-
অণু গল্প- বৃক্ষরোপণ উৎসব
বৃক্ষরোপণ উৎসব
-সুজিত চ্যাটার্জিকারা যেন বৃক্ষরোপণ করেছিল পৃথিবীকে সবুজ করে তোলবার অঙ্গিকারে।
সম্ভবত সেটা একটা কবি সাহিত্যিক গোষ্ঠী।
অনেকেই আমন্ত্রিত। হাজিরার সংখ্যা নেহাৎ মন্দ ছিল না যদিও সেটা ছিল প্রভাতী অনুষ্ঠান।
প্রভাত বলতে মেট্রো শহর অবিশ্যি দশটার আগে জাগে না।
তবুও রবিবার ব’লে রক্ষে।
ছুটির গন্ধ গায়ে মেখে স্নিগ্ধ সুষমায় পরিবেশ গড়ার ভাবনায় বিমোহিত হয়ে ,
কল্পজগতের ভাবুকতা সমেত সমবেত মণ্ডলীর সহাস্যমুখ বিজ্ঞান ভাষণের প্রাজ্ঞতায় সবিশেষ করতালি ধ্বনি মুখরিত হলো আকাশে বাতাসে।
যন্ত্রণার যন্ত্র মাইকের অমাইক ব্যবহারে লজ্জিত হলো শব্দদূষণ।
শহুরে ফুটপাতের কোল ঘেঁষে ভূমিষ্ঠ হলো শিশু বৃক্ষ পরম আদরে।
হলো জল সিঞ্চন। নিরাপদ লৌহ জালের বেষ্টনীর কঠিন বন্ধনে বাঁধা রইলো শিশু তরুর ভবিষ্যৎ ।
ফুটপাতের চা দোকানি কালি দা র ফোকলা মুখে চওড়া হাসি। তিনশো টাকার বাড়তি বিক্রির খুশিতে।
সেই খুশির বহর আরও চওড়া হলো বৎসরান্তে।
শিশু তরু র কৃষ্ণপ্রাপ্তি হয়েছে নিদারুণ অবহেলায় অচিরেই । তবুও অটুট আছে সেই লৌহ জালের কঠিন বেষ্টনী।
সেটি বর্তমানে ফুটপাতের চা দোকানি কালি দা র নিরাপদ হেফাজতে।
এঁটো চায়ের ভাঁড় ফেলার চমৎকার জায়গা রুপে ।। -
গল্প- মাধু
মাধু
-সুজিত চ্যাটার্জিমাধু বিয়ের দশদিনের মাথায় বিধবা হল। বর রতন মাঠে চাষ করতে গিয়ে সাপের ছোবল খেল।
ধন্বন্তরি ওঝার যাবতীয় ঝাড়ফুঁক কেরামতিকে নিষ্ফল প্রতিপন্ন করে শেষ নিঃশ্বাস ফেলে সব্বাইকে আকুল পাথারে ভাসিয়ে রতন চলে গেল।
কপাল লিখনে অবিশ্বাসী গুটিকয় অনামুখো যারা বলেছিল হাসপাতালে নিয়ে গেলে ছেলেটা প্রাণে বেঁচে যেত, রতনের সর্বজ্ঞানী মুখরা মা শীতলা, তাদের সাতগুষ্টির মৌখিক শ্রাদ্ধ করে পিন্ডি চটকে নিদান দিয়েছিল, তাদের ছেলেমেয়েদের সাপে কাটলে যেন তারা তেমনই করে।
কেননা কপালের লেখন খন্ডায় কারো বাপের সাধ্যি নেই।মাধু বিধবা হবার দশদিনের মাথায় তারই মেজ দেওরের সঙ্গে মাঝরাতে একই ঘরে একসঙ্গে পাকড়ে গেল।
পাকড়াও করার অসাধ্য সাধন করল কে?
সেই সর্বজ্ঞানী মুখরা মা শীতলা।
মাধু চোখের জলে নাকানিচুবানি খেয়ে প্রাণান্তকর ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করল, সে কোনও ভাবেই দায়ী না ।
একলা ঘরে সুযোগ বুঝে মেজ দেওর এই কান্ড ঘটিয়েছে, সে সম্পূর্ণ নির্দোষ।
ভোবি ভোলবার নয়।
শীতলার অকাট্য প্রমাণ, তার নির্ভুল অনুমান দক্ষতা এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।
সে নিশ্চিত জানতো, এ মেয়ে অপয়া, এক ছেলেকে খেয়েছে এবার নির্বংশ করে তবেই ছাড়বে এই রাক্ষসী ডাইনির বংশধর।
সুতরাং এই কালনাগিনীকে কোনোমতেই আর এ ভিটেতে রাখা চলেনা।
বিধবা মাধু শ্বশুর ঘর ছাড়া হল।উঠতি ধনী দাসু বাবুর দয়ার শরীর, তার ওপর তিনি সদ্য বিপত্নীক।
মাধু দেখতে শুনতে বেশ। বয়স কম, এমন ডাগরডোগর বিধবাকে তো আকুলে ভাসিয়ে দেওয়া যায় না। সুতরাং মোসাহেবদের মান এবং মুখ রাখতে মাধু এখন দাসু বাবুর আশ্রিতা।মাধু এখন অনেক পরিণত।
প্রতি রাতেই তার ঘরে পুরুষ ঢোকে। দয়ালু দাসু বাবু, রসালো বাবু হয়ে রাত বিতোয় নধর নারী শরীরের সঙ্গে।
তবে একেবারে খালি হাতে নয়।
মাধুর দেওয়া শর্ত পূরণের অঙ্গীকারে।
প্রতি রাতেই পুরনো তবুও নতুন খেলা।
প্রতি রাতেই নতুন নতুন শর্তের অঙ্গীকার।
আজ অলংকার, কাল টাকা, পরশু জমির দলিল আরও আরও আরও…
দূর্বল মুহূর্তে পুরুষেরা বড়ই দাতা হয়ে ওঠে।
মাধু বুঝেছে বোবা আর বোকা থাকার অনেক জ্বালা। তাছাড়া যৌবনের জৌলুশ বড়ই ক্ষণস্থায়ী।
মেজ দেওরের ধাষ্টামো আর সর্বজ্ঞানী মুখরা মা শীতলার নির্মম আচরণ তাকে চতুর হতে শিখিয়েছে।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চুলে পাক ধরা মাধুর এখন নিজস্ব ঘর।
মেয়ে ঐশ্বর্য আর কিছুদিনের পরেই ডাক্তার হয়ে যাবে।
ভাগ্যিস সেদিন প্রবল চাপের মধ্যেও অবিচল থেকেছিল মাধু।
না, সে গর্ভত্যাগ করেনি।
সবই দয়ালু দাসু বাবুর দান।
শুধু একটাই আফসোস,
দয়ালু দাসু বাবু মান আর মুখ বাঁচাতে স্বেচ্ছায় কড়িকাঠে ঝুলে প্রাণত্যাগ করেছিল। -
রম্য- প্রেম ডট কম
প্রেম ডট কম
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়চন্দ্র সেদিন রাতে মত্ত অবস্থায় তার বউ বিন্দুকে পরকীয়া প্রেমের অপরাধের শান্তি হিসেবে গলা কেটে খুন করে নিজেও গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে গেল।
একটি অপ্রেম দাম্পত্য জীবনের নিদারুণ পরিসমাপ্তি।
এটা পাঁচশো বছরের পুরনো কথা।পাঁচশো বছর পরে পুনরায় চন্দ্রের নরলোকে আগমন এবং দৈবযোগে সঙ্গে বিন্দু । বিধাতার লিখনে তাদের আবারও মিলন কিন্তু পরিনতি ?
