-
গল্প- ডিমের ঝোল
ডিমের ঝোল
-সুতপা মন্ডলতোমাদের কতবার বারণ করেছি তাও আজ আবার আমায় ডিমের ঝোল দিয়েছো?
একটা কথা এতবার করে কেন বলতে হয়? জানো তো আমি ডিমের ঝোল খাই না, খেতে বসে ঝোলের বাটি দেখে রেগে যান শশী বাবু।
বাবা, ওটা আপনার না, ওটা আপনার ছেলের, ভুল করে বাটিটা আপনার জায়গায় রাখা হয়ে গেছে। মা আপনার জন্য দুধের বাটি আনছেন।
– বাড়ির ছেলেদের খাবার শেষে শাশুড়ি বৌমা দুজনে খেতে বসে গল্প করার সময় উষশী শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা মা, বাবা কেন খান না ডিম?”
– কি জানি কেন যে খান না! বিয়ের পর থেকেই দেখছি কোনোদিন খাননি, অবশ্য আমাদের খেতে কখনো মানা করেননি, বাড়িতে জিজ্ঞাসা করার মতন কেউ তো ছিল না, তোমাদের পিসি বলেন ও ছোট থেকেই দেখেনি দাদাকে ডিম খেতে।
জানো তোমার বাবাকে অনেক বার জিজ্ঞাসা করেছি কেন খেতে চান না, কিছু অসুবিধে আছে কিনা, উনি কখনোই উত্তর দেননি, বলেছেন এটা নিয়ে কথা বলো না, রাগারাগি হবার ভয়ে আমিও চুপ করে গেছি।
খাবার টেবিলে বসে শাশুড়ি বৌয়ের সব কথা কানে যায় শশীবাবুর। মনে ভাবেন, এই কষ্টের কথা তোমাদেরকে বলতে চাই না।
আমার ভিতরের চাপা কষ্টটা তোমাদের দেখাতে চাই না। তাতে তোমাদেরও কষ্ট বাড়বে বিশেষ করে আমার ছোট বোনটার। সে তো তার ছোটদাকে ঠিকমতো চেনেই না, কিন্ত তবু নিজের দাদার কথা শুনলে মনখারাপ হয়ে যাবে।
বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে বসে ভাবতে থাকেন, যেন দেখতে পাচ্ছেন নিজের হাফপ্যান্ট পরা ছোটবেলাটাকে।
ছোট সংসার ছিল গ্রামে, মা-বাবা আর আমরা দুই ভাই, ছোট্ট বোন পরী।
আমরা ঠিক গরীব ছিলাম না, মোটামুটি সচ্ছল পরিবার বলা হতো আমাদের।
তখন তো চাইলেই সবকিছু হাতের কাছে পাওয়া যেত না, পুকুরে মাছ ধরা হলে মাছ আসতো বাড়িতে, অবশ্য কখনো কখনো আমরা দুই ভাই মিলে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতাম। দুপুরবেলা মাকে লুকিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে কতবার মায়ের কাছে বকুনি খেয়েছি।
মাংস অবশ্য হত মাঝেমাঝে, বাড়িতে মুরগি ঢোকা মানা ছিল, পাঁঠার মাংস সব সময় পাওয়া যেত না, তবে যেদিনই গ্রামে বা আশপাশের গ্রামে পাঁঠা কাটা হতো আমাদের বাড়িতে দিয়ে যেত বাবার এরকম বলা ছিল।
সেদিন আমাদের দুই ভাইয়ের খুব আনন্দ হতো, পরী তখন খুবই ছোটো, কথা বলতে শেখেনি, কিছু বুঝতো না। আমাদের সেদিনের আনন্দ এখনকার ছোট ছেলেদেরকে বোঝাতে পারবো না।
রাতের বেলা আলুপোস্ত অথবা একটা সবজি আর ডিমের ঝোল। মুরগির ডিম বাড়িতে আসত না কখনো। মা কতকগুলো হাঁস পুষেছিলেন, গ্রামের অনেক বাড়ি থেকেও ডিম বিক্রি করে দিত মা কিনে রাখতেন, ডিম আমাদের দুই ভাইয়ের ভীষণ পছন্দের ছিল। তার ওপর মায়ের হাতে বানানো ডিমের ঝোলের স্বাদ ছিল অসাধারণ।
আমরা দুই ভাই খেতে বসে ডিমটাকে লাড্ডুর মতো একবার থালার এদিকে রাখতাম তো আবার একবার ওদিকে। ঝোল তরকারি মেখে পুরো ভাত খাওয়া হয়ে যেত, কিন্তু ডিম পুরো থালা ময় ঘুরে বেড়াতো।
সবার শেষে ওটাকে একটু একটু করে ভেঙে খাওয়া। প্রথমে ডিমের সাদা অংশটা খেয়ে নিয়ে কুসুমটা রাখা থাকতো থালায়, গোটা থালা ফুটবল গ্রাউন্ড আর কুসুমটি ছোট্ট ফুটবল, গোল গোল করে ঘুরছে। আবার নিজের খাওয়া হয়ে গেলে একজন আরেকজনের থেকে মেরে খাওয়ার চেষ্টা করতাম তাই নিয়ে মায়ের কাছে খুব বকুনি খেতাম।
কি জানি তারপর হঠাৎ কি হল? পরপর কয়েক বছর হয়তো ফসল ভালো হয়নি, বাবার আয় হয়তো একটু কমে গিয়েছিল, বাড়িতে প্রায় প্রতিদিন ডিম আসার বদলে সপ্তাহে দু- তিন দিন আসতে থাকলো। কোনো কোনো দিন মা আমাদের দুই ভাইকে একটা ডিম দু’ভাগ করে দিতে লাগলেন। ভাই এটা কিছুতেই মানতে পারছিল না, বাবার ভয়ে কিছু বলতেও পারতো না। তবু সেদিন কি হয়েছিল কে জানে?
