-
কবিতা- হৃদয় দেবতা
হৃদয় দেবতা
-শিলাবৃষ্টিঅন্তরে প্রভু আছো সদা মম,
বাহিরেও দেখি তোমারে,
নক্ষত্রের দীপ্ত আলোকে
আলোকিত করো সবারে।
মন্দ বাতাসে অনুভূত তুমি
সাগরের নীলে সীমাহীন।
এ জীবনে মোর সকলই তুচ্ছ –
যদি হই আমি তোমা-বীন।
সবুজে সবুজে শ্যামলকান্তি
প্রিয়তম তুমি আছো
যে ফুল ফুটিছে তব পদতলে
রঙে রূপে বিরাজিছ।
মরূ প্রান্তরে দাও জল তুমি
আঁধারে ফোটাও আলো,
ক্ষমা ভরা থাক দুচোখ তোমার
জগতের করো ভালো।। -
কবিতা- হেমন্তিকা
হেমন্তিকা
-শিলাবৃষ্টিবঙ্গের এই রঙ্গশালায়
নটরাজের নাচন…
ছয়টি কালের আসা যাওয়া
মনের মাঝে মাতন ।
ঢাকের বাদ্যি ,শিউলি শালুক
শরৎ সুবাস শেষে,
বৈরাগিনী হেমন্তিকা
আসলো মৃদু হেসে ।
হিমেল আবরণে আজ
ঘোমটা খানি টেনে —
দুহাত ভরে দিয়েই গেলে
স্ব- স্নিগ্ধ নয়নে ।
খেটে মরে চাষি সারা দিনভর
বারোমাস জলেরোদে,
মুখের আহার জোগায় তারা
মেটায় পেটের খিদে।
হেমন্তে এসে উৎসবে মাতে
হাতে হাতে ধান কাটে,
স্বর্ণ ফসলে ভরে দেয় গোলা
আনন্দ মাঠে বাটে ।
আঙিনার মাঝে ঘট পাতা ঐ
নতুন ধানের শিসে
উৎসব হোক তোমার আমার…
স্নেহ ভালবাসা মিশে।
নবান্ন এল প্রতি ঘরে ঘরে
মাঠের সোনার ধানে ,
অঙ্গন আজ হাসছে দেখো …
তোমার পূর্ণ দানে।
নিজেকে কেন গুটিয়ে রাখা !
বিষন্নতার ছায়ে !
হেমন্তিকার প্রাচুর্য তো –
তোমার পায়ে পায়ে ।
মমতাময়ী মাগো আমার
উদাস কেন বলো ?
নতুন ধানের ঘ্রাণে যখন-
সবাই দেখে আলো !
তোমার আশিস মাথায় নিয়ে
আনন্দে আজ মাতি,
শাঁখ বাজিয়ে,উলু দিয়ে
“নবান্নে” হও সাথি । -
কবিতা- জ্বালাও তোমার আলো
জ্বালাও তোমার আলো
-শিলাবৃষ্টিসিঁদুরে চন্দনে মাগো !
সাজাই তোমার পট,
আম্রপল্লব দিয়ে …
পেতেছি মা’র ঘট।
চালপিটুলির আলপনাতে
সাজলো গেহখানি,
পায়ে পায়ে এসো ঘরে
ওগো লক্ষ্মীরাণী ।
নববস্ত্র পানসুপুরি ,
নারকেল আর চিড়া,
ভুবনমোহিনী রূপে মাগো
জগৎ আলো করা।
সব কালোকে দূর করো মা
তোমার আশীর্বাদে,
ঘরে ঘরে জ্বালাও আলো
কেউ যেন না কাঁদে।
আজো কেন দুধের শিশু
মরে ক্ষুধার জ্বালায় !
গরীব কেন এই সমাজে
অবহেলাই পায় !
মাগো ,তুমি তাদের দেখো
ঘুচাও যত কালো ,
পঞ্চপ্রদীপ সাজিয়ে দিলাম-
জ্বালাও তোমার আলো -
কবিতা- আগমনীর আবাহনে
আগমনীর আবাহনে
শিলাবৃষ্টিপেঁজা তুলো মেঘে আকাশ গিয়েছে ছেয়ে
বৃষ্টিদানারা তবু টুপটাপ ঝরে,
হলুদবসনা কন্যারা ওঠে সেজে
বরণের ডালা প্রস্তুত ঘরে ঘরে।নদীতটে সাদা কাশফুল মাথা নাড়ে
খেয়া বেয়ে আসে ওপারের মাঝি-মাল্লা
পানকৌড়িরা ছোট্ট ডানায় ওড়ে
রোদ বৃষ্টির কোনটা যে দেয় পাল্লা !ভোরের শিশির ঘাসের আগায় ব’সে
মাথা নেড়ে নেড়ে জানায় সুপ্রভাত !
