• অণু গল্প

    অণু গল্প- দীপা বলি

    দীপা বলি
    – সৃজিতা ধর

     

     

    গোটা বাড়িটা আলোয় সাজানো হচ্ছে। প্রতিটা ঘরের বাইরে দুটো‌ করে মোমবাতি জ্বালানো। চারিদিকে শুধুই আলো আর আলো। অন্ধকার চিরে যেন আলো‌ বেরিয়ে আসছে। কিন্তু নিজের ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে আছেন দীপা দেবী। ওনার এসব ভালো লাগছে না। হঠাৎ জোরে একটা আওয়াজ পেলেন। বারান্দায় গিয়ে দেখলেন আকাশে হাজার রঙের খেলা। ছোট ছোট বিন্দুর মত আলো গোটা আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে বার বার। চোখের সামনে ভেসে উঠছে বছর ছাব্বিশ আগের কথা। একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছেন আগের রঙিন দিনগুলোতে। তখন হয়তো এত আলোর সমাহার ছিল না… কিন্তু যেটা ছিল সেটা মনের ভেতরে কোনো অন্ধকার জমা হতে দিত না।
    বারান্দা থেকে আস্তে আস্তে ঘরে যাচ্ছেন উনি। লাঠির খট্ খট্ শব্দ এত বাজির আওয়াজে শোনা যাচ্ছে না। চোখের কোণে যে জলটা জমে আছে সেটা আলোর রোশনাইয়ে হারিয়ে গেছে।
    বৃদ্ধাশ্রমের ছোট্ট একটা ঘরে থাকা দীপা দেবীর কাছে এটা যেন একটা সত্যিকারের দীপা বলি।

  • কবিতা

    কবিতা- অসুরদলনী

    অসুরদলনী
    – সৃজিতা ধর

     

     

    সেই আদি যুগের আদ্যাশক্তি
    তখন‌ থেকেই তোমার প্রকাশ
    মা গো তুমি অভয়দাত্রী
    করেছ সব অশুভ বিনাশ

    আশ্বিন মাসে ঢাকের কাঠি
    আগমনীর সুর বাজে
    কাশফুলেরা দিচ্ছে উঁকি
    দুলিয়ে মাথা তোমার খোঁজে

    তুলোর‌ মত মেঘের মাঝে
    দেখি তোমার শুভ্র হাসি
    শিশির ভেজা ভোরের আলোয়
    মন তোমাতেই বানভাসি

    এসেছিলে শেষ ত্রেতাযুগে
    তখন তুমি যোগোমায়া
    এই কলি-তেও এসো আবার
    ধরে তুমি মানব কায়া

    এই যুগের অশুভ শক্তি
    এবং আছে অসুর যত
    তোমার পরশে শুদ্ধ হোক
    তোমার সামনে হোক নত

    তুমিই দুর্গা তুমিই কালী
    তুমিই আবার লক্ষ্মীরূপীনি
    অন্নপূর্ণা হলেও তুমি
    প্রয়োজনে হও অসুরদলনী।

  • অণু গল্প

    অণুগল্প- হাওয়া বদল

    হাওয়া বদল
    – সৃজিতা ধর

     

     

    ভেদনীতিতে আস্থাবান ব্যক্তি বা বৈষম্যমূলক আচরণকারীর অভাব খুব একটা চোখে পড়ে না এই তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ সমাজে। পুরুষতান্ত্রিকতা গ্রাস করেছে নৈতিকতাকে। মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও কিছু কিছু মেয়েদের পরিস্থিতি আমাদের গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র অনামিকা-র মতও হয়।

     বছর পঁচিশের অনামিকা-র চোখে অনেক স্বপ্ন। না, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা বলছি না। অনামিকা ঘুমের ঘোরে দেখা অবাস্তব স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে না। ও খোলা চোখে স্বপ্ন দেখে যে, নিজেকে কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় সে নিয়ে যেতে পেরেছে। প্রথমবার অনু(অনামিকা) বৈষম্যের আঁচ পেয়েছিল ক্লাস ফাইভে। তখন অনু নাচ শিখতে যেত এক জায়গায়। ছেলে-মেয়ে একসাথে নাচ শিখলেও সেদিন‌ নাচের রমা দিদিমণি মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলেছিল যে, “তোদের একটু সহজ মুদ্রা শেখাই।” সেদিন অনুর আর বলা হয়ে ওঠেনি যে “ওরা পারলে আমরাও পারবো।”