সেদিনও বাড়িতে মা ডিমের ঝোল রান্না করেছিলেন, আমাদের দুই ভাইকে একটা ডিম অর্ধেক ভাগ করে দিতেই ভাই বলে ওঠে ‘আমি আধটা ডিম খাব না, আমার গোটা ডিম চাই, আগে তো গোটা ডিম দিতে এখন দিতে পারো না?’
অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন, বলেছিলাম তুই আমারটা নিয়ে নে তাহলেই তো গোটা হয়ে যাবে। আমি না হয় আজকে খাবো না। সেদিন কোনো কথা শুনতে সে রাজী হচ্ছিল না, শেষে বাবা এসে বকাবকি করতে চুপচাপ খেয়ে শুতে চলে যায়।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি, ভাই আমার পাশে নেই, মা বাবাকে জানাতে শুরু হয় খোঁজাখুঁজি, কিন্তু না, সে যে কোথায় চলে গেল কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
গ্রামে, আশেপাশের গ্রামে এমনকি সমস্ত পুকুরে জাল নামিয়ে খোঁজা হয়েছিল ভাইকে, কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি।
বাবা একদম চুপ হয়ে গেছিলেন, মা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করতেন।
সেদিন থেকে বাড়িতে ডিম আসা বন্ধ হয়ে গেল, মা বাবা আমি কেউই ডিম খেতে পারতাম না, একটা ডিমের জন্য ভাইটাই হারিয়ে গেল!
কয়েক বছরের মধ্যেই আমাকে আর পরীকে একা করে দিয়ে মা-বাবা একে একে চলে গেলেন। নিজের পড়াশোনা, পরীকে বড় করা সব দায়িত্ব আমার ওপর। কোনক্রমে নিজের পড়াশোনা শেষ করে গ্রাম সম্পর্কিত এক কাকার সাহায্যে একটা চাকরি পেয়েছিলাম।
শহরে আসার কিছুদিন পর গ্রামের সমস্ত জমি জায়গা বিক্রি করে এই বাড়িটা বানিয়ে সংসার, বোনের বিয়ে হয়েছে। সেও সুখী হয়েছে।
কিন্তু এখনো ডিমের ঝোল দেখলেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে একবার যদি ভাইটাকে খুঁজে পেতাম ।-আমার অফিসের নতুন বসকে একদিন আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে হবে মা, অফিস থেকে এসে বলে অমিত।
-কেন রে?
-উনি বহু বছর বিদেশে ছিলেন, বাঙালি খাবার প্রায় ভুলে গেছেন অথচ খেতে খুব ভালোবাসেন। আজ আমাদের সাথে বসে লাঞ্চ করছিলেন, তোমার হাতের সবজি খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কথায় কথায় অবশ্য বললেন ওনার মা খুব ভালো রান্না করতেন। আমি বললাম আপনাকে একদিন আমাদের বাড়ি আসতে হবে।
শুনে খুব খুশি হলেন বললেন- নিশ্চয়ই আসবো।
-তাহলে এক কাজ কর সামনের রবিবার ওনাকে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ কর।
-কি বৌমা, তুমি কি বলছো? সেটা ভালো হবে না?
-হ্যাঁ মা তাই ভালো রবিবার ওনাদের ডাকো সন্ধ্যেতে, আমরা সব অ্যারেঞ্জ করে ফেলবো, ভালোই হবে তোমার বসের সাথে আমাদের আলাপ হয়ে যাবে।
-তোর বসের কি নাম?
-সি.কে .রায়
-আমরাও রায় আর উনিও রায়, আসতে বলে দে ভালই হবে।
রবিবার সন্ধ্যাবেলা সস্ত্রীক সি.কে. রায় আসার পর অমিত সবার সাথে আলাপ করাতে থাকে।
-বাবা উনি আমার বস।
বসের মুখের দিকে অনেকক্ষণ থেকে তাকিয়ে থাকেন শশী বাবু।
সবাই গল্প করছেন, কিন্তু শশীবাবুর মনে কোনো সুখ নেই, তিনি বারবার মনে করতে চাইছেন এনাকে কোথায় দেখেছেন, ভীষণ চেনা লাগছে ।
মিস্টার সি. কে. রায়-ও বারবার তাকে দেখছেন।
শেষে বলেই ফেললেন, আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো! আপনাকে আমার ভীষণ চেনা মনে হচ্ছে।
-বাবা তুমি ওনাকে কোথায় দেখবে? উনি সারাজীবন বাইরে ছিলেন।
হঠাৎ দেয়ালে টাঙানো মা বাবার ফটোটা দেখে সি.কে. রয় বলে ওঠেন “এনারা!”
