• গল্প

    গল্প- স্বপ্ন যেখানে ছোঁয়া যায়

    স্বপ্ন যেখানে ছোঁয়া যায়
    – সঞ্জয় গায়েন

    এটা এক স্বপ্নের গল্প। স্বপ্ন সত্যি হওয়ার গল্প।
    হ্যাঁ, শুরুর আগে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: যারা স্বপ্ন সত্যি হবে না এই ভয়ে স্বপ্ন দেখতে চান না, এ গল্প তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয়। কিছুটা ক্ষতিকরও বটে। সময়ের ক্ষতি আর কি। সময়ের প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল, তখন বলা দরকার, স্বপ্ন দেখতে হলে সময় তো দিতেই হবে। কিন্তু সেই সময় বড় কম। তাই তো? সময় নেই, অথচ স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে আছে এবং তা সত্যি হোক সেটাও চান, এ গল্পটা এক্কেবারে তাদের জন্য।
    তাহলে শুরু করা যাক।
    গল্পের নায়িকা হিয়া। ও একটি টিন-এজার। সেভেনটিনথ। আর নায়ক কৃশ। ও টুয়েন্টি ওয়ান। বুঝতেই পারছেন ছুটন্ত বয়স। এক মধ্যরাতে হঠাৎ-ই, এরা একটা স্বপ্ন স্টার্ট করলো এবং পরদিনই তা সত্যি হয়ে গেল।
    আমি জানি আপনারা প্রত্যেকেই এমন চান। তাই এ গল্পের ক্যাচলাইন স্বপ্ন দেখলেই সত্যি। এবার তাহলে গল্পটা বলি। কিভাবে ওরা স্বপ্ন দেখা শুরু করল আর তা সত্যি হল।
    হিয়াকে ওর বাবা বার্ড-ডেতে একটি ল্যাপটপ গিফট করেছে। ও সেদিনই নিজের ই-মেল আই-ডি ক্রিয়েট করেছে এবং অ্যাকাউন্ট খুলেছে ফেসবুকে। এতদিন ওকে মায়ের সাথে রুম শেয়ার করতে হতো। ন্যাচারালি, রাতে চ্যাট করতে পারতো না। তাই ফেসবুক করে নি। আজ থেকে ও সেই ফ্রিডম পেয়েছে। ওর একার জন্য একটা রুম।
    ফেসবুক ওপেন করতে করতেই ও স্বপ্ন দেখল, যে ওকে প্রথমবার্থ-ডে উইশ করবে, সে হবে ওর বেস্ট ফেবুফ্রেন্ড এবং তাকে ও ওর সবকিছু উজাড় করে দেবে।
    কৃশ সেই লাকি বয়।
    সামান্য কিছু সময়েই ওরা চ্যাট করে একে অপরের পছন্দ অপছন্দ জেনে নিয়েছে। হিয়া ওর স্বপ্নের কথাও কৃশকে জানিয়ে দিয়েছে। এন্ড কৃশ তা অ্যাকসেপ্টও করেছে।
    আচ্ছা এই ফাঁকে, হিয়া ও কৃশের পি ডি মানে পারসোনাল ডিটেলস জেনে নেওয়া যাক। হিয়া সদ্য এইচ এস দিয়েছে। মা বাবার একমাত্র মেয়ে। আর কৃশ ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট। ফাইনাল ইয়ার। ও-ও মা-বাবার একমাত্র সন্তান। ওর বাবা মা দুজনেই সার্ভিস করে আর হিয়ার বাবার বিজনেস। এটুকুই যথেষ্ট। কারণ গল্পটা যখন হিয়া আর কৃশকে নিয়ে তখন ওদের ফেমিলি হিস্ট্রি দীর্ঘায়িত করে কি লাভ?
    এদিকে হিয়াদের ফ্রেন্ডশিপের আয়ু ওয়ান আওয়ার ক্রশ করেছে এবং এই ফার্স্ট আওয়ার ওর খুব এনজয় করছে। কিভাবে? চলো লেটস সি।
    -অ্যাই হিয়া, কি ভাবছিস?
    -কিচ্ছু না। আমি জাস্ট এনজয় দিস মোমেন্ট।
    -দিস মোমেন্টকে আরও একটু মেমোরেবিল করতে একটা জিনিস চাইবো। দিবি?
    -কি?
    – অ্যা সুইট কিস।
    -ধ্যাৎ।
    – দে না রে। প্লিজ।
    – ঠিক আছে। দিচ্ছি। তবে, শুধু ওইটুকু। এর বেশি কিছু চাইবি না কিন্তু।
    – বা রে, তুই তো বললি আমাকে সবকিছু উজাড় করে দিবি। এখন প্রমিস ব্রেক করছিস কেন?
    – অ্যাই, একদম বাজে কথা বকবি না।
    – আমি বাজে বকছি? নাকি তুই?
    – ও.কে. কি চাই বল?
    – তোকে এক জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।
    – কোথায়? কবে?
    -কাল। মানে আজ রাতটা ফুরোলেই।
    – উফ্‌। তোর সবকিছুতেই তাড়া দেখছি।
    – ইয়েস ম্যাডাম, সময় কোথায় সময় নষ্ট করবার।
    – ও.কে. তা কোথায় নিয়ে যাবি সেটা তো বল।
    – নো, ও-টা-আ সিক্রেট। তবে কলকাতার মধ্যেই।
    -প্লিজ, বল।
    – আবার…
    – ও.কে.। কখন আর কোথায় যেতে হবে বল।
    – রাজারহাট সিটি সেন্টারের সামনে। সকাল দশটা।
    – ওঃ! এই তোর সিক্রেট প্লেস। সিটি সেন্টারে লাঞ্চ, আইনক্সে মুভি আর কিছু শপিং।
    – নো ম্যাডাম। তোকে ওখানে নিয়ে যাব বলি নি। ওখানে জাস্ট আমরা মিট করব। তারপর দুজনে যাব ড্রিম টাউনে।
    – ওয়াহ। সেটা কোথায় জিজ্ঞেস করব না। বাট তুই পাংচুয়াল তো? সিটি সেন্টার দশটায় খোলে না। সো আমায় বাইরে ওয়েট করতে হবে।
    – ডোন্ট ওয়ারি। আমিই আগে পৌঁছে যাব। তোকে ওয়েট করতে হবে না।
    – গ্রেট। এই তোকে চিনতে পারব তো?
    -কেন? ফেসবুকে আমার যে ইমেজগুলো আছে সেগুলো কি অন্য কারও মনে হচ্ছে?
    – তা নয়। তবে এডিট করে পোস্ট করেছিস তো…
    – মোটেও না। সব ন্যাচারাল।
    – তাই! খুব ভালো। হি হি হি।
    – ইয়েস ডিয়ার। বাট তোরগুলো কি?
    – আমিও ন্যাচারাল বিউটি। আমার এডিটিং করতে হয় না।
    – বুঝেছি। তাইতো এখুনি তোর কাছে যেতে ইচ্ছে করছে।
    – আয়। বারণ করেছি নাকি?
    – সত্যি সত্যি চলে যাব কিন্তু।
    – আয়। তবে বাড়াবাড়ি কিছু করবি না তো?
    – সে আমি কি জানি! তুই যখন সব উজাড় করে দিবি বলেছিস, তখন তুই জানিস।
    – দেব রে বাবা দেব, অতবার করে মনে করিয়ে দিতে হবে না। এখন গুড নাইট। কাল তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।
    – ই-য়া-আ! গুড নাইট। উ-উ-উ-উ-ম। হ্যাভ এ সুইট ড্রিম।
    এতক্ষণে নিশ্চয় বোঝা গেছে, কৃশ আর হিয়া রিলেশানের কোন্‌ স্টেজ অ্যাচিভ করেছে। ওদের কাল সকালের টার্গেট কি সেটাও আর কারও অজানা নেই। তবে সেই টার্গেট ফুলফিল হবে কিনা এখনই বলা পসিবিল নয়। পৃথিবী দ্রুত পাল্টাচ্ছে। তাই পূর্বাভাস যতই রোদ ঝলমল রঙীন দিনের ইঙ্গিত দিক একটা সুনামি কিংবা স্যান্ডি ওদের হৃদয় আকাশ মেঘে ঢেকে দিতে পারে। যাইহোক দেখা যাক, কি হয় এরপর।
    পরদিন। কাঁটায় কাঁটায় সকাল দশটায় যাকে বলে একেবারে জাস্ট টাইমে ওরা মিট করল। একে অপরকে চিনে নিতে সামান্য প্রবলেম হলেও অসুবিধা হল না। ছবি আর জীবন্ত। এর মধ্যে একটু ডিফার তো হবেই। অনেকে বলে ছবি নাকি মুখোশ। আর জীবন্ত যেটা সেটাই আসল মুখ। ছবি দেখে চরিত্রের কিছু বোঝা যায় না। হাসিহাসি মুখের ছবিওয়ালা কথায় কথায় রেগে যায়। আবার গোমড়ামুখো ছবির মানুষ যে এত হাসাতে পারে ভাবা যায় না। যাইহোক দর্শনতত্ত্বের আলোচনা এখন থাক। বরং দর্শন করা যাক হিয়া আর কৃশকে। দেখা যাক ওরা প্রথম দেখা, প্রথম দুজনের কাছে আসা, কিভাবে এনজয় করছে।
    -ওয়াহ! ইউ আর সো বিউটিফুল হিয়া। আই ক্যান্ট বিলিভ। তুই ছবির থেকেও সুন্দর।
    -থাক। আর মিথ্যে প্রশংসা করে আমার মনজয়ের চেষ্টা করতে হবে না। চল। তোর ড্রিমটাউন কোথায় দেখি। যদি সত্যি টাউনটা ড্রিমফুল হয় তোকে আজই আমার আমিকে গিফট দেবো।
    – গ্রেট। চল লেটস গো।
    ওরা হাঁটতে হাঁটতে এভাবেই কথা বলে চলেছে। সিটি সেন্টারকে পিছনে ফেলে রেখে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠের উপর যে কালো পিচরাস্তাটা শুয়ে আছে তার বুকের উপর দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা হাসছে। একে অপরের গায়ে হেলে পড়ছে মাঝে মাঝে। এভাবেই দুজন দুজনের শরীরের সুগন্ধ মাখতে মাখতে হেঁটে চলেছে। পাশ দিয়ে ফুলস্পিডে ট্যাক্সি ছুটে যাচ্ছে। মাঝেমাঝেই মাথার খানিক উপর দিয়ে প্লেন উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওদের সেদিকে কোন লক্ষ্য নেই। ওরা হাঁটছে তো হাঁটছেই। যেন পথ হারিয়ে পথের খোঁজে চলেছে।
    অবশেষে পিচরাস্তাটা বাঁক নিতেই ওরা থামলো। সামনেই একটা ছিমছাম রিসর্ট। নাম-ড্রিমটাউন। নীচে ক্যাচলাইন-এনজয় দ্য নেচার।
    -কি হল চল?
    – কৃশ, এ কোথায় নিয়ে এলি আমাকে?
    – চল, নিজেই দেখবি।
    -কি আর দেখবো? বাইরে থেকেই সব বুঝতে পারছি।
    -নাঃ! পারছিস না। এটা সত্যিই স্বপ্ননগরী। আমাকে বিশ্বাস করে ভিতরে চল। সত্যি এখানে স্বপ্নকে ছোঁয়া যায়।
    – কি যা তা বলছিস?
    -ঠিকই বলছি। চল, ভিতরে চল। স্বপ্ন ছুঁতে পারবি।
    জানি। সকলেই কৌতুহলী। উৎসুক। স্বপ্ননগরী ছোঁয়ার জন্য। অবশ্য অনেকেই ইমাজিন করছেন অলরেডি। তবে তাদের ইমাজিন করা থেকে বিরত থাকতে বলব। স্বপ্ননগরীর পরিবেশ কল্পনাতীত। তাই জাস্ট চিন্তা করা ভুলে গিয়ে, শুধু দেখতে থাকুন।
    হিয়া মৃদু আপত্তি করা সত্ত্বেও কৃশ প্রায় জোর করে ওকে রিসেপশান রুমে নিয়ে গেল। রুমটার চারদেয়ালই কাচ দিয়ে তৈরি। অনায়াসে একে কাচঘর বলা যেতে পারে। তবে এগুলি সাধারণ কাচ নয়। ম্যাজিক মিরর। ড্রিমটাউনের ভাষায় মিরর অফ ড্রিম। এর যে কোন দিকে তাকালেই আপনার নিজেকে একটা অন্যরূপে দেখার ইচ্ছা হবে , আর আপনার সেই ইচ্ছে মিররে ছবি হয়ে ফুটে উঠবে। হিয়া মনে মনে ভাবছিল, ও যেন রজনীগন্ধা রঙের ঘাঘড়া পড়ে ফুলের দেশে হাঁটছে। ভাবামাত্রই দেয়ালগুলো মুহুর্তে ফুলের দেশ হয়ে গেল। চারদিকে কত রঙ বেরঙের ফুল ফুটে আছে। প্রজাপতি উড়ছে। হিয়া সেগুলি ধরার জন্য ছুট্টে যেতে চাইল।
    পারলো না। কৃশের ডাকে ফিরে আসতে বাধ্য হল।
    ‘চল, বুকিং হয়ে গেছে। রুম নম্বর থ্রি জিরো সেভেন।’ বলেই কৃশ রুমের চাবিটা হিয়ার হাতে দিল। দিয়ে বললো, ‘তুই রুমে চল, আমি একটু পরেই যাচ্ছি। আর হ্যাঁ, ইয়োর শ্যু মানে জুতোটা বাইরে খুলে রেখে খালি পায়ে ঢুকবি। এখানে এটাই নিয়ম।
    হিয়া বাধ্য মেয়ের মতো কৃশের কথা মেনে একাই রুমের দিকে এগিয়ে গেল। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে জাস্ট আশপাশটা দেখে নিয়ে রুম ওপেন করলো। ভিতরে ঢোকামাত্রই দরজাটা অটোমেটিক ক্লোজড হয়ে গেল।
    বিশাল বড় ঘর। কিন্তু সম্পূর্ণ ফাঁকা। চারদেয়ালে একটা জানালাও নেই। ভিতরটা বড্ড অন্ধকার। হিয়ার গা-টা ছমছম করে উঠল। হঠাৎ ওর মনে হল, কোথা থেকে যেন আলো এসে ঘরটাকে একটু একটু করে আলোয় ভরিয়ে দিচ্ছে। হিয়া নিস্তদ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো। সেই মৃদু আলোয় ও দেখতে পেল ঘরের মেঝেটা সবুজ ঘাস দিয়ে ঢাকা। কী নরম ঘাস! পায়ের তলায় সুখের পরশ। ঘাসের ডগায় মুক্তোকণার মতো বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশির ওর পা ধুয়ে দিল। ভেসে এল জাদুকন্ঠ, ওয়েলকাম টু আওয়ার ড্রিমরুম।
    এবার ঘাসের মেঝেতে পায়চারি করতে করতে দেয়ালে চোখ রাখল হিয়া। সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেল, ভোরের প্রথম সূর্য। ও বুঝতে পারল, এই সূর্যটায় এতক্ষণ আলো দিচ্ছিল। ও আনন্দে নেচে উঠল। সূর্যটা এত কাছে! একবার ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হল। উঃ! উষ্ণতার ছোঁয়ায়সারা শরীর কেঁপে উঠলো।
    এত্তবড় ঘরে ও একা। আর কেউ ওকে দেখতে পাচ্ছে না। আনন্দে খানিক দৌড়ে নিল। শুয়ে পড়ল ঘাসের উপর। জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকল। বুকটা ওঠানামা করছে। ঠিক তখনই ওর চোখ পড়ল ঘরের কোণে। একরাশ শিউলি ঝরে পড়ে আছে। দুহাতে আঁচলা ভরে ফুল কুড়িয়ে নাকের কাছে ধরল। মিষ্টি সুবাস।
    হঠাৎ হিয়ার জল পিপাসা লাগল। লাগামাত্রই চোখ গেল অন্য এক দেয়ালে। ঝর্নাধারার ছবি। কিন্তু এত জীবন্ত মনে হল যেন সত্যি জল ঝরছে।
    ওর ঝর্নার জল খাওয়ার ইচ্ছে হল। মুখ ঠেকালো ছবিতে। ঠেকাতেই ওর ঠোঁট ভিজে গেল! হিয়া দুই হাত জড়ো করে ঝর্ণামুখে ধরল। মুহুর্তের মধ্যে কোথা থেকে জল এসে হাত ভরে যেতে লাগল। ও পান করতে শুরু করে দিল।
    এতক্ষণ কেটে গেল। কৃশ কোথায়? হিয়ার মনে আদৌ এ প্রশ্ন এল না। ও যেন হারিয়ে যেতে চাইছে। একা একা। তাই কৃশ কোথায় তা পরে জানা হবে। এখন হিয়া কি করছে দেখা যাক।
    পুরো ঘরটা চড়া রোদে ভরে গেছে। এবার হিয়ার গরম করতে লাগল। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। জিনস্‌-টপ ঘামে ভিজে শরীরে লেপ্টে গেছে। রীতিমতো বিরক্তি ফুটে উঠল চোখে মুখে। ঠিক তখনই কোথা থেকে কালো মেঘ এসে ঢেকে দিল সূর্যটাকে। দেখতে দেখতে ঘরের ছাদ পুরো মেঘে ঢাকা। তারপরেই বিদ্যুৎ ঝলক। কড় কড় কড়াৎ। হিয়া ভয়ে মুখ ঢেকে মেঝেতে বসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি এল। বৃষ্টি এল ছাদ জুড়ে। ঝমঝমিয়ে।
    হিয়া নেচে উঠল। ভিজতে লাগল ঠায় দাঁড়িয়ে। তখনই চোখে পড়ল অদূরে একটা ময়ূর দাঁড়িয়ে। সত্যিই তাই। পেখম মেলে নাচছে। আ-আ-হা। কী আনন্দ ! হিয়াও নেচে উঠল। ছুটে গেল খসে পড়া একটা পেখম তুলে নিতে।
    এভাবে ভিজে কাঁপন এল হিয়ার শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল বৃষ্টি। ঘর আবার আলোময়। ভেসে এল জাদুকন্ঠ। লুক হিয়া…
    এবার হিয়া দেখল ঘরের একটা দেয়াল অটোমেটিক সরে যাচ্ছে। তারপরেই দেখতে পেল, ওপারে সুসজ্জিত নরম বিছানা। সেখানে কৃশ ওর অপেক্ষায়। ছুটে গেল হিয়া।
    খানিক পর। হিয়া আর কৃশ বেরিয়ে আসছে। হাসতে হাসতে। ওদের হাতে ব্যানার-ওয়েলকাম টু ড্রিমটাউন। স্বপ্ন যেখানে ছোঁয়া যায়।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- সরস্বতী

    সরস্বতী
    -সঞ্জয় গায়েন

     

     

    বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে এবছর দু’দিন। এক দৈনিক সংবাদপত্রের হেডলাইন। দেবী সরস্বতীর আরাধনার সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে এমনই লিখেছেন জনৈক সাংবাদিক। বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি আরও লিখেছেন, পঞ্জিকা মতে সরস্বতীপুজো এবার দ্বিমতে৷ কেউ বলছেন, বুধবার পুজো। কারও মত, বৃহস্পতিবার। এরপর আরও কিছু শব্দ খরচ করে উপসংহারে গিয়ে তিনি লিখেছেন, এতে অবশ্য সরস্বতীপ্রেমীদের কোন অসুবিধা নেই। তারা বরং খুশি। তার কারণ হিসাবে তারা জানিয়েছেন, এতে দু’দিন ধরে প্রেম করা যাবে। আর এভাবেই বাঙালির ভ্যালেন্টাইন ডে দু’দিন ধরে পালিত হবে।
    সংবাদটি পুঙ্খানুপুঙ্খ পাঠ করার পর রাগে সারা শরীর ঘিনিয়ে উঠল শাশ্বতের। এইভাবে দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে হাসি ঠাট্টা মজার মোড়কে পরিবেশন করে হিন্দুত্বকে অপমান করেছেন এই সংবাদপত্র। তার চেয়ে বড় কথা সাংবাদিকটি দ্বিমতের পুজো ব’লে নিজের মুর্খামীর পরিচয়ও দিয়েছেন। পরক্ষণেই মনে হল, ওনাকে দোষ দিয়ে কি লাভ? বহু পুরোহিতই তো এমন বিধান দিচ্ছেন। ভুল পঞ্জিকা দেখিয়ে বলছেন, দু’দিন ধরে পুজোর কথা। নিজস্ব স্বার্থে।
    শাশ্বত তাই কিছু কমেন্ট না করে এড়িয়েই যাচ্ছিল। পরে ভাবল, না। এভাবে এড়িয়ে গিয়ে গিয়েই সনাতন ধর্মে বিশ্বাস তলানিতে ঠেকছে। অথচ সনাতন ধর্মের আচার বিচার সংস্কারের সঙ্গে ওতোপ্রতো ভাবে বিজ্ঞান জড়িয়ে।
    শাশ্বত নিউজটার লিঙ্কে গিয়ে দেখে ইতিমধ্যেই খিল্লি করা শুরু করে দিয়েছে সবজান্তা ফেসবুকওয়ালারা। ও আর থাকতে পারে না। কমেন্টে গিয়ে লেখে, সরস্বতী পুজো দিবারম্ভের পুজো। তাই এবছর পঞ্চমী তিথির সময়কালের মধ্যে যেহেতু বৃহস্পতিবার দিবারম্ভ আছে, সেই হেতু পুজো হবে বৃহস্পতিবারের প্রত্যুষে। দ্বিমতের পুজো বলে যারা প্রচার করছেন তারা ভুল বলছেন। আর অন্যায় করছেন বিদ্যার দেবীকে প্রেমের দেবীর সঙ্গে তুলনীয়া করে তুলে… শাশ্বতের কলম এভাবেই এগিয়ে চলতে থাকে। আর মনের মধ্যে উচ্চারিত হতে থাকে, দেবীর অঞ্জলির মন্ত্র–
    শ্বেত পদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা
    শ্বেতাম্বরা ধরা নিত্যা শ্বেত গন্ধানুলেপনা
    শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা
    শ্বেতবীণা ধরা শুভ্রা শ্বেতাভরণভূষিতা….।
    ঋনস্বীকার- জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়

  • ধারাবাহিক

    আয়নামহল (পর্ব-৬)

    আয়নামহল (পর্ব-৬)
    -সঞ্জয় গায়েন

     

    ২৬
    মেয়েলি পুরুষের মেয়ে সাজ
    সিনেমা নাটকে হাসির কাজ

    জীবনে কিছু হতে হয়, কিংবা কিছু করতে হয়, এসব কখনও ভাবিনি। ভাবার দরকারই পড়ে নি। কারণটা অন্য কিছু নয়। আমি ভাবতাম কিছু করা বা কিছু হওয়া তো মানুষদের জন্য। আর আমরা তো মানুষ নই। তাই কিছু করা বা কিছু হওয়ার প্রশ্নই ছিল না। যদিও আমার প্রেমিক বলত, তুমি যেই হও,কিছু না কিছু করতেই পারো। তার জন্য শুধু কিছু করার ইচ্ছে চায়। ওর কথা শুনে কবি হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। লিখেওছিলাম কিছু ছাইপাঁশ। তারপর আমার প্রেমিকই একদিন সেই ছাইপাঁশে জল ঢেলে দিয়ে পালিয়েছিল।
    সে যাক গে। তারপর থেকে আর কিছু হওয়ার কথা ভাবিনি। বাড়ি ছেড়ে লগনে গিয়ে লন্ড্রা নাচ নেচে বেশকিছু টাকা হাতে এসেছিল। ফিরে আসার পর, মনে হয়েছিল, কিছু করলে হয়। এমনকিছু যাতে আমিও কিছু হয়ে উঠব। কিছু হওয়ার কথা মনে হতেই মায়ের মুখটা ভেসে উঠেছিল। আর ভেসে উঠতেই নিজেকে সামলাতে না পেরে মা’কে ফোন করে ফেলেছিলাম। কিন্তু কথা বলতে পারি নি। বললেই মা নির্ঘাত জিজ্ঞেস করত, কি করিস এখন? তখন কি বলতাম আমি। কিছুই তো করি না। কিছু করতে পারি না আমি। মা কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বলতো, তোর দাদা ইঞ্জিনিয়ার হবে। তুই কি হবি?
    দাদা সত্যি সত্যি ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিল। আমি কিচ্ছু হতে পারি নি। নিজের উপার্জন করা টাকা হাতে আসার পর কিছু হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু কি হবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ঠিক তখনই অফার এসেছিল, সিনেমায় নামার। যাদের সঙ্গে লগনে গিয়েছিলাম, তারাই খবরটা এনেছিল। ততদিনে তাদের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তারাই আমার জন্য থাকার ঘর ভাড়া করে দিয়েছিল। এত সাহায্য আমার আপনজনরাও করে নি।
    যাইহোক অফার পাওয়া মাত্রই রাজী হয়ে গিয়েছিলাম। নাই বা হতে পারলাম নায়িকা। ছোটখাটো অভিনয় করলেও অভিনেত্রী তো। কে বলতে পারে, ছোট থেকেই বড় হতেও তো পারি একদিন। অনেক আশা নিয়ে ছুটে গিয়েছিলাম।
    এ কি! অভিনয় তো কিছু নয়। এ যেন রাস্তায় মিছিলের মতো পর্দায় ভিড় বাড়ানোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোমর দুলিয়ে তালি দেওয়া। হেসে হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়া।
    রাজী হই নি। উল্টে প্রতিবাদ করেছিলাম। কারও শারীরিক চেহারা বা পোশাক আশাককে উদ্দেশ্যহীনভাবে সিনেমায় দেখিয়ে লোক হাসানোটা অন্যায়। অপমানকর। এসব আইন করে বন্ধ করা উচিৎ।
    কিন্তু আমার প্রতিবাদ ধোপে টেকে নি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল সবাই। এ নাকি শিল্প। বিনোদন শিল্প। আর এভাবে দেখানো শিল্পীর স্বাধীনতা। তখন বলেছিলাম, আমাদের দেখিয়ে এতদিন তো লোককে হাসতে শিখিয়েছেন। একবার অন্যভাবে দেখিয়ে কাঁদতে শেখান। টেস্ট বদলাবার ইচ্ছে তো সবার হয়। যদি তেমন ইচ্ছে হয় খবর দেবেন, আসবো। এইসব ব’লে মুখের উপর দু’টো তালি মেরে চলে এসেছিলাম।

