• গল্প

    গল্প- জীবনগান

    জীবনগান
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

    প্রতিদিনের মতো আজও পাখির কলকাকলিতে ভোর ভোর‌ই ঘুমটা ভেঙে গেল বিমলবাবুর। মুখ হাত ধুয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই একরাশ টাটকা বাতাস জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। বাতাসে পাতলা কুয়াশার আস্তরণ , সূর্য ওঠেনি এখন‌ও। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে বাগানে নেমে এলেন তিনি। ডানদিকে তরকারির বাগান । প্রথমে সেইদিকেই পা বাড়ালেন । শিশিরভেজা সবুজ পাতার ঘেরাটোপে ফুলকপির কচি মুখ উঁকি দিচ্ছে , পালং চারা মাথা তুলেছে, ধনেপাতার সবুজ ঝালর বাতাসে কাঁপে ,লাউডগায় সাদা সাদা ফুল ।অন্যপাশে ফুলের বাগানে চন্দ্রমল্লিকা ,ডালিয়া , গাঁদা ফুলের সমারোহ।
    মাঝখান থেকে লাল সুরকিঢালা পথ সামনের সাদা ফটকের কাছে গিয়ে থেমেছে । গেটের মাথায় লাল সাদা বোগেনভিলিয়ার ঝাড় অজস্র ফুল ফুটিয়ে রাখে। সারা বাগানটায় টহল দিচ্ছিলেন তিনি, ছুঁয়ে ‌যাচ্ছিলেন শিশির ভেজা গাছের পাতা । অনির্বচনীয় এক প্রশান্তিতে ভরে যাচ্ছিলো মন। আজকাল রীতিমতো আফসোস‌ই হয় ,কেন যে এতটা কাল এইসব ছেড়ে সংসারের আবিলতায় ডুবে র‌ইলেন —!
    “বাবু -চা” —মালতীর ডাকে সম্বিত ফিরল বিমলবাবুর , বারান্দায় উঠে এসে ,বেতের চেয়ারখানায় আরাম করে বসে , চায়ের কাপটা হাতে নিলেন ,সকাল বেলার প্রথম চা -টা তিনি এখানে বসেই খান।
    এই কুসুমতলিতে বসবাস শুরু করার পর থেকে ধীরে ধীরে প্রকৃতির সঙ্গে কেমন যেন একটা একাত্মতা বোধ তৈরী হয়ে গেছে বিমলবাবুর। বাড়ির পিছনে বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে একখানা তিরতিরে নদী, ওপারের সবুজ বন, আকাশের নীলিমা একটু একটু করে সেঁধিয়ে যাচ্ছে তাঁর মধ্যে।
    এই বাড়িটা আসলে তাঁর পরলোকগতা স্ত্রী মাধবীর , উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পৈত্রিক সম্পত্তি। মাধবীর খুব টান ছিলো এই বাড়ি এই জায়গার প্রতি। ছেলেবেলার জায়গা মানুষের সবসময়ই প্রিয় হয়। মাধবীর পীড়াপিড়িতে ,বিমলবাবু কয়েকবার এখানে এসেছেন বটে , কিন্তু আদ্যন্ত শহুরে বিমল বাবুর এখানে মন টিঁকতো না মোটেই। দুদিন যেতে না যেতেই হাঁপিয়ে উঠতেন তিনি।
    বালিগঞ্জের জমজমাট জায়গায় তাঁদের পৈত্রিক বাড়ি। দাদা আর তিনি সারাজীবন ঐ বাড়িতে একত্রে কাটিয়েছেন । বৌদি আর মাধবীর সম্পর্কটাও মিষ্টি মধুর ছিলো। বাড়িতে বন্ধুবান্ধব , আত্মীয় স্বজনদের আসা যাওয়া তো ছিলই , তাছাড়াও নামী কলেজে অধ্যাপনার সূত্রে ছাত্র ছাত্রীদের আনাগোনা লেগেই থাকতো।
    বিমলবাবু আর মাধবী নিঃসন্তান ছিলেন , দাদার দুই ছেলেকে সন্তানস্নেহেই লালন করতেন তাঁরা। তাদের‌ও যতো আবদার ছিলো তাঁদের কাছেই। মোটকথা দিব্যি আনন্দে দিন কেটে যেতো সকলের। ছেলেদুটিও যোগ্য হয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে গেল, সবাই তখন তাদের বিয়ে থা দিয়ে বাড়িতে নতুন বৌ আনার চিন্তায় মশগুল, ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো তাঁদের সংসারে নেমে এলো বিপর্যয়। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে অকস্মাৎ চলে গেলো দাদা আর মাধবী। একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন তাঁরা। সামলাতে একটু সময় লেগেছিলো , তারপর আবার মনে শক্তি সংগ্রহ করে উঠে দাঁড়ালেন। বিয়ে দিলেন ভাইপোদের। ভেবেছিলেন বাড়ির পরিবেশ আবার একটু একটু করে স্বাভাবিক হবে , কিন্তু যা ভাবা হয়েছিলো সেটা হলো না ।
    দুই বৌমার মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক দানা বাঁধলো না ,দুজনেই নিজস্ব গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ রাখলো নিজেদের। বাড়ির আবহাওয়া বদলে যাচ্ছিলো দিন দিন, অশান্তির আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছিলো ।ভাইপোরা এতটাই মেরুদন্ডহীন আগে জানা ছিলো না। ইতিমধ্যে বিমলবাবু চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ,মোটা পেনসন মেলে। সংসারের আবিলতায় দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়তেন বেশ কিছুদিনের জন্য । সেবার বৌদিকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন , ফিরে এসে স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন নিত্য দিনের ঝামেলা মেটাতে ,ভাইপোরা ‌পার্টিশন দিয়ে বাড়ি ভাগ করে নিয়েছে , তাঁর আর বৌদির জন্য তাঁদের নিজস্ব ঘর দুখানা বাদ দিয়ে। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা ভাগের সংসারে। আশ্চর্য !তাঁদের অনুমতির জন্য সামান্য ক’টা দিন‌ও অপেক্ষা করা গেল না ।শুভার্থীরা মামলা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন , আইনতঃ বাড়ির অর্ধেক অংশ তাঁর । প্রবৃত্তি হয় নি। কেস করে হয়তো বাড়ির ভাগ পাওয়া যায় কিন্তু সম্পর্ক !সেটার কি হবে?অনুভব করলেন “সময়‌এসেছে নিকট এখন বাঁধন ছিঁড়িতে হবে”।
    তীব্র অভিমান বুকে নিয়ে চলে এলেন মাধবীর এই কুসুমতলিতে। বৌদিকেও তাঁর সঙ্গে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন , তিনি ভিটের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারলেন না। অঝোর ধারায় অশ্রুজলে বিদায় দিয়েছিলেন কেবল ,যাক তবু একজন কেউ ছিলো তাঁর জন্য চোখের জল ফেলার !
    এখানে এসে মাধবীর জ্ঞাতিদাদাদের সাহায্যে ঘরদোর সাফ সুতরো করে বাসযোগ্য করে নিলেন, ‌আউটহাউসে রেখে নিলেন মধ্যবয়সী এক দম্পতিকে । সংসারের ভার এখন তাদের হাতে। নিশ্চিন্ত অবসরে দিন কাটে এখন। মাধবীর আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে ভুলে যাওয়া সম্পর্কগুলি নবজীবন লাভ করেছে। মায়ার নতুন বন্ধনে আবার তাঁকে আপন করে নিয়েছেন ওঁরা।
    দৈনন্দিন জীবনে এখন নতুন ছন্দ। সকালে জলখাবারের পর শহরে গিয়ে দোকান বাজার ,ব্যাঙ্কের কাজকর্ম সারেন , দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম , সন্ধ্যেটা কাটে স্থানীয় ক্লাবে কিছু সজ্জন মানুষের সাহচর্যে।ফেরার সময় একলা পথে দুচোখ ভরে দেখেন জোনাকজ্বলা প্রান্তর, পরিযায়ী পাখির ডানার শব্দ চমক লাগায় বুকে ,আকাশজোড়া ছায়াপথ ধরা দেয় আপন মহিমায় । মনে ভাবেন ঐ ধাক্কাটার প্রয়োজন ছিল ,ন‌ইলে এই সমস্ত‌ই অধরা থেকে যেত তাঁর জীবনে।
    কে যেন বলেছেন জীবন নাকি একটা বহতা নদী ,তার প্রতিটি বাঁকে নতুন গল্প। বিমল বাবুর জীবনে সেই কথা আবার নতুন করে প্রমাণিত হলো।
    সেদিন সকালে মালতী এসে কেঁদে পড়লো। গতরাতে তার ষোড়শী কন্যা ফুলি শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে এসে উঠেছে, বিয়ের সময় সাইকেল দেবার প্রতিশ্রুতি রাখা যায় নি বলে এই শাস্তি। বাবু যদি অনুগ্রহ করে ক’টা দিন এখানে থাকার অনুমতি দেন –একটা খাওয়া পরার কাজ জোটাতে পারলেই …..
    মাত্র একখানা সাইকেল ,একটি মেয়ের গোটা জীবনের দাম! একখানা সাইকেল তিনি কিনে দিতেই পারেন কিন্তু সেটাই কী সমস্যার সমাধান ! দারিদ্র্য আর অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকা ঘুণধরা সমাজের চেহারা কী তাতে বদলানো যায়! অত‌এব রয়ে গেল মেয়েটি।
    কয়েক দিন পর জীবন আবার নতুন বাঁকের মুখে এসে দাঁড়ালো।
    ইদানীং ভাইপোরা ঘনঘন ফোনে কুশল সংবাদ নিচ্ছিলো , তারপর হঠাৎ একদিন চলে এলো।ব্যাপারখানা খোলসা হলো তখন। নামজাদা এক প্রোমোটারের সুনজর পড়েছে তাঁদের গোটা পাড়াসহ তাঁদের বাড়িটার উপরে।ভাইপোরাও কম আগ্রহী নয় , বিশাল অঙ্কের টাকার হাতছানি। যেহেতু বিমলবাবু অর্ধেক সম্পত্তির অংশীদার তাই তাঁর স‌ইটা জরুরী । আগামী সপ্তাহে প্রোমোটারের লোক নিয়ে আসবে তারা যদিও কাকুমণির আপত্তি হবে না তারা জানে,তবু আগে থেকেই জানিয়ে গেল।
    মাথায় রক্ত চড়ে গেল ,প্রচন্ড ক্ষোভে ফেটে পড়লেন তিনি —টাকার লোভে নিজের শিকড় নিজে হাতে তুলে ফেলতে এতটুকু দ্বিধা নেই, ঐ চ‌ওড়া ঘর বারান্দায় কতোশতো স্মৃতির মায়া সব টাকার কাছে বিকিয়ে যাবে !! এককথায় ভাগিয়ে দিলেন তাদের কিন্তু ব্যাপারটা যদি এতোই সহজ হতো ! কয়েক দিন বাদেই তারা আবার এলো , এবার সঙ্গে এলো প্রমোটারের তরফে অত্যন্ত অমায়িক , ভদ্র এক যুবক রাজিন্দর । সারাদিন টানাপোড়েন চললো , তিনি অনড় , অবশেষে বিদায়কালে রাজিন্দর অতি অমায়িক ভাবে , ভদ্রতার মোড়কে একখানা হুমকি দিয়ে গেল ,যেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
    গুম হয়ে গেলেন বিমলবাবু ।মনটা অস্থির ।ক্লাবে গিয়ে দাবার চালে বারবার ভুল হয়ে যাচ্ছে, অবশেষে দাবার বোর্ডখানা বন্ধ করে দিয়ে পুরন্দর উকিল বললেন —‘নাও হে এবার বলে ফেলো তো সমস্যাখানা কী?
    বিমলবাবু অবাক হয়ে চাইতেই বললেন ‘লোকে এমনি এমনি আমায় ধুরন্ধর উকিল নাম দেয় নি’
    মন দিয়ে সমস্তটা শুনে নিয়ে বললেন ‘এই পরিস্থিতিতে তোমার বোধহয় রাজি হয়ে ‌যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’
    অত্যন্ত আহত হয়ে বিমলবাবু বললেন ‘আপনিও তাই বলছেন!’
    ‘আচ্ছা বলো তো তোমার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী কে বা কারা ‘।
    ‘আমার অবর্তমানে ভাইপোরাই তো সব —‘
    ‘সেটাই তো সমস্যা হে —কেউ যদি তোমার ‘অবর্তমান’ টা তাড়াতাড়ি ঘনিয়ে আনতে চায় তাহলে!!’
    ‘মানে ‘?
    ‘আহা তোমার ভাইপোদের কথা বলছি না , তবে কিনা প্রমোটাররা তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের পথে কোন‌ও কাঁটা বরদাস্ত করে না কিনা। উপড়ে ফেলতে কতক্ষণ , শোনো ছেলেবেলায় মাধবীর কাছে অনেকবারই ভাইফোঁটা নিইচি ,সেই সূত্রে তুমি আমার ভগ্নিপতিই হলে সে , চলো সবাই মিলে তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি ।’ কাঁধে হাত রাখলেন তিনি।