-আমার মা-বাবা।
-দাদা..আমাকে চিনতে পারছিস না! আমি তোর চাঁদু।
দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরেন, দু’জনে আনন্দে আত্মহারা।
কান্নাকাটির অভিমানের পর্ব শেষে শশী বাবু বলেন, তুই কোথায় ছিলিস তোকে কত খুঁজেছি?
সব বলবো দাদা, তোকে যখন পেয়েছি আর হারাবো না । কিন্তু আমাদের বোন পরী, পরী কোথায়?
ভালো আছে, ওর বিয়ে হয়েছে খুব সুখে আছে। কিন্তু তুই বল তুই কোথায় ছিলিস?
-বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়াতে শুরু করেছিলাম স্টেশনের দিকে। ভোরবেলা প্রথম যে ট্রেনটা পেলাম তাতে উঠে পড়লাম, টিকিট কাটিনি। চেকার এসে টিকিট চাইতেই মুশকিলে পড়লাম, ভাগ্য খুব ভালো ছিলো, আমার সহযাত্রী ছিলেন এক নিঃসন্তান দম্পতি, তারা ফাইন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন।
আমাকে ওনার সঙ্গে করে নিয়ে চলেন ওনাদের বাড়ি। অবশ্য বারবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাড়ির কথা আমি ওনাদের কিছু বলিনি।
ওনারা আমাকে নিয়ে গিয়ে সন্তান স্নেহে মানুষ করতে থাকেন, অনেকবার বলেছিলেন একবার অন্তত মা-বাবার কাছে যেতে, তখন আর রাগ ছিল না লজ্জা লাগতো, তাই ভেবেছিলাম চাকরি পেয়ে একবারে যাব মা-বাবার কাছে, একদম গিয়ে অবাক করে দেবো। চাকরি পাবার পর গিয়েছিলাম গ্রামে কিন্তু ততদিনে তোমরা গ্রাম ছেড়েছো। গ্রামে আমাকে কেউ চিনতে পারলো না, আসলে ছোটবেলায় ঘর ছেড়ে ছিলাম তো তাই কেউ আর চিনতে পারলো না।
বাড়িও গিয়েছিলাম গিয়ে দেখলাম ওই বাড়িতে গ্রামের স্কুলের মাস্টারমশাই থাকেন যাকে আমি চিনি না।
অনেকের কাছে তোমাদের ঠিকানা চাইলাম কিন্তু কেউ দিতে পারল না। হতাশ হয়ে ফিরে এসেছিলাম।
তারপর চলে গেলাম বিদেশে।
আজ এই ভাবে তোমাকে পাবো ভাবতেই পারিনি।
-সত্যি রে, কি আনন্দ হচ্ছে, মা বাবা থাকলে কত খুশি হতেন, তোকে হারিয়ে খুব মনোকষ্টে ছিলেন। যাক আর আমি তোকে কোথাও যেতে দেব না। বৌমা আজ তোমাদের কি রান্না হয়েছে?
-বাবা মাছ মাংস সব রান্না করেছি।
-ডিম, ডিম রান্না করোনি!
-না বাবা, আপনি তো ডিম খান না।
পাশ থেকে চন্দ্রকান্ত বাবুর স্ত্রী বলে ওঠেন, ভালো করেছেন আমার উনিও কিন্তু ডিম খান না।
দুই ভাই জোরে হেসে ওঠেন।
-বৌমা কাল ভালো করে ডিমের ঝোল রান্না করো আমরা দুই ভাই কবজি ডুবিয়ে খাবো।
সবাই একসাথে বলে ওঠে “কিন্তু তোমরা তো ডিম খাও না!”
“ভাইয়ের সাথে সাথে ডিম হারিয়ে গেছিল” সবাই হেসে ওঠেন। -
কবিতা- রোজনামচা
রোজনামচা
-সুতপা মন্ডলসকাল বেলা চায়ের কাপে শুরু খুনসুঁটি,
তারপর বাজার দেখে মাথা গরম,
মোচা, কচুশাক, চুনোপুঁটি!
কাজের মেয়ে আসছে না সাতদিন
আমার কথা কেউ ভাবে না,
আমি যে বাড়ির বিনা মাইনের ঝি।গিন্নী একটু চা হবে? শুনেই মাথায় জ্বলে আগুন,
চা এনে দেখি, বিছানায় রাখা ভিজে গামছা,
আর কি তোমায় ছাড়া যায়?
