• গল্প

    দ্বেষে বিদ্বেষী

    দ্বেষে বিদ্বেষী
    -সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী

     

    রণেন আর রিনি গাইনোকলোজিস্টের চেম্বারের ওয়েটিং রুমে বসে আছে প্রায় ঘন্টা দুয়েকের মতো।রিনি ছটফট করছে অধৈর্য্য হয়ে। সাড়ে ছ-বছরের মেয়েকে প্রতিবেশীর বাড়িতে রেখে এসেছে। ওরা আন্দাজ করে নি এতটা সময় লাগতে পারে, তাহলে ওরা মেয়ে কৃতিকে সঙ্গে করেই নিয়ে আসতো। রিনি ফিরে যেতে চাইছে আরও ঘন্টা খানেক লাগতে পারে শুনে। মেয়ের পড়াশোনা খাওয়া দাওয়া পুরো রুটিনটাই এলোমেলো হয়ে গেলো। রিনির মনটা ছটফট করছে বুঝে রণেন রিনিকে আশ্বস্ত করলো।দেরীর কারণে রণেন শিখাবৌদির সাথে ফোনে কথা বলে নিয়েছে, কৃতি খুব শান্ত হয়ে আছে, বৌদির মেয়েদের সাথে খেলছে, গান চালিয়ে তিনজনে নাচছে, চিন্তার কিচ্ছু নেই।

    ডাক্তারবাবু রিনির ওপর একগাদা বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিলেন। একার সংসারে রিনি কী করে এতো বাঁধাধরা নিয়মে থাকবে? কৃতির ক্লাস টু, কনভেন্ট স্কুলে যথেষ্ট চাপ কৃতির । রিনি নিজেও একটা বেসরকারি স্কুলে পড়ায়, রণেনের আপাতত কোলকাতায় হেড অফিসে পোস্টিং…যাতায়াতেই অনেকখানি সময় যায় রণেনের। সারাদিনের ক্লান্তি মাথায় নিয়ে রণেন কতটুকুই বা রিনিকে সাহায্য করতে পারবে… মুখে রণেন যতই যা বলুক না কেন… বাস্তবটা তো বুঝতে হবে। পুষ্পর মাইনে কিছুটা বাড়িয়ে রান্নাঘরের কাজেও পুষ্পকে সাহায্য করতে বলবে, এছাড়া তো আর উপায়ও নেই।

    রিক্সায় অন্যমনস্ক রিনি, রণেনের কথাগুলো ওর কানে ঢুকছে বটে, তবে মস্তিষ্কে কোনো রেখাপাত করতে পারছে না। রিনির ভারী অভিমান হোলো সকলের ওপর। কান্নায় গলাটা বুজে আসছে যেন, রিনি কোনো কথা বলতে পারছে না। রিনি কিছুতেই রণেনের কাছে এই দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না।
    ভেতরে ভেতরে একেবারে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে রিনি….
    মা-বাবার ওপর ভয়ানক অভিমান রিনির। মা-বাবা কিছুতেই রিনির সাথে রণেনের বিয়েটা মেনে নিতে পারলো না এই এতগুলো বছর পার করেও। প্রথম প্রথম তো রণেনের বাড়ীতেও ওদের বিয়ে নিয়ে প্রবল অশান্তি ছিলো, বিশেষতঃ রণেনের মায়ের।
    কৃতি হবারও বছর দুই পরে রণেনের বাবার ভীষণ অসুস্থতায় রণেনের বড়দার উদ্যোগে পরিস্থিতি সামান্য অনুকূল হয়, তবে কোথায় যেন একটা সুক্ষ্ম লক্ষ্মণরেখা রয়েই গেছে। রিনি কিছুতেই ওবাড়ীতে সহজ হতে পারে না, পালাপার্বণে গেলেও থাকতে চায় না ওবাড়ীতে। রিনির এই সমস্যাটা রণেন খুব ভালো মতোই বোঝে, কিন্তু দু’জনের কেউই এই বিষয়ে কখনো কোনো আলোচনায় ঢোকে নি, রিনি এব্যাপারে বিশেষ স্পর্শকাতর নিজের মা-বাবার এই বিদ্বেষমূলক আচরণে।