এবার ঘটনা এক্কেবারে বিপরীত। চন্দ্রর পরকীয়া প্রেমের অপরাধের শান্তি হিসেবে তাকে গলা কেটে খুন করে নিজেও গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে গেল বিন্দু।
ব্যস হ’য়ে গেল এবারের মতো আপদের শান্তি ।আবারও পাঁচশো বছর পরে পুনরায় চন্দ্রর মর্তলোকে আগমন এবং সঙ্গে যথারীতি চিরসঙ্গী বিন্দু। বিধাতা বিগবসের অদ্ভুত খেল ।
এবারেও মিলন বিবাহ ঘরসংসার এবং পরকীয়া।
তবে এবার আর কোনও ঝামেলা ঝঞ্ঝাট না, কারণ দুজনেই দু’ জায়গায় মন দেওয়া-নেওয়ার পালায় মেতেছে। দু’জনেই খোস মেজাজে আছে। অপূর্ব সমঝোতা। যে যার পছন্দের ডালে বসে মনের সুখে দোল খাচ্ছে। তুমিও সুখী আমিও সুখী। অসাধারণ দাম্পত্য সুখ যাপন।জীবনের খেলাঘর। ইয়েস, খেলাঘর। যে যেভাবে পারো খেলে যাও। মানিয়ে নাও নয়তো মেনে নাও। আরে বাবা সুখ হলো দর্শনধারী। দেখানোতেই সুখ। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়দের কাছে
নৈনিতালের নাম করে নৈহাটির গঙ্গা দর্শন লজে দুর্বিষহ সাতদিন কাটিয়ে এলেই মিলন মধুর দাম্পত্যের অকাট্য দলিল প্রমাণ। যেমন দেখানো হবে, লোকে তেমনই দেখবে। পাক্কা খেলোয়াড়, ডুব সাঁতার মাষ্টার।ভালই চলছিলো চন্দ্- বিন্দুর মন কী খেল, কিন্তু ঐ-যে কথায় আছে,,
সুখের পরমায়ু বডই ক্ষণিকের। এই আছে এই নেই,,,
মুঠোয় ধরে রাখা বরফের মতো। ফাঁকা হাতের তালুতে জল লেগে আছে ঠান্ডা পরশ আছে কিন্তু বরফ নেই, সে আঙুলের ফাঁক গলে ফক্কা। শুধু স্মৃতি রেখে গেছে, সে নেই।
চন্দ্রর মন পাগল করা মানবী, পরিনতি বিহীন প্রেমের জালে হাঁসফাঁশ করতে করতে জাল ছিঁড়ে নতুন নৌকোর সওয়ারী হল। বাই জান,
সেই বিরহে বিরহী হয়ে চন্দ্র সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হয়ে বিবাগী হল।
বিন্দু এখন একা ঘরে আনন্দে ডগমগ । ভাবে, যাক ভালোই হল, বাঁচা গেল । হাত পা ঝাড়া। ওপেন সিক্রেট ছিল ঠিকই, দুজনের তরফেই ছিল, তবুও চক্ষুলজ্জা বলে তো একটা কথা আছে, তাই একেবারে খুল্লামখুল্লা, কিন্তু এইবার?
এই তো পরকীয়া প্রেমের অবাধ আনাগোনার ভরপুর সুযোগ।
কিন্তু ঐ-যে কথায় আছে, সবার কপালে সুখ সয় না। বিন্দুতে বেশিদিন মন পোষালো না বিন্দুর মনের মানবের।
সে-ও নিজের সুখময় ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নতুন কোকিলার কুহুতানে মন মজিয়ে রাধাচূড়ার ফুলেল শাখে দোল খেতে চলে গেল।
বিন্দু দুঃখে আফসোসে দিশাহারা হয়ে কব্জির শিরা কেটে রক্তের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে ইহজীবনের সমাপ্তি ঘটালো।পাঁচশো বছর পরে তারা দুজনেই আবারও এলো ধরাধামে, মিলিতও হল কিন্তু কেউ-ই আর পরকীয়ার ফাঁদে হৃদয় গলালো না। কেন !
এমন হবার কারণ কী?
এবারে ওরা যৌথ ভাবে দেবতা বিগবসের কাছ থেকে বর চেয়ে এসেছে ,
‘যা ইচ্ছে তাই দাও শুধু প্রেমের ডোজ কম করে দাও।’ ওটা বড্ড জ্বালিয়ে মারে, লণ্ডভণ্ড করে দেয় জীবন। প্রেম কম, ঝামেলা কম।
এ জীবনে শুধুই প্রেম ডট কম।
এদিকে আপনাদের চুপিচুপি একটা কথা ব’লে দিই, এদের সঙ্গে কিন্তু ওদিকে সেই
মানব আর মানবীও জন্ম নিয়েছে। আরও সমস্যার কথা, ওদের সঙ্গে কিন্তু দেবতা বিগবসের কোনো চুক্তি কিংবা বর ইত্যাদি কিছুই হয়নি, সুতরাং ওদিকের রাস্তা খোলা।
কে জানে কী আছে বিগবসের মনে। চন্দ্র-বিন্দুকে, কে যে কখন আপন করে নেয় কে জানে?
খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, হা হা হা হা -
অণুগল্প- মানু’র চোখে জল
মানু’র চোখে জল
–সুজিত চট্টোপাধ্যায়রাত প্রায় বারোটা।
এইমাত্র শবদেহ দাহ করে ফিরলো মানু। কথাটা মা’কেও জানালো না। মা জানলে এই শীতের রাতে তাকে স্নান না করিয়ে ছাড়বে না। মাথা খারাপ, জেনেশুনে সেই ভুল কেউ করে ?
অবিশ্যি এমন ঘটনা মানুর এই বাইশ বছরের জীবনে প্রথম ঘটলো এমন নয়। এটা যেন ওর নেশার মতো। খবর পেলেই ছুট। কত যে শবদাহ কাজে অংশ নিয়েছে মানু সে হিসেব কে-ই বা রাখে। ওর শুধু মনে হতো চলে যাওয়া মানুষটার শেষ যাত্রায় যাত্রী হয়ে তাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা যায়। স্বজন হারা শোকার্ত পরিবারের পাশে সহমর্মিতা নিয়ে পাশে থাকা যায়। ভালো লাগে। নিজের অন্তরের পবিত্রতার পরশ পাওয়া যায়।
মানু র বাবা বলতেন,,,
আমার চার ছেলে। আমি মারা গেলে চার ছেলের কাঁধে চড়ে যাবো।সময় বড়ো দ্রুত পাল্টে যায়। পাল্টে যায় ব্যবহারিক গতানুগতিক ধারার জীবনের গতি।
কালের নিয়মে একদিন মানু মানে বর্তমানের মৃন্ময় মুখার্জি যিনি একটি বিখ্যাত কর্পোরেট হাউসের সি ই ও,, তার বাবা একাশি বছর বয়সে দেহ রাখলেন।
এখন কেউ কাঁধে চড়ে যায় না। শেষ গন্তব্যের জন্য বিশেষ যানের ব্যবস্থা আছে। একেবারে সাজানো গোছানো মানে না ফেরার দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে যেমনটি সাজগোজের নিয়মমাফিক প্রয়োজন তার সুচারু বন্দোবস্তো করাই আছে শুধু দাম ধরে দিলেই হবে।
নাহঃ,, বর্তমানের অন্তিম যাত্রায় খাট লাগেনা। কাঁধে গামছার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। হাতে অগুরু সুগন্ধির যুগ আর নেই।
হরিধ্বনি তে ও গুরুগম্ভীর ভাব। সেই উচ্চস্বরের চঞ্চলতা কোথায় হারিয়ে গেছে। মৃতের পায়ের তলায় আলতা লাগিয়ে সাদা ফুলস্কেপ কাগজে ছাপ তুলে রাখার কথা কারোর মনেই আসেনা আর। বুক চাপড়ে কেঁদে দাঁতে দাঁত চেপে ফিট্ হয়ে যাবার দিন শেষ। এখন গম্ভীর মুখে ফিসফিস করে কথা আর হালকা করে নাকের সর্দি টানার মতো আওয়াজ করেই শোক প্রকাশ করা রেওয়াজ।
এক্ষেত্রে ঠিক তেমনই হয়ে চলেছে।
” যেতে তো একদিন সকলকেই হবে, দু’দিন আগে কিংবা পরে। ”
এহেন দার্শনিক ধারার কথাবার্তা গুনগুন করে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।রাত প্রায় বারোটা ।
মৃন্ময় মুখার্জি ( মানু ) একা ছাদে আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে উচ্চারণ করলো,,
” বাবা, তোমার ইচ্ছে পূরণ করতে পারলাম না। সময় পাল্টে গেছে বাবা। এখন সবাই বড্ড একা।
যাবার কালে তো অবশ্যই ।
ক্ষমা করে দাও বাবা,, ক্ষমা করে দাও,,,। ”
না না,, মৃন্ময় মুখার্জি নয় ,
মানু র চোখে জল ,, পরিতাপের।। -
গল্প- শব্দভেদী বাণ
শব্দভেদী বাণ
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়বাড়িতে ঢোকা যাচ্ছে না। শব্দভেদী বাণ না নিয়ে বাড়িতে যাওয়া যাবে না।
বুলিবুলি নির্ঘাৎ সিঁড়ির পাশের বারান্দায় ঘুরঘুর করছে। যদিও রাত দশটা বেজে গেছে। এইটা ওর ঘুমোনোর সময়। কিন্তু আজ কি তেমনই হবে?
