই কল্পনা
তাই আমার হৃদয় নিংড়ানো কবিতারা
ধূলোয় গড়াগড়ি যায়
কেউ ফিরেও দেখে না
শুধু আমি যত্ন করে ধুলো ঝেড়ে সাজিয়ে রাখি আমার মনের খাসমহলে
জানি তোমাদের কাছে আমার কবিতারা
কবিতা হয়ে উঠবে না কোনোদিন
তোমাদের কাছে এ নিছকই প্রলাপ
আর আমার কাছে?
এরা যে প্রস্ফুটিত হৃদয়। -
মুক্তগদ্য- কোন্দলপ্রিয়
কোন্দলপ্রিয়
– শম্পা সাহামানুষ বড় কাজিয়া কোন্দলপ্রিয় প্রজাতি। প্রজাতি বললে আবার রাগবেন না যেন! আমরা প্রাণীই, সে যতই ঐতিহ্য -টৈতিহ্যর বুলি কপচান! আমরা প্রাণীদের মধ্যে একটু উন্নত, হোমো সেপিয়েন্স আমাদের নাম। এর বেশি কিছু না।
আপনি যদি ভেবে থাকেন মানুষ হয়ে আপনি মাথা কিনে নিয়েছেন, ভুল ভাবছেন। আপনার মত দল বেঁধে সামাজিক জীবন যাপন ওই সামান্য উই পোকা, বোলতা বা মৌমাছিরাও করে। কিন্তু তারা ঝগড়া করে না, একে অপরকে লোভে পরে হত্যা করে না অকারণে যেমন আমরা করি।
যতই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাদের গাত্র ব্যথা হোক লোকের উন্নতিতে গাত্রদাহ মাস্ট। আর ভাগাভাগিতে? ওরে বাবা শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই সেখানে পি এইচ ডি।
আমরা প্রথমে দেশের বিরুদ্ধে লড়ি। এই যেমন ভারত পাকিস্তানের লড়াই, আমেরিকা ইরাকের ওপর বোম ফেলে, এইসব করতে করতে বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত আমরা করে ফেলেছি। ভাবখানা এমন যেন ওরা বিদেশি তাই শত্রু, ঘরের লোকদের মধ্যে গলায় গলায় ভাব!
তাহলে আর প্রাদেশিকতা শব্দটাই আসতো না? আমরা সীমান্তে লড়ছি বিদেশের বিরুদ্ধে আবার দেশের মধ্যে এক রাজ্য লড়ছি অন্য রাজ্যের বিরুদ্ধে। সেখানে লড়াইটা, ও বিহারী, ও বাঙালি, ও অসমিয়া, ও মারাঠি!
তাহলে শত্রু ভাবাপন্ন আমরা সীমান্তের বাইরের লোকেদের সম্পর্কে শুধু নই দেশের ভেতরেও শত্রু খুঁজে পাচ্ছি!
আচ্ছা তাহলে রাজ্যের মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা নেই? ও বাবা ওখানেও আছে! ও হিন্দু, ও মুসলমান, ও খৃষ্টান, ও শিখ, ও জৈন। সেই ভিত্তিতে বিভাজন, লড়াই, দাঙ্গা!
তাহলে কি এখানেই শেষ? তাহলে আর ও ব্রাম্ভ্রণ, ও কায়স্থ, ও উঁচু জাত, ও নিচু জাত কিসের? তাতে অনার কিলিং? হায় রে? কিলিং তাও অনার?
আর রাজনৈতিক তরজা, তা নিয়ে রং অনুযায়ী মার ধোর, খুন,জখম। এক দেশ, এক রাজ্য, এক ধর্ম হয়েও রক্ষা নেই। সেখানে আবার রাজনৈতিক রং দেখে আমরা লড়ছি একে অপরের বিরুদ্ধে!
এরপর লড়াই ভাইয়ে ভাইয়ে, ভাই বোনে, বোনে বোনে টাকার জন্য, জমির জন্য, সম্পত্তির জন্য।খুন খারাপি, জখম, ধর্ষণ কিছুই বাদ নেই।
আর শেষে লড়ছি নারী পুরুষের মধ্যে! নারী বড় না পুরুষ? নারী ভালো না পুরুষ?
