• গল্প

    গল্প- একটি চোরের কাহিনী

    একটি চোরের কাহিনী
    – শুভায়ন বসু

     

    সকাল থেকে হুলুস্থুলু।চোর ধরা পড়েছে ভটচাজবাবুর বাড়িতে। কুয়োতলায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল ।চাকর পঞ্চাই প্রথম দেখেছিল। তারপর আর যায় কোথায়? ভটচাজবাবুর বাড়িকে বাড়ি না বলে, প্রাসাদ বলাই ভাল। তিনতলা অট্টালিকা, অসংখ্য ঘর। যেমন পেল্লায় বাড়ী,তেমনই জমকালো তার ভেতরটাও।চাকরবাকরও কম নয়, দারোয়ান খানদুয়েক, তাছাড়া ড্রাইভার, মালি, ম্যানেজার সব নিয়ে একটা এলাহি ব্যাপার। সেই বাড়িতে চুরি! দুই দারোয়ান তো একেবারে হামলে পড়েছে। সঙ্গে চাকর, মালি, ড্রাইভার। সবাই মিলে ঘিরে ধরে যা তা কান্ড! চোর বেচারা পালাবার পথ পায়নি। তারপরেই শুরু হয়েছে হাটুরে মার, এখনো চলছে। ল্যাম্পপোস্টে বাঁধা হয়েছে হাড়জিরজিরে ভিখিরিপানা মানুষটাকে, খালি হাত জোড় করে বলছে, সে নাকি চুরি করেনি। কিন্তু কার কি?
    ভটচাজবাবুর বিশাল ব্যবসা, প্রচুর টাকা। নিন্দুকেরা বলে তার নাকি সবই ব্ল্যাকমানি। তিনি দু’তিনজন ইনকাম ট্যাক্স লইয়ার আর চাটার্ড একাউন্টেন্ট পুষেছেন মোটা টাকা দিয়ে। তারাই ট্যাক্স ফাঁকি আর ব্যালেন্সশীটের ফিকিরগুলো দেখে। ভটচাজবাবু নিজে নেমে এসে অবশ্য বলেছিলেন,চোরটাকে ছেড়ে দিতে। তবে সে কথার টানে একটা গূঢ় অর্থ ছিল বোধহয়,যে বোঝার সেই বোঝে।
    চোরটা ধরা পড়ে মার খাওয়ার সময়, রাগের বশে অবশ্য বেজায় গাল পাড়ছিল। ভটচাজবাবুর দিকে ঘৃণাভরে তাকিয়ে, জ্বলন্ত চাওনি ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিএ,”তুই ধরবি চোর! শালা চোরাই সোনার দোকানে এত রমরমা না? তাই মুখে বড় বড় কথা! নিজের যত বেআইনি কারবার আর আমাকে বলিস চোর?” ভটচাজবাবু দ্রুত গেটের ভেতরে ঢুকে গটগট করে ভেতরে চলে গেলেন, গেট বন্ধ হয়ে গেল।
    চোরটাকে এসে মেরে গেল বাজার করতে, অফিস করতে আসা কত মানুষজন। সবচেয়ে রোগা,সবচেয়ে দুর্বল এমনকি সবচেয়ে থুথ্থুরে বুড়োটারও চোর পেটানোর সময় হাতের জোর দেখে কে! এদিকে চোরটাও সমানে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। হাত পা বাঁধা হলেও মুখটা একমাত্র খোলা। সে নাকি চুরি করেনি। কিন্তু পাবলিকের মারের ভয়ে সবাই তো এমন বলে,সেসব কথা কেউ বিশ্বাস করে নাকি? চুরির মাল অবশ্য বাজেয়াপ্ত হয়নি কিছুই, কোথায় লুকিয়েছে দু’ চার ঘা দিলেই বেরিয়ে আসবে। তার মধ্যে অবশ্য ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হরেন সান্যালকে কথা শুনতে হল চোরটার কাছে। “কত টাকার কারেন্ট জালি করে চুরি করেছিস রে, তোর বেআইনি তিনঘরার কারখানায়? মজুরদের তো ন্যায্য টাকা কিছুই দিস না, বারোঘন্টা অমানুষিক খাটাস। তুই আবার এসেছিস আমাকে মারতে?” হরেন বাবু পালিয়ে বাঁচেন, ভিড়ে গা ঢাকা দেন।পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন সুদখোর মানিক দাস। তাক করে দু’ চারটে মোক্ষম মার তিনিও মেরেছিলেন। চোরটা কঁকিয়ে উঠে বলে “চোরকে মারতে এসেছে, শালা সুদখোর! হাজার টাকার এক বছরের সুদও হাজার টাকা? শালা।” আবার দু’চারটে মার পড়ে, তবে এবার জোরটা একটু যেন কম। চোরটা মানিককে ছেড়ে, রেগে গিয়ে পাশে দাঁড়ানো ফিটফাট রবীন পাকড়াশির চোখে চোখ রেখে বলে “জাল ওষুধের কারবারটা কেমন চলছে রে রবীন? আর জাল বেবিফুডটাও চালিয়ে যাচ্ছিস ভালোই, নারে?” রবীন আর মানিকবাবু একটু সরে গেলেন আড়ালে। দূর থেকে দেখে নিলেন চোরটাকে। চেনা লোক নয়তো, এত কথা জানলো কি করে?
    এসি গাড়িটা ঘ্যাঁচ করে পাশে এসে থামল। কাঁচ নামিয়ে মুখ বার করলেন পাড়ার সম্মানীয় নেতা অতুল লাহিড়ী। “কিরে, এখানে কি চলছে এসব?” সবাই নালিশ জানিয়ে গেল তার কাছে, পাড়ায় চোরের উপদ্রব বেড়েছে। তাই চোর ধরে পেটানো চলছে। “ও, ভালো করেছিস। মার শালাকে। কেলিয়ে বিন্দাবন দেখিয়ে দে।” চোরটা মুখ তুলে দেখে। কোথা থেকে এত গলায় জোর পায় কে জানে? আসলে ওর তো আর কিছু হারানোর নেই, হেরে দেয়ালে পিঠ ঠেকেই গেছে। চেঁচিয়ে বলে “এই তো এসে গেছ বাবা দাপুটে নেতা। শালা, ভালোমানুষী দেখাচ্ছ? কটা বেনামে ফ্ল্যাট কিনে রেখেছ, কটা জমি দখল করেছ, কোথায় কোথায় তোলাবাজির টাকা লাগিয়েছ জানি না ভাবছ? শালা ঘুষখোর।” অতুলবাবুর গাড়ির কাঁচটা একটু উঠে যায় ,মুখটা বার করে হাজিমস্তানকে বলেন, “এই, এটা কে রে? বিরোধী দলের মনে হচ্ছে। শালা মাওবাদী নয়তো?” চোরটার গলা এবার সপ্তমে “হ্যাঁ ,তা তো বটেই। তুমি মহান নেতা আর আমি চোর, তাই না? তা বাবা,বল দেখি ,অনি-বুড়ো আর স্বপ্নার লাশগুলো কি করেছ? স্বপ্নার সঙ্গে কি করেছিলে বলে দেব নাকি? নিমেষে কাঁচটা পুরো উঠে যায়। নেতার গাড়ি হাওয়া হয়ে যায়।
    পাড়ার সব ছুটকো মস্তানদের রাগ এবার গিয়ে পড়ে এবার চোরটার উপর, যত মুখ নয় তত বড় কথা! অতুলদার বেইজ্জতি! বেধড়ক মার শুরু হয়। চোরটা আরো ঝিমিয়ে পড়ে। ওদিকে মন্ত্রীর নীলবাতি লাগানো গাড়ি ভীড়ে আটকে যায়। চুপিচুপি কাকে ডেকে মন্ত্রী কি সব জানতে চান। চোরটা গজরাতে থাকে “ওই এলেন মন্ত্রী সাহেব। সমবায় ব্যাঙ্ক দেউলিয়াকান্ডের কান্ডারী। কত সোনা জমিয়েছ বাবা বাড়িতে? কত টাকার হাওয়ালায় ফেললে আজ সুইস ব্যাঙ্কে? এই না হলে মন্ত্রী!” মন্ত্রীর গাড়ি কিছু না শুনতে পাবার ভান করে চলে যায়।
    মারধোর চলছেই, বিরাম নেই। পাশের পাড়ার উকিল প্রশান্তবাবু অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও সেজেগুজে চোর পেটাতে এসেছিলেন। চোরটার কথাবার্তা শুনে তার মতিগতি ভাল ঠেকল না। তিনি চুপচাপ চলে যেতেই চেয়েছিলেন। চোরটার চোখে পড়ে গেল। আর যায় কোথায়?গোঙাতে গোঙাতেই অস্ফুটে বলে, “আরে পালাচ্ছেন কোথায়? আসুন,আসুন,মারবেন না আমাকে?” প্রশান্তবাবু দ্রুত একটা চলন্ত বাসে উঠে হাওয়া হয়ে গেলেন। এদিকে ভীড় বাড়তে শুরু করেছে, কোথাকার কোন চোর এসে বুলি কপচাচ্ছে আর সবার সব গোপন কথার হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিচ্ছে। ওদিকে টোটো করে মাইকে প্রচার শুরু হয়- ‘সবাই আসুন, মণ্ডলপাড়ায় চোর ধরা পড়েছে। অগণতান্ত্রিক, অরাজনৈতিক, অসামাজিক এবং অধার্মিক এক বিশুদ্ধ চোর। গণধোলাই দিয়ে হাত পাকিয়ে যান।
    চোরটা নেতিয়ে পড়েছে। তাই দেখে লোকজনের জমায়েতের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। চোরটা কে, কোথা থেকে এল? এত কথা জানলোই বা কি করে? নেতা-মন্ত্রীর বাপান্ত করছে। গণ্যমান্য লোককে খিস্তি করছে।যার বাড়ি চুরি হয়েছে সে তো নিজেই বেপাত্তা। পাড়ার যত হোমরাচোমরা মুখ লুকোতে ব্যস্ত, কেউ পালিয়ে পথ পাচ্ছে না, সবার গোপন খবর ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। চোরটা কি ঠিক কথা বলছে? সবার সব অপকর্ম ও জানলোই বা কি করে? কেউ কেউ বলে উঠলো ঠিকই তো বলেছে। ওই নেতা অতুল লাহিড়ি, ওই ব্যাবসাদার সমীর ভটচাজ আর ওই মন্ত্রী সত্যব্রত সাধুখাঁ, ওদের তো সত্যিই অনেক ব্ল্যাকমানি, স্মাগলিং আর বেআইনি ব্যবসা আছে। গরীবের কত টাকা মেরেছে চিটফান্ডে। কানাঘুষো অনেকদিন ধরে শোনা যায়। কে যেন বলে উঠল, ও পাড়ার সুনীলবাবুরও তো ভুয়ো কোম্পানি আর কটা এনজিও খুলে সরকারি টাকা মেরে দিয়েছে। কে বলে ওঠে ওপাশের গলিতে একটা বেআইনি বাড়ি উঠছে। কার যেন মার্সিডিজ গাড়ি আছে ড্রাগের ব্যবসার টাকায়, কার জাল নোটের কারবার, কোন বালি মাফিয়া ডাম্পারপিছু পুলিশ আর পার্টিকে কত যেন মাসোহারা দেয়, কোন নামকরা ডাক্তারের নার্সিংহোমে কিডনি পাচার আর কন্যাভ্রুণ হত্যার মত ঘৃণ্য কাজ হয়। কে যেন চাকরি দেওয়ার নামে কত লোকের টাকা মেরেছে। কোন সরকারি বড়কর্তা দূষণ নিয়ন্ত্রণের গাড়ি নিয়ে এসে কত ঘুষ নিয়ে যায়। চারিদিকে ফিসফাস গুঞ্জন ওঠে। কোন গুন্ডার নামে কটা রেপ, নারীপাচার আর কটা মার্ডারের কেস চলছে, অথচ তাদের পুলিশ খুঁজেই পাচ্ছে না। সব ফাঁস হয়ে যায়। পলিটিক্সের নোংরামো,মন্দিরের নামে ধর্মের ব্যবসামাফিয়া আর তোলাবাজদের কীর্তিকলাপ, এইসব বেআইনি কাজকর্মের গল্প-আলোচনাই চললো মুখে মুখে।
    গণধোলাইয়ের আসরের ভিড়টা পাতলা হতে শুরু করে, চোরটার দিকে আর কারো কোন নজর নেই। এদিকে চোরটার ততক্ষণে হয়ে এসেছে। রক্ত ঝরছে সারা শরীর থেকে। চোখ থেকে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়ছে, মুখ থেকে লালা সিকনি সব মিশে ছেঁড়া গেঞ্জি ভিজে গেছে। অর্ধনগ্ন মানুষটার আর জ্ঞান নেই, মুখে আর কথাও নেই কোন। আর হয়তো কোন কথা ও কোনদিনই বলবে না, আর বললেই বা শুনছে কি কেউ? নাকি শুনছে??