                     ক্লাস নাইনে ওঠার পরে নাচটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঐ ‘তৃতীয় হাত’-টা হিসেবে বলা হয় যে নাচ করা হয়তো শ্বশুরবাড়ি মেনে নেবে না। তাহলে অত নাচ শিখে আর কি হবে! আসলে মেয়েদের সেই ছড়া শেখানোর বয়স থেকেই শেখানো হয় যে-“…রাঙা মাথায় চিরুনি/বর আসবে এখুনি, নিয়ে যাবে তখনই।” অর্থাৎ ছোট থেকেই বোঝানো হয় যে, কোনো এক ছেলে এসে তাকে নিয়ে যাবে…আর তাহলেই যেন সেটা সার্থক। একটা প্রশ্ন থেকেই যায় তাহলে- বর না আসলে সেই মেয়েটা এগোতেই পারবে না? নাকি বরের আগমনটাই একটা মেয়ের জীবনের চূড়ান্ত সার্থকতা?

                     অনু-র সম্বন্ধ এসেছে। ছেলের সাথে আলাদা কথা বলার সময় জানতে পারে যে চাকরি করা মেয়ে তাদের খুব একটা পছন্দ নয়। অনু এবার আর চুপ থাকেনি। নিজেই না করে দিয়েছে…এখানে সে‌ বিয়ে করবে না। আসলে এরকম অনু-রা কখনোই এটা বলে খুশি হয় না যে, আমার বর অমুক জায়গায় চাকরি করে। ওরা এটাও বলতে চায় যে সে নিজে আজ কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।

                     স্কুলের‌ বেল‌ পড়তে আর দশ মিনিট বাকি। অনুর স্বামী বাইকে করে এসে নামিয়ে দিল অনুকে স্কুলের সামনে। আজ শিক্ষিকা হিসেবে অনু প্রথম পা রাখলো‌‌ স্কুলে। সেদিনের সম্বন্ধটা না করে দিয়েছে বলে আজ আরও একবার খুব খুশি হল অনু। সবাই সমান‌ নয়। অনুর আজ যার সাথে বিয়ে হয়েছে সে একদম অনুর মনের মতই…সেও নারীদের অধিক সুবিধাদানে নয়, বরং সমান‌ সুবিধাদানে বিশ্বাসী।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- দিদি

    দিদি
    – সৃজিতা ধর

     

     

    ছোটবেলার কথা খুব একটা মনে নেই। সবটাই গল্পে‌ শোনা। ছবিতে বরাবর দেখেছি একটা হাত আমায় আগলে রেখেছে, স্নান করাচ্ছে।‌ না, আমি মায়ের কথা বলছি না। সে‌ আমার‌ দিদি, বিনি দিদি। মাকে নিয়ে তো অজস্র গল্প শুনি আমরা। আজ না হয় দিদি নামক এই সম্পর্কটার একটা রূপকথা হোক।
    একটা ঘটনা বেশ মনে আছে।‌ দিদিকে নিয়ে একটা ভয়ের স্বপ্ন দেখে খুব কেঁদে উঠেছিলাম। আসলে আমরা কিন্তু স্বপ্ন দেখেছি বলে ভয় পাই না, সেটার বাস্তবায়ন নিয়ে ভয় পাই। আমিও সেদিন কেঁদেছিলাম, তবে সেটা ওকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে। আজ আবার খুব কান্না পাচ্ছে। আবার যেন‌ কাছছাড়া হয়ে যাচ্ছে দিদি। আজ দিদির বিয়ের সানাইয়ের আওয়াজে আমার কান্নাটা কেমন চাপা পড়ে যাচ্ছে। আজ থেকে আমার একলা ঘরে শোওয়ার পালা। এতগুলো বছর ওর সাথেই একটা ঘরে শুয়েছি। হয়তো কাল সকালে আবার ভুল‌ করে বিনিদি ডেকে উঠবো, মা হয়তো ভুল করে দিদির থালায় ভাত বেড়ে রাখবে। অনেকটা কবিতা করে ঠিক এরকম বলাই যায়-
    অন্য বাড়ির শ্রী ফেরাতে
    বাড়ির লক্ষ্মী পর হয়েছে,
    পঁচিশ বছরের অভ্যাসে মা
    মেয়ের নামে ভাত বেড়েছে।

