• ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- অজানা অভিশাপ (পর্ব-৫)

    অজানা অভিশাপ (পর্ব-৫)
    -সুপর্ণা নাথ

     

     

    আমি ব্যাগে হোলি ওয়াটার, ফাদারের দেওয়া ক্রস, মারিয়ানার দেওয়া একটা ছোট পাউচ্ সব গুছিয়ে রেখেছিলাম, জানি না এগুলো কোন কাজে লাগবে, জানি না আমি ঠিক কি করতে যাচ্ছি শুধু এটা জানি যে ওই অভিশপ্ত Casa de Monte র কয়েদ থেকে আমার তিয়াসকে বের করতেই হবে।
    ফাদার বলেছিলেন, উপায় দু’টো- এক যদি শয়তানকে ওর বাড়িতে পুনরায় ঢোকানো অথবা ওকে প্রাণে মেরে ফেলা। মানে যে শরীর নিয়ে ও ঘুরছে তার বিনাশ। যদিও সেটা নেক্সট টু ইম্পসিবল । দু’শো বছর আগেও কেউ তা পারেনি।
    সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার।

    আমরা দু’জন গাড়িতে উঠে বসলাম, গাড়ি স্টার্টের শব্দে বোধয় মারিয়ানা জেগে গেছিলো। গাড়ি মেইন গেট দিয়ে বেরোনোর সময় পেছন থেকে ওর চেঁচানোর শব্দ শুনতে পেলাম, ও আমাকে মানা করছে। কিন্তু আমি মরিয়া। আমি সরাসরি Casa de monte র রাস্তা ধরলাম না, Fontainhas এর রাস্তা নিলাম। শহরের পশ্চিমে Ourem Creek (Creek – নদীর থেকে ছোট কিন্তু নালার থেকে বড় ) আছে তার পাশ ঘুরে একটা রাস্তা আছে যেটা আবার পাহাড়ের উপরের দিকে উঠেছে।
    কারো মুখে কোনো কথা নেই। জানিনা ও কিছু আন্দাজ করতে পারছে কিনা। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা আমার নেই। রাস্তার দিকে নজর নিবদ্ধ। হঠাৎ একটা বিশ্রী খিক খিক হাসিতে চমকে ফিরে তাকাই, এ কি দেখছি!
    তিয়াসের মুখ বদলে যাচ্ছে এক লোলচর্ম বৃদ্ধার মুখে, চোখ দু’টো হিংস্র হলদেটে, চোখের ছাই রঙা মনি দুটো চোখের সাদা অংশের সাথে এমন ভাবে মিশে গেছে যে তাদের অস্তিত্বই বোঝা যাচ্ছে না আর তার ফলে চোখ দু’টো মারাত্মক ভয়ঙ্কর লাগছে।
    সে খসখসে গলায় বলল
    – এত ঘুরে casa de monte তে যেতে হয় নাকি? তুমি আমাকে এত বোকা ভাবলে? তুমি আমাকে টোপে ফেলানি আমি ফেলেছি তোমাকে।

    আমার চমকের ঘোর না কাটতেই ও ঝাঁপিয়ে পরে আমার উপর। বীভৎস কর্কশ একজোড়া হাত আমার গলা চেপে ধরেছে, তীক্ষ্ণ নখ গুলো বসে যাচ্ছে আমার গলায়, রক্ত চুঁইয়ে নামছে বুকের উপর দিয়ে বুঝতে পারছি, আমি ড্রাইভ করা থামাই নি, যে করেই হোক আমি ওকে ওর অভিশপ্ত আস্তানাতে নিয়ে যাবোই।
    ওর চোখ দু’টো নিস্পলক ভাবে আমার চোখের দিকে চেয়ে আছে। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। ফাদারের কথা মনে পড়ে গেলো, ও তার শিকারকে হিপনোটাইজ করে। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে যা হোক করে ড্রাইভ করছি অন্য হাতে আন্দাজে ব্যাগ হাতড়ে পেয়ে গেলাম হোলি ওয়াটারের পট, মুহূর্তে ছিটিয়ে দিলাম ওর উপর, ও ছিটকে সরে গেলো আমার উপর থেকে। গাড়ির দরজা খুলে পালানোর উপক্রম করতেই আমি প্রতিটা ডোর আর সামনের কাঁচের উপর ছিটিয়ে দিলাম হোলি ওয়াটার, আর ক্রসটা মুঠিতে চেপে ধরলাম।
    ও বন্দি কোনো দরজাই ছুঁতে পারছে না। মারিয়ানার দেয়া মালাটা ছিঁড়ে গেছে। ও রাগে ফুঁসছে আমার উপর ঝাঁপাতে গিয়েও পারছে না। এটাই আমার শেষ সুযোগ। আমি নিজে শেষ হয়েও তিয়াসকে বাঁচাবো। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে অরিকে টেক্সট করে সবটা জানিয়ে দিয়েছি। আমি তিয়াসের কাছে পৌঁছতে না পারলেও অরি যাতে অন্তত ওকে খুঁজে পায়।

    গাড়িটা রাস্তার ধারে পার্ক করে, গাড়ির ব্যাক সিটের পায়ের কাছে রাখা পেট্রোলের জারটা নিয়ে ছিটিয়ে দিলাম সারা গাড়ির ভেতর, সামনের মূর্তিটা তখন ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতম রূপ নিয়েছে। বীভৎস সে মুখের আকৃতি। গলিত শবের মতো গন্ধ বেরোচ্ছে। সে তার শেষ চেষ্টা করলো তীব্র আক্রোশে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, আমি হাত দিয়ে আড়াল করতে একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করলাম, দেখলাম আমার ডান হাতের কনুইয়ের নিচের থেকে এক খাবলা মাংস ছিঁড়ে নিয়েছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, হাতটা অবশ হয়ে আসছে। কিন্তু না, এখন নিজের কষ্ট ভেবে লাভ নেই, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তো পুড়ে ছাই হয়ে যাবো, আর ছাই হবে ওই পিশাচ। তাতে দুঃখ নেই। শেষবারের মতো চোখ বুজে তিয়াস আর অরির মুখটা মনে করলাম। বাম হাতে লাইটারটা ছিল, সেটা জেলেই ছুঁড়ে দিলাম পিশাচের উপর, মুহূর্তে দপ করে আগুন লেগে গেলো। আমি দরজা খুলে বেরোতে গেলেই পিশাচ পালানোর পথ পেয়ে যাবে তাই আমাকেও …. তিয়াস বাঁচুক, আর কিছু চাই না। অসহ্য আগুনের তাপ আমি আর সইতে পারছি না‌। আমার চেতনা অবশ হয়ে আসছে, সেই অর্ধ চেতনে দেখলাম সামনে এক জ্বলন্ত মূর্তি বীভৎস শব্দে চিৎকার করছে। আমার আর কিছু মনে নেই আমি চোখ বুঝলাম।

    খুব ঠান্ডা একটা ঘরে চোখ খুললাম, মাথার উপর সাদা আলো, এটা কি স্বর্গ! হঠাৎ এক অচেনা মানুষের মুখ দেখতে পেলাম সে ঝুঁকে পড়ে আমাকে দেখছে আর তারপর কাকে যেন ডাকলো, আর তারপরেই এক অতিপরিচিত ব্যাকুলতা মাখা আনন্দিত স্বর শুনলাম …. অরি!

    ও আমার মাথায় আলতো করে হাত রাখল, আমার প্রথম প্রশ্ন
    – তিয়াস?
    – তুমি চিন্তা করোনা তনু, তিয়াস ভালো আছে।
    – ম্যাডাম, তুমি তো অসাধ্য সাধন করেছ! (হাসি মুখে মারিয়ানা বললো।
    – তুমি ঠিক আছো তো?
    – সবাই ভালো আছে, তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ি চল। তুমি না থাকলে বাড়ি ফাঁকা লাগে যে।

    আমার বাম হাতের আর পিঠের পাশটা বেশ একটু পুড়েছিলো। প্রায় দুই সপ্তাহ পর হসপিটাল থেকে ফিরলাম। আমি তিয়াসকে দেখার জন্য উদগ্রীব। ও এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, মা ও মেয়ে বেশ কিছুটা কান্নাকাটি করলাম। ও আমার কোলে মাথা রাখতেই আমি আগে ঘাড়ের পেছনের চুলটা সরিয়ে দেখলাম এবং আশ্বস্ত হলাম, আমার তিয়াস …. সত্যি আমার তিয়াস।

    মারিয়ানা আর অরির দিকে তাকিয়ে বললাম,
    – এবার সবটা গুছিয়ে বলো তো তোমরা।
    আগে বলো আমি আগুন থেকে বেরোলাম কি করে?
    মারিয়ানা বলতে যাওয়ার আগেই স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে হৈ চৈ করে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে অদ্রিয়ানো বললো,
    – ম্যাডাম, আমি বলবো, নাহলে ওই স্টুপিড মেয়েটা সব ক্রেডিট একা নিয়ে নেবে। বলেই চোখ টিপে হাসলো।
    মারিয়ানা মুখ বেঁকিয়ে অন্য দিকে তাকালো,
    – আচ্ছা যে খুশি বলো, বাট প্লিজ বলো।
    মারিয়ানাই শুরু করলো,
    -সেদিন ফাদারের ওখান থেকে ফিরে আমরা যখন ভাবছি কি করবো তখনই আমি অদ্রিয়ানোকে টেক্সট করে দিয়েছিলাম, যে ও যেন একটা গাড়ি নিয়ে বাড়ির বাইরে ওয়েট করে কেন না, বাড়ির ভেতরে কোনো প্রবলেম হলেই ও যাতে আমাদের জন্য হেল্প আনতে পারে।

    আমি বুঝিনি যে আপনি এমন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবেন। একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ গাড়ির আওয়াজে ঘুম ভাঙে, আমি আপনাকে ডাকি, বারণ করি কিন্তু ততক্ষণে আপনি বেরিয়ে যাচ্ছেন, সাথে সাথে আমি আমার দিদুর দেয়া জিনিসগুলো নিয়ে অদ্রিয়ানোর গাড়িতে গিয়ে উঠি,
    – ওহ্ ফাদারের বাড়িতে যে ব্যাগটা তোমার হাতে ছিল?
    – হ্যাঁ, ফাদারই আমাকে বলেছিলেন যে দিদুর কাছ থেকে কিছু স্পেলড আইটেম, মানে মন্ত্রপুত জিনিস পত্র আনতে যা কিনা পিশাচকে শায়েস্তা করতে কাজে লাগতে পারে।
    -তারপর?
    – আমাদের গাড়ি তোমাদের পিছু নেয়, তারপর রাস্তার ধারে তোমার গাড়ি দাঁড়ায়। অদ্রিয়ানো তাড়াহুড়ো করছিল। আমি বাঁধা দিই, কেননা পিশাচ যে ঠিক কি করতে পারে তার ধারণা আমাদের নেই। কিন্তু হঠাৎ গাড়ির ভেতরে আগুন জ্বলে ওঠে।
    এবার অদ্রিয়ানো বলে,
    – আমরা দৌড়ে যাই দরজা খোলা যাচ্ছিল না, আগুনে তেতে উঠেছিল। তখন রাস্তার একটা পাথর দিয়ে কাঁচটা ভেঙে ফেলি। একটা আগুনের হলকা বেরিয়ে আসে। যা হোক করে জ্যাকেট দিয়ে হাতটা মুড়ে হাত ঢুকিয়ে লক খুলি। ম্যাডাম দরজা খোলা মাত্রই আপনি লুটিয়ে পড়েন রাস্তায়, কপাল ক্রমে আমার গাড়িতে দু’টো দশ লিটারের জলের পট ছিল। বিকেলেই কিনেছিলাম। কাল অফিসে সাপ্লাই দেবার ছিল। মারিয়ানা সেই জল আপনার গায়ে ঢেলে দেয়। আগুনটা নেভে আর হঠাৎই সেই দরজা দিয়ে আগুনের একটা মূর্তি বেরোনোর চেষ্টা করে …
    মারিয়ানা ওকে থামিয়ে আবার বলা শুরু করে,
    – পিশাচ আগুনে জব্দ, তবু সে শেষ চেষ্টা করে পালানোর। সাথে সাথে আমি দিদুর দেয়া আয়রন নেটটা ওর উপর ছুঁড়ে দিই, এটা একটা পাতলা লোহার তারে বানানো জাল যার সাথে মন্ত্রপুত কড়ি আর বিডস বোনা থাকে। যে কোনো অশুভ আত্মাকে বন্দি করতে পারে এটা। ব্যাস পিশাচও বেরোতে পারে না। সাথে তার উপর ওই নুন আরো ছিটিয়ে দিই। আমাদের চোখের সামনে শতাব্দী প্রাচীন বিভীষিকা জ্বলে শেষ হয়ে যায়। এক ছিটে ফোঁটা ছাইও অবশিষ্ট থাকে না। তার পর অদ্রিয়ানো আপনাকে নিয়ে হসপিটালের দিকে যায়।

    এবার অরি বলা শুরু করে ,
    -অফিসে কাজের ফাঁকে তোমার sms পেয়ে আকাশ ভেঙে পড়ে মাথায়। বারবার তোমাকে ফোনে ট্রাই করে না পেয়ে আমি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ি। বাড়িতে এসে দারোয়ানের কাছে শুনি কেউ নেই বাড়িতে, তখন মারিয়ানাকে কল করি, যে সে কিছু জানে কিনা। ও ওদের লোকেশন জানায় আমি পৌঁছে যাই, ততক্ষণে তোমাকে হসপিটালে নিয়ে গেছে অদ্রিয়ানো। মারিয়ানাকে তোমার টেক্সট এর কথা বলতেই ও বললো, এখুনি আমাদের Casa de monte তে যেতে হবে।