সূয্যি মামার সোনালী আলোর ছোঁয়ায়
কালো মেঘ বুঝি হয়েছে যে কুপকাৎ।কমলা আভায় সাদা শিউলির মেলা
প্রাঙ্গণে আঁকে অপরূপ আল্পনা ;
শহর গঞ্জে উৎসব সাজো সাজো
পল্লী উঠোনে ঢাকিদের জল্পনা।পদ্ম ফুটেছে মায়ের চরণ লাগি…
শালুক ফুলের ঘটেছে যে সমারোহ,
ব্যস্ততা ঐ কুমারপাড়ার দাওয়ায়,
এসো আজ সবে আগমনী গান গাহো। -
গল্প- দত্তক
দত্তক
– শিলাবৃষ্টিআমি রিনিঝিনি রায়। ছেলেবেলা থেকে কানাঘুষো শুনতে হয়েছে আমি দত্তক নেওয়া মেয়ে। একটা একান্নবর্তী পরিবারে আমি বড় হয়েছি। মায়ের কোনো অযত্ন ছিলনা কোনদিন। কিন্তু বাবা! না সেই মানুষটা হয়তো আমাকে সেভাবে মেনে নিতেই পারেননি। আসলে বাড়িতে আর পাঁচজন মানুষ যখন সমালোচনার ঝড় তোলে, তখন বাবা হয়তো ভাবেন যে বিরাট ভুল করে ফেলেছিলেন অতীতে!
আসলে আমিও এ বাড়ির আদব কায়দা মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেও পারিনি। আমার ভিতরে সবসময় একটা বিদ্রোহ কাজ করে। ছোটবেলায় বলতে পারতামনা, এখন বলি, প্রতিবাদের ভাষা আমার ঠোঁটে। আর সে জন্য কথায় কথায় আমাকে শুনতে হয় ” আমি এ বাড়ির দত্তক “।
” বিনোদবিহারী কোয়েড কলেজে ” সেকেণ্ড ইয়ারের ছাত্রী আমি। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে আজও কলেজে এসেছি। লিজার পিরিয়ডে অমল যথারীতি হাজির।
– চল রিনি এক পেয়ালা চায়ে চুমুক দিয়ে আসি ক্যাণ্টিনে।
অমল যে আমাকে লাইক করে সেটা আমার বুঝতে অসুবিধে হয়না। আমিও ওকে পছন্দ করিনা তা নয়! তবে ওকে সব বলা উচিৎ। বললাম
-তুই বাইক এনেছিস আজ?
-হ্যা, কেন রে?
-আজ লাস্ট পিরিয়ডের ক্লাসটা ডুব দিবি?
-বাব্বা! আজ রিনিঝিনি রায়ের হলো কি?
-ইয়ার্কি মারিসনা তো..
বিকেলের পড়ন্ত রোদে অমল আর আমি বাইকে
দিল্লী রোড ধরে অনেকটা পথ পেরিয়ে এলেও হঠাৎ বিনা মেঘেই বৃষ্টি নামলো। শেষে একটা মধ্যবিত্ত ধাবায় আমরা ঢুকে চা আর ওমলেট অর্ডার দিয়ে কোণের দুটো চেয়ার দখল করে বসলাম। এটা সেটা কথার পরে অমল বললো
-এবার আসল কথাটা বলে ফেল রিনি
– কি আসল কথা?
– যার জন্য ক্লাস অফ করে আমাকে নিয়ে এতদূর ছুটে এলি?
– হ্যাঁ, ঠিক ধরেছিস অমল…
– কিরে প্রোপোজ করবি নাকি?
বলেই অমল হা হা করে খানিক হেসে নিল।
নারে, যাতে তুই আমাকে কোনোদিন না প্রোপোজ করিস সেই ব্যবস্থা করতে।
কথাটা বলার সাথে সাথে অমলের মুখটা যেন রক্ত শূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ । বললো
-কাউকে ভালোবাসিস তুই?
-না তো –
– তবে? আমার ভালোবাসায় তোর কি আস্থা নেই?
– আজ আমার সব কথা তোকে শুনতে হবে।
– বল
জানিস অমল আমাদের বাড়িটা মানে আমি যেখানে থাকি সেটা একটা একান্নবর্তী পরিবার। এখনো এক রান্নাঘরে চোদ্দ জনের রান্না হয়।
বাবারা তিন ভাই। আমার বাবা মেজ।
জ্যেঠুর দুই সন্তান। কাকারও এক মেয়ে। কিন্তু আমার মায়ের বিয়ের ছ বছর কেটে যাওয়ার পরেও কোল ভরে কোনো সন্তান এলোনা। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছিল, অনেক জড়ি বুটি খাইয়েছিল ঠাম্মি কিন্তু না, মা সন্তান সুখ থেকে বঞ্চিতই থেকে গেল! জ্যেঠু কাকুরা যখন তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে ভীষণ সুখী, মা বাবা তখন আড়ালে চোখের জল ফেলতো। ঠাকুমা কথায় কথায় মাকে আঁটকুড়ি বলতো। সেই সময় একদিন হঠাৎ মায়ের বাপের বাড়ির পাশের এক বান্ধবী এ বাড়িতে আসেন আর মাকে জানিয়ে যান তিনিও ভাগ্য দোষে গর্ভে সন্তান ধারণ করেননি ঠিকই, কিন্তু তিনি একজন পরিপূর্ণ মা। তিনি একবছরের একটা শিশুকে দত্তক নিয়েছেন। মা যেন কথাটা শুনে হাতে চাঁদ পেয়ে গেল। বাবার কাছে দিন দুবেলা করুণ আবেদন নিয়ে বসে থাকলো। বাবা রাজি হতে পারেন নি সহজে, ঠাকুমা একেবারেই বেঁকে বসলো। বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকলো। মাও জেদ ধরে খাওয়া দাওয়া ত্যাগ করলো। অনেক লড়াই এর পরে পুরুলিয়ার এক অনাথ আশ্রম থেকে মা যে শিশু কন্যাকে দত্তক নিয়ে এসেছিল সেই মেয়েটা আজ তোর সামনে বসে আছে অমল..