    তবে বিনিদি আর আমার মধ্যে একটা ছোট্ট ব্যবধান আছে। ব্যবধানটা একটা শূন্য-র। বিনিদি বানানের ‘ব’-এর নীচে একটা ছোট্ট শূন্য এঁকে দিলেই আমার নাম, রিনি। এই বিনি-রিনির মধ্যের ব্যবধানটা যেন সবসময় শূন্য-ই থাকে। যদি কেউ বলে “দুই বোনে মিল আছে তো?” তখন এটাই বলব যে মিল আছে কিনা জানি না তবে‌ ‘ব্যবধানটা শূন্য’।

  • অণু গল্প

    অণু গল্প- প্রাপ্তি

    প্রাপ্তি
    – সৃজিতা ধর

     

     

    আন্তর্জাতিক আর্ট গ্যালারিতে একটা ছবি আজ‌ জায়গা করে নিয়েছে। প্রদর্শনীতে আগত প্রায় প্রত্যেকটা লোক ছবিটার সামনে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে শিল্পীর সৃষ্টি দেখে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা বড়ো স্টেডিয়াম, হ্যালোজেন, অগণিত মানুষ, একজন ফুটবলারের পা আর পায়ের সামনে একটা ফুটবল। কি অদ্ভুত সুন্দর ভাবে আঁকা হয়েছে সেই ছবিটা…যেন জীবন্ত!
    আজ প্রদর্শনীতে স্থান প্রাপ্ত সকল চিত্রের চিত্রশিল্পীদের উত্তরীয় পরিয়ে সন্মান জানানো হচ্ছে। সেই ফুটবলারের ছবিটার শিল্পীর নাম ঘোষণা করার পর স্টেজের সামনে এগিয়ে আসছে হুইলচেয়ারে বসে থাকা অতীন্দ্র সেন। একটা পা ওনার নেই। আসলে যার নেই শুধু সেইই বোঝে। জীবনের সবথেকে বড় আঘাতটা ওনাকে যেন নতুন করে পথ দেখিয়েছে। এটাই হয়তো সেই হার না মানা প্রবৃত্তি। হাততালির আওয়াজটা ক্রমশঃ জোরালো হয়ে উঠছে।

  • কবিতা

    কবিতা- ঐ মেয়েটা

    ঐ মেয়েটা
    – সৃজিতা ধর

     

     

    অন্ধকারে ঠেলছো যাকে
    সেই মেয়েটিও বাঁচতে চায়
    আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে
    ডানা মেলে উড়তে যায়।

    সেই ডানাটি সমাজ নামক
    বিষাক্ত এক ছুরির কোপে
    গাত্রবর্ণের অভিশাপে
    সমাজেই তাকে দিয়েছে সঁপে।

    “গায়ের রঙে‌ কি যায় আসে”
    কথাটি যদি সত্য হয়
    সেলাই করা মুখে সেই
    “সত্য” বলার ভীষণ ভয়।

    একলা থাকায় সবাই বলে
    মেয়েটা বড্ড একাচোরা
    সমাজ নামক কষ্ট দিয়েই
    মেয়েটার পুরো পাঁজর মোড়া।

    কখনো হাসে কখনো কাঁদে
    কখনো থাকে চুপটি করে
    কেউ বোঝে না সবার থেকে
    ক্রমেই সে মেয়ে যাচ্ছে সরে।