    মানসিক যন্ত্রণায় অবিরত ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলেন তিনি ,মন থেকে সায় পাচ্ছিলেন না কিছুতেই, শেষবয়সে এতোবড়ো পরাজয় !!
    দিনদুয়েক কেটে গেল ,
    ইতিমধ্যে রাজিন্দর মোলায়েম করে কুশল সংবাদ নিয়েছে , এটা যে পরোক্ষ চাপ সেটা বুঝতে বেশী বুদ্ধি লাগে না।
    সেদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর রোজকার মত পিছনের বারান্দায় পায়চারী করতে যাবেন , মালতী বাধা দিলো।
    ‘এখন ক’টা দিন রেতের বেলা বাইরে বসবেন না বাবু , আগে তো কেউ এদিকে আসতোই না আজকাল রাতবিরেতে ঐ পিছন মাঠে উটকো লোকের আনাগোনা বেড়েছে । মাঝরাতে বাগানে জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ে , কুকুরগুলান রাতভর চেঁচায়।ফুলির বাবা আজ থেকে রাতে পাহারা দেবে।’
    বিছানায় শুয়ে দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছিলো না , পুরন্দর উকিলের কথা সত্যি হলে , তাঁর উপর আক্রমণ অনিবার্য ।তাঁকে বাঁচাতে অন্য মানুষের প্রাণসংশয় হবে না তো ?
    আউটহাউস থেকে কথাবার্তার শব্দ ,ফুলির অস্ফুট কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিলো । ভাগের পরিহাসে ফুলি আর তাঁর অবস্থান আজ এক‌ই অসহায়তায় দাঁড়িয়ে আছে।ভাগ্যের পায়ে আত্মসমর্পণ! পাশ ফিরে শুলেন , আচমকাই মনের মধ্যে আলোর ঝলকানি, আনন্দের উদ্ভাস ,পথ পেয়ে গেছেন তিনি। বিছানা ছেড়ে উঠে ফোন হাতে নিলেন ।রাত এখন সাড়ে এগারোটা ,তা হোক ,ভাইপোদের ফোনে ধরলেন, বলে দিলেন তিনি রাজি।
    এরপর দ্রুত পটপরিবর্তন ঘটলো , প্রোমোটারকে সঙ্গে নিয়ে তড়িঘড়ি এসে পড়লো তারা। পূর্ব নির্ধারিত , দিনক্ষণে স‌ইসাবুদ সেরে ফেললেন তিনি তবে এবারে আর শুধুমাত্র দানপত্রে নয়, পুরন্দর উকিলকে সাক্ষী রেখে, ভাইপোদের একেবারে স্তম্ভিত করে পাওনাগন্ডার কানাকড়িটুকু পর্যন্ত আদায় করে ছেড়েছেন তিনি।
    বিমলবাবু এখন একখানা জুতসই জমির খোঁজে আছেন ,
    এই কুসুমতলিতেই মেয়েদের জন্য একখানা স্কুল আর স্বনির্ভরতা শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করবেন তিনি। নাম হবে মাধবীছায়া।
    রাতের খাওয়া সেরে আবার আগের মতো নিশ্চিন্ত মনে পিছন বারান্দায় রাখা আরামকেদারাখানায় গা এলিয়ে বসলেন বিমলবাবু। এই সময়টায় মনে মনে ভবিষ্যতের একখানা রূপরেখা তৈরী করেন তিনি , হঠাৎ চোখ চলে গেল আকাশে । ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মধ্যে কয়েকটি তারা , এককোণে একফালি হলুদ চাঁদ ঝুলে আছে, ঠিক যেন ভ্যানগঘের ছবি । মনে পড়ে গেল Stary nights এর ক’টা লাইন— “Now I Understand What You Tried To Say To Me”

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- ‌সাদা কালো

    ‌সাদা কালো
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

    “একি বুবু‌সোনা, তুমি এখনও কেঁদেই চলেছো? অনেকক্ষণ কেঁদেছো, নাও এবারে কান্নাকাটি থামাও।”