    রাতের আঁধারে অচেনা মৃত্যু পুরীতে গিয়ে পৌঁছাই। মারিয়ানা আমাকে নিয়ে সোজা দোতলায় যায়। সেখানে গিয়ে দেখি তিয়াস অচৈতন্য হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ওর চেহারা দেখে চমকে যাই। গাল বসে গেছে, চোখ কোটরাগত, সারা গায়ে কেমন একটা দাগ, চোখে মুখে কি এক কষ্টের ছাপ স্পষ্ট।
    মারিয়ানা বলতে লাগল,
    – আমি দিদির গায়ে, মাথায় হোলি ওয়াটার ছিটিয়ে দিই, গলায় রোসারি মালা পরিয়ে দিই। ওর স্পিরিচুয়াল ক্লেনসিং করে ওকে ওই বাড়ি থেকে বের করে সোজা হসপিটালে যাই।

    আমি তিয়াসকে বললাম,
    – আমি এটাই বুঝতে পারছি না তুই ওই বাড়িতে কবে আর কখন গেলি? আর কেনই বা গেলি। আর তোর যাওয়ার সাথে সাথেই ওই পিশাচ এই বাড়িতে কেন এলো?
    -পিশাচ না ডাইনি নাকি অন্য কিছু তা তো জানি না মা, আর সে এ বাড়িতে কেন এলো তাও জানি না। তবে এ বাড়িতে আসার পর ওই বাড়িটা আমার নজরে আসে। শুনে অবাক হই যে তোমাদের চোখেই পড়েনি বাড়িটা এতদিনে! জঙ্গলের মধ্যে পোড়ো বাড়ি; বিষয়টা দারুণ থ্রিলিং লাগে আমার, তবে বাড়িটার দিকে প্রথম প্রথম নিজের ইচ্ছাতে তাকালেও পরের দিকে মনে হতো কি এক অমোঘ আকর্ষণ আছে ওই বাড়িটার, না চাইলেও যেন সারাটা দিন ওর দিকেই চেয়ে থাকতে মন চায়!

    বাইনোকুলারটা আনার পর সেদিন রাতে দেখলাম ভাঙা বাড়িতে আলো জ্বলছে। খুব মৃদু আলো আর নোংরা অর্ধস্বচ্ছ কাঁচের ভেতরে একটা অবয়ব। একটা মানুষ আর তাকে দেখতে আমার মতো! অবিকল আমার মতো! তোমাদের বললেও তোমরা অতটা কেয়ার করতে না। ইনফ্যাক্ট তোমরা দেখতেও পেতে না কিছু। তাই বলিনি, ভেবেছিলাম বলা তো যায় না কাউকে আটক রেখেছে হয়তো ওখানে, তাই যেদিন তোমরা বাবার অফিসের বন্ধুর ইনভিটেশন অ্যাটেন্ড করতে গেলে আমিও চুপিসারে বেরিয়ে পড়লাম।

    বন জঙ্গলে ভরা বাড়ির সামনেটা, বাড়ির সিঁড়িতে পা দিতেই মচমচ করে উঠলো যেন জানান দিলো কত দিন পর কোনো মানুষের পা পড়েছে ওখানে। আমি খোলা দরজা দিয়ে উপরে উঠে যাই, হঠাৎ সামনে দেখি একটি মেয়ে একদম আমার মতো দেখতে, সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে, আমার মাথাটা ঘুরে গেলো মুহূর্তে চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেল। যখন চোখ খুললো দেখলাম আমি বন্দি একটা অন্ধকার বাড়িতে। চিৎকার করলাম জানালাতে আঘাত করলাম কেউ শুনলো না। তোমাদের কথা খুব মনে পড়ছিল। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন সারাক্ষণ বেরোনোর পথ খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেও পেলাম না। খিদে তৃষ্ণাতে আর পারছিলাম না, হঠাৎ জ্যাকেটের পকেটে রাখা দু’টো চকলেটের কথা মনে পরে, ভুলেই গিয়েছিলাম, খুব অল্প পরিমাণে সেটা খাই, এটুকুই সম্বল। তবে সেটা আর কদিন? পরের দিন তাও শেষ। শরীরে কোন বল পাচ্ছিনা, মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। অনেক রাতে মুখে জলের ছিটে লাগায় চোখ খুলে দেখি বাইরে ভীষণ জল ঝড় আর ছাদের ফাটল দিয়ে অঝোর ধারায় জল পড়ছে, আমি প্রাণ ভরে সেই নোংরা জলই খেলাম, তারপর সমস্ত শক্তি জোগার করে উঠে চার দিকে খুঁজতে থাকি কোনো পাত্র পাওয়া যায় কিনা, অবশেষে একটা ভাঙা টিনের বালতির মতো কিছু একটা পাই সেটা পেতে দিই ওই ফাটলের নীচে, সারা রাতের অঝোর বৃষ্টিতে জলে ভরে যায় ওটা। বাকি দিনগুলো ওটাই ছিল আমার লাইফ লাইন। শেষের দিকের দিনগুলো একটা আছন্ন ভাব লাগতো যখন জ্ঞান আসতো জানলাতে নক করতাম। তার পর হঠাৎ এক দিন কয়েকটা চেনা গলার স্বর …বাবা …মারিয়ানা। ওদের দেখার পর আমি জ্ঞান হারাই। তার পর চোখ খুলি হসপিটালে।
    – চুপ কর বাবু, কত কষ্ট পেয়েছিস তুই আমি আর শুনতে পারছি না।
    – মা, আমি তো তোমার কাছে এখন, কোনো ভয় নেই।

    অরি আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
    – তুমি এত কিছু করলে কি করে, আমিতো কিছুই জানতে পারিনি …. তুমি বলোনি কেন তনু?
    – তোমাকে বলিনি না, বলার চেষ্টা করেও পারিনি, এক তুমি এসব মানো না, পুরোটা বুঝতে পারতে না, আমি নিজেও বুঝেছি অনেক পরে। ঠিক বুঝিনি একটা সন্দেহ করেছিলাম মাত্র।
    আর কি করে পারলাম? এই যে আমার এই দু’টো ছেলে আর মেয়ে অদ্রিয়ানো আর মারিয়ানা এদের সাহায্যেই সবটা সম্ভব হয়েছে।
    – কিন্তু তনু সন্দেহ কি করে হলো?
    – তিয়াসের অদ্ভুত ব্যবহার, সারাদিন অন্ধকার ঘরে বসে আছে। খেত না।
    – আর ..
    অদ্রিয়ানো মাঝখানে বলে ওঠে,
    – খাবে কি করে ম্যাডাম, সারা রাত তো খেয়ে বেড়াতো শিকার করে আর সারাদিন অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতো।
    – তনু তোমার সন্দেহর কথাটা বললে না?
    – সেদিন ওই বহুরূপীটা আমার কাছে বসেছিল। বলেছিল চুলে তেল দিয়ে দিতে। আমি চুল সরিয়ে ওর ঘাড়ের কাছটা দেখি সেখানে ওর ত্রিশূল এর ট্যাটুটা দেখতে পেলাম না। তখনই মনে হলো এ আমার তিয়াস না। কখনো না।
    মারিয়ানা বললো,
    – পিশাচ, ঈশ্বর সংক্রান্ত কোনো চিহ্ন কি বহন করতে পারে ম্যাডাম; তাই সব নকল করলেও ওটা পারেনি।
    – কিন্তু মারিয়ানা, তোমাদের এই পিশাচ আমাকেই কেন টার্গেট করলো?
    – আসলে আমরা যারা এখানের বাসিন্দা সবাই কম বেশি জানি ওই বাড়ির সম্পর্কে, সবাই এড়িয়ে চলি। আর পাহাড়ের এত উপরে বাইরের লোক তত আসে না, আসলেও তারা রাস্তা ধরে যাতায়াত করে এই উল্টো পথে জঙ্গলে কেউ এসে না। আর এ বাড়িতে ওই ডাইনির এমন জাদু ছিল যে তুমি সম্মোহিতের মতো টান অনুভব করেছিলে। আর দিদি হতে পারে এটাই গডের প্ল্যান ছিল যে তুমিই হবে ওর শেষের কারণ।
    ম্যাডামের হাতেই ওর শেষ লেখা ছিল।

    – আচ্ছা তনু, কি এই শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাস?
    – আমি ফাদারের কাছে শুনেছি বটে তবে মারিয়ানা ব্যাপারটা বেশি ভালো গুছিয়ে বলতে পারবে।
    – বেশ তুমিই বলো। তবে তার আগে এক রাউন্ড কফি হলে ভালো হতো, তাই না।
    অদ্রিয়ানো বললো,
    – স্যার একদম আমার মনের কথা বললেন।
    কফির কাপ নিয়ে আবার সবাই গুছিয়ে বসলাম জমিয়ে কিংবদন্তির গল্প শুনতে। মারিয়ানা শুরু করলো,
    – এটা পর্তুগিজ অধ্যুষিত এলাকা ছিল, ইংরেজরা সারা ভারতে প্রতিপত্তি বিস্তার করলেও এখানে তখনও জমিয়ে বসতে পারেনি। কয়েকজন ক্যাথলিক এখানে বসতি স্থাপন করেন তবে তারা আমাদের পূর্ব পুরুষদের সাথে মিলে মিশে থাকতো। তেমনই একজন ছিলেন Jacob Adley, ব্যবসা করে প্রচুর টাকা উপার্জন করে পাহাড়ের একদম উপরে নিও গথিক আর্কিটেকচার এ দারুণ এক বাড়ি বানান। এখানে সব বাড়ির থেকে আলাদা। নাম দেন Casa de Monte, হিল ম্যানশন।

    বছর ঘুরতে তিনি আবার বাণিজ্যে যান চাকরবাকরদের উপর বাড়ির ভার দিয়ে। ফেরেন সাথে বিয়ে করা বউ নিয়ে, সে নাকি ছিল অপ্সরাদের মতো সুন্দরী। নাম ম্যাডেলাইন। আর তেমন মিষ্টি ব্যবহার, তবে ঈশ্বর তাদের সব দিলেও সন্তান সুখ দেন নি। বেশ কয়েকবার সন্তানসম্ভবা হয়েও, জন্মের আগেই সন্তানদের হারায়।

    তার পর থেকেই তার ব্যবহার বদলে যেতে থাকে, এমনিতেও পাহাড়ের উপরে ততো বসতি ছিল না। তবে কথা হওয়ায় ভাসে। লোক মুখে প্রচার হয় ওই বাড়ির সব চাকর বাকররা এক এক করে উধাও হয়ে যাচ্ছে। জ্যাকব ব্যবসার কাজে অনেক মাস বাড়ির বাইরে থাকতো। সে কিছু জানতে পারে না।

    তার পর হঠাৎ নিচের জন বসতিতে পোষা প্রাণী, রাস্তার কুকুর এমনকি মানুষের উপর আক্রমণ শুরু হয়। রোজ রাতে শিকার করতো কেউ, ছিঁড়ে খেত তার শিকারকে। মানুষ জন ক্ষেপে ওঠে। রাত পাহারা, চার্চে প্রার্থনা সব শুরু হয়। হঠাৎই একজন কোনো কারণে জঙ্গলে গেছিলো, সে দেখে ম্যাডেলাইন একজন মানুষকে কামড়ে খাচ্ছে, তারপর আধ খাওয়া মড়াটা ফেলে সে বাড়িতে ঢুকে যায়।
    তার কাছে সব শুনে গ্রামের মানুষরা প্রিস্টকে সাথে নিয়ে হিল ম্যানশনে হামলা করে, ম্যাডেলাইন কিছু না জানার ভান করে। মানতে চায় না কিন্তু প্রিস্টরা অনেক রকম রিচুয়াল ইত্যাদি করে তাকে জব্দ করে ফেলে। তখন সে বলে, সে সন্তানের কামনায় শয়তানের কাছে, নিজের আত্মা উৎসর্গ করেছে। নরমাংস খাওয়া তার শয়তানি রিচুয়ালেরই অংশ। এতে তার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। সে এটাও স্বীকার করে জ্যাকব আর তার সব চাকরদের সেই মেরেছে। প্রিস্টরা সবাই মিলে অনেক চেষ্টা করেও তাকে প্রাণে মারতে পারেনি আর ম্যাডেলাইনকে বন্দি করার আগেই সে তার বাড়িতে ঢুকে যায়। বাড়িটা তার জাদু, ডাইনি বিদ্যা দিয়ে এমন ভাবে ঘেরা ছিল যে তার ভেতর ঢোকা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি।
    তখন তাকে বাড়ির ভেতরেই বন্দি করে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে মন্ত্র বলে বাড়িটা বেঁধে দেয়া হয়। যাতে ম্যাডেলাইন আর কোনোদিনও তার অভিশপ্ত বাড়ি থেকে বেরোতে না পারে। কাল ক্রমে না খেতে পেয়ে বন্দি হয়ে তার মৃত্যু হয় আর তার শয়তানি আত্মা মারাত্মক পিশাচে পরিণত হয় আর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে। আর বাকিটা তো …