মাত্র চার বছর বয়স। কী সাংঘাতিক জেদ রে বাবা। অবিশ্যি দোষ কাকুরই।
টিভিতে রামায়ণ সিরিয়ালে রামের বাবা দশরথের ছোঁড়া শব্দভেদী বাণে অন্ধমুনির একমাত্র ছেলের মৃত্যু হলো।
চার বছরের বুলিবুলি কী মাথামুণ্ডু বুঝলো কে জানে, হঠাৎ কাকুর কাছে বায়না ধরলো, তার শব্দভেদী বাণ চাই।
কাকুর উচিৎ ছিল তখনই তাকে বুঝিয়ে বলা যে এসব প্রাচীন ব্যাপার, এখন আর শব্দভেদীর যুগ নেই। এখন শব্দ করার যুগ। দুম ফটাস ব্যস হয়ে গেল।
তা না করে বাহাদুরি দেখিয়ে বলে দিলো,
“ঠিক আছে কাল অফিস ফেরত নিয়ে আসবো।”
মনেই ছিল না। কিন্তু বুলিবুলি ভোলবার মেয়ে নয়। কাকু বাড়ি ফেরা মাত্রই ছুটে এলো।
“দাও শব্দভেদী বাণ।”
কী ভাবে বলবে ভুলে গেছে। তাই মিথ্যার আশ্রয়।
“আজকে বড্ড কাজ ছিল সোনা। একদম সময় পাইনি। কাল আনবো।”
পরের দিন আবারও একই ব্যাপার। আবারও নতুন মিথ্যা।
“আজ বাণ পেয়েছিলাম কিন্তু শব্দভেদী নয়। কাল আনবো।”
চার বছরের মেয়ে মিথ্যার কারসাজি বোঝে না। তার সরল বিশ্বাস। সুতরাং কালের অপেক্ষায় তার আরও কয়েকটা কাল কেটে গেল। ইচ্ছেপূরণ হলো না। এবার ধৈর্যের পাঁচিল খসে গেল। লাস্ট ওয়ার্নিং।
“আজই চাই। যেমন করেই হোক। আজ চাই…চাই… চাই… নইলে বুঝবে ঠ্যালা। কেঁদে কেটে একসা করবো। কারুর কথা শুনবো না। খাবোও না।”
এই শেষের কথাটা মারাত্মক। খাবোও না। ক্লিয়ার ব্ল্যাকমেইল। শিখলো কোথায়, কখন, কীভাবে? আশ্চর্য! এরা তো কিচ্ছুটি শিখে আসে না। এসে শেখে।আজ আর চালাকি চলবে না। তাই আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে ধর্মতলা থেকে শ্যামবাজার যতগুলো খেলনার দোকান আছে সব চষে ফেললো। নাহ্, কোথাও নেই।
হায় কপাল। এতো বড়ো শহরের একটা শিশুর চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা নেই?
তা-ও তো শব্দভেদী বাণ চায়ই নি। চাইবার প্রশ্নই নেই। যা নেই, কেবলই কল্পনা, তাই চেয়ে হাস্যরসের উপাদান যোগানোর মতো পাগল সে নয়। তাই শুধু একটা সাধারণ তীর-ধনুক চেয়ে ছিল। বিশ্বাস ছিল এটুকু পেলেই শিশুমন শান্ত হবে। হায় রে, তা-ও নেই।
সব দোকানদারদের একই কথা,
“এখনকার বাচ্চারা ওসব তীর-ধনুক টনুক নিয়ে খেলা করে না। অন্য কিছু নিয়ে যান। নতুন নতুন ইলেকট্রনিক ডিভাইস আছে। বাচ্চাদের এইসবই পছন্দ।”
সুতরাং কি আর করা। বুলিবুলির আবদার মেটানোর সাধ্য যখন নেই, তখন বিকল্প একটা কিছু তো ব্যবস্থা করতেই হয়। তাই অনেক ঘেঁটেঘুঁটে একটা বেশ বড় বন্দুক কেনা হয়ে গেল।
দারুণ দেখতে। প্লাস্টিকের তৈরি, ফুটখানেক লম্বা। খানকতক ব্যাটারি ভরে ট্রিগার টিপলেই বন্দুকের সারা গায়ে নানান রঙের আলো ঝলমল করে লাফালাফি করবে। আর আওয়াজ করবে গোঁও গোঁও ফটফট ফটফট। বেশ চটকদার খেলনা।
তবুও সন্দেহ থেকেই যায়। বুলিবুলি যদি জেদ বজায় রেখে বলে, না আমার এ চাই না। আমার শব্দভেদী বাণ চাই, তবেই হয়েছে।
ছোটদের খুশি করতে না পারলে, বড়দের মনও যে দুখী হয়, সেকথা ছোটদের বোঝায় এমন সাধ্য কার!
খেলনাটা ব্যাগের ভেতর নিয়ে কাকু চুপিচুপি পা টিপে টিপে প্রায় চোরের মতো বাড়িতে ঢুকে নিজের ঘরে চলে গেল। যাকে নিয়ে ভয় সেই বুলিবুলির সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
মা এসে বললেন,,
“কি রে আজ এতো দেরী হলো, কোথাও গিয়েছিলি?
“না। মানে, বুলিবুলির জন্যে একটা খেলনা কিনতে গিয়েছিলাম।”
“ওঃ, তাই বারবার তোর খোঁজ করছিলো!”
“কোথায় ও, ঘুমিয়ে পড়েছে?”
“হ্যাঁ। এই তো খানিক আগেই, থাক না, কাল সকালে দিবি। হাতমুখ ধুয়ে আয়। খেতে দেবো।”
যাক, খানিকটা রিলিফ। কাল যা হয়, দেখা যাবে।
পরদিন, তখন সকাল আটটা নাগাদ বুলিবুলি কাকুর ঘরে এসে হাজির।
“কি গো এনেছো, ভুলে যাওনি তো? দাও।”
গলায় বড়সড় অফিসারের সুর। প্রবল দাবী। এ দাবী উপেক্ষা করে এমন সাধ্য কার।
কাকু কিছুটা ইতস্তত করে ভয়ে ভয়ে ব্যাগ থেকে সেই বন্দুকটা বের ক`রে বুলিবুলির হাতে দিলো।
সে সেটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গোয়েন্দার মতো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। চোখে মুখে একটা কেমন যেন সন্দেহের ছায়া। তারপরই বললো,
“এটা তো বন্দুক। শব্দভেদী বাণ কোথায়?”