বলতে বলতে চোখদুটো ভিজে যায় আমার। নিজের ভাবাবেগকে সংবরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করি। অমল কিন্তু নির্লিপ্ত। সে শুধু বলে
তাতে কি? কি এসে যায় তাতে?
অমল!
-বল, উত্তর দে। এতদিন যে শব্দগুলো শুধু মনেই জমা রেখেছিলাম, আজ তা প্রকাশ করছি রিনি।আই লাভ ইউ। আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসি পাগলী।
-কিন্তু, এ হয় না অমল। তোর বাড়ির কেউ আমাকে মেনে নেবেনা।
-দূর! আগে তো আমি তোকে প্রাণ ভরে ভালোবাসি, তারপর বাড়ি।
-অমল, আমাকে যে মা অনাথ আশ্রমে ফেলে চলে গিয়েছিল হয়তো সে কোনো
কুমারী! হয়তো মুসলিম! হয়তো বা
পতিতা! একবার ভেবে দেখ, কেন আমায় মানুষ মেনে নেবে?
-তোর কি দোষ? নিজেকে অসম্মান করিস না। যে মা তোকে বুকে নিয়ে সব দুঃখ ভুলে গিয়েছিল, পরম স্নেহে তোকে আগলে বড় করে তুলেছে, তোকে সন্তান হিসেবে পেয়ে যার সব শূন্যতা ভরে গেছে সেই তোর আসল মা।
অন্য কিছু আর ভাববিনা কোনোদিন।
বৃষ্টি কমে গেলেও আকাশে কালো মেঘ ছিল।
ফেরার পথে একবার দাঁড়িয়ে ও শুধু আমায় বললো – তুই নিজেকে ঘৃণা করিস?
আমি কোনো কথা না বলে ওর পিঠে মাথা রাখলাম।দুদিন কলেজে যাইনি। জ্বর কমছিলনা বলে মাকে নার্সিহোমে এডমিট করতে হয়েছিল। আগামীকাল সকালে ছুটি দেবে। বিকেলে অমল এসে হাজির। আমি তো চমকে গেছি প্রথমে। ও আমার ক্লাসমেট বলে পরিচয় দিল। বাবা মাও অবাক হয়েছে বুঝলাম। বাবা বসার টুলটা এগিয়ে দিল।এরপর ও বসে নিজস্ব বাচনভঙ্গীতে আলাপ চালিয়ে গেল। হঠাৎ একসময়ে মাকে প্রশ্ন করে বসলো
– মাসীমা! আপনার সেই ছোটবেলার বান্ধবীর নাম কি? যার কথায় আপনি রিনিকে দত্তক নিয়েছিলেন?
আমার খুব অস্বস্তি লাগছিল।
– বুড়ি। ভালো নাম অসীমা
– বাড়ী কোথায় ছিল মাসীমা?
– মগরার দিকে। পরে…
– পরে কোন্নগরে ফ্ল্যাট কিনেছিল। অসীমা সরকার। আমার মা। মা আর এই পৃথিবীতে নেই। আর আমিই সেই দত্তক নেওয়া ছেলে অমল।
অপার বিস্ময়ে আমি চমকে তাকাই অমলের দিকে। এও কি সম্ভব?
ও আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট কিরে হাসছে।
দেখ কি মিল আমাদের। একেবারে রাজজোটক।
বলেই মা আর বাবাকে প্রণাম করে বললো
—- আমি নিজেকে উপযুক্ত করে আবার আসবো। সেদিন রিনিকে চেয়ে নেব আপনাদের কাছ থেকে। আজ আসি।
আমার বিস্ময় তখনো কাটেনি। -
গল্প- অজান্তে…
অজান্তে…
-শিলাবৃষ্টিআজকাল কেকাকে কেমন অচেনা লাগে!
সব সময় ব্যস্ততা দেখায়! সত্যিই কি ও এতটা ব্যস্ত! মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় রাজুর। কেকাকে ছাড়া এখন কিছুই সে ভাবতে পারেনা, অথচ “ভালোবাসি তোকে ভীষণ” এই কথাটা আজো বলা হয়ে ওঠেনি। ঠিক যখন বলি বলি করছে মন তখনই কেকার পরিবর্তন রাজুকে ভাবনায় ফেলে দেয়।
“হ্যালো কেকা ”
‘বল, কিরে কথা বল। তাড়াতাড়ি বল।’
” সবসময় এত তাড়া কেন তোর কেকা? ‘
” আছে বন্ধু, তাড়া আছে। তোকে তো জোজোর কথা বলাই হয়নি! কখন বলি বলতো? ”
রাজু অবাক হয়! প্রশ্ন করে
” জোজো? ”
” হ্যাঁ বন্ধু। বেস্ট ফ্রেণ্ড হিসেবে তোকেই আমার আগে বলা উচিৎ ছিল, কিন্তু ফোনে এত কথা হয়? আর আমিও তোর সাথে বেশী কথা বলতে পারছিনা এখন! প্লিজ ডোন্ট মাইণ্ড রাজু।আসলে জোজো কি ভাববে.. তাই তোর সাথে গল্প করতে পারিনা।
ও আমাকে এত ভালোবাসে… তুই বিশ্বাস করতেও পারবিনা। আর আমিও। ওকে ছাড়া কিছু ভাবতে পারিনা। ঠিক আছে রাখ। রাতে ফোন করিস।” বলেই লাইনটা কেটে দেয় কেকা। রাজু স্তম্ভিত। ও ভাবতেই পারেনা কেকা ওকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে পারে!