    “কী করবো মা, আমার যে খুব কান্না পাচ্ছে। ঐ দুষ্টু লোকেরা মিলে মিছিমিছি ভালো দাদুটাকে মারলো কেন?
    জানো মা,রোজ সকালে মোবাইলের ইস্কুল শেষ হয়ে গেলে,’বাই‌ বাই ম্যাম্’ বলে আমি যখন দোতলার এই বারান্দাটায় বসে বসে রাস্তা দেখি তখনই রোজ‌ই দেখতে পাই রায়দাদুর বাচ্চা নাতিটাকে নিয়ে ওদের আয়ামাসি রাস্তা পেরিয়ে ঐ পার্কে বেড়াতে নিয়ে যায়, আর সেখানে গিয়েই বাচ্চাটাকে একা ছেড়ে দিয়ে বেঞ্চিতে বসে, অন্য আয়ামাসিদের সঙ্গে গল্প করে। বেবিটা একা একাই টলমল করে এদিকে ওদিকে হেঁটে বেড়ায়। কখনো হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েও যায়। আয়ামাসি দেখলেও ওকে তুলে দেয় না, শুধু গল্প‌ করেই যায়। আজ ওরা যখন নিজেরা গল্প করছিল, তখন বেবিটা যে আপনমনে একা একা গেটের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সেটা দেখতেই পায় নি। বেবিটা আপনমনে একা একা ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাচ্ছিলো। ভাগ্যিস ঐ রাস্তায় চা ফিরি করা চা’ওয়ালা দাদুটা দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলো! না হলে আর একটু হলেই রাস্তায় নেমে গেলে কী সাংঘাতিক কান্ড হতো বলো! কোথায় দাদুটাকে সবাই থ্যাঙ্ক ইউ বলবে তা না ঐ আয়ামাসিরা সবাই ছুটে এসে ওকে ছেলেধরা বলে লোকজন জুটিয়ে কতো মারলো। আমি এখান থেকে কত চেঁচালাম, বললাম ওকে মেরো না, ও ভালো লোক, কেউ শুনতেই পেল না। ভাগ্যিস ট্রাফিক পুলিশকাকুটা, দাদুটাকে চিনতে পেরে এসে বাঁচালো! জানো মা দাদুটার কপাল কেটে রক্ত পড়ছিলো। কেন মা ওরা ভালো দাদুটার সঙ্গে ঐ রকম করলো?”
    ” কী আর বলি বলো। আসলে নিজেদের গাফিলতি আর অন্যায়, চাপা দিতেই ওরা এমনটা করেছে। মানুষের স্বভাবটাই যে এইরকম, নিজের অপরাধের দায় সবসময় অন্যের উপরে চাপিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চায়।”
    ” কেন মা? নিজে দোষ করলে অন্যকে কেন শাস্তি পাওয়াবে? আমাদের ইস্কুলে তো এইরকম হয় না। বড়ো হলেই কী মানুষই এইরকম হয়ে যায়?”
    “না সোনা সবাই এইরকম হবে কেন? চারপাশে দেখো না, এই দুঃসময়েও নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কত মানুষ নীরবে কত ভালো কাজ করে যাচ্ছেন।
    নাও এখন মনখারাপ না করে একটা ছবি এঁকে আমাকে দেখাও তো দেখি।”
    “কীসের ছবি আঁকবো?”
    “যা ইচ্ছে হয়। এই তো তোমার আশেপাশেই তো কতো কিছু আছে।”
    “কিন্তু মা আমার রঙপেন্সিলের বাক্সটা যে কাল‌ রান্না মাসির ছেলেটাকে দিয়ে দিলাম।রঙ তো করা যাবে না। ”
    “ঠিক আছে, সাদা কালো ছবিই আঁকো না হয়।”
    চারপাশে চেয়ে বুবুর নীচের বাগানে ফোটা গন্ধরাজ ফুলগুলো মনে ধরে গেল, কিন্তু একটাই সমস্যা। সাদা কাগজে সাদা ফুল ফুটিয়ে তোলা যাবে কী করে! অতঃপর সে সাদা কাগজে গন্ধরাজ ফুল এঁকে, ফুলগুলোর চারপাশটা কালো রঙ দিয়ে ঢেকে দিচ্ছিলো, দিতেই থাকলো, যতক্ষণ না সেগুলি রাতের আকাশে তারার মতো ফুটে ওঠে। এছাড়া আর কী-ই বা সে করতে পারতো এই সাদা কালোর দুনিয়ায়!

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- শিক্ষক

    শিক্ষক
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

    -মা জানো, কাল তো শিক্ষক দিবস। আমাদের ম্যামদের জন্য কী চমৎকার সব গিফট কেনা হয়েছে, উঁচু ক্লাসের দিদিরা সব গিফট সুন্দর করে প্যাক‌ও করে ফেলেছে।কাল দেওয়া হবে। সব রেডি।
    -আমার গিফট‌ও রেডি।
    -তোমার গিফট? কার জন্য মা? তোমার ম্যামের? কোথায় থাকেন তিনি? কোথায় খুঁজে পেলে তাঁকে?
    -এইখানেই, শুধু চোখ মেলে দেখি নি এতোদিন।
    -কে মা?
    -কমলামাসি। এই যে এতো রেলিশ করে কাঁকড়ার ঝাল আর তালক্ষীর খাও, সব‌ তো ওঁর কাছেই শেখা। আগে এইধরনের রান্না কোনও দিন বানানো দূরে থাক চেখেও দেখি নি।
    -ও, কিন্তু তাই বলে উনি তোমার টিচার!
    -অবশ্য‌ই। হাতে ধরে স্টেপ বাই স্টেপ তো উনিই আমাকে শিখিয়েছেন।
    মনে রেখো, জীবনে যখন‌ই কারো কাছে কিছু শিখবে, তিনিই তোমার শিক্ষক, তাঁর সামাজিক অবস্থান যেমন‌ই হোক না কেন, তিনি তোমার গুরু।

  • প্রবন্ধ,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    প্রবন্ধ- লীলাময়ী লীলা মজুমদার

    ।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।। 

     

