• গল্প

    একান্ত ব্যক্তিগত

    একান্ত ব্যক্তিগত
    -সুস্মিতা সাহা 

     

     

    (নিজের কথা থাক্ নিজেরই কাছে …মনের কথা মনেই )

    “ও বৌদি, রাগ কোরো না গো…কালও কিন্তু ভোর ভোর উঠে দরজা খুলে দিতে হবে। ঠিক পাঁচটার সময় এসে তোমার বাসন মেজে, ঘর ঝাড়পোঁছ করে দিয়ে যাবো” – মেঝেতে বসে আটা মাখতে মাখতে জানালো চামেলী…
    সঙ্গে সঙ্গে রুমনার ভুরু কুঁচকে গেলো। একরাশ বিরক্তির সাথে ও বললো- ” আবার সেই ভোর পাঁচটা ? জানিস কত রাত পর্যন্ত আমার কল্ থাকে? আমি ঘুমাতে যাই ই তো রাত দুটো আড়াইটের সময়…তারপর আবার ভোরবেলা উঠে তোকে দরজা খুলে দেওয়া…উফ্ এরকম করলে চলে না “
    মৃদুস্বরে চামেলী বলে- “রোজ রোজ এরকম করি না কি? ঠিক সময়েই তো আসি…মাঝেমাঝে এক আধটা দিন”…
    ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রুমনা আরও একটু ঝাঁঝিয়ে বলে- ” মাঝেমাঝে নয় চামেলী, আজকাল তুই প্রায়ই … খুব ঘনঘন এরকম করছিস।”
    মুখ নীচু করে চামেলী উত্তর দেয়- “কি করবো বলো বৌদি…ভাই এর মেয়েটার বিয়ে, বাপ মা মড়া মেয়ে…আমার মা এমন কান্নাকাটি করে…ভাই, ভাই এর বৌ তো নেই, আমরা চার পিসী দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে না দিলে “…
    রুমনা একটুও নরম হয় না, বিরক্ত কণ্ঠে সে বলে- “সে দাও না বিয়ে, যত খুশি বিয়ে দাও…আমি তো একবারও বারণ করছি না। আমাকে একজন বদলী লোক ঠিক করে দিয়ে তুমি পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে নাও। বারবার এই টাইম চেঞ্জ করা…আমাদের অফিস-করা লোকেদের খুব অসুবিধা হয়। আমি না হয় বেলা সাড়ে এগারোটা বারোটায় বেরোতে পারি…দাদাদের তো একেবারে সাড়ে ন’টার মধ্যে অফিসে পৌঁছাতে হয়। সময়ের একটুও এদিক ওদিক হলে চলে না। রাতের ঘুমটা ঠিকমতো না হলে…”
    এইবার চামেলী একটু নড়েচড়ে বলে ওঠে- “হ্যাঁ গো বৌদি, দাদা তো কদিন ছুটিতে আছে…এই সপ্তাহের ক’টা দিন তুমি একটু মানিয়ে নাও না গো”…

    একটু চমকে উঠলো রুমনা, দু’ সেকেন্ড থমকালো। প্রবাল যে গত বেশ কয়েকদিন ধরে বাড়িতে থাকছে- সেটা চামেলী কিভাবে জানতে পারলো?
    প্রত্যেকদিন বেলার দিকে অফিসে বেরোনোর আগে রুমনা পই পই করে স্বামীকে নানারকম ইনস্ট্রাকশন দিয়ে বেরোয় -“ফ্ল্যাটের দরজা একদম খুলে বাইরে বেরোবে না, ব্যালকনিতে গিয়ে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই , খাবার দাবার সব রেডি থাকবে, মাঝেমাঝে কিচেনে গিয়ে মাইক্রোওভেনে গরম করে নিলেই হবে।” মোদ্দা কথা -বেডরুমের বাইরে যাওয়ারই দরকার নেই । অ্যাটাচড বাথরুম তো আছেই , ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসে দরকারী কাজগুলো সেরে ফেলা যেতেই পারে…
    এসব সত্ত্বেও চামেলী কিভাবে টের পেলো যে প্রবাল গত কয়েকদিন ধরে বাড়িতেই থাকছে ?

    মেজাজটা আরও একটু তিরিক্ষি হয়ে উঠলো রুমনার। সেটা কোনোরকমে সামলে নিয়ে ও বললো- “সে তো গত দু’দিন তোর দাদার ওয়ার্ক ফ্রম হোম ছিল মানে বাড়ি থেকে কাজ করছিল তাই।”
    চামেলী তবুও বলে চললো-” দু” একদিন কি গো ? আমি তো দশ পনেরোদিন ধরে রোজই দেখি …ওই টিয়াদিদিদের ফ্ল্যাট থেকে… দুপুরবেলা ঘর মোছার সময়…তোমাদের শোওয়ার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাদা সিগারেট খায়…ওই দুপুরবেলায়…”

    রুমনাও ঝটপট বললো- ” হ্যাঁ হ্যাঁ , হতে পারে…দাদাদের অফিসে আজকাল মাঝেমাঝেই ওয়ার্ক ফ্রম হোম …বাড়ি থেকে কাজ করতে হচ্ছে “
    চামেলী তবুও থামেনা, সে বলে- “সেসব তো তোমার অফিসে হতো গো বৌদি, দাদাকে তো আগে কখনও দেখিনি বাড়ি থেকে কাজ করতে…দাদার তো সেই লম্বা লম্বা ট্যুর, দেশ বিদেশে যেতো…ইদানিং আর তেমন …”

    মানুষের প্রতিটি কথপোকথনেই চোরাগোপ্তা থাকে এক ধরণের “পাওয়ার গেম্”।রুমানা দেখল বলটা বারবার চামেলীর কন্ট্রোলেই চলে যাচ্ছে। রাশ টেনে ধরার জন্য ও বলে উঠলো- “ওসব বাদ দে, দাদার অফিস নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। তুই আমাকে অন্য কাজের লোকের ব্যবস্থা করে দে, নিজে পনেরো দিনের টানা ছুটি নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে বিয়েবাড়ি কাটিয়ে আয়।”

    মাথা নীচু করে কিছুটা যেন কান্না মেশানো মৃদুস্বরে চামেলী বলে- “ওখানে গিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগেনা গো বৌদি।”
    রুমনাও ছাড়বেনা, সে বলে- “কেন? তোরা তো চার বোন…সবাই আসবে, হৈ হৈ করবি ক’টা দিন”
    ম্লান মুখে চামেলীর উত্তর- “না গো বৌদি, একসাথে থাকলেই কত কথা প্রকাশ পেয়ে যায়…বড় লজ্জা করে, ভালো লাগেনা”
    সত্যিই অবাক হয়েই এবার প্রশ্ন করে রুমনা- “তার মানে ?”
    চামেলী বলে- “কি আর বলবো বলো বৌদি …আমার বোনদের সব ভালো বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে, ওদের স্বামীরা প্রত্যেকেই ভালো কাজ করে, হাতে ভালো পয়সা…একসাথে হলেই কত খরচাপাতি করে…শুধু আমারই পোড়া কপাল…”
    খুব গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চামেলী বলেই চলে- “জানো বৌদি, আমার স্বামীও কিন্তু ওই মোটর কারখানায় মজুরের কাজ ভালোই করছিল…সে কন্ট্রাক্টে হলেও…। কারখানাটাই বন্ধ হয়ে গেলো…কাজটাও চলে গেলো…। তারপর থেকে কত কিই যে চেষ্টা করলো লোকটা, কোনোটাই ঠিকমতো হলো না। সোনারপুরের দিকে আমাদের অল্প জমিজমাও ছিল গো…শাশুড়ির ক্যানসার ধরা পড়লো, চিকিৎসার জন্য সেগুলোও সব বেচে দিতে হলো। প্রোমোটাররা তো ওৎ পেতেই ছিল। বিপদের দিনে তাড়াহুড়োয় ভালো দামও পাওয়া গেল না।”

