-
অণুগল্প- ঘোমটা
ঘোমটা
– শম্পা সাহানতুন বৌ দেখতে গ্রামের বৌ ঝি’রা ভিড় করেছে। চৌধুরী বাড়ির একমাত্র ছেলের বৌ, আবার নাকি বিদেশী! তাই ভিড় যে দেখার মত তা বলাই বাহুল্য।
চৌধুরী গিণ্ণীও আজই ছেলের বৌ’কে প্রথম দেখবেন। ছেলে জানিয়ে ছিল বটে যে সে বিদেশী মেয়ে বিয়ে করতে চায়, ভিক্টোরিয়া না কি যেন নাম!
গিণ্ণী প্রথমে রাগ রাগ করলেও পরে মেনেও নিয়েছেন। বাব্বা, বিদেশী বৌমা বলে কথা! আশেপাশের দশ গাঁয়ে কাদের বাড়ি আছে বিদেশী বৌ? ছেলে বলেছে, এখন থেকে এখানেই থাকবে।
তবে এতো সহজে কি মানে, চৌধুরী বাড়ির লোকজন! সেদিন দিদি নাম্বার ওয়ান-এ দেখালো কেমন সুন্দর বিদেশী বৌ, ফর্সা টুকটুক করছে! তার মুখে আধো আধো বাংলা! আহা! আর ভিক্টোরিয়া নাম যখন তখন রানী ভিক্টোরিয়ার মতন সুন্দরী হবে!
বিদেশী বৌ গাড়ি থেকে নামলো। ওমা! শাড়ি পড়া! আবার ঘোমটা দেওয়া! রণ শিখিয়েছে নিশ্চয়ই। দেখি দেখি! মোটামুটি বেশ একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। আর বৌ ঘাবড়ে গিয়ে ঘোমটা খুলে ড্যাবড্যাব করে দেখতো লাগলো চার পাশের লোকজন!
যেন বাজ পড়লো হঠাৎ। ফিসফিস, গুনগুন, চাপা হাসি, বেশ একটা আলোড়ন পড়ে গেল! চৌধুরী গিণ্ণীর হাতের বরণ ডালা হাতেই রয়ে গেল, বরণের জন্য আর উঠলো না।
গিণ্ণীমা দাপাতে দাপাতে ফিরে চললেন বাড়ির ভেতর। নিজের ঘরের ভেতর ঢুকে খিল দিলেন। বাইরে থেকে শোনা গেল চাপা কান্না আর গর্জন, “তুই এভাবে আমাদের ঠকালি?”
লোকজন বেশ স্থির, নড়তে চায় না। বড় বাড়ির এই রং তামাশা তো সহজে দেখা যায় না। গ্রাম্য জীবনে বেশ আলোড়ন ওঠার মত ঘটনা, বেশ কদিন রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে আলোচনার মত বিষয় পাওয়া গেছে!
রণ জানতো মা কালো একদম পছন্দ করে না, তবে এতোটা বাড়াবাড়িও আশা করেনি! এই জন্যই আগে থেকে বাড়িতে জানায় নি যে ভিক্টোরিয়া নাইজেরিয়ান, ওর কোনো ছবিও পাঠায়নি!
ভিক্টোরিয়াও বুঝতে পারছে না, হঠাৎ কি হল? “হোয়াই দে আর সো অফেন্ডড?” রণ তো বলেছিল, “এভরিথিং ইজ ওকে”!
রণ কি করে ভিক্টোরিয়া কে বলে, ওর গায়ের রং দেখার আগে পর্যন্ত, “এভরিথিং ওকে”- ই ছিল! কি করে বলে যে বিদেশী দুশো বছরের আগ্রাসন থেকে ওরা এখনো মুক্ত হতে পারেনি!
ভিক্টোরিয়ার মুখ থেকে ঘোমটা সরে যেন আমাদের নির্লজ্জ দাসত্বের মানসিকতাকে এক ঝটকায় বে-আব্রু করে দিল এক বিদেশীর সামনে।
-
গল্প- জরায়ু
জরায়ু
– শম্পা সাহাএকটা ঠিকানা বিহীন ট্রেনে উঠে বসলাম। না, না, ট্রেনটার ঠিকানা ছিল আমার ছিল না।
কদিন থেকেই মনটা বেশ খারাপ। জয়ী কেন যেন আমাকে অ্যাভয়েড করছিল। কারণটা বারবার জিজ্ঞাসা করেও উত্তর পাইনি!
গত সাত বছর আমার আর জয়ীর সম্পর্ক। শুধু সম্পর্ক বললে ভুল হবে, প্রেম..গভীর প্রেম। আমাদের সম্পর্কটা একটা নেশার মত যেন। ঝড় জল বজ্রপাত তুষার ধ্বস কোনো কিছুই যেন আমাদের বাধা নয়।আমরা রোজ দেখা করতাম, কোনোদিন বেলেঘাটা লেক, ফুলবাগান মোড়, কোনোদিন ভিক্টোরিয়া। প্রথম প্রথম অচেনা জায়গায় তারপর সবার চোখ সওয়া হয়ে গেলে আমার মেসে ও আসতো। আবার কখনো আমি ওর হোস্টেলে।
আমাদের কথা যেন ফুরোতো না। পাড়ার নেড়ীটার সাইকেল চাপা পড়া থেকে বারাক ওবামার রাজনৈতিক পন্থা সব কিছুরই অবাধ যাতায়াত ছিল আমাদের প্রেমালাপে।
কি জানি? ঠিকঠাক প্রেমটা পারতাম কিনা আমরা? আমরা সংসারের কথাও ভাবতাম না, বিয়ের কথাও না। আমরা সমাজ বদলাবার কথা বলতাম, বিপ্লবের কথা ভাবতাম, নারী স্বাধীনতা, দেশের রাজনীতি এ সব নিয়ে ঝগড়া, তর্ক অবলীলায় এসে পড়তো আমাদের কথায়।
আমরা অবশ্য প্রেমও করেছি, যে রকম লোকে করে! ওর ঠোঁট আমার ঠোঁট ছুঁয়েছে বহুবার, আমি পথ হারিয়েছি ওর ভেতরে লক্ষ বার।
লোকে বলে শারীরিক সম্পর্ক হলে নাকি প্রেম শেষ হয়ে যায়। সব ভুল। আমার তো মনে হতো, জয়ী শুধু আমার। জয়ীকে এত গভীর ভাবে আর কে জানে? কে পেরেছে ওর এতো গভীরে প্রবেশ করতে, আমার মত?