    ২৭
    কি করা যায় কি হওয়া যায়
    কানেতে বাজে হায় হায় হায়

    শিল্পী লেখক কেউ বোঝে না। এ পৃথিবী আমাদের না। একটা ডায়েরী কিনে প্রথম পাতায় এই দু’টো লাইন লিখেছিলাম। কিন্তু যাব কোথায়? এই পৃথিবীর বাইরে কি কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে। থাকলে চলে যেতাম। সত্যি সত্যি চলে যেতাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব সাত পাঁচ ভাবছিলাম। তখন আমার সেই চার লগনওয়ালি বান্ধবী হায় হায় হায় হায় করতে করতে আমার ঘরে ঢুকেছিল। সঙ্গে দুই হাতে সেই অদ্ভুত তালি যা শুনলে সকলেই চিনে যায় এরা কারা। কিন্তু ওরা অমন করে তালি বাজাতে বাজাতে আর হায় হায় করতে করতে আমার কেন ঢুকেছিল বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম।
    কি লা, অমন তাকিয়ে কি দেখছিস? একজন খনখনে গলা করে জিজ্ঞেস করল। তাই শুনে আর একজন বলল, কি আর দেখবে ও ভাবছিল, কোন মওগা এল নাকি। কতদিন ধরে উপোস যাচ্ছে ডাঁসা শরীরখানা।
    ওদের কথা কিছু বুঝতে পারছিলাম না। এমনকি ওদের কন্ঠস্বরও অচেনা ঠেকছিল। তার মানে অমন গলা নিয়ে কেউ জন্মায় না! অমন গলার আওয়াজ, অমন তালি সব শিখতে হয়!
    আমার মনের ভাবনা ওরা কেমন করে বুঝে নিত কে জানে! হঠাৎ একেবারে স্বাভাবিক হয়ে আমার পাশে বসে বলেছিল, তোর প্রতিবাদটা কাল খুব ভালো লেগেছিল। আমরাও তোর সাথে ওই কাজকে লাথ মেরে চলে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আসতে পারি নি। কেন জানিস? শুধু টাকা নিয়ে রেখে ছিলাম বলে। তবে হ্যাঁ, আসার সময় বলে এসেছি, এই শেষবার। আর কোন ‘হিজড়া’ হিজড়া সেজে সিনেমায় লোক হাসানোর জন্য অভিনয় করতে আসবে না। পারলে কোন অভিনেতাকে হিজড়া সাজিয়ে অভিনয় করে দেখিও। তাহলে যদি বোঝে হিজড়া সাজার জ্বালা কতখানি।
    ওদের কথা শুনে চোখে জল এসে গিয়েছিল। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ওদের জড়িয়ে ধরেছিলাম।
    দূর পাগলি! কাঁদবি কেন? কাঁদলে লোকে দুর্বল ভাবে। তাই একদম কাঁদবি না। যত কষ্টই হোক, কাঁদবি না। আমাদেরও কি কষ্ট হয় না? হয়। খুব কষ্ট হয়। কিন্তু সব কষ্ট তালি মেরে উড়িয়ে দিই। তুইও এখন থেকে তাই করবি। চল্‌ এবার।
    কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, এই সমাজের বাইরে। আমাদের, শুধু আমাদের এক সমাজ আছে। সেখানে যাবি চল।
    শুধু আমাদের মতো মানুষদের জন্য সমাজ! শুনেই চোখ দু’টো হেসে উঠেছিল। আর কোনকিছু জিজ্ঞাসা না করেই পিছু নিয়েছিলাম।

    ২৯
    মাস চলে যায় মাসের পর
    ছুটে বেড়াই এ ঘর সে ঘর

    মানুষ। মানুষ। শুধু আমাদের মতো মানুষ। দেশে আমাদের মতো মানুষ যে এত হাজার হাজার আছে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হত না। দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আনন্দিত হয়েছিলাম। এত ভালো আর কখনো লাগে নি। আগে প্রতি মুহুর্তে মনে হত, এ পৃথিবী আমাদের না। কিন্তু নিজের মতো এত মানুষকে একসঙ্গে দেখার পর মনে হয়েছিল, এ পৃথিবী শুধুই আমাদের। সত্যিই এ আমাদের পৃথিবী। আমাদের দেশ। এক দেশের ভিতর এ এক অন্য দেশ। সেই দেশে আমাদের জন্য সব আছে। তার চেয়ে মজার বিষয়, এই পৃথিবীর চারপাশে আমাদের মতো মানুষেরা এমন এক পাঁচিল তুলে রেখেছে যা টপকে বাইরের পৃথিবীর কেউ ঢুকতেই পারবে না। সে কথা শুনে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। এমন আবার হয় নাকি? সমাজে বাস করেও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা। সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। এও কি সম্ভব! আমার মুগ্ধতা, আমার আনন্দ যেমন চোখে মুখে প্রকাশ পেয়েছিল, তেমনই আমার অবিশ্বাসও লুকোতে পারি নি। দু’ একটা প্রশ্ন করতে যেতেই ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। তাতে অবশ্য কোন ক্ষতি হয় নি। বরং উপকারই হয়েছিল। আমার একটা প্রশ্ন শুনে অত মানুষের ভিড় থেকে একজন বলেছিলেন, বিশ্বাস একটা অভ্যাস। আর কোন অভ্যাসই একদিনে গড়ে ওঠে না। প্রতিদিন তাকে অনুশীলন করতে হয়। তবেই একদিন তা অভ্যাসে পরিনত হয়।
    কথাটার মধ্যে কী ম্যাজিক ছিল কে জানে, আমি আমাদের নিজস্ব পৃথিবীকে দেখার জন্য বেড়িয়ে পড়েছিলাম। আমার সঙ্গী হয়েছিল আমার সেই চার বন্ধুও।
    সারা দেশ জুড়ে আমাদের মতো মানুষের কত ঘর। ঘুরে ঘুরে সব ঘরে যেতে লাগলাম। কী আশ্চর্য্য! যে ঘরেই গিয়েছি সকলেই নিমেষে আপন করে বুকে টেনে নিয়েছে। ক’জন অচেনা মানুষ, চেনা নেই, জানা নেই, তাদেরকে দেখেই খেতে দেওয়া, থাকতে দেওয়া সভ্য সমাজের মানুষেরা কল্পনাও করতে পারে না। অথচ সেই সমাজ যাদের তাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে তারা অনায়াসে পরকে আপন করে নিতে পারে। এমন করে কাছে টেনে নিতে পারে সবাই যেন আমাদের কত দিনের চেনা।
    এভাবে ক’মাস ঘুরেই আমার বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল। ঠিক করে নিয়েছিলাম এরপর যে ক’দিন বাঁচব আমাদের পৃথিবীতেই বাঁচব। এই পৃথিবী আর যাই হোক, যার জন্য আমি দায়ী নই, তার জন্য আমার কাছে কৈফিয়ৎ চাইবে না।
    এতদিন আমার জন্মের জন্য বাইরের পৃথিবী অনেক প্রশ্ন করেছে। উত্তর দিতে দিতে আমি ক্লান্ত হয়েছি। কিন্তু পৃথিবীর প্রশ্ন থামে নি। তাই আর নয়। যে পৃথিবী আমাদের ভালোবাসতে জানে না, সে পৃথিবীকে প্রশ্ন করারও সুযোগ দেব না। আর তা বন্ধ করার একমাত্র পথ আমাদের নিজস্ব পৃথিবী।

    ৩০
    মনে কি পড়ে না মায়ের মুখ
    ডুকরে কাঁদি ফেটে যায় বুক

    লোকে ব’লে এ পৃথিবী নাকি গোল আর খুব ছোট। যদি কাউকে মন প্রাণ দিয়ে খোঁজা যায়, তার দেখা মিলবেই মিলবে। আমি আমার ছেলেকে খুঁজে পেতে হন্যে হয়ে খুঁজেছিলাম। দিনের পর দিন। কই তার দেখা তো পাই নি। খুঁজতে খুঁজতে একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। আসলে ও যদি হারিয়ে যেত, তাহলে হয়তো ওকে ফিরে পাওয়া যেত। সংসার তো সমুদ্রের মতো। সমুদ্র যেমন সবকিছু ফিরিয়ে দেয়, আমার হারানো ছেলেকেও তেমন ফিরিয়ে দিত। হারিয়ে পাওয়ার আনন্দে ভরে যেত আমার বুক। কিন্তু ও তো হারায় নি। চলে গিয়েছিল। আর যে চলে যায়, সে বোধহয় আর ফেরে না। তবে ফেরে নি বলেই ওর কচিমুখটা বড্ড বেশি করে মনে পড়তো। সবাই বলতো, আর মনে রেখে কি হবে! এবার ভুলে যাও। মিথ্যে বলব না। ভুলতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওর মুখ যত ভোলার চেষ্টা করেছি, তত বেশি করে মনে পড়েছে। ওর মুখ যত মনে পড়ত, ততই ভাবতাম আমি মা বলে ওকে ভুলতে পারি নি। কিন্তু ও তো ছেলে। ও আর কেমন করে বুঝবে মায়ের কষ্ট। ও ঠিক মায়ের মুখটা ভুলে গিয়েছে। এমনটা মনে হলেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠতো! সত্যিই কি ওর একবারও মনে পড়ে না মায়ের কথা! ছোটবেলায় মাকে দেখতে না পেলে তো চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে তুলতো। আর বড় হয়ে মাকে একেবারে ভুলেই গেল! এও কি হতে পারে! এইসব ছাইপাঁশ ভাবতাম। ওর ছবিতে ভর্ত্তি অ্যালবামটাই হাত বুলোতাম। আর ডুকরে ডুকরে কাঁদতাম।
    ঠিক সেই সময় খোঁজ পেয়েছিলাম, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার। যারা নাকি আমার ছেলের মতো ছেলেদের পাশে দাঁড়ায়। তাদের সুখ দুঃখের সঙ্গী হয়। শোনামাত্রই ছুটে গিয়েছিলাম। নিজের ছেলের ছবি আঁচলে বেঁধে। গিয়ে দেখেছিলাম, সত্যি আমার ছেলের মতো অসংখ্য ছেলে। মেয়েলি ছেলে। মনের ভিতর আশার আলো উঁকি দিয়েছিল। ওরাও আশা দিয়েছিল। খুউব করে চেষ্টা করবে। ওরাই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, আমার ছবি দিয়ে। নীচে লিখে দিয়েছিল- মনে কি পড়ে না মায়ের মুখ?

    ৩১
    কাঁধে ঢোলক হাতে তালি
    বলে উঠলাম জয় মা কালী

    নিজস্ব পৃথিবীতে এক এক করে সব পাচ্ছিলাম। অবশেষে একজন মাও পেয়ে গিয়েছিলাম। আমকে নিজের মেয়ের মতো বুকে টেনে নিয়েছিল সেই মা। আমার গর্ভধারিনী মায়ের মুখে যে ডাক শোনার জন্য দিনের পর দিন হা পিত্যেশ করেছিলাম, সেই ডাক অবশেষে শুনতে পেয়েছিলাম। পাতানো মায়ের গলায়। আমি মেয়ে হতে পেরেছিলাম। আমার সেই পাতানো মা আমার নতুন নাম দিয়েছিল। নারী নাম। শুধু তাই নয়, আমাকে একটু একটু করে মেয়ের মতো গড়ে তুলেছিল। আমি বুক জুড়ে স্তন গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, মাঝপথে থেমেও গিয়েছিল যে স্বপ্ন, তা মা নিজে খরচ করে পূরণ করে দিয়েছিল। এককথায় একজন মা যেমন মেয়ের সুখের জন্য সব উজার করে দিতে পারে, আমার নতুন মাও তেমন সব দিচ্ছিল।
    এভাবে মায়ের আদরে বেশ কাটছিল। তারপর এসেছিল সেই কাঙ্খিত মুহুর্ত। মা কালীর পুজোর রাতে। মায়ের পায়ের কাছে ঢোলক রেখে তাতে ফুলের মালা পরিয়ে আরও সব নানা উপাচারে সাজিয়ে দেওয়া হল। সারারাত ধুমধাম করে পুজো হল। তারপর আমার সিঁথি রাঙিয়ে দিয়ে কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছিল ঢোলক। সেই রাতে অনেক দামি দামি উপহার পেয়েছিলাম। সঙ্গে অনেক টাকাও। তবু আমার চোখে জল এসেছিল। জানি না। আনন্দে নাকি কষ্টে। কিছুতেই জলের ধারা বাগ মানছিল না। মা পিছনেই দাঁড়িয়েছিল। কি বুঝেছিল কি জানি। আমাকে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, আজ থেকে আর চোখে জল নয়, সব কষ্ট দুই হাতের তালি দিয়ে বোঝাবি, বুঝলি। আর কাল, মা কালীর বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গে তোকেও একটা জিনিস বিসর্জন দিতে হবে। যেটা তুই এতদিন ঘৃণা করে এসেছিস, যেটাতে চোখ পড়লেই তোর গা ঘিনঘিন করে উঠতো, সেটা। তোর শরীরের সব থেকে ঘৃণ্য অঙ্গ পুরুষাঙ্গটা। লিঙ্গ বিসর্জন দিয়ে তুই হিজড়া জীবন সাধনায় ব্রতী হবি। একজন সন্ন্যাসী যেমন সন্ন্যাস গ্রহণের মুহুর্তে নিজ পুরোনো জীবনের সবকিছু ত্যাগ করে, এমনকি নিজ হস্তে নিজ শ্রাদ্ধাদিও সম্পন্ন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন, তুইও তেমন জৈবিক লিঙ্গ ত্যাগ করে নতুন জীবনে পা রাখবি। তবেই তো তুইও সন্ন্যাসীর মতো আশীর্বাদ করার ক্ষমতা লাভ করবি। কি রে পারবি তো?
    মায়ের কথার মধ্যে কী যাদু ছিল কে জানে, আমি হ্যাঁ ব’লে মাথা হেলিয়েছিলাম।

    ৩২
    হারিয়ে ছিলাম এক মেয়ে
    ধন্য জীবন অন্যদের পেয়ে

    কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই ফোন করেছিলেন। আশ্বাস দিয়েছিলেন আমার সন্তানকে খুঁজে পেতে সাহায্য করার। তবে প্রত্যেকেই বলেছিলেন, ছেলে একবার যখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে, তখন আর সে আগের চেহারায় নেই। এতদিনে তার নিশ্চিতভাবে নারীর শরীর হয়ে গিয়েছে। হোক, ওকে তো বাড়িতেও শাড়ি-শালোয়ারে দেখেছিলাম। তার উপর মায়ের মন। ও যে পোশাকেই থাকুক, যেমন চেহারাই হোক। মা হয়ে চিনতে পারব না, তা কি হয়। আমার মুখে এমন কথা শুনে, প্রত্যেকেই চুপ করে গিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, ওরা বলতে চেয়েছিল, আমার সন্তান তো আর ছেলে নেই। মেয়ে হয়ে গিয়েছে। হয়তো জীবিকা হিসেবে হিজড়াবৃত্তি বেছে নিয়েছে। আমি মা হয়ে তার তালি বাজানো, বাচ্চা নাচানোর জীবন মেনে নিতে পারবো কিনা।
    সত্যিই তো, ও যতদিন আমার কাছে ছিল, ততদিন ওর মেয়ে হতে চাওয়া মেনে নিতে পারি নি। বরং দিনের পর দিন চেষ্টা করেছিলাম, ও যাতে ছেলের মতোই জীবনযাপন করে। কিন্তু ও আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বুঝেছিলাম, সেই চেষ্টাটা কত ভুল ছিল। সেই ভুল বিশ্বাস নিয়েই হয়তো বাকী জীবনটা কেটে যেত। যদি না ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় যাওয়ার সুযোগ হত। ওখানে যাওয়ার পরই বুঝেছিলাম, শরীরটা শুধু খোলস মাত্র। মনটাই আসল। আমরা যা কিছু করি মনের জন্য করি। মনের মতো করে করি। বোঝার পরেই মনে হয়েছিল, ছেলেটার উপর কী জুলুমটাই না করেছি। ও চেয়েছিল, মনের মতো শরীর। আর আমরা ওকে শরীরের মতো মনটাকে গড়ে নেওয়ার জন্য জোর করে গিয়েছি। যা এক কথায় অসম্ভব ছিল।
    আমিও তো নারী। খুব মনে পড়ে, আমি তখন বছর আট দশেক হব। বাবা সেলুনে নিয়ে গিয়ে আমার চুল ছোট ছোট করে কাটিয়ে দিয়েছিল। ওইটুকুন বয়সে মাথা ভর্ত্তি চুল রাখতে চেয়ে পারিনি সেদিন কী কান্নায় না কেঁদেছিলাম। নারীমন মাথাভর্ত্তি চুল ভালোবাসে। কানে দুল, নাকে নাকছাবি, হাতে চুড়ি, গলায় হার পরতে ভালোবাসে। ঠোঁটে লিপস্টিক, নখে নেলপালিশ, চোখে কাজল দিতে ভালোবাসে। শাড়ি-শালোয়ার ভালোবাসে। সব বুঝেও বুঝি নি আমার ছেলেটা না ছেলে নয় মেয়েটা মন থেকেই এসব ভালোবাসতো। যদি ওর সেই ভালোবাসা বুঝে ওকে ওর মতো থাকতে দিতাম, বড় হতে দিতাম তাহলে ও হয়তো বাড়ি ছেড়ে চলে যেত না।
    সেই না বোঝার মাশুল এখন দিতে হচ্ছে। তবে এই মাশুল না দিলে আমি আমার মেয়েকে চিনতে পারতাম না। আর চিনেছি বলেই ওকে আর একবার, অন্তত একবার দেখতে চাই। সেই চাওয়ার জন্যই ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় বারবার আসি। ওদের সঙ্গে চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। ঘুরতে ঘুরতে যদি আমার মেয়ের দেখা পেয়ে যাই।
    তবে নিজের মেয়েকে না পেলেও ওখানে গিয়ে অনেক নতুন মেয়ে পেয়েছি। আমার মেয়ের মতো মেয়ে সব। তাদের বুকে টেনে নিই। আর সুযোগ পেলেই আমার মতো অবুঝ মায়েদের ভুল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করি।
    এই কাজ করতে গিয়ে আমার নতুন নাম হয়েছে। রূপান্তরকামীদের মা। এক মেয়েকে হারিয়ে এত মেয়ে পাওয়া, এতজনের মা হতে পেরে আমি ধন্য। শুধু এ জীবনে একটাই আক্ষেপ হয়তো থেকে যাবে, আমার মেয়ে আমার আগের রূপ দেখে গিয়েছে। আমার এই নতুন রূপটা দেখে গেল না।

    ৩৩
    মা হতে চায় মায়ের মন
    যোনি তো নেই প্রয়োজন

    শরীর থেকে লিঙ্গত্যাগ করাকে যদি জীবনের সবথেকে বড় ত্যাগ না বলে, তবে আর কাকে ত্যাগ বলব? একজন সন্ন্যাসী গৃহত্যাগ করে যে সম্মান সমাজের কাছে পান, আমরা কেন আমাদের ত্যাগের বিনিময়ে তা পায় না? সন্ন্যাসীর যেমন সাধনা আছে, আমাদেরও আছে। তবু আমাদের জন্য এ সমাজের বরাদ্দ কেবল ঘৃণার গরল। আমাদের লিঙ্গ বিসর্জন দেওয়াকে সাধনা ব’লেই মানতে চায় না। একজন মানুষ কেন লিঙ্গ বিসর্জন দেয়, তা শুধু যে এই বিসর্জন দিয়েছে, সেই বোঝে। বাকীরা যা বোঝে তা নিছকই অনুমান। আর অনুমান থেকে জন্ম নেওয়া বিশ্বাস বেশিরভাগ সময়ই ভুল হয়। ভয়ংকর হয়। ক্ষতিকর হয়। সেই ক্ষতি আমরা জীবনের পর জীবন দিয়ে পূরণ করে আসছি।
    যাইহোক, লিঙ্গহীন মানুষ হওয়ার পর জীবন সম্পর্কে ধারনা অদ্ভুতভাবে বদলে যেতে শুরু করেছিল। লিঙ্গ বিসর্জন দেওয়ার আগে সবাইকেই সন্দেহের চোখে দেখতাম। পরকে সহজে আপন করতে পারতাম না। শুধু মনে হত, এই বুঝি আমাকে দেখে হাসছে। আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। কিন্তু লিঙ্গহীন হওয়ার পর বিশ্বাসটাই বদলে গিয়েছিল। আপনপর, ভয়ডর, সন্দেহ সব একেবারে উবে গিয়েছিল। বিপদহীন, সমস্যাহীন এক আনন্দময় জীবনের সন্ধান পেয়েছিলাম। বেশ কাটছিল। খুব তাড়াতাড়ি মায়ের প্রিয় মেয়ে হয়ে উঠেছিলাম। তারপর মা আমার বিয়ে দিল। বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি গেলাম। সেও এক নতুন অভিজ্ঞতা হল। সমাজের বাইরে আমাদের যে সমাজ সেখানে এমন এক পাতানো সংসার সংসার খেলা খেলতে খেলতে, নিজেকে সত্যিই কারোর মেয়ে, কারোর স্ত্রী মনে হত।
    এরপর হঠাৎ একদিন আমিও মা হয়ে গেলাম। রেল স্টেশনে বসে ভিক্ষে করা একটি বছর আটেকের মেয়েকে নিজের মেয়ে করেছিলাম। ওর গর্ভধারিনীও স্টেশনে বসে ভিক্ষে করত। আর ভিক্ষে কম পেলেই মেয়েকে ধরে ধরে মারতো। বাধাই সেরে বাড়ি ফেরার পথে প্রায়ই মেয়েটাকে দশ বিশ টাকা দিয়ে আসতাম। মেয়েটাও আমার ন্যাওটা হয়ে গিয়েছিল। আমি ওকে একথা সেকথা জিজ্ঞেস করতাম। সেই সুযোগে একদিন ও বলে ওঠে, জানো মাসি আমার ভিক্ষে করতে ভাল্লাগে না। আমার বই পড়তে ইচ্ছে করে। তুমি পড়াবে আমাকে? শুনে তখনই রাজী হয়ে গিয়েছিলাম। তবে ওকে বলেছিলাম, পড়াতে পারি একটা শর্তে। আর তা হল আজ থেকে মাসি নয়, আমাকে ‘মা’ বলে ডাকতে হবে। কি রে পারবি তো? মেয়েটি দু’দিকে মাথা দুলিয়ে মা মা করে চেঁচিয়ে উঠে আমাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল। ওর মা হকচকিয়ে তেড়ে এসেছিল। তবে আমি যখন বলেছিলাম, ওকে স্কুলে ভর্ত্তি করাব, অনেকদূর লেখাপড়া শেখাব… তখন শান্ত হয়ে গিয়েছিল। রাজীও হয়েছিল। কিন্তু তার বিনিময়ে ও সারাদিনে ভিক্ষে করে যতটা উপার্জন করতো তত টাকা আমাকে দিতে হবে সেকথা বলে নিয়েছিল। মা হওয়ার আনন্দে আমি তাতেও রাজী হয়ে গিয়েছিলাম।

    ৩৪
    মায়ের সঙ্গে মায়ের দেখা
    আয়নামহল সাক্ষী একা

    মা চাইলে হয়/ না চাইলে নয়। নইলে দুই মায়ের দেখা হওয়ার তো কোন জো ছিল না। পৃথিবী যতই গোল হোক, দুই মায়ের পৃথিবী ভিন্ন ভিন্ন ছিল। তবু দেখা হয়ে গেল। একেবারে হঠাৎ করেই। কিংবা পৃথিবীর নিয়ম মেনেই।
    কেউ কেউ একে যোগও বলতে পারেন।
    শারদ উৎসব উপলক্ষ্যে একটি টিভি চ্যানেল মায়েদের নিয়ে এক রিয়ালিটি শো-র আয়োজন করবে বলে ঘোষণা করেছিল। তবে কোন্‌ মায়েরা, কেমন মায়েরা অংশ নিতে পারবেন কিছুই জানানো হয় নি। বিজ্ঞাপনে কেবল ট্যাগলাইন হিসাবে দেখানো হচ্ছিল-
    জন্ম দিলেই নয়
    জীবন দিলে হয়
    কেউ মা।
    বিজ্ঞাপন শেষে এও ঘোষণা ছিল অংশ নিতে হলে যোগাযোগ করুন- ৮৬×××××৬৭৩ নাম্বারে। আর শর্ত হিসাবে বলা হয়েছিল মা হয়ে ওঠার কাহিনি যা শোনাবেন তা আপনার অজান্তে যাচাই করা হবে। পুরস্কার স্বরূপ কুড়ি লক্ষ টাকা দেওয়ার কথাও ঘোষণা হয়েছিল, তবে সে টাকা মা নয়, পাবে তার গর্বের সন্তান।
    বিজ্ঞাপন দেখে অনেক মায়েরা যোগাযোগ করেছিল। প্রাথমিক বাছাই পর্বের শেষে শুরু হয়েছিল সেই কাঙ্খিত রিয়ালিটি শো। অংশগ্রহণকারী সব মায়েদের আলাদা আলাদা ঘরে রাখা হয়েছিল। এমনকি মায়েদের সন্তান বা অন্য নিকট আত্মীয়দেরও অন্য ঘরে রেখে মায়েদের কথার যাচাই করার ব্যবস্থাও হয়েছিল। আর সব ঘরের চারদিকের দেওয়াল জুড়ে ছিল বড় বড় আরশি। ঘরের ভিতর একবার ঢূকলেই মনে হবে এ যেন আরশিনগর। যেদিকেই তাকানো হোক না কেন শুধু নিজেকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। প্রতিমুহুর্তে শুধু নিজেকে দেখা। তাও একা একা। এভাবে দেখা হলেই মানুষ আরশির ওপারে থাকা নিজেকে নিজের সব কথা বলতে পারে। সহজে নিজেই নিজের মুখোমুখি হতে পারে।
    সেকথা মাথায় রেখেই আয়োজকরা বোধহয় এমন ব্যবস্থা করেছিল। এবং তাদের ব্যবস্থা যে প্রত্যাশার থেকেও বেশি পরিমানে সফল হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
    আয়নামহলে থাকতে থাকতে কিছুক্ষণের মধ্যেই অতীতযাপন করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। নিজেকেই নিজে শুনিয়েছিলাম একা একা নিজের মা হয়ে ওঠার কথা।
    শেষে জেনেছিলাম রিয়ালিটি শোয়ের এটাই নাকি নিয়ম ছিল। এ শর্তও নাকি ছিল যে মা হয়ে ওঠার গল্পের শেষটুকু শোনাতে হবে সন্তানের সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রম হয়েছিল। কারণ অংশগ্রহণকারী হিসাবে আমি ছিলাম মা। আবার পাশের ঘরেই ছিল আমার মা।
    আয়োজকরা আমাদের দুই মাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন কাহিনির শেষটুকু।
    মায়ের সামনে মা হয়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছিলাম না কি বলব। মায়ের অবস্থাও তেমনি। মা তো ভাবতেই পারে নি, আমি মাকে ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে মা হতে পারি। মা হয়তো ভেবেছিল, মায়ের ঘেন্না দেখে ঘর ছেড়েছিলাম আমি। তাই মায়ের প্রতি বিতৃষ্ণা আমার সবথেকে বেশি হবে। তারপরেও আমি মা হয়েছি। হতে চেয়েছি। আর তা দেখার পর, জানার পর মা বাকরুদ্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক।
    তাছাড়া এভাবে যে দেখা হবে, হতে পারে কেউই তো ভাবিনি। এর আগে কতবার ভেবেছি মাকে একবার দেখে আসি। দেখার জন্য এসেওছি ছুটে। কিন্তু দেখা করতে পারিনি। ভয়ে। মা যদি তাড়িয়ে দেয়…! ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নেয়…!
    কিন্তু এ আমার কোন্‌ মা কে দেখছি! মা আমাকে হারিয়ে আমার মতো সন্তানদের মা হয়েছে! তার মানে মা আমাকে আর ঘেন্না করে না!
    অবশ্য আমিও মা হওয়ার পর বুঝেছিলাম, মা আমাকে ঘেন্না করতো না। মা শুধু ভয় পেত। এই বুঝি আমার কোন ক্ষতি হয়ে যাবে। সন্তানের কিছু ক্ষতি হওয়ার ভয় মা’কে আজীবন তাড়া করে বেড়ায়। সেই ভয়েই তো মা প্রতিক্ষণে সন্তানকে বুক দিয়ে আগলে রাখে।

