-
বহ্নি পতঙ্গ
বহ্নি পতঙ্গ
-সঙ্কর্ষণএমনি করেই একদিন উড়তে উড়তে
বিশাল পাহাড় সমুদ্রগুলো পেরিয়ে যাবো…
পেছনে খাল, বিল, মরুভূমি ফেলে ইচ্ছেগুলো
সব অজান্তেই আকাশের বুকে মিশে যাবে।মাঠের সবুজ ঘাসে নিজের মখমলে ডানা ঘষে
প্রজাপতি থেকে ফড়িং হয়ে যাবো আমি।
প্রাণভোমরার বোঁ-বোঁ শুনতে পেলে ছুটে যাবো
কবিতার রক্তমাখা লাশ পড়ে আছে যেখানে।
রোদের তাপে ফ্যাকাশে হওয়া ডানা বেয়ে
সরীসৃপের মতো চলে যাবে একদলা আগুন…
ঘেন্নায় নেতিয়ে যাবে প্রাণ, ঠাণ্ডা হবে রক্ত,
পাল্টে যাবে রঙ, উড়তে ভুলে যাবো।
শেষে তুমিই আমায় গিরগিটি বলে ভুল করবে…আমারও প্রজাপতিজন্ম সার্থক হবে।
-
বেকার
বেকার
-সঙ্কর্ষণসকালের পাতে বেড়ে দেওয়া ভাতে
যায় থেকে কিছু ক্ষোভ,
না বলার মাঝে দু’চোখের ভাঁজে
উগরানো কতো লোভ।বিশুর মাইনে একলাখি প্রায়
চিন্টুরও হাজার আশি,
ওদের কপালে লক্ষ্মী বসতি
হেথা দুর্ভাগা রাশি।কষ্টরা শুধু আঁকে অজুহাত
কান্নারা তোলে ঢেউ,
পকেটের মাঝে রেস্ত শূন্য
পাশে নেই কোনো ফেউ।“আমার ছেলে তো ইঞ্জিনিয়ার
তোমারটা করে কী? “,
মায়ের চোখেতে আঁধারে চাহনি
বাবার মুখেতে “ছি”।একই বাসে ওরা ছুটেছে অফিসে
আমি ইন্টারভিউ,
চিনি না-ই চিনি, এটুকু তো জানি
তাকাবেনা ফিরে কেউ।পুজোর ছুটিতে কলকাতা ছেড়ে
ব্যাংকক থাইল্যান্ড,
আমার পুজো তো পায়ে ধরাধরি
“চাকরিটা করে দ্যান।”সকাল মানেই ঘুমচোখে শুধু
নিন্দের বন্দনা,
বিয়ে-থাও হোতো চাকরিটা হলে
চেহারাটা মন্দ না।হতাশার বাণী কতবার জানি
কাঁদিয়ে দিয়েছে রেগে,
এ ঘুমের থেকে চিরঘুমই ভালো
উঠবোনা আর জেগে।ক্লেশগুলো সব পিঠপিছে শুনি
সস্তা আত্মপ্রচার,
পারিনা শোনাতে, সমাজই দেগেছে
এই ছাপ ‘ছোঁড়া বেকার’। -
মানুষ
মানুষ
-সঙ্কর্ষণতো, অঘোরবাবু একটি গাধা পুষিয়াছেন,
দেখাদেখি অশেষবাবুও…
দুই গাধা একই মাঠে চরে… থুড়ি ইস্কুলে পড়ে।
মোটা মোটা বোঝা নিয়ে রোজ রোজ… হেঁ হেঁ।অঘোরবাবু জানেন গাধা পিটিয়ে ঘোড়া হয়,
অশেষবাবুর গাধা আদরে গোবরে থাকে।
“বাঁদর হবে হুঁহ্।রেস… সামনে লম্বা রেস, ভাগো।”
লাল চোখ, ধমকানি, পিটানি… বাবা রে।দিন পাল্টায়, মাস যায়… বছর, যুগ ইত্যাদি।
রেসের মাঠ, জোরসে চাবুক,
ছুটছে অঘোরবাবুর ঘোড়া…”আগে বাঢ়ো, অউর আগে।”
অশেষবাবুর ঘোড়া ট্র্যাকের শেষ দেখতেই পায়নি।বছর দশেক পর…
অঘোরবাবুর ঘোড়া এক দৌড়ে সিধা লণ্ডন,
দাপিয়ে বেড়াচ্ছে… বিশাল ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু…
কিন্তু ঠুলি পরা ঘোড়া পেছনে ফেরেনা… হেঁ হেঁ।
অশেষবাবুর ঘোড়াটা আর দৌড়ে পারেনি
তাই শেষে পিঁজরাপোল… মানে বাড়িই আর কী।সাফল্যের ঘোর এখনো কাটেনি অঘোরবাবুর।
অশেষবাবুরও দুঃখের শেষ নেই।গাধা…
-
আকাশী
আকাশী
-সঙ্কর্ষণবৃষ্টি আর রঞ্জার বাড়ি পাশাপাশি।
একই আকাশের নীচে ছোটোবড়ো দুটো আকাশ,
তাতে সাদা কালো কিছু গল্প বলা মেঘ-রা থাকে।
না বলা গল্পও থেকে যায়… বললেও হয়, না বললেও।ব্যালকনি থেকে জিজ্ঞাসু দুটো চোখ…প্রশ্ন করে,
“আচ্ছা, আকাশটা কী ঐ উঠোনের থেকেও বড়ো?”
