-
কবিতা-“মনুষ্যত্ব”
“মনুষ্যত্ব”
-সুমিতা পয়ড়্যাওই ছেলেটি নিশ্চয়ই নালিশ করেছে ঈশ্বরের কাছে!
ঈশ্বর সবটা শুনেছেন আর বসে বসে ভাবছেন…
না না ভাবছেন না; দেখছেন; সত্যতা যাচাই করছেন- কারণ শিশুরা কখনো মিথ্যা কথা বলে না।
ঈশ্বর তাই নিশ্চুপ; আকাশের ওপারে।মানুষের ভোগের বাসনা কত আড়ম্বরপূর্ণ,
মানুষের লোভ লালসা দিগন্ত ব্যাপৃত,
আরো চাই আরো চাই-এর ঘরে আবদ্ধ।
কে মরছে! কে কাকে মারছে! কে হারছে! কে জিতছে…
কি হচ্ছে- ওসব দৃষ্টিপাতের বাইরে!মনুষ্যত্ব স্বার্থপরতার করাল গ্রাসে আটকে গেছে।
বিশ্ব বিবেক আত্মকেন্দ্রিকতার রুদ্ধদ্বারে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে
দিশেহারা মনুষ্যত্ব বিশ্বমানবতার কানে কানে ফিসফিস করছে।ঈশ্বর দেখছেন; তবু চুপচাপ অলৌকিক শক্তির ঘরে
তিনি দেখছেন, মানুষের বাড়বাড়ন্ত আর কতদূর প্রসারিত হতে পারে!
কতদূর প্রভাবিত হয় ঘরে কিংবা বাইরে!
চাওয়া আর পাওয়ার নেশায় উন্মত্ত মানুষ।
সবাই যেন অন্ধত্বের খাতায় নাম লিখিয়েছে।এ কেমন মানুষ! এ কেমন তার মানবতা জ্ঞান!
এ কেমন তরো মনুষ্যত্বের অধিকারী!
ঈশ্বর দেখছেন অদৃশ্যে অলক্ষ্যে বসে…
ভাবছেন আর ভয় পাচ্ছেন…
এ কোন ভুল সমীকরণের ফল!শ্রেষ্ঠ জীবের ক্ষমতা হাতে নিয়ে মানুষের মনুষ্যত্ব আজ ধুলায় লুণ্ঠিত।
ঈশ্বর উপলব্ধি করেছেন, শিশুটি ঠিকই বলেছিল…
যে যন্ত্রণা সে সয়ে এসেছে তা কি তার প্রাপ্য ছিল!
হিংসা, অবজ্ঞা, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা- এই মনুষ্যত্বের ধারক বাহক!বিস্ময় বিস্মিত ঈশ্বর এখনো চুপ তার নিত্য ধামে
কেউ দমে নেই; সবাই হয়েছে রাজা।
অনুধাবন করছেন আর অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ভাবছেন-
এ কেমন সৃষ্টি তার!মানুষ তো মানুষের জন্য
একে অপরের পাশে থাকার জন্য
ভরসার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য
উন্মুক্ত পৃথিবীতে যে কজন বেঁচে আছে
সকলেই আরো বেঁধে থাকার জন্য।তবুও মানুষ তো মানুষই।
নিজের আত্মমর্যাদা হারিয়েছে,
নিজের মনুষ্যত্ব হারিয়েছে,
মনুষ্যত্বের, বিবেকের সংকটে মিথ্যা করে তুলেছে চিরন্তন সত্য কে-
“প্রত্যেকে আমরা পরের তরে”হাজার কোটি বছর ধরে মানুষ মানুষ হয়ে জন্মেছে আর মৃত্যু হয়েছে।
অমরত্তের মহান অর্ঘ্য পেয়েছে কি কোনদিন!
সেইতো পঞ্চভূতে বিলীন হবে।
সেইতো প্রকৃতির সঙ্গে মিশবে।
মানুষ মরণশীল; বৃথা আত্মম্ভর আশায় আর্তনাদ
অনন্তকালের পবিত্র আলোয় মিশে যাওয়ায় মানুষের মনুষ্যত্বের পবিত্র আহ্বান। -
কবিতা- বিরহ
বিরহ
-সুমিতা পয়ড়্যাআমার ভালোবাসার কোন শোক নেই
নেই কোন বিষাদ
ব্যথা- বেদনা-যন্ত্রণা কিছুই নেই
কোনো ক্ষোভ নেই, কোনো অস্থিরতা নেই
আমি জানি আমার জন্য কোনো ভালোবাসা নেই
কৈশোর থেকে শুধু আশা করে বসে আছি
একদিন ঠিক কোন এক ভালোবাসা এসে বলবে— ভালোবাসি ভালোবাসি।
সত্য প্রেমই ছিল আমার আস্ফালন।
আর সব মিথ্যা জীবন দর্শন।
কিন্তু আমি তো সবটা জানি না!
ভালোবাসায় মিথ্যাও থাকে, তাও জানিনা !
কিভাবে মিলনের বিচরণ করতে হয় তাও জানি না ,
নীরব থাকতে শিখেছি; নিভৃতে জলে ভিজতে শিখেছি
কিন্তু জোর শিখিনি; ভালবাসায় যে তা ব্রাত্য
আমি ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করতে শিখেছি
নিজেকে দুমড়েমুচড়ে শেষ করতে শিখেছি
অপেক্ষা করতে করতে নিয়ম ভেবেছি
অভ্যাস করেছি অনায়াসে
নিজেকে হাতের মুঠোয় আবদ্ধ রেখেছি।
আমার ভালোবাসার কোন বাসনা নেই
নেই কোনো ইচ্ছা; নেই কোনো প্রতিবাদ
প্রতিকারও চাইনি কখনো!
আমার ভালোবাসার প্রতি অটল বিশ্বাসই সাজিয়েছে আপন অন্তঃপুরে।
আমার কোন প্রার্থনা নেই; আমার কোনো কান্না নেই
আমার কোন লজ্জা নেই; নেই কোন প্রতীক্ষা
আমি আর শুনছি না, দেখছিনা চারিদিকে।
প্রথম আলিঙ্গনের ভালোবাসা আমার আগুন
সেই আগুনে আমি দগ্ধ হয়েছি বারংবার
সেই তাপে এখনো পুড়ছি!
দগদগে ক্ষত স্মৃতির যজ্ঞে।
আত্মার আত্মীয় তেমনই উন্মুখ প্রতীক্ষায়-
একটাই লক্ষ্য- একটাই দৃষ্টি- যা সর্বোত্তম তাই আমার ভালোবাসা।
আমি কখনো ফিরেও চাইনি আমার ভালোবাসাকে
কখনো জিজ্ঞাসা করিনি, কেন চলে গেছে?