    লীলাময়ী লীলা মজুমদার
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    বড়ো ইচ্ছে, তাঁর জন্মদিনে একখানা হলদে পাখির পালক উপহার দিই ।
    তুমি বলবে — ওমা সে তারিখ তো কবেই পেরিয়ে গেছে !
    আমি বলি তাতে কী? তারিখ পেরিয়ে গেলেই তো আর জন্মদিনটা মিথ্যে হয়ে যায় না , বিশেষ করে আপামর বাঙালির বুকের মধ্যে একখানি মায়ার পিদ্দিম জ্বালিয়ে দিয়েছেন যিনি তাঁর তো প্রতিটি দিন‌ই জন্মদিন!
    হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, তিনি হলেন আপামর বাঙালি পাঠকের প্রিয় লীলাময়ী, লীলা মজুমদার ।
    এখন মুশকিল হলো উপহারটা যে দেব ,তা সেই পালকখানা পাই কোথায়? তাকে তো ঝগড়ু আর ঝগড়ুর ভাই ছাড়া কেউ দেখেই নি !
    গুণুপন্ডিত বললে -” তা ওকেই শুধোও না গিয়ে।”
    আহা, তা কি আর আমি ভাবিনি ভাবছো , মুশকিল হলো ঝগড়ুকেই বা পাই কোথায়!।সে তো বোগি আর রুমুকে সঙ্গে নিয়ে সারা দুপুর ,খোয়াই এর মধ্যে সেই ফুল খুঁজে বেড়ায় ,যা নাকি কক্ষনো শুকোয় না। কবে থেকে যে খুঁজেই চলেছে,আজ‌ও পায় নি -তবে কিনা চায়‌ও না পেতে! বলে, পেয়ে গেলেই তো সব মজা মাটি!
    গণশা পরামর্শ দিলে — “পদিপিসির বর্মীবাক্সটা একবার খুঁজে দেখলে হতো না? ধনরত্নের মধ্যে যদি একখানা পালক‌ও লুকিয়ে থাকে! ” শুনে গুপির সে কী হাসি !বললে
    “ওরে সে বাক্স তো এখন খালি।ওর ভিতরের সোনাদানা, মণিমুক্তো,মায় , বিয়ের আসর থেকে চুরি যাওয়া মন্তরের পুঁথিখানা পর্যন্ত কবেই ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে নিয়েছে সবাই।”
    তাহলে উপায়?
    আচমকা পেরিস্তানের চোরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কালোমাস্টার বললে—
    “সবাই জানে আমি মানুষটা মোটেও সুবিধের ন‌ই, কাউকে যেচে পরামর্শ দিই নে, কিন্তু এই যে ছেলেটা এর মতো এতো ভালো মনের মানুষ
    ভূ ভারতে আর কোথাও দেখলাম না। আমায় আশ্রয় দিয়ে, লুকিয়ে রেখেছে ওর গোপন আস্তানায়, বাড়ি থেকে খাবার চুরি করে এনে খাওয়ায়।
    তাই হদিশখানা বলেই দিচ্ছি। ঐ সামনের পাহাড়ে পাকদন্ডী বেয়ে উপরে উঠে যাও দিকিনি, ওখানে পাহাড়ের ঢালে বড় লামা থাকে ।ওর পুষ্যি হলো ধিঙ্গিপদ , সারা দিনমান ,হেথা হোথা ঘুরে ফিরে কাজকর্ম করে , দুনিয়ার খবর তার নখদর্পণে। শোনো তাকে আবার আহ্লাদ করে ঘাস খাওয়াতে যেও না যেন , সে কেবল সুয্যির আলো খায়।”
    বড়লামার বাড়ি পৌঁছে দেখি,ধিঙ্গিপদ রোদে কাঠকুটো শুকোতে দিচ্ছে , আমাদের তো পাত্তাই দেয় না,বড় গুমোর তার, অনেক সাধ্যসাধনার পর, বললে
    ” যতদূর জানি পাহাড়চূড়োয় মেঘের দেশে যে বাতাসবাড়ি, হলদে পাখি ইদানীং সেখানেই আশ্রয় নেছে ,আর কিছু জানি নে ,যাও ভাগো” ।
    তাড়া খেয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। তারপর ধিঙ্গিপদর কথামতো
    পাকদন্ডী বেয়ে উঠছি তো উঠছিই , চারপাশে সে কী ঘন বন, বনের মধ্যে হু- হু করে হাওয়া বয় , পাতার ফাঁক দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া সূর্যের আলো , আড়াল থেকে কারা যেন উঁকি ঝুঁকি মারে , তাকালেই চট করে সরে যায় ,সে ভারি রোমহর্ষক ব্যাপার! ভয় কাটাতে গুপি পকেট থেকে টিনের ব্যাঙ্ কটকটিখানা বের করে যেই না, কটকট করতে লেগেছে ওমনি কোথা থেকে একদল নোংরা জামাকাপড় পরা ছেলে মেয়ে এসে আমাদের পাশে পাশে হেঁটে ভয়ের রাস্তাটুকু পার করে দিয়ে গেল। একটাও কথা ক‌ইলে না। বোবা নাকি রে বাবা!
    বন ছাড়িয়ে একটু উপরে উঠেই দেখি, মাথার উপরে উপুড় করা প্রকান্ড একখানা গামলার মতো কী চমৎকার নীল আকাশ,রাস্তার ধারে ধারে, বাগান ঘেরা চমৎকার সব বাড়িঘর। সাদা রেলিং দেওয়া কাঠের বারান্দায় সারি সারি টবে র‌ঙবেরঙের ফুল ফুটেছে, বাগানে নাসপাতিগাছে , সোনালীরঙা রস টুপটুপে পাকা ফলের বাহার । আরে এইটিই তো তাঁর ছেলেবেলার বাড়ি।
    এরপর যতো এগোই পাকদন্ডীর প্রতিটি বাঁকে ,থুড়ি পৃষ্ঠায় কতো যে বিখ্যাত মানুষের ঠিকানা! তাঁদের অতুলনীয় কীর্তি কলাপ , অসামান্য জীবনযাপনের মনকাড়া গপ্পো।
    ও হরি !এতক্ষণ বলি নি বুঝি , হলদে পাখির পালক খোঁজার অছিলায় তাঁর‌ই লেখা বই নিয়ে বুঁদ হয়ে আছি আবারও। আহা ,যদি সত্যি হতো এই পথ চলা ! হঠাৎ শুনি মনের ভিতর ঝগড়ুই কথা কয়ে উঠলো
    “সত্যি যে কোথায় শেষ হয়,আর স্বপ্ন যে কোথায় শুরু বলা মুশকিল।কেন তোমাদের রবিঠাকুর‌ই তো বলে দিয়েছেন ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি ,ঘটে যা ,তা সব সত্য নহে’ —পড়ো নি বুঝি!”
    এতক্ষণে হয়তো বিজ্ঞজনের ভ্রূ কুঁচকে গেছে। —এটা আবার কী ধরনের প্রবন্ধ ! গুরুগম্ভীর একখানা বিষয়, থান ইটের মতো শক্ত শক্ত শব্দ আর, তথ্যের বুনটে ঠাসা থাকবে , তবেই না বুঝি! কিন্তু কী আর করা , যাঁর সম্পর্কে লিখতে বসেছি তিনি মানুষটাই যে এমন‌ই। সহজ সরল ভাষায় ,কখন যে মনের মধ্যে সেঁধিয়ে যান ,কেউ টেরটিও পায় না। তাঁর চরিত্রদের কেউ বা “বারান্ডাওয়ালা” টুপি পরে, আবার কারোও বা উত্তেজনায় চোখ “জ্বলজ্বলিং”।
    যাঁর বর্ণনার এমন সহজ সরল ভাষা, তাঁর জন্য এমন ভাষাই তো লাগস‌ই ,কী বলো!
    উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভাইঝি, সুকুমার রায়ের বোন ,এই পরিচয় পাশে সরিয়ে রেখে , অনায়াসেই নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছেন শিশুসাহিত্যের পোক্ত জমিতে।
    কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রী, স্বর্ণপদকসহ , রবীন্দ্র পুরস্কার ,দেশিকোত্তম আরও কতশত সম্মাননায় ভূষিত, কর্মজীবনে কখনও বা রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে বিশ্বভারতীর শিক্ষকতা আবার কখনও বা কেন্দ্রীয় সরকারে উচ্চপদের গুরুদায়িত্ব ,এইসব সামলেও, তিনি অনায়াসেই খেলতে নেমে পড়েন শিশুমনের আঙিনায়।
    কথায় বলে , নিজের ছেলেবেলা ভুলে যাওয়া নাকি মহাপাপ। লীলা মজুমদারের কলমের মায়ায় ,ঘটে যায় সেই শাপমুক্তি। কতো কী-ই যে মনে পড়িয়ে দেন তিনি! বাথরুমে বন্দী কতশত দুষ্টু শিশুকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন সাবানের ফেনার রঙিন বুদবুদে রামধনু তৈরী করার ফন্দি ফিকির , আঙুলের ডগায় স্কেল নাচানোর খেলা , তিনিই তো শিখিয়ে দিয়েছেন কতগুলো ফুটোকে ময়দা দিয়ে জুড়ে তৈরী হয় পাঁউরুটি।
    সেইসব মনে পড়তেই প্রাপ্তবয়স্করাও নিজেদের অজান্তেই সামিল হয়ে যান শিশুদের সঙ্গে পথ হাঁটতে। চলে লম্বা শোভাযাত্রা ‌।সেই শোভাযাত্রায় থাকে , কানকাটা নেড়ি ,ডানা ভাঙা পাখি,পকেটমার , বাঁশ বাগানের ভূতের দল, মায় রাতের বেলায় পুল পার হ‌ওয়া মালগাড়ির চেনে লেগে থাকা গানের সুর , টং -লিং – টং লিং।
    দৈনন্দিন জীবনের ব্যথা বেদনায় দরদী হাতে মলম লাগিয়ে দিতে তাঁর জুড়ি নেই। বুঝিয়ে দেন এই পৃথিবীটা মোটেও স্বর্গরাজ্য নয় , ভালো লোকের পাশাপাশি চোর জোচ্চোর ফেরেববাজের‌ও অভাব নেই কিন্তু তাই বলে ‌তোমার মনের ভিতরে মায়ার প্রদীপখানি কিছুতেই নিভতে দেওয়া চলবে না। কারণ তুমি যে ‌মানুষ!
    তাঁর মুখচ্ছবিতে তামাম বাঙালি খুঁজে পায় নিজের ঠাকুমার আদল , আদর করে‌ সকলের মনেই গেঁথে দিয়ে গেছেন জিয়নকাঠির মন্ত্র।তাই তো মনখারাপের আঁধার পেরিয়ে আজও ভোরের আলোয় হেসে ওঠে বাঙালি ,পায় প্রতিদিনের পথ চলার নতুন উৎসাহ।

  • প্রবন্ধ,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    প্রবন্ধ- মায়ের আঁচল

    অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    প্রবন্ধ- মায়ের আঁচল
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