আরো স্নেহে, আরো মায়ায়, ওর কপালে চুমু খেতাম, ওর কপালের চুল সরিয়ে দিতাম আলগোছে। ও ভয় পাওয়া তিতিরের মত আমার বুকের মধ্যে ঢুকে যেত যেন।
কিন্তু ওই দিনগুলোতে ও খুব কষ্ট পেতো। আসতো, দেখা করতে আসতো রোজই, কিন্তু বুঝতাম ওর কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মাঝে পেট চেপে বসতো, হঠাৎ কেউ যেন পেটের মধ্যে খিঁমচে ধরছে এমন ভাবে আঁতকে উঠতো, যন্ত্রণায় নীল ওর ঠোঁট দুটো।
আমি জোর করে ওকে হস্টেলে পৌঁছে দিতাম, ঘন্টায় ঘন্টায় ফোনে জানতে চাইতাম কেমন আছে? ও ফোন না ধরলে অপেক্ষা করতাম ওর ফিরতি ফোনের।
দিব্যি তো চলছিল সব। কিন্তু ওর পেটের ব্যথা ওই দিন গুলোয় ধীরে ধীরে অসহ্য হতে লাগলো। হস্টেলে নাকি একদিন অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসা চলছিল, শহরের নামকরা গায়নোর কাছে।
কলেজ শেষে আমার কেউই গ্রামে ফিরে যাইনি। ওর নদীয়া আর আমার বাড়ি মেদিনীপুর। কিন্তু এই শহরটাকেই আমরা আমাদের স্থায়ী ঠিকানা করে ফেললাম।
চাকরি, পড়াশোনা আর প্রেম সবই চলছিল খুব সুন্দর ভাবে। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরেই দেখছি জয়ী কেমন অন্যমনস্ক। মনমরা হয়ে থাকতো, কথা বললে উত্তর দিতো না, আমার কাছে এসেও যেন আমার কাছে থাকতো না।
অনেক জিজ্ঞাসা করেছি, এড়িয়ে গেছে, অথবা হ্যাঁ, হুঁ ব্যস্। আমার কষ্ট হতো, ছটফট করতাম, বুঝতে পারতাম ও কোনো কিছুতে কষ্ট পাচ্ছে খুব কিন্তু বলছে না। কেন বলবে না? এ আমার রাগ! এতোদিনে কি আমি ওর আপন হতে পারিনি, যাতে ও ওর সমস্যাগুলো আমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে!
গত সাতদিন ধরে হঠাৎ জয়ী উধাও। ওর ফোন বন্ধ, হোস্টেলে গিয়েও ওর কোনো খবর পেলাম না। ওর বন্ধু বলতে বিধি, ও তখন অফিসে। আমি অফিস ছুটি নিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, কিন্তু বিধি আমার সঙ্গে দেখা করলো না! এমনকি ওর নম্বরে ফোন করে দেখলাম বারবার বিজি আসছে, বুঝলাম আমাকে ব্লক করেছে।
শিয়ালদহ থেকে নর্থের একটা ট্রেনে উঠে বসলাম। বোধহয় লালগোলা প্যাসেঞ্জার। লালগোলা পর্যন্তই রিটার্ন টিকিট কেটে উঠে বসলাম। আমার ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছি। বাবা, মা, দাদা, বন্ধু কারো সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। রাগ দুঃখ মনখারাপ ঘৃণা সব মিলিয়ে কেমন একটা অনুভূতি, সে যে কেমন একটা অসাড় করা অনুভূতি! এর যে কি নাম, আমি জানি না। মাথাটা একেবারে ফাঁকা! ব্ল্যাঙ্ক!
ট্রেন চললো, ফাঁকায় ফাঁকায় উঠেছিলাম বলে জানালার ধারে সিট পেয়েছিলাম। জানালার পাশে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার মত মানসিক অবস্থা আমার ছিল না। চোখ বুজে ঝিম মেরে বসে রইলাম। মাথার মধ্যে জয়ী ভাসতে লাগলো, মনের মধ্যে পাক খেতে লাগলো জয়ীর মুখখানা, ওর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখটা, পিরিয়ডের দিনগুলোর মলিন মুখ।
কি হলো? কেন হলো? আমি কি এমন করলাম যে কোন কিছু না বলে জয়ী আমাকে একা করে হারিয়ে গেল? কি দোষ আমার? কেন, কেন?
আমার অজান্তেই কখন যেন গাল বেয়ে জল পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমার গাল, শার্টের কলার। এভাবে কতক্ষণ যে বসে ছিলাম, জানি না! কিন্তু ট্রেন যখন আবার ফিরে এলো শেয়ালদহ স্টেশনে, বাধ্য হলাম ট্রেন থেকে নামতে। ভীষণ অবসন্ন লাগছে! ধীরে ধীরে পা বাড়ালাম মেসের দিকে।
মেসে ঢুকতেই শুভ হৈ হৈ করে উঠলো, “কি ব্যাপার, সকাল থেকেই উধাও! কোথায় ছিলি?”
