• অণু গল্প

    অণু গল্প- সহজিয়া

    সহজিয়া
    -সঞ্জয় গায়েন

    – সত্যি করে বলো তো আমাকে দেখে আগে মেয়ে বলে মনে হত?
    – হ্যাঁ।
    – নাঃ! তুমি মিথ্যে বলছ!
    – বা রে! শুধু শুধু মিথ্যে বলতে যাব কেন!
    – মেয়েদের মতো আমার তো কিচ্ছু ছিল না। শুধু মনে মনে আমি নারী ছিলাম। কিন্তু মনের অনুভব তো শরীরে থাকে না! তাহলে আমাকে দেখে মেয়ে মনে হত কি করে!
    – আমি তো বাইরেটা দেখি না। অন্তরের গভীরে…
    – সান্ত্বনা দিচ্ছ ! দিও না! আমি জানি পুরুষ নারীকে চেনে বুকের খাঁজ দেখে।
    – তাই বুঝি!
    – হুম।
    – সেজন্য বুঝি অমন সুডৌল স্তন তৈরি করেছো?
    – নাঃ! পুরুষকে সুখী করতে বা পুরুষ সঙ্গী পেতে এসব করি নি।
    – এবার তুমি মিথ্যে বলছ।
    – মোটেও না।
    – সত্যি বলছ তুমি চাও না একজন মনের মানুষ হোক?
    – তা চাইব না কেন?
    – তবে?
    – মনের মতো খুব কাছের একজন হোক সে তো চাই। কিন্তু সেই চাওয়া যেন শুধুই যৌনতার জন্য না হয়।
    – যদি তা হয়ও ক্ষতি কি? যৌনতার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে কেউ তো কাছে এসে ধরা দিতেই পারে।
    – কি বলছ তুমি! যৌনতা আবার কবে সৌন্দর্যের স্বীকৃতি পেল?
    – সৃষ্টির আদিকাল থেকে পেয়ে আসছে। শুধু…
    – শুধু কি?
    – শুধু এই আধুনিক যুগে এসে তাকে মোড়কে ঢাকার বৃথা চেষ্টা করা হচ্ছে।
    – উফ্‌! অত ভারি ভারি কথা বুঝি না। সহজ করে বলো।
    – সহজ করেই তো বলছি, চলো আজ থেকে আমরা সহজিয়া হয়ে যাই।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- জিয়নকাঠি

    জিয়নকাঠি
    -সঞ্জয় গায়েন

     

