• গল্প

    গল্প- লাল টিপ

    লাল টিপ
    -সঞ্চিতা রায় (ঝুমা)

     

    ড্রেসিং টেবলের আয়নায় এখনও অনেগুলো লাল টিপ লাগানো। লাল টিপ পড়তে ভীষণ ভালবাসে সুচিস্মিতা। কিন্তু সমাজের বিধানে রিন্টু চলে যাওয়ার পর থেকে নাকি তার লাল টিপ পড়া বারণ। “আর সব রঙ পড়লেও লালটা পড়ো না, একজন বিধবা মানুষকে লাল পড়লে ভাল দেখায় না”। পাশের বাড়ির মাসিমা সহ অনেকেই বললেন একথা।
    লাল রঙটা সুচিস্মিতার খুব প্রিয়। তার চুড়িদার, শাড়ী বেশীরভাগই লাল রঙের, অথবা অন্য কোনো রঙের সাথে লাল রঙ আছে অনেকটা জুড়ে।
    সুচিস্মিতার মেয়ে শুচিতা লাল রঙ নিয়ে মাকে বলা নানারকম কথা প্রায় রোজই শোনে। সে এখন নবম শ্রেণীতে। লাল রঙটা যে তার বাবার ও খুব প্রিয় ছিল সে জানে। আর তার মা যখন লাল টিপ পড়ে বাবার সামনে যেতেন, বাবা কাব্য করতেন মাকে নিয়ে আর বলতেন “বয়স হলেও কিন্তু তুমি লাল টিপ লাল শাড়ী ছেড়ো না জেনো বয়স একটা সংখ্যা মাত্র, মনের বয়স বাড়তে দিও না। ”বাবার সপ্রশংস দৃষ্টি বেশ লাগতো শুচিতার। বাবাকে একদিন বলতে শুনেছিল, ’জানো আমার মা সবসময় সিঁদুর শাখা পলায় নিজেকে সাজিয়ে রাখতেন, সুন্দর শাড়ী পড়তেন, বাবা চলে যাওয়ার পরে মায়ের ওই শাখা সিঁদুর বিহীন রূপ আমি সহ্য করতে পারতাম না। তাই তোমাকে আমি বলেছি আমার জন্য শাখা সিঁদুর পড়ার কোনো দরকার নেই। তুমি মেয়েবেলা যেমন সাজে কাটিয়েছ, সেই সাজেই কাটাও। যখন যে রঙ, যে সাজ তোমার ভাল লাগবে তাই করো। হ্যাঁ আমি যদি তোমার আগে যাই তাও নিজেকে বদলিও না। ” একজন বয়স্ক মানুষ এসে কালচে টাইপের একটা টিপের পাতা মায়ের হাতে ধরিয়ে বললো “এই ধরণের টিপই এখন থেকে পড়বে বুঝলে। ”কারোর কারোর মতে আবার এখন থেকে হালকা রঙের শাড়ী পড়াই ভালো। কোনোদিনই খুব সাজগোজ করতো না সুচিস্মিতা। কিন্তু রিন্টুর আব্দার ছিল, লাল টিপ পড়া অবস্থাতেই যেন সে অফিস থেকে ফিরে সুচিস্মিতাকে যেন দেখে।
    রিন্টুর ছবির দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে সুচিস্মিতা। কপালে তার ছোট্ট একটা কাল টিপ,আর পড়নে হালকা রঙের নাইটি। তার বারবার মনে হতে লাগলো, ছবি থেকে বেরিয়ে এসে রিন্টু যেন বলছে, “তোমার কপালে জ্বলজ্বলে লাল টিপটা কই” টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে সুচিস্মিতার গাল বেয়ে।
    ছোট বেলায় বাবা লাল জামা কিনে আনলে আনন্দে লাফিয়ে উঠতো সুচি। তার বাবা মা তাকে সুচি বলে ডাকতেন। সুচির নির্মল আনন্দ দেখে বাবা মা খুব মজা পেতেন। সুচিস্মিতা ভাবে লাল রঙটা তো ও বিয়ে করার পর থেকে ব্যবহার করা শুরু করেনি,তবে কেন এই অদ্ভূত নিয়ম । সমাজ এতটা বদলে গেছে,তবুও অদ্ভূত অদ্ভূত নিয়ম জোড় করে চাপানো। সামনের দেওয়ালে টাঙানো তার ভীষণ প্রিয় রবিঠাকুরের দিকে চেয়ে থাকে সে। রবিঠাকুর লিখেছিলেন, ‘বিপুল তরঙ্গ রে’। কেউ চলে গেলে শোক তো থাকবেই,কিন্তু এটাও ঠিক পৃথিবীর কোনো কিছুই থেমে থাকে না। কে কিভাবে তার ব্যক্তিগত জীবন কাটাবে,কি খাবে কি পড়বে সেটা তার নিজের উপর ছেড়ে দেওয়া যায় না? যদিও রিন্টু তার জীবনে নেই ভাবলেই তার বুকের মধ্যে এক অসহ্য কষ্ট হয়। কিন্তু তবু সে বিশ্বাস করে জীবন থেমে থাকে না। তাকে তার মেয়ের জন্য এরপরেও হাসিমুখে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
    রিন্টুর অফিসে যোগদান করেছে সে। বেরাবার জন্য তৈরী হচ্ছে। ছোট কাল টিপটা যেই কপালে লাগাতে যাবে, মেয়ে তার হাত থেকে টিপটা ফেলে দিল। বাবার কিনে দেওয়া লাল টিপের পাতা থেকে টিপ নিয়ে মায়ের কপালে পড়িয়ে দিল। “এ কি করছিস,লোকে কি বলবে”। “মা লোকে এসে কি বাবার শূণ্যতাকে পূরণ করে দিতে পারবে? না কি নিজেদের কাজ ছেড়ে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করবে? মাগো তোমায় ছোটোবেলা থেকে লাল টিপ পড়তে দেখেছি, লাল টিপ ছাড়া তোমায় দেখলে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মানুষ যদি প্রতিবাদ না করতো, তবে আজ সতীদাহ প্রথা থেকে যেত, বিধবা বিবাহ দেওয়া যেত না, বাল্যবিবাহ রদ হ’ত না। এমনকি মেয়েরা হয়তো পড়াশোনাও করতে পারতো না। তারপরের ধাপ জোড় করে সাদা শাড়ী পড়িয়ে নিরামিষ খাওয়ানো থেকে বেড়িয়ে আসতে পারতো না। হ্যাঁ নিজের মত বাঁচো, সমাজের কথাকে নয়, নিজের মনের, নিজের যুক্তির কথা শোনো। আজ তোমার আগে কিছু হলে বাবাকে কি কোনো রঙ বা কোনো কিছু ছাড়তে হ‘ত?তবে কেন মেয়েরা?” সুচিস্মিতা তাকিয়ে দেখলো চিরদিন পড়ে আসা লাল টিপটা পড়ে তাকে সত্যিই অনেক প্রাণবন্ত লাগছে। আর বেঁচে থাকতে গেলে প্রান্তবন্ত ভাবেই বেঁচে থেকে জীবনে এগিয়ে যেতে হবে।
    মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললো, “সোনা আমার সত্যিই তুই বড় হয়ে গেছিস মনের দিক থেকে”। “হ্যাঁ মা আমি শুধু নই আমাদের প্রজন্মের অনেক অনেক মানুষ এই নিয়ম, ভুলভাল নিয়মের বিপক্ষে আছি এবং থাকবো জেনো। তুমি শুধু তোমার মত থাকো মাগো। মা মেয়ে দু’জনে দু’জনকে ভালোবাসার আলিঙ্গনাবদ্ধ করলো।

  • গল্প

    গল্প- আত্মার ধর্ম

    আত্মার ধর্ম
    – সঞ্চিতা রায় (ঝুমা)

     