রঞ্জার চোখে আকাশ টেনে আনে ছ’তলার ছাদ,
যেন সেট-টপ বক্সে সিগন্যাল… রঙিন ছবি… বিশাল, বিরাট।তবু বৃষ্টি হয়… সমান সমান… ভাগাভাগি
ওর টিপটিপ হলে ওর টুপটুপ… তবু আছে, তবু নেই।
খোলামেলা উঠোনে খেলার সাথী হয় ঝমঝমে জোলো নূপুর
ব্যালকনিটা আগলে রাখে স্লাইডিং… যমের মতো,
“বৃষ্টি, ভেজেনা জ্বর হবে”, বলে চোখ পাকানো মায়ের মতো।রঞ্জাও নিজের আকাশে আলো দেখে।
উজ্জ্বল স্নিগ্ধ একটা আলো… অন্ধকারে সইয়ে নেওয়া
দুটো চোখের সই হয়ে বৃষ্টি ভেজে সবাই মিলে।
আর বৃষ্টির চোখ ধাঁধিয়ে যায় সব পাওয়ার আলোতে,
তাও বৃষ্টি ভেজা হয়না রঞ্জার মতো।বৃষ্টি আর রঞ্জার বাড়ি পাশাপাশি।
ব্যালকনি ভেজেনা আর… উঠোন কখনো শুকোয়না।
-
বর্ণন
বর্ণন
(A homage to artist Benode Behari Mukherjee)
-সঙ্কর্ষণরঙিন কিছু মূহুর্ত… ।
লালমাটির আবিরে নিয়ত হোলি খেলা
সবুজ মাঠের গল্পগুলো,
কবিতা হয়ে যায় কাজলকালো দুই তারায়…
প্যালেটে কাব্যিক ছোপ পড়ে নতুনের,
ভারী প্রিয়, ভারী সুন্দর এই অমরত্ব।টলটলে কালো জলে সাদা কুয়াশার মতো কিছু বক,
বিষণ্নতার বাঁশীতে সাদাকালো, দুপুরগুলোর
বায়নাতে কিনে আনে শান্তিনিকেতনী সুর…
রঙে রঙে ঘুম ভেঙে যায় জলে ভেজানো তুলিটার।
কোথাও যেন জাগিয়ে তোলে অন্ধত্বের বাইরে
অস্পষ্ট একটা নতুন পৃথিবী,
যা শুধু শিল্পীর, শুধু কবির, শুধু আমার, তোমার সবার… ।ছবির আড়ালে লুকানো ছন্দের খোঁজ
পাওয়া হয়নি আজও… ।
কাঁপা কাঁপা হাতে বসা রঙিন প্রজাপতিটা
কখনো চেনেনি মনের রঙ, তাই তো…
তাই তো আজও মিশে যায় নতুন কোনো ছবিতে,
নতুন কোনো কবিতায়…
বৃষ্টিভেজা সৃষ্টিতে অমরত্ব চায় আরেকটিবার,
জানতে পারেনা অন্ধকারের শরিক, দুই চোখ।
তুলি কলমের লড়াইতে জয়ী হন শিল্পী।
তবে হারে কে?কেন? … আমরা।
-
আবর্ত
আবর্ত
-সঙ্কর্ষণদুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে একটা মনখারাপ আসে।
শেষবারের মতো ডুবন্ত সূর্যের ভাসমান বিলাপ
গোধূলি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে,
কে যেন ডেকে ওঠে “আয় আয় আয় আয়…”
ছেয়ে আসে অন্ধকার…প্রথমে আলতো,
তারপর… তার পর গভীর।কালচে ছোপের আতঙ্কে বাসায় ফেরে কিছু রঙিন কাকলি…
কিচমিচে কান্নাতে আগুন জ্বালায় গাছের কোলে।
মনে পড়ে দাওয়াতে বসে থাকা বুড়িটাকে…
দশ বছর ধরে ছেলের পথ চেয়ে যে মরে গেলো,
ঠিক এমন… এমনই একটা সন্ধ্যেতে।একটা মনখারাপ।
সন্ধ্যে, সন্ধ্যে থেকে রাত, রাতের আকাশে চাঁদ