  • গল্প

    গল্প- তনুর রবীন্দ্রনাথ

    তনুর রবীন্দ্রনাথ
    – শুভায়ন বসু

     

    তনু কোনদিন সেভাবে রবীন্দ্রনাথ পড়েনি, বোঝেওনি।শুধু জানত, রবিঠাকুর মানে শুধু কবিতা, গান,গল্প বা নাটকই নয় – রবিঠাকুর ওর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন পরতে পরতে। জীবনের ওঠাপড়া, বড় হয়ে ওঠা, সুখ-দুঃখ সবেতেই রবিঠাকুর ওতপ্রোতভাবে মিশে আছেন। তনুর মনে হয়, এ যেন একটা জাতির চিরকালের বন্ধন, অন্তরের পরিচয়,কৃষ্টি বা সংস্কৃতি।
    ওর মনে পড়ে ছোটবেলায়, রেডিওতে ভেসে আসা রবীন্দ্রসঙ্গীত কানে ঢুকে, মর্মে পৌঁছে যেত, এমনই ছিল তার যাদু। একটু বড় হয়ে স্কুলে ‘সহজ পাঠ’ বইয়ে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম পেয়েছিল। তারপর নানা ছড়া, কবিতা দিয়ে মানুষটার সঙ্গে যাত্রা শুরু হল। বিভিন্ন গল্প, গান,নাটক ইত্যাদি দিয়ে আরো গভীরে প্রবেশ করল । ওর বাবারই অফিসে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় তনু আবৃত্তি করল ‘দামোদর শেঠ’। তখন ওর বয়স ছয় কি সাত , ও প্রথম হল। বাবা ওকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় মডুলেশনগুলো। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের প্লাস্টার অফ প্যারিসের ফ্রেমে বাঁধানো, হলুদ সেলোফেনে মোড়া পূর্ণাবয়ব ছবি। সেই পুরস্কার ওর এখনও যত্ন করে তুলে রাখা আছে।
    বাবার একটা সঞ্চয়িতা ছিল, মাঝে মাঝে তনু বের করে পড়ত, বাবা নিজেও কখনও সখনও পড়ে শোনাতেন। কখনও শীতের দুপুরের মিঠে রোদে,ছাদে বসে আলগা সময়গুলোয় বাবা-মা আর তনুর সাথে থাকত বাবার একটা বুশ ব্যারন রেডিও। কত অনুষ্ঠান ,কত গান, কত নাটক। সন্ধ্যাবেলায় প্রায়ই লোডশেডিং হয়ে যেত, বাবা রেডিওটা চালাতেন। লম্ফ বা হ্যারিকেনের আবছা আলোয় ওদের তিনজনের ছায়াগুলো দেওয়ালে নড়েচড়ে উঠত আর রেডিওতে বাজত রবীন্দ্রনাথ। বাবা বুঝিয়ে দিতেন গানের এক একটা কথার মানে। তখন শিশুমনে তনু সব বুঝত না হয়ত, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বোধহয় সেই তখন থেকেই ওর জীবনের এক অপরিহার্য অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। পরে বড় হয়ে তনু যখন কিছুটা রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র বিষয়ক বইপত্র পড়ে ফেলেছে, যখন রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতার এক একটা লাইন জীবনের পরম আনন্দ, দুঃখ বা অনুভবে স্রোতের মত ওর গলায় নেমে আসত, তার অর্থ জীবন দিয়ে বোধগম্য হত, হৃদয়ের গভীরে ঢুকে যেত আর ওর চোখ ভিজে যেত; সেই মহানুভব, সেই দার্শনিকতা, সেই ব্যাপ্তি আর জীবনবোধ যখন ওকে ঘিরে ধরেছিল, তখন তনু বুঝতে পারল, ওর ছোটবেলার সেই অনুভূতি কতটা সঠিক ছিল। সত্যিই, বাঙালীর জীবনের শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মনেপ্রাণে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে যার উপস্থিতি, তিনিই তো রবীন্দ্রনাথ।