    বিয়ের পর কেটে গেছে,পাঁচটা বছর। সুস্মিতা মা ডাক শোনার জন্য বড় আকুল। শাশুড়ি,শ্বশুর সর্বক্ষণ বলে চলেছেন “আমাদের ছোট্ট সোনার মুখ দেখাও”। ডাক্তারি পরীক্ষায় সুস্মিতার কিছু ত্রুটি ধরা পড়লো। সুস্মিতা সারাটা দিন মনমরা হয়ে থাকে। পুতুল নিয়ে খেলা করে। একদিন এক জায়গায় বেড়াতে গিয়ে সে ও তার বর তন্ময় একটি অনাথ আশ্রম ঘুরতে যায়। কত মিষ্টি মিষ্টি শিশু খেলে বেড়াচ্ছে। সুস্মিতার মনে হয়, যদি তারা একটি শিশুকে দত্তক নেয়, শিশুটি মা বাবা পাবে আর ও পাবে চির আকাঙ্খিত মাতৃত্বের স্বাদ। আশ্রম কর্তৃপক্ষর সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা। কর্তৃপক্ষ বলে ব্যাপারটা একটু সময়সাপেক্ষ। কিছু অফিসিয়াল কাজকর্ম আছে এবং কোন শিশু তারা পাবে সেটা আশ্রম কর্তৃপক্ষই ঠিক করবে।
    বাড়িতে জানালে, তন্ময়ের মা ঘোর আপত্তি জানায়,বলেন জাত কূল জানি না এমন শিশু কিছুতেই এ বাড়িতে আসতে পারে না। সুস্মিতার শ্বশুর কিন্তু রাজী হয়ে জান। বলেন একটি শিশুর কলতান এই বাড়িকে ভরিয়ে তুলবে, এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? যাও শিশুটিকে নিয়ে এসো,মুনিয়া (তন্ময়ের মা)কে বোঝানোর দায়িত্ব আমার।
    আশ্রম তাদের একটা ছোট পুত্র সন্তান দত্তকে অনুমোদন দেয়, আইনি কাজকর্ম সম্পন্ন করে শুভদিনে শিশুটিকে নিয়ে আসে সুস্মিতা ও তন্ময়। দু’জনের নামের সাথে মিলিয়ে শিশুটির নাম দেওয়া হয় সুতনু। অন্নপ্রাশন দেওয়া হয়। মিষ্টি ফুটফুটে বাচ্চাটা প্রতিবেশীদেরও খুব আদরের হয়ে যায়। কিন্তু মুনিয়া মানে সুস্মিতার শাশুড়ি কোনো ভাবেই একে মেনে নিতে পারেন নি।
    একটু একটু করে বড় হতে থাকে সুতনু। হামাগুড়ি দেয়। হামা দিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। টুকটুক করে মুনিয়ার ঠাকুর ঘরে ঢোকে। ঠাকুরের জিনিসপত্রতে হাত দেয়। “আমার সব ঠাকুরের জিনিসপত্র অশুচি করলো রে!” চিৎকার করে ওঠেন উনি। “বৌমা একে সরাও তাড়াতাড়ি।” সুস্মিতা রান্না করতে করতে ছুটে আসে। টলমল পায়ে হাঁটা শুরু হয় পুঁচকেটার। সারাবাড়ির জিনিস ঘাঁটাঘাঁটি করে। যা পায় কুড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করে। পাড়ার দিদি দাদারা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাকে। গোলগাল মিষ্টি মিষ্টি সুতনু সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখে। এবার ভালভাবে ঠাকুরঘরে ঢুকতে শুরু করে,
    নকুলদানা আর বাতাসার লোভে। ঠাকুর সিংঘাসনে গোপালকে দেওয়া প্রসাদ খেয়ে নেয় বলে“পীপী খেয়েছে”। পিঁপড়েকে পীপী বলে ও। মুনিয়া চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলে। “হয় এই ছেলে এই বাড়ি থাকবে, নয় আমি! দিয়ে আয় যেখান থেকে এনেছিস।” সুস্মিতা বুকে নিয়ে ছেলে আগলায়। এ যে তার চোখের মণি। এর মা ডাকই তো তাকে ভরিয়ে রাখে।
    “দেখো কী কাণ্ড করেছে, সিংহাসন থেকে গোপালকে নামিয়ে কোলে বসিয়ে বাতাসা খাওয়াচ্ছে আর নিজেও খাচ্ছে, আমার ঠাকুরকে এঁটো খাওয়াচ্ছে.. গেল, গেল, আমার সব গেল, নাম হতচ্ছাড়া” গঙ্গাজল ছিটাচ্ছে চারিদিকে মুনিয়া। “ঠাকুর দোষ নিওনা দোষ নিওনা” বার পঁচিশেক বললো মুনিয়া। রেগে ঠাকুর ঘর তালা দেওয়ার কথা ভাবলো।
    যেদিন সুতনুকে অনাথ আশ্রম থেকে আনা হয়েছিল, সেই দিনটিই তার জন্মদিন হিসাবে পালিত হয়। দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেল। জন্মদিনে বাড়ি হৈচৈ মুখর। মাসি, পিসি, জেঠি, কাকি, কাকু, মামা সবাই হইহই করছে। আসন পেতে বসিয়ে সবাই আশীর্বাদ করছে। কত খেলনা। খুব মজা সুতনুর। “থাম্মি ছবাই তো আছির্বাদ করছে, তুমি কলো”। “না না তোকে কীসের আশীর্বাদ রে!জাতকূল জানিনা,ছোঁবোই না তোকে।”
    শিশুটা শুধু বারবার ঠাকুর ঘরে গিয়ে দুষ্টুমি করে। আর রাগত মুনিয়া গালাগালি করে। আজ কয়েকদিন হ’ল সুতনুর জ্বর। তাপ যথেষ্ট বেশী। চুপ করে বিছানায় পরে আছে। কিছু খেতে চাইছে না। রান্না করতে করতে বারবার সুস্মিতা ছেলেকে দেখতে আসছে। কিন্তু এটা কি দেখছে সুস্মিতা? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার শাশুড়ি মুনিয়া সুতনুকে কোলে নিয়ে বসে মাথায় হাত বুলোচ্ছেন। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। আস্তে আস্তে কি সব যেন বলছেন শিশুটিকে। সুস্মিতা তার শ্বশুরকে ডেকে আনে। শ্বশুর কাছে গিয়ে দেখেন মুনিয়া বলছেন,“সোনা আমার তাড়াতাড়ি সুস্থ হও গোপালের প্রসাদ খেতে হবে তো?”
    যে কটা দিন ছোট্ট সুতনু অসুস্থ ছিল, ঠাকুর ঘরে ঢোকেনি, মুনিয়ার বড় ফাঁকা ফাঁকা লেগেছে। সে নিজেও বোঝেনি, মনের দিক থেকে কি ভীষণ ভাবে সে শিশুটার সঙ্গে জড়িয়ে পরেছে। গোপালের প্রসাদ থালাতেই পড়ে থাকছে, মুনিয়ার মনে হচ্ছিল, তার দেওয়া প্রসাদ বোধহয় সুতনুই গোপাল হয়ে খেয়ে যেত। সারাটা ঘর ঘুরে বেরাতো পুঁচকেটা। ঘর বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। স্নেহ অতি ভীষণ বস্তু। স্নেহের বাঁধনে কখন বাঁধা পরে গেছে মুনিয়া। মানবমনের গতি বড় বিচিত্র। কখন তার গতি কিভাবে বদলে যায়, মানুষ বোধ হয় নিজেও বুঝতে পারেনা। তন্ময় ডাকলো “মা তোমার পুজোর সময় যে পেরিয়ে যাচ্ছে, দাও ওকে আমার কোলে, তোমার গোপাল কিন্তু অভুক্ত আছে।”
    “ও আজ আমার কোলেই থাকবে, বৌমা গোপালকে আজ তুমি খেতে দাও আমাকে আমার জীবন্ত গোপালকে নিয়ে থাকতে দাও, হে আমার ঈশ্বর তোমাকে প্রসাদ পেতে গেলে আগে আমার এই গোপালকে সুস্থ করতে হবে, ও প্রসাদ খেলেই আমার পুজো সার্থক।”
    তন্ময় ও সুস্মিতা দু’জনেরই প্রাণের দেবতা মনের লেখক রবিঠাকুর। তাঁর লেখা অনধিকার প্রবেশ গল্পটা মনে পড়লো। যুগ যুগ ধরে মানুষের অন্তরে জাগ্রত মানবধর্মের চেয়ে বড় বোধ হয় আর কিছু নেই। সত্যিই সত্যি বড়ই সত্যি একথা।

  • গল্প

    গল্প- কৃষ্ণকলি

    কৃষ্ণকলি

    – সঞ্চিতা রায়

     