আর একটা প্রতিশ্রুতি।
প্রতিশ্রুতি রাত আরো গভীরতর করার,
প্রতিশ্রুতি চাঁদের বুকে কলঙ্কের।
চাঁদে কোনোদিনও ফিরে পাবোনা প্রিয়তমাকে,
খুঁজে যাবো শুধু… দোষ তো চাঁদের নয়।
তবে কার?সকালে, আবার একটা মনখারাপের শেষ হবে।
দিনের আলোয় মনে পড়বে দিনের শেষে সন্ধ্যে,
সন্ধ্যেগুলো মনখারাপের… আবারো রাত,
রাতে সেই প্রতিশ্রুতি… ইত্যাদি।মৃত্যুও আসলে এক কবিতা।
আর অন্ধকারের কবিতার পাঠক বেশী।
-
জীবন-আনন্দ
জীবন-আনন্দ
(কবি জীবনানন্দ দাশের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য)
-সঙ্কর্ষণসেদিন রাতে একটা মৃত্যু ঘটেছিলো
নিখাদ, নির্ভেজাল একটা মৃত্যু।ঝোড়ো হাওয়ার প্রবল ধাক্কায় দুঃখরা
টুপটাপ ঝরে গিয়ে তৈরী করেছিলো আকাশের সাথে যোগাযোগ।
হাজারো জ্বলা নেভা তারাতে, স্থবির ধ্রুবতারা
নিশ্চল নির্বাক… যেদিকে তাকাও নেই প্রাণ,
নেই রূপ-রস-গন্ধ… তবু আছে
কবিতার আকাশে তারা হয়ে… নীল, ম্রিয়মান এক তারা।নতুন আকাশ নয়…
উঠেছিলো সেই পুরোনো বরিশালের ডাক।
শহরের বুকে মরা পাতার বদলে,মরা ইটে ডাকেনি
কোনো ছাতারে পাখি…রূপসী বাংলার রাতগুলো
ধূসর হয়ে রঙ ধরিয়েছিলো ফেরত আসা পাণ্ডুলিপিতে,
হাজার বছর হেঁটেও তখনো ধরা দেয়নি নাটোর,
অপেক্ষা থাকেনি কোনো স্বপনচারিণীর, বোঝেনি
“এ কোন সকাল,এ যে রাতের চেয়েও অন্ধকার।”কিন্তু সেদিন…,
সেদিন রাতে হাত ধরেছিলো কোনো এক বনলতা
একটুকরো বরিশাল জেগেছিলো পাষাণের বুকে,
বিভোর সে কাকলিতে শোনা যায়নি ট্রামের ঘণ্টী।
না কবি আজ কোনো দুঃখ নয়…
আজ শুরু হয়েছিলো অনন্তের পথে তোমার যাত্রা,
হে অপার্থিব, তোমার জীবন নেই, তোমার মৃত্যু নেই,
তোমার চলা আছে… হাজার বছরের পথ চলা।সেদিন রাতে কেউ অমর হয়নি,
শুধু… একটা মৃত্যু ঘটেছিলো।
নিখাদ, নির্ভেজাল একটা মৃত্যু। -
অনিচ্ছেপূরণ
অনিচ্ছেপূরণ
-সঙ্কর্ষণবর্ষার শেষ কালটা শরৎ
গন্ধটা পূজো পূজো,
নেইগুলো শুধু গুনতে না বসে
আছেগুলো আগে খুঁজো।লালরঙা পচা, নীলটাও বাজে
চাই নয়া জামা জুতো,
কোথাও ফুটেতে সদ্যোজাতরা
কেউ পায়ে হাতে খুঁতো।বিরিয়ানী পড়ে কারোর পাতেতে
কারোর কপালে ফ্যানা,
কেউ সারাদিনে আধপেটা খাবে
কেউ মোগলাই খানা।শোকেতে এখনো মেয়েটির বাবা
বালিশ ভেজায় রাতে,
হারিয়েছে কোনো অভাগা
প্রেমিকা, পথদুর্ঘটনাতে।কেমনটি আছে সীমন্তিনী সে
সীমান্তে স্বামীহারা,
অরির গুলিতে দেবতা যাহার
দূর আকাশের তারা।বন্যাতে যার ভেসে গেছে কুঁড়ে
ওপরওয়ালার রোষে,
মনে রেখো কবি কেঁদেছো তুমিও