আমরা শুধু লড়ছি, লড়েই যাচ্ছি আর ভাঙছি! পৃথিবী ভাঙছি দেশের নামে, দেশ ভাঙছি রাজ্যের নামে, রাজ্য ভাঙছি ভাষার নামে, সংসার ভাঙছি অধিকারের নামে!
এই ভাঙার খেলায় সামিল। আমরা সবাই, সব্বাই, প্রত্যেকে! কেউ জানে না এর শেষ কোথায় তবুও লড়েই যাচ্ছি! জানি না এতে কার ভালো হচ্ছে, তবে মানবিকতার যে ভালো হচ্ছেনা তা হলফ করে বলতে পারি!
-
গল্প- খেপী
খেপী
– শম্পা সাহাখেপীটা রাস্তায় রাস্তায় মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ায়। ও শুধু রাস্তা ঘাটে ঘুরেই বেড়ায় না, ইস্কুলেও যায়। যেদিন যেদিন চাল দেয়, সেদিন সেদিন।
গিয়ে ফার্স্ট বেঞ্চের ধারে বসে, ওটাই ওর বাঁধা জায়গা। যেদিন যেদিন যাবে, সেদিন সেদিন কেউ ওখানে বসার সুযোগ পায় না। ওরই যেন কেনা জায়গা।
রহিমা একদিন বসেছিল, খেপীটা ঘাড় গোঁজ করে বলে, “তুই সর”
“কেন, এ কি তোর কেনা জায়গা?” রহিমা তেড়িয়া জবাব দেয়।
ব্যস্, হুটোপুটি, মারামারি, রহিমার চুল ছিঁড়ে, তার স্কুল থেকে দেওয়া শার্টের পকেট ছিঁড়ে একাকার। বেচারা রহিমা কেঁদে আকুল। কিন্তু খেপীটা কে বোঝায় যে ও ভুল করেছে।হেড দিদিমণির ঘরে ডাক পড়লো, ওর সেই এক কথা, কোনো যুক্তি নেই, কোনো বুদ্ধি নেই, কোনো ঠিক ভুল নেই, “ও কেন আমার জায়গায় বসেছে?” ওকে বোঝানো গেল না, যে ও ভুল। দিদিমণির আর কিই বা করার থাকে? তবু যতটা পারলেন বুঝিয়ে পাঠালেন খেপীকে। ও এসে আবার নিজের জায়গাতেই বসলো! রহিমা কেঁদে ফোলানো চোখ নিয়ে সরে বসলো পিছন বেঞ্চে।
ওর একটা পোশাকী নাম আছে বাসন্তী, বাসন্তী মন্ডল। কিন্তু সবাই ওকে খেপী বলেই ডাকে আর ও সাড়াও দেয়। বরং স্কুলে ওর নাম ডাকলে ও বুঝতেই পারে না, যে ওকে ডাকা হচ্ছে! বরং অন্য মেয়েরা ওকে খোঁচায়, “এই উপস্থিত বল!” ও যন্ত্রের মত উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “উপস্থিত”..
স্কুল থেকে যখন কাউন্সিলিং-এ আসা ডাক্তার ওকে গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অন্বেষা ক্লিনিকে যেতে বললো, কে শোনে কার কথা! ও তো কিছু বুঝলোই না। ওর বাড়ির লোককে ডেকে পাঠানো হল, তাও বোধহয় খেপীটা বলতে ভুলে গেছে। শেষে অন্য ছাত্রী দিয়ে খবর পাঠানো হল। ওর বাড়ির লোক এসে বললো, তাদের মাঠে খাটতেই দিন যায়, “হাসপাতালে যাবো কখন?”