    যে যার মতো শোনায় কথা
    যে যার মতো ভুল বোঝে
    ঐ মেয়েটা বাঁচার জন্য
    শক্ত কোনো হাত খোঁজে।

  • গল্প

    গল্প- অসমাপ্ত

    অসমাপ্ত
    -সৃজিতা ধর

    – আজ ফিরতে অনেকটা দেরী হয়ে গেল। আসলে ফিরতে গিয়ে গাড়িটা…বিপ্লবকে আর বাঁচাতে পারলাম না, জানো তো! বড্ড ভালো ছিল ছেলেটা।
    – কি! কি বললে!
    – ওমা, তুমি ‘এভাবে’ কাঁদছো কেন!

    সদ্য স্বামীহারা হতে যাওয়া মনোরমা দেবী যেন আরেকবার নতুন জীবন পেলেন। অবনীমোহন বাবুর মৃত্যু সংবাদটা তাহলে বোধ হয় ভুল ছিল। পাশের বাড়ির রমেশবাবু এই ভুল খবরটি দিয়েছিলেন মনোরমা দেবীকে। অর্ধেক খবর শুনে তাৎক্ষণিক গল্পকার হয়ে যাওয়াটা কিছু মানুষের স্বভাবগত ত্রুটি। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ মুছে মনোরমা দেবী অবনীবাবুকে ভুল খবর শোনার কথাটি জানায়। কাছে গিয়ে স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে ওনার কখনো না ছেড়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেন।
    সেই রাতে কেউই খায়নি কিছু। ভোরের দিকে ওনাদের ছেলে সুজয় এসে দরজায় কড়া নাড়ল। ভেতরে এসে জিজ্ঞাসা করছে যে মনোরমা দেবী কিছু খাবেন‌‌ কিনা। স্বামী কিচ্ছু খায়নি, আর উনি খেয়ে নেবেন…তাই ছেলেকে না খাওয়ার কারণটা বললেন দরজার কাছে গিয়ে। সুজয় পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ঘাড় নাড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। মনোরমা দেবী চাদরটা অবনীবাবুর বুক অবধি টেনে দিলেন। পাশে শুয়ে বারবার এপাশ-ওপাশ করছেন কিন্তু ঘুমটা আর আসছে না। স্বামী হারানোর ভয়টা খানিক বাদে বাদেই তাড়া করে বেড়াচ্ছে। অতএব, খানিকটা বাধ্য হয়েই বিছানা ছেড়ে উঠে ছাদে‌ চলে গেলেন। ঠান্ডা হাওয়াটা বেশ ভালো লাগছে। শরীরে যে ম্যাজম্যাজে ভাবটা ছিল সেটা অনেকংশেই কমে‌ আসছে। কিছুক্ষণ পর নীচে নেমে দেখলেন অবনীবাবু ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন আর হাতে খাতা-পেন।
    – বুঝলে গিন্নি, গল্পটা সম্পূর্ণ হয়নি। মনটাও‌ ভালো নেই। গল্পটা নিয়েই থাকি আপাতত। কি বলো?
    – ও…সেই গল্পটা! আচ্ছা লেখো। তবে একটানা বেশিক্ষণ লিখে আমায় আবার ঘাড়ে মালিশের কথা বলো না যেন!
    – হাসালে। না, না বলব না তোমায়। একটু চা করে দাও না…ফ্রেশ হয়ে যাবে মাইন্ডটা।