    কৃতিকে শিখাবৌদি দুধরুটি খাইয়ে দিয়েছে, আর রিনিদের দেরী দেখে ওদের জন্যও গরম গরম কটা রুটি আর তরকারী ক্যাসেরোলে ভরে রেখেছে। রিনি নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলো আর রণেন ঘুমন্ত কৃতি আর রাতের খাবার নিয়ে শিখাবৌদির বাড়ী থেকে ফিরলো। রিনি আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না, রণেনের বুকে মুখ গুঁজে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললো। রণেন রিনির মাথায় হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বললো, মেয়ে জেগে যাবে তো।

    পরেরদিন রিনি স্কুলে গিয়ে উইদাউট পে’তে ছুটি নিয়ে নিলো কমাসের জন্য। ফেরার পথে রিনি শিখাবৌদির ফ্ল্যাটে দেখা করতে গেলে শিখাবৌদি খুব সাহস দিলো, সাথে আশ্বাস … কোনো কিছু অসুবিধা হবে না, শিখাবৌদি নিজের জীবন দিয়ে ভুক্তভোগী এমন পরিস্থিতিতে। রিনি খুব ভরসা করে শিখাবৌদির ওপর, বিয়ের পর নতুন সংসার পেতে যখন রিনি-রণেন এই আবাসনের চারতলায় ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে এলো, সেই তখন থেকেই দোতলার এই শিখাবৌদিই পরমাত্মীয়ের মতো রিনিদের সবরকম সহযোগিতা করে চলেছে স্নিগ্ধ আন্তরিকতায়। রিনি বেশ খানিক হালকা হোলো শিখাবৌদির সাথে কথা বলে। এখন রিনিকে ডাক্তারের পরামর্শ মতোই চলতে হবে…ভুললে চলবে না রিনি হাইরিস্ক প্রেগনেন্সিতে আছে আর একমাত্র নিজেই নিজের খেয়াল সব থেকে ভালো করে রাখতে হবে রিনিকে।

    কৃতি স্কুল থেকে ফিরলে ওকে খাইয়ে দাইয়ে রিনি মেয়েকে বুঝিয়ে বললো… কৃতির ছোট্ট একটা ভাই কিম্বা বোন আছে মাম্মামের পেটের ভেতরে, তাহলে কৃতি তো এখন দিদি হয়ে গেছে, তাই যখন তখন মাম্মামের কোলে উঠে পড়াটা কি আর ভালো দেখাবে? চোখ বড়বড় করে ঘাড় দুলিয়ে কৃতি এক কথায় রাজি কোলে না উঠতে আর ভীষণ ব্যস্ত এতো দেরী করার কী দরকার? সেদিনই তো পেট থেকে ডাক্তারবাবু বের করে দিতে পারতো ভাইকে…
    না না বোনকে ….না না দুজনকে… একটা ভাই আর একটা বোনকে। খুব মজা কৃতির … বিকেলে খেলতে নেমে বন্ধুদের সবাইকে সুখবরটা দেওয়া হোলো আর রোজকার মতো খেলে ফেরার সময় পুজোর প্রসাদ খেতে গিয়ে জেম্মার (শিখাবৌদি) গলা জড়িয়ে বলা হোলো সুখবরটা, পুপুন দিদি ছোটন দিদিকে বলা হোলো এরপর ওদের পাঁচ জনে মিলে খেলতে হবে চোর পুলিশ বা ক্যারম খেলার সময়।

    অফিস থেকে ফিরতেই কৃতি রণেনের গলা ধরে ঝুলে পড়লো… তক্ষুনি কৃতি বাবাকে নিয়ে মরণকাকুর খেলনার দোকানে যেতে চায়, নতুন আর একটা টেডি কিনতে হবে, একটা টেডি তো নতুনই আছে এবারকার জন্মদিনে পাওয়া, আর একটা কিনে নিলেই হবে, তাহলে ভাই বোন দুজনকেই কৃতি গিফ্ট করতে পারবে…..কী মজা !
    অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রণেন মেয়েকে শান্ত করলো আর কৃতির সহজ সরল উচ্ছাসে রিনির মন থেকে একটা ভার নেমে গেলো। কৃতি খুব ভালো করেই মানিয়ে নিতে পারবে….ভাই বা বোনের সাথে।