    চামেলীর সব কথা আর শেষ পর্যন্ত কানে যাচ্ছিল না…রুমনা নিজের চিন্তায় ক্রমশঃ নিজের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলো…
    প্রবালদের কোম্পানিতে অর্ডার আসছে না। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। তাকে স্মার্ট সাইজ করার গ্লোবাল ডিসিশন নিয়েছে ম্যনেজমেন্ট। ডিক্লেয়ার করা হয়েছে ভি.আর.এস অর্থাৎ ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট স্কীম। যাদের বসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেই লিস্টের একেবারে প্রথম দিকেই প্রবালের নাম…

    সম্বিত ফিরলো আবার চামেলীরই কথায়- “ও বৌদি আমি কিন্তু বাপের বাড়িতে মা বাবাকে , আমার বোনদের কারুকেই আজও বলিনি আমার বরের কাজ চলে যাওয়ার কথা। আমি নিজেও যে লোকের বাড়িতে বাসন মাজি, ঘর ঝাড়পোঁছ করি সেকথাও কেউ জানে না গো । তাই তো ওখানে গিয়ে থাকতে পারি না । কত যে নকল অভিনয় করতে হয়…ওদের আমি বলি- সকাল সকাল ফ্যাক্টরি যাওয়ার আগে আমার স্বামীকে টিফিন বানিয়ে দিতে হয় রোজ, আমার বাপু রাত্তিরে অন্য কোথাও থাকা চলে না…”

    রুমনার মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। নরম কণ্ঠে সান্তনা দিয়ে ও বললো- “তাতে কি হয়েছে চামেলী , তুই নিজেই তো এখন আট নয় বাড়িতে কাজ করিস…ভালোই তো রোজগার তোর…আর কোনো কাজই ছোট নয়…”
    রুমনার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চামেলী বললো- “বৌদি গো, আমিও কোনো কাজকেই ছোট ভাবি না, খারাপ ভাবিনা …তাই তো পায়খানা-বাথরুম ধোওয়ার কাজ বললেও আমি করে দিই… কিন্তু ওই যে আত্মীয়স্বজন…। আসল কথা কি জানো বৌদি, নিজের জীবন দিয়ে টের না পেলে কেউ অন্য কারুর কষ্ট বোঝে না গো। পেটের ক্ষিদে যে কি জিনিস…নিজের না পেলে কি টের পাওয়া যায়…বলো?”

    সত্যিই তো, নিজের জীবন দিয়ে টের না পেলে অন্যের কষ্ট, অন্যের মনের কথা কিছু টের পাওয়া যায় না- চামেলীর কথাগুলো রুমনার মনের মধ্যে অনুরণিত হতে থাকলো…
    রুমনা নিজেও তো আই.টি. সেক্টরে মোটামুটি ভালোই একটা কাজ করে, তবুও প্রবালকে ওদের কোম্পানি জোর করে ভি.আর.এস. দিয়েছে- এই কথাটা কারুকে জানাতে এতো লজ্জা করছে কেন? কেন অফিসে বেরোনোর আগে ও পই পই করে ইনস্ট্রাকশন দিয়ে যায় স্বামীকে- “ব্যালকনিতে দাঁড়াবে না, ফ্ল্যাটের বাইরে যাবে না, কেউ যেন টের না পায় তুমি বাড়িতে বসে আছো…বেডরুমে বসেই নেটে নূতন চাকরির খোঁজ কোরো …কেউ যেন কিছু জানতে না পারে “
    গত সপ্তাহেই পাশের বিল্ডিং এর তানিয়ারা বিশাল বড় একটা পার্টির আয়োজন করেছিল, সৈকতের প্রমোশন উপলক্ষ্যে। প্রবাল রুমনা সযত্নে সেটা এড়িয়ে গেলো মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে। বাপেরবাড়ি, দেওরের বাড়ি সব জায়গাতেই সামাজিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। প্রবাল-রুমনা আজকাল ব্যস্ততার অজুহাতে কোথাওই যাচ্ছে না।

    কোনো মানুষই বোধহয় অপরের মনের কথা, কষ্ট সঠিক বোঝে না। হঠাৎ রুমনার মনে হলো-ও নিজেও কি পারে অন্যের কথা সত্যিই উপলব্ধি করতে ?
    এই তো গত বছর, ওদের এই হাউসিং কমপ্লেক্সের স্যান্যাল দম্পতির একমাত্র ছেলের বিয়ে … অনুষ্ঠানের মাত্র তিনদিন আগে ভেঙ্গে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে তার সঠিক কারণ নিয়ে পাড়া প্রতিবেশী গুঞ্জনে মেতে উঠলো। যেন তারা পেয়ে গিয়ে গিয়েছে এক রহস্যগল্পের খোরাক। রুমনা নিজেও কি একেবারেই কান পাতেনি সেই গল্পে? যোগদান করে নি?
    তারপর যখন জানা গেলো, ডি ব্লকের কেয়ার মেয়েকে নিয়মিত নিয়ে যেতে হয় সাইকায়াট্রিস্ট এর কাছে কাউন্সিলিং এর জন্য। তখন? মহিলা মহলের আড্ডায় কত আলোচনা…কত অ্যানালিসিস…কেয়াদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। রুমনা কি একবারও তার প্রতিবাদ করেছিল?
    আরও, আরও আছে…যখন স্কুলের বন্ধুমহলে খবর পাওয়া গেল- শৈশবের বান্ধবী সঞ্চারীর একমাত্র সন্তানটি ড্রাগ অ্যাডিকট্ হয়ে গিয়েছে…তখন?
    কিম্বা নীপা সমরেশের বিবাহ বিচ্ছেদের সময়ে? কজন ব্ন্ধু খবর নিয়েছিলো ওদের মনের অবস্থার? রুমনা নিজে? কতটুকু অনুভব করেছিলো? তার বদলে বন্ধুমহল ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল নীপার বিবাহিত জীবনের পোস্টমর্টেমে। সিমপ্যাথী, এমপ্যাথি শব্দগুলো আসলে শুধুই ভেসে বেড়ায় ডিকশনারির পাতায়। মানুষের চরম বিপদের দিনে এখনও একজন দু’জনকে পাশে পাওয়া যায় ঠিকই। কিন্তু মনের সূক্ষ বেদনা, দুঃখ, চিন্তা ভাগ করে নেওয়ার জন্য সত্যিই কি কারুকে পাশে পাওয়া যায়?

    চামেলী তখনও বলেই চলেছে – “কি লাভ বলো বৌদি, নিজেদের দুঃখের কথা…অসুবিধার কথা অন্যকে জানিয়ে। মেজ বোনটা ছোটোবেলা থেকেই বড্ড হিংসে করতো। আমার অভাব অনটনের কথা শুনে মনেমনে হয়তো খুশিই হবে। বড় দিদিটা শুনলে বড্ড দুঃখ পাবে গো। মা বাবাও কাঁদবে…আমি ঝিয়ের কাজ করি জানতে পারলে…আনন্দ তো আর পাবে না…কি দরকার বলো নিজের কষ্টের কথা অন্যকে জানিয়ে …”

    খাওয়ার টেবিলে বসা রুমনার চোখ দিয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো ক’ফোঁটা চোখের জল- বাস্তবটা যে এমনই …সত্যিই কেউ নেই পাশে …কেউ থাকে না। আজকের পৃথিবীতে মানুষ একা, একেবারে একা…নির্জন দ্বীপের মতো। ফেসবুক, ওয়াটস্আ্যপে ব্ন্ধুতালিকা উপচে পড়ছে। সুখের ছবি, সুখের গল্প তাদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে বেশ লাগে …মন্দ কি? কিন্তু জীবন তো নয় নিরবচ্ছিন্ন সুখ…তবে?

    ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল রুমনা। গ্যাসের ওভেনে চায়ের জল চড়ালো…তিন কাপ। প্রবাল, রুমনা আর চামেলী আজ একসাথে চা খাবে। তবে ওইটুকুই…ওই পর্যন্তই । গ্যাসের আগুনের দিকে তাকিয়ে রুমনা মনেমনে বললো- “নিজের কথা থাক্ নিজেরই কাছে…হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে একান্ত ব্যক্তিগত হয়ে…মনের কথা থাক্ মনেই। “

  • গল্প

    ক্লেপটোম্যানিয়াক

    ক্লেপটোম্যানিয়াক

    -সুস্মিতা

    বেঙ্গালুরু শহরের ইন্দিরানগরে মঞ্জরিদের থ্রি-বি-এইচ কে অ্যাপার্টমেন্টের ড্রয়িংরুমটা আজ ফুল আর ধূপের গন্ধে ভরে গিয়েছে। ঘরের ভিতরে তিল ধারণের জায়গা নেই…অথচ সেখানে একটা সূঁচ পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে, এমন নিথর নৈঃশব্দ…।
    ঘরের ঠিক মাঝখানে শোয়ানো রয়েছে রিকিকে। সাদা ফুলের মধ্যে থেকে শুধু দেখা যাচ্ছে দশ বছরের ছোট্ট মেয়ে রিকির নিষ্পাপ শিশু মুখটুকুনি। রিকির মাথার কাছে বসে আছে ওর মা মঞ্জরি…ওর পরণে এখনও গতকালের রাত্রিবাস। মঞ্জরিকে আগলে ঘিরে রয়েছে ওর চারপাঁচজন বান্ধবী। ওরা কেন মঞ্জরিকে আগলে রেখেছে? মঞ্জরি তো কাঁদছে না…ও শোকে ভেঙ্গেও পরেনি। ও যেন কিছু বুঝতেই পারছে না…ওর কোনো বোধই নেই …
    মঞ্জরি শুধু ভাবছে…রিকু সোনাটা আজ বড় বেশি সময় ধরে ঘুমোচ্ছে…। অন্যান্য দিনে তো রিকি এই সময়ে ঘরের মধ্যে খেলা করে নয়তো স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে স্কুলবাস ধরতে যায়। আজ রিকি এতো ঘুমোচ্ছে কেন? ও কি আর জাগবে না?কোনোদিন ঘুম থেকে উঠবে না? খেলবে না? স্কুলে যাবে না? সবাই এসব কি বলছে?
    মঞ্জরির জীবনটা যে শুধুই পুতুলের মতো ওই বাচ্চা মেয়েটাকে নাওয়ানো খাওয়ানো, পড়ানো আর তাকে স্কুলে, আঁকার ক্লাসে, সুইমিং ক্লাসে পাঠানো নিয়েই কাটে। রিকি ঘুমিয়ে পড়লে মঞ্জরি থাকবে কি নিয়ে? ওর জীবনটা কাটবে কি করে? মঞ্জরি সত্যিই কিছু ভাবতে পারছে না, বুঝতে পারছে না। ওর চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে আসছে কিছু দৃশ্য …

    বারো বছর আগের কথা। শ্যামবাজারের ভূপেন বোস অ্যাভিনিউ এর বনেদি বাড়ির মেয়ে মঞ্জরির বিয়ে হলো প্রবাসী বাঙ্গলী পাত্র প্রসূন রায় চৌধুরীর সঙ্গে। বংশ কৌলিন্যে, চেহারায় এবং বিদেশে চাকরীর সুবাদে প্রসূন বড়ই দামী এবং লোভনীয় পাত্র। মা-বাবার সাথে সাথে মঞ্জরিও দারুণ খুশি। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী ও বান্ধবীদের দিকে বিজয়িনীর হাসি হেসে বিয়ের পরের সপ্তাহেই মঞ্জরি চললো ইওরোপে…তার নূতন সংসার পাততে। দু’ চোখের পাতায় তখন সুখের স্বপ্ন আঁকা …

    ইওরোপের যে শহরে মঞ্জরি প্রসূনের নূতন জীবন শুরু হলো তার আশেপাশের বেশিরভাগ মানুষই স্প্যানিশ ভাষাভাষী। উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করা মঞ্জরির এটাই ছিলো প্রথম ধাক্কা। ইংরেজীতেও যে ও খুব সাবলীল,তা নয় …তবুও স্প্যানিশ এর তুলনায় ভাষাটা কিছুটা পরিচিত তো বটে।
    প্রসূন নিজেও যেন হাবেভাবে বড্ড বেশি বিদেশী।
    ইওরোপের অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য, ছবির মতো সাজানো বাড়িঘর…সবকিছুর মাঝেও নবদম্পতির প্রেমের মধ্যে কি যেন একটা ফাঁকি…। নূতন জীবন, নূতন পরিবেশ, নূতন সম্পর্ককে বুঝতে বুঝতেই সময় হু হু করে কেটে গেলো। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় মঞ্জরি প্রসূনের জীবনে এলো রিকি।

    মাতৃত্ব যে একটা মেয়েকে কি দিতে পারে…।
    রিকিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে মঞ্জরি প্রথম বুঝতে পারলো- ‘ডলার কিম্বা পাউন্ড নয়,ইওরোপ আমেরিকা,বংশকৌলিন্য,রূপ বা পদমর্যাদাও নয়…স্বর্গীয় সুখের স্বাদ এনে দিতে পারে ফুলের মতো নিষ্পাপ একটি শিশু। আত্মজাকে পেয়ে জীবনের সব ছোটখাটো শুন্যতা ভুলে গেলো মঞ্জরি। দিন ওর কাটে শুধুই রিকির যত্ন করে, রিকি সোনাকে আদর করে আর ওর সাথে খেলা করে। প্রসূন চাকরী জীবনে তখন দিনেদিনে আরও বেশি ব্যস্ত। ও ভোরবেলা অফিসে বেরিয়ে যায়…বাড়ি ফিরতে ফিরতে গভীর সন্ধ্যা। সময় সুযোগ পেলে মেয়েকে আদর অবশ্যই করে, কোলে নিয়ে অনেক কথাও যে বলে না তা নয় …তবে সে সব কথাই ইংরেজি ভাষায় ।

    প্রথম অসুবিধাটা টের পাওয়া গেলো রিকির আঠারো মাস বয়সে। সে দেশের প্রথা অনুযায়ী রিকি যেতে শুরু করলো প্লে–স্কুলে। সেই স্কুলের শিক্ষিকা স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলেন। স্কুলের বাকি বাচ্চারা হয় ফ্রেঞ্চ, নয় স্প্যানিশ অথবা জার্মান। বাড়িতে রিকির মায়ের যত কথা বাংলায়। বাবা সময় পেলে কথা বলেন ইংরেজিতে। রিকির মস্তিষ্ক কোনো ভাষাই সঠিকভাবে অনুকরণ করতে পারে না। জিভের জড়তা ভাঙ্গে না। রিকি কিছুতেই কথা বলতে চায় না। ও কারুর সাথে মিশতেই চায় না।
    মঞ্জরি নিজেও ভাষা নিয়ে বড় হীনমন্যতায় ভোগে। প্রসূনের সময় নেই এসব ঝামেলা নিয়ে মাথা ঘামানোর। তবুও অসহায় মঞ্জরি জোর করে সমস্যার কথা বলতে গেলে ওর সোজাসাপটা সমাধান- “তুমি নিজে ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাস জয়েন করো আর মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। এসব সামান্য বিষয় নিয়ে নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই …ব্যস”।
    মঞ্জরির নিজের আর লজ্জা ভেঙ্গে কোনো ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাসে ভর্তি হওয়া হয়ে ওঠে না।রিকিকে নিয়েও কোনো ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয় না…সেখানে কোন্ ভাষায় ও নিজেদের সমস্যার কথা জানাবে?