যেখানে ভালোবাসা নেই; সত্য প্রেম নেই
সেখানে প্রশ্নটাই তো মিথ্যা অবান্তর!
আমার কৃতজ্ঞতা আমার ভালোবাসার চরণে নিবেদিত প্রাণ। -
কবিতা- অহংবোধ
অহংবোধ
– সুমিতা পয়ড়্যাআজ আমি আমিত্বের ঘরে প্রবেশ করলাম-
আজ ঘুম থেকে উঠে নিজের মুখটা ভালো করে দেখলাম আয়নায়।
দেখলাম অন্তরের আমিটাকে, এতদিন বাহিরের আমিটাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।
আমার আমিত্বকে বিসর্জন দিয়েছিলাম শুধু একজন মানুষের জন্য
খালি ওই মানুষটার কথা ভাবতে ভাবতেই কেটে গেছে দিন রাত;
আজ ওই মানুষটার জন্যই আমার আমিটাকে খুঁজে পেলাম। প্রতিমুহূর্তের অপেক্ষা- প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে।
আজ নিজেকে নিজের মতো করে দেখলাম।
স্বামীজীর কথাটা আজ সত্যি হলো— উনি বলেছিলেন,“অন্তত দিনে একবার সেই মানুষটার সাথে কথা বলো, যাকে তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো। “
অথচ তার সঙ্গে কথা বলাই হয়নি।
কত কাল কত যুগ পেরিয়ে গেল,
আমি আমার আমিটাকে ভুলেই ছিলাম;অনেক অনেক দিন পর সেই আমিটা ধরা দিয়েছে।
প্রত্যেক মানুষ তো তার নিজস্ব আমিটাকেই বেশি ভালোবাসে;
আর আমি শর্তের আবর্তে আমার
আমি-টাকে বলি দিয়েছিলাম, দেখছিলাম মানুষ কত নিচে নামতে পারে!
ভালোবাসতে গেলে বোধ হয় নিচেই নামতে হয়!
শুধু ছলনার আশ্রয়; সত্যরা ঘুমায়!
ভালোবাসতে গেলে বোধহয় শর্তের ঘেরাটোপে আবদ্ধ হতে হয়!
ভালোবাসতে গেলে অন্ধ থাকতে হয়!তবুও বিশ্বাস হাওয়ায় মিলায়।
এরচেয়ে ঢের ভাল আমার আমিত্বের অহংকারের একলা একা পথ চলা।
অন্তর-বাহির জুড়ে শুধুই আমি, আমি আর আমি। -
গল্প- বদ অভ্যাস
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
বদ অভ্যাস
-সুমিতা পয়ড়্যাটিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে এলো যেন! বাড়ির সামনে দিয়ে লম্বা রাস্তা চলে গেছে চৌরাস্তার মোড় পর্যন্ত। সেই রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। দু-একটা ঝাঁপ ফেলা দোকান খোলা। রাস্তাতে লোকজন নেই, একেবারে শুনশান।
দূরে কোথাও মেঘমল্লার রাগের সুর ভেসে আসছে। বাতাসে ঝোড়ো হওয়া। স্যাঁতসেতে বাতাসে গরম গরম আর চা খেতে ইচ্ছে হলো অক্ষয়বাবুর।
বয়সটা প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই করছে। কদিন পরেই চাকরি জীবনের অবসর নেবেন। ছেলেমেয়েরা সব বাইরে চাকরির সূত্রে। বাড়িতে এখন লাবু আর তিনি।
লাবু হলো গিয়ে অক্ষয়বাবুর একমাত্র সঙ্গী লাবণ্যময় দেবী। যেমন তার প্রভা তেমন তার গুণ। একাই এই বয়সেও সংসারটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছেন। অক্ষয়বাবু মুখে কিছু না বললেও ভিতরে ভিতরে স্ত্রীকে নিয়ে একটা আলাদা গর্ববোধ করেন। উপরে সবসময় খুনসুটি। এতে লাবুর মেজাজ থাকে সপ্তমে চড়ে। আর অক্ষয়বাবু এটাই উপভোগ করেন খুব বেশি করে। নুন ছাড়া রান্নার স্বাদ কেমন বিষাদ হয় তেমনি লাবণ্যময়ী দেবীর চিৎকার বকবক ছাড়া সংসারটাও কেমন যেন বিস্বাদ লাগে অক্ষয়বাবুর।
সাহসে ভর করে অক্ষয়বাবু বলেই ফেললেন, লাবু ভিশন চা আর পকোড়া খেতে ইচ্ছে করছে; খাওয়াবে গো!
লাবণ্যময়ী দেবী বলে উঠেন, এত খাই খাই করো না তো! শরীরটা ঠিক রাখতে হবে, বয়স হয়েছে এটা জানো তো!
বলে নিয়ে আবারও বললেন—-ঠিক আছে, আজ দিচ্ছি। ঘনঘন বলবে না কিন্তু!
অক্ষয়বাবু হেসে উঠলেন, বললেন–না না আজই প্রথম, আজই শেষ। আমি জানতাম তুমি আমাকে না বলতে পারবে না। তাইতো তোমাকে এত ভালোবাসি।লাবণ্য দেবী হাসতে হাসতে বললেন, খুব হয়েছে! বলেই রান্না ঘরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা আর পকোড়া এসে হাজির।
দুজনে মুখোমুখি বসলেন ব্যালকনিতে। খাওয়া শুরু করলেন গল্প করতে করতে।কিন্তু যেটা হবার সেটা তো হবেই। যা ঘটবার তা তো ঘটবেই। সেখানে কারুর কিছু করার থাকে না।
হঠাৎ অক্ষয়বাবুর হাতটা কেঁপে ওঠে আর চায়ের কাপটা থেকে ছলকে খানিকটা গরম চা পড়ে যায়। পড়বি তো পড় একেবারে লাবণ্যময়ী দেবীর পায়েই পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে লাবু দেবী হাঁ হাঁ করে উঠলেন—-কি যে করো বুঝি না বাপু! সবকিছু তোমারই কি হতে হয়? অসহ্য! যত্তসব বদ অভ্যাসের রাজা। গরম চা টা ফেললো ফেললো আমার পায়েই ফেললে। মেঝেতেও তো পড়তে পারতো! তানা সেই আমার কপালে। উফফ! কি যন্ত্রনা মাগো। এদের হাত থেকে আমার নিস্তার নেই।অক্ষয় বাবু বললেন, আরে ইচ্ছে করে করেছি নাকি! হঠাৎ হাতটা কেটে গেল। তা আমি কি করবো বলো! শান্ত হও লাবু। সরি লাবু। দেখি কোথায় লাগলো! গরম চা টা পড়েছে। পুড়ে গেল কিনা দেখি। দাও পাটা। একটু বার্নল লাগিয়ে দিই। দেখাও পা টা। আর কখনো হবে না।
সরি- সরি- সরি।লাবণ্যময়ী দেবী বকবক শুরু হয়েছে। থামানোটা অত সহজ নয়। তবু বলে গেল এক নিঃশ্বাসে—–
আমার তো সকাল-সন্ধ্যা বলে কিছু নেই; শখ- আহ্লাদ বলে কিছু নেই।
তার ওপর যত বদঅভ্যাসগুলো সব সহ্য করতে হবে। খালি কাজ বাড়াও। কোন কাজই তো কোন সাহায্য নেই, শুধু অকাজ। দুমিনিট শান্তিতে বসব তারও উপায় নেই। তুমি কেমন মানুষ কে জানে? ভগবান কি দিয়ে তৈরি করেছেন তোমাকে?অক্ষয়বাবুও কম যান না। বলে ফেললেন—‘যত দোষ নন্দ ঘোষ।’
ব্যাস আর যান কোথায়?লাবণ্যময়ী দেবী বলে ওঠেন: না মশাই! কেউ এমনি এমনি বলে না। একটাও যদি ভাল অভ্যাস দেখতাম তাহলে আর বলার জায়গায় থাকত না। সব বাজে অভ্যাস— যাকে বলে বদ অভ্যাস।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেশের মধ্যে নাক ঝাড়া —কোথায় গিয়ে কি পড়ল তা কে দেখে শুনি! সেই তো আমি। কোনদিন বেসিনটা পরিষ্কার করেছ?না তো!