    অরিন্দম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
    – কি বিচিত্র! এ ও কি সম্ভব?
    অদ্রিয়ানো বললো,
    – স্যার, কত কিছুই তো চোখে দেখা যায় না, তাই বলে কি তা নেই? এই যেমন ধরুন এই স্টুপিড মেয়েটার ঘটে এত বুদ্ধি আর সাহস ছিল কে জানতো?
    মারিয়ানা রাগে কট মট করে ওর দিকে তাকালো,
    আমরা সবাই হা.হা.হা করে হেসে উঠলাম।
    তিয়াসের মুখটা সকালের ঝলমলে রোদ্দুরে আরো মিষ্টি লাগছে।
    ঈশ্বর তুমি সবাইকে ভালো রেখো ।

    =সমাপ্ত=

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- অজানা অভিশাপ (পর্ব-৪)

    অজানা অভিশাপ (পর্ব-৪)
    -সুপর্ণা নাথ

     


    আমি জানি মারিয়ানা যা বলবে তা তিয়াসের শোনা উচিত না। আমি চোখের ইশারায় ওকে উপরে যেতে বললাম। ও বুঝে গেলো আমি কি চাই।
    – মা এই কয়েকদিন বাড়িতে থেকে থেকে বোর লাগছে আর আমার ফোনটাও একটু প্রবলেম করছে, আমি নিচের মার্কেটে যাবো একটু? লাঞ্চটা বাইরেই করে নেব। ফোনটাও ঠিক করিয়ে নেব।
    – আচ্ছা যা তবে সন্ধ্যা নামার আগে ফিরিস।
    – একদম, চিন্তা করো না।

    ও মিনিট পনেরোর মধ্যে বেরিয়ে যায়।
    আমার পক্ষে শাপে বর হলো। খুব দরকার ছিল ওর সরে যাওয়ার। আমি মারিয়ানাকে ডাকতেই, এক ছুটে ও আমার কাছে এসে বললো,
    – ম্যাডাম, দিদিমনির ঘরের বিছানার চাদরটা দেখবে চলো।

    গিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার সন্দেহ আরো পোক্ত হলো। ওর বিছানার চাদর নিচের দিকে মানে যেদিকে পা থাকে কাদায় মাখামাখি! যে কাল সারাদিন ঘর থেকেই বেরোয়নি তার চাদরে কাদা আসে কি করে? কোনো বিড়াল বা কিছুও ঢুকতে পারবে না কেন না এটা দোতলার ঘর। তাহলে? আমার সন্দেহই কি ঠিক!

    না না আমাকে মাথা ঠান্ডা করে আরো কিছু হিসেব মেলাতে হবে। হঠাৎ কি মনে হতে দূরবীনটা নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বাড়িটার দিকে ভালো করে দেখলাম। কিন্তু নাহ্, ভাঙা চোরা কাঠের দেওয়াল আর বন্ধ কাঁচের জানালা ছাড়া আর কিছুই নজরে এলো না।
    মারিয়ানা বললো,
    – দিনের আলোতে অনেক কিছু লুকিয়ে থাকে, খালি চোখে দেখা যায় না, আঁধারে দেখতে শেখো ম্যাডাম।
    আমি সত্যিই ওর কথার মানে বুঝলাম না।
    – মারিয়ানা আমার সাথে যাবে?
    – কোথায় ম্যাডাম?
    – প্রিস্ট মিখাইলের কাছে যার কথা অদ্রিয়ানো বলেছিল।
    – যাবো।

    ফাদার মিখাইল বয়স অনুপাতে খুবই সুস্থ বলা যায়, দেখে বোঝার উপায় নেই ওনার বয়স নব্বই-এর উপর।
    বাড়িতে একাই থাকেন একটি ছেলে দেখাশোনা করে। মারিয়ানাকে চিনতেন তাই পরিচয় হতে বেশিক্ষণ লাগলো না।
    – ফাদার এই অশুভ ছায়াটা কি আসলে? সবাই বলছে শতাব্দী প্রাচীন কোনো অভিশাপ!
    – সব বলছি কিন্তু এ বিষয়ে এত আগ্রহ কেন দেখাচ্ছেন?
    অগত্যা আমার সন্দেহ আর তিয়াসের বিষয়ে সবটা বললাম।

    উনি চেয়ারে বসে ছিলেন, একপ্রকার লাফিয়ে উঠলেন। বললেন,
    – God please save her..
    – কেন ফাদার? কি হয়েছে? আমার আশঙ্কা কি তাহলে …
    – উনি সংক্ষেপে আমাকে Casa De Monte এর ইতিহাস টা বললেন। যা শুনলাম তাতে আমার মন বসে যেতে লাগলো। খালি মনে হচ্ছে কি কুক্ষণে মেয়েটাকে এখানে ডেকে এনেছিলাম।
    ফাদার আবারও মারিয়ানাকে কি সব বুঝিয়ে বললেন ওদের ভাষা আমি বুঝলাম না। ও মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলো।
    আমার চোখে প্রশ্ন দেখে ফাদার আস্বস্ত করলেন,
    – মারিয়ানাকে ওর দিদার কাছে পাঠিয়েছি কিছু জিনিস আনতে।

    ওর দিদা এক কালে খুব নাম করা গুনীন বা উইচ ডক্টর ছিল। আমার সাথেও কাজ করেছে।
    আমি তোমাকে যা বলবো যা বোঝাবো ঠিক সেই মতো চলবে আর তোমার husband-কেও বুঝিয়ে দেবে। মারিয়ানাকে সাথে রেখো, মেয়েটি খুব কাজের। ওর দিদার অনেক বিদ্যে ও জানে।
    – আমার মেয়ের কি হবে ফাদার, ওর কোনো ক্ষতি…
    – উপরওয়ালার উপর ভরসা রাখো। মনে সাহস রাখো। তুমি মা, গড এর পর সব থেকে শক্তিশালী তুমি, এটা মাথায় রাখবে। আর আগের বার যদি শয়তানকে শায়েস্তা করা গেছে, এবারেও যাবে।
    মারিয়ানা এসে পড়ল, হাতে একটা ব্যাগ।
    ফাদার সবটা বুঝিয়ে দিলেন আমাদের, কি করতে হবে, না হবে।

    মারিয়ানা দু’টো পুঁতির মালা এনেছিল, ছোট পাথর আর কাঠের বিডস দিয়ে বানানো মালা, মন্ত্র পরে আমার গলায় পরিয়ে দিলো আর নিজেও একটা পড়লো, ফাদার ও দু’টো হলি ক্রস দিলেন সাথে রাখার জন্য।
    ফাদারের কাজের ছেলেটি হঠাৎ হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বললো, নিচের বসতিতে আজ সকাল বেলাতেই শয়তান হামলা চালিয়েছে,
    – সেকি দিনের বেলায়?
    – হ্যাঁ, দু’জন মানুষ আর বেশ কিছু স্ট্রিট dog-কে উন্ডেড করেছে। একটা লোক পুলিশকে জানিয়েছে, কালো পোশাক পরা মুখ ঢাকা এক নারী মূর্তি, আলোর গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আর তারপর জংলি পশুর মতো নখ দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে খাবার চেষ্টা করেছিল। লোকটি বেশ জোয়ান আর হাট্টা কাট্টা তাকেও কাবু করে ফেলেছিল এতই তার শক্তি !

    – (ফাদার বিড়বিড় করলেন) এত শতাব্দীর খিদে, একি সহজে থামবে!
    – ফাদার আমার মেয়ের কি হবে?
    – ব্যাকুল না হয়ে যা বলছি যেভাবে বলছি করো। ভয় পাবে না।
    – আচ্ছা ফাদার দিনের আলোয় শয়তান / অশুভ ছায়া বের হচ্ছে কি করে?

    – শয়তানের অনেক রূপ অনেক শক্তি। আর শয়তানের প্রধান খাদ্য কি জানো? আমাদের মনের ভয়।
    শুধু মাত্র ড্রাকুলা আর কিছু নাইট স্পিরিট আছে যারা দিনের আলো সইতে পারে না। ওদের অনেক ক্ষমতা অনেক রূপ, বেশভূষা, ভাষা সব নকল করতে পারে। যাক গে তোমরা বেরিয়ে পরো সময় বেশি নেই।

    আমি জানি না কি হতে চলেছে, কি ভাবে সবটা সামলাবো? তার মাঝেই অরিন্দম জানালো, ওদের কাস্টমারদের ডিটেইলসের ডাটা বেসে কি এরর হয়েছে, মারাত্মক চিন্তায় আছে ও, যতক্ষণ সবটা না শর্ট আউট করতে পারছে ও আর ওর টিম অফিসেই থাকবে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।

    পরের কয়টা ঘন্টা বোধহয় আমার জীবনের সব থেকে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন ছিল। যা সারা জীবন মনে থাকবে।
    বাড়ি ফিরেই মারিয়ানা, তার সেই ব্যাগ থেকে নুন বের করে সেটা দিয়ে সারা বাড়ির কম্পাউন্ড ঘিরে একটা গন্ডি কেটে দিলো। শুধু দরজার কাছটা ফাঁকা রাখলো। এখন শুধু অপেক্ষা।
    তিয়াস না ফেরা পর্যন্ত বুঝতে পারছি না, ওর উপর শয়তানের ছায়া আছে কি না? মারিয়ানা আর আমি চুপচাপ বসে আছি, এতটাই নিস্তব্ধতা চারদিকে যে আমরা পরস্পরের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি।

    বিকেল নাগাদ তিয়াস ফিরলো। আমি আমার স্নায়ু ঠান্ডা রেখে ওর সাথে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ব্যবহার করছি। মারিয়ানা এক ফাঁকে উঠে বাইরে গেলো। আমি জানি এবারও দরজার সামনেও মন্ত্রপুত নুন দিয়ে গন্ডি কেটে দেবে।
    আমি তিয়াসকে বিভিন্ন কথায় ভুলিয়ে রাখলাম। ও কিছু সময় পর নিজের ঘরে চলে গেলো। তবে ওর চোখের ভাষায় একটা অস্থিরতা ধরা পড়েছিল।
    ক্রমশঃ সন্ধ্যে নামলো। তিয়াস এখনো ঘরেই, মারিয়ানা কফি দিয়ে এলো, যথারীতি ঘরে ঢুকতে দেয়নি দরজার ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিয়েছে।
    আমার মাথায় মারিয়ানার বলা কথাটা ঘুরছে, অন্ধকারে দেখতে শেখো। বাইনোকুলারটা নিয়ে বাড়ির পেছনে কাঠের বাউন্ডারির উপরে উঠলাম একটা মই এর সাহায্যে। মারিয়ানা আগে থেকেই মইটা বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। ফাদারের দেওয়া একটু হলি ওয়াটার চোখে বুলিয়ে ওনার বলা মন্ত্র বলতে বলতে মই দিয়ে উপরে উঠে Casa de Monte র দিকে দেখার চেষ্টা করলাম, আমার আরাধ্যকে মনে মনে বললাম, ঈশ্বর আমাকে শুধু সত্যিটাই দেখাও কোনো মায়া যেন আমার দৃষ্টিকে অবরুদ্ধ না করে।
    চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আকাশের মুখ ভার, কালো মেঘ ঢেকে রেখেছে চারিদিক, বড্ড নিস্তব্ধ চারিদিক। যেন প্রকৃতিও অজানা আতঙ্কে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে। বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি পিটছে।
    Casa de Monte একটা মূর্তিমান প্রেতপুরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে, যেন এক তাল অন্ধকার। কিন্তু আশ্চর্যভাবে ঈশ্বরের নাম নিয়ে বাইনোকুলারটা চোখে লাগানো মাত্রই যেন চোখের সামনে অন্য এক ছবি ভেসে উঠলো! স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ওই বাড়িতে হালকা ম্যারমেরে হলুদ আলোতে দু’হাতে জানলার কাঁচে করাঘাত করছে আর চেঁচাচ্ছে একজন। যদিও তার শব্দ এ পর্যন্ত আসছে না।
    পাগলের মতো উদ্বিগ্ন চেহারা তার!