    দেখতে দেখতে রিকির প্রায় সাড়ে তিন বছর বয়স হলো।ও বড় একা, মুখচোরা বাচ্চা।ওর সমবয়সী কোনো বন্ধু নেই…। রিকির মা ই ওর একমাত্র বন্ধু। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে মঞ্জরি মেয়ের সাথে যত মনের কথা বলে। রিকি বড় বড় চোখ মেলে সেসব কথা শোনে। ও কিন্তু বোবা নয়…কিন্তু ওর জিভের জড়তা কাটছে না। ইংরেজি,স্প্যানিশ আর বাংলা মিশিয়ে ও টুকরো টুকরো কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু সেসব প্রায় কেউই বোঝেনা। রিকি দিনে দিনে আরও গুটিয়ে যেতে থাকে।

    ইতিমধ্যে রিকির বাবার আরও উন্নতি হয়েছে। এবার ওরা পাড়ি দিলো জার্মানি। জীবন সেখানে আরও কঠিন। রিকির বাবা নূতন দেশে নূতন চাকরীতে আরও বেশি ব্যস্ত।আবার একটা একেবারে নূতন ভাষা ছোট্ট রিকির জীবনকে আরও কঠিন করে দিলো।ওর মাও যে এই সমস্যায় রিকিকে কোনো সাহায্য করতে পারে না।
    নূতন দেশে নূতন স্কুলে ভর্তি হয়ে রিকি নিজেকে আরও বেশি গুটিয়ে নিলো। ও যেন মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে “সমবয়সীদের সাথে ও কথা বলবে না…খেলবে না”।
    জার্মানিতে কাটলো মোটে দেড় বছর। প্রসূনের উন্নতি তখন গগনচুম্বী। ওদের এরপরের ঠিকানা আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট। ইওরোপ থেকে আমেরিকা…এ যেন মঞ্জরি আর রিকির কাছে পৃথিবীর উল্টো পিঠ। আবার…আবার একটা নূতন দেশ, নূতন সংস্কৃতি আর আমেরিকান স্কুলের ইংরেজির সাথে রিকির আর বন্ধুত্ব হলো না।হয়তো হয়ে যেত…কিন্তু ততটা সময় পাওয়া গেলো না।
    রিকির সাত বছরের জন্মদিনে মঞ্জরি উপহার পেলো- “প্রসূনের দেশে বদলী হওয়ার চিঠি”। যদিও পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতা নয় তবুও নিজের দেশ তো …। মঞ্জরির খুশি আর ধরেনা। ও যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলো। ছোট্ট রিকি কিন্তু মায়ের এতো খুশির কারণ সঠিক কিছুই বুঝলোনা। ওর সাত বছরের জীবনে ও তিনবার দেশে এসেছে ঠিকই কিন্তু দাদু দিদার আদর ছাড়া ওর আর সেরকম কিছু মনে পরছেনা।

    অবশেষে প্রায় আটবছর বিদেশের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ২০১০সালের মার্চ মাসে বেঙ্গালুরু শহরে ফিরে এলো মঞ্জরি,প্রসূন আর রিকি। তিনজনের মধ্যে মঞ্জরিই সব থেকে বেশি খুশি। মঞ্জরির মনে হলো-এবার ওদের জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বন্ধু বান্ধব আর আনন্দে ভরে উঠবে ওর আর রিকির জীবন। অনেক সমবয়সী বাঙ্গালী বন্ধু বান্ধবী পেয়ে মঞ্জরির জীবনে খানিকটা হলোও তাই। প্রসূন কাজ পাগল মানুষ…যেখানেই থাকুক,কাজে ব্যস্ত থাকলেই ও খুশি।

    কিন্তু রিকির কি হলো ?
    বয়সের হিসেব অনুযায়ী সি.বি.এস.ই. বোর্ড এর স্কুলে ক্লাস টু’তে ভর্তি হলো রিকি।দক্ষিণ ভারতের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। সেখানে পড়াশোনার মান বেশ উঁচু আর তার সাথে পড়তে হবে দ্বিতীয় ভাষা কন্নড়। রিকির ছোট্ট জীবনটা যেন আরও গুলিয়ে গেলো। দক্ষিণ ভারতীয় শিক্ষিকাদের উচ্চারণ ছোট্ট মেয়েটা কিছু বোঝেনা আর রিকির কথা তো কেউ বুঝতেই পারে না। ইওরোপ আমেরিকায় রিকির স্কুলে এতদিন পর্যন্ত পড়াশোনার পদ্ধতিও ছিলো একেবারে আলাদা।
    এখানে রিকির সাথে কেউ কথা বলেনা, ওকে কেউ খেলতে ডাকে না…বরং ওর উচ্চারণ নিয়ে বন্ধুরা হাসাহাসি করে। শিশুরাও যে কত নিষ্ঠুর হতে পারে।
    রিকির মা আজকাল অনেক বান্ধবী, অনেক আড্ডা, অনুষ্ঠান পেয়ে আগের থেকে অনেকটা বেশি খুশিতে থাকেন। রিকির মাঝেমাঝে মনে হয় “মা যেন অনেক দূরের মানুষ হয়ে যাচ্ছে”। কিন্তু রিকিও তো বড় হচ্ছে…ওরও সঙ্গী দরকার…আনন্দ দরকার। রিকি সেই আনন্দ সেই আশ্রয় খুঁজে নেয় টেলিভিশনের বড়দের অনুষ্টানের মধ্যে…

    আজকাল রিকির খুব নিষ্ঠুর হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে-যারা ওর উচ্চারণ নিয়ে হাসাহাসি করে তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে। নিজের মতো একটা রাস্তা খুঁজে বের করে রিকি…স্কুলের লাঞ্চব্রেকের সময় ওকে কেউ খেলতে ডাকেনা, একেবারে একা একবুক কান্না বুকে চেপে রিকি ক্লাসরুমে বসে থাকে …।বাইরে খেলার মাঠে বাকি বাচ্চারা তখন টিফিন ভাগ করে খাচ্ছে , খেলছে। ঠিক সেই সময় সহপাঠীদের ব্যাগ থেকে তাদের পছন্দের ইরেজার, পেন্সিল নিঃশব্দে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয় রিকি। কি যে এক নিষ্ঠুর উল্লাস মনের মধ্যে টের পায় তখন সে। ভীষণ উত্তেজনা…দারুণ আনন্দ হয় …।

    ঘটনাটা মঞ্জরি প্রথম জানতে পারলো যেদিন রিকির ক্লাসটীচার মঞ্জরিকে স্কুলে ডেকে পাঠালেন। অত্যন্ত মার্জিত ভাষায় শিক্ষিকা রিকির আচরণের এই দিকটি খুলে বলেন। তিনি বিশেষ ধৈর্যসহকারে বেশ কয়েকদিন ঘটনাটি আড়াল থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন …এবং শেষপর্যন্ত একদিন একেবারে হাতেনাতে ধরে ফেলার পরেই মঞ্জরিকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
    লজ্জায় দুঃখে অপমানে মঞ্জরির একেবারে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিলো। ও একেবারে হতবাক্ …কোনো কথাই বলতে পারলো না…না খুঁজে পেলো এর কোনো কারণ ,কোনো ব্যাখ্যা…। পাশেই রিকি দাঁড়িয়ে…মাথা গোঁজ করে মাটির দিকে তাকিয়ে…মুখে কোনো কথা নেই ।

    বাড়িতে ফিরে এসে মঞ্জরি মেয়েকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরে, একবার শক্ত হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে জানতে চাইলো- “বল বল কেন এমন কাজ করেছিস বল? আমাদের কাছে না চেয়ে কেন অন্যের জিনিষ নিয়েছিস? জানিস না এটাকে চুরি বলে?”- রিকির মুখে কোনো উত্তর নেই…ঘাড় শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে ও …

    মঞ্জরিরা যে সোসাইটিতে থাকে, সেখানে প্রায় সব বাচ্চারাই রিকির সাথে এক স্কুলে পড়ে। দু’একদিনের মধ্যেই বিল্ডিংএর অন্যান্য ছেলেমেয়ে ও তাদের মায়েদের আলাপ আলোচনা গুঞ্জন থেকে মঞ্জরি টের পায় ‘রিকির এই চুরি করা স্বভাব এই মুহূর্তে পাড়ার মুখ্য আলোচ্য বিষয়’। লজ্জায় অপমানে কারুর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনা মঞ্জরি। ভয়ে প্রসূনকেও সব কথা খুলে বলতে পারেনা। প্রসূন তো ওদের কোনো অভাব রাখেনি। বরং এতদিন বিদেশে থাকার ফলে মঞ্জরিদের জীবনে প্রাচুর্য্য যথেষ্ট বেশি।এছাড়াও পরিবার ও রিকিকে সময় দিতে পারেনা বলে প্রসূন ওর আদর্শ পিতৃত্বকে প্রমাণ করে দামী উপহার দিয়ে। তাহলে রিকির কিসের অভাববোধ?