    বাংলায় একটা কথা আছে “বন্যেরা বনে সুন্দর , শিশুরা মাতৃক্রোড়ে” । কোন‌ও সন্দেহ নেই জগতের সমস্ত শিশুদের জন্য‌ই এই কথাটি ধ্রুব সত্য। মানবশিশুর জন্য আরও একটি পরম ভরসাস্থল ধ্রুবতারার মতো চিরসত্য হয়ে বিরাজ করে , সেটি হলো মায়ের আঁচল।
    এই জগতে মায়ের আঁচলের তুল্য আর আছেটা কী? ছেলেবেলায় স্নানের পর ভেজা চুল , খেলার মাঠ ফেরত ঘামে ভেজা মুখ,
    অঙ্কের খাতায় কম নম্বর পাওয়ার চোখের জল , বাড়িতে আসা অচেনা অতিথির সামনে‌ থেকে আড়াল খোঁজা , এইসব কিছুর জন্য , মায়ের আঁচল‌ই তো চিরকাল শিশুদের একমাত্র ভরসাস্থল।
    স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ‌ও তাঁর “ছেলেবেলা”র
    স্মৃতিচারণায় লিখেছিলেন সন্ধ্যাবেলায় গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে লম্বা অন্ধকার বারান্দা দিয়ে ‌”ভূতের ভয় শিরদাঁড়ার উপর চাপিয়ে চলে যেতুম মায়ের ঘরে”…., সেই মায়ের আঁচলের ভরসায়।
    কালের নিয়মে বয়স বাড়ে। শিশু থেকে বালক, বালক থেকে কিশোর , তরুণ ,যুবক — ক্রমশ সে স্বাবলম্বী মানুষ , পা বাড়ায় মুক্ত জীবনের পথে। তখন তার আর ঠিক সেইভাবে মায়ের আঁচলের দরকার পড়ে না , আঁচলের আওতা ছেড়ে বহির্বিশ্বে পা রাখার জন্য সে উদগ্রীব।
    ” র‌ইবো না আর বদ্ধঘরে দেখবো এবার জগতটাকে , কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে” —প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পক্ষে সেটাই তো স্বাভাবিক। মা-ও, সন্তানকে এগিয়ে দেন জীবনের যাত্রাপথে।
    মায়ের আঁচলের ছায়া , কিছুটা নেপথ্যে রেখে তখন সে জীবন পথের পথিক।
    পথ হাঁটতে হাঁটতে ক্রমে বেলা বাড়ে । অপরাহ্ণের আলো এসে পড়ে গায়ে মাথায়।জীবনের অতিবাহিত কাল ক্রমশ পিছে সরে সরে যায়। সংসারের নিত্য দিনের টানাপোড়েনে মায়ের ছায়া আবার মাঝে মাঝে মানসপটে উঁকি দিয়ে যায়, হয়তো বা সেদিন সে রৌদ্রদগ্ধ মানুষের মতোই ক্লান্তিতে বিধ্বস্ত , কখনও বা অকূল পাথারে দিশাহারা । মনখারাপের দিনে যেদিন সে নিজের সঙ্গে নিজে একেবারে একা ,খুব ইচ্ছে যায় মায়ের আঁচলের তলায় স্নিগ্ধ শীতল পাটির স্নিগ্ধ আশ্রয়টুকু আরও একবার ফিরে পেতে। মধ্যরাতের একা বিনিদ্র শয্যায় , নিভৃতে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দু মুছতে মায়ের অদৃশ্য আঁচলখানিই যে তখন একমাত্র সম্বল। পৃথিবীর সমস্ত আলো নির্বাপিত হলেও, মায়ের স্নেহপরশটুকু আঁধার ঘরের প্রদীপ হয়ে জ্বলতে থাকে , জ্বলতেই থাকে অনির্বাণ শিখায়।

  • প্রবন্ধ,  স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার

    প্রবন্ধ- খাদ্যরসিক বাঙালি

    ।। অমরনাথ স্মৃতি সাহিত্য প্রতিযোগিতা ।।

     

    খাদ্যরসিক বাঙালি
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    বাঙালি যে চিরকালের খাদ্যরসিক, সেকথা কে না জানে ! এই অবিসংবাদিত সত্যটি এক লহমায় জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় সুরসিক সাহিত্যিক শ্রী সুকুমার রায়ের লেখা বিখ্যাত “খাই খাই” কবিতায়। বাঙালিকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন –“যতো কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে ,
    জড়ো করে আনি সব ,থাকো সেই আশাতে” ।
    এককথায় এইটিই হলো আমবাঙালির মনের কথা।
    কথায় বলে রসে বশে বাঙালি। তাতে আর সন্দেহ কী! হাস্যরস আর খাদ্যরস উভয় ক্ষেত্রেই যে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার আমাদের কাব্য সাহিত্য ,গান চিরকাল তার সাক্ষ্য দিয়ে এসেছে।
    প্রাণধারণের জন্য প্রাণীমাত্রের‌ই খাদ্যের প্রয়োজন , মানুষ‌ও ব্যতিক্রম নয় ,যেটা ব্যতিক্রমী সেটা হলো একদল খায় বেঁচে থাকার জন্য আর অপরদল খাওয়ার জন্যই বাঁচে। বাঙালিকে এই দ্বিতীয় শ্রেণীতেই মানায় ভাল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ‌ই তো বলে গিয়েছেন–বাসনার সেরা বাসা রসনায় “
    প্রাচীনকাল থেকে বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের মূল কাঠামোটি অপরিবর্তিত থাকলেও, তার খাদ্য তালিকায় যুক্ত হয়েই চলেছে নিত্যনতুন রেসিপি।
    বাংলাভাষায় রান্নাঘরের অপর নাম রসবতী কারণ এইখানেই বাঙালি,স্বাদের তিক্ত ,কটু ,কষায় , লবণ,অম্ল , এবং মধুর এই ষড়রস অবলম্বনে রসনা পরিতৃপ্তির, নিত্যনতুন ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’মেতে থাকে । তবে
    যতোই আধুনিক হোক না কেন , বাঙালির আজও ভাত ছাড়া চলে না।ভেতো বাঙালি তকমাটি সে সানন্দেই বয়ে বেড়ায়, ন‌ইলে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ানো ,মুর্গমুসল্লম্, কাবাবে অভ্যস্ত শ্রী সৈয়দ মুজতবা আলী খোলাখুলি ঘোষণা করবেন কেন , একবার জাহাজে ভ্রমণকালে ‘চারটি আতপ চাল ,উচ্ছেভাজা, সোনামুগডাল , পটলভাজা আর মাছের ঝোলের’ জন্য তাঁর প্রাণ কেঁদেছিলো!
    প্রখ্যাত ঐতিহাসিক শ্রী নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন ”ইতিহাসের ঊষাকাল হ‌ইতেই ধান যে ‌দেশের প্রধান উৎপন্ন বস্তু, সে দেশে প্রধান খাদ্য হ‌ইবে ভাত ইহাতে আশ্চর্য কিছু নাই’।
    দ্বাদশ শতকের কবি শ্রীহর্ষের নৈষধ চরিত গ্রন্থে ভাতের একটি অনবদ্য বর্ণনা মেলে।