    বোঝাই যাচ্ছে বিধস্ত আর ক্লান্ত সে। আমার আশঙ্কা তাহলে ঠিক ছিল? সে মানুষটা আমার বড্ড চেনা … সে তিয়াস !!
    ফাদার এটাই আঁচ করেছিলেন। আর এটাও বলেছিলেন, তিয়াসকে ও বাড়িয়ে দেখা মানে, যুদ্ধটা আরো কঠিন হয়ে যাবে! আমার দু’ গাল বেয়ে নেমে আসে চোখের জল। কাঁধে একটা আলতো স্পর্শে চমকে ঘুরে দেখি, মারিয়ানা!
    – কেঁদো না ম্যাডাম। আমাদের দিদিমনিকে ফেরাতেই হবে। আর তারজন্য এই পিশাচটাকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে, ও আমাদের দিদিমনির জীবনী শক্তি শুষে ওর রূপ নিয়ে এসেছে। আর এই নিরীহ পশু আর মানুষদের শিকার করে নিজের পেট ভরছে আর শক্তি বাড়াচ্ছে।
    – এসব সত্যি হতে পারে এ যুগে?
    – চাঁদ তারা সূর্য সত্যি হলে, ঈশ্বর সত্যি হলে তার বিরুদ্ধ শক্তিও থাকবেই ম্যাডাম। তবে আজ ও বন্দি এই বাড়িতে নুনের মন্ত্র পড়া গন্ডি কোনো পিশাচই পার করতে পারে না।
    – আমরা কি করবো এখন?
    – অপেক্ষা, রাত আরো ঘন হওয়ার। স্বাভাবিক থাকুন ওকে বুঝতে দেবেন না। তবে দিদিমনি যত অসুস্থ আর ক্লান্ত হবেন পিশাচের পক্ষে দিদির রূপ নকল করা ততই অসুবিধেজনক হবে। ওকে নিজের রূপে আসতে হবেই।

    ইতিমধ্যে অরিন্দমকে কয়েকবার ফোন করলাম, বলতে চেয়েও পারলাম না। ও বললো আজ রাতে কোনোভাবেই ফিরতে পারবেনা। খুব কান্না পাচ্ছিল, জানি না আর কোনোদিন ওকে দেখতে পারবো কিনা। আমি মারিয়ানাকে অনেক করে বললাম বাড়ি চলে যেতে কিন্তু ওই ভীতু মেয়েটি যে আজ কোথা থেকে এত সাহস পাচ্ছে কে জানে! কিছুতেই আমাকে ছেড়ে গেলো না। বললো,
    – ও আমাদের ঘাঁটাবে না, এটা ওর ডেন, হাইড আউট। আমাদের উপর আঘাত আসবে একদম শেষে তবে আমাদের গলার এই মালা অনেকটা প্রটেকশন দেবে।

    রাত বাড়তে থাকল। তিয়াসকে খাবার জন্য ডাকলেও সে এলো না, বললো খিদে নেই। আমি সারাক্ষণ ভাবছি ওকে ওই বাড়িতে ঢোকাব কি করে? না হলে যে তিয়াসের মুক্তি নেই ! মারিয়ানা একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল, ওকে এরমধ্যে টানতে চাইনা আমি তাই ওকে জাগালাম না। সন্তর্পণে তিয়াসের ঘরে গেলাম, ও যে জেগে আছে আমি জানি, এটা তো ওর শিকারে যাওয়ার সময় কিন্তু ওই গন্ডির জন্য ও আটক হয়েছে আজ। দেখলাম চোখে মুখে এক অন্য অভিব্যক্তি ওর। কেমন যেন ছটফট করছে ওর চোখ। সে চোখ ঘোলাটে আর লোভাতুর। খুব চেষ্টা করছে নরমাল থাকার।
    – তিয়াস মারাত্মক বিপদ হয়েছে রে..
    – কি?
    – তোর বাবার অফিসের একজন ফোন করে বললো, চেষ্ট পেইন হয়েছে ওর। হসপিটালে এডমিড করেছে। কিন্তু কি সব এক আতঙ্ক.. জন্তু বেরিয়েছে, রাতে একা বেরোতেও ভয় করছে, একটু যাবি আমার সাথে?
    – হ্যাঁ, হ্যাঁ এখুনি চলো..
    ওর চোখ চক চক করে উঠলো। আমি জানি যে করেই হোক ও এই গন্ডির বাইরে বেরোতে চায়। আমি জানিনা কি অপেক্ষা করছে আমার কপালে। তবে আমি জানি তিয়াসকে বাঁচতেই হবে।

    চলবে….

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- অজানা অভিশাপ (পর্ব-৩)

    অজানা অভিশাপ (পর্ব-৩)
    -সুপর্ণা নাথ

     

     

    তিয়াসের পাশে বসে ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, যেন কত ক্লান্ত ও। ডাকতে ইচ্ছে হলো না কিন্তু, এভাবে খাওয়া দাওয়া না করলেও যে ….
    আলতো করে কপালে হাত দিলাম, কি ঠান্ডা কপালটা !! ঘরটা এমন অন্ধকূপ করে রেখেছে তার উপর শীতের শুরু, একটু রোদ ঘরে না আসলে ভালো লাগে নাকি! একটু আলো হওয়া ঘরে না ঢুকলে ঘরে কেমন যেন একটা গুমো গন্ধ লাগে। সন্তর্পণে পর্দার উপর থেকে বেড শিটটা সরিয়ে পর্দা খুলে দিলাম, পড়ন্ত বিকেলে সোনালী আলো পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে যেন হুড়মুড় করে ঢুকে এলো ঘরে। মুহূর্তে ঘর আলোকিত, কাঁচের দরজাটাও একটু খুলে দিলাম হালকা রোদ মাখা বাতাস কিছু বুনো ফুলের গন্ধ দিয়ে মুহূর্তে ঘরটাকে ভরিয়ে দিলো।
    পেছন ফিরে দেখি তিয়াসের ঘুম ভেঙেছে। ফলের প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে একটা চিরুনি নিয়ে ওর চুলটা আঁচড়ে দেয়ার জন্য বসলাম। কিন্তু ওর চোখে মুখে ভীষণ অস্বস্তি। যেন আমার ঘরে আসা টা ওর ভালো লাগেনি, কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। আমি গলার স্বর আরো খানিক নরম করে বললাম,
    – অর্কর সাথে কি হয়েছে রে?
    – কি হবে? কিছু না।
    – তাহলে কথা বলিস না কেন? ও চিন্তা করছে যে।
    – আমাদের পার্সোনাল স্পেসে ঢোকার তোমার দরকার নেই তো। আমরাই সর্ট আউট করে নেব।
    এত রুক্ষ জবাবের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
    আর মা, আমাকে না বলে ব্যালকনির দরজা, পর্দা খুলেছো কেন?
    – কত হওয়া আর আলো আসছে দেখ।
    – কোনো দরকার নেই। আমার ঘরটা আমার মতই থাকতে দাও।
    আমার খারাপ লাগাটা প্রকাশ করলাম না।
    – আচ্ছা তুই যে ওই বাড়িতে কাকে দেখতে পেতিস, এখনো দেখা যায়?
    – কে আছে? কাউকে দেখা যায় না আর কোনোদিন যায়নি।
    – কি! তুইই তো কতবার বলেছিলি!
    – মজা করেছিলাম, মিথ্যে কথা।
    – কি? (খুব অবাক হই আমি)
    – হম জাস্ট গল্প বানাচ্ছিলাম।
    – তাই? (আমার অবিশ্বাসটা গলার স্বরে আসতে দিলাম না)

    আমি কথায় কথায় ওর কেনা বাইনোকুলারটা নিয়ে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে যাই, চোখে বাইনোকুলারটা লাগিয়ে বাড়িটার দিকে দেখার চেষ্টা করি। মুহুর্তের মধ্যে একটা ভীষণ জোর হ্যাঁচকা দিয়ে তিয়াস আমার হাত টেনে ধরে, বাইনোকুলারটা হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায় দরজার বাইরে করিডোরে! আমি তো হতভম্ব!
    দেখি তিয়াসের মুখে প্রচন্ড রাগ আর বিরক্তি
    – মা, তুমি বারণ বোঝনা? প্রাইভেসি বোঝো না? বলছি আমার ভালো লাগছে না তবু …তবু তুমি …
    আমার উত্তর দেয়ার ভাষা নেই, ওর চোখ দু’টো বড্ড অচেনা লাগছে। এটা আমার তিয়াস!

    চেঁচামেচি শুনে মারিয়ানা উঠে এসেছিল, আমাকে বেরোতে দেখে, আমার হাত দু’টো চেপে ধরে বলল,
    – ম্যাডাম, চিন্তা করো না। দিদির মনে হয় হওয়া লেগেছে, বলেছিলাম না Casa de monte অভিশপ্ত। রাত দিন ওদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে…. তুমি চিন্তা করোনা , আমার গ্র্যানি অনেক দাবাই জানে কালই এনে দেব। সব ঠিক হয়ে যাবে।
    ওর সব কথা ঠিক ঠাক কানে ঢুকলো না, শুধু বললাম- হুম।

    সন্ধ্যে থেকে খুব ঝড় জল শুরু হয়েছে, অরি এখনো আসেনি। কি যেন এক অশনি সংকেতের বার্তা দিচ্ছে প্রকৃতি। কারেন্ট নেই সাথে ফোনের লাইনেও প্রবলেম করছে এই খারাপ ওয়েদারের জন্য। অদ্রিয়ানোকে ফোন করার চেষ্টা করছিলাম, মারিয়ানা বললো ও পাশের শহরে গেছে ওর রিলেটিভের বাড়ী আজ ফিরবে না।
    তিয়াস এর ঘরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। তবুও উপরে একা আছে তাই একটা মোম নিয়ে দিতে গেলাম। দরজা অল্প ফাঁক করে বললো, মাথা ধরেছে তাই ওষুধ খেয়ে শুয়ে আছে ওর আলো ভালো লাগছে না। আর বলল বিকেলে যে ফলগুলো নিয়ে গেছিলাম ওগুলো খেয়ে নেবে, রাতে যেন ডিনারের জন্য ওকে না ডাকা হয়। ও একটু ঘুমোতে চায়, মাইগ্রেনের ওষুধ খেয়ে।
    অগত্যা আমি আর মারিয়ানা কয়েকটা মোম বাতি জ্বেলে বসে রইলাম।

    বাইরে প্রকৃতির ঝড় আমার মনের ভেতরে যেন ঢুকে পড়েছে, তোলপাড় হচ্ছে ভেতরটা। কিছু একটা ভুল, কিছু একটা বেঠিক হচ্ছে কিন্তু সেটা কি বুঝতে পারছি না। তিয়াস বদলে যাচ্ছে, কিন্তু কেন? ওর আর অর্কর কিছু? কিন্তু ও বরাবরই আমাদের কাছে খুব ওপেন কিছু লুকাতো না। নাকি সমস্যা আরো অন্য কোথাও! অফিসের কিছু কি? কিন্তু তাহলে এই কয় দিন এত আনন্দ করে ছিলো কি করে! নাকি … ওই বাড়ির বিষয় কিছু? এত আগ্রহ ছিল আর আজ সব আগ্রহ ভীষণ রকম অনীহায় পরিণত; কারণটা কি? ঘড়িতে প্রায় সাড়ে দশটা, গাড়ির শব্দে আমার চিন্তার জাল কেটে গেলো। অরি এলো নিশ্চয়ই? মারিয়ানা দরজা খুলে একটা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আমাকে একা রেখে আজ ও বাড়ি যেতে চায়নি, আমি একটা পাঁচ সেলের তেজলো টর্চ নিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম, ঝড় একটু কমেছে কিন্তু বৃষ্টি ভালোই জোরে হচ্ছে, টর্চের আলোতে অরির জমায় কিছু কাদা আর রক্তের দাগ দেখলাম; আমি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠি,
    – অরি কি হয়েছে তোমার, জমায় কাদা জল রক্ত কেন? কোনো এক্সিডেন্ট ….
    ও আমার ব্যাকুলতা বুঝে আমাকে তাড়াতাড়ি শান্ত করে বলে,
    — আমি একদম ফিট আছি। সব বলছি একটু স্নান করে আসি আর ডিনারটা সার্ভ করো, খুব খিদে পেয়েছে। আমি একটু আস্বস্ত হলাম।

    মারিয়ানার হাতে দারওয়ানজির খাবারটা পাঠিয়ে দিলাম আমি দরজার কাছে একটা আলো নিয়ে দাঁড়ালাম। ও একটা টর্চ আর ছাতা নিয়ে আউট হাউসের দিকে গেলো, এটা বাড়ির একটু পেছন দিকে, আলো সরাসরি মারিয়ানার উপর না পড়লেও ওর যাওয়ার রাস্তা আর আশপাশটা আলোকিত করছে। এমনিতেই মেয়েটা অন্ধকারে ভয় পায়। আলোর অস্তিত্বটা ওকে ভরসা দেবে, ও একা নেই। খাবারটা দিয়ে ফিরে আসার সময় হঠাৎ যেন থমকে যায়, পরের মুহূর্তেই উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালিয়ে আসে আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দমাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে হাঁফাতে থাকে। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। আমি বললাম,
    – ভয়ের কি আছে আমি ছিলাম তো? পাগলী মেয়ে।
    – ম্যাডাম, শতাব্দী প্রাচীন অভিশাপ আবার ফিরে এসেছে। জানিনা এর শেষ কোথায়? খুব সাবধানে থাকতে হবে।
    – কি বলছো, কিছুই বুঝতে পারছি না।
    – অশুভ ছায়া আবার ফিরে এসেছে। আমি আউট হাউস থেকে ফেয়ার পথে দেখলাম কেউ একজন খুব দ্রুত গতিতে মাত্র দু’টো লাফে পুরো কম্পাউন্ডটা টপকে বেরিয়ে গেলো! কোনো মানুষ বা পশুর পক্ষে এটা সম্ভব নয়।

    আমি আরো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অরিন্দম স্নান সেরে খাবার টেবিলে এসে বসে।তাই কথা সেখানেই বন্ধ হয়ে যায়। খেতে বসে অরিকে জিজ্ঞেস করি এবার বলো কি হয়েছিল …
    – আর বলো না, আজ অফিসে সারাদিনই কানাঘুষো শুনছিলাম কি নাকি এক পুরোনো আতঙ্ক আবার ফিরে এসেছে। বিশেষত যারা এখানে বংশ পরম্পরায় বাস করে তারাই বলছিল। বহু বছর প্রায় দু’শো বছর আগে এই জনপদ নাকি শেষ হতে বসেছিল কোনো এক অশুভ ছায়ার প্রকোপে। অনেক ঝামেলার পর প্রিস্টদের সাহায্যে তখন সবাই মুক্তি পায়। কিন্তু প্রকৃত বিষয়টা ঠিক জানি না। কেন না যারা বলছে তারা সবাই কিংবদন্তির গল্প শুনেছে। আর জানোই তো কিংবদন্তির গল্পে সত্যির উপর কত রং চড়ে!
    – হম, মারিয়ানাও বলছিল। তারপর?
    – বলছি, কিন্তু মাম্মা? খেয়েছে ও?
    – না ওর মাইগ্রেনের যন্ত্রণা হচ্ছে তাই শুয়ে পড়েছে।
    – ওহ্, আচ্ছা যা বলছিলাম, হঠাৎ আমার এক কলিগের বাড়ি থেকে খবর আসে তার বাড়িতে কি একটা মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি হয়েছে এই ওয়েদারের জন্য গাড়ি ঘোড়াও কম চলছে, আমিই তাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিলাম। পাহাড়ি রাস্তায় হাজারটা বাঁক তার উপর বৃষ্টি। তাই ধীরে ধীরেই ড্রাইভ করছিলাম ফেরার পথে, হঠাৎ একটা বাঁক ঘুরতেই হেডলাইটের আলোটা কারো উপর পড়া মাত্রই সে যেন এক লাফে খাদে মিলিয়ে গেলো, কোনো মানুষ বা জন্তু অমন ভাবে আর অতো জলদি লাফাতে পারেনা। খুব চমকে গেছিলাম, ঘোরটা কাটতেই গাড়ির আলোতে দেখি একটা মানুষ উন্ডেড হয়ে পড়ে আছে তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে দেখি তার বাম পায়ের থাই- এর কাছটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে যেন এক খাবলা মাংস কেউ ছিঁড়ে নিয়েছে। তাকে নিয়ে হাসপাতালে এডমিট করে তারপর এলাম। ওই যে প্রাণীটা লাফিয়ে পালিয়ে গেছিলো, মানুষটা তারই শিকার ছিল হয়তো
    – কি বলছো!
    মারিয়ানা খাবার টেবিলের পাশের ছিল, নিজের মনেই বিড়বিড় করলো,
    – অশুভ ছায়া, আবার ফিরে এসেছে!

