-
কবিতা- সাকিন
সাকিন
-সুমিতা দাশগুপ্তমুখটা যেন চেনা, চেনা
সাকিন কোথায় কোন সুদূর?এই তো কাছে, বুকের মাঝে
মর্মতলের হৃদয়পুর।
রাস্তা গেছে মন বরাবর
হৃৎসায়রের কূলে,
প্রাণচঞ্চল তরঙ্গদল নাচছে, দুলে দুলে।
যেথা ইচ্ছে কুঁড়ির ফুল ফুটেছে,
মন হতে চায় উধাও,
ঠিক সেখানে অপেক্ষমান
মন পবনের নাও।
মুচকি হাসির মাশুল দিয়ে
বসলে তাহার পর,
হু হু করে চলবে ভেসে
বাতাস করে ভর,
এক নিমেষেই পৌঁছে দেবে
ঐ ওপারের দেশে
কল্পলোকের স্বপ্নমাখা
পথটি যেথায় মেশে —
বন্ধমনের আগল খোলো,বাতাস লাগুক প্রাণে,
পথের হদিশ পৌঁছে যাবে
ভোরের পাখির গানে,বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না
তাই পাঠানু ডাক
জরুরী সব কাজের বোঝা
ধুলোয় পড়ে থাক।
পথের হদিশ সরল অতি
তাও যদি না বোঝো
চক্ষু মুদে মনের মাঝে
একটু কেবল খোঁজো,
ভিতর পানে চক্ষু মেলে
ঐ যে দেখো মোর আঙিনা,
ভালোবাসার বৃক্ষতলেএইতো আমার ঠিক ঠিকানা।
-
অণুগল্প- অন্ধ তামস
অন্ধ তামস
-সুমিতা দাশগুপ্তউচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থানাধিকারী হওয়ার সুবাদে অভিনন্দনের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছিলো সুনন্দ। প্রেস্, মিডিয়া, ফুলের তোড়া, মিষ্টির বাক্সের স্তূপ জমছে। আত্মীয়স্বজন, আবাসনের পরিচিত অপরিচিত অনেক হাসি মুখ। কেউ বা চায় কাছে এসে হাত মেলাতে, আবার কেউ বা চায় পাশে দাঁড়িয়ে মিডিয়ার সামনে আত্মীয়তা জাহির করতে। এই সব কিছুর মধ্যে, অসম্ভব জেনেও সুনন্দর চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছিল তার অতি প্রিয় স্নেহময়ী এক বৃদ্ধাকে, এই আবাসনেরই পাঁচতলার বাসিন্দা, লোকে যাঁকে কোনও অজানা কারণে, এই একা থাকা বৃদ্ধাটিকে স্রেফ কুসংস্কারের বশে, অপয়া বলে দাগিয়ে রেখেছে।
তাঁকে এড়িয়ে চলতে সবাই সদা তৎপর। কোনও আনন্দ আয়োজনে তাঁর ডাক পড়ে না, কোনও উৎসবে নেই তাঁর আমন্ত্রণ।শুভকাজে বের হবার সময় সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে পাছে লিফটে তাঁর মুখোমুখি হতে হয়!
সুনন্দকেও তার মা সাবধান করে দিয়েছিলেন, স্পষ্ট নির্দেশ ছিলো কোনও রকম আলাপচারিতার বিরুদ্ধে, কিন্তু কে না জানে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানব চরিত্রের অমোঘ আকর্ষণের কথা! সুনন্দই বা তার ব্যতিক্রম হয় কী করে!
সুনন্দর আজ আর মনেও পড়ে না, সেই কবে থেকে ওঁর সঙ্গে তার একটা অজানা আকর্ষণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে, শিশু বয়সের কৌতূহলে আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি, মাঝে মধ্যে হাসি বিনিময়, তারপর সাহস করে তাঁর কাছে নিয়মিত আনাগোনা লুকিয়ে টুকটাক বাদাম তক্তি, টফি, চকোলেটের উপহার। এইসবই কাছাকাছি এনে তাদের দুজনের মধ্যে অসমবয়সী বন্ধুত্বের একখানা সেতু গড়ে দিয়েছিল।
সুনন্দ’র জন্য, প্রতিদিন উদগ্রীব অপেক্ষায় থাকা স্বজনহীন বৃদ্ধাটির একক জীবনে সুনন্দই হলো একমাত্র প্রভাতকিরণ, আহ্লাদের আলো। এই লুকোচুরি খেলার গল্প, এখনও পর্যন্ত, কেউ জানে না। তবে আজ সুনন্দ বড়ো হয়েছে। আজই সেই উপযুক্ত সময়, জনসমক্ষে সবকিছু জানানোর এবং একটা জোরালো প্রতিবাদের! হ্যাঁ আজই মিডিয়ার সামনে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময়, কথা প্রসঙ্গে সুনন্দ অকম্পিত দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করবে, পয়া অপয়া বলে কিছু হয় না, প্রতিবারের মতো এবারেও ওঁকে প্রণাম করেই পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল সুনন্দ এবং এজন্য তার পরীক্ষার ফলাফলের কোনও রকম হেরফের আগেও হয়নি এবারেও নয়। আসলে হবার কথাও তো নয়, যে কোনও যুক্তিবাদী মনই সেকথা স্বীকার করবে। নইলে শিক্ষার কী উদ্দেশ্য? কেবলই কি গোটাকতক সার্টিফিকেটের কাগজ সংগ্রহ করা!
এখন সময় এসেছে নতুন প্রজন্মের কাছে, এই অন্ধ তমিস্রা কাটিয়ে, নতুন আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠার। পারবে না সুনন্দ অন্তত একটি মনকেও যুক্তির আলোয় আলোকিত করতে? -
কবিতা- জীবনের সালতামামি
জীবনের সালতামামি
-সুমিতা দাশগুপ্তশৈশব মানে, অবাক চাউনি মেলে টলোমলো পায়ে বহির্বিশ্বে পা বাড়ানোর আকুলতা।
কৈশোর মানে, খোলা প্রান্তরে দে-ছুট, আর ঘনায়মান সন্ধ্যেয়, শাঁখের আওয়াজ শুনে তুলসী মঞ্চের প্রদীপের আলোয় পথ চিনে ঘরে ফেরা।
যৌবন মানে, ঝিরি ঝিরি বাতাসে মুক্তডানায় উড়াল দেবার অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়ানো প্রতিস্পর্ধী চেতনায় উজ্জীবিত বিবেকের পরিবর্তনকামী বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ।
বার্ধক্য মানে, জীবনের বিক্ষুব্ধ উত্তাল তরঙ্গের অভিঘাতে ক্লান্ত চেতনায় অনবরত স্বপ্নে দেখা ছেলেবেলার ঘরটিতে ফিরে যাবার মনকেমন করা সুরের গুঞ্জরণ।
-
গল্প- রুপোর সিন্দুক
রুপোর সিন্দুক
-সুমিতা দাশগুপ্তদীর্ঘদিন পর, বাচ্চাদের স্কুলগুলো আবার ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে। সুপর্ণার নাতনি, ক্লাস থ্রি-র পড়ুয়া রাই আজ অনেক দিন পর আবার স্কুলে গেল। ধোপদুরস্ত ইউনিফর্ম গায়ে, পিঠে দামী স্কুলব্যাগ ঝুলিয়ে, দোতলায় দাঁড়ানো সুপর্ণার দিকে চেয়ে একগাল হেসে হাত নেড়ে পুলকারে গিয়ে উঠলো। গাড়ির ভিতর থেকে আরও কয়েকটি শিশুর কলকাকলি ভেসে আসছিলো, কী খুশি যে দেখাচ্ছিল ওদের! স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরে যেন ফুরফুরে এক একটা প্রজাপতি ওরা।
গাড়িটা চলে যাবার পরও আকাশে বাতাসে একটা আনন্দের রেশ বয়ে যাচ্ছিলো। তাঁর নিজের মনটাও বেশ ভালো লাগছে আজ -যেন মুক্তির হাওয়া তাঁকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে।
আরও খানিকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে সকালটা উপভোগ করছিলেন তিনি।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদটা চড়চড়িয়ে উঠতে থাকে। এবারে তাই ধীরে ধীরে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন সুপর্ণা।