    কৃতি আজকাল মাকে একটুও জ্বালাতন করে না, নিজের সব কাজ নিজেই করার চেষ্টা করে, এমনকি রিনি ওষুধ খেলো কিনা…দুধ খেলো কিনা…. ডাবের জল আর পাকা পেঁপে-কলা খেলো কিনা এসব খোঁজ খবরও রাখতে শুরু করলো পাকাবুড়ির মতো। রিনি মনের চাপগুলো একপাশে সরিয়ে শারীরিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা করছে।
    রণেন নিজের বাড়ীতে রিনির হাইরিস্ক প্রেগনেন্সির খবর জানিয়েছে, তবে রিনিকে জানায় নি সেসব কথা। ডাক্তারবাবুর মতে পাঁচ মাস পার হয়ে গেলে আর উচিৎ হবে না রিনিকে কোনো জার্ণি করানো অথবা যাতায়াতের ধকল নেওয়ানো। হয়তো সে কারণেই রণেন এক রবিবার সকালে রিনি আর কৃতিকে নিয়ে ওদের ব্যারাকপুরের ফ্ল্যাট থেকে শ্যামবাজারে রণেনের বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে যাবে ঠিক করলো, সঙ্গে আরও একটি উদ্দেশ্য… সামনে পুজোর আগে রিনি হয়তো আর বেরোতে পারবে না। তাই কয়েক ঘণ্টা কৃতিকে ওবাড়ীতে রেখে রিনিকে নিয়ে রণেন শ্যামবাজার আর হাতিবাগান থেকে খানিকটা কেনাকাটা সেরে নেবে। এছাড়া পাশের পাড়াতেই তো রিনির বাপের বাড়ী, একবার ওখান থেকেও ঘুরিয়ে আনবে রিনিকে …সে রিনির বাবা-মা যাই বলুক না কেন। তারপর একটা রাত্তির থেকে আবার ব্যারাকপুরের ফ্ল্যাটে ফিরে আসবে ।

    নিয়তি কিন্তু নিজের নিয়মেই চলে… শনিবার একটু বেশী রাতেই ফোন এলো রিনির ঠাকুমা মৃত্যুশয্যায়, তিনি তাঁর শেষ সময়ে দেখতে চান একমাত্র নাতনি – নাতজামাই তার তাদের বাচ্চাটিকে। বাধ্য হয়েই তাই রিনির বাবা রণেনদের বাড়ীতে জানিয়েছেন, কারণ তাঁদের কাছে তো মেয়ের ঠিকানা নেই… তাঁরা এতদিন মেয়ের ঠিকানাটুকু রাখারও প্রয়োজন বোধ করেন নি। যাইহোক এসব নিয়ে এখন আর অভিমান করে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না বলে রণেন রবিবার খুব ভোরে রিনি আর কৃতিকে নিয়ে ট্যাক্সি করে শ্যামবাজারে সোজা রিনির বাপের বাড়ী। অর্ধ অচৈতন্য ঠাকুমার সাথে দেখা করে রিনি আর বেশীক্ষণ বাপের বাড়ীতে থাকতে চাইলো না, ওরা আস্তে আস্তে হেঁটেই রণেনদের শ্যামবাজারের বাড়ীতে চলে গেলো। রিনি আর কেনাকাটা করতে যেতে চাইলো না, ব্যারাকপুরে ফিরে যেতে চাইলো বিকেল বিকেল। রণেন রিনিকে কোনো বিষয়ে জোর করে না, রিনির বুদ্ধি বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের ওপর রণেন পূর্ণ আস্থা রাখে। তাই বিকেলে ফিরে যাবে তাই ঠিক হোলো।

    বিধি বাম… দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ হতে না হতেই রিনির খুড়তুতো ভাই এসে খবর দিলো ঠাকুমার এখন তখন অবস্থা… পিসিরা এক্ষুনি রিনিকে আসতে বলেছে ঠাকুমার মুখে শেষ সময়ে দুধ-গঙ্গাজলটুকু দেবার জন্য। বলেই যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিলো তেমনই ঝড়ের বেগে রিনির ভাই চলে গেলো । রণেন রিনিকে বোঝালো যাওয়া উচিৎ এবং এসময় কৃতিকে আর নেবার দরকার নেই। কৃতি থাক কিছুক্ষণ….. ওখানে রণেনের ভাইপো ভাইঝিদের সাথে খানিকক্ষণ খেলুক, তারপর রিনির ঠাকুমার মুখে জল দেওয়া হলেই নাহয় ওরা ফিরে আসবে। রিনি কিছু বলতে পারলো না, এই ঠাকুমাই রিনিকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন
    একথা সবাই জানে। অতএব রিনি কৃতিকে রেখে রণেনের সাথে রওনা হোলো বাপের বাড়ীর দিকে।