    – মা….মা , মাগো..
    – তিয়াস , কোথায় তুই মা? চারদিকে এত অন্ধকার আমি তোকে দেখতে পাচ্ছি না যে ..
    – এই তো এই জানালার দিকে দেখো মা।
    – কোন জানালা? পাচ্ছিনা দেখতে তো!
    – দূরবীনটা নিয়ে দেখো, জঙ্গলের বাড়ির জানলায় দেখো
    আমি চমকে উঠলাম, তুই ওখানে?
    দূরবীনটা নিয়ে চোখে লাগাই … ওই …ওই তো তিয়াস ওই Casa de monte এর জানলায়! কিন্তু এক বিশাল ছায়া হঠাৎ ওর পেছনে এসে এক ঝটকায় ওকে টেনে নিয়ে গেলো…
    আমি তিয়াস বলে আর্তনাদ করে উঠি।
    ঘুমটা ভেঙে যায়, সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, উফফ কি বীভৎস স্বপ্ন ছিল! আমার চিৎকারে অরিও জেগে গেছে, আমাকে শান্ত করে বললো,
    – আমি দেখে আসছি তিয়াসের ঘরে গিয়ে।
    কিছু পরে এসে বললো,
    – নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে, আমি আর ডাকিনি।
    অরি শুয়ে পড়লো, আমি বাকি রাত ঘুমোতে পারলাম না। অদ্ভুত স্বপ্ন? কেন এমন দেখলাম?
    কি অশুভ ছায়া?
    পড়শী দের তিনটে Husky, দারোয়ানজির গ্রামের পশু আর অরির দেখা উন্ডেড মানুষটা …. সবার শিকার কি এক? এরই কাজ নাকি পুরোটাই কো ইনসিডেন্ট?
    কে আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে?
    এসব ভাবতে ভাবতে ভোরের দিকে চোখ লেগে গেছিলো।

    সকালে উঠতে দেরি হলো। ঘুম ভাঙলোই অদ্রিয়ানো আর মারিয়ানার গলার স্বরে, আবার দু’টোতে ঝগড়া করছে। ফ্রেশ হয়ে নীচে এলাম। মারিয়ানা ব্রেকফাস্ট দিয়ে বললো,
    -sir বেরিয়ে গ্যাছেন, আপনার রাতে ঘুম হয়নি তাই ডাকতে মানা করেছিলেন, আর দিদির ঘরে খাবার দিয়ে এসেছি উনি আসবেন না বললেন।
    অদ্রিয়ানো বললো,
    – ভারী চিন্তার ব্যাপার ম্যাডাম, কোনো এক জংলি জানোয়ার লোক্যালিটিতে এসে পড়েছে, মানুষ আর অন্য পশুদের উপর হামলা করেছে।
    – কি ব্যাপার ঠিক করে বলো তো?
    – আমি পাশের শহরে গেছিলাম, আমার এক কাকা থাকে, ওনার ডেয়ারি ফার্ম আছে। তো হঠাৎ এক সকালে দেখেন ফার্ম এর উপরের টালির চাল ভাঙা সারা ফার্ম লন্ড ভন্ড অন্তত তিন- চারটে গরুর র ছিন্ন ভিন্ন রক্তে মাখা দেহাংশ চারদিকে ছড়িয়ে।

    কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, রাতে এত বড় এট্যাক হওয়া সত্ত্বেও কোনো গরুর ডাক বা দৌড়াদৌড়ির শব্দ পাওয়া যায়নি! সবাই খুব ভয় পেয়ে আছে। জন্তুটা না ধরা পড়লে ….
    মারিয়ানা মাঝ পথে থামিয়ে বললো,
    – জন্তু না, অশুভ ছায়া।
    অদ্রিয়ানো আবার ওর সাথে তর্ক শুরু করলো। তবে মারিয়ানার চোখের ভাষায় অদ্ভুত এক দৃঢ়তা দেখলাম আজ। আমাকে আজ এই বিষয়টা জানতেই হবে। কে এই অশুভ ছায়া কি তার গল্প? মারিয়ানা আর অদ্রিয়ানোকে জিজ্ঞেস করলাম এখানের পুরোনো কিংবদন্তি আর ইতিহাস কার থেকে জানা যাবে?
    মারিয়ানা বলল তার দিদু অনেক কিছু জানে।
    অদ্রিয়ানো ওর কথা উড়িয়ে দিয়ে বললো,
    – এখানে চার্চের পুরোনো পোপ, এখন তিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ, প্রায় নব্বই বছর বয়স, তবে মাথা এখনো পরিষ্কার। উনি আপনার উত্তর জানলেও জানতে পারেন। আমি ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি।
    ঠিক করলাম আমি যাব…যাবোই।

    কিন্তু তিয়াস? দিন দিন মেয়েটা এভাবে বদলে যাচ্ছে কেন? আমার মন কু ডাকছে। আজ ওর সাথে আমাকে কথা বলতেই হবে যে করেই হোক।
    হঠাৎ পেছন থেকে তিয়াসের গলা;
    – মা খেতে দাও, খুব খিদে পেয়েছে।
    যাক, নিজে খেতে চাইছে, তাহলে বোধহয় ….
    – আয় বস।
    ও খাচ্ছিল নিজের মনে, অদ্রিয়ানো আর মারিয়ানার সাথে টুকটাক কথাও বলছিল, আমি অপলক ওকে দেখছিলাম। সব কিছুই স্বাভাবিক, আমার চিন্তা কমে যাওয়ার কথা, কিন্তু …. কি যেন একটা অদেখা কারণ মনে সন্দেহের কাঁটা ফোটাচ্ছে।
    ওর চোখ দু’টো বড্ড ম্লান আর ঠোঁট যেন শুকনো রুক্ষ ফাটা ফাটা, বিবর্ণ নিষ্প্রাণ!
    ওর সাথে চোখাচোখি হতেই নজর ঘোরালাম। কিন্তু ও বোধহয় বুঝেছে বিষয়টা। তাই বললো,
    – মারিয়ানা একটা চিরুনি আর তেল এনে দাও না, মা আমার মাথাটা একটু ম্যাসাজ করে দিক।
    স্বাভাবিক হচ্ছে ও … কিন্তু আমার কেন মনে হচ্ছে যে ও শুধুমাত্র স্বাভাবিক হওয়ার অভিনয় করছে!

    তেল লাগাতে গিয়ে দেখলাম, চুলটা ভীষণ নির্জীব আর রুক্ষ যেন কতকাল কোনো যত্ন পায়নি, যেন ধুলো মাখা আর বিশ্রী একটা গন্ধ আসছে। চুলে হাত দিয়েই চমকে উঠলাম, একটু টান লাগতেই এক গোছা চুল উঠে আমার হাতে চলে এলো! কিন্তু ওর কোনো ভাবান্তর নেই! এভাবে কারো চুল উঠতে পারে না। অতি সন্তর্পণে চুলটা আঁচড়ে বেঁধে দেয়ার সময় যা দেখলাম তাতে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে বরফ গলা জল নেমে গেলো আর ঠিক সেই সময় মারিয়ানা উপর থেকে প্রায় ছুট্টে নীচে নেমে আসে হাতে একটা বিছানার চাদর। চোখের আতঙ্কের ভাষা বলছে ও আমাকে কিছু বলতে চায় … আমি আন্দাজ করতে পারছি কথাটা কি বিষয়। কিন্তু মনে প্রানে চাইছি আমার ধারণা যেন ভুল হয়।

    চলবে…….

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- অজানা অভিশাপ (পর্ব-২)

    অজানা অভিশাপ (পর্ব-২)
    -সুপর্ণা নাথ

     

     

    তিয়াসের ফ্লাইট লেট করেছে তাই পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। এসেই হৈ চৈ করে বাড়ি মাথায় করলো। মারিয়ানা অদ্রিয়ানোর সাথেও খুব জলদি মিশে গেলো। আজ আমার বাড়িটা সত্যি যেন প্রাণ পেলো। নিজের রুমটা দেখে ওর খুব পছন্দ, বললাম
    – রাতে কিছু বুঝবি না, সকাল হতে দে, ব্যালকনির ভিউটা জাস্ট ব্রেথ টেকিং!
    – মা, আমি যে কি এক্সসাইটেড কি বলবো; তবে খুব হিংসে হচ্ছে জানো তো আমি মোটে কয়েক সপ্তাহ আর তোমরা গোটা তিনটে মাস থাকতে পারবে (কপট রাগে ঠোঁট ফোলায় ও)।
    – তোকে কে বলেছে ফিরে যেতে? Quit that Job কলকাতাতে কিছু একটা ঠিক মনের মতো পেয়ে যাবি দেখিস।
    – আবার শুরু করলে! আমি আর দু’বছরের মধ্যেই তোমাদের কাছে ফিরে আসবো মা।
    বলেই ছোট বেলার মতো আমার কোলের মধ্যে মাথা গুঁজে দিলো।

    রাতে ডিনার টেবিলে অনেকক্ষণ গল্প আড্ডা হলো। মারিয়ানার দেখলাম আজ বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই। অনেকটা রাত হয়ে যাওয়াতে আর মারিয়ানার অস্বাভাবিক ভূতের ভয়ের কারণে ওকে রাতে থেকে যেতে বললাম। ও এক কথায় রাজি। রাতে অরি ঘুমোতে যাওয়ার পর মা আর মেয়েতে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম তিয়াসের ঘরে বসে।
    সময়টা হেমন্ত কাল আর পাহাড়ি জায়গা তাই একটা শিরশিরে ঠান্ডা ভাব থাকে রাতের দিকে।মেয়ে তার বাবার ধাত পেয়েছে, দিনে অজস্র বার কফি খাবে মানা করেও পারিনা। মারিয়ানা রান্না ঘর গোচ্ছাছিলো। তিয়াস কফির কথা বলছে শুনে নিজেই এক কাপ করে নিয়ে এলো, কিন্তু সে ঘরের ভেতর ঢুকতে নারাজ। তিয়াস ওর ভুতের ভয়ের কথা কিছুটা শুনেছিল, তাই হাসি মুখে ওর হাত ধরে ঘরে নিয়ে এলো। বললো,
    – তুমি আজ আমার সাথে থাকো না, গল্প করতে করতে ঘুমোবো।
    মারিয়ানার মুখ নিমেষে কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল।
    সে কিছুতেই রাজি হলো না। আমি তিয়াসকে ইশারায় বারণ করলাম যাতে জোর না করে। তবে এবার আমি অদ্রিয়ানোর কথা অনুসারে মারিয়ানার ভয় পাওয়াটাকে ব্যঙ্গ করতে পারলাম না। একটি কুড়ি-বাইশ বছরের মেয়ে এভাবে কি ছোট বাচ্চাদের মতো ভয় পেতে পারে?
    বিষয়টা আমাকে ওর থেকে জানতে হবে।