ঘরের ছড়ানো ছিটানো কিছু অগোছালো জিনিসপত্র, জায়গায় রেখে জানলার পাশে রকিং চেয়ারটায় গিয়ে বসলেন তিনি। সংসারের আসল দায়িত্বভার বৌমাই সামলায়। সুপর্ণাও অবশ্য অনেক ধরনের টুকিটাকি কাজে কর্মে ব্যস্ত রাখেন নিজেকে।পুরো বাড়িটার আসবাবপত্রের ধুলো ঝাড়া, সোফার উপরের কুশনগুলো গুছিয়ে রাখা, ফুলদানিতে বাগানের ফুল পাতা তুলে এনে সাজানো ইত্যাদি ইত্যাদি।আজ অনেক দিন পর নাতনির সঙ্গে কিছুটা দৌড়াদৌড়ি করে , সামান্য ক্লান্ত লাগছে। তাই বারান্দায় রাখা আরাম কেদারায় গিয়ে বসলেন,একটু বিশ্রাম নিয়েই আবার কাজে নামবেন না হয়! অন্যমনস্ক হয়ে, পাশের টেবিলে রাখা মোবাইলটা হাতে নিলেন , অন্ করতেই ফেসবুকের মেসেজ দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। সম্প্রতি ,বৌমার আগ্রহে ফেসবুকের জগতে প্রবেশ করার পর থেকে,দীর্ঘকাল আগে হারিয়ে যাওয়া কিছু পরিচিত মানুষকে খুঁজে পেয়েছেন। বেশ লাগে তাদের সঙ্গে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে।
সেই রকমই একজন হলো বিনি। বিনি তার স্কুলের সহপাঠিনী ছিল। তারপর জীবনের স্রোতে কে যে কোথায় ভেসে গিয়েছিল! বিনি আপাতত সপরিবারে পুরী বেড়াতে গিয়েছে , আর ক্রমাগত প্রচুর ছবি পোস্ট করছে। ছবিগুলো দেখতে দেখতে মুখে একটা মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠলো সুপর্ণার। চিরকালের উচ্ছ্বল স্বভাবের মেয়ে বিনি আজও ঠিক একই রকম রয়ে গেল।
বিনির কথা ভাবতে গিয়ে, কখন যেন অতীতের পথে স্মৃতির সরণী বেয়ে হাঁটা শুরু করেছেন সুপর্ণা ! বিনি তাঁর ছেলেবেলার বান্ধবী, পাশাপাশি বাড়িতে থাকার সুবাদে একই সঙ্গে বড় হয়ে ওঠা। তাদের দুই পরিবারেও বেশ হৃদ্যতা ছিল। একই সঙ্গে স্কুলে ভর্তি হবার পর কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে স্কুল যেতেন তাঁরা । না তাঁর নাতনির মতো এতো সফিস্টিকেটেড ব্যাপার স্যাপার ছিল না তখন, খুব সাধারণ মোটা কাপড়ের কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ ,যা তখনকার দিনে বাজারে মিলতো । তাই দিয়েই দিব্যি চলে যেত তাঁদের।
এরপর একবার একদিন বেশ একটা মজার ঘটনা ঘটলো। সেবার নতুন বছরে অন্য একটা শহর থেকে একটি নতুন মেয়ে এসে ভর্তি হলো।
একে বড়লোকের মেয়ে , তায় চালবাজ , প্রথম থেকেই মেয়েটিকে একটু এড়িয়ে থাকতেন তাঁরা, বিশেষ ভাব ভালবাসা হয়নি ।তাতে কী ! মেয়েটিকে ঘিরে কৌতূহলের কমতি ছিল না তাঁদের । অনেক কারণের মধ্যে একটা, ছিল মেয়েটি বই নিয়ে আসতো একটা চকচকে রুপোলি বাক্স করে,হাতে ঝুলিয়ে, তাঁদের মতো কাঁধে ঝুলিয়ে নয় । এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য , তাদের কল্পনারও বাইরে, বই যে ব্যাগের বদলে বাক্স করে আনা যায় ,সেই তাঁদের প্রথম দেখা। বেঞ্চের উপর বাক্সটা রেখে ঢাকনাটা সামান্য ফাঁক করে বই খাতা বের করেই তড়িঘড়ি বন্ধ করে দিতো ,যেন ওটি মহামূল্যবান ধনসম্পদে ঠাসা ,কেউ দেখে ফেললেই সর্বনাশ, তাছাড়াও , হাওয়ায় গল্প ভাসতে লাগলো ওটি নাকি, তার ঠাকুমার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রুপোর বাক্স , যক্ষের পাহারায় থাকে, ওতে অন্য লোকের হাত পড়লেই ,না হাত পড়লে যে কী হবে সেকথা ,আর মুখ ফুটে বলে নি সে। তাঁদের ঐটুকু বয়সের নিস্তরঙ্গ জীবনে ,সে কী সাঙ্ঘাতিক রোমাঞ্চকর ব্যাপার!
আড়ে আড়ে সবসময , বাক্সটার দিকে চেয়ে থাকতেন তাঁরা।
কয়েকদিনের মধ্যেই অবশ্য তার ধাপ্পাবাজি ধরা পড়ে গিয়েছিল, তাদের মফস্বল শহরের দোকানগুলোতে এ্যালমুনিয়ামের বাক্সের চালান আসতে দেরী হয় নি।
স্বাভাবিকভাবেই লোকজন ঐ আকর্ষণীয় বাক্স কিনতে এবং নানা কাজে ব্যবহার করতে শুরু করলো।
তাঁরা নিজেরাও অনতিবিলম্বে অভিভাবকদের, বায়নায় জেরবার করে ঐ বাক্স আদায় করেই ছেড়েছিলেন। সবচেয়ে মজার কথা , এরপর ঐ নবাগতা মেয়েটির সঙ্গে ভাব হতেও দেরী হয় নি। আসলে শিশু বয়সের ধর্মই তাই ! ঝগড়াঝাঁটি , মনকষাকষি এই সবকিছুই তো প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের ব্যাপার!
জ্যাঠামশাই, দোকান থেকে তাঁদের দুজনের বাক্সের উপরে চমৎকার ডিজাইন আঁকিয়ে, নাম লিখিয়ে এনেছিলেন। ছোট্ট ছোট্ট দুখানা তালাও জুটেছিল সেই বাক্সদুটির।
কী সুন্দর ছোট্ট লকেটের মতো দুলতো বাক্সের গায়ে!
এর ফলে তাঁদের নিজেদের অজান্তেই আরও একটা ব্যাপার ঘটে গিয়েছিল । ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে একটা নিজস্ব সম্পত্তির বোধও জাগ্রত হতে থাকলো , ব্যাগ, ব্যাপারটা এজমালি আর বাক্সটা একান্তই নিজের।
নিষিদ্ধ প্রেমের আভাসও প্রথম জানা হয়েছিল এই সূত্র ধরেই ।উঁচু ক্লাসের এক দিদির আধখোলা বাক্সের মধ্যে থেকে ভেসে আসা গোপন প্রেমপত্রের গায়ে মাখানো সেন্টের গন্ধে।
ধাপে ধাপে উঁচু ক্লাশে ওঠার পর্যায়ে সেই বাক্স আর বইয়ের বাক্স রইলো না ,সেটি রূপান্তরিত হয়ে গেল ব্যক্তিগত টুকরো স্মৃতির ঝাঁপিতে। পুরনো গ্রিটিংস কার্ড , স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার আগে ক্লাশের ছাত্রীদের সঙ্গে তোলা, হলদে হয়ে যাওয়া গ্রুপ ফটো , বন্ধুদের বিয়ের কার্ড, প্যাঁচ হারানো কানের দুল– আরও কতো কী!
বিয়ের পর বাক্সটি তো আর সঙ্গে আনা হয় নি, বাপের বাড়িতেই রয়ে গিয়েছিল, ক্রমে ভুলেই গিয়ছিলেন সেটির কথা। তারপর বহুবছর পরে,এই বছর তিনেক আগে, একদিন তাদের পুরনো বাড়ি সারাই করতে গিয়ে বিস্তর বাতিল জিনিসপত্রের মধ্যে থেকে উদ্ধার হওয়া বাক্সটা বড়দা এনে তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ।কী যে খুশি হয়েছিলেন সুপর্ণা –যেন পুরো ছেলেবেলাটা এসে ধরা দিয়েছিল , তাঁর হাতের মুঠোয়।
আজ তাঁর অনেক আলমারি , কাবার্ড,বাকসো ,ডেসকো — তবু তার মাঝে, এটি এক অমূল্যধন । এটিতে হাত বুলিয়ে তিনি যেন পূর্বাচলের পানে ফিরে তাকান, তাঁর এই অপরাহ্ণ বেলায় !
আচ্ছা বিনির কাছে ওর বাক্সটা আজও আছে? খোঁজ নেওয়া হয়নি তো!