    মনোরমা দেবী গেলেন চা‌ করতে। দু’কাপ চা করে নিয়ে আসার সময় সুজয় একটা কাপ নিতে যাচ্ছিল। উনি বললেন- তোর চা ফ্লাস্কে রাখা আছে। একটু নিয়ে নিস বাবা। আজ তোর বাবার সাথে চা খেতে বড্ড ইচ্ছে করছে।
    বিকেলের দিকে অবনীবাবু আর মনোরমা দেবী বেরোলেন একটু পাড়াটা হেঁটে আসার জন্য। প্রতিদিনেরই অভ্যাস। ফুচকা দেখতে পেয়ে ফুচকাও খেলেন। তারপর পাড়ার একটা পার্কের বেঞ্চে বসে দু’জনে‌ গল্প করছেন। তাদের বিয়ের গল্প, প্রথম প্রথম প্রেমের আব্দারগুলো…এইসব গল্পের মাঝে হারিয়ে গেলেন দুই প্রবীণ। অবনীবাবুর চোখে আজ একটু বেশিই মায়া। একজন‌‌ বেলুনওয়ালা রঙ-বেরঙের বেলুন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। একটা হার্ট শেপের বেলুন স্ত্রীকে দিয়ে বললেন- এই নাও তোমায় হৃদয় দিলাম।
    – আজ প্রথম দিলে বুঝি!
    – হ্যাঁ।
    – মানে?
    – তোমার প্রেমে যে রোজ পড়ি…
    – থাক্ হয়েছে। সবাই শুনবে যে!

    দু’জনে এবার বেঞ্চ ছেড়ে উঠে বাড়ি ফিরছেন। ওঠার সময় খোঁচা লেগে বেলুনটা ফেটে গেছিল যদিও। অগত্যা মন খারাপ করেই বাড়ি ফিরলেন মনোরমা দেবী। ঘরে ঢুকতেই দেখেন এক ভদ্রলোক মাঝের ঘরে সোফায় বসে আছেন। সুজয় আলাপ করাতে যাওয়ার আগেই মনোরমা দেবী বললেন- আমি যাই ওপরের ঘরে। তোর বাবা বোধ হয় ঐ দিকেই গেলেন। ওনার লেখা বইটা খুঁজছিলেন কিন্তু পাচ্ছিলেন না। এখনও বোধ হয় ওটাই খুঁজতে গেলেন। আমি গিয়ে খুঁজে দিয়ে আসি। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, ঐ‌ ভদ্রলোক সুজয়ের বন্ধুর দাদা, ড. অনিমেষ রায… সুজয়ের ডাকে আজ‌ এসেছেন।
    মনোরমা দেবী অবশেষে খুঁজে ‌পেলেন‌ বইটা। অবনীবাবুর হাতে দিয়ে পাশে চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন। অবনীবাবু ওনার নির্দিষ্ট আরাম কেদারাটিতে বসে বইটা উল্টে-পাল্টে দেখছেন। উনি বাংলার প্রফেসর ছিলেন। এককালে প্রচুর গল্পও লিখতেন। ওনার গল্প সমগ্রের একটা বইও বেরিয়েছিল। তবে একটা গল্প তিনি তিন-চিরদিন ধরে লিখছিলেন। সেটা এখনও শেষ হয়নি। গল্পের নাম নির্বাচনও হয়নি। মনোরমা দেবী গল্পটা নিজে‌ নিয়ে পড়লেন। উনিও সাহিত্যে‌ কম কিছু নন। অবনীবাবু বসার জায়গা ছেড়ে উঠে সারা ঘর পায়চারি করছেন। মনোরমা দেবী একগ্লাস জল‌‌ নিয়ে অবনীবাবুকে দিয়ে বললেন- জল খেয়ে মাথাটা ঠাণ্ডা করো। তারপর ঠিক লিখতে পারবে। অবনীবাবু নীচের ঘর থেকে কি একটা আনবেন বলে নীচে গেলেন।