“তাহলে আপনাদের মেয়ে কি এভাবেই থাকবে?” কি করবো দিদিমণি, সবই কপাল!” ব্যস কপালের দোহাই দিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ে বঞ্চিত হল স্বাভাবিক জীবন থেকে।পাশ ফেল না থাকার দৌলতে খেপী এখন ক্লাস সেভেন। তবে স্কুল না গিয়ে ও ঘুরে বেড়াতে ভালবাসে আদাড়েবাদাড়ে। কখনো হয়তো নদীর ধারে একটা কাশের শিষ্ চিবোচ্ছে, অথবা নদীর একেবারে শেষ ধাপে বসে জলে পা ডুবিয়ে ঢিল ছুঁড়ছে, যে তরঙ্গ উঠছে তাতে ওর বেশ মজা।কেমন ঢেউগুলো সরে সরে ধাক্কা মারছে সিঁড়ির ধাপে,ওর পায়েও। খেপীটা হাততালি দিয়ে ওঠে, খুশি হয় খুব। মাথার চুলে জট, উকুন, মাঝে মাঝে উকুন নামে গাল বেয়ে। দুই আঙুলের ফাঁকে ধরে টুক্ করে টিপে মারে।
তবে যখন ছোট ছিল, তখন এক রকম। কিন্তু এখন বড় হয়েছে, মনে নয় শরীরে। যদিও ও অতশত বোঝে না। কিন্তু শকুন শিয়াল নেকড়েরা ঠিকই বোঝে। তারা তো জানে, যে এ খুব সহজ শিকার।
তাই আজকাল ওরা পাটের খেতে ডেকে নিয়ে যায় ওকে। ওই যারা পাট খেতে কাজ করতে আসে। খেলা করার অছিলায় বাচ্চা মেয়েটার কোমল শরীরে এদিক ওদিক হাত বোলায়। কখনো কখনো খেপীটার ব্যথা লাগে। ধুরন্ধর শকুন বোঝায়, “এটা খেলা, এতে একটু লাগে, কাউকে বলতে নেই।”
আস্তে আস্তে খেপীটারও ভালো লাগে খেলা। ও প্রায়ই চলে আসে খেলতে বর বৌ খেলা। শকুনেরা বলে এ রকম করেই নাকি খেলতে হয়। খেপীটার কষ্ট হয় খুব। শকুনেরা খুব চালাক, বোঝে তাড়াহুড়ো করলে শিকার ফস্কে যেতে পারে, এছাড়া অন্য বিপদও আছে।
কিন্তু একদিন ওর মা মেয়ের শরীরে পরিবর্তন দেখে একটু সন্দেহ করে। নানান প্রশ্ন করে বোঝে সত্যিটা কি? নিয়ে যায় গ্রামের ডাক্তারের কাছে। কি একটা ওষুধ দেয় ডাক্তার। খুব কষ্ট পায় খেপীটা। পেটে যে খুব যন্ত্রণা।
ধীরে ধীরে খেপীটা সুস্থ হলে ইস্কুলে যায় চাল আনতে, আলু আনতে, সাবানও। খেপীর মা বোঝে, ও তো মানুষও না। যদি ওকে দিয়ে সংসারের কিছু সুরাহা হয়।
তারপর থেকেই বিভিন্ন মেলায় খেপীটাকে ওর বাবা মা-ই নিয়ে যায়। গ্রামের চালাঘরগুলোতে খেপীটা খেলে সেই পুরোনো, আদিম খেলা নিত্য নতুন শকুনের সঙ্গে। ওর মা কড়কড়ে নোট গুণে বাকি ভাই বোনেদের জন্য কিনে দেয় মেলায় বিক্রি হওয়া পাঁপড় ভাজা, জিলিপি, রঙীন কাঁচের চুড়ি। খেপীটাও পায়, কিন্তু শেষে।
এখন অবশ্য খেপীটা আর স্কুলে যায় না, চাল আলু আনতে, আর মেলার মাঠেও যায় না। এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, আর খিদে পেলে হাত পাতে। শকুনেরা আজও ওৎ পাতে, তবে খেপীটা আজকাল কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেখলেই চিৎকার করে মারতে যায় থান ইট নিয়ে।
সেই যেবার একটা শকুন যখন অনেকগুলো কড়কড়ে নোট দিয়ে ওকে বেশি করে যন্ত্রণা দিয়েছিল, খেপীটা হাতের কাছে থাকা থান ইট তুলে বসিয়ে দিয়েছিল মাথায়। শকুনটা মরে নি, কিন্তু রক্ত বেড়িয়েছিল খুব। সেই থেকে খেপীটার মাও সাহস পায় না ওকে কড়কড়ে নোটের বিনিময়ে খেলতে বাধ্য করতে।
-
গল্প- শিকার
শিকার
– শম্পা সাহাএমিলি পাশে শুয়ে শুনতে পায়, নিহাল ফিসফিস করে কাকে যেন বকছে, “এতো রাতে বলেছি না আমায় ফোন করবে না!”