    মা তখনো ঠায় দাঁড়িয়েছিল। নিজে মা না হলে ভাবতাম, মা বুঝি আমাকে দেখে খুশি হয় নি। তাই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে নি। কিন্তু এখন তো আমি মা। তাই দূরে দাঁড়িয়েও বুঝতে পারছিলাম, মায়ের বুক ফেটে যাচ্ছিল। তবু মা আমাকে এসে জড়িয়ে ধরছিল না তার কারণ মা ভাবছিল, আমি যদি এখন মাকে ঘৃণা ভরে সরিয়ে দিই। অপমানের তিরে বিদ্ধ করি…। মা তাই নীরবে আঁচলের আড়ালে চোখের জল লুকোচ্ছিল।
    সেই চোখের জল বাঁধ ভাঙল আমি ছুটে এসে মায়ের বুকে আছড়ে পড়তেই…।
    ওদিকে টিভি চ্যানেলের পক্ষ থেকে আনানো বাউলশিল্পী প্যারোডি করে গাইতে শুরু করেছে, মায়ের সঙ্গে মায়ের দেখা, আমরা ভেবে করব কি…মায়ের সঙ্গে মায়ের দেখা…। আয়নামহল সাক্ষী একা… আমরা ভেবে করব কি… মায়ের সঙ্গে মায়ের দেখা…।

    =সমাপ্ত=

  • ধারাবাহিক

    আয়নামহল (পর্ব-৫)

    আয়নামহল (পর্ব-৫)
    -সঞ্জয় গায়েন

     

     

    ২১
    মাসির বাড়ি মুক্তির আলো
    কয়েকমাস ছিলাম ভালো

    একবার করে সকলেরই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করা উচিৎ। মরতে মরতে বেঁচে ফেরার কি যে আনন্দ তা অন্যদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। বোঝানোও সম্ভব নয়। আমি ফিরেছিলাম বলেই আমি বুঝি। বেঁচে থাকার আনন্দ যে কতখানি তা একমাত্র অনুভব করা যায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে মরতে মরতে বেঁচে ফিরে আসার পর। আমি সেই আনন্দ পেয়েছিলাম। জীবনে এত আনন্দ আর কখনো পাই নি। কয়েকমাস কেমন এক ঘোরের মধ্যে কেটেছিল। শুধু মনে হত, আমি সত্যি সত্যি বেঁচে আছি এখনো। নিজের গায়ে নিজেই হাত বুলোতে বুলোতে ভাবতাম, এই তো আমার হাত, পা, গলা বুক সব আগের মতোই আছে। বুলোতে বুলোতে কি যে হতো আমার ছুটে যেতাম আয়নার কাছে। নিজেকে দেখতাম প্রাণ ভরে। কী ভালোই না লাগতো। সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে ফেলতাম আমি। কেন আমি নিজেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম? ছি ছি! কী ভুলটাই না করেছিলাম। প্রায়দিনই আমি এমন ভাবতাম। আর ঠিক তখনই আমার মাসি এসে আমাকে পিছন থেকে জাপটে ধরতো। কি রে কি এত দেখছিস নিজেকে? বলতে বলতে এক হেঁচকায় আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলত, নিজের প্রেমে পড়েছিস তো এবার। ঠিক করেছিস। এতদিনে এই প্রথম ভালোবাসতে শিখলি। এই সংসারে নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে নেই। বুঝলি। এই আমাকে দেখ। আমি তো বিয়ে থা করি নি। করবোও না কোনদিন। কেন বলতো? কারণ আমি নিজেকে ভালোবাসি। আর যাকে ভালোবাসি তাকে নিয়েই তো জীবন কাটানো উচিৎ। তাই নয় কি?
    মাসির কথাগুলো কেমন অদ্ভুত শোনাতো। নিজেকে ভালোবাসি। নিজেকে নিয়েই থাকবো। এ কেমন কথা। এভাবে একা একা থাকা যায়? তাও সমস্ত জীবন! কিন্তু মাসিকে দেখে মনে হয়েছিল থাকা যায়।
    মাসির বাড়ি থাকতে থাকতে কিছুদিনের মধ্যেই আমার শারীরিক দুর্বলতা যেটুকু ছিল তা কেটে গিয়েছিল। তবু ঘরের মধ্যেই থাকতাম। বাইরে তেমন একটা বের হতাম না। মাসিও অফিস চলে যেত। তখন আমি একা। একা একাই থাকতাম। বই পড়তাম। গান শুনতাম। ঘুমোতাম।
    মাসিটাও যেন কেমন ছিল। আলমারী ভর্ত্তি কত শাড়ী, ব্লাউজ, শালোয়ার কামিজ। কিন্তু সেসব কোনদিন পড়তো না। মাসির একটাই ড্রেস। জিনস আর টি শার্ট। নেলপালিশ, লিপস্টিক, পারফিউম, জুয়েলারীও ছিল। সেসবেও হাত দিত না। মাথা ভর্ত্তি চুলও রাখতো না। ছেলেদের মতো ছোট ছোট করে কেটে আসতো। একদিন জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, আমার মেয়ে হতে ভাল্লাগে না। বলেই কেমন এক রহস্যের হাসি হেসে বলেছিল, তুই তো মেয়ে। যা আজ থেকে এগুলো সব তোর।
    আমি তারপর থেকে মাসির সেইসব শাড়ী একটা একটা বের করে নিজেকে সাজাতাম। আর নিজে নিজেই দেখতাম। এমনি করতে করতে নিজেকে একটু একটু ফিরে পাচ্ছিলাম। তারই মধ্যে হঠাৎ একদিন। গভীর রাত। আচমকা আমার ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল। মাসির বাড়ি এসে মাঝে মাঝেই এমন হত। সেদিনও তেমন ঘুম ভেঙে যেতে, কী জানি কেন ঘর থেকে বেরিয়ে ছাতে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল। যাওয়ার পথে কেমন যেন গোঙানির আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। আওয়াজটা মাসির ঘর থেকে আসছিল। কান পেতে শোনার চেষ্টা করতেই বুঝেছিলাম কিসের আওয়াজ। যৌনসুখ পাওয়ার শিৎকার। কিন্তু মাসির ঘরে তো কোন পুরুষ নেই! সেদিন মাসির এক বান্ধবী এসেছিল। তাকেও মাসি বলেই ডেকেছিলাম। দুই মাসিই সেদিন ঘরে ছিল। তাহলে ওই সুখ কিভাবে পাচ্ছিল। কৌতুহল দমন করতে না পেরে পা টিপে টিপে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আসতে আসতে পর্দার আড়াল সরাতেই চোখে পড়েছিল, ঘরময় মৃদু আলো। সেই আলোয় দেখেছিলাম মাসিরা সম্পূর্ন নগ্ন হয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় দেহসুখ নিচ্ছিল। মাসির কোমরে ঝুলছিল আস্ত পুরুষাঙ্গের মতো একটি দন্ড। আর সেই দন্ড দিয়েই মাসি তার বান্ধবীকে দেহসুখে ভরিয়ে দিচ্ছিল। নিজেও নিচ্ছিল। দেখতে দেখতে কেমন যেন বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম। বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে। খেয়ালই ছিল না, মাসিরা কখন বেরিয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়েছিল। খেয়াল হয়েছিল, যখন জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে মাসি বলে উঠেছিল, এভাবে দেখতে নেই সোনা। যাও নিজের ঘর যাও।
    সেই রাতে বুঝেছিলাম, মাসিও আমার মতো উলটো। শরীরে নারী মনে মনে পুরুষ। আর তাই চাকরীর অছিলায় বাইরে চলে এসেছিল। সবার সংসর্গ ত্যাগ করে। সেটা জানার পর আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলাম। বুঝেছিলাম, এইজন্যই মাসি আমার মন বোঝে।
    কিন্তু সেই আনন্দ আমার কপালে সইল না। আমার অমন মাসি যে আমাকে মরার হাত থেকে বাঁচিয়ে নতুন জীবনের সন্ধান দিয়েছিল; বলেছিল, শুধু নিজেকে ভালোবাসবি; সেই মাসি কিনা গায়ে আগুন লাগিয়ে পুড়ে মরল! কেন? কেন! কেন! মাসিও তো নিজেকেই ভালোবাসতো। সেই ভালোবাসার এমন পরিণতি ভাবতেই পারি নি।
    মাসি যেন আমার জীবনে কর্পূরের মতো এসেছিল। প্রথমে সুগন্ধে ভরিয়ে দিল। তারপর আগুনের পরশমনির ছোঁয়া দিতে নিজেকে পুড়িয়ে উবে গেল। কিন্তু কর্পূর নিজে পুড়লেও অন্যকে যেমন তার আঁচও লাগতে দেয় না, মাসিও তেমনি ছিল। পুড়ে মরার জন্য কাউকে দায়ী করে যায় নি। সুইসাইড নোটে লিখেছিল, হঠাৎ করেই বাঁচার ইচ্ছে চলে গেল। কেন তা বলতে পারব না। এরপর জোর করে বাঁচতে চাইলে সে বাঁচা হত যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচা। যা আমি কক্ষনো চাই নি। তার চেয়ে এই বরং ভালো। যে ক’দিন বেঁচেছি নিজের মতো করে বেঁচেছি। মৃত্যুটাও তেমন হলে বৃত্ত পূর্ণ হবে। তাই স্বেচ্ছামৃত্যুই শ্রেয়। জীবনের দৈর্ঘ্যটা হয়তো ছোট হল। কিন্তু যেটুকু জীবন পেয়েছিলাম আনন্দেই কাটিয়ে গেলাম।
    মাসির মৃত্যুর পর মাসির সেই বান্ধবীর খোঁজ পেয়েছিলাম। মাসির অফিসেই কাজ করতো। একবার ভেবেছিলাম, সবাইকে সেই রাতের কথা বলে দিই। কিন্তু বলিনি। কারণ বললেই মাসির যৌন পরিচয় সবাই জেনে যেত। তখন মাসির প্রতি দেখানো সহানুভুতির সব রস মরে গিয়ে যা পড়ে থাকত তার নাম ঘৃণা। আর আমি তা কিছুতেই চাই নি। তাই মুখ বুজে সব সয়েছিলাম। শুধু একবার সেই বান্ধবীকে দেখতে চেয়েছিলাম। আমাকে দেখে ওনার চোখ দু’টো ভিজে উঠতো কিনা দেখার জন্য। সে আশাও পূরণ হয় নি।

    ২২
    মাসির মৃত্যু আমার দোষ
    সবার গলাতে আফশোষ

    মাসি আমাকে দোষী করে নি। তবু খবর পেয়ে ছুটে এসে সবাই যেন আমাকেই দোষীর চোখে দেখছিল। গলায় আফশোষ আর চোখে সন্দেহের তির দিয়ে আমাকেই বিদ্ধ করেছিল। মাসিকে দগ্ধ করতে যেটুকু আগুন দেখেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি আগুন আমাদের আত্মীয় স্বজনদের চোখে জ্বলে উঠেছিল।
    এমনই পোড়া কপাল আমার সেই আগুনে ফুঁ দিয়েছিল পুলিশও। নেভাতে নয়, আরও দাউ দাউ করে জ্বালিয়ে দিতে। মাসির মৃত্যুর জন্য নাকি আমিই দায়ী ছিলাম। আমি রূপান্তরকামী নারী হয়ে স্বাধীনচেতা মাসির সঙ্গে একা একা থাকতাম। আর আমাদের মতো মানুষ নাকি সম্পর্কের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে শিখি নি। সমাজের বেড়াজাল মানতে শিখিনি। এককথায় আমাদের দু’জনের মধ্যে কোন আগল ছিল না। তাই আমার জন্যই মাসির মৃত্যু হয়েছিল তা বুঝে নিতে পুলিশের নাকি দু’মিনিট সময় লেগেছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখারও প্রয়োজন পড়ে নি।
    পুলিশ এসেছিল। এসেই যখন শুনেছিল আমি মাসির সঙ্গে একা থাকতাম, তখনই বাঁকা হাসি হেসেছিল। কোন ফরম্যালিটির ধার না ধেরেই আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। আমার বাড়ির লোক ন্যূনতম প্রতিবাদটুকুও করে নি। করবে কেন? তারাও তো পুলিশের মতে সায় দিয়েছিল এবং আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় তারা যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিল।
    আমিও আমার স্বপক্ষে কিছু বলি নি। কি হত বলে! বিশ্বাস যখন ধারণা থেকে জন্ম নেয়, তখন ধারালো যুক্তিও তা খন্ডন করতে পারে না। মনে মনে ভেবেছিলাম, এ বরং ভালোই হল। মাসি চলে যাওয়ার পর সেই তো নাহলে আবার বাড়ি গিয়ে থাকতে হত। আবার নিজের বাবার হাতে…। তার চেয়ে বাকী জীবন জেলে কাটিয়ে দেব। তাই চুপচাপ সবার সামনে দিয়ে পুলিশের জিপে গিয়ে বসেছিলাম।
    তবে, পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু লকআপে ঢোকায় নি। কি করে ঢোকাবে? লকআপে তো দু’টো সেল। পুরুষের আর নারীর। আমাদের জন্য কোন সেলই নেই। তার জন্য অবশ্য পুলিশের কোন অসুবিধে হয় নি। লকআপে ঢোকাতে না পারলেও সারারাত দু’ তিনজন মিলে নিজেদের পুরুষ হিসাবে জাহির করতে যে রডের কথা বলে, তা ঢুকিয়েছিল। আমার পায়ুছিদ্রে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠেছিলাম। ছটফট করেছিলাম সারারাত। শেষে ভোররাতে আর সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদ করেছিলাম। কেঁদে কেটে বলেছিলাম, আমি তো কোন অন্যায় করি নি। তবু আমাকে মারছেন কেন? আপনারা কেন ভাবছেন মাসির সঙ্গে আমার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। আমার কাছে আমার মাসি ছিল জীবন্ত দেবীর মতো। দেবীর চরণ ছোঁয়া যায়। অন্য কিছু স্পর্শ করার কথা মনে আনাও পাপ। কিন্তু আমার সেই কাকুতি-মিনতিতে কেউ কর্ণপাত করে নি। শেষে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলাম, আমার উপর এমন টরচার করছেন তো, কাল যখন আমাকে কোর্টে তুলবেন আমি মিডিয়া ডেকে সব বলবো। একজন রূপান্তরকামী নারীকে ধরে এনে লকআপে না রেখে সারারাত তার ধর্ষণ করেছেন।
    ব্যাস। আর যাই কোথা। লকআপ থেকে কয়েকজন গুন্ডা মতো দেখতে লোককে বের করে এনে আবার আমার উপর শারীরিক অত্যাচার করিয়েছিল। আমি ব্যথায় উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। পায়ু থেকে গল গল করে রক্ত বের হচ্ছিল। গড়িয়ে যাচ্ছিল মেঝেতে। আর সেই রক্ত দেখতে দেখতে পুলিশের এক অফিসার বলেছিল, এ দেশে কেবল নারীর শ্লীলতাহানি হয়, ধর্ষণ হয়। তোরা যতই নারী সেজে নিজেদের নারীী- নারী বলে চিৎকার করিস, আসলে লোকে তোদের হিজড়েই ভাবে। এমন হিজড়ে সেজেই থাক। কিচ্ছু বলব না। লোক জানে তোদের যৌনাঙ্গ বলে কিছু নেই। তাই ওসব শ্লীলতাহানি, ধর্ষনের কথা মুখেও আনিস না। বুঝেছিস। এরপরও যদি মিডিয়ার হুমকি দিস, তাহলে সবার সামনে ন্যাংটো করে দেখিয়ে দেব তোর আস্ত পুরুষাঙ্গটা। হিজড়ে না হয়েও হিজড়ে সেজে টাকা তুলিস ব’লে কেস দিয়ে যাবজ্জীবনের জন্য ঢুকিয়ে দেব।
    ওসব শুনে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। লোকমুখে শোনা প্রবাদ বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে একশো আট ভয়ংকরভাবে সত্যি মনে হয়েছিল সেদিন।
    তারপর ভোরের আলো ফুটতেই পুলিশের কি মনে হয়েছিল কি জানি। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল থানা থেকে।

    ২৩
    ছেলের জন্য মুখ কালো
    হারিয়ে গেলে হয় ভালো

    ছিঃ ছিঃ ছিঃ! কী লজ্জা! কী লজ্জা! শেষে কিনা নিজের মাসির সঙ্গে… ভাবতেই পারিনি সেদিন। বোনটাকেও বলিহারি। স্বাধীনভাবে জীবন কাটাবো। কক্ষনো বিয়ে করব না। কত বড় বড় বুলি। ছেলেটা আমার বিষ খেয়ে মরতে বসেছিল। দেখতে এসে ভালোমানুষী দেখিয়ে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেই শুনে অনেকেই তখন বলেছিল, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি ভালো লক্ষণ নয়। সেদিন কারও কথা বিশ্বাস করি নি। কিন্তু সেটাই সত্যি হল। মায়ের পেটের বোন শেষে এইসব করার জন্য নিজের বোনপোকে নিয়ে গিয়েছিল…। একথা শোনাও পাপ। আর আমার ছেলেটা। ছোট থেকেই নিজেকে নাকি মেয়ে ভাবতো। তাই যদি হত তাহলে মাসিও তো মেয়ে। তাহলে তার সঙ্গে কি করে অমন করতে পেরেছিল…?
    বোনটার নিশ্চয় গর্ভে বাচ্চাকাচ্চা এসে গিয়েছিল। তাই আগুনে পুড়ে মরে লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু কথায় ব’লে সাগর কখনো শুকোয় না আর পাপ কখনো লুকোয় না। মরার পরে পুলিশ ঠিক ধরতে পেরেছিল। আর ধরতে পেরেই আমার ছেলেটাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গিয়েছিল। ভালোই হয়েছিল। অমন ছেলে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। ওর জন্য জেলই উপযুক্ত জায়গা ছিল।
    কিন্তু পরদিন বডি আনতে যেতে বলেছিল, আমার ছেলেকে নাকি ওরা ছেড়ে দিয়েছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও বোনের প্রেগনেন্সির কথা লেখে নি। না লিখলেও সন্দেহের দাগ একবার লাগলে তা সহজে ওঠে না। আর এ তো চরিত্রে দাগ লাগা। সারাজীবন দগদগে হয়ে থাকবে।
    ছেলেটা নিজে থেকে হারিয়ে গিয়ে একদিক থেকে ভালোই করেছিল। লোকলজ্জার মাথা খেয়ে আবার যদি বাড়ী ফিরে আসতো ওর বাবা ওকে তাড়িয়েই দিত। আমি মা হয়েও আটকাতে পারতাম না। তার চেয়ে ছেলে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়ে বাপ-মা’কে ছেলেকে তাড়িয়ে দেওয়ার মতো পাপ কাজ করা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
    তবে ছেলে তার কর্তব্য করেছিল। কিন্তু আমরা আমাদের কর্তব্য করি নি। একটুও খোঁজার চেষ্টা করি নি ছেলেটাকে। ওর বাপ না হয় পুরুষ মানুষ। মায়া-দয়া ছিল না। কিন্তু মা হয়ে সেদিন আমিও তো পাষাণ হয়ে ছিলাম। আমিও তো পারতাম এদিক ওদিক খোঁজ করতে। থানায় গিয়ে নিদেন একটা ডায়েরীও তো করা যেত। ওর প্রতি আমাদের রাগ-ঘৃণা এত জমেছিল যে সেদিন কিচ্ছুটি করি নি।
    লুকিয়ে লুকিয়ে আঁচলে মুখ ঢেকে ওর জন্য কেঁদেছিলাম। তাও প্রায় মাস ছয়েক পরে।

    ২৪
    জীবন পথে আবার বাঁক
    লগনে যাওয়ার এল ডাক

    থানা থেকে বের করে দেওয়ার পর সোজা স্টেশনে এসেছিলাম। কোনরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এসেই স্টেশনের বেঞ্চে শুয়ে পড়েছিলাম। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল ছিল না। যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখি একটি চলন্ত ট্রেনে শুয়ে আছি। সারা গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। জিভ শুকিয়ে আঁঠা আঁঠা হয়ে আছে। কোনরকমে অস্ফুট স্বরে বলতে পেরেছিলাম, জল। জল। তারপরেই আবার চেতনা হারিয়ে ছিলাম। তবে পুরো চেতনা হারায় নি মনে হয়। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়ে গিয়েছিলাম। আর সেই ঘোরের মধ্যেই শুনতে পাচ্ছিলাম, কারা যেন বলাবলি করছিল, তুই ঠিক চিনেছিস তো? এ আমাদের মতো? সেই শুনে অন্য একজন বলেছিল, ওরে আমরা হলুম সাপুড়ের জাত। সাপ চিনতে পারব না তা কি হয়! বিশ্বাস না হয়, ওর জ্ঞান ফিরলে জিজ্ঞেস করিস ওকে।
    পরদিন। ট্রেন থেকে নেমে জেনেছিলাম, ওরা চারজন আমাকে স্টেশনে শুয়ে গোঁ গোঁ করতে শুনে ছুটে গিয়েছিল। আমাকে দেখেই ওরা বুঝেছিল, আমিও ওদের মতো। রূপান্তরকামী নারী। তাই সাত পাঁচ না ভেবে ওরা আমাকে সঙ্গে নিয়েই ট্রেনে উঠেছিল। ঠিক করেছিল না ভুল করেছিল জানি না। তবে আবার আমি মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলাম। দু’দুবার বেঁচে ফেরা। ভগবান কি আমার কপালে মৃত্যু লেখে নি? শুধু কষ্ট পাওয়া লিখেছিল? যদি তাই হয়, সে লিখন মানবো না। এবার নিজেই লিখব নিজের ভাগ্য।
    ওরা চারজন লগনে নাচতে যাচ্ছিল। সেই মোতাবেক নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমেওছিল। শুধু দাঁড়িয়েছিল, আমাকে নিয়ে কি করবে সেটা ঠিক করার জন্য। আমাকে পাশে বেঞ্চে বসিয়ে ওরা সেই নিয়েই আলোচনা করছিল। আমি ভেবে নিলাম, এই সুযোগ। হাত ছাড়া করার মানেই হয় না। উঠে এসে বলেছিলাম, আমাকে তোমাদের সঙ্গে নিলে খুব অসুবিধে হবে? আমি তেমন নাচতে জানি না। তবে তোমরা শিখিয়ে নিলে আমি পারব। তোমরা দেখো, আমি ঠিক পারবো। আমার কথা শুনে ওরা খিলখিল করে হেসে উঠেছিল। হাসতে হাসতেই বলেছিল, না পারার কি আছে? এ তো খুব সোজা। সবাই পারে। তবে অমন মেয়েলি পুরুষ সাজে হবে না। পুরোপুরি মেয়ে সাজতে হবে। পারবে তো?
    আমি উত্তর দেওয়ার আগেই, ওদের মধ্যে একজন বলে উঠেছিল, খুব পারবে। সেই শুনে অন্য একজন বলল, তুই কি করে বুঝলি? তার উত্তর দিল অন্য আর একজন, ওর বুক দু’টো দেখে। হি হি হি। বলেই সবাই মিলে একে অপরকে ঠেলা দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়েছিল। আমিও সেই হাসিতে যোগ দিয়েছিলাম।

    ২৫
    লন্ড্রা নাচে মাসেক ছয়
    তারপরেতে ফেরা হয়

    হাফলেডিস, ছক্কা, হোমো এসব শুনতে অভ্যস্ত ছিলাম। বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে যাদের সহযাত্রী হিসাবে পেয়েছিলাম তাদের সৌজন্যে শুনলাম, আমাদের আর এক নাম লন্ড্রা। ছেলেলি শরীরে মেয়ে সাজ সেজে লগন মানে বিবাহ অনুষ্ঠানে মেয়ের বাড়ি থেকে বরের বাড়ি আর বরযাত্রীদের আগে আগে নেচে যাওয়া, তারপর বিয়েবাড়ি পৌঁছে সেখানেও প্রায় সারা রাত নাচা। নানা চটুল গানে। ক’দিনেই কিছুটা নাচতে শিখে গিয়েছিলাম। আসলে এই ধরনের নাচ নাচতে হলে প্রথম যেটা দরকার তা হল লজ্জা ত্যাগ করা এবং লজ্জা বলতে সমাজ তো কেবল শারীরিক লজ্জা বোঝে। আর আমাদের শরীরে নাকি কোন লজ্জার অঙ্গ নেই। আমাদের শরীর কেবল লোক হাসাবার জন্য। সমাজের এই বিধান শুনে শুনে আমরাও লজ্জার উর্ধে উঠে গিয়েছিলাম। আর একটা ব্যাপার খুব কাজ করে মনে মনে। মানুষ তার চেনা পরিবেশে বেশি করে লজ্জা পায়। প্রতিপদে ভাবে, এই বুঝি কেউ কিছু বলল। কিন্তু একেবারে অচেনা জায়গায় যেমন খুশি, যা খুশি করা যায়। আমিও তাই করেছিলাম। যারা আমায় নিয়ে গিয়েছিল, তাদের অনুকরণ করে করে নাচতাম। তাতেই সবাই খুশি হত। সেই খুশিতে কেউ কেউ নাচ চলাকালীন উঠে এসে জড়িয়ে ধরতো। হাত ধরে টান দিত। কিন্তু সেই টানাটানিটা যে নাচ দেখে খুশি হয়ে নয়, পুরোপুরি শরীর ছোঁয়ার অছিলায়, সেটা বুঝতে মাত্র দু’দিন সময় লেগেছিল আমার।
    তবে এবার আর রাগ হয় নি। কারণ ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম, পুরুষ মানুষ নারীর শরীর ছুঁতেই ভালোবাসে। সুযোগ পেলেই ছোঁয়। আমাকে যারা নিয়ে গিয়েছিল, তারা এ ব্যাপারে বেশ চৌখোশ ছিল। একটু লক্ষ্য রাখতেই দেখতে পেয়েছিলাম, ছুঁতে দেওয়ার ফাঁকে তারা হাত রাখতে দিচ্ছিল নিজেদের বুকে। আর তার বিনিময়ে বুকের খাঁজে গুঁজে দিচ্ছিল এক দু’শো টাকার নোট। ওদের দেখাদেখি আমিও আর বুক আগলে রাখলাম না। কথায় বলে নাচতে নেমে ঘোমটা দিতে নেই। সেই প্রবাদ মেনে আমিও যেন বুঝে গিয়েছিলাম লন্ড্রা হয়ে বুক আড়াল করতে নেই। বরং বুক উঁচু করে নাচতে পারলেই, ছুঁতে দিলেই টাকা পাওয়া যাবে।
    তবে লন্ড্রা নাচ মানেই শুধুই শরীর ছোঁয়া নয়। ক’দিন যেতেই বুঝেছিলাম বিবাহাচারের এ এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। হাজার হাজার বছরের পরম্পরা। আমাদের বহু প্রাচীন সংস্কৃতি। আর তখনই ভালোবেসে ফেলেছিলাম লন্ড্রানাচকে। সেই ভালোবাসার আরও একটা কারণ অবশ্য আমাদের মতো মানুষদের রুটি রুজির ব্যবস্থা করছে এই নাচ। বছরের পর বছর ধরে। যুগের পর যুগ ধরে। সেটাও কি কম নাকি! আমাদের কে তো কেউই কোন কাজ দিতে চায় না। সেখানে লন্ড্রা সংস্কৃতি বেঁচে আছে ব’লে কতজন খেয়েপড়ে বেঁচে আছে।
    যাইহোক, লন্ড্রা নাচের সিজন ফুরিয়ে গেল। তারপরেও কিছুদিন এখানে ওখানে নেচে বেড়িয়েছিলাম। তাতেও কিছু উপার্জন হয়েছিল। তাও শেষ হল একসময়। আমার কোন ফেরার তাড়া ছিল না। প্রয়োজনও ছিল না। আমি তো ফিরব না বলেই বেড়িয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু অন্যরা ফিরছিল দেখে আমারও ফিরতে ইচ্ছে হয়েছিল। ফিরেও এসেছিলাম।