হঠাৎ সম্বিত ফিরলো।
মনে হলো অনেক দিন খোলা হয়নি বাক্সটা। দুপুরের নিভৃত অবসরে আজ আরও একবার বাক্সটা নিয়ে বসলে বেশ হয় কিন্তু! -
গল্প- দোলাচল
দোলাচল
-সুমিতা দাশগুপ্তসকাল থেকে রক্ষিত বাড়িতে মহা হুলুস্থূল পড়ে গেছে। সকাল থেকে বীরেনবাবুর চুণীর আংটিটা গায়েব। আংটিটা আঙুলে একটু ঢিলে হওয়ায়, স্নানের আগে নিজের ঘরে পড়ার টেবিলের উপরে খুলে রেখে গিয়েছিলেন। স্নান সেরে ফিরে এসেই , আঙুলে গলাতে গিয়ে দেখেন সেটি গায়েব।আশ্চর্য! তাঁর ঘরে ঢুকে আংটিটা সরাবে কে! ঐ আংটির উপরে বীরেনবাবুর দূর্বলতার কথা বাড়ির সবাই জানে। তাঁর গুরুদেব গ্রহাচার্য তুরীয়ানন্দ শাস্ত্রী মহাশয়, বীরেন বাবুর কোষ্ঠিবিচার করে, তাঁর কুপিত গ্রহশান্তির জন্য ঐ চুণীর আংটিটি ধারণের পরামর্শ দিয়েছিলেন। বীরেনবাবু গুরুবাক্য অমান্য করেন নি। তড়িঘড়ি আংটিটি বানিয়ে এবং গুরুদেবকে দিয়ে শোধন করিয়ে নিয়ে ধারণ করে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।
ধারণ করার পর অচিরেই সুফলও ফলতে শুরু করে দিয়েছে, এই যেমন বাগানের আমগাছটায় এতোদিন ফল ধরে নি, এইবারই প্রথম তাতে মুকুল ধরলো, ছোট ছেলেও একটা ভালো চাকরির অফার পেয়েছে। আগের রান্নার লোকটি ঝগড়া করে কাজ ছেড়ে দেবার পর নতুন যাকে পাওয়া গেছে তার রান্না অমৃততুল্য, বড় নাতিটি ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রথম সেমিস্টারে দারুণ রেজাল্ট করেছে, এইসব তো আর ফেলে দেবার জিনিস নয়, আর আজ এই যে তিনি আমন্ত্রণমূলক বক্তৃতায় অংশগ্রহণ করতে চলেছেন, তাও কী কম সম্মানের!
বীরেনবাবুর, আংটির উপরে নির্ভরতা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যে ওটি ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতেও সাহস হচ্ছিল না তাঁর। কে জানে কোথায় কোন বিপদ ওঁত পেতে থাকে!
অজানা আশঙ্কা ক্রমে ক্রোধে পরিণত হচ্ছিলো। মুখে খাবার রুচছিলো না। পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপের দিকে গড়াচ্ছে, এমন সময়ে বড় নাতি এসে আংটিটি এগিয়ে দিল।
উচ্ছ্বসিত বীরেনবাবু দ্রুত আংটিটি আঙুলে গলিয়ে নিয়ে, নাতিকে জড়িয়ে ধরলেন।“কোথায় পেলি? আজ রাতে তোকে তো একটা ট্রিট দিতেই হচ্ছে।”
“আমিই সরিয়ে রেখেছিলাম।” নির্বিকার ভাবে বললো নাতি।
“কী-ই- ই। কিন্তু কেন?” মুখ দিয়ে কথা সরছিল না বীরেনবাবুর।
“পরীক্ষা করে দেখতে চাইছিলাম, কতোখানি বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে এই বিজ্ঞানমঞ্চে বক্তৃতা দিতে যাচ্ছ তুমি।”
“কী বলতে চাও, আমি একজন বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়ে বিজ্ঞানমনস্ক নই!”
“না নও, তাই তো দেখলাম। আসলে রাতজেগে পড়াশোনা করে যে বক্তৃতাখানা তুমি তৈরী করেছো সবটাই তোমার মুখের কথা, মুখস্থ বিদ্যা। নইলে ঐ একখানা পাথরের আংটি তোমাকে এই রকম নাকানিচোবানি কি করে খাওয়ায়!”
“তোমার এতো বড়ো সাহস, তুমি আমাকে তো বটেই, সেইসঙ্গে আমার গুরুদেবকেও অপমান করলে!”
“উঁহু, তোমার গুরুদেবকে তো আমি অপমান করি নি, তিনি নিজে যা বিশ্বাস করেন, তোমাকে সেই পথই দেখিয়েছেন, কিন্তু তুমি তো গুরুদেবের নির্দেশে আংটি ধারণও করেছো, অথচ বক্তৃতায় আজ যেটা বলতে চলেছো, সেটা তুমি নিজেই বিশ্বাস করো না। আমি শুধু তোমার এই দ্বিচারিতাটুকুই তোমায় ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।”
“সরে যা সামনে থেকে” বেজায় রেগে, নাতিকে সামনে থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে, গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেলেন বিজ্ঞানমঞ্চ আয়োজিত সভায়, “সমাজে কুসংস্কারের কুফল” শীর্ষক বক্তৃতামালার আজকের প্রধানবক্তা বীরেনবাবু।
গাড়িতে যেতে যেতে, মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হলো, নাতির কথার সারবত্তাটি এতক্ষণে একটু একটু করে মাথায় ঢুকছে। আসলে নিজেও যে বোঝেন না তা নয়, তবু কী করবেন, এই যুক্তি আর যুক্তিহীনতার টানাপোড়েনের হাত থেকে রেহাই পাবার পন্থা যে তাঁর জানা নেই। ঠিক ঐ রবিঠাকুরের কবিতার লাইনগুলো মতো — “নিজের হাতে নিজে বাঁধা,
ঘরে আধা, বাইরে আধা…”
-
অণুগল্প- স্বাদ
স্বাদ
-সুমিতা দাশগুপ্ত-তুমি কি এবারেও যাচ্ছো?
-হুম্ কাল ভোরে বেরোচ্ছি, তুমি আসবে নাকি ?
-না বাবা, ওই গোটাকতক পিঠে, পায়েসের জন্যে অফিস কামাই করে, তোমার ওই ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরের দেশে ছোটা আমার পোষায় না। আর তোমাকেও বাপু বলিহারি যাই! পিঠে খাবে তো এখানে বসেই খাও না, আজকাল তো এই শহরেই সব মেলে। পিঠের দোকান পিঠে পুলি উৎসব, এই শহরেই তো কতো আয়োজন। সেই সব তোমার নজরেও পড়ে না, না-কি!
-তা ঠিক, সবই নজরেও আসে, তবে কিনা ওখানকার পিঠের স্বাদই যে আলাদা।
-পিঠে তো পিঠেই হয়, তার আবার এখান- ওখান কি?
-উঁহু, উপকরণ এক হলেই কি স্বাদ এক হয়! ওখানকার নারকেলের পাকে মেশানো হয় ভালোবাসার গন্ধ, দুধের হাতায় থাকে মোলায়েম আদর। এখানে কোন দোকানে মিলবে সেসব?
-তোমার সঙ্গে কথা বলাই ঝকমারি, সবেতেই কাব্য।
-তেমন করে দেখতে গেলে জীবনটাই তো এক মহাকাব্য। আরে বাবা কাব্য কি আর আকাশ থেকে ঝরে পড়ে! ওটা যে মানুষেরই শিকড়ের উপাখ্যান।
পরদিন ভোরে সৌম্য তৈরি হয়ে বের হতে যাবে- পৌষালীও হাজির।
-একী তুমি! তৈরী হয়ে এসেছো দেখছি, কোথায় চললে?
