-
অস্তিত্ব সংকট
অস্তিত্ব সংকট
-সোনালী গুপ্ত(১)
“জানিস ভাই সাধারণ মানুষদের জীবন থেকে আমরা হারিয়ে যাচ্ছিরে। আর কয়েক বছর পর মনে হয় আমাদের কেউ মনে রাখবে না।” লাউচিংড়ির আক্ষেপ শুনে ঝুরঝুরে আলুভাজা দৌড়ে এল। ছানার ডালনা বলে উঠল, “কি হলো কি তোদের? সকাল থেকে মরা কান্না জুড়ে দিলি কেন?”
চালকুমড়া তারস্বরে চিৎকার করে বলে উঠল, “আমরা যে আধুনিক যুগ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছি তাকি তুমি বুঝতে পারছনা ছানার ডালনা মাসি? বয়স ত অনেক হল চোখের মাথা খেয়েছ তাই কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছনা।”
“ঐ বয়স তুলে কথা বলবিনা বলে দিচ্ছি” বলে লাঠি নিয়ে চালকুমড়াকে তাড়া করল ছানার ডালনা। মোচাঘন্ট ছানার ডালনা মাসিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মাসি আমরা সত্যি এই যুগে বেমানান খাদ্য হয়ে গেছি। আমরা যে হারাতে বসেছি।”
সজনে ডাটা ও কাঁচকলা গাছের ডালে ঝুলে সব শুনছিল। ডাটা বলে উঠল,”জানিস সেদিন ঘোষ বাড়ির বুড়ি বড় বৌএর কাছে সব সব্জী দেওয়া নিরামিষ ঝোল খেতে চেয়েছিল। বড় বৌমা খুব যত্ন করে ঝোলটা রান্না করে। বুড়ি তৃপ্তি করে ঝোলটা খেয়েছিল।”
দাসেদের ছাদ থেকে ডালের বড়ি চেঁচিয়ে উঠল, ” বাবা খুব নিজেদের গুণগান চলছে দেকছি এখানে। আমার কথা ত কেউ বলছো না।”
কাঁচকলা স্মিত হেসে বলে উঠল, “ভাই বড়ি হতে পার তুমি আমাদের সবচেয়ে ছোট সদস্য কিন্তু তোমাকে ছাড়া নিরামিষ ঝোল কিংবা শুক্ত যে একদম বেমানান।” নিজের প্রশংসা শুনে বড়ি শান্ত হল।
ঢেঁড়স ত ভীষণ শান্ত। সব শুনে সে বলল, “জানো তোমরা আজ আমার মনেও খুব কষ্ট হয়েছে।” ছানামাসি স্বভাবসিদ্ধ চিৎকার করে বলে উঠল, “বাবা তোদের খালি মনোকষ্টই হয়।”
ঢেঁড়স বলল, “মাসি হতে পারি আমরা সব্জী কিন্তু আমাদের ও আত্মসম্মান বোধ আছে। সেদিন কাবেরী দিদি ঠাকুমার তৈরী ঢেঁড়সের দম দিয়ে রুটি খাচ্ছিল। হঠাৎ সব ভাইবোনেরা গান গেয়ে উঠল, “ঢেঁড়সে ঢেঁড়স খায়। এটা কোন খাবার নাকি।”
(২)
বেগুন উত্তেজিত হয়ে বলল, ” মেয়েটাকে আমি চিনি রে ঢেঁড়স। ওর মা স্কুল যাবার সময় ওকে গরম ভাতে একটু ঘি ও দুটো ডান্টিয়ালা বেগুন ভাজা দিয়ে ভাত মেখে দেয়। সোনা মুখ করে মেয়েটা খেয়ে নেয়।”