“এই একটু”, প্রচন্ড ক্লান্তি সারাদিন না খাওয়া আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না।
-“বিধি এসেছিল”
-“কি? কেন?” আমি যেন আবার শক্তি ফিরে পেলাম।
-“কিছু বলেনি, তোর ফোন অফ দেখে, এই কাগজটা দিয়ে গেছে..”আমি লাফ দিয়ে ওর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে খুললাম! একটা চিঠি, জয়ীর চিঠি। বুঝলাম আমার ভেতরটা কাঁপছে, হার্ট বিট প্রায় একশো, আমার হাত কাঁপতে লাগলো থরথর করে, অজানা আশঙ্কাগুলো হুড়মুড় করে নামতে লাগলো যেন।
লক্ষ্মীটি,
রাগ কোরো না, ভুল বুঝো না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি। তাই আমার অসম্পূর্ণ জীবন নিয়ে তোমার জীবনকেও অসম্পূর্ণ, দুর্বিষহ করে দিতে পারবো না।
আমার পেটের ব্যথাটা আসলে ইউট্রাস ক্যান্সার। ফার্স্ট স্টেজ, তাই জরায়ু কেটে বাদ দিতে হয়েছে।
এ কদিন হাসপাতালে ছিলাম, তাই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো নি। আজ রিলিজ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।
ডাক্তার বলেছেন, আমি কোনোদিন মা হতে পারবো না। কিন্তু তোমার বাবা হবার অধিকার আমি কেড়ে নিতে পারবো না।
ভালো থেকো, সুখে থেকো, আর আমাকে ভুলে যেও।
জয়ীআমার মাথা রাগে দপদপ করতে লাগল। দুঃখ নয়, প্রচন্ড রাগ! মেয়েটা কি মুর্খ? আমাদের মধ্যে ওসব বাবা হওয়া, মা হওয়া কবে এলো? আমি এসব কবে বললাম? জয়ী কেন টিপিক্যাল মেয়ে হয়ে গেলো? ও না বিপ্লবের কথা বলতো। ওর মনে কোথায় ছিল এই অত্যন্ত সাধারণ এক মেয়ের ইচ্ছে?
না, ওকে আমায় খুঁজে বার করতেই হবে, ওকে বোঝাতেই হবে, সন্তান হওয়া না হওয়ার সঙ্গে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই! ও আর সবার মত নয় ও আলাদা, সবার থেকে আলাদা!
আমরা একে অপরের জন্য বাঁচবো, বাকি দশজনের জন্য বাঁচবো। ওকে বোঝাতেই হবে, সন্তান না হলেই একটা মেয়ে শেষ হয়ে যায় না। সন্তান না হলেও একজন প্রিয় মানুষের মূল্য কখনোই কমে যায় না!
আমি সঙ্গে সঙ্গেই ছুটলাম জয়ীর হস্টেলের দিকে, দেখি বিধির থেকে ওর গ্রামের বাড়ির ঠিকানা পাওয়া যায় কিনা! আমাকে যে জয়ীকে খুঁজে বার করতেই হবে, আমার যে শুধু ওকেই চাই, আমার যে শুধু ওকেই দরকার, আজীবন, সারা জীবনের জন্য।
-
গল্প- পাগলী
পাগলী
– শম্পা সাহা-এই শুনছো?
-উঁ”, মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে স্বাতীর ডাকে অন্যমনস্ক সাড়া রথীনের।
-শোনো না…
-কি হল? রথীনের গলায় বিরক্তি ঝরে পড়ে।
-আমার কিছুতেই ঘুম আসছে না।
-কেন, ঘুমের ওষুধটা খাওনি আজ?
-খেয়েছি তো!
-তাহলে? মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ না তুলেই স্বাতীর দিকে আলগা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় রথীন।
-তবু ঘুম আসছে না! স্বাতীর গলায় ক্লান্তি আর হতাশার মিশেল।
-এবার গিয়ে তাহলে ডাক্তারকে বলবে, ডোজটা একটু বাড়িয়ে দিতে। রোজ রোজ এভাবে না ঘুমিয়ে থাকলে সকালে অফিস যাবে কি করে? তাছাড়া এভাবে চললে তো শরীরও খারাপ করবে।
-আমায় তুমি আর ভালোবাসো না বলো? স্বাতীর গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ে।
-কেন? হঠাৎ আবার এসব কথা কেন? রথীনের চোখ তখনো হোয়াটসঅ্যাপে।
-কখন থেকে ডাকছি, আর তুমি সেই থেকে মোবাইল খু্ঁচিয়েই যাচ্ছো!
-চোখ দিয়ে শুনবো না কান দিয়ে? আমি শুনছি। রথীন গম্ভীর।
-স্বাতীর বাচ্চাটা মিসক্যারেজ হয়ে যাবার পর থেকেই ও ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনে চলে যেতে থাকে। কারো সঙ্গে কথা বলতো না, ঘর থেকে বেরোতো না, এমনকি একটা সময় তো এমন হয়েছিল, অফিস যাওয়াও বন্ধ!