    ‘পরিবেশিত অন্ন হ‌ইতে ধূম উঠিতেছে, তাহার প্রতিটি কণা অভগ্ন,একটি হ‌ইতে আর একটি বিচ্ছিন্ন ,সে অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু শুভ্রবর্ণ ,সরু ও সৌরভময় ‘।
    এমন চমৎকার অন্নসুবাসের আখ্যান, বাংলা ছাড়া অন্যত্র কোথাও সম্ভব কিনা জানা নেই ।
    প্রখ্যাত সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন,
    সে যুগে কৃষি গবেষণাগার ছিলো না ,সম্পন্ন চাষীরা নিজেদের চেষ্টায় মাটি বদলে বদলে , নতুন ধরনের সার ও গন্ধদ্রব্য দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ধান চাষে ব্রতী হতেন। বংশানুক্রমে, সেই সব ধান চাষ করিয়ে ধান বীজ রক্ষা করা হতো ।তাঁর পিতামহের সৃষ্টি, সজনেফুলি ,বাসরভোগ , রাঁধুনিপাগল, নামের চালগুলি আজও সেই সাক্ষ্য বহন করে।
    ‘ধন্য ধন্য বলি তাঁরে’।
    প্রাচীনকালে সম্পন্ন গৃহস্থের ভাতের থালায় নাকি চৌষট্টি পদ পরিবেশিত হতো।শেষ পাতে দ‌ই । এযুগেও বাঙালির পাতে পঞ্চব্যঞ্জনের সমাহার। অভিজাত সবজির পাশাপাশি খাদ্যগুণসমৃদ্ধ থোড় ,মোচা ,ডুমুর‌ও পিছিয়ে নেই। রন্ধনপটিয়সীর হাতের গুণ ও মশলায় এগুলির স্বাদ‌ও যে অনন্যসাধারণ , বাঙালি মাত্রেই তা জানে। জানিয়ে রাখা ভালো এইসব রান্নায় ফোড়ন এবং মশলার আনুপাতিক হার‌টি পাটিগণিতের তেলচিটে বাঁশ আর অক্লান্ত বানরের , অঙ্কের চাইতে কিছু কম জটিল নয়!
    কথায় বলে মাছে ভাতে বাঙালি।
    নদীমাতৃক বাংলাদেশের খালবিল যেন সোনালী, রুপালি আঁশে ভরা মছলি কাঁথার মাঠ, ফলে বাঙালি যে ‘ চিরকাল মৎস্য মারিবে খাইবে সুখে’ তা-তো স্বতঃসিদ্ধ।
    বৈদিক যুগের মুণিঋষিদের ভ্রূকুটি অগ্রাহ্য করে বঙ্গবাসী মাছকে বেশ করে তেলে মশলায় , কষিয়ে ঝালে, ঝোলে অম্বলে রসনার তৃপ্তি সাধন করে এসেছে, এমনকি কণ্টকের কল্পনাতে ম্রিয়মান না হয়ে,নির্দ্বিধায় মাছের মাথা এবং কাঁটাচচ্চড়িটুকুও সাপটে খেয়ে নিয়েছে।
    প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে নাকি সরষের তেলের প্রচলন ছিল না , পর্তুগীজদের হাত ধরে সর্বপ্রথমে বাঙালিই তৈলবীজ থেকে ঝাঁঝালো সরষের তেল নিষ্কাশনের ব্যাপারটা চালু করেছিলো। ভাগ্যিস্ ! ন‌ইলে আমরা তেল ক‌ই ,ইলিশপাতুরি ,চিতলমাছের- মুইঠ্যার স্বাদ পেতাম কী করে! আর আলু ভাতে মাখতে কাঁচালঙ্কার সঙ্গে এক ফোঁটা সরষের তেল !!
    মাংসেও বাঙালির অরুচি নেই। প্রাচীন গ্রন্থে শূল্যপক্ক মাংসের উল্লেখ তো মেলেই ,আধুনিক যুগে মোগলাইখানার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তাও তার প্রমাণ। চপ কাটলেট, বিরিয়ানি- চাপ, ছাড়া আজ বাঙালির ভোজ‌ই অসম্পূর্ণ।
    ‌‌ চা-স্পৃহ চঞ্চল, বাঙালির স্ট্রিটফুডে আসক্তির তুলনাও মেলা ভার। ফুচকা , সিঙারা, আলুরচপ, ঝালমুড়িই তার প্রমাণ।
    বাঙালি সর্বদা
    মধুরেণ সমাপয়েৎ-এ বিশ্বাসী।বাংলার পোশাকি মিষ্টির জগৎজোড়া সুনামের পাশাপাশি, ঘরোয়া নলেন গুড়ের পায়েস পিঠে, ,নাড়ু,মোয়া ,মুড়কিও কম আদরণীয় নয়!
    এক কথায় পুরো বঙ্গসংস্কৃতিতেই জুড়ে রয়েছে সুখাদ্যের আঘ্রাণ।
    এইখানে উল্লেখ করা ভালো , কোলোষ্টরেলের তোয়াক্কা না করা, শ্রমবিমুখ বাঙালির শরীর স্বাস্থ্য ,তাকে প্রায়ই বিপদে ফেলে।
    এই রসগোল্লার আবিষ্কারক হিসেবে বাঙালি যতোই কৃতিত্বের দাবিদার হোক না কেন ,বহির্বাংলায় চিরকাল‌ই সে ‘বাঙালিবাবু’ নামে টিটকিরির পাত্র। তবে সুখের বিষয় আধুনিক বাঙালি এখন অনেক বেশী স্বাস্থ্যসচেতন , সুষমখাদ্য‌ ও শরীরচর্চায় মনোযোগী।
    বাঙালির সংগীত, শিল্প , সাহিত্য , ছেলেভুলানো ছড়া, ব্রতকথা– এককথায় সম্পূর্ণ জীবনচর্যায় নানাভাবে খাবারের প্রসঙ্গ,প্রমাণ করে দেয় বাঙালির খাদ্যরসিক তকমাটি কতোটা উপযুক্ত।
    রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানসীর উদ্দেশ্যে
    লিখেছিলেন ,
    ‘একালে চলে না সোনার প্রদীপ আনা
    সোনার বীণাও নহে আয়ত্তগত ,
    বেতের ডালায় রেশমি রুমাল টানা
    অরুণবরণ আম এনো গোটাকত।’
    এতেই পরিষ্কার, কবি মাত্রেই বায়ুভূক নয়। তাঁরাও দিব্যি রসে বশে জীবন কাটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং রান্না নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসতেন। তাঁদের বাড়িতে বিদ্বদজনসভায় প্রচুর সুখাদ্য পরিবেশিত হতো যদিও কবি স্বয়ং ভোজনরসিক হলেও ভোজনবিলাসী ছিলেন না।
    সুকুমার রায়ের মন্ডাক্লাবের‌ও এই বিষয়ে যথেষ্ট সুনাম ছিল। অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিই এই সভার নিয়মিত সভ্য ছিলেন।
    কাজী নজরুল ইসলাম‌ও কম যেতেন না। জেলবন্দী থাকাকালীন নিয়মিত মোগলাইখানা রেঁধে নিজে তো খেতেন‌ই, সঙ্গে রাজবন্দীদের‌ও খাওয়াতেন। শিবরাম চক্রবর্তী যখন স্বদেশী আন্দোলনের জেরে জেলে গেলেন, নজরুল ইসলাম যারপরনাই খুশি হয়ে, তাঁকে খাইয়ে দাইয়ে, এমন একখানা মোগলাই চেহারা বানিয়ে দিলেন যে , সারা জীবনেও সেই চেহারা একটুও টসকায়নি।
    সাম্প্রতিকতম উদাহরণ
    জুনিয়র উইম্বলডন চাম্পিয়ান, আমেরিকাবাসী বঙ্গসন্তান সমীর‌ ব্যানার্জি ।একটি সাক্ষাৎকারে,নিজেকে বাংলার বিরিয়ানি আর চাটের ভক্ত বলেই দাবি করেছেন । আরও অজস্র উদাহরণ পেশ করাই যায়, তবে মনে হয় তামাম বঙ্গসন্তানের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বাদটি বোধহয় দিনশেষে, শৈশবের নৈশাহারে, ঘুম জড়ানো চোখে মায়ের হাতের রূপকথার গন্ধমাখা গরাসখানাতেই মেলে।