    সকাল বেলা ব্রেকফাস্ট করতে করতে গল্প করছি। অরি আজ ছুটি নিয়েছে। অদ্রিয়ানো আজ আমাদের আশপাশটা ঘুরিয়ে দেখাবে, একটু বাদেই হয়তো এসে পড়বে। তিয়াস বললো,
    – সত্যি মা সকালে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মনে হলো স্বর্গে এসে পড়েছি ! কি অপূর্ব সিনিক বিউটি! পাহাড় জঙ্গল ঝর্ণা …. শুধু ওই বাড়িটা কেমন যেন খাপ ছাড়া।
    অরি বললো,
    – ওই নীল বাড়িটা? ওরাই আমাদের এক মাত্র পড়শী। আর তো বাড়ি নেই না …
    তিয়াস একটু ভুরু কুঁচকে অবাক হয়ে বলল
    – ধুর, নীল বাড়িটা তো left hand সাইডে, ওটার কথা কেন বলবো? ওটা কি বাড়ির পেছনের ব্যালকনি দিয়ে দেখা যায় নাকি!
    আমি অবাক হয়ে বললাম,
    – পেছনের জঙ্গলে বাড়ি! কি বলছিস কি তুই?
    আমরা এই কদিনে কোনো বাড়ি তো দেখিনি!
    ও আমাদের দু’জনের হাত ধরে টেনে উপরে নিয়ে চললো। অরি এ ঘরে খুব বেশি আসেনি তাই ওর না খেয়াল করাটা স্বাভাবিক কিন্তু আমি তো …. কাঁচের দরজা খুলে ব্যালকনিতে গিয়ে দেখালো; আমি অবাক সত্যিই তো একটা বাড়ি আছে কিন্তু পাইন গাছের গুঁড়ির পিছনে কাঠের বিশাল জীর্ণ বাড়িটা কি ভাবে যেন Camouflage হয়ে আছে , চোখেই পড়েনি! দৌড়ে আমাদের রুমের ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলাম এখান থেকে একটু কোনাকুনি হওয়ার কারণে বাড়িটার অস্তিত্ব একদমই বোঝা যায় না।
    অরি বললো,
    – মাম্মা তুই তো এসেই দারুন জিনিস আবিষ্কার করে ফেললি। একদিন তুই আর আমি দু’জনে ওই দিকটায় ঘুরে আসবো বেশ ট্রেকিং এর মত হবে, কি বলিস?
    -দারুণ হবে বাবা; কবে যাবে বলো?
    আমি ওদের থামিয়ে বললাম,
    -একদম না, বাড়িটা কিন্তু বেশ দূরেই, আর ওদিকে রাস্তা ঘাট তেমন নেই সাথে জঙ্গলটাও গভীর, সাপ খোপ না জানি কি আছে, কোনো দরকার নেই। ট্রেক করতে হলে অদ্রিয়ানোকে বলো, যেখানে সবাই যায় সেখানে যাও।
    অরি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
    -জো হুকুম রানী সাহেবা।
    মারিয়ানা এতোক্ষণ কিছু বলেনি, খুব ক্ষীণ স্বরে বললো,
    – ওটা, Casa de Monte, ওটা কার্সড। অভিশপ্ত ওখানে যাবেন না প্লিজ।
    তিয়াস কি একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কিন্তু কথার মাঝেই অদ্রিয়ানো চলে এলো আমাদের নিয়ে যেতে, ও কিছুটা কথা শুনেছিল, বললো,
    – অভিশপ্ত না আরও কিছু, কিছু না ম্যাডাম, বহু পুরোনো বাড়ি কয়েকশো বছরের পুরনো। যতদূর শুনেছি আড়াইশো বছরেরও বেশি। ওটা কিন্তু কোনো পর্তুগিজের বাড়ী না, তবে বাড়ির মালিক নাকি খুব ধনী ছিল। বেশি কিছু জানি না তবে ওর মালিকের সাথে নাকি এখানে লোকেদের কি সব ঝামেলা হয়, বাড়ির মালিক এখান থেকে পালিয়ে বাঁচে, সেই থেকে বাড়ি ফাঁকা।
    তিয়াস বললো,
    – মারিয়ানা তো বললো, casa de monte…. মানে কি কথাটার?
    – Casa de Monte মানে হিল হাউস।
    শুনেছি পাহাড়ের এত উপরে প্রথম ওই বাড়িটাই হয়েছিল তাই এখানের মানুষজন ওটাকে casa de monte (হিল হাউস) বলতো।
    আর ওসব অভিশাপ টাপের গল্প মারিয়ানাই বলতে পারবে। ওর গ্র্যানি তো বংশ পরম্পরায় ওঝা গুনীন আর হাতুড়ে ডাক্তার তাই ওসব ওই ভালো জানবে।

    আমি জানি কথাটা ব্যঙ্গ করে বললো অদ্রিয়ানো। কিন্তু মারিয়ানার চোখে মুখে যেন এক করুণ আকুতি!

    আমরা day out এর জন্য তৈরি। বেরিয়ে পড়লাম। সারাদিন Frontainhas এর বিভিন্ন গলিতে ঘুরে বেড়ালাম। কি অপূর্ব শহর, উজ্বল রঙের অভিজাত ভিলা, ঝকঝকে রাস্তাঘাট, বাড়ির পাঁচিলের বেড়াজাল টপকে কিছু ফুল আর ফলের গাছ উঁকি মারছে। রাস্তায় দেশ বিদেশের ট্যুরিস্ট।
    বাজারটাও ভারী চমৎকার। মন ভরে শপিং করলাম। আর পেট ভরে লাঞ্চ করলাম স্টিমড রাইস আর চিকেন ভিন্দালু দিয়ে। প্রায় সন্ধ্যের মুখে বাড়ি ফিরলাম। মারিয়ানার আজ ছুটি, আর দারওয়ানজিকেও সপ্তাহ খানেকের ছুটি দিয়েছি। বাড়িতে এতোজন আছি, বুড়ো মানুষটা একটু অবসর পাক।
    অদ্রিয়ানো আর ভেতরে এলো না। আমরাও খুব ক্লান্ত, ফ্রেশ হয়ে সবাই একটু রেস্ট নেব ঠিক করলাম। হালকা একটু ডিনার করে নিলাম তাড়াতাড়ি তার পর টানা ঘুম।

    হঠাৎ তিয়াসের ডাকে ঘুম ভাঙে,
    – আমরা ঘরে একটু এস তো মা,
    – কেনরে? কি হয়েছে?
    – এসোই না।
    – উফফ চল ..
    ওর ঘরে এসে ও ব্যালকনির দিকে দেখিয়ে বললো, – ওই বাড়িটাতে লোক থাকে গো মা
    – ওই ভাঙা চোরা বাড়িতে কেউ থাকতে পারে?
    – বিলিভ মি মা, আমি ঘুমাচ্ছিলাম তারপর টয়লেটে যাওয়ার জন্য উঠলাম, এসে আবার শুতে যাবো তখন দেখলাম ওই বাড়ির জানলার সামনে থেকে কে যেন সরে গেলো। ভেতরে হালকা মলিন হলুদ একটা আলো জ্বলছিল।
    – এত দূর থেকে কি দেখতে কি দেখেছিস। যা ঘুমিয়ে পড়।

    পরের বেশ কয়েকদিন খুব ভালো কেটে গেলো। তিয়াসকে আমি কাছে পাই না তাই এই কয়েকদিনের প্রতিটা মুহূর্ত দারুণ ভাবে উপভোগ করতে চেষ্টা করছি। অরি কাজে ব্যস্ত থাকলেও মেয়ের জন্য ঠিক সময় বের করছে। তবে এর মাঝে আরো দু’ তিন বার ও বলেছে ওই বাড়িতে কেউ থাকে, এবং একবার নাকি ওর সাথে চোখচোখিও হয়েছে। আমি বিভিন্ন সময় ওর ব্যালকনি থেকে দেখার চেষ্টা করেছি, সত্যি বলতে অত ঝোপ ঝাড় আর পাইন গাছের পেছনে বাড়িটা ঠিক মতো বোঝাই যায় না, আর যেটুকু দেখা যায় সেটা অতি জীর্ণ। তবে হ্যাঁ, বাড়ির দোতলার একটা জানলা সরাসরি চোখে পড়ে। তবে ওই বাড়ি মনুষ্যবাসের অযোগ্য এটা যে কেউ মানবে।

    পরদিন সকালে তিয়াস হঠাৎ একা বেরিয়ে গেলো। বললো মার্কেটে যাচ্ছে। কিছু পরে ফিরে এলো দেখলাম একটা বাইনোকুলার কিনে এনেছে। তারপর সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো। এবার বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে, ও দিন দিন ওই বাড়ির প্রতি অবসেসড হয়ে পড়ছে। এটা ঠিক না । অরিকে বলতে ও বললো
    – ছক বাঁধা জীবনের বাইরে অন্য রকম কিছু পেয়েছে তাই নিয়ে মেতে আছে, বাদ দাও না। ওকে ওর মতো ছেড়ে দাও।

    ছাড়তে পারলে খুশিই হতাম, কিন্তু আমি তো মা, মেয়ের ছোট ছোট চেঞ্জও আমার চোখে বাঁধে।
    এখন দিনের বেশির ভাগ সময় ঘরের ওই কাঁচের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, এক দৃষ্টিতে ওদিকে তাকিয়ে থাকে। সব সময় কিছু যেন একটা বিষয় চিন্তা করছে।
    মারিয়ানা বিষয়টা লক্ষ্য করেছে, ও বলল,
    – দিদিকে ওই রুমে রেখো না ম্যাডাম, ও বাড়িটা অভিশপ্ত, জাদু করতে পারে মানুষের উপর।
    এবার আমার সত্যি ভয় করতে শুরু করেছে।
    আমি তিয়াসকে নিচের ঘরে শিফট করতে চাইলাম কিন্তু ও রাজি হলো না। বললো,
    – তুমি ভাবছো আমি অদ্ভুত আচরণ করছি। তা নয় মা। ওই বাড়ি আর বাড়ির ভেতরের মানুষটার সম্পর্কে আমাকে জানতেই হবে।
    -তিয়াস এবার আমার বিরক্ত লাগছে। যে খুশি থাক ওখানে, বলা যায় না কোনো আন্টি সোশ্যাল ডেরা বানিয়েছে ওখানে, ফালতু ঝামেলায় জড়াস না সোনা।
    – এক্সাক্টলি মা, আমিও এটাই ভেবেছিলাম কিন্তু তাহলে সারাদিনে বা এতগুলো দিনে তাদের একবারও বাড়ি থেকে বেরোতে তো দেখবো? তাই না? কেউ বেরোয় না। তবে ওখানে যে থাকে সে সারারাত কাল আমার ঘরের দিকে চেয়ে ছিল।
    – তুই নিচের ঘরে থাকবি আজ থেকে, আমিও তোর সাথে থাকবো। মারিয়ানা বলেছে …
    – (মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলে) ওর কথা রাখো তো। খালি অন্ধ বিশ্বাস ওর। আমি কাল সকালে একবার ওদিকে ঘুরে আসবো?
    – একদম না কোনো দরকার নেই।
    – ও.কে.. ও.কে যাবো না ।
    আমার মনে কাঁটা বিঁধেই থাকলো, আমি জানি তিয়াসের জেদ কতটা। সেদিন বিকেলে অরির এক কলিগের বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল, তিয়াস কিছুতেই যেতে চাইলো না।

    আরো চার দিন কেটে গেছে, তিয়াস ও বিষয় আর কোনো কথা বলেনি। ওর মুড একটু অফ আছে কয়েকদিন, হয়তো অর্কর সাথে ঝামেলা হয়েছে। আমি আর ঘাটালাম না ওকে।

    ভেবে খুশি হলাম যে ওই বাড়ির রহস্যর ভূত ওর মাথা থেকে নেমেছে। দারওয়ানজি কাল ফিরে এসেছে। ওদের বাড়ি পাহাড়ের পুবের ঢালের বস্তিতে। বাড়িরতে সব ভালো কিনা খোঁজ নিতে বললো,
    – বস্তিতে এক পুরোনো উপদ্রব শুরু হয়েছে।
    – কিসের উপদ্রব?
    – অশুভ ছায়ার।
    – মানে!
    – সে বহুকাল আগের কথা আমার দাদাজিও জন্মায়নি তখন। এক অশুভ ছায়ার প্রভাবে গ্রামের পালিত পশু সব মারা পড়ছিল। শেষে বেশ কজন মানুষকেও সেই অশুভ ছায়ার শিকার হতে হয় তারপর এখানকার প্রিস্ট অনেক চেষ্টায় তাকে দূর করে। কিন্তু গত তিন দিনে আবার গ্রামের রাস্তা ঘাটে মৃত পশুর দেহাংশ আর রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে।
    পুলিশে রিপোর্ট করার কথা জিজ্ঞেস করতে বললো,
    – এ পুলিশের কাজ না ম্যাডাম। কি জানি আবার কত সর্বনাশ হবে!
    আমি চাইনা কথাটা তিয়াসের কানে যাক। কে জানে এবার হয়তো এইটা নিয়ে পড়বে।