কোনদিন দেখলাম না পাপোশ গুলো সুন্দর করে ঠিক জায়গায় রয়েছে। দোমড়ানো মোচড়ানো—-
পাপোশ দিয়ে কেউ পায়ের ওপরের জল গুলো মুছে জানা ছিল না। তোমার সঙ্গে বিয়ে না হলে জানতেই পারতাম না।
যেখানে বই পড়ছে সেখানে বই খুলে রেখে চলে গেলে। কে গোছায় শুনি! ছোটবেলায় শুনেছিলাম বই খুলে রাখলে ভুতে পড়ে নেয়। তুমি নিজেই একটা ভূত তাই তোমার কাছে কোন ভূতেরাও আসবেনা। ওরাও জানে তোমার ছিরিগুলো! কি সুন্দর সুন্দর সব অভ্যাস! এক্কেবারে যা তা।এইতো সেদিন চোখের চশমাটা পড়ার সময় নিয়ে পড়বে তারপর তাকে খুঁজতে গিয়ে ঘরবাড়ি সব লন্ডভন্ড করবে। করেছিলে কিনা বল! তোমার সঙ্গে কোন মানুষ থাকবে? কেউ থাকবে না। আমি বলে বর্তে গেলে এ যাত্রায়।
তুমি যে কি পারো আর কি পারো না, তা একমাত্র আমি আর ওই ওপর ওয়ালায় জানেন।
বাথরুমে যাবে জল দেবে না। জলের নাকি ঘাটতি চলছে! পরবর্তী প্রজন্ম খেতেই পাবেনা। তাই বাথরুমে জল না দিয়ে জল জমাচ্ছেন। তোমাকে পৃথিবীর সব জল ধরে রাখার দায়িত্ব দিয়েছেন ভগবান।
আর এদিকে ফ্ল্যাট বাড়িতে যে গন্ধে গন্ধে বাস করাটা কি দুর্বিষহ তা কে ভোগ করে শুনি! খুব যে বড় বড় কথা বলছে!জায়গার জিনিস জায়গায় থাকলে অন্ধ মানুষও খুঁজে পায়। সেই কোন ছোটবেলায় বাবার কাছে শুনেছিলাম। আজো তা পালন করে চলেছি। আর তুমি তো চোখ থাকতেও অন্ধ। কিছুই খুঁজে পাওনা। এক জায়গার জিনিস কোথায় গিয়ে বাস করছে তা এই আমি ছাড়া কেউ জানে না।
অক্ষয়বাবু আবার বলে উঠলেন—–তোমার কি কোন বদ অভ্যাস নেই। যদি তোমারটা বলি!
লাবণ্য দেবী আবার বলে উঠলেন—-হ্যাঁ! হ্যাঁ! বল! বলো না! থামলে কেন! দেখি কি দোষ দেখতে পাচ্ছ!
বছরে কটা ছাতা হারাও খেয়াল আছে? ভোটের ডিউটি সারতে গিয়ে প্রতি ভোটে লুঙ্গি- গামছা- মশারি আমি ফেলে আসি, আমি! তাই না! নতুন জিনিস গুলো পাল্টে পুরনো নিয়ে আসি আমি।
আর কত বলব! বলতে গেলে মহাভারতও মুখ লুকাবে। বদ অভ্যাসের রাজা তুমি। বুঝেছ!
মানুষ চেষ্টা করে নিজেকে পাল্টাতে। ভালো হতে। ভালো ভালো অভ্যাস গড়ে তুলতে। সেটা তোমার দ্বারা হবে না তা আমি অনেক আগেই বুঝেছি। আর যার নয়ে হয় না তার নব্বই এ হবে! কক্ষনো না। কোনদিনও না।দেখছো,এই পকোড়াগুলো খেয়ে তেলটা কেমন গেঞ্জিতে মুঝে নিলে! দেখেছো তোমার কি অবস্থা! দিনে দিনে কি যে হবে কে জানে! আমাকে আরো কতই না সহ্য করতে হবে!
লাবু অশান্তি করো না। চুপ করো প্লিজ। এত মাথা গরম করতে নেই।
দেখো তোমারও অনেক বদ অভ্যাস আছে। আমি কিছু বলি না তাই।মানুষ মাত্রেই ভালো মন্দ অভ্যাস থাকে। কারো বেশি তো কারুর কম এই যা। কিন্তু থাকে তো। সে গুলোকে এভাবে বলার কি আছে? ভালো লাগবে না সেদিকে দেখবে না। আমিও দেখি না। তাই কখনো তোমাকে কিছু বলিও না।
লাবণ্য দেবী বললেন: থামলে কেন? বল বল, বাকি রাখছো কেন? এইটা বাকি আছে বলে ফেলো!
অক্ষয় বাবু বললেন: আজ্ঞে না, তোমার মত এত বকবক বা ঝগড়া করার অভ্যাস আমার নেই, অপ্রয়োজনীয় কথা নাই বা বললাম।
লাবণ্য দেবী আবার বলে উঠেন: ও আমি ঝগড়া করি, বকবক করি—তাই না! ঠিক আছে মনে থাকে যেন! এই আমি মুখ বন্ধ করলাম। আর কোন কথাই বলবো না। দেখি তুমি কি করে থাকো?অক্ষয় বাবু বললেন, আরে, মহা মুশকিল! আমি কি তাই বললাম! ওটা তো কথা প্রসঙ্গে কথা বলা। লাবু তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। রাগ করো না প্লিজ। লাবু শুনছো!