    ২৬
    হঠাৎ আসে অচেনা ফোন
    কেঁদে উঠল মায়ের মন

    রোদ যত চড়া-ই হোক, মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাক, এক পশলা বৃষ্টি পড়লেই সব নরম। অমন প্রকৃতি যদি ওইটুকুতে নরম হয়ে যায়, আমি তো মা! ছেলের প্রতি মায়ের মন নরম না হয়ে থাকতে পারে? পারে না। তাছাড়া ছেলে কাছে থাকলে, চোখের সামনে থাকলে রাগ করে থাকা যায়। চোখের আড়াল হলেই সব রাগ গলে জল হয়ে যায়। তখন তাকে কাছে পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ওঠে মায়ের মন। আমিও আকুল হয়েছিলাম। প্রত্যেকদিন ঠাকুরকে ডাকতাম। কেঁদে কেঁদে বলতাম, হে ঠাকুর, তুমি তো সব জানো, সব বোঝ। কত অবিশ্বাস্য অঘটন ঘটিয়েছো। তেমন কিছু করতে পারো না আর একবার? তুমি কি এই অসহায় মায়ের ডাকে সাড়া দেবে না? তার রাগের মুখে ছেলেকে হারিয়ে যেতে বলাটাই বড় করে দেখবে? সবার আড়ালে দিনের পর দিন কান্নাটার কোন দাম নেই তোমার কাছে?
    আমার সেই প্রার্থনার কারণে, নাকি ছেলে নিজে থেকেই সব অভিমান ভুলে, জানি না কোনটা ঠিক, হঠাৎ এক বিকেলে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল। আমি রিসিভ করে হ্যালো.. হ্যালো.. বলেই যাচ্ছিলাম, ওপ্রান্ত থেকে কোন সাড়া নেই। কিন্তু কেটেও দেয় নি। শুনে যাচ্ছিল। কি হল কে বলছো? কথা বলছ না কেন? আমি এভাবে বলে যাচ্ছি, হঠাৎ ওপ্রান্ত থেকে যেন ফোঁপানির আওয়াজ পেলাম। আমার গলা শুনে কে কেঁদে উঠতে পারে? তাহলে কি আমার খোকাই… ও প্রান্তে তখনই ফোনটা কেটে দিয়েছিল। আমি তাড়াতাড়ি করে ওই ফোনে কল করতেই উত্তর এল সুইচ অফ।
    পরদিন। আবার ঠিক ওই একই সময়ে। ওই একই নাম্বার থেকে ফোন এসেছিল। আমি দু’চারবার হ্যালো হ্যালো বলার পর, জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন আছেন?
    শুনেই আমি থ হয়ে গিয়েছিলাম। চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। বুকটা মোচর দিয়ে উঠেছিল। অবিকল সেই গলা! যে গলা শোনার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। দিনের পর দিন। সেই গলা শুনে বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করব। কত কথা হুড়মুড় করে বলতে ইচ্ছে করছিল। কিচ্ছুটি বলতে পারি নি। আমার গলাটা কে যেন চেপে ধরেছিল। আমি শুধু ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম।
    আমার কান্না ছাপিয়ে আবার ভেসে এল সেই একই জিজ্ঞাসা, কেমন আছেন?
    আমার অভিমানী ছেলেটা যেন শুনতে চাইছিল, আমি তাকে ছেড়ে ভালো আছি কিনা। পাগল ছেলে আমার। কোন মা তার ছেলে কে হারিয়ে ভালো থাকতে পারে! আমি নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়ে বলেছিলাম, তুই কেমন আছিস বাবা?
    ব্যাস। ওইটুকু। উত্তর না দিয়েই ফোন কেটে দিয়েছিল। তারপর অনেকবার চেষ্টা করেছিলাম। আর যোগাযোগ করতে পারি নি। ও-ও আর যোগাযোগ করে নি। ওর বাবাকে বলেছিলাম, নাম্বার টা থানায় দিয়ে খোঁজখবর নিতে। শুনেই খেঁকিয়ে উঠেছিল। বলেছিল, হিজড়ে ছেলের খোঁজ করে আর লোক হাসিও না।
    লোক হয়তো সত্যিই হাসতো। কিন্তু মা কি আর হাসতে পারে? তাই সবাইকে লুকিয়ে নিজেই থানায় গিয়েছিলাম। নাম্বারটা জমা দিয়ে অনুরোধ করেছিলাম, কোন্‌ এলাকা থেকে ফোনটা এসেছিল, সেটুকু অন্তত বলে দিলে খোঁজখবর করতাম। হাজার হোক পেটের ছেলে তো! কেমন আছে একবার চোখের দেখা দেখে আসতাম।
    পুলিশ মুখ টিপে হাসি চেপে, চেষ্টা করব ব’লে দায় সেরেছিল।

     

    চলবে…. 

  • ধারাবাহিক

    আয়নামহল (পর্ব-৪)

    আয়নামহল (পর্ব-৪)
    -সঞ্জয় গায়েন

     

     

    ১৬
    কষ্ট পেলে পেটের ছেলে
    ছুটবেই মা স্বকাজ ফেলে

    ও তো বেশ ছিল। দেখে মনে হয়েছিল আনন্দেই ছিল। মায়ের মন জুড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ছেলের কি যে হল, হঠাৎ একদিন কলেজ থেকে ফিরে দরাম করে দরজা বন্ধ করে বালিশে মুখ গুঁজেছিল। সারারাত শত ডাকাডাকিতেও দরজা খোলে নি। খুব ভয় পেয়েগিয়েছিলাম। মনটা খুব কু ডেকেছিল। সেই রাতে ওর বাবাও বাড়ি ছিল না। ওর দাদা ততদিনে চাকরী নিয়ে বাইরে থাকে। সারা বাড়িতে আমি একা। একবার মনে হয়েছিল, ওর বাবাকে ফোন করি। কিন্তু করলেই তো বলতো, ভালোই হয়েছে। এবার ওষুধ টষুধ খেয়ে মরতে বলো। ল্যাটা চুকে যাক।
    বাপের আর কি! পেটে তো ধরে নি! ধরলে বুঝতো মা হওয়ার জ্বালা কি! সেই জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে এক একবার আমারও মনে হত, ও মরুক! মরে গিয়ে বরং আমাকে একটু শান্তি দিক। পরক্ষণেই নিজেকে ধিক্কার দিতাম। ছি ছি আমি না মা! মা হয়ে কখনো কেউ ছেলের মৃত্যু কামনা করে! নাকি করতে আছে! তবু মনে হত ও কি আমায় সারাজীবন একটুও শান্তি দেবে না!
    ওর মন নাকি মেয়েদের মতো! সত্যি যদি মেয়ের মন হত তাহলে মায়ের কষ্ট ঠিক বুঝতো। বোঝে নি। বুঝবে কি করে! ও তো মেয়ে নয়। মেয়ে হওয়া কি অত সোজা!
    মেয়ে হলে অনেককিছু ত্যাগ করতে হয়। মুখ বুজে মেনে নিতে হয়। সহ্য করতে হয়। মেয়েরা সবসময় আমার আমার করে না। কিন্তু ও করতো। মেয়ে নয় বলেই করতো!
    ও যদি মেয়ে হতো তাহলে মা হয়ে আমি ঠিক বুঝতে পারতাম। ওকে আমি পেটে ধরেছি। কোলে পিঠে করে বড় করেছি। লজ্জার মাথা খেয়ে ওর বুকে মেয়েদের মতো গজিয়ে ওঠা স্তন দেখেছি। ও মেয়েদের মতো ছেলে দেখলেই আকৃষ্ট হত তাও বুঝতাম। তারপরেও বলছি ও মেয়েদের মতো হতে পারে। কিন্তু মেয়ে নয়। ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট হলেই কেউ মেয়ে হয়ে যায় না। মেয়ে হতে হলে নরম হতে হয়। নিজের ইচ্ছেকে লুকিয়ে রাখতে হয়। তার চেয়ে বড়কথা মেয়েরা কক্ষনো শরীর শরীর করে অত উতলা হয় না! ও অমন করে উতলা হত কেন! ও ভাবতো শরীর দিয়েই ছেলেদের মন জেতা যায়। বোকা কোথাকার।
    আমি সব বুঝেও কিছু করতে পারি নি। ও আমার মেয়ে হলে মা হয়ে আটকাতে পারতাম। অন্তত আটকাবার চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু মা হয়ে ছেলেকে আটকানো যায় না। ছেলেরা বড় হলেই মায়ের আঁচল ছেড়ে দেয়। ও-ও ছেড়েছিল। আমিও হাঁপ ছেড়েছিলাম। কিন্তু তা আর হল কই। কলেজের বন্ধুর কাছে এমন চোট খেয়েছিল যে একবচ্ছর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে নি। আর আমি এমন হতভাগ্য মা না পেরেছি ছেলের প্রেমকে মেনে নিতে, না পেরেছি প্রেমে ব্যর্থ সেই ছেলেকে সান্ত্বনা দিতে। না না, ছেলের প্রেম করা নিয়ে আমার কোন আপত্তি ছিল না। বরং ভালো তো ছেলে নিজে নিজের জীবনসঙ্গী খুঁজে নেবে। কিন্তু আমার ছেলের প্রেম তো তেমন প্রেম নয়। এ সমাজে ছেলেই ছেলে বন্ধুত্ব হয়, প্রেম নয়। সেই বন্ধুত্বকেই প্রেম ভেবে ছেলেটা আমার দিনের পর দিন কেঁদেছে। ঘুমের ঘোরে সেই বন্ধুর নাম ধরে ডেকেছে। আমি মা হয়ে ছেলের সেই কান্না শুনেছি। কিচ্ছুটি করতে পারি নি। কি করতাম? ওর সেই বন্ধুর বাড়ি গিয়ে হাতদু’টো ধরে যদি বলতাম, বাবা একটিবার চলো, আমার ছেলেটা বড্ড কষ্ট পাচ্ছে! ওর সেই বন্ধু কি শুনতো! শুনতো না। উল্টে হয়তো হেসে বলতো, ওকে ডাক্তার দেখান। ডাক্তারই দেখিয়েছিলাম। মনের ডাক্তার। সেই ডাক্তারকে ও ওর প্রেমের কথা বলেছিল। ডাক্তারই এটা সেটা প্রশ্ন করে জেনে নিয়েছিল। কিন্তু কি হল? ডাক্তারও কি মানলো ওর প্রেমের কথা! মানে নি। সব জেনে বলেছিলেন, আপনার ছেলের জেন্ডার ডিসঅর্ডার আছে। এর বেশি কিচ্ছু বলেন নি। ডাক্তার তো পারতেন স্পষ্টভাষায় বলতে, যে এ আপনার ছেলে নয়, মেয়ে। মনের ডাক্তাররা তো কথায় কথায় বলেন, শরীর নয়, মনই শেষ কথা। আমার ছেলেটা ছোট থেকেই মনে মনে নিজেকে মেয়েই ভাবে, মেয়েই বলে। কই ডাক্তার তো এর বেলা মনের কথাকে শেষ কথা বলে আমার ছেলেটাকে মেয়ে বলে সার্টিফিকেট দিতে পারেন নি। তা না বলেছিলেন, জেন্ডার ডিসঅর্ডার আছে। ডিসঅর্ডার! ওইটুকু বললেই হল। এমনিতেই মনের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনেই তো লোক আমার ছেলেকে পাগল বলেই দেগে গিয়েছিল। তারউপর ডিসঅর্ডার শুনলে তো আর রক্ষে থাকতো না। কে বুঝতো ওসব ডিসঅর্ডারের মানে। ওই ডিসঅর্ডারটা যে নরম্যাল ব্যাপার সেটাও কেউ বোঝে না।
    আমিও বা কতটুকু বুঝেছি! বুঝিনি। তবু মা যখন হয়েছি, তখন ছেলে কষ্ট পেলে ছুটে না গিয়ে কি থাকতে পারি। ছুটে যেতাম। কোলে তুলে নিতাম। চাইতাম ছেলের কষ্টের ভাগ নিতে। কিন্তু পারি নি। কিছুই করতে পারি নি ওর জন্য।

    ১৭
    পরীক্ষা দিতে পথে পথে
    যৌনকর্ম জুটলো সাথে

    কিচ্ছুটি ভাল্লাগতো না। তবু জোর করে ঘর থেকে বের হতাম। না বের হয়ে হয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। কলেজ আগেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাই একবার ভেবেছিলাম আবার নতুন করে পড়াটা শুরু করি। পরক্ষণেই মনে হত দূর কি হবে পড়ে! কার জন্য পড়ব? এটা একটা জীবন? কোন বন্ধু নেই, আড্ডা নেই, গল্প করার লোক নেই। একা একাই যখন থাকতে হবে জীবনের বাকীদিন, তখন বই পড়ে আর কলেজের পরীক্ষা দিয়ে কোন লাভ নেই। সে পরীক্ষা তো সবাই দেয়। দিতে হয়। বরং জীবনের কয়েকটা পরীক্ষা দিয়ে দেখা যাক। এমনকিছু পরীক্ষা যা না দিলেও চলতো। জীবনে চলার পথ তাতে থামে না। কিন্তু চলার পথ বদলে যেতে পারে। বদলটা ভালো না খারাপ সে বিচার না করে যারা বদল ভালোবাসে তারা এমন পরীক্ষা দেওয়ার ঝুঁকি নেয়। আমিও নিয়েছিলাম।
    রোজ সক্কালবেলা বের হয়ে পড়তাম। বাড়ি থেকে কাছেই ছিল রেলস্টেশন। যেদিন যেদিক যেতে ইচ্ছে করত, ট্রেনে উঠে পড়তাম। যেখানে ইচ্ছে হতো নেমেও পড়তাম। তারপর সারাদিন টো টো করতাম। বাড়ি ফিরতাম গভীর রাতে।
    ওইসময় মেয়েদের মতো সাজতাম না। নরম্যাল জিনস্‌ আর টি-শার্ট কিংবা গেঞ্জি পড়ে বের হতাম। যদিও কিছুদিন হরমোন নেওয়ার ফসল আমার বুকে ফুলের মতো ফুটেছিল। কিছুটা শুকনো হলেও একেবারে ঝরে যায় নি। তবু সেই শুকনো ফুলের মধু খাওয়ার জন্য নিশ্চয় মৌমাছিরা হামলে পড়বে না।
    তাই স্তনজোড়াকে গুরুত্ব না দিয়েই বেরিয়ে পড়তাম। ভিতরে ইনার জাতীয় কিচ্ছু পড়তাম না। তার একটা উদ্দেশ্যও ছিল। আসলে আমি আমার প্রথম যে পরীক্ষাটা নিতে চাইছিলাম তা হল আমার শরীর। আমাদের এই পুরুষী শরীরে নারীর সাজ দেখলে লোকে হিজড়া মনে করে। কিন্তু শরীরসজ্জা না করলে কি বলে শুনতে চাইছিলাম।
    শুনলাম হাফলেডিস, ছক্কা, হোমো এরকম কত নাম। টোনটিটকিরি, হাসি ঠাট্টা, মুখ বাঁকানো, ঘাড় বেঁকিয়ে মুচকি হাসাও চোখে পড়ছিল। অচেনা জায়গা। অচেনা পথ। একটাও চেনা মুখ নেই কোথাও। তারাও আমার শরীরটা দেখে উপহাসই করেছে। কিন্তু কেন? কেন কারো শারীরিক চেহারা দেখে হাসতে হয়? এই হাসি তো আনন্দ পাওয়ার হাসি নয়। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গ করার হাসি। তবে শুধু হাসিতেই থেমে থাকতো না। ট্রেনের কামরায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বা ভিড় স্টেশনে হাঁটতে হাঁটতে যদি কারও গায়ে ছোঁয়া লেগে যেত, তাহলে এমন করে উঠতো, দেখে মনে হত আমি যেন একটা বিচুতির গাছ। ছোঁয়া লাগলেই চুলকানি হবে।
    প্রথম ক’দিন অস্বস্তি হয়েছিল। তারপর অভ্যাস হয়ে গেল। ব্যঙ্গ ঠাট্টা না শুনতে পাওয়ার অভ্যাস। বাঁকা হাসি না দেখতে পাওয়ার অভ্যাস। টোন-টিকিরিকে এড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার অভ্যাস। আমার ছোঁয়া লেগে বিরক্তি প্রকাশকে সামাল দিতে ফোঁস করার অভ্যাস। এরকম কতোরকম অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার পরীক্ষা যে দিচ্ছিলাম তা ভাবলে তাজ্জব হতে হয়। তবে সব অভ্যাস কী সুন্দর রপ্তও হয়ে যাচ্ছিল। সব্বার হাসি ঠাট্টা দেখতে দেখতে কেমন যেন বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল, আমরা তো হাসিরই পাত্র। আমাদের দেখে হাসাই উচিৎ। এবং সেই বিশ্বাসের শিকড় এত গভীরে চলে গিয়েছে, যে আমরাও অন্য আমাদের মতো মানুষকে দেখে হেসে উঠি।
    যাক গে। ট্রেন সফরের কথায় ফিরি। সবাই যে আমাকে দেখে হাসাহাসি করতো তা কিন্তু নয়। কেউ কেউ অন্যভাবেও দেখতো। চেয়ে থাকতো স্থির হয়ে। ঠিক যেমন জলে ছিপ ফেলে মাছুড়েরা চেয়ে থাকে। কখন টুক করে জলের তলায় মাছ ছোট্ট টোপে ঠোকর মারবে অমনি ছিপ ধরে টান। ফস্কে গেলে বেঁচে গেল। কিন্তু কাঁটায় যদি একবার বেঁধে ভালো মাছুরে ঠিক খেলিয়ে খেলিয়ে মাছটাকে উপরে তুলবেই। আমিও যেন ভিড় ট্রেনে মাছের মতো থাকতাম। মানুষের জলে ডুবে। আর সেই ভিড়ের ভিতর কেউ কেউ দৃষ্টির টোপ দিয়ে অপেক্ষা করতো। আর দৃষ্টি এমন জিনিস যাকে দেখছে সে ঠিক টের পাবেই। আমিও পেতাম। পাওয়া মাত্রই চোখে চোখ পড়তো। তখনই দৃষ্টি নামতো মুখ থেকে বুকে। আমিও টোপ না খেয়ে ছিটকে পালাতাম।
    কিন্তু একদিন কিছুতেই পালাতে পারলাম না। যতদূর মনে পড়ছে, সেদিন সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। তার আগে একপশলা ঝড়বৃষ্টি হয়েওছিল। ট্রেনটা মোটামুটি ফাঁকা। সিটে বসে আছি। ওপাশে একজনের চোখ যথারীতি চোখে। চোখ থেকে মুখে। মুখ থেকে বুকে। তবে সে দৃষ্টিতে শুধু চাওয়া ছিল না। কেড়ে খাওয়ার লোভ ছিল। হিংস্র কুকুরের মতো। গা টা ঘিনঘিনিয়ে উঠলো। সৌভাগ্যক্রমে তখনই ট্রেনটা একটা স্টেশনে থেমেছিল। মুহুর্তের মধ্যে ঠিক করেছিলাম, এই কামরা থেকে নেমে সামনে বা পিছনের কামরায় চলে যাব। কিন্তু আমি প্ল্যাটফরমে নামামাত্রই লক্ষ্য পড়ল, সেই লোভাতুর দৃষ্টিও পিছু পিছু আসছে। দৃষ্টি এড়াতে দ্রুত পা চালিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম স্টেশনের টয়লেটে। আর সেই টয়লেটেই সেদিন ওই কেড়ে খাওয়া দৃষ্টিটা আমায় ছিঁড়ে খুঁড়ে খুবলে খুবলে খেয়েছিল। পরনের গেঞ্জিটা ফেঁড়ে দিয়েছিল। কোমরে বেল্টও হ্যাঁচকা মেরে ছিঁড়ে টেনে নামিয়েছিল জিনস্‌ প্যান্টটা। তারপর নিজের পুংদন্ডটা দিয়ে ফালাফালা করে দিয়েছিল আমার পায়ুছিদ্র। রক্তে ভিজতে ভিজতে আমি কঁকিয়ে কেঁদে উঠে মাগো ব’লে বসে পড়েছিলাম। আর তখন আমাকে অবাক করে লোকটা আমার ছেঁড়া গেঞ্জির কোঁচড়ে ছুঁড়ে দিয়েছিল একশোটা টাকা। দিয়েই পালাতে চাইছিল। আমারও কি হল কে জানে। লোকটাকে জাপটে ধরেছিলাম। ধরেই চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, হেল্প হেল্প।
    কাছেই রেলপুলিশ ছিল। অন্যদিন থাকে না। সেদিন কেন ছিল কে জানে! আমার ডাক শুনেই ছুটে এসেছিল। ধর্ষিত আমি ! ধর্ষককেও পালাতে দিই নি। সাহায্যের প্রার্থনা জানিয়েছিলাম। শুনে হো হো হো করে হেসে উঠেছিল। পুলিশটি। হাসতে হাসতেই বলেছিল, তুই কি পুরোপুরি লেডিস নাকি, যে তোর ধর্ষণ হবে? আমাদের দেশে শুধু নারীরা ধর্ষিতা হয়। বাকীরা বড়জোর ধর্ষক হতে পারে!
    তার মানে রক্তাক্ত আমি কোন আইনি সাহায্য পাব না? কাতর হয়ে জানতে চেয়েছিলাম। উত্তরে আবার হেঁ হেঁ করে দেঁতো কন্ঠে বলেছিল, আইন তো শুধু নারীদেরই ধর্ষিতা হিসাবে গণ্য করে। আর কাউকে নয়। তবে তোর রক্তস্রোত আমি বন্ধ করে দিতে পারি। বলেই লোকটাই দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুই এখনো এখানে কেন? যা ভাগ!
    দেখে তো মনে হচ্ছে লাইনে নতুন। এই স্টেশনে আগে কোনদিন দেখিনি। তাই ধর্ষন টর্ষন বলে নাটক করা হচ্ছিল। নে ওঠ এবার। আমি কিছু না বুঝেই উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। আর ওঠামাত্রই আমাকে পিছন দিক থেকে টয়লেটের দেওয়ালে ঠেসে ধরে নিজের প্যান্টের চেন খুলেছিল পুলিশটি। শেষে ঘর্মাক্ত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল, তোকে ক’রে খুব ভাল্লেগেছে। যা আজ থেকে এই স্টেশন তোর একার। এতদিন যে দু’ তিনজন থাকতো তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।
    ওসব শুনে কানমাথা ভোঁ ভোঁ করে উঠেছিল। মনে হয়েছিল আমি যেন কোন রেলস্টেশনে নয়, সমুদ্রের তীরে ছিলাম। আর চোরাবালিতে আটকে পড়েছিলাম। উঠে পালাবার যতই চেষ্টা করছিলাম, ততই আরও বেশি করে ডুবে যাচ্ছিলাম। ঠিক তখনই একটা ট্রেন এসে আমাকে বাঁচিয়েছিল। কোনরকমে নিজেই নিজের শরীরটাকে টেনে তুলে ট্রেনের ভিতর নিয়ে গিয়ে রাখতে পেরেছিলাম। তারপর ট্রেনটাই দয়া করে আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল আমার স্টেশনে।

    ১৮
    আবার ছেলে সাজলো নারী
    বাপ-বেটার হল ছাড়াছাড়ি

    ছেলেটা একটা বছরেরও বেশি সময় নিজেকে গৃহবন্দী করে রেখেছিল। মা হিসেবে তা মেনে নিতে মন সায় দিত না। মেয়ে হলে ঠিক ছিল। মেয়েদের তো গাছের মতো জীবনযাপন। ঘরের মেঝেতে শিকড় চেলে দিয়ে দিন কাটানো। কিন্তু ছেলে হয়ে জন্মে ঘরে বাইরে করবে না তা কি হয়? তাছাড়া ও ঘরবন্দী হওয়ায় পাড়ায়-আত্মীয় স্বজনের মধ্যে জোর গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছিল। এমনিতেই আড়ালে আবডালে ফিসফিসানি ছিলই। মাঝে শালোয়ার কামিজ পরে কলেজ যাচ্ছিল দেখে হাসির হাট বসে গিয়েছিল। সেই নারী সাজ ছেড়ে দেওয়ায় স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিলাম। কিন্তু তার বিনিময়ে ও অসুস্থ রোগীর মতো সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকবে তাও কি মেনে নেওয়া যায় নাকি! ওভাবে শুয়ে থাকলে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়বে। ভুলে যাবে হাঁটাচলা। আর ও তো মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিলই। কম বার তো ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয় নি।
    কি আর করব, সবই আমার পেটের দোষ! নিশ্চয় আগের জন্মে বড় কোন পাপ করেছিলাম। তার শাস্তি হিসেবে ভগবান এমন ছেলে দিয়েছিল। কিন্তু এ এমন শাস্তি যার হাত থেকে রেহাই পেতে সেই ভগবানকেই ডাকতে হত। রোজ ডাকতামও। সেই ডাকের জন্যেই কিনা জানি না, ও বছর ঘুরতেই হঠাৎ একদিন বিছানা থেকে নিজে নিজেই ঝেড়ে উঠেছিল। নইলে ধিক্কারে শেষদিকে ডাক্তার দেখানোও ছেড়ে দিয়েছিলাম।