-চলো তোমার সঙ্গে তোমার দেশে গিয়ে দেখেই আসি, কেমন করে পিঠে পায়েস তৈরী হয় সেখানে। পুলিপিঠের খামে কেমন করে ভালোবাসা ভরে দেন তোমার মা -ঠাম্মারা। -
গল্প- একটি স্বপ্নাদ্য উপাখ্যান
একটি স্বপ্নাদ্য উপাখ্যান
-সুমিতা দাশগুপ্তশীতকালের মধ্যাহ্ণ। নরম মিঠে রৌদ্রে, অযোধ্যায় রাজপ্রাসাদের ছাদে উপবিষ্ট মহাদেবী সীতা, আপন পৃষ্ঠদেশে ঘন কুন্তলরাশি বিছাইয়া, পশম ও লম্বা শলাকা দ্বারা বুননকার্যে রত। তাঁহার চম্পককলিসদৃশ অঙ্গুলি ক’টি ছন্দে ছন্দে ওঠানামা করিতেছে। অদূরে পুষ্পকানন পাখির কলকাকলিতে মুখর।
মহাকাব্য রামায়ণ যেখানে সমাপ্ত হইয়াছিল, অর্থাৎ সীতার পাতালপ্রবেশ, তথা হইতে ঘটনাক্রম অনেক দূর আগাইয়া আসিয়াছে।
সুড়ঙ্গ খনন করাইয়া, রামচন্দ্র স্বয়ং ধরণীগর্ভস্থ শ্বশুরবাড়িতে গিয়া, অনুনয় বিনয় ও ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া সীতা দেবীকে সসম্মানে ফিরাইয়া আনিয়াছেন।
এখন আবার রামরাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।
কালের নিয়মে লব ও কুশ উচ্চশিক্ষা লাভ করিয়া প্রতিষ্ঠিত হইলে, যথাকালে উপযুক্ত পাত্রীদ্বয়ের সহিত পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন ।এক্ষনে দুই ভ্রাতার আবার দুই জোড়া পুত্র লাভ হইয়াছে। পরমাহ্লাদিত সীতা দেবী, তাঁহার চারটি পৌত্রের জন্য সোয়েটার বুনিতেছেন।
তাঁহার চক্ষু হইতে স্নেহধারা ঝরিয়া পড়িতেছে।
এমন সময়ে দাসী আসিয়া খবর দিল পাশের রাজ্য হইতে তাঁহার ভগিনীতুল্য সখী দ্রৌপদী আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। সীতাদেবী তাঁহাকে সত্বর তথায় আনয়ন করিতে আদেশ দিতে যাইবেন, এমন সময়ে দ্রৌপদী নিজেই তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন, অতশত প্রোটোকলের ধার তিনি ধারেন না।
তাঁহাকে দেখিয়া সীতাদেবী শশব্যস্তে মখমলের আসনখানা আগাইয়া দিয়া বলিলেন ,
“আইস ভগিনী, এতক্ষণ ধরিয়া তোমারই প্রতীক্ষায় আছি, এত বিলম্বের কারণ?”“আর বলো কেন, এই ছাতার মাথার সংসারের জোয়াল টানতে টানতে ঘেন্না ধরে গেল।”
দ্রৌপদী সীতাদেবীর ন্যায় দেবভাষা ব্যবহারের ধার ধারেন না।
“ভগিনী তোমার কী হইয়াছে! ইতিপূর্বে তোমাকে এতো রুষ্ট হইতে তো দেখি নাই! এতো দাসদাসীপূর্ণ সংসার তোমার, উপরন্তু তোমার পঞ্চপতি তোমার তুষ্টি সাধনার্থে সদা তৎপর, তবুও এত খেদ কিসের!”
“থামো তো!! সবক’টাই ঢেঁড়স।”
“ছিঃ, প্রাকৃত ভাষায় এইরূপ অশিষ্ট বাক্য প্রয়োগ কদাপি সমীচীন নহে।”
“তা ঢেঁড়শদের, ঢেঁড়শ বলবো না তো কী?”
“আহা নিদেনপক্ষে লেডিশ ফিঙ্গারও তো কহিতে পারো”।
“তা সে তো একই হলো ,নাকি! হুঃ, যার নাম চালভাজা, তার নাম মুড়ি।”
“আচ্ছা বেশ, তোমার এতো রোষের কারণ কী, যদি একটু খুলিয়া বলিতে!”
“কী আর বলি! রাঁধতে রাঁধতে হাড়মাস কালি হয়ে গেল। রাজপ্রাসাদের পাচকগুলো বসে বসে মাইনে নেয়, আর তাস পাশা খেলে।
আমার পঞ্চপতির আবার অন্য লোকের রান্না মুখে রোচে না।
কী-ই না, দ্রোপদীর মতো রান্না নাকি এই ভূ ভারতে কেউ পারে না।”“আচ্ছা মধ্যম পান্ডবও তো নাকি দক্ষ পাচক! অজ্ঞাতবাসকালে তিনি তো বিরাট রাজার পাচক হইয়াই আত্মগোপন করিয়া ছিলেন।”
“ঘোড়ার ডিম! বাইরে ঐ কথাই চালু ছিল বটে, আড়ালে এই আমিই তো কলকাঠি মানে হাতাখুন্তি নাড়তাম।”
“কী বলিতেছ! জগৎ সংসারে অপর কেহই তো এই সংবাদ অবগত নহে!”
“তাহলে আর বলছি কী। তুমি কিন্তু দিব্য আছো। হাতা খুন্তি দূরে থাক, সংসারে কুটোটি ভেঙে দু- টুকরোও করতে হয় না।”
“ইহা অবশ্য সত্য কথা। বনবাসকালে যতোই বল্কল পরিধান করি না কেন, পাকশালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব এবং রন্ধনের ভার দেবর লক্ষ্মণের উপরেই ন্যস্ত ছিল। আহা কী চমৎকার সব দিন কাটাইতাম।
বন হইতে বনান্তরে ভ্রমণকালে অজস্র ফল ও ফুল সংগ্রহ করিয়া লইতাম। প্রতিদিন সকালে লোধ্র ফুলের শুভ্র রেণু দ্বারা অঙ্গরাগ শেষে, ফলমূল সহকারে প্রাতঃরাশ সম্পন্ন হইতো। ইহার পর পদচারণায় বাহির হইয়া আমরা গিরি, নির্ঝরিণী পুষ্পিতকানন শোভা দর্শন করিতাম, দেবর লক্ষ্মণ ইত্যবসরে আহার্য সংগ্রহ করিয়া লইতো।”“সত্যিই!”
“বিশ্বাস না হয় কৃত্তিবাসী রামায়ণের পৃষ্ঠা উল্টাইয়া দেখ”
“ওঃ, তাই এখনও তোমার স্কিনটা এতো গ্লো করে! তোমার মতো আমিও তো কতবছর বনে বনে ঘুরে বেড়ালাম, কিন্তু কোথায় ফুলরেণু কোথায় প্রসাধনী! আমার যেমন কপাল! আর্যপুত্ররা কেবল শিকার করে গাদা গাদা আহার্য জোগাড় করতো, আর হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের ফন্দিফিকির আঁটতো, নাও রেঁধে মরো!”
“শোনো ভগিনী, তোমাকে একখানা মূল্যবান উপদেশ দিই। সর্বদা শাদির প্রথম রজনীতেই মার্জার বধ করিতে হয়, কোথায় বলিবে, তুমি রাজার আদরের কন্যা,গৃহকর্মে অপটু, তাহা না করিয়া, তুমি স্বয়ং জনসমক্ষে স্বীয় রন্ধনপটুত্বের সংবাদ পরিবেশন করিয়া ফেলিলে। ইহা তাহারই পরিণাম। তবে ভগিনী ইহাও বলি, অযথা পতিদিগকে দোষারোপ উচিত কার্য হয় না। তাঁহাদের উপরে এই বিশাল রাজ্য পরিচালনার গুরুদায়িত্ব, উহাদের সময় কোথায়!”
“ঘোড়ার ডিম। তুমি ঐ আনন্দেই থাকো। দেশে এখন গণতন্ত্রের হাওয়া। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা রাজ্য শাসিত হয়।”
“তাহা হইলে ইঁহারা সারাটা দিন করেন কি?”
“ওঃ তাতে আর অসুবিধা কোথায়! বড়জন সারাদিন মোবাইলে জুয়ার বাজি ধরেন,
মধ্যমপান্ডব ছিপ ফেলে মাছ ধরার চেষ্টা করেন, আজ অবধি একখানা চুনোপুঁটিও ধরা দেয় নি।
তৃতীয়জনের অস্ত্রগুলো এখন ভোঁতা, তাই বাচ্চাদের খেলনা পিস্তল নিয়ে সারাদিন মুখেই রাট, ট্যাট, ট্যাট শব্দ করে, কুকুর বিড়ালকে ভয় দেখায়, আর ছোট দুজন সারাদিন লুডো খেলে।”“কী সর্বনাশ! যুধিষ্ঠির আবার জুয়া খেলিতেছেন?”