    পাঁচবছর অন্তর। পরিবর্তন প্রয়োজন। নইলে সেই একই মুখ। ভাল্লাগে না। একঘেয়েমি আসে। তাই সরকার নতুন মুখ পাওয়ার সুযোগ করে দেয়। সবার কাছে। আমাদের জীবনে এমনটা হলে মন্দ হয় না। প্রজ্ঞার একথা লেখার উদ্দেশ্য বুঝতে পারল না কৃষ্ণেন্দু। তাই ভ্রু কুঁচকে দু’চোখ নাচিয়ে ইশারা করল। মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল সে কিছু বুঝতে পারে নি। প্রজ্ঞা হাতের মুদ্রায় জানাল, পরে বলবে। দু’জনে আবার কমপিউটারের কী-বোর্ডে আঙুল চালানো শুরু করল। ওদের অফিসে কথা বলা নিয়ে বিশেষ নিয়ন্ত্রণ বিধি চালু আছে। তাই কাজের ফাঁকে কিছু বলার ইচ্ছে হলে ওরা স্ক্রিনে লিখে জানিয়ে দেয়। ওদের চেয়ার পাশাপাশি। একে অপরের রিপ্লাই দেয়া-নেয়া করতে অসুবিধা হয় না। এভাবে সারাদিন কাজ করে ওরা। গল্পগুজবও সেরে নেয়। লাঞ্চব্রেকে কৃষ্ণেন্দু ধরল প্রজ্ঞাকে।
    -এবার বল্‌। পাঁচবছর অন্তর পরিবর্তন চাই মানে কি?
    প্রজ্ঞা বলল, সত্যি কৃশ তুই ব্যাকডেটেড রয়ে গেলি আজও। কথা বুঝে নিতে হয়। কিছু কিছু।
    – তোকে বারন করেছি, আমাকে কৃশ বলবি না। আমি কৃষ্ণেন্দু। কৃষ্ণ যুক্ত ইন্দু। কৃষ্ণের সঙ্গে চন্দ্রের…
    – থামবি তুই। তোর পৌরাণিক গল্প শুনিয়ে আধঘন্টার লাঞ্চব্রেকটা বোর করে দিস না প্লিজ।
    – ওকে। বল্‌ কি বুঝে নিতে হবে?
    – শোন্‌ কলেজ লাইফে সুমন্তর সঙ্গে প্রেমটা পাঁচবছর হেভি এনজয় করেছি। তারপর পরস্পরের কাছ থেকে আর কিছু পাওয়ার ছিল না। শুধু শুধু একে অপরের দায় নিলে বোর হতাম। তাই বিয়ে করি নি আমরা। রঞ্জনকে বিয়ে করলাম। নতুন সাথী। নতুন রোমাঞ্চ। নতুন শিহরণ। কিন্তু বিয়ের ফিফথ্‌ অ্যানিভারসারি সেলিব্রেট করতে গিয়ে দু’জনেই ফিল করলাম আমাদের একঘেয়েমি এসেছে।
    – তাই রঞ্জনকে ডিভোর্স দিবি তাই তো? ভালো ল-ইয়ার চাই। খোঁজ নিয়ে কাল জানাবো।
    – না রে। ডিভোর্স করব না আমরা।
    – তাহলে?
    – সেটাই তো ভাবছি। তোর পৌরাণিক যুগে এর কোন সমাধান নেই?
    – পৌরাণিক যুগে দেবগণ বহুবিবাহ করতেন এই কারণে। কিন্তু তোরা মর্ডান লেডি। তোরা কি বহুবিবাহ মানবি?
    – ইয়েস মানব। তবে বহুবিবাহ নয়। বহুপ্রেম।
    – মানে!
    – রঞ্জনকে বলব, তুমি মেয়ে খুঁজে প্রেম করো। আমিও হ্যান্ডসাম কাউকে সার্চ করি। হেভি এনজয় হবে। থ্যাংক ইউ কৃশ। ইউ আর সো কিউট। যুগ যুগ জিও পুরাণকাব্য।
    কৃষ্ণেন্দু একেবারে থ। বিষ্মিত হয়ে বলে ওঠে, কি বলছিস তুই?
    – ইয়েস ডিয়ার। এ যুগে পরকীয়ায় আমাদের জিয়নকাঠি।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- বাংলার দুর্গা

    বাংলার দুর্গা
    – সঞ্জয় গায়েন

     

    এবার বৃষ্টি ভালো হয়েছে। জলাতেই বুক সমান জল। ধানগাছগুলো বাঁচার জন্য তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কোনোরকমে। খালেতে তো মাটির তল পাওয়া যাবে না। তাই সাঁতরে সাঁতরেই কলমী শাক তুলছে দুগ্‌গা। পীচরাস্তায় একটা কালো স্করপিও গাড়ী এসে দাঁড়ালো। হাঁটুর একটু নীচে পর্যন্ত ঝুল এমন প্যান্ট আর পাতলা গেঞ্জি পরা একটা লোক আর জিনস্‌ প্যান্ট ও হাফ হাতা জামা পরা একটি মেয়ে বাইরে এল। লোকটার সাথে ক্যামেরা। মেয়েটির হাতে মাইক্রোফোন।
    ও দিভাই, দিভাই… শুনছেন… মেয়েটি দুগ্‌গা কে ডাকছে।
    দুগ্‌গা মাথা তুলে তাকাতেই মেয়েটি আবার বলল, আমরা কলকাতা থেকে আসছি। টিভির জন্য ছবি তুলি। তোমার ছবি তুলবো।
    ও মা, সে কি কতা! গায়েতে বেলাউজ নেই! সব দেকা যাচ্চে। ওনারা এইচেন ছবি নিতে! দূর অ পোরামুকি! দুগ্‌গা খেদিয়ে দেয় ওদের।
    কিন্তু ওরাও সাত জায়গায় ঘোরা পার্টি। কোন্‌ রোগের কি ওষুধ ভালো করেই জানে।
    মেয়েটি হাসিমুখে বলে, ও দিভাই শুনবে তো। ছবি তুলতে দিলে পাঁচশো টাকা দেব।
    পরের মাসে। বাংলার দুর্গা প্রতিযোগিতায় ওই মেয়েটির তোলা ভিডিও ফার্স্ট হয়। টিভিতে দেখাচ্ছে। পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কারের চেক হাতে মেয়েটি ওর ছবি তৈরির গল্প শোনাচ্ছে। আর দুগ্‌গা নিজেকে টিভিতে দেখতে দেখতে গজগজ করতে থাকে, আসুক এবার। আবার বেলা পাঁচসো আর উনি পঞ্চাস হাজার। এমন করে কেউ কাউকে ঠকায়! সইবে নি কপালে!
    ওদিকে টিভিতে ঘোষণা করছিল যে সুন্দরী মেয়েটি সে বলে চলেছে,আপনারা দেখলেন হাংগার ফিগার কিভাবে শিল্পীর হাতে চমৎকার রূপ পায়! যাইহোক আজ এখানেই শেষ করতে হচ্ছে বাংলার দুর্গা প্রতিযোগিতার গ্রান্ড ফাইনাল। আবার দেখা হবে। অন্য কোন দিন। অন্য কোন অনুষ্ঠানে।