কাকু কাঁচুমাচু মুখে বললো,
“এই তো, এই দ্যাখো এই-যে ট্রিগার দেখছো এখানে একটু চাপ দাও, দেখবে কেমন শব্দভেদী বাণ হয়ে যাবে।
এইটা হলো আধুনিক মানে এখনকার শব্দভেদী বাণ। টিভিতে যেটা দেখেছো সেটা প্রাচীন কালের ব্যাপার। নাও ট্রিগারে চাপ দাও।”
ট্রিগারে কচি হাতের কৌতুহলী চাপ পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক নানান রঙে রঞ্জিত হয়ে বিকট আওয়াজ করতে শুরু করলো।
গোঁও গোঁও ফটফট ফটফট,,,
সারা বাড়িময় সেই বিকট আওয়াজ, সকালের কর্মব্যস্ততার যাবতীয় মনঃসংযোগ ভেঙে চুরমার করে দিতে লাগলো।
রান্নাঘর থেকে বুলিবুলির মা আর ঠাকুমা, তিতিবিরক্ত হয়ে রান্না ফেলে ছুটে এসে চিৎকার করতে লাগলো,
“এ-ই কী আরম্ভ করেছিস তোরা এই সকালবেলা! এখনো কত রান্না বাকি। এইভাবে যাচ্ছে তাই আওয়াজ করলে রান্না করতে পারবো না, বলেদিলুম। কী খেয়ে অফিস ইস্কুল যাবি সব যা।”
এখানে “সব” মানে, যাদের উদ্দেশ্যে এই সতর্কবার্তা বর্ষিত হচ্ছে তারা হলো,বুলিবুলির বাবা, কাকু এবং বুলিবুলি ও তার দু’বছর বড় দাদা।
বুলিবুলি বড়দের চ্যাঁচামেচি এবং সেই চ্যাঁচামেচির কারণ সে নিজে, এটুকু বুঝতে পেরে ভ্যাবাচেকা খেয়ে আওয়াজ বন্ধ করে কাকুর দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে রইলো। কাকু তার ঐরকম অসহায় মুখের চেহারা দেখে না হেসে পারলো না।
তার মাথায় নির্ভয়তার হাত বুলিয়ে প্রশ্রয় দেবার ভঙ্গিতে চোখ টিপে ফিসফিস করে বললো,
“চালিয়ে যা, থামবি না।”
বুলিবুলি দ্বিগুণ উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে ট্রিগারে আঙুল চালাতে লাগলো।
গোঁও গোঁও ফটফট ফটফট ফটফট ফটফট।
এদিকে যত আওয়াজ হয়, ওদিকেও ততই মুখের তড়পানো বাড়ে।
“বাড়াবাড়ির একটা সীমা আছে। বুড়োধাড়ি জুটেছে বাচ্চার সঙ্গে। সকাল থেকে অসভ্যতা শুরু হয়েছে, ছি ছি, লজ্জাও করে না।”
কাকু ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছে,
“দেখলি তো? একেই বলে শব্দভেদী বাণ। কান দিয়ে ঢুকে একেবারে মাথার ঘিলুতে গিয়ে গোঁত্তা মারবে।
থামবি না, মনের সুখে চালিয়ে যা।
গোঁও গোঁও গোঁও ফটফট ফটফট ফটফট। একেই বলে শব্দভেদী বাণ, হা হা হা হা,
বুলিবুলির মুখেও তখন দুষ্টুমি ভরা চওড়া হাসির নির্মল ঝিলিক। -
গল্প- হর কী পৌড়ি ঘাট
হর কী পৌড়ি ঘাট
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়“পা চালিয়ে চলো বাবা। দেখে এসেছি খাবার প্রায় শেষের দিকে। দেরি হলে কিছুই মিলবে না। চলো। ঐ তো আর একটুখানি…”
বিবেক আর কেয়া। মাঝেমধ্যে সময় পেলেই চলে আসে হরিদ্বারে। সুভাষ ঘাটের গঙ্গা ঘেঁসা এই লজেই ওঠে।
অত্যন্ত সাধারণ বিলাসবিহীন সাদামাটা লজের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বহমান স্রোতস্বিনী অপরূপা গঙ্গা দেখার অনিন্দ্য অনুভূতিই বারবার টেনে আনে এই পবিত্র গঙ্গা নগরী হরিদ্বারে।
সত্যি কথা বলতে এই লজ পছন্দের সম্পূর্ণ হকদার কিন্তু কেয়া। বিবেকের বিবেচনায় বেড়াতে এসে এইরকম একটা ধর্মশালা মার্কা লজে ওঠার কোনো মানেই হয় না। হরিদ্বারে লাক্সারি ডিলাক্স হোটেলের কি অভাব আছে?
কিন্তু কেয়ার যুক্তি অন্যরকম। তার মতে, বেড়াতে এসে এমনই জায়গায় থাকা উচিৎ যেখানে থেকে মনে হবে, হ্যাঁ বেড়াতে এসেছি। চোখের সামনে সর্বক্ষণ থাকবে সেই অনির্বচনীয় দৃশ্যগুলো যেগুলো দেখবার জন্যেই এতদূর ছুটে আসা।
হোটেলের বিলাসিতা করবার জন্যে বাইরে বেড়াতে আসার প্রয়োজন কী, ঘরে থাকাই ভালো।
সেই থেকে হরিদ্বারে এলেই এই লজই একেবারে পাকাপোক্ত আস্তানা।
এর বারান্দা থেকেই দেখা যায় পৌরাণিক আখ্যান ঘেরা মনোহর হর কী পৌরী ঘাট। গঙ্গা মাতার মন্দির। ভক্তবৃন্দের প্রবল স্রোত ধারায় শিকল মালা আঁকড়ে ধরে স্নান।লজ থেকে বেরিয়ে বাঁ দিকে, ডান দিকে কয়েকটা চা, সিঙারা, পুরি, পরোটা ইত্যাদির দোকান।
দয়ালু ভক্তগণ এদের কাছেই সামর্থ অনুযায়ী টাকা দিয়ে, নরনারায়ণ সেবা করান। ব্যাবস্থাপনার দায়িত্ব থাকে দোকানদারের ওপর। তারা এ ব্যাপারে যথেষ্টই পটু।
কেয়ার এই ব্যাপারটা বড্ড ভাললাগার। তাই এখানে এলেই, নরনারায়ণ সেবার আয়োজন ও করেই। অবিশ্যি বিবেকেরও আন্তরিক সায় আছে এই ব্যাপারে।তখন বিকেল তিনটে হবে হয়তো। একটি বছর দশেকের ছেলে, একটি অতি বৃদ্ধ মানুষকে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে চলেছে, লক্ষ্য সেই ভোজন অনুষ্ঠান।
বিবেক লজের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিল সেই ঘটনা। বৃদ্ধের হাতে একটি বাঁশের লাঠি। যার ওপর ভর করে তার উপায়হীন অনিচ্ছাকৃত নড়বড়ে হাঁটাচলা। পরনে কমলা রঙের খাটো ধুতি। গায়ে একটি ময়লা চাদর।
রোগা হাড়জিরজিরে লোকটিকে ছেলেটি এমন আগ্রহ ভাবে নিয়ে চলছিলো, তাতে সেই মানুষটির প্রতি তার ভালোবাসা প্রবল ভাবে প্রকাশ পাচ্ছিলো।
খাবার যদি ফুরিয়ে যায়? মানুষটি খাবে কী? খাবারের জায়গায় না গেলে তো খাবার পাওয়া যাবে না। অন্যের জন্য খাবার নিয়ে আসাও নিয়ম বিরুদ্ধ। তেমন নিয়ম থাকলে ভালো হতো। তাহলে এই বয়স্ক মানুষটাকে এইভাবে দৌড় করাতে হতো না। কিশোর ছেলেটি একছুট্টে গিয়ে ওনার জন্য খাবার নিয়ে আসতে পারতো।
বিবেক সেই দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, এই দুজনের মধ্যে সম্পর্ক কী !
বাপ-ছেলে, দাদু-নাতি না কি কেউই নয়। নিছকই মুখ চেনা নাম ছাড়া কোনও এক স্বার্থহীন ভালোবাসার নির্মল সম্পর্ক। যে সম্পর্ক রক্তের কিংবা আত্মার তথাকথিত কেতাবী সংজ্ঞার বাইরে নির্ভেজাল মানবিক সম্পর্ক?ছেলে কুন্তলের বিয়ে যখন পাকা। বিয়ের নিয়মমাফিক মার্কেটিং করতে করতে কেয়া আচমকা বলেছিল- ছেলের বিয়ের আনন্দে এলোমেলো খরচ কোরো না। ভবিষ্যৎ তোমার আমার কারুরই জানা নেই।
বিবেক ক্ষণিকের জন্য থমকে গিয়েছিল। ভালো লাগেনি কথাগুলো। কেয়া কী স্বার্থপর হয়ে উঠছে? নইলে একমাত্র সন্তানের বিয়েতে ওর মনে আশঙ্কা কেন?
এ কি সেই চিরাচরিত মেয়েলি সংস্কার? কর্তৃত্ব হারাবার ভয়? না-কি সুপরিকল্পিত বাস্তব ভাবনার ফসল?
বিবেক এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছিল, কুন্তলের বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই, যখন কুন্তল তার স্ত্রীকে নিয়ে নতুন ফ্যাটে চলে গেল। নিঃশব্দে, অকারণে। তাদেরকে একা করে দিয়ে।কেয়া সেবারে যখন এখানে এসেছিল তখনও এই লজেই উঠেছিল। চেপে রাখা কান্না বুকে নিয়ে।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে বিবেক দেখেছিল, কেয়া নিঝুম বারান্দায় একাকিনী উদাসী।
বিবেক পাশে এসে দাঁড়াতেই বহমান গঙ্গার দিকে আঙুল দেখিয়ে কেয়া ফিসফিস করে বলেছিল, “দ্যাখো কী অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। অন্ধকারে ও যেন আরও রূপবতী। শুনতে পাচ্ছো ওর ছুটে চলার কলধ্বনি? কী মধুর তাই না?