আমার মত মেয়ে বলেই সামলায় তোমার ঝক্কি,
ব্যাস, তুমিও বলে উঠলে-
“ভাগ্যে বিয়ে করেছিলাম তাই উদ্ধার হলে”।চিত্রগুপ্তের খাতার মত খুলে যাবে মনের খাতা,
অভিযোগ অনুযোগের চুল চেরা বিশ্লেষণে-
গলার পারদের ওঠানামা।মাত্রা যখন ছাড়িয়ে যাবে,
তোমার সঙ্গে ঝগড়া হবে ভীষণরকম বাড়াবাড়ি,
খাবার টেবিল জুড়ে নেমে আসবে নিস্তব্ধতা।আরো কিছু পর রাত্রি গভীর হবে-
এক শয্যায় তুমি পাশ ফিরে শোবে,
আমার ফেরানো অন্যদিকে মুখ।
অভিমান পাহাড় প্রমাণ, দূরত্ব সহস্র যোজনের।অবশেষে, দুটো বালিশ পাশাপাশি,
তোমার বাহু ডোরে এক পৃথিবী সুখ। -
গল্প- সাপ লুডো
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
সাপ লুডো
-সুতপা মন্ডলকোর্ট থেকে বেরোনোর পর অনীক বুঝে উঠতে পারে না তার এখন কি করা উচিত। আজ ফাইনালি ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর সে খুশি হবে না দুঃখ পাবে।
তবে একটা কথা ঠিক, সুচেতনাকে নিয়ে তার আর কোন দায়িত্ব রইল না।
শুধু বাচ্চাগুলোর জন্য খারাপ লাগলেও কে জানে বাচ্চাগুলো আমার তো! নিজের মনে নিজেই হেসে ওঠে অনীক।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে একটা ট্যাক্সি ধরে বলে বাবুঘাট।
নদীর ধারে সিঁড়িতে বসে থাকে চুপচাপ।
এই জায়গাটা তার প্রিয় ছিল একসময়, মন খারাপ হলেই চলে আসতো এখানে।
অবশ্য সুচেতনাকে নিয়েও বহুবার এসেছে এখানে বিয়ের আগে।
সুচেতনার সাথে বিয়েটা প্রেম করেই হয়েছিল। সত্যিই প্রেম!
এক বন্ধুর মারফত আলাপ হয়েছিল। স্মার্ট সুন্দরী সুচেতনা কে দেখলে যে কোন ছেলেই প্রেমে পড়তে বাধ্য।অনীক তখন ডিপ্লোমা পাস করে একটা এমএনসি তে জুনিযার হিসেবে ঢুকেছে। মধ্যবিত্ত ঘরের সাদামাটা ছেলে কি করে একটু বেশি টাকা রোজগার করবে সেটা নিয়েই ভাবতো অন্য কিছু নিয়ে ভাবার অবস্থা তার ছিল না।
আর মেয়েদের ব্যাপারে তার একটু অনীহায় ছিল স্কুল-কলেজও খুব একটা মেয়ে বন্ধু নেই শুধু ‘ শ্রী’ ছাড়া, পাশাপাশি একসাথে বড় হয়েছে তারা।
ওই বন্ধু একদিন বলেছিল চল তোকে, আজকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব , ‘আমি একজনকে বুক করেছি’। খুব খারাপ লেগেছিল অনীকের।
মন সায় দেয়নি ওর সাথে যেতে তবু বন্ধুর পীড়াপীড়িতে একরকম বাধ্য হয়েই সঙ্গী হয়েছিল।
সেই মেয়েটি ছিল সুচেতনা যে প্রফেশনালি একজন কল গার্ল।
অনীকের ব্যবহারে সে বুঝে গিয়েছিল তথাকথিত কাস্টমার আর অনীক এক গোত্রের নয়।
একটা অন্যরকম বন্ধুত্বের শুরু হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
এরপর ওরা মাঝে মাঝে দেখা করতে থাকে, না ক্লায়েন্ট হিসাবে নয় একজন আরেকজনের বন্ধু হয়ে। ওদের মেলামেশায় ওরা অনুভব করতে থাকে অন্য টান।
একদিন অনীকই বলেছিল কথাটা ” সু, তুমি এই জীবনটা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারো না”!
-তোমার ভালো লাগে রোজ রোজ অন্য মানুষ।
-কি করবো বলো? আমি তো কোন চাকরি পাব না আমার মত মেয়েদের ঘর সংসারের স্বপ্ন দেখতে নেই।
সব কথা জেনে কোন সুপুত্তর বিয়ে করবে বলো?
-ধরো আমি যদি বলি আমার সাথে বাকি জীবনটা কাটানোর কথা।
– পারবেনা সু সবকিছু ভুলে আমার সাথে একটা সংসার গড়তে।
– অনি তুমি যা বলছ ভেবে বলছো তো!