এই লাবু ডাকে একটা মাদকতা আছে। এটা লাবণ্যময়ী দেবী ভিতরে ভিতরে বারংবার উপলব্ধি করেছেন। তখন যেন সব রাগ, সব ক্ষোভ এক নিমেষে কোথাও উধাও হয়ে যায়। প্রেমের জোয়ার এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূরে- দুরান্তে কোন এক অজানা দেশে। আসলে অক্ষয়বাবু মানুষটা তো খুব ভালো মানুষ।
সামান্য কারণে একটু বেশি বেশিই করে ফেলেন লাবণ্যময়ী দেবী। নিজের ভুলটা বুঝতে দেরি হয় না তার।
সমস্ত রাগ উধাও করে লাবণ্যময়ী দেবী বলে বসলেন, আর এক কাপ চা দেবো নাকি?
অক্ষয় বাবু বললেন, দেবে বলছো! দাও তাহলে!দুজনে দুজনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। যেন সেই অবশ হওয়া চাহনি—যাকে বলে শুভদৃষ্টি! দুজনেই যেন এক আত্মার আত্মীয় হয়ে ওঠেন এক পূর্ণতায়। এ যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠে বিশ্বাস আর ভরসায়। রাতের আকাশের চাঁদটাও ফেল ফেল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে অবাক বিস্ময়ে।
দুজনেই একসঙ্গে বলে ওঠেন: দেখো, চাঁদটা কেমন দেখছে আমাদেরকে! বলেই দুজনে হা হা হা হা করে হাসিতে পুরনো হয়ে ওঠেন।
আর দুজনেই একসঙ্গে গেয়ে ওঠেন—-
“এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি! বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু…………………।” -
গল্প- “শূন্যতার করাল গ্রাসে”
অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার
“শূন্যতার করাল গ্রাসে”
-সুমিতা পয়ড়্যাহিরুবাবু মোটা মাইনের চাকরি করেন। ভরপুর সংসার। বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে আনন্দের ধরাধাম।কারুর নজর লেগেছিল কিনা জানা নেই।তাই ছেলে মেয়ে বড় হতে তাদের ভর্তি করা হলো কোনো এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় এক। হিরুবাবুর বাবা ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ডের কোন এক স্কুলে শিক্ষক ছিলেন। তিনি বলেই বসলেন, আমরা বাঙালি ;ছেলে মেয়ে মাতৃভাষায় বড় হবে এটাই গর্বের। পিতার মুখের উপর কথা বলবে এমন সাধ কোনকালেই ছিল না।
তাই হল। পিতৃদেবের আজ্ঞা শিরোধার্য। হিরুবাবু ছেলে মেয়েকে নিয়ে বাবার কাছে চলে এলেন। ছেলে মেয়েকে বাংলা মিডিয়ামে ভর্তি করানো হলো কিন্তু তাদের থাকতে হলো ঠাকুমা দাদু কাকু কাকিমার কাছে। হিরুবাবু ফিরে গেলেন। কিন্তু অত ছোট ছোট ছেলে মেয়ে বাবা মাকে ছেড়ে দাদু ঠাকুমার কাছে থাকা- এ যেন কোন এক অচেনা অজানা দ্বীপে পাড়ি দেওয়া। হিরু বাবু কিছু বলছেন না তো তাদের মায়ের কান্না দূর অস্ত।ছেলে অভ্র আর মেয়ে অনিমা ভর্তি হল স্কুলে। যথারীতি পড়াশোনা করতে করতে এক বছর পার হলো । বাবা মায়ের আদরের ছেলে-মেয়ে আজ ঠাকুমা দাদু কাকা কাকুর অনুগত। উনারা যা বলেন তাই শুনতে হয়। তার ফলে অভ্র খানিকটা মানিয়ে নিলেও অনিমা সারাক্ষণ মন খারাপ করে আর মায়ের জন্য কাঁদতে থাকে। যারপরনাই পরের বছরই অনিমা আবার বাবা-মার কাছে ফেরত চলে যায়। অভ্রকেও যেতে বললে সে আর গেল না। অভিমান থেকে সে বলেই বসলো—তোমরা কি শুরু করেছ! একবার এখানে, একবার ওখানে, আমি কোথাও যাবো না। এখানেই থাকবো। অভ্র তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। অনেক দুঃখ- ক্ষোভ-বেদনা নিয়ে তার পথ চলা শুরু হয়। কাউকে কোনো কথা বলত না । নীরবে সব কাজ সম্পন্ন করে যেত।ঠাকুরমা অভ্র কে অবশ্য খুব ভালোবাসতো। আর ভালোবাসত তার বন্ধুরা।কারণ বন্ধুদের কাছে অভ্রর কোনো না নেই।সব কর্মকাণ্ডে অভ্র সঙ্গী। একমাত্র ঠাকুরমাই অভ্র নাএলে খেত না, দুজনে একসঙ্গে গল্প করতো। এই ভাবেই চলছিল অভ্রর বড় হওয়া। হিরো বাবু মাসে মাসে মোটা অংকের টাকা বাবার হাতে তুলে দিতেন। কোনদিন হিসেবে নেন নি কিংবা জিজ্ঞাসা করেননি। ওদিকে হীরু বাবুর বাবা মানে অভ্রর ঠাকুরদা ঐ মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে শুধু জমি আর জমি কিনতে লাগলেন।
এরপর অভ্র পড়া শেষ করে বিটেক, এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করে। চেষ্টা করে চাকরিও পায়।
কিন্তু যে অনুপাতে তার পড়াশোনা ভালো করা উচিত ছিল তা পারেনি। কাকু কাকিমার গঞ্জনা, দাদুর বকুনি সব মিলেমিশে এক নৈরাশ্যের রাজ্যে বিরাজ করতো।
দিন যায় রাত যায়। এমনই এক দিনে হিরুবাবুর বাবা মারা যান।তখনও অভ্র ঠাকুরমার সাথে।অবশেষে হিরুবাবুর চাকরি জীবনের অবসান ঘটে। তখন ছেলের কাছে তারা চলে আসে। সেখানেই জায়গা কিনে বাড়িঘর করেন। বেশ চলছিল এইভাবে।
অভ্রর মা বেশ রাজরানী হয়ে ছিলেন। কোনদিন হিসেব-নিকেশ এর মধ্যে যাননি। খরচ করতে করতে একসময় টাকা শেষ হতে থাকে। তবুও তারমধ্যে মেয়ের বিয়ে ছেলের বিয়ে সব তিনিই দেন। ছেলে চাকরি পেলেও মোটা মাইনের চাকরি ছিল না। তাই তার পক্ষে খুব বেশি খরচ করা সম্ভব ছিল না।হিরু বাবুই ছেলের বিয়ে দিলেন।