  • অণু গল্প

    অনু গল্প-কাঁচা সোনা

    কাঁচা সোনা
    -সঞ্জয় গায়েন

    সামনে হলুদ সরষের বন। দুপাশে লালগোলাপের ক্ষেত। মাটির দেয়াল আর খড়ের ছাউনি দেয়া সারি সারি ঘর। হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো তমাল গাছ ও বটবৃক্ষ তলায় বিরাট উঠোন। গোবর জলে নিকোনো। এরকম এক আশ্রমে ওকে দেখা। একমনে বাউল গান শুনছিল। হঠাৎই আমার চোখে পড়ে। একা বসে আছে। তবে কি সঙ্গীরা কাছেপীঠে কোথাও ঘুরছে? নইলে বাঙালী মেয়ের এত সাহস! কাছাকাছি থেকে এসেছে বলে তো মনে হচ্ছে না। পোশাকে শহরের চিহ্ন। গায়ের রঙ কালো হলেও রূপচর্চার লক্ষণ স্পষ্ট। ঘন্টাখানেক ধরে ওকেই দেখে গেলাম। কেউ এসে ওর পাশে বসে নি। ওর চোখেও কাউকে খোঁজার চাউনি নেই। নিশ্চিন্তে বাউলের কন্ঠে শুনে চলেছে- ঢলিয়া ঢলিয়া / ঢলিয়া ঢলিয়া / ঢলিয়া ঢলিয়া গো / বৈকুন্ঠ আসরে / সঙ্গীরা আসি ভিড় করে / আর বৈরাগী কলসী ভাসে / যমুনারই জলে…
    লক্ষ্য করলাম ওর শরীরে গানের ছন্দ খেলা করছে। আমি আর থাকতে পারলাম না। নিজেকে টেনে গিয়ে বসালাম একেবারে ওর কাছে। পাশে বসেও এত সুখ। আমার নিঃশ্বাস ওর ঘাড়ে। কিন্তু সে সবে এ মেয়ের হুঁশ নেই।
    দেখতে দেখতে সন্ধ্যে নেমে এল। এবার ওর চোখে মেঘের ছায়া। আমি ঠিক এই মুহুর্তটুকুর অপেক্ষাতেই ছিলাম। নিশ্চিত বৃষ্টির পূর্বাভাস। আমি ছাতা ধরব। মনে মনে প্রস্তুত। তবে ওকে আগে সাহায্য চাইতে হবে। আমি যে এতক্ষণ ওর পাশটিতে পরাণসখা হয়ে বসে আছি সেটা অবশ্যই বুঝেছে। মেয়েদের তৃতীয় নয়ন খুব প্রখর। এখন দেখার ও রাধারানী হবে নাকি দ্রৌপদী। আমি তো কৃষ্ণ হব।
    উঠে দাঁড়াল ও । মৃদু হাসি মাখা মুখ। আমি সামনে। দৃষ্টি বিনিময় হল। কিন্তু ওইটুকুই। গটগট করে হেঁটে এগিয়ে গেল। একা। ওদিকে বাউল গান ধরেছে, তারে ধরি ধরি মনে করি / ধরতে গেলেম / আর পেলেম না / দেখেছি রূপসাগরে / মনের মানুষ কাঁচাসোনা…

  • অণু গল্প

    আনন্দ

    আনন্দ
    – সঞ্জয় গায়েন

     