আচ্ছা, ওর সঙ্গে ছুটতে ছুটতে চলতে চলতে হারিয়ে যাওয়া যায় না? কী গো যায় না?
বিশাল লম্বা চওড়া ঘাটের ওপর অনেক মানুষ সার সার শুয়ে পরম নিশ্চিন্তে রাত্রি নিদ্রায় অচেতন। মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়া শিশুর মতো তাদের মুখ।
হঠাৎ কেয়া, কিশোরীর মতন আদুরে গলায় বলে উঠেছিল,
“আচ্ছা, তুমি কখনও চন্দ্রাস্ত দেখেছ? দেখোনি না? ও-ই দ্যাখো…”
বিবেক অবাক চোখে দেখেছিল সেই মায়াময় অনির্বচনীয় দৃশ্য। যা সে আগে কখনও দেখেনি। সে কি ভোলবার!এরপর ওরা এখানে এসেছিল প্রায় এক বছর পর। সেটা দশেরার রাত। এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আতসবাজির চোখধাঁধানো আলোর দিকে তাকিয়ে ধীর অকম্পিত গলায় কেয়া বলেছিল,
“একটা কথা বলবো, রাখবে?”
বিবেক কোনও কথা বলেনি। শুধু পরম ভালোবাসায় ওর হাতের ওপর হাত রেখেছিল।
-“তোমার সুবিধে মতো, যখনই সময় সুযোগ পাবে, এখানে এসে দরিদ্র মানুষগুলোকে অন্নদান কোরো। আর… “
-“আর?”
বিবেকের হৃদয় নিংড়ানো ব্যগ্রতা কেয়ার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিল। কেয়া সেটুকু আবেগ লুকিয়ে বলেছিল,
“যদি সম্ভব হয়, আমার অস্থি দেহভস্ম এই পবিত্র গঙ্গা বক্ষে বিসর্জন দিও। শ্রাদ্ধ নয়, একটু শ্রদ্ধা । তাতেই শান্তি তাতেই মুক্তি।”
বিবেক চমকে উঠে বলেছিল,
“কেয়া, কেমন করে এই ভয়ানক কথাগুলো এমন অবলীলায় উচ্চারণ করলে! বুক তো শুধু তোমার ভাঙেনি কেয়া। আমিও যে বাবা।”
-“তবুও, তোমার আর আমার মধ্যে একটা বিশাল ব্যবধান। আমি যে মৃত্যুপথ যাত্রী।”
বিবেক আঁতকে উঠেছিল,
-“কেয়া…”
অদূরে একটা আতসবাজি বিকট শব্দে ফেটে একরাশ ধোঁয়া ছড়িয়ে দিয়ে গেল। বাতাসে বারুদের গন্ধ।
“তুমি লুকিয়ে গিয়েছ। আমাকে ভয়মুক্ত রাখতে। বিশ্বাস করো, মাত্র এই একবারই আমি তোমায় অবিশ্বাস করেছি। তোমার কথা মিথ্যে ভেবেছি। তাই ডক্টর আদিত্য সেনকে ফোন করে সবচেয়ে কঠিন সত্যিটা জেনেছি। লাঙ্গ ক্যান্সার। ফাইনাল স্টেজ। হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা দিন।
ভালোই হলো জানো। জানি খুবই স্বার্থপরের মতো শোনালো কথাটা। সত্যিই তো শুধু নিজের কথাই ভাবছি।
তোমাকে কার কাছে রেখে যাচ্ছি; কে দেখবে তোমাকে; কী নিয়ে, কেমন করে, কার ভরসায় বাঁচবে তুমি? জানি না… জানি না… আমি কিচ্ছু জানি না, শুধু জানি, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম আমৃত্যু শুধু তোমার সঙ্গে, শুধু তোমার সঙ্গে।”
বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল কেয়া।
গঙ্গার ওপারে দশাননের কুশপুত্তলি দাউদাউ করে পুড়ছে তখন। অজস্র রঙীন আতসবাজি ছেয়ে ফেলেছিল দশেরার মধ্যরাতের আকাশ।একসময় শান্ত হলো সবকিছু। এখন গঙ্গাস্নান বন্ধ থাকবে কিছুদিন। সেই দীপাবলি পর্যন্ত। এটাই রেওয়াজ।
তারপর আবারও স্বাভাবিক হবে সবকিছু। যেমন চলছিলো প্রকৃতির নিয়মে। গঙ্গা বহে যাবে তার নিজস্ব ছন্দে। চন্দ্রোদয় থেকে চন্দ্রাস্ত আকাশগঙ্গায় জাগাবে মায়াজাল। গঙ্গা আরতির প্রজ্বলিত দীপশিখা
ঘন্টা ধ্বনির সাথে নৃত্য করবে নিত্যকার মতো। প্রতি সন্ধ্যায় সবুজ পাতার ডোঙায় ভেসে যাবে শতশত মনোকামনার দীপ।
“কালের” হাত ধরে “আজ” চলবে পথ আগামীর লক্ষ্যে অনন্তকাল ধরে, যুগে যুগে।
কপাটহীন হরির দুয়ার সদাই উন্মুক্ত। এখান থেকেই যে শুরু সকল দর্শনের, বিশেষত আত্মদর্শনের।এখন নিশুতি রাতের নিঃস্তব্ধতার মাঝে জেগে আছে ভীষ্ম মাতা আর বিবেক। পৃথিবী যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন মৃত্যুপুরী।
কেয়ার দেহভস্মের কলসটি পরম ভালোবাসায় করপুটতলে নিয়ে শেষবারের মতো তার গায়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে চুম্বন এঁকে দিলো বিবেক।
সাক্ষী থাকলো আকাশ বাতাস অগনিত তারা গ্রহ নক্ষত্রপুঞ্জ আর ভাঙা চাঁদ।
সেই স্বর্গীয় প্রেমের স্পর্শ কেয়ার হৃদয়ে সুখ পৌঁছে দিতে পারলো কিনা বোঝা গেল না। তবে, ভস্মবাহিত কলসখানি ভীষ্ম মাতার পবিত্র কোলে দোল খেতে খেতে কোন সে অচিনপুরে হারিয়ে গেল, তা হয়তো মা গঙ্গাই জানেন।
মুহূর্তে বিবেকের মনে হলো, সে একা। সর্বস্ব খুইয়ে রিক্ত। চলৎশক্তিহীন একাকী অসহায় সঙ্গীহীন একটি অক্ষম মানুষ।
কে তাকে হাত ধরে নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় নিয়ে যাবে তার লক্ষ্যে?
নিশুতি রাতে, ব্যস্ততার কোলাহল থেমে যাওয়া নির্জন “হর কী পৌড়ি” ঘাটের মতো সেও নিঃসঙ্গ, একাকী। -
গল্প- ঐতিহাসিক খাট
ঐতিহাসিক খাট
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়পয়লাবৈশাখের বাংলা ক্যালেন্ডার নাতি ভম্বল টাঙিয়ে দিলো ঠাকুমার ঘরে , ঠাকুরের সিংহাসনের পাশে।
দুর্গাঠাকুরের ছবি আঁকা ক্যালেন্ডার। “আদিগঙ্গা বস্ত্রালয়” প্রতি বছরের মতো এবছরও দিলো। সঙ্গে এক বাক্স সস্তা মিষ্টি। নববর্ষের প্রীতি উপহার।
ঠাকুমা বললো, “দেখ তো ভম্বল, পুজো কবে?”