ওপাশের কন্ঠস্বর শোনা যায় না, কিন্তু এ পাশে বক্তা বেশ বিরক্ত, ফোনটা কেটে খটাস করে বেডসাইড টেবিলে রেখে চোখ বোজে। বাঁ-পাটা অভ্যাস বশতঃ এমিলির গায়ে এসে পড়ে।
এমিলি কিছুক্ষণ পর, ধীরে ধীরে পা-টা গা থেকে নামিয়ে দেয়। ততক্ষণে নিহাল গভীর ঘুমে।ঘুমোলে বোধহয় মানুষের ওজন বেড়ে যায়। যেমন ড্যাডি ছোট্ট এমিলিকে মাম্মির পাশ থেকে বেবি কটে শোয়াতে শোয়াতে বলতো, “বাব্বা! এমিলি তো দেখছি বেশ ভারী হয়েছে! আমি ওকে আর কোলে নিতে পারছি না!” আদরে আবদারে আধো ঘুমে এমিলি আঁকড়ে ধরতো ওর বড় টেডিটাকে। যেটা ছিল ওর সব সময়ের সঙ্গী।
নিহাল পাঞ্জাবি পরিবারের উচ্ছল চঞ্চল এক যুবক। সবাইকে মাতিয়ে রাখাই ওর উদ্দেশ্যে যেন। পড়াশোনা তো আছেই তবে তার সঙ্গে সঙ্গে কাউকে ব্লাড দেওয়া, কে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া, নোট দেওয়া এসব তো আছেই। তা ছাড়া ও ভালো গান গায়, গিটার বাজিয়ে যখন চোখ বুঁজে রবীন্দ্র সঙ্গীত গায় তখন কে বলবে ও বাঙালি নয়! আসলে ওদের পাঁচ পুরুষই বাংলার বাসিন্দা তাই ও নামেই পাঞ্জাবি কিন্তু মনে প্রাণে বাঙালি।
এমিলি যে এমন একজন ছেলেকে পছন্দ করবে এ তো বলাই বাহুল্য। কিন্তু নিহালকে ভালোলাগার মূল কারণ হল, ফার্স্ট ইয়ার বোটানি পরীক্ষা। হঠাৎ তলপেটে ব্যথা। কিন্তু পেপার শেষ করার এতো তারা, যে আর কোনো দিকে তাকানোর সময় নেই।
পরীক্ষা দিয়ে বেরোচ্ছে হঠাৎ নিহাল কানের কাছে এসে বললো, “তোর বোধহয় পিরিয়ড হয়েছে। একটু দেখ তো! ” চমকে তাড়াতাড়ি পেছনে দেখে, প্যান্ট প্রায় মাখামাখি। কি হবে? এমিলি বোকার মত নিহালের দিকে তাকায়। পরিস্থিতি বুঝে, নিহাল বলে, “দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়া, আমি আসছি”। বাইকটা ওর কাছে এনে বলে, “ওঠ”। সেদিন নিহাল ওকে বাড়ি পৌঁছে দেয়।
এরপর ওদের প্রেমটা শুরু থেকে বিয়ে পর্যন্ত যেতে আর সময় লাগলো না। যদিও অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এমিলির পরিবারের তুলনায় নিহালের পরিবার থেকে বাধাটা এসেছিল অনেক বেশি! কিন্তু সেটা ওরা সহজেই পার করলো। কারণ কলেজ শেষ হতেই এমিলি আর নিহাল দুজনেই বেশ মোটা মাইনের জবে ঢুকে গেল।
ওদের বারোশো স্কোয়ার ফিটের সংসার গড়িয়া হাটের মোড়ে। সেখান থেকে দুজনেরই অফিস কাছে। কিন্তু প্রাইভেট ফার্ম মানেই আঠারো ঘন্টার অফিস। বাড়ি ফিরে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরেও ওরা প্রেমটা বাঁচিয়ে রেখেছিল।
উইক এন্ডে একটু আউটিং, ডিস্কো, লেট নাইট পার্টি এ সবই ওদের ব্যস্ততম জীবনের ক্লান্তি হয়তো কাটাতো কিন্তু মন! মন যেন ধীরে ধীরে দুদিকে হাঁটা দিল।