    পরদিন সকালে আমাদের প্রতিবেশী সেই নীল বাড়িতে খুব হট্টগোল শুনছিলাম। তেমন পরিচয় হয়নি তাই আগ বাড়িয়ে যেতে পারলাম না। মারিয়ানাই খবরটা দিলো, ওটা ডিসুজাদের বাড়ি ওদের বাড়িতে তিনটে বিশাল Husky dog পেট ছিল । সারা দিন বাঁধা থাকলেও রাতে বাড়ির কম্পাউন্ডের ভেতর তাদের ছেড়ে রাখা হতো। চোর ডাকাতও বাড়ির ত্রিসীমানায় যেতে ভয় পায়। কিন্তু আজ সকালে … সকালে…. ওর চোখে মুখে মারাত্মক আতঙ্কের ছাপ।
    – আহ্, কি আজ সকালে বলবে পরিষ্কার করে..
    – আজ তিনটি Husky-কেই কেউ বা কারা ছিন্ন ভিন্ন করে আধখাওয়া করে রেখে গেছে। কি মারাত্মক দৃশ্য।
    -;Husky তো শিকারি কুকুর খুবই শক্তিশালী। তাহলে বড় কোনো পশু কি!
    – Altinho hill এ তেমন কোনো পশু বা হিংস্র জন্তু নেই ম্যাডাম।
    খুব চিন্তায় পড়া গেলো। আমি মারিয়ানাকে বললাম,
    – তিয়াস যেন এসব কিছু জানতে না পারে।
    অরিকে সংক্ষেপে সবটা বললাম, আর সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসতে বললাম। তিয়াস এখনো ঘুমোচ্ছে অনেক বেলা হলো, গত কয়েকদিন ধরেই খুব বেলা করে উঠছে, চুপচাপ থাকছে। নিশ্চয়ই অর্কর সাথে কিছু হয়েছে। চার-পাঁচ দিন আগেও তো বেশ ছিল ও। অর্ক ওর ফিয়ান্সে, এক সাথেই কাজ করে, আমাদের দু’বাড়ি থেকে সব ঠিক হয়ে আছে। সাত পাঁচ ভেবে অর্ককে ফোন করলাম, সে জানালো গত পাঁচ দিন ধরে তিয়াসের সাথে ওর কথাই হচ্ছে না। ও নাকি নম্বর ব্লক করেছে, কিন্তু ওদের কোনো ঝগড়াও হয়নি। শেষ যেদিন কথা হয় সেদিন তিয়াস খুব এক্সইটিং কিছু বলবে বলেছিল। ওর হলিডে দারুন কাটছে সেটাও বলেছিল।
    -এক্সাক্টলি কি এক্সইটিং ঘটনা সেটা কি তোমাকে বলেছিল অর্ক?
    – না আন্টি, দুপুরের দিকে কথা হয়েছিল, বলেছিল রাত এ সব বলবে, খুব রোমহর্ষক ব্যাপার নাকি!
    – ওহ্
    – কিছু হয়েছে কি? আমি তো বুঝতে পারছি না আন্টি ঠিক কেন ও হঠাৎ …
    – ও.কে, চিন্তা করোনা, ও ঠিক আছে আমি কথা বলছি।

    ফোন রাখার পর অনেকগুলো অদ্ভুত চিন্তা আর প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে লাগলো, হঠাৎ সব কিছু যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। অনেক বেলা হলো এবার ওকে ডাকা দরকার। দেখলাম ও নিচে আসছে।
    মুখটা ভারী লাগছে, চোখগুলো যেন কেমন নিষ্প্রভ, প্রাণহীন। আমার মনটা বড্ড খারাপ লাগছে। ব্রেকফাস্টটা এগিয়ে দিয়ে মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে বললাম,
    – কি হয়েছে রে, বলবি?
    – নাথিং, কি হবে? একটু টায়ার্ড লাগছে, মে বি ওয়েদার চেঞ্জ এর জন্য।
    কথাগুলো কেমন কাঠ কাঠ ভাবে বলেই উঠে গেলো। খাবারগুলো নাড়াচাড়া করলো শুধু, খেলনা কিছুই।
    দুপুরে লাঞ্চের সময় নামলো কিন্তু ওর ফেভারিট খাবার থাকা সত্তেও কিছুই সে ভাবে খেলো না। এবার সত্যি চিন্তা হচ্ছে। কথাবার্তা বলছে না, আবার ঘরে গিয়ে দরজা দিলো।

    মারিয়ানাকে ঘর পরিষ্কারের জন্য ঢুকতে দেয়নি। বিকেলের দিকে কিছু ফল নিয়ে ওর ঘরে গেলাম যদি কিছু খায়, ঘরের দরজা খুলে দেখলাম সারা ঘর অন্ধকার, জানলার পাল্লা বন্ধ ব্যালকনির কাঁচের দরজার উপর পাতলা আসমানী পর্দা, তার উপর দিয়ে একটা মোটা বেডশিট টাঙিয়ে দিয়েছে যাতে ঘরে মোটেও আলো না আসে, ও কি ওই বাড়িটাকে …. ভয় পাচ্ছে কি কোনো কারণে? আগে খালি বলছিল কে যেন ওই বাড়িতে থাকে, আমরা গা করিনি, তারপর আর কিছু বলেনি … বড় হয়েছে, বার বার অবিশ্বাসটা নিতে পারেনি তাই চেপে যাচ্ছে বিষয়টা তবে কিছু একটা ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আমাকে জানতেই হবে।

    চলবে….

  • ধারাবাহিক

    ধারাবাহিক- অজানা অভিশাপ (পর্ব-১)

    অজানা অভিশাপ (পর্ব -১)
    -সুপর্ণা নাথ

     

     

    পঁচিশ বছরের পুরনো কর্তাটি যদি আচমকা এক সুন্দর সকালে বলে,
    – বাক্স প্যাটরা গুছিয়ে নাও, গোয়া যাচ্ছি তাও পুরো তিন মাসের জন্য।
    আনন্দের আগে চমকটাই লাগবে, তাই না? সাথে একটু আধটু বিষমও লাগতে পারে। আমারও তাই হলো। অবিশ্বাসের ঘোর কাটিয়ে উঠে পুরো বিষয়টা গুছিয়ে শুনেই প্রথম ফোন করলাম আমাদের একমাত্র মেয়ে তিয়াসকে, ও কাজের জন্য আপাতত ব্যাঙ্গালোরের বাসিন্দা। শুনে বললো,
    – ভাগ্গিস অনেকটা ছুটি বাঁচিয়ে ছিলাম মা, আমিও তোমাদের জয়েন করছি গোয়াতে। উফফ কি এক্সইটিং ব্যাপার!

    এই অপ্রত্যাশিত আনন্দ যে সাথে এক অনির্বচনীয় বিভীষিকা বয়ে আনছে সেটা আমরা কেউ আঁচ করতে পারিনি। যে আতঙ্কের ছায়া হয়তো সারা জীবন আমাদের ধাওয়া করে বেড়াবে। এতকালের বিশ্বাস, যৌক্তিকতা, বোধ সব কিছুর ভিতকে নাড়িয়ে দেবে।

    আমি তনুকা আর আমার কর্তা অরিন্দম, সে একটা বহুজাতিক ব্যাঙ্কে উঁচু পদে কর্মরত। আর সেই কাজেই তাকে গোয়ার নতুন ব্রাঞ্চে কিছুদিনের জন্য যেতে হচ্ছে। থাকার ব্যবস্থা অফিসই করে দেবে। সব কিছু ব্যবস্থা পাকা।

    আমরা গোয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছলাম শেষ দুপুর তখন, অফিসের একজন হাতে অরিন্দমের নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার সাথে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম, অরি বললো আমাদের গন্তব্য পানাজির Fontainhas, এটা নাকি গোয়ার খুব পুরোনো পর্তুগিজ প্রভাবিত অঞ্চল, ইংরেজদেরও আগে পর্তুগিজরা উপনিবেশ স্থাপন করে এখানে আর এই Fontainhas ছিল তাদের বিশেষ প্রিয়। আমাদের যে ছেলেটি নিতে এসেছিল সে বেশ মিশুকে আর সপ্রতিভ, নাম অদ্রিয়ানো বয়স তেইশ-চব্বিশ হবে।
    সে গরগর করে তাদের তথা গোয়ার ইতিহাস বলে গেলো, জানলাম সে নিজেও পর্তুগিজদের শোনিত বাহক। তার পূর্বপুরুষ এক জাহাজের কর্মচারী ছিল। গোয়াতে আসে কাজের সূত্রে কিন্তু তখন পর্তুগিজদের রমরমা এখানে, ইংরেজরা তখন জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। এখানেই এক ভূমি কন্যার সাথে ঘর বাঁধে সে। পরের প্রজন্ম এটাকেই তাদের নিজের দেশ বলে আপন করে নিয়েছে। অদ্রিয়ানো আরো বললো আমাদের গন্তব্য যে Fontainhas সেটা আসলে এক লাতিন প্রভাবিত অংশ, এখন হেরিটেজ সাইটের তকমাও পেয়ে গেছে। 1770 খ্রিস্টাব্দে Antonio Joao de Sequeira যিনি কিনা আদতে গোয়ান, Mozambique এ ব্যবসাসূত্রে ছিলেন বহুকাল এবং সেখান থেকে প্রচুর আয় করে দেশে ফিরে এই Fontainhas জনপদটি স্থাপন করেন হুবহু পর্তুগিজ শহরের ধাঁচে। অদ্রিয়ানোর কথাগুলো শুনতে শুনতে হঠাৎ মনে পড়ে গেলো কোথায় যেন পড়েছিলাম ঐতিহাসিক William Dalrymple এর উক্তিটি
    Fontainhas is ” a small chunk of Portugal washed up on the shores of the Indian Ocean”
    গল্প, কথা আর ইতিহাস শুনতে শুনতে কখন যে এক ঘন্টা কেটে গেছে খেয়াল করিনি।

    Fontainhas এ পৌঁছে অদ্রিয়ানো গাড়িটা থামালো। অরি বললো,
    – এখানেই কি?
    – না sir, অফিস আপনাদের জন্য যে বাংলোর ব্যবস্থা করেছে সেটা আর একটু উপরে, এটা তো আল্টিন্হ হিলের পাদদেশ, বাংলোটা হিলের উপরে, চলুন না দেখে মনে ভরে যাবে।
    আমি গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললাম
    – তুমি এখানে থামালে কেন তাহলে?
    – ম্যাডাম, আজ তো মেইডকে পাবেন না, সে কাল থেকে আসবে আর বুড়ো দারোয়ানটা কোনো কাজের নয়, না চোখে দেখে না কানে শোনে। তাই আপনাদের জন্য কিছু খাবার আর ফ্রুটস নিয়ে নেব।

    মনে ভাবলাম, সত্যি খুব গুছানো ছেলে আর খুব আন্তরিক। বেশ ভালো লেগে গেলো ওকে। হয়তো বাৎসল্য, তিয়াসের কাছাকাছি বয়স ওর। ও বললো
    – ম্যাডাম, একটু ঘুরে দেখুন না, জায়গাটা সত্যি দারুণ।
    – আজ না, একটু জেট ল্যাগ লাগছে।
    – ঠিক আছে, আমি সামনের উইক এন্ডে আপনাদের গাইড হয়ে পুরো Fontainhas ঘুরিয়ে দেখাবো।

    পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গাড়ির উঠতে একটু সময় বেশি লাগে, প্রায় মিনিট দশ পর আমাদের বাংলোর সামনে গাড়ি দাঁড়ালো। টিপিক্যাল পর্তুগিজ আর্কিটেকচার। উজ্জ্বল মেটে হলুদ রং এর দেওয়াল, দোতলা বাড়ি মাথার উপর লাল টালি। জানলায় সান শেড নেই, রট আয়রনের রেলিং ঘেরা ব্যালকনিগুলো যেন দেয়াল থেকে এগিয়ে বাইরের দিকে বেরোনো (protrudind out)।
    তবে এতক্ষণ পাহাড়ি রাস্তায় ওঠার সময় বেশ ঘিঞ্জি শহর দেখছিলাম, সব বাড়িগুলোই পর্তুগিজ স্টাইলের, হলুদ, নীল বা সবুজ দেয়াল, বাউন্ডারি ঘেরা, সাথে গাছগাছালিও আছে। কিন্তু ওপরে ওঠার সাথে সাথে বসতি পাতলা হয়েছে। এখানে দূরে আর একটা নীল বাড়ি ছাড়া অন্য বাড়ি চোখে পড়লো না। আমাদের বাড়ির চারদিকে বেশ বড় লন আর বেশ কিছু ফুলের গাছ সাথে দু’টো কাজুবাদাম গাছ আর একটা লেবু (লেমন ) গাছ। পুরোটাই কাঠের তক্তার বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাড়ির সামনে ফ্রন্ট পর্চে সাদা রং করা লোহার চারটি চেয়ার আর একটা টেবিল। এ যেন গল্পে পড়া অন্য কোনো দেশ! মাথার উপর আকাশটাও অদ্ভুত নীল। মনটা সত্যি খুব ভালো হয়ে গেলো। শুধু মনে হচ্ছে তিয়াস কবে আসবে, ও বরাবরই পাহাড় ভালোবাসে।

    অদ্রিয়ানো নিপুণ ভাবে বুড়ো দারোয়ানকে সব বুঝিয়ে দিলো আর চটপট আমাদের জিনিসপত্রগুলোও গুছিয়ে দিলো, কাজের ছেলে। আমাকে পুরো বাড়ি দেখিয়ে চাবি বুঝিয়ে চলে গেলো, কাল সকালেই মেইডকে নিয়ে আসবে কথা দিয়ে গেলো।
    আমরা ফ্রেশ হয়ে এসে গরম কফি, কুকিজ সহযোগে উদর্পূর্তী করলাম। অরিন্দম এসেই অফিসের কাজে লেগে গেছে স্কাইপে কথা বলছে অফিসের কারো সাথে। ওকে আর ডিসটার্ব করলাম না। বাড়িটা আরো একবার ঘুরে দেখলাম। নীচে গেস্ট রুম, কিচেন, ড্রইং এন্ড ডাইনিং আর উপরে দু’টো বড় বেড রুম আর একটা বসার ঘর আছে। দু’টো ঘরের ব্যালকনি দিয়েই পাহাড়ের চূড়ার দিক দেখা যায় আর একটা সরু রুপালি রেখা চোখে পড়ে, পাহাড়ি ঝর্ণার জন্যই নাকি এই জনপদের নাম Fontainhas, পর্তুগিজে এর মানে “Little Fountain” মনে ভাবলাম আজন্ম কলকাতার ব্যস্ততায় অভ্যস্ত চোখ আর মন যেন স্বস্তির অবকাশ পেয়েছে। চারিদিকটা কেমন নিস্তব্ধ তবে প্রকৃতির নিস্তব্ধতারও কি সুন্দর একটা সুর থাকে ভাষা থাকে। নাম না জানা পাখির ডাক, গাছের পাতার শিরশিরানি, খুব ক্ষীণ ঝর্ণার শব্দ সব মিলে এক অদ্ভুত বাঙ্ময় নীরবতা সৃস্টি করেছে!