সেই ইলেভেন থেকে ওরা এক আত্মা এক প্রাণ যেন। এতগুলো বছরেও কেকাকে সে চিনতে পারলো না! রাজু ভালো জবের জন্য কম্পিটিটিভ এক্সাম দিচ্ছে, কলকাতায় পড়াশোনার জন্য থাকতে হয় ঠিকই তবে মন পড়ে থাকে নিজের ছোট্ট শহর গোপালপুরে, কেকার কাছে।
আজ আর কিছুতেই পড়াশোনায় মন বসানো যাবে না। বিকেল বেলা রাজু এলোমেলো চিন্তা নিয়ে ময়দানের দিকে
হাঁটতে থাকলো এদিক ওদিক।
ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! কেকার জন্যই নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলবে ভেবেছিল৷ কিন্তু আর কিছুই হবেনা তার দ্বারা।
রাতে কেকাকে ফোন করলো রাজু। আজ তাকে জানতেই হবে সব।
“হ্যালো হ্যালো”
” ওয়েট কর একটু। জোজোর ঘুম ভেঙে যাবে। আমি ব্যালকনিতে যাই! ” ফিসফিসিয়ে বলে কেকা।
“হোয়াট!! ”
মিনিট খানিক চুপচাপ।
” বল, আসলে জোজো আর আমি আজ এক বিছানাতেই…. ”
“মানে? !”
“কি আবার মানে! ”
“কাকিমা কাকু কোথায়! ”
” মামাবাড়ি গেছে। খুব বৃষ্টিতে আটকে পড়েছে। ফিরতে পারেনি।”
” আর তুই! ”
” নারে একটুও একা লাগছেনা, জোজো আছে তো! ও এত সুইট না… তুই ভাবতেও পারবিনা। আমার শয়নে স্বপনে শুধু এখন জোজো আর জোজো! বাপি আর মা নেই বলে ওকে আমি আমার কাছেই ডেকে নিয়েছি! আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়েছি। আর জোজোও কিন্তু ..
রাজু মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় খাটে।
এই কেকাকে সে ভালোবেসেছিল! ভাবতেই কেমন লাগছে। কেকা এত নোংরা?
সারারাত ঘুমাতে পারেনা রাজু। মাথায় খুব যন্ত্রণা! বার বার হোয়াটসঅ্যাপ খোলে। পুরোনো চ্যাটগুলো দেখে। কত রাত অব্দি তারা গল্প করতো। কেকা বলেছিল সেটে কিছু সমস্যা হচ্ছে, হোয়াটসঅ্যাপ খুলতে পারলেও মেসেজ করতে পারছেনা।
নাহ, এ জীবন রাজু আর রাখবেনা। বেঁচে থেকে কী হবে। কেকা তো এখন অন্যের।ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধহয়। এলার্ম বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সেকেণ্ড এপ্রিল সকাল সাতটা।
অভ্যেস বশত হোয়াটসঅ্যাপ খুলে তাকালো।
কেকার মেসেজ এসেছে!..আজ দেখছি মেসেজ করতে পারলাম।
গুড মর্নিং রাজু
এই দেখ – আমার জোজোকে।…কিন্তু ডাউনলোড হচ্ছেনা ছবিটা। রাজু
দেখতেও চায়না। নিশ্চয়ই তার থেকে অনেক বেশী সুপুরুষ এই জোজো!
হ্যাঁ হয়েছে ডাউনলোড। কিন্তু….
কোথায় জোজো? এতো একটা বিদেশী কুকুরবাচ্চার ছবি!!
…..