কোথায় সেই চঞ্চল, ছটফটে, আনন্দ মুখর নিহাল, অফিস, আর অফিস শেষে বোতল খুলে বসা। এতো ব্যস্ততায় ওরা কোনো ইস্যু নেবার কথাও ভাবতে পারে না। কে সময় দেবে? কে কেয়ার নেবে সন্তানের? তাছাড়া এই মুহূর্তে কেরিয়ারই সব। প্রোমোশন, প্রোমোশন, প্রোমোশন, তারপর বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি, শেয়ার মার্কেট, ইনভেস্টমেন্ট।
এই করতে করতে কবে যে বয়স পঁয়ত্রিশ পার হলো, কবে যে নিহাল আর এমিলি প্রেমিক যুগল থেকে এক ছাদের তলায় থাকা দুটো আলাদা মানুষ হয়ে গেলো, ওরা জানতেই পারলো না।
নিহাল আর এমিলির মধ্যে কোনো রহস্য খুঁজে পায় না, কোনো নতুন কিছু আর এমিলির নেই যা খুঁজবে নিহাল। আর এমিলিরও ধীরে ধীরে একাকীত্বটাই অভ্যাস হয়ে গেল।
অফিস থেকে ফিরে এমিলি আর পার্টিতে আনন্দ পায় না, ড্রিংকে উত্তেজনা পায় না, নিহাল আর ওর কাছে শরীরের জন্যও আসে না। গত তিন চার বছর ধরে ওরা দু’টো শরীর এক বিছানায় উপবাস পালন করে। তবে এমিলির আর ওসব ইচ্ছে করে না। কি হবে? কোনো কিছুতেই আর কি কিছু হবে? এটাই এখন মনে হয় এমিলির।
অনেক রাত পর্যন্ত নীল আলো জ্বেলে চ্যাটে ব্যস্ত থাকে নিহাল, কারো সঙ্গে যে ভীষণ ভাবে ব্যস্ত অথবা কারোর কারোর সঙ্গে, সেটা এমিলির কাছে স্পষ্ট। কিন্তু এমিলির তাতে কিছু যায় আসে না।
নিত্য নতুন অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে অফিসের দু’ এক জনের সঙ্গে দীঘা, পুরিও গেছে। কিন্তু প্রতি বারই ঘেন্না লেগেছে, বিশ্রী লেগেছে এই ভেবে যে মনের যেখানে পরিপূর্ণতা নেই, সাড়া নেই সেখানে শরীর কি তৃপ্তি দেয়?
ও নিজেকে নিজে অনেক প্রশ্ন করেছে কেন এই অপূর্ণতা? নিহাল তো বিভিন্ন ভাবে খুশি রাখতে চায় নিজেকে কিন্তু এমিলি? ডিলডো, ভাইব্রেটর সব সব কেমন যেন ফালতু। তাতে যেন শেষে আরো বেশি করে ডিপ্রেশন চেপে বসে। আরো বেশি একা, আরো বেশি নিঃসঙ্গ, আরো বেশি করে বন্ধুহীন!
এখন ঘর অন্ধকার করে বসে থাকতে ভালো লাগে আলোর তুলনায়। অনেক রাতে ঘুম ভেঙে শোনে নিহালের প্রেমালাপ, আশ্লেষপূর্ণ আবেগের অস্ফুট উচ্চারণ। আগে আগে মন খারাপ করতো, গরম জল চোখ গড়িয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে বালিশ, কিন্তু এখন আর কিছু মনে হয় না। শুধু থাকার জন্য থাকা, ভালোলাগাহীন শুধুই অভ্যাস যেন। নতুন কাউকে এমিলির আর ভালোও লাগলো না, কারণ সে অনুভূতিটাই তো মরে গেছে। অফিস আর বাড়ির অন্ধকার ঘর এছাড়া ওর আর কোনো অবস্থান নেই! নিহালের ওপর রাগ নেই, দুঃখ নেই শুধু শূণ্যতা, এক বিরাট শূণ্যতা যেন।
এ তো লক্ষ কোটি ব্যস্ত মানুষের ভবিতব্য, যারা কেরিয়ার গড়তে, ভবিষ্যৎ খুঁজতে আসল জীবনকেই হাতছাড়া করে ফেলে! এর পরবর্তী শিকার আপনি নন তো?