    যাইহোক ও উঠে দাঁড়ানোই, বাইরে পা বাড়ানোই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। জানতাম ও বাড়ির বাইরে পা রাখলেই আবার পাড়ার গলিতে, রাস্তার মোড়ে, চায়ের দোকানে ওকে নিয়ে হাসি-মশকরা করবে সবাই। পিছনে লাগবে ওর। কিন্তু ওকে সেসব মেনে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। যত পিছু ফিরবে ততই আরও বেশি হা-হা-হি-হি হবে। সবথেকে আশ্চর্য্য লাগতো, সেই ছোট্ট থেকে একটা ছেলেকে নিয়ে রোজ হাসি ঠাট্টা করতে ওদের এত ভালো লাগতো কেন? ওদের কি একঘেয়েমি বলে কিছু ছিল না? সব জিনিস তো দেখতে দেখতে একসময় চোখ সওয়া হয়ে যায়। তখন তা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। ওরা যদি আমার ছেলেটাকে সেরকম স্বাভাবিক বলে মনে করতো, তাহলে বোধহয় ছেলেটা বেঁচে যেত! আসলে ওর মতো আমাদের পাড়ায়, শুধু পাড়ায় বলি কেন এ তল্লাটে আর কেউ ছিল না। ও একা বলেই ওরা আরও পেয়ে বসতো।
    এতকিছুর পরেও ও আবার বাইরে বের হওয়া শুরু করেছিল। যদিও বের হত সাতসকালে, ফিরতো রাতদুপুরে। সারাটাদিন কোথায় যে টো টো করতো, একা একাই ঘুরতো নাকি সঙ্গে কেউ থাকতো, কিচ্ছুটি জানতে পারতাম না। ও-ও বলত না। জিজ্ঞেস করলেও চুপ করে থাকতো। আমিও তাই হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। মনকে বোধ দিয়েছিলাম এই বলে যে যাক, ভেসে যাক, ডুবে যাক, তবু যাক যেদিক খুশি, যেখানে খুশি। ভাসতে ভাসতে বা ডুবতে ডুবতে যদি ভাগ্যে থাকে ঠিক চর খুঁজে পাবে।
    কিন্তু আমার কপালটাই খারাপ। চর পাওয়া তো দূরের কথা, একদিন রাতে ফিরে এল জীন্মমৃত হয়ে। গায়ের জামাটা ছেঁড়া। মুখে-গলায়- ঘাড়ে নখের আঁচড়ের দাগ। প্যান্টেও রক্ত লেগেছিল। ভয় পেয়ে আমি ছুটে যেতেই ও খেঁকিয়ে উঠেছিল পাগল কুকুরের মতো। আমিও কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপচাপ ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। ও সঙ্গে সঙ্গে খিল তুলেছিল ওর ঘরে। পাশের ঘর থেকে লক্ষ্য করেছিলাম সারারাত ওর ঘরে আলো জ্বলেছিল।
    পরদিনও খিল খোলে নি। অনেক ডাকাডাকিতে কোনরকমে শুধু জানলা দিয়ে ভাতের থালাটা নিয়েছিল। ছেলে এমন আচরণ করলে এক মায়ের বুকে কি হয়, তা যদি ছেলেরা বুঝতো, তাহলে ধন্য হয়ে যেত সব নারীর মা হওয়া। আমার ছেলে আমাকে এতটুকু ধন্য করতে পারে নি। তবে নিজেকে ধন্য করতে এবার আর শালোয়ার কামিজ নয়, কখন আমার ঘর থেকে শাড়ি-ব্লাউজ নিয়ে গিয়ে পরে বেরিয়েছিল ঘর থেকে। কিন্তু বেরোবি বেরো, একেবারে বাপের সামনে দিয়ে বের হতে হল। আর ওর বাপও তেমন। ওকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখামাত্রই চুলের মুঠি ধরে সেদিন কী মারটাই না মেরেছিল। মারতে মারতে পরনের শাড়ি খুলে…। আমি ওর বাবাকে অনেক করে আটকাবার চেষ্টা করেছিলাম। পারি নি। পুরুষ মানুষ রাগলে অসুরের মতো শক্তি পায়। তখন তাকে আটকাতে পারব এমন সাধ্য আমার মতো সাধারণ মায়ের ছিল না। আমি শুধু কেঁদে উঠেছিলাম, লজ্জায় মুখ ঢেকে বলেছিলাম, এ তুমি কি করলে! ও যাই হোক, ছেলে হোক, মেয়ে হোক, বাপ হয়ে অত বড় সন্তানের পরনের পোশাক জোর করে খুলে দিলে! আর মা হয়ে আমাকে তা দেখতে হল! ছিঃ ছিঃ!
    আমার ছেলেটা কিন্তু ওত মার খেয়েও একটুও কাঁদে নি। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল কিছুক্ষণ। ভাবলেশহীন এক চাউনি। সেই দৃষ্টিতে কী ছিল জানি না। রাগ! ক্ষোভ! ঘৃণা! কিছুই তো প্রকাশ করে নি। সেই প্রথম আমার মনে হয়েছিল, আমি যেন আমার ছেলেকে চিনতে পারছি না। সেই চিনতে না পারার কারণে হোক, কিংবা মেঝেতে লুটিয়ে পরে থাকা শাড়ি দেখে হোক, হঠাৎ ছুটে গিয়ে শাড়িটা তুলে ছেলের শরীরে জড়িয়ে দিয়েছিলাম। আর তখনই ছেলে আমার হাউহাউ কেঁদে উঠেছিল। ওর বাবা প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। পরক্ষণেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চেঁচিয়ে উঠে বলেছিল, আজকের পর যেন ওকে আর এ বাড়িতে না দেখি।

    ১৯
    খেলাম রাতে ঘুমের বড়ি
    হাসপাতালে তড়িঘড়ি

    নিজের বাবা যখন দুঃশাসন হয়ে তার মেয়ের বস্ত্রহরণ করে, তখন কোন মেয়ে আর বাঁচতে চায়বে? তার উপর আমার মতো অভাগা মেয়ে হলে তো কথায় নেই। এই লজ্জা নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরণ অনেক ভালো। হঠাৎ লোডশেডিং হলে চারদিকটা যেমন সঙ্গে সঙ্গে নিঃঝুম অন্ধকার হয়ে যায়, সেদিন আমার জীবনেও তেমন অন্ধকার নেমে এসেছিল। চোখের সামনে এত্ত ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, কিচ্ছুটি দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিছু সময় অপেক্ষা করলে হয়তো অন্ধকার সয়ে যেতো। অস্পষ্টভাবে হলেও দেখা যেত চলার পথ। তখন হাতড়ে হাতড়ে এগোলেও একসময় অন্ধকার থেকে আলোর সন্ধান পেতে পারতাম। কিন্তু তখন অপেক্ষা করার মতো ইচ্ছে, ধৈর্য্য কিছুই ছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল বাবার দেওয়া এই লজ্জা ঢাকতে কি করি কি করি! মাঝে একটা বছর নিজেকে ঘরবন্দী করার সময় মায়ের জোরাজুরিতে ডাক্তারের কাছে যেতাম। সেই ডাক্তার কি ওষুধ দিত কে জানে। তবে খেলে ভালো ঘুম হত। সেই ওষুধের একটা পাতা তখনও ঘরে ছিল। তা থেকেই গোটা ছয়েক বের করে খেয়ে নিয়েছিলাম। উঃ! সে কী ঘুম! জুড়িয়ে যাচ্ছিল সারা শরীর। কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’চোখের পাতা লজ্জাবতীর মতো মুদে গিয়েছিল। কিছুতেই আর তাকে জাগাতে পারছিলাম না। গালের ভিতর জিভও কেমন আঁঠালো হয়ে সেঁটে গেল। দু’ঠোঁট ফাঁক করে আর বের হচ্ছিল না। সেই মুহুর্তে স্থির বিশ্বাস জন্মে গেল মনের ভিতর, আমি সত্যি সত্যি মরতে চলেছি। তবে মৃত্যুর সময় অন্যদের মনে কি আসে জানি না। হয়তো বাঁচার আকাঙ্খা তীব্র হয়ে ওঠে। কিন্তু আমার মনে এসেছিল একটি কবিতার দু’টো লাইন। আমার সেই প্রেমিক প্রায়ই শোনাতো লাইন দু’টো।

    যেদিন সত্যিকারের ভালোবাসবে
    জিভ জড়িয়ে যাবে। কথা বলতে পারবে না।
    ভালো তো সত্যি সত্যিই বেসেছিলাম। বলতামও যখন তখন। কই সেদিন জিভ তো জড়িয়ে যায় নি। এখন মরতে বসে জিভ জড়িয়ে যাওয়া দেখে মনে হল, তার মানে সত্যিকারের ভালোবাসার আর এক নাম মরণ!
    মরুক। মরে যাক আমার শরীর। সেই শরীরটাকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলাম। তাই শরীরের মৃত্যুর সময়ই জিভ জড়িয়ে যায়। কথা হারিয়ে যায়। আমারও হারিয়ে গিয়েছিল। সব। তারপর কি হয়েছিল আর মনে নেই।

    ২০
    ওরই এক মাসি এসে
    নিয়ে গেল ভালোবেসে

    ওর বাবা যা করেছিল তার পর কোন দুর্ঘটনা না ঘটলেই বরং অবাক হতাম। সেরকম আশঙ্কাও করেছিলাম। ওর বাবা তো মারধোর করে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু আমি তো মা। আমি কোথায় যাব? ওর জন্মের সময় নাড়ী ছিঁড়ে আলাদা করে দিলেও আলাদা কি হওয়া যায়? যায় না। মা-ছেলের টান এমন টান একেবারে শিকড়ে টান পড়ে যে। সেই টানের জোরেই তো বুঝি ছেলের কষ্ট। সেই বুঝে সেদিন সারাদিন ওকে কাছছাড়া করি নি। কোলে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে খাইয়ে দিয়েছিলাম। ও-ও ছোট্টবেলার মতো শান্ত হয়ে খেয়েছিল। যদিও মাঝে মাঝে ফুঁপিয়ে উঠছিল। কিন্তু সেই ফোঁপানি যে টুপ টুপ করে ঝরে পড়া শিশিরবিন্দুর মতো কান্না ছিল না, ছিল দূর সমুদ্রে ভেসে যাওয়ার, একটুও টের পাই নি। পেয়েছিলাম রাতে। ও ভেসে যেতে গিয়েও যখন আছড়ে পড়েছিল পাড়ে। মন তো কূ গাইছিলই, একেবারে কাছ থেকে নজরেও রেখেছিলাম। তাই বড় বিপদ ঘটতে ঘটতেও ঘটে নি। দু’দিন হাসপাতালে থাকার পর ওর জ্ঞান ফিরেছিল। ওই দু’দিন ওর বেডের পাশ থেকে নড়ি নি। কিন্তু ওর জ্ঞান আসার পর ওর চোখের সামনে যেতে ভয় করছিল। শুধু মনে হচ্ছিল আমাকে দেখলে ও যদি আবার…। সেই ভয় থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিল আমার ছোট বোন। ও একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরী নিয়ে বাইরে থাকতো। আমার থেকে অনেক ছোট। বলতে গেলে আমার বড় ছেলের বয়সী। তাই আমরা দু’বোন হলেও বোনেদের মধ্যে যেমন সখ্যতা থাকে আমাদের মধ্যে তেমন ছিল না। বরং ওর আমার সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধা আর স্নেহের সম্পর্ক। ও আমাকে মায়ের মতো দেখতো। যাইহোক আমরা অনেক পীড়াপীড়ি করেও ওর বিয়ে দিতে পারি নি। শেষে একপ্রকার হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। বাইরে চাকরী করে। একা একা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। আমাদের ওকে নিয়েও দুশ্চিন্তা কম ছিল না। তবে ও ছোট থেকেই বেশ ডাকাবুকো ছিল। যাক গে। কী মন গিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে ওকেই ফোন করেছিলাম। ও শুনেই ছুটে এসছিল। ছিলও দু’টো দিন। আর দু’টো দিনে ওকে আমার ছেলের সবকথা বলেছিলাম। ও কি বুঝেছিল কে জানে। ছেলের জ্ঞান ফেরামাত্রই ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, চল আমার সঙ্গে। আমার কাছে গিয়ে থাকবি।
    ছেলেও যেন মাসির কথাটা লুফে নিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে সোজা স্টেশনে গিয়েছিল। মাসির সঙ্গে মাসির বাড়ি যাবে বলে। আমরাও আপত্তি করি নি। থাকুক দু’টিতে। অন্তত কিছুদিন।

     

    চলবে… 

  • ধারাবাহিক

    আয়নামহল (পর্ব-৩)

    আয়নামহল (পর্ব-৩)
    -সঞ্জয় গায়েন

     

     

    ১০
    লোকলজ্জার মাথা খেয়ে
    ছেলে হয়ে সাজলো মেয়ে

    ঠাস করে চড় কষিয়েছিলাম। বড় হয়ে যাওয়ার পর মারধোর বন্ধ করে দিয়েছিলাম। মা হয়ে সতেরো বছরের ছেলের গায়ে হাত তুলতে কি ভালো লাগে! কিন্তু ওই বাধ্য করেছিল। সবাই মিলে অত বোঝানোর পরও সবার অবাধ্য হয়ে মেয়ে সেজে কলেজ যাওয়া শুরু করেছিল। বাড়ির কথা কোনদিনই ভাবতো না। নাই ভাবুক। কিন্তু লোকলজ্জা বলে তো একটা কথা আছে। সেই লোকলজ্জার মাথা খেয়ে মেয়ে সেজে রাস্তায় বেরোতে একটুও বাঁধল না ওর। ও কেন বুঝলো না, অমন সেজে গেলে ওকে সবাই ‘হিজড়া’ বলে ডাকবে। ডাকতোও তো। আর সেই ডাক শোনার পর মায়ের বুক কিভাবে ফাটতো তা কেন ও বুঝতো না? জানি ও বারবার আমাকে বলত, মা, আমি তোমার ছেলে নই, আমি তোমার মেয়ে। ভগবান আমাকে ভুল শরীর দিয়েছে। ওর এই কথাগুলো কিছুটা হলেও সত্যি ছিল। নারীত্বের কিছু চিহ্ন ওর শরীরে দেখাও দিয়েছিল। সেই চিহ্নগুলোকে মুছে ফেলতে কম চেষ্টা তো করিনি। কিন্তু কিচ্ছু ফল হয় নি।
    শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওকেও আর কিছু বলতাম না। চেয়েছিলাম, ও মুখ বুজে পড়াশোনাটা শেষ করুক। তারপর যা হোক একটা চাকরী বাকরী… এইসব বলে ওকে বোঝাতাম। বলতাম, দ্যাখ সবসময় অত শরীর শরীর না ভেবে আগে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাব। শুনে ও বলত, নিজের মনের মতো করে এখন বাঁচি, তারপর ভবিষ্যতের কথা ভাবব। ওর এই মুখের উপর কথা বলাটা আগে ছিল না। আগে চুপ করে সব সহ্য করে নিত। কিন্তু বড় হয়ে কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে মনে হত, ওকে কি কেউ এসব বলা শিখিয়ে দিচ্ছে। আর তার সাহসেই ও শালোয়ার কামিজ পরে কলেজ যেতে শুরু করেছিল। তাই চড় মারার পরেও ও মেয়ে সাজা ছাড়ে নি। আমি তখন বুঝেছিলাম, না, মারধোর ধরে কিচ্ছু হবে না। আগে জানতে হবে ও কলেজ যাওয়ার নাম করে অন্য কোথাও যায় কিনা। সেই জানার জন্য ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই ওর পিছু ধাওয়া করতাম। তাতেও কোন ফল হয় নি। ও সোজা কলেজেই যেত। তবু সন্দেহটা ছিলই। শুধু মনে হত, কলেজের ভিতরের কেউ বন্ধু সেজে ওর এই সর্বনাশ করছিল না তো? কিন্তু তা হলে তা আটকাবার উপায় কোথায়!
    এরই মধ্যে ওর ঘর পরিষ্কার করতে একদিন এক প্যাকেট ওষুধ পেয়েছিলাম। বালিশের তলা থেকে। কিসের ওষুধ খেত ও! কেনই বা খেত! জিজ্ঞেস করতে বলেছিল, ওসব জেনে তোমাদের কোন লাভ নেই। তোমরা তোমাদের মতো থাকো। আমি আমার পথ ঠিক পেয়ে যাব।
    ওর মুখে এমন উত্তর শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম। বছর তিনেক আগে যাকে নিজে হাত ধরে ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়েছি, সেই ছেলে তিন বছরে এত বড় হয়ে গেল যে নিজে নিজে ডাক্তার দেখাতে শিখে গিয়েছে! না, না, এ হতে পারে না। হাজার হোক মায়ের মন তো! ছেলে মিথ্যে বললে বা কিছু লুকোলে মা বুঝতে পারবে না তা কি হয়! আমি ঠিক বুঝেছিলাম, ও আমার কাছে নিজেকে গোপন করা শুরু করেছিল।
    ছেলে হলে ওর গোপনীয়তাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়ে এড়িয়ে যেতাম। মেয়ে হলে বেশি বেশি করে কাছে টেনে নিতাম। কিন্তু ওর ক্ষেত্রে না পেরেছি এড়িতে যেতে, না পেরেছি কাছে টেনে নিতে। তাই বাধ্য হয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখা শুরু করেছিলাম। আর সেটা দেখতে গিয়েই বুঝেছিলাম, ওর বুক যেন দিনদিন ভারী হচ্ছিল। তবে কি ওই ওষুধগুলো সেজন্যই খেত! হে ভগবান, মনের মতো শরীর পেতে গিয়ে ও কোন বিপদের ঝুঁকি নিচ্ছিল? কিছুই তো বলতো না। তবু বুঝতাম, বিপদ আসবেই। বড় বিপদ!

    ১১
    ক্লাসরুমে স্তনে হাত
    নিত্য নতুন উৎপাত

    পিসতুতো দাদা সেইসময় প্রায়ই আদর করতো। আমার শরীরটাকে। চটকাতো আর বলতো, তোকে দেখলেই কেমন মেয়ে মেয়ে মনে হয়। কী সুন্দর নরম, তুলতুলে তোর শরীর। তোর বুক দু’টোও বেশ, বলেই সেখানে মুখ গুঁজতো। নাক ঘষতো। তারপরেই বলেছিল, অ্যাই এই বুক দু’টোকে পুরো মেয়েদের মতো করতে পারিস তো। আমি বলেছিলাম, তা আবার হয় নাকি! খুব হয়। তুই করবি কিনা বল শুধু। যা খরচ লাগবে আমি দেব। দাদার মুখে এরকম লোভনীয় প্রস্তাব শুনে হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। আর দাদা সেই সুযোগে আমার হাঁ হয়ে যাওয়া মুখে ওর পুরুষাঙ্গ ঢুকিয়ে বলেছিল, তোর শরীরটাকে গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। কোন চিন্তা করিস না।
    কথামতো দাদা একদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেই ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধও খাওয়া শুরু করেছিলাম। কী আশ্চর্য্য ম্যাজিকের মতো ফল হচ্ছিল। ক’মাস যেতে না যেতেই আমার পাছা বুক সব ভারী হয়ে উঠছিল। তাই দেখে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছিলাম। এত সুখ এর আগে পাই নি। যেন উপছে পরছিল শরীর বেয়ে।
    কিন্তু অন্যদের তা সহ্য হবে কেন। একে তো শুধুই শরীর! মনটার দাম কোনদিও কেউ দিত না। চাইও নি কারও কাছে। এমনকি যে দাদা এত্ত এত্ত খরচ করছিল আমার জন্য তার কাছেও না। দাদার কাছে যদি আমার মনের কোন দাম থাকতো, তাহলে দাদা আর সবার সামনে আমাকে না চেনার ভান করতো না। দাদা প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসতো। এটা ওটা ছুঁতো নিয়ে। আমাকে অবশ্য ফোন করে বলে দিত কবে কখন আসবে। আর তা শুনে নিয়ে আমাকে কিছু একটা অজুহাত খুঁজে কলেজ ছুটি করে বাড়িতে থাকতে হত। কিন্তু দাদা এসেই আমার মায়ের সঙ্গে গল্প জুড়তো। তারপর কিছু একটা বাহানা বের করে মাকে বাজারে পাঠিয়ে দিত ঘন্টা খানেকের জন্য। মা হাসিমুখে চলেও যেত। পরে জেনেছিলাম, এর জন্য দাদাকে মায়ের হাতে বেশ কিছু করে টাকা দিতে হত। সেটা দিত দাদা বাড়িটা ফাঁকা পাওয়ার জন্য। আর একবার ফাঁকা পেলেই বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তো আমার উপর। মুহুর্তের মধ্যে আমাকে খুবলে খুবলে খেতে শুরু করতো। প্রথম প্রথম দাদা আমাকে ছুঁলে শরীরে শিহরণ হত, কিন্তু কিছুদিন পর তা চলে গিয়েছিল। যাবে নাই বা কেন! দাদা তো আর আদর করতো না। ছিঁড়ে খেতো। আমি সব বুঝতে পারতাম। কিন্তু মুখে কিছু বলতাম না। বললেই আমার মনের মতো শরীর পাওয়া বন্ধ হয়ে যেত।

    সে যাইহোক, দাদার সঙ্গে একপ্রকার অলিখিত চুক্তি হয়ে গিয়েছিল যেন। তাই ওই নিয়ে কিছু ভাবতাম না। কিন্তু কলেজে গেলেই আমাকে ক্লাসরুমে, ক্যান্টিনে নানারকম অত্যাচার সহ্য করতে হত। প্রায় প্রত্যেকদিন কেউ না কেউ আমার স্তনে হাত দিতই। ভালো লাগতো না। একটুও। বাড়িতে পিসতুতো দাদা, কলেজে সহপাঠীরা, বাসের ভিড়ে সহযাত্রীরা প্রতিটা দিন আমার বুকে যে ব্যথা দিত তার খবর কেউ নিত না। সবার শুধু একটাই খরব, ওর স্তনগুলো অমন হচ্ছিল কি করে!

    ১২
    এমনি করে কাটছিল দিন
    হঠাৎ প্রেমে জীবন রঙীন

    বেশ চলছিল। বুকে ব্যথা নিতে নিতে অভ্যাসও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অভাগার কপাল নিয়ে জন্মেছিলাম। সুখ তো ফুরুৎ হবেই। পিসতুতো দাদার হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল। ব্যাস, দাদা আসল নারী পেয়ে আমার মতো নকল নারীর কাছে আসা বন্ধ করে দিল। আমি চোখে সরষেফুল দেখতে শুরু করলাম। কি হবে এবার! ডাক্তারের কথা মতো আমার শরীর রেডি হয়ে গিয়েছে। এবার অপারেশান করিয়ে আমার বুকে সিলিকন বসিয়ে দেবে। ব্যাস, আমি হয়ে উঠব স্তনবতী। আর আমাকে দেখলে অর্ধনারী মনে হবে না। আমার শরীর পূর্নতা পাবে। কিন্তু টাকা! দাদার বাড়ি ছুটে গিয়ে দু’পায়ে আছড়ে পড়েছিলাম, দাদা এত কিছু করেছো। শেষটুকুও দাও। এর বিনিময়ে সারাজীবন তোমার পায়ের কাছে পড়ে থাকবো। দাদা সঙ্গে সঙ্গে এক লাথিতে পায়ের সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। তারপর আমাদের বাড়ী এসে মাকে ডেকে বলে গিয়েছিল, মামি তোমরা তোমার ছোট ছেলেটাকে কিছু বলো না কেন? অমন হিজড়ে সেজে ঘুরে বেড়ায়… নাকি ও সত্যি সত্যিই তাই? আমাদের কাছে গোপন করে গিয়েছো!
    এসব শুনতে শুনতে আমার কান মাথা ভোঁ ভোঁ করে উঠেছিল। মানুষ যে সত্যি সত্যি মুখোশধারী হয় সেই প্রথম দেখেছিলাম। মা দাদাকে সেদিন আমার সম্পর্কে কি বলেছিল জানি না। তবে বাড়ি যাওয়ার সময় দাদা শেষ বারের মতো আমার বুকের কাছে হাত ঢুকিয়ে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল দাদা যেন ওখানে একটা শুঁয়োপোকা ছেড়ে দিয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন সেই শুঁয়োপোকাটা আমার সারা শরীরে ঘুরে বেড়িয়েছিল। আমি হাজার চেষ্টা করেও তাকে মারতে পারিনি, নীরবে তার রোঁয়ার খোঁচা খেয়ে গিয়েছি।
    তবে মারিনি বলেই বোধহয় আমার শরীর বেয়ে ঘুরে বেড়ানো সেই শুঁয়োপোকা থেকে একদিন হঠাৎ করেই জন্ম নিয়েছিল এক রঙীন প্রজাপতি। আর সেই প্রজাপতি উড়ে উড়ে গিয়ে আমার জন্য খুঁজে এনেছিল একটা মনের মানুষ।
    কতদিন ভেবেছিলাম, চারদিকে এত মানুষ আছে, আমার জন্য কেউ নেই… ছিল। শুধু তাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হয়তো ঠিকমতো খুঁজি নি বলে। নইলে যে কলেজ ছিল আমার সব থেকে বিরক্তির জায়গা সেই কলেজেই তাকে পেয়েছিলাম কি করে!