“আরে না না, চিন্তার কিছু নাই। রাজকোষ থেকে খুব সামান্যই হাতখরচ মেলে, তা দিয়ে বেশি অঙ্কের বাজি ধরা চলে না।”
“ওহ্ এইরূপ অলস পুরুষদিগকে লইয়া তো মহা মুস্কিল! চা সরবরাহ করিতে করিতে দিন যায়। দাঁড়াও সত্বর ইহাদের ব্যবস্থা করিতেছি।”
অতঃপর সীতা দেবী হনুমানের সহিত পরামর্শ করিয়া পান্ডবদিগকে টেলিসিরিয়ালে অভিনয় করিতে নামাইয়া দিলেন।
সমগ্র ভারতবাসী তাহা দর্শন করিয়া মহাভারত পাঠের পূণ্যলাভ করিতে লাগিল।
—– বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ—–~স্বপ্নাদ্য কাহিনী কথা
নহে তুল্যমান,
অকিঞ্চিৎ লেখক রচে,
পড়ে ধৈর্যবান~। -
প্রতিবেদন- জীবনপুরের পথিক
জীবনপুরের পথিক
-সুমিতা দাশগুপ্তজীবনপুরের পথিক বিশেষণটি যদি কারো জন্য সুপ্রযুক্ত হয়ে থেকে থাকে তবে তা হল সাতাশি বছরের তরুণ মানুষটির জন্যে, এই বয়সেও জীবন সম্পর্কে যাঁর আগ্রহ, কৌতূহল, সৃষ্টিশীলতা অবাক বিস্ময়ে অনুভব করে সমগ্র জগৎ।
জীবন তাঁকে দিয়েছে অনেক কিন্তু কেড়েও নিয়েছে প্রচুর।জীবনের শুরুটা ছিল আরও পাঁচটি শিশুর মতোই। উনিশশো চৌত্রিশ সালের পরাধীন ভারতে তাঁর জন্ম। বৃটিশ বংশোদ্ভূত পিতা, মাতার সন্তান, শিশুটির ছেলেবেলা অতিবাহিত হয়েছে জামনগর এবং সিমলায়। আর পাঁচটা শিশুর মতোই দিব্যি হেসে খেলে বাবা মায়ের ছত্রছায়ায় আনন্দে কাটছিলো ছেলেবেলার দিন, কিন্তু ভাগ্য যে তার জন্য লিখে রেখেছিল এক অন্য গল্প। টেরও পায়নি কখন যেন বাবা মায়ের সম্পর্কে ধরেছে চিড়। ক্রমশ বাড়তে থাকলো ফাটল। অবশেষে ঘটে গেল বিচ্ছেদ, উপরন্তু মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিল শিশুটির শৈশব।
অতঃপর বাবার হাত ধরে জীবনপথে যাত্রা শুরু। বাবা-ই তার একমাত্র বন্ধু পথপ্রদর্শক।
বাবার সঙ্গেই কাটে দিন। পড়াশোনার ফাঁকে বাবার হাত ধরেই প্রকৃতির পাঠ নেওয়া শুরু। জঙ্গলের পশুপাখি বৃক্ষলতা সবই হয়ে ওঠে পরমাত্মীয়। এরই মাঝে ধীরে ধীরে, গড়ে উঠছে অবসর সময়ে গল্পের বই পড়ার এক অদম্য নেশা, এ-ও বাবার কাছে থেকেই পাওয়া উত্তরাধিকার।
কিন্তু জীবন তো আর সবসময় একই খাতে বয় না ।
বাবার বদলির চাকরি। এবারে তাদের প্রকৃতির কোল ছেড়ে চলে যেতে হলো দিল্লীতে।
সপ্তাহের অন্যান্য দিন বাবার অফিস, তার স্কুল। ছুটির দিনে বেড়ানো, থিয়েটার দেখতে যাওয়া, গান শোনা। অজস্র রেকর্ড কিনে আনেন বাবা। তাই নিয়ে দিব্যি কাটে দিন। পরিকল্পনা হয়, ভবিষ্যতে বিলেতে পাড়ি দেবার।বাবার বদলির চাকরি। হঠাৎ কলকাতায় বদলি হতে হলো। আপাতত সিমলায় বিশপ কটন স্কুলে বোর্ডিং স্কুলেই ভর্তি করে দিলেন বাবা। প্রতি সপ্তাহে বাবার চিঠি আসে। পরম সম্পদের মতো সেগুলো আঁকড়ে ধরে রাখে বালক। এতেই মেলে বাবার সাহচর্য।
কিন্তু আবারও ঘটলো ভাগ্যবিপর্যয়। আচমকাই তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন বাবা। স্কুল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় হারিয়ে গেল তার জীবনের একমাত্র মহার্ঘ্য সম্পদ, বাবার লেখা চিঠির তাড়া। পরিপূর্ণ হয়ে গেল নিঃস্বতার মাত্রা।
এবার তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গিয়ে পড়লো কখনও ঠাকুমা কখনও বা তার মা আর সৎ বাবার উপর। না, তাঁরা এড়িয়ে যান নি, তার খাওয়া পরা, পড়াশুনার সব দায়িত্ব নিয়েছেন কিন্তু, মনের দায় নেয় কে? নিঃসঙ্গ শিশুটির সঙ্গী হলো প্রকৃতি আর কিছু গল্পের বই। ঈশ্বর বুঝি পারিবারিক গন্ডীর আওতা ছাড়িয়ে, তাকে দিয়ে দিলেন বিশ্ব নিখিলের অধিকার।
নিঃসঙ্গ বালক একা একা পথ পথ হাঁটে বনজ্যোৎস্নায় সবুজ অন্ধকারে। চেনা হয়, পশু পাখি, জানা হয় মানুষকে। অচিরেই বন্ধু জুটে যায়। ভবঘুরে কিশোর, ফলওয়ালা, ভিক্ষুক, জীবনযুদ্ধের সৈনিক একা ফেরিওয়ালা। ক্রমাগত সমৃদ্ধ হতে থাকে অভিজ্ঞতার ঝুলি। বই পড়ার নেশা তো ছিলই। এই দুইয়ে মিলে কিশোর মনে জন্ম নেয় লেখালেখির নেশা। পড়াশুনার ফাঁকে শুরু হলো লেখালেখি। মাত্র ষোল বছর বয়সে লেখা হয়ে গেল, সাড়া জাগানো গল্প- untouchable কিছুদিন পর আত্মজীবনীমুলক উপন্যাস- The room on the roof জিতে নিল বৃটিশ সরকারের মর্যাদাপূর্ণ J.L.R. পুরস্কার।
বিশপ কটন কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পরে নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার পরিকল্পনায় সে পাড়ি দিয়েছিল ইংল্যান্ডে। কিন্তু তার যে মনপ্রাণ জুড়ে রয়েছে ভারতবর্ষের সেই ছেলেবেলার শহর। মনে অনুক্ষণ ভাবনা কী করে ফেরা যায়!
ইংল্যান্ডে বসবাস কালে চাকরির পাশাপাশি লেখালেখিও চলছিলো সমানতালে । সঙ্গে জুটলো ফটো স্টুডিওর কাজ। এতেও কিছু কিছু রোজগার হতে থাকলো। সব জমা হতে থাকে দেশে ফেরার প্যাসেজ মানি জোগাড় করতে। সেই টাকা জমতেই দেশে ফেরার জাহাজ ধরলো সে। মানুষের সংসর্গ যে বড্ডো প্রিয় তার। ততদিনে স্থির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে, লেখালেখিই তার ভবিতব্য, এ ছাড়া অন্য কিছুই তার পেশা হতে পারে না। মনের আনন্দে চলতে থাকে তার লেখনী। লেখা হতে থাকলো অজস্র গল্প, উপন্যাস। পাঠক মহলে সাড়া ফেললো সেই সব। Penguin Publishers বরাত দিলো, তাদের জন্য ছোট গল্প লিখতে, ক্রমশঃ জুটতে লাগলো পুরস্কার। বিখ্যাত গল্প THE BLUE UMBRELLA নিয়ে তৈরী হওয়া সিনেমা, রাতারাতি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে গেল তাঁকে। সাহিত্য একাডেমী, পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ কী নেই তাঁর ঝুলিতে! সম্প্রতি সাহিত্য একাডেমী তাঁকে ফেলোশিপ দিতে পেরে নিজেরাই নিজেদের ধন্য মনে করেছেন।
বৃটিশ বংশোদ্ভূত, সাতাশি বছরের এই ভারতীয় লেখকটি আজও সমান দাপটে বিচরণ করছেন সাহিত্যের সাম্রাজ্যে।
অকৃতদার এই মানুষটির বর্তমান ঠিকানা মুসৌরির আইভি কটেজ। সেখানে তিনি বসবাস করছেন তাঁর ‘এক্সটেন্ডেড ‘ পরিবারের সঙ্গে।
এককালের স্নেহকাঙাল নিঃসঙ্গ বালকটি আজ দুনিয়ার লক্ষ লক্ষ মানুষের নয়নমণি, বিখ্যাত লেখক রাসকিন বন্ড। ভাবলে অবাক লাগে এভাবেও ফিরে আসা যায়! নাকি এভাবেই ফিরে আসতে হয়! -
গল্প- বহমান
বহমান
-সুমিতা দাশগুপ্ত
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙতেই মধুসূদন বাবুর মনে পড়ে গেল , কাল রাতে তাঁর ইংল্যান্ড প্রবাসী নাতি অভি ,বিদেশিনী স্ত্রী এমিলিকে নিয়ে হঠাৎই চলে এসেছে এখানে মানে তাঁদের ফুলডুংরিতে। কয়েকদিন আগে মাসখানেকের ছুটিতে তারা কলকাতায় এসেছে,সে খবর জানাই ছিল , এখানেও দাদু ঠাম্মার সঙ্গে যে দেখা করতে আসবে তা-তো স্বাভাবিক , কিন্তু দিনক্ষণ জানা ছিলো না। কাল রাতে , ঘরে যা ছিল তাই দিয়ে তড়িঘড়ি , ডিনারের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল ,আজ একটু ভালো করে বাজার করতে হবে। তাঁর আদরের নাতিটি খেতে যে খুব ভালোবাসে সে কথা তিনি বিলক্ষণ অবগত আছেন।ভাগ্যিস আজ হাটবার ,নইলে এই মফস্বল শহরে চট্ করে সবকিছু সবসময় মেলে না।