বহু ওষুধ, ডাক্তার, কাউন্সেলিং-এ এখন অনেকটা ভালো কিন্তু তার পরবর্তী উপসর্গ হিসেবে এই ইনসমনিয়া!বেশিরভাগ দিনই সারারাত দু’ চোখের পাতা এক করতে পারে না। লম্বা লম্বা অসহ্য, বেসুরো গানের মতো রাতগুলো মনের সবকটা স্নায়ুকে একেবারে জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।
চোখের সামনে দেখে, কি ভাবে রথীন নাক ডেকে ঘুমোয়, কি ভাবে রাত জাগা ট্রাক ড্রাইভার জোরে হুঁস্ করে ট্রাক নিয়ে বেড়িয়ে যায়। বড় রাস্তার একেবারে পাশে ওদের ফ্ল্যাট, সব শব্দই যেন ওর রাতজাগাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ঘুমের ওষুধগুলোও যেন আজকাল ঠাট্টা করে। শুধু ধীরে ধীরে রক্তে স্নায়ু ক্লান্তির রাসায়নিকের মাত্রাই বাড়তে থাকে, ঘুম আর আসে না!
আজ কতদিন যে স্বাতী ঘুমোয়নি! মাঝে মাঝে রথীনকে ডাকে গল্প করতে, একটু কেউ কথা বললেও শান্তি! রথীন বিরক্ত হয়, স্বাভাবিক। ওরও তো সকালবেলা অফিস যাওয়া থাকে। ডাক্তার দেখাচ্ছে, ওষুধ খাচ্ছে, কাউন্সেলিং চলছে, আর কি করার থাকতে পারে রথীনের?
আজ কিন্তু মনটাও চরম অশান্ত, স্বাতীর ভিতরে ভিতরে একটা ভয়ংকর আনচান অবস্থা। খারাপ লাগা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ভীষণ ভাবে।ও হঠাৎই উঠে বসে খাটের উপর, তারপর খাট থেকে মেঝেতে পা দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
-কি হলো, উঠলে যে?” ঝট্ করে রথীনের দিকে ঘাড় ঘোরায় স্বাতী।
-তুমি তোমার মোবাইল নিয়ে থাকো! আবার ভালো থাকা মন্দ থাকার তোমার কাছে কোন মূল্য নেই যখন, তখন তোমাকে ভাবতে হবে না!
দ্রুতপায়ে ঘর ছেড়ে বেরোতে যায় স্বাতী। আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে! এ জীবন অসহ্য! কারো কাছে আর কোন মূল্য নেই ওর! সন্তান হারানোর কষ্ট যেন ওর একার, মন খারাপ তাও ওর! রাত জাগার কষ্ট তাও শুধু ওরই! তাহলে ওর আর এসব কিছুরই দরকার নেই!ওর ভাব দেখে রথীন ভয় পেয়ে যায়। চট করে উঠে তাড়াতাড়ি স্বাতীর হাত চেপে ধরে। স্বাতীর আচার-আচরণ ওর কেমন একটা অস্বাভাবিক ঠেকে।
স্বাতী এক ঝটকায় রথীনের হাত ছাড়িয়ে ঘরের বাইরে যেতে চায়, কিন্তু ততক্ষণে ও বাঁধা পড়েছে রথীনের দুই বাহুর শক্ত বাঁধনে। রথীন আঁকড়ে ধরে স্বাতীর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে, কে বলেছে পাগলী, তোমার থাকা না থাকার আমার কাছে কোন মূল্য নেই? কে বলেছে তোমার মন খারাপে আমার মন খারাপ হয় না?কে বলেছে তোমার কষ্টগুলো আমার কষ্ট নয়? তুমি একটা পাগলী, আস্ত পাগলী!
শক্ত করে ওকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রথীন। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে স্বাতী। রথীন চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় ওর পাগলীকে।
-
অণু গল্প- শেষ চিঠি
শেষ চিঠি
– শম্পা সাহাজানো তো, ক’দিন ধরে তোমার কথা খুব মনে পড়ছে। আসলে যবে থেকে জানতে পেরেছি আমি আর বেশিদিন নেই, মানে ডাক্তার বলেছে!ডাক্তার বলেছে আমার নাকি হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, ওই তোমরা যাকে বল ভালভ্ ব্লক হয়ে যাওয়া। তাতে যা অবস্থা মাস দুই তিন বা তারও কম। এখন আমি লাইফ সাপোর্টে আছি, তাই চিঠি লিখতে পারছি না আর তোমার ফোন নাম্বার তো নেই। থাকলেও ফোন করতে পারতাম কিনা জানি না? কারণ তিন সন্তানের মা তার কোনো এক প্রাক্তন প্রেমিককে ফোন করবে আর তার সন্তানেরা সেটা মেনে নেবে, ভারতবর্ষ এখনো এতোটা আধুনিক হয়নি।
হৃদযন্ত্র বিকল তো হবেই, এমন একটা অমনোযোগী, নিষ্ঠুর আর অহংকারী লোকের হাতে দিয়েছি বিকল তো হতেই হতো। এতো অযত্ন, তবু যে এতদিন কিভাবে একেবারে ছন্দবদ্ধ ভাবে চলে গেলো, এটাই আশ্চর্য! মাঝে মাঝে অবশ্য বিদ্রোহও করতো। তখন এই নাকে নল আর বুকে তার লাগিয়ে শুয়ে থাকতাম হাসপাতালের কেবিনে। আসলে যন্ত্রণা হত প্রচন্ড, “সবাই বলত কোলেস্টেরল জমেছে” তারা তো কেউ জানত না এই হৃদযন্ত্রের শুধু কাঠামোটি ছিল আমার কাছে প্রাণটা তো ছিল না কোনো দিনই। সে যাই হোক বেচারা হৃদয় অকারণেই দোষী হতো। জানো তো ডাক্তার যাই বলুক, আমি কিন্তু মরবো না এখন কারণ আমার যে একটা গোপন স্বপ্ন আছে, সেই কিশোরী বয়স থেকেই। যবে থেকে তোমার সঙ্গে আলাপ তবে থেকেই। তা