টাইপিং কেকা…দেখলি আমার জোজোকে? কেমন লাগলো? দারুণ না? তোকে আমি পরে ভিডিও কল করে জোজোকে ভালোভাবে দেখাতে চাই । বাই।
তুই কবে আসবি রাজু? আমি ভীষণ ভীষণ মিস করছি তোকে…মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে রাজু। অজান্তে দুটো চোখ জলে ভরে গেছে।
কেকা না জেনেই এপ্রিল ফুল বানিয়ে দিয়েছে তাকে কাল সারাদিন সারারাত।
“আই লাভ ইউ কেকা, আমি আসছি খুব তাড়াতাড়ি…” মনে মনে বলে ওঠে রাজু। -
গল্প- প্রতিশোধ
প্রতিশোধ
– শিলাবৃষ্টিঅণু ছোটবেলার সেই অপমান এখনো ভুলতে পারেনি। প্রায় সাত আট বছর কেটে গেছে, তবু যেন সেই দিনটার ছবি চোখের সামনে স্পষ্টভাবে দেখতে পায় সে। বিনোদকাকার বাগান বাড়িতে অনেক আমগাছ, আর প্রতিটা গাছে শয়ে শয়ে কাঁচাপাকা আম ঝুলে ছিল, মাঝখানে পুকুরে পড়ে কত নষ্টও হয়ে গেছে। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে পাড়ার ছেলেমেয়েরা আর অণু আম পাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়, আর ঠিক তার পরের দিন রবিবার দুপুরে সবাই যখন ভাত ঘুম দিচ্ছে, তখন চুপিচুপি ওরা বিনোদকাকার বাগান বাড়িতে পেছনের ছোট গেট টপকিয়ে ঢুকে পড়ে। কয়েকজন গাছে উঠে আম পেড়ে ফেলছিল মাটিতে, আর বাকিরা কুড়িয়ে কুড়িয়ে পলিপ্যাকে ভরছিল। প্রত্যেকে পলি প্যাক নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু অণু ভুলে গিয়েছিল। তাই সে গাছে বসে বসেই আম খাচ্ছিল আর মাঝে মাঝে ছুঁড়ে ফেলছিল গাছের পাশের একটা ঝোপে। আর নীচু গলায় বলছিল ‘আমার তোলা আম কেউ নিবিনা কিন্ত’ বন্ধুরা মেনে নেয় তার কথা।
হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে কাশির আওয়াজ পেয়ে সবাই সচকিত হয়ে গাছ থেকে নেমে একে একে দ্রুত আম বাগান থেকে বেরিয়ে যায় কিন্তু অণু গাছ থেকে নেমে ঝোপের ভেতর তার ফেলা আমগুলো খুঁজতে থাকে। তার বেরনো আর হয়না, দুহাতে কোনরকমে আমগুলো আঁকড়ে ধরে উঠতে যাবে, পেছন থেকে বিনোদকাকার বাড়িতে কাজ করে যে লোকটা মানে গনেশ নামের ছেলেটা তাকে আচমকা ধরে ফেলে, আতঙ্কে অণুর হাত থেকে আমগুলো পড়ে যায়। গনেশের হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করেও পারেনা। সে টানতে টানতে বিনোদকাকার ঘরে নিয়ে যায় তাকে। বিনোদকাকার সবে তখন দিবানিদ্রা ভেঙেছে। হাই তুলে জিজ্ঞেস করে- এ আবার কে?
গণেশ বলে- চোর বাবু, চোর। এই বাগানের আমটা কলাটা চুরি করে নিয়ে যায়, নারকেল পড়লেই হলো, সব নিয়ে পালায়। আজ তকে তকে ছিলাম, আম গাছ থেকে নামতেই পাকড়াও করে এনেছি… বিনোদকাকা শুনে রেগে বলে- বেশ করেছিস, একটা ঘরে ঢুকিয়ে বন্ধ করে এখন রেখে দে।
সেদিন কান্নাকাটি করেও ছাড়া পায়নি অণু। সন্ধ্যাবেলায় যা ঘটলো ওই দশ বছর বয়েসেও সেই অপমান হজম করতে পারেনি সে।
গ্রামের মাঝখানে একটা পুরোনো রাধামাধবের মন্দির আছে। সন্ধেবেলায় গ্রামের অনেক মানুষ বিশেষত মুরুব্বিরা মন্দির সংলগ্ন নাটমন্দিরে গিয়ে বসে, কথাবার্তা বলে, তাস খেলে, চা খায়..বিনোদকাকার সেই গণেশ দরজা খুলে অণুকে নিয়ে বিনোদকাকার পেছনে পেছনে সেই নাট মন্দিরে আসে। সবে আরতি শেষ হয়েছে, সবাই জড়ো হয়েছে। এমন সময় বিনোদকাকা মুখ খোলে- দেখো গো তোমরা সবাই চোর দেখো
সবাই অবাক হয়ে অণুর দিকে তাকায়।
-যারা চোর দেখনি কোনদিন দেখে নাও আজ। এই মেয়েটা আমার বাড়ির বাগানের ফলমুল রোজ চুরি করে, আজ গনেশ ধরেছে চোরকে।
সবাই এটা ওটা বলতে থাকে। গুঞ্জন শোনা যায়। এই রকম সময়ে অণুর জ্যেঠু এসে পৌঁছায়। সব শুনে ঠাস করে অণুর দুগালে দুটো চড় মারে। তারপরের কথা আর ভাবতে চায়না অণু। শুধু কানে এখনো শুনতে পায় তার নিজের বলা শেষ কথাগুলোই- কাকা মনে রাখবে তুমি, একমাঘে শীত যায়না। এ কথা আমি মায়ের কাছে শিখেছি, এ মিথ্যে হবেনা দেখো।
বাচ্চা মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে সবাই সেদিন হেসে ফেলেছিল।এই ঘটনার পরে শীত এসেছে আর গেছে প্রায় সাতবার।
……..
কলেজে যাওয়ার সময় খেতে বসেছে অণু রান্নাঘরে, কানে এলো লক্ষ্মীমাসী মাকে বলছে- বিনোদ ঘোষ লোকটার স্বভাব আর পাল্টাবে না!
মা বললো- কেন রে লক্ষ্মী কি হয়েছে?
-কেন আবার! ঘরে বউ ছেলে মেয়ে থাকতে বুড়োটা আবার বিধবা ওই রাধার উপর কৃপা করেছে। রাধার ঘরে তো আর কেউই নেই। বিনোদের পরিবার পুরী গেছে পরশু আর সেও মওকা পেয়ে রাধার ঘরে মউজ করছে।
-সে কি রে!