    ঠাকুমা মারা যাবার পর রিনি আর দেরী করতে চাইলো না, শরীরটা ঠিক ভালো লাগছে না, রিনি ব্যারাকপুরে ফিরে যেতে চাইছে নিজেদের বাসায়।
    সেদিনই একটু রাত করেই রিনিরা ট্যাক্সি করেই ফিরে যাচ্ছে। ট্যাক্সিতে রিনি চুপচাপ অবসন্ন, কানে
    বাজছে রিনির বাপের বাড়ী তুলে শাশুড়ি আর মেজো জায়ের কর্কশ ঐসব বাক্যবাণ। কৃতিও খুব চুপচাপ গম্ভীর….এতো দৌড় ঝাঁপ হোলো তো তাই। রণেন কৃতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো আর রিনি সিটে হেলান দিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে। কমবেশী ঘন্টা খানেকের মতো সময়েই ওরা ব্যারাকপুরে পৌঁছে গেছে। শিখাবৌদির কাছ থেকে চাবি নিয়ে ওরা নিজেদের ঘরে ফিরে এসে মুখ হাত পা ধুয়ে আলু সেদ্ধ ভাত করে নিলো। কৃতিকে খাইয়ে নিজেরা খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লো সারাদিনের ধকলে ক্লান্তিতে।

    সকালে রণেন অফিসে চলে গেলো, কৃতি স্কুলে, রিনি ঘরে একা…… কাজকর্ম টুকিটাকি সেরে খেয়ে দেয়ে খবরের কাগজটা নিয়ে ওল্টাতে পাল্টাতেই কৃতির স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। কৃতির খাবারদাবার গুছিয়ে রেখে রিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ালো, এক্ষুণি কৃতি ফিরবে। শরীরে দ্বিতীয় সন্তানের আগমনের পর প্রথম সন্তানের জন্য টানটা রিনির আরও বেড়ে গেছে, সতর্কতা বেড়েছে…… কৃতির যেন সামান্যতমও অযত্ন না হয়, কৃতির মনে যেন কোনোভাবেই কোনো ক্ষোভের জন্ম না হয়। এব্যাপারে রণেনও খুব সচেতন।

    কৃতি কাল থেকেই খুব চুপচাপ, একটু যেন বিরক্ত ও অন্যমনস্ক। খাওয়া দাওয়ার পরে রিনি কৃতিকে নিয়ে শুলো। রোজকার মতো কৃতি গল্প শুনতে চাইলো না, উল্টে রিনির দিকে পিছন ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম থেকে উঠেও চুপচাপ, নীচ থেকে খেলে উঠেও চুপচাপ হাতমুখ ধুয়ে দুধ খেয়ে পড়তে বসে গেলো। রিনির কথার উত্তর হুঁ হাঁ করে দিচ্ছে। রিনি আন্দাজ করতে পারলো কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটেছে আর সেটা ঘটেছে আগের দিনে শ্যামবাজারের বাড়ীতে রিনি-রণেনের অনুপস্থিতিতে অবশ্যই। রিনির কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো, রণেন ফিরতে এতো দেরী করছে কেন? ঘড়ির কাঁটা যেন ঘুরছে না মনে হোলো রিনির। কৃতিকে কিচ্ছুটি জিজ্ঞেস করার সাহস হারিয়েছে রিনি, একবার ভাবলো শিখাবৌদিকে ডাকে, কিন্তু কি মনে করে সংকোচে পিছিয়ে গেলো।