  • চিঠি

    চিঠি- আমার একলা লাগে ভারি

    আমার একলা লাগে ভারি
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    ….
    আজ রবিবার। সকাল থেকেই তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। আমার বাড়ির প্রশস্ত লনের কোণে, বিশাল ওক গাছটা থেকে থেকেই প্রবল বেগে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, এই বন্দীজীবন ওর‌ আর ভালো লাগছে না বোধহয়, ওর‌ও কী আজ মনখারাপের দিন ঠিক আমার‌ই মতো!
    আশ্চর্য! কতোগুলো বছর কেটে গেল এদেশের মাটিতে, তবু এইরকম ঘনঘোর বর্ষায় আমার মন ছুটে চলে যায়, আমার ছেলেবেলার রাঙামাটির দেশে, খুব মন কেমন করে তোর জন্য, তোদের সক্কলের জন্য। রাস্তাঘাট, স্কুল বাড়ি, খেলার মাঠ, নীল গগনের সোহাগ মাখা আমার সকাল সন্ধ্যেবেলা, সব, -সব কিছু এসে ভীড় করে এসে দাঁড়ায়, আমার মনের মধ্যে। খুব ইচ্ছে করে, তোর সঙ্গে কথা বলতে, কিন্তু এখন তো তার‌ও কোন‌ও উপায় নেই, পৃথিবীর অপর গোলার্ধে এখন গভীর রাত, তোরা সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। অগত্যা নিজের মনে একাএকাই সুখ দুঃখের কথা ক‌ই।
    আমার ছেলেরা তো এখন যে যার নিজের ঘরে দুয়ার এঁটে মোবাইল নিয়ে বসেছে। প্রকৃতির পানে চেয়ে দেখার অবকাশ নেই তাদের। আসলে ওরা তো কেউ রোদেপুড়ে, জলে ভিজে কাদামাটি মেখে বড়ো হয়নি আমাদের মতো, কোন‌ও দিন হাঁটে নি শীতের কুয়াশা মাখা আবছাপথে।এদেশে কেবল বৃষ্টি আর বরফ, গৃহবন্দী এইসব শিশুদের খেলাধূলাও সব গ্যাজেট নির্ভর। তাই ওদের শৈশব‌ও আমাদের মতো স্বপ্নেমোড়া নয়। ওরা কেউ কোন‌ও দিন কাগজের নৌকা ভাসানোর আনন্দটুকু পেল‌ই না। আমাদের এইসব সুখ দুঃখের গল্পের মর্ম ওরা আর কী বুঝবে বল!
    খুব ভুল যদি ভেবে না থাকি তাহলে এখন তো বোধহয় আষাঢ়ের শুরু। আমাদের রাঙামাটির দেশে বৃষ্টি নেমে গেছে। আমি মনে মনে বেশ দেখতে পাই, তুই বাদলা দিনে বারান্দায়, থামে হেলান দিয়ে, কালো পাথরের বেদীতে পা ছড়িয়ে বসে বৃষ্টি দেখছিস। বড়ো বড়ো সব গাছপালার পাতা বেয়ে জল গড়িয়ে নামছে, কাকগুলো সব ভিজে ঝুপ্পুস।
    আমাদের বাড়ির এই বারান্দাটা কিন্তু বড্ডো ভালো, বল্! বিরাট বড় বারান্দায় গোটা চারেক থাম, রেলিং এর বদলে চ‌ওড়া কালো পাথরের বেদী দেওয়া। ছুটির দিনে অনেকটা সময় আমরা ওখানেই কাটাতাম।
    দুই ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে লাল সুরকি ঢালা পথ সারা বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে, পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে বেলফুল আর রঙ্গনের গাছ। গেটের মাথায় জুঁই এর ঝোপ আজ‌ও গন্ধ ছড়ায় জানি। কুয়োতলার পাশে নীলমণি লতার মনকাড়া নীলিমা।
    এক একদিন রাতে আমরা সবাই রাতের খাওয়ার পর বারান্দায় বসে গল্প গুজব করতাম, বাবা আমাদের গান গাইতে বলতো। তুই তো চিরকাল‌ই ভালো গাইতে পারিস।তোর রিনরিনে গলার সুর ছড়িয়ে পড়তো চারপাশে। আমি ছিলাম ফাঁকিবাজ। গান গাইতে চাইতাম না, গাইলেও মাঝপথে থেমে গিয়ে বলতাম- আর জানি না।
    একবার কিন্তু, বাবা আমায় খুব জব্দ করেছিল, মনে আছে তোর? ‌ ছেলেবেলায় খুঁটিনাটি সব কিছু নিয়ে বায়না ধরা ছিল আমার স্বভাব। যেটা চাই, সেটা না পাওয়া পর্যন্ত ঘ্যানঘ্যান চলতেই থাকতো। প্রতিবছর বর্ষায় কদম ফুল ফোটা শুরু হতেই বায়না জুড়তাম, ঐ ফুল পেড়ে দিতে হবে। রোজ রোজ অতো উঁচু গাছের ফুল পাড়ে কে? একদিন মালীকাকু একখানা কদমগাছ এনে পুঁতে দিয়ে বলেছিল-
    “নাও আজ থেকে এটা তোমার গাছ। বড়ো হলে দেখবে কতো ফুল দেয়।”
    বাবা বলেছিলো-
    “না, অতো সহজে কোনো কিছু পাওয়া যায় না, পেতে নেই। যেদিন ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ গানটা ঠিকঠাক গাইতে শিখবে, সেই দিন‌ই ওটা তোমার হবে।”
    আমিও তেড়েফুঁড়ে উঠে কিছুদিনের মধ্যেই শিখে নিয়েছিলাম গানটা, আর নিজের অজান্তেই পেয়েছিলাম এক অমূল্য শিক্ষা। আকাঙ্ক্ষার বস্তু পেতে নয়, নিজের যোগ্যতায় অর্জন করতে হয়। আজ‌ও মনে রাখি সেই কথা।
    আমার পূর্ণবয়স্ক কদম গাছ সময় মতোই ফুল ফুটিয়েছে, এখন‌ও নিয়মিত অজস্র পুষ্পসম্ভার নিয়ে হাজির হয় বাদলের গান শোনাতে। তোর তোলা ছবি দেখে, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাই।
    বৃষ্টিটা মনে হয় ধরে এলো। ওকের ছুঁচালো পাতার আগা থেকে বিন্দু বিন্দু জল ঝরছে, ঠিক যেমনটি আমাদের বাড়ির সামনের ইউক্যিলিপটাস গাছ থেকে ঝরতো টুপটাপ করে। মনে আছে, বৃষ্টিটা একটু ধরলেই আমরাও বেরিয়ে পড়তাম? বাগানের জল যাওয়া নালাটা তখন ঘোলা জলের খরস্রোতা নদী । সেই নদীতে আমরা দুজন কত্তোগুলো কাগজের নৌকায় নিজেদের নাম লিখে ভাসিয়ে দিতাম! দিব্যি হেলেদুলে ভেসে ভেসে চলে যেত ওরা অজানার পথে।
    জুঁই ফুলের গন্ধ ভরা রাতে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে কল্পনায় দেখতাম সেই নৌকা তখনও ভেসেই চলেছে পরীরাজ্যের ঠিকানায়। হাতের মুঠোয়, আপনি এসে ধরা দিতো স্বপ্নলোকের চাবি।
    ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে এখন। আকাশ থেকে বিলীয়মান আলোর আভা এসে পড়েছে লনের উপরে। ঠিক যেন সেই গানটা ‘ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে ,বাদল বাতাস মাতে মালতীর গন্ধে’- কিন্তু আমাদের দেশের মালতীর গন্ধ এরা পাবে কোথায়?
    চল দাদা আমরা দুজন মিলেই না হয় গাই গানটা,
    আমি গাইবো গুনগুন করে, আর তুই গাইবি আমার মনে।
    ও আর‌ও একটা কথা, এবার যখন দেশে যাবো আমরা দু’জন মিলে কাগজের নৌকা ভাসানোর খেলাটা আবার খেলবো, শুধুই আমরা দুজন, কেমন! ……

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- প্রভু আমার প্রিয় ‌আমার

    প্রভু আমার প্রিয় ‌আমার
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    -“দাদু ও দাদু নীচে যাবে না?” ঠাকুরমশাই তো কখন এসে গেছে। পুজোও শুরু করে দিয়েছে, একটু পরেই আরতি হবে। ঠাম্মা তোমাকে নীচে যেতে বললো।”
    -“আমি যে এখানেই আরতি দেখতে বসে আছি দাদুভাই।”
    -“সে আবার কী, এখানে আবার কে আরতি করবে? কোন ঠাকুরের আরতি?”
    -“এখানে যে স্বয়ং প্রকৃতি আয়োজন করেছেন জগদীশ্বরের বন্দনায়। ওই দেখো পুবের আকাশ আলো করে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। বাতাসে ফুলের সুগন্ধ। এইসব আয়োজন কী শুধুই এমনি এমনি কোনও কিছুই বৃথা যায় না জেনো।”
    -“যাঃ , কী যে বলো না তুমি! দুটো কী এক হলো নাকি?”
    -“এক‌ই দাদুভাই। তফাৎ শুধু কে কেমন ভাবে দেখবে তার উপরে। ওখানে গৃহস্থের গৃহকোণে বিগ্রহের পায়ে আত্মনিবেদন, আর এখানে প্রকৃতির মাঝে অসীমের আরাধনা।”
    -“বা -রে,আরতি করতে তো কতো কিছু লাগে, যেমন পঞ্চপ্রদীপ, ধূপ, আরও কতো কী। এখানে সেইসব ‌কোথায়?”
    -“এখানেও সব আয়োজন তৈরি। ঐ দেখো, পূর্ণিমার চাঁদে পঞ্চপ্রদীপের আলো, ফুলের সুবাসে ধূপধুনোর আয়োজন, হাওয়ায় নারকেল পাতারা চামর দোলায়।”
    -“আর মন্ত্র? মন্ত্র পড়বে কে?”
    -“কেন আমি।”
    -“তুমি মন্ত্র জানো?”
    -“জানি বৈকি। শোনো মনকে যা ত্রাণ করে, তাই হচ্ছে মন্ত্র। আমার ‌অবলম্বন শুধু কিছু গান, ঐ ভাষাতেই আমি আত্মনিবেদন করি, ওটাই আমার মন্ত্র।”
    -“দাদু, তোমার পাশে একটু বসি?”
    -“ইচ্ছে হলে বসবে বৈকি! যাও তাহলে ওপাশ থেকে ছোট টুলখানা টেনে নিয়ে এসে বসো।”
    অতঃপর সেই চন্দ্রালোকিত সন্ধ্যায়, দাদু তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে গান ধরলেন-“ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা, প্রভু তোমার পানে…”
    নীচ থেকে ভেসে আসা ধূপের গন্ধ আর ফুলের সুবাসে মাখামাখি হয়ে সেই সুর, পার্থিব সীমানা ছাড়িয়ে পাড়ি দিচ্ছিলো ঊর্ধ্বলোকে।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- জীবনের চালচিত্র