    সুজয় আর ড. অনিমেষ রায় দরজা দিয়ে দেখছিল পুরো বিষয়টা। সুজয় বললো- এবারই ইঞ্জেকশনটা দিয়ে দাও দাদা।
    – হ্যাঁ, আমি গিয়ে কথা বলি, তুমি এসো।
    ড. অনিমেষ মনোরমা দেবীর সামনে গিয়ে কথা বলে নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। হঠাৎ পেছন‌ থেকে সুজয় এসে মাকে শক্ত করে ধরলো। ইঞ্জেকশনটা পুশ করার সময় মনোরমা দেবী বলে উঠলেন- ওই তো…ওই তো… তোর বাবা…দেখো না কিসব করছে ওরা…। বলতে বলতেই চোখটা বুজে আসছে। ওরা তাকিয়ে দেখে দরজার কাছে কেউই নেই। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে ধাক্কা লেগে আরাম কেদারাটা দুলতে শুরু করলো, পাশে গল্পের খাতাটাও পড়ে আছে। সুজয় খাতাটা হাতে নিয়ে দেখলো ওটা বাবার লেখা সেই অর্ধেক গল্পটা, যেটার নামকরণ মনোরমা দেবী সবেমাত্র করেছিলেন। গল্পের নাম দিয়েছেন-“অসমাপ্ত”।
    “বুঝলে সুজয়, ‘সিজোফ্রেনিয়া’, সহজ ভাবে বললে হ্যালুসিনেশন। যা যা করছেন, ভাবছেন, বলছেন সেগুলোর অস্তিত্ব নেই কোনো। মেসোমশাইয়ের হঠাৎ চলে যাওয়াটা মানতে পারেননি। গতকাল খবর শোনার‌ পর থেকে তো নাকি এই ঘরেই পড়ে আছেন! উনি আসলে ওনার মত করে একটা কল্পনার জগৎ তৈরি করে নিয়েছেন। সেখানে তিনি স্বামীকে নিয়ে আরেকটা সাজানো সংসার পেতেছেন। এরকম সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার ঠিক হতে অনেক সময় লাগবে। ওনার ঘুমটা খুব জরুরি। এখন বেশ কিছুক্ষণ ঘুমোবেন উনি। কোনো চাপ সৃষ্টি করো‌ না। শুধু নজরে নজরে রেখো। আর বাড়াবাড়ি হলে ইঞ্জেকশন…।”
    -“থ্যাংকু দাদা। বাবার কাজে নিমন্ত্রণ রইল। পরে দিন আর সময়টা জানিয়ে দেব। এসো কিন্তু।”
    সত্যি, কিছু কিছু গল্প ‌অসমাপ্তই থেকে যায়, চাইলেও শেষ করা যায় না। ভালো থাকুক এরকম মনোরমা-রা। বাস্তবটা বোধগম্য হলে বোধ হয় গল্পে দাড়ি‌ পড়বে। নয়ত সারাজীবন মনোরমা-রা গল্পের ইতি খোঁজায় ব্যস্ত থাকবে। সকাল হলে আবারও হয়ত মনোরমা দেবী আর অবনীবাবুর দেখা হবে। তবে কল্পনায়… নিছকই কল্পনায়। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। তবে কি সেটা ভালোবাসার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য! কিছু কিছু সুজয়ের মনে এই প্রশ্নটা থেকেই গেল।