    রণেন ফিরেছে …… কিন্তু আজ আর কৃতি ছুটে গিয়ে রোজকার মতো বাবার গলা ধরে ঝুলে পড়লো না। রণেনও একটু অবাক হোলো। রিনি রণেনকে রান্নাঘরে ডেকে নিয়ে নিজের আশংকার কথা জানালো। রণেন শোবার ঘরে এসে দেখলো কৃতি স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে একা একা ড্রইং খাতায় আঁকিবুঁকি কাটছে। রণেন কৃতিকে ডেকে চকলেট ধরা হাতটা কৃতির দিকে বাড়িয়ে ধরতেই কৃতি কেমন একটা দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে অসহায় বিকট স্বরে ডুকরে উঠলো, “বাবা তুমি এক্ষুণি মাম্মামের পেটের ভেতর থেকে ভাইটা বোনটাকে ডাক্তারবাবুর কাছে ফেরত দিয়ে এসো,
    চাই না আমার ভাইবোন কিচ্ছু, তোমরা বাজে পচা হয়ে গেছো। ভাইবোন এলে তোমরা আমাকে আর ভালোবাসবে না, আদর করবে না, কিচ্ছু কিনে দেবে না। তাই তো তোমরা কালকে মিথ্যে কথা বলে আমাকে আম্মা বাড়ীতে একা রেখে বোর্ডিং আশ্রম দেখতে গেছিলে আমাকে ওখানে রেখে দিয়ে আসবে বলে। আম্মা (রণেনের মা) আর রাঙামা (রণেনের সেজোবৌদি) বলেছে তো তোমরা আমাকে গঙ্গার ঘাটে কুড়িয়ে পেয়েছো, তাই তো ভাইবোন আনছো, আমাকে আর নিজেদের কাছে রাখতে চাও না। কিন্তু আমি তোমাদের কাছেই থাকতে চাই…….” হাউহাউ করে চিৎকার করে কাঁদছে কৃতি।

    রিনি আর রণেন পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল….. রিনির পায়ে আর জোর পাচ্ছে না, বসে পড়েছে মাথায় হাত দিয়ে। কী করবে এখন রিনি – রণেন? কী করে তাদের প্রথম আত্মজার মন থেকে এই সর্বনাশা বিধ্বংসী বিদ্বেষী দ্বেষের বিষাক্ত আগুন নিভিয়ে নির্মূল করবে? কৃতিকে স্বাভাবিক চিন্তার স্রোতে কেমন করে ফেরাবে ওরা?

  • কবিতা

    সম্মাননা

    সম্মাননা
    -সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী

     

    প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের দ্বীপরাষ্ট্র
    পাপুয়া নিউগিনি,
    সেখানকার প্রত্যন্ত এক উদ্বাস্তু শিবিরে বন্দী
    এক যুবক ইরানি।
    নামে যদিও বা উদ্বাস্তু শিবির বটে,
    তবে অস্ট্রেলিয় সরকারের জেল তা আদতে।
    বছর ছয়েক আগে অস্ট্রেলিয়া অভিমুখী এক নৌকা
    আশ্রয়প্রার্থী ইরানীয় ঠাসা একদল উদ্বাস্তু পাকা,
    অস্ট্রেলিয়া উপকূলে ভেরবার আগেই সাগরেই
    সে তরী,
    আটক নৌকাযাত্রী ক্ষুদ্র জনতা রক্ষীদলের হাতে
    ধরা পড়ি।
    অস্ট্রেলীয় রক্ষীবাহিনীর অফিসারেদের অধীনে
    ইরানীয় শরণার্থীরা রইলো ‘প্রসেসিং’এর জন্যে।
    জায়গা জুটলো তাদের ফুটিফাটা ফুটো কপালে,
    পাপুয়া নিউগিনির ‘মানুসদ্বীপ’ ক্যাম্পে এক জেলে।
    শিবির কারাগারে বন্দীদলের ইরানি যুবক
    বেহরাউজ্ বুচানি,
    লেখক নাকি পেশায় সে এক, তরতরে গতিশীল
    তার অদ্ভুত লেখনী।
    অর্ধনগ্ন বুচানি কর্মরত জেলের বেড়াঘেরা গন্ডীপারে
    ব্যাঙ্গ বক্রোক্তিতে বিদ্ধ বুচানি,
    অফিসার হাসে বিদঘুটে ঘড়ঘড়ে।
    জানে নি কেউ, বোঝে নি কোনো জনে,
    চলেছে যে ঘটে কত শত সব বিপ্লব,
    বুচানির মোবাইল ফোনে।
    হয়ে চলেছিলো লেখা পরপর অধ্যায়,
    সুন্দর সুললিত বর্ণনাতীত ফারসি ভাষায়,
    হোয়াটসঅ্যাপে সে লেখা চলে যেত অবলীলায়,
    অস্ট্রেলীয় অনুবাদকের তত্ত্বাবধানে,
    যে ফারসি ভাষাটা দস্তুরমতো জানে।
    পরপর গাঁথা হোলো সব অধ্যায় যত্নে অতি,
    জন্ম হোলো ‘নো ফ্রেন্ডস বাট দ্য মাউন্টেন্স’…….
    নাম্নী অসাধারন এক কীর্তি।
    কেমন ছিলো বুচানির সেই বই লেখার দিনগুলি?
    দ্বীপান্তরে বন্দীদশায়, হাসির খোরাক রূপে,