অভ্রর বিয়ের পরে সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক অশান্তি লেগেই থাকত। সেই অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে অভ্রর মা একদিন বলেই বসলেন, আলাদা থাক, শান্তিতে থাক।
যেই বলা সেই কাজ। অভ্র তার স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেল এবং আলাদা থাকতে শুরু করলো। যথারীতি বাবা মায়ের প্রতি তার দায়বদ্ধতা কমে গেল। স্ত্রীকে নিয়ে সুখের ঘরে আড়ম্বরের, পরিপাট্যের ঝাঁ-চকচকে জীবনে অভ্যস্ত হলো। নিজের ছেলে হল।অন্নপ্রাশন থেকে পড়াশোনা কোনো কার্পণ্য নেই অভ্রর।স্ত্রীর সমস্ত চাহিদা পূরণ,স্বপ্ন পূরণ সবটাতেই অভ্রর কমিটমেন্ট ভরপুর।অথচ বাবা-মা-বোন এদের থেকে দূরে বহুদূরে সরে গেল। একবারের জন্যেও ফিরে তাকায় নি। অভ্রর পরিবর্তন লোকচক্ষুর আড়াল হল না। তবুও সে নির্বিকার।এদিকে হিরুবাবুর জমানো টাকা ক্রমশ শেষ হতে হতে তলানীতে ঠেকলো। কিন্তু কাউকে কিছু বলার নেই। ছেলেকেও না।
যেহেতু ছেলে ছোট থেকে বাইরে মানুষ হয়েছে তাই বাবা মায়ের প্রতি তার এমনিতেই অসন্তোষ ছিল। আর বিয়ের পরে আলাদা হয়ে আরো পাষাণ হয়ে গেল। ভুলেই গেল যে বাবা-মা তার আপনজন।
যথারীতি হিরুবাবু চিন্তা মগ্ন হয়ে পড়লেন। যখন চাকরি করতেন তখন বেশিরভাগ টাকাটাই বাবার হাতে তুলে দিতেন। তখন এত চিন্তা ভাবনা করেন নি। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে হিরুবাবু দেখতে পান কিছু জমি ছাড়া তার আর কিছু নেই। প্রায় সবটাই ছোট ভাইয়ের দখলে। হিরুবাবু এমনই এক মানুষ যিনি কখনো কারো সঙ্গে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হন নি। তার এই উদারচিত্ত আজ তাকে চিন্তায় ফেলেছে।চিন্তা করতে করতে অবসাদগ্রস্ত জীবনে চলে গেলেন। যেটুকু ছিল সেটুকু দিয়েই কোনরকমে চলছিল, আর মেয়ে এসে খানিকটা সামাল দিয়েছিল।
তবুও দিনে দিনে তিনি এক বিরাট শূন্য গহবরে তলিয়ে যেতে থাকলেন। যেখান থেকে মানুষ আর মানুষের মত ফিরে আসতে পারে না। নানা রোগে আক্রান্ত হলেন। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার আর কোন উপায় রইল না। শেষে ডাক্তারও জবাব দিলেন। আর কিছু করার নেই। যে কদিন বাঁচবেন এমনই বাঁচবেন।এমন শূন্যতার দ্বীপে পৌঁছে গেলেন যেখানে মানুষ হয়েও, এতকিছু করার পরও সবকিছুই শূণ্য।
পরে ছেলে বড় চাকরী করলেও বাবা-মাকে আর কাছে টেনে নেয় নি। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে সেদিন বলেনি, আমি আছি চিন্তা কিসের! কিছুটা ভরসার হাত বাড়ালে হয়তোবা এত শুন্যতা আসতো না। জীবন এতটা অন্ধকারময় হোত না।———
-
গল্প- স্মৃতির পাতায়
।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
স্মৃতির পাতায়
-সুমিতা পয়ড়্যাতমসা এখনো বসে বসে ভাবছে সেই দিনগুলোর কথা। আজ তমসার শাশুড়ি মায়ের বাৎসরিক কাজ শেষ হলো। ঘর গোছাতে গোছাতে ছবিটির সামনে বসে পড়ল, চোখে জল, ডুকরে ডুকরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো। মনের ভেতর দিয়ে এক ঝড় বয়ে গেল এক লহমায়। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যেন এক আবর্তে ঘিরে থাকা পুরো অজানা গল্পটা পড়ে ফেলল এক মুহুর্ত।
জন্মের পর জ্ঞান হবার মুহূর্ত থেকেই কালী কালী শুনে বড় হয়েছে তমসা। সত্যিই এত কালো যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না; পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে শুনতে-শুনতে কখন যেন আর ভালো নামের আড়ালে ডাকনামটাই বেশি প্রচলিত হয়ে গেছে। কালী বলে পাড়াই পরিচিতি।
22 বছর সংসার করেছে, তার শাশুড়ি মায়ের কাছে থেকেছে কিন্তু কোনদিন শাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে এমন কথা শোনেননি কিংবা কোন কাজে কোনো কটু মন্তব্যও কানে আসেনি– নিজের বাবা-মা যা অনায়াসে বলতে পেরেছিল যখন পাত্রপক্ষ পছন্দ করত না। কোন একদিন ছেলের বিয়ে দেবে বলে এই মা তো তমসাকে দেখতে এসেছিল। সবাই যেমন চা- জল- মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে তেমনি করেছিল তমসার বাবা-মা। এই নিয়ে পঁচিশ জন পাত্রের বাড়ির লোক দেখে গেছে। কালোর জন্য কেউ পছন্দ করে নি। তমসার বাবা-মা জানতো এনারাও পছন্দ করবেন না। তবুও মেয়ের বিয়ে দেবার চেষ্টা তো করতেই হবে আর তাই দেখতে আসতে বলা এবং তমসাকে সামনে হাজির করা।
সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের তমসার জন্ম। এক দাদা, এক দিদি ও বাবা মাকে নিয়ে পরিবার। সবাই যেমন তেমন হলেও তমসার গায়ের রং খুব কালো। তাই ওর বাবা-মা আদর করে নাম রেখেছিল তমসা। মানুষ ভাবে এক আর হয় এক। যতদিন এগোচ্ছিল নামের তাৎপর্য সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা মায়ের মনেও এক নীরব দ্বন্দ্ব শুরু হয়। খুবই খারাপ লাগত তমসার।