  • গল্প

    গল্প- ঘুঙুর

    ঘুঙুর
    – সৃজিতা ধর

    ঘুঙুরের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো অনন্যার। ওর বাবা ওর সাধের ঘুঙুরটা হাতে নিয়ে চোখের জল মুছছে। কাল অনুর(অনন্যার) বিয়ে। রোজকার অভ্যাসের ছেদ ঘটতে চলেছে। প্রতিদিন আদরের মেয়েটার নাচের ছন্দ আর বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখবে না। নাচের জগতে অনন্যার পা পড়েছিল সেই ছয় বছর বয়সে। সামর্থ না থাকায় নাচ শিখতে পারেনি। দেখে দেখে যা শিখেছে…আর বড়ো হয়ে স্মার্টফোনের দৌলতে ইউটিউবে নাচ শেখা….অনু নাচে কিন্তু দারুণ, দেখার মত। নিজেদের আর্থিক অবস্থা দেখে নাচ শেখার কথা মুখ ফুটে বলেনি কখনো। কিন্তু বাবার মন আজও কষ্ট পায়, অলক্ষ্যে কাঁদে। ও যখন বছর ষোলোয়, তখন একটা ঘুঙুর উপহার হিসেবে পেয়েছিল বাবার থেকে। মাধ্যমিকের দুর্দান্ত রেজাল্টের পর এটাই ছিল অনুর উপহার। পড়ালেখাতেও বেশ ভালো। প্রাইভেট কোম্পানির উচ্চপদে চাকরিও পেয়েছে মাস তিনেক হল।
    অনু এগিয়ে এসে বাবার চোখের জল মুছে দিল।
    – মন খারাপ? বেশি দূরে তো না। মন খারাপ হলেই চলে যাবে।
    – নারে মা, মন খারাপ না…. কষ্ট। আচ্ছা, কাল নাচ নিয়ে কি কথা হচ্ছিল অজয়ের সাথে?
    খানিকটা গর্বিত হয়েই বলল অনু- “ও বলেছে আমাকে নাচের ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দেবে। আমার সব না পাওয়াগুলোকে পাইয়ে দেবে বলেছে।” বাবার চোখে তখন মেয়েকে সুপাত্রস্থ করার শান্তি দেখা গেল।
    – বাবা-মেয়ের গল্প শেষ হলে এদিকে এসো।
    মায়ের এই মধুরবচন অনেকটা বিরিয়ানি খেতে খেতে মুখে লবঙ্গ পড়ার মতই লাগল… যাই হোক।
    আজ অনুর বিয়ে। “কন্যা সম্প্রদান”-এর সময় চোখের কোণে যে জলটা চিকচিক করছিল সেটা একমাত্র অনুর চোখ এড়াতে পারেনি। মেয়ে বিদায়ের সময় আশীর্বাদ করে বাবার প্রথম প্রশ্ন- “ঘুঙুরটা নিয়েছিস তো?” অঝোরে কাঁদতে লাগলো মেয়ে। পরে অবশ্য সামলে নেয়।
    বৌভাতের রাতে অজয়ের প্রথম প্রশ্ন
    – তুমি কবে জানি জয়েন করছো?
    – কেন…..কেন বলো তো?
    – না মানে আমার বস্ হার্ডলি পাঁচদিনের ছুটি মঞ্জুর করেছে। তোমার?
    -আমি দিন দশেকের ছুটি নিয়েছি।
    পরের দিন সকালে খালি ভাবছে অনু- শুধু চাকরির খবর নিল? কই… আমার কোনো শখের কথা তো জানতেও চাইলো না। পরে অবশ্য মনকে শান্ত করে- কিবা আর শুনবে? সবই তো জানে…ঐ নাচটাই যা শখের আমার।
    বিয়ের মাস চারেক কেটে গেল। একদিন অনু বললো অজয়কে,
    – তোমায় একটা কথা অনেকদিন ধরে ভাবছি বলবো। বলছিলাম, মনে আছে আমায় তুমি বলেছিলে….
    – কি বলেছিলাম?
    – ঐ যে নাচের ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দেবে।
    – ধুর পাগল…. তুমি সিরিয়াসলি নিয়েছিলে নাকি? আমি তো জাস্ট কথার কথা বলেছিলাম। তাছাড়া ঘরের কাজ মিটিয়ে অফিস করে এসব নাচ করার সময় পাবে?
    – কিন্তু ওটা যে আমার ইচ্ছে…. তাছাড়া বাবার সামর্থ্য ছিল না। তোমার তো আছে, আমারও আছে।
    – কি হবে ঐ নাচ শিখে?
    – কেন? আমি কত নাচের মুদ্রা শিখতে পারবো, কত নাচ শিখতে পারব… তোমার আপত্তি?