প্রভাদেবী আগেই উঠে পড়েছিলেন। স্নান ,পুজো সেরে চায়ের জল বসিয়ে দিয়েছেন তিনি।
চা খেতে খেতে বাজারের লিষ্টটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন মধুবাবু , বাড়ির পুরোনো লোক গোবিন্দ ,ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিয়ে রিক্সা ডাকতে যাচ্ছিলো।নাতবৌ এমিলি ,এসে দাঁড়িয়েছে। ঘুম ভাঙা মুখে একগাল হাসি।
“গুড মর্নিং দাদু -ঠাম্মা।” ভাঙা বাংলায় বললো সে।
বছর দুয়েক আগে ইংল্যান্ডেই অভির আর তার বিয়ের রেজিষ্ট্রেশনটা হয়েছিল, তার কিছুদিন পরে ওরা কলকাতায় এলে সামাজিক মতে বিয়ের ব্যবস্থা করা হয় । মধুসূদন বাবু আর প্রভাদেবী কলকাতায় গিয়ে সেই বিয়েতে যোগ দিয়েছিলেন। তখন এমিলি বাংলা বলা দূরে থাক, বুঝতেই পারতো না কিছু। এই দু বছরে সে যে শুধু বুঝতে পারে তাই নয় , কাজ চালানো গোছের বাংলা বলতেও শিখে নিয়েছে, এতে পরিবারের সবাই , বিশেষ করে প্রভাদেবী খুবই খুশি।
কার্তিক পেরিয়ে অঘ্রান পড়ে গেছে , বাতাসে শিরশিরানি হাওয়া , কলকাতার তুলনায় এদিকে ঠান্ডাটা একটু বেশিই । এমিলিকে চায়ের পট আর কাপটা এগিয়ে দিয়ে, ঘর থেকে একখানা পাতলা শাল এনে প্রভাদেবী জড়িয়ে দিলেন তার গায়ে। আরাম পেয়ে এমিলি জড়িয়ে ধরলো ঠাম্মাকে।
রিক্সা এসে গেছে , মধুসূদন বাবু মানিব্যাগটা পকেটে পুরে এগোতে যাবেন এমিলি একচুমুকে চা শেষ করে চট করে এগিয়ে এলো ।
“আমিও যাবো ” আহ্লাদী সুরে বললো এমিলি।
“আরে না না , এইসব বাজার তোমার ভালো লাগবে না মোটেই। এখানে তো শহরের মতো মার্কেট প্লেস নেই , মাটিতে বসে কেনাবেচা চলে ,একে বলে হাট।”
“জানি । গুগলে ছবি দেখেছি ,আর তাই তো নিজের চোখে দেখে নিতে চাই।” বলল এমিলি।
মধুসূদন বাবু গাড়ি বের করতে যাচ্ছিলেন , এমিলি বাধা দিলো—
“আরে আমি তো মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছি , তোমরা এগোও , আমি ধীরেসুস্থে সব দেখতে দেখতে যাবো।”
অভিটা এখনও ঘুমোচ্ছে। সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায় এমিলিকে একা ছেড়ে দিতে,মন ঠিক সায় দিচ্ছিল না মধুসূদন বাবুর তবে দূরত্ব খুব একটা বেশি নয় , বলে রাজি হয়ে গেলেন ।
এমিলি তৈরি হয়ে ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়লো। পেশায় সে একজন নামকরা ফোটো জার্নালিস্ট।এই দেশটাকে একটু কাছ থেকে জানার একটা প্রবল ইচ্ছে মনের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।
চারপাশটা দেখতে দেখতে পথ হাঁটছিলো এমিলি ।কুয়াশা কাটিয়ে রোদ উঠেছে , ঘাসে ঘাসে শিশিরের ফোঁটায় হীরের ঝলকানি , গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে লোকজন চলেছে হাটের পথে । খেজুর গাছে , রস সংগ্রহের জিরেন কাটের হাঁড়ি , তালগাছে বাবুই পাখির বাসা ঝুলছে , অবাক বিস্ময়ে এইসব দেখতে দেখতে পথ হাঁটছিলো এমিলি। মাঝে মাঝে পথচলতি মানুষজনকে জিজ্ঞেস করে কৌতুহল মিটিয়ে নিচ্ছিলো সে ।
সামনের সপ্তাহে যাত্রা আসছে , ঘোষকের ছড়ানো লাল হলুদ কাগজ সংগ্রহ করতে ছুটে আসছে বাচ্চারা ,ঠিক যেন একঝাঁক উড়ন্ত প্রজাপতি।
সে যতক্ষণে হাটে পৌঁছলো , দাদুর বাজার করা শুরু হয়ে গেছে।রোদ ঝলমলে বাজারটা যেন উজ্জ্বল রঙে আঁকা চমৎকার একখানা ছবি। কোথাও বাঁশে দড়ি বেঁধে রঙ বেরঙের নকশা কাটা গরম চাদর ঝুলছে , কোথাও আবার গোছা গোছা কাঁচের চুড়ি । ওপাশে বাঁশিওয়ালা সুর তুলেছে । বাচ্চাদের খেলাধুলো ছোটাছুটি ,এ যেন চমৎকার একখানা কার্নিভাল। এমিলি চটপট বেশ কয়েকখানা ছবি তুলে নিলো। তারপর মনের আনন্দে কাঁচের চুড়ি, মাটির তৈরি খেলনা বাটি, গোটাকতক বাঁশের বাঁশি সহ আরও কিছু পছন্দসই জিনিসপত্র সংগ্রহ করে নিয়ে এগিয়ে গেল দাদুর কাছে। ওজন করার দাড়িপাল্লার অভিনবত্ব অবাক করছিল তাকে।
বাড়ি ফিরে এসে দেখলো অভি তখনও বিছানা ছাড়ে নি। ঠাম্মার কোলে মাথা রেখে আদর খাচ্ছে। মুচকি হেসে এমিলি সরে যাচ্ছিলো , ঠাম্মা ডেকে বললেন–” দেখ তো পাগল ছেলের কান্ড , আমাকে আঁকড়ে ধরে আছে, ছাড়তেই চাইছে না , সেই ছেলেবেলার মতো। পুরনো দিনের সব গল্প, ছেলে বেলার খেলার সাথীদের খোঁজ খবর, সব কিছুই বলতে হবে এখন। কবেকার কথা সে সব, কিচ্ছু ভোলে নি ।”
“ভুলবে কী করে ঠাম্মা !শিকড় ভুলে গেলে গাছের মতো মানুষও যে নীরস, নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।”
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর রোদভাসি উঠোনে , খাটিয়ায় বসে রোদ পোহাচ্ছিলো এমিলি।তার দেশের শীত, কঠোর ,রুক্ষ নিষ্প্রাণ , এমন আদুরে শীতের ঊষ্ণতা আগে কখনো উপভোগ করে নি সে। উঠোনে একটা কাঠবিড়ালি নির্ভয়ে ঘোরাফেরা করছিলো, ওপাশে গোবিন্দর বাচ্চা মেয়ে ফুলি,গাছের পাতা আর নুড়িপাথর দিয়ে,সদ্য উপহার পাওয়া খেলনাবাটির সংসার পেতে বসেছে। এমিলি আবারও অনুভব করলো , প্রকৃত আনন্দ , নিজেই নিজেকে নিয়ে সম্পূর্ণ। উপকরণের মূল্য দিয়ে আনন্দের পরিমাপ করা যায় না।
সূর্য পশ্চিমে ঢলে। ফুলি খেলা থামিয়ে তার হাত ধরে ছাদে নিয়ে যায় সূর্যাস্ত দেখাতে। চারপাশ অস্তরাগে রাঙিয়ে সূর্য অস্ত যায়, নদীর জলে তার ছায়া।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে। অজস্র মণিমুক্তো দিয়ে সাজানো নিটোল একটা দিন সে আজ উপহার পেলো।
হৈ হৈ করে কেটে যায় দিন। ঠাম্মার কাছে রান্না শেখা , ভোরবেলা গ্রামে গিয়ে খেজুর রস খাওয়া, সারা দুপুর মাঠে ঘাটে ধুলো মেখে টৈ টৈ,খেত থেকে কোঁচড় ভরে মটরশুঁটি তুলে নদীর ধারে বসে খাওয়া,অভি তাকে খেজুর পাতার বাঁশি বানিয়ে দিলো —অনন্য সব অভিজ্ঞতা, তারপর একদিন সন্ধ্যা নামলে নদীর ওপারে যখন রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছে ,অভি কী যেন একটা কবিতা বলছিলো ‘আবার আসিবো ফিরে —‘গলা ধরে আসছিল তার ।এ কোন অভি , আবার নতুন করে তার প্রেমে পড়লো সে।
খুব দ্রুত ফুরিয়ে গেল ছুটির মেয়াদ।
যাবার দিন নিজের বিয়ের বেনারসীখানা এমিলির হাতে দিয়ে বললেন,” যদি আর দেখা না হয়!” ঠাম্মার চোখে জল। ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে এমিলি বলে “কেঁদো না , আমি আবার আসবো ,আমাকে তো আসতেই হবে , ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিকড়ের সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে না! Yes I am carrying কাউকে বলিনি , তোমাকেই বলে গেলাম , শিকড়ের কাছেই অঙ্কুরের খবরটা সবার আগে দিতে হয় তো!”