একের পর এক পাত্রপক্ষ দেখছে আর চলে যাচ্ছে। দ্বিতীয় বার আর কোন খবর আসছে না। এত কালো মেয়েকে নেওয়া যায় না। প্রত্যেকেই প্রথমে রূপ দেখে। তারপর গুণ বিচার করে। তমসা ছোট থেকেই খুব মেধাবী। সব কাজেই সে পারদর্শিতার পরিচয় দেয়। কিন্তু পাত্র পক্ষের কাছে সেটা ব্রাত্য। যাকে চোখে ধরছে না, তাকে মনেই বা ধরবে কেন! এইভাবে দিনগুলো চলছিল।
তবে তমসা এবার মনে মনে কি যেন একটা ঠিক করে রেখেছিল। যা কাউকে বলেনি। এমনকি বুঝতেও দেয়নি। দিন যায়-রাত যায় আর মনে মনে ভাবে তাকে একটা কিছু করতেই হবে। বাবা-মা তো কালো বলে চাকরি করা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে না সেটা তমসা বুঝেই গেছিল। দাদা দিদিদের বিয়ে হয়ে গেছে। এখন তারই পালা। কিন্তু পাত্রপক্ষ কিছুতেই তাকে পছন্দ করছে না। এমনই এক সম্বন্ধ আবার এলো এবং সেইদিনও উপস্থিত হল। পাত্রের বাবা-মা, মাসি মেসো, দিদি- জামাইবাবু দেখতে এলেন।
যথারীতি চা জলখাবার পরিবেশনের দায়িত্ব এল তমসার হাতে। একই প্রথা। নীরবে তমসা তা পালন করল। পরিপাট্য আভিজাত্যের একরাশ আন্তরিকতা। পাত্রপক্ষের আদব-কায়দা দেখে সবাই খানিকটা বুঝেই গেল যে, এটাও হবার নয়। তবুও পাত্রপক্ষ বলল বাড়ি গিয়ে আলোচনা করে জানাবো। ইত্যবসরে পাত্রের মা একটু বাইরে থেকে এসে ওয়াশরুম খুঁজতে লাগলেন। তখন তমসাই এগিয়ে এসে দেখিয়ে দিল। যখন উনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলেন ঠিক তখনই তমসা উনার পা দুটি জড়িয়ে ধরল আর বলতে শুরু করল———-
মা, তুমি তো মা। একজন মেয়েও। তুমি সর্বংসহা। তুমি জগৎ জননী। তুমি তো সব জানো মা। তুমি জানো আমি কালো, আমাকে কেউ পছন্দ করছে না। এমনকি তুমিও না। তোমার বাড়ির লোকেরা ও না। কিন্তু তুমি তোমার সন্তানকে বাঁচাতে পারো। তুমি আমাকে বাঁচাও মা, বাঁচাও। না হলে আমার আর বাঁচার উপায় থাকবে না। তুমি পারো আমাকে বাঁচাতে বলে তমসা কাঁদতে শুরু করল।
পাত্রের মা একটু অপ্রস্তুত এর মধ্যে পড়লেন। তবু তমসার মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি কেঁদোনা। আমি দেখছি কতটা কি করা যায়। তুমি ভালো থাকো। নিজেকে এত ছোট মনে কোরো না। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। এমনটা আর কেউ জানলো না। সবার অলক্ষ্যে এমন এক কাণ্ড ঘটে গেল। এরপর পাত্রপক্ষ বিদায় নিল। বাড়িতে গিয়ে সবাই এক বাক্যে বলল—-এত কালো মেয়ে; বাদ দাও। সবাই সব কিছু আলোচনা করলেও পাত্রের মা সেদিন কিছু আর বললেন না। খাওয়া-দাওয়া সেরে যে যার ঘরে শুতে চলে গেলেন। শুধুমাত্র পাত্রের মা সারারাত না ঘুমিয়ে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন। কোনটা দেখবেন—কালো না মেয়েটির গুণ! অনেক ভাবলেন! কিন্তু স্বামীকে কিছু বললেন না। অবশেষে রাত্রি থেকে সকাল হলো।
সকলে সকালবেলা থরর চায়ের আসরে বসেছেন। এমন সময় কথা প্রসঙ্গে পাত্রের মা বলে বসলেন—ওই কালো মেয়েটিই আমার ছেলের বউ হবে। সকলে সমস্বরে বলে উঠল, কি বলছো তুমি! ওই কালো মেয়েটা তোমার ছেলের বউ হবে! তোমার কি মাথাটা খারাপ হলো! পাত্রের মা অবিচল । তিনি আবারো দৃঢ়তার সঙ্গে জানালেন হ্যাঁ! ওই কালো মেয়েটি আমার ছেলের বউ হবে। ছেলেও শুনল সে কথা। ছেলেতো নিরুত্তাপ। মা হ্যাঁ বলেছে মানে হ্যাঁ। কিছুতেই মায়ের কথা ফেলতে পারবে না। মা কে দুঃখ দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং আর কোন কথা থাকতেই পারে না।
কথা বলা, বিয়ে সব হয়ে গেল। কালো মেয়ের সংসার বসল। তমসার চলাফেরা, আদব-কায়দা, চিন্তাভাবনা এক অনন্য পর্যায়ের দাবিদার হয়ে উঠল। সংসারের সকল কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা তাকে গুনগ্রাহী করে তুলল। মনে মনে সকলে সমীহ করতে শুরু করল। সব সময় সংসারকে আগল দিয়ে রেখেছে তমসা। আর মাকে রাজরানী করে রেখে দিল। মা মায়ের কাজ করেছে– তার সন্তানকে সমাজজীবনে কালোর হাত থেকে রক্ষা করেছে। সংসার দিয়েছে। নতুন জীবন দিয়েছে। তমসাকে আর কিছু বলতে হয়নি। নিজের সর্বস্ব দিয়ে আজ বাইশ বছর সংসার সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। কখনো কোনো আঁচ পড়তে দেয় নি। যদিও কখনো পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে কটুক্তি এসেছে কিংবা আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে কটুক্তি এসেছে তা মা একাই প্রতিবাদ করেছে । সুতরাং তমসার আর কিছু ভাবতে হয় নি।
স্বামী তাকে সত্যিই গ্রহণ করেছিল কিনা তা সে কোনদিন জিজ্ঞাসাও করে নি কিংবা ভাবেও নি কোন কিছু। কারণ তমসার বিয়ে হয়েছে এই না কত! নতুন জীবন পেয়েছে আর কি চাই!