ঘরে নতুন ক্যালেন্ডার এলেই সবার আগে খোঁজ হবে পুজো কবে? পুজো বললেই বুঝে নিতে হবে দুর্গা পুজো।
পুজো অনেক দেবদেবীরই হয়। কিন্তু দুর্গাপূজার ব্যপারটাই আলাদা। একটা অদ্ভুত আনন্দ হিল্লোল আকাশে, বাতাসে, মনে।
লালকালিতে সার সার অন্তত চারটি দিন। ইস্কুলের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।
“আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে ” সত্যি কথা বলতে, বয়স যতই এগোয় মন ততই দরকচা মেরে যায়।
অনাবিল হাস্যমুখর ডানপিটে মজাগুলো গুমড়োমুখো হয়ে যায়। তখনই আসে গলায় বিষাদের সুর, “আজকাল সেই আগের মতো প্রাণবন্ত পুজো আর নেই। কেমন যেন দায়সারা গোছের হয়ে গেছে।”
আসলে কিন্তু তা নয়। পুজোর জৌলুশ আগের চেয়ে বেড়েছে বৈ কমেনি। জৌলুশ কমেছে মনে। পাংশুটে পটলের মতো কোঁচ ধরেছে।
তবুও ঠাকুমা বৈশাখের নতুন ক্যালেন্ডারে আশ্বিনের শারদীয়া খুঁজছে। জপের মালা সমেত হাত কপালে ঠেকিয়ে অস্ফুট উচ্চারণ দুগগা… দুগগা।
আজ থেকে উনিশ বছর আগে দুর্গা সপ্তমীতে বৈধব্য পেয়েছিলেন। তাতে কী? তাই বলে দুগগা মায়ের ওপর থেকে বিশ্বাস ভালোবাসা উঠে যাবে কেন! তা অটুট আজও।
নাতি ক্যালেন্ডার টাঙাতে টাঙাতে হেসে বলে,
“কী হবে জেনে তোমার? ধুনুচি নাচবে না-কি বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘের ঠাকুর দেখতে যাবে?”
ঠাকুমা চুপ করে যায়। জম্পেশ জবাব দেওয়া যেতো কিন্তু ঠাকুমা চুপ করে থাকাই ঠিক মনে করে মুখে কুলুপ দিলো।
নইলে অনায়াসেই বলা যেত, একটা গাড়ি কেনার যোগ্যতাও তো নেই কারো অথচ ঠাকুর্দার গাড়িটা পুরনো হয়ে যাবার অজুহাতে জলের দামে বিক্রি করতে এতটুকু লজ্জা বোধ হয়নি।
ঐ গাড়িতে চড়ে সারারাত ধরে কত ঠাকুর দেখে বেড়িয়েছি সব্বাই মিলে।বাংলা ক্যালেন্ডার এখন আর তেমন করে কারুরই কোনও কাজে লাগে না। বিলুপ্ত প্রায় প্রাণীর মতো টিমটিম করছে। তবে ঠাকুমার ওটা চাই। বিশেষ করে একাদশী পূর্ণিমার হদিস পাবার জন্যে।
তাছাড়াও যেগুলো ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে শহুরে ব্যস্ততার দাপটে- ঝুলনযাত্রা, স্নানযাত্রা, রাধাষ্টমী, পঞ্চম দোল, বিপত্তারিণী ব্রত, ষষ্ঠী ইত্যাদি। কেউ তো বলে দেবার নেই। সবাই ব্যস্ত যে যার নিজের কাজে। তাই তাকেই খোঁজ রাখতে হয়।
কিছুই নয়, শুধু ভালো দিনগুলোতে রাধামাধবের পায়ে একটু পুজো দেওয়া। পরিবারের মঙ্গল কামনায়। যদিও ঠাকুমা জানে এ-সব কিছুই না, প্রাচীন প্রথাগত সামাজিক লোকাচার মাত্র।
পালন করলে কি না করলে, কিছুই এসে যায় না তাতে। তবুও যতক্ষণ টিকে থাকা ততক্ষণ টিকিয়ে রাখা। তার সঙ্গেই বিদায় নেবে এইসব অনাহুত অলাভজনক পুরাতন সংস্কার কিংবা কুসংস্কার।
সেদিন ঠাকুমা বললেন “ওরে ভম্বল, একটা কাজ করে দিবি বাবা?” গলায় অনুনয়ের সুর। “এই ঘরের মেঝেতে একটা বিছানা ক`রে দিতে পারবি?”
স্বাভাবিক ভাবেই ভম্বল অবাক।
“মেঝেতে বিছানা, কেন কী করবে? “
“আমি মেঝেতে শোবো।”
“মেঝেতে শোবে! কেন হঠাৎ? খাটে কি তোমার অসুবিধে হচ্ছে?”
“না না সে কথা নয়। আবার অসুবিধে একেবারেই হচ্ছে না এমনও নয়। বিশেষ ক`রে ওঠানামা করতে বড্ড…যাকগে, সেটা বড় কথা নয়। আসলে কি জানিস, চোদ্দো বছর বয়সে এবাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলাম। এই খাটেই ফুলশয্যা হয়েছিল। শৌখিন মানুষ ছিলেন উনি। গোলাপ দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন সেই মধুযামিনী রাতের শয্যা। সেই কতদিন আগের কথা। আজও ছবির মতো চোখের সামনে যেন দেখতে পাই।
এক এক ক`রে ছেলেমেয়েরা এলো। সব এই খাটে।
নরম নরম কচি কচি হাত পা ছুঁড়ছে, কাঁদছে, ঘুমোচ্ছে। রোজ একটু একটু ক`রে বড় হয়ে যাচ্ছে। সব এই খাটে।
উনিশ বছর আগে যখন উনি চলে গেলেন চিরকালের জন্য, ওনার শেষ শয়ন ছিল এই খাটে। কত সুখস্বপ্ন সুখস্মৃতি কত বেদনা স্বপ্নভঙ্গ চোখের জল, জন্ম থেকে মৃত্যু সবকিছুর নির্বাক সাক্ষী এই খাট।
এবার ছুটি নেবো, ছুটি দেবো। বহুকাল ঐ
মাটি ছেড়ে এই উঁচু ঐতিহ্যশীল বনেদীয়ানায় মোড়া আভিজাত্যের অহংকারে নিজের সবটুকু নিয়ে বসে আছি। এবার ফিরে যেতে চাই মাটিতে অকাতরে সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে।”
ভম্বল ব্যস্ত মানুষ। কথাগুলো শুনে মুখ কুঁচকে হাত ঝাঁকিয়ে বিরক্তি দেখিয়ে বললো, “আচ্ছা আচ্ছা, সে দেখা যাবে আখুন।”পরদিন সকালে সবাই অবাক চোখে প্রত্যক্ষ করলেন ঠাকুমার নিথর নিষ্প্রাণ দেহ স্থির হয়ে পড়ে আছে সেই খাটেরই মাঝখানে। তার শেষ ইচ্ছে পূরণ করার সুযোগই আর পাওয়া যাবে না। ঐতিহাসিক খাটে ইতিহাস হয়ে রয়ে গেলেন।
-
রম্য- ই যুগের ই স্নান
ই যুগের ই স্নান
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়প্রস্তর যুগ তাম্র যুগ লৌহ যুগ এইভাবে নানান যুগের হার্ডল রেস পেরিয়ে এখন ই`যুগে ঢুকে পড়েছি।
রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘন্টা বাজছে রাতের যুগকে অনেক পিছনে ফেলে ডাকহরকরাকে সরিয়ে টেলিগ্রামকে আদিম করে দিয়ে এখন, ই মেল @.com স্বাগতম।ই পোর্টাল, ই মানি লেন্ডিং, ই টেন্ডার, ঠিকই আছে। যুগের সঙ্গে সময়ের সঙ্গে চলাই জীবন। নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। তবে আমার খুব আশ্চর্য লেগেছে, ই স্নান। সত্যি বলতে হাসিও পেয়েছে খুব। ঘটনাটা বলি।
ঠাকুমার খুব ইচ্ছে, বলতে গেলে বিরানব্বই বছরের বৃদ্ধার অন্তিম ইচ্ছে শেষ বারের মতো গঙ্গা স্নান করে।
ডক্টরকে কথাটা জানাতেই তিনি হাঁ হাঁ করে লাফিয়ে ওঠার মতো ক`রে বললেন, আরে ওনার না-হয় বয়স হয়ে গিয়েছে ভুলভাল বলছেন, আপনারাও পাগল হলেন না-কি?
বললাম না না সেই স্নান নয়, একেবারে নিরাপদ পবিত্র নির্ভয় স্নান। ই স্নান।
ডক্টর স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বললেন, ও তাই বলুন। ওকে, ই স্নান Absolutely lovely Idea. You may proceed.
ঠাকুমাকে আর সাত মাইল দূরে গিয়ে নাক টিপে ডুব দিয়ে পূণ্যলাভ করতে হবে না, ঘরে বসেই গঙ্গাস্নান। ই স্নান। ঠাকুমা আকাশ থেকে পড়লো।
সেটা আবার কী?