-হ্যাঁ, গো হ্যাঁ…পুরোনো অপমানটার শোধ এবারে হয়তো নেওয়া যাবে! অণু সব প্ল্যান তৈরী করে সারাদিন ধরে। তারপর গ্রামের অনেক মানুষকে জড়ো করে সেদিন রাত্রি বারোটাতে রাধার বাড়ির মেন দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে অনবরত। রাধা দরজা খুলতে বাধ্য হয়। সবাই ঘরে ঢুকে অণুর কথা মেলানোর চেষ্টা করে, কিন্তু বিনোদকে দেখতে পায়না। অবশেষে খিড়কির বাথরুম থেকে বিনোদ ঘোষকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে অণু। সবার কাছে প্রমাণ হয়ে যায় বিনোদ ঘোষের চরিত্র।
হা হা করে হাসতে হাসতে অণু বলে- সাত
বছর আগের সেই দিনটার কথা মনে পড়ছে কাকা। একটা বাচ্চা মেয়ে একদিন তোমার বাগানের কটা আম পেড়েছিল বলে তুমি কি করেছিলে? সেদিন আমি বলেছিলাম- এক মাঘে শীত যায়না! মনে পড়ছে? আমিই সেই অনুপমা! যাকে ঘরে আটকে রেখে তুমি মজা দেখেছ! যাকে নাটমন্দিরে এনে সকলের কাছে অপমান করেছ! যাকে মার খাইয়েছ! আজ তোমার কীর্তি সকলের সামনে এনে আমার অপমানের শোধ নিতে পারলাম।
সকলে ছি ছি করতে করতে বাড়ি চলে গেল। অণু আজ শান্ত হতে পারলো। আর
রাধা অপমানে লজ্জায় বিনোদকে বের করে দিয়ে দরজাটা সজোরে লাগিয়ে দিল। টাকার দম্ভে ফুলে ওঠা বিনোদ ঘোষ স্বপ্নেও ভাবেনি এরকম পরিস্থিতির স্বীকার হবে সে কোনদিন! -
কবিতা- পথশিশুর পাঁচকাহন
পথশিশুর পাঁচকাহন
– শিলাবৃষ্টিপথেই জন্ম, পথেই জীবন,পথই ঘরবাড়ি ;
শিক্ষা- দীক্ষা সভ্যতার সাথে ওদের আড়ি।
আজ খেতে পায়, কাল কী হবে!পরশু অনিশ্চিত!
কিলবিল করে পথের দু’পাশে গ্রীষ্ম কিংবা শীত।
ছেঁড়া জামা জুতো, চুলে নেই তেল.. দেখো ওই শিশুটাকে!
ভিক্ষা চাইতে শিখেছে নতুন, ধরে পথে যাকে তাকে।
একদল ছেলে ডাস্টবিন ঘেঁটে নির্বাহ করে ক্ষুধা ;
নেই রোগ ভোগ,সয়ে গেছে সব! উচ্ছিষ্টই সুধা।
সুন্দরী মিনা ভাগ্যের দোষে ফুটপাথে বড় হয় ;
পালিয়েছে মাতা সদ্যোজাতকে ফেলে সমাজের ভয়ে।
‘কাগজকুড়ানি’ নাম পাবে শেষে পরিচয়হীন বালা!
শৈশব থেকে ‘নষ্ট’ হবে সে, মেটাতে ক্ষুধার জ্বালা।। -
কবিতা- শিশুর সাধ
শিশুর সাধ
-শিলাবৃষ্টিশিশু! সে তো সবার প্রিয়-
মায়ের যখের ধন,
বুকের হিরে, চোখের মাণিক,
ফুলেল্ সম মন।
নিষ্পাপ তার মুখের হাসি,
আধো আধো বোল…
চোখ দু’টি তার খুঁজে ফেরে –
কোথায় মায়ের কোল!
ছোট্ট বুকে স্বপ্ন অনেক …
কবেই হবে বড়ো!
সাবধানী মা সব সময়েই
ভাবেন তাকে জড়!
তারও যে চাই ইচ্ছে ডানা
কেউ বোঝে না তেমন,
নীল আকাশে উড়তে সে চায়
যেথায় খুশি যেমন।
ফুলের বনে গোলাপ হয়ে
ফুটে ওঠার লাগি…
ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে
হঠাৎ ওঠে জাগি।
ওই ঝমঝম্ বৃষ্টি এলো
নিকষ কালো মেঘে,
স্বপ্ন দেখে ছোট্ট শিশু
মায়ের কোলে জেগে।
জল ছিটিয়ে দস্যিপনা
করতে যদি পেত-
সারা গায়ে বৃষ্টিফোঁটা …
কেমন মজা হত!
স্বপ্ন দেখে ছোট্ট শিশু
ছোট্ট দু’টি চোখে।
কচি বুকে রং বেরঙের
রামধনু রং মাখে। -
গল্প- র্যাট কিলার
র্যাট কিলার
-শিলাবৃষ্টি
গণেশ আর গণেশের বউ টুম্পার খুব কষ্টে দিন চলে। রোজগার পাতি খুব কমে গেছে। এখন আর ইঁদুর মারা বিষ তেমন বিক্রি হয়না শহর বাজারে, ট্রেনে বাসে। টুম্পা গণেশকে বোঝায় এভাবে আর কদিন চলবে! সে একটা বাসন মাজার কাজ পেয়েছে। গণেশ মত দিলেই সে দু বেলা লোকের বাড়িতে খেটে কিছু টাকা রোজগার করতে পারে! কিন্তু গণেশ একদম রাজি হয়না। সে বলে ” দেখ টুম্পা! আমাদের একটা বংশ মর্যাদা ছিল! আজ হয়তো নুন আনতে পান্তা ফুরোয় কিন্তু আমার ঠাকুরদাদা বড় পূজারী ছিল। আমরা ব্রাহ্মণ! তুই কিনা লোকেদের বাড়িতে এঁটো বাসন মাজবি? ” টুম্পা এসব কথা বহুবার শুনেছে! গণেশ রেগে গেলে সে চুপ করে যায়! কিন্তু কিছু তো একটা করতেই হবে!