গাড়িতে যেতে যেতে এমিলি মনে মনে ভাবছিলো একটা
কবিতার লাইন —“Thank you for giving me roots ,to stay grounded ,and the wings to fly .” -
গল্প- রোমহর্ষক
রোমহর্ষক
-সুমিতা দাশগুপ্তরোববারের সকাল। বাড়ির সকলের ব্রেকফাস্ট পর্ব সারা।
সুরমা দেবীও স্নান পুজো সেরে সবে দোতলার বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে খবরের কাগজখানা খুলেছেন ,বিল্টুনের উত্তেজিত গলা কানে এলো , “ঠাম্মা ও ঠাম্মা।” চেঁচাতে চেঁচাতে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে সদা চঞ্চল বিল্টুন, একটুতেই মহা উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে।
“কী হলো আবার?”– চোখ তুলে চাইলেন সুরমা দেবী।
“শোনো না,ঐ যে মামা দাদু , তোমার বড়দা গো , ফোন করেছিলেন”।
” কী হয়েছে তাঁর?”
“কিচ্ছু হয় নি , ফোন করে বললেন, ঐ যে ‘কলকাতা’ না কী যেন একটা ক্লাবের মেম্বার তিনি , তাঁরা নাকি এই শীতে ভিনটেজ কার রেস করবেন, ভিনটেজ কার রেস মানে জানো তো ,ঐ যে পুরনো দিনের সব গাড়ির মিছিল বের হয় , রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে মানুষ জন হাত নাড়ে,সেই রকম। এবারে সেই রেসে তোমাদের ঐ যে ছোটবেলার পেল্লায় গাড়িখানা ,যেটা মামা দাদু যত্ন করে পুষে রেখেছেন, সেটাকে ক্লাবের লোকেরা মিছিলে সামিল করতে চান। অমন পুরোনো মডেলের গাড়ি নাকি এই তল্লাটে আর নেই!”
“ও ,তা বেশ তো, তবে পথে নামালেই তো আর হলো না , সেটাকে তো রাস্তায় খানিকক্ষণ চালাতেও হবে। অত পুরোনো গাড়ি কী আর এখন চলবে?”
“আরে সবটুকু শোনোই না। ও সব ওঁরা দেখে নিয়েছেন। তাই তো লিষ্টিতে নাম লিখে নিয়েছে। আসল কথাটা হলো যেদিন ঐ শোভাযাত্রা বের হবে , সেইদিন বাড়ির কেউ কেউ পুরনো দিনের মতো সেজেগুজে ঐ গাড়িতে চড়ে যাবে ,আর দর্শকদের দিকে চেয়ে হাসিমুখে হাত নাড়বে। গাড়ির মাথার ছাদটাও তখন আগেকার মতোই গুটিয়ে রাখা হবে যাতে সবাই দেখতে পায়!কী দারুণ ব্যাপার , তাই না ! জানো তো ঐ গাড়িতে আমিও যাচ্ছি , তার জন্য দাদু নতুন ধুতি চাদর কিনে আনবে বলেছে।”
“ও আচ্ছা, তাই বলো, এটাই তাহলে আসল কথা!” মৃদু হেসে বিল্টুনের চুলটা একটু ঘেঁটে দিলেন সুরমা দেবী।
“আচ্ছা ঠাম্মা ,ঐ গাড়িটা নিয়ে সেই গল্পটা আরেকবার বলো না।”
“আহা সে গপ্পো
তো কতবার শুনেছিস্ “
” তা হোক, সে কবে শুনেছিলাম , ভুলে গেছি আর একবার বলো না, প্লিজ।”
মৃদু হেসে কাগজটা পাশের টেবিলে ভাঁজ করে রাখলেন সুরমা দেবী। বিল্টুন মোড়াটা টেনে এনে ঠাম্মার কাছে ঘনিয়ে এলো।
সেই কতকাল আগের কথা ,আজও যেন টাটকা তাজা । সুরমা দেবী একেবারে ডুবে গেলেন মনের মধ্যে,
ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন—
” আমাদের ছেলেবেলাটা কেটেছে মধ্যপ্রদেশের একটা ছোট শহরে , আমার বাবার কর্মস্থলে। চাকরির সূত্রে বাবাকে প্রায়ই ট্যুরে যেতে হতো। কখনও দুই একদিনের জন্য, কখনও বা ফিরতে সপ্তাহ ঘুরে যেত। সঙ্গে থাকতো দক্ষ ও বিশ্বাসী ড্রাইভার রামাদীন।
মা আমাদের নিয়ে কোম্পানির বাংলোতেই থাকতেন । দাদা, দিদি আর আমি ওখানকার স্কুলে পড়াশোনা করতাম।
সেবার, কিছুদিন হলো বাবা গিয়েছেন ট্যুরে , দিন দুয়েকের মধ্যেই ফিরবেন , এমন সময় কলকাতা থেকে দাদুর টেলিগ্রাম এলো , ফুল পিসির বিয়ে হঠাৎ ঠিক হয়ে গেছে , পাত্রপক্ষের দাবি সামনের সপ্তাহেই বিয়ে দিতে হবে ,না হলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে আর দিন নেই, পাত্রপক্ষ অতো দেরি করতে নারাজ, অগত্যা—।
আমাদের মধ্যে তো আনন্দ আর উত্তেজনার সীমা নেই , কোন জামা পড়বো , নতুন বালাজোড়া মা নিশ্চয়ই পড়তে দেবে এবারে কিন্তু গলার হার যে নেই কী হবে? পড়াশোনা ছেড়ে এইসব আলোচনায় মত্ত আমরা দুই বোন, কিন্তু আসল সমস্যা হলো বাবাকে খবর দেওয়া! মনে রাখতে হবে, সে যুগে ফোনের এতো সুবিধা ছিল না।যাইহোক, মা কীভাবে যেন, খবরটা পাঠিয়ে দিলেন। বাবাও এসে পড়লেন তড়িঘড়ি।
সেইসময় কলকাতায় আসার জন্য ট্রেনযাত্রাই সবচেয়ে সুবিধাজনক , কিন্তু কলকাতার ট্রেন ধরতে হলে আমাদের তখন ছোটরেলে করে জংশনে এসে ট্রেন ধরতে হতো। এবারে সেটা সম্ভব হবে না , একে সময় কম ,তায় সঙ্গে প্রচুর লটবহর, গয়নাগাঁটি , বিয়ে বাড়ি বলে কথা!