    যে শুনছে সেই বলছে, ছিঃ! বাপ হয়ে নিজের একমাত্র ছেলের জন্য ওই কটা টাকা খরচ করতে রাজী হচ্ছে না! জানতাম, রাধানাথ সাঁতরা কৃপণ। কিন্তু এ তো দেখছি, কসাই! কি করবি টাকা রেখে দিয়ে? নিজের ছেলের শেষ যাত্রায়… খরচ করতে কেউ ভাবে নাকি! আরে বাবা, যাদের যেটা প্রাপ্য দিতে তো হবেই। দেশের নিয়ম মেনে না চলে উপায় আছে ? তাছাড়া সবাই যেটা মেনে নেয় তুমি সেটা মানবে না কেন? প্রতিবাদ! কিসের প্রতিবাদ? সকলে তো রাধানাথের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে এখন। আহাঃ বেচারা ছেলেটা! অ্যাক্সিডেন্টে মরেও শান্তি পেল না! ওই নিষ্ঠুর বাপটার জন্য। আচ্ছা, পুলিশ কি এমন দোষ করেছে শুনি? রাস্তাঘাটে বেপরোয়া বাইক চালিয়ে মরার বেলা হুঁশ ছিল না? ঝামেলা এড়াতে পুলিশ বডি আটকে হাজার কুড়ি টাকা নিয়ে রফা করতে চেয়েছিল। তা উনি দেবেন না। বলে, আইন মেনে বডি নিয়ে যাব। শোনো কথা। আইনের মারপ্যাঁচ কতটুকু বোঝে? তবু, পুলিশকে ভাল বলতে হয়। টাকা না পেয়েও বডি পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠিয়েছিল।
    মর্গে গিয়েও রাধানাথা ঝামেলা জুড়ে দিল। কাটাছেঁড়া বিনা পয়সায় করে দিল। কিন্তু সেলাই করতে হাজার আষ্টেক আর বডিটা গাড়িতে তুলে দেওয়ার জন্য হাজার দুয়েক… মাত্র দশহাজার তাও তর্কাতর্কির জন্য হাজারখানেক কমিয়েছিল। কিন্তু ওনার এক গোঁ। সরকারী নিয়মের বাইরে একটাকাও বেশি দেবে না! ভাবতে পারছ? মাত্র ওই কটা টাকার জন্য ছেলেটা কাটা লাশ হয়ে মর্গে পড়ে! তি-ই-ন দিন। আর একটা তো বলাই হয় নি। বরফ। সামান্য দুহাজার টাকা। দিল না। বরফের অভাবে ছেলেটা পচে গেল। শুনলাম, পুলিশও নাকি বলেছে, দেখি কত ক্ষমতা! টাকা ছাড়া লাশ নিয়ে যায় কি করে!
    তবে এসবের চেয়েও, আশ্চর্যের কথা কি জান? একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে চোখে একফোঁটা জল নেই! কী পাষাণ্ড! ভাবতে পারছ? নাঃ নাঃ! পাথর হতে যাবে কেন? গভীর শোকের চিহ্ন থাকলে ঠিক চোখে পড়ত। থাক, এবার যখের ধন আগলে। বলি ভোগ করবে কে?
    তারপর কি হল?
    দূর, দূর, কে রোজ রোজ কাজ কামাই করে খোঁজ নিতে যাবে। তবে কি আর হবে? নিশ্চয় শেষমেষ গোপনে কিছু একটা রফা করে নিয়েছিল। বড়লোকদের ব্যাপার। সব কি আর জানা সম্ভব!
    ইচ্ছে থাকলেই জানা যায়। এই যেমন আমি। শহরে থেকেও রাধানাথবাবুর সব খবর জানি। আপনি যা বললেন তার শেষটুকু আমি বলি শুনুন। উনি সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে কে চিঠি দিয়েছিলেন। তারপর হোম সেক্রেটারির তত্ত্বাবধানে সম্পূর্ণ বিনা খরচে উনি ছেলে কে পেয়েছিলেন। আর ওই কৃপণ লোকটা নিজের দোতলা বাড়ি সরকারকে লিখে দিয়েছেন। আপনাদের গ্রামে হাইস্কুল করার জন্য। আমি এসেছি সবকিছু সরজমিনে দেখতে। স্কুলের নাম কি হবে শুনবেন? আনন্দ শিক্ষা নিকেতন। ওঁর একমাত্র ছেলের নামে।

You cannot copy content of this page