    – নাচের মুদ্রা কি আর মুদ্রার আগমন ঘটাবে? আমি তোমার চাকরি দেখে সম্বন্ধ এনেছিলাম। ওসব নাচ-টাচ ভুলে যাও। তাছাড়া তুমি তো আর মমতা শঙ্কর নও….
    এক লহমায় সবটা যেন শেষ হয়ে গেল। শুধু ভাবছে- আমার চাকরিকে, আমার টাকাকে ভালোবাসে? বিয়ের আগের সব প্রতিশ্রুতি মিথ্যে ছিল?
    অফিস না গিয়ে সোজা বাবার কাছে গেল অনু, সবটা খুলে বললো। বাবা হয়ে মেয়েকে কিভাবে বলবে সংসার ভেঙে চলে আসতে? বলল- “আর কোনো উপায় নেই? তাহলে নাচটা নাহয় বাদই….” “চুপ করো‌ বাবা। তুমিও? তুমিও সেই একই কথা বলছ? আজ আমি স্বাবলম্বী। নিজের খরচ চালিয়ে নাচ শেখার ক্ষমতা আমার নিজেরই আছে। আমি তো শুধু পাশে থাকার মানুষ খুঁজছিলাম। কি চাইছো? সংসার বাঁচাবো? ওটা কি কোনো সংসার যেখানে আমার ইচ্ছেটাকে পায়ে পিষে মারা হয়, যেখানে কেউ আমাকে না… আমার টাকাকে ভালোবাসে? ওটা সংসার না। ওটা অন্যকিছু।” নিজের সিদ্ধান্ত জানায় অনু। আর ফিরবে না ঐ বাড়িতে। নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করে তবেই দাঁড়াবে অজয়ের সামনে।
    অনুর নাচের দক্ষতা ওকে খুব তাড়াতাড়ি ওপরে উঠিয়ে দিচ্ছিল।
    দু’বছর পরের কথা। একটা ইন্টারন্যাশনাল ডান্স কম্পিটিশন হয়। সেখানে অনু সেকেন্ড পজিশন পায়। তারপর থেকেই ওর নাচের কেরিয়ার শুরু। না, নাচটাকে পেশা করেনি অনু। বরং বিনামূল্যে নাচ শেখায় আজ। অনুর জায়গাটাই এখন অন্যরকম।
    রাতে ঘুমানোর সময় হঠাৎ সেই পরিচিত পুরোনো নম্বর থেকে ফোন।
    – হ্যালো, অজয় বলছি।
    – হুম্ বলো।
    – কাল দেখা করবে একবার?
    – কেন?
    -কথা আছে কিছু। আমি আমার ভুলটা বুঝতে পারছি।
    – যাক শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে তবে। তবে কাল না, আগামী ২ তারিখ। ঐ কফিশপে যেখানে প্রথম দেখা করেছিলাম।
    – আচ্ছা বেশ। আর… থ্যাংকস আমাকে বোঝার জন্য।
    – ঠিক আছে। রাখি। গুড নাইট।
    -হুম গুড নাইট।
    ২ তারিখ আবার দেখা হল সেই আইনত স্বামী-স্ত্রীর। টেবিলে বসে কথা বলছে। হঠাৎ একটা খাম বের করে দিল অনু। অজয় খামটা খুলে নির্বাক। হ্যাঁ…. ডিভোর্স পেপার। যে অজয় কোনোদিন ওর শখের দাম না দিয়ে শুধু টাকা চেয়েছে, সেইইই অজয় আজ নাচের “সেই মুদ্রার” লোভেই যে আবার ফিরে আসেনি তার কোনো নিশ্চয়তা আছে কি? জীবনে একবার করা ভুলটাকে দ্বিতীয়বার আপন করতে চায়নি অনু। শুধু একটা কথাই বললো অনু- “তুমি বলেছিলে না নাচ শিখে কি হবে? আমি অনেক কিছু পেয়েছি এই নাচ থেকে। তোমার মত বিষাক্ত কীটদের চিনতে পেরেছি যারা নাচের মুদ্রার সাথে ব্যাবসায়িক মুদ্রার তফাৎটুকু বোঝে না। তোমার সাথে বিয়ে নামক পুতুল খেলাটা আজ নাহয় ভেঙেই দিলাম। আমি আমার যোগ্য মর্যাদা পেয়েছি যেটা তুমি আমায় কোনোদিন দিতে পারতে না।”
    চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই একটা মেয়ে এসে অনুকে প্রণাম করে বলল-“ম্যাম আমি ঐ কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছি।” অনু অজয়ের দিকে তাকিয়ে বললো- সন্মানটাও পেয়েছি।

You cannot copy content of this page