    অসহায় মঞ্জরি ফোন করে মাসতুতো দিদি চন্দ্রিমাকে। তিনি সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।সব কথা শুনে অভিজ্ঞ, সহৃদয়া চন্দ্রিমাদি ভারি সদুপদেশ দিলেন বোনকে। তিনি বললেন-“শোন,তুই কিন্তু একেবারেই উত্তেজিত হবি না,বকাঝকা বা মারধোর একদম নয় রিকিকে। অনেক কারণে যে কোনো মানুষের মধ্যেই এই প্রবণতা দেখা দিতে পারে…এটাকে ক্লেপটোম্যানিয়া বলে। রিকির দরকার সঠিক কাউন্সিলিং…গরমের ছুটিতে তোরা কলকাতায় এলে আমি নিজে ওর সাথে কথা বলবো। এতো ভেঙ্গে পড়ার মতো কিছু হয়নি। একটু ধৈর্য রাখ।”
    অস্থির অশান্ত মঞ্জরির মনে পড়ে যায় ছোটবেলায় সত্যজিত রায়ের কোনো একটি লেখায় প্রথম ‘ক্লেপটোম্যানিয়া’ শব্দটি পড়েছিলো ও। বালিকা বয়সে ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমা দেখে সরল মনে বাবাকে প্রশ্নও করে ফেলেছিলো মঞ্জরি- “বাবা দুর্গা কি ক্লেপটোম্যানিয়াক ছিলো ?” বাবা মাথায় হাত রেখে বুঝিয়ে বলেছিলেন- “না রে মা, অভাবের তাড়নায়, অনেক না পাওয়ার বেদনায় ছেলেমানুষ বয়সে ওরকম অনেকে
    করে ফেলে।”
    কিন্তু রিকির তো কোনো কিছুর অভাব নেই …ওর অভাববোধটা কোথায়? মঞ্জরির মাথা ঘুরতে থাকে …

    শেষ পর্যন্ত সেই চরম অপমানের ঘটনাটা ঘটে গত পরশু সন্ধ্যায়…মঞ্জরিদের পাশের ব্লকেই মঞ্জরির বান্ধবী অদিতির ছেলে অর্কর জন্মদিন সেদিন। বাড়িতে এসে বড় সুন্দর করে নিমন্ত্রণ জানিয়ে গিয়েছে অদিতি।
    সকাল থেকেই ভয়ে বুক ধুকপুক্ করছিলো মঞ্জরির। আজকাল রিকি যে বন্ধুর বাড়িতেই যায়,সেখানে থেকে গোপনে নিয়ে আসে কখনও একটা রং পেন্সিল কখনো ইরেজার, দামী স্কেচ পেন বা যে কোনো কিছু। আনেক বুঝিয়েও কোনো ফল হয়নি। রিকির ব্যাগ বা ফ্রকের পকেট থেকে সেসব খুঁজে বের করে মঞ্জরি নিজে গিয়ে সেগুলো ফেরত দিয়ে আসে …সাথে বানিয়ে বলতে হয় একটা গল্প। অথচ সকলের সাথে ওর মেলামেশাটাও বন্ধ করে দিলে রিকি যদি আরও অস্বাভাবিক হয়ে যায়…

    সন্ধে সাতটা নাগাদ রিকিকে সাজিয়ে গুছিয়ে , “অন্যের জিনিষে হাত দিতে নেই” বুঝিয়ে অদিতিদের ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে দিয়ে আসে মঞ্জরি।
    বাড়ি ফিরে আসার পরে আধঘণ্টাও কাটেনি…
    কলিংবেলের শব্দ শুনে উঠে গিয়ে দরজা খোলে মঞ্জরি…দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে থমথমে মুখে অদিতি আর ওর হাত ধরে রিকি। রিকির হাতে একটা বড় খাবারের বাক্স।
    ঘরের ভিতরে ঢুকে শান্ত কণ্ঠে অদিতি বলতে শুরু করে- “দেখো মঞ্জরি,আমি তোমাকে কোনো আঘাত দিতে আসিনি, তোমার আমার বন্ধুত্ব নষ্ট হোক্ সেটা আমি একেবারেই চাইনা…সেইজন্যই বাড়ির পার্টি ছেড়ে আমি নিজে তোমার কাছে ছুটে এলাম”…মঞ্জরি ভীত অবাক চোখে চেয়ে থাকে…এরপরে আর কি শুনতে হবে তাকে?
    অদিতি বলে চলে- “এতদিন পাড়ায় কানাঘুষোয় শুনছিলাম রিকির চুরি করা স্বভাবের কথা, কিন্তু আজ আমার বাড়িতে ….”মঞ্জরি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা…ওর মাথাটা তখন বন বন করে ঘুরছে…। অদিতি জানালো- “বাচ্চারা সবাই পৌঁছে যাওয়ার পরে আমরা যখন কেক কাটার আয়োজন করছি, হঠাৎই তখন আমার নজরে পড়ে রিকি সেখানে নেই। কি যেন একটা মনে হওয়াতে আমি অর্কর ঘরে যাই …সেখানে ওর জন্মদিনের পাওয়া দামী উপহারগুলো সাজানো ছিলো। গিয়ে দেখতে পাই- রিকি টেবিল থেকে আমার বাবার দেওয়া সোনার আংটি, আমার এক কলিগের দেওয়া রিস্টওয়াচটা ওর ফ্রকের পকেটে ঢোকালো ….তুমি কিছু মনে কোরোনা মঞ্জরি আমি আর রিস্ক নিতে পারলাম না। অতগুলো বাচ্চার মধ্যে কে ওকে চোখে চোখে রাখবে বলো?…তবে ও ছেলেমানুষ …ওর খাওয়া হয়নি …ওর খাবারগুলো আমি এই বাক্সতে ভরে দিয়ে গেলাম …তুমি যেন আমাকে ভুল বুঝো না “।

    অপমানে ,লজ্জায়,রাগে দুঃখে মঞ্জরির আর কোনো হুঁশ থাকেনা। উন্মাদ হয়ে যায় ও…প্রথমেই রিকির হাত থেকে খাবারের বাক্সটা টেনে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ও। এই প্রথম কেঁদে ওঠে রিকি…খিদে পেয়েছে ওর …কখন থেকে কেক খাবে বলে আশা করে বসে আছে যে …। সেটা দেখে যেন মঞ্জরির মাথায় আগুন জ্বলে যায় …। জীবনে প্রথমবার মেয়ের গায়ে হাত তোলে সে…উন্মাদের মতো মেয়ের চুলের মুঠি ধরে এলোপাথাড়ি চড় মারতে থাকে মা।
    চিৎকার করে কাঁদতে থাকে রিকি…কাঁদতে কাঁদতেই কত কিছু যেন বলতে চায় এতদিনের নির্বাক শিশুটি। কিন্তু আজ মঞ্জরি কোনো কিছু শোনার মতো অবস্থায় নেই। মেয়েকে ‘চোর’ ‘লোভী’ বলে গালি দিতে দিতে ধাক্কা দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকিয়ে দেয় মঞ্জরি। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে- “যতদিন না তোর স্বভাব শুধরাবে ততদিন বেরোবিনা তুই এই ঘর থেকে। না খেতে পেয়ে মরে যা…তবু কারুকে মুখ দেখাবি না তুই “….

    মেয়েকে তার ঘরে বন্ধ করে নিজের ঘরে এসে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মা। প্রসূন অফিস থেকে যথারীতি ফেরে রাত এগারোটা নাগাদ। প্রতিদিনের মতোই তার নিয়মমাফিক ক্লান্ত প্রশ্ন- “রিকি ঘুমিয়েছে?”…মঞ্জরিরও সংক্ষিপ্ত জবাব- “হ্যাঁ,ঘুমিয়ে পড়েছে”…
    বুকচাপা কষ্ট নিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে কেঁদে রাত কেটে যায় মঞ্জরির…

    পরদিন সকালে সাড়ে সাতটার সময় বিছানা থেকে উঠেই মেয়ের ঘরের দিকে যায় মঞ্জরি। বাইরে থেকে দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে দেখে- যেন এক পুকুর রক্তের মধ্যে কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে রিকি। বাবার শেভিং ব্লেডটা তখনও ওর ডানহাতে ধরা…বামহাতের শিরা কেটে ফেলেছে রিকি। টেলিভিশনে বড়দের সিরিয়াল দেখতে দেখতে কখন এসব শিখে ফেলেছে রিকি ?

    জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলো মঞ্জরি…তারপরে কি ঘটেছিলো ও জানে না …

    তারপরে এখন চোখ খুলে চারপাশে এতো ভীড় …মঞ্জরি কিছু ভাবতে পারছে না, বুঝতে পারছে না …কি করে বুঝবে? গতকাল সন্ধ্যায় রিকি আনেক কিছু বলতে চেয়েছিলো …সেসব কিছু যে শোনেনি মঞ্জরি…
    কোনো ডাক্তার নয়, সাইকায়াট্রিস্ট নয়…একমাত্র রিকিই সঠিক বলতে পারতো কোন্ কষ্টে কোন্ কারণে এমন ক্লেপটোম্যানিয়াক হয়ে যাচ্ছিলো ও ?

    কতটা শাসন বেশি হলে,কতটা আদর কম হলে বা কোন্ অভাববোধ থেকে, কোন্ নিষ্ঠুরতা থেকে শুরু হয় মনের এমন সব জটিল অসুখ? রিকি কাল অনেক কথা বলতে চেয়েছিলো…মন্দিরা সেকথা শোনেনি। তাই আজ আর ও কিছু বুঝতে পারছেনা ।
    আমরা সবাই সঠিক সময়ে কারুর কথা শুনি না …বড় দেরি করে ফেলি। মঞ্জরি এখন শুধু ভাবছে -কত তাড়াতাড়ি…কিভাবে ও মেয়ের কাছে পৌঁছাবে…তার রিকিসোনার মনের কথা শুনতে…বুঝতে …

    সুস্মিতা

  • গল্প

    ভিন্ন স্বাদের চার

    ভিন্ন স্বাদের চার
    -সুস্মিতা সাহা 

     

     

    ভালোবাসার পাশেই (১)

     

    “ওহ্…মম্ ,টুডে দ্য ফিশকারি ইস জাস্ট অসম”…টিংকার কথা শেষ হতে না হতেই আঙ্গুল চাটতে চাটতে রণিত বলে উঠলো-“রিয়েলি অল দ্য আইটেমস্ আর সুপার্ব টুডে”….
    সত্যিই আজ রণিত মনিদীপা আর ওদের একমাত্র ছেলে টিংকার ফ্যামিলি টাইমটা একেবারে সুপার হিট হয়ে গেলো। সপ্তাহের এই একটা দিন অর্থাৎ শনিবারের ডিনারটা ওরা তিনজনে একসাথে হৈচৈ করে এনজয় করার চেষ্টা করে…তা সেটা রেস্তোরাঁতেই হোক্ বা বাড়িতে। ভোজনরসিক রণিত অবশ্য খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে রেস্তোরাঁর ওপরেই বেশি নির্ভরশীল। মনিদীপার রান্নার ওপরে অতটা ভরসা করা যায় না। যদিও মনিকে একেবারেই দোষ দেওয়া যায় না। ওর কেরিয়ার এবং সেই সংক্রান্ত ব্যস্ততা কিছু কম নয়। একটি বিশাল মাল্টিন্যাশনাল কম্পানীর বড়সড় অফিসার মনিদীপা, রণিতেরই মত ।

    তবে আজকের সব ব্যাপরটাই যেন আলাদা। আজ মনিদীপা ডাইনিং টেবিলটা সাজিয়েও ছিলো দারুণ সুন্দর করে। আর খাবারগুলো ? কি জানি কোন্ ম্যাজিকের গুণে আজকের প্রত্যেকটা আইটেমই হয়েছিলো লা-জবাব। বিশেষ করে বেকড্ পমফ্রেট আর চিংড়ির মালাইকারীটা যেন একেবারে….
    খেতে বসে ছেলে আর স্বামীর কাছ থেকে প্রশংসা পেতে পেতে মনিদীপা ঘেমে নেয়ে একাকার। ওর চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছিলো…

    অনেকদিন পরে রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আজ মনিদীপা একটা কবিতার বই খুলে বসলো…সত্যিই বহু বছর পরে। আজ গোটা দিনটাই কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেলো…

    আজ দুপুরে মনিদীপার প্রিয় বান্ধবী সুনয়না এসেছিলো। সেই স্কুলজীবন থেকে ওদের বন্ধুত্ব। সুনয়না একটা স্কুলে সাহিত্য পড়ায়। সেই সাথে যাবতীয় নান্দনিক কাজে মেয়েটার তুখোড় প্রতিভা। মনিদীপা তার জীবনের যত ব্যথা,আনন্দ,গোপন কথা নির্দ্বিধায় নয়নের কাছে জমা রাখতে পারে…কারণ ও জানে-এর থেকে নিশ্চিন্ত আশ্রয় আর কোথাও নেই । সত্যিই সে বান্ধবীকে বড় ভালোবাসে এবং ওর সমস্ত গুণ ও প্রতিভার কদর করে।
    সুনয়নাও বোঝে মনির বড় ব্যস্ত জীবন…নিজের হাতে রান্নাবান্না করার অবকাশই পায় না। মাসীমা মেসোমশাই চলে যাওয়ার পর থেকে মেয়েটার ‘বাপের বাড়ি’বলে আর কিছু নেই। তাই প্রত্যেকবারের মত আজও ও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলো নিজের হাতে রান্না করা দারুণ সব খাবার…মনি, রণিত আর টিংকার জন্য।

    কিন্তু আজ কি যে হলো…আজ প্রথমবার এমন হলো…
    সন্ধ্যেবেলা ডিনার টেবিলে বসে রণিত আর টিংকার মুখে খাবারগুলোর অত প্রশংসা শুনতে শুনতে মনিদীপার কিছুতেই ওদের জানাতে ইচ্ছে করলো না যে – আজকের প্রতিটি আইটেমই সুনয়না বানিয়ে নিয়ে এসেছে। ও চুপ করে রইলো। কেন যে বলতে ইচ্ছে করলো না …কে জানে ? মনিদীপার নিজেকেই বড় অচেনা লাগছে…

    কিছুতেই ঘুম আসছে না…। কবিতার বই এর পাতা ওলটাতে ওলটাতে যে কবিতাটায় মনির চোখ আটকে গেলো , তার প্রথম লাইন- “ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে”

    নাম তার ঈর্ষা…..

    ******

    (কবিতা-“ভালোবাসার পাশেই”-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)

    কৃতজ্ঞতা জানালাম

    আগামীকাল….হয়তো বা ….(২)

    স্যাটেলাইটের মেজাজটা আজ ভালো নেই । ওহ্ নো , ও স্যাড ফীল করছে না ….ওইসব ফীলিংস্ এখন আর নেই। হি ইজ আ লিটল ডিপ্রেসড অ্যান্ড হাইলি ইরিটেটেড । সামার ক্যাম্প এর জন্য ওর ক্লাসমেটরা একটা মুনট্রিপে যাচ্ছে , ওখানে একটা ইন্টার প্ল্যানেট কম্পিটিশন আছে । স্যাটেলাইটেরই শুধু যাওয়া হবে না। ওর বায়োলজিকাল ড্যাড মার্স এ একটা বাংলোবাড়ি কিনছে। সেটার ডিল ফাইনাল করতে ওকেও ড্যাডের সাথে মার্স এ যেতে হবে । উফ্ফ্ রিলেশনশিপের এই প্রেসারগুলো যে আর কতদিন থাকবে …ডিস্গাসটিং লাগে ওর …।
    স্যাটেলাইটের সারোগেট মাদার এখন ওর ড্যাডের পার্টনার…শি ইজ রিয়েলি ইনট্রেসটিং…শি ইজ অলসো গোয়িং উইথ দেম । তার কথা ভেবে ক্লাস নাইনের স্যাটেলাইটে একটু উত্তেজিত বোধ করলো ।