    কৃষ্ণকলি সেলাই স্কুলের আজ বাৎসরিক অনুষ্ঠান। সারা শহরে আজ কৃষ্ণকলির অনেক শাখা। এই স্কুলের কর্ণাধার কৃত্তিকা এখন শহরের যথেষ্ট পরিচিত নাম। শহরের অনেক ছেলেমেয়ে তার সাহায্যে আজ স্বাবলম্বী। বার্ষিক অনুষ্ঠানে সেলাই যেমন আছে, তেমনি নাচ গান কবিতা নানা অনুষ্ঠানের ও ব্যবস্থা আছে। সব মিলিয়ে এ এক বড় মিলন উৎসব। সমস্ত শাখার ছাত্ররছাত্রীরা মিলেই অনুষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যায় এরা। হাতের কাজের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা আছে। চার দিন ধরে অনুষ্ঠান চলে। অনুষ্ঠান মানে আনন্দের বন্যা । সারা বছর ছাত্রছাত্রীরা এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে, ঠিক যেমন করে মানুষ দুর্গাপুজোর জন্য অপেক্ষা করে। কৃত্তিকা একটা চেয়ারে বসে বসে ছাত্রছাত্রীদের তৎপরতা দেখছে, অনাবিল এক আনন্দে তার মন ভরে যাচ্ছে। কৃষ্ণকলি সেলাই স্কুলের সাথে আরেকটি স্কুল যুক্ত আছে। শুভাঙ্কন স্কুল, শুভর অঙ্কন স্কুল। এই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অনেক ক্ষেত্রেই কৃষ্ণকলি স্কুলের সেলাই-এর কাজে ড্রইং এঁকে সাহায্য করে। শুভ আর কৃত্তিকার মধ্যে রয়েছে অপূর্ব এক বন্ধুত্ব। দু’জনে দু’জনকে নিঃস্বার্থ ভাবে সব কাজে সাহায্য করে। ছাত্রছাত্রীর কাজ দেখছে মুগ্ধ হয়ে কৃত্তিকা। বাড়িতে পরপর দুই ছেলের পর যখন কৃত্তিকা জন্মায়, বাড়ির লোক ভীষণ ভীষণ খুশি ছিল। খুশি ছিল দুই ভাই তাদের বোনকে পেয়ে। বড়দাদা দশ, ছোড়দাদা আট। অনেকটাই বড় তার চেয়ে। দাদাদের আদরের খুব। কিন্তু আত্মীয় স্বজনরা পাড়াপ্রতিবেশীরা এবার নতুন এক আলোচনা শুরু করলো। কৃত্তিকা তার দাদাদের মত ফর্সা নয়। “শোনো একটু বড় হলেই দুধের সর মাখানো শুরু কোরো কিন্তু, তাতে যদি রঙটা একটু খোলে”। “বিয়ে দিতে হবে মনে থাকে যেন”। কৃত্তিকার বাবা প্রতিবাদ করতো, “মেয়ে আমার নিজের পায়ে দাঁড়াবে, ওর রঙ নিয়ে আমি ভাবতে চাই না”। বড় হতে থাকে কৃত্তিকা । কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলেই রঙ নিয়ে প্রশ্ন তোলে লোকজন। মনে মনে গুটিয়ে থাকে কৃত্তিকা।

    পড়াশোনায় যথেষ্ট ভাল সে। মাধ্যমিকে স্টার পায়। কিন্তু আত্মীয় পড়শীরা বিরক্ত করতে থাকে। “এখন থেকেই সম্বন্ধ দেখতে থাকো, পরে কিন্তু বিপদে পরবে”। বাবা মা যথেষ্ট প্রগতিশীল হয়েও সমাজ দ্বারা প্রভাবিত হতে থাকে। পাত্র পক্ষরা আসে, মিষ্টি খায় রঙ নিয়ে কটাক্ষ করে চলে যায়। উচ্চ মাধ্যমিকের পর ফাইন আর্টস-এ অনার্স নেয় সে। পাত্র পক্ষ আসে, অনেক মোটা অঙ্কের টাকা দাবী করে। মেয়ের প্রতি কটাক্ষ সহ্য হচ্ছিল না বাবা মায়ের। তারা অনেক টাকার বিনিময়ে মেয়েকে পাত্রস্থ করতে রাজি হয়ে যান। সব শুনে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে কৃত্তিকা। “এ বিয়ে আমি করবো না বাবা”। বড়বৌদি তাকে সমর্থন করলেও ছোটবৌদি বলেন, “তবে কি সারাজীবন এই বাড়িতেই থাকবে?এরপর আর কেউ যদি তোমায় বিয়ে করতে না চায়”! “শোনো বৌদি এই বাড়িতে দাদাদের বা তোমাদের যতটা অধিকার আছে, আমার ঠিক ততটাই আছে, বাড়িটা আমার বাবার। বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে, যে টাকা বাবা আমার বিয়েতে দিতে চেয়েছিলেন, তার থেকে কিছুটা নিয়ে আমি ব্যবসা শুরু করবো। পরে প্রতিষ্ঠিত হলে ওই টাকা বাবার হয়েই গরীব মানুষকে দান করবো, আমার জীবনের সিদ্ধান্ত এখন থেকে আমিই নেবো।” স্নাতক হওয়ার পর সেলাইয়ে লেডি ব্রাবোর্ণ-এ ডিপ্লোমা করলো সে। বাড়ির একটা ঘর নিয়ে মাত্র দু’জন ছাত্রীকে নিয়ে তার পথ চলা শুরু। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দুঃস্থদের জন্যেও প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে কৃষ্ণকলি সংস্থা। সাথে রয়েছে শুভাঙ্কনের শুভ ও তার ছাত্রছাত্রীরা। মাঝে মাঝে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শুভ ও কৃত্তিকা একসঙ্গে বেড়াতে যায়।
    মাঝে মধ্যে শুভ ও কৃত্তিকা একই ট্রাভেলিং এজেন্সির সাথে নিজেরাও ঘুরতে যায়। শান্তিনিকেতন ওদের প্রিয় জায়গা। কোপাই এর তীর, বাউল গান, ছাতিম তলা বড় মনকে ভাল করে দেয় তাদের। হোটেলে তাদের ঘর আলাদা থাকে। তবে তারা ঘুরে বেড়ায় একসাথে। সমাজে এই নিয়েও নানা কথা ওঠে। ছোটবৌদি ডেকে বলে “তোমার জন্য আমাদের সম্মান নষ্ট হচ্ছে,সেরকম হলে বিয়ে করে নাও না তোমরা”। “আমরা খুব ভাল বন্ধু। বন্ধুত্বের কোনো লিঙ্গভেদ হয় না। আপাতত আমরা বন্ধু হিসাবেই পরস্পরের পাশে থাকবো, তবে পরে বিয়ে করবো, না লিভ টুগেদারে থাকবো, না এই রকম বন্ধু হিসেবেই কাটাবো সেটা আমরাই ঠিক করবো, সমাজ নয়। জীবনটা আমাদের তাই সিদ্ধান্তটা আমরাই নেবো। ভাইঝিরা দু’জন এসে পিসিকে পূর্ণ সমর্থন জানায়। “হ্যাঁ পিসি জীবন তোমার সিদ্ধান্ত ও একান্ত তোমার হোক আমরা পাশে আছি ও থাকবো।
    হ্যাঁ এখনও সুন্দর বন্ধুত্বের বাঁধনে থেকে তারা কাজ করে চলেছে। কৃত্তিকা বাবা মায়ের যত্ন স্কুল চালানো সবেতেই সফল আজ। সমাজকে উপযুক্ত জবাব সে তার কাজ দিয়েই দিয়ে দিয়েছে।

  • গল্প

    গল্প- অধিকার বোধ

    অধিকার বোধ
    – সঞ্চিতা রায় (ঝুমা)

     