আমাদের এই গাড়িটা তখন সদ্যই কেনা হয়েছে , একেবারে আনকোরা, তাই বাবা ঠিক করলেন গাড়িতেই কলকাতায় যাওয়া হবে। বাবা আর রামাদীন ভাগাভাগি করে গাড়ি চালাবে। পথে অনেক ডাকবাংলো রয়েছে , সুবিধেমতো জায়গায় রাত কাটিয়ে নেওয়া যাবে। ট্যুরের চাকরির কল্যাণে এই অঞ্চলের সমস্ত রাস্তাঘাট বাবার নখদর্পণে।
ঠিক হলো পরদিন খুব ভোরেই রওনা দেওয়া হবে ,আসলে পথে শোন নামে একটা বড়ো নদী পড়ে , সেটা পার হবার একটা ব্যাপার আছে। তখন ঐ নদীর উপরে কোনো ব্রিজ ছিলো না। বিশাল এক ভেলায় করে নদী পারাপার করতে হতো। ট্রাক হলে একেকবারে একটা করেই পার হয়, আমাদের মতো প্রাইভেট কার হলে, কয়েক জন মানুষও,গরু ছাগল নিয়ে ভেলায় চড়ে বসে। সন্ধ্যের পর পারাপার বন্ধ হয়ে যাবে, ওপারে আবার রাস্তার দুই ধারে বেশ কয়েক মাইল জুড়ে জঙ্গল। বাবা চাইছিলেন বেলাবেলি ঐ পথটুকু অতিক্রম করে যেতে। সেইমতো ,পরদিনই খুব ভোরে আমরা রওনা দিলাম। তখনও আকাশের এক কোণে শুকতারা মিটমিট করছে। বাগানের লম্বা লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছ , হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে আমাদের বিদায় জানালো।
প্রথমদিকে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো ,আমরা সময়মতো পথে থেমে থেমে জলখাবার , দুপুরের খাওয়া মিটিয়ে নিচ্ছি। দারুণ একটা পিকনিকের মতো ব্যাপার। সে কী আনন্দ!! হঠাৎ ঘটলো ছন্দপতন। এক জায়গায় রাস্তা আটকে দিয়েছে পুলিশ। কী যেন একটা কারণে সামনে রাস্তা বন্ধ।
ঘন্টা দুয়েক আটকে থেকে , আবার যখন যাত্রা শুরু হলো ,তখন বেলা পড়ে আসছে।
নদীর ধারে পৌঁছতে বেলা গড়িয়ে গেল । সমস্ত আকাশ অস্তরাগে রাঙিয়ে সূর্যদেব ধীরে ধীরে পাটে বসছেন, নদীর জলে আবীর গুলে দিয়েছে কেউ ।
সেদিন আবার নদীর এপারে গঞ্জের হাট ছিল, হাট ফেরত দেহাতি মানুষজন ,গরু ,ছাগলের ভীড়ে, নদীতীর একেবারে ছয়লাপ।
পাশে ধাবার কাছে দুটো লরি দাঁড়িয়ে। চালকদের জোরদার খানাপিনা চলছে। মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে সুরার বোতল। আমাদের দেখেই কিনা কে জানে ,উল্লাস, হুল্লোড় একেবারে তুঙ্গে। ওদিকে ভেলায় পারাপার চলছিলোই।
কোনও মতে চা জলখাবার খাইয়েই বাবা আমাদের গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। লরিচালকদের লোলুপ দৃষ্টির মর্ম ঐ ছোটবয়সেও বুঝতে অসুবিধা হলো না আমাদের।
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতেই চাইছিলেন বাবা, কিন্তু বাদ সাধলোঐ লরির ড্রাইভাররা। খাওয়া ফেলে উঠে এসে পারাপারের অগ্রাধিকার নিয়ে তুমুল ঝগড়া বাধিয়ে দিল।
বাবা সরে দাঁড়াতেই চাইলেন , কিন্তু সেখানেও সমস্যা , তাদের খাওয়া আর শেষই হয় না।
অবশেষে , অনেকক্ষণ পরে একখানা ট্রাক রওনা হলো।তারপর দ্বিতীয়টির পালা। কিন্তু না! হুকুম জারি করা হলো আমাদের গাড়িটা ভেলায় তুলতে। ঘাটের কর্মচারীদের একজন বাবার পরিচিত। সঙ্গোপনে বলে গেলেন , ওদের মতলব সুবিধের ঠেকছে না। ওরা চাইছে আপনাদের গাড়িটাকে মাঝে রেখে ঘেরাবন্দী করার, যাতে ওপারে জঙ্গলের নির্জন রাস্তায় লুটপাটের সুবিধা হয়। ইদানীংকালে এই ধরনের বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটেছে বলে কানে আসছে।
শুনুন আপনাদের বাঁচানোর জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো , বাকিটা আপনাদের ভাগ্য আর ঈশ্বরের দয়া।
আপনাদের গাড়ি চলে যাবার পর নানা অজুহাতে পিছনের লরিটাকে পার করতে দেরী করবো , তারমধ্যে যা করার আপনাদেরই করতে হবে। ভেলায় পার হবার সময়টুকুতেই প্ল্যান করে নিন। প্রথম ট্রাকের দুজনের সঙ্গে এঁটে ওঠাটা তবু, চারজনের চাইতে সহজ হবে। একটাই ভরসা এরা মদ খেয়ে ঈষৎ বেসামাল। ধাক্কাধাক্কি হলে ভারসাম্য হয়তো রাখতে পারবে না , অবশ্য ওদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারে , অবস্থা বুঝে কাজ করবেন।
ওপারে নেমে ,দেখা গেল রাস্তা পরিষ্কার শুনশান। আধমাইলটাক নির্বিঘ্নেই যাওয়া গেল , কিন্তু জঙ্গল শুরু হবার একটু পরেই সব আশঙ্কা সত্যি করে ,দেখা মিলল লরিখানার। সেটা পথের উপরে আড়াআড়ি ভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা।
ড্রাইভার আর খালাসি, ঈষৎ অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় পথের উপরে দাঁড়িয়ে , হাতে পিস্তল ।
রামাদীন প্রস্তুতই ছিল। সবাইকে গাড়ির মধ্যেই বসে থাকতে বলে , গাড়ি থেকে নেমে মাথার উপরে হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গীতে সোজা এগিয়ে গেল ওদের দিকে । পরিস্থিতির আকস্মিকতায় ওরা থতমত খেয়ে কি করবে বুঝে ওঠার আগেই রামাদীন কাছাকাছি গিয়ে লাফিয়ে উঠে এক লাথি কষালো হাতের অস্ত্রটা লক্ষ্য করে। ছিটকে পড়ে গেল অস্ত্রখানা ,সেই সুযোগে রামাদীন বেসামাল ড্রাইভারকে একধাক্কায় মাটিতে ফেলে পিস্তলটা কুড়িয়ে নিয়ে একলাফে লরির ড্রাইভারের সিটে উঠে বসলো , গাড়ির চাবিটা ঝুলছিলোই ,রামাদীন অনায়াসে লরিটায় স্টার্ট দিয়ে সোজা চালিয়ে দিল ওদের লক্ষ্য করে। হতভম্ব হয়ে, প্রাণ বাঁচাতে ওরা দুজনে তখন মাঠঘাট পেরিয়ে দে ছুট।
রামাদীন বাবাকে গাড়িটা নিয়ে পিছন পিছন আসতে ব’লে, ট্রাকটা চালিয়ে নিয়ে এগিয়ে চললো সামনের দিকে । রামাদীনের পরিকল্পনাটা ঠিক বোধগম্য না হলেও সেই মুহূর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে ও-ই সেনানায়ক। বাবা বিনা প্রতিবাদে ওর নির্দেশ মেনে চলছিলেন। আমাদের হাতে বিশেষ সময়ও তো নেই , পিছনের ট্রাকটা এসে পড়লো বলে!
প্রায় মাইলখানেক গিয়ে রামাদীন ট্রাকটাকে পথের পাশের নয়ানজুলিতে নামিয়ে দিয়ে গাড়ির চাবিটা ছুঁড়ে দিলো দূরের মাঠে। তারপর তড়িঘড়ি
আমাদের গাড়িতে উঠে এসে ,স্টিয়ারিং হুইল ধরলো। পিছনের ট্রাকটা আমাদের ছেড়ে কথা কইবে না। অতএব দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে হবে আমাদের।
রামাদীন গাড়িতে স্পিড তুললো। সে যুগের গাড়ি এই যুগের মতো এতো গতিসম্পন্ন ছিল না। বোঝাই যাচ্ছিল পিছনে ধেয়ে আসা ট্রাকটার, আমাদের নাগাল পেতে বেশীক্ষণ লাগবে না। আমাদের বাঁচার জন্য অন্য কিছু একটা করতেই হবে।
এবার বাবা আসরে নামলেন , একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এসে, বাবার নির্দেশে রাস্তা ছেড়ে গাড়ি ঢুকলো ঝোপ জঙ্গলে প্রায় ঢেকে যাওয়া একটা কাঁচা রাস্তায়। ঝোপঝাড় ভেঙে এগিয়ে যেতে যেতে একটু দূরেই দেখা মিলল ভগ্ন ও পরিত্যক্ত এক ডাকবাংলোর। মাথার ছাদ পড়োপড়ো , ভাঙা ফটক, বাতিস্তম্ভ কাঁটা ঝোপে ঢাকা। বাবা ইতিমধ্যে নেমে পড়েছেন ঝোপের ভাঙা ডালপালার যথাসম্ভব মেরামতিতে , যাতে রাস্তা থেকে আমাদের জঙ্গলের পথে নেমে আসার চিহ্ণটুকুও কেউ খুঁজে না পায়। বাবার দুই হাত রক্তাক্ত, শার্ট ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই। ওদিকে দূরে অন্ধকারের মধ্যে দেখা যাচ্ছে ধেয়ে আসা তীব্র হেডলাইটের আলো। সম্ভবত শিকার ফসকে যাবার আক্রোশে উন্মত্ত তারা।
বাবা তড়িঘড়ি গাড়িতে উঠে পড়লেন। তাঁর নির্দেশে
অবশেষে ঐ ডাকবাংলোর ফটকের সামনে আসা গেল। আপাদমস্তক কাঁটায় আবৃত বাংলোটি বাইরে থেকে প্রায় অদৃশ্য। আন্দাজে সামান্য একটু পথের নিশানা মিলতেই গাড়ির সমস্ত আলো নিভিয়ে রামাদীন সবেগে আরোহীসহ গাড়িটা ঢুকিয়ে দিলো কাঁটাবনে,আর কী আশ্চর্য দুর্ভেদ্য সেই কণ্টকবন একেবারে মায়ের মতোই , আঁচল চাপা দিয়ে লুকিয়ে ফেললো আমাদের।
সাধে কী আর এত বছর ধরে এতো যত্নে গাড়িটাকে আগলে রেখেছে দাদা!