তবে মাঝে মাঝে রবি ঠাকুরের কবিতার মাধ্যমে কিছুটা বুঝিয়ে দিতেন—-
“কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক—“।
তবে তমসা কখনো যাচাই করতে চাই নি। তমসা শুধু ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছিল।এই ভাবেই সুন্দর সংসার চলছিল তমসার জীবনে।
কিন্তু আমাদের জীবন এমনই যে, সব দিন একই রকম যায় না। জীবনে ওঠাপড়া থাকবেই। তাই হল। মা চলে গেলেন।হঠাৎ মায়ের চলে যাওয়াতে তমসা খুব ভেঙে পড়েছিল। তমসা এখনো বসে বসে ভাবছে সেই দিনগুলোর কথা। মা ও মেয়ে সেইদিনের অজানা ঘটনা তমসার স্মৃতির পাতায় একেবারে জ্বলজ্বল করছে উত্তর আকাশের ধ্রুবতারাটির মত। মাও কোনদিন কাউকে কিছু বলেননি এই প্রসঙ্গে।যা আর কেউ কখনও জানতে পারবে না।
ওমা কাঁদছো কেন? ছেলের ডাকে তমসার চমক ভাঙে আর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আরো জোরে আবেগে কাঁদতে থাকে। না বলা বাণী তমসার স্মৃতির পাতায় পাতায় কালো রং দিয়ে আজ পুরোটাই লেপে দিলো–যা আর কেউ কোনদিন পড়তেও পারবে না। পুরোটাই তমসার একান্ত গভীর গহনে সঙ্গোপনেই থেকে গেল। -
কবিতা- মৌন মেঘ
মৌন মেঘ
-সুমিতা পয়ড়্যারোদ ফুরিয়ে আঁধার ঘনাবে
কালো মেঘেরা বৃষ্টির কথা বলবে;
আনমনা উদাস মনে বৃষ্টির ছাঁট লাগবে গায়ে
ভেবেছিলাম মনের ভিতরে বাস করবো;
বাস করা আর হয়ে ওঠেনি
ভেবেছিলাম বৃষ্টির জলে সব বিষাদ ধুয়ে নেব; সেটাও হয়নি
ভেবেছিলাম অভিমানের গন্ধে কাছে আসবে; না কেউ আসেনি।
এমন দিনে তাকে বলবো ভেবেছিলাম; যদিও বলা হয়ে ওঠেনি
যখন নীল আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা
এখানে ওখানে জল ঝরে পড়ার গৌরব গাঁথা
বজ্রকন্ঠে মেঘ স্বর গর্জায় আকাশে আকাশে
তখন কত নকশার সমাগম জল ধারায়।
নীরব নিভৃতে হৃদয় অনুভবে কেবল সিক্ত প্রাণের অনুরণন—
যেমন করে বিদ্যুতের ঝলকানি ধরা মাঝে এক চিলতে আলোর ছটায় আলোকিত করে।
আষাঢ় বর্ষণে ব্যাকুলতা জীবনের কলরবে।
শ্রাবণ তখন একা একাই আভাস পাই ভরা বর্ষায় প্রাণবন্ত পৃথিবীর,
কেঁপে ওঠে হৃদয়- মন,আকুল, দোঁহে মেলাবার,
বাদল বেলায় ঘন ঘোর আঁধারে অভিসারে মন ধায় প্রাণপণে;
অনুভূতি ঝরায় আবেগের মনে তখন।
আর সব মিথ্যা জীবনের সুর কলতান
জীবনভর দুঃখ যন্ত্রণা, ব্যথা বেদনা; থাকে মনোভার।
সত্য শুধু সেই প্রেম যেখানে আপন আপনার।
এমন দিনে তাকে ইচ্ছে ছিল বলার—-
ভেবেছিলাম বলবো তাকে সুখে দুঃখে অনিবার।
মিলব দহে দুটি হৃদয় দুটি প্রাণ একাকার।
যেখানে হবে না কোনো দেওয়া নেওয়া, চাওয়া পাওয়া
থাকবে না আড়ম্বর; থাকবে না রাশি রাশি মিথ্যা সম্ভার।
শুধু দুজনে হবে দুজনার; একজনমের দীর্ঘশ্বাস!
এমন দিনে তাকে বলবো ভেবেছিলাম—
আর কিছু নয়; এমন বর্ষায় চিরন্তন সত্য সে প্রেম আপনার।
হলো না আর গান গাওয়া।
ঘুম ভাঙা চোখে দেখি ক্লান্ত মেঘেরা নিয়েছে ছুটি।
তৃষ্ণার্ত চাতকের মৌন মেঘ নানান কায়দায় নানান রঙে প্রকাশ করেছে নিজেকে নীল আকাশে।
দৃষ্টি পড়ে কদম গাছটায়। না- এখনো কদম পুরোটা ফোটেনি।
বৃষ্টিরা লজ্জায় প্রিয়ার আঙিনাতে আসেনি।
বৃষ্টি কখন বিষাদের জলে মিশে
ক্ষনিকের স্বপ্নের কাব্যরা বর্ষা ঋতুর ছবি আঁকে।
ভেবেছিলাম এমন দিনে তাকে বলবো।
বলা হলো না। -
কবিতা- প্রাক্তন
প্রাক্তন
-সুমিতা পয়ড়্যাপ্রাক্তন শব্দটি শুনলে অতীত মনে হয়
প্রাক্তন মানে তো অতীতই।
এ এমন অতীত যা বর্তমানে থাকে, ভবিষ্যতে থাকে
যখনই হোক না কেন স্মৃতিতে মিশেই থাকে
তাকে না যায় ভোলা, না যায় ভুলে থাকা।
মনে প্রাক্তন হলেও সর্বক্ষণের বর্তমান।
এক আলোকবর্ষ দূরে থাকলেও অশেষ কষ্ট- যন্ত্রণা সহ্য করা
কঠিন ভাবে বাঁচা;
প্রাক্তন মানে যার কথা মনে হলে এখনো বুকের ভেতরটা হা হা করে ওঠে, চিনচিন করে ওঠে,
ভুলতে গিয়ে বেশি করে মনে পড়ে যায়
প্রাক্তন বোধ হয় এমনটাই!
প্রাক্তন হলেও সে তো প্রিয় মানুষ।
প্রাক্তন মানে এক বিশাল ইতিহাস।
প্রাক্তন কি কখনো দুজনের হয়!
অবুঝ ভালোবাসা একজনেরই থাকে
না হলে বিচ্ছেদ হবে কেন; নাহলে অসহ্য হবে কেন!