তবে, এসি ঘরে বসে।লিখতে তো পারো তাতে থাকো খুশী
শুনে রাখো ওহে কবি,
কবিতায় বাঁচো, কবিতায় থাকো
কবিতাকে করো হবি।এমনি করেই লম্বা তালিকা
মেটেনা চাহিদাগুলো,
আছেগুলো দেখে নেইগুলো নয়
এবারের মতো ভুলো। -
জন্মদিন
জন্মদিন
-সঙ্কর্ষণএকটা কবিতা হঠাৎ জন্ম নিলো আজ।
কাব্যহীন বন্ধ্যাত্বে বহু রাত কেটে গেছে।
যেমন করে ঝরে যায় হলদেটে পাতা, চুপিসাড়ে, নির্ঘুমে
তেমনি অবহেলে রাতগুলোও আর ফিরলো না
একলা রোদ্দুরের ঠিকানাতে।
বারান্দায় খেলতে আসবে ঠোঁটকাটা ছন্দগুলো,
কার অপেক্ষায় জানি না দোলে, পুরোনো ইজি চেয়ারটা।
কান্না আসে, নিশ্চুপ কান্না।
পেনের ডগাতে কালির বদলে অশ্রু দেখা দেয়।
রঙ নেই তার, কোনোই।
হাল ছেড়ে দেওয়ার হা-পিত্যেশে
নষ্ট হয়ে যায় অনেকদিনের জমানো কিছু রাত।
আবার আসবে কখনো, ডানা ভাঙা পাখিটা।
নীল নীল রঙ ছড়িয়ে মিশে যাবে, নীল আকাশের কোণায়।
যেমন আজ এসেছিলো, পেনের ডগায়, কবিতা হয়ে। -
অজানা
অজানা
-সঙ্কর্ষণ ঘোষএ বাবা মডার্ণ জেনারেশন,আবেগ তেমন কোথা?
যেমন ছিলো দস্যি ছেলের প্রেমের গল্পটা।
মেয়েটা ছিলো বড্ড লাজুক, বয়সে ধরো কুড়ি
ধাতটা থোড়া অন্য হলেও প্রেমের ফুলঝুরি।ফ্ল্যাশব্যাকেতে উনিশ শতক,সালটা বোধ হয় তিরিশ
বড্ড ভালো শুরুটা করেও, এক লহমায় ফিনিশ।
ফিরিঙ্গিদের বাড় বেড়েছে, দেশটা পুরো চুলি
প্রাণগুলো আজ সস্তা বড়ো, দাম শুধু এক গুলি।চাঁটগাইয়ার গল্প এটা, জায়গার নাম ধলঘাট
মরবো ভালো দেবোনা ধরা,পালানো বড়ো বিভ্রাট।
ঘরের ভেতর তিনটে মানুষ, ওরা দুজন আর স্যার
বাইরে আসানুল্লাহ চেঁচায়, “ফায়ার”, ট্যাট্ ট্যার্।“পালান, পালান, মাস্টারদা, সঙ্গে নিয়ে ও’কে
এই গোটা দুই লাল পাগড়ী, নিচ্ছি আমি দেখে।”
লাগলো গুলি দড়াম করে বামদিকেতে বুকের
স্বপ্ননীড়ের ভাঙলো আশা, স্বাধীন দেশে সুখের।”হারিয়ে প্রেমিক সামনে চোখের,বাঁধলো সে মেয়ে বুক
এবার ব্রিটিশ কুকুরগুলো ধ্বংস করেই সুখ।
মাস তিনেকে তৈরী সেনা, ইউরোপীয়ান ক্লাব
লক্ষ্য এবার শিকল ভাঙার, স্বাধীন ভারত লাভ।যুদ্ধ শেষে পায়েতে গুলি, পকেটে সায়ানাইড
সময়টা কম, শত্রুর দল, জলদি হোক ডিসাইড।
দেশের লড়াই পূর্ণ হোলো, ফিরবে মেঘের কাছে
সুখের বাড়ি প্রেমিক সনে বাঁধার বাকি আছে।এমনি করেই মৃত্যুসুখে বিলীন হোলো তারা
প্রেমগুলো সব দেশ বাঁচাতে,হয়েছে কোথাও হারা।
খুশীর নীড়ে পাঠাই চিঠি, নই পরাধীন আর
ভুলিনি তোমায় নির্মল সেন, প্রীতিলতা ওয়েদ্দেদার।