    স্কুলে তনুর পাশে বসত প্রিয় বন্ধু পার্থ । খুব মেধাবী আর রবীন্দ্রনাথের অন্ধ ভক্ত । দুজনে অনেক তর্কবিতর্ক হত । স্কুলের কয়েকজন স্যার আপামর রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন,তারা ওদের জুড়ে দিতেন সেই রবীন্দ্র ফল্গুধারার সঙ্গে। তনু জানে, বাংলা মিডিয়ামে না পড়লে রবীন্দ্রনাথকে কখনও ও এভাবে জানতে পারত না। স্যারেরা পড়াতেন আর ওদের সামনে সেই অজানা রবীন্দ্র জগতের একের পর এক দরজা খুলে যেত।ক্লাসের জানলা দিয়ে দূরের নারকেল গাছের সারির দোল খাওয়া দেখতে দেখতে কি সব যেন ভাবত ,কেউ বকত না। নীচু ক্লাসে ‘আব্দুল মাঝির গল্প’, পরে হাইস্কুলে ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’,’কাবুলিওয়ালা’ গল্প; কবিতার মধ্যে ‘দীনদান’ ,’নববর্ষা’ স্যারেরা যখন পড়াতেন, তনু ঢুকে যেত সেই জগতে। তার ব্যঞ্জনা ,গভীরতা, সেই বয়সে হয়ত পুরোপুরি বোধগম্য হত না, কিন্তু গভীরে কোথাও যেন দাগ কেটে যেত, একটা জমি তৈরি হয়ে যেত।ওর বাবা আবৃত্তি করতেন ‘দুই বিঘা জমি’ বা ‘পুরাতন ভৃত্য’। তনু দেখত, বাবার চোখে জল । বাবা বুঝিয়ে দিতেন লেখার গভীর অনুভূতির জায়গাগুলো। তখনই ও হয়ত ভাবত, একদিন রবীন্দ্রনাথ পড়বে, বুঝবে। বাবা বলতেন “দেখবি , সব কিছুতেই রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে আছেন”।
    বাবার অসংখ্য বই ছিল, রবিঠাকুরের ওপর নানা বই- প্রবন্ধের। সেসব অতটা না টানলেও গল্পগুচ্ছ,চিঠিপত্র আর রবিজীবনী খুব টানত।আর গান। শুরু হলো গুনগুন করে গান, তারপরে গান শেখা ।একদিন প্রায় সেই সময়েই ওর হাতে এল প্রথম প্রেমপত্র । তাতেও রবীন্দ্রনাথ। শুধু দুটি লাইন “আমার সকল রসের ধারা, তোমাতে আজি হোক না হারা।” তারপর “তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার, জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার ।” প্রেম তো হলতনু দেখতে দেখতে বড়ও হল। রবীন্দ্রগান আর কবিতায় নিজের বিভিন্ন চেতনাকে এখন ও খুঁজে পেতে লাগল ধীরে ধীরে। বাবা লেখালেখি করতেন ।বলতেন, “লিখতে গেলে রবীন্দ্রনাথকে এড়ানো অসম্ভব। ঠিক কোথাও না কোথাও ওনার প্রভাব এসে পড়বেই। নতুন কিছু লিখতে গেলেও দেখি, যা ই লিখতে যাই উনি আগেভাগেই তা অনেক সুন্দর করে লিখে বসে আছেন।” মেঘ ডাকলে আকাশ কালো করে বিদ্যুতের চমক দেখা গেলে ,বাবা গুন গুন করে গাইতেন ” গগনে গরজে মেঘ,ঘন বরষা ” বা “ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে, জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে, ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা, শ্যামগম্ভীর সরসা “। তনু বুঝত বাঙালীর সুখে-দুঃখে যে গান, সেই গান ,সেই প্রাণের কথা,মনের কথা এইতো ও পেয়ে গেছে । ওর চাই’ই রবীন্দ্রনাথ ।যেমন না চাইতেও, উনি এসে পড়েন বাঙালীর অনুভবে। বাবা এও বলতেন, “যে বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ আর বিদ্যাসাগরের ছবি দেওয়ালে ঝোলানো থাকে না ,তারা মানুষ নয়।”
    তারপর শুরু হল ক্যাসেট কেনা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট কিনত কম। আধুনিক, হিন্দি গানের সুর ঝংকার টানত বেশী। বাবার কাছে বকুনি খেত ।তবু বয়সটা ছিল কম, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগসূত্রটা আলগা হতে বসেছিল। বয়সের উত্তাপে ওর তখন ভাল লাগত মান্না দে ,হেমন্ত, কিশোরকুমার ,ম্যাডোনা ।পাগল পাগল অবস্থা ।
    হঠাৎ তনুর প্রিয় বন্ধু সুনন্দ ওকে দিল ‘শেষের কবিতা ‘ শ্রুতিনাটক। শুনতে শুনতে ও যেন অন্য রবীন্দ্রনাথকে আবারও খুঁজে পেল, এ যেন ওরই কথা। তনু বুঝল বাবা ঠিকই বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া উপায় নেই। ‘শেষের কবিতা’য় সৌমিত্রর সেই ‘নির্ঝরিণী’ আবৃত্তি, ওর জীবনের প্রতিদিনকার অংশ হয়ে গেল। খাতায় লিখে রাখতে শুরু করল প্রিয় সব কবিতা, আবৃত্তি করতে চেষ্টা করত সেগুলো ।ফ্যান হয়ে গেল জগন্নাথ- উর্মিমালার। কিনে ফেলল ‘রবিবার’,’শেষ চিঠি’ শ্রুতিনাটক। আবার চমক, আবার রবীন্দ্রমোহ, উনিযে কত আধুনিক, সেদিন ও বুঝতে পারল। ওর জীবনে ,মননে আবার জড়িয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। গানের বা কবিতার এক একটা লাইন শুনে এক এক সময় ওর খুব কষ্ট হত, ভীষণ কষ্ট । গলায় আটকে থাকত সেই কষ্ট । চোখের জল হয়ে তা কখনও বা নেমে আসত, আর তার সঙ্গে সেই সমগ্র অনুভূতিগুলোকে নিয়ে ওকে জড়িয়ে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ।সেই ওর কবিতা লেখার শুরু। খাতাগুলো ভরে উঠত নানা কবিতায়,ছড়ায়।ও সচেতন ভাবে চাইত সেসব যেন হয় রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত।কিন্তু ধীরে ধীরে ও বুঝল গভীরতা ও দার্শনিকতায় সেসব কথা রবীন্দ্রনাথ সত্যিই আগে বলে গেছেন।আরও সুন্দর করে বলে গেছেন।তনু দেখল,বাবার কথাই সত্যি।প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই কথাটাই বোধহয় এই বাংলায় আবিষ্কার করে যায়।আবার কখনও বা কারণে অকারণে ওর গলায় উঠে আসত রবীন্দ্রসঙ্গীত, মানেটাও বোঝার চেষ্টা করত।একই গানের ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন অর্থ হৃদয়ঙ্গম হয়।ও দেখত আর অবাক হয়ে যেত।সুনন্দ এবার ওকে দিল, তার এক দাদুর ছোট্ট একটা ডায়েরি, যাতে প্রতি পাতায় মুক্তোর মত অক্ষরে উনি লিখে গেছেন এক একটা কোটেশন। পাতায় পাতায় শুধু রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতার থেকে নেওয়া কয়েকটি করে লাইন। সেই ডায়েরিটা যেন তনুর কাছে এক মহা মূল্যবান রত্ন হয়ে দাঁড়াল, তাকে নিয়েই কাটত ওর দিনগুলো।ও নিজেও একটা ডায়েরিতে লিখতে শুরু করল বিভিন্ন গান বা কবিতার ভালোলাগা সব লাইন।তারপর বড় হয়ে , কেরিয়ারের লড়াই লড়তে লড়তে,তনুর গান শোনাও গেছে কমে ।রাস্তাঘাটে রবীন্দ্র সঙ্গীত কানে এসে পড়লে শুধু থমকে দাঁড়াত ওর পা। ভাবত , কই, হিন্দি গান শুনে কখনো তো এমন হয় না!তনু বুঝল, বাবা কেন মার মার করতেন চটুল গান শুনতে দেখলেই।
    সেদিন বিকেল, তনুর প্রেম ভেঙে গেছে ।শেষমেশ দেখা করে সব চিঠিচাপাঠি ফিরিয়ে দেবার দিন। তনু দেখতে পেল হলদে শাড়ি পড়ে সে আসছে ,চোখ মুখ অন্যরকম ।অনেক কেঁদেছিল নাকি? সে এগিয়ে আসছে, বুকের কাছে ধরা ওরই উপহার দেওয়া ‘শেষের কবিতা’ বইটা। সে বলল, “মানুষটাই যখন চলে গেছে, তখন আর উপহারগুলো রেখে কি লাভ ?এই নাও, সব ফিরিয়ে দিলাম।” শেষের কবিতা বইয়ের প্রথম পাতায় তনুরই লেখা কবিতার ধৃষ্টতা, ভেতরে অসংখ্য হাত চিঠি। সব কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়? শেষ প্রেমিকা বাস ধরে চলে গেল। তনুর হাতে থেকে গেল “শেষের কবিতা”। সেদিন সেই মুহূর্তে ওর গলায় নয়, মনে ভেসে আসছিল একটাই গান ,”তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম”।তারপর থেকে আজ অবধি যখনই ও গানটা গুনগুন করে গায়,ওর চোখে ভেসে ওঠে এক ধূসর বিকেলবেলা।যেখানে জীবনের সবচেয়ে দামী সঞ্চয় অক্লেশে ফিরিয়ে দিয়ে, কাঁদতে কাঁদতে বাসে চেপে চলে যাচ্ছে একটি নিঃস্ব মেয়ে,আর বাসটি চোখের আড়ালে চলে গেলে ধীর পায়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে আরও একটি নিঃস্ব ছেলে ,আর কখনও সে ফিরে আসতে পারবে না সেই মেয়েটার কাছে,যাকে তার চেয়ে বেশী ভাল কেউ কখনও বাসেনি ।

  • গল্প

    গল্প- অন্য খেলা

    অন্য খেলা
    -শুভায়ন বসু

     

    “সুদীপ,প্লিজ আজ আর এরকম দুষ্টুমি কোরোনা।” মিষ্টি কাতর স্বরে বলে ওঠে।সুদীপ হেসে বলে “আরে না না, কিচ্ছু করবো না। এত ভয় পাও কেন বলতো? আমি তো আছি।” “না গো, আমার বুকটা না একেবারে ধড়াস ধড়াস করে। আমি সহ্য করতে পারিনা। তুমি জানোতো।”
    আসলে সুদীপ ইচ্ছে করে ক্রিকেট কোচিং মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় বাইকের হেডলাইটটা হঠাৎ নিভিয়ে দেয়। সন্ধ্যাবেলায় এই জায়গাটা এমনিতেই প্রায় অন্ধকার থাকে, স্ট্রীট লাইটের বালাই নেই। স্কুল বাড়িতে শুধু একটা টিমটিমে আলো জ্বলে। ক্রিকেট কোচিং মাঠ আর ওপাশের ঘন গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বেশ সুন্দর একটা মায়াবী রাস্তা। এটা খুবই পছন্দ করে সুদীপ, সন্ধ্যার পর হলেও। হেড লাইট নেভাতেই , চারপাশে ঘুটঘুটে ঘন অন্ধকার ওদের ঘিরে ধরে। পিছনে বসে মিষ্টি আর্তনাদ করে ওঠে, সুদীপকে প্রাণপনে জড়িয়ে ধরে। কয়েক সেকেন্ড। আবার হেড লাইটটা জ্বেলে দেয় সুদীপ, বাকি রাস্তাটা আলোতে আরামে পেরিয়ে যায়। মিষ্টি তখনও সুদীপকে খামচে ধরে থাকে।
    সুদীপ মিষ্টির প্রেমটা বেশ ক’বছরের পুরোনো। তবুও ওদের দুষ্টুমি, খুনসুটি চলতে থাকে, পুরোনো হতে দেয় না ওদের দু’জনের জাগতিক চাওয়া-পাওয়াকে। প্রতিদিনই ওরা যেন নতুন করে কিছু না কিছু আবিষ্কার করে একে অপরের মধ্যে। বিকেলে যেদিন একটু বের হতে দেরী হয়ে যায়, লেকের ধারে ওদের প্রেমপর্ব সেরে ফিরতেও সেদিন সন্ধ্যা হয়ে যায়। আর বাইকে সুদীপ এই নির্জন রাস্তাটা সেদিন ধরবেই, মিষ্টির শত অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও। আর একবার হেডলাইটের আলোটাও কয়েক সেকেন্ড নেভাবেই। তখনই অন্ধকারে ভয়ে, মিষ্টি সুদীপকে প্রাণপনে জড়িয়ে ধরবেই। এমনটা ওদের মাঝে মাঝেই হয়।
    কিন্তু সেদিন যেন মিষ্টি একটু বেশিই কাতর অনুনয় বিনয় করছিল ফেরার সময় ।সন্ধ্যা অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, ক্রিকেট কোচিং মাঠের ধারের সেই রাস্তাটা আজকে কিছুতেই ধরতে দেবে না মিষ্টি। কিন্তু সুদীপের গোঁ, এটাই ওর খেলা, এটাই মজা। এই যে মিষ্টির ভয় পাওয়া আর জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করা এটাই ওর সুখানুভব। তাছাড়া ঘুরে গেলে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হয়ে যাবে, দু’জনকেই কথা শুনতে হবে।
    ” প্লিজ, প্লিজ, সুদীপ,আলো নিভিয়ো না আজ। দোহাই তোমার” মিষ্টির এত অনুরোধ সত্বেও সুদীপ সেদিনও যথারীতি হেডলাইটের সুইচটা বাঁ হাতের আঙুলে টুক করে নিভিয়ে দিল। চারদিকে অমনি নিকষ কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু সেদিন এ কি হল? সুদীপের এমন অভিজ্ঞতা তো কখনো হয়নি! মিষ্টির চিৎকার নেই, প্রানপনে জড়িয়ে ধরা নেই, কি ব্যাপার? মিষ্টি কি আজ ভয় পায়নি? আলোটা কয়েক সেকেন্ড নেভানো, বাইকটা ঠিক রাস্তায় আস্তেই চলছে ।হঠাৎ সুদীপ অনুভব করল, অন্ধকারে সাদা মতো একটা কাপড় যেন ওর মাথার উপর দিয়ে উড়ে পেছনে চলে গেল। ততক্ষণে কিছুটা এগিয়ে এসেছে এবার আলোটা জ্বালতেই হবে, নইলে অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে। অন্ধকার আর রাস্তার ঠাহর হয় না। কিন্তু সুইচ দিতেও হেড লাইটের আলো জ্বললো না। পাগলের মত আরও দু-তিন বার সুইচটা মেরেও হেড লাইট না জ্বলায় ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো সুদীপ। রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। তখনই হেডলাইটটা জ্বলে উঠলো, কিন্তু আলোর জোর এত কম কেন? পিছনে ঘুরে সুদীপ দেখে মিষ্টি নেই, কেউ কোথাও নেই। অজানা একটা রাতপাখির ডাক আকাশ চিরে অন্ধকারে খান খান হয়ে যায়।