কয়েকদিন পরেই টুম্পা বুঝতে পারে তার পেটে গণেশের সন্তান। তাদের ভালোবাসার সম্পদ। কিন্তু এই অভাব অনটনের মধ্যে সেই সন্তানকে কিভাবে সে পৃথিবীর আলো দেখাবে!কয়েকদিন ধরেই গণেশের জ্বর আসছিল, সে ফেরি করতে বেরোতে পারেনি। টুম্পা দোকানে ধার করে চাল ডাল, আর ওষুধ কিনে চালাচ্ছিল। না আর গণেশের কথা শুনলে হবেনা। তাকে কাজটা ধরতেই হবে।
গণেশকে আজ সকালে হাসপাতালে টিকিট করে দেখাতে নিয়ে গেছিল। ডাক্তারবাবু কেন জানি ভর্তি করে দিতে বললো। টুম্পা চিন্তায় পড়লেও ভর্তি করেই ফিরলো। তবে ডাক্তারবাবু বলেছে ভয় নেই কোনো। শরীর দুর্বল, তাই সেলাইন দিতে হবে।
আর দেরি না করে সে ছুটলো কাজের বাড়িতে। বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে, কাজটা যদি অন্য কেউ ধরে নেয়!
যা ভেবেছে ঠিক তাই। ও বাড়ির মাসীমা বললেন ” নারে বৌ, তুই পরের দিন এলিনা দেখে অন্য লোক লাগিয়েছি।”
টুম্পা অসহায় ভাবে মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসতে যাবে, এমন সময় মাসীমা ডাকে
” এই শোন শোন, তুই ভালো রান্না করতে পারিস? ” টুম্পা হাতে যেন স্বর্গ পেল। ” হ্যাঁ মাসীমা আমি খুব ভালো রান্না পারি।”
“তোরা কি জাত?”
” আমরা চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ গো মাসীমা, অবস্থার ফেরে আজ কাজ খুঁজে ফিরছি।”
মাসীমা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ” তাহলে
কাল থেকেই লেগে পড়। আমাদের বোউটা পোয়াতি। সে আর নিজে রান্না করে খেতেই পারছেনা। খুব অরুচি মুখে! ” টুম্পা অন্যমনস্ক হয়ে যায়… সেওতো পোয়াতি, অথচ…. যাক গে”
রাতে একা ঘরে শুয়ে শুয়ে টুম্পা ভাবে এখন কোনো কথা গণেশকে সে জানাবেনা। টুম্পা যে মা হতে চলেছে তাও সে গণেশকে লুকিয়ে রেখেছে। রান্নার কাজে বেশী অসম্মান নেই, পরে গণেশ জানলে খুশিই হবে হয়তো।
সকাল হতে না হতেই টুম্পা রান্না করতে বেরিয়ে গেল। ভালোই লাগছে তার অনেক রকম রান্না করতে। জল খাবারের পরোটা আলুর দম তাকেও খেতে দিল মাসীমা। ওরা বলেছে টুম্পা রান্না খারাপ করেনা। দু’হাজার টাকা দেবে ওরা। মাসীমা অগ্রিম টাকা দিয়েছেন কিছু, তাতেই চালাতে হবে।
দশটার সময় সে গণেশের কাছে গেল। আজ গণেশকে অনেকটা সুস্থ লাগছে। টুম্পার মনটা শান্ত হলো। চার বছর ওদের বিয়ে হয়েছে। দুজনেই দুজনকে খুব ভালোবাসে। গণেশ সব সময় টুম্পাকে আগলিয়ে রাখতে চায়। ডাক্তার বাবু বলেছে কাল ছুটি দেবে।
পরের দিন কাজের বাড়ি থেকে এসে
টুম্পা গণেশকে বাড়িতে নিয়ে এলো। মাছের ঝোল ভাত রান্না করে দুজনে খেল।
গণেশ প্রশ্ন করে ” তুই বাজার করেছিস, মাছ এনেছিস কিন্তু টাকা কোথায় পেলি?”