তোমাকে বলিনি কোনোদিন, তুমি হাসবে বলে তবে আজ মনে হচ্ছে বললেই হতো। শুনে হাসবে না তো? আমার বড় ইচ্ছে এক শরৎ শেষের বর্ষণমুখর রাতে যে দিন সারারাত ধরে অঝোর বৃষ্টিতে চারিদিক সঁপসঁপে, তুমি আর আমি পাশাপাশি বসবো খোলা জানালার সামনে খাটের ওপর। তোমার কাঁধে থাকবে আমার মাথা, নাকে ভেসে আসবে তোমাদের উঠোনের ভেজা শিউলির গন্ধ, মাঝে মাঝে সামনের জানালার অর্ধেক ঢাকা পর্দা উড়বে আর সামনের রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলো এসে পড়বে তোমার মুখের ওপর।
অন্ধকার সেই রাতে আমরা কোনো কথা বলবো না, শুধু অনুভব করবো আমার পাশে তোমার থাকাটুকু। তোমার গায়ের মৃদু পুরুষালী গন্ধ আমাকে আশ্বস্ত করবে। তোমার কাঁধে মাথা রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়বো ধীরে ধীরে । জানতো ডাক্তার যতই বলুক, এ স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমি কিছুতেই মরতে পারবো না, কিছুতেই না…
“মা, মা, ও মা.. ডাক্তারবাবু দেখুন তো, মা কিছুতেই চোখ খুলছে না, এতো ডাকছি! ও মা মা… “ -
কবিতা- তোকে আমি আর চাই না
তোকে আমি আর চাই না
– শম্পা সাহাযখন চলে গেছিস তখন ফেরার কথা আর ভাবিস না
তুই ভাবলেও আমি ভাবতে দেবো না
না, আমি প্রেমিকা হলেও ন্যাকা প্রেমিকা নই
যারা সারাজীবন প্রেম প্রেম করে হেদিয়ে মরে
জানিনা কোনো স্বর্গে তাদের জন্য কোনো মূল্যবান সিংহাসন রাখা আছে কিনা?
থাকলেও আমার চাই নাযেদিন আমি কালো বলে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলি
হাজার চুমু খাবার সময় চোখ বোজা ছিল
তাই বোধহয় আগে গায়ের রংটা চোখে পরেনিযেদিন আমার বাবা গরীব বলে শুনিয়েছিলি
“বিয়েতে চার লাখ খরচ, তা তো আর তোর বাবা দিতে পারবে না, তাই দেরীতে বিয়ে”
অথচ তার আগে মাত্র দু’মাস আগেই আমরা বিয়ে করবো প্রতিশ্রুতি দিয়ে
ফাঁকা ঘরে আমায় ছুঁতে তোর বাধেনি
তখন এসব টাকাপয়সা হিসেব নিকেশ তুচ্ছএকটু একটু করে আমাকে শুষেছিস
আর তোর মোহ মিটতে মিটতে তলানিতে
সামান্য দোষে আমাকে এক কথায় ছেড়ে যেতে তুই দুবার ভাবিসনি
পিছন ফিরে তাকাসনি একবার ওতারপর জীবনের কানা গলিতে ঠোক্কর খেতে খেতে যখন মনে হয়েছে
আমি বোধহয় ভালো ছিলাম আরো অনেকের চেয়ে
আমার দোষগুলোই তখন গুণ হয়ে গেলথাক চাইনা তোর ঐ ড্যামেজ কন্ট্রোল
যে একবার ছেড়ে যেতে পারে
সে বারবারই পারে ভরসা ভাঙতে
জানিস তো ভাঙা কাঁচে যতো জোড়া লাগাস
চিড়টা কিন্তু থেকেই যায়আমার চিড় ধরা জীবন বা সম্পর্ক কোনোটাই চাইনা
সেদিন তুই আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলি
আজ আমি তোকে ফিরিয়ে দিলাম
তোকে আমি আর চাই না। -
কবিতা- এভাবেও ফিরে আসা যায়
এভাবেও ফিরে আসা যায়
– শম্পা সাহাফিরে তো সব সময়ই আসা যায়
ঘুরে দাঁড়ানো যায় যে কোনো সময়ই
বিশেষ করে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঘুরে দাঁড়াতে তো হবেই।যে মেয়েটাকে গর্ভেই কন্যা ভ্রুণ বলে মারতে চাওয়া হয়েছিল
কোন রকমে কারো দয়ায় সে প্রাণ পেলে জন্ম দিতে পারে আর একটা প্রাণেরযে মেয়েটা সারা জীবন কালো, মোটা আই বুড়ি নানান তকমাতে দেগে
সে সারাদিনের পরিশ্রমের পর বাবার হাঁপানির ওষুধটা আনতে ভোলে নাযে মেয়েটা ঠোঁটে চড়া রং মেখে রোজ দাঁড়ায় ল্যাম্পপোস্টের আলোর নীচে
প্রতি দিন একতাল মাংস পিণ্ডের নিচে ধুকপুক করে
অসুস্থ ঘরে রেখে আসা অভুক্ত সন্তানের চিন্তা
ফিরে এসেই কোলে তুলে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয় বাছাকেযে ছেলেটা বত্রিশটা চাকরির ইন্টারভিউতে রিজেক্টেড হয়ে
রেল লাইনের ধারে জীবনের শেষ বিড়িটা ধরাতে গিয়ে
অসাবধান বৃদ্ধকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে চলন্ত ট্রেনের সামনেযে মেয়েটা প্রেমিকের প্রতারণার চিহ্ন বয়ে বেড়ায় ক্ষত বিক্ষত মনে
অথবা পণের বলি হতে, পণ্য হতে গিয়েও যে বেঁচে ফিরে হাসি মুখে আবার দাঁড়ায় সূর্যের মুখোমুখি
অ্যাসিড বিকৃত মুখ নিয়েও যারা জীবনকে ভালোবাসে
তারা সবাই তো এভাবেই ফিরে এসেছেখাদের কিনারা থেকে, কূয়োর ধার থেকে, ফাঁসির ঝুলন্ত দড়ির সামনে থেকে
তারা তো বার বারই ফিরে এসেছে
বলে গেছে এভাবেও ফিরে আসা যায়
এভাবেই ফিরে আসতে হয়
তাহলে তুমি এখনো কিসের অপেক্ষা করছো?