তোমার মা-বাবা কেন মেনে নেবে আমার মত মেয়েকে তাদের ছেলের বউ হিসেবে।
-তুমি রাজি কিনা বল মা বাবার সাথে আমি কথা বলবো।
সুচেতনা হাতটা অনীকের হাতের উপর রাখে।
মা বাবা সব শুনে বলেছিলেন কোন মেয়ে এই জীবনটা চায় না নিশ্চয়ই অনেক যন্ত্রণায় বাধ্য হয়েছে এরকম একটা জীবন বাছতে। ” তুমি যদি মন থেকে মেনে নিতে পারো আমাদের কোন অসুবিধা নেই”।আমাদের কোনো মেয়ে নেই আমরা ওকে নিজের মেয়ের মতো করেই রাখবো।
-অনীকের বন্ধুরা অবশ্য বারবার বারণ করেছিল সে শোনেনি, তার মনে হয়েছিল একটা মেয়ে শুধুমাত্র পরিস্থিতির শিকার কেন সুস্থ জীবনে ফিরতে পারবে না নিশ্চয়ই পারবে।
-তারপর চার হাত এক হতে বেশি দেরি হয়নি।বিয়ের পর প্রথম দু’বছর শত্রুদের মুখে ছাই দিয়ে খুব সুখে কাটে।
কিন্তু তারপর থেকে হঠাৎ হঠাৎ দুপুর বেলা একটু ঘুরে আসি করে বেরিয়ে পড়তে থাকে সুচেতনা কোথায় যাবে কাউকে কিছু বলে না, তারি মাঝে আসে সুখবর।
অন্তঃসত্ত্বা বৌমাকে যত্ন করা দেখে পাড়া-প্রতিবেশী অনেক কথাই বলত কিন্তু অনীকের মা বলতেন ও তো আমার মেয়ে, ছেলের বউ নয় গো।
ওর দেখা শোনা করবো না তো কার দেখাশোনা করব!
দুটি ফুটফুটে যমজ সন্তান হয় ওদের। বেশ কিছুদিন সুখেই কাটে। বাচ্চা গুলো একটু বড় মানে এক বছর, আবার বেরিয়ে পড়তে থাকে সুচেতনা, দুধের শিশু গুলো কাঁদতে থাকে কিন্তু তবু সে বেরিয়ে পড়ে।
অনিকের মা অনেক বারণ করেছেন তোমার কি চাই বল আমরা এনে দিচ্ছি নয়তো বাবুকে বলো সে এনে দেবে, নয়তো বাবু ফিরলে একসাথে বেরিয়ো। তুমি এই সময় বাইরে বেরিও না, কিন্তু কে শোনে কার কথা, সে রোজ বেরিয়ে পড়তে থাকে ।
একদিন একটি ফ্লিম ম্যাগাজিনের কভার ফটোতে সুচেতনার আবেদনময়ী ছবি দেখে অবাক অনীক।
এ কোন সুচেতনা! অনীক তো এ ব্যাপারে বিন্দুবিসর্গও জানেনা।
এই ম্যাগাজিন যদি তাদের আত্মীয়-স্বজনরা দেখে, পাড়া-প্রতিবেশী দেখে তাদের যে বদনাম হবে, কেউ সহজভাবে নিতে পারবেনা, আর কিছু নয় তারা তো মধ্যবিত্ত।
সুচেতনাকে জিজ্ঞাসা করতেই রেগে ওঠে বলে তোমার যা রোজগার তাতে তুমি আমার কোন শখ-আহ্লাদ মেটাতে পারবে বলে মনে হয় না।
– তাই যা করেছি বেশ করেছি।
– ভালোই হলো তুমি জেনে গেলে আর লুকোচুরি দরকার হবে না।
তোমার এই মধ্যবিত্ত জীবন মানতে আমি পারবো না।
সুচেতনা ব্যবহারে কষ্ট পায় অনীকের মা-বাবা।
পাড়া-প্রতিবেশীর চোখের চাওনি রাস্তাঘাটে চেনা মানুষের ব্যবহার প্রতিনিয়ত মানুষ দুটো কে কুরে কুরে খাচ্ছিল তবে বেশিদিন সহ্য করতে পারেননি ওনারা। এক মাসের মধ্যেই মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে ওনারা চলে যান ‘না ফেরার দেশে’।
মা বাবা চলে যাওয়ার পর আরও অশান্তি বাড়তে থাকে।
কোন কোন দিন রাতে বাড়ি ফেরে না সুচেতনা।
কোন কোনদিন মাঝরাতে আকণ্ঠ পান করে ফেরে বাড়ি।
অনীক মানতে পারছিল না তবুও চেষ্টা করছিল, বোঝাতে চাইছিল সুচেতনাকে।
কিন্তু সে তখন টাকার নেশায় বুঁদ।
একদিন নিজেই বলে অনী আমার মনে হয় আমাদের আলাদা থাকাই ভালো তাতে তোমার শান্তি আর আমার মুক্তি।আজ ফাইনালি ডিভোর্স হয়ে গেল।
বাচ্চা দুটিকে কাস্টডিতে নিয়েছে সুচেতনা।
অনি জানেনা তাকে বাবা বলে ডাকা বাচ্চা দুটোর সত্যিই সে বাবা কিনা!পুরনো কথা ভাবতে ভাবতে একদম অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল অনীক হঠাৎ কাঁধে একটা আলতো স্পর্শ তাকিয়ে দেখে ‘ শ্রী,’ এখন ওর একমাত্র বন্ধু, অনীকের যন্ত্রণার দিনেও সব সময় পাশে থেকেছে।
শ্রী বলে জানতাম তুই এখানেই থাকবি তাই সোজা চলে এলাম এখানে।
এবার ওঠ বাড়ি চল, কাল থেকে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে যে।………. সমাপ্ত…………
-
গল্প- ঠাকুরানীর দোর
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