টুম্পা বলে ‘ তুমি এখন অসুস্থ, এত কথা তোমাকে চিন্তা করতে হবেনা! ” গণেশ বিকেলের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছে। আসলে ওষুধ খেয়ে শুধুই ওর ঘুম ঘুম পাচ্ছে।
সন্ধ্যা বেলায় রুটি বানাতে যেতে হবে মাসীমাদের বাড়িতে, টুম্পা একবার ভাবলো গণেশকে বলেই যাবে। কিন্তু ও তো ঘুমাচ্ছে। থাক রাতেই সে সব খুলে বলবে। ভালো তাঁতের শাড়িটা পরে সে বেরিয়ে যায় সন্তর্পণে।
পাশের বাড়ির কাকি এসে ডাকে ” ও গণেশ ওঠ বাবা, ওঠ। আজ কেমন আছিস? তোকে দেখতে এলাম!” গণেশ উঠে বসে। টুম্পাকে ডাকে। কাকি বলে ” তোর বৌ তো কাজ ধরেছে ওই রায় বাড়িতে। সেখানেই গেছে বোধহয়!” গণেশ
আকাশ থেকে পড়ে, সে স্তম্ভিত। টুম্পা তার অমতে রায় বাড়িতে বাসন মাজতে গেছে! সে থ হয়ে বসে থাকে। কাকি চলে গেলে রাগে দুঃখে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে ঘরের তাকে থরে থরে সাজিয়ে
রাখা তার ব্যবসার জন্য কেনা ইঁদুর মারা বিষ কয়েকপাতা জলে গুলে খেয়ে নেয়। এ জীবন থেকে কি হবে! স্বামী হয়ে স্ত্রীকে খেতে দিতে পারেনা সে। তাই তো টুম্পা বাসন মেজে খাওয়ার জোগাড় করে। তাদের বংশের সম্মান আজ ধুলোয় মিশে গেল। সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। গণেশের
জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে। ” টু..ম্পা, টু…ম্পা” কেমন যেন একটা গোঙানির মতো আওয়াজ বেরোচ্ছে গণেশের গলা থেকে।
টুম্পা খানিক বাদেই এসে পড়ে। দরজা ঠেলে ঢুকে আলোটা জ্বালিয়ে সে হতবাক। একি! গণেশ এরকম ভাবে শুয়ে আছে কেন? মুখ দিয়ে ফেনা বেরোচ্ছে কেন? মেঝের দিকে তাকিয়ে সে চিৎকার করে ওঠে ” গ…ণে…শ”। বিষের ছেঁড়া প্যাকেটগুলো ছড়িয়ে পড়ে আছে এদিক ওদিক।
ছুটে বাইরে বেরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে পাড়ার ছেলেদের ডেকে নিয়ে আসে সে। তারপর সবাই মিলে ধরে একটা ভ্যানে করে হাসপাতালে নিয়ে যায় গণেশকে। ওয়াশ করে প্রায় চার ঘণ্টা পরে গণেশকে ছাড়লো হাসপাতাল থেকে। টুম্পা পাগলের মতো অস্থির হয়ে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়িয়েছে। ঠাকুর তার ডাক শুনেছেন। গণেশ ঘরে এসেছে। তার জ্ঞান ফিরেছে।
রাতে টুম্পা গণেশের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে ” কেন তুমি এরকম কাজ করলে? কিছু যদি হয়ে যেত আমি কোথায় যেতাম? বলো আমার কি হতো?”
কান্নায় ভেঙে পড়ে টুম্পা। গণেশ অভিমানে প্রথমে চুপ করে থাকলেও টুম্পার কান্না তার সহ্য হয়না। বলে – ” তুই
আমার সম্মান নষ্ট করেছিস, আমার অবাধ্য হয়ে কায়েত বাড়িতে এঁটোকাঁটা…. ছি ছি ছি! “
‘ চুপ করো তুমি! আমি রান্নার কাজ নিয়েছি। মাস গেলে দুহাজার টাকা পাবো। আর টাকাটা এখন আমাদের ভীষণ দরকার! “
গণেশ অবাক হয়ে তাকায় টুম্পার মুখের দিকে। সে ভুল ভেবেছিল? বলে – ” কেন টাকা ভীষণ দরকার কেন? “
“টুম্পা চুপ করে থাকে, তারপর গণেশের
পাশে শুয়ে পড়ে গণেশের চোখে চোখ রেখে বলে ” দেখোতো আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে, কিছু বুঝতে পারো কিনা! ” গণেশ খুব ভালো করে টুম্পাকে নিরিক্ষণ করে! ” কি হয়েছে তোর? কোনো অসুখ করেছে? বলনা!”
টুম্পা খিলখিল করে হেসে ওঠে। বলে ” এই যে আমার হাঁদা গঙ্গারাম বর! আরে তোমার টুম্পা যে মা হবে তুমি বুঝতেও পারলেনা? “
” কি!! তুই মা? মানে আমি বাবা হবো?”
পাগলের মতো টুম্পাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে গণেশ। ” ছাড়ো না ” টুম্পা কোনরকমে বলে। গণেশ বলে ” না, ছাড়বোনা আমি তোকে, সারারাত আদর
করবো।”
……………
কত রাত কে জানে। দুজনের বিনিদ্র কাটে। কত কল্পনা দুজনের আগামীর জন্য। টুম্পা বলে – কোনো কাজই ছোট নয় গো! রান্না একটা শিল্প! পরে আমি হোম ডেলিভারি খুলতে পারবো। আমি ভালো ভালো রান্না করবো আর তুমি সাইকেলে করে সেই রান্না অর্ডার মতো বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেবে। আমাদের সন্তানকে আমরা ভালোভাবে মানুষ করবো। “
” হ্যাঁ রে টুম্পা আমি পরশু থেকে আবার ট্রেনে হকারি শুরু করবো। তবে এই সাধারণ ইঁদুর মারা বিষ নয় এবার আমি বিক্রি করবো র্যাট কিলার! “