কার অপেক্ষা করছো?
আর করছো কেনই বা? -
কবিতা- হলদে চিঠি
হলদে চিঠি
– শম্পা সাহাযখন হঠাৎ বলেছিলে
“আমি আর সম্পর্কে আগ্ৰহী নই”,
কারণ না দেখিয়ে সামনের পথটা তোমার প্রিয় মনে হলো
আমার চেয়েও অনেক অনেক বেশি প্রিয়
হয়তো ভেবেছিলে চিৎকার করে কাঁদবো
হয়তো ভেবেছিলে দয়া ভিক্ষা চাইবো
হয়তো ভেবেছিলে বলবো,
“প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাস না”,
হয়তো আমাকে ঠিক ছাড়তেও চাওনি
শুধু বাজিয়ে দেখে নিতে চেয়েছিলে
আমার সমর্পণ কতোখানি পূর্ণ শতাংশ
হয়তো এটাও জানতে চেয়েছো
আমাকে বাদ দিয়ে আমি ঠিক কতোখানি
কতোখানি শুধু তোমার ইচ্ছে কেই নিজের ইচ্ছে মানি
হয়তো চেয়েছিলে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়বো
অথবা ঠোঁটে মাখবো ইঁদুর মারা বিষ
নিদেন তোমার মা দাদার কাছে দরবার করবো
তুলে ধরবো আমার অসহায়তা
কাঁদবো মাথা কুটবো তোমার মনের দরজায়
প্রেম ভিক্ষা চাইবো
অসহায় ভিখিরীর মত চাইনি তো
চাইতে পারিনি কোনো দয়া কোনো কৃপা
মনে করাইনি কোনো বিগত চুম্বন
অথবা কাটানো হাতে হাত, ঠোঁটে ঠোঁট
কোনো অতীত সংবাদ
শুধু দেখলাম তুমি চলে গেলে
বিপুল পৌরুষ বজায় রেখে
অথবা অহংকার
পিছু ফিরে ডাকিনি তো আর
জানি এক যুগের ভালোবাসা মুহুর্তে বেরঙীন যবে
সে প্রেম ফেরাতে পেরেছে কোনো প্রেম হারা প্রেমিক কে কবে?
যবে সব ছোঁয়া বিগত অতীত
সব ভালোবাসা প্রেম বাসন্তী বিকেল
মুহুর্তে মিথ্যে হয়ে যায়
সে প্রেম চাইনি তো কোনোদিন
তোমার চলে যাওয়া আজও রোজ দেখি
সেই এক মোড়ে দাঁড়িয়েই
জানি ফিরবে না কোনোদিনও আর
তবুও আমি হারিনি তাও জানি
সব কাহিনী উপসংহারে হয় না তো শেষ
বেশ তবে তাই হোক
মিথ্যা প্রেমের বোঝা বওয়ার চেয়ে এই ভালো
সব তুলসী তলায় জানি সন্ধ্যায় জ্বলে না তো আলো
কিছু অন্ধকার না হয় হোক আলোর সমান
কিছু প্রেমের হলদে হয়ে আসা চিঠির ফাঁকেই হোক স্থান। -
অণু গল্প- চড়
চড়
– শম্পা সাহা‘ঠাস’ হঠাৎ একটা আচমকা শব্দ যেন গালে নয় আছড়ে পড়ল সবার মনের ওপর। বাঁ গালে হাত বুলাতে বুলাতে অবাক হয়ে অর্ক মায়ের দিকে তাকিয়ে। প্রদীপ বাবু বুঝতে পারেন না হঠাৎ কি হলো? অর্ক মায়ের বিরুদ্ধে কি একটা বলতে গিয়ে থমকে চুপ করে রেগেমেগে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
মনমোহিনী বালিকা বিদ্যালয়ের অংকের রাশভারী প্রধান শিক্ষিকা প্রভাবতী দেবী । যেমন ডাকসাইটে তেমনি দুর্দান্ত দিদিমণি। হেডমিস্ট্রেস, অফিসিয়াল কাজের চাপ বা মিড-ডে-মিল থাকলেও প্রতিদিন চেষ্টা করতেন একটা করে ক্লাস নেওয়ার। তাই ছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কটা যেমন ভালো তেমনি তাদের কাছে জনপ্রিয়ও বটে। তবে শুধু রাগী বলে বা ভালো পড়ান বলে নয় প্রভাবতী একজন ছাত্রদরদী শিক্ষিকা বলে। এক ছেলে অর্ক আর মেয়ে অঙ্কিতা।
বেশ চোখে চোখে মানুষ করেন ছেলেমেয়েদের। একটু নিয়মের নড়চড় নেই। বা রে! মানুষের মতো মানুষ হতে হবে না?