    আজ রবিবার প্রমিতার আজ অখণ্ড অবসর। অন্যদিন তার অফিসের তাড়া থাকে। মেয়েকে স্কুলের জন্য রেডি করার তাড়া থাকে। আজ বিছানায় অনেকক্ষণ গা এলিয়ে সে শুয়েছিল। সুশোভন আজ বাড়িতে নেই। অফিস ট্যুরে বাইরে। আজ সন্ধ্যায় ফিরবে। আলসেমি কাটিয়ে প্রমিতা আস্তে আস্তে নিজের এবং মেয়ের জন্য চা করলো। মা মেয়েতে গল্প করতে করতে চা খাওয়া শেষ হলো। তাদের মেয়ে সৃষ্টি নাচ অনুশীলন করতে দোতালার ঘরে গেল। প্রমিতা ঘর সাজাতে ব্যস্ত। সুশোভনের প্রিয় গোলাপী রঙের চাদর বিছানায় পাতছে। মিলিয়ে মিলিয়ে মাথা বালিশ আর কোলবালিশের ওয়ার। ফুলদানিতে সুশোর প্রিয় রজনীগন্ধা। প্রমিতা মাঝে মধ্যে সুশোভনকে আদর করে সুশো বলে ডাকে। মিষ্টি গন্ধে ভরপুর ঘর। সাতদিন পর, আজ সুশো ফিরবে। প্রমিতা মনে মনে সুশো ফেরার পর ওদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত গুলো কল্পনা করে নিচ্ছে। ওর মন খুশি খুশি। ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’ প্রমিতার মোবাইলের রিংটোন। মোবাইলটা বাজছে। ভাবলো সুশো হবে। কিন্তু এতো অচেনা নম্বর।
    “হ্যালো”,
    “আমি প্রশান্ত বলছি,চিনতে পারছো আমার গলা’।
    “এতদিন পর তুমি হঠাৎ ?”
    “তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে,আমি জানি তুমি তোমার প্রথম প্রেমকে ভুলে যেতে পারো না, আমি একবার ডাকলেই তুমি আসবে”।
    “বেশ তো কোথায় যেতে হবে বলো”। “নন্দনের কাছাকাছি, যেখানে আমরা রবীন্দ্র চর্চা করতাম,উদাত্ত গলায় গান করতাম, সেখানে কাল সন্ধ্যা ছয়টায় এসো। ”
    “ও কে”। একই কলেজে পড়তো প্রমিতা ও প্রশান্ত। কলেজে একসঙ্গে গান গাইতে গাইতে, নাটক করতে করতে কখন যেন মন বিনিময় হয়ে যায়। ভালবেসে ফেলে দু’জনে দু’জনকে। ওদের প্রেম দেখে মনে হ’ত যেন একে অপরের পরিপূরক । আর নামের প্রথম অক্ষর দু’জনেরই প্র। দু’জনেই দু’জনের প্রথম প্রেম। বন্ধুরা জানতো এরা একে অপরকে একদিন ও না দেখে থাকতে পারে না। বাড়িতে জানাজানি হয়ে যায়। দুই বাড়ির কারুরই আপত্তি ছিল না। দু’জনেই ঠিক করে যে ওরা দুজনেই চাকরি পেলে তবেই বিয়ে হবে। প্রশান্ত আই.টি. সেক্টারে বড় চাকরি পায়। প্রমিতা এস.এস.সি. দিয়ে স্কুলে চাকরি পায়। দু’জনের দেখা করার সময় কমে আসে। সপ্তাহে একবার কি দু’বার দেখা হয়। প্রমিতা লক্ষ্য করতে থাকে, প্রশান্ত যেন দেখা করার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ আর দেখাচ্ছে না। কেমন যেন এড়িয়ে যাচ্ছে প্রমিতাকে। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে প্রমিতা জানতে পারে, প্রশান্তর অফিসে জুন নামক একটা মেয়ের সাথে প্রশান্তর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মনে জোর আঘাত লাগে প্রমিতার। এরপর প্রশান্ত একদিন প্রমিতাকে জানায়,তার লাইফপার্টনার হিসাবে জুন-ই উপযুক্ত । জুন স্মার্ট সুন্দরী দুর্দান্ত ইংরাজী বলে। প্রশান্ত কদিন পর আমেরিকা যাচ্ছে। জুনকে বিয়ে করে। জোর ধাক্কা খায় প্রমিতা। সবসময় বড় বিষণ্ণ দেখায় তাকে। গান করা আবৃত্তি করা সব ছেড়ে দেয় সে। স্কুলের পর লাইব্রেরিতে গিয়ে বইয়ের সাথেই সে কাটিয়ে দিত অনেকটা সময়। এই লাইব্রেরিতেই তার আলাপ হয় সুশোভনের সাথে। খুব সুন্দর একটা বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দু’জনের মধ্যে। সুশোভন প্রমিতার চোখে বিষণ্ণতা দেখতে পায়। ক্রমে প্রমিতার প্রতি একটা দুর্বলতা তৈরী হয় সুশোভনের। সে প্রমিতাকে জানায় তার দুর্বলতার কথা। প্রমিতা তাকে বলে যে এখনও তার মন জুড়ে প্রশান্তই আছে। ওদিকে প্রমিতার বাবা মা’ও চাইছিলেন, প্রমিতার জীবনে কেউ আসুক,যে ওর মনকে ভাল করে দিতে পারবে। ওনারা সুশোভনের কথা জানতে পারেন। প্রমিতাকে বোঝান। প্রমিতা সুশোভনকে বলে “কিন্তু আমাদের দুজনের মাঝে যে প্রশান্ত সবসময় থেকে যাবে, আমি হয়তো কোনোদিনই তোমায় ভালবাসতে পারবো না, আর ভাল না বাসলে কাছেও আসতে পারবো না”। সুশোভন কিন্তু প্রমিতাকে ভালবেসে ফেলেছিল। সে বলে, “বেশ তো আমরা বন্ধুর মত পাশাপাশি থাকবো, কিন্তু বিয়ে না করে তো একসঙ্গে থাকা যাবে না, তাই সামাজিক বিয়ে আমাদের করতে হবে। ”বাবা মা একটু স্বস্তি পাবেন এই ভেবে প্রমিতাও রাজী হয়ে যায়।

    শুরু হয় প্রমিতা ও সুশোভনের নতুন জীবন। না স্বামীর দাবী নিয়ে সুশোভন কখনও আসে না প্রমিতার কাছে। প্রমিতার সব প্রয়োজনে সুশোভন তার পাশে থাকে। বিনিময়ে সে কিছুই কখনই দাবী করে না প্রমিতার কাছে। সে প্রমিতাকে বলেছিল, দু’টো মন কাছাকাছি না এলে, কখনই দু’টো শরীর কাছাকাছি আসতে পারে না। তাই কখনই কোনোরকম দাবী সে করেনি। বলেছিল, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মানে শুধুমাত্র শারীরিক সম্পর্কই নয়, এক অনন্ত বন্ধুত্বও বটে। দিন কাটতে থাকে, প্রমিতার ক্রমে মনে হতে থাকে ওর দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ সুশোভন। শ্রদ্ধা তো ছিলই, কিন্তু শ্রদ্ধাটা কেমন যেন অন্য এক অনুভূতিতে বদলিয়ে যাচ্ছে। সে নিজেও বুঝতে পারে না, এই অনুভূতিটাকেই কি ভালবাসা বলে? কিন্তু
    একদিন সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে এসে বই পড়ছিল সুশোভন। প্রমিতাও স্কুল থেকে এসে একটু ফ্রেশ হচ্ছিল, স্নানঘর থেকে গা ধুয়ে বেড়িয়ে এল, একটা হালকা রঙের নাইটি গায়ে দিয়েে। ভীষণ গরম তাই গায়ে শুধু নাইটি। আজ ওপর থেকে ওড়নাটাও নেওয়া নেই। বই থেকে মুখ তুলতেই সুশোভনের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় প্রমিতার। বিনা সাজেও ভীষণ সুন্দর লাগছিল প্রমিতাকে। নাইটি ছাপিয়ে বেড়িয়ে আসছিল ভরা যৌবনের চিহ্ন। সংযত করে নিল সুশোভন নিজেকে। উঠে স্টাডি রুমে চলে গেল। বই পড়তে পড়তে একটু চোখটা লেগে গিয়েছিল। হঠাৎ ঠোঁটে আলতো ছোঁয়া অনুভব করলো। চমকে দেখে প্রমিতার অধর তার ওষ্ঠকে ছুঁয়ে আছে। সচকিত হয়ে সরে যেতে চাইলো সে, এবার বাহুবন্ধনে নিল প্রমিতা সুশোভনকে।
    “তুমিই বলেছিলে দু’টো মন কাছাকাছি না আসলে দু’টো শরীর কাছাকাছি আসতে পারেনা, কবে কেমন করে আমার মনটা তোমার হয়ে গেছে আমি বুঝতেই পারিনি”। তোমার সংযত ভালবাসা, তোমার আত্মত্যাগ কখন যে আমার মনকে জয় করে ফেলেছে। দু’টো মন আজ কাছাকাছি আজ অবশ্যই এসে গেছে,তাই… ” আর কিছু বলতে পারে না প্রমিতা আবেগে গলা বুজে আসে। দু’চোখ বেয়ে বয়ে চলে অশ্রুধারা। কাছে টেনে নেয় সুশোভন প্রমিতাকে। তাদের ভালবাসার সাক্ষী স্বরূপ পৃথিবীতে আসে সৃষ্টি । ভালবাসা প্রগাঢ় থেকে প্রগাঢ়তর হতে থাকে। সোমবার সন্ধ্যা ছটা ওইতো প্রমিতা আসছে। দূর থেকে দেখতে পায় প্রশান্ত। তাহলে ঠিক যা ভেবেছিলাম, আমার প্রমিতা আমারই আছে। কিন্তু সঙ্গে কে?
    “প্রশান্ত আলাপ করিয়ে দিই- সুশোভন, আমার জীবনসাথী আমার মনের মানুষ আমার প্রাণ।” যেন বিদ্যুতের শক খেল প্রশান্ত। প্রশান্ত বড় অদ্ভূতভাবে দেখছে প্রমিতাকে। সে যে ভেবেছিল..
    “শোনো প্রশান্ত তুমি আমার কাছে ফিকে হয়ে যাওয়া স্মৃতি মাত্র, আমার জীবনে আমার মনে তোমার কোনো স্থান নেই, আমার একমাত্র ভালবাসা এখন সুশোভন”। চলো সুশো এখানে আর দাঁড়াবার দরকার নেই- চলি”।
    সুশোভন সব কথা শোনার পরেও কিন্তু একাই পাঠাতে চেয়েছিল প্রমিতাকে, বলেছিল, “তোমার যদি ওর সংস্পর্শ ভাল লাগে যাও দেখা করে কথা বলে এসো”। প্রমিতা রাজী হয়নি। সে তার সুশোকে সঙ্গে নিয়েই গেছে।
    বাড়ি ফিরে প্রমিতা সুশোভনকে বললো “তোমার কাছে একটা জিনিষ চাইবো দেবে?”
    “তোমাকে অদেয় তো আমার কিছু নেই,বলো কি চাও”।
    “অধিকার বোধ‌, আমার প্রতি তোমার অধিকার বোধ থাকুক, এইটুকুই চাই,আমি চাইনা তুমি আমায় যখন তখন যার তার সাথে দেখা করতে দাও, একটু অধিকার বোধ, একটু পসেসিভনেস চাই আমার প্রতি তোমার। ”এই কথা সে তো মনে মনে কবে থেকেই আছে, কিন্তু তোমার স্বাধীনতায় আমি কখনও হস্তক্ষেপ করতে চাইনি, জানো তো একটা কথা আছে ভালবাসাকে মুক্ত আকাশে উড়তে দাও, সে যদি তোমার কাছে ফিরে আসে, তবেই জানবে তোমার ভালবাসার জয় হয়েছে, আর আমার ভালবাসা তো আমার কাছেই ধরা দিয়েছে। ভালবাসার নিবিড় বন্ধনে চিরতরে বাঁধা রইলো দু’টো মন।