    আমাদের বেডরুমটা মোটামুটি গুছিয়ে ফেললাম। পাহাড়ে সন্ধ্যে যেন ঝুপ করে নেমে আসে। ব্যালকনি সংলগ্ন দরজাটা পুরো কাঁচের, কাঁচের ওপারে জমাট কালো অন্ধকার, বসতি নেই তাই আলোর রেখাও নেই। অন্ধকারটা যেন কেমন অস্বস্তিকর। পরক্ষণে নিজেরই হাসি পেলো, জায়গাটা নতুন আর পরিবেশটাও অন্য রকম তাই একটু অস্বস্তি হওয়া তো স্বাভাবিক। ভারী মোটা পর্দাটা টেনে দিলাম। ব্যাস সব অস্বস্তি গায়েব। নিচে গিয়ে দেখলাম দারোয়ান বসে ঝিমোচ্ছে, বেচারা বুড়ো মানুষ, শক্তি সামর্থ নেই তবু পেটের দায়ে … তাকে জাগাতে আর মন চাইলো না।

    আর অরিন্দম গেস্ট রুমটাকেই আপাতত তার হোম অফিসে পরিণত করেছে, আর এক প্রস্থ কফি খাবে কিনা জিজ্ঞেস করার জন্য দরজা দিয়ে গলা বাড়ালাম, দেখলাম বর মশাই তার কোনো এক সাবোর্ডিনেটকে খুব বকাঝকা করছে ফোনে। চুপচাপ সরে এলাম, এই মানুষটা কাজ পেলে বিশ্ব সংসার ভুলে যায়। আমার আসার শব্দে বুড়ো দারোয়ান জেগে উঠেছে , ভাঙা হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো, কি লাগবে আমার? তাকে বাঁধা দিয়ে কিচেনে গেলাম, বুঝলাম তিন মাসের সংসার হলেও কালই কোমর বেঁধে লাগতে হবে। তিন কাপ কফি বানিয়ে নিলাম। দারওয়ানজিকে দিলাম, এক কাপ কফি যে কারো চোখে এত আনন্দ আর আপ্লুত ভাব আনতে পারে জানতাম না।
    অরিন্দমের কাপটা ইচ্ছে করেই ওর সামনে ঠক করে রাখলাম যাতে সে বুঝতে পারে যে এসে থেকেই কাজে লেগে পড়াতে আমি মোটেও খুশি না।
    – কাপ প্লেটের উপর রাগটা নাই দেখালে, চলো আমার কাজ শেষ, এখন আমি আপনার সেবাদাস ম্যাডাম।
    – থাক হয়েছে, অতো সেবা আমার সইবে না, তুমি বরং তিয়াসকে ভিডিও কল করো তো। ও এতক্ষণে ফিরে এসেছে অফিস থেকে ।

    কফি খেতে খেতে কর্তা গিন্নি অনেকক্ষণ মেয়ের সাথে আড্ডা দিলাম। ও বললো আগামী পরশু এসে যাবে। পুরো তিন সপ্তাহের ছুটি চেষ্টা করছে যাতে আরো কয়েকদিন ম্যানেজ করতে পারে। খুব খুশি ও।

    রাতের দিকে দারোয়ানজি বললো, রাতের খাবার তৈরি। অদ্রিয়ানো নাকি তার বাড়ি থেকে খাবার দিয়ে গেছে, কোন ফাঁকে এলো ছেলেটা বুঝতেই পারিনি! রুটি আর গরম চিকেন কারি খেয়ে নিলাম। খাওয়া মিটিয়ে দারোয়ান তার আউট হাউসে চলে গেলো। সারাদিনের ক্লান্তি চোখে ঘুম নেমে আসতে দেরি হলো না।

    রাত তখন কত জানি না, হঠাৎ মনে হলো চোখের উপর জোরালো কোনো আলো পড়ছে, চোখ বন্ধ থাকলেও চোখের উপর আলো পড়লে একটা অনুভুতি হয়, আমার ঘুম বরাবরই পাতলা। ঘুম ভেঙে জাগতেই, মনে হলো ব্যালকনির কাঁচের উপর কোনো আলো পড়েছে সেটা মুহূর্তে নিভে গেলো, চোখে ঘুম ছিল তাই অতো তোয়াক্কা না করেই আবার ঘুমালাম, কিন্তু সেটা বেশিক্ষণের জন্য না। আবারও সেই এক অনুভূতি! এবার সত্যি ঘুমের ঘোরটা কেটে গেছে, মাথায় এলো অতো মোটা ভারী পর্দা ভেদ করে আলো আসবে কি করে? বেড সাইড টেবিলের ল্যাম্পটা জ্বেলে নেমে দেখলাম পর্দাটা বেশ অনেকটা সরে গেছে! অরিন্দমকে ডাকলাম, ও চোখ না খুলেই বললো
    – আরে ও কিছু না, পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে বড় কোনো গাড়ি নামছিল হয়তো তারই হেডলাইটের আলো এসে পড়েছে কোনো ভাবে কাঁচের উপর।
    আমার মনের খুঁতখুতুনি রয়েই গেলো, সারা সন্ধ্যে কি একটাও গাড়ি ওই রাস্তায় যায়নি! কৈ কোনো আলোর রেখা তো দেখিনি! বাকি রাতটা ঘুমালাম তবে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম। সকালের আলোতে রাতের সব দুশ্চিন্তা মুহূর্তে হারিয়ে যায়। সাত সকালে হৈ চৈ করে অদ্রিয়ানো বাড়ি মাথায় করেছে। ভোর বেলাতেই সে এক গাদা বাজার করে এনেছে সাথে একটা অল্প বয়সী মেয়ে, আজ থেকে আমাকে সাহায্য করবে। ওর নাম মারিয়ানা। একটু চুপচাপ, ইংরেজিতে অতো সরগর না তবে কাজ চলা হিন্দি বলে, এখানকার বেশিরভাগ মানুষ এখনো পর্তুগিজ ভাষাতেই স্বচ্ছন্দ। অদ্রিয়ানো ওকে বললো চটপট কাজে লেগে যেতে বললো। আমাদের কফি দিয়ে সে ব্রেকফাস্ট বানাতে গেলো।
    খাবার টেবিলে নানা বিষয় কথা হচ্ছিল। অদ্রিয়ানো একটা চাবির গোছা অরিন্দমকে দিয়ে বলল,
    – Sir, আপনাদের সুবিধের জন্য এই গাড়িটা আজ থেকে এখানেই থাকবে। যদি ড্রাইভার লাগে অফিস সেটাও দিয়ে দেবে।
    আমি বললাম,
    – আমরা দুজনেই ড্রাইভিং জানি তাই ড্রাইভারের দরকার নেই। আর হাতের কাছেই তো সব একটু আধটু হাঁটাও ভালো।
    – ওকে ম্যাডাম। তাও যদি কখনো দরকার হয় আমাকে একটু জানাবেন আমি চলে আসব।
    – বেশ জানাবো (হাসি মুখে বললাম), আচ্ছা অদ্রিয়ানো, আমাদের বাড়ির পিছন দিকে মানে যেদিকে ঝর্ণা ওদিকের রাস্তা দিয়ে রাতে খুব গাড়ি যাতায়াত করে না? সারাদিনে তো তেমন কিছু…
    আমার কথা মাঝখানে থামিয়ে ও বলল,
    – ওদিকে তো রাস্তাই নেই ম্যাডাম! গাড়ি কি করে আসবে?
    রাস্তা তো আপনাদের বাংলোর সামনে দিয়ে গিয়ে আরো পূর্ব দিকে চলে গেছে আর এরপর তো তেমন বাড়িও নেই আবার পাহাড়ের পুব দিকের ঢালে বস্তি আছে। এদিকটা খুব posh অঞ্চল কিন্তু পাহাড়ের পুবের ঢালটা একটু নিম্নবিত্ত মানুষদের বসতি।
    – ও আচ্ছা
    – কেন ম্যাডাম, কি হয়েছে?
    অরিন্দম কথাটা ঘুরিয়ে দিলো, অফিসের কি সব কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো, আমিও আর কথা বাড়ালাম না।
    উপরে চলে এলাম, বাড়ির সামনেও একটা ব্যালকনি আছে, ওখান থেকে নিচের বাজার এলাকার কিছুটা আর আল্টিহ্ন ( Altinho) হিলের গায়ের রঙচঙে বাড়ি আর রাস্তাঘাট কিছুটা দেখা যায়, ব্যস্ত জীবনের চেনা ছবি। দেখলাম অদ্রিয়ানো বেরিয়ে যাচ্ছে আর মারিয়ানা তার পেছনে ছুটে গেলো, সে হাত মাথা নেড়ে তাদের ভাষায় কি সব বলছে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মনে হচ্ছে সে ভারী বিরক্ত আর অস্বস্তিতে আছে। চোখে মুখে উদ্বিগ্ন ভাব। অদ্রিয়ানো তাকে কিছু বোঝাচ্ছে। হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে ও হন হন করে হেঁটে বেরিয়ে গেলো, আর মারিয়ানা ব্যাজার মুখে বাড়ি ঢুকলো। নতুন এসেছে তাই এখনই কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক মনে হলো না।

    একটু বেলার দিকে অরি বেরিয়ে গেলো অফিসে আর আমার সারাদিনটা প্রচুর ব্যস্ততায় কাটলো। মারিয়ানা ধীরে ধীরে অনেকটা সাবলীল হয়ে গেছে, কথা কম বলে কিন্তু বেশ কাজের আর হাসিখুশি, কিছু টুকটাক কেনাকাটার ছিল, ওকে সঙ্গে নিয়ে নিচের বাজারে গেলাম, আমাকে নতুন দেখে পাছে কেউ ঠকায় তাই মারিয়ানাই দেখে শুনে গুছিয়ে কেনাকাটা করলো, বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে হলো। আজ ও এখানেই থেকে যাবে তবে কাল থেকে সন্ধ্যেবেলা ফিরে যাবে, তেমনটাই ঠিক হয়ে আছে। তিয়াসের ঘর সাজানোর কিছু জিনিস কিনেছি সাথে সুন্দর আসমানী পর্দা। ওর পছন্দের রং। আমি রান্না ঘরে কিছু কাজ করছিলাম, অরি জানিয়েছে ওর ফিরতে দেরি হবে। আমি মারিয়ানাকে বললাম,
    – উপরের আমাদের পাশের বেড রুমে পর্দাগুলো লাগিয়ে দেবে। তারপর একটু কিচেনে এসে হেল্প করবে।
    বেশ অনেকটা সময় কেটে যেতেও ও ফিরছে না দেখে আমি ওকে ডাক দিলাম, কোনো উত্তর নেই। আশ্চর্য! আমি ওকে ডাকতে ডাকতে উপরে উঠে দেখি ফ্যাকাশে মুখে হাতে পর্দা নিয়ে ঘরের দরজাতে দাঁড়িয়ে, আমি আবার ডাকলাম, কোনো সাড়া নেই। মুখ পুরো সাদা, চোখ বিস্ফোরিত, চেয়ে আছে ব্যালকনির কাঁচের দরজার দিকে। আমি ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে ওর যেন সাড় ফিরলো, আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
    – ম্যাডাম এ ঘরটাতে আমি একা যাবো না,
    – কেন?
    – ওই অন্ধকার …. না মানে আমি সব কাজ করবো ম্যাডাম শুধু এখানে যেতে বলবেন না প্লিজ।
    কথার মাঝেই শুনলাম, পুরোনো লোহার দরজার ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ আর গাড়ির শব্দ। অরি ফিরলো। আমি নিচে এলাম পেছন পেছন মারিয়ানাও নেমে এলো। দেখলাম অদ্রিয়ানো এক বোঝা ফাইল নিয়ে অরির পেছনে আসছে। অরি ফ্রেশ হতে গেলো। মারিয়ানা জলখাবার তোড়জোড় করছে।
    – আচ্ছা অদ্রিয়ানো, মারিয়ানা কি এখানে অনিচ্ছাতে কাজে এসেছে?
    – কেন ম্যাডাম কি বলেছে ও?
    আমি সকালের ওদের কথোপকথন আর একটু আগের ঘটনাটা বললাম। ও হা হা করে হেসে মারিয়ানাকে শুনিয়ে জোরে জোরে বললো,
    – ও একটা ভিতুর ডিম ম্যাডাম, অন্ধকার হলেই ওর চারপাশে ও ভুত দেখতে পায়। ব্যালকনিতে অন্ধকার দেখেছে ব্যাস আর দেখে কে। ওর এমন অনেক ভুত দেখার গল্প সব্বাই জানে। এরজন্য দায়ী ওর গ্রানি সারাক্ষণ বুড়ি খালি ভুত পিশাচ আর উইচদের গল্প শোনাত তাই ও ওই সব শিখেছে। বুঝলেন ম্যাডাম লেখা পড়ায় ফাঁকি দিলে যা হয় আর কি (মিচকে হেসে বললো)।
    মারিআনা কটমট করে ওর দিকে তাকাচ্ছে।
    আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু ভীষণ মারাত্মক কিছু একটা যে আমাদের ভবিতব্যে লুকিয়ে আছে তা তখনও জানতাম না ।

You cannot copy content of this page