ঠাকুরানীর দোর
-সুতপা মন্ডলকলেজের বন্ধু অমলের দৌলতে জীবনে প্রথম গ্রাম দেখা সুপ্রতিমের। স্টেশন থেকে নেমে বাস, আবার বাস থেকে নেমে রিকশায় প্রায় চল্লিশ মিনিট, কলকাতায় বড় হওয়া সুপ্রতিমের কাছে যোগাযোগের এমন অবস্থা সত্যি আশ্চর্যের।
গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই চাষাবাদ করেন, যারা চাকরি করেন তারা কখনো সখনো গ্রামে আসলেও পূজা-পার্বণে, বেশিরভাগ বাইরেই থেকে গেছেন।
মন ভালো করা আতিথিয়তা আর মানুষের সারল্যে একবারে মুগ্ধ সুপ্রতিম।
ওর কাছে গ্রাম মানে ছিল শুধুমাত্র সিনেমায় দেখা, কিন্তু সত্যি যে গ্রামের রূপ এত সুন্দর হয় এখানে না এলে বুঝতে পারত না। সে যেন শুধু অমলের বাড়ির অথিতি নয় পুরো গ্রামের অতিথি।
তাই গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়ি থেকে তার জন্য আসে নিমন্ত্রণ, ” আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসো গো বন্ধু”, খুব ভালো লাগে সুপ্রতিম এর। এই কথা তো সে কলকাতাতে ভাবতেই পারেনা। গ্রামের সবার বাড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে একটা বাড়ি ওর মনে কৌতূহল জাগায়। বাড়িটাতে কেউ আছে বলে মনে হয় না তবুও মড়াই বাঁধা আছে, রান্না চালা আছে, যদিও প্রতিদিন রান্না হচ্ছে না, বড় বড় গামলা ধুয়ে মুছে রাখা যেন ওতে খাবার ছিল এখনই কেউ ধুয়ে রেখে গেছে ।
বাড়িটির বিশেষত্ব আলাদা, উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়িটির প্রবেশদ্বারে কোন দরজা নেই। একটা জায়গা রং করে তার উপরে অন্য রং দিয়ে লেখা আছে “ঠাকুরানীর দোর।” বাড়িটি যে খুব যত্নে আছে সেটা দেখলেই বোঝা যায়।
সন্ধ্যেবেলা গল্প করতে করতে তমালকে বাড়িটির কথা জিজ্ঞাসা করতেই উঠে এল এক অভূতপূর্ব কাহিনী।
ওই গ্রামেরই মেয়ে বাল্যবিধবা এক নারী শৈলজার কথা। আর তাও আজকের নয় প্রায় একশ বছর আগের একটি মেয়ে, স্বাধীনতার আগের একটি কাহিনী।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল শৈলজার। মেয়ে বারো বছরের হলেই শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হবে এরকমই ঠিক করেছিলেন বাবা-মা। কিন্তু শৈলজার আর শ্বশুর বাড়ি যাওয়া হলো না, মাত্র নয় বছর বয়সেই বাপের বাড়িতে বসেই হয়ে গেলেন বিধবা। স্বামীর কথা তার কিছুই মনে নেই। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ দের তত্ত্বাবধানে শৈলজার শুরু হলো নিয়ম-কানুন শিক্ষা।
একটু বড় হতে না হতেই শৈলজা সাংসারিক বুদ্ধিতে নিপুন হয়ে উঠল, তাকে কেউ হারাতে পারত না।
এই গ্রামেরই মেয়ে হওয়ায় সব বৌদিদের সে ঠাকুরঝি আদরের ঠাকুরানী। দিনে দিনে শৈলজা নামটাই সবাই ভুলে গেল। তার নতুন নামকরণ ঠাকুরানী।
নিজের কোন সংসার ছিল না ঠিকই কিন্তু এই গ্রামের প্রতিটি সংসার ছিলো তার নিজের সংসার। মানুষের আপদে-বিপদে সবার আগে ছুটে আসতেন ঠাকুরানী। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে শলা-পরামর্শর জন্য সবার আগে ঠাকুরানীর কাছে আসতো সবাই। আবার তার শাসনও ছিল প্রচুর। আচার-বিচার নিয়ম-কানুন থেকে রক্ষা ছিলনা কারোর। সে যেমন মানুষকে ভালবাসতো তেমনি শাসন ও করত কড়া হাতে।
বাবা মা চলে যাবার পর আরো একা হয়ে যায় শৈলজা। তখন আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরতে থাকে গ্রামের মানুষ গুলিকে।
পুরো গ্রামের মানুষ যেমন ভালবাসতো তেমনই মান্য করত। গ্রামের প্রতিটি জিনিস ছিল ঠাকুরানীর নখদর্পণে। ঠাকুরানীর চোখ এড়িয়ে কোন কিছু সম্ভব ছিল না। এই গ্রামের মেয়ে হওয়ার সুবাদে পুরুষদের সাথে কথা বলতেও তার কোন ভয় ছিল না কখনো কখনো তারাও সাংসারিক বুদ্ধি ধার নিতো ঠাকুরানীর কাছে। ঠাকুরানী ছিল ন্যায়ের পক্ষে তার কথা মান্য করবে এই গ্রামের কারো সাহস ছিলনা। এক কথায় তিনি ছিলেন এই গ্রামের “রাজ্যহীন রাজকন্যা” ভালোবাসার শাসক।