    ১৩
    ছেলের গলায় গুনগুন গান
    শুনেই জুড়ায় মন ও প্রাণ

    বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তেই চাকরী পেয়ে গিয়েছিল। তাই ওকে নিয়ে আর কোন চিন্তা ছিল না। যত চিন্তা ছোটটাকে নিয়ে। একে তো ছেলে হয়ে মেয়েদের মতো পোশাক পরা শুরু করেছিল। সেই নিয়ে বাড়িতে নিত্য অশান্তি লেগে থাকতো। ওর বাবা দু’চক্ষে এসব সহ্য করতো না। তাই ছেলেকে পইপই করে বারণ করতাম, ওই পোশাকে যেন বাবার যেন না যায়। সেই শুনে নাকি বাবার প্রতি অভিমানে ছেলে পারতপক্ষে বাবার সামনে যেতোই না। আর ওর বাবাও তেমনি একটা দিনের জন্যও ছেলের খোঁজ করতো না। একবাড়িতে থেকেও বাপ ছেলের মুখ দেখাদেখি ছিল না বলতে গেলে। আমিও অশান্তির ভয়ে এই নিয়ে কিচ্ছুটি বলতাম না।
    ওর বাবাকেও কি দোষ দেব! পুরুষমানুষের রকমসকম বুঝি তো। একটুতেই রাগ। দয়ামায়া, স্নেহ, আদর এসব কখনো থাকতে দেখিনি পুরুষমানুষের মধ্যে। অবশ্য আমার চোখে দেখা কাছ থেকে দেখা পুরুষ বলতে তো দু’জন। এক আমার বাবা। কী রাশভারী লোক ছিলেন। ভয়ে কথায় বলতাম না। আর দ্বিতীয়জন আমার স্বামী। উনিও যেন শ্বশুরের ধাঁচে গড়া ছিলেন। ওনার দায়িত্ব নাকি শুধু টাকা রোজগার করা। ছেলেদের মানুষ করার দায়িত্ব মায়েদের। মা হিসেবে বড় ছেলের প্রতি সেই দায়িত্ব ঠিকঠাকই পালন করেছিলাম। কিন্তু ছোটটাকে তো… পারি নি।
    যাক গে, যেকথা বলছিলাম। কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে উঠতেই ওর মধ্যে পরিবর্তনটা লক্ষ্য করেছিলাম। শালোয়ার কামিজ ছেড়ে আবার ছেলেদের মতো পোশাক পরা শুরু করেছিল। না, আগের মতো প্যান্ট শার্ট নয়। আবার ঠিক মেয়েদের পোশাকও নয়। দেখে ভালো লাগতো। মা হয়ে দেখতে লজ্জা করলেও লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম ছেলে আর প্যাড দেওয়া ব্রা পরতো না। তার পরিবর্তে টাইট ফিটিং কী একটা পরতো। তার উপর পরে নিত পাঞ্জাবীর মতো এক ধরনের পোশাক। বাইরে থেকে বোঝাই যেত না যে ওর বুকে মেয়েদের মতো স্তন আছে। ছেলে এই যে নিজের মেয়েলি শরীরকে বাইরের লোকের কাছে লুকোতে শিখছিল এটা দেখেই ভালো লাগতো। তবে সেই ভালোলাগা ওর কাছে কোনদিনও প্রকাশ করি নি। ভয় হত। কিছু বললেই যদি আবার বেঁকে বসে।
    আর একটা জিনিস লক্ষ্য করতাম। ওর হাঁটাচলায় কথাবলায় কী সুন্দর সাবলীলতা এসেছিল। আর কথায় কথায় তর্ক করতো না। মুখের উপর না বলে ঘরের দরজা বন্ধ করতো না। রাত্রিরে না খেয়ে শুয়েও পড়তো না। তবে নিজেকে খুব বেশি মেলেও ধরতো না বাড়িতে। আসতো যেতো, খেতো ঘুমোতো। ওই কী যেন বলে পেয়িং গেস্টের মতো। আমিও কিছু বলতাম না। থাক নিজের মতো। ওরকম থাকলে যদি ভালো থাকে থাকুক। মা হয়ে সেটুকুই তো চেয়েছিলাম।
    তবে উপরি পাওনা হিসাবে পেয়েছিলাম, ছেলের গলায় গুনগুন করে গান। ও ছোট থেকেই সাজতে ভালোবাসতো। ছবি আঁকা শিখতো। নাচ শেখার বায়না ধরেছিল কিছুদিন। শিখতে পাঠাইনি। ছেলে আমার এমনিতেই মেয়েলি ছিল। তার উপর নাচ শিখলে আর রক্ষে থাকতো না। কিন্তু গান কখনো ভালোবাসতো না। সেই ছেলে বড় হয়ে ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গায়। তার মানে বেশ আনন্দেই আছে। শুনে মন-প্রাণ জুড়িয়ে দিত। ওই সময়টা খুব ইচ্ছে করতো ওকে কাছে টেনে নিতে। পারি নি! কাউকে দূরে ঠেলে দেওয়ার পর কাছে টেনে নিতে চাইলেই কি টেনে নেওয়া যায়? যায় না। তা সে যতই নিজের পেটের ছেলে হোক। তাই মা হয়ে ছেলের ভালোলাগা অদূরে দাঁড়িয়ে, আড়াল থেকে দেখতাম। আর মনে মনে ঠাকুরকে বলতাম ঈশ্বর ওর মঙ্গল কোরো।

    ১৪
    নারীর মতো নারী তো নয়
    বিয়ে সংসার কি করে হয়

    সব কবি প্রেমিক কিনা জানি না। সব প্রেমিক কিন্তু কবি। প্রেমে পড়লেই ছন্দ করে কথা বলা প্রেমের ধর্ম। আমিও কবি হলাম। অবশ্য সত্যি কথা বলতে গেলে আমার প্রেমিক আমাকে কবি বানিয়েই ছেড়েছিল। উফ্‌। কী সব কবিতা লিখতাম।
    বুকের ভিতর দু’টি হৃদয়
    সদাই ধুকপুক।
    একটি ঘরে বন্দী থাকে
    আরেকটি খোঁজে সুখ।
    আর আমার প্রেমিক সেই সব ছাঁইপাশ শুনে বাহ্ বাহ্ করে উঠতো। প্রেমে পড়ার প্রধান শর্ত বোধহয় প্রেমিকার সবকিছুকে ভালো বলা। আর যত্তরকম ছেলেমানুষী করা। আবোল তাবোল বকবক করা। যুক্তিহীন, বাস্তবতাহীন স্বপ্ন দেখা। কয়েকশো প্রতিজ্ঞা আর কয়েক হাজার প্রতিশ্রুতি দেওয়া। এবং আশ্চর্য সেগুলোকে সেই মুহুর্তে সব সত্যি বলে বিশ্বাস করা।
    আমার প্রেমিকও তাই করত। ওর দেখাদেখি আমিও ওকে আমার মনের সবকিছু বলতাম। ও মন দিয়ে শুনতো। শুনতে শুনতে আমার মাথার চুলে বিলি কেটে দিত। মাঝে মাঝে চুপ করে শুধু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতো। তাকিয়েই থাকতো। কি দেখতো কে জানে! কিন্তু আমি ওর চোখের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়েই লজ্জাবতী লতার মতো মূর্ছা যেতাম। বলে উঠতাম, অমন করে রোজ কি দেখো বলো তো?
    এমনি করেই বেশ কাটছিল। নিজেকে ওর পছন্দমতো সাজিয়ে তুলছিলাম। ঘাড় ঢাকা পড়ে যাওয়া আমার একমাথা চুল ও পছন্দ করতো না বলে কেটে ছোট করেছিলাম। শালোয়ার কামিজ ছেড়ে ইউনিসেক্সুয়াল ড্রেস পরা শুরু করেছিলাম। গাঢ় করে ঠোঁটে লিপস্টিক দিতাম না। চোখে আই লাইনার দেওয়া, কাজল দেওয়া, নখে নেলপালিশ দেওয়াও বন্ধ করেছিলাম। কপালের টিপ, কানের দুল, নাকের নাকছাবি সব খুলে তুলে রেখেছিলাম। ও আমাকে বোঝাতো, তুমি নারী কিনা তা পোশাক পরে বোঝাবে কেন? তোমার নারীত্ব তোমার ভিতরের সত্বা। তা বাইরের লোক বুঝলো কি বুঝলো না তাতে কি যায় আসে! তাছাড়া তোমার শরীর তুমি নও। তোমার কর্মই হল তুমি।
    ওর কথা শুনে কেমন যেন বিশ্বাসও হত। সত্যিই তো আমি কি কেবল আমার শরীর! তার বাইরে আমার আমি বলে কিচ্ছু নেই! আছে অনেক কিছু আছে। আর তা আমি প্রমাণ করবই।
    যাইহোক, শরীরের কথা উঠলেই আমার ভিতরে কেমন যেন হত। পিসতুতো দাদা চলে যাওয়ার পর এই শরীর আর কেউ ছোঁয় নি। কিন্তু যে একসময় দিনের পর দিন শরীরী ছোঁয়ায় বুঁদ হয়ে থেকেছে তার পক্ষে বেশিদিন উপোসী থাকা খুব কষ্টের। তবু ঠিক করেছিলাম, যত কষ্টই হোক নিজের যৌন ইচ্ছেগুলো লুকিয়ে রাখবোই। কিন্তু একটা সময়ের পর কোনকিছুই বোধহয় লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। বিশেষ করে প্রেমের মতো সম্পর্কে। এই সম্পর্কের মাঝে এমন এক আয়না থাকে যাতে ভিতরের সব ছবি দেখা যায়। ও-ও দেখতে পেলো। আমার ঠোঁটে, আমার চোখের চাউনিতে…। তাছাড়া প্রেম তো বিরুৎ। একটু বেড়ে উঠলেই তাকে শরীরের অবলম্বন দিতে হয়। তখন সে শরীর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তরতর করে ওপরে ওঠে।

    আমাদের প্রেমও একদিন শরীরের অবলম্বন খুঁজে নিয়েছিল। আর প্রেম একবার শরীর পেলে তা শরীরময় হয়ে ওঠে। চুম্বকে চুম্বকে খুব বেশি ঘষাঘষি করলে যেমন চুম্বকের আকর্ষণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, শরীরে শরীর ঘষে তেমনই প্রেমে পড়ার আকর্ষণও নষ্ট হতে থাকে। তখন আকর্ষণ জিইয়ে রাখতে প্রেম করতে হয়। প্রেমে পড়া থেকে প্রেম করা।
    কিছুদিন আমরাও প্রেম করেছিলাম। আর প্রেম করলে যা হয়, একসময় বিরক্তি আসে। আমাদের প্রেমেও তাই এসেছিল। সে আসুক। ক্ষতি ছিল না। জীবনে প্রেম আসা যেমন অনিবার্য তেমন প্রেমের বিচ্ছেদও ভবিতব্য। প্রেম তো এক ফাগুনের আয়ু নিয়ে আসে। তাই মেনে নিতে একটুও দ্বিধা করি নি। শুধু কষ্ট হয়েছিল প্রেমের বিচ্ছেদের কারণ হিসাবে ও যা বলেছিল সেটা শুনে।
    ও আমার নারীত্বকে অস্বীকার করেছিল। একদিন পিসতুতো দাদা যেমন আমাকে ব্যঙ্গ করেছিল, ও-ও তেমনই বলেছিল। আমি নারীর মতো কিন্তু নারী নই। দিনের পর দিন যে লোকটা কাব্য করে বলতো,
    মনের ভিতর তুমি নারী
    বাকী সব তুচ্ছ।
    প্রেমবারি বরষিলে নাচে
    মনময়ূরীর পুচ্ছ।
    সেই লোকটাই আমাকে শোনানো তার শেষ কবিতায় বলেছিল,
    শরীরই সত্য, মন নয়
    এ জীবন শুধু শরীরময়
    তা শুনে ঠাস করে মারতে ইচ্ছে করেছিল। মারতে পারিনি। যাকে মন থেকে ভালোবেসেছিলাম, ভালোবাসি তাকে কি মারা যায়! যায় না।

    ওর বাড়ি থেকে ওর বিয়ে ঠিক করেছিল। ও বলতেই পারতো, আমাকে বিয়ে করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তো আমার ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার গড়তে ওকে ভালোবাসিনি। তেমন কোন শর্ত কোনদিন উচ্চারণও করি নি। কি গো এত ভালোবাসছো? আমায় বিয়ে করবে তো? এমন কিছু যদি বলতাম, তাহলে ও না হয় অজুহাত খুঁজতো। আমি তো তা করি নি। আমি তো শুধু ভালোবেসেছিলাম। নিটোল নিখাদ ভালোবাসা। চলে যাওয়ার সময় ও যদি বলে যেত, তোমাকে বিয়ে করতে পারলাম না ঠিকই, কিন্তু সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিলাম তাহলে এ জীবন ধন্য হয়ে যেত। কিন্তু তা বলে নি। বলতে পারে নি। তবে আমি বিদায়বেলায় আমার শেষ কবিতা ওকে শুনিয়েছিলাম,
    বলতে পারতে আয় দু’জনে শরীর জুড়াই
    কেন দিয়েছিলে শুধু শুধু প্রেমের দোহাই!

    ১৫
    নারীসাজ বন্ধ থাক
    মনপাখি পুড়ে খাক

    পিসতুতো দাদা টাকা দেওয়া বন্ধ করার পর হরমোনথেরাপি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। থেমে গিয়েছিল নারী হয়ে ওঠা। আর প্রেমে পড়ে প্রেমিককে খুশি করতে গিয়ে নিজের খুশি জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম। খুলে রেখেছিলাম পছন্দমতো শরীরের সাজ। তখন তো ভাবি নি সেই প্রেমিক এভাবে আমার মনটাকে পুড়িয়ে খাক করে দিয়ে যাবে। শরীর পুড়লে তার যন্ত্রণা হয়তো অনেক বেশি। তবে ডাক্তারি চিকিৎসায় সেই যন্ত্রণার উপশমও হয় দ্রুত। আর মন পুড়লে যন্ত্রণা হয় না, ব্যথা হয়। অথচ সেই ব্যথা কমাবার কোন ওষুধও নেই। সময় একমাত্র তার মলম। কিন্তু সময় যেন সেই সময় কাটতেই চাইতো না। দিনের পর দিন জানলার গরাদ ধরে শুধু আকাশ দেখে গিয়েছি। আর ভেবেছি আমার আকাশ বারবার কেন এমন মেঘে ঢাকা পড়ে যায়! শুধু ভাবতাম। আর বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতাম।
    এভাবে বছর ঘুরে গেল। এই একটা বছরে বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোই নি। মায়ের জোরাজুরিতে শুধু ক’বার ডাক্তারখানায় যেতে হয়েছিল। ডাক্তার আমাকে দেখে কি বুঝতেন কে জানে! তবে কিছু ওষুধ দিতেন যা আমার খুব উপকার করেছিল। সারাদিন ঘুমিয়ে থাকতে পারতাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কত কি স্বপ্ন দেখতাম। মাথামুন্ডুহীন স্বপ্ন। একা একা হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। হঠাৎ করে কঁকিয়ে কেঁদে ওঠার স্বপ্ন। আবার মাঝে মাঝে ভয়ের স্বপ্নও দেখতাম। কে যেন আমার গলা টিপে ধরতো। দম নিতে পারতাম না। হাঁপিয়ে উঠতাম। দরদরিয়ে সারা শরীর ঘামে ভিজে যেত। মা কি করে বুঝতো কে জানে। ছুটে আসতো আমার ঘরে। মাথার বালিশটা সরিয়ে দিয়ে নিজের কোলটাকে বালিশ হিসেবে রাখত আমার মাথার নীচে। কিচ্ছুটি না বলে শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। কিছুক্ষণ পর আমি শান্ত হয়ে যেতাম। তখন মাকে আমার ভিতরে জমে থাকা কষ্টের কথাগুলো বলতে ইচ্ছে করতো। পারতাম না। গলার কাছে দলা পাকাতো। কিন্তু কিছুতেই উগড়ে দিতে পারতাম না। মাও জোর করতো না। পরনের শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছে দিয়ে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যেত।
    মায়ের এভাবে চলে যাওয়া দেখে আমার কান্না পেত। ছোটবেলায় মায়ের হাতে মার খেয়েও এমন কান্না পেত না। তখন মনে হত, মা তো আমাকে ভালোবাসে না। শুধু দাদাকে ভালোবাসে। কিন্তু এই মা কোন্‌ মা। এভাবে আমি স্বেচ্ছায় ঘরবন্দী আছি দেখেও কিছু বলে না। উল্টে ডাক্তার দেখায়, খাইয়ে দেয়, ঘুম ভেঙে গেলে ছুটে আসে! আমার এই মা’কে আমি ছোটবেলায় কেন পাই নি! পেলে হয়তো আমি নিজেকে নষ্ট করতাম না। নষ্ট হতাম না।
    যাই হোক সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে আমি আবার একসময় চরা খুঁজে পেয়েছিলাম। দাঁড়িয়েছিলাম উঠে। পা রেখেছিলাম জীবনের নতুন রাস্তায়। এই নতুন করে চলার শুরুতে খুব ইচ্ছে করেছিল মাকে সবকিছু বলতে। কিন্তু বলতে পারতাম না। কেন পারতাম না? কোথায় বাধতো? তখন বুঝতে পারি নি। পরে বুঝেছিলাম বাধতো আমার পৌরুষে। যতই আমার স্বত্তা নারীর স্বত্ত্বা হোক না কেন পারিবারিক পরিবেশে আমার বেড়ে ওঠা নারীর মতো হয় নি। তাই আমার সঙ্গে মায়ের সম্পর্কটা মা-মেয়ের সম্পর্ক ছিল না। আর ছিল না বলেই মেয়েরা যেমন বড় হয়েও মায়ের গলা জড়িয়ে ধরতে পারে আমি পারি না। একটা লক্ষণরেখা থেকেই যায়। তাই মাকে এত কাছের করে পেয়েও আবার দূরে সরে যেতে হয়েছিল।
    সেই দূরে সরে যাওয়া ক্রমেই বেড়েছিল। বাড়তে বাড়তে এত দূরের হয়ে গেল যে আর মায়ের কাছে ফেরা হল না।

     

    চলবে…..

  • ধারাবাহিক

    আয়নামহল (পর্ব-২)

    আয়নামহল (পর্ব-২)
    -সঞ্জয় গায়েন

     


    টয়লেটে ছিঁড়লো প্যান্ট জামা
    আমার কান্নায় ওদের থামা

    তখন ক্লাস নাইনে উঠে গিয়েছি। বড় না হলেও আর ছোট বলা যায় না। নিজেকে একটু একটু হলেও বুঝতে শিখছি। নিজের পছন্দ অপছন্দ তৈরি হয়ে গিয়েছে। কিছুতেই আর ছেলেদের মতো জামা প্যান্ট পরে স্কুলে যেতে ইচ্ছে করত না। বিশেষ করে বুক দু’টোর জন্য। জামা পরলে কেমন উঁচু হয়ে থাকতো। মা’কে একদিন বলেছিলাম, মা আমি মেয়েদের মতো ফ্রক পরে স্কুলে যাব। শুনেই মা এত রেগে গিয়েছিল কি বলব। আচ্ছা মাও তো মেয়ে। মা-র কি চোখ পড়তো না আমার উপর? না কি দেখেও না দেখার ভান করে থাকতো? কি জানি? কিছু চাইলেই তো বলে উঠতো, বড় হয়ে গিয়েছ, এবার সব নিজে নিজে করে নিতে শেখ। মা-র কথামতো নিজে নিজেই একদিন স্যান্ডো গেঞ্জির পরিবর্তে স্ক্রিন ফিটিং ইনার কিনতে গিয়েছিলাম। দোকানদার দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়ে গেঞ্জি ও জামা পরেই স্কুলে যেতাম। তার উপর আমাদের স্কুলটা ছিল শুধু ছেলেদের স্কুল। তাই ছেলেদের পাশেই বসতে হত। এক বেঞ্চে পাঁচ পাঁচজন। গায়ে গা ঠেকে যেত। কী যে অস্বস্তি হত। সেই অস্বস্তি এড়াতে আমি নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইতাম। কিন্তু চাইলেই কি গুটিয়ে নেওয়া যায়। যায় না। আমি যত বেশি করে নিজেকে গুটিয়ে নিতে যেতাম আমাদের ক্লাসের সহপাঠীরা আমাকে তত বেশি করে টেনে নামাতো। আমি যেন ওদের কাছে একটা রাবারের বলের মতো ছিলাম। যার যখন যা ইচ্ছে হত, আমাকে নিয়ে তাই করত। কেউ এসে চুল টেনে ধরত। কেউ গাল টিপে টেনে ধরত। আর আমায় দেখে হাসাহাসি করা, ধাক্কা দেওয়া, কাঁধে খেমচে ধরা এসব তো ডেলি রুটিন হয়ে গিয়েছিল। ওসব আমার ধীরে ধীরে অভ্যেসও হয়ে যাচ্ছিল। বরং যেদিন কেউ কিছু করত না, সেদিন মনে হত, কি ব্যাপার আজ কি ক্লাসের সবার মন খারাপ। কেউ আমার পিছনে লাগছে না যে।
    আমি প্রত্যেকটা দিন মনমরা হয়ে পিছনের বেঞ্চে বসে ব্যাগে মুখ গুঁজে নিজেকে লুকিয়ে রাখতাম। কিন্তু ক্লাসশুদ্ধু সকলের প্রথম কাজ ছিল আমাকে খুঁজে বের করা আর টানাটানি করা।
    এভাবেই কাটছিল আমার স্কুলবেলা। কিন্তু সেদিন যা হয়েছিল তা মনে পড়লে এখনো আমি শিউড়ে উঠি। আমাদের স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টস ছিল। সামনের মাঠে সবাই খেলায় ব্যস্ত। আমি দোতলায় উপরের বারান্দা থেকে খেলা দেখছিলাম। দেখতে দেখতে টয়লে্ট পেয়েছিল। তাই নীচে নামতে হয়েছিল। নেমে এসে যেই টয়লেটে ঢুকেছি, দেখি আমাদের ক্লাসের চার পাঁচজনও পিছু পিছু টয়লেটে এসেছে। একে স্কুলের টয়লেট, তার উপর শুধু ছাত্রদের জন্য। দরজা থাকলেও তা বন্ধ করে লক দিয়ে একজন একজন টয়লেট করবে তেমন ব্যবস্থার প্রশ্নই ওঠে না। স্কুলে একসঙ্গে অনেকজন করে ঢুকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে টয়লেট করে। আর করতে করতে একে ওপরের পেনিস দেখে। কারটা ছোট কারটা বড় কারটা মোটা কারটা কালো এসব নিয়ে গল্পও করে। আমি কোনদিনও এসব গল্পে ঢুকতামই না। বরং আমি টয়লেটে গেলেই পায়খানা করার ঘরে ঢুকে ছিটকিনি দিয়ে বসে টয়লেট করতাম। ওদিনও তেমনই করতে যাচ্ছিলাম, কে যেন বলে উঠেছিল, অ্যাই তুই কি খেয়ে আসিস রে রোজ তোর পায়খানা পাায়। আমি সরল মনে বলে ফেলেছিলাম, না পায়খানা করব কেন? টয়লেট করার জন্যই… বলে ফেলেই বুঝতে পেরেছিলাম কী ভুল বলে ফেলেছি। কিন্তু কথা তো তীরের মতো ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। এইটুকু শুনেই ওরা সব বুঝে গিয়েছিল। ব্যাস, আর আমি যাই কোথা। ওরা কিছুতেই ছিটকিনি লাগিয়ে আমাকে টয়লেট করতে দেবে না। আমিও নাছোড়বান্দা। কিন্তু ওদের একটাই বুলি ছেলে হয়ে ছেলেদের সামনে দাঁড়িয়ে টয়লেট না করলে ওরা স্যারকে বলে দেবে।
    এমন কথা শুনে আমার খুব ভয় করতে লাগলো। আর একবার ভয় পেলে মাথা কাজ করে না। কি করা উচিৎ, কোনটা উচিৎ নয় সব যেন গুলিয়ে যায়। সেদিনও তাই হয়েছিল। আমি জড়ভরত হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছিলাম। ওরা তখনও পায়খানার দরজা আটকে দাঁড়িয়ে। একবার মনে হচ্ছিল, ওদের হাতে পায়ে ধরে বলি যে আমায় তোমরা ছেড়ে দাও। কিন্তু ততক্ষণে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। কথা বলতে গিয়ে মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ ছাড়া কোন আওয়াজ বের হচ্ছিল না।
    ওদিকে ওরাও গোঁ ধরে বসেছিল, ওদের সামনে প্যান্টের চেন খুলে দাঁড়িয়ে টয়লেট করতে হবে। নইলে ওরা আমাকে ‘ছেলে’ বলে মানবে না। বলতে বলতে আমার জামা ধরে টানাটানিও করছিল। আর সেই টানাটানিতে জামার দু’টো বোতাম ছিঁড়ে যায়। ছেঁড়ামাত্রই হাট হয়ে দেখা যাচ্ছিল আমার বুক দুটো। আমি তখন লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছিলাম। দুই হাত দিয়ে কোনরকমে বুকটা আড়াল করতে চেষ্টা করছিলাম আর কাঁদছিলাম। আমার চোখের জল আর ঘামে সারা শরীর ভিজে যাচ্ছিল। ওরা তখনও থামে নি। হ্যাঁচকা টানে দু’জন আমার দুইহাত টেনে ধরেছিল। আর দু’জন প্যান্টের চেন খুলে… আমি হাত পা ছুঁড়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না। হাঁসফাঁস করছিলাম। দমও বন্ধ হয়ে আসছিল। ঠিক তখনই হঠাৎ যেন আমার গলার আওয়াজ ফিরে পেয়েছিলাম। আমি ‘বাঁচাও বাঁচাও’ করে চিৎকার করে উঠেছিলাম। সেই চিৎকারে ওরা থমকে ওঠে। তারপর পায়খানা ঘরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল।


    স্যারকে নালিশ করে
    মহা বিপদ এল ঘরে

    ভাইকে পছন্দ করতাম না ঠিকই। ওর উপর রাগও হত। আসলে ওকে দেখে সবাই যেমন হা হা হি হি করত, তেমন সুযোগ পেলেই আমাকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে করে আমার মাথা খেয়ে ফেলতো। সবার কাছে জবাবদিহি করতে করতে আমি বিরক্ত হয়ে যেতাম। বিশেষ করে স্কুলে। রাগে-বিরক্তিতে কতবার বাবার কাছে বলেছি, ভাইকে অন্য স্কুলে ভর্ত্তি করে দাও। করে নি। তবে তার বিনিময়ে একটা ব্যাপারে বাবাকে রাজী করিয়েছিলাম। ভাই যেন আমার সঙ্গে স্কুলে না যায়। স্কুলে আমার সঙ্গে কথা না বলে। তাই শুনে মা একটু কিন্তু কিন্তু করেছিল। বলেছিল, তোরই তো ভাই। তার উপর সবই তো জানিস। সবাই কিরকম ওর পিছনে লাগে। তুই দাদা হয়ে ওকে একটু চোখে চোখে রাখলে ওর সুবিধা হত। ও না হয় একা একাই যাবে। তুই শুধু স্কুলে একটু খেয়াল রাখিস। আমি মায়ের মুখের উপর ‘না’ বলে দিয়েছিলাম। বলাটা হয়তো উচিৎ হয় নি। তবু বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। কারণ ওর জন্য আমাকেও সবার কাছে কথা শুনতে হত। সেটা তো মা বুঝতো না। জানতোও না। অবশ্য আমিও জানাতে চাই নি। ভাইকে নিয়ে মাকেও তো কম কথা শুনতে হত না। পাড়ায়-আত্মীয় স্বজনের বাড়ি যেখানেই মা যেত সব্বাই কথা শোনাতো। কেউ হেসে হেসে, কেউ ঠোঁট বেঁকিয়ে। কেউবা দরদ দেখানোর ভান করে। মাও সব বুঝতো। কিচ্ছু বলতে পারতো না। ভাই যে এমন হাফলেডিসের মতো দিন দিন মেয়েলি হয়ে যাচ্ছিল তা নাকি মায়ের জন্যই। আসলে আমাদের সমাজটাই এমনি। ছেলে মেয়ের যাই হোক প্রথমেই তার জন্য বাপ মা’কে দায়ী করা হয়। বিশেষ করে মা’কে।
    সে যাক গে। কি আর করা যাবে। আমরা তো আর সমাজ পাল্টাতে পারবো না। ভাইকে পাল্টাবার চেষ্টা করতাম। তাই ভাই জেদ করলেও ওকে ফ্রক পড়তে দেওয়া হত না। একবার মেয়ে সাজালে আর কি রক্ষে থাকতো? এমনিতেই ছোটবেলায় মেলার গাজনে ওকে মেয়ে সাজিয়েছিল বলে সেই নিয়ে কম কথা হয়েছিল নাকি। সেটা তবু মেলা ছিল, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে মেয়ে না হয়ে মেয়েদের পোশাক পরতে চাওয়া পাগল ছাড়া আর কেউ ভাবে না। ওর সেই পাগলামো ছিল। বাবা সেজন্য ডাক্তারও দেখিয়েছিল। কিছুদিন ওষুধ খেয়ে ভালোও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওষুধ বন্ধ হওয়ার পর আবার যেই কে সেই। তাই বলে ওর ফ্রক পরতে চাওয়ার আবদার মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে নি। পড়তে দেওয়াই হয় নি কোনদিন। হ্যাঁ, ওর হরমোনাল কিছু সমস্যা হয়তো ছিল। সেজন্য বুক দু’টো একটু বড় বড় দেখাতো। তবে ওগুলো মেয়েদের মতো স্তন মোটেও ছিল না। কিন্তু ভাই তা বুঝতো না। বাড়িতে একটা দিনও খালি গায়ে থাকতো না। এমনকি বাথরুমে স্নান করতে ঢুকলেও গামছা গায়ে দিয়ে ঢুকতো আর বের হত। হাজার বলেও ওকে পাল্টানো যায় নি। শেষে আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।
    কিন্তু সেদিন স্কুলে কি যে হল আমার, জানি না। বন্ধুদের সঙ্গে বসে মাঠে স্পোর্টস দেখছিলাম। হঠাৎ বাথরুম থেকে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনে ছুটে গিয়ে দেখি, ভাই মুখ ঢেকে কাঁদছে। কি হয়েছে রে, জিজ্ঞেস করতে ভাই কেঁদে কেঁদেই বলেছিল, আমাদের ক্লাসের চারজন বাথরুমে ঢুকে আমার জামা প্যান্ট ছিঁড়ে…। শুনে আমারও মাথা গরম গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ভাইকে নিয়ে গিয়ে স্যারের কাছে নালিশ করেছিলাম।
    কিন্তু স্যার সবটা শুনলেন না। মাঝপথে হাত তুলে আমাদের থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, সব বুঝেছি। যাও ভাইকে নিয়ে বাড়ি যাও। আর কাল তোমার বাবাকে স্কুলে আসতে বলবে একবার। বলবে, স্যার ডেকেছেন। খুব দরকারী কথা আছে। অবশ্যই যেন আসেন।
    বাবা পরদিনই অফিস কামাই করে স্কুলে গিয়েছিল। স্যার কি বলেছিলেন জানি না। তবে বাবা ফিরে এসে ভাইকে বেধড়ক মেরেছিল। আর বলেছিল, এরপর যদি স্কুল থেকে তোমার নামে কোন নালিশ আসে তাহলে তোমার স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেব আমি।