    জীবনের চালচিত্র
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

    তরুণ ফল বিক্রেতা ফটিক, ঠেলাগাড়িতে করে ফল নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি করে বেড়ায়। বেলা এখন প্রায় সাড়ে দশটা। নানান এলাকা ঘুরে, অবশেষে এই শুনশান পাড়াটিতে ঠেলা নিয়ে ঢুকে পড়লো সে। এদিককার ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে অনেক বাঁধা খদ্দের আছে তার।
    এই এলাকায় বেশ কিছু সম্পন্ন মানুষের বসবাস। ফটিক সঠিক ওজনে, ন্যায্য দামে, টাটকা ফল বেচে বলে অনেকেই বাজার থেকে না কিনে তার‌ অপেক্ষাতেই বসে থাকেন। তাই ফটিক রোজ একবার করে এই পাড়াটা ঘুরেই যায়।
    আজ‌ও এই পাড়ায় ঢুকতেই সাদা রঙের ফ্ল্যাটবাড়িটার দিকে নজর চলে গেল। তিনতলার ‌বারান্দা থেকে হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকছেন বোসবাবু। তিনি একজন শাঁসালো খদ্দের, দু’ তিন দিন অন্তর‌ বিস্তর ফল কিনে থাকেন। ফটিক খুব খুশি হয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল।
    তিনতলা থেকে নীচে নেমে এসে নেড়েচেড়ে ফলগুলো বাছাই করে রাখছিলেন বোসবাবু। তরমুজ, সবেদা, কলা, পেয়ারা বেছে বেছে একপাশে রেখেছেন, আর কী নেওয়া যায় ভাবছিলেন‌ তিনি। ওপাশের বটতলায় খেলা করা দুটি বাচ্চা, খেলা ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
    -“ও দাদু ঐ যে দেখো দেখো ওপাশে কতো আঙুর- সবুজ, কালো নেবে না?”
    -“আঙুর? কোথায় আঙুর? ওহ্ ঐ যে, হ্যাঁ হ্যাঁ, পাঁচশো আঙুর‌ও দিয়ে দে তো” তারপর হঠাৎই খেয়াল পড়তেই বাচ্চাদুটিকে খেঁকিয়ে উঠলেন,”এ্যাই‌ তোরা এখানে কী করছিস রে? ভাগ্ এখান থেকে।”
    শিশুদুটি একটু সরে দাঁড়ালো কিন্তু চলে গেল না।
    ফটিক সবুজ রঙের ‌আঙুর ওজন করছে, অপেক্ষাকৃত ছোট বাচ্চাটি বলে উঠলো, “ও দাদু ঐ কালোগুলো নাও না, কী সুন্দর দেখতে!”
    না, তারা নিজেরা খাওয়ার কথা ভাবছিল না, তাদের ‌ইচ্ছেটুকু মর্যাদা পাচ্ছে, এইটুকু দেখলেই তারা খুশি, এটাও বুঝি তাদের খেলার‌ই অঙ্গ!
    বোসবাবু আবার খেঁকিয়ে ওঠার আগেই ফটিক ছোট এক থোলা কালো আঙুর তাদের হাতে তুলে দিতেই, অবাক বিস্ময়ে উৎফুল্ল বাচ্চাদুটি এক ছুট লাগালো ওই বটতলার পানে।
    ফটিক এবার মুখে মুখে হিসেব কষছে, শেষটায় সাড়ে পাঁচশো আঙুরের দাম ধরতেই, বোসবাবু রেগে উঠে বললেন, “এ্যাই দাঁড়া দাঁড়া, এতকাল ধরে ফল নিচ্ছি তোর কাছে, এখন আবার ঠকাতে শুরু করে দিলি!”
    -“কী ঠকালাম বাবু?”
    ওই বাচ্চাগুলোকে যে আঙুরের থোকাটা দিলি, তার দামটাও এখান থেকেই আদায় করছিস না রে? চাইলাম পাঁচশো আঙুর, দাম নিচ্ছিস সাড়ে পাঁচশোর?”
    মৃদু হেসে ফটিক আঙুরগুচ্ছ আবার পাল্লায় চাপিয়ে সঠিক ওজন বোসবাবুকে দেখিয়ে দিল। ইলেকট্রনিক ওজন যন্ত্র বরং ওপাশেই একটু ঝুঁকে আছে। বোসবাবুকে আশ্বস্ত করে ফটিক হেসে বললে, “খদ্দের ঠকানোর ব্যবসা আমি করি না বাবু। ওটুকু আমিই ওদের ভালোবেসে খেতে দিলাম।”
    বোসবাবু এবারে আশ্বস্ত হয়ে দাম মিটিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ পিছন ফিরে বললেন, “এভাবে চললে তোর ব্যবসা তো লাটে উঠবে রে।”
    ফটিক হেসে বললে, “ওটুকু ক্ষতি আমার পুষিয়ে যাবে বাবু, ওদের হাসিমুখের দামে।”
    আজীবন পাইপয়সার হিসেব কষা বোসবাবুর ভ্রু’টা অবশ্য কোঁচকানোই রয়ে গেল! এইসব আবেগকে প্রশ্রয় দিলে ব্যবসা করে আর খেতে হয় না!
    আদ্যোপান্ত ঘটনাটির সাক্ষী, দোতলার বারান্দায় বসা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের মুখে একটুকরো হাসি খেলা করে গেল। নিজের মনেই মৃদুস্বরে আবৃত্তি করলেন –
    ” যে ধনে হ‌ইয়া ধনী
    মণিরে মানো না মণি
    তাহারি খানিক মাগি আমি নতশিরে।”
    এমন‌ই কতোশতো টুকরো টাকরা মুহূর্ত দিয়ে তৈরি হয় আমাদের জীবনের চালচিত্র, কখনও খেয়াল করি, আবার কখনও বা আনমনে ভেসে যায়, কালের স্রোতে, হারিয়ে যায় কালের গর্ভে।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- চির পথের সাথী

    ‌ চির পথের সাথী
    -সুমিতা দাশগুপ্ত

     

     

    -“ঈশ্, কী যে বিচ্ছিরি লাগছে, এবারের পঁচিশে বৈশাখটা, কেমন মাঠে মারা গেল, বলো দাদু! না কোনও সেলিব্রেশন, না একটু গান বাজনা, কেবল‌ই মনখারাপ করে ঘরে বসে থাকো।”
    -“গান! সে তো তুমি ঘরে বসেও গাইতে পারো”।
    -“দূর্ আমি কি গাইতে পারি নাকি? সুর ভুল হয়ে যায়।
    -“তুমি তো অন্যকে শোনানোর জন্য গাইছো না, গাইবে নিজের জন্য, সেখানে তোমার মনের সুর‌ই আসল সুর। শুধু কথাগুলো ভালো করে বুঝে গেও, তাহলেই হবে।”
    -“ধুর কী যে বলো না! কোথায় সবাই মিলে মজা করে হৈ চৈ করবো, তা- না ঘরের কোণে চুপচাপ বসে থাকো।”
    -“তা বটে, তোমাদের মজাটাই তো আসল, সেটাই তো ঠিক জমলো না।”
    -“তবেই বলো। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে দাদু, ছোটবেলায় আমাদের রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন! একমাস ধরে সে কি আনন্দ, হৈ চৈ! স্কুল থেকে ফিরে কোন‌ওমতে নাকে মুখে গুঁজেই দে ছুট্ —রিহার্সালে। আবৃত্তি, গান নৃত্যনাট্য, আর‌ও কতো কী। তারপর রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনে কতো লোক, ফুল, মালা, আলো, হাততালি, আহা! কী যে আনন্দের দিন ছিলো সেসব।”
    -“হুম্”
    -“কী-ই তখন থেকে শুধু হুঁ হুঁ করেই যাচ্ছো। আচ্ছা তুমি সবসময় এতো কুল থাকো কী করে বলো তো? তুমিই তো বলো রবিঠাকুর তোমার জীবনের একমাত্র ঠাকুর! তাঁর জন্মদিনটা এইভাবে চলে গেল,খারাপ লাগছে না তোমার?
    -“না তো, আসলে আমার ঠাকুরের যে প্রতিদিন‌ই জন্মদিন।”
    -“কী যে হেঁয়ালি করো না তুমি! রোজ কার‌ও জন্মদিন হতে পারে নাকি?”
    -“পারে বৈকি। প্রতিদিন‌ই আমি যে তাঁকে নতুন রূপে পাই, আমার মনে তাঁর নিত্য নতুন উদ্ভাস।”
    -“বুঝলাম না ঠিক।”
    -“না বোঝার তো কিছু নেই দিদিভাই, তিনি রোজ আমার মননে নতুন ভাবে ধরা দেন, তাই তিনি নিত্য‌ই নূতন।”
    -“আর, তুমি যে বলো তিনিই তোমার একমাত্র ঠাকুর, মানুষ কখনও ঠাকুর হয় নাকি?”
    -“হয় বৈকি। একলা রাতের অন্ধকারে, মানুষ যখন নিজের সঙ্গে নিজে একা, সংসারের অকূল পাথারে দিশাহারা, তখন তিনিই তো এসে হাতখানি বাড়িয়ে দেন, একলা পথের সঙ্গী হতে।”
    -“আচ্ছা তিনি কি কেবল তোমারই ঠাকুর?”
    -“তেমন করে চাইলে তিনি সবার‌ই ঠাকুর, শুধু তাঁর মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করার অপেক্ষা।”
    -“পাবো কোথায় সেই মন্ত্র?”
    -“গীতবিতানের পাতায় পাতায়, তাঁর‌ই পূজার গানে।”
    -“দাদু একটা গান গাও না প্লিজ।”
    -“বেশ লাইটটা নিভিয়ে এসে বোসো, আমার সাথে গলা মেলাও।”
    -“আমার যে গলায় তেমন সুর নেই!”
    -তাতে কী, মনপ্রাণ ঢেলে গাইলে, সুর আপনি এসে ধরা দেবে তোমার প্রার্থনায়।”
    -“কোন গান দাদু?”
    -“চিরসখা হে ছেড়ো না মোরে ছেড়ো না….”

You cannot copy content of this page