    এনিওয়ে ,আজ স্যাটেলাইট বড্ড বোর ফীল করছে । এর থেকে হাফব্রাদার টুইটার আর হাফসিস্টার ইন্স্টার প্ল্যানটা অ্যাকসেপ্ট করলেই ভালো হতো । ওরা একটা এল.জি.বি.টি স্কুলের কার্নিভালে যাচ্ছে । ওখানে গিয়ে অ্যাটলিস্ট অনেক এক্সাইটিং গেমস্ এনজয় করা যেত …

    স্যাটেলাইটের কিছু ভালো লাগছে না …কিছু না ….হি হেট্স্ দিস প্ল্যানেট …

    ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কেন যেন আজ ওর বাড়ির একেবারে পেছনের ঘরটায় যেতে ইচ্ছে করলো …

    ঘরটা বড্ড অন্ধকার …সেখানে ওর ড্যাডের ড্যাড মানে দাদু একলা থাকেন । হি ইজ ভেরি ওল্ড এন্ড টোটালি ডিফরেন্ট । স্যাটেলাইট ওকে একদম বুঝতে পারে না । হি সিমস টু বি আ স্টোনএজ পারসন । তবুও আজ কেন যেন দাদুর কাছেই একটু গিয়ে বসতে ইচ্ছে করছে …।

    দাদু কারুর সাথেই প্রায় কথা বলেন না । সারাদিন ইলেকট্রনিক ডিকশনারিতে কি যেন খোঁজেন ।স্যাটেলাইট একদিন জিজ্ঞেস করাতে ওল্ড ম্যান বলেছিলেন – হি ইজ লুকিং ফর্ আ ওয়র্ড , একটা শব্দ…আ ভেরি ফানি ওয়র্ড ”ভালবাসা” …
    স্যাটেলাইট কিছু বুঝতে পারেনি । আর দাদু মাঝে মাঝেই একলা ঘরে শুন্যে হাত মুঠো করে চিৎকার করে বলেন-”যুদ্ধ নয় …শান্তি চাই …সাম্য চাই “- স্যাটেলাইট সেসব কথার মানেও কিছু বুঝতে পারে না …ওহ্ ,দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ সো ডিফিকাল্ট । দাদুকে তখন ওর বড্ড ভয় করে …

    তবুও আজ কেন যেন স্যাটেলাইটের শুধু দাদুর কাছেই …

     

    ডাইনিং_টেবিল (৩)

     

    সিক্স সিটার ডাইনিংটেবিল…সেগুন কাঠের। টেবিলটা যখন কেনা হয়েছিল, ছেলে মেয়ে দুজনেই তখন স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। চারজনের সংসারে ফোর-সিটার কিনলেও চলতো। অনিমেষবাবু তবুও ওইটুকু বিলাসিতাকে তখন প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। মাইনে পত্তর যদিও সেই আমলে বিরাট কিছু ছিল না…তবুও।
    বড়সড় ডাইনিংটেবিলটা অনিমেষবাবুর মধ্যবিত্ত জীবনে মনের মধ্যে বেশ একটা রাজকীয় ভাব আনতো। দক্ষিণের বারান্দার দিকের চেয়ারটা হয়ে গেলো বাড়ির কর্তার সীট…অলিখিত অবশ্যই।
    রবিবার দুপুরে গোটা পরিবারসহ খাওয়াদাওয়ার সময় বারান্দাঘেঁষা চেয়ারটায় বসে অনিমেষবাবু স্বর্গসুখ উপভোগ করতেন…

    দেখতে দেখতে কেটে গেল কতগুলো বছর। ছেলে মেয়ে দুজনেই নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, বিয়ে থাও করেছে। ছেলেবৌমাসহ বাড়িতে আবার চারজন সদস্য। ছুটির দিনে নূতন জামাই আর মেয়ে বেড়াতে এলে সিক্স-সিটার টেবিলটা সত্যিকারের কাজে লাগে। দক্ষিণের চেয়ারটায় বসে অনিমেষবাবু বেশ জমিদারী মেজাজে খাওয়া দাওয়া সারেন। “কর্তামশাইএর সীট” বলে কথা। তার পাউডার মাখা ঘাড়ে সুখের হাওয়া সুড়সুড়ি দেয়…

    পেরিয়ে গিয়েছে আরও কয়েকটা বছর। অনিমেষবাবু চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। এক নাতি ও এক নাতনিসহ বাড়িতে এখন সদস্য পাঁচজন। অনিমেষবাবুর স্ত্রীর চেয়ারটা গত দুবছর ধরে খালি পড়ে থাকে। মেয়ে জামাই বর্তমানে থাকে বিদেশে। দু বছরে একবার আসার চেষ্টা করে।
    বাড়ির বেশিরভাগ আসবাবপত্রই পাল্টে গিয়েছে। তবে সেগুন কাঠের ডাইনিংটেবিলটা একই জায়গায় একইভাবে আছে। দক্ষিণের চেয়ারটা এখনও অলিখিতভাবে বাড়ির কর্তার।

    ওটাতে এখন বসে রাজেশ, অনিমেষবাবুর ছেলে…

    সম্প্রীতি (৪)

    জানালার কাছে দাড়িয়ে দুশ্চিন্তায় ছট্ফট্ করছে জুবেদা । আট বছরের ছেলে ইমরান টা আজই এমনভাবে সাইকেল থেকে পড়ে গেলো …পাশের ফ্লাটের ডেভিড আঙ্কল ইমরানকে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছে ।জুবেদার আজ যাওয়ার কোনো উপায়ই ছিলো না।
    চারতলার ফ্লাটের প্রিয় বান্ধবী দেবলীনার বাবার গতকাল রাতে হার্টঅ্যাটাক হয়েছে । ও চলে গিয়েছে সেখানে,জুবেদার কাছে ছেলের দায়িত্ব দিয়ে। ওর ছেলে দেবমাল্যর আজ স্কুলে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা। বাচ্চাটার ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে । দেবমাল্যর স্কুলবাসের ড্রাইভার শার্দূল সিং কড়া ধাঁচের লোক । মা দেবলীনা অথবা পাড়ার জুবেদা খালার কাছে ছাড়া সে বাচ্চা ছাড়বেই না …

  • গল্প

    মৃত্যুর ডিগনিটি

    মৃত্যুর ডিগনিটি
    -সুস্মিতা

     

     

    (জীবন যেমনই কাটুক , মৃত্যুর যেন একটা …)

    “আচ্ছা, বৃষ্টি বাদলের সময় পাগলীটা কী করে? ও কি তখন ওর দড়ির মতো পাকানো রোগা শরীরটা নিয়ে গাছের কোটরের মধ্যে ঢুকে যায়?
    বর্ষার সেই রাতগুলোতে? যখন সারা রাতের দানবীয় বর্ষণে চরাচর ভেসে যায়…তখন ?”—শুধু একা দীপু নয়, মনের মধ্যে এইরকম কৌতূহলী প্রশ্ন অনেকেরই জাগে কিন্তু উদ্যোগ নিয়ে গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে উঠে ঘন বর্ষায় কেউই খোঁজ নেয় না- “পাগলীটা তখন কি করছে?”
    প্রশ্নের রোমান্টিকতা অনেকের মনেই খেলা করে, কিন্তু সঠিক সময়ে উত্তর খোঁজার দায়বদ্ধতা কারুরই নেই…

    বিশাল ঝাঁকড়া আমগাছটা আর তার নীচে বসে থাকা পাগলীটার বয়স কেউ জানেনা। হতে পারে ওরা সমবয়সী। এ পাড়ার বেশিরভাগ মানুষজনের যেদিন থেকে স্মৃতির বয়স তখন থেকেই তারা দেখছে- বিশাল মোটা গুঁড়িওয়ালা গাছটার নীচে পাগলীটা বসে থাকে। দিন রাত…সবসময়।
    সে কবে প্রথম এই গাছটার নীচে এসে বসেছিল? কোথা থেকেই বা এসেছিল? না কি সে ছিল এই পাড়ারই কোনো মেয়ে বা বৌ? পাগল হলো কিভাবে? কোনো শোক বা দুঃখে? কোনো দুর্ঘটনা…অঘটন?—সেসব গল্পও এখন আর কেউ করেনা।