    হারিয়ে মাতৃভাষার বুলি।
    আদর্শ সামনে ছিলো তাঁরই দেশের পরিচালক
    জাফর পানাহি,
    আইফোনেতেই বানিয়ে সিনেমা পাওয়া তাঁর হক
    খ্যাতি পরিচিতি।
    লেখার ক্ষমতাই যাঁর লেখনী,
    কিবা আসে যায় তাঁর কলম না হোক …..
    লেখার মাধ্যম যদি হয় ফোনই।
    ক্যাম্পে বুচানি থাকতেন থরহরি কাঁটা হয়ে,
    অস্ট্রেলীয় কারারক্ষীদের হাঁকডাক আর
    ফোন খোয়াবার ভয়ে।
    সদা আতঙ্কিত, রক্ষীরা কেড়ে নেয় তাঁর
    ফোন লেখনীটি যদি,
    গর্ভেই যাবে মরে তবে তাঁর অসম্পূর্ণ…..
    অপরিণত বইশিশুটি।
    যে দেশে শরণার্থী হয়ে পান নি পাটুকু রাখার ঠাঁই,
    সে দেশই দেয় এক ইরানি উদ্বাস্তুকে
    সেরা লেখকের সম্মানটাই।
    সম্মান তাঁর লেখনীর, সম্মান পেলো তাঁর শব্দ,
    ‘ভিক্টোরিয়ান প্রাইজ ফর লিটারেচার’ হোলো জব্দ।
    পেলেন সেই বন্দী ইরানি যুবক লেখক বুচানি,
    অস্ট্রেলিয়া দেশের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মানখানি।
    পুরষ্কার মূল্যের ৭২,৩৯০ ডলার পুরোটাই
    করে দিলেন বুচানি দান,
    নির্দোষ উদ্বাস্তু বন্দীদের জন্য যাঁরা অকারণে শিবিরে অকথ্য কষ্ট পান।
    জানুয়ারী ৩১শে , ২০১৯……
    পুরষ্কার ঘোষিত হওয়ার পর উল্লসিত দর্শকাসন,
    ভিডিও বক্তৃতায় বেহরাউজ্ বুচানি ততক্ষণ,
    জিতেছেন উদ্বেল জনতার উচ্ছসিত মন!
    তাঁর কথায়….শব্দেরা রাখে আজও ক্ষমতা,
    পাল্টে দেওয়ার পৃথিবীর সব অমানবিক ব্যবস্থা,
    সাহিত্য পারে আনতে স্বাধীনতা,
    সাহিত্যই দিতে পারে জয় আস্বাদনের বারতা। সম্মাননায় বেহরাউজ্ বুচানির……
    সম্মানিত দেশকাল ভেদে যাবতীয় কলমকার,
    সম্মানিত অভিধান-শব্দকোষে জমানো শব্দভাণ্ডার,
    শব্দ ব্রহ্ম শব্দ নিত্য ক্ষমতার অপরিমেয় আধার,
    লেখক-লেখনী-শব্দ কুর্নিশ লক্ষ কোটি হাজার।

    তথ্যসূত্র —– আনন্দ বাজার পত্রিকা (সংবাদসংস্থা) এবং গুগল সার্চ

  • কবিতা

    দেখছি নাথবতী অনাথবৎ

    দেখছি নাথবতী অনাথবৎ
    -সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী

     