  • গল্প

    চেনা

    চেনা
    -শুভায়ন বসু

     

     

    যদিও পশ্চাদ্দেশের ফোঁড়াটা জ্বালাচ্ছে দু’দিন ধরেই, তবুও সকালে ঘুম থেকে উঠেও পড়েছিলুম ঠিকঠাক ।তারপর চশমাটি নিঃশব্দে চোখে নিয়ে বাসি মুখেই মোবাইলে খুটখুট করছিলুমও যথারীতি। হঠাৎই গিন্নির তাগাদা দিয়ে দিনটা শুরু হয়ে গেল, একেবারে রসকষহীনভাবেই দুম করে শুরু হয়ে গেল।
    কিন্তু এই সাধারন দিনটা যে একটা অসাধারণ দিন হিসেবে পরিগণিত হবে তা কে জানত? আজ অফিস ছুটি, বাজারটাও সেরে ফেলেছিলুম এক্কেবারে সেন্ট পার্সেন্ট বিনা ভুলে। চুনোমাছ কিনিনি, মাছের পিস ছোট করে কাটাইনি, গিন্নির ঢেঁড়স অবশ্যই কিনেছি এবং আমার প্রিয় বরবটি মাত্র আড়াইশো গ্রামের বেশি কিনিনি (বেশি বেশি বরবটি কিনি বলে আমার কিঞ্চিত বদনাম আছে), দুধের প্যাকেট নিতেও যথারীতি ভুলতে ভুলতেও ভুলিনি এবং ছেঁড়াফাটা নোট বা একগাদা খুচরো পয়সারও আমদানি করিনি। ফুলকপিটা পেয়েছিলুম জলের দরে আর বেগুনগুলোর চেহারা ছিল একেবারে ঘি চকচকে। শাকের বান্ডিলও বেছে বেছে কিনেছিলুম,পচা টচা ছিল না। যাকগে, দুর্দশার কাহিনী বলতে এসেছি, বাজারের কিস্যা নয়।
    তো সেসব সেরে বাড়িতে পৌঁছতেই, পুনর্বার নির্মম অর্ডার হল। ছেলের আজ পরীক্ষা, স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হবে, পুলকার আসবে না। যাই হোক যথারীতি বিস্বাদ, একঘেয়ে জলযোগ, (যা নিয়ে কোন অভাব অভিযোগ জানানো মানা, আর করলেও তা ভস্মে ঘি ঢালার মত) গলধঃকরণ করে অগত্যা বেরিয়ে পড়তে হল পুরনো সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িটা নিয়ে। জানলার কাঁচ ছিল নামানো, মৃদুমন্দ হাওয়াও আসছিল, স্টিরিওতে গান চালাতে গিয়ে দেখলুম স্পিকারটা কেটে গেছে, সেই শুরু। ঘ্যাংকোর ঘ্যাংকোর শব্দে কান ঝালাপালা।তাড়াতাড়ি সেটা বন্ধ করে নিজেই বেসুরো গুনগুন গান করতে শুরু করেছিলুম মহানন্দে। যদিও তখনো জানিনা কি দিনটাই না অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য, যদি জানতুম!
    কিছুদূর যাবার পরই গাড়িটা টানতে শুরু করলো একদিকে, যেন চলতেই চায়না। স্কুল তখন অল্পই দূর, প্রায় দেখা যায়। গাড়িটা রাস্তায় সাইড করে, নেমে দেখি, সর্ব্বনাশ! সামনের চাকা বসে গেছে। নির্ঘাত পাংচার। এই অবস্থায় আর চালালে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা, টিউব বদলানোর মতো পয়সা নেই। এখনো মাসের চার পাঁচ দিন পড়ে আছে, কোনোক্রমে চালিয়ে নিতে হবে ফাটা রেকর্ডের বেজে যাওয়া একটানা গানের মত। এখন চাকাটাকে কোনোক্রমে খুলে স্টেপনিটা লাগিয়ে নিলেই কেল্লাফতে। বাকি পরে দেখা যাবে। এই মনে করে ডিকি থেকে জ্যাকটা বের করলুম। জ্যাকটার অবস্থা শীর্ণ, মরচে ধরা।ক্যাচোরকোঁচোর শব্দে সেটা ভীষণ আপত্তি জানাতে লাগল। কতদিন ব্যবহার হয়নি, কে জানে? আমার আশঙ্কাকে নির্ভুল প্রমাণ করে সে সত্যিই দেহ রাখল। বেঁকে তেবড়ে তার দেহ পড়ে রইল। পাশে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি। আমার দুরবস্থা দেখে এগিয়ে এল একটা কমবয়সী ছেলে, কোন পুলকারের চালক। রাস্তার ওপাশে তার গাড়ি দাঁড় করিয়ে সে বোধহয় ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছিল। ছেলেটি নেমে এসে বলল ‘কি দাদা,পাংচার?’ বললুম ‘হ্যাঁ ভাই, জ্যাকটাও গেছে।’ বললাম না শুধু টায়ার নয়,প্রেস্টিজটাও পাংচার। হাতে কালি মেখে, ভ্যাবলা ক্যাবলার মত মাঝরাস্তায় দাড়িয়ে আছি, ঠিক যেন একটা জোকার। তখনই গিন্নির ফোন এল। ছেলের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, পৌঁছেছি কিনা। বলতে গেলুম ‘গাড়ি খারাপ হয়েছে,’ কিন্তু তার আগেই পিঁ পিঁ করে মোবাইলটা সুইচড অফ হয়ে গেল। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। এবার মোবাইলটাও দেহ রাখল। আরো একটা ধাক্কা খেলাম। ক’দিন ধরেই চার্জারটা লুজ কানেকশন হচ্ছিল, সারারাত চার্জই হয়নি, মনে হচ্ছে। চার্জার আর মোবাইলের বাপান্ত করতে লাগলুম। এদিকে ছেলের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, আর আমি রাস্তায় ত্রিশঙ্কু। মুখ কাঁচুমাচু করে ছেলেটিকে বললুম ‘ভাই, কি হবে এখন?’ আমার বিপন্ন, বিপর্যস্ত দশা দেখে তার দয়া হল। সে আশ্বাস দিয়ে বলল ‘দাঁড়ান,দেখছি।’ বলে, তার গাড়ির ডিকি থেকে একটা নতুন জ্যাক নামিয়ে নিয়ে এল। ‘সরুন, আমি করে দিচ্ছি’ বলে নিপুণ হাতে, চটপট চাকাটা খুলে ফেলল। বুঝতেই পারলাম সে ড্রাইভার কাম মেকানিক। বিপদের মধ্যে যেন আশার আলো দেখতে পেলুম। পাংচার চাকাটা খুলে ছেলেটি বলল ‘কই, আপনার স্টেপনি দিন এবার, লাগাতে হবে।’ মহানন্দে ডিকি থেকে অব্যবহৃত স্টেপনি বার করে দিলুম। সে তো স্টেপনি মাটিতে নামিয়েই আর্তনাদ করে উঠল। ‘এ কি করেছেন? স্টেপনিতে তো হাওয়াই নেই!’ তার আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকটাও যেন হায় হায় করে উঠল। এবারে স্টেপনিও গেল, কি হবে? একে একে সবাই সুযোগ বুঝে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে লাগল। বৃথা শাপ-শাপান্ত, গালমন্দ। আমি যেন নির্বাক, অপদার্থ একটা কাঠপুতুল, মুখটা হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। এরপর কি বলতে হবে, আমার জানা নেই। ছেলেটি মোটেও ঘাবড়াল না, আমাকে দাবড়ালও না। এই বিপদে আমাকে ছেড়েও গেল না। বলল ‘স্টেপনিতে হাওয়া ভরে রাখেন না?’ আমার মনে পড়ল গাড়িতে যখনই হাওয়া ভরি, খুবই আলিস্যি করে ড্রাইভার সিট থেকে নেমে ডিকিটা আর খুলি না। চারটে চাকায় হাওয়া ভরা হয়ে গেলেই, তাচ্ছিল্যভরে একটা দশ টাকার নোট গরিব ছেলেটার ময়লা হাতে আলগোছে দিয়েই, সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে, নিজেকে দুনিয়ায় রাজা প্রতিপন্ন করে চলে যাই, প্রতিবারই। স্টেপনির কথা মনেই থাকে না। সেই তাচ্ছিল্যের আজ সে বদলা নিল, একেবারে মোক্ষম সময়ে। ঘাম মুছে বোকার মত জানতে চাই ‘তাহলে কি হবে?’ এবারও সে আমার রক্ষাকর্তা হয়ে হাজির হয়, আমার মত অপোগন্ডকে সে এবারেও ক্ষমা করে দেয়, আর আমি সেই একমাত্র আশাভরসা, একমাত্র শেষ অবলম্বনকে জড়িয়ে ধরি। ‘দাঁড়ান, দিন আমাকে চাকাটা। আমি গাড়িতে করে সামনের মোড় থেকে সারিয়ে নিয়ে আসছি। আপনি যাবেন আমার সাথে?’ আমি দেখলাম আমার হয়ে ছেলেটা যখন এতই করছে, এত সময় নষ্ট করছে, তার মানে এর বোধহয় কোন কাজই নেই। স্বার্থপরের মত তাই বললাম ‘ভাই, তুমি করিয়ে আনোনা একটু, আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি।’ যেন টাকা দিলেই দুনিয়ার সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে টাকাই যেন শেষ কথা। আমার সেই ঔদ্ধত্য সে তার সরল মনে বুঝতে পারল না। হাত পেতে বলল ‘দিন টাকা’। আমি স্যাট্ করে পেছনের পকেটে থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা দিতে গিয়ে প্রথম বার থাপ্পড়টা খেলুম। মানিব্যাগে মাত্র তিরিশটা খুচরো টাকা পড়ে আছে, সব টাকা বাজারে শেষ। সাবেক মধ্যবিত্ত আমি, বাজারে মানিব্যাগ খালি হয়, এ আর নতুন কি? পুঁজিও এমন নেই যে, সেই মানিব্যাগ পরমুহূর্তেই নতুন টাকায় ভরে দেব। বুরবক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এবার মনে হয়, আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলব। এত অপমানিত জীবনে হইনি। লজ্জায় মাথা কাটা যেতে লাগল। এবারেও পরিত্রাতা হয়ে ছেলেটি বলল ‘ও টাকা নেই, ঠিক আছে। আমি আমার নামে লিখিয়ে করে আনছি। আপনি নাম বলে, কাল দিয়ে দেবেন দোকানে। ঠিক আছে?’ আমি পুতুলের মত ঘাড় নাড়ি। সে চাকা নিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে যায়। পরক্ষণেই মনে হয় নামটাই জানা হয়নি ছেলেটার, ঠিক আছে ফিরুক, তখন জেনে নেব। আবার কিঞ্চিৎ সন্দেহও হয়, চাকাটা নিয়ে হাপিস হয়ে যাবে না তো? আজকাল তো কত কিছুই হচ্ছে! চারিদিকে এ.টি.এম. ফ্রড আর লোকঠকানো ব্যবসা।কাকে বিশ্বাস করব? আসলে মানুষ চিনি না আমিও, এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেও। কে সৎ আর কে অসৎ কে জানে? মানুষকে বিশ্বাস করতে ভয় হয়। পরক্ষণেই চোখ পড়ে যায় ছেলেটার জ্যাকটার ওপর, আমার গাড়িতেই লাগানো আছে, নতুন ।একটা পাংচার হওয়া শতচ্ছিন্ন চাকার থেকে কম দাম হবে না নিশ্চয়ই। আরো একটা যেন থাপ্পর এসে পড়ে গালে। মানুষকে অবিশ্বাস করার শাস্তি। মানুষ না চিনে ,অমানুষকে আপন করে নেবার প্রায়শ্চিত্ত কবে যে করব, কে জানে? খেয়াল হল, ছেলের অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গেছে। এটুকু রাস্তা হেঁটে গিয়ে বরং নিয়ে আসি স্কুল থেকে। অগত্যা পদব্রজন, ঘামতে ঘামতেই। ছেলেকে অনেক জবাবদিহি করে, অবশেষে ফিরতে শুরু করি। মনে মনে ভাবি এর চেয়ে শতগুণ বেশি জবাবদিহি এখনও অপেক্ষা করে আছে বাড়িতে, শতগুণ অপমান। নিজের অপদার্থতার এবারে সবকিছু খুল্লামখুল্লা হল বলে। মনটা ভারাক্রান্ত হয়, হাজার বেগড়বাঁই এই একই দিনে হতে হলো? কি কুক্ষণেই না আজকের ছুটিটা আরাম আয়েশ করে কাটিয়ে দেব ভেবেছিলুম! সে কি আর হবার জো আছে? কার যে মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলুম আজ! মনে পড়তেই ঢোঁক গিলে নিলুম, এ কথা ভুলেও বলা যাবে না। নিজেই জোর করে ভুলে নিলুম,গিলে নিলুম সেকথা।এখন বাড়িতে পৌঁছতে পারলে হয় ।এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে গাড়ির শবদেহের পাশে এসে উপস্থিত হলুম। ঠক ঠকাঠক শব্দে ততক্ষণে কাজ শুরু হয়ে গেছে, চাকা সারিয়ে এনে ফিটিং হচ্ছে। পাঁচ মিনিটেই কাজ শেষ। সব কাজ সেরে, ডিকি বন্ধ করে, হাত তাত মুছে, ছেলেটি হেসে সামনে এসে বলল ‘যান, হয়ে গেছে।’ ছেলেটির হাত দু’টো ধরে, অজস্র ধন্যবাদ দিয়ে বললাম ‘ভাই, তোমার নামটা তো জানা হয়নি। টাকা দেবার সময় বলতে হবে কাল।’ ‘কোন কিছু দিতে হবে না, আমার চেনা দোকান। ক’টাকাই বা খরচ হয়েছে।’ ‘তবু তোমার নামটা?’ ‘শেখ জামাল’, বলে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিল সে। হাত নেড়ে চলে যেতে যেতে বলল ‘স্টেপনিতে হাওয়া দিয়ে রাখবেন এবার।’ তার গাড়ি আমার হতভম্ব চোখের সামনে দিয়ে হুশ্ করে চলে গেল। মনে হল জামাল নাম না হয়ে. অন্য কোন নাম শুনলেই যেন বেশি খুশি হতাম। সেটাই সেদিন আমার গালে শেষ থাপ্পর হয়ে নামল, আগের চেয়েও জোরে। মানুষ চিনিনা আমি, দেশটাকেও চিনিনি কিছুই। নিতান্তই একটা গোমুখ্যু হয়ে এতগুলো বছর পার করে দিলুম।
    গাড়ি স্টার্ট দিলুম। ভাবছিলুম, আজকের দিনটা খারাপ না ভাল? এতগুলো খারাপ অভিজ্ঞতাকে ম্লান করে দিল একটা ভাল অভিজ্ঞতা। মনটা ভাল হয়ে যায়, শেষমেষ সারাদিনের সব গ্লানি ধুয়ে যায় জামালের মতো একটি ছেলের সান্নিধ্য, তার পরম মনুষ্যত্ব, অচেনা অজানা একটি বিপদগ্রস্ত মানুষকে অবলীলায়, সব কাজ ছেড়ে সাহায্য করার মহত্বের কাছে। আসলে এটাই আমার দেশ। একদিনেই আমি সারা জীবনের শিক্ষা পাই, সেটাই আমার পরম পাওয়া হয়।বাকি রাস্তা ছেলেকে সেটাই বোঝাতে বোঝাতে আসি, কে জানে বোঝে কিনা? আজ না বুঝলেও, আমার মতোই একদিন বুঝবে ঠিকই, নিশ্চিন্ত হই।

  • গল্প

    ডেড লেটার

    ডেড লেটার

    -শুভায়ন বসু

     

     

    “কি সব চিঠি আসে দেখুন অনিলদা, কি যে করব এদের নিয়ে!” বিরক্তির সঙ্গে একটা সুন্দর গোলাপী খাম  পোস্টমাস্টার অনিল ঘোষের হাতে প্রায় জোর করে ধরিয়ে দিয়ে পালায় পোস্টম্যান হারু।
    অনিল বাবু খামটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে একটু দেখলেন। এরকম বেশ কিছু চিঠি প্রতিদিনই জমা পড়ে, যার হয় ঠিকানা ঠিকমত লেখা নেই বা ভুল লেখা আছে। এসব চিঠি ডেডলেটারের খোপে জমা হয় আর কয়েক বছর পর পর অনেক জমে গেলে, অকশন করে দেওয়া হয় বা পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এই চিঠিটা হারু কেন যে তার হাতেই দিয়ে গেল বুঝে পেলেন না অনিলবাবু। হাতের লেখাটা4 বাচ্চার আর চিঠিটা লেখা হয়েছে ভগবানকে ।খামের উপর ডাকটিকিটও ঠিকঠাক বসানো ।চিঠিটা পাশে রেখে নিজের কাজে ডুবে গেলেন তিনি। মফস্বলের পোস্টঅফিস হলেও, স্টাফ কম বলে চাপ খুবই বেশি। তার ওপর তিনি আবার পোস্ট মাস্টার। টিফিন টাইমে ভিড় একটু পাতলা হতেই তিনি চিঠিটা হাতে নিয়ে আবারও দেখেন। একটা বাচ্চা ভগবানকে কি চিঠি লিখেছে তা জানতে বড় কৌতুহল হয়। ডেডলেটার বলেই শেষে খামটা আস্তে আস্তে খুলে চিঠিটা বার করে ফেলেন অনিল বাবু। গোটা গোটা অক্ষরে কয়েক লাইনের চিঠি ,একটা বাচ্চারই কান্ড। চিঠিটা এরকম।