    আধা গ্রাম আধা শহরের মতো এই জায়গাটায় যেমন ওই ন্যাড়া রেলস্টেশন অথবা তার গায়ে লেগে থাকা চায়ের দোকান কিম্বা ওই যে বুড়ো টিউবওয়েল…ঠিক তেমনই আমগাছ আর তার নীচে বসে থাকা পাগলীটা …যেন অতি স্বাভাবিক এক চিত্র। ওকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ওর জীবনের প্রতি সুস্থ মানব সমাজের সবাই উদাসীন। যে উদাসীনতা বুকে নিয়ে বেঁচে থাকে মরা নদী।

    দীপু কলেজে যায় পাড়ার রতনকাকার স্কুটারে চেপে। বিকেলে বাড়ি ফেরে লোকাল ট্রেনে। কলেজ থেকে ফেরার সময় স্টেশনের সামনে প্রতিদিনই সে একবার পাগলীটার দিকে তাকায়। স্টেশন থেকে হেঁটে বাড়ি ঢুকতে দীপুর সময় লাগে ঠিক আট মিনিট। ওই “আট মিনিট” সময়টা দীপুর মন ও মস্তিষ্কে পাগলীর জন্য বরাদ্দ। বেশ কয়েকটা প্রশ্ন তখন দীপুর মনে প্রায় রোজই খেলা করে। দীপুর বিবেক তখন দীপুকে সুড়সুড়ি দেয়।
    আবার বাড়ি ঢোকার সাথে সাথে দীপু সব প্রশ্নগুলো ভুলেও যায়। পাগলীর জন্য বা সমাজের জন্য কিসের দায়বদ্ধতা?

    মাঝেমাঝেই দীপু ভাবে- “পাগলীটা তবে কী খেয়ে বেঁচে থাকে? ও কি শুধুই ওই গাছের আম খায়?” তবে সেটা তো সম্ভব শুধুই গরমকালে…বছরের বাকি সময়টা? কখোনো সখনো পাগলীর সামনে দীপু এক থালা মুড়িও দেখেছে। আশেপাশের দোকানীরা হয়তো দেয়। সে মুড়ির থালা টানা দু’ তিনদিন একইরকমভাবে পড়ে থাকে। তারপরে কখন যেন শেষও হয়ে যায়। দীপু নিজে কখনও পাগলীকে খেতে দেখেনি।
    পাগলী নিজের জায়গা থেকে কখনও নড়াচড়াও করেনা। যেন গাছটার মতো ওরও শিকড় গজিয়ে গিয়েছে। মাথার মধ্যে কিলবিল করতে থাকা উকুনগুলো টেনে বের করে নখ দিয়ে টিপে মারা ছাড়া পাগলীর আর বিশেষ কোনো কাজকর্মও নেই।
    “আচ্ছা পাগলীর প্রাকৃতিক কাজকর্মগুলো সারার দরকার হয় না?”
    দুর্গন্ধের জন্য পাগলীটার খুব কাছকাছি যাওয়া সম্ভব হয় না। তবে একদিন দীপু দেখেছিল-সবুজ জলের মতো পাতলা পায়খানা করে পাগলী তার উপরেই বসে আছে ।

    দীপুর বাবা ইস্কুলের মাস্টারমশাই। পিতার কয়েকটা কথা সতেরো বছরের সন্তানের মনে নিজের অজান্তেই দাগ কেটে স্থায়ী হয়ে থাকে।
    দীপু খেয়াল করেছে বাবা মাঝেমাঝেই বলেন- “জীবন যেমনই কাটুক, মানুষের মৃত্যুর যেন একটা ডিগনিটি থাকে…শেষের সেই দিনটা যেন সম্মানের হয়…।”
    কথাটা বিশেষভাবে উঠেছিল সেদিন…
    যেদিন দীপুরা হঠাৎ খবর পেলো- ওদের পাড়ার মুরারীজ্যেঠু কলকাতায় গিয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আচমকা ফুটপাথের উপরেই হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছেন…
    মুরারীজ্যাঠা খুব “শৌখিন মানুষ” হিসেবে পাড়াতে পরিচিত ছিলেন। সবসময় গিলে করা পাঞ্জাবি আর দুধ সাদা ফিনফিনে ধুতি তাঁর পোশাক ছিল, তিনি সেতার বাজাতেন।
    এরকম একজন মানুষের মৃত্যু এমন স্বজনবিহীন অবস্থায় পথের ধুলোয় হবে কেন? দীপুরা খবর পেয়েছিল- মুরারীজ্যেঠুর নিথর দেহ বহুক্ষণ কলকাতার রাস্তায় একা পড়ে ছিল। উদাসীন পথচারী কেউ সেদিকে ফিরেও তাকায়নি …

    নিজের জন্মমুহূর্ত নিয়ে কল্পনাবিলাসী হওয়ার সুযোগ কারুরই হয় না। কিন্তু নিজের রোমান্টিক মৃত্যু কল্পনায় কখনও গোপনে চোখের জল ফেলেনি, এমন মানুষ কমই আছে।
    জীবনের একমাত্র ধ্রুবসত্যই হলো মৃত্যু। জন্মমুহূর্ত থেকেই সেইদিকে পথ চলা। কিন্তু কার মৃত্যু কখন, কোথায় কিভাবে আসবে সেটাই জীবনের সব থেকে বড়ো রহস্য। আসবে কি সে জানান দিয়ে? প্রস্তুতির সময় পাওয়া যাবে? বরণ করে নেওয়া সহজ তাকে দুু’ হাত বাড়িয়ে…হাসি মুখে ?
    সত্যিই কারুর জানা নেই, তবুও সকলেরই ভাবতে ভালো লাগে, ইচ্ছে করে- “রোগ, শোক, দুর্ঘটনায় নয়…সে যেন আসে স্বাভাবিক বার্ধক্যের হাত ধরে…নিজের প্রিয় পরিচিত শয্যায় এবং প্রিয়জন পরিবৃত হয়ে।”
    সত্যিই যদি সকলের এমন হতো…সত্যিই যদি …

    দু’দিন ছুটির পরে সেদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় ট্রেন থেকে স্টেশনে পা দিয়েই দীপুর চোখ চলে গেল ঝাঁকড়া আমগাছটার নীচে…
    আজকের দৃশ্যটা যেন একটু অন্যরকম। পাগলীকে দূর থেকে দেখা যাচ্ছেনা। তার বদলে সেখানে জনা পঁচিশ তিরিশ লোকের একটা জটলা। দুর্গন্ধের জন্য পাগলীর বেশি কাছেও যাওয়া যাচ্ছেনা। সে তো আগেও যাওয়া যেতো না…
    কিন্তু আজ পাগলীটা বসে নেই, কেমন যেন কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ভীড়ের লোকজনদের ছেঁড়া ছেঁড়া কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল- “গত প্রায় তিনদিন ধরে পাগলীটা এরকমভাবেই শুয়ে ছিলো…। দুর্গন্ধটা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করতেই চায়ের দোকানের লোকেদের টনক নড়েছে।

    পাগলীটাকে জানে দু’দিন না তিনদিন হলো ওখানে মরে পড়ে রয়েছে। কেউ সঠিক জানেনা। দীপুর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো…মনে পড়ে গেল বাবার সেই কথাটা- “জীবন যেমনই কাটুক, মৃত্যুর যেন অন্ততঃ একটা ডিগনিটি থাকে। যে কোনো মানুষেরই অন্তিম লগ্নটি হোক্ সম্মানের।”

    নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দীপু পাগলীর মৃতদেহের একটু কাছে এগোনোর চেষ্টা করলো…
    অর্ধনগ্ন দেহটাকে তখন প্রায় ঢেকে ফেলেছে ডেঁয়ো পিঁপড়ে, মাছি আর পাগলীর মাথার উকুনগুলো।
    গত দু’দিন বা তিনদিন ধরে মৃতদেহটিকে সসম্মানে আগলে রেখেছে ওরাই …

You cannot copy content of this page