প্রদীপ বাবু ভালো মানুষ গোত্রীয়, মাস্টার বটে কিন্তু বাংলার, বিষয়ের মতো নরম সরম, বৈষয়িক ব্যাপারে বীতস্পৃহ । একটু-আধটু লেখালেখিও করেন। নিজের বই পড়া আর লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত আর ব্যস্ত নিজের স্কুল নিয়ে । আসলে বউ এর দাপটে শশব্যস্ত।সবাই জানে অর্ক আর অঙ্কিতা খুব ভালো, যেমন পড়াশুনা তেমন আচার-আচরণে। হবে না?
মা যেমন দাপুটে ! প্রভাবতী দেবীও ছেলের ভালো ব্যবহার আর ভালো রেজাল্টের ফলে, ছেলে মানুষের মত মানুষ হচ্ছে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ।অর্ক মা বলতে অজ্ঞান। সবে ক্লাস ইলেভেন সাইন্স। পাশের স্কুলে পড়ে। প্রভাবতী দেবী বছর তিনেক হলো মনোমোহিনীতে হেডমিস্ট্রেস হয়ে এসেছেন। তার আগে অবশ্য দূরে বারাসাত কলোনি স্কুলে ছিলেন ।
বাড়ির কাছাকাছি স্কুল হলে যাতায়াতে অত সময় নষ্ট হবে না, ছেলে মেয়েকে আরো একটু সময় দেওয়া যাবে এই ভেবেই সহ শিক্ষিকা থেকে হেডমিস্ট্রেস হওয়া।
অঙ্কিতা এখনও নরম মাটির দলা, মায়ের আঁচল ধরা। প্রভাবতী দেবী ছেলে গরবে গরবিনী । হবেন নাই বা কেন? অর্ক মাধ্যমিকে জেলার মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে আর রাজ্যে সপ্তদশ তাই শুধু প্রভাবতীই নয় অর্ককে নিয়ে পুরো পরিবারই গর্বিত।
পড়তে বসে অঙ্কিতা হঠাৎই বলে উঠলো, “জানো মা, দাদা না আজ স্বাতী দিদির সঙ্গে ঝগড়া করছিলো”
– “ঝগড়া?” প্রভাবতী অবাক, “স্বাতী কে?” প্রভাবতী দেবী একটু কৌতুহলী।
-“স্বাতী দিদি আমাদের স্কুলে পড়ে, নাইনে।”
-“দাদা ওর সঙ্গে ঝগড়া করছিলো কেন?”
-“রোজ যখন স্কুলে যাই দাদা স্বাতী দিদির সঙ্গে কথা বলতে চায়, স্বাতী দিদি চায় না।”
স্বাতী অঙ্কিতার স্কুলে পড়ে। প্রভাবতী পাশের স্কুলে ইচ্ছে করেই মেয়েকে দিয়েছেন, নিজের স্কুলে না দিয়ে। নিজের কাজের প্রভাব যদি মেয়ের উপর পড়ে।সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে ডেকে পাঠান।
“স্বাতী কে? তোমার সঙ্গে তার ঝগড়া হয় কেন?”
– “ধুর, ও একটা বাজে মেয়ে।” ওর বাজে মেয়ে কথাটা উচ্চারণের ভঙ্গি দেখে প্রভাবতী অবাক । একট বয়সে ছোট মেয়ের সম্পর্কে ছেলের বাজে শব্দটা উচ্চারণ করার ভঙ্গি দেখে প্রভাবতী চমকে ওঠেন। অর্ক কবে এরকম বদলে গেল? কবে মানুষকে বিশেষ করে মেয়েদের সম্পর্কে এভাবে অবজ্ঞা করে কথা বলতে শিখলো? শুধু ছেলের রেজাল্ট আর মিষ্টি বুলিতে ভুলে ওর ভেতরের আমূল পরিবর্তনটাই প্রভাবতী বুঝতে পারেননি।রাগে দুঃখে যেন নিজের উপরই ক্ষেপে উঠলেন প্রভাবতী। ছেলেকে বললেন, “ভালো ভাবে কথা বলো, মনে রেখো তুমি একজন মেয়ের সম্পর্কে কথা বলছো।”
-“যা বাব্বা! আমি আবার কি করলাম?”
-“কিছু করনি, কিন্তু ভদ্রভাবে কথা বলো। আর তার সম্পর্কে তোমার এত বিরক্তি কেন?”অর্ক দু’হাত ছড়িয়ে কাঁধ নাচিয়ে বলে, “আরে ওই ফালতু মেয়েটা আমাকে ..”
ব্যাস আর কথা শেষ করতে পারে না অর্ক। প্রভাবতীর চড়টা সজোরে এসে পড়ে ছেলের গালে।
-“একটা মেয়েকে ফালতু বলার তুমি কে? এসব বিশেষণ বাদ দিয়ে আসল কথাটা বলো..”অর্ক বোনের সামনে চড় খেয়ে হতভম্ব। প্রভাবতী ভাবছেন চড়টা মারলেন বটে, তবে মনে হয় যেন চড়টা আরো আগেই মারতে হত, তবে বেটার লেট দ্যান নেভার!