    অধোবদনে কুরুশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম পিতামহ,
    নির্লজ্জ স্তব্ধতায় আচার্য্যগণ,
    দিগ্বিদিক হিতাহিত জ্ঞানশূন্য উদ্ধত গান্ধারী পুত্রগণ!
    একি লাঞ্ছনা, একি অপমান,
    প্রতিহত করার ব্যক্তিত্ব অনুপস্থিত,
    নিদারুণ করুণ নিগীর্ণ ঘৃণ্য এক দৃশ্যের সাক্ষী মহাভারত,
    সমগ্র মহাভারতের ভারতবাসী নিগড়িত নারীনিগ্রহ বীক্ষণে!
    কুরুরাজদ্বারে নীরব প্রার্থনায় পঞ্চপান্ডবপ্রিয়া
    দ্রুপদনন্দিনী ,
    যিনি নন খর্বা, নন যিনি কৃশা,
    যিনি অতীব সুন্দরী, নন যিনি যোণিসম্ভূতা,
    পিতৃবীজে নন যিনি উৎপন্না মাতৃজঠর যজ্ঞে,
    যিনি হোমাগ্নি উদ্ভূতা, তিনি কৃষ্ণা যাজ্ঞসেনী,
    গরিয়সী আপন গরিমায়,
    তাঁর নারীত্বের অবমাননায়,
    অপমানিত মানবেতিহাসের এক অধ্যায়।
    একবস্ত্রা ঋতুমতী কৃষ্ণসখী রজঃস্নানের পূর্বাহ্নেই
    বিক্ষত অন্তরে উষ্ণ শোণিতধারায়।
    প্রথম পান্ডব ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির পাশাপণে পরাজিত
    বিজিগীষায়।
    কী চূড়ান্ত নির্লজ্জ স্বামীত্বের প্রকাশে,
    দানে হারেন স্ত্রী সম্পদরূপিণী দ্রৌপদীকে
    নিরাবরণ অমিত্র বিতংসে।
    যাঁকে লাভ করেছিলেন মাতৃআজ্ঞা দানে,
    তৃতীয় পান্ডবই একমাত্র ছিলেন
    যাঁর দয়িত হবার দাবিদার স্থানে।
    স্বেচ্ছায় বহুগামিনী পৃথার আদেশে বরি পঞ্চপতি
    পাঞ্চালির শিরোভাগে তকমা ‘বহুগমনে অসতী’।
    ধিক অন্তঃপুরবাসিনী মাতাকুন্তী,
    ধিক কৌন্তেয়গণ শূর বীর অতি।
    বাহুবলী পবননন্দনের কৃচ্ছ্র সীমাবদ্ধতা
    কেবল দন্তসারির নিষ্ফল নিষ্পেষণে ।
    বৃহন্নলা রূপধারণের পূর্বেই
    গান্ডীবধারী পার্থ রূপান্তরিত নির্বীর্য নপুংসকে।
    মাদ্রী আত্মজেরা কি যথেষ্ট পৌরুষলাভে অপারগ
    জন্মকালে অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের অপর্যাপ্ত বীর্যে?
    যত রথী মহারথী প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ সভাস্থলে পারিষদ দল
    নীরব দর্শক মাত্র!
    এক নাথবতীর অনাথবৎ হওয়ার দুঃসহ দৃশ্যায়নে
    লোলুপ অঙ্গরাজ মার্তন্ডেয় কর্ণসহ কুরু ভ্রাতাগণে
    ধর্ষকামে উল্লসিত!
    বিকট অপচিকীর্ষার প্রদর্শনে!
    আরক্ত আনত পাঞ্চালির প্রতি অপচার,
    অনাথা নাথবতীর নিঃশব্দ ক্রন্দন হাহাকার,
    ব্যথিত, লজ্জিত ব্যতিক্রমী বিকর্ণ অসহায় সোচ্চার দর্শনে পিতা ধৃতরাষ্ট্র ও মাতা গান্ধারীর
    ভিতর ও বাহিরের অন্ধত্বের বিকার।
    তথাপি বিরত নহে কেহ নিষ্ঠুর অভীপ্স সাধনে,
    আজও নাথবতীরা অনাথবৎ হয়,
    মহাভারতের মহাদৃশ্যকাব্য অবতারণে।
    তবু একজন ছিলেন হস্তিনাপুরে……সখা কৃষ্ণ,

    কৃষ্ণার লজ্জা নিবারণে।

    যুগে যুগে কালে কালে দিকে দিকে পুনরাবৃত্তি
    ঘটে আজও এ অনিষ্ট পদে পদে,
    নাথবতীরা অনাথবৎ হয়ে আকূল আহ্বানে খোঁজে
    ত্রাতারূপী কৃষ্ণসখারে বিষম বিপদে।।

You cannot copy content of this page