একবার বন্যায় আশেপাশের সব গ্রাম ডুবে যায় ক্ষতি হয় এই গ্রামের বেশ কিছু মানুষের। মানুষের আর্তনাদে মন কেঁদে ওঠে ঠাকুরানীর। তার ঘরের উঠোনে কাটা হয় বড় বড় উনুন । নিজের ঘরের ধানের গোলা খুলে দেন সর্বহারা মানুষগুলোর জন্য। মানুষগুলো ঠাকুরানীকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরে। বন্যার জল আস্তে আস্তে সরে যায়। স্বাভাবিক হতে থাকে জীবন কিন্তু ঠাকুরানীর মনের মধ্যে রয়ে যায় একটা বিরাট দাগ, এই বিপদ আবার আসতে পারে, তখন কি হবে সেই ভাবনায়।
তার পরেই তিনি এই অভাবনীয় পরিকল্পনা নেন। এই গ্রামের প্রতিটি সচ্ছল পরিবার থেকে প্রতিদিন একজনের মত খাবার দিয়ে আসতে হবে ঠাকুরানীর ঘরে ওনার নিজের জন্য নয়, তাদের জন্য যাদের খাবার জোটেনি সেদিন।
বিকেল হলেই ঠাকুরানী বেড়িয়ে পড়তেন লাঠি নিয়ে, সবার ঘরের দরজায় একটা হাঁক ” কিগো বউ কত দেরি সাঁঝ হয়ে এলো যে” ।
ঠাকুরানীর ঘরে খাবার খেতে আসতো আশেপাশের বহু গরিব গরিব মানুষ, যতদিন ঠাকুরানী বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থাকতেন ওদের খাবার সময়।
ঠাকুরানীর কথা ছিল “কেউ যেন না খেয়ে ঘুমায় না, তাতে যে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়” । এই গৃহস্থ বলতে তিনি তার গ্রাম বলতেন।
ঠাকুরানীর জমি থেকে যা আয় হত তা খরচা হত গ্রামের কল্যাণের কাজে।
গরিবের বাড়ির মেয়ের বিয়েতে আরো নানারকম সমাজকল্যাণমূলক কাজেতে।
ঠাকুরানী তৈরি করিয়েছিলেন এই গ্রামের পাঠাগার। বিদ্যালয়ের বাড়িটিও তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
তিনি যতদিন ছিলেন তার সবকিছু দেখভাল তিনি নিজেই করতেন কিন্তু তিনি চলে যাবার পর গ্রামের মানুষরা নিজেরাই এর পরিচালনা করতে থাকেন।
মানুষের মনে আজও বিশ্বাস ঠাকুরানী এখনো এই গ্রামে লাঠি ঠুকে ঠুকে ঘুরে বেড়ান, তার লাঠির আওয়াজ নাকি এখনো সন্ধ্যেবেলা পাওয়া যায়, সন্ধের আগেই সব বাড়ি থেকে খাবারের থালা আজও চলে আসে ঠাকুরানীর দোরে। কোন অভুক্ত যেন না খেয়ে ঠাকুরানীর ঘর থেকে যায়।
রাতের আঁধারে এখনো অনেক মানুষ খেয়ে যান ঠাকুরানীর দোরে।
গ্রামের ছেলেরা পাত পেরে খাওয়ায় তাদের।
সুপ্রতিম স্তম্ভিত। মনে মনে প্রণাম করেন সেই মৃত্যুঞ্জয়ীকে।
কি জানি তিনি হয়তো গ্রামের আনাচে-কানাচে সত্যিই ঘুরে বেড়ান।
……সমাপ্ত………
-
গল্প- করোনাকাল
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ।।
করোনাকাল
-সুতপা মন্ডলব্রেকিং নিউজ: করোনায় লকডাউন, চাকরি হারিয়ে আত্মঘাতী ইঞ্জিনিয়ার।
প্রত্যেকটি চ্যানেলে খবরটা বারবার দেখাচ্ছে। খবরটা শুনতে শুনতে পার্থ ভাবে তার মনের কথাটা জানল কি করে?
কাল রাতেই টারমিনেশন লেটার পেয়েছে মেলে, পাওয়ার পর থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না এই মুহূর্ত থেকে সে বেকার।
বারবার বাবা-মা, ছোট বোনটা, সুচেতার কথা মনে পড়ছে।ভালো করে পড় বাবু, তোকে অনেক বড় হতে হবে। তুই যখন বড় হয়ে এই এত বড় চাকরি করবি তখন আমাদের আর কোনো দুঃখ থাকবে না।
দেখো মা, একদিন আমি অনেক বড় হবো, এত বড় চাকরি করব, আর বাড়ি বানাবো অনেক উঁচুতে ওই হারান জেঠুদের ঘর টার থেকেও উঁচুতে।
পার্থ হেড স্যার এসেছেন বাড়িতে।
আজ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে বাবা, ” তুমি আমাদের স্কুলের, এই অঞ্চলের নাম রোশন করেছ। আশীর্বাদ করি তুমি অনেক অনেক বড় হও, দশজনের একজন হও।”দাদা তুই জয়েন্টে চান্স পেয়েছিস! তুই এবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বি?