  • গল্প

    গল্প -প্রতীক্ষার ইচ্ছা

    প্রতীক্ষার ইচ্ছা
    -সঞ্চিতা (ঝুমা ) রায়

     

    চার বছরের জন্মদিনে মেয়ে ইচ্ছার মুখে পায়েস তুলে দিচ্ছিলেন মা। “মা ওমা” মেয়ে ইচ্ছার মুখে এই প্রথম কথা ফুটলো। “মা” এই ডাকটা শোনার জন্য যে দীর্ঘ প্রতীক্ষা ছিল প্রতীক্ষার। আনন্দে চোখ জল ভরে উঠলো তার। ইচ্ছা প্রতীক্ষার একমাত্র সন্তান। চারবছর আগে ইচ্ছা যখন পৃথিবীতে আসে তখন খুব খুশী ছিল পরিবারের সকলে। রবি ঠাকুরের কবিতার একটি পঙতি ‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে’ খুব প্রিয় ছিল প্রতীক্ষার। তাই মেয়ের নাম সে রেখেছিল ইচ্ছা। তাঁর যেন মনে হ’ত তার এই ছোট্ট সোনা একদিন তার সব ইচ্ছা পূর্ণ করবে।
    শিশুটি ধীরে ধীরে যখন বড় হচ্ছে প্রতীক্ষা ও তার পরিবার বুঝতে পারে ইচ্ছা আর পাঁচটা শিশুর মত নয়, একটু অন্যরকম। শিশু বিশেষজ্ঞর সাথে কথা বলে জানা যায়, বুদ্ধি বা মেধার দিক থেকে ও তিন বছর পিছিয়ে আছে। ওর কথা বলা, ওর পড়াশোনা ওর স্বাভাবিক ব্যবহার সব কিছুই অন্য শিশুদের থেকে পিছিয়ে থাকবে। শুনে মনটা খারাপ হয়েছিল ইচ্ছার বাবা মায়ের। ডাক্তার আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, “সুদীর্ঘ জীবনে কয়েকটা বছর পিছিয়ে আছে বলে ও জীবনে কিছু করতে পারবে না, এমন কিন্তু নয়। একটা বয়সের পর কিন্তু এই বুদ্ধিবৃত্তির তফাৎটা আর থাকবে না। তখন ও সব অসুবিধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু মা বাবার পূর্ণ সহায়তা এই জন্য প্রয়োজন।

    শুরু হয় প্রতীক্ষার পরীক্ষা। ইচ্ছার বাবাকে চাকরি সংক্রান্ত ব্যাপারে অনেকক্ষণ বাইরে থাকতে হ’ত। তাই মূল দায়িত্ব এসে পড়ে প্রতীক্ষার হাতে। সবটুকু ভালবাসা দিয়ে সে বড় করতে থাকে ইচ্ছাকে। ধৈর্যশীলা হয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে পাশে থাকে ইচ্ছার। আজ ইচ্ছার চার বছরের জন্মদিনে প্রথম বড় জয় প্রতীক্ষার। “মা” ডাক শুনে ইচ্ছাকে জড়িয়ে আনন্দে কেঁদে ওঠে প্রতীক্ষা। ধীরে ধীরে টুকটুক করে আরো কিছু কথা শিখল সে। “এবার ওকে স্কুলে দেব।” “না না তার দরকার নেই বাড়িতেই পড়ুক।” ইচ্ছার ঠাকুরদাদা বলেন।

    “কিন্তু কেন?”

    “বুঝতে পার না আমাদের একটা সামাজিক সম্মান আছে, এই রকম মেয়ে আমাদের বংশে সবাই জেনে যাবে যে।” কঠিন গলায় বলেন ইচ্ছার ঠাকুমা।

    “কিন্তু আমি তো ওকে স্কুলে পাঠাবোই।”

    “তোমরা বরং ওকে কোনো হোস্টেল, হোম বা আশ্রমে দিয়ে দাও, এমনিতেই বাড়িতে অনেক সম্মানীয় লোকজন আসেন, তাদের সামনে আমি নাতনীকে আনতে পারি না, আমাদের সামাজিক সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়।”

    “ পারবো না,শরীরের কোনো অঙ্গ বাদ দেওয়া যেমন মানুষের পক্ষে কষ্টকর তেমনই ওকে ছেড়ে আমরা বাঁচতে পারবো না।” একই সুরে কথা বলে প্রতীক্ষা ও তার জীবন সাথী,ইচ্ছার বাবা মা।

    “তবে তোমরা এবাড়ি ছেড়ে চলে যাও, আমাদের সমাজে একটা পরিচয় আছে, একজন অপরিণত শিশু, একজন অর্ধেক মানুষের জন্য আমরা সামাজিক সম্মান হারাতে চাই না।” অন্য বাড়ি খুঁজে নিতে হ’ল তাদের। বেসরকারী সংস্থার কর্মী নিশীথ (ইচ্ছার বাবা) ছোট্ট একটা বাড়ি তারা ভাড়া নিল। কিন্তু এই বাড়িতে খুব সুন্দর একটা বাগান ছিল। মা মেয়ের কাছে সেই বাগানটা ছিল ভগবানের আশীর্বাদের মত। একটা গুণ অবশ্য এর মধ্যে ইচ্ছার মধ্যে প্রকাশ পায়, সে একটু একটু করে বাঁশী বাজাতে শিখে যায় তার মা প্রতীক্ষার কাছ থেকে। বিকাল বেলা বাগানে বসে সে বাঁশী বাজাতো। গাছগুলো যখন হাওয়ায় দুলতো ইচ্ছার মনে হ’ত গাছেরা তার গান শুনে যেন আনন্দ প্রকাশ করছে। পাখিরা নীড়ে ফেরার আগে বাগানে কিচির মিচির করতো। ভোরবেলা বাগানে গিয়ে ইচ্ছা পাখিদের দানা খেতে দিত। রোজ রোজ পাখিরা আসতো। আসতো চারটে কুকুরছানা, দুটো বিড়াল ছানা। সবাই ইচ্ছার কাছের বন্ধু ছিল। ভোরের সূর্যর লাল আলো দেখে সে খুব আনন্দ পেত। ভালবাসতো বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ শুনতে। প্রকৃতি তার খুব কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যেত না প্রতীক্ষা কারণ সেখানে নানা ভাবে হেনস্থা করা হ’ত ইচ্ছাকে। স্কুলেও নানা রকম ভাবে জালাতন করা হ’ত ইচ্ছাকে। এরই মধ্যে কিছু শিক্ষিকা খুব ভাল ছিলেন, যারা যথেষ্ট স্নেহ দিয়ে শিশুটিকে বিকশিত হতে সাহায্য করতেন। “মা ওরা আমায় পেনসিল দিয়ে খোঁচা মারে, টিফিন খাওয়ার সময় ধাক্কা মারে,কেন মা?” চোখ ভরে জল আসে প্রতীক্ষার মানুষ কেন এত নিষ্ঠুর হয়। একই ক্লাশে একবার রেখে দেওয়া হ’ল ইচ্ছাকে। পরে আরেক বার একই কাজ করা হ’ল। আস্তে আস্তে ইচ্ছা কলেজে পৌঁছালো। উচ্চ মাধ্যমিকের সময় থেকেই ইচ্ছার মধ্যে পরিণত ভাব আসতে শুরু করেছিল। ডাক্তার ঠিকই বলেছিলেন, একটা সময়ে এই অসুবিধা অতিক্রান্ত হবে। উচ্চমাধ্যমিকে ভাল রেজাল্টই করলো। মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করছে সে। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকর্ড নম্বর পেল। অন্যদিকে দিকে দিকে তার বাঁশি বাজানোর সুনাম ছড়িয়ে পড়লো। একদিন সে মায়ের একটা ডায়েরী খুঁজে পেল, মাকে জিজ্ঞাসা করলো “মা তোমার ব্যক্তিগত ডায়েরী আমি কি পড়তে পারি?” মা তাকে অনুমতি দিলেন। ডায়েরী থেকে সে তার মায়ের সমাজের বিরূদ্ধে পরিবারের বিরূদ্ধে সংগ্রাম করে তাকে বড় করে তোলার কথা সে আরো বেশী করে জানতে পারলো, অনেকটা তো সে জানতোই। “তোমার ঠাকুরদাদা আর ঠাকুমা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন,প্রণাম করো।” ইচ্ছার মনে হচ্ছিল বলে যে যাদের আমি শ্রদ্ধা করি না,তাঁদের পা ছোঁবো না। কিন্তু মায়ের কথা সে অমান্য করে না, তাই প্রণাম করলো।