    পাড়ার ডাক্তার টিপল বুক
    অস্বস্তি হলেও হল সুখ

    বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমার বুক জুড়ে কুসুমের মতো ফুটে থাকা বুক দু’টো বেশ বড় হয়ে গিয়েছিল। বাথরুমে স্নান করতে ঢুকে রোজ দেখতাম, হাত বুলোতাম। লজ্জা লজ্জা লাগতো। তবু না দেখে থাকতে পারতাম না। দেখতাম আর ভাবতাম এ তো পুরো মায়ের মতো হয়ে উঠছে। পরক্ষণেই মনে পড়ে যেতো, আমি তো ছেলে। কি করব এবার? ছেলেদের তো অমন বুক থাকে না। থাকতেও নেই। তাই বাধ্য হয়ে একদিন দুপুরে মায়ের ঘরে গেলাম। মা তখন শুয়েছিল। দরজা ভেজিয়ে মায়ের মাথার পাশে বলেছিলাম, ও মা, কি হবে এবার। মা অন্যমনস্কের মতো কিছু না বুঝেই উত্তর দিয়েছিল, কি আবার হবে। যা হচ্ছে তাই হবে। বুঝেছিলাম, এভাবে হবে না। মাকে দেখাতে হবে। শেষে লজ্জার মাথা খেয়ে জামা খুলে বলেছিলাম, আমার দিকে দেখো একবার। মা মুখ তুলে আমাকে দেখে কি বুঝেছিল কে জানে। খানিকক্ষণ কোন কথা বলে নি। একেবারে চুপ করে গিয়েছিল। অনেকপরে প্রায় ফিসফিস করে বলেছিল, জামাটা পরে নিয়ে নিজের ঘরে যাও। তারপর সেইদিনই সন্ধ্যে হব হব এমন সময় মা আমাকে নিয়ে পাড়ার ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। কিন্তু আমাকে কিচ্ছু বলে নিয়ে যায় নি। শুধু বলেছিল, চল্‌, আমার সঙ্গে। গিয়ে বুঝেছিলাম ডাক্তারখানায় এসেছি।
    যাইহোক গিয়ে বসেই ছিলাম। অনেকক্ষণ। একটার পর একটা রোগী আসছিল, ভিতরে ঢুকে ডাক্তার দেখিয়ে চলেও যাচ্ছিল। কিন্তু মা আমাকে নিয়ে চুপ করে বসেছিল। এমনকি আমাদের পরেও ক’জন এসে আগে চলে গিয়েছিল। তবু মা উঠে ভিতরে যাচ্ছিল না। কারণটা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ওদিকে মা এমন গম্ভীর মুখ করে বসেছিল জিজ্ঞেস করারও সাহস পাচ্ছিলাম না। এভাবে কতোক্ষণ কেটেছিল মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে প্রায় ফাঁকা হয়ে যাবার পর, মা ধীরে ধীরে যেন চোরের মতো ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। খানিকক্ষণ কথা বলে বাইরে এসে সেই দুপুরের মতো ফিসফিস করে বলেছিল, যা ভিতরে যা। তবে কোন কথা বলবি না। ডাক্তারবাবু যা বলবে তাই করবি।
    আমি তো শুনে ভয়ে কাঁটা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার তো কোন অসুখ করে নি। তাও ডাক্তারখানায় কেন? তার উপর মা কেন বলল, কোন কথা বলবি না। ডাক্তার যা বলবে তাই করবি…। ডাক্তার কি করতে বলবেন… ভয়ে ভয়ে ভিতরে ঢুকেছিলাম। চেনা ডাক্তার। আগেও ওনার কাছে গিয়েছিলাম। তবু সেদিন যেন ডাক্তারবাবুকে অচেনায় ঠেকেছিল। যেন প্রথম গিয়েছিলাম ওনার কাছে। প্রথমে চশমার ফাঁক দিয়ে কিছুক্ষণ আমাকে দেখেছিলেন। তারপর ইশারায় ওনার পাশে রাখা কাঠের টুলটায় বসতে বলেছিলেন। আমি যন্ত্রবৎ ধীরে ধীরে গিয়ে বসেছিলাম। খুব বুক ঢিপ ঢিপ করছিল। ডাক্তারবাবু মনে হয় অন্তর্যামী ছিলেন। অমন রাশভারী ডাক্তার কী নরম করে সেদিন বলেছিলেন, কোন ভয় নেই। আরাম করে বোসো। বলেই গলায় ঝোলানো স্টেথোটা দিয়ে আমার বুকের ঢিপঢিপানি শুনতে লাগলেন। আমি ভয়ে হোক, অস্বস্তিতে হোক চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম। হঠাৎ ডাক্তারবাবু স্টেথো রেখে আমার জামার সব কটা বোতাম খুলে বুকে হাত দিয়েছিলেন। আমি থরথর করে কেঁপে উঠেছিলাম। কিন্তু চোখ খোলার সাহস পাচ্ছিলাম না। মুখেও কিছু বলতে পারছিলাম না। ডাক্তারবাবুর সেসবে কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। উনি আমার বুক দু’টো হাতের মুঠোয় ভরে টিপে যাচ্ছিলেন।
    সেদিন মাত্র কিছুক্ষণই ডাক্তারবাবুর হাত ওভাবে আমার বুকে খেলা করেছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যেন অনন্তকাল। আমি হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিলাম। ডাক্তার হোক আর যেই হোক কোন পুরুষের হাত বুকে পরলে যে সুখ হয় তা ওই প্রথম বুঝেছিলাম। শুধু যেটুকু বোঝার বাকী ছিল সেটা বুঝেছিলাম বাড়ি ফিরে। ডাক্তারবাবুর চেম্বার থেকে আমি বেরিয়ে আসার পর মা আবার ঢুকেছিল। কারণ জানিয়েছিল বাড়ি এসে। আমার হাতে দু’রকম ওষুধ তুলে দিয়ে বলেছিল, রোজ সকালে আর রাতে খাবি। সব ঠিক হয়ে যাবে।


    মেয়ের মতো ছেলের ক্ষরণ
    শোনার পরেও হয় নি মরণ

    বড় হলে মাকে মেয়ের বন্ধু হতে হয়। কিন্তু ছেলের? হওয়া যায় না। ছেলে যত বড় হয়, ততই মায়ের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে। বাড়াতে হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু আমি বোধহয় সেই হতভাগ্য মা যাকে ছেলের বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দূরে ঠেলে না দিয়ে কাছে টানার চেষ্টা করতে হয়েছিল। তবে তা যে কী ভীষণ রকম কঠিন কাজ ছিল, মুখে বলে বোঝাতে পারব না। লজ্জা আর ঘৃণা প্রতিমুহুর্তে সাঁড়াশি হয়ে আমার গলা টিপে ধরতো। মনে হত, এর চেয়ে মরণ ভালো। তবু জীবন্মৃত হয়ে ছেলের বেড়ে ওঠার গোপন কথা শুনতে হত, দেখতেও হয়েছিল।
    ও তখন বছর পনেরো। একদিন দুপুরে আমার কাছে এসে, পাশে বসে নিজের জামা খুলে…। মা হয়ে মেয়ের ‘মেয়ে হয়ে ওঠা’ চোখে দেখা যায়। আমার মা যেমন আমাকে দেখেছিল। দেখেই কোলে টেনে নিয়েছিল। আদর করতে করতে বলেছিল, আহা রে। আমার মেয়েটা এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল। এবার তো মেয়ের বিয়ে দিতে হয়। মোটেও না। আমি বিয়েই করব না। মায়ের কথা শুনে এরকম কিছু একটা বলে মায়ের বুকে মুখ গুঁজেছিলাম। মা-ও ‘পাগলি কোথাকার’ বলে জড়িয়ে ধরিয়েছিল। কিন্তু আমি আমার ছেলেকে তেমনভাবে জড়িয়ে ধরতে পারিনি। কোন মা-ই পারবে না। মেয়েদের মতো ছেলের বুক ওঠা দেখে, তার উপর ছেলে যদি লজ্জার মাথা খেয়ে জামা খুলে সেই বুক হাট করে খুলে দেখায়, কোন মা পারবে তাকে কাছে টেনে নিতে? পারবে না। বরং অমন দৃশ্য দেখার পর পাথর হয়ে যাবে। আমিও হয়েছিলাম। পাষানী মা।
    ওই মুহুর্তে ছেলেকে কি বলা উচিৎ ছিল, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একবার মনে হয়েছিল, ও যে বারবার নিজেকে মেয়ে বলত, মেয়ে ভাবতো তবে কি তা সত্যি! পরক্ষণেই মনে হয়েছিল তা কি করে সম্ভব! এখন না হয় ও বড়ে হয়ে গিয়েছে। ক’বছর আগেও ওকে চান করিয়ে দিয়েছি, জামা প্যান্ট পরিয়ে দিয়েছি, ওর শরীরের প্রতিটই কণায় তেল মাখিয়েছি। না, না, আমার ভুল হতে পারে না। ও মেয়ে নয়, ছেলে। আমার ছোট ছেলে। কিন্তু একটু আগে ও যা দেখিয়ে গেল আর নিজের চোখে তা দেখেওছি তাও তো ভুল নয়। সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল। ওকে তাই ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। বুক ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু ওই যে বললাম আমি এক পাষানী মা। পাষানের বুক ফাটলেও মুখ ফোটে না। ছেলে আমার চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। যাওয়ার সময় একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখেওছিল। তখন ওর দু’চোখ জলে ভরে টলটল করছিল। আমি মা হয়ে ছেলের সেই জল ভরা চোখ মুছে দিতে ছুটে না গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বালিশে মুখ গুঁজেছিলাম।
    বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগেছিল নিজেকে সামলাতে। সামলে নেওয়ার পর, মনে হয়েছিল ওর বাবাকে সব জানাই। মায়েরা যদি মেয়ের বন্ধু হয়, তাহলে বাবা হয়ে নিশ্চয় ছেলের বন্ধু হবে। কিন্তু ফোনে একটুকু শুনেই ওর বাবা খেঁকিয়ে উঠে বলেছিল, বাড়িতে তো ছুরি আছে। যাও ছুরি দিয়ে ওই দু’টো কেটে দাও। সব ল্যাটা চুকে যাবে। বলেই ফোনটা কেটে দিয়েছিল। কিন্তু আমার কেমন করে কাটব! নাড়ি কেটে দিলেও তার দাগ যে আজও রয়ে গিয়েছে। ওর শরীরের সেই জন্মদাগ প্রতিমুহুর্তে জানান দেয়, যে ও আমার ছেলে।
    সেদিনই রাতের অন্ধকারে পাড়ার ডাক্তারের কাছে ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কোনোরকমে বলেছিলাম ওর সমস্যার কথা। ডাক্তার ওষুধও দিয়েছিল। কোন ফল হয় নি। উল্টে ক’মাস যেতে না যেতেই যা হয়েছিল তা শোনার পর কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠেছিল। বিষ খেয়ে মরতে ইচ্ছে করেছিল। ঠাকুরঘরে ছুটে গিয়ে মাথা কুটে বলেছিলাম, হে ভগবান আগের জন্মে কী এমন পাপ করেছিলাম যে এজন্মে এমন শাস্তি দিচ্ছ।
    ছেলেটাও তেমন বেহায়া হয়ে গিয়েছিল। নির্লজ্জ কোথাকার। নইলে ছেলে হয়ে কোনো মাকে ওসব কথা কেউ বলতে পারে! ছেলে এসে বলে কিনা ওর ওখান দিয়ে রক্ত ঝরার মতো করে সারাদিন রাত ফোঁটা ফোঁটা কিসব বের হচ্ছে। আগের মাসেও নাকি তিন চার দিন ধরে এমন হয়েছে। উঃ! কী ঘেন্না! কী ঘেন্না! সারা শরীর রি রি করে উঠেছিল। কিন্তু সেই ঘেন্না নিয়েও আমাকে আবার ছুটতে হয়েছিল ডাক্তারের কাছে। গর্ভে ধারণ করেছিলাম যে। তাই ওর বাবা অমন ছেলেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে চাইলেও আমি শেষ চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছিলাম। ছেলেটা যেন স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, মা হয়ে শুধু সেটুকু দেখার জন্যই ওসব করেছিলাম। তবে কোন লাভ হয় নি। আমার ছেলেটা জন্মেইছিল মেয়ে সেজে ঘুরে বেড়াবার জন্য।

     


    উপুর হয়ে বালিশে বুক
    পিসতুতো দাদা দিল সুখ

    কী নরম কাঁধ, হাত, কোমর। বুক জুড়ে নরম মাংস। মেয়েদের মতো সবই তো আছে আমার। তবু কেন আমি মেয়ে নই? এসব ভাবতাম আর নিজেই নিজের শরীরে হাত বুলোতাম। বুলোতে বুলোতে মনে হত, না না তফাৎ তো একটু আছে। আর সেই তফাৎ আমার গোপনাঙ্গ। ওই তফাৎটুকুর জন্যই আমি মেয়ে নই। তখন মনে হত, ওইটুকুই সব? বাকী শরীরটা কিচ্ছু নয়! আমার সমস্ত শরীর আর মন তো প্রতিমুহুর্তে বলত আমি মেয়ে। আর তাই একজন মেয়ে যেমন করে নবযৌবনে তার শরীরটাকে সাজায় আমিও তাই করতে লাগলাম। মাথায় চুল রাখতে শুরু করলাম। দুই হাতের নখে নেলপালিশ, ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে আইলাইনার, কানে দুল, নাকে নাকছাবি। পোশাকেও নারীসুলভ ভাব। মানে এমন কিছু পড়তাম যা সরাসরি মেয়েদের পোশাক না হলেও দেখলে মেয়ে মেয়ে মনে হবে।
    বাড়িতে সেই নিয়ে অশান্তি হবে জানতাম। তবে আমিও ঠিক করেছিলাম। অনেক সহ্য করেছি, আর না। মারুক, কাটুক আমি মেয়েই হব। হব বলছি কেন আমি তো মেয়েই। শরীরে একটু ভুল থাকতে পারে। কিন্তু মনের দিক থেকে আগাগোড়া আমি মেয়ে। তাইতো ছেলেদের দেখলে আকৃষ্ট হতাম। স্কুল যেতে আসতে রাস্তাঘাটে, বা বাসে অটোয় ছেলেদের ছোঁয়া লাগলে কেঁপে উঠতাম। তাই মেয়েরা যেমন করে ছেলেদের ছোঁয়াচ এড়াতো আমিও তাই করতাম। তাই দেখে প্রায় সবাই হাসাহাসি করত। তবে আমার ওসব সয়ে গিয়েছিল। আর কোন ভ্রুক্ষেপ করতাম না। এটুকু বুঝেছিলাম, বাঁচা শিখতে হলে আমাকে এমনই হতে হবে।
    হয়েও উঠছিলাম। সেই হয়ে ওঠাটা দেখানোর জন্য বাড়িতে মেয়েদের পোশাক পরা শুরু করে দিয়েছিলাম। দিনের বেলাতেও নাইটি পরে থাকতাম। তাই দেখে দাদা কথা বলা বন্ধ করে দিল। মাও এড়িয়ে এড়িয়ে চলতো। আর আমি তখন আমাকে নিয়ে এমনই ব্যস্ত থাকতাম, ওসব দেখে একটুও কষ্ট পেতাম না। বরং ভালো লাগতো একা একা থাকতে পারতাম বলে।
    এমন করেই বেশ কাটছিল। তাল কাটলো এক নিঝঝুম দুপুরে। ততদিনে আমার হাঁটা-চলা- শোওয়া-বসা সবই মেয়েদের মতো হয়ে গিয়েছিল। সেই অভ্যেসেই উপুড় হয়ে বুকে বালিশ দিয়ে বই পড়ছিলাম। আর পা দু’টো ভাঁজ করে উপুরে তুলে দোলাচ্ছিলাম। স্বাভাবিকভাবে নাইটি তলার দিকটা উল্টে গিয়ে আমার পা থেকে ঊরুদেশ পর্যন্ত নগ্ন হয়ে গিয়েছিল। আর ঠিক তখনই পিসতুতো দাদা এসেছিল আমাদের বাড়ি। মা মনে হয় কোথাও গিয়েছিল। দরজা খোলা পেয়ে সরাসরি দাদার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ঢুকে পড়েছিল ঘরের ভিতর। দাদা বাড়ি ছিল না। তাই কোন সাড়া না পেয়ে এঘর ওঘর উঁকি দিতে দিতে তার চোখ পড়েছিল আমার উপর। আমিও তার ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম কে এসেছে। সেই দেখাদেখি ওকে এমনই আকৃষ্ট করেছিল যে ও ঘরে ঢুকতে বাধ্য হয়েছিল। আমিও বুঝতে পারিনি আমার ভিতর কতটা শরীরের খিদে লুকিয়েছিল। ওকে দেখেই সেই খিদে চাগাড় দিয়েছিল। ও-ও আমাকে চটকে-আঁচড়ে-কামড়ে খেয়েছিল সেদিন। সেই প্রথম কোন পুরুষ আমার শরীরটা দেখে হা হা হি হি না করে আঁকড়ে ধরেছিল। আকৃষ্ট হয়েছিল আমার শরীরের প্রতি। তাই আমিও প্রেম নয়, ভালোবাসা নয়, ভবিষ্যতের জন্য কোন প্রতিশ্রুতি নয়, শুধুমাত্র সেই মুহুর্তের ভালোলাগাটুকু উপভোগ করতে সব উজার করে দিয়েছিলাম। পেয়েওছিলাম শরীরী সুখ।

    সেই সুখ আমাকে যেন নদীর মতো ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমার তখন একটাই লক্ষ্য সাগর সঙ্গম। তার জন্য কুল ভাঙতে হলে ভাঙব। ভেঙেওছিলাম।
    কদিন পর থেকে কলেজে যাওয়া শুরু করেছিলাম শালোয়ার কামিজ পরে।

     

    চলবে…… 

  • ধারাবাহিক

    আয়নামহল (পর্ব-১)

    আয়নামহল (পর্ব-১)
    -সঞ্জয় গায়েন

     


    গাঁয়ের মেলায় মেয়ে সাজানো,
    মামি বলল লোক হাসানো

     

    আমি তখন বছর দশেক কি বছর এগারো হব। সঠিক মনে নেই। প্রাইমারী স্কুল ছেড়ে হাইস্কুলে পড়ছি। এটুকু মনে পড়ে। তো সেই সময় আমাদের গাঁয়ে বৈশাখ মাসে বড় করে গোষ্ঠমেলা হত। আর সেই মেলায় গাজন হত। গাজন গান নয়, শুধু গাজন। সঙ সাজানো। গাঁয়ের ছেলে মেয়েদের রাধা, কৃষ্ণ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, অর্জুন,ভীম, রাম, সীতা এসব সাজিয়ে ভ্যানে দাঁড় করিয়ে ঘোরানো হত মেলার মাঠে। চুনকালি মাখিয়ে যাহোক করে সাজানো হত না কিন্তু। রীতিমতো বাইরে থেকে ভালো মেকআপ ম্যান আসতো। গাড়ী ভর্ত্তি করে কত্ত ড্রেস আসতো। সে এক এলাহি ব্যাপার। আর তা দেখতে উপচে পড়তো ভীড়। সঙ সাজানোর পর কেউ কিন্তু সঙ বলে হাসাহাসি করত না। সবাই বলত, জীবন্ত ঠাকুর। দু’ হাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করত কতজন।
    সেই মেলায় আমিও সঙ সাজতে গিয়েছি। পাড়ার দাদারা বলে গিয়েছিল। সেইমতো আমি দুপুর দুপুর চলে গিয়েছি। তখন অতটা কেউ আসে নি। তবে মেকআপ ম্যানরা এসে গিয়েছিল। আমিও সাত পাঁচ না ভেবে সামনের চেয়ারে বসে পড়েছিলাম। মেকআপ ম্যান কি বুঝলো কে জানে। আমি কি সাজব জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না। টেবিলে রাখা একটা মেকআপ টিউব থেকে একটুখানি ক্রিম বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, এটা মুখময় মেখে নাও তো ভালো করে। আমি যথারীতি তেমন করলাম। তারপর চোখ বুজিয়ে বসেছিলাম আধঘন্টাটাক। সেই চোখ বোজা অবস্থায় এটুকু বুঝতে পারছিলাম মেকআপ ম্যান আমার মুখে কত কি মাখিয়ে চলেছে। কি মাখাচ্ছে, কেন মাখাচ্ছে কিংবা আদৌ কিছু মাখাচ্ছে কিনা কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। দেখার দরকারও ছিল না। কেননা মেকআপ ম্যান তার দুই হাত দিয়ে যেভাবে আমার মুখটাকে আদর করছিল তাতেই আমি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল অনন্তকাল আমি এভাবে ঘাড়টা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে থাকতে পারি অমন আদর পেলে।
    মেকআপ শেষ করে মেকআপম্যান যখন ছোট আয়নাটা আমার মুখের সামনে ধরল, আমি তো থ! এ কার মুখ! এটা আমি! নিজেই নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। তবে আমার অবাক হওয়ার তখনও অনেক বাকী ছিল। মেকআপ শেষ হওয়া মাত্রই আমার ডাক পড়ল ড্রেস পরার জন্য। যথারীতি ড্রেসআপ ম্যানও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। সব যেন আগে থেকে ঠিক করা আছে। তাই চুপচাপ যন্ত্রবৎ কাজ করে চলেছেন। শুধু যাকে সাজানো হচ্ছে সে জানে না কি সাজছে। তার জিজ্ঞেস করারও জো নেই। মুখ ফুটে কিছু বলার জন্য একটু ঠোঁট ফাঁক করিছি কি করিনি, অমনি ধমক, উঁহু কথা নয়, মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে। অগত্যা চুপ থাকা। এবং ড্রেসআপ ম্যানের নির্দেশ মতো সাজঘরেও চোখ বুজিয়ে দাঁড়ানো।
    মিনিট দশেক পরে আমার তো চক্ষুস্থির। আমাকে এক দেবী সাজে সাজানো হয়েছে। নাম জানি না কোন্‌ দেবী। কিন্তু পরনের শাড়ি, আর মাথার মুকুট জানিয়ে দিচ্ছিল আমি এখন জীবন্ত কোন দেবী। অন্তত আজকের মেলা শেষ না হওয়া অবধি।
    অস্বীকার করব না, সেদিন আমাকে অমন সাজে সাজানো ভালোই লেগেছিল। তখন ওই বয়সে আমার শরীরটা ছেলের মনটা মেয়ের এত অনুভুতি আসে নি। কিংবা হয়তো এসেছিল আমি বুঝতে পারি নি। না, না, নিশ্চয় এসেছিল। নইলে আমার মন যদি ছেলেদের মতো হত তাহলে আমার তো রেগে যাওয়ার কথা। কই সেদিন রাগ হয় নি তো। তবে এটা মনে আছে, আমি আসতে আসতে ড্রেসআপ ম্যান কাকুকে বলেছিলাম, কাকু, আমি তো মেয়ে নই, ছেলে। তবু আমাকে মেয়েদের মতো সাজালে কেন?
    কাকু কি বুঝেছিল কে জানে। উলটে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এমন সেজে তোমার কি মন খারাপ করছে?
    – নাঃ! তা করে নি। আমি মুখ ফুটে বলে ফেলেছিলাম।
    -আমরা বুঝি। তাই তো সাজালাম। কাকু সুন্দর করে হেসে বলেছিল। আরও বলেছিল, যে যাই বলুক, কারও কথা শুনবে না। মন যেমন চাইবে তেমন সাজবে। মনে রাখবে শরীরটা তোমার, তাকে অন্য কেউ সাজিয়ে দেবে কেন? তুমিই তোমার মনের মতো করে এই শরীর সাজাবে। তারপর তা তুলে দেবে তোমার স্বপ্নের মানুষের হাতে।
    -ও কাকু, কী সব কথা বলছ। বুঝতে পারছি না তো।
    -বুঝবে বুঝবে, আর একটু বড় হও, সব বুঝবে। বলেই কাকু আর একজনকে ড্রেস পরাতে চলে গিয়েছিল।
    কাকুর সেদিনের সব কথা বুঝি নি। মনেও থাকে নি। তবে ওই মন যেমন চাইবে তেমন সাজবে কথাটা খুব ভালো লেগেছিল। সেই ভালো লাগা নিয়ে চুপ করে বসেছিলাম সারা বিকেল। তারপর সন্ধ্যে নামলো। শুরু হল মেলা। ভ্যানে উঠে আমি স্ট্যাচু হয়ে দেবী ভঙ্গিমায় কিভাবে দাঁড়াব সেই কথা ভাবছিলাম, ঠিক তখনই আর একজন উঠে এল আমার ভ্যানে। রাজপুত্র সাজে। এসেই আমার ডানদিকে দাঁড়িয়েছিল মনে আছে। তারপর মেলা কমিটির কোন একজন এসে বলে গিয়েছিল, আমি নাকি মোহিনী আর আমার পাশে আমার স্বামী আরাবন।
    সেদিন হাজার হাজার লোক আমাদের দেখেছিল। আর সবাই দেখবে ব’লে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে আমার হাত পা অসাড় হয়ে গিয়েছিল। তবু কষ্ট করে মুখ বুজে ছিলাম। মানুষ আমাদের দেখছে, দেখে ভালো বলছে। এমন প্রশংসা সব কষ্ট দূর করে দেয়। শুধু কি তাই! মেলা শেষে সাজার জন্য একটা পুরস্কারও দিয়েছিল।
    আমি পুরস্কার নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম হাসিমুখে। মেকআপ না তুলেই। ভেবেছিলাম, দেখব আমাকে কেউ চিনতে পারে কিনা। ও মা, আমাকে সবাই চিনে ফেলেছিল। এবং এই নিয়ে কিছু কথা কাটাকাটিও হয়েছিল। আর মা উনুন থেকে জ্বলন্ত কাঠ বের করে পুড়িয়ে দিয়েছিল আমার হাত। মা এমনিতেই উঠতে বসতে মারতো। ভালোও বাসতো। কিন্তু মেলায় মেয়ে সাজানোর জন্য অমন হাত পুড়িয়ে দেবে ভাবতে পারিনি। তবে মায়ের কোন দোষ ছিল না। পাড়ার লোকেরা যখন তখন আমার নামে যা ইচ্ছা নয় তাই বলতো। মা কত সহ্য করতো বলুন তো। ওই যে মেলার দিন, মেলা উপলক্ষ্যে আমাদের বাড়ি আসা আমার মামিই তো মাকে শুনিয়ে বলেছিল, দিদি তোমার ছেলেটা এমনিতেই দিনদিন মেয়েলি হয়ে যাচ্ছে, তার উপর অমন মেয়ে সাজিয়ে আর লোক হাসিও না। তাই শুনেই মা মাথা গরম করে হাত পুড়িয়ে দিয়েছিল। মেয়ে সাজার আমার প্রথম পুরস্কার ছিল সেটা।