আলু এতক্ষণ চুপ করে পুরো আলোচনা শুনছিল। সব শুনে সে বলে উঠল, ” ঘোর কলিযুগ এসেছে বন্ধুরা। ঘোর কলিযুগ। মনুষ্য জাতি এখন নতূনকে গ্রহণ করতে গিয়ে পুরানোকে ভুলে যাচ্ছে। যা পাচ্ছে তাই নকল করছে। না জেনে বুঝে সব কিছু নকল করতে গিয়ে বুঝতেই পারছে না কোনটা গ্রহণযোগ্য ও কোনটা গ্রহণযোগ্য নয়। যখন শরীর খারাপ হচ্ছে তখন আমাদের স্মরণ করছে। ঐ তো সেদিন দাসদের ছোট ছেলেটার কি পেট খারাপ। পথ্য হিসাবে ওর মা কাঁচকলার ঝোল ও ছানা দিল। তা খেয়েই তো ছেলেটা সুস্থ হল।”ছানা মাসি বলে উঠল, “দেখ বাছারা আমার অনেক বয়স হল। আমি তো তোদের সেটাই বোঝাতে চাইছি। একটু ধৈর্য্য ধরে মনুষ্য জাতিকে লক্ষ্য কর তাহলেই বুঝতে পারবি মনুষ্য জাতির চিত্ত কত চঞ্চল। এরা কত নকলনবিশ হয়। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে কাছের মানুষকে কেমন দূরে ঠেলে দিতে পারে।”
ঝিঙা বলে উঠল,”ছানা মাসি বোধহয় একেই বলে অভিজ্ঞতার দাম। সত্যিই তুমি ঠিক কথাই বলেছো। খালি তুমি একটু চেঁচিয়ে ফেলেছিলে।”
দৌড়ে এসে চাল কুমড়া ছানা মাসির হাত ধরে বলে উঠল, “ক্ষমা করে দাও গো মাসি। অস্তিত্ব সংকটে ভুগছি তো। বড্ড অভিমানী হয়ে পড়ছি।”
সজনে ফুল চিৎকার করে উঠল ” কাবেরী দিদি আসছে গো। সেদিন তাকে শুধালাম আমায় যে যত্ন করে নিয়ে যাচ্ছ খাবে তো? উত্তরে সেকি বলল জানো? বলল তার ঠাম্মির বানানো সজনে ফুলের পাতুরি নাকি অমৃত।
(৩)
-“কিগো এই সকালবেলা কিসের গোল টেবিল হচ্ছে তোমাদের? ” এই কথা বলে কাবেরী সুন্দরী লাউডগাকে যত্ন করে মাচায় বেঁধে
দিল।ছানা মাসী বলে উঠল, “বুঝলে নাতনী মনুষ্য জাতির নকলনবিশ স্বভাবের জন্য আমরা অস্তিত্ব সংকটে ভুগছি। জানো তোমরা! সেদিন এক বিয়েবাড়িতে খেতে বসে দেখি কত নতূন রান্না। মাঞ্চুরিয়ান, রেজালা, ফিশফিংগার কিকি সব নামের নতূন খাবার। বান্ধবী টুলুকে বললাম,” হ্যাঁরে ছোলার ডাল, ফিশ ফ্রাই, কাশ্মীরি আলুর দম, পাকা মাছের কালিয়া এরা কোথায়? টুলু উত্তরে বলেছিল আমি নাকি এখনো মান্ধাতার আমলে রয়ে গেছি।”
মিষ্টি দই হেসে নালিশ জানালে, ” দিদি শুভ কাজে শেষ পাতে আমার বদলে চলে এসেছে আইসক্রিম। “
-“একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না তোমাদের সমস্যাটা কি? পুরানোর বদলে নতূন আসবে এটাই তো রেওয়াজ। “
লঙকার কথা শুনে কাবেরী বলে উঠল, “ভাই তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করি। যতই পুরানো বাদ যাক তোমায় কিন্তু সব রান্নায় দরকার। একদিন হঠাৎ করে রান্নায় তোমার ব্যবহার বন্ধ করে দিলে তোমার মনকষ্ট হবেনা?”