    “দিদিভাই আমার এত বড় বাড়ি বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, ফিরে চলো সব্বাই, তোমাকে আমি বিদেশে পড়তে পাঠাবো, তোমার বাঁশি চর্চার ও যথাযথ ব্যবস্থা করবো, আর তোমার সাফল্যে সবাইকে নিয়ে পার্টি দেব, ফিরে চলো।”

    কিন্তু আমি এবাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না, বাবা এখন বাড়িটা কিনে নিয়েছেন। এবাড়ির ফুল পাখি পশু গাছপালা এরাই আমার প্রকৃত বন্ধু। আর এরা মানুষের চেয়ে অনেক আপন।” আরো বললো “আমি এই বাড়ির একটা ঘরে পিছিয়ে থাকা শিশুদের নিয়ে শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুলেছি। বিদেশ তো কোন দূর এই বাড়ি, এই শহর, এই বাগান কাউকে ছেড়ে আমি যাব না এরাই আমার আপন জন।”

    “তোকে সম্বর্ধনা দিতে চায় আমাদের ক্লাব, কত সম্মান পাবি,আর_____”

    “না দাদু একদিন সামাজিক অসম্মানের ভয়ে যাকে গ্রহণ করোনি, আজ তার সম্মান নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। ওই দেখ আমার ছোট্ট বন্ধুরা এসে গেছে।”

    “ও পিয়ান ফু নাও”,ও পী বাছি বাও” ও মিছ্ কো উথবো”। কচি কচি গলায় ঘর ভরে উঠলো। এরা সবাই দেরী করে কথা শিখেছে, এখনো কথা স্পষ্ট হয়নি। এম.এ. পড়তে পড়তেই এদের নিয়ে আলাদা জগৎ গড়ে উঠৈছে ইচ্ছার। প্রতীক্ষার প্রতীক্ষা আজ সব দিক থেকে সার্থক।

  • গল্প

    গল্প- উপহার

    উপহার
    -সঞ্চিতা রায়

     

    অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন সুবীর সেন। কি করবেন কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। স্ত্রী রীমা রাগত স্বরে বলছেন “এত অন্যমনস্ক হলে হয়? দেখ তো কী সর্বনাশ করলে। এই জন্যেই আমি সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম”। মেয়ের বিয়ের গয়না ভরা ব্যাগ কোথায় ফেলে এলেন তিনি। নিজেই নিজের চুল ছিঁড়ছেন সুবীরবাবু। রীমা বলছেন,এখন আমার লকারে যা আছে তাই দিয়ে মেয়েকে সাজিয়ে দেব উপায় তো কিছু নেই। পুলিশে জানাও ,কিন্তু কিছু লাভ হবে কি? বাড়ির গাড়ীটাও আর বিগরানোর সময় পেলো না। বাড়ির গাড়িতে করে গেলে কি আর এত বড় ক্ষতি হ’ত? মেয়ে সিম্পি বাবা মাকে সান্তনা দিয়ে বলে “আমি তো গয়না পড়তেই ভালবাসি না। এত টেনশান কোরো না তো। কিন্তু বাবা মায়ের মন তো তাঁরা মেয়েকে সোনার গয়নায় সাজিয়ে রাজকন্যা রূপে দেখতে চান বিয়ের দিন। সুবীর সেনের মোবাইলটা বেজে উঠলো অজানা নম্বর। কে এই সময় ফোন করলো? একদম কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। ফোনের ওপার থেকে ‘আমি সিদ্ধার্থ,আপনি আমার টোটোতে আজ একটা ব্যাগ ভুলে ফেলে গেছেন। ব্যাগে আধার কার্ডের একটা জেরক্স ছিল,সেখান থেকেই নাম আর ফোন নম্বর পেলাম। আমি এই মুহূর্তে কিছু ব্যস্ততার জন্য আপনার বাড়ি গিয়ে ব্যাগটা দিয়ে আসতে পারছিনা, অনুগ্রহ করে আপনি কাউকে পাঠিয়ে প্রমাণ দিয়ে ব্যাগ নিয়ে যান”। “হ্যাঁ হ্যাঁ আজ বিকালেই যাব,আর আমিই যাব। ” “রীমা গয়না পাওয়া গেছে”। “আমিও যাব তোমার সাথে ”দৃঢ় কন্ঠে বলেন রীমা। “সঙ্গে সিকিউরিটি যাবে বলে দিলাম ,অজানা জায়গায় একা একা যাওয়া ঠিক নয়,গয়নাগুলো ক্যাশমেমোর সাথে মিলিয়ে নিও কিন্তু”। “রীমা যে মানুষ ফোন করে এতগুলো গয়না ফিরিয়ে দিতে পারে তাকে অকারণ সন্দেহ কোরো না প্লীজ”। “তবুও” রীমা এইটুকু বলেই চুপ করে গেলো। বাড়ির গাড়িতে করে সিকিউরিটিকে নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করেন। বাড়িটা গ্রামের দিকে,অনেকটা পথই যেতে হচ্ছে। দু’ধারের সবুজ সুবীরকে মুগ্ধ করছে। সত্যি গ্রামের দিকে এখন ও কত সবুজ। “দেখো রীমা প্রকৃতিকে দেখো”। “দূর আমার মাথায় এক চিন্তা কতক্ষণে গয়না ফেরত পাবো”। গাড়ি এসে পৌঁছালো নির্দিষ্ট ঠিকানায়। একেবারে ছোট্ট একটা বাড়ি। কিন্তু বাড়ির সামনে ছোট্ট বাগানে কত ফুল। চোখ জুড়িয়ে যায়। কিছু ফল ও সব্জি ও আছে। সিদ্ধার্থ একটা কাজে  বেড়িয়েছিলেন, স্ত্রী কে সব বলা ছিল। আপ্যায়ন করে তাঁদের বসতে দিয়ে ,তিনি নিজে হাতে তৈরী সরবত নিয়ে এলেন। সঙ্গে ঘরে তৈরী করা মিষ্টি। “এসবের কি দরকার ছিল?”। “আমাদের কাছে অতিথি নারায়ণ”। সত্যিই কী অপূর্ব স্বাদ এই ঘরে তৈরী সরবতের। সুবীররা তো কেনা সরবত খেতে খেতে ঘরোয়া সরবতের স্বাদ ভুলেই গিয়েছিলেন। মিষ্টি আর সরবত দু’টোতেই আন্তরিকতার ছোঁয়া এক অন্যরকম স্বাদ এনে দিয়েছিল। “ হ্যাঁ, এই নিন আপনাদের ব্যাগ। একটু মিলিয়ে নিন।” সিম্পির বয়সী একটি মেয়ে এসে তাঁদের প্রণাম করে বললো “জেঠু জেঠিমা একটু বসে যান। বাবা এক্ষুনি ঢুকবেন।” “তুমি কি করো মা?” বাংলায় এম এ করেছি, এখন আপাতত একটা বেসরকারী স্কুলে চাকরি করছি”। সিদ্ধার্থর প্রবেশ। “কমাস পরে আমার এই মেয়ের বিয়ে। ও নিজেই পছন্দ করেছে। ভাল ছেলে। কোনো দাবী নেই”। আমি তো মেয়েকে কোনো দিনই তেমন কিছু দিতে পারিনি। ও গৃহশিক্ষকতা করে নিজের পড়াশুনো চালিয়েছে। ও বই পড়তে খুব ভালবাসে। বই কিনে দিতে পারি কই? ও লেখেও ভাল। “কিছু যদি মনে না করো আমি এখান থেকে কিছু গয়না তোমার মেয়ে সুধাকে দিতে চাই”। সুবীর বলেন। “না বাবু তা নিতে পারবো না, যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিতে চাই শুধু”। “তাহলে কিছু টাকা”। “না না”—-“বেশ তবে তোমার মেয়ের বিয়েতে আমায় বলবে তো?” “সে তো ছমাস দেরী আছে। কার্ড ছাপাই নি । “তুমি মুখে বললেই আমি আসবো,আর মা তোমার লেখার খাতাটা আমায় কদিনের জন্য পড়তে দেবে এখানে বসে বসে পড়ছিলাম খুব ভাল লাগছিল”। “হ্যা অবশ্যই”। আজ সুধার বিয়ে। সিদ্ধার্থ খুব ব্যস্ত। ব্যস্ত বাড়ির সবাই। আত্মীয় স্বজনে ভর্তি বাড়ি। সুবীর বাবু এসেছেন। সঙ্গে স্ত্রী ও নববিবাহিতা মেয়ে। সঙ্গে সুন্দর মোড়ক মোড়া অনেকগুলো উপহার। সুধাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। “এই নাও মা তোমার জন্য রবীন্দ্র রচনাবলী।, আরো কিছু বই, আর এইটা তোমার জন্য আমার বিশেষ উপহার। খুলে দেখো তো মা”। খুলে সুধা দেখে তার খাতার লেখাগুলোকে বই হিসাবে প্রকাশ করে নিয়ে এসেছেন তিনি। সেদিন ছিল পূর্ণিমা। সুবীর সেনের মনে হ’ল তিনি যেন চাঁদের সমস্ত উজ্জ্বলতা সুধার মুখে দেখলেন। আনন্দে ঝলমল তার মুখ। জীবনে অনেক দামী দামী উপহার উনি অনেককে দিয়েছেন। কিন্তু দেওয়ার মধ্যেও যে এত আনন্দ আছে সেটা বোধহয় তিনি আজ সবচেয়ে বেশী অনুভব করলেন। সুধা যেন আজ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটা পেল। সিদ্ধার্থ বললেন “আজ আপনি সত্যিই আমার মেয়েকে পৃথিবীর সেরা উপহার দিলেন। আর আমাকে দিলেন আমার মেয়ের খুশী উপহার যা আমাকে সারাজীবন ভরিয়ে রাখবে। সুধা প্রণাম করে বললো “আমায় আশির্বাদ করুন”। “হ্যাঁ, মা আশীর্বাদ করি আরো অনেক অনেক পড়, অনেক অনেক লেখো আর খুব আনন্দে কাটাও জীবন।” না এটা কোনো ঋণ শোধ নয়, নয় গয়না ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো প্রতিদান। এ শুধু পিতৃসম একজন মানুষের ভালবাসার স্পর্ষে এক কন্যার প্রতিভার বিকাশের দ্বার খুলে যাওয়া। সুন্দর সম্পর্কের মেল বন্ধনে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