    নানা জনের নানান কথা,
    কেউ বোঝেনি মায়ের ব্যথা

    ছেলেটা ছোট থেকেই মা ন্যাওটা ছিল। সবসময় আমার আঁচল ধরে ঘুরতো। ঘর-বার যাই করতাম পায়ে পায়ে পিছু নিত। কুটনো কুটি, রান্না করি, স্নানে যাই, শাড়ি পড়ি ও পাশে থাকতোই। আমিও থাকতে থাকতে ওকে পাশে খুঁজতাম। আর এটা ওটা ফাই ফরমাস করতাম। হাসিমুখে করেও দিত। বুঝতাম আমার ঘরকন্নার কাজ ওর খুব ভালো লাগতো। তাইতো সারাটা দিন রান্নাবাটি ছাড়া অন্যকিছু খেলতে চাইতো না। কিন্তু যখন একটু বড় হল, এই ধরুন ন’দশ বছর তখনো ঘর আর স্কুল, স্কুল আর ঘর। তখন কেমন যেন বিরক্ত লাগতো। যদিও ও আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। শাড়ির পাড় ধরা, কুটনো কেটে দেওয়া, আর ঘুমোনোর সময় আমার গলা না জড়িয়ে তো ঘুমোতোই না। তবু বিরক্তই লাগতো। কই আমার বড় ছেলেটা তো অমন নয়। বু খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার পরেই ও কাছছাড়া, কোলছাড়া। আর ছোটটা যেন যত বড় হচ্ছিল তত বেশি করে কাছে আসছিল। শেষে বিকেল হলে, আমি জোর করে ওকে খেলতে পাঠাতাম। ছেলেদের মতো বাইরে। মাঠে। কিন্তু প্রায়দিন ছেলে আমার কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরতো। আর একটাই বুলি, ছেলেদের সঙ্গে আমার খেলতে ভালো লাগে না। ওরা পচা, ওরা বাজে। মা হয়ে ছেলে কাঁদলে, খেলতে না চাইলে কি করে জোর করতাম বলুন তো? তবু আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শি সবাই যখন বলতো, তোর ছোট ছেলেটা অমন কেন রে? সবসময় মেয়েদের সঙ্গে মিশতে চায়। হাঁটাটাও তো মেয়েদের দেখে নকল করে। আর যখন বসে পা মুড়ে, কোমর বেঁকিয়ে…ছি ছি। কিছু মনে কোরো না, তোমার জন্যই এমন হচ্ছে কিন্তু। তোমায় দেখেই শিখছে। ছোট ছেলে ব’লে এত আদর দিয়ে আঁচলে বেঁধে রেখো না। ছেলেকে ছেলেদের মতোই মানুষ করতে হয়। এসব কথা শুনতে শুনতে কান পচে যেত। রাগে ওকে মারতাম। বকতাম। আর ও বালিশে মুখ গুঁজে সারাদিন ঠোঁট ফুলিয়ে নাক টেনে কেঁদে যেতো। আমি তো মা, ছেলে কাঁদলে, না খেলে কি যে হয় একমাত্র মা-ই বোঝে। তবু ওর মুখ চেয়ে, ওকে ছেলেদের মতো করে গড়ে তুলতে ওর সামনে নিজের দুর্বলতা দেখাতাম না। ওকে আরও বেশি করে বকতাম। ও হয়তো ভাবতো ওর মা ওকে ভালোবাসে না। ওকে যে ওর ভালোর জন্যই বকতাম, মারতাম সেটা যদি বুঝতো ও নিজেকে পাল্টাতে চাইতো। কিন্তু লক্ষ্য করতাম, ও নিজেকে পাল্টাতে চেষ্টা না করে আরও জেদ করতো। খেতে বসলে ছেলেদের মতো বাবু হয়ে না বসে মেয়েদের পা দু’টো পাশে মেলে দিয়ে বসতো। সে জন্য কী মারটাই না খেত। কিন্তু অবাক হতাম, ও মুখে মুখে কোনদিন তর্ক করতো না। মার খেয়ে দু’চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তো ভাতের থালায়। তাও মুখ বুজে খেয়ে যেতো। তবু একদিনও ওর দাদার মতো বাবু হয়ে খেতে বসতো না। মাঝে মাঝে মনে হত ও যেমন করে বসে খেতে চাই, খাক। কী এমন ক্ষতি তাতে। পরক্ষণেই মনে হত, না না, ওকে প্রশ্রয় দিলে ও আরো বেশি মেয়েলি আচরণ করবে। তাই আঁচলে মুখ চেপে আরও কঠোর হয়েছিলাম।
    এভাবেই চলছিল। নানা জনের নানা কথা শুনতে শুনতে। শুনতাম, আর ব্যথায় টনটন করতো বুকখানি। ইচ্ছে করতো ওকে যে বুকের দুধ খাইয়ে বড়ে করেছি, সেই বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরি, হাপুস নয়নে কাঁদি। বাছা আমার প্রত্যেকটা দিন মার খেত। একটা দিনও আদর পেতো না।
    কিন্তু একদিন এমন কান্ড করে বাড়ি ফিরেছিল রাগটা সেদিন আর দমিয়ে রাখতে পারি নি।
    আমাদের গাঁয়ের মেলায় গাজন সাজতে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম, ভালো হয়েছে, ছেলে একা একা বাইরে বের হতে শিখবে এইভাবে। কিন্তু সেজেছিল মেয়ে। ছোটবেলায় অনেক ছেলেকেই আদর করে মেয়ে সাজানো হয়। কিন্তু আমি জানতাম, আমার ছেলেকে ওরা আদর করে ভালোবেসে সাজায় নি। ওর গড়ন, ওর চালচলন একটু মেয়েলি ছিল বলে ব্যঙ্গ করতেই তেমন সাজিয়েছিল। একটা মায়ের কাছে এটা কতখানি ব্যথার তা অন্য কেউ বুঝবে না। আমি বোঝাতেও পারবো না। তাইতো সেই ব্যথার রাগে সেদিন আমার ছেলেটার হাতটা উনুনের জ্বলন্ত কাঠ দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলাম। ও মা গো, মা গো, বলে চিৎকার করে উঠেছিল, আর আমি মা হয়ে সেদিন ওকে বলেছিলাম, আজ থেকে আমি তোর মা নই।


    লিপস্টিক দিয়ে খেলাম চড়
    শরীর জুড়ে এল যে জ্বর

     

    মামার ছেলের জন্মদিন না অন্য কি একটা অনুষ্ঠান ছিল। আমাদের সবার নিমন্ত্রণ। কিন্তু বাবা কাজে যাবে, যেতে পারবে না। দাদার সামনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। কোচিং বা স্কুল কামাই করতে পারবে না। তাই যাবে না। যাওয়ার মধ্যে ছিলাম আমি আর মা। আমি তখন ক্লাস সেভেন বা এইটে পড়ি। আমার একদিন স্কুল ছুটি করলে কিচ্ছু অসুবিধে নেই। কিন্তু সকাল থেকেই আমার শরীরটা খারাপ। বমিও হয়েছিল মনে হয়। আমার তো তখন একটু কিছু হলেই বমি হত। কত লোকের যেমন ঠান্ডার হাত, আমার তেমন বমির ধাত। আর বমি হলে কি বলো তো শরীরটা খুব হালকা হয়ে যায়। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। এদিকে মা আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। যাওয়াটা বন্ধ করে দেবে, নাকি অসুস্থ হওয়া স্বত্ত্বেও আমাকে সঙ্গে নিয়েই যাবে। অবশ্য আমার এমন কিছু শরীর খারাপ করে নি। যাওয়া যেতেই পারতো। কিন্তু মামার বাড়ি যাওয়াটা আমি খুব একটা পছন্দ করতাম না। শুধু মামার বাড়ি কেন, কোন আত্মীয় বাড়ি যেতেই আমার ভালো লাগতো না। মা সেটা জানতো। তাই মা বেশ সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল সেদিন। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাকে লক্ষ্য করছিলাম। মা ইতস্তত ভাব নিয়েই টুকিটাকি কাজ সারছিল। শেষে আমিই সমস্যাটার সমাধান করে দিয়েছিলাম। মাকে ডেকে বলেছিলাম, তুমি একাই যাও না। ঘুরে এসো। আমার কোন অসুবিধে হবে না।
    মা যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। আসলে আমি মাকে এমনিতেই সারাক্ষণ আঁকড়ে থাকতাম। আর শরীর খারাপ হলে তো একেবারে কাছ ছাড়া করতাম না। বিরক্ত হলেও মাও আমার কাছ থেকে যেতে পারতো না, সেই মা দেখল, আমি নিজে থেকে বলছি, আমার কোন অসুবিধা হবে না। আমার এমন কথা শুনে মা খুশিই হয়েছিল। খুব মনে আছে, মা তখন পাশে বসে আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলেছিল, এই তো ছেলে আমার বড় হয়ে গিয়েছে।
    –কি করে বুঝলে আমি বড় হয়ে গিয়েছি। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করেছিলাম।
    –বা রে, বড় না হলে কেউ মাকে ছেড়ে একা একা থাকতে চায় না। বলেই মা উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। হয়তো ভেবেছিল আর কিছুক্ষণ থাকলেই যদি আমি আমার মত পালটে ফেলি। যদি বলি, আমি এক্ষুনি বড় হতে চাই না মা…। এর আগে তো কতবার অমন করেছি। মা আমার ঘর ছেড়ে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিন বলেছিল, তাহলে আমি তোর মতো রান্না করে রেখে যাচ্ছি। শুধু নিয়ে খেয়ে নিস।
    তারপর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই মা রেডি হয়ে আমার মাথায় আর একবার হাত বুলিয়ে চলে গিয়েছিল মামার বাড়ি। আমি মনে হয় তারপরেও বেশ কিছুক্ষণ বালিশ আঁকড়ে শুয়েছিলাম। শুয়ে শুয়ে কত কি ভাবছিলাম। হঠাৎ মনে পড়েছিল, ড্রেসআপ ম্যান কাকুর কথা। মন যেমন চাইবে তেমন করে সাজাবে। আমার মন কি চাই? কিরকম সাজতে ভালোবাসে?
    মন কি চায়, জানার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠে নিজেকে দাঁড় করিয়েছিলাম মায়ের ড্রেসিং টেবিলের সামনে। পেট থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যায় এমন একটা আয়না ফিটিং ছিল সেই ড্রেসিং টেবিলের সঙ্গে। সেই আয়নায় নিজেকে দেখেছিলাম অনেকক্ষণ। নিজের ভ্রু, চোখ, নাক, ঠোঁট , চিবুক, গলা স-অ-ব দেখছিলাম। দেখতে দেখতে নিজের অজান্তেই গায়ের জামাটা কখন খুলে ফেলেছিলাম খেয়াল ছিল না। শুধু হঠাৎ মনে হল, আয়নার ওপারে নগ্ন যে দাঁড়িয়ে ছিল সে একটা ছেলে নয়, মেয়ে। সত্যিকারের মেয়ে। নইলে তার অমন কুসুম কুসুম বুক হবে কেন। এর আগে মায়ের বুক দেখেছি। লুকিয়ে লুকিয়ে। নিজের বুকেও ছোট্ট হলেও অমন বুক উঠতে দেখে মনে হয়েছিল, আমিও তাহলে মায়ের মেয়ে।
    দেখামাত্রই আমি পাগলপারা। শুধু মনে হচ্ছিল, এই জন্য এতদিন আমার মেয়েদের সবকিছু ভালো লাগতো। সেদিন ছুটে গিয়ে দরজা জানলা বন্ধ করেছিলাম। পুরো বাড়ি ফাঁকা। ঘরে কেউ নেই। তবু কেউ যদি দেখে ফেলে, কিংবা কেউ হঠাৎ এসে পড়ে…।
    বন্ধ করেই আলনা থেকে মায়ের একটা শাড়ি পেরে নিয়েছিলাম।
    ছোট থেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের শাড়ি পরা দেখতাম। পাড় ধরে দিতাম। কেমন করে চোখে কাজল দিত, কপালে টিপ পরত, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতো সব দেখতাম। ড্যাব ড্যাব করে। মা বকতো। তবু আমি দেখতাম।
    তাই অনায়াসেই মায়ের শাড়িটা পেঁচিয়ে নিলাম সারা শরীরে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা মায়ের কাজল দিলাম চোখে। টিপের পাতা থেকে একটা লাল টিপ খুলে লাগালাম কপালে। তারপর লিপস্টিক দিয়ে রাঙিয়েছিলাম আমার ঠোঁট। তারপর দুচোখ তুলে দেখি, আয়নার ওপারে এক কিশোরীই দাঁড়িয়ে।
    হঠাৎ বাইরের দরজায় ঠক ঠক ঠক। আমি তো ভয়ে কাঁটা। এমন দুপুরে কারও তো আসার কথা নয়। আবার ঠক ঠক। সঙ্গে চিল চিৎকার, ওই সমু দরজা খোল্‌। দাদার গলা। দাদা এখন? কি করি এবার। তাড়াহুড়ো করে শাড়িটা খুলে জামাটা পরতে পরতেই ছুটেছিলাম দরজা খুলতে। খেয়াল ছিল না রাঙানো ঠোঁটের লিপস্টিক মোছা হয় নি।
    দরজা খোলামাত্রই দাদা আমাকে দেখে আগুন হয়ে গিয়েছিল। কোন কথা না বলে দু’গালে ঠাস ঠাস করে চড় কসিয়ে দিয়েছিল। তারপর চুলের মুঠি ধরেও উদ্দুমুদ্দুম। আমি কিচ্ছু বলি নি। মুখ বুজে মার খেয়ে যাচ্ছিলাম। আসলে ছোট থেকে মা বাবা দাদা সবাই একটু কিছু হলেই আমাকে মারতো। আমি যেন মার খাওয়ার জন্যই জন্মেছিলাম। খেতামও। খেতে খেতে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। সহ্যও হত। আগে চিৎকার করতাম। একটু বড় হওয়ার পর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হত না। শুধু চোখ দিয়ে জল ঝরতো।
    দাদা বেশ কিছুক্ষণ মেরে মেরে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। তারপর আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল। আমিও কোনরকমে উঠে নিজের বিছানায় যেতে পেরেছিলাম। তবে এত মার খেয়েছিলাম যে উঠে ভাত খাওয়ার ইচ্ছে হয় নি। অবশ্য ওঠার শক্তিও ছিল না। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। জানি না। যখন চোখ খুলেছিলাম, বুঝলাম আমার সারা শরীর আগুন। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। আসতে আসতে আমার দুপুরের ঘটনা মনে পড়েছিল। জিভ বের করে ঠোঁটে বুলোতে বুলোতে বুঝেছিলাম, শুকনো ঠোঁটেও লিপস্টিকের দাগ লেগেছিল।


    চেয়েছিল ভাই ফোঁটা দিতে,
    পারি নি আমি মেনে নিতে

    ক্লাস নাইনে পড়তে পড়তেই জীবন বিজ্ঞানে পড়েছিলাম লিঙ্গ নির্ধারণের অধ্যায়। দেহ ক্রোমোজোম, সেক্স ক্রোমোজোম। এক্স ওয়াই থাকলে ছেলে। এক্স এক্স মানে মেয়ে। আর এক্স এক্স ওয়াই কিংবা এক্স ওয়াই ওয়াই এরকম কিছু থাকলে ছেলেও নয়, মেয়েও নয়। স্যার বলেছিলেন এরাই তৃতীয় লিঙ্গ। একেবারে জলের মতো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওসব ক্রোমোজোম টোমোজোম তো বাইরে থেকে দেখা যায় না। খালি চোখে কি দেখে বুঝবো কে তৃতীয় লিঙ্গ! বিজ্ঞান স্যার একটুতেই যা রেগে যেতেন ওসব জিজ্ঞেস করার সাহসই হত না। জানতে চাইলে হয়তো বলে দিতেন, বাইরে থেকে দেখে বোঝার জিনিস বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞান হল গবেষণা। তাই ওসব আজগুবি প্রশ্ন না করে মন দিয়ে মুখস্থ করো।
    আমার মনে হয়, উনিও বাইরে থেকে দেখে কিছু বুঝতে পারতেন না। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই আমার ভাই তৃতীয় লিঙ্গ ছিল আর ভাইও তো আমার স্কুলেই পড়তো, বিজ্ঞান স্যার ওদেরও ক্লাস নিত, কই স্যার তো ভাইকে দেখে কিচ্ছু বলতেন না। বুঝতে পারলে নিশ্চয় চুপ থাকতেন না।
    আমি তো ভাইকে ছোটবেলায় ন্যাংটো দেখেছি। ভাই পুরোপুরি আমার মতোই ছিল। মোটেও তৃতীয় লিঙ্গ ছিল না। একটা ক্রোমোজোম বেশি কিংবা কম হলে ভাইয়ের ওখানটা একটু তো আলাদা হত নাকি! কি জানি, বিজ্ঞান নাকি যা বলে সত্যি বলে। কিন্তু বিজ্ঞানের সেই সত্যি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করি কি করে?
    হ্যাঁ, তবে এটা ঠিক, ভাইয়ের হাঁটাচলা, কথা বলা, ওঠা বসা একটু অন্যরকম ছিল। আর ছেলেদের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসতো না। আমরা ছেলেরা যেমন ঝগড়া, মারামারি পছন্দ করি ও ওসব পছন্দ করতো না। ও মেয়েদের মতো পুতুল খেলা, রান্নাবাটি খেলা, ঘর সাজানো এসব খেলতে চাইতো। কিন্তু মেয়েরা ওকে নেবে কেন? নিতও না। উলটে বলত, যা দিনি এখান থেকে। ছেলে হয়ে মেয়েদের কাছে আসিস কেন? তুই ওদের মতো ফুটবল খেলতে পারিস না?
    কিন্তু ভাই ফুটবল না খেলতে এসে মেয়েদের সঙ্গে বউ বাসুন্তী খেলতে চাইতো। বউ সেজে উবু হয়ে বসে থেকে কী আনন্দ পেত ওই জানে। মেয়েরা ওকে তাড়িয়ে দিলেও এক আধদিন খেলতে নিত। বিশেষ করে যেদিন মেয়ে কম থাকতো।
    অস্বীকার করব না ওসব দেখে আমার রাগই হত। ছেলে হয়ে মেয়েদের মতো উবু হয়ে দুই হাঁটু জড়িয়ে বসত আর থুনতিটা রাখতো ওই হাঁটুর উপর। ওরকম দেখলে কার না রাগ হবে! নিজের ভাই বলে আমি তবু মেনে নিতাম। কিন্তু আমার বন্ধুরা? আমাদের পাড়ার ছেলেরা? সব্বাই ওকে দেখে হা হা হি হি করতো। এরপরে রাগ না করে থাকা যায়?
    মা তো এ জন্য প্রায়ই ওকে মারতো। কিন্তু ও এমন গাধা মার খেয়ে খেয়েও একটুও নিজেকে পাল্টাতে চাইতো না। চেষ্টাই করতো না। উলটে একদিন বাড়িতে কেউ ছিল না, সেই সুযোগে এমন কান্ড করেছিল, মনে পড়লে এখনো আমার গা রি রি করে ওঠে। মায়ের লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে মেয়ে সেজেছিল। শাড়িও পরেছিল মনে হয়। মায়ের ঘরে মেঝেতে সেদিন শাড়ি পরে থাকতে দেখেছিলাম। তো যাই হোক, সেদিন ভাইয়ের অমন লিপস্টিক লাগানো ঠোঁট দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারি নি। খুব মেরেছিলাম। পরে বুঝেছিলাম, ওভাবে মারা ঠিক হয় নি। তবু রাগের বশে না মেরে থাকতেও পারি নি। আসলে ও যদি নিজেকে শুধরোতে একটু চেষ্টা করতো তাহলে অমন মার খেত না। কিন্তু ও সেই চেষ্টা একদিনও করে নি। করলে ওকে সবাইই ভালোবাসতো।
    চেষ্টা তো দূরের কথা। অমন মার খাওয়ার পরের বছর, আমি তখন কলেজে ফার্স্ট ইয়ার। আমার কোন বোন নেই বলে, কলেজে থার্ড ইয়ারের একজনকে দিদি পাতিয়েছিলাম, তো ভাইফোঁটার দিন সেই দিদির বাড়ি যাব বলে বের হচ্ছিলাম, ভাই এসে বলে কিনা আমায় ফোঁটা দেবে। ও নাকি আমার বোন। শুনে মারবো বলে হাতও তুলেছিলাম। তবে ওই দিনে মুডটা খারাপ করতে চাই নি বলে মারি নি। শুধু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলাম। না দিয়ে কোন উপায়ই ছিল না। ভাই কে কি কখনো বোন বলে মেনে নেওয়া যায়? যায় না।

     

    চলবে…..

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- রূপান্তরকামী

    রূপান্তরকামী
    -সঞ্জয় গায়েন

    -দু’ একটা কথা বলতে না বলতেই শরীরের কথায় চলে এলে! তোমরা পারো বটে।
    – আসলে…
    – আসল নকল সব বুঝি। প্রথম রিপুর তাড়নাও বুঝি।
    – না, দেখ আমি কিন্তু…
    – অত কিন্তু কিন্তু করছ কেন? স্পষ্ট বলো কামিনী কাঞ্চন পাবার লাগি জনম আমাদের।
    – বাহ্। তুমি বেশ সুন্দর করে কথা বলতে পারো তো।
    – তা পারি। আসলে শিখতে হয়েছে। নইলে…
    – নইলে কি?
    – ওই যে ষড়রিপু। তোমরা ছেলেরা তো প্রথম রিপুর স্বাদ না পেলেই দ্বিতীয় রিপু প্রকাশ করো।
    – মানে!
    – আহা! যেন কিছুই জানে না।

    – সত্যি জানি না। তুমি বলো শুনি।
    – থাক আর জেনে লাভ নেই।

    – ও। বলবে না তো।
    – দেখলে তো এইটুকুতেই কেমন দ্বিতীয় রিপু প্রকাশ পেয়ে গেল। কিন্তু অমন রাগ যে ভাল নয়।
    – কি যে বলো! রাগ! তাও তোমার উপর! না গো। থাকতেই পারব না রাগ করে।
    – তাহলে কি পারবে? কি পারো তুমি? তোমরা? শুধু লোভ দেখাতে?
    – ছি! ছি! লোভ দেখাতে যাব কেন?
    – কারণ তোমার তৃতীয় রিপু।
    – প্লিজ। বিশ্বাস করো আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি।
    – এই তো। পেরেছি। আমি পেরেছি।
    কি পেরেছো?

    – কেন তোমাকে মোহাচ্ছন্ন করতে। অবশ্য আমি জানতাম তোমার ভিতরের চতুর্থ রিপু এভাবেই প্রকাশিত হবে।
    – দেখ অত কিছু জানি না। শুধু এটুকু বুঝেছি এই মুহুর্তে সব কিছু তুমিময়। তুমি আমার…
    – মদের নেশার মতো। তাই তো।
    – নেশা! একে তুমি নেশা বলছ!
    – হ্যাঁ। নেশাই তো। তুমি অবশ্য পঞ্চম রিপুর তাড়না বলতে পারো।
    – আমি অন্য কিচ্ছু বলতে চাই না। শুধু তোমাকে পেতে চাই। না পেলে কিন্তু…
    – ষষ্ঠ রিপুর প্রকাশ ঘটাবে তাই তো। কিন্তু হিংসা (মাতসর্য) দিয়ে কি কিছু পাওয়া যায়। কি গো?
    – না গো। পাওয়া যায় না। ষড়রিপু দিয়ে কিচ্ছু পাওয়া যায় না। সেজন্যই তো তোমার কাছে এসেছি।
    – কিন্তু আমি …
    – তুমি যে কামের রূপান্তর ঘটাতে পারো। কারণ তুমি রূপান্তরকামী।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- সুমনা

    সুমনা

    -সঞ্জয় গায়েন

     

    আমি তখন পনেরো। কদিন পরেই মাধ্যমিক পরীক্ষা। এই অজুহাতে বন্ধুদের সঙ্গে দোল খেলতে গোষ্ঠতলার মাঠে যাই নি। দোতলায় ছাদে গিয়ে বইয়ে মুখ ঢেকে শুয়েছিলাম। অনির্বান কখন যে চুপিচুপি সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছিল। টের পাইনি । তুই এখানে লুকিয়ে… আর আমি সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজছি। বলেই মুখ থেকে বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সারা মুখে রঙ মাখিয়ে ওর হাত তখন আমার বুকের কাছে। আমার কি যে হল, বুঝতে পারলাম না। শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল। অনি কি বুঝল কি জানি। বুক থেকে হাত না সরিয়েই আমার মুখের দিকে তাকালো। তারপর সিঁড়ির দিকে একবার তাকিয়েই আমাকে চিত করে শুইয়ে আমার উপর শুয়ে পড়ল। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ঘষতে লাগল। কী ভয়ংকর এক ভাললাগা! ও গোঙাতে গোঙাতে আমাকে জাপটে ধরছিল। আমিও একটুও বাধা না দিয়ে চুপচাপ মেনে নিচ্ছিনাম। আর মনে মনে বলছিলাম, অনি এভাবে অ-নে-ক ক্ষণ আমাকে জড়িয়ে থাক। পিষে ফেল আমার শরীর।
    বেশ কিছুক্ষণ পর, ও জোরে শ্বাস নিল। ডানহাত দিয়ে ভেজা ঠোঁট মুছতে মুছতে আমাকে ছেড়ে দিল। মুখে জয়লাভের হাসি। সামান্য হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, সুমন তোর শরীর রিয়ার থেকেও ভালো। আজ থেকে তোকে সুমনা বলে ডাকব।
    আমি এখন সত্যি সত্যি সুমনা হয়ে গিয়েছি। এস আর এস করে।
    কিন্তু অনির্বান আর আসে না। সুমনা বলে ডাকার জন্য।

You cannot copy content of this page