লঙকা বলে উঠল,” তুমি ঠিক কথাই বলেছ দিদি।”
বড়ি তখন কাবেরিকে মনুষ্য জাতি সম্পর্কে কিছু বলতে অনুরোধ করে। “আমি একজন সাধারণ মানুষ। সব কিছু বুঝিনা। কিন্তু এইটুকু বুঝি মনুষ্য সমাজে এখন নির্মমতা চলছে। এক ঝটকায় পুরানোদের ফেলে দিতে বিবেকের দংশন হয়না। তা আত্মীয়তা হোক বা আমাদের সংস্কৃতি।” কথা বলা শেষ করে সজনে ফুলকে ঝুড়িতে নিয়ে কাবেরী সবাইকার থেকে বিদায় চাইল।
ঝুরঝুরে আলুভাজা বলে উঠল,”দিদি যারা বুদ্ধিমান হয়েও অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে তাদের ব্যবহারে আমরা আর কষ্ট পাবোনা। এই প্রতিজ্ঞা করছি।
লাউডগা বলে উঠল,” কাবেরী দিদি আবার এসো। তুমি তো পুরানো সম্পর্কদের ভালবাসো তাই তুমি এলে আমরা খুশি হই। আবার এসো ও এরকমই থেকো।
-
কিছু ফিরিয়ে দেওয়া
কিছু ফিরিয়ে দেওয়া
-সোনালী গুপ্তআমাদের ব্যস্ততাপূর্ণ জীবন, কাজের চাপ, কাকে কতটা হারাতে পারব, বিভিন্ন সমস্যার চাপে রোজ একটু একটু করে কোথায় যে হারিয়ে যাচ্ছি তা বুঝতে চাইছি না অথবা বুঝতে পারছি না। এগিয়ে যেতে গিয়ে আমরা বাড়ির বয়স্ক মানুষ দের উপস্থিতিই ভুলে যাচ্ছি। ওনারা সংসারের জন্য জীবনের প্রায় সবটাই দিয়ে দিয়েছেন। তার বদলে কতটুকু সময় আমরা তাদের জন্য দিতে পারছি? আচ্ছা এই ব্যস্ততাপূর্ণ জীবন থেকে সারাদিনের শেষে একটু সময় তাদের জন্য কি আমরা বের করে নিতে পারিনা? একটু সময় বের করে তাদের কাছে বসে তাদের ভালবাসা, ভাললাগা, তাদের মনের ইচ্ছাকে জানার চেষ্টা ত আমরা করতেই পারি। কেন আমরা ভুলে যাচ্ছি তাদের ও একটা মন ছিল। ভালবাসা, ভাললাগা ছিল। তাদের একান্ত আপন একটা মন ও জীবন ছিল। আমাদের মত ওনারাও নিজেদের জীবন নিয়ে কিছু স্বপ্ন একেঁছিলেন মনের মধ্যে। বৃদ্ধরা অমুকের কাকা, বাবা, ছেলে, জেঠু, স্বামী এবং বৃদ্ধারা অমুকের মা, কাকী, বৌমা, জেঠিমা হতে গিয়ে নিজেদের স্বপ্নের বিসর্জন দিয়েছিলেন এবং নিজেদের নামটাই ভুলে গিয়েছিলেন। অমুকের বাবা, অমুকের মা হয়েই তারা কাটিয়ে দিলেন জীবন টা। রোজ যদি কিছুটা সময় তাদের দিই, তাদের ভাললাগা, ভালবাসা,পছন্দ,অপছন্দের কথা জিজ্ঞেস করি তাহলেই তারা তাদের হারিয়ে যাওয়া মন ও স্বত্বা কে আবার ফিরে পাবেন। যে অপছন্দকে তারা সংসারের চাপে পছন্দের অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিলেন আমরা হয়ত সেই অপছন্দ থেকে তাদের মুক্তি দিতে পারব একটু সময় দেবার মাধ্যমে।
কিচ্ছু না। ওনাদের একটু সময়, যত্ন ও সম্মান করলেই ওনারা খুশী থাকবেন।দিনের শেষে পাশে বসে তাদের জিজ্ঞাসা করা, “কেমন কাটল আজ সারাদিন?” রোজ রান্নার সময় জিজ্ঞাসা করা, ” আজ আপনার কি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে?” কোন কাজ করার আগে একটু তাদের মতামত নেওয়া। তাহলে ওনারা অনুভব করবেন সংসারে ওনারা ব্রাত্য নন। বয়স্ক মানুষ গুলো এর থেকে বেশী কিছু চান না। সপ্তাহের ছুটির দিনে মাঝেমাঝে ওদের কোথা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসুন দেখবেন ওনারা কত খুশী হবেন। তার বদলে ওনাদের মুখে যে হাসিটি দেখতে পাবেন তা হচ্ছে আপনাকে দেওয়া ওনাদের আশীর্বাদ।