    প্রিয় ভগবান,
    তুমি তো আকাশে থাক, মা বলেছে। আমার বাবাও তো আকাশে চলে গেছে ।সবার বাবা আছে,কিন্তু আমি কখনো আমার বাবাকে দেখিনি ।শুনেছি সে তোমার কাছে আছে ।সবাই নাকি মরে গেলে তোমার কাছে চলে যায়। ভগবান আমার বাবাকে তুমি কোথায় লুকিয়ে রেখেছ? আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে বাবাকে ।বাবা কেমন আছে ?আমার আর মা’র কথা বলে ?বাবা কি আমাদের কাছে আর কখনো আসবে না ?তুমি বাবাকে আমার কথা বোল, আর বোল আমি বাবাকে খুব ভালোবাসি। বাবার কি আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না ?তাহলে আসে না কেন?আমার এবারের জন্মদিনে একবার নেমে আসতে বলো প্লিজ। ভগবান, আমার এই কথাটা বাবাকে জানিও ,তাহলেই বাবা ঠিক চলে আসবে ,আমি জানি। শুভ্র দাস পড়তে পড়তে চোখে জল এসে যায় অনিলবাবুর। চোখটা রুমালে মুছে, চিঠিটা যত্ন করে খামে ভরে রেখে দেন ।ঠিকানাও লেখা আছে ছেলেটার, চিঠির এককোণে। একবার ভাবলেন চিঠিটা ফেরত পাঠিয়ে দেবেন ‘আনডেলিভার্ড’ বলে।
    আনমনে ভাবতে থাকেন নিজের জীবনের কথা ।তার বাবাও এইভাবেই একদিন খুব ছোটবেলায়, দুম করে মরে গেলেন। ক্যান্সারে। তখন অনিল বাবুর বয়স মাত্র দশ। সেই থেকে কত খুঁজেছেন বাবাকে, আকাশে নক্ষত্র মন্ডলের দিকে তাকিয়ে, বর্ষার দামাল মেঘের ঘনঘটার মধ্যে বা বাজারে হঠাৎ কারও দিকে চোখ আটকে গেলে। বাবার অল্প চেনা ছবিটা খুঁজে গেছেন কতদিন। যদি পাওয়া যায়! মন মানেনি যে বাবা নেই। এই ছেলেটাও হয়ত তাই। জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছে ।কি জানি কি ভাবে ?হয়তো কোন অ্যাক্সিডেন্টে! বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখেছে, এও বাবার অনুসন্ধান চালাচ্ছে। অবুঝ মনের আর কি দোষ? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন অনিলবাবু।
    বিকেলে পোস্টঅফিস ফাঁকা হতে, যে যার ব্যাগ পত্র গুছিয়ে উঠতে থাকে। তখনই বন্ধু ও সহকর্মী মাধববাবুকে ডেকে চিঠিটা দেখান তিনি। মাধব চিঠিটা পড়ে হেসে বলল ” যতসব ছেলেমানুষি! নাও, এবার এটা ভগবানের কাছে পাঠাও দেখি! ছেলেটা কিন্তু উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে থাকবে।” বলে উঠে পড়ল।
    অনিলবাবু ভাবনায় পড়ে যান ।চিঠিটা ডেডলেটারের খোপে পাঠাতে তারও বাধে। ছেলেটার আশায় তাহলে একরাশ জল ঢেলে দেওয়া হবে। কত আশা করে ,শিশুর নিষ্পাপ ভালোবাসা নিয়ে,না দেখা প্রিয় বাবার জন্য অপেক্ষা ।শেষে তিনি ডেড বাবার মত চিঠিটাও ডেডলেটার করে দেবেন! না, একবার অন্তত, শিশুটির মুখে হাসি ফোটাতেই হবে ।একবার অন্তত, পিতৃহীন ছেলেটিকে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করবেন না। নিজের ছোটবেলার যন্ত্রনা মনে পড়ে গেল।
    সব স্টাফেরা চলে গেলে, নিজের ডেস্কে একটা সাদা খাম আর সাদা কাগজ টেনে নেন তিনি। চোখের জল আজ বাঁধ মানছে না। চোখটা রুমালে আরো একবার মুছে ফেলে, লেখা শুরু করেন।

    প্রিয় শুভ্র,
    তোমার চিঠি পেয়েছি। পোস্টম্যান অনেক কষ্টে অনেক তারা আর উল্কা পেরিয়ে, শেষমেষ আমার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। তোমার বাবা আমার কাছেই আছেন। এই আকাশে উনি খুব ভালো আছেন। রোজ4 বিকেলে আমরা এখানে বসে তোমাকে দেখি ।তোমার বাবা খুব ভালো মানুষ, তোমার কত কথা আমাকে বলেন। তুমি কখন খাও ,কি খাও, কি বই পড়, কখন খেল, মার সঙ্গে কখন দুষ্টুমি কর, আর কখন মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি স্বপ্ন দেখ, সেটাও তোমার বাবা বলেন ।বলেন, তুমি একদিন খুব বড় হবে। তোমার মন হবে উদার, তোমার দৃষ্টি হবে স্বচ্ছ। তুমি গরিবদের, অসহায়দের ভালবাসবে। তোমার বাবা তো আর তোমার কাছে যেতে পারবেন না। শুধু তুমি যখন এক একটা ভালো কাজ করবে, পড়াশোনা- খেলাধূলা- ছবিআঁকা বা যে কোন ভালো কাজে সফল হবে, তখনই তোমার বাবা খুব খুশী হবেন আর তুমি তোমার মন দিয়ে তখনই সেটা বুঝতে পারবে। এই ভাবেই তুমি তোমার বাবাকে পাবে ।তোমার বাবা জানেন, তুমি তাকে কত ভালবাস। তাই তোমার জন্য পৃথিবীতে ,অনেক খুশি, আনন্দ আর ভালোবাসা সাজিয়ে রেখে এসেছেন ।বড় হবার পথে, ধীরে ধীরে ,তুমি সেগুলো খুঁজে পাবে আর বুঝতে পারবে ।তোমার বাবা সব সময় তোমার কাছে আছেন। ভালো থেকো।ইতি,
    ভগবান পোস্টঅফিসের দরজা বন্ধ করে ,চিঠিটা লেটারবক্সে ফেলে ,আকাশের দিকে তাকিয়ে অনিলবাবুর মুখে একটা প্রশান্তি ফুটে ওঠে। যদিও তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে, আকাশ অন্ধকার। তবু দূর কোন দেশের কোন দূরতম তারার থেকে একটা মনের বার্তা পান তিনি, তার মনটা ভারি ভালো হয়ে যায়।

  • গল্প

    ভালবাসার মানুষ

    ভালবাসার মানুষ

    -শুভায়ন বসু

     

     