না না, প্রাক্তন একজনের দিক থেকেই হয়
প্রাক্তনকে কোন সীমারেখায় বাধা যায় না।
প্রথম প্রেম তো ছাড়াছাড়িতে প্রাক্তন হয়।
তাকে ভুলবে কার সাধ্য! তবু প্রাক্তনই বলতে হয়।
শত শত পুরাতন গল্প কথা যেমন নতুন থাকে,
বুকের বামপাশে প্রাক্তনও সর্বদা বিরাজমান।
প্রাক্তন এর আয়োজন থাকে, প্রয়োজন থাকে,
কিন্তু কখনো ফিরে আসে না।
যা হারিয়ে যায় তা হারিয়েই যায়।
মন ভেজায় একা থাকা সুখের গন্তব্যে
একাকিত্বেই সম্পূর্ণতা; প্রহর গোনার প্রতীক্ষায় সম্পূর্ণতা
প্রাক্তন এসবের উর্দ্ধে।
ওরা ছেড়ে দেবে বলেই প্রাক্তন হয়–
ওরা কষ্ট যন্ত্রণা দেবে বলেই প্রাক্তন হয়–
ওদের নেশাতে প্রাক্তন, পেশাতে প্রাক্তন
প্রাক্তন শিরোপা নিতে ওরা ভালোবাসে।
কিন্তু প্রেমিকাকে ভালোবাসে না।
ওরা উজ্জ্বল আলোর গহনে ডুব দিতে ভালোবাসে,
ওরা আড়ম্বরের জীবনে নিজের সুখের সখ্যতাকে ভালোবাসে,
খড়কুটোর মতো অযাচিত হয়ে স্বপ্নের আবেশে বেঁচে থাকতে ভালোবাসে,
ওরা মরীচিকা বোঝেনা,
প্রেমিকার পাঠানো শেষ চিঠি পড়ে না,
জমকালো বিপুল দীর্ঘ বহুতলে মহিমার, পিয়াসার মসি মাখে;
তবুও ওদের পাষাণ হৃদয়ে কোনো আক্ষেপ থাকে না।
অপেক্ষা, প্রতীক্ষারা তো দূর অস্ত!
ওরা প্রাক্তন হতেই ভালোবাসে। আপনার আপনজন ভালবাসাকে কখনো ভালোবাসে না। -
কবিতা-“অদৃশ্য দৃশ্যমান”
“অদৃশ্য দৃশ্যমান”
-সুমিতা পয়ড়্যাস্মৃতিগুলো বড় দুরন্ত
কখনো হাসায় কখনো কাঁদায়
মনের মাঝে উঁকি দিয়ে শুধু কিছু বলতে চায়,
একাকিত্বের সঙ্গী।
লুকোচুরি খেলতে খেলতে দিন কাটায়;
রাত যখন গভীর হয়; তখন শিশুর মতো
তার মাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে থাকে।
ভয় পায় সে পাছে হারিয়ে যায়!
ভয় পায় নতুন উৎস সন্ধানে!
যদি ভেসে যায়, যদি বিনাশ হয়,
যদি সবটাই আঁকিবুকিতে কালো হয়ে যায়!
স্মৃতিগুলো আনন্দের সমারোহের গান গায়।
নতুন ভাবে বেঁচে থাকে নতুন নতুন দিনে
অধরাকে অধরাই রেখে দেয়।
যার শেষ নেই, ধ্বংস নেই, নেই কোনো বিবর্ণতা
শুধু বলে ওঠে–“স্মৃতি সততই সুখের।”
প্রতিক্ষণ-প্রতিমুহূর্ত জীবনেরই গান গায়—
তা সে যতই অন্ধকার হোক, ক্ষত-বিক্ষত হোক!
মনের অন্তরালে সুখ দুঃখের স্মৃতিগুলো জ্বলজ্বল করে ওঠে
আবার কখনো বা ঝাপসা করে দেয়—
এই নাকি তার কাজ!
এই ভাবেই নাকি মানুষের বেঁচে থাকার রসদ যোগান দেয়,
স্মৃতিগুলো ভিড় করে আসে বন্যা মহামারীর মত,
বিবর্ণ, জীর্ণতার ধুলায় ধূসরিত পাতায় পাতায় তালে তালে গান গেয়ে ওঠে।
ভালো স্মৃতি, ব্যথায় পরিপূর্ণতা স্মৃতি অনেকটা ঠিক পর্ণমোচী বৃক্ষের মত!
কখনো কিশলয় তো কখনো শুষ্ক রুক্ষ!
ক্ষনিকের জীবনে স্মৃতিগুলোই থেকে যায় অসম্ভবের সঙ্গতে।
অদৃশ্য অথচ দৃশ্যমান।
জীবন আছে তো স্মৃতি আছে–
এ যেন এক মহা কালের চক্রাবর্ত, একে যেন অপরের পরিপূরক। -
কবিতা-“মেয়েটির কবিতা বিহার”
“মেয়েটির কবিতা বিহার”
-সুমিতা পয়ড়্যামেয়েটি এখনো স্বপ্ন দেখে মনের ক্যানভাসে
মেয়েটি এখনো জীবনের ছবি আঁকে জলরঙে
মেয়েটি এখনো নতুন নতুন লেখা কবিতায় বাঁচে।তুলে আনে দিগন্তপারের গোটা সূর্যটাকে
কখনো মিশিয়ে দেয় সবুজের সাথে নীলকে;
কুড়িয়ে আনে অঞ্চল জুড়ে বকুলের সৎগাঁথা।
মনের আবেগে খুনসুটির সংসারে হেলায় হারায়,
আবার কখনো আবেগঘন কালো মেঘের বিদ্যুতের ঝলকানিতে দৃঢ়তা স্থাপন করে;
এটা সেটা করে করে ক্লান্ত দেহ মন কাব্য রোগে আক্রান্ত হয়
আর তখন মুঠো মুঠো কবিতাদের ছুঁড়ে দেয় বাতাসে।কোনোটা গিয়ে বসে গাছের মগডালে,
কোনোটা আকাশের তারাদের পাশে জায়গা খোঁজে,
কোনোটা বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে সাগর পাড়ে বিশ্রাম নেয়;
ধরণীর কোলে যেটা পড়ে থাকে তাকে হাতছানি দিয়ে পাঠকেরা ডাকে।
কত কথা, কত ছবি, কত স্বপ্ন, কত শব্দ!
সবাই একসাথে জীবনের কথা বলে; বেঁচে থাকার কথা বলে
আর বলে অনুভূতির কথা, উপলব্ধির কথা।মেয়েটি কবিতা লিখতে লিখতে শেখে জীবনের মানে
হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটু একটু চলতে চলতে এগিয়ে যায়,
অনুভূতির ঘরে অন্তরের- বাইরের মেলবন্ধনের সুখের- সম্ভোগের সান্নিধ্যের উপলব্ধি।
কবিতা লিখতে লিখতে মেয়েটি পৌঁছে যায় এক অনবদ্য বাস্তবের কঠিন সত্যে।
আর তখনই সহজে অনুধাবন করতে পারে সত্যের অচেনা গন্ধে আগুনের শীতলতা।