একটু সন্দেহ ছিল ঠাকুমার। স্বাভাবিক, পুরনো দিনের মানুষ, আধুনিকতার চাকচিক্যের প্রতি নাক সিঁটকানো অবিশ্বাস।
তাই বুঝিয়ে বলতে হলো, এই জল সাধারণ ঐ মাটি গোলা নোংরা গঙ্গাজল নয়। এ একেবারে হরিদ্বারের হর কী পৌড়ী ঘাটের জল। অর্ডার দিয়ে নিয়ে আসতে হয়।
সেই কথা শুনে ঠাকুমার সেকি আনন্দ হাসি।
বলিস কি! এমনও হয়? বেশ বেশ, তাহলে সেই ব্যবস্থাই কর। হলো ব্যাবস্থা।ঠাকুমা আজ আর নেই। কিন্তু ক্যামেরায় ধ`রে রাখা তার সেই ফোকলা দাঁতের সরল হাসি, ই স্নান সমেত আজও ঘরের দেওয়ালে উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে আছে।
-
রম্য- ফুঁ বাবার ফুসমন্তর
ফুঁ বাবার ফুসমন্তর
–সুজিত চট্টোপাধ্যায়-ফুঁ বাবা, একটা প্রশ্ন ছিল।
-ক`রে ফ্যাল। ( ছিলিমে টান দিয়ে )
-বাবা, জীবন কী?
-হা হা হা হা হা, জীবন হলো সময়ের সীমাবদ্ধ কাল।
-আর একটু সহজ করে যদি বলেন। মানে জানেনই তো, ভেজাল খেয়ে খেয়ে একেবারে
-এককথায় আয়ু। আরও সহজ কথায় প্রাণবায়ু। কেউ বলে প্রাণ আত্মা নির্ভর, আমি বলি আত্মনির্ভর। (ধোঁয়া ছেড়ে )
-তফাৎ কী গুরুদেব?
-ওহে বৎস, আসলে তো বায়ু। নাসারন্ধ্রে প্রবেশ এবং বাহির। সেই গর্বিত বায়ু যতক্ষণ হাপড় টানবে আর ছাড়বে ততক্ষণ জীবন।
বায়ু ফুরলো জীবন জুরলো। ( আবার টান)
-বড়ই ক্ষণস্থায়ী গুরুদেব।
-আক্ষেপ থাকবে না, যদি এ-কে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারিস।
-কাকে ফুঁ বাবা, বায়ু কে?
-দূর বোকা। তাকে ব্যবহার করেই তো বেঁচে আছিস, আবার কী?
-তাহলে?
-জীবন, সুখের স্বর্গে বেঁচে থাকার পথ।
-কেমন করে ফুঁ বাবা? পথ দেখান প্লিজ। সত্যি কথা বলতে, নানা মুনির নানা মতের ধাক্কায় আমরা অর্বাচীনের দল একেবারে দিশেহারা। যখন যেটা শুনি সেটাই ঠিক মনে হয়। গোলকধাঁধার চক্কর। পথ বাৎলে দিন প্রভূ।
-দু’টো রাস্তা। একটা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর পথ, অন্যটা সর্বগ্রাসী ভোগের পথ।
– না না স্যার মানে গুরুদেব, আজেবাজে কথা বলে লাভ নেই, পেটে খিদে মুখে লাজ। ওসব সন্ন্যাসী টন্ন্যাসী হওয়া সম্ভব নয়, মেন্টেইন করা যাবে না। অনেক ঝক্কি, নিয়ম কানুন আচার বিচার অমাবস্যা পূর্ণিমা জপ তপ পুজো, না না তার চাইতে ঐ ভোগের রাস্তার ব্যাপারটা যদি একটু খোলসা করেন কৃপা করে।
-আগে ভোগ পরে ত্যাগ, তাই তো? একেবারে সহজ মসৃণ পথ। শুধু বুদ্ধি খরচ করে দাপিয়ে চলো।
-নট ক্লিয়ার। মানে আর একটু যদি..
-কিচ্ছু নয় শুধু বারফট্টাই মারো, মিথ্যের বুলেট ট্রেন চালাও। লেঙ্গি দাও, অন্যের নামে চুকলি আর নিন্দেমন্দ করে নিজে প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠো। চামচা বাজি করে ধীরে ধীরে ওপরে চড়ে যাও, তারপর সুযোগ সুবিধে মতো গুছিয়ে গাছিয়ে নিয়ে একটা ঠিকঠাক জায়গায় পৌঁছে গিয়ে চোখ পাল্টাতে কতক্ষণ?
-তার মানে বেইমানি?
-ওরে, এপথে এটাই দস্তুর। কাজ ফুরলেই পাজি। শোন, গিরগিটি দেখেছিস তো? গায়ের রঙ বদল করে কিন্তু গিরগিটির স্বভাব চরিত্র বদলে যায় না।
– হ্যাঁ, এটা বেশ লাগদাই মনে হচ্ছে। চলবে। এরকম আরও দু’একটা অস্ত্রের সন্ধান দিন গুরুদেব।-অস্ত্রের শেষ নেই রে, কিন্তু এইসব দিয়ে কী হবে! লক্ষ্য কী?
-লক্ষ্য কী একটা প্রভূ। যতই প্রত্যাশা, ততই লালসা ততই লক্ষ্য।
-আরে মুর্খ প্রত্যাশার অন্ত নেই। অনন্ত কাল ধরেই অন্তহীন। শোন তবে, নেহাৎ সে যুগে অর্থোপেডিক্স সার্জারীর তেমন রমরমা ছিল না, নইলে ভীমের গদার গোঁতা খেয়ে ঊরুভঙ্গ দুর্যোধন ঊরুর বোন ফ্যাকচার সারিয়ে সেকেন্ড চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়ে যেতো। এতো সহজে হাল ছাড়ার পাত্র সে মোটেই ছিল না।
অতো অতো ধনসম্পদ, গোটা একটা রাজ্য হস্তিনাপুর সঙ্গে নবনির্মিত সুদৃশ্য ইন্দ্রপ্রস্থ, ঊরু উন্ডেড হলো বলে যাবতীয় বৈভব ফেলে রণে ভঙ্গ দেবে এটা বিশ্বাস করা মুশকিল নয় কী?
-ঠিকই তো,,,
-কামনা ফুরোয় না রে কামনা ফুরোয় না। ভাগ্যিস ফুরোয় না। কামনা ফুরোলে মন বাগিচার সতেজ পদ্ম শুকিয়ে একেবারে কড়কড়ে মড়মড়ে হয়ে মাটিতে নেতিয়ে পড়ে অবহেলায় গড়াগড়ি যেতো।
-এই তো মাথা সাফ হতে শুরু হয়েছে, সুতরাং বাঁচতে হলে ভেক ধরতে হবে, নাহলে বোকা বুদ্ধু হয়ে ভোটের বাজারে দেওয়াল দখলের সিজিনাল হিরো হয়ে যৌবনের শবযাত্রা দেখতে হবে। অতএব, মিথ্যের পিরামিড সাজাও। মনোলোভা মণিমাণিক্যের বাক্য বপন করো। নাই বা হলো কল্পনার কল্পতরু। নাই বা ধরলো তাতে মণিকাঞ্চন, বয়েই গেল। তোর কার্যসিদ্ধি হওয়া নিয়ে কথা।
-বুঝলুম। কিন্তু ঢপবাজি ধরা পড়তে কতক্ষণ, তখন? পাবলিক মেরে লাট করে দেবে না?
-ধুস, কিসসু হবেনা। পাবলিক এক অদ্ভুত প্রাণী। ওরা ভুলে যেতে ভালোবাসে। প্রতিশ্রুতির মেগা সিরিয়াল। আবার নতুন কেরামতি। পাবলিক হলো হাওয়া নিশানের মুরগী। যেদিকে হাওয়া সেদিকে চোখ। কি হলো, কী ভাবছিস? আরে বাবা পরের কথা পরে ভাববি। যখন যেমন তখন তেমন। এখন তো আখের গুছিয়ে সুখ ভোগ করে নে। দামী দামী স্যুট, কোট, নানান রঙের চোখধাঁধানো পোশাক। বহু মূল্যের বিলাসবহুল বিদেশি গাড়ি, অট্টালিকা, পারলে বিশ্বভ্রমণটাও সেরে ফেলিস। দুনিয়ায় সুখ ভোগের অণুসঙ্গ কি কম রে?
-কিন্তু!