-
কবিতা- প্রেম
প্রেম
-শম্পা সাহাচোদ্দো বছরের সরল কিশোরী আড়চোখে তাকায়
তার একই ক্লাসে পড়া সহপাঠীর দিকেএকটা প্রেমের সূত্রপাত হল
শরতের শিশির ধোয়া শিউলির মত!বছর বাইশের এমে ক্লাস
আগের প্রেমের দাগা মুছে
ফের পড়ে চশমা পড়া ঐ ছটফটে ফাজিলের প্রেমেতারুণ্যের প্রেম
বসন্তের লালরঙা সুগন্ধি গোলাপ!শাখা সিঁদুরে রেঙে
পাশে দাঁড়ানো টোপর পড়ার প্রেমে
একেবারে সইসাবুদে বাঁধা পড়ে
টগবগে লালচেলীযৌবনের নিরাপদ প্রেম
বৃষ্টস্নাত কামিনীর মত মাতাল করা
নেশা ধরানো।শীতের সকালে
গরম চায়ের কাপ ধরা হাতখানা
বড় প্রেম জাগায়
মুখে বলীরেখা,চুলে দু একটা পাক
থাক
ঐ যেন বড় প্রেম জাগানিয়াবার্ধক্যের প্রেম
শীতের সকালের রোদে ভেজা গাঁদা
গন্ধ?
আছে যাও
কাছে যাও!তবু এরই ফাঁকে কত দেবদাস
কত বিরহ, বিরোধিতা, কত বিচ্ছেদ!
কত নাম না জানা জংলা ফুল
ফুটে ঝরে গেছে
কেউ তার খবর রাখেনি
সে খবর তুমি আমি কতটুকুই বা জানি
প্রেমটা সবার
দুঃখটা কারোর কারোর! -
গল্প- চিংড়ি
চিংড়ি
-শম্পা সাহা“আবার তুমি এতগুলো চিংড়ি মাছ নিয়ে এসেছ এই অবেলায়! আমি স্কুলে বেরোবো, না চিংড়ি বাছবো? এ হে হে এগুলো তো নরম! ফ্রিজে রেখে দিলেও খারাপ হয়ে যাবে! কত করে নিল?”
“সত্তর টাকা শ”,
রাঘবের উত্তর শুনে চোখ কপালে চন্দ্রার।
“তুমি জানো, আজ ফুলির মা আসেনি তাও ! আমি বাছতে পারবো না, বসে বসে তুমি বাছো গে”!রাঘব মনে মনে লজ্জিত হয়। সত্যিই তো ফুলির মা আজ আসবে না, চন্দ্রা গতকালই বলেছিল। ও কি মনে থাকে ছাই ! চিংড়ি দেখে একটু লাউ চিংড়ি খাবার ইচ্ছে হয়। মিন মিন করে বললো,
“রাতে করলেও হবে”,
“কিন্তু বাছবে কে?” চোখের সামনে খুন্তি নাড়ায় চন্দ্রা।স্কুলে বেরোতে হবে সাড়ে নটার মধ্যে। অন্যরা তো বের হয় সেই কোন ভোরে, নেহাত এসএসসিতে রাঙ্কিং ভালো ছিল, তাই বাড়ির কাছে স্কুল! না হলে টের পাওয়া যেত, মনে মনে গজগজ করে চন্দ্রা। হাঁটা দেয় রান্নাঘরের দিকে। এসব নিয়ে ভাবলেই মাথা গরম হয়ে যায়, লোকটার কি কোনোদিন বুদ্ধি হবে না!
সহেলি বিরক্ত হয়, রোজ এক ঘটনা। বাবার কি কোনোদিনই বুদ্ধি হবে না!
পাশের বাড়ির অপর্ণার মা চেঁচামেচি শুনে উঁকি দেয়, “কি হল গো বৌদি, এত রাগ করছো কেন?”
“আর বোলো না! এই দেখো না তোমার দাদা, এই সময় একগাদা চিংড়ি এনে হাজির করেছে! এখন কে বাছবে?”
“কেন ফুলির মা আসেনি?”
“সে তো আজ ছুটি নিয়েছে”
“ওহ্, তাহলে আমাকে দাও, আমি বেছে দিচ্ছি।
“সত্যিই দেবে? তোমার রান্না হয়ে গেছে?” হাতে চাঁদ পায় চন্দ্রা!
“আমার আবার রান্না! ও তো কখন সারা! দাও আমি বেছে দিচ্ছি।”
চন্দ্রা জানালা দিয়ে মাছের প্লাস্টিকটা বাড়িয়ে দেয়।সত্যিই মাঝে মাঝে অপর্ণার মা বেশ ত্রাতার ভূমিকা নেয়। কাঁথা কেচে দেওয়া, পোড়া কড়াই মেজে দেওয়া, লেপ-তোষক রোদে দেওয়া, বেশি লোকজন আসলে রান্নাঘরে সাহায্য করা। ফুলির মা তো লাট সাহেব, তাকে কিছু বললে বলে ওঠে, “দত্ত কাকিমা রাগ করবে বা ডাক্তার বৌদির দেরি হয়ে যাবে”, মনে মনে আওড়ায় চন্দ্রা ।
অপর্ণার মা খুব যত্ন করে মাছগুলো বেছে, ধুয়ে, নুন হলুদ মাখিয়ে দেয়, চন্দ্রা স্কুলে বেরোবার আগেই। চন্দ্রা বাটিটা ফ্রিজে তুলে রাখে, কাল রাঁধবে।
অপর্ণার মা একটা পেঁয়াজ আর একটা ছোট আলু কুচিয়ে নেয়। ওই চিংড়ির মাথাগুলো দিয়ে মেয়েটাকে একটু চচ্চড়ি করে দেবে। মেয়েটা চিংড়ি খুব ভালোবাসে, ওর বাবার কাজটা যাওয়ার পর থেকে তো মাছ বলতে পুঁটি তাও সপ্তাহে একবার । অপর্ণার মা যত্ন করে মাথাগুলো ধোয়, যাতে জলের তোড়ে একটাও পড়ে না যায়।