  • কবিতা

    কবিতা- বিশ্বাসে মেলে ভালবাসা

    বিশ্বাসে মেলে ভালবাসা
    (একটি ইংরাজী অনুচ্ছেদ দ্বারা প্রভাবিত)
    -সঞ্চিতা রায়

     

    প্রাকৃতিক নিয়মে নর-নারী
    কাছাকাছি আসলে অনেক
    ক্ষেত্রেই জন্ম নেয় ভালবাসা।
    কখন ও বা তা দুটি হৃদয়েই
    বয়ে চলে, কখন ও বা হয় তা একতরফা
    এমন ই ঘটনা ঘটেছিল
    শ্রীজিৎ ও শ্রীতমার জীবনে।
    শ্রীতমার হৃদয় জুড়ে শুধুই শ্রীজিৎ।
    কিন্তু শ্রীজিৎ এর হৃদয়ে শ্রীতমার নাই স্থান|
    শ্রীতমার মনে ওঠে ঝড়|
    জানতে চায় সে বিধাতার কাছে,
    শ্রীজিৎ কী তাকে ভালবাসে?
    বিধাতা করলেন কাণ্ড এক।
    পাঠালেন ধরাধামে একটি চেয়ার।
    বলে পাঠালেন, মিথ্যা বললে
    জ্বলবে লাল আলো,
    আর সত্যিতে সবুজ|
    শ্রীজিতের মুখে ‘ভালবাসি’
    শোনার প্রতীক্ষায় শ্রীতমা|
    সান্তনা দিতে শ্রীজিৎ বলে
    হ্যাঁ ভালবাসি।
    জ্বলে ওঠে লালবাতি।
    এ যে বড় মিথ্যা কথা|
    “না না এ হতে পারে না”।
    চিৎকার করে বলে ওঠে শ্রীতমা|
    “আমার বিশ্বাস মিথ্যা হতে পারে না,
    মিথ্যা তোমার চেয়ার বিধাতা
    হয়েছে কোথাও গণ্ডগোল।”
    অবাক হয় শ্রীতমার গভীর বিশ্বাসে শ্রীজিৎ।
    মনের মধ্যে হয় তোলপার|
    এত বিশ্বাস?
    শ্রীতমার অনুরোধে আবার চেয়ারে
    বসে বলতে হয় “হ্যাঁ ভালবাসি”।
    কিন্তু জ্বললো যে সবুজ বাতি।
    কী ঘটে গেল এতটুকু সময়ে?
    বিশ্বাসের জোড় জাগালো যে ভালবাসা
    হয়তো গহন মনের অন্তরালে
    লুকিয়ে ছিল ভালবাসা
    বিশ্বাসের জাদুকাঠির স্পর্ষে
    উঠলো তা জেগে।
    ভালবাসায় বিশ্বাস ই
    যে পারে ভালবাসাকে জিতে নিতে।
    ভালবাসাই পারে ভালবাসাকে জিতে নিতে।

  • গল্প

    গল্প – শাশুড়িষষ্ঠী

    শাশুড়িষষ্ঠী
    -সঞ্চিতা রায় (ঝুমা)

     