ধুর বোকা মেয়ে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে কত খরচ হয় জানিস? ওসব আমাদের জন্য নয়।বাবা শুনতে পেয়ে বলেন এসব নিয়ে ভাবিস না বাবা, আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি, পুবের মাঠের জমিটা বেচে দিয়েছি আর তোর মায়ের গয়নাগুলোও আছে, তুই একদম চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে, তুই শুধু মন দিয়ে পড়াশোনাটা কর।
কিন্তু বাবা বোনের জন্য মায়ের গয়না গুলো-
তুই চাকরি করে বোনের জন্য গয়না। গড়িয়ে দিস।দাদা চাকরি পেয়েছিস! কলকাতায় থাকবো আমরা! আমার বন্ধুদের কে বলব আমার দাদা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি পেয়ে গেছে।
বাবাকে প্রনাম করে বলে চাকরি পেয়েছি এখনই মাইনে বেশি নয় তবে পরে উন্নতি হলে মাইনেও বাড়বে।
পাঁচ বছর হয়ে গেছে পার্থর চাকরি। সাধারন একজন এমপ্লয়ী থেকে পার্থ এখন ম্যানেজার, মাইনের রকম টাও ভালো।
বোনের বিয়ে তো ঠিক হয়ে গেছে, কিছু গয়না যে গড়াতে হবে বাবা।
চিন্তা করোনা বাবা, আমার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দিয়েছি বোনকে, বলে দিয়েছি ওর যা যা লাগবে কিনে নিতে। তুমি ভয় পেয়ো না বাবা, আমার স্যালারি থেকে মাসে মাসে কেটে যাবে।বাবা গাড়ি কিনলাম তোমাকে আর মাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়বো এখানে ওখানে ঘুরতে।
এখনই এত টাকা কোথায় পেলি বাবা, একটু বুঝেশুনে খরচা কর।
বাবা টাকা একসাথে দিতে হয়না E MI তে কিনেছি, আস্তে আস্তে শোধ হয়ে যাবে।বাবা একটা ফ্ল্যাট বুক করলাম, তিনটে রুম বড় একটা হল ঘর রান্নাঘর নিচে গ্যারেজে আছে। আর ভাড়া বাড়িতে থাকব না। অনেক উঁচুতে ফ্ল্যাট শহরটাকে তোমরা ব্যালকনিতে বসে দেখতে পাবে।
খোকা ফ্যাট কিনতে যে অনেক টাকা লাগে বাবা!
বাবা কিছু টাকা দিয়ে বুকিং করেছি আর বাকি টাকা লোন করেছি, মাসে মাসে স্যালারি থেকে কেটে যাবে।
এখন টাকা জমিয়ে আর কেউ ঘর কেনে না, নিজের ঘরের আরামে থাকতে থাকতে কিস্তিতে কিস্তিতে লোন শোধ করে।কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিয়ে হয়েছে পার্থর আর সুচেতার। সুন্দরী, সুশিক্ষিত সুচেতা সুন্দর করে সাজিয়েছে ঘর।
শাশুড়ি বউ দোকানে দোকানে ঘুরে ম্যাচিং করে কিনেছে পর্দা থেকে চাদর।
প্রতিটা ঘরের আসবাবপত্রের মধ্যেও একটা শৌখিনতার ছাপ। ঘরে ঢুকলেই দামি জিনিসের আভিজাত্য টুকু চোখে পড়ে।
এইতো মাত্র কয়েকদিন আগেই রান্না ঘরের ইন্টেরিয়র বদলে ফেলল। আগের ইন্টেরিয়ার এর সাথে লিভিংরুমের ইন্টেরিয়ার ঠিক ম্যাচ খাচ্ছিল না।সব মিলিয়ে পার্থর এখন বেশ গোছানো সংসার। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
বাবা মা সুচেতা পার্থ, বেশ সুখের সংসার।করোনার জন্য সব লন্ডভন্ড, দেশজুড়ে তথা বিশ্বজুড়ে লকডাউন চলছে।
পার্থদের যদিও ওয়ার্ক ফ্রম হোম চলছে।
কয়েকদিন আগে হঠাৎই ওদের প্রোজেক্ট বন্ধ হয়ে যায়, নতুন প্রজেক্ট এর আশা এখন প্রায় নেই।
কাল রাতে এসে গেছে টার্মিনেশন লেটার।
পার্থর চোখের সামনে ভাসতে থাকে ঘরের ইএমআই গাড়ির ইএমআই ক্রেডিট কার্ডের লোন ……
তারপর:-
সকাল থেকে টিভি চ্যানেল গুলোতে ব্রেকিং নিউজ, “লকডাউন এর জেরে চাকরি খুইয়ে আত্মঘাতী ইঞ্জিনিয়ার।”
পর্দায় ভেসে ওঠা ছেলেটাকে একদম পার্থর মত দেখতে।….সমাপ্ত……