আজকাল প্রযুক্তিবিদ্যা অনেক উন্নত হয়ে গেছে। তার সাহায্য নিয়ে আমরা পারি এই বয়স্ক মানুষ গুলোর যে বন্ধু ও বান্ধবীরা জীবিত আছেন তাদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে। সংসারের বেড়াজালে তারা তাদের যে ব্যক্তিগত জীবনকে হারিয়ে ফেলেছিলেন আমরা পারি তাদের মনকে সেখানে পৌঁছে দিতে। শেষ কয়েকটা দিন নাহয় একটু নিজের মত করে বাঁচলেন। আর কতদিনই বা এই মানুষগুলো দুনিয়াতে থাকবেন? নিজেদের ভবিষ্যতে কি হতে পারে সে কথাই না হয় চিন্তা করে বয়স্ক মানুষগুলোকে শেষ জীবনে একটু তাদের মত করে থাকতে সাহায্য করি। ওনারাও ভাল থাকবেন এবং আমাদের দেখে আমাদের সন্তানরাও আমাদের ভাল রাখার চেষ্টা করবে। কথাতেই ত আছে, ” তুমি যেমন করবে ঠিক তেমনই ফল পাবে।” -
গৃহবধূর মনের কথা
গৃহবধূর মনের কথা
-সোনালী গুপ্ত” সারাদিন ত বাড়িতে রয়েছ বুঝবে কি করে বাইরে বেরিয়ে পয়সা রোজগার করার কষ্ট কত? আমার পয়সায় ফুটানি করছ লজ্জা করেনা? এখন ত তোমাদের কত সুবিধা আর আমাদের মায়েদের কত কষ্ট করতে হয়েছে।” যে কোন গৃহবধূ কে এই কথাগুলি জীবনের কোন না কোন সময়ে শুনতে হয়। প্রতিবাদ করলেই অশান্তি। কারোর কারোর কপালে না হয় দুটো চড় থাপ্পড় জুটল। শিক্ষিত সমাজের মানুষ দের মনে হয়না গৃহবধূর সংজ্ঞা এখন বদলে গেছে। এখন আমরা শুধু বাড়িতে রান্নাঘরে বন্দী থাকিনা। আমাদের বাইরে বেড়োতে হয়। সংসার টা চালানোর জন্য আমাদের অনেক রূপ ধারণ করতে হয়। কখনো নার্স, কখন শিক্ষিকা কিংবা সংসারের বাজেট মন্ত্রী। এখন শিক্ষিতা পূত্রবধূ ঘরে আনা হয়। যে তার সন্তানের প্রথম শিক্ষিকা। অনেক কটুকথার মধ্য দিয়ে, অনেক না ভাললাগাকে মনের অনিচ্ছায় ভাল লাগিয়ে একটা অন্য পরিবারের অচেনা মানুষদের আপন করে নেয়। আগেকার গৃহবধূ দের এখনকার গৃহবধূদের মত অত বাইরে বেড়োতে হত না। এখন আমরা সন্তানের স্কুল, ব্যাংক, বাজার দোকান করা সব কাজ করি এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে বরের অফিস পার্টিতেও যাই। এবার আসি বরের পয়সাতে ফুটানীর কথায়। প্রতিটা দিন সঠিক সময়ে, সঠিকভাবে, সুস্বাস্থ্যর অধিকারী হয়ে স্বামীরা যে অফিসে যান তার জন্য সারাবছরে অন্তত একটা ধন্যবাদ আমাদের পাওনা। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই গৃহবধূরা চেষ্টা করেন তাদের স্বামীরা যেন ঠিকমতো খেয়ে সঠিক সময়ে অফিস যেতে পারেন। কর্তা বাইরের খাবার খেয়ে অসুস্থ না হয়ে যান সেদিকে ও আমাদের নজর সর্বদা। ” ঠিক আছে তুমি শান্তিতে কাজ কর আমি ছেলের স্কুল মিটিং এও যাব এবং কালকে শাশুড়ি মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছেও যাব।” আজকালকার দিনের শিক্ষিত গৃহবধূরা প্রায় সময় এই কথা বলেন কর্তাদের। সেই জীবন সঙ্গীর পয়সাতে কি তার স্ত্রীর কোন অধিকার নেই? তাহলে কেন আমাদের এখন শুনতে হয় আমরা বরের পয়সাতে ফুটানী করছি? আমাদের কোনদিন ছুটি নেই, প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই, গ্র্যাচুইটি নেই, নেই কোন পেনশন। আছে শুধু একটি তুলনা মূলক গঞ্জনা “অমুক বাড়ির বৌদি কত কিছু করতে পারে আর তুমি কিছুই পারনা।”