    “বাবা আসছেনা কেন?” এই নিয়ে পাঁচবার প্রশ্ন করল মিতুন ।প্রথম প্রথম বিরক্ত হচ্ছিল অপরাজিতা।বলছিল “আমি কি করে বলব কেন আসছে না? ঠিক আসবে এখন।” ঘরের কাজ করতে করতে বারান্দা দিয়ে দূরে রাস্তায় চোখ চলে যাচ্ছিল বারবার। মিতুনেরও আজ পড়ায় মন নেই ।সবে তো বাজল মাত্র সাড়ে ছটা। মানুষটা আসার সময় পেরিয়ে যায়নি এখনো।
    টিভিতে আজ মন বসলো না অপরাজিতার। এত দেরী করেনাতো অভী সচরাচর। কিছু বলেও যায়নি সকালে। ফোনটাও কখন থেকে সুইচড্ অফ। একটু চিন্তা হচ্ছে, রাস্তাঘাটের ব্যাপার। সব সময় খারাপ চিন্তাটাই আগে মাথায় আসে ।মেয়েটা যখন বারবার ঘ্যানঘ্যান করে বাবার কথা জিজ্ঞেস করতে লাগল, শেষে মিথ্যে করেই বলে দিল অপা “বাবার অফিসের কাজ ছিল বোধহয়, ফিরতে তাই দেরি হচ্ছে। তুমি হোমওয়ার্ক করে ফেলো।”
    বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো অপা। মেয়েটাও সঙ্গ ছাড়ছে না ।মেয়েটা বড্ড বাবার ন্যাওটা ,যত রাতেই বাবা ফিরুক না কেন, একছুটে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর অভীরও কোন ক্লান্তি নেই ,ব্যাগ-জুতো-মোজা কোথায় কোথায় ছুঁড়ে ফেলে, মেয়েকে নিয়ে খাটে গড়াগড়ি, আদর।
    “তুমি এখানে কি করছ মিতুন? যাও ঘরে। হোম টাস্ক গুলো হলো না এখনও ?বাবা এখনই আসবে, যাও বলছি।” মৃদু শাসনের সুর অপরাজিতার গলায়।ওর দুশ্চিন্তামগ্ন অন্যমনস্কতা ছ’বছরের মেয়েরও নজর এড়ায়না বোধহয়। তাই মেয়ে কাছ ছাড়ে না মায়ের। দুজনে তাকিয়ে থাকে তৃতীয় ব্যক্তিটির ঘরে ফেরার অপেক্ষায় ।মায়ার বাঁধন একেই বলে।
    টিভিতে কোন প্রোগ্রামই তেমন ভাল লাগছে না আজ। আরও একবার চেষ্টা করেছে অভীর মোবাইলে। এখনো সুইচড্ অফ।এবার একটু দুশ্চিন্তা হতে শুরু করলো অপার। আর কাকে ফোন করবে, কোথা থেকে খবর পাবে?অভীর কোন বন্ধুকে ফোন করবে কি ?কিন্তু এই ডিপার্টমেন্টে তো ওর সবেমাত্র বদলি হয়েছে, সে রকম কোনো কলিগের নাম্বারও নেওয়া হয়ে ওঠেনি ।কি করবে ও?
    আটটা বাজল, মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে না খেয়েই। মোবাইলে একটা ফোন এলো, বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। ও,বাবার ফোন ।অভী ফেরেনি শুনে বলল, “দ্যাখ ,আজও তো অবরোধ হয়েছে কলেজ স্ট্রিটে। কলকাতার রাস্তাঘাট যা ,কারো বাড়ি ফেরার টাইমের ঠিক নেই ।চিন্তা করিস না ,ঠিক ফিরে আসবে।”বাবারা এরকমই হয়,কত সহজে অস্থির মনে শান্তির আশ্বাসবাণীটুকু ভরে দিতে পারে।মনে একটু বল পায় অপা।কিন্তু রাস্তার জ্যাম, মিটিং ,মিছিল ,অবরোধ তো আগেও হয়েছে ।অভীও জানিয়ে দিয়েছে যে বাড়ি ফিরতে দেরী হবে ।কিন্তু আজকে একটাও ফোন করলো না কেন ?মোবাইলটাই বা সুইচড্ অফ কেন? দুশ্চিন্তাটা আবারও ঘিরে ধরেছিল অপাকে ।কিছু ভাল লাগছিল না ,অসহায় লাগছিল।
    ঘড়ির কাঁটা কথা শুনছে না, ন’টা ছুঁইছুঁই ।বাবাকে আবারও ফোন করতে হল অভীর অফিসে একবার ফোন করে খোঁজ নেবার জন্য। পুরনো ডিপার্টমেন্টের তন্ময়দা, সৌভিকদা সবাইকে ফোন করা হয়ে গেছে, কেউ কিছু বলতে পারেনি। বুকের মধ্যে উৎকণ্ঠাটা এখন অনেক বেড়ে গেছে বুঝতে পারে অপা। একবার গেট অব্দি হেঁটে গিয়ে ঘুরে এসেছে। দারোয়ান শিবপ্রসাদ বলেছে “বাড়ি যান ম্যাডাম, বাবু ঠিক ফিরে আসবে। আজকে রাস্তায় বহুৎ জ্যাম আছে।” কিন্তু কোথাও কোনো খবর পাওয়া গেলনা। দুশ্চিন্তাটা গ্রাস করে ফেলল অপাকে। অথচ মেয়েটা কি নিষ্পাপ মুখে শান্তির গভীর নিদ্রায় মগ্ন ।কি নিশ্চন্তে মিথ্যে আশ্বাসটুকুকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে।হায়রে কেউ যদি এমন আশ্বাস দিতে পারত অপাকে,কেউ যদি দিত একটু মনের শান্তি।কি হলো অভির?
    অপা আর ভাবতে পারেনা। অনেক পুরনো কথা মনে আসতে লাগলো, অনেক অযথা ঝগড়া, অনেক অভিমান ।”আজ আসুক অভী, আর ঝগড়া করব না কখনো”, মনে মনে বলে অপা।চোখে একরাশ জল কোথা থেকে জমা হয়েছে, মনে ঝড় ।”কোথায় গেলে অভী? কি করব আমি একা?”, বিপন্ন,বিপর্যস্ত অপা।বড্ড অসহায়।
    দরজা খোলাই ছিল,হঠাৎ মনে হয় কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে ।চমকে ওঠে অপা। ” একি, সব অন্ধকার কেন? কি করছো তোমরা ?”চেনা স্বরে সম্বিত ফেরে অপরাজিতার। বুঝতে পারে মানুষটা ফিরেছে। নিমেষে সব উৎকণ্ঠার অবসান ,হঠাৎ এত আবেগ উঠে আসে ওর গলা দিয়ে !জীবন-মরণ যাই বল, সব তো এই টুকুই ।এই অভী আর মিতুন ।নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা অপা। একটা আশ্রয় চাই। ঝাঁপিয়ে পড়ে অভির বুকে। চেনা ঘামের গন্ধে মুখটা গুঁজে দিয়ে ডুকরে ওঠে ,”কি করছিলে এত রাত পর্যন্ত ,কেন এত দেরী করলে, কেন একবারও জানাওনি ……..”
    সব ভালবাসার মানুষই জানে এই সময় কিছু বলতে নেই। শুধু পাল্টা অনুভূতির উত্তাপে মুড়ে ফেলতে হয়, জড়িয়ে নিতে হয় আশ্লেষে।

  • গল্প

    পাথরে লেখা নাম

    পাথরে লেখা নাম
    -শুভায়ন বসু

     

     

    পূর্বা আর পৃথা দুই পিঠোপিঠি বোন। মাত্র দু’বছরের ছোট বড়ো। একেবারে একই স্বভাব, একই গলার স্বর। যদিও পূর্বা ফর্সা, সুন্দরী আর পৃথার একটু চাপা রং, দেখতেও তেমন সুন্দরী নয়। দু’জনে খুব ভাব, খুব মিল। শুধু দুই বোন বলে নয়, ওরা একে-অপরের সবচেয়ে ভালো বন্ধুও,যেন হরিহর-আত্মা। রামপুরহাটের নিশ্চিন্তপুরে, সবাই জানত দু’বোনের এমন মনের মিলের কথা।
    ওদের বাবা প্রতীকবাবু ওদের একই স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। দু’জনেই পড়াশোনায় ভালো। দিদি পূর্বা খুব খেয়াল রাখে ছোট বোন পৃথার, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে দু’জনে দু’জনকে। পৃথাও দিদি বলতে অজ্ঞান, দিদিই তার টিচার ।দিদিই সবকিছু দেখিয়ে দেয়। পড়াশোনা, ছবি আঁকা, খেলাধুলা যাই হোক না কেন।
    হঠাৎই এই দুই বোনের মধ্যে অযাচিতভাবে এসে পড়ল একটি ছেলে। পূর্বা তখন পরে ক্লাস টুয়েলভে। হঠাৎই বরুণ স্যারের কোচিং এ আলাপ হল রুপমের সঙ্গে।একটা ছটফটে দুরন্ত ছেলে, তার সঙ্গে তার স্বপ্নীল চোখ আর পড়াশোনায় দারুণ রেকর্ড, যেন ঠিক ম্যাচ করত না। দুজনেরই ভালো লেগে যায় দু’জনকে ।কোচিং যাওয়া-আসার পথে, একটুখানি পথ একসঙ্গে চলা, এই ছিল ওদের অস্ফুট প্রেম।
    হঠাৎই পৃথার নজরে পড়ে যায় ব্যাপারটা। রূপমের বাইকে পূর্বা না! ব্যস আর যায় কোথায়? পূর্বা ধরা পড়ে যায় ।তারপর খানিক মান-অভিমান, রাগ। “কেন আমাকে বলিসনি আগে?” পৃথা কেঁদেই ফেলে। শেষকালে দুই বোনে রফা হয়। রুপমের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে হবে পৃথার, পৃথাও বাড়িতে কাউকে কিছু বলবে না।
    কিন্তু সমস্যা শুরু হল তখনই। যখন রুপমের সঙ্গে পরিচয়ের পর, তার কথা বলা, তাকানো, স্টাইল, সব কিছু ভাল লেগে যায় পৃথারও। মুখে কিছু বলতে পারে না, দিদির বয়ফ্রেন্ড বলে কথা। চোরাচাউনিতে চেয়ে থাকে শুধু, চোখে মুখে মুগ্ধতা। বারবার বোঝায় নিজেকে, না, এটা ঠিক হচ্ছে না, ওকে পিছিয়ে আসতেই হবে। মনে কোন দুর্বলতার স্থান নেই। দিদিকে যে সে প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবাসে, তার সঙ্গে কোনো অন্যায় সে করতে পারবে না। সব ঠিকই, পিছিয়েও সে আসে জোর করে, নিজেকে কষ্ট দিয়ে, কিন্তু গোপন মুগ্ধতা থেকেই যায়। দুর্গামন্দিরের পশ্চিমে, পাথরের উপর বসে, বিকেলের আলোয় যখন পূর্বা আর রুপমের প্রেম জমে উঠতো, আড়াল থেকে মাঝে মাঝে নজর রাখত পৃথা। ঈর্ষা? হয়ত বা।আসলে মানুষের মন তো! তার উপর মেয়ে হয়ে জন্মেছে দু’জনেই। স্বাভাবিক এই মুগ্ধতা। চোরাচাউনিতে বন্দী, অক্ষম গোপন প্রেম, কতই তো মরে যায়। এও হয়ত তারই নামান্তর।
    ধীরে ধীরে পূর্বা আর পৃথার মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়। পৃথা ঈর্ষা করতে শুরু করে পূর্বার দামাল প্রেমকে। দুই বোনে ক্ষণিক মানসিক দূরত্বও তৈরি হয়। পূর্বা হয়ত বুঝতে পার একটু, ভালোবাসা দিয়ে ভোলাতে চেষ্টা করে বোনকে। বোন তো তার প্রাণাধিক প্রিয় ,কেউ নয় তার আগে। কিন্তু প্রেমের জোয়ারে ভাসতে শুরু করলে কোনকিছুই আর বেঁধে রাখতে পারে না কাউকে, প্রেমিকের চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না তখন।
    তাই হল। ওদের বাইকে করে ঘুরে বেড়ানো বেড়ে গেল। কোচিং কামাই করে প্রেম, আর তার ফলে অবধারিতভাবেই পূর্বার রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করল। প্রতীকবাবুর কানে এসেছিল কিছু কথা। একদিন বড় মেয়েকে ডেকে  শুনিয়ে দিলেন দু’ চার কথা। ব্যাস! এইটুকুই। পূর্বা মনে করল ছোট বোনই নিশ্চয়ই লাগিয়েছে বাবাকে। দুই বোনে কথা বন্ধ, মনোমালিন্য, রেষারেষির শুরু সেই থেকে। হায়রে, রক্তের সম্পর্ক ,জন্মগত ভালোবাসা কোথায় গেল!
    তবে ভালোবাসা মরে না, ভেতরে ভেতরে ঠিকই বইতে থাকে তার গোপন ধারা। দুই বোনে যতই ঝগড়া অভিমান হোক না কেন, হয়ত মিটেও যেত একদিন। কিন্তু হল না।
    তার আগেই বিজয়া দশমীর দিন সন্ধ্যায় ঝড়ের বেগে এলো সেই দুঃসংবাদটা। বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে রূপম -পূর্বার ।দামাল গতিতে কোথায় যেন যাচ্ছিল দু’জনে মেনরোড ধরে, লেন ভেঙে উল্টোদিক থেকে এসে পড়েছিল এক কালান্তক ডাম্পার। সব শেষ! রুপম হাসপাতালে যাবার আগেই, পূর্বা খুব লড়েছিল মৃত্যুর সঙ্গে। কিন্তু দু’দিন পরে সেও আর চোখ খুলল না, ঢলে পড়ল রুপমের চলার পথে। নিস্তব্ধতা নেমে এলো নিশ্চিন্তপুরে, বাড়ি বাড়ি অরন্ধন।
    তিন দিন ধরে কিচ্ছু খায়নি পৃথা। মা বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন, বাবা বাকরুদ্ধ। সবাই ঘিরে রেখেছে ওদের।বাড়িতে শুধু কান্নার রোল, নানা স্বরে, নানা প্রেক্ষিতে।স্মৃতি বড় অবুঝ, মনটাও। কিছুতেই বাঁচতে দেবে না যেন। পাগলের মত হয়ে গেছে পৃথা। মনে তার ঝড়। দিদি নেই, ভাবতেও পারে না সে। এত আপনার জন, এইভাবে, দুম করে চিরতরে চলে যায় নাকি? বিশ্বাস হয় না পৃথার। সদর দরজার দিকে তাকিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে, লাল চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ।এই বুঝি দিদি ফিরে এল। কেন, ফিরে আসবে না?
    দু’দিন পরের কথা। পৃথা বাড়ির বাইরে প্রথম পা রাখে ।পায়ে পায়ে চলে আসে সেই দুর্গা মন্দিরের কাছে। এক অদৃশ্য অমোঘ টানে, এগিয়ে চলে পাথরের টিলাটার কাছে, যেখানে বসে থাকতো রুপম আর পূর্বা। কতদিন, কত প্রেম জমে উঠত ওদের এখানেই, লুকিয়ে দেখত পৃথা ,অদম্য আকর্ষণে। হঠাৎ পা আটকে যায় মাটিতে। একটা পাথর, তার ওপর খোদাই করা নাম “রুপম + পূর্বা”। একটু যেন হালকা হয়ে গেছে লেখাটা ক’দিনে। চোখ সরাতে পারে না পৃথা ।ও এই লেখা খোদাই করতে দেখেছে ওদের। ছোট একটা পাথরের মাথাটা ঘষে ঘষে ধার করে নিয়ে লিখেছিল ওরা । দুর্গা মন্দিরের আড়াল থেকে দেখেছিল পৃথা। এই সেই লেখা। অজান্তে চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে আসে পৃথার, পাগলের মত খোঁজে একটা নুড়ি। তারপর ছুটে যায় সেই পাথরের কাছে, আর জীবনের যত রাগ- দুঃখ- অভিমান সব যেন ঘায়ে ঘায়ে নেমে আসে সেই পাথরের উপর। ফোঁপাতে থাকে “দিদিভাই ,তুই এইখানে থাক, তুই আমাকে ক্ষমা করে দে দিদিভাই, তুই কোথায়, দিদিভাই ?” বারবার বলতে থাকে পৃথা। যেন এখনই জ্ঞান হারাবে, উত্তেজনায় ।আর তার পর  ছোট্ট একটা পাগলামি আর আবেগের বশে,হাঁপাতে হাঁপাতে, অপটু হাতের আঘাতে রুক্ষ পাথরের উপর ফুটে উঠতে থাকে সেই দুটো নাম।ঘষে ঘষে সেই লেখা আবার জ্বলজ্বলে করে তোলে ও।মানুষ দু’টো নেই,শুধু পরিষ্কার হয়ে যায় পাথরে খোদাই করা “রুপম + পূর্বা”। দিনের আলো ঢলতে শুরু করে মন্দিরের আড়ালে।