-আবার সেই বোকার মতো কিন্তু কিন্তু করে, দ্যাখো! আরে বাবা সুখ পেতে সাহস চাই। বুকে বল আন, দেখবি সবই সহজ। তাছাড়া জানিসই তো… প্রতিশ্রুতির সহবাস আর পরকীয়াও বর্তমান আইন মোতাবেক অন্যায্য নয়। সুতরাং চালাও পানসি। চুটিয়ে ভোগ করো। নো রিস্ক নো গেইন। সাহসী হও। নির্ভীকতাই জীবনের উন্নতির সোপান।
গলাবাজিতে ফার্স্টক্লাস ফাস্ট হও। নাকের ডগায় কাঁঠাল পাতার টোপ ঝোলাও। লোভ মেশানো টোপ বড়ই কার্যকরী। বিষ মাখানো মাখন রুটি, নেংটি ইঁদুর মুখ দেবেই দেবে। প্রত্যাশার হাতছানি, রেহাই নেই। এ বড়ো সাংঘাতিক ছোঁয়াচে অসুখ। হে মানব জাতি ভুলিও না, যুগে যুগে এই সত্য। বীর ভোগ্যা বসুন্ধরা।শুটআউট ইজ দি বেস্ট পলিসি।রাইভ্যাল দেখলেই উড়িয়ে দাও। আগুন আর শত্রুর শেষ রাখতে নেই বৎস। নদীচরের সোনালী বালি বালুকাবেলায় ট্রাক বোঝাই করে পাচার করো। নদী বাঁধের কাটামাটি কাঁচাটাকা হয়ে তোমার কালো আমানতের শ্রীবৃদ্ধি করুক। শ্রী-ঘরের খোদ কর্তার খোসামোদের পাত্র হও। সেই হবে তোমার পাড়ানির কড়ি। কামিনীকাঞ্চন মোক্ষম দাওয়াই। নীলসায়রে কালীয় ফনায় ত্রিভঙ্গ মুরারি হয়ে যদি বাঁশীতে সপ্ত সুরের মূর্ছনায় ভাসতে চাও তাহলে “শুভ কর্মপথে ধরো নির্ভয় গান…” আচার বিচারের মাথায় চড়ে তাতা থৈথৈ নেত্য যদি করতে চাও, হাতজোড় নাটুকে জনহিতৈষীদের জন্যে অম্লমধুর আচারের সুবন্দোবস্ত করো। জেনো তারাই তোমার চৌকিদার। হাইলাইটেড হও।
নিজের ঢাক নিজেই পেটাও। টুইটারে অশ্লীল বাণীর বান শানাও তোমায় রোখে কার বাপের সাধ্যি?
টিভি চ্যানেলে তোমার মুখনিঃসৃত বাণীকে হেডলাইন বানিয়ে প্যানেলে চর্বিত চর্চার মুখরোচক বিতর্কের কফি ঝড় বইবে। পাবলিককে গেলানো হবে। তোমাকে সেলিব্রিটি বানানো হবে। তুমি রাতারাতি এলেবেলে থেকে সেলএবেল হয়ে যাবে।
হা হা হা আর কি চাই?
এইবারে “হাম হ্যায় রাজা” হয়ে সমাজের কেউকেটা হয়ে বুক চিতিয়ে ফুলিয়ে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি করে ব্ল্যাক ক্যাটের ঘেরা টোপে ঘুরে বেড়াও। সুখ সুখ আর সুখ। চারদিকে সপ্ত রঙের অজস্র বুদবুদ উড়ছে ঘুরছে আহা কী বাহার। তুমি যথার্থই জনগনেশের ত্রাস থুড়ি ত্রাতা। নাও সব্বাই উঠে দাঁড়াও, এখন উল্টো পতাকা টাঙ্গিয়ে দেশভক্তিতে গদগদ হয়ে গান শুরু হবে। সমস্বরে বলো সবাই,
জয় ফুঁ বাবার ফুসমন্তর এর জয়। -
রম্য- জ্ঞাতি ধর্ম
জ্ঞাতি ধর্ম
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়গুরুদেব, কী করা যায় বলুন দেখি, আর যে পারি না। জ্ঞাতিগুষ্টির অত্যেচারের ঠ্যালায় নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি।
-কী করতে চাস?
-কিচ্ছু করতে চাই না। শুদ্ধু রেহাই পেতে চাই।
-কী থেকে রেহাই! জ্ঞাতিগুষ্টি নাকি অত্যাচার?
-আজ্ঞে নাজেহাল অবস্থা থেকে।
-বড়োই মুশকিল;
-এই সেরেছে; কেন গুরুদেব! কিসে আটকাচ্ছে?
-দাঁতে। কচি পাঁঠার ঝোল ভাত খাওয়ালি যে, তারই টুকরো-টাকরা যাক গে, শোনো বাবা, আসলে ব্যাপার কী জানো, জাগতিক কারণেই জ্ঞাতি সর্বদাই দুর্যোধন গোত্রীয় যাঁতি ধর্মী।
-আহা, আহা, কী শোনালেন গুরুদেব। মধুর বাণী। এক্কেবারে ঠিক কথা। স্বভাব যায় না ম`লে।
-এই তো কেমন সুন্দর বুঝেছ। রতনে রতন চেনা কেস কিনা,
-মানে?
-সে তোমার জ্ঞাতি, অর্থাৎ তুমিও তার জ্ঞাতি, ঠিক কি না?
-তা অবিশ্যি ঠিকই, কিন্তু,
-আরে বাবা আমড়া গাছে কি আম ধরে? সেখান যে রক্ত তোমাতেও সেই একই রক্তধারা।
-তাহলে উপায়?
-উপায় যাঁতি। জ্ঞাতি ঠেকাতে যাঁতির জুরি নেই।
-ওভার বাউন্ডারি হয়ে যাচ্ছে গুরুদেব। জলবৎ তরলং হলে বুঝতে সুবিধে হয়।
-এ-ই হলো তোদের সমস্যা। টাকা আছে ষোল আনা, লোভ আছে আঠারো আনা, হিংসে আছে বত্রিশ আনা অথচ বিদ্যে নেই এক আনা।
-(মনে মনে) বিদ্যে নেই বলেই তো গুরুদেব পুষছি গাদা খানেক দানদক্ষিণা দিয়ে। সঙ্গে প্রণাম টোনাম সব উপরি। নেহাৎ পারিবারিক পুরনো পরম্পরা, নইলে কে পোঁছে তোকে…
(মুখে) তা-ও ঠিক। কিন্তু গুরুদেব সেই একই দোষ তো ওদিকেও রয়েছে, তাহলে?
-হা হা হা হা, দুই ষাঁড়ের লড়াই দেখেছিস কখনও। গোদা শরীর, আর মাথায় মোটা শিঙের ঠোকাঠুকিতে মরণপণ যুদ্ধ। একটা শুয়ে না পড়া পর্যন্ত রেহাই নেই।
-শান্তি কি নেই গুরুদেব?
-হা হা হা হা, একবার একজন শান্তিকামী সমাজকর্মী দু’টো যুদ্ধরত ষাঁড়ের কানের কাছে গিয়ে সত্যজিৎ রায়ের তৈরি গানের কলি শোনাতে গেল-
“তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল..”
গোড়ায় গোড়ায় তেমন গা করেনি ষাঁড় দুটো। হঠাৎ শিঙ বাগিয়ে দিলো গুঁতো। ব্যস, এক গুঁতোতেই শান্তিকামীর চিরশান্তি প্রাপ্তি। হরিবোল হরিবোল।
-তাহলে লড়াই চলবে বলছেন?
-একপক্ষ শুয়ে না পড়া পর্যন্ত।
-তাহলে যাঁতির ব্যাপারটা?
-আরে এখনো বুঝলি না?
-যাঁতির দুটি অংশ। ওপর দিকে ধারালো অংশ নিচের দিকে ভোঁতা। ঐ দুয়ের মাঝখানে সুপুরি বসিয়ে যাঁতির ওপর আর নিচের হাতলে মার চাপ একসঙ্গে। কট আওয়াজ। কঠিন সুপুরি একেবারে দু’ফাঁক। আর বিবাদ নেই। ধারালো আর ভোঁতা এক হয়ে মিশে আছে। যাঁতি আর জ্ঞাতির স্বভাব, দু’ভাগ না করে বিশ্রাম নেবে না।
হরি হে মাধব, চান করবো না, গা ধোবো।