    সুসজ্জিত আসনে বসে আছেন রিমঝিম সেন। জামাই তাকে পাখায় বাতাস করছেন। যদিও বৈদুতিক পাখা আছে,তবুও লাল জড়ির লেস লাগানো হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে নীলাভর খুব ভালো লাগছে। রিমঝিমের চোখে আবেগাশ্রু। যা যা তিনি ভালোবাসেন সবকিছু আজ রান্না করা হয়েছে। সুসজ্জিত থালার চারদিকে অনেক বাটিতে অনেক উপাচার সাজানো। রিমঝিম সেনের মেয়ে সিঞ্জিনি আজ খুব ব্যস্ত। সিঞ্জিনির বয়স যখন মাত্র দুই বছর ,তখন তাঁর বাবার ব্যবসায় হঠাৎ করে অবনতি হতে শুরু করে , একসময় ব্যবসায় তাদের যথেষ্ট রমরমা ছিল। খুবই স্বচ্ছল ছিল তাদের অবস্থা। হঠাৎ করে ব্যবসা র অবস্থা খারাপ হয়ে ,আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন টা মানসিক ভাবে মেনে নিতে পারেন নি সিঞ্জিনির বাবা। মানসিক এবং শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেন তিনি। সিঞ্জিনির যখন সাড়ে তিন বছর বয়স তখন তাঁর মৃত্যু হয়। শুরু হয় রিমঝিমের জীবনসংগ্রাম। সেলাই করা,এবং গৃহশিক্ষতা করা শুরু করেন তিনি। তাঁর নিজের জন্য কোনো সময় ই ছিল না। একমাত্র লক্ষ ছিল মেয়েকে ভালভাবে মানুষ করে নিজের পায়ে দাঁড় করানো। নিজের সমস্ত গয়না বিক্রি করে দিয়ে,ব্যবসাটাকে ধীরে ধীরে আবার দাঁড় করান। ভোর চারটের সময় উঠে তিনি রান্না করতেন, তারপর বৃদ্ধা শাশুরীর পরিচর্চা করতেন,সংসারের খুঁটিনাটি কাজ সেরে সকাল সাতটায় গৃহশিক্ষতা করা শুরু করতেন, মাঝে ছোট্ট মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আসা,নিয়ে আসা। তারপর সেলাইয়ের কাজ। কখনও কখনও তাকে ব্যবসার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তুলতে বড়বাজার যেতে হ‘ত। কোনো কোনো দিন ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়াও করতে পারতেন না। অথচ মেয়ে বা শাশুড়ি যা খেতে ভালবাসে তার খাওয়ানর চেষ্টা করতেন। সিঞ্জিনির জন্মদিনের আগে আরো বেশী করে সেলাই এর কাজ নিতেন,যাতে জন্মদিনের দিন মেয়ের প্রিয় সব খাবার দিতে পারেন। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো, পড়ার খরচ আরো বাড়লো। মাধ্যমিকের পর মেয়ে যখন বিজ্ঞান শাখায় পড়তে চাইলো,অনেকেই বললো,“ অত খরচ তুমি সামলাতে পারবে না”। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছা তিনি পূরণ করলেন। ব্যবসার অবস্থাও আবার ধীরে ধীরে ভাল হয়ে উঠলো,সিঞ্জিনি ও স্কুলে চাকরি পেল। কিন্তু জীবনের যে সময়টা তিনি একটু আরাম আনন্দ করতে পারতেন, তার অনেকটাই তিনি সংসারকে দিয়ে দিলেন। সিঞ্জিনির জীবনে যখন নীলাভ এল,তাকে সিঞ্জিনি সব কিছু জানালো। প্রথম জামাইষষ্ঠী টা শাশুড়ির নিমন্ত্রণে নীলাভ গিয়েছিলেন,খুবই আদর যত্ন পেয়েছিলেন।
    দ্বিতীয় বার নীলাভ সিঞ্জিনিকে বলেন,সারা জীবন তো উনি দিয়েই গেলেন, এবার আমরা ষষ্ঠীর দিন ওনাকে ওনার প্রিয় সব খাবার নিজে পরিবেশন করে খাওয়াবো। রিমঝিম বেশ আপত্তি করেছিলেন, নীলাভ বলেন,“আমাকে যদি সত্যিই ছেলে ভাবো,আমার এই আব্দারটা রাখতেই হবে”। সকাল বেলায় শাশুড়ির মঙ্গল কামনায় পুজো করা হয়েছে। স্নান সেরে নতুন কাপড় পরে খুব সুন্দর লাগছে আজ রিমঝিমকে। মেয়ে তাঁর হাতে বেঁধে দিয়েছে তেল হলুদ মাখানো মাঙ্গলিক সুতো। আর তাঁকে প্রণাম করলো মেয়ে জামাই । সবুজ দূর্বা র আঁটি আর ধান দিয়ে তাঁদের আশীর্বাদ করলেন রিমঝিম। তিনজনেই কপালে দইয়ের টিপ পড়লেন। অনেক রকম ফলের গন্ধে ম ম করছে বাড়ি। হ্যাঁ খাবারের প্রথম গ্রাস টা মুখে তুলে দিলেন নীলাভ । তারপর মেয়ে।
    ও হ্যাঁ আনন্দের কথা হ‘ল নীলাভর বোন ও ভগ্নীপতি একই ভাবে আজ ওদের বাড়িতে নীলাভ র মা নীনার শাশুড়ি ষষ্ঠী করছেন। আনন্দের এই অনুষ্ঠান যেন প্রতীকী হয়ে রইলো,মায়েরা মেয়েরা সারাজীবন অনেক অনেক ত্যাগ করেন কিন্তু তাদের হয়তো পরিবেশন করে কেউ খাওয়ায় না। তাঁদের প্রিয় খাবার অনেক ক্ষেত্রেই তাদের খাওয়ার সময় থাকে না। আর নীলাভ সেদিন তাঁর শাশুড়ি মা যা যা ভালবাসে তা উপহার হিসাবে নিয়ে এসেছিলেন। পুরো বাড়ি আনন্দে আর মঙ্গল ধ্বনি তে মুখর হয়ে উঠেছিল।
    রিমঝিম ভাবছেন তাঁর সন্তান সত্যিই সুসন্তান হয়েছে এবং সঠিক জীবনসঙ্গী খুঁজে নিয়েছে

  • কবিতা

    কবিতা- প্রকৃতি

    প্রকৃতি
    -সঞ্চিতা রায়

     

    সকালের শিউলীর সুরভীতে
    তোমার ছোঁয়া পেলাম।
    ভোরের রক্তিম সূর্য
    যখন ধীরে ধীরে সোনালী
    হয়ে উঠছিল, মনের পলে পলে
    তোমাকে অনুভব করছিলাম।
    এখন ও কী ভোরে উঠে সূর্যপ্রণাম করো।
    নাকি এখন কোলবালিশ জড়িয়ে
    অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে থাকো?
    ভোরের বেলা ঘাসের শিশির কণা
    এখন ও রোজ তোমার কথা
    জানতে চায়।
    ভোরের স্নিগ্ধ বাতাস সকালবেলা
    যখন আমায় এসে বলে সুপ্রভাত
    তোমার সুপ্রভাত শুভেচ্ছা পেতে
    ইচ্ছা করে ঠিকই, কিন্তু কী জান,
    প্রকৃতি এত স্নিগ্ধতা ও ভালবাসা
    দিয়ে আমায় ভরিয়ে তোলে যে
    কোন কিছুর অভাব বোধ হয় না
    প্রকৃতির ভালবাসা স্নাত হয়ে
    আমি ভীষণ ভাল আছি, ভাল থাকবো।
    তুমিও ভাল থেকো।

  • চিঠি

    চিঠি- ‘না লেখা চিঠি’

    না লেখা চিঠি
    -সঞ্চিতা রায়

     

    স্নিগ্ধ , এত বছর ধরে মনের যে অনুভূতিগুলো ছিল,একান্তই আমার অধীন, সে কেন যে আজ শব্দে শব্দে ধরা দিতে চাইছ, কেন যে বাঁধনহারা হতে চাইছে জানি না রে! আমার না বলা কথাগুলো আজ বহুবছর পর চিঠির পাতায় শব্দের মালা হয়ে ধরা দিতে চাইছে,তাই তো তোকে লিখছি। জানিস সেই ছোট্ট থেকে তোর উপর কেন জানিনা আমার অদ্ভূত এক অধিকার বোধ ছিল। মনে হ‘ত তুই সবার আগে আমার বন্ধু পরে অন্যদের। এখন ভাবলে বড্ড হাসি পায়। একসঙ্গে খেলা করতে করতে, পড়তে পড়তে এই অধিকার বোধ যে কবে কখন ভালোলাগায় পরিণত হয়ে যায়, তাও ভালো করে মনে নেই। ভালোলাগার পথ ধরে ঠিক কতটা হাঁটলে ভালোবাসা হয় রে! ধূর সেসব বোঝার বয়স ছিল নাকি তখন। সবই তো কিশোর বয়সের অবেগ প্রবণতা। শুধু তুই খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে আঘাত পেলে খুব মন খারাপ হ‘ত। আর তুই ভালো ছেলে ছিলি বলে সচরাচর বকা খেতিস না, কিন্তু কোনো কারণে তুই বকা খেলে সারাদিনের জন্য মনটা আমার খারাপ হয়ে যেতো। এই অনুভূতিটাকে কী ভালোবাসা বলে নাকি রে?কেন যে দূরে গিয়ে বন্ধুদের দুষ্টুমির মধ্যে শুধু তোকে খুঁজতাম কে জানে? কিন্তু নবম শ্রেণীতে তোর হৃদয় জুড়ে অন্য কারুর উপস্থিতি দেখেও মনকে অদ্ভূত ঔদাসীন্য দিয়ে ভরিয়ে রাখতে পেরেছিলাম। মনে হ‘ত আমার বন্ধু যেন ভালো থাকে, হ্যাঁ ওর যাকে ভালো লাগে তাকে পেয়েই ভালো থাক। ভালোবাসা বোধহয় আশ্চর্য নরম আর সুন্দর হয় তাই না রে? ত্যাগের আরেক নামই তো ভালোবাসা। আর আমার ওই মিষ্টি অনুভূতির নাম যদি ভালোবাসাও হয়ে থাকে তো ভালোবাসাকে খাঁচাবন্দী করায় আমার বিশ্বাস নেই। আমার ভালোবাসা তাই ডানা মেলুক অনন্ত আকাশে। তুই খুউউউউব ভালো থাক তোর ভালোলাগা আর ভালোবাসাকে নিয়ে। তোর ছোট বেলার বন্ধু অঙ্কিতা।

You cannot copy content of this page