  • গল্প

    উত্তর

    উত্তর
    -শুভায়ন বসু

     

     

    অমিত আর অদিতির প্রেমটা ছিল দামাল হাওয়ার মত, সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া। ওরা ছিল যাকে বলে ‘মেড ফর ইচ আদার’। কলকাতার রাস্তায় ওদের প্রেম উড়ে বেড়াত কোন বাঁধন ছাড়াই।

    কিন্তু হঠাৎই তাল কাটল, আস্তে আস্তে দুরে সরে যেতে লাগল অদিতি ,আর অমিতের সঙ্গে দেখা করে না বা চিঠির উত্তর দেয় না। অনেক চেষ্টা করেছিল অমিত ওকে ফিরিয়ে আনার, কিন্তু একেবারে ঘরকুনো হয়ে গেল অদিতি। এমনকি বিচ্ছেদের কারণটাও কেউ জানতে পারেনি কোনোদিন ,অমিতও না।

    অমিত পাগলের মত চেষ্টা করেছিল অদিতির সঙ্গে একবার দেখা করার। সব কাজ ছেড়ে পড়ে থাকত ,ওর বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াত, কলেজে গিয়ে দেখা করার চেষ্টা করত। কিন্তু হলো না। বন্ধু-বান্ধবীদের মাধ্যমেও যোগাযোগ করার বা চিঠিও দিয়েছে অমিত। অদিতি হেসে সে চিঠি রেখে দিয়েছে ,কোনো উত্তর দেয় নি।

    অমিত হাজার চেষ্টাতেও জানতে পারল না ,কেন চলে গেল অদিতি। কি ভুল ছিল অমিতের।

    জীবনতো কখনোই একভাবে থেমে থাকেনা। কয়েক মাসের মধ্যেই শোনা গেল অদিতির বিয়ে ।কোন এক এনঅরআইকে বিয়ে করে স্টেটসে সেটেলড্ হল অদিতি। খবরটা শুনে রাগে-দুঃখে হতবাক হয়ে গেল অমিত ।সে বুঝলো অদিতি তাকে ঠকিয়েছে। তার ভালোবাসার মূল্য সে দেয়নি, পায়ে দলে দিয়েছে তার আবেগ, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে তার হৃদয়ের সবচেয়ে দামি উপহারটাকে -অমিতের প্রেম ।অমিতের সেই শুরু অদিতিকে ঘৃণা করার।

    জীবন যুদ্ধ চলতেই থাকল। অমিত তার নিজের জীবনের দিকে এবার ফিরে তাকাল। দেখল সে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে ।কেরিয়ারের লড়াই লড়তে হবে তাকেও। দাঁতে দাঁত চেপে ,চোখের জল মুছে, সেই লড়াইটাতেই এবার নামল সে।

    কুড়ি বছর পরের কথা ।অমিত আজ বড় সহকারী পদে কর্মরত। তার সুখের সংসার, স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে সেও আজ প্রকৃত অর্থেই সফল ভাবে প্রতিষ্ঠিত। থাকে জামশেদপুরে। কলকাতায় আসে মাঝে মাঝে। জীবন যে যার মত এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ একদিন অমিতকে কলকাতা আসতে হয়েছিল কলেজের রিইউনিয়নে। একটা বড় শপিংমলের টপ ফ্লোরে অনুষ্ঠান ।লিফটে করে উঠছিল অমিত ।আর সেই লিফটেই দেখা হয়ে গেল অদিতির সঙ্গে, দীর্ঘ কুড়ি বছর পর। অদিতির সঙ্গে ওর বাচ্চা ছেলেও ছিল। অদিতি যেন আরো সুন্দরী হয়েছে, আরও জেল্লা। অমিতেরও একটু ভারী হয়েছে চেহারাটা, মাথায় হালকা টাক। কিন্তু আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। অবাক বিস্ময়ে অদিতি দেখছিল অমিতকে। ঘোরলাগা চোখ অমিতেরও, কিন্তু মুখে কথা সরছিল না। অদিতি জিজ্ঞেস করেছিল “কেমন আছো? চিনতে পারছো আমাকে?” অমিত উত্তর দেয়নি। নিজের ফ্লোরে নেমে যেতে যেতেও ,অদিতি উত্তরের জন্য পিছন ফিরে তাকিয়েছিল ।অমিত চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিল, মুখে কোন উত্তর নেই। লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল দুজনের দৃষ্টির মাঝখানে।

    অমিত মনে মনে বলল, বিদায় অদিতি, একদিন কতশত প্রশ্ন ছিল, একদিন কত চিঠি দিয়েছিলাম ।তোমার উত্তর পাইনি ।হাজার প্রশ্ন, হাজার দুঃখ ,হাজার অভিমানের কোন জবাব সেদিন দাওনি। আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছিলে ।আজ তোমার একটা প্রশ্নের উত্তর না হয় নাই পেলে।

    কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর পেতে কি সারা জীবন লেগে যায়? অমিত জানতে পারল না, অদিতির এক্বেবারে নিজস্ব আলমারিতে, বিয়ের বেনারসি গুলোর ভাঁজেভাঁজে অদিতি আজও, গভীর গোপন কোন অনুভূতিতে, রেখে দিয়েছে অমিতের সব চিঠিগুলো ।উত্তর দেবে বলে